এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • পায়ের তলায় সর্ষেঃ পুরনো সিল্ক রুট।

    I
    অন্যান্য | ২৮ মার্চ ২০১৩ | ২৪৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • pipi | 139.74.191.52 | ১৫ এপ্রিল ২০১৩ ২১:৪৪599860
  • ফাঁকিবাজ দাগদার! খালি ভাটে বসে ভাটাচ্ছে। এটা যে অনাথ শিশুর মত কাঁদছে সেদিকে নজর নাই!
  • I | 24.99.63.74 | ১৬ এপ্রিল ২০১৩ ০০:২৬599861
  • এবার আর ভুল রাস্তায় নয়। কিছুক্ষণ হাঁটতেই দেখা গেল লেক। কিন্তু সে যে-এই অরিজিত, ব্ল্যাংকি এরা সব বলেই দিয়েছে- একটি আদ্যন্ত ম্যানমেড লেক। তাই বলে সাইজে ছোট নয় অবশ্য। চারধার বেশ সুন্দর করে বাঁধানো।লেকের জল সন্দেহজনকভাবে সবুজ। তাতে ছোট থেকে মাঝারি সাইজের সব কমলা রংয়ের মাছেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি লোক্যাল ছেলে বসে বসে গুলতানি মারছে ও কিছু বেকার কুকুর যুবক-যুবতী ইয়ে করছে। কোত্থাও কোনো নীতি-পুলিশ নাই। ছেলেরা মাঝেমধ্যে জলে কিসব যেন ছুঁড়ে মারছে, কমলা মাছেরা লম্ফ দিয়ে উঠে সেসব মুখে পুরে নিয়ে আবার জলস্থ হচ্ছে। চারিদিকে একটা খুশিয়াল ভাব, যদিও আলো পড়ে আসছে। এবং পরিযায়ী পাখীদের দেখা নেই। লোক্যাল পাখীও দূর অস্ত। শুধু কয়েকটি রাজহংস ক্যাক ক্যাক করে বিকট জোরে চীৎকার করে খুশিমন্ত নশ্বর মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে-এয়সা দিন রহে থোরি ! রহে থোরি ! দান করো, দান করো, পাখপাখালিকে দান করো।
    এদের আওয়াজকেই আমরা তার মানে দূর থেকে বিশাল বিহগসমাবেশের সমবেত কূজনকাকলি বলে ভুল করেছিলাম; ও আমাদের লেন্সের জিভ লকলকিয়ে উঠেছিল। তবে মিথ্যে বলবো কেন, কিছু পাতিহাঁসও ছিল বটে, তারা পাড়ে বসে নির্বিঘ্নে রোদ পোয়াচ্ছিল। মানে যখন যেটুকু রোদ পাচ্ছিল আর কি।

    লেকের চারপাশে চক্কর মারবো মনস্থ করি। মোটামুটি সুন্দর সাজানো গোছানো বাগান, ম্যানমেড। বোধ হয় সিকিমের রাজা চামলিং মশায় কোনো এক সময় কিছু একটা ফিতে কাটা কি পাথর পোঁতা ইত্যাদি করেছিলেন। আমরা ডান দিকে হাঁটতে শুরু করলেই ক'টি লোক্যাল যুবা এসে বিনীতভাবে বলল-এদিক দিয়ে হাঁটবেন না। বাঁদিক ধরে হাঁটতে হয়। কেন রে বাপু ! বুদ্ধদেব নাকি রিম্পোচে -কে বারণ করে গেছেন জিগ্গেস করি না; বারণ মেনে বাঁদিক দিয়েই হাঁটা শুরু করি। সাথে সাথে আরো কটি উনযুবা এসে ধরে- মছলিকো চারা খিলানেকে লিয়ে পয়সা দিজিয়ে! কেন, উসমে কেয়া হোগা শুধোনোয় তারা হাসিমুখ করে বলল- মছলিকা তাকত হোগা, আপকা ভি পুন্ইয়া হোগা। এ হেন এক চারায় দুই মছলি মারার ( না কি ধরার?) সুযোগ হেলায় ফেলে রেখে আমরা গড়গড়িয়ে হেঁটে যাই সুমুখপানে। মছলিকুলের ( এবং সন্দেহ করি উনযুবাদেরও) জীবাত্মা তো বটেই, পরমাত্মা অবধি যে বাঙালীবাবু-বিবিগণের নাস্তিকতায় ঘৃণায় শিহরিত হয়ে ওঠে সে বিষয়ে বিলকুল সন্দেহ করি না।

    একটু দূরেই লেকের জেটি। সেখানে পৌঁছতেই এক ফোকলা বৃদ্ধ আমাদের দেখে একমুখ মাড়ি বের করে অভ্যর্থনা করেন; বৃদ্ধ খুব অমায়িক, কিন্তু তাঁর হিন্দি শব্দভাণ্ডার নিতান্তই সীমিত, এবং যেটুকু আছে, তাও অনুধাবন-অযোগ্য হওয়ায় এক সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমরা প্যাডল বোট চড়তে চাই ( মানে ঠিক সবাই চাই না, কিম্বা চাই কিনা ঠিক জানি না) এবং তিনি চড়াতে চান - এটুকু অবধি পরিষ্কার হলেও একখানা বোটে ছ'জন আঁটবে কিনা, আঁটলেও সে আঁটন লেকমাঝারে গিয়ে ফস্কা গেরোর প্যাঁচালে পড়বে কিনা সে বিষয়ে কিঞ্চিৎ ক্যাঁচাল তৈরী হয়। রাজহাঁসেরাও সুযোগ পেয়ে গলা বাড়িয়ে চাট্টি মতামত জানিয়ে দেয়।
    কে না জানে এইরূপ ঐহিক সমস্যার সমাধানে গিন্নীদের কী অসীম ভূমিকা ! ঠিক এই কারণেই পারমার্থিক প্রশ্নে "একলা চলো রে নীতি' ধারী অধিকাংশ পুরুষই ( আমার জানা-চেনা আর কী) সংসারধর্ম পালনার্থে অন্ততঃ একটি করে ( কেউ কেউ আবার একাধিক ) বিয়ে করে রেখেছেন। মাড়িময় বৃদ্ধও দেখলাম সমরূপ স্যায়না, তিনি তাঁর "ও অনাথের নাথ ও অগতির গতি '' গিন্নিকে পাশেই আচার বিক্কিরি করতে বসিয়ে রেখেছিলেন; তিনিই যথাসময়ে এসে সব ঠিকঠাক করে দিলেন।

    মানে ঠিকঠাক করবার চেষ্টা করলেন আর কি। আমরা ছজনায় তুমুল বিক্রমে অন দ্য সেম বোটায়িত হওয়ার চেষ্টা করামাত্র তরীটি প্রবল দুলে উঠে আপত্তি জানাল, তারপর থেকেই সে মুহূর্মুহু কখনো ডাইনে, কখনো বাঁয়ে ঘনঘন মাথা হেলিয়ে এহেন ব্যবস্থার প্রতি তার তীব্র বিদ্বেষ ক্রমাগত জানিয়েই যেতে থাকল। আর যাত্রীপুঞ্জও সেই করালকুটিলা বিদ্যুতজিহ্বলেকজলরাশির খর আস্ফালনমধ্যে , সেই ঘোরা তরঙ্গরাজির অট্ট অট্ট হাস্যনিনাদে, সেই নিবিড় অমানিশার মসিময় তমিস্রামাঝে, সে নিদারুণ নিষ্করুণ ঘুর্ণ্যবাত্যারবে কাঁপতে কাঁপতে মধুসূদন-আল্লা-গড-দক্ষিণরায় ! পরিত্রাহি-ত্রাহি-বাঁচাও-রক্ষা করো- SOS ইত্যাদি যে যাঁর মাতৃভাষায় মামাগাগা হরেকরকম বলে যেতে থাকলেন। যদিও নৌকা তখনো জেটির কয়েক হাতের বাইরে যায় নি, কিন্তু পরিস্থিতি হরি-আল্লা-গড-শাক্যসিংহ প্রমুখের হাতের বাইরে বিধায় বৃদ্ধের ছেলে কোত্থেকে যেন জল ফুঁড়ে উঠে এসে বোটটিকে ঘাড়ে ধরে ফিরিয়ে আনলেন, যেন টাইটানিক ফিরে এয়েছেন জেটিতে। এইসব দেখেশুনে তো আমার ঘেন্নাই ধরে গেল মশয়, ঠিক করলাম পরের জন্মে আর বিয়েই করবো না, একটি চালাক-চতুর ছেলে অথবা মেয়ের বাবা হয়েই জীবন কাটিয়ে দেবো, সংসারসমুদ্রের কাণ্ডারী হবে।

    ফিরে এসে গিন্নিগণ ঠিক কল্লেন, অনেক হয়েছে, লেকবিহার আর নয়। আমরা বাপে-ছায়ে চারজনায় তখনো কিঞ্চিদধিক অ্যাডভেঞ্চারের আশা রাখি, আমরা আবার চেপে বসলাম, তবে অন্য বোটে। আগের বোটটির নাকি এরকম পিত্তির ধাত আগে থেকেই রয়েছে জানা গেল, মাঝেসাঝেই তার কেমনধারা বেয়াড়া রোখ চাপে, সে এমনতরো ঘূর্ণিপাক খেতে থাকে। এবারের বোট তেমন নয়, ভারি শান্ত ও ভব্য, দুধভাত ছাড়া কিচ্ছুটি খায় না -বলে ছেলে আশ্বাস দিল।

    তবে কিনা যাত্রারম্ভেই বিপত্তি। কি কারনে নীচু হয়েছি, ক্যামেরা থেকে লেন্সের ক্যাপটা গেল খুলে। বোটের মেঝেয় খানিকটা জল জমা ছিল, সেই জলের মধ্যে একেবারে। লেন্সক্যাপ ও ক্যামেরা শুদ্ধু রাত্রির হাতে ধরিয়ে প্যাডল করতে শুরু করলাম। এবারে আর তেমন কোনো বিপত্তি হল না। জেটির নিচ থেকে একটা বড়সড় কোলাব্যাঙ শুধু চোখ মটকালো। কিছুটা ঘোরাঘুরির পর-পা-ও তখন ক্লান্ত হয়ে আসছে-আকাশে গুড়ুম-গুড়ুম-মড়াৎ ! বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে। কলো মেঘ আরো কালো হয়ে এসেছে। বৃষ্টি এল বলে।
  • nina | 79.141.168.137 | ১৬ এপ্রিল ২০১৩ ০৭:৪৫599862
  • আহা নতুন বছরটা কি ভাল কি ভাল লেখা পড়ে শুরু হল---সারা বছর যাবে ভাল--ডাগদার যেন সারা বছর ইতি-উতি ঘোরে আর ঘোরে----লেখে আর লেখে !
    কিন্তু ডাগদার বেচার বোটের পিত্তির রোগের একটা ওষুধ দিলে না?

    গিন্নিগণ !! ঃ-)) হেব্বি ভাল লেগেছে এই ডাকটা--
  • I | 24.99.120.69 | ২১ এপ্রিল ২০১৩ ১২:৩৩599863
  • তড়িঘড়ি জেটিতে নৌকা ভেড়ানো হল। ক্যামেরা ব্যাগে পুরে ব্যাগের গায়ে বর্ষাতিজামা পরানো হল ( যেন ঐটিই সবচেয়ে মূল্যবান ধন , রোগারোগা ছানাগুলো এবং ঈষৎ ইয়েমত গিন্নিরা কিছু নয়), তারপর হাঁটা দিলাম হোটেলের দিকে । হাঁটা মানে হাঁটাদৌড় আর কি। এই ডামাডোলে লামপোখরি লেক রিসর্ট আর দেখা হল না, দেখব বলে মনস্থ করে এসেছিলাম যদিও; সে নাকি বেশ সুন্দর জায়গা। একটি কুকুর ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বাচ্চাদের পিছু নিল। দূরে মেঘমাশ্লিষ্টসানু এবং বপ্রক্রীড়াপরিণতগজঃ পর্যন্ত, বৃহংণটৃংহণ সমেত; গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে এবং ফোঁটারা ক্রমেই আরো বড় বড় ও ফ্রিকোয়েন্ট হচ্ছে। তখন রীতিমত দৌড় ঐ উৎরাই রাস্তায়। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে গেল। কাছেই একটা হাইস্কুল ছিল, আরিতার সরকারী স্কুল-তার বারান্দায় উঠে পড়লাম।যাওয়ার সময় দেখে গেছি স্কুলের দরজা-জানালা বন্ধ হচ্ছে, কোনো দারোয়ানটারোয়ান সম্ভবতঃ নেই, ছেলেমেয়েরাই টেনেটুনে বন্ধ করে তালা লাগিয়ে বাড়ি ফিরছে।স্কুল বেশ বড়, দোতলা কি তিনতলা হবে, লাইব্রেরি-টিটি রুম ইত্যাদি সবই রয়েছে; স্থাপিত ১৯৪৬ সালে, অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতার চেয়ে এক বছরের বড়ো।

    তখন এই জনপদ কেমন ছিল ভাববার চেষ্টা করি।ভাবনায় কিছুই আসে না, এখনই তো কেমন জনবিরল এলাকা। হয়তো দশ-বারো মাইল দূর দূর থেকে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসত, দীর্ঘ বনপথের মধ্য দিয়ে, বাঁশবন, শাল আর পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। সে পথে রেড পাণ্ডা আর ভালুকের যাতায়ত ছিল নিশ্চয়, চিতাবাঘও কী ছিল না? সেসব গল্প শোনানোর লোক আছে হয়তো গ্রামে, কিন্তু অচেনা লোকের সঙ্গে ভাব জমাতে একদম পারি না; আর তাছাড়া আমাদের সময় কোথায়? এই ঝাঁকিদর্শনে বেড়ানো হয় না।

    আধ ঘন্টা কেটে গেল , বৃষ্টি ধরার নাম নেই। যে জিনিষ হোটেলের জানলা থেকে খুবই উপভোগ্য হতে পারত, চা আর পকোড়ার সঙ্গে, তা এখানে আধভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে একটু বোরিং লাগছে। একটি কুকুর অবশ্য আমাদের মনোরঞ্জন করবার খুব চেষ্টা করছে, বিশেষ করে শিশুদের। কে জানে ঐ পিছুনেওয়া কুকুরটাই কিনা! রাস্তায় অজস্র কুকুরের ছড়াছড়ি, সকলেই ঝাকড়া লোমওলা, সকলেই ল্যাজ নাড়ায়, কেউই কদাচ ঘেউ ঘেউ করে না। তাই বলে যে কামড়ায়, তাও না। এদিকে জলরেণু আর মেঘ-কুয়াশায় কেমন একটা মোহ জন্ম নিয়েছে সেই বিকেল-করা পাহাড়ে, গাছগুলো জলের তোড়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, অনেক উঁচু ডালে ফুটে -থাকা মোমের মত সাদা অর্কিড ছিঁড়ে পড়ে যাবে মনে হচ্ছে বৃষ্টিতোড়ে।

    বোধ হয় মিনিট পঞ্চাশেক পরে বৃষ্টি কিছুটা ধরল; আমরা আর চান্স না নিয়ে ওর মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম, কে জানে বাবা, আবার কখন বেড়ে যায়; ঐ তো একটু দূরেই হোটেল দেখা যাচ্ছে।

    ঘন্টাখানেক পরে একটু ঘুমটুম দিয়ে উঠে বেশ ফূর্তি হল মনে। বোলাও তবে চা আর পকোড়া। শবরীরা সপরিবারে আমাদের ঘরে এসে বসল, সেখানে চা-পান পর্ব চলবে, আড্ডার সঙ্গে। শবরী খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, ও গান শিখেছে ( এখনো শিখছে ইন ফ্যাক্ট) কাকলি রায়ের কাছে; এঁর আর এক পরিচয়, ইনি দেবেশ রায়ের স্ত্রী। একটু কম চেনা গানই আমাদের পছন্দ, আমার ফরমায়েশে গানের আসর শুরু হল - 'এ কী এ সুন্দর শোভা' দিয়ে। তারপর গাইল- যারা বিহানবেলায় গান এনেছিল, বাজাও আমারে বাজাও। আরো কত গান।

    গান নিয়ে , গানের বাইরেও নানান গল্প আছে শবরী-সুমনের স্টকে। একটা গল্প একটু বললে হয়।

    সুবিনয় রায় তখন আনন্দলোক হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়। ডিমেনশিয়া, সেমি-কোমাটোজ অবস্থা। সুমন তখন আনন্দলোকে ডাক্তারী করে। শবরী, যদিও অনেকদিন আগে আনন্দলোক ছেড়ে দিয়েছে, ডাক্তার-নার্সদের সঙ্গে পরিচয়-হৃদ্যতা রয়ে গেছে। তাই ও এসেছে আই সি সি ইউতে সুবিনয় রায়কে দেখতে। পাশে সুমনও দাঁড়িয়ে আছে। নানাভাবে ও কথা বলবার চেষ্টা করছে সুবিনয় রায়ের সঙ্গে ( "আপনার গান আমার খুব ভালো লাগে, আপনার কাছে গান শিখবার ইচ্ছে ছিল, সুযোগ পাই নি কখনো''-এইসব), কিন্তু বৃদ্ধ কিছুকাল হল কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। নড়েন-চড়েন না, কথা বুঝতেও পারেন না। তখন, সেই মৃত্যুর ছায়ায় -ঢাকা আই সি সি ইউ-র বেডের পাশে দাঁড়িয়ে শবরী চাপা গলায় গান ধরেছে-ক্ষত যত ক্ষতি যত; আর ওর চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় গড়িয়ে পড়ছে জল। এইবার একটা আশ্চর্য ম্যাজিক ঘটতে চলেছে, আধা-অচৈতন্য বৃদ্ধের ডান হাত ঈষৎ নড়ে উঠছে, সে হাত গানের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ তাল দিচ্ছে বিছানার ওপর। শবরী গেয়ে চলেছে, তালও চলেছে সাথে সাথে। এই যে হেরিলে চোখে অপরূপ ছবি- এইখানটায় এসে বৃদ্ধের ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে, ঠোঁটদুটো অস্ফুট নড়ে কী যেন বলতে চাইছে। লিপ রীড করে ওরা বুঝতে পারে, বৃদ্ধ বলছেন -রিপিট, রিপিট। শবরী আবার সেই লাইনটি গাইছে, এবং ও-ও বুঝতে পারছে, কোথাও একটা সুরচ্যুতি হচ্ছে। এবং বৃদ্ধ গায়ক বলে যাচ্ছেন-রিপিট! রিপিট! বেশ কয়েকবারের পর ঠিকঠাক সুরটি লাগল। মুমূর্ষু মানুষটির মুখে একটুখানি প্রশান্তির হাসি, এবার আর একটু পরিষ্কার গলায় বলছেন- "এইটে আমার বেশ ভালো লেগেছে"। যে মানুষ শেষ ক'দিন প্রায় মৃতবৎ অচৈতন্য পড়ে ছিলেন।

    এই ঘটনার দুদিন পরে উনি মারা যান।
  • nina | 79.141.168.137 | ২১ এপ্রিল ২০১৩ ২১:১৫599864
  • সুর এমনই জিনিষ !!!!
    ডাগদার এই সুমন শবরী কি আমাগো দাগদার সুমন সান্যাল?
  • siki | 132.177.25.86 | ২১ এপ্রিল ২০১৩ ২১:১৬599865
  • ধুর, সে সুমিত সান্যাল। সুমন নয়।
  • sosen | 111.63.195.86 | ২১ এপ্রিল ২০১৩ ২১:১৯599866
  • "জলরেণু আর মেঘ-কুয়াশায় কেমন একটা মোহ জন্ম নিয়েছে সেই বিকেল-করা পাহাড়ে, গাছগুলো জলের তোড়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, অনেক উঁচু ডালে ফুটে -থাকা মোমের মত সাদা অর্কিড ছিঁড়ে পড়ে যাবে মনে হচ্ছে বৃষ্টিতোড়ে।"
    ওয়াহ ওয়াহ । মন-ভালোর ডাক্তার, আমার পের্মাই দিলাম তোমারে। এমন ছবির জন্য বড় দাদাকে-ও আশিব্বাদ করা যায়।
  • nina | 79.141.168.137 | ২১ এপ্রিল ২০১৩ ২১:২০599867
  • অ্যালল--তাই তো ছরি ছরি-----গান কেউ গায় বল্লেই মন বলে শুনব শুনব--আর তাই এই ভুল--ভাবলুম আরে বাহ তাহলে যদি আম্মো শুনতে পাই শবরীর গান!!
    থেঙ্কু রে সিকি।
  • I | 24.99.178.218 | ২৮ এপ্রিল ২০১৩ ২০:০৪599868
  • পরদিন সকালে আমরা যাবো মানখিম টপ। তারপরে আরিতার থেকে বিদায় নিয়ে জুলুকের পথে যাত্রা। সে অর্থে আরিতারে ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু দেখার মত জায়গা নেই। আরিতার এমনিতেই একটা ছোট জায়গা। থাকার মধ্যে আছে লামপোখরি লেক, মানখিম টপ, একটি ছোট মনাস্ট্রি,একটি পুরনো সাজানোগোছানো ডাকবাংলো-এই। আরিতার আসার পথেই ডাকবাংলোটি এক ঝলক চোখে পড়েছিল আগের দিন । সেটি আমরা স্কিপ করব মনস্থ করলাম। নইলে জুলুক পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে। এতেই দুপুর পেরিয়ে যাবে।
    মানখিমের পা অবধি গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল। এবার সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে উঠতে হবে। এখানে এসে দেখি আরিতার অনেক আকাশমুখো আর একলা হয়ে উঠেছে, আদিত্য হোটেলের আশেপাশের সেই ঘিঞ্জি ভাবটা আর ততটা নেই। টপে ওঠার গোটা পথটা জুড়ে অজস্র গাছ আর ফুলের আয়োজন। মাঝে মধ্যেই বেশ কিছু নির্মীয়মান হোটেল আর হোম স্টে। দুয়েকটা হোটেল নাকি তৈরীও হয়ে গেছে। ট্যুরিস্ট যদিও দেখলাম না। মনে হল এখানে এসে থাকলেই তো হত, এই অনেকটা খোলা আকাশ আর পাহাড়ের -জঙ্গলের মধ্যে। রডোডেনড্রন-ম্যাগনোলিয়া ও অজস্র নাম না জানা ফুলের মধ্যে। পাখীদের মধ্যে। কিন্তু কলকাতায় বসে এদের হদিশ পাওয়া যায় নি। আশা করা যায়, আর কিছুকালের মধ্যে আরিতার যখন ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে আরো নাম করবে, তখন এইসব হোটেল ও হোম স্টে বেশ পরিচিত হয়ে উঠবে।

    ছোট্ট ট্রেকের শুরুটা হয় একটা সুন্দর বাগানের মধ্য দিয়ে, একটি দেখনদার হোটেলের পাশ দিয়ে। এক ভদ্রলোক আমাদের সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসে নিজেই যেচে অর্কিডের ঘর দেখতে নিয়ে গেলেন। স্ট্রবেরি চাষ দেখালেন, প্যাশন ফ্রুটের গাছ দেখালেন। আমরা খালি ভাবছি-এই বুঝি পয়সা চাইবেন কিম্বা গাছ বিক্কিরির ধান্দা আছে। ওমা, সেসব দিক দিয়ে গেলেনই না, বরং শবরী-সুমনের গাছের শখ শুনে কী একটা ক্যাকটাস ( নাকি অন্য গাছ?) বিনে পয়সায় কাগজে মুড়ে হাতে ধরিয়ে দিলেন।
    সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কেমন একটা পারো-র টাইগার'স নেস্ট মনাস্ট্রি-ট্রেকের কথা মনে পড়ছিল। যদিও দুটোর মধ্যে কোনো তুলনাই নেই, টাইগার'স নেস্ট বেশ টাফ ট্রেক আমাদের মত পেটপাতলা বংদের জন্য, আর এখানে কেমন হেলে-দুলে গান গাইতে গাইতে ক্যামেরা তাক করতে করতে উঠা যায়। কিন্তু পাহাড় চড়লেই আসলে ওপরের আকাশটা বেশ ঘন নীল হয়ে আসে, অনেক উঁচুতে ঈগলপাখী চক্কর দিতে থাকে, নীচে সারি সারি নানা শেডের সবুজ সার বেঁধে নেমে যাচ্ছে দেখা যায়, অজস্র অচেনা পাখীর ডাক কানে আসতে থাকে, আর পাখীদের দেখাও যায়, হলদে-সবুজ আর কালো-সাদার ঝিলিমিলি লাগানো কৌতূহলী গ্রেট টিট, তুঁতে রংয়ের ভার্ডিটার ফ্লাইক্যাচার, লাল-কমলা-কালোর স্কারলেট মিনিভেট। এবং শবরী তখন গেয়ে উঠতে পারে-আমার মুক্তি আলোয়-আলোয়-এই আকাশে।

    ওপর থেকে আরিতার লেকটি এবার বেশ আগাপাশতলা দেখতে পাওয়া যায়। এখান থেকে ভারি সুন্দর লাগে, অজস্র গাছ-গাছালির মধ্যে সবুজ জলের একটি লেক। আর অনন্ত আকাশ বুকে এসে লাগতে থাকে, মানখিমের একদম চূড়াটুকুতে, যেখানে ঐ রেলিং দেওয়া বসার জায়গা, মাথায় তার সিমেন্টের ছাতা; মনে হয় হিমালয়ের বুক থেকে শূন্যে ঝুলে আছি আমরা ক'টি দীনহীন মনিষ্যি।আর সেইভাবেই বসে থাকতে ইচ্ছে করে অনন্তের অপেক্ষায়।

    তারপর ফিরতে হয়। ফেরার সময় এদিক-সেদিক নানান পথ আমাদের ডাকাডাকি করে, এমনকি আমরা অন্যদিকে হাঁটাও লাগিয়ে দিই; নীচ থেকে ড্রাইভার আমাদের হাত নেড়ে বলেন -এদিকে না, অন্য পথে ,শর্ট্কাট অন্য পথে। আমরা আবার অন্যদিকে হাঁটি। এবার গাছের আড়ালে একটি চঞ্চল ভার্ডিটার ফ্লাইক্যাচারের উজ্জ্বল নীল ডানা দেখতে পেয়ে সুমন ক্যামেরা তাক করে। আমিও টেলিটা লাগাবো বলে হাতড়াতে গিয়ে দেখি, টেলি নেই। নেই মানে? এই তো ছিল ! হঠাৎ মনে পড়ে ওঠার সময় একটা বেঞ্চের ওপর টেলিটা খুলে রেখে সেই যে লেন্স চেঞ্জ করলাম। তারপর বন্ধুজনের ডাকাডাকিতে টপে উঠে এসেছি, টেলিটাকে আর ব্যাগে ভরা হয় নি। ছুট ছুট! প্রবল হৃদকম্প নিয়ে ছুট। টুংকাইও আমার সঙ্গে ছুট লাগায়।

    গিয়ে দেখি-আছে। যেমন তাকে রেখে গেছিলাম বেঞ্চের ওপর, সে ঠিক তেমনটি শুয়ে আছে পাষাণবৎ। ক্যাসাবিয়াঙ্কার মত। ঈষৎ অভিমানী। যত্নে তাকে ব্যাগে ঢোকাই, যেন আমার হৃদয় ঢোকাচ্ছি বক্ষপঞ্জরের ওমে, ওপেন হার্ট সার্জারীর পরে শান্তি ও নিরাপত্তায়। আবার অনেকটা দৌড়, কেননা দেরী হয়ে গেছে। এত চড়াই-উৎরাইয়ে জিভ বেরিয়ে পড়ে, হ্যা হ্যা করে হাঁপাই, গলা শুকিয়ে কাঠ। এতসব কী আর হয় এই সুখী শরীরে! তাও সকালে উঠে হাঁটবে না- অনুচ্চারিত বিরক্তি দেখতে পাই রাত্রির চোখে। টুংকাইটাও যে কেন ছুটতে গেল! এদিকে সে ফ্ল্যাইক্যাচার তো ভোঁ ভাঁ।

    ফেরার পথে আর কিছু না, শুধু একবার মনাস্ট্রিটা ঢুঁ মেরে যাবো- এই বাসনা ব্যক্ত করে জনগণ। সিকিমের অন্যতম পুরনো এই মনাস্ট্রি,দ্রষ্টব্য নিশ্চয়ই। যাওয়া হয় সেখানে। কিন্তু আমাদের আশায় জল ঢেলে মনাস্ট্রি তখন বন্ধ। এমনিতেও ছোট একটি গুম্ফা, ছোট্ট একটা মাঠের মধ্যে। আশেপাশে লোকজন কাউকে দেখাও যাচ্ছে না এই ভরদুপুরে, ফিরে যাবো কিনা -এই সাত-পাঁচ ভাবতে না ভাবতেই দেখি একজন ছোট্ট লামা, মানে সদ্য কিশোর আর কী-গটগটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সুমন তাকে গিয়ে পাকড়াও করে। আমরা বাকিরা উদাসীন, গাড়ি থেকে নামি না। ছেলেটি সুমনের জন্য পোজ দেয়, এমনকি তালা খুলে মনাস্ট্রি দেখানোর প্রতিশ্রুতিও দেয়। সত্যি সত্যি খুলেও দেয় সে মনাস্ট্রি, আমি আধো-উদাসীন মত গুম্ফার ভেতরে গিয়ে ঢুকি। সেখানে সবচেয়ে বড় মূর্তিটি গুরু পদ্মসম্ভবের, পাশের বুদ্ধমূর্তির চেয়েও আয়তনে সে বড়। কেন এমন-আমি নবীন লামাকে জিগ্গেস করি। সে আমতা আমতা করে ভাঙা হিন্দিতে বলে-কেননা উনি আমাদের সবচেয়ে বড় গুরু , তাই। বুদ্ধের চেয়েও? সে উত্তর দেয় না। বেরিয়ে আসার সময় দেখি আধখোলা মনাস্ট্রির দরজার পাশে সে দাঁড়িয়েছে, লাল-মেরুন পোষাক পরা কাগিউপা সেক্টের সেই কিশোর লামা, আর পেছনের জানালা থেকে অল্প আলো এসে পড়েছে মনাস্ট্রির প্রায়ান্ধকার লাল-হলুদ দেওয়ালে। বেশ ভালো ছবি হয়।
  • Blank | 69.93.205.77 | ২৮ এপ্রিল ২০১৩ ২২:০৪599870
  • টাইগার নেস্টে উঠেছিলে নাকি ডাক্তার দা? কি সুন্দর রাস্তা, পাগল হয়ে গেছিলুম। ওপরে উঠছি আর একটু করে কাছে আসছে মনাস্ট্রি।
    ভেতরে ঢুকতে পারিনি যদিও
  • Blank | 69.93.205.77 | ২৮ এপ্রিল ২০১৩ ২২:২৮599871
  • গুরু পদ্মসম্ভব ই পাহাড়ে তান্ত্রিক বুদ্ধিজম ছরিয়েছে। মিডল হেভেনে একা রাজত্ত করে। পাহাড়ের সব বড় বড় দেবতারা ওর ই অংশে তৈরী। তাই সবার ওপরে পদ্মসম্ভব।
  • কৃশানু | 213.147.88.10 | ২৮ এপ্রিল ২০১৩ ২২:৩৬599872
  • আচ্ছা, তুঁতে রংয়ের পাখিটা তাহলে ভার্ডিটার ফ্লাইক্যাচার।
    ব্ল্যান্কিদা ওটাকে কাক বলছিল।
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ২৯ এপ্রিল ২০১৩ ১৯:০৬599873
  • http://www.flickr.com/photos/31660067@N06/8130201774/

    "ছোট্ট ট্রেকের শুরুটা হয় একটা সুন্দর বাগানের মধ্য দিয়ে, একটি দেখনদার হোটেলের পাশ দিয়ে। এক ভদ্রলোক আমাদের সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসে নিজেই যেচে অর্কিডের ঘর দেখতে নিয়ে গেলেন। স্ট্রবেরি চাষ দেখালেন, প্যাশন ফ্রুটের গাছ দেখালেন। আমরা খালি ভাবছি-এই বুঝি পয়সা চাইবেন কিম্বা গাছ বিক্কিরির ধান্দা আছে। ওমা, সেসব দিক দিয়ে গেলেনই না, বরং শবরী-সুমনের গাছের শখ শুনে কী একটা ক্যাকটাস ( নাকি অন্য গাছ?) বিনে পয়সায় কাগজে মুড়ে হাতে ধরিয়ে দিলেন।"

    ইন্দোদা, ঐটে মনে হয় রবিন রাই
  • I | 24.96.120.192 | ২৯ এপ্রিল ২০১৩ ২২:৫০599874
  • ঐশিক,
    নাঃ, ইনি রবিন রাই নন। আমার এই ভদ্রলোকের বয়স আরো বেশী ছিল।

    ব্ল্যাংকি,
    আমার পুরোটা ওঠা হয় নি। কাফেটেরিয়া অবধি উঠতে পেরেছিলাম। তাতেই জিভ বেরিয়ে গেছিল। হয়তো আরেকটু ভেঞ্চার করা যেত, কিন্তু নিচে বৌ-আর ছেলেও উঠছে শুনে ( তাদের বারণ করা হয়েছিল) টেনশন হয়ে যায়, নেমে আসি। তাছাড়া কাফেটেরিয়া থেকেই বোঝা গেল , আমি মোটামুটি যেসময় গিয়ে পৌঁছব, তখন টাইগার'স নেস্ট বন্ধ হয়ে যাবে। বেশ বোকার মত ট্রেক করতে গেছিলাম। পায়ে একখানা পাতি জুতো, হাতে একটা লাঠি অবধি নেই। জলের বোতল নেই। মাঝেমধ্যেই পা স্লিপ করছিল।
  • I | 24.96.120.192 | ২৯ এপ্রিল ২০১৩ ২৩:০১599875
  • ঐশিকের ছবিগুলো দেখতে দেখতে আবার বেড়ানোর স্মৃতি ফিরে এল। তোমরা কি জুলুকে গোপাল প্রধানের হোম স্টে-তে ছিলে?
    আমার ছবিগুলো ফেসবুকে আছে-
    http://www.facebook.com/media/set/?set=a.493194724073997.1073741825.100001504225301&type=1&l=2a88d0966b
  • ঐশিক | 132.167.228.100 | ২৯ এপ্রিল ২০১৩ ২৩:৫৫599876
  • হ্যা ওখানেই ছিলাম
  • kumu | 52.110.10.200 | ৩০ এপ্রিল ২০১৩ ০৭:৫৭599877
  • সুবিনয় রায়ের গল্পটা অমূল্য।
  • I | 24.96.28.157 | ১২ মে ২০১৩ ১৩:১২599878
  • শবরী বলে দিয়েছে , সুবিনয় রায়ের গল্পটায় একটু ভুল লিখেছি। সুরচ্যুতি নয়, মাত্রাচ্যুতি।
  • I | 24.99.218.61 | ১২ মে ২০১৩ ১৮:৩৭599879
  • আরিতার থেকে এবার আমাদের নেক্স্ট স্টপ জুলুক। মানে আদত সিল্ক রুট। এইবার আমরা আর্মি এলাকার দিকে যাচ্ছি, আমাদের পারমিট লাগবে। পারমিটের ব্যবস্থা ড্রাইভার আগের দিনই করে রেখেছেন, কাজেই সেকাজে সময় খরচা হবে না । রাস্তা ক্রমেই উঁচু আর বৃক্ষহীন হবে; কিন্তু তার আগে আসবে রংলি।

    রংলি একটি বাজার এলাকা । সিকিমের একটি ছোট্ট টাউন, পাহাড়ী টাউনগুলি যেমন হয়। তার সিটিসেন্টার বলতে একটি বাজার, সেখানে সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তারা নানান জায়গা থেকে এসেছে, নানান জায়গায় যেতে তৈরী। বাজারের ঠিক মাঝখানটাতে একটা বড় গাছ, তার সমস্ত গা জুড়ে বিশাল বোগেনভিলিয়া উঠেছে, তার গোলাপী ফুলে গাছটা পুরো ঝলমল করছে। পুরো বাজারটাই, পেছনের পাহাড়, পাহাড়ী বাড়িগুলো, দোকানপাট, দাঁড় করানো বাইকগুলো, গিজগিজে মানুষজন-সবাই হাইলাইটেড হয়ে উঠেছে ঐ বোগেনভিলিয়ার সৌজন্যে। আমরা ওখানে গাড়ি থামিয়ে নাস্তা করতে নামলাম। নাস্তা বলতে মোমো।কেউ বোধ হয় মিষ্টিটিষ্টিও খেল। ফুটপাথের অন্যদিকে চাঁদোয়া খাটিয়ে কী এক পূজার অনুষ্ঠান হচ্ছিল। বেশ কিছু ন্যাড়ামাথা নেপালী মন্ত্রপাঠ করছে দেখে মনে হল শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান।

    এর পরে লিংটাম। এটি একটি ছোট্ট জনপদ, নাকি একখানা রিসর্টও আছে। এখানেই আমাদের পারমিট চেক হবে।পারমিট ঘরের আগে একখানা বোর্ড ঝোলানো, তাতে প্যাঁচানো শিং ছাগলের ছবি আঁকা। কী প্রাণী পড়বার আগেই গাড়ি হুস করে বেরিয়ে গেল। লিংটামের কাছাকাছিই কাউখোলা ঝর্না। ঝর্নার আগে একটি কাঠের ব্রীজ, সেই ব্রীজে ওঠার আগে চেতাবনি-একদা এক দুর্ঘটনায় এখানে চার জন মারা গিয়েছিল। ঝর্না এখন অনেকটাই শুকনো, তাও যেটুকু কুলকুলিয়ে বইছে, তাতেই আমাদের সুখেশান্তিতে চলে যাবে। এখানে পাথরের ওপর একটি চঞ্চল পাখী দেখতে পেলাম; লালচে খয়েরি গায়ের রং, মাথাটা সাদা, ডানাদুটি কালো। হোয়াইট ক্যাপড রেডস্টার্ট। জলের ধারে থাকে বলে একে ওয়াটার রেডস্টার্টও বলা হয়। চেনা পাখী। আগেরবার বিন্দুতে জলঢাকা নদীর ওপর দেখেছিলাম। মনে হল পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সে কিন্তু বন্ধুত্বে মোটেও আগ্রহ দেখালো না, ফস করে উড়ে গেল, ছবি তুলতেই সময় পেলাম না।

    রাস্তা আরো উপরে উঠছে পাক খেয়ে পাক খেয়ে। হাওয়ায় শীতের কামড় টের পাচ্ছি। আশপাশটাও ক্রমেই ম্যাড়মেড়ে মত। এই এসে গেছে জুলুক-ড্রাইভার বললেন। দেখলাম চারিদিকে পাহাড় মেলা এক বিস্তারের মধ্যে বেশ নীচে একটি ছোট্ট ভ্যালি। ঐ নাকি জুলুক গ্রাম। যেন পাহাড়ের শতদল পাপড়ির মধ্যে একটা পাথুরে বৃতি, রোদে জ্বলে যাওয়া হলদে -বাদামী রংয়ের লম্বা লম্বা ঘাসে ছাওয়া। আসল রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে সবুজ রংয়ের কয়েকটা বাড়ি, খেলনা বাড়ির মত,বাড়ির সামনে গোটা তিনেক যেন খেলনা গাড়ি দাঁড় করানো-ড্রাইভার জানালেন ঐখানে আপনারা থাকবেন। কি করে সেখানে নামা হবে, রাস্তা তো নেই-এমন ভাবছি, তখনি দেখা গেল বাড়ির সামনে থেকে একজন পুতুল মানুষ হাত দেখাচ্ছে, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সে পথ দেখাচ্ছে আসলে। চারিদিকে মিলিটারি আস্তানা, সার সার আর্মি ট্রাক দাঁড় করানো; ঐ আর্মি সেটলমেন্টের পেছন দিয়ে, জমে থাকা আনাজের খোসা-মদের বোতল-ম্যাগির প্যাকেট-মুরগীর পালক-হাড়গোড় পাশে রেখে, পিচরাস্তা ছেড়ে খড়খড়ে নড়বড়ে পাথুরে রাস্তা দিয়ে গাড়ি নেমে চলল গড়গড়িয়ে। ঐ ঘেসো প্রান্তরের মধ্য দিয়ে। এই পড়ি কি সেই পড়ি। ওরি মধ্য দিয়ে ঠিক কায়দা করে কয়েক পাক ঘুরিয়ে গাড়ি এসে সবুজ বাড়ির সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। আর নামতে নামতে দেখি , হাতজোড় করে হাসিমুখে একজন যুবক বলছেন-ওয়েলকাম টু জুলুক। ইনিই আমাদের হোম স্টে-র মালিক সুরজ প্রধান। গোপাল প্রধানের ছেলে।
  • I | 24.99.152.165 | ১২ মে ২০১৩ ২২:৩৮599881
  • সূরজকে কলকাতা থেকে যতবার ফোনে ধরবার চেষ্টা করেছি, অভিজ্ঞতা সুখের হয় নি। বেশ নিরুৎসাহী ও ভুলো মনে হয়েছে। এক তো প্রায়ই ফোন পাওয়া যেত না ( সেটা অবশ্য ওর দোষ না, ঐ প্রত্যন্ত জায়গায় মোবাইল সার্ভিস তেমন ভালো না), তার ওপরে পাওয়া গেলেও প্রত্যেকদিনই শূন্য থেকে শুরু করতে হত, কেননা আগের দিনের কথা ও বেমালুম ভুলে মেরে দিত। তার ফলে কলকাতায় বসে নখ কামড়ানো ছাড়া উপায় থাকত না। আগে থেকে টাকা অ্যাডভান্স করতে হয়, তার প্রাপ্তিস্বীকার করে না। ড্রাইভারের কী ব্যবস্থা হবে, সেসব খুলে বলে না। চিন্তাতেই ছিলাম।

    এখানে এসে দেখি, অন্য সূরজ। অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ, খুব ভদ্র, সবেতেই ভরসা দেয়- আপ বিলকুল বেফিকর রহিয়ে। হাম হ্যায় না ! আপ হামারা মেহমান হ্যায়, কোই চিন্তা নেহি। হাম সবকুছ কর দেঙ্গে। তা, সে করেওছিল।

    বাড়িটা , দেখলাম সামনে থেকে দেখলে মনে হয় পাহাড়ের ওপর ঝুলে রয়েছে। কেননা বাড়ির ঠিক নিচ থেকে পাহাড়ের ঢাল শুরু হয়েছে, বিশাল লম্বা ঢাল, পোড়া পোড়া ঘাসে ঢাকা। তার মধ্য দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে। দূরে এদিক-ওদিক ছড়ানো-ছিটোনো আরো গুটি দুয়েক বাড়ি। একটা জলের ট্যাঙ্ক। ঢালের প্রান্তে যেখান থেকে আকস্মিক খাদ শুরু হয়েছে, সেখানে হাল্কা বাঁশবনের আভাস। মে-জুন মাসে ওখানে নাকি রেড পাণ্ডা ও ভালুক আসে কচি বাঁশের কোড় খেতে। এই বাড়ি থেকে দেখা যায়।

    আমরা এসেছি দুপুর পেরিয়ে। এখানে প্রবল শীত, হাত-পা জমে যাচ্ছে। ঠান্ডা পেয়ে দিল তর্‌র হয়ে গেল। আমাদের দোতলায় থাকার ব্যবস্থা। একটা সরু দেড় মানুষ গলবার মত করিডোর, অন্ধকার। তার দুপাশে ঘর। শেষ দুটো মুখোমুখি ঘর আমাদের। ব্যবস্থা অসাধারণ কিছু না, কিন্তু কমফর্টেবল। হোম স্টে তো আর তিন তারা হোটেল হবে না। তবে কিনা বাড়িটা একটু যেন পাহাড়ের ঢালের দিকে ঝোঁকা। আরেকটু ঠেললেই পড়ে যাবে, এইরকম ভাব। গোল্ডরাশের সেই বাড়ির মতন। আমি ভয়ে ভয়ে জানলার বেশী কাছে যাই না, ভর বাড়িয়ে কিবা লাভ! খিদে পেয়েছে, এখন লাঞ্চ খেতে যেতে হবে, সেটি অন্য একটি বাড়ি। একটুখানি দূরে।

    চারিদিকে পাহাড় , পাহাড়। সমুদ্রের মত পাহাড়, জমে যাওয়া পাথুরে ঢেউ। পাহাড়ের ঢেউ। নীল ও সবুজের নানান শেড আকাশের ভেতরে অনেকদূর অবধি চলে গেছে। এই সিল্ক রুট, এর কোনো এক পয়েন্ট থেকে ৯০-এর ওপরে পাহাড়ের ঢাল দেখতে পাওয়া যায় আকাশ পরিষ্কার থাকলে। কিন্তু এখন আকাশের মুখ ভার, বিকেলের দিকে প্রায়ই এখন এরকম হবে। মেঘ ঘনিয়ে আসছে ওপর থেকে, আশপাশ থেকে। নীচ থেকে। বিভিন্ন ডিরেকশনের মেঘেরা এসে একে-অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে, তারই মাঝখান থেকে ক্কচিৎ উঁকি মারছে পাহাড়ঢালের সবুজ ও নীল। একদম নীচের পাহাড়টি হলদেটে বাদামী। লাগছে যেন ওয়াশের ছবি।

    খেয়ে উঠে একটু বেরোনো হল। জুলুক গ্রামটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে। দূরে একটা সাদাসিধে মন্দির দেখা যাচ্ছে, তার মাথায় লাল পতাকা উড়ছে। ঐখানে গিয়ে একটু ঘন্টা বাজিয়ে আসি। এই মেঘ-কুয়াশার মধ্য দিয়ে। তবে কিন যাত্রা তেমন সহজ না। উঁচু-নীচু নানান টক্কর, রাস্তার কোত্থাও সমতল নয়। এর বাড়ির উঠোন দিয়ে, তার বাড়ির মুরগীর খাঁচার পাশ দিয়ে। কোথাও উনুনে আঁচ পড়েছে, কোথাও ঝাউপাতা পোড়ানোর মিষ্টি গন্ধ ভাসছে। বোঁচা নাক অবাক বাচ্চা ও তার লোম ঝোলা কুকুর হাঁ করে অতিথির দিকে তাকিয়ে আছে। মুরগীর ছানারাও। একটা জায়গায় ছোট্ট একটা সাঁকো পেরোতে হয়, সেটা একসঙ্গে একজনই পেরোতে পারে। বাচ্চাদের নিয়ে একটু ভয়।

    মন্দিরটা একটা উঁচু ভ্যান্টেজ পয়েন্টের ওপর তৈরী। সেখান থেকে পুরো জুলুক গ্রামটা দেখা যায়। নীচে অনেক দূর অবধি বিছিয়ে আছে রুখাসুখা পাহাড়। এখানে চাষের তেমন সুযোগ নেই বোঝাই যাচ্ছে। বাসিন্দাদের পেট চলে বর্ডার রোড সারানোর কাজে, অনেকে আর্মিতে কাজ করে; হালে কিছু পর্যটনের সুযোগ খুলেছে। তার জন্যে গোপাল প্রধানকে ধন্যবাদ দিতে হবে। ইনিই মোটামুটি এই গ্রামের মুখিয়া।

    সন্ধ্যেয় চা-পকোড়া পর্ব শেষ করে গপ্পোগাছা করবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শবরীর আর্টিকারিয়া বেরিয়েছে। গান হবে না, অগত্যা। ইমু অবিশ্যি অদম্য, ওর সারাক্ষণই নাচ পায়। গায়ের মধ্যে সুড়সুড়ি দেওয়ার মত নাচের হিল্লোল উঠতে থাকে ওর। আমাদের অনেক নাচ দেখিয়ে গেল, উজানদাদাকেও বেশ কিছু নাচ শেখালো।

    বাইরের আকাশ ঘন নীল-কাজল রং নিয়েছে। তারই মধ্যে দিয়ে কে যেন খামখেয়ালে এক পোঁচ গাঢ় লাল ছড়িয়ে দিয়ে এইমাত্র রং-তুলি গুটিয়ে চলে গেল। দূরের পাহাড়ে মিটমিট করে আলো জ্বলছে, ওটা পেডংয়ের আলো। পাশের ঘরে কিছুক্ষণ আগে বোতল ঢুকলো গোটাকয়েক, এখন গান হচ্ছে আল্লা কে বান্দে হাস দে। তারপর ভুল সুরে কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়। কিছুক্ষণ নীরবতা। লেপের তলায় গুটিসুটি মেরে রুমহীটারের ওম নিতে নিতে এই পাহাড়ী নীরবতাকে রক্তের মধ্যে চাখছি। কোন ঘরে যেন সিকিমিজ ফোক বাজছে। একটু পরে ভুল ভাঙে-আসলে পবনদাস-তোমার দিল কি দয়া হয় না। সঙ্গে স্যাম মিলস। হাল্কা তন্দ্রা আসে।

    চটকা ভেঙ্গে যায় কার একটা হুল্লোড়ে। বাইরে থেকে-"হ্যাঁ , বল !(মোবাইলে চীৎকার) কে বলছিস ?"
    -"এই, হেরে গেছে ইস্ট বেঙ্গ-অ-ল !"

    হায় রে আমার পাহাড়ী শান্তি! হায় মোবাইল! হায় বাঙ্গালী !

    বাড়িটায় গিজগিজ করছে বাঙ্গালী। সারাক্ষণ তারা উঁচু গলায় কথা বলছে, হ্যাঃ হ্যাঃ করে ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসছে। আরিতারে যেমন আমরাই একমাত্র ট্যুরিস্ট ছিলাম, এখানে তেমন নয় মোটেও। জুলুক তাহলে জমে গেছে! কিন্তু যা বলছিলাম, কেন বেড়াতে আসে? বাঙ্গালী?

    রাতে খেতে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম কথোপকথন। "দুটো জাত ভারতের সব জায়গায় পাবি। বাঙ্গালী আর মারোয়ারি । বাঙ্গালী না থাকলে অনেক জাত না খেয়ে মরত।''

    বেনেভোলেন্স ! এতক্ষণে তবে উত্তরটা পাওয়া গেল !
  • nina | 79.141.168.137 | ১৩ মে ২০১৩ ০২:০৩599882
  • ঃ-)))
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ১৩ মে ২০১৩ ১০:৪৫599883
  • ইন্দোদা, ওখেনে সানসেট টা জব্বর হয় কিন্তু
  • I | 24.99.115.98 | ১৯ মে ২০১৩ ১২:৩৮599884
  • পরদিন খুব সক্কালবেলায় আমাদের কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই। কেননা আমরা তো সিল্করুটের প্রখ্যাত সানরাইজ দেখতে যাবো না, তার কারণ আকাশ প্রবল মেঘে ঢাকা,ঐ মেঘ ছিঁড়ে সানরাইজ দেখতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব মনে হয়, এবং যদি সূর্য ওঠেও,ঐ দুঃসহ ঠাণ্ডায় ভোর চারটের সময় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে সূর্যের মুখ দেখে আসার মত সূর্যপ্রীতি আমার কোনোকালেও ছিল না। নীচের তলার ট্যাঁশ ফ্যামিলিটি যাবে বলে হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছিল, বাকিরাও যাবে বলেই ধারণা। সুতরাং ফাঁকা লজে আমরাই একমাত্র কম্বলমুড়ি দিয়ে ভোরের ঘুমের তলায় পাশ ফিরে শোবো-এমত বিশ্বাস ও তজ্জনিত আরামবোধ হল।

    খুব ভোরবেলায় খুব জোর একপ্রস্থ কোলাহল শোনা গেল-তবে শিব্রামের গল্পের মত সেসব ইগনোর করেই আমরা কান চেপে ঘুমিয়ে পড়লাম। তফাতের মধ্যে একটু পরেই আমার ঘুম গেল ভেঙ্গে, ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটে। বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করে ঠিকরে ভেতরে ঢুকে আসতে হল-এত ঠাণ্ডা। অগত্যা বিছানায় বসেই জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের আকাশ ও পাহাড় দেখতে থাকলাম। যদিও এটা পূব দিক নয়, সূর্য এদিকে উঠবে না, তবু কেমন করে অন্ধকার কাটবে, আকাশে বেগুনী-লালচে-কমলা রং ধরবে, নীল-সবুজ পাহাড়দেরই বা কী দশা হবে, সেটা দেখার একটা ব্যাপার থাকে। আর দেখলামও পেট ভরে। মজার কথা হল, সকালের আকাশে সেদিন মেঘ নেই ছিঁটেফোঁটাও। মিটমিট করা তারাদের নিভে যাওয়া পর্যন্ত দেখতে পেলাম। তারপরে একটু একটু করে আলো ক্রমেই আসতে থাকল আর নভোমণ্ডল কেমন করে মুকুতাফলের ন্যায় হিমবৎ , নীলাভ হয়ে ওঠে সেসবও দিব্যি বুঝে নেওয়া গেল। প্রথম পাহাড়ের মাথায় সোনালী রোদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর থাকা গেল না, ঠাণ্ডাকে পাত্তা না দিয়েই বাইরে বেরিয়ে এলাম। সামনের খোলা চত্তরটায় বেশ কিছু বেঞ্চ, টেবিল, চেয়ার পাতা, তাতে অবিশ্যি বসা গেল না, পেছন ঠেকানো মাত্রই ছ্যাঁৎ করে উঠল। রেলিংয়ে হেলান দিয়েই প্রকৃতি দেখতে থাকলাম। ঘাসের ডগারা, টবের গাছেরা সব সরু বরফের চিলতেয় ঢাকা;রান্নাঘর থেকে গড়িয়ে নামা জলের ধারা জমে বরফ হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সকালের চা এসে গেল। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে হাতে পৌঁছে দিল বিনুনি-টুপি পরা কিশোর ছেলেটি। ওরা দুই যমজ ভাই, দুজনেই বিনুনি-টুপি পরে, দুজনেই সমান পরিশ্রমী, হাসিমুখ ও কার কখন কী লাগবে সে বিষয়ে সদা সজাগ। চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখলাম আস্তে আস্তে একের পর এক পাহাড়ের ঢেউয়ে সকালের রং ধরছে; এক সময় আমাদের পাহাড়ের ঢালেও আলো এসে পড়ল। প্রথমে দূরতম এক চিলতে হলুদ ঘাস আলোময় হল, তারপর দূরের বাড়িটার চাল, তারপর কাছের বাড়িটা হলদে-সোনালী রং পেল সঙ্গে বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে ঘাসের হলুদ জ্বলজ্বল করে উঠল , তখনো কিন্তু বাকিটা ছায়ায় ঢাকা। রান্নাঘরের ব্যস্ততা সেই ভোর থেকেই শুরু হয়ে গেছে, জিমি কুকুরটা পায়ের সামনে এসে ল্যাজ নাড়ছে , এদিকে আর দুটো নির্লজ্জ কুকুর একটু দূরে মনের সুখে যৌনতা করছে। সকালে উঠেই এ কী কাণ্ড ! পাখিরা মহা কোলাহল জুড়ে দিয়েছে, উড়তে দেখছিও এদিক-সেদিক , কিন্তু কেউই ক্যামেরার রেঞ্জে আসতে চায় না। পাখির সন্ধানে যেদিকেই যাই, ল্যাজ নাড়তে নাড়তে জিমি আগেভাগে গিয়ে পাখী তাড়িয়ে দেয়। ওর নিশ্চয়ই ধারণা ওটা বন্দুক, আমি পাখি মারবার তাল করছি, আর এলাকার পাখিদের সাথে ওর যে বিশেষ দোস্তির সম্পর্ক সে আর বলতে হয় না। কিম্বা হয়তো-আমার এলাকার পাখি, আমি মারবো-রাখবো, তুমি কে হে বট !

    সাড়ে ছটা মত বাজে, হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে গিন্নিবান্নিরাও নেমে আসছেন। ওদিকে তুমুল হৈ-হল্লা করে সূর্য-দেখার দল ফিরল এইমাত্র। নাঃ, এবার রেডি হতে হয়, আমাদের আজকে সিল্ক রুট বেরোনোর কথা, বেশী দেরী হয়ে গেলে আবার ডাইনিং রুমের চেয়ার বেদখল হয়ে যাবে, তার মানে নাস্তা খেতে দেরী,বেরোনোটাই পিছিয়ে যাবে সব শুদ্ধু।
  • I | 24.99.31.228 | ১৯ মে ২০১৩ ২২:৩৪599885
  • নাস্তা বলতে তিনটি মেনু-রুটি-তরকারি, লুচি-তরকারি, আর ওয়াই ওয়াই। সবদিন সেই একই। এই দুর্গম জনপদে কে আর আপনাকে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট খাওয়াচ্ছে মশাই ! ওয়াই ওয়াই নামটা অচেনা ও চমকদার মনে হওয়াতে তাই অর্ডার দেওয়া হল সকলের জন্য-বাদে রাত্তির; সে বৈচিত্রাভিলাষী নয়, রুটি-তরকারি খাবে। খাবার আসার পরে দেখি-ও হরি ! এ যে আমাদের আদি-অকৃত্রিম নুডলস-সুপে ডোবানো; গ্রেভিতে একটু বেশী রসুনের গন্ধ , এই যা ! শবরী খেতে পারল না, রাত্তিরের সঙ্গে রুটি ভাগ করে খেল; ইমুরও গা বমি বমি করতে লাগল, সে অল্পই খেল।

    আজকে আকাশ পুরো রোদ- ঝলমলে, মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। সেই দিকে তাকিয়ে ড্রাইভার দাওয়া লামা চিন্তিতমুখে বললেন-আজ লওটনেকে সময় মৌসম খারাব রহেগা লাগতা হায়। কী করে বুঝলেন কে জানে!
    রাস্তার পাশে পাহাড়ের ঢালে ঘাসের ওপর প্লাস্টিক শিট বিছিয়ে বসে এক মহিলা গামবুট ভাড়া দিচ্ছিলেন; নেবো না নেবো না করে ভাড়া নিয়েই নিলাম। নাকি পুরো রাস্তা বরফে ঢাকা, জুতোয় জল ঢুকে যাবে। আমরা যাবো ছাঙ্গু অবধি, কিন্তু উল্টো রুটে, গ্যাংটক থেকে যে পথে যাওয়া হয়, তার উল্টো পথে-সেটাই সিল্ক রুট।অনেক বেশী দুর্গম, উঁচু, বরফে ঢাকা। আর অনেক বেশী সুন্দর।

    কয়েক কিলোমিটার যেতে না যেতেই সেই বিখ্যাত জিগজ্যাগ- নীচে এঁকে বেঁকে নেমে গেছে বিভিন্ন হেয়ার পিন বেণ্ড; পুরো জুলুক গ্রাম ও তার আশপাশ সূর্যের আলোয় ঝকমকে, মাঝেমধ্যেই ইকড়িমিকড়ি কেটে গেছে দীর্ঘ সব পাহাড়ের ছায়া, সেনা ছাউনির ছাদ থেকে আলো ঠিকরে আসছে, আর্মি ট্রাকগুলো সার সার দাঁড়িয়ে আছে যেন খেলনা গাড়ি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে সেই আঁকা বাঁকা পাহাড়ী রাস্তার সর্পিলতা-শ্বাসরুদ্ধকর। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, সুমনের মোক্ষম ওয়াইড অ্যাঙ্গল আছে বলে মনে মনে একটু হিংসে দিচ্ছি। এই পথে আসতে হয় শীতের সময়, তখন পুরো এলাকা বরফে ঢাকা থাকে, তার মাঝে কালো কালো জিগজ্যাগ রাস্তা দেখায় আরো দুর্দান্ত। তবে কিনা অত বরফ পড়লে পুরো রাস্তা যাওয়াও যায় না। সব কিছুরই প্রাইস ট্যাগ আছে।

    আর কিছুদূর যেতে বরফের রাজ্য শুরু হল। প্রথমে রাস্তার পাশে এখানে সেখানে বরফের চাবড়া দিয়ে শুরু হল ব্যাপারটা। পাহাড়ের ছায়াওয়ালা অংশে জল গড়িয়ে নামতে নামতে জমে গিয়ে আইসিকল হয়ে গেছে, রোদ এসে পড়লে তাদের গা থেকে হীরে ঠিকরোচ্ছে। দূরের পাহাড়গুলিতে বাদামীর ওপরে সাদার অজস্র ছোপ পড়েছে, টুংকাই বা ইমু কে একটা বলল ভ্যানিলা আইসক্রীম উইদ চকোলেট স্যস। লোকজন খুব সুইটজারল্যাণ্ড ইত্যাদি বলছে-টলছে,এমনি সময়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার বললেন -থাম্বি ভিউ পয়েন্ট।

    রাস্তার পাশে বেশ খানিকটা চওড়া সমতল জায়গা, প্রায় ন্যাড়া-ঐ বাদামী ঘাসে ছাওয়া। তার কিনারায় লালচে খয়েরি নিষ্পত্র একধরণের শুকনো ঝোপ। তাদের পেছনে একটি সাদাটে পাথর উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর পরেই খাদ নেমে গেছে গড়িয়ে। সামনের দিক ঘেঁষে সেই ন্যাড়া বাদামী পাহাড় মাথা তুলেছে, তার চূড়ায় দুটি পত্রহীন গাছ ডালপালা মেলে বেঁকে দাঁড়িয়ে। অনেক পেছনে নীল পাহাড়ের সারি, তাদের মাথার ওপরে অবারিত ঘন নীল আকাশ, আকাশে সাদা মেঘেদের আনাগোনা। সেসবের মধ্য দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন চিরতুষারমণ্ডিত হিমালয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা তাঁর পারিষদদের সঙ্গে নিয়ে। অনেক দূরে কোথাও বুম বুম শব্দে ব্লাস্টিং হচ্ছে। কামানের আওয়াজ বলে ভুল হতে পারে, ভারত-চীন যুদ্ধ বাঁধল মনে হতে পারে। এছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একজন আর্মি জওয়ান ধড়াচুড়ো পরে নীচে নেমে যাচ্ছেন। এই মহানতার সামনে দাঁড়িয়ে আমার অকস্মাৎ হিসি পেয়ে গেল।

    এর আগে , বলতে ভুলেছি আমরা পেরিয়ে এসেছি আমাদের ড্রাইভার যাকে বললেন ভুলভুলাইয়া। ঐ জিগজ্যাগ রাস্তারই আরো বিস্তৃত রূপ, আর একটু উঁচু থেকে। পেরিয়ে এসেছি সানরাইজ পয়েন্ট, সেখান থেকে নাকি ৭২ খানা পাহাড়তরঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। সৌভাগ্যবান লোকেরা ওখান থেকে এমন সূর্যোদয় দেখেছেন, যা পৃথিবীর মাটি থেকে দেখা আদারওয়াইজ সম্ভব নয়। আমি সে ছবি দেখেছি, সম্পূর্ণ মেঘের রাজ্যের ওপরে দাঁড়িয়ে মেঘের স্তরে স্তরে রং লাগলে যেমনটা হয়-যেন এরোপ্লেনে বসে দেখা সূর্যোদয়।

    এবার আমরা পুরোদস্তুর বরফের রাজ্যে ঢুকে গেছি। যেদিকে তাকাই চারিদিকে বরফ, মাঝে মাঝে কালো কালো পাথরের মাথা এবং পাতাহীন শুকনো ঝোপঝাড় ইতস্ততঃ উঁকি দিচ্ছে। তাদের ছায়া আবার নীলচে ও দীঘল হয়ে পড়েছে বরফের ওপর। আকাশ এখানে কালচে -নীল, তার মধ্যে সাদা মেঘের বিরামহীন যাতায়ত। রাস্তার অনেকটাই বরফে ঢাকা, তার ওপর দিয়ে চাকার দাগ চলে গেছে, বরফে-কাদাজলে মাখামাখি। বাঁদিকে অনেক নীচে একটি সাদা হয়ে যাওয়া ছোট্ট জনপদ দেখিয়ে ড্রাইভার বললেন -ঐ দেখুন নাথাং ভ্যালি, ফেরার সময় আমরা ওখান দিয়ে ফিরবো। এই রাস্তায় মিলিটারি গাড়ির খুব আনাগোনা সেইসব গাড়ির চাকায় ব্যতিক্রমহীনভাবে চেন লাগানো, যাতে বরফে পিছলে না যায়। রাস্তার বাঁদিকে মাঝেমধ্যে সেনা ছাউনি, সেটুকু না থাকলে একে মায়ার রাজ্য মনে হত। গগন ঠাকুরের আঁকা জলরংয়ের ছবির মত।
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ২০ মে ২০১৩ ১২:৪৭599886
  • ইন্দোদা দারুন লাগছে, নাথাং ভ্যালি যাওনি?
  • I | 24.96.82.73 | ২৩ মে ২০১৩ ২০:৫১599887
  • রাস্তায় কোথায় একটা যেন কোন এক বুড়ী এককালে ইয়েতি দেখতে পেয়েছিল বলে গল্পকথা। আমি জানতাম না, সুমন পড়ে এসেছিলো। ড্রাইভারকে শুধিয়ে লাভ হল না। সে বিষম অবিশ্বাসী, নাস্তিক ও সর্বোপরি আনরোম্যান্টিক। উইলফুল সাসপেন্সন অফ ডিসবিলিফেরই নাম শোনে নি, ইয়েতি তো দূরস্থান! বরং বাঁদিকে আঙুল তুলে বলল- উ দেখিয়ে , কালাপোখরি লেক। এর জল নাকি বছরভর কালো থাকে, কক্ষণো রং বদলায় না। আসলে ঠিক কালো নয়, কালচে নীল। চারিদিকে এত বরফের মধ্যেও দিব্বি টলটল করছে।

    ইতিউতি বাংকার দেখা যাচ্ছে , বরফে ঢাকা। সীমান্তের বেশ কাছে এখন আমরা। এই এসে পড়লাম আদি বাবা মন্দির। যাঁরা জানেন না- বাবা হরভজন সিং ছিলেন ভারতীয় আর্মির এক সিপাই। ১৯৬৮সালের অক্টোবর মাসে খচ্চরবাহিনী নিয়ে এই রাস্তা পেরোনোর সময় উনি পা হড়কে খাদে পড়ে যান। ওঁর দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায় নি, কিন্তু উনি নাকি কোনো এক জওয়ানকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে ওঁর উদ্দেশে একটি সমাধিমন্দির স্থাপন করতে বলেন। জওয়ানদের বিশ্বাস, ওঁর বিদেহী আত্মা এই দুর্গম বরফিলা পৃথিবীখণ্ডে তাঁদের রক্ষা করে থাকেন। শুনলাম ভারতীয়দের মত চীনারাও বাবা হরভজন সিং সম্বন্ধে সমান শ্রদ্ধাশীল। চীন-ভারত সীমান্ত বৈঠক হলে বাবার জন্য একটি চেয়ার খালি রাখবার প্রথা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অজস্র ইনফ্যান্ট্রি এখানে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্লাক-ট্যাবলেট লাগিয়ে রেখেছে। যাত্রীদের জন্য সর্বক্ষণ গরম চা- জলের ব্যবস্থা রয়েছে।

    বরফ ও মেঘই এখানকার দুটিমাত্র প্রধান চরিত্র। গাভীর মত নয়, মেঘ এখানে প্রিয় ডাইনীর মত, কুটিল ও মায়াবী ষড়যন্ত্রের মত চরে বেড়ায়। আমি , রাত্রি আর টুংকাই মন্দিরে না গিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছিলাম-কতবার যে মেঘ এসে আমাদের আপাদমস্তক ঢেকে ফেলল ও ফের অবহেলায় রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে গেল তার ইয়ত্তা নেই। শীতল বরফকুচির মত মেঘ। নির্বিকার প্রবল মেঘ। এখানে দাঁড়িয়ে দেশ-বিদেশ-সীমান্ত-কাঁটাতারের মানে গুলিয়ে যায়, যুক্তির পৃথিবী আর বেঁচে থাকার স্বাভাবিকতা ধ্বস্ত হয়ে যায়। আদিম প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুতেই বিশ্বাস থাকে না। বেশ কিছুকাল থাকলে হয়তো বিকার জাগে, আত্মহত্যাপ্রবণতা জাগে। তুচ্ছতার বোধ তো অবশ্যই জাগে। সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে তাহলে কীরকম ভাব হয় কে জানে !

    আমাদের দেখে এক জওয়ান এগিয়ে এসে বললেন- কোথা থেকে আসছেন ? কোলকাতা? ইনি নদীয়া জেলার মানুষ, গত ছ'মাস ধরে এখানে রয়েছেন। কেমন লাগে জিজ্ঞাসা করাতে হেসে আনমনা হয়ে গেলেন। মাতৃভাষা হয়তো এইসব সময়ে পিপাসার জলের মত লাগে।

    আদি বাবা মন্দির ছাড়িয়ে কিছুদূর এগোলে ডানদিকে টুকলা ভ্যালি। এখানেই রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ(?) গল্ফ কোর্স। ড্রাইভার আঙুল দেখালেন কোন একটা দিকে। কিন্তু চারিদিক বরফে লেপাপোঁছা, আলাদা করে ভ্যালি কিম্বা গল্ফ কোর্স কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। এর পর আমরা দেখতে পাবো এলিফ্যান্ট লেক, নাকি ওপর থেকে হাতির মত দেখতে। হাতির আকার-প্রকার কিছুই বোঝা গেল না যদিও। বেশ বড় লেক, তার একটা বিশাল অংশ পুরো জমে সাদা।

    এবার নেমে আসা টের পাচ্ছি। জওয়ানবসতি বাড়ছে, বরফের পরিমাণ কমছে, ন্যাড়া পাহাড় বাড়ছে। কিন্তু কোত্থাও একটাও গাছ নেই, এক কুচি সবুজ নেই। ডানদিকে এক জায়গায় একটি আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তা উঠে গেছে, তার ঠিক মুখেই বোর্ড লাগানো -Young Husband's Track-520 kms। এই পথ দিয়েই স্যার ফ্রান্সিস ইয়ং হাজব্যান্ড ১৯০৩ সালে তিব্বত আক্রমণ করেন এবং লাসার অদূরে ৬০০-৭০০ ( মতান্তরে ৫ হাজারের বেশী) তিব্বতী যোদ্ধা -মঙ্ককে হত্যা করেন ; ব্রিটিশ ক্যাজুয়ালটির সংখ্যা ছিল পাঁচ। ইনি-ই আবার পরে রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হন, মাউন্ট এভারেস্ট কমিটির চেয়ারম্যানও। জর্জ ম্যালোরি'র মুখ্য উৎসাহদাতাদের মধ্যে ইনি ছিলেন অন্যতম। বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র মানুষের সভ্যতা!
  • I | 24.96.82.73 | ২৩ মে ২০১৩ ২১:৫৪599888
  • পরের স্টপ মেমেচু লেক। দূর থেকে দেখা। দুই পাহাড়ের মাঝখানে লুকোনোমত একটি লেক, তার চারপাশে পাইনের বন। ড্রাইভার সায়েব বললেন, পুরো সিকিমে এর মত সুন্দর লেক আর হয় না। এখানে গিয়ে থাকলে তবে মজা। তবে হোটেল কিছু নেই, হোটেল করার পারমিশনও নেই। একটি ফরেস্ট বাংলো রয়েছে, তাতে সরকারী কর্তারা গিয়ে থাকেন। আশার কথা, গোপাল প্রধান নাকি ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। তবে কিনা এই চৌহদ্দিতে আবার আসা হবে, সে সম্ভাবনা খুব কম।

    এর পর সেই অর্বাচীন বাবা মন্দির। যেটি অনেক পরে তৈরী হয়েছে, এবং আসল জায়গাতেও নয়। গ্যাংটক থেকে ছাংগু অভিলাষীগণ ক্কচিৎ-কদাচিৎ এই অবধি এসে পৌঁছতে পারেন ও অহো ! কী দেখিলাম- বলে বুকের ছাতি ফুলিয়ে ফিরে যান। অবিশ্যি সইত্যের খাতিরে বলতে হবে নতুন বাবা মন্দির পুরনোর চেয়ে অনেক বেশী সাজানোগোছানো, সুন্দর সবুজ ও লাল রং করা চালে, পতাকায়, রেস্তোরাঁয় মনোরম। আদি মন্দির অনেক রাস্টিক, অগোছালো, কাঁচা হাতের- কয়েকটা হলুদ -লাল রং করা খোরো ঘর, মাথায় জং -ধরা লাল টিন, দেয়ালের গায়ে নো স্মোকিং লেখা, দড়ি থেকে গামছা ঝুলছে, সামনে সিমেন্টের বেঞ্চি ও ক'খানি সিন্টেক্সের ট্যাংক; কিন্তু তাকে ঘিরে আছে আদিমকালের চাঁদিম হিম, সে অনেক প্রাকৃতিক ও মহিমময়।

    এসে পৌঁছলাম নাথু লা। চীন-ভারত সীমান্ত। আমি আলাদা করে কিছু বুঝলাম না। বেশ রুখাসুখা, কয়েকটি যন্ত্রখনক পাথর খুঁড়ছে। ছবি তোলো-ছবি তোলো রব ওঠায় আমিও যন্ত্রবৎ দিলেম ধাঁ করে শাটার টিপে-কোন দিকে কে জানে। তারি মধ্যে একখানি বেশ বড়সড় নধর প্যাঁকপেঁকে হাঁসের মত পক্ষী , গায়ের রং ইয়েলো অকার ও পাতিলেবু হলুদের মিশ্রণ-মাথার ওপর দিয়ে ধাঁ করে উড়ে গেলো। কী পক্ষী কে জানে। সটান চীনদেশ থেকে ভারতবর্ষের দিকে উড়ে এসে অনধিকার প্রবেশ ঘটালো। দূর সাইবেরিয়া থেকে, চীন তুর্কীস্তান থেকে না মঙ্গোলিয়া-কোত্থেকে উড়াল দিয়ে এলো কে জানে। দেখে মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠলো। এইখেন থেকে নাকি চীনের প্রাচীর দেখা যায়, সুমন আমায় হোটেলে ফিরে এসে বললো। ওর তোলা ছবি জুম করে দেখালো- চীনের দিকের পাহাড়ের ওপর কেমন একটা আবছা লম্বামতন খাঁজকাটা খাঁজকাটা। কে জানে বাবা কী! এত শীতে-বরপে ক্যামেরা কী দেখতে কী দেখেছে ! ক'টি ইয়েতি দেখলেই বা কী এমন ক্ষতি হত!

    আরো খানিক পরে চীন-ভারত বানিজ্যকেন্দ্র। দুধারে দুটি কয়েকতলা উঁচু মনোহর বাড়ি, তাদের ছাদে বরফ জমে আছে।তাদের একটি ভারতের দোকান, অন্যটি চীনের। এইখানে বছরে ছ'মাস চীন-ভারত ব্যবসাবাণিজ্য হয়। সীমান্ত পেরিয়ে ওপাড়ের ব্যবসায়ীরা সওদা নিয়ে আসেন, স্থানীয় মানুষেরা চীনা মাল কেনাকাটা করেন; চীনারাও ভারতীয় জিনিষ কিনে ফিরে যান। ড্রাইভার তো তেমনই বললেন। বিশ্বাস করে নিলাম, বিশ্বাস করে নিতে খুব ইচ্ছে হল।

    এরপর সেই চিরকেলে চেনা বাঙালীর ছাঙ্গু। রাস্তার এই স্ট্রেচটা কয়েক জায়গায় খুব খারাপ। রাস্তা বানানোর কাজ চলছে। ছাঙ্গুতে এসে পৌঁছলাম যখন, তখন ভরদুপুর। কিন্তু চারিদিক কুয়াশামাখা, কালো গোমড়া মেঘ ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। কালো নয় ঠিক, ইস্পাতের মত কালচে-নীল ও ছাইয়ের মিশ্রণ। সকালের সেই নীল আকাশ ও সাদা মেঘ এখানে গল্পকথা মনে হচ্ছে। ঠিক যেরকম রেখে গেছিলাম ছাঙ্গুকে ২১ বছর আগে। এই একুশ বছরে সে আর সূর্যের মুখ দেখল না তাহলে! তবে কিনা সেবার দেখেছিলাম বরফে ঢাকা ছাংগু, এখানে-ওখানে প্রিমুলা ফুটে রয়েছে-এবার টলটলে জল, প্রিমুলাদের দেখা নেই।

    ছাঙ্গুর রেলিং দেওয়া বাঁধানো পাড়ে সওয়ারীসন্ধানী ইয়াকগণ ঘুরে বেড়াচ্ছে,তাদের কারো শিংয়ে লাল রংয়ের উলের টুপি পরানো, কেউ আবার টুপিহীন, তবে সকলেই সাদা-কালো লোমে ঝুব্বুস, পিঠে রংবেরংয়ের মনোহর হাওদা। আমাদের ছোটবেলায় পাড়ায় এক মুসলমান ফকির আসতেন ,চিত্রবিচিত্র তালিমারা আলখাল্লা -পরা, চামর দুলিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে বালা-মুসিবত দূর করতেন, এই চমরীগাইদের দেখে সেই ফকিরের কথা মনে পড়ে গেল। টুংকাই-ইমু ইয়াকের পিঠে চড়ে ঘুরে এল কয়েকচক্কর, ফটোসেসন হল-আর কী ! এবার ফেরার পালা। তবে কিনা বেলা দ্বিপ্রহর, পেটে ছুঁচো, আমি ও সুমন দৌড়ে গিয়ে লেকের পাড়ের দোকান থেকে ক`টি মোমো কিনে আনলাম। নিতান্ত ভেজ মোমো। সুমন আবার সাধ করে দস্তানাও কিনল-কিন্তু বিধি বাম! গাড়িতে উঠে দেখা গেল দস্তানায় ফুটো।
  • siki | 132.177.5.51 | ২৪ মে ২০১৩ ১২:২৭599889
  • বাহ্‌!
  • Blank | 122.79.37.169 | ২৪ মে ২০১৩ ১২:৩০599890
  • দারুন লেখা। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি - ইয়ংহাজব্যান্ডের ডায়েরীও পড়ার জন্য ব্যপক।
  • . | 152.176.84.188 | ০৪ জুন ২০১৩ ১৯:৪২599892
  • .
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন