এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • রাষ্ট্রের ম্যাজিকথলি

    Anamitra Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১৫১৯ বার পঠিত
  • রাষ্ট্র একটি কল্পিত ব্যবস্থা। রাষ্ট্র বলে আসলে কিছু হয় না। আমরা ভেবে নিয়েছি এবং বিশ্বাস করছি তাই রাষ্ট্র আছে। আমার সামনে এই মুহূর্তে যে কম্পিউটারটা রয়েছে রাষ্ট্রের থেকে তা অনেক বেশি সত্যি। এই স্ক্রীনটাকে আমি ছুঁয়ে দেখতে পারি, রাষ্ট্রকে ছুঁয়ে দেখতে পারি না; বিভিন্ন প্রতীক ও প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র প্রতিভাত হয় আমার কাছে।

    ধরা যাক, একটি হাওয়া ভর্তি থলি, তার ভিতরে যে হাওয়াই রয়েছে এমনটা কেউ বুক ঠুকে বলতে পারে না। কারণ হাওয়া চোখে দেখা যায় না। থলিটি বন্ধ থাকলে বোঝা যায় শুধু যে ভিতরে কিছু একটা রয়েছে। খুলে দেখা হয়েছিল সময়ে সময়ে, কিন্তু কিছু দেখা যায়নি। এর ফলে এক জাদুই-ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে থলিটিকে ঘিরে। আজকাল আর কেউ খুলে দেখতেও যায় না, কারণ সকলেরই বিশ্বাস ওই থলিটির ভিতর যাই থাক না কেন সেটি মহামূল্যবানই হবে। এই বিশ্বাস তারা পেয়েছে তাদের পিতামাতার থেকে, ইস্কুল থেকে, লোকমুখে প্রচারিত গল্পকথা শুনে। এমনকি থলিমাহাত্যে বিশ্বাস না করলে যে একদল লোক এসে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বন্দী করে রাখে সেটাও তো একপ্রকার প্রমাণই হলো যে থলিটির ভিতর নিশ্চয়ই মহার্ঘ্য কিছু আছে। এখন, যেহেতু বাইরে থেকে কিছু আছে বোঝা গেলেও থলিটি খোলার পর আর কেউ কিছু দেখতে পায়নি অতএব বোঝাই যাচ্ছে নিশ্চয়ই দৈব কোনোকিছুই থেকে থাকবে থলিটির মধ্যে। থলির ভিতরে থাকা ওই অদৃশ্য বস্তুটি সবার কাছেই মহামূল্যবান। তাই দশ-বারোটি গোষ্ঠীর মধ্যে লাঠালাঠি-কাটাকাটি হয় থলির অধিকার নিয়ে, থলির সম্মান-অসম্মান নিয়ে। এসবের কোনোকিছুই হতো না যদি লোকজন জেনে ফেলতো যে থলিটির মধ্যে রয়েছে আসলে হাওয়া আর ওই না-থাকা টুকুকেই তারা নিজেদের প্রয়োজনে এতদিন দৈব বলে বিশ্বাস করে এসেছে। প্রয়োজন ছিল তাদেরই, কারণ তাদের অস্তিত্বগত অর্থহীনতার অতীত জীবনে আরও কোনো মাত্রার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল বিশাল ভূ-খন্ড জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কোনো এক সাধারণ বিশ্বাস। শুধু এইটুকু বুঝে ফেলতে পারলেই থলির দৈবতা নিরীহ এক শাস্ত্রীয়-আচরণবিধির মতো হয়ে টিকে থাকতে পারতো। কিন্তু না, সেরকম হওয়ার উপায় নেই। কারণ যতবারই কেউ মুখ ফুটে বলতে যায় "ওরে তোর থলির ভিতর হাওয়া" ততবারই গুম হয়ে যায় তারা। কারা যেন রাতের অন্ধকারে কালো ভ্যানে তুলে নিয়ে চলে যায়। সেইসব মানুষেরা আর ফেরত আসে না। অথবা ফিরে এলেও একঘরে হয়ে যায়। পাগল দাগিয়ে দেওয়া হয় তাদের, যাতে তাদের কথায় আর কেউ বিশ্বাস না করে। এইভাবেই থলিমাহাত্য জারিত হয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
    "ধরা যাক" লিখে শুরু করা এই অবাস্তব কাহিনীর গোটাটাই আসলে বাস্তব হতে পারতো যদি একদল লোক পাওয়া যেত যারা বিনা বাক্যব্যায়ে বিশ্বাস করে নেবে থলির ভিতর হাওয়া নয়, দৈব কিছু আছে, যাকে নেই বললেও তার অপমান করা হয়।

    মজার ব্যাপার হলো ভারতীয় সেনায় বেশ কিছু এমন মানুষ কর্মরত রয়েছেন যাঁরা নিজেরা সম্ভবত এই থলি-বাস্তবতা বিষয়ে সচেতন। ফিল্ড পোস্টিং-এর সময় ফোনের লাইনে অপেক্ষা করা থেকে বর্ডারের ওপারের গ্রামে দূরবীন হাতে উঁকি দেওয়ার গল্পের ফাঁকে মনে হতো কোথাও যেন হাওয়ার শব্দ হচ্ছে। দৈনিক জীবনের ছবি খুঁড়ে তুলে আনার সময় কোথায় যেন শূন্যতার আঁচ লেগে যাচ্ছে ফটোফ্রেমে। এক ফৌজি একবার বলেছিলো, "ফৌজ মে তো আধে দিমাক সে হি কাম চল্ যাতা হ্যায়। অর্ডার কে হিসাব সে কাম হো জানা চাহিয়ে বস!" পাকিস্তানেও এরকম কেউ নেই বলছি না, ওরাও নাকি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে খুব খবর নিতো ওপার থেকে; শেষ কবে চিঠি এলো, অফিসারের বৌ কি লিখলো চিঠিতে, এইসব। তারপর সেই শচীন আর মাধুরী নিয়ে ফাজলামো তো রয়েছেই। ইয়ার্কির মাঝে মাঝেই আওয়াজ দেওয়ার মতো করে কয়েকরাউন্ড গুলিও ছুঁড়ে দিতো আবার নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য ছাড়াই। হাজার হোক যুদ্ধের সম্পর্ক বলে কথা। তবে কিনা এ সবই শুনেছি কেবল অন্যের মুখে। ওদেশের কাউকেই আমি নিজের চোখে দেখিনি। দু-একজন অ্যানিমেটরের সঙ্গে কাজ করেছি বটে, তবে তাদের কারুর সঙ্গেই কাশ্মীর বা বালুচিস্তান নিয়ে কথা হয়নি কখনও। সাধারণ মানুষ যেরকম হয় আরকি, বাড়িতে কে কে আছে, ছেলের জ্বর সারলো কিনা, ওদেশে কান্দা-র কেজি থেকে কোকাকোলার বোতলের দাম --- এইসব নিয়ে কথা হতো ফাঁকে ফাঁকে। কে জানে, তারা হয়তো ততটাও "পাকিস্তানী" ছিল না তবে! অথবা আমরা, এমনকি আমাদের ফৌজিরাও হয়তো ঠিক ততটা "হিন্দুস্তানী" নয় যতটা বানিয়ে রাখা গেলে কিছু লোকের খুব লাভ হতো নিঃসন্দেহে। শত্রুতা তো মানুষে মানুষেই হয়, থলির ভিতর হাওয়া থাক বা প্রাণ। সবচেয়ে সমস্যার হলো হাওয়াকে হাওয়া বলে জেনে ফেলার পরও থলি আগলে বসে থাকা। চোখে ঠুলি নেই কোনও, আমি শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছি আমি জানি, কিন্তু সরে আসতে পারছি না। কিছু লোক ধুয়ো তুলে কাগজে-টিভিতে খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে আপনি লড়ে যান, বাকিটা আমরা বুঝে নিচ্ছি। আপনি মরে গেলে আপনার পরিবারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আপনার দেহ অথবা দেহাবশেষ তিনরঙা পতাকায় মুড়ে আমরা গান স্যালুট দেব। দেশজুড়ে নানান পাথরে আপনার নাম খোদাই করে দেওয়া হবে। আপনি বীর, বলছে ওরা, আর আমি ভাবছি আমার আড়াই বছরের বাচ্চা মেয়েটাকে আর দেখতে পাবো না। একথলি হাওয়ার জন্য আমি উৎসর্গ হতে চলেছি। কিন্তু কেন?
    --- উত্তর আছে ওই থলির ভিতর যেখানে মানুষের বিশ্বাস পরে পরে দমবন্ধ হচ্ছে। ওই বিশ্বাস থেকে হয়তো সরে এসেছিলো কেউ, কিন্তু যারা সরে আসতে পারেনি তারাই এখন ধাক্কা দিয়ে দিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে সেই ব্যক্তিকে শূন্য থেকে আরও শূন্যতর-র দিকে। একজনের আকাশপ্রমান মূর্তি বানিয়ে তাকেই চ্যালেঞ্জ করছে ছুঁয়ে দেখাও। কাউকে একবার বীরের আসনে বসিয়ে মাপছে, আবার পরক্ষনেই তাকে ওজন করে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ হওয়ার দাঁড়িপাল্লায়। মাংসের বাজার বসেছে যেন, "ওরাও তো প্রাণী" আর "কিলো কত করে"-র বাক্যবাণ ছুটেছে একসাথে। তারই মধ্যে একদল আবার বলছে মুরগীর জন্মই মাইক্রোওভেনে ঢোকার জন্য। একমাত্র সেইজন্যেই আমরা মুরগীর চাষ করে থাকি। তাতে আরেকদল জুটে গিয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিচ্ছে, "কেন হে? তোমার মুরগীরা কি ডিম দেয় না নাকি?" একপাশে নধর দুটো মোরগের মধ্যে লড়াই বাধিয়ে দিয়ে কারা যেন আবার বাজী ধরতে লেগেছে, দশ কা বিশ, দশ কা বিশ, দশ কা বিশ! কালো মোরগটা ঠুকরে খয়েরী মোরগের ঘাড় থেকে রক্ত বার করে দিয়েছে। দশ কা তিস, দশ কা তিশ। পুলওয়ামায় সিআরপিএফ-এর গাড়ি উড়ে গেছে। দশ কা চালিস দশ কা চালিস দশ কা চালিস...

    যদি শুধু মেনে নেওয়া যেত, রাষ্ট্র এক কল্পিত অস্তিত্ব, মানুষের ভেবে নেওয়া একটা ব্যবস্থা, মানুষের নিজের সুবিধার্থে...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১৫১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সিকি | 894512.168.0145.123 (*) | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:০৯49819
  • আর ভাই। সেনাবাহিনির মধ্যে, বিশেষত নিচু র‌্যাঙ্কের জওয়ানদের মধ্যে দিন সাতেক থেকে এলেই দেশপ্রেমের গল্পটা দিব্যি বুঝে যাওয়া যায়। কিন্তু কে বুঝতে চায়!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন