এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ০৮:২২719435
  • গল্পকথা--১
    ------------
    নাগপাশ
    ------------------
    গঙ্গারামদা, আপনি 'অগ্নিসাক্ষী' সিনেমাটা দেখেছিলেন?
    -- কোনটা? সেই যে মনীষা কৈরালাকে বউ করে স্বামী নানা পাটেকরের সিন্দুকের মত আগলে রাখা? ওকে নাচতে না দেওয়া? ওকে গান শুনতে বা অন্যদের সঙ্গে মিশতে না দেওয়া? এক অসহ্য অবাস্তব পুরুষালি অধিকারবোধের গল্প?
    -- হ্যাঁ। ওটাই। অসহ্য তো বটেই, কিন্তু অবাস্তব নাও হতে পারে।
    -- ধেৎ; আমার কলিগ মহারাষ্ট্র মন্ডলের নাট্যপরিচালক জোগলেকরই জোরাজুরি করে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। দূর! আবার নানা পাটেকরের ওই ম্যানারিজমে ভরা অ্যাক্টিং?
    --দাদা, আবার বলছি আপনার সব কথাই সত্যি, কিন্তু গল্পটা খুব অবাস্তব নয়।
    --- তোরা মারাঠিরা না! যা তা! জোগলেকরও বলেছিল --অবাস্তব নয়। এমন ঘটতে পারে, কোটিকে গোটিক, কিন্তু হয়। ছাড়্‌ ফালতু কথা। বল্‌, কেন এসেছিস? শুধু চা খেতে? না সাতসকালে বাড়ি বয়ে নানা পাটেকরের জন্যে ভক্তিগীতি শোনাতে?
    --- ঠিক তা নয়। কিন্তু যদি বলি যে আপনাকে চাক্ষুষ প্রমাণ দেখাতে যে অগ্নিসাক্ষী সিনেমাটা একেবারে গাঁজাখুরি নয়?
    --- তোর কী মাথা খারাপ ? আমাকে কি তোর সঙ্গে মুম্বাই যেতে হবে? আর ফিল্মের পরিচালক বা নানা পাটেকরের সঙ্গে দেখা করতে হবে?
    --- না; যেতে হবে জবলপুরে। শুধু মনীষা কৈরালার কাছে।
    --আচ্ছা? উনি আজকাল জবলপুরে থাকেন নাকি? নেপালে ফিরে যান নি?
    --- আমি সিনেমার কথা বলছি না। সত্যিকারের এক অন্য মনীষার কথা বলছি। ওকে ওইরকমই এক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে আনতে হবে।
    --- আমার বয়ে গেছে। আমি এই বয়সে কেন এ সব ফালতু ঝামেলায় জড়াতে যাব? আমার লাভ? আর এই গরমে জবলপুর? মাথা খারাপ?
    --- ধৈর্য্যং রহু। সবগুলো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছি,--একটা একটা করে।
    আমি জানি আপনি যাবেন। কারণ এই মনীষা আপনার খুব পরিচিত, একেবারে ছোটবোনের মত। লাভ? নিজের চোখে দেখতে পাবেন আর এক 'অগ্নিসাক্ষী' সিনেমা, যার কুশীলব আমাদের দুজনেরই পরিচিত।
    আমার মাথা ঘুরে যায়। তুই কার কথা বলছিস? জবলপুরের মনীষা? আমাদের চেনা? মনীষা খারে? আমাদের নাটকের দলের একচেটিয়া নায়িকা? ও তো বহুদিন থিয়েটারের থেকে দূরে সরে গেছে। ভাইয়েরা ছোট, সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে জবলপুরের কোন প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছে।ওকে দেখতে যেতে হবে?
    হ্যাঁ, যেতে পারি। কিন্তু এখন হেড অফিসে আছি, ছুটি পাওয়া মুশকিল। এক খেঁকুরে স্বভাবের পাঞ্জাবী জি এম এসেছে।
    -- দাদা, এর আগে ইউনিয়নের কাজে বহুবার ছুটি ম্যানেজ করেন নি? গল্প বানিয়ে ছুটি নেওয়ার টেকনিক নিয়ে একটা বই লিখেছেন শুনলাম। ভালই বিক্রি।
    -- এবার মার খাবি। কিন্তু একটা কথা বল।-- এই গল্পের নানা পাটেকরকেও কি আমি চিনি?
    -- অবশ্যই; নাম বলব। কিন্তু আগে আজ আর কাল এই দু'দিনের জন্যে সি এল এর দরখাস্ত লিখুন, আমি আপনার হেড অফিসে গিয়ে এইচ আর এর কাছে পৌঁছে দিয়ে আসব। তারপর ট্রেনের টিকিট কাটব। হাতে মাত্র দু'ঘন্টা। একরাত্তিরের মত ব্যাগ প্যাক করে নিন। আমরা আজ রাত্তিরে পৌঁছে কাল সন্ধ্যেয় ফিরে আসব। ডিটেইল্স পরে বলব।
    এইভাবে আমার থেকে কথা আদায় করে সি এল এর দরখাস্ত পকেটে পুরে স্কুটি চেপে উধাও হল নিখিল। নিখিল ধারকর। আমাদের অগ্রণী থিয়েটার এর পরিচালক।
    ব্যাগ প্যাক করতে তো পাঁচ মিনিট। কিন্তু মনীষার হয়েছেটা কী? এমন কী বিপদ যে আগে থেকে বলা নেই, কওয়া নেই --- আজকেই জবলপুরে দৌড়তে হবে?
  • কান্তি | 113.26.218.14 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ১০:৩৯719446
  • কতক্ষণ এভাবে দম বন্ধ হয়ে ঝুলতে হবে?
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ১১:১৩719457
  • ২)
    মনীষা খারে। ছোটখাটো দেখতে মেয়েটি আসলে একটা ডায়নামাইট। মানে আমাদের ছত্তিশগড়ের গাঁইয়া শহরে আমরা এরকমই ভাবতাম। কলেজে পড়তে পড়তেই অভিনয় দক্ষতার গুণে অনেকের সম্ভ্রম আদায় করে নেয়।
    তারপর নিখিল, ধীরেশ আর ও--তিনজনে মিলে শহরের প্রথম রেজিস্টার্ড নাটকের দল বানায়। গরমের ছুটিতে মে মাসের ৪৪ ডিগ্রি আগুনের হলকার মধ্যে চারদিন ধরে শহরের চারটি মোড়ে ভিড়ের মধ্যে সকাল সন্ধ্যে নুক্কড় বা স্ট্র্রীট-কর্নার নাটক করে সংবাদপত্রের খবর হয়। পরিচালনার ব্যাপারটা দেখত জবলপুরের বড় দল থেকে আসা নিখিল। স্টেজক্র্যাফ্ট ও মিউজিক ধীরেশ ফনসালকর , কিন্তু স্ক্রিপ্ট নির্বাচন, সম্পাদন ও রিহার্সালের ব্যবস্থা --এসবই ছিল মনীষার জিম্মায়। ঘরের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। কিন্তু হিন্দিতে নাটক , কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্য পাঠ ওকে দলের মধ্যে আলাদা জায়গা করে দিয়েছিল। বিশ্ব নাট্য দিবস ও হিন্দি নাট্য দিবসে বিভিন্ন সিম্পোসিয়ামের আয়োজন---খোলা পার্কেই সই-- সব ওর মাথা থেকেই আসত। ও অনায়াস সারল্যে অগ্রাহ্য করত বাবার রক্তচক্ষু এবং পাড়ার মর‌্যাল কাকু ও কাকিমাদের টিপ্পনী।
    নাটকের প্রয়োজনে সারারাত স্টেজেই কাটানো বা ছেলেদের সঙ্গে রেলগাড়ি করে অন্য শহরে গিয়ে দুদিনব্যাপী প্রতিযোগিতায় অভিনয় করে আসা ওর কাছে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই সহজ।
    একটা সময়ের পর ও ভাবল অভিনয়কেই পেশা করবে। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার পটভূমিকায় লেখা হিন্দি উপন্যাস, "মুঝে চাঁদ চাহিয়ে" (আমার চাঁদ চাই) ছিল ওর প্রেরণা।
    ছত্তিশগড়ের ও বাড়ির পরিবেশের সীমাবদ্ধতা বুঝে ও শহর ছাড়ল। হাজির হল মামাবাড়িতে, ওখানে থেকে আইন পড়বে আর রাত্তিরে নিখিলের পুরনো দলে রিহার্সাল দেবে।
    কয়েকমাস পরে মামাবাবু বুঝে গেলেন যে ভাগ্নী এখানে পড়াশুনো করতে আসে নি। তারপর রাত্তিরে দেরি করে বাড়ি ফেরে। শেষে দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে উনি ভাগনীকে দরজা দেখিয়ে দিলেন।
    বলিলেন--- পিতৃগৃহে ফিরিয়া যাও, উহাই তোমার আসল ঠাঁই, যদ্দিন না বিবাহ হয়।
    দিদিকে বলিলেন-- ভাগিনেয়ীর বায়ু কুপিত হইয়াছে; শীঘ্র বিবাহের জোগাড় দেখ। অন্যথা সমূহ বিপদ।
    ও বাড়ি ফিরে গেল না। একটি জুনিয়র দলের সঙ্গে বাড়িভাড়া শেয়ার করে জবলপুরেই থাকতে লাগল আর ছোটখাট অস্থায়ী চাকরি খুঁজে পেট চালাতে লাগল। কখনও কোন কম্প্যু সেন্টারের জন্যে ক্যাম্পেন, কখনো নোকিয়া মোবাইলের শপে হিসেবপত্তর দেখা বা কোন নতুন প্রাইভেট স্কুলের হয়ে অফিস সামলানো।
    ধীরে ধীরে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ কমতে লাগল। আমাদের লিঙ্গোতে মনীষা বিলাসপুরিয়া থেকে জবলপুরিয়া হয়ে গেছে।
    তবু এক ক্রিসমাসের ছুটিতে গোরখপুরের শীতকালীন নাটক প্রতিযোগিতায় আমরা গলা ফাটাই জবলপুর টিমের মনীষার জন্যে, ও যে দুলারীবাঈ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয়ের সুবাদে কুড়িটি দলের প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরষ্কার জিতেছে!
    না, সে বছর আমাদের বিলাসপুরিয়া টিম কোন পুরষ্কার পায় নি।
    ফেরার সময় আমরা প্রচন্ড শীতের মধ্যে গোরখপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে বসে পায়চারি করে রাতটা কাটাই। ভোরের ট্রেন। দুটো টিম একই ট্রেনে ফিরবে।
    মাঝরাতে জবলপুরের পরিচালকের খেয়াল হল ওদের পুরষ্কার বিজেতা অভিনেত্রীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ১১:৪৪719468
  • খোঁজ, খোঁজ , খোঁজ!
    ক্রিসমাসের ছুটি। প্ল্যাটফর্মে বেজায় ভিড়। আমরা কাছাকাছি সব চা-পান-বিড়ির কিওস্ক ও গলিঘুঁজি পায়ে হেঁটে চষে ফেলি। তবে ভয় অনেকটাই কেটে গেছে। কারণ ও একা নয় আমাদের বিলাসপুরিয়া টিমের পরিচালক নিখিলকেও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এখন সাড়ে চারটে বাজে। একঘন্টা পরে ট্রেন। এই জোড়া গেল কোথায়? অবশেষে দেখা গেল ওরা কাছেই মালগাড়ির সাইডিং এর আড়ালে এক কোণায় বসে মগ্ন হয়ে কথা বলে চলেছে, বলে চলেছে।
    জবলপুরের বড় টিম। সফল নামী পরিচালক। কড়া নিয়মশৃংখলায় বিশ্বাসী রোম্যান ক্যাথলিক। উনি তেতো মুখে আমাকে বললেন-- আপনাদের দলের ব্যর্থতার বড় কারণ ডিসিপ্লিনের অভাব। আপনি বয়সে বড়। দলের ম্যানেজার। বেশি লাই দেবেন না, মাথায় তুলবেন না।
    নিখিল ও মনীষার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব নিয়ে আমরা বেশ উৎসাহী ছিলাম। মারাঠি ব্রাহ্মণ ও ইউপির কায়স্থ; বেশ তো!
    এরপর মনীষা নিখিলের অনুরোধে আমাদের কল শো চেখভের 'ম্যারেজ প্রপোজাল' এ রোল করে গেল। সেই আগের মত হৈচৈ করা প্রাণবন্ত মনীষা। বলল-- বড় দলের সঙ্গে পোষাচ্ছে না। আর ছোট দলের দুজন মুম্বাইয়ের মায়ানগরীতে গেছে ভাগ্যান্বেষণে; আপাততঃ সিরিয়াল ভরসা! কাজেই ওর অভিনয় কম করে সর্বক্ষণের চাকরি খোঁজা দরকার। ছোট ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে, ওর সঙ্গে রাখবে; ওকে পড়িয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করাবে। একটা এড্স্‌ নিয়ে প্রচারমূলক ফিল্মে অভিনয়ের প্রস্তাব এসেছে--দশহাজার টাকা দেবে। ভাবছিল লুফে নেবে-- দশহাজার যে অনেক টাকা।
    কিন্তু নিখিল বলেছে--প্রোডিউসাররা হঠাৎ নবাব ফোতো কাপ্তান। ফিল্ম পুরো হোক বা নাহোক, অন্য কিছু আগেই হয়ে যাবে। কাজেই না করে দিয়েছে।
    একবছরের মধ্যে যোগাযোগ আরও ক্ষীণ হয়ে যায়। কারও কারও মনে হচ্ছিল ও কোন কারণে আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছে। বিলাসপুরে বাড়িতে এলেও আর দেখা করে না। খবরও দেয় না।
    জবলপুর জানায় যে ও নাটক থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে।
    একদিন নিখিলকে চেপে ধরলাম। ওর ব্যাপারটা কী বলত? সেদিন পেট্রোল পাম্পে দেখা হল। স্কুটিতে তেল ভরছিল আমি এগিয়ে গিয়ে বলাম-- কী রে! ভাল আছিস?
    ও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে ভাইকে বলল --তাড়াতাড়ি কর। আর আমাকে বলল একটু তাড়া আছে। তুই কী বুঝছিস?
    --- আমিও ছাই কিছু বুঝতে পারছি না। আমাকেও এড়িয়ে গেল। মরুক গে! ওর কথা ছাড়ুন, রবীন্দ্রনাটকের প্রোডাকশান নিয়ে কী ভাবছেন সেটা বলুন।
    তারপরে দুটো বছর গড়িয়ে গেছে। মনীষাকে নিয়ে আমরা একবারও কিছু ভাবি নি। আমাদের গরজ নেই। এখন গরজ ওর বাবা-মার।
    এদিকে আমার কল্পনায় জল ঢেলে নিখিলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ওদের পারিবারিক সূত্রে চেনা মারাঠি পরিবার, জবলপুরের। বিয়েটা শীতকালে হবে।
    দিব্যি সব চলছিল, এখন এই বিবাদী সুর। সাতসকালে নিখিল এসে হাজির। মনীষার বিপদ, কোন বড় ঝামেলা। প্রায় অগ্নিসাক্ষী সিনেমার মনীষা কৈরালার মতই। কী সেটা?
    নিখিল স্টেশনে যাওয়ার আগে খুলে বলবে বোধহয়।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ১২:০৪719470
  • চেখভের ঐ একাঙ্ক নাটকের বাংলা রূপান্তর করেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, নাম- "প্রস্তাব"। একটা অসম্ভব ন্যাকা মেয়ে এই নাটকের মূল চরিত্র, তাই না?
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ১২:১০719471
  • কুমড়োপটাশ,

    ঠিক। তবে রমেন লাহিড়ি ও রুদ্রপ্রসাদও করেছিলেন।
    আমরা হিন্দিতে এন এস ডি দিল্লির স্ক্রিপ্ট ফলো করতাম।
    তবে শুধু ন্যাকা বলে নয়। নাটকটিতে দুই পড়তি জমিদার পরিবারে বিয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনটে পাত্রই ( আইবুড়ো বদরাগী মেয়ে,ওর খেঁকুরে বাপ এবং অমনি বিয়ের অপেক্ষায় বসে থাকা পাশের এস্টেটের জমিদারনন্দন) মূল কথা ভুলে গিয়ে জমির মালিকানাসত্ত্ব ও কার কুকুরের পেডিগ্রি ভাল সেই নিয়ে তক্কাতক্কি/বচসা/হাতাহাতি ও পরস্পরের কুচ্ছো গাওয়ায় জড়িয়ে পড়ল। হিলারিয়াস স্ল্যাপস্টিক কমেডি!
  • ঝর্না | 125.117.218.119 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ১২:১৬719472
  • ভালোলাগছে পড়ে...।দারুন হতে চলেছে গল্পটা...
  • | 213.132.214.84 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ১৩:৫৯719473
  • তারপর?
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ১৬:০৬719474
  • ৩)
    নিখিল
    ---------
    কীই বা বলতে পারি গঙ্গাদাকে!
    আসলে সব কিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল। বছর দুই হয়ে গেল মনীষা আর আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখে না।যখন বাপের বাড়ি আসে হোলি বা দীপাবলীতে তখনও না। কয়েকবার আমিই এগিয়ে গেছি, ভেবেছি রাগ হয়েছে।
    কিন্তু এমন কোল্ড যে নিজেকে অপমানিত মনে হয়েছে। আমার দোষ কোথায়? আরে নাটক করবি না তো কী হয়েছে, কতজনই তো এল আর গেল। কেউ বাইরে চাকরি পেল, তো কেউ এই শহরেই বিয়ে করে বৌ-বাচ্চা নিয়ে সংসার পেতে বসল। তাবলে কি বন্ধুত্ব চলে যায়? হয়ত একটু ভাঁটা পরে। ওরা এখন আমাদের বড় নাটকগুলোতে বউবাচ্চা নিয়ে টিকিট কেটে দেখতে আসে। শো শেষ হলে বৌকে নিয়ে স্টেজে চড়ে, গ্রীনরুমে যায়; একসঙ্গে গ্রুপ ফোটো তোলে।
    এতদিন পরে মাত্র ছ'মাস আগে মাকে জানিয়েছি, তোমরা চেষ্টা কর, আমার অমত নেই। শ্রী আপ্টের সঙ্গে ঠিক হল। যখন জবলপুরে কলেজে পড়তাম তখন ও আমাদের পাড়ার মাঠে খো-খো খেলত। এত বছর পরে ওকে দ্খে চিনতেই পারিনি। সেই দুরন্ত চুলবুলি লাফিয়ে এসে চাঁটি মেরে খো' বলা মেয়েটা কিরকম শান্ত হয়ে গেছে।
    না, আমি শ্রীর মধ্যে মনীষাকে খুঁজিনি। অত ন্যাকাবোকা আমি নই।
    গঙ্গাদা একটু অবাক হয়েছিল। তারপর বলল--তুইই বা কী করবি? অপেক্ষারও লিমিট আছে।
    গঙ্গাদা বরাবর আমাদের প্রোটেকশন দিয়ে গেছে। সেবার ওয়ার্কশপের মাঝখানে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের টিচার আমাদের দুজনের অন্তরঙ্গ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাতে ওর পেছন থেকে এসে লাফিয়ে আমার কাঁধ ধরে ঝুলে পরা থেকে শোয়ের পরে প্রপার্টি সামলাতে সারারাত আমার সঙ্গে স্টেজের উপর রাতকাটানো সবই ছিল।
    সবকিছু শুনে গঙ্গাদা বলল-- শুনুন, উৎপল দত্ত বলেছেন যে অভিনেতারা হল আবেগের ব্যবসায়ী। কিছু বুঝলেন? তাই এরা আবেগে ডুববে ভাসবে-- এর মধ্যে কারও কারও সঙ্গে অন্যরকম কেমিস্ট্রি গড়ে উঠবে --এটাই নিয়ম। নইলে ভাল অভিনয় হয় না। আমার কথা না মানেন তো দিল্লি গিয়ে এন এস ডি বা ভোপালের ভারত ভবনের হোস্টেলে থেকে আসুন দুচারদিন।
    আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সবটা বোধহয় বুঝিনি। বুঝলাম কয়েক বছর পরে , মনীষা যখন পুরোপুরি জবলপুরের দলের সদস্য।
    আমাদের মনীষা সেবার বিলাসপুরে এল জবলপুরের দলের সঙ্গে-- কল শো' করতে, ভাবা যায়! আর নাটকটাও ছিল জব্বর। হাবিব তনবীরের ছত্তিশগড়ি ভাষায় "চরণদাস চোর"। মনীষা রাণীর রোলে আর চোর চরণদাস করেছিল ওই দলের বেস্ট অ্যাক্টর--আমার পুরনো বন্ধু রোশন।
    আমাদের গুরু মানে ওই দলের ডায়রেক্টর রোমুলাস শেষের কম্পোজিশন অন্যরকম করেছিলেন। শেষ দৃশ্যে চরণদাস যখন নিজের পণরক্ষা করতে রাণীর প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল, আর রাণী হুকুম দিল ওকে শূলে গেঁথে ফেলতে --সীনটা দারুণ হয়েছিল।
    রক্ষীদের উদ্যত শূলের সামনে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চরণদাস রোশন প্রেমের প্রস্তাবে না করল আর ওরা শূলে গাঁথা চরণ্দাসকে শূন্যে তুলে ধরল। একই সঙ্গে হাহাকার করে রাণী মনীষা মাটিতে পড়ে গেল। দর্শকদের তুমুল ক্ল্যাপের মধ্যে পর্দা নামল ধীরে ধীরে।
    আমার পুরনো টিম, তাই রোমুলাস স্যারের কথায় আমি উইংসের মধ্যে থেকে লাইটটা দেখছিলাম। এবার হাসিমুখে স্টেজে ঢুকে দেখি মনীষা ফ্লোরে লুটিয়ে পরে কাঁদছে। ওর হাহাকার থামছে না। কোথায় রাণীর হাহাকার ওর ভেতরে কোন চেপে রাখা কান্নার উৎসমুখ খুলে দিয়েছে --- কে বলতে পারে!
    কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে রোশন। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কানের গোড়ায় কত কি ফিসফিসিয়ে বলছে।
    আমার যা করার ছিল তাই করলাম। এক-পা, দু-পা করে পিছিয়ে এলাম। তখনই জীবনে প্রথমবার মনীষাকে নিয়ে বুকের মধ্যে একটা কাঁটা বেঁধার জ্বালা অনুভব করলাম। জেলাসি? হবেও বা।
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ১৯:০৭719436
  • কিন্তু মনীষার ছোট বোন মেঘনার বিয়ে সব পালটে দিল। গত সপ্তাহে ওর ভালভাবে বিয়ে হয়ে গেল। আমি তো ওদের পরিবারের সব দায় সামলাতেই আছি। মনীষা প্রবাসী হলেও মেঘনা আর তার ছোট প্রমীলা আমাদের দলের ব্যাকস্টেজের কাজকম্মে যুক্ত।
    তাই আমি কার্ড ছাপানো, ডেকরেটারের সঙ্গে কথা বলা, বরযাত্রীদের আপ্যায়ন সব কিছুই নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছি।
    মনীষা এসেছে, বিয়ের মাত্র দুদিন আগে।
    কিন্তু এ কোন মনীষা? চোখের কোণে কালি, কন্ঠার হাড় উঁচু হয়ে ভেসে ওঠা, বয়েস যেন পাঁচবছর বেড়ে গেছে। ওর মা বাবা থেকে শুরু করে আত্মীয়পরিজন সবারই চোখে লেগেছে।
    আমার চোখে চোখ পড়লেই অন্যদিকে তাকাচ্ছে। কাজেই আমিও চুপ। আমিও মানুষ, ভিখিরি নই।
    বিয়ের পর দিন বরবউ সন্ধ্যেবেলা বিদেয় হয়ে গেলে প্রমীলা এসে বলল-- দিদি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
    আমি মাথা নাড়ি। আমার কিছু বলার নেই।
    দুটো দিন কেটে গেল। এবার মেঘনা আর জামাই দ্বিরাগমনে এখানে আসবে। তার আগের দিনই মনীষা ফিরে যাবে জবলপুর। ওখানে অফিসে নাকি কিছু কাজ আটকে আছে, ওকে ছাড়া চলবে না।
    আবার প্রমীলা এল চায়ের কাপ নিয়ে। পেছন পেছন মনীষা। আমার দিকে কড়া সুরে বলল-- দিদি কাল চলে যাবে। তার আগে আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে নিতে চায়। ও বিপদে পড়েছে। আপনি ছাড়া আর কাকে বলবে? গোঁ ধরে থাকলে চলবে? এবার আপনারা ঠিক করুন, কী করবেন। আমি কাটি।
    খালি ঘর। খানিকক্ষণ আমরা দুজনেই চুপ। আশকথা পাশকথা দিয়ে শুরু হয়।
    ও আসল কথায় আসার আগে ওর বাবা এসে গল্প শুরু করলেন। মিনিট পনের কাটিয়ে দেবার ব্যর্থ চেষ্টার পর ওকে ইশারা করে বাইরে এনে স্কুটি চাপিয়ে কাছের ছোট স্টেশন বিসেনপুরে নিয়ে গেলাম। সেখানে খালি ওয়েটিং হলে বসে কথা শুরু হল। সব শুনে বললাম- এতদিন বলিস নি কেন? কেন কথা বলা বন্ধ করে দিলি?
    -- বলার চেষ্টা করেছিলাম। তুমি বুঝতে চাও নি। তোমার ছোট বেলার বন্ধুর সম্বন্ধে কোন নেগেটিভ ইশারা -- তুমি সিগন্যাল রিসিভ কর নি।
    এতদিন এত কিছু করেছ, কিন্তু আমার যখন সবচেয়ে সাহায্যের প্রয়োজন তখন কোথায় তুমি?
    রাত বাড়ছে। এই নিরালা নির্জন পাতি স্টেশনে এত রাতে দুজনে বসে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই ওকে নিয়ে আমার বাড়িতে গেলাম।
    মাকে বললাম-- আয়ী! এর সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে। আজ রাত্তিরে ও আমাদের বাড়িতে থাকবে, আমার ঘরে। কথা শেষ হতে সারারাত্তির লাগতে পারে।
    রাত্রিশেষে ওকে বললাম-- তোকে চাকরি ছেড়ে ওখান থেকে চলে আসত্রে হবে।, ওখানে
    --তা হয় না নিখিল । আমি পালিয়ে যেতে চাইনে।
    -- এছাড়া কোন উপায় দেখছি না। জবলপুরের ওই শহরের বাইরে ফ্যাকটরি এলাকায় রোশনের হাত থেকে তোকে বাঁচাতে পারব না। তুই এখন ফিরে যা। সাতদিন। সাতদিনের মাথায় আমরা আসছি--তোকে বিলাসপুরে ফিরিয়ে আনতে। না, কোন ওজর আপত্তি শুনব না। এখন ওঠ, তোকে তোর ঘরে ছেড়ে দিয়ে আসি।
  • Titir | 138.210.106.129 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ২১:৩০719437
  • তারপর.............
  • Bratin | 11.39.39.72 | ২৫ আগস্ট ২০১৬ ২১:৩৫719438
  • আরেক কিস্তি নামাও রঞ্জন দা। জমে গেছে
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৬ আগস্ট ২০১৬ ০৫:৪৪719439
  • ৪)
    মনীষা
    ----------
    একটা সুড়ঙ্গের মত। না, ঠিক সুড়ঙ্গ নয়। রাস্তার ধারে ফেলে রাখা বড় বড় স্যুয়ারেজ পাইপ। তার মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিলাম চোর-পুলিশ খেলতে খেলতে।অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। বেরোতে হবে। হাঁটতে থাকি, নাঃ, বেশিক্ষণ হাঁটা যায় না। হামাগুড়ি দিই। কিন্তু এ কি! পাইপটা সোজা ছিল, বেঁকে যাচ্ছে কেন? আবার নীচু ঢালানের মত, ঘষটে ঘষটে এগোচ্ছিলাম, এখন সরসরিয়ে নেমে যাচ্ছি। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!
    না, না; এমনিই হয়। এই হিউম পাইপগুলো দিয়ে নর্দমার জল যায়, গিয়ে শহরের বাইরের নদীতে পড়ে। তারপর? সব পাপ ধুয়ে যায়। কারণ নদীটা যে নর্মদা। মহাকাল পর্বতের মেয়ে,। বাবা একটা শ্লোক শিখিয়েছিলেন, একটু একটু মনে আছে--- নর্মদেসিন্ধুকাবেরী জলেস্মিন সন্নিধে কুরু।
    কিন্তু এই বয়ে যাওয়া জলধারা তারপর ভেড়াঘাটের কাছে গিয়ে বিশাল জলপ্রপাত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে অনেক নীচে। লোকে বেড়াতে এসে অবাক হয়ে দেখে।তবে একবার ওই জলের চোরাটানে পড়লে আর রক্ষে নেই, সোজা প্রপাতের সঙ্গে মিশে কয়েকহাজার ফুটের মরণঝাঁপ।
    তবে? একটাই উপায়। আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। যে করে হোক। কাউকে ডাকব যে রাস্তা চেনে? যাদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলছিলাম? তারা তো কখন খেলা ছেড়ে যার যার বাড়ি ফিরে গেছে। আমাকে ডাকেও নি। হয়ত আমি যে খেলছিলাম সেটাই ভুলে গেছে।
    ওদের দোষ নেই। আমিই তো লুকোচুরি করতে করতে কী করে যেন এই বাঁকাচোরা হিউম পাইপের জঙ্গলে ফেঁসে গেছি। কেউ আসবে না। আমাকেই পথ চিনে বেরোতে হবে। আমি নর্মদায় ঝাঁপ দেব না। আমি তো কোন পাপ করিনি।
    কী করে এখানে এলাম? ও হ্যাঁ, মনে পড়ছে। আমি এই পাইপ বিক্রির দোকানে কাজ করি। একাধারে অ্যাকাউন্ট্যান্ট, রিসেপশনিস্ট, গোডাউন কিপার--সবকিছু।
    কিন্তু পাইপ বিক্রি করতে করতে পাইপের মধ্যে সেঁদিয়ে যাওয়া--এটা কী রকম ইয়ার্কি!
    আরে, ওই তো পাইপের মুখ দেখা যাচ্ছে, আলো এসে ঢুকছে। আর কয়েক পা,-- হ্যাঁ , এবার সোজা হয়ে হেঁটেই বেরনো যাবে, একটু ঝুঁকে ব্যস।
    হল না; উল্টোদিক থেকে পাইপের মুখ আটকে দু-হাত দিয়ে রোদ্দূর আটকে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। আমি আর বেরোতে পারব না।
    মা নর্মদেশ্বরী! বাঁচাও! বাঁচাও!

    --দিদি! এই দিদি! কী হয়েছে? ঘুমের মধ্যে কাঁদছিলি কেন? নে জল খা।
    আস্তে আস্তে সব স্পষ্ট হয়। চারতলার একটা ঘরে মাটিতে বিছানা পেতে ঘুমুচ্ছিলাম। পাশে নেয়ারের খাটিয়া থেকে নেমে এসেছে ভাই প্রমোদ। আমাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে। বড্ড গরম, বোধহয় বিজলি চলে গেছে।
    --- কিছু না, একটা খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম। ঘুমিয়ে পড়।

    জল খেয়ে একটু ভাল লাগছে। ভোর হতে বেশি দেরি নেই। ঠিক সময়ে পাশে রাখা টেবিল ফ্যানটাও চলতে শুরু করল।
    আরেকটা সকাল আসছে। ঠিক অন্য সকালগুলোর মতই। আরেকটা হিউম পাইপ। আরেকটা চোর-পুলিশ খেলা।
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৬ আগস্ট ২০১৬ ০৭:৩৬719440
  • সাড়ে আটটা বাজে। আমি স্নান করে ভাইয়ের জন্যে রান্না সেরে অফিসের জন্যে তৈরি হয়ে গেছি। এখন চারতলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে।
    না, আগে থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। ওর স্কুটার এসে হর্ন দেবে, তবে আমি নীচে নামব। এটাই নিয়ম। নিয়ম ভাঙা চলবে না।
    ভাঙলে? কী হবে ভাঙলে?
    কী বোকার মত প্রশ্ন? আইন ভাঙলে শাস্তি পেতে হয় এ তো বাচ্চারাও জানে।
    আইন? কে বানিয়েছে এই আইন?
    কে বানায়? আইন বানায় যারা মালিক। যারা দাস তারা শুধু মেনে চলে । ওরা কক্ষনো দাসদের জিগ্যেস করে না। দরকার নেই। ওরা ভালো জানে কিসে এদের ভালো হবে।
    স্কুটারের হর্ন বাজছে। ও কোনদিন দেরি করে না। রোজ আসে, আমাকে অফিস পৌঁছে দিয়ে তবে নিজের ডিউটিতে যায়। ওর অসুখ হয় না। বিকেলে আমার ছুটি হলে বেরিয়ে দেখি রাস্তার উল্টোদিকে ও স্কুটার নিয়ে দাঁড়িয়েছে আছে, ঘরে পৌঁছে দিয়ে তবে আমাকে রেহাই দেয়।
    ভাইকে বলি ঠিক সময়ে স্কুলে যেতে আর খাবারগুলো যাওয়ার আগে ঢেকে দিয়ে যেতে। দুধের বাটিটা একটা থালায় জল ঢেলে দিয়ে তার ওপর বসাতে। তাহলে পিঁপড়ে উঠবে না।
    এর পর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে অফিস যাওয়ার ব্যাগ তুলে নিয়ে তরতর করে সিঁড়ি ভাঙতে থাকি।
    ফ্ল্যাটবাড়িটার উল্টোদিকে স্কুটারটা দাঁড় করানো, রোশন ওর ব্যাকভিউ মিররে চোখ রেখে চুল আঁচড়াচ্ছে। তাতেই বোধহয় আমার আসা টের পেয়ে মুখ না ফিরিয়েই বলে উঠলো-- এত দেরি হল যে? কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
    আমি উত্তর না দিয়ে অপেক্ষা করি, কখন ও স্টার্ট করবে আর আমি পেছনে উঠে বসব। আজ ওএকটা খুনখারাপিরঙের ফুলশার্ট পরেছে, সাদা প্যান্ট আর মোটা বেল্ট, চোখে মোটা ফ্রেমের রোদচশমা; কেমন যেন তেলেগু বা তামিল ফিল্মের হিরোদের মত। হাসিটা গিলে ফেলি। ওরে বাবা, স্কুটারটা স্টার্ট কর। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
    কিন্তু ও চুল আঁচড়ে সোজা হয়ে আমাকে কড়া স্বরে বলে-- ঘরে কে আছে?
    -- কে আবার! আমার ভাই প্রমোদ, স্কুল যাবে বলে তৈরি হচ্ছে। রান্না করতে করতে একটু দেরি হয়ে গেল।
    -- সত্যি কথা বলছিস? ওপরে গিয়ে দেখবো? কোন গেস্ট আসেনি তো? ধর তোর বিলাসপুরের দলের কেউ? নইলে সাতসকালে এত রান্না কিসের?
    --- বিশোয়াস কীজিয়ে; ঝুট কিঁউ বোলুঁ?
    ও এগিয়ে আসে, আমি মার ঠেকাতে হাত তুলি। গালে দাগ পরে গেলে অফিসে কথা উঠবে।
    কিন্তু ও কী ভেবে পেছন ফেরে, স্কুটার স্টার্ট করে। আমরা অফিস রওনা হই।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২৬ আগস্ট ২০১৬ ১০:৪৮719441
  • হুঁ। তারপর?
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৬ আগস্ট ২০১৬ ১৪:১৭719442
  • আজ অফিসে কাজের চাপ অন্যদিনের চেয়ে বেশি, কারণ মধুশ্রী ছুটি নিয়েছে। আর সেকন্ড হাফে কিছু কনসাইনমেন্ট পাঠানো দরকার ছিল। এমনিতেই দুদিন দেরি হয়ে গেছে, পার্টির তাগাদা মারা ফোন এসে গেছে।
    অফিস থেকে বেরোতে সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেল।
    এতক্ষণ ওকে ভুলে ছিলাম, কিন্তু ছুটির সময় কাছে আসতেই মাথার মধ্যে পিন ফোটার যন্ত্রণা । সেই পুরনো দিনের গ্রামোফোনের মত। খ্যাস খ্যাস শব্দ করে একই শব্দগুচ্ছ কানের পাশে বেজে চলে।
    রাস্তার লাইট জ্বলে উঠেছে। ওদিকের ফুটপাথের দিকে চোখ যায়---স্কুটারটা ঠিক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও লেট হয় না, ও ভুল করে না। একদিনও না।
    -- কী ব্যাপার? কার সঙ্গে ফস্টি-নস্টিতে ব্যস্ত ছিলে?
    কী জবাব দেব? রোজ রোজ একই ঘ্যানর ঘ্যানর! আজকে একটু সাহস করে বলে ফেলি-- আন্দাজ কর দেখি।
    --মানে?
    -- তুমিই আন্দাজ কর নামটা?
    ও দ্রুত আমার কাছ ঘেঁষে দাড়িয়ে কব্জিটা চেপে ধরে। একটু একটু করে চাপ বাড়ায়। হিসহিসিয়ে বলে--বেশি বাড় বেড়েছে? ইয়ার্কি হচ্ছে? যদি কোন দিন কারও সঙ্গে ঢলানিপনা করতে দেখি তো খুন করে ফেলব? দুজনকেই! সাবধান করে দিলাম। এবার বাড়ি চল।
    আমার চোখে জল আসে। আমি গাল দিয়ে ওর চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে পারি। চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে ওকে ঠ্যাঙানি খাওয়াতে পারি। কিন্তু তারপর? কোথায় যাব? এই শহরে আমার কোন ঠাঁই নেই।
    ও আমায় চারতলার ওপরে এই এককামরার ঘর পাইয়ে দিয়েছে, কম ভাড়ায়। দুমাসের অগ্রিম টাকাটাও ওই দিয়েছে। চাকরিটাও ওই খুঁজে দিয়েছে। দুবছর হল, মোটামুটি স্থায়ী চাকরি। ওর বন্ধুর ফার্ম।
    ও আমার জন্যে অনেক করেছে। আমার পরম সুহৃদ, অন্তত; ও তাই বলে। আমারও মনে হয়।
    বছর দুই আগে যখন অনিল আর হাফিজ ভাই নাটক ছেড়ে রূপোলী পর্দার হাতছানিতে মুম্বাই চলে গেল তখন ওই বাড়িটা আমাকে ছাড়তে হল। তিনকামরার অ্যাপার্টমেন্ট হাফিজ ভাইয়ের নামে এগ্রিমেন্ট করা ছিল। আমি একা কি করে অত ভাড়া গুণব? আর একলা মেয়ের এই শহরে নিজের নামে বাড়ি পাওয়া কঠিন। পেলেও তাতে সম্মানের সঙ্গে বাস করা কঠিন।
    তখন ও এসে আমার হাত ধরল। চরণদাস চোর তার পণ ভেঙে রাণী ফুলমতীর হাত ধরল। রোশন আমার খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠল।
    শুধু এই নয়। আমি তখন ক্লান্ত; প্রতি তিনমাসে দু'মাসে নতুন চাকরি খোঁজার চাপ।আর পারি না। ভাইকেও নিয়ে এসেছি। এখান থেকেই ম্যাট্রিক দিয়ে দিক। তারপর আই টি আই থেকে কোন ট্রেড শিখে নিলে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে লাগিয়ে দেবে। রোশন বলেছে। ওর সোর্স আছে।
    এইভাবেই শুরু হল। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। ভাইয়ের দায়িত্ব নেওয়ায় রিটায়ার্ড বাবা খুশি হয়েছেন। ভাই সঙ্গে থাকায় আমিও সেফ।
    একটা জিনিস একটু খচখচ করত, রোশন টাকা ফেরত নিচ্ছে না। বলছে --এখন অল্প মাইনে, একটু সেভ কর। আমাকে পরে দিবি। আস্তে আস্তে দিবি। আরে, আমরা তো একসঙ্গে নাটক করেছি, আমাদের মধ্যে কিসের হিসেব?
    আমি বর্তে গেলাম। একটু যেন অক্সিজেন পেলাম।
    তাই যখন বলল যে দুবেলা বাসে বা অটোতে যেতে রোজ কুড়ি-কুড়ি চল্লিশটাকা খরচ, এর কোন মানে নেই। ওই নিজের অফিস যাওয়ার আগে আমাকে পৌঁছে দেবে আর বিকেলে বাড়ি ছেড়ে দেবে তো না করতে পারি নি।আর বাসস্টপ যেতেও অন্ততঃ দশ মিনিট হাঁটতে হত। কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেল।
  • ranjan roy | 192.69.74.122 | ২৬ আগস্ট ২০১৬ ১৪:৫৩719443
  • দেখতে দেখতে একটা বছর পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেল।
    আমি বুঝতে পারলাম সারাদিন অফিস ঠেঙিয়ে ঘর গুছিয়ে সন্ধ্যে বেলা শহরের অন্য প্রান্তে গিয়ে নিয়মিত নাটকের রিহার্সাল দেওয়া সম্ভব নয়। গোরখপুর নাট্যোৎসবে অখিল ভারতীয় স্তরে দুলারীবাঈ করে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিলাম। তারপর তিনটে গোল্লা! এভাবে হয় না।
    রোমুলাস ভাইয়ারা অন্য মেয়ে অভিনেতা নিয়ে নিয়েছে। আমি দল ছাড়লাম।
    আমি এখন বিয়ে করব না, ছোট ভাইকে দাঁড় করাব--এইসব বলায় বাবার মুখে হাসি ফুটল। পরের দুবোনের জন্যে ছেলে খুঁজতে লাগল। এছাড়া আমি প্রতিমাসে দুহাজার টাকা করে বাবাকে পাঠিয়ে দিই।
    কিন্তু এখানেই শেষ হল
    রোশন আমাকে বিয়ে করতে চাইল। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ও খেপে গিয়ে আমাকে নখরেওয়ালী মর্দমার যা খুশি বলল। আমি নাকি ওর সঙ্গে ঢলানিগিরি করে কাজ করিয়ে নিয়েছি। আর স্বার্থসিদ্ধি হতেই ওকে 'ইউজ অ্যান্ড থ্রো' করে দিয়েছি। খো করে দিয়েছি।
    আমার গলার কাছটায় কিছু পাকিয়ে উঠল। শরীর খারাপ লাগতে লাগল। আমি দুর্বল গলায় বোঝালাম -- আমার ঘাড়ে এখন অনেক দায়িত্ব; বিয়ের কথা ভাবার সময় নেই।
    ও চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইল।
    শেষে উঠে যাবার আগে আমার কাছে এল। দু'কাঁধ চেপে ধরে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল-- শোন, আমরা উত্তর প্রদেশের লোক।আমার বাড়ি এমন একটা গাঁয়ে যেটাকে সবে রাবণের জন্মস্থান বলে জানে। তো এক অর্থে আমি রাবণের বংশধর।
    রাবণের ক্যারেকটার খুব স্ট্রং; আমারও। রাবণ সীতাকে বন্দী করেও গায়ে হাত দেয় নি। জোর করে ভোগ করার চেষ্টা করে নি। অপেক্ষা করেছে যদি সীতা কখনও হ্যাঁ করে।
    আমিও অপেক্ষা করব; তোকে জোর করে বিছানায় নেব না। কিন্তু ততদিন তুই বন্দী। কোন ছেলের সঙ্গে মিশতে পারবি না। বাসে অটোতে লোকজনের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেষি করে চলাফেরা করবি না। যেখানে যাওয়ার আমিই তোকে নিয়ে যাব। আমাকে বলবি। তুই আমার, যতদিন পুরোপুরি হবি না, ততদিন আর কারও ছায়াও পড়তে দেব না।
    সেই শুরু।
    কিন্তু তখন ভেবেছিলাম একটু সহ্য করে নেব। কিছুদিনে এ সব পাগলামি সেরে যাবে। উল্টো হল। ও নিজের অফিস আর বাড়ি ছাড়া অন্য সময় আমার পেছনে ছায়ার মত লেগে রইল। আমার মোবাইলের মেসেজ কললিস্ট সব চেক করতে লাগল। ধীরে ধীরে ওর ভেতর থেকে এক উন্মাদ বেরিয়ে এসেছে, যার কোন কান্ডজ্ঞান নেই।
    কয়েক মাস আগে। দিল্লি থেকে সুমিত এল একদিনের জন্যে নিজের কাজে। ও আগে বিলাসপুরে আমাদের সঙ্গে নাটক করত। ভাল বন্ধু।
    সকালেই ফোন করল। একঘন্টার জন্যে কোথাও আড্ডা দেওয়া যেতে পারে কি না।
    সাতপাঁচ ভেবে আমার অফিস থেকে দূরে রাসেল টাউন পাড়ায় একটা পার্কে মিট করলাম। ভেবেছিলাম অফিস ছুটি হবার আগে ফিরে যাব। একটা বেঞ্চে বসে কথা বলছি। পুরনো দিনের কথা শুরু হল। সুমিতের ফককুড়ি স্বভাব। আগের মতই বলল-- অউর ডার্লিং! ক্যা চল রহা আজকাল?
    কিন্ন্তু বাক্যটা শেষ করতে পারল না।
    তার আগেই পাশের একটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রোশন। ঝাঁপিয়ে পড়ল সুমিতের উপর। ওকে মাটিতে ফেলে বুকের উপর বসে গলা টিপে ধরল।
    ---- মাদর--! তেরি ইয়ে হিম্মত! মেরী অউরত কো ডার্লিং! কাট কে ফেক দুঙ্গা শালে!
    আমি হাতেপায়ে ধরে অনেক কষ্টে সুমিতকে ওর কবল থ্কে ছাড়াই।
    আহত বিধ্বস্ত সুমিত যেতে যেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-- তোর বিয়ে হয়ে গেছে আমাকে জানাস নি কেন?
  • ranjan roy | 192.69.167.171 | ২৭ আগস্ট ২০১৬ ১৪:০৬719444
  • আমি এই ভয়ংকর অবস্থার কথা কাউকে বলতে পারছি না।
    যে রোশন আমাদের জবলপুরের নাটকের দলের নায়ক, যাকে সবাই ভালবাসত- -- সে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমার মাথার উপরে ছাদ খুঁজে দিয়েছে , চাকরি জোগাড় করে দিয়েছে। আমি যে কৃতজ্ঞ; বলেইছিলাম--রোশন, তোর ঋণ কী করে শোধ করব জানি না।
    ও হেসে কেমন একরকম করে তাকিয়েছিল, আমি তার মানে বুঝি নি।
    বিলাসপুরের নিখিলএর থেকে সাহায্য চাইতে সংকোচ হয়েছিল।
    রোশন যে ওর পুরনো সাথী। যদি বিশ্বাস না করে! যদি আমাকে অকৃতজ্ঞ ভাবে?
    আর প্রথম প্রথম ভাবতাম, কী আর হয়েছে, একজন সাথী আমাকে বিয়ে করতে চাইছে--- এমন তো কতই হয়। আমি না করে দিয়েছি। ব্যস্‌; ও আশায় আছে কোনদিন হ্যাঁ করব, তো ঠিক আছে। আশায় বাঁচে চাষা। বাঁচুক গে! আমি জানি যে কোনদিন এই 'না' বদলে গিয়ে 'হ্যাঁ' হবে না।
    কিন্তু আসতে আসতে ও যে আমাকে এমন করে গিলে খাবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার জীবন এখন যেন ওর প্রোগ্র্যামিং এ চলে। আমি একটা নির্জীব মেশিন মাত্র।
    বাড়ি এসে গেছে। স্কুটার থেকে নেমে ওকে হাত নেড়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকি। দুটো তলা উঠতেই কানে এল গানের আওয়াজ, সঙ্গে হারমনিয়াম বাজছে! আমারই ঘর থেকে।
    বাকি দুটো তলা দৌড়ে উঠে ঘরে পৌঁছে যাই।
    আরে! আমার ভাই প্রমোদ গাইছেঃ
    " আ যা সনম, মধুর চাঁদ্নী মেন হম,
    তুম মিলে তো বিরানী মেঁ ভী আ যায়েগী বহার;
    --ঝুমনে লগেগী আসমাঁ।

    আর হার্মোনিয়ম বাজাচ্ছে ওর বন্ধু সমর সিং। নিঘ্ঘাৎ ওদের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। মনটা হটাৎ ভালো হয়ে যায়।
    ওরা আমাকে দেখে হৈ হৈ করে ওঠে।
    এই তো দিদি এসে গেছে। দিদি শুরু হো জাইয়ে!
    প্রমোদ আবার মুখড়াটা গাইতেই আমি সুর ধরিঃ
    কহতা হ্যায় দিল, অউর মচলতা হ্যায় দিল,
    মোরে সাজন লে চলোঁ মুঝে তারোঁ কী পার,
    --লগতা নহীঁ হ্যায়ঁ দিল ইহাঁ।
    দুবার রিপিট করে অন্তরায় যাবো কি তার আগে দুপ দুপ করে ঘরে ঢুকে পড়ে রোশন, আর এসেই আমার চুল ধরে মুঠো করেঃ
    শালি, হরামজাদি! বলেছিলিনা যে ঘরে ভাই ছাড়া কোন অন্য পুরুষ নেই? দিব্যি গেলে বলেছিলি? তবে এই নোটংকীবাজ হারমোনিয়মের বাজনদার এল কোত্থেকে?
    এই আকস্মিক আক্রমণে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও প্রমোদ আর ওর বন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়ে আর এক লহমায় আমি মুক্ত হই।
    --খবরদার রোশনভাইয়া! আমার দিদির গায়ে হাত তুলবেন না। ভল হবে না।
    কুটিল হাসে রোশন।
    --ওয় ছোরে! আমার গায়ে হাত? আমাকে ধমকানো? জানিস আমি কে? তোর জীজাজি।তোর দিদির পতিদেব। তোর বাবা-মা যদি জানতে পারে যে ওদের দামাদের সঙ্গে এই ব্যবহার, তো পিটিয়ে তোর পিওঠের ছাল তুলে নেবে, বুঝলি!
    --এঃ জীজাজি! কত খায়! বন্দর কে গলে মেঁ মোতি কে মাল?
    -- মনীষা, তোমার এই বড়বোলে ভাই কে সামলাও। বুঝিয়ে দাও যে তুমি এখন আমার। আর আমাকে অপমান করার আগে ওকে এখানকার স্কুল থেকে নিজের নাম কাটিয়ে এই বাড়ি খালি করে দিয়ে বিলাসপুর ফিরে যেতে হবে।
    আমি মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
    --ভাই, তু চুপ হো যা। আমি সব বুঝিয়ে বলব। এখন প্লীজ চুপ কর। ওকে যেতে দে।
    প্রমোদ ও তার বন্ধুটি অবাক হয়ে আমাকে দেখে।
    রোশন আবার স্বমূর্তি ধরে। মোচড়ানো কলার ও মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলে-- হ্যাঁ, আমি এখন যাব। কিন্তু একা যাব না। ওই হারমনিয়ামওলাও যাবে। ওর বাজগাজা সমেত।
    --- কেন?
    --- কেন আবার কী? বলেছি না--এ ঘরে তোর ভাই ছাড়া অন্য কোন পুরুষ থাকবে না?
    --- পুরুষ? ও তো বাচ্চা ছেলে, আমার ভাইয়ের বন্ধু, দিদি বলে ডাকে।
  • অভি | 37.63.191.54 | ২৭ আগস্ট ২০১৬ ১৫:৫১719445
  • বেশ ভালো লাগছে।
  • ranjan roy | 192.69.167.171 | ২৭ আগস্ট ২০১৬ ১৭:২৯719447
  • --বাচ্চা ছেলে? বাচ্চার বাপ হওয়ার ক্যালি রাখে; দেখ গোঁফ উঠেছে কি না! ওসব দিদি-টিদি অনেক শোনা আছে। ওকে এক্ষুণি যেতে হবে।
    অপমানিত ছেলেটি হারমনিয়াম বাক্সে ভরে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যায়। একবারও ফিরে তাকায় না।
    ওরা দুজন নেমে গেলে আমি দরজায় ছিটকিনি এঁটে দিয়ে বিছানায় মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ি।
    কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না।
    --দিদি, ন'টা বাজে। ওঠ , খাবি চল। আমি ভাত গরম করে ফেলেছি। বেড়ে দিচ্ছি, উঠে হাত মুখ ধুয়ে নে।

    খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেছল। কোনরকমে আলুসেদ্ধমাখা দিয়ে দুটো গরাস গিলে পাতে জল ঢেলে উঠে পড়লাম। ভাই দেখল, কিছু বলল না।
    শোয়ার সময় ও বলল, 'দিদি একটা কথা। এ ভাবে আর কতদিন? সেদিন সকালবেলায় রোশন ভাইয়া নাকি তোকে বাড়ির সামনে স্কুটার থেকে নামিয়ে চড় মেরেছে। পাড়ার লোকজন আটকাতে এলে বলেছে এটা স্বামীস্ত্র্রীর মধ্যেকার ব্যাপার, আপনারা নাক গলাবেন না?
    আমি তখন বাজারে গেছলাম, কিছুই টের পাই নি, বাড়িওয়ালা আংকল আমাকে ডেকে বলেছেন--দিদিকে বল , এসব মিটমাট করে নিতে। নইলে পাড়ায় সম্মান থাকে না। সবাই ভাবছে নিশ্চয়ই তোর কোন খোট আছে।
    দিদি, আমার কথা শোন। এখানে আর না। চল আমরা কালকেই বিলাসপুরে চলে যাই। আমার আর না পড়লেও চলবে। ওখানে কোন ভাইয়ার দোকানে পার্টটাইম বসে যাব। প্রাইভেটে ম্যাট্রিক দেব। তোরও কিছু একটা হয়ে যাবে।
    --- তা হয় না রে!
    --কেন হয় না? তোকে কি জাদু করেছে? বাঙ্গাল কী কালা জাদু?\
    -- দূর পাগলা! ও যে আমাদের জন্যে অনেক করেছে। এখনও ও আমাদের থেকে বেশ কিছু টাকা পায়। সেগুলো শোধ না দিয়ে--
    -- কত টাকা দিদি?
    --- এখনও বিয়াল্লিশ হাজার পাবে।
    --ব্যস্‌?
    --বিয়াল্লিশ হাজার টাকা তোর কাছে' ব্যস'্‌হল ছোটু?
    --- আরে টাকা দিয়েছে, টাকা ফেরত পেয়ে যাবে। তোকে কিনে তো নেয় নি!
    --- বেশ, কী করে দিবি?
    --- বিলাসপুরে ফিরে চ'; ওকে টাকাটা মনি অর্ডার করে দেব।
    -- না না। বাবা-মা'র অবস্থা তো জানিস। ওঁদের কাছে চাইতে পারব না।
    --আরে এখনও দুই ডিসিমেল জমি আছে জটিয়া তালাওয়ের পাড়ে। সেটার দাম কম করে দুলাখ টাকা।
    -- ওটা বাবার শেষ সম্বল। ওটা বাকি মেয়েদের বিয়েতে খরচ করবেন।
    --আর কোন রাস্তা নেই? আমাদের বিলাসপুরের নাটকের দলের? নিখিল ভাইয়ারা?
    --- কথা হয়েছে। বলেছে সাতদিনের মধ্যে এসে একটা হেস্তনেস্ত করে যাবে।
    --- তারপর কোন খবর? কতদিন হয়েছে?
    -- চার দিন, এখনও কোন খবর আসে নি।
    -- ব্যস্‌, আর তো তিনদিন।
    --শোন, ওরকম কথা অনেকেই বলে। আমার কোন ভরসা হয় না। আউট অফ সাইট, অউট অফ মাইন্ড। আমাকেই কিছু ভেবে বের করতে হবে। আমি হেরে বাড়ি ফিরতে চাইনে।
    --- দোহাই দিদি! কোন শর্টকাট খুঁজিস না। যেমন ওকে বিয়ে করিস না।
    -- তাহলে তো ল্যাটাই চুকে যেত রে! কখনও কখনও এই রাস্তাটাও ভেবেছি। ও আমার ভাল বন্ধু ছিল। কিন্তু এখন ওর যে রূপ দেখছি তাতে ওর স্ত্রী হয়ে বাকি জীবন কাটাবো ভাবতেই গা ঘিন ঘিন করে।
    তুই ঘুমো ছোটু; একটা না একটা রাস্তা ঠিক খুঁজে পাব।
  • ranjan roy | 192.69.167.171 | ২৭ আগস্ট ২০১৬ ২০:৪৩719448
  • ৫)
    ছোটু ঘুমিয়ে পরে। আমার ঘুম আসে না। আকাশ পাতাল ভাবি, কোন কুলকিনারা পাইনে।
    ভাবতে ভাবতে রোশনের চেহারাটা লম্বা হতে হতে একটা বিশাল সাপের মত হয়ে যায়। অ্যানাকোন্ডা। আমাকে জড়িয়ে ধরে মট মট করে হাড়গোড় ভেঙে কাবু করে ফেলেছে। তারপর গিলে ফেলা একটা সরল প্রক্রিয়া মাত্র। আমাকে বাঁচাতে কোন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়া রাজকুমার আসবে না। ওসব রূপকথায় হত। আজকাল রূপকথারা হারিয়ে গেছে। তবে রূপকথায় মেয়েগুলো বড্ড ন্যাকা আর ছুঁইমুই ফুলটুসি হয়। অসহায়, পরিস্থিতির শিকার।
    আমি ওরকম নই। কোনকালে ছিলাম না। তবে আজ আমার এই দশা হল কী করে? আনাকোন্ডার সম্মোহনের শিকার?
    একটা চেষ্টা করে দেখলে হয়। সাতদিন হয় নি, আরও দু'দিন বাকি। ওদের ফোন না আসুক, আমিই করে দেখি। না, না। আমি করব না। ওর চোখ আমাকে ফলো করে। কল লিস্ট চেক করে। ঠিক টের পেয়ে যাবে। তারপর উন্মাদ অ্যানাকোন্ডা কী করবে আমি জানি না। আর যদি নিখিলরা শেষ পর্য্যন্ত না আসে? তখন ?

    আজ শনিবার। হাফ ডে।
    আগের দিনের ওই নোংরা ইঙ্গিত আর কদর্য কথাবার্তা। এখনো গায়ে জ্বালা করছে। তবু ওর স্কুটারের পেছনে বসে পড়ি। কিন্তু স্কুটার অন্য দিকে বাঁক নিচ্ছে! ও আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
    এ তো নেপিয়ার টাউনের বাজার এলাকা। একটা শাড়ির দোকানের সামনে গিয়ে স্কুটার থামে। ভেতরে গিয়ে বুঝলাম দোকানদার ওর চেনা। অন্তরঙ্গ ব্যবহার। ও বলে এর জন্যে একটা ভাল শাড়ি দেখান তো। কাঞ্জিভরম বেনারসী--দু'রকমই। মিডিয়াম দামের।
    দোকানদার হাসিমুখে গোটা দশেক শাড়ি পাট খুলে কাউন্টারের উপর বিছিয়ে দেয়। তারপর আমাকে বলে-- যেটা ইচ্ছে পছন্দ করুন।
    আমার মাথা অজানা আশংকায় দপ দপ করতে থাকে। একবার ওর দিকে তাকাই। ও হেসে উৎসাহ দেয়। বলে -জ্যাদা শোচো মৎ। দোনো কিসম কে এক এক লে লো!
    আমি পাথর।
    ও দাঁত পেষে। তারপর হেসে দোকানদারকে বলে-- ও লজ্জা পাচ্ছে। তাহলে আমিই দুটো পছন্দ করি।
    তারপর একটা লাল বেনারসী ও সবুজ কাঞ্জিভরম আর তেমনি ম্যাচিং ব্লাউজ বেছে নিয়ে আমাকে বলে ওই কোণের দিকে ট্রায়াল রুম, ভেতরে বড় আয়না আছে। যাও, অফিসের পোশাকটা পাল্টে বেনারসীটা জড়িয়ে এসো।
    এরপর বেনারসী পরেই আমি ভর বিকেলে ওর স্কুটারে চড়ে বসি। এখান থেকে আমার বাড়ি অনেক দূর। ভাই বোধহয় চিন্তা করছে।
    নাঃ, এখনও স্কুটার আমার ঘরের দিকে গেল না। নেপিয়ার টাউন থেকে পূবদিকে বাঁক নিয়ে আধঘন্টা পরে সন্ধ্যে হবার মুখে ও ঘিঞ্জি শ্রমিক পাড়ায় যে বাড়িটার সামনে স্কুটার থামাল। সেটা তো আমার চেনা। এটা রোশনেরই বাড়ি। আগে নাটক করার সময় বেশ কয়েকবার এসেছি।
    ওর বাবা অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে কর্মরত অবস্থায় মারা যান। বদলে রোশন ওখানে চাকরি পেয়ে যায়। ফলে ওর মাকে আর পুরনো কোয়ার্টার ছেড়ে যেতে হয় নি।
    আঙিনায় দাঁড়িয়ে রোশন হাঁক পাড়ে-- মা, দ্যাখ কাকে নিয়ে এসেছি।
    তারপর ওর মা দরজা খুলে আলো জ্বালিয়ে বাইরে আসার আগেই ও দ্রুতহাতে স্কুটারে ডিকি থেকে একটা সিঁদূর কৌটো বের করে এক খাবলা আমার কপালে ও সিঁথিতে লেপে দেয়।
    অ্যানাকোন্ডা এবার শিকারকে গিলতে শুরু করেছে।
    ওর মা বাইরে এসে আমাদের দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আমাকে চিনেছেন ঠিকই। কিন্তু এভাবে? বিনা নোটিসে?
    -- কী হল মা, হাঁ করে দেখছিস কী? তোর জন্যে কেমন বউ এনেছি। ওকে এখন বরণ করে ঘরে তোল।
    মাসীমা সম্বিত ফিরে পেলেন।
    আমাকে এস মা ঘরে এস বলে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন। তরপর এক গেলাস জল ও একটা পেঁড়া দিয়ে বললেন-- খেয়ে নাও।
    খেঁকিয়ে উঠল রোশন-- না, খাবে না। আগে মার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে, তারপর। কায়স্থ বাড়ির মেয়ে। এইটুকু সহবৎ শেখেনি?
    আমি কলের পুতুলের মতন ওঁর পা ছুঁলাম। উনি থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু খেলেন।
    তারপর ছেলেকে বললেন--এভাবে হয় না; এখন বরণ করব কী? আগে জয়মালা হোক। সপ্তপদী হোক। কুশন্ডিকা হোক। পন্ডিত দেখে দিনক্ষণ ঠিক করি। তারপর। এখন তুই ওকে ওর ঘরে ছেড়ে আয়।
    আঃ কী শান্তি ! কী শান্তি!
    অ্যানাকোন্ডা শিকারকে মুখে পোরার আগে দম নিচ্ছে। আমিও তাই। কিন্তু কতদিন? আমার ভবিষ্যৎ স্থির হয়ে গেছে।
  • ranjan roy | 192.69.167.171 | ২৮ আগস্ট ২০১৬ ১৮:৩২719449
  • ৬)
    মনীষা- উদ্ধার পর্ব
    =============
    ভাগ্যিস ইন্দোর এক্সপ্রেস মেইন স্টেশন থেকে ছাড়তে কুড়ি মিনিট দেরি করল। ফলে আমরা ঘরের কাছের ছোট্ট স্টেশন বিষেনপুর গিয়ে টিটিকে ধরে স্প্লিপার ক্লাসের জন্যে এক্স্ট্রা রসিদ কেটে একটা কোচে উঠে পড়তে পারলাম। সময় সত্যিই কম পড়ে গেছল।
    আমরা মানে চারজন,-- আমি, নিখিল, মনীষার তৃতীয় বোন প্রমীলা ও ওদের মা।
    এই ট্রেন নামেই এক্সপ্রেস; জবলপুর অবদি প্যাসেঞ্জারের মত সবকটা স্টেশনে থামতে থামতে যায়। তারপর আড়মোড়া ভেঙে এক্সপ্রেসের মূর্তি ধরে ভোপাল-ইন্দোর দাপায়।
    ট্রেন চলেছে তার নিজস্ব ছন্দে, চারদিকে একের পর এক পাহাড় আর শাল-সেগুনের জঙ্গল। এই রাস্তা পেন্ড্রা হয়ে অমরক্ন্টকের পাশ দিয়ে জবলপুর গেছে। বিন্ধ্য-সাতপুরা -মহাকাল রেঞ্জ। কিন্তু এই সীজনে প্রাকৃতিক শোভা দেখবে কে?
    আগুন গরম; চুয়াল্লিশ ডিগ্রি। জানলা খুললে লু' বাতাসের হলকা আর বন্ধ করলে সিলিং ফ্যান ওপর থেকে গরম হাওয়া টেনে নামায়। বারো ঘন্টা এইভাবে যেতে হবে! এই রুটে খাবার দাবার কিছু পাওয়া যায় না। শুধু খোড্রি-খোঙ্গসরায় ভাল দুধের চা'। সেও প্রায় একঘন্টা পরে। আর তারপরই হল ভাওয়ারটংকের খাড়াই। যেখানে কুড়িবছর আগে পাহাড়ি খাড়াই বেয়ে উঠতে গিয়ে দুর্বল ইঞ্জিনের দমে না কুলোলে এই এক্সপ্রেস ট্রেনটাই হুড়মুড়িয়ে মাধ্যাকর্ষণের টানে নীচে নেমে পাশের কয়েকহাজার ফুট নীচের খাদে পড়ে যায়। শ'দুই যাত্রী মারা যায়। বহুবছর ধরে ওই জঙ্গলে জানলা দিয়ে তাকালে নীচে সেই অভিশপ্ত ট্রেনের কংকাল দেখা যেত। জনশ্রুতি যে রাত্রিতে কেউ যদি ভনোয়ার টংক বা খোড্রির রেল ট্র্যাকে পায়ে হাঁটার সাহস করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে এক নব বিবাহিত যুবতী আছাড়ি-পিছাড়ি কেঁদে তাকে অনুরোধ করছেন নীচে খাদে পড়ে যাওয়া তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে।
    একটু পরে সেই নারী গাছের গায়ে আছড়ে আছড়ে তাঁর হাতের শাখা-পলা ভেঙে হটাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবেন।
    এইসব গল্প আর নুন-লংকা মাখানো শসা কিনে খেতে খেতে দুতিন ঘন্টা কাটল। ওদের মা উল্টো দিকের বার্থে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন।
    প্রগলভ প্রমীলা আমায় হেসে হেসে এবং নকল করে দেখাতে লাগল কীভাবে নিখিল ভাইয়া দিদির সঙ্গে কথা বলব না বলেও পরে দিদিকে নিয়ে প্রথমে বিষেনপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ও পরে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে সারারাত ধরে গল্প করেছে।
    সবাই এই গরমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বোতলের জলও আগুন গরম, তেষ্টা মেটেনা। তাড়াহুড়োয় একাটা কুঁজো বা ফ্লাস্ক কিছুই আনা যায় নি। নিদেন পক্ষে একটা' ছাগল' ( ছোট মশক মত) আনলেও হত।
    এইবার একান্তে নিখিলকে জিগ্যেস করি--কিসের তাড়াহুড়ো? আর প্ল্যানটা কী?
    --- গতকাল রাতে একটা ফোন এল। কোন পাবলিক বুথ থেকে এসটিডি কল। জবলপুরের নম্বর; কিন্তু মনীষা নয়। অল্পবয়েসী ছেলের আওয়াজ। বলল আমি ছোটভাই প্রমোদ বলছি। আপনি তো আমায় চেনেন।
    দিদি ফোন করতে বারণ করেছে, ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এখানে আর থাকা যা্ছে না। দিদির বিপদ বেড়ে যাচ্ছে।
    আরে সাতদিনের মধ্যে কিছু একটা করব তো বলেছিলাম, তো ভয় পাচ্ছে কেন? ও অভিযোগের সুরে বলল--জানি, কিন্তু আজ পাঁচদিন হয়ে গেল। আপনাদের কোন খবর নেই। তাই দিদি আর আপনাদের বিশ্বাস করছে না।
    মহা মুশকিল! আরে রোশন তো ওর কললিস্ট চেক করে তাই করিনি।
    ওর অফিসের ল্যান্ডলাইনে করলে পারতেন। ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। যাকগে, একটা খবর দিই। রোশন ভাইয়া আজ অফিসের কাজে ভোপাল গেছে। ফিরবে পরশু সকালে। এই সুযোগ। আগামী কাল রাত্তিরে চলে আসুন। আমি রিসিভ করে নিয়ে আসব। দিদিকে এখনও বলিনি, আপনি হ্যাঁ করলে বলব। পরশু সকালের ছ'টার ট্রেনে দিদিকে নিয়ে বিলাসপুর রওয়ানা দেবেন। রোশন শালা এসে দেখবে ওর পিঞ্জরে সে চিড়িয়া উড় গয়ী। ওর মুখের চেহারাটা যা হবে না! আর না পারলে এখনই বলে দিন, তখন আমাকেই কিছু করতে হবে।
    ব্যস্‌, কাল রাত্তিরেই ওর মা-বোনের সঙ্গে কথা বলে এই প্ল্যান বানিয়েছি। আন্টি খুব শক্ত মহিলা-- কষ্ট করে সংসার চালান। আংকল তো কিছুই দেখেন না। উনি বললেন--আপনাকে সঙ্গে নিতে। আপনার বয়স ও ব্যাংকের চাকরির একতা ওজন আছে, আপনি ঠান্ডা মাথা । তাই ফালতু ওখানের পুলিশের খপ্পরে পড়লে বা কোন ক্যাল খাওয়ার উপক্রম হলে আপনি পাবলিককে বোঝাতে পারবেন।
    ও! আমি তাহলে মধুসূদনদাদা!
    আমার ভয়ে পেটের মধ্যে আরশোলা শুড়শুড় করছে। কিন্ত বাঙাল গোঁ।
    রাত্তির সাড়ে দশটায় নেমে দেখা গেল স্টেশনে প্রমোদ হাজির। বলল দিদিও এসেছে।একটা টেম্পো (স্থানীয় ভাষায় শুয়োরগাড়ি) বুক করে এনেছে। তাতে ছয়জনে চেপে রওনা দিলাম। আধঘন্টার পথ --শহরের বাইরে , উপকন্ঠে।
    চারতলায় উঠে হাসিঠাট্টা গল্প চলছে, ওর মা চোখ বুলিয়ে চারদিক দেখছেন। কোন কথা বলছেন না। ঠো`ট টিপে রেখেছেন।
    সবাই এই গরমে নীচে নেমে রাস্তার টিউকলে চান করলাম। মায়ের জন্যে ছোটছেলে চারতলা অব্দি দুবালতি জল তুলে দিল। এচাড়া সকালে সবার বাথরুম যাওয়া আছে। গরমকালে এত উঁচুতে জল ওঠে না। নিখিল আর প্রমোদ জল টানতে লাগল।
    এরপর একটু অড়হরের ডাল , আলুর চোখা আর ভাত দিয়ে পেট ভরিয়ে ঢেঁকুর তুলে আমরা মাটিতে বাবু হয়ে বসলাম। প্রমোদের ভারি উৎসাহ। ও সবাইকে চা বানিয়ে দিল।
    এবার মা তাকালেন নিখিলের দিকে , নিখিল তাকাল আমার দিকে। আমি মনীশার দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম-- বড়িয়া খানা খিলায়ী তু; অব?
    কেউ কোন কথা বলছে না। একটা টাইমপিস ঘড়ির টিক টিক শোনা যাচ্ছে।
    মনীষা খানিকক্ষণ ধরে নখ খুঁটতে লাগল। তারপর হটাৎ মুখ তুলে আমার চোখে চোখ রেখে বলল-- অব ক্যা? আপনাদের চারজনের জন্যে চারটে চাদর দিচ্ছি। মেজেতে বিছিয়ে শুয়ে পড়ুন। এখন রাত একটা। ভোর চারটেয় এলার্ম দিয়ে উঠতে হবে। আপনারা সবাই চা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে পাঁচটায় টেম্পো চড়ে স্টেশন চলে যাবেন। সাড়ে পাঁচটায় ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দিয়ে দেবে। ছ'টায় ছাড়বে। ভাই আপনাদের তুলে দিয়ে ফিরে আসবে।
    --- আমরা চারজন? আর তুই?
    -- আমি কোথাও যাব না; এখানেই থাকব। কাল আমার ডিউটি আছে। এবার শুয়ে পড়ুন।

    সন্নাটা! সন্নাটা!
  • ranjan roy | 192.69.167.171 | ২৮ আগস্ট ২০১৬ ২৩:২৮719450
  • কেউ নড়ে না। আমি রাগে ফুঁসতে থাকি। ওর মা পর্যায় ক্রমে আমার আর নিখিলের মুখের দিকে তাকাতে থাকেন।
    আমার গলার স্বর চড়ে যা।
    -- হমলোগ বেওকুফ হ্যায়, ইতনী গর্মী মেঁ দিনভর জার্নি করকে সির্ফ চারঘন্টা সোনে কে লিয়ে ইঁহা আয়ে, কিঁউ? পুছ অপনী মম্মী সে। ইতনে দিন কে বাদ আজ কিঁউ আয়ে হ্যায়? ভাবিজী আপ হী বতাইয়ে।
    -- আমি এসেছি আমার মেয়েকে এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে নিয়ে যেতে।
    -- মা, তুমি কিচ্ছু বোঝ না। আমাকে ভাবার সময় দাও। বললেই হুট্‌ করে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে যাওয়া যায়? দাদা, আপ হী সোচিয়ে, মম্মী কো সমঝাইয়ে না!
    নিখিল বলে--আসল কথা তুই ভয় পাচ্ছিস। কাল সকালে ও ফিরে আসবে, এসে অনর্থ করবে। কেন ওর পারমিশন না নিয়ে গোপনে বিলাসপুর গেছিস, তাই না?
    মনীষা চুপ করে থাকে।
    -- আমি ভাবতেও পারি না। আমাদের সেই মনীষা, যার সঙ্গে নাটকের দল বানিয়েছিলাম, যে পথে পথে ঘুরে নুক্কড় নাটক করত, বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে আমাদের সঙ্গে অন্য শহরে অভিনয় করতে যেত, তার আজ একটা পুরুষের ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়! ও কি ভূত প্রেত? অলৌকিক ক্ষমতা ধরে? তো? এমনি করে নিজের ব্যক্তিত্ব ইচ্ছাশক্তি সব বিসর্জন দিয়ে---
    -- ব্যস্‌ ব্যস্‌, অত লেকচার ঝাড়তে হবে না। আমি খালি বলছি যে একটু ভাবার সময় চাই; আর্থিক , ব্যবহারিক--অনেকগুলো ইস্যু আছে। তা এটা কি খুব বেশি আবদার? তোমরা সব এমন করছ কেন মা? আমার জোর জবরদস্তি ভাল লাগে না।
    ছোট ভাই প্রমোদ শ্লোগানের ভঙ্গিতে বলে ওঠে--হর জোর-জুলুম কে টক্কর মেঁ , সংঘর্ষ হমারা নারা হ্যায়।
    সবাই হেসে ওঠে।
    মনীষা হাসতে হাসতেই বলে--আরে চুপ চুপ! রাত দেড়টা বাজে, নী্ধের তলায় লোকজন ঘুমুচ্ছে। ও কে, দাদা আপনি বলুন, আমি কি কিছু ভুল বলেছি?
    -- না; ভুল বলনি। তোমায় ভাবার সময় দেওয়া উচিত। এটা তোমার জীবন। ভেবে আলোচনা করে তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই সবাই মেনে নেবে। মানতে বাধ্য।
    আমাদের একটাই কথাঃ
    সাতদিনের জন্যে বিলাসপুরে নিজেদের বাড়িতে গিয়ে থাক। আচ্ছা, না হয় চারদিনের জন্যে। সেখানে বসে তুমি ইন্ডিপেন্ডেন্টলি পুরো ব্যাপারটা ভাবতে পারবে। তারপর তোমাকে এখানে, মানে জবলপুরে আসতেই হবে। হয় পাকাপাকি ভাবে থাকার জন্যে, নয় চাকরিতে রেজিগনেশন দিয়ে সব চুকিয়ে বিলাসপুর যাওয়ার জন্যে।
    --এখানে থেকে কেন ভাবা যাবে না?
    -- এখানে রোজ রোজ রোশনের অত্যাচার ও ভয়ের পরিবেশে তুমি খোলা মনে ভাবতে পারবে না। এছাড়া ও যা শুরু করেছে দেরি করলে তোমার শারীরিক ক্ষতি হতে পারে।
    --- ও ছাড়বে না; উহাঁ ভী ধাবা বোল দেঙ্গে।
    -- জানি; এখানে নিজের পাড়ায় ও সিংহ, আর বিলাসপুরে ওর অবস্থা কুকুরের মত। ও তোমার ঘরের অ্যাড্রেস জানে না, বাড়ি চেনে না। তুমি যেচে দেখা না করলেই হল। বাকি আমরা দেখে নেব। ঠিক আছে?
    এবার শুয়ে পড়া যাক। তবে অসুস্থ বাবাকে দেখতে যাচ্ছ বলে চারদিনের ক্যাজুয়ালের চিঠিটা লিখে এখনই ভাইকে দিয়ে দাও। ব্যাগ গুছিয়ে নাও।
    ভোর বেলায় উঠতে হবে। এসেছিলাম চারজন, যাব পাঁচজন।
  • ranjan roy | 192.69.167.171 | ২৮ আগস্ট ২০১৬ ২৩:৪৮719451
  • ৭)
    নিখিল
    ====
    সাত সকালে সবাই স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ট্রেন দু'ঘন্টা লেট। মরেছে।
    আমাদের ট্রেন আসার আগেই তো রোশনের ভোপাল থেকে ফেরার ট্রেন ঢুকে পড়বে। মুখোমুখি প্ল্যাটফর্ম। ও নেমে যদি আমাদের দেখতে পায়? এটা ওর শহর; যদি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করে যে এরা ওর অবর্তমানে বৌকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে?
    এটুকু বুঝি পরে যা হয় হোক, প্রথমে তো জিআরপি আমাদের গ্রেফতার করবে।
    ভয় পেয়েচে দুজন। মনীষা নিজে আর গঙ্গারাম দাদা।
    মনীষা রোশনের মারপিট আর ওর মার সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ভয় পাচ্ছে। দাদা ভয় পাচ্ছেন যে আজ শনিবার। অ্যারেস্ট হলে জামিন পেতে সেই সোমবার। ব্যাংকের নিয়মমাফিক যদি কেউ আটচল্লিশ ঘন্টার বেশি পুলিশ বা জেল কাস্টডিতে থাকে তাকে সাসপেন্ড করতেই হবে। তারপর কেস চলবে। বছর তিন চার পরে মামলায় বেকসুর খালাস পাবেন বটে , তবে ততদিন আদ্দেক মাইনেয় থাকতে হবে।
    স্থানীয় খবরের কাগজে পুলিস ফাইলে ছাপা হবে -- মেয়ে অপহরণের দায়ে ব্যাংক অফিসার গ্রেফতার!
    ভয় পাইনি আমি। বহুদিন এই শহরে কাটিয়েছি। খুঁজলে স্কুল কলেজের দোস্ত ঠিক পেয়ে যাব। আর নাটকের দল তো আছেই।
    ভয় পান নি ওর মা। পরে ট্রেনে দেখিয়েছিলেন যে ওঁর ব্যাগের ভেতরে লুকনো ছিল একটি ছ'ইঞ্চি তরকারি কাটা ছুরি। বললেন-- আমার সামনে তোর গায়ে হাত তুলত? তোকে জোর করে নিয়ে যেত?
    যাকগে, গঙ্গাদাদা চা' টা না খেয়ে চোখ কুঁচকে আতিপাতি করে ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের মধ্যে রোশনকে খুঁজতে লাগলেন আর মনীষাকেও ওর মায়ের পাশ থেকে নড়তে দিলেন না।
    অবশেষে ট্রেন এল আর আমরা উঠে বার্থ দখল করে ঘুমিয়ে পড়লাম। শান্তির ঘুম, ভরসার ঘুম।
    এ যাত্রা সফল; জিতে গিয়েছি।
    অমরকন্টকের পাহাড়ের সারি দেখা যেতেই মনীষার মুখে হাসি ফুটল। যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে জেগে উঠেছে। ওর মা নর্মদেশ্বরীর উদ্দেশে হাত জোড় করে মাথায় ঠেকালেন।
    বিলাসপুরের কাছাকছি আসতে আসতে দু'বোনের মধ্যে খুনসুটি শুরু হয়ে গেল।
  • Du | 182.56.6.161 | ২৯ আগস্ট ২০১৬ ২০:৩৪719452
  • তারপর?
  • ranjan roy | 192.69.167.171 | ৩০ আগস্ট ২০১৬ ০০:৪০719453
  • উপসংহার
    ----------------
    কেটে গেছে দুটো দিন। আজকে তৃতীয়।
    যা ভয় পেয়েছিলাম! তবু দুগ্গা বলে ঝুলে পড়েছিলাম। কেন?
    নবকুমার নবকুমার খেলতে ভাল লাগে?
    তা একটু লাগে বইকি। ছোটবেলা থেকেই।
    অ! গীতার নিষ্কাম কম্ম?
    আজ্ঞে না মশায়! আমারও একটা স্বার্থ আছে।
    আসলে কারো পাশে দাঁড়ালে তার চোখে মুখে অসহায় ভাবটা কেটে গিয়ে যখন একটু আলো ফোটে তখন নিজেকে একটা কেউকেটা বা রাজাগজা লাগে। মনে হয়, সেই 'আমারও মূল্য আছে'। আমি গঙ্গারাম নেহাৎ ভ্যবাগঙ্গারাম বা গঙ্গাদা নই, আরও কিছু। কারও কারও মধুসূদনদাদা।
    এইটুকু? ব্যস্‌?
    হ্যাঁ, এইটুকুই। একটু চেনাপরিচিতদের মধ্যে ঘ্যাম নেওয়া ও অন্যেরা প্রশংসা করলে বিনয়ে গলে গিয়ে বলা-- না, না; এ আর কি করেছি!
    যেন চাইলে অনেক কিছু করার ক্ষ্যামতা রাখি!

    সে যাকগে, প্রথম দু'দিন উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটে নি। কেবল আমার অফিসে জি এম এর থেকে হুট করে ছুটিতে যাওয়ার অপরাধে একটা মেমো খাওয়া ছাড়া।
    মনীষা?
    ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। খাচ্ছে দাচ্ছে, ছোট বোনের সঙ্গে লুডো খেলছে আর ঘুমোচ্ছে।
    ক'দিন আরাম করে নে বাপু! তার পর আমরা তোর জন্যে যা হোক একটা চাকরি খুঁজে দেব'খন। এই তো আমার বন্ধু আসফাক ভাই -- নোকিয়া মোবাইলের একটা নতুন আউটলেট খুলেছে। ওর সেলস কাউন্টার সামলাতে পার্টটাইম কিছু হয়ে যেতে পারে। ক'টা দিন যাক।

    আজ সকালে চায়ে চুমুক দিয়ে সবে খবরের কাগজটা খুলেছি এমন সময় নিখিলের এত্তেলা। পাড়ার একটা বাচ্চাকে দিয়ে চিরকুট পাঠিয়েছে যে গঙ্গাদাকে এক্ষুনি ওর ফোটো স্টুডিওতে যেতে হবে। সাতসকালে? মনটা কুডাক ডাকছে। কী হতে পারে? মনীষা আবার মত পালটাল নাকি? রোশন কোন তন্ত্রমন্ত্র করে নি তো!
    পাড়ার আরেক প্রান্তে নিখিলের ছোটখাট স্টুডিও। পেছনে ফোটো তোলার ও ডেভেলপ করার আলাদা কামরা আছে।
    --- আসুন গঙ্গাদা, আসুন। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
    --কী ব্যাপার রে! এখনও তো কাকে গু খোঁটা শুরু করে নি আর তুই দোকানের শাটার তুলে বসে আছিস? এখন খদ্দের কোথায় পাবি?
    নিখিল মৃদু হাসে।
    --আছে দাদা, আপনর চেনা খদ্দের। পেছনের কামরায় চলুন।
    গিয়ে দেখি একটি মাত্র খদ্দের টিনের চেয়ারে বসে ক্লান্ত পা দুটো লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর একটা গরমের সাদা কাপড়ের টুপি দিয়ে মুখচোখ ঢেকে সম্ভবতঃ ঘুমুচ্ছে।
    আমার পায়ের শব্দে সে উঠে সোজা হয়ে বসে; টুপি নামিয়ে সোজাসুজি তাকায়।
    রো-শ-ন!
  • ranjan roy | 192.69.167.171 | ৩০ আগস্ট ২০১৬ ১৯:৩৭719454
  • আমি দেঁতো হেসে হাত বাড়িয়ে দিই। ও ধরে না।
    আমি ভয় পাই।
    দম হ্যায় শালে! মাননা পড়েগা। ঠিক হ্যায়, দেখা জায়েগা শালে কো!
    রোশন একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
    আমি অস্বস্তি বোধ করি। জোর করে রোশনকে উপেক্ষা করে নিখিলকে বলি-- কেন ডেকেছিস? কাজের কথা বল। এখনও নাস্তা হয় নি।
    --দাদা, রোশন এসেছে জবলপুর থেকে । মনীষাকে নিয়ে কথা বলতে চায়। আমি বলেছি গঙ্গাদাও থাকবে।
    রোশন নীচু কিন্তু বাস আওয়াজে বলে-- গঙ্গাদা কেন? ও কী করবে থেকে?
    --গঙ্গাদা আমাদের সবাইকে চেনে। আর আমরা একসঙ্গে জবলপুর থেকে এসেছি। তাই। এবং এইধরণের আলোচনায় একজন তৃতীয় ব্যক্তি থাকা দরকার।
    ( নিখিলও কি ভয় পাচ্ছে?)
    -- বেশ, রোশন। বল, কী বলবে?
    --আমি মনীষাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনারা আমার সঙ্গে মনীষার দেখা করিয়ে দিন।
    -- মনীষা তো দেখা করতে চায় না; ফিরে যেতেও না।
    --সেটা মনীষার মুখের থেকে শুনতে চাই; আপনাদের ওকালতির দরকার নেই।
    --- মনীষা কোন বাচ্চা মেয়ে নয়। ফোন করে শুনে নাও।
    --চেষ্টা করেছি। ওর ফোন বন্ধ।
    --তো আমরা কী করতে পারি?
    --আমাকে মনীষার বাড়ি নিয়ে চলুন। না, ওর ঠিকানা দিন। আমি একাই যাব।
    --- হবে না; বারণ আছে।
    -- কার?
    --ওর মায়ের।
    -- বিশ্বাস করি না; আপনারা চারজন গিয়ে জোর করে মনীষাকে তুলে এনেছেন। ওর মোবাইল থেকে সিম খুলে নিয়েছেন। ওকে ঘর থেকে বেরোতে দিচ্ছেন না।
    ওর গলা চড়তে থাকে।
    -- আচ্ছা? বেশ, থানায় যাও। গিয়ে এফ আই আর কর।
    -- এখানে তো আপনাদের জোর। পুলিশ কেস নেবে না।
    --জবলপুরে গিয়ে তোমার এলাকার থানায় নালিশ কর। পেনাল কোডের ধারা লাগাও। তারপর তোমার বিরুদ্ধে অ্যাবিউসের কেস চলবে। আই উইটনেসের অভাব নেই। ওর ভাই, পাড়ার লোক, বাড়িওয়ালা এবং মনীষা নিজে। রাজি?
    --- আপনারা মনীষাকে কতটুকু জানেন?
    --তুমি কী বলতে চাও?
    -- ও আমাদের নাটকের টিমের অনেক ক্ষতি করেছে। আগে ল্যাংড়া বলে একটা গুন্ডামত লোকের সঙ্গে থাকত, তারপরে---।
    আমি হাত তুলে থামিয়ে দিই।
    -- কী ব্যপার? সব হাতিয়ার ফেইল তো ক্যারেকটার অ্যাসাসিনেশন? লজ্জা করে না?
    --কী বলছেন? সবগুলো সত্যি কথা। একবার জবলপুরে চলুন।
    -- শোন, ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমার বা বিলাসপুরের টিমের কোন মাথাব্যথা নেই। তোমাদের যদি থাকে তো ওকে ছেড়ে দাও। আর তুমি আপদ গেছে বলে খুশি হবে, তা না একটা চরিত্রহীন মেয়ের জন্যে কাজকম্ম ছেড়ে এই চারশ' কিলোমিটার দৌড়ে এসেছ?
    --আমার অধিকার আছে।
    -- একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের জীবনের উপর অধিকার ফলাচ্ছ? তুমি কে হে?
    -- যখন ওর মাথা গোঁজবার ঠাঁই ছিল না, দুবেলা খাবার জোগাড় তখন আপনারা কোথায় ছিলেন, গঙ্গাদা? আমি, এই নিখিল, সব করেছি ওর জন্যে, সব।

    --- খুব ভাল করেছ। আমরা , ওর গোটা পরিবার তার জন্যে কৃতজ্ঞ। কিন্তু ভাবছ, ওকে সারা জীবনের মত কিনে নিয়েছ? আর তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
    নিখিল, আমি চললাম। অফিস যেতে হবে।

    মুখে একটা তেতো স্বাদ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কিছু ভাল লাগছে না। আমারও কি কিছুদিনের জন্যে বাইরে বেরিয়ে আসা উচিত? একটু গিয়েই টের পেলাম সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার নিখিলের স্টুডিওতে ফেলে এসেছি। ফিরে যেতেই হবে। উপায় নেই।
    স্টুডিওর শাটার তেমনি তোলা রয়েছে। ভেতরের কামরায় ঢুকতে গিয়ে পাথর হয়ে যাই।
    রোশন নিখিলের পা জড়িয়ে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে।
    ওরে, ওর সঙ্গে একবার দেখা করিয়ে দে। মাত্র একবার। ওরে ওকে নিজের মেয়ের মত আগলে আগলে রেখেছিলাম রে। পায়ে একটা কাঁকরও লাগতে দিইনি। একবার শুধু ওর মুখ থেকে শুনতে চাই।
    (সমাপ্ত)
  • ranjan roy | 192.69.167.171 | ৩০ আগস্ট ২০১৬ ১৯:৩৯719455
  • ডিঃ
    এই লাইনটায় "আমি, এই নিখিল, সব করেছি ওর জন্যে, সব' নিখিলের জায়গায় 'রোশন' হবে।
  • Ela | 164.59.142.91 | ৩১ আগস্ট ২০১৬ ১৮:১৪719456
  • ভাল্লাগল, কিন্তু শেষটা একটু তাড়াহুড়ো মনে হল। যাই হোক, গল্পকথা ২ শিগ্গিরি নামান রঞ্জনদা, না হলে খেলব না ঃ)
  • Ranjan Roy | ৩১ আগস্ট ২০১৬ ২২:২৬719458
  • বালিকে,
    আসিতেছে গোটা দুই অকিঞ্চিৎকর ব্যাংক ডাকাতির গল্প।
    "ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর, ধৈর্যে বাঁধ বুক।"
    কারণ দু'একটা ফরমায়েশি লেখা লিখিতে হইতেছে।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন