এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ১৯৪৬, এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বছর

    Arijit Guha লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৯ অক্টোবর ২০১৭ | ১৬৩৪ বার পঠিত
  • সদ্য তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে।ফ্যাসিস্ট বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছে।পৃথিবীর ইতিহাসে এক যুগসন্ধিক্ষণ।পৃথিবী জুড়ে সব মানুষের বাধ ভাঙা উচ্ছ্বাস। যারা যারা যুদ্ধে নিজের প্রিয়জনকে হারিয়েছে, তারাও এই বিভৎসতার শেষে হাপ ছেড়ে বেঁচেছে।সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ এই যুদ্ধে চেয়েছিল হিটলারের পরাজয়।কারন পৃথিবী নিয়ন্ত্রণের ভার এক উন্মাদের হাতে পরলে সে যে কী ভয়াবহ অবস্থা হত তার ধারণাও করা যায় না।
    কিন্তু বাংলায়, তখনকার অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে অবস্থাটা একটু অন্যরকম।ভারতে তখন চলছে ব্রিটিশ শাসন, আর ব্রিটিশরা এই যুদ্ধে হিটলারের বিপরীতে।যুদ্ধের ফলে বাংলা দেখেছে ৪৩ এর মন্বন্তর।সেনাবাহিনীর খোরাকির যোগান দেওয়ার জন্য সারা বাংলার শস্যভান্ডার চলে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে।মজুতদার আর কালোবাজারিদের রমরমা।চাল তখন সোনার চেয়েও দামী।কলকাতার রাস্তা গ্রাম ছেড়ে চলে আসা দলে দলে মানুষের ভিড়ে একাকার। আর সেই মানুষগুলো কেউ কেউ শীর্ণকায় কঙ্কালসার কেউ বা অর্ধ অথবা সম্পূর্ণ উলঙ্গ।ফ্যান দাও মা ধ্বনিতে মুখরিত কলকাতার রাস্তা।তার সাথে ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার।স্বভাবতই মানুষের তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে।কয়েকবছর আগেই বাঙালী বীর নেতাজি সুভাষ কংগ্রেস থেকে চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করে নিজের দল ফরোয়ার্ড ব্লক প্রতীষ্ঠা করেছেন।সেই নেতাজি, বাঙালির আবেগ নেতাজি যুদ্ধে সমর্থন করছেন হিটলারকে।নেতাজির আবেগে ভর করে বাঙালি ব্রিটিশ খেদানোর স্বপ্নে মশগুল।গ্রাম ছেড়ে দলে দলে মানুষ পালিয়ে আসার আগে খোয়াব দেখছে কবে নেতাজি জাপানি সৈন্য নিয়ে নিয়ে ভারতের মাটিতে প্রবেশ করবেন।বেশিরভাগ লোক হিটলারের সমর্থক।হিটলার জেতা মানে আর্যরক্তের জয়।প্রায় সবাইই মনেপ্রাণে হিটলারের জয় কামনা করে চলেছে।এমনকি যুদ্ধের যখন অন্তম পরিণতি, রাশিয়ার লালফৌজ দখল করে নিয়েছে বার্লিনের একাংশ, তখনো মানুষ ভেবে চলেছে হিটলার শেষ মুহূর্তে এমন একটা কৌশল খাটাবে যাতে করে সবাই মুখ থুবড়ে পড়বে।হিটলারের এই পরাজয় সাময়িক।কিন্তু না, শেষ অবদি পরাজয় ঘটল হিটলারের।
    হঠাৎ একদিন কলকাতার মানুষ অবাক হয়ে লক্ষ্য করল একটা মিছিল এগিয়ে আসছে কলকাতার বুকে।পায়ের নিচের গলন্ত পিচ উপেক্ষা করে পতাকা ফেস্টুন নিয়ে যে মিছিলটা এগিয়ে আসছে তার পুরোভাগে কল কারাখানার শ্রমিক ও মুটে মজুররা।ভদ্রলোক মধ্যবিত্তের চোখের সামনে দিয়ে মিছিল করে এগিয়ে চলেছে কয়েকটা ছোটলোকের দল।সামনে লাল পতাকা নিয়ে সেই মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছে বঙ্কিম মুখার্জি মুজফফর আহমেদ ভবানী সেনরা।আর ওই শ্রমিক মুটে মজুরদের সাথে রয়েছে ছাত্র, শিল্পী, সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা।আরেকটা চমকপ্রদ ব্যাপার, সেই মিছিলে রয়েছে কংগ্রেস নেতা ক্ষিতিশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আর মুসলিম লিগ নেতা লালমিঞা।লোকে বুঝল এ স্তালিনপন্থীদের মিছিল।কমিউনিস্টদের মিছিল।লালঝান্ডার মিছিল।তার মানে যুদ্ধে হিটলারের পরাজয় ঘটেছে।কয়েকমাস আগেই নেতাজি সম্পর্কে একটা খুব বাজে খবর সবার কানে এসেছে।লোকে ভাবল ব্রিটিশ খেদানোর স্বপ্ন বুঝি স্বপ্নই হয়ে রইল।বছর কয়েক পরেই অবশ্য সাধারণ মধ্যবিত্তের এই ভুল ভেঙেছিল।
    কমিউনিস্টদের প্রতি তখন সাধারণ মানুষের তীব্র ক্ষোভ ছিল।যদিও প্রথম থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একেবারে সামনের সারিতে ছিল কমিউনিস্টরা।তাই জন্মের পর থেকেই একের পর এক ষড়যন্ত্র মামলায় কম্যুনিস্ট দের দলে দলে জেলে ঢোকানো হত।যেহেতু কমিউনিস্টরা ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, তাই তাদের প্রধাণ শত্রুই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।কংগ্রেসের মধ্যে থেকে প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তারাই উত্থান করে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য ছিল এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ।তাই এই যুদ্ধে ভারতীয়দের অংশগ্রহন না করার আহ্বান জানিয়েছিল তারা। কিন্তু যখনই সোভিয়েত রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল তখন জেল থেকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক বি টি রনদিভে চিঠি দিয়ে আহ্বান জানালেন, সোভিয়েতের এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধের চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটেছে।এই যুদ্ধ এখন আর সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ এখন জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছে।সোভিয়েতের হেরে যাওয়ার অর্থ মুক্তিকামী মানুষের হেরে যাওয়া।তাই সর্বশক্তি দিয়ে এই যুদ্ধে সোভিয়েতের পক্ষে থাকতে হবে।এদিকে সোভিয়েতের পক্ষে থাকা মানে ব্রিটিশদের পক্ষে থাকা।ঠিক সেই সময় থেকেই মানুষের ভুল বোঝা শুরু হল কমিউনিস্টদেরকে।এই সময়েই গান্ধীজির আহ্বান কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট।অগাস্ট মাসের ভারত ছাড়ো আন্দোলন।৪২ এর এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করল না কমিউনিস্টরা।কারন তখন সর্বশক্তি নিয়ে সোভিয়েতের পাশে থাকতে হবে।সেই আহ্বান মেনে পার্টির মূল ভিত্তি যারা তারা তো সারা দিলই, সেই সাথে আস্তে আস্তে করে লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিতে থাকল সোভিয়েতের পক্ষে।তৈরি হল সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি, লেখক শিল্পী সঙ্ঘ।তৈরি হয়েছে আইপিটিএ।সেখানে দলে দলে যোগ দিচ্ছেন পৃথ্বিরাজ কাপুর, বলরাজ সাহনি,উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, সলিল চৌধুরি, পন্ডিত রবিশঙ্কর সহ নানা স্তরের শিল্পীরা।এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরাও দেখল কমিউনিস্টদের কারাবন্দি করে রাখার আর কোনো মানে হয় না।জেল থেকে ছাড়া পেতে শুরু করল কমিউনিস্টরা।সাধারণ মানুষ ঠিক এই সময় থেকেই ভুল বুঝতে শুরু করল কমিউনিস্টদের।এক সময়ে যে কমিউনিস্টরা ছিল লোকের ভালোবাসার পাত্র, তারা হয়ে উঠল এক শ্রেনীর মানুষের ঘৃণার পাত্র।কমিউনিস্টের বাচ্চা বলে গালাগাল করা হত। যদিও নেহেরু সহ কংগ্রেসের সহানুভূতি ছিল সোভিয়েতের প্রতি।গান্ধীজি সরাসরি যুদ্ধে কোন পক্ষকে সমর্থন করতে হবে তার কোনো নির্দেশ না দিলেও কংগ্রেসের একটা পরোক্ষ সমর্থন ছিল সোভিয়েতের প্রতি।এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।এক সময়ে কমিউনিস্ট সহ কংগ্রেসের যে বামপন্থী উইং এর সমর্থন ছিল সুভাষ বোসের প্রতি, যাকে সীতারামাইয়ার বিরুদ্ধে সমর্থনও জানিয়েছিল কমিউনিস্টরা, সেই তারাই এখন নেতাজির বিরুদ্ধে।আবার কংগ্রেসের যে উইং তখন গান্ধীজির সাথে ছিল, তারাও তখন নেতাজির মতই চাইছে ব্রিটিশদের এই মুহূর্তে বিতারন।ইতিহাসে কিছু কিছু মুহূর্ত এমন আসে, যখন এক পক্ষ ভুল মানেই যে অপর ঠিক, তা নয়।৪২ এর আন্দোলন ছিল ঠিক সেরকমই এক আন্দোলন।ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে পক্ষ বেছে নেওয়াই হয়ে ওঠে দুষ্কর।তাও বেছে নিতেই হয়।সেই সময়ে কমিউনিস্টরা নিয়েছিল আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষ, আর নেতাজি সহ তাকে যারা অপমান করেছিল তারা বেছে নিয়েছিল জাতীয়তাবাদের পক্ষ।
    তো যাই হোক, যে মিছিলের কথা বলে থেমে গেলাম, সেই মিছিল দেখে কলকাতার মানুষ অবাক হয়ে নিজেদের মধ্যে প্রশ্ন করছে, এত লোক জোটালো কোথা থেকে কমিউনিস্টরা!
    যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আরেক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি।ব্রিটিশ সরকার ঠিক করল নেতাজির বাহিনী আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার হবে।যারা যারা ধরা পরেছিল তাদের বিচার শুরু হল লালকেল্লায়।বিচারে ফাঁসি সাব্যাস্ত হল আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশিদ আলির।
    ব্যাস।আগুন ছিলই।এবার তা দাবানলের আকার নিল।সোভিয়েতকে সমর্থন মানেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন যে নয় সেটাও বুঝিয়ে দিল এবার মানুষ।যেদিন রশিদ আলির সাজা ঘোষণা করা হল সেটা ৪৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি, আর ১১ ই ফেব্রুয়ারি ছাত্র ফেডারেশনের ডাকে এক প্রতিবাদ সভার আহ্বান জানানো হয়।মূল দাবি ছিল রশিদ আলি সহ আজাদ হিন্দ ফৌজের বাকি বন্দীদের মুক্তি।নেতাজি হিটলারের সমর্থক হতে পারেন, কিন্তু তিনি সাচ্চা দেশপ্রেমিক।এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।তার তৈরি আজাদ হিন্দ ফৌজও দেশপ্রেমিকদের ফৌজ।তাই তাদের সবাইকে মুক্তি দিতে হবে এই দাবীতে একমত হল কমিউনিস্ট কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ।
    ওয়েলিংটন স্কয়ারে একটি জমায়েত ছাত্রদের।ওয়েলিংটন স্কয়ার থেকে ছাত্ররা মিছিল করে এগিয়ে চলল ধর্মতলার দিকে।ধর্মতলায় এসে পুলিশ মিলিটারির কর্ডনে ধাক্কা খেল সে মিছিল।আর এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই।ততক্ষণে খবর চলে এসেছে ডালহৌসি অঞ্চলের মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ।এই খবর ছড়িয়ে গেল দাবানলের মত। ধর্মতলায় পুলিশি কর্ডন ভেঙে এগিয়ে চলল ছাত্রদের মিছিল।শুরু হল অমানুষিক লাঠিচার্জ।লাঠিচার্জের ঘটনা কলকাতার বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে প্রতিরোধ করতে।বিভিন্ন অঞ্চলে দোকান পাট বন্ধ হয়ে যায় এবং জায়গায় জায়গায় মিলিটারির গাড়ি পোড়ানো হয়।পরদিন খবরের কাগজে খবর বেরোল ৩২ জন ছাত্র গ্রেপ্তার ও আহত শতাধিক।প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল চারিদিকে।এবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শেষ লড়াই।১১ তারিখের পর ১৩ তারিখেই কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মঘটের ডাক দিল।কিন্তু কংগ্রেস আর মুসলিম লিগ ধর্মঘটে রাজি নয়।তাই ডাক দিয়েও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের স্বার্থে ধর্মঘট থেকে পিছিয়ে আসতে হল।তবে সাধারণ জনতার মারমুখী মেজাজকে সামলানো যায় নি আর।দিকে দিকে শুরু হয়ে গেল অভ্যুত্থান।জগুবাবুর বাজার হাজরা সেন্ট্রাল এভিনিউ মানিকতলা রাজাবাজার প্রভৃতি অঞ্চলে মিলিটারির ট্রাক পোড়ানো শুরু হয়ে গেল।জায়গায় জায়গায় ড্রাম আর কাটাতার ফেলে পুলিশ আর মিলিটারির চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হতে থাকল।ট্রাম শ্রমিকদের মধ্যে তখন ছিল কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপক প্রভাব।ট্রাম শ্রমিকরা কিন্তু পার্টির ধর্মঘটের ডাক থেকে পিছিয়ে আসা সত্ত্বেও সার্বিক ধর্মঘটে সামিল হয়।১৩ আর ১৪ এই দুদিন উত্তর চব্বিশ পরগণার বিভিন্ন জুটমিলে পালিত হয় ধর্মঘট। কলকাতার রাস্তা তখন যেন উনবিংশ শতাব্দির বিপ্লবী প্যারিস।রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে লড়াই চলছে পুলিশ মিলিটারির সাথে সাধারণ জনতার।মহম্মদ আলি পার্কের ফায়ার ব্রিগেডের স্টেশনে তৈরি হয়েছে মিলিটারির অস্থায়ী ক্যাম্প।একই ক্যাম্প তৈরি হয়েছে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোরে।তার মধ্যেও রাস্তায় ঠেলাগাড়ি প্যাকিং বাক্স ডাস্টবিন দিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যারিকেড।আর সেই ব্যারিকেডের আড়াল থেকে হিন্দু মুসলমান ফলওয়ালা রিক্সাওয়ালা কিশোর ও যুবকরা লড়ে যাচ্ছে।তাদের সবার চোখে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতার স্বপ্ন।আজ লিগ কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা একই ছাতার তলায় এসেছে।দেশের স্বাধীনতা আর আটকায় কে।সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'আমার বাংলা' তে লিখেছেন চৌদ্দ বছরের কিশোর আজমিরি মল্লুমিয়া দুধওয়ালার একমাত্র সন্তান।রিপন স্ট্রিটের গুলির লড়াইতে তার দেহটা চার পাচটা গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেল।তের বছরের ছেলে ইশাক।বাপ মা নেই, এক দিদি আছে।তার ডান হাতে গুলির চোট।রাস্তায় মিলিটারির গাড়ির সামনে কেউ নেই।এমনকি রেডক্রশের গাড়িও নেই।শুধু ছিল লিন্টন স্ট্রীট ও মফিজুল ইসলাম লেনের বস্তির ছেলেরা।ঠেলা গাড়িতে করে ওরাই তুলে আনল আহতদের।খলিলও সেদিন চোট খেয়েছিল।ফাটা মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠল, ফির এক মর্তোয়া লড়েঙ্গে।আজমিরি মারা গেল।মহল্লার তিন হাজার বস্তিবাসী লাল সবুজ ও তেরঙ্গা ঝান্ডার মিছিলে মুদিওয়ালি বাগানে শহীদকে কবর দিয়ে এলো'।
    কলকাতার আন্দোলনের পাশে সেই সময়ে এসে দাঁড়িয়েছিল গোটা বাংলাদেশ।চট্টোগ্রাম ঢাকা খুলনা কাটোয়া ডায়মন্ড হারবার জলপাইগুড়ি সিরাজগঞ্জ নাটোর সবাই তখন কলকাতার আন্দোলনের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নিয়েছে।গোটা বাংলা তখন ফুটছে আবেগের আতিশয্যে।সব জায়গাতে ছাত্র যুবরা প্রতিবাদ আন্দোলনে সামিল হচ্ছে, কোথাও কোথাও বা ধর্মঘটও হচ্ছে।গোটা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে এরকম চলল।এরপর আস্তে আস্তে কলকাতার আগুন নিভে এলো।একদিকে যখন দেশের পূর্ব প্রান্তে এরকম অবস্থা , তখন পশ্চিম প্রান্ত আরেক বড় লড়াইতে সামিল।এই লড়াই কাঁপন ধরিয়ে দেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বুকে।
    ভারতীয় নৌ সেনা বাহিনীর এক জাহাজ, 'তলোয়ার' এর কিছু প্রশিক্ষণ রত শিক্ষার্থী তাদের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাল তাদের খাদ্যের মান নিয়ে।তাদের দিনের পর দিন নিম্নমানের খাদ্য পরিবেশন করে যাওয়া হচ্ছে এই নিয়ে অভিযোগ।তারা ভেবেছিল হয়ত এই অভিযোগের সুরাহা হবে, কিন্তু তার বদলে জুটল চরম অপমান।শাস্তির খাঁড়া নেমে এলো সবার ওপর।আরো বেশি বেশি করে ডিউটি আওয়ার্স বাড়িয়ে দেওয়া হল।ব্রিটিশ অফিসিয়ালরা ভেবেছিল হয়ত এই ভাবে তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া যাবে।কিন্তু না, মুখ বন্ধ হল না, উলটে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ল পুরো জাহাজ জুড়ে।এরই মধ্যে ঘৃতাহূতি দিল কলকাতার খবর।রশিদ আলির মুক্তিকে কেন্দ্র করে কিভাবে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতা সহ সারা বাংলায়, এই খবর উদ্দীপিত করল নৌ সেনাদের।সাথে সাথেই 'তলোয়ার' জাহাজ সহ অন্যান্য জাহাজও সামিল হল বিদ্রোহে।উড়িয়ে দেওয়া হল কংগ্রেস মুসলিম লিগ আর কমিউনিস্ট পার্টির ঝান্ডা।নৌ সেনারা আবেদন জানাল তিনটি দলের প্রতিই তাদের এই বিদ্রোহে পাশে থাকার।কমিউনিস্ট পার্টি সাথে সাথে এগিয়ে এলো নৌ সেনাদের সমর্থনে।বোম্বাইয়ের জনগণকে আবেদন জানানো হল পরিপূর্ণ শক্তিতে নৌ সেনাদের পাশে থাকার।জনগণও সেই আবেদন শিরোধার্য করে নেমে পরল বোম্বাইয়ের রাস্তায়।যখন জাহাজের মধ্যে ব্রিটিশ বাহিনী গুলি করে মারছে নৌ বাহিনীর সেনাদের, তখন বোম্বের রাস্তায় কলকাতার মতই একই কায়দায় বোম্বের মানুষ ব্যারিকেড তৈরি করে লড়ে যাচ্ছে পুলিশ ও মিলিটারির সাথে।এই অবস্থায় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ দোনোমনা করতে থাকল এই বিদ্রোহে সামিল হবে কিনা তা নিয়ে। কারন তাদের নেতৃত্বের কাছে তখন ক্ষমতার গাজর ঝোলানো শুরু হয়ে গেছে।ব্রিটিশরা নাকি কথা দিয়েছে ভারত ছেড়ে চলে যাবে।তাই এই শান্তিপূর্ণ সময়ে শুধু শুধু কেন রাজশক্তিকে বিব্রত করা!
    বোম্বের শ্রমিক এলাকায় যেখানে দলে দলে লোক এসে জমা হচ্ছে রাস্তায় লড়াই করার জন্য, নৌ বাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য, এমনকি জাহাজে খাদ্য ফুরিয়ে আসছে এই খবরে লোকজন প্যাকেটে করে খাবার জল এসব নিয়ে বন্দরে ভিড় করে ফেলছে জাহাজের লড়াকু কমরেডদের দেওয়ার জন্য, সেই সময়ে কংগ্রেস আর লিগের নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে যাচ্ছে এই হটকারী আন্দোলনের ফলে কি কি হতে পারে সেই নিয়ে।এমনকি স্থল বাহিনীর মিলিটারিরা পর্যন্ত নৌ সেনাদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করল ওপরের আদেশ সত্ত্বেও, অথচ দেশের নেতৃবৃন্দ বুঝতেই পারল না দেশের লোক কী চাইছে।অবশেষে যে নৌ বিদ্রোহ লিগ কংগ্রেস আর কমিউনিস্ট পার্টির ঝান্ডা একসাথে উড়িয়ে শুরু হয়েছিল, সেই বিদ্রোহ কংগ্রেসের নেতাদের চাপে শেষ হল নৌ সেনাদের আত্মসমর্পনের মাধ্যমে।যদি তৎকালীন নেতৃবৃন্দ আরেকটু সাহস দেখাতে পারতেন তাহলে কে জানে দেশভাগ ছাড়াই ভারতবর্ষ হয়ত স্বাধীন হতে পারত।১৯৪৬ শুধুমাত্র দাঙ্গার ইতিহাস নয়, ১৯৪৬ এক পরাধীন ভারতে এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৯ অক্টোবর ২০১৭ | ১৬৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কল্লোল | 233.227.48.155 (*) | ১৯ অক্টোবর ২০১৭ ০৪:২৩61710
  • ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন এরকমই। বহু ভালো কাজ করেও তাকে ধরে রাখতে অক্ষম। বারবার আন্তর্জতিক নেতৃত্বের(রাশিয়া থেকে চিন) কথা মানতে গিয়ে ভুল পথে চলেছে ও তার খেসারত দোতে হয়েছে। তাই আজও সারা ভারতে নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক।
    গৌরবগাথা তো অনেক হলো, এবার একটু ভুলগুলো নিয়ে কথা হোক।
  • amar | 226.163.254.4 (*) | ২০ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:৪৭61711
  • তারপরেও ১৯৬২ তে চীন যুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট রা সমর্থন করে চীন কে এবং মিছিল বের করে। দেখুন কান্ড কিছুদিন আগেও দোকা লাম এ চীন রাস্তা করছিলো তখনও কমিউনিস্ট রা একদিন এর জন্যেও কিছু বলেন নি। লোকে কি আর এমনি এমনি বলে! নিজেদের ভুল না শুধরোলে মুশকিল। তবে পার্টি এর ইডিওলজি কিন্তু সত্যি ভালো। বিমান বসু এনাদের মতন কিছু ভালো লোক এখনো আছে। কিন্তু নিজেদের রাশিয়া আর চীন এর কাছ থেকে আলাদা কিছু করতে পারলো না।।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন