এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • Tukitaki

    joldip
    অন্যান্য | ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ | ৩৮৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • joldip | 134.125.50.16 | ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৭:০৭648342
  • অবসর
    ******

    (১)

    গতকাল পত্রা এসেছিল | এক প্রস্থ কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে | মেয়েটা বড় অল্পে মাথাগরম করে ফেলে | নিজের যুক্তির বাইরে কিছু শুনতেই চাইছিল না | অবশ্য খুব যে ভুলভাল যুক্তি ছিল ওর কথায় তা নয় | তবু মানতে পারেনি প্রথমা | এখনও এত অথর্ব হয়ে যায়নি সে‚ যে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে | কোন পুরোনো লিখিত বা অলিখিত নিয়মের নিগড় নয়‚ সেসব তার কোনকালেই নেই | তবু এখন থেকেই পরহস্ত হতে মন চাইছে না |

    গোধুলির আলোতে উড়ন্ত ধুলোকণা দেখতে দেখতে ভাবে প্রথমা | আজ কি আর পত্রা আসবে? নিয়ম করে মেয়েটা রোজ আসে তার কাছে অল্প কিছুক্ষণের জন্য | একটা অভ্যেস হয়ে গেছে | বারান্দা দিয়ে পথ চেয়ে তাকিয়ে থাকে সে |

    সদ্য সদ্য সে অবসর নিয়েছে | এখন অবসর জীবনটাকে সে উপভোগ করতে চায় | সারাটা জীবন সংসারের জোয়াল কাঁধে বয়েছে | এবার জোয়াল নামিয়ে রেখে কিছুটা সময় নিজের সাথে কাটাতে চায় | এই ছোট্ট জীবনে কত কিছু তো বাকী থেকে গেল‚ সেগুলো সব পুষিয়ে নিতে চায় এই সুযোগে | পত্রা বোঝে না এসব | বোঝানো সম্ভব নয় | সব কিছু কি বোঝার মত‚ কিছু কিছু জিনিস আছে বুঝে নিতে লাগে |

    সূর্যের আলোয় যেন ভাঁটার টান লেগেছে | একটু একটু করে সরে যাছে তার রক্তিম আভা‚ নেমে আসছে সন্ধ্যা রাজকুমারীর মত আভিজাত্য নিয়ে | নাহ আজ বুঝি আর পত্রা এলো না | কালকের মন কষাকষির রেশ বুঝি এখনও যায়নি | বারান্দা থেকে সরে আসে সে | আকাশে একটা-দুটো করে তারা আলোর পাপড়ি মেলছে |

    ঘরগুলোতে আলো জ্বেলে দেয় প্রথমা | সন্ধ্যেবাতি দেবে সে | সুগন্ধী ধূপ জ্বেলে এ ঘর থেকে ও ঘর ঘোরে | সব ঘরে সন্ধ্যা দেখানো হলে বসার ঘরে এসে ধূপটা ধূপদানীতে লাগিয়ে দেয় | শাড়ীটা পাল্টে নেয় | মুখটা চেপে মুছে নিয়ে পাওডার লাগানো পাফটা মুখে আলতো করে বুলিয়ে নেয় | চুলটা সামনে থেকে আঁচড়ে নেয় | আয়নায় নিজেকে আপাদমস্তক দেখে নেয় সে | এসবই দীর্ঘদিনের অভ্যাস | নিজেকে বেশ ভালো লাগে | নিজের কাছে নিজেকে ভালো লাগা সেটা খুব দরকারী‚ নিজেকে ভালোবাসার মতই |

    বসার ঘরে টিভিটা চালিয়ে দেয় সে | একটার পর একটা সিরিয়াল হচ্ছে | গড়পড়তা সব একইরকম সিরিয়াল | চ্যানেল সার্ফ করে করে কিছু ভালো লাগা সিরিয়াল দেখবে সে | তারপর খবরের চ্যানেলে যাবে সে | একগাদা খবরের চ্যানেল | একটা খবর কতবার করে যে দেখায় | আজকাল খবর দেখতে ভালো লাগে না | সেই এক ধর্ষন‚ খুন ভালো লাগে না | প্রশাসন বলে যেন কিছু নেই | ক্লান্ত লাগে |

    সাড়ে সাতটা বেজে গেল | পত্রা আর এলো না তবে আজ | ভাবতে ভাবতেই বেলটা বেজে ওঠে | ছুটে যায় প্রথমা বারান্দায় | পত্রা‚ আজ দাদুভাইকে নিয়ে এসেছে | নিজেকে ভারমুক্ত মনে হয় | বিকেল থেকেই একটা আশা-নিরাশা মনের মঝে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেট যেন একটা হালকা দীঘশ্বাস হয়ে বুক ঠেলে বেড়িয়ে যায় |চাবিটা ফেলে দেয় ওপর থেকে | দরজা খুলে পত্রা বন্ধ করার আগেই পিকুন দুরদাড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে এসে জড়িয়ে ধরে দিদুনকে | হাঁফাতে হাঁপাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে পত্রা |

    নাতির চুল ঘেঁটে দিতে দিতে জানতে চায় প্রথমা আজ যে এত দেরী করে এলি?

    পিকুন আজ আসতে চাইলো তাই |

    গলাটা এখনও ভার ভার | এখনও রেশ তবে কাটেনি | পিকুন তো রোজ আসতে চায় | মনে মনে হাসে প্রথমা | মেয়েটা এখনও ছেমেমানুষ রয়ে গেল |

    বোস চা করি |

    হু - পুরোনো একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সাড়া দেয় পত্রা |

    বিকেল থেকে চা খায়নি | একবারও কিছু মনে হয়নি | এখন টের পেল প্রথমা মাথাটা টিপটিপ করছে | চা চড়ায় | পিকুন পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় তার পিছনে |

    দাদুভাই গিয়ে বস আমি আসছি |

    দিদুন আমাদের বাড়ি চল না | আমার কাছে থাকবে |

    হেসে ফেলেন প্রথমা | পত্রা নিজে না পেরে এবার ছেলেকে দিয়ে বলাচ্ছে | মা যা শিখিয়েছে পাছে ভুলে যায় তাই আগে-ভাগেই বলে দিচ্ছে |

    যাব তো সোনা | তুমি আর একটু বড় হয়ে যাও আর আমি আর একটু বুড়ি হয়ে যাই তখন গিয়ে তোমার কাছে থাকব |

    প্রমিস দিদুন ?

    প্রমিস দাদু |

    ছুটে চলে যায় পিকুন | মায়ের কাছে গিয়ে কানে কানে কিছু বলতে গিয়েই বকুনি খায় | মায়া লাগে প্রথমার |

    আহা ওকে বকছিস কেন? এসো তো দাদু আমার কাছে এসো | ছুটে চলে আসে পিকুন | দিদুনের শাড়ীর আঁচল ধরে থাকে সে | চোখে চিকচিক করে কুচো কুচো জল |

    চাটা ছেঁকে কাপে ঢেলে ধরে দেয় পত্রাকে | নিজেও নেয় | এসো দাদু আমার কাছে বস | মা আর বকবে না | পিকুন বসে দিদুনের পাশে |

    এ নিয়ে আর একটা কথাও নয় | কাল অনেক কথা হয়েছে | তুমি জান আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না | শুধুশুধু তাই নিয়ে আর কথা বলো না |

    মায়ের দিকে ঠান্ডা হতাশ চোখে চেয়ে থাকে পত্রা |

    (ক্রমশ)
  • de | 190.149.51.69 | ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৭:৪৪648353
  • ভালো হচ্ছে! চলুক!
  • joldip | 134.125.50.16 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৫:৩৪648364
  • (২)

    ******

    কেমন আছ মা?

    ভালো আছি | তুই কেমন আছিস্? আর স্থিতি?

    আমি ভালো আছি মা | স্থিতিও ভালো আছে | ও একটা জব জয়েন করেছে এই দিনকয় হল | তোমাকে বলা হয়নি | ও এখনও অফিস থেকে ফেরেনি মা |

    সেকি এখনও ফেরেনি? ওর কি ফিরতে এরম দেরী রোজ হয়?

    হ্যাঁ মা | ওর অফিসটা অনেকটাই দূর তো | তাই যেতে আসতে অনেকটা সময় রাস্তাতেই চলে যায় |

    বুঝলাম | অনেকদিন তোদের দেখি না |

    আমিও অনেকদিন তোমায় দেখি না | একবার আমার এখানে ঘুরে যাও না |

    আসব‚ আসব | এখন তো আমার অখন্ড অবসর |

    জানি মা | তোমর মেইলটায় পড়েছি | শেষ অবধি তুমি অবসর নিলে | ওপ্রান্ত থেকে একটা তৃপ্ত হাসির আভাস ভেসে আসে |

    হ্যাঁ | এবার একটু নিজের সাথে সময় কাটাবো নিজের মত করে‚ নিজের ভালোলাগাগুলোকে নিয়ে |

    তাই কাটাও মা | কিন্তু নিজের যত্ন নেবে |

    নেব | তুই চিন্তা করিস না |ছাড়ি এবার | ভালো থাকিস তোরা দুজনে |

    সপু-সুপর্ন | প্রথমার পুত্র | প্রবাসে থাকে | প্রথম প্রথম ছেলেকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হত | চিন্তা হত ছেলেটা ঠিকঠক আছে তো | খাওয়া-দাওয়া করছে তো ঠিকমত | যেমন সব মা ভাবেন তেমন আর কি | মায়েদের সব ভাবনাই তো সন্তানকে ঘিরে | নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে যে নিজের জন্য ঠিক বাঁচা যায় না | বাঁচাটা সবসময় অন্যের জন্য | সেই অন্যটা নিজের সন্তান‚ বাবা-মা বা অন্য কেউ বা অন্য কিছু হতে পারে | আসল কথাটা হল নিজেকে জড়িয়ে রাখা কোনকিছুর সাথে | আজকাল বড় বেশি ভাবে সে | এইসব অদ্ভুত ভাবনা তো আগে আসত না |

    রাতে আজকাল তেমন ঘুম হয় না | বয়সের দোষ | শুধু ঘুম কেন আধি-ব্যাধি তো লেগেই আছে | বয়সটা তো বাড়ছে | শরীরের কলকব্জাগুলো জানান দেয় মাঝে মাঝেই তাদের অস্তিত্বের | রোজ কিছু না কিছু লেগেই আছে | এসব বাহ্যিক ব্যাপার তাকে অস্বস্তিতে রাখে বটে কিন্তু কাবু করতে পারে না | আসল হল মনটা | সেটা এখনও বেশ সতেজ-তরতাজা | সারা জীবন ধরেই তো মনটাকে সতেজ রাখার চেষ্টা করে এসেছে | আঘাত-প্রতিঘাত জীবনের কাছ থেকে কম কিছু তো পায়নি | তবু কোনকিছু তাকে স্থায়ীভাবে কাবু করেনি |

    রাতের তারাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে তার রাত জাগা | নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝেই প্রথমা হারিয়ে যায় অতীতে | মনে পড়ে কত কথা‚ ছবি যেন স্মৃতির পর্দায় একের পর এক ভেসে ওঠে ছায়াচিত্রের মত | পিছু হাঁটতে থাকে স্মৃতিপথে | মনে হয় এইতো সেদিনের সব কথা | ভ্রম হয় হয়ত এ জন্মের নয় যেন নিজের গত জন্মের কথা |

    মনে পড়ে পত্রকের কথ | সম্পর্ক কবেই তো শেষ হয়ে গেছে‚ তবু মনের চোরা কুঠুরিতে এখনও পত্রকের স্মৃতি অমলিন | বাবা পছন্দ করত পত্রককে | বাবার অফিসে পুশ সেলার হিসাবে শাড়ী বিক্রি করতে আসত পত্রক | দু চোখে অপার স্বপ্ন নিয়ে | ঘুরে ঘুরে শাড়ী বিক্রি নয়‚ নিজের একটা শাড়ীর দোকান দেবে সে ব্যস্ত কোন বাজারে | আলোর রোশনাইতে চকমক করবে শাড়ীগুলো | নিজের স্বপ্নকে অন্যের মধ্যে চারিত করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল পত্রকের | চোখ বুঁজলেই সেই স্বপ্নকে যেন ছুঁয়ে ফেলা যেত | বাবাই প্রথম বাড়িতে আসতে বলেছিল কোন একটা দুর্গাপুজোর আগে | ছেলেটার কিছু বাড়তি বিক্রিবাটা করিয়ে দেবার একটা সৎ ইচ্ছে ছিল বাবার | অনেকগুলো শাড়ী নিয়েছিল মা | প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেছিল প্রথমার | চোখদুটি ছিল ভারী সুন্দর | ঘন কালো নিবিড় পল্লবের আড়ালে এক জোড়া স্বপ্নালু গভীর চোখ | দেখে মনে হয়েছিল স্বপ্ন বুঝি ও চোখেই মানায় |

    তারপর তো একটা সময় পত্রক ঘরের ছেলের মত হয়ে গিয়েছিল | পত্রক বাড়িতে এলেই প্রথমার বুকের মধ্যে যেন হাজার ড্রামের দ্রিমদ্রিম কিছুতেই থামত না | কিছুতেই চোখের পাতারা বাধ্য থাকত না | কোথা থেকে যে একরাশ লজ্জা এসে চোখের মণিতে স্থান করে নিত বুঝত না সে | চোখ তুলে তাকালেই বুঝি ধরা পড়ে যায় |

    ধরা অবশ্য একদিন পড়ে গেল বাবার চোখে | সেদিন খুব কেঁদেছিল সে বালিশে মুখ লুকিয়ে | কেন ‚ কিসের জন্য সে কান্না আজও বোঝে নি | নিজের মনের নিভৃত গোপনে পালিত ভালো লাগা ধরা পড়ে গেছিল বলেই হয়ত | কে জানে? এক জীবনে কি সব বোঝা যয় | বোঝা তো অনেক পরের ব্যাপার চেনা- জানাও কি যায়? মানুষের জন্য বরাদ্দ মাত্র একটা জীবন | আর চেনা- জানার জন্য একটা জীবন যথেষ্ট নয় | একটা সময় তো তার মনে হত যে সে খুব ভালো করে চেনে পত্রককে | জানে তার আপন মানুষটাকে | কিন্তু সব ভুল | মনের অগুন্তি প্রকোষ্ঠের মধ্যে কত যে অচেনা- অজানা প্রকোষ্ঠ রয়ে যায় কেই বা তার হিসাব রাখে |

    চোখটা জ্বালা করে | রাত বুঝি অনেক হল | শুয়ে পড়তে হবে | কিন্তু ঘুম যে আসে না | আজ রাতে আর ঘুম আসবে না | কবর থেকে খুঁড়ে আনা স্মৃতি আজও কত জ্বলন্ত | চোখে ঘুম আসতে দেয় না | সম্পর্ক শেষ হয় না কখনও বাস্তবে | ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকে নিভে যাওয়া ছাইয়ের মত যতদিন না বিস্মৃতি এসে স্মৃতিকে অধিকার করে |

    (ক্রমশ)
  • joldip | 134.125.50.16 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৫:৫৩648375
  • অবসর
    *****

    (৩)

    ল্যান্ডফোনের লাইনটা বেজে ওঠে | এখনও এ বাড়িতে ল্যান্ডফোন আছে | বাবার ফোন | স্মৃতি হিসাবেই রয়েছে | মাঝে মাঝেই ডেড হয়ে থাকে | আজকাল ল্যান্ডলাইনটায় কেউ কল করে না | চলমান ফোনের যুগ | তাই চেনা-পরিচিত -আত্মীয়-বন্ধু-সেলসম্যান-মেকানিক সবাই মোবাইলেই ফোন করে | তন্দ্রা টুটে যায় | মাথাটা ভার ভার | উঠতে ইচ্ছে করে না | তবু ওঠে | হেঁটে গিয়ে ফোনটা ধরার আগেই কেটে যায় | কে জানে কে করেছে? এ সময় তো পত্রা ফোন করে না | সুপর্নও করবে না | করলে ওরা দুটিতেই মোবাইলে করে | আর তো করার মত কেউ নেই | ফিরে যেতে গিয়েই আবার বেজে ওঠে ফোনটা | তুলে নেয় রিসিভারটা |

    কিছু বলার আগেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসে দিদি কেমন আছো?

    তুমি? গলাটা নিজের কানেই ফ্যাসফ্যাসে অনুভুতিহীন তিক্ত শোনায় |

    দিদি ও আর নেই | এক অনন্ত নিস্তবদ্ধতা উভয়প্রান্তে শিরশির করে বয়ে যায় |

    কোন কথা বলে না প্রথমা | | স্বল্প নীরবতায় ওপ্রান্ত অপেক্ষা করে কিছু শোনার জন্য |

    একটু আগেই সব শেষ হয়ে গেছে - এপ্রান্তের অদ্ভুত শীতলতায় ওপ্রান্ত থেকে ভেজা গলার শব্দরা আছড়ে পড়ে নিবিড় বেদনায় | অনুভব করে প্রথমা | তবু কোন অনুভুতি হয় না নিজের মধ্যে |

    আমি এখন রাখি | বলেই প্রথমা লাইনটা কেটে দেয় | সকাল থেকে ভালো লাগছিল না | শরীরটা ঠিক যূত নেই | পায়ে পায়ে এসে বসেন ডাইনিং এ | এক কাপ চা করে খেতে পারলে ভালো লাগবে শরীরটা | ঠিক এই সময়টাতেই পত্রার কথাগুলোর যৌক্তিকতা অনুধাবণ করে প্রথমা | মেয়েটা সেদিন অনেক করে বলেছিল তাদের সাথে গিয়ে থাকার জন্য | উঠে পড়ে গা ঝাড়া দিয়ে | মনকে দুর্বল হতে দিতে নেই | চাটা বসায় ওভেনে | আবার বেজে ওঠে ল্যান্ডফোনটা | বাজতেই থাকে | ধরে না প্রথমা | আরও কিছু কথা আছে হয়ত তাই ফোন | কিন্তু তার তো কোন কথা নেই | সব কথা শেষ হয়ে গেছে | বেজে বেজে থেমে যায় ফোনটা | চাটা হয়ে গেছে | কাপে ছেঁকে নেয় | আজ আর কিছু রাঁধবে না | ফ্রিজে কিছু খাবার আছে গরম করে চালিয়ে নেবে | চাটা নিয়ে শোবার ঘরে এসে ঢোকে | মোবাইলটা বেজেই চলেছে | শুনতে পায়নি সে | পত্রার কল | রিসিভ করে কলটা |

    কোথায় ছিলে মা? উৎকন্ঠা ঝরে পড়ে পত্রার গলা থেকে | টের পায় প্রথমা |

    এইতো চা বানাচ্ছিলাম কিচেনে |

    জানো আমার কি টেনশন হচ্ছিল | মোবাইল ধরছ না | ল্যান্ডলাইনে করলাম সেটাও ধরলে না | এইবারটা না ধরলে আমি তো হার্টফেলই করতাম | একদমে কথাগুলো বলে থামে পত্রা |

    ল্যান্ডে তুই ফোন করেছিলি?

    আর কে করবে মা? গলাতে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ পত্রার |

    না তা না | তুই তো এ সময়ে করিস না | তাই ভাবিনি যে তুই করেছিস |

    তোমারা গলটা ভারভার কেন মা? সন্দেহ ঝরে পড়া পত্রার গলা থেকে |

    ঐ একটু শরীরটা যূত লাগছে না | মাথাটা ভার ভার তাই বোধহয় গলাটা ওরম লাগছে |

    আর কিছু নয়ত মা? কিছু লুকোচ্ছ না তো?

    না রে বাবা কি লুকোব? কিচ্ছু লুকোচ্ছি না | সবসময় আমায় নিয়ে এত টেনশন করিস না | আমি ঠিক আছি |

    ওকে মা | এখন রাখছি | অনেক কাজ আছে | বলে ছেড়ে দেয় ফোনটা ওপ্রান্তে পত্রা |

    কথায় কথায় জানা হয় না এই অসময়ে কেন পত্রা ফোনটা করেছিল | রিং ব্যাক করে জেনে নিলেই হয় | কিন্তু ইচ্ছে করে না | চাটা ঠান্ডা হয়ে গেছে | দু চুমুক খেয়ে বাকিটা রেখে দেয় | বেসিনে ঢেলে দেবে পরে | ঠান্ডা চা তার দুচক্ষের বিষ | চা ঠান্ডা করে খেতে ভালোবাসত পরমা |

    অন্যমনস্ক হয়ে যায় প্রথমা | অনেকদিন বাদে পরমার গলা শুনল | তা প্রায় বছর কুড়ি তো হবেই | মনে রেখেছে নম্বরটা এখনও | শুধু নম্বর নাকি সবকিছু মনে রেখেছে? কি যেন বলল ?সব শেষ হয়ে গেল | শেষ সেতো কবেই হয়ে গিয়েছিল | একটা দীর্ঘঃশ্বাস বেড়িয়ে যায় বুক ঠেলে |

    লেটার বক্স খুলল

    এই উপছে পড়ত একরাশ চিঠি | বাবা খবরের কাগজে বিঞ্জাপন দিয়েছিল পাত্র-পাত্রী কলামে | তার উত্তরে পাওয়া চিঠি | কোনটাই যেন বাবার মন্ঃপুত হচ্ছিল না | শেষে নিজে স্থির করলেন বাড়িতেই তো পাত্র আছে‚ তার সাথে বিয়ে দিলে হয় না | প্রথমার মনের কথাটা টের পাবার পর বাবার আর দ্বিধা ছিল না | মা একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল | কিন্তু বাবার যুক্তি ছিল অন্য | ছেলেটা তো ভালো | বংশ স্বভাব-চরিত্র সবই তো ভালো | শুধু রোজগারটা কম | কিন্তু খাটিয়ে ছেলে‚ দুচোখে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার আন্তরিক প্রচেষ্টা | ও ছেলে দাঁড়াবেই | নিজের দৃঢ় বিশ্বাসকে বাস্তবায়িত করতে নিজের পিএফ থেকে কিছু টাকা লোন করে ছেলেটিকে দিলেন | দোকান নিল | পরিশ্রম‚ ব্যবসয়িক বুদ্ধি আর সততা এই তিন মূলধন তো আগেই ছিল‚ চতুর্থ অর্থ যুক্ত হতেই চড় চড় করে ব্যবসা বাড়িয়ে ফেলল পত্রক কয়কগুন | একটু দাঁড়াতেই ফিরিয়ে দিয়েছিল বাবার সমস্ত টাকা | ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে আর কি চাই | বাবা প্রস্তাব দিলেন প্রথমাকে বিয়ে করার জন্য্ | দ্বিরুক্তি না করে রাজি হয়েছিল পত্রক | ধরেই নিয়েছিল বাবা‚ আগুন দুতরফেই সমান সমান লেগেছে | কিন্তু ভুল‚ আগাগোড়া সবটাই ছিল বোঝার ভুল | সেদিন যদি সত্যি করে জানত পত্রকের মনের কথা তাহলে সে নিজে থেকে সরে আসত | সব ভালবাসাকেই পরিণতি পেতে হবে এমন তো নয় |

    ঘরে বিবাহযোগ্যা মেয়ে থাকলেই বাবা-মা উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করে | আর সেই পাত্র যদি ঘরেই পাওয়া যায় তাহলে প্রস্তাব আসতেই পারে | সেই প্রস্তাব স্বীকার করতে হবে এমন তো কোন লিখিত নির্দেশ ছিল না | সেদিন যদি পত্রক রাজি না হত তবে ভালো হত | দশবছর ঘর করেও কিছু বোঝেনি | ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই থেকেছে যে পত্রকও তাকে ভালোবাসে | অথচ এতটা অবোধ তো সে নয় | তবু কিছু বুঝল না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আজও মাঝে মাঝে সে খুঁজে ফেরে |

    (ক্রমশ)
  • de | 190.149.51.67 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৬:১৭648380
  • পড়ছি!
  • | 172.136.192.1 | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১৬648381
  • *
  • Ishani | 116.216.128.41 | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৮:৪৪648382
  • আমিও পড়ছি !
  • joldip | 134.125.50.16 | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৫:৫৮648383
  • অবসর

    (৪)

    কি করবে মা?

    কিসের কি করব?

    না‚ মানে একবার কি যাবে? ইতঃস্তত করে জানতে চায় পত্রা |

    তোমরা যেতে চাইলে যেতেই পার | আমি যাব না | দৃহকন্ঠে বলে প্রথমা |

    নাহ আমি যেতে চাই না | আর আমি তো লোকটাকে তেমন করে চিনিই না | একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে পত্রা |

    বাস্তবিক পত্রা চেনেই না তার বায়োলজিক্যাল পিতাকে | পত্রকের বাড়ি ছেড়ে যখন বেরিয়ে এসেছিল প্রথমা‚ তখন মাস আষ্টেক বয়স পত্রার | সুপর্ণ আট | বাধা দেয়নি পত্রক | আশ্চর্য্য লাগে এখন ভাবতে গেলে | স্ত্রীর প্রতি না থাক সন্তানের প্রতিও সামান্যতম ভালোবাসা পিতার থাকবে না‚ এমনটা বুঝি চট করে দেখা যায় না | কিন্তু পত্রকের ক্ষেত্রে এমনটাই দেখেছিল প্রথমা |

    বাড়ীর বাতাসে কেমন যেন অস্বস্তিকর একটা ভারী ভারী ভাব অনুভব করে প্রথমা | ভালো লাগে না | অস্থির লাগে | কবে সেই কোনকালে চুকে যাওয়া সম্পর্ক আজও কেন পোড়ায় বোঝে না প্রথমা |

    আজও ক্ষমা করে উঠতে পারেনি সে পত্রক আর পরমাকে | কতই বা বয়স হবে তখন পরমার? বছর দশেকের ছোট ছিল তার থেকে | তার যখন বিয়ে হয় এই পরমাই কি কান্নাটাই না কেঁদেছিল | একটা ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে‚ হয়ত তার জন্য না পত্রকের জন্য | পত্রকের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলেই ছিল ওত কান্না | মানুষের মন বড় বিচিত্র | মনের আয়নায় প্রকাশিতের চেয়ে অপ্রকাশিত চিত্রই বেশী |

    বেশ কিছুদিনের জন্য থাকতে এসেছিল পরমা‚ বাবা মারা যাবার পর তার আর পত্রকের সংসারে | খুশি হয়েছিল প্রথমা | পরমার ফাঁকা জায়গাটা ভরাট হবে কিছুটা আর তাছাড়া ছোট পত্রার পিছনে খাটুনি তো কিছু কম ছিল না | তার ওপর সুপর্নর স্কুল‚ টিউশন | পরমা আসাতে সুবিধাই হয়েছিল | আসলে তখন বোঝেনি সবটাই প্ল্যান অনুযায়ী |

    তারপর কবে যে কোথা থেকে কিভাবে প্রথমার জায়গাটা পরমার হয়ে গেল আজও ভেবে পায় না | একদিন পত্রক বিয়ে করে নিয়ে চলে এল পরমাকে | পত্রক তাকে যতটা না আঘাত করেছিল অবাক করেছিল অনেক বেশি | এ কি করে সম্ভব | আর তখনই জেনেছিল সে সেই অমোঘ সত্য | পত্রক প্রথম থেকেই নকি ভালোবসত পরমাকে | এতগুলো বছর ঘর করেও এ সত্য উদঘাতিত হয়নি তার কাছে‚ কোথাও এতটুকু বেচাল দেখেনি পত্রককে | দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়েও কোন অভিযোগ ছিল না প্রথমার | পরমা এর আগেও এসে তাদের সংসারে থেকে গেছে‚ তখনও এমন কিছু চোখে পড়েনি যা নিয়ে সে সতর্ক হতে পারে |

    যে চোখে স্বপ্ন মানায় সে চোখ শুধু পরমাকে খুঁজেছে স্বপ্নে-বাস্তবে‚ যে শরীর-মনে তার একার অধিকার এতকাল ভেবে এসেছে সে শরীর-মন আদৌ তার নয় | সবটাই পরমার | বিস্ময়ের পর বিস্ময় তাকে দিশেহারা করে দিয়েছিল | তবে এতকাল কিসের ছল ?

    অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছিল পত্রক | বাবা যেহেতু ঋণ দিয়েছিল তাই বাবা প্রথমার সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাড়ায় সে না বলতে পারেনি | কৃতজ্ঞতাবোধে সে রাজী হয়েছিল | কৃতজ্ঞতাবোধ শব্দটাই যেন এক্ষেত্রে হাস্যকর | বাবা তো কৃতজ্ঞতা চাননি | মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিল পত্রককে জামাই করার | প্রথমার সাথে বিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি | বাবার ইচ্ছে‚ প্রথমার ভালোবাসা আর পত্রকের কৃতঞ্জতা এই তিন নাগপাশে জীবনটাই এক অদ্ভুত বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছিল সেদিন |

    জীবনের সব চাওয়াই পাওয়া হয়ে ওঠে না সামাজিকতা‚ সন্তান ও অন্যান্য নানা কারণে | কিন্তু পত্রকের জীবনে এসবের মূল্য বুঝি কিছু ছিল না | না হলে পরমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসতে পারত না | বাবার মৃত্যুর অপেক্ষাতেই ছিল দুজনে |

    দুই সন্তানকে নিয়ে বেড়িয়ে এসেছিল প্রথমা | বাধা দেয়নি পত্রক | নিজের আত্মসন্মান নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল | বাবা মারা গেছে | পেনশনের টাকায় মায়ের সংসার চলে | ফিরে গিয়েছিল মায়ের সংসারে ঠিকই‚ কিন্তু সেখানে বোঝা হতে চায়নি | সচেতন ছিল নিজের ভবিষ্যত নিয়ে | তার ওপর ছিল ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা‚ পালনের মস্ত দায়িত্ব |সেদিন প্রথম টের পেয়েছিল প্রথমা যে মেয়েদের আর্থিকভাবে সবল হওয়া উচিত | জীবনের কোন কিছু চিরস্থায়ী নয় | ভাবনারও অতীত অনেক কিছু থাকে |

    শুরু করেছিল পুশ সেলারের কাজ বাবার অফিস থেকেই | পত্রককে সাহায্য করতে মাঝে সাঝে সে এমন কাজ করেছে | কিছুটা অভিজ্ঞতা তো ছিল | বাবার অফিসের অনেকেই চিনত তাকে | বাবার মৃত্যু আর নিজের জীবনের বিপর্যয় হয়ত কিছুটা করুণার উদ্বেগ করেছিল | প্রথম অ্যাপ্রোচেই বিক্রি তাই মন্দ হয়নি | জানত করুণার পরিধি বেশিদিন নয় | যদিও করুণা সে চায়নি | তবু সেটা করুণাই ছিল | নিজের পরিচিতি বাড়িয়েছিল ক্রমশ | আর সেই পরিচয়কে মূলধন করে অফিসে অফিসে ঘুরে ঘুরে বিক্রি শুরু করেছিল শাড়ী | ধীরে ধীরে বাড়িয়েছিল নিজের কাস্টমার | শুধু শাড়ী নয় অন্যান্য পোষাকও বিক্রি শুরু করেছিল |

    আজ পত্রকের শ্রাদ্ধবাসরে পরমা আমন্ত্রণ জানিয়েছে | অনেক করেই বলেছে | সামাজিক সম্পর্কের শ্রাদ্ধ তো কবেই সম্পন | তবে আর কিসের জন্য যাওয়া ভেবে পায়নি সে | পরমার আমন্ত্রণে তাই সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে যে যাওয়া সম্ভব নয় |

    মা কদিনের জন্য দাদার কাছে ঘুরে এস | নীরবতা ভাঙে পত্রা | মনটা ভালো লাগবে |

    আমার মন ভালো নেই এমনটা তোমায় কে বলল পত্রা?

    থতমত খেয়ে যায় পত্রা | মাঝে মাঝেই এমন কিছু বলে ফেলে পত্রা | হয়ত না বুঝেই বলে ফেলে | তার মত গভীরতা নেই মেয়েটার মধ্যে |

    (ক্রমশ)
  • de | 69.185.236.54 | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৫:৩৩648384
  • তারপর?
  • joldip | 134.125.50.16 | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৬:০২648343
  • (৫)

    অবসর

    *******

    জান এখানে অনেক ভালো আছি আমি | তিনবেলা খাওয়া পাচ্ছি | অসুখ করলে যত্ন করার লোক আছে | কথা বলার সঙ্গী আছে | ভালো লাগে আমার | বলে হাসেন অশীতিপর বৃদ্ধা | অনেকক্ষণ ধরেই কথা বলে একটু ক্লান্ত | কিছুদিন আগেও রাস্তায় বসে ভিক্ষা করতেন | আজ একটা নিরাপদ আশ্রয় আছেন | অথচ সারাটা জীবন এমনটা ছিল না | ভালো ঘরের বউ ছিলেন | কিন্তু মা হিসাবে সন্তানের সংসারে ঠাঁই পান নি | তাই রাস্তাই ছিল অবলম্বন | ভিক্ষাকেই করেছিলেন জীবিকা | বয়স এখন আশির ঘরে | মাথায় অবশিষ্ট নেই আর একটাও কালোচুল | গালে অগুনতি প্রকোষ্ঠ | গলাটা ঝুলে গেছে | হাতের চামড়া গুটিয়ে গেছে | হাঁটতে পারেন না কেউ হাত না ধরলে | এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্যে না এলে প্রথমার বোঝাই হত না অবসরটাও কত দামী |

    সকাল থেকেই আজ এসেছে এদের কাছে | অনেকের সাথেই কথা বলেছে সে | যেন মন খুলে কথা বলতে পেরে এরাও কিছুটা খুশী | অভিজ্ঞতায় বুঝেছে সে যে কিছু একটার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রাখলে মন ভালো থাকে | মাথায় আজে বাজে চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খায় না | বাবাও বলতেন | এমনই একটা কিছুর দরকার বুঝি ছিল তার জীবনে | সারা জীবন তো নিজের সন্তানদের জন্য খেটে এল‚ তাদের সুখ-সুবিধা দেখে এল‚ তাদের ভবিষ্যত চিন্তা করেই ফুরিয়ে ফেলল জীবনের কতগুলো বছর | এখন তারা স্বাধীন‚ উড়তে শিখে গেছে‚ খুঁটে খেতে শিখে গেছে‚ এখন তো সেও স্বাধীন | দায় নেই দায়িত্বও নই | এই স্বাধীনতাটাকে উপভোগ করতে চায় প্রথমা কিছুটা অন্যভাবে | কিন্তু কিভাবে সেটাই বুঝি খুঁজে ফিরছে‚ কিন্তু ঠিকঠাক পথটা পাচ্ছিল না | কেমন যেন এক অলসতা চেপে বসছিল | এখানে এসে থেকেই মনে হচ্ছে এটাই বুঝি সেই পথ |

    ছাদ জুড়ে ফুলগাছ করার সখ জেগেছিল সেই কবেই | কিন্তু করা হয়নি | অবসরের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সেই সখ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল | পত্রা আর ভুষণ দুজনেই উৎসাহ জুগিয়েছিল | কাছাকাছি একটা নার্সারী থেকে চারা আনতে গিয়েই পিউএর সাথে আলাপ হয়েছিল প্রথমার | মেয়েটারও বড় গাছ-গাছালীর সখ | চব্বিশ-পঁচিশের মেয়েটা একটা ছোটখাটো সংস্থা চালায় | অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত ব্যাপার | অসহায়-অথর্ব-আশ্র্য়হীন-অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পথ থেকে তুলে আনে পান্থশালা নামক এই সংস্থাটির ছাদের নীচে | উদ্দ্যেশ্য তাদের শেষের দিনগুলোকে কিছুটা মসৃণ করে তোলা | মেয়েটার বড্ড মায়া | অবাক হয়েছিল প্রথমা | আজকালকার দিনে এত কেউ ভাবে কারও জন্য? আত্মীয়-স্বজন তো ছাড় নিজের সন্তান-সন্ততিরাই ভাবে না | চমৎকৃত হয়েছিল প্রথমা |

    সাময়িক আলাপ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হতে সময় লাগেনি | আর সেই সুত্রেই প্রথমার আহ্বানে পিউ বাড়িতে এসেছিল | ছাদে ঘুরে ঘুরে গাছগুলো দেখতে দেখতেই বলেছিল এই গাছগুলো প্রদর্শনীতে ভাড়া খাটাবে মাসীমা? আয় হবে কিছুটা |

    কিছুটা বিরক্ত আর অনেকটা অযাচিত এই প্রস্তাবের উত্তরে বলেছিল এটা আমার সখ পিউ‚ অর্থের প্রয়োজনে আমি এসব করি না |

    আমি জানি তুমি অর্থের প্রয়োজনে গাছ কর না | আর এও জানি যে প্রদর্শনী থেকে যে অর্থ আসে তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয় এই গাছগুলি করতে | নরম স্বরে বলেছিল মেয়েটা |

    জিঞ্জাসু চোখে তাকিয়েছিল প্রথমা | কি বলতে চায় মেয়েটা?

    আমি আমার জন্য বললাম মাসিমা | তোমার এই গাছগুলো নিশ্চিত পুরষ্কার পাবে | সেই টাকায় তোমার দরকার নেই | কিন্তু আমি ভাবছিলাম যদি সেই টাকাটা আমার সংস্থাকে দিতে তাহলে ভালো হত | অযাচিতভাবেই বললাম | জানতো আমার তো তেমন সঙ্গতি নেই | যেখান থেকে যতটুকু পারি চেয়ে আনি | জান এদের জন্য আমার ভিক্ষে করতেও আপত্তি নেই | যাবে মাসিমা আমার সংস্থায়? গিয়ে দেখবে কি অসহায় ওরা | রাস্তায় পড়ে থাকে | কারও হয়ত সত্যি করে কেউ নেই | কেউ হয়ত বাড়ি থেকে বিতাড়িত | আমি এদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি | সামান্য চিকিৎসা‚ পথ্য‚ একটু ভালোবাসা‚ একটু ভালো রাখার চেষ্টা করি | এর বেশি করার ক্ষমতা আমার নেই |

    পিউ-এর সেই কথা শুনেই আসতে ইচ্ছে হয়েছিল | পিউএর কথার সত্যতা যাচাই করার সাথে সাথে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল নিজের কেরিয়ার বিসর্জন দিয়ে আজকের দিনে কে এমন পাগল আছে যে এমন করে জীবনপ্রান্তে উপনীত মানুষগুলিকে সেবা-শুশ্রষা করার কথা‚ ভালো রাখার কথা ভাবে |

    এসে বুঝেছে এখনও পৃথিবীটা এত সুন্দর কেন? লোভ-লালসা-অন্যায়-অত্যাচার-বঞ্চনার পাশাপাশি ফল্গুধারার মত বয়ে চলে মানবিকতা নিস্তরঙ্গ কিন্তু স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে |

    খাবে না মাসিমা? বেলা তো অনেক হল | তোমার পথ চেয়ে আমার আবাসিকরা বসে যে | আর কতক্ষণ তাদের অপেক্ষা করাবে? মৃদু হেসে বলে পিউ |

    লাজ্জিত হয় প্রথমা | সত্যি তো বেলা দুপুর কখন হয়ে গেছে খেয়াল পড়েনি | পিউ বলেছিল আসবে যখন তখন আমাদের সাথেই খেও | বাড়িতে আর রান্নার পাট রেখো না | তাই সেপথ মাড়ায়নি প্রথমা |

    সেকি তুমি ওঁনাদের এখনও খেতে দাওনি আমার জন্য? ছি ছি একি কথা |

    তুমি যে আজ আমাদের পান্থশালার অতিথি মাসিমা | তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে ওঁনারা খেতে বসতে রাজী হলেন না |

    কথা না বাড়িয়ে ওরা এগিয়ে যায় খাবার ঘরের দিকে | আয়োজন সামান্যই | সবই ঐ বয়স্ক মানুষদের পেটে সইবে এমন করেই তৈরি | তবু মনে হয় এমন তৃপ্তি করে বুঝি বহুদিন খায়নি সে | তৃপ্তি তো মনের সঙ্গে সংযুক্ত‚ পেটের সাথে নয় |

    (ক্রমশ)
  • chan | 132.162.165.210 | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৭:১৭648344
  • খুব ভাল লিখ্ছ,
  • joldip | 134.125.50.16 | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৭:০০648345
  • অবসর

    (৬)

    *******

    কেমন আছ অ্যান্টি ?

    ভালো | তুই কেমন আছিস?

    ভালো আছি |

    অফিস যাসনি আজ?

    নাগো লিভ নিয়েছি আজ |

    শরীর খারাপ নাকি?

    না না কিছু পার্সোনাল কাজ ছিল তাই নিলাম লিভ |

    ও আচ্ছা | সপু কেমন আছে?

    ও ভালো আছে অ্যান্টি | জানো এই অফিস-বাড়ি করে করে হাঁপিয়ে উঠেছি | বোরিং লাইফ |

    কদিন কোথা থেকে ঘুরে আয় না | মনটাও ভালো লাগবে | কাজে এনার্জি পাবি |

    তোমার সপুর ছুটি নেই অ্যান্টি? আর‚ আমিও পাবো না এখন ছুটি |

    আমার সপু? হাসালি স্থিতি | সপু এখন তোর্ | উঠতে স্থিতি‚ বসতে স্থিতি‚ ডায়ে স্থিতি‚ বাঁয়ে স্থিতি | বলতে বলতে শব্দ করে হাসেন প্রথমা |

    অ্যান্টি ভালো হবে না কিন্তু | একটা লজ্জিত কিন্তু তৃপ্ত মৃদু হাসি চুঁয়ে পড়ে স্থিতির টোলপড়া গালের গর্তে | কল্পনার চোখে দেখতে পান তিনি | নিজেকেও বড় তৃপ্ত-সম্পুর্ণ মনে হয় |

    এরকম ঠিক এই রকমই একটা সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছিল সে পুত্রবধুর সাথে | নিজেকে কখনও ঘর করতে হয়নি শাশুরী-দেবর-ননদ নিয়ে | পত্রকের কোন ভাই-বোন ছিল না | বাবা- মা অল্পবয়সেই হরিয়েছিল সে | কিন্তু নিজের জীবনে তো সে শাশুরী বউ এর কিসসা কিছু কম দেখেনি বা শোনেনি | কোথায় যেন একটা দুরত্ব | এক অদৃশ্য রেখা কিছুতেই যেন দুজনের সম্পর্ককে স্বাভাবিক হতে দেয় না | এমন সম্পর্ক সে চায় নি |

    একটা বিয়েবাড়িতে আলাপ হয়েছিল স্থিতির সাথে | কিছুটা অদ্ভুতভাবেই | পত্রকের সাথে বিয়েটা ভেঙ্গে যাবার পর মোটামুটি নিজের আত্মীয়-স্বজনদের এড়িয়ে চলত সে | শুধু আত্মীয় না এমনকি চেনা লোকেদের এড়িয়ে চলত | পারতপক্ষে নিতান্ত বাধ্য না হলে কারও বাড়ি যেত না | মনে হত পত্রক না‚ সেই সমস্ত দোষের ভাগী | পুরুষ মানুষ তো সোনার আংটি | তার দোষ ধরতে নেই | বিবাহবিচ্ছিন্নাকে সমাজ ভালো চোখে দেখে না | অথচ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাও সম্ভব না | বেঁচে থাকার সাথে জীবিকা আর জীবিকার সাথে সামাজিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে | সেই জীবিকার দোর ধরেই ঘটেছিল স্থিতির সাথে আলাপ |

    এক কাস্টমারের বোনের বিয়েতে গেছিল সে আরও কিছু কাস্টমারের সাথে | এক অফিসে কাজ করার সূত্রে সবাই তার কাস্টমার | ওরা এদিক-ওদিক ঘুরছিল আর সে হলে বসে বসে একদল উচ্ছ্বল তরুনীর আলাপ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল | এ ওর গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল | কোন রসালো কথা নিয়েই আলোচনা চলছিল হয়ত | একটা মেয়ে এসে ওদের সাথে যোগ দিল | হাতে কুলফি | মেয়েগুলোকে কি বলতেই তারাও ছুট লাগালো ভিতরের দিকে যেদিকে আইসক্রিম পার্লারটা | মেয়েটা গেল না | একটুক্ষন বাদে ফিরে এল সবাই হাতে কুলফি নিয়ে | কৌতুকভরেই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল ব্যাপারটা আর নিজের ফেলে আসা ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল | ঠিক সেই সময় মেয়েটা এসে বলল অ্যান্টি তুমি কুলফি খাবে?

    না না‚ এই তো খেতে ডাকলেই খেতে যাব | তখন খাব | আচম্বিত জিজ্ঞাসাতে থতমত খেয়ে যায় প্রথমা |

    আরে তখন দেখবে সব শেষ | তুমি বস আমি নিয়ে আসছি তোমার জন্য | বলেই উড়ে গেল মেয়েটা | নিয়ে এল একটা কুলফি |

    প্রথমার লজ্জা করছিল | ইশ কে কি ভাববে? ছোটদের যেটা সাজে সেকি তার সাজে |

    আরে নাও নাও লজ্জা পেও না | মেয়েটা হেসে বলে |

    কেউ দেখতে পেলে কি ভাববে? তুমি মনে হয় এই বাড়ির মেয়ে | কিন্তু আমি তো নিমন্ত্রিত | তুমি খেয়ে নাও | আমি পরে খাব |

    ওহ্হ অ্যান্টি দেখেছ গলতে শুরু করে দিয়েছে | নাও ধরো | আর কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে তোমার খাওয়া হয়ে গেছে |

    সাংঘাতিক মেয়ে তো তুমি | তারপর রাতে পেটে কিল মেরে থাকতে হবে তো বলে হাত বাড়িয়ে নেয় প্রথমা | এক চামচ কেটে মুখে দিয়েছে কে দেয়নি এসে হাজির যাদের সাথে গিয়েছিল তারা | রীতিমত অপ্রস্তুত অবস্থা | তারা তো ভেবেই নিয়েছে যে তার খাওয়া হয়ে গেছে | এক প্রস্থ রাগারাগি | মনে পড়তেই নিজের মনে হেসে ফেলে প্রথমা |

    অ্যান্টি কথা বলছ না কেন? হ্যালো হ্যালো? ওপ্রান্ত থেকে ক্রমাগত বলে যেতে থাকে স্থিতি | স্বর থেকে ঝরে পড়ে উদ্বেগ |

    আছি রে লাইনে | বল শুনতে পাচ্ছি |

    আমি ভাবলাম লাইনটা কেটে গেল বুঝি | কি ভাবছিলে?

    তোর সাথে প্রথম আলাপের কথা মনে পড়ল |

    তারপর তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব | উচ্ছ্বল হাসি ভেসে আসে ওপার থেকে | নির্মল হাসি | বন্ধুত্ব হয়েছিল স্থিতির সাথে | তখনই ভাবনাতে ছিল সপুর বউ করলে মানাবে বেশ |

    তারপর তো সুপর্নর সাথে তুমি আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে | আমি লাকি মা | তোমার মত অ্যান্টি পাওয়া‚ সুপর্নর মত হ্যাজব্যান্ড কাম বন্ধু পাওয়া আর পত্রার মত একটা বন্ধু পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার মা |

    একটা আত্মতৃপ্তিতে মনটা ভরে যায় | জীবনের কিছু প্রাপ্তি বড় সুন্দর‚ বড় সুখদায়ক |

    (ক্রমশ)
  • jol_dip | 125.241.27.251 | ১৫ অক্টোবর ২০১৪ ১৫:৫৭648346
  • (৭)

    অবসর

    ******

    এতগুলো শাড়ী কি হবে মা? তুমি কি আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করবে নাকি? বিস্ময় ঝরে পড়ে পত্রার গলা থেকে |

    করি যদি অসুবিধে কোথায়? একটু হালকা কৌতুক স্বরে প্রশ্ন রাখে প্রথমা |

    কি মানে এসবের মা? তাহলে তুমি যে বললে অবসর নিলে‚ সেটা তবে কি? কিছুটা উদ্বেগ আর কিছুটা বিস্ময় ঝড়ে পড়ে পত্রার গলা থেকে | ভালো লাগে পত্রার এই উদ্বেগ |

    মানে কিছু না | শখ হল অবসর নিলাম | এখন দেখছি বড় বোরিং এই অবসরযাপন |

    শখ‚অবসরটা শখের বিষয়বস্তু বুঝি? আর এই বয়সে তুমি আবার এইসব শাড়ী বিক্রি করতে শুরু করবে? আজ ভালো আছ তো কাল বাতের ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছ‚ তার ওপর এটা ওটা তো লেগেই আছে | আজ জ্বর তো কাল ঠান্ডা লাগা | এই শরীর নিয়ে তুমি আবার শাড়ী বিক্রি করবে অফিস-বাড়ি ঘুরে ঘুরে? তোমার কি টাকার খুব দরকার পড়ে গেছে মা ? তাহলে আমায় বললে না কেন? দাদাকেও তো বলতে পারতে | পারতে না?

    আর পারে না প্রথমা | মেয়েটা বড় ছেলেমানুষ | গলার স্বর শুনেও বোঝে না মা তার সাথে মজা করছে | মেয়েটার মনটা বড় নরম | আর একটু ধরে রাখলেই এবার পত্রা কেঁদেই ফেলবে হয়ত | সে বড় বাজে ব্যাপার হবে | তাছাড়া পত্রা ভাবছে অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই তার মা আবার ব্যবসা শুরু করতে চলেছে |

    ব্যবসা না | শাড়ীগুলো অন্য কাজে লাগবে |

    কি কাজ মা? গলায় কিছুটা আশ্বস্ততার সাথে সন্দেহ উঁকি দেয় |

    চা টা হয়ে গেছে | আগে খেয়ে নে‚ তারপর বলছি |

    না তুমি আগে বল |

    সামনে তো পুজো | তাই পান্থশালার কয়েকজন মহিলার জন্য কিনলাম কয়েকটা শাড়ী | সবাইকে তো দেওয়া সম্ভব না | অন্য কেউ দেবে বাকীদের |

    কিসের পান্থশালা? আমি কিছু বুঝছি না | তুমি কি বলছ? বিস্ময়ের পর বিস্ময় | পত্রা থেমে থেমে জানতে চায় মায়ের কাছে |

    তোকে বলা হয়নি | বেশ কিছুদিন আগে আমার সাথে একটা অল্পবয়সী মেয়ের আলাপ হয়েছে | মেয়েটা একটা সংস্থা চালায় | সেটারই নাম পান্থশালা | ওখানে কিছু অসহায় মানুষ আছে‚ যাদের দেখার কেউ নেই | জোয়ান বয়সটা যেমন-তেমন করে কাটানো যায় কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে একটা অবলম্বন লাগে | মেয়েটা সেই অবলম্বন যোগানোর চেষ্টা করছে |

    তুমি গেছিলে সেখানে? কই আগে তো বলনি? গলায় স্পষ্ট ক্ষোভ |

    প্রথমা হাসে | গেছিলাম | ওদের সাথে একটা বেলা কাটিয়েও এসেছি | বড় ভালো লেগেছে জানিস | মাঝে মাঝে ভাবছি ওখানে চলে যাব | ওদের সাথে সময় কাটাবো | ওদেরও ভালো লাগবে‚ আমারও সময় কাটবে একটা ভালো কাজে |

    একে বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো | রাগ রাগ স্বরে বলে পত্রা |

    একদম ঠিক বলেছিস | হাসে প্রথমা | এই যে নিজের সঞ্চিত অর্থ খরচ করে ওদের জন্য শাড়ী কিনলাম এটাতে কোন লাভ হবে না‚ সবটাই বলতে পারিস জলে দিলাম | কিন্তু সত্যি কি তাই পত্রা? একটু ভেবে দেখ তো এই যে শাড়ীগুলো পেলে ওদের মুখে যে হাসিটা ফুটে উঠবে তার মূল্য কি কিছু কম ? ওদের হাসি আমাকে যে স্যাটিসফ্যাক্সন দেবে সেটার মূল্য কি কিছু কম? সবকিছুর একটা দাম থাকে | ধর না ঐ স্যাটিসফ্যাকসানটুকুর দাম আমি দিলাম এই শাড়ীগুলির মধ্য দিয়ে | টাকার অঙ্কে সবকিছুর বিচার যে চলে না | কথা বলতে বলতেই অন্যমনস্ক হয়ে যায় প্রথমা |

    নিজেকে কত চেনা এখনও বাকি | নিজের ভিতরেই এইরকম একটা ফল্গুধারা লুকিয়ে আছে কোনদিন টের পায়নি সে | রাস্তা দিয়ে পথচলতে গিয়ে কত মানুষকে দেখেছে অসহায়ভাবে পড়ে থাকতে | কোনদিন এগিয়ে যায়নি | পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে গেছে আর পাঁচটা পথচলতি মানুষের মত | টাকার অঙ্কেই বিচার করেছে অনেককিছু একটা সময় | অথচ আজ এই মানুষগুলোর জন্য তার প্রাণ কাঁদে |

    একটা জীবনে নিজেকে ঠিক কতটা চেনা-জানা যায়? পরতে পরতে পাপড়ির মত উন্মোচিত হতে থাকে নিজের রুপ পরিস্থিতি অনুযায়ী | পত্রক যখন পরমাকে বিয়ে করে আনল‚ তখন টের পেয়েছিল নিজের ভেতরে একটা আগুন আছে‚ একটা জেদ আছে | সেই জেদ‚ সেই আগুনকে নিয়েই তো অনাগত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাবার সাহস পেয়েছিল সে | চিনতে পেরেছিল নিজের ভিতরের অন্য আমিগুলোকে |

    মা কি ভাবছ?

    সম্বিত ফিরে পায় প্রথমা | মৃদু হেসে বলে না কিছু ভাবিনি |

    কিছুক্ষণ প্রথমাকে মৌন দেখেই হয়ত গলার স্বরটা পাল্টে ফেলে পত্রা | গলায় এখন আর রাগত স্বরটা নেই |

    তোমার তো অনেক পুরানো‚ অব্যবহৃত শাড়ীও আছে | সেগুলো দিতে পারতে |

    পূজোর দিনে পুরানো শাড়ী দিতে মন চাইলো না | পূজোর এই সময়টাতে যে যেখানে আছে সবাই তো একটু নতুন সূতো আশা করে পত্রা | ওদের সামর্থ্য নেই | আমার আছে | আমি না হয় দিলাম আমার সঞ্চয় থেকে কিছুটা বিলিয়ে |

    বিলিয়ে দেবার এই প্রবণতা তো তোমার নতুন নয় মা | বাবাকেও তো তুমি বিলিয়ে দিলে |

    চমকে যায় প্রথমা | থেমে থেমে বলে তোমার বাবা তো কোনদিন আমার ছিল না | তাই বিলিয়ে দেবার প্রশ্ন ওঠে না |

    বাবা যদি তোমার হত‚ তাহলেও কি এভাবে বিলিয়ে দিতে?

    ভিতরে শুকিয়ে যাওয়া একটা ক্ষতর মুখ চুঁইয়ে রক্ত নামে | টের পায় প্রথমা | এমন করে তো কখনও ভাবেনি সে | যখন জেনেছিল পত্রক পরমাকেই ভালোবাসত প্রথম থেকে তখন নিজের ভিতরে আগুন যতটা টের পেয়েছিল যন্ত্রণা ততটা বেশি টের পায়নি | যা নিজের নয় তা নিজের বলে ভাবতে ইচ্ছে হয়নি | তাই কি এত সহজে পেরেছিল পত্রককে ছেড়ে যেতে? একে কি বিলিয়ে দেওয়া বলে ?

    (ক্রমশ)
  • Ishani | 24.96.187.112 | ১৫ অক্টোবর ২০১৪ ১৭:১৪648347
  • আমি বাপু এখানেই পড়ছি | এক জায়গায় ...পরপর... অনেক সুবিধা | :))
  • jol_dip | 111.63.144.98 | ১৮ অক্টোবর ২০১৪ ১৪:৫৬648348
  • (৮)

    অবসর

    ********

    ছেলেটার সাথে পিউ বেশ সুন্দর পা মিলিয়ে ধুনুচি নাচ‚ নেচেই চলেছে | ঢাকের বাদ্যির একটা আলাদা ঋদম আছে‚ আপনার থেকেই পায়ের পাতা থেকে শরীরের কোণে কোণে ছড়িয়ে যায় এমন একটা তরঙ্গ যে নিজের অজান্তেই শরীরের প্রতিটা অঙ্গ সঞ্চালিত হয় | আট থেকে আশি সবার প্রিয় এই ঢাকের তালবাদ্যি‚ তাই বুঝি অশীতিপর বৃদ্ধাদের তোবরা গালে তরঙ্গায়িত হাসির সাথে পায়ের পাতায় হিন্দোল | বেশ লাগছে প্রথমার | হঠাৎ করে মনে হচ্ছে বয়সটা যেন কমে গেছে |

    আজ অষ্টমী | একটু আগেই সন্ধিপুজো হয়ে গেছে | মায়ের চোখ ছল ছল | নবমী নিশি বাদে মায়ের যাবার পালা | এক বিষাদিত মুহুর্ত | তাকে বিলম্বিত করার নিশ্চিত প্রয়াসেই বুঝি বা এই ধুনুচি নৃত্য‚ আবাসিকদের একাধিক ইভেন্টের আয়োজন করেছে পিউ | যে যা করতে পারে | যে গান করতে পারে সে গান করবে | যে আবৃত্তি করতে পারবে সে তাই করবে | সুর-তাল-লয় নিয়ে ভাবার কেউ নেই‚ কিছু নেই | নিছক পান্থশালার আবাসিকদের আনন্দ দেবার প্রয়াস | যার কিছু জানা নেই সে নাহয় নিছক অতীতের সুখস্মৃতিচারণাই করল | আজ দুখের কোন জায়গা নেই | আজ সারারাত ব্যাপী চলবে এসব প্রোগ্রাম | জোর নেই‚ যার শরীর যতটা দেবে ততটাই সে করবে | রাতে এখানেই থাকবে প্রথমা | সকাল থেকে নিজের কাঁধে আজ তুলে নিয়েছে পান্থশালার রান্নার ভার |

    পান্থশালার রোজকার থোড়বড়ি খাড়া জীবনে আঝালা পাতলা ঝোলের বদলে আজকে সামান্য মশালাদার স্বাদবদল করেছে প্রথমা | অবশ্যই স্বাস্থ্যহানির কথাটা মাথায় রেখেই যথাসম্ভব তেল-মশলা কম দেবার চেষ্টা করেছে | লুচি‚ ছোলার ডাল নারকেল কোড়া দিয়ে‚ বেগুন ভাজা‚ আলু-কপি-কড়াইশুঁটির দম‚ চাটনি | ওদের মুখে ছিল অপার্থিব হাসি | ঝুলে যাওয়া চামড়ার অজস্র প্রকোষ্ঠে টুকরো টুকরো হসির কোলাজ দেখতে দেখতে প্রথমার সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে যাচ্ছিল |

    ছেলেটাকে ভারি মানাচ্ছে পিউ এর সাথে | বেশ দেখতে | ফরসা‚টিকালো নাক‚ সু-উচ্চ মেদহীন শরীর‚ প্রশান্ত মুখ | দুপুরে খাবার সময় থেকে দেখছে | স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজেই সাহায্য করেছে প্রথমাকে | যদিও কাজের মাঝে আলাপ করার সুযোগ হয়নি | কিম্বা পিউ চায় না হয়ত আলাপ করাতে | একটু অভিমান স্পর্শ করে যায় প্রথমাকে | বয়স হলেই কি মানুষ একটু অভিমানী হয়ে পড়ে?

    মাসিমা তুমিও চলো নাচবে আমাদের সাথে | কখন এসে যে পিউ পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল হয়নি | কপালে-মুখে ঘাম | এতক্ষণের নাচের ফলেই শারের উর্ধাঙ্গের টপটি ভিজে গেছে ঘামে | পরণের জিনসেও ঘামের ছোপছোপ দাগ | এবার পূজোতে এই টপটি পিউকে সে উপহার দিয়েছে |

    এতক্ষণে তোর সময় হল আমার কাছে আসার | আর আমি নাচতে পারি না পিউ | গলায় স্পষ্ট অভিমান ঝরে পড়ে প্রথমার |

    সত্যি করে বলো তো সারাদিনে কি সেই সময়টা পেয়েছি | পূজোর দিনে বাড়িতে না থাকলে মায়ের মুখ হাঁড়ি হয়ে যায় | বাড়ির মানুষগুলোকে খুশী করে এলাম তো দুপুরে | তারপর আর দেখা করার সুযোগ হয়নি গো | তুমি প্লিজ রাগ করো না মাসিমা | বেশ নাচত হবে না‚ পা নাহয় একটু মেলাও আমাদের সাথে | স্পষ্ট আবদারের সুর পিউ-এর গলায় |

    এই আমরাটা কে কে পিউ? সতর্ক প্রশ্ন করে প্রথমা |

    একটা গোলাপী আভা খেলে যায় পিউ-এর গালে মুহুর্তের জন্য | চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে বুঝি একরাশ লজ্জায় | সামলে নেয় নিজেকে পিউ |

    দেখেছ মাসিমা তোমার সাথে পরিচয় করানো হয়নি | দাঁড়াও ডাকি ওকে |

    সারাটাদিন তো তোর সময় হয়নি পরিচয় করানোর | এখন না করালেও অসুবিধা নেই | স্বরে রাগতভাবটা চাপতে পারে না প্রথমা |

    রাগ হয়েছে মাসিমার বলে জড়িয়ে ধরে পিউ | স্পর্শে এক অদ্ভুত ভালোলাগা | পত্রার মত | পিউ এর বয়সে যখন-তখন এইভাবে জড়িয়ে ধরত পত্রা তাকে |

    আর তুমি নিজেও তো ওর পরিচয়টা জেনে নিতে পারতে মাসিমা | আর ও কি রকম মানুষ দেখো নিজের পরিচয়টাই তোমায় দেয়নি |

    পরিচয় করাতে হয় না | ডাকতেও হয় না পিউকে | ফুলের স্বাভাবিক আকর্ষণেই মৌমাছি এসে যেমন ধরা দেয়‚ তেমন করেই এগিয়ে এসে ছেলেটি দুটো হাত বুকের কাছে জড়ো করে সপ্রতিভ ভঙ্গীতে বলে আমি ময়ূর | পিউ এর বন্ধু |

    ময়ূর বিদেশে থাকে মাসিমা | এই সংস্থার বেশিরভাগ সাহায্যটা ওর কাছ থেকেই পাই | বলতে পার এটা ওর ব্রেণ চাইল্ড | আমি দেখভাল করি মাত্র |

    প্রথমা কিছু বলার আগেই ময়ূর বলে ভূল মাসিমা | আসলে এটা আমাদের দুজনের ব্রেণচাইল্ড | কিন্তু সশরীরে আমি আর কতটুকু থাকতে পারি | সবতাই তো করে পিউ | আমি বাইরে থেকে শুধু আর্থিক সাহায্যটুকু মাত্র করার চেষ্টা করি |

    সেটাই যে অনেকখানি ময়ূর | সমস্ত প্রজেক্টটাই আটকে যেতে পারে ফান্ডের অভাবে যতই আন্তরিক ইচ্ছা থাক না | আমাদের মত ছাপোষা মানুষ বছরে হয়ত এক-আধটা শাড়ী বা কিছু আর্থিক অনুদান দিতে পারে কিন্তু তাতে তো পান্থশালার মত একটা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না | অকপটে বলেন প্রথমা |

    হাসে ময়ূর | না মাসিমা | টাকা দিলেও অনেকসময় সঠিক কাজের মানুষ পাওয়া খুব ভার | আমার কপাল ভালো পিউ নিজে থেকে যথেষ্ট সংবেদনশীল এইসব মানুষদের প্রতি | আমার মস্ত ভরসা পিউ |

    শুধু ভরসা তার বেশি কিছু না আলপটকা কথাটা মুখ থেকে বেড়িয়ে যায় প্রথমার |
    একটা বিষাদের ছায়া নেমে আসে দুজনের মুখে |

    ব্যথিত হয় সে | মানুষের স্বাভাবিক কৌতুহল বোধে দুই দুই চার করার প্রবণতা থেকে কিছু কি ভূল বলে ফেলেছে? চর্মচোক্ষের বাইরেও কি কিছু আছে এই দুটি নর-নারীর জীবনে?

    (ক্রমশ)
  • jol_dip | 125.242.252.0 | ২২ অক্টোবর ২০১৪ ১২:৪৮648349
  • (৯)

    অবসর

    ******

    দেখতে দেখতে সব বড় পূজো শেষ | বাতাসে হিমেল পরশ | রাতের দিকে কুয়াশা পড়ছে | সকালের ঘাস স্যাঁতস্যাঁতে হিমে ভেজা | গাছের পাতা ঈষৎ ধুসর | শুকনো বাতাসে রাশ রাশ ধুলোকণা আর ছাতিম ফুলের গন্ধ | হেমন্ত জাগ্রত দ্বারে | আজকাল আর হেমন্ত তেমন আগের মত বোঝা যায় না | সারাবছর গরমের প্রকোপ থাকে বেশি | দু-দশদিনের জন্য শীতের হিমেল পরশ আর বর্ষাকাল | সাকুল্যে এই তিনটে ঋতুতে এসে ধরা দেয় এখন বাংলার ঋতুচক্র | তবু এবার যেন হেমন্ত একটু বেশি করেই ধরা দিচ্ছে |

    ভোরের দিকে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিলো বলে সিলিংফ্যানটা বন্ধ করে দিয়েছিল | সকাল হয়ে গেছে তবু হালকা চাদরের ওমে বিছানা কামড়ে পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে প্রথমার | বিছানাটাকে বড় আপন মনে হয় | চোখের পাতায় নরম আলোর মত ঘুম ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে লেগে থাকতে চায় | ভালো লাগায় ভরা আলসে সকালটায় আর কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিতে মন চায় | পাশ ফিরে শোয় প্রথমা |

    ল্যান্ডফোনটা তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে | চমকে যায় প্রথমা | চোখের পাতা থেকে টুটে যায় আলস্য | যদিও সূর্য্যদেব আকাশের অনেকটা ওপরে এসে গেছেন‚ বারান্দার গরাদ গলে উঁকিঝুকি মারছেন তিনি তবুও এ সময়টাতে ফোন এলে বুকের মধ্যে একটা ধুকপুকুনি হয় | মন ভালোর চেয়ে খারাপ চিন্তাই বেশি করে | প্রথমা ছুটে গিয়ে কলটা রিসিভ করে |

    হ্যালো বলতেই ওপ্রান্ত থেকে রিণরিণে গলায় ভেসে আসে দিদি পরমা বলছি |

    আবার পরমা | ভালো লাগা সকালেবেলাটা পানসে হয়ে যায় | একরাশ বিরক্তি এসে গলায় ভর করে প্রথমার |

    কিছু বলার আছে কি?

    খুব রেগে আছ এখনও আমার ওপর দিদি?

    রিণরিণে কন্ঠে বেদনার পরশ পায় প্রথমা | তবু মনটা নরম হয় না | গলার স্বরে ঝড়ে পড়ে ঘৃণা‚ বিরক্তি | শব্দগুলো মনে প্রবেশ করে না |

    আমার কাজ আছে | তোমার কিছু বলার থাকলে বল | আমার সময় নেই |

    জানি দিদি তুমি খুব ব্যস্ত | দিনকয় আগেও তোমায় ফোন করে পায়নি | তাই আজ সকাল সকাল করলাম | ওপর প্রান্তের অযাচিত কন্ঠস্বর থেমে থেমে বলে |

    বেশ তো এবার কি বলার আছে বল?

    তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই | তুমি যেদিন বলবে?

    কেন? কি দরকার? একটু অবাক হয়েই প্রশ্নটা করে ফেলে প্রথমা |

    সব কথা কি ফোনে হয় দিদি? সামনা-সামনি হলে বলব | তুমি যেদিন বলবে আমি চলে আসব বাড়িতে | অনেকদিন দেখি না বাড়িটাকে | তোমাদেরও দেখি না কতকাল হয়ে গেল |

    বাড়ি শব্দটা কানে এসে লাগে প্রথমার | বাকী শব্দগুলো হাওয়াতে ভেসে অশ্রাব্যই থেকে যায় | কান বেয়ে মনে প্রবেশ করে না | বাস্তবিক সে ভুলেই গেছে এই বাড়িটা একা তার নয় | পরমারও বাড়ি | বাবা বা মা কেউ বাড়িটার বিলি বন্দোবস্ত করে যাননি | বাবা চেয়েছিলেন কিন্তু বাধ সেধেছিল প্রথমাই | দরকার মনে করেনি তখন সে | মৌখিকভাবে তাঁরা বাড়িটা তাকে দিয়ে গেলেও আইনত পরমাও এ বাড়ির অংশীদার |

    বাড়িতে আসতে চাও?

    ওপ্রান্ত থমকে যায় মুহুর্তের জন্য | তুমি চাইলে বাইরেও দেখা করতে পারি |

    দেখ করতে চাও | কিন্তু আমার হাতে এখন সময় নেই | পরে জানাব | এখন রাখি |

    কবে ফোন করব?

    তোমায় করতে হবে না | আমি করে নেবো |

    একটা হালকা হাসি খেলে যায় অপর প্রান্তের গলায় তুমি আমায় কল করবে না আমি জানি দিদি | আমি বরং সপ্তাহখানেক পর করে নেব |

    বেশ তাই করে নিও | আমি ছাড়ছি |

    রিসিভারটা রেখে দেয় প্রথমা | সকালের ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজটা উধাও | বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদের তেজ বেড়েছে | ঘষামাজা আকাশটা যেন আগুন ঝরাচ্ছে | ডাইনিং এর সোফায় বসে পড়ে প্রথমা | আজ কোথাও বেড়োবার নেই | পান্থশালার সে নিয়মিত সদস্য বা কর্মী নয় | তাই নিয়ম করে যেতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা তার নেই | যেদিন যেদিন মন করে সেদিন সেদিন সে চলে যায় | আজ যাবে না | তাই আজ হাতে অঢেল সময় | তবু পরমাকে সেই সময়টা দিতে ইচ্ছে করল না | খুব কি খারাপ ব্যবহার করে ফেলছে সে পরমার সাথে? পরমা যেন কি বলল এখনও আমার ওপর রাগ করে আছ? পত্রক নেই বলেই কি কথাটা বলল পরমা ? যে পুরুষটিকে নিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই তার অবর্তমানে পরমা কি আবার জোড়া লাগাতে চায় পুরোনো সম্পর্ক? হঠাৎ দেখা করতেই বা চায় কেন? নাকি এই বাড়িটার অধিকার চাইতেই দেখা করার ছলনা? প্রশ্ন ভিড় করে আসে মনে |

    সে তো কখনও পরমাকে দায়ী করেনি কোন কিছুর জন্য | কখনও নিজের অন্তরের রাগ-ক্ষোভও দেখাতে যায়নি পরমা বা পত্রককে | ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হয়েছে তবু নিজেকে রেখেছে শান্ত | বয়স হয়েছে বলেই কি এখন কথায় কথায় প্রকাশ পাচ্ছে দীর্ঘদিন পুষে রাখা রাগ-ক্ষোভগুলো? নিজেকে নিজে বিশ্লেষণ করে প্রথমা | নিজেকে বিশ্লেষণ করাটা সবচেয়ে কঠিন |

    উঠে পরে প্রথমা | প্রাত্যহিক কাজ সারা বাকি | একলা মানুষ বলে তো আর কাজ কিছু কম না | আগে কাজের লোক ছিল | ইদানীং সব কাজ নিজেই করে | তবে মাঝে মাঝে কেমন যেন একটা কুঁড়েমি পেয়ে বসে | যেমন আজকের দিনটা সকালে মনে হয়েছিল গড়িয়ে গড়িয়ে কাটিয়ে দেবে‚ কিন্তু পরমার ফোনটা আসার পর সেটা আর হল না |

    তার থেকে বেশ ছোট এই বোনটাকে ছোটবেলায় খুব ভালোবাসত প্রথমা | সারাদিন বুকের কাছে আগলে রাখত জ্যান্ত পুতুলটাকে | পুতুলের মত হেলেদুলে হাঁটত যখন সবাইকে ডেকে দেখাত দেখ দেখ বোন হাঁটছে | পরমাকে নিয়ে উৎসাহের সীমা ছিল না | পরমাকে খাইয়ে দেওয়া‚ পরমার হাজার বায়না মেটানো সবই ছিল প্রথমার কাজ্ | পরমা স্কুল থেকে ফিরতে দেরী করলে প্রথমা খুঁজতে বেড়িয়ে যেত | পরমা খেলতে গিয়ে পড়ে গেলে প্রথমা কেঁদে ফেলত |

    সময় কত দ্রুত বদলে যায় | সেই পরমা আজ আসতে চাইছে কিন্তু সে চাইছে না | ভালোবাসা‚ বিশ্বাসের জায়গা নিয়েছে ঘৃণা‚ সন্দেহ |

    (ক্রমশ)
  • hu | 188.91.253.22 | ২২ অক্টোবর ২০১৪ ১২:৫৯648350
  • সুন্দর হচ্ছে লেখাটা
  • jol_dip | 111.63.153.236 | ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ১৪:৫৪648351
  • (১০)

    অবসর

    *****

    বাড়িটা সুন্দর করে সেজেছে | আজ প্রথমার নয় যেন বাড়িটারই জন্মদিন | নতুন এই প্রজন্ম হুজুগেও মাততে পারে | গত কয়েকদিন ধরে বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ চলেছে | নতুন রঙ হয়েছে বাড়িটায় | কিছু কিছু ইলেকট্রিক্যাল কাজও হয়েছে | এদিকের জিনিস ওদিক আর ওদিকের জিনিস এদিক | সবকিছুর হোতা ভুষণ | প্রথমা কেবল দর্শক মাত্র | ভুষণের ওপর কোন কথা বলা চলে না |

    দেওয়ালীর সময় নিমন্ত্রণ ছিল পত্রার বাড়িতে | প্রতিবছরই থাকে | দেওয়ালীর দিন আবার ভুষণের জন্মদিন | দেওয়ালী ধরে ওরা জন্মদিন পালন করে | তারিখ ধরে না | প্রতি বছরের মত এ বছরও দাদা মানে ভুষণের বাবা প্রথমাকেই উদ্দেশ্য করে বলছিলেন দেওয়ালীর শুভ অবসরে ভুষণের জনম‚ তো ওহি দিন আমি ওর জনমদিন মনাই | অর ভি এক কারণ আছে ভুষণ পয়দা হুয়া আর আমার কোপাল ভি খুলে গেলো‚ তো উসি লিয়ে অমি ঐ দিনটাই ওর জনমদিন মনহাই | ভদ্রলোক ভাবেন প্রথমা বুঝি হিন্দী বোঝে না | তাই এরম হিন্দী-বাংলা মেশানো এক বিদঘুটে ভাষায় কথা বলেন | প্রথমা তাকে শুধরে দেবার পরও একই রকম কথা বলার ধরন রেখে দিয়েছেন | প্রতিবছর রিপিটেডলি কথাটা শোনে | কিন্তু এবছর সেখানেই কথায় কথায় প্রথমা বলে বসল শ্রী পঞ্চমীতে তার জন্মদিন বলে তার বাবা-মাও ঐ দিনটা ধরেই জন্মদিন পালন করতেন‚ তারিখ ধরে না | ব্যস ভুষণ তখনই বলল মায়ের জন্মদিন এবার চল পালন করি | যে কথা সেই কাজ | পত্রাও নেচে উঠল |

    তা সেই জন্মদিন পালনের তাগিদেই বাড়ি রঙ ও আনুষঙ্গিক কাজকর্ম শেষে সকাল থেকে বাড়ি আজ টুনি আর চিনে আলোর যুগলবন্দীতে নববধুর সাজে সজ্জিত | কেমন যেন একরাশ লজ্জা ঘিরে রেখেছে প্রথমাকে | লজ্জার সাথে তিরতির করে একটা ভালো লাগাও মনের ভেতরে সমান্তরালে বয়ে চলেছে সেটাও বেশ টের পাচ্ছে প্রথমা |

    আগে আগে বাড়িতে বাবা-মা তাদের দুই বোনের জন্মদিন পালন করত | লোকজন কেউ আসত না | নিজেরা চারজনেই হৈ হৈ করে দিনটা কাটাত | সকালে মা কতকিছু রান্না করত | নতুন জামার গন্ধ‚ কপালে চন্দনের গন্ধ‚ নতুন গুড়ের পায়েসের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত | দিনটা ছিল অন্য সবদিনের থেকে আলাদা | যা খুশী কর মা মোটেই বকত না | অতীতে চারণ করতে করতে বুঝি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছিল | আর সেই হাসি লক্ষ্য করেই কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় ভুষণ |

    মা তুমি খুব খুশী আজ তাই না ?

    ধুস | তোরা পারিস বাপু | বুড়ো বয়সে জন্মদিন পালন | লোকে শুনলেও হাসবে |

    কেউ হাসবে না মা | আমর তো খুব এক্সাইটিং লাগছে | এনজয়ও করছি | পত্রাও খুব এক্সাইটিং | একটা বড় চকোলেট কেকের ওর্ডার দিয়েছি | সন্ধ্যায় পত্রা নিয়ে আসবে | আর হোম ডেলিভারী থেকে খাবার দিয়ে যাবে | ভেজ - ননভেজ সব আছে | আর আছে তোমার জন্য একটা বিগ সারপ্রাইজ |

    কি সারপ্রাইজ?

    বলে দিলে বুঝি সেটা সারপ্রাইজ থাকে?

    বেশ তাহলে থাক বলতে হবে না | তা কত লোক আসবে রে? আমার কিন্তু সত্যি খুব লজ্জা করছে |

    বেশি লোক আসবে না মা | আমাদের বাড়ি‚ স্থিতিবৌদির বাড়ি আর তোমার পান্থশালার সবাই | আর আমরা সবাই তো তোমার খুব পরিচিত‚ তাই লজ্জা পেও না |

    এটা ভালো করেছিস | পান্থশালার মানুষগুলোকে বলেছিস | ওরা তো কোথাও তেমন যেতে পারে না | এখানে আসলে ওরা খুব আনন্দ পাবে |

    জানি মা | আর তুমিও আনন্দ পাবে | মৃদু হেসে বলে ভুষণ | আমি একটু বাড়ির বাইরে থেকে ঘুরে আসি |

    ঘাড় কাৎ করে অনুমতি দেয় প্রথমা | হয়ত সিগারেট খেতে গেল | প্রথম যখন দেখেছিল ছেলেটাকে তখন ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারে নি | বাঙালীর মেয়ে পারবে অবাঙালী ঘরে গিয়ে মানিয়ে নিতে? দ্বন্ধ ছিল আরও অনেক কিছু নিয়ে | পত্রা ছোট থেকেই ছিল সুন্দরী | যেন পত্রকের জেরক্স কপি | স্বপ্নালু চোখে অবশ্য পত্রকের মত স্বপ্ন ছিল না | গ্রাজুয়েশনটা কোনক্রমে শেষ করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছিল | এতটা তাড়াহুড়ো ঠিক মনঃপূত ছিল না | নিজের জীবনের থেকে শিক্ষা নিয়েই চেয়েছিল মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াক | কিন্তু পত্রা বাড়িতে এনে হাজির করল ভুষণকে | সটান জানিয়ে দিয়েছিল মা আমি এই ছেলেকে বিয়ে করব | পত্রার কিছু করার ছিল না | আজকালকার দিনের ছেলে-মেয়ে ঠিক-ভুল নিজেরাই ঠিক করে | বাঁধা দিতে সাহস হয়নি | রাজী হয়ে গিয়েছিল বিয়েতে |

    ভাষা-খাদ্য-আচার-ব্যবহার-অর্থ কোন দিক দিয়েই তো মিল নেই তাদের পরিবারের সাথে ভুষণের পরিবারের | ভয় একটা ছিল | কিন্তু ভুষণ আর তার পরিবারের মত পরিবার বুঝি খুব কম আছে | পত্রাকে ওরা খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছে | নিজে খুঁজলেও এমন একটা জামাই আর পরিবার পেত কিনা সন্দেহ আছে |

    দাদা বলেছিলেন আপনার পত্রা যেমন আমার বেটি আছে তেমন মেরা বেটা আজ সে আপনারও বেটা আছে | দামাদ নেই বেটা মানকে চলিয়ে বহেনজী | ভুষণকে সে সুপর্ণর থেকে আলাদা করে দেখেও না | সম্পর্ক যত সহজ হয় জীবনে জটিলতা তত কম হয় | শ্বাশুরী-বৌয়ের সম্পর্ক জামাই-শ্বাশুরীর সম্পর্কের মত স্পর্শকাতর সম্পর্কগুলো প্রথম থেকেই যদি আন্তরিকতা দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে জীবন অনেক সহজ হয় | নিজের জীবনেই তো সে দেখেছে | স্থিতি বা ভুষণ এরা তার কাছে খুব সহজ |

    মা চল চল রেডি হয়ে নাও | এবার সব গেস্ট আসতে শুরু করে দেবে | হাঁপাতে হাঁপাতে পত্রা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলে |

    হুম চ একটা শাড়ী পছন্দ করে দিবি |

    পছন্দ করার কিছু নেই মা | তোমার জন্য এই শাড়ীটা ভুষণ কাল দোকান থেকে নিয়ে এসেছে | তোমাকে দারুন লাগবে পড়লে |

    আবার শাড়ীও এনেছিস | খুশী হয় প্রথমা | শাড়ীর প্রতি একটা স্বাভাবিক দুর্বলতা আছে তার | আসাম সিল্ক | সাদা জমির ওপর সবুজ-কালো কাজ | ঘরে চলে যায় সে শাড়ীটা নিয়ে | শাড়ীটা পড়ে নেয় | ছোট্ট একটা টিপ কপালে পড়ে নেয় | চুলটা খোঁপা করে নেয় | কানে শাড়ীর সাথে ম্যাচিং মুক্তোর টপ ব্যস তার সাজ কম্প্লিট | নিজেকেই বেশ ভালো লাগে | সব বয়সের একটা স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য আছে |

    একটু লজ্জা লজ্জা মুখে ডাইনিং-এ পৌঁছতেই দেখে সবাই এসে হাজির | কেক কাটা হবে | চোখের সামনে একটা বাষ্প ঘোরফেরা করে চোখটাকে ঝাপসা করে দেয় | তার দেওয়া শাড়ী পড়ে পান্থশালার অনেকে এসেছে | তাদের কুঁকড়ে যাওয়া মুখে অনাবিল হাসি | পিউ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে প্রথমাকে নিয়ে যায় কেক কাটতে | পিছন থেকে ভেসে আসে হাপি বার্থ ডে ডিয়ার মামনি | চমকে দেখে স্থিতি আর সুপর্ণ | এটাই বুঝি আজকের সারপ্রাইজ | বাষ্প এবার আর বাঁধ মানে না চোখ বেয়ে নেমে আসে | আজ যেন চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে প্রথমার জীবনে |

    (ক্রমশ)
  • jol_dip | 125.241.78.186 | ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ১৪:০৩648352
  • (১১)

    অবসর

    *****

    বাড়িটা যেন নিঝুম পুরী | কম পাওয়ারের আলোতে জমাট বেঁধে আছে একরাশ অন্ধকার মনখারাপের সাথে গলাগলি করে | সদর দরজাটা বন্ধ করে দেয় প্রথমা | মনটা বড় খালি খালি লাগছে | কম আলোটা নিভিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসে সে | সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দেয় | ডাইনিং-এর জোর আলোতেও খালি খালি ভাবটা যায় না | বুক ঠেলে একটা কান্না উঠে আসতে চায় | অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা কান্নারা নিঃশব্দে কখন যে ঝড়ে পড়তে শুরু করেছে টের পায়নি প্রথমা | মুখটা চেপে মুছে নেয় | মোবাইলটা বেজে ওঠে | সুপর্ণ |

    হ্যাঁ বল যথসম্ভব গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে সে | তবুও কথাগুলো কেঁপে যায় |

    কাঁদছিলে তো? ওপ্রান্তের সুপর্ণর গলার মনখারাপ ছুঁয়ে যায় প্রথমাকে |

    উত্তর দেয় না সে | সুপর্ণ তাকে খুব ভালো পড়তে পারে |

    কাঁদবে না মা একদম | তুমি কাঁদলে যে আমার ভালো লাগে না মা | বেদনার সাথে ঝরে পড়ে আর্তি |

    নিজেকে সামলে নিয়ে গলাটা পরিস্কার করে নেয় প্রথমা | হালকা গলায় বলে নাহ কাঁদব না | তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলে তুই এখন কোথায় পৌঁছোলি?

    এই তো ট্রেন খড়গপুর ছেড়ে গেল |

    সাবধানে যাস | আর নেমেই আমায় ফোন করিস |

    করব মা | তুমি এবার খেয়ে শুয়ে পড় | রাত অনেক হয়েছে |

    তোরা খেয়েছিস ?

    হ্যাঁ এই যাস্ট শেষ করেই তোমায় কল করলাম | আমি এখন রাখি? কাল নেমেই তোমায় ফোন করে দেব |

    রাখো |

    সাতটা দিন যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল | সুখের মুহুর্তগুলি বড় দ্রুত শেষ হয়ে যায় | মাত্র সাতটা দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল সুপর্ণ | প্রবাসে থাকা মানেই তো আসলেই এর-তার বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ আসতেই থাকে | কয়েকটা বাড়ি তো না গেলেই নয় | শ্বশুরবাড়ি‚ শালির বাড়ি‚ বোনের বাড়ি তো আছে | আছে বন্ধুদের বাড়িও | একে সময় দিতে গেলে ওর বাড়ি যাওয়া হয় না কি অন্যকে সময় দেওয়া হয় না | সময়ের অপ্রতুলতা কেউ বোঝে না | সবাই অভিমান করে | তার মাঝেই সময় বার করে সুপর্ণ মা আজ এটা রাঁধ কাল ওটা রাঁধবে | সুপর্ণ খেতে বড় ভালোবাসে | মায়ের হাতের রান্না হলে তো কথাই নেই | প্রথমা ছেলের ফরমায়েশ মত সব রেঁধেছে | স্থিতিও বাদ পরেনি | তার পছন্দ অনুযায়ীও বেশ কিছু পদ প্রথমা রেঁধে খাইয়েছে | বাড়িতে যেন কয়েকটা দিন চাঁদের হাট বসেছিল‚ ছেলে-বউ-মেয়ে-জামাই-নাতি |

    বড্ড ফাঁকা লাগছে | সন্ধ্যেবেলা ওদের ছাড়তে গেছিল স্টেশনে পত্রার গাড়িতে | ট্রেন এঁকেবেঁকে চলতে শুরু করতেই ওরা বাড়ির পথে পা বাড়ায় | স্টেশনে যাবার সময় যাও বা কিছু কথা হয়েছিল ফেরার পথে সবাই খুব চুপচাপ | পত্রার‚ ভুষণেরও মন খারাপ | গতবারও এমনটাই হয়েছিল | ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে | বেশিদিন তো হয়নি সুপর্ণ বাইরে গেছে | এবারে সবচেয়ে মুশকিল হয়েছিল দাদুভাইকে নিয়ে | দাদুভাই তো কিছুতেই তার মামু আর মিমিকে ছাড়বে না | অনেক কষ্টে বুঝিয়ে তাকে ফেরৎ আনা হয়েছে | একটা কান্না আবার বুক ঠেলে উঠতে চায় | শাড়ীটা বদলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে প্রথমা | কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না | সন্ধ্যেবেলা সুপর্ণ স্টেশনে স্ন্যাক্স খাইয়েছিল |

    ঘুম আসতে চায় না | সেদিন‚ তার জন্মদিনের দিন সত্যি খুব চমকে গেছিল প্রথমা | ভাবতেই পারেনি যে সুপর্ণ আসবে | পত্রা‚ভুষণ সব জানত কিন্তু কিছুটি টের পেতে দেয়নি | খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন | রাতে খাবার পর একে একে বিদায় নিয়েছিল পান্থশালার অধিবাসীরা‚ ভুষণ আর স্থিতির বাড়ির লোকেরা | থেকে গিয়েছিল পত্রা আর ভুষণ | অনেক রাত অবধি গান-গল্প চলেছিল | পথশ্রমের ধকল টেরও পেতে দেয়নি সুপর্ণ বা স্থিতি |

    আজ সকালেই জানিয়েছিল সুপর্ণ‚ খুব শীঘ্রি ওকে হয়ত বিদেশে পাঠাবে কোম্পানী | শুনে প্রথমে খুব খুশী হয়েছিল প্রথমা |

    কোথায় পাঠাবে জানিস কিছু?

    সম্ভবত ইটালী |

    অনেক দূরে চলে যাবি | একটা বিষন্নটা স্পর্শ করে যায় প্রথমাকে |

    দূর মনে করলেই দূর | আজকের দিনে দূর বলে কিছু হয় নাকি | টেকনোলজি কোথায় চলে গেছে বলত | চাইলেই দেখবে তোমার পাশে বসে গল্প করছি | হাসে সুপর্ণ |

    সত্যি সত্যি প্রযুক্তি কত উন্নতি করেছে | কিন্তু ইচ্ছে করলে কি ছুঁতে পারবে সে সুপর্ণকে? তপ্ত কপালে কি পারবে মায়ের স্নেহভরা হাতটা ছুঁইয়ে দিতে? পারবে না | এসব ইমোশোনাল কথা অবশ্য সে বলেনি সুপর্ণকে | শুনতে বোকা বোকা লাগত | কিন্তু এগুলো-ও খুব সত্যি | মনখারাপটা বারে বারে ছোবল দিয়ে যায় | পাশ ফিরে শোয় প্রথমা |

    পাশের রাজ্য থেকে তবু ছমাসে-নমাসে আসতে পারিস‚ অতদূর থেকে কি আর আসতে পারবি ইচ্ছে হলে এই যেমন এবার এলি? সেটা তো পারবি না |

    না তা পারব না | তবে বছরে - দুবছরে তো একবার আসবই | তখন না হয় চেপে থাকব | আর তুমিই বল এত বড় সুযোগ কি ছেড়ে দেওয়া যায় মা?

    নাহ যায় না | সুযোগ জীবনে বারবার আসে না | প্রথমা জানে সুপর্ণ উচ্চাকাঙ্খী‚ পরিশ্রমী‚ নিষ্ঠাবান | লক্ষ্যে অবিচল থেকে একটু একটু করে সে এগিয়েছে তার গন্তব্যের দিকে | কোনভাবেই সে সুপর্ণকে বাঁধা দেবে না | সুপর্ণ তার গর্ব | তবু মাতৃস্নেহ বলে একটা কথা আছে‚ সেটা কাউকে বোঝানো যায় না | জীবনের পথে চলতে চলতে আপনি তার উপলব্ধি হয় | চুপ করে ছিল প্রথমা |

    আর তোমার ভিসা করে দেব আমি | তুমিও গিয়ে থাকবে আমাদের কাছে | ছোট বাচ্চাকে যেভাবে প্রবোধ দেয় সেভাবেই সুপর্ণ তাকে প্রবোধ দিচ্ছিল | হেসে ফেলে প্রথমা শব্দ করে | নিশীথ রাতে ঘরের কোণে কোণে প্রতিধ্বনিত হয় সেই হাসি | একটু একটু করে মনখারাপের চাদরটা সরে যাচ্ছে মনের ওপর থেকে |

    আর এখুনি তো যাচ্ছি না | সে যেতে এখনও তিন থেকে ছয়মাস বাকী | তার আগে তুমি চলো না অ্যান্টি কদিন আমাদের ওখানে থেকে আসবে | আমার এই সংসারটা তো তোমার দেখাই হয়নি | দেখবে খুব ভালো লাগবে | স্থিতি বলছিল |

    হুম যাবে কদিন ওদের ওখানে থেকে আসবে | একঘেয়ে পরে থাকতে থাকতে শরীর-মন সব স্থবির হয়ে গেছে | ঘুরে আসবে কদিনের জন্য |

    মনটা বেশ হালকা লাগে | অনেক দূর থেকে রাতশেষের ইঙ্গিত দিয়ে ডেকে ওঠে একটা পাখি | প্রথমার চোখ জুড়িয়ে আসে |

    (ক্রমশ)
  • jol-dip | 233.29.204.178 | ০৩ নভেম্বর ২০১৪ ১৬:০৮648354
  • (১২)

    অবসর

    ********

    শরীরটা এখনও বেশ দুর্বল | চলতে গেলেই মাথাটা টলে যাচ্ছে | জ্বরটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল | সঙ্গে কাশি | জ্বরটা সেরে গেছে কিন্তু এই কাশিটা কিছুতেই চট করে সারতে চাইছে না | অ্যান্টিবায়োটিক কতগুলো খেয়ে ফেলল তবু কাশিটা যাবার নাম করছে না |

    রান্নাঘরে খুটখাট আওয়াজ | ইচ্ছে করছে দেখে মেয়েটা কি করছে‚ কিন্তু শরীর সাথ দিচ্ছে না | সারাদিন খালি শুয়ে -বসে থাকতেই ইচ্ছে করে | কিছু খেতেও রুচি নেই | এটা-ওটা ঘুরিয়ে রান্না করে দিচ্ছে মেয়েটা‚ তবু কিছু খেতে ইচ্ছে করে না |

    মোবাইলটা আবার বাজছে | সারাদিন ধরে ফোন আসার বিরাম নেই | ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে করে না | কানে নিলেই যেন কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠছে | ফোনের রিং শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে পিউ | ফোনটা কানে দিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে যায় | কিছু হয়ত ওভেনে বসিয়েছে | আজ বলেছে নতুন কিছু আইটেম বানিয়ে খাওয়াবে |

    এমন একটা সময়ে প্রথমা অসুস্থ হল যখন কলকাতায় পত্রা নেই | এবার ওর শ্বশুরবাড়ির তরফে কোন এক ননদের বিয়ে সেই বিকানীরে | পত্রা যেতে চায়নি | প্রথমা একরকম জোর করেই পাঠিয়েছে | মেয়েটা কোথাও বেড়াতে যেতে পারে না তাকে একা রেখে | ভুষণ তাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল | প্রথমা যেতে রাজী হয়নি | চেনা নেই জানা নেই গিয়ে যদি অস্বস্তিতে পড়ে‚ যদিও ওঁনরা লোক ভালো তবু যায়নি সে | রোজ ফোন করবে‚ নিজের যত্ন নেবে এরম হাজারো প্রতিশ্রুতির বান বইয়ে দিয়ে তবে পত্রাকে পাঠাতে পেরেছে | গিয়েও কি রেহাই আছে | সারাক্ষণ ফোন করেই চলেছে | ভাগ্যিস ফোন করেছিল পিউকে | না হলে আর এ যাত্রা এইভাবে বসে থাকা হত না | এতক্ষণে বুঝি ফোটো বানানোর তোড়জোড় চলত | মনে মনে হাসে প্রথমা |

    নাও কফি খাও | খেয়ে বল কেমন হয়েছে?

    ধুমায়িত দুটো কাপ এনে সেন্টার টেবলে রাখে পিউ | কফি ভালোবাসে প্রথমা | কখন-সখন সাধ হলে কিনে এনে বাড়িতে বানিয়ে খায় | কাপটা তুলে নেয় সে |

    পত্রাদি ফোন করেছিল | আশা করেছিল ফোনটা তুমি তুলবে |

    ফোনে কথা বলতে ভালো লাগছে না পিউ | তুই বলেছিস তো ভালো আছি আমি?

    হ্যাঁ বলেছি | তবে খুব চিন্তায় আছে তোমায় নিয়ে | আগামীকাল ওদের সব রসম মিটলেই ও ফ্ল্যাইট ধরবে |

    আমি তো এখন ভালো আছি | এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে বলত? আর তুই তো আছিস |

    তা বললে কি হয় মাসিমা | তুমি যেমন ওর জন্য উতলা হও‚ ওরও তো সেরকম তোমায় নিয়ে চিন্তা হয় | নিজের হাতে করা আর অন্যকে দিয়ে করানো একটা পার্থক্য তো থাকেই | বলে পিউ রান্নাঘরে চলে যায় |

    কফির কাপে অল্প অল্প চুমুক দিতে থাকে প্রথমা | দিনকয় আগে সেদিন রাতে গঙ্গার ঘাট থেকে ফিরেই জ্বরে পড়েছিল প্রথমা | সন্ধ্যেবেলা খবর এসেছিল পান্থশালার একজন আবাসিক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে | ছুটে গিয়েছিল প্রথমা | এই কদিনেই পান্থশালার লোকজন তার অতি আপন হয়ে উঠেছিল | গিয়ে অবশ্য তার সাথে দেখা হয়নি | ছেড়ে চলে গিয়েছেন তিনি বাকি আবাসিকদের | ঝুলে পড়া দন্তবিহীন গালের চামড়ায় পরম প্রশান্তি নিয়ে শুয়ে আছেন তিনি চৌকিতে | পরণে প্রথমার দেওয়া শাড়ীটা | তার শেষ ইচ্ছাই ছিল প্রথমার সাথে দেখা করার | খুব কেঁদেছিল প্রথমা | বুকের ভিতরের থেকে হুড় হুড় করে বাঁধভাঙা জলের মত বেড়িয়ে আসছিল কান্নার স্রোত | কেন এত কেঁদেছিল আজও স্পষ্ট নয় | হয়ত দুঃখে হয়ত দেখা করতে না পারার কারণে | অনেক কান্না জমেছিল ভিতরে |

    দাহ করে ফিরতে সেদিন মাঝরাত পেড়িয়ে গিয়েছিল | পিউ বারণ করেছিল ফিরতে | কিন্তু প্রথমা শোনে নি | বাড়ি ফিরে এসেছিল | সারারাতের পর ভোরবেলা এসেছিল জ্বর | গাটা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছিল | তাই নিয়েই সব কাজ সেরে এক কাপ চা খেয়ে সেই যে শুয়ে পড়েছিল আর কোন হুঁশ ছিল না | পত্রা অনেকবার ফোন করে না পেয়ে পিউকে ফোন করেছিল | কি ভাগ্যি রোজকার মত সেদিনও সকাল বেলা সদরটা খুলে ঠেকিয়ে দিয়ে এসেছিল তাই রক্ষে নাহলে পিউকে অনেক কষ্ট পেতে হত বাড়িতে ঢুকতে |

    পত্রা ফোনে তো সাঙ্ঘাতিক বকুনি দিয়েছে | ফিরলে কপালে আরও বকুনি আছে | সুপর্ণ - স্থিতি দুজনেই আসতে পারছে না বলে একটা অপরাধবোধে ভুগছে | প্রথমা জানে ইচ্ছে করলেই আসা যায় না | আশ্বস্ত করেছে সে |

    মাসিমা ভাজা কাজুগুলো খেয়ে নাও | একপ্লেট সল্টেড কাজু এনে পিউ রাখে টেবলে |

    সারাদিন তো খাইয়েই যাচ্ছিস | আর পারি না বাপু | ছদ্মরাগের সাথে বলে প্রথমা |

    হাসে পিউ | না খেলে শরীরে শক্তি পাবে কি করে | শরীরটার কি হাল হয়েছে বলোতো?

    তুই না আসলে এ যাত্রা আমি কি আর বাঁচতাম? তোর কাজ কি শেষ হল পিউ? কাজ শেষ হলে আমার কাছে একটু বোস |

    একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পিউ | ধুস কি যে বল তুমি | তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলে জানো এই সল্টেড কাজু আমার খুব প্রিয় |

    হাসে প্রথমা | আমারো ভালো লাগে | পিউ একটা কথা জানতে চাইবো? কিছুটা ইতঃস্ততভাব ফুটে ওঠে প্রথমার স্বরে |

    হাসে পিউ | আমি জানি কি জানতে চাও তুমি | মায়ূর আমার কিরকম বন্ধু তাই তো?

    লজ্জিত হয় প্রথমা | অনুভব করে পিউকে কোথাও যেন আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে | চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ | কখনও কখনও মৌনতা নিরাপদ অবলম্বন হয়ে ওঠে | ঘরের মধ্যে শুধু তাদের দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস আর ঘুর্নায়মান পাখার ব্লেডের মৃদু শব্দ |

    তুই রাগ করলি? প্রথমা কুন্ঠিত হয়ে পড়ে | নিজেকে হঠাৎ যেন বেশি দুর্বল মনে হয় |

    নাহ রাগ না | তবে কি জান এই প্রশ্নটা এতজন এতভাবে করেছে যে এখন উত্তর দিতে ক্লান্তি লাগে | ময়ূর আমার বন্ধু এটুকু কি যথেষ্ট নয় ? কেন মানুষ কাটাছেঁড়া করে বলোতো সম্পর্কটা নিয়ে |

    পিউ আমি খুব দুঃখিত | আসলে কি জানিসতো আমাদের সমাজে আমরা দেখে এসেছি ছেলে-মেয়ের নির্দিষ্ট সম্পর্ক | ঠিক তার বাইরে কেন জানি চোখ আর মন এখনও অভ্যস্ত হতে পারেনি ছেলে-মেয়ের বন্ধুত্বের মত একটা সহজ-সরল সমীকরণের | তাই বুঝি দুটো ছেলে-মেয়ের ঘনিষ্টতা দেখলে মন অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে | তুই মনে কিছু করিস না পিউ | আমি বুঝি সেই পুরোনো আমলের মানুষের মত হয়ে যাচ্ছি বয়স যত বাড়ছে | আমার খুব খারাপ লাগছে |

    হাসে পিউ | মনে করার মত অনেককিছু আছে আমার জীবনে | সেসব নিয়ে লিখতে গেলে জানো একটা পুরো উপন্যাস হয়ে যাবে | আমি জানি তুমি আমায় খুব ভালোবাসো | ভালোবাসার একটা অধিকার থাকে | সেই অধিকারকে সন্মান দিতেই তোমায় আমি সব বলব‚ তবে আজ নয় মাসিমা | আজ সেই মন নেই | একটা উদাসী দীর্ঘঃশ্বাস পিউ-এর বুক ঠেলে বেড়িয়ে আসে |

    চুপ করে থাকে প্রথমা | মনের মধ্যে একটা অজানা দংশন টের পায় | চুপ করে থাকে পিউ | অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতায় ঘরটা গুমোট হয়ে ওঠে |

    (ক্রমশ)
  • jol_dip | 233.29.204.178 | ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ১৭:০৫648355
  • (১৩)

    সকাল থেকেই রান্না-বান্নায় মেতেছে আজ প্রথমা | টুকটুক করে বেশ কিছু পদ বানিয়েও ফেলেছে | রান্না করাটা বরাবরই তার একট প্রিয় কাজের মধ্যে পড়ে | পরিশ্রম হয় বটে কিন্তু যখন খেয়ে সবাই তৃপ্তি পায় তখন খুব ভালো লাগে | একটা সময় তো নিজের রান্না নিয়ে রীতিমত এক্সপেরিমেন্ট করত সে | এটার সাথে ওটা‚ ওটার সাথে এটা দিয়ে উল্তোপাল্টা কত কি যে বানাতো | বাবা কোনদিন খেয়ে খারাপ বলতো না | যা বানাতো তাই চেটেপুটে খেয়ে বলত মায়ের আমার রান্নার হাতখানি বড় চমৎকার | আহ্লাদে গলে যেত সে | পরে নিজে খেতে গিয়ে দেখত হয়ত বিচ্ছিরি হয়েছে‚ নয়তো নুন্-মিস্টি কম | খেতেই পারা যাচ্ছে না | তখন বাবার ওপর খুব অভিমান হত | বাবাকে বললেই বলত এই যে তুমি এত কষ্ট করে রান্না করলে তার মূল্য দিতে হবে বইকি | বাবারা বুঝি এইরকমই হয় | হাসে প্রথমা | পত্রা বাবা বলে কিছু জানলই না |

    জ্বর থেকে সেরে ওঠার পর পর সুপর্ণ এসে নিয়ে গেছিল ওর শহরে | বলেছিল অনেকদিন একঘেয়ে পড়ে আছ‚ চল আমার ওখানে কটাদিন থেকে আসবে | ব্যাগ প্যাক করে দিয়েছিল পত্রা মহা আনন্দে‚ ভবখানা এমন যেন কত জব্দ হয়েছে প্রথমা | সত্যি কথা বলতে কি পত্রা‚ পিকুন্‚ পিউ‚ পান্থশালা আর কলকাতা এদের ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না তার | কটাদিন সুপর্ণর কাছে যাবার নাম শুনে মনটা নেচে উঠেছিল ঠিকই‚ কিন্তু একইসাথে মনটা খারাপও হয়েছিল |

    সুপর্ণর শরহরটা খুব সুন্দর | আর তাদের ছোট্ট দুকামরার সংসারটা যেন ফোটোফ্রেমের ছবি | পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিয়ে তৈরি | সংসার এত সুন্দরও হয় জানা ছিল না | আসলে দশ বছর পত্রকের সংসার করেছে সে ঠিকই‚ তবু সে সংসারকে এত সুন্দর মনে হয় নি | কথায় বলে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে | পুরানো অনেক বাড়িতেই দেখেছে সে সূঁচ-সূতোয় ফুটিয়ে তোলা এই প্রবাদ বাক্যকে | কিন্তু নিজের জীবনে সে ঠিক উল্টোটাই দেখল | তার সংসারটা কোনদিন সংসার বুঝি ছিলই না | পাশাপাশি কাটিয়ে যাওয়া কিছু মুহুর্ত মাত্র | যেখানে অপার ভালোবাসা নিয়ে বসেছিল প্রথমা আর অন্যজন অপার বিরাগ নিয়ে | মাঝের দুটি হয়ত দুর্ঘটনা কিম্বা স্বাভাবিক ঘটনা - সুপর্ণ আর পত্রা | এদের জন্য সে পত্রকের কাছে কৃতঞ্জ |

    পালংশাকের ঘন্টটা নামিয়ে নেয় প্রথমা ওভেন থেকে‚ জল টেনে গেছে আর মরালে ভালো লাগবে না | কড়াইশুঁটি আর বড়ি দিয়ে খেতে ভালোবাসে পরমা | গরম বেশ পড়ে গেলেও বাজার থেকে এখনও জিনিসগুলো উধাও হয়ে যায়নি | সুপর্ণর ওখানে যাবার আগেই বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল পরমা | এড়িয়ে যাবারও একটা সীমা থাকে | ফিরে এসে দেখা করবে বলেছিল | সেইমত গত সপ্তাহে ফিরে আসার পর পরমা ফোন করেছিল | এবারটা নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পেয়েছিল সে | তাই আসতে কখন চাও জানাতে বলেছিল দুপুরে আসবে সে | দুপুরে আসার কথা শুনেই মনে হয়েছিল পরমা কি দুপুরে এখানে খাবে | সেটাই সে জানতে চাইতেই পরমা থেমে থেমে বলেছিল কতদিন তোমার হাতে খাই না দিদি | কিছুক্ষণের জন্য প্রথমা নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল | বলেছিল বেশ তো তাহলে আমার এখানেই খেও |

    পরমা কেন আসছে জানে না সে | জানার খুব ইচ্ছেও নেই | তবু আসছে বলেই আজ পরমার প্রিয় পদগুলো রান্না করেছে সে | বরফ কি গলতে শুরু করেছে | না হলে এই সেদিন পর্যন্ত যে পরমাকে সে সহ্য করতে পারছিল না আজ তার জন্য সকাল থেকে খেটে তারই প্রিয় রান্নাগুলো কেন করল সে? নিজেকে প্রশ্ন করে প্রথমা | মন কোন উত্তর দেয় না | মাঝে মাঝে মনও কেমন বোবা হয়ে যায় |

    ডোরবেলটা বাজতেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় প্রথমা | পরমা | চিনতে একটু কষ্ট হয় | অনেক বদলে গেছে | আস্তে করে বলে দরজা খোলা আছে |

    পরমা ওপরে তাকিয়েই ছিল | অল্প হাসে | তারপর আস্তে আস্তে সদর পেরিয়ে দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে আসে প্রথমার | হৃপিন্ডটা যেন বড় জোড়ে জোড়ে লাফাচ্ছে | শরীরের শিরা-ধমনীতে উষ্ণ শোনিতধারা যেন দিকবিদিক ভুলে ছুটছে উর্ধশ্বাসে | আসতে আসতে নিজেকে আপাত শান্ত করে প্রথমা ডাইনিং-এ এসে দাঁড়ায় | এ বাড়ি পরমার চেনা | তবু ওপরে আসতে সময় লাগে তার | সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটু হাঁপিয়ে নেয় সে | তারপর তাকায় প্রথমার দিকে | মুখে হালকা হাসি | তাকিয়ে থাকে প্রথমাও | কত বছর পর আবার তারা মুখোমুখি |

    মিস্টিটা ধরো দিদি | বলে পরমা |

    মিস্টি ? মিস্টি এনেছ কেন? প্রথমা থেমে থেমে বলে |

    কতদিন পর এলাম তোমার কাছে‚ খালিহাতে আসি কি করে? পরমার কন্ঠে সহজ অভিব্যক্তি |

    মিস্টির প্যাকেটটা নিয়ে ফ্রিজের মাথায় রাখে প্রথমা |

    আমি একটু বসি দিদি | এখন আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না |

    লজ্জিত হয় প্রথমা | বস বস | আমি বরং চা করে আনি | চা খাবে তো?

    দিদি বেলা অনেক হয়েছে | এখন আর চা খাবো না | বিকালে খাইও | সোফায় বসতে বসতে বলে পরমা | তুমি বরং এখানে বস একটু |

    প্রথমার ঘরে একটাই বড় সোফা | বসে না সোফাতে প্রথমা | ডাইনিং টেবলের চেয়ার একটা টেনে নিয়ে বসে | একটা অস্বস্তি খচ খচ করে মনের ভিতরে | কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না সে | কিরম একটা রেস্টলেস লাগছে মনে মনে | তুলনায় পরমাকে অনেক শান্ত লাগছে |

    দিদি তুমি একইরকম আছ | সেই ছিপছিপে চেহারা এখনও ধরে রেখেছ | দেখে তো মনে হয় সুগার-প্রেসার কিছু তোমায় ধরে নি তেমন জাপটে | পরমা মৃদু হেসে জানতে চায় |

    ঘাড় নেড়ে বলে না সুগার আমার নেই | প্রেসারের ওষুধ খাই | মুখ আর মনের কিছুতেই মিলবন্ধন হয় না | মুখ উত্তর দেয় মন অনুসন্ধান করে‚ পরমার মত স্বাভাবিক কেন হতে পারছে না সে |

    আমায় দেখ কতরকমের রোগ নিয়ে বসে আছি | সুগার-প্রেসার-গেঁটে বাত-স্পন্ডালাইসিস কি নেই | হেসে বলে পরমা | হাসিতে একটা বিষন্নতা |

    চুপ করে থাকে প্রথমা | বাস্তবিক পরমা কত বদলে গেছে | বেঢপ মোটা শরীর | গায়ের রংও চাপা পড়ে গেছে | মাথার চুল একটা কালো নেই | তার মাথায় এখন কাঁচা-পাকা চুল | এই পরমা ছিল একসময় কত সুন্দরী | চাঁপা ফুলের মত গায়ের রং | প্রথমাও দেখতে খারাপ ছিল না‚ কিন্তু পরমার পাশে ম্লান ছিল তার সৌন্দর্য্য |

    সব আমার পাপের ফল দিদি | না হলে এত ভুগি | ভাবনায় ছেদ পড়ে |

    পাপ-পূন্য বলে কিছু হয় না | যেটা তোমার কাছে ঠিক সেটা তোমার কাছে পূন্য যেটা বেঠিক সেটা পাপ আবার সেটাই দেখবে অন্যের কাছে ঠিক উল্টোটা | এই যে দেখছ বোমা বিস্ফোরণে এখানে - ওখানে এত লোক মরে যাচ্ছে | যারা মারছে তারা একে পবিত্র বলে ভাবছে আর আমরা অন্যায় বলে | তাই ওসব নিয়ে ভেবো না | চল খেতে চল | এতক্ষণে নিজেকে একটু স্বাভাবিক বলে মনে হয় প্রথমার | টেবলের দিকে এগিয়ে যায় সে‚ একটু পিছনে পরমা | বসলে উঠতে কষ্ট হয় | চোখে পড়ে প্রথমার |

    খাবার বাড়ে প্রথমা | পরমার চোখে চিকচিক করে জল | সব তার প্রিয় রান্না | বরফ গলছে কি? চোখের দিকে তাকিয়ে এমন একটা প্রশ্ন পড়তে পারে প্রথমা | সকাল থেকে নিজেও তো ভাবছে একই কথা |

    (ক্রমশ)
  • de | 24.139.119.173 | ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ১৭:৩১648356
  • ভালো লাগছে!
  • jol_dip | 233.29.204.178 | ১০ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:১৩648357
  • (১৪)

    অবসর

    *********

    অমন একজন সুন্দর পুরুষমানুষের পাশে আমায় কি মানায় মা? তবু তো ঘর করলাম বেশ কয়েকটা বছর | তারপর সব কপাল | কোথা থেকে এক বেহায়া মেয়েমানুষ গায়ে পড়ে পড়ে আলাপ করে মানুষটাকে হাত করে নিল | কপাল পুড়লো | চলে গেল তার সাথে | বস্তিতে একা ছেলেকে নিয়ে থাকতাম | পেট তো চালাতে হবে | আগেও যে কাজ করিনি তা না | মায়ের সাথে কাজ করতাম বাবুদের বাড়ি | মা মাঝে মাঝে নিয়ে যেত | তিনি থাকতেও কয়েক বাড়ি কাজ করতাম | তা তিনি চলে যাবার পর আরও কয়েক বাড়ি বাসন মাজার কাজ নিলাম | স্বামী গেছে যাক‚ ছেলেটা মানুষ হোক চাইলাম | তা মা সে ইচ্ছেও পূরণ হল না |

    কথা হচ্ছিল পান্থশালায় কাজ চাইতে আসা পার্বতীর সাথে | শরীরের বাঁধন দেখে বয়স আন্দাজ করা যদিও কঠিন‚ তাও গোটা পঁয়তাল্লিশের নীচে হবে না | একটা চুলেও পাক ধরেনি | নিকষ কালো মুখে ধবধবে ফর্সা দাঁতগুলো চোখ টানে | মুখটা মন্দ নয় | কোন এক সূত্র থেকে পান্থশালার কথা শুনে এসেছে | পান্থশালার আবাসিক সংখ্যায় আরও দুজন যুক্ত হয়েছে | কাজও বেড়েছে | এখানে অনেকেই স্বেচ্ছাশ্রেম দেয় | তবে যারা রান্না করে‚ পয়-পরিস্কারের সাথে যুক্ত তারা মাইনে করা লোক | এদের কাছ থেকে ভালো কাজ আদায় করার জন্য পিউ এদের ভালো মাইনে দেয় | দরকার পড়লে অন্যান্য কাজেও এদের পাওয়া যায় | সেসব শুনেই বুঝি পার্বতী এখানে এসেছে |

    পার্বতীর কথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় প্রথমা | এ যেন আয়নায় তার বিগত জীবনের প্রতিবিম্ব | মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় অমন একজন সুন্দর পুরুষমানুষের পাশে আমায় কি মানায় কথাটা | কথাটা আজ প্রথমবার যে শুনল তা নয় | আগেও শুনেছে | পরমার মুখে | একটু অন্যভাবে | সেদিন পরমা এসেছিল স্বীকারোক্তি করতে যেন | প্রথমা কোন প্রশ্ন করেনি | চুকে যাওয়া বিষয়কে নিয়ে প্রশ্ন করার মানসিকতা‚ ইচ্ছা কোনটাই ছিল না | বিষয়টাকে তুলেছিল পরমাই |

    দিদি জানো পত্রককে যখনই তোমার পাশে দেখতাম আমার ভেতরটা জ্বলে যেত | মনে হত ওমন একজন পুরুষের পাশে শুধু আমায় মানায় | তুমি কুৎসিত ছিলে না‚ কিন্তু আমার মত সুন্দরীও ছিলে না | পত্রক আমায় ভালোবাসত আর আমিও পত্রককে | কিন্তু বাবা বিয়ে দিল তোমার সাথে | বাবা তোমার‚ পত্রক তোমার | বাবার নয় তুমি প্রিয় পাত্রী ছিলে কিন্তু পত্রক সেও মুখ বুজে মেনে নিল | তোমাকে আমি সহ্য করতে পারতাম না তখন |

    তাই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলে | বাবা চলে যেতেই তোমরা হাতে চাঁদ পেলে | ভিতরে ভিতরে চাপা থাকা একটা ক্ষোভ বুঝি নিজের অজান্তেই মুখ ফুটে বেড়িয়ে এসেছিল |

    অস্বীকার করেনি পরমা | তারপর বিড়বিড় করেই বলেছিল সেই পাপের শাস্তি আমি পেলাম জানো | আমার ছেলেটা হল কিন্তু মৃত | আর তারপর একটাও সন্তান হল না | কতকিছু করলাম | সবই কপাল নাকি কর্ম ফল জানি না |

    মায়ের মৃত্যুর সময় পরমা ছিল সন্তান সম্ভবা | আসেনি | তারপর আর তার কোন খবর রাখেনি প্রথমা | মনটা একটু দ্রব হয়ে যায় | মাথায় স্বান্তনার হাত রাখতে ইচ্ছে করে | কিন্তু ইচ্ছে আর বাস্তব দুই সবসময় এক সূতোতে গ্রথিত হয় না | চুপ করে উদাস বসে থাকে প্রথমা |

    জান দিদি এখানেই নিজের করা সব অন্যায়ের বিচার সেরে ফেলতে হয় | স্বর্গ-নরক সব এখানেই |পরমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে যেতে থাকে | পাপ-পূন্য এসব মানে না প্রথমা | ন্যায়-অন্যায় অবশ্য মানে |

    কেন ছেলের আবার কি হল? পিউ-এর স্বরে সম্বিত ফেরে প্রথমার |

    দিদি আমরা যে বস্তিতে থাকি সেখানে কি আর ভদ্দরলোকের মত ছেলে মানুষ করা যায় | চোর-গুন্ডা-বদমাস-নেশাখোরের আড্ডা | চেষ্টা করেছিলুম কিন্তু হল না | হাত-পা পচিয়ে‚ উদয়াস্ত খেটে ছেলে মানুষ করতে চেয়েছিলুম তা সে মানুষ হল না | মদ‚ গাঁজা‚ পাউডারের নেশা করে | যা কিছু জমিয়েছিলাম‚ ঘরে একটা একটা জিনিস করেছিলাম সে সব ভোগে গেছে | বেচে খেয়েছে | বলতে গেছি বলে‚ কি বলেছে জানো মা‚ আমি নাকি শরীর বেচে এসব করেছি | পাপের ধন ওসব | বেশ করেছে সে বেচে দিয়েছে | পাপের ধন না থকলে বেচতিস কি? বলেছি বলে মা চ্যালা কাঠ তুলে মেরেছে | ন মাস এই দেহে বহন করেছি এই দিনটা দেখার জন্য | হাত-পাগুলো দেখ দিদি‚ দেহ বেচলে কি এই দশা হয়? চোখ দিয়ে জল পড়ে পার্বতীর |

    চোখে জল চলে আসে প্রথমার | পিউ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে | তারপর কেটে কেটে বলে জনোয়ারটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা উচিত |

    মারতে হবে না দিদি | মরবে সে | নেশা‚ নেশা করে করে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে এনেছে | সইতে পারব না আমি | নাড়ী কেটে তো জন্ম দিয়েছি দিদি | পারব না দেখতে ওকে মরতে | তারচেয়ে ওর থেকে দূরে চলে এসেছি | জানব সে আছে | তোমার এখানে কাজ দাও দিদি | খাওয়া-পরা আর থাকার জায়গা হলেই চলবে | টাকা আমার চাই না |

    বেশ থাক তবে | পিউ রেখে দে ওকে | বলে ফেলে প্রথমা | যদিও সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তার নেই |

    কাজের লোক আমার লাগবে | থাকো তুমি | মাস-মাইনে একটা পাবে | শুধু নিজের কাজটুকু করলেই হবে না | দরকারে অন্য কাজও করতে হবে | এখানে থাকার জায়গা পাবে | তার আগে আমাদের পান্থশালার কিছু ফর্মালিটি আছে সেগুলোতে তোমার সই লাগবে | তুমি বস আমি ঘুরে আসছি একটু | তুমিও থাক মাসিমা | চলে যায় পিউ |

    মাথার মধ্যে পাক খায় অমন সুন্দর পুরুষ কথাটা | চেতনে-অবচেতনে গেঁথে যাওয়া বাক্য কৌতুহলী করে তোলে প্রথমাকে |

    তোমার স্বামী বুঝি দেখতে খুব সুন্দর ?

    পার্বতীর চোখদুটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নিমেষে | হ্যাঁ মা খুব সুন্দর উনি | বড় ঘরের ছেলে ছিলেন তো | ফর্সা‚ লম্বা | ছেলেটা বাপের মত রুপ পেয়েছে জানেন | শেষের কথাগুলোতে বিষাদ ধরা পড়ে |

    তা তোমার সাথে বিয়ে হল কি করে তার ?

    গুছিয়ে নেয় পার্বাতী | তারপর বলে আমার মা ওঁদের বাড়ি বাসন মাজত | মাঝে মাঝে আমিও যেতাম | তা সেখানেই তিনি বললেন মাকে আমায় পাড়ার সর্বশিক্ষা মিশনে ভর্তি করে দিতে | লেখা-পড়া করতে ভালো লাগত না | আর্ধেক দিন যেতাম না | মার চোখে স্বপ্ন আমায় লেখাপড়া শেখাবে | ভালো ঘরে বিয়ে দেবে | তা তিনি আমায় পড়াতে শুরু করলেন | কালো বটে আমি‚ কিন্তু বয়সকালে দেখতে সুন্দর ছিলাম | তেঁনারও তখন বয়স কম | প্রেমে পড়লেন আমার | কেউ তো আমাদের বিয়েটা মেনে নিত না | তাই আমরা পালালাম |মন্দিরে বিয়ে করলাম | এই বস্তিতে এসে বাসা বাঁধলাম | সাথে করে যা পয়সা এনেছিলেন সব শেষ হল একদিন | তার মত মান্যি-গন্যি মানুষ বস্তিতে এসে রয়েছেন‚ তাকে কাজ করার কথা কি বলা যায় | আর কি জানেনে মা অত সুন্দর ছিলেন বলেই বড় হারাই হারাই ভয় ছিল আমার তাই তাকে কাজের কথা না বলে আমি কাজ নিলাম বাবুদের বাড়ি | তা মা সবই কপাল | এই বস্তিতেই ঘুরে ঘুরে একজন দিদিমণি ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়তে নিয়ে যেত | খুব ভাব হয়ে গেলে দুজনের | প্রথমটা বুঝিনি | বুঝলাম যখন তখন দেখলাম পাখি উড়ে গেছে | খুব কেঁদেছিলাম | বলে হাসে পার্বতী | হাসিটা বড় বিষন্ন |

    জানেন মা পরে খবর পেলাম সেই দিদিমণিকে বিয়ে করেছেন তিনি | বাড়ি থেকে মেনেও নিয়েছে | ভালো আছে দুজনে | সাজানো-গোছানো সংসার | আবার হাসে সে | আমি ছিলাম তার কদিনের খেলার পুতুল | বুঝি নি মা |

    চুপ করে থাকে প্রথমা | অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক পার্বতী | ইচ্ছে করে না বলতে কেন নিজের অধিকার নিয়ে দাঁড়ালে না সেই মানুষটির কাছে | আজকাল এসবে বড় ক্লান্তি লাগে |

    (ক্রমশ)
  • jol_dip | 213.147.90.49 | ১১ নভেম্বর ২০১৪ ১৫:৪৩648358
  • (১৫)

    অবসর

    ********

    দিদুন তুমি ঐ টুইঙ্কল টুইঙ্কল রাইমটা জানো |

    না তো দাদুভাই‚ আমি তো জানি না | তুমি জানো?

    হ্যাঁ জানি তো | শুনবে দিদুন?

    নিশ্চয় শুনব | তুমি বল |

    উৎসাহ নিয়ে পিকুন অঙ্গভঙ্গী করে রাইম বলতে থাকে | পিকুন নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে প্লে স্কুল ছেড়ে | নতুন ইউনিফর্ম‚ নতুন ব্যাগ‚ নতুন জুতো‚ নতুন বই নিয়ে খুব উৎসাহী | আধো আধো স্বরে রাইম বলে নিজেই হাততালি দিয়ে উঠল | প্রথমাও হাততালি দেয় |

    বা দাদু তুমি কত কিছু জানো? কি সুন্দর রাইম বললে |

    তোমার কি দুঃখ হচ্ছে দিদুন?

    দুঃখ কি তুমি জানো দাদুভাই?

    একটু মাথা চুলকে নেয় পিকুন | তারপর একগাল হেসে বলে এই যে আমি বলতে পারলাম রাইমটা আর তুমি পারলে না‚ এটাই তো দুঃখ | তুমি কিচ্ছু ভেবো না | তোমায় শিখিয়ে দেবো আমি দিদুন | তুমিও দেখবে আমার মত বলতে পারবে | আমি তো এখন থেকে রোজ তোমার কাছে আসব | সব শিখিয়ে দেব |

    নাতির সাথে খুনসুটিতে মাতে প্রথমা | হাসে সে | আজকালকার বাচ্চাগুলোকে কিছু শেখাতে হয় না‚ কথার ঝুড়ি যেন | মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো নেড়ে দেয় | বেশ লাগে শৈশবের গা ঘেঁষে থাকতে | বয়সটা যেন হঠাৎ করে কমে যায় | পিকুনের নতুন স্কুল প্রথমার বাড়ির কাছাকাছি | তাই স্কুল থেকে নিয়ে টিউশন পড়িয়ে একেবারে পত্রা মায়ের কাছ থেকে হয়ে চলে যায় | এই টুকু ছেলেকেও টিউশন পড়াতে নিয়ে যেতে হয় আজকাল | সর্বত্র প্রতিযোগিতা | টিকে থাকার লড়াই | হাঁটুর ওপর মাথা রেখে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে পিকুন | ভোরের শিশির যেন | একমাথা চুলে হাত ঢুকিয়ে বিলি কেটে দেয় প্রথমা | বড় মায়া লাগে | ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই যেন জীবনযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় | খারাপ না‚ কিন্তু খুব ভালো-ও কি? শৈশব সীমাবদ্ধ‚ কৈশোর ভিডিওগেম আর কম্পিউটারে বন্দী | মস্ত ব্যাগের বোঝা‚ প্রত্যাশার বোঝা এইসব বইতে বইতেই বড় হয়ে ওঠা | সব কিছু পাল্টে যাচ্ছে | অতীতের সাথে বর্তমানের দ্বন্ধ যুগযুগ ধরে এভাবেই বুঝি চলে আসছে | অতীত বর্তমানকে বুঝতে চায় না | অতীত দিয়ে বর্তমানের ব্যাখ্যা করতে চায় |

    মা পিকুন ঘুমিয়ে পড়ল? পত্রা এসে কখন দাঁড়িয়েছে টের পায়নি প্রথমা |

    হ্যাঁরে এই মাত্র ঘুমল | ডাকিস না | মুখটা কি ক্লান্ত দেখ | মমতা ঝরে পড়ে প্রথমার কন্ঠ থেকে |

    না ডাকব না এখনি | একটু ঘুমোক | বেড়োবার সময় তুলে দেব | তুমি বললে বলে পেপারগুলো আমি দেখে নিয়েছি মা | কিন্তু ওঁনার কিছুতেই আমার কোন আগ্রহ নেই সেতো তুমি জান মা |

    চুপ করে থাকে প্রথমা | পত্রা নতুন কিছু বলে নি | পরমা আবার এসেছিল | পত্রকের করে যাওয়া উইল নিয়ে | পত্রকের যাবতীয় সম্পত্তি সে সমান তিনভাগ করে দিতে চেয়েছে | পরমারও খুব ইচ্ছে প্রবেট নিক পত্রা আর সুপর্ণ | কিন্তু তারা কেউ তাদের বাবার সম্পত্তি প্রত্যশাই করে না | সুপর্ণ সরাসরি জনিয়ে দিয়েছে সে প্রবেট নিতে ইচ্ছুক নয় | পত্রাও আজ জানিয়ে দিল | প্রথমা চেনে তার সন্তানদের | তাই পরমাকে আগেই জানিয়েছিল যে তুমি তোমার উকিলের সাথে কথা বলে নাও | আমার মনে হয় না ওরা কেউ তোমাদের সম্পত্তি নেবে | পরমা মানেনি |

    পত্রক জীবিত থাকতে তার সন্তানদের জন্য কিছু করেনি | ন্যুনতম একটা খবর নেবার প্রয়োজন মনে করেনি | সেই পত্রক তার উইলে যে সুপর্ণ আর পত্রাকে সম্পত্তি দেবে এটা ভাবতে পারেনি প্রথমা | পত্রক আর পরমার সন্তান বেঁচে থাকলে কি পত্রক ঠিক এইভাবেই সম্পত্তি ভাগ করত? এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত পরমা দিতে পারবে | কিন্তু প্রথমা জানতে চাইবে না কোনদিন | কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর জীবনে না খোঁজাই ভালো |

    আমি কালই পরমাকে ফোন করে জানিয়ে দেব যে তোরা কেউ প্রবেট নিতে চাস না | তার জন্য মনে হয় কিছু আইনী কার্য্যকলাপ আছে সেগুলো করে দিস | নিস্পৃহ স্বরে বলে প্রথমা |

    দেব | মা‚ আজকাল তোমার বোন প্রায় আসে না এখানে?

    নাহ প্রায় না | আগে এসেছিল একদিন আর সেদিন এই পেপারগুলো দিতে এসেছিল | আর পত্রা আমার বোন মানে‚ এভাবে কথা বলতে নেই | যাই হোক আর যেমনই হোক উনি তোমাদের মাসি | তাঁকে তার যোগ্য সন্মানটুকু দেওয়া উচিত |

    শুধু মাসি না মা‚ উনি আমাদের মাও তো | একটা শ্লেষ ঝরে পড়ে পত্রার গলা থেকে |

    চুপ করে থাকে প্রথমা | পত্রা সুপর্ণর মত ধীর-স্থির-নম্র না | সহনক্ষমতাও খুব কম | মনে যা আসে তা বলে দেয় |

    লোকটা ভাবল কি করে যে আমরা তার সম্পত্তি নেব? কোনদিন এসে দুটো মিস্টি কথা বলেনি | বন্ধুরা যখন বাপি বাপি বা বাবা করে সোহাগী হয়ে উঠত | আমি শুধু চোখের জল ফেলেছি আড়ালে‚ পাছে তুমি কষ্ট পাও | পিকুন যখন বাবার সাথে গল্প করে আমার তখন খুব কষ্ট হয় | কই আমার বাবা তো কোনদিন আমার সাথে গল্প করেনি | দাদা তবু কিছুদিন পেয়েছে তার বাবাকে‚ আর আমি‚ আমি পুরোটাই তোমার‚ আমার মায়ের সন্তান | আমার জগতে বাবা একজন অপরিচিত পুরুষ | বাবা কি আমি কোনদিন বুঝতে পারলাম না | স্বামী-স্ত্রীতে ডিভোর্স হয়‚ কিন্তু বাবা-মায়ের কি ডিভোর্স হয়? তাহলে সেই লোকটার কি কোনদিন আমাদের কথা মনে পড়ত না? কোনদিন আমাদের দেখতে ইচ্ছ করত না? আর আজ সম্পত্তি দিয়ে নাম কিনতে চাইছে | হু হু করে কেঁদে ফেলে পত্রা |

    স্তব্ধ বসে থাকে প্রথমা | এত কষ্ট জমিয়ে রেখেছিল পত্রা? সারাজীবনটা সে দিয়েছে তার সন্তানদের কিন্তু শুধু মা হয়েই থেকে গেলে‚ বাবার অভাব পূরণ করতে পারল না | এ কি তার ব্যর্থতা ? হয়ত | চোখটা জ্বালা জ্বালা করে | পিকুনের মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে কুশনে রেখে পত্রার কাছে এসে দাঁড়ায় | মাথায় হাত রাখে | জড়িয়ে ধরে পত্রা‚ সেই যেমন অনেকদিন আগে এমন করেই জড়িয়ে ধরত ঠিক তেমন করে জড়িয়ে ধরে | প্রথমাও জড়িয়ে ধরে মেয়েকে তার দুই বাহুর মাঝে স্বান্তনায়‚ ভালোবাসায়‚ আশ্বাসে | মা আর মেয়ে |

    সময় বয়ে চলে | পত্রাকেও বয়ে যেতে দেয় প্রথমা‚ বয়ে যাক মনের সব ক্লেদ‚ সব কষ্ট‚ সব অপ্রাপ্তি |

    (ক্রমশ)
  • nina | 78.37.233.36 | ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০৮:০৮648359
  • একসঙ্গে বসে পুরোটা পড়লাম--খুউউব ভাল হচ্ছে রে---বাহ! আবার আসব পড়তে--অনেক লিখিস।।।
  • de | 69.185.236.51 | ১২ নভেম্বর ২০১৪ ১৬:৪০648360
  • খুব ভালো লাগছে - আরেকটু তাড়াতাড়ি চলুক!
  • jol_dip | 213.147.90.225 | ১৩ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:৪৯648361
  • (১৬)

    অবসর

    ******

    পান্থশালার কাজকর্ম আগের থেকে অনেক বেশি বেড়েছে যেমন‚ সুসংহত হয়েছে কর্ম প্রণালী | আবাসিকদের সুযোগ-সুবিধা আগের থেকে অনেক বেশি রাখা সম্ভব হচ্ছে | তার একটা কারণ যদি ময়ূরের বদন্যতা হয়‚ তবে অন্য কারণটা অবশ্যই প্রথমা | প্রথমা এতটাই এই সংস্থার সাথে জড়িয়ে পড়েছে যে নিজে থেকেই সুপর্ণকে বলে কিছু ডোনেশানের ব্যাবস্থা করে দিতে পেরেছে | ব্রীজমোহনজী‚ মানে ভুষণের বাবাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছেন এ ক্ষেত্রে | নিজের যোগাযোগ থেকে তিনিও বেশ কিছু এককালীন সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন |

    পিউ এখন আগের থেকে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার পান্থশালা নিয়ে | ফলে এখন অনেক দায়িত্বই পালন করতে হয় প্রথমাকে | পিউ জানে প্রথমার মত দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা সবার থাকে না | তাছাড়া পান্থশালায় তার গুরুত্ব এখন ঠিক পিউ-এর পরেই | পিউ পান্থশালা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে প্রথমার সাথে আলাপ-আলোচনা করে নেয় | প্রথমাও পান্থশালাকে ঘিরে কিছু নতুন নতুন ভাবনার সৃজনও করেছে | শুধু আবাসিকদের সেবা-শুশ্রষাই নয় | তাদের আনন্দে রাখাটাও পান্থশালার একটা কর্তব্য | সেই লক্ষে প্রথমা প্রত্যেক আবাসিকের জন্মদিন পালন করার একটা প্রস্তাব দিয়েছিল | সাদরে সে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে | যারা তাদের জন্মদিন জানে তাদের সেই দিনেই পালন হয়‚ আর যারা জানে না তাদের পান্থশালায় আসার দিনটাকে ধরে পালিত হয় জন্মদিন | তেমনই দুজনের জন্মদিন আজ পালিত হয়েছে | এদের পান্থশালায় আগমনের তারিখ ধরেই জন্মদিন পালনে আবাসিকরা উৎসাহী ছিল | খাওয়া-দাওয়া সারতে সারতেই রাত বেড়ে গেছে | পিউ আজ আর ফিরতে দেয়নি | প্রথমাও আপাত্তি জানাইনি | আগেরবারের অসুস্থতা তাকে সচেতন করে দিয়েছে |

    পান্থশালায় পিউ-এর একটা ঘর আছে | প্রথমা সেখানেই রাতে শুয়েছে | কিন্তু ঘুম আসছে না চোখে | অচেনা জায়গায় কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না | যদিও পান্থশালা অচেনা নয়‚ তবু এখানে কখনও সে রাত কাটায়নি | খনিকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে পড়ে প্রথমা | বারান্দায় এসে দাঁড়ায় | আজ বুঝি পুর্নিমা‚ আকাশে মস্ত এক গোল চাঁদ | বাড়িটা ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোতে | মন ভালো করা একটা রাত যেন | আকাশের বুকে টিম টিম করে জ্বলে চলেছে নাম না জানা কতশত গ্রহ | জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্ররা | নিঝুম-নিস্তব্ধ রাতের একটা নেশা আছে‚ কেমন যেন নিশি পাওয়া মানুষের মত রাতের সৌন্দর্য্যে মোহিত হয়ে যায় প্রথমা |

    একি এখনও জেগে আছ ? রাত তো ঢের হল | বলে পিউ |

    কখন যেন বারান্দায় এসে সে দাঁড়িয়েছে | হাসে প্রথমা | ঘুম আসছে না পিউ | তুই শুবি না ?

    আমারও ঘুম পাচ্ছে না | তুমি ঘুমোবে না‚ আর আমি ঘুমিয়ে পড়ব? সেটা কি হয় | চল আজকের রাতটা আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দি | রোজ তো ঘুমই | বলে পিউ |

    মন্দ হয় না | কিন্তু নৈশ আড্ডার তো একটা ট্রপিক চাই | প্রথমা ট্রপিক হাতড়ায় | যদিও হাতড়াবার তেমন দরকার নেই‚ কিন্তু সেই রাতের পর থেকে পিউকে প্রশ্ন করার ব্যাপারে সচেতন থাকে সে | কি জানি কখন কোন কথায় মেয়েটা আঘাত পায় বা অপ্রস্তুত হয় |

    ট্রপিকের অভাব আছে নাকি মাসিমা? কথা বলতে শুরু করলেই দেখবে কথা নিজের পথ খুঁজে নিচ্ছে | প্রাসঙ্গিক-অপ্রসঙ্গিক‚ প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় এক কথা থেকে অন্য কথায় দেখবে সময় বয়ে যাবে |

    রোজ কি এত রাত অবধি কাজ করিস? জানতে চায় প্রথমা |

    মাঝে সাঝেই করি | মেইল চেক‚ প্রেজেন্টেশন রেডি করা এসব রাত ছাড়া করার সময় পাই কোথায় বল |

    তা বটে | সারাদিন তোকে একাই অনেক কিছু সামলাতে হয় | সায় দেয় প্রথমা |

    দাঁড়াও দুটো চেয়ার নিয়ে আসি ঘর থেকে | বলে পিউ তার ঘর থেকে দুটো চেয়ার নিয়ে এসে রাখে | প্রথমার পা টনটন করছে বসতেই টের পায় | অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে সে | পিউ বসে অন্য চেয়ারটায় | তারপর কোনরকম ভণিতা না করেই বলে তোমার মনে আছে মাসিমা তোমার অসুখের সময় তোমায় বলেছিলাম একদিন ময়ূরের সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে সব বলব | আজ বুঝি সেই রাত | আজ তোমার চোখেও ঘুম নেই‚ আমার চোখেও না | গোড়া থেকে শুরু করি | পিউ একটু চুপ করে যায় | হয়ত একটা মনসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেয় মনে মনে | প্রথমাও চুপ করে থাকে |

    আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তখন থেকে আমার আলাপ ময়ূরের সাথে | ও ছিল তখন ফাইনাল ইয়ারে | ময়ূর ছিল লেখাপড়াতে খুব ভালো | দেখেছ তো ওকে দেখতেও খুব সুন্দর | মেয়েদের হার্টথ্রব বলতে পার | হাসে পিউ | সবার সাথে বন্ধুত্ব | আমার সাথেও বন্ধুত্ব হল | সময়ের সাথে কখন যেন সেই বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়ে উঠল আমরা নিজেরাই টের পাইনি | ময়ূর পাশ করে চাকরী নিল | চোখে নতুন স্বপ্ন আমাদের | ঘর বাঁধব দুজনে | আপাত বাঁধা কিছু ছিল না | দুই বাড়ীর বাবা-মারা সব জানত | বিয়ের প্রস্তাব এল ময়ূরের বাড়ি থেকে | আমার বাবা ডেকে বললেন বিয়ের প্রস্তাব এসেছে খুব ভালো | কিন্তু একটা সত্যি কথা তোমার জানা দরকার | একটু চুপ করে থাকে পিউ |

    বাড়ির কার্নিসে বসে থাকা কয়েকটা পায়রা বুঝি ডানা ঝাপটায় | নিশুতি রাতে সেই সামান্য শব্দও কানে এসে ধরা দেয় | চুপচাপ মুখোমুখি বসে থাকে তারা নিশ্চুপ | বয়ে চলে সময় | আবার একটু মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেয় পিউ |

    জানো মাসিমা সেদিন জানলাম আমার বাবা-মা‚ মানে যাদের আমি বাবা-মা বলে ডাকি তারা আমার পালক পিতা-মাতা | আমার চারবছর বয়সে তারা আমায় শহরের এক অর্ফানেজ থেকে নিয়ে আসে | জান নিমেষের মধ্যে সারা পৃথিবীটা আমার কাছে অন্ধকার মনে হল | কি দরকার ছিল এ সত্য জানানোর? এই সত্য না জানলে কি কিছু ক্ষতি হত? বাবা বললেন আমি তোমায় না জানালে অন্য কেউ জানাত | তার থেকে বরং নিজের হাতে বিষ পান করানো আর নিজে পান করা আমার কাছে শ্রেয় | যেখানে তোমার বিয়ে হবে‚ সেখানে এটা জানানো অবশ্য কর্তব্য | পরে জানলে তোমায় অনেক অসুবিধার সন্মুখীন হতে হবে | তাই তাদের বলার আগে তোমায় জানানো উচিত বলে আমার মনে হয়েছে | এবার সবকিছু তোমার ওপর নির্ভর করছে | বাবা আমায় একা রেখে চলে গেল |

    খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল আমার আসল বাবা-মা কারা ? কেনই বা আমায় তারা ত্যাগ করল এরম হাবিজাবি অনেক অনেক প্রশ্নে আমি নিজে জেরবার হয়ে গেলাম | কটাদিন আমার নিজেকে সামলাতে লাগল | তারপর মনে হল মিথ্যে কেন আমি মরীচিকার পিছনে ছুটব | যারা আমায় চারবছর বয়স থেকে পালন করল‚ তারা আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ন | তাদের স্নেহে‚ তাদের ভালোবাসায় আমি তো কোনদিন কোন ফাঁক পাইনি | তারা মনের কোণে কাঁটার মত বিঁধিয়ে রাখা চরম সত্যটাকে চেপে রেখে কোনদিন আমাকে বুঝতেও দেননি তারা আমার আপন পিতমাতা নয় | এর দাম আমার কাছে অনেক বেশি নিজের আসল পরিচয় খুঁজে বার করার চেয়ে |

    প্রথমা উঠে গিয়ে হাত রাখে পিউ-এর মাথায় | এমন মেয়ে কজনের হয় আমি জানি না পিউ | আমার তোর জন্য গর্ব হচ্ছে | বাকিটা আমি অনুমান করতে পারি | ময়ূরের বাড়ি থেকে আপত্তির জন্যই তোদের বিয়েটা হল না | কিন্তু ময়ূর‚ ওত স্বাবলম্বী ছিল‚ ও তাহলে পিছিয়ে গেল কেন?

    ময়ূর না মাসিমা | আমি‚ আমি পিছিয়ে গেলাম | আজ নয় হয়ত কোন না কোন দিন ময়ূর সবকিছুর জন্য আমাকে দায়ী করবেই | সম্পর্কটা বরং সুন্দর থাক‚ স্বচ্ছ থাক | সব নদীকেই কি সাগরে মিশতে হবে? থাক না নদী আপনমনে‚ নিজের গতিতে মগ্ন হয়ে |

    কখন যেন রাতের আঁধার কেটে গিয়ে একটু একটু করে পুবাকাশে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে | দূর থেকে ভেসে আসছে দিন শুরুর আহ্বান নিয়ে পাখিদের কলকাকলী |

    (ক্রমশ)
  • jol_dip | 233.29.204.178 | ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:৩১648362
  • (১৭)

    অবসর

    *********

    পান্থশালা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয় যে আজকাল বাড়িতে প্রায় সারাটাদিন থাকাই হয় না | কয়েকটা দিন অবশ্য বাড়িতেই কাটিয়েছে প্রথমা | সুপর্ণ এসেছিল | যাওয়ার আগে ঘুরে গেল | বাড়িটা যেন কদিন খুব হৈ চৈতে মুখর হয়েছিল | যদিও খুব অল্পসময় সুপর্ণ অর স্থিতি বাড়িতে থেকেছে | কলকাতার বন্ধুবান্ধব - অত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঘুরতে ঘুরতেই সময় যেন ফুরিয়ে গেল কোথা দিয়ে বোঝা গেল না | গত পরশু উড়ে গেছে ওরা |

    কাল সারাদিন মনটা খুব খালি খালি লাগছিল | বাড়ি থেকে কাল বেরোয়নি | আজও সারাটাদিন বাড়িতে | ভালো লাগছে না বেড়োতে | রোদের কি তেজ | গনগনে রোদের তাতে যেন প্রাণ ওষ্ঠাগত | এবার এসে সুপর্ণ সব ব্যবস্থা করে বাড়ির দোতলার সব ঘরেই এসি লাগিয়ে দিয়ে গেছে | মাঝে মাঝে এসিটা চালাতে হচ্ছে | বিলটাও বেশ ভালো আসবে | এত গরমে এসিটা না চালিয়ে থাকাও যাচ্ছে না | কিছু কিছু অভ্যাস খুব বাজে হয় | প্রথমা এসিটাকে তার অভ্যাসে পরিণত করতে চায় না একান্ত দরকার ছাড়া |

    ডোরবেলটা বেজে ওঠে | পরমা | বারন্দায় গিয়ে উঁকি মেরে বলে দরজাটা ভেজানো আছে | ওঠার সময় লকটা টেনে দিও |

    সুপর্ণর আসার পর পরমা একদিন ফোন করেছিল | সুপর্ণ এসেছে শুনে আসতে চেয়েছিল | কিন্তু সপু চায়নি পরমার মুখদর্শন করতে | তাই সুপর্ণ চলে যাবার পর আজ আসছে | পরমার এই আসাটাকে পত্রা বা সুপর্ণ কেউ ভালো চোখে দেখছে না | নতুন করে কি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে ? দেখেশুনে তো তাই মনে হচ্ছে | কোথাও যেন মনের কোণে পরমার জন্য একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে | পরমা আসতে চাইতে তাই আর কোন প্রশ্ন করেনি সে |

    সিঁড়িটা যদিও পাতা‚ তাও পরমার সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে আসতে সময় লাগে | দেখেশুনে মনে হয় পরমাই বুঝি প্রথমার দিদি | ওপরে উঠে একটু হাঁপিয়ে নেয় সে‚ তারপর ম্লান হাসে |

    চা খাবে? প্রথমা শুধোয় |

    ঘাড় নেড়ে জানায় খাবে | এখনও বুকের ওঠাপড়া কমেনি | পায়ে পায়ে গিয়ে সোফাতে বসে পরমা | চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকে প্রথমা | একটু একটু মায়া লাগে | পায়ে পায়ে কিচেনে গিয়ে চায়ের জল গরম বসায় | সময় কত শক্তিশালী | ফেলে আসা দিনগুলো যেন পাতা ওল্টানোর মত পিছনে পড়ে থাকে | উল্টে উল্টে দেখা যায় ধুসর হয়ে যাওয়া দিনগুলোকে স্মৃতির আয়নায়‚ কিন্তু ফিরে যাওয়া যায় না সেইসব দিনে | ফিরে যাওয়া গেলে হয়ত জীবনের অনেক ভুলকে শুধরে নেওয়া যেত‚ অনেক ইচ্ছেকে পূরণ করা যেত | চায়ের জল ফুটে যেতেই চায়ের পাতা ভিজিয়ে দেয় প্রথমা | ব্রীজমোহনজী দিয়ে পাঠিয়েছেন চা পাতাটা পত্রাকে দিয়ে | সুগন্ধী‚ হালকা একটা ব্রাউন রঙ আসে | চা‚ দুটোকাপে ঢেলে নিয়ে এসে প্রথা বসে ডাইনিং-এ |

    চাটা নাও | বলে এগিয়ে দেয় একটা কাপ | নিজে তুলে নেয় অপর কাপটা | চায়ে একটা মৃদু চুমুক দেয় প্রথমা | চায়ে চিনি খাওয়াটা অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছে সে | সুগার নেই‚ তবু খায় না | চিনি ছাড়া চা মন্দ লাগে না |

    চায়ের গন্ধটা খুব সুন্দর দিদি | বলে পরমা |

    পত্রার শ্বশুরমশায় এনে দিয়েছেন | বলে প্রথমা |

    কদিন থেকে জান শরীরটা ভালো নেই | প্রেশারটা বেড়েছে | সুগারটা হাই হয়েছে |

    চুপ করে প্রথমা পরমাকে লক্ষ্য করে | ক্লান্ত লাগে পরমাকে | মুখটা বেশ শুকনো |

    তুমি কি বাড়িতে একা থাক? নীরবতা ভেঙ্গে বলে প্রথমা |

    আর কে আছে বল আমার? একাই থাকি | মাঝে মাঝে ভাবি আমার যদি কিছু হয়ে যায়‚ কেউ কিছু জানতেও পারবে না | ঘরের ভিতরে পচব |

    এটা এখন একটা কমন সমস্যা | আমিও তো একা | বলে প্রথমা |

    তুমি একা থাক ঠিকই | তবু তোমায় দেখার কেউ না কেউ তো আছে দিদি | আমার যে কেউ নেই | একটু চুপ করে থেকে আবার বলে বাড়িটা মাঝে মাঝে যেন গিলতে আসে | এ ঘর ও ঘর সব ঘরে যেন এক অপার শুন্যতা | শেষের দিকে পত্রক যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছিল‚ তখন দিনগুলো যেন কোথা দিয়ে কেটে যেত বুঝতাম না | মাঝে মাঝে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে যেতাম | বিরক্তও হতাম | আর এখন কেমন যেন কিছু করতে ইচ্ছে করে না | করতে হয় বলে করা | খেতে হয় বলে খাওয়া | থামে পরমা |

    কোনকিছুর সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখ পরমা | যেটা ভালো লাগে সেটা কর | মাঝে মাঝে ঘুরতেও তো যেতে পার | ভালো লাগবে দেখবে | একঘেয়ে কোথাও পড়ে থাকলে দেখবে জীবনকে এমন বোরিং লাগে | বোনটার জন্য হঠাৎ করেই খুব মায়া হতে থাকে | সেই প্রাণচঞ্চল মেয়েটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে |

    বিষন্ন হাসে পরমা | কিছু ভালো লাগে না জান | কিছু না |

    ছাদে যেতে পারবে? দেখবে গিয়ে কত গাছ লাগিয়েছি | নিজের হাতে ওদের পরিচর্য্যা করি | সিজনে যখন গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায় মনটা ভরে যায় | যাবে?

    পরে যাব | সিঁড়ি ভাঙ্গতে কষ্ট হয় | একটু হাঁটলেই বুক ধরফড় করে‚ শ্বাসকষ্ট হয়‚ পা ফুলে যায় | আস্তে আস্তে বলে পরমা | মাঝে মাঝে ভালো লাগে না‚ মনে হয় চলে যেতে পারলে বাঁচি |

    এইসব নেগেটিভ কথাবার্তা কে নিজের জীবনে প্রাধান্য দেয় না প্রথমা | জীবন আছে মানে সমস্যা আছে | সেই সব সমস্যাকে সরিয়েই তো জীবনের পথে এগিয়ে চলা | তার নিজেরও তো অনেক সমস্যা | কিন্তু সেইসব সমস্যাকে সে অতটা প্রাধান্য দেয় না | বিশেষ করে পান্থশালার সাথে যুক্ত হবার পর থেকে জীবনটাই পাল্টে গেছে | পাল্টে গেছে সে নিজেও | মাঝে মাঝে এসব বেশ টের পায় সে |

    পরমা জীবন যখন আছে সমস্যাও তো থাকবে | তাই বলে কি কোন কাজ থেমে থাকে ? কিছুর সাথে নিজেকে জড়িয়ে নাও | দেখবে জড়িয়ে গেলেই জীবনটাকে ওত ভারী মনে হবে না |

    এই অথর্ব শরীরটাকে নিয়ে কিসের সাথে জড়াবো দিদি?

    এখনও এত অথর্ব হয়ে পড়োনি তুমি পরমা | তোমার থেকে অনেক অথর্ব মানুষ আমি নিত্য দেখি | তাদের জীবনীশক্তি দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে | একদিন চল আমার সাথে পান্থশালায় |

    পান্থশালা কি কোন আশ্রম? জানতে চায় পরমা |

    পান্থশালায় চল একদিন | নিজের চোখে দেখবে পান্থশালা কি | ভালো লাগবে তোমার | আমি প্রায় যাই সেখানে | ইচ্ছে করলে তুমিও যেতে পার আমার সাথে | জানবে জীবন একটাই‚ সেটাকে ভরপুর বেঁচে নাও | আর শরীর সেতো তোমায় তার অস্তিত্বের জানান দেবেই | তুমি তাকে নিয়ে যত ব্যতিব্যস্ত হবে‚ সে তত তোমার মনের ওপর চেপে বসবে | মনটাকে সুস্থ রাখ‚ দেখবে শরীরও অনেক সুস্থ থাকবে |

    (ক্রমশ)
  • jol_dip | 213.147.90.228 | ১৮ নভেম্বর ২০১৪ ১৩:৪৮648363
  • (১৮)

    অবসর

    *********

    মাঝে মাঝে আসবেন এখানে‚ ভালো লাগবে আমাদের অ্যান্টি | আবাসিকদের সাথে গল্পগুজব করবেন | ওঁরা তো সেভাবে কারও সাথে কথাবার্তা বলতে পারে না | আমি সারাদিন ব্যস্ত থাকি | বাকি যারা এখানে কাজ করে তারাও তো ব্যস্ত | মাসিমা আগে এদের সাথে অনেকটা সময় কাটাতেন‚ কিন্তু ইদানীং মাসিমাকেও আমরা কিছু কাজে জড়িয়ে দিয়েছি | মাসিমা সেই আগের মত আবাসিকদের সাথে গল্প করার সুযোগটা পান না | আপনি আসবেন‚ ওঁদের সাথে কথাবার্তা বলবেন | এটা আমার অনুরোধ | একটানা কথাগুলো বলে থামে পিউ |

    সেদিন পান্থশালার কথা বলেছিল প্রথমা‚ পরমাকে | দিনদুই কাটতে না কাটতেই আজ পরমার আগ্রহেই এখানে এসেছে প্রথমা | পান্থশালা ঘুরে ঘুরে দেখছিল পরমা | চলতে- ফিরতে স্বভাবতই কষ্ট হচ্ছে পরমার | তবু মুখে যেন তার চিহ্ন নেই | আসলে মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে | নিজের সুখসুবিধে‚ নিজের চাওয়া-পাওয়া ‚ নিজের ভালো থাকা খারাপ থাকা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে চোখ মেলে দেখতে ভুলে যায় যে আমার আশে-পাশেই এমন অনেক মানুষ আছে যে আমার থেকেও খারাপ আছে | এসব কথাই ভাবছিল প্রথমা পরমাকে দেখে | আজ কার্যত সে পরমার গাইড | দেখিয়ে এনেছে এখানকার আবাসিকদের | বয়স্ক-অথর্ব মানুষগুলো সামান্য শুশ্রষা আর ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে জীবনযুদ্ধে নিজেদের ব্যাপৃত করেছে |

    আসব ভাই নিশ্চয় আসব | তোমাকে যত দেখছি তত আমি অবাক হচ্ছি | একটা মেয়ে এতবড় কর্মকান্ড কি করে চালাচ্ছ ? বয়সও তোমার অনেক কম | আবেগমথিত কন্ঠে বলে পরমা |

    হাসে পিউ | আমি একা কোথায়? কত মানুষ আমার পাশে আছে জানেন আপনি? সবার মিলিত প্রয়াস আর সন্মিলিত সদিচ্ছার বাস্তবায়িত রুপ হল পান্থশালা |

    পিউ খুব সুন্দর করে কথা বলে | প্রথমা মনে মনে তারিফ করে | পরমাও চমৎকৃত হয় পিউ এর বাচনভঙ্গীতে | মেয়েটার একটা সন্মোহিনী ক্ষমতা আছে নাকি? কেমন যেন এখান থেকে উঠে চলে যেতে ইচ্ছে করে না | অথচ যাবে বলেই তো বিদায় নিতে এসেছিল পরমা |

    একটা কথা জানতে চাইবো পিউ? প্রশ্নটা মাথার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছিল পরমার | প্রথমা এখানে শ্রোতা ও দর্শক | প্রথমা বুঝতে চেষ্টা করে কি প্রশ্ন করতে চায় পরমা |

    বলুন?

    হঠাৎ এমন একটা সংস্থা খোলার প্রয়োজনীয়টা অনুভব করলে কেন? পরমা জানতে চায় |

    পিউ হাসে | একদিনেই সব জেনে নেবেন অ্যান্টি ? আসুন না মাঝে সাঝে | সব প্রশ্নের উত্তর আমি কেন দেব‚ আপনি নিজেই খুঁজে পাবেন |

    এমন উত্তর বুঝি পরমা আশা করেনি | একটু আহত দেখায় তাকে | প্রথমার দিকে চায় সে | পরমার এই প্রগলতা ভালো লাগে না প্রথমারও | বুঝতে দেয় না মনের কথা পরমাকে | প্রথমা মৃদু হেসে বলে চলো এবার উঠি | উঠে পড়ে প্রথমা পরমাকে নিয়ে | পায়ে পায়ে নেমে আসে পথে |

    একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ে দুজনে | রোজ প্রথমা ট্যাক্সি নেয় না | বাসেই চলে আসে | আজ পরমার অসুবিধে হবে মনে করেই ট্যাক্সিটা নিল সে | পরমার বাড়ির আগে প্রথমার বাড়ি পড়ে | সে নেমে গেলে ট্যক্সিটা নিয়েই পরমা বাড়ি ফিরে যেতে পারবে | কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনেই |

    কতদিন তুমি আসছ এখানে দিদি? নীরবতা ভাঙে পরমা |

    বছরখানেক হতে আসছে প্রায় | বলে প্রথমা |

    তোমার ভালো লাগে? পরমা প্রশ্ন করে |

    তোমার ভালো লাগেনি? পাল্টা প্রশ্ন করে প্রথমা উত্তর না দিয়েই |

    ইতিবাচক ঘাড় নাড়ে পরমা | জানো দিদি ওদের দেখতে দেখতে নিজের সাথে ওদের খুব মিল পাচ্ছিলাম | আমিও তো ওদের মত অসহায় | কেউ নেই আমাকে দেখার | কেউ নেই যার সাথে মন খুলে দুটো কথা বলি | কোথায় যেন খুব মিল ওদের সাথে আমার | তাই না দিদি?

    উত্তর দেয় না প্রথমা | কলকাতার বুকে তখন নেমে আসছে অন্ধকার একটু একটু করে | জ্বলে উঠছে স্ট্রীটলাইটগুলো একে একে | দোকান থেকে বয়ে আসা আলোতে আলোকিত ফুটপাতে চলছে সন্ধ্যের ফিরতি পথের কেনা কাটা | তাকিয়ে থাকে প্রথমা | পরমার দুঃখটা ছুঁয়ে যায় তাকে | চোখের কোণে জমা হয় হালকা বাষ্প |

    দিদি আমাকে ওরা ওখানে থাকতে দেবে? পরমা হঠাৎ জানতে চায় |

    ওটা তো তোমার আমার থাকার জায়গা নয় পরমা | আমাদের বাড়ি আছে‚ সংস্থান আছে | প্রয়োজন হলে তুমি বা আমি এমন কোন বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে পারি যেখানে টাকা দিয়ে থাকা যায় | উচ্চ সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় | কিন্তু পান্থশালায় যারা থাকে তাদের একমাত্র সহায় ঐ পান্থশালা | বলে প্রথমা |

    উত্তর দেয় না পরমা | কেমন যেন অন্যমনস্ক | রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে | পরমাকে দেখতে দেখতে প্রথমার মনে হয় পরমা কি খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে? বারংবার তার নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে কেন?

    একা থাকাতে ভয় পাচ্ছ? আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে প্রথমা |

    ঘাড় নাড়ে পরমা | খুব ভয় লাগে | পত্রক চলে যাবার পর থেকেই আর একা থাকতে পারি না | মনে হয় আশেপাশে কেউ থাকুক | চোখের সামনে কেউ না থাকলে আমার কেমন যেন অসহায় লাগে | আমি তোমায় ঠিক বোঝাতে পারবো না দিদি |

    একজন ভরসার কাউকে রাখো না | এখন তো কিসব এজেন্সী হয়েছে | তাদের সাথে যোগাযোগ করে কাউকে রাখো |

    কাউকে যে ভরসা হয় না | কাকে রাখব? কে বলতে পারে‚ সেই ব্যক্তি আমাকে হত্যা করবে না?

    এমন একটা সন্দেহ উপড়ে ফেলতে পারে না প্রথমা | নিত্যদিন এমন খবর কাগজে কম বেড়োয় না |

    কিছুদিন ওখানে যাতায়াত কর | দেখবে ওদের তোমার ভালো লেগে যাবে | তারপর দেখবে তুমি পান্থশালার কত কাছের মানুষ হয়ে গেছ | জড়িয়ে পড়বে তুমিও পান্থশালার কাজে | তখন দেখবে নিজেকে আর অসহায় মনে হবে না | মনে আছে তোমার‚ বাবা প্রায় বলতেন নিজেকে কোন না কোন কাজে জড়িয়ে রাখো | খালি মাথা সবসময় উল্টোপাল্টা চিন্তা করে |

    প্রথমার কথার সাড়া না দিয়ে পরমা বলে দিদি আমরা কি আবার এক সাথে থাকতে পারি না? জীবনের শেষ দিনগুলো কি একসাথে কাটাতে পারি না?

    কে যেন প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারে প্রথমাকে | অদ্ভুত চোখে চায় | কে এ? একি তার সহোদারা নাকি সতীন নাকি নিতান্তই এক অসহায় মানুষ

    (ক্রমশ)
  • de | 69.185.236.53 | ১৮ নভেম্বর ২০১৪ ১৪:১০648365
  • বাঃ!
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন