এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • খড়কুটো -২

    Tim
    অন্যান্য | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ | ২৬৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Tim | 12.133.56.166 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০০:৩৮584710
  • আগের টইটা একটু পুরোনো ও পানসে হয়ে গেছে। তায় বিস্তর ধুলো। তাই এই দ্বিতীয় ভাগ। লেখা কতদূর কি হবে, আদৌ হবে কিনা, হলে কি নিয়ে হবে --- দেখা যাক।
  • Tim | 12.133.56.166 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:০২584721
  • ছুটির দিন আলমাস বাড়ি থেকে বেরোতে ভালোবাসেনা। বাইরে খুবই ঠান্ডা। বাড়ি থেকে বেরোলেই কনকনে হাওয়া এসে চোখেমুখে খোঁচা মারে, পায়ের তলায় শুকনো গুঁড়ো দুধের মত তুষার নড়াচড়া করে - যাতে গোড়ালি অবধি অনায়াসে ডুবে যায়। আলমাস গুঁড়ো দুধ ভালোবাসেনা। জলের উষ্ণতাজনিত গোলমালে দলা দলা দুধের টুকরো ভেসে উঠতে দেখে গা গোলাতো তার। যেন জলে ডুবে মরা লাশ ভেসে উঠেছে অবলীলায়। মরার পরেই ভেসে থাকা এত সোজা হয়ে যায় কেন? মুখে স্কার্ফটাকে ভালো করে পেঁচিয়ে বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আলমাস ভাবে।

    চতুর্দিক খোলা, দূরে দূরে কিছু কংক্রিটের চাঁই। কায়দার রং আর কারিকুরি করে সেসব স্তেপের ওপরে মেলে থাকা ঘোলাটে আকাশকে বিরক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। চওড়া, দুধারে বরফের মলাট দেওয়া রাস্তা চলে গেছে ইশিম নদীর ধার বরাবর। সামনেই তুরফান অ্যাভিনিউ এর মোড়। পেরিয়ে মিউজিক হলের পাশ ধরে ডানদিকে মিনিটখানেক এগোতেই বাজারটা দেখা যায়। এদিক ওদিক দেখে রাস্তা পেরোয় আলমাস। তার বুকের কাছে, পকেটে ভাঁজ করা সব্জি ও ফলের তালিকার কাগজটা আড়মোড়া ভাঙে। আর্তিউম এসে গেছে। আর্তিউম - পুরোনো খোলা বাজার।
  • Tim | 12.133.56.166 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:২৩584732
  • আইগেরিম সবুজ সব্জি ভালোবাসেনা। আলমাস যেহেতু বিদেশে ছিলো কিছুদিন, তাই তার কাছে আইগেরিমের এই অভ্যেস অদ্ভুৎ লাগে। আলু আর মাংস ভালোবাসে আইগেরিম। স্যালাড দেখলে নাক শিঁটকোয়। উঁচু হিলতোলা জুতো পরে, চোখা নাক ও টানা চোখের আইগেরিম। আদিগন্ত স্তেপের মধ্যে দ্বীপের মত ছড়িয়ে থাকা ইস্পাতনগরীগুলোর একটা আইগেরিমের শহর। আইগেরিমের শহর? এরম কি হয়?- ভাবে আলমাস। শহর কি কখনও মানুষের নিজের হয়? নদী?

    কপাল খারাপ। আর্তিউমে লিস্টি মিলিয়ে সব পাওয়া যায়না। কিছু জিনিসের দাম যেন বেশি - আলমাসের সন্দেহ হয়। জিনিস ফুরিয়ে এলে আস্তে আস্তে দাম বাড়তে থাকে ছুটির দিনে। বাধ্য হয়ে আলমাস সব্জির বোঝাটা নিয়ে বাসস্টপে এসে দাঁড়ায়। মাইল চারেক দূরে আরেকটা জায়গা আছে। ছোট বাজার, আরো খোলামেলা। সাধারণত ভালো চাকরি করা লোকেরা ওখানে যায়না। আলমাস ভালো চাকরি করে।

    তবে আজ একটু অসুবিধের দিন, আজ যেতেই হবে।

    রাস্তা পার হয়ে বাসস্টপের ছাউনির দিকে যাওয়ার সময় পথে লাল লাল কিসের দাগ দেখে আলমাস। ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগের মত এগিয়ে দূরে মিলিয়ে গেছে। আশ্চর্য! এইটা তো ভেবে দেখিনি - নিজের মনে বিড়বিড় করে আলমাস - এগুলো তো রক্তই। গাড়ির রেডিয়েটারে ভরে দেওয়া লালচে রাসায়নিকের ফোঁটার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে আলমাস। ধড় থেকে ছিন্ন হওয়া মাথা আর রক্তের ফোঁটা দেখে যেমন নিশ্চিন্তে বিড়ি ধরিয়ে হেসে ফেলে মাছের ব্যাপারি, সেরকম হাসতে হাসতে নিস্চিন্ত ছাউনির মধ্যে এসে ঢোকে সে। বুকের কাছে গুটিয়ে থাকা কাগজটা সজাগ হয়। বাকি আছে, আরো কিছু জিনিস বাকি আছে।

    এমন সময় আলমাসের পিঠে টোকা পড়ে। কেউ ডাকছে।
  • Tim | 12.133.56.166 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:৫৩584743
  • বছর দশেক আগেও ফি হপ্তায় "শ্রদ্ধেয়া প্রফেসর আন্তোনিনা মানাতোভা-" দিয়ে চিঠি লিখতে হত আলমাসকে। সেই ডঃ মানাতোভা একটু আগেই আলমাসকে দেখে চিনতে পেরে যেচে কথা বলতে এসেছেন। আলমাস খুব কলেজ কামাই করত। কখনো জ্বরজারি হয়নি তার, কখনও পেটের অসুখ - ---আইগেরিমের তাড়া ছিলো বিয়ের।

    আন্তোনিনাও খোলা বাজারে যাবার বাস ধরতে এসেছেন। আর্তিউমের কাছেই এই বাস জংশন। আলমাস সাহস করে জিগ্যেস করতে পারেনা আন্তোনিনা কোথায় থাকেন।

    সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার ফেলে আসা খানিকটা অনুজ্জ্বল কৈশোর আর ততোধিক হতোদ্যম শৈশবের কথা ভাবতে থাকে।

    এমন সময় ৩২ নম্বর বাস এসে দাঁড়ায়। হাসিখুশি যুবতী কন্ডাক্টর দরজার ধারে এসে হেঁকে জায়গার নাম বলে। ওরা দুজনেই উঠে পড়ে বাসে। এই বাস শহরের পেট চিরে দুইপ্রান্তের শহরতলিতে গিয়ে একটা করে পাক দিয়ে আসে। নিরবচ্ছিন্ন এই পাক খাওয়া চকচকে বাসে বসে আলমাস আন্তোনিনাকে ভালো করে দেখে।

    আন্তোনিনার বয়স হয়েছে। গোল মুখ, মোটা মোটা পা, পায়ের গোছার নিচে বাদামী চামড়ার জুতো। গায়ে ধূসর পশমের ওভারকোট, কাঁধে ঝোলা চামড়ার ব্যাগ। চামড়াগুলো পুরোনো হয়েছে, তাতে অসংখ্য ভাঁজ। হাতের দস্তানাটা পাকিয়ে ধরে কোনক্রমে পাসটা বের করে দেখান আন্তোনিনা। কন্ডাক্টর হাসিমুখেই চলে যায়।

    আন্তোনিনা নিশ্চই শহরতলির বস্তিতে থাকেননা। নইলে তো সোজা সেখান থেকেই বাস ধরতে পারতেন। এইসব ভেবে, আর বাসের মাগনা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ঘেরাটোপে আলমাস বড়ো আরাম পায়। গত রাতের সুখস্মৃতি এই অবকাশে মনে এলে সে জানলার বাইরে তাকায়। লম্বা বাসটা ততক্ষণে শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে। খানিকটা করে বরফে ঢাকা সাদা ধবধবে মাঠ, আর মাঝে মাঝেই দরমার বেড়া দেখা যেতে থাকে। কিছু বেড়ার গায়ে নীল সাদা অপরূপ সবুজ উপত্যকার টানা পোস্টার সাঁটা।

    ঐ বেমানান ও মেকি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যটুকু আলমাসকে খানিকটা স্বস্তি দেয়।
  • Tim | 12.133.56.166 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০২:১৫584754
  • বাস যত এগোতে থাকে, যতই বাজার এগিয়ে আসতে থাকে, ততই আলমাস সহজ হতে থাকে। বাইরের দৃশ্যাবলীতে চোখ সয়ে যায় তার। দুধারেই বিস্তর ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি দেখা যায়। টিনের কৌটোর মত পড়ে থাকা ঝরঝরে গাড়িগুলো, তাদের কঙ্কাল, ছিঁড়ে খুবলে বেচে দেওয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাড়া - মৃত গাড়ির গণসমাধিক্ষেত্র পার হয়ে আসার সময় আলমাস রীতিমত সুস্থই বোধ করে। জমিয়ে আন্তোনিনা আর সে তাদের পরিবারের গল্প, তেলের দাম, বাঁধাকপির দর আর ফেলে আসা কলেজের দিনগুলো নিয়ে জল্পনা করে।

    এইরকম করে একসময় কেরুয়েন এসে যায়। ডাঁই হয়ে থাকা তরমুজের খোলার মধ্যে থকথকে ফল আর বীজ আর কাদারঙের বরফের পিচ্ছিল ফুটপাথ সমেত কেরুয়েন। বাজার দেখে আলমাসের বুকপকেটে কাগজটা খোঁচা মারে আবার।

    আমাদের আর মাইনে বাড়ালোনা, স্বগতোক্তির মত করে আন্তোনিনা বলে যান, সেই দশ বছর আগের মাইনেতেই আটকে রেখেছে। অবশ্য খুব যে কষ্টে আছি তাও না। চলে যাচ্ছে বেশ।

    এইসব শুনে, আর শুকনো ফলের দর করতে করতে আলমাস একটু সাবধান হয়। তার ভালো চাকরি, তেরোতলার ফ্ল্যাট আর উত্তরণের গল্প সে যথাসম্ভব রেখেঢেকেই করে। তার আঙুলের ফাঁকে শুকনো ফলগুলোর নাভিশ্বাস ওঠে, দোকানদার ভাবিত হয় -- ।

    কিন্তু কাগজটা এমন সময় পকেট থেকে আলগোছে উড়ে যায় বলে কথা এগোয়না। মিনিট খানেকের পরিশ্রমে হাঁফিয়ে উঠে যখন আলমাস আবার কাগজটা হাতে পায়, ততক্ষণে তার মাথা থেকে বুড়ি আন্তোনিনার কথা বেরিয়ে গেছে। সে নিশ্চিন্তে বাজার সেরে দুপুর একটা নাগাদ আবার সেই ফুটপাথে এসে দাঁড়ায়। দুহাতে প্রচুর জিনিস, এইভাবে বাসে বাড়ি ফেরা যাবেনা আজ। ট্যাক্সি চাই।
  • Tim | 12.133.56.166 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০২:৩৯584759
  • এই শহরে, ট্যাক্সি লাগলে ডানহাত বাড়াতে হয়। যেন বন্ধুর হাত, শহর অন্যহাতে জড়িয়ে নেবে। দুপুর গড়িয়েছে এখন, মেঘের স্তর ভেদ করে হলদে ফ্যাটফ্যাটে আলো এসে আরো ম্লান করেছে এই জনপদ, শহর। সেই শহরের পাশে ডানহাত বাড়িয়ে ধরে দাঁড়ায় আলমাস। তার পকেটের নিশ্চিন্ত কাগজ এতখানি শ্রমের শেষে এলিয়ে পড়ে থাকে - যেমন কাল রাতে সুখে জ্বলজ্বল করে ঘুমিয়েছে আলমাস, সেইরকম যুদ্ধজয়ের ক্লান্তি ও আনন্দ মেখে কাগজটা শুয়ে থাকে।

    আলমাস ট্যাক্সির চিন্তায় মশগুল হয়ে ভাবে। শহর কি আপনার হয়? স্তেপ? ঐ রঙ ওঠা আকাশ বুকে করে বসে আছে যে শহর, সেই কি তার শহর? ইশিমের জমাট পাথরের মত সাদা বুকের থেকে হাওয়া এসে আরো আনমনা করে দেয় তাকে, এতই, যে ট্যাক্সির ধুন্ধুমার ব্রেকের আওয়াজও তাকে চেতনায় ফেরাতে পারেনা পুরো।

    নতুন মডেলের চৌকোনো ছককাটা নক্সাদার ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে চারিদিক দেখে নেয় আলমাস। নাহ, ধারেকাছে আন্তোনিনা নেই। পৌঁছে দেওয়া যেত। শ্রদ্ধেয়া প্রফেসর মানাতোভা, আলমাসের এক চতুর্থাংশ মাইনে পান। নিশ্চই খুশি হতেন।

    এমন সময় কাগজটা খচমচ করে ওঠে। সশব্দে, প্রচুর ধোঁয়াশা তৈরী করে ট্যাক্সি চলতে শুরু করে। সে ধোঁয়ায় ভাঙা বাড়িগুলো, চিমনির জংধরা কঙ্কাল, গাড়ির কবরখানা, মায় রাস্তায় চুইঁয়ে পড়া অ্যান্টিফ্রিজের ফোঁটাগুলো পর্যন্ত অস্পষ্ট হয়ে যায়। এফেম রেডিওতে চমৎকার গান শুনতে শুনতে গাড়িতে আরাম করে বসে আলমাস। স্বস্তি ও আরামে তার চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসে।

    --------------------------------------------------
  • i | 147.157.8.253 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০২:৪১584760
  • ভালো লাগছে
  • nina | 79.141.168.137 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০৭:২৭584761
  • বাহ! ভিনদেশি নামগুলোর কি বাহার!
  • I | 24.96.75.87 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০৮:৫৯584762
  • চলুক। থামে না যেন।
  • | 24.97.101.127 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ১৯:২৪584711
  • বেশ লাগছে। চলুক চলুক
  • kk | 78.47.250.76 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ২০:৫১584712
  • এই লেখাটা খুব ভালো হচ্ছে।
  • siki | 132.177.249.151 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ২১:৩৭584713
  • জ্জিওত্তিমি।

    সঙ্গে আছি।
  • Tim | 12.133.55.10 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ২২:৫৮584714
  • রাতের দিকে বৃষ্টি এল। জানলার কাচের গায়ে লম্বাটে দাগ কেটে কেটে এঁকে বেঁকে জলের ফোঁটা নামছে। এখানে জলের শব্দ হয়না, জানলায় ভারি পর্দা টানা থাকলে বাজ পড়ার শব্দ কিংবা ঝলকানি, কোনটাই ঘরে ঢোকেনা। জলের ফোঁটা আলো পড়ে চকচক করছে, এইসব দেখতে দেখতেই আলমাস শুনতে পেলো, ফোন বাজছে।

    কালো কাঠের টেবিল, সঙ্গে মানানসই গদি আঁটা ঘূর্ণীচেয়ার। কিছু ড্রয়ার আর আধুনিক নানান সরঞ্জামের সামনে আলমাস এসে বসে। পুরোনো কালো ভারি ফোন না, মোবাইল ফোন বাজছে সামনেই। সাথে গোঙানির মত শব্দ করে কাঁপছে সেটা। আলমাসের মনে হয় মাংসের দোকানে ছটফটানো পশুর শরীর।

    পাভলোদারের গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ে। টিনের চাল, চালে হাওয়া মোরগ বনবন করে ঘুরছে। বৃষ্টি হলে ঝমঝম আওয়াজ হত। জলের শব্দ। বরফ গলে কার্নিশ থেকে চাঁই ভেঙে পড়ার আওয়াজ। বাবার ঘড়ঘড়ে গলার চিৎকার, মায়ের সেলাইমেশিনের শব্দ। জঙ্গলের দিকে উঠে যাওয়া রাস্তার দিক থেকে একটা খোঁড়া কুকুর ডাকত সারারাত। কুকুরটার একটা নাম দেওয়া হয়েছিলো যদিও এখন আর মনে পড়েনা সে নাম। বরং আমিনার কথা মনে পড়ে। রুটির কারখানায় কাজ নেওয়া হাড় জিরজিরে আমিনা, যে ওকে ভোরের দিকে চুরি করে আনা রুটির টুকরো দিয়ে যেত কাজে যাওয়ার পথে।
    আলমাসের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। দেশের গরীব লোকেদের কথা ভেবে শ্বাস ঘন হয়। কি করা যায়, ভাবতে থাকে আলমাস। একটু মদ খাবে নাকি? ঘুমোনোর জন্যে একটু মদ? জানলার কাচে জলের ফোঁটাগুলো তেষ্টা বাড়িয়ে অপচয়ের মত নিচে পড়ে যায়। খানিক দূরেই একটা নতুন অট্টালিকা তৈরী হচ্ছে, সেখানে এত রাতেও গুমগুম করে শব্দ হয়। রাতেও কাজ হয় ওখানে। ক্রেন ওঠে নামে, শক্ত টুপিতে মগজ ঢেকেঢুকে কাজ করে যাচ্ছে সব। ধুলো ওড়ে।
  • Tim | 12.133.55.10 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ২৩:১৫584715
  • দানিয়ারকে মনে পড়ে আলমাস? সেই যে হুজ্জুতে ছোকরা?

    দানিয়ারের সাথে কলেজ থেকেই প্রেম ছিলো আইগেরিমের। দানিয়ার ঝকঝকে যুবক, কবিতা লিখতে পারত, ভালো দাবা খেলতো আর সিগারেট খেত খুব। চোখগুলো একটু ছোট হলেও দানিয়ারকে দেখতে বেশ ভালো ছিলো বলে মনে করে আলমাস। একটু হালকা রঙের পোষাক পরতো দানিয়ার, আইগেরিমের পছন্দের হালকা সবুজ পোষাক।

    কিন্তু আইগেরিম তো ঘুমোচ্ছে। তার বউ, তার হতে চলা বাচ্চার মা আইগেরিম ইব্রায়েভা ঘুমোচ্ছে এখন।

    ... বৃষ্টির তেজ বাড়ে। আলমাস বসার ঘরের দিকে আসে। ঘুম তো এখুনি আর আসছে না, গলাটা ভেজানো যাক। দানিয়ারের সাথে একবার বাজি রেখে ভদকা খেয়েছিল। স্ট্রবেরি ফ্লেভারের ভদকা। পরে স্ট্রবেরি ফ্লেভারের বমি হলো। তারপর অনেকদিন স্ট্রেবেরি দেখলেই রেগে যেত দানিয়ার।
    ফ্রিজে কি স্ট্রবেরি আছে, আইগেরিম? ওহ! আইগেরিম তো ঘুমোচ্ছে। মসৃণ রাতপোষাক পরা পরির মত আইগেরিম ঘুমোচ্ছে।
  • Tim | 12.133.55.10 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ২৩:৪০584716
  • দানিয়ার একসময় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তৈগা এক্সপ্রেস তাকে গিলে নিয়ে কোথায় উগরেছে জানা যায়নি। কাস্পিয়ানের দিকে তেলের কারবারে জুড়ে গেল কি সে? শিমকেন্তের হুল্লোড়ে মারদাঙ্গা করে বেঘোরে মরে গেল? শিমকেন্ত, তরাজ এসব জায়গায় খুনখারাপি হয়। লাইসেন্স দিয়ে জুয়োর আড্ডা করেছে সরকার ওখানে। ইউরেশিয়ার লাস ভেগাস।

    নাকি আলতাই পাহাড়ের দিকে চলে গেল দানিয়ার। ওখানে হিমবাহ আছে শুনেছে আলমাস। সাইবেরিয়াও ঐদিকেই। আহা, বড় ভালো সময় কাটত দানিয়ার সঙ্গে থাকলে আজ।

    সাটিনের মৃদু খসখস শব্দ হয়। বিজ্ঞাপনে দেখেছে আলমাস, অবারিত সাটিনের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া, ভাঁজ খওয়া জমির ওপরে মোটাসোটা সাপ যাচ্ছে। সেরকম শব্দ করে উঠে আসে আইগেরিম।
    এতরাতে জেগে কি করছো আলমাস? বৃষ্টি দেখছি আইগেরিম। আলতাই পাহাড়ের হিমবাহে এখন....স্ট্রবেরি এনেছিলাম না আজ? ফ্রিজে আছে?

    জানলার পর্দাগুলো টেনে দিয়ে বৃষ্টির চোখ অন্ধ করে দিয়ে দুজনে শুতে যায়। মনে করে চাদরটা টানটান করে নেয়। দূরে ঘটাং ঘটাং আওয়াজ করে ক্রেনটা চলতে থাকে।
  • Tim | 12.133.55.10 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ ০০:২৯584717
  • সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হয়ে যায় আলমাসের। উঠতেই আইগেরিম ডাকে। এখন ওরা চা খাবে আমোদের দুটো কথা বলবে ধীরস্বরে জড়ানো গলায়। আলমাসের বাবা, ইয়েরবোলাত তোক্তামিসের এরকম ঘরঘরে গলা ছিলো। যৌবনে দর্জির কাজ করতেন ইয়েরবোলাত। পরে দোকান উঠে যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে এবং পাভলোদারের গ্রাম থেকে দলে দলে লোক শহরের দিকে আসতে শুরু করে। ইয়েরবোলাত, আনারা আর আলমাস শহরে এসে কারাগান্ডার দিকে একটা বস্তিতে ঘর বাঁধে সেই সময়। সেই পাঁচ বছরের খোকা আলমাস এখন তেরোতলার ফ্ল্যাটে থাকে, শহরের পথে ট্যাক্সি চড়ে সব্জি কিনে বাড়ি আনে। তার বিছানায় মহার্ঘ্য সাপের মত শুয়ে থাকে আইগেরিম।

    এই শহরে মেঘ করে থাকে রোজ। সূর্য উঠলেও একতাল মাখনের মত ঝুলে থাকে ধোঁয়াটে আকাশের গায়। জানলা দিয়ে দেখা যায় নিচে রাস্তায় সরু সরু পেন্সিলের রেখার মত করে বরফ জমেছে। হাওয়া দেয়, সেইসব বরফের গুঁড়ো নিজেরাই নড়াচড়া করে জায়গা বদল করে। রেখাগুলো বদলে বদলে নতুন ছবি। এই যেখানে ঢেউ, একটু পরেই মেঘের মত, আবার মিনিটেই সেখানে সব মুছে কালো পিচের রাস্তা ফটফট করে।

    ঐ রাস্তা দিয়েই বাবাকে নিয়ে গেছিলো। একদা দর্জি, পরে দিনমজুরির কাজ করা ইয়েরবোলাত ছেলের গৌরবে সুখী হতেন। সংখ্যায় মজে থাকার সময় কতবার ভেবেছে আলমাস, বাবাকে একবার দেখে এলে হয়। হয়নি। এখন সেখানে জানুয়ারির শীত বরফের সাথে এলোঝেলো হয়ে খেলতে বসেছে।

    ঐ বরফের আঁকিবুকি দেখে বলিরেখা মনে পড়ে আলমাসের। নাকি আইগেরিমের কোঁকড়ানো চুল? আমাদের সন্তানের চুল কি কোঁকড়ানো হবে, প্রিয় আলমাস?
    শীতটা যাক আইগেরিম। পাভলোদারের হাওয়া মোরগ কেমন যেন করছে, কুকুরটার পা ভালো নেই, চোখে দেখেনা। লেক থেকে দূর্গন্ধ কাদা উঠছে আজকাল। ঐখানেই নাকি ডীপ টিউবওয়েল বসবে, বুঝলে আইগেরিম ?

    আইগেরিম ঘাড় নাড়ে। ঘরোয়া মেয়ে, আলমাসের বউ শান্তস্বভাব আইগেরিম। ইউরেশিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একরোখা হুল্লোড়ে ডাকাবুকো চ্যাম্পিয়ন দানিয়ারের প্রাক্তন প্রেমিকা, আইগেরিম ইব্রায়েভা।
  • lcm | 138.48.127.32 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ ০০:৩৬584718
  • বাহ! কিন্তু এর প্রথম পার্ট আছে নাকি, সেটা কোথায়?
  • Tripti | 138.210.80.42 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ ০০:৪৭584719
  • অজানা শহর। অচেনা মানুষজন। দেশ কাল সময় ভুলে একাত্ম হয়ে যাচ্ছি তাদের সঙ্গে।
  • Tim | 12.133.55.10 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ ০০:৫০584720
  • ওখানে একটা পিরামিড হচ্ছে, জানো আইগেরিম? নকল পিরামিড, স্বচ্ছ স্ফটিক আর রঙিন কাচ বসানো পিরামিড। আমি একবার আসল পিরামিড দেখতে চেয়েছিলাম। মিশরে যেতে চেয়েছিলাম। দানিয়ার বলেছিলো নিয়ে যাবে। ওর কাছে ম্যাপ ছিলো, সেটা ছুটিছাটার দিনগুলোতে বসে বসে মুখস্থ করতাম, মকশো করতাম দুজনে। যেন গুপ্তধনের হদিস, যেন ধরা পড়ে গেলে গুপ্তচরের মত মানচিত্র পুড়িয়ে ফেলে স্মৃতি থেকে খুঁটে নিতে হবে জায়গার নাম।

    রান্নার আওয়াজে আইগেরিম কিছু শুনতে পায়না। দেখে, অস্ফুটে হেসে আবার বিছানায় গড়িয়ে যায় আলমাস। পাভলোদার তার নিজের জায়গা ছিলো। রক্তে বসে আছে সে জায়গা, টের পায় সে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে লেকের ধারে গিয়ে বসে পড়তে পারে সে। চড়াইয়ের প্রতিটা বাঁক তার শিরা উপশিরায়।

    কিন্তু সে শহরের রাস্তায় লাল লাল ছোপ দেখেনি সে। মাছ মাংস কিনতে গেলে রক্তের দাগ দেখতে হয়্না? পাভলোদার জেলা মরে হেজে যাওয়া পশু এক।

    লেক থেকে জারিকেন নিয়ে জল নিয়ে যেত অনেকে। আমিনাকেও দেখেছে এক আধবার। রুটি কারখানার মজুর আমিনা, হাড় জিরজিরে উঁচু গালের পাহাড়ি মেয়ে। এখন সেই লেকে সাদা বালির মত তুষারের ঢেউ ছড়িয়ে আছে। খোঁড়া কুকুরটা নিশ্চই এই শীতে কঙ্কাল হয়ে লেকের কোন গর্তে শুয়ে আছে।

    পাভলোদারে চাঁদ ওঠে এখনও? লেকের জলে আলো পড়ে কিলবিল করা দেখে আমিনা একদিন তাকে চুমু খেয়েছিলো।

    রান্নার সুঘ্রাণ ভেসে আসে। এত মন দিয়ে কি ভাবছো আলমাস? মমি, পিরামিডে জিইয়ে রাখা মমি দেখতে ভারি ইচ্ছে যায় আইগেরিম। মাকড়শার জালের মত ফিনফিনে আবছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকা মমি, চাঁদের আলোয়।
  • Tim | 12.133.55.10 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:১৫584722
  • ইতিমধ্যে শীত ফুরিয়ে আসতে থাকে। হাওয়া মাঝে মাঝে কমে আসে, মাটির ওপর জমে থাকা বরফের স্তূপ একটু একটু করে নরম হতে থাকে। শহরের বাইরের জলা জমিটা আবার কাদাকাদা হয়ে ওঠে একদিন। সেখানে ম্যাগপাই জঞ্জাল আর পোকামাকড় খোঁজে। আরো কিছুদিন গেলে দুয়েকটা বক দেখা যাবে।

    নূর আস্তানার থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসে। ডুকরে ডুকরে ওঠা সুরেলা আজান। একদিন ঐ মসজিদের ইমামের সাথে আলাপ হয়েছিলো আলমাসের। বাসের ছাউনিতে। রোগামত মধ্যবয়সী ইমাম, সামনের একটা দাঁত সামান্য ভাঙা, হাসিখুশি। সঙ্গে পরিবার ছিলো, বোরখায় ঢাকা বউ, দুটি শিশু। ভালো লেগেছিলো আলমাসের। ইমামের নাম জিগ্যেস করা হয়নি। গর্ব করে বলেছিলো, আমি দিল্লীর মসজিদে গেছি, জানো? বিশাল মসজিদ সে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আলমাস দেখেনি সেসব। ফিকে রোদে হাসতে হাসতে বিদায় নিয়ে বাসে উঠে যায়িমাম পরিবার। আলমাসের বাস এটা নয়।

    শীত কমে গেলেই কথা রাখতে হবে, মনে মনে বিড়বিড় করে আলমাস। আমিনা কিছু টাকা দিয়েছিলো, ফেরৎ দিয়ে আসব আইগেরিমকে সাথে নিয়ে। কুকুরটাকে কবর দেব, ব্যাটা মরেই গেছে হয়ত। কপালজোরে, ফৌৎ না হয়ে গেলে নিয়ে আসবো সাথে করে। এই শহর বিরাট বিশাল তার উনুন, পাভলোদারের খোঁড়া কুকুরটার হিল্লে হয়ে যাবে।

    নূর আস্তানার চূড়া রোদ পড়ে একটু ঝকমক করে। মাখনের দলা থেকে চুঁইয়ে আসা রোদ।
  • raatri | 24.99.61.124 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:৩৪584723
  • মায়াবী!!
  • nina | 79.141.168.137 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ ০৩:৫৫584724
  • টিম্ভাই ঠিক যেন সেই বাঁশীওয়ালা---

    -আপন মনে বাজাতে বাজাতে চলেছে--আর যে শুনছে সে ই আচ্ছন্ন হয়ে চলছে পিছু পিছ----এক অচিন দেশের নূর আস্তানার চূড়ার দিকে-----মাখনের দলা থেকে চুঁইয়ে আসা রোদের ওম পেতে!
  • Tim | 12.133.44.30 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০০:০০584725
  • বাড়ি থেকে আসি, চলো আলমাস। জানলা দিয়ে কমে আসা শীতের রাস্তার দিকে তাকিয়ে খানিকটা অন্যমনস্ক আইগেরিম বলে। যাবে?

    এখন ওদের দুজনেরই বাড়ি কারাগান্ডায়। কয়লার শহর, ইস্পাতের শহর কারাগান্ডা। কারলাগের শহর।

    সেদিন বিকেলেই ভাড়া করা গাড়ি করে দুজন রওনা দেয় কারাগান্ডার দিকে। আস্তানা ছেড়ে বেরোনোর মুখে রাষ্ট্রপ্রধানের বাড়ি দেখা যায়, একাধিক। শেষবাড়িটার সাথে বিশাল জমি নিয়ে খামার। রাজার নিজস্ব খামারবাড়ির চারপাশে উঁচু দেওয়াল, তবু এক আধফালি ছবি দেখা যায় ট্যাক্সির ভেতর থেকে। অনেক আশা নিয়ে আইগেরিম আতিপাতি করে তাকায়, যদি বিশেষ কিছু দেখা যায়। কিন্তু কিছুই নেই। খালি মাঠ, আর দুয়েকটা নেড়িকুত্তা দেখা যায়। পাঁচিলের কোন লুকোনো গর্ত দিয়ে ঢুকে পড়া কুকুর।

    এরপর শহর শেষ হয়ে যায়। কখনও একপাশে, কখনও দুপাশেই ঢেউখেলানো স্তেপ, আর সেই স্তেপের বুক চিরে হাইওয়ে। এতই সোজা, যে মনে হয় রানওয়ে। ওদের গাড়িটা আরেকটু এগিয়েই শিং উঁচিয়ে ঝুলে পড়বে আকাশে।

    মাঝে মাঝে এক আধটা টিলা। এরকম টিলা আলমাস দেখেছে এর আগে নেভাদার দিকে। কাঁকুড়ে ঢিপির পাশ কাটিয়ে, দৈবাৎ বাঁক নিয়ে গাড়ি ছোটে। আইগেরিমের দিকে অপাঙ্গে দেখে আলমাস। কি সুন্দর দেখচ্ছে ওকে! হাওয়ার ঝাপটা আসছে গাড়ির কোন ফাঁকফোকর দিয়ে, সেই হাওয়ায় আইগেরিমের কপালের একগাছি অবাধ্য চুল উল্টে পাল্টে লাট খাচ্ছে কাটা ঘুড়ির মত।
  • Tim | 12.133.44.30 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০০:২০584726
  • ব্যস্ত শহর থেকে সপ্তাহ শেষ হলে সবাই পালায়। কারাগান্ডা হয়ে যে রাস্তা আরো দক্ষিণে আলমাটি চলে গেছে সেটা তখন ভয়ানক ব্যস্ত। দুদিকেই বেপরোয়া গাড়ি চলে। উল্টোদিকের গাড়ির রাস্তায় উঠে এসে অন্য গাড়িদের থেকে আগে পৌঁছে যেতে চায় সবাই। কোথায় পৌঁছতে চায় সবাই? ভুল করছো তোমরা, এত তাড়াহুড়ো করে, ভুলই করে চলেছো সবাই। ও কি তোমার নিজের শহর, নিজের বাড়ি? বাড়ির শিকড় তুলে খুঁজে দেখেছো সেখানে তোমার রক্ত কালচে দানা বেঁধে আছে কিনা? নেই, নেই --- ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে ওঠে আলমাস। গরম লাগতে থাকে ওর। জানলার কাচটা অনেকটা নামিয়ে দিতে হয় বাধ্য হয়েই। ঠান্ডা হাওয়া এসে সামলায় আলমাসকে। একটা প্রকান্ড থালার মত এই দেশের সব স্তেপ আর পাহাড়ের সেরা স্বাদু সঞ্জীবনী হাওয়া এসে ওকে আগলে রাখে, যেন।

    বাইরের দৃশ্য তখন একটু পাল্টেছে। একটা বড়োসড় বিলের পাশ দিয়ে ছুটছে গাড়ি। খানিকটা বরফ গলেছে, সেই আধাশক্ত জল বরফের মিশ্রণে খাবার খুঁজে মরছে কিছু ম্যাগপাই। আরো কিছুদিন পরে এইখানে সাদা বকের দল দেখা যাবে। তারা এখন অন্য শহরে, গরমের দেশে। দেখেছো আইগেরিম, একতরফা মালিকানা নেই কারো কোন শহরের ওপর। এইটাই নিয়ম।

    ওরই মধ্যে একটা হালকা সবুজরঙের পাখি দেখা যায়। আলমাস সব পাখির নাম জানেনা। এ কী পাখি, আইগেরিম? আইগেরিম বুদ্ধীমতী, প্রাণিবিদ্যার কৃতী ছাত্রী। কিন্তু আইগেরিম বলতে পারেনা। হালকা সবুজ না নীল দেখলাম, হুশ করে বেরিয়ে গেল বলেই কি চেনা গেলনা আলমাস? অর্ধেকের বেশি পথ এসে গেছি আমরা, বলে হাঁফ ছেড়ে এলিয়ে পড়ে আলমাস। অদূরেই আরেকটা টিলা দেখা যায়। আর সামান্য কৃষিকাজের জমি। গম আর আলুর খেত ওগুলো, এখন যদিও কিছুই চাষ হচ্ছেনা। সবাই অপেক্ষায় আছে এপ্রিলের। তারপর আর এখানে বরফ পড়বেনা।
  • Tim | 12.133.44.30 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:০৫584727
  • অনেকক্ষণ পরে কিছু মানুষের মুখ, বাড়িঘর দেখে ভালো লাগে আলমাসের। টিলার একঢালে ছোট্ট গ্রামটা। ছবির মত। ছবিতেও একেবারে অবিকল এরকম রুগ্ন মানুষ আরে ভাঙাচোরা গ্রাম থাকে, দেখেছে আলমাস। বিদেশে দেখেছে, ছবির প্রদর্শনীতে।

    গাড়ির গতি একটু কমাতে বলে আলমাস। পেছনের একটা গাড়ি সশব্দে ওদের অতিক্রম করে একরাশ ধুলো উড়িয়ে চলে যায়। রাস্তা এখানে খুব চওড়া নয়।

    টিলার পাশ দিয়ে যেতে যেতে গ্রামটার প্রায় সবটাই দেখা যায়। পায়ে চলা পথঘাট, মরচে ধরা চিমনি তাকিয়ে আছে জোড়াতালি দেওয়া বাড়ির চালের থেকে। চোখের পলক ফেলবার আগেই শেষ হয়ে যায় গ্রাম। তারপরেই লম্বাটে একফালি জমিতে কবরখানা। কবরও কি ফসল, আলমাস ভাবে। মাটিতে কি আমরা আসলে বীজ ছড়িয়ে দিই, কবরের ছলে? আমাদেরই অতীত কি মজ্জায় মাংসে অস্থিতে শ্যাওলার ছোপ হয়ে জমে থাকেনা সেখানে? আলমাসের ভারি আনন্দ হয়, যেন ওর পায়ের আঙুলগুলো ক্রমশ সরু হয়ে মাটির রসের খোঁজে এগিয়ে চলেছে পরপর শুয়ে থাকা আপনজনেদের শবগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে। এই তো এসে গেছি আইগেরিম, আর মিনিট পনেরো পরেই বাড়ি এসে যাবে। বোকা আলমাস, তুমি এখনও একে বাড়ি বলো? কবেই কি সব চুকেবুকে যায়নি?

    আলমাস উত্তর দেয়না। খোঁড়া কুকুরটাকে এরকম একটা কোথাও কবর দিতে পারলে ভালো হত। নিজের লোকেদের মধ্যে থাকতো। এখানে গম আর আলুর চাষ হয়। গরমের দিনে পাখিরা ফিরে আসে।
  • Tim | 12.133.44.30 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:৪৪584728
  • আনারা এখন বস্তিতে থাকেন না। কারাগান্ডা শহরের অপেক্ষাকৃত শস্তার অঞ্চলে ভাড়া বাড়িতে উঠে গেছেন কয়েক বছর। ছেলে ভালো চাকরি করে, নিজে সেলাই করেন এখনও অল্পস্বল্প, চলে যায়। কোনক্রমে চলে যায় কি, ডঃ মানাতোভার মত? আলমাস ভাবে। মানুষের কিসে চলে যায়, আর কিসে চলেনা বোঝা ভার।

    আনারার বাড়ির পথে একটা সরাইখানা পড়ে। পুরোনো সরাই, এখন লোকের থাকার তেমন সুবিধে নেই, খালি কাজচালানো গোছের খাবার পাওয়া যায়। এই অবেলায় আনারাকে বিরক্ত করা উচিত হবেনা, তাই ওরা ওখানে বীটের ঝোল আর পাঁউরুটি খেয়ে নেয়। টকটকে লাল ঝোলের নিচে ওঁত পেতে বসে থাকে এক টুকরো সেদ্ধ মাংস।

    সরাইখানায় সেই ভিনদেশী লোকটির সাথে দেখা হয়ে যায় আলমাসের। কয়লার তোলার কোম্পানিতে কাজ করে, হিসেবের খাতা লেখে। অদ্ভুৎ লোক, বউবাচ্চা দেশে রেখে এখানে চাকরি করে। কথায় কথায় বলেছিলো, সব টাকা জমিয়ে রাখে। বছরে একবার দেশের বাড়িতে গিয়ে ব্যাঙ্কে রেখে আসে। কালোমত, সামান্য মুটিয়ে যাওয়া লোকটার চোখের নিচে ঘন অন্ধকার দেখে অস্বস্তি হয় আলমাসের। খারাপ রোগটোগ হলো নাকি? ছোঁয়াচে রোগ? পরে অবশ্য ভুল ভাঙে তার। সরাইয়ের আলো আঁধারির সাথে অস্তমিত সূর্যের খামখেয়ালিপনায় অমন দেখাচ্ছে।

    সরাইয়ের ধুলোটে গলি থেকে আবার বড়ো রাস্তায় এসে পড়ে গাড়ি। আলো জ্বলে উঠছে একে একে এখানে সেখানে। হমদে স্তিমিত আলো সব, ঘুমপাড়ানি। সেই ঝিমন্ত কারাগান্ডায়, সন্ধ্যের ঝোঁকে সস্ত্রীক আলমাস আনারার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।

    ভেতরে সেলাইকল চলছে। বাবার সেলাইকল, বুঝলে? একফোঁটাও মরচে ধরেনি এখনও। কি চমৎকার কূর্তাই না বুনে দিত ঐ কলে। সেবার....

    ঘটনাটা বলা হয়না আলমাসের। দরজা খোলার আওয়াজের সাথে সাথে একঝলক আলো ওদের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর আনারার আহ্লাদিত গলা শোনা যায়। এইসবে পাড়ার শান্তিভঙ্গ হওয়ায় কাছেই কোন বাড়ির ভেতর থেকে কুকুর ডাকতে থাকে। ওরা ব্যস্তসমস্ত পায়ে বাড়িতে ঢোকে।

    এবং, চাঁদ ওঠে। আলমাস চাঁদের দাগধরা ক্ষয়াটে চেহারায় অবাক হয়ে সরাইখানার ভিনদেশী লোকটার মুখ দেখতে থাকে।
  • __ | 12.133.44.30 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:৪৭584729
  • টাইপো হচ্ছে।
    হলদে স্তিমিত আলো... ইত্যাদি।
  • nina | 79.141.168.137 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৩ ০৩:৩৮584730
  • কি মিঠে বোল রে তোর টিম্ভাই-----কি মনভোলানো সুর--
  • de | 69.185.236.53 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ১৭:১৪584731
  • খুব ভালো হচ্ছে -- যেন পুরনো রাশান বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখচি!
  • jhumjhumi | 127.194.238.209 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ১৮:৩০584733
  • চমৎকার!!
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন