এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আমার মা, বুড়োর মা আর সঞ্জীবের মা

    Pradhanna Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ জুন ২০২৩ | ৩৫৫ বার পঠিত


  • একটা গন্ধ আমাকে ঘিরে থাকে, মায়ের গায়ের গন্ধ। সে গন্ধ আমি চোখ বুজলেও টের পাই। যেখানেই থাকি না কেন, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, একবার মনে করলেই গন্ধটা তার অস্তিত্ব নিয়ে আমাকে ঘিরে ধরে। আমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। 

    কিছুকাল আগের ঘটনা। আমার তখন ধুম জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। বড়ো অস্থিরতা। ঘুমহীন রাত। সকালে মা আমার মাথার কাছে এসে বসল। সদ্য স্নান করে পুজো দিয়ে এসেছে। আমাকে দেখতে এসেছে। মায়ের গায়ে আমার গা ঠেকল। কি ঠান্ডা তার শরীরটা! আমি হাঁচোড় পাঁচোড় করে মা-কে জড়িয়ে ধরলাম। মায়ের বুকের মধ্যে আমার মুখ গুঁজে দিলাম। আমার কপাল তার বুকে ঠেকল। আঃ! কি শান্তি। আমাকে মা ঠেলে সরিয়ে দিল না। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরল। তার ভেজা হাত দুটো দিয়ে পরম মমতায় আমার মুখে, গলায় বুলিয়ে দিল। শান্তি শান্তি শান্তি...

    আমার কান মায়ের ঠিক বাম বুকে। আমার মুখ ডুবে গেছে বর্ষাকালের নরম কচি ঘাসের নিবিড় কবুতর উষ্ণতায়। আর সেখান থেকে আমি শুনতে পাচ্ছি একটা ছন্দ --- “কানের কাছে মায়ের হৃৎপিন্ড ধুকধুক করছে।” আমার হৃৎপিন্ড মায়ের হৃৎপিন্ডের সাথে তাল মেলাতে থাকে। সে ছন্দের এক মাধুর্য আমাকে নিমেষে টেনে নিয়ে গেল সব জ্বালা যন্ত্রণার পাড়ে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। যতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম, মা স্থির হয়ে বসেছিল। একটুও নড়াচড়া করে নি।

    মায়েরা কি এমনই হয়? আমি মা হলে কি এমনই হব? মনে হয় না। আমার বুকের মধ্যে এমন মমতা ভগবান দেন নি। মায়ের কাছে ধার চাইলে তিনি কি একটু দেবেন না? ২৫%...???

    সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় আজীবন অনেক লেখা লিখেছেন। অধিকাংশই লোকে মনে রাখবে না। যে কয়টা মনে রাখবে তাও কয়েক দশক বাদে হয়তো বা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম করবে। কেবল একটা উপন্যাসের হারিয়ে যাওয়া উচিৎ না।

    ‘ইতি তোমার মা’

    কারণ ওটা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় নিজে লেখেন নি। দেবী সরস্বতী তার কলমে নিজের নখাগ্র ঠেকিয়েছিলেন। মানুষের পক্ষে এ লেখা সম্ভব নয়। সেই সময় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মানুষ ছিলেন না। তিনি সরস্বতীর বরপুত্র হয়ে গিয়েছিলেন। 

    কিশোর উপন্যাস প্রচুর লেখা হচ্ছে। কিশোর উপন্যাস একটাও লেখা হচ্ছে না। 

    ‘ইতি তোমার মা’ সেই কিশোর উপন্যাস, যা আমাকে আমার মায়ের স্পর্শ দিতে পারে। এ উপন্যাস আমি দরজা-জানলা বন্ধ করে পড়েছি, আমি চাইছিলাম না, আমার চোখের জল কেউ দেখুক; এ উপন্যাস পড়ার সময় আমার ফোন বন্ধ করে রেখেছি, আমি চাইছিলাম না, আমার কান্নাভেজা গলা অন্য কারো কানে যাক; এ উপন্যাস আমি গভীর রাত্রে পড়েছি, আমি চাই নি মা-কে চেনবার সময় সময় আমার বিরুদ্ধে চলে যাক। মা-কে চিনতে গভীর রাতই তো উপযুক্ত সময়। মা, তুমিই রাত্রি, তুমিই নিশা, তমশা, তমস্বিনী, তমিস্রা। তুমিই শুদ্ধ, বুদ্ধ, নির্মোহ। তুমিই এক, আবার তুমি-ই বহু হয়েছ। তুমিই আমি, আমি-ই তুমি।

    আমার মা সব জানে। আমার মা সব পারে।

    এর মানে এই নয় যে, বইটায় শুধুমাত্র মা-ছেলের সম্পর্ক আছে। একটা পরিবার, যে কিনা নিজগুণে সমৃদ্ধ, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাকে আদর্শ রূপ দান করতে চেষ্টা করেছেন। আছেন আদর্শ বাবা, ঠাকুর্দা, পাড়ার ছেলে এবং ডাক্তারবাবু কিম্বা জেলে থাকা এক ইংরাজী বলা-কওয়া পুরাতন ভৃত্য। কিন্তু, বাস্তব এমন নয়। না হোক। এক কিশোরের প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার পথে এমন আদর্শ চরিত্রগুলো যদি মনের মধ্যে ছাপ না ফেলা যায়, কোন কিশোর প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে কি?

    “মা যখন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, মুখটা এত সুন্দর দেখায়! আমার মুখটা যদি মায়ের মতো হত। টানা-টানা দুটো ভুরু। সেই ভুরু দুটো এখন ধনুকের মতো বেঁকে গেছে। চোখ দুটো মা দুর্গার মতো। চাঁপাফুলের মতো গায়ের রঙ। ... আমার মাকে আমি কখনও নোংরা জামাকাপড় পড়তে দেখিনি। সব সময় পরিস্কার। কোন কিছু নোংরা অপরিস্কার দেখলে মা ভীষণ রেগে যায়। ... আমার মায়ের পা দুটো কী সুন্দর। ফর্সা ধপধপে। পাতলা। যেন মাটির সঙ্গে মিশে আছে। ... আমার চুলে মায়ের হাত খলবল করছে। কানে চুড়ির টিংটিং। ... মায়ের মাথায় কী সুন্দর চুল! কালো কুচকুচে। একটু কোঁকড়া-কোঁকড়া। সব দিক থেকে আমার মা এত ভাল! এমন মা আর কারো নেই।” --- এ কোন মায়ের কথা বলছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়? এ তো বুড়োর মা নয়, এ তো আমার মা! 

    “মা কালী, আমার এই সুন্দর মা কে একশো বছর বাঁচিয়ে রাখো মা।”

    আমার মা আর বুড়োর মা --- এক হয়ে যাচ্ছে। আবার আলাদা হয়ে যাচ্ছে। একে সবাই। সবাইতে এক।

    “সব সময় সোজা পথে চলবে। সমস্ত ব্যাপার বুদ্ধি দিয়ে নয় হৃদয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে। রোজ আয়নার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। ... চিন্তাই মানুষ। একা থাকবে না। কাজকে সঙ্গী করবে। ... সবুজের ঘরে থাকলে মানুষ চির সবুজ থাকে। দিতে শিখবে, নিতে নয়। ‘আমি আমি’ করবে না। ‘আমি’ বলে কিছু নেই। সবই  ‘তুমি’। ভেতরটাকে বড়ো করলে বাইরেটা বড়ো হয়। নকল থেকে আসল বেছে নিতে শেখো। ... প্রতিষ্ঠা মানে সত্যের প্রতিষ্ঠা। ঐশ্বর্য হল চরিত্র। যুদ্ধ হল নিজের সঙ্গে। জয় হল নিজেকে জয়। ... 
    বিদায়। অনেক ভালোবাসা। জল নয়, আগুন। --- ইতি তোমার মা।”

    আমার কি চিঠিটা মনে থাকবে? আজ থেকে এক মাস পরে? 

    হয়তো বা, হয়তো না।

    কিন্তু আমি মনে ঠিক জানি...

    আমার একটা মা আছে।

    সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় আমাকে আর সে সত্যটা ভুলতে দেবেন না।

    ==========================

    ইতি তোমার মা
    সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
    আনন্দ পাবলিশার্স
    মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০/-
    ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সুমন দাস, সমর্পিতা
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন