এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ওয়াহে গুরুজী কা বান্দা

    Simanta Nandi লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ৩৫৪ বার পঠিত
  • ১৭ জানুয়ারি ২০১০, জ্যোতি বসু মারা যাওয়ার পরে পাঞ্জাব জাতীয় শোক ঘোষণা করে, শীর্ষ নেতারা আপৎকালীন বিমানে কলকাতা চলে আসে। এমনকি কানাডা থেকেও। মাথা ঠেকে জ্যোতি বসুর নিথর দেহে। জ্যোতি বসু বাংলা ডকে তুলে দিয়েছে না দেয়নি, ৫০ বছর বাংলাকে পিছিয়ে দিয়েছে না প্রান্তিকের হাত মজবুত করেছে তাই নিয়ে বিতর্ক চলুক, কিন্তু আজ যে গল্প বলবো তার রাজনৈতিক অভিঘাত প্রশ্নাতীত। 
     
    প্রথম গল্পটা ভবানীপুরের একটি পানশালার৷ এক যুগ আগে। যারা এই শতাব্দী প্রাচীন বারে যেতে অভ্যস্ত তারা দেখে থাকবেন এর ঠিক পাশেই একাধিক সরদারজীর দোকান আছে। এই সরদারজি কাজ সেরে ঠিক ন'টার সময় উপরে একটা টেবিলে এসে বসেন। ওয়েটার তিনটে হুইস্কির পেগ রেখে যায়। সরদারজি দুধ খাওয়ার মতো ঢক ঢক করে এক একটা গ্লাস শেষ করেন। প্রতি গ্লাসের মাঝে গল্প চলে দশ মিনিট। ওরকম এক টেবিলে নানা গল্পের মাঝে শুনেছিলাম জ্যোতি বসুর কথা। তখন জ্যোতি বসুকে যে যত খিস্তি করতে পারে সে ততো বড় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ইয়া মস্ত বিদ্বজ্জন। পাশের টেবিলে বসে ব্যবসায়ী পাঞ্জাবি এই ভদ্রলোক বাঙালিদের এসব জ্যোতি- খেউড় শুনে গোঁফ থেকে পানীয় মুছে শুদ্ধ বাংলায় বলেছিল, 'দাদাভাই, জ্যোতি বাবু ভগবান লোক। ওনাকে নিয়ে কোন বাজে কথা না বলাই ভালো। ভুল সবার হয় কিন্তু ভাই ওনাকে খারাপ কিছু বলা বেইমানি হবে, প্লিজ হাত জোড় করছি। উনি না থাকলে জানে বাঁচতাম না অনেকেই আমরা।" সেদিন জানি না পানীয়র জন্যে কিনা কিন্তু সরদারজির আবেগটা কাঁচা সোনার মতো নিখাদ ছিল। 
     
    কাট টু অমৃতসর, পাঞ্জাব। স্বর্ণমন্দিরের ঠিক সামনের বাজার এলাকা। বালা, কৃপাণ, তলোয়ার, মেয়েদের ওড়না, ভগত সিং বা গুরু নানকের জামা - সব মেলে ওখানে। আমাদের একাধিক লোককে কিছু না কিছু উপহার দিতে হতো। বসলাম গিয়ে এক ইয়া মস্ত পাগড়ি পরা লোকের দোকানে। আদ্যোপান্ত খালসা। একথা সেকথার পরে কলকাতা শুনেই বলে ১০% ছাড়। আমি বলি, কারণ? বলে, তোমার ওটা শহর না স্বর্গ আছে। আর ওই জ্যোতি বাবু উনি ওয়াহে গুরুজী কা বান্দা আছেন। ওনাকে খোদ গুরু নানক সাহাব কলকাতা পাঠিয়েছিলেন শিখেদের বাঁচাতে।
     
    অবাক হয়ে শুনতে থাকলাম, ওনার ভাই, ভাইয়ের পরিবার নিয়ে ওনার চিন্তা ১৯৮৪সালে। ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিলেন ওনার ভাই কলকাতায়। গোটা দেশে পরিবারের অনেকে মারা গেলেও কলকাতায় ওদের কারো কিচ্ছু হয়নি। পরে অনেকে কলকাতা চলে এসেছিল। ততোদিনে চুল কেটে ফেলেছে, পাগড়ি পরেনা। বৃদ্ধ শিখ মানুষটি বললেন, হয়তো কিছুদিন আগে কলকাতা চলে আসলে চুলও কাটতে হতো না। ওয়াহে গুরুজী কা বান্দা থা ওত্থে!
     
    জ্যোতি বসু বাঙালির জন্য কিছু করুক ছাই না করুক, পাঞ্জাবিদের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। তাই হয়তো হাউ হাউ করে কাঁদে পাঞ্জাবি সমাজ জ্যোতি বাবুর মৃত্যু -দিনে। তাই হয়তো শিরোমণি আকালি দলের মতো আদ্যোপান্ত ধর্মীয় দল প্রকাশ্যে কৃতজ্ঞতা জানায় জ্যোতি বসুকে তার ১৯৮৪সালের ভূমিকা নিয়ে।
     
    সে রাতে ইন্দিরা গান্ধী মারা গেছে ও দুজন শি খ নিরাপত্তাকর্মী ধরা পরেছে শুনেই জ্যোতি বসু পুলিশকে অর্ডার দেয় সর্বশক্তি নিয়ে রাস্তায় নামতে, সেনাকে বলে বলয় তৈরি করতে আর দলের ছেলেদের বলে সব পাঞ্জাবি পরিবারের দোরগোড়ায় বসে পরতে। সারারাত তাস পেটাক কিন্তু বাড়ি ফেরা যাবে না। কেউ দা ঙ্গা করতে এলেই মাথা ভেঙে দেওয়া হয় যেন। গোটা দেশে বেছে বেছে নিধন চললেও বাংলাতে একজন মানুষেরও পাগড়ি নিয়ে টানাটানি হয়নি, নিহত তো দূরের কথা।  
     
    গোটা শিখ সমাজে বাংলার ভূমিকার গল্প ছড়িয়ে পরে। কানাডা থেকে লুধিয়ানা মাথা নত করে বাঙালিদের অভিবাদন জানানো হয়৷ জ্যোতি বসু এক মসীহা যেন। উনি মারা যাওয়ার পরে পাঞ্জাব জাতীয় শোক ঘোষণা করে, শীর্ষ নেতারা কলকাতা চলে আসে। মাথা ঠেকে জ্যোতি বসুর নিথর দেহে। স্রেফ একটা সাল, ওই ১৯৮৪সালের কৃতজ্ঞতা।
     
    আজকের "কে কতবড় সেকুলার, কে কত বড় লিবারেল" প্রমাণ করার যুগে, জ্যোতি বসুকে কোনদিন পাগড়ি পরে, কৃপাণ নিয়ে, তলোয়ার হাতে ভোট চাইতে হয়নি ১৯৮৪-র আগে বা পরে। জ্যোতি বসুকে কোনদিন নামাবলী বা ফেজটুপি পরতে হয়নি কিন্তু তবু শিখেদের পীঠস্থান থেকে দু পা দূরে আজও কোন ধর্মপ্রাণ মানুষ ওকে ওয়াহে গুরুজী কা বান্দা বলে ডাকে৷ পাঞ্জাবের কোন ঘরের শোকেস এ আজও রাইটার্স বিল্ডিং এ গিয়ে জ্যোতি বাবুকে অভিনন্দন জানানোর ছবি জ্বলজ্বল করে।
     
    অবশ্য ফেসবুকের যুগে ওনাকে এসব নিয়ে জবাব চাইলে হয়তো বিরল হাসি হেসে বলতেন, "আমি এমন কী করেছি। ১৯৮৪সালে রাজ্যবাসীকে বাঁচানো তো কাজের মধ্যে পরে"। আর রাজ্যে হিংসা কেন হয়না? "কিঁউ কি হুকুমত নেহি চাহাতি হে!"

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন