এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভ্রমণ :- রাজরাপ্পা 

    Bratin Das লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ আগস্ট ২০২১ | ১০৯৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)


  • অনেক দিন থেকেই বন্ধুবর সন্দীপ বলছে ব্রতীন ধানবাদটা ঘুরে যা। অবশেষে এক গ্রীষ্মের দিনে প্ল্যান করলাম।
    সকালে উঠতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখি তখনও ইন্টারসিটি হাওড়া ধানবাদ এক্সপ্রেস দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। চটপট নিজের কামরায় উঠে পরা গেল। পুরো ট্রেনটাই বাতানুকূল। আর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও বেশ ভালো। ক্ষণেক্ষণে চা, কফি, স্যান্ডুইচ, অমলেট এই সব আসতেই থাকছে। আর ইয়ে বলতে নেই খাবার দেখলেই টেনিদার ভাষার আমি একটু "মেফিস্টোফিলিস" "মেফিস্টোফিলিস" হয়ে যাই। ট্রেন মোটামুটি ঠিক সময়েই গন্তব্যে পৌঁছলো। বন্ধুবর সন্দীপ প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিল। ওর গাড়ি করে সোজা আইএসএম এর ক্যাম্পাস। সন্দীপ আইএসএম এ অধ্যাপনার সাথে যুক্ত। ধোকলা আর আম পোড়ার সরবত দিয়ে ওয়েলকাম জানাল সৌমিতা। বেশ খানিক্ষণ গল্পগুজব হল। আইএসআই ছাড়ার পরে সন্দীপের সাথে এই প্রথম দেখা। নয় নয় করে মাঝে পার হয়ে গেছে প্রায় পনেরোটা বছর। সৌমিতা তাড়া লাগালো স্নানে যাবার জন্যে। দুপুরে রাজকীয় ভোজ :- ভাত, ডাল, শুক্তো, আলুভাজা, পার্শে মাছ, মাটন, চাটনি, দই। পথশ্রমে এবং প্রচুর আহারে যারপরনাই ক্লান্ত বোধ করছিলাম। তাই একটু গড়িয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙলো সন্দীপের ডাকে। চা হয়ে গেছে। চা খেয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম মাইথনের উদ্দেশ্যে।

    ধানবাদ থেকে মাইথন ৪৮ কিমি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছানো গেল সেই গন্তব্যে। ৬০,০০০ কিলোওয়াট ইলেক্ট্রিক পাওয়ার উৎপাদনক্ষম এই বাঁধ। প্রধাণত বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বরাকর নদীর ওপর নির্মিত এই বাঁধটি ১৫,৭১২ ফুট (৪,৭৮৯ মিটার) দীর্ঘ ও ১৬৫ ফুট (৫০ মিটার) উচ্চ। এখানে একটি ভূগর্ভস্থ পাওয়ার স্টেশন রয়েছে, যা সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রথম ভূগর্ভস্থ পাওয়ার স্টেশন। এইসব শুকনো তথ্য বাদ দিয়ে আমার বরং মনে হচ্ছিল, “যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে...."। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় বড় মায়াবী সেই বিশাল জলাশয়। ছোট ছোট কিছু দ্বীপ চোখে এল এখানে ওখানে। দিনের বেলায় সেখানে প্রমোদ ভ্রমনের ব্যবস্থা আছে। মনপ্রাণ স্নিগ্ধ করা এই পরিবেশে ফটো তোলা হল। এবারে ফেরার পালা। ফেরার পথে আমি ধরলাম আমার প্রিয় গান "তাই তোমার আনন্দ আমার পর..."। সৌমিতা শোনাল "আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান"।

    ফেরার পথে সন্দীপ নিয়ে গেল ওর কলেজ দেখাতে। "ইন্ডিয়ান স্কুল অফ মাইনস" স্থাপিত হয় ১৯২৬এ। বর্তমানে মোট ১৮টি বিভাগ। পড়াশুনা করে ৫০০০ এর বেশি ছাত্র ছাত্রী। ছেলেদের হোস্টেল গুলোর নাম বিভিন্ন রত্নের নামে যেমন ডায়মন্ড, সাফায়ার, টোপাজ ইত্যাদি। আর মেয়েদের হোস্টেলের নাম রুবি। ফিরে এসে ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ দেখতে দেখতে আড্ডা চললো। সেই আড্ডা প্রলম্বিত হল ডিনারের পরেও। শেষে রাত প্রায় ১৩:১৫ তে আমরা ক্ষান্ত দিলাম।

    পরের দিন ঘুম ভাঙল সন্দীপের ডাকে। আজকের গন্তব্য রাজরাপ্পা। গাড়ি এসে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি করেও নির্দিষ্ট সময়ে বেরোনো গেল না। খুব রুক্ষ ঝাড়খন্ডের নৈসর্গিক পরিবেশ মন টানছে। ব্যাগের মধ্যে পছন্দের গল্পের বই। গান, ইন্টারনেট কিন্তু সব ছাড়িয়ে চোখ চলে যাচ্ছে বাইরের দিকে, ছোট ছোট গ্রাম শান্তি মাখানো, বাড়ীর কর্তা, গিন্নী এবং অন্যান্যরা মিলে চাষ করছেন। অসহনীয় সেই গরমে সম্বল মাথায় এক ফালি ছোট্ট কাপড়। কারোর কারো বা মাথায় টুপি। প্রায় ঝলসে যাওয়া গাছের ছায়ায় ধুঁকছে মৃতপ্রায় এক কুকুর। ঘাস খাওয়ার জন্যে বেঁধে রাখা দুএকটা গরু দড়িটাকে এক বারে শেষ প্রান্ত অবধি টেনে নিয়ে সেই ঝলসনো রোদের তাপ থেকে বাঁচতে চাইছে।

    রাস্তা বেশ ভালো। আড়াই ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম রাজরাপ্পায়। ফেলুদার গল্প "ছিন্নমস্তার অভিশাপ" এ প্রথম শুনি রাজরাপ্পার নাম। রাজরাপ্পা এক হিন্দু তীর্থস্থান। দশ মহাবিদ্যার  অন্যতমা "ছিন্নমস্তা" রুপে দেবী এখানে পুজিতা। ভারতের অন্যতম ছিন্নমস্তার মন্দির। অন্যান্য ভক্তদের সাথে সাথে সাঁওতাল এবং অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় এখানে পুজো দিতে আসে। বৃহস্পতি ও শনিবারে এখানে ছাগ বলি দেওয়া হয়। আর অসংখ্য বলি দেওয়া হয় কালী পুজোর দিন। রক্তে সেদিন লাল হয়ে ওঠে ভৈরা নদীর জল। গড়ে দিনে ২৫০০-৩০০০ জন ভক্ত সমাগম হয় এখানে। বলাবাহুল্য আমি সেই অর্থে ভক্ত নই। কিন্তু ঘুরতে ভালোবাসি। ভালো লাগে এইসব মন্দিরের প্রাচীন গাঁথা, মন্দিরের গঠনশৈলী। বুঝতে চেষ্টা করি সেই সময়ের আর্থসামাজিক অবস্থান। মন্দিরের গঠনশৈলীতে তান্ত্রিক আর্কিটেক্চারের ছাপ পরিস্ফুট। তেমন ভিড় নেই। ড্রাইভার ছেলেটি এল আমাদের সাথে। একটা দোকানে গিয়ে জিনিসপত্র রেখে ভৈরবী বা ভৈরা নদীর ঠান্ডা জলে চোখ মুখ হাত পা ধুয়ে পুজোর প্রস্তুতি নেওয়া গেল। এখানে প্রধান প্রসাদ হল পেঁড়া। মন্দিরে মূল বিগ্রহ নেই। চুরি হয়ে গেছে। দায়িত্ব নিয়ে পুজো দিয়ে দিলেন পান্ডা গোছের একজন। ভক্ত না হলেও নিজেকে নাস্তিক বলার ধকও নেই। তাই পুজান্তে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বাইরে এলাম। মন্দিরের মাথায় বাংলায় লেখা "তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি... "


    বাইরে এক জায়গায় নারকেল ভাঙা হচ্ছে আর মূর্তির মাথায় ঢালা হচ্ছে। ছিন্নমস্তার মাপে বেশ কয়েকটি বিগ্রহ করা আছে। কিন্তু এত লাল সুতো জড়ানো হয়েছে তার ওপর যে সেগুলো কে চেনার জো নেই।


    বাইরে গিয়ে প্রফেশন্যাল ফটোগ্রাফার দিয়ে একটা ছবি তুললাম। ভৈরা নদীতে কিঞ্চিত নৌকাবিহার করলাম। একসময়ের প্রবল নদী যদিও এখন অনেকটাই ক্ষীণকায়া হয়ে গেছে, তবুও এক দিকে ছোট্ট এক ঝর্ণা একে অন্যরকম সৌন্দর্য্য দিয়েছে।


    এইবার ফেরার পালা। ঝকঝকে রাস্তায় খুব অল্প সময়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। মনে রয়ে গেল রাজরাপ্পায় অমলিন স্মৃতি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুমন | 2a01:4262:1ab:20::71 | ০৯ আগস্ট ২০২১ ১৪:১৯496601
  • এই শর্ট ভ্রমণকাহিনীগুলো এনজয় করছি

  • dc | 223.226.11.86 | ০৯ আগস্ট ২০২১ ১৫:৫৩496603
  • "শেষে রাত প্রায় ১৩:১৫ তে আমরা ক্ষান্ত দিলাম"


    এটা কি ​​​​​​​১ঃ১৫ ​​​​​​​হবে? 

  • অপু | 2409:4060:95:e2b5::184e:a1 | ০৯ আগস্ট ২০২১ ১৬:৩৯496604
  • হমম ডিসি। একদম ঠিক। রাত 1:15 :)))

  • অপু | 2409:4060:95:e2b5::184e:a1 | ০৯ আগস্ট ২০২১ ১৬:৪০496605
  • সুমন বাবু, অনেক ধন‍্যবাদ। :))

  • Prodip Kumar Bhattacharjee | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:০৫519062
  • বেশ ভালো  লেগেছে 
  • Bratin Das | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৪৪519087
  • প্রদীপ বাবু , অনেক ধন্যবাদ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন