এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একইসময়ে বহু জায়গার সাথে জড়িয়ে থাকা প্রসঙ্গে / এলিফ শাফাক

    Irfanur Rahman Rafin লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০২ জুলাই ২০২২ | ৭৬৯ বার পঠিত
  • তর্জমা: ইরফানুর রহমান রাফিন

    গ্রিক কবি কন্সটান্টাইন কাভাফি লিখেছিলেন, “এই শহরটা সবসময়ই তোমাকে তাড়া করে ফিরবে।” এমনকি আপনি যখন অন্য কোনো দেশে, অন্য কোনো সৈকতে, যান। যে-শহরটা সবসময়ই আমাকে তাড়া করে ফিরেছে, সেটা ইস্তানবুল।

    আমি যদি আর কোনোদিন ইস্তানবুলে ফিরে যেতে নাও পারি, আমার হৃদয় ইস্তানবুলেই পড়ে থাকবে। এই শহরটার জন্য আমার ভালোবাসা আর মায়া অফুরান। আমি বিশ্বাস করি আমার উপন্যাসগুলোতে সেটা পরিষ্কারভাবেই চোখে পড়ে। আমি যেখানেই যাই, ইস্তানবুল আমার সাথে সাথে যায়, এমনটাই অনুভব করি আমি। আমরা যে-জায়গাগুলোকে ভালোবাসি, স্রেফ শারীরিকভাবে দূরে আছি বলিই সেগুলোকে আমরা ভুলে যাই না।

    মাতৃভূমিগুলো হল আরশিমহল। সেগুলো ছেড়ে যাওয়ার জন্য আপনাকে কিছু না কিছু ভাঙতে হবে  — একটা দেয়াল, একটা সামাজিক প্রথা, একটা সাংস্কৃতিক নিয়ম, একটা মনস্তাত্ত্বিক বাধা, বা একটি হৃদয়। আপনি যাই ভাঙুন না কেন, তা আপনাকে তাড়া করে ফিরবে। তাই দেশান্তরী হওয়ার মানে হল ভাঙা কাচের টুকরোগুলো চিরকালের জন্য পকেটে বয়ে নিয়ে চলা। হালকা আর ছোট্ট হওয়ার কারণে, ওগুলো যে সেখানে আছে সেটা ভুলে যাওয়া সহজ। সহজ আপনার ছোট ছোট আকাঙ্ক্ষা আর গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাগুলো নিয়ে জীবনের পথে হাঁটতে থাকা। কিন্তু সামান্যতম সংস্পর্শেও এই কাচের টুকরোগুলো আপনাকে তাদের উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেবে। আপনার বুকটা চিরে ফেলবে।

    আমরা যে-মাতৃভূমিগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছি, সেগুলো আমরা শিশু হিশাবে যেসব শপথ নিয়েছিলাম অনেকটা সেরকম। আমরা হয়তো সেসব শপথে আর বিশ্বাস করি না। সেসব নিয়ে হয়তো আর ভাবি না অতোটা। কিন্তু সেগুলো আজও আমাদের জবানটাকে বেঁধে ফেলে। সেগুলো হল রক্ষাকৃত গোপনীয়তা, গিলে ফেলা জবাব, অব্যক্ত হৃদয়, নতুনভাবে রক্তাক্ত হওয়া পুরনো জখম, আর কখনোই ভুলতে না পারা প্রথম প্রেম। আমরা হয়তো আমাদের মাতৃভূমিগুলো ছেড়ে যেতে বদ্ধপরিকর, কারণ আল্লাহ জানেন সহ্যের একটা সীমা আছে, তাদের নির্বুদ্ধিতা আর অযৌক্তিকতা আর শত্রুতা আর নিষ্ঠুরতা আমাদের যথেষ্ট দেখা হয়েছে। কিন্তু সত্যটা হল এই যে, মাতৃভূমিগুলো কখনোই আমাদেরকে ছেড়ে যাবে না। দুনিয়ার চার কিনারেই ছায়া হয়ে আমাদের সাথে লেপ্টে থাকবে। কখনো এগিয়ে যাবে, কখনো বা পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু কখনোই খুব দূরে থাকবে না। আর তাই, দেশান্তর ও স্থানান্তরের বহুবছর পরেও, যদি কান পেতে শোনেন, তাহলে আমাদের ভাঙা উচ্চারণ, অনিচ্ছুক হাসি, আর অস্বস্তিকর নৈঃশব্দে আমাদের মাতৃভূমিগুলোর চিহ্ন খুঁজে পাবেন।

    তাই, হ্যাঁ, আমি একজন ইস্তানবুলবাসিনী।

    কিন্তু আমি বলকানের প্রতিও খুব গভীরভাবে অনুরক্ত। আমাকে একজন গ্রিক, বুলগেরীয়, বসনীয়, আলবানীয় বা রোমানীয় ব্যাকগ্রাউন্ডের লেখকের সাথে বসিয়ে দিন, দেখে অবাক হবেন আমাদের মধ্যে কতোটা মিল। একইভাবে, আমি আমার হৃদয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বহু উপাদানও বয়ে নিয়ে চলেছি। তাই এবার আমাকে কোনো সিরীয়, লেবানীয়, জর্দানীয়, মিশরীয়, ইসরায়েলি, ফিলিস্তিনি বা তিউনিসীয় ব্যাকগ্রাউন্ডের লেখকের সাথে বসান। আবারও, আপনি এটা দেখে তাজ্জব বনে যাবেন যে, আমাদের একজনের আরেকজনের সাথে কতোটা মিল।

    একইসময়ে, আমি একজন লন্ডননিবাসী, একজন ব্রিটিশ নাগরিক। সেই দেশের সাথে আমার গভীর ও আবেগময় সম্পৃক্ততা আছে, যে-দেশে আমি লেখালিখি করার স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছি। আমি একজন ইওরোপীয় — জন্মগতভাবে, পছন্দের দিক থেকে, এবং আমি যেসব মূল্যবোধ ধারণ করি সেসবের দিক থেকে। আর আজকাল আমাদের রাজনীতিকরা যাই বলুন না কেন, আমি নিজেকে মহাপৃথিবীর একজন হিশাবে, এই গ্রহের একজন বাসিন্দা হিশাবে, একটি বিশ্বজনীন আত্মা হিশাবে ভাবতে ভালোবাসি।

    বহু জায়গার সাথেই জড়িয়ে আছি আমি।

    লোকরঞ্জনবাদীরা বলবেন, “আচ্ছা, আচ্ছা, ওটা একটা বিলাসিতা। সবাই ভ্রমণ করতে পারে না।”

    হ্যাঁ, হয়তো সবাই এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে সফর করতে পারেন না, কিন্তু যারা পারেন তাঁরা সকলেই অভিজাত ব্যাপারটা এমন নয়। মহামারীর পরে আগের চেয়ে কম পর্যটক বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন, কম আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবেন, এবং কম অভিবাসী শ্রমিককে স্বাগত জানান হবে। এই চিন্তাটা আমাকে ব্যাপক উদ্বেগে ফেলে দেয়। যখন আমি দেখতে পাই দেয়ালগুলো উঁচু থেকে উঁচুতর হচ্ছে।

    বহু জায়গার সাথে জড়িয়ে থাকার ব্যাপারটা সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে পুষ্টি পায়। কিন্তু এগুলো কেবল পর্যটকদের ব্যাপার নয়। এটা একটা মনোভাব, একটা চিন্তাপদ্ধতি। স্রেফ আপনার পাসপোর্টে কয়টা ছাপ্পড় মারা হয়েছে তার ব্যাপার নয় এটা। এটা নিজের ব্যাপারে চিন্তা করার একটা পদ্ধতি। নিজের সতীর্থ মানুষদের ব্যাপারে চিন্তা করার একটা পদ্ধতি। কঠোরভাবে নয়, নমনীয়ভাবে চিন্তা করার একটা পদ্ধতি।

    আপনি হয়তো একই শহরের পরিধির মধ্যেই জন্ম নিয়েছেন ও বেড়ে উঠেছেন, পড়াশোনা করেছেন ও বিয়ে করেছেন। যদি এমনটা হয়ে থাকে, এমনকি তখনো পারিবারিক গল্প, সাংস্কৃতিক সংযুক্ততা, সামাজিক পক্ষপাত, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, খেলাধুলা আর শিল্পকলার সংযোগ, এরকম অনেক অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে, বহু জায়গার সাথে জড়িয়ে থাকতে পারেন আপনি।

    একজন মানুষ, পৃথিবীর সব মানুষ, সীমাহীন এবং তাদের প্রত্যেকের ঘরেই বহুজন বসত করে।

    আরো কথা আছে। একই পরিচয় ধারণ করা মানুষদের চেয়ে বহু জায়গার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে সাধারণ একটা দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর তারপরও, কেন এমন হয়, ইশকুলে, পরিবারে, এবং সমাজে, আমরা আমাদের শিশুদেরকে তারা যে বহু জায়গার সাথে জড়িয়ে আছে এটা শেখাই না, তাদেরকে আমরা শেখাই না যে তারা নিজেদের দেশ আর নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে প্রচণ্ড ভালোবাসতে পারে, এবং একইসাথে, নিজেদেরকে বিশ্বনাগরিক হিশাবে দেখতে পারে।

    অনুবাদকের নোট: এলিফ শাফাক সমকালীন তুরস্কের জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিকদের একজন। তিনি যুক্তরাজ্যে থাকেন। রাজনীতিবিজ্ঞানে শাফাকের একটি পিএইচডি ডিগ্রি আছে। তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়িয়েছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইন্ট অ্যান’স কলেজের সাম্মানিক ফেলো। ৪০টি ভাষায় শাফাকের বইগুলোর তর্জমা প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখাটি তাঁর ২০২০ সালে প্রকাশিত হাউ টু স্টে সেন ইন অ্যান এজ অফ ডিভিশন বইয়ের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ, নির্বাচিত অংশটি সে-বছরের ৯ অক্টোবর লিটহাবে ছাপা হয়েছিল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০২ জুলাই ২০২২ | ৭৬৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন