অনেকদিন ধরেই দৌড়াতে যাবো ভাবছিলাম। লকডাউনে ঘরে থেকে থেকে একরকম আলস্য ধরে গেছিল। এছাড়াও চার বছর ধরে ওজন যন্ত্রের কাটাটা একই জায়গায় দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। কিন্তু গতকাল রাতে সেটা একেবারে চার দাগ উপরে চলে যাওয়ায় মাথায় চিন্তা ঢুকে গেছে।
ডায়াবিটিস আমাদের বংশগত রোগ। জানি অনেকে আমার এই যুক্তি মানবে না। কিন্তু আমার ঠাকুমা, বাবা,পিসি ,কাকা সবাই এই রোগেই আক্রান্ত। এমনকি বাড়ির কুকুরটারও ডায়াবিটিস টেস্ট করাতে হবে। তাই ভয় হয়। অবহেলা অনেক হয়েছে। সকালে বিকেলে ইনসুলিন নিতে পারবো না।
তাই ঘড়ির এলার্ম বাজতেই বেরিয়ে পড়লাম। একটা হালকা পুল ওভার চাপিয়ে, পকেটে স্যানিটাইজার আর মুখে মাস্ক নিয়ে চললাম আমি শহর ঘুরতে।
শীতের আমেজ এসেছে ।
আমি একেবারে শীত কাতুরে নই। বরঞ্চ আমার মায়ের মতো শীতের অপেক্ষাতেই থাকি। বরফে আমার শরীর গরম হয়ে ওঠে । হতে পারে আগের জন্মে পেঙ্গুইন ছিলাম । পাহাড়ে যাওয়ার নাম শুনলেই আমি এক পায়ে খাড়া। কিন্তু এখন সেই অবকাশ নেই। ছুটি ছাটারো তো একটা ব্যপার আছে।
শীতের আগমনী হওয়া গায়ে মেখে বেরিয়ে পড়লাম পুরানো শহরের রাস্তাতে। পর পর তিনটে বাড়ির পাস দিয়ে যেতে যেতে সকালের রেওয়াজের ঘনঘটা টের পেলাম। এক বিশাল কম্পিটিশন চলছে। এবারে এই পাড়া থেকে সা রে গা মা পা -এর স্টেজে একজনকে চাই ই চাই। ভালো লাগলো । পাড়ায় বাড়ির দেওয়ালের কোনা কাঞ্চি গুলো ভরে গেছে বিজ্ঞাপনে। এমনকি পোস্ট গুলোরও কোন অংশ বাদ নেই। এমনি সময় চোখে পড়ে না। কিন্তু আজ ফাঁকা রাস্তা বলে একটু বেশি নজর কারছিল।
হেটে হেটে পিচ রাস্তা ছাড়িয়ে মাটির রাস্তায় পা দিলাম। রাস্তার দুপারে কিছু শালিক খেলা করছে নিজেদের মধ্যে। আমাকে দেখে একটুও জায়গা দিলো না। পুরানো মজে যাওয়া খালের উপর দুএকজন বৃদ্ধ লোক বসে আছে। সম্ভবত আসন্ন ভোটে কার মাথায় মুকুট বসবে সেই নিয়েই আলোচনা চলছে। আমি তাদের পাস কাটিয়ে কুয়াশার বুক চিরে এগিয়ে গেলাম। গন্তব্য হচ্ছে রাস্তা।
গতকাল রাতেই কবিগুরুর রাজপথ পড়ছিলাম। যারা পড়েছেন তারা জানেন , শুধু রাস্তা নিয়ে ওরকম একটা লেখা কেবল কবিগুরুর দ্বারাই সম্ভব। সত্যি রাস্তা গুলো খুব একলা। সবাইকে আশ্রয় দেয়, সবাইকে বাড়ির দুয়ারে পৌঁছে দেয়। কিন্তু নিজেদের বাড়ি বলে কিছু নেই। নিজেদের গন্তব্য বলে কিছু নেই। আমি হাটতে হাটতে ভাবছিলাম আমার গন্তব্যের কথা। আপাতত আমার কোন ঠিকানা নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই। খালি এই একলা রাস্তার উপর দিয়ে একলা ভাবে চলেছি। খোলা আকাশের নিচে ,শিশিরভেজা রাস্তা দিয়ে অনেকক্ষন ধরে হেটে গেলাম। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলাম।
পথে যেতে যেতে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেলাম। চার কিলোমিটার হেঁটেছি। কিভাবে জানলাম? আমার মোবাইলে স্টেপ কাউন্ট করে বলে দেয় কত কিলোমিটার হল। টেকনোলজি কোথায় চলে গেছে।
তো চার কিলোমিটার হাঁটার পরে একটা চায়ের দোকান দেখে মনটা চা চা করে উঠল। দোকানিকে বললাম একটা লিকার চা দিতে। সবে গ্যাস জ্বালাচ্ছে সে। আমাকে দিয়েই তার বউনি হচ্ছে ।
পাস থেকে আর একজন লোক এসে সেই একই লিকার চা বানানোর অনুরোধ করলো দোকানিকে। দেখলাম হাতে তুলি আর রঙ। একটা পুরানো সুতির প্যান্টের উপর চাদর চড়িয়েছেন ভদ্রলোক। মাথায় টুপির ফাঁক দিয়ে সাদা চুল উকিঝুঁকি দিচ্ছে । বয়স সত্তরের কাছাকাছি হবে। হাতে তুলি দেখে পেন্টার আন্দাজ করলাম। পেন্টার দের প্রতি আমার আলাদা ভালোবাসা আছে। জানিনা কেন, আমার মতে ছবি আঁকার মতো ওত বড় ক্রিয়েটিভ মিডিয়াম আর কিছু নেই। প্রতিটা তুলির টানে ভালোবাসা মাখাতে হয় , না হলে ছবি কথা বলবে না। গল্প শোনাবে না। কিন্তু এই সাত সকালে পেন্টিং কেউ করে না। তাহলে কি আমার মত সখের পেন্টার?
কৌতূহল না চেপে জিজ্ঞাস করলাম,"কি রঙ করছিলে এই সকালে?"
বয়স্ক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,"পোস্টে লিখছিলাম"
"কি? পার্টির স্লোগান?"
ভদ্রলোক একটু জিভ কেটে বললেন,"আরে না না। ও দেরী আছে। এখন বিজ্ঞাপন দিচ্চিলাম। আমি পাত কুয়োর মিস্ত্রি তো, তাই নিজের ঢাক নিজেই পেটাচ্চি"
আমার তখুনি মনে এলো আগে দেখা বিজ্ঞাপনের কথা । অসংখ্যের মধ্যে একটা পাত কুয়োর মিস্ত্রির বিজ্ঞাপন ও ছিল।
"তা এই সময় পাত কুয়ো কার আর কার বাড়িতে বেঁচে আছে। সবই তো পৌরসভার জল দিয়ে চলে যায়।"
লোকটা হেসে বললেন,"যাদের বাড়িতে আছে, তারা লোক পায়না ঠিক করানোর। তাই দিয়ে রাখলাম।"
আমার বাড়িতেও একটা পাত কুয়ো আছে। ছোটবেলায় অনেকবার বল পড়ে গিয়েছিল খেলতে খেলতে। বাড়িতে স্নান ,বাসন মাজা, জামা কাপড় কাঁচা সব কিছুর জন্যই তার ব্যবহার হতো। কিন্তু পৌরসভার জল বিতরণের পরে সেটা এক কোনায় পড়ে আছে পুরানো আসবাবের মতো। প্রাণহীন ভাবে।
আমি বললাম,"তা এই করেই তোমার দিন চলে?"
লোকটি চায়ের কাপে এক চুমুক মেরে বললেন," আগে খুব চলতো। কিন্তু এখন কোন কিছুই চলে না। কত রকম কাজ করেছি। কিন্তু এখন তো সবই বন্ধ। আগে মাটি কেটে পুকুর বানাতাম । সেই পুকুরে এখন বড় বড় বাবুরা মাটি চাপা দিয়ে ফ্ল্যাট বানায়। নারকেল গাছ ঝেড়ে নারকেল পারতাম তাও নতুন ঘর ওঠার ঠ্যালায় কাটা পড়ে যায়। প্যান্ডেলে বাঁশ বেঁধে পুজো কালের দিনে প্রচুর টাকা আসতো। কিন্তু এইবারে তো আর সেরকম পুজো হলো কৈ? এখন এই তুলি ধরলাম। নিজের বিজ্ঞাপন দিয়ে হাত পাকা করছি। ভোটের আগে যদি দেওয়াল লিখে দুটো পয়সা আসে।"
আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলাম না। এই ভদ্রলোক জীবনে যে এত কিছু করেছে সেটা শুনেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। ভাবছিলাম ভুল করে উনি যদি জিজ্ঞেস করে ফেলেন আমি কি করি তাহলে এত সহজভাবে কি বোঝাতে পারবো? জমানা অনেক পাল্টে গেছে।
আমি চা শেষ করে দোকান ছেড়ে বাড়ির দিকে পথ ধরলাম। জীবনে কম্পিউটার চালানো ছাড়া আর কিছুই শিখিনি। আর যা শিখেছিলাম সেগুলো এখন ভুলতে বসেছি। এক একদিন স্বপ্নে দেখেছি পৃথিবী আবার সেই ইন্টারনেট পূর্ববর্তী যুগে চলেছে। যেখানে ফেসবুক নেই, কম্পিউটার নেই ,মোবাইল নেই, কারেন্ট নেই। ভাবতেই গা শিরশির করে ওঠে। এরকম দিনগুলি ফিরে এলে আজকালকার মিলেনিয়ালদের কি যে হবে? বলা তো যায়না, আসতেই পারে। করোনার মতো মহামারিও এক সময় সাইন্স ফিকশন সিনেমার টপিক হয়েই ছিল।
আমি এইসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। বাড়ির সামনেই একটা ল্যাম্পোস্টে দেখলাম লাল রঙের বিজ্ঞাপন,"পাত কুয়োর মিস্ত্রি লাগলে ফোন করুন " অমুক নাম্বারে।
মনটা কেমন করে উঠল। দুটো পয়সার জন্য একজন বৃদ্ধকে সকাল বেলায় উঠে পোস্টে পোস্টে নিজের বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে। একটা অনুভূতি নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই চোখ চলে গেল আমাদের সেই পুরনো পাত কুয়োর দিকে। অবহেলায় কে আকড়ে ধরে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে পেট ভর্তি জল নিয়ে ।
আমার ঠাকুমা বলতেন রাতে খারাপ স্বপ্ন দেখলে কুয়োর সামনে গিয়ে বলবি। দেখবি সেটা আর হবেনা।
ঠাকুমা ও তার এই ধরণের উপদেশগুলো দুটোই আমার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছিল। ব্যস্ত জীবনে ছোট ছোট এরকম আরো অনেক কিছু নিত্যদিন হাড়িয়ে যায়। আমার পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো পাত কুয়ো বলতে যে একটা জিনিস ছিল সেটা হয়তো মিউজিয়ামে গিয়ে দেখবে। জানতেই পারবে না তাকে নিয়ে জড়িয়ে থাকা নানান উপকথা।
সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বাড়ির সব থেকে উপেক্ষিত সদস্যটির জন্য কেন জানিনা করুণা হল। আমি উপুড় হয়ে দেখলাম, তার মধ্যে এখনো জল ছই ছই করছে। আমি বললাম,"কুয়ো তুমি আমার খারাপ স্বপ্নটা কেড়ে নিয়ে ভালো স্বপ্ন দেখিও"।
কুয়ো উত্তর দিলোনা। তার রাগ হয়েছে। কতদিন কথা বলা হয় না তার সাথে। তার নতুন করে স্বপ্ন শোনা হয় না। তার সাথে গল্প করার লোক নেই ।
আমার কথা শুনে তার অভিমান হয়েছে। প্রচুর শ্যাওলা জমে গেছে তার গায়ে গায়ে। নতুন করে সাজালে হয়তো একটু মন ভালো হবে তার। পকেট থেকে ফোনটা বার করে নতুন একটা নাম্বারে রিং করলাম,"পাত কুয়োর মিস্ত্রি বলছেন কি?"