এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ৩

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ২২৬ বার পঠিত
  • দাদুভাই আমাকে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা শিখিয়েছিলেন। কীভাবে জাল ধরতে হয় এবং পুকুরের জলে ছড়িয়ে দিতে হয় শিখিয়েছিলেন। সেই বয়সেই আমি ওনার কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে মাছ ধরার জাল বুনতে হয়।
    গ্রীষ্মের দুপুরে, আমি এবং দাদুভাই আমের মুকুলের দিকে নজর রাখার জন্য একটি মাদুরে আম বাগানের নীচে শুয়ে থাকতাম। তপ্ত দুপুরের দখিনা বাতাস, বয়ে আসত পুকুর থেকে। স্নিগ্ধ ও উৎফুল্লতায় ভরা সেই বাতাসের রেশ। ভেসে আসত বাতাসের সাথে কু-হু কু-হু কোকিলের ডাক। শুনতে পেতাম চড়ুই পাখির কিচিরমিচির। চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকতাম তাদের আনন্দ-উল্লাস। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেতাম নীল আকাশ। সাদা মেঘের দেখা নেই, শুধুই নীল আকাশ। পড়ন্ত বেলার ছায়ায় - স্নিগ্ধ বাগানের শ্যামলতায়, পাখির ডাকে, চারধারে ছড়ানো গাছগাছালির ঐশর্য উপভোগ করতে করতে - কত দূরে দুচোখ চেয়ে যেন এক স্বপ্নের দেশে চলে যেতাম আমি তখন। দাদুভাইয়ের থেকে রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যেতাম আমি। খুব কষ্ট হত তখন কর্ণের কাহিনী শুনে। নিস্তব্ধতার দুপুর খান খান করে, মাঝে মাঝেই কানে আসতো, বাসনওয়ালীর ডাক -  বাসন লিবে গো মা --- বাসন, পুরানো কাপড় দিয়ে বাসন লিবে ---- ইস্টিলের গ্লাস, বাটি, থালা সব আছে গো মা।
    সবচেয়ে ভালো লাগত বিকেলের রাঙা রোদ অলসভাবে যখন গাছগুলোর মাথায় জড়িয়ে থাকত। দাদুভাই তখন থেকেই ধীরে ধীরে আমার ভিতরে জীবনের মূল্যবোধ, আদর্শের বীজ রোপণ করার চেষ্টা করতেন। সবকিছু ঠিক করে বুঝতে পারতাম না। কিন্তু উৎসুক মন নিয়ে শুনতাম। আজ বুঝতে পারি উনি কী বোঝানোর চেষ্টা করতেন ঐসময় আমাকে। উনি বলতেন, মানুষ হয় আশাবাদী। কিন্তু এই আশা ধীরে ধীরে মানুষকে করে দেয় লোভাতুর অনেকসময়। লোভ বড় হলে লোভের কাছে পরাজিত হয় মনুষ্যত্ব। আবার লোভ ছাপিয়ে উঠতে পারলে ওই মানুষই হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠতর। যেমন মহাভারতের দুর্যোধনকে লোভ আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল। আর দুর্যোধনের ক্রোধ এবং অহংকারকে উস্কে দিতেন মামা শকুনি এবং অন্যান্য পারিষদগণ। কর্ণের কী দোষ, ও তো ছোটবেলা থেকেই অবহেলিত, ও কেন পরাজিত হলো এবং সেটাও অন্যায়ভাবে - এই প্রশ্নের উত্তরে উনি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, কর্ণ অসত্যের সাথ দিয়েছিলেন। তাই সত্য, যার জয় সর্বকালে, কর্ণকে পরাজিত করেছিল। বলতেন, বড় হয়ে সব বুঝতে পারবে। উনি বোঝাতেন - সবসময় নির্লোভ থাকতে, সত্যের পথে চলতে - জীবন সুখময় হয়ে উঠবে। উনি আরও একটি অমূল্য কথা বলতেন - বলতেন, আমার নাকি খুব রাগ আবার অনুভবীও। অনুভবী হওয়া ভালো, কিন্তু রাগ নয়। উনি বলতেন, রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন - মন এবং পাঁচ ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখা। ধর্মের পথপ্রদর্শক যুধিষ্টির এইজন্য হারিয়েছিলেন সবকিছু পাশা খেলায়। কারণ উনি ওনার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে তখন বশে রাখতে পারেননি।
    উনি একটা গল্প বলতেন আমাকে, গল্পটা এইরকম। অনেকেরেই জানা অবশ্য গল্পটা। এক দেশে এক রাজা ছিলেন। ধনসম্পদ, হাতি, ঘোড়া, সৈন্য - কিছুর কমতি ছিল না। কিন্তু তাও রাজার মনে কোনো সুখ ছিল না। সুখের চিন্তা করতে গিয়ে রাজা অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক বৈদ্য, হেকিম আসলো - কিন্তু রাজার অসুখ ধরতে পারে না। অবশেষে একদিন এক চিকিৎসক এসে বললেন, রাজা একজন সত্যিকার সুখী লোকের জামা পড়লে ঠিক হয়ে যাবেন। সারা দেশে পাইক পেয়াদা বেরিয়ে পড়লো একজন সুখী লোকের খোঁজে। সারা দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটি সত্যিকারের সুখী লোকের সন্ধান মেলে না। প্রত্যেকেরই হাজারো দুঃখের গল্প। অবশেষে এক নদীর ধারে হাসিখুশি একটি লোককে আনন্দে গান করতে দেখে, জিজ্ঞেস করে তার ঘর কোথায় ? সে জানায়, নদীর পাড়ই তার ঘর। বিছানা কোথায় জানতে চাইলে বলে, গাছের ছায়ার নীচে ঘাসের উপর তার বিছানা। খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে জানায়, গাছের ফল, নদীর জল, যখন যা পাওয়া যায়। হাসিমুখ দেখে বোঝা যায়, এ সত্যিই সুখী লোক। সেনাপতি তখন বলে, তাহলে তুমি বেশ সুখী লোক। লোকটির হাসিখুশি জবাব, অবশ্যই আমি সুখী, আমার কোনো দুঃখ নেই। তখন সেনাপতি জামা চাইলে বলে, আমার তো কোনো জামা নেই। দাদুভাই তখন বোঝাতেন এই গল্পের মাধ্যমে, সুখের কোনো মাপ নেই। কেউ মাংস-ভাত খেয়ে সুখী, কেউ পান্তাভাত খেয়ে সুখী। কিন্তু যখন কেউ লোভী হয়ে যায়, আরও পেতে চায়, সুখ তখন তার জীবন থেকে পালিয়ে যায়। সুখ বাস করে প্রত্যেক মানুষের ভিতরে, তাকে খুঁজে নিয়ে উপলব্ধি করতে হয়।  
    দাদুভাই সবসময় আমার মাথায় দু'হাত রেখে বলতেন, 'মানুষের মতন মানুষ হও। তোমার বিদ্যা, বুদ্ধি, বিবেকের জন্য আমি সর্বদা আশীর্বাদ করি দু'হাত ভরে।' মনে পড়ে একথাটা আরও যখনই আমি পড়ি উত্তরাধিকারের সেই লাইনটি, যখন অনিমেষ জলপাইগুড়ি ছেড়ে কলকাতা যাচ্ছে কলেজে পড়তে, সরিৎশেখর এসেছেন স্টেশনে, অনিমেষের মাথায় দু'হাত রেখে বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছেন অনেক কিছু। অনিমেষ শুনতে পেল শেষ বাক্যটি, "বিদ্যা দাও, বুদ্ধি দাও, হৃদয় দাও।"   
    আমি ঐসময় দাদুভাইয়ের সাথে একসাথে ঘুমোতাম, মাঝখানের ঘরে। তখন দোতলা বানানো হয়নি। ছিল পাঁচটি বড় বড় ঘর। সামনে বিশাল বারান্দা আর পিছনে রান্নাঘর ও খাওয়ার জায়গা। সামনের বারান্দায় রাখা থাকত দাদুভাইয়ের গড়গড়া আর তামাকের সরঞ্জাম, কয়েকটি বসার চেয়ারের সাথে দাদুভাইয়ের একটি ইজিচেয়ার। ওখানে বসে দাদুভাই টানতেন গড়গড়া, আমিও টেনেছি কয়েকবার। পিছনের বিশাল বারান্দায়, দুর্গাপুজোর সময় দেখেছি প্রায় পঞ্চাশজন নীচে মেঝেতে বসে পাত পেড়ে খেত - কলাপাতায়। বাড়ির চারিদিক ঘিরে ছিল অসংখ্য কলাগাছ। একটি ঘরে ঠাম্মা ফুলপিসি আর কুট্টিপিসিকে নিয়ে শুতেন। একটি ঘর রাখা থাকত বাবা-মায়ের জন্য। বাকি দুটি ঘরে কাকুমণি আর ছোটকাকু থাকতেন। মাঝারি বৃষ্টির সময় দরজা খোলা রাখা থাকত, বিশাল বারান্দা সামনে এবং পিছনে থাকার জন্য জলের ছাঁট আসতে পারত না। কিন্তু আসত ভিজে বাতাসের শীতল পরশ, বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা সোঁদা সুগন্ধ।   ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন