এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • লাইব্রেরির বাতিল বই

    pragati
    বইপত্তর | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ | ৪০৩২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • pragati | 126.68.75.199 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:১৯628331
  • আমাদের লাইব্রেরির ঝাড়পোঁচ, বই-আলামারির নতুন বিন্যাস, উদ্বৃত্ত,অনাদৃত বই-পত্রিকার একটা ইনভেনটরি নিয়ে তাদের কিছু একটা উচিত মূল্য দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক আকুতি এই ঘটনাটি ঘটিয়ে দিলো।
    হিসেব মতন বাতিল বই, তামাদি ম্যাগাজিন ...'পারী-মাচ' থেকে 'বোজ আর' লাইব্রেরিতে ঢুকতেই সামনে একটা টেবিলে পরিপাটি করে সাজিয়ে দিলো মারী, আলিয়ঁস ফ্রঁসেস এর গ্রন্থগারিক, ছ' মাসের জন্য ইন্টার্নশিপ, ভারতে। একটু ভারিক্কি, স্বাস্থবতী বইদের বাগান থেকে তুলে আনা ইঁটের টুকরো দিয়ে হেলান দিয়ে দিয়েছে।
    লাইব্রেরিতে ঢুকতেই ঘাঁটতে থাকি। এই সাজানো, বই -উপছানো টেবিলটা প্রায় তিনমাস ছিলো। আমি রোজই প্রায় এই টেবিলের ধারে আনাগোনা করতাম। বই তুলতাম একটা একটা করে। কবে পড়বো, জানিনা, তবুও। বেশী শক্ত ভাষা হলে ফরাসী-ইংরেজি অভিধান দশবার দেখতে হবে,একটি ছোট্টো বাক্যের ঘুর্ণিকে আবিষ্কার করতে। তবুও আবছামতন অজানা রহস্য থেকে যাবে বাক্যের, অনুচ্ছেদের শরীরে। তবুও। কেননা এই প্রক্রিয়া তীব্র আকর্ষক, আর এই ভাষাটি প্রতি আমি ভয়ানক ভাবে অনুরক্ত, কেননা এই ভাষাটি আমাকে পৃথিবীর অন্য একটি প্রান্তরের উজ্জ্বলতার সমনে দাঁড় করায়।
    এই জন্যই এই উপছে-ওঠা ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরি, প্রায় প্রতিদিন। মারী আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বাড়ি ফিরে রোজ তাদের যত্ন করে রেখে দিই। ছোটো ছোটো ছ'ইঞ্চি লম্বায়, পাঁচ ইঞ্চি আড়ে নরম বাঁধনের বইগুলি অনেক তখনও পড়ে রয়েছে, যখন মার্চের দিনগুলি সাঁতরে জুলাইএর কুলে উঠে পড়ছে, এক এক করে। বকি বই গুলি অবশেষে কাবাডিওলার দাঁড়িপাল্লায় উঠবে -উঠবে করছে, এমন এক বৃষ্টি-পড়া সকালের শেষে আরো কয়েকটি বই বুকে করে আগলে নিয়ে আসি। এমন কিছু বিব্লিওফিল নই আমি। তবুও। পড়বো না হয়তো অর্ধেক, তবুও। একটা আকুল, ঘট-উপছনো মায়া হয়, এই বাতিল, ফরাসী বইগুলির প্রতি। গুটেনবার্গীয় ম্যাজিক।
    ল্যু আন্দ্রেয়াস সালোমে'র (Lou Andreas-Salomé) ওপর ফ্রঁসোয়াস জিরু'র লেখা
    বইটা তুলেছিলাম মলাটের ছবি দেখে ; গলা পর্যন্ত বোতামে আটকানো পোষাকে একটি তরুণী। একটি হাত চেয়ারের মাথায়, অন্যটি টেবিলের ওপর রাখা বারোক স্টাইলের মোমদানের পাশে ভাঁজ হয়ে চিবুকের কাছে রাখা। সাদা-কালো ছবির মধ্যেও বোঝা যায় মেয়েটির হালকা চোখের মণি। টানটান করে বাঁধা চুল, চওড়া কপাল, খুব সরু কোমর। বছর-কুড়ি বয়েস। ল্যু।
    ইয়োরোপে উনিশ শতকের শেষ দুটি দশক নিয়ে বিশ শতকের গোড়ায়, বেল এপোকের দিনগুলিতে ভাবনা-চিন্তা, শিল্পের উঠোনে নানারকম রোদ্দুর আর হাওয়া মেশামিশি করেছে। এরমধ্যেই আবার ডবল-পেটিকোট, কর্সেট,পারাসোলের আড়ালে থাকা মানুষগুলি একলা একলা অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটে চলে বেড়িয়ে নিজেদের ইন্টেলেকচ্যুয়াল ভূমি তে নিজেই কোদাল কুপিয়ে নিজেদের ফসল নিজেরাই ঘরে তুলেছেন। ল্যু এদের মধ্যে একজন। এঁরা লেখাপড়া করেছেন, রোজগার করেছেন, পুরুষ-বন্ধুর সঙ্গে সেরিব্রাল-দৈহিক আনন্দের আদান-প্রদান করেছেন। ল্যু'র মতন এদের মধ্যে বেশির ভাগ সমাজের ওপরতলায়্গ্য জন্ম-নেওয়া। গ্যাসলাইটের তেকোনা ছায়ার নিচে হাড়-জিরজিরে রোগা, লালচুলের ছেঁড়া শাল-জড়ানো মেয়েটি হয়তো ল্যু'র মতন লেখা-পড়া করে বই-এর সাঁলো'য় গিয়ে পুরুষ-বন্ধু'র সঙ্গে ডিসকোর্স করেনি তবে,সেও কি রাস্তার কোণে ধূসর বৃষ্টি দেখতে দেখতে কয়েকটি কবিতা-প্রায়, নরম বাক্য মনের মধ্যে সাজায় নি?
  • pragati | 126.68.75.199 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:৩০628342
  • তবে এখন ল্যু-কেই দেখা যাক। ল্যু ছিয়াত্তর বছরের জীবনটি নিজের শর্তে বেঁচেছেন। লেখাপড়া করেছেন, নিজের লেখা ত্থেকে অর্থ উপার্জন করেছেন। ইয়োরোপের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেরিয়েছেন। তিনটি বিখ্যাত পুরুষ, ফ্র্রীডরিখ নীৎচে, রাইনার মারিয়া রিলকে, সিগম্যুন্ড ফ্রয়েড বন্ধুত্বে, প্রেমে, লেখাপড়ায়, মাঠে-ঘাটে, গ্রামের খামার-বাড়ির খড়ের গাদায়, বই-এর সাঁলো'য়, চিঠি-লেখায়, স্যুয়িস আল্প্স এর কোলে, মিউনিখের থিয়েটারে, ল্যু-কে চেয়ে গেছেন।
    উনিশ শতকের ইয়োরোপ যেন নানা রঙের উল-সুতোয় বোনা ছোটো ছোটো ক্রশ স্টীচের ফোঁড়ে একটি আসন। আর যা দিয়ে আসনের ছবি ফুটে ওঠে, সে হল দু'টি ভাষা ... ফরাসি আর জর্মান। যারা কবিতা লেখে, ফিলোসফি পড়ে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়,ডিসকোর্স করে,বোহেমিয়ান হয়ে প্যারিস থেকে ভিয়েনার শীত-বসন্ত কাটায়, তাদের কাছে ভাষা-বাগানের কোনো আগল নেই। ফরাসি আপেল দিয়ে তৈরি হতে পারে জর্মান টার্ট। রাশিয়া এই ইয়োরোপের কোণের দিকে পড়ে গেলেও সমাজে জল-চল করতে হলে সেই ফরাসি-জর্মান। যেমন রয়েছে তলস্টয়ের 'আনা কারেনিনায়'। উনিশ শতকের রাশিয়ায় বুর্জোয়া বৈঠকখানায় বসতে গেলে এই ধরণের প্যান ইউরোপিয়ানায় চোস্ত হতে হবে। যাতে আমদের নায়িকা ল্যু জীবনের শেষ ক্ষণ পর্যন্ত অতি পারঙ্গমা ছিলেন।
  • | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:৫৮628353
  • কত্ত বছর পরে প্রগতির লেখা, একেবারে অচেনা জগত।

    লেখো লেখো
  • san | 133.63.144.85 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ২৩:৪৩628364
  • তারপর ?
  • kc | 222.43.31.180 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ২৩:৫২628375
  • লেখাটা যেন থেমে না যায়। খুব মন দিয়ে পড়ছি।
  • a x | 86.31.217.192 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ২৩:৫৭628377
  • কী ভালো যে লাগছে এতদিন পর আবার প্রগতির লেখা পড়তে!
  • kk | 81.236.62.176 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ ০১:৩৫628378
  • খুব ভালো লাগছে। চলতে থাকুক।
  • nina | 78.37.233.36 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ ০৫:৪২628379
  • আরে --আজ সকালে কার মুখ দেখে শুরু করেছি দিন---সেই প্রগতির লেখা --লা মোদে ঢালিয়া দিয় মন--নীলিমায় নীল----
    লিখুন লিখুন, প্রগতি---এই বসলাম এখেনে পাটি পেড়ে
  • শ্রাবণী | 127.239.15.27 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:০৮628380
  • এক ঝলক টাটকা হাওয়া, অনেককাল বাদে!
  • h | 213.99.212.224 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:১৭628332
  • কি অসম্ভব ভালো। মনে হচ্ছে প্রগতি দি বই গুলোর বন্ধু বা আত্মীয়। কিন্তু কোন লাইব্রেরী এই বই ফেলে দেয়?
  • pragati | 126.68.75.199 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:৩৫628333
  • দময়ন্তী, নিনা, kk, স্যান, শ্রাবণী,kc, a x, থ্যাঙ্কু ঃ)

    বোধি, অনেক লাইব্রেরিই বোধহয় আছে, যেখানে পড়ে থাকে কিছু অনাদৃত বই, কত বছর পেরিয়ে যায় কেউ তাদের বাড়ী নিয়ে যায়্না, বিশেষত যদি তারা হত কবিতার বই। ধুলোভরা তাকে তারা ঝিমোয়। আর লাইব্রেরিতে যায়ই তো মানুষ বেশ কম। আমার মা পাড়ার যে লাইব্রেরির প্রায় পঁয়্তাল্লিশ বছর ধরে মেম্বার, সেতো প্রায় জনশূন্যই থাকে।
  • pragati | 126.68.75.199 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:৪০628334
  • ল্যু জন্মে ছিলেন ১৮৬১ এ, জার রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে। বাবা গুস্তাভ ভন সালোমে জারের অতি বিশ্বস্ত রাজকর্মী। লিথুয়ানিয়া থেকে অভিবাসী পরিবারটির ভাষা জর্মান। রুশ ভাষা লেখাপড়ার,কাজের, বন্ধুত্বের। লিউয়ালিয়া নামে ডাকা হয় বাড়ীতে। ষোলো-সতেরো থেকেই ল্যু'র অনন্যতা ফুটে বেরোতে থাকে। সমবয়সীদের ফঙ্গবেনে সাজ-পোষাক, ঝুরঝুরে আলাপচারিতায় সে নেই। হল্যাণ্ডের এক যাজক এই সময় ল্যু'র বৃত্তে আসেন। যাজকটি ল্যু'কে পড়তে দেন কান্ট, লিবনিৎজ, ভলতেয়ার। প্রেমেও পড়লেন ল্যু'র। ল্যু কিন্তু প্রেমে পড়েনি। তাঁর কাছে নিজস্ব বাগানে ভাবনা-চিন্তার রকমারি চারা রোপন এবং তাদের নিয়মিত জল-সিঞ্চিত করে বাঁচিয়ে রাখাই ছিলো প্রধান প্রধান কাজ। আর ল্যু জানে আঠেরো'র মধ্যে এই বাগানটা দরকার। না, গোপন বাগান নয়। একেবারে সামনাসামনি।এই জন্যেই ল্যু জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে আসেন, যে বিশ্ববিদ্যালয় ইয়োরোপের গুটিকতক শিক্ষাপ্রতিস্ঠানের মধ্যে রাজী মেয়েদের ফিলোসফির ক্লাসে ভর্তি নিতে।
    রাশিয়ায় উচ্চপদস্ত রাজ-কর্মচারীদের মৃত্যুর পর তাদের সন্তানেরা একতি ভাতা পেত, আর সেই টাকায় ল্যু'র ইয়োরোপে থাকার দিন শুরু হয়। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর বিডারম্যানের মনে হল মেয়েটির খুশি-ওপছানো পার্সোনা'র মধ্যে, টলটলে ছেলেমানুষীর মধ্যে, সব সময় থেকে যাচ্ছে একধরনের নিভৃত বুদ্ধির ঝলক। ল্যু-র পড়াশোনা এর মধ্যে খানিকটা থেমে যায়। অসুখ করে। স্বাস্থ্য-উদ্ধারের জন্য ইতালি আসেন। পল রে, এক তরুণ জর্মান দার্শনিক ইতালির একটি শহরে এক ইন্টেলেক্চ্যুয়াল আখড়ায় মোটা সোনালী চুলের বিনুনী আর ঝকঝকে নীল চোখের ছিপছিপে আমাদের নায়িকার প্রেমে অন্ধ হলেন। এদিকে ল্যু পল রে-কে বেশ পছন্দ করেন, তার সঙ্গে দর্শন নিয়ে কথালাপে সময় কাটান, একটি বাড়ী নিয়ে একসঙ্গে থাকতেও চান, কিন্তু প্রেমে নয়। ল্যু যে সমমনস্ক বুদ্ধিজীবী পুরুষ-বন্ধুদের সঙ্গে কমিয়্যুন-প্রতিম জীবনে রাজী আছেন, এই তথ্যটি থেকে পল, সব্সময় ল্যু'র কাছে কাছে থাকতে একটি প্ল্যান করেন, যদি এই কমিয়্যুনে আরেকজন দার্শনিক বন্ধুকে ডাকা যায়, তা'হলে ল্যু কি আপত্তি করবেন?
  • pragati | 126.68.75.199 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:৫৯628335
  • আর সে দার্শনিক বন্ধুটি যদি হয় ফ্রীডিরিখ নীৎচে? না , পল রে নয়। ল্যু'র জীবনে তিন প্রধান, প্রগাঢ ইন্টেলেকচ্যুয়াল আসেন তার মধ্যে পল রে গণ্য হননি কখনও। তিনজনেই ল্যু'র জীবনে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ,উত্তাপ আর তরঙ্গ আনেন। এই তিনজন হলেন, ফ্রীডরিখ নীৎচে, রাইনার মারিয়া রিলকে আর সিগম্যুন্ড ফ্রয়েড।

    " কি তিথি আর নক্ষত্র আমাদের কাছাকাছি নিয়ে এল ! "

    সাঁইত্রিশ বছরের নীৎচের একা-বাউল জীবন তখন শরীরের আধি-ব্যাধি,মনের নিদারুণ, করুণ ক্লান্তিতে ইয়োরোপের শহর থেকে শহরান্তের ঘুরে বেড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটি নেই, চারিদিকে সিসিফাস-তুল্য নীরেট অস্তিত্বের মধ্যে লেখার বিরাম নেই। এই সময়কালে নীৎচের নতুন দার্শনিক - সূত্রঃ ' ঈশ্বর মৃত, মানুষ একা, হয়ত এখন তার নতুন পথনির্দেশিকার প্রয়োজন। হয়ত তাকে এবার হতে হবে 'উবেরমাঞ্চ ' বা সুপারম্যান। এর মধ্যেই নীৎচের জীবনের সিঁড়ির ধাপে এসে দাঁড়ালেন ল্যু।
    রোমে ল্যু-নীৎচা'র কয়েকদিনের মেলামেশায় দুই স্বীকৃতি দুজনের দিকে হালকা ডানায় ভাসতে ভাসতে উড়ে যায় ---
    ল্যু নীৎচের প্রতি , " খুব ভালো লাগে দর্শন নিয়ে কথা বলতে, ইটার্নিটি, মেটাফিসিক্স,... খুব সুন্দর হাতের পাতা,... কিন্তু বুর্জোয়া বিবাহে তো আমি কখনও পা রাখতে পারবো না ।"
    নীৎচে ল্যু'র প্রতি , " আপনি আমাকে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নটি দেখালেন,"
    নীৎচে যেদিন জানতে পারেন ল্যু বিবাহে রাজী নন, সেদিন থেকেই তাঁর গলায় ঝুলতে থাকলো ভাঙ্গা প্রেমের আলবাট্রোস। শরীর নুয়ে পড়ে নানান বোধ্য ও অবোধ্য ক্লেশে, কিন্তু এর মধ্যেই লেখা চলে,নতুন বই,"'দাস স্পেক জরাথ্রুষ্টা" যেখানে আবার সেই 'অতিমানব', উবেরমাঞ্চ এসে পড়ে, এই পুরুষ-লিঙ্গ যেন হবে পৃথিবীর চালক, আর মেয়েরা নীৎচের ভাষায় প্রেমহীন তুচ্ছ্তম প্রাণী, তারা যেন হবে পাখী বা বেড়ালের মতন অল্পবুদ্ধির উপস্থিতি। নীৎচের পরবর্তীকালের মিসোজিনি কি ল্যু-কে না পাবার ক্লেশের বীজ?
    ক্রমশ গহন খাদের অন্ধকারের দিকে ঝুঁকে পড়া , ভারসাম্যহীন নীৎচের অস্তিত্ব একদিন তুরিন শহরের রাস্তায় একটি রুগ্ন ঘোড়ার ওপর তার কোচম্যানে্র চাবুকের সামনে এসে দাঁড়ালো। লুটিয়ে পড়া ঘোড়াটিকে নিয়ে নীৎচে রাস্তায় অনেকক্ষণ শুয়ে থাকেন। পরের প্রায় কুড়িটি বছর একটি বাক্যও না বলে, একটি অক্ষরও না লিখে,নীজের মধ্যেই একা-একা বাস করতে করতে, ১৯০০ সালে নীৎচে মারা যান।
    ল্যু'র কাছে জীবনযাপন সরলরেখায় টানা একটি ঐকিক বিস্তার নয়। সেখানে দক্ষিণ-দুয়ার খোলা একটা একটি গোটা প্রান্তরের প্রয়োজন। নীৎচের থেকে দূরে চলে গিয়ে ল্যু লিখতে থাকেন সমাজ ও জীবনের ওপর ছোটোখাটো লেখা, তাঁর কুড়ির কোঠার মাঝামাঝি বয়সে পল রে'র সঙ্গে বার্লিনে এক তিন কামরার বাসায় থাকতে শুরু করেন। এই সহবাসে যৌনতা নেই। শুধু বন্ধুত্ব, ডিসকোর্স, লেখা... ঘন একটি ককটেল। ক্রমে এই ককটেলটি পল রে'র কাছে আবেদন হারিয়ে ফেলে, কারণ তিনি ল্যু'র প্রেমে আচ্ছ্ন্ন, বিবাহ -ইত্যাদির দিকে এই সম্পর্ককে টানতে ইচ্ছুক। বার্লিনে একসঙ্গে থাকার দিনগুলি ক্রমে ক্রমে নিভে আসে, আর ল্যু'র জীবনে একটি মানুষের আবির্ভাব হয় যার সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ বছর বিবাহ-বন্ধনে থাকবেন ল্যু। কার্ল আন্দ্রেয়াস ফার্সী সাহিত্য ও সংস্কৃতির অধ্যাপক। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। ছোটোখাটো , আর্মেনিয়ান পিতৃত্বের সূত্রে ঘন বাদামী ত্বকের আন্দ্রেয়াসের সঙ্গে এই বিবাহটি ছাব্বিশ বছরের ল্যু'র কাছে কি অর্থ নিয়ে সূচিত হয়েছিলো, তা দুরূহ থেকে যায়।তবে এই বিবাহ তার প্রায় পঞ্চাশ বছরের স্থায়িত্বে কিছু তথ্য সামনে আনে, এই বিবাহে আন্দ্রেয়াসের কাছে ল্যু'র প্রধান শর্ত ছিলো যৌনতাহীন সহবাস। আন্দ্রেয়াস রাজী ই ছিলেন তাতে। আন্দ্রেয়াস বাড়ীর পরিচারিকার গর্ভে দুই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, একটি শৈশবে মৃত হলেও, দ্বিতীয়টি,মারী, ল্যু'র কাছে 'মারীচেন' বা ক্ষুদে মারী হয়ে পরে অতি প্রিয় হয়ে ওঠেন। ল্যু'র শেষবেলা তার কাছেই কাটে। আন্দ্রিয়াসের সঙ্গে থাকতে থাকতে ল্যু নিজের মতন করে ঘুরে বেরিয়েছেন,ইয়োরোপের শহরে শহরে,অন্য পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করেছেন নিজের ছত্রিশ বছরের পর থেকে... লিখেছেন, পড়েছেন। শেষ সত্তরে মারা যাবার আগে পর্যন্ত আন্দ্রেয়াসের নামটি নিজের নামে রেখে দিয়েছেন । ১৯২০ –র শেষাশেষি, ল্যু যখন খুব অসুস্থ, পঁচাশি বছরের আন্দ্রেয়াস ল্যুকে দেখতে রোজ আসতেন হাসপাতালে। অর্থাৎ, ল্যু আন্দ্রেয়াস সালোমে'র মধ্যে কার্ল আন্দ্রেয়াস ছিলেন অনেকদিন, হয়তো প্রেমে নয়... হয়তো অপ্রেমে নয়.... পরের দিকে ল্যু যখন সাইকো-অ্যানালিসিস নিয়ে চর্চা করেন তখন এই নিয়ে কি ভেবেছিলেন?
  • Tim | 12.135.61.46 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ ০০:৪৯628336
  • দারুণ লাগছে প্রগতিদি। অনেকদিন পর, সত্যি। পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।
  • pragati | 126.68.75.199 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:১৭628337
  • ল্যু-রিলকে

    ১৮৯৭ তে ল্যু'র যখন ছত্রিশ বছর বয়েস, তখন তাঁর সঙ্গে একুশ বছরের প্রাগ ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে ইয়োরোপে ইন্টেলেক্চ্যুয়াল বোহেমিয়ানার কাঁচা রোদ্দুরে নিজের কবিতার খেরোর খাতাটি একটু মেলে দিতে চাওয়া রেইনার মারিয়া রিলকের আলাপ।
    মিউনিখের একটি থিয়েটারে এক সন্ধ্যেবেলায় ল্যু'র সঙ্গে দেখা হওয়াটা রিলকের কাছে একটি অক্ষয় সত্যবিন্দুর মতন থেকে গেছে। একবার ল্যু কে নিয়ে একটি কবিতায় লিখছেন, "পাহাড়-চুড়ো'র তুমি একটি শান্ত ঝরনা, আর তার পাশে আমি একটি কুঁড়েঘর বানিয়েছি..."
    রিলকের সঙ্গে এক গভীর বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে ল্যু, পাশাপাশি ঝুপুর-ঝাপুর করে এসে যায় শরীরের ভালোবাসা,যে শরীর ফ্রঁসোয়াস জিরু'র মতে ল্যু সবে মাত্র পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা-বন্ধুত্বে নিয়ে আসছেন, প্রায় ছত্রিশ বছর কুমারী থাকার পর। এবং রিলকে হয়তো ল্যু'র জীবনে প্রথম যৌনতা আনেননি। জিরু বলছেন, হতে পারে এর কাছাকাছি সময়ে অস্ট্রিয়ান ডাক্তার ফীডরিখ জেমেক সেই পুরুষ, রিলকের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরেও যার সঙ্গে কিছুদিন থাকবেন ল্যু।
    ১৮৯৭ এ অবশ্য ল্যু-রিলকের ভুবনটি গভীর দীপ্তিময় ...প্রেমে, কথামালায়,লেখাপড়ায়। ল্যু রিলকের লেখায় আনে এক প্রবল বাঁক, রিলকের কবিতার লাইনের লিরিক্দ্যুতি আরও অর্গলমুক্ত হয়। ল্যু রিলকের নাম পরিবর্তন করে দেন, রেনে মারিয়া রিলকে বড্ড মেয়েলি, এবার থেকে রেনে মারিয়া হবেন রাইনার মারিয়া, হের রাইনার মারিয়া রিলকে। ১৯০০ সালে হঠাৎ ল্যু-রিলকে বেড়াতে বেরোলেন, রাশিয়ায়। ল্যু'র মাতৃভূমি। দুই প্রেমিক-প্রেমিকা আর আন্দ্রেয়াস। সেই আন্দ্রেয়াস, যে ল্যু'র জীবনে একটি আঁচড় হলেও কখনও ধেবড়ে যায়নি। ঘুরতে ঘুরতে তিন জন তলস্তয়ের খামার-বাড়ী ইয়াসিনা-পলিয়ানায়। পরের বছর এইরকম আরেকবার রাশিয়ায়, এবার সঙ্গে নেই আন্দ্রেয়াস। কিন্তু এর পর থেকেই ল্যু-রিলকের সংরাগে আসে হঠাৎ বিচ্ছেদ, এবং তা ল্যু'র তরফ থেকেই। একটি সুকঠিন, নিষ্করুণ বিচ্ছেদের চিঠি রিলকে-কে পাঠিয়ে দেন ল্যু। এই সময় মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন রিলকে। তার মধ্যে ল্যু লিখলেন," আমি তোমার থেকে দূরে যেতে চাই কারণ তুমি অসুস্থ আর আমি, আমার যে সবে মনে হচ্ছে আমি সবে আঠেরো বছরের। জীবনের সব তারুণ্যের রস যেন আমার মধ্যে বইছে। তুমি পঁচিশ আর আমি উনচল্লিশ, কিন্তু তুমি যেন হারিয়ে যাচ্ছ চরাচরের মধ্য ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র্তর হয়ে, আর আমি যেন নতুন ভাবে আমার যৌবনকে খুঁজে পাচ্ছি ..." ভয়ঙ্কর রুক্ষ একটি বিচ্ছেদলিপি, সন্দেহ নেই, কিন্তু জিরু বলছেন এই হল ল্যু, এই জন্যই সে এত অনন্য, এত তীব্র স্বাধীন।
    এই বিচ্ছেদ্র পর অবশ্য ল্যু'র সঙ্গে রিলকের যোগাযোগ থেমে যায়নি। ১৯২৬ এ রিলকের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ল্যু-রিলকে অতি আদরে-সহমর্মিতায় দু'জন দু'জনকে চিঠি দিয়েছেন। রিলকের জন্য সারাজীবন ছিলো একটি ল্যু, যুদ্ধের বছরগুলির অর্থকষ্ট, অসুখ আর 'দুইনো এলিজি'র লেখার দিনগুলিতে। রিলকের মৃত্যু পর্যন্ত এক ফিনিক্সীয় তেজে বেঁচে থেকেছে ল্যু-রিলকের যোগাযোগ।
  • π | ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:২৮628338
  • দারুণ লাগছে। কিন্তু প্রগতিদি, ব্লগের সমস্যা মিটলোনা ?
  • Pragati | 126.68.75.199 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:৩২628339
  • না পাইঃ)
  • π | ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:৩৩628340
  • এই রে .. একটা মেইল করবে ?
  • pragati | 126.68.75.199 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১১:৫৭628341
  • ল্যু-ফ্রয়েড

    পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে ল্যু'র জীবন যেন একটি নতুন আর চমকপ্রদ পরিক্রমার দিকে এগিয়ে যায়। এই পরিক্রমায় এক সুবিখ্যাত পুরুষ ল্যু'র খুব কাছাকাছি এসে পড়েন। সিগম্যুন্ড ফ্রয়েড। যেভাবে ল্যু-ফ্রয়েড প্রায় পঁচিশ বছর ধরে পরস্পরকে চিঠি লিখেছেন, বন্ধুত্বের রুমালে জড়ানো ভালোবাসায় ভালোবেসেছেন শরীর ছাড়াই; তাতে তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বোধের এক ঠাসবুনন,ওম-ওলা আলোয়ান তৈরি হয়, যা দু'জনেই গায়ে দিয়েছেন নিজেদের সংকটে, অস্থিরতায়, অনিশ্চয়তায়।
    ১৯১১-১২ থেকেই ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের সাইকোঅ্যানালিসিসের ঢেউ ইয়োরোপের বুদ্ধিজীবীদের সাঁলো'র দরজায় ধাক্কা মারে। সাইকোঅ্যানালিসিস যেন টাঁকশাল থেকে বেরিয়ে আসা এক নতুন মুদ্রা, হাতে হাতে ফিরছে ডিসকোর্সের আড্ডায়। সর্বদা নতুন নতুন চিন্তার রসে মজে থাকা, ক্ষুরধার বুদ্ধি'র ল্যু'র কাছে এই নতুন বিষয়টি মনে লেগে যায়। ভিয়েনায় তখন প্রতি বুধবার সাইকোঅ্যানালিসিসের চর্চা-আলোচনার আসর বসে, ফ্রয়েডের নেতৃত্বে। ল্যু ভিয়েনায় এসে বেশ কয়েকদিন থেকে শিখলেন ফ্রয়েডের কাছে এই নতুন চিন্তার সূত্রগুলি। লেখা বাদ দিয়ে পরের দিকে সাইকোঅ্যানালিসিস-ই হবে ল্যু'র আরেক জীবিকা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলির কিছু আগে থাকতেই গটিনজেনে একটি বাড়ীতে প্রায় সংসার পেতেই বসেন ল্যু। বাড়ীর জানলা থেকে এক টুকরো এলোমেলো বন-বাদাড়,পোষা কুকুর। আন্দ্রিয়াস আর বাড়ীর পরিচারিকার ছোট্টো মেয়েটি ল্যু'র ও বড় প্রিয় হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে ইয়োরোপের শহরে শহরে ঘোরেন, পাশে থাকে কোনো কোনো তরুণ বন্ধু, যাদের সঙ্গে শরীরের ভালোবাসা হয় যাকে ল্যু বর্ণনা করেছেন " প্রেমের উৎসব " হিসেবে। ফ্রঁসোয়াজ জিরু'র ফরাসিতে যার অনুবাদ, 'ফেস্তঁ দামুর"( festins d'amour)
    যুদ্ধের শনশনে ধারালো হাওয়ায় ইয়োরোপে আসে অজানিত ভয়, সংশয়। বিদ্যুতহীন গটিনজেনে মোমের আলোয় বসে ল্যু লেখেন ছোটো ছোটো লেখা আর চিঠি, ফ্রয়েডকে। ফ্রয়েডের ল্যু-কে লেখা চিঠিতে সম্বোধন,'প্রিয় মহাশয়া' থেকে 'আমার প্রিয় ল্যু'। ল্যু'র দিক থেকে 'প্রিয় প্রোফেসর' থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। ১৯২০'র পর থেকে ফ্রয়েডের পরিবারের কাছেও ল্যু প্রায় আপনজন হয়ে ওঠেন। ফ্রয়েডের মেয়ে আনা ল্যু'র প্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠেন। আরেকটি যুদ্ধের নিষ্করুণ, সূর্যহীন সময়টি আসতে না আসতেই ল্যু-ফ্রয়েড পৃথিবী ত্যাগ করেন। ১৯৩৭ এ ল্যু মারা যান ছিয়াত্তর বছর বয়সে। ফ্রয়েড, ইংল্যান্ডে, তার পরের বছর, নাৎসী আগ্রাসনের হাত থেকে পালিয়ে লন্ডনে আশ্রিত থাকার সময়। এই ভাবেই শেষ হয় ল্যু-ফ্রয়েডের বন্ধুত্বের দিনগুলি। রিলকে-ল্যু'র মতন যে বন্ধুত্বে যৌনতা আসেনি, নীৎচে-ল্যু'র মতন যা একপেশেও হয়নি। ফ্রয়েড -ল্যু এক প্রাপ্ত-বয়স্ক গভীর বন্ধুত্ব, নারীতে, পুরুষেতে, যেখানে মাঝেমাঝে ঢেউ তুলে গেছে নরম ভালোবাসা।
  • kumu | 133.63.144.117 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৪:৪০628343
  • প্রগতির লেখা অনবদ্য।
  • h | 213.99.212.224 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৯:৩৯628344
  • প্রগতি দি, খুব সুন্দর লাগছে।
  • দ্রি | 116.66.108.99 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২৩:০২628345
  • খুব কিউরিয়াস চরিত্র ল্যু!

    জানতে ইচ্ছে করে, ল্যুর অর্থ উপার্জনের সোর্স কি ছিল। হয়ত ইনহেরিটেন্স ছিল, হাজার হোক বাবা জারের কাছের লোক। রাশিয়ান ভাতা ছিল। নিজে লেখালেখি করে কত উপার্জন করতেন? কি লিখেছেন? কারা ছিল পাবলিশার? আন্দ্রিয়াসের কাছে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ছিল?

    কি বলছে লাইব্রেরির বাতিল বই?

    ল্যুর জীবন কি বিভিন্ন চিঠি থেকে রিকন্স্ট্রাক্টেড?
  • দ্রি | 116.66.108.99 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২৩:০২628346
  • খুব কিউরিয়াস চরিত্র ল্যু!

    জানতে ইচ্ছে করে, ল্যুর অর্থ উপার্জনের সোর্স কি ছিল। হয়ত ইনহেরিটেন্স ছিল, হাজার হোক বাবা জারের কাছের লোক। রাশিয়ান ভাতা ছিল। নিজে লেখালেখি করে কত উপার্জন করতেন? কি লিখেছেন? কারা ছিল পাবলিশার? আন্দ্রিয়াসের কাছে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ছিল?

    কি বলছে লাইব্রেরির বাতিল বই?

    ল্যুর জীবন কি বিভিন্ন চিঠি থেকে রিকন্স্ট্রাক্টেড?
  • pragati | 126.68.75.199 | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২৩:৩৪628347
  • ফ্রঁসোয়াস জিরু'র আলোকপাতে ল্যু আন্দ্রেয়াস সালোমে বিশেষ স্বতন্ত্র এইভাবে যে ল্যু ,সমাজ পুরুষের জন্য জীবন থেকে পাঠ নেবার, পুষ্টি নেবার যে সরলতর রাস্তা পৃথিবীর আদিম যুগ থেকেই দিয়ে আসছে; সেই রাস্তাটি একেবারে চোস্ত ভাবে, আপনার করে চিনে নিয়ে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে ল্যু কোনো বাধা মানেননি। এটা তাঁর পুং-উত্তরাধিকার। সঙ্গে রাখতে ভোলেনি মেয়ে-হৃদয়ের একটি সোনার কৌটো। জিরু'র ভাষায় এই পুং-স্ত্রী সত্তার পুরোপুরি মেশামেশি করা একটি সানন্দিত জীবন ল্যু'র উত্তরাধিকার পরের দিকের মেয়েদের জন্য। যে জীবন কখনো ডানা গুটিয়ে বসে না। ল্যু কে জিরু সোজাসুজি বলছেন আধুনিক নারী স্বাধীনতার একটি প্রাণপ্রতিমা।
    খুব সুস্পষ্ট ভাবে ল্যু তাঁর জীবনের অর্থনৈতিক ও নৈতিক দায়ভার নিয়েছিলেন। ল্যু যখন ইয়োরোপে একা থাকতে শুরু করেন, তখন রুশ সরকারের একটি ভাতা অবশ্য ছিলো, কিন্তু ইয়োরোপে ঘোরাঘুরি, আহার, বাসস্থান, নিজের উপার্জিত অর্থেই কুলিয়ে দিয়েছেন। প্রধানত লিখে। লেখা থেকে উপার্জন ল্যু'র জোড়া ডানা। আরেকটি জীবিকা, সাইকো- অ্যানালিসিস নিয়ে মানুষের চিকিৎসা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভাতা বন্ধ হয়ে যায়।এই সময় ল্যু অর্থকষ্টে থেকেছেন। জিরু লিখছেন এই সময় কিছু সাহায্য করেছেন ফ্রয়েড। কিন্তু সে সাহায্য এক বন্ধু যেমন আরেক বন্ধু'র দিকে হাত বাড়ায়, সেই ভাবে। ফ্রয়েড নিজেও এই সময় নিজের লেখার সান্মানিক চেয়েছেন একটি পত্রিকার কাছে , কয়েক কিলো আলু। অবশ্যই , ল্যু নিজের মৃত্যুদিন পর্যন্ত থেকেছেন নিজের দুইজোড়া ডানায় উড়ে যাওয়া পাখী। আন্দ্রেয়াস এই উড়ন্ত পাখীটির দানাপানি বা খাঁচা কিছুই আনতে পারেননি। গটিনজেনের বাড়ীটি হয়তো আন্দ্রেয়াসের ছিলো, কিন্তু বাড়ীতে একটানা থেকেছেন কদিন ল্যু ? ল্যু যে পথে হেঁটেছিলেন সে পথ কে পরে সবাই নাম দেয় আধুনিক নারীর স্বাধীনতার পথ। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ, ষাটের দশকের পিলের নিঃশব্দ বিপ্লব যে পথ কে মশৃণতর করে।
  • pragati | 126.68.75.199 | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২৩:৪৬628348
  • *মসৃণতর
  • nina | 22.149.39.84 | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০০:১৯628349
  • প্রগতি তোমার লেখার সুরে আচ্ছন্ন হয়ে চলেছি তোমার পিছু পিছু-----
  • pragati | 126.68.75.199 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২১:২৮628350
  • নিনাঃ)
  • sosen | 125.241.85.249 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২১:৪১628351
  • প্রগতিদির লেখা ভারী পুরনো শালের মত, কারুকার্য্যময়---
  • kk | 81.236.62.176 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২১:৪৭628352
  • খুব ভালো লাগছে প্রগতি দি। আমি কিন্তু সেই 'দিওর' নিয়ে লেখাটার অপেক্ষাতেও আছি। লিখবেন যখন সময় সুযোগ হবে।
  • pragati | 126.68.75.199 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:৩১628354
  • 'Histoire d'une femme libre', ফ্রঁসোয়াজ জিরু'র লেখা বইটি একটি ছিপছিপে পকেটবই, একশো তিপান্ন পাতার।
    এটি লাইব্রেরির বাতিল বই-এর খাতিরে হাতে না আসা পর্যন্ত ল্যু'র ওপর বিন্দু -বিসর্গও জানতাম না। উনিশ শতকের ইয়োরোপের ইতিহাস, ফ্যঁ দ্য সিয়েক্ল, উনিশ শতক-বিশ শতকের সেতুসময়ে ইয়োরোপে ইন্টেলেক্চ্যুয়াল টানাপোড়েন , পুরোনো ও নতুনের মধ্যে গা ঘেঁসাঘেঁসিতে শিল্পীদের নতুন ছবি,কবিতা, সাত নম্বর আর্টের জন্ম , মেয়েদের নতুন ধরনের 'গিবসন গার্ল' খোঁপা, স্কার্টের নতুন কাট-ছাঁট ইত্যাদি নিয়ে এই সময়্টা আমার খুব প্রিয়। আর ল্যু যেহেতু এই সময়ে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের, সেটা আরো ইন্টারেস্টিং। কেননা, ল্যু তখন প্রায় মধ্য বয়সের, অন্তত সেযুগের হিসেবে। কিন্তু এখান থেকেই ল্যু জীবনে আরো প্রগাঢ় ভাবে ঝাঁপ দিচ্ছেন। নিজের বাগান তৈরি মোটামুটি শেষ। লেখা থেকে উপার্জন। 'ফেস্তাঁ দামুর' ইত্যাদি ও সে ঝাঁপের মধ্যে রয়েছে।
    আসলে ল্যু অসাধারণ ভাবে ইন্টেলেক্চ্যুয়াল হলেও সব সময় নতুন আনন্দের খোঁজে ফিরেছেন। সিনেমা যখন এল, প্রায়ই, প্রথমদিকের নির্বাক ছবি দেখতে ল্যু গিয়েছেন তরুণ বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে।
    ল্যু সোজাসুজি ভাবে সন্তান চাননি। ল্যু লিখছেন," ঋতুবন্ধের পর মেয়েদের অ-নে-ক সুবিধে। অফুরন্ত অবধিকালের মধ্যে নিজেকে পূর্ণভাবে মেলে বিকশিত করার।" ল্যু'র সময়ে যেহেতু মেয়েদের হাতে জন্মনিয়ন্ত্রণ ছিলোনা, ঋতুবন্ধের পরের সময়কাল ই কি ল্যু'র কাছে মেয়েদের জন্য আদর্শ মনে হয়েছে? আপেল-গাছ থেকে পড়ে যাওয়া গর্ভপাতের কষ্ট কি ল্যু-কে এমন লিখতে বলে? ঋতুবন্ধ বা পঞ্চাশ বছর পরেও ল্যু ছিলেন প্রগাঢ় সুন্দরী, তখনও তাঁর অনেক অনুরাগী পুরুষ বন্ধু, ফ্রয়েডের সঙ্গে আলাপ ই এই সময়ে।
    ফ্রঁসোয়াসের লেখা ল্যু'র জীবন পড়ার আগে পর্য্ন্ত ল্যু'র নামও শুনিনি। পরে বইটি পড়ার পরে ওয়েবে দেখেছি ল্যু'র ওপর অজস্র তথ্য। ফরাসি রেডিয়ো'য় কিছুদিন আগেই শুনলাম ল্যু'র ওপর একটি প্রোগ্রাম। তথ্যের কোনো অভাব নেই ল্যু'র ওপর। এবং ল্যু-চর্চার একটি বিশাল ভাণ্ডার এসেছে ল্যু-রিলকে,ল্যু-ফ্রয়েডের চিঠিপত্র থেকে। ফরাসি, জর্মানে তো আছেই, ইংরেজিতেও বোধহয় যার অনুবাদ পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে ল্যু'র লেখা, যা মূলত জর্মানে।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন