এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভুতুড়ে রিক্সাওয়ালার কাহিনি 

    অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • নমস্কার। আমি বিনয়ভূষণ মুখোপাধ্যায়। লেখক অর্ঘ্যদীপের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে কলকাতার বইমেলায়। একটা বুক স্টলে।
    তবে আমি বইটই লিখি না। আমি খুব গল্প বলতে ভালোবাসি।তবে কোনো বানানো গল্প নয়, নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার কথা বলি।আর সেই থেকেই লেখক আমার সাথে বন্ধুত্ব করেন। আমার বাড়িতে আসেন প্রায়শই। আমার মুখ থেকে সেইসব ঘটনার কথা শোনেন।আর তা থেকেই গল্প লেখেন।
    তো আজ সেইরকমই আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার কথা শুনবেন লেখকের কলমের মাধ্যমে।
    আমার জন্ম ইছামতি নদীর তীরে একটি ছোট্ট গ্ৰাম গঙ্গাপানিতে। বর্তমানে আমার বয়স ষাট বছর।যে সময়ের কথা বলছি তখন আমার বয়স বারো কি তেরো বছর। মানে ঐ ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি।আমাদের গ্ৰামে কোনো স্কুল ছিলো না। চাঁপাডাঙা বলে একটি গ্ৰামে স্কুল ছিল।আমাদের গ্ৰাম থেকে সেই গ্ৰামের দূরত্ব প্রায় কুড়ি কিলোমিটার। আমাদের স্থানীয় রেলস্টেশন থেকে দশ কিলোমিটার দূরে চাঁপাডাঙা রেলস্টেশন। চাঁপাডাঙা রেলস্টেশন থেকে বড়ো রাস্তা গেছে রামনগর নামক আরও একটি গ্ৰামে।এই রামনগর গ্রামে যাওয়ার পথের একদম পাশেই পড়ে স্কুল। তা স্কুল স্টেশন থেকে নয় বা দশ কিলোমিটার দূরে। স্টেশন থেকে বাস, অটো, রিক্সা প্রভৃতি যানবাহন চলাচল করে। তবে তা সংখ্যায় অতি কম।
    সেদিনটা ছিল গ্ৰীষ্মকালের কোনো এক দিন।যথাসময়ে স্কুলে উপস্থিত হলাম।স্কুল ছুটি হয় বিকাল চারটেয়। আমি যদি ঠিক ছুটির সময়েই বেরিয়ে আসতাম তাহলে হয়তো জীবনে একটা অভিজ্ঞতা কম হতো। মানে একটা বড়োসড়ো অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতাম না।
    যাইহোক স্কুল ছুটির পরে কী কাজ ছিল আমি বেরোলাম আরও আধঘন্টা পরে।
    ততক্ষণে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে।চারিদিকে থমথমে ভাব।
    স্কুল থেকে যে মুহূর্তে বেরোলাম সেই মুহূর্তেই শুরু হল ঝোরো হাওয়ার সাথে মুষলধারে বৃষ্টি। গ্ৰামের দিকের স্কুল বলে সামনে একটা বিশাল মাঠ ছিল। সেই মাঠে দৈনিক কত গরু ছাগল ঘাস খায়। কিন্তু সেদিন আর কাউকে দেখতে পেলাম না। এমনকি একটা কুকুর পর্যন্ত না।আমি মাথা বাঁচিয়ে কোনোরকমে দৌড় লাগিয়ে স্কুল চত্বর ছেড়ে বড়ো রাস্তার কাছে এলাম।
    ওদিকে আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎএর রেখা দেখা যাচ্ছে।রাস্তার পাশে ছিল ফজল মিঞার চায়ের দোকান।আমি তার ছাউনির তলায় এসে দাঁড়ালাম। সেদিন ফজল মিঞা দোকান বন্ধ করে আগেই চলে গেছে।সারা তল্লাটে যেন আমি একাই জীবিত প্রাণী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর কেউ কোথাও নেই। আগেই বলেছি চাঁপাডাঙা রেলস্টেশন থেকে গাড়ি যায় রামনগর গ্রামে আবার ফিরে আসে।তো আমি এভাবেই গাড়ি ধরি। কিন্তু সেদিন কোনো গাড়ি দেখতে পেলাম না। এমনই অন্ধকার হয়ে আছে যে একহাত দূরের কাউকে দেখা যায় না।
    হঠাৎ শুনলাম আমার কানের কাছে কে যেন প্যাঁ পুঁ শব্দে হর্ন বাজাচ্ছে। হকচকিয়ে গেলাম।কে রে বাবা! তারপর দেখি একটা রিক্সা। রিক্সার ছাদ কেমন গোলাপী রঙের ছাতা দিয়ে ঢাকা।
    আচ্ছা রিক্সাটা কখন এলো? কোনো আওয়াজও পেলাম না।উড়ে উড়ে এলো নাকি?আর রিক্সাওয়ালা তো ভিজে একাকার।মুখ, চোখ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তারমধ্যে আকাশও ঘোরতর অন্ধকার হয়ে আছে।
    রিক্সাওয়ালা বললো, "খোকা উঠে পড়ো। এই ঝড় জলে আর একা থাকতে হবে না।আকাশের গতিক ভালো নয়।"
    আমি বললাম, "তা তুমি কোথায় থাকো? তাছাড়া এই দুর্যোগের সময় তোমার ঘর থেকে বেরোতে ভয় করলো না?"
    রিক্সাওয়ালা বললো, "ঐ রামনগরের পরের গ্ৰামে গো খোকা। এত ভয় করলে চলে? তোমার জন্যই তো আসতে হলো। তুমি একা আছো"
    আমি শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আমার জন্য আসতে হলো?আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
    যাইহোক আর কথা হলো না মাঝপথে।রিক্সা চলতে থাকলো। কিন্তু রিক্সার গতিবেগ এত বেশি হতে পারে?এ তো ট্রেনের গতিকেও হার মানাবে! ভাবছিলাম, রিক্সাটা কি উড়ে উড়ে যাচ্ছে নাকি?চাকার কোনো আওয়াজ নেই।প্যাডেল করার আওয়াজ নেই। এসব ভেবে বুকটা যেন কেমন করে উঠলো।কার পাল্লায় পড়লাম রে বাবা, মনে মনে ভাবছিলাম। আধঘন্টার রাস্তা আমাকে দশ মিনিটে পৌঁছে দিল।
    রিক্সা থেকে নেমে টাকা বার করলাম। স্টেশনের অত আলোতেও লোকটার মুখ দেখতে পেলাম না। মুখ নিচু করে আছে। টাকা দেওয়ার সময় লোকটার হাতের ছোঁয়া পেলাম।সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা শরীরে যেন বরফের স্রোত বয়ে গেল! জীবিত মানুষের হাত এত ঠান্ডা হতে পারে? এ কার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি? কয়েক মুহূর্তের জন্য মাথাটা কেমন হয়ে গেল।চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল।যেই চোখদুটো ভালো করে মুছতে গেলাম দেখি লোকটা আর সামনে নেই।
    এ কি! কোথায় গেল? রিক্সা নিয়ে নিমেষের মধ্যে উধাও হওয়া সম্ভব? আমি অবাক হয়ে গেলাম।
    আর বেশি কিছু না ভেবে প্লাটফর্মের দিকে এগোলাম।
    এসে দেখি প্লাটফর্ম ভর্তি লোক। ট্রেন এখনও আসেনি। এই যা বাঁচোয়া। এতক্ষণ যে কোথায় ছিলাম তা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!
    যথা সময়ে ট্রেন এলো।ট্রেনে উঠলাম। অনেক লোক একসঙ্গে উঠলো।ট্রেন ছেড়ে দিল। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে।
    আমি জানলার ধারে বসে বিকেলের কথাগুলো ভাবছিলাম। ঘটনাটা ঠিক কী হলো?লোকটা কি হাওয়ায় উড়ে এলো? লোকটার ঐরকম ঠান্ড হাত?মুখটাও দেখা গেল না।
    আমার পাশের দুটো সিটে দুজন মাঝবয়সী লোক বসেছিল।তারা নিজেদের মধ্যে কী একটা দুর্ঘটনার কথা নিয়ে আলোচনা করছিল।আমি একটু শোনার চেষ্টা করলাম।
    ---"আরে দাদা, মণীন্দ্রদা কী বেঘোরে প্রাণটা হারালো আজকে,কপাল মন্দ ছিল খুব!"
    ---"ইস। খুব খারাপ লাগছে গো। বেচারা! রাস্তার ধারের আমগাছের একটা শক্ত মোটা ডাল এসে পুরো মাথায় পড়লো।আর কেউ বাঁচে?"
    ---"লোকটা বাড়ি থেকে রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছিল। রিক্সাচালক যে। কিন্তু কে বলবে ঐ বেরোনোই তার শেষ বেরোনো হবে?"
    আমার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো।এরা কার কথা বলছে?সেই রিক্সাচালকের কথা যার রিক্সায় আমি আজ এলাম? কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, "দাদা ঐ রিক্সার ছাদটা কি গোলাপী রঙের ছাতা দিয়ে ঢাকা ছিল?"
    ওঁদের মধ্যে থেকে একজন বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাদের ঐ রামনগর থেকে এই চাঁপাডাঙা পর্যন্ত ঐরকম রিক্সা আর কারও নেই। তাই মণীন্দ্রদাকে চিনে নেওয়া খুব সহজ।কেন ভাই তুমি চেনো নাকি লোকটাকে?"
    আমি বললাম, "না না আমি চিনি না।"
    লোকটি আবার বললো, "তাহলে হঠাৎ ঐ ধরনের ছাতার কথা বললে কেন?"
    আমি বললাম, "আরে না না আমি এমনি বললাম।"
    আমি সিট ছেড়ে উঠে এলাম। আমার বাড়ির স্টেশন চলে আসছে।আর আমি লোকদুটোকে বলবোই বা কী যে আমি ঐ মণীন্দ্র নামের লোকটার রিক্সাতে করেই এসেছি?আমাকে তো পাগল ভাববে। আর আমি আজ পর্যন্ত এতদিন স্কুলে এসেছি ঐ পথে, কিন্তু অমন রিক্সা দেখিনি।এটা আর এমন কী? সবসময় কি সব গাড়ি চলাচল করে?পরে নিশ্চয়ই দেখতে পেতাম।কোনো না কোনো দিন হয়তো উঠেও পড়তাম।
    লোকদুটো কেমন সন্দেহের চোখে আমাকে দেখতে লাগলো। আমার তখন শরীরের ভিতর যে কী হচ্ছিল তা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না।
    আমি কার সঙ্গে স্টেশনে এলাম তাহলে? এক প্রেতাত্মার সঙ্গে? হাত পা প্রচন্ড ঘামছিল।মাথা ঝিমঝিম করছিল।
    ট্রেন হুইসেল দিয়ে আমার গন্তব্য স্টেশনে ঢুকলো।

    ৩/১০/২০২৩
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন