এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • দ্রোহ-প্রেম-১

    তিয়াষ মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২১ এপ্রিল ২০১৯ | ১৪৬১ বার পঠিত
  • "ফিরভি ইঁয়াদ আ গ্যয়ে, তো কেয়া করে! খুদকো ডাঁটে কেয়া? ইঁয়াদকো রুখ দে কেয়া?"

    বলতে বলতে জল গড়িয়ে পড়ছিল ওঁর তুবড়ে যাওয়া গাল বেয়ে। গালের খাঁজে এসে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছিল সে নিম্নগামী নুন জলের স্রোত। চিবুক ছুঁয়ে সে জল পড়ে যাওয়ার আগেই তার উপর পশমের আস্তিন বুলিয়ে নিচ্ছিলেন মানুষটা। স্বজনের স্মৃতিতে বৃদ্ধ চোখে ভরে আসা মুক্তোজল, বড় দামী। ফেলা যায় না যে!

    তিনি মহম্মদ আতাউল্লা। তুরতুকের বাসিন্দা। ভারতের শেষ গ্রাম হিসেবে পরিচিত কাশ্মীরের এই তুরতুক। কয়েক কিলোমিটার দূরেই পাকিস্তান সীমান্ত। এই তুরতুক গ্রামের মানুষেরা এখনও নিজেদের পরিচয় দেন বাল্টিস্তানি বলে। বছর কয়েক আগে বাল্টিস্তানই নাম ছিল এই প্রদেশের। আর দেশের নাম ছিল পাকিস্তান। তার পরে এল সেই চরম অস্থির বছরটা, ১৯৭১। মানচিত্রের সঙ্গেই ছারখার হয়ে গেল শতশত জীবন, পরিবার, সম্পর্ক, ভালবাসা। সীমান্তকে দিব্যি রেখে ভাগ হয়ে গেল জমিন। কিন্তু মানুষগুলোর ভাগ হওয়া তো জমিনের মতো সহজ নয়! সে যে কঠিন, বড় কঠিন!

    সেই কঠিনেরই শিকার হয়ে 'ভারতীয়' বনে গেলেন বাল্টিস্তানি আতাউল্লাজি। আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগে, বয়স তখন ২০। তখন রক্তে ফুটছে দেশপ্রেম। ভেবেছিলেন, যে করেই হোক ফিরে পাবেনই নিজের জায়গায়। ভেবেছিলেন, প্রিয়জনদের কাছে যাবেনই ফিরে! ভেবেছিলেন যুদ্ধের ক্ষমতা বুঝি ভালবাসার চেয়ে বেশি!

    বোকা ছেলে!

    বোকামির ঘোর কাটতে ঘুরে গেল অনেক বছর, অনেএএএক...। বোঝা গেল, যাওয়া হয়তো হবে, কিন্তু ফেরা হবে না আর। শেখা হল, ফিরব বললে ফেলা যায় নাকি? কোন এক অভিমানে যাওয়াও হয়নি তাঁর। আসলে যে চিরতরে ফিরতে চায়, সাময়িক যাওয়ার লোভে তাকে বাঁধা যায় না। যে অতল সমুদ্রে মুক্তি খুঁজেছে, সাজানো ঝিলে তার তীব্র অনীহা। যে অনন্ত মুক্তি চেয়েছে, সে কখনও ক্ষণিকের ছুটি চায়নি!

    কিন্তু অভিমান এক দিকে, কৃতজ্ঞতা অন্য দিকে। খানদানি বাল্টিস্তানি মুসলিম তিনি! সারা দুনিয়া ভুলে যাবেন, কিন্তু মেহেরবানি ভুলবেন না। "এই যে এই দেশের হাওয়া, জল, মাটি-- বাঁচিয়ে রেখেছে তো আমায়! এরা কিন্তু আমায় সব হারানোর ব্যথা বুঝতে দেয়নি! এরাই আমার দেশ ছুঁয়ে আছে, এদের ছুঁয়ে আমি বেঁচে আছি! এই এতটা বয়স পর্যন্ত সুস্থ আছি, সহি-সালামত আছি। এদের আমি কেমন করে ভুলব! কেমন করে অস্বীকার করব, আমি চাই কি না চাই এই দেশ আমায় আপন করে নিয়েছে! ও দেশকে মা মানতাম। এ দেশও তো আমায় মায়ের মতোই স্নেহে-মায়ায়-মমতায় মুড়ে দিল। আমার অভিমান ভুলিয়ে দিল। দিল তো!"-- বলতে বলতে কেঁপে ওঠেন বৃদ্ধ।

    সে কাঁপুনিতে ধরা পড়ে যায় বিমাতৃকা এক দেশকে জাপটে ধরে ভালবেসে ফেলার আকুতি। তাতে কোনও খাদ নেই। তাতে নেই কোনও ভান। ভালবাসার ভান হয়তো করা যায়। কিন্তু বেঁচে থাকার ভান করা যায় কি? বৃদ্ধের শিরায় শিরায় যে এ দেশের বেঁচে থাকার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা ধরা পড়ে যায় প্রতি নিঃশ্বাসে।

    এক সময়ে ঝড়ের শব্দ স্তিমিত হয়ে আসে, ফুটে ওঠে এক চোরা আতঙ্ক। আজ কোন এক অজানা হাওয়ায় বার্তা রটেছে, তাঁর ভালবাসা ঝুটা! এ দেশের জল-হাওয়ায় বেঁচে বুকে করে পাকিস্তান নিয়ে বাঁচছেন তিনি! পাকিস্তানের পতাকায় খুবানির সুঘ্রাণ খুঁজছেন! সীমান্তের ওপারে খুঁজছেন মুক্তি! আজ়াদি!

    "না!"-- তীব্র চিৎকার করে ওঠেন বৃদ্ধ আতাউল্লা। এ চিৎকারে যতটা বিদ্রোহ আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে যন্ত্রণা। যন্ত্রণা, সেই ছোটবেলায় গলির মুখে ফেলে আসা ক্রিকেট খেলার স্মৃতির। যন্ত্রণা, এক ঠোঙা থেকে জিলিপি ভাগ করে খাওয়ার প্রিয়তম বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার স্মৃতির। যন্ত্রণা, সব ভাইবোনেরা মিলে ইদের মেলায় নাগরদোলনা চড়তে যাওয়ার স্মৃতির। যন্ত্রণা কৈশোরের প্রথম প্রেমিকার চোখের কাজলটুকুর স্মৃতির!

    "বিশ্বাস করো, আমি নেমকহারাম নই! মাঝেমাঝে বেইমানি করে শুধু এই স্মৃতিরা! ওরা অবুঝ। ওরা শৈশব খোঁজে। ওরা বন্ধু খোঁজে। ওরা আত্মীয় খোঁজে।"-- যে খোঁজের শেষে কান্না ছাড়া কিচ্ছু নেই, সেই খোঁজেই উতল হয় বৃদ্ধের আবছা স্মৃতিরা। আর তখনই, জল গড়িয়ে পড়ে ওঁর তুবড়ে যাওয়া গাল বেয়ে। গালের খাঁজে এসে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যায় সে নিম্নগামী নুন জলের স্রোত।

    ভাঙা গলায় বৃদ্ধ বলেন, "ফিরভি ইঁয়াদ আ গ্যয়ে, তো কেয়া করে! খুদকো ডাঁটে কেয়া? ইঁয়াদকো রুখ দে কেয়া?"

    সত্যিই তো, সব কিছু ছেড়ে এ দেশে এসে যাঁরা বছরের পর বছর ধরে আপন করে নিলেন অন্য দেশ, আপন হলেন সময়ের স্রোতে... তাঁদের কি একটু কষ্ট পাওয়ারও অধিকার নেই ছেড়ে আসাটুকুর জন্য? অধিকার নেই স্মৃতিচারণ করার? ছোটবেলার স্কুলের মাঠে উড়তে দেখা পতাকার সবুজটুকু যদি আজ বৃদ্ধ চোখের কার্নিশে খানিক চলকে ওঠেই বা, তাতেই কি পর হয়ে যায় গোটা মানুষটা? দেশ মানে কি? কেবল পতাকা? কেবল সীমানা এত সহজ? জল-হাওয়া-মাটি-মানুষের ঊর্ধ্বে কেবল মানচিত্রটুকুই সত্যি বুঝি?

    চিরন্তন এ প্রশ্ন বুকে করে ফিরতি পথ ধরি। আরও এক বার ঝালিয়ে নিই, যন্ত্রণার কথামালা। পিছু ডাকেন বৃদ্ধ। শিরাওঠা ধবধবে হাত বাড়িয়ে বলেন, "নিজের দেশকে ভালবাসলেই পালিকা দেশের শত্রু হয় না মানুষ। দেশ এত ঠুনকো নয়, দ্রোহ এত সহজ নয়! তার চেয়ে সহজ ভালবাসা!"

    আতাউল্লার বাড়িটা এখন তুরতুকের মিউজিয়াম। ১০০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। এক টুকরো বাল্টিস্তান ধরে রেখেছেন, সেই বাড়িতে বা মিউজিয়ামে। পুরনো বাসন, পোশাক, উনুন, লাঙল, দোলনা... আরও কত কী!

    ছায়া ছায়া অন্ধকার ঘরগুলোয় বৃদ্ধ রাজার মতো ঘুরে বেড়ান আতাউল্লা। হাত বোলান বাসনগুলোর গায়ে, ঝেড়ে দেন পোশাকগুলো। মুছে নেন চোখ।

    একই সঙ্গে দীর্ঘশ্বাসের ক্ষয় আর স্মৃতিদের সঞ্চয়... আগে বড় দেখিনি।



    (চলবে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২১ এপ্রিল ২০১৯ | ১৪৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Suman | 566712.91.3412.219 (*) | ২১ এপ্রিল ২০১৯ ১১:২৫78155
  • পরের পর্বেরঅপেক্ষায় রইলাম
  • aranya | 3478.160.342312.238 (*) | ২২ এপ্রিল ২০১৯ ১২:৩৮78156
  • বাঃ
  • তন্বী হালদার | 785612.40.3412.144 (*) | ২৩ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩৭78157
  • অসাধারণ লেখা। জ্ঞান হ ওয়ার পর থেকে যে জায়গার জল আলো বাতাস মানুষের সান্নিধ্যে বড়ো হয় তাই তার দেশ। আমি ও যেমন ভুলতে পারিনা বসিরহাট ইছামতি নদীকে
  • মারিয়া | 2345.110.235612.57 (*) | ২৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৬:৫৮78158
  • সেই!
    শুধু দৃশ্যমান চোখের জল টুকুই মুছে ফেলা যায়... আর বাকি!!??
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন