এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • অর্ধেক জীবন আর অর্ধেক আকাশ

    Ishani
    বইপত্তর | ২৬ জুন ২০১৪ | ৪৪৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Ishani | 69.92.177.211 | ২৬ জুন ২০১৪ ২৩:২২640697
  • আমার প্রবাস জীবন শুরু হয় বিয়ের পর | আগে কখনও বাড়ি ছেড়ে থাকিনি | তখন গলির মাথায় ডাকবাক্স ভরসা | চিঠি লিখি | চিঠি পাই | আর খুব মন কেমন করে |
    ১৯৮৮ সালে "দেশ" পত্রিকায় শুরু হল এক নতুন বিভাগ | "বুদ্ধদেব বসুর চিঠি : কনিষ্ঠা কন্যা রুমিকে " | বু.ব.-র লেখার অনুরাগিনী ছিলাম খুব | আমার লেখায় ঠিক ওইরকম চিত্রকল্প ব্যবহারের অপটু অনুকরণ করতাম | বু.ব. কে চিনি ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, শিশুদের লেখক , কবি আর অনুবাদক হিসেবে | কিন্তু এই মানুষটি চিঠি লেখেন কেমন ? চিঠিতে কি আমার বাবার মতোই উৎকন্ঠা থাকে ? যা চাপা দিতে অন্য সাতসতেরো প্রসঙ্গ উঠে আসে চিঠির পাতায় ? আমি তখন জানি যে রুমি অর্থাৎ দময়ন্তীর শিক্ষাগুরুও তাঁর পিতা | তাহলে কি লেখাপড়ার কথাও থাকে চিঠিতে ?

    অজস্র চিঠি | তার থেকে বেছে নেওয়া ১৭৮ টি | রচনাকাল ৬/৯/৬২ থেকে ১১/৩/৭৪ | এই চিঠিপত্র পাঠকদের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন রুমি | কারণ এতে ধরা আছে বু.ব.-র জীবনের শেষ দশকের ইতিহাস এবং তাঁর আজীবনের চিন্তাভাবনার অন্তর্লীন সুর | রুমির ভাষাতেই লিখি, " পরিবার থেকে দূরে থাকতে যতই খারাপ লেগে থাক না কেন , পরবর্তী সময়ে উপলব্ধি করেছি ধারাবাহিক চিঠির মাধ্যমে যত সহজে মনের বিনিময় হয় , ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা-সুখ দু:খ- সাংসারিক সমস্যা ইত্যাদির আলোচনা যত হৃদয় খুলে হওয়া সম্ভব , তা কখনোই দৈনন্দিন দেখাশুনোয় অন্তত পিতাপুত্রীর হয় না | আমি যে বাবাকে ক্রমাগত পত্রবিনিময়ের মধ্যে দিয়ে পেয়েছিলাম , গভীরভাবে জেনেছিলাম তাঁর মন , শরিক হতে পেরেছিলাম তাঁর সুখ দু:খের মুহূর্তের , তা আমি পরিবার থেকে শারীরিক দূরত্বে বহু বছর থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম বলেই | বাবার চিঠিপত্রের রাশি এখন যখন বারবার পড়ি , সেই সাময়িক বিচ্ছিন্নতা ঘটেছিল বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিই | "
    বু .ব-র সঙ্গে রুমির পিতা-পুত্রী সম্পর্ক ছিল একরকম | এর বাইরেও কিন্তু একটা অন্য সম্পর্ক ছিল | দীর্ঘকাল তিনি কন্যার শিক্ষাগুরু ছিলেন | যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ'বছর ; পরে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে | এই পত্রগুচ্ছে আছে দৈনন্দিন যাপনকথা , নানা খুঁটিনাটি সমস্যা , অর্থাভাবের সঙ্গে অসম যুদ্ধের ইতিবৃত্ত | আবার একই সঙ্গে রাজনীতি , কন্যাকে নানা নির্দেশ ..যাতে থিসিস নিখুঁত হয় , অজস্র রেফারেন্স | বুদ্ধদেব চেয়েছিলেন আর দশটি বছর বেঁচে থাকতে | এই চিঠিপত্রে মনের শেষ কিছু ভাবনা, পরিকল্পনার ছক কষা হয়েছে | লিখেছিলেন , "কাজের স্তূপ জমে আছে, তবু আমি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি ...." | রুমির কথায় " শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর
    তমসাহত মন কক্ষে কক্ষে ঘুরে ফিরেছে অমৃতসূর্যের সন্ধানে |" এ পত্রাবলী সেই অনন্য দস্তাবেজ |
    পরবাসে রুমি ভালো নেই | মন খারাপ নিশ্চয়ই | কিন্তু যদি বাবাও মন খারাপের গান গাইতে থাকেন , মেয়ের মন বসবে কী করে ? তাই ১২/৯ /৬২-র চিঠি :
    " অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবার শক্তি মেয়েদের অনেক বেশি | যে সভ্যতা পৃথিবীতে গত পাঁচশ ' বছর ধরে শ্রেষ্ঠ ; শ্রেষ্ঠ না হোক , সবচেয়ে প্রতাপশালী , তার মধ্যে প্রবেশ করাটাই অভিজ্ঞতা হিসেবে মূল্যবান | কত ছবি , গান , বই , মিউজিয়াম , জ্ঞান , শিল্পকলা , চিত্তপ্রসাদ | আমরা মনে মনে থাকব তোর সঙ্গে | তোর সব নতুন আহরণের মধ্যে | "

    বু. ব. কন্যার দীক্ষাগুরুও তো ছিলেন | তাই লিখেছিলেন , মন খারাপ লাগলে বিদেশকে দোষ না দিতে | আমরা যেখানে যখন থাকি , সেখানেই অবস্থা বা নিয়তির কারণে আমাদের হাত ধরে থাকে নি:সঙ্গতা , শূন্য প্রহর আর অসীম তমসা | মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ও স্বজন বান্ধবদের সঙ্গে একটি মৌলিক ও গভীর বন্ধন থাকে ঠিকই , কিন্তু আর সবাই আমার "পর "-- এই ধারণা লালন করাও অনুচিত | উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথের গানের কথা | বলেছেন, "রুমি , রেডিও ও মাতাল জনতা র. ঠ . কে পচিয়ে দিচ্ছে | তাঁর গানের কথাগুলো তলিয়ে দেখিস , গায়ে কাঁটা দেবে |"

    আবার ১৭/৯/৬২-র চিঠিতে :
    " গরম আর ঠাণ্ডা জল মেশাবার সময় খুব সাবধান , ঝুপ করে যেন ফুটন্ত জল গায়ে না পড়ে , বা হিম জলে মাথা ফেটে না যায় | মাথায় ঠাণ্ডা জল দিতে পারিস , কিন্তু চুল যেন শুকোয় !"
    আমি পড়ছি আর ভাবছি... বাবারাও কখনও কখনও কেমন "মায়ের" মতো দুর্ভাবনায় থাকেন ! হয়ত এই চিঠি না লেখা হলে তা প্রকাশই পেত না আদৌ |
    ওই দিনই আর একটি চিঠি :
    " রুমি , মানুষের শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ এবং সর্বসময়ের নির্ভর সে নিজে -- নিজেকে অসহায় বা দুর্বল বলে ভাববি না কখনও ..."

    বু.ব-র প্রতি " শনিবারের চিঠি"-র সজনীকান্ত দাসের শত্রুতা ও অশালীন আক্রমণ বিষয়ে তদানীন্তন পাঠকরা ওয়াকিবহাল এই প্রসঙ্গে চিঠিতে বু.ব. কী লিখেছেন ..একবার দেখি |
    " হয়ত সজনীকান্তর কন্যা -জামাতার সঙ্গে তোর দেখা হয়ে যাবে -- যদি হয় , কোনো অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলিস না | অপ্রীতির কারণ যখন পরলোকে তখন সেটা নিতান্তই অবান্তর | তাছাড়া পিতার দোষ সন্তানে বর্তায় না , এবং আমরা ইতালিয়ানও নই যে বংশপরম্পরায় যুদ্ধ চালাব | যদি পরস্পরকে ভালো লেগে যায় , সেটাকেই সযত্নে রক্ষা করবি |"
    ১৭/১১/৬২ :
    " আমরাই ভারতীয় বলতে একটা মামুলি ছবি বিদেশীদের মনে মুদ্রিত করে দিয়েছি | প্রথমে আমাদের মনীষীরা জগতকে জপালেন যে ভারত হল আধ্যাত্মিক আর পশ্চিম জড়বাদী | তারপর স্বাধীন হয়ে আমরা প্রহিবিশন ঘোষণা করলুম , কোনো এক সম্প্রদায় গো- হত্যা নিবারণের জন্য খেপে উঠল | আমাদের প্রহিবিশন এতদূর পর্যন্ত সার্থক হয়েছে নিরীহ শান্তিপ্রিয় লোকগুলো ক্রিমিনাল হয়ে গেল অবস্থার গতিকে..এ খবর বিদেশে ততটা পৌঁছয় না, যতটা পৌঁছয় নেতাদের সাধুবচন | "

    এরপরেই আবার শিক্ষক বু.ব . মেয়েকে লিখছেন , " আগের চিঠিতে museum ( muse থেকে ) বানান দু'বার ভুল করেছিলি আর হঠাৎ মূর্ধন্য ণ দিয়ে প্রধান বানান লিখছিস কেন জানি না !"

    এই চিঠি পড়েই রুমির মতো আমিও যে প্রথমই জেনেছি যে সেরেজকভস্কি , এক রুশ লেখক বহুকাল আগে দ্য ভিঞ্চির জীবনী অবলম্বন করে একটি উপন্যাস লেখেন | আর এই বইটি পড়েই বু.ব. হাতের কাছে দ্য ভিঞ্চির ওপর যা আছে, সব পড়ে ফেলেছিলেন | সব !

    লিখেছেন , " লিপিকা আমার এখনও ভালো লাগে , কিন্তু ইংরেজিতে সেন্টিমেন্টাল মনে হয় --অতএব বিদেশীরা মুগ্ধ না হলে হতাশ হস না | আমাদের মনে এত যে নাড়া দেয় , তার কারণই হয়ত ভাষার জাদু !"
    শান্তিনিকেতন প্রসঙ্গে :
    " আমার কাছে শান্তিনিকেতন মানেই উত্তরায়ণ ও ছাতিমতলার অঞ্চল | আমার কাছে শান্তিনিকেতন মানেই রবীন্দ্রনাথ | সেই আকাশ বাতাস সবই আছে --কিন্তু জায়গাটা আর বিশেষ নেই , অন্য পাঁচ রকম সাধারণের মধ্যে মিশে গেছে | "

    মেয়েকে চিঠি লেখেন বাবা | ছেলের বয়:সন্ধি তখন |
    " এই বয়সে উদ্দামতা যেমন স্বাভাবিক , তেমনি কিছুটা প্রিয় ও অপ্রিয় বন্ধনও প্রয়োজন "
    পরিবারের কিছু আদর যেমন আছে, সত্যিই তো , শাসনও তো আছে | ছিল | আমার নিজের কিশোরীবেলার বিদ্রোহ মনে পড়ে যায় | মায়ের শাসন অসহ্য লাগত | এই লেখা লিখছি আর ভাবছি, সত্যি ! আমার ছেলে দুটোও কিন্তু ওই বয়সে কেমন বুনো ঘোড়ার মত কিছুটা জেদী , অবাধ্য হয়ে উঠেছিল ! গল্প সব পরিবারেই এক | দুর্ভাবনাও |

    আমার ছোটবেলার জন্মদিনে একপাতা চকোলেট আর একটা বই থাকত | ভোরবেলা ঘুমচোখে বালিশের পাশে | আমার বাবা তো কবিতা লিখতে পারতেন না ! কিন্তু রুমির বাবা ? তিনি লিখেছিলেন . "ও রুমি , ও রুমি , আমায় চিনবে না কো তুমি , আমি তোমার পরি -মা !"
    পরে চিঠিতে লিখেছিলেন , " এত অর্থাভাব চলছিল তখন যে তোর জন্মদিনে একটা ভালো উপহার কিনব এমন সাধ্যও ছিল না | সেই জন্য ৮ ই জানুয়ারী রাত্তির জেগে জেগে ওই কবিতাটা লিখেছিলুম , তক্ষুনি কপি করে একপাতা চকোলেটের সঙ্গে লুকিয়ে রেখেছিলাম তোর বালিশের তলায় | তখনকার তুই ওই কবিতা আর চকোলেট পেয়ে যত অবাক আর খুশি হয়েছিলি তা ভাবলে মনে হয় আমার আর কোনো কবিতার ভাগ্যে ও রকম অভ্যর্থনা জোটেনি |"
    " ইন্ডিয়ানাতে পড়াবার জন্য ভার্জিল পড়ছি | বেশ লাগছে এবং বহু প্রশ্নের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছি | হোমর , মহাভারত, রামায়ণ , রঘুবংশ ..এগুলোও আবার পড়ে নেব ভাবছি | অভাব আমার সময়ের | কিন্তু কে জানে , এ সব পড়া আমার নিজের কোনো কাজে লেগে যেতে পারে কোনদিন |"

    কাজে লেগেছিল | প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিকড় সন্ধান করতে তিনি যে ব্যাপক পড়াশুনো করেছিলেন , তারই ফল "মহাভারতের কথা "|
    এরপর কিছু ছেদ পড়েছে পত্রবিনিময়ে | কারণ বু.ব সপরিবারে আমেরিকায় | ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে | রোজই প্রায় দেখা হত | এইরকম সময়ে রুমির বিবাহ | এবং ধীরে ধীরে তাতে ভাঙনকাল | রুমি বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে বিশদ হননি পরবর্তী ১৭ বছর | সন্তান এসেছে দু'টি , সমস্যাও জটিল হয়েছে | একা হাতে সংসার , সন্তান , বিদেশে পড়াশুনো , অশান্তির চোরা স্রোত ..পরিস্থিতি বড় সহজ ছিল না | বুদ্ধদেব বুঝতেন | আলো দেখাতেন সুকৌশলে | তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন | এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্মান করতেন | মেয়ের ভঙ্গুর দাম্পত্যে নাক গলাতেন না | বারবার বলতেন , থিসিস শেষ করে পড়াশুনো নিয়ে থাকতে | কারণ প্রথমত স্বনির্ভর্শীলতা , দ্বিতীয়ত নিত্য নৈমিত্তিক মালিন্য যেখানে, সেখানে একমাত্র বাগ্দেবী ব্যতীত কে বা শেষ আশ্রয় হয়ে থাকতে পারে ! যত চিঠি লিখেছেন , সব ক'টিতে থিসিসের জন্য নির্দেশ , বইপত্র পাঠানোর কথা , অন্তহীন সাহস যুগিয়ে যাওয়া আর কালো ছাপিয়ে আলোর গান | আর একটি কথা শব্দহীন মাধুর্যে উচ্চারিত হয়ে যায় , "আমরা আছি | রুমি , তোর সঙ্গেই আছি | সম্পদে ও বিপদে |" কী অনায়াস দক্ষতায় পিতা ও শিক্ষক ..এই দুই ভূমিকায় বুদ্ধদেবের অনায়াস বিচরণ !
    রুমির প্রথম সন্তান জন্মাবার পর বুদ্ধদেবের লেখা পড়ে চমকে গেছি |
    " মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্বন্ধ চিরকাল রহস্য থেকে গেল | হয়ত এই জন্যেই পুরুষ রচিত শিল্পকলায় এর প্রকাশ এত বেশি | কল্পনা বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছয় ; কিন্তু মা হতে ঠিক কেমন লাগে , পুরুষের পক্ষে তা বোঝা অসম্ভব |"

    ৩৫ নং চিঠিতে বুদ্ধদেব আত্ম সমালোচক |
    " বয়স বাড়তে বাড়তে আমি যে কী পরিমাণ বদলে গেছি , তা লক্ষ্য করে নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই | আমার মনোমতো তীক্ষ্ণ কথাবার্তা না পেলেও মানুষে ভালত্বের আমি মূল্য না দিয়ে পারি না আজকাল |"

    এলিয়টের মৃত্যুসংবাদ শুনে আমেরিকার খবরের কাগজে তেমন কিছু না দেখে এবং নিউজ উইকের মলাটে নয়, পেছনের দিকে কোনক্রমে চার কলম লেখা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব | সেই ক্ষোভে লিখেছিলেন , " এর চেয়ে অনেক বেশি লেখা দেশ , আনন্দবাজারে নিশ্চয়ই বেরিয়েছে | অনুন্নত দেশ হবার সুবিধেও আছে কতগুলো ... অত্যন্ত বেশি খেয়ে পড়ে অত্যন্ত বেশি সুখে থাকলে মনে কতগুলো বৃত্তি মরে যায় |"

    যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগটি বুদ্ধদেবের মানস সন্তান | সেখান থেকে পদত্যাগ করার পর যখন লেখেন , " পুনশ্চ চাকরি করার ইচ্ছা আমার শূন্য থেকে শূন্যতরতে ঠেকছে | যে যাদবপুরকে এত ভালোবেসেছিলাম , তার কথা ভাবতে এখন বিবমিষা হয় আমার ..." সে অস্ফুট অভিমান আমাদেরও বেদনার্ত করে |

    একের পর এক চিঠিতে রুমির থিসিস নিয়ে দুর্ভাবনা কাজ করে গেছে | পিতার ও শিক্ষাগুরুর | লিখছেন , " আমার সাহায্য সব সময়েই পাবি | আমার সামান্য যা পুঁজি সবই তোকে দিয়েছি |"

    যাদবপুরের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন | অনিয়মিত আয় | চিঠিতে লেখেন , " সকলে যেন ভালো থাকে এবং আমার স্বাস্থ্য যেন চলনসই থাকে | শরীর যদি ভেঙে না পড়ে , তাহ'লে হয়ত হেরে যাব না ! "
    কত কাজ যে বাকি থেকে গিয়েছিল !
    ২০/৯/৬৫ | চীন -ভারত যুদ্ধ |
    " এ লড়াই ডেমোক্রেসির সঙ্গে ডিকটেটরশিপের , ধর্মীয় ও মানবিক স্বাধীনতার সঙ্গে ধর্মান্ধতার | এটি স্বাধীন ভারতের বিরাট পরীক্ষা | এতে কষ্টের অংশ যতই বড় হোক , আমাদের চরিত্র প্রমাণ করার সুযোগও এটা | তবে রুমি , ভুলে যাস না যে মানুষ মানুষই | কখনোই কোনো ব্যক্তির অন্যায় তার জাতির ওপর আরোপ করিস না |"

    আমরা , সত্যি , এই আলোককণাটুকু এতদিনেও নিজেদের চেতনায় বহন করে চলতে শিখিনি ! সাম্প্রদায়িকতা এখন ফায়দা তোলার রাজনীতির তুরুপের তাস | আর তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার খাতিরে ইচ্ছাকৃতভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে সেই একই অন্ধকারে | আমরা জাতি ধর্মের উর্ধ্বে ব্যক্তিকে বসাতে অনিচ্ছুক |
    রুমির ২৬ বছর পূর্ণ হবার ঠিক আগে তিনি লিখছেন , " সেই ঝাঁকড়া চুল , পড়তে না চাওয়া , খেলায় মেতে থাকা রুমি , যাকে ভালো করার চেষ্টায় তার বাবা মা অনেক গল্প কবিতা লিখেছেন , তারও যদি এখন ছাব্বিশ বছর বয়স হয় , তাহলে তো আমার নিজের বয়সের সীমাসংখ্যা নেই ! অথচ তেমন প্রাচীন বলে তো মনে হচ্ছে না নিজেকে |"

    রুমি খুব স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন , বুদ্ধদেবের স্বভাবের সেরা দিকটি ছিল সবাইকে বিকশিত হতে উৎসাহিত করা |
    " যার মধ্যে যেটুকু গুণপনা আছে (সেটা যতই ছোট হোক ) তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার না করাটা অন্যায় , এটা আমি ধর্মের মতো বিশ্বাস করি |"
    যে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন বুদ্ধদেব |
    " Messogis , Messis ..এই দুটো শব্দ বিষয়ে ব্রিটানিকায় কী লেখা আছে আমাকে কপি করে পাঠাস | দুটোই পুরাকালীন ভৌগলিক নাম , এশিয়া মাইনরের কোনো পাহাড় বা শহর |আমার কাছে যে সব বই আছে, তাতে Messogis কোথাও পেলুম না , Messis পাওয়া গেল (শহর ) ..এ দুটো এক কিনা , তাই নিয়েও ধাঁধা লাগছে | আমি হ্যেলডার্লিনের একটা কবিতা অনুবাদ করছি , তাতে এই নামগুলো আছে ... টীকা লিখতে হবে , তাই জানা দরকার |"
    বুদ্ধদেব বিশ্বাস করতেন , গীতার নিষ্কাম কর্মে | বলতেন , কত মানুষ তার মেধা নিষ্ঠা বা পরিশ্রমের কোনো স্বীকৃতি পায় না | সন্তানও বড় হয়ে দূরে চলে যায় | এ সবই নিষ্কাম কর্মের উদাহরণ | কিন্তু গীতা নিষ্ক্রিয়তা সমর্থন করে না | সে প্রত্যেক মানুষকে তার গুণ অনুসারে কর্মিষ্ঠ ও বিকশিত হতে বলে | তাই জীব সার্থক হয় ত্যাগে নয়, স্বধর্মপালনে ; অর্থাৎ আত্মপ্রতিষ্ঠায় |

    বুদ্ধদেব ছেলেমেয়েদের জন্য সেই অর্থে কেরিয়ার চাননি , চেয়েছিলেন " বৃহৎ জগতের সংস্পর্শ " | আলোকময় জীবনে উত্তরণ | যা আসবে সৃজনশীলতা ও স্বনির্ভরতার হাত ধরে |
    ২৭/১/৬৯ সালের চিঠির অংশ :
    " স্ত্রী পুরুষ প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র সত্তা বিকশিত হোক , যার যেটুকু যোগ্যতা তা যেন সে ফুটিয়ে তুলতে পারে --এই আদর্শের প্ররোচনায় তোকে অনেক কথা বলে থাকি ; কিন্তু আমি তো স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক পুরুষ , তাই ভুলে যাই প্রকৃতির নিয়মেই মেয়েরা কত অধীন , কত বন্দী | আমি তর্কস্থলে তোর কথা মানি যে উচ্চশিক্ষিত না হলেই মেয়েদের জীবনে ব্যর্থতাবোধ কমে যায় ; কিন্তু তবু একথা ভাবতে আমার অহমিকায় যেন আঘাত লাগে যে আমরা কেউ দু:খের ভয়ে বৃহৎ জগতের সম্পর্ক এড়িয়ে চলেছি |"
    তিনি লিখেছেন , কত সময়ে এক অপার শূন্যতাবোধ তাঁকে গ্রাস করেছে | কিছুই ভাবা হচ্ছে না | শব্দরা অধরা রয়ে গেছে | তবু..মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে শব্দ আর বাক্যের খেলা খেলে যেতে হয় | সে কি কম যন্ত্রণার ? কিন্তু কেন ?
    " প্রথমত স্থূল খাওয়া পরার তাগিদে , দ্বিতীয়ত (সেটাও কম জরুরি নয় ) সময় কাটানোর জন্য | কিন্তু এই কষ্টও আমাকে এক ধরনের সুখ দেয় , আর সেই সুখানুভূতি থেকেই কিছুক্ষণ পরে মনটা বেশ তেতে ওঠে যেন | সেই গরম অবস্থারই অন্য নাম বোধহয় প্রেরণা | ধৈর্যই সব | অথবা বাধ্যতা |"

    বারবার রুমিকে পড়াশুনো নিয়ে বলেছেন তিনি | পিতা নয় , শিক্ষকও নয় | এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা দীক্ষাগুরুর | প্রকৃত অর্থে আলোকজ্জ্বল জীবনে সন্তানকে দীক্ষিত করা |
    " যে কোনো সৃষ্টিশীল শ্রমের মতো (হোক তা কৃষি বা মেয়েদের গৃহকর্ম বা গবেষণা বা কবিতা লেখা ) সুন্দর ও উজ্জীবক ও স্বাস্থ্যকর আর কিছু নেই | আমার বইয়ের বিক্রি নেই , তাতে আমার আর্থিক অনটন ঘটে , মনও বিষণ্ন হয় মাঝেমাঝে -- কিন্তু লেখার মধ্য দিয়ে আমি আমার নিজের ও জগতের যে আস্বাদ পাই , তা তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না !"

    পুত্রের বিবাহের পর ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী বুদ্ধদেব রুমিকে লিখেছিলেন ,
    " প্রবীণ ও নবীন বসু দম্পতি যেখানে চলনসই আরামে পরস্পরের অত্যধিক সংসর্গ এড়িয়ে বাস করতে পারে এমন বাড়ি -র " আকাশচুম্বী ভাড়া ও সে বিষয়ে নিজেদের আর্থিক অপারগতার কথা | কোনও দিন তিনি চাননি , পুত্রের জীবিকার মুখাপেক্ষী জীবন হোক তাঁদের | বরং ভাবনা ছিল কোনো স্বল্পমেয়াদী বৃত্তি থেকে নিয়মিত কিছু সঞ্চয়ের , যাতে " পরবর্তী কৃশ দিনগুলিতে রসদ জোটাতে পারি |"

    মানুষটির প্রাণ হল বই | কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ নেই | এ যে কী কষ্ট ! তিনি তাই রুমিকে লিখেছেন , " প্রতি মাসে টাকা পেয়ে কিছু বই কিনবি ..এটা একটা নিয়ম করে নে |"

    আবার মেয়ে টাকা পাঠাতে চাইলে তখন নিজের একমাত্র ভালোবাসাকে খানিক দূরে থেকে রেখে বলছেন , "তুই আমাকে বই কেনার জন্য হাজার টাকা দিতে চাচ্ছিস , তাতে আমি চমৎকৃত | ঠিক যেন তেষ্টার সময়ে ঠান্ডা জল নিজে নিজেই এগিয়ে এল | মহাভারতের জন্য অনেক বই আমার দরকার | এই সংকটের মধ্যেও কিছু কিছু কিনছি | আড়াইশ' টাকা দামে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড জাতকের সেট কিনলাম সেদিন | আরও কিনতে হবে | তাই বলে আমি তোর সব টাকা চাই না | অর্ধেক পেলেই খুশি |"

    আমি ভাবছিলাম, কী ভীষণ অভিমানে আর দু:খে এক একটা করে দিন কেটেছে | যখন স্ত্রী শয্যাশায়ী , আর্থিক অপ্রতুলতা , আয় অনিয়মিত ... | এই বহুমুখী প্রতিভাবান ( নাকি মনীষা শব্দটি উপযোগী ; কারণ অন্তর্নিহিত অর্থে প্রতিভা উজ্জ্বল ..কিন্তু মনীষা উজ্জ্বলতর ) মানুষটি সমালোচিত হয়েছেন পত্রপত্রিকায় ..তীব্র অসূয়ার শিকার হয়েছেন | তাঁর প্রাণভ্রমর যে কুঠুরিতে বন্দী ; যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ..সেখান থেকে বিনা দোষে নির্বাসিত হয়েছেন | কিন্তু কোনো চিঠিতে এর বিরুদ্ধে কারো বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার নেই | এ সব ব্যক্তিগত চিঠি | লিখতেই পারতেন অনেক কিছু | তিনি তো জানতেনও না .. এই চিঠি অগণিত পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে....কিন্তু কোথাও কোনো বিরূপতা নেই | দু:খ আছে , ক্ষোভ -অভিমান আছে ..কিন্তু বৈরিতা নেই | কারণ প্রকৃত মনীষা মানুষকে অন্ধকার পেরিয়ে আলোয় নিয়ে যায় | বুদ্ধদেব নিজে সেই আলোয় পৌঁছেছেন এবং তাঁর কন্যাকেও সেই আলো দেখিয়েছেন প্রতিটি চিঠির প্রতিটি ছত্রে | তিনি একটি বড় মূল্যবান কথা বলেছেন ১৫৮ নং পত্রে :
    " বিবিক্ত হতে না পারলে নিজের ভিতরকার শক্তির সন্ধান পাওয়া যায় না | একা থাকা , একা বসে ভাবা , কোনো একটা দাবিদার কাজে লিপ্ত হয়ে থাকা --এ সব যার ভাগ্যে ঘটেনি , সে জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ জানে না | "
    রুমির কথা দিয়ে শেষ করি |

    " আমার বাবা বুদ্ধদেব বসু অথবা আমি বুদ্ধদেব বসুর কন্যা ..এ নেহাত দৈব সংযোগ ; পড়ে -পাওয়া ভাগ্য | না তিনি আমাকে বেছেছিলেন , না আমি তাঁকে | আমি তাঁর আত্মজা | জন্ম থেকে অচেতনভাবে আহরণ ও আত্মস্থ করেছিলাম তাঁর মূল্যবোধ , কলেজ জীবনে পৌঁছে পেয়েছিলাম এক আদর্শ গুরুকে যাঁর উদাহরণ আমার পরিণত জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ | তিনি আমার পিতা , তিনিই আচার্য | তিনি আমার হৃদয়ে স্থিত আরাধ্য দেবতা | "

    পিতা সন্তানের কাছে চিরকালই রোল মডেল | তাঁর হাত ধরে বহির্জগতে পা ফেলা | টাল সামলাতে না পারলে সেই হাত ধরেই উঠে দাঁড়ানো | এ কোনো নতুন কথা নয় | কিন্তু বুদ্ধদেব বসু সেই বিরলতম ব্যক্তিত্ব যিনি একই সঙ্গে সন্তানের শিক্ষাগুরু ও দীক্ষাগুরু | এই সৌভাগ্য সব সন্তানের হয় না | তাই রুমিই অক্লেশে সোচ্চারে ঘোষণা করতে পারেন ,

    " আমার জীবনে একাধারে তিনিই আকাশ , তিনিই নীড় |"
  • kumu | 132.161.64.9 | ২৬ জুন ২০১৪ ২৩:৩২640708
  • ঈশানী আপনাকে ধন্যবাদ।একই অনুভূতি হয়েছিল আমারো।
  • byaang | 37.57.136.169 | ২৭ জুন ২০১৪ ০৮:১৬640719
  • বাঃ ঈশানী! খুব সুন্দর লেখা। খুব ভালো লাগল পড়তে।
  • Abhyu | 81.12.53.79 | ২৭ জুন ২০১৪ ০৯:০৬640730
  • খুব ভালো টই। অনেক ধন্যবাদ।
  • nina | 78.37.233.36 | ২৭ জুন ২০১৪ ০৯:১১640735
  • আগেও পড়েছি--আবার পড়লাম--এমন লেখা বারবার পড়ার মতন-----
  • san | 113.245.14.209 | ২৭ জুন ২০১৪ ০৯:৫১640736
  • খুবই ভালো লাগল।
  • Ishani | 69.92.177.211 | ২৭ জুন ২০১৪ ১১:০৪640737
  • নারী তো কখনো কন্যা , কখনো প্রেমিকা, তারপর জায়া ও জননী | আমি এখন এক জননীর দিনলিপিতে মগ্ন হয়ে আছি | বিবশ | বিস্ময়ে আর ব্যথায় | এ এক এমন বিষয় , যা আমাদের কাছে নতুন নয় | আমাদের দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ , নকশালবাড়ি .. অনেক কিছু লেখা হয়ে গেছে | সংগ্রামের কথা , অত্যাচারের কথা , নির্বিচারে হত্যা ...সব কিছু | কিছু লিখেছেন প্রত্যক্ষ সংগ্রামী যাঁরা , কিছু বা উঠে এসেছে গবেষকদের কলমে | কিন্তু কোনো জননীর প্রতি মুহূর্তের যন্ত্রণার যুদ্ধের রোজনামচা আমি অন্তত পড়িনি | তাই এই লেখা , এই ভাগ করে নেওয়া | সকলের সঙ্গে | তাই এই "অন্ধকারের আলো"|

    অন্ধকারের আলো
    ..............................

    একটি রোজনামচা | একাত্তরের দিনগুলি | জাহানারা ইমাম | শহীদ জননী |
    এক বাংলাদেশী বন্ধু আমার হাতে এই বইটি তুলে দিয়ে বলেছিলেন , " বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে এই বইটি আলো ছড়ায় |"

    জাহানারা ইমাম | আয়ুষ্কাল ৩.৫.১৯২৯ - ২৬. ৬ .১৯৯৪ | মানুষ সত্যিসত্যি কতদিন বাঁচে ? যতদিন সে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় নাকি যতদিন সে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যটা নিজে নিজের কাছে প্রমাণ করতে পারে ? জাহানারা পেরেছিলেন | ৬৫ বছর ধরে প্রতিদিন | একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ | অস্পষ্ট অন্ধকারের জঠর থেকে জন্ম নেওয়া আলোর রেখা | গোঁড়ামির আবিল আবর্ত থেকে উঠে আসা প্রতিবাদের আগুন | জাহানারার প্রতিদিনের চিন্তায় , প্রতিদিনের ডায়েরির পাতায় | ১লা মার্চ থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাকে চিনিয়ে দিচ্ছে জানিয়ে দিচ্ছে ঠিক কেমন ছিল সেদিনের বাংলাদেশ |

    ১লা মার্চ থেকে এই রোজনামচার শুরু | এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম | এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম | রুমী বলেছিল , " ঘটনার একটা নিজস্ব গতি আছে | জলপ্রপাতের মতো | উঁচু পাহাড় থেকে যখন গড়িয়ে পড়ে , তখন তাকে রুখতে পারে এমন কোনো শক্তি নেই | আমাদের দেশের জনতা এখন ওই জলপ্রপাতের মতো একটা অনিবার্য পরিণতির দিকে অত্যন্ত তীব্রবেগে ছুটে যাচ্ছে | একে আর বোধ হয় রক্ষা যাবে না |"

    যায়ওনি | জনতা একের পর এক কারফিউ লঙ্ঘন করছে , মিটিং মিছিল , আকাশ ফাটানো স্লোগান , এবং গুলি খেয়ে কালো পিচের রাস্তা রং বদল করে রাঙা | তাই রুমী বাইরে গেলেই " আমার প্রাণটা যেন হাতে কাঁপতে থাকে |জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে একটা গুলির ব্যবধান মাত্র , কখন আচমকা কোনদিক থেকে তীক্ষ্ণ শিস ছুটে আসে , কে বলতে পারে !"

    শেখ মুজিবর রহমানের সেই নির্বাচনী পোস্টার খুঁজে পেলে বোঝা যেত , প্রমাণ করে দেওয়া যেত চাল, আটা , নুন , কাগজ , সোনা থেকে শুরু করে সব খাতে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শুষে ছিবড়ে করে দিয়েছিল | সেই ইস্তাহার ছিল "সোনার বাংলা শ্মশান কেন "| তাতে পাই পয়সা ধরে লেখা ছিল বৈষম্য আর শোষণের সমস্ত তথ্য |

    জাহানারার মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দ্বন্দ্ব | ছেলে কি শুধু মায়ের ? দেশের নয় ? " আমি কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম | সারা দেশ স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল | শান্তিপ্রিয় বাঙালিরা আজ মরিয়া হয়ে লাঠি , সড়কি যা পাচ্ছে , তাই হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে গুলির সামনে | ঘরে ঘরে নিজের হাতে বোমা, পটকা , মলোটভ ককটেল বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর | এই রকম সময়ে আমার ছেলেকে আমি কি চাইব ঘরে আটকে রাখতে ? আমি কি চাইব সে শুধু বন্ধুবান্ধব নিয়ে জাঁকিয়ে বসে স্বাধীনতার দাবিদাওয়ার প্রশ্নে তর্কবিতর্ক , চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে মত্ত থাকুক ?"

    এর পাশাপাশি অজিত নিয়োগী | জ্যোতিষশাস্ত্রজ্ঞ | তাঁকে জিজ্ঞাসাও তো করতে হয় , " আমার কপালে পুত্রশোক আছে কিনা তাই বলুন | ওটা থাকলে লখিন্দরের লোহার ঘর বানিয়েও লাভ নেই |"

    "এক একটি বাংলা অক্ষর এক একটি বাঙালির জীবন |" " একতারা তুই দেশের কথা বল রে আমায় বল .."
    এই সব কথা , এই সব গান নিরীহ মানুষের বুঝে ঝড় তুলে দেয় | রক্ত ছলকে ওঠে বুকে | সুকান্তর কবিতার ওপর অনুষ্ঠান হয় | ছাড়পত্র | দেশলাই | অসংখ্য দেশলাই কাঠি একটার পর একটা জ্বলে ওঠে | একটা থেকে আর একটা , তার থেকে আর একটা | গুনতে গিয়ে গুলিয়ে যায় | চোখে শুধু মশাল জ্বলে |

    এপ্রিল মাস | " ইসলামের নামে ওরা যা করছে , তাতে খোদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠছে | খোদার ঘর মসজিদে ঢুকে কোরান তেলওয়াতরত মানুষ খুন ! মায়ের সামনে ছোট বাচ্চাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে | বয়:প্রাপ্ত ছেলের সামনে মাকে বেইজ্জত করেছে |"

    মে মাস | " কাছেই বোমা পড়েছে , বিকট শব্দ , লোকজনের চিত্কার শুনেছি , আগুন দেখেছি | আর তখুনি একবস্ত্রে পালিয়েছি পাশের এক গ্রামে | কিন্তু সেখানে এক রাত থাকার পরই শুনলাম মিলিটারি আসছে | যাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলাম , তারাশুদ্ধু পালালাম | দু'দিন পর ফিরে এসে দেখি -- পুরো গ্রাম আগুনে পুড়ে ছাই |"

    সব ছবি সাদা-কালো | তাতে এলোমেলো রক্তের ছিটে |

    রুমী চলে গেল | ৬ই মে | মুক্তিযুদ্ধে | দুটো বই ছিল সঙ্গে | সুকান্ত সমগ্র আর জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা | আর জাহানারা ?

    " একটা লোহার সাঁড়াশি যেন পাঁজরের দুই পাশ চেপে ধরে আছে | মাঝেমাঝে নি:শ্বাস আটকে আসে | মাঝেমাঝে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে | মাঝেমাঝে সব কাজ ফেলে ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে | কিন্তু মাছের মাকে নাকি শোক করতে নেই | চোরের মাকে নাকি ডাগর গলায় কথা বলতে হয় |”

    ৩রা মে | টাইম ম্যাগাজিন | ড্যান কগিনের প্রবন্ধের শিরোনাম " ঢাকা , সিটি অফ দ্য ডেড |"

    যুদ্ধ জারি থাকুক | পূর্ণমাত্রায় | দাউদকান্দিতে নদী পেরিয়ে নগরদা বলে একটা জায়গা | ক্যাম্প সেখানে | কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের এক অধ্যাপকের নেতৃত্বে | প্রতিদিন নতুন নতুন ছেলে জমা হচ্ছে | অধ্যাপক তাদের রিক্রুট করে বাছাই করে কোম্পানি গঠন করে তারপর প্লাটুনে ভাগ করে দিচ্ছেন | একজন ল্যান্স নায়েক ছেলেদের ট্রেনিং দেন |

    জুলাই | " বিকেলবেলা জিন্না এভিনিউতে গিয়েছিলাম একটা কাজে | গ্যানিজের দোকানটা আছে না ? ঐখানে কয়েকজন বিচ্ছু গুলি আর গ্রেনেড ছুঁড়ে কয়েকজন পুলিশ মেরে দিয়ে চলে গেল | উ: , কী সাহস ছেলেগুলোর ! একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে..."

    আর কীই বা আছে ! সাহসটুকু ছাড়া ? যে সাহস অবিরতই প্রেরণা যুগিয়ে যায়..বাঁচার অর্থ খুঁজে নেবার |

    এপ্রিলের রাজশাহী | টাউনের চোদ্দ আনা লোক পলাতক | বাকি দু'আনা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে মৃতপ্রায় | রাজশাহী টাউন শ্মশান হয়ে গেছে | পাক সেনা দুপাশের সব কিছু জ্বালাতে জ্বালাতে শহরে ঢুকেছিল | ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদে আকাশ লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিল কি , মেঘের আড়ালে ? কেউ রেহাই পায়নি সেদিন | বয়স নির্বিশেষে | এক ডাক্তার বলেছিলেন , " যদি এই খানসেনারা ধ্বংস না হয় , তাহলে আল্লার অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমাকে নতুন করে ভাবতে হবে |"

    ১লা অগাস্ট | জাহানারা লিখছেন , " তিনজন মার্কিন নভোচারী এপোলো -১৯ নভোযানে চড়ে কোটি কোটি মাইল মহাশূন্যে পাড়ি দিয়ে চাঁদের পিঠে নেমে আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে | আহা, আমি যদি কোনরকম একটা টুটাফুটা আকাশযান পেতাম , যেটায় চড়ে মাত্র কয়েকশ' মাইল দূরে মেলাঘর বলে একটা জায়গায় নেমে মাত্র একপলকের জন্য আমার রুমীকে চোখের দেখা দেখে আসতে পারতাম ! রুমী গেছে আজ আটচল্লিশ দিন হল | মনে হচ্ছে আটচল্লিশ মাস দেখিনি | এক এক সময় মনে হয় রুমী বলে কেউ কি আছে ? রুমী বলে কেউ কি ছিল কোনকালে ? নাকি রুমী একটা অলীক মায়া ?"

    মেলাঘরে সে মেলা ভিড় | ঢাকার যত কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা , ধানমন্ডি -গুলশনের বড়লোক বাপের গাড়ি হাঁকানো ছেলেরা , খেলার মাঠের চৌকস ছেলেরা , ছাপোষা চাকুরে বাপের ছেলেরা ..সব্বাই সেখানে গেছে | যুদ্ধ করতে | ওখানে গেলে নাকি সিগারেট না ধরে উপায় নেই ! কারণ খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই তো ; সিগারেট ভরসা | খিদে ভুলিয়ে রাখার | আর খাবার ? ভাত আর ঘোড়ার ডাল | মানে সাধারণভাবে ঘোড়ার খাবার | রুটির মধ্যে সেঁকা পোকা | কিছু ব্যাপার না | সেঁকা পোকাটা খুঁটে ফেলে দিয়ে রুটি খেয়ে নাও | আবার কখন কী জুটবে কে জানে |

    গেরিলা নিয়ে লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা এরপর |

    " দেখতে কেমন তুমি ? অনেকেই প্রশ্ন করে , খোঁজে
    কুলুজি তোমার আতিপাতি ! তোমার সন্ধানে ঘোরে
    ঝানু গুপ্তচর , সৈন্য , পাড়ায় পাড়ায় | তন্ন তন্ন
    করে খোঁজে প্রতি ঘর |
    পারলে নীলিমা চিরে বের
    করত তোমাকে ওরা , দিত ডুব গহন পাতালে |
    তুমি আর ভবিষ্যত যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর |
    সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি , দু:খ-তাড়ানিয়া
    তুমি তো আমার ভাই , হে নতুন সন্তান আমার |"

    যখন খুব বৃষ্টি নামে , মেলাঘরেও কি বৃষ্টি খুব ? খোলা আকাশের নীচে ঘাসজমিনে শুয়ে কেটে যায় রাতের পর রাত | ভাত খাওয়া মাটির সানকিতে , গ্রেনেডের খালি বাক্স কেটে | ভারতীয় সেনানায়ক বাসনের ব্যবস্থা করতে চাইলে ওরা বলেছিল , তার বদলে বুলেট চাই | নুন ছাড়া তরকারী... দিনের পর দিন | অনেকদিন বাদে নুন জুটলে সেদিন খাবার কম পড়ে যায় |

    শাবাশ বাংলাদেশ , এ পৃথিবী
    অবাক তাকিয়ে রয় !
    জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
    তবু মাথা নোয়াবার নয় |

    রুমী বলেছিল , "কোনো স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না | চায় রক্তস্নাত শহীদ | আমরা সবাই শহীদ হয়ে যাব -- এই কথা ভেবে মনকে তৈরী করেই এসেছি | এ অনেকটা বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মতো | হয়ত জীবনের পুরোটা তোমাদের মতো জানি না , ভোগও করিনি , কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য-তিক্ততা-বিষ --সবকিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যেই পেয়েছি | যদি চলেও যাই , কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না |"

    ২৯শে অগাস্ট | বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল রুমীকে | সঙ্গে জামী আর ওদের বাবা শরীফ | কিছুই নাকি না ! নিয়মমাফিক জিজ্ঞাসাবাদ | রাতভ'র ফেরেনি ওরা | রুমীকে বাইরে নিয়ে গিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছিল অন্য একটা জীপগাড়িতে | বাকিরা আলাদা | রুমীর কী হয়েছিল ?

    ৩১শে অগাস্ট | মঙ্গলবার | শরীফ , জামীর মুক্তি হল | ফিরল না শুধু রুমী | জামী বলেছিল , " ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চের পর পাঁচ মাসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পাঁচশ' বছর এগিয়ে গেছে | ওদের কীর্তিকলাপ শুনলে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীও মাথা নত করবে | তার প্রমাণ আমরা এই দু'দিনে দু'রাতে দেখে এসেছি | আমরা সশরীরে সজ্ঞানে হাবিয়া দোজখ ঘুরে এসেছি |"

    সেপ্টেম্বর | কিছুতেই মার্সি পিটিশন নয় | যে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রুমীর মুক্তিযুদ্ধ , তার কাছে মার্সি পিটিশন করলে রুমী তার মা বাবাকে ক্ষমা করবে না | খুনী সরকারের কাছে প্রাণভিক্ষা মানে আদর্শের অপমান |

    বন্দীরা সব খেলনা | বুকে ঘুষি , পেতে লাঠি , আচমকা ঘাড়ে রদ্দা , চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে এল , রাইফেলের বাঁট দিয়ে অকথ্য মার , বুট দিয়ে কনুই , কব্জি আর হাঁটুর জোড় খুবসে থেঁতলে দাও ! কয়েক মিনিট বিরতি | আবার শুরু | অজ্ঞান হয়ে গেছে ? তাহলে তো খেলার মজাটাই মাটি | জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনো | দেখো , এমনভাবে মেরো না , যাতে বন্দী হঠাত করে মরে যায় | হাড় ভেঙে চুরচুর করে দাও , নাকমুখ দিয়ে রক্তের ঢল , চোখ উপড়ে নাও..কিন্তু প্রাণটুকু ধুকপুক করুক | তবেই না মজা ! হাড় ভেঙেছে এমনভাবে যে নড়বড় করছে, ঝুলছে অসহায়ভাবে , চোখ গলে বেরিয়ে এসেছে গালের ওপর , জখম আঙুল মুচড়ে পাটকাঠি | বন্দীর পা দুটো সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে জোরে পাখা চালিয়ে দিলে হয় না ? নীচের দিকে মাথা | নাকে চোখে মুখে ছিটকে যায় , ভলকে ভলকে ওঠে তাজা রক্ত | কিন্তু স্বীকারোক্তি আদায় কি অতই সহজ ? কেউ কেউ ফেরে | বেশিরভাগই ফেরে না | রুমীও না |

    ২রা সেপ্টেম্বর | আজ জামীর জন্মদিন | বাগান আলো করে ফুটে ছিল বনি প্রিন্স | রুমী তার আম্মীকে জন্মদিনে দিয়েছিল না , একটি আধফোটা বনি প্রিন্সের কলি ? রুমী নেই | কিন্তু নির্লজ্জের মতো বাগান আলো করে ফুটে থাকে গোলাপ | রুমী নেই | জামী তো আছে | জাহানারার আর একটি বনি প্রিন্স | যে ফেরেনি , তার কথা ভেবে ভুলতে বসা কি ভালো যে আছে তাকে ? জামী সেতার বাজায় খোলা ছাদে | মুখটি নীচু | একা | " আমার চোখ ভ’রে পানি এল | ফুলটা আলতো করে জামীর গায়ে ছুঁইয়ে অস্ফুটে বললাম , মেনি মোর রিটার্নস |"

    জাহানারা জামীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন , রুমীর ওপর ঠিক কতখানি অত্যাচার হয়েছে | জামী বলেছিল তার মায়ের চোখে চোখ রেখে , " ভাইয়াকে আমরা শেষ দেখি ৩০ তারিখ দুপুরে | ভাইয়া বলেছে ও খুব টাফ | " রুমী তার মাকে বলেছিল , " যার ওপর টর্চার করা হয় , খানিকক্ষণ পরে সে কিন্তু আর কিছু ফীল করে না | যারা শোনে বা পড়ে , তারাই বেশি শিউরায় ভয় পায় |"

    রুমী নেই ? রুমী যে এই সেদিনই আবৃত্তি করছিল :

    " যা কিছু পেয়েছি , যাহা কিছু গেল চুকে ,
    চলিতে চলিতে পিছে যা রহিল পড়ে ,
    যে মণি দুলিল , যে ব্যথা বিঁধিল বুকে ,
    ছায়া হয়ে যাহা মিলায় দিগন্তরে ,
    জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা --
    ধূলায় তাদের যত হোক অবহেলা ,
    পূরণের পদ-পরশ তাদের 'পরে |"

    জাহানারা রুমীর ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকেন | কতদিন দেখা হয়নি ওই প্রিয় মুখটি ? রুমীরা থাকে না | যুদ্ধ জারী থাকে |

    "দু:খ যদি না পাবে তো
    দু:খ তোমার ঘুচবে কবে ?
    বিষকে বিষের দাহ দিয়ে
    দহন করে মারতে হবে | "

    হৃদয়কে পাথর করে রেখে তার নীচে তিরতির করে বয়ে যেতে দাও ব্যথার নদী | অনেক নীচে বিছিয়ে আছে অভিজ্ঞতার নুড়িপাথর | রাশিরাশি | মন শক্ত কর , রুমী-জামীর মা ... শোকবিহ্বল ফরিয়াদ নয় , তোমার বাগানের কালো গোলাপ বনি প্রিন্স..ঠিক তেমন করে পাপড়ি মেলুক তোমার রোজনামচার ব্যথার ফুলটি ... হৃদয়ের ফুল | স্বাধীনতা পেল বাংলাদেশ | তোমার নেতৃত্বে গড়ে উঠল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি | ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধা ছিল অসংখ্য, গ্রামে বা শহরে রাজাকারও তো কিছু কম ছিল না | তাদের চিনিয়ে দিতে হবে | কাজটা কঠিন | কিন্তু অসম্ভব নয় | রুমী নেই | রুমীর বাবা শরীফ যুদ্ধের ডামাডোলে চিকিত্সাবিভ্রাটে চলে গেছেন | কিন্তু তুমি আছ | সমাজ বদলাতেই হবে | আজ তোমার অজস্র সন্তান | যারা তোমার চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখে | আলোর স্বপ্ন | শুধু মা হলেই হয় না | মাকে স্বপ্ন চেনাতেও জানতে হয় | যে স্বপ্নের রং শুধু আত্মসুখের উগ্র রং নয় | যে রং চেতনার রং, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রং | খানিক পেরেছিলে, খানিক পেরে ওঠোনি | কর্কটরোগ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল খানসেনাদের মতো | কাঁকড়াবিছের কামড় | শরীরের যুদ্ধে হার হয়েছিল | মনের যুদ্ধে জিতে গেছ | তবে সে সব তো সবাই জানে | আমি আছি তোমার রোজনামচার পাতায় | যেখানে তুমি জননী থেকে শহীদ জননী হয়ে গেলে !
  • byaang | 132.167.79.119 | ২৭ জুন ২০১৪ ১১:১২640738
  • ঈশানী, অপূর্ব্ব বললে কম বলা হয়। এই লেখার প্রতিটা শব্দের রেণু মেখে নিলাম। জড়িয়ে থাকুক আমাকে।
  • সিকি | 135.19.34.86 | ২৭ জুন ২০১৪ ১১:১৫640739
  • অত্যন্ত ভালো লাগছে।
  • Ishani | 69.92.177.211 | ২৭ জুন ২০১৪ ১১:৩২640698
  • এই পাতায় দু'টি লেখা দেবার ইচ্ছে আছে | কোনো বিশেষ বই নিয়ে নয় | দু'জন মানুষের আবাস, লেখার প্রেক্ষাপট নিয়ে | সদ্য দেখে আসা | লেক ডিস্ট্রিক্ট -এ | উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং বিয়াট্রিক্স পটার | যদি আপনারা পড়তে ইচ্ছুক থাকেন |
  • byaang | 132.167.79.119 | ২৭ জুন ২০১৪ ১১:৩৫640699
  • প্লিজ লিখতে থাকুন ঈশানী।
  • Ishani | 69.92.177.211 | ২৭ জুন ২০১৪ ১১:৪৪640700
  • সোনালি ড্যাফোডিল
    ..........................

    রাণীর দেশ | গ্রীষ্মকাল | এ এক আজব দেশ , সত্যি ! আকাশের যখন মন ভালো , কেমন রোদ ঝিলমিল হাসি | আবার মেজাজ বিগড়ালে মুখখানি থমথমে, চোখে ডুবজল | তারপর কারণে অকারণে দু:খ পেড়ে আনল আঁকশি দিয়ে কোন মুল্লুক থেকে কে জানে ! ব্যস , ছটফটিয়ে ঝরঝরিয়ে কান্না | ঠিক মেয়েদের মনের মতো | হদিশ মেলা ভার | সেই ভয়ে এই ঋতুতে গাছ আর মাটি পশরা সাজিয়ে রাখে খুব | লাল নীল সবুজ হলুদ সাদা গোলাপী কমলা বেগুনী ...ফুল আর ফুল ! গাছ উপচে পড়ে , ঘাসজমিন ভেসে যায় | রঙিন গালিচা বিছিয়ে থাকে পীচের রাস্তা জুড়ে | রংবেরং লজেন্স আর ললিপপ কত ... আকাশের মনমর্জি শরীফ করতে | আর জল | অনেক জল | লেক ডিস্ট্রিক্ট | নীল জলে নীল ছায়া | এখানে তাই অসংখ্য রাজহাঁস তাদের অহঙ্কারী গ্রীবায় রোদ্দুরের রুপোর হাঁসুলি পরে ডানায় জলের মুক্তোবিন্দুর ঝালর দুলিয়ে ঝমরঝমর চলে | ধবধবে সাদা কবুতর নির্ভয়ে মখমলী সবুজ ঘাসের বীজ খুঁজে খুঁটে খুঁটে খায় ; তাদের পায়ে পরানো থাকে নীল সবুজ আংটি | উদাসীন অনাগ্রহে ঘুঘু পালকে ঠোঁট ডুবিয়ে ঝিমোয় গৃহস্থের বাগানে , চবুতরায় বা রংবেরং মরশুমী ফুলের আলপনা আঁকা কার্নিশে | এখানে রোম্যান্টিকতার সংজ্ঞা খুঁজতে অভিধান বা গুগুল সার্চ সময়ের অপব্যয় | এখানে শুধু শুষে নেওয়া | প্রকৃতির অকৃপণ দাক্ষিণ্য | স্বপ্ন চেনা, স্বপ্ন আঁকা | আর কবিতা | কবিতা স্বয়মাগতা | তাকে হাত ধরে আমাদের সামনে এনে অবগুন্ঠনটিকে অপসারণ করেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ ,শেলী , কোলরিজ , বায়রন , কীটস |প্রেমিকের মতন যত্নে এবং মায়ায় |

    লেক ডিস্ট্রিক্ট | অজস্র রোম্যান্টিক কবিতার জন্মভূমি | অসংখ্য কবির চারণভূমি | এখনও | এখনও ওয়ার্ডসওয়ার্থ ট্রাস্টের আনুকূল্যে কবিতার ওয়ার্কশপ হয় | দোকানে বিক্রি হয় স্ক্র্যাবলস -এর মতো দেখতে একরকম খেলনা..যা দিয়ে নিজের শব্দ সাজিয়ে কবিতা লেখার খেলা খেলতে শেখা যায় | এখনও ওয়ার্ডসওয়ার্থ ট্রাস্টের সংগ্রহশালায় নমুনা সাজানো থাকে টেবিলে..হাঁসের পালকের কলম..কীভাবে লিখতে হয় ...আনাড়ী আমরা সে যুগের কবিদের পাণ্ডুলিপি দেখে দেখে নকলনবিশী করার ব্যর্থ প্রয়াস করি |

    ডাভ কটেজ | এবং সংগ্রহশালা | লেক ডিস্ট্রিক্ট -এর গ্রাসমেয়ার -এ | যে ছোট্ট বাড়িটিতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ কাটিয়েছিলেন ৯ বছর | ১৭৯৯ থেকে ১৮০৮ | যে বাড়িটিতে এক সময় নিত্য আনাগোনা ছিল তত্কালীন শ্রেষ্ঠ কবিকুলের | যে বাড়িতে কবির সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা ছাড়াও বাস করেছিলেন সেই বিখ্যাত গ্রাসমেয়ার জার্নালের লেখিকা কবির বোন ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থ | এই জার্নালের কথা একটু বিশদে বলব , এবং ডরোথির ভাষা ধার করেই ... কারণ তা না হলে সেই সময়ের লেক ডিস্ট্রিক্টকে চেনা যাবে না |

    আমাদের আস্তানা ছিল লেক ডিস্ট্রিক্ট-এর অ্যাম্ব্লসাইডে | যেদিকেই চোখ ফেরাই , ৩৬০ ডিগ্রী জুড়েই ছবির মতো | রিসেপশনে এক ফুটফুটে মেমসাহেব | ক্যারল | তাকে জিজ্ঞেস করলাম , " ডাভ কটেজ কোনদিকে ? ওয়ার্ডসওয়ার্থ থাকতেন |" সে লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল , " আমি তো স্কট | ওনার লেখা পড়িনি | এখানেই থাকতেন বুঝি ? নাম শুনেছি ওই কবির |" আমি ওর মাথার ঠিক পেছনেই তাক জুড়ে সাজিয়ে রাখা নানান ফ্লায়ার থেকে ডাভ কটেজেরটা বের করে বললাম, " এই তো ! " সে বিধুমুখী মার্জারাক্ষী আরও লালিমারঞ্জিত হয়ে বলল , "কী কাণ্ড ! এ তো এখান থেকে হাঁটা পথ ! আমি জানতামই না |"

    তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি | এবং ফুরোনো বিকেল |এ বৃষ্টি অদ্ভূত | গায়ে লাগে , আবার লাগেও না | ভেজায় , আবার ভেজায়ও না | ঠিক করলাম , পরের দিন দুপুর গড়ালে যাব | সব কিছু আবার ছটা বাজলেই ঝাঁপ ফেলে দেয় | খাবার জায়গা ছাড়া | যদিও দিনের আলো থাকে রাত নটা পর্যন্ত !

    পরের দিন দুপুর দুটোয় ডাভ কটেজ | ছিমছাম সাদা বাড়ি | দোতলা | ফুলের ঝাড়ে ঢাকা | সঙ্গে সংগ্রহশালা | এবং দোকান | পাশে ক্যাফে | এখানেই প্রতি বছর নানা অনুষ্ঠান , ওয়ার্কশপ হয়..আগেই বলেছি | প্রবেশমূল্য বরাদ্দ আছে | রক্ষণাবেক্ষণ নিপাট , সুন্দর , ঈর্ষনীয় | গাইড আছেন দেখানোর জন্য | আগে একটু বাইরের কথায় আসি | ডরোথির জার্নাল থেকে | তাহলে বোঝা যাবে...সেই সময় ছবি কেমন ছিল | কারণ ভেতরে সবকিছু ঠিক আগের মতোই যে সাজিয়ে রাখা |

    ৬ই মে, ১৮০২
    " কী মিষ্টি এ সকাল | এখন বেলা একটা | আমরা বসে আছি ডাভ কটেজের বাগানে | আকন্ঠ এক অন্যরকম নির্জনতায় ডুব দিয়ে | দেওয়ালের গা ঘেঁষে একটি বসার জায়গা | ছায়া ছায়া , মায়াবী আলোয় ভরা | পাতার আড়ালে পাখিদের কাকলি | ভেড়াগুলো ডাকছে ..অনেকটা দূর থেকে | মুরগিগুলো এমন হট্টগোল করে ! কোকিল..কুহুকুহু | গাছ নুয়ে পড়েছে অজস্র ফুলের ভারে | মঞ্জরী এসেছে প্লাম আর ন্যাসপাতি গাছে | আপেল গাছের রং আবছা সবুজ | থমাসের কুঠার কী উদাসীন অনাগ্রহে উঠছে নামছে গাছের গুঁড়ি বেয়ে | পড়শিনীরা যে যার দরজায় ..অলস কথায় | পাখি আর ফুল | ফুল আর পাখি | ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে প্রিমরোজ গাছ | ভায়োলেটস , জেরানিয়াম আর প্যানজি ...দেওয়াল জুড়ে ! "

    আমরা যখন সেই দুপুরে .. ঠিক ২১২ বছর পর ... ছবি প্রায় এক | শুধু দুষ্টু মুরগিগুলো ছিল না | ছিল না থমাস | বাড়ির বাইরে |

    ভেতরে ঢুকে দেখতে গেলে টিকিট কাটতে হয় | ভারতীয় মুদ্রায় নেহাত কম নয় | ওই টাকায় রক্ষণাবেক্ষণ , ওয়ার্কশপ ইত্যাদি হয় | গাইড ছিলেন এক মহিলা | ওয়ার্ডসওয়ার্থ ট্রাস্টের | দোতলা বাড়িটি | একতলায় ঢুকেই একটি পার্লার | জানলা ঘেঁসে একটি ওক কাঠের চেয়ার | সামান্য আসবাব | ফুলতোলা কুশন | আমরা জানলার পাটাতনে বসলাম | চেয়ারটি স্বয়ং কবির | আর এই ঘরে আরও কতজন যে এসেছেন | ফায়ারপ্লেসের ওপরে একটি বাদামী রঙের সারমেয় | ছবিতে | আমাদের দিকে তাকিয়ে | ওর নাম পেপার | স্যার ওয়াল্টার স্কটের পুষ্যি | এবং উপহার ওয়ার্ডসওয়ার্থকে | পেপার আমৃত্যু এবাড়িতেই ছিল | একতলার ছাদগুলি নীচু | দেওয়াল বিবর্ণ হলুদ | রান্নাঘরে কয়লা ভাঙার হাতুড়ি | স্টোভ | তখন তো ফ্রিজ ছিল না | ডরোথির ভাঁড়ার ঘরটি কী আশ্চর্য ঠাণ্ডা | অদ্ভূত লাগছিল আমার | ঠিক যেন ন্যাচারাল ফ্রিজ | মাংস কাটার টেবিল | শস্যদানা রাখার চিনেমাটির বয়াম |

    মুখ হাত ধোয়ার দুটি বিচিত্রদর্শন বেসিন | সঙ্গে টানা ড্রয়ার দেওয়া | ভাই আর বোনের | পাশাপাশি | একটি চিনেমাটির আবছা হলদেটে পাত্রে দাঁতন রাখা | লালচে বাদামী কাঠের হাতল দেওয়া পাতলা বুরুশ | দেখতে অনেকটা আমাদের নিমের দাঁতনের মতো | আমি হাতে নিয়ে দেখলাম | কী যে যত্ন করে রেখেছে এরা | আর কী যে যত্ন করে দেখাচ্ছে ! ছাদ এত নীচু..তখন হয়ত তেমনই হত ! কী জানি কবির অসুবিধা হত কিনা | শুনলাম দৈর্ঘ্য ছিল ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি | এই বাড়িতেই কবির স্ত্রী হয়ে আসেন মেরি হাচিনসন | এই বাড়িতেই দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাটিয়েছেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং কোলরিজ | এই গ্রাসমেয়ারেই লেখা হয় কোলরিজের রাইম অফ অ্যান এনশেন্ট মেরিনার | এই ডাভ কটেজে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ে | কবির ৫ টি সন্তানের তিনজন এখানেই জন্মায় |

    দোতলাটি অপেক্ষাকৃত বড় পরিসরের | ডরোথির শোবার ঘর , কবির শোবার ঘর , স্টাডি , বাচ্চাদের ঘর , অতিথির ঘর | ওপরে আলো বাতাস বেশি | রোমাঞ্চও | কারণ কবির স্টাডিতে আলমারিতে রাখা কবির চশমা, কলম , টুকিটাকি ব্যবহারের জিনিস | শোবার ঘরটিতে পরিপাটি বিছানা পাতা | কবি লিখতেন কখনো স্টাডিতে , কখনো বাইরে বাগানে বসে | আছে ডরোথি আর মেরির সেলাই বাক্স , কবির কুড়িটি মাদার অফ পার্লের পদক , সোনার পকেট ঘড়ি , লেখার কলম | সিল্কের কুশনে কবির স্ত্রী ও মেয়ের স্বাক্ষর পড়া যায় পরিষ্কার | সীবনে কী দক্ষতা ! একটি দেওয়ালে কবির পাসপোর্ট | তখন কী অন্যরকম ছিল দেখতে ! ঘুরে ঘুরে দেখছি..কিছু কিছু জিনিস স্পর্শ করছি..আর মনে হচ্ছে এক্ষুণি ওপার থেকে কেউ এসে বলবে, " ছি , অন্যের জিনিসে হাত দেয় না !"

    এমনটা তো দেশেও দেখেছি | আমাদের প্রাণের ঠাকুরের ব্যবহারের জিনিস | বিলিতি কবি..তাই এই উচ্ছ্বাস ? না , তা নয় | কষ্ট হচ্ছিল খুব | সংগ্রহশালায় ঢুকে কষ্ট বেড়ে গেল | মুগ্ধ দর্শক | ছড়িয়ে রাখা পাণ্ডুলিপি দেখে দেখে হাঁসের পালকের কলম দিয়ে লেখা মকশো করছে | শুধু লেখা আছে..."এই দুর্মূল্য পৃষ্ঠাগুলি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন না অনুগ্রহ করে |" ব্যস, এইটুকুই | লুকোনো ক্যামেরা ? আছে হয়ত ! খুঁজে দেখিনি | কেউই দেখে না | কারণ কেউ ভাবেই না..এসব কারো ব্যক্তিগত | এ সবকিছু সবার | সব অনুরাগীদের | আছে অজস্র পাণ্ডুলিপি . অজস্র পোর্ট্রেট , অনেকের আঁকা ছবি …যাঁদের পদধূলিতে ডাভ কটেজ ধন্য হয়েছে | আছে কবির প্রিয় কন্যা ডোরার মাথার একগুচ্ছ সোনালি চুল | আরও কত কী ! সব মনেও নেই | শুধু মনে আছে আলমারিতে রাখা সেই সম্পূর্ণ পরিচ্ছদ , জুতো মোজা সমেত | যেটি পরিধান করে রাণীর দরবারে পোয়েট লরিয়েটের খেতাব আনতে গিয়েছিলেন সর্বকালের দুই সেরা ইংরেজ কবি | আলফ্রেড টেনিসন এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ !
    প্রসঙ্গত বলি , পোয়েট লরিয়েট হতে গেলে এক অলিখিত শর্ত থাকত..রাজকাহিনী লিখতে হবে | কবিতায় | ওয়ার্ডসওয়ার্থ একমাত্র পোয়েট লরিয়েট ..যিনি খেতাব নিতে স্বীকৃত হবার আগে রাণীকে জানিয়েছিলেন , তিনি নিজের তাগিদে লেখেন | নিজের জন্য লেখেন | নিজের আনন্দে লেখেন | ফরমায়েসী সভাকবি হতে তিনি অরাজী | সারা জীবন কবি সত্যিই কোনো রাজগাথা লেখেননি |

    বেরিয়ে এসে বসেছিলাম ওই বাগানে | যে বাগানে বসতেন কবি | রোদ্দুরের ঝাঁঝ ছিল না | ডাভ কটেজে শীত ঋতু কেমন ..কে জানে ! আমার তো অগতির গতি ওই ডরোথির জার্নাল |

    ২৪ শে নভেম্বর , ১৮০১
    " আমাদের বড় প্রিয় ..বার্চ গাছটা ..আর পারছে না উত্তুরে হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে | ওর নরম ডালপালাগুলো নুয়ে পড়ছে | আর যখন রোদ্দুর এসে স্পর্শ করছে ওকে .. ও তাকিয়ে আছে বাতাসের দিকে ..এলোমেলো উত্তাল সোনারং ঝাঁপালো ঝর্ণার মতো .. গাছ...গাছই তো.. ডালপালা নিয়ে যেমনটি হয়... কিন্তু কোথায় যেন ঝর্ণার মতো ..জলদেবীর মতো..এক অপার্থিব অফুরান স্বর্ণিম সৌন্দর্যে ...."

    আর কিছু দিন পর... ২৯ শে ডিসেম্বর , ১৮০১
    " আমরা উঠছিলাম পাহাড়ী পথ বেয়ে | ঠাণ্ডা , পিছল | মার্টিনডেলে শিলাবৃষ্টি হচ্ছে খুব | বুনো লতাপাতায় ঢাকা কুঁড়েঘরগুলো ওলটপালট | পাহাড়টা কী ভীষণ আর ভয়াল | ঝড়ের তাণ্ডবে ফুলে ফেঁপে উঠেছে |"

    আমি বর্ষাও দেখলাম ডরোথির চোখ দিয়ে |
    ৫ই জুলাই , ১৮০২
    " বৃষ্টি এল | অতিথি হয়ে | প্রথমে চুপিচুপি পায়ে | তারপর উদ্দাম | এল , ভাসিয়ে নিয়ে গেল | দুর্বার গতিতে | ফিরে গেল জলের ঘুঙুর পরে ...ঝমঝমিয়ে |"

    বিকেল ফুরিয়ে এল | বাতাসে সামান্য হিমেল ভাব | পাশেই ক্যাফে | বাইরে বসি | চোখের ওপারে নীল সবুজের মেলা | মাথা দুলিয়ে হাসে ঝকঝকে সোনালি ফুল | অনেক অনেক | ক্যাফের মালিক নীল চোখের যুবকটি হালকা হেসে বলে, " মাদাম , ড্যাফোডিল |"

    সারা জায়গা জুড়ে | আলো ছড়াচ্ছে | বিকেলের রোদ্দুর এক নিমেষেই উজ্জ্বল সোনালি হয়ে যায় | ডরোথিকে মনে পড়ে |

    ১৫ই এপ্রিল, ১৮০২
    " খুব কুয়াশা আজ | শনশন হাওয়া বইছে | হ্রদের জল উত্তাল | আমরা ফিরছিলাম বনের পথটি দিয়ে | দেখি জলের কোল ঘেঁষে কয়েকটি ড্যাফোডিল | এগোচ্ছি...আরও ফুল...আরও আরও... শেষ প্রান্তে গাছের নির্জনতা খানখান করে ভেঙে দিয়ে ফুলেদের হাসি | বিস্তীর্ণ জমি জুড়ে ... আমি এত সুন্দর ড্যাফোডিল আগে তো দেখিনি ! শ্যাওলা দিয়ে সাজানো পাথুরে জমি .. কেউ কেউ যেন আয়েস করে ক্লান্তি থেকে মুক্ত হতে চাইছে পাথরের গায়ে লেপ্টে থেকে ...বাকিরা নাচছে, গাইছে, ফুর্তিতে মশগুল ...নাচের সঙ্গী ওই মাতাল বাতাস | এখান ওখানে সবখানে... এত সহজ এত সুন্দর ...বৃষ্টি এল বুঝি ? ঝিরঝিরিয়ে ? "

    আমিও ছুঁতে পারছিলাম বৃষ্টিকে | সেই মুহূর্তে | জলের আতর !
  • Ishani | 69.92.177.211 | ২৭ জুন ২০১৪ ১১:৪৬640701
  • অপরূপ রূপকথা
    ........................

    চারটে খুদে খুদে খরগোশ ছানা ছিল | ফ্লপসি , মপসি , কটন টেইল আর পিটার | তারা থাকত একটা বিশাল বড় ফার গাছের নীচে , শিকড় যেখানটায় বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ..সেখানে | নরম বালির গদি দেওয়া বাড়িতে | মায়ের সঙ্গে | তিনটে খরগোশ ছানা ভারী লক্ষ্মী | কিন্তু পিটার ? সে দুষ্টু , ডানপিটে |
    একদিন সকালে তাদের মা বলল , " বাছারা , যাও , বাইরে মাঠে ঘুরে এস | পারলে চাট্টি কালোজাম এনো| কিন্তু খবদ্দার , ভুলেও মিস্টার ম্যাকগ্রেগরের বাগানের দিকে যেও না | ওখানেই তোমাদের বাবার ওই বিচ্ছিরি দুর্ঘটনা হয়েছিল | ম্যাকগ্রেগর গিন্নি তেনাকে দিয়ে মাংসের পিঠে বানিয়ে ফেলেছিলেন | সাবধানে যেও | আমিও বাজারে যাব |"
    তা খরগোশ-গিন্নিও সাজুগুজু করে মাথায় ছাতাটি দিয়ে বেরোলেন, বাচ্চারাও চরতে বেরোলো | ফ্লপসি , মপসি আর কটন টেইল তো লক্ষ্মীছানা , তারা কালোজাম খুঁজতে গেছে | আর ওই হতচ্ছাড়া দুষ্টুর শিরোমণি পিটার ...ঠিক গেটের তলা দিয়ে ঢুকেছে ম্যাকগ্রেগরের বাগানে | আর পড়বি তো পড় মিস্টার ম্যাকগ্রেগরের সামনে !
    তারপর ? আর বলব না | কারণ আমি পিটারের কাণ্ডকারখানার গল্প ফাঁদতে বসিনি | সে বলতে গেলে দিন ফুরিয়ে রাত কাবার হয়ে মাস কাবার হয়ে যাবে | আর শুধু গল্প তো নয় ! ছবি ? ছবি ছাড়া পিটারের গল্প অচল | আমার এই পর্ব পিটারের স্রষ্টা বিয়াট্রিক্স পটারকে নিয়ে | আর তাঁর সেই আজব পৃথিবী , যা এতদিন শুধু দ্বিমাত্রিক উপস্থিতিতে আমার বইয়ের আলমারিতে ছিল |
    বিয়াট্রিক্স জন্মেছিলেন ১৮৬৬ সালে | এক অভিজাত রক্ষণশীল ইংরেজ পরিবারে | নিয়মমাফিক স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর | বাড়িতেই যা কিছু পড়াশুনো ..গভর্নেসের কাছে | বন্ধুবান্ধব নেই | সঙ্গী বলতে ছোট ভাই , একটা সবুজ ব্যাং , দুটো গিরগিটি , গুটিকয় গোসাপ , একটা হিলহিলে সাপ আর একটা খরগোশ | না-মানুষ সঙ্গীসাথীরা বেশ ! একটি কথা বলেছিলেন বিয়াট্রিক্স | " ভাগ্যিস আমাকে ইস্কুলে পাঠানো হয়নি ! তাহলে নির্ঘাত আমার কিছুটা স্বকীয়তা নষ্ট হয়ে যেত |"
    গ্রীষ্মের ছুটি হলে সবাই মিলে লেক ডিস্ট্রিক্ট | আপনমনে ঘুরে বেড়ায় বালিকা | জলের ধরে, বনের পথে | তার খুদে খুদে নোটবুক ভরে ওঠে পেন্সিল স্কেচে আর জলরঙে আঁকা ছবিতে | ছোট থেকেই আঁকার বড্ড শখ তার | জীবজন্তুর ছবি | কিন্তু তাদের আচার আচরণ মানুষের মতো | খরগোশ জামাকাপড় পরে স্কেট করছে | কিংবা ইঁদুর গাউন পরে মাথায় রুমাল বেঁধে বেতের ঝুড়ি হাতে বাজার যাচ্ছে | বালিকা বড় হল | এভাবেই | প্রকৃতিকে আশ্রয় করে |
    বিয়াট্রিক্স প্রথম মডেল করেন তাঁর পোষা খরগোশকে | তাঁর আঁকা ছ’টি ছবি ব্যবহার করা হয় গ্রিটিংস কার্ডে | সম্মান দক্ষিণা পান ৬ পাউন্ড | ১৮৯০ সালের গ্রিটিংস কার্ড |
    বিয়াট্রিক্স খুব ভালবাসতেন বাচ্চাদের চিঠি লিখতে | পিটারের গল্প শুরুই হয়েছিল চিঠিতে | পেন্সিল স্কেচ আর ছোট ছোট বাক্য দিয়ে | সেই যে ছোটবেলার গভর্নেস , তাঁর নাতি নোয়েল মুর ...অসুস্থ..তাকে চিঠি লেখেন বিয়াট্রিক্স | ৪ ঠা সেপ্টেম্বর , ১৮৯৩ | এরও কয়েক বছর পর ওই চিঠির হাত ধরে এল পিটারের গল্প |
    কপাল মন্দ | ছ'জন প্রকাশকের ঘর থেকে ফিরে এল পিটার | অবশেষে খরগোশের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল | ফ্রেডেরিক ওয়ার্ন ছাপতে রাজি হলেন এই গল্পমালা | ১৯০২ সাল |
    লেখিকার সাফল্যৰ পেছনে ছিল সহজ সরল ভাষা | মনভোলানো ছবি | গল্পের খসড়া করে বন্ধুবান্ধবদের ছানাপোনাদের শোনাতেন তিনি | তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন | তাঁর লেখনীতে সমান্তরালে চোরাস্রোতে বয়ে যেত হাসি আর গাম্ভীর্যপূর্ণ কথা | পড়তে পড়তে তাই পিটারকে বাচ্চারা চিনে নিত নিজেদের দুষ্টুমীর অংশীদার হিসেবে | পিটার তো খরগোশ নয় ! সে তো ও বাড়ির বাচ্চু বা পিঙ্কু | আর পিটারের মা ? মা গো মা ...উফ ..বাড়িতে তো আমার মাও দেখি ওই একই ভাষায় কথা বলে | বকাবকি করে | অর্থাত এরা সবাই আমাদেরই মতো | তাই অবাধ্য পিটার গুচ্ছের লেটুস খেয়ে পেটের ব্যথায় কাতরায় | তার মা তাকে পাঁচন গেলায় | বিয়াট্রিক্স খুব সচেতন ছিলেন ..বইয়ের দাম যেন কম রাখা হয় | যাতে বাচ্চারা তাদের হাতখরচের টাকা দিয়ে স্বচ্ছন্দে কিনতে পারে | আর বই যেন মাপে ছোট হয়...নইলে খুদে খুদে হাতে তারা ধরে পড়বে কেমন করে ?
    ১৯০৩ ফুরোবার আগেই ফুরিয়ে গেল পিটারের গল্পকথার ৫০,০০০ কপি | ১৯০৫ -এ পিটারের এই সাফল্য নিয়ে বিয়াট্রিক্স লিখেছিলেন , " সরাসরি সত্যিকারের শিশুদের গল্প বলা সহজ কাজ | এই গল্প সটান পৌঁছে দিয়েছি শিশুদের কাছে | নিজের তাগিদে | কথায় , চিঠিতে | এ তো ফরমায়েশী লেখা নয় | আসলে গল্পের শুরুটুকু লেখা খুব রোমাঞ্চকর | কারণ জানাই থাকে না..কোথায় গিয়ে পৌঁছব !"
    এরপর এল পিটার ...পুতুল হয়ে | খরগোশ পুতুল | তুলির আঁশ ছিঁড়ে পিটারের গোঁফ তৈরী হল | ২৮ শে ডিসেম্বর ১৯০৩ লন্ডনে পিটারের পুতুল পেটেন্ট নেওয়া হয় | এরপর একে একে আসে ওয়ালপেপার , বোর্ড গেম ইত্যাদি | আর অবিশ্বাস্য সব মিনিয়েচার পোর্সেলীন ক্রকারি | তাদের গায়ে নিখুঁত ছবি আঁকা | আর ধার ঘেঁষে ২২ ক্যারেট সোনার জলরেখা |
    এরপর এল বেঞ্জামিন বানি | তাকে আঁকা হয় লেখিকার পোষা খরগোশ বেঞ্জামিন বাউন্সারের আদলে...যার ঝোঁক খালি গরম গরম মাখন মাখানো টোস্ট আর মিষ্টি | সে আবার পিটারের সম্পর্কে ভাই |
    এরপর ফ্লপসি বানিদের গল্প | ১৯১২ তে এল দ্য টেল অফ মিস্টার টড | সে এক রোমহর্ষক ছেলে থুড়ি খরগোশছানা ধরার গল্প | দুষ্টু টমি ব্রক খুদে খরগোশছানাদের ধরে আনে ভুঁড়ো শেয়াল মিস্টার টডের আস্তানায় | তাদের বাঁচাবে কে ? বেঞ্জামিন আর পিটার ছাড়া ? শুধু মজা নয় , বিয়াট্রিক্স লেখায় আনেন বাস্তবের খুঁটিনাটি সমস্যাও | প্রতীকী সূক্ষ্মতায় | আর ছবিতে..যা প্রথমে ছিল সাদা কালো..পরে রঙিন ...উঠে এসেছিল তখনকার লেক ডিস্ট্রিক্ট -এর নিখুঁত ছবি | ১৯০৫ -এ বিয়াট্রিক্স কেনেন হিল টপ ফার্ম ..ওই লেক ডিস্ট্রিক্ট -এই | কারণ এখানেই তাঁর প্রাণভোমরা | ১৯০৭ সালে শুরু হল দ্য টেল অফ টম কিটন | তিনটে বেয়াদব বেয়াড়া বেড়াল বাচ্চার গল্প | এল জেমাইমা পাডল ডাক .. জেমাইমা ওই খামার বাড়িরই হাঁস ..সত্যিকারের ..যে এদিক ওদিক গিয়ে ডিম পেড়ে আসত | এরা সবাই ছোট্ট ছোট্ট পেনিফ্রক , টাকার্স ..এসব পরে ফিটফাট থাকে সর্বদা | খামারবাড়ির পশু পাখিরা বাস্তবের কাঠামোয় কল্পনার রং মেখে গয়নাগাঁটি পরে আমাদের কাছে আসে... এবং আমাদের জয় করে নেয় অনায়াসেই | এরপর একে একে আরও অনেকে | স্যামুয়েল হুইস্কার্স , পাই আর প্যাটি প্যান , জিনজার আর পিকলস , দুষ্টু ইঁদুর হুঙ্কা আর মুঙ্কা ..যারা পুতুলের বাড়িতে ঢুকে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড করে ছেড়েছিল |
    বিয়াট্রিক্স মারা যান ১৯৪৩ -এ | ততদিনে তিনি দেশকে দান করেছেন ৪০০০ একর জমি...ফল ফুল পশু পাখিদের অবাধ চারণক্ষেত্র | সত্তর বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন , " এই যে আমি শুয়ে আছি বিছানায় ...আমি মনে মনে হেঁটে যাই পায়ে পায়ে পাহাড়ী পথে..বনের শুঁড়িপথ ধরে...ঝর্ণার পাশে পাশে..নদীর পাশে | অমসৃণ বা মসৃণ জমিতে ..প্রতিটি নুড়ি , ফুল পাতা ..আমার আজন্মের চেনা ...| আর হয়ত আমার স্থবির জীর্ণ শরীর বাস্তবে আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে না কখনও |"
    এবার তাই লেক ডিস্ট্রিক্ট যাব শুনেই আমি আহ্লাদে নেচে উঠেছিলাম | বোনেস অন উইন্ডারমেয়ার | দ্য ওয়ার্ল্ড অফ বিয়াট্রিক্স পটার | অবিকল সেভাবে সাজিয়ে রাখা | নিখুঁত , নিপাট | আর কী ভালো..ভেতরে ছবি তুলতে দেয় ! কে নেই সেখানে...পিটার , পিটারের পুরো পরিবার , কাঠবিড়ালি নাটকিন , জেমাইমা , মিস্টার টড,টম কিটন ...মোটমাট পুরো গুষ্টি ! আমি তো ..ওরে বাবা ..কী খুদে খুদে জামাকাপড় মেলে দিয়েছে দড়িতে মিসেস টিগী উইংকল , পিগলিং ব্ল্য্যান্ড গম্ভীর আলোচনা করে স্যার আইজ্যাকের সঙ্গে , ফ্লপসি বানিরা উঁকি মারে জানলা দিয়ে |মিস্টার টড আবার নাকে চশমা এঁটে খবরের কাগজ পড়ে ! মিস্টার জেরেমি ফিশার উড়ে যায় মেঘ পেরিয়ে | গম্ভীরভাবে তাকিয়ে থাকে ওল্ড ব্রাউন নামের প্যাঁচাটা |
    এ এক অন্য জগত ! একে ঠিক পুতুলের জাদুঘর বলা চলে না .. যেমন আছে দিল্লিতে | তাতে পুতুল আছে , কিন্তু তাতে প্রাণ নেই | সাজানো গোছানো কিছু কাচের বাক্স বা আলমারি | দেশ বিদেশের পুতুল | বড়জোর রামায়ণ মহাভারতের কিছু কুশীলব | সে তো কিনে গুছিয়ে আলমারি ভর্তি করে বাড়িতেও রাখা যায় | এখানে আঁকাবাঁকা করিডোর ধরে এগোনো , অল্প আলো | একটু মোড় ঘুরতেই দেখি আমার দিকে গরাদের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে তিনটে দুষ্টু মিষ্টি কাঠবিড়ালি | লাল টুকটুকে ভেলভেটের জামা পরে | আমাকে ডেকে বলেছে , "এই যে , আমাদের না দেখেই চলে যাচ্ছিস যে বড় !" কিংবা ওই যে...খুদে খুদে জামা শুকোচ্ছে আর টিগী উইংকল … মুখটা দেখো.." বাবা গো , আর পারি না..সংসারের কাজ করতে করতে হাড় কালি !"
    আমার এত আহ্লাদে আদেখলেপনা কেন ? চোখের সামনে এত নিখুঁত গল্পের চরিত্ররা উঠে এসেছে , তাই ? গল্পগুলো আমার খুব চেনা তাই ? না | আমি দেখছিলাম আর মনে পড়ছিল গল্পগুলো..সত্যি..কিন্তু মনে মনে আরও হাজার গল্প তৈরী হয়ে যাচ্ছিল | মনে হচ্ছিল...আরও অনেক গল্পকথা আছে ..এরা বলছে আমাকে ডেকে..যা বইতে লেখা নেই..যা আমি জানি শুধু | দর্শক ছিল আরও অনেকে | নানা বয়সের | বাচ্চারা উচ্ছ্বসিত ; কিন্তু প্রাপ্তবয়স্করা মোহিত | কারণ শিশুরা শুধু গল্পের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েই খুশি | বড়রা কুর্নিশ করছেন স্রষ্টাকে | সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে স্রষ্টার প্রতিভার এত মনোগ্রাহী দৃষ্টিনন্দন বহি:প্রকাশ সত্যিই দুর্লভ | কেউ যখন গল্প লেখেন , গল্পের গতিতে গল্প বয়ে যায় আপন খেয়ালে..কিছু বর্ণনা থাকে কুশীলবদের ...ওই পর্যন্তই | কিন্তু বিয়াট্রিক্স শুধু কলমে অক্ষর আঁকেননি , চরিত্রদের সাজিয়ে গুছিয়ে ঠিক কেমন দেখতে হবে..আমাদের সামনে এনে হাজির করেছেন | এরা সকলেই না-মানুষ..অথচ মানুষ | আমরা তাই শুধু পড়ার ঝোঁকে গল্প পড়েই থেমে থাকি না, এদের সঙ্গে কথা বলি, গল্প করি | চোখ বুজলে দেখি পিটার আসমানী রঙের জামা পরে স্লেজ গাড়ি টেনে নিয়ে যায় বা ভাবি , ইস , পিটার আবার জ্বর গায়ে শুয়ে আছে |
    বিয়াট্রিক্স গল্পে , স্কেচে, রঙিন ছবিতে , মডেলে ...এক কমপ্লিট প্যাকেজ | ছোটদের কাছে তো বটেই , আমার মতো কিছু ছোটবেলার ক্যালাইডোস্কোপে সুযোগ পেলেই চোখ রেখে রঙের অজস্র কারিকুরি দেখতে চাওয়া আধ বা পুরো পাগল প্রাপ্তবয়স্কদের কাছেও | তাই আমি ফিরে এসে বড়দের বই শিকেয় তুলে রেখে আপাতত বুঁদ হয়ে আছি বিয়াট্রিক্স -এর গল্পে আর ছবিতে | আবারও এবং এই বয়সেও !
    বিয়াট্রিক্স পটারের কথা দিয়েই শেষ করি :
    " এখন সব কিছু বদলে গেছে | অন্যরকম | চেনা মুখগুলো গেছে হারিয়ে | কিন্তু সবচেয়ে বেশি বদলে গেছি আমি | তখন ছিলাম নিতান্ত শিশু | জানতামই না , জগৎটা কেমনধারা | স্থলেই থাকি বা জলে যখন বা সমুদ্রে , নিজের ওপর আস্থা রাখতাম খুব | আমার চোখে সব কিছুই ছিল রোম্যান্টিকতার তুলিতে আঁকা | কল্পনা করতাম বনে জঙ্গলে থাকে রহস্যময় অগুণতি ভালো লোক | পুরাকালের রাজা রাণীরা ফুলে ঢাকা বনের পথে আমার পাশাপাশি হেঁটে যেত | আমার সাথে ফুল কুড়াত , ভরিয়ে নিত হাতের সাজি |
    ছোট ছিলাম | বিশ্বাস করতাম , পরীরা আছে | মনে মনে খেলাও তো কত তাদের সাথে | আর কোন আশ্রয় আছে কি এমন, যা সারাটি জীবন আঁকড়ে থেকে বাঁচতে পারি ...ছোটবেলার সেই কল্পনার স্বর্গভূমি ছাড়া ? শুধু তাকে নতুন করে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে মানানসই করে নিতে হবে ... আমাদের ব্যবহারিক নিত্য নৈমিত্তিক দিনযাপনের সলমা চুমকি রাংতার টুকরোটাকরা দিয়ে ... তা যতই ছেঁড়াখোঁড়া বাতিল জঞ্জাল হোক ! এমনভাবে সাজিয়ে নেওয়া , এমনভাবে ... যে ফুটিফাটা বিবর্ণ বাস্তব কিছুক্ষণের জন্য হলেও যবনিকার অন্তরালে চলে যায় |"

    আমিও তাই | এখন বিয়াট্রিক্স-এর হাত ধরে হেঁটে চলেছি বনের পথে | এক অত্যাশ্চর্য অনামা অজানা সব-পেয়েছির দেশে |
  • Ishani | 69.92.177.211 | ২৭ জুন ২০১৪ ১১:৪৮640702
  • আপাতত এই চারটি লেখা | পরেরটি কয়েক দিন জিরিয়ে নিয়ে | :)
  • kiki | 127.194.70.83 | ২৭ জুন ২০১৪ ১৫:৪০640703
  • প্রথম দুটো লেখা পড়লাম, পরের দুটো আবার সময় নিয়ে। সত্যি তোমার বিষয়বৈচিত্র (ঠিক হলো শব্দটা! আমি আজকাল শব্দ হারিয়ে ফেলছি) সব সময় অবাক করে। খুব সুন্দর।ঃ)
  • nina | 22.149.39.84 | ২৭ জুন ২০১৪ ২১:৫০640704
  • ঈশানী,
    তোমার প্রতিটি লেখা বারবার পড়া যায় --তোমার সোনার কলম অক্ষয় হোক।
    আরও অনেক অনেক লেখ---অনুরোধ জানিয়ে গেলাম--
  • kiki | 127.194.66.46 | ২৮ জুন ২০১৪ ১০:১৯640705
  • তৃষা,
    দারুন। রুমি জামীর কথা আগেও পড়েছি, এ পাতায় ই কি! পুরোপুরি মিল না থাকলেও কেমন যেন অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট মনে পরে।

    বিয়াট্রিক্স কে নিয়ে মনে হয় একটা সিনেমা হয়েছে। মাঝখান থেকে কিছুটা দেখেছিলাম, তাই খুব সিওর নই। গাউন পরা মেয়ে, সবুজ মাঠে বসে আঁকছে। ঢালু মাঠ। তাতেই মনে হলো পারফিউম ও এখন ও দেখে উঠতে পারলাম না। সত্যি কি দারুন এই পশুপাখিদের নিয়ে গল্প গুলো হয় না! ডিজনির মুভিগুলো ও দারুন প্রিয়, এরকম ই। সেদিন আবার লায়ন কিং পার্ট ওয়ান আর টু, আমি আর ঋভু মিলে দেখছিলাম। টিমন চলে যাচ্ছে, মা তখন ও বলে যাচ্ছে, বাইরের লোকের সাথে কথা বলো না, ঠিক করে স্নান করো। তারপর গাছের তলায় গিয়ে হাঁওমাও কান্না। এত গভীরে এর চলে যেতে জানে।

    এনসিয়েন্ট মেরিনারের গল্প ও বাবা বলতো, এখন আর স্পষ্ট মনে নেই, এটুকুই মনে আছে, অ্যালব্যাট্রস পাখি পথ চিনিয়ে নিয়ে চলেছে। আর ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়ার নর এ ড্রপ টু ড্রিঙ্ক। বাবাদের এক মাষ্টার ছিলেন, তিনি নাকি এত সুন্দর পড়াতেন যে মনে হত চোখ বুঁজলেই সব দেখা যাবে ছবির মতন। সেই মাস্টার পড়ানোর নেশাতেই বুঁদ হয়ে থাকতেন। ও পাড়ের মানুষ, ভারী গরীব। তখন তো বেশিরভাগ ই গরীব মানুষের মেলা ছিলো। একটা ইলিশ মাছের টুকরো এক চুড়ো ভাতের মাথায় বসিয়ে রেখে গরাস নিয়ে তাতে ঠেকিয়ে খেয়ে ফেলতেন। শেষে ভারী তৃপ্তি করে মাছটা খেতেন। আর তার ফাঁকেই ছাত্রদের পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কোন পয়সা নিতেন না। আর নেবেন ই বা কি, ছাত্ররাও সেই ঐরকম ই ঘরের। কিছুদিন আগেও ভাবতাম কি অপচয়, কি নির্বুদ্ধিতা। অমন ভালো মাস্টার কিছু বড়লোক ঘরের টিউশন ও তো নিতে পারতেন।এখন মনে হয় না, যে যেরকম ভাবে খুশী থাকতে পারে। এখন ইলিশ মাছের দুটো পিস ও আমার কাছে বিরাট পরিমান, কিন্তু অনায়াসে আমি তা নিতে পারি , তাও সে পরিতৃপ্তি তো আমার আসবে না।
  • Ishani | 69.92.198.239 | ২৮ জুন ২০১৪ ১৪:৪৬640706
  • ভারী সুন্দর লিখেছ কিকি | জাহানারা ইমামের বইটির আলোচনা আমি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মুখবইতে লিখেছিলাম |
  • kiki | 127.194.76.70 | ২৮ জুন ২০১৪ ২০:৩৬640707
  • উপস! তবে সেখানেই পড়েছি।
  • i | 134.149.65.156 | ২৯ জুন ২০১৪ ১২:১২640709
  • সুন্দর টই। লিখতে থাকুন।
  • Ishani | 116.216.143.198 | ৩০ জুন ২০১৪ ১৭:২৫640710
  • ফ্রিডা কাহলো -র রোজনামচা |

    গৌরচন্দ্রিকা
    ..................

    মেক্সিকো সিটির ঠিক বাইরে " নীল বাড়ি "| সেদিন জুলাই মাসের ৬ তারিখ | ১৯০৭ সাল | ফ্রিডার জন্ম | চার বোন | সে তিন নম্বর |" সারাক্ষণ বাড়িতে শুধুই নারীসঙ্গ !" এই উক্তি ফ্রিডার |
    বয়স মাত্র ৬ | পোলিও | ডান পা -টা কী বিচ্ছিরি সরু লাগে বাঁ পায়ের থেকে | লজ্জা, অস্বস্তি | তাই লম্বা ঝুলের রংচঙে স্কার্ট |
    অষ্টাদশী তরুণী সে | মারাত্মক পথ -দুর্ঘটনা | মেরুদণ্ডের হাড় , কলার বোন , পাঁজর এমনকি শ্রোণীও চুরমার | ডান পায়ে ভাঙল ১১ টি হাড়, ডান পায়ের পাতাও গেল পিষে | কাঁধ দুমড়ে গেছে | একটা লোহার শিক এফোঁড় ওফোঁড় | পেটে আর জরায়ুতে | তবে কি বন্ধ্যাত্ব ? আজীবন ?
    এরপরেও কিন্তু মানুষ উঠে দাঁড়ায় , বেঁচে থাকে| ফ্রিডাও তাই | নতুন করে বাঁচতে শিখল | অস্ত্রোপচার ৩৫ বার | নতুন করে হাঁটতেও শিখল | কিন্তু মাঝে মাঝে কী যে অসহ্য যন্ত্রণা !
    বিয়ে | বিখ্যাত মেক্সিকান চিত্রী দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে | তিনি আবার স্ত্রী-পুরুষ উভয় সংসর্গেই পটু | মেনে নিতে কষ্ট হয় ফ্রিডার| ফলে বিচ্ছেদ | কিন্তু প্রেম তো ধিকিধিকি করে জ্বালিয়ে মারে আজীবন| তাই আবার বিয়ে | ওই মানুষটিকেই| এবং অবিরাম বৈষম্য |
    মা হবার বড় সাধ ছিল তার | তিন তিনবার সন্তানসম্ভবা হয়েও শারীরিক কারণে গর্ভপাত করাতে বাধ্য হয়েছে ফ্রিডা |
    আর শখ ছিল ডাক্তার হবার | দুর্ঘটনা সেই শখেও ইতি টানতে বাধ্য করেছে| ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে | তাই ফ্রিডা খুব আঁকে , খুব আঁকে | চিত্রী হয়ে ওঠে নিজের খেয়ালখুশিতে | ছবি এঁকেছে ১৪৩ টি , ৫৫ টিই আত্ম-প্রতিকৃতি | কেন ?
    " নিজেকে আঁকি বারবার ;কারণ একা থাকি তো , এত ভালো বিষয়বস্তু আর পাই কোথায় ! নিজেকে ছাড়া ? যার সঙ্গে আমার চেনাজানা আর অন্তহীন বোঝাপড়া ? আমি স্বপ্ন আঁকতে পারি না | আমার ওই বাস্তবই ভালো !"

    এত কম ছবি ? চলেই তো গেল ফ্রিডা মাত্র ৪৭ বছর বয়সে | সেদিন জুলাই ১৩, ১৯৫৪ | ঘুমের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল হৃদযন্ত্র | নাকি এক মুঠি ঘুমের ওষুধ ? ময়নাতদন্ত হয়নি |
    ডায়েরির শেষ পাতায় ঠিক কী লিখেছিলেন ফ্রিডা ? বলব | আর সেই সঙ্গে কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া পংক্তি |ওই শেষ কথা সমেত |

    "আগে আগে ভেবেছি , পৃথিবীতে আমিই সবচেয়ে অদ্ভুত আর খামখেয়ালী | তারপর মনে হল , গোটা দুনিয়ায় এই যে এত মানুষ ... কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আছে ঠিক আমারই মতো ! বেঁচে আছে অন্তহীন পাগলামি আর ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে | আমি এখন তার কথা ভাবছি |সেও কি আমার কথা ? এই মুহূর্তে ? একইভাবে ? তুমি জানো ? চেনো ? বোঝো আমাকে ? আমিও তো আছি ! কী ভীষণভাবে আছি ! ঠিক তোমার মতোই ... বিচিত্র রমণী এক !

    পানাসক্তিকে প্রশ্রয় দিলাম খুব | ভাবলাম , এইভাবে ডুবিয়ে মারব আমার যত দু:খ | কখন যে আমার অগোচরেই ওরা সাঁতার কেটে বাঁচতে শিখে গেল !

    ভাবছি , সব ছেড়েছুড়ে চলে যাব | কিন্তু শুধু ছেড়ে যাওয়াই তো যথেষ্ট নয় | ছেড়ে যেতে গেলে সেভাবেই পুরোপুরি আড়ালে থেকে যেতে হয় , রেখে দিতে হয় | নিজেকে |

    নিজের হৃদয়কে করে নেব পোষা কুকুর | আমার পায়ে পায়ে ...পায়ে পায়ে ...এই যেমন | আমার এই বাড়িতে আমার প্রেমিক কস্মিনকালেও আসবে না , জানি | কিন্তু তবু... বলা তো যায় না ! তাই সদর দরজার ছিটকিনিটা পালটে ফেলতে হবে |

    কী ভাগ্য আমার ! ঘরটা ঠিক আমার মাপসই , স্নানঘরে আমার পছন্দের পানীয় | হৃদয় এক ঊষর ও উন্মুক্ত মরু /\ কিন্তু না : , সম্পূর্ণ বন্ধ্যাত্ব বোধহয় এখনো অর্জন করে উঠতে পারেনি ! আমার ফুটিফাটা অতীত ! ভুলিনি তো ! ভুলতেই পারিনি | এই যে আমার পায়ের আঙুলগুলো নিখুঁত নয় , একট বেঁকা , বেশ তো দেখায় ! আমার যা যা সমস্যা ... যেন কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরী পুতুল সব | কিছু আমার নিজের হাতে বানানো , কিছু নাছোড়বান্দা দোকানীর পাল্লায় পড়ে কেনা |

    প্রেমিক হবে কেউ | বড় সাধ ছিল | পেয়েও ছিলাম | এখন আমি আমার আর ওর বাড়ির মাঝের সেতুটা নিজেই ভেঙে ফেলেছি | যদি আসতে চায় কখনও , ডাক দেবে | প্রেমিক ? সে তো থাকবেই | থাকবে বলেই তো এসেছে | তার চোখে আমি যেন এক জাদুকরী হয়েই থাকি |

    আকণ্ঠ মদিরা পান | হৃদয় আমার এক বিশাল ক্যানভাস | হৃদয়ে অবিরাম ক্ষরণ | তীব্র সে ক্ষরণ জানান দেয় তার অস্তিত্ব | সর্বত্র | আধচেনা এক আসবগন্ধে | অনেক অনেক দূর থেকে|

    শুধু ভাবি , আমার এ চলে যাওয়া যেন সুখের হয়|
    শুধু ভাবি , এ যাওয়া যেন শেষ যাওয়া হয় | "

    এই বইটি সংগ্রহে এল যখন ..সে এক অন্য অনুভব | কারণ লেখায় , ছবিতে, ডুডল -এ ছয়লাপ ! এই মেক্সিকান শিল্পীর মূল ডায়েরি স্প্যানিশে | আমি স্প্যানিশ জানি না | তবে এই বইটিতে সমান্তরালে ইংরিজি অনুবাদ দেওয়া আছে | আমি অবশ্য না পড়তে পারলেও ফ্রিডার নানা রঙের কালিতে লেখা রোজনামচায় হাত বুলিয়েছি এক অবোধ আনন্দে..এভাবেও তো ছুঁয়ে থাকা যায় ! এই বইটিতে আছে স্কেচ , সেল্ফ পোর্ট্রেট , অন্য ধরনের কিছু ছবি , ফ্রিডার ভাবনা , ফ্রিডার উন্মাদনার আভাস , ফ্রিডার দেখা আর অদেখা যত স্বপ্নের নকশিকাঁথার রঙিন ফোঁড় | ১৭০ পাতার জার্নাল | ফ্রিডার সে বালিকা বেলা , রাজনৈতিক মতাদর্শ , ফুটিফাটা দাম্পত্য , দুরন্ত আবেগ আর প্রেম | ৭০ টি জলরঙে আঁকা ছবির কী বাহার ! অন্যরকম ছবি | প্রথাগত নয় | হবার কথাও নয় | কারণ ফ্রিডা...ফ্রিডাই !

    এই বইটি নিয়ে লিখতে বসেছি | আজ এইটুকুই গৌরচন্দ্রিকা করে রাখা | তবে আলোচনায় কিছু আমার নিজের কথা থাকবে এই বই নিয়ে | কিছু ধার করা কথাও | ভাষান্তরে | সেই ঋণস্বীকার আগেভাগেই করে রাখলাম |
  • nina | 78.37.233.36 | ০২ জুলাই ২০১৪ ০২:৩৬640711
  • চলুক চলুক---
  • Ishani | 127.96.6.96 | ০২ জুলাই ২০১৪ ২০:২২640712
  • ফ্রিডার ডায়েরি পড়া... কেমন আমার মনে হল জানালার পর্দা সরিয়ে কারো শোবার ঘরটিতে উঁকি দেবার মতো | এত ব্যক্তিগত আলো আঁধারিতে ঘেরা , অনুভবের নকশা আঁকা মেঝে ...যেন বহিরাগতদের জন্য নয় ! এক নারীর খুব নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনার আঁকিবুকি..এবং তাও শুধু নিজের জন্য | ডায়েরি লেখে মানুষ খানিক নিজের সঙ্গে কথা বলতে | নিজের কাছে হালকা হতে | ঠিক বুঝি না..ডায়েরি কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মকথা ? আত্মকথন আর আত্মকথা কোথাও কোনও অদৃশ্য দিগন্তে মিলিত হয় ? এই ব্যক্তিগত অভিমান , ভালোবাসা , বীতরাগ ...এমন নানা অনুভবের ঝাঁপি যখন উপুড় করে দেওয়া হয় সবার চোখের সামনে ... তা কতটা যুক্তিযুক্ত ? ডায়েরি পড়ে কতটা চিনে নিতে পারি মানুষটিকে আর তার অনন্ত টানাপোড়েন ?

    এই রোজনামচাতে ফ্রিডাকে চিনতে গেলে আত্মপ্রতিকৃতির কথা আসে | ফ্রিডা খুব সচেতনভাবে নিজেকে এঁকেছিলেন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে | পাঠক-দর্শকদের কথাও মাথায় রেখেছিলেন বৈকি ! এই আত্মপ্রতিকৃতিগুলি বিস্ময়করভাবে উজ্জীবক এবং একই সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণও বটে ! তা সে বিষয়বস্তু নির্বাচনেই হোক , বা মনস্তাত্ত্বিক অভিনিবেশজনিতই হোক | কাহলো-র পূর্বসূরী কোনো শিল্পী এমন অনায়াসে ছবিতে সন্তানজন্ম , গর্ভপাত , যুগ্ম আত্মপ্রতিকৃতি ( দৃশ্যমান অভ্যন্তরীণ শরীরযন্ত্র সমেত ) বা পুরুষকে নারীবেশে বা নারীকে পুরুষের সজ্জায় সাজিয়ে গুছিয়ে সর্বসমক্ষে শিল্প হিসেবে উপস্থাপিত করার সাহস দেখাননি | রেমব্রাঁর আত্মপ্রতিকৃতিতে ধরা পড়ে এক বৃদ্ধ শিল্পীর বলিরেখা আঁকা মুখে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা অসহায় আর্তি , ভ্যান গখ প্রকাশ করেছিলেন এক নি:সঙ্গ বঞ্চিত মানুষের খেদ ..যাকে কেউ বুঝলই না কখনও তার জীবনকালে ... এইসব ছবি কিন্তু সাধারণভাবে যে কোনও দর্শকের কাছে মানবিক গুণাগুণ সহজেই উপস্থাপিত করতে পারে | কিন্তু ফ্রিডা ? সেই নিজের ছবিই ... যা রঙিন ঝড় হয়ে এসেছে কখনও ; আবার কখনও বা তাতে মিশেছে চূড়ান্ত অশ্রদ্ধা | এই সব ছবি এত ভয়ঙ্করভাবে ব্যক্তিগত যে এক সময় তার তেমন কোনও সর্বজনীন আবেদন ছিল না | তবে এখন হয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নারীদের অবস্থানের পরিবর্তন সাপেক্ষে দর্শকদের এই কঠোর বিরূপ মনোভাব খানিক লঘু হয়েছে |
    কাহলো ধীরলয়ের শিল্পী ছিলেন | ইচ্ছেসুখে আঁকতেন | বিপরীতে কিন্তু যখন রোজনামচা লিখেছেন , সেখানে লেখা -ছবি-ডুডল ...সে সবই অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে | আর এই যে ছবি দিয়ে ডায়েরি সাজানো , এতে এক অন্যতর অভিনবত্বের মাত্র অস্বীকার করতে পারি না | ছবি আছে..কিন্তু স্কেচবুক বলা যায় না | স্কেচবুকে শিল্পী অনেক সময় টুকিটাকি ধারণা এঁকে রাখেন..পরে সেটাই হয়ত বড় মাপের ক্যানভাসে জায়গা করে নেয় বিবর্ধিত হয়ে | কাহলো-র রোজনামচায় ছবির স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েই এসেছে | প্রতিবার | শুধু ৭৩ নম্বর প্লেটটি ছাড়া | যেখানে কালিতে আঁকা ডায়েরির ছবি পরে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে |

    কোনও গুরুগম্ভীর বিষয় নয় | ফ্রিডা ভার্জিনিয়া উলফের মতোই ব্যক্তিগত রোজনামচাকে ব্যবহার করেছিলেন দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নয় ..অনুভবের পটচিত্র আঁকবার মঞ্চ হিসেবে | তাই এই ডায়েরিকে চিরাচরিত ফর্মে ফেলা যায় না | এই সব বর্ণময় পৃষ্ঠাগুলিকে যাচাই করতে হবে কিছু ব্যাখ্যাহীন উপলব্ধি দিয়ে | এখানে আঁকা যত ছবি , এখানে লেখা যত গদ্য - পদ্য ...রেখায় এবং রঙে ... নিটোল একটি ক্যানভাস ... শিল্পীর মুখোশহীন মুখের | চোখের | এবং অনুভূতিরও | ফ্রিডা ডায়েরি লিখতে শুরু করেছিলেন মধ্য ত্রিশ পার করে | জীবনে আলোর চেয়ে অন্ধকার ছিল বেশি | সে প্রসঙ্গে তো প্রথমেই বলেছি | এই ডায়েরির প্রায় প্রতিটি ছবি স্বত:স্ফুর্ত ও অপরিকল্পিত ভাবনার ফসল | এই সব বিচিত্র ছবি হয়ত কথাও লুকিয়ে ছিল তাঁর অবচেতনে , যা সযত্ন সচেতন প্রয়াসে বাইরের আলোয় এনে রঙে রেখায় রূপ দিয়েছিলেন ফ্রিডা | ডায়েরি লিখতে বা বলা ভালো সাজাতে ফ্রিডা ব্যবহার করেছেন রঙিন পেন্সিল , কালি , ক্রেয়ন , অনচ্ছ বা ক্ষেত্রবিশেষে অত্যন্ত পাতলা জলরঙের মিশ্রণ ইত্যাদি বহুবিধ মাধ্যম | মাধ্যম যেমন যেমন বদলেছে , ভাবনার বিষয়বস্তুও দিক পরিবর্তন করেছে |

    ফ্রিডার জীবনে সফল সুস্থ প্রেম ছিল না | সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ছিল , আবাহন ছিল ... সে রোমাঞ্চ , আনন্দ আমৃত্যু অধরা থেকে গেছে | শারীরিক অপারগতা প্রতিনিয়ত জীবনের আলোর ওপর অন্ধকারের যবনিকা টেনে দিতে চেয়েছে ...তবুও সেই যন্ত্রণা আর সন্তাপের কাঁটাতারের বেড়ায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত আর রক্তাক্ত করতে করতে তিনি মুক্তকন্ঠে শুনিয়েছেন আলোকিত জীবনের প্রতি স্পৃহার বার্তা | নিজের মতো করে , নিজের ভাষায় ... প্রতিটি খুঁটিনাটি অনুরাগ বিরাগ স্বপ্ন ও দু:স্বপ্ন রংবেরঙে আঁকিবুকি কেটে | ফ্রিডা লিখেছিলেন , " আনন্দ এবং মৃত্যু কিছু জৈবিক বিক্রিয়া মাত্র | "
    আর রোজনামচাতেও সেই বিক্রিয়ার বর্ণিল বহি:প্রকাশ |
    ফ্রিডার বালিকাবেলায় সঙ্গিনী ছিল এক অলীক বালিকা | সেও ফ্রিডাই | এই ডায়েরিতে ফ্রিডা লিখেছেন সেই নিজের ছায়ার কথা ..দ্বৈত সত্তা ... ১৯৫০ সালের নথিতে | প্রথমে নীল কালিতে লেখা ছোট্ট ছোট্ট হরফে আর তারপর অপেক্ষাকৃত বড় মাপের বাদামী - ধূসর অক্ষরের আলোয় | এভাবেই ফ্রিডার আজীবন নিজের সঙ্গে নিজের কথা |
    আমি এই অংশটুকু ভাষান্তরে দেবার প্রয়াস করব | কারণ আর কিছুই নয় | নির্জন ফ্রিডাকে চেনা |
    “ আমি তখন কতই বা আর ? হব বছর ছয় |
    সেই তখনই তো আমার তোলপাড় করা সখ্য | সে এক অভিজ্ঞতা বটে ! এক অলীক বন্ধুতা |
    একটি ছোট্ট মেয়ে | এই..আমার মতোই বয়স তার |
    আমার ঘরের জানালার ঠিক ওপারে | যে দিকে আলেন্দ স্ট্রীট |
    আমি নি:শ্বাস ফেলি ওপরের ওই কাচের শার্সিটিতে | বাষ্প জমে | আঙুল দিয়ে আঁকি ..
    "দরজা "
    আর ওই "দরজা" পেরিয়ে
    কল্পনায় বেরিয়ে আসি...
    সেও সেই আমিই !
    আর চটুল পায়ে খুশির নূপুরটি পরে ঝুমুরঝুমুর ছুটে যাই
    মাঠ ঘাট বন পেরিয়ে
    যতদূর দু'চোখ যায় ...
    একটি মিঠাইয়ের দোকান আসে ... তার নাম "PINZON "
    সেই "O " অক্ষরটির মধ্যে দিয়ে আমি প্রবেশ করি ...
    দোকান পেরিয়ে নেমে যাই মাঠে ..মাটিতে ..
    সেইখানে আমার অলীক সখী অপেক্ষায় আছে | থাকে | রোজ |
    ও কেমন দেখতে , গায়ের রংটি কেমন...মনে নেই তো !
    শুধু ওর খুশি মনে আছে , মনে আছে ওর ঠোঁটে আলতো লেগে থাকা রোদেলা হাসিটুকু..
    নি:শব্দ |
    প্রাণোচ্ছল | নাচে যখন...পলকা পাখির মতো লঘু শরীরটি ভেসে ভেসে যায় |
    আমি ওর পিছু পিছু যাই | বলি ..আমার সব সমস্যার কথা | সব গোপন কথা |
    কী সমস্যা ? কীই বা আমার গোপন কথা ?
    মনে নেই তো !
    আমার কন্ঠস্বরই তো সব বলে দেয় ওকে | আমাকে আর বিশদ হতে হয় না |

    আবার ফিরে আসি জানালায়..
    ফিরে আসি ওই দরজা দিয়ে |
    কতক্ষণ ছিলাম ? কতক্ষণ থাকি ওর সঙ্গে ?
    জানি না !
    একটি মুহূর্ত ? সহস্র বছর ?
    এবার আঙুল দিয়ে সন্তর্পণে মুছে দিই দরজার আবছা ছবিটি ...দরজা হারিয়ে যায় ...
    আমার গোপন খুশি, গোপন আলো নিয়ে আমি ছুট্টে চলে যাই বারান্দার নির্জনতম কোণটিতে
    প্রিয় গাছের ছায়ায় ..
    হাসি , ছটফট করি ..
    কী বিপুল বিস্ময়ে ..একা একাই ..ওই অলীক বালিকার সখ্যের নদীজলে স্নান করে ...
    দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর আমার এই সম্মোহনী সুখ , অলৌকিক সখ্য ..
    যখনই ভাবি...সজীব সচল ছবির মতো...
    ব্যাপ্ত হয়ে যায়
    আমার হৃদয়ে , মননে এবং
    অস্তিত্বে |"
  • Ishani | 127.96.6.96 | ০৩ জুলাই ২০১৪ ১৯:৪৬640713
  • দিয়েগো রিভেরা | ফ্রিডার প্রেম | ফ্রিডার আজীবনের অশান্তিভোগও বটে ! কেমন চিঠি লিখতেন ফ্রিডা ? দিয়েগোকে ? এখানে সে নমুনাও থাক | একটি |

    ফ্রিডা কাহলো-র চিঠি ... দিয়েগো রিভেরাকে
    ....................................................................

    দিয়েগো ,

    সত্য বড় বিশাল , জানো ! আমার তাই ইচ্ছে করে না.. কথা বলতে , ঘুমোতে , কিছু শুনতে এমনকি ভালোবাসতেও | এ এক বিচিত্র অনুভব | আমি বাঁধা পড়ে গেছি | এখন আর ভয় নেই অবিরল রক্তক্ষরণের | এই এখন কেমন সময় আর সম্মোহনের সীমারেখা পেরিয়ে ; তোমার নিজস্ব ভয়ে, তোমার একান্ত যন্ত্রণার গোপন ঘূর্ণিজলে | এবং তোমার হৃদস্পন্দনে | এই সব ছেঁড়া ছেঁড়া অসংলগ্নতা আমার.....আর তোমার অপার নৈ:শব্দ্য...শুধুই অকারণ সংশয়ের ধুলোবালি বয়ে নিয়ে আসে | আমি জানি |
    অপ্রকৃতিস্থ এই আমি তোমার কাছে ভিক্ষা করে যাই নিষ্ঠুরতা আর তুমি...আমাকে দিয়ে যাও তোমার প্রসাদগুণ , তোমার আলো , তোমার উত্তাপ |
    বড় ইচ্ছে করে তোমায় আঁকি | কিন্তু রঙ কই ! কারণ আমার এই সংশয়ের উঠোন জুড়ে এত অজস্র রঙের মেলা ... আমার ভালোবাসার এত আগ্রাসী স্পর্শগ্রাহ্যতা ......

    ফ্রিডা
  • kiki | 127.194.73.50 | ০৪ জুলাই ২০১৪ ০০:১৬640714
  • ফ্রিডা কে নিয়ে তুমি কি বালাতে লিখছিলে, না বৌমা? খুব চেনা লাগছে।

    যাহোক! মন দিয়ে পড়ছি।
  • Ishani | 116.216.137.23 | ০৪ জুলাই ২০১৪ ০০:৩২640715
  • আমিই লিখেছিলাম | সংক্ষেপে | সে একটা ভিন্নধর্মী ব্লগ ছিল | তার নাম ছিল ডায়েরির ছেঁড়া পাতা |
  • Rit | 213.110.246.22 | ০৪ জুলাই ২০১৪ ০১:৪২640716
  • এ টইটা প্রিন্ট নিয়ে রাখব।
  • kiki | 127.194.75.159 | ০৪ জুলাই ২০১৪ ১১:০৯640717
  • তৃষা,
    ঃ)
    ঋত্বিক,
    আমাজ্জন্যও রাখবি তো। আর তোর সেই বেড়াতে যাবার একটা ব্লগ খোলার ছিলো না? একটা এখানেও টই খুলে দে না কেন!
  • Ishani | 69.92.136.75 | ০৪ জুলাই ২০১৪ ১২:০৯640718
  • জ্যোৎস্নার জল
    ..........................

    আলি আকবর খাঁকে একবার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত জিজ্ঞেস করেছিলেন , " আপনি মধ্যে মধ্যে এমন দুরূহ লয়কারীতে ঢুকে যান , লয়কে যদৃচ্ছ বাড়ান কমান , তানের প্যাটার্নগুলির দৈর্ঘ্যের কোনো হিসেব থাকে না , অথচ ঠিক সময়ে 'সম'-এ পৌঁছে যান , এটা কী করে সম্ভব করেন ?" আলি আকবর খুব সংক্ষেপে বলেছিলেন , " কবিতাটা ঠিকঠাক মিলে গেল কিনা বুঝতে পারি | " এরপরে তিনি কিঞ্চিত বিশদ হন | " তালের ঠেকার এক একটি আবর্তনকে কবিতার এক একটি লাইন ভাবো | তার পরের লাইনটির বিভিন্ন শব্দ ছোট বড় হতেই পারে | কিন্তু তাদের যোগ করলে লাইনটা আগের লাইনের সমান হল কিনা , এটা যদি ঘটাতে পারো , তবেই হল | " অর্থাত কবিতাটা ঠিকঠাক মিলে যাবে |

    বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে হাতে এল " বামনের চন্দ্রস্পর্শাভিলাষ "| প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড (অপার কৃতজ্ঞতা : দিশা প্রকাশনী ) | বিখ্যাত সরোদিয়া শ্রী বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর স্মৃতিচারণ | বইটির কথা প্রথম শুনি আমার বান্ধবীর কাছে | কলকাতায় থাকি না , অথচ এ সব বই পড়ব না ! তাহলে আর বেঁচে থেকে লাভ ? আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে বই দুটো যোগাড় করল সে . আর আমিও আদ্যন্ত মজে ....সুরে আর লেখনীর জাদুতে |

    বুদ্ধদেবের সরোদ প্রথমবার যখন শুনি , তখন আমি স্কুলের শেষ ভাগে | রবীন্দ্রসদন | সকাল দশটা | দিনটি রবিবার | যুগলবন্দী | সরোদ ও পিয়ানো | বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত - ভি. বালসারা | এর আগেও সরোদ শুনেছি | আলি আকবরের | তখনও আমজাদ শুনিনি | সবক'টি তারযন্ত্রের মধ্যে , কেন জানি না , সরোদ আমার সবচেয়ে পছন্দের | আর ওই যে এক যুগলবন্দী ..কী বিচিত্র..সরোদ আর পিয়ানো ... আমার মনে ঝিমঝিম ঝংকার তুলে দিয়ে গেল | সেই থেকে আমি বুদ্ধদেবের অনুরাগিনী হয়ে গেলাম | সেই তাগিদেই এই দু'টি বই পড়া , আর এই নিয়ে দু'চার ছত্র লেখা |

    প্রথমেই লেখকের যে গুণটি আমাকে আকৃষ্ট করল , তা হল ..বিনয় | নিজেকে একেবারে লো প্রোফাইলে রেখে ( বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার দুরূহ সংকল্প ! ) যেভাবে নিজের জীবনের কথা , গুণীজন সান্নিধ্যে সংপৃক্তির কথা , বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা ও দীক্ষাগুরুদের অকৃপণ দাক্ষিণ্যলাভের কথা , পারিবারিক নানা আপাততুচ্ছ ঘটনা ..যা থেকে তাঁর জীবনের মূল্যবোধের সূচনা… বুদ্ধদেব অতি অনায়াসে অতি সাবলীল দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন , আমার পড়তে পড়তে মনে হল , এও যেন সেই আত্মোপলব্ধির এক দুরূহ লয়কারী ও বিস্তার |

    এই স্মৃতিকথার মুখড়াটি বড় মধুর ও কৌতুকময় | বুদ্ধদেবের যখন সাড়ে তিন বছর বয়স , তখন তাঁর মা বাবা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর শহরের টাউন হলে | মিউজিক কনফারেন্স | প্রধান আকর্ষণ সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ গোস্বামী | ছেলের যদি সঙ্গীতে সামান্য অনুরাগ জন্মায় , সম্ভবত সেই আশাতেই | সবে জ্ঞানপ্রকাশ গান ধরেছেন , ছেলে বিপুল বিক্রমে চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে সঙ্গীতাচার্যকে এক ধমক , " চুপ কর ! অত গোলমাল করছ কেন ? অত চ্যাঁচামেচি কোরো না "| অত:পর মায়ের কাছে চড় ও কানমলা |
    এর পরের কেলেঙ্কারী বছর দেড়েক বাদে | বরিশালে | বুদ্ধদেবের বাবার শখ ছিল বাড়িতে গানের আসর বসানোর | নানা লোকজন আসতেন | এঁদের মধ্যে ছিলেন দুই ভাই | একজন "বাঁশিকাকু", অন্যজন তাঁর সঙ্গতকারী অনুজ | বুদ্ধদেবের খুব শখ বাঁশি বাজানোর | রথের মেলায় মা কিনে দিলেন না | অগত্যা বাঁশিকাকু ভরসা | " আপনার তো এতগুলো বাঁশি , আমাকে একটা দেবেন ?" ভদ্রলোক দিলেন | বললেন, "বৌদি, বাচ্চাটাকে আর বকাবকি করবেন না | " সেই দাতা ও দান মূল্যায়নের বয়েসে পৌঁছে বুদ্ধদেব জেনেছিলেন | বাঁশিকাকু ছিলেন স্বয়ং পান্নালাল ঘোষ আর সঙ্গতকারী অনুজ তবলা শাস্ত্রজ্ঞ নিখিল ঘোষ |

    এর পর বুদ্ধদেবের গুরুলাভ | রাধিকামোহন মৈত্র | বুদ্ধদেবের বয়স তখন বছর দশ -এগারো | তাঁর হাতে গুরু তুলে দিয়েছিলেন নিজের বাল্যকালের ব্যবহৃত তারযন্ত্রটি |

    ঠিকঠাক মাপের সরোদ হাতে আসে ম্যাট্রিকের ফল প্রকাশের পর | তাও মায়ের জন্য ! মা ছেলের হয়ে স্বামী আর ছেলের শিক্ষাগুরুর সঙ্গে প্রভূত রাগারাগি করেন |

    অবাক হয়েছি বড়ে গোলাম আলি খাঁর নানান ঘটনা জেনে | " বিশাল মোটা চেহারা , কালো রং , উড়ন্ত ডানা-মেলা চিলের মতো ইয়া গোঁফজোড়া , হাতে একটা বেঁটে লাঠি , মাথায় কালো লোমের ফেজ টুপি | কোলে একটা যন্ত্র | দেখতে পিঁড়ির মতন | বাঁধা শেষ করে মিনিটখানেক টুং টাং করে বিভিন্ন তারকে ছাড়লেন , একটা তান অথবা গৎ যেন বেরিয়ে এল যন্ত্রটার ভিতর থেকে | শেষকালে তারসপ্তক থেকে মন্দ্রসপ্তক পর্যন্ত একটানা সুরের একটা ঝর্ণা | গলা যখন ছাড়লেন , আমার মতো অর্বাচীনেরও শরীর হিম হয়ে গেল | সঙ্গীতসমুদ্রে আমার সেই প্রথম সত্যিকারের অবগাহন | নড়েচড়ে বসবার শক্তিও ছিল না ... সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম , সত্যিকারের গান ব্যাকরণ- না - জানা লোককেও কীভাবে স্তব্ধ করতে পারে !"

    এরপর ওস্তাদ হাফিজ আলি খাঁ | মঞ্চ তখন "দরবার গোয়ালিয়র "| টকটকে রং , বাদশাহী সাজ | বুদ্ধদেব সেই প্রথম হাফিজের মুখোমুখি | উল্লেখ করেছেন ঝালার কথা | রাগ টোড়ি | "ঝালার প্রতি চারটি দানার মধ্যে প্রথমটির থেকে বাকি তিনটি একটু দূরে সরানো | ফলে তার একটি অননুকরণীয় চাল | দ্রুত নয় , মধ্যগতিতেই তার শব্দসুষমা | লয় বাড়ালে তাকে রাখা মুশকিল হবে ! "

    মন টুকরো টুকরো অজস্র ছবি | আমিও যেন বুদ্ধদেবের সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম সেই সব অনুষ্ঠানে | গল্পের ছলে এসেছে ওস্তাদদের খানাপিনার প্রসঙ্গ | হান্ডা হান্ডা বিরিয়ানি , দিস্তে দিস্তে পরোটা , সেগুলিকে যথাযথ মর্যাদা দেবার উপযোগী কাবাব আর চাঁপ , আর চপচপে ঘিয়ের গপ্প |

    জেনেছি বাবা আলাউদ্দিন খাঁয়ের কথা | এই মানুষটি সম্বন্ধে আগেও পড়েছি অনেকের লেখায় | কিন্তু এঁরা এমনই বিরল ব্যক্তিত্ব , যে এক একজনের লেখা এক একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে নতুন আলোয় | একটি ঘটনার কথা জানলাম | বুদ্ধদেবের মা গেছেন দেখা করতে | আলাউদ্দিন উঠে এসে নিজের গায়ের চাদর বিছিয়ে দিয়েছিলেন ... বুদ্ধদেবের মাকে বসবার জন্য | আর বলেছিলেন, "কী শোনাব আজ ?"

    এই বই পড়ছি আর ভাবছি , সত্যিই বিদ্যা তখনই সম্পূর্ণতা পায় , যখন তা শুধু জ্ঞান নয় , বিনয়ও দেয় | প্রত্যেকটি মানুষ একেবারে "তৃণাদপি " বিনয়ী |

    এসেছে রাধুবাবুর সঙ্গে জ্ঞানবাবু (জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ) -র সৌহার্দ্যের গল্প | এসেছে বিলায়েত খাঁর কাছে প্রথম শোনা রাগ " গৌরীমঞ্জরী" প্রসঙ্গ |

    একদিন নাকি জ্ঞানবাবু বুদ্ধদেবের বাজনা শুনে রাধুবাবুকে বলেছিলেন , "ভালো করে পালিশ করুন , মনে হয় কিছু একটা দাঁড়িয়ে যাবে | " গুরুজি সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, "দূর মশাই , এখনও ঘষাই শেষ হয়নি | " বারবার গুরুজি শিষ্যের হাত পা শক্ত হবার জন্য তাকে জলে ফেলে দিয়েছেন | মহামন্ত্র ছিল একটিই , "যতদিন বাঁচি , ততদিন শিখি | "

    বুদ্ধদেব জানিয়েছেন তাঁর বাবার এক অনন্য অভিজ্ঞতার কথা | বাবার বন্ধু ছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় | একদিন ভীষ্মদেবের বাড়িতে আসেন খলিফা বাদল খাঁ | নব্বই বছরের জরাজীর্ণ বৃদ্ধ | শিষ্যকে তালিম দিতে | কন্ঠ ক্ষীণ কিন্তু শিষ্য একাগ্র | ভীষ্মদেব গুরুকে খাইয়ে দিয়ে পকেটে পাঁচ টাকা গুঁজে দিলেন | কারণ গুরুর চূড়ান্ত দারিদ্র্যদশা | খাঁ সাহেব গুটিগুটি হাঁটছেন , বুদ্ধদেবের বাবা পিছুপিছু | ফুটপাথে এক অন্ধ মুসলমান ভিখারী | খাঁ সাহেব তাঁর পকেটের পাঁচটি টাকা তুলে দিলেন তার হাতে | পেছনে বিস্ময়ে নির্বাক বুদ্ধদেবের বাবা |

    বুদ্ধদেবের প্রথম অডিশন এবং তাতে কী নিদারুণ আত্মঘাতী পদস্খলন ! বিলম্বিতের গৎ বাজাতে গিয়ে ভালো করে তালিম না থাকার জন্য কী কেলেঙ্কারী ! এবং গুরুদেব আর তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের কাছে শিষ্যের নিগ্রহ | জ্ঞানবাবু বলেছিলেন, "এ যে একেবারে পিলার অফ সাকসেস ! " রাধুবাবু রাগে কাঁপছেন , "এ:, ট্যালেন্টের কাঁপ ছটকে গিয়েছে ! বেশ হয়েছে !"

    এরপর ধাপে ধাপে এসেছে প্রেসিডেন্সি কলেজের, শিবপুর ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের কাহিনী , অগণিত শিক্ষকের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার পর্ব , বন্ধুদের ফরমাশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রেওয়াজে বসার আগে সরোদে বাজানো..'' পাতলি কমরি হ্যায় , তিরছি নজর হ্যায় " অথবা " এক ভুল্লর ভাল্লর লেড়কি এক পাগল উগল ছোঁড়া ..''...আমি পড়ছি আর হাসছি....

    ইঞ্জিনীয়ারিং ড্রয়িং পরীক্ষায় ট্রেসিং আর কাঁটা মারা . কিছুই বদলায় না | মনে পড়ে গেল আমাদের কীর্তি !

    ফৈয়াজ খাঁ , আমির খাঁ , কেরামুতুল্লা , শামতাপ্রাসাদ , রবিশংকর থেকে অজয় ও কৌশিকী চক্রবর্তী | অজস্র গুণীজন আসা যাওয়া করেছেন ছত্রে ছত্রে | আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি | এসেছে বিদেশযাত্রা , শিক্ষানবিশী , বিবাহ প্রসঙ্গ | সব কিছু অনায়াস ও স্বচ্ছ |

    রবীন্দ্রসদন | বিলায়েত খাঁ আর কেরামতুল্লা খাঁ | বিলায়েত যতবার তান করে সমে এসে পড়েন , কেরামত সেখান থেকেই তবলা নিয়ে ওঠেন | তান যেখানে ওঠে , যেখানে থামে , যেভাবে দিক পরিবর্তন করে , ছন্দ, প্যাটার্ন , যে অভাবনীয়ভাবে মুখড়া ধরে সমে পড়া , কেরামত খাঁ তার কোনটিকেই বাদ না দিয়ে প্রতিটি অংশের নির্ভুল প্রতিচ্ছবি নিয়ে সমে পড়ছেন | শ্রোতারা উন্মাদপ্রায় | সেতার নয় , তবলা শুনে | তবলা প্রতি পলে পলে বুঝিয়ে দিচ্ছে তার কোন জায়গাটা সেতারের কোন অংশের জবাব | বুদ্ধদেব বর্ণনা করছেন , আমি পড়ছি... এবং রোমাঞ্চিত হচ্ছি | লেখক লেখেন..কুশলী হলে আমরা তৃপ্ত হই | কিন্তু লেখক যখন ছবি আঁকেন , আমরা রোমাঞ্চে শিহরিত হই |

    শুধু বুদ্ধদেব আশ্চর্য নীরব আমজাদ আলি খাঁ -র বিষয়ে | অবশ্য এক জায়গায় বলেছেন , শিল্পীদের প্রত্যেকের নিজস্ব ঘরানার প্রতি তীব্র আনুগত্য থাকে , যা হয়ত ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিযোগিতামূলক অনুভূতির জন্ম দেয় | আমি দুজনেরই অনুরাগিনী | তাই এ নিয়ে আর নিজের মনে প্রশ্ন তুলিনি |
    বুদ্ধদেব ঋণস্বীকার করেছেন অসংখ্য ব্যক্তিত্বের কাছে , যাঁরা নিজেরা নামযশ পাননি ; কিন্তু অন্য সবাইকে উত্তরণে সহায়তা করেছেন |

    অজস্র হীরের কুচি আলো ছড়িয়েছে এই লেখায় | অনেক সোনালি মুহূর্ত ধরা পড়েছে দুর্লভ আলোকচিত্রে | বুদ্ধদেব শুধু দক্ষ বাদক নন , দক্ষ কথকও | তাঁর সরোদ যেমন কথা বলে , লেখনীও | সকল রসে মদির বললেও অত্যুক্তি হয় না | মজলিশি কথকতা নিমেষে রূপান্তরিত হয়েছে এক ধ্রুপদী সঙ্গীতালেখ্যে | আমার তো সাধ্যই হয়নি এই ঐকতান থেকে মন আর শ্রুতি ফিরিয়ে রাখার | আমি এই বই দু'টির সমালোচনা বা আলোচনা কোনটিই করছি না | সে যোগ্যতাই নেই আমার | কাজেই ধৃষ্টতা প্রকাশ করার মতো অর্বাচীনতাও নয় | এই লেখা আমার মুগ্ধতা আর অনুরাগ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছেটুকু কয়েক ছত্রে প্রকাশ করার প্রয়াস মাত্র |
  • b | 135.20.82.164 | ০৪ জুলাই ২০১৪ ১২:৫৬640720
  • বইটা যোগাড় করতে হবে বটেক। ঈশাণী ধন্যবাদ জানবেন।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন