এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বাঁকিহাটের ঢাকি -১

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৫৭৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বশিষ্ঠ নিমগাছটা থেকে একটা কচি ডাল ভাঙল দাঁতন করার জন্য। দাঁত আর কটাই বা আছে।
    ছিয়াত্তর বছর বয়েস হল। হাতে পায়ে তেমন বল নেই। শুধু ঢাকের দুটো কাঠি হাতে নিলে কি যেন ভর করে হাতে পায়ে।

    সাত পুরুষের ঢাকির পরিবার। তিন পুরুষ আগে তার কে যেন কলকাতায় রাজা নবকৃষ্ণের শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় ঢাকের বোল তুলতে যেত। তার নাম ছিল দুর্গাচরণ। সেই অষ্টমীপুজোর সকাল সন্ধেয় আরতির সময়ে দুর্গাচরণের ঢাকের বোলে রাজবাড়ির আনাচ কানাচ দুলতে থাকত ভাবের দোলায়। এইসব শোনা কথা অবিশ্যি। ভোরবেলায় সাদা সাদা শিউলি ফুলের মতো দুর্গাচরণের ঢাকের বোল ঝরে পড়ত রাজবাড়ির উঠোনময়। আশপাশের লোকজন ঘুম ভেঙে বিবশ হয়ে বসে থাকত যে যার ঘরে। হাওড়ার বাঁকিহাটের এই ঢাকিপাড়ায় এসব কথা বংশপরম্পরায় চলে আসছে। সবই শোনা কথা অবশ্য। তবে এই বশিষ্টর ঢাক এরা সবাই শুনেছে। সবাই এক বাক্যে মেনে নেয় যে বশিষ্টর কাঠিতে যাদু আছে। অন্তত বছর দশেক আগে পর্যন্ত ছিল। এখন ওর হাতে পায়ে কেমন যেন ঘুন ধরে গেছে। বয়সের ভারে হতে পারে, খাদ্যাভাবজনিত অপুষ্টির কারণেও হতে পারে। বশিষ্টর তিনটে ছেলে। তিনজনই ঢাক বাজায়, কিন্তু কেউই বাপের গুনের ছিটেফোঁটাও পায়নি। ওদের ঢাকের বোল কখনও শিরায় শিরায় আবেশ ছড়ায় না। আর পাঁচটা ঢাকি যেমন বাজায় তেমনি আর কি।

    তিরিশ বছর আগে পুজোর আগে কলকাতা থেকে এই গাঁয়ে লোক আসত বশিষ্টের কুঁড়েতে বায়না দিতে। এখন আর কেউ আসে না। শিয়ালদা স্টেশনের সামনে গিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এ গাঁয়ের যত ঢাকি। বশিষ্টের তিনটে ছেলে মাদল, বিকাশ আর সুনীলও ক বছর ধরে তাই করছে। বছরের অন্য সময়ে বাড়ির সামনে ক কাঠা জমিতে সব্জির চাষ করে তিনজনে মিলে। নিজেরাই বেগুন ঢ্যাঁড়স ঝিঙে তুলে নিজেরাই বাজারে গিয়ে বসে। কুমড়োর মাচা লাগিয়েছিল বশিষ্ট অনেক দিন আগে। কুমড়ো ফলে মাচা আলো হয়ে থাকে। মাদল বিকাশেরা কুমড়োও তোলে কদিন পরে পরে।
    কিন্তু সব এক করেও কটা টাকাই বা রোজগার হয় এই ছ সাত কাঠা জমি থেকে। তিনজনেরই পুত্র কলত্র আছে। বড্ড টানাটানির সংসার। তিনজনে তিনটে মাটির ঘর তুলে নিতে পেরেছিল তাই রক্ষে।
    বশিষ্টকে এখন আর কেউ ডাকে না। রোজগার কিছু নেই। সেও এই জমির ওপর বসে খাচ্ছে। মানে, শুধু খাওয়াটুকুই জোটে আর কিছু নয়। ঠিকমত ডাক্তার বদ্যি করতে পারলে হয়ত হাত দুটোয় আবার বল ফিরে পেত। কিন্তু অত খরচাপাতি করার ক্ষমতা কোথায়। খাওয়াদাওয়াই তেমন জোটে না.....।সে তাই চোখ কান বুজে থাকে। আর তো কটা দিন । কোনরকমে কেটে গেলেই হল। মাঝে মাঝে বৌটার জন্যে চিন্তা হয়। ভাবে, সে চোখ বুজলে কে দেখবে বাসন্তীকে। ছেলেগুলো তো তেমন কাজের না। কেমন ঢিলেঢালা গোছের। ওসব ঝক্কি সামলানো কি তাদের কাজ। বশিষ্ট তাই চিন্তায় থাকে। দাওয়ায় বসে বিড়ি খেতে খেতে নানা কথা ভাবে। বাসন্তীর তলপেটে একটা ব্যথা ওঠে মাঝে মাঝে। বামুনপাড়ার ওদিকে হারাণ ভটচাজ্যির কাছ থেকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এনে খাওয়ায় মাঝে মাঝে। তাতে ব্যথাটা একটু কম পড়ে বলে মনে হয়। যদিও হারাণ ডাক্তার প্রতিবারই বলে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে হাসপাতালের আউটডোরে দেখাতে, আগাগোড়া সব রকম পরীক্ষা টরিক্ষা করাতে। এসব ব্যথা বেদনার রোগে আলিস্যি করা ঠিক না। কখন কি হয়ে যায়। কখন কি হয়ে যায় .... ভাবলেই বশিষ্টের বুক ভয়ে কেঁপে ওঠে। শরীর যখন ভাল থাকে বাসন্তী দিন রাত খাটে। এতগুলো লোকের সংসার একাই টানে। কাউকে কোন দিকে তাকাতে হয় না, নড়ে বসতে হয় না ছেলের বৌয়েদের। শরীর জুতের থাকলে বাসন্তী একেবারে দশভূজা। একাই একশ। কিন্তু কলকাতার হাসপাতালে এখান থেকে রুগী নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর ঝকমারির কথা ভাবলে বশিষ্টের বুদ্ধিসুদ্ধি কেমন ঘোঁট পাকিয়ে যায়। সে উদাস চোখে সামনের পুকুরটার দিকে তাকিয়ে বিড়ি টানতে থাকে।

    সুকল্যান চক্রবর্তী সম্পন্ন ঘরের ছেলে। তার বাবা মোহিত চক্রবর্তী হাওড়া কোর্টের উকিল। নেহাৎ গাঁয়ের টান কাটাতে পারে না তাই বাঁকিহাটে পড়ে আছে। মোহিত উকিল বশিষ্টের ঢাক শুনে আসছে সেই ছোটবেলা থেকে। তার গাঁয়ের মায়ার টানে পুজোর কদিন বশিষ্টর বুক ছলাৎ ছলাৎ করা ঢাকের টান মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। ছেলে সুকল্যান ঢাক বাজাতে পারে না বটে কিন্তু যোগ্য ঢাকির ভীষণ তারিফদার সে। বশিষ্টের ঢাকের বড় ভক্ত ছিল সুকল্যান। বাজারে যাওয়ার রাস্তায় সেদিন বাজারের রাস্তায় দেখা হয়ে গেল বশিষ্টের সঙ্গে।
    বলল, ‘ আরে .... বশিষ্ট কাকা চললে কোথায় ..... কি এত চিন্তা করছ? ’
    — ‘ আর কি বলব .... চিন্তার কি আর শেষ আছে বাপ? কতরকম যে চিন্তা সে আর কি বলব তোমারে .... ’
    — ‘ এবারে পুজোয় তোমার ঢাক শুনতে পাব তো ? ’
    — ‘ হায় হায় .... কি যে বল ! আমার কি আর ঢাক চাগাবার বল আছে শরীরে ? দুটো হাতই যে চলে না ঠি কমতো। ’
    — ‘ না না না না ..... ওসব কোন কাজের কথা নয়। ঢাক তোমাকে বাজাতেই হবে। বাঁকিহাট আছে আর তোমার ঢাকের বোল নেই এটা মেনে নিতে পারি না। বাবা তো শুধু তোমার ঢাকের টানেই বাঁকিহাটে থেকে গেল। লোকে আড়ালে মুখ টিপে হাসে। সব জানি। বলে .... মাথামোটা । এত টাকা উপায় করে কেউ এই অজ গাঁয়ে পড়ে থাকে ! ’
    বশিষ্ট ব্যথা মাখা হাসি হাসে মাটির দিকে তাকিয়ে।

    ...........       ..........    

    শিশিরবিন্দু মল্লিকের মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। কনসার্টের দিন এগিয়ে আসছে। তার পঁচিশ বছরের কেরিয়ারে এমন সমস্যায় সে কখনও পরে নি। সে নিজে বাজাতে পারে না এমন কোনো তালবাদ্য নেই। এমনকি খোলও ভাল বাজায়। তাছাড়া ‘কি’ এবং ‘রিড’ ইন্সট্রুমেন্ট যেমন পিয়ানো, অ্যাকোর্ডিয়ান, হারমোনিয়াম এইসব বাজানোতেও সে পারদর্শী।
    শিশিরবিন্দু সিম্ফনি গ্রুপে আছে প্রায় বছর দশেক। মানে, এই গ্রুপের শুরু থেকেই। গান বাজনা করতে করতে সে খেয়ালই করে নি তার পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেল। সুর তালের লহরে পড়াশোনায় ফাঁক পড়ে গেল। মাধ্যমিকের গাঁটটা কোনরকমে পেরিয়েছিল। বাড়ির আর্থিক অবস্থা অতি সাধারণ। সিম্ফনিতে ইন্সট্রুমেন্ট বাজিয়ে যে কটা টাকা রোজগার করে সেটাই তার একমাত্র রোজগার।
    কিন্তু সেটুকুও বোধহয় কপালে সইল না। গ্রুপের মধ্যে শিশিরের মধ্যমনি হয়ে ওঠাটা তীর্থঙ্করের মোটেই সহ্য হচ্ছিল না। তীর্থঙ্কর পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে। ইলেকট্রনিক গুডসের তিনটে বড় শো রুম আছে কলকাতায়। তীর্থঙ্করই বলতে গেলে সিম্ফনির মালিক। শখ করে এ লাইনে এসেছে। সে নিজে একজন সিন্থেসাইজার প্লেয়ার। মোটামুটি ভালই বাজায়। তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু মালিকানা সংক্রান্ত কর্ত্তৃত্বের ব্যাপারে অতি সচেতন। দলের আর সব শিল্পীকে সে তার বেতনভূক কর্মচারি মনে করে। তার সিদ্ধান্তের ওপর কেউ কোন মত প্রকাশ করবে এটা তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। এরকম অবস্থায় শিশির যে তার জন্মগত প্রতিভার কারণে পরোক্ষভাবে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে এটা তার পক্ষে হজম করা মুশ্কিল হয়ে গেল।
    সেদিন তীর্থঙ্কর গ্রুপের সবার সামনে বলে বসল, ‘ তুই কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস শিশির। কনসার্টে সানাই ঢোকাচ্ছিস। কোথা থেকে কাকে একটা ধরে এনেছিস। ’
    — ‘ আরে কি বলছিস তুই.... সাজ্জাদের বাজানো শুনলে পাগল হয়ে যাবি। ’, শিশিরবিন্দু জোরগলায় বলে।
    — ‘ আরে দূর দূর .... সুস্থ লোক পাগল হতে যাব কেন ? যত ফালতু বেজাতের লোক এনে ঢোকাচ্ছে .... মিউজিক জিনিসটা যেন অতই সোজা। সব জিনিস সবার জন্য নয় ..... এসব তোর মাথায় ঢুকবে না। আমি তোকে পরিষ্কার বলে দিচ্ছি আমার গ্রুপে এসব চলবে না। যদি না পোষায় তুই গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যা। ওইসব আলবাল লোকজন নিয়ে নিজে গ্রুপ তৈরি করগে যা। দেখব কেরামতি। বুঝতে পারবি কত ধানে কত চাল ..... ’
    তীর্থঙ্করের কথাগুলো শুনে সে রেগে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় থাকল না। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। সে কিছুতেই বুঝতে পারল না তার ওপর তীর্থঙ্করের এত রাগ জমা হল কি কারণে। আসলে, সে তীর্থঙ্করের মনে তিলে তিলে পুঞ্জীভূত ঈর্ষার আগ্নেয়গিরির কোন আন্দাজ পেল না। তার মতো একজন অভাগা যে কারও ঈর্ষার লক্ষ্য হতে পারে সেটা তার কল্পনাতেও আসে না।
    শিশির কোন কথা বলল না। এরপর তার কি বলা উচিৎ সেটা তার নরম স্পর্শকাতর শিল্পী মন বুঝতে পারল না। সে নরম গলায় শুধু বলল, ‘ ঠিক আছে .... আসছি .... ’, বলে আস্তে আস্তে আর কোন কথা না বলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
    রাস্তায় বেরিয়ে এক জায়গায় ছায়ায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। তার কোমল শিল্পীসত্ত্বা ভেঙে খাড়া দাঁড়িয়ে উঠল এক সংকল্পকঠিন মূর্ত্তি।
    খড়দার বাস ধরল শিশির। সাজ্জাদের বাড়ি সাঁকরাইলের ভিতরদিকে বাঁকিহাট গ্রামে হলেও সে খড়দার একটা ঘরে ভাড়া থাকে। বারাকপুরে না টিটাগড়ে চটকলে কাজ করে। ঘরটায় তার সঙ্গে আর একজন থাকে। তাতেই মাথাপিছু দেড় হাজার টাকা করে পড়ে যায়। কোন আলাদা রান্নাঘর নেই। বাথরুম টাথরুম সব অন্যান্য ভাড়াটেদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়। সাজ্জাদ ভোরবেলায় আর রাত্তিরবেলায় সামনের উঠোনে পাতা একটা চৌকিতে বসে সানাইয়ে ফুঁ দেয়। কেউ কোন আপত্তি করে না। দু একজন বাদে বস্তির সকলেই বেহাগ রাগের হাওয়ায় দোল খেতে খেতে ঘুমোতে যায়, আবার ভোরবেলায় চোখ মেলে ভৈরবীর তানে।

    আজ বুধবার। সাজ্জাদের আজ ছুটির দিন। রবিবারের শিফটে কাজ পড়বে। খুঁজে খুঁজে হয়রাণ হয়ে শেষ পর্যন্ত শিশির যখন সাজ্জাদের আস্তানা বার করল তখন প্রায় বেলা দুটো বাজে।
    — ‘ দাদা .... আপনি এখানে.... কি আশ্চর্য ! ’
    — ‘ কেন আশ্চর্য হবার কি হল, আসতে পারি না ?’
    — ‘ না .... তা না , আমার মতো গরীব মানুষের বাড়ি .... ’
    — ‘ হ্যা: হ্যা: .... ভাল বলেছিস .... যাকগে, কিছু কাজের কথা ছিল। ’
    — ‘ কি রকম .... কিরকম দাদা ? ’
    — ‘ আমি ভাবছি একটা নতুন গ্রুপ করব। তাতে তোকে থাকার জন্যে রিকোয়েস্ট করছি’, শিশির বলে।
    — ‘ কি যে বল .... আমিও একটা মানুষ .... আমাকে আবার রিকোয়েস্ট .... ’
    কথাটা বোধহয় ঠিক শিশিরের কানে গেল না। সে আনমনে কি একটা চিন্তা করছিল। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ কিন্তু শুধু আমরা দুজনে কি অর্কেস্ট্রেশান কম্পোজ করব ! আর .... আমাদের কাছে তো কোন ইন্সট্রুমেন্ট নেই। তোর তো তবু একটা সানাই আছে। আমি তো চিরকাল ভাড়ার বাজনাই বাজিয়ে এলাম। কি করা যায় তাই ভাবছি।’ শিশির দু আঙুল দিয়ে কপাল টিপে মাথা নীচু করে ভাবতে লাগল।
    সাজ্জাদ বলল, ‘ আমি একটা কথা বলব দাদা ? ’
    — ‘ হ্যাঁ বল না .... ’
    — ‘ আমাদের বাঁকিহাটে একজন ঢাকি আছে। দারুন হাত। আমার সঙ্গে একদিন গিয়ে শুনে দেখতে পারেন। এখন অবশ্য অনেক বয়েস হয়েছে, তবে মরা হাতি লাখ টাকা। দেখতে পারেন .... ’।
    শিশিরবিন্দু তেমন আগ্রহ বোধ করল না ব্যাপারটায়। আবার সাজ্জাদের কথা উড়িয়েও দিল না। বলল, ‘ আচ্ছা ঠিক আছে .... প্রোগ্রাম কর একদিন। গিয়ে দেখা যাক। ’

    গৌরীশঙ্কর চৌধুরী একটা লাল গামছা পরে বসে আছেন খালি গায়ে। গরমের দিনে তিনি এমনিই থাকেন। তাতে কে কি মনে করল তার কিছু যায় আসে না। তার গিন্নী এই বিদঘুটে অভ্যেস ছাড়াবার অনেক চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। গৌরবর্ণ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা গৌরীশঙ্করবাবুর । বসিরহাটের রাঙা খাপি পাঁচহাতি গামছায় মন্দ লাগে না কিন্তু। কিন্তু ওই ....... বাড়িতে লোকজন এলে কি ভাববে, বাড়ির লোকে অস্বস্তিতে থাকে।
    আজ সকাল থেকে গৌরীবাবুর মেজাজ ভাল নেই। সকালে জলখাবারে ময়দার লুচি হয়নি। আটার লুচি হয়েছে। ডাক্তারবাবু কি একটা কারণে তাকে ময়দা খেতে বারণ করেছে। গৌরীবাবুর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তার গিন্নী অক্ষরে অক্ষরে ডাক্তারবাবুর কথা মেনে চলেন সবসময়ে। কিন্তু আটার লুচি গৌরীশঙ্করবাবুর মোটেই পছন্দের জিনিস নয়। কিন্তু কি করা যাবে। বেজার মুখে তিনি তাই খেতে লাগলেন। খান চারেক খেয়ে প্লেট সরিয়ে রাখলেন। বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে তোয়ালেটা হাতে নিয়েছেন এমন সময় তারসানাই বেজে উঠল রাস্তায়। জয়জয়ন্তীর ধুনে ছড় টানতে টানতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিরিশ অ্যাভিনিউয়ের দিকে চলেছে একটা লোক। রাঙা গামছা পরা গৌরীশঙ্কর ময়দার লুচির শোক ভুলে দ্রুতপায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। নীল আকাশ শরতের রূপোলী রোদ্দুর ঝরাচ্ছে। রামকান্ত বোস স্ট্রীটের আলো ভেঙে ভেঙে ওদিকে চলে যাচ্ছে তারসানাইওয়ালা। গৌরীবাবু উদাস চোখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। তার মন কেমন করা শুরু হল। সানাইয়ের সুরে, ঢাকের বোলে তার সব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। আচ্ছা আচ্ছা ওস্তাদের গানবাজনা তিনি শুনেছেন নানা কনফারেন্সে সেই ছোটবেলা থেকে এই পঁচাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু ওসব ওস্তাদেরা কখনও তার মনের বাগানে কোন সুদূর স্মৃতিভেজা শিউলি ফুল ঝরাতে পারে নি। তার অনেকদিনের ইচ্ছে এমন কোন বাজনদার খুঁজে পাওয়া যে তার শৈশবের সজল হাওয়া বইয়ে দেবে সারা চরাচর জুড়ে। গৌরীশঙ্কর চৌধুরীর বাড়িতে বংশপরম্পরায় একশ বছরের ওপর দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। তার খুব ইচ্ছে কোন এক যাদুঢাকি এসে ঢাক বাজিয়ে যাক তার বাড়ির পুজোয়। সঙ্গে বাজুক পিলুর তানে বাঁধা সানাই। তার স্বপ্ন কি আর পূর্ণ হবে !

    মোহিত উকিলের ছেলে সুকল্যান চক্রবর্তী এল সকালবেলায়। কি সব কাগজপত্তর পাঠিয়েছে তার বাবা।গৌরীবাবু গামছা ছেড়ে একটা নতুন লুঙ্গি পরে বাইরের ঘরে এলেন। সুকল্যান মাঝে মাঝেই আসে। হাওড়া কোর্টে তার বাবা গৌরীবাবুর হয়ে দুটো মামলা লড়ছে। হাতীবাগান আর বেনিয়াটোলার দুটো বাড়ি নিয়ে শরিকি মামলা চলছে। মোহিত চক্রবর্তী বাঁকিহাট না কোথায় যেন থাকে। কোন এক ঢাকির টানে নাকি সেখানে পড়ে আছে। যত পাগল ছাগলের কারবার। গৌরীশঙ্করবাবুর নিজেকেও পাগল মনে হয়। এসব মামলা মোকদ্দমা আজকাল একদম ভাল লাগে না। পরিবারের চাপে বিষয়সম্পত্তির লড়াইয়ে লটকে আছেন। তার মন অন্য কোথাও পড়ে থাকে। কোথায় যে পড়ে থাকে তিনি নিজেই বোঝেন না।
    সুকল্যান বলল, ‘ চব্বিশ তারিখে হিয়ারিং-এর ডেট পড়েছে জেঠু। বাবা আপনাকে এগারোটার মধ্যে কোর্টে পৌঁছে যেতে বলেছে। বাবা বার অ্যাসোসিয়েশান রুমে থাকবে।’
    — ‘ আ..চ্ছা, ঠিক আছে। পুজোর আর কদিন বাকি আছে যেন .....’
    — ‘ ওই..... কুড়ি একুশদিন ’
    — ‘অ ... এখনও একটা ভাল ঢাকি পেলাম না। কি যে হবে ....’
    গৌরীশঙ্করবাবু বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র লোক যে এরকম একটা অদ্ভুত সমস্যায় বিব্রত থাকতে পারে। লোকে পাগল বলে কি আর সাধে !
    সুকল্যান বলল, ‘ আমাদের বাঁকিহাটে একজন আছে .... সেই যে আপনাকে বলেছিলাম।যদি বলেন তো আনতে পারি।’
    গৌরীশঙ্করবাবু তেমন উৎসাহ পেলেন না। বললেন, ‘ তার তো শুনেছি অনেক বয়েস হয়ে গেছে। তাছাড়া শরীরও অসুস্থ । সে কি আর ....’
    — ‘ ওটা নিয়ে চিন্তা করবেন না জেঠু মানুষের শরীরের ক্ষয় হতে পারে, প্রতিভার ক্ষয় হয় না । ’
    — ‘ হুমম্ ..... দেখ কি করতে পার .... ’, গৌরীশঙ্করবাবু অন্যমনস্কভাবে মামলার কাগজপত্রে চোখ বোলাতে লাগলেন। ঢাকির ব্যাপারে তাকে বিশেষ আশাবাদী মনে হল না।

    সাজ্জাদের সঙ্গে শিশিরবিন্দু বাঁকিহাটে এসে হাজির হল সন্ধেবেলায়। ঠিক হল আজ রাতটা ওরা এখানে থেকে যাবে।পরদিন সকাল ছটার সময় দুজনে বশিষ্টের বাড়ি গিয়ে দেখল বশিষ্ট ক্ষেতের বেড়ার ধারে বসে আগাছা নিড়োচ্ছে। ওর চারপাশে মেলা চড়ুই আর শালিখ স্বচ্ছন্দে ঘুরে ফিরে ওড়াউড়ি করছে।
    বশিষ্ট ঘাড় ঘুরিয়ে সাজ্জাদকে দেখে একগাল হেসে বলল, ‘ আরে সাজ্জাদ .... তুই হঠাৎ ! ’
    — ‘ হ্যাঁ... এই এলাম চাচা ... তোমার ঢাক শুনতে ’
    — ‘ মানে ? ’
    বলে শিশিরের দিকে তাকাল। সেটা লক্ষ্য করে সাজ্জাদ বলল, ‘ আসলে .... বুঝলে চাচা ইনিই তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। কাল রাত্তিরে ট্রেন ধরার অসুবিধে ছিল তাই রাতে কষ্ট করে আমাদের কুঁড়েতে থেকে গেছেন।’
    বশিষ্ট হাঁ করে তাকিয়ে থাকল সাজ্জাদের মুখের দিকে ।
    — ‘ আ..মার সঙ্গে দেখা ! ..... কি জন্যে ? ’
    — ‘ উনি একটা বাজনার দল করতে চান। উনি চান তুমি তাতে ঢাক বাজাবে। দল দাঁড়িয়ে গেলে ভাল পয়সা আসবে বুঝলে কিনা ..... আমাকেও নেবে বলেছে ..... ’
    — ‘ ও বাবা .... তাই নাকি ! তা বাজনার দলে ঢাকের বাজনা শুনবেটা কে ? তাছাড়া আমি কি এখন বাজাতে পারি নাকি ? বাসন্তীর পেটের ব্যথাটা আবার বড্ড বেড়েছে ..... কি যে করি .... মাঝরাতে উঠে গরম তেল মালিশ করলাম পেটে ..... তাতে একটু কম পড়ল ব্যথাটা .... কিন্তু ....’
    শিশির আর থাকতে না পেরে বলল, ‘ কি হয়েছে .... মানে কার ব্যথা ..... ’
    — ‘ ওই আমার পরিবারের .... মহা মুশ্কিলে পড়েছি । তেমন চিকিচ্ছেও হচ্ছে না .....’
    বশিষ্ট দাঁড়িয়ে উঠল।
    শিশিরবিন্দু নাড়া খেয়ে যায়।
    — ‘ সেকি ? সেকি কথা ..... চিকিৎসা কেন হবে না ? আজই কলকাতায় নিয়ে চলুন। হাসপাতালে দেখাতে হবে। ’
    বশিষ্ট মৃদুস্বরে বলে , ‘ তা ... হলে তো ভালই হয় .... ’।
    সাজ্জাদ অকৃত্রিম সমবেদনায় বলল, ‘ এসব কথা তো কোনদিন বলনি চাচা .... না না আর দেরি করা যাবে না। ’
    এইসব গন্ডগোলের মধ্যে বশিষ্টের ঢাক বাজাবার প্রস্তাব আপাতত চাপা পড়ে গেল।
    কিন্তু অভাগা যেথায় যায় সাগর শুকায়ে যায়। বাড়ি থেকে সাঁকরাইল রেলস্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার জন্য কোন ভ্যানরিক্শা পাওয়া গেল না। কাল সন্ধেবেলা ওদের ইউনিয়নের এক নেতা কার হাতে যেন গুলিবিদ্ধ মারা গেছে। ফলে আজ বাঁকিহাট এলাকায় সমস্ত ভ্যানরিক্শা বন্ধ।
    সাজ্জাদ বলল, ‘ শিশিরদা, চলুন আপনাকে সাইকেলে করে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।’
    শিশির বলল, ‘ না, তা হয় না। আমি এদের এই অবস্থায় ফেলে চলে যেতে পারি না। কাল সকালে এদের নিয়েই কলকাতায় যাব। ’

    বশিষ্টর আর কলকাতার হাসপাতালে যাওয়ার দরকার হল না। সেদিন সন্ধে ঠিক ছটার সময়ে পেটে পুষে রাখা টিউমার ‘বার্স্ট’ করে বশিষ্ট বাউড়ির বউ বাসন্তী বাউড়ি ‘মরে গেল’ আচমকা।
    শিশির কালো মেঘে ছাওয়া জলদগম্ভীর মন নিয়ে বশিষ্ট ঢাকির ঢাক না শুনেই কলকাতায় ফিরে এল।

    ...........       .......... 

    আজ দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন। গৌরীশঙ্কর চৌধুরীর বাড়ির মস্ত উঠোনে একচালা কাঠামোয় ডাকের সাজের প্রতিমা বসেছে। এ বাড়ির পুজো এককালে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর সঙ্গে পাল্লা দিত। ধূপ ধুনোর সৌরভে ভরে আছে সারা অঙ্গন। গৌরীশঙ্করবাবু রাঙা গামছা ছেড়ে একটা কোরা ধুতি আর নতুন একটা গেরুয়া ফতুয়া পরে বসে আছেন দোতলার ঘরে। এই পুজোর দিনগুলোর সুরভিত আবেশের মধ্যে নিরালায় বসে বসে পুরনো দিনগুলোর স্মৃতিতে ডুবে যেতে ভাল লাগে তার। গভীর অতল এক মন কেমন করা আবেশে ডুবে বসে ছিলেন তিনি। কত কথা মনে পড়ছিল তার। বাবা মার কথা, ঠাকুর্দা ঠাকুরমার কথা, জ্যাঠামশাই জ্যাঠাইমার কথা, ঠাকুর গড়ার শিল্পী ননী পালের কথা, পুজোর সময় প্রতিবার ঢাক বাজাতে আসা প্রমোদ ঢাকি আর তার দুই সঙ্গীর কথা। এ জন্মের মতো চলে গেছে সে দিনগুলো। আর কখনও ফিরে আসবে না সেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া সুগন্ধের মতো সেই মনোরম সময়। প্রবল স্মৃতিমেদুরতার সজল হাওয়ায় তার চোখ ছলছল করতে লাগল।

    দিনগুলো সব কোথায় চলে গেল ..... আর ফিরবে না .... ফিরবে না ..... ফিরবে না ....

    ঠিক এই সময়ে নীচের উঠোনে ছিয়াত্তর বছরের সদ্য পত্নীবিয়োগে বিপন্ন দুর্বলদেহ বশিষ্ট ঢাকি তেহাই আড়ায় ঢাকে কাঠি মারল। গুড় গুড় গুড়...... গুড়াক গুড়াক..... ঝাকক্..... । বোলের তিনটে চক্কর মেরে এক লহমায় সমে ফিরল। বশিষ্টর তিনটে ছেলে চতুর্থ চক্করে বাপের কাঠিতে কাঠি মেলাতে শুরু করল .....
    দোতলার ঘরে বসে থাকা গৌরীশঙ্করবাবুর বুকের রক্ত চলকে উঠল। তিনি হুড়মুড় করে নীচে উঠোনে নেমে এলেন। উঠোনে বহু লোকজন আত্মীয়স্বজনের ভিড়। একচালার একপাশে চারটে ঢাকি ঢাক বাজাচ্ছে। তার মধ্যে একটা নুয়ে পড়া অথর্ব বুড়ো। চোখ বুজে মাথা নীচু করে মাটিতে দাঁড় করানো ঢাকে কাঠি মারছে। ঢাক কাঁধে নেবার মতো বল বোধহয় শরীরে নেই। কাঠির বোলগুলো ঢাকের চামড়ায় না, গৌরীবাবুর হৃদপিন্ডে গিয়ে আছড়ে পড়তে লাগল। তার মনে হতে লাগল এই বাড়ির প্রতিটি ইঁট পাথর যেন বহুযুগের ঘুম থেকে জেগে কান পেতে উঠে বসল। তিনি ঘোর লাগা চোখে মেঘমেদুর দৃষ্টিতে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন এক বুড়ো ঢাকির দুহাতের দুটো কাঠির দিকে। শরতের ভোরে শিশির ভেজা শিউলি ফুল অবিশ্রান্ত ঝরে যেতে লাগল গৌরীবাবুর চোখের সামনে।
    মোহিত উকিলের ছেলে সুকল্যান গৌরীশঙ্কর চৌধুরীর পাশে এসে দাঁড়াল নি:শব্দে। তার মনে হল তার চেষ্টাটা সার্থক হয়েছে। ভাবল, বশিষ্ট শুধু বাঁকিহাটের নয়, তার মুখও উজ্জ্বল করল।
    সারা পরিপার্শ্ব নিতল এক কম্পনে ভরিয়ে রেখে একসময়ে বশিষ্টর ঢাক নীরব হল। গৌরীবাবু দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে আবেগের উত্তাপমাখা দুহাত দিয়ে বশিষ্টর দুহাত চেপে ধরলেন। সুকল্যান ভাবল, বশিষ্ট শুধু বাঁকিহাটের নয়, তার মুখও উজ্জ্বল করল।
    ঘটনাক্রমে সাজ্জাদ ওখানে চুপিচুপি এসে হাজির হয়েছিল বশিষ্টর পিছু পিছু। সে এক পাশে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে কান্ডকারখানা দেখছিল। সে এবার ঝোলা থেকে তার সানাইটা বার করে ফুঁ দিল। ঊষার আকাশ চোঁয়ানো ভৈরবীর মনোরম ঢেউ সহসা শুভ্র বকপাঁতির মতো ভেসে বেড়াতে লাগল অমল বাতাসে।
    বশিষ্টর দুহাত বাক্যহারা গৌরীশঙ্কর চৌধুরীর দুহাতে আটকেই রইল। তিনি নির্নিমেষে সাজ্জাদ আর বশিষ্টর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
    কি জানি কি কারণে অথর্ব বশিষ্টর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল তার দু গাল বেয়ে।

    ............ 

    ট্রমবোন, স্যাক্সোফোন, চার রকমের ড্রাম, পাঁচরকম পার্কাশান , স্প্যানিশ গীটার ..... সে এক সুরেলা হৈ চৈ। কনসার্ট শোনা তো পরের কথা শুধু ইন্সট্রুমেন্ট দেখলে তাক লেগে যাবে।
    অল বেঙ্গল ইন্সট্রুমেন্টাল কনসার্ট কনটেস্ট। সব বাঘা বাঘা আলোকোজ্জ্বল গ্রুপ রবীন্দ্রসদনের বাইরে ছড়ানো সামিয়ানার নীচে। পনেরটা গ্রুপ স্টেজে ওঠার আগে নিজেদের মধ্যে নিমগ্ন রিহার্সালে ব্যস্ত। সুরের মেলা। এক সুরের সঙ্গে আর এক সুর মিলে মিশে যাচ্ছে। রবীন্দ্রসদন চত্বর এখন ভরভূর নানা বাজনার ধ্বনি মূর্ছনায়।
    শিশিরবিন্দু বশিষ্ট, তার তিন ছেলে আর সাজ্জাদকে নিয়ে সামিয়ানার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বশিষ্ট নিয়ে এসেছে তার ঢাক, সাজ্জাদের ঝোলায় আছে সানাই আর শিশির নিয়ে এসেছে একটা মাউথ অর্গ্যান। এটা তার নিজস্ব। ভাড়া করা নয়। অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে ওটা কিনেছিল পার্ক সার্কাস থেকে। ব্যস্ ... এই । আর কিছু নেই। শিশির তাদের গ্রুপের নাম রেখেছে ‘বশিষ্ট’।
    শিশির দেখতে পেল দূরে .... ওই ওপাশে , সামিয়ানার একধারে সিম্ফনির লোকজন হাজির হয়েছে। তীর্থঙ্কর সেনকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। ব্যাপক ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে এসেছে। নানা তদারকিতে ভীষণ ব্যস্ত। শিশিরের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সে বশিষ্ট আর সাজ্জাদের দুটো কাঁধ খামচে ধরল। ওদের চোখে গনগনে চোখ রেখে বলল, ‘ আজ যেন শুধু আমাদের দিন হয় আর সবাইকে ঝড়ে উড়িয়ে দিয়ে .....জীবন বাজি রইল.....’।
    রবীন্দ্রসদনের প্রেক্ষাগৃহ লোকে ঠাসা। শুরু হয়ে গেল কনসার্টের প্রতিযোগিতা। নানা বাজনার সুরে তালে লয়ে ছন্দে রবীন্দ্রসদন অডিটোরিয়াম উচ্ছল স্পন্দনে অনুরণিত হতে লাগল। কয়েকশো শ্রোতার মধ্যে অনেকে প্রাণবন্ত সুরের দোলায় দুলতে লাগল। আবার অনেকের মনে কোন কনসার্ট তেমন দাগ কাটল না। তারা নির্বিকার বসে রইল। সত্যিই তো নানা রুচির লোক নিয়েই তো এ জগৎ। আর, বিচারকদের মনের কথা পড়া বড় শক্ত।
    ‘বশিষ্ট’ গ্রুপের ডাক পড়ল সবার শেষে। উদ্যোক্তাদের কোন দোষ নেই। শিশির নাম এন্ট্রি করেছে অনেক দেরিতে, সবার শেষে। জৌলুসহীন কটা লোক সঙ্গে নিয়ে শিশিরবিন্দু স্টেজে উঠল।কয়েকশো লোক অবাক হয়ে দেখল লোকগুলোর সঙ্গে দু একটা ঢাক ছাড়া আর কিছু নেই। তারা কৌতূহলভরে এই অদ্ভুত কয়্যারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পপকর্ন চিবোতে লাগল এবং ঘড়ি দেখতে লাগল। ভাবল, এরা শুরু করলেই আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে হবে। যা যা শোনার সবই তো শোনা হয়ে গেছে। আর সময় নষ্ট করে লাভ কি। কিন্তু সময়ের মহিমা সময়ই জানে। কোথায় যে কার সময় আটকে যায় কে বলতে পারে।
    সাজ্জাদ সানাইটা বার করে ফুঁ দিল। সময় থমকে গেল......। ভোরের আলোর মতো তানের আভা ছড়িয়ে পড়ল প্রেক্ষাগৃহের আনাচে কানাচে। বশিষ্টর হাতের কাঠি ঢাকের বুক ছুঁল। এক এক বোলে বহুযুগের ওপার থেকে যেন স্মৃতির সোনালী ফুলকি ভেসে এসে মুক্ত আনন্দে নেচে বেড়াতে লাগল। শিশির মাউথ অর্গ্যানে ঠোঁট ছোঁয়াল। বশিষ্টর ঢাকের দু:খী বোল সওয়ার হল মাউথ অর্গ্যানের কোন এক বিদেশী সিম্ফনির গুঞ্জনে। বসন্তের ঝুরো বাতাসে যেন রাশি রাশি বকুল ফুল ঝরে পড়তে লাগল। প্রায় দশ মিনিট কেটে গেল। হলের মানুষদের পপকর্ন চিবোনো থেমে গেছে। তারা তাদের নিষ্ক্রমণ পরিকল্পনার কথা ভুলে গেল। তীর্থঙ্কর একপাশে দলবল নিয়ে বসে আছে। সে রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ে স্টেজের ওপর তাকিয়ে রইল, বশিষ্টর দিকে। বশিষ্টর ছেলেরা এখনও হাতে কাঠি নেয় নি। এতগুলো মানুষের মনের তলায় ঘুমিয়ে থাকা সুখ দুখ আনন্দ বিষাদের পরতে পরতে সঞ্চারিত হতে লাগল বশিষ্টর শ্রাবণের বৃষ্টিধারার মতো ঢাকের মর্মর।
    সতের মিনিট পরে, নির্ধারিত সময়ের আর যখন তিন মিনিট বাকি তখন বশিষ্টর তিন ছেলে কাঁধে ঢাক তুলে নিল। সম্মিলিত বৃন্দবাদ্যে রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহের প্রতিটি কোণ মুখর উদ্বেলতায় তরঙ্গায়িত হতে লাগল .....

    বাজনা যখন থেমে গেল অডিটোরিয়ামে নেমে এল প্রায় পনের সেকেন্ডের স্নায়ুবিবশা নীরবতা। 

    তারপর সহসা জেগে উঠল হাততালি ও সহর্ষ কলরোলের ঝড়। শিশিরবিন্দু, সাজ্জাদ, বশিষ্টরা সরে যাবার পরও তুমুল হর্ষে অনুরণিত হতে লাগল রবীন্দ্রসদনের প্রেক্ষাগৃহ।

    (বাকিটুকু পরের পর্বে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:ed39:bfb2:b74:ff06 | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:০৭503976
  • সুন্দর 
  • Anjan Banerjee | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:৫৭503978
  • ধন্যবাদ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন