এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • a | 213.219.201.58 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:১৩667365
  • কল্লোঅলদা যেহেতু মাসুমের সাথে যুক্ত তাই সেই ডিঃ টা থাকলে ভাল হত
  • ছিটমহল সমীক্ষা | 127.194.212.132 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:৪৪667366
  • ওই তো ইন্ডিয়া! ওই যে মাঠে ধান কাটছে

    শুভপ্রতিম রায়চৌধুরি

    (ছিটমহল সমীক্ষা থেকে ফিরে)

    আসরের আজান তখন সবে শেষ হয়েছে, মুসল্লিরা একে একে মসজিদে প্রবেশ করছেন৷‌ বৃদ্ধ তাকালেন আমাদের দিকে, আস‍্সালামো আলেইকুম৷‌ আমাদের আসার উদ্দেশ্য তাঁকে জানানো হল৷‌ ‘বাপ একটু অপেক্ষা করেন, নামাজ শেষেই আসছি আমরা৷‌’ নামাজ শেষে ছোট জমায়েত আমাদের ঘিরে৷‌ আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি, কলকাতা থেকে৷‌ তাও আবার ছিটমহলের কথা শুনতে৷‌ আবেগে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধ মুহম্মদ দুলাল৷‌ ‘ওই জলপাইগুড়ি জেলায়, আমার বাপ-দাদার কবর৷‌ আমার ছোটবেলার খেলার মাঠ, পাঠশালা, পৈতৃক ভিটে৷‌ আমার বড় আব্বা, ছোট বুয়া সকলেই সেখানে থাকতেন৷‌ বড় আব্বার যখন এম্তেকাল হল, আমি গেলাম মাটি দিতে৷‌ সীমাম্ত তখন শুধু নামেই, আমাদের যাতায়াতের কোনও বাধা ছিল না৷‌ কিন্তু আমাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করা, আমার ছোট বুয়া আখলিমা বেওয়া যখন মারা গেলেন, যেতে পারলাম কই? কাঁটাতার আটকে দিল, আটকে দিল বি এস এফ৷‌ ’৪৭-এ সম্পত্তি বিনিময় করে আমরা চলে এসেছিলাম এপারে৷‌ এসে দেখছি, এখানেও ইন্ডিয়া৷‌’

    ছিটমহল হস্তাম্তরের এই সন্ধিমুহূর্তে ছিটমহলে গিয়ে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলা এবং সেখানকার ভূমি-বাস্তবতা সরেজমিনে জানা বড় প্রয়োজন ছিল৷‌ এই প্রয়োজনীয়তার তাগিদেই বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)-এর পক্ষ থেকে ভারত-বাংলাদেশের মোট ২২টি ছিটমহলে সমীক্ষা করা হয়৷‌ মাসাধিক কালব্যাপী এই সমীক্ষায় যুক্ত ছিলেন মাসুমের ফিল্ড, অফিস কর্মীরা ও বন্ধুরা৷‌ এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয় আজিজুল হক, দীপ্যমান অধিকারী, আবু সৈয়দের নাম৷‌ ভারতে কোচবিহার জেলার ৩টি বাংলাদেশি ছিট– বাংলাদেশে লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও নীলফামারি এবং কুড়িগ্রাম জেলার ১৮টি ভারতীয় ছিট এবং বাংলাদেশেই একটি ভারতীয় ছিটমহলের মধ্যে থাকা একটি বাংলাদেশি ছিট৷‌ আশ্চর্য! এ যেন দ্বীপের মধ্যে আর এক দ্বীপ৷‌ সব সমীক্ষার মতো এক্ষেত্রেও সংখ্যা ও পরিসংখ্যানের অতিরিক্ত তথ্য ও তত্ত্বের সমাবেশ ঘটেছে৷‌ মানুষের কষ্ট, কান্না যদিও কোনও পরিসংখ্যানেই মাপা যায় না৷‌ মাপার চেষ্টাও বৃথা৷‌ কেননা প্রত্যেকটি মানুষ (যাঁদের কাছে আমরা পৌঁছতে পেরেছি) যাবতীয় শব্দ ও শব্দময়তা নিয়ে, আবেগ নিয়ে হয়েছিলেন উপস্হিত এবং উপস্হাপিত৷‌ এক-একটি নিটোল জীবনচিত্র, সবগুলিকে এক শব্দবন্ধনীতে বেঁধে ফেলা হয়ত ঠিক হবে না৷‌ তবে সমীক্ষার মধ্যে এক সর্বজনীনতা থাকে, তাকেই বা অস্বীকার করি কীভাবে? সমীক্ষার কাজগুলিতে স্হানীয় মানুষের সহযোগিতা ব্যতিরেকে সম্ভব হত না৷‌ আমরা আবদ্ধ চিরকৃতজ্ঞতায়৷‌

    সমীক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দু’রকম পদ্ধতি ব্যবহার করি৷‌ প্রথম পদ্ধতি, কোনও একটি ছিটমহলের প্রতিটি বাড়ি গিয়ে পরিবারভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা৷‌ এক্ষেত্রে পরিবারটির বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষা, রোজগার, জমি-সংক্রাম্ত প্রশ্ন রাখা হয়েছে৷‌ ১৯৪৯ (কেননা এই সালেই কোচবিহার রাজ্য ভারত রাষ্ট্রের অম্তর্ভুক্ত হয়) সালে পরিবারটির অবস্হান জানতে বিশেষ কয়েকটি সংস্হান রয়েছে সমীক্ষাপত্রে৷‌ মিথ্যা পরিচয়ে ছিটমহলবাসীদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সরকারি স্কুলে বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়৷‌ ছিটমহলবাসীর কথায়, এমনকি মক্কায় হজ করতে বা ভারতে তীর্থদর্শনে যেতেও আমাদের মিথ্যা পরিচয় দিতে হয়৷‌ সেসব কথা উঠে এসেছে তাঁদের বয়ানে৷‌ যেমন এসেছে নাগরিকত্বের দাবি৷‌ দাবি পানীয় জল, রাস্তা, বিদ্যুৎ, স্বাস্হ্য পরিষেবার৷‌ আমাদের সমীক্ষাপত্রে একটি নির্দিষ্ট কলাম রাখা ছিল ব্যক্তিমানুষের বক্তব্য শোনার জন্য৷‌ দ্বিতীয় যে পদ্ধতি অনুসরণ করি তা হল, নমুনা সমীক্ষা৷‌ তামাকের খেতে বা গ্রামের প্রাম্তে বাঁশের মাচানে, বাড়ির বৈঠকখানায়, মসজিদ মাজারের প্রাঙ্গণে, আসন্ন কালীপুজোর জন্য মূর্তিতে মাটি চাপানো হচ্ছে সেখানে, কথা বলি মানুষের সঙ্গে৷‌ ন্যূনতম ৫, সর্বাধিক ২০ জন ব্যক্তির বয়ান রেখেছি সমীক্ষাপত্রে৷‌ দু’টি পদ্ধতিতে প্রশ্ন ছিল একইরকম, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিতে ছিল ভিন্নতা৷‌ আমরা সংগ্রহ করেছি কোচবিহারের রাজা, রংপুরের রাজার আমলের দলিলের কপি৷‌ একই দাগ, খতিয়ানের ওপর বিভিন্ন সময়ে জমি রেজিস্ট্রেশনের ফলে কখনও গর্জনরত বাঘ চিহ্ন (প্রযত্নে কোচবিহার রাজা), কখনও ষষ্ঠ বা সপ্তম জর্জ, কখনও অশোকস্তম্ভ, কখনও চাঁদ তারা বা শাপলার সমাবেশ৷‌ শাসন ও প্রশাসনের বদল বিগত ১০০ বছরে বহুবার দেখেছেন ছিটমহলের মানুষ৷‌ বদলায়নি জীবনের অনিশ্চয়তা৷‌

    সেদিন সেই প্রাক-সন্ধ্যায় লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার মধ্যে ছোট্ট দ্বীপের মতো লোথামারি ছিটের ছোট একটি মসজিদের পরিসরে আমাদের কথোপকথন৷‌ আমাদের চারপাশে কমবয়সী, মাঝবয়সী মানুষের ভিড়৷‌ এঁদের বেশিরভাগ ঢাকায় পোশাক শিল্পে কাজ করতে যায়৷‌ ধান কাটার মরশুমে রাজশাহি, কুমিল্লা, নোয়াখালি৷‌ দিল্লিতে নির্মাণ শিল্পে কাজ করে সদ্য ফিরে এসেছেন মুজাফ‍্ফর হোসেন (নাম পরিবর্তিত)৷‌ এখানে শীতের ধান কাটা হয়ে গেলে অনেকেই দিল্লি যায়, গুজরাট যায়৷‌ ঠিকাদাররাই আমাদের নিয়ে যায়৷‌ মাসে প্রায় ৭-৮ হাজার টাকার ইনকাম হয় সেখানে৷‌ ৩-৪ মাস থাকি৷‌

    কোলে বছর তিনেকের নাতনি কখন এসে বসে পড়েছে৷‌ শুরু হয়েছে দাদুর সঙ্গে খুনসুটি, দাদুর কথা থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার দিকে মন দিতে হবে৷‌ ছোট মৌসুমি৷‌ ২০১১ সালে আজকের দিনেই তার জন্ম হয়েছিল, পাটগ্রামের এক হাসপাতালে৷‌ ভারতীয় ছিটমহলের পরিচয়ে ভর্তি করা যেত না, তাই পাশের গ্রাম (বাংলাদেশি রাজস্ব গ্রাম) বামুন দল-এর ঠিকানায় আসন্ন প্রসবা মর্জিনা বিবিকে ভর্তি করতে হয়৷‌ দুলাল মিয়াঁ আদরের নাতনিকে আদরের ফাঁকে ফাঁকে জানালেন তাঁদের নিত্যদিনের অনাদরের যাপন-কথা৷‌ অবহেলার কয়েক দশক৷‌ মাত্র ৪ বিঘা জমির ওপারে ভারত৷‌ আমাদের যাতায়াতের রাস্তা দেওয়া হোক৷‌ যেমন দেওয়া হয়েছে তিনবিঘায়৷‌ আমাদেরও করিডর দেওয়া হোক৷‌ বাপ, হাজার বছর ধরে আমরা ভারতীয়৷‌ আমরা ’৪৭, ’৪৯, ’৫২, ’৭১ অনেক দেখলাম৷‌ আমরা এখন ‘বিদেশি’ হলাম, হলাম ‘অনুপ্রবেশকারী’? আমার ভাতিজা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছে, আবার ওপার থেকে ছোট বুয়ার বড় ছেলে এখানে এসেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে, একাত্তরে৷‌ আমাদের আটকাবে কোন সরকার?’

    এর উত্তর সত্যি আমাদের জানা ছিল না৷‌ উত্তরের খোঁজে পাড়ি দিলাম এই জেলারই বাঁশকাঠা ছিটমহলে৷‌ বাঁশকাঠা নামে একাধিক ছিট আছে পাশাপাশি৷‌ আমরা এখানে চারটি ছিটে সমীক্ষা করি৷‌ সেদিন একটু সকালেই পৌঁছে গেছিলাম ১১৯ নম্বর ছিটে৷‌ দাওয়ায় বসে ছিলেন প্রৌঢ় উকিলচন্দ্র বর্মন৷‌ মাত্র ৫ বিঘা দূরত্বে কোচবিহার৷‌ ধল্লা নদীর ওপারে সাতগ্রাম আর মানবাড়ি৷‌ ‘নদীর ভাঙনে ৮-৯ বার বাস্তুচ্যুত হয়েছি আমরা৷‌ উদ্বাস্তু জীবন৷‌ বৈধ কোনও পরিচয়পত্র, কোনও দিন কোনও সহায়তা পাইনি আমরা৷‌ বাংলাদেশ সরকার দেয়নি, আমরা বিদেশি তাই৷‌ ভারত সরকার কিছুই পাঠায়নি, মাঝের এই পাঁচ বিঘা বাংলাদেশ, তাই৷‌’ পাশে বসে ছিলেন মকসুল ইসলাম৷‌ ‘মরেও শাম্তি নেই আমাদের! এই পাটগ্রাম থানার ভেতরে ভোটগ্রাম ছিটে বিয়ে হয়েছিল সেলিনা বেগমের৷‌ বিয়ে ভাল হয়নি হতভাগীর৷‌ ওর স্বামী রুবেল মিয়াঁ অত্যাচার করত ওর ওপর৷‌ নিত্যনতুন টাকা আনতে হত বাপের বাড়ি থেকে৷‌ পাচারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল রুবেল৷‌ টাকার দরকার পড়ত প্রায়ই৷‌ সেদিন ২১ অক্টোবর, অত্যাচার মাত্রাছাড়া হল, খুন হয়ে গেল মাইয়াটা! লাশ হয়েও শাম্তি নাই! ১৮ দিন সেই লাশ পড়ে থাকল, কোনও ময়নাতদম্ত ছাড়াই৷‌ পাটগ্রাম থানার পুলিস বলে, ছিটমহলের ঘটনা, ওরা ছিটের অধিবাসী, আমরা কী করব? ১৮ দিন পরে লাশ গেল ওপারে, মাথাভাঙা মহকুমা হাসপাতালের মর্গে৷‌ বেঁচে থেকে কোনও দিন ইন্ডিয়ায় যাওয়া হয়নি সেলিনার৷‌’

    মকসুল, উকিলচন্দ্র-সহ প্রায় জনা বিশের একদল আমাদের নিয়ে গেলেন নদীর পাড়ে৷‌ ওঁদের চোখেমুখে ফুটে উঠছিল, উচ্চারণও করছিলেন এমন প্রশ্ন– ‘ওই তো ইন্ডিয়া, ওই যে মাঠে ধান কাটছে, ওই যে গরু চড়ছে নদীর ওই পাড়ে৷‌ আমরা এক দেশ ছিলাম, আবার এক দেশ হতে পারি না?’

    শেষাংশ আগামীকাল
    ---------
    যেন সাতচল্লিশের পুনরাবৃত্তি না হয়!

    শুভপ্রতিম রায়চৌধুরি

    (ছিটমহল সমীক্ষা থেকে ফিরে)

    (গতকালের পর)

    আমাদের সঙ্গে মকসুল, সফিউল, উকিলচন্দ্র, বলরাম বর্মনরা৷‌ বলরাম বর্মনের বাড়ি, পার্শ্ববর্তী ১১২ নম্বর ছিটে৷‌ ‘আমাকে ভিটেছাড়া করেছে গ্রামের মানুষ, আমার গ্রামে জামাতিদের প্রভাব বেশি৷‌ পাশের গ্রাম থেকে এসে তারা উসকানি দেয়, বলে হিন্দুদের দেশছাড়া করো৷‌ আরে আমরা তো রয়েছি ইন্ডিয়াতে, এটা তো ইন্ডিয়ার ছিট৷‌ এতদিনের প্রতিবেশীরা তাড়িয়েছে আমাকে৷‌ আমি জলপাইগুড়িতে ছিলাম ৪ বছর৷‌ ফিরে এসেছি৷‌ ১১৯ নম্বর ছিটে অনেক মুসলমান বন্ধু আছে আমার, বলেছে ফিরে এসো৷‌ তারাই আমাকে আশ্রয় দিয়েছে৷‌ পাশের এই ছিটে থাকি আমি৷‌ মোটর সাইকেল মেরামতের কাজ করি৷‌ আমি মামলা করেছি জেলা আদালতে৷‌’

    বাংলাদেশিদের শত্রুতায় পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া বাড়ির সামনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়, পঞ্চগড় জেলায় গাড়াতি (ছিট নম্বর ৭৮) ছিটমহলে৷‌ ২০১০ সালে এক বাংলাদেশি ডাকাতকে পিটিয়ে মারে গাড়াতির গ্রামবাসীরা৷‌ তারই বদলা নেয় তারা৷‌ পুড়িয়ে ফেলে প্রায় ১০০টি বাড়ি৷‌ ছিটের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা মৌলানা মদিরুদ্দিন সাহেবের বাসা৷‌ দগ্ধ, ভাঙাচোরা বাড়িগুলির সামনে আমাদের নিয়ে যান ফৈজুল হক সর্দার, মুহম্মদ মাহাবুবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তি৷‌ তাঁরা বলেন, ‘পাশের বাংলাদেশি গ্রাম অমরখানা, হরিভাসা, ভিতরগড় থেকে দুষ্কৃতীরা এসে আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, ২০১০ সালের ১৫ অক্টোবর৷‌ পঞ্চগড় থানা অভিযোগ নেয় না এটা ভারতীয় ছিটমহল বলে৷‌ আমাদের চোখের সামনেই দুষ্কৃতীরা ঘুরে বেড়ায়৷‌ বাংলাদেশের বেসরকারি উদ্যোগ রেড ক্রিসেন্ট ত্রাণ পাঠায়৷‌ ভারত সরকার পাঠিয়েছিল তাঁবু, শাড়ি, লুঙ্গি৷‌ কিন্তু বিচার পাইনি কোথাও৷‌ অভিযুক্তরা উল্টে আমাদের নামে বাংলাদেশের আদালতে মামলা দায়ের করেছে৷‌ আমরা আসামি হতে পারব, বাদী হতে পারব না৷‌’

    ‘তবু এত অশাম্তি সত্ত্বেও আমরা বাংলাদেশেই যুক্ত হতে চাই দাদা৷‌’ বললেন গাড়াতির মানুষজন৷‌ ‘কেননা আমাদের আত্মীয়-কুটুম, অনেকের ব্যবসা, কর্ম বাংলাদেশেই৷‌ এমন পরিবার পাবেন না, যাঁদের কেউ ঢাকার পোশাক শিল্পে কাজ করেন না৷‌’ ছিটমহলটি ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির প্রভাবাধীন৷‌

    সমাম্তরালে আর একটি কমিটিও আছে, ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিল৷‌ দুই কমিটির মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে, আছে ‘আমরাই একমাত্র ছিটমহলবাসীর প্রতিনিধি’– এই দাবিও৷‌ ছিটমহল বিনিময়ের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব-সহ মৌলিক অধিকার কায়েমের দাবিতে সহমত আছে দুই কমিটির৷‌ ভিন্নতা বাংলাদেশের সঙ্গে অথবা ভারতের সঙ্গে ভারতীয় ছিটমহলগুলির যুক্ত হওয়া নিয়ে৷‌ কাগজ-কলমে না হলেও স্হানীয় নেতৃত্বের ভাষণে, বয়ানে অবস্হানগত ভিন্নতা নজরে আসে৷‌ কুড়িগ্রাম জেলার দাসিয়েরছরা (নম্বর ১৫০) ছিটমহলে গিয়ে প্রত্যক্ষ করলাম সঙঘর্ষের স্বরূপ৷‌ এখানে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির অফিসে টাঙানো আছে বাংলাদেশের পতাকা৷‌ অফিসের ভেতরে কমপক্ষে ২৫-৩০ জন মানুষ অপেক্ষা করেছিলেন আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে৷‌ ‘একুশে ফেব্রুয়ারিতে এখানে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিলাম আমরা, গেয়েছিলাম ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’র গান’– বললেন মহম্মদ আলতাফ হুসেন৷‌ বললেন, ১৯৭৪-এর ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির বাস্তবায়ন চাই আমরা৷‌ আমরা বাংলাদেশে যুক্ত হতে চাই, আমাদের সব কিছুই বাংলাদেশে৷‌’ কথা বলে বাইরে এসেছি, দেখছি আরও কিছু মানুষের জটলা৷‌ অল্প দূরেই ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিলের অফিস৷‌ উড়ছে ভারতের পতাকা৷‌

    কীভাবে আমাদের ছিট বাংলাদেশে দিয়ে দেওয়া হবে, জানতে চাইলেন কতিপয় যুবক৷‌ আমরা নিরুত্তর, বললাম সমীক্ষা করতে এসেছি, শুনতে এসেছি আপনাদের কথা৷‌ বসলাম তাঁদের অফিসে৷‌ ‘এ বছর ১৫ আগস্টে তেরঙ্গা তুলেছি আমরা, গেয়েছি জনগণমন, বাংলাদেশ পুলিস হুমকি দেয়, পতাকা তুলতে নিষেধ করে৷‌ শেষ পর্যম্ত বিদেশ মন্ত্রক পর্যম্ত কথা পৌঁছয়৷‌ আমাদের দমানো যায়নি৷‌ বললেন ফজলুদ্দিন শেখ৷‌ ‘আমরা ভারতীয় নাগরিক৷‌ কোনও চুক্তি আমাদের নাগরিকত্ব কাড়তে পারে না৷‌ এই জমি ভারতের, কীভাবে তা অন্য দেশকে দেওয়া যাবে? ভারতের সংবিধান অনুসারে তা কি দেওয়া যায়?’ আমরা বলি প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করবে সরকার৷‌ উত্তর আসে ১৯৭৪-এ বাংলাদেশ সরকার তাদের সংসদে চুক্তিটি পাস করায়৷‌ কিন্তু ভারতে আজ পর্যম্ত তা হয়নি৷‌ আমরা প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টে যাব৷‌

    দাসিয়েরছরা ছিটের মধ্যেই একটি বাংলাদেশি ছিট আছে৷‌ নাম চন্দ্রখানা, নম্বর ২০৷‌ এই সেই দ্বীপের মধ্যে দ্বীপ৷‌ ‘বাংলাদেশি ছিটগুলো যদি ছিটমহল বিনিময়ের ফলে ভারতে যুক্ত হয়, তবে আমরাও যাব ভারতে৷‌ এখানকার শাসন ব্যবস্হা ভাল নয়৷‌ করিডর চাই আমাদের৷‌ জানালেন মুহম্মদ রফিকুল আলম, নজরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান মিজান৷‌ আমাদের এখান থেকে বহু মানুষ ভারতে যায় কাজ করতে৷‌ কাঁটাতার দেওয়ার আগে ওপারে যেতাম যাত্রা শুনতে৷‌ ভাওয়াইয়া গানের আসরে কেঁদে ভাসাতাম৷‌ দিনহাটা থেকে গান শুনে রাত্রি শেষে হাঁটা লাগাতাম, সকালে পৌঁছে যেতাম গ্রামে৷‌’

    এইরকম অজস্র কথামালা কান্না ও আকুতির মুহূর্ত পেয়েছি প্রতি পদে, ছিটমহলের পথে পথে৷‌ ছিটমহলকে বর্গকিমির হিসেবে দেখা হত এতদিন৷‌ ‘আমাদের জমি বেশি যাচ্ছে’– এই ছিল বোধ এবং বিবৃতি, বিশেষত রাজনৈতিক মহলে৷‌ আর এখন ছিটমহলবাসীদের ভোটার হিসেবে দেখা হচ্ছে৷‌ কোথাও তৃণমূল বা বি জে পি-র অথবা কোথাও বি এন পি বা আওয়ামি লিগের৷‌ পশ্চিম বাংলার যুযুধান দুই পক্ষ শুরু করেছে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ বলার প্রতিযোগিতা৷‌ ভারতীয় ছিটমহলগুলির মানুষ যাঁরা করিডর চান, উদ্বাস্তু হয়ে নয়, পুনর্বাসন নিয়ে নয়, নিজের গ্রামেই থাকতে চান যাঁরা, তাঁদের কী হবে? প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি জনপদ, জনগোষ্ঠীর চাওয়া ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্য আছে৷‌ তাঁদের সকলের কথা শোনা হবে তো? রংপুর বিভাগে থাকা ১০৮টি ভারতীয় ছিটের মধ্যে মাত্র ১৮টি ছিটে পৌঁছতে পেরেছি আমরা৷‌ তাই সকলের বক্তব্য জানা হয়নি, অধরা থেকে গেছে৷‌ ভারতে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলগুলির বাসিন্দারা ভারতেই থাকতে চান, সার্বিক এই চাওয়া৷‌ এ নিয়ে বিতর্ক নেই কোথাও৷‌ কিন্তু বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের মতামত মিশ্র৷‌ সমীক্ষা করার সময় প্রতিটি পরিবারের সামনেই রেখেছিলাম এই প্রশ্ন৷‌ সংখ্যাতত্ত্ব সব কথা বলতে পারে না, জানি৷‌ তবু আমাদের সমীক্ষা বলছে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি মানুষ চান না তাঁদের গ্রাম বাংলাদেশে বিলীন হয়ে যাক৷‌ ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলি থেকে তাঁরা বঞ্চিত৷‌ ভোটাধিকার তো শৌখিনতা, বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার থেকেই তাঁরা বহু যোজন দূরে৷‌ তবু সেই দেশের সঙ্গেই যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা কতটা দেশপ্রেম, কতটা বৃহৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে থাকার বাস্তব সুবিধা তার বিচার করবেন সমাজবিজ্ঞানীরা৷‌

    মনে হয়, কলকাতা, ঢাকা বা দিল্লিতে বসে কোনও সিদ্ধাম্ত নেওয়া উচিত হবে না৷‌ কমিটি আছে, থাকবেই, কিন্তু শুধু তাঁদের সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধাম্ত ও তার রূপায়ণ যেন না হয়৷‌ ছিটমহলগুলিতে আসুন সকলে৷‌ ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক, সরকারের প্রতিনিধিরা৷‌ দেখবেন আবার যেন ’৪৭-এর পুনরাবৃত্তি না হয়৷‌ শরণার্থী শিবির, উদ্বাস্তু জীবন যেন ফিরে না আসে আবার৷‌ ‘জাতীয় স্বার্থ’ বা ‘প্রতিবেশীর বন্ধুত্ব’ যৌথ চাপে যেন লঙিঘত না হয় মানবাধিকার৷‌ নাগরিক পরিচয়হীনতার মুক্তি ঘটুক৷‌
  • কল্লোল | 125.242.138.93 | ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৯:০৭667367
  • এ। এতে ডিঃ দেবার কি আছে। মাসুম ভালো কাজ করলে গর্ব হয়। সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। এখন তো আর আমি মাসুমের কোন কাজেই থাকতে পারি না। ব্যাঙ্গালোরে বসে আংশিক সময়ের কর্মী হিসাবে কিছু হাত পা ছুঁড়ি মাত্র।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন