'মিথ্যামেব জয়তে' প্রকাশিত হয়েছে তিন মাস হয়ে গেল। পঞ্চম বই, আলাদা করে তেমন কোনও অনুভূতি হয়নি। তাও বই প্রকাশের সময়ের এই পোস্টটা আরো একবার দিয়ে রাখলাম। ফেসবুক কখন উড়িয়ে দেয় ঠিক নেই। সুতরাং ব্যাকআপটুকু থাক...
দীর্ঘ সময় ধরে বহন করে চলা একটা লেখা যখন অবশেষে দু মলাটে বাঁধাই হয়ে বই হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন মনে নানা রকমের ভাবের উদয় হয়। আনন্দ, গর্ব, স্বস্তি, কৃতজ্ঞতা...কিন্তু আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, আমার ক্ষেত্রে এই সমস্ত ইমোশনকে ছাড়িয়ে গেছে বিষাদ। বন্ধু বিচ্ছেদ আর হতাশার হাত ধরেই যে লেখার সুত্রপাত, অসহায় যাপন আর নীরব দীর্ঘশ্বাস অবলম্বন করেই যে আখ্যান গড়ে উঠেছে, সেখানে আর আনন্দের অবকাশ কোনটুকু থাকতে পারে? যতবার ভাবি, মনে হয় এই লেখার প্রয়োজন না পড়লেই সবচেয়ে ভাল হত।
'ফেক নিউজ' -- যে শব্দটা গত কয়েক বছরের অন্তরালে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে সরল আর যুক্তিহীন মনে হয় যে খবরগুলোকে, সেগুলোই যে একটু একটু করে আমাদের সমাজের ভিত নড়বড়ে করে দিচ্ছে সে সম্পর্কে আমাদের অনেকেই অবগত নন। প্রযুক্তি ও মানুষের জন্মগত সংস্কারকে হাতিয়ার করে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই যে গরল-বীজ রোপণ শুরু হয়েছিল, তা আজ বিষবৃক্ষে পরিণত হয়ে মনুষ্যসমাজের প্রতিটি স্নায়ুকে আচ্ছন্ন করতে শুরু করেছে। কর্পোরেটদের সঙ্গে চুক্তি করে চালানো সার্ভেলেন্স ক্যাপিটালিজম-এর এই বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক যে কীভাবে আমাদের মগজধোলাই করছে, তা বিশদে জানতে পারলে আতঙ্কে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়।
রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্য বিকল্প সত্যের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এই কাজ একদিনে কিন্তু সম্পন্ন হয়নি। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা হোক অথবা স্নোডেন লিক, পানামা পেপার্স হোক অথবা তুরস্কের মিলিটারি ক্যুপ-এর ব্যর্থতা, এমনকি গত ৬ জানুয়ারি ২০২১-এ ট্রাম্পের মিথ্যাচারে ভরসা করে এক দঙ্গল লোক ওয়াশিংটনে কংগ্রেসের বিল্ডিংয়ে চড়াও হওয়া --- আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও, এই প্রত্যেকটি ঘটনা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। 'আইটি সেল' আর 'পেইড মিডিয়া'-এর যোগসাজশে চালিয়ে যাওয়া ধর্মীয় মেরুকরণ আর 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল'-এর এই পদ্ধতি নির্বাচন হ্যাক করে আর মানুষকে 'ডিসইনফর্মেশন' দিয়েই থামেনি, এই আগুনের আঁচ এসে লাগছে প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও।
নিতান্ত সাধারণ কিছু মতবিরোধের ফলে পুরোনো স্কুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যায় চিরকালের মতো, কিংবা আত্মীয়দের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়, ফেসবুকেও ব্লক হয়ে যেতে পারে পছন্দের আপন ব্যক্তিজনরা, সেই অভিজ্ঞতা হয়নি এমন মানুষ খুব কমই আছেন।
গত পনেরো বছরের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম আর ফেক নিউজের ধারাবাহিক বিবর্তনের কথা তুলে ধরার এই কাহিনি ততটাই বাস্তব, যতটা আমাদের জীবন। আমি ক্ষমাপ্রার্থী, এ কাহিনী ফিকশন বা নন ফিকশন, উপন্যাস বা গল্প সংকলনের প্রথাগত নিয়ম মেনে এগোয়নি। ফাস্ট পেস থ্রিলারের উপাদান থাকলেও বইটাকে সে চেহারা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই গল্প আদ্যপান্ত হিউমান স্টোরি, যেখানে সম্পর্ক ভেঙে যায় পরিস্থিতি বদল হওয়ায়, সততার পক্ষ নিলে শাস্তি পেতে হয় বাস্তবের মতোই, মিড লাইফ ক্রাইসিস এসে আত্মবিশ্বাস ভোঁতা করে দেয় উদ্যমী মানুষের।
এই গল্প সেই রুঢ় বাস্তবের, যেখানে সত্যি ও মিথ্যের যুদ্ধে 'সত্যি' হেরে যায় প্রতিনিয়ত। জয়ী হয় 'মিথ্যে'। যেমন সে বরাবর জিতে এসেছে, জিতছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো জিতবে। 'সত্যমেব জয়তে'-এর স্তোকবাক্য বইয়ের পাতায় ধুলো খাবে ঠিকই, কিন্তু আমাদের অলক্ষেই হয়তো বা দুনিয়ার নতুন স্লোগান বাস্তবায়িত হবে ক্ষমতা দখলের যুদ্ধে---- মিথ্যের জয়!
"মিথ্যামেব জয়তে"
দ্য ক্যাফে টেবিল এর অভিষেকদা ও অরিজিৎদাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। একটুও বিনয় না করে বলি -- ৯০ শতাংশ চরিত্র যে লেখায় বাস্তব, তাদের উপস্থিতিও আছে স্বনামে, কিন্তু লেখাটা নন ফিকশন বলেও দাগানো যাবে না, তার ওপর বইয়ের দৈর্ঘ্য এক লক্ষ শব্দেরও বেশি, প্রয়োজনে ছবির ব্যবহারও করা হয়েছে -- বর্তমান পরিস্থিতিতে এতটা ঝুঁকি নিয়ে এরকম বই করা অত সহজ নয়। অভিষেকদার পাশাপাশি ক্যাফে টেবিলের অন্যান্য সদস্যরাও আন্তরিক আগ্রহ নিয়ে খেটেছেন। এত বড় লেখা নিখুঁতভাবে দাঁড় করানো একা লেখকের কাজ নয়, ফাঁকফোকর থেকেই যায়, বিশেষ করে আমার মতো আনাড়ির কলমের পক্ষে। ঋষাকে অফুরন্ত ধন্যবাদ। ধন্যবাদ রইল প্রচ্ছদশিল্পী স্বর্নাভদার উদ্দেশেও যিনি অসাধারণ দক্ষতায় বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। সবশেষে ধন্যবাদ সেই সমস্ত পাঠককে যারা গত বছর অচেনা এক লেখকের বই তুলে নিয়েছিলেন অনেক বইয়ের ভিড়ে, আশা করি সময় দিলে এই বইটাও পাঠককে খুব একটা হতাশ করবে না। এইটুকুই।