বাইরে কে একটা চিৎকার করছে। বাইরে মানে এই ছোট্টো নোংরা কফির দোকানটা, যার বৈশিষ্ট্যহীন টেবিলগুলোর ওপর ছড়িয়ে রয়েছে খাবারের গুঁড়ো আর দেয়ালে ঝোলানো ফ্যাকাশে ছবিটা কোনো জলপ্রপাত নাকি মেয়ের মুখ বোঝা যাচ্ছে না — এই দোকানটার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কেউ চিৎকার করছে। বাইরে বরফ পড়ছে। আশ্চর্য নিস্তদ্ধভাবে বরফের গুঁড়োগুলো নেমে আসে, যেন রুখসানার হাত থেকে এইমাত্র পেনটা খসে পড়ে গেল — ইরফানের মনে হল এমন দৃশ্য; অথচ আমি জানি না কেন তার হাত থেকে পেনটা খসে পড়ে গেল। তার মাথার পিছনে দেয়ালের গায়ে লাল ও বেগুনি, নাকি নীল, হয়তো নীল মাছেদের ছবি, কোনাকুনি অনেকগুলো ছোট ছোট মাছ, অথবা যেন একটাই মাছ লাফ দিচ্ছে, বদলে বদলে যাচ্ছে তার গায়ের রঙ, আলোর রঙও হতে পারে; মাছগুলো ছবি ছিঁড়ে খেলা করছে মেঝেতে এইরকম মনে করে যেন আমি চাইলাম মেঝের দিকে — তার চোখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করল না আমার, কেননা বিস্বাদ এত বেশী। জীবনানন্দ আমাকে নষ্ট করেছে, আমার সমস্ত স্থিতি ও জড়তা ভেঙে এই কবিতাগুলো আমায় সম্পূর্ণ ক্লান্ত ক্লান্তিকর এক দ্বন্দ্বের ভেতর ক্রমাগত ঠেলে দেয়। কেন এরকম হয়ে গেল সব? ইরফানের পায়ের কাছে সামান্য দূরে উল্টে রয়েছে একটা কফির কাপ; গাঢ় বাদামী কফি গড়িয়ে এসেছে মেঝেতে, তার দাগ, দু-একটা মাছি, অবিন্যস্ত। রাস্তার ওপারে, দোকানের কাঁচের দেয়াল পেরিয়ে তাকালে দেখা যায়, অবেলার আলো নষ্ট হচ্ছে ক্রমে। দূরে সিএন টাওয়ারের মাথায় আলোগুলো জ্বলে উঠেছে, শহরের মুখে পড়েছে নিয়নের সেইসব আলো; যে মেয়েটা সারাদিন কফি বানিয়ে খদ্দেরকে দিতে দিতে ক্লান্ত, তার ক্লান্ত আঙুলের মতো মানুষেরা রাস্তা বেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, মনে হয় ঠিকানাবিহীন; অথচ একটু আগেও সিএন টাওয়ারটা দেখা যাচ্ছিল না কুয়াশায়। নিজের কফিতে চুমুক দিয়ে ইরফান বুঝতে পারল আজ রাতে আবার সে স্বপ্নে দেখবে আমলকী গাছটাকে। তার ঘুমের ভেতর, স্বপ্নের ভেতর ফিরে ফিরে আসে অনেকদূরের দ্রাঘিমায় তাদের বর্ষার জলে শ্যাওলার দাগ-ধরা বাড়ীটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ঝিরঝিরে পাতাওয়ালা আমলকী গাছটা, হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠত তার পাতাগুলো আর পড়ার ঘরের জানলা থেকে গাছটাকে দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে পড়ত সে পাতা ঘষটানোর শব্দে। সেই শব্দটা ফিরে ফিরে আসে তার স্মৃতির ভেতর আর সেটা ভেঙে বৃত্তাকারে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে একটা টেলিফোন বাজার তীক্ষ্ণ আওয়াজ।
সেদিনটা ছিল এক ঠান্ডা কনকনে অভ্যর্থনাহীন রাত; জানলার বাইরে পাতাঝরা গাছগুলো বরফে বরফে সাদা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মাঝে মাঝে রাক্ষসী হাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে, আর রুখসানার তীব্র আশ্লেষ তার ঠোঁটে। ক্রমশ দুজনে দুজনের পোশাকগুলো খুলতে খুলতে ভেসে যাচ্ছিল কামনার নির্জন অন্তরীপে যেন তারা পৃথিবীর একমাত্র নরনারী, তাদের নগ্ন শরীরের রূপ ও জড়ুলকার্য অথর্ব এবং স্থবির হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত তাদের হৃদয়ের উষ্ণতাকে যেন আর থামতে দেবে না। ঠিক তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠেছিল, কয়েকটা রিঙ হয়ে যেতে দিয়ে অবশেষে ইরফান রুখসানার নাভি থেকে মুখ তুলে হাত বাড়িয়ে টেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল কর্ডলেসটা, আর অনেকদূরের কোনো টেলিফোন বুথ থেকে ভেসে এসেছিল এক আতঙ্কিত বুড়োগলা ইরফানের কানে। উদ্বিগ্নভাবে একটা অদ্ভুত খবর শুনিয়েছিল ইরফানের বাবা আর শুনতে শুনতে হিম হয়ে গিয়েছিল হাজার হাজার মাইল দূরে শুয়ে থাকা দুজন নগ্ন নরনারী; হঠাৎই অসম্ভব শীত-শীত যেন। ক্রমশ ইরফান বুঝতে পারল গরম কফিটা তাড়াহুড়ো করে খেতে খেতে তার জিভটা পুড়ে যাচ্ছে; কেন সে খাচ্ছে এত তাড়াতাড়ি? বাইরে কে একটা চিৎকার করছে। মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণা অনুভব না করা কী ভীষণ কঠিন কাজ! নদীর ওপর দিয়ে হাঁটা হয়তো বা সম্ভব, সহজ এর চেয়ে। কফিটা আস্তে আস্তে ডাস্টবিনে ফেলে দিল ইরফান। তারপর দরজার কাছে দাঁড়ানো গৃহহীন নোংরা পনেরো বছর চান না করা ইঁদুরের মতো চিৎকার করতে থাকা লোকটার পাশ দিয়ে ভয়ে ভয়ে সে বেরিয়ে এল। বরফঠান্ডা হাওয়া তার ওভারকোট ভেদ করে হাড়ে লাগল যেন। এখন যদি নদীর ধারে বেড়াতে যাওয়া যেত, বেশ হত। এখন তার আফশোস হল কফিটা ফেলে দেওয়ার জন্যে। অন্ততঃ উষ্ণতাটুকু।
— তুমি বাচ্চাদের মত কথা বোলো না ইরফান। প্লিজ। — নীচু হয়ে পেনটা কুড়িয়ে নিতে নিতে রাগতভাবে বলল সে। তার চুলগুলো কপালের ওপর, চোখের ওপর নেমে এলো। সেগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে, অবেলার আলো পিছলে পিছলে যাচ্ছে তার গালে, রুখসানা পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে — এ নিয়ে আমি আর কথা বলতে চাইনা। এ নিয়ে তাহলে কি সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে? কখন নেওয়া হয়ে গেল? আমি ভাবলাম। আমি তাকালাম জানলার বাইরে। সমস্ত দিন যেন ক্লান্তিকর ঘটনার মিছিল; কার্নিশ থেকে পোষা বেড়ালের মতন আয়েশী আলো আড়মোড়া ভেঙে ক্রমে নেবে যাচ্ছে জলে-ভেজা রাস্তায়। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে কলেজ স্ট্রীট ধরে সেপ্টেম্বরের কোনো এক বিকেলে, মাথার ওপরে জলজ আকাশ তখন ফের ধূসর উজ্জ্বল হয়ে এসেছে যেন আর দূরে সিএন টাওয়ারটা ঢেকে গেছে আবছা-ঝাপসা হয়ে, ইরফান বাড়ী ফিরছিল ইউনিভার্সিটি থেকে। নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরের শুরুতে বরফ পড়বার আগে পর্যন্ত অকারণে বৃষ্টি তো এরকমই হয়, ঠান্ডা স্যাঁতসেতে হাওয়া বইছে শহরের সমস্ত উন্মুক্ত প্রত্যঙ্গে, হাওয়া এভাবেই বইতে থাকে। রাস্তায় অবিশ্রান্ত ট্র্যাফিকের শব্দ, বাস বা স্ট্রীটকার গড়িয়ে চলার আওয়াজ এবং টিপটিপ করে আবার পড়তে শুরু করা বৃষ্টির ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকা অফিসফেরত মানুষদের কোলাহল অথবা সেইসব তরুণ-তরুণীর জুটি যাদের প্রেম এখনও অন্তর্গত অন্ধকারের ভেতর ক্লান্ত হয়ে পড়েনি, হাতে হাত রেখে তাদের উষ্ণ উচ্ছল হাসিতে গলে পড়া যা পৃথিবীকে এখনও কিছুটা আলো জুগিয়ে থাকে, তার ভেতরেও ইরফানের মন নিজস্ব ভাবনায় আশ্চর্য মগ্ন হয়ে ছিল। কেননা সে এমনকি তার ভেজা জুতোর ভেতর পায়ের পাতা পিছলে পিছলে যাবার মসৃণ অনুভূতিটা পর্যন্ত টের পাচ্ছিল না; এতখানি অসতর্ক ছিল তার স্নায়ুগুলো।
— বাবরি মসজিদ? — রুখসানা শুকনো গলায় জিগ্যেস করেছিল পোশাক পরে নিতে নিতে। পলকের মধ্যে সমস্ত রূপ ঝরে গিয়ে তাদের দেখাচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় হাঁস ও হাঁসিনীর মতন, চিন্তা এবং উদ্বেগে ক্লিষ্ট। প্রিয়জনদের খোঁজ নিতে নিতে সেইসব দিনগুলো কেটে গিয়েছিল একে একে, দাঙ্গার প্রবল আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত দাঙ্গা বাঁধেনি তাদের মফস্বল শহরটায়। পরিবর্তে একটা অন্য জিনিস ঘটে; শহরের মন্দির আর মসজিদগুলো পাল্লা দিয়ে চকচকে হয়ে উঠতে শুরু করে। রাস্তার পাশে রেস্তোরাঁর বাইরে বসার জায়গাগুলো ভিজছিল ক্রমাগত, বলাই বাহুল্য সেখানে কেউ ছিলনা, কিন্তু রেস্তোরাঁর কাঁচের জানলার ওপারে অনেক মানুষজন বসে গল্প করছিল, সুঠাম চিনেমাটির প্লেট থেকে চামচে গেঁথে তুলছিল ধোঁয়াওঠা খাবার, ছোটো ছোটো পোড়ানো মাংসখন্ড হয়তো, গেলাসে চমৎকার পানীয়; মেঘ ও বৃষ্টি অবেলার অনেকখানি আকাশকে নষ্ট করেছে বটে, তবুও কাঁচের দেয়ালের এপারে এত আলো এখনও জমে আছে যে একজন মানুষ তার সামনে রাখা সুদৃশ্য খাদ্যতালিকা থেকে পছন্দমত খাবার বেছে নেবার যথেষ্ট সময় পায়। এসবের পাশ দিয়ে ইরফান হেঁটে যাচ্ছিল; কারণ জীবনের অফুরন্ত স্বাদ ও উল্লাসের চলকে ওঠা টুকরোগুলো থেকে এতদূর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সে যে কোনোভাবেই সেগুলো তাকে ছুঁতে পারছিল না আর। মাথার ভেতরে একধরনের বোধশূন্য অন্ধকার নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে অনুভব করল সেই অস্বস্তিটা ফিরে ফিরে আসছে, যেন জোড়া জোড়া চোখ তাকে নিবিষ্টভাবে পরখ করছে, এরকমই মনে হয়েছিল তার ক্লাস নেবার সময় ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে ফিরে খসখস করে লিখতে লিখতে। অথচ সকলেই ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়েছিল নিশ্চিত জানে সে, তবুও একসময় আর সহ্য করতে পারল না ব্যাপারটা, চকের টুকরোটায় কখন বেশি জোরে চাপ দিয়ে ফেলেছে খেয়ালই হয়নি, মট করে ভেঙে গেল সেটা মাঝামাঝি আর সে যেন ঘুরে টেবিলের ওপর রাখা চকের বাক্স থেকে একটা নতুন চক তুলে নেবার অছিলায় ছাত্রছাত্রীদের দিকে চকিতে তাকাল একবার।
— প্রফেসর!
যেন জজসাহেবের রায় শোনানোর আগে গ্যাভেলটা ঠোকার শব্দ —
— বলতে পারেন কাছাকাছি সেভেন-ইলেভেনটা কোনদিকে হবে?
ইরফান চমকে উঠল, একজন প্রৌঢ় চীনা ভদ্রলোক, সেভেন-ইলেভেন, সেভেন-ইলেভেনটা কোথায় জানতে চান উনি। পিছনের সারি থেকে একটি খয়েরিমাথা বলল — আই থিঙ্ক দ্যাট মাইনাস সাইন শুড বি প্লাস ইন দ্য থার্ড লাইন।
ঘুরে খুঁজল সে তৃতীয় লাইনটা — ও, ইয়েস, ইয়েস! অফ কোর্স! — বিয়োগচিহ্নটার মাঝামাঝি একটা উল্লম্ব রেখা টেনে দিল নিমেষে। তারপর অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল সে, জানে না কাছাকাছি সেভেন-ইলেভেনটা কোথায়। কেবল সে টের পাচ্ছে বাতাসে ছুঁড়ে দেওয়া বলগুলো লুফে নিতে নিতে অবিশ্বাস্যরকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তার হাত।
ছুঁড়ে দেওয়া বলগুলো নিয়মিত হাতে ফিরে আসে। এভাবেই জাগলার খেলা দেখিয়ে চলেন। দুটো থেকে তিনটে, তিনটে থেকে চারটে, চারটে থেকে পাঁচটা — উড়ন্ত বলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দর্শক গুনতে থাকে। একসময় দর্শকেরা তাল হারিয়ে ফ্যালে। তাদের মনে হয় অনেক অনেক বল চক্রাকারে ঘুরে চলেছে এক আশ্চর্য জাদুর সম্মোহনে। সেই জাদু একমুহূর্তে ভেঙে পড়বে, যদি একটা বল ঠিকমতো হাতে ফিরে না আসে অথবা ছিটকে পড়ে হাত থেকে। ভাবতে ভাবতে নিজেকেই বলে যেন ইরফান বিড়বিড় করে — আমি আর পারছি না। আমার আর ভালো লাগছে না। তার আর ভালো লাগছে না। এইকথা বুঝেই একদিন তাকে ধমক দিয়েছিল তার স্ত্রী — কেন তুমি পড়ছ ঐ বইগুলো? — কেন আমি পড়ছি? — ইরফান ভাবে — জীবনানন্দ আমাকে নষ্ট করেছে, আমার সমস্ত স্থিতি ও জড়তা ভেঙে এই কবিতাগুলো আমায় সম্পূর্ণ ক্লান্ত ক্লান্তিকর এক দ্বন্দ্বের ভেতর ক্রমাগত ঠেলে দেয়। কেন এরকম হয়ে গেল সব? এরকম হবার কথা তো ছিল না যখন সে প্রচুর উদ্যম ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাদের ছোট্টো মফস্বল শহরটার গন্ডি ছেড়ে বেরিয়েছিল, জীবন ও জীবিকার স্রোতে ঘুরতে ঘুরতে সে এসে পৌঁছেছিল এইখানে। তবুও অন্তহীন কাজের মাঝে, টরন্টোর রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয় ফিরে যাওয়া যায় না? শেষপর্যন্ত ইরফান টাকাটা দিয়েছিল; তার বাবা বলেছিল ফিসফিস করে তাদের পাড়ার লোকেরা দারুণ খুশি হয়েছে, অনেক দোয়া দিয়েছে।
— কেন দিলাম? — ভাবল ইরফান।
— শেষঅব্দি মসজিদ মেরামত করে দোয়া পেতে চাইবে তুমি এটা জানতাম না — রুখসানা কাটা কাটা গলায় বলেছিল — বলো তো বোরখা কিনে আনি?
ইরফান মাথা নেড়েছিল, সে জানে সে ভুল করেছিল, লোকগুলোকে এড়াতে না পারাটা মারাত্মক একটা ভুল হয়েছিল।
— দ্য টেডিবিয়ার ইজ ডাউন! — সোনালী চুলের ছেলেটা জোরে জোরে বলল। বছরসাতেকের মেয়েটার হাত ধরে তার কৃষ্ণাঙ্গ মা খানিকটা এগিয়ে গেছে ততক্ষণে। ইরফান দ্যাখে বরফের তোড় বাড়ছে যেন; স্ট্রীটল্যাম্পের আলোর সামনে, চলে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটের সামনে বরফের গুঁড়ো কিলবিল করছে দেয়ালিপোকার মতন। মেয়েটার হাত থেকে টেডিবিয়ারটা ছিটকে পড়েছে বরফের ওপর। টেডিবিয়ারটাকে ঠেলে ঠেলে মেঝেতে আধশোয়া হয়ে খেলা করছিল নীপা, ইরফান হাতের বইটা ভাঁজ করে রেখে হেসে মেয়েকে কী যেন একটা বলতে গেল। রুখসানা রুদ্ধশ্বাসে ঘরে এসে ঢুকল হাঁপাতে হাঁপাতে — বিবিসি চালাও এক্ষুণি। ছেলেটা বরফ ঝেড়ে তুলে দেয় পুতুলটা মেয়েটার হাতে, তার মা ধন্যবাদ দিল। দেখল ইরফান। একটা অদ্ভুত খবর ব্রডকাস্ট করছে বিবিসি। একটা অদ্ভুত ভিডিও ফুটেজ। নীপা দ্যাখে একটা বিরাট বাড়ির মাথায় এসে ধাক্কা মারছে একটা প্লেন আর ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশের নীল মগ্নতা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নদীর ধারে বেড়াতে যাই, নদীর জলে মাজা বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদ, চোখ বন্ধ করে দেখি; দেখি নদীরও তো বয়েস বাড়ছে, কমে আসছে যৌন আকাঙ্ক্ষা। চোখ খুলে দেখি দেয়ালের গায়ে মেরিলিন মনরো। এই কয়েন লন্ড্রীটার নাম হলিউড লন্ড্রী। দেয়ালে ক্লাসিক চিত্রতারকাদের পোষ্টার। আমি ওয়াশিং মেশিনে জামাকাপড় ঢুকিয়ে অপেক্ষা করছি। আর কেউ নেই। আমি যেখানে বসে আছি, আমার মাথার ওপরে এলভিস। বন্দুক হাতে এলভিস। আমার চোখের সামনে মেরিলিন। তার ঠোঁটজোড়া যৌন আবেদনে ভরপুর। আমি তার ঠোঁট বা বুক দেখছি না। আমি দেখছি তার চোখদুটো। এসময় আমার আত্মহত্যার কথা মনে পড়ে। আমার জিভটা কফির কষাটে স্বাদে পুড়ে আছে এখনও। এইবার আমি উঠে দাঁড়াই। অন আ কোল্ড অ্যান্ড গ্রে শিকাগো মর্নিং……
কোনো বিশ্বাস নেই তার, কোনো অবিশ্বাস নেই; একটা নূন্যতম স্পষ্টতা যা মানুষের প্রয়োজন বোধগম্য জীবনের ভেতর বেঁচে থাকবার জন্যে — ইরফান হারিয়ে ফেলেছে। এই অন্ধকার তাকে টানে, যেখানে তার কোনো পরিসর নেই নষ্ট ও অপচয় হয়ে যাওয়া ছাড়া। আলোর ধারে বসে জীবনানন্দের উপন্যাসগুলো পড়তে তার ভালো লাগে। হয়তো ভালো লাগে না, একধরনের নিরাময়হীন রোগের শ্রুশুষামাত্র — এ জিনিস তার চেয়ে খুব বড় বা মহৎ কিছু নয়। যেসমস্ত ঋতুতে বিঠোফেনের সঙ্গীত শোনা অথবা রবীন্দ্রনাথ পড়া যেতে পারত, সেরকম ঋতু আর এ শতাব্দী দ্যাখেনি। নীপা জীবনে দেখবে না হয়তো, ভাবে ইরফান। নীপা খেলা করে মেঝেতে বসে, এত কী খেলে সে? শিশুর এখনও খেলবার অফুরান অফুরান সাধ বিস্মিত করে দেয় পৃথিবীকে। পৃথিবীর নির্জন পথে বৃষ্টি বা তুষারের ভেতর উড়ে উড়ে চলে যায় জন্মদিনের বেলুনসমূহ। ইরফান কোলে নেয় নীপাকে — আজ জন্মদিন তোমার? — তাকে আদর করে ইরফান। রুখসানা কেক কিনে আনবে অফিস থেকে ফেরার পথে। কেকের ওপরে লেখা থাকবে শুভেচ্ছাবার্তা। ঘরের ভেতর অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়, কিন্তু বাইরে আলো আছে, তবু দূরে সিএন টাওয়ারের মাথায় আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। খানিক পরে রুখসানা ফিরে এল। প্লাস্টিকের ব্যাগটা ডাইনিং টেবিলে নামিয়ে কোনো কথা না বলে সে গিয়ে ঢুকল বাথরুমে। নীপা মোমবাতি জ্বালায়, নিজেই কেক বের করে বাক্স থেকে। ঘর থেকে হঠাৎ সে শুনতে পেল মায়ের চিৎকার। আচমকা রুখসানা কাঁদতে কাঁদতে 'ধূসর পান্ডুলিপি'-টা টেনে এনে ধরিয়ে দিল মোমবাতির আগুনে। ঘরে সামান্য ধোঁয়া হতেই স্মোক অ্যালার্মটা তীব্র শব্দ করে বাজতে শুরু করেছে। নীপা চুপ করে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দ্যাখে হলুদ আগুন বইটাকে পুড়িয়ে আঙরাটে লাল করে ফেলছে প্রায়। তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে।
— আমাকেও সহ্য করতে হয় অনেক — দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল রুখসানা — তবু আমি তোমার মতো ভেঙে পড়িনা। হাঁপাতে হাঁপাতে দম নিচ্ছিল সে, তার গাল বেয়ে চোখ থেকে জল পড়ছিল। ভয়ে আর অপমানে শিঁটিয়ে গেছিল সে যখন মেট্রোতে বুড়িটা আঙুল উঁচিয়ে প্রায় অবোধ্য ইংরেজিতে হঠাৎ ধমকাতে শুরু করেছিল তার উল্টোদিকে বসা হিজাব পরা মেয়েটাকে — গো ব্যাক টু ইয়োর ওন কান্ট্রি! স্মোক অ্যালার্মের শব্দের মতো দূর থেকে পুলিশের সাইরেন ভেসে আসে, ইরফান হাঁটছিল একা, বরফ দূরত্বে পড়ছে। ঠান্ডা নীরব পার্কে কারা যেন স্কেট করছে। বাদামী লোমওয়ালা স্বাস্থ্যবান একটা কুকুর জিভ দিয়ে চেটে নিল বরফের স্বাদ; তার বকলস ধরে চুপচাপ হাঁটে ম্যানিকুইনের মত মানুষ। গো ব্যাক টু ইয়োর ওন কান্ট্রি! নৈঃশব্দের জঙ্ঘা ছুঁয়ে থাকে স্মোক অ্যালার্মের শব্দ; হাওয়া ঘুরে ঘুরে উঠছে হাওয়ার ভেতর, মোড়ের মাথায় ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয় কোনো যুবতীর পানীয়ের গ্লাস থেকে চলকে মোমের নরম আলো লেগেছে কোনো যুবকের মায়াবী চিবুকে। একলা সে আনমনা, ক্রমশ তার অপসৃয়মান অবয়ব বিকেলের গায়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকে; একসময় এতখানি একলা হয়ে দূরে, আরো দূরে সে চলে যায় যে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না দৃষ্টিসীমার ভেতরে, মনে হয় হয়তো সে কোনোদিনই ছিলনা, যেন আর জানা যাবেনা শেষপর্যন্ত সে তার গন্তব্য খুঁজে পেয়েছিল কিনা। অনেক অনুসন্ধানের পরে একটা পাঁচ লাইনের খবর পাওয়া যেতে পারে মাত্র, টরন্টো স্টার জানাচ্ছে গতকাল সন্ধ্যেবেলা কুইন স্ট্রীট ইস্ট ও ব্রডভিউ অ্যাভেনিউয়ের ক্রসিংয়ে পেডেস্ট্রিয়ান সিগন্যালের দিকে খেয়াল না করে একজন মধ্যবয়েসী ব্যাক্তি অন্যমনস্কভাবে রাস্তা পেরোনোর সময় ধাবমান স্ট্রীটকারের ধাক্কায় লুটিয়ে পড়ে এবং তার পা থেকে কোমর পর্যন্ত দুমড়ে-মুচড়ে ঢুকে যায় স্ট্রীটকারের নীচে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও কয়েকঘন্টার মধ্যেই সে মারা যায়। কেউ জানবে না ঐ কয়েকঘন্টা ইরফান কেবল তার ধূসর চেতনার প্রেক্ষাপট জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা আমলকী গাছকে দেখতে পাচ্ছিল, যার ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো পাতাগুলোয় অবেলার সামান্য রোদ পাখি হয়ে উড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল আর সেকারণেই তারা থিরথির করে কাঁপছিল ফেরারী হাওয়ায়।