এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • অনলাইন

    Avik Mukherjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৭ জুন ২০১৪ | ২৩৫৭ বার পঠিত
  • অনলাইন
    অভীক মুখোপাধ্যায়
    ‘ধুস! এর চেয়ে ফ্লাইট – এ আসাই ভাল ছিল।’ একরাশ বিরক্তি ফুটে ওঠা মুখের প্রতিচছবি হাতে ধরা ট্যাবের স্ক্রীন – এ ফুটে উঠল অভিষেক – এর। দোষটা তারই। কি মরতে যে এই শিয়ালদা দুরন্ত এক্সপ্রেসের থ্রী-টীয়ার – এ আসার শখ জাগল তার? মনে হয় না টু-টীয়ার – এ বার্থ খালি হয়ে তার সিট টা আপগ্রেডেড হবে। সামনের বার্থের বিচ্ছু ছেলেটা এতো জ্বালাচ্ছে যে ল্যাপটপ- টাও অন করা গেল না। গাজিয়াবাদ পেরোনোর পর যখন ও ল্যাপটপ অন করতে গেল ছেলেটা এমন এসে হামলে পড়ল, যে ভেঙে যাবার ভয়ে ওটা রুকস্যাকে ভরে দিতে বাধ্য হল অভিষেক। তার আগেও একবার এমন লাফিয়ে এসেছিল যে হাতের বোতল থেকে জল পরে যেত ল্যাপটপের ওপর।
    ‘সত্যি বিরক্ত করছে বড্ড। বাবা-মা কিছু বলেও না।’ আসলে এই সব ট্রেন-এর আদব কায়দা রপ্ত করার মত পরিবার নয় ও। কথাবার্তা থেকে আঁচ করা যায় নিম্নস্তরের কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। সরকারী সুযোগে এই ট্রেন-এ চাপার ব্যাবস্থা হয়েছে। “যাক, কি আর করা যাবে! আর কয়েক ঘণ্টা সহ্য করতেই হবে।” ট্যাব –এ ফেসবুক পেজ ওপেন করতেই দেখল তিনটে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, দশটা মেসেজ আর অজস্র নোটিফিকেশন জমে আছে। যে তিনটে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছে তিনটেই মেয়ে। মনটা মুহূর্তে পালটে গেল। অবশ্য এটা নিত্যদিনের ঘটনা, বন্ধুমহলে তাকে নিয়ে এব্যাপারে রীতিমত ঈর্ষা করে। ফেসবুক-এ আটশো’র ও বেশি বন্ধু, যার মধ্যে সাড়ে সাতশো মেয়ে তো হবেই। ওর স্ট্যাটাস যদিও সিঙ্গল তবু বলে রাখা ভাল যে আত্রেয়ীর সাথে তাঁর পাঁচ বছরের প্রেম চূড়ান্ত পরিণতি পাবে আর মাস ছয়েক বাদেই। আসলে আত্রেয়ী ফেসবুক-এ নেই। তাই অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে অভিষেক। দিনরাত অন থাকে তাঁর ঝা-চকচকে ট্যাব অথবা ল্যাপটপে আর চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে যায় পামেলা, নবনিতা, মধুবনি বা মিতুলের মত অজস্র বান্ধবীর সাথে। একসাথে ছয়জন বান্ধবীর সাথে চ্যাট করার রেকর্ড আছে অভিষেকের। আসলে নয়নলোভন চেহারা, নিউ কুল লুকস আর “অভিষেক রকস” এই ক্যাপশন ফেসবুক – এ অনেকের নজর কাড়ে। ইতিমধ্যে টিকিট পরীক্ষক এসে টিকিট দেখতে চাইলে সে দেখিয়ে দেয় তার স্মার্টফোনের স্ক্রীন – এ থাকা এস.এম.এস.। টিকিট পরীক্ষক তার কাগজে নোট নেন। বাকি সবার হাতের কাগুজে টিকিট দেখে মুখে একটা প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে ওঠে ওর। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় এই দিনগুলো যদি চব্বিশ ঘণ্টার বেশি হত ভাল হত খুব। না, কাজের জন্যে মোটেই নয়, এই চ্যাট, শেয়ার, লাইক দিতে দিন ছোট পরে যায় তার। অবশ্য কাজ সে মন্দ করতনা, একটা বড় সফটওয়্যার কোম্পানি থেকে সদ্য পদত্যাগ করে নতুন কাজের সূত্রেই ইনটারভিউ দিতে এসেছিল কোলকাতা থেকে গুরগাও। পরশু ফ্লাইট –এ আই.জি.আই-তে নেমে সোজা ক্যাব নিয়ে গুরগাও-এর হোটেল। কাল ইনটারভিউটা ফাটাফাটি হল। মানে ওর ভাষায় “অভিষেক রকস”। হবে নাই বা কেন!!!! যাদবপুরের সফটওয়্যার এঞ্জিনিয়ারিং – এর ছাত্র মানে কি যা তা নাকি? বাকি আবেদনকারীদের সাথে কথা বলে ও যা বুঝেছে কি অভিজ্ঞতা, কি তার যোগ্যতা সব দিকে সে যোজনক্রোশ এগিয়ে। আর বাকি রইল প্রশ্নোত্তর পর্ব। সেখানে অভিষেক অর্ধেক কাজ হাসিল করেছে নিজের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়েই। বাকিটা ছিল তার কাছে আসান। আরেকটা কাজ অভিষেক ভোলেনি, অন্য আবেদনকারীদের সে ফেসবুকে অ্যাড করে নিয়েছে আর ফোন নম্বর আদান-প্রদান করেছে, যাতে এই কাজটা পেলেই তাদের সুখবরটা দিতে পারে। তবে তার এই কদিনের হুড়োহুড়ি করে যাওয়া আসায় রাতে একদম ঘুম হয়নি। এখন এই বিটলের জ্বালায় মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।
    স্টার্টার এসে গেল টমেটো সূপ আর ব্রেডস্টিক। আর এক ঘণ্টার মধ্যে এল ডিনার। যাক তবু খেয়ে নিয়ে পুঁচকেটা শুয়ে পরল এই বাঁচোয়া। পাশের সুইচটা অফ করে দিয়ে লোয়ার বার্থে চাদর, বালিশ পেতে কম্বলটা বুক অব্দি টেনে অভিষেক রোজ রাতের অভ্যেস মত ফেসবুক অন করে দিল তার ট্যাব এ, রিয়া অনলাইন আছে। নতুন প্রোফাইল পিক’টা দারুন লাগছে, সেলফি। একটু কাত করে তোলা। অভিষেক তখনি ভাবে আত্রেয়ীটা একেবারে গেঁয়ো। এই সেলফি তোলা নিয়ে সেদিন ও একটু জোর করতে গেল বলে শুনতে হল কিনা এসব আদিখ্যেতা নাকি ওর ভাল লাগে না। আর সবসময় এক অভিযোগ এই ফেসবুকে অন থাকা নিয়ে। এটা নাকি অভিষেকের একটা অদ্ভুত বাজে নেশা।
    নেশা তো ভাল, হাজার বার করবে, যখন তার পোস্টে পটাপট লাইক পরে, হুরোতারা করে শেয়ার হয়, কমেন্টে ভরে যায় তখন তার বুকটা ফুলে যায়। কোন সুদূর গুজরাটে বসে থাকা কোনও এক কোকিলা মোদি তার ছবি দেখে ঋত্বিক রোশনের সাথে তুলনা করে তখন মনে হয় তার সত্যি মনে হয় দুনিয়া অনেক ছোট হয়ে গেছে। এই নেশা তার ধরেছে যাদবপুরে পড়ার সময়েই। তবে তখন পড়ার চাপে খুব বেশি মন দেয়নি এদিকে।
    স্মার্টফোনের রিনিরিন টোনে দেখল লেখা উঠছে ‘ওয়ান এস.এম.এস ফ্রম আতা’ ; মানে আত্রেয়ীর মেসেজ। এখন ট্রেন কোথায় জানতে চাইছে আর গোটা রাত যাতে ফেসবুক - এ অন থেকে না কাটায় অভিষেক সেটাও উপদেশ দিতে ভোলেনি। একটা দায়সারা জবাব দিয়ে খানিক বাদে ফোনটা অফ করে দিল অভিষেক। আত্রেয়ীর এই জবাবদিহি ছাড়াও আর একটা কারণ এই ফোন কোম্পানি এবার যত বার রাজ্য পরিবর্তন হবে ট্রেনের পথে ততবার এস.এম.এস. পাঠাবে, জানাবে যে সে রোমিং-এ আছে।আর মাকে সে জানিয়েই দিয়েছে ট্রেন -এ উঠেই। ফেসবুক থেকে বেরিয়ে নিজের মেইল ইনবক্স চেক করলো অভিষেক। আবার ফিরল ফেসবুক – এ, একজন মেয়ে জানতে চেয়েছে সত্যি সে সিঙ্গল নাকি। এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই সর্বপ্রথম আত্রেয়ীর মুখটা মনে ভেসে ওঠে। কিন্তু তার মুখ তো কেউ দেখতে পাচ্ছেনা তাই মনের চিন্তাটা সরিয়ে ও জবাব দেয় “ইয়েস আই আম সিঙ্গল অ্যান্ড রেডি টু মিঙ্গল”। নামেই এটা ফেসবুক কিন্তু যতখন না মুখ দেখতে পাবে ও যা দেখাবে সেটাই ওর মুখ। হঠাৎ ওর মনে হয় এটা মুখ নয় তার মুখোশ। এটা যেন তার সামাজিক মুখের ওপর পরানো। অথবা এটাই তার আসল রূপ! হবে একটা কিছু, এটা নিয়ে ভাবার মত ইচ্ছা ওর নেই।
    শতরূপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে জানল এইমাত্র, কদিন পরে সেও তার সিঙ্গল স্ট্যাটাস এইভাবেই ভাঙবে। আত্রেয়ীটা বড্ড গতানুগতিক। নিজের পড়াশুনো আর গল্পের বইয়ের বাইরে কিছু বোঝেনা। গত জন্মদিনে অভিষেক ওকে বলেছিল যে একটা স্মার্টফোন দেবে যার দাম পঁচিশ হাজার, শুনে আত্রেয়ী বলেই দিল নেবেনা, দেবার হলে দিক সুনীল গাঙ্গুলি’র উপন্যাস সমগ্রর ফুল সেট, তার দাম তো পড়বে মাত্র পঁচিশ’শ টাকা। অভিষেক খানিক হতাশ হলেও কিনে দিয়ে মন রেখেছিল। দুনিয়া কোথা থেকে কোথায় চলে গেল আর ও এখনও পরে আছে দুই মলাটের ভারী বই নিয়ে। এখন কেউ ই-বুক, অডিও বুক ছাড়া পড়ে নাকি। যাকগে মানিয়ে নিতেও তো হয় নাকি। ইউটিউবে ঢুকল অভিষেক। এই একটা দারুন জায়গা মনোরঞ্জনের জন্যে। রিয়ালিটি শো- এর নিয়মিত দর্শক ও। কিন্তু এই কয়দিনের তাড়াহুড়োর ফলে কয়েকটা এপিসোড মিস করে গেছে ও। আজ সময় পেয়েছে তাই মিসড এপিসোডের ভিডিও গুলো ডাউনলোড করে নিতে চায়। ডাউনলোড চাপাতে চাপাতে ভাবে কি অদ্ভুত বিনোদনের উপাদান। একা যে ও ফিরছে ওর সাথে যেন সবাই আছে।বাড়িতে বসে টি.ভি. দেখার মতই। ‘না! এ.সি.টা বড্ড বেশি ঠাণ্ডা লাগছে। একটা কনকনে ভাব। সামনের পরদা টা টানাও নেই।’ বুক থেকে কম্বল নামিয়ে উঠে পড়ল ও। গেল প্যান্টরিবয়দের কাছে। ওদের বলতেই এ.সি. কমিয়ে দিল। একটা অতিরিক্ত মিনেরাল ওয়াটারের বোতল কিনল, মুখে চোখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। এমনিতে অবশ্য খুব বেশি খায়না ও। এসে দেখল দুটো ভিডিও ততক্ষণে ডাউনলোড হয়ে গেছে। রোজ রাতে অনেকক্ষণ জেগে এইসব –এ করে ও। মা তাই রোজ বলে, ‘বুকুন অনেক রাত অব্দি লাইট জ্বলে তোর ঘরে। কি করিস?’ মুচকি হেসে ও কথা ঘুরিয়ে দেয়। ওর অন্য অনেক বন্ধুকে কাজের চাপে ঘুমের ওষুধ নিতে হয়। আর ও এই যে বিন্দাস থাকে তার কারণ এই ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এইসব – ই তো। ভাবতে ভাবতে কখন যে দু চোখ এক হয়ে যায় ওর বুঝতেই পারেনা।
    সারারাত যে ঘুম ভাল হয়েছে তা নয়, তবে খুব একটা অসুবিধাও হয়নি। সকালে ছটায় উঠে পড়ল। টয়লেট থেকে ফিরে দেখল একটা নিউজপেপার দিয়ে গেছে। ওপরের দুটো বারথের লোকজন নামেনি তাই একটু অসুবিধা করেই বসলো। “স্যার চা না কফি?” মুখ তুলে দেখল আগের রাতের সেই প্যান্টরিবয় জাকে এ.সি. টা কমিয়ে দিতে বলেছিল। হাসি মুখে অভিষেক জবাব দিল, “চা – ই দিয়ে দাও।” টি – ব্যাগ গরম জলে ডোবাতে ডোবাতে দেখল তখনও বাংলার সীমায় ঢোকেনি ‘দুরন্ত’। খবরের কাগজে চোখ রাখল অভিষেক। প্রথম পাতায়, দেশের বেহাল অর্থনীতি নিয়ে দাওয়াই দিয়েছেন দেশের অর্থমন্ত্রী, এক প্রথম সারির জাতীয় রাজনৈতিক নেতার সাথে পড়শি মুলুকের এক মহিলা সাংবাদিকের টুইট নিয়ে টানাপোড়েন চলছে, রাজ্যসভার সাংসদ হতে চলেছেন এক বিখ্যাত বাঙালি অভিনেতা, টানা পঁচিশ দিন অসুস্থ থাকার পরে নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরবেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। খেলার খবরে মজাদার কিছু নেই।

    ‘স্যার কোথায় রাখব ট্রে – টা? ব্রেকফাস্ট এনেছি। আধঘণ্টা পরেই আবার চা আসবে।’, হেসে চলে গেল প্যান্টরিবয়। এখনও উপরের ভদ্রলোক দুজনেই নামেননি। হাতেই নিয়ে নিল অভিষেক ট্রে – টা। সামনের বার্থের বিটলেটা জেগেছে তবে আজ একদম চুপ। ভাল ছেলের মত খেয়ে নিচ্ছে।
    খাবার খেয়ে নিয়েই ট্যাব টা হাতে নিল অভিষেক। কাল রাতে ও ইন্টারনেট কানেকশন টা অফ ই করেনি। যাক তাতে ক্ষতি নেই।তবে সারারাত ফেসবুক এ অন থেকে গেছে। ইউটিউব -ও অফ করেনি। পোস্ট দেখতে গিয়ে একটু চমকেই উঠল, “চির অন্তরালে মহানায়িকা”। ‘যাঃ হঠাৎ কি হল যে একরাতে এতো বড় ব্যাপার? না। এতে অবাক হবার কি আছে! জন্ম যে নিয়েছে মৃত্যু তো তার অর্জিত অধিকার। প্রাণ যেতে মুহূর্তের প্রয়োজন মাত্র।’ আঙুলের টানে ফেসবুক পেজ স্ক্রল করতে করতে আবার একটা ধাক্কা। যে প্রথম সারির জাতীয় রাজনৈতিক নেতার সাথে পড়শি মুলুকের এক মহিলা সাংবাদিকের টুইট নিয়ে বিতর্ক চলছিল সেই নেতার স্ত্রীর মৃতদেহ গতরাত্রে দিল্লির এক নামজাদা হোটেল থেকে উদ্ধার করে পুলিস। ‘সত্যি খবরের কাগজ ও এখন পিছিয়ে পরছে। ক্ষণিকের পরিবর্তনে তাল মেলাতে পারছেনা। এখন অনলাইনই সব জানা জায়। জীবনটাই এখন অনলাইনের সমার্থক। অফলাইন মানেই জীবন শেষ।’ আর কিছু শেয়ার, লাইক, চ্যাটের রিপ্লাই করতে করতে মশগুল হয়ে থাকল অভিষেক। কিছুখন বাদেই চা নিয়ে আবার এল সেই প্যান্টরিবয়। এবারে সে বখশিশ চাইল। দিয়ে দিল অভিষেক। যাক রাত জেগে কাটাতে হয় এদের আর লোকের ফরমাস ও শুনতে হয়। কিন্তু বিরক্ত হল আবার ঝাড়ুদার এসে বখশিশ চাইতে। তাকেও দিতেই হল। কিন্তু সামনের বার্থের সেই কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী ভদ্রলোক, উনি কিন্তু কাউকেই কিছুই দিলেন না।উনার হাবে ভাবে মনে হল উনি সরকারী টাকায় ট্রেন চাপছেন বলে একটাও বাড়তি টাকা পকেট থেকে খসাতে রাজি নন। উনার ছেলেটা একদম শান্ত হয়ে গেছে আজ। ওপরের বার্থের দুজন ভদ্রলোক উঠে পরেছেন। বাইরে তাকাতে চোখে পড়ল ট্রেন আসানসোল পার হল। ব্যান্ডেল ঢোকা অব্দি ট্রেন ঠিক তালেই চলছিল। কিন্তু তারপরই যেমন অচেনা পথে প্রথমবার যেতে হলে মানুষজন সমঝে বুঝে ধীরলয়ে হাঁটে, তেমনি ট্রেন তার ‘দুরন্ত’ গতি হারিয়ে মন্থর হয়ে পড়ল। দমদম পার হবার পর তো মনে হচ্ছিল ড্রাইভার, গার্ড ঘুমিয়ে পরেছে। ‘পাশ দিয়ে আপ- ডাউন কত যে ট্রেন গেল!’, বলে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অভিষেক।

    ট্রেন শিয়ালদাহ ঢুকতে অনেক দেরি করলো। তার পরে নেমে চিকেন বিরিয়ানি খেয়ে একটু ধাতে ফিরল অভিষেক। একটা মিনারেল ওয়াটার এর বোতল কিনে নিয়ে ট্যাক্সি ধরল। হাওড়া ব্রিজের আগে জ্যাম। ব্যাস হয়ে গেল দেরি। যাই হোক হাওড়া এসে ব্যান্ডেল লোকাল ধরে সোজা শ্রীরামপুর। নেমে রিক্সায় বেল্টীং বাজার। অবশ্য আসার আরও একটা পথ ছিল। যদি ব্যারাকপুর হয়ে আসতো ঘাট পার হয়ে যেত। কিন্তু বাজে লাগে ওদিকের ট্রেন এ ভীড় এ বসতে না পেলে। আর বসতে পেলেও খানিক বাদেই বলবে অন্য লোকে, ‘দাদা আমরাও যাচ্ছি। সিট টা শেয়ার করুন একটু।’
    বাড়ি ঢুকে আত্রেয়ীকে একটা এস.এম.এস. করে দেয় অভিষেক। নিজের ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে যায়। তারপর টানা ঘুম দিয়ে যখন উঠল তখন সন্ধে পেরিয়ে গেছে। ওর মায়ের ঘড় থেকে গান আসছে কানে “যতবার তুমি জননী হয়েছ, ততবার আমি পিতা...............।।” মায়ের খুব প্রিয় গান। সুমন বাবুর এসব রচনা সত্যি রোজ রোজ কেউ লিখতে পারবেনা।যেন কোনও পবিত্র মুহূর্তে রচনা করা হয়েছিল আর শুনেও মনে হয় সেই মুহূর্তের ভাগীদার। প্রথমেই হাত চলে গেল ট্যাব –এ। ফেসবুক টা অন করে দিয়ে অ মেইল চেক করতে শুরু করলো। মেইল বক্স খুলেই মুখটা উৎফুল্ল হয়ে গেল ওর। সফটওয়্যার প্রোগ্রেস থেকে ই-মেইল করেছে। সত্যি ও ভাবেনি এত তাড়াতাড়ি ফিডব্যাক পাবে। কোম্পানি গুলো কি করে যে এতো জলদি সিলেক্ট করে নেয়। ক্রেডিট দিতেই হয় এদের।
    ‘কিন্তু এটা কি? ও মাই গুডনেস!’ ও ঠিক পড়ছে তো? ওকে তো বলা হয়েছে যে কোম্পানির তরফ থেকে খুব দুঃখের সাথে জানানো হচ্ছে যে সব দিক দিয়ে যোগ্য হওয়া সত্তেও ওকে নিতে পারছে না তারা। ‘কারণ?’ সেখানে বলা হয়েছে যে ওর জমা দেওয়া সি.ভি. থেকে নাম, ছবি এসব নিয়ে ওরা ওর কেতাদুরস্ত সোশ্যাল স্ট্যাটাস চেক করেছে। ওর ফেসবুক পেজ খুলে দেখে সেখানে অগুনতি মেয়ে বন্ধুর মাঝে কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করতে ওর দিন কাটে। দিনের বেশির ভাগ সময়েই নাকি সে আপডেট করতে থাকে। কি করছে, কি পড়ছে এইসব। এতে কোম্পানি মনে করছে তাদের পক্ষে এটা ক্ষতিকারক হতে পারে। সারাদিন সে হয়ত এভাবেই তার কাজের জায়গায় অনলাইন থেকেই কাটাবে। আর একটা অভিযোগ জানানো হয়েছে তার নামে। সে নাকি তথ্য গোপন করেছে। ওরা খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে ওর আগের কাজ থেকে পদত্যাগ করার কারণ ছিল তার ঊর্ধ্বতনের সাথে এই সারা দিন ফেসবুক এ অন থাকা নিয়ে ঝগড়া। অভিষেক ছাড়ার কারণ হিসাবে বলেছিল মাইনে কম বলে তার নাকি কাজ করতে অসুবিধা ছিল। তাই সে ছেড়ে দেয়।
    রীতিমত কান্না পাচ্ছে ওর। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। গলার কাছে একটা ব্যাথা অনুভব করছে। ট্যাবটা হাত থেকে ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে দিল অভিষেক। কি বলবে ও? ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে আত্রেয়ীর মুখটা। ‘কি জবাব দেবে ওকে? কি বলবে মাকে?’ মিথ্যে বলতেও তো গলা কাঁপবে। এটা তো অনলাইন হবেনা। চোখে চোখ রাখতে পারবে মিথ্যে বলার সময়? খানিক ক্ষণ এভাবেই এলোমেলো ভাবে কাটে। শরীরটা টান টান করে শোয়। কিন্তু কান্নার দমকে আবার কুঁকড়ে যায়। এত অসহায় নিজেকে কখনও ফিল করেনি সে। হঠাৎ উঠে বসে। তখন সব রাগ টা গিয়ে পরেছে ট্যাবটার ওপর। ‘অনেক খেলা হল, আজ থেকে আর নয় এসব।’ আজই ডিলিট করবে প্রোফাইল -টা। ‘এই এক ই ব্যাপার নিয়ে দু- দুবার। ওহ! রাগে মাথা গরম হয়ে গেছে।’ একটা মুখোশ বলেই মনে হচ্ছে এটাকে এখন। যেন তার মুখে চেপে বসে দম নিতে দিচ্ছেনা। এই শীতেও ঘাম হচ্ছে তার।
    খানিক এভাবে কাটার পর ও ট্যাবটা হাতে নিল আবার। ফেসবুকের সেটিং খুলে প্রোফাইল ডিলিট করতে যাবে কি একটা টুংটাং শব্দে মেসেজ ঢুকল ওখানেই। চ্যাট বক্সে নাম দেখাচ্ছে সৌরভ কুমার। এর সাথে গাজিয়াবাদের সফটওয়্যার কোম্পানির ইনটারভিউতে পরিচয় হয় অভিষেকের। জানিয়েছে ওকে নাকি ই-মেইল করে জানিয়েছে কোম্পানি থেকে। ও সিলেক্টেড। সব দিকে এই সৌরভের চেয়ে এগিয়ে থেকেও শুধু এই সারাক্ষণ অনলাইন থাকার ভূতই কেড়ে নিল এই চাকরির সুযোগ। নিজের প্রোফাইল –এ ফিরে আসতেই মনে হল ওর নিজের হাস্যমুখ ছবিটা যেন ওকেই ব্যাঙ্গ করছে। এক অসহনীয় অবস্থা। আবার ঝাপসা হয়ে আসে চোখ।এই অনলাইনের নেশায় ওর জীবন ওর কেরিয়ার সব কিছু অফলাইন হয়ে গেল! লজ্জা করা উচিত। বজ্রাহতের মত খানিক থাকার পর আবার মন দেয় প্রোফাইল ডিলিট করার কাজে। আবার টুংটাং শব্দে সাড়া দেয় হাতের যন্ত্রটা। প্রোফাইল –এর ওপরের ডান দিক ঘেঁসে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ফুটে ওঠে। নাম- তনুকা
    সরকার। তনুকার প্রোফাইল পিক-এ দেখা যায় এক জিন্স – টপ পরিহিতা লাস্যময়ী যুবতী। “মন পালটে গেল নাকি! হতে পারবে তো অফলাইন?”
    (সমাপ্ত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৭ জুন ২০১৪ | ২৩৫৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 24.97.58.120 (*) | ০৮ জুন ২০১৪ ০৩:৫৮73454
  • এটা কি গল্প? যাই হোক পড়তে মন্দ লাগল না। অনলাইন অ্যাক্টিভিটি নিয়ে প্রচন্ড অবসেসড হয়ে থাকা পাবলিক সেই ২০০৩-০৪ থেকেই দেখছি। বাড়ছে ক্রমশঃ তো, টেকনোলজি এলে তার ভাল খারাপ দুইই থাকবে। ইউজারের নিজের ওপরে কন্ট্রোল থাকা দরকার।

    যাই হোক, দুটো কথা।

    ১) আপনার ব্লগের ওপরেই তো লগিন নেম দেখাচ্ছে। আবার নামটা বোধহয় না লিখলেও চলে।

    ২) লেখায় প্যারাগুলো বড্ড জুড়ে গেছে। আপনি কি অন্য কোনও সফটওয়ারে লিখে কপি করেন? তাহলে এডিটার উইন্ডোয় ফেলে প্রত্যেক প্যারার পর একটা করে হার্ড এন্টার দিন। পড়তে একটু সুবিধে হবে।
  • সিকি | 131.241.127.1 (*) | ০৯ জুন ২০১৪ ০৫:১২73455
  • প্যারাগ্রাফ ব্রেকিং আরও প্রপার হলে সুখপাঠ্য হত।

    অভিষেকের চরিত্র বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা গেলেও চাকরিতে রিজেকশনের কারণ হিসেবে ফেসবুক অ্যাডিকশনটা মেনে নেওয়া বেশ টাফ। অন্তত এটা কোনও ভ্যালিড কারণ বলেই আমার মনে হল না আমার।

    দুরন্ত এক্সপ্রেস ব্যান্ডেল দিয়ে যায় না। হাওড়া শিয়ালদা কোনও লাইনের দুরন্তই ব্যান্ডেলে ঢোকে না।

    গাজিয়াবাদে সম্ভবত কোনও সফটওয়্যার কোম্পানি নেই। ওটা নয়ডা হলে ভালো হত।

    কিছু বানান বেশ বাজে রকমের ভুল। ঘর-কে লেখা হয়েছে ঘড়। "লাইক পরে", "উঠে পরেছেন", "ঘুমিয়ে পরেছে", "প্যান্টরিবয়" - একটু চোখে লাগে। ধরে নিচ্ছি এগুলো সবই টাইপো।
  • sch | 192.71.182.106 (*) | ০৯ জুন ২০১৪ ০৯:৩৪73456
  • কোনো চাকরিতে রিজেকশানের এতো এক্সপ্ল্যানেশান দেয়?
    জানতাম না

    আর যারা এই ধরণের এক্টিভ ফেসবুক করে, তারা সাধারণতঃ প্রোফাইল সার্চ হাইড করে রাখে বা টাইম্লাইন, ফ্রেনড লিস্ট হাইড করে রাখে আর চ্যাটে ইনভিসিবল থাকে।

    যাকগে
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন