এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • হরিশরাজার জঙ্গলে

    T
    অন্যান্য | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | ১৫২৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২০:২২691732
  • ১.

    রবিবার সকালবেলা পুঁটে খালপাড়ে দাঁত মাজতে গিয়ে দেখল বৈঁচি ঝোপের ধারে গোবিন্দখুড়ো শালমুড়ি দিয়ে ওত পেতে বসে আছে। খুড়োকে প্রায়শই ওরকম ওত পেতে বসে থাকতে দেখা যায়। শেষ দেখা গিয়েছিল কালীগঞ্জের নবীন মহাজনের বাড়ীর সামনে, পুঁইমাচার পাশে। তারও আগে জলবেহারীর সেলুনের দোকানে, কিংবা হাঁসপুকুর কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে। প্রতিবারেই খুড়ো শালমুড়ি দিয়ে সন্দেহজনক ভাবে বসে থাকে। মুখ নাক চাপা, খালি চোখ দুটো বেশ জ্বলজ্বল করছে, যেন একেবারে সব দেখে ফেলছে। যারা খুড়োকে চেনে জানে তারা কিছু না বলে সবজান্তা মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অবিশ্যি যারা জানে না তারা ব্যাপারখানা মোটেই ভালো চোখে দেখে না। মাঝে মাঝে ব্যাপারখানা খুবই অসুবিধেজনক হয়ে দাঁড়ায় বৈকী। যেমন, গেল হাটবারে খুড়ো শিবু ময়রার জিবেগজার দোকানের পাশে ওই রকম শালমুড়ি দিয়ে বসে ছিল। ভরদুপুর, খাঁ খাঁ রোদে খামোখা শালমুড়ি দেওয়া কেন বাপু? তা, ওটা নাকি হল ডিসগাইজ। শিবুময়রা অবশ্য অতশত বোঝে না, খুড়োকে ধরে এই মারে তো সেই মারে। ভাগ্যিস স্টেশন মাস্টার হরিহরের শ্বশুরবাড়ি ওদিকে। খবর পেয়ে সেই কোনমতে ছাড়িয়ে এনেছিল।

    আসল ব্যাপার হল খুড়ো নাকি একেবারে খাঁটি নিয্যস ভালো নির্লোভ লোক খুঁজে বেড়াচ্ছে। তা, ওরকম লোক পাওয়া কী চাট্টিখানি কথা নাকি? ওসব লাখে একটা দুটো মেলে, তাও তাদের বেশ তোয়াজ করে রাখতে হয়। ওদের আবার যখন তখন ভীষন খিদে পায়। শালপাতার ঠোঙায় জিলিপি জিবেগজা না ধরেছ কি অমনি ওরা মুখ হাঁড়ি করে। তাছাড়া দেখা পাওয়া খুবই ঝঞ্ঝাটের কিনা। এই যে সব এত এত ভালোমানুষের মত মুখ করে হাটে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খোঁজ নিয়ে দেখ, এক একটা সব পাজির পাঝাড়া। খাঁটি নির্লোভ লোক সব নাকি চুপিসাড়ে আড়ালে আবডালে রয়েছে। ঝপ করে ঠিক লোক দেখে যদি লাফিয়ে পরে চেপে না ধরেছ তো একবারে ফুরুৎ। ঐ ফঙ্গবেনে ব্যাপার আর কি!

    পুঁটে অবশ্য ব্যাপারটা জানত।

    —‘কি গো খুড়ো, আজ কাকে...’
    —‘শসসস। এই বারে পেয়েছি বুঝলি...’

    খালের ধারে নব সামন্ত নিবিষ্ট মনে মাছ ধরছে। সর্বনাশ খুড়ো ওকেই ভালো লোক ঠাউরেছে নাকি? পুঁটে জানে নব সামন্ত মোটেই ভালো লোক নয়। জলবেহারীর দোকানে গিয়ে আটাআনার চুল সে দরদাম করে চার আনাতে কেটে এসেছে এ তো পুঁটের নিজের চোখে দেখা। তাছাড়া প্রতিবেশী গুপী মাস্টারের বাড়ীর আমগাছ থেকে কে রাতের বেলা আম চুরি করে! ওর গোয়ালে যে সোনামুখী বলে গরুটা সকালবিকেল বিচালি চিবোয় ওকে নিয়ে ওর সাথে পাশের গ্রামের ঘোষেদের মামলা নেই বুঝি!

    খুড়ো পেছন থেকে লাফ দিয়ে একেবারে ঘাড়ের কাছে পড়ে নবর জামার কলার চেপে ধরল। ‘আই বাপ’, বলে নব ভিরমি খায় আর কি।
    —‘অ্যাঁ, কি ব্যাপার খুড়ো, এসব কি? না বলে কয়ে পেছন থেকে এমন ভাবে—’
    —‘আ হা হা, চুপ কর বাপ আমার। এতদিনে খুঁজে পেয়েছি। ওরে কে আছিস, উলু দে, শাঁখ বাজা, ধরাধামে আবার প্রভু নিতাই নেমে এলেন রে—’
    ‘ও খুড়ো, ও মোটেই ভালো লোক নয় গো, ও তোমার চাঁদ আঁকা নস্যির কৌটো, যেটা তুমি গত মাসে চন্ডীমন্ডপ থেকে হারিয়েছ, সেটা হাতিয়েছে’ পুঁটে চেঁচিয়ে উঠল।
    —‘অ্যাঁ, বলিস কী? তবে যে স্বচক্ষে দেখলাম, ওতবড় কইমাছটা পেয়ে ও হাত বুলিয়ে ছেড়ে দিল।’
    —‘আরে ওর তো দাঁতই নেই, কাঁটা চিবুবে কি করে? হয়ত ঘ্যাঁসা মাছ ধরার তালে ছিল।’
    কথাবার্তার ফাঁকে খুড়োর হাত একটু আলগা হয়েছিল। এক ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নব পাশের খাগড়া বনে সুট করে সেঁধিয়ে গেল। এক ঝলক সেদিক পানে তাকিয়ে খুড়ো করুণ চোখে বলল, ‘ধুসস! পরিশ্রমটাই বৃথা। একটা নিপাট ভাল লোক কোথা পাই বলত—’

    ফিক করে হেসে ফেলল পুঁটে। ‘খুড়ো তুমি বরং অন্য কিছু খোঁজ। যেমন ধর সবচেয়ে বোকা লোক খুঁজছ। তা সে আমাদের ঘোষের পো কেই ধর না কেন। কিংবা সবচেয়ে চালাক আমাদের কানাই মাস্টারের ছেলে পটলা। হয়ত সবচেয়ে লম্বা লোক খুঁজছ, এক ধাক্কায় পেয়ে গেলে শিবতলার ফটিক কে। সবচেয়ে বেঁটে যদি চাও তো ওরই ভাই বটুক। সবচেয়ে ধড়িবাজ বিশু গায়েন, সবচেয়ে কেপ্পন আমাদের মহাজনের পো—’
    —‘ওসব নয় রে ভাই, আমার একখানা খাঁটি, নিরেট, বোকা, ভালো মানুষ চাই যার মনে লোভ নেই।’
    —‘ও খুড়ো তুমি একজনের মধ্যে পাবে না। যেমন ধর বিশু ধড়িবাজ হলে কি হবে একেবারে খাঁটি লোক, আবার পটলা ভীষন বিচ্ছু হলে কি হবে মন খুব ভালো। সেই যে সেবার দোলের দিন বিশুকে জলবিছুটি ঘষেছিল, তাপ্পর সারা গা চুলকোতে চুলকোতে নুন ছাল ওঠার পর ওই তো আবার টিংচার আয়োডিন লাগিয়েছিল, তারপর ধরো—’
    —‘আঃ মেলা বকিস না তো, সন্ধানে থাকলে বল না বাপ, দুটো পয়সার মুখ দেখি।’

    খালের ধারে যখন এইসব কথোপকথন চলছে তখন হাঁসপুকুরের চন্ডীমন্ডপে কবিরাজ মশাই আধশোয়া হয়ে হুঁকো খাচ্ছেন। গদাই পালোয়ান ডাম্বেল ভেঁজে ছ ছটাক ছোলা খেয়ে কুস্তি করতে লেগেছে। গুপীবাবু ধুতি মালকোঁচা মেরে বাজারের দিকে চলেছেন। হাঁসপুকুর পুলিশ ফাঁড়ির দারোগাবাবু দুগ্ধবরন বাপুলি স্বপ্নে জামাইষষ্ঠী সারছেন। গাঁয়ের চাষাভুষোর দল হাল বলদ নিয়ে রোজকার খেতখামারি করতে চলেছে। ডিটেকটিভ সত্যরঞ্জন চাকলাদার তাঁর সাকরেদ গবু কে নিয়ে তাঁর বাড়ির সুপুরি গাছের তলায় ক্লু খুঁজতে বেরিয়েছেন। হাঁসপুকুর স্টেশনারির মালিক শতদল ঘোষ ঘুমোতে ঘুমোতে পাশ ফিরছেন। জগা পাগলা কালীবাড়ির রোয়াকে শুয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। চালের ওপর কুঁকড়োরা সবে ডাকাডাকি করতে শুরু করেছে। মোটকথা গোটা হাঁসপুকুর রাতশেষে ঘুম সরিয়ে উঠিউঠি করছে।

    এমন সময় সুপুরিগাছের তলায় টেক্কামার্কা দেশলাই পাওয়া গেল। বিরাট ক্লু! সত্যরঞ্জন চাকলাদার তাঁর মসৃন গোঁফে তা দিলেন।
    —‘কেমন, বলিনি?’
    গবু একটু অবাক হয়ে বলল, ‘ইয়ে, কিন্তু এটা দেখে কি বোঝা গেল?’
    —‘মূর্খ। এই দেশলাই এখানে পাওয়া যায় নাকি।’
    —‘তাইতো, তাহলে এল কোথা থেকে?’
    —‘গবেট। আরে এটা নির্ঘাৎ বাইরের কেউ এনেছে।’
    —‘বাইরের লোক?’
    —‘হ্যাঁ, এবার বল দেখি, গত ক’দিনে বাইরের কেউ হাঁসপুকুরে এসেছে কিনা।’
    —‘কই এমন দেখিনি তো।’
    —‘হুঁ হুঁ, তাহলেই বোঝ, যে এসেছে সে গা ঢাকা দিয়ে আছে।’
    —‘আরিব্বাস, এ তো রহস্যের খাসমহল। কিন্তু কি মতলব হতে পারে?’
    সত্যরঞ্জন গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘মতলব বিরাট বড় কিছু হওয়া বিচিত্র নয়। হয়ত কোন আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীরা এর মধ্যে জড়িত, কিংবা তার চেয়েও বড় কোন রহস্য, হয়ত কোনো গুম খুন।’
    ‘উরেব্বাবা’, গবুর চুল খাড়া খাড়া হয়ে উঠল।
    —‘কিন্তু এসবের চেয়েও বড় প্রশ্ন সে লুকিয়ে আছে কোথায়?’
    —‘ইয়ে, এটা তো আমাদেরই সুপুরি গাছ। তাহলে কি আমরাই কাউকে লুকিয়ে রেখে—’
    —‘চোপ ইডিয়ট। কেউ হয়ত আমাদের ফাঁসাতে চায়।’
    —‘অ্যাঁ!’
    —‘শোন, চারিদিকে নজর রাখবি। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই আমাকে খবর দিবি।’
    —‘ইয়ে, সন্দেহজনক কি করে বুঝব! ওই যেবার সোনামুখীর গলায় বাঁধা ঘন্টা দেখে আপনার যেমন ভাবগতিক হয়েছিল, ওইরকম—’
    —‘উফফ। আবার ঐসব কথা।’
    —‘না মানে, ঐ যে গরুর পেছনের পায়ে ‘এ’ লেখা দেখে, সেই যে মনে পড়েছে, হ্যাঁ, হ্যাঁ—’
    —‘চুপ করবি। বলেছি তো যারা চট করে কথা বলতে চায় না, নাম জিজ্ঞাসা করলে পিটপিটে চোখে তাকায়, যাদের প্যান্টের পেছন দিকের পকেটে চিরুনি থাকে আর কান খাড়া করে চায়ের দোকানে বসে গল্প শোনে তারা সবাই সন্দেহজনক। আচ্ছা শোন এখন আমি বাজার করতে চললাম। আর খবরদার রাত বারোটার আগে দরজা ধাক্কাবি না।’
    —‘আজ্ঞে, যা বলবেন।’

    সত্যরঞ্জন চাকলাদার একবার চারপাশ দেখে নিয়ে বাড়ীর ভেতর ঢুকে পড়লেন। তাঁর গিন্নী সৌদামিনী দেবী এখনো বিছানা ছেড়ে ওঠেন নি। গা ভর্তি সোনার গয়না পরে পালঙ্কে শুয়ে তবিয়ত যাচাই করছেন। খাটের কোনে মোটাসোটা বেড়ালটা একপাশে কাত হয়ে শুয়ে ঝিমোচ্ছে। সত্যরঞ্জন বাবু তাঁর বাজারের ব্যাগ নিয়ে চুপিসাড়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অবশ্য সামনের দরজা খুলে বেরোনোই যেত, তবে কিনা পেছনের দরজা খুলে পুকুরপাড় ঘেঁষে কচুপাতার আর আগাছার ঝোপ পেরিয়ে ধুতির কোঁচায় এতটুকু কাদা না লাগিয়ে ঘাসজমি টপকে বড়রাস্তায় পৌঁছনোর যে আনন্দ তা ডিটেকটিভ ছাড়া আর কেউ বুঝবে কি?

    এদিকে হাঁসপুকুর অপেরার একনম্বর পালাকার গগন চৌধুরী তাঁর খানসামাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে তাঁর ফুলকো লুচি, চাকা চাকা বেগুনভাজা, বড়সড় কাপে এলাচ দেওয়া চা খেতে ইচ্ছে করছিল। হনুমানের অনুমান পালার শেষ ক্ল্যাইম্যাক্সটা জুত করে লিখতে হবে না? অপেরামালিক চৌধুরী মশাই তো রোজদিন হত্যে দিচ্ছেন। এদিকে দুম করে তাঁর কবেকার কাশীবাসি পিসী এসে হাজির। দুবেলা মাংসের সুরুয়া খাওয়া তো ঘুচেইছে, উলটে চিরতার জলে আমলকি গুলে খেতে হচ্ছে। তাঁর পেয়ারের খানসামাটি কি পিসীর ভয়েই কেটে পড়ল? আহা রাঁধত বড় ভাল।
    —‘গগন, উঠেছিস বাবা?’
    গগনবাবু ইজিচেয়ারে শুয়ে আলিস্যি ভাঙছিলেন। পিসীমার ডাক শুনে ধড়ফড় করে উঠলেন। নির্ঘাৎ মহিলা চিরতার গ্লাস নিয়ে এদিকপানে আসছেন। তড়িঘড়ি দোতলার জানালার পাশের গাবগাছ বেয়ে হাঁচোড়পাঁচোড় করে গগনবাবু সড়াত করে মাটিতে নেমে এলেন। নামার সময় হাতের কনুই আর হাঁটুর নুনছাল উঠে গিয়ে বেশ জ্বালা জ্বালা করতে লাগল। দূর দূর, এভাবে ভদ্রলোক থাকে। বাজারের দিকে গিয়ে বরং একটু সিঙ্গাড়া জিলিপির সুলুকসন্ধান করা যাক।

    পেয়ারা গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে ধড়িবাজ বিশু গগনবাবুর পলায়ন বেশ নিবিষ্ট মনে দেখছিল। গগনবাবু ধুতির কোঁচা, আন্ডারওয়্যার সব সামলে হাঁটা লাগাতেই সে বাইরে বেরিয়ে এসে গলাখাঁকারি দিয়ে সঙ্গ নিল।
    —‘আপনার পিসিমা আমাকে কাল ক্ষীরের নাড়ু দিলেন।’
    —‘যা যা, তোর আবার কী চাই?’
    —‘এই বড় বড় গোল গোল নাড়ু।’
    —‘সরে পড়, আমার কাজ আছে।’
    —‘তা তো বটেই, তা তো বটেই। নিশ্চয় বেশ দরকারী কাজ, নইলে কেউ সিঁড়ি থাকতে ওইভাবে নামে।’
    ‘বেশ করেছি, তোর কি, গগনবাবু হুঙ্কার দিলেন। আমার বাড়ী, আমার সিঁড়ি, আমার গাছ। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামব না গাছ বেয়ে সেটা আমি বুঝব।’
    বিশু মোলায়েম গলায় বলল, ‘আজ্ঞে একশোবার, একদম হক কথাই বটে। তবে কিনা নিজের বাড়ীর সিঁড়ি দরজা জানলার খবর কজন আর সঠিক রাখে বলুন।’
    —‘বটে!’
    —‘আজ্ঞে একেবারে নিয্যস কথা। এই দেখুন না, কালীগঞ্জের মহাজনের বাড়ীতে এই যে এতবড় ডাকাতি হল, ওরা কি জানত ওদের রান্নাঘরের মাঝের শিকদুটো একটু চাপ দিলেই খুলে যায়। না কি ওরা জানত যে, ঐ অতবড় আমগাছের ডাল বেয়ে পাঁচিল পেরিয়ে একদম সটান ভেতরবাড়ীতে ঢুকে পড়া যায়।’
    —‘তুই জানতিস নাকি?’
    —‘আজ্ঞে জানতুম মানে, একশবার জানতুম। মহাজন একবার বলুক দেখি ওকে গিয়ে আমি সাবধান করে দিইনি। বদলে কী জুটছিল মশয় জানেন, স্রেফ গলাধাক্কা।’
    —‘বটে’
    ‘আজ্ঞে ওই তো কটা টাকা, ওটুকুর জন্য আর এমন কি বলুন। ওটুকু তো মানুষ ভালবেসেই দিয়ে দেয়। এই দেখুন না, কালু গুন্ডার দল কেমন গুনীর কদর করতে জানে। ট্যাঁক ভর্তি করে সেলামী তো দিয়েইছে আবার লুটের বখরাও পেলুম।’ বিশু ভক্তিতে একেবারে নুয়ে পড়ল।
    —‘তাই বলছিলুম, এই যে সঠিক খবর সঠিক লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়া, এর দাম আর কতজন দেয়?’
    গগনবাবুর একটু অস্বস্তি হল।
    —‘ইয়ে পিসিমা খুবই বাতিকগ্রস্ত, বুঝলি। তাছাড়া চিরতার জল মোটেই ভাল কথা নয়।’
    —‘আজ্ঞে হক কথা। পিসিমাও ওই কথা বলছিলেন কিনা! সব কথাই তো হয়। এই যেমন সেদিন বললেন, আপনি নাকি ঘুমের মধ্যে কান্নাকাটি করেন, তারপর এই এতবড় বয়সেও নাকি বিছানাতে—’
    —‘আহা চুপ চুপ। এই সকালবেলা আবার ঐ সব কথা কেন। আচ্ছা এই নে দশটা টাকা দিলাম। ঘুনাক্ষরেও যেন কেউ টের না পায়।’
    বিশুর মুখ গম্ভীর হল। ‘আপনি আমায় অবিশ্বাস করেন। রেখে দিন মশাই আপনার টাকা। আমি সত্যের পুজারী, আমি পেশাদারভাবে সত্য কথা বলে থাকি , আমি—’
    —‘আচ্ছা আচ্ছা এই নে, কুড়িটা টাকা দিলুম তোকে।’
    বিশু টাকাটা নিয়ে ফের ভক্তিতে নুয়ে পড়ল। ‘আপনি নিশ্চিত থাকুন, এসব কথা পাঁচকান হবে না। এটা আমার পোফেশানের সাথে জড়িত, হেঁ হেঁ। আচ্ছা আসি তাহলে, অন্য দরকারে লাগলে বলবেন, একটু সেবা করে যাব।’
    —‘আচ্ছা যাও বাপু। পরে তোমায় খবর দেবখন।’
    বিশু ফের পেয়ারা গাছের পেছনে অদৃশ্য হল। গগনবাবু বিরক্ত হয়ে খানসামাটার কথা ভাবতে ভাবতে বাজারের দিকে হাঁটা দিলেন। তালডুমরি গাছের ওপর থেকে ফরসাপানা রোদ এসে সকাল ভরিয়ে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলতে হবে। নতুবা লুটবেহারীর সিঙাড়া শেষ হতে আর কতক্ষণ!
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২০:৪৬691743
  • ২.

    চন্ডীমন্ডপে ঢোকার মুখে বিশু উঁকি মেরে দেখল কবিরাজমশাই আধশোয়া হয়ে হুঁকো টানছেন। রোগী বিশেষ নেই। রোজ সকাল হলে কবিরাজমশাই তাঁর ওষুধের বাক্সটি বগলদাবা করে দাওয়ায় এসে বসেন। পসার ভালোই, তবে ইদানীং শহুরে অ্যালোপ্যাথিক আসার পর থেকে একটু মন্দা যাচ্ছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। রুগী দেখার ফাঁকফোকরে গ্রামের ভালো মন্দের ব্যাপারে মতামত দেন। গ্রামের লোকেরা দরকারে অদরকারে দুচারটে পরামর্শ করতে আসে। বিশু ত্রস্ত পায়ে হাতজোড় করে দাঁড়াল।
    —‘পেন্নাম হই কবরেজমশাই।’
    —‘কে? বিশু? বোসো, বোসো। খবর কি?’
    —‘আজ্ঞে খবর এমনিতে ভালোই, তবে মাঝে মাঝে শূলবেদনাটা একটু চাগিয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে যেন।’
    কবিরাজমশাই বিশুর নাড়ীটা একটু ধরে দেখলেন। ‘হুঁ, তোমার বায়ু প্রবল হয়েছে, নাড়ীর গতি খানিক বেশী। রোজগারপাতির চেষ্টায় খানিক ক্ষান্ত দাও বাছা।’
    —‘আজ্ঞে তা আর কম কি করে করি বলুন। আমি না চাইলেও বিষয়কর্ম যে একেবারে আমার পেছন পেছন ছুটছে।’
    —‘বটে! তা এবার কার সর্বনাশ করলি?’
    জিভ কেটে ঘাড় নাড়ল বিশু। ‘এ হে হে, কি বলছেন কবরেজমশয়, আমি হলাম গিয়ে ওই কি বলে, কি যেন কথাটা, খবর এদিক থেকে ওদিক করে যে, বাবুলোকেরা বলে, আহাহা পেটে আসছে মুখে আসছে না, কি বেশ যেন, শুনলে মনে হয় ঠুক করে কেউ হাতুড়ি পিটল।’
    —‘বার্তাবাহক?’
    —‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই, আহাহা কান যেন জুড়িয়ে গেল।’
    কবিরাজমশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তা কি খবর নিয়ে এলি?’
    বিশু একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ‘খবর অতি গুহ্য কবরেজমশয়। গগনবাবুর চাকর ঝিকু মিঞাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
    —‘ঝিকু ওই চাকরটা, যে সারক্ষণ নস্যি নেয়?’
    —‘আজ্ঞে হ্যাঁ সেই।’
    —‘অ্যাঁ, বলিস কি? কখন থেকে?’
    —‘আজ্ঞে কাল সন্ধ্যে থেকে।’
    —‘তুই জানলি কি করে?’
    —‘আজ্ঞে নিখোঁজ হওয়ার আগে অবধি তো আমিই তো ওর পেছু পেছু যাচ্ছিলাম।’
    —‘বটে বটে! তা কোথায় নিখোঁজ হল?’
    বিশু একটু দোনোমনো করল। ‘ইয়ে, হরিশরাজার জঙ্গলে।’
    ‘অ্যাঁ!’ কবিরাজমশাই সবেগে সোজা হয়ে উঠে বসলেন। জঙ্গলে ঢুকেছে সন্ধ্যাবেলা! ঝিকুর সাহস তো কম নয়। সাথে আর কেউ ছিল নাকি।
    —‘আজ্ঞে না। একাই ছিল।’
    কবিরাজমশাই চিন্তিত হলেন। হরিশরাজার জঙ্গল বড় সহজ ব্যাপার নয়। বিশেষত রাতের বেলায়।
    —‘তা গগন জানে?’
    —‘আজ্ঞে উনি এখনো টের পাননি। তবে শিগগিরিই পাবেন।’
    —‘বেশ, আচ্ছা শোন, এখবর যেন এখনি পাঁচকান না হয়।’
    —‘আজ্ঞে এই যে আপনি বিধান দিলেন। এই ঠিক রইল।’
    —‘আচ্ছা এখন বিদায় হ, আর শোন ওবেলা আসিস, কিছু জড়িবুটি বেটে রাখবখন।’
    —‘আর একটা কথা কবরেজমশয়?’
    —‘আবার কী?’
    —‘ইয়ে, গোবিন্দখুড়ো।’
    —‘তার আবার কী হল?’
    —‘আজ্ঞে, মানে, জানতে চাইছি আর কি! আচ্ছা উনি কী অপদেবতা?’
    কবিরাজমশাই চটে উঠলেন। ‘হারামজাদা, গুলিখোরদের আড্ডায় যাচ্ছিস নাকি আজকাল?’
    —‘আজ্ঞে না না কর্তা। অপরাধ নেবেন না। তবে কিনা কাল পষ্টাপষ্টি দেখলুম যেন, নিশুতরাতে খুড়ো কদমতলার পেছনের বাঁশঝাড় দিয়ে যাচ্ছেন, অন্ধকারে মাথাটা সবুজ বলে মনে হল।’
    —‘মুন্ডু সবুজ! কি দেখতে কি দেখেছিস!’ কবিরাজমশাই খেঁকিয়ে উঠলেন।
    বিশু মাথা চুলকে বলল, ‘তা হয়তো হবে কর্তা, তবে সুরকিকলের অতবড় সাঁকোটা যে পেরিয়ে গেলেন একলাফে, সেটাও কি দিনের আলোয় ভুল দেখলাম।’
    ‘হুঃ’, কবিরাজমশাই তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, সকালে পিত্তনাশ, বায়ুনাশ, কোষ্ট পরিস্কার না হলে লোকে অমন খোয়াবই দেখে। আচ্ছা তুই এখন আয়। আমার রুগী দেখার সময় হল।

    বিশু প্রনাম করে বিদায় নিল। কবিরাজমশাই চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। সন্ধ্যেবেলা হরিশরাজার জঙ্গলে ঢোকা মোটেও কাজের কথা নয়। সাপ, বিছে, বুনো কুকুর, শেয়াল, বন্যজন্তু ছাড়া আর যেসব আছে তা মোটেও ইহলৌকিক জগতের মধ্যে পড়ে না। পাগল ছাড়া ঐ জঙ্গলে রাতের বেলা কেউ ঢোকে নাকি! রাতের বেলা শেষ ঐ জঙ্গলে বাজী রেখে ঢুকেছিল দাশুবাবুর নাতি। সে আর ফিরে আসেনি। তাও প্রায় এককুড়ি বছর হতে চলল। তারও আগে ব্রিটিশ আমলের কোনো এক সাহেব মাপজোক করতে এসেছিল। সেও তার চাকর সমেত উধাও হয়! খালি খাঁটি ব্রিটিশ ফেল্ট হ্যাটটুকু শুধু পাওয়া গেছিল! অবিশ্যি এসব বহুবছর আগেকার কথা।

    চন্ডীমন্ডপ রোদে ঝলমল করছে। একে একে রোগী আসা আরম্ভ হল। বেলা বাড়তে হেলতে দুলতে এলেন দারোগা দুগ্ধবরন বাপুলি। পেছনে দুখানা হাফপ্যান্ট পরা লাঠি হাতে কনস্টেবল। তারা চন্ডীমন্ডপে ঢুকে উপস্থিত লোকজনকে প্রথমে এদিক সেদিক লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলঞ্চ গাছের টবটাতে পানের পিক ফেলে, দরজার পেছনে উঁকি ঝুঁকি মেরে, আড়চোখে কবিরাজমশাইকে দেখতে লাগল।

    —‘কি ব্যাপার দুগ্ধবরন।’
    দারোগাবাবু পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাচ্ছিলেন। নিতান্ত দরকার না থাকলে তিনি থানা ছেড়ে অসময়ে খুব একটা বেরোন না। প্রশ্ন শুনে একটু উদাস হয়ে বললেন, ‘শরীরে চোখটাই তো সবচেয়ে কাজের, তাই তো কবরেজমশাই।’
    —‘কেন কেন, কি হল?’
    —‘চোখে মনে হয় কম দেখছি জানেন! নইলে গিন্নী কি আর দশটা লুচি কম দিয়ে পার পেয়ে যান, নাকি আমার গোনাগুনতি রোজ চারটে সন্দেশ ভুল করে দুটো হয়ে যায়। চোখেই যদি কম দেখলাম তবে সাপ খাচ্ছি না ব্যাঙ খাচ্ছি, কি করে বুঝব বলুন। আর খেলামই যদি কম তাহলে এই কাজের ধকল সামলাব কি করে বলুন। কাজই যদি করতে না পারি তাহলে এই যে সরকার বাহাদুর আমাদের মাইনে দিয়ে পুষছেন আপনাদের সেবায় তারই বা কি হবে বলুন, আর আপনাদের সেবাই যদি—’
    কবিরাজমশাই থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তবে আমি যে লোকেমুখে শুনলাম তুমি লুচি সন্দেশ কম খাচ্ছ ঠিকই তবে ক্ষীরপুলি আর পাটিসাপ্টার পরিমান নাকি বেড়েছে। হরকিষেন গোয়ালা সকাল বিকেল তোমাদের বাড়ি যাচ্ছে। খবর পেলুম তোমার শ্বশুর নাকি কাল কালীগঞ্জের হাটে গোরুর দরদাম করছিল।’
    দুগ্ধবরন একটু বিরক্ত হয়ে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, ‘আজ্ঞে ছোটমুখের ওসব কথা শোনেন কেন। আমি একটু না হয় বেশী খাইদাই তাতে নজর করা কেন বাপু। দেখুন হরকিষেনের গোরুটাকে আমি একটু বেশীই নাহয় ভালবাসি, আর ক্ষীরপুলি আর পাটিসাপ্টা! ও তো দুধে একটু পিটুলি গোলার মতন। এই চেহারায় ওরা কোথায় হারিয়ে যায়। সেই কে যেন বলেছিলেন না ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ আর গোরুটা মশাই শ্বশুরের এমনিই দেবার কথা। ছাদনাতলায় কানে কথাটা তুলতে বলেছিলেন আধেক ব্যবস্থা হয়েছে, বাকিটুকু পরে হবে। দেখুন, এসব ইর্ষাকাতরদের কথা, দেখুন—’
    —‘আহা বুঝেছি, বুঝেছি, তা কবে থেকে মনে হল চোখে কম দেখছ?’
    —‘ইয়ে, গতকাল সন্ধ্যে থেকে। তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বেলে, একটু জলবাতাসা খেয়ে সবে একটু চেয়ারে দেহ রেখেছি, এমন সময় গোবিন্দবাবু, মানে আপনাদের গোবিন্দ নারায়ন চক্রবর্তী থানায় এসে হাজির। ওনার কি সব ভালো লোকের খোঁজ চাই। তা আমি বল্লুম আমাকেই নিন না, যেমন চাচ্ছেন তেমনটিই পাবেন।’
    —‘তাই বললে?’
    —‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তারপর শুনুন। তা বুড়ো বলে আমাকে দিয়ে হবে না, ওনার নাকি একেবারে আসল ভালো নির্লোভ লোকেদের লিস্টি চাই। তা আমি বললাম এখানে তো মশাই উল্টোটাই পাবেন। তা, এইসব বলাতে আমাকে রেগেমেগে অকর্মার ঢেঁকি, কূপমন্ডুক, আরো কি কি সব খারাপ খারাপ কথা বলতে লাগলেন।’
    পেছন থেকে একটা পুলিশ বলল, ‘হাঁ হাঁ, গায় ভ্যাঁস ভি বলিয়েছেন।’
    দুগ্ধবরন চোখমুখ লাল করে বললেন, ‘এইও চোপ, মাইনে দিই না তোদের! লজ্জা করে না, এই যে সব ফি দিন গরমেন্টের পয়সা নিয়ে গামছা পরে থানায় বসে তাস খেলিস, সে সব কথা বড়সাহেবের কানে তুললে কী হবে জানিস?’
    পুলিশ দুটো জিভ কেটে একটু তফাত গিয়ে লাঠি ঠুকতে লাগল।
    দুগ্ধবরন পকেট থেকে ফের রুমাল বার করে মুখ মুছে বলতে লাগলেন, ‘যাক গে, তারপর শুনুন। বুড়োকে শেষমেশ তল্লাটে যত লোক আছে তাদের লিস্টি ধরালাম। আর ঠিক সেই সময় ঝপ করে লোডশেডিং। বাতি নিভে গেল।’
    —‘তো, তাতে কি হল? সে তো হামেশাই হচ্ছে।’
    —‘আরে ঐখানেই তো যত গন্ডগোল কবিরাজমশাই। নিকষ অন্ধকারে পষ্ট দেখলুম গোবিন্দবাবু লিষ্টি পড়ে যাচ্ছেন। এদিকে আমি তো আমার ভুঁড়িটাকে অবধি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলুম চোখটাই বুঝি গেল।’

    কবিরাজমশাই একটু চুপ করে রইলেন। ব্যাপার স্যাপার মোটেই সুবিধার নয়। প্রথমে বিশু তারপর দুগ্ধবরন দুজনেই অশৈলী কান্ডের কথা বলছে। কিছু একটা ঘটছে তো বটে।

    দুগ্ধবরন আরো কিছু মামুলি কথাবার্তার পর বিদায় নিল। উপস্থিত বেশ কিছু রোগীকে ওবেলা আসতে বলে কবিরাজমশাই হাতবাক্স গুছিয়ে উঠে পড়লেন। ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গুপী মাস্টারের সাথে একবার বসতে হচ্ছে।
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২১:১২691754
  • ৩.

    জগা পাগলা, কালীবাড়ী থেকে তার প্রতিদিনকার জিবেগজা সাঁটিয়ে সুরকিকলের গলি হয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় লক্ষ্য করল ফটিকদের বাঁশবনের পেছনে গোবিন্দখুড়ো গলায় গামছা দিয়ে ওত পেতে বসে আছেন। কাছে এসে একগাল হেসে জগা বলল, ‘বাঘ ধরছেন বুঝি নিতাই বাবু?’
    গোবিন্দখুড়ো কিছুক্ষন চোখ পিটপিট করে বললেন, ‘জগা পাগলা মনে হচ্ছে।’
    —‘ধরেছেন ঠিকই। এমন সুন্দর ডোরাকাটা ছোপ ছোপ, ইয়া বড় গোঁফ, আর ওই অত বড় ল্যাজ, নাহ, ও জিনিস বাঘ ছাড়া পাবেন কোথায়?’
    খুড়োর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল, ‘বাঘ নয় রে ভাই, মনের মত একখান লোক খুঁজছি।’
    —‘তা এ আর কঠিন কি। দরকার শুধু টোপ। তা বাজার থেকে একখানা পাঁঠা কিনে আনুন না?’
    ‘আহ মেলা বাজে বকিস না তো।’ খুড়ো খেঁকিয়ে উঠলেন।
    —‘অবশ্য আর একটা সহজ উপায় আমি জানি।’
    ‘বটে!’, খুড়ো একটু সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘কি সেটা শুনি?’
    হ্যা হ্যা করে খানিক হেসে জগা পাগলা বলল, ‘সোজা হরিশরাজার জঙ্গলে চলে যাও গুপীদাদু। ওখানে বুড়ো বটের নীচে পাথরগুহার সামনে গিয়ে পাকা আমটির মত বসে থাকো। ওখানেই পাবে। অবশ্য বড় ছিপ নিয়ে যেতে হবে। নইলে ধরবে কি করে?’
    খুড়ো সবেগে উঠে দাঁড়ালেন, উত্তেজনায় চুল খাড়া খাড়া হয়ে গেছে। গলার গামছাটাকে কোমরে জড়িয়ে বললেন, ‘তুই গিয়েছিস ওখানে? আবার যেতে পারবি?’
    —‘কি যে বলেন, সোনামুগের ডালের খোসবায় কি আর আমি জানি না, গেল হাটবারে সেই যে— ওই যা ভুলে গেছি।’
    —‘আ হা হা, বাপ আমার, সোনামুগের ডালের কথা হচ্ছিল নাকি? বল দেখি ওই যে জঙ্গলের ভেতর যেখানে কাক পক্ষীও যায় না সেখানে তুই গিয়েছিলি নাকি!’
    ঢুলুঢুলু চোখ করে জগা বলল, ‘আমিও তো সেই কথাই বলি সোনাকাকা! না হয় শেষপাতে কুমোরদের বাড়ীতে মন্ডা কমই পড়েছিল তা বলে কি ঐ টক দৈ ভোলা যায় নাকি।’
    খুড়ো জগাপাগলার আস্তিন ধরে মোলায়েম সুরে বলতে লাগলেন, ‘বাবা জগু আমার, মানিক আমার, বল না বাছা, গিয়েছিলি সত্যিকারের, হ্যাঁরে গিয়ে কি দেখলি, পাথরগুহায় ঢোকার রাস্তাখান দেখতে পেলি, বল না বাপ আমার, ইয়ে তোকে, কি বলে, অনেক টক দৈ খাওয়াব।’
    —‘বলছেন?’
    —‘একশোবার এই গামছা ছুঁয়ে বলছি।’
    —‘তাহলে শুনুন, প্রথমে কালীবাড়ীর কাছে যে তালঢ্যাঙা লম্বা সুপুরি গাছ টা আছে, ওইটা দেখেছেন তো, ওটার মাথায় উঠতে হবে।’
    —‘বেশ উঠলাম।’
    —‘ওঠার পর দেখলেন নীচে বড় বড় সব শুঁয়োপোকা উত্তর দিকে চলেছে। অমনি দুদ্দাড় করে নেমে এলেন।’
    —‘বেশ নামলাম।’
    জগা সবেগে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘নেমে এসেই তো ভুল করছেন। ওই গাছের পাশেই তো পুরোহিত মশাইয়ের বাড়ী, ঐ বাড়ীর ছাদেই তো যত ঢ্যাঁড়শ গাছ। আবার না উঠলে সেগুলো দেখতে পাচ্ছেন কোথায়?’
    —‘বেশ আবার নাহয় ওঠা গেল।’
    —‘উঠেই দেখলেন নীচে কালীবাড়িতে প্রসাদ দিচ্ছে। খেতে হবে তো, অমনি সটান নেমে এলেন।’
    খুড়ো এবার ভীষন রেগে আস্তিন ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘হতভাগা, তখন থেকে খালি উঠছি আর নামছি। বলি বুড়ো মানুষ টার প্রতি একটুও দরদ হয় না তোর। সেই কবে থেকে হা পিত্যেশ করে বসে আছি। বলি বল না হতভাগা বনের মধ্যে পাথরগুহার ওখানে গেলি কি করে?’
    জগা পকেট থেকে একটা পেয়ারা বার করে কামড় দিয়ে বলল, ‘আমিও তো সেইকথাই ঝিকু কে বললাম।’
    ‘অ্যাঁ, বলে দিলি, তুই বলে দিতে পারলি, বলি আগে তো সুলুকসন্ধান করে নিয়ে দেখতে হয় রে বোকা। ও যে আমার হকের ধন’, খুড়ো ফোঁত ফোঁত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। কোমরের গামছার খুঁট টা খুলে খানিক চোখ মোছা হল।
    —‘সেই কবে বাপ পিতেমোর আমল থেকে শুনে আসছি। একএকটার ওজন নাকি চোদ্দ ভরি। বনের মধ্যে পাথরগুহার খাঁজের মধ্যে নিতান্ত হেলাফেলা হয়ে পড়ে রয়েছে। আ হাহা, হয়তো পালিশ উঠে গেছে। আমার বংশের সবেধন সম্পত্তি, এখন আমি যদি ওগুলোয় নিদেনপক্ষে একটু হাত বুলোতে চাই তবে কী অধর্ম করলাম তুই বল আমায়। হা ভগবান, হা হতোস্মি।’
    জগা একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, ‘বুনোকুল খেতে চান যদি, তো আগে বললেই হয়। জঙ্গলের ভেতর ওই যে যেখানে তিনবার ঘড়ির ঢঙ শোনা যায় ওখানে তো মেলা কুল গাছ।’
    খুড়ো আর থাকতে পারলেন না। মুখে হাত দিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে বললেন, ‘ও জগা সবই তো বলছিস ভাই, খালি এইটুকু বলে দে আমার সাত রাজার ধন মানিক ওখানেই আছে কিনা। ও হো হো, কি গেরোয় পড়েছি রে ভাই।’
    —‘দুত্তোর তারপর শুনুন, সেই কবে একটা কে যেন পেয়ারা গাছের তলায় মাচা বানিয়ে ছিল, তারপর ভাত রান্না করে ওখানে খুব করে ডাল দিয়ে মেখে—’
    খুড়ো চোখ মুছে বললেন, ‘বুঝেছি রে বুঝেছি, আর বলতে হবে না, তোর খিদে পেয়েছে তো, চল ভাই আমার সাথে। তোকে আমি রেঁধে খাওয়াব। কাল হরেন যে লালশাক গুলো দিয়ে গেল ও তো এমনই পড়ে আছে।’
    জগা ফিক করে হেসে বলল, ‘তবে খাল পাড়ে কোথায় কাঁকড়ার গর্ত আছে সে কি আর আমি কাউকে বলেছি।’
    খুড়ো হতাশ হয়ে বললেন, ‘সে কি আর আমি জানি না রে। এই ঘোর কলিযুগে কেউ কি কাউকে আসল গুহ্য কথাটা বলে রে, নাকি যে যেটা খুঁজছে সেটা পায়। এই আমাকেই দেখ না, কতদিন ধরে এমন একজন লোকের সুলুক সন্ধান করছি যাকে দিয়ে কিনা কার্যোদ্ধার হবে, তা এমনি পোড়া কপাল যে পুরো গোটা একটা ভালো লোক পেলুম না মাইরি। এই যখন তোকে পেলাম, তুই আবার তাও লেজে খেলাচ্ছিস। হ্যাঁরে পাগল বলে কি দয়ামায়া থাকতে নেই।’
    —‘তা কেন? এই তো সেদিন রাধাকান্তবাবুর ট্যাঁকঘড়িটা পষ্ট দেখলাম হাবু চোর হাতিয়ে নিল।’
    —‘চল বাবা চল। বেশ বুঝেছি তোর উপরই বেবাক হাঁ করে বসে থাকতে হবে। বেলা হয়েছে, আজ না হয় আমার বাড়ীতেই দুটি ভাত খেয়ে যাবি।’
    —‘এই রে মনে পড়েছে। ও দাশুখুড়ো আমাকে আজ ছেড়ে দাও, আজ আবার ঘড়ি উল্টোতে যেতে হবে।’
    —‘অ্যাঁ!’
    —‘বুঝছ না নবীন ভায়া। পাথরগুহার ভেতর ঐ লাল-নীল ঘড়িটা উলটে দিয়ে আস্তে হবে না, না হলে স্লো চলবে তো।’
    আঁক করে শব্দ করে গোবিন্দখুড়ো ভিরমি খেয়ে পড়লেন। জগা খুব খুশি হয়ে বললে, ‘তাহলে রাজাবাবু, পাকা তেলাকুচো লাগলে বলবেন, খানিক দিয়ে যাবখন, আচ্ছা আসি এখন।’ এই বলে ফটিকদের বাঁশবনের পেছন দিক দিয়ে যে রাস্তাটা সোজা বিল পেরিয়ে হরিশরাজার জঙ্গলের দিকে গেছে সেদিকে হাঁটা দিল।
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২১:৩৮691764
  • ৪.

    গত দুদিন একটু বাদলা করেছিল, এখন আবার আকাশে নীল রঙ ধরেছে। শীত আসছে গুটি গুটি পায়ে। হাঁসপুকুরের উত্তরে চাষের জমির ধান তোলার জন্য দুরের গ্রাম থেকে লোক লশকর সব আস্তে শুরু করেছে। চন্ডীমন্ডপে অপেরা বসবে, তার জন্য চৌধুরী মশাই দৌড়দৌড়ি শুরু করেছেন। চারদিকে বেশ খুশী খুশী ভাব।

    স্নান আহ্নিক সেরে, কবিরাজমশাই গায়ে শাল জড়িয়ে গুপী মাস্টারের বাড়ীর দিকে রওনা দিলেন। গুপী মাস্টারের বাড়ি বাজার ছাড়িয়ে গ্রামের প্রায় শেষ দিকটাতে। মাস্টারের সাথে একটু শলা পরামর্শ করা দরকার। বড় মন খুঁতখুঁত করছে।

    গুপী মাস্টার অর্থাৎ হাঁসপুকুর কালীসুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ের অঙ্কের মাস্টার গোপীনাথ বর্মনকে তাঁর রাশভারী মেজাজের জন্য ছেলেমেয়েরা ভয় পায়। তবে কবিরাজমশাই তাঁকে স্নেহ করেন। অঙ্কে তাঁর মাথা বড় সাফ। এরকম লোক গ্রামে অবশ্যি দরকার, বিপদে আপদে দরকারী পরামর্শ পাওয়া যায়।

    গুপী মাস্টারের একতলা বাড়ী। সামনে বেড়া দেওয়া গোলাপ বাগান। মরসুমি ফুল লাগানো হয় মাঝে মাঝে। সামনে বেশ বড়সড় ঘোড়ানিম গাছ। ভদ্রলোক অবিবাহিত। কবিরাজমশাই বাড়ীর সামনে এসে হাঁক দিলেন, ‘মাস্টার আছ নাকি?’

    আগেই খবর পাঠানো ছিল, গোপীনাথ সবুজ-সাদা চেক কাটা লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
    —‘আসুন কবরেজমশাই।’
    —‘শোনো হে তোমার সাথে কিছু পরামর্শ করার ছিল।’
    —‘বেশ তো, আগে ভেতরে আসুন।’
    কবিরাজমশাই ভেতরে ঢুকলেন। বসার ঘরের দেওয়ালে নানান মনীষীদের ছবি টাঙান। সামনে টেবিলে স্তূপাকার বইপত্র। চতুর্দিকে মেলা কাগজপত্র, মোটা মোটা অংকের খাতা।
    —‘আজ তোমার পোড়োরা সব কোথায়?’
    —‘আপনি আসবেন বলে ছুটি দিয়েছি। ব্যাপার কি কবিরাজমশাই?’
    জল-বাতাসা খেয়ে ধীরেসুস্থে কবিরাজমশাই বললেন, ‘গাঁয়ে কিসব অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার ঘটছে, তার খবর রাখো?’
    —‘কি হয়েছে?’
    —‘নানান আজব ব্যাপার স্যাপার। আজ সকালে আমাদের বিশু আর দারোগা দুগ্ধবরন, দুজনের মুখেই শুনলাম।’
    —‘গোবিন্দনারায়ন বাবুকে নিয়ে কি?’
    কবিরাজমশাই সচকিত হলেন। গলা খাটো করে বললেন, ‘তুমিও কিছু দেখেছ নাকি?’
    —‘ইয়ে, দেখেছি বটে। আসলে কাল দুপুরে উনি আমার বাড়ীর নিমগাছে উঠে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। তা অবশ্য উনি প্রায়ই করেন। আমায় দেখতে পেয়ে নেমে এসে গল্পগুজব করলেন, তারপর যাবার সময় একটা ভীষন শক্ত অঙ্ক দুমিনিটে কষে দিয়ে চলে গেলেন।’
    —‘বল কী!’
    —‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে আমি যতদুর জানি উনি কোনকালে আঁক কষা শেখেননি।’
    —‘আরে আঁক কষা তো দুরের কথা, ও তো কোনকালে লেখাপড়ার ধার দিয়েই গেল না হে। অবশ্য দৌড়ঝাঁপ করত বেশ ভালো। অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, কুস্তি সবেতেই পারদর্শী ছিল।’

    গোপীনাথ কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন, শেষে বললেন, ‘কবিরাজমশাই, আমার চেয়ে এ গাঁয়ের হাঁড়ির খবর আপনি বেশী জানেন।’

    কবিরাজমশাই ইঙ্গিত বুঝলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ভয় কী জানো মাস্টার, বাবার কাছে শুনেছি, গোবিন্দর বাবা উপেন্দ্রনারায়ণ উবে যাওয়ার আগেও নাকি ঠিক এই রকমই হয়েছিল। নানান রকম অদ্ভুত ক্ষমতা দেখা দিয়েছিল।’
    —‘উবে গিয়েছিলেন মানে?’
    —‘হরিশরাজার জঙ্গলে শেষ তাঁকে ঢুকতে দেখা যায়। তারপর গায়েব। গ্রামের লোক নাকি অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিল।’

    গোপীনাথ ধন্দে পড়লেন। ঠিক কিরকম ক্ষমতা ছিল উপেন্দ্রনারায়ণের।

    —‘তা হলে বলি শোন। আমার বাবার মুখে শোনা। তখন বেশ স্বচ্ছল অবস্থা ছিল চক্রবর্তীদের। শীতের শেষে নতুন ধান বোনার আগে ওঁদের বাড়ীর রোয়াকে প্রতিবছর কেতাবী গানবাজনার আসর বসত। কলকাতার নামী সব গাইয়েরা আসতেন। একবার এক পন্ডিতজী এলেন, বেহাগ রাগে আলাপ ধরার পর যেই বিলম্বিতে এসেছেন অমনি উপেন্দ্রনারায়ণ উঠে দঁড়িয়ে পন্ডিতজীর ভুল ধরে দিলেন।’
    —‘বলেন কী!’
    —‘হ্যাঁ, অথচ ওনার কোন রেওয়াজী শিক্ষা মোটেই ছিল না।’ কবিরাজমশাই চুপ করলেন। ‘আরোও শুনবে?’
    —‘বলুন।’
    —‘রসিকবিল তখন আরো বড় ছিল, আরো গভীর। নদীর সাথে যোগও ছিল। তো সেই নদীতে এক বার শরতের রাতে উপেন্দ্রনারায়ণ স্ত্রী সমেত নৌকাবিহার করছেন বুঝলে। স্ত্রী সৌদামিনী অভ্যাসবশত জলে হাত দিয়ে আদিখ্যেতা করছেন। এমনসময় হাতের আঙুল থেকে আঙটি খুলে টুপ করে পড়ে গেল জলে। প্রথম চোটে বোঝেননি, তারপর ডাঙায় নেমে দেখলেন আঙটি নেই, ব্যস হুলুস্থুলু কান্ড। 'উপেন্দ্রনারায়ণ তারপর কী করলেন বলত?’, কবিরাজমশাই গোপীনাথের দিকে তাকালেন।
    —‘বুঝতে পারছি কবিরাজমশাই, উনি আবার ডুব দিয়ে বিলের তলা থেকে ওই অন্ধকারে আঙটি তুলে আনলেন, তাই তো?’
    —‘একদম ঠিক।’
    ‘কিন্তু কবিরাজমশাই, এগুলো তো গুজবও হতে পারে।’ গোপীনাথের ভ্রু কুঞ্চিত হল।
    কবিরাজমশাই মৃদু হাসলেন, ‘না হে, ব্যাপারটা সত্যি। কারন চক্রবর্তীদের বাড়ীর দোতলা থেকে আমার বাবা পুরো ব্যাপারটাই দেখেছিলেন।’
    —‘আপনি বিশু আর দারোগাবাবুর কথা বলছিলেন না?’
    —‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওদের দুজনের বক্তব্যই মোটামুটি এক, দুজনেই দেখেছে গোবিন্দ অন্ধকারেও পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে।’
    গোপীনাথ চমৎকৃত হলেন। ‘কিন্তু কবিরাজমশাই, বিজ্ঞান তো তা বলে—’
    —‘বিজ্ঞানের এখনো অনেক কিছু শেখা বাকী আছে হে গোপীনাথ।’

    গোপীনাথ তর্কে গেলেন না। হতে পারে গোবিন্দনারায়নের অতিমানবিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু সে তো কতই শোনা যায়। প্রায়শই খবরের কাগজে সাংবাদিকরা ফলাও করে সেসব লেখে, সেই যে চামচ বাঁকানোর গল্প! জলের তলায় শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকার গল্প! মানুষ নিজেকেই বা চেনে কতটুকু।

    কবিরাজমশাই গোপীনাথের মনের অবস্থাটা আন্দাজ করলেন। আর একটু জল খেয়ে, কেশে গলা সাফ করে বললেন, ‘বুঝলে ঝিকু মিঞাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
    —‘সে কী!, ঝিকু মানে গগনবাবুর চাকর?’
    —‘হ্যাঁ হে, সেই। সে নাকি কাল সন্ধ্যাবেলা হরিশরাজার জঙ্গলে ঢুকেছিল।’
    ‘বলেন কী’, গোপীনাথ নড়েচড়ে বসলেন। ‘এত জায়গা থাকতে হরিশরাজার জঙ্গলে কেন? ও তো শুনি খুব একটা ভালো জায়গা নয়। পুলিসে খবর দেওয়া হয়েছে?’
    —‘পুলিশ এখনো জানে না, মানে তাদের জানানো হয় নি, আর ঠিকই শুনেছ ও জঙ্গল মোটেও সুবিধার জায়গা নয়, আহা দাশুবাবুর জোয়ান নাতিটা!’

    দুজনেই কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইলেন। শেষে গোপীনাথ মুখ খুললেন, ‘আপনি কি কোনোভাবে ঝিকুর জঙ্গলে যাওয়া আর গোবিন্দবাবুর অলৌকিক ক্ষমতার মধ্যে কিছু যোগাযোগ আছে বলে মনে করছেন?’

    কবিরাজমশাই একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘কিছুই অস্বাভাবিক নয় হে, কিছুই অস্বাভাবিক নয়। শাস্ত্রে বলেছে সিংহের গুহায় মৃগ এমনি এমনি যায় না।’
    —‘সব রহস্যই তো হরিশরাজার জঙ্গলে গিয়ে ঠেকছে বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা কবিরাজমশাই আপনি গোবিন্দবাবুকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করছেন না কেন?’

    কবিরাজমশাই একটু অস্বস্তিতে পড়লেন। কিছুক্ষন উশখুশ করার পর বললেন, ‘আসলে গতবছর বুঝলে, ওই চৌধুরীর ‘রাবনের আর্তনাদ’ পালা দেখার পর থেকেই ওর সাথে বড় মনোমালিন্য।’
    —‘ঝগড়াটা কি নিয়ে?’
    ‘ইয়ে’, কাষ্ঠহাসি হেসে কবিরাজমশাই বললেন, ‘ঐ কার চরিত্র বড়, মেঘনাদ না বিভীষণ, সেই নিয়ে।’

    ঝপ করে বিজলি চলে গেল। অবশ্য ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। গোপীনাথ বেশ চিন্তায় পড়লেন। হরিশরাজার জঙ্গলে আছেটা কী? তিনি নিজে হাঁসপুকুর আসা ইস্তক শুনছেন ও বড় ভয়ের জায়গা। যদিও দিনমানে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। তাছাড়া গোবিন্দনারায়নের বংশপম্পরায় এরকম অলৌকিক শক্তি-- তাইই বা কি করে হয়? উপেন্দ্রনারায়ন হঠাৎ হরিশরাজার জঙ্গলেই বা কি করতে গিয়েছিলেন।
    —‘তুমি একটু ভাব হে গোপীনাথ। আমি এখন উঠি।’

    কবিরাজমশাই উঠে পড়লেন। রোদ পড়ে এসেছে। গ্রামের আরো কয়েকজনের সাথে শলা পরামর্শ করতে হবে। গোপীনাথ কবিরাজমশাইকে একটু এগিয়ে দিতে গেলেন।
    —‘ভালো কথা, তুমি কোনোদিন গোবিন্দনারায়নের বাড়িতে গেছ নাকি?’
    —‘ইয়ে না তো, ও হ্যাঁ, বোধহয় একবার। ইস্কুলের মাঠের জন্য ওঁদের রসিকবিলের পাশে যে জমিটা আছে ওটা ডোনেশন হিসেবে পাওয়া যেতে পারে কিনা সে ব্যাপারে কথা বলতে। কেন বলুন তো?’
    —‘ওদের, বৈঠকখানায় হরিণের মুন্ডুর পাশে যে মুর্তিটা রাখা আছে, দেখেছ?’
    —‘না খেয়াল করিনি তো। কেন, কিছু অস্বাভাবিক আছে নাকি?’
    —‘কোনো মানুষের চারহাত লম্বা ল্যাজ হয় দেখেছ নাকি?’
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২২:০৪691765
  • ৫.

    হরিশরাজার জঙ্গলের উপর দিয়ে সূর্য্য ঢলে পড়ল। নিঝুম শিরশিরানি হাওয়া বইছে। জঙ্গল থেকে একটা দুটো শেয়ালের হুক্কা হুয়া শোনা যাচ্ছে। এমন সময় হাঁসপুকুরের যত ঝোপে ঝাড়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকারা একসাথে ডেকে উঠল, আর অমনি গবু একটা লন্ঠনে কালো কাপড় জড়িয়ে, খিড়কির দরজা খুলে চুপিসাড়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

    ঘুটঘুটে অন্ধকার। যদিও আকাশে চাঁদ আছে। চবুতরা পেরিয়ে, বনমালীবাবুর বাড়ীর পাশ দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে সে বড় রাস্তায় এসে পড়ল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সামান্য আলো রাস্তায় এসে পড়েছে। ঐ যে দূরে গগনবাবুর বাড়ীর জানালা দেখা যাচ্ছে। গবু দেখল গগনবাবু পিসীমার হাত থেকে কী একটা খেলেন। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে তারস্বরে। আরো একটু এগোতেই চন্ডীমন্ডপ পড়ল। কবিরাজমশাই শতদল ঘোষের সাথে নিচু স্বরে কীসব ষড়যন্ত্র করছেন। যথাসম্ভব আড়াল রেখে সে চন্ডীমন্ডপ পেরিয়ে বাজার চকের দিকে এগোলো। দোকানপাট সব বন্ধ, চারিদিক নিঝুম হয়ে রয়েছে। গাছের পাতায় পাতায় হাওয়া সরসর আওয়াজ তুলছে। ও কি! কালু ষাঁড়টা বসে আছে না? নিঃশব্দে বাজার চক পেরিয়ে সে ফটিক ঘোষের বাঁশবাগানের দিকে এগোলো। বাঁশবাগানের পাশে গদাইপালোয়ানের কুস্তির আখড়া পেরিয়ে, গুটিকতক সারি সারি বাড়ীঘর পেরিয়ে নিচু ঘাসজমি ডিঙিয়ে সে ফের বনমালীবাবুর ঘরের কাছে এসে পড়ে হাঁফ ছাড়ল। তাকে কেউ দেখেনি। বনমালীবাবুর ঘরে এখন কুপী জ্বলছে, শুঁটকি মাছ রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে। নাকে হাত চাপা দিয়ে কোনমতে চবুতরা পেরিয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকে, তার ঘরের ঠিক পাশের ঘরটিতে কড়া নাড়ল। পাশের ঘরে যাওয়ার জন্য অবশ্য এতটা ঘোরার দরকার ছিল না, কিন্তু একটু অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া কি আর গোয়েন্দাগিরি মানায়!

    ডিটেকটিভ সত্যরঞ্জন চাকলাদার একটা আলোয়ান গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। চোখেমুখে বিরক্তি, ‘তোকে বলেছিলাম না রাত বারোটার আগে দরজা ঠকঠকাবি না।’
    —‘ইয়ে খবরগুলো আর চেপে রাখতে পারছিলাম না।’
    —‘কি খবর পেলি?’
    —‘আজ্ঞে প্রচুর খবর পেলুম। ইয়ে, এখানে বড় ঠান্ডা, আমার ঘরে আসুন।’
    দুজনে মিলে গবুর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। লন্ঠনের কালো মোড়ক খুলে দিতে ঘর একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মফস্বলের এসব দিকে এমন সময় ঠান্ডা তেমন জমিয়ে পড়ে না, তবে এবার যেন একটু তাড়াতাড়িই শীত এসে পড়েছে।
    —‘ইয়ে, আজ ফটিকবাবুর বাঁশবনে আড়ি পেতেছিলাম।’
    —‘তারপর?’
    —‘তারপর যা হ'ল, তা দেখলাম বেশ রোমহর্ষক, যাকে বলে একেবারে সত্যিকারের গায়ে—’
    সত্যরঞ্জন রেগে গিয়ে বললেন, ‘ধানাইপানাই ছেড়ে আসল কথা বলবি কি না?’
    গবু ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারপর শোনেন, সকালবেলার ঘটনা। তখন সবে রাস্তা দিয়ে লোকচলাচল শুরু হয়েছে, পষ্ট দেখলাম, ফটিকদের বাঁশবাগানের পাশে জগা পাগলা আর গোবিন্দখুড়ো আড়ালে খাটো গলায় কি যেন ষড়যন্ত্র করছে।’
    —‘কিছু শুনতে পেলি নাকি?’
    —‘আজ্ঞে মনে হল, হরিশরাজার জঙ্গল নিয়ে কিছু কথা হচ্ছিল। সেখানে নাকি কারা সব আছে, তারা নাকি ঘন্টা বাজায়। আর খুড়োর নাকি কিসের উপর হাত বোলাতে খুব ইচ্ছে করে।’
    ‘ধ্যাৎ, কিসব আজে বাজে বলছিস।’ সত্যরঞ্জন ভ্রু কোঁচকালেন।
    —‘আজ্ঞে, একেবারে নিয্যস সত্যি কথা বটে, কিসব কাঁকড়ার গর্তের ভেতর ট্যাঁকঘড়ি, আর যখের ধনের কথাও শুনলাম যেন।’
    ‘ঠিক শুনেছিস!’ উত্তেজনায় সত্যরঞ্জনের চুল খাড়া খাড়া হয়ে উঠল।
    —‘তাই তো মনে হল। আর, ইয়ে, এখানেই শেষ নয় গোবিন্দখুড়ো দেখলাম শেষে ভিরমি খেয়ে উলটে পড়ল।’
    —‘ভিরমি খেল, অ্যাঁ, কিন্তু ভিরমি খাবে কেন?’
    —‘আজ্ঞে, তা তো জানি না, তবে আমিই তো আবার চোপা চোপা জল ঢেলে ওনার মুচ্ছো ভাঙালাম। যদিও মুচ্ছো ভেঙে উঠে বসে আমাকে দেখে খানিক গালমন্দ করে চলে গেলেন।’
    —‘হ্যাঁরে, এক শুনতে গিয়ে আরেক শুনিসনি তো?’
    —‘এক শুনতে গিয়ে আরেক? ব্যাপারটা কিরকম বলুন তো? ও ও ও, বুঝেছি সেই যে গেল বছরের সেই গোরুদের—’
    সত্যরঞ্জন গবুর দিকে রক্তচক্ষু করে বললেন, ‘উফফফ। তোকে বারণ করেছি না যে ওইসব কথা আমাকে মনে করাবি না! যাক গে আর কি শুনলি?’
    —‘ইয়ে, ওখানে তারপর বড্ড মশা কামড়াচ্ছিল, তাই গগনবাবুর বাড়ীতে আড়ি পেতে বসেছিলাম।’
    —‘কেন কেন? গগনবাবুর বাড়ীতে কেন?’
    —‘আজ্ঞে ওনার চাকর ঝিকু কাল থেকে উধাও হয়েছে। তাই ভাবলাম—’
    সত্যরঞ্জন গবুকে হাত তুলে থামিয়ে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, ‘রোসো, আড়ি পেতে বড়জোর শুনেছিস তো যে গগনের সোনার জরি দেওয়া অতবড় পানবাটাটা হারিয়েছে আর সেজন্য নির্ঘাত ঝিকুকে ওরা সন্দেহ করে। হয়তো এটাও শুনেছিস ওর বৌয়ের রুপোর নাকছাবি, তারপর ওর পিসীমার সোনার কানের দুল, এসবও হারিয়েছে। হাঃ হাঃ, আরে বলেই ফেল না, গগনের পিসীর মুখ হাঁড়ি হয়ে আছে আর তার সঙ্গে এটাও দেখে ফেলেছিস যে পিসীকে ধোঁকা দিয়ে গগন চালের বস্তার মধ্যে লুকোনো নতুন কেনা খাস্তা বিস্কুটের প্যাকেট টা সাবাড় করছে।’
    —‘আজ্ঞে এরকম তো কিছু দেখলাম না। খালি দেখলাম গগনবাবু থেকে থেকে মোগলাই পরোটা বলে ডুকরে কেঁদে উঠছেন, আর পিসীমা দেখলাম ঐ পানের বাটা যেটা বলছেন ওখান থেকে থোকা থোকা পান দোক্তা চিবুচ্ছেন। দুখানা দাসী পদসেবা করছে, আর রান্নাঘরের কুলুঙ্গিতে ওদের হুলোটাকেও দেখলাম যেন বলে মনে হল।’
    সত্যরঞ্জন এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘শুধু হাঁ করে দেখলেই হয় না, কি কি দেখা উচিত আর কি কি নয় সেসবের একটা লিস্ট বানিয়ে নিয়ে যেতে হয়, নইলে বুদ্ধু বনতে হয়। এই যেমন ধর তুই দেখতে চাইছিস জমিদারবাড়ির অন্দরমহলে কার গলায় পান্না দেওয়া জড়োয়া ঝুলছে, তার বদলে দেখলি জমিদারগিন্নী ঘুঁটে শুকোচ্ছেন, কাপড় কাচছেন। মনে কর দেখতে চাইছিস গলির ভেতর গুম খুন, বদলে দেখে ফেললি ছানাবাঁদরে উকুন বাছছে। তারপর যা দেখছিস ঠিক সেটাই ঘটছে কিনা সেটাও বাজিয়ে দেখা দরকার। এবিষয়ে বড় বড় গোয়েন্দাদের যা মত, আমারও ঠিক তাই। আমি বলি কী যে যা ভালো বুঝছে সেটাই করছে, তবে আমরা যেটা দেখছি সেটা ভালো করে বুঝছি না—, না না, কথাটা অন্যরকম হবে মনে হচ্ছে, মানে আমরা যেটা ভালো বুঝছি না সেটাই সবাই করছে—না না, এরকমও তো নয়, মানে আমরা যেটা করছি না সেটাই সবাই ভালো বুঝছে—যাচ্ছলে, এরকমও তো ছিল না, যাকগে ইয়ে আর কি দেখলি?’
    গবু চোখ পিটপিট করে বলল, ‘আর দেখলাম কবিরাজমশাই অঙ্ক স্যারের বাড়ী গেলেন।’
    —‘গুপী মাস্টারের বাড়ী।’
    —‘আজ্ঞে হ্যাঁ, নিচু গলায় কিসব শলা পরামর্শ হচ্ছিল। দোরের বাইরে আড়ি পেতে খুব ভাল কিছু শুনতে পেলুম না। তবে এইটুকু শুনলুম, হরিশরাজার জঙ্গলে নাকি সিংহের গুহা আছে, আর সেখানে বিস্তর আংটি, গয়না লুকোনো আছে, আর গোবিন্দখুড়ো সেখানে নাকি বসে বসে আঁক কষে।’
    —‘আঁক কষে?’
    —‘ইয়ে, তাইতো শুনলুম।’
    সত্যরঞ্জন চিন্তায় পড়লেন। হরিশরাজার জঙ্গলে গিয়ে সিংহের গুহায় বসে আঁক কষার ব্যাপারটা যেন কেমন ঠেকছে। অবশ্য সত্যকারের ডিটেকটিভদের সামনেই তো যত রহস্যের ঘনঘটা তৈরী হয়। কায়দা করে ক্লু খুঁজে পেয়ে ওরা কেমন বেয়াদবদের ধরে বার করে। সেই যে পুলিশরা কিছুতেই খুঁজে পায় না, আর গোয়েন্দারা কেমন একটা মাত্র ভাঙা হুঁকোর টিকে থেকে গন্ধ পেয়ে, কচুগাছের তলায় আধপোড়া বিড়ি খুঁজে পেয়ে সব কিছু বলে দেয়। মায় চোরেদের জামার হাতার রঙ অবধি। অবশ্য তার জন্য সত্যিকারের সুত্র চাই। এলেবেলে কিছু দিয়ে হবে না। যতক্ষন না কোন নৃসিংহ মূর্তির ভাঙা কানের পাশে রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে, কিংবা ভাঁড়ার ঘরের দেওয়ালে চাবি দিয়ে আঁকাবাঁকা হাতে 'পানু হইল ভুত' লেখা বের হচ্ছে, ততক্ষন কিচ্ছুটি হবার নয়।

    গবু একটু মাথা চুলকে বলল, ‘আচ্ছা কর্তা, একটা কথা বলব?’
    —‘বল।’
    —‘আজ্ঞে, কবিরাজমশাই অঙ্ক স্যার কে গোবিন্দখুড়োর ল্যাজের কথা বলছিলেন বলে মনে হল।’
    —‘ল্যাজ? ঠিক শুনেছিস!’
    —‘আজ্ঞে হ্যাঁ। পষ্ট শুনলাম যেন কবরেজমশাই বলছেন, খুড়োর ল্যাজ নাকি খুড়োর বাড়ীর বৈঠকখানায় রাখা থাকে। অঙ্ক স্যার সেটা নাকি আবার ডোনেশন চেয়েছেন।’

    সত্যরঞ্জনের চক্ষুস্থির! সাধারন মানুষের ল্যাজ থাকে নাকি। আবার সেটা ধারও দেওয়া যায়! অবশ্য খুড়ো কে দেখে কোনদিনই তাঁর ঠিক সুবিধের লোক বলে মনে হয়নি। উকিলবাবুর চেম্বারে বসে একঘর লোকের সামনে সত্যরঞ্জনকে যে লোক অকর্মার ঢেঁকি বলে, গোয়েন্দাগল্পের চেয়ে ঢ্যাঁড়শভাতে যার প্রিয়, দুগ্ধবরন দারোগার সাথে হাত মিলিয়ে যিনি কালীগঞ্জের হাটে গোরুগুলোর সামনে অবধি অপমান করেন তাঁর শুধু ল্যাজ কেন শিংও থাকা উচিত।

    খুড়োই সব রহস্যের মূলে মনে হচ্ছে। এক নম্বর রহস্য হ'ল, নতুন ধরনের দেশলাই পাওয়া গেছে। তারপর ধরো গগনবাবুর চাকর গায়েব। তিন নম্বর, হরিশরাজার জঙ্গলে যখের ধন, সেখানে আবার সিংহের গুহা। আর গুহার ভেতর বসে মিচকে হাসি হেসে গোবিন্দখুড়ো আঁক কষছে। অবশ্য খুড়োর ল্যাজের কথাটাও ধরতে হবে।

    সত্যরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। এসবের সমাধান করতে পারলে হাঁসপুকুরে তাঁর সুনাম প্রতিষ্টিত হতে বাধা কোথায়? দারোগাবাবুকে তিনি তখন দেখে নেবেন। খুড়োকেও। চন্ডীমন্ডপে এখন যারা তাঁকে সামনের সারিতে বসতে দেয় না, তাঁরাও তখন তাঁকে মুখ চুন করে জায়গা ছেড়ে দেবে। চাই কি শহর থেকে কাগজওয়ালাদের আসতেই বা আটকাচ্ছে কে! তাঁকে নিয়ে ইন্টারভিউ ছাপা হবে। বাজারচকের ঠিক মধ্যিখানে তিনি দপ্তর খুলবেন। উপরে হোর্ডিং থাকবে ‘সত্যরঞ্জনের সত্যদর্শন, সঠিক দামে সেরা পরিষেবা।’

    শীত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শেয়ালের ডাক। খিড়কির পেছনে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দও ক্রমশ বাড়ছে। সত্যরঞ্জন চাকলাদার বেশ বুঝতে পারছেন গোবিন্দখুড়োর ওপর অনুসন্ধানের দরকার। কিন্তু আজ রাতে এই সময় তা হবে কী?

    গবুর জামার আস্তিন খামচে ধরে তিনি নীচু স্বরে বলতে লাগলেন, ‘শোন, এখন আমি চল্লুম। কাল রাত দুপুরে ক্লু এর খোঁজে বেরোতে হবে।’
    —‘যে আজ্ঞে, কিন্তু কোথায় যাব যদি বলেন।’
    —‘গোবিন্দখুড়োর বাড়ীতে। লুকিয়ে যেতে হবে, খুড়ো যেন টের না পায়।’
    —‘ইয়ে, অতরাতে খুড়ো যদি দরজা না খোলে?’
    —‘ইডিয়ট! ওই যাকে বলে ট্রেসপাশিং, তাই করতে হবে।’
    —‘সে আবার কী। ও ও ও বুঝেছি, সেই গতবারের মতন গোরুদের গোয়ালে—’
    —‘চুপ করবি! আর তাছাড়া তোকে অত মাথা ঘামাতে হবে না। আমি তো তোর সঙ্গে থাকব রে গর্দভ।’
    —‘বুঝেছি।’
    —‘আচ্ছা সরে পড়ছি এখন। ওভার এন্ড আউট।’
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২২:২৯691766
  • এতো জানা কথাই যে প্রতিদিন সকালে বাজার চকের মোড়ে জলবেহারীর সেলুনের দোকান সবার আগে খুলে যায়। গদাই পালোয়ানের কুস্তির আখড়ায় ভিড় জমে। লুটবেহারী তার দোকানের সামনে উনুনের উপর রাখা বিরাট বড় কালো কড়ায় ছাঁকা তেলে সিঙাড়া ছাড়ে। চৌধুরী মশাই মাছস্বপনের কাছে পোনামাছের দরদাম করেন তবে তার আগে চট করে গাজর কিনে নেন। পাশের গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা সাইকেল চালিয়ে ইস্কুলে আসে এবং হাঁসপুকুর কো অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার নবীন স্যান্যাল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে গোনাগুনতি তিনবার হোঁচট খান।

    তবে এই রোজকার ঘটনার পাশাপাশি চায়ের দোকানের গুলবাজরা লক্ষ্য করল বাজারের মাঝখানে ছোট করে শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। গুটি কয়েক চেয়ারও রাখা। অবনী ডেকরেটার্সের লোকজন, মাইক চোঙা ইত্যাদির জোগাড়যন্ত্র করছে। এবং এটাও চোখে পড়ছে যে মঞ্চের সামনে বিরাট বড় হোর্ডিং এ লেখা রয়েছে, ‘জগা পাগলা অনুসন্ধান সমিতি’। এর কারণ খুবই স্বাভাবিক। জগা পাগলাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

    বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শামিয়ানার সামনে লোকজন জড় হতে লাগল। একই সাথে ‘হাঁসপুকুর নির্বান্ধব সমিতি’, ‘হাঁসপুকুর নজরদারি সমিতি’ ও ‘হাঁসপুকুর পুকুরচুরি বন্ধ কর সমিতি’র প্রেসিডেন্ট এবং সুবিখ্যাত হাঁসপুকুর স্টেশনারির মালিক শতদল ঘোষ এসে পড়ে তদারক করা শুরু করলেন। লাল শালু দিয়ে মঞ্চ খাটানো হয়েছে। মঞ্চের উপর বেতের লাঠিতে সভাপতি লেখা একখান কাগজ সাঁটা। তার তলায় একটি তীরচিহ্ন। কবিরাজমশাই ও গোপীনাথ বর্মন মঞ্চে উঠে এক কোণে দুখানি চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। গদাই পালোয়ানের আখড়ায় ছেলেরা কুস্তি করছিল। ব্যাপার স্যাপার দেখে তারা সবাই এগিয়ে এসে মুন্ডু বার করে দেখতে লাগল।

    শতদল ঘোষ মঞ্চে উঠে তীরচিহ্নের তলায় বসে পড়লেন। চোখে মুখে আত্নপ্রসাদ ঝরে পড়ছে। রসে ডুবুডুবু অবস্থা যাকে বলে। পকেট থেকে সাদা কাগজে লেখা বক্তৃতাটা আরেকবার ঝালিয়ে নিলেন। বিশেষতঃ ঐ যেখানে মাতঙ্গিনী আর সুভাষের কথাটা বলতে হবে, সেখানে গলা একটু না কাঁপিয়ে বললে চলবে কেন? দরদর করে ঘামছেন। সাদা ফতুয়া ঘামে ভিজে গেছে।

    একটু পরে কবিরাজমশাই পেছন থেকে ঠেলা মেরে বললেন, ‘কই হে এবার শুরু কর।’

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে’। ঘোষমশাই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মাইক টেনে নিয়ে মোলায়েম সুরে বলতে লাগলেন, ‘হে আমার হাঁসপুকুরের ভাই ও বোনেরা, তোমরা কী জান আজ আমরা কিসের জন্য এখানে জমায়েত হয়েছি। আজ এই সমাবেশের হেতু হল জগা পাগলা। তার স্মৃতিতে এই হাঁস—’
    কবিরাজমশাই পেছন থেকে খাটো গলায় বললেন, ‘মরে গেছে ধরে নেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?’
    —‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই তো। যাইহোক, মোটমাট জগা পাগলই আমার বক্তব্যের বিষয়। এ ব্যাপারে বলতে হলে প্রথমে আমাদের বলতে হয় পাগল কেন দরকার। আবার হাঁসপুকুরেরই পাগল কেন দরকার। পাগল কোনো উপকারী জীব নয়। বইতে অ্যামন লেখা নেই। তাছাড়া গোরু নয় যে দুধ দেবে, পাঁঠা নয় যে মাংস হবে এমনকি বুদ্ধুও নয় যে দারোগা হবে—’
    জনতা সোৎসাহে হাততালি দিল।
    ‘হ্যাঁ যা বলছিলাম’, কপালের ঘাম মুছে শতদল ঘোষ ফের বলতে থাকলেন, ‘তাহলে পাগল থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি। ভেবে দেখুন ভাইসকল, সমাজে একটা পাগলের থাকাটা কত জরুরী দরকার আবার না থাকাটাও কত জরুরী। ইয়ে, তবে থাকার দিকটাই বেশী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কেন?’
    জনতা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
    —‘পাগল আছে বলেই তো আমরা বলি, পাগলে কী না বলে ছাগলে কী না খায়। ভেবে দেখুন এই যে কথায় কথায় আপনারা সব বলছেন পাগলের হদ্দ, পাগল না থাকলে কী আর সেই সুবিধা পেতেন। পাগলরা কোথায় নেই বলুন, সাপ, ব্যাঙ, হাতি, ঘোড়া, লুডো, সব জায়গায় ওরা আছে। তাছাড়া কত দরকারী অদরকারী পরামর্শ পাওয়া যায়। ভেবে দেখুন জগা পাগলা ছিল বলেই তো বলতে পেরেছিল, রাবনের আর্তনাদ পালায় রাবণ নাকিসুরে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদবে, নাকি ভেউ ভেউ করে মুখ ঢেকে কাঁদবে। তারপর ধরুন রসিকবিলে মাছ ধরার টোপ হিসেবে ওই তো বলেছিল কেঁচোর সাথে পিঁপড়ের ডিমের বদলে ময়দা ঠাসতে। আজ এই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার কত কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে, ও হো হো হো।’
    ফোঁত ফোঁত করে খানিক কেঁদে রুমালে মুখ মুছে শতদল ঘোষ ফের বলতে শুরু করলেন, ‘ভাইসব, আমাদের হাঁসপুকুরে জগা পাগলের মতো পাগল অবশ্যই চাই। একধাপ এগিয়ে আমি দাবী করছি, সরকার বাহাদুর যেন প্রত্যেক গ্রামে একজন করে এরকম পাগল পাঠান। আজ জগার স্মৃতিচারনায় আমার বার বার এই কথা মনে হচ্ছে যে, যে জাতি একদা মাতঙ্গিনী, সুভাষ বোসের মতন দেশপ্রেমিকদের দেখেছে, আজ জগা পাগলের জন্য সে কাতর—’
    কবিরাজমশাই শতদল ঘোষের কোঁচার খুঁটে একটু টান মেরে বললেন, ‘আহা আসল কথাটা বল না হে।’
    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো বটেই, তা তো বটেই, হয়েছে কী ভাইসকল, জগা পাগলাকে মোটেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাঁসপুকুরের সমস্ত গাব গাছ ভালো করে খুঁজে দেখা হয়েছে। সমস্ত খড়ের গাদা, নদীতে যত গাধাবোট, কালীবাড়ীর রোয়াক, ইস্কুলবাড়ী, এই বাজারচকের আনাচকানাচ, চৌধুরী মশায়ের অপেরা হাউস, হাঁসপুকুরের যত গোয়াল, হেঁসেল মায় খাটের তলা, কিছুই বাদ পড়ে নি। বিশ্বস্ত সুত্রে আমরা খবর পেয়েছি, সে নাকি হরিশরাজার জঙ্গলে সেঁধিয়েছে। হয়ত কেউ তাকে খেপিয়েছে, পাগল বলে গাল পেড়েছে, আর তাই আমাদের সাধের জগা পাগলা মনের দুঃখে শ্রীচৈতন্যের মতো দেশত্যাগ করে জঙ্গলে গেছেন। এখন তাঁর মানভঞ্জন করে তাঁকে ফিরিয়ে আনাটা আমি আমাদের আশু কর্তব্য বলে মনে করি, বিশেষতঃ তোমরা সবাই তো জানই ওই জঙ্গলে, ইয়ে কী বলে কী সব নাকি রয়েছে।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শতদল ঘোষ বসে পড়ে হাঁপাতে লাগলেন।

    তখন কবিরাজমশাই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমাদের একটা সার্চ পার্টি দরকার। কে কে ওই বনে যেতে রাজী আছো।’
    ভীড়ের মধ্যে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ‘পুলিশ কে বললেই তো হয়।’

    কবিরাজমশাই জানতেন চট করে কেউ রাজী হবে না, শান্ত গলায় বললেন, ‘দারোগা দুগ্ধবরনের সাথে আমার কথা হয়েছে, উনি যেতে রাজী হয়েছেন, তবে এও বলেছেন যে, এই সমস্ত সংস্কারমূলক কাজে জনসাধারনের উপস্থিতি ও অংশগ্রহন একান্ত কাম্য।’

    সামনের সারিতে গগনবাবু দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, ‘ওখানে যে কী সব আছে শুনি। ঐ যে কীসব যেন, গেলেই খপ করে ধরে।’

    —‘যা শুনেছ তার কিছুটা হয়তো সত্যি। আমি কিছুই লুকোব না। হয়তো প্রানের ভয়ও আছে। অপদেবতারা আছেন কি না জানি না তবে এটুকু আমি নিশ্চিত যে ওখানে অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা হয়।’

    শতদল ঘোষ ফের উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘হে আমার হাঁসপুকুরের সাহসী বীর ভাইসকল, আজ এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে দেশমাতৃকা আমাদের ডাকছে। সেই যে কে যেন বলেছিলেন, কীসব যেন ডাক দিয়েছে, আয় রে ছুটে আয়। আজ সব ছুটে ছুটে এসো, হাঁসপুকুরের পরমহংসেরা। এই অদ্ভুত অভিযানে আমি তোমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছি। এখন চট করে বলে ফেল কে কে আমাদের সঙ্গে যাবে।’

    কেউই অবশ্য হাত তুলে এগিয়ে এল না।
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২২:৪৫691767
  • ৭.

    মাঝরাতে গোবিন্দখুড়োর ঘুম ভেঙে গেল। কোথা থেকে চাপা স্বরে কাদের সব কথাবার্তা ভেসে আসছে। প্রায় ফিসফিস করে, শোনাই যায় না। চোর ছ্যাঁচোড় নাকি? খুড়ো কান খাড়া করে শুনতে লাগলেন। জিনিসপত্র নাড়াঘাঁটার টুকটাক শব্দ হচ্ছে। পায়ের খসখসানি, টেবিলের উপর বইপত্রের নাড়াচাড়া। খুড়ো পা টিপে টিপে শোওয়ার ঘরের ছিটকিনি খুলে সাবধানে দরজার ক্যাঁচকোঁচ সামলে বাইরের দালানে বেরোলেন। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চাঁদের আলোটুকু অবধি নেই। আশপাশ সব যেন ঝিম মেরে রয়েছে। দূরে হরিশরাজার জঙ্গলে বোধহয় শেয়াল ডাকল।

    সাবেক আমলের জমিদারবাড়ীতে যেমন মাঝখানে রোয়াক থাকে সেইরকম দূর্গাদালানের চারপাশে সারিসারি ঘর। একপাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে। দোতলার নকশাও একইরকম। বেশিরভাগ ঘর ই তালাবন্ধ। একতলায় বৈঠকখানা আর রান্নাঘর খালি খোলা থাকে। দোতলায় পশ্চিমদিকে খুড়োর শোওয়ার ঘর। পাশের ঘরে যতরাজ্যের পুরনো আসবাবপত্র ডাঁই করে রাখা। শৌখিন খাটপালঙ্ক চেয়ার, বইপত্র ঠাসা আলমারি, স্প্রিং দেওয়া গ্রামোফোন, আরামকেদারা, কিম্ভুত কিমাকার কিছু মূর্তি, নানারকম ডিজাইনের হুঁকো কলকে ইত্যাদি। উপেন্দ্রনারায়ণ বেঁচে থাকাকালীন ঘরখানি ব্যবহার করতেন। ইদানীং খোলাই পড়ে থাকে। আদ্যিকালের দরজা। সামান্য পাল্লা ভেজানো। কোনো তালা নেই।

    সাধারনতঃ বছরের এই সময় কেউ না কেউ তাঁর বাড়িতে চুরি করতে আসে। বেশীর ভাগই উঠতি চোর। হাত পাকানোর তালে থাকে। খুড়ো ওদের কিছু অবশ্য বলেন না। রোগা লিকলিকে হাত পা। দেখলে মায়া হয়। সারা গায়ে তেল মেখে চুপিচুপি রান্নাঘরের তলা দিয়ে সিঁধ কেটে ঢোকে। দশ ইঞ্চি পুরু দেওয়ালে সিঁধ কাটতে অবশ্য পুরো রাতটাই কাবার হয়ে যায়। এই যেমন সেদিন কালীগঞ্জের বখতিয়ারউদ্দিন অনেকক্ষন ধরে চেষ্টা করছিল। শেষে উল্টোদিক থেকে খুড়ো একটু হাত লাগাতে কাজটা তবু তাড়াতাড়ি হল। তারপর রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে একগ্লাস বেলের পানা দেওয়া শরবত আর আমসত্ত্ব খেয়ে বখতিয়ারুদ্দিন সলজ্জ হেসে বলল, ‘বয়স হয়েছে তো, তাই হাত পা আর চলে না।’

    অবশ্য সব চোরই ওরকম বুড়ো হাবড়া নয়। ছেলে ছোকরারা রীতিমতো গাছ কিংবা দেওয়াল বেয়ে ঢোকে। তাদের জন্য কুলুঙ্গিতে টিংচার আয়োডিন রাখা থাকে। বাড়ীতে ঢুকে প্রথামাফিক সবাই এটাসেটা উল্টোয়, ঘরের কোনে রাখা তেলের কুপি নিভিয়ে দেয়, সিঁড়ির দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটার পেছন দিকটা নেড়ে ঘেটে দেখে। খাটপালঙ্ক বিছানা তোষক আলমারি, মায় চালের হাঁড়ির ভেতর অবধি আঁতিপাঁতি করে সেই সব পায়রার ডিমের মতো গোলগোল মুক্তো খোঁজে। তবে পাবে কি করে। থাকলে তো? মাঝে মধ্যে ওদের সাথে খুড়োও একবার করে খুঁজে নেন। ওরা একটু বিরক্ত হয় বটে, তবে শেষমেশ হেঁসেলে গিয়ে হাঁড়ির ভেতর পান্তা আর লঙ্কা দেখে মহাখুশি হয়ে একলপ্তে সাবাড় করে দিব্যি নাক ডাকায়। তা, ওদেরই কেউ আবার এলো নাকি ? কথাবার্তার শব্দ মনে হচ্ছে পাশের ঘর থেকে আসছে।

    উপেন্দ্রনারায়ণের ঘরের দরজায় খুড়ো আড়ি পেতে শুনতে লাগলেন তাঁর সন্দেহ একেবারে ঠিক। ভেতরে কারা সব যেন রয়েছে। ঢুকল কোথা দিয়ে? বোধহয় পাশের কাঁঠাল গাছ বেয়ে এসেছে। দরজা সামান্য ফাঁক করে দেখতে পেলেন দুটো ছায়ামূর্তি নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কথাবার্তা বলছে।
    —‘শ স স স। বুঝলি একেবারে সঠিক জায়গায় হানা দিয়েছি।’
    —‘আজ্ঞে, কি করে বুঝলেন?’
    —‘ঐ মূর্তিটা দেখছিস, কিংবা ঐ যে কাঠের টেবিলটা। কত পুরোনো। আমি বেশ রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।’
    —‘কিরকম, কিরকম?’
    —‘আহ। এই তো দেখ না, ঐ যে বইয়ের আলমারির ভেতর কালো নস্যির কৌটো। বুঝতে পারছিস!’
    —‘আজ্ঞে, এখনো তো ঠিক বুঝছি না মনে হচ্ছে।’
    —‘ওরে পাগলা, বইয়ের আলমারিতে নস্যির কৌটো থাকবে কেন?’
    —‘কেন?’
    —‘ওটা হচ্ছে একটা ক্লু। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওটার পিছনে ঐ যে কিসব অদ্ভুত ভাষায় লেখা বইটা আছে, ওটা সরালেই কোন গুপ্ত দরজার খোঁজ পাওয়া যাবে।’
    —‘বলেন কী! গুপ্ত দরজা! কেন কেন গুপ্ত দরজা কেন?’
    —‘আহা দেখিস না, বড় বড় গোয়েন্দারা ওরকম নস্যির কৌটো দেখেই তো সব টের পায়। আর তাছাড়া এরকম পুরোনো বাড়িতে গুপ্ত দরজা থাকে। হয়তো দেখবি ওর ভেতরে কোন ধনরত্ন আছে।’
    —‘আজ্ঞে সেটা কি করে বুঝলেন?’
    —‘হুঁ হুঁ বাবা, চালাকি নয়, ঐ দ্যাখ বাঁদিকের দেওয়ালে কতদিনের পুরোনো ঝুলকালি মাখা সব পোট্রেট ঝুলছে। একেবারে বাঁদিকের প্রথম ছবিতে জমকালো কাপড় চোপড় পরা লোকটার চোখ কোনদিকে ইশারা করছে দেখছিস? ওই ইশারা মিলিয়ে দেখলে দেখবি ডানদিকের ছবিটাতে রানীমার কোলে যে বেড়ালটা আছে ওটার গায়ের রঙ কালো। এসবই হল গিয়ে গুপ্তধনের নিশান।’
    —‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও নিশেন পেয়েছি। ওই যে কালো ল্যাজওলা মূর্তিটা, ওর হাতের বর্শাটার গায়ে গোল গোল দাগ। তারপর ওই গোল শ্বেতপাথরের টেবিলের উপর কাগজ কলম দোয়াত রাখা, আর সেইসঙ্গে দুপাটি চটি, তারপর ধরুন—’
    —‘দ্যুৎ! থামবি? গুপ্তধনের আসল ক্লু পাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। ক্লু গুলো বিশ্লেষণ করতে হবে না? প্রথমে দেখতে হবে মূর্তিটার হাতে বর্শা কেন? তারপর দেখতে হবে বর্শার গায়ে কেন গোল গোল দাগ। সেসবের হদিস পেলে তবেই না দোয়াত কলম কাগজ ওইসব হিসেবের মধ্যে আসবে। তবে লক্ষ্য করেছিস কি ছবিতে রানীমা যে টেবিলের সামনে বসে আছেন সেটা অবিকল এই টেবিলটার মত।’
    —‘তা তো বটেই। এ তো পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। তাছাড়া রানীমার টেবিলেও তো এই রকমই কাগজ কলম দোয়াত রাখা আছে বলে মনে হচ্ছে।’
    —‘বটে বটে! আলোটা একটু ধর দেখি।’
    একজন হাতের কালো কাগজ মোড়া লন্ঠনটা একটু তুলে ধরল। অন্যজন সেই আবছা আলোয় দেওয়ালের ছবিটা নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করতে লাগল। দুজনেরই আপাদমস্তক কালো র‍্যাপার ঢাকা, মায় মুখ অবধি। তবে এ তো পরিস্কার বোঝাই যাচ্ছে একজন একটু মাঝারি লম্বা, মোটা হোঁৎকা গোঁফওলা, কুতকুতে চোখ, হাতে হামানদিস্তা মতো কিছু একটা ধরা। আরেকজন একটু বেঁটে, রোগা শিড়িঙ্গে মার্কা, বড় বড় চোখ, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। দরজার ফাঁক দিয়ে জুলজুল চোখে খুড়ো দেখতে পেলেন হোঁৎকাটা তাঁর সাধের বেতের চেয়ারের উপর চটিসুদ্ধু উঠে দঁড়িয়ে লন্ঠনটা তুলে দেওয়ালে রানীমার ছবিটার দিকে হাঁ করে চেয়ে কিসব দেখছে। অন্যজন ওর সাগরেদ বোধহয়, জামার পকেট থেকে একতাড়া কাগজ লন্ঠনের মৃদু আলোয় পড়বার চেষ্টা করছে। কাগজে আবার কি সব লেখা, সিংহ, কাঁকড়া, ডোনেশান, ঘন্টা। ইশ্‌, কীসব বানান ভুল! খুড়ো বেশ বিরক্ত হলেন।

    এদিকে হোঁৎকাটা চেয়ার থেকে নেমেছে। পা টিপে টিপে সাবধানে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে টেবিলের দিকে এগোচ্ছে। ওর নজর টেবিলের উপর কাগজটার দিকে। খুড়োর আসোয়াস্তি হল। ঘরে তো কেউ নেই বাপু, সোজা গিয়ে টেবিল থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে পড়লেই তো হয়। অত নিয়ম কানুন মেনে কি হবে।
    —‘আলোটা এদিকে নিয়ে আয়।’
    —‘আজ্ঞে কিছু পেলেন নাকি?’
    —‘দেখেছিস! টেবিলের উপর হলদেটে কাগজে কিসব নকশা আঁকা। ছবিতে রানীমার টেবিলের উপরে রাখা কাগজেও একই নকশা দেখলাম!’
    —‘বলেন কি?’
    —‘এ নির্ঘাৎ গুপ্তধনের নকশা না হয়ে যায় না।’
    —‘আজ্ঞে তা তো বটেই। কাগজের উপরেই তো লেখা আছে।’
    —‘দ্যুৎ, ওটা একটা কৌশল, লোককে ধোঁকা দেওয়ার জন্য।’
    —‘কৌশল! সেটা কিরকম, ও ও সেই যেবার আপনি কৌশল করে গোয়ালে—’
    —‘আবার ওইসব কথা! তোকে কতবার বারণ করেছি না? যাক গে, নকশাটা ভালো করে দেখতে দে।’

    অপেক্ষাকৃত মোটা লোকটা টেবিল থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে লন্ঠনের আলোয় ধরে দেখতে লাগল। পকেট থেকে একটা আতস কাঁচ আর নোটবই বার করেছে। প্রথমে কাগজের পেছন দিকটা ভালো করে দেখে নোটবই তে কিসব আঁকিবুকি কাটতে লাগল। তারপর কাগজটাকে খুব কসরত করে উলটে পালটে নানান কায়দা করে দেখে, কিসব ভেবে আবার নোটবই খুলে লিখতে লাগল। খুড়ো ভালো করে নজর করে দেখলেন নোটবইয়ের বাঁদিকের পাতায় লেখা আছে ‘পর্যবেক্ষণ’, ডানদিকের পাতার উপরের দিকে কালো কালিতে লেখা ‘ফলাফল’। হোঁৎকাটা তার নিচে লিখল ‘গুপ্তধনের নকশা হইলেও হইতে পারে’। উঃ, বলিহারী বুদ্ধি এদের! নকশা হইলেও হইতে পারে! আরে ওটা আলবাত গুপ্তধনের নকশা। সেই কবে বাপ পিতেমোর আমল থেকে খুড়ো দেখে আসছেন। পরিস্কার সমস্ত কিছুর হদিস দেওয়া। হলদেটে তুলট কাগজের চারধারে নানারকম নকশি করা কাজ। মাঝখানে নীল রঙে একটা বড় করে গোল বৃত্ত। পাশে ব্যাঁকাটেরা হাতে লেখা হরিশরাজার জঙ্গল। বৃত্তের মাঝখানে আবার একটা গোল। এবার লাল রঙে। তার পাশে একটা ঘন্টার ছবি। ওই গোলের মাঝখানে আবার একটা চৌকো। পাশে লেখা পাথরগুহা। আর চৌকোর মাঝখানে বড় বড় করে ঢেঁড়া কেটে লেখা সাবধান। একদম সহজ সরল নকশা। যথাযথ দিক নির্দেশ অবধি দেওয়া আছে। গুটিগুটি গিয়ে খপ করে বাগিয়ে নিলেই হয় আর কি।

    মোটা লোকটা নকশাটা নোটবইয়ের ভেতর ভাঁজ করে ঢুকিয়ে বইটা ট্যাঁকে গুঁজে গম্ভীর মুখে বলল, ‘হুম।’ তারপর চেয়ারে বসে আরাম করে ঠ্যাং দুটো রেখে সাগরেদের দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল, ‘বুঝেছি।’
    অন্যজন এতক্ষন রানীমার ছবিটা হাঁ করে দেখছিল, কথাটা শুনে খাড়া হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে, কি বুঝলেন?’
    —‘আচ্ছা বল তো, এই যদি গুপ্তধনের নকশা হবে তাহলে এটা এখানে এমনভাবে রাখা থাকবে কেন?’
    —‘তাই তো, কেন?’
    —‘এটা মোটেও গুপ্তধনের নকশা নয়।’
    —‘নয়!’

    মোটা লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরময় পায়চারি করে বলল, ‘গুপ্তধন কি হেলাফেলার করার মতো জিনিস নাকি যে তার সংকেত এমন ছাপোষা হবে। একটাও ধাঁধাঁ নেই। কোন কিছু সাঁটে বলা নেই। এযেন আমাদের গঞ্জের হাটের মুদিখানার দোকানের হালহদিস, ‘শিবু ময়রার দোকানের পাশে বাঁদিকে’। তারপর ধর গুপ্তধনটাই বা কী সেটাও তো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হয়ত খুঁজে পেতে গিয়ে দেখলি কতগুলো বনমুরগী চরে বেরাচ্ছে।’
    —‘বুঝেছি। সেই সেবার যেমন বিন্তীপিসীর ভাঁড়ার ঘরে—’
    —‘আবার!’ মোটাটা তো মহা খাপ্পা। প্রায় দুঘা দেয় আর কী। সুঁটকেটা দুহাত পিছিয়ে এসে বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা আর বলবনা। কিন্তু তাহলে এটা কী?’
    —‘সহজ উত্তর। এটা স্রেফ একটা ধাপ্পা।’
    —‘তাই বুঝি!’
    —‘ঠিক তাই। আমার মনে হয় কেউ আমাদের বোকা বানাতে চাইছে। ওইসব গুপ্তধন বলে কিস্যু নেই।’
    —‘কিন্তু তাহলে ওই ছবিটাতেও অমন হুবহু নকশার মানে কি?’
    —‘নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আরো ক্লু দরকার। তবে ওটাও হয়ত ধাপ্পা।’

    খুড়ো আর থাকতে না পেরে দড়াম করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বললেন, ‘কি ধাপ্পাটা কি শুনি? ওটা যাকে বলে দস্তুরমতো গুপ্তধনের ম্যাপ। একেবারে বর্ণে বর্ণে সত্যি। গিয়ে একবার চাক্ষুস করেই এস না। গোনাগুনতি হাজার খানেকের কিছু বেশী মোহর আছে। এই এত বড় বড়। আবার ন্যাকা সেজে বলিস না যেন জানলুম কি করে। আমার হকের ধন বুঝলি। নকশায় সমস্ত বলে দেওয়া আছে দেখছিস না। নিবি নাকি? আদ্ধেক তোদের আদ্ধেক আমার। খালি আমার একটা উপগার করে দে বাপ। ওই পাথরগুহার ভেতর একখান বালিঘড়ি আছে। ওটা শুধু একবারটি—’

    লোকদুটো এতক্ষন হাঁ করে গোবিন্দখুড়োর দিকে চেয়েছিল। যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। হঠাৎ ‘বাবাগো’ বলে ডাক ছেড়ে এ ওর পা মাড়িয়ে চেয়ার টেবিল উলটে ফেলে ফুলদানী ভেঙ্গে দুদ্দাড় করে দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।

    খুড়োও পেছন পেছন ছুটে বেরিয়ে এসে বলতে লাগলেন, ‘এত পালানোর কি আছে এ্যাঁ! না হয় রাতবিরেতে গেরস্থবাড়িতে হানা দিয়েছিস, তাবলে অত লজ্জা পাবার কি আছে? দুটো কথা কইবার যো নেই। কি আক্কেল সব তোদের! না হয় ভাগ-বাঁটোয়ারা পছন্দ হয় নি তা বলে একটুও দর কষাকষির জায়গা দিবি না। চোর হয়ে এত গুমোর কিসের তোদের? আরে শোন শোন—’

    লোকদুটো ততক্ষনে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে সদর দরজার দিকে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় লাগিয়েছে।
    খুড়ো দোতলার বারান্দার রেলিং ধরে চীৎকার করতে লাগলেন, ‘ওরে হতভাগারা, সদর দরজায় তালা দেওয়া। এই মাঝরাতে আমাকে দিয়ে চাবি খোঁজাবিনা বলে দিলুম। আর লজ্জা করে না তোদের হাতে সিঁদকাঠি নিয়ে বাড়ীর সদরদরজা খুলে বেরোতে। তোরা চোর না নবাবপুত্তুর!’

    লোকদুটো সদরদরজায় অনেক ধাক্কাধাক্কি করার পর হতাশহয়ে উপরপানে খুড়োর দিকে তাকাল। পরক্ষনেই আঁতকে উঠে হুড়মুড়িয়ে উঠোনের এককোনে রাখা বড় ঘরাঞ্চি বেয়ে পাশের গোয়ালঘরের ছাদে উঠে পুঁইমাচা লন্ডভন্ড করে ছুটে পালাল।

    খুড়ো তখনও চেঁচাচ্ছেন, ‘ওরে পাষন্ডের দল, বলি মানুষ না গোভূত তোরা! কি খারাপ বলেছি বল? নিজের সাধ্যে কুলোবে না, তাই না তোদের বলা! কি জন্য এত হুটোপাটি শুনি? তোদের ইউনিয়নে চাঁদা দিই না আমি।’
    লোকদুটো অবশ্য ততক্ষনে পগার পার। অবশ্য ওরকম হাঁচোড় পাঁচোড় করে পালানোর কারনটাও জলের মতো স্পষ্ট।

    ওই ঘুটঘুটে অন্ধকারে খুড়োর মাথা জুড়ে সবুজ রঙের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছিল যে।
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২৩:০০691768
  • ৮.

    সকাল হতে না হতেই সৌদামিনী চীৎকার করতে শুরু করলেন, ‘আমি কিছু বুঝি না, না! অ্যাঁ, কোথায় যাওয়া হয় রাতবিরেতে! মাগো মা, পেটে পেটে এত। বিয়ের সময় ওরা বলল, ঠাকুরঝি তোমার কত ভাগ্য, আমাদের বড়দা একেবারে সুপুত্তুর। কী পোড়াকপাল আমার! ছি ছি, রাতের বেলা কোনো ভদ্দরলোকে চোর সেজে বেরোয়? আবার লন্ঠনটাকেও কোন চুলোর দোরে ফেলে এসেছে। আমি এসব সইব না এই বলে দিলুম। রাতের বেলা বুদ্যোদেবের মতো চুপিসাড়ে গৃহত্যাগ করবে আবার রাত না ফুরোতেই কোথা থেকে হুড়মুড়িয়ে ডাকাতের মতো ঘরে সেঁধোবে, এসব হচ্ছে কী শুনি। ও মা গো, ভেবে ভয়েই তো আমার পেট গুড়গুড়। অ্যাই ভালো চাও তো ঝেড়ে কাশো, নইলে এই আমি হাটের মাঝে হাঁড়ি ভাঙলুম।’

    সত্যরঞ্জন প্রবল মুখঝামটার মুখেও বালিশ আঁকড়ে ধরে বিছানায় পড়ে রইলেন। গত রাতে যা ঘটেছে তার তুলনায় এসব তো শিশু। লন্ঠনটা ফেলে এসেছেন। ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়তে গিয়ে দুপাটি চটি কোথায় গায়েব হয়েছে। থলথলে শরীরে আমন আচমকা দৌড়ঝাঁপ পোষায় নাকি! বাড়ি আসা ইস্তক বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছেন। ঐ ভৌতিক দৃশ্য মনে পড়লেই প্রায় মুচ্ছো যাবার মতো অবস্থা। প্রাণে বেঁচেছেন এই ঢের। ভাগ্যিস গবু ছিল, নাহলে ওইখানেই দেহত্যাগ করতে হত আর কী।

    এদিকে সৌদামিনী বলে চলেছেন, ‘আমি আজই পিসেমশাই কে খবর পাঠাচ্ছি। পিসেমশাই আসুক, আমি বলবখন গতবছর কে ঘোষেদের গোয়ালে ছাতা নিয়ে ঢুকেছিল। আমি নিজেই জজকোটে সাক্ষী দেব। আমি সব্বাইকে বলব যে গেলবার ধান তোলার সময় বিন্তীপিসীর হাতবাক্স কেন ভাঙ্গা ছিল। পিসেমশাই এর সাধের আলোয়ান কেন হাট থেকে চুরি যায় আর সেটা কে গায়ে দিয়ে শোয়—’

    সত্যরঞ্জন উশখুশ করতে লাগলেন। এইজন্যেই মেয়েদের বিশ্বাস করতে নেই। ওদের পেটে একটুও কথা থাকে না। অমন সাংঘাতিক গায়ে কাঁটা দেওয়া ঘটনার পর কোথায় যে একটু ধাতস্থ হবেন তার যো নেই।
    —‘আর পাশের ঘরের ঐ হতভাগা পড়াশোনায় গোমুখ্যু, এদিকে খাওয়া দাওয়ার শেষ নেই। বলদও নয় যে হাটে বেচব। সারাদিন দুজনে মিলে খালি গুজগুজ আর ফুসফুস। আমি এই বলে দিলুম—’

    সত্যরঞ্জন বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। চুড়ান্ত অপমানিত। শেষে কিনা পিসেমশাইয়ের ভয় দেখাচ্ছে। ওরকম জাঁদরেল উকিল সত্যরঞ্জন ঢের দেখেছেন। ভারী তো। গত রাতের অমন অশৈলী কান্ডের সামনে পড়লে নির্ঘাত দাঁত ছরকুটে পড়ে থাকত। সত্যরঞ্জন তো তার উপর অলিম্পিক রানার কে হারিয়ে দেবার মতো দৌড়েছেন। কী সাংঘাতিক দৌড় রে বাবা। দৌড়ের এমনই বহর যে বাড়ী চলে আসার পরও হাত পা থামতে চাইছিল না। নেহাত গোয়েন্দাসুলভ মন্ত্রগুপ্তি আছে তাই, নইলে এক্ষুনি সমস্ত কিছু ফাঁস করে দিলেই হয়। কোথায় একটু সেবা যত্ন আহা উহু করবে তা নয় কেবল পিসেমশায়ের হুড়ো দিচ্ছে। দুত্তোর!

    সত্যরঞ্জন কাপড় জামা গায়ে চড়িয়ে পাম্পশু পরে পাশের ঘরে গিয়ে ঠক ঠক করে তিনবার কড়া নাড়লেন। গবু জেগেই ছিল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
    —‘শোন, এ সংসার আর আমার জন্যে নয়। আমি গৃহত্যাগ করছি।’

    এরকম প্রায়শই হয়। নতুন কিছু নয়। মাঝে মধ্যেই সত্যরঞ্জন প্রতিজ্ঞা করে গৃহত্যাগ করেন। পরের ঘটনাসমূহও বেশ নিয়মমাফিক। প্রথমে কালীগঞ্জের হাট অবধি পদব্রজে বীরদর্পে আগমন ও শিবু ময়রার দোকানে জলযোগ জনিত সাময়িক বিরতি। অনুপান হিসেবে চা। পথিমধ্যে নানান অপোগন্ডের দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ। এরপর ধীরেসুস্থে রেলস্টেশন অভিমুখে উদাস মনে যাত্রা। যাত্রা অন্তে গলদ্ঘর্ম হয়ে স্টেশনে আগমন ও বেঞ্চে বসে তাঁর অবর্তমানে সৌদামিনীর কষ্ট বোধ করে পুলকিত হওন। পকেট গড়ের মাঠ হওয়া ইস্তক বাদাম ভাজা ভক্ষন ও নিজের অবস্থা সমন্ধে চিন্তা। শেষমেষ সন্ধ্যার মেলট্রেন আসা মাত্র ক্ষুধায় ব্যাকুল হয়ে কাঁচুমাঁচু মুখে গৃহে প্রত্যাগমন। প্রতিবারই পুরো পরিক্রমায় গবু সাথে সাথে থাকে। তাই এবারও দ্বিরুক্তি না সে অনুগত ভক্তের মতো জামাজুতো পড়ে সত্যরঞ্জনের সঙ্গ নিল।

    মৃদু হিমেল হাওয়া বইছে। নরম রোদ। বাইরে হাল্কা কুয়াশা। চবুতরা পেরনোর সময় গবু দেখল বনমালী বাবুর ছাগলটা সৌদামিনীর সদ্য কলম করা কৃষ্ণকলি গাছের পাতা চিবুচ্ছে। রাস্তা দিয়ে খেতমজুরদের দল হাল বলদ নিয়ে চাষ করতে চলল। আশেপাশের গাছপালা থেকে টুপটাপ শুকনো পাতা উড়ে আসছে। শীত এল বলে।

    গতরাতে তার ভালো করে ঘুম হয়নি। হবেই বা কী করে। এমনভাবে ভূত দেখতে হবে কে জানত। আর কী সব অনাসৃষ্টি কান্ড বাবা। দিনের বেলাতে সব কেমন দিব্যি দেহ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখে একটুও বোঝার উপায় নেই। রাতে আবার তেড়ে মেরে দাঁত খিচুচ্ছে। এরকম আরো কত আছে কে জানে। তবে ছোটবেলা থেকে যত ভুতের গল্প পড়া তার সাথে এটা একটুও মিলছে না। দুনিয়ার তামাম অপদেবতাদের তো কুলোর মত কান আর মুলোর মত দাঁত। কারোর তো সবুজ রঙ্গের মাথা আছে বলে শোনেনি। তবে কলিকালে কত কিছুই না হয়। এখনতো মনে হচ্ছে পাশের গ্রামের মোড়লমশাইয়ের ছোটছেলেটাও বোধহয় ভূত। ওর কান দুটো যেন কেমন খাড়া খাড়া। তারপর জলবেহারী, মন্মথ, পাকড়াশীবাবুর বৌ এদের সবারই তো মনে হচ্ছে ল্যাজ আছে। পুরোহিতমশাইয়ের নাতিটার দাঁতগুলোও যেন কেমন। তার নিজের তো চোখ দুটোও তো ভাঁটার মতো। এমনকি এখনতো সন্দেহ হচ্ছে ঘোষেদের গরুগুলো অবধি যেন—

    গবু নানারকম কথা ভাবতে ভাবতে চলছিল। সত্যরঞ্জনবাবু একটু তফাতে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছেন। বড়রাস্তায় কালীমন্দিরের সামনে পৌঁছে গবু লক্ষ্য করল সত্যরঞ্জন বাজারের দিকে না গিয়ে উলটো দিকের মেঠো রাস্তা ধরলেন। গবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, ‘ইয়ে রাস্তাটা একটু ভুল হয়ে যাচ্ছে নাকি?’
    —‘একদম না।’
    —‘কিন্তু বাজারচক, কালীগঞ্জের হাট, রেলস্টেশন সবই তো অন্যদিকে।’
    —‘আমরা ওসব জায়গায় যাচ্ছি না।’
    গবু একটু অবাক হয়ে বলল, ‘তাহলে আমরা যাচ্ছি কোথায়?’
    ট্যাঁক থেকে নোটবইটা বের করে সত্যরঞ্জন ভুরু নাচিয়ে বললেন, ‘আমরা যাচ্ছি হরিশরাজার জঙ্গলে। সোজা গুপ্তধন উদ্ধার করে হাজির হব, বুঝলি! এ হল যাকে বলে হৃতসম্মান পুনরুদ্ধার। আমাকে কিনা পিসেমশাইয়ের ভয় দেখায়।’
    —‘আজ্ঞে গুপ্তধন যে আছেই, সেটা বুঝছেন কী করে?’
    —‘আরে আছে রে আছে। বড় বড় জমিদারবাড়ীতে অমন একটু আধটু থাকে। দেখিস না গোয়েন্দারা কেমন ক্লু খুঁজে বার করে সেসব উদ্ধার করে। তাছাড়া রাজা বাদশাদের অমন শখ আহ্লাদ থাকত। গল্পে পড়িস নি কতকালের পুরোনো পায়রার ডিমের মতো সাদাসাদা গোলগোল হীরে মুক্তো যা কিনা শোবার ঘরের লোহার সিন্দুকে রাখলেই ল্যাঠা চুকে যায়, তা কিনা কত ভেবে চিন্তে মাটির নীচে চোরকুঠুরির ভেতর ওরা লুকিয়ে রাখে। আবার জামাই-ঠকানো ছড়া কেটে সেসবের হদিস বাতলানো থাকে। অমন সুন্দর হরিশরাজার বন লুকোনোর জায়গা হিসেবে খারাপ কি তা তুই বল। আমি, ইয়ে কি বলে, বেশ গুপ্তধনের গন্ধ পাচ্ছি বুঝলি।’

    গবু একটু চিন্তিত মুখে বলল, ‘আরো লোকলস্কর নিয়ে গেলে হত না। তাছাড়া গতকাল অমন তেনাদের দেখা পাওয়ার পর—’
    —‘হ্যাং ইয়োর ভূত এটসেটরা। কাউকে বলার দরকার নেই। জানতে পারলেই সব ভাগ বসাতে আসবে। খবরদার বলে দিচ্ছি কাউকে কিন্তু কিছু বলবি না।’
    —‘যে আজ্ঞে।’
    —‘ভাগ্যিস কাল রাতে নকশাটা নোটবইতে হাতসাফাই করেছিলুম। না হলে নেহাত আপশোস করতে হত। আচ্ছা তোর কি মনে হয় ওটা কি ছিল? ব্রহ্মদত্যি?’
    গবু মাথা চুলকে বলল, ‘আজ্ঞে, তা হয়তো হবে। খুড়ো তো বামুন। কিন্তু ব্রহ্মদত্যির অমন সবুজ রঙা মুন্ডু হয় নাকি?’
    —‘তাও বটে। যাক গে। কালকের ঘটনার পর আমি নিশ্চিত যে হরিশরাজার জঙ্গলে কিছু একটা আছে। সে রহস্য আমিই উদ্ধার করব। গোটা হাঁসপুকুরে, বুঝলি একেবারে হৈ চৈ পড়ে যাবে। তারপর ঐ পিসে আর তার ভাইঝিকে দেখে নেব।’
    —‘আজ্ঞে একশবার। তবে আরো লোকজন জুটিয়ে গেলে হত না? নিতান্তই দেহত্যাগ করতে হলে কেউ তবু খবর পেত।’
    সত্যরঞ্জন গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দেখ এসব আনাড়িদের কর্ম নয়। অত্যন্ত চৌকশ না হলে মুশকিল। আর আমি একেবারে নিশ্চিত যে গোটা হাঁসপুকুর জুড়ে আমার মত এক্সপার্ট আর কেউ নেই। তাছাড়া দিনমানে রওনা দিচ্ছি। ভয়ের কিছু নেই। আর শুনিসনি কাল ভূতটা পরিস্কার বলল হাজার খানেক সোনার মোহর আছে। সেসব দুজনে মিলে বমাল সমেত নিয়ে ফিরলে গঞ্জে কেমন খাতির হবে বুঝেছিস?’
    —‘আজ্ঞে সে সব তো সবই বুঝলাম, কিন্তু ভূতপ্রেতের কথায় আমল দেওয়া কি উচিত হচ্ছে?’
    —‘ইস, আমল দেব না তো কি। জানিস ওরা ত্রিকালদর্শী হয়। ওদের মিথ্যে বলা বারন। কি সব নিয়মকানুন আছে। বড় বড় গোয়েন্দারা রহস্যের কিনারা করতে ওঁদের হেল্প নেয় তা জানিস। এখন তো আমার এমনও মনে হচ্ছে যে ভূতটা নেহাত আমাকে চিনতে পেরেই ওরকম সাঁটে হদিশ বলেছে।’
    —‘আজ্ঞে, তাই হবে বোধহয়।’
    —‘আলবাত। নে এখন তাড়াতাড়ি পা চালা। কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগেই সরে পড়ি।’

    দুজনে মিলে শিশিরে ভেজা মেঠো পথ ধরে দ্রুত চলতে লাগলেন। আস্তে আস্তে বেলা বাড়ছে। দূরে ধানক্ষেতের উপর দুধের সরের মতো জমে থাকা কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফটিকদের বাঁশবনের ভেতর থেকে রাতপাখি ডেকে উঠল।

    বুনো আগাছার ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ধড়িবাজ বিশু ওদের চলে যাওয়া নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করল। ঐ মেঠোপথ খেত ছাড়িয়ে রসিকবিলের পাশ দিয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয় তা সে বিলক্ষণ জানে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর সে পড়ি কি মরি করে দৌড় দিল চন্ডীমন্ডপের দিকে।
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২৩:১১691769
  • হরিশরাজার জঙ্গল বেশ ঘন। হরেক রকমের ফল-পাকুড়ের গাছ, বড় বড় গুঁড়িওলা বট গাছ, অ্যাশশ্যাওড়া, অশ্বথ্থ, শাল ইত্যাদিতে ভর্তি। বনের ভেতর দিনের বেলা সূর্যেয়র আলো প্রায় পড়েই না। তাই ভরদুপুরেও চারিদিক আধো অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকে। জঙ্গলের ভেতর মাঝেমাঝে কিছু নিচুমতন জলা রয়েছে। ছোটখাটো বন্যজন্তুরা সেখানে জল খেতে আসে। ব্রিটিশ আমলে বনের ভেতর একটা বাংলো মতন তৈরী হয়েছিল। লোক যাতায়াত করত। সায়েবরা পাততাড়ি গোটানোর পর বাড়িটা কবে আগাছায় ঢাকা পড়ে গেছে। ছোটখাটো শুঁড়িপথ বেয়ে বনের ভেতর বেশ খানিকটা যাওয়া যায়, তারপর কাঁটাঝোপ আর বুনোলতাপাতার ঠাসবুনোট ভেদ করে আরও এগোনো মুশকিল। জঙ্গলের উত্তর দিকের প্রান্ত বেয়ে নদী বয়ে গেছে। অবশ্য বর্ষাকাল ছাড়া আর অন্য কোনো সময় জল থাকে না।

    জঙ্গলের সামনে এসে একটা শিরীষ গাছের তলায় সত্যরঞ্জন বসে পড়লেন। গবুও তাঁর পাশে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল। চারিদিক ভীষন নিঝঝুম, খালি ঝিরঝিরে হাওয়ায় গাছের পাতায় সরসরানি আওয়াজ আর বনের ভেতর থেকে একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। রোদ বেশ বেড়েছে যদিও বনের ভেতরে তা বুঝবার উপায় নেই। আড়চোখে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে গবুর গা শিরশির করে উঠল, কী ভয়ংকর সব ঘাপটি মেরে আছে কে জানে?

    সত্যরঞ্জন নোটবইয়ের ভেতর থেকে নকশাটা বার করলেন। খানিকক্ষন ভালো করে দেখে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ব্যাপারখানা যত সহজ ভেবেছিলাম ততটা নয় বলেই মনে হচ্ছে।’
    —‘কেন কেন?’
    —‘তুই যে বলেছিলি বনের ভেতর নাকি সিংহের গুহা আছে, ওর ভেতরেই নাকি সব হীরে মানিক, খুড়ো নাকি সেখানে বসে আঁক কষে, কই সেসবের তো কিছু হদিস নেই।’
    —‘আজ্ঞে, তাই তো শুনেছিলুম।’
    —‘ভুল শুনেছিলি। সব্বাই জানে হরিশরাজার জঙ্গলে বাগ-সিংগি ওসব কিছু নেই। সিংহের গুহা নয় রে বোকা ওটা পাথরগুহা হবে। বনের একদম ভেতরে, এই যে দ্যাখ নকশায় হদিস দেওয়া আছে। ওর ভেতরেই মনে হয় সব আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অন্য জায়গায়।’
    গবু নকশাটার উপর একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘আবার কী?’
    সত্যরঞ্জন নকশাটার দিকে চেয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘যাওয়ার রাস্তা আর ফেরবার রাস্তাটা একনয় কেন বলত? আটকাচ্ছে কিসে? তাছাড়া ফেরবার রাস্তায় অমন অদ্ভুত গোল্লা পাকানো কেন?’
    —‘তাই তো!’
    খানিকক্ষন ভাবার পর মাথামুন্ডু কিছু না পেয়ে সত্যরঞ্জন নকশাটা গুটিয়ে নিয়ে বললেন, ‘চল যাওয়া যাক, যা থাকে কপালে।’

    দুজনে মিলে বনের ভিতরে ঢুকলেন। অপ্রশস্ত বনপথ ধরে পাশাপাশি দুজনে মিলে হাঁটা যায় না। আগুপেছু করে হাঁটতে হয়। বিশাল বড় উঁচু উঁচু সব গাছ। তার লতাপাতা ডালপালায় আকাশ প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। মানুষ সমান উঁচু বুনো ঝোপ। কিছু একটা ভাবে ওরই মধ্যে কোনরকমে হাঁটার মতন পথ তৈরী হয়েছে। দুজনে মিলে সন্তর্পণে এগুতে লাগলেন।

    নকশায় একটা বেশ চওড়া খালের উল্লেখ আছে। সুর্মাখাল। আগে হয়তো নদীর সাথে যোগ ছিল। এতবছর পরে শুকিয়ে হয়ত হেজে মজে গেছে। আগে ঐটি খুঁজে বার করতে হবে।

    গবু একটা বড়সড় পেয়ারা গাছের ডাল ভেঙ্গে সপাত সপাত করে দুধারের ডালপালা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগোতে লাগল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাখিদের কিচিরমিচির বেড়েছে। বনের ভেতর প্রচুর টিয়াপাখি। এত টিয়াপাখি কেন রে বাবা? বেশ কিছু বাঁদর গাছের ডাল বেয়ে লাফালাফি করছে। ওদেরকে চোখ গোলগোল করে দেখতে লাগল। গবু দেখল একরকম গাছের বেশ মোটা গুঁড়ি, তবে তার গায়ে কেমন সব খোঁচা খোঁচা কাঁটা দেওয়া। তবে কাঠবেড়ালীরা সেসবের উপর দিয়েই দিব্যি যাতায়াত করছে। বন যেখানে একটু কম ঘন সেখানে প্রচুর বুনো অর্কিড ছড়িয়ে আছে। বেশ কিছু ঝোপের ভেতর কেমন সব জ্বলজ্বলে চোখ। খরগোশ না সজারু কে জানে?
    সত্যরঞ্জন মাঝে মাঝে নকশায় চোখ রাখছিলেন। সে জন্য দুতিনবার বুনো লতাপাতায় পা জড়িয়ে আছাড় খেয়েছেন। পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। কোনরকমে সামলে সুমলে চলছেন।

    ঘন্টাখানেক চলার পর গাছের ফাঁক দিয়ে একটা নালা মতন চোখে পড়ল। সেই সঙ্গে মৃদু ঝরনার কুলুকুলু শব্দ। সত্যরঞ্জন তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে দেখলেন নালাই বটে। ছোটবড় অসংখ্য নুড়িপাথরের উপর দিয়ে জলের মৃদু স্রোত। পা দিলে গোড়ালি অবধি ডুবে যায়। দুপাশের সারিসারি গাছের মাঝখান দিয়ে নালাটা এঁকেবেঁকে গেছে। নালার ধারের ভিজে মাটিতে জন্তু জানোয়ারের ছোট ছোট পায়ের ছাপ। শেয়াল জাতীয় কিছু বোধহয় রাত্রে জল খেতে আসে। স্বচ্ছ জল। দুজনে মিলে আঁজলা ভরে খানিক জল খেলেন। দূরে জলের স্রোতের ওপর আলো পড়ে চিকচিক করছে।
    —‘এই কি তবে সেই সুর্মাখাল?’
    —‘হবে হয়তো।’
    ‘তাহলে নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের স্রোতের দিক বরাবর হাঁটতে হবে, সামনে গেলে নালাটার দুভাগে ভাগ হবার কথা’, সত্যরঞ্জন কোঁচার খুঁট দিয়ে মুখ মুছলেন।
    —‘কোন রাস্তা দিয়ে এলাম তা মনে রেখেছিস?’
    —‘আজ্ঞে খুব একটা জটিল নয়। মনে হয় চিনতে পারব।’
    —‘তবু সাবধানের মার নেই, কিছু একটা চিহ্ন দিতে দিতে এগোতে হবে।’
    —‘যে আজ্ঞে।’
    দুজনে মিলে ফের নালার পাশ দিয়ে সতর্কভাবে এগোতে লাগলেন। গবু মাঝে মাঝে দুহাত অন্তর কোন বড় গাছের গুঁড়িতে তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে ‘এ’ লিখতে লাগল।
    আরো কিছুদুর এগোনোর পর সত্যসত্যই দেখা গেল সুর্মানালা সামনের দিকে দুভাগ হয়ে গেছে। সত্যরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘দেখেছিস! হুবহু যেমন নকশাতে আছে, ঠিক সেইরকম।’
    গবুর উত্তেজনায় চুল খাড়া খাড়া হয়ে গেল, ‘ওইখানেই আছে বুঝি!’
    —‘আরে না না, আরো যেতে হবে, তবে বেশীদুর আর নয়।’
    নালা যেখানে দুভাগে ভাগ হয়েছে সেখানে এসে সত্যরঞ্জন ফের নকশাটা খুলে বসলেন। একটা ত্রিকোনাকৃতি জায়গা নালাটাকে দুভাগে ভাগ করেছে। ডানদিকের শাখা বেয়ে কিছুদুর এগোনোর পর ম্যাপের উপর একটা বড়সড় গোল দাগ। পাশে একটা ঘন্টার ছবি আঁকা। ঘন্টা কেন? মন্দির আছে নাকি?
    গবু দেখে বলল, ‘খুড়ো আর জগা পাগলা মিলে ঘন্টার কথা কিসব বলছিল বটে।’
    —‘তাই নাকি!’
    —‘তবে আর কি, মার দিয়া কেল্লা। এবার পাকা আমের মতন পেড়ে নেব।’

    দুজনে মিলে তাড়াতাড়ি নালা বরাবর এগোতে লাগলেন। গবুর অবশ্য মাঝেমাঝে একটু দেরী হচ্ছিল গাছের গায়ে ‘এ’ লিখতে গিয়ে। বেশ কিছুদুর এগোনোর পর সামনে নালার পাড় ঘেঁসে একটা নিচু ঘাসজমি দেখা গেল। পাড় বেয়ে উঠে গুটিগুটি পায় সেখানে এসে দুজনে মিলে হাত পা এলিয়ে শুয়ে পড়লেন। মখমলের মত সবুজ নরম ঘাস। এই দূর্গম বনের ভেতর হঠাৎ করে এরকম ঘাসজমি কোথা থেকে গজিয়ে উঠল তা ভেবে অবশ্য গবু একটু অবাকই হচ্ছিল।
    ঘাসজমিটা আরো ঢালু হয়ে যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আবার বনের শুরু। বেলা বেশ বেড়েছে। হয়তো দুপুর এখন। গবুর বেশ খিদে খিদে পাচ্ছিল। আসার পথে একটা পেয়ারা গাছ থেকে বেশ কিছু পেয়ারা পেড়েছিল, সেসব কখন খাওয়া হয়ে গেছে। দূরে একটা বড় শিংশপা গাছে প্রচুর বাঁদর বসে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে গবুর কেমন ঘুম ঘুম পেতে লাগল।

    সত্যরঞ্জন আধশোয়া অবস্থায় বললেন, ‘এতদুর চলে এলাম কই সেরকম ভয়ের তো কিছু দেখতে পেলাম না। বুঝলি বনটা একটু দুর্গম এই যা। লোকে অপদেবতা আছে বলে গুজব রটায়। সাত রাজার ধন নিয়ে ফেরার পর দেখবি লোকের ভয় কেটে গেছে। রাতারাতি এসব তখন ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে যাবে। হামেশাই তখন বনের ভেতর পিকনিক বসবে। কলাপাতার থালায় মোহনভোগ খিচুড়ি, বেগুনভাজা আর শেষপাতে শিবু ময়রার রসবড়া।’
    এসব শুনে গবুর আরো খিদে পেয়ে গেল, উৎসাহী হয়ে বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওর সাথে আমসত্ত্বর চাটনী আর দই থাকলেই বা ক্ষতি কী। কিংবা ধরুন—’
    গবু আরো কিসব বলতে যাচ্ছিল। সত্যরঞ্জন মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কান খাড়া করে কি যেন শুনতে লাগলেন। কোথাও দূরে একটা ঘন্টা বাজল মনে হচ্ছে।
    একটু পরে দুজনেই বেশ পরিস্কার শুনতে পেলেন দূরে কোথাও যেন ঢং করে ঘন্টা বাজল। সত্যরঞ্জন তাড়াতাড়ি ট্যাঁক থেকে নোটবইটা বার করে নকশাটা দেখতে লাগলেন। যেদিকে যেতে হবে মনে হচ্ছে সেদিক থেকেই ঘন্টার আওয়াজটা আসছে। বেশ বড়সড় কোনো ঘন্টা বোধহয়, কেননা সে আওয়াজের রেশ থাকছে অনেকক্ষন।
    —‘তাড়াতাড়ি চল। কুইক। বেশ কাছাকাছি এসে পড়েছি মনে হচ্ছে।’
    গবু তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। শিংশপা গাছে বাঁদরগুলো কেমন ভয় পেয়ে লাফালাফি করছে। সেদিকে চেয়ে গবুর অসোয়াস্তি হল। পায়ের তলাটা কেমন শিরশির করছে। ঘন্টাটা বাজাচ্ছে কে? আবার কোন সবুজ মুন্ডুওলা ভুত নয়ত? ওঁদের খপ্পরে একবার গিয়ে পড়লে আর রক্ষে আছে! গতরাতে কোনওমতে পালিয়ে বেঁচেছে। ঘুঘু তো আর বারবার ধান খাবে না। কী দরকার রে বাবা এইসব গুপ্তধনটন খুঁজে, তার চেয়ে আয়েশ করে ক্লু খোঁজাতেই বেশি আনন্দ।

    সত্যরঞ্জন ইতোমধ্যে একটু এগিয়ে গেছেন। ঘাসজমি শেষ হয়ে ফের যেখানে বন ফের শুরু হচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘কোথাও একটা নিশেন দিয়ে রাখ। ফেরবার পথে চিনে ফিরতে সুবিধা হবে।’
    ‘যে আজ্ঞে’, বলে গবু ফের ঘাসজমি পেরিয়ে নালাটার দিকে চলল। নালার পাড় ঘেঁসে একটা বড়সড় জারুল গাছ দেখে ছিল কিছুক্ষণ আগে। ওর গায়েই একটা বড়বড় করে ‘এ’ লিখে আসা যাক।

    ঘাসজমির শেষে এসে গবু ভীষন জোর আঁতকে উঠল। নিজের চোখকে অবধি বিশ্বাস করতে পারছে না। নালাটা! ওই অতবড় নালাটা কোথায় গেল! এই তো এইমাত্র হাঁচোড়পাঁচোড় করে দুজনে মিলে পাড় বেয়ে উঠেছে। জারুলগাছটাই বা কোথায়। তার জায়গায় এতো বেবাক একটা বাঁশবন। গবুর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। সে বেশ বুঝতে পারছে ফিরতে সুবিধা হবে বলে সে যত চিহ্ন দিয়ে এসেছিল সে সব এখন আর নেই। হয়তো পুরো বনটাই ওলটপালট হয়ে গেছে। এ কি করে সম্ভব?

    কিছু ভাবতে না পেরে সে ধপাশ করে ঘাসজমির উপর বসে পরল। সত্যরঞ্জন তাড়াতাড়ি দৌড়ে এলেন।
    —‘কি ব্যাপার? বসে পড়লি কেন?’
    গবু কোনওমতে নালার দিকটা দেখিয়ে দিল। ঘন বাঁশবনের দিকে চেয়ে সত্যরঞ্জন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ফেরবার রাস্তা মুছে গেছে। তাঁরা এখানে বন্দী।
    অনেকক্ষন পর একটু ধাতস্থ হয়ে সত্যরঞ্জন পায়চারি করতে লাগলেন। বিপদে পড়লে বড় বড় গোয়েন্দারা মাথা ঠিক রাখে। তাঁকেও মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। নালাটার জায়গায় রাতারাতি বাঁশবন গড়ে উঠল কী করে। এরকম যে হবে সে সব তো নকশাতে বলা নেই। এই ভাবেই কী যারা হরিশরাজার জঙ্গলে ঢোকে তারা আর বেরোতে পারে না? ঘন বাঁশবনের ওপাশে কী আছে তাও দেখা যাচ্ছে না। একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে, তখন বিপদ হয়তো আরো বাড়বে বই কমবে না। বাঁশবনের ভেতরটা একবার সরেজমিনে তদন্ত করে আসলে হয়। কোন ক্লু হয়ত পাওয়া যেতে পারে।

    সত্যরঞ্জন বাঁশবনের দিকে এগোনোর উপক্রম করতেই গবু লাফ দিয়ে তাঁর পা জড়িয়ে ধরল। বেবাক ভয় পেয়ে ধপাশ করে পড়ে প্রায় কুমড়ো গড়াগড়ি অবস্থা।
    —‘এসব কি? এসবের মানে কি? দেখছিস পদে পদে বিপদ, তায় আবার এমন করে চমকে দিচ্ছিস!’
    —‘আজ্ঞে ওদিকে যাবেন না কর্তা।’
    সত্যরঞ্জন একটু নার্ভাস হয়ে বললেন, ‘কেন বলত?’
    —‘আজ্ঞে যদি আবার এখানে না ফেরা যায়, যদি আবার সব কিছু পালটে যায়। বলা যায় না বাঁশবনে গিয়ে হয়ত দেখলেন এখানটা বেবাক পুকুর, মাঝখানে হাঁস চরছে।’
    সত্যরঞ্জন বিবেচনা করে দেখলেন কথাটায় যুক্তি আছে। হতাশ হয়ে বললেন, ‘তাহলে এখন কী করা যায় বলত?’
    —‘আজ্ঞে নকশাতে কিছু হদিস দেওয়া নেই?’
    ‘নকশাতে? কই না তো, সেরকম তো কিছু নেই।’

    গবু হতাশ হয়ে চুপ করে গেল। এই মহাবিপদ থেকে বাঁচবার এখন উপায় কী? গঞ্জে এতক্ষন তাদের দেখতে না পেয়ে নির্ঘাত হুলুস্থুলু পড়ে গেছে। যেসব জায়গা সাধারনত সবাই খোঁজে সেসব এতক্ষনে দেখা হয়ে গেছে নিশয়। সবাই হয়ত ধরে নিয়েছে যে তারা বরাবরের মতো দেশত্যাগী হল বোধহয়। ইস, যদি কাউকে বলে আসা যেত। অবশ্য তাতেই বা কী। হরিশরাজার জঙ্গলে কেউ ভুলেও খুঁজতে আসত না। তাছাড়া কী ভীষণ খিদে পেয়েছে। আহা কেউ যদি এক্ষুনি গরম সোনামুগের ডাল, বাঁশকাঠি চালের ভাত, পাঁচমিশেলী তরকারি, আর তেলাপিয়া মাছের ঝাল মুখের সামনে ধরত।

    সত্যরঞ্জন হঠাৎ ‘ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। যা ভাবছেন তাই বোধহয় ঠিক। ব্যাপারখানা দিনের আলোর মত পরিস্কার। এমন যে কিছু একটা হতে পারে তা আগেই আঁচ করা উচিত ছিল। মৃদু গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, ‘ম্যাপখানায় যাবার আর ফেরবার রাস্তা একনয় কেন বুঝতে পারছিস?’
    এইবার গবু বুঝতে পারছে। যে পথে আসা যায় সে পথেই ফেরা যায় না কেন? এমনভাবেই হয়ত সব ক্রমাগত ওলটপালট হতে থাকে। পথ ক্রমাগত মুছে যায়। রাস্তাই মুছে গেলে আর সেই রাস্তায় ফেরা যাবে কিভাবে?
    দুজনে চুপ করে বসে রইলেন। নেহাত ঝোঁকের বশে বেরিয়ে পড়া বোধহয় উচিত হয়নি। এ জঙ্গল এত ভয়ানক হবে তা কে জানত।

    আচমকা ঘন্টার আওয়াজে দুজনের সম্বিত ফিরল। সত্যরঞ্জন গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ঘাবড়াও মৎ! ম্যাপে ঘন্টা অবধি হদিস তো দেওয়াই আছে। চল ব্যাপারখানার শেষটুকু দেখেই আসা যাক। ওঠ ওঠ, দেরি করিস না। বেলাবেলি ফিরতে হবে।’

    গবু উঠে বসল। শিংশপা গাছটা থেকে বাঁদরগুলো কখন পালিয়েছে। বনের ভেতর থেকে একঝাঁক টিয়াপাখি উড়ে গেল। সেদিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে সত্যরঞ্জনের পেছুপেছু বনের ভেতর ঢুকে পড়ল।
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২৩:২৯691733
  • ১০.

    ছেলেদের দুটো শক্ত শক্ত এক্সট্রা করতে দিয়ে গোপীনাথ ক্লাসরুম পায়চারী করছিলেন। এমন সময় জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন স্কুলের ফাটক দিয়ে কবিরাজমশাই ঢুকছেন। সাথে বিশুও আছে। তাড়াতাড়ি বোর্ডে আরও শক্ত একটা অঙ্ক কষতে দিয়ে গোপীনাথ নীচে নেমে এলেন।
    —‘কি ব্যাপার কবিরাজমশাই?’
    কবিরাজমশাই ঝড়ো মুখে বললেন, ‘খবর খুব খারাপ। আমাদের দুঁদে গোয়েন্দা আর তার চেলাটি নিরুদ্দেশ।’ গোপীনাথ ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘গোয়েন্দা? তার মানে আমাদের সত্যরঞ্জন, আর তার শাগরেদ গবু?’
    —‘হ্যাঁ হে।’
    —‘কখন থেকে নিরুদ্দেশ?’
    পাশ থেকে বিশু হাতজোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে তা প্রায় সাতসকাল থেকে।’
    —‘তা এতে ঘাবড়াচ্ছেন কেন? ওর মুরোদ তো জানি। দেখুন গিয়ে এতক্ষনে হয়ত ফিরে এসেছে।’
    —‘না হে না। সত্যরঞ্জন প্রায়শই বিবাগী হয়, সে তো সবাই জানে। কিন্তু এবারের ব্যাপার আলাদা। বিশু নিজের চোখে ওদেরকে হরিশরাজার জঙ্গলে ঢুকতে দেখেছে। তাছাড়া শুনেওছে যে কি সব গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য নাকি তারা বনের ভেতর যাচ্ছে।’
    —‘বলেন কি?’
    —‘তবে আর বলছি কি? এখন কি করা যায় বলোতো?’
    —‘আচ্ছা কবিরাজমশাই, সবাই এত জঙ্গলের দিকে সেঁধোচ্ছে কেন? প্রথমে গগনবাবুর চাকর, তারপর জগা পাগলা, সবশেষে আমাদের গোয়েন্দাবাবু আর তার চেলা। বনের ভেতর সত্যই মেলা ধনরত্ন নেই তো।’
    —‘ঠিক বুঝছি না হে। যাইহোক তুমি একবার চন্ডীমন্ডপে এস, আমি গাঁয়ের মাতব্বর দের খবর দিয়েছি। দারোগাবাবুকেও ডাকা হয়েছে। সবাই মিলে একবার শলা পরামর্শ করে মতলব বের করা যাবে।’
    গোপীনাথ কিছুক্ষন ভেবে বললেন, ‘গোবিন্দনারায়ণ বাবুকেও খবর পাঠিয়েছেন কী?’
    —‘ওকেও খবর পাঠাতে হবে বলছ। কেন? তুমি কিছু সন্দেহ করছ নাকি?’
    গোপীনাথ একটু হেসে বললেন, ‘সন্দেহ ঠিক নয়, অনুমান মাত্র। দেখুন কবিরাজমশাই আমি এ গঞ্জে প্রায় বিশবছর আছি। আশেপাশে কারা কেমন অবস্থাপন্ন সেসব মোটামুটি আন্দাজ করতে পারি। হরিশরাজার জঙ্গলে ধনরত্ন পোঁতা থাকলেও সেসব একমাত্র জমিদারবাড়ীরই হতে পারে। আমার আপনার এমনকি গঞ্জের আর কারোর চোদ্দপুরুষের নয়। সুতরাং গোবিন্দবাবুকে খবর দিলে এ রহস্যের কিছুটা হদিশ পাওয়া গেলেও যেতে পারে।’
    কবিরাজমশাই মাথা নেড়ে বললেন, ‘ঠিক বলেছ। এমনটা আগে ভাবিনি, ঠিক আছে ওকেও খবর পাঠাচ্ছি। এই বিশু তুই দৌড়ে যা দিকিনি। গোবিন্দকে একটা এত্তেলা দে।’
    বিশু ‘যে আজ্ঞে’ বলে দ্রুত বাজারচকের দিকে ছুট লাগালো।
    —‘আপনি একটু দাঁড়ান কবিরাজমশাই। আমি একবার হেডমাস্টারমশাইকে বলে আসি।’
    কবিরাজমশাই সম্মতিসুচক ঘাড় নেড়ে ফাটকের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
    গোপীনাথবাবু বেশী সময় নিলেন না। হেডমাস্টারের কাছ থেকে ওবেলার জন্য ছুটি মঞ্জুর করে বাইরে এসে দেখলেন কবিরাজমশাই কোথা থেকে একটা ভ্যান রিকশা যোগাড় করেছেন।
    —‘উঠে পড়ো, জলদি পৌঁছনো চাই।’
    গোপীনাথ দিরুক্তি না করে উঠে বসলেন।

    এদিকে ভরদুপুরে চন্ডীমন্ডপে গঞ্জের মাতব্বররা হাজির হয়েছেন। হাঁসপুকুর স্টেশনারীর মালিক শতদল ঘোষ, হাঁসপুকুর অপেরার আবির চৌধুরী, হাঁসপুকুর কো অপারেটিভের ক্যাশিয়ার নবীন স্যান্যাল এঁরাও আছেন। উপস্থিতদের মধ্যে মৃদু জল্পনা চলছিল এই যে, হঠাৎ এমন জমায়েতের কারন কি। শতদল ঘোষ জনান্তিকে বলছিলেন এ নির্ঘাত জগা পাগলা সংক্রান্ত ব্যাপার। অপেরামালিক চৌধুরীবাবু বারবার হাতঘড়ি দেখছিলেন। তাঁকে বিকেলের ট্রেন ধরতেই হবে। ক্যাশিয়ারমশাই দুঃখু করে ব্যাঙ্কের দুরবস্থার কথা বলছিলেন। চাষাভুষোর দল যারা হাট থেকে সবজি বেচে ফিরছিল তারা এত লোকের জমায়েত দেখে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল।

    এমন সময় গোবিন্দখুড়ো ঝড়ের বেগে চন্ডীমন্ডপে ঢুকে রোয়াকে একটা আসনপিঁড়ি টেনে নিয়ে বসে পড়লেন। শতদল ঘোষ একটু খুক খুক করে কেশে গলা সাফ করে খুড়োর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাকেও ডেকেছে দেখছি।’
    —‘ভালোই হয়েছে, আমার এমনিতেই নালিশ করার ছিল।’
    জনতা একটু নড়েচড়ে উঠল। খুড়োর আবার কার উপর কিসের নালিশ কে জানে?
    খুড়ো হাতপাখা খুলে হাওয়া খেতে খেতে আক্ষেপ করলেন, ‘কি ঘোর কলিটাই না পড়েছে বল দিকি?’
    চৌধুরীবাবু একটু উশখুশ করে বললেন, ‘কি হয়েছে বলে ফেল্লেই হয়।’
    খুড়ো একটু হুংকার দিয়ে বললেন, ‘তুমি থাম হে চৌধুরীর পো। ব্যাপার হয়েছে আমার মাথা। আমি এর বিহিত চাই। আমার বাড়ীতেই কিনা সব হাত পাকাবি, পুজোপাব্বনে আমার কাছ থেকে সিকিটা মুলোটা নিয়ে যাবি, আর উপগার করতে বললেই দে দৌড়। এমনকি এতই লাটসাহেব যে কানে কথাই তুলতে চায় না সব।’
    শতদল ঘোষ একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘কার কথা বলছেন বলুন তো।’
    ‘চোরের দল সব’, খুড়ো বলতে লাগলেন, ‘বুঝলে মুদির পো। অস্বীকার করুক দেখি ওরা। আমার বাড়ীতে হেথা হোথা সিঁদ কেটে বাবুরা সব টেনিং নেবেন। ভাঁড়ার ঘরের চাতাল থেকে মেঝেতে লাফ দিয়ে পড়ে প্যাক্টিস হবে। ওদের উৎপাতে একটু আমসত্ত্ব খাব তার জো নেই। আর শেষমেশ কিনা আমারি পুঁইমাচা লন্ডভন্ড করে দিয়ে পালায়। রীতিমতো রসিদ কেটে ইউনিয়নের চাঁদা অবধি নেয় জানিস।’
    শতদল ঘোষ কিছুক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি চুরিচামারির ট্রেনিং দেন?’
    খুড়ো বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহা আমি কেন টেনিং দেব বাপু। অতবড় বাড়ি, নাহয় পেটের দায়ে ওরা নিজেরাই একটু কাজে লাগাবে, এই ভেবেই তো রফা হয়েছিল। আর লুটের বখরাও আমি কমসমই নিই। কিন্তু ব্যাপার তো তা নয়। কী রোয়াব সব। আবার আমার সাধের বাপদাদার আমলের ফুলদানীটাও গেল। ভাবতে পারিস তোরা, চোর হয়ে ঘরাঞ্চি বেয়ে উঠতে গিয়ে আছাড় খায়। রামোঃ।’
    এদিকে গঞ্জের মেলা লোক জড়ো হয়ে গেছে। ভিড় ঠেলে গোপীনাথ আর কবিরাজমশাই চন্ডীমন্ডপের দিকে এগিয়ে এলেন। ওঁরা কতক্ষন এসেছেন কেউ লক্ষ্য করেনি। খুড়ো অবশ্য তখনো তিরিক্ষে হয়ে বলে চলেছেন, ‘আরে থাম না বাপু। মেলা গোল করিস না। হ্যাঁ, তারপর যা বলছিলাম, এই তো গত রাতের কথা। দেখি কি, কোথা থেকে আমার সাধের বৈঠকখানায় দুটো অপোগন্ড এসে জুটেছে। আমি ভাবছি এমন তো রফা নেই, বড়জোর গোয়ালঘরের ছাদ অবধি ওঠার পারমিশান দেওয়া আছে। উৎসাহের চোটে দু একটা কুশল প্রশ্ন করেছি কি করিনি তা সব পড়ি কি মরি করে ছুট লাগাল।’
    সবাইকে ঠেলে সরিয়ে গোপীনাথ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দু জন ছিল কি?’
    —‘আলবাত দুজন। আবার পকেটের নোটবই তে কি সব টোকা হচ্ছিল। অবশ্যি নীচের তলায় আরো ওদের সঙ্গীসাথী থাকলে কিচ্ছুটি অবাক হবার নেই।’
    —‘তা হঠাৎ ছুটে পালাল কেন?’
    —‘হতভাগাদের মতিগতি বোঝাই সার। বেশী কিছু নয়, খালি বলেছিলুম একটা উপগার করতে। কী উপগার সে সব বলা বারন।’
    কবিরাজমশাই সামনে এসে বললেন, ‘দেখ গোবিন্দ। ভালো চাও তো সব খুলে বল।’
    চৌধুরীমশাই হুড়ো দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলে ফেললেই তো ল্যাটা চুকে যায়। সব শোধবোধ মীমাংসা হয় আবার বিকেলের ট্রেনটাও ধরা যায়।’ পাশ থেকে স্যান্যাল মশাই টিপ্পনী কাটলেন, ‘কথা চেপে রাখবেন না মশাই তাহলে গ্যাস অম্বল বুকজ্বালা বাধতে কতক্ষন। জানেনই তো এগুলো রোগ নয় রোগের উপসর্গ মাত্র।’
    এসব শুনে শতদল ঘোষও বলতে লাগলেন, ‘কথা চেপে রাখা খুব খারাপ। আমার ছোটোবেলায় একবার—’
    গোপীনাথ শতদল ঘোষকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন গোবিন্দবাবু, বেশ কিছুদিন হল জগা পাগলাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার আগে গগনবাবুর চাকর ঝিকু নিরুদ্দেশ। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে এদেরকে সব নাকি হরিশরাজার জঙ্গলে যেতে দেখা গেছে।’
    খুড়োর হাতের পাখা থেমেছে। খুড়োর মুখ গম্ভীর। উপস্থিত জনতা নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে আলোচনা করতে লাগল। গোপীনাথ খুড়োর দিকে তাকিয়ে ধীর ধীরে বললেন, ‘আর আজ সকাল থেকে আমাদের গ্রামের একমাত্র ডিটেকটিভ সত্যরঞ্জন সমাদ্দার আর তার শাগরেদ গবুও নিরুদ্দেশ। ওদেরকেও নাকি শেষবার বনের কাছেই দেখা গেছে।’

    উপস্থিত লোকজন প্রায় হতবাক। ভীড়ের মধ্যে থেকে নানান রকম কথা ভেসে আসতে লাগল। যেমন, ‘সে কি আমাদের সত্যরঞ্জনও!’, ‘আহা বড় মেধাবী ছিল’, বা ‘এখন কেই বা আমাদের কলাটা মুলোটা খুঁজে পেতে দেবে’, ‘শেষমেশ বেঘোরে প্রান দিল’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
    শতদল ঘোষ একধাপ এগিয়ে এ বিষয়ে শোকপ্রস্তাব ঘোষনা করলেন। জানা গেল আগামী রবিবার বাজার চকে তাঁর পৌরহিত্যে বড় করে শ্রাদ্ধবাসর হবে।

    কবিরাজমশাই ভীড়ের উদ্দেশ্যে গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘অ্যাই, সব চ্যোপ! এখনই মারা গেছে ধরাটা ঠিক হবে না।’ তারপর খুড়োর দিকে তাকিয়ে গলা খাটো করে বললেন, ‘আমি যতদুর খবর পেলাম হরিশরাজার জঙ্গলে ওরা গেছে কিসব গুপ্তধন উদ্ধারে। এখন আমায় বলোতো গোবিন্দ, জমিদারবাড়ীর সাথে এই হরিশরাজার জঙ্গলের সম্পর্কটা ঠিক কি?’

    গোপীনাথ দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘বলে ফেলুন গোবিন্দবাবু। সব বলুন। কাল রাতের চোর দুজন কি আমাদের ডিটেকটিভ আর তার শাগরেদ? সেই সঙ্গে এটাও বলুন সেদিন আমার বাড়ীতে এসে অত শক্ত অঙ্কটা কি করে দুমিনিটে করে দিয়েছিলেন। আর ইদানীং যে শুনছি আপনি নাকি অন্ধকারেও দেখতে পান সেটাই বা কী?’
    খুড়ো মুখ গোঁজ করে উত্তর দিলেন, ‘অঙ্কে আমি বরাবরই ভালো।’
    ‘আরে রাখো’, কবিরাজমশাই খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘সামান্য শতকিয়া ধারাপাত মুখস্থ করতে গিয়ে হেদিয়ে যেতে, তুমি করবে অঙ্ক। ভালো চাও তো সব বলে ফেল না হলে দারোগা দুগ্ধবরনকে খবর দেওয়াই আছে।’

    ঠিক এমনি সময় হেলতে দুলতে দুজন কনস্টেবল সমেত দারোগা দুগ্ধবরন চন্ডীমন্ডপে দোরগোড়ায় হাজির হলেন। তাঁকে আগে থেকে খবর দেওয়াই ছিল। যদিও দ্বিপ্রাহরিক দিবানিদ্রা ভঙ্গ করে আসতে তাঁর একটুও ইচ্ছে ছিল না। তবে কিনা কবিরাজমশাইয়ের কথা তিনি চট করে ফেলেন না। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাজির হয়েছেন।

    কনস্টেবল দুজন লাঠি দিয়ে ‘অ্যাই হ্যাট হ্যাট’ বলতে বলতে সব্বাইকে ঠেলে সরিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দিল। দারোগাবাবু সোজা চন্ডীমন্ডপের রোয়াকে বসে জামার বোতাম খুলে জিরোতে লাগলেন। ব্যাপার স্যাপার দেখে খুড়োর দিকে আড়চোখে চেয়ে কবিরাজমশাই বললেন, ‘দেখ গোবিন্দ বেশী দেরি হবার আগেই সব খুলে বল, কে জানে হয়ত বাছাদের প্রানটুকু বাঁচানো যাবে।’
    খুড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
    গোপীনাথ নিচু স্বরে খুড়োর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হরিশরাজার জঙ্গলে কি জমিদারবাড়ীর লুকোনো ধনরত্ন পোঁতা আছে? থাকলেও সেটা কোথায়? তাছাড়া ওখানে কী আছে যে লোকজন বেবাক লোপাট হয়ে যায়। ঐ জঙ্গল নিয়ে এতসব গল্পকথার কারন কি গোবিন্দবাবু?’
    খুড়ো আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এবার দুগ্ধবরন সাধাসাধি করতে লাগলেন। ‘বলুন না, আপনার কী সব বলার আছে, আরে মশাই মেডেল পাইয়ে দেব!’, ‘আপনি কি সব ভালো লোক খুঁজছেন তাও দেব’ ইত্যাদি। এমনকি অসভ্য কনস্টেবলগুলো পর্যন্ত এসে লাঠির খোঁচা মেরে ইয়ে দেঙ্গে উয়ো দেঙ্গে করতে লাগল।

    শেষমেশ আর থাকতে না পেরে খুড়ো গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। খুড়ো সবাইকে একবার দেখে নিয়ে, গলা কেশে ঝেড়ে সাফ করে ধীরে ধীরে বললেন, ‘জঙ্গলের ভেতর পাথরগুহার মধ্যে একখানা ঘড়ি আছে। বালিঘড়ি।’
    প্রথমদিকে সবাই কে কী বলবে ভেবে পেল না। তারপর ভীষন রকম হট্টগোল শুরু হল। স্যান্যাল মশাই বলতে লাগলেন, ‘আরে ছোঃ, একটা কবেকার পুরোনো বালি ঘড়ি তারই জন্যে সব হেদিয়ে মরছে। আরে ঘড়ির কালেকশন দেখতে চান তো সোজা কুমিরমারিতে আমার সেজ পিসেমশায়ের বাড়িতে যান। হেন ঘড়ি নেই ওনার কালেকশনে, এমনকি ঠাকুরদাদার আমলের চেন দেওয়া ঘড়ি পর্যন্ত।’
    ভীড়ের মধ্যে গগনবাবুর পিসীমা উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, ‘কেন আমাদের কাশীতে যে ঘড়িবাবা ছিলেন, উনি কী কম ঘড়ির খবর জানতেন নাকি? যে পাশে গিয়ে বসত সেই শুনতে পেত সারাক্ষন টিকটিক টিকটিক করে আওয়াজ হচ্ছে।’

    এমনি করে আরো অনেকের কতরকম ঘড়ির কাহিনী বেরোতে লাগল। শতদল ঘোষই বা কম যাবেন কেন, তিনিও বলতে লাগলেন, ‘ইস! আমাদের সরখেল মশাইয়ের ঘরের ঘড়িটা যদি—’
    গোপীনাথ রোয়াকের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘খামোশ!’
    সব্বাই ফের চুপ মেরে গেল। গোপীনাথ খুড়ো মশায়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বললেন, ‘বালিঘড়িটা দিয়ে কী হয় গোবিন্দবাবু? ওটা ওখানেই বা রাখা কেন?’
    খুড়ো খানিক চুপ করে থেকে ঘুম ঘুম স্বরে বলতে লাগলেন, ‘ওটাই তো হল ইমেৎ! ওটাকে উলটে দিলেই তো ফের আমার খসরুৎ হবার কথা। পাছে যাতে ভুল করে কেউ উলটে না দেয় তাই তো ওটা অমন করে লুকিয়ে রাখা আছে।’

    গোপীনাথ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন, আর সব লোকজনও তাই। হঠাৎ খুড়ো ধড়ফড়িয়ে উঠে বলতে লাগলেন, ‘এসব আমার কিচ্ছুটি মনে নেই বিশ্বাস কর তোরা।’
    কবিরাজমশাই অবাক হয়ে বলে উঠলেন, ‘এসব কি বলছ হে গোবিন্দ? ইমেৎ, খসরুৎ এসব কী ফুরুৎ ফারুৎ করছ?’
    খুড়ো দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললেন, ‘আমিই কি ছাই বিশ্বাস করতাম। কবে সেই দাদামশাই, বাপ জ্যেঠারা বলত, আমল দিতাম না। বাপ হরিশরাজার জঙ্গলে নিখোঁজ হওয়ার পর পিসী একদিন বুঝিয়েছিল। মনেও ধরেছিল সেসব কথা। তা তেনারা গত হওয়ার পর গত বিশ বছরে একটিবারের জন্যেও টেরটি পাইনি। হঠাৎ করে একদিন ঐ জগু হতভাগা দিল সব চৌপাট করে। রাতের বেলা সব পষ্টাপষ্টি দেখতে লাগলুম। উঃ সে কি আপদ। পাছার দিকে অযথা সুড়সুড়ি আরম্ভ হল, বেশ বুঝতে পারলুম ল্যাজ বেরোতে চলেছে। লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে দিব্যি খাল নালা টপকে যেতে পারছি। আরো নানারকম সব অশৈলী ব্যাপারস্যাপার। প্রথম প্রথম খুব ফুর্তি হল, তারপর বেজায় ভয় ধরল। পুরোনো বইখাতা সব আঁতিপাতি করে খুঁজে শেষে একখানা নকশাতে হদিস পেলাম কোথায় ইমেৎখানা রাখা আছে। সেই ইস্তক একখানা ভালো নির্লোভ লোক খুঁজে বেড়াচ্ছি। এখন আমার দোষ কি তাই তোরা সব বল?’

    ভিড়ের মধ্যে সবাই বেবাক হয়ে শুনে যেতে লাগল। দুগ্ধবরন অনেকক্ষণ ঘাড় উঁচু করে খুড়োর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ঘাড় টনটন করে উঠলেও খুড়োর মুখের উপর থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। কবিরাজমশাই বহুক্ষন আগে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন।
    গোপীনাথ কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, ‘আপনি কি মানুষ নন?’
    —‘না রে দাদা। ওইখানেই তো যত গন্ডগোল। শোন তবে খুলেই বলি, প্রায় পাঁচপুরুষ আগে কি সব অং বং চং গ্রহ থেকে এই খানে এসে আমরা পড়ি। গ্রহটার খটমট নাম আমি বলতে পারি না বাপু, তবে এটুকু শুনেছি কিসব দাঙ্গা হাঙ্গামার ভয়ে আমাদের পূর্বপুরুষ পালিয়েছিলেন। ওঁদের নামে হুলিয়া জারি হয়েছিল। পাছে কেউ খুঁজে ফেলে ওইজন্যে আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা কিসব কলকাঠি নেড়ে এই তোদের মত ভেক ধরার উপায় বার করেন। ঐ বালিঘড়ি টাই তো সেই চাবিকাঠি। ওটাকে উলটে দিলেই আবার ফের মানুষ থেকে খসরুৎ হবার কথা।’

    খুড়ো চুপ করলেন। গোপীনাথ হতবাক। শতদল ঘোষ ইতোমধ্যে দুবার হাঁ করে থাকার দরুন মাছি গিলে ফেলেছিলেন। একটু ধাতস্থ হয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘বেড়ে গল্পটা বানিয়েছেন যা হোক। এটা নিয়ে যাত্রাপালা কর যায় না চৌধুরীবাবু?’
    খুড়ো তেরিয়া হয়ে বললেন, ‘তোমার এটা গল্প মনে হচ্ছে, ধুতি খুলে ছোট্ট ল্যাজখানা দেখাব নাকি? নাকি একবার লাফ মেরে দেখাব? এই তোমাদের মতো বুদ্ধুদের দেখলেই রাতের বেলা পেসার বেড়ে আমার মুন্ডু দিয়ে সবুজ আলো বের হয়।’
    শতদল সভয়ে পিছিয়ে গেলেন। স্যান্যাল মশাই ডুকরে উঠে শিবস্ত্রোত্র জপ করতে লাগলেন। ওদিকে ভীড়ের মধ্য থেকে কারা সব ‘ঐ আসছে, সব্বাইকে জবাই করবে’ বলে চেঁচাতে লাগল। লোকজন সব দেখে শুনে ভয়ের চোটে বাজারচকের গলি ধরে যেযার মতন সরে পড়তে লাগল। কিছুক্ষনের মধ্যেই চন্ডীমন্ডপ প্রায় ফাঁকা, শুধু দারোগাবাবু আর তাঁর দুই উড়িয়া পুলিশ, গোপীনাথ, কবিরাজমশাই, গোবিন্দখুড়ো আর শতদল ঘোষ পড়ে রইলেন। অবশ্য দারোগাবাবু ইতোমধ্যে বসে বসেই মুচ্ছো গেছেন। সেটা দেখে কনস্টেবল দুজন একটু দূরে বসে তাদের দেশ গাঁ এর বাতচিত করতে লাগল।

    কবিরাজমশাই অপলক চোখে খুড়োর দিকে তাকিয়ে রইলেন। অস্বাভাবিক কিছু ব্যাপার যে ঘটছে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, কিন্তু তা বলে এসবের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। গোবিন্দ হয়ত মিথ্যে বলছে না কিন্তু তাঁর ছোটবেলাকার বন্ধু, এত কাছ থেকে যাঁকে দেখেছেন সে যে একটা দস্তুরমত ভিনগ্রহী অমানুষ জীব এ ভাবতে তাঁর কেমন আসোয়াস্তি হচ্ছিল। খুড়োর দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘ব্যাপারখানা যে এখনো ঠিক বুঝছি না হে গোবিন্দ। তাছাড়া এর মধ্যে জগা পাগলাই বা কী করে আসে।’

    খুড়ো বিমর্ষ মুখে বললেন, ‘এ সব অতি গুহ্য কথা হে। তোমাদের বলা ঠিক হচ্ছে না। নেহাত এতগুলো লোকের প্রানের ব্যাপার তাই বলছি। হরিশরাজার জঙ্গলে আমার পুর্বপুরুষেরা তুক করে রেখে গেছেন। ঐ বালিঘড়ি যাতে কেউ ভুল করেও কেউ উল্টে না দেয় তার জন্যেই সেসব ভয়ংকর ব্যবস্থা। রুয়াৎ রয়েছে, রুয়াৎ। সেসব এড়িয়ে হতভাগা পাগলটা কি করে জানি ঠিক সেই কাজটাই করেছে সবার অজান্তে। তাই তো আমার এই অবস্থা। আর বেশীদিন চললে পুরোপুরি খসরুৎ বনে যাব আর তখন কি করে মৌরলা মাছের ঝোল খাব বল আর আমার দুধেল গরুটারই বা কী হবে?’ খুড়ো ডুকরে উঠলেন।

    গোপীনাথ উপর্যুপরি বিস্মিত হচ্ছিলেন। যেসব ভিন গ্রহী প্রানীদের কথা গল্পের বইতে এত পড়েছেন, যাদের খোঁজ কেবল সায়েবসুবোরাই পায় সেইরকম জলজ্যান্ত একজন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল দেখে কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই। একবার ছুঁয়ে দেখবেন নাকি?
    কবিরাজমশাই রোয়াকে বসে পড়লেন। দারোগা দুগ্ধবরনের মুচ্ছো এখনো ভাঙ্গেনি। সেদিকে আড়চোখে দেখে খুড়োকে প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে বনের ভেতর ধনরত্ন কিছু নেই, খালি তোমার ওই কিসব ইমারৎ না কি সব আছে? তাহলে ওরা বনের ভেতর ঢুকল কেন?’
    —‘ইমারৎ নয় ইমেৎ। আর ধনরত্ন আলবাত আছে। বনের ভেতর সোনার মোহর হাজার খানেক মতন রাখা। তবে পাওয়া অত সহজ নয়। নকশাটা যদিওবা ওরাই চুরি করে থাকে তাহলেও ও জিনিস পাওয়া ওদের কম্ম নয়। ব্যাটারা বুদ্ধির ঢেঁকি আর পয়লা নম্বরের ভীতুর ডিম।’
    প্রাথমিক ঘোর কাটার পর ধাতস্থ হয়ে গোপীনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা খসরুৎবাবু আপনাদের ইয়ে কি বলে বিজ্ঞান বুঝি খুব উন্নত?’
    —‘আঃ আমার নাম খসরুৎ নয়। ও তো আমাদের জাতিটার নাম। জন্মগত নাম একটা কী বিচ্ছিরি বদখত। তাই বাপ মা আহ্লাদ করে গোবিন্দ নাম রেখেছিল। আর বিজ্ঞানের কথা আমায় শুধিয়োনা বাপু, সে সব আমি কখনো চোখে দেখিনি। খালি মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে কিসব কালো কালো ছায়া ছায়া দেখি।’

    বিকেল হয়ে এসেছে। চন্ডীমন্ডপে রোদের ছায়া লম্বা হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে খুড়ো আনমনে বলতে লাগলেন, ‘তবে তোদের এইখানটাই বা কী কম সুন্দর বল। কেমন সুন্দর সব মানুষজন, খাসা তরিতরকারি খাবারদাবার, গঞ্জের হাটে শিবুর দোকানের জিলিপি, আমার বাগানের বাতাপিনেবু, বর্ষাকালে অমন সুন্দর পয়সাফুলের ঝোপ, এসব ছেড়ে ওরকম বিচ্ছিরি একখানা খসরুৎ বনতে কি ইচ্ছে করে রে বাপ? কেউ যদি ঘড়িখানা একবার উল্টে দেয় তো বাঁচি।’ বলতে বলতে খুড়োর গলা ধরে এল। কোঁচার খুঁটে চোখ মুছলেন।
    শতদল ঘোষ উৎসুক হয়ে বললেন, ‘তা আপনি নিজে গেলেই তো পারেন।’
    —‘সেইখানেই তো মুশকিল রে ভাই। ঐ যে বললাম না ঠাকুরদার ঠাকুরদা সব তুকতাক করে গেছেন। বালিঘড়ির পাশে মোহরের বস্তা কি আর এমনি এমনি রাখা। বাপ আমার ঐসবের খোঁজে গিয়েই তো মলো।’
    গোপীনাথ ধাঁধাটা বুঝতে পারলেন না।

    খুড়ো রোয়াক থেকে নেমে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘শোনো সকলে। হরিশরাজার জঙ্গলে কেউ যদি রুয়াৎ এর খপ্পরে পড়ে তবে তা থেকে কাউকে উদ্ধার করে আনা মুশকিল। বেলা পড়ে এসেছে, এখনই বেরোতে হবে। ঐ দারোগাটাকে টেনে তোলো। একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।’

    দারোগা দুগ্ধবরনকে কনস্টেবল দুটো তাদের জুতো শুঁকিয়ে জ্ঞান ফেরাল, কিন্তু পরক্ষনেই জঙ্গলে যেতে হবে শুনে তিনি ফের মুচ্ছো গেলেন। খুড়ো সেদিকে চেয়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘অকর্মার ঢেঁকি! যাকগে ওকে ছাড়াই চল সব। পুলিশ দুটো থাক, বরং ওকে পাহারা দিক।’

    এদিকে শতদল ঘোষ চন্ডীমন্ডপ থেকে একটা পাকা বাঁশের লাঠি জোগাড় করেছেন। তা দেখে খুড়ো বললেন, ‘ওই বুদ্ধি নিয়েই থাক। রুয়াৎ কি যে সে জিনিস রে। ওই লাঠি দিয়ে কি আর সে সব সামলানো যায়?’
    গোপীনাথ দুর্বল স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিন্তু সেটা কী গোবিন্দবাবু? আর সেটা থেকে ভয়টাই বা কী। জগা পাগলা যেতে পারলে আমরা পারবো না কেন? তাছাড়া সত্যরঞ্জন আর গবু কে ওই অত বড় জঙ্গলে কোথায় খুঁজব?’
    খুড়ো কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, ‘রুয়াৎ কি জিনিস তা আমি বিশদে জানি না, তবে কিছু কিছু জানি। সে সব যেতে যেতে বলছি। তবে ওরা রুয়াৎকে ফাঁকি দিয়ে যদি বেরোতে পারে তাহলে কোথায় ওদের শেষমেশ পাওয়া যাবে আমি জানি। চল তোমাদের সেখানেই নিয়ে যাব।’

    কবিরাজমশাই চন্ডীমন্ডপের মূর্তিকে একবার প্রনাম করে নিলেন। রোয়াকে দারোগা দুগ্ধবরনের মুচ্ছো তখনো ভাঙেনি। চারজনে রওনা দিলেন। রোদ বেশ পড়েছে। গোবিন্দখুড়োকে একটু তফাতে রেখে বাকি তিনজন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলতে লাগলেন।

    চন্ডীমন্ডপের আড়াল থেকে বিশু বেরিয়ে এসে ওঁদের চলে যাওয়া দেখল, তারপর অম্ফুট স্বরে বলল, ‘দুগগা দুগগা।’
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২৩:৪৮691734
  • ১১.

    বনের এ অংশ বেশ পাতলা, ফাঁকা ফাঁকা। বুনো কাঁটা ঝোপ ঝাড় একটু কম। ত্রিকোনাকার সবুজ পাতাওলা নরম ন্যাতানো একধরনের গুল্ম জাতীয় গাছে ভর্তি। হঠাৎ দেখলে মনে হয় কে যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। লম্বা লম্বা গাছের সংখ্যাও বেশ কম। আর তাদের ডালপালাও অত বিস্তৃত নয়।

    সত্যরঞ্জন বারবার নকশায় চোখ রাখছিলেন। পাথরগুহা কাছাকাছিই কোথাও হবে। অন্তত ম্যাপে সেরকমই তো বলা আছে। ম্যাপটা অবশ্য বড্ড সহজ সরল। কোথাও কোনো কিছু সাঁটে বলা নেই। একটুও রহস্য রোমাঞ্চের গল্পগুলোর মতো নয়। সেই যে পুরোনো কাগজে বড্ড শক্তরকমের ধাঁধা লেখা থাকে আর গোয়েন্দারা সেসব উদ্ধার করতে গিয়ে মাথার চুল ছেঁড়েন। কোনো ক্লু পাওয়া যায় না। শেষমেশ হঠাৎ কেমন সব হুড়ুদ্দুম ঘটনা ঘটে আর সঙ্গে সঙ্গে ধাঁধার মানে বোঝা যায়। সেরকম এটাও হলে সোনায় সোহাগা হত। ম্যাপটা এত সহজ সরল হবার মানে কী? আহা বেশ জম্পেশ করে যদি রহস্যখানা সমাধান করা যেত তবেই না ঐ পিসে আর তার ভাইঝির মুখে চুনকালি পড়ত।

    ভাবতে ভাবতে সত্যরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। এইসব গুপ্তধন ইত্যাদি তো প্রায় তাঁর হাতের মুঠোয়। তিনি মনশচক্ষে দেখতে পেলেন ফেরার পর তাঁকে ঘিরে গঞ্জে তুমুল হৈ চৈ হচ্ছে। বড় বড় পোস্টার পড়েছে। দুরদুরান্ত থেকে লোকে তাঁকে দেখতে আসছে। বাজার চকের মাঝখানে তাঁর চেম্বারে কী ভিড়। গবু দিস্তা দিস্তা পাতায় লোকজনের কেস ডায়েরি নিচ্ছে। নাওয়া খাওয়ার জো নেই। সত্যরঞ্জন আরো দেখতে লাগলেন ক্ষীরপুলির বাটি হাতে লালপেড়ে গরদের শাড়ি পরে কে যেন অফিসঘরে ঢুকছে। খাও খাও বলে সাধাসাধি করছে। হুঁ হুঁ বাবা, এইবার? ভাবাবেশে সত্যরঞ্জনের চোখ বুজে এলো। তিনি আয়েশ করে ভাবতে লাগলেন, ঐ সেয়ানা পিসেমশাই দস্তুরমতো অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্য সকালথেকে তাঁর চেম্বারে এসে বসে আছেন। আর সেসবের তোয়াক্কা না করে উর্দি পরা দারোয়ানকে তিনি হুকুম দিচ্ছেন, ‘এই পাহারাওয়ালা বান্দরলোগোকো বাহার ফেকো।’ আহা, কী সুখ।

    হঠাৎ পেছন থেকে গবুর চীৎকারে সত্যরঞ্জন আঁতকে উঠলেন। আহা বেশ সুন্দর একটা ভাব মাথাচাড়া দিচ্ছিল। দিলে দফা রফা করে। বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে সত্যরঞ্জন পেছনে ঘুরে দেখলেন গবু হাঁ করে তাঁর দিকে চেয়ে আছে।
    —‘কি হলো। অমন করে চীৎকার করলি কেন?’
    —‘আ-আপনার পা।’
    —‘আমার পা! আমার পা মানে?’
    —‘আ-আপনার পা! নে-নেই!’
    সত্যরঞ্জন ভীষন রেগে গিয়ে বললেন, ‘দেখ ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আমাকে এমন করে ভয় দেখাবি না বলে দিলুম। জলজ্যান্ত নিজের পা দুখানা পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তুই বললেই হল নেই। আরে পা নেই তো দাঁড়িয়ে আছি কী করে রে হাঁদারাম।’
    গবু ভালো করে চোখ কচলাল। তারপর আরো জোরে চীৎকার করে উঠল, ‘আজ্ঞে বিশ্বাস করুন। হাঁটুর নীচ থেকে আপনার পা দুখানা বেবাক গায়েব হয়ে গেছে।’
    সত্যরঞ্জন ফ্যাকাসে মেরে গেলেন। বলে কী? পা নেই? কিন্তু তিনি তো দুখানা পাই দেখতে পাচ্ছেন। এই তো তাঁর কবেকার বাদামী কালো পাম্পশু, হাঁটুর নীচ থেকে নীল রঙের মোজা, সবই তো জলজ্যান্ত বর্তমান। তাহলে গবু বলছে টা কী?
    ‘ওই ওই!’ গবু আবার চেঁচিয়ে উঠল।
    সত্যরঞ্জন শুকনো গলায় বললেন, ‘এবার কী মিসিং?’
    —‘না না, এই তো পা দুটো আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে।’
    বলে কী! গোলগাল পা দুটো তিনি দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন, আর এ ব্যাটা বলে কিনা আসতে আসতে ফুটে উঠছে। এ কি পা না ভোরের আলো! সত্যরঞ্জন বেদম খেপে গিয়ে বললেন, ‘ভয়ের চোটে তোর মাথা খারাপ হয়েছে গবু। দেখ ফের যদি এরকম করবি তো তোকে আমি এইখানেই ফেলে রেখে যাব।’
    গবু অনুনয় করে বলল, ‘আজ্ঞে বিশ্বেস করুন, এই কিছুক্ষন আগে অবধি পাদুটো ছিল না। এ-এইমাত্র হল, মানে এইমাত্র আবার দেখতে পেলুম।’
    —‘তোর মুন্ডু! যতসব খোয়াব দেখছিস। তোকে বলেছি না কোনটা দেখা উচিত আর কোনটা নয় এ বিষয়ে ভালো করে বিবেচনা করতে। এখন চুপচাপ পিছু পিছু আয়। পাথরগুহা এই কাছাকাছি কোথাও একটা হবে।’
    গবু বকুনি খেয়ে মাথা নীচু করে চুপচাপ চলতে লাগল। তার কী দোষ বাবা! পষ্টাপষ্টি দেখা যাচ্ছিল পা দুটো নেই। এখন অস্বীকার করলেই হল নাকি? তাছাড়া ভয়ের চোটে নিতান্তই যদি খোয়াব দেখে থাকে তো সে আর এমন কি? হাঁটতে হাঁটতে যদি পেছন ফিরে দেখা যায় পেছনের রাস্তা নিঃশব্দে মুছে গিয়ে সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে তবে ভয় না পেয়ে উপায় কী?

    আলো বেশ কমে এসেছে। আশপাশ কেমন নিঝুম। গবু লক্ষ্য করল আর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না। সুর্মানালার কাছে তবু দু একটা ময়ুর চোখে পড়েছিল, এখন সে সব ও নেই। সব যেন কেমন দম বন্ধ করে একটা কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে।

    আরো বেশ কিছুটা যাবার পর হঠাৎ সত্যরঞ্জন হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। গবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে দেখল বনের মাঝখানে একটা নিচু জলা, তার বাঁদিক ঘেঁসে বেশ বড় খানিকটা উঁচু ঢিবি। গাছপালায় ঢাকা বলে চট করে ঠাহর হয় না। আশেপাশে বুনোলতাপাতা একটু কম। ঢিবির ভেতর একটা গুহা মতন। সামনে পাথর দিয়ে খিলান মত করা। আর তার সামনে সত্যরঞ্জন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন। চারিদিক কি স্যাঁতসেঁতে। গবুর শীত করতে লাগল।
    —‘মার দিয়া কেল্লা! বুঝলি। আশা করি এতটা যখন আসা গেছে তখন আর খালি হাতে ফিরতে হবে না। বেশ বড়সড় দাঁও মারা যাবে কি বলিস। উহ কি আনন্দ!’ সত্যরঞ্জন হাত পা তুলে নাচতে লাগলেন।
    তবে কম আনন্দের ব্যাপারটা ঘটল এর পরেই। গবু দেখল সত্যরঞ্জনের কথাটা শেষ হওয়া মাত্র মুহূর্তের মধ্যে ওনার নীচ থেকে কোমর পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে গেল। অথচ সত্যরঞ্জনের দেহের উর্দ্ধাংশটুকু দিব্যি দেখা যাচ্ছে। গবু পরিস্কার চোখে দেখল উপরের অংশটা পাথরগুহার মুখে উঁকি ঝুঁকি মারছে। অথচ কোমরের নীচ থেকে বাকিটা নেই। গবু প্রথমে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল ওই অশৈলী কান্ডের দিকে, তারপর চীৎকার করে হাত পা ছুঁড়ে শ্যাওলামাখা জমির উপর জ্ঞান হারিয়ে একেবারে চিতপাত। সত্যরঞ্জন তাড়াতাড়ি ছুটে এসে দেখলেন গবুর দাঁতে দাঁতকপাটি লেগে গেছে।
    কোনোরকমে চোয়াল চেপে ধরে দাঁতকপাটি ছাড়ানো গেল। বেচারা এখনো গোঁ গোঁ করছে। সত্যরঞ্জন জলা থেকে আঁজলা ভরে নোংরা জল তুলে এনে গবুর মুখে চোখে ছিটিয়ে দিলেন। বিচ্ছিরি দুর্গন্ধের চোটে গবু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
    —‘কি ব্যাপার কি শুনি? ওরকম হাঁউমাউ করে চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলি কেন?’
    গবু আধবোজা চোখে সত্যরঞ্জনকে দেখতে লাগল। কোমরের নীচের অংশটা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে যেন। একটু সাহস ফিরে পেয়ে গবু কোনওমতে উঠে বসল। আস্তে আস্তে সত্যরঞ্জনের ধুতি সমেত হাঁটু জুতো মোজা ইত্যাদি ফুটে উঠছে। সেদিকে চেয়ে থেকে শুকনো গলায় গবু বলল, ‘আজ্ঞে, বার বার অমন উবে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে কেন বলুন তো?’
    সত্যরঞ্জন রেগেমেগে বললেন, ‘ফের ওইসব বাজে কথা। অনেক্ষন খাসনি কিছু তাই অমন হচ্ছে। মনকে শক্ত কর। সামনে অনেক কাজ।’
    ইতোমধ্যে পুরো অংশটাই ফুটে উঠেছে। গবু একবার জুতোয় হাত দিয়ে পরখ করে দেখল। হ্যাঁ বেবাক সত্যিকারের বলেই তো মনে হচ্ছে।
    সত্যরঞ্জন ভীষন বিরক্ত হয়ে একটা বড় গোলমতো পাথরের উপর বসে পড়ে ম্যাপটা খুলে ধরলেন। ম্যাপের নির্দেশ আগের মতোই সহজ। সোজা লম্বা গুহাটার শেষপ্রান্তে যেতে হবে। তারপরেই ফকির থেকে তিনি রাজা উজির বনে যাবেন। তখন তাঁকে আর পায় কে।

    এদিকে আধশোয়া হয়ে বসে গবু একমনে তাঁকে লক্ষ্য করতে লাগল। বারবার দুবার এরকম হল। শেষমেশ সত্যই সে খোয়াব দেখছে নাকি? কিন্তু তা কি করে হবে? দ্বিতীয়বার তো রীতিমতো নিজেকে চিমটি অবধি কেটে দেখেছে। এই তো হাতের লাল দাগ তার সাক্ষী। তাহলে সত্যরঞ্জন অমন মাঝে মাঝে উবে যাচ্ছেন কেন?
    ধাঁধাঁর কোনো কুল কিনারা না পেয়ে গবু হতাশ হয়ে পাথরগুহার দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ের চোটে রীতিমতো ঘেমে চান করে গেছে সে। ছুটে যে পালাবে তার উপায় নেই, যে রাস্তায় এসেছে সে রাস্তা কখন মুছে গেছে। ম্যাপে বেরোবার উপায় লেখা আছে বটে কিন্তু সত্যরঞ্জন এতদুর অবধি এসে কি আর শেষ না দেখে যাবেন। অবশ্য গোয়েন্দা হতে গেলে রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা থাকা ভাল। ওতে নাকি গোয়েন্দারা পোক্ত হয়, সাহস বাড়ে। তখন চোরাগলির মধ্যে বন্দুক হাতে যত ছিঁচকে দের পেছনে ধাওয়া করা মামুলি কাজের মতো হয়ে যায়। তাছাড়া এর থেকেও ভয়ংকর সমস্ত ব্যাপার তো ঘটতেই পারে। সেই যে চোরাকুঠুরিতে সব বন্দী থাকে, আর ছাদে রাতবিরেতে কাদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, তারপর কালো রঙের ছানাবেড়ালের ল্যাজ— যাক গে সে সব কথা। মোটকথা ভয় পেলে চলবে না।

    গবু একটু একটু করে সাহস ফিরে পাচ্ছিল। দিব্যি সহজ সরল লাগছে সব। যেখানে রাতারাতি বনবাদাড় সব কেমন পালটে পালটে যায় সেখানে এমন ঘটনা তো ঘটবেই। ধড় মাথা সব উবে যাচ্ছে তো যাক না, আবার ফিরেও তো আসছে।
    ঢং করে ঘন্টা বেজে উঠল। এবার খুব কাছ থেকে। পাথরগুহার ভেতর থেকে কী? গবুর পিলে চমকে উঠল। থেকে থেকে এমন ঘন্টা বাজানোর মানে কী বাপু? এসব শুনলেই ইস্কুলের টিপিনের কথা মনে পড়ে যায়। সেই যে লোহার গেটের তলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হজমি গুলি আর ঘুগনি কেনা। উফফ সে সবের কী স্বাদ ছিল। এখন সে সব মনে পড়তেই তার বেজায় খিদে খিদে পেয়ে গেল। গরম ভাতের সাথে একটু ঘি, বড়িভাজা, চাকা চাকা করে কাটা আলুভাজা কিংবা উচ্ছে। তারপর গরমাগরম ছোলার ডাল দিয়ে চাট্টিখানি ভাত মেখেই মাছের ঝোলের বাটির দিকে হাত বাড়ানো। সে সব শেষ হলে আমসত্ত্বর চাটনী আর পাঁপড় দিয়ে পুন্যকাজে ইতি। উলস। ভাবতে ভাবতে গবুর চোখ বুজে এল। জিভে জল। পেটের ভেতর কেমন যেন খুন্তিমোচড় দিয়ে উঠল। খিদের কী জ্বালা রে বাপ।

    সত্যরঞ্জন মনোযোগ সহকারে ম্যাপ দেখছিলেন। লাল রঙের গোলের ভেতর যেখানে পাথরগুহার হদিস দেওয়া আছে তার পাশে ঢেঁড়া দিয়ে লেখা ‘সাবধান’। কি থেকে সাবধান হতে বলছে? চারপাশে যা সব অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা ঘটছে তার থেকেও সাংঘাতিক কিছু? কে তার হদিশ দেবে? তার উপর গবুটাও থেকে থেকে অমন দাঁত ছিরকুটে পড়ছে কেন কে জানে?
    গবুর কথা খেয়াল হতেই মুখ তুলে তাকিয়ে সত্যরঞ্জন আঁক করে লাফিয়ে উঠলেন। কারন আর কিছুই নয়, পরিস্কার দিনের আলোয় তিনি দেখতে পেলেন গবুর মুন্ডুটা শুন্যে ভাসছে। ধড়টা বেবাক লোপাট। একলাফ দিয়ে পাথরের পেছনে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঁকি মেরে তিনি মুন্ডু টাকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। একটু আগে গবু যা বলছিল তা তবে সত্যি। কোনোরকমে চিঁ চিঁ করে সত্যরঞ্জন বলে উঠলেন, ‘এ-এই গবু, এই হ-হতভাগা।’
    মুন্ডুটা প্রথমে ঘাড় ঘুড়িয়ে ওঁকে এদিক ওদিক খুঁজল, তারপর বিনীত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ্ঞে আপনি কোথায়?’
    —‘ইয়ে, পা-পাথরের পে-পেছনে!’
    মুন্ডুটা একটু শুন্যে উঠল তারপর এগিয়ে আসতে লাগল।
    —‘অ্যাই খবরদার এগোবি না!’
    মুন্ডুটা থেমে গেল ওখানেই। প্রশ্ন করল, ‘কেন কি হল?’
    —‘ইয়ে, তোর ধড়টা কই, খালি মুন্ডুটা দেখতে পাচ্ছি যে।’
    গবু চোখ বড়বড় করে বলল, ‘দেখেছেন, আমিও তখন ঠিক এমনি দেখেছিলাম। তখন তো পেত্যয় হয় নি। এইবার দেখুন।’
    সত্যরঞ্জন দেখলেন কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আবার গবুর মাথার নীচে ধড় গজাচ্ছে। হাত পা, লাল ফতুয়া, সব কেমন ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। কিছুক্ষন পর দিব্যি পুরোটাই আবার যেমনটি ছিল তেমনটি হয়ে গেল। সত্যরঞ্জন পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
    —‘ওরে গবু, ওরে অলুক্ষুনে এ কী দেখলুম রে বাপ!’
    গবু স্বান্তনার স্বরে বলতে লাগল, ‘আজ্ঞে, কিচ্ছুটি ভাববেন না, মুছে দেবার পর সব যখন আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে তখন ভয়ের কিছু নেই।’
    —‘কিন্তু এ সব কেন হচ্ছে বলত। নকশাতে তো এরকম কিছু বলা নেই।’
    গবু চিন্তিত মুখে বলল, ‘আজ্ঞে, আমিও তো রকম সকম কিছু বুঝছি না। আহা দিব্যি বসে বসে ডালভাতের খোয়াব দেখছিলুম।’
    সত্যরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অন্ধকার হয়ে এসেছে। এরপরেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসবে। তখন আরো কি কি সব মাদারীর খেলা শুরু হবে কে জানে। নকশাতে সাবধান বলতে কি এইসবই বোঝানো হয়েছে?

    গবু পাথরগুহার সামনে গিয়ে একবার উঁকি ঝুঁকি মেরে এলো। ভেতর টা প্রায় অন্ধকার। যদিও কোথা থেকে যেন আবছা আলো আসছে। ক্ষীণ অদ্ভুত আওয়াজ ও একটা শোনা যাচ্ছে যেন। শব্দটার রকমফের বোঝা যাচ্ছে না। ভেতরে জন্তু জানোয়ার কিছু আছে নাকি? নাকি কালকের মতো ওই রকম ভুতুড়ে মার্কা কিছু। গবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
    সত্যরঞ্জন কখন গুটিগুটি পায়ে গুহার মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। শব্দটা তিনিও শুনেছেন। এ আবার কী নতুন বিপদ কে জানে? দুজনে মিলে একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
    —‘ইয়ে ভেতরে কি যেতেই হবে?’
    —‘উপায় নেই। এখান থেকে বেরোতে গেলে গুহার ভেতর ঢুকতেই হবে, ম্যাপে সেরকমই বলা আছে।’
    —‘কিন্তু শব্দটা?’
    —‘আর ভেবে কি হবে? চল, যা আছে কপালে।’
    গুহার মধ্যে পা রাখতেই বাইরে যেন প্রলয় ঘটে গেল। গবু আর সত্যরঞ্জন দুজনেই বুঝলেন পিছনের দৃশ্যপট ওলটপালট হয়ে গেল। ঐ শ্যাওলা মাখা স্যাঁতস্যেঁতে জমি, জলার পাশে বাঁশগাছের সারি, এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ছোট বড় গোল গোল পাথর সেসব হয়তো এখন আর নেই। বদলে হয়তো বিশাল বড় একটা দিঘীই তৈরী হয়েছে, কিংবা হয়তো চারপাশে বড় গাছে ঘেরা কোন মাঠ, অথবা আরো অন্য অলৌকিক কিছু। ভয়ের চোটে সাহস হল না পেছন ফিরে দেখার। কাঁপতে কাঁপতে দুজনে মিলে গুহার ভেতর ঢুকে পড়লেন।

    অপ্রশস্ত গুহা। পাশাপাশি দুজনে মিলে হাঁটা যায় না। পাথরের দেওয়াল। গুহার মেঝেও চৌকো চৌকো পাথর পাশাপাশি বসিয়ে তৈরী। দেওয়ালের ফাঁকফোঁকর থেকে গাছের শিকড়বাকড় বেরিয়ে নানান অদ্ভুত রকম নকশা তৈরী হয়েছে। তার মাঝে মাঝে অদ্ভুত ভাষায় খোদাই করে কি সব লেখা। কিছু কিছু জায়গায় ছবিও আছে। অবশ্য দেখে বোঝাই যাচ্ছে বেশিরভাগই অপটু হাতের খোদাই। মানুষ না জন্তু জানোয়ার বোঝার উপায় নেই। কয়েক জায়গায় তো চোখমুখ রীতিমতো টেরাবেঁকা। কে আবার তার উপর ছেলেমানুষী করে ল্যাজও এঁকেছে।

    লম্বা গুহাটা মাঝে মাঝে এঁকেবেঁকে গেছে। তবে কোথাও কোন শাখা প্রশাখা নেই। এক অদ্ভুত রকম নীলচে আলোয় ঢেকে আছে পুরো গুহাটা। এরকম আলো সত্যরঞ্জন কখনো দেখেননি। দেখে মনে হচ্ছে যেন আলোটা এক্ষুনি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে ফেলা যায়। সেই আলোতে মাঝে মাঝে নকশাটা খুলে মিলিয়ে দেখছিলেন তিনি। যদিও বিশেষ কিছু দেখার নেই, জলের মতো সহজ পথনির্দেশ। অবশ্য ম্যাপে এই শব্দটার ব্যাপারে কিছু বলা নেই।

    আরো একটা বাঁক নেওয়ার পর শব্দটা বেশ জোরালো হল আর সেই সঙ্গে পিলে চমকানো ঘন্টার আওয়াজ। সত্যরঞ্জনের মনে হল গুহার প্রায় শেষের কাছাকাছি পৌঁছেছেন। সামনে হয়ত কোন বড়সড় ঘর মতো আছে, আর তার মধ্যেই হয়ত সেই সব চোখ জুড়োনো আহ্লাদী জিনিসপত্তর। আলোর তীব্রতা বেড়েছে। গুহার দেওয়ালের নকশা গুলো এই আলোতে আরও পরিস্কার।
    ‘এই যে! এই যে! আবার সেরকম হচ্ছে।’ গবু ফিসফিসিয়ে উঠল।
    সত্যরঞ্জন ঘাবড়ে গেলেন। আবার অদৃশ্য হচ্ছেন নাকি?
    —‘গোড়ালি...না না হাঁটু অবধি উবে গেছে যে!’
    ‘অ্যাঁ, বলিস কী’, সত্যরঞ্জন দরদর করে ঘামছেন। এ কি গেরো রে বাবা।
    —‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, আবার সব ফেরত আসছে!’
    —‘আসছে?’
    —‘তাই তো দেখছি।’
    —‘যাক বাবা। ফেরত এলেই বাঁচি। একবার খালি ওই হীরে মাণিক হাতে পাই তারপর এমুখো আর কখনো হব ভেবেছিস?’
    —‘কী আশ্চর্য! এই দেখুন আবার কোমর অবধি উবে গেল।’
    সত্যরঞ্জনের এবার কেমন সন্দেহ হল। তিনি ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন। গা হাত পা উবে যাওয়ার সাথে সাথে কিছু একটার সম্পর্ক আছে বলে মনে হচ্ছে। যা ভাবছেন তাই কী ঠিক? চেষ্টা করে আবার দেখা যাক।
    —‘ওরে, এখন কেমন বুঝছিস?’
    —‘ইয়ে, যেমন হয় আবার আস্তে আস্তে সব ফুটে উঠছে।’
    সত্যরঞ্জন কোমর, পা, ছেঁড়া ধুতি, জুতো মোজা সব ফেরত আসা পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে রইলেন। তারপর ফিসফিসিয়ে গবু কে বললেন, ‘আচ্ছা, এবার দেখ তো আবার সব অদৃশ্য হচ্ছে কি না।’
    এই বলে একমনে চোখ বন্ধ করে গুহার ভেতর সাত রাজার ধনের কথা ভাবতে লাগলেন। মোহর ঠিক কতগুলো আছে ভেতরে? আশা করা যাক সবকটাই একদম খাঁটি সোনা। অবশ্য এদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকাও বিচিত্র নয়। যা দাম পাওয়া যাবে তাতে হেসে খেলে বাজার চকের মাঝখানে সবচেয়ে বড় একখানা এজেন্সি খুলতে আর কতক্ষন। সত্যরঞ্জনের সত্যসন্ধান। আহা ভেবেও সুখ, একেবারে যাকে বলে তূরীয় অবস্থা।
    ‘আজ্ঞে, মাথার চুল ছাড়া আর কিছুই তো নেই দেখছি’, গবু ধরা গলার বলে উঠল।
    সম্বিত ফিরে পেয়ে সত্যরঞ্জন চোখ খুলে অবস্থাটা পর্যালোচনা করলেন। এক্সপেরিমেন্ট একটু বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
    —‘আচ্ছা বেশ, এবার দেখা যাক কী হয়।’
    সত্যরঞ্জন ফের চোখ বন্ধ করে এবার স্ত্রী সৌদামিনীর মুখঝামটার কথা ভাবতে লাগলেন। ইস, কথার তেজ আছে বটে। হবে নাই বা কেন? পূর্বপুরুষ এককালে ডাকাত ছিল তো। ছোড়দাদু বারন করেছিল বটে, ‘সত্য অমন মেয়ে বে করিসনি বাপ’। আবার পিসেমশাইটিও কম ধুরন্ধর নন। কালীগঞ্জের দাশু শ্যামাপদর সাথে মামলা মোকদ্দমা করে পেড়ে উঠত নাকী। নেহাত ঐ পিসেমশাই রাঘব পোড়েল দাশুর উকিল ছিলেন, তাই না অমন সাংঘাতিক ভাবে হারা কেস দাশু জিতে যায়। এমনকি শ্যামাপদর নামে পালটা ফৌজদারী মামলা অবধি ঠোকা হয়েছিল। যদিও বছর ঘুরতে না ঘুরতে সেসব সামলে ফের শ্যামাপদই শেষ হাসি হাসে। এবার অবশ্য রাঘববাবু শ্যামাপদর সাথে ছিলেন। ফলতঃ দাশু এখন শহরে জেলের ঘানি ঠেলছে।
    —‘আসছে আসছে, সব আবার যেমনকে তেমন হচ্ছে। মায় চুলের ছাঁটটুকু অবধি ঠিক রেখেছে!’
    সত্যরঞ্জন চোখ খুলে কাষ্টহাসি হেসে বললেন, ‘বুঝলি?’
    —‘ইয়ে না তো!’
    —‘খুব সহজ। আসল ব্যাপার হল লোভ। যেই লোভ করবি অমনি হাপিশ হতে আরম্ভ করবি। উলটো ভাবলেই ফেরত।’
    ‘বলেন কী। কী সর্বনাশ!’ গবুর চুল খাড়া খাড়া হয়ে উঠল।
    —‘শ স স স। সর্বনাশের কিছু নেই, খালি লোভ না করলেই চলবে। এইটাই আসল ফাঁদ বুঝেছিস। এখন পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে বনের ভেতর যারা ঢোকে তাদের কে আর খুঁজে পাওয়া যায় না কেন?’
    —‘কেন কেন?’
    —‘যারা বনের ভেতর ধনরত্নের খোঁজে আসে তারা একা একাই আসে। কাউকে সাথে নিয়ে আসে না। পাছে ভাগ দিতে হয়। এদিকে লোভের চোটে তারা নিজেরা বুঝতেই পারে না কখন তারা উবে যায়, তাই আর কেউ দেখতেও পায় না। একবার পুরোপুরি উবে গেলে হয়তো কিছু করেই হয়ত আর ফিরে আসা যায় না।’
    গবু ভেবে দেখল কথাটায় যুক্তি আছে। একটু আগে সে যখন প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছিল তখন তার ভালমন্দ খেতে ইচ্ছে করছিল বটে। কিন্তু তাহলে ওইসব মোহর ইত্যাদি হাতে পেলে কী হবে? লোভ না করে থাকা যাবে নাকি?
    একথা বলতেই সত্যরঞ্জন গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। আপাতত গুপ্তধনের কথা মাথাতেও আনিস না। বদলে সাত্ত্বিক কিছু ভাব।’
    —‘কি রকম?’
    ‘আহ। ভাব তীর্থে যাচ্ছিস। এখন কথা না বাড়িয়ে পিছু পিছু আয়।’ সত্যরঞ্জন খেঁকিয়ে উঠলেন।
    গবু কথা না বাড়িয়ে সত্যঞ্জনের পেছন পেছন চলতে লাগল। তীর্থে যাচ্ছি এসব ভাবা কী সোজা নাকি।

    এদিকে শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। একটানা নয়, মাঝে মাঝে কমছ বাড়ছে। আলোও বেশ বেড়েছে। গুহা এখানে একটু চওড়া। গুহার দেওয়াল জুড়ে আঁকা ছবি গুলো ওই অদ্ভুত নীলচে আলোয় যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। অদ্ভুত রকম সব ছবি। মাঝে মাঝেই গোল চ্যাপ্টা মতন কিছু একটার ছবি আঁকা। তার ভেতর থেকে ল্যাজওলা, কুলোর মত কান গোরিলাদের মতন দেখতে কি সব যেন বেরোচ্ছে। কোথাও ঐ গোরিলার পাশাপাশি মানুষের ছবি আঁকা। নীচে অদ্ভুত হরফে কি সব লেখা।

    আবার ঘন্টা বেজে উঠল, এবার এত জোরে যে কানের পর্দা প্রায় ফেটে যাবার জোগাড়। গবু কান চেপে ধরে বসে পড়ল। সত্যরঞ্জনও দাঁড়িয়ে পড়েছেন। ঘন্টার গৎ এর রেশ গুহার দেওয়ালে প্রতিধ্বনি হচ্ছে।
    সামনে একটা বড় পাথরের দেওয়াল। পাথর কেটে দরজা মতন করা।
    ওই দেওয়ালের হদিশ নকশায় দেওয়া আছে। শেষ দেওয়াল পাশে ঢেঁরা কাটা।
    ঘন্টার শব্দের রেশ কমে এসেছে।
    তবে অন্য শব্দটা বেড়েছে। কেমন ঘড় ঘড় আওয়াজ।
    সত্যরঞ্জন থমকে দাঁড়ালেন। ওই দেওয়ালের পেছনেই যদি গুহ্য বস্তু সব থাকে তাহলে আগে থেকে তৈরী থাকা দরকার। তাঁকে থামতে দেখে গবুও দাঁড়িয়ে পড়ল।
    ভীষন কিছু একটা ভাবা দরকার। স্ত্রী সৌদামিনীর মুখটা ভেসে উঠল। সত্যরঞ্জন মহাখুসি হয়ে গবুকে বললেন, ‘অন্য কিছু ভাবতে থাক। তবে খবরদার গুপ্তধনের কথা ভাববি না।’
    গবু অন্য কিছু না পেয়ে ঘোষেদের গোয়ালের সেই ভয়ানক গোরুদের কথা ভাবতে লাগল। বিশেষ করে সেইটার কথা যার শিঙের গুঁতোয়—
    ‘ওই দ্যাখ!’, সত্যরঞ্জন পাথরের দেওয়ালের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে উত্তেজনায় গবুর জামা খামছে ধরেছেন। অবশ্য হাত দিয়ে ধরেছেন কিনা বোঝার উপায় নেই। কারন ওনার মুন্ডু বাদে বাকি সব কিছুই উবে গেছে। গবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
    দরজার ধার এসে উঁকি মেরে গবু দেখল ওধারে একটা বেশ বড় ঘর। পুরোটা নীলচে আলোয় ছেয়ে গেছে। সেই অদ্ভুত আলোর উৎস হল একটা বালিঘড়ি। ঘরের মাঝখানে সেটা শুন্যে ভেসে আছে! গবু একবার নিজের চোখ কচলে নিল। হ্যাঁ, নিয্যস বালিঘড়িখানা শুন্যেই ভেসে আছে বটে। ঘড়ির উপরের খোপখানা নীলরঙের, নীচের খোপের রঙ হাল্কা গোলাপী। উপরের খোপের ভেতর কেমন সাদা গুঁড়ো মতন রয়েছে। সেই গুঁড়ো ধীরে ধীরে নীচের খোপে ঝরে পড়ছে। গবু ভীষন রকম অবাক হয়ে গেল।
    অবশ্য অবাক হওয়া তখনো বাকি ছিল। শুন্যে যেখানে ঘড়িটা ভেসে আছে তার পাশেই মেঝের উপর একখানা চটের বস্তা রাখা। আর সেই বস্তার ওপর—
    রাশি রাশি সোনার মোহর! নীল রঙের আলোয় সে সব কেমন ঘোর লাগিয়ে দেয়। এত মোহর! এক একটা অন্তত হাতের তালুর মতন সাইজ। উপরে কি সব লেখা তা অবশ্য দূর থেকে স্পষ্ট নয়। কিন্তু তাতে কি? এক্ষুনি ছুটে গিয়ে সব হাতিয়ে নিলেই তো হয়।

    ইচ্ছেটা মনে হতেই দ্রুত নিজেকে সামলাল সে। নাহ গরু গুলোর ব্যাপারে ভাবতেই হচ্ছে। তড়িঘড়ি পিছিয়ে এসে সে সত্যরঞ্জনের দিকে তাকাল। মাথার ব্রক্ষ্মতালুর শেষটুকু ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। উনি বোধহয় এখনো মোহরের দিকে চেয়ে আছেন। আন্দাজে সে জামা ধরে এক হ্যাঁচকায় তাঁকে সরিয়ে আনল।

    ফের নিজের চেহারা ফিরে পেতে সত্যরঞ্জনের সময় লাগল ঝাড়া পাঁচমিনিট। পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছে টুছে তিনি বললেন, ‘বাপস! চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। ভাগ্যিস তুই ছিলি।’
    —‘এবার কী করবেন?’
    —‘শ স স স!’
    পাশের ঘরের ঘড় ঘড় শব্দটা থেমেছে। মনে হল কেউ যেন হাই তুলল। সত্যরঞ্জন আর গবু তাড়াতাড়ি একটু আড়াল খুঁজে সরে এলেন। দরজা দিয়ে কেউ বেরোলে চট করে তাঁদের দেখতে পাবে না।
    ঘরের ভেতর কার যেন পায়ের আওয়াজ।
    ওঁদের হৃদকম্প হতে লাগল। ঘরের ভেতর কী আছে কে জানে?
    পায়ের আওয়াজটা এবার দরজার দিকে এগিয়ে আসছে।
    ভয়ের চোটে গা হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা। গবু একবার অজ্ঞান হবে নাকি?
    পায়ের আওয়াজ দরজার ওপাশে।
    ঠিক এমন সময় কান ফাটিয়ে ফের ঘন্টার আওয়াজ ভেসে এল। সত্যরঞ্জনের দাঁতে দাঁতকপাটি লাগার যোগাড়। গবু ভয়ের চোটে তাঁর কাঁধ এমনভাবে খিমচে ধরেছে যে নুনছাল উঠে গিয়ে জ্বালাজ্বালা করছে। ঐ আসছে, এসে পড়ল বলে।

    ঘরের ভেতর থেকে জগা পাগলা বেরিয়ে এল।

    প্রথম চোটে সত্যরঞ্জন এতটাই অবাক হয়ে গেলেন যে ভীষন রকম তোতলাতে লাগলেন। গবুও চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।
    জগা পাগলা দরজার বাইরে বেরিয়ে ওঁদের দেখতে পেয়ে হাই তুলে একগাল হেসে এগিয়ে এলো।
    সত্যরঞ্জন এবার হাঁউমাউ করে উঠলেন, ‘এই এই ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।’
    —‘হি হি। এই যে কালীবাবু, কুকুরছানা নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন বুঝি?’
    গবুর পিত্তি জ্বলে গেল। ছোটোলোক কোথাকার।
    —‘তুই এখানে?’
    —‘হি হি। তা এখানে কিন্তু বেল গাছ পাবেন না সেই বকুলতলায় যেতে হবে।’
    ব্যাটা বদ্ধ উন্মাদ, সত্যরঞ্জন ভাবলেন। যাইহোক আপাতত ঘরের ভেতরে গিয়ে একবার সরেজমিনে তদন্ত করে আসতে হবে। বালিঘড়ির ব্যাপারটাই বা কী? ওটা শুন্যেই বা ঝুলে কেন?
    জগাপাগলা কে আড়চোখে দেখতে দেখতে দুজনে মিলে ঘরের ভেতর সাবধানে ঢুকলেন। আর অমনি ঘন্টার গৎএর রেশ মিলিয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে বালিঘড়িটা এখনো শুন্যে ভাসছে। আর তার পাশে জ্বলজ্বল করেছে মোহরগুলো। বেশীক্ষন তাকালে কেমন ঝিম ধরে যায়। এই তাহলে গোবিন্দখুড়োর সাতরাজার ধন মানিক।

    সত্যরঞ্জনের মনে হল ওদিকে বেশী না তাকানোই উচিত। মোহরের চেয়ে তাঁর নিজের নধর দেহ খানা তাঁর কাছে অনেক বেশী প্রিয়। দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে তিনি ট্যাঁক থেকে ম্যাপখানা বার করলেন। গবু হাঁ করে ঘরের দেওয়ালে আঁকা ছবি দেখতে লাগল। এখানকার ছবিগুলো অন্যরকম। রঙ দিয়ে আঁকা। সেই গোরিলাদের ছবিই বটে তবে কেমন যেন যুদ্ধ যুদ্ধ মনে হচ্ছে। একদল তাড়া করছে, একদল পালাচ্ছে, একদল মাটিতে পড়ে রয়েছে। অনেক গোল গোল চ্যাপ্টা পিঠের মতো জিনিসও আঁকা। একজায়গায় দেখল ঘড়ির ছবিটাও আঁকা। ঘড়িটার সাথে কি ওই ওইসব গোরিলা গুলোর যোগাযোগ আছে নাকি। সেসব আবার হাজির হবে না তো! কালকে রাতের ভূতটাও বালিঘড়িটার কথা বলছিল না? বালিঘড়িটা আসলে কী? ভূতটা বালিঘড়ি টা চায় কেন? ওটা অমন শুন্যে ঝুলেই বা আছে কি করে। অবশ্য এর আগে যা সব ঘটেছে তারপর এ আর অস্বাভাবিক কি?

    এদিকে সত্যরঞ্জন একমনে ম্যাপটা দেখছিলেন। ওতে এরপর কি করতে হবে সে সব কিছু বলা নেই তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ফেরবার রাস্তাটা শুরু হচ্ছে ঘরের মাঝখান থেকে। কিন্তু ঘরের মাঝখানে তো বেরোনোর কোনো রাস্তা নেই। তাহলে? আর এই ফেরবার রাস্তা এরকম বেখাপ্পা একটা গোলদাগে শেষ হচ্ছে কেন?
    ‘ঠিকানা মিলিয়ে বাড়ি খুঁজছেন বুঝি? আমাকে বললে সুলুকসন্ধান দিতে পারব, এখানে প্রায়ই আসা যাওয়া করি কিনা, বাব্বাঃ যা ঘুম হয় না’, জগা পাগলা পাশে এসে দঁড়িয়েছে। হাই তুলছে। তাহলে ওইরকম বিচ্ছিরি আওয়াজ করে জগাই নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল।
    সত্যরঞ্জন চোখ ছোট করে জগার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘তুই এখানে প্রায়ই আসিস নাকি?’
    —‘আজ্ঞে তা তো বটেই। বনের ভেতর নানান মজাদার জিনিস আছে!’
    সত্যরঞ্জন বিরক্ত হলেন। গবুকে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘কি করা যায় বল তো। আমি তো বেশীক্ষন লোভ সামলে রাখতে পারব না।’
    গবু মাথা চুলকে উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে বস্তাটা নিয়ে একছুটে পালালে হয় না?’
    —‘গবেট! পালাবার রাস্তাটা কোথায়? যে পথে এসেছিস সে পথ কি আর আছে?’
    —‘তাই তো। কিন্তু...কিন্তু তাহলে জগা পাগলা কি করে আসে যায় এখান থেকে?’
    দুজনে হাঁ করে একে অপরের মুখের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে রইলেন। তারপর খুব করে জগা পাগলার কাছে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ সুরু হল। কিন্তু পাগলের কাছ থেকে হদিস পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! এদিকে মোহরের উপর লোভ লালসাও কেমন চিড়বিড়িয়ে উঠছে। ওগুলো প্রায় চুম্বকের মতো টানছে। এ সব সামলানোর জন্য সত্যরঞ্জন আরো বেশী বেশী করে সৌদামিনীর কথা ভাবতে লাগলেন। পুরোনো নতুন গালমন্দ মুখঝামটা সব হুড়মুড়িয়ে মনে পড়তে লাগল।

    গবু এর আগে গল্পে পড়েছে কেমন করে সব মোহরের লোভে যখ হয়ে বসে থাকে। সে সব যে নেহাত মিথ্যে নয় এইবার সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে লাগল। চটের বস্তাটার ওপর রাশি রাশি মোহর কেমন এলিয়ে পড়ে রয়েছে। নীলচে রঙ তার উপর পড়ে মাঝে মাঝে ঠিকরে উঠছে যেন। ওর কয়েকটা পেলেই সে বড়লোক। জীবনে আর খাওয়া পরার চিন্তা থাকবে না।
    ভাবনা থামিয়ে হঠাৎ গবুর মনে হল, এই এতক্ষন যে দিব্যি মোহরের চিন্তায় মশগুল ছিল, হাত পা মায় গোটা দেহটাই মুছে যায়নি তো। জগাপাগলার মতো হলে বেশ হত। পাগল তো তাই মোহর গুলোর মানে বুঝছে না। আর তাই উবে যাওয়ার ভয়ও নেই।

    কোনোমতে মোহরের উপর থেকে চোখ সরিয়ে সত্যরঞ্জনের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল তিনি কোনোমতে দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে দাঁত মুখ খিঁচিঁয়ে আড়ষ্ট ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। গবু কাছে গিয়ে একটু ঠেলা দিল। সত্যরঞ্জন ওই অবস্থাতেই বললেন, ‘তাড়াতাড়ি মোহর গুলো ওই চটের বস্তায় বাঁধ।’
    —‘কিন্তু ইয়ে লোভ সামলাভ কি করে? এই আপনার মতো দুচোখ ঢেকে—’
    —‘ওরে গবেট চোখ ঢাকলে দেখবি কি করে? লোভ সামলা, লোভ সামলা। শুধু মোহর কেন, যে কোন লোভকেই এখন সামলে সুমলে রাখ। ভাব ওগুলো মোহর নয়, ইয়ে কি বলে, ওগুলো হচ্ছে...ওগুলো হচ্ছে...আলু।’
    —‘আলু!’
    —‘হ্যাঁ হ্যাঁ আলু। কেন কি হয়েছে কি তাতে?’
    গবু কথা না বাড়িয়ে ধীর পায়ে সাবধানে মোহরের দিকে এগিয়ে গেল। জলজ্যান্ত মোহরগুলো কে আলু ভাবা কি চাট্টিখানি ব্যাপার। তাছাড়া মোহরের কাছে যেতেই কি ভয় করছে। কোথা থেকে আবার নতুন করে কি অশৈলী কান্ড শুরু হয়, কে জানে। অবশ্য মোহরের বস্তাটার কাছে পৌঁছে গবু দেখল নতুন করে কোথাও কিছু হল না। সত্যরঞ্জনও ঠায় চোখ বন্ধ করে আছেন। বালিঘড়িটাও যথারীতি শুন্যে ভাসছে। আর ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে জগা পাগলাও তাকে নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করে চলেছে। তার ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি।

    মোহরগুলো একএকটা বেশ ভারী। ওপরে কোনো রাজা বাদশার ছবি আঁকা। উলটো পিঠে শিলমোহরের ছাপ। হয়ত কোনো আদ্যিকালের রাজার টাঁকশাল থেকে চুরি করা। সবকটা মোহরই একরকম। গবুকে মোহরগুলো বস্তাবন্দী করতে দেখে, জগা পাগলাও এগিয়ে এসে হাত লাগাল।
    —‘কচি পটল গুলো বেশ সরেস কি বলেন?’
    —‘তা তো বটেই।’
    —‘তবে বাজারচকের কালুর সবজির দোকানের মতো নয়।’
    ‘তাও ঠিক’, গবু জগা পাগলা কে আমল না দিয়ে মোহরগুলোকে বস্তায় ভরতে লাগল।
    সত্যরঞ্জন চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওর সাথে বকবক করিসনি। জলদি কর, আমার পায়ের তলায় মাটিটা কেমন কাঁপছে।’
    গবুও টের পেল তার পায়ের তলায় মৃদু কম্পন। দ্রুত মোহর বস্তাবন্দী করার পর সে হাঁফ ছেড়ে উঠল।
    —‘হয়ে গেছে।’
    সত্যরঞ্জন বলে উঠলেন, ‘ওটা শিগগির জগা পাগলার পিঠে চাপা।’
    গবু তো ভীষন অবাক। এমনতো কথা ছিল না। জগা পাগলার পিঠ কেন, তার নিজের পিঠ কি দোষ করল।
    —‘আহ যা বলছি কর। ওর পিঠে মোহর গুলো থাকলে আমরা নিরাপদে থাকব। এখান থেকে বেরোবার সময় আবার কী বিপদ হয় কে জানে! ওসব নিজেদের কাছে না রাখাই ভালো।’
    গবু ভারী বস্তাটা জগার ঘাড়ে চাপাতেই সে দিব্যি মুঠো করে ধরল। তারপর গম্ভীর মুখে বলে উঠল, ‘লাশ টা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে ঠিক করলেন না মুখুজ্জ্যেমশাই।’
    সত্যরঞ্জন চোখ খুলে চীৎকার করে উঠলেন, ‘ওরে মনে হচ্ছে গোটা গুহাটাই ভেঙ্গে পড়বে। শিগগির ওকে হুড়ো দে, তাড়া কর।’
    গবু হাঁ করে সত্যরঞ্জনের দিকে চেয়ে রইল। ভয়ের চোটে শেষে কী ওঁর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল।
    ‘বুঝতে পারছিস না? জগা হয়ত জানে এখান থেকে কী করে বেরোতে হয়। ওকে তাড়া না করলে ও বেরোবে কেন?’
    —‘কিন্তু ওকে সেটা জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়।’
    ‘ওরে বুদ্ধু, ও তো পাগল, ওর কি মাথার ঠিক আছে?’ এই বলে সত্যরঞ্জন জগা পাগলার দিকে তেড়ে গেলেন।
    জগা একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘দেখুন আমি কিন্তু গোপীবাবুর গাছের আম চুরি করি না। তাছাড়া আমার পকেটে আমসত্ত্ব মোটেও নেই।’
    —‘গবু!’

    গবুকে আর বলতে হল না। সেও একছুটে জগা পাগলার সামনে এসে দাঁড়াল। জগা পেছোতে পেছোতে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। কাঁধের ভারী বস্তাটাকে সে অন্যকাঁধে নিয়ে হেসে বলল, ‘চোরপুলিশ খেলবেন বুঝি!’ তারপর গবুর দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ওই ওকে তাহলে পুলিশ হতে হবে।’
    সত্যরঞ্জন উপায়ন্তর না দেখে বলতে লাগলেন, ‘এই যাঃ যাঃ পালা, হুস হুস।’
    উৎসাহী হয়ে গবুও বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই পালা পালা, ভাগ, হ্যাট হ্যাট, আঃ চুঃ চুঃ।’
    এদিকে কম্পন আরোও বেড়েছে, এবার আর সেটা খালি মেঝে নয়, গোটা পাথরগুহাটাই ভয়ানক ভাবে কাঁপতে লেগেছে। সেসব দেখে সত্যরঞ্জন তুমুল হাত পা ছুড়ে জগা পাগলাকে রাক্ষস খোক্ষসের ভয় দেখাতে লাগলেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে সৌদামিনীর বাছা বাছা বাক্যগুলো শোনাতে লাগলেন। গবুও সুযোগ বুঝে লাফালাফি জুড়ে দিল।

    হঠাৎ কী ভেবে জগা গবু আর সত্যরঞ্জনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে সোজা বালিঘড়িটার দিকে দৌড় লাগালো। পড়ি কি মরি করে ওঁরাও পিছু পিছ ছুট লাগালেন। জগা সোজা বালিঘড়ির তলায় দাঁড়াতেই তীক্ষ্ণ শিসের মত আওয়াজ হল। সেই সঙ্গে কম্পন এত বেড়ে গেল যে মনে হতে লাগল কেউ যেন জামবাটিতে জাম ঝাঁকানোর মত করে পাথরগুহা ঝাঁকাচ্ছে।

    সত্যরঞ্জন পরিস্কার বুঝতে পারলেন বেরোতে হলে ঐ বালিঘড়ির তলায় গিয়েই দাঁড়াতে হবে, ম্যাপেও তো তাই লেখা আছে। জগা পাগলার কাছে ম্যাপ না থাকলেও কাকতালীয় ভাবে হয়ত সে রাস্তা খুঁজে পেয়েছে।
    আর দেরী না করে গবুকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে কোনরকমে টাল সামলে সত্যরঞ্জন বালিঘড়ীর নিচে ছুটে গিয়ে জগা পাগলার কোমর জাপটে ধরলেন।
    কম্পন প্রচন্ড বেড়ে গিয়ে প্রায় উথালপাথাল অবস্থা। মাথার উপর বালিঘড়িটা এখনো একইরকম ভাবে শুন্যে ঝুলে আছে। হঠাৎ জগা পাগলা কি ভেবে বেমালুম ঘড়িটাকে শুন্য থেকে আম পাড়ার মতো করে পেড়ে নিল। সত্যরঞ্জন তা দেখে আঁ আঁ করে চীৎকার করে উঠলেন। কিন্তু ফের তীক্ষ্ণ শিসের আওয়াজে তাঁর স্বর ঢাকা পড়ে গেল।

    পায়ের তলা থেকে মাটি সরছে। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে সত্যরঞ্জন শুনতে পেলেন জগা পাগলা বিড়বিড় করে বলছে, ‘ঢাকা খুলনা পুরী পাবনা, ঢাকা খুলনা পুরী পাবনা...’
  • T | 190.255.241.93 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২৩:৫৫691735
  • ১২.

    বনের অন্যপ্রান্তে নদীর ধারে চারজনে এসে উপস্থিত হলেন। বিকেল পেরিয়েছে। সূর্য ঢলে পড়েছে। পাখিরা সব সদলবলে বাসায় ফিরছে। নদীতে মৃদু স্রোত। গোবিন্দখুড়ো নদীর ধারে একটা বেশ বড় কালো পাথরের উপর বসে পড়লেন। এলোমেলো হাওয়ায় তাঁর চুল উড়তে লাগল।

    শতদল ঘোষ লাঠি নিয়ে এতটা পথ প্রায় তীর্থযাত্রীর মতো এসেছেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘এখানেই অপেক্ষা করতে হবে বুঝি?’
    খুড়ো বললেন, ‘যদি রুয়াৎ এর কবল থেকে বেরোতে পারে তাহলে এই খানেই দেখবে ওরা উদয় হবে।’
    গোপীনাথ কবিরাজমশাইয়ের গা ঘেঁষে একটা ঢিবির উপর বসেছেন। খুড়োর উত্তর শুনে প্রশ্ন করলেন, ‘আর না হলে?’
    —‘না হলে কোনদিনই ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওরা বুঝতেই পারবে না কখন ওরা দুম করে বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কেউ ওদের আর দেখতে পাচ্ছে না। পাথরগুহা থেকে বেরোনোর রাস্তা ওই একটাই। তবে বড় শক্ত। অপেক্ষা কর হে মাস্টার।’
    কবিরাজমশাই চোখ বুজে গোয়েন্দা আর তার শাগরেদের জন্য প্রার্থনা করছিলেন। এবার চোখ খুলে বললেন, ‘কিন্তু অসম্ভব নয়, তাই না?’
    —‘তা তো বটেই। তবে সেরকম মনের জোর কী ওদের আছে? তাছাড়া ঘড়িটাকে যে উলটে দেবার কথা তারই বা কী হবে?’
    শতদল ঘোষ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হঠাৎ বনের ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শুনে থমকে গেলেন। আওয়াজটা প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। শুনে মনে হচ্ছে যেন বিশাল বড় কোনো হাতি উন্মত্তের মতো ডালাপালা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগিয়ে আসছে। ঘোষমশাই তার লাঠিটা বাগিয়ে ধরলেন।

    এদিকে খুড়ো পাথরের উপর থেকে নেমে পড়েছেন। উত্তেজনায় তাঁর চোখমুখ চকচক করছে। গোপীনাথ আর কবরেজমশাই একটু সন্ত্রস্ত হয়ে খুড়োর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
    ‘বেঁচে গেছে মনে হচ্ছে, প্রশ্ন হচ্ছে দুজনেই বাঁচল কী?’ খুড়ো বিড়বিড় করে উঠলেন।
    বনের মধ্যে একটা বাজ পড়ার মতো আওয়াজ হল। তারপরেই সব চুপচাপ। একটা পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এল।
    খুড়ো বনের ভেতর যেখান থেকে আওয়াজটা এসেছে সেদিক পানে দৌড়োলেন। তাঁর পিছু পিছু শতদল ঘোষ, গোপীনাথ আর কবরেজমশাই।

    বনের ভেতর একটু এগোতেই দেখা গেল গবু এবং সত্যরঞ্জন হাত পা ছড়িয়ে চিৎপাত হয়ে এ ওর ঘাড়ে পড়ে আছেন। সংজ্ঞানহীন। একটু দূরে জগা পাগলা মস্ত বড় ঝোলা কাঁধে আঁতিপাঁতি করে কী যেন খুঁজছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার যেটা সেটা একটু দূরেই শুন্যে ভাসছে। খুড়ো একগাল হেসে সেদিকে এগিয়ে গেলেন।

    কবিরাজমশাই নদী থেকে কোঁচাখানা জলে ভিজিয়ে চোপা চোপা করে ওঁদের মুখে জল ছিটোতেই সত্যরঞ্জন আঁকুপাঁকু করে উঠে বসলেন। কিছুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার পর ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কবিরাজমশাই, আমার পুরো দেহটাই কি দেখা যাচ্ছে?’
    কবিরাজমশাই স্মিত হেসে বললেন, ‘চিন্তা কোরো না। পুরোটাই আছে। ধন্যি সত্যরঞ্জন। খেল দেখালে বটে।’
    গবুও উঠে বসেছে। কবিরাজমশাই তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘তুমিও কম যাওনা বাপু।’

    ওদিকে গোবিন্দখুড়ো বালিঘড়িটা বগলদাবা করেছেন। ধীরে সুস্থে সেটাকে গামছাচাপা দিয়ে সত্যরঞ্জনের সামনে নিয়ে এসে ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে লাগলেন। তা দেখে গবুর গা পিত্তি জ্বলে গেল। সত্যরঞ্জন রেগে মেগে বলতে লাগলেন, ‘খুব যে হাসছেন, জানেন ওই বনের ভেতর কি আছে। জানেন কি সাংঘাতিক রকম বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমরা আপনার গুপ্তধন উদ্ধার করেছি, বলতে গেলে একরকম ওটা তো আমাদেরই, কই কোথায় সেটা, জগা পাগলা কই।’

    তখন সবাই ব্যস্ত হয়ে জগা পাগলাকে খুঁজতে লাগল। শেষমেশ শতদল ঘোষ তাকে করমচা গাছের পেছনে দেখতে পেলেন। তার কাঁধে তখনো মোহর ভর্তি ব্যাগ। জগা পাগলা ব্যাগটা ধপাস করে সত্যরঞ্জনের পাশে রেখে বলল, ‘এই নিন আপনার বেগুন, খেত থেকে এর বেশী আর পেলাম না।’
    সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাগ থেকে মোহর গুলো বার করে দেখতে লাগল। একটা মোহর দেখে গোপীনাথ বললেন, ‘এ তো গুপ্তযুগের মনে হচ্ছে।’
    খুড়ো মাথা নেড়ে বললেন, ‘তোমার ভুল হচ্ছে হে মাস্টার। গুপ্ত ফুপ্ত নয়, এ হল জমিদারবাড়ীর টাঁকশালে তৈরী মোহর। একেবারে আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি।’
    সত্যরঞ্জন তেরিয়া হয়ে বলে উঠলেন, ‘কিরকম, কিরকম। উদ্ধার করলাম আমরা, আর এখন আপনি জমিদারবাড়ীর বললেই হল।’
    কবিরাজমশাই তাঁকে শান্ত করে বললেন, ‘আহা খেপছ কেন। এ বিষয়ে পরে একটা শান্তিপুর্ণ সমাধান করলেই হবে। আপাতত গা ঝাড়া দিয়ে ওঠ, বাড়ী চল। তোমার গিন্নী তো ওদিকে নাওয়া খাওয়া ছেড়েছেন। কই হে গোবিন্দ এবার তোমার কাজ শেষ কর।’
    ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই যে’, গোবিন্দখুড়ো গামছা সরিয়ে ঘড়িটা বের করলেন। উজ্জ্বল নিলাভ রঙে চারপাশ ছেয়ে গেল। ঘড়ির গোলাপী রঙের খোপ সাদা গুঁড়োতে প্রায় অর্ধেক ভর্তি হয়ে গেছে। খুড়ো ধীরে সুস্থে এবার সেটাকে উলটে দিলেন। সাদা গুঁড়ো গোলাপী খোপ থেকে নীল খোপের ভেতর পড়তে লাগল। মহা খুশি হয়ে খুড়ো সকলের দিকে চেয়ে একবার মুচকি হেসে নিলেন।
    —‘ব্যস, আর কিছু না?’ কবিরাজমশাই বিস্মিত।
    ‘না হে কবরেজ, আর কিছু নয়।’ খুড়ো এই বলে ফের ঘড়িটাকে গামছা মুড়ী দিলেন। তারপর একগাল হেসে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলতে হে, এতদিন অমানুষ ছিলাম, এইবারে পাকাপাকি মানুষ হব।’

    সত্যরঞ্জন কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়েছিলেন। কবিরাজমশাই তাঁর মনের অবস্থা আন্দাজ করে পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘চল হে যাওয়া যাক, যেতে যেতে তোমাকে সব খুলে বলব খন।’

    সবাই মিলে উঠে পড়ে নদীর দিকে হাঁটা দিলেন। নদীর পাড় বরাবর চললে সোজা বাদাপুর ঘাট। সেখান থেকে হাঁসপুকুর বাজার চক বড়জোর দুক্রোশ। পা চালিয়ে চললে খুব বেশী রাত হবে না। বস্তাটা যেহেতু বেশ ভারী সেজন্য গোপীনাথ আর শতদল পালা করে বইতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে খুড়ো আর জগা পাগলার মধ্যে কালীগঞ্জের হাটে গামছার দর কত তা নিয়ে এক অদ্ভুত রকম আলোচনা শুরু হল। সত্যরঞ্জন কবিরাজমশাইকে তাঁদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বলতে বলতে চললেন। গবু হাত পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল সামনের বুনো লতাপাতার ঝোপের পাশে একখানা মোহর পড়ে আছে। কোনো সময় বস্তা থেকে পড়ে গেছে হয়তো। কাউকে কিচ্ছু না বলে মোহরখানা পকেটস্থ করে সে খুশি মনে হাঁটা দিল।

    আকাশে চাঁদ উঠে পড়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বনের ভেতর থেকে শেয়াল আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে একজন ওদের চলে যাওয়া বিষন্ন মনে লক্ষ্য করল। তারপর ট্যাঁক থেকে নস্যির কোটো খুলে একটিপ নস্যি নিয়ে ফের বনের মধ্যে ঢুকে গেল। তাকে অবশ্য কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। তবে গগনবাবু শুনলে আশ্চর্য হতেন যে তাঁর চাকর ঝিকু মিঞা পৃথিবীর মায়া কাটালেও, নস্যির মায়া কাটাতে পারেনি।

    (শেষ)
  • | 11.39.84.240 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:২৯691736
  • কুডোস।
    অসম্ভব ভাল। আমার মত ঘুমকাতুরেকেও জাগিয়ে রেখেছে।
  • rabaahuta | 215.174.22.20 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৩০691737
  • তুমুল।

    আচ্ছা, ঘোষেদের গোয়ালে কি হয়েছিল সেই ব্যাপারটা জানা যায়না?
  • Binary | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৪691738
  • দারুন লাগলো । লেখায় বেশ শীর্ষেন্দু স্টাইল আছে ।
  • T | 190.255.241.93 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৯691739
  • তোমাদের ভালো লেগেছে শুনে খুশি হলুম। ধন্যবাদ।

    হুতোদা :),
  • sosen | 177.96.16.66 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:০৩691740
  • ভালো হচ্ছে, আমার সমালোচনা আছে কিন্তু লেখা শেষ হলে বলবো ;)
  • sosen | 177.96.16.66 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:০৪691741
  • এমা, শেষ কি রে
  • T | 190.255.241.93 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:১৯691742
  • সোসেনদি, এখানেই শেষ তো। পাঁচ বছর আগে, কলেজ ম্যাগাজিনের জন্য লেখা। আজ, পুরোনো হার্ড ড্রাইভ ঘাঁটছিলাম, দেখতে পেয়ে এখানে পোস্ট করলুম। ইলাসট্রেশনের কপি গুলো খুঁজে পেলুম না। আছে নিশ্চয়ই কোথাও।
  • sosen | 177.96.16.66 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:০২691744
  • আমি তো এই পোস্টটা আদ্ধেক লিখে চলে গিয়েছিলাম কাজে। ফিরে এসে পোস্ট করে দেখি গল্প শেষ!
  • achintyarup | 125.187.53.68 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:২৯691745
  • হেব্বি কিন্তু! সাধু সাধু। আরও লেখ দিকি
  • 4z | 86.68.72.238 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৫:৪২691746
  • ফ্যান্টাবুলাস হয়েছে!
  • dd | 116.51.28.112 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৮:৪৪691747
  • ভয়ংকর ভালো হয়েছে। এক্কেবারে ভালো
  • Abhyu | 81.12.53.208 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৮:৫৮691748
  • খুবই ভালো লেখা। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের লেখা পড়ছি মনে হল। হুতো কটা ছবি এঁকে দিক?
  • b | 135.20.82.164 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৯:০০691749
  • ইকডু শীর্ষেন্দু আছেন।
  • | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৯:০৫691750
  • ইলাসট্রেশানগুলো পেলে পোস্ট করে দিস।

    পাঁচ বছর আগে লেখা। বেশ। কথা হল এখন লিখলে নিশ্চয় এই প্রবল শীর্ষেন্দু গন্ধটা থাকবে না, তাই তো? শীর্ষেন্দুগন্ধ ছাড়া এরকম ধরণের অন্য গল্প পড়তে চাই।
  • T | 24.100.134.177 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৯:৩৭691751
  • সব্বাইকে থ্যাঙ্কু।

    দ দি, এ তো শীর্ষেন্দুকে নকল করেই লেখা। ইচ্ছাকৃত। আসলে আমি চেষ্টা করে দেখছিলুম। ফাইজলামো একপ্রকার। ঐ শীর্ষেন্দু গন্ধ বাদ দিয়ে অন্য গল্প লিখছিলাম তো। যথারীতি বাদবাকী সমস্ত কিছুর মতো সেসবও আর শেষ করা হয়নি। দাঁড়াও, মার্চের শেষে বাড়ি ফিরব। তখন ট্রাই মারিবেক।
  • T | 24.100.134.177 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৯:৫৪691753
  • নাকি 'আলস্য'...গুলিয়ে যাচ্ছে।
  • Abhyu | 138.192.7.51 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৯:৫৯691755
  • বাঃ দারুণ ইলাস্ট্রেশন
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন