এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • একাত্তরের অ্যান্টিথিসিস - লাশগণনার ভূতুড়ে ইতিহাস ( প্রথম কিস্তি)

    ফারুক ওয়াসিফ লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ২৫ এপ্রিল ২০১১ | ৬৫১ বার পঠিত
  • ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দু:খের খনি ভেদ করে শোনা যায়, শতজল ঝর্ণার ধ্বনি/ জীবননান্দ দাশ

    শর্মিলা বোসের নতুন বইয়ের নাম Dead Reckoningx Memories of 1971 Bangladesh War’ বা মৃতশুমারি: ১৯৭১ এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি। মৃতশুমারিটা কে করছে? স্মৃতিটা কার? শুমারির জন্য তিনি নির্ভর করেছেন পাকিস্তানী সেনাভাষ্যকে আর স্মৃতিটা প্রধানত তাদেরই। কারণ, যুদ্ধটা ভারত-পাকিস্তানের বাংলাদেশ যুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়। আমেরিকার জন্য যা ইরাক যুদ্ধ, ইরা কিদের জন্য তা আগ্রাসন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। ১৯৭১-এ উপমহাদেশ এবং বিশ্বের দুটি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শিবির যে যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল, সেই যুদ্ধটা প্রথমত এবং প্রধানত স্বাধীনতা যুদ্ধ। তাঁর গবেষণার সারসংকলন তাঁর বইয়ের নামানুসারেই তাই করা যায় মৃতদের শুমারি: হারানো বাংলাদেশের ভুতুড়ে স্মৃতি। হ্যঁ¡, যে পূর্ববঙ্গের মুসলমানের আন্দোলন ও ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যারা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের প্রাণ, ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে কেবল পাকিস্তানের পূর্ব অংশেরই মৃত্যু ঘটেনি, মৃত্যু ঘটেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের কনসেপ্ট তথা দ্বিজাতিতত্ত্বের। মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ''...পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদমসন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হিসেবে বিরাজ করছে। পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হওয়ার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল, তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।'' বাংলাদেশের জনগণ এবং তার রাজনৈতিক পুঁজিই ছিল পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার শেষ ভরসা। কিন্তু তারা তাকেই হত্যা করতে গিয়ে আসলে হত্যা করে পাকিস্তানের বেচে থাকার সম্ভাবনাকেই। রাষ্ট্রের কনসেপ্ট বা চেতনা মারা গেলে রাষ্ট্রের শারীরিক মৃত্যুটা সময়ের ব্যাপার। পাকিস্তান এখন সেই সময়টাই পার করছে ভুতুড়ে অস্তিত্ব নিয়ে। সেই যে সুকুমার রায়ের রামছাগলের মেজোদাদার অর্ধেকটা বাঘে খেল বলে বাকি অর্ধেকটার সেই দু:খে মারা যাওয়ার মতো। শর্মিলা বসুর দু:খটা তেমনই।

    এক.

    মুক্তিযুদ্ধের একাডেমিক ইতিহাস চর্চার খাতাটা প্রায় সাদাই ছিল অনেক দিন। শর্মিলা বোস সেখানে একের পর এক কদর্য কিছু দাগ রেখে চলেছেন। তাঁর একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং সাম্প্রতিক প্রকাশিত বই দিয়ে তিনি স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগ, গণহত্যা ও গণধর্ষণের অলংঘনীয় বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলেছেন। তাঁর দাবি মানলে মুক্তি সংগ্রামের রাজনীতি নাকচ হয়ে যায়। গবেষক বা লেখকের অনুসন্ধানের একটা অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য থাকে। শর্মিলা বোসের অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ও তত্ত্বের খণ্ডন। তিনি আসলে একাত্তরের অ্যান্টিথিসিস বা পাল্টা তত্ত্ব রচনা করে যাচ্ছেন। নতুন বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে গবেষণা ও মাঠকর্ম করতে আসার পর মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ও সাক্ষিরা তাঁকে বলেছে, "এইসব ঘটনায় দুর্ঘটনাবশতভাবে ছাড়া সেনাবাহিনী নারীদের কোনো ক্ষতি করেনি। এসব ঘটনা থেকে যে ধরনটা দাঁড়িয়ে যায় তা হলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নারী ও শিশুদের বাদ দিয়ে কেবল বয়স্ক পুরুষদের নিশানা করেছিল।' এটা বলেছেন কয়েকটি "ঘটনার' ব্যাপারে। এরপরে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ বিষয়েই তাঁর রায় হচ্ছে, "কোনো সন্দেহ নেই যে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অবস্থার সুযোগ নেওয়া সুবিধাবাদী যৌন অপরাধ বাদ দিলে, প্রশ্ন হলো, কোন মাত্রায় ধর্ষণ ঘটেছিল, কে কাকে শিকার করেছিল এবং সেসময় কোনো পক্ষ লাগাতারভাবে পরিকল্পনামাফিক ধর্ষণ চালিয়েছিল কিনা।' তাঁর সিদ্ধান্ত: সেরকম কিছু পাকিস্তানী বাহিনী করেনি। তাঁর দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি গণহত্যা বিষয়ে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার শাঁখারিবাজারে তিনি কেবল ১৫ টি মৃত্যুর প্রমাণ পেয়েছেন, অথচ মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে একাধিক স্যা সেখানে কয়েক হাজার নর-নারীর হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত করেছে।অ্যানাটমি অফ ভায়োলেন্স প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি লিখেছেন, "১৯৭১ সালের গৃহযুদ্ধে দুটি পক্ষ লড়েছিল, যাদের একপক্ষের বিশ্বাস তারা পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার জন্য লড়ছে, অন্যপক্ষ লড়েছে সুবিচারের সুযোগ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের উন্নতি হবে এমন বিশ্বাসে। উভয়ের অবস্থানই রাজনৈতিকভাবে বৈধ। উভয় পক্ষই সহিংসতার পথে সমাধান চেয়েছে, সবাইই যুদ্ধের গৃহীত নিয়মকানুনের বাইরে গিয়ে নৃশংস কর্মকাণ্ড করেছে, এবং উভয়ই মানবতার অংশ। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অপরাধীকরণের (পাকিস্তানী সৈন্যদের) দাগ মেরে দেওয়ার বদলে বরং ১৯৭১-এর সংঘাত বিশেষভাবে সমঝোতা প্রয়াসের উপযোগী।' এটাই শর্মিলা বোসের অভিপ্রায়, এই-ই তাঁর উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি ঘটাতে চান এবং চান শত্রুভাবাপন্ন দুটি দেশ ও জাতির মধ্যে, নিপীড়ক ও নির্যাতিতের মধ্যে, ঘাতক ও নিহতদের মধ্যে সখ্য স্থাপন করতে। কারণ, উভয়পক্ষই তো সমান দোষী! কারণ, তাঁর চোখে একাত্তরের যুদ্ধটা স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল না, ছিল "গৃহযুদ্ধ'। কারণ বাঙালিরা কোনো সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কারণে নয়, কেবল "উন্নতির আশাতেই' স্বাধীনতা চেয়েছিল, কারণ বাঙালিরাই অসহযোগ আন্দোলনের নামে আগে সহিংসতা ঘটিয়েছে, উস্কানি দিয়েছে; নৃশংস কর্মকাণ্ড তারাও করেছে। এই যদি হয় ইতিহাস তাহলে "ভুল বোঝাবুঝি' মিটমাট করে নেওয়াই ভাল! মনে রাখা দরকার, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামেই, মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বা ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ আখ্যা দিয়েই রাজাকার-আল বদর, জামাতে ইস লামি যাবতীয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সুতরাং শর্মিলা বোসের প্রস্তাবটা কেবল পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের মাফ করে দেওয়ারই নয়, বাঙালি ও বাংলাদেশি যুদ্ধাপরাধীদেরও মেনে নেওয়ার প্রস্তাব। এককথায়, এটা হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের একাত্তরের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকারের বুদ্ধিবৃত্তিক প্ররোচনা।

    মুক্তিযুদ্ধে সবার ভূমিকার সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু শহীদদের প্রাণদান আর যোদ্ধাদের সংগ্রামকে কোনোভাবেই বাতিল বা হেয় করা যায় না। মানবতার বিপুল ধ্বংসের পক্ষের যুক্তি বা অবস্থান যেমন মানবতাবিরোধী, তেমনি শর্মিলা বোস কিংবা মানেকশ-জ্যাকবের-র স্বাধীনতা যুদ্ধকে "গৃহযুদ্ধ' বা "ভারত-পাকিস্তান' যুদ্ধ বলার মাধ্যমে বাংলাদেশের যুদ্ধকে এর অধীনস্থ করে দেখার অবস্থানও বাংলাদেশবিরোধী।পাকিস্তান একে গৃহযুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ যে কোনো নামেই ডাকতে পারে, তাতে করে তাদের ঐতিহাসিক বিকার আরো প্রলম্বিতই হবে। ভারতেও অনেকে বৃহ ত রাষ্ট্রের উচ্চম্মন্যতার বাতিক থেকে একাত্তরের যুদ্ধকে ভারতের যুদ্ধ বলতে পারেন এবং তার বাইপ্রডাক্ট হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ভেবে থাকেন। ১৯৭১-এ ভারতের বাংলাদেশকে সর্বে?তভাবে সাহায্‌য করা নিশ্চয়ই ভারতের মহিমা, কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম বা বিজয় কোনোটাই সেই মহিমার গুণে হয় নাই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম এ অঞ্চলের জনগণের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিকাশ এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খার মধ্যেই সুপ্ত ছিল। এ বিষয়ে ছাড় দেয়া মানে ঐ রাজনৈতিক ইতিহাসকে ভুল বলে বাতিল করা নতুবা তাকে ঠিক মতো বুঝতে না পারা। শর্মিলা বোস সেটাই করেছেন। গণহত্যা ও গণধর্ষণ অস্বীকারে তাঁর প্রয়াসের রাজনৈতিক মাজেজা এটাই এবং এখানেই তাঁকে মোকাবেলা করতে হবে দায়বদ্ধ গবেষকদের। এ ধরনের চিন্তা মনে করে, একাত্তরে পাকিস্তান বাড়াবাড়ি না করলে, কিংবা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে, কিংবা আরো কী কী যেন করলে পাকিস্তান ভাংতো না। (মার্চের মাঝামাঝি পাকিস্তানের লারকানা থেকে ঢাকায় পাঠানো এক পাকিস্তানী সামরিক নির্দেশিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, "শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, অতএব তাকে ঠেকাও বা হত্যা করো' এমন কথা সেখানে লেখা আছে। তারা জিন্নাহ-লিয়াকত-সোহরাওয়ার্দিকেও হত্যা করেছিল বলে অভিযোগ) সমস্যাটা আচরণের ছিল না, ছিল উভয় খণ্ডের ঔপনিবেশিক সম্পর্কের মধ্যে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তির সংকট, যা রাষ্ট্রের নাগরিকদের অভিন্ন নাগরিক পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছিল।

    পাকিস্তান কেন এক থাকবে, এর যুক্তি তারা কাল্পনিক মুসলিম জাতীয়তাবাদ দিয়ে করে। ভারত যেমন করে কখনো প্রগতির নামে (নেহরুর জাতীয়তাবাদ), কখনো হিন্দুত্ববাদ (বিজেপির জাতীয়বাদ), কখনো পরমাণুবোমাসমৃদ্ধ পরাশক্তির সমৃদ্ধির প্রতিশ্‌রুতি এবং হিন্দি ভাষা ও হিন্দি ছবির নামে (নিওলিবারেল সোনিয়া-মনমোহনের ইন্ডিয়া)। এখনো ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে সব জাতি-বর্গ-শ্রেণীকে ধারণকারী মতাদর্শ ও রাজনীতি নির্মিত তো হয়ইনি, বরং দিনকে দিন সেই সম্ভাবনা তিরোহিত হচ্ছে। সেই রাজনীতি বাংলাদেশেও নেই, কিন্তু মোটাদাগে সমজাতীয় মানসিকতা, এক জনগণ এক ভূমি হওয়ার কারণে তা এখনো প্রকট হয়নি। আমরা এক জাতি বলেই এক স্বাধীন রাষ্ট্রে থাকবো তা-ই নয়, একাত্তরের ঐক্য ও যন্ত্রণার স্মৃতিও আমাদের সংহতির রসায়ন। সেকারণে আমরা বারবার মুক্তিযুদ্ধের নাম নেই, সকল কিছুর প্রেরণা বা প্রণোদনা আকারে এর কথা বলি। অনেক সময় রাষ্ট্রীয় বা দলীয় শয়তানির দোহাইও এখান থেকে টানা হয়। তাহলেও, একাত্তরের অভিজ্ঞতা এত ব্যাপক যে সহসা তার জিয়ন ক্ষমতা ফুরাবার নয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের আত্মদান, সংগ্রাম ও ধ্বংসের অভিজ্ঞতা হলো সেই বুনিয়াদি ভিত্তি যার ওপর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভিত্তি দাঁড় করানো। আবার দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক শক্তি এই ভিত্তিকে ওল্টানোর প্রকাশ্য ও গোপন কর্মসূচিও জারি রাখছে। এই দুই-ই মোটাদাগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতি বলে চিহ্নিত_ যদিও কার্‌যত মুক্তিযুদ্ধ রাজনৈতিক উত্তরাধিকারহীন। তাহলেও জনইতিহাস ও জনস্মৃতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ তেমনই এক পরম ঘটনা, যাকে আগলে রাখার কাজ জনগণ করে এবং বারে বারে তা থেকে বৈধতার তকমা রাষ্ট্রকেও গলায় ঝোলাতে হয়। যুক্তিটা এরকম: বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কারণ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। একাত্তর-পূর্ব বা পরের রাজনীতির আলোচনা আর গণমৃত্যু ও দুর্ভোগের আলোচনাকে তাই গুলিয়ে ফেলা যাবে না। বাংলাদেশ সার্বভৌম থাকবে, কারণ তা লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মদানের ও সংকল্পের অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা। একাত্তরের রাজনীতির আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে এই স্বীকৃতি দানের পরেই। গণমৃত্যু ও দুর্ভোগের আলোচনাকে তাই গু লিয়ে ফেলা যাবে না।

    বাঙালিরা স্বাধীনতার ইচ্ছা করেছে এবং তার জন্য যুদ্ধ করার প্রস্তুতিও নিয়েছে। এই সংকল্প না থাকলে কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না বাংলাদেশকে মুক্ত করা। এই সংকল্প তিনটা ধারায় দিনে দিনে দানা বেঁধেছিল। প্রথমটি সাংস্কৃতিক: জাতীয়তাবোধের জায়গা থেকে বাংলার মানুষ পাকিস্তানি পরিচয় ও তার মতাদর্শের বাইরে নিজেকে ক্রমাগত রক্ষা ও বিনির্মাণ করে গেছে_ অর্থনৈতিক বঞ্চনা এতে আরো বেগ যোগ করেছে মাত্র। বাস্তবের পাকিস্তানের আগেই মনের পাকিস্তান শুকিয়ে মরেছে। এ থেকেই জন্ম নিয়েছে জাতীয়তাবাদের রাজনী তি। এই রাজনীতির আবির্ভাবই দ্বিতীয় ধারা। জাতীয় মুক্তিকে এই রাজনীতি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের আধারে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছে (না পারুক, সেটা অন্য আলোচনা)। ৪৮-৭১ পর্‌যন্ত এরই বিকাশ আমরা বহুধারায় বহু ঘটনার মধ্যে দেখি। এরই চরম পর্‌যায়ে জন্ম নেয় তৃতীয় ধরনের সংগ্রাম: সামরিক সংগ্রাম। ৫২ সাল থেকে শুরু করে আগরতলা মামলা হয়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (আগরতলা ষড়যন্ত্র যে শেখ মুজিব করেছিলেন, সেটা এখন আওয়ামী লীগের নেতারাও স্বীকার করছেন) পর্‌যন্ত এর প্রথম ধাপ। চূড়ান্ত ধাপে দেখা দেয় সাতই মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্‌যন্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস হচ্ছে স্বাধীনতার সেই পর্বত, সশস্ত্র যুদ্ধ যার শিখর। এই শিখর পর্বেই ভারতসহ আন্তর্জাতিক নানান শক্তির ভূমিকা দেখতে পাই। কিন্তু কেবল শিখরকেই স্বাধীনতার মূল দেহ ভাবলে পর্বতটাকে টিলা বলে ভ্রম হতে পারে। সেই টিলা জয় করে কেউ নাচানাচি করতে পারে, কিন্তু তাতে বাস্তবতা বদলায় না। শর্মিলা বোসেরো সেই মতিভ্রমই হচ্ছে।

    মুক্তিযুদ্ধ ও এর রাজনীতিকে একদল ভারতের বগলের তলায় ঝুলে থেকে দেখেন, আরেকদল মৃত পাকিস্তানের ভুতেরকাঁধে বসে দেখেন। বাংলাদেশের স্বতন্ত্র জায়গা থেকে দেখার জরুরি কাজটা এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেদেরও তেমন করতে দেখা যয় না। ঠিক যে, ১৯৭১ সালে উপমহাদেশে দুটি যুদ্ধ হয়েছিল। একটি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের অন্যটি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের। পাক-ভারত যুদ্ধ হচ্ছে সেই টিলা বিজয়ের যুদ্ধ। ভারত রাষ্ট্রের ইতিহাসে এটা এক গৌরবজনক অধ্যায় মাত্র, তার সম গ্র অস্তিত্বের প্রতীক বা তার সমমূল্য এই বিজয় পায় না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা তার জাতীয় অস্তিত্বের সমতু ল। কয়েক বছর আগে একাত্তর সালে ভারতের সমরপতি স্যাম মানেকশ'র একটি সাক্ষাতকার দেখেছিলাম রেডিফ-এ। সেখানে তিনি ও পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান জ্যাকব দাবি করেছিলেন যে, তারা বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। মানেকশ'র বিজয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছে বা সেই বিজয়ের ফলে বাংলাদেশের জন্ম, এমন মনোভাবের মধ্যে যে অধিপতি সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি বা তাকে মেনে নেয়ার মধ্যে যে সমর্পিত মনোভাব থাকে, তা আপত্তিকর। সৈনিকেরা সর্বদাই জনগণের থেকে তো বটেই, এমনকি তার সৈনিকতার থেকেও অস্ত্রশক্তিকে বড় করে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু অস্ত্রের কাজ নয় কোনো দেশ স্বাধীন করা। সেটা তাদের ক্ষমতার বাইরের ব্যাপার। সমগ্র জনগণের গভীর সাং স্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতি ও সংকল্প না থাকলে জাতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যায় না। এই জিনিষ সেনা কমান্ডে গঠিত হয় না। এরা এতই বেহুঁশ যে, জনগণ এবং জাতিই যে একমাত্র অলৌকিক, সে নিজের গর্ভে নিজেকে জন্ম দেয়, সেই হুঁশ আসে না। সে নিজেই নিজের স্রষ্টা, যেমন করে ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম হয়, তেমনি জনগণ জাতি হয়ে উঠে নিজেকেই গঠিত করে। এই জন্যই রাজনৈতিকভাবে ঈশ্বর ও জনগণ পরস্পরকে কখনো সার্বভৌম বলে স্বীকার করতে পারে না।

    শর্মিলা বোসের "সিভিল ওয়ার' তত্ত্বের ভুল হলো তা পাকিস্তানকে একটি জাতিরাষ্ট্র ভেবেছে এবং মুসলমানিত্বকে সেই জাতিরাষ্ট্রের ঐক্যসূত্র ধরে নিয়েছে। যে পাকিস্তান মুসলমানদের একজাতি বলেছে, সে নিজেই আবার বাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েপ্রমাণ করেছে, তারা এক জাতি নয়। ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম ঐক্যটা কংগ্রেসি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাময়িক রাজনৈতিক কৌশল ছিল, এবং রাজনৈতিক কারণেই হিন্দু জমিদার শ্রেণীর ভীতি অপসারিত হওয়ায় ঐক্যটাও প্রয়োজন হারিয়েছে এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে। একে দেশভাগ বলে না, বলে ভাঙ্গন এবং তা রাষ্ট্রের ভাঙ্গন। এর মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র পেয়েছে তার আসল রূপ। যে রূপটা বণিক-সামরিক পাঞ্জাবি এলিটতন্ত্রের, যা ব্রিটিশ-মার্কিনের ঔপনিবেশিক জের বহন করছে, ঔপনিবেশিক ব্রিটেন আর সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার উত্তরাধিকার ও রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। আর বাংলাদেশের আবির্ভাব এই জোটেরই বিরুদ্ধে। যে কোনো রকম উপনিবেশিকতা ও আঞ্চলিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক, সেক্যুলার, কৃষকমেজাজি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে। এটাই নিশ্চয় এই রাষ্ট্রের মকসুদে মঞ্জিল নয়, তবে সেটা অন্য আলোচনা। এখন কেবল এই সত্যটা আমাদের মনে থাকা চাই দ্বিজাতিত্ত্বের মিছা আশা এবং ভারতবর্ষীয় একজাতিতত্ত্বের মায়ার নাগপাশের বাইরে এর আবির্ভাব হয়েছিল। আর মান্য করা চাই যে, এই রাষ্ট্রের ভিত নির্মিত হয়েছে সংগ্রামে, রক্তে, অশ্‌রুতে আর আগুনে। যার সম্মান ও সার্থকতা আজ অবধি আমরা দিতে পারি নাই। সংশোধনবাদী ইতিহাস চর্চা এরই সুযোগ নিচ্ছে এবং নিতে থাকবে।

    একাত্তরের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার প্রাণভোমরা হলো বর্বর দখলদারদের প্রতিরোধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা। এই কারণেই একাত্তরের প্রাণ বিসর্জন, নিপীড়নের অভিজ্ঞতা মানবতার ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মহত্ব অর্জন করে। শর্মিলা বোসেরা এই প্রাণভোমরাকেই হত্যা করতে চান এবং অস্বীকার করতে চান এই মহত্বকে। একাডেমিক চর্চার পলেটিক্যাল কারেক্টনেস যদি যান্ত্রিক বিমানবীকরণে পর্‌যবসিত হয়, তখন চিন্তা-জ্ঞান-তৎপরতা প্রেক্ষিতহীন হয়ে পড়ে এবং হয়ে পড়ে প্রতিক্রিয়াশীল। তাই গণহত্যা ও গণধর্ষণের কার্‌যকারণ ও মাত্রাকে ঢেকে দিতে তিনি যে ঐতিহাসিক প্রতারণার দাগ আঁকেন সেটা একে একে স্বাধীনতা আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি সব কিছুকেই বিদ্ধ করে, নাকচ করে দেয় - সবকিছুর অ্যান্টিথিসিস হয়ে ওঠে। তিনি হয়ে ওঠেন একাত্তরের অ্যান্টিথিসিসের প্রণেতা।

    (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ২৫ এপ্রিল ২০১১ | ৬৫১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ঢেকুর  - Tanima Hazra
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন