এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অন্য যৌনতা

  • দিল্লীর এলজিবিটি মিছিল ও কিছু কথা

    বিনয় সিং লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্য যৌনতা | ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ | ৫৮৬ বার পঠিত
  • জুলাই ২০০৯

    গত একমাসেরও বেশি সময় ধরে দিল্লীর LGBT (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) সমাজে অনেক পরিকল্পনা-আলোচনার ঢেউ তোলা সেই দিনটা অবশেষে এল। দিল্লির রাজপথে আজ প্রথমবার "দিল্লী এলজিবিটি'-র প্রকাশ্য মিছিল। যদিও ভারতে এটা প্রথম নয়, কলকাতা আগেই এ জাতীয় মিছিল দেখেছে, কিন্তু আমার মত দিল্লিওয়ালাদের কাছে আজকের দিনটা গর্বের, প্রথম পাওয়া অহঙ্কারের।

    মিছিলে থাকার জন্য মনে মনে তৈরী হয়েছি প্রায় একমাস ধরে। তবুও কেন জানি না একটা দ্বিধা, একটা সংকোচ আজ মনটাকে গ্রাস করছে। কেউ যদি চিনে ফেলে? কী হবে তাহলে? আমার বাড়ি কনট প্লেসের কাছেই। যদি বাবা মা দেখে ফেলে? এইসব সাতপাঁচ ভেবে যদি শেষ পর্যন্ত না যাই তাহলে আমার বন্ধুরাই বা কী ভাববে? এতদিন আমরা সবাই একসাথে বসে পরিকল্পনা করেছি। এখন আমিই যদি পিছিয়ে আসি সেটা কি ঠিক হবে? যদি আমি না যাই, তাহলে এর পরেও কি আমার যৌন পরিচয় নিয়ে আমি গর্ব বোধ করতে পারব? এই প্রথমবার আমি টের পেলাম আমার নিজের মধ্যে লুকনো এক "হোমোফোবিয়া'র অস্তিত্ব। এই সব টানাপোড়েন কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম যে আমি যাব, তারপর না হয় ঐ ভিড়ে অস্তিত্বহীন একজন হয়ে মিশে যাব।

    বিকেল নামতে উপস্থিত হলাম সেই মিছিলে, যদিও মনে সংশয় ঘন্টি বেজে চলেছে নিরন্তর। দেখলাম মিছিলটা এক দারুণ রঙিন জমায়েতে পরিণত হয়েছে। মানুষ স্লোগান দিচ্ছে হোমোফোবিয়া এবং সংবিধানের ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে। সত্যি বলতে কি, এমনটা যে দেখব আগে ভাবিনি। আমার ভাবনা ভুল ছিল, আমি ওখানকার বেশীরভাগের সাথেই নিজেকে মেলাতে পারছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম অনেক মেয়ে আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছে। মেয়ে হয়েও তারা যে যৌনতা বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ্যে জানাচ্ছে, এটা ভারতের নারী স্বাধীনতারই প্রমাণ। নি:সন্দেহে খুব আনন্দের মুহূর্ত, কিন্তু আমার নিজেকে মেরুদণ্ডহীন মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে ভারতের মতন দেশে যেখানে মেয়েরাও সাহসী হয়ে এল জি বি টি দের অধিকারকে সমর্থন জানাতে পারছে, সেখানে আমি-ই কিনা কিছুক্ষণ আগেও এই মিছিলে আসব কিনা ঠিক করতে পারছিলাম না! সেই মিছিলেই আমার চোখ পড়লো কয়েকজন "ক্রস ড্রেসার'এর ওপর। ঝলমলে পোষাকের এই "ক্রস ড্রেসার'রা ওখানে থাকা মোট লোকের পাঁচ শতাংশও ছিলো না। কিন্তু পুরো মিছিলটা জুড়েই আমি এদের নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলাম, চেষ্টা করছিলাম এইসব তথাকথিত "ক্রস ড্রেসার' বা "কুইন' দের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রাখার। বোধহয় তখনো আমি বুঝতে পারিনি এল জি বি টি দের সমাজ শুধুমাত্র গে-দের নিয়েই নয়। বিভিন্ন প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের একটা কমন প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে এই রকম একটা মিছিল খুবই দরকারি ছিল।

    এর পরে মিছিলে উপস্থিত সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সমকামী মানুষেরা ভাষণ দিলেন এবং সবশেষে সন্ধ্যের অন্ধকারে জ্বলে উঠল কয়েকশ শান্ত মোমবাতি। মোমবাতি জ্বালানোর সময় আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে আমার মনেও এইরকম একটা আলো জ্বালানো প্রয়োজন, হোমোফোবিয়ার জমে থাকা অন্ধকার দূর করতে। আমি অনুভব করতে পারছিলাম, এই এল জি বি টি সমাজের অংশীদার হওয়ার আগে আমাকে বাকি সব রকম যৌনতাকেও স্বীকৃতি দিতে শিখতে হবে। আমার নিজের ভেতরের হোমোফোবিয়া দূর করতে হবে, গোঁড়ামির ফাঁদ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে।

    আমার মনের মধ্যে যখন এইসব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেই সময়ে একজন পুলিশ কনস্টেবল এসে আমায় বলল, "সাহেব জি, আমি ভেবেছিলাম এই মিছিলটা হিজড়েদের, কিন্তু তোমরা এতজন ছেলে-মেয়ে কেন এসেছ?' ঠিক তখনই আমি বুঝতে পারলাম আমার এই মিছিলে আসার উদ্দেশ্য সফল। ঐ কনস্টেবলের মতন অনেকই এখন থেকে এটা জানবে যে এল জি বি টি সমাজ মানে শুধু হিজড়ে আর "ক্রস ড্রেসার'-রাই নয়, বরং যৌনতার আরো বড়ো প্রেক্ষিত। পরেরদিন সব খবরের কাগজ ভর্তি ছিলো এল জি বি টি প্রাইড র‌্যালির খবরে, আর "ক্রস ড্রেসার'-দের পোষাকের খুঁটিনাটি বর্ণনায়। আমার মনে হচ্ছিলো সংবাদ মাধ্যমগুলো এই মিছিলের উদ্দেশ্য বুঝতে কোথাও ভুল করছে, মিস করে যাচ্ছে এল জি বি টি সমাজের সবাইকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার সিম্ফনি।

    তবুও শেষপর্যন্ত আমি এইটুকু বুঝেছি যে এই মিছিল অন্তত আমার নিজের মনের মধ্যে থেকে অনেক দ্বিধাকে দূর করেছে, এল জি বি টি সমাজের অন্যান্য অংশকে স্বীকার করার, শ্রদ্ধা করার সাহস এনে দিয়েছে। আমাকে প্রথমবারের জন্য বুঝতে শিখিয়েছে "গে' হওয়ার আসল মানে। এই বছর দিল্লী যখন তার দ্বিতীয় মিছিলের সাক্ষী হওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে, তখন আমি অনেক বেশী উদার, নিজেকে নিয়ে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ। এবার আমি নি:সন্দেহে আমার নিজের অস্তিত্ব নিয়েই জড়তাহীন পায়ে মিছিলে হাঁটব।

    *লেখাটি অনুবাদ করেছেন সুমন্ত, ব্রতীশ গোস্বামী ও অভিজিৎ মজুমদার

    ১৩ই ডিসেম্বর, ২০০৯

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অন্য যৌনতা | ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯ | ৫৮৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন