এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর...

    Pradhanna Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ জুন ২০২৩ | ৩২৯ বার পঠিত


  • “রাত কত হল?
    উত্তর মেলে না।
    কেননা, অন্ধ কাল যুগ-যুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে, পথ অজানা,
    পথের শেষ কোথায় খেয়াল নেই।”

    অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার চারপাশ রহস্যময়ী তামসী তপস্বিনী রাত্রি ঘিরে রেখেছে। নিশীথিনীর রঙ কালো। এই কালরাত্রির কোন রূপ নেই। রাত্রিনাম্নী এই কালভৈরবিনী নীরব, নিস্তব্ধ। আস্তে আস্তে আমার চেতনায় দ্যুতি ফিরে আসে। নিশাচরের সকরুণ ডাকে আমি তন্দ্রাবিলাস থেকে জাগ্রত চেতনার দ্যোতনায় ফিরে আসি। আমি জেগে উঠি। আধো ঘুম আধো জাগরণে আমার শরীর শান্ত, মন সজাগ, আত্মা ধীর, স্থির, সদাসর্বদার মতো জাগ্রত।

    আমি শুয়ে শুয়েই চোখ নামাই আমার পায়ের কাছে। নাইটির আবরণে ঢাকা সুউচ্চ দুই চূড়ার মধ্যবর্তী উপত্যকার ফাঁক দিয়ে আমার পা-দুটো দেখা যায়। কি করে? জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকেছে আলো, এসে লুটিয়ে পড়ছে আমার অনাবৃত পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে। রূপার আঙট ঝলসে উঠছে মাঝে মাঝে, আমার পদঙ্গুলিহেলনে। তন্দ্রাজড়িত মায়ানেশায় আমি তাকাই আমার চারদিকে। কালো আর তত কালো নয় এখন। অন্ধকারেরও আলো আছে।

    আমার মাথার কাছে কে? আমার আলুলায়িত চুলের গোছার ফাঁক দিয়ে আলতো করে টেনে টেনে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কে? তার স্নেহের পরশ পাই, তাকে পাই না। সে আমায় জাগাতে চায়। সে চায়, আমিও তার মতো আমার ঘুমের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ি তার জগতে। যে জগত দেখা-অদেখার, জানা-অজানার এক অতীত শিলালিপি। হারিয়ে গেছে সে জগতের বাসিন্দারা...
    তাই কি? না তো!

    আমার পায়ের কাছে বিছানা ঘেসে তারা এক এক করে আসে, দাঁড়ায়, চলে যায়। মাথার কাছের মানুষটা আমার কানের কাছে ঠোঁট রাখে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার গলায়, ঘাড়ে। ফিসফিসিয়ে সে বলে চলে সামনে এক এক করে চলে যাওয়া আগন্তুকের নাম, ধাম, আর পরিচয়...

    রব গ্রিয়ে, ভলতেয়ার, ইয়েট্‌স, বঙ্কিমচন্দ্র, ক্রিস্টোফার মার্লো, পল এল্যুয়ার, শেলী, এডগার এলান পো, অরুণ মিত্র, রোমাঁ রোল্যাঁ ও মাদলেন, মপাসাঁ, ভার্জিনিয়া উলফ্‌... আরও আরও কত মানুষ... তারা জীবনের চিহ্ন রেখে গেছেন তাদের সৃষ্টিতে। তারা আছেন। তারাই আছেন।

    আমার মাথার কাছে তুমি কে? কে তুমি আমায় চিনিয়ে দিচ্ছ এইসব কালাতীত মহামানবদের? কালের গন্ডী ছাড়িয়ে জ্যোতিভূষণ চাকী তোমায় যাদের চিনিয়েছিলেন এককালে, কালের দরজা ঠেলে অনেক পথ উজিয়ে এসে কি পরম মমতায় তুমিও আবার আমায় চিনিয়ে দিতে চাইছ সেইসব কালপুরুষদের? আর তাই সেইসব সিংহরাশির জাতকেরা, সময়ের দরজা ঠেলে, চন্দ্রিমার পথ বেয়ে নেমে আসে আমার পায়ের কাছে। কে তুমি? আমাকে বারবার ফিসফিসিয়ে বলে চলো, এদের ভুলো না। এদের না চিনলে তুমি নিজেকে চিনবে কি করে?
    তুমি চিন্ময় গুহ। চিনেছি তোমায়।

    তুমি নিজের ঘুমের দরজা ঠেলে একের পর এক ঘর খুলে দিচ্ছ। প্রত্যেক ঘরে এক-এক জ্যোতিষ্ক। কোথাও বা জ্যোতিষ্কমণ্ডলী। তুমি প্রত্যেক অধ্যায়ে এক-একজন করে চিনিয়ে দাও আমাকে। তারা কে, কি বা সেই জ্যোতি; কোন তারকাই বা আত্মহত্যা করেছিল, আর কাকেই বা হত্যা করা হয়েছিল; কে কবিতায় মুড়ে দিয়েছে গোটা পৃথিবী, আর কারই বা মহাউপন্যাস জীবৎকালে কল্কে পায় নি; কোন ধুমকেতু হাতের নাগালে এসেও চলে গিয়েছিল চেতনসীমার বাইরে; কিম্বা কোন উল্কা আছড়ে পড়ে নড়িয়ে দিয়েছিল তাবৎ মহাপৃথিবীকে।

    ঘুমের দরজা ঠেলে তুমি আমাকে নিয়ে চলেছ অতীতে। যেখানে বালক মায়াকোভস্কি উচ্চৈস্বরে কবিতা আওড়ায়। প্যারিসের সমাধিক্ষেত্রের মধ্যে আমাকে নিয়ে হাটতে হাটতে এক এক করে তুমি চেনাও সার্ত্রে, সিমোন দ্য বোয়াভেরা, মার্সেল প্রুস্ত, শার্ল বোদল্যের, মাজারিনকে। কখনও কখনও অন্ধকার রাত্রি বেয়ে নেমে আসেন আঁরি মিশো, নীৎসে, শোপেনহাওয়ার, ফিলিপ সিডনি। তোমার হাত ধরে তারা এসে দাঁড়ায় আমার সামনে। অবন ঠাকুর ছবি আঁকেন। জাক প্রেভের কবিতা বলেন। সিলভিয়া প্লাথ তার ফেটে যাওয়া চূর্ণ-বিচুর্ণ মাথা নিয়ে নীরবে শুয়ে থাকেন আমার দিকে বিষন্নভার মায়াদৃষ্টি নিয়ে। আর সত্যজিৎ রায় সখেদে বলে ওঠেন, “এই না হলে সভ্যতা... একটি সুইচ টিপে...”। সভ্যতার এই মহাসংকটে দেখি রবীন্দ্রনাথকে, দেখি গ্যোয়েটেকে, তলস্তয়কে, শেক্সপীয়রকে। তুমি চিনিয়ে দাও তাদের, একে একে, সবাইকে।

    তাদের সামনে এসে নতজানু হই আমি। চিন্ময় গুহ আমাকে নিয়ে আসেন এক টুকরো অতীতের সামনে। যারা একদিন বেঁচেছিল। যাদের জন্য আজ আমরা বেঁচে আছি। ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকব।

    তারা নীরবে আমার চোখের দিকে চেয়ে থাকেন। তাদের প্রত্যেকের চোখে একটাই কথা --- কিন্তু তবুও, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।

    একটা আলোর প্রদীপ, ক্ষীণকায়, কিন্তু জ্বলে। তারা চান, আমি সেই ক্ষীণকায়াকে আলোকবর্তিকাকে আমার নগ্ন হাতে ধরে পথ চলতে থাকি। চলতে থাকি তাদের পথ বেয়ে, যে পথ সমুখে, যে পথ শান্তি পারাবারের পথ, শিশুতীর্থের পথ...

    =============================
    ঘুমের দরজা ঠেলে
    চিন্ময় গুহ
    সিগনেট প্রেস
    মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০টাকা
    [কবিতা কৃতজ্ঞতাঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
    [ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন