এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • দাস্তাঁ-এ-মুহব্বত

    অনুপম ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৬ জুলাই ২০১৮ | ৯৬৯ বার পঠিত
  • "সব লোকে কয় লালন কি জাত এই সংসারে
    লালন বলে জাতের কি রূপ, দেখলেম না এই নজরে"...

    সাহিল অ্যাগনেলো পেরিওয়াল, নামটা প্রথমে শুনে একটু চমকেই গেছিলাম । মুমতাজ ম্যামের কাছেই শুনি এই নামটা। পুরো বিষয়টা বুঝতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে আপনাদের। ছাত্র পড়ানোর সূত্রেই পরিচয় মুমতাজ ম্যামের সঙ্গে। লা মার্টিনিয়ার, ডন বসকো, সেন্ট জেভিয়ার্সের মতো নামিদামি স্কুলের ছাত্র ছাত্রী পড়ানোর সুবাদে আমাদের দুজনের বহু স্টুডেন্টই কমন। আমি অংক আর ফিজিক্স পড়াই, মুমতাজ ম্যাম ইংরেজি। ম্যাম হঠাৎ করেই ফোন করে দেখা করতে বললেন। একটু অবাকই হয়ে গেছিলাম। সেশনের মাঝখানে জেনারেলি ব্যাচে নতুন স্টুডেন্ট নেওয়া হয়না। এটা ম্যামও ভালোই জানেন।

    যাই হোক, ওনার সাথে দেখা করলাম পরের দিন। মুমতাজ ম্যাম কাতর ভাবে অনুরোধ করলেন ওনার ছোট বোনের ছেলেকে পড়ানোর জন্য। জেনারেলি এরকম ইন্ডিভিজুয়াল স্টুডেন্ট পড়ানোর অনুরোধ আসেনা, কারণ বেশি টাকা দিতে হয় বলে অনেক অভিভাবকই ব্যাচে পড়ানো প্রেফার করেন। মুমতাজ ম্যামকে খোলাখুলি টাকার কথা বলতেই উনি বললেন, "টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। ইউ টেক হোয়াট এভার ইউ থিংক ফিট। উই নিড রেজাল্ট।"

    চ্যালেঞ্জটা অ্যাক্সেপ্ট করলাম এবং আজ মনে হয় সেদিন চ্যালেঞ্জটা না নিলে এমন একটি পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হতোনা। আর সেটায় ব্যক্তিগত ক্ষতিই হতো। যেদিন ওদের বাড়ি গেলাম, প্রথম বিস্ময়টা দরজার সামনেই অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য। ঝকঝকে গেটের মাথায় একটা নাইট ল্যাম্প লাগানো। আর তার একদিকে "786" আর অন্য দিকে "Jesus Loves Us" লেখা। বেল বাজাতে ছোটখাটো চেহারার ফর্সা টুকটুকে একটা ছেলে দরজা খুলেই এমন হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলো, যেন আমি তার বহুদিনের পরিচিত। ছোট্ট Three BHK ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটে পা দিলেই আপনার মনে হবে স্বর্গ বোধহয় এরকমই হবে।

    ফ্ল্যাটে ঢুকলেই আপনার নজর কাড়বে গৃহসজ্জা। দ্বিতীয় বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো ওদের ডায়নিং কাম ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুমের একপ্রান্তে বিরাট প্লাজমা টিভি আর সারাউণ্ড সাউন্ড সিস্টেম। আর টিভির দুদিকে দুটি বড় ছবি। একদিকে ক্রুশবিদ্ধ জেসাস, আর অন্য দিকে কাবার ছবি। দুটি ছবির মাঝে আর একটি বালব লাগানো রয়েছে। আর দুটি ছবিকে ঘিরে এলইডি লাইট সাজানো। লাইফে কখনও এমন হতভম্ব হতে হয়নি। এ ও কি সম্ভব!! এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান! তাহলে কি প্যালেস্টাইন, গাজা স্ট্রিপ, ক্রুসেড, নানা হানাহানি, এসব বানানো গল্প!! কোনও সংঘাত ছাড়া যীশুখৃষ্টের সাথে মহম্মদ এক দেওয়ালে থাকেন কীভাবে? একই পরিবারে? লাভ জিহাদ? সাহিলের শোয়ার ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে একঝাঁক প্রশ্ন মাথায় ভিড় করে এলো।

    সাহিলের ছোট্ট বেডরুমকে কি আদৌ বেডরুম বলা যায়? ঘরের এককোণে একেবারেই ছোট স্টাডি টেবিল। তার ওপরেই কম্পিউটার রাখা। একটা ওয়ার্ডরোব আর বাকি দেওয়াল জুড়ে বুক শেলফ ঠাসা বইয়ে। সিংগেল ডিভানে অজস্র বই। গোটা ঘর জুড়ে শুধু বই আর বই। দরজার পাশে বড় বোর্ড, আর তাতে পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ছবি দিয়ে কোলাজ বানানো। পরিবারের দ্বিতীয় সদস্য যিনি এলেন, তাঁর নাম শেহনাজ মনসুর পেরিওয়াল, সাহিলের মা। এই দুনিয়ায় কেউ কেউ থাকেন, যাঁদের দেখলেই আপনার মনে হবে নিজের মায়ের মতো। তেমনই একজন মানুষ শেহনাজ। আলাপের পরেই প্রথম জিজ্ঞাসা করলেন আমি খেয়ে এসেছি কি না!

    তারপরে কোথা দিয়ে কেটে গেছে দুটি বছর, টেরও পাইনি। সাক্ষাৎ পরিচয় হয়েছে এক অনবদ্য পরিবারের সাথে। আমার জানা নেই, এমন পরিবার কোলকাতা শহরে আর দ্বিতীয় আছে কি না। সাহিলের বাবা মারিয়ো পিটার পেরিওয়াল ধার্মিক খ্রিস্টান। ভালোবেসে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছেন শেহনাজকে। শেহনাজ ধর্মে মুসলিম। পিটারের মা বাবাও পরস্পরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন। এবং পিটারের মা কিন্তু খ্রিস্টান নন, মাড়োয়াড়ি হিন্দু। পিটারের শ্যালক, মানে সাহিলের মামা আবার যাঁকে বিয়ে করেছেন, তিনি ধর্মে হিন্দু এবং বাঙালি। দু'বছরে ঈদ, ক্রিসমাস, বিজয়া দশমী, তিনটি উৎসবের নেমন্তন্ন পেয়েছি ওদের বাড়িতে। এমন নয় যে পরিবারে কেউ ধর্মের ধার ধারেনা। একই ছাদের তলায় নামাজ পড়া এবং রবিবারে চার্চে যাওয়া নিত্যকারের কাজ হিসাবেই দেখতাম আর অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, এও সম্ভব!!

    সপ্তাহে দুদিন পড়াতে যাওয়া, বই পড়া, নিত্যনতুন খাওয়া এবং গল্পের নেশায় কখন যে হিসাবের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে, নিজেও বুঝতে পারিনি। শেহনাজ নিজে অসাধারণ রাঁধুনি। রান্নাটা ওনার প্যাশন থেকে পেশায় পরিবর্তিত হয়েছে। নিউমার্কেট অঞ্চলে একটি রেস্তোরাঁ চালান একার হাতে। ওনার এই প্যাশনের সাক্ষী আমার রসনা। চিকেন প্যাটি হোক বা কুকিজ, লাচ্ছা পরোটা বা মাটন বিরিয়ানী, অথবা ফিরনির মধ্য দিয়ে শেহনাজ আমার হৃদয় ছুঁয়ে যেতেন বারেবারে।

    অন্যদিকে পিটারের পেশা ফ্যাশন ডিজাইনিং হলেও নেশা গান গাওয়া। অনবদ্য গলা ভদ্রলোকের। রুজি রোজগারের জন্য একটি বুটিক চালিয়ে যেটুকু সময় পান, পরিবার এবং সঙ্গীত চর্চা ছাড়া আর কিছুতেই নজর নেই। বহুদিন এমন হয়েছে সাহিলকে অংক করতে দিয়ে আমরা দুজনে ডাইনিং রুমে বসে গল্প করে কাটিয়েছি। পিটার বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে বলতেন, আর আমি এক মনে শুনতাম ওনার কথা। দেওয়ালে ঝোলানো জেশাস ক্রাইস্ট আর কাবার ছবির মাঝে আলোটা জ্বলে থাকতো। মনে হতো এই দুনিয়াদারির আনা পাইয়ের হিসাবের বাইরের এক জগতে সফর করতে বেরিয়েছি। পিটারের হাত ধরে সেই সফরে শুধুই আনন্দের মেলা। ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে যেন নেগেটিভ কিছু নেই। আপনার নেশা হয়ে যাবে এমন আসরে বসলে।

    ঝরঝরে ইংরাজিতে পিটার বলে যেত ধর্ম কী? অলওয়েজ থিংক গুড, থিংক পজিটিভ অ্যাবাউট লাইফ। ডোন্ট স্পেন্ড ইওর টাইম থিংকিং নেগেটিভ। ইট উইল মিসগাইড ইউ। পজিটিভ থিংকিং উইল শো ইউ দ্য রাইট ওয়ে অফ লাইভলিহুড। বিলিভ মি, এটাই ধর্ম, আর কিচ্ছু না। স্বর্গ বা নরক কোথাও নেই। সব কিছুই এখানে, এই পৃথিবীর বুকেই। যখনই তুমি অন্যের জন্য ভালো কিছু করবে, তখনই তুমি স্বর্গে থাকবে। কথার ফাঁকে ফাঁকে গিটার বাজিয়ে হয়ত দুচার কলি গান। আমার মধ্যেও কোথাও যেন এই বিশ্বাস ছড়িয়ে যেত, ডু গুড টু আদারস এন্ড ইউ উইল বি ইন হেভেন। বাড়ি ফেরার পথ জুড়ে মাথায় ভাসতো আমির খসরুর লেখা...


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৬ জুলাই ২০১৮ | ৯৬৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 3478.160.342312.238 (*) | ২৮ জুলাই ২০১৮ ০২:৫৬85530
  • সুন্দর
  • শঙ্খ | 671212.206.012323.112 (*) | ২৮ জুলাই ২০১৮ ০৪:০৪85531
  • বাহ
  • Atoz | 125612.141.5689.8 (*) | ৩১ জুলাই ২০১৮ ১০:৫৫85534
  • ঈশ, এই লেখাটা কিনা এতদিন পর পড়লাম!!!!
  • ফরিদা | 12.38.45.15 (*) | ৩১ জুলাই ২০১৮ ১২:২০85532
  • এই লেখাটা ওপরে থাক।
  • ফরিদা | 12.38.45.15 (*) | ৩১ জুলাই ২০১৮ ১২:২৪85533
  • এই লেখাটা ওপরে থাক।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন