এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • মুরগিচোর

    আনিস হক
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৪১৮ বার পঠিত

  • বুড়িটা দু'দিন পরপরই আসে। ক্ষুধা আর রোগে শুকিয়ে যাওয়া চেহারা, পিঠটা কুঁজো। পরনে একটি শতছিন্ন সাদা শাড়ি। ভিক্ষা চায় প্রথম, তারপর বলে,
    - আম্মাগো, মুরগির সালুন খাইতে কইলজা পোড়ে! দিবেন নি আম্মা?
    নাই বললে দ্বিতীয়বার আর চায় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করে। গেট অবধি গিয়ে পেছন ফিরে তাকায় একবার। ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায় বাইরে। তারপর পাশের বাড়িতে একই চাওয়া-
    - আম্মাগো, মুরগির সালুন খাইতে কইলজা পোড়ে! দিবেন নি আম্মা?
    কেউ দেয়, কেউ বা বকাঝকা দিয়ে বিদায় করে। শান্তা দেয় মাঝে-মধ্যে। কিন্তু কতটুকুই বা দিতে পারে? ছেলেমেয়েদের সবাইকে নিয়ে খাবার পর সামান্যই হয়তো বাড়তি থাকে। জুটলেও একটা দুটো হাড়ই হয়তো জোটে বুড়ির কপালে। সেটাই চেটেপুটে খেয়ে প্রাণভরে দোয়া করতে করতে চলে যায়। কখনো প্লাস্টিকের বাটিতে করে নিয়েও যায়। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা কখনো কখনো পিছু নেয় তার। শিশুরা যেমনি সরল-সুন্দর, তেমনি নিষ্ঠুরও হতে পারে। ওদেরই একটি দল বুড়ির পেছনে লাগে। জ্ঞমুরগিচোরঞ্চ জ্ঞমুরগিচোরঞ্চ বলে তাড়া করে বুড়িকে। একজন ঢিল ছুঁড়ে রক্তাক্ত করে দেয় বুড়ির মাথা। বাকিরা রক্ত দেখে ভয়ে থেমে যায়। বুড়ি আর্তনাদ করে ওঠে। মাথায় হাত চেপে হাঁটতে হাঁটতে পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

    অনেক দিন তাকে আর দেখা গেল না। কেউ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, কেউ ভাবল, মরেই গেছে বুড়িটা। শান্তার মন খারাপ হলো খুব। জাহিদ সেই সকালে অফিসে যায়, খানিক পরে ছেলেমেয়েরাও যায় স্কুলে। তারপর শান্তার একলা নিভৃত সময়। বুড়ি এলে তাই ভালো লাগে তার। খেতে খেতে সে নানা ধরনের গল্প শোনায় শান্তাকে। সে নিজেও কিছুটা মায়ায় পড়ে গেছে বুড়ির।

    শুক্রবার ছুটির দিন। ভালোমন্দ খাওয়া দাওয়া হয় এই দিন। জাহিদ মুরগি কেনে আজ একটা। ছেলেমেয়েরাও বাবামায়ের সাথে থাকতে পেরে খুশি। বাড়িতে কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব। বেশ যত্ন করে রান্না করে শান্তা। গোসল সেরে একসাথে মিলেমিশে খেতে বসে সবাই। কিন্তু টেবিলে বসে শান্তার এত বেশি মন খারাপ হয় যে, পেটে খাবার আর যায় না। মুরগির তরকারি প্লেটেই পড়ে থাকে। বাকি খাবারও নেড়েচেড়ে রেখে দেয়। দৃশ্যটা জাহিদের নজর এড়ায় না। একটা হাড় চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করে-
    - কী হলো বউ, উঠে পড়লে যে? এত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ!
    - মন চাইছে না।
    - কেন, শরীর খারাপ?
    - না না! শরীর ভালৈ আছে।
    - আম্মার মন খারাপ! ফোড়ন কাটে তিন্নি।
    - মন খারাপ কেন? কেউ বকেছে?
    উত্তর না দিয়ে কলঘর থেকে হাত ধুয়ে আসে শান্তা। বাকি সবার খাওয়া শেষ হয়। ছেলেমেয়েরা ক্যারামের আসর বসিয়েছে বসার ঘরে। জাহিদ শুধুমাত্র ছুটির দিনেই দুপুরের খাবারের পর একটু পান চিবোয়। শান্তা ম্লানমুখে ওকে পান দিয়ে খাবার টেবিল পরিষ্কারে ব্যস্ত। আরাম করে পান চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করে জাহিদ্রে
    - কিগো, মন খারাপ কেন?
    - এমনি।
    - এমনি বুঝি মন খারাপ করে কেউ! আমাকেও বলবে না?
    - না গো, বলার মতো কিছুই ঘটে নি। ঘটলে, তোমাকে না বলে পারি?
    - তাহলে মুখটা কালো কেন?
    কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে শান্তা। এসব ছোটখাট অনুভূতির কথা কী বলবে? অনেকসময় এগুলো দুর্বলতারই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হাসির পাত্র হতে হয় কখনো কখনো কারও কারও কাছে। অনেকবারই হয়েছে এরকম। জাহিদ যদিও সেরকম নয়, যতটুকু পারে ততটুকু নিয়েই আগলে রাখে শান্তাকে।
    - আমাদের মুরগি পাগল বুড়িকে দেখেছ কখনো?
    - কেন দেখব না। প্রতি শুক্রবারই তো আসে। তোমার কাছে ওর গল্পও শুনেছি।
    - কিন্তু আজ আসে নি।
    - তাই নাকি? কী হয়েছে?
    - গত সপ্তাহ থেকে আসে না ও। শুনলাম পাড়ার ছেলেরা ঢিল মেরে ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।
    - হায় আল্লাহ! মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে? কী দোষ করেছে বুড়ি? একটা দুটো মুরগির হাড় ভিক্ষে চাওয়া ছাড়া তো আর কিছুই চাইতে শুনি নি কখনো!
    - সেই তো! তারপরও ছেলেরা ওকে মুরগিচোর মুরগিচোর বলে পেছনে লাগল!
    - কী আর বলব! সময়টা ভালো নয়! মন খারাপ করো না। দেখবে কাল ও ঠিকই হাজির হবে।

    শনিবার না এলেও, রোববার ঠিকই এল বুড়ি। চেহারাটা আগের চেয়েও আরো বেশি মলিন। মাথায় ময়লা কাপড়ের পট্টি। তাতে রক্তের ছোপ। আবারও মুরগি খেতে চাইল আগের মতৈ,
    - আম্মাগো, মুরগির সালুন খাইতে কইলজা পোড়ে! দিবেন নি আম্মা?
    ফ্রিজে তুলে রাখা মাংসের কয়েকটি টুকরো শান্তা বের করে দেয় তাকে। বুড়ি প্লাস্টিকের বাটিতে ঢেলে নিয়ে দোয়া করতে করতে চলে যায় তার পথে। আবারও ছেলে মেয়েরা পেছনে লাগে কি না, সে ভয়ে দরজা অবধি এগিয়ে যায় শান্তা। এবার কিন্তু তেমন হলো না। ছেলেরা দূর থেকেই তাকিয়ে দেখল শুধু। বুড়ি ওদেরকে পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের রাস্তায় বাঁক নেয়।

    পরের শুক্রবার বাজার থেকে দুটো মুরগি কিনে বাড়ি ফেরে জাহিদ। শান্তা অবাক হয় খুব। জিনিসপত্রের যা দাম, তাতে এত বিলাসিতা করার সুযোগ কই? ওদের তো একটিতেই বেশ চলে যায়। আর অতিথি কেউ আসার কথা থাকলে তো জাহিদ আগেই জানাতো।
    - কী ব্যাপার? দুটো মুরগি আনলে যে আজ?
    - হ্যাঁ, দুটৈ, একটা আমাদের, একটা বুড়ির।
    - যাহ!
    - যাহ নয়। সত্যিই বউ! আজ বুড়ি ইচ্ছে মতো মুরগি খাবে। সঙ্গেও নিয়ে যাবে। ওর সামনেই জবাই করা হবে। ওর সামনেই রান্না হবে।
    - আস্ত এক পাগল তুমি!
    মনটা নরম মোমের মতো তরল হয়ে যায় শান্তার। এই পাগল লোকটা এত বেশি বোঝে তার মন! হোক না অভাবের সংসার, হোক না একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবন। তারপরও সে তার জীবনের কত বড়ো ঐশ্বর্য, প্রতিবারই সে টের পেয়েছে। আনন্দে চোখ ভিজে যায় শান্তার।

    রুটিন মতো কিছুক্ষণ পরই বুড়ি আসে। তার জন্যে মুরগি কেনা হয়েছে শুনে অবাক হয়ে একবার শান্তার দিকে, আরেকবার জাহিদের দিকে তাকায়। বিশ্বাসই করতে পারে না। কিছুক্ষণ ওদেরকে পরখ করে সাথের ঝোলাটা নামিয়ে বসে মাটিতে। একটি মুরগি ধরতেই কক কক করে ওঠে। শান্তা পাখা-পা ধরে। জাহিদ ছুরি চালায় গলায়। রক্তের ফিনকিতে লাল হয়ে যায় মাটি। মুরগিটি হাত থেকে মাটিতে রাখতে রাখতেই বুড়ির দিকে তাকায় ওরা। আঁতকে ওঠে দুজনেই। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে ঝোলার উপর লুটিয়ে আছে শুকনো মলিন বুড়ি। ভয় পেয়ে দু'জনেই দৌড়ে যায় ওর কাছে। মাথায় ও মুখে পানির ঝাপটা দেয়। জ্ঞান ফিরে পায় বুড়ি। কষ্টে উঠে বসে। শীর্ণ, কুঁচকানো চোখের কোনে অঝোর কান্না। সে কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠে ওর শীর্ণ শরীর। পাশে রাখা মুরগিটি মরণ যন্ত্রণায় তখনো ছটফট করছে ...।
    - এই মুরগি আমি খামু না আম্মা, এই মুরগি খাইতে পারুম না ...!
    - তোমার জন্যে আনলাম, আর তুমি খাবে না!
    - না গো আম্মা, এই মুরগি আমার গলা দিয়া ঢুকব না।
    - কেন? কী হয়েছে এই মুরগির।
    - মুরগির কিছু অয় নাই, আম্মাগো! যুদ্ধের সময় হেরা আমার সোয়ামীরে এমুন কইরাই জবাই করছিল আমার সামনে। এই কাটা মুরগিডার মতনই ছটফটাইয়া মরছিল আমার সোয়ামী!
    - কারা করেছিল জবাই?
    - রাজাকারেরা! আম্মা, রাজাকারেরা! ধইরা গলাডা কাইট্টা দিছিলগো...! কাইট্টা দিছিল...!
    বলেই ঝোলাটা নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় বুড়ি। ভয়ংকর স্মৃতির আঘাত আর বিস্ময়ের ঘোরে হতবাক শান্তা ও জাহিদ। কিছু বলার আগেই বাইরের গেটের দিকে এগিয়ে যায় বুড়ি। আজ আর পেছন ফিরে তাকায় না সে।

    (ছবি: সায়ন কর ভৌমিক)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৪১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন