এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বাবায়াগা

    sosen
    অন্যান্য | ১৭ জুলাই ২০১৪ | ২৬৭৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • sosen | 125.241.48.65 | ১৭ জুলাই ২০১৪ ২১:৪৬647139
  • মাঠের একপাশ দিয়ে যে মেঠো রাস্তাটা চলে গেছে, সেটা দিয়ে টিপকল অব্দি গিয়ে বাঁ দিকে বেঁকে গেলে উঁচু পাম্প হাউস, তার পিছনেই রঞ্জনমুদির বাড়ি। আর উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে পুকুর, জলা বাঁশ ঝাড়ের খোয়াকুচির বাধা পেরিয়ে যেতে পারলেই নাকি সে এক ডাইনিবুড়ির বাড়ি, তার নাম বাবায়াগা।
    এর বেশি আর গল্পটা সে জানে না। বাবায়াগার গল্পটা।
    বাবায়াগার গল্পটা একটা লাল মলাট-অলা বইয়ে আছে। সেদিন যখন টুকুনদাদামশাই ছোট্ট ফুচি-নাতনিকে যতীনের জুতোর গল্পটা পড়ে শোনালেন, সেদিন সেও হাঁটু-দুটো জড়ো করে বসে ছিল। দেরী হয়ে যাচ্ছিল, সন্ধে পেরিয়ে যাচ্ছিল, তবু বসে ছিল। ফুচি নাতনি এমনিতে খুব দুষ্টু, কিন্তু গল্প শোনে চোখ গুলগুলিয়ে, পায়ের কাছে লুটোপুটি খায় তুলোর ভালুক, আধ-খাওয়া আপেল। যতীনের জুতোর গল্প শেষ হলে, বাবায়াগার গল্প শুরু হলো। গল্প শুনতে শুনতে ফুচি ঘুমিয়ে পড়লে আপেলটা তুলে টুকুনদাদামশাই তাকে দিয়ে দিলেন। বললেন, ধুয়ে খেয়ে নে।
    ধুলো-লাগা আপেল ট্যাঁক-কোমরে কাপড়ে বেঁধে সে বাসার পানে হাঁটে। পুকুর, জলা, বাঁশ ঝাড়, খোয়া-কুচির রাস্তা পেরিয়ে। এইদিকে তাদের বস্তি।
    একদিন-ও বাবায়াগার দেখা পাওয়া যায় না। ডাইনিবুড়ির বাড়ি কোথায়, কে জানে?
    হু-উ-ই দূরে ট্রেনলাইন থেকে ছেলে দুটো হেঁটে ফেরে। ওদের দাঁত কালো, চোখ বসা, গালে ছোপ ছোপ। ওদের বয়েস সাত আর নয়।
    ওরা গল্প শুনতে চায় না। মতি যতীনের জুতোর গল্প মনে করে করে শোনাতে গিয়েছিল ওদের। ছোটটা ঘুমিয়ে পড়ল, বড়টা বলল, মা, চুপ কর। মাথা কিলবিল করে।
    ভিক্ষার দলে ভিড়ে রোজ নাহক কুড়িটা টাকা আনে বড়। আরো একটু পায়, কিন্তু বিড়ি খায়, আঠার ধোঁয়া টানে। মাথা তো কিলবিল করবেই।
    আয় বাবা, মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।
    এক ঝটকায় হাত ফেলে দেয় বড়। ঘুমুতে দিবি কি না?

    ভেজা ভেজা চোখ হয় মতির। ঘরের মাঝ বরাবর শাড়িটি টেনে দিয়ে সে সানকিতে তরকারী বেড়ে রাখে। নিজে কাজের বাড়ি থেকে আনা রুটি দিয়ে তরকারী দিয়ে রাতের খাওয়াটি সেরে নেয়। তারপর মাদুর পেতে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমিয়েও পড়ে। উঁচু দাঁত দুটি একটু হাসি হাসি হয়ে কালচে ঠোঁটের উপর জেগে থাকে।
    রূপকথার স্বপ্ন দেখে মতি। নীল জলের পুকুর, ফুলের গাছের পাশে একখানা সাজি নিয়ে বসে ফুল তুলছে সে, গাছে আপেল ধরেছে, লাল রঙের, তাদের গায়ে সাদা ইস্টিকার লাগানো। ভালো খেয়ে দেয়ে রূপকথার দেশে থেকে শরীরটিও কেমন শুধরেছে তার, দেখসে। গোল গোল হাতে ও কিসের চুড়ি, সোনার? হলুদ ছাপা কাপড়, একেবারে যেন ফুচির মা নতুন বউ। এমন সময় পিছনবাগের দুয়ারে এসে ডাইনি বুড়ি বাবায়াগা ঠকঠক লাঠি ঠোকে।
    ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে মুখে একখানা লবঙ্গ পোরে মতি। তারপর ধীরে সুস্থে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে, এসেই একখানা খিঁচুনি খায়। গজ গজ করে কাজলমাসি।
    তোরে আর খদ্দের দিবুনি। চারবার দরজা ঠুকতে হয়, বলি মাগনা শোবে নাকি ভালোমানষের পো, যে তুমি গতর নাড়াতে পারুনি?
    মতি হাত তুলে খোঁপা টি ঠিক করতে করতে হাসে, বোকার হাসির মধ্যে না-হক খানিক স্বপ্নোত্থিতা রাজকুমারীর হাসি মিশেল খায়। তার মুখের ওপর চাঁদের আলো চকচক করে ।

    চেনা লোক, অল্পবয়েসী, বাবুপাড়ার ইস্কুল মাস্টার, দেখে আরাম পায় মতি। অচেনা খদ্দেরে তার ভয়। একমুখ হেসে বলে অমা, মাস্টার যে গা। অনেকদিন পর!
    তিনঘর দূরে বাপের ঠিক ঠিকানা হীন বড় আর ছোট অঘোরে ঘুমোয়। বস্তির কয়েকঘরে গেরস্তদের বাস, তারা মেয়ে-ব্যাটায় গতর খাটিয়ে খায়, তাদের ছেলে মেয়েরা মুনিসিপ্যাল ইস্কুলে পড়ে। তারা আগে কলে জল তোলে, আগে মুনিসিপ্যালের বাথরুমে যায়, ছোঁয়া লাগায় না। ঝগড়া লাগলে গাল দ্যায় বটে।
    মতি, কড়ি, তুলতুলি হাফ-গেরস্ত। কারোর বাড়ি ব্যাটাছেলে আর নাই, কারোর কখনই ছিল না। পাঁচ পাড়ার উপোসী ব্যাটাছেলেরা বাড়ি ফেরার সময় চুপি চুপি শুয়ে যায়, বাঁধা রেট দুইশো টাকা, তার পঁচাত্তর কাজলমাসির। সবাই জানে, চুরি নাই, লুকোছাপা নাই, শুধু গলা ফুটে বলতে মানা।

    এই যে শরীরের গর্তে ঢুকছে বেরোচ্ছে বাবুরা, এতে কি মতির আরাম নাই? আছে বৈকি, ষোলো আনা আছে। আর কি টান আছে বলো দেখি এই হাফ-গেরস্থালিতে?

    গল্প আছে। আস্তে আস্তে এই যে বাবুর পিঠটা মালিশ করে দিচ্ছে মতি, আর বাবু আরামে ঘাড় ফোলাচ্ছে , আর কত কি বলছে। মন দিয়ে সব শোনে মতি। রূপকথার মত। এই য্যামন বাবুর বউ আছে, সেও ইস্কুলে চাকরি করে, অনেক দূরে , পাহাড়ের দিকে ইস্কুল, আর বাবুর চাকরি এই করিমপুরের ইস্কুলে। কেউ চাকরি ছাড়ে না, মাসে একবার দেখা শোনা, দুজনেই চাকরি কাছাকাছি আনার চেষ্টা করে, সে আর হয় না। ভাল্লাগে কি?
    খুব টের পায় মতি। তেলের মত বাবুর গা চুইঁয়ে পড়ে না ভালো-লাগা, কেমন ধূপ ধূপ গন্ধ তার। সেই রকম ধুপের গন্ধ-অলা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নাকি বাবুর বউ ছাতা হাতে ইস্কুলে যায়। চোখে চশমা, বাবুর ছেড়ে রাখা প্যান্ট , মানিব্যাগের দেওয়াল থেকে গম্ভীর চশমা-চখি বউছবি উঁকি মারে, দেখেছে মতি।
    একেকজনের গায়ের থেকে গল্প টেনে নেয় মতি, ভারী সুখ তাতে। কিন্তু সে কথা বলতে যাও দেখি কড়িকে। মুখ বেঁকিয়ে সে বলবে, পয়সা রোজগারের কথা, দুবার নয় চারবার শুলি কাজে দিবে গা। তুই একখানা হাঁদা মেয়ে, তোরে একবারের ভাড়া দিয়ে দুবার আরাম করে ন্যায়।
    তা হবে। একটু হাঁদাই আছে মতি, কিন্তু গল্পের নেশা আর তাকে ছাড়ে কই?
    বাবু, তুমি বাবাইগার গল্প জানো?
    কি গা বললি?
    বাবায়গা, লাল মলাটের বইয়ে আছে-টুকুনদাদা পড়ে শোনায়।
    ওহ। এক গাল হেসে ফ্যালে মাস্টার, সে তো ছোটদের গল্প, আমি ভুলে গেছি। বেল্ট আঁটতে আঁটতে বলে আচ্ছা, তোকে বইখান দেব।
    তার মুখখানা ছোট হয়ে যায় -আমি তো পড়তে জানিনে।

    তা-ও তো।
    বিবেচনা করে বলে মাস্টার, আচ্ছা, কখনো পড়ে এসে তোকে শোনাব। নেক্সট যেদিন আসব।

    ঘরে এসে শুলে বেড়ার ফাঁক দিয়ে চিরচিরে চাঁদের আলো পড়ে গায়ে। কেমন কুঁক্ড়ানো দেখায় চামড়া।
    আচ্ছা, সত্যি ডাইনিবুড়ি এই বস্তিতে থাকে না তো? কেমন ভয়ে গা শিউরয় মতির। পাশের ঘরে চতুর্থবার কড়ির গুঙ্গনোর আওয়াজ পাওয়া যায়, শুনতে শুনতে ঘুম আসে মেঘের মত, চাঁদ ঢেকে।

    বাগানের গাছগুলোতে ঝপাস ঝপাস করে জল ঢালতে থাকে নবনীতা। সদ্য কুঁড়ি বেরোনো গাছগুলো, বর্ষায় লতিয়ে ওঠা লতাগুলো বেজায় মুষড়ে যায়। বারান্দায় বসে টুকুনদাদামশায় ফুচিকে খেলা দিতে দিতে আড়চোখে দ্যাখেন, কিছু বলতে সাহস হয়না। বৌমা তাঁর বেজায় রাগী, আরো রেগে গেলে ফুচিকে ঠাসঠাসিয়ে চড়থাপ্পড় মেরে দ্যায়। তার চেয়ে অবোলা গাছগুলোর উপর দিয়ে যাচ্ছে যাক। রাতে বড্ড ঝগড়া হয়েছে ছেলে-বৌমায়, ফুচি উঠে পড়ে কেঁদে উঠেছিল। তখন ফিসফিসিয়ে তর্কাতর্কি। বচসা অশান্তি ফিসফিসিয়ে করলেও শুনতে পাওয়া যায়। ছোট্ট বাড়ি, ফাঁকা জায়গা, চাঁদের আলোয় ভেসে যায় ইঁটের ছাদ। সে আর প্লাস্টার করা হয়ে ওঠেনি। ঐখানে একদিন চেয়ারে বুড়োবুড়ি মুখোমুখি বসবেন ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বুড়ির আবার তর সইল না।

    কাজেই রাত্তির জেগে ছোট্ট টেবিলল্যাম্পের আলোয় টুকুনদাদামশায় বই পড়েন। আর ঝগড়া শোনেন। কত রকমের, কত কারণের ঝগড়া। জানলা দিয়ে চাঁদের আলোয় ধোয়া মেঠো রাস্তা দিয়ে অনেক রাতে কারা সব এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হেঁটে আসে। সন্ত্রস্ত পায়ে ঢুকে যায় ছোট ছোট গর্তে। ওদিকে বস্তি।

    ফুচিকে শিখিয়ে দিতে হয়, ওদিকে ডাইনিবুড়ি বাবায়াগা থাকে, তার লোহার দাঁত, তার হাড়ে হাড়ে লেগে শব্দ হয় খটাখট।
    চাঁদের আলোয় তার ঝাঁটা দেখা যায়, তার তাঁতে মাকু দৌড়ে যায়। স্টেশনে মাঝরাতের এক্সপ্রেস এসে দাঁড়ায়।
    সকালবেলা না খেয়ে ছেলে আপিস বেরিয়ে যায়, কপালে গভীর ভ্রুকুটি।

    ও বৌদি, অত জল দিচ্ছ কেনেক? গাছ্গুলিন মরে যাবে তো।
    আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে মতি এসে দাঁড়ায়, দুটি দাঁত উঁচু, মুখে নির্বোধ হাসি। মেয়েটার মুখে কি এক ধরনের মায়া আছে।
    নবনীতা আরো জোরে এক বালতি জল ঢালে, বেশ করছি। ফটর ফটর করিসনা। বাসন ধুয়ে ঝুড়িতে তুলেছিস? সব বাসন মুছেছিস?
    সব মুছেছি গো, তুমি ভাত চড়াবে না? দাদাবাবু সকাল সকাল বেইরে গেলেন বুঝি?
    হুম।

    আস্তে আস্তে হাত ব্যথা হয়ে আসে নবনীতার। রাগ-ও স্তিমিত হয়। বালতি নামিয়ে রাখে, জলের কল বন্ধ করে।
    এদিকে কাজের লোক পাওয়া খুব মুশকিল। এই থাকে, এই চলে যায়, স্টেশনের কাছাকাছি বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে, সেখানে সারা দিনমানের কাজ করে। ভিতরদিকে ঠিকে কাজ কেউ করতে চায়না। এই মেয়েটা একটু কুঁড়ে। কিন্তু খুব পরিষ্কার ঝরিষ্কার, মুখে কথাও তেমন নেই, একটু বোকা বোকা হাসি। যদিও ওর ছেলেরা ভিক্ষে করে শুনে গা গুলিয়ে উঠেছিল নবনীতার, কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল ওর কোনো ছেলেই এদিকে আসেনা, ছেলেদের প্রতি ওর টানও তেমন নেই, মা বিড়াল যেমন জন্ম দিয়ে দুধ খাইয়ে তারপর ছানাদের কথা ভুলে যায় তেমনি মতিও। ছেলেদের শরীরখারাপের কথা বলে কাজটাজ কামাই করে না। ঘর মুছে বাইরের বারান্দাতে বসে থাকে, দুপুরের এক থালা ভাত দিলে খেয়ে নেয় তৃপ্ত মুখে, প্রয়োজন মত ভারী কাজগুলো করে দিয়ে, বিকেলে বাসন মেজে তারপর যায়। দুপুরে দাওয়ায় শুয়ে ঘুমিয়েও নেয়। রোগা-পাতলা চেহারা, ভারী বুক,চওড়া পেছন, ওর দিকে তাকিয়ে তখন বেশ হিংসে হয় নবনীতার। সে চিরকালের মোটাসোটা মানুষ, বাচ্চা হওয়ার পর আরো মেদ জমেছে গায়ে। হাতে সোনার বালা এঁটে বসে, খুলে রাখতে হয়।
    কি খাস রে মতি, এমন সুন্দর চেহারা তোর।
    মতি অবাক হয়ে হাসে, যা দাও বৌদি, তাই তো খাই, ঘরে এক কড়ার তরকারী রাঁধি।
    নবনীতা রাঁধতে বসে, দাঁড়িয়ে রান্না করতে পারেনা সে, হাঁফ ধরে, কাজেই গ্যাসের উনুন নিচে নামিয়ে রাখা। একটু সেকেলে মতন রান্নাঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসে কুটনো কুটে দ্যায় মতি।
    তোর ছেলেদের বাপ কোথায় থাকে?
    এ প্রশ্নের জবাব ঠোঁটস্থ মতির, সে আমারে ছাইরে চলে গেল।
    গ্যালো তো গ্যালো, তা তোর তাকে মনে পড়ে না? দুক্ষু হয় না?

    এই যে মিছি মিছি ঝগড়া রাগারাগি হয়ে যায়, থাইরয়েড বাড়ার জন্যই হবে, দীপ্তেন রাগ করে বেরিয়ে গেলে সারাটা দিন নবনীতা ভিতরে ভিতরে গলে যেতে থাকে, তরলের মত, ওই তো একটা মানুষ তার, আজ এলে আর রাগ করবে না সে। আর এই একটা মানুষ ছেড়ে দিয়ে চলে গেল, মতির দুক্ষু হয় না? এই প্রশ্নের কুলকিনারা পায়না নবনীতা। কেমন ছিল সে লোকটা, যাকে ঘিরে কোনো গল্প নেই?

    মতি ভারী আতান্তরে পড়ে যায়। কাজলমাসী যা শিখিয়ে দিয়েছে তাই বলেছে, কিন্তু গল্প নেই কি গো। কত গপ্প। কিন্তু সেসব ফুচির মা নতুন বৌকে বললে তার কাজটি কি আর থাকবে? কড়ির মত চারটে বাবু নিতে হবে তখন রাতে।
    তাই মতি মুখ নিচু করে সবজি কাটে। কাটতে কাটতে গল্পের ঘোরে ডুবে যায়। কড়াই-এ ছ্যাঁক ছোঁক ফোড়নের আওয়াজ হয় তখন।
    বড়র বাপটা যে কে, সেটা ভেবেই পায় না মতি। রেল থানার সেই পুলিশবাবু? তেনার পেটের আর বুকের মাঝে মস্ত জরুল ছিল, ভারী মোটা মানুষ, চোদ্দ বছরের মতি কেমন চ্যাপ্টা মতন হয়ে গিয়েছিল, আর ভ্যাবলা মত, কিন্তু সেসব ছাড়িয়ে মতির মনে আছে, পুলিশবাবুর পকেটে থাকত কিরিম বিস্কুট, কাজকম্মের পর অন্ধকারে থেবড়ে বসে তারা বিস্কুট খেয়েছিল, আর পুলিশবাবু বলেছিল তার বয়েসী একটা মেয়ে আছে পুলিশবাবুর, এই বলে ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলেছিল অত বড় লোকটা। মতি ভারী অবাক হয়েছিল, তার তো লাগেনি তেমন, একটু দম আটকেছিল, এইটুকুই শুধু। তার পর একটা টর্চ জ্বালিয়ে পুলিশবাবু তার মুখখানা উঁচু করে দেখেছিল, আর বিড়বিড় করে বলছিল---কণার দাঁতগুলো এরকম উঁচু নয়--না নাহ।
    নাকি সেই গুন্ডা মতন লোকটা, আ:, সে খুব ব্যথা পেয়েছিল, কিন্তু জ্বলুনি-অলা একরকম আনন্দ-ও, বেশ কয়েকবার এসেছিল লোকটা, কামড়ে দিত, দাগ হয়ে যেত গায়ে, তখন মতি স্টেশনের পাশে বস্তিতে থাকত। শেষ একবার লোকটা এসেছিল একটা নুলো লোককে সাথে নিয়ে, সে নাকি তার ভাই, ডবল টাকা নিয়েছিল তার জন্য ইস্টিশনের খিলওয়ানদাদা। নুলো লোকটা যখন চেষ্টা করছিল প্রাণপণ, কিন্তু পারছিল না, খুব মায়া হচ্ছিল মতির। তখন হঠাত প্লাস্টিকের পর্দা সরিয়ে গুন্ডা লোকটা ঘরে ঢুকে এলো, আর দুহাতে যত্ন করে ধরে রইলো নুলোকে, একবার তাকে খেঁকিয়েও উঠলো। আর তার পর, যখন সাইকেলের ক্যারিয়ারে ভাইকে বসিয়ে চলে গেল গুন্ডা মত লোকটা, ইস্টিশনে হাওয়া উঠলো, একটু ঝড়ো----
    নাইটিটা পরতে পরতে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে মতি লোকদুটোকে দেখছিল, ভাবছিল, ওরা কি আজ একই বাড়িতে ফিরবে, এক-ই তরকারী দিয়ে ভাত খাবে? মা আছে কি ওদের বাড়িতে, জেগে এখনো, ভাতের থালা বেড়ে, যেমনটা কিনা গেরস্ত ঘরে থাকে কিংবা সিনেমায়---
    সেই গুন্ডা লোকটা একটা কথাও তেমন বলেনি তার সাথে কখনো-কাত হয়ে শো' কিংবা নড়লে এক চড় মারব, এই সব ছাড়া।

    বড় খেতে বসলে রাতে বড়র মুখটা তুলে দেখার চেষ্টা করে মতি, চিবুকে আঙ্গুল দিয়ে। সব মনে আছে, কিন্তু কোন গল্পটা নেবে সে?
    বড় এক ঝটকা মেরে হাতটা ফেলে দ্যায় "খেতেও দিবিনে, নাকি!"
    গল্পগুলো মতিকে ঘিরে ঘোরে, কিন্তু বৌদিমনিকে বলা যায়না, অমন সুন্দর বৌদিমনি, ফর্সা, গোল গোল হাত, এক এক থাবা মাংসে ভর্তি গাল, লাল ছোপ ধরা, বলতে সাধ যায়, কিন্তু উঁচু দাঁত দুটোকে দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে রাখতে হয়। এসব বুঝি নোংরা গল্প, কিন্তু মতি তো কই বোঝে না, কোনখানটা নোংরা, অমনিই তো, মানুষের গন্ধ, মাংসের গন্ধ, ধুপ , বই, বিড়ি, ঘামের গন্ধ, গল্পের গন্ধ, ময়লা নয় তো। আরামের কথাই তো সব।
    অমন আরাম , যা মাঝে মধ্যে হয়, বিষ্টির জল গায়ে পড়লে, ইলিশ- কাঁটা বৌদিমণির কাছ থেকে চেয়ে এনে তাই দিয়ে টালির লাউ রাঁধলে, বাচ্চা বুকের দুধ টানলে। ঝুলনের রাতে রাসের গান শুনলে, এইরকম করেই তো আরামের গল্প জমায় লোকে, নাকি?

    কি বৃষ্টিটাই না হলো আজ বিকেলে। রাস্তার ধুলো সব পেত্থমে কাদা হলো, তারপর ধুয়ে লাল জল হয়ে নয়ানজুলিতে নেমে গেল সব হুড়্মুড়িয়ে। এখন চাঁদের আলোয় রাস্তাটা কেমন পারা ওঠা আয়্নার মত চকমকিয়ে উঠছে। ভিজে ঝুপ্পুস সব লোকজনেরা একটু আগেই সাতটার লোকাল থেকে নেমে কাদা মেখে ভ্যানে চড়ে বাড়ি ফিরেছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে আজ মতির। দাদাবাবু ফিরতে দেরি করছিল, বৌদিমণি ধরে রাখলো, নৈলে এই বিষ্টি ভিজে পুকুরধারের রাস্তা দিয়ে ফিরতে কি আরাম, কি আরাম। সাধে কি বলে ভগোমানের জল! গায়ে পড়লো কি পড়লো না, চিড়বিড়িয়ে সব ঘামাচিরা মরে গেল, গাছের পাতাগুলিন তেলতেলে সবুজ হয়ে উঠলো, জুঁই ফুলের কি খোশবাই। ওদিকে বিষ্টি হলেই আবার ট্রেনের তার ছিঁড়ে যায়, সবার বাড়ি ফিরতে দেরি। দাদাবাবুও এখনো ফিরলো না। ডিমের পরোটা মেখে বসে থেকে বৌদির মুখ হাঁড়ি। মতি বেরিয়ে এসেছে।

    পুকুরধারের রাস্তা দিয়ে জল ছপছপিয়ে হাঁটবে এখন সে। হাওয়াই চটি হাতে খুলে নিয়ে।
    বড় আর ছোট ফিরলো কিনা কে জানে। মাঝে মাঝেই ওরা ফেরে না। কিন্তু তার পর আবার ফিরে আসে। বিড়ালের বাচ্চার মত। খুব কিছু একটা চিন্তা হয়না মতির, কেন হয়না কে জানে। ইস্কুলে দিতে বলেছিল সবাই বাচ্চাগুলোকে। দিয়েও এসেছিল সে, মুনিসপ্যালিটির ইস্কুলে। কিন্তু ওরা ইস্কুলে গেলো না। এমনকি ইস্টিশান ছেড়ে যখন মতি এই বস্তিতে এলো, একখানা ঘর ভাড়া করলো, ওরা ইস্টিশনেই থেকে যেতো সারা দিন। শুধু খেতে আসতো মায়ের কাছে। এক এক দিন আসতো-ও না। ইস্টিশনে গিয়ে নিয়ে আসতে হতো। চায়ের দোকানের বেলালদাদা বলেছিল, ইস্টিশনে জন্মানো বাচ্চারা রেললাইন ছেড়ে কোথাও যায়না।
    বলতে কি, যদ্দিন বাচ্চাগুলো বুকের দুধ খেতো, তদ্দিন-ই ওদের জন্য একটু হলেও হা-পিত্যেশ লাগতো মতির। আর তেমন লাগে না। আর একটা বাচ্চা হলে ভালো হয়, ভাবে মতি। আবার বেশ গায়ের মধ্যে বুকের মধ্যে তুলতুলে ধুকধুকে একটা ছোট্টো বাচ্চা।
    কড়ি বলেছিল, শরীলের সুখ ভিন্ন কিছু বুঝিস না তু।
    তা সুখ তো শরীলেই হয়। এই ঝিপিঝিপি বিষ্টিতে যে গায়ে কাঁটা হচ্ছে রোঁয়া রোঁয়া, গরম ভাতের থালাটি নিয়ে বসলে য্যামন সুখ হয়, গন্ধ সাবান গায়ে মাখলে, টুকুনদাদার বই থেকে গল্প শুনলে, আর রাতে গল্প গল্প স্বপ্ন থেকে উঠে পিছল ঘামে ভেজা, কুসুম-গরম মানুষের গায়ের ঝাপটানি খাওয়া, এই সবই তো সুখ, সবি শরীলের বটে তো।

    দূর মড়া, ছেলেপুলের মুখের দিকে তাকিয়ে সুখ, ঘরে পুরুষমানুষ থাকলে সুখ, এসব বুঝিসনে তু?

    ছেলেপুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ত্যামোন সুখ হয়না মতির। মায়া হয়, মুখ্টুকু পুঁছিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, চান করিয়ে পোষ্কার করে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ছেলেপুলে সেসবের ধার ধারে না। গল্প শোনাতে ইচ্ছে করে। কেশবদাদুর গল্প, কেশবদাদু নাকি একসময় মস্ত চাকরি করত। তারপর একদিন, গাড়িতে ধাক্কা লেগে, বাম হাতটি অকেজো হয়ে গেলো। তখন, কেশবদাদুর চাকরিটে তার ছেলে পেলে, আর ছেলে বৌমা মিলে সব টাকা পয়্সা লিখে নিয়ে বুড়োকে কেবল অপমান করতে লাগলো। অপমানের জ্বালায় নাকি বুড়ো দেশান্তরী হয়ে এই ইস্টিশনের ধারে কবেকার পুরোনো সে ভাঙ্গা পৈত্রিক বাড়িতে চলে এলো। অনেক দূর তার নিজের করা বাড়ি, সেখেনে সবাই হিন্দিতে কথা কয়, সেসব ছেড়ে, নিজের বৌকে ছেড়ে। বৌ দু একবার এলেও এখানে থাকতে পারতো না। তার পর বুঝি বৌটা মরেই গেলো।
    রোজ সকাল সন্ধ্যে বেলায় কেশবদাদুর বাড়িটা মুছে দিয়ে আসতো মতি। ঘর অন্ধকার করে একটা টিমটিমে মোমবাতি জ্বেলে বসে থাকতো কেশবদাদু। মতি গিয়ে বসতো সেখানে। গল্প শুনতো। রেল্লাইন ধরে সোজা উত্তুর্মুখী গেলে নাকি কেশবদাদুর নিজের হাতে গড়া বাড়ি। সেখানে গমের খেত, সেখান থেকে র্যাশনে গম আসে, তাই দিয়ে শ্যামলী মিলে আটা হয়।
    তখন বড়োটা পেটে। আস্তে আস্তে পেটে ভার আসছে, রোগা বলে তেমন বোঝা যেতো না যে মতি পোয়াতি। রাতবিরেতে তখনো ঘরে লোক ঢোকে। একদিন বেলালদাদা তাকে বল্লো, পুঁটুলি বাঁধ।
    সোজা তাকে নিয়ে এলো কেশবদাদুর কাছে। বললো, মেয়েটাকে থাকতে দ্যান দাদু। আপনার সব কাজ করে দেবে। পোয়াতি মেয়েছেলে, ইস্টিশনে থাকে, এ তো শ্যালদা নয়, আমাদের মানে লাগে।
    ঘোলাটে চোখ তুলে একবার দেখলো কেশবদাদু, চশমার মধ্যে দিয়ে। বিড়বিড় করে বললো, থাকবে? তা থাক।
    অনেক দিন, কেশবদাদু মরে না যাওয়া অব্দি সেখেনেই রয়ে গ্যাছিলো মতি। বড় যদিও দিনদুপুরে, ইস্টিশনের মধ্যেই নামলো।
    একদিন কেশবদাদু হাত রেখেছিলো তার পেটে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিলো, মানুষের আসার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছে করে। বড় সুন্দর। তারপর অচেনা ভাষায় কি একটা বলেছিলো। টানটান পেটের চামড়ায় কুঁচকানো, বুড়ো হাত বুলিয়ে।
    কথাটা বুঝতে পারেনি মতি। এখন একটু একটু বুঝতে পারে। শোনা যায়, আসার শব্দ। অম্নি। যেমন ট্রেন আসার শব্দ। বিষ্টি আসার আগে গমগমে আকাশ। আলো ফোটার আগে পাখিদের আসার শব্দ।
    মানুষের আসার শব্দও আছে নিশ্চই। বই পড়লে জানা যায়। ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল মতি।
    সন্ধের ঝোঁকে পাতার থেকে জল পড়ে টুপটাপ। কার পায়ের আওয়াজ! ভয় পায় মতি। এ রাস্তা দিয়ে তো তেমন কেউ যায় আসে না। তারপর দ্যাখে, ওমা, এ তো দাদাবাবু। জলে, কাদায় চুপ্পুস।
    দা'বাবু এ রাস্তায় যে!
    চমকে তাকালো দাদাবাবু। বললো, ও, তুমি!
    আমি বাড়ি যাই। বৌদিমনি আপনার আসার দেরি দেখে চিন্তা কর্ছিলো যে।
    হুঁ, অন্যমনস্ক গলায় বলে দীপ্তেন। ও রাস্তায় গাছ পড়ে গেছে।
    তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালায় দীপ্তেন। দেখে ভারি খুশি হয় মতি, এমনি এমনিই। বৌদিমনির সাথে কাল ঝগড়া হয়েছিলো বুঝি। আজ আবার ভাব হয়ে যাবে। কাল সকালে আপিস যাওয়ার সময় বৌদিমনি আদুরে মুখ করে গেটের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকবে, ফুচিকে বলবে, বাবাইকে টা টা করো তো মা!
    বিষ্টি হলে গল্পেরা অম্নি বেড়ে যায়, খদ্দেররা কোথায় রেললাইনে বাজ পড়ে আটকে গিয়েছিল সে গল্প শোনায়, টালির চালে জল পড়ে টিপ টিপ, ঠান্ডা হয় রাত।
    বৃষ্টি আর জলের রাতে ডাইনীবুড়িরাও নিশ্চই ঘুমোয়।

    আনমনা একটা মেঘ করেছিলো সারাদিন। গরাদ দেওয়া জানলার ওপাশে ময়লা তোয়ালের মতো আকাশের দিকে চেয়ে ছিল দীপ্তেন, সারাদিন। কাজটাজ কিছু করেনি, কাজ তেমন কিছু জমেও নেই। দুপুরবেলা একবার রঞ্জিত পিওন একটা স্লিপ ধরিয়ে গেলো, বড়বাবু বেরিয়ে যাচ্ছেন, দীপ্তেন যেন ছন্দা সিমেন্টের অর্ডার খাতাটা দেখে রাখে, কাল বিল আপডেট চাই।
    হাই উঠছিল দীপ্তেনের, টিফিন না আনায় ক্যান্টিনে গিয়ে লোভে পড়ে একপেট চিলিচিকেন আর ফ্রায়েডরাইস সাঁটিয়ে এসেছে, এখন ঘুম পায়। অর্ডারের গোলাপি হলুদ কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে আরো। তারপর ময়লা তোয়ালে আরো ময়লা হয়ে উঠলো, তারপর কে এসে কাচাকুচি শুরু করলো, আকাশ ভেঙ্গে ঘ্যানঘেনে ময়লা জল, রাস্তায় কাদা, লোকজন বাড়ি ফিরতে পারবে না বলে হা-হুতোশ, বাড়িতে কি থাকে লোকের? তারপর ট্রেন বন্ধ, ভিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে স্টেশনে নেমে ভ্যান নেই তাই হেঁটে আসা। এর মধ্যে আকাশ ধুয়ে একটা চকচকে চাঁদ কে টাঙিয়ে রেখেছে। পায়ে কাদা লাগে, কিন্তু আকাশ আর হাওয়া বেশ পরিষ্কার, আরাম লাগছিল দীপ্তেনের। আনমনা, বেভুল একরকম আরাম, যেন সে বত্রিশ বছরের পুরোনো নিজের বাড়িতে যাচ্ছে না, একদম অচেনা, অন্য কারো বাড়িতে---হলেও তো হতে পারে এরকম!
    এমন সময় হঠাৎ একটা মেয়ে সামনে এসে পড়ে বলে উঠল , অমা, দাদাবাবু যে।
    ঘোর ভেঙ্গে যাওয়া মুখে সামনে তাকিয়ে ঠাওর করে দীপ্তেন দেখলো। তাদের কাজের মেয়েটা বোধহয়। অকারণে কৈফিয়তের সুরে কি একটা বলে হনহন করে এবার হাঁটতে থাকে দীপ্তেন। নাঃ, অনেকটাই রাত হয়েছে।
    আজকে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে। জলখাবারের ডিমের পরোটা ডিনারে চলে এসেছে, সাথে আলুর দম, দেখে রাতে খৈ দুধ খাওয়া বাবাও আমায় দুটো দাও তো নীতা, বলে এসে বসে পড়লেন। নবনীতার মেজাজ ঝটাকসে ভালো হয়ে যায়। রান্না ভালো করে সে ,খাওয়াতেও ভালোবাসে। ফুচি ঠান্ডায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে, তাতে দীপ্তেনও কেমন কাঁচুমাচু অপরাধী মুখে বাড়ি ঢুকলো, ট্রেনের তার ছিঁড়ে যাওয়ায় এত দেরি। কত ভিড় হয়েছিল ট্রেনে। আরো দুটো পরোটা চেয়ে খায়। বড্ড মায়া হয় নবনীতার। সকালে কিছু খেয়ে যায়নি, দুপুরে খায়নি হয়তো।
    আকাশ জুড়ে চাঁদ, ঠিক মাথার ওপর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটা দীর্ঘদেহী ছায়া দেখতে পায় দীপ্তেন, তার উপর পড়ছে। চমকে পিছন ফিরে দেখলো বাবা আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছেন, ঘর থেকে, বারান্দায় দাঁড়াতে এসেছিলেন কি? ছায়াটা গায়ের উপর থেকে সরে যেতে দেখে কেমন ভয় পায় দীপ্তেন, ডেকে ওঠে " বাবা!"
    স্বরটা একটু আর্ত হয়ে গিয়েছিলো কি? বাবা দ্রুত ফিরে বললেন কি রে!
    লজ্জা পায় দীপ্তেন, পাশের চেয়ারটা নির্দেশ করে বলে, এখানে বসবে, বাবা? বোসো না।
    তোর অসুবিধে হবে না তো, ফিরে আসতে আসতে বলেন টুকুন।
    বুঝতে পারে দীপ্তেন, বাবা ভেবেছিলেন সে এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে।তাড়াতাড়ি বলে, না না, কোনো অসুবিধে হবে না।
    চেয়ারে এসে বসেন বাবা। সরাসরি বাবার দিকে তাকায় না অনেকদিন দীপ্তেন। কোনো কারণ নেই, কিন্তু কেমন যেন মাঝখানে নিজের বড় হয়ে যাওয়াটা এসে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজের বাবা হয়ে যাওয়াটা--আজও তাকায় না। মেঝের ছায়াটার দিকে তাকিয়ে থাকে। থাকতে থাকতে বলে , কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে।
    ছায়া ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। খানিক পরে বলে, তোমার বন্ধুরা আর কেউ আসে না তো বাড়িতে, দীপু?

    বন্ধুরা? দীপ্তেন চিন্তা করে। কারা আসত বাড়িতে? রণেন আসত, সে এখন কোথায় কে জানে, উত্সব একটা বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করে, ফোনে কথাবার্তা হয়, কিন্তু হ্যাঁ , বাড়িতে আর কেউ আসে না-
    অফিসের কলিগদের সেদিন ডেকে খাওয়ালাম যে বাবা, ফুচির জন্মদিনে?
    তারা তো অফিসের লোক, দীপু, বন্ধু কি তারা?
    একথা শোনা যায় না, কিন্তু দীপ্তেন শুনতে পায়। আরো একটা কিছু শুনতে পায়, একটা শ্বাস, একটা বয়ে যাওয়া হাওয়ার হিমেল স্পর্শ পায়, কে যেন পাশ দিয়ে সরে গেলো। ছ্যাঁত করে ওঠে দীপ্তেনের বুক।
    বাবা উঠে পড়েছেন, একটু হাঁফ ছাড়া ধরার আওয়াজে টের পায় দীপ্তেন, বাবা চলে যাচ্ছেন। ঘরে। মনে মনে ডাকতে থাকে দীপ্তেন, বাবা, বাবা, যেও না। এতো সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজ। আর একটু দেখো।

    বাবার ঘরে ছোট্ট টেবিলল্যাম্প জ্বলে ওঠে।

    এত ভোর সকালে উঠিছিস যে, মতি?
    মতি তার বোকা হাসি হাসে। কাল তার ফাঁকা রাত গেছে, তাই সকাল সকাল ভেঙ্গে গেছে ঘুম। কলতলা থেকে জলের বালতিটি তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিতে নিতে বলে তুমি নাও গো দিদিমা, আগে।
    অন্ন কলতলায় নিজের বালতিটি আগে পেতে নেন। ছোঁয়া বাঁচিয়ে অবশ্য। জল এখনো আসেনি, সবাই একে একে বালতি রেখে যায়। সাড়ে পাঁচটায় জল আসবে মুনিসপ্যালের কলে। অতক্ষণ কে ডাঁড়িয়ে থাকে।
    তা হ্যাঁ লা মতি, কাজকম্ম কেমন করছিস বাবুপাড়ায়? হেসেই তো আছিস সারাক্ষণ। এ যেন অন্নর অনুযোগ, কেন যে মতি হেসেই থাকে তা বুঝে উঠতে পারেননা তিনি। শেষটায় স্থির করেন দাঁতগুলো উঁচু বলেই অম্নি লাগে।
    মতি অবশ্য অন্নর অনুযোগের সার পায় না, বলে, ভালো ই গো দিদিমা। দাদাবাবু বৌদিমণি সবাই ভালো মণিষ্যি।
    হ্যাঁ, তোর কাছে তো সবাই ভালো। এই ভোরে যাস, রাতে ফিরিস, ছেলে পিলে দুটিকে একটু দেখিসও না। ভিখিরি বলে কি ভিক্ষে মেগেই খেতে হবে?
    এ অভিযোগের আর উত্তর দেয় না মতি। অপরাধীর মতো মুখ করে থাকে। তাই দেখে অন্ন আরাম পান। কাউকে তো উচিত কথা কইতে হবে, বিড়বিড় করেন। তা তুমি যতোই হাপ গেরস্ত হও না, মা তো বটে।
    ফুচি বাগানের সামনের রাস্তায় টলমল করে হাঁটে। কাদা হাতে তুলে খিলখিল করে হাসে। দাদাবাবু চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। অন্যমনস্ক চোখ। লোহার গেট ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে দেখে মতি চেঁচিয়ে ফেললো-ও ফুচিমণি, মাটি খেওনি!
    কোথা থেকে দৌড়ে এলো বৌদিমণি, ফুচিকে কোলে তুলে নিল। দাদাবাবুর দিকে তাকিয়ে ভীষণ বিরক্ত গলায় বললো, খেলা দিতে পারো না, তো দেখতে নেওয়া কেন? সামনে মুখে মাটি দিচ্ছে, দেখতে পাও না?
    দাদাবাবু বলে দেয়নি তো মুখে। আমি দেখছিলাম। আর একটু মাটি মুখে দিলে কিছু হয় না। ইমিউনিটি বাড়ে।
    তবে আর কি, মাটি খাওয়াও। ধুপ করে ফুচিকে বারান্দায় বসিয়ে চলে যায় নবনীতা। ফুচি গোল গোল চোখ তুলে বাবার দিকে তাকায়।
    দাদাবাবু নীচু হয়ে ফুচির পেটে আঙুল দিয়ে সুড়্সুড়ি দ্যায়। অম্নি হেসে কুটিপাটি হয়ে যায় ফুচি। আঙুল ধরে টেনে বলে -খেলবে।
    কি খেলবে মা?
    বল খেলবে।

    দাঁড়িয়ে মজাটা দেখছিল মতি। নবনীতা চিৎকার করে, হ্যাঁ, তুই-ও ওখানে দাঁড়িয়ে আদিখ্যেতা দ্যাখ, আমি বাসনগুলো মাজি।
    জিভ কেটে কাজে যায় মতি। ঠাকুরঘর থেকে টুকুনদাদামশায়ের ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসে।
    দীপ্তেন ঠিক করে ফ্যালে, আজ অফিস যাবে না। সারাদিন বাড়িতেই থাকবে। কোনো সই করবে না। এটা ঠিক করে ফেলেই তার মনে খুব শান্তি হয়। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে।
    সেঁকা পাঁউরুটি আর মাখন হাতে নিয়ে নবনীতা যখন বারান্দায় এসে বসে, তখন দীপ্তেন তাকে বলে, আজ অফিস যাবো না।
    শরীর ঠিক আছে তো? নবনীতা একটু উদ্বিগ্ন হয়।
    হ্যাঁ হ্যাঁ শরীর ঠিক আছে, বাড়ি থাকার কোনো অজুহাত খুঁজে পায় না দীপ্তেন, তারপর হঠাৎ বলে ফেলে, আসলে এক বন্ধুর বাড়ি যাবো ভাবছিলাম বিকেলে, তাই--
    কে বন্ধু গো?
    তুমি চিনবে না, ছোটোবেলার বন্ধু। আমরা তখন স্টেশনের ওদিকে ভাড়া থাকতাম। যা হোক একটা কিছু বলে দেয় দীপ্তেন, হুড়্মুড়িয়ে।
    ও আচ্ছা। আর আগ্রহ দেখায় না নবনীতা। দীপ্তেনও বেঁচে যায়।

    মতি কুয়োর পাশে নিচু হয়ে চোখে মুখে জল ছিটোয়। রাতের বৃষ্টির পর রোদ্দুরটি উঠেছে দুপুরের বড় কড়া। গা চিড়বিড় করে। আজ দা'বাবু বাড়ি থাকায় খাওয়া দাওয়া তাড়াতাড়ি চুকলো। খানিক দাওয়ায় শুয়ে ছিলো সে, টুকুন দাদামশায়ের হাল্কা নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো। এখন আর পাচ্ছেনা, দাদামশায় বড্ড ঘুমিয়ে পড়েছেন। পা টিপে টিপে কুয়োর দিকে যেতে গিয়ে জানলা দিয়ে দেখলো বৌদিমণি দাদাবাবুর গায়ে পা তুলে শুয়ে ঘুমোচ্ছে, খোলা, মোটা, কলার থোড়ের মতো পা, সাদা। দেখে মতির মুখে হাসি এলো, সুখ সুখ হাসি।
    সিনিমায় গল্প দেখলে এরকম হয়। ছুঁতে হচ্ছে না তোমায়, চটকাতে হচ্ছে না, মেখে দেখতে হচ্ছে না অথচ দেখ কি না দ্যাখ রুটি হোলো, তরকারি হোলো, সেসব খেয়ে দ্যাখাও গেলো, কড়ির ঘরে ছোটো টিভি আছে, তাইতে এসব দেখা যায়। আরো লোকের বাড়িতেও আছে, কিন্তু সে বাড়িতে মতিকে ঢুকতে দ্যায় কে। এবাড়িতেও টিভি আছে, কিন্তু সে রাত্তিরে চলে, তখন মতি বাড়ি যায়।
    তার চেয়ে বই ভালো। ডাইনীবুড়ির গল্পটা আর শোনাই হোলো না। ডাইনিবুড়ি নিশ্চিত দখিমায়ের মতো হবে, সাত বুড়ির এক বুড়ি তাকে কে ইস্টিশনে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো, বুড়ি মরলো তো না-ই, দিব্বি হেঁটে বেড়াতে লাগলো তুরতুর করে। তারপর যখন সব্বাই দখিমা'কে ঘর করে দেবে বল্লো, তখন একদিন বুড়ি পুট করে মরে আমগাছের গোড়ায় পড়ে রইলো। তার হাঁ-মুখের কাছে মাছি উড়ছিলো, মুনিসপ্যালিটির গাড়ি না আসা অবদি মতি বসে বসে মাছি তাড়িয়ে দিয়েছিলো। সারা বেলা। ঘেন্না লাগেনি।
    এখন মতি মাঝে মাঝে ভাবে, বড়োটাকে বেশ করে সাবান মেখে চান করিয়ে দেবে। ওকে সবাই ঘেন্না করে। খুব নোংরা। কিন্তু বড়ো ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দ্যায়। ঘেন্না পেলে ভিখিরিরা বেশি পয়্সা পায়।

    বেশ গরম দিয়েছে। ঘুমন্ত নবনীতার পা গায়ের থেকে আস্তে আস্তে নামিয়ে খাট থেকে নামে দীপ্তেন। সন্তর্পণে খোলে ছিটকিনি। পিছন পানের দাওয়ায় বেরিয়ে আসে। একটা সিগারেট হলে ভালো হতো। কিন্তু আবার ঘরে ঢুকতে হবে, নাঃ থাক। রান্নাঘরের লাগোয়া কুয়োতলার কাছে কাজের মেয়েটা চোখ মুখ ধুচ্ছে। পুরোনো ইঁটের পাঁজা, বর্ষার আগাছায় ঢেকে গেছে। দাওয়ায় রাখা একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসে দীপ্তেন। নিজের বাড়ির পিছনদিকটা কেমন অচেনা, আশ্চর্য তো! এতোটা জায়গা আছে এখানে, বেশ ভালো একটা বাগান হতে পারে। সামনের দিকে অনেকটা বাগান করেছে নবনীতা, কিন্তু খেদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই বলে, ওর হাতে গাছ বাঁচে না।
    চাকরিটা ছেড়ে ভালো করেনি নবনীতা। মনে হয় দীপ্তেনের। কেমন আটকে গেছে ও, বাড়িটার সঙ্গে, এই মফস্বলী একাকিত্বর সঙ্গে, আজকাল বাপের বাড়ি গিয়েও থাকতে চায় না, বেকবাগানের দু-কামরার বাসায় ওর দম আট্কায়। ভাইও বড়ো হয়েছে, ঘরের অভাব।
    পড়াশুনোয় এমন কিছু ভালো ছিলো না দীপ্তেন, ভালো রেজাল্টও করেনি কোনোদিন, গড়িয়ে গড়িয়ে পাস করে গেছে, বি কম পাস করে হঠাৎ এই লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের পরীক্ষা লেগে যেতে চাকরি নিতে আর দ্বিধা করেনি সে। বরং বাবার খানিক আপত্তি ছিল, মাস্টার্সটা হল না--এ বংশে সকলেই--
    মাস্টার্স করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না দীপ্তেনের। তাড়াতাড়ি চাকরিতে ঢুকে এসব পালা চুকিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল , রোগা, অমিশুক, বোকাটে, অন্যমনস্ক দীপ্তেন। অবাক কান্ড, চাকরিতে তার ভালই উন্নতি হতে লাগল। লোকে তার অন্যমনস্কতাকে ভারি পাত্তাও দিতে লাগল-মুহুরিবাবু বলেন, দত্ত আমাদের বড়বাবুকে পকেটে পুরে রেখেছে। বড়বাবু ভাবেন সে বুঝি অনেক অফিস পলিটিক্স বুঝে ফেলেছে। তার মিটমিটে হাসি , অন্যমনস্কতা যে আসলেই বুদ্ধির পরিচায়ক কিছু নয়, দীপ্তেন যে অম্নিই, সে কথা অগত্যা চাপা পড়ে গেলো।
    তেমন কোনো অশান্তি নেই দীপ্তেনের। কোনো অভিযোগও তেমন নেই। বন্ধুরা অনেকেই বেশ ভালো ভালো জায়্গায় আছে, সে নিয়েও ভাবে না সে, সে তো তেমন একটা উজ্জ্বল ছাত্র ছিল না। নবনীতাও বি এ পাশ, কিছুদিন চাকরিও করেছে, মাঝে মাঝে বনে, মাঝে মাঝে তুমুল অশান্তি হয়, হিসহিসে অশান্তি, কখনো একটা সিনেমা দেখা নিয়ে, কখনো একটা সিগারেটের ছাই ঝাড়া নিয়ে, কিন্তু এতোদিনে জেনে গেছে দীপ্তেন, ঐ অশান্তিগুলোই নবনীতার শরীরের চাবিকাঠি। তার পরেই শরীর-জ্বর ছেঁকে ধরে তাদের, এছাড়া বিনোদনটাই বা কি?
    নাঃ, ঘাড় নাড়ে দীপ্তেন। বড্ড চেনা চতুর্দিকটা। ভীষণ চেনা। সর্দিমোছা ন্যাক্ড়ার মতো, জ্বরো রোগীর গন্ধে ভরে থাকা ঘরের মত। ভাল্লাগে না।
    কাজের মেয়েটা সামনে এসে বলল, চা করি দেব?
    মাথা নাড়ল দীপ্তেন। বেশ কয়েকবার।
    মেয়েটা কিছু বলল না। বোকা বোকা মুখে তাকিয়ে রইল। বিরক্ত হয়ে দীপ্তেন মুখে বলল-না। বেশ স্পষ্ট উচ্চারণ করে।
    এবার বোধহয় বুঝল মেয়েটা। ঘাড় হেলিয়ে সরে গেলো। বেশি দূরে নয়। রান্নাঘরের দাওয়ায় গিয়ে বসল। ওখানে ওর মাদুর পাতা আছে।
    দীপ্তেন দেখল, অদ্ভুত শান্ত মুখে মেয়েটা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রায় মৃত দৃষ্টিতে। সামনে দুটো নীল ফড়িং উড়ে যাচ্ছে একে অন্যকে ঘিরে, গোল গোল---
    ফুচির বাবার কোনো বন্ধু নেই।

    সন্ধ্যের ঝোঁকে টিভি খুলে বসলো নবনীতা। তারপর আবিষ্কার করলো, কেবল এর অর্ধেক চ্যানেল আসছে না। মেজাজ বিগড়ে গেল তার। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল, কি করে এখন। রাত্রের রান্না সকালেই হয়ে গেছে, মতি রান্নাঘরে বসে রুটির আটা মাখছিল, সেখানে গিয়ে বসল। একটা পুরোনো সাইকেল নিয়ে কোথায় বেরোলো দীপ্তেন, বন্ধুর বাড়ি নাকি।
    মতি, এখন বাড়ি গিয়ে কি করিস?
    ফিক করে হাসল মতি, বাড়ি যেতে যে এক পোয়া রাত হয় গো। গিয়ে আর কি করব।
    অনেকটা সময় লাগে বুঝি যেতে? স্টেশনের কাছে নয় তোদের বস্তি?
    মতি অপাঙ্গে একবার বৌদিমণিকে দেখে নেয়। বোকা মানুষ সে, বুঝে সুঝে উত্তুর দিতে হয়, কাজলমাসীর শেখানো।
    ইস্টিশনের কাছে, কিন্তু তোমরা যে রাস্তা দে' যাও, ঐটে নয়, হাঁটা পথ গো। বড় পুকুরের পাশ দিয়ে যেতি হয়।
    ওটা পুকুর নাকি, ছড়িয়ে বসলো নবনীতা, ওতো পচা ডোবা!
    না গো, ঐতে মাছ আছে, উপ্রে শেওলা, নিচে কতো মাছ, তাদের চোখ পুটি পুটি করে জলে ভাসে।
    মাছ ধরিস বুঝি তোরা?
    আমি? না, আমি দেখি। পুকুর পেরিয়েও অনেক যেতে হয়, কামালিপাড়ার মদ্দি দিয়ে, আদ্যিদাদার সাইকেল রাখার দোকান, তার পর গে হোলো, ইস্টিশনের দিকে হুই রাস্তা গেছে, আর একদিকে দেখবা, ভুরুর মতো বেঁকে গেছে রাস্তা। সেই দিকে যেতে হয়।
    ভুরুর মতো রাস্তা? নবনীতার মুখে হাসি ফোটে, বেশ কথা বলিস তো তুই, গল্পের মতো।
    লজ্জা পায় মতি, তারপর বলে সত্যি অমন।
    নবনীতা ভাবে, সত্যি কতদিন একটাও গল্পের বই পড়া হয় না, অথচ কতো বই পড়্ত সে, বিয়ের আগে, বিয়ের পরেও, ভারী বই নয়, নেহাত গল্পের বই, প্রতিভা বসু, আশাপূর্ণা--
    মতি দেখল, বৌদিমণির চোখ দুটো অনেক দূর কোথায় চলে গেলো। এরম হয়, জানে সে। কেশবদাদুর হত। একরাতে তার উপরে গোঙাতে থাকা মাস্টারের মুখটা তুলে সে দেখেছিল, চোখ্দুটো কোথায়, ভিতরপানে, অনেক ভিতরে আছে ধূপের বন, সেইখানে ছাতা হাতে মাস্টারনী হেঁটে যায়। মাস্টার বলেছিল।

    আটার লেচি কেটে, সাদা প্লাস্টিকের কৌটোয় তরকারি ভরে মতি চলে গেল। ওঘরে টুকুনদাদামশায়ের সাথে ফুচি খেলতেই লাগল, রান্নাঘরের মেঝেতে বসেই রইল নবনীতা। জল পড়েছে মেঝেতে, তাই আঙুলে করে নিয়ে একজোড়া ভুরু আঁকল। তাতেই ফুরিয়ে গেল জলটুকু।

    সন্ধ্যা গড়িয়ে যেতে থাকলে ডাইনিবুড়ি চক্কর কাটে এদিক ওদিক। তার ঝাড়ুর হাওয়া লাগে মানুষের গায়। চাঁদের গায়ের থেকে এক খাবলা আলো খসে গড়িয়ে পড়ে একলা পথচলতি লোকের গায়।
    চমকে উঠে মতি দেখল, আজও দাদাবাবু ঐ রাস্তা ধরে আসতেছে। আনমনা বেভুল চোখ। সাইকেল হাঁটিয়ে।
    মতি দাঁড়াল। কিছু বলল না।
    দীপ্তেনও দাঁড়াল। তারপর অপ্রস্তুত গলায় বলল, নিজেকে অবাক করে বলল, রাস্তাটা খুব সুন্দর, না? গল্পের মত।
    মতিকে উদ্দেশ করেই বলল বোধহয়।
    মতি ফিক করে হেসে দিল। দুটো দাঁত আরো একটু বেরিয়ে এল। তারপর দুটো বোকা মানুষ উল্টো দিকে হেঁটে বাড়ি ফিরতে লাগল। যে যার গল্পের দিকে।

    সেই রাতে মতির ঠোঁটের মধ্যে একটা একেবারে অচেনা ঠোঁট যখন ডুবে যাচ্ছিল, তখন আঁকুপাকু করে নিজেকে বের করে এনে মতি হাঁফ ধরা গলায় জিগেশ করলো, তোমার নাম কি গো বাবু? তোমার নাম?
    খসখসে একটা গলা উত্তর দিল, কালু। তারপর আবার ডুবে গেল।
    বালিশে রাখা মাথা একটু কাত করে মতি দেখে, একটা ডুরে শার্ট, পকেট থেকে একটা গোলাপি কাগজ বেরিয়ে আছে। পানমশলার গন্ধ। বিড়ির। আর টালির ফাঁক দিয়ে, চাঁদের আলোর সঙ্গে ঘরে নেমে আসছে গুছি গুছি গল্প। মাটির মতো। ফুচির মতো। বড়োর মতো।
    ডাইনিবুড়ির চুল।
    বোকা বোকা হেসে আরামে চোখ বুজল মতি।
    ____________________________
  • | ১৭ জুলাই ২০১৪ ২২:৫৫647150
  • বাঃ বাঃ বাঃ
  • কল্লোল | 125.185.150.10 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ০৫:২৪647161
  • ভালো লাগলো। খুব ভালো।
  • nina | 78.37.233.36 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ০৬:৫৭647164
  • বেড়ে লিখিস তুই ----
  • sosen | 111.63.159.56 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ০৮:৪২647165
  • থেঙ্কু। এই প্রথম বোধহয় একটা গল্প লিখে শেষ করলাম।
  • সিকি | ১৮ জুলাই ২০১৪ ০৯:১৫647166
  • অসাধারণ লাগল।
  • dd | 125.241.33.227 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১১:২৫647167
  • উফ।
    ক্ষী ল্যাখে এই মে'টা।
  • Suhasini | 213.99.205.102 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১১:৪৫647168
  • কী দারুণ মায়া মায়া গল্প... খুব ভালো লাগলো সোসেন।
  • i | 134.171.22.0 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৪:০৮647169
  • বড় সুন্দর লেখা বোনটি। ভাবে বল্‌, বুনোটে বল্‌- বড় সুন্দর। অসম্ভব সুন্দর।প্রথম গল্পই যার এত সুন্দর, তাকে এখনও টল্প লিখে যাওয়া ছোটাই দি আর কি বলে !
    আরো লেখ্‌ বোন। আরো লেখ্‌।
    অনেক ভালোবাসা-
  • b | 135.20.82.164 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৪:১৫647140
  • বড় মায়াবী।
  • san | 113.245.14.209 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৪:১৭647141
  • হ্যাঁ , পরতে পরতে মায়া। আরো লিখো।
  • de | 69.185.236.52 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৪:১৯647142
  • উঃ! ক্ষী ভালো! ক্ষী ভালো!
  • kumu | 52.104.24.219 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৪:২৬647143
  • অসাধারণ লাগলো গো সোসেন।
    ল্যাবারু হইয়া ল্যাবারুর কৃতিত্বে কলার তোলন ও ছোটাইএর মাথায় চাঁটি মারন।
    পরে বিস্তারিত লিখচি।
  • | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৪:৪২647144
  • ওঃ উনি আবার 'বিস্তারিত' ল্যাখবেন! এদিকে ওনার টইটা পড়ে আছে!:-ক্ষ
  • Blank | 69.93.247.130 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৪:৪৯647145
  • ব্যাপক
  • সায়ন | 170.83.97.83 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৪:৫৫647146
  • দমদির ভাগাড়পাড়া, সোসেনের ফেসবুক থেকে পুরনো লেখা আর এখন এটা জুড়ল - এবং তোলা রইল। জুত করে বসে পড়ার সময় নাই ঃ(
  • kiki | 127.194.70.84 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৫:০৭647147
  • বাঃ
  • ঐশিক | 127.218.17.62 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৫:১৫647148
  • এবারের পুজোর প্রথম গল্প!!!!!!! দারুন দারুন!!!!!
  • yashodhara | 69.97.148.238 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৫:২৭647149
  • অমন আরাম , যা মাঝে মধ্যে হয়, বিষ্টির জল গায়ে পড়লে, ইলিশ- কাঁটা বৌদিমণির কাছ থেকে চেয়ে এনে তাই দিয়ে টালির লাউ রাঁধলে, বাচ্চা বুকের দুধ টানলে। ঝুলনের রাতে রাসের গান শুনলে, এইরকম করেই তো আরামের গল্প জমায় লোকে, নাকি?।।। এই জায়গাটা ভারি ভাল লাগল।।।ভাল গল্প , বেশ দুক্ষু দুক্ষু।।।
  • - | 102.96.218.40 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ১৫:৪৯647151
  • চমত্কার।
    দুবার দীপ্তেন কে মতির সাথে রাস্তায় দেখা করিয়ে দেওয়াতে একটু ভয় হয়েছিল, কালু কে দিয়ে চমত্কার ইতি হলো।
    ছোটো গল্পের ঠিক ঠাক শেষ না হলে জমে না।
    লিখে যান।
  • sosen | 111.63.178.137 | ১৮ জুলাই ২০১৪ ২০:১৩647152
  • সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। বেশ ভয়ে ভয়ে লেখাটা পোস্ট করেছিলাম। এখন সবার ভালোলাগা দেখে খুব খুশি হচ্ছি।
  • byaang | 52.104.60.148 | ১৯ জুলাই ২০১৪ ০৭:৩৪647153
  • দারুণ হয়েছে গল্পটা। জাস্ট টু গুড। লেখিকার চুলগুলো একটু ঘেঁটে দিলাম।
  • byaang | 52.104.60.148 | ১৯ জুলাই ২০১৪ ০৭:৩৪647154
  • দারুণ হয়েছে গল্পটা। জাস্ট টু গুড। লেখিকার চুলগুলো একটু ঘেঁটে দিলাম।
  • pragati | 126.68.64.245 | ১৯ জুলাই ২০১৪ ১৬:২২647155
  • সোসেন, একেবারে পাকা, ঘন বুনোটের একটি গল্প । নরম, কিন্তু তীব্র আর তীক্ষ্ণ। আর শব্দের তীর একেবারে ঠিক নিশানার বিদ্ধ হয়েছে। ব্রাভো!
  • pragati | 126.68.64.245 | ১৯ জুলাই ২০১৪ ১৬:২৪647156
  • *নিশানায়
  • sosen | 125.241.39.252 | ২০ জুলাই ২০১৪ ১৩:১৫647157
  • প্রগতিদি, ব্যাংদিকে ধন্যবাদ আর গাল ভরা হাসি।
  • Ranjan Roy | ২০ জুলাই ২০১৪ ১৪:৪৬647158
  • একজন বৈজ্ঞানিকের হাতে এমন পাকাপোক্ত গল্প!
    অবশ্যি এর প্রস্তুতি অনেকদিন ধরেই চোখে পড়ছিল।
    ভাবতেও ভাল লাগছে যে আমি এমন সব সংবেদনশীলের মনের আড্ডার সভ্য।
    অনেক কুর্ণিশ!
  • শ্রী সদা | 212.142.113.94 | ২০ জুলাই ২০১৪ ১৫:২৭647159
  • অদ্ভুত সুন্দর।
  • robu | 122.79.37.72 | ২০ জুলাই ২০১৪ ১৮:৩৪647160
  • খুবই মনখারাপিয়া। দারুণ সুন্দর।
  • PM | 233.223.159.146 | ২০ জুলাই ২০১৪ ১৯:৩০647162
  • একরাশ বিরক্তির মাঝে একটু ভাললাগার মুল্য-ও অপরিশিম। ধন্যবাদ সোশেন
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন