এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  স্মৃতিচারণ   নস্টালজিয়া

  • হারানো লেখা : বাংলালাইভ

    Archive
    স্মৃতিচারণ | নস্টালজিয়া | ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ২৭২২ বার পঠিত
  • কালের নিয়মে বেশ কিছু ওয়েবসাইট থেকে নানান লেখাপত্র হারিয়ে গিয়েছে। তার কিছু আর্কাইভ ডট অর্গ এর ওয়েব্যাক মেসিন থেকে উদ্ধার করা সম্ভব। এরকম সাইটের সংখ্যা কম নয়। হারানো লেখাপত্তরও অসংখ্য। উদ্ধারসম্ভব লেখা সে তুলনায় নগন্য। এরকম সাইটের কথা মনে করিয়ে দিতে পারেন পাঠকেরা, এখানেই।
     গুরুচণ্ডা৯ শুরুর আগে থেকে যে সাইটে আড্ডা তক্কাতক্কি মাখা বাংলা লেখালেখি, সেটা বাংলালাইভ। সেও ইউনিকোডের আগের পৃথিবী। তার ফন্টের নাম : BanglaFontNormal.ttf যেমন গুরুর ফন্টের নাম ছিল Banglaplain.ttf
    সেখানের হারিয়ে যাওয়া লেখার যেটুকু যা পাওয়া যায় এই টইতেই তুলে রাখব ভেবেছি। এরকম অন্য সাইটের কথা মনে পড়লে সেই সাইট স্পেসিফিক অন্য টইও খোলা যাবে। 
    গুরুর হারানো লেখাপত্তর গুরুর রোবোটেরা আর্কাইভ থেকে খুঁজে নেবেন আশা করি। তার জন্য আলাদা স্পেসিফিক টই ও রয়েছে। আমি আর সে চেষ্টা করছি না।
    এই লিংক থেকে বাংলাপ্লেন ও বাংলাফন্টনর্মাল এর টেকস্ট ইউনিকোডে কনভার্ট করা যায়। সেভাবেই এই উদ্ধারকার্য চলবে। অনবধানে কিছু ইংরিজিতে লেখা শব্দ কনভার্ট হয়ে অদ্ভুত অক্ষরসমষ্টি হয়ে যেতে পারে। এই ট্রান্সলিটারেশন পাতায় আবার ইউনিকোড থেকে বাংলাপ্লেন-এ সেই অক্ষরসমষ্টি কে কনভার্ট করে নিলেই মূল ইংরাজি টেকস্টটা পাওয়া যাবে। 
    কালাতিক্রম দোষ মেনে নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবেই সবচেয়ে প্রিয় লেখাটিকে প্রথমে রাখব। 
     
    ===========================================================
     বিভাগ : গল্প, প্রকাশ : Jan 16 2006, আর্কাইভ লিংক
     
    নিহত অশ্বের স্বরলিপি
    ইন্দ্রনীল ঘোষদস্তিদার
      
    অশ্ব হইতে এ আখ্যানের আরম্ভ। অশ্ব স্বভাবত বেগবান, ইন্দ্রিয়জ। অশ্বময় দ্বীপরাষ্ট্র, প্লাবিত বেলাভূমি ও নারিকেলের বনমর্মর। তথায় বনবাসিনী, প্রশান্তসাগরীয় দ্বীপবালিকা, তাহার ভ্রুমধ্যে আনত উল্লাস, বঙ্কিম চপলতা ও রিনিঠিনি। পুষ্পসাজ। নৃত্যভঙ্গিমা।

    দেখিবেন, মানবী নৃত্যে উদ্যত হইলে দিবাকর তরল হয়েন, অস্তমিত হয়েন। আইল মেঘরাগ, ধাইল বর্ণচ্ছটা। দিনমণি সমুদ্রপারে, যেন বিগতস্পৃহ, সুখী, স্থবির যেহেতু প্লাবিত মনুষ্যরূপে। দেহসুখের, আনন্দভঙ্গিমার শীর্ষে মধ্যবিত্ততায় আক্রান্ত পদ্মবনের সততসতর্ক প্রহরী যেইরূপ। তাঁহার সপ্তাশ্বরথ সংবরণ করিলেন।

    অশ্বে প্রত্যাবর্তন হইল। তুরঙ্গ হইতে মুক্তি নাই। উহা ব্যতীত গতি নাই।

    অপিচ বিপন্ন অশ্ব। মন্থরগামী,যেহেতু গ্রামদেশে সন্ধ্যাযোগে আন্ধার ঘনাইল দ্রুত, বিজলি মিলিল না শত পিটিশনান্তে, শঙ্খ বাজে নাই, মুর্শিদাবাদী মুসলমানি গ্রাম, চেরাগ জ্বলিল দরগায়। কিশোর ছিন্ন পুস্তকখানি খুলিল। ইহা কুয়াশা হয়, এই বিপন্নতা, কর্তিত শস্যক্ষেত্রে অশ্ব একাকী চলিল পদব্রজে। কিঞ্চিৎ বিভ্রম, মস্তকোপরি মশকাদি পতঙ্গের ঘূর্ণমান বলয়। পাটকিলা অশ্বখানি যায়, শ্বেত অক্ষি, শ্বেত পুচ্ছ। রেললাইন পার হইতেছিল, এই লগ্নে ধাবমান যন্ত্রদানবের সহিত সংঘর্ষ রচিলে অজানা আশঙ্কা উতরোলে, গতি গতিরে গ্রাসিবে, মধ্যসাগরে নিম্নমেধা তরীদেহে সূক্ষ্ম কলরোল, উহাতে জালিকেরা শিহরিয়া সুপ্ত শিশুমুখ স্মরে, হা দরিয়ার পীর।

    কিন্তু কোথা হে যন্ত্র! আদিমতায় আক্রান্ত চরাচর, এই গ্রামরাষ্ট্র। গ্রামধরণী। সন্ধ্যাগমে খদ্যোতশাসিত  এ রজ:স্বলা রাত্রির নাগরচন্দ্রমা অথবা তাহার বিকল্পতা, শীতলতা ও গন্ধরাজের বিশীর্ণ সৌরভ, জলতন্ত্র হতে উঠিছে নিয়ত উদাসী বাষ্প, হিমে হিম , কদাচ অগ্নিতে দ্রব। নিন্দুকে আলেয়া বলে থাকে।

    এই সে বাষ্প, প্রণয়ে প্রখ্যাত, ইহারে স্মৃতি বলে-আবরিছে ভ্রম ও তাহার মহাপথ, পথিপার্শ্বস্থ চটি, তৃষ্ণা নিবারণের চায়ের বিপণী, গ্রামীণ, ভগ্ন। কুপি ও তাহার আলো, কেরোসিন শিখার শীর্ষ হইতে উত্থিত কালিমা, অশ্বটি চাহিয়া দেখে। দুইটি প্রাচীন মানব, প্রাচীন অস্থি, প্রাচীন বল্কল। এ পথে দেবানামপ্রিয়দর্শী অশোক একদা দিগ্বিজয়ে গিয়াছিলেন, নবদ্বীপমণি স্মার্ত রঘুনন্দন হাঁটিলেন, নিমাই পণ্ডিত আঁখিলোর ও প্রেমগানে ভিজাইলেন, পশ্চাদে কত শত পারিষদবর্গ, হরিবোলধ্বনি, ধৌত সফেদ ও পীত বস্ত্রাদি, পীত উত্তরীয় পিচ রাস্তায় লুটায় হে, কেশব ভারতী ঐ দেখ, দেখ নিত্যানন্দ মহাপ্রভুরে, যবন হরিদাসে আলিঙ্গনপাশে আবদ্ধ করিয়া কান্দে বিবিধমন্দ্রে। এ দুইটি মানব সাক্ষী। অক্ষয়বট সাক্ষী,অশ্ব তাহার শাখামূলে রজ্জুপাশে আবদ্ধ আছিল।

    আমি ভ্রমিয়া বেড়াই; ইহা দৈব, বিধিনির্দিষ্ট,অশ্বের পশ্চাতে মনুষ্য রাখিয়া দিগ্বিজয় সৃজন করিবেন প্রজাপতি। অশ্বমেধ যজ্ঞ। গান্ধার হইতে পৌন্ড্র, প্রাগজ্যোতিষপুর, মণিপুর, দ্রাবিড় বনাঞ্চল হইতে কাশ্মীর ব্যাপিয়া সুকেশিনী এ ফলভারানত জম্বুদ্বীপে অশ্বটির চলাচল। অব্যহত হউক, নির্বাধ হউক-রাষ্ট্র ইচ্ছিল ভারতে। সৃজিল রেশমপথ, ব্যবসায়, মধ্য এশীয় মরুবালু; তাহাতে বিকীর্ণ সূর্যতাপ, কি খর, কি যে ভানুমতী। অশ্ব, ঐ দেখ, তোমার করোটি বিদীর্ণ হয়ে আছে, মাংস নাই এক কণা, শবভোজী গৃধিনীকূলের উল্লাস দেখ, চক্রাকারে পাখসাট মারে, গিরিকন্দরে-কন্দরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হো-হো রব, তুরগ, হে প্রিয় প্রাণ, তুমিও কি অভিসম্পাতী আকাশে ক্ষণেক আত্মবিস্মৃত চাহিলে? বিস্মৃত বালুকা খনিয়া তুলিতে মৃত জনপদ জাগে, জাগে শুষ্ক চর্মাস্থিসার মৃত শরীর, কেহ শিশু, কেহ নারী, লম্পট ও অকৃতদার, সাধু ব্যক্তি তথা কুসীদজীবী, কাহারো মস্তক চূর্ণ, কত বা প্রাকার, বিশুষ্ক পয়:প্রণালী, নগরসভ্যতা, রত্ন আভরণ, মণিময় সিংহাসন-হা, কালের প্রহারে জীর্ণ। জাগে মৃত অশ্ব। অশ্বসভ্যতা। যাহারে ছাড়িয়া শুদ্ধোদনসুত আষাঢ়পূর্ণিমারাত্রে চলিলা, একাকী, নগরপ্রান্তে সভ্যতার গতিবাহী শ্লথ মূক পশু নীরবে ফিরিছে দেখ।

    হে গৌতম, অমৃতলোভী, হে আত্মদীপ, আমারে, এই কন্থক অশ্বটিরে কোথায় রাখিয়া গেলেন? কোন আস্তাবলে, কিবা সহিসী পীড়নে, এ পরদেশে কে রবে হায়! একদা ধান্যক্ষেত্র-জলাভূমির ই. এম বাইপাসে এ কোন মায়ারজ্জুপাশে আক্রান্ত , এ কি  হে বিভ্রম, নিয়ন আলোকিত বিলবোর্ডে যুবতী রমণীর চিক্কণ ঈশারা, বারিবিন্দু,বৃষ্টিবিন্দু, মদ্যপের কিঞ্চিদধিক আত্মার প্রগলভতায় ছয় কার্ষাপণে বিক্রিত হইলাম। নীলামবাজারে। পথে একটি  সারমেয় নাই, রাত্রিজীবী মোটরযানের হুসহাস শব্দ, হেডলাইটের বিষন্নতা, রঙ্গিলা নগরী ও ছায়াশরীরী গ্রামভারতের কাঁটাতারে উচ্চকিত বিসর্পিল সীমান্ত  বরাবর একাকী, জলহীন। নদীহীন। মধ্যরাত্রির নিরালোক নগরবাজারে গলিত আবর্জনা ও শল্কফলাদির স্তূপ,যৌনচিকিৎসার হ্যান্ডবিল উড়ে অসুখী বেতনহীন হাওয়ায়, ভ্রান্ত অশ্বত্থামা  খুঁজিয়া ফিরে শিরোমণি, লোকে পাগল বলিবে আগামী প্রভাতে। নগরীর ঘরে ঘরে কালান্তক শিশুঘাতী বাণে ভ্রূণগুলা গর্ভে শুখাইল, ভ্রূণপ্রশ্নে মনে আসে আমিও চলিব নাইটডিউটিতে, এই অশ্ব আমার বাহন, এই বি.টি রোড আমার  রাজসড়ক, রাত্রি আমার উদযাপন।

    তাই অশ্বে আরোহণ, তাই গতি, পাঁচমাথা ও নেতাজীমূর্তি ছাড়াইয়া, মানিকতলা পশ্চাতে ফেলিয়া, শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন বামে রাখিয়া আমি কর্মক্ষেত্রে , নীলরতন সরকার হাসপাতালে পৌঁছিলাম। অশ্ব হইতে অবতরণ করি, গতি নষ্ট হয়, স্থিরোভব,আমি সহজ হইলাম, হইতে থাকি, হয়েছি। লেবার রুমে ঢুকতে বমি পায়। এখনো পায়, এতদিন পরেও। আঁশটে গন্ধ। গন্ধ মানে মলিকিউল। অলফ্যাকটরি বাল্ব বেয়ে, কোটি কোটি নিউরোন বেয়ে কেমিক্যাল মেসেঞ্জার  বিদ্যুৎতরঙ্গ হয়ে চিঠিরা পৌঁছে যায় যে যার বেগুনি বাক্সে। অতিদূর সমুদ্রের মাঝখানে শ্যামলা, একহারা অরক্ষণীয়া দ্বীপে চার্চের স্ফটিক ঘন্টা বাজে পরাক্রমী হাওয়ায়,আর কি বা করবার থাকে ঘন্টা অথবা হাওয়ার! জনহীন দ্বীপ, গির্জার দেয়ালে ফ্রেস্কো, চিত্রবিচিত্র রঙ্গিন কাচে সমুদ্রের গুঁড়ো নুন। পচা মাছের গন্ধ, অনৈসর্গিক।

    ঘুম পায়, যে ঘুম আমি আশুপ্রসবিণীদের দিলাম; জন্মপদ্ধতিকে দিলাম। এই ভাঙা অ্যাম্ফিথিয়েটার, এর চারপাশে পাক খায় ঘর-গেরস্থালির কুকুর-বেড়ালেরা। প্ল্যাসেন্টা, ছিন্ন কর্ড, অ্যামনিওটিক ফ্লুইড ভেজানো ছোট ছোট সুখ মুখে নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে জিভ চাটার স্বাধীনতা। চোখের আপত্তি হয়। ভালো কথা নয়।
    ভালো নয় এত অগণিত শিশুজন্ম। ভুলভাবে জন্মায় বাচ্চারা- গ্যারাজে, ভাঙা নৌকোয়, পরিত্যক্ত রানওয়েতে। কলতলায়, শ্যাওলা জমে পিছল। পিছল শিশুরা, গতজন্মের শিশুরা, গতজন্মের শ্যাওলা নিয়ে জন্মায়। জন্মদাগ নিয়ে। কেউ কেউ লেবার রুমেও জন্মায়। তারাও অসংখ্য , অগণন। শরীরের তুলনায় বড়সড় মাথা, হতদরিদ্র ঘিলু। ভাবে না, শোকতাপ নেই, কবচকুণ্ডলহীন শুধু জন্মে যাওয়া। বিস্ময় থাকে? যেমন বিস্ময়ে, কিঞ্চিৎ খেদে-অভিমানে, ভরা একাডেমির হিম স্টেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গৌতম হালদার বলে উঠবেন-এ আমি কোথায় এলাম! জন্মাতেই থাকে ওরা। লাল, নীল, সবুজ, গোলাপি বাচ্চারা, বেলুনের মতো ফোলানো বাচ্চারা। বাচ্চাদের মতো দেখতে বেলুনেরা। এক এক সময় এত বাচ্চা জন্মে যায়, লেবার রুম থই থই করে। প্রতিটি তাকে, প্রত্যেকটা বাক্সে, আনাচে কানাচে, গলি-ঘুঁজিতে বাচ্চা। বাচ্চা ঝুলছে সিলিং ফ্যান থেকে। বাথরুমের কল খুললে ঝরে পড়ে বাচ্চারা। আমরা গ্লাভস পড়ার সময় পর্যন্ত পাই না, যন্ত্রের মতো ডেলিভারি করাই। সাবধানে পা ফেলি, মেঝের চারদিকে জমে উঠেছে বাচ্চার স্তূপ। ওরা হাসে, কুয়াশার ঝাউবনে একজন-দুজন করে মিলিয়ে যায়। শ্রেয়বোধে। মনস্তাপহীন।

    আমি শিশুময় দেখি পৃথিবী। বিগতজন্ম দেখি, সাইকেল দেখি। সন্দীপের সাইকেল। আমরা শীতের দুপুরে যাই, নীলগঞ্জ রোড খোলস ছাড়ে মন্থর বহুবল্লভা সাপিনীর মতো। দুপাশে মাইলের পর মাইল সর্ষেক্ষেত দেখি, আর নীল দিগন্ত। ফুলের আগুন বোঝাবেন রেজওয়ানা চৌধুরী। এই  বোঝা, আগলে রাখি একে, আমি আবার জন্মাই আর জন্মদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসার অনেক, অনেক পরে লেবার রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকি। জন্মক্রিয়ার মধ্যে আবার, জন্ম আচারে। কেননা অগ্নিতে ঘৃত অর্পণ করিব, তৈলসিন্দূর, খই ছড়াইব। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে অনন্ত নীলগঞ্জ রোড। দুপাশে বাচ্চাদের ক্ষেত, হলুদ ফুলে ঝকমক করছে। হা জীবন, এ আমি কোথায় এলাম!

    এইখনে নব্যেন্দুর সঙ্গে দেখা হবে। নব্যেন্দুর কেফালহেমাটোমা হয়, একটি দীর্ঘ প্রসবক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের এক কুয়াশাময় রাত্রে নব্যেন্দুর মা ওদের দুজনকে মোচন করেন। নব্যেন্দুদের। বন্যা রাতের আহত মহানন্দার মত আপগার স্কোরের বিপদসীমা অতিক্রম করা ছাই-ছাই বর্ণ ফ্লপি হাত-পায়ের নব্যেন্দুকে বাঁচাতে  পারব ভাবিনি। পিত্তসবুজ মেকোনিয়াম শ্বাসনালীতে নিয়ে ফেলা নব্যেন্দু, শীতল নব্যেন্দুকে রিসাসিটেট করে বেবিকটে জীবনের উষ্ণতায় শোয়ানো হলে চোখ খুলে নব্যেন্দু বলে, কেমন আছেন, ইন্দ্রনীল?  
    নব্যেন্দু অর্থৎ নব্যেন্দু ১। ১, কেননা যে যার নিজস্ব সুবিধামত আমরা, ভাষাময় জীবিত প্রাণীকূল বেঁচে থাকাকে মৃত্যুর আগে স্থাপন করেছি এবং মৃত্যুকে জীবনের অপর হিসেবে দেখতে অভ্যাস করলাম। যুধিষ্ঠিরকে দ্রোণাচার্য বললেন-কি দেখছো, বাছা? যুধিষ্ঠির, সত্যবাদী ধর্মনিষ্ঠ, বললেন-সমগ্র বৃক্ষ। পক্ষীটি। উহার জননপদ্ধতি, মা-পাখির ডিমে তা দেওয়া। আমি উষ্ণতা দেখলাম, হে মহাগুরু। আমি শীতল সরীসৃপকেও  দেখলাম, ঐ যে গাছ বেয়ে উঠছে পাখির ডিমের লোভে। ঐ পক্ষীটি মহাব্যধিগ্রস্ত হইতেছে, কাল উহাকে হরণ করিবে, মহারাত্রি সকল দিনাবসানে আসিবেন ধ্রুবচরণে। তাঁহার নূপুরনিক্কণ শুনিলাম। জীবন সান্ত। ঐ রুনুঝুনু অনন্ত। এই বৃক্ষ বিনষ্ট হইবে, আপনি বিনষ্ট হইবেন, ঐ কোটরস্থিত শাবককূল, রথীবৃন্দ, পদাতিককূল, ধার্তরাষ্ট্রগণ, পান্ডবসেনানী ও যদুবংশ। মুষল প্রসব করিবেন শাম্ব। দ্রোণ বিরক্ত হলেন। অর্জুন এসে বলল, আমি পাখির চোখ দেখছি। সফলতা দেখছি। দ্রোণ খুশি হলেন। অর্জুন প্রথম হল। একনম্বর। আমরা জীবনকে প্রথম করে দিলাম। তেজী ও বেগবান বাজিরাজি তাঁহার রথে নিযুক্ত করিলাম, যদুপতি স্বয়ং সারথ্য স্বীকার করিলেন। অশ্বগণের হৃদয়ের পরিমাপ তো কেহ লইল না। তাই ১ নম্বর। দ্বিতীয়  নব্যেন্দু তো কাগজ, তামাগন্ধী, সব  লেখা মুছে যাওয়া প্যাপিরাস, ভুর্জপত্র যাহা হইতে বিধাতা তাঁহার স্বাক্ষর প্রত্যাহার করিলেন, দত্তাপহারক। ফিটাস প্যাপিরাসিয়াস। নব্যেন্দু থেকে গেলো। অনন্ত এপিসিওটমির ফাঁকে ফাঁকে, অগণিত জন্মসহায়তার ফাঁকে ফাঁকে আমরা গল্প করতাম, নব্যেন্দু আমাকে লেখালিখি করতে বলত। উস্কানি দিত সবসময়। আমি বলতাম,-গল্প বলুন, নব্যেন্দু। নব্যেন্দু খুশি হত, বলতো- ঘোড়ার গল্প শুনুন তবে।

    আদিতে ছিল ঘোড়া। ঘোড়ার  ধবধবে সাদা রং, যেন বরফের ফুল, নাকের ফুটোদুটো গোলাপি। যেখানে পাথরে পাথরে টুং টাং আওয়াজ করে ছোট্ট দস্যি মেয়ের মতো রুপোলি ঝর্না নেমে আসছে, দুধারে ঝুঁকে পড়েছে ঘন সবুজ সব গাছ, যাদের ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ্দুর এসে পড়ে কি পড়ে না, ঘোড়া সেখনে জল খেতে যেত। শীতে গাছের পাতারা হলদে হত, লাল হত, ঝরে পড়তো রাশি রাশি, আর কিশোরী মেয়ে ঝর্না তাদের ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের মাথায় মাথায় নাচিয়ে নিয়ে ফেলত নদীতে, নদী বয়ে নিয়ে যেত সমুদ্রে। ঘোড়া সেখানে কোনদিন যায়নি। সেখানে হলুদ বালি, কালচে পাথরের খাঁজে বাসা বেঁধেছে সাদা সাদা পাখি, গোলাপি ছানারা না-ফোটা চোখ নিয়ে সোরগোল করলে মা-পাখি সমুদ্রের মাছ ধরে এনে খাওয়ায়। বসন্তে ছোট্ট, মিষ্টি, হলদে-সাদা-গোলাপি ফুলে ভরে যেত সবুজ ঘাসে ভরা পাহাড়ের ঢাল। ঘোড়া ঘাস খেতে খেতে একলা চোখে কোন দূরের দিকে যে তাকাত ! গলার কাছটাতে কি একটা সুর গুণগুণিয়ে উঠেই থেমে যেত। গাছেরা  বলত-গান গাও, ঘাসফুলেরা বলত গান গাও, পাখিরা বলত-গান গাও, ঘোড়া। হায়, ঘোড়া গান গাইতে শেখেনি!

    একদিন আর থাকতে না পেরে বিধাতার কাছে গিয়ে আর্জি জানাল সে। একলা লাগে বড়, আমাকে একজন বন্ধু দিন, সারাদিন আমায় গান শোনাবে। গান গাওয়া তো হল না আমার।
    বিধাতা তখন ঘোড়ার  বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন মানুষ। মানুষ গান নিয়ে এল পৃথিবীতে, মেঘ-আলো-নীল পাহাড়ের গান, কাঠবেড়ালীর গান। ঘোড়া আর মানুষ দিব্যি সুখে থাকতে লাগল। কিন্তু মাটির তলার সাপ, সবুজ রং, চেরা জিভ- ও কেন প্রায়ই মানুষের সংগে দেখা করতে আসে, ফিসফিস করে কথা বলতে চায়? প্রথম প্রথম রেগেমেগে তাড়িয়ে দিত মানুষ। একদিন আর তাড়াল না। পরদিন ভোরে যখন পুবদিক লালচে, পাখিরা প্রার্থনা গাইছে, হলদে ব্যাঙ টুপ করে লাফিয়ে পড়ল জলে, মানুষ ঘুম থেকে উঠে ঘোড়াকে বলল-আমায় স্বর্গের বাগানে নিয়ে যাবে?

    নিষিদ্ধ বাগান, যাওয়া বারণ। ঘোড়া অনেকবার বোঝাল, অনুনয়-বিনয় করল; মানুষ কিন্তু একগুঁয়ে, জেদি, নাছোড়বান্দা। তাছাড়া কিছু তো আর ছুঁচ্ছি না, দেখব শুধু চেয়ে। অগত্যা দু:খী ঘোড়া, মানুষ-ভাইয়ের ভালোবাসায় কাহিল ঘোড়া মাথা নিচু করে ভাইকে নিয়ে চলল বাগান দেখতে। এই শর্তে যে বাগানের একটা পাতাতেও হাত দেওয়া চলবে না।

    রাত নামলে মেঘের ডানায় ভর করে সবুজ অন্ধকারের মতো গর্তের সাপ উড়ে গেল, বিধাতার বাগানের অমৃতফলটি, বিধাতার প্রিয় অমৃতফলটি মুখে করে ফিরে আসবে বলে। আর পরদিন ভোরবেলা বিধাতা উঠে দেখলেন অমৃতবৃক্ষ ফলহীন, বাগানময় ঘোড়ার পায়ের ছাপ।

    শাপগ্রস্ত হল সেদিন থেকে ঘোড়া। আদিগন্ত সাভানায় ঘুরে বেড়ানোর মতো পায়ে কুটিল ধাতুর নাল চেপে বসল। মানুষের মনসবদার হল ঘোড়া।

    এই সে অশ্বপুরাণ, ইন্দ্রনীল, ইহা একান্ত মানবিক হইল, অশ্বে এ দায় অর্পণ।  স্বাধীনতার এইরূপ হনন।
    আসুন, নিহত স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন  করি। ফুলের তোড়া জমে উঠুক, সুগন্ধী মোম জ্বলুক। অর্ধনমিত রাখি পতাকা।

    জ্বলুক তবে মোম। জ্বলুক জ্বলুক চিতার অনল। গণচিতায় শুয়ে অছে টুইন টাওয়ারের ক্যাজুয়ালটি, লন্ডন  বোমার ছিন্নহাত ছিন্নমুণ্ড লাশ। জ্বলুক তবে বাগদাদ, জ্বলুক কান্দাহার। লাফিয়ে উঠুক পতাকা, উর্ধশির আলোকশিখা। সাম্য , মৈত্রী, স্বাধীনতা। কোল্যাটারাল ড্যামেজ। দুর্দান্ত স্প্যানিশ ইস্পাত ঝিকিয়ে উঠুক দক্ষিণ মহাদেশের কোস্টলাইন বরাবর, যখন দাবানল ঘিরছে সকল ঘুমের গ্রাম। স্থিরপায়ে, অবহেলাময়। আমাদের একটা দেশ ছিল। সবুজ দেশ। তামার খনি ছিল। আমাদের ছিল বর্ণমালা, সহজ, মোটাসোটা, ঝোলা স্তন। কালো মেয়েরা যেমন হয়। নিষাদ ও নি:সংশয় পুরুষ ছিল, দেবতাত্মা বৃক্ষ ছিল। ঘুমের গ্রাম।

    ঘুমের জলে ভেসে উঠি আমরা, একটি অ্যামিবাসদৃশ প্রাণ। একোহং। বহুষ্যাম। বহু হইব বলিয়া বিভাজিত হইলাম, আমি ও নব্যেন্দু। নব্যেন্দুগণ। এক নিউক্লিয়াস বহু হইল, দুই পৃথক কোষপুঞ্জ হইলাম, দুই পরিপূরক সত্ত্বা। দুই  ভ্রাতা, সহোদর। ক্রমে জল নামিল, দেখা দিল স্থলভাগ। আমরা মৎস্য আছিলাম, স্থল ক্রমেই বাড়িতেছে বলিয়া উভচর হইলাম, সরীসৃপ, পক্ষী ও মেরুদণ্ডী হইলাম। নব্যেন্দু, সরল নব্যেন্দু, গতিপ্রত্যাশী নব্যেন্দু অশ্ব হইবার লাগিল। কেননা ছুটে বেড়াবার জন্য রয়েছে  অনন্ত প্রান্তর, অনন্ত গ্রহ। আর আমি, এ চারণভূমির গান গাহিব বলিয়া, স্বাধীনতার মোহিনী দেবীর বাতায়নতলে দীপশিখাময় প্রেমগান গাহিব বলিয়া  ত্রুবাদুর হইলাম, মনুষ্যস্বরূপ।

    ফিটাস প্যাপিরাসিয়াসের জন্মরহস্য জানেন? যমজ প্রাণযুগলের একটি যখন প্রবল হয়ে ওঠে, মাতৃগর্ভে তখনও, শুষে নেয় সকল অম্লজান, প্রত্যেক পুষ্টিকণিকা যা ঐ আমবিলিক্যাল কর্ড বেয়ে সমধারে  নেমে এসে দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল এক মিছিলে সমানতালে হাঁটবার, এক নদীতীরে সূর্যাস্ত দেখবার। হায়, সে আলোর ফলে কীটরূপী তক্ষক প্রবেশ করিলেন, আমি আত্ম-পর ভেদ শিখিলাম। দেখতে দেখতে ফুলেফেঁপে  উঠি আমি, প্লেথোরিক শিশু। আর নব্যেন্দু, প্রাণবিহনে, মেঘজলবিহনে  যেন ধানের বুকের দুগ্ধবিন্দু, শুকিয়ে কঙ্কালসার। বলিরেখাময়, জরাজীর্ণ। প্রাচীন  অশ্বের মমি, মিশরীয়। সুদূর।

    এইভাবে জন্ম নিলাম আমরা, ইন্দ্রনীল, আমি ও নব্যেন্দু-নব্যেন্দু আমাকে বলে। প্লেথোরিক  শিশু। নব্যেন্দু ১। অন্য  নব্যেন্দু  তো কাগজ, তামাগন্ধী, সব লেখা  মুছে যাওয়া প্যাপিরাস।

    রাত শেষ হয়। ডিউটি শেষ হয়, কাজ তো অনন্ত  নয়। আমি দিনের আলোয় বাড়ি ফিরি। সহজ, সাধারণ  মানুষ যেভাবে  ফেরে। ট্রেনে ওঠে, সিট পেলে বসে। তাস খেলে, গল্প করে। রুমালে ঘাম মোছে। তারপর নেমে যায় যে যার নিজস্ব স্টেশনে।

    কুয়াশার  মধ্যে অথবা দিনের আলোয় জেগে ওঠে এক অন্য চরাচর। যেন আমার এই বাড়ি ফেরা মিথ্যা, এই রিক্সার ঘন্টি মিথ্যা। রিক্সাওয়ালার জালি গেঞ্জি নেই। হ্যান্ডেলে রানি মুখার্জির ছবি নেই। চারিদিকে জল, শুধু কূলহীন উন্মাদ জলরাশির মধ্যে , প্রলয়সাগরের মধ্যে নেমে আসছে মাতঙ্গী বৃষ্টির ধারা, ভীমা, ভয়ঙ্করী। আমি ডুবে যাই আকণ্ঠ, হায়, কাকে বলি রক্ষাশব্দ, একখানি ভগ্ন মাস্তুল, একটি নিষ্পরাগ ছিন্নদল পুষ্পও যে দৃষ্টিগোচর হইল না। যাপিত জীবন স্মরণ করি বিভ্রমে, সভয়ে, স্মরিলাম সকল ঋণ। মনে পড়ে ঐ প্রতীক্ষার মুখখানি, রেলব্রিজে, একা, বত্তিচেল্লির ভেনাস। ঐ সে শকুন্তলা, ঐ মিরান্দা। অসহ্য বোকা। ধূর্ত নাবিক, আমি এক ফার্দিনান্দ, আনখশির দুষ্মন্ত, সরে গেছি অকূল সাগরে আলোকবিন্দুসম দূরতম লাইটহাউসের দিকে। প্রতিশ্রুতি থেকে নিরাপদে বহুদূর।

    দিগন্তে কড়কড় শব্দে ক্ষণপ্রভা ঝলসে কালানলসম তেজে, ছিন্ন করিয়া এ প্রলয়াকাশ। সহসা অশ্বক্ষুরধ্বনি জাগিল  সঘন, জাগিল তীব্র হ্রেষাধ্বনি ভৈরবে। আকাশে, ভূতলে, পাতালে। সপ্তনরকে।

    হৃদয়কন্দরে গ্যালপ রিদম জাগিলে, বিষনীল সুখাবেশে মূর্ছিত হইবার পূর্বমুহূর্তে জানিলাম-আমিই সে নিহত অশ্বের সহোদর।

    অশ্ব আমাতে নিহিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • যোষিতা | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:২৪741407
  • হ্যাঁরে আমার লেখাগুলো খুঁজে দিবি? প্লীজ।
  • 1 | 185.220.101.135 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:৫৭741408
  • হাজার বছর ধরে
    যোষিতা ঘোষাল

    আজ মহালয়া, সন ১৩৫০ বঙ্গাব্দ।

    ঢাকা শহরের লক্ষ্মীবাজার অঞ্চলের এই বনেদি বাড়িটাতে দেবীর আবাহনের আনন্দে আজ সাজ সাজ রব পড়ে গেছে।

    এ বাড়িতে পুজো হয় না, কিন্তু পুজোর ছুটির আনন্দে সবাই মশগুল।

    বেলা এখন সাড়ে দশটা এগারটা; বুড়িগঙ্গার তীরে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পন শেষ করে বাড়িতে ফিরে এসেছেন বাড়ির কর্তাসহ বাকি সব পুরুষ সদস্য।

    আজ কারও অফিস কাছারি নেই, ছোটদের ইস্কুল-কলেজ ছুটি, দুপুরের খাওয়া হতে হতে আজ দুটো আড়াইটে হবেই। একান্নবর্তী এই পরিবারে দুটো রান্নাঘর, আমিষঘরে মেয়েবৌয়েরা রান্না করতে ব্যস্ত, আর নিরামিষ রান্নাঘরে ঢাকাই পরোটা তৈরি হচ্ছে, কর্তাদের জন্যে ছুটির দিনের জলখাবার।

    এ বাড়িটার দুটো অংশ, বার-বাড়ি আর ভেতর-বাড়ি। ভেতর-বাড়ি বলতে অন্দরমহল, যদিও বাড়ির মেয়েরা কেউই পর্দানশীন নয়।

    বার-বাড়িতে রয়েছে বৈঠকখানা, চাকরবাকরদের ঘর, আরও গোটা তিনেক ঘর আর ছোট্ট মতন লাইব্রেরি ঘর। গৃহশিক্ষক এলে ওই লাইব্রেরি ঘরেই পড়তে বসে ছেলেরা।

    আরেকটা ঘর বাড়ির বড়কর্তার ওকালতির চেম্বার, সেখানে শুধু মক্কেল, মুহুরিবাবু, এদের আনাগোনা।

    তবে আজ উৎসবের দিন, ও ঘরগুলো বন্ধ।

    বাড়ির বড়কর্তা ঢাকা কোর্টের নামকরা উকিল, বয়েস পঞ্চাশ ছুঁয়েছে, রাশভারি মেজাজের মানুষ।

    বড় বৈঠকখানায় বসেছে আড্ডা, তাসখেলা চলছে না বটে, তবে আড্ডা জমে উঠছে ধীরে ধীরে। এ বাড়িতে চায়ের নেশা ঢুকে গেছে, বড় থালার ওপরে গোটা পাঁচেক কাঁসার গেলাসে করে চা এনে তেপায়ার ওপর রাখল চাকর মৃত্যুঞ্জয়।

    চা পাঠানো হয়েছে শুধু কর্তাদের জন্যে, আড্ডায় উপস্থিত থাকলেও বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে ছোকরারা চা খাবার স্পর্ধা রাখে না এই বাড়িতে।

    কর্তারা একে একে চায়ের গেলাস হাতে তুলে নিয়ে সবে এক আধটা চুমুক বসিয়েছেন, দরজার সামনে দেখা গেল এক আগন্তুককে।

    বৈঠকখানাঘরের অনেকগুলো দরজা, আর দরজাগুলো সবসময়ই হাট করে খোলা, বিশেষত: কর্তারা উপস্থিত থাকলে বা উৎসবের দিন হলে তো দরজা বন্ধ করবার প্রশ্নই ওঠে না। আগন্তুক এক বছর তিরিশেক যুবক, পরনে ধুতি পাঞ্জাবির পরিবর্তে শার্ট-প্যান্ট, যেটা এই উৎসবের দিনের মেজাজের সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছে না, তবে যুবকটির হতে একটা বড়সড় মাটির হাঁড়ি, তাতে যে মিষ্টান্না রয়েছে সেটা বলে দিতে হয় না। যুবকটিকে কেউ চিনতে পারল না, যদিও সবাই তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে, সবার চোখেই প্রশ্ন, আড্ডাও থমকে গেছে।

    যুবক নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন, দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই।

    সালাম, নমস্কার, আমি সৈয়দ মকবুল আনসারি।

    বড়কর্তা তক্তপোষের ওপরে আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন, নড়েচড়ে উঠে বসে বললেন, কাকে চাই?

    সরাসরি বড়কর্তার চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টির হাঁড়িশুদ্ধ হাতডুতো বুকের কাছে এনে সম্মান দেখিয়ে যুবক বললেন, আপনার সঙ্গেই দরকার, কয়েকটা কথা বলার ছিল।

    ঠিক এই সময়ে ভেতর-বাড়ির সেলাই মেশিনের সামনে বসে বাড়ির বাচ্চাদের পুজোর জামা আর মেয়ে-বউদের রকমারি ব্লাউজ-সায়া-সেমিজ সেলাই করতে করতে হিমসিম খাচ্ছে রাণী। রাণীর ভাল নাম কমলা, ডাক নাম রাণী, তবে ছোটরা সবাই ওকে রাঙাদি বলেই ডাকে। সেলাইয়ের হাত রাণীর বরাবরই ভাল, কাটিংও জানে আবার লেস বোনা, এমব্রয়ডারি করা এগুলোও ওর নেশার মতো। এবার আই. এ. পরীক্ষায় বসেছিল, কিন্তু পাশ করতে পারেনি, পরীক্ষার ফল বেরোবার পরে একমাস খুব দু:খ করেছিল, কিন্তু এখন আবার ঠিক করেছে, সামনের বছর আবার পরীক্ষায় বসবে। একুশ বছর বয়েস অবধি কোনও মেয়ে আইবুড়ো থাকে না এ বাড়িতে, এমনকী রাণীর ছোট বোন বাণীর পর্যন্ত বিয়ের কথাবার্তা চলছে, পাত্রপক্ষ এসে দেখেও গেছে, শুধু বাণীর গায়ের রংটা একটু কালো বলে পণের অঙ্ক নিয়ে দরদাম হচ্ছে, সেইসঙ্গে আবার গায়ের রং মাজাঘষার কাজও চলছে পুরোদস্তুর, আর বাণী তো রাণীর চেয়ে সাড়ে চার বছরের ছোট, তবে রাণীর বিয়েতে বাধা কোথায়? রাণী দেখতে শুনতে ফর্সা, সুন্দরী, ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে, হারমোনিয়াম আর অর্গ্যান বাজাতে পারে, হাঁটু ছুঁই ছুঁই ঘন কালো ঢেউ খেলানো চুল, এ হেন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার দিকে বাড়ির কারও উদ্যোগ নেই কেন? উদ্যোগ নেই, কারণ এতগুণ থেকেও রাণীর একটা শারীরিক খুঁত আছে, রাণীর দু-পায়েই গোদ। হাঁটতে শেখার আগেই মশার কামড়ে এলিফেন্টাইটিসের প্রকোপে পড়ে ও। ছোট বাচ্চাদের জ্বরজারি তো হয়ই, তাই খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি ওর এই অসুখটাকে, কিন্তু পরে যখন জানা গেল, ততদিনে এই অসুখের প্রকোপে ওর পা দুটো অসম্ভব ফুলে গেছে, তখন বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে, তখন আর এ রোগ কোনও ডাক্তার সারাতে পারেনি, সময়মতো ধরা পড়লেও সারত কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। টলোমলো পায়ে প্রথম যখন হাঁটতে শিখছিল ও, কারও মুখে হাসি ফোটেনি।

    তাই বলে দু:খ করে বসে থাকবার মেয়ে সে নয়, ঘোড়ার গাড়ি চড়ে সে ইস্কুলে পড়তে গেছে, গান শিখেছে, সাংসারিক বুদ্ধিও ভালই, সংসারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে রাণীর মতামত জানতে চাওয়া হয়, আবার বাড়ির মেয়েরা যখন রান্নাবান্না শিখতে ব্যস্ত, সে তখন তার নিজের ঘরে জানলার পাশে সঞ্চয়িতা খুলে বসে থাকে। জানলার পাশে প্রকান্ড একটা উঠোন, সেই উঠোনে আছে পেয়ারা গাছ, ডালিম গাছ, দুটো পাতিলেবু গাছ। চাকরেরা রোজ দশ-পনেরো বালতি জল দেয় লেবু গাছের গোড়ায়, পেয়ারা গাছে ফল বেশি হয় না বটে, কিন্তু পেয়ারাগুলোর ভেতরটা লাল। উঠোনের শেষে পাঁচিল, বাড়ির সীমানা সেখানেই শেষ, পাঁচিলের ওপারে কলেজের হস্টেলবাড়ি। হস্টেলবাড়ির একতলাটা দেখা যায় না, পাঁচিলে ঢাকা পড়ে, তবে এই জানলা থেকেই মাথা উঁচু করলে বা ছাদে গেলে দোতলার হস্টেল সুপারের ঘরটা পরিষ্কার দেখা যায়; গরাদ দেওয়া প্রকান্ড জানলার পাশে টেবিল আর চেয়ার, টেবিলে টেবিল ল্যাম্প জ্বলে সন্ধ্যায়, এ বাড়িতে গৃহদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণজির আরতি শুরু হয়ে যায় ঠাকুর ঘরে, প্রণাম করতে যাওয়ার আগে জানলার পর্দা সরিয়ে রাণী উঁকি মেরে দেখে নেয় পাঁচিলের ওপারে জানলার পাশে সেই চেয়ারটা তখনও খালি কিনা।

    আদর দিয়ে দিয়ে বড় মেয়ের মাথা খেয়েছেন, বাবা এ কথা বাড়ির সবাই জানে। আবার, বাড়ির আর পাঁচটা মেয়ে-বউয়ের চেয়ে সে বুদ্ধিমতি, তাই তাকে সকলেই সমীহ করে চলে।

    একটা চেঁচামেচির শব্দ আসছে বার-বাড়ির দিক থেকে, রাণী সেলাই মেশিন বন্ধ করল। মেশিন চালানোর আওয়াজে আর কিছুটা অন্যমনস্ক থাকায় সে টের পায়নি বার-বাড়ির দিক থেকে বেশ গন্ডগোল্রে আওয়াজ আসছে।

    সেলাইয়ের জন্যে কাটা কাপড়ের টুকরোগুলো সাবধানে গুছিয়ে রেখে, রাণী বেরিয়ে এল ভেতরের বারান্দায়, এখান থেকে বড়কর্তা অর্থাৎ রাণীর বাবার গলার স্বর বেশ জোরেই শোনা যাচ্ছে, ভেতর বাড়ি থেকে মেয়েবৌয়েরা কী হয়েছে দেখার জন্যে বেরিয়ে এসেছে, বাড়ির অন্য পুরুষ সদস্যেরা নীচু স্বরে কী বলছে ভাল শোনা যাচ্ছে না, তবে বড়কর্তার মেজাজ যে সপ্তমে তা বুঝতে কারও বাকি নেই।

    রাণী এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, "কী ব্যাপার? কী হয়েছে?'

    কর্তা কোনও উত্তর না দিয়ে গটগট করে ভেতর বাড়িতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

    সামনের উঠোনে বাচ্চারা খেলা বন্ধ করে জড়সড় হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়েছিল, রাণী সেদিকে তাকিয়ে খুড়তুতো ভাই নিমুকে ডাকল, "নিমু শোন, কী হয়েছে রে? কিছু জানিস?' নিমু কিছুটা জানে।

    সে জানাল যে, একটু আগে একটা লোক এসে রাণীর বাবাকে অপমান করে গেছে, লোকটা নাকি একহাঁড়ি নিখুতি নিয়ে এসেছিল, জ্যাঠামশাই লাথি মেরে সে হাঁড়ি ভেঙে ফেলেছেন।

    -- কী! এত বড় সাহস? লোকটা কে? কী বলেছে বাবাকে?

    রাণী এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার বাবার মতো গণ্যমান্য একজন লোককে কেউ বাড়ি বয়ে এসে অপমান করে যেতে পারে। সেই সাহসই তো কারও হওয়ার কথা নয়, রাণীর বাবা ক্ষিতিনবাবু ঢাকা কোর্টের নামজাদা আর ডাকসাইটে উকিল।

    আড্ডা ভেঙে গেছে আগেই। অতিথিরা সব একে একে চলে গেছেন, বাড়ির অন্যান্য পুরুষরাও ভেতর-বাড়িতে চলে আসছে একে একে, চাপা উত্তেজনা ছেয়ে গেছে অন্দরমহলে।

    রাণী ব্যাপারটা জানবার জন্যে সোজা বাবার ঘরে ঢুকে পড়ে বলল, "কার এত বড় সাহস যে তোমাকে অপমান করে গেল?'

    ক্ষিতিনবাবু রাণীর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, "আমার সমস্ত মান-সম্মান আজ ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে গেল শুধু তোর জন্যে রাণী!'

    ক্ষিতিনবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন আগন্তুক কোনও মুসলমান মক্কেল, হয়তো জরুরি প্রয়োজন আছে, তাই ছুটির দিনেও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দেওয়ানী মামলা করলেও, তিনি মাঝে মাঝে ফৌজদারি কেসও নেন, আর ফৌজদারি কেসেই সাধারণত মক্কেলরা অসময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। হাতে করে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে উকিলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসা কোনও নতুন ঘটনা নয়, তাই মকবুল আনসারির সঙ্গে কথা বলতে তিনি বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন।

    কিন্তু সেই যুবক কোনও মামলার কাজে আসেনি। সে এসেছে সম্পূর্ণ অন্য কারণে, ক্ষিতিনবাবুর মেয়ে রাণীর সঙ্গে নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।

    ঘটনাটা এত অবিশ্বাস্য, এত আকস্মিক, যে রাণীর বাবা প্রথমে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

    কিন্তু মকবুল জানাল যে সে বাড়ির পাশেই থাকে, অতএব ক্ষিতিনবাবুর প্রতিবেশী, যদিও আলাপ নেই। সে পাশেই বয়েস হস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট, রাণীর সঙ্গে তার পরিচয়ও হয়েছে বেশ কিছুদিন হল এবং এও জানাল যে রাণীরও এ বিয়েতে সম্পূর্ণ সম্মতি আছে। যে পরিবারে কুল, শীল, গোত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মিলিয়ে বিয়ের প্রচলন, সেখানে বিধর্মীর এই প্রস্তাবে মানহানি হওয়ারই কথা। রাগে অপমানে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন বড়কর্তা, নিজেকে সংযত করবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে তিনি বললেন, "এক্ষনি বাইর হৈয়া যান, এক্ষনি। এত বড় স্পর্ধা, আমার বাড়িতে ঢুকে আমাকেই অপমান?' মকবুল মাটির হাঁড়িটা রোয়াকে নামিয়ে রাখল, সাদর আপ্যায়নের আশা করে সে আসেনি, সে ধরেই রেখেছিল প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে পারে, কিন্তু রাণীর তো অন্যত্র বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়, তাই একটা ক্ষীণ আশা তার মনে ছিল, যে কর্তা হয়তো তার কথা শুনলেও শুনতে পারেন।

    মকবুল রোয়াক থেকে নেমে যখন সদর দরজার দিকে যাচ্ছে, কর্তা লাথি মেরে মিষ্টির হাঁড়িটা ভেঙে ফেললেন, ক্রমশ তাঁর গলার স্বর চড়তে শুরু করল, "আমার বাড়িতে ঢুকে, আমারেই অপমান করে গেল? আমি মানহানির মামলা করব।'

    কর্তার সঙ্গে মকবুলের কী কথা হয়েছে, তা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি, আর বাড়িশুদ্ধ সবাই কর্তাকে এত ভয় পায় যে, কেউ সাহসই করল না কোনও প্রশ্ন করে পুরো ব্যাপারটা বিস্তারিত জানতে।

    প্রথম দিকে বাপ-বেটিতে চেঁচামেচি কথা কাটাকাটি চলল অনেকক্ষণ। রাণীর মা চুপ। বাবার আদরের মেয়ে রাণী। সে বাপের সঙ্গে চেঁচিয়েও কথা বলে, তার রাগ অভিমান সব সহ্য করেন ক্ষিতিনবাবু, এমনকী রাণীর মা পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেন না।

    ঘরের দরজা বন্ধ। আজ যা ঘটে গেছে, তা যেন পাঁচকান না হয়, তাহলে রাণীর বিয়েতে সমস্যা দেখা দেবে। শুধু তাই নয়, এই একান্নবর্তী পরিবারে বিবাহযোগ্য মেয়ে আরও তিনটি, তাদেরও আর বিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না, আরও আগে হলে হয়তো সমাজচ্যুতই হতে হত, কিন্তু রাণী এত বুদ্ধিমতী মেয়ে হয়ে এ কী করল?

    বাবা মেয়েকে প্রথমে ধমক-ধামক করলেও, পরে নরম হয়েছেন, কিন্তু মেয়ের এই বেয়াড়া আব্দার মেনে নেওয়া তো কিছুতেই সম্ভব নয়।

    ধীরে ধীরে অনেক কান্না অভিমানের পরে জানা গেল, মকবুলের সঙ্গে রাণীর অনেক চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে, আর তার বাহক ছিল চাকর মৃত্যুঞ্জয়।

    ঘরের দরজা বন্ধ থাকলেও, কথা ছড়িয়ে যায়, রাণীর দাদা শম্ভূ ভেতরবাড়ির উঠোনে মৃত্যুঞ্জয়কে টেনে জুতোপেটা করল। সম্ভবত রাণীর মা এই খবরটা দিয়েছেন শম্ভুকে। মারধর করে মৃত্যুঞ্জয়কে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল, পত্রবাহক হওয়ার অপরাধে।

    পুজোর দিনগুলো কেটে গেল স্বাভাবিকভাবেই; রাণীর নিজের ঘরে সেলাই মেশিন নিয়ে বসে রইল, আত্মীয়স্বজন অতিথিরা সব ঘুরে গেল, রাণী কারও সঙ্গে দেখা করতে বাইরে বেরলো না।

    দ্বাদশীর দিন কলকাতা থেকে পূর্ণ এসে উপস্থিত। রাণীর পিসতুতো দাদা, পিসিমাকে নিয়ে পূর্ণ কলকাতায় থাকে, যদিও তার পৈত্রিক বাড়ি টাঙ্গাইলে। প্রতিবছর বিজয়ার প্রণাম সারতে সে দেশের বাড়ি আসে, ঢাকায় মামাবাড়ি হয়ে তারপরে সে টাঙ্গাইলে যায়। পূর্ণ কলকাতার কলেজে অধ্যাপনা করে, বছর দুয়েক হল বিয়ে করেছে, বউ বরানগরে মেয়ে।

    প্রথমবার বউ নিয়ে বিজয়ায় এলেও, এবার সে একাই এসেছে, এবার বউয়ের শরীর ভাল নয়, সে সন্তানসম্ভবা।

    পূর্ণ আসায়, বাড়ির থমথমে ভাব খানিকটা কেটে গেল। রাণী পূর্ণদার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল, পূর্ণদা কলকাতার গল্প বলে, রাণী শোনে, প্রশ্ন করে কতরকম। সে কখনও কলকাতায় যায়নি, ট্রাম দেখেনি, গঙ্গা দেখেনি, গড়ে মাঠ দেখেনি।

    আর শুধু কি কলকাতার গল্প? পূর্ণদার সঙ্গে সে আলোচনা করে কবিতা নিয়ে, রবীন্দ্রনাথ, শেলী, কীটস, বায়রন, শেকসপীয়র, যতটুকু সে পড়েছে, যতটুকু বুঝেছে তা নিয়ে, ... তর্ক করে ফিলসফি নিয়ে, শুধু পূর্ণদা এলেই তো এইসব আলোচনা তর্ক সে করতে পারে, বাড়ির অন্য মেয়েরাতো এসব আলোচনা বোঝে না, তারা শুধু সিনেমা দেখতে ভালবাসে, সিনেমার নায়িকাদের নকল করে চুল বাঁধে ... আর এ বাড়ির পুরুষেরা মেয়েদের সঙ্গে কাব্য-তত্ত্ব-দর্শন নিয়ে আলোচনায় বসতে নারাজ, তাই পূর্ণদা এলে রাণী বছরভরে জড়ো করে রাখা সব গল্পে, প্রশ্নে সারাদিন তাকে অস্থির করে তোলে।

    ক্ষিতিনবাবু পূর্ণকে ব্যাপারটা বললেন। তিনি জানেন, পূর্ণ তার যুক্তি দিয়ে, মননশীলতা দিয়ে রাণীকে বোঝাতে পারবে। শুধু ধমক-ধামক দিয়ে তো এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়; রাণী তাঁর বড় স্নেহের ধন, কিন্তু সমাজ, ধর্ম, বাড়ির অন্য সদস্যদের প্রতি দায়বদ্ধতা, এই সব কিছুর বাঁধনে তিনি অসহায়, আর সেই সঙ্গে রাণীও যদি অবুঝ হয়, এত লেখাপড়া শিখেও সে যদি সমাজকে অগ্রাহ্য করতে চায় তবে তিনি কী করতে পারেন?

    তিনি পূর্ণকে বললেন, রাণীকে বুঝিয়ে বলতে।

    পূর্ণদা সঙ্কোচ করলেও, রাণীর কিন্তু কোনও লজ্জা-সঙ্কোচ নেই। সে যুক্তি চায়।

    পূর্ণদা তাকে নানারকম জিনিস বোঝাতে চায়, কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নিতে বলে, তাতে রাণীর মন শান্ত হবে। রাণী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, "আমি কি বিধবা, নাকি বুড়ো হয়ে গেছি, যে এখনই দীক্ষা নিয়ে নামজপ করে দিন কাটাবো?'

    -- না তা নয়, শুধু কি বুড়ো আর বিধবারাই দীক্ষা নেয়?

    -- বেশ আর কাউকে দেখাও আমার সামনে?

    পূর্ণদা বলে, আধ্যাত্মিক চিন্তায় মন শান্ত হয়, তোমার মন অস্থির হয়ে আছে, তাই একথা বলেছি।

    রাণীও উত্তর দেয়, মন অস্থির আমার নয়, হিন্দুর মেয়েরে মুসলমানের ঘরে দেওয়া যায় না, তাই আর সবার মন অস্থির হইছে।

    -- না দেওয়া যায় না।

    পূর্ণদা এবার কড়াস্বরে বলেন, "আমরা জাতিচ্যুত হই, তুমি সেটা চাও? তোমার একার আবদারে তোমার ছোট বোনটার জীবন নষ্ট হয়ে যাক, সেটাও তোমার কাম্য? শুধু স্বার্থপরতার জন্যে সমাজের আচার-বিচার সবই কি তুমি উড়িয়ে দিতে চাও রাণী? শুধু নিজের কথা ভাবছো রাণী? শুধুই নিজের স্বার্থ? তোমার মধ্যে ত্যাগের কণামাত্র নেই?

    রাণী কিছুক্ষণ চুপ থাকে, আবার তেড়ে উঠে বলে, "হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হলেই জাত চলে যায় পূর্ণদা, পাড়ার ছোট ছোট বাচ্চারা বাড়ির বাচ্চাদের সঙ্গে যখন ভেতর বাড়ির উঠানে খেলা করে, সাঞ্জিদা, জাহানারা, আফ্‌জালুন, ছুটতে গিয়ে ভুলে রান্নাঘরের চৌকাঠ মাড়ালে রান্না করা সব খাবার ফেলে দেওয়া হয়, সব কিছুতে ছোঁয়া লেগে যায়? তুমি বিশ্বাস করো এগুলো? এগুলোকে কী বলে? স্বার্থপরতো আমি, আর এগুলো হচ্ছে ঘৃণা, কোনটা বেশি খারাপ পূর্ণদা? তাহলে তো বাবার নব্বই শতাংশ মক্কেলের দেওয়া টাকার নোটগুলোও ফেলে দেওয়া উচিত। টাকায় বুঝি কোনও ছোঁয়া লাগালাগির বালাই থাকে না? টাকার নোট সবসময়ই শুদ্ধ?

    না; এই মেয়েকে এখানে রাখা আর সঙ্গত নয়। যে নিজের ভালমন্দ বোঝে না, এত বড় একটা দোষ করেও যার বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ নেই, লজ্জা হওয়া দূরে থাক, সমাজকে পর্যন্ত যে অস্বীকার করতে চায়, তাকে দূরে রাখাই সমীচিন মনে করলেন ক্ষিতিনবাবু। তাছাড়া সামনেই অঘ্রাণ মাসে বাণীর বিয়ে, সব কিছু জানাজানি হয়ে শেষমেশ সব না ভন্ডুল হয়ে যায়।

    (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

    হাজার বছর ধরে ২
    যোষিতা ঘোষাল

    ঠিক হল টাঙ্গাইল থেকে ফেরার পথে পূর্ণর সঙ্গে রাণী কলকাতায় চলে যাবে। কলকাতায় থেকেই সে আরও পড়াশোনা করতে চায় করুক, ক্ষিতিনবাবুর কোনও আপত্তি নেই। তিনি ঢাকা থেকে রাণীর খরচ বাবদ নিয়মিত টাকা পাঠাবেন।

    রাণীরও এই প্রস্তাবে কোনও আপত্তি নেই। সেই মহালয়ার দিনের পর থেকে মকবুলের কোনও খবরই সে জানে না। উঠোনের দিকের জানলা বন্ধ হয়ে গেছে, দোতলার সেই গরাদওয়ালা জানলার পাশে চেয়ারটা খালি পড়ে আছে কি নেই, তা দেখবার কোনও উপায় নেই তার এখন। তার মন এখন পাথরের মতো শক্ত, এই বাড়ি, এত সব আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, চারিদিকের এত চেনা মানুষের ভিড় থেকে সে এখন মুক্তি পেতে চায়, কলকাতা তার কাছে অচেনা জায়গা, পূর্ণদার মা তাকে বরাবরই স্নেহ করেন, পিসিমা আগে যখন টাঙ্গাইলে আসতেন মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে ছাপা শাড়ি নিয়ে আসতেন এ বাড়ির সব মেয়ে বৌদের জন্যে, ইশ্‌ কলকাতায় কী সুন্দর সুন্দর মিলের ছাপাশাড়ি পাওয়া যায়। অবশ্য লিলিবৌদিকে সে চেনে না, তো কী হয়েছে লিলিবৌদির সঙ্গে সে ভাব করে নেবে, কলকাতায় গিয়ে কলেজে ভর্তি হবে, এই বাড়ির গুমোট থেকে বেরোতে পারলেই সে এখন বাঁচে।

    কলকাতায় বিবেকানন্দ রোডের ওপর কত বড় বড় বাড়ি কোনওটা দোতলা, কোনওটা তিনতলা চারতলা। তেমনিই একটা তিনতলা বাড়ির সামনে মোটরগাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল রাণী, পূর্ণদা রাণীকে জিজ্ঞেস করলেন, আন্দাজ করো তো কোন বাড়িটায় আমরা থাকি? সামনের গাড়িবারান্দাওয়ালা বাড়িটা দেখিয়ে রাণী বলল, এই বড় দালানটা নাকি!

    লিলিবৌদি ভীষণ ফর্সা, মাঝে মাঝে মনে হয় রক্তশূন্য, কাগজের মতো সাদা। বেস্পতিবার করে পায়ে আলতা মাখে, ঘরদোর তকতকে করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, ঝি-চাকরদের সঙ্গে খিটখিট করে, কুলো ভরে ভরে নানান ধরনের বড়ি দেয়, সারা দুপুর ধরে আচার-মোরব্বা কিছু না কিছু বানাচ্ছেই।

    রাণী বন্ধুত্ব করতে গেল লিলিবৌদির সঙ্গে। আলাপ হল, কিন্তু বন্ধুত্ব হল না। পূর্ণদা বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে নিজের লাইব্রেরি ঘরে ইজিচেয়ারে বসে কাগজ পড়ে, কখনও বই বা মাসিক পত্রিকার পাতা ওল্টায়। রাণী রান্নাঘরে বৌদির কাছে থেকে লুচির থালা নিয়ে যতটা জোরে চলা যায় ওই ভারি পায়ে, চলে আসে পূর্ণদার কাছে; জলখাবারও দেওয়া হল, আবার গল্প-আড্ডাও দেওয়া যাবে কিছুক্ষণ।

    তবে ঢাকায় গেলে পূর্ণদা যেমন সারাক্ষণ গল্প করত, তর্কে আলোচনায় রাত হয়ে যেত, এখানে তেমন নয়; রাণী পূর্ণদার সামনে গেলে লিলিবৌদি যেন ছায়ার মতো কোথা থেকে নজর রাখে, সামনে আসে না, তবু রাণী টের পায়, হয়তো দরজার পেছনেই সে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে। শুধু রাণী কেন, পূর্ণদাও নিশ্চয়ই বোঝে, তাই বেশি গল্প আড্ডা করতে চায় না। আচ্ছা, বৌদি নিজেও তো এলে পারে ওখানে, সবাই মিলে গল্প করলে কী ক্ষতি। কিন্তু লিলিবৌদি আসবে না, রাণী বলে দেখেছে "বৌদি তুমিও চলো না', বৌদি কাজের অজুহাত দেখিয়ে সরে গেছে, আবার হঠাৎ কখনও কখনও রাণী লক্ষ করেছে বৌদি কী অদ্ভুতভাবে তার দিকে চেয়ে রয়েছে, রাণী তাকালেই চোখ সরিয়ে নিয়েছে তক্ষুনি।

    কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস কিছুটা আলাদা। তবে মন দিয়ে পড়লে সে পাশ করে যাবে, এ বিশ্বাস তার আছে। সারা দুপুর সে মন দিয়ে পড়া মুখস্ত করে, এখন শীতকাল, বেলা ছোট হয়ে এসেছে, দুপুরে খাবার পর একটু ঘুম ঘুম পায় ঠিকই, তবু মনে জোর আনে রাণী, হিস্ট্রি বা ফিলসফির নোটসের খাতা নিয়ে সে সারা বাড়ি পায়চারি করতে করতে পড়ে।

    বৌদি এসময়ে হয়তো দক্ষিণের বারান্দায় রোদে টুলের ওপর বসে বড়ি পাহারা দিচ্ছে, নয়তো পাশের বাড়ির বৌটির সঙ্গে পাশাপাশি বারান্দায় গল্পে মশগুল, দুজনেই নিজেদের শাশুড়ির নিন্দেয় ব্যস্ত, পিসিমাতো আজকার আর প্রায় উঠতেই পারেন না বেশি, পায়ে বাতের ব্যথা নিয়মিত, তাই বসুমতী বা ভারতবর্ষের পাতা উল্টোতে উল্টোতে কখন ঘুমিয়ে পড়েন একফাঁকে। লিলিবৌদি রাণীর সামনে কখনই পিসিমার নিন্দে করে না, তবুও রাণীর কানে এসেছে, হয়তো ঘুরে ঘুরে পড়তে পড়তে লাইব্রেরি ঘর পেরিয়ে বারান্দার কাছটায় চলে এসেছে, হঠাৎ কানে এল দু-বাড়ির দুই বউ খুব সুখ-দু:খের গল্প করছে।

    সেদিনও এমনই অনিচ্ছাবশত দুই বউয়ের গল্প আবার কানে এল, তবে সেদিন পিসিমা নয়, রাণীর নিন্দা। আর তা শুনে রাণী কৌতুহল দমন করতে পারল না, খড়খড়ি দেওয়া দরজার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে সে আড়ি পাততে লাগল।

    বৌদির সব দু:শ্চিন্তার কারণ তাহলে সে নিজে? হাড়জ্বালানি শাশুড়ি থাকলেও বৌদির আপত্তি নেই, যতটা না রাণীকে নিয়ে। বৌদির সন্দেহ পূর্ণদাকে রানী ছলাকলায় ভুলিয়েছে। এসব কী বলছে বৌদি? আর পাশের বাড়ির বৌটাও সে সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও কীসব বলে চলেছে বৌদিকে, ইশ্‌ ছি ছি, বৌদির কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

    রাণী ছুটে যাবে এখন বারান্দায়? স্পষ্ট করে ওদের মুখের ওপর বলবে, ছি: এ-ই তোমাদের মন?

    কিন্তু পারল না, ওই খড়খড়ির পাশেই হাতে নোটসের খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় কেটে গেল, বৌদিরা এরমধ্যে অন্য গল্প শুরু করে ফেলেছে, রাণী একতলায় নেমে গেল, লেটারবক্স থেকে চিঠি আনতে।

    চিঠি এসেছে, আগামী আঠারই অঘ্রাণ বাণীর বিয়ে। ভালই হয়েছে, বাণীর বিয়েতে গিয়ে রাণী আর ফিরবে না, কলকাতায় থাকার শখ তার মিটে গেছে।

    বৌদিও তাই চায়, রাণী না ফিরলেই বৌদির সব দু:শ্চিন্তার অবসান হয়।

    ***

    ফুলের দোকানের ছোকরাটার নাম বিকাশ, অনেক বোঝানো সত্ত্বেও শেষকালে ও রজনীগন্ধার মালা গছিয়ে দিল। না নিয়েও উপায় নেই। রাণী যতই বোঝায়, যে এ হচ্ছে বিয়ের মালাবদলের মালা, জুঁই বা বেলফুলের গোড়ে মালা চাই, বিকাশ কিছুতেই বুঝবে না, সে বলে চলে "এই শীতকালে জুঁই বা বেলফুলের মালা পাবেন কোথায়? আর সেরকম কষ্ট করে যদি জোগাড় করিও, টানা তিনদিন টিঁকবে না মাসিমা বাসি হয়ে যাবে, রজনীগন্ধা নিয়ে জান, আমি ভাল করে প্যাক করে দেব, স্পেশালি আপনার জন্যে বানিয়ে দেব, পুরো এক্সপোর্ট কোয়ালিটি, কবে ফ্লাই করছেন বলুন, আমি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাব মালাগুলো, যদি বাসি হয়ে যায়, আপনি পুরোদাম ফেরত নিয়ে যাবেন।'

    রাণী হাসবেকি কাঁদবে বুঝতে পারে না। বলে, "তুই পাকা ব্যবসায়ী বিকাশ, আমি নাতির বিয়েতে কতদূরে যাব কোনও ধারণা আছে তোর? যদি ফুলের মালা শুকিয়েই যায়, তবে মালাবদল হবে কী করে বল?'

    বিকাশ হাসতে থাকে।

    নাতি। নাতি নয়তো কী?

    মন আবার চলে যায় অনেক দূরে। পূর্ণদার নাতি গৌতমের বিয়ে আগামী পাঁচই ডিসেম্বর, বাংলা ক্যালেন্ডারে এ বছর পড়েছে ঊনিশে অগ্রহায়ণ।

    ওরা বিয়ে করছে কেপ-টাউনে, সাউথ আফ্রিকায়।

    পূর্ণদার নাতি তো রাণীরও নাতি।

    আজ থেকে একষট্টি বছর আগে এমনই আরেকটা বিয়েতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্চিল সে। বাণীর বিয়ে ঠিক ছিল আঠারই অগ্রহায়ণ।

    শেষ মুহূর্তে অবশ্য যাওয়া ওঠেনি। ঢাকা যাওয়ার বন্দোবস্ত সব ঠিক, পিসিমার শরীর খুব খারাপ। আবার মনও খারাপ এই জন্যে যে, রাণী তার মেজবোনের বিয়েতে গিয়ে আর ফিরবে না, অনেক বোঝানো হয়েছে তাকে, কিন্তু সে মন ঠিক করে ফেলেছে।

    সেদিন দুপুরবেলা, পূর্ণদা তখন কলেজে গেছে, বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে লিলিবৌদি আর বেরোয় না। পিসিমাই লক্ষ করেছেন স্নানের শব্দ আর আসছে না, বৌয়ের কি স্নান করা হয়ে গেছে? কোনও সাড়া নেই কেন?

    বাড়িতে তিনটে মেয়েমানুষ আর রান্নার ঠাকুর শ্রীনিবাস। শ্রীনিবাসই অনেক ধাক্কাধাক্কি করে দরজা ভাঙতে চেষ্টা করল, দরজা ভাঙা গেল না, তবে অতি কষ্টে ছিটকিনিটা খুলে পড়ল, বাথরুমের মেঝেতে লিলিবৌদি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে।

    ডাক্তার ডাকতে হবে নয়তো বৌকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে, আট মাস পোয়াতি লিলিবৌদিকে সঙ্গে নিয়ে ট্যাক্সি করে রাণী চলল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

    -- পূর্ণদাকে কলেজে একটা খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করেন পিসিমা। আমরা চললাম, হাসপাতালে।

    আলমারি থেকে সমস্ত টাকা বের করে রাণীর হাতে গুঁজে দিয়ে পিসিমা বললেন, ডাকতারকে সব কিছু বুঝিয়ে বলিস, যদি সাহেব ডাক্তার হয়, ইংরিজিতে কথা বলিস, বৌয়ের কাছে কাছে থাকিস রাণী।

    লিলিবৌদি আর রাণীর সঙ্গে যায় একটি ছেলে, সে প্রতিবেশী।

    পথেই জ্ঞান হল বৌদির, বাথরুমের মেঝেতে পা হড়কে পড়ে গেছিল সে, পেটে অসহ্য যন্ত্রণা।

    লিলিবৌদিকে ভর্তি করে ওরা করিডোরে অপেক্ষা করছিল, হন্তদন্ত হয়ে পূর্ণদা এলেন, আরও পাঁচ-ছ'ঘন্টা যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াই করে লিলিবৌদি একটা কন্যাসন্তানের জন্ম দিল। তারই ছেলে গৌতম।

    মেয়ের জন্ম দেওয়ার পরে চব্বিশ ঘন্টাও বাঁচেনি লিলিবৌদি।

    সেই গৌতমের বিয়েতে রাণী আজ রাঙাদিদু হয়ে চেলেছে কেপটাউনে। গৌতমের মা মিতালিকে রাণী পিসিমা নয়, মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করেছে, ঢাকায় আর ফিরে যাওয়া হল না, কোনওদিন আর দেশেই ফেরা হল না।

    প্রথম স্টপ-ওভার ফ্র্যাঙ্কফুর্টে। সারা ফ্লাইট জড়োসড়ো হয়ে বসে বসে গায়ে ব্যথা হয়ে গেছে, বুড়ো বয়সে এত ধকল সয় না, ওভাবে আধশোয়া হয়ে ঘুমোনো`য় যায় না, ক্লান্ত লাগছে, পা দুটো অসম্ভব ভারি লাগছে, কিন্তু উপায় নেই। আবার হাঁটতেও প্রচন্ড ইচ্ছে রাণীর।

    তাকে রাণী বলে ডাকবার আর কেউ অবশিষ্ট নেই এই পৃথিবীতে। আজ সে শুধু, রাঙাপিসি কিংবা রাঙাদিদু কিংবা মাসিমা।

    এবার ফ্লাইট বদলাতে হবে, এত বড় এয়ারপোর্ট, মাথা ঘুরে যায়। জীবনে প্রথম সে বিদেশ যাচ্ছে, একা। বিদেশ! আচ্ছা, এখন যে দেশটায় সে থাকে, সেটা কি নিজের দেশ, নাকি বিদেশ? নিশ্চয়ই নিজের দেশ, রাণী নিজেই নিজেকে বোঝালো, অথচ যে দেশটায় সে জন্মেছিল, বড় হয়ে উঠেছিল, প্রথমবার কাউকে ভালবেসেছিল, সেই দেশটা? সেটা দেশ না বিদেশ? বিদেশ না দেশ? উফ! এখান থেকে এত দেশে এত জায়গায় এত ফ্লাইট যাচ্ছে, যে খুঁটিয়ে না দেখলে সব গুলিয়ে যাবে। চারিদিকে এত ভাষায় এত কিছু অ্যানাউন্স করছে, কোনটা যে ইংরিজি মন দিয়ে না শুনলে বুঝবার উপায় নেই।

    না: এবার এগোতে হবে কেপটাউনের ফ্লাইট অ্যানাউন্স কএ দিয়েছে, চেক-ইন হচ্ছে।

    গৌতম অবশ্য বার বার ফোন করে করে, চিঠি লিখে লিখে সব বুঝিয়ে দিয়েছে। তবু একটু জড়োসড়ো লাগেই।

    রাণী বলেছিল, দেখ গৌতম, আমেরিকায়ই তো থাকিস, তা ওখানে বিয়ে করলেই পারতিস।

    গৌতম বলল, "দিদু ক্যারোলাইনের বাড়ি তো সাউথ আফ্রিকায়, ওর খুব ইচ্ছে বিয়েটা কেপটাউনে হোক, তারপর আমরা আবার আমেরিকায় ফিরে যাব। তুমিও আসবে আমাদের নতুন সংসার দেখতে, কি, আসবে না?'

    পাত্রপক্ষের একমাত্র প্রতিনিধি রাঙাদিদু, গৌতমের বাবা-মা মানে প্রবীর-মিতালি আসবে না, ওরা আটলান্টায় ফিরে গেলে সেখানে রিসেপশনের আয়োজন করবে।

    মুশকিল হয়েছে, এই ফুলের মালাগুলো নিয়ে, কেবিন ব্যাগেজ হিসাবে নিলেও অন্য সবার ব্যাগের চাপ লেগে লেগে কী যে অবস্থা হচ্ছে মালা দুটোর প্যাকেট খুললেই বোঝা যাবে।

    রাণী এই পথটা ভাল করে ঘুমিয়ে নিল।

    বিকেল হয়ে গেছে, সময় কত বাইরেটা দেখে বোঝবার উপায় নেই, তবে স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটে। রিসিভ করতে এসেছে গৌতম, ইশ্‌ প্রায় চার বছর পরে দেখা, একটু বেশি রোগা দেখাচ্ছে, সঙ্গে এক কৃষ্ণাঙ্গী যুবতী। গৌতম আলাপ করিয়ে দিল, ক্যারোলাইন। ওপরের পাটির দাঁত উঁচু মেয়েটি হাসিমুখে হাত জড়ো করে নমস্কার করল, গৌতমের চেয়ে আধহাত লম্বা।

    এ-ই সেই মেয়ে? কৃষ্ণাঙ্গী। তাই মিতালির এত আপত্তি এই বিয়েতে, তাই ওরা আসেনি? এতক্ষণে পরিষ্কার হল ব্যাপারটা।

    ক্যারোলাইন খালি হাসে, ছিপছিপে রোগা, জিমন্যাস্টিকের ইন্সট্রাক্টর।

    ওদের বাড়ি কেপটাউনের শেষ প্রান্তে। এখন গ্রীষ্ম এদেশে, অপূর্ব বাতাস দিচ্ছে, মহাসাগর উপকূলের বাতাস।

    ক্যারোলাইন গাড়ি চালাচ্ছে, গৌতম পাশে বসে, পেছনের সিটে রাঙাদিদু।

    -- দিদু তুমি বাংলায়ই কথা বলো।

    -- তোর বউ বাংলা বোঝে? আমরা বাংলায় কথা বললে কিছু মনে করবে নাতো?

    -- না, না, মনে করবে না, ভাল বোঝেন না, একটা দুটো কথা বোঝে।

    -- তোদের মালাবদলের জন্যে মালা এনেছি সঙ্গে করে, তুই চেয়েছিলি।

    -- এনেছ?

    গৌতম আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠল।

    -- জানো দিদু বিয়েতে বাংলা গান বাজবে, কনে শাড়ি পরবে, এইরকম প্ল্যান আমাদের। কালকে বিয়ের ঝামেলাটা কেটে গেলেই, আমি চাই তুমি ভালো করে ঘুরে বেড়িয়ে কয়েকদিনের ছুটি কাটাও এখানে।

    বাড়ি পৌঁছে, ক্যারোলিনের প্রথম পক্ষের দুই মেয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল গৌতম। বড়ো নাতাশা, ছোট রোজমেরি, আট আর ছয়।

    একটু অস্বস্তি হচ্ছে রাণীর, মানে আগে থেকে তো কিছুই জানায়নি গৌতম। মনটা খচ্‌খচ্‌ করছে, ও আর মেয়ে পেল না? দেশে কি মেয়ের অভাব ছিল?

    কিন্তু মুখে এসব কথা প্রকাশ করা অভদ্রতা; কোথায় ভেবে রেখেছিল গৌতমের কচি বৌকে আশীর্বাদ করবে, গয়না দেবে।

    পরের দিন বিয়ের আসরে হৈ হৈ কান্ড, কনে খুব সুন্দর করে বেনারসি শাড়ি ম্যানেজ করেছে, সিডি-তে বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, কখনও বা হেমন্ত-মান্নার গান, নানান পোজে মালাবদলের ফটো উঠল অনেক, আজকাল তো সব ডিজিটাল ক্যামেরা। চারিদিকে খুশির হাওয়া।

    -- দিদু তুমি তো ওয়াইন খাবে না জানি, একটু শ্যাম্পেন নাও প্লিজ, খেতে হবে না, জাস্ট গ্লাসটা হাতে ধরে রেখো, নইলে ওরা দু:খ পাবে।

    -- কেন খাবো না রে? দে।

    গৌতম উৎসাহে প্রায় লাফ মেরে ওয়াইন নিয়ে এল রাঙাদিদুর জন্যে।

    ঘড়িতে সময় যদিও বলছে বিকেল সাড়ে পাঁচটা, অন্ধকার হতে অনেক দেরি। ওরা ভাড়া করেছে একটা ওপেন এয়ার রেস্টুরেন্ট, খাবারের আয়োজন অনেক, একটা প্লেটে স্যালাড আর মাংস তুলে নিয়ে এক কোণে এসে বসল রাণী, একটু পরে নাচগান শুরু হবে।

    অতিথিদের নিয়ে হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও গৌতম মাঝে মাঝেই খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে দিদিমার, আলাপ করিয়ে দিচ্ছে বন্ধুবান্ধব আর কনের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে।

    এবার গৌতম সনে করে নিয়ে এল এক বৃদ্ধকে। ভদ্রলোকের হাতে গ্লাস।

    -- দিদু আলাপ করিয়ে দিই। লেট মি ই®¾ট্রাডিউস শি ইজ মাই গ্র্যানি, হার নেম ইজ রাণী, সরি কমলা, দিদু তোমার ভাল নাম কমলা তো? অ্যান্ড ... দিদু ইনি একজন ট্যুরিস্ট গাইড, এঁর নাম, মাইকেল।

    -- মকবুল?

    -- মকবুল নয়, মাইকেল। তোমার আজকাল শুনতে একটু প্রবলেম হচ্ছে দিদু।

    মাইকেল হাত বাড়িয়ে বলল হ্যালো।

    -- তোমরা কথা বলো।

    বলেই গৌতম আবার হাওয়া।

    ভদ্রলোকের সঙ্গে আস্তে আস্তে আলাপ জমে উঠল। মাইকেল বলতে লাগল, বহু বছর তার কেটেছে জেলে, জেল থেকে বেরিয়ে সে এখন ট্যুরিস্ট গাইড।

    -- জেলে কেন?

    -- আপনি জানেন না? এদেশে আমরা বহু বছর ধরে মনুষ্যত্বের অধিকারের জন্যে লড়েছি।

    -- ও, হ্যাঁ হ্যাঁ জানি।

    রাণী লজ্জা পেয়ে গেল, ইশ্‌ কী ভুলটাই না ভেবেছিল, জেল শুনেই চোর-গুন্ডা-বদমায়েশ ভেবে বসেছিল মাইকেলকে।

    মাইকেল শোনাতে লাগল তার দীর্ঘ সংগ্রামের কাহিনী। জেলের গল্প, অত্যাচারের বিবরণ, বেঁচে থাকার আশা নিয়ে দিন গুনবার গল্প।

    মাইকেল বলে চলল, জেলখানাটা দ্বীপের মধ্যে, পালাবার কোনও পথ নেই ... অবশ্য, এখন সেটা মিউজিয়াম, আমি সেখানেই ট্যুরিস্ট গাইড। আঅনাকে নিয়ে যাব একদিন দেখাতে, ... যাবেন তো?

    -- হ্যাঁ হ্যাঁ যাবো, নিশ্চয়ই যাবো।

    মাইকেল কেমন যেন সুর করে কথা বলে। তার ওপরে ওয়াইন খেয়েই চলেছে অনবরত।

    -- আপনার হাঁটতে কষ্ট হবে না তো? আপনার পায়ে শুনলাম প্রবলেম।

    -- না, কষ্ট আর কি! বয়েস হয়েছে অনেক, তবে পায়ের ব্যথা আমার চিরকালই। এই পা নিয়েই তো শয়ে শয়ে হাজার হাজার বছর হেঁটেই চলেছি। অভ্যেস হয়ে গেছে।

    -- হানড্রেডস অ্যান্ড থাউজেন্ডস অফ ইয়ারস? হা: হা: হা: ... আমি জানি আপনি কী বলতে চাইছেন।

    -- আবার দেখুন, এত বুড়ো হয়েও বেঁচে রয়েছি বলেই তো, এত কিছু দেখে যেতে পারছি। মাইকেল সায় দিল, হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, আশা নিয়ে নিয়ে বেঁচে থেকে আজ এই পরিবর্তন দেখে যেতে পারলাম, সেটাই কি কম অ্যাচিভমেন্ট?

    সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ওপাশটায় সবাই যোগ দিচ্ছে নাচে।

    রাণী মাইকেলকে বলল, এবার আমি আপনাকে একটা গল্প শোনাই?

    -- হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

    রাণী বলল, "সেটা অক্টোবর নাইনটিন ফর্টি থ্রি। ১৩৫০ বঙ্গাব্দ। বঙ্গাব্দ মানে, বেঙ্গলি ক্যালেন্ডার ... আপনি জানেন কি?'

    -- হ্যাঁ হ্যাঁ বেঙ্গলি জানি, বাংলাদেশ তো?

    রাণী নিজের মনেই বলে চলল, "ঢাকা শহরের লক্ষ্মীবাজার অঞ্চলের একটি বনেদি বাড়িতে সেদিন দেবীর আবাহনের আনন্দে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। সে বাড়িতে পুজো হয় না, কিন্তু পুজোর ছুটির আনন্দে সবাই মশগুল।'

    মাইকেল অনেক প্রশ্ন করে চলেছে, যেমন, পুজো কী, দেবী বলতে কোন গডেস-এর কথা বলা হচ্ছে।

    রাণী বোঝাচ্ছে, উত্তর দিয়েও যাচ্ছে, কিন্তু তার মন এখানেই নেই, সে দেখতে পাচ্ছে, তার সামনে একটা সেলাই মেশিন, চারিদিকে স্তূপ করে রাখা অসংখ্য কাপড়ের টুকরো, সেই কাপড়ের টুকরোর স্তূপের মধ্যে সে আটকার পড়ে গেছে, ওগুলো ঠেলে সে এগিয়ে যেতে চায় ওপাশটায় খোলা জানলার ধারে, জানলার পর্দা সরিয়ে রাণী শুধু একবার উঁকি মেরে দেখে নেবে পেয়ারা গাছের পেছনে, পাঁচিলের ওপারে জানলার পাশে সেই চেয়ারটা তখনও খালি পড়ে আছে কিনা।

    (শেষ)
  • 2 | 193.218.118.136 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:১০741409
  • বসন্তের উত্তর
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ০৯.০৯.২০০৭
    শীতের শুরুটা এরকমই। শিরশিরে হাওয়া। পাতা ঝরতে থাকে। শুকনো মরা পাতা। বাদামি, হলদে। হাওয়ায় পাকসাট খায়, তারপর মাটি ছোঁয়। কম্যুনিটি নোটিসবোর্ডে গাঁথা কাগজগুলি হাওয়ায় ওড়ে। লম্বাটে, চৌকোনা, আয়তাকার, লাল, গোলাপি, সবুজ কাগজ। আয়তাকার কাগজখানিতে চোখ যায়। তিব্বতী শ্রমণদের অনুষ্ঠান ঞ্ছমন্ডলাঞ্চ -- নর্থ সিডনি কাউন্সিলের একটি সভাগৃহে। পাঁচদিনের অনুষ্ঠানের প্রথম দিনই উপস্থিত হই। যেতে বেলা হয়ে যায়। ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে "মন্ডলা' নির্মাণ। সুবিশাল সভাগৃহের মাঝখানে বর্গাকার বিশাল একটি নকশার হালকা আভাস, তিনজন ভিক্ষু আসনপিঁড়ি, পাশে পিতলের বেশ কয়েকটি শঙ্কু রাখা, ভিন্ন রঙের সূক্ষ্ম মসৃণ প্রস্তরচূর্ণ ভরা শঙ্কুগুলি ...
    তিব্বতী বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী "মন্ডলা' স্বপ্নসম্ভব, অলীক আদর্শ জগৎ সকল জীবের ঠাঁই সেথায় এবং ধ্যানে কেবল ধ্যানেই উপলব্ধি করা যায় "মন্ডলা'। প্রাচিন পুঁথিপত্র মেনে অতি যত্নে তৈরি হয় "মন্ডলা'। দেখলাম, শ্রমণত্রয় আসনপিঁড়ি অবস্থায় সামনে ঝুঁকে ছোট ধাতবদন্ড দিয়ে শঙ্কুর সম্মুখভাগ ঈষৎ ঘর্ষণ করছে, সেই মৃদু ঘর্ষণে সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ ভরে দিচ্ছে নকশার ছোট ছোট অংশগুলি -- লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ... এইভাবেই ধীরে ধীরে "মন্ডলা' নির্মাণ। তারপর এই অসাধারণ আলপনাটি এক নিমেষে পরিষ্কার করে ফেলা হবে -- অনিত্য জীবন বোঝাতে। ভাসিয়ে দেওয়া হবে নদীতে। নদী বহন করবে ওই প্রস্তরচূর্ণ, বালি -- সকল প্রাণীর কাছে বয়ে নিয়ে যাবে শুশ্রুষা, শান্তি, সম্প্রীতি -- ওঁদের বিশ্বাস তাই।

    শীতের শুরুতে "মন্ডলা' নির্মাণশেষে ভিক্ষুরা যখন নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন আলপনার অবশেষ, সেই সময়ে শোনা গিয়েছিল "সেক্রেড ফুটস্টেপস ফ্রম দ্য রুফ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' -- অস্ট্রেলিয়ায় এসে পৌঁছেছিলেন দলাই লামা, জন হাওয়ার্ড টালবাহানা করছিলেন শীতের এই বিশিষ্ট অতিথির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে, হাওয়ার্ডকে চাপে রাখতে রোজ হুমকি দিচ্ছিল চিন, চিনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মুক্ত বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হচ্ছিলেন সবাই, আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছিল, ঠিক এই কারণে দলাই লামার বেলজিয়াম সফর বাতিল হওয়ার কথা। অবশেষে চিনের হুমকি উড়িয়ে দিয়ে হাওয়ার্ড দেখা করেছিলেন শীতের অতিথির সঙ্গে। দশদিনের সফর নির্বিঘ্নে শেষ হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ড্যামেজ ক®¾ট্রালের চেষ্টায় নেমেছিলেন হাওয়ার্ড। ততদিনে অলীক ভুবনের অবশেষটুকু ভাসিয়ে নিয়েছিল নদীটি।

    এই সময় পেঙ্গুইনটি এসেছিল। শীতের আর এক অতিথি। এসেছিল আড়াই হাজার কিলোমিটার সাঁতার কেটে। কোস্টাল নিউজিল্যান্ড থেকে। খাবারের খোঁজে বেরিয়ে, সিল আর হাঙরের হাত থেকে বাঁচতে দলছুট হয়ে। অর্ধমৃত অবস্থায় পৌঁছেছিল অস্ট্রেলিয়ার সে¾ট্রাল কোস্টে। অত্যন্ত দুÖপ্রাপ্য প্রজাতির পেঙ্গুইনটি -- ফিওর্ডল্যান্ড ক্রেস্টেড। তার এই দু:সাহসিক সমুদ্রযাত্রার পরই জানা গিয়েছিল আর মাত্র ২০০০টি পেঙ্গুইন আছে এই প্রজাতির। টরঙ্গা জুতে আশ্রয় হয় তার -- নাম হয় মিস্টার মুনরো, নিউজিল্যান্ডের তার বাসস্থান মুনরো বিচের নামে। জু'র বিশেষজ্ঞরা চাইছিলেন এখানে একটি মিলন ঘটুক, নতুন প্রাণ আসুক। টরঙ্গা জুতে আমি যখন তাকে দেখতে যাই, সে তখন অনেকটাই সুস্থ; ছোট ছোট ফেয়ারি পেঙ্গুইনদের কর্যকলাপ ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছিল কিঞ্চিৎ অবজ্ঞাভরে। কমলা ঠোঁটটি তার, চোখের ওপর দিয়ে হলদে পালকের বাহার। শেষ বিকেলের সূর্যের আলোর পড়েছিল তার ওপর। সেই ছবি তুলতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছিলাম ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ।

    ফুরনো ব্যাটারি, ভিজে ঠান্ডা হাওয়া, সে¾ট্রালকোস্টের সাইক্লোন, খবরের কাগজের হেডলাইন হয়ে প্রিজনভ্যানে মুখ গুঁজে বসে থাকা মানুষটি -- আমাদের শীতকাল এইভাবেই কেটে যেতে থাকে। ফুরিয়েও আসে এক সময়। মরা ডালে পাতার অঙ্কুর দেখি। খবর আসে -- মিস্টার মুনরোর মিলন ঘটেছে সেই ছোট ছোট পেঙ্গুইনদের দুই মহিলা চকি আর মিলফোর্ডের সঙ্গে। ডিম ফুটবে শিগগিরি। এই বসন্তেই। ... শ্রমণত্রয় আসনপিঁড়ি অবস্থায় সামনে ঝুঁকে, ধাতবদন্ড দিয়ে শঙ্কুর সম্মুখভাগ ঈষৎ ঘর্ষণ করবেন, সেই মৃদু ঘর্ষণে সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ ভরে দেবে নকশার ছোট ছোট অংশগুলি -- লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ... এবং নদীটি বয়ে চলবে।

    এই সময়
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ২৮.০৯.২০০৭
    এখন সময় বড় অন্যরকম। এখন সময় উদ্বেগের, সময় বিষাদের। কোথায়ও বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন শিশুশরীর, কখনও রক্তে ভাসে স্টেশনচত্বর, শপিং মল, ভিড়ে ঠাসা স্টেডিয়াম, অথবা অ্যাম্বুশের মাঝখানে পড়ে যায় সাধারণ যাত্রীবাহী বাস-বুলেট গেঁথে যায় নিরীহ শিক্ষিকাকে, সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফেরে না গৃহস্থ-স্রেফ লশ হয়ে যায়, নরদেহের টুকরোয়, রক্তে মাখামাখি পড়ে থাকে আমাদের চটি, জুতো, পুতুল, টিফিন কৌটো কিংবা বাজারের ব্যাগ। সময় বড় অন্যরকম। সময় বড় ভয়ের, সময় বড় অস্বস্তির। তুতোভাই, সিমকার্ড আর ওয়ান ওয়ে টিকেটে সন্তাসবাদীর সংজ্ঞা নিরুপণ। বুক বাজিয়ে ধর্মযুদ্ধে যায় মহাশক্তিধর, ধর্মগ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যায়, অসম্পূর্ণ উদ্ধৃতিতে ফতোয়া জারি হয়ে যায় হুটহাট, ত্রিশূলের উঁকিঝুঁকি এদিক-ওদিক। সুশিক্ষিত মানুষের নখ দাঁত দেখা যায় ঘরোয়া আসরে। এ বড় ভয়ঙ্কর সময়।

    এসময় অন্যরকম। এ বড় বিস্মৃতির সময়। সকালের হেডলাইন বিকেলে মনে পড়ে না, আজকের কথা কাল ভুলে যাব, কালকের কথা পরশু। যদিও তাঁর অনুবাদ লাখে লাখে বিকোয়, এই অদ্ভুত সময়ে আটশো বছর আগের মানুষটিকে ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। মনে করায় ইউনেস্কো -- দু'হাজার সাতকে রুমির বছর ঘোষণা করে, সেই সূত্রেই এই শহরেও আসেন জালালুদ্দিন রুমি, সুফি সাধক, মরমিয়া কবি। সেদিনের সন্ধ্যায় সিডনি টাউন হলে ইউনেস্কো আর টার্কির পর্যটন বিভাগের উদ্যোগে অনুষ্ঠান -- ঠবভক্ষরভশফ ঈনক্ষৎভড়বনড় ঘুরন্ত ফকির। দু'হাজার আসনের প্রেক্ষাগৃহে কানায় কানায় ভরা। টার্কির ওপর একটি ভিডিও ক্লিপিং আর দুজন মন্ত্রীর ভাষণের পরে অনুষ্ঠানের সূত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, ওটোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই রুমির অনুসারীরা "সামা'য় অংশ নেন। সামা খুব সম্ভব আরবী শব্দ-অনেক অর্থের মধ্যে একটি অর্থ খুব মন দিয়ে কিছু শোনা। সুফি মৌলবীরা রুমির কিছু পংক্তির সুরমূর্ছনায় ঘুরবেন, ভাববিভোর -- সেই থেকেই ঘুরন্ত ফকির কথাটি।

    স্বল্পালোকিত মঞ্চে একে একে জনা কুড়ি পুরুষ ঢুকলেন -- ধীরগতি, বিনম্র -- কালো জোব্বা, লালচে টুপি - সিক্কা। এক বৃদ্ধের টুপিতে শুধু সবুজ বর্ডার। বৃদ্ধ মঞ্চের ডানদিকে হাঁটু মুড়ে বসলেন -- বাকিরা মঞ্চের মাঝখানে তিনটি ধাপে কারোর হাতে বাদ্যযন্ত্র -- সবই অচেনা প্রায়। কেউ বা খালি হাতে -- তাঁরা গাইবেন -- সামনে স্বরলিপি। গানের দল ওপরের ধাপে, মাঝের ধাপে বাদকবৃন্দ আর নীচে সাত আটজন হাঁটু মুড়ে যাঁদের সামনে স্বরলিপির খাতা বা বাদ্যযন্ত্র কিছুই নেই। শুরুতে বাঁশি বেজে উঠল মৃদু, ধীরলয় -- "বাঁশি শোনো, শোনো বাঁশি/বাঁশি বাজে বিরহের, বাঁশি বলে ভালোবাসি'। বাঁশির পরেই একক পুরুষকণ্ঠ সুর ধরলেন -- পয়গম্বর মুহম্মদের উদ্দেশে -- অনেকটা আজানের মতো -- 'ঠবষ দতক্ষনড় পষক্ষ সতভশপয়র ধতঁড় শষং ফষশন/ঊষক্ষ ঁষয় ক্ষনলতভশ, ঘ সয়ক্ষন ষশন.'। একক কন্ঠের সঙ্গে সুর মেলালেন বাকিরা, আর সমস্ত বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠল। বৃদ্ধ উথে দাঁড়ালেন। সামনের সারির ওই আটজন একে একে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে এলেন। প্রথমজন বৃদ্ধের কাছে এসে মাথা ঝোঁকালেন, বৃদ্ধও ঝোঁকালেন মাথা। বৃদ্ধ সামান্য এগোলেন, প্রথমজন তখন বৃদ্ধের জায়গায় দাঁড়ালেন, দ্বিতীয়জন এলেন, সেই একইরকম অভিবাদনের আদান-প্রদান -- এবারে প্রথম এগিয়ে গেলে, দ্বিতীয় ওই জায়গা নিলেন -- এইভাবে বৃত্তপথে ঘুরতে লাগলেন সবাই -- তিনবার পরিক্রমা এইভাবে নিশ্চিত জ্ঞানে, নিশ্চিত দর্শনে, নিশ্চিত উপলব্ধিতে -- ঐশ নৎনক্ষঁ দষলসতশঁ, ঐ লষতশনধ তশধ ঐ দক্ষভনধ/ঝবন লভড়নক্ষতথরন তশধ ঢ়বন বতসসঁ, থষঢ়ব ভশ পক্ষভনশধড়বভস ঢ়ক্ষভনধ'. সুর বদলে গেল। বৃদ্ধ আবার মঞ্চের ডানদিকে এলেন -- প্রথম দরবেশ এগিয়ে এলেন -- বৃদ্ধের খুব কাছে -- বৃদ্ধ তার কানে কানে কিছু বললেন -- তিনি সামান্য এগিয়ে দাঁড়ালেন -- দ্বিতীয় এলেন বৃদ্ধের কানে-কানে কথা হল। 'ইষলন, দষলন ংবষনৎনক্ষ ঁষয় তক্ষন/ঠতশধনক্ষনক্ষ, ংষড়বভসসনক্ষ, রষৎনক্ষ ষপ রভৎভশফ, ভঢ় ধষনড়শ'ঢ় লতঢ়ঢ়নক্ষ/ঘয়ক্ষড় ভড় শষঢ় ত দতক্ষতৎতশ ষপ ধনড়সতভক্ষ/ইষলন, নৎনশ ভপ ঁষয় বতৎন থক্ষষযনশ ঁষয়ক্ষ ৎষং ত ঢ়বষয়ড়তশধ ঢ়ভলনড়/ইষলন ঁনঢ় তফতভশ, দষলন দষলন.' এবারে দ্বিতীয়জন প্রথমের কাছে এসে তাঁকে প্রদক্ষিণ করলেন যেন, প্রদক্ষিণ শেষে খুলে ফেললেন কালো জোব্বা -- ভিতরে সম্পূর্ণ সাদা পোশাক -- ঘাগরার মতো -- তলায় চাপা পাজামা -- ওপরেও সাদা জামা বহিরঙ্গের আবরণ ছেড়ে অন্তরে সত্যের সন্ধানে বোঝাতে। ঘুরতে লাগলেন আপন অক্ষ বরাবর, হাত দুটি শরীরের খুব কাছে নিয়ে ঘাড়টি ঈষৎ হেলিয়ে ক্রমে দু'হাত প্রসারিত হল -- ডান হাতের মুদ্রা ঊর্ধগামি, বাঁ হাতের মুদ্রা মাটির দিকে -- ঘুরছিলেন দম দেওয়া পুতুলের মতো -- একে একে বাকি সবাই। এই ঘূর্ণনের অর্থ -- মহাবিশ্ব, মানুষের জীবনচক্র এবং আত্মোপলব্ধিতে "ইনসান-ই-কামিল' হয়ে ওঠা -- "উদারতায় নদীর মতো যেন, ব্যক্তিত্বে সূর্যস্বরূপ হই/পরদোষ ঢাকি রাতের আঁধার হয়ে, ক্রোধপ্রকাশে যেন মৃতবৎ রই/বিনম্রতায় মাটির কাছেই থাকি, সাগরসম সকল যেন সই/যেমন আছি তেমনই আসি যেন, যেমন আসি তেমনই যেন হই' -- এক একটি ঘূর্ণনশেষে বাঁ হাতটি ডান কাঁধে আর ডান হাতটি বাঁ কাঁধে রেখে দাঁড়িয়ে থাকছিলেন তাঁরা, পাশাপাশি। তারপর আবার প্রদক্ষিণ, আবার ঘূর্ণন, আবার দাঁড়িয়ে থাকা কোণাকুণি দু'কাঁধ ধরে ... "একটি ঘূর্ণন আছে আমাদের গোপনে, গভীরে; ব্রহ্মাণ্ডকে এই, যা ঘোরাও। মাথাও জানে না পা-কে, পা-ও কি জেনেছে মাথাটিরে?'

    আটজন ফকির ঘুরে চলছিলেন মঞ্চে। প্রেক্ষাগৃহ করতালিতে মুখর হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হচ্ছিল মানবশরীরে -- লেবাননে, আফগানিস্তানে, ইরাকে, লুম্বিনী পার্ক লেসারিয়ামে, মাহিম রেলস্টেশনে, লন্ডনের বাসে, ... সন্ত্রাসবাদীর সংজ্ঞা নির্ধারিত হচ্ছিল ধর্মে ও শ্মশ্রুগুম্ফে। চায়ের পেয়ালার তুফানে বেরিয়ে পড়ছিল ভদ্র সুশিক্ষিত মানুষের নখদন্ত। জালালুদ্দিন রুমি বিস্মৃত হচ্ছিলেন।

    দৃশ্যাবলী
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ২৩.১১.২০০৭
    "বরং রেখা, সমূহে একা.....'

    সাদা পাতারা আক্রান্ত নয় বহুদিন। শব্দে শব্দে বিয়া হয় নাই। এই ব্যস্ততা, এই ক্লান্তি, এই দিনযাপন। মনিটরে ধুলোর সর। কী-বোর্ডেও। অক্ষরের পাশে অক্ষর বসে না, শব্দের পরে শব্দ আসে না। কী-বোর্ড হাৎড়ে বেড়াই। লেখার বসত খুঁজি এদিক সেদিক.....

    খাঁড়ির জল আর সামান্য জঙ্গল ঘিরে বিকেলের হাঁটা। স্বাস্থ্যচর্চায় ব্যস্ত মানুষের জগিং। শুভেচ্ছা বিনিময়, হাত নাড়া। জ্যাকারান্ডাগুচ্ছে আকাশের বেগুনি হয়ে থাকা। একা একা জলের মুখোমুখি দাঁড়ানো। সেই সব বোটগুলি। পরিত্যক্ত জেটি। ইউক্যালিপটাসের এলোমেলো হাওয়ায় সূর্য ডোবা, স্কাই লাইনে হারবার ব্রিজ। আলো জ্বলে ওঠে শহরের সৌধে, আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একলা ক্রেনটি। জল-মাটি-মানুষের এই আয়োজন। আমার লেখা বসত করে কোনখানে?

    দৃশ্য এক

    আমার প্রতিদিনের পথটি। সেই ইন্টারসিটি। সেই সব সবজেটে সিট। সেই পুরোনো কালচে কার্পেট। জানলার বাইরে সেই যে নদীটি, সেই জল, জঙ্গল, উপত্যকা এবং ঘোড়াগুলি। কামরার আলো ঘিরে বসন্তের পতঙ্গসমূহ। সহযাত্রীরা কেউ ঘুমে, কেউ বই মুখে, কেউ গান কানে, জানলার বাইরে তাকিয়ে কেউ। সহযাত্রী মহিলাটি আচমকাই বের করেন কুরুশে বোনা একখানি ছোটো ব্যাগ। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে পোকাদের পশ্চাৎধাবন করতে থাকেন কামারার ভেতরে। একটি একটি ধরেন আর ব্যাগে পোরেন। বেশবাস অসম্বৃত হয়ে পড়ে। তবু পোকা ধরেই চলেন, ধরেই চলেন তিনি। হতভম্ব দৃষ্টি আর অবাক প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে দৌড়ে পাশের কামরায় চলে যান। আমি বের করি কাগজ-কলম। একটি শব্দ, দুটি শব্দ....। তারপর ছিঁড়ে ফেলি। আমার লেখা বসত করে কোনখানে?

    দৃশ্য দুই

    তখনও ভোর হয়নি পুরোপুরি। গাড়িগুলি পার্ক করা। শেষ রাতের শিশিরে ভিজে। জলের ফোঁটা গড়িয়ে নামে ধাতব শরীর বেয়ে। সামান্য আবছা জানলার কাচের ভেতর চোখ চলে যায়। চালকের সিটে পরিণতবয়স্ক ভারিক্কি মানুষটি। স্যুটেড বুটেড। ঘুমোচ্ছেন। মুখে তাঁর বুড়ো আঙুল! চুষছেন! সেকি ঘুমে? সে কি জাগরণে? কি জানি কি জানি! দাঁড়িয়ে দেখি। ষষ্ঠেন্দ্রিয়টি সক্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর। ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে অপ্রস্তুত। হুষ করে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে পলকে হাওয়া। ঝোলাতে হাত ঢোকাই। কলমে হাত ঠেকে। বের করি। আবার ঢুকিয়ে রাখি। আমার লেখা বসত করে কোন খানে?

    দৃশ্য তিন
    সিডনি নোলানের এক্সিবিশনে গিয়ে এই গল্পটা আবিষ্কার করি। গল্পটা বেহড়-বাগী বন্দুকের আর রং তুলি ক্যানভাসের। গল্পটা অস্ট্রেলিয়ার রবিন হুড সদৃশ নেড কেলি আর বিখ্যাত শিল্পী সিডনি নোলানের। ঊনিশ শতকের আইরিশ কনভিক্ট বাবার ছেলে, দুটি শূয়োর চুরি করে যাঁর অপরাধ জীবনের শুরু, পরবর্তীকালে স্বহস্তনির্মিত বর্ম পরিধান করে পুলিশের সঙ্গে নিয়ত সংঘর্ষে, পুলিশ নিধনে আর ফাঁসির দড়িতে হয়ে উঠবেন অস্ট্রেলিয়ান আইকন, গানে গল্পে মিথে লোকের মুখে ফিরবেন, সেই নেড কেলি একশো বছরেরও বেশি সময়পরে সিডনি নোলানের তুলিতে ফিরে আসবেন সেই স্বহস্ত নির্মির্ত বর্মে, হাতে বন্দুক নিয়ে, ঘোড়ার পিঠে। ডিম্বুলার নিসর্গ, রাঙা ভাঙা চাঁদ কিম্বা গোলাপ বাগিচার তলায় শুয়ে থাকা মেয়েটিকে সরিয়ে রেখে নোলানের তুলিতে ঘুরে ঘুরে আসবে নেড কেলি-পতোন্মুখ ঘোড়ায়। নদীটির বাঁকে বাঁকে, জঙ্গলে পুলিশের মুখোমুখি হয়ে বর্মে, বন্দুকে কিম্বা অশ্বারূঢ়। চল্লিশের দশকে, নোলানের ক্যানভাসকে সম্পুর্ণ অধিকার করবে নেড কেলি। বাগী বন্দুক হয়ে উঠবে রং তুলির অনুপ্রেরণা।

    আমার লেখা বসত করে কোন মানুষে? তারেই খুঁজে বেড়াই।

    দৃশ্য চার

    নিউ সাউথ ওয়েলস আর্ট গ্যালারিতে একটি ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পিতলের, ভিক্ষাপাত্রসদৃশ। থাইল্যান্ডের শিল্পী, বুনমার কাজ। তিনি কর্কটে আক্রান্ত সেইসময়। স্ত্রীও চলে গিয়েছিলেন এই অসুখেই। পাত্রটির সমস্ত অভ্যন্তর জুড়ে শিল্পীর দাঁতের ইম্প্রেশন। সারি সারি দাঁতের পাটি কেবল। কৃষ্ণবর্ণ। পাত্রের কিনারায় হাতের মুঠি। অস্থিসর্বস্ব। তলদেশে একটি ছোটো পানপাত্র। হাঁ করা করোটির আদলে। আমূল কেঁপে যাই। শুনতে পাই স্পষ্ট-এই আমার সমস্ত যন্ত্রনা, এসো। পান করো, পান করো, শুষে নাও। এই যন্ত্রনা। এই মন্থন। এই শিল্প।

    এইখানেই কি বসত আমার লেখার? এই যন্ত্রনায়? এই মন্থনে?

    শেষ দৃশ্য

    প্রবাসী বসে থাকে কী-বোর্ড হাতে। একা একা। লেখার টেবিলে। মধ্যরাতে। সেই সব শব্দাবলীর প্রতীক্ষায়। আর দূরে কোন নির্জনে বকুলশাখায় দোলায় কেউ দোলে। দোদুল দোলে, দোদুল দোলে, দোদুল দোলে। ঝরকে ঝরকে বকুল ঝরে। আকাশে তার আঁচল ওড়ে। কবরী খসে যায়। কেশদামে আবৃত মুখমন্ডলটি তার। প্রবাসী লেখার টেবিল ছেড়ে ওঠে। কী-বোর্ড সরিয়ে রাখে। কম্পিউটার অফ করে দেয়। তারপর বেরিয়ে পড়ে। অদেখা সে মুখটির খোঁজে। টেবিল বাতিটি জ্বলতে থাকে।
  • 3 | 193.218.118.136 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:১৩741410
  • গল্প লিখব না বলে
    অরণ্য
     
     
    আমি গল্প লিখি না, এভাবেই ভাবি, যেন বা লিখি না এমনটা ভাবলেই লিখতে ইচ্ছে হবে আর ওভাবেই হঠাৎ কোনো নতুন গল্প শুরু হয়ে যাবে। রোজ সকাল থেকে ক'ঘন্টা এভাবে ভেবে ভেবে অবশেষে যখন কলম ধরি, তখন আমার ঘুম আসে। একপালা ঘুম, ঘুমে টইটুম্বুর আমি যখন এলিয়ে পড়ি একদিকে, তখুনি কেউ এসে সন্তর্পণে আমার পাশে দাঁড়ায়, আমার হাত ধরে, তারপর টানতে টানতে নিয়ে যায়। নিয়ে চলে যেতে থাকে, দূরে, অনেক দূরের অচেনা দেশে, যেখানে নদী নেই কোনো। আমি চলতে চলতেই আরও ঘুমিয়ে পড়ি আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যখন ঘুমের মধ্যেই জেগে উঠি, দেখি গল্প লেখা শুরু হয়ে গেছে। যেটা খুব সম্ভবত আরেকটা নতুন স্বপ্ন, যা আমি আগেও অনেকবার দেখেছি কিংবা কখনই দেখেনি। অমি সত্যিকার অর্থেই তখন বিশ্বাস করি, আসলেই আমি গল্প লিখি না বরং কিছু স্বপ্ন দেখি, যারা সেই হাতের আশ্রয়ে এসে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে আসে অচেনা দেশ, অচেনা ঘর ও অন্ধকার এক টেবিলে। যেখানে আমাকে জোর করে বসিয়ে দেয়া হয়, হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় ধারাল এক ছোরা। আমি আনমনেই ছোরাটা আঁকড়ে ধরি, ধরে লিখতে শুরু করি আর আমার হাত যততত্র কেটে গিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে থাকে রক্ত। রক্ত আর রক্ত! রক্তে রক্তে ভরে ওঠে ঘরের মেঝে আর তার ভেতরে আনন্দে সাঁতার কেটে বেড়ায় বিভিন্ন রকমের পোকা, যারা ধীরে ধীরে পাখা গজিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘরময়, তারপর আমার মাথার চারপাশে উড়ে উড়ে অবশেষে অনায়াসে ঢুকে পড়ে পাতায়।

    যে কোন গল্প শুরুর প্রাক্কালেই আমার প্রচণ্ড ঘুম আসে এবং খুব শীঘ্রই তা ভেঙে যায়! আমি অসহায় বোধ করি, আশ-পাশ, এদিক-ওদিক তাকাই। কাউকে যেন খুঁজি, খুঁজতেই থাকি, অথচ পাই না। আসলে আমার চারপাশে কখনওই কেউ থাকে না বা ছিল না। অসহায় বোধটা তার নিজস্ব স্বভাবে বেড়ে যেতে যেতে অপর বেলাতে গিয়ে পৌঁছায়। আমি উঠে দাঁড়াই, একটু বাহির চাই। যদিও একটু বাহির মানেই আরও একটু বেশি ভেতর। তাছাড়া আজকাল বাড়ির বাইরে যেতে আমার কেন জানি খুব ভয় করে। মনে হয় অমি বাইরে বেরুলেই ঘুমিয়ে পড়ব কিংবা আশপাশে থাকা মানুষগুলো পোকা-মাকড় হয়ে উড়ে এসে ঢুকে পড়বে আমার ভেতরে। তারপরও বেরুতেই হয়, বেরুতে হয় এজন্য যে, গল্প না লিখতে লিখতে অভ্যাস এমন হয়েছে যে আজকাল মানুষ অথবা পোকা, যে কোনো একটা না দেখলে কিছুতেই থাকতে পারি না। অনেকবার পোকা ও মানুষ নিয়ে ভেবে দেখেছি যে, আমি মানুষ থেকে পোকাদের ভালবাসি বেশি, বিশেষ করে সেসব পোকা, যারা রক্তের ভেতরে সাঁতার কাটতে কাটতে উল্লাসে অনয়াস পাখা গজিয়ে নিতে পারে।

    ঘর থেকে বেরিয়ে আমি প্রতিবার-ই বাম দিকে গেছি। ডান দিকটাতে একটা নদী আছে সেটা মনে থাকে না বলেই বাম। অথচ বাম দিকে গিয়ে কিছুদূর এগিয়ে দেখি সত্যি সত্যিই ডানদিকের নদীটাকে ভুলে গেছি। ভুলে যাওয়া ব্যাপারটা আমার অনেক আগের, তবে নতুন করে পুনরায় যার কাছে শিখেছিলাম, তার নামটা অনেক চেষ্টা করেও আর মনে করতে পারি না। শুধু এটুকু মনে পড়ে সে একটা নারী, যে কখনও আমার না লেখা গল্পের নায়িকা হতে পারেনি এবং যার, ডানদিকের সঙ্গে, নদীর সঙ্গে, খুব নিবিড় একটা সম্পর্ক আছে। একবার ফারুক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "তুই নদীর ধারে কেন যাস না বলতো?' আমি ওর প্রশ্নে সরাসরি ওর চোখে তাকাই, কিছু পোকা ওর মাথার আশেপাশে উড়ছিল, খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল ওর মুখ। কিছুক্ষণ পর যখন ও আমাকে জোরে ধাক্কা দিল, আমি হাসতে হাসতে বললাম, "তোদের মতো ফিরতে পারি না যে'। এবার ও আমার দিকে তাকিয়ে, সম্ভবত মাথায়, হয়তো বা অনুরূপ কিছু পোকা আমার মাথার চারপাশেও উড়ছিল আর আমাকে দেখাচ্ছিল বীভৎস।

    বস্তুত আমি কোনোদিনই ফিরতে পারিনি, সেটা বাম হোক কিংবা ডান। ডান দিকে যদিও যাই না, অথচ বাম দিকে গিয়ে শেষ কবে ফিরেছি মনে নেই। হয়তো বা আমি কোনো দিক থেকেই ফিরতে পারি না কিংবা চাইও না, অথচ ফেরার নেশাটাকে জাগিয়ে রাখার জন্যই ডান-বাম পৃথক করে বার বার বামের দিকে যত এগোয়, দেখি ডানটা সবসময় আমায় টানছে। আমি অস্থির হয়ে উঠি, আরেকটু জোরে, ক্রমশ জোরে, বামে আরও বামের দিকে এগিয়ে যাই এবং একসময় দেখি সম্পূর্ণ ডানে এসে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে সেই নদীটি আমার সামনে দিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে যায় আর আমি ধীরে ধীরে তার পিছু নিই।

    বেশ কিছু বছর ধরে একটা কষ্টকে আমি দিনরাত নিজের ভেতরে লালন করে, ভয়ানক থেকে ভয়ঙ্কর করে দেখেছি, কষ্ট আসলেই ভীষণ নিরীহ, ওর তেমন কোনো ক্ষমতাই নেই। শুধু ঘরের এককোণে পড়ে পড়ে তেল ফুরিয়ে আসা বাতি যেভাবে শেষ হয়ে আসার মুহূর্তে দপদপ করে জ্বলে উঠে অনিবার্যভাবেই নিভে যায়, বেশিরভাগ কষ্টই খুব সাধারণ রূপ থেকে জন্ম নিয়ে প্রকোপ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেভাবে নিভে যায়। শুধু ঘর বলে, দপ করে ওঠার শব্দ কানের ভেতর, মাথার ভেতর, মনের ভেতরে দিন-রাত বাজতে থাকে, ফলত মনে হয় বেঁচে থাকা দুষ্কর। অথচ ব্যাপারটা ভাবলেই আমার প্রচন্ড হাসি পায় যে, কষ্টে কখনোই মানুষ মারা যায় না অথচ তারপরও সারাক্ষণ মরে যাব, মরে যাব ভাব।

    যে কোনো গল্প লেখা শুরু হলেই অমি কিছুটা হলেও শঙ্কিত হয়ে উঠি, কারণ আমি জানি আমার গল্পের নায়ক ছাড়া বাকি সবাই অবশ্যম্ভাবীরূপে মারা যাবে। কিছু কিছু গল্পে তো আমার গল্পের নায়িকাগুলো একদম শুরুতেই মারা যায় আর তখন কেন জানি গল্পটা লিখে যেতে খুব ভাল লাগে। নায়িকাবিহীন গল্পগুলো খুব সরল হয়, যেন বা সত্যিকারভাবেই বাকি চরিত্রগুলো হেসে-খেলে, যে যার উল্লাসে স্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তখন গল্পের ভেতর একটা অনন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়, আর আমি চুপচাপ আর কিছু না লিখে সেগুলো উপভোগ করতে থাকি।

    যে গল্প শেষ হয়ে যায়, সেটা কোনো গল্পই নয়। চাক্রিক বৃত্তে কোনো কিছুর-ই শেষ হবার জো নেই, চাইলেও তা সম্ভাব নয়, আর আমি সেটা ভাল করে জানি বিধায় কখনও গল্প লিখি না। অথচ ঘরের ভেতরে দিন-রাত ওভাবে বসে থাকলেই গল্পে বাস করা নানাবিধ মানুষজন এসে হানা দেয়, আমার সঙ্গে কথা বলে, জ্বালাতন করে, তাই আমাকে ঘর ছেড়ে বেরুতেই হয় এবং বেরিয়ে বরাবরের মতো বাম দিক, কেবল বাম দিকটা ঠিক রেখে এগিয়ে যাই। নানাবিধ ভাবনা, বহুরকমের পোকা, মানুষের মুখ, সবুজ ঘাস, গাছ-পালা, পাখি এসব নিয়েই বামদিকটা ক্রমেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসে। আমি সেই অন্ধকারের ভেতরেই হাতড়ে ফেরার মতো একটু একটু করে এগোয়, কারণ আরেকটু সামনেই মন্দির। মাথা নোয়ানোটা যদিও আমি কোনোদিনই শিখে উঠতে পারিনি, তবুও মন্দিরটার কাছে এলেই মাথাটা কেমন করে জানি নুয়ে যায়। কেন যায়, সে কারণ খুঁজি না, কারণ গল্প না লেখার ইচ্ছেটা যখন থেকে আমার ভেতরে জেগেছে, তখন থেকেই আমি প্রশ্ন ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে চেয়েছি। প্রশ্ন মানেই অনেক জটলা, হট্টগোল, আঁধারের ভেতরে অসংখ্য শরীর আর হাত, যার সবগুলোই সবগুলোকে আপ্রাণ আঁকড়ে ধরতে চায়।

    মন্দিরের সিঁড়িতে প্রায় প্রতিদিন গিয়ে বসে থাকি। বসে থাকি যেন বা একটা পাথর হয়ে মন্দিরের সঙ্গে সেঁটে গিয়ে সম্পূর্ণ মন্দির বোধে ডুবে থাকা। ক্রমেই মন্দির চত্বর ভরে ওঠে মানুষে, শাঁখ বাজে, পূজা-অর্চনা হয় আর প্রসাদের অলৌকিক ঘ্রাণ যখন নাকে এসে লাগে আমি চমকে উঠি, পাথরটা আচমকা ভেঙে গুড়িয়ে যায় একটা বাক্যে, "এমা! তুমি এখানে, কখন এলে?' এদিক-ওদিক তাকাই, হঠাৎ মনে পড়ে তাইতো, আমি এখানে কেন, আমি তো যাচ্ছিলাম। কিন্তু কোথায়? আবারও তাকাই আশেপাশে আর হতভম্বের মত সিঁড়ি থেকে উঠে দিশাহীন হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত যেখানে এসে পৌঁছেছি, সেটা আমার ঘর ছাড়া কিছু নয়। অথচ আমি তো ফিরে আসিনি, তাহলে? আসলে কেউ-ই আসেনি কিংবা আমিও হয়তো বাইরে যাইনি। বারান্দায় কিছুক্ষণ বসি, জোরে জোরে শ্বাস নিই। সন্ধ্যার ঠিক পর পর-ই পৃথিবীর যে গুমোট কান্নাটা আঁধারের পরতে পরতে ধীরে ধীরে মিশতে থাকে সেগুলো শুনতে পাই। যারা সেটা শুনতে পায়, তাদের কেউ-ই বাকি জীবনে আর ঘরে ফেরে না। উন্মুক্ত প্রান্তরে, দিক চিহ্নহীন বোধছড়া পৃথিবীর সমস্ত কান্না ভুলে দিনের প্রথম সে হাসি, তার লোভেই তারা ফেরে না। আমিও ফিরিনি, অথচ যে ফিরে এল সে কে? প্রশ্ন শুরু হলেই কাঁপতে শুরু করি, ভয় পাই আর পুরোনো কোনো গল্প হঠাৎ করে শুরু হয়ে তার একটিমাত্র চরিত্র এগিয়ে যেতে থাকে, ডান-বাম কোন কিছু না ভেবে সোজা নদীর দিকে।

    আমি শুয়ে পড়তে চেষ্টা করি, হয়তো শুয়েও পড়ি একসময়। অসমাপ্ত গল্পগুলো আর কোনোদিনই শেষ হবে না এমনটা ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো ভারী হয়ে উঠলে, বুঝতে পারি খুব সন্তর্পণে আমার পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে। না, আমি তার মুখ দেখতে পাই না, চাইও না। বিগত বছরগুলোয় আমি সত্যিকার অর্থেই কোনো মুখ দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। তাছাড়া যে কোনো মুখের দিকে তাকালেই আমার চোখে ভেসে ওঠে অজস্র পোকা, যারা মুখ থেকে উড়ে এসে আমার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে একসময় মাথার ভেতরে ঢুকে পড়ে। তাই আমি মুখ দেখি না, দেখতে চাই না। অবয়বের ভেতরে সেভাবে তো কিছু থাকতে পারে না, তাহলে অবয়ব সম্বলতা কেন? আমার পাশের মানুষটির মুখ না দেখলেও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি সে আমার খুব পরিচিত একজন। আমি আশ্বস্ত হই, সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে, কিছু বলে না, কোনো শব্দ করে না, শুধু গল্প লেখার সেই ধারালো ছোরাটা টেবিল থেকে তুলে এনে আমার ঘুমন্ত হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে আমাকে বিছানা থেকে টেনে ওর জায়গায় দাঁড় করিয়ে নিজেই শুয়ে ঘুমিয়ে যায়। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে ওর প্রশান্ত ঘুম দেখি, ঈষৎ হাসি ছাড়িয়ে পড়া গভীর মুখ। কখন জানি অজান্তেই একটা হাত আর কোনোদিন কোনো গল্প লিখবে না বলে জেগে ওঠে।
     
    অলঙ্করণ: সোমা সাহা
  • 4 | 23.129.64.221 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:১৯741411
  •  
    নিষিদ্ধ ফল

    দুই ভাই থাকে একই বাড়িতে, অথচ কথাবার্তা মুখ দেখাদেখি সব বন্ধ। আসলে চার ভাই আর এক দিদি; শুধু মেজ আর ছোট ভাই একই বাড়িতে, বাকি ভায়েরা আলাদা আলাদা অন্য জায়গায় থাকে তাদের ঘর সংসার নিয়ে। এই দুই ভায়েরই বৌ আছে, মেজভাই নি:সন্তান। এই কথা বন্ধ নিয়ে কোনওদিন একফোঁটাও অবাক হইনি। এমনটাতো ঘটেই থাকে কত ঘরে, ভায়ে ভায়ে ঝগড়া, জায়ে জায়ে ঝগড়া। খুঁজে দেখলে হয়তো শরৎচন্দ্রের গল্পে উপন্যাসেই এমন গন্ডাখানেক একজ্যাম্পেল পাওয়া যাবে। তাই ছোটবেলা থেকেই এতে আশ্চর্যের কিছু খুঁজে পাইনি। তবুও মাঝে মাঝে থমকে ভাবতে থাকতাম, বাবার মতো শান্তশিষ্ট মানুষটা, যে কিনা সাতচড়ে রা কাড়ে না, এত নরম যার মন যে একটা পিঁপড়েকে পর্যন্ত মারতে পারে না, সে এত কঠিন শর্ত পালন করে চলে কেমন করে? কত ভয়ানক সে ঝগড়া, যার রেশে মায়ের পেটের ভায়ে ভায়ে জন্মের মতো সব সম্পর্ক শেষ? আমারও তো ছোট বোন রয়েছে, কতটা ঝগড়া মারপিট হলে জন্মের মতো মুখ দেখাদেখি কথাবলা সব বন্ধ হতে পারে? একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে, তখন সবে দাবার ঘুঁটি কেমন করে চলে সেটুকু শিখেছি আমরা দুই বোনে, হারিয়ে দিলাম কিস্তিমাৎ করে ছোটবোনকে। ব্যস্‌! অমনি রাগের মাথায় কান্ডজ্ঞান হারিয়ে বোন বসিয়ে দিল ছুঁচোলো পেন্সিল আমার হাঁটুর উপরে। রক্তারক্তি কান্ড। আমি তখন ক্লাস ফোর বা ফাইভ। চেঁচিয়েছিলাম খুব, হয়তো চুলোচুলি অবধিও গড়িয়ে থাকবে এই ঝগড়া, কিন্তু তাই বলে জন্মের মতো কথা বন্ধ? বাপরে! কী প্রচন্ড মনের জোর দরকার এর জন্যে। হলফ করে বলতে পারি ছোটরা কিছুতেই পারবে না, কিছুক্ষণ পরে হার স্বীকার করে নেবেই, ঠিক ভাব করে ফেলবে আবার।

    একই বাড়িতে দুটো পরিবার পরস্পরকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলত। এমনকি বিজয়ায় প্রণাম-কোলাকুলি, এ সমস্তও বাদ। আমি বিশ্বাস করতাম, বাবা নিশ্চয় লুকিয়ে লুকিয়ে কখনও সখনও মেজজেঠুর সঙ্গে কথা বলে, নিশ্চয়ই যখন কেউ দেখতে পায় না তখন। হয়তো টুক করে একটু কথা বলেই চারদিক দেখে নিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে, গম্ভীর হয়ে চলে যায়। আমি সত্যিই এমনটা ভাবতাম। ভাবতাম, মা বা জেঠিমা, এরা তো নিজেরা তো আর মায়ের পেটের বোন নয়, বন্ধুও নয়, এরা কথা বন্ধ রাখতে পারে। রক্তের সম্পর্ক তো নেই!

    আমি নিজেই তো পারতাম না। যা যা নিষেধ, সেগুলো করতেই বেশি বেশি ইচ্ছে করত। সাত বছর বয়েস তখন আমার, মর্নিং ইস্কুল সাড়ে দশটায় ছুটি। আমাকে একা থাকতে হত বিকেল পাঁচটা অবধি অন্তত। মা আর বোন একসঙ্গে ফিরত ডে ইস্কুল থেকে। ক্লাস থ্রি - ফোর দুটো বছর, যতদিন ইস্কুল খোলা থাকে, ঠিক ততগুলো দুপুর আমি রাশি রাশি নিষিদ্ধ কাজ করে চলি। সে যে কী অপূর্ব নেশা, তা বোঝানোর সাধ্য আমার নেই।

    একটা করে করে নিষিদ্ধ কাজ করি, আর আমার দু:সাহস বাড়তে থাকে। আমার কাছে প্রতিটি কাজই গর`ড়িত অপরাধ। যেমন, আমার জন্যে ঢাকনা দিয়ে রাখা দুপুরের ভাত-তরকারি লুকিয়ে ফেলে দেওয়া। "ফেলে দেওয়া' মানে ওটা কাউকে খেতে দিয়ে দিতাম। তখন আমাদের পাড়ায় অনেক গরীব লোক থাকত, রাস্তায় সংসার পেতে। বাড়ির বাইরের রকেই থাকত চিনিবাস, চিনিবাসের বৌ, ওদের মেয়ে "বুলি', আর বুলির দুটো দাদা। আমি চুপচাপ ওদের কলাইয়ের কানা উঁচু থালায় পুরোটা ঢেলে দিলাম। তারপরে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে, দুড়দাড় লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যেতাম। নিভোনো উনুন থেকে ছাই বের করে ঘষে ঘষে মেজে ফেলতাম, থালা বাটি গেলাস। কেউ যেন টেরটি না পায়, চিহ্নটি না থাকে কোথাও এই অপরাধের।

    খিদে পেত না। অথচ বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিনিট তিনেক হাঁটলেই মন্দিরের সামনে, ফুটপাথে বসে আছে পেয়ারাওয়ালা। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে তিনটে বাজলেই আসবে আচারওয়ালা, তার পরপরই ফুচকাওয়ালা। পেয়ারা নয়, "পিয়ারা' বলতাম তখন। একটা পিয়ারা দশ পয়সা। ওই দশ পয়সা দিয়েই আবার কেনা যেতে পারে তিনটে ফুচকা, কিংবা একদলা কুলের আচার, তেঁতুলের আচার, বিলিতি আমড়া, চরম লোভনীয় কাঠিবরফ। অসংখ্য অপ্‌শান, কিন্তু আমার কাছে একটাই দশ পয়সার কয়েন। পুরোনো পয়সাগুলো ভারি আর ছোট, বাজারে তখন পাশাপাশি বেরিয়েছে চকচকে হালকা পয়সা। তাতে পরিষ্কার দেখা যায় একটা মেয়ের মাথা। পয়সায় তো যা লেখা থাকে সব ইংরেজি নয় হিন্দিতে, কোনওটাই পড়তে জানি না, অবশ্য দশ লেখাটা খুব ভাল করেই পড়তে পারি। পড়তে না পারলেও, শুধু পয়সার আকার দেখেই চিনতে পারি আর দামটাতো বটেই। দেয়ালঘাড়িও দেখতে শিখে গেছি তখন, রোম্যান সংখ্যা পড়তে না জানলেও সময় কত বলে দিতে পারতাম।

    আমি অপেক্ষা করতে থাকি বিকেল হওয়ার। কিংবা ঠা ঠা দুপুরে দৌড়ে গিয়ে কিনেও আনতে পারি ঝালঝাল নুন মাখানো শসা। পয়সাটা অবশ্য আমার নিজের নয়, চুরি করা। লক্ষ্মীর ভাঁড় থেকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কাঠি দিয়ে নেড়ে নেড়ে বের করে আনা। অনেক সময় বেরিয়ে আসে সোনালি রঙের গোল, ভারি, পদ্মফুল আঁকা কুড়ি পয়সা। এই দশ পয়সাটা নতুন। আমি পয়সাটা সঙ্গে নিয়ে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই আরেকটা গর`ড়িত অপরাধ করতে।

    যাদের সঙ্গে কথা বলা বারণ, তাদের সঙ্গে কথা বলি, গল্প করি, সংসারের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। চলে আসি সিঁড়ির এক্কেবারে নীচের ধাপটায়। আরেকটু এগোলেই কলতলা। মোটামুটি বড় উঠোন। উঠোনের একপাশে কলতলায় জলের বালতিতে জল উপচে পড়ছে। উঠোনের দুদিক ঘিরে চওড়া রোয়াক। সেই রোয়াকের এক কোণে গনগনে আঁচে জ্বলছে কয়লার উনুন। আমার মেজ জেঠিমার গেরস্থালি। সে তখন রান্না করে, কোনও কাজের ঝি পাশেই মশলা বাটে চওড়া মোটা শীলে। হলুদ, আদা, লঙ্কা, ধনে-জিরে, পিঁয়াজ। হ্যাঁ, আমি পেঁয়াজ বলি না, বলি পিঁয়াজ। এই দুপুরে যাদের সঙ্গে মিশি, কথা বলি, তারাও অমন উচ্চারণ করে। ওপাশের বাড়িতে কাজ করে এক বুড়ি, তার নাম অনিলের মা। অনিলের মার নাতনীর নাম টেঁপি। টেঁপির বয়েস এগারো-বারো, কিন্তু দেখলে মনে হবে সাত-আট, একদম আমার মতো। ও-ও গায়ে জামা দেয় না, আমিও না। টেঁপি ভেতরের রোয়াকের এক কোণে পা ছড়িয়ে বসে কাঁইবিচি খেলছে। ওর কাছে একমুঠো তেঁতুলের বিচি আছে। আমারও ছিল, কিন্তু সবসময় লুকিয়ে রাখতে পারি না। আমাদের ঘরে আবার ওগুলো দেখলেই ফেলে দেয়। টেঁপি খুব গম্ভীর হয়ে একমনে খেলতে থাকে। আমাকে পাত্তা দিতে চায় না। বারোটা সাড়ে বারোটা বাজলে, ওর ঠাকুমা কাজ শেষ করে বেরোবে পাশের বাড়ি থেকে। তারপরে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। ঘরে ফিরে, ওর ঠাকুমা, উনুন ধরাবে, ভাত চড়াবে। ততক্ষণ টেঁপি বসে থাকবে। চাইলে যে কেউ ওকে দিয়ে ফাইফরমাশ খাটিয়ে নিতে পারে এই সময়ে।

    -- অ্যাই টেঁপি, যা তো দৌড়ে উপীনদার দোকান থেকে দশ নয়ার মুড়ি নিয়ে আয়। আর শোন, এই নিয়ে যা তেলের শিশি, দুপলা সর্ষের তেল আনবি, ভাল করে মেপে দিতে বলবি। আর দুটো হাঁসের ডিম। শোন্‌ শোন্‌, ডিম সাবধানে নিয়ে আসবি, তড়বড় করবি না!

    -- টেঁপি, যা তো চট করে মোড়ের মাথা থেকে দুটো চারমিনার আর এক বাক্স দেশলাই নি আয় তো!

    -- টেঁপি, কাপড়গুলো শুকিয়ে গেছে কিনা দেখা আয়, আকাশ কালো করে আসছে, শোন, অল্প ভেজা থাকলেও তুলে আন তো কাপড়গুলো।

    -- অ্যাটেঁপি বসে আচিস শুদুমুদু? দুটো কুটনো কুটে দেনা! কোটা হয়ে গেলে আসিস, মুড়ি দোবোখন।

    অনিলের মার ছেলে হচ্ছে টেঁপির বাপ। সে মরে গেছে কবেই, আর টেঁপির মা ও পালিয়ে গেছে তারপরে। পালিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও ঘর-সংসার করছে, বাচ্চাকাচ্চাও হয়েছে। অনিলের মা নিজেই লোকের বাড়ি ঝিগিরি করে তার নাতনিকে মানুষ করছে। ওর বিয়ে দিতে পারলে তবে শান্তি। খালপাড়ে দরমার ঘরে থাকে ওরা। ওই যেদিকে বাঁশের পোল। পোল ভেঙে বিরাট ব্রিজ বানাচ্ছে, ওদিকটায় গেছি আমি। ওখানে সুরশ্রী সিনেমায় তখন হিটবই চলছিল, সুজাতা। সৌমিত্র-অপর্ণা।

    মা পালিয়েছিল তো টেঁপির, তাই লোকে ওকে খিস্তি করবেই। আমি তো প্রথমে বুঝতাম না, একদিন রাস্তায় শুনি কে একটা বৌ খুব চেঁচাচ্ছে ওর উপরে, "তুই শান্তির বেটি!'

    আমি পরে জিজ্ঞেস করলাম, তোর মায়ের নাম শান্তি?

    -- না!

    -- হ্যাঁ। নইলে কী নাম তোর মায়ের?

    -- মায়ের নাম করতে নেই!

    -- হ্যাঁ, তোকে বলেছে করতেই নেই! কেন? কেন করতে নেই?

    টেঁপি আমার জেঠিমার দিকে তাকিয়ে বলে, "মায়ের নাম বলতে নেই, না?'

    জেঠিমা সায় দেয়। বলে, "বলতে নেই, মায়ের নাম হল, শুধু মা'।

    আমি ঘ্যান ঘ্যান করি, কেন বলতে নেই? বলো না, কেন বলতে নেই? বললে কী হয়? মা মরে যায়?

    ওরা আমাকে থামিয়ে দেয়, অ্যাই ঘ্যানঘ্যান করিস না তো!

    আমি এবার পাল্টা প্রশ্ন করি টেঁপিকে, তাহলে তোকে সেদিন শান্তির বেটি বলছিল যে! তোর মায়ের নাম শান্তি, আমি জানি জা আ নি!

    টেঁপি, খচ্‌ করে রেগে গিয়ে চোখ মুখ খিঁচিয়ে বলে, শান্তি না, খান্‌কির বেটি বলছিল। খান্‌কি।

    ওর বলার ধরণ দেখেই বুঝে ফেলি, ওটা ওর মায়ের নাম নয়, একেবারেই নয়।

    টেঁপি কোনওদিন ইস্কুলে যায়নি, একবর্ণ লিখতে পড়তেও জানে না, কিন্তু কি অদ্ভুত ভাল হিসেব করতে জানে! চারটে ডিম, আড়াইশো আলু, এক প্যাকেট গরম মশলা, ছটা কোলে বিস্কুট, একশো বাতাসা, এক প্যাকেট বিড়ি একসঙ্গে কিনতে দাওনা ওকে, ঠিক পাঁচ থেকে দশ পয়সা সরিয়ে ফেলবে, আবার চমৎকার হিসেব বুঝিয়ে দেবে। আমি দেখেছি যে নিজের চোখে। একদিন ওর সঙ্গে লাফাতে লাফাতে দোকানে গেলাম। পরে দেখালো দশ পয়সা আলাদা করে রেখে দিয়েছে ইজেরের কোমরে গুটিয়ে। অথচ কেউ ওকে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ শেখায়নি পর্যন্ত।

    নতুন হালকা আর বড় দেখতে দশ পয়সা যে বেরিয়ে গেছে, বাজারে সেটাও নির্ঘাৎ জানে। জানবে না? সবসময় দোকানে যাচ্ছে তো। কিন্তু এখন ওর সঙ্গে কথা শুরু করি কেমন করে? আমি পয়সাটা নিয়ে লুফে লুফে খেলি। হাত থেকে পড়ে গিয়ে পয়সাটা গড়িয়ে যায়, গড় গড় করে গড়াতে গড়াতে একদম কলতলার ভিজে নোংরা শ্যাওলা জমা গর্তটার মধ্যে, ভাগ্যিস নর্দমার ভেতরে চলে যায়নি। শ্যাওলা তো কি? ওসব নোংরা-টোংরায় কোনও ঘেন্না নেই আমার, আমি দৌড়ে উঠোনের কলতলা থেকে তুলে নিই পয়সাটা।

    তারপর নিজেই গরজ করে আলাপ শুরু করি।

    -- এই পয়সার মধ্যে একটা মেয়েছেলের মাথা, দেখেছিস?

    -- হুঁ।

    টেঁপি সংক্ষিপ্ত উত্তর। তখনও খেলছে একমনে।

    -- মেয়েছেলেটা কে রে? জানিস?

    -- ওটা ইন্দিরা গান্ধির মাথা।

    আমি মানতে চাই না, ওটা কেন ইন্দিরা গান্ধির মাথা হবে

    টেঁপি হেসে গড়িয়ে পড়ে, যেন আমি কত বড় একটা মূর্খ! একটা সামান্য ব্যাপারও জানি না। ওর হাসি দেখে আমার গা পিত্তি জ্বলতে থাকে। তবু আমি চুপ করে থাকি; এই ইন্দিরা গান্ধির ব্যাপারটা না জানা থাকায় আমি কতটা অপদস্থ হলাম। হাসি থেমে গেলে টেঁপি বলে, ওটা কি তবে তোর মাথা হবে নাকি রে? ইন্দিরা গান্ধি হল আমাদের রানি, তাই তার মাথা পয়সায়।

    একদম ট্যালা রে তুই! তুই রানি হলে, তোর ফটোও ছাপবে, হি হি!

    আমি কথা ঘুরোই, পয়সাটা দেখিয়ে ওকে লোভ দেখাই, "পিয়ারা কিনতে যাবি?'

    দুজনে মিলে খালি পায়ে খালি গায়ে, শুধু ইজের পরে দৌড়োই ফুটপাথের গাছতলায়। উ: কি গরম রে রাস্তাটা, কোনও কোনও জায়গায় পিচ গলে গেছে, পায়ের তলায় লাগলে আর রক্ষে নেই! ইয়া বড় বড় ফোস্কা পড়ে যাবে। গাছতলায় দুটো ঝুড়ি, একটায় পেয়ারা, কচি আর ডাঁশা, একটু বড় দেখায় অন্যদিনের চেয়ে। অন্য ঝুড়িটায় শাঁকালু, কামরাঙা। আগের চেনা বুড়ো পেয়ারাওলাকে দেখতে পাই না। বদলে ওপাশ থেকে হেঁটে আসে অল্পবয়সী একটা ছেলে। বোঝা যাচ্ছে ও-ই আজ দোকানের মালিক। পেয়ারা বেছে নিয়ে আমি দশ পয়সাটা বাড়িয়ে দিই। ছেলেটা পয়সাটা হাতে নিয়ে বলে আরও পাঁচ পয়সা লাগবে।

    -- কেন? দশ পয়সাইতো দাম।

    -- এগুলো বড় সাইজ, পোঁয়োরো নয়া করে। চারানা জোড়া।

    ছেলেটা পয়সা ফেরত দিয়ে দেয়।

    আর তো পয়সা নেই, আগের দিন বুড়ো দোকানদার থাকলে হয়তো দরদাম করা যেত, কিন্তু এই বাচ্চা পেয়ারাওয়ালাটারতো বড্ড পাজি। কী মেজাজ! কিচ্ছু কিনতে না পেরে ভয়ানক ইজ্জতে লাগে আমার। একবার মনে হয়, একেবারে খালি হাতে ফিরব? কামরাঙা আছে হলুদ হলুদ, হয়ে যাবে কি দশ পয়সায়? কিন্তু যদি টক হয়? আর যদি কমরাঙার দামও বেশি হয়, তবে তো ডবল অপমান হবে। তার চেয়ে ফিরেই যাই। কিন্তু ছেলেটার বড্ড ডাঁট। কিছু একটা করা উচিত। পেয়ারাটা ছুঁড়ে দিই ওর ঝুড়িতে। ফিরতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়িয়ে বলি, "তোর পিয়ারা, তুই-ই খা।' বলেই দুজনে হাত ধরে টেনে দৌড়।
  • 5 | 23.129.64.221 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:২০741412
  •  
    তিরুপতি
    পর্ব - ১

    শিকাগো শহর থেকে কিছু দূরে ওয়েস্টমন্ট নামে একটা জায়গায় থেকেছিলাম কিছুদিন। তখন ২০০১ সাল হলেও নাইন ইলেভেনের অনেক আগে। আমেরিকা তখন আমার কাছে নতুন দেশ, অচেনা তো বটেই তার ওপরে তখন আমি প্রবল হোমসিক। এক সহকর্মী ছিল, বয়েসে অনেক ছোট আমার চেয়ে, তামিলনাড়ুর ছেলে, নাম শানমুগন লিঙ্গম্‌, ছোট করে ডাকলে শান। সে আমাকে দিদিজ্ঞানে খুব ভক্তিশ্রদ্ধাহেল্প করত। মনের কথাবার্তা বলবার মতো তখন ওই শানই একমাত্র লোক এবং ওর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই, ওরও কথা বলবার মতো কেউ ছিল না ওইখানে। ফলত, আমরা একে অন্যকে নিজেদের গল্প বলতাম নির্দ্বিধায়। তখন একটা ভয়ঙ্কর সময় গেছে, ভীষণ বিপদের সময়, সে গল্প বলব পরে, আজ নয়। যে এম্‌প্লয়ার আমাদের চাকরি দিয়েছিল, শানকে এবং আমাকে, সে পুরো ঠগ্‌। এক্কেবারে জালি লোক। আমি ওয়ান ওয়ে টিকিট কেটে আমেরিকায় গিয়েছিলাম, সঙ্গে খুব কম ডলার, সেই ডলারে ফেরার টিকিট কেনা সম্ভব নয়। মাইনেপত্র যে মিলবে না, সেটা গোড়াতেই বুঝে গেছি। শান আমার থেকে প্রায় এক বছর আগে এসেছিল, এই এক বছরে ও কোনও বেতন পয়নি, শুধু থাকা আর খাওয়া পায়, আর উপায় খোঁজে পালাবার। এই ভয়নক বিপদ থেকে কিভাবে মুক্তি পাবো তা ভেবেই আমার হুহু করে কান্না পেত। শান আমাকে বোঝাতো, আর বলত প্রাণপনে ঠাকুরকে ডাকতে। ঠাকুর দেবতার প্রতি ওর তীব্র আস্থা।

    কিন্তু আমি তো ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করি না শান।

    একথা শুনে শান প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলে নিল। বলল, ওহো আপনি তো ওয়েস্ট বেঙ্গলের লোক, কম্যুনিস্ট?

    কম্যুনিস্ট নই জেনে, আবার পুনরুদ্যমে বোঝাতে শুরু করে দিল। বলল, যে কোনও ঠাকুরকে ডাকলেই যে ফল দেবে এমনটা ভাবা কিন্তু ঠিক নয়। খুব জাগ্রত কোনও ঠাকুরকে ডাকা উচিত।

    আমরা আমাদের জালি এম্‌প্লয়ারের চোখ এড়িয়ে সন্ধেবেলায় বেরিয়ে পড়তাম রাস্তায়; মে মাসের সন্ধে, হাঁটতে হাঁটতে দেখতাম আশেপাশের বাড়িতে বারবিকিউ হচ্ছে, তার গন্ধ নাকে ঢুকে মন আরও খারাপ করিয়ে দিত। দুজনে মিলে পালাবার অনেক মতলব করতাম। তার কিছু কিছু বাস্তব, কিছু কিছু সায়েন্স ফিকশনের প্লটের মতো। ঠিক কী করা উচিত বুঝতে না পেরে হতাশ হয়ে গেছি যখন, তখন শান আমাকে ওর নিজের দিদির গল্প শুনিয়েছিল। ও চাইছিল, আমি যেন ভেঙে না পড়ি। ও যেমন করে বলেছিল, সেভাবেই লিখি। ডোন্ট গেট সো আপসেট, মাই সিস্টার ইজ জাস্ট লাইক ইউ। শি হ্যাড অলসো সাফার্ড এ লট। এটা বুঝতাম যে আমাকে ওর নিজের দিদির মতো লেগেছে। শুনেচি অন্যের দু:খকষ্টের কথা শুনলে নিজের দু:খের ভার লাঘব হয়, তাই আমি শুনে চলি। শান বলে চলে, ওর দিদির বিয়ে হয়েছিল খুব সাকসেসফুল এক পাত্রের সঙ্গে; জামাইবাবু বিরাট কোম্পানিতে আই টি ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার। আজ বিলেতে মিটিং করতে যাচ্ছে তো, কাল আমেরিকায় ক্লায়েন্ট মিট। কিন্তু এত ভাল বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও ভাগ্য দোষে দিদির খুব খারাপ সময় গেছে। এই অবধি শুনে, আমি মনে মনে প্রস্তুত হই, যে কোনও দুর্ঘটনা বা কোনও মৃত্যুর কথা হয়তো আসতে চলেছে, কিংবা কোনও ভয়ানক রোগ দুর্ভোগ।

    কিন্তু না। ঘটনাটা অন্যরকম। বিয়ের দুবছরের মধ্যে ওর দিদির চার পাঁচবার অ্যাবর্শান হয়। হয় মানে করানো হয়, শ্বশুরবাড়ির আদেশে। দিদি যেই প্রেগন্যান্ট হতো, প্রতিবারই আÒট্রাসাউন্ড যন্ত্রে ধরা পড়ে যেত যে গর্ভে পুত্রসন্তান নেই। তৎক্ষণাৎ ভ্রূণটির বেড়ে উঠবার এবং তার ভূমিষ্ঠ হবার অধিকার লোপ পেত। এরকম চলতে থাকায় ওর দিদি মানসিকভাবে ভেঙে তো পড়েই, শারীরিকভাবেও খুব রোগা আর দুর্বল হয়ে যায়। ভয়ানক রক্তাল্পতায় ভুগতে থাকে। শানের নিজের ভাষায়, "ইভ্‌ন্‌ ডক্টর্স অল্‌সো টোল্ড দ্যাট্‌ কি ওয়ান মোর অ্যাবর্শান ক্যান কজ হার ডেথ।'

    আমি রেগে যাই এবার। দেশে কোনও আইনকানুন নেই নাকি? এভাবে আÒট্রাসাউন্ড দিয়ে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ তো ভারতে অ্যাক্কেবারে বে-আইনি। যে সব ডাক্তারেরা এভাবে সেক্স ডিটারমিনেশান করে, তাদের এগেইন্‌স্টে কেউ রিপোর্ট করে না কেন? আর বলিহারি তোমার দিদি ও জামাইবাবুকে, অদ্ভুত ভাবনা চিন্তা তো! আই অ্যাম্‌ সরি টু সে, কিন্তু থার্ড মিলেনিয়ামেও এই মানসিকতা?

    শান একটু লজ্জিত হয়ে বলে, "হ্যাঁ হ্যাঁ, অফিসিয়ালি তো বেআইনি বটেই, তেমনি আরও কত কিছুই তো বেআইনি আমাদের দেশে। তবুও জানবার দরকারও তো আছে? আগে থাকতেই জেনে নিলে তো সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া যায়, রাইট? না জানলে নিজেদেরই ক্ষতি, একটার পর একটা মেয়ে জন্মাবে, তখন? আজকালকার দিনে খুব বেশি বাচ্চা তো অ্যাফোর্ড করা যায় না। তার চাইতে আগে জানা থাকলে অন্তত প্রিভেনটিভ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ইট্‌ ইজ্‌ বেটার টু বি সেফ্‌ দ্যান সরি, রাইট? আর আজকাল এইসব টেস্ট ভীষণ এক্‌স্‌পেনসিভ হয়ে গেছে, খুব রিস্কি তো, তাই আন্ডার দ্য টেবিল প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়।'

    আমার বিরক্ত লাগতে থাকে, আর এদিকে শান বলেই চলতে থাকে দিদির কথা। দিদির মঙ্গলকামনা করে শানের মা মন্দিরে মন্দিরে মানত করে। অনেক ব্রত, অনেক উপোস, অনেক পুজো, অনেক প্রার্থনা, হে ভগবান পরের বার যেন ছেলে হয়, পরের বার যেন মেয়ের গর্ভে কন্যাভ্রূণ না আসে। কিন্তু কোনও ফল হয় না। বরঞ্চ দিদির শরীর দিনকে দিন আরও ভেঙে পড়ে, চোখের কোণে কালি, মেজাজ বিগড়ে আছে সর্বক্ষণ। দিদি একেকবার গর্ভবতী হয়, তার কিছুমাস পরে আÒট্রাসাউন্ডের ডাক্তার হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দেন, পেটে কন্যাভ্রূণ; শুধু ইশারায়, কারণ লিখিতভাবে জানানোর নিয়ম নেই, এমনকি মুখে বলতেও ভয় পান ডাক্তার, কে কোথা থেকে আড়ি পেতে খবর দিয়ে দেয় যদি, খুব সাবধান, কখন কে শত্রুতা করবে ফাঁদ পেতে রেখে, কাউকে বিশ্বাস নেই।

    এই ডায়াগোনিসিসের পরে, দিদি পুরো হিস্টেরিক হয়ে যায়। তাকে আবার যেতে হবে অ্যাবর্শান ক্লিনিকে। তারপরে আবার চেষ্টা করতে হবে পুত্রবতী হবার।

    ক্রমশ বিপদ আরও ঘনায়। শেষবার শানের জামাইবাবু নিজেই জানান যে, একটা লাস্ট ট্রাই নেওয়া হবে। এই লাস্টবারেও যদি ভাগ্য না প্রসন্ন হন, দেন হি ক্যান্ট অ্যাকসেপ্ট হার এনি মোর। তখন একটা লিগ্যাল সেপারেশনের কথা ভাবতে হবে। এটা জেনে শানের দিদি প্রায় পাগল হয়ে যায়।

    শান বলে, "জাস্ট ইমাজিন, উই অল্‌ নিউ কি দিস ওয়াজ হার লাস্ট চান্স, শি ওয়াজ সো ডিপ্রেস্‌ড্‌, সো ডিপ্রেস্‌ড্‌ কি, আই ক্যান্ট এক্সপ্রেস ইন ওয়ার্ডস, অ্যান্ড মাই মাদার ওয়াজ অলসো টোটালি আপসেট।'

    এই অবধি শুনে আমি বলি, "এরকম লোককে তো অনেক আগেই ডিভোর্স দেওয়া উচিত। তোমরা এরকম একটা লোককে মেনে নাও কেমন করে?'

    শান সামলে নিয়ে বলে, "নো, নো, হিয়ার মি, থিংস আর নট সো ইজি না! ইফ মাই ব্রাদার ইন ল থ্রোজ হার অ্যাওয়ে, হোয়ার উইল শি গো, আফটার অল শি ইজ ম্যারেড না? ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড বাবা, আওয়ার ইন্ডিয়ান সোসাইটি, ইট ইজ আওয়ার কালচার। অ্যাকচুয়ালি মাই ব্রাদার ইন ল ইজ এ ভেরি গুড ফেলো, বাট হি ওয়াজ অলসো আপসেট না। এভরিওয়ান ওয়ানটস এ বয় চাইল্ড।'

    আমি শুনতে থাকি, "সো আল্টিমেটলি মাই মাদার প্রেইড টো তিরুপতি।' শানের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়েওঠে, "অ্যান্ড ইউ ওন্ট বিলিভ, দিস টাইম শি হ্যাড এ বয়। নাউ দে আর ওয়েল সেট্‌ল্‌ড্‌ -- আওয়ার ফ্যামিলি ইজ সো হ্যাপি নাউ'।

    আর তোমার দিদি নিজে?

    অব্‌ভিয়াসলি! দিদি তো হ্যাপি হবেই। কত কষ্টভোগের পর ছেলের জন্ম দিয়েছে সে। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করে না। শুধু তাই না, জামাইবাবুও আগের সব রাগ ভুলে গেছে, দিদিকে অ্যাকসেপ্ট করেছে এবং নিজেই গিয়েছিল তিরুপতিতে পুজো দিতে, পুত্রের কল্যাণে।

    কথায় কথায় দেখি চারপাশ ঘোর অন্ধকার, হাঁটতে হাঁটতে বহুদূরে চলে গিয়েছিলাম আমরা।

    এবার ফেরার পথ ধরি। আমার মনে পড়ে যায় ডলির কথা। ছাত্রাবস্থায় তাশকেন্তের হোস্টেলে, এক বাংলাদেশি ছাত্রের বউ ডলির সঙ্গে বেশ আলাপ হয়েছিল আমার। ওর বর তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, সে তুলনায় আমি তখন সদ্য আগত, নেহাতই জুনিয়র। ডলি অবশ্য পড়াশুনো করত না। সংসার সামলাত আর কোলে তখন বছর দেড়েকের একটা বাচ্চা। ডলির মেয়ে, নাম মিলি। ওই হোস্টেলে আমি ছাড়া আর কোনও বাঙালি মেয়ে ছিল না, আর ডলিও বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা জানত না, না ইংরিজি, না রাশিয়ান। মাঝে মাঝেই দেখতাম, দোতলার করিডোরে পা ঘষে ঘষে হাঁটছে, এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত উদ্দেশ্যবিহীন। একদিন আমাকে দেখে অল্প হাসির ভঙ্গি করেছিল মুখে, সেই থেকে আলাপ শুরু হয়ে গেল। অসম্ভব রোগা আর রক্তশূন্য চেহারা, শরীরের যে যে অংশ শাড়ি ব্লাউজে ঢাকা থাকত না, সেখানে মাঝে মধ্যেই দেখা যে রং-বেরঙের কালশিটে, ক্ষত। মোটকথা, ডলি নিয়মিত মার খেত ওর বরের হাতে। ও নিজেই বলেছিল আমাকে পর্দার রড খুলে গত পরশু পিটিয়েছে বর, কানের নরম হাড়ে সাংঘাতিক লেগেছে, মাথার তালুতেও ফুলে আছে কিছু জায়গা, মাথার চুল সরিয়ে দেখালো সন্তর্পণে। ঠোঁট অধিকাংশ সময়েই কাটা বা ফোলা থাকত, কখনও কপাল ফোলা, বা ফোলা কমে এলে চোখের নিচে কালি। এর কোনও প্রতিকার নেই? বাধা দেবার কেউ নেই? বড্ড আশ্চর্য লাগত আমার। এত ছাত্র ছাত্রী বাস করে যে হোস্টেলে তাদের অনেকেই বিবাহিত বা সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে নিয়ে রয়েছে, সেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে একটা মেয়ে দিনের পর দিন মার খাচ্ছে, লোকে দেখছে, অথচ কেউ কিছু বলছে না? এ ধরনের ব্যবহার জন্যে ওর বরের সোজা হাজতবাস হতে পার, কিন্তু কিছুই হত না। কিচ্ছুটি না। আরও জানালো ডলি, যে ওই মিলির জন্মের পরে ওরও নিয়মিত অ্যাবর্শান করানো হচ্ছে। তাতেই এত রোগা হয়ে গেছে। অ্যাবর্শান কেন? অন্য অনেকরকম ব্যবস্থা আছে তো জন্মনিয়ন্ত্রণের, সেগুলো চেষ্টা করে দেখেছ?

    হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে থাকে ডলি। তারপরে আমাকে পুরো চমকে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে যে, আমি অতসব জানলাম কোত্থেকে? আমার তো বিয়েই হয়নি। তারপরে, যেন খুব হাতেনাতে ধরে ফেলেছে এমনভাবে চোখ টিপে হাসে।

    ওকে বললাম যে, এসব জানবার জন্যে বিয়ে করবার দরকার হয় না, তাছাড়া ইস্কুল কলেজের বইতেই এসব কথা লেখা থাকে। ডলি বিশ্বাসই করে না যে ইস্কুলের বইয়ে এসব কথা লেখা থাকে। ছি:! লজ্জায় লাল হয়ে গেল, একথা শুনে। তারপরে হাসিমুখে বলল, ভালই হয়েছে আব্বা আমাকে ক্লাশ ফোরের বেশি পড়ায়নি। তারপরে, যেন খুব গোপন কথা বলছে এমন করে বলল, মিলির জন্মের সময়েই ধাই দেখে নিয়েছে, পরপর আরও সাতটা মেয়ে আছে ভেতরে।

    -- মানে! ভেতরে মানে? কী বলছ আজেবাজে কথা?

    -- আহ্‌ আস্তে কও। ভেতরে মানে পেটের ভেতরে। যে কইছে সে খুব ভালো দাই। শয়ে শয়ে বাচ্চা প্রসব করাইছে।

    -- কোন দেশে জন্মেছে তোমার মেয়ে? সোভিয়েত ইউনিয়নে নয়? এদেশের শিক্ষিত ডাক্তার নার্স আয়া, কেউই এরকম অদ্ভুত ভুল কথা বলতে পারে না! এ পুরো মিথ্যে কথা।

    -- না, তোমার কসম, সত্যি বলেছে, এর পরে আরও সাত সাতটা মেয়ে পেটে ধরব আমি!

    -- ওরকম দেখা যায় নাকি? মিথ্যের একটা সীমা থাকা দরকার। কে তোমাকে বলেছে ডলি? আর কোন ভাষায় বলেছে? তুমি তো রাশিয়ান ভাষা জনো না।

    -- আহা, আমারে কয় নাই, আমার সায়েবরে কইছে।

    এত বড় প্রবঞ্চনা, অথচ ওই অশিক্ষিত মেয়েটা জানেও না, তার বর তাকে মিথ্যা গল্প বলে চলেছে। আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও, ও মানবে না। ভ্রূণের লিঙ্গ ও তার পেছনে ক্রোমোজোমের ভূমিকা নিয়ে কিছুই ওকে বোঝানো যাবে না। যে মেয়ে স্থির মনে বিশ্বাস করে চলেছে যে তার জরায়ুর মধ্যে অনগত সাতটি কন্যা অপেক্ষা করছে, তাকে কী করে বোঝাবো যে এসব মিথ্যে, আর বোঝালেও বা সে আমার কথা মানবে কেন?

    আন্তর্জাতিক নারীদিবসের দিন আরেকবার প্রচন্ড মার খায় ডলি, রাস্তায় শাড়িপরে স্বামীর পেছন পেছন হেঁটে আসছিল। পাশাপাশি হাঁটবার মতো বেয়াদপিও করেনি। কিন্তু উটকো ঝঞ্ঝাট উপস্থিত হয়, হঠাৎ এক সুবেশী যুবা এক তোড়া ফুল উপহার দিয়ে যায় তার হাতে, নেহাতই ভদ্রতা বশত: সমগ্র নারীজাতির প্রতি অভিনন্দন জানিয়েই। তার নি:সন্দেহে কোনও কূট উদ্দেশ্য ছিল না, কারণ সে ফুলের তোড়া ও সাদর সম্ভাষণটুকু জানিয়েই চলে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবল বিপদে ফেলে দিয়ে গেল সে ডলিকে। পথ চলতে পিছন ফিরে ডলির স্বামী দৃশ্যটি দেখে, তখনকার মতো হাসি হাসি মুখ করেছিল, কিন্তু সেটা নেহাতই মুখোশের হাসি। এক্কেবার রাস্তার ওপর তো বউকে পেটানো যায় না। চুপচাপ ঘরে ফিরে বউকে মনের সুখে পেটালো মামুন ইসলাম। তারপরে সাজসজ্জা করে বেরিয়ে গেল তার রাশিয়ান বান্ধবীর সঙ্গে উৎসবসন্ধ্যাটুকু কাটিয়ে আসতে। সিঁড়ির আবছায়া অন্ধকারে দেখি গোলাপি বেনারসিতে ঢাকা ডলি লুকিয়ে লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ভয়ানক রাগ তার ওই অচেনা যুবকটির ওপর। কী দরকার ছিল, চেনা নেই জানা নেই, ফুলের তোড়া দেবার?

    ডলি ডুকরে কেঁদে উঠে বলে, "আমি কি রাস্তার খান্‌কি? আমারে ফুল দেয় ক্যান?'

    একবার কয়েকজন প্রোফেসরের সঙ্গে ডলির এই সমস্যা নিয়ে কথা পেড়েছিলাম। প্রতিকারের উপায় কী?

    আপাতভাবে কিছু প্রতিকারের উপায় থাকলেও, এর কোনও স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মামুনকে তার কৃত অপরাধের জন্যে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু তার ফল ক্ষণস্থায়ী। শাস্তিভোগের পর, মামুন কিন্তু পুরো শোধ তুলে নেবে ডলির ওপরে। আরও বেশি অত্যাচারিত হতে পারে সে। পড়া শেষ করে সস্ত্রীক দেশে ফিরে গিয়ে সে কিন্তু সুদে আসলে প্রতিশোধ তুলবে ডলির ওপরে। সেটা ডলি সহ্য করতে পারবে কি? তার কি সামর্থ আছে এই চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসবার? কিংবা সাহস দরকার। তা যদি না থাকে তবে, কোনও প্রতিকার নেই।

    মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম ডলি পা ঘষে ঘষে হেঁটে চলেছে রান্নাঘরের দিকে, চোখাচোখি হলে শুকনো হাসত, কিংবা ফিস্‌ফিসিয়ে বলতে, "কাইলই নষ্ট করাইসি, শরীর ভালো নয়, দুর্বল লাগে, ব্যথা, এখনও খুব ভাঙছে'।

    আমি হঠাৎ ভাবি, ডলি কি ওপরওয়ালার কাছে সুবিচার চেয়ে প্রার্থনা করেনি? কেমন হয় যদি আমি প্রার্থনা করি ওর জন্যে, যেমন শানের মা করতেন নিজের মেয়ের জন্য? হিন্দু দেবতা কি মুসলমান মেয়ের দু:খে মুখ তুলে চাইবেন? কী চাইব ডলির জন্য? ওর বর ওকে পেটানো বন্ধ করুক, অত্যাচার বন্ধ করুক, এইসব? নাকি, ইন জেনেরাল বলব, হে তিরুপতির দেবতা, এই মেয়েগুলোকে আর কিছু নয় শুধু একটু আত্মসম্মানবোধ দিও, সেইসঙ্গে কিছুটা সাহস, যেটায় ভর করে তারা অজানা ভয় কাটিয়ে নিজের সামর্থ মতো নিজের ইচ্ছেমত বাঁচার কথা ভাবতে পারে।
  • 6 | 23.129.64.221 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:২৬741413
  • কুউউউ ঝিক্‌ঝিক্‌
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ৩০.০৮.২০০৭
    অ্যামট্র্যাকের রেলওয়ে স্টেশনটি ছোট, অপেক্ষমান যাত্রীসংখ্যা একদম হাতে গোনা, দুই সাদাচুল প্রৌঢ়া হাতে দুটি ব্যাগ, পরিপাটি গোছানো ঝোলা স্কার্ট আর টপ পরা, জিনসটিশার্ট পরা নীলচোখ যুবতী পিঠে ব্যাকপ্যাক, একটি ছোট্ট পরিবার-মাবাবা আর দুটি ছেলেমেয়ে, অজস্র লটবহর সঙ্গে, একজন উদাসীন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, একহাতে ছোট্ট একটি ব্যাগ আর আরেকহাতে একটি বই,আর এই পিঠে ব্যাকপ্যাক আর লাগেজ ব্যাগ হাতে আমি। ভাবা যায়, দিনের মধ্যে এই একখানা ট্রেন, তার জন্য যাত্রী এখান থেকে মাত্র এই কজন? এদেশে ট্রেনের জনপ্রিয়তা যে একদমই নেই, তা স্টেশনে এলেই টের পাওয়া যায়। সকলেই নিজের নিজের গাড়িতে চড়ে ঘোরে,তাই ইন্টারস্টেট রাস্তাগুলো অসাধারণ ভালো,মেইন্টেনান্সও তেমনি। সেই পথসমূহই সকলে ব্যবহার করে। খুব বেশি দূর যাবার দরকার হলে লোকে প্লেনে করে যায়। অ্যামট্র্যাক এখনও কিছু কিছু ট্রেন চালায়, আস্তে আস্তে এগুলোও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। তবু বাসের কিছুটা বেশি জনপ্রিয়তা আছে, গ্রেহাউন্ড বাস সার্ভিসে অনেক লোক দেশের রাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে যায়। আমাদের ছোট শহর থেকে ট্রেনযাত্রাটি বেশ মনোরম, সকাল নটায় ট্রেনে উঠে পড়া, আস্তে আস্তে পুবের সবুজ বনভূমি আর ঢেউখেলানো পাহাড়ের ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট শহর ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে যায় ট্রেন। পুবের রাজ্যের গন্তব্যশহরে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে পড়ে, ঘড়ি বদলে ফাস্ট করে নিতে হয় একঘন্টা, এপথে এলে এক টাইম জোন থেকে চলে আসতে হয় আরেক টাইমজোনে। প্রথমবার খুব মজা লেগেছিল। দুপুরবেলা পাশের সহযাত্রিণীর সঙ্গে গেলাম সাজানো ডাইনিংকারে,সেখানে খাবারের দাম এমনি জায়গার থেকে বেশি,কিন্তু খাবার ভালো।খেয়ে দেয়ে ফেরৎ এসে সিট এলিয়ে দিয়ে বিশ্রাম।এই ট্রেনের সিট ইনক্লাইনড করা যায়, ফুটরেস্টে পা রেখে আরামে ঘুমানো যায়। জানালার বাইরে বেলা পড়ে আসে, গ্রীষ্মের ঘন সবুজের উপরে পড়ন্ত রোদ্দুরের খেলা কাব্যময় হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে ছন্দময় দোলানিতে চোখদুটো জড়িয়ে আসে।

    ট্রেনের দেশের মানুষ আমি। ট্রেন আমাদের শৈশব কৈশোর প্রথম যৌবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রেশমী সুতোর বুনুনির মতন। শীতের ভোরে ট্রেনের ভোঁ একরকম আর গ্রীষ্মের ভোরে আরেকরকম। মাঝরাত্রির দুরপাল্লার ট্রেনের হুইসেলের দ্রুতচ্ছন্দ চলে যাওয়া আরেকরকম। একটা সময় ছিল, যখন আমরা কান পেতে থাকতাম, সকালের গাড়ির শব্দের জন্য। বাড়ি থেকে কত দূরে রেলস্টেশন, তবু শোনা যেত স্পষ্ট। তখন বাড়িঘর অনেক অনেক কম ছিল। সে আমাদের ছোটবেলা। ছোট স্টেশনটি ছিল আমাদের, দূরপাল্লার ট্রেনগুলো দাঁড়াতো না,এখনও দাঁড়ায় না।তবে এখন বড় হয়েছে প্লাটফর্ম,প্রতিদিনের লোকাল ট্রেনযাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক অনেক।সকলের যেতে হয় বড় শহরে,ট্রেন ছাড়া অন্য উপায় খুব একটা নেই সাধারণ লোকের কাছে। বাসের ব্যবস্থা ইদানীং আছে বটে, কিন্তু খুব সুবিধাজনক নয়। শীতের ভোরে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা ট্রেনের আলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হত, ছোট স্টেশনের প্লাটফর্মে অসংখ্য মানুষ সোয়েটার মাফলার চাদরে আবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত অপেক্ষায়-এনারা নিত্যযাত্রী।

    লোকাল ট্রেনগুলো চলমান সমাজদর্পণ, প্রতি কামরায় নানা পেশার মানুষজন, প্রায় সকলেই চলেছেন কাজে, সকালের ট্রেনগুলোতে বিরাট বিরাট বস্তা, ঝুড়ি, দুধের বড় বড় ড্রামওলা অনেক লোকজনও থাকত, এরা নিত্য এইসব দ্রব্যাদি শহরে পৌঁছে দেন। আর অবধারিত অসংখ্য হকার - ঝালমুড়ি, লজেন্স, ছোলাভাজা, বাদামভাজা, গয়না, পোষাক, মলম, থালাবাটি, ফলমূল তেলেভাজা - কী যে নেই সেই হকারদের পসরায় তা বলা কঠিন। আর গানশোনানোর ছোট ছোট দল, তবে এনারা খুব ভোরে থাকতেন না, একটু বেলা হলে উঠতেন। স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে ফিরে আসে ছবি, দেশকালের দূরত্বে ধরা পড়ে সুন্দর হয়ে, যেসব ছোটখাটো সুন্দর এড়িয়ে গেছিল তা অনেক পরে স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া যায়। কে যেন বলেছিল, চলে যাওয়া বেলাকে ফিরে পেতে হয় শুধু স্মৃতির মধ্যেই, স্বপ্নের মধ্যেই।

    "উঠে পড়ো,উঠে পড়ো,এসে গেছি,এসে গেছি। পৌঁছে গেছি।' -সহযাত্রিণী প্রৌঢ়া আস্তে আস্তে আমার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকছেন। ঈশ, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি!

    চোখ থেকে ঘুম মুছে ফেলে সোজা হয়ে বসি, সিট খাড়া করে দিই। ট্রেনের গতি মন্দীভূত হচ্ছে, গন্তব্য শহরের বড় প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে আমাদের ট্রেন। কেমন যেন দূরপাল্লার ট্রেনের হাওড়া স্টেশনে ঢোকার সময়ের মতন একটা অনুভূতি হয়, আস্তে আস্তে ট্রেন থামে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য এগিয়ে আসে স্বয়ংক্রিয় চেয়ার, প্রথমে ওনারা নামেন, তারপরে আমরা আস্তে আস্তে নামি। ইউনিফর্ম পরা গার্ড ট্রেনের পাশে হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় দেন আমাদের। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখতে পাই অপেক্ষমান বন্ধুদের হাসিমুখ, আমাকে নিতে এসেছে ওরা। সহযাত্রিণী বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে শুভকামনা করে চলে যান নিজের পথে, আমি আমার শুভেচ্ছা দিয়ে দিই ওঁর সঙ্গে। তারপরে বন্ধুদের সঙ্গে মিলনমুহূর্তের উষ্ণতা-তা বর্ণনা করতে পারি এমন শব্দ তো নেই আমার ঝুলিতে! অনূক্ত থাক তাই সেসব, ভাষাহীন ভাষা হয়ে পৌঁছাক সুধী পাঠকের হৃদয়ে। ওই দূরে, কুউউউ ঝিকঝিকঝিক করে চলেছে স্মৃতি ও স্বপ্নের মায়াময় সবুজ ট্রেন, সময় তাকে ধরতে পারেনি, ক্ষয় করতে পারেনি...কোনও এক ভালোবাসার স্টেশনে পৌঁছানোর জন্য একদিন সবাই ওই ট্রেনে যাত্রী হয়েছিলাম, যাত্রী হব আবারও, বারে বারে... সবুজ ধানের খেতের পাশ দিয়ে, কুলকুল বয়ে যাওয়া নদীর পাশ দিয়ে, ফার্নের পাতায় কুচোজল লেগে হীরার মতন জ্বলজ্বল করতে থাকা আলোছায়া বনভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে ট্রেন... কুউউউ...ঝিক্‌ঝিক্‌ করে....

    অন্য শারদোৎসব
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ১১.১০.২০০৭
    শিরশিরে শরতের ভোর। হাওয়ায় কোমল শীতভাব। নীলকান্তমণিপ্রভ আকাশ, ঘাসে ঘাসে চিকমিক করছে শিশির,পুবে রাজকীয় ভোর হচ্ছে। চারটে পাখির একটা ছোট্ট দল চক্র দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, ওদের ডানায় ঝকমক করছে নতুন ভোরের আলো।

    এইসব সময়গুলোতে বাতাসে শিউলির নরম সুগন্ধের জন্য মন উতলা হয়, মাঠভরা নরম কাশগুচ্ছ দেখতে সাধ হয়। আমাদের দেশে শরৎ তো শুধু ক্যালেন্ডারে আসে না, সাদা মেঘের ছবি দেওয়া আকাশের নীল খামে পুজো-পুজো গন্ধের রোদ্দুরের অক্ষরে-শব্দে ভালোবাসার চিঠি হয়ে আসে। এমন সোনারোদের ওড়না জড়ানো নীলপ্রভ আকাশের নীচে আগমনীর গান যদি না থাকে, তাহলে কি আর মন মানে? ওই পুজো পুজো গন্ধের রোদ্দুরে যে ছুটির নিশান আঁকা! কতকাল ধরে রক্তের মধ্যে যে মিশে গেছে "পুজোর ছুটি'।

    এখানে পুজোর ছুটি বলে কোনও কথা নেই, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় অগাস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে। অক্টোবরে একেবারে যাকে বলে পুরোদমে চলা সময়, ভরভরন্ত সেমেস্টার। ছুটি হবে সে-এ-এই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, তখন সেমেস্টার শেষ হবে। তবু আছে অন্যরকম নানাধরনের উৎসব-আয়োজন। এমন টলটলে আলোয় পরিপূর্ণ সময় মানুষের হৃদয়ের কাছে আবেদন রাখবে না, তাই হয় নাকি? সমস্ত উত্তর গোলার্ধ জুড়েই যে এখন ভরা ফসলের গান, "শেষ ফলনের ফসল এবার কেটে লও, বাঁধো আঁটি...', ওদিকে দক্ষিণ গোলার্ধ সেজে উঠছে বসন্তের সবুজ কিশলয়ে।

    এই সিজন হল ফুটবল সিজন। এই ফুটবল আমাদের চেনা ফুটবল নয়, আমি বাঙালি মানুষ এই ফুটবলের আকৃতি দেখেই তো প্রথমে ঘাবড়ে গেছিলাম। আমাদের ফুটবল তো দিব্যি গোল, একেবারে গোলালো। এখানের ফুটবল হলো উপগোলকীয়, যেন অনেকটা বিরাট এক পটোলের মতন। ফুটবল এখানে শুধু খেলা নয়, একটা উৎসবের মতন। যেদিন ফুটবল হয়, সাধারণত সপ্তাহান্তে হয়, সে এক সাজো সাজো অবস্থা। শুক্রবার বিকেল থেকেই সব মোটর হোম এ করে সমর্থকের দল সপরিবারে এসে পৌঁছায় পতাকা টতাকা উড়িয়ে। এসে লাল নীল সাদা তাঁবু খাটিয়ে রান্না-বান্না (সাধারণ গ্রিল করা) করে এসে এক এলাহি কারবার। ফুটবল শুরুর আগে এই পিকনিক হল মাস্ট, একে বলে টেইলগেটিং। এটা কালচারের অঙ্গ, সেদিন চেনা-অচেনা বন্ধুরা মিলে খাওয়াদাওয়া হবে, আনন্দ করা হবে, এ হল ফুটবল-দর্শকের আবশ্যকীয় রীতি।

    তবে খেলাটা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি, একবার বন্ধুদের অনুরোধে গেছিলাম দেখতে, গ্যালারিতে জমিয়ে বসলামও বন্ধুদের সঙ্গে। দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম, প্রায় মহাকাশযাত্রীর মতন পোশাক আর হেলমেট পরে অতগুলো খেলোয়াড় যে কি করছে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে, গ্যালারি থেকে দর্শকেরা যে কেন অমন মারাত্মক চিৎকার করছে, সে আর বোঝা সম্ভব হল না। খেলার একেক পর্বের পরেই বিরতি, বিরাট বাজনার পার্টি ইয়া ইয়া ভেঁপু ড্রাম ইত্যাদি বাজাচ্ছে, মেয়েদের দল নাচ করছে-সে বিরাট উৎসব আর সেই উৎসবের স্পিরিট আমার মতন আউটসাইডারের পক্ষে লিখে বোঝাতে পারা অসম্ভব।

    আমি শুধু বাইরে ঘুরতে ঘুরতে মুগ্ধ হয়ে দেখি নানারঙের তাঁবুতে ভরে গেছে সব মাঠগুলো, গাড়ীতে গাড়ীতে ছয়লাপ চারিদিক, সমর্থকেরা সব সপরিবারে তাদের প্রিয় দলের রঙের পোশাকে, কেউ কেউ মুখেও সেই রঙ করে নিয়েছেন, ছোট্ট ছোট্টো বাচ্চাদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে রঙিন ওইসব পোশাকে। দেখি বিরাট বড় বিজ্ঞাপন বেলুনে উড়ছে এই খেলার কথা। আমি অবাক হয়ে মুগ্ধ চোখে এই অন্য শারদোৎসব দেখি। অচেনা অন্য পৃথিবীর উৎসব যেন এক, কিন্তু হৃদয়ের আনন্দের তরঙ্গমালা চেনা যায়।

    মনে পড়ে যায় আমাদের দুর্গাপূজা, ঢাকের ঢ্যামকুড়কুড়, আর মাঠভরা মাথা-দোলানো কাশেরা, ভোরের বেলা শিউলিদের টুপটুপ ঝরে পড়া।

    "ঢ্যামকুড় কুড় বাদ্যি বাজে/ ঢাকে পড়লো কাঠি/ যা দিবি মা তাই হবে আজ/ পরমান্নের বাটি...' মনে পড়ে যায় সেই সপ্তমীভোর, অষ্টমীসন্ধ্যার আলো ও কোলাহল ও ভীড়, পুজোর জামায় ছেলেপুলেরা, আর নবমীর নরম দিন, নবমীরাতে সেই "নবমী নিশি গো পোহায়ো না ধরি পায়/ তুই চলে গেলে মাগো উমা মোরে ছেড়ে যায়', দশমীর বিদায়-অশ্রু আর ঘরে ফিরে বিশ্ব-মাকে ঘরের মা করে পাওয়া।

    এই তো পূজা, যা অনেক বড়, অনেক দূরের, যাকে এই সীমাবদ্ধ ক্ষুদ্র হৃদয়ে ধরতে পারা যায় না, অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য, শক্তি ও করুণার উৎস যে-তাকেই কাছে পাওয়ার আকুতি, তাকেই হৃদয়ে ধারণ করার আর্তি। তাই নয় কি? উৎসবের বাঁশি তো তাই বলে, যে দূরের মানুষ, সে এলো কাছে, আকাশের মা মাটির মা হয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো, তারপরে ঘরের মা হয়ে এসে কোলে তুলে নিলো, বুকে জড়িয়ে নিলো। ঘাম ও ধুলা মুছে নিলো কোমল আঁচলে। তাই তো সবই সেদিন পরমান্ন হয়ে যায়, তুচ্ছ বলে আর সেদিন কোনোকিছুই থাকে না। "যা দিবি মা তাই হবে আজ পরমান্নের বাটি...'

    আমাদের সহকার-শাখা ও মঙ্গলকলসের সঙ্গে কখন এই এদের পতাকা, তাঁবু, রঙীন বেশ, মুখে মাখা রঙ---সব এক হয়ে যায়, আনন্দের জ্যোৎস্না ভরে দেয় আকাশ ও সমুদ্রের মাঝখানের অলংখ্য দূরত্ব---"মগন করেছে মধ্যে তাহার আনন্দ পূর্ণিমা...' কত দূরে প্রশান্ত অতলান্ত মহাসমুদ্র পার হয়ে আমার দেশ- গাঁয়েও তো উৎসবের বাঁশি বেজে উঠেছে.... লাল-নীল-সবুজ-হলুদ ঘুড়িতে পেটকাটি চাঁদিয়ালে মোমবাতি বগ্গায় ভরে গেছে বিশ্বকর্মা পূজার রোদ্দুরভরা দিনের নীল আকাশ...ঘুড়িতে ঘুড়িতে ওই তো প্যাঁচ লেগে গেছে.... ওই তো কারা সমস্বরে কোলাহল করে উঠছে ভোঁ ও ও ও কাট্টা....

    মিলনমেলা
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ০৪.০১.২০০৮
    একবার লিখতে লিখতে ভাবনায় পড়লাম কেন লিখি এসব? প্রবাসীর পত্রে? আসলে এইসব লেখার মধ্য দিয়ে কিছু কি পৌঁছে দিতে চাই? সদর্থক কিছু? তাই যদি হয় তাহলে কী সেই জিনিস, কী সেই বার্তা যা এইসব ছবিহীন গানহীন সুরহীন শুকনো কথা দিয়ে পৌঁছে দিতে চাই? কোনো উদ্দেশ্যই কি এতে পূরণ হয়? সকলে নিজের নিজের সুন্দর দেশে নির্জনে স্বজনে প্রেমে অপ্রেমে সুখে দু:খে বিরাগে অনুরাগে আছেন, কখনো ঝড় আসে বাসা ভাঙে, আবার দুর্যোগ থামে, রোদ ওঠে, ঝলমলে সুন্দর দিন আসে। এর মধ্যে পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র কোণার এই সামান্য একটি মানুষের ততোধিক সামান্য দিনকথনের কোনো মানে আছে কি?

    ভাবতে ভাবতেই একদিন এসে যায় দীপাবলি উৎসব, দেশে বাড়িতে বাড়িতে মোমবাতি বা প্রদীপ বা ছোট্ট লালনীল টুনিবাল্ব দিয়ে সেদিন সাজানো হয়েছে বাড়ির চৌহদ্দি, ছাদের রেলিং, বাড়ির পাঁচিলের উপরে উপরে অজস্র মোমবাতির শিখা কাঁপছে সন্ধ্যার বাতাসে। আশ্চর্যভাবে প্রায় একই সময়ে এখানে হ্যালোউইন উৎসব, একত্রিশে অক্টোবর, মস্ত মস্ত মিষ্টিকুমড়োর ভেতরের সব কিছু বার করে নিয়ে গায়ে নানা আকারের ফুটো করে ভেতরে আলো জ্বেলে বাড়ির দোরে দোরে বসিয়ে রাখা হয়, সেইদিন সন্ধেবেলা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বাড়ি বাড়ি যায় ক্যান্ডি চাইতে, তারা নানাধরনের অদ্ভূত পোশাকে সাজে, কেউ সাজে ভূত, কেউ প্রেত, কেউ দৈত্য, কেউ রাজকন্যা, কেউ দেবদূত। এসময় সব দোকানে দোকানে হ্যালোউইন কস্টিউমের হিড়িক পড়ে যায়। এ উৎসব ভূতুড়ে একটু, আমাদের ভূতচতুর্দশীও তো ভূতুড়ে।

    হ্যালোউইনের পরেরদিন অবশ্য খুব উজল পবিত্র দিন, সকল সন্তের দিন-অল সেইন্ট'স ডে। আমাদের ভূতুড়ে ভূতচতুর্দশীর পরেও যেমন আসে দীপান্বিতা উৎসব, আলোর আহ্বান। এই আশ্চর্য মিলগুলো দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আগে তো দেশে দেশে এত যোগাযোগের উপায় ছিল না, হোস্টিলিটিও অনেক বেশি ছিল, নানা অন্য অন্তরায়ও ছিল, কিন্তু কী করে উৎসবে লোকাচারে বিশ্বাসে উপকথায় গল্পে এত এত এত মিল? তাহলে কি আমরা যা ভাবি তা সর্বাংশে সত্য নয়, বহু আগেও দেশে দেশে মানুষে মানুষে অনেক যোগাযোগ ছিল? যত বিদ্বেষ যত যুদ্ধ হত্যা মারামারি কাটাকাটি বংশধ্বংস হয়েছিল বলে শুনি, সব কি সত্য নয়? কোথাও কি রূপকথার কিশোরী পোকাহন্তেস, স্নোহোয়াইট বা অ্যালিসের মতন কেউ ছিল করুণার আলো চোখে নিয়ে, চুবড়ি থেকে সযত্নে রুটিখানি বার করে ভাগ করে খেয়েছিল অচেনা সাতটি মানুষের সঙ্গে? অথবা সেই কালো মা মেয়ে, ঠান্ডায় বৃষ্টিতে কাহিল হয়ে দাওয়ায় পড়ে থাকা দুর্বল অজানা মানুষটিকে ঘরে নিয়ে দিয়েছিল আগুনের উত্তাপ, গরম খাবার আর হৃদয়ের শুভেচ্ছা? কারণ সে বেচারা লোকটি যে একা, ওর যে মা নেই,ওকে দুধ এনে দেবে কে?/ওর যে সাথী নেই, ওকে ময়দা পিষে দেবে কে?...

    হ্যালোউইনের পরে থ্যাংকসগিভিং-এর জন্য প্রস্তুতি চলছে, এও এখানকার আরেক উৎসব। নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার পরিবারের সকলে মিলিত হয়ে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হয়, খাওয়ার আগে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন। সারাবছর যেন এমনি দুধেভাতে মানে মাংসে রুটিতে রাখেন তিনি, যেন সন্তানসন্ততি সুখে থাকে। প্রধান খাবার টার্কি পাখির মাংস আর ভুট্টা সেদ্ধ। তবে পরিবারে পরিবারে খাবারে বৈচিত্র থাকে অনেক, ডেসার্ট হিসাবে কেউ করেন পেকান পাই, কেউ পামকিন পাই। কেউ টার্কির সঙ্গে সঙ্গে রাখেন চিকেন, রাখেন ল্যাম্ব। থাকে কর্ণ ব্রেড, থাকে গ্রিন বিন, থাকে নানাধরনের স্যালাড। এই সব মিলেই ধন্যবাদজ্ঞাপন অনুষ্ঠান। থ্যাংকসগিভিং-এর আগে আগেই অনেকে দেখা করতে চলে যাচ্ছে বাবামায়ের সঙ্গে, পরে সেসময় আবার যাবে, অনেকে সপ্তাহান্তে গ্রিল বের করে টার্কি বসিয়ে দিচ্ছে, আহা ধন্যবাদ যত বেশি হয় ততই তো ভালো। ভালো খাবারের বিকল্প আছে নাকি দুনিয়ায়?

    খাবার বলতেই খাদ্যোৎসব মনে পড়ে গেল। বিভিন্ন দেশের খাবার দাবার নিয়ে ছোট করে আন্তর্জাতিক উৎসব হয় প্রত্যেক শরৎ-চতুর্মাস্যে, আগে এটা হত বসন্তে। আগে শপিং মলে কোনো অংশ ভাড়া নিয়ে হত, এখন ক্যাম্পাসেই হয়। প্রত্যেক দেশের জন্য ছোট ছোট টেবিল, তাতে নিজের দেশের শিল্পকর্মের কিছু নমুনা, পতাকা, ছবি আর খাবার। সকলে সকলে ঘুরে দেখে, প্লাস্টিকের প্লেটে প্লেটে খাবার তুলে তুলে দেয় ভলান্টিয়াররা! এত ভালো ভালো সব খাবার! এত দেশ এই পৃথিবীতে আর প্রত্যেকের খাবারদাবার এত ভালো। মাত্র দুইঘন্টার উৎসবকে মনে হয় খুবই সংক্ষিপ্ত, বেশ হপ্তা জুড়ে খাদ্যোৎসব হলেই যেন ভালো হত, নইলে এত খাবার চাখা যায় নাকি? কোরিয়ার খাবার খেতে খেতে ভেনিজুয়েলা বাদ পাড়ে যায়, সৌদি আরবের অপরূপ আলুবড়া আর বিরিয়ানি চাখতে গিয়ে ভারতের আলুছোলে আর পায়েস খাওয়াই হয় না। ইরাকে যে এত ভালো মিঠাই বানায় তাই বা কে জানত? ইরাকের টেবিলে আবার এক মস্ত মস্ত টানা চোখের এক দেবীমূর্তির ছবি দেখে চমকে উঠি, দুর্গা কিএকরে ইরাকে? টেবিলের ওদের জিগাতে ওরা বলে না না ইনি হলেন কুইন হশেপসুত। কিন্তু তিনি তো মিশরের! যাই হোক একটু সপ্রশ্ন অবস্থাতেই এবারে কোস্টারিকার টেবিলের দিকে যাই। ওদের পায়েসসদৃশ খাবারটি একটু চেখে আসা হলো এরই মধ্যে, জাপানের সুশি, চিনের ঝালঝাল বাদাম-চিকেনও।

    বহু দেশের ছেলেমেয়ে পড়ে হেথায়, এমনিতে তো সবাই জিনস টিশার্ট বা সেরকম কোনো গ্লোবাল পোশাকে কেলাস টেলাস করে, আজকে অনেকে নিজের দেশের রঙিন বস্ত্র পড়েছে, প্রসারিত ঘেরওয়ালা পোশাক, মাথায় পরেছে আপন দেশের শিরোশোভা। অজস্র ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক করে উঠছে অজস্র ছবি, বিরাট পৃথিবীটার কোণার কোণার রূপরসশব্দ একই ঘরের মধ্যে দেখতে পাবার অদ্ভূত অনুভব ধরার চেষ্টা, চলিষ্ণু সময়ধারাকে ফাঁকি দিয়ে ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা। কি বিপুল এই পৃথিবী, অথচ কি কোমল,কী করুণ। ভালোবাসার ঝর্ণাধারা বয়ে চলেছে, নিজের চারপাশের পাথরের খোলস খুলে ফেলতে পারলেই অবগাহন করা যায়। দুর্লভ মানবজীন ও সে জীবনের দুর্লভ আশীর্বাদ বুঝতে পারি, ""মধুময় পৃথিবীর ধূলি/ অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি....""

    হেমন্তদিনের নেমন্তন্নে
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ১৪.২.২০০৮
    আমাদের দীর্ঘ পথযাত্রা শুরু হয়েছিল হ্যালোউইনের দিন, অক্টোবরের শেষদিনের দুপুরে। পালা করে চালানো হবে ঠিক হয়েছিল আর যদ্দুর যাওয়া যায় গিয়ে গভীর রাতে কোনও সরাইয়ে ওঠার কথা ছিল। হাজার মাইলের পথযাত্রা, একটানা তো সম্ভব না। থামতেই হবে। কিন্তু প্ল্যান অনুযায়ী কিছু হল না, বিকালে এক ইটালিয়ান রেস্তরাঁয় খেতে থামা হল, সেখানে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেলো এক সঙ্গী একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায়। পরে রাত্রে গাড়ি চলছে, যিনি চালাচ্ছেন তার ঘুম এসে যাচ্ছে, পাশ দিয়ে দৈত্যের মতন সব ট্রাক... ভয়ে উদ্বেগে বাকিরা অস্থির। রাত একটায় থামা হল পথের ধারের কম্ফর্ট ইন-এ। দোতলায় দুই ঘর মিলল, সব কজনে দুই ঘরে ভাগ হয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া, সকালে উঠে ফের নতুন করে পথে, হিট দ্য রোড এগেইন...

    এসব দীর্ঘ যাত্রায় অডিও-বই খুব ভালো জিনিস, যন্ত্রের মধ্য থেকে শান্ত ধীরগতি গলাটি পড়ে যায় গল্প, শুনতে শুনতে চালাতে থাকে চালক, শুনতে থাকে অরোহীরা, পথের একঘেয়েমি কেটে যায়। সেই বেতালের গপ্পো শুনতে শুনতে রাজা বিক্রমের পথচলার মতন, তবে গল্পের শেষে প্রশ্ন নেই, এইটা অনেক সুবিধে। বনপাহাড়ের ভিতর দিয়ে কেটে বেরিয়ে গেছে আন্ত:রাজ্যমহাসড়ক। চারিপাশে ছড়ানো হেমন্ত সৌন্দর্য্য। পাহাড়ের গা ভরে সমস্ত গাছপালার পাতাগুলো রঙিন হয়ে গেছে-লাল, বাদামি, কমলা হলুদ। ঝরে যাবার আগে ওরা এত রঙিন হয়ে যায়, তারপরে গাছেরা ন্যাড়া বৈরাগী হয়ে যাবে গোটা শীতকালের জন্য, এ ক্ষণিক রাঙাবাস খসে যাবে ধারালো শীতবাতাসে, তারপরে নামবে তুষার। এখন এই অপূর্ব ফল-কালারের উপরে ঝলমল করছে হেমন্তের সোনালি রোদ,নেশা ধরানো সৌন্দর্য্য। মনে পড়ে যায় এই সময়েই তো আমার দেশে পাকা ধানের উপরে শীতের কোমল উজল রোদ ছড়িয়ে গেছে দূর কতদূর... ধানকাটার সময়ও হয়ে এলো সেথায়, তুলে আঁটি বেধে নিয়ে যাবে, গাঁয়ের পথ ভরে যাবে ধান্যসুবাসে...

    দেখতে দেখতে পাহাড়নদীর পাশ দিয়ে ভুটাক্ষেতের দেশে চলে আসি আমরা। যে ছোট্ট শান্ত শহরটিতে আমরা অতিথি, সেখানে গিয়ে মুগ্ধ। বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমস্ত গাছেরা ফল কালারে সেজেছে, অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য। ছবিতে এর শতাংশে একাংশও ফুটবে না, তবু ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক। বহমান সময়ধরাকে দুহাতের অঞ্জলিতে একটুখানি ধরে রাখার চেষ্টা। চিরবৃদ্ধ চিরতরুণ সময় হাসে মানবশিশুদের ব্যর্থ এ চেষ্টা দেখে। গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেছিল, হোস্ট ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন ডিনারে। এঁরই ষাটতম জন্মদিন উপলক্ষে কনফারেন্স, আয়োজন করছেন প্রাক্তন ছাত্রশিষ্যেরা। ডিনারের জন্য বুক করা ছিল ঝর্ণাধারার কাছ ঘেঁষে হোটেল, ঝর্ণার উপরে মুখ বাড়ানো একটি ঘর, চারিধারে স্বচ্ছ কাচ ঘেরা, সেখানেই আয়েস করে বসে অতিথিদের খাদ্যপানীয়ের ব্যবস্থা। তখন সূর্য পশ্চিমে একদম দিগন্তে ঢলে গেছে, আলো আঁধারি জলধারার উঁচু পাড়ির উপরে একটি গাছ হেমন্তে সোনালি হয়ে যাওয়া পত্রসম্ভার নিয়ে ঝরঝর করে কাঁপছে সন্ধ্যার বাতাসে---কী অপূর্ব অনুভবী দৃশ্য। পৃথিবী কী আশ্চর্য সুন্দরী। ঋতুতে ঋতুতে প্রহরে প্রহরে কী অপরূপ তার সাজবদল রঙবদল সুরভিবদল সুরবদল। অবন ঠাকুরের ছবিকলমখানি থাকলে হয়তো বর্ণনা করতে পারতাম, কিন্তু আমার ছবিহীন এই রুখু কলমে সে বর্ণনা অসম্ভব।

    তবু কেন লিখি? কেন এই অস্থির আকাঙ্ক্ষা? মনে হয় আকাশ-বাতাস জল-পাহাড়-গাছপাতা-মানুষজন সব কিছু নিয়ে সমস্ত দৃশ্যখানি নকশিকাঁথার মতন মুড়ে উপহার পাঠিয়ে দিই সেই প্রিয়জনকে যে প্রান্তটুকু ছুঁয়েই বুঝে ফেলবে গোটাগুটি সবটাই, যা দেখা যায় তাও যা না দেখা যায় তাও-যা কিছু রয়েছে আঁকা আর যা কিছু পাওয়া গেল অনুভবে-তার এতটুকুও বাদ যাবে না ওর বুঝতে। কিন্তু সে তো হবার নয়, এ যে জলমীনের আকাশ ছোঁয়ার সাধ! তাই বুঝি দেখতে গিয়ে সব ঝাপসা হয়ে যায় নোনতা অশ্রুতে? দুদিন থাকা হল সেখানে, সদ্যপরিচিত মানুষগুলোর আন্তরিক আতিথেয়তা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পৃথিবীতে কত ঋণ থেকে যায়, কোনো কোনো ঋণে ঋণী থেকেই সুখ। ""তুমি যে তুমিই ওগো, সেই তব ঋণ...''
    ফেরার পথ আবার সেই অপরূপ সৌন্দর্য্যের মধ্য দিয়ে-পথে বেরুলেই কেমন একটা লাগে, বোধহয় সেই বিস্মৃত পূর্বজদের যাযাবর রক্ত বুকের মধ্যে কোলাহল করে ওঠে, সেই যে এক কবি বলেছিল-""তারাই যথার্থ যাত্রী যারা চলে যায়/ কেবল যাবারই জন্য/ হাল্কা মন, বেলুনের মতন/ নিশিত নিয়তি ফেলে একবার ফিরে না তাকায়/ কেন তা জানে না,তবু চলো চলো বলে অবিরত/ তাদের বাসনা পায় মেঘপুঞ্জে উজ্জ্বল বিন্যাস/ স্বপ্নে হানা দিয়ে যায় সৈনিকেরে যেমন কামান/ অপরিবর্তনীয় দেশ, মহাশূন্যে ইন্দ্রিয়বিলাস/ যার নাম কখনো জানে নি কোনো মানবসন্তান...''

    বনপাহাড়ির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ যাত্রায় বারে বারে ফিরে আসে কবেকার এই লাইনগুলো, উড়ন্ত রঙিন পালকের মতন ভেসে যায় যেন, আকাশে তখন রঙিন মেঘ, বেলা ঢলে এলো, আরেকটু পরেই রাতবাতিরা জ্বলে জ্বলে উঠবে। রাত্রির সরাই এ বিশ্রামের পরে আবার পরদিন সকালে চলা শুরু, একসময় এসে গেল চেনা শহর, ক্লান্ত আমরা ফিরে যাবো যে যার নীড়ে। কিন্তু পথ ফুরাবে না, সে অনি:শেষ বয়ে গেছে, এক সূর্যোদয় থেকে নতুন সূর্যোদয়ের দিকে, দেশ থেকে দেশান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে ... সেই পথযাত্রার আনন্দতিলক কি পড়বে এসে এই কপালে, পরিব্রজনপ্রিয় পা দুটি যে পথের ডাকে খুশি হয়ে ওঠে? ""এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে....''
  • 7 | 107.189.14.4 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৩১741414
  • পশম চাই না আর?
    আমোদ বোষ্টুমি, সুইটজারল্যান্ড
    ২০.০৯.২০০৭
    তিন বছর বয়েসে, ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের মন্তেস্যরী বিভাগে আমার জীবনে প্রথম ইস্কুলে শেখা ছড়াটা ছিলো এই রকম :-

    ব্যা ব্যা কালো ভেড়া, পশম আছে কি?
    আছে আছে, তিনটি ছালা ভর্তি রেখেছি।
    একটি ছালা কর্তাবাবুর, একটি গিন্নিমা'র,
    ছিঁচ্‌কাঁদুনে ছেলের ত'রে পশম নাই আমার।

    এর মূল ইংরিজি ভার্সানটা, অনেক অনেক পরে শেখা- ইংরিজি শিখতে গিয়ে।

    কয়েক যুগ বাদে এই ছড়াটা ফের মনে পড়ছে।

    কালো ভেড়া, ব্ল্যাকশিপ- মানেই খারাপ, কুলাঙ্গার, কলঙ্ক। কলঙ্ক কালো। কালো মানুষেরাও কারো কারো চোখে কলঙ্ক হয়ে উঠতে পারে। এ কালো যেমন তেমন নয়। আর কালো মানুষদের দেশ মানেই গোদা হিসেবে অনগ্রসর দেশ, গরীব দেশ। যারা রুজি রোজগারের আশায়, একটু ভালো থাকার আশায়, কখনো উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয় সাদা মানুষের দেশে। সাদা ভেড়ার পালে, এই কালো ভেড়াদের এক ঝলকেই চেনা যায়, তা মেঝ ভায়ের রং ছোট আর বড় ভায়ের চেয়ে যতই পরিষ্কার হোক না কেন, সাদা ভেড়ার পালে সে কালোই। সাদা মানুষ কালো মানুষ ক'রে মানুষকে আলাদা করা ভারী অসভ্য জিনিস। সভ্য জগৎ, পশ্চিমের জগৎ, টাকা পয়সাওয়ালা মানুষের জগৎ নিয়ম ক'রে নিজেরাই সেসব ঠিক ক'রে দিয়েছে। কালোরা আসবে, কাজ করবে, মূলত অল্প মাইনেয় ফাইফরমাসির কাজ করবে, জঞ্জাল সাফ করবে, এঁটোকাঁটা ধোবে, বেয়ারার কাজ করবে, আর চুপচাপ থাকবে। কে না জানে ওসব কাজ হচ্ছে নীচু কাজ। আর অল্প স্বল্প কালো লোক, যারা সাদা কলারের কাজ করবে, তারাও যেন বেশি উৎপাত না করে। ঝামেলা করেছ কি ঘেঁটি ধরে বের করে দেওয়া হবে। কোনো ক্রাইম যদি করে বসো, বিচারে যদি ক্রিমিনাল বলে ছাপ লাগে, তবে ক্রিমিনালটিকে সপরিবারে দূর করে দাও এদেশ থেকে।

    মাফ করবেন। এ আমার বক্তব্য নয়, সুইস দেশের সব চেয়ে বেশি ভোট পাওয়া পার্টির এটাই বক্তব্য, এটাই দাবি। এই নিয়ে সরাসরি জনসাধারণের থেকে ভোট ও নেওয়া হবে। ডিরেক্ট ডেমোক্র্যাসির দেশ কিনা, যে কোনও অ্যাজেন্ডাতেই সরাসরি জনগণের ভোট। জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয় না সরকার। দুনিয়ার প্রাচীনতম ডেমোক্র্যাটিক দেশ বলে কথা। এমনিতেই সাড়ে সাত মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশে শতকরা পঁচিশ ভাগ মানুষই বহিরাগত। তাদের শ্রম না থাকলে "ছোট' কাজ, "নীচু' কাজ করবার কেউ থাকবে না। আর এরাই খুব ক্রাইম ক'রে থাকে। ছোটলোক তো। মুশকিল হচ্ছে ক্রাইম করলে তার জন্যে শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে, তারপরে ঘেঁটি ধরে দেশ থেকে বহিষ্কার। পরিবার সহ। ক্রিমিনালের সন্তান যে ক্রিমিনাল হবেই তা সে যত ছোট`ই হোক না কেন, এ তো জলের মতো পরিষ্কার লজিক। না, না, এর মধ্যে ষাট সত্তর বছরের পুরোনো নাৎসী ইতিহাস টেনে আনবেন না, প্লিজ। এ তো বৈজ্ঞানিক সত্য। সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক তৃতীয়াংশ ক্রিমিনাল যারা সুইস জেলে সাজা ভোগ করছে, তারা বিদেশী। এই বিদেশীদের মধ্যে আবার আশেপাশের টাকা পয়সাওয়ালা দেশের লোক খুব কম। যে সব দেশের সঙ্গে সুইস কন্‌ফেডারেশনের দ্বিপাক্ষিক যুক্তি আছে, যারা বিদেশী হলেও একটু "কম বিদেশী'র ছাপ পায়। এই দেশগুলো হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো, তাছাড়া রয়েছে প্রথম বিশ্বের বাকি দেশগুলো। এরা তেমন ক্রাইম টাইম করে না, ছোট কাজও এরা করে না, এদের জন্যে সুইস নাগরিকত্ব পাবার হিসেব অন্যরকম। এসব নিয়ম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ঘামিয়ে কিস্যু হবার নয়।

    কিন্তু এখন ঝামেলা পাকিয়েছে একটা পোস্টার। সারা দেশের সর্বত্র, রাস্তায়, স্টেশনে, অলিতে গলিতে, হাতের নাগালে, বাইরে সর্বত্র শোভা পাচ্ছে সেই পোস্টার। দেশের নিরাপত্তা বিষয়ক সতর্কতাবাণী। নীচে লেখা জদবভদবনক্ষবনভঢ় ড়দবতপপনশ ওপরে ছবি। ছবির একাংশ লালের ওপর সাদা ক্রস, হেলভেটিক কনফেডারেশনের ফ্ল্যাগ (সুইস ফ্ল্যাগ)। সেই ফ্ল্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ভালোমানুষ তিনটে সাদা ভেড়া, আর ফ্ল্যাগের বাইরে একটা কালোভেড়া, তার চোখেমুখে ক্রিমিনালের ছাপ। সাদা ভেড়া তাকে লাথি মেরে সুইস সীমার বাইরে বের করে দিচ্ছে। নীচে পার্টির ছাপ, জদবংনভ।নক্ষভড়দবন টষরযড়সতক্ষঢ়নভ বা জটঙ, বাংলা করলে দাঁড়ায় সুইস জনতার পার্টি। সুইস পার্লামেন্টে এদের স্থান এক্কেবারে দক্ষিণদিকে। এই পোস্টার তথা বিজ্ঞাপনের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে এতক্ষণ ধরে যা লিখেছি, সেই অ্যাজেন্ডা। সামনাসামনি দেশের লোক যতই এদের অগ্রাহ্য করবার ভাব দেখাক না কেন, গণতান্ত্রিক ভোটে এদের এইরকম অ্যাজেন্ডাগুলো কেমন করে জানি পাশ হয়ে যায়। সেই গেলবার যখন এরা বিরোধীতা করেছিল, দ্বিতীয় প্রজন্মের বিদেশীদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেবার অ্যাজেন্ডায়। বাপমা যদি এদেশে ন্যাচারালাইজেশন পদ্ধতিতে অন্তত বারো বছরের অগ্নি পরীক্ষায় পাশ করে নাগরিকত্ব পায় ও, তাদের সন্তান কিন্তু জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাবে না, তাকেও যেতে হবে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে, কেনা জানে, কষ্ঠিপাথরে বারবার করে ঘষে না নিলে কখন কোত্থেকে ভেজাল বেরিয়ে আসে। বলি বংশগতি ব`লে একটা জিনিস আছে তো, না কি? দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারের এক্‌জিবিশানে ভরে গেল তখন সুইট্‌জারল্যান্ড। একটা কালো হাত লালের ওপর সাদা ক্রস আঁকা পাসপোর্টের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। দেখেছ কী আস্পর্দা! না: কিদ্‌হুতেই এমন হতে দেওয়া যায় না। জনগণ ভোট দিয়ে কিছুতেই এই অনর্থ হতে দেয়নি। কালো হাতে অত সহজে পাসপোর্ট তুলে দেওয়ায় জনতার ই আপত্তি ছিলো। এই পার্টি প্রচার চালিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু ভোট তো জনসাধারণ দিয়েছেন। এক প্রজন্মে যে কালোর ময়লা ধুয়ে সাফ হয় না, সে তো নতুন কিছু নয়, কয়লা বারবার ধুলেও.. ইত্যাদি।

    এবারেও খুব জল ঘোলা হয়েছে এই ভেড়ার পোস্টার নিয়ে, ইউনাইটেড নেশন অবদি এই নিয়ে খুব কড়া ক্রিটিসিজম করেছে। এরকম করে সাদা ভেড়া কালো ভেড়া দেখানো নাকি প্রকারান্তরে বর্ণবিদ্বেষেরই প্রকাশ। কোনও ভদ্র ডেমোক্র্যাটিক দেশের দেয়ালে দেয়ালে, একি অনর্থ! কিন্তু তাও পোস্টার গুলো কেউ সরায়নি। অথচ এই গেলো বছর, জরষফফঁ বলে এক কোম্পানির অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপনে, অন্তর্বাসের তুলনায় নিতম্বের বিজ্ঞাপন বেশী প্রকট হওয়ায়, খুব হই চই হয়েছিল; তখন সবকটা পোস্টার উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন জরষফফঁর বিজ্ঞাপন এজেন্সি। অবিশ্যি প্রায় নিরাবরণ নিতম্বের সঙ্গে এই ভেড়াদের কোনও তুলনাই চলতে পারে না। ভেড়ার ছবিতে কোনও অশ্লীলতা , ওব্‌সিনিটি নেই। ভেড়া কালো কি ভালো, সে সব প্রশ্নের উত্তর দুরূহ, সবই স্থির হবে গণতন্ত্রের দ্বারা। এখন কথাটা হচ্ছে, এরপরে পশমের জোগান দেবে কে?

    * কয়েকটি জ্ঞাতব্য তথ্য।
    এমনিতে সুইস নাগরিকত্বের জন্যে বারো বছর এদেশে একটানা বসবাস করা, ট্যাক্স দেওয়া, এবং কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড না থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়। সঙ্গে চাই যে কোনো একটি সুইস জাতীয় ভাষায় মোটামুটি দক্ষতা, ও সমাজের সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড হওয়া। এই ইন্টিগ্রেটেড হবার সংজ্ঞা খুব স্পষ্ট নয় যদিও। বারো বছরটা খাটে না শিশু, উদ্বাস্তু, সুইস নাগরিকের সঙ্গে বিবাহিত এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আবদ্ধ দেশগুলির নাগরিকদের ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে সময়টা অর্ধেক। এদেশে থাকা ও কাজ করা নিয়ে কেমন নিয়ম আছে, সে নিয়ে পরে একদিন বলবার ইচ্ছে রইল।

    স্বর্গ হইতে বিদায়
    আমোদ বোষ্টুমি
    ২৭.১২.২০০৭
    ভোর হয়ে আসছে, অন্ধকার কাটছে একটু একটু ক'রে। জানলার সামনে পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। তার পরনে শুধু সৌখিন অন্তর্বাস। আলো আরেকটু বাড়লো, নারীটি ফস্‌ করে লাইটার জ্বালিয়ে ধরালো সিগারেট। এবার এক পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠলো, "নাতাশা, আমি তোমাকে ভালোবাসি' - নারীটির এতে কোনো প্রতিক্রিয়া হ'লো না। পুরুষটিকে যদিও আমরা দেখতে পাচ্ছিনা, তবুও পুরুষকণ্ঠ এবার বললো, "আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।' এবারে ঘাড় ঘোরালো নাতাশা, ঘাড় ফিরিয়ে হোটেলকক্ষের বিছানায় শুয়ে থাকা পুরুষটির দিকে তাকালো, তার দিকে এগিয়ে গেল।

    আমাদের দৃষ্টিও সেইদিকে, আমরা ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখছি, নাতাশা ও পুরুষটির চলাফেরা-কথোপকথন। পুরুষটির হাতে নোট, ডলার বিল। সে ডলার গুণে, নাতাশার হাতে দিচ্ছে, নাতাশার পারিশ্রমিক। নাতাশা মুচ্‌কি হেসে সেটা নিতে নিতেও নিলো না, পুরুষটির চোখে বিষ্ময়, নাতাশা এই প্রথম মুখ খুলল, "আমাদের দেশে মেয়েরা, বিছানায় শোবার জন্যে স্বামীর কাছ থেকে টাকা নেয় না।'
    এটাই প্রথম দৃশ্য ছিলো, "ইন্তারজেভোচ্‌কা' ছবির। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৮৯ এর গ্রীষ্মশেষে, সোভিয়েত দেশে। হ্যাঁ তখনো সেটা সোভিয়েত দেশ। পিয়োতর তাদারোভ্‌স্কির ছবিতে, নাতাশার শহরটার নাম, তখনো লেনিনগ্রাদ, আজকের সাঙ্ক্‌ৎপিয়োতর্স্‌বুর্গ নয়।

    ছবিটি এক রাশিয়ান মেয়েকে নিয়ে, যে সুইস নাগরিক কে বিয়ে ক'রে সুইটজারল্যান্ডে চলে যায়। মেয়েটির নাম যে নাতাশা, আর তার অন্যতম পেশা যে বেশ্যাবৃত্তি, সেট ছবির প্রথম দৃশ্যেই আমরা আঁচ করে নিয়েছি। মেয়েটির মূল জীবিকা যদিও অন্য, সে নার্সের কাজ করে, কিন্তু তাতে আয় নেহাতই কম, সেই উপার্জনের ওপর ভরসা করে দামি ফারকোট কেনা যায় না, আরামে বসবাস করা অসম্ভব। ধনতান্ত্রিক দেশগুলো তাকে হাতছানি দেয়, বিদেশী ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে দেহের বিনিময়ে আয় করে ডলার, পাউন্ড, বিদেশীমুদ্রা। একদিন এরকমই কোনো বিদেশী তাকে প্রস্তাব দেয় বিয়ের, এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কোনো প্রশ্নই ওঠে না, কোনো নাতাশাই আর পেছন ফিরে তাকায় না, যত বাধাই থাকুক না কেন, সে প্রতিটি বাধার জন্যে একে একে গুণে গুণে মূল্য ধ'রে দিয়ে, ছুটে যায় পশ্চিমে। এই ছবিটিতে নাতাশা চলে এসেছিলো সুইটজারল্যান্ডে, সুইস স্বামীর সঙ্গে। লেনিনগ্রাদের সরকারী অ্যাপার্টমেন্টে ফেলে এসেছিলো মা কে, আর সেই কোন ছোটোবেলায় যে বাবাকে শেষ দেখেছে কি দেখেনি মনেই নেই, সেই বাবার কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়েছিলো, দেশের নিয়ম অনুসারে। হ্যাঁ, দেশের নিয়ম ঐরকমই। অচেনা পিতার কাছে গেল নাতাশা, ছাড়পত্রে সই করাতে। বৃদ্ধ, প্রায় অথর্ব, অ্যালকোহলিক বাবা, যে মেয়ের খোঁজ কোনোদিন রাখেনি, সই করতে রাজি হ'লো ছাড়পত্রে ছ'শো ডলারের বিনিময়ে।তার সঙ্গে করল, ছশো ডলারের সওদা। বিয়ের আনন্দে বেশ্যাবৃত্তি ছেড়েই দিয়েছিল নাতাশা, ফের বাপকে দিয়ে কাগজ সই করাতে, আবার করতে হলো দেহের সওদা, এবারের খদ্দের এক জাপানি ডিপ্লোম্যাট। এসব কথাতো হবু বরটিকে বলা চলে না, কতো ছোটো হয়ে যাবে না নাতাশার বাপ তথা রুশ সমাজ, একজন সুইসের চোখে?

    নতুন দেশে যায় নাতাশা, মুক্তি সমাজতন্ত্রের রেজিম থেকে, মুক্তি বাধা বাঁধন থেকে, অথচ, মেয়েটার মনে আনন্দ নেই, তার চঞ্চলতা লাফানো ঝাঁফানো উচ্ছ্বাস, সব কেমন যেন মিইয়ে গেছে।
    আমরা দর্শকরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, কেন এমনটি হ'লো? গল্পটা ভুল?
    পরিচালকের দোষ? স্বপ্নের মতো দেশটাতে গিয়ে কী এমন অসুখ করেছিলো নাতাশার? যে অসুখের শেষ পর্যায়ে , সে বেরিয়ে পড়ে একা, হাইওয়ের ওপর দিয়ে চুড়ান্ত স্পিডে গাড়ি নিয়ে এগোতে থাকে, চোখ ঝাপসা, চারিদিকে শুধু আলো...

    প্রচুর বিজনেস করতে পেরেছিল ছবিটা। যদিও শেষটা অস্পষ্ট লেগেছিল, কেউ কেউ ব'লেছিল, মেয়েটা তো মূলত বেশ্যাই যতই ভালো জীবন দাও না কেন, ওদের স্বভাব বদলাবার না। আরো কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলো, যাই বলো না কেন, জননী জন্মভূমিশ্চ ইত্যাদি। একটা প্রচন্ড আওয়াজের শেষে ছবিটা শেষ হয়েছিল। আজ আঠারো বছর পরেও এই সুইসভূমিতে সারি সারি বিয়ে হওয়া নাতাশাদের দেখা মেলে। এদের কেউ এসেছে রাশিয়া থেকে, কেউ ইউক্রেন, কেউ স্লোভাকিয়া, কেউ ঘানা, ব্রেজিল, নিকারাগুয়া, কোস্তারিকা, ভিয়েতনাম, কোথা থেকে নয়? সবাই যে আগে একেকটি দেহপসারিণী ছিলো, তা নয়। সবার নাম ও এক নয়, ভাষাও নয়, কিন্তু এরা সকলেই আজ কোনো না কোনো ভাবে, কোনো সুইসের ঘরণী। সুখী গৃহে সুখী ঘরণীরা আছে নিশ্চয়, এমনকি, যাদের চোখের চারপাশ থেকে স্বপ্নের মায়াজাল আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে, তাদেরও সংসার ধরে নিচ্ছি সুখেরই, কিন্তু তাদের মুখের সঙ্গে সিনেমার নাতাশার অদ্ভুত একটা মিল খুঁজে পাই।

    ডোরা ব'লে একটি মেয়ে, ঘানা থেকে আসা সুইস গৃহবধু, রাস্তায় রাস্তায় হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে চলেছে, গতকালই দেখা হলো ওর সঙ্গে, সাফাইয়ের কাজ খুঁজছে ডোরা, হাসিমুখে, মুখের পেশিগুলোকে কুঁচকে হাসির মতো করে তুলছে ভঙ্গিটা, চোখের ভেতরে হয়ত চিক্‌চিক্‌ করছে বালি, কিম্বা আমার দেখার ভুল। মনে হয়, ডোরা আরেকবার মুক্তি খুঁজছে। সাতদিনের কোস্তারিকা ট্যুরে গেছলেন এক সুইস ব্যাঙ্ক কর্মচারী। সেইখানেই ফাতিমার সঙ্গে আলাপ, একটা বারে। ও ওয়েট্রেসের কাজ করছিলো। সেই সাতদিনের আলাপেই বিয়ে হয়ে গেল। সাড়ে তিন বছর হলো ফাতিমা তার কুমারী জীবনের পুত্রসহ স্বামীর সংসার করছে জুরিখে, কিন্তু না:, এবার যে ক'রে একটা কাজ জোটাতেই হবে। এইরকমই গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুনতে পাব জাপানের মেয়ে তোমোকো'র কাছে, হাঙ্গেরির টিওডোরার কাছে, পারাগুয়ায়ের ক্লাউদিনার কাছে।

    ঠিক কীভাবে তিনদিন থেকে সাতদিনের ভেতরে প্রথম আলাপ থেকে বিয়ের সিদ্ধান্ত সব ঠিকঠাক হয়ে যায়, কীভাবে অচেনা বিদেশীকে স্বামী বলে মেনে নেয় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের মেয়েগুলো, ঠিক কী যে হয়, সেই আসল রহস্যটা কেউ আমাকে খুলে বলে না। বলতে চায় না। এক সুইসের কাছে শুনেছিলাম, বিয়ে করবার জন্যেই অনেকে বিদেশে বেড়াতে যায়, অনেক ভালো ভালো বউ পাওয়া যায় বিদেশে, গরীব মেয়ে, নরম স্বভাবের মেয়ে, সুশ্রী মেয়ে, নির্দ্বিধায় মা হতে রাজী হওয়া মেয়ে, ঘরোয়া মেয়ে, যার যেমনটি চাই, ঠিক যেটা পছন্দ বেছে নেওয়া শুধু। ভালোবাসার টান কি প্রাচুর্যের টান জানি না, কোনো একটা টানে তো ছুটে ছুটে আসে এরা, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটের বিয়ে ক'রে ক'রে। তারপরে অন্তত: পাঁচ বছর বিয়েটাকে যেমন ক'রে হোক, টিঁকিয়ে রাখা, ভুল হয়ে গিয়ে থাকলে ফেরার টিকিটের দাম বড্ড বেশি, প্রায় দুর্মূল্য। তারপরে? নাতাশা প্রচন্ড বেগে চালাতে থাকে গাড়ি, মাথা খারাপ হ'য়ে যাবার মতো আলোর ঝলকানি চতুর্দিকে, সব গাড়িই আসছে উল্টোদিক থেকে, স্রোতের বিপরীতে চলছে গাড়ি, প্রচন্ড আওয়াজ, নাতাশার নিথর দেহ, গলায় রক্ত জবার মালা, সারা গায়ে অজস্র রাঙাজবা। ব্যাকগ্রাউন্ডে শুনতে পাচ্ছি, ম্লান হয়ে এলো কণ্ঠে মন্দার মালিকা, হে মহেন্দ্র! নিবাপিত জ্যোতির্ময় শিখা মলিন ললাটে, পুণ্যবল হল ক্ষীন, আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন...
    না:, হল ফাঁকা হয়ে গেছে, উঠুন, উঠুন, শো শেষ। সবাই বেরিয়ে গেছে, আমাকেও বেরোতে হবে। সিনেমার শেষটা ওই উজ্জ্বল আলো আর আওয়াজ অবধিই ছিলো, বাকিটুকু আমি বাড়িয়ে লিখেছি, বাকি অন্য সবকিছু এবং সবটুকুই। ওগুলো আমার কষ্টকল্পনা। এখন শুরু হবে পরের শো।

    দীর্ঘ পথ, শর্ট ট্রিপ
    আমোদ বোষ্টুমি, সুইটজারল্যান্ড
    ০১.০২.২০০৮
    জুরিখ শহরের ৩২ নম্বর ট্রলিবাসের রুটটা বিরাট লম্বা; শহরের উত্তর-পশ্চিম সীমানা থেকে শুরু হয়ে অলিগলিচলিরাম ক'রে, নদীনালা ডিঙিয়ে, অনেক লম্বা চওড়া রাস্তা পেরিয়ে, গোটাকয়েক প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে তার গন্তব্য অবশেষে শহরের দক্ষিণ পশ্চিমে। এই গোটা পথপরিক্রমায় সে পেরিয়ে আসে একটা বিশেষ রাস্তা, যে রাস্তার নাম লাংস্ট্রাস্‌সে, বাংলায় যার অর্থ লম্বা রাস্তা। ওই একমাত্র ৩২ নম্বরই সাহস করে লাংস্ট্রাস্‌সের গোড়া থেকে ডগা অবদি বেশ কয়েকটা স্টপেজ থামতে থামতে যায়, আর কোনো বাস ওই বিশেষ রাস্তাটির ছায়া মাড়ায় না। জুরিখে যাঁরা একাধিকবার এসেছেন টুরিস্ট হিসেবে, কিম্বা জুরিখ সম্বন্ধে হাল্কা ধারণাও যাঁদের আছে, লাংস্ট্রাস্‌সের নাম তাঁদের কানে কখনো না কখনো আসবেই। এটাই শহরের মূল রেডলাইট এরিয়া। যাঁরা "বর্ন্‌ ইন্টু ব্রথেল্‌স্‌' অথবা "ল্যান্ড অফ্‌ মিসিং চিল্ড্রেন' গোছের ডকুমেন্টারি দেখে কলকাতার রেডলাইট এরিয়া সোনাগাছি সম্পর্কে আবছা হলেও কিছুটা অন্তত ধারণা করে ফেলেছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই, লাংস্ট্রাস্‌সের সঙ্গে সোনাগাছির অমিলই বেশি।

    গোটা রাস্তাটা জুড়ে ছোট বড় কয়েকশো অফিস, তাদের মধ্যে বেশ কিছু সরকারি অফিসও রয়েছে, এমনকি একটা বাসস্টপের নাম বিজ্ঞানী রোয়েন্টগেনের নামে। বাস থেকে নামলেই দেখা যাবে অফিসবাড়ির একতলাগুলোয় সব নাইটক্লাব, আর তাদের দেয়াল জুড়ে লাস্যময়ী নগ্নিকাদের ফোটোসহ বিজ্ঞাপন। প্রদীপের তলাতেই যে অন্ধকার হয় তার এক্কেবারে মোক্ষম উদাহরণ। বড়বড় সব উকিলের চেম্বার, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পার্লামেন্টের মেম্বার, আছেন প্রচুর কৃতীব্যক্তি, বড়বড় ডাক্তার মোক্তার, তাঁরাও ওইসব নাইটক্লাবের পাশের দরজা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজ নিজ অফিসে চলে যান। এই এলাকায় অফিসস্পেসের ভাড়া মারাত্মক বেশি। আবার এইসব বাড়িগুলোর পেছনদিকগুলোয় থাকে অ্যাপার্টমেন্ট, যেখানে ঢেলে দেহব্যবসা চলে। মোটকথা এই রাস্তাটি শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে খুবই কাছে এবং দিনে ও রাতে সমান ব্যতিব্যস্ত। এপাড়ায় অফিস খুলেছেন বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যাঁরা সমাজ সংস্কারে আগ্রহী, মেয়েদের দুর্ভোগ যাঁদের বরদাস্ত হয় না। তাঁরাই দিনদুপুরে জুগিয়ে চলেছেন প্রয়োজনীয় সাহায্য এবং দরকারি মতামত, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় বড্ড কম অথবা আইনের মারপ্যাঁচে নিস্তেজ।

    পাড়ার ডাক্তারদের কাছ থেকেও নর্তকীদের দৈনন্দিন জীবনের শোষণ অবিচার অত্যাচার অসহায়তার খবর পাওয়া যায়, কিন্তু প্রতিকারের খবর কেউ দেয় না। হিউম্যান ট্র্যাফিকিং হতেই থাকে, পাসপোর্ট-ভিসা-ওয়ার্কপার্মিট এর সমস্ত নিয়ম কানুন মেনেই। সকলেরই জীবনে দরকারি কাজ আছে, তাই ঊর্ব্বশীরা নাচতেই থাকে নাচতেই থাকে, নৃত্যের তালে তালে এক এক করে তাদের পোশাক খুলে যেতে থাকে, লজ্জা খুলে খুলে ঝরে পড়ে মাটিতে মিলিয়ে যেতে থাকে, আমাদের কারোর ই কিছু এসে যায় না এতে, কারণ আমরা তথাকথিত ভদ্রলোক, লাংস্ট্রাস্‌সের ক্রেতা বা বিক্রেতা কোনো ক্যাটেগরির অন্তর্ভূক্তই নই, ৩২ নম্বরের জানলার কাচ ভেদ করে করে আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখের সামনে এসে পড়ে এই মরশুমের নতুন নর্ত্তকীদের ফোটো। আমরা যুধিষ্টিরের দল শুধু আলতো পাপক্ষয়ের নিমিত্ত অনিচ্ছায় ৩২ নম্বরে চড়ি, নরকদর্শনের ঘৃণায় দেখতে পাই দোকানগুলোয় এসেছে নতুন নতুন স্টক।

    কৌতুহলের জেরে জানা হতে থাকে নানান তথ্য। অন্য একদিন এদেশের নানান ধরনের ওয়ার্ক পার্মিট নিয়ে আলোচনা হবে'খন, এখন শুধু গণিকা-নর্তকীদের ওয়ার্ক পার্মিটের কথা বলি বরঞ্চ। শুনতে একটু অস্বস্তিকর হলেও, বিদেশ থেকে গণিকাবৃত্তি করতে আসা এই নর্ত্তকীদের আর বিভিন্ন দেশ থেকে অল্প সময়ের জন্য কাজ করতে আসা কনসাল্টেন্টদের পার্মিট অভিন্ন ক্যাটেগরির। ক্যাটেগরি ক, হাজারে হাজারে তথ্যপ্রযুক্তি বিশারদেরা স্বল্পমেয়াদী প্রোজেক্ট করতে এই ক পার্মিটই পেয়ে থাকেন। স্বল্পমেয়াদ বলতে তিনমাস থেকে বড়জোর দুবছর, আর এই ক অক্ষরটির অর্থ লিমিটেড ক্যাটেগরি, তার লিমিটেশন নানাবিধ- যতদিন এদেশে কাজ করবে মনিব বদলাতে পারবে না, চাকরি ছেড়ে দিলে বা চাকরি চলে গেলে অনতিবিলম্বে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মজাটা অন্যখানে। বাঘা বাঘা ডিরেক্টর ম্যানেজার অফিসার ব্যক্তিদের দেখেছি, ক পার্মিট নিয়ে এদেশে এসে বছরখানেক কাটিয়ে যেতে। পার্মিটের সুফলটুকু উপভোগ করেছেন এঁরা, সোশ্যাল সিকিওরিটি বাবদ যে টাকা বেতন থেকে কাটা যায় সফরশেষে সুদে আসলে ফেরত পান সেসব, শুধু ট্যাক্সটুকু দিতে হয় এই-ই যা। অথচ নর্তকীদের ক পার্মিটের গায়ে লেখা থাকে এক অদ্ভুত সাংকেতিক শব্দ, "শিল্পী'- ঔস্বশড়ঢ়রনক্ষভশ; শিল্পই বটে। এদের পার্মিটের মেয়াদ সীমিত তিনমাসের জন্যে, তিনমাস কেটে গেলে ফেরৎ যায় শিল্পী, আসে নতুন শিল্পী তার শিল্পের নতুন পসরা নিয়ে। সোশ্যাল সিকিওরিটি বাবদ এদের বেতন থেকেও কাটা যায় অর্থ, কিন্তু সিকিওরিটি শব্দটাই এক্ষেত্রে এদের কাছে অর্থহীন; ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে দিয়ে কাজ করানো, তা সে যে কাজই হোক না কেন, যা সুইস আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তা ই হয়ে চলেছে প্রদীপের নীচে, চারপাশে, প্রতি নিয়ত। তার ওপর এই "শিল্পের' বাজারে খদ্দেরদের সবসময় নতুন নতুন জিনিস চাই, তিনমাস হয়ে গেলেই মুখগুলো, দেহগুলো পুরোনো হয়ে যায়। তখন আসবে নতুন নতুন কচি কচি ফ্রেশ শিল্পীরা, ব্যাঙ্কক থেকে, পূর্ব ইউরোপ থেকে, মনভরা আশা নিয়ে ভালো বেতনের কাজের খোঁজে। ভালো বেতন, অথচ চিপ-লেবার, কী অদ্ভুত প্যারাডক্স। অবশ্য, গোড়ার দিকে এই "কাজ'-এর গতিপ্রকৃতি অধিকাংশ সময়েই জানা থাকে না নর্তকীদের। এদেশের মাটিতে পা রাখার পর সত্যের উদ্‌ঘাটন হতে থাকে। কিন্তু তখন ফেরবার উপায় নেই। নেই বললে ভুল হবে, আছে, কিন্তু তার মূল্য প্রচুর। তারচেয়ে তিনমাসের নর্তকীজীবনের সঙ্গে সমঝোতাই না হয় হল। সেই তিনমাসে যদি বরাত খুলে যায়, কে বলতে পারে? হয়তো দেখা হয়ে গেল কোনো স্বপ্নের সওদাগরের সঙ্গে, হতেই পারে, কখনো কখনো হয় ও। আমি চিনি একটি মেয়েকে, তার নাম মাম, তার সফরও শুরু হয়েছিল ওই লম্বা রাস্তায় একটা শর্ট ট্রিপ দিয়ে। বছর দুয়েক পরে মাম আবার ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে এসেছে এদেশে, থাকে একটা ছোট্ট রাস্তায়, শুরু করেছে একটা অন্য জীবন খুব ধীর পদক্ষেপে। কিন্তু সবাইতো মাম নয়।

    এক গ্রীষ্মের ভোরে অচেনা পথ ধরে খেয়ালহীন হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেছলাম রোয়েন্টগেন নামাঙ্কিত সেই বাসস্টপটার পেছনের গলিতে, হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি, ফ্রেমে বাঁধানো এক শিল্পকর্ম বুঝি, তবে সেটা ছিল চকিতের ভুল; ঠাওর করে বুঝলাম, জানলার ফ্রেমে বাঁধা পড়ে আছে এক তরুণী, অতি স্বল্পবাস, একহাতে চিরুনি। শার্সিতে ঠেশ দিয়ে বসে যেন এক মোমেগড়া পরী। ওই নিখুঁত ভাস্কর্য এক ঢাল চুল
    আঁচড়েই চলেছে, হয়তো মনিবের ওরকমই নির্দেশ, হয়তো ওভাবেই ক্রেতাদের ডাকতে হয়।

    আমার ভয় হয়েছিল সেদিন, যা দেখলাম তা কি সত্যিই দেখলাম ঝকঝকে দিনের আলোয়? শুধু আমি কেন, আরো চারপাশের সবাই নিশ্চয় দেখেছিলো, তবু কেউ কেন কোনো প্রতিবাদ করল না? একতলার জানলায় বসা মেয়েটিকে কেন আমি শুধু একটি কথা জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না, যে ও কি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেতেই ওখানে ওইভাবে বসে আছে? আমার সমস্ত জড়তা ভীড় করল জিভে, আর আমি দৌড়ে পালাতে লাগলাম ওই লম্বা রাস্তা ধরে সিধে, যেন রোয়েন্টগেনের অদৃশ্যকণিকা আমাকে তাড়া করেছে, আমার ভেতরটা ভেদ করে সব দেখে নেবে, তাই তাকে ছাপিয়ে আমার মান সম্ভ্রম আগলে ধরে আমি দৌড়ে পার হয়ে গেলাম লাংস্ট্রাস্‌সে। অদ্ভুত ম্যাজিক! নিরাপদ ভদ্রপাড়ায় পৌঁছেই আমার ওপর ভর করে বসল সহমর্মিতা সহানুভূতি ইত্যাদি যাবতীয় ভালোভালো জিনিস, আবার ইচ্ছে হতে লাগল মেয়েটিকে একবার দেখে আসবার, তবুও যেতে পারিনি, আর সময় গড়িয়ে গেছে নিয়ম করে, তিনমাস পরপর গলে গেছে পুরোনো মোমের পুতুলগুলো, বসেছে নতুন পুতুল, শুধু ফ্রেমগুলো রয়ে গেছে অবিকৃত অবিনশ্বর।
  • 8 | 77.68.20.217 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৪৮741415
  • পড়শিনগর
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ০৪.০১.২০০৭
    মেয়েটি ছবি আঁকে। ছবি তোলেও। এটুকু জানা ছিল। ক্লেয়র কনরয়। আমার পড়শি। দেখা হয় লন্ড্রিতে। সিঁড়িতে। দেখা হয়। কথা হয় কম। মেয়েটি স্বল্পবাক। আমি মুখচোরা প্রবল। একটু হাসি-কুশল বিনিময় -- আজ গরম বেজায় ... বিকেলে বৃষ্টি নামবে ... এই ফিরলেন বুঝি?

    গত শীতের সকালে মস্ত এক ট্রাক এল বাড়ির দোরগোড়ায়। চারদিক বন্ধ বিশাল রেন্টাল ট্রাক। বাড়ি বদলালে লোকজন যেরকম ট্রাক ভাড়া করে সেরকম। ক্লেয়র সেই ট্রাক নিয়ে বেরোয় প্রায়ই। ছবি তুলতে যায়। কোনওদিন সঙ্গীসহ। কখনও একা। গ্রীষ্মে ওর একজিবিশন। এত বড় ট্রাকে কি এত সরঞ্জাম নেয় -- জিগ্যেস করতে ভুলে যাই।

    শীত চলে যায়। বসন্তও। ক্লেয়র আমাকে কার্ড দেয় ওর একজিবিশনের -- "লাইট স্পিড -- আ জার্নি অ্যাক্রস সিডনি ইন আ পিনহোল ক্যামেরা।' অবাক লাগে। অ্যাত্ত বড় ট্রাক নিয়ে টই টই, তার সঙ্গে পিনহোল ক্যামেরা -- মেলে না যেন ...

    আসে শনিবারের দুপুর। ডে স্ট্রিটে গ্যালারিটি। মোরি গ্যালারি। সাদামাটা ব্যবস্থাপনা। দেওয়ালে ফ্রেমহীন ছবিগুলি। আট ফুট বাই তিন ফুট মোটামুটি। সাদা-কালো। প্রতিটি ছবির সঙ্গে সাউন্ডট্র্যাক। এম পি থ্রিতে। ছবি তোলার এক্সপোজারের সমান সময় সাউন্ড ট্র্যাকেরও।

    ছবিগুলি সিডনি শহরের। বা শহর থেকে সামান্য দূরের। যেমন, কুড়ি মিনিট এক্সপোজারের এম টু ট্রান্স -- আরবান টোলগেটের ছবি -- সাউন্ডট্র্যাকে ট্যাক্সি স্টার্ট নিচ্ছে, খুচরো পয়সার আওয়াজ উঠছে টোলগেটে বা পনেরো মিনিট এক্সপোজারের কন্সট্যান্স ক্লোজ ছবিটি -- একটি পরিত্যক্ত কারখানা -- সাউন্ড ট্র্যাকে গেট খোলা-বন্ধ, মেশিনের আওয়াজ গা ছমছমে -- এইরকম, গোরে পয়েন্ট অয়েল টারমিনাল, বেরি আইল্যান্ড রিজার্ভ, লাইটহর্স এক্সচেঞ্জ, সিনক্লেয়ার মোটোরস ... আদ্যন্ত নাগরিক ছবি। চূড়ান্ত ব্যস্ত, ক্লান্ত, নির্জন। বন্ধ গেট, পরিত্যক্ত কারখানা, কাঁটা তারের বেড়া, বজ্রগর্ভ মেঘরাজি ফিরে ফিরে আসে ছবিগুলিতে। নেপিয়ান নদীর ছবিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে উদাসীন ক্লেয়র-বেরি আইল্যান্ড রিজারভেও একটি শূন্য বোট বাঁধা থাকে পাড়ের কাছে -- তিনটি বোট উল্টে রাখা ঘাসজমিতে -- আবছা জঙ্গল -- বিজনতরুমূলে জল ছলছলিয়ে উঠছে ...

    গ্যালারির এককোণে ক্লেয়রের পরিকল্পনার ভিডিও বিবরণ ক্লেয়র অঙ্ক কষছে -- পিনহোলের মাপজোক, এক্সপোজার টাইমের হিসেবনিকেশ। ট্রাক ভাড়া করছে। তারপর ট্রাকটিতে ঢুকে শাটার বন্ধ করছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেতরে। সে টর্চ জ্বালায়। ড্রিল করে তৈরি করে সুগোল ছিদ্র। বাকি ফুটোফাটা ব্ল্যাকটেপ দিয়ে ঢাকে ... অর্থাৎ? অর্থাৎ ট্রাকখানি-ই আদতে পিনহোল ক্যামেরা! সকালে-সন্ধ্যায় কতবার ট্রাকটি বাড়ির দোরগোড়ায় -- কল্পনাও করিনি তার পিনহোলনয়নের।

    গ্যালারি থেকে বেরিয়ে ঝাঁ ঝাঁ দুপুর। ব্যস্ত শহর একলা ঝলসাচ্ছে। ক্রসিংয়ে সিগনাল সবুজ। কালো, সাদা, লাল, রুপোলি গাড়ি, মোটরবাইক, বিরাট ট্রাক ... বাসা বদলায় কেউ। আর, তার লটবহরের সঙ্গে, বন্ধ শাটারের সুগোল রন্ধ্র বেয়ে কখন ঢুকে পড়ে ফেলে আসা শহর। ট্রাকের ভিতর। কাঁটাতারের বেড়া ... বন্ধ কারখানা ... একলা তরীখান ... এক্সপোজার বদলে বদলে যায়। শাটার পড়ে। নির্মাণ চলে। পড়শির পিনহোল ক্যামেরায়।

    অকালবোধন
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ৬.০২.২০০৭
    দেখা হওয়ার সময় হয়নি এখন। কথা ছিল না কোনই। তবু দেখা হল। হঠাৎ। এই সময়। যখন নীলকণ্ঠ পাখিটি ওড়েনি -- শিউলি ফোটেনি -- কাশের গোছা দুলছে না কোত্থাও -- পদ্মটি নাই -- পদ্মটি নাই।

    অস্ট্রেলিয়ান সামার তুঙ্গে, পারা ছুঁয়ে যাচ্ছে চল্লিশ প্রায় -- বুশফায়ারে ঝলসাচ্ছে ভিক্টোরিয়া-ঘামে জবজবে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ...

    অথচ তিনি এলেন। সিডনিতে। শুধুই সিডনিতে।

    প্রস্তুতি ছিল। পরিকল্পনামাফিক। দু'হাজার ছয়ের অক্টোবরের মাঝামাঝি শুরু হয়েছিল প্রদর্শনী -- "গডেস -- ডিভাইন এনার্জি'। নিউ সাউথ ওয়েলস আর্ট গ্যালারিতে। ভারত, তিব্বত আর নেপালের শ'দেড়েক ছবি আর ভাস্কর্য। কোনটি ব্রিটিশ মিউজিয়ম, কোনটি সানফ্রান্সিস্কো, কোনটি বা ভারতের সংগ্রহশালা থেকে এসেছে। দশটি কক্ষে সাজানো ছবি আর ভাস্কর্য ভিন্ন শিরোনামে -- "আর্লি গডেস', "রাধা', "দেবী', "কালী', "পার্বতী', "তারা', "কালী', "তন্ত্র', "বুদ্ধিস্ট গডেস' এবং "বজ্রযান'। প্রদর্শনীর পাশাপাশি, নাচের আসর-ওড়িশি, ভরতনাট্যম। সেমিনার, ওয়ার্কশপ। আর সিনেমা। থিম -- "গডেস'।

    এই থিমসরণি বেয়েই তাঁর আবির্ভাবের সূচনা দু'হাজার সাতের ৯ই জানুয়ারি "দুর্গা-ক্রিয়েটিং আ গডেস'।

    মূর্তি গড়তে কৃষ্ণনগর থেকে এসেছেন নিমাইচন্দ্র পাল মশাই তাঁর আরও দুই সঙ্গীকে নিয়ে। মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছেন ঢাকি ছয়জনা। আর ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রাফটস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে উপস্থিত শ্রীমতী রুবি পালচৌধুরী।

    একচালা ট্রাডিশনাল প্রতিমার মিনিয়েচার ভারশানটি রাখা আছে একপাশে আর মূল প্রতিমার খড়ের কাঠামো বাঁধা হয়, মাটি পড়ে তাতে, একমেটে, দোমেটে ... ক্রমে আদল গড়ে ওঠে ... লাল রঙের গণেশটি ... সবুজ অসুর ... আর বাদামি সিংহমশাইয়ের পিঠে চড়ে কি অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী --

    নির্মাণের জাদুতে বিদেশী দর্শককুল হতবাক।

    সবিস্ময়ে আর্ট গ্যালারি অপেক্ষায় থাকে ২৬ তারিখের। গ্র্যান্ড ফিনালে। পুজো আর বিসর্জন।

    ২৬শে অস্ট্রেলিয়া ডে-র ছুটি। আর্ট গ্যালারি উপচে পড়ে মানুষে -- ধুতি, শাড়ি, জিন্‌স, ট্রাকস্যুট, শর্টস-কে আসেনি একচালাটির সামনে? ষোড়শোপচারে পুজো। ধূপ, ধুনো, ফুলমালা, মঙ্গলারতি, অঞ্জলি -- ঢাকের বাদ্যির তালে শরীর দোলায় বাঙালি আর বিদেশী, মাথা নামিয়ে শান্তিজল নেয়, হাত ভরে প্রসাদ। বিসর্জনের সময় হয়ে আসে। আর্ট গ্যালারির সামনে দিয়ে নিয়ে আসা হয় প্রতিমা -- ট্রাকে করে। ঢাকের তালে শুরু হয়ে যায় বিসর্জনের নাচ-রাস্তার উল্টোদিকের ঈষৎ উঁচু ঘাসজমিতে আমরা ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াই। এই যে অসময়ের পুজো অথচ না-পুজো, এই যে খেলা খেলা বিসর্জন-ঢাকের বোলে মনে আসে না সে কথা। প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া হাত জোড় করছেন, রুমালে চোখ মুছছেন। আর এই যে আমরা - চোখে চালশে, চুলে পাক -- অবশ্যম্ভাবী মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের ছোটবেলা, আমাদের প্রথম যৌবন, মৃত প্রিয়জনসকল -- ক্যামেরার লেন্স ঝাপসা দেখাচ্ছে। হয়তো রোদ, হয়তো ধুনুচির ধোঁয়া, হয়তো প্রবাসীর ন্যাকামি কেবল --

    আর্ট গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি -- ভুবনমনোমোহিনী -- ডাকের সাজে, ঢাকের বোলে, ধুনোর গন্ধে। রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে আমরা। মুঠিতে পরের প্রজন্মের হাতখানা।

    পাশে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ। বিদেশী। শুধোন -- "আর ইউ হিন্ডু?'

    "ইয়েস আই অ্যাম।' অ্যাম আই? অ্যাম আই?

    হিন্দু ধর্ম ছাতার তলায় ছাতা -- বড় ছাতা, মেজ ছাতা, ছোট ছাতা -- কেমন করে কোন ছাতার তলায় ঢুকে যাচ্ছি আমাহেন ব্যক্তি -- এই সব দার্শনিক কচকচি শুরু হয়ে যায়। অর্থহীন ঠেকে নিজের কানেই।

    মাঝের রাস্তাটুকু জুড়ে বিসর্জনের উদ্দাম নাচ চলছে তখন -- সেখানে অস্ট্রেলিয়া ডের প্যারেড ফেরত ভিড় করছে মানুষ, হাতে অস্ট্রেলিয়ান ফ্ল্যাগ -- বাঙালি, চিনা, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান, আফ্রিকান -- সাদা, কালো, বাদামি, পীতবর্ণ -- মিলেমিশে যাচ্ছে সব মানুষ -- মানুষ, মানুষ শুধু -- আমরা রাস্তায় নেমে আসছি। আলগা হচ্ছে মুঠো। হারিয়ে ফেলছি -- খুঁজে পাচ্ছি -- হারাচ্ছি আবার -- ঢাকের বোল ঘা দিচ্ছে বুকে ... ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন -- ভুবনগ্রাম ভুবনগ্রাম ভুবনগ্রাম ...

    প্যাচওয়ার্ক কুইল্ট
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ১.০৩.২০০৭
    "... বরিশালের কৃষকজীবন নিয়ে একটা কিংবদন্তি তখন খুব চালু ছিল। ক্ষেতে বর্ষা নেমেছে, হাঁটু অবধি জল, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুই চাষী ধানের চারার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। প্রথমের প্রশ্ন, "ক দেহি, মহারাণী ভিক্টোরিয়া এহন কি করতে আছে?' ... উত্তর, "হে কি আর আমাগো মতো? পানি নামতেই পান্থাভাত খাইয়া কাঁথামুড়ি দিয়া উব্বুত ...'। রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা -- তপন রায়চৌধুরী।

    ...'The bed itself was decorated with a patchwork quilt of great antiquity; and at the upper end, upon the side nearest to the door, hung a scanty curtain of blue check, which prevented the Zephyrs that were abroad in Kingsgate Street, from visiting Mrs. Gamp's head too roughly' ... Martin Chuzzlewit' -- Charles Dickens.



    পাড়ার কমিউনিটি নোটিশবোর্ড। পিয়ানো শিক্ষক চাই ... অভিজ্ঞ বেবি সিটারের জন্য এই নম্বরে যোগাযোগ করুন ... যোগ শিখতে আসুন কিংবা ক্যারাটে ... মেদ কমাতে চান? ... আগামী পরশু গ্যারাজ সেল ... কুকুরছানা হারিয়ে গেছে ... একখানি কুইনসাইজ খাট জলের দরে বিক্রি হবে ... তারই মধ্যে চোখে পড়ে -- ফ্রম মাদার্স টু ডটার্স : অ্যান একজিবিশন অফ প্যাচওয়ার্ক কুইল্টস। ভেন্যু নর্থ সিডনি হেরিটেজ সেন্টার, আমাদের পাড়ার স্ট্যান্টন লাইব্রেরির দোতলায়।



    অস্ট্রেলিয়ায় কলোনি পত্তনের গোড়ার দিকেই কুইল্ট আসে। এলিজাবেথ ফ্রাই কয়েদী সংশোধনাগারে কাজ করতেন। জাহাজে করে মহিলা কয়েদীরা যখন অস্ট্রেলিয়ায় আসছেন, এলিজাবেথ তাঁদের হাতে তুলে দিলেন প্যাচওয়ার্কের টুকরো, সূঁচ-সুতো। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় তৈরি হতে লাগল প্যাচওয়ার্ক কুইল্ট। নকশা করা ছোট ছোট কাপড়ের ফালি সাজিয়ে প্রথম স্তর। তার তলায় ইনসুলেশন আর ব্যাকিং। একসঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে সূঁচ সুতোয় -- তৈরি হয়ে যাচ্ছে প্যাচওয়ার্ক কুইল্ট।



    নয়খানি সিল্কের ফালি, ন'রকম রঙ, জুড়ে জুড়ে গড়ে ওঠা হীরকাকৃতি টুকরোগুলি পরপর সেলাই করা। এইভাবেই প্রথম স্তর। কিংবা "ইংলিশ পেপার টেম্পলেট পদ্ধতিতে হেক্সাগোনাল প্যাচ -- দুশো বছর আগে বিলেতে তুমুল জনপ্রিয় ছিল; মোটা কাগজ বা কার্ড ব্যবহার করে হেক্সাগোনাল প্যাচটি তৈরি করা, তারপরে কাগজটি সরিয়ে নেওয়া। কখনও হয়তো ভুল হয়েছে, কাগজ সরিয়ে নেওয়া হয়নি, কুইল্ট ততদিনে ঠাকুমা থেকে নাতনীর ঘরে, কাগজটি অটুট তখনও। অথবা লগ কেবিন কুইল্ট। চৌকোনা প্যাচওয়ার্কটি ব্লকটি মাঝখানে। তাকে ঘিরে লম্বাটে ফালিগুলি -- কখনও ডায়মন্ড, কখনও ক্রস, কখনও হার্ট, গাঢ় বা হাল্কা শেড মেলানো মেশানো। একটি লগ কেবিন কুইল্ট দেখলাম ১৮৮৭ নাগাদ তৈরি -- মধ্যিখানে তিনটি রিবন, একটিতে ক্রাউন, পরেরটিতে রানি ভিক্টোরিয়া, তার পরেরটিতে ভিক্টোরিয়ার জুবিলি সন ১৮৮৭। রিবন তিনটিকে ঘিরে রোজ, শ্যামরক, থিসল আর লিক-ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ওয়েলসের প্রতীক। মহারানির মহার্ঘ্য বালাপোষ।



    আর ওয়াগ্গা কুইল্ট। অনভিজাত, খেটে খাওয়া মানুষের দিনযাপন। অস্ট্রেলিয়ার ওয়াগ্গা ওয়াগ্গার একটি ময়দার মিলের বস্তা ব্যবহার করা হত কুইল্টগুলির ব্যাকিং মেটেরিয়াল হিসেবে। সেই থেকে এই নাম। দর্জির দোকান অথবা সেলসম্যানের ফেলে দেওয়া স্যাম্পল বুক থেকে নেওয়া হত কাপড়ের টুকরো। প্যাচওয়ার্কের জন্য। আর পুরোনো ছেঁড়া মোজা, সোয়েটার ভরে দেওয়া হত ইন্সুলেশনের জন্য।



    আঠেরোশো ছেচল্লিশ সালের একখানি কুইল্ট দেখলাম -- এক পুরুষের তৈরি। নাবিক ছিলেন তিনি। তাঁদের হামেশাই জাহাজের বিশাল বিশাল পালে রিফুকর্ম করতে হত। সেই দক্ষতাই কাজে এসেছে এক্ষেত্রে। পেপার টেম্পলেট ঘরানার সিল্কের এই কুইল্টটির চারপাশে সাদা লেস। বড় যত্নে বসানো। নাবিক নিজেই বসিয়েছিলেন নাকি নাবিকঘরণী -- কে জানে?



    কুইল্টের ভিড়ে ব্যতিক্রম একটি ড্রেসিংগাউন। ইটালি থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসে একটি মেয়ে, জুমা কারও। হাইস্কুলে পড়ার সময় সে নিমন্ত্রিত হত বন্ধুদের বাড়ি, রাতে থাকত সেখানে। বড়লোক বন্ধুরা সব। সিল্কের রাতপোশাক, ড্রেসিংগাউন। জুমার সাধ হোত। সাধ্য ছিল না। একদিন সে নিজেই বানিয়ে নিল নিজের ড্রেসিংগাউন। পুরোনো কাপড় কেটে। প্যাচওয়ার্কের কাজ সারা গায়ে। অদ্ভুত সুন্দর।



    ক্রেজি কুইল্ট ঘরানায় প্যাচগুলি ইচ্ছেমতো সাজানো। প্যাটার্নহীন। আপাত। তবু একটা নকশা কোথাও থেকেই যায়। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী আর শরণার্থীদের তৈরি কুইল্টের মোটিফে গোড়ার দিকে এসেছে তাঁদের ফেলে আসা দেশ, বাড়ি, ঘর, প্রকৃতি ... শ্যামরক, থিসল, লম্বা ডাঁটি সাদা লিলিক্রমে তা বদলে গেছে অস্ট্রেলিয়ান মোটিফে ... ক্যাঙারু, কোয়ালা, সাদার্ন ক্রস, নক্ষত্রপুঞ্জ ...

    ... এদিকে তো সাগরপারে রানিমা বালাপোষ মুড়ি দিয়ে নিদ্রা গেলেন। ওদিকে নিজভূমে পরবাসী সব। বরিশাল থেকে গোয়ালন্দ হয়ে বনগাঁ সীমান্তে ট্রেনটি থামে। মোটিফ বদলে যেতে থাকে ... ছুটির দুপুরে জানলার খড়খড়ি বেয়ে ঘরে ঢোকে মায়াবী আলো, সাদা দেওয়ালে কালচে ডোরা আড়াআড়ি, নারকেল গাছের সিল্যুয়েট। মোটিফ বদলে যাচ্ছে ... ব্লাইন্ডের আড়াআড়ি ডোরা, সিল্যুয়েটটি মেপল ট্রির। মোটিফ বদলে যায় ... খাঁড়ির শান্ত জলে ঝাঁক বাঁধা বোটগুলি। মোটিফ বদলায় আবার ... রাতে আকাশে তারা ফোটে একটি দুটি -- সেই আকাশে হেলান দেয় নি:সঙ্গ একটি ক্রেন। ব্রিজ কাঁপিয়ে ট্রেন চলে যায় কোথায় ... মোটিফ বদলে যেতেই থাকে প্রবাসীর জোড়াতালির নকশিকাঁথায়। চিরকাল।

    সেতুপ্রসঙ্গ
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ১৯.০৪.২০০৭
    দক্ষিণ গোলার্ধের শরৎ-সূচনায় সেতুটি পঞ্চসপ্ততি বৎসরে পদার্পণ করিল। অস্ট্রেলিয়ার নামোল্লেখেই যেমন ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা এবং ক্রিকেট ভাবনায় ভাসিয়া উঠে, তেমনই সিডনি শ্রবণে মনশ্চক্ষে উদিত হয় অপেরা হাউজ এবং হারবার ব্রিজ। এই সেতুটিরই পঁচাত্তর পূর্ণ হইল সম্প্রতি। বিশাল সে সেতু। সম্ভবত পৃথিবীর প্রশস্ততম; অথচ ফেব্রুয়ারি-অন্তে এক সন্ধ্যায়, সেতুটিতে যান চলাচল বস্তুত রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। নীলবর্ণ বাসগুলি বিবিধ বর্ণের ও আকৃতির মোটর গাড়ি সকল, মোবাইক, সাইকেল প্রভৃতি সকল প্রকার যানবাহনের গতি স্তব্ধ হয় সেইদিন। হেতু বিবৃত করি এইক্ষণে।

    দুখানি বিশালাকৃতি প্রমোদতরণী সেইদিন সিডনি বন্ধরে নোঙর করিয়াছিল -- কুইন মেরি এবং কুইন এলিজাবেথ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এই প্রথম দুই সুবিপুল বিলাসবহিত্র একত্রে সিডনি আসিল। অতএব জনতা হুজুগে মাতিলেন। প্রভাতে কুইন মেরি যখন বন্দরে আসিতেছিল, নবোদিত সূর্যদেব বহিত্রের বিশাল ছায়াটিকে বন্দরের নিকটস্থ সুউচ্চ হর্ম্যরাজিতে স্থাপন করিলেন। অত:পর পাজামা পরিহিত সদ্য নিদ্রোত্থিত জনতা হর্ম্যের উচ্চতমতলে আরোহণপূর্বক রাজকীয় দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করিয়া যৎপরনাস্তি আনন্দিত হইয়া প্রাত:রাশ ভুলিলেন। কর্মস্থলে পৌঁছিয়া কহিতে লাগিলেন -- "ও: ইট'স হিউজ। ও: ইট'স গর্জাস।' অতপর, মধ্যাহ্নভোজনকালে বিলাসতরণীযুগলের উচ্চতা, আয়তন এবং অবশ্যই উক্ত তরণীদ্বয়ের আরোহীগণের সুবিপুল ধনের পরিমাণের আনুমানিক নিরুপণ চলিল। ফলত, ভোজনান্তে তৃপ্তির উদ্‌গারের সহিত সামান্য দীর্ঘশ্বাস মিশিয়া গেল।

    অতপর সন্ধ্যা নামিল। সেই রাত্রিকালেই একটি তরণীর বন্দরের কাল সমাপ্ত হইবে। এতদুপলক্ষ্যে রাত্রি নয় ঘটিকায় আতসবাজির আয়োজন করা হইয়াছে। অতএব, জনতা কর্মক্ষেত্র হইতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া, বেশ পরিবর্তনান্তে পথে নামিলেন। আপন আপন গৃহের দূরত্ব অনুযায়ী, কেহ পদব্রজে অগ্রসর হইলেন, কেহ মোটরযানে রওনা হইলেন, কেহ বা রেলশকটে আরোহণ করিলেন। কাহারও সহিত পরিবার, জল, দুগ্ধ, শিশুখাদ্য। কেহ বিয়ারের বোতল আঁকড়িয়া বন্ধুসমভিব্যহারে যাত্রা করিলেন। আপন আপন বিবেচনামতো সকলেই সংক্ষিপ্ত ও নিরাপদ পথ নির্বাচন করিয়াছিলেন। কিন্তু সকল পথ আসিয়া হারবার ব্রিজে মিলিয়া গেল, ফলত: জনতা গতিরুদ্ধ হইলেন। নয়টা বাজিতে বিলম্ব নাই।। অথচ যানসকল একই স্থলে দণ্ডায়মান। শিশুদিগের কেহ কেহ সজোরে ক্রন্দন শুরু করিল, কেহ সেই অতীব সঙ্কটকালে প্রাকৃতিক বেগ অনুভব করিয়া আপন আপন জনক জননীর অপার বিরক্তিভাজন হইল। যানারোহী সকলেই তারস্বরে হর্ন বাজাইতে শুরু করিলেন এবং পার্শ্ববর্তী যানচালকের প্রতি কভু হতাশ কভু ক্রুদ্ধ লোচন স্থাপন করিতে লাগিলেন। কেবল, মদ্যপসকল শকটের গবাক্ষপথে মুণ্ড নিষ্ক্রমণপূর্বক উল্লাসের ধ্বনিতে যাত্রাপথ মুখর করিতে লাগিলেন। এই বিচিত্র সিম্ফনিতে তরণীদ্বয় যোগ দিল -- তাহারা গুরুগম্ভীর নিনাদে শিঙা ফুঁকিতে লাগিল। পুন: পুন: ভেঁপু নির্ঘোষ শুনিয়া সকলে ললাটে করাঘাতপূর্বক কহিলেন, "জিসাস! অই বোধকরি শুরু হইয়া গেল।' বাস্তবিকই বাজি শুরু হইয়া গিয়াছিল। নয়টা বাজিতেই আকাশে একখানি আলোকবিন্দু উঠিল, এক বিন্দু হইতে বাহির হইয়া আসিল সহস্র বিন্দু আলো -- কখনও তাহা সিংহের কেশরের ন্যয়, কখনও একটি বৃহৎপুষ্পের উড্ডীয়মান স্বর্ণালী পরাগরেণু সদৃশ, কখনও অগ্নিবৃক্ষরূপ। সেতুতে সেইসময় কাহারো কাহারো অবস্থান অনুকূল ছিল -- তাঁহারা বাজি দেখিয়া হৃষ্টচিত্ত হইলেন। বাকি হতভাগ্যসকল সেই স্থলে রুদ্ধগতি যানে আসীন হইয়াই পরিবহনমন্ত্রীর ঊর্দ্ধতন চৌদ্দ গোষ্ঠীর শ্রাদ্ধশান্তি সমাপ্ত করিলেন। রাজ্যের নির্বাচন আসন্ন সেইসময়।

    পরদিন সকল সংবাদপত্রের প্রথম পাতাটি দখল করিয়াছিল দুই বহিত্র এবং রুদ্ধগতি সেতুটি। দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত না হইতেই সেতু পুনরায় সংবাদশিরোনামে আসিল। সেদিন, ষোলই মার্চ, তাহার এই পঞ্চসপ্ততি বয়োপ্রাপ্তি উপলক্ষ্যে জনতা পদব্রজে সেতু অতিক্রম করিয়াছিলেন। পুলিশে স্বেচ্ছাসেবকে শহর পূর্ণ ছিল; প্রশাসনের তরফে, সেতুর উপর সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ রাখা হইয়াছিল। বিশেষ ব্যাজে, টুপিতে, টি শার্টে জনতা সাজিয়াছিলেন। ভারতীয়, ফিলিপিনো, পূর্ব ইউরোপিয়ান, ব্রিটিশ, চৈনিক, জাপানি, কোরিয়ান, আফ্রিকান -- কৃষ্ণ, বাদামি, শ্বেত, পীত -- কেহই বাদ পড়েন নাই -- সকলেই হাঁটিয়াছিলেন। এই সম্মিলিত পদচারণার প্রত্যক্ষ বিবরণ লিপিবদ্ধ করিতে প্রবাসী অপারগ। উক্ত দিবসের প্রাক্কালে প্রবাসীর নিকট বঙ্গভূমের একটি অঞ্চলের দুই রাত্রি পূর্বের নরমেধের বিশদ বিবরণ আসিয়াছিল। সে হাঁটে নাই।

    নেমসেক
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ১০.০৫.২০০৭
    বছর তিনেক আগে আমার হাতে নেমসেকের যে কপি এসেছিল তার হাল্কা রঙের মলাটে আড়াআড়ি একটি বৃক্ষশাখা ছিল। বাসাবদলের কালে বইটি হারাই। এখানে বেশ কিছুদিন হল নেমসেক রিলিজ করেছে -- টিকিট কাটার আগে আবার পড়ে নিতে গিয়ে দেখি মলাটের কেন্দ্রে আলম্ব চৌখুপিতে ইরফানের কাঁধে টাবুর নত ললাট। পাশের খোপে বিহ্বল কাল পেন। বাঁদিকের কোণে তাজমহল। সিনেমার বিভিন্ন স্টিলের কোলাজ আর কি। চৌকোনা। লালে-হলদে আর নীলে। গ্লসি। মলাট বদলে গিয়েছে। বেমালুম।

    চ্যাটসউডের একটি মাল্টিপ্লেক্সে ম্যাটিনি শো-তে আমি ছাড়া ভারতীয় আর জনা দুই, দুটি চিনা তরুণী, বাকিরা শ্বেতাঙ্গ। ছবি শুরুর আগে হলের আলো আঁধারিতে চোখ সইয়ে বই-এর পাতা উল্টে যেতে থাকি। আমার ঠিক পরের সারির একাকী প্রৌঢ়া আলাপ জুড়লেন -- কি বই -- ঝুম্পা -- পুলিৎজার -- ইন্টারপ্রেটার অফ ম্যালাডিজ -- কলকাতা -- আমার শহর -- কতদিন দেশছাড়া -- অস্ট্রেলিয়ায় কদ্দিন? আলো নিভে গিয়ে ছবি শুরু হয়ে গেল।

    তুলির টানে বাংলা হরফে পর্দায় লেখা হতে থাকে নেমসেক, নেমসেক। দর্শকদের কথা ভেবে সামান্য অস্বস্তি হয় আমার। অস্বস্তি হয় ইরফানের প্রথম আবির্ভাবেও ঈষৎ ফোলা চোখের কোল, বাংলা উচ্চারণে কেমন একটা টান! অস্বস্তি বেড়েই চলে। পাত্রপক্ষের সামনে আসার আগে টাবু শাড়ি বদলাতে গিয়ে শরীর দেখান অকারণ। মেলাতে পারি না ঠিক।  ... 'And so, obediently but without expectation, she had untangled and rebraided her hair ... patted some cuticura powder from a velvet puff onto her skin ...'  এই কি সেই অসীমা? পাত্রের মেড ইন ইউ এস এ জুতোয় পা গলিয়ে দৃশ্যত নেচে ওঠেন টাবু। উসখুশ করি। এরকম তো কথা ছিল না।  'She saw the size, eight and a half, and the initials U.S.A ... Ashima, unable to resist a sudden and overwhelming urge, stepped into the shoes at her feet. Lingering sweat from the owner's feet mingled with hers, causing her heart to race ... on the left shoe she had noticed that one of the crisscrossing laces had missed a hole, and this oversight set her at ease.'  আরও ধাক্কা খাই এয়ারপোর্টে মালা গলায় নবদম্পতিকে দেখে, আমেরিকার অ্যাপার্টমেন্টে শাড়ি পাজামায় মিলনদৃশ্যে। কুৎসিত লাগে। অসম্ভব মিস করি, অসীমার বাবার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে পেন্টব্রাশ আর সোয়েটার ট্রেনের কামরায় রেখে আসা। ছবিতে নেই ছোট্ট গোগোলের সেমেট্রিতে ফিল্ডট্রিপের প্রসঙ্গও। 'The children begin to scamper between rows of the dead, over leathery leaves, looking for their own names, a handful triumphant when they are able to claim a grave they are related to ... Gogol is old enough to know that there is no Ganguli here. He is old enough to know ... that no stone in this country will bear his name beyond life.'  আমার কাছে ছবিটি নিদারুণ একমাত্রিক হয়ে যেতে থাকে।

    কাল পেন পর্দায় আসেন -- গোগোল হিসেবে অসম্ভব মানায় -- ইরফান, টাবুর বয়স বাড়ে -- এইসময় ওঁরা একদম অশো, অসীমা হয়ে যান। অসীমার সামান্য জড়তা মাখানো ঈষৎ টেনে বলা ইংরেজি, "লিটিল' উচ্চারণ, অশোকের শান্ত চাহনি, ক্লান্ত পদক্ষেপ -- এইবার ছবির সঙ্গে একাত্ম হতে থাকি। বাকি দর্শকদের কাছে ছবি কি বার্তা বহন করছে বুঝতে পারি না। অশোক যখন ক্লান্ত স্বরে গোগোলকে বলে, উই অল কেম আউট অফ গোগোল'স ওভারকোট -- দর্শক হেসে ওঠে। কেন কে জানে? এরকম হাসির হুল্লোড় প্রেক্ষাগৃহে আরও অনেকবার ওঠে -- ম্যাক্সকে ঘিরে অসীমার আড়ষ্টতায় তার অদক্ষ ড্রাইভিং-এ। বলা নিÖপ্রয়োজন, সেই সব মুহূর্তে আমার হাসি পায় না।

    অবশেষে সেই ক্রিসমাস কার্ড লেখার দৃশ্যটি আসে। মীরা নায়ার এখানে বইটি হুবহু অনুসরণ করেন। টেলিফোনে অসীমা যখন অশোকের চলে যাওয়ার খবর পায়, সমস্ত হলে পিনড্রপ সাইলেন্স। শুধু আমার পিছনের সারির প্রৌঢ়া ককিয়ে উঠেই চুপ করে যান।

    এরপর আবার সব কিছু তুমুল তাড়াহুড়োয় মীরা ভরে দিতে থাকেন সিনেমায় ম্যাক্স আর গোগোলের বিচ্ছেদ, গোগোল মৌসুমীর বিয়ে, মৌসুমীর জীবনে অন্য এক পুরুষের আগমন -- সব কিছু অতি দ্রুত ঘটতে থাকে। এইভাবে, একসময় আলো জ্বলে ওঠে। ছবিটি শেষ হয়। প্রৌঢ়া এগিয়ে এসে বলেন -- "ওয়ান্ডারফুল!' আমি বলি, "কেন এত ভাল লাগল আপনার? আমি একাত্ম বোধ করেছি আমার শিকড়ের জন্য। কিন্তু আপনি?' এইবার ডুকরে কেঁদে ওঠেন প্রৌঢ়া -- "আই ক্যান ফিল দ্যাট টু, আই ক্যান ফিল দ্যাট। আয়াম অলসো অ্যান ইমিগ্র্যান্ট।' আমি প্রৌঢ়ার পিঠে হাত রাখি। হলের বাইরে আসি। তখনও বিকেল। তুমুল রোদ। কালো চশমায় চোখ ঢাকি। হাঁটতে থাকি। আমি। সেই একাকী প্রৌঢ়া। চিনা তরুণীদ্বয়।

    'Will you remember this day, Gogol? ...
    ... How long do I have to remember it? ...
    ... Try to remember it always ... Remember that you and I made this journey, that we went together to a place where there was nowhere left to go.'

    সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে পাথরে, একের পর এক। কেপ কডে। অনিবার্য মনে আসে "কোমল গান্ধার'। ভিড়ে মিশে যাই। আমি। আমরা। আমরা সবাই।

    সাগর থেকে ফেরা
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ১৯.০৭.২০০৭
    "কি যেন কি যেন ঠিক
    মন দিয়ে জানতে না জানতে,
    স্টীমার পৌঁছে যায়
    আজ-কাল-পরশুর প্রান্তে।'



    সমুদ্র কি আর টানে না তেমন? আজকাল? নীলচে সবুজ, সবজেটে নীল ঢেউগুলি। গাঙচিল, জল ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক। সিন্ধুসারস। বালি আর কাঁকড়া। শুকনো গুল্ম, ভাঙা ঝিনুক। সানসেট, সানরাইজ, রৌদ্রস্নানে আদুল গাত্র নরনারী। ব্যালকনিতে গোল ছোট টেবিল, অ্যাশট্রে আর ভেজা তোয়ালে। বালিমাখা হাওয়াই চটি। আকাশ মেঘহীন। পাবে আর ফিস অ্যান্ড চিপসে উপচানো ভিড়। হলদে চাঁদ।

    সিডনির ঘরে বাইরে মেঘলা আকাশ। বৃষ্টি। রোদ্দুর চাই। রোদ্দুর। সমুদ্রকেই মনে পড়ে তখন।



    "খুঁজে দেখো, আছে, আছে,
    নির্জনে কি কোনও জনতায় ...'

    কুইন্সল্যান্ডের গোল্ডকোস্ট। হোটেল, মোটেল আর হলিডে অ্যাপার্টমেন্ট -- নো ভেকেন্সি। স্কুল হলিডেতে ভিড় আর ভিড়। প্রায় ষাট কিলোমিটার তটরেখা বরাবর সারফার্স প্যারাডাইস, ব্রডবিচ, পামবিচ, মারমেইডস বিচ ইত্যাদি নির্জন সৈকতসকল। অথচ ভিড় উপচে পড়ে মুভি ওয়ার্ল্ডে, ওয়েট অ্যান্ড ওয়াইল্ড, সি ওয়ার্ল্ডে কিংবা ওয়ন্ডার ওয়ার্ল্ডে। মুভি ওয়ার্ল্ডে ঘুরে বেড়ায় ব্যাটম্যান, বাগসবানি, টুইটি, স্কুবি ডি। অস্টিন পাওয়ার। ক্যাট উওম্যান। লাস্যে ও হলদে স্পোর্টসকারে মেরলিন মনরো। পোলিস অ্যাকাডেমির লাইভ স্টান্ট শো। ভয়াবহ কিছু রোলার কোস্টার। তবে সব ভিড় টেনে নেয়ে সবুজ দত্যিটি, মিষ্টি বিড়াল আর বকবকম গর্দ্ধভ। শ্রেক, পুস ইন দ্য বুটস, ডংকি লাইভ শো, ফোর ডি -- সবেতেই উপচে পড়া ভিড়। প্যারেডে সবাই হাত মেলাতে চায় শুধু এদেরই সঙ্গে। গথাম সিটি হলটি জনহীন। সুপার হিরোর দিন গিয়াছে বুঝি। দেখেশুনে বিশাল বপু এক বন্ধু তার বিরলকেশ ললাটে হাত বুলিয়ে হেসে বলেন, "আমাদেরও আশা আছে তাহলে?' সবুজ লম্বকর্ণ দত্যি অসম্ভব সরল চোখে চেয়ে থাকে।

    হাতের নাগালে জ্যান্ত সমুদ্দুর, অথচ লোকজন হু হু নেমে যাচ্ছে ওয়েট অ্যান্ড ওয়াইল্ডের ওয়েভ পুলে। বিশাল শঙ্কুতে ঘুরপাক খেতে খেতে আছড়ে পড়ছে জলে। ভীষণ প্যাঁচালো টিউব দিয়ে ফ্লাশড অ্যাওয়ে হচ্ছে মহানন্দে। আরও আছে ব্ল্যাক হোল, অ্যাকোয়া রেসার, ম্যামথ ফলস, ক্যালিপসো বিচ, স্পিডকোস্টার -- এইসব।

    সমুদ্র কি বড় একঘেয়ে আজকাল? ঢেউ ভাঙে, ফেনা সরে যায়, ভিজে বালি অপেক্ষায় থাকে। ওদিকে জনতা ভিড় করে সি ওয়ার্ল্ডে সিলের কেরামতি আর ডলফিনের খেলায়। স্কাই সাফারি, ওয়াটার স্কি, কর্কস্ক্রু, রোলার কোস্টার, ভাইকিং রিভেঞ্জ রাইড অথবা স্নরকেলিংয়ে। বিষণ্ন মেরুভল্লুকটি মুখ তোলে না।

    সমুদ্র আর টানে না তেমন? বোট নিয়ে তাই ভেসে পড়া খাঁড়ির জলে? আনাড়ি হতে স্টিয়ারিং। ভরা জোয়ারে নয়, তরি টলমল বিশাল বোটের পাশ কাটাতেই। তবু এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপ। ক্যাম্পিং। পাহাড়ের কাছে যাওয়া। মাউন্ট টাম্বুরিন -- সিনিক ড্রাইভ -- ওয়াইনারি -- মস্ত সবুজ উপত্যকা। রাতের গোল্ডকোস্টে ফূর্তির অঢেল আয়োজন -- ক্যাসিনো, নারী, পানীয়। গভীর রাতে এগিয়ে আসে ফসফরাসের দাগ -- সাদা। একটানা।



    "যত গুমোট মেঘ-সরানো
    হৃদয় জুড়ে রোদ-ছড়ানো
    সেই তো তোমার অগাধ অপার নীল।'

    সমুদ্র আর টানে না তেমন? তবু আটটা পাঁচটা নেই। নেই রাশ আওয়ার ট্রাফিক। ভিজে ঠান্ডা উধাও। নীলকান্তমণি আকাশ। ঝলসানো ত্বক। জুতোয় বালি। পকেটে ঝিনুক। বালিকাটির তুমুল উচ্ছ্বাস। অনেক খুঁজে কেয়াগাছ চিনে নেওয়া। বহুদিন পরে চোখে চোখ রাখার অবসরটুকু। আর বন্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ফুটে থাকা একাকী গন্ধরাজটি। এইটুকুই। হাওয়াবদল।
  • যোষিতা | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৫২741416
  • চুমু চুমু চুমু অসংখ্য চুমু তোকে সোমনাথ।
  • 9 | 77.68.20.217 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৫২741417
  • একটা হাটের গল্প
    আমোদ বোষ্টুমি
    ১৫.১২.২০০৬
    সুইস দেশের উত্তরে খোঁচার মতো যে জায়গাটা ফ্রান্স আর জার্মানির সীমান্তে ব্যস্ততায় জমজমাট, সেই বাজ্‌ল্‌ শহর থেকে মাত্র পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরত্বে - ফ্রান্সের মুলুজ। মেরে কেটে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা।
    বাজ্‌ল্‌-এর রেল স্টেশন থেকে হরদম মুলুজগামী ট্রেন ছাড়ছে; ফ্রান্স আর জার্মানি থেকেও সকাল বিকেল যাতায়াত করছে ডেলি প্যাসেঞ্জারের দল। অফিসের কফিব্রেকে ফুটবল, দামি মোটরগাড়ি, ফ্যাশন, পোলিটিক্স, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ফ্রান্সের ট্রেন ধর্মঘট, থেকে শুরু করে ভিডিও গেম ইস্তক যাবতীয় বিষয় নিয়েই তুমুল আলোচনা তর্ক বিতর্ক চলে। একেকটা বিষয় থেকে শুরু করে আমরা বিষয়ান্তরে চলে যাই, আলোচনা জমে ওঠে। তেমনি একদিন আলোচনার হাত ধরেই কেমন করে যেন ঢুকে পড়লাম মুলুজে। মুলুজেই শুধু নয়, মুলুজ শহরের মধ্যিখানে, একটা হাটে। এই সস্তার হাট বসে হপ্তায় দুদিন। বিষ্যুদবারে হাটটা ছোট করে বসে - একদিকে জামাকাপড় অন্যদিকে শাক-সবজি-ফলমূল। শনিবারেও আবার বসে ওই একই হাট, তবে সেদিন আকারে বিরাট। আসলে আমাদেরই সহকর্মিনী নাদিন, প্রায় জোর করেই শোনাতে শুরু করেছিল এই হাটের গল্প। আমার কফিব্রেকের সঙ্গীরা সবাই ডেলি প্যাসেঞ্জার, প্রতিদিন তারা জার্মানি বা ফ্রান্স থেকে এদিকে আসে, মোটামুটি কাছাকাছিই গ্রামে ও শহরে এদের বাড়ি। আর এদের প্রত্যেকের বাড়ি থেকেই মুলুজ গাড়ি করে বড়জোর আধঘন্টার পথ, কিন্তু শুধু ওই নাদিন ছাড়া আর কেউই সে হাটে কখনও যায়নি অবশ্য।

    নাদিন আমাদের শোনায় সেই হাটের ফল আর সবজির বর্ণনা। ওই হাটে সবজি আর ফলমূল নাকি যেমন সস্তা আর তেমনি টাটকা। শুনে লোভ হয় আমার, বাকিদেরও লোভ হয় হয়তো। কিন্তু তারা আর শুনতে চায় না। হঠাৎ যেন হাটের গল্প থামিয়ে দিতে চায়। একজন বলে ওঠে, ওসব হাটে যাওয়া খুব ঝামেলার, আমি তো কিছুতেই আমার বৌকে নিয়ে যেতে পারব না।
    -কেন? কেন?
    বেশ কয়েকজন জিগ্যেস করে ওঠে একসঙ্গে। তাদের মুখে মৃদু হাসি, যেন খুব মজার কোনও উত্তর খুঁজছে।
    - বৌকে নিয়ে যাব না, কারণ, গাড়ি ছাড়া তো বৌকে নিয়ে বাজার করে ফিরতে পারব না!
    আরেকজন যোগ করে,
    - কেন গাড়ি করে ফিরবে কেন? হেঁটে ফিরবে! হেঁটে!
    এই শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে, যেন খুব হাসির ব্যাপার।
    অমনি আরেকজন বলে ওঠে,
    - ওই হাটে কিন্তু এলজেসিশ (উরড়ন্ডড়ড়ভড়দব) ভাষা চলবে না।
    আরেকজন বলে ওঠে, ফরাসিও চলবে না!
    তবে চলবেটা কী? অ্যাঁ? সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
    তারপরে একজন আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, এলজেসিশ ভাষাটা কী, তা জানো কি?
    জানব না কেন? গড়গড়িয়ে বলে যাই, ফ্রান্সের পূব দিকের ওই অঞ্চলগুলোতো দুই বিশ্বযুদ্ধে বহুবছর ধরে বারবার করে জার্মানির দখলে চলে গেছে, তখন ওইসব অঞ্চলগুলোয় জার্মান ভাষা ছিল বাধ্যতামূলক ও একমাত্র ভাষা, ফরাসি বললে ধড়ে প্রাণ থাকত নাকি? সেই থেকে ওরা ওই বিশেষ জার্মান ডায়লেক্টেই কথা বলে, ওটাই এখন ওদের ভাষা।
    - কিন্তু মুলুজের হাটে ফরাসিও চলে না, এলজেসিশও চলে না!
    এই বলে আবার কয়েকজন ভয়ানক হাসতে থাকে।
    - তাহলে কোন ভাষা চলে সেখানে?
    আবার হোহো করে হাসির ধূম।
    আর ওই হাসির মধ্যেই কফিব্রেক ভেঙে যায়।

    আরেকদিন একলা পেয়ে নাদিনকে শুধো`ই, মুলুজের হাটে কোন ভাষায় বেচাকেনা করে দোকানিরা?
    - কেন? ফরাসিতে।
    - তবে যে সেদিন ওরা বলছিল ফরাসি চলে না ওখানে?
    আমার প্রশ্নে নাদিন কিন্তু একটুও হাসে না, শুধু আমরা দুজনে আলাদা করে সময় নিয়ে চলে যাই কাফেটেরিয়ায়, যে কফিব্রেকে নাদিন আমাকে শোনায় ওই হাটের দোকানিদের গল্প। দোকানিরা মূলত উত্তর আফ্রিকার মানুষ। যদিও আজ তারা ফরাসি দেশেরই নাগরিক। এরা ফরাসিতেই কথা বলে সবাই। ওই যেমন, এক পরিচিত দোকানি নাদিনের, তার মেয়েতো গতবছর পাশ করল সোর্বোন থেকে, সাহিত্যে এম.`এ। সেই মেয়েটিও পারি থেকে ফিরে এসে মাঝে মাঝে সাহায্য করে বাবা আর কাকাকে সবজির ব্যবসায়। চাকরি পেল না ও। আর পাবে কিনা কে জানে। ওর অ্যাপ্লিকেশনের প্রথমেই একটা বিরাট ভুল - ওর নাম। হামিদা। এমন হামিদারা অসংখ্য। এলজেসিশ এরা বলতে পারে না, কারণ এরা ইমিগ্র্যান্ট, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার অনেক পরে পা রেখেছে ফরাসি মাটিতে। এদের ফরাসিতে আরবি শব্দের ছোঁয়া। কেউ এসেছে মরোক্কো, কেউ অ্যালজিরিয়া, কেউ তুনিসিয়া থেকে। এই কিছুদিন আগেই তো রাজধানী পারির শার্ল দ্যগল এয়ারপোর্ট থেকে গুনে গুনে ঠিক একশো জনের চাকরি গেছে। এই একশোজনেরই কারও নাম মুহামেদ, কারও আব্দুকাদির, কারও এল'দ্রিস, ইত্যাদি। এরকম নাম যাদের, তাদের তো ঠিক এয়ারপোর্ট সিকিওরিটির কাজে রাখা যায় না। সন্দেহভাজন হয়তো একজন, কিন্তু সাবধান তো হতে হবে। তার ওপর গতবছর কম গাড়ি জ্বলেছে গোটা ফ্রান্সে? শুনলে না, বাজারের শেষে হেঁটে হেঁটে ফেরার কথা বলছিল ওরা? ওরা ভয় পায়।

    হঠাৎ আমার চোখের সামনে একটা সিনেমার মতো ভেসে ওঠে মুলুজের কেন্দ্রস্থলের ওই হাটটি। শনিবারের সকাল। বিকোচ্ছে টাটকা টম্যাটো, স্যালাদ পাতা, আপেল, প্লাম, আঙুর। রীতিমতো দরকষাকষি চলছে ক্রেতা বিক্রেতায়। কেউ কেউ বেচছে মুর্গির ডিম, আর আরেকটু ওদিকে জামা কাপড়ের বাজারেও রীতিমতো ভিড়। ঝলমলে রোদ আকাশে; আর যদি মেঘলা করে আসে, যদি ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি নামে, সেজন্যেও প্রস্তুত দোকানিরা। কিনে বেচে সকলেই বেশ খুশি, বেশ তৃপ্ত। ভিড়ের মধ্যে নাদিনের সঙ্গে আমিও চলতে থাকি, বেশ মজা লাগে, যেন উৎসব, যেন নিমন্ত্রণ। মানে ফিয়েস্তা, ফেৎ, কিংবা কেফে। "কেফে' - শব্দটা নতুন শিখেছি। ফরাসিতে এমন দু একটা অ্যালজিরিয়ান-আরবি শব্দের ব্যবহার কি খুব দোষের? খুব শিগগিরই আমি যাব ওই উৎসবে। খুশির নিমন্ত্রণে।

    পাতালের পথ এবং হাইডি
    আমোদ বোষ্টুমি
    ১২.০১.২০০৭
    একই রাস্তা। অথচ আমূল ভোল পাল্টায় ঋতু পরিবর্তনে।

    বসন্তে গ্রীষ্মে যে পথের দুধার ফুলে ফুলে রঙিন, যেখানে দুপা চলতে না চলতেই দৌড়তে মন চায়, সবকিছু ভুলে গড়াগড়ি খেতে খেতে ঢালু ঘাসের গালচে বেয়ে অনায়াসে নেমে যেতে ইচ্ছে করে, সেই পথই শীত পড়লে অন্যরকম। একদম।

    যেদিকে দুচোখ যায় সেসব দিক অধিকাংশ সময়ে সাদা তো বটেই তার ওপরে রাতগুলো বড় বেশি দীর্ঘ। আরও বেশি নি:স্তব্ধ - অথচ তার অন্ধকারের ঘনত্ব কেমন যেন ফিকে। তুষারের ওপরে আকাশের আলোর প্রতিফলন অন্ধকারের বারোটা বাজিয়ে দেয়। তবুও রাত্রির দৈর্ঘ্য ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় - ভূগোলের নিয়মে। ঘড়ির কাঁটা ঘন্টাখানেক পিছিয়ে দিয়েও হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে থাকি সকালটাকে।

    ঘড়ির কাঁটা সকাল সাতটা ছুঁলেও চারিদিকে নিশুত রাত।

    সেই রূপকথার গল্পের রাস্তা।

    সমস্তই দেখা যাচ্ছে আবছা আলোয় কিন্তু আকাশে সুজ্যি নেই। গাছগুলো সব নেড়া। পায়ের নীচে তুষার কখনও বালির মতো নরম, কখনও কাদাকাদা, কখনও জমাট বরফের পাথর; মরণ ফাঁদ - পদস্খলন হলে ভোগান্তি আছে। চতুর্দিকে চলাফেরা করছে ছায়ামূর্তিরা। তাদেরকে অনায়াসে এই আঁধারে রাক্ষস খোক্কস বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পাতলপুরীর মতই, তবে একেবারে কার্বন কপি ঠিক নয়। শুধু তুষারটুকু বেমানান।

    আমি প্রতিনিয়ত ট্রেনে উঠি। এই ট্রেন ধরাটা এত বেশি রুটিনমাফিক হয়ে গেছে যে মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি ট্রেন না ধরলে, ট্রেন আমাকে ধরবে ফেলবে - ক্যাঁক্‌ করে - ভূতে ধরার মতো। যদি আমি বালির মতো ঝুরঝুরে বরফের ওপর দিয়ে দৌড়বার ছল করে ভেসে যেতে চাই, ঘাসে গড়াগড়ি খেতে খেতে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে চাই নীচের উপত্যকায় বা কোনও হ্রদে, কি জানি হয়তো সেখানেও গজিয়ে উঠবে সমান্তরাল দুটো ইস্পাতের রেল - হাঁ হাঁ করে তেড়ে আসবে ট্রেন, খপ্‌ করে ধরে ফেলবে আমার টুঁটি, আর টুপ করে গিলে নিয়ে ভরে ফেলবে একটা কামরার মধ্যে। আমি পালাতে পারব না।

    অজগরের পেটের মধ্যে ঢুকে আমি ওভারকোটটা খুলে ঝুলিয়ে দেব জানলার পাশের হুকে। সিটটাকে অল্প এগিয়ে পিছিয়ে নেব সুবিধেমতো বোতাম টিপে টিপে আর চেষ্টা করব কাচে ঢাকা জানলার দিকে না তাকাতে। শুধু শীতকালে।

    বসন্ত গ্রীষ্ম শরৎ যত খুশি দেখতে পারি আমি জানলার বাইরে। তখন অজগর মর্তের ওপর দিয়ে যায়। শুধু শীতে সে যায় পাতালের পথ দিয়ে। আর তখনই আমার ভয় করে।

    ভয়টা অমূলক নয়। শীতের রাস্তায় রেলপথে আমি অজগরের পেটের ভেতরে বসে দুরন্ত বেগে পার হয়ে চলেছি নদী গ্রাম শহর পাহাড় উপত্যকা হঠাৎ জানলার কাচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম - হাইডিকে।

    হাইডি, যাকে নিয়ে গল্প। যাকে নিয়ে সিনেমা, কার্টুন, অ্যানিমেশন। সেই হাইডিই কি? ঊনবিংশ শতকের গ্রাম্য মেয়ে। সুইস দেশের গ্রাব্‌ভিন্‌ডেন্‌ অঞ্চলের বালিকা। অনাথ। একবার অবশ্য সে গেছল বিরাট এক গমগমে শহরে, ফ্রাঙ্কফুর্টে। সেখানে ক্লারা বলে আরেকটা মেয়ে ছিল, যে হাঁটতে পারে না। তারপরে কী কী হয়েছিলো সেসব গল্প প্রায় সবাই জানে।

    একবার জুরিখ এয়ারপোর্টের এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যাচ্ছি, একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে রেলপথে। হ`ঠাৎ জানলার পাশে হাইডিকে দেখা গেল, তার মাথায় বেড়া বিনুনি করা। চুপচাপ আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে জানলার কাচে চুমু খেয়ে গেল হাইডি। তারপরেই গরুর গলায় বাঁধা ঘন্টার ঢং ঢং শব্দ। চমকে গেছলাম আমরা সবাই। উ: দারুণ তো! টেকনোলজির কি অপূর্ব ব্যবহার। চাপা প্রশংসার গুনগুনানিতে ভরে গেছল সুড়ঙ্গ।

    শীতের রেলপথে আমার ঠিক পাশেই কাচের ওপারে যে হাইডি -তার বয়েস এখন অনেক।

    একটু খুঁটিয়ে দেখলে তার পাক ধরা রূপোলি চুল, মুখের বলিরেখা সব নজরে আসবে। মহানগরের কলকারখানার ধোঁয়ার গন্ধ তার পোশাকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই হাইডি অন্ধকার পাতালের ভেতর জানলার কাচের পাশে পাশে আমার সঙ্গে সবখানে যায়, কটমট করে বারবার তাকায় আমার চোখের ভেতরে। তাই আমি ওদিকে দেখি না। শুধু চুপ করে অপেক্ষা করি আলো ফোটার। আলো ফুটতে না ফুটতেই অজগর উঠে আসে মর্তে। জানলার পাশের হাইডি নিমেষে মিলিয়ে যায়।

    আমিও তৃপ্তির সঙ্গে দেখতে থাকি বাইরের দৃশ্যাবলী। প্রতিনিয়ত।

    পুরোনো চিঠি
    আমোদ বোষ্টুমি
    ১৫.২.২০০৭
    তাশখন্দ, ১লা অক্টোবর ১৯৮৫

    মা,

    তুমি, তোমরা সবাই কেমন আছো? গত সপ্তাহে এদেশে এসে পৌঁছনো সত্ত্বেও চিঠি লেখা হয়নি, জানি তুমি ভীষণ চিন্তা করেছো, ভেবেছো মেয়েটা তোমার হারিয়েই গেল কোথায়, কিন্তু কী করব বলো? লিখিনি নানা কারণে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো কারণ হচ্ছে আমার ঠিকানা; নিজের কোনো ঠিকানাই ছিলো না আমার এই কদিন। একে তো এদের ভাষা জানিনা, আর এরাও না বোঝে ইংরিজি না বোঝে হিন্দি বা বাংলা। মস্কোতে এসে পৌঁছনোর পর তিনদিন রইলাম ইউনিভার্সিটি হোটেলে; সেখান থেকেই একদিন এরা বলে দিল যে আমায় যেতে হবে মধ্য এশিয়ার তাশখন্দে। এয়ারপোর্টে যেই তোমাদের ছেড়ে আলাদা হলাম, তখন থেকেই এক ঝটকায় সাবালিকা বনে গেছি মনেপ্রাণে, তাই হাজার হাজার মাইল উড়ে যেতে কোনো ভয় হয়নি, তুমি বিশ্বাস করো। জানো,এরা তাশখন্দকে বলে তাশকেন্ত, যে শহরে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মারা গিয়েছিলেন।

    মস্কোয় আমাদের ইউনিভার্সিটি হোটেলে থাকতে দিয়েছিল, আমার ঘরের জানলা থেকেই দেখতে পেতাম মস্কো স্টেট ইউনিভর্সিটি, আর ওই জায়গাটার নামই ইন্দিরা গান্ধির নামে। ইন্দিরা গান্ধি স্কোয়ার, পাশেই জওহর লাল নেহেরু স্কোয়ার। মস্কোয় হোটেলের পাশেই ছিল একটা ক্যান্টিন, রাশিয়ান ভাষায় এরা বলে "স্তালোভাইয়া', সেখানে পাসপোর্ট দেখালে বিনি পয়সায় খাবার দিত। যত খুশি খাবার নিতে পারতাম, কিন্তু আমাদের ঝোল ভাত খাওয়া জিভে ওসব খাবার একদম রোচে না। একটা চপের মতো দেখতে খাবার দিয়েছিল, কামড় দিয়ে দেখি ভেতরে পুর দিয়েছে ভাতের, আর কীরকম টক টক খেতে। টকে যাওয়া ভাত নয় কিন্তু। কিংবা শরবৎ খেতে গিয়ে দেখি তা প্রায় ফুটন্ত। নানান রকমের ফল সেদ্ধ করে বানিয়ে দিয়েছে। না হয়েছে অম্বল, না হয়েছে শরবৎ। এরা একে বলে "কামপোৎ'। প্রতিবারে নতুন কোনো খাবারে মুখে দেবার আগে একটু ভয়ে ভয়েই থাকি। এদেশের খাবার দাবারের সঙ্গে, টেস্ট ডেভেলপ করার বেশ যোগ আছে সে বুঝতে পারছি। চিন্তা কোরো না, সঙ্গে আনা বিস্কুটের বাক্স প্রায় খালি করেই ফেলেছি। গতকাল থেকে বাসনকোসন কিনে, নিজেই রাঁধছি সেদ্ধভাত, আলুভাজা এইসব। শনি রবিবারে আমিষ রাঁধতে শুরু করব।

    এই দেখো, খাওয়া নিয়েই একগাদা লিখে চলেছি। কেমন করে ইউরোপ থেকে মধ্য এশিয়ায় এসে পৌঁছলাম জানো? ট্রেনে। তিনরাত আর তিনদিন ধরে ট্রেন চলল মস্কো থেকে তাশখন্দ। উরাল পর্ব্বত পেছনে ফেলে কাজাখস্তানের এশীয় ভুখণ্ডে পৌঁছলাম। তখন অবশ্য রাত্রি ছিল। তাই উরাল দেখা হয়নি ভালো করে, অন্ধকারে সব ঝাপসা ছিল। কি সুন্দর আর পরিষ্কার যে এদের ট্রেনগুলো, কী বলব তোমায়। রাজধানী এক্সপ্রেসকেও হার মানিয়ে দেবে। একদিকে কম্পার্টমেন্টগুলো, আর একপাশে লম্বা করিডোর। সব জানলায় পরিষ্কার পর্দা দেওয়া, করিডোরে মাঝে মাঝেই বসবার জায়গা আছে। প্রায় মরুভূমির মতো জায়গা দিয়ে ট্রেন চলল। কখনো কখনো থামত কোনো স্টেশনে, সেসব জায়গায় লোকজন প্রায় নেই বললেই হয়, শুধু স্টেশনের একপাশে কোনো টুপিপরা বুড়ো হয়ত বেচছে তরমুজ। ইচ্ছে করত ট্রেন থেকে নেমে কিনে আনি একফালি, কিন্তু নামতাম না ভয়ে, যদি ট্রেন ছেড়ে দেয়? আর একদিন দেখলাম দলবাঁধা উটের সারি। একদম ট্রেন লাইনের কাছ দিয়ে যাচ্চিল; কি অদ্ভুত গো, উটগুলোর সব দুটো করে কুঁজ। ট্রেনেই আলাপ হয়েছিলো এক উজবেক বুড়োর সঙ্গে। সে না বোঝে আমার ভাষা, না বুঝি আমি ওর কথা। তবু ইশারায় ইঙ্গিতে হাত পা মাথা সব নেড়ে চেড়ে আমরা অনেক কিছু বলেই চলেছি। সেই বুড়োর কাছেই শিখলাম একটা নতুন রাশিয়ান শব্দ, "ভেরব্লুদ'! উটকে এদের ভাষায় ওরকমই বলে। তারপরে হঠাৎ দেখি দূরে নীল জল, ঠিক যেন সমুদ্র, আমি ভাবছি এই জায়গায় সমুদ্র এলো কোত্থেকে, মরুভূমিতে মরীচিকা দেখছি না তো? তারপরে জানলাম, ওটা একটা বিরাট লেক, নাম আরাল। আরালের পাশ দিয়ে বহুক্ষণ চলেছিল ট্রেন, তার ওকুল দেখাই যাচ্ছিল না। আরেকটা দারুণ জিনিস জানলাম জানো? ইন্ডিয়াকে এরা খুব ভালোবাসে, এরা বলে "হিন্দিস্তান' (হিন্দুস্থান নয় কিন্তু!), আর ভীষণ হিন্দি সিনেমা ভালোবাসে। ট্রেনের ওই বুড়ো তো গুন্‌গুন্‌ করে "মেরা জুতা হ্যায় জাপানী...' গাইছিল।

    ট্রেনে উঠবার আগে, আমাদের প্রত্যেককে হাতে নয় রুব্‌ল্‌ করে ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রতিদিন তিন রুব্‌লের হিসেবে। একটা রেটুরেন্ট কার ছিল বটে ট্রেনে, কিন্তু আমি ওই নয় রুব্‌ল্‌ খরচ করিনি, তোমার দেওয়া নাড়ু আর মস্কো থেকে আনা ফল দিয়েই ওই তিনদিন চালিয়ে দিয়েছি। আমরা মোট বারোজন ছাত্রছাত্রী এসেছিলাম ওই ট্রেনে। আমাদের মধ্যে চারজন আরব, তাদের মধ্যে কেউ ইরাক, কেউ সিরিয়া, কেউ ইয়েমেন থেকে; জিম্বাবুয়ে আর ইথিওপিয়ার কয়েকজন ছেলে, আমরা তিনজন ভারতীয়, তবে আমি একাই মেয়ে। তাশখন্দে ট্রেন থেকে নেমেই আমার কোলাপুরি চটিটা পটাশ্‌ করে ছিঁড়ে গেল। আমাদের নেবার জন্যে বাস এসেছিল। বাসে করে আমরা ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। হোস্টেল, ঘর, বিছানা-বালিশ, সব পেয়েছি। দিনের বেলা খুব গরম এখানে, আর রাত হলেই কি ভীষন ঠান্ডা গো! তাশকেন্ত হচ্ছে মরূদ্যান, তবে জলের কিন্তু কোনো অভাব নেই আমাদের। গতকাল সন্ধেবেলা একটা দোকানে ঢুকতে গেছি, এদিকে তখন দোকান বন্ধ হবার সময় হয়ে এসেছে। আমাদের সঙ্গে ছিল এক সিনিয়র ছাত্র, সেও ভারতীয়, এখন ভাষা বোঝার সমস্যা তো, তাই সিনিয়রেরা খুব সাহায্য করছে। দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে আমরা আমতা আমতা করে ভাবছি অনুরোধ করব যাতে আমাদের তাড়াতাড়ি কিছু কিনে নিতে দেয়; অমনি কী হলো জানো? আমি তো শাড়ি পরে ছিলাম, তাই দেখে ওরা বুঝেছে যে আমরা ভারতীয়, দুহাত বাড়িয়ে আমাদের ডেকে নিল দোকানে, তারপরে কি খাতির, কি যত্ন। সিনিয়র ছাত্রটিকে তো গড়গড় করে অনেক কিছু বলে গেল সেই দোকানের বিক্রেতা। আমরা তো বুঝিনি, কী বলছে, দোকান থেকে বেরোবার পরে জানলাম, সেই দোকানদার বলছিল, "এসো এসো, যতক্ষণ চাও পছন্দ করে কেনো কি কিনবে, আমাদের বন্ধুদের জন্যে এ দোকান খোলা আছে।'

    কাজেই তুমি চিন্তা কোরো না একদম আমার জন্যে। বিদেশ হলেও, এখানে খুব ভালো থাকব, খুব সম্মানের সঙ্গে থাকব সেটা বুঝতে পারছি। আজ থেকে ক্লাস শুরু হয়েছে আমাদের। আমার ঠিকানা টুকে রেখে দিও ভালো করে। একদম চিন্তা করবে না। একদম না।
    ইতি
    তোমার মেয়ে।

    পুনশ্চ:- এ চিঠি পৌঁছতে কতদিন লাগবে তাতো জানি না; শুধু মনে রেখো, যেখানে আছি, নিরাপদে আছি।
  • ওমনাথ | 43.251.171.105 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৫৭741418
  • এ সকল পোস্টদাতা আমি নই। চুমুগুলো রিডাইরেক্ট করে দিলাম আসল প্রাপকের দিকে।
  • 10 | 185.220.101.4 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৫৯741419
  • মধ্যশীতের মাধুকরী
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ১৮.০১.২০০৭
    ঘোর শীতের দিনে ভ্রমণে বেরুতে হল, ঠিক মুক্ত ভ্রমণ নয়, মাধুকরীতে বেরুতে হল বলাই ভালো। ঘটনাচক্রে কয়েক ঘন্টার জন্য থাকতে হল উত্তরের একটি শহরে। মধ্য জানুয়ারির ভোর, অতি প্রত্যূষ। তখনও সূর্যোদয়ের দেরি আছে। বাইরে তুষার ঝরছে তখন। কাচের দেয়ালঘেরা ঝকঝকে বাড়ি হাওয়াই আড্ডায়। ঘরের মধ্যে সেই কাচের দেয়ালের পাশেই বাইরের দিকে চেয়ে বসে ছিলাম। বিদ্যুতবাতিগুলির উজল আলোর পাশে পাশে দেখা যাচ্ছিল তুষারের নেমে আসা। আকাশ থেকে নি:শব্দ শ্বেতপুষ্পবর্ষণ বা যেন দ্যুলোকের লাজাঞ্জলি। লঘুদেহিনী নৃত্যপরা অপ্সরাদের মতন নেমে আসছে তুষারকণারা, এত হাল্কা যে অল্প বাতাসেই উড়ে উড়ে যাচ্ছে ডাইনে বাঁয়ে, সামনে পিছে, জ্বলে জ্বলে উঠছে, ঝিকমিকিয়ে উঠছে ত্রসরেণুর মতন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাগুলি কাচের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, জমা হচ্ছে কোণায় কোণায়। ছয় পাপড়ি ফুলের মতন গঠন তাদের, অতুলনীয় নক্সা সেই পাপড়িতে। সেই সুগঠন তুষারকণার অপরিসীম বৈচিত্র, বর্ণনার অতীত। প্রত্যেকটি কণা দেখতে আলাদা, অথচ সেই হেক্সাগোনাল শেপটি কিন্তু একই।

    যে শহরটিতে থাকি, সেখানে কখনও বরফ পড়তে দেখিনি এভাবে, কোনও কোনও শীতল ভোরে শুধু দেখেছি ফ্রস্ট পড়ে আছে ঘাসে ঘাসে। জল, আমাদের প্রাচীন পূর্বজ-পূর্বজারা যাকে বলতেন অপ্‌, তার কত ভিন্ন ভিন্ন রূপ, কি অপরূপ প্রকাশ! মহা বারিধির ওই সুনীল বিস্তারে, মেঘে মেঘে রঙে রঙে রঙীন হয়ে, ইন্দ্রধনুর বর্ণসুষমায়, বৃষ্টিধারায়, শিলাবৃষ্টির বরফখণ্ডে, নৃত্যপর তুষাপপুষ্পবর্ষণে.... দেখলাম মাটি ঢেকে গেছে ঝুরো বরফে, সাদা তুলোর আস্তরণের মতন পড়ে আছে চরাচর ঢেকে। এ শহুরে বরফে ওই মহা ধ্যানগম্ভীর তুষারচূড়াসমূহের তুহিনশুভ্র সৌন্দর্য্য বোঝা অসম্ভব। তবু চোখ বন্ধ করতেই ফুটে ওঠে পাইন ফার বার্চ ওক জুনিপারের সীমাহীন অরণ্য শীতস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তপস্বীর মতন আর সেই ধ্যানলীন অরণ্যের তপোভঙ্গ করতে নৃত্যপরা অপ্সরাদের মতন নেমে আসছে তুষারধারা---নামতে নামতে নিজেরাই তপোস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে, মাটি ঢেকে যাচ্ছে সাদা কঠিন বরফে। ওই দূরে নীল আকাশপটে অচল অটল প্রাচীন বৃদ্ধ প্রপিতামহের মতন এক সুগঠন পর্বতচূড়া সুস্নিগ্ধ হাসিমুখে চেয়ে আছে, নবোদিত সূর্যকিরণ করুণার মতন ছলছল করছে সেই চূড়ার তুষারমুকুটে। পৃথিবীটা কি আশ্চর্য সুন্দর! কি বিরাট এর ব্যপ্তি! কি গভীর এর মায়া, কি অপরিসীম এর করুণাময় হৃদয়!

    স্মৃতিতে দগদগে হয়ে থাকা ধুলো জটলা কাদা ইঁটপাথর চিৎকার চেঁচামেচি গর্ত হোঁচট ---সব ছাপিয়ে জেগে ওঠে করুণাময়ী দুটি চোখ, কালচিহ্নবিহীন দুটি স্নেহটলটল চোখ, সব ধূলিমাটিঝঞ্ঝাট পেরিয়ে পেরিয়ে চিরঞ্জীব স্নেহসুধা, ধ্রুবতারকার জ্যোতি। মাধুকরী সার্থক হয়ে ওঠে। লেবুগন্ধী ঘাসগুলোর মধ্যে মুখ নামিয়ে দিই, স্বপ্নস্মৃতির মতন ফিরে আসে ফেলে আসা বালুবেলা, সুখ দু:খের আলোছায়া। অনেক অনপনীয় বেদনা, অনেক রক্তমুখ ক্ষত ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকে অবিরল কৃপাবর্ষণে, মনে হয় অতি দীর্ঘ এক রাত্রি বুঝি বা এবারে প্রভাত হবে। এমন করুণাও কি আছে কোথাও যা পুড়ে যাওয়া ডানাও নতুন করে গজিয়ে দিতে পারে?

    "Little fly
    Thy summer's play
    My thoughtless hand has
    Brushed away ... '

    কার অন্যমনস্ক হস্ততাড়না ঘষে দেয় এই ক্ষুদ্র কোমল ডানাগুলি, সে কি বুঝতেও পারে? হয়তো পারে, হয়তো না। ছিন্ন ডানা নতুন করে গজিয়ে দেবার মতন কৃপাবর্ষণ কি এই পাথুরে দুনিয়ায় থাকতে পারে? মধ্যশীতের করুণা বর্ষণ নামে জীবন জুড়ে,সব ক্ষতি ও ক্ষত মিলিয়ে যায়। কি বিপুল তরঙ্গ! খরনদীর জলে চন্দনসাজের মতন ধুয়ে যায় তুচ্ছ অহংকার ও অভিমান। ভীরু ও পলাতক এই আমিও তবে একমুঠো বালি হয়তো একদিন দিতে পারব সেতুবন্ধে। নিরভিমান ভিক্ষু আমার, এবারে তোমার বীণার মতন বাজাও এ সদ্য জলে ধোয়া হৃদয়।

    উপসমুদ্রের বসন্তোৎসব
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ০৮.০৩.২০০৭
    এইসময়টা শীত আর বসন্তের একটা মধুর লড়াইয়ের সময়। কোনও কোনওদিন হু হু করে হাড়কাঁপানো হাওয়া নিয়ে আসে কড়া শীত, আবার পরদিনই হয়তো দক্ষিণের কুসুম কুসুম গরম হাওয়া এসে শীতভাব এক্কেবারে কমিয়ে দিল! পর্ণমোচী বন এখনও ন্যাড়া, গাছেদের কঙ্কালসার পাতাহীন চেহারা সেখানে, কিন্তু কোথাও কোথাও পাতার কুঁড়ি ধরতে আরম্ভ করেছে, আর কয়েক সপ্তাহ পরেই এইসব গাছেদের চেহারা একদম বদলে যাবে। কচি হাল্কা সবুজ পাতায় সেজে উঠবে বন-বনান্ত। বসন্তের আগমনের ইঙ্গিত নিয়ে এসে গেছে হাল্কা গোলাপির আভা লাগা সাদা একরকম ফুল, পাতাহীন গাছ জুড়ে ভর্তি হয়ে ফুটেছে। এইরকম একটা শীত যাই যাই দিনের ঝলমলে রোদের সকালে আমরা রওনা হলাম মারডি গ্রা প্যারেড দেখতে। মার্ডি গ্রা এখানের এক জনপ্রিয় উৎসব, বসন্তের প্রথম কার্নিভাল। তারপরে তো সামার জুড়ে চলবে আরও অনেক উৎসব। সকালের যাত্রা আরামদায়ক, বিশাল আন্ত:রাজ্য মহাসড়কের দুপাশে শুধু সবুজ পাইন গাছ, তরুণ ও বয়স্ক গাছেরা পথের দুধারে লাইন করে সার বেঁধে, মাঝে মাঝে দেখা যায় এক একটা ম্যাগনোলিয়া, ওদের চকচকে পাতায় রোদ্দুর ঝকঝক করে রূপার মতন। এত রোদ্দুরে কেমন নেশা লেগে যায়, উজ্জ্বল দেবসুরার মতন পত্রপুটে ভরে ছাপিয়ে পড়ছে চরাচরে। এইরকম রোদ্দুরের কথা ভেবেই হয়তো রক্তকরবীর বিশুপাগল ভাবত যে রোদের সোনা মেলছে মায়া, বনের সবুজ মেলছে মায়া, তারা নেশা ধরিয়েছে, বলছে ছুটি ছুটি।

    আমার রবিবারের স্মৃতির সঙ্গে কেন জানি জড়িয়ে গেছে সবুজ একখানা দরজা আর তার পাল্লার উপরে বাঁকা হয়ে পড়া একটা সোনালি রৌদ্ররেখা, জানি না কেন। অথচ আজও কোনও ছুটির দিনে ঘরের বার হয়ে বেড়াতে বেড়াতে কোথাও চলতে থাকলেই সেই সবুজ রঙের রবিবার ফিরে আসে স্মৃতির দরজা খুলে। ঘন্টাদুই চলার পরে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়ে নেমে পড়া। গাড়ির ভেতরের নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় বোঝা যায়নি, বাইরে বেশ ঠান্ডা আর ভালোই উত্তুরে হাওয়া। সবাই মাফলার সোয়েটার জড়িয়ে মড়িয়ে প্রথমে রেস্তরাঁর দিকে যাওয়া। প্যারেড শুরু হতে দেরি আছে, এদিকে সবায়ের লাঞ্চ দরকার। পথে যেতে যেতেই একটা ছোট্ট দলের সঙ্গে দেখা, বড়রা বাচ্চারা মিলিয়ে সাত-আটজন। লম্বা লম্বা লাঠির আগায় নীললালসবুজ পুঁতির মালা নিয়ে পথের পাশের গাছের ডালে ডালে,ল্যাম্পপোস্টে টাঙাচ্ছেন। সকলের গলায় নানা রঙ ও আকারের পুঁতির মালার বোঝা, ওনারা আমাদের প্রত্যেকের গলায় দশবারওটা করে পুঁতিমালা পরিয়ে দিলেন, এই মার্ডিগ্রায়ের আসল ব্যাপার নাকি বিডস! ওদের সঙ্গে অনেক ছবিটবি তুলে আমরা শাটলবাসের মোড়ে এসে দাঁড়ালাম সবুজ ছাতার নীচে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাস চলে এল, এই বাস শহরের বিনামূল্যের পরিষেবা, ভারী ভালো লাগে এসব দেখলে। থাই রেস্তরাঁ ম্যাপে দেখানো ছিল, কিন্তু দেখা গেল সপ্তাহান্তে সেটি বন্ধ থাকে, সেখান থেকে ফিরে অন্য একটি কেজানে ফুডের রেস্তরাঁয় যাওয়া হল, অ্যালিগেটার সসেজ দিয়ে পোবয় স্যান্ডউইচ, জাম্বালায়া, গাম্বো উইথ রাইস-এসব চেনা অচেনা খাবার খেয়ে ক্ষুধাশান্তি ও মনের আনন্দবৃদ্ধি করে আমরা গিয়ে মিউজিয়ামের মোড়ে জায়গা খুঁজে দাঁড়ালাম। পথের যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই প্যারেডের জন্য, রাস্তার দুপাশ লোকে লোকারণ্য, তবে ভিড়ের মধ্যে গন্ডগোল যাতে না হয় তারজন্য একটু পর পর পুলিশের মোটর চলছে, আজ ওরাও নানা মজা করছে, অদ্ভুত শব্দে ভেঁপুর মতন কি বাজাচ্ছে, পুলিশের পোশাকের সঙ্গে আটকেছে পুঁতির মালা, গাড়ির জানালায় ঝুলিয়েছে পুঁতিমালা, গাড়ির হুডের উপরে চাপিয়েছে রঙচঙে মার্ডিগ্রা টুপি।

    দুপুর দুটোতে শুরু হল প্যারেড! সে এক সাংঘাতিক কান্ড! পথের দুধারে লোকে লোকারণ্য, পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিরা সব উন্মত্তের মতন নৃত্য করছেন গলায় পুঁতিমালার বোঝা নিয়ে, বাচ্চাদের তো কথাই নেই। দেশের নানা অংশ থেকে লোক এসেছে এই উৎসব দেখতে, এখানে এখন বেশ কদিন ধরেই এরকম চলবে প্যারেড, শেষ হবে সেই অ্যাশ ওয়েডনেসডের আগেরদিন। সেটাই হল ফ্যাট টুইসডে, সেদিনের মতন হুল্লোড় করে নিয়ে চল্লিশদিনের সংযমে চলে যাবেন ভক্ত খ্রিস্টানেরা, যা কিনা শেষ হবে ইস্টারে। এই মার্ডিগ্রা শুরুই নাকি হয়েছিল পারিবারিক আনন্দ উৎসব থেকে, ক্রমে বহু লোকের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। নিউ অর্লিয়াঁতে নাকি সেই মার্ডিগ্রায়ের মঙ্গলবারে লোকে সত্যি সত্যিই উন্মাদের মতন আচরণ করে, সভ্যতার সব শেকলবাকল ছিঁড়ে ফেলে মানুষ নাকি মেতে ওঠে মুক্তি আস্বাদনে। এখানে অতটা না, তবুও তার একটা আভাস পাওয়া যায়। পথের দুধারে উদ্বেল জনতা, কমলা হলদে দড়ি দিয়ে সীমানার মতন করেছে রাস্তার দুধারে, যাতে লোকে পথে গিয়ে না পড়ে। প্রথমে জরিলেসচুমকি পোশাকে রানি সেজে ঘোড়ার গাড়িতে এক তরুণী, কোলে পুঁতিমালার বোঝা, ছুঁড়ে দিচ্ছেন পথের দুধারে, ঝকঝকে রোদ্দুরে ঝলমল করে ছড়িয়ে পড়ছে সেসব দর্শকের হাত, মাথায়। একদল ঘোড়সওয়ার এরপরে, সুন্দর সাদা, বাদামি কালো ঘোড়ারা চামরের মতন লেজ দুলিয়ে দুলকি চালে, ওদের পিঠে সৈনিকের বেশধারী পুরুষ ও মহিলারা। এই ঘোড়সওয়ার বাহিনিও পুঁতিমালা প্লাস্টিকের ফুল চকোলেট এইসব হরিলুটের বাতাসার মতন ছুঁড়ে গেলেন হাসিমুখে। তারপরে এল ব্যান্ডপার্টি, স্থানীয় হাইস্কুলের, ইয়া বড়ো বড়ো সোনালি রঙের ধাতব ভেঁপু বাজাতে বাজাতে ওরা চলে যাবার পরেই এলো কার্নিভালের গাড়ি, সামনেটায় বিরাট এক সবুজ মুখ, গডজিলা। এই গাড়ির উপরে অনেক লোক, সকলের মুখে মুখোশ, গায়ে নানারঙের কার্নিভাল পোশাক, ওরা মালা, টেডি বেয়ার জাতীয় সফট টয়,লজেন্সের বোঝা এইসব হরিলুট দিয়ে গেল। রাঙতামোড়া লজেন্সের যখন বরষণ হচ্ছিল তখন ছোটবড় সকলেই লাফাচ্ছিল আর ক্লিক ক্লিক করে ডিজিটাল অডিজিটাল ক্যামেরা ছবি তুলছিল, হঠাৎ দেখি পাশের ভদ্রলোকের উত্তোলিত হাতে এসে পড়েছে অর্ধেক ফুরানো এক বিশাল প্লাস্টিকের প্যাকেট যার মধ্যে প্রায় শদুই লজেন্স। হাসির হররা পড়ে গেল, এবারে ইনিই লজেন্সের হরির্লুট দিতে শুরু করলেন। তো, এইরকম আরও অনেক কার্নিভাল গাড়ি গেলো,ব্যান্ডপার্টিও অনেক গেলো,মাঝে মাঝে গেলো পুঁতিমালায় ছয়লাপ দুচাট্টি পুলিশমোটর। তিনটেয় শেষ হল প্যারেড, আস্তে আস্তে এবার দর্শকেরা ফিরতিপথে, কেউ কেউ রাতের প্যারেডের জন্য থেকে যাবেন, কেউ কেউ এখানে হোটেলে আছেন প্রায় হপ্তাখানেক, প্রতিদিন প্যারেড দেখছেন।

    মেক্সিকো উপসাগর এখানে প্রসারিত আঙুলের মতন ঢুকে গেছে স্থলভূমির ভেতরে ভেতরে। তার উপরে এক স্থলখণ্ড থেকে আরেকে ব্রিজ বানিয়েছে এরা, নীচে টলটল করে উপসমুদ্রের নীল জল, মাঝে মাঝে সাদা ফেনার মুকুটমাথায় ঢেউয়েরা, সমুদ্রপাখির ঝাঁক দেখা যায় কোথাও কোথাও। এইরকম একটি দীর্ঘ ব্রিজ দিয়ে পুবের দিকে যেতে যেতে নীচে ওই টলটলে তরলরাত্রির দিকে চেয়ে মন নামহীন আনন্দে আর আকাঙ্খায় আন্দোলিত হয়, কোথায় যেন আগে দেখেছি এমন, কোথায় যেন এমন এক আশ্চর্য ভালোলাগায় মন দুলে উঠেছিল! কিন্তু কোথায়? হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতন মনে পড়ে, পুরী! মনে পড়ে সেই রেলস্টেশন থেকে রিকশা করে যেতে যেতে হঠাৎ এক বাঁকের মুখে এসে স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া, সমুদ্রের সঙ্গে প্রথম চোখাচোখি! ওই পারাপারহীন তরল রাত্রি দুলছে সমস্ত দিগন্ত জুড়ে, সর্ব অস্তিত্ব আচ্ছন্ন হয়ে যায় সেই অনুভূতিতে। এ কি কোটি কোটি বছর আগের সেই টান, আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোনে কোনও না কোনওভাবে যার চিহ্ন রয়ে গেছে? ব্রিজ একসময় শেষ হল, আমরা একটা গোল মতন বাজার চত্বরে এসে থামলাম। পরপর সব জামাকাপড় খাবার্দাবারের দোকান। কফিশপে ঢুকে হাল্কা স্ন্যাকস খেয়ে নেবার পরে এবারে ফিরতিপথে। তখন অন্ধকার হয়ে আসছে, জ্বলে জ্বলে উঠছে বিদ্যুৎবাতিসব, শহরটিকে মণিখণ্ডের মতন লাগছে সেই আলোয়। একসময় শহর পিছে রয়ে যায়, পূর্ণ স্মৃতিসুধাপাত্র বহন করে ফিরে চলতে থাকি আমরা।

    বসন্তযাপন
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ২৬.০৪.২০০৭
    সূর্য এখন সরে এসেছে অনেক উত্তরে, হয়তো কোনও দূর কাননের কুন্দকলি করুণ চোখে শেষ চাওয়া চেয়ে নিয়ে ঝরে গেছে ধূলায়। শীত বিদায় নিয়েছে পুরোপুরি। কিশলয়বর্ণ জয়পতাকায় দিকদিগন্ত আচ্ছন্ন করে এসে পড়েছে ঋতুরাজ বসন্ত। আমাদের রুটিন-নেটওয়ার্ক-ডেডলাইন-দূরভাষ-বাড়ি-আপিস দিয়ে আঁট করে বাঁধা জীবনে কিন্তু বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। হরেক রকম ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি আর কম্পুটারে ঠাসা সব ঘর। গভীর রাতে সব বড় বড় আলো যখন নিভে যায়, তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সবুজ আলো জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে। অন্ধকার ঘরে ভারী অদ্ভুত লাগে, আমার এক বন্ধু এদের ইলেকট্রনিক ফায়ারফ্লাই বলে। বৈদ্যুতিন জোনাকি। জ্বলে জ্বলে উঠে সবুজ আলো ছড়ায়। চুপ করে শুয়ে থাকি রাত্রির ঘুমের জন্য, ঘুমের জলে ডুবে যাবার আগে বহুদূরে ফেলে আসা ঘরবাড়ি মাঠ বাগান ঝোপঝাড় সব মনে পড়ে, সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি জ্বলত সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে গভীর রাত্রি পর্যন্ত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উড়ন্ত লালচে-হলুদ আলো। মনে হত আহা ওরা কেন সবাই একরঙের আলো দেয়? কেন কেউ নীল আলো কেউ সবুজ আলো কেউ বেগুনি আলো দেয় না? এই সবুজ আলো দেয়া বৈদ্যুতিজোনাকিরা জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে, আমায় ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

    মাঠবনবাগান এখন সবুজে সবুজ, ফুলে ফুলে ছয়লাপ চারিদিক। ঘাসফুলেদের বেগুনিহলদে পেরিয়ে গোলাপি আজেলিয়ার ঝাড়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়েছে সোনালি রোদ। আজেলিয়ার ফুল গোলাপি, কমলা, লাল, সাদা-নানা রঙের হয়। আমার দোপাটির কথা মনে পড়ে। দক্ষিণের জোরালো হাওয়ায় আজেলিয়া ঝোপেরা এলোমেলো হয়ে হাসতে থাকে, ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে উড়তে থাকে, রেণু ঝরতে থাকে পথের ধূলায়। পথের দুপাশে ওক গাছেরা অজস্র নতুন সবুজ পাতায় ভরে গেছে, শুধু তাই না, গাছ ভরে মঞ্জরী ধরেছে, রাস্তা ভরে গেছে সেই ঝরা মঞ্জরীতে।
    স্প্রিং ব্রেকের ছুটি ছিল সপ্তাহখানেকের কিছু বেশি (মানে আগের সপ্তাহের শনি ও রবি ধরে নিয়ে নদিন)। ব্রেকের আগের সেই শুক্রবারে যখন সব শুনশান হয়ে এল, ধৈর্যশীল বাহনেরা যখন মালিকদের নিয়ে সব পাড়ি দিল উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে, খুব ইচ্ছে হল বন্ধুকে নিয়ে হারিয়ে যাই নতুন বসন্তের সবুজ জঙ্গলে, তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন করি, মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে উঠে বেরিয়ে আসি বনজ্যোৎস্নায়, দেখি কথা কয়ে ওঠে কিনা রহস্যময় বনস্থলীর কোনও আত্মা, যেমন কইত বহু বহু বছর আগে, যখন এদেশে শ্বেতকায়রা আসেনি, এ ভূখণ্ড ছিল লালমানুষদের, যারা পৃথিবীকে তাদের মা বলে জানত, তারা শুনতে পেত পাতার কুঁড়ি খোলার শব্দ, তারা শুনতে পেত জলের ঘূর্ণীর শব্দ, তারা দেখতে পেত অনেক অনেক দূর, বৃষ্টির পরে কেমন পরিষ্কার হয়ে যায় আকাশবাতাস-অনুভব করত তারা। আমি কতকাল পরে এসেছি হেথায়, ওরা তো আর নেই এখানে, হয়তো আছে কোনও রিজার্ভে, হয়তো ভুলে গেছে সবকিছু।

    লালমানুষদের এখন সবাই বলে "ইন্ডিয়ান', আমিও আরেক ইন্ডিয়ান, বহুদূরের ইন্ডিয়া বলে দেশটির মানুষ, আমাদের বলে এশিয়ান, নেটিভ আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের থেকে আলাদা করার জন্য। কী অদ্ভুত, না? কলম্বাসের ভুলই "সত্য' হয়ে গেল, সে কিনা ভেবেছিল উরোপের লিসবোঁয়া থেকে ক্রমাগত পশ্চিমের দিকে জাহাজ চালিয়ে এসে ইন্ডিয়াতে পৌঁছেছে, কারণ পৃথিবী যে গোলকাকার! তীরে নেমে সে অধিবাসীদের ইন্ডিয়ান বলে স্থির করল। বোঝো কান্ড! পৃথিবী যে কত বড় গোলক, হয়তো ঠিকঠাক জানত না ওরা, জানলে হয়তো টাকাকড়ি যোগাড় করে পাড়ি দিতে পারত না। পশ্চিমের পথে পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছাতে ওদের আরও বহুদিন চলতে হত, ততদিনে সব ফুরিয়ে যেত, খাবারদাবার, জল, সব। ঝড়টড় হলে তো আরও সোনায় সোহাগা। মাঝে বিরাট ওই মহাদেশ না থাকলে কি হত কেজানে! উনি তো ইতিহাসে ঢুকে গেলেন, কিন্তু ওনার ভুলটিও ইতিহাসে ঢুকে গেল, আদি-অধিবাসীরা হয়ে গেল ইন্ডিয়ান। কি গেরো!

    দ্বীপগুলো হয়ে গেল ইন্ডিজ, পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বলে কোনওভাবে একটা রফা করেছে,কিন্তু এই লালমানুষদের বেলায় তাও করেনি। "রেড ইন্ডিয়ান' কথাটা শুনলে এরা ভুরু কপালে তুলে তাকায়! আবার জিগায়,"হোয়াই আর ইউ সেইং রেড?' যাকগে,হচ্ছিল বসন্তের ছুটিতে বেড়ানোর প্ল্যানের কথা। আমরা প্ল্যান করতে থাকি ক্যাম্পিং এর, নানারকম প্রস্তাব উঠতে থাকে, পড়তে থাকে, কখনও একমত হয়ে জোরালো হয়, কখনও দ্বিমত হয়ে ভেঙে পড়ে। প্ল্যান করে ক্লান্ত তৃপ্ত মনে চলে যাই যে যার বাড়ি।

    ""বিজন ঘরে,
    এলে যদি নিশীথ রাতে
    আমি তাইতে কি ভয় মানি?
    জানি বন্ধু জানি---
    তোমার আছে তো হাতখানি
    ....''

    এয়ারকন্ডিশনারের হাল্কা চাপা শব্দের গুম গুম শোঁ শোঁ,অসংখ্য সবুজ জ্বলানেভা আলোর মধ্যে অনুভব করি তাকে, যে ছিল অনেক অনেক অনেক দিন আগে, যে আছে এখনও, যে থাকবে আরহও অনেক অনেক দিন পরেও। যে জানে আমাদের লক্ষ লক্ষ বছরের অতীত, জানে আমাদের কৃপণ বর্তমান, প্রতি মুহূর্তে পালিয়ে যাওয়া ক্ষণগুলির জন্য আমাদের দু:খ ও অশ্রুকণিকা, জানে আমাদের প্রসারিত অনন্তস্পর্শী ভবিষ্যৎ। সভ্যতার এই পরতের পর পরত খোলসগুলো আমাদের ঢেকে রেখেছে পোশাকের মতন, ঘরের মতন, যানবাহনের মতন, ডেডলাইনের মতন, আরও আরও অনেক ছোট-বড় কনস্ট্রেইন্ট আমাদের চোখের সামনের জিনিস চোখের থেকে মুছে দিয়েছে। আমাদের ব্যথিত আত্মা যখন কেঁদে ওঠে সেইসব হারানো জিনিসগুলোর জন্য, হারানো সম্পর্কগুলোর জন্য, তখন কোনও আশ্চর্য কৌশলে সে ছুঁয়ে ফেলে আমাদের ভিতরমন, আমাদের আত্মা, এমন করে ছোঁয় যেন ছিলই সে আমাদের একদম ভেতরে, কোনও খোলোস না পেরিয়েই কেমন করে যেন পৌঁছে গেছে সেখানে। ওই সেই ফ্ল্যাটল্যান্ডের উপর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ত্রিমাত্রিক আপেল যেমন সোজাসুজি পৌঁছে গেছিল বৃত্তের কেন্দ্রে, পরিধি না পার হয়েই! ঠিক তেমনি করে।

    নানা কারণে ক্যাম্পিং হল না, এমনিই আমরা ঘুরতে যাই বাইসিক্ল ট্রেইল ধরে, বসন্তের সবুজ গাছগাছালি, সুরমুখর পাখপাখালি আমাদের অভ্যর্থনা করে নীরবে সরবে। হরবোলা পাখির ডাক শুনতে শুনতে আমার হারানো দুপুরগুলি মনে পড়ে, মনে পড়ে শালিক চড়ুই কাক কোকিল সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আমার দেশেও, উষ্ণদিনের মোহন আলোর ঝর্ণাধারা যখন চরাচর ধুইয়ে দেয় তখন তা তো ওদের ভিতর বাহিরও ধুইয়ে দিয়েছে। আমরা মানুষেরাই শুধু এত এত জালের পর জালে আটকানো। অর্ধেক দিন ধরে ঘুরেফুরে বেশ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত হয়ে শেষে গড়িয়ে-যাওয়া দুপুরে আমরা বিশ্রাম নিতে আর আহার গ্রহণ করতে বসি স্টেট পার্কের কৃত্রিম সরোববরের ধারে, পল্লবিত ওয়াটার ওকের ছায়ায়। আকাশ আজ এক্কেবারে নীল, দূরে চিল পাক খায়, হ্রদের জলে সরু পাতলা মোটরচালিত নৌকায় লোকেরা জলবিহার করছে, নৌকার অতি দ্রুতগতি আর পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে উল্টোমুখে বেরিয়ে যাওয়া হাওয়ার স্পর্শ নিশ্চয় ওদের খুব আনন্দ দিচ্ছে, ওরা চিৎকার করছে খুশিতে। সকাল বেলাতেই দোকান থেকে খাবার দাবার কেনা হয়েছিল, এখন সেই সেদ্ধ টার্কির ফালি আর চিজের ফালি মাঝখানে দেওয়া দুই স্লাইস পাউরুটিই অমৃত মনে হয়। ক্ষুধাই হল সুধা, যদিও দেশের লুচি-আলুরদমের কথা মনে পড়ে যায়। সে যেন গতজন্মের স্বাদ, এত মধুর সেই স্মৃতি।

    কচি সবুজ ঘাসের উপরে কাত শুয়ে পড়ি, ঘাসের সুড়সুড়ি লাগে কানে, বেশ লাগে। ""তোমার দেশ এত সুন্দর!'' মুগ্ধ হয়ে বন্ধুকে বলি। সে ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে,""না না, এর চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর জায়গা আছে, ক্যালিফোর্নিয়ার রেড উডের বন, ওখানে পাঁচ হাজার বছরের পুরানো গাছ আছে, গত গ্রীষ্মে গেছিলাম, সে এক অদ্ভুত জিনিস। তুমি ও গাছ ছুঁলে মনে হবে টাইম মেশিনে চড়ে চলে গেছো সেই তত হাজার বছর আগে...মিশরে তখন পিরামিডগুলো তৈরি হচ্ছে।'' আমি হেসে ফেলি, পাছে এই দুটো গাছপালা ঘাসফুল পাখপাখালি দেখে একেই দেশের সেরা সৌন্দর্য ভেবে বসি, এই ভয়ে কেমন ব্যস্ত হয়ে আশ্চর্য সুন্দর জায়গার কথা বলছে! আরে, বিখ্যাত জায়গা তো আছেই, আশ্চর্য সব জিনিস তো আছেই পৃথিবীতে, কিন্তু তার জন্য এই হাতের ছোঁয়ার মধ্যের, এই বুকের কাছের, এই চোখের সম্মুখের অপরূপ আশ্চর্য সৌন্দর্য কি বৃথা হয়ে গেল? অপরূপ এই জগৎ, জগতের প্রতিটি কোণাতেই অফুরন্ত আনন্দের উৎস লুকিয়ে আছে। নিজেদের বাঁধা জালগুলো ছিন্ন করতে পারলেই রূপকথার সোনার পালক আপনিই উড়ে এসে পড়ে হাতে, মাথায়, চোখেমুখে। আমরা গল্প করতে থাকি, কোথা থেকে কোথায় চলে যায় গল্পের বিষয়বস্তু, ছোটবেলার কথা, সেকেন্ডারি ইস্কুলের কথা, নানাসময়ের বেড়ানোর গল্প, এখনকার কাজের কথা ---সব মিলেমিশে জগাখিচুড়ি হয়ে যায় গল্পের মধ্যে।

    বেলা পড়ে আসে, ঢলে পড়া সূর্যের কিরণে কোমলতা, পশ্চিমের মেঘগুলি আরেকটু পরেই অরুণরঙে রাঙা হয়ে সন্ধ্যাকে মায়াবতী করে তুলবে। আমরা ঘরে ফিরতে থাকি, ক্লান্ত দেহে, তৃপ্ত হৃদয়ে। একটি মুক্তির দিনের স্মৃতি অবিনশ্বর হয়ে থাকে মনের মণিকোঠায়।

    হাট্টিমাটিমটিম
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ১২.০৭.২০০৭
    পথের দুধারে আর পার্কিংলটের চারপাশ ঘিরে অসংখ্য জারুলগাছ। সাদা আর হাল্কা গোলাপি থোকা থোকা ফুলে ভরে উঠেছে। বেশিরভাগই সাদা। জোরালো হাওয়ায় খইয়ের মতন উড়ে যায় শত শত, হাজার হাজার ফুল।

    একদিন মেঘ করে আসে,আকাশ ভরে জটামেলা মেঘ আর দূর সমুদ্র থেকে আসা পরাক্রান্ত হাওয়া---সেই হাওয়ায় ওড়ে অসংখ্য জারুল ফুল। মনে পড়ে যায় আমাদের পাড়ার মাঠের ধার ঘেঁষেও অমন জারুলগাছে ফুলের মঞ্জরী, মৌসুমীমেঘের নীচে ওড়াও উড়ছে জোরালো বাতাসে। আহা উড়ুক, উড়ুক ওরা, মৌসুমী হাওয়ায় আনন্দে উড়ুক। এখানে আমি হাঁটতে হাঁটতে থেমে পড়ে নিচু হই, হাত বাড়িয়ে কুড়িয়ে নিই উড়েপড়া জারুলের হাল্কা পাপড়িগুলো, হাতের তালু থেকে উড়ে যায় ওরা সামান্য শ্বাসবাতাসে। এদিক ওদিক তাকাই, কেউ দেখলো না তো? এইবয়সী মানুষকে এরকম ছেলেমানুষী করতে দেখলে কি ভাববে কে জানে! ভোরবেলায় নির্জন অবশ্য চারিধার, লোকজন আসতে থাকবে আরেকটু বেলা হলে।

    পরদিন বাদলশেষের সোনালি রোদ্দুরের সকাল, গাছগুলোর কাছ দিয়ে আসতে গেলেই শোনা যায় গুন্‌গুন্‌গুন্‌-ভোমরার ডানার শব্দ-আরও কাছে গেলে দেখা যায় অসংখ্য চকচকে সোনালি পিঠওলা কালো ভ্রমর খুব ব্যস্ত মধু খেতে, ওদের ডানায় লেগে লেগে ঝরে পড়ে হলদে পরাগ, বাতাসে উড়ে যায় স্বর্ণরেণুর মতন। ওদের কাছ দিয়ে কেউ চলে যাচ্ছে এ হয়তো ওরা লক্ষও করে না, এত ব্যস্ত! অদ্ভুত প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘাই দেয়, গোটা শীতকাল---যখন গাছপালা রিক্তপর্ণ হয়ে ধূসর তপস্বীর মতন পড়ে ছিল শুকনো কাঠের মতো হয়ে, তখন এরা, এই মৌমাছি ভোমরা--এরা কোথায় ছিল?

    ক্যাম্পাস বিস্তৃত হচ্ছে, নতুন নতুন সব বিল্ডিঙ তৈরি হচ্ছে। আহা সেই উজ্জ্বল খয়েরিবুক সূর্যরঙের ফুলেঢাকা টিঁ-ই-ই-ই করে ডাকা পাখিদের মাঠখানা বুঝি আর রইবে না, দেখি বালি সিমেন্ট এইসব জমা করছে, বিরাট বিরাট রোবট আর্মওলা কন্সট্রাকশনের গাড়ি কেবলই মাটিখোঁড়ে, জঞ্জাল সরায় আর কংক্রিটের চৌকো চৌকো স্ল্যাব এনে জড়ো করে।

    ওই মাঠ যখনই পার হই দিনে বা রাতে, সকালে বা সন্ধ্যায় --- যখনই পার হই দেখি ওই কখানা পাখিকে, গলা বেষ্টন করে দুখানা গোল কালো দাগওয়ালা ধূসর রঙের লম্বা লেজ ছোট পাখি, অক্লান্ত দৌড়ে বেড়ায় ওরা মাটির উপর দিয়ে, ওড়ে খুব কম। টিঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ তীক্ষ্ম চড়া স্বর এই পাখির ডাকে।আমার খুব অবাক লাগে, এই পাখি ঘুমায় কখন? ছোট্টবেলার ছড়া কেন জানি মনে পড়ে এদের দেখে--""হাট্টিমাটিম্‌টিম্‌/ তারা মাঠে পাড়ে ডিম/তাদের খাড়া দুটো শিং/তারা হাট্টিমাটিম্‌টিম্‌।""

    কে জানে এরা সেই হাট্টিমা পাখির কোনও দূরসম্পর্কের আত্মীয় কিনা! এই মাঠখানি ঘুচে গিয়ে কংক্রিটের স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে গেলে এরা কোথায় যাবে? টিঁ -ইঁ-ইঁ-ইঁ করে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে যাবে কোনও অভয়প্রান্তরে, যেখানে ওদের মাঠের বাসাখানি কেউ কেড়ে নেয় না?

    ত্বিভিন্ন প্রকৃতিবন্ধু ক্লাব, অর্গানাইজেশান এসব আছে এদেশে, তারা চেষ্টা করছে এইসব তৃণভূমি জলাভূমি বনাঞ্চল,বিশুদ্ধ নদীধারা এইসব বাঁচিয়ে রাখতে, মাঝে মাঝে ওরা দিয়ে যায় আবেদনপত্র, পোস্টে ও পাঠায়।কিন্তু কতটুকুই বা ওরাও করতে পারবে এই সর্বগ্রাসী লৌহসভ্যতার সঙ্গে লড়ে?

    কত কত বন্য পশুপাখি চিরদিনের মতন লুপ্ত হয়ে গেছে দেশে দেশে - বামীর হাতের প্রদীপ শিখাটির মতন। কে জানে হয়তো কিছুই হারায় না, সবই রয়ে যায় কোথাও না কোথাও-কোনও নির্জন হৃদয়ের গভীর গোপন কোনও কুঠুরিতে। ডোডো পাখি, সলিটেয়ার পাখি, নিনি হাঁস---সবই হয়তো রয়ে গেছে সেই অভয় দেশের সবুজ বনে, সোনালি বালুচরে, নীল সমুদ্রে।

    একটা মকিং বার্ড সুর করে ডাকছে,এই পাখি একদম আমাদের দোয়েলের মতন দেখতে-কেন এত সুর করে ডাকে রিকিউ রিকিউ টিইন্না রিকিউ রিকিউ টিইন্না-দূর থেকে আরেকটা পাখি সাড়া দেয় ঠিক একই সুরে। কেবল মনে পড়ে যায় সব, অজস্র পাখির পৃথিবী ছিল আমাদের শৈশবে বাল্যে কৈশোরে --- মৌটুসি পাখিরা--মাথায় বাহারি ঝুঁটি ওদের, কী ব্যস্ত হয়ে পোকা খুঁজত ঘাসবনে, মা-ডাহুক কি দ্রুত লিকলিকে সরু ঠ্যাং নিয়ে দৌড়ে যেত সদ্যবোনা ধানচারাদের মধ্য দিয়ে, কদিন পরে ওর ক্ষুদে ক্ষুদে ছানাগুলো ওর পেছনে, বড় বড় শামুকখোল পাখি আসত বর্ষার শস্যক্ষেত্রে, সবুজ টিয়ার ঝাঁক নামত সবুজ বাগানে...আর সেসব নেই, অজস্র বাড়িঘরে ইঁটকাঠের জঙ্গলে ঢেকে গেছে প্রায় সবটুকু সবুজ, ওরা কোথায় চলে গেছে!

    একদিন কি মানুষ বুঝবে না, এইভাবে একাকী মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না শুধু সভ্যতার অহংকার নিয়ে, সে একা বিচ্ছিন্ন নয়, সে এইসবের-এই সবুজের, এই পাখিদের, এই আকাশের,এই বাতাসের...

    অজস্র গাড়ি চলে পথে পথে,অসংখ্য কলকারখানা ধোঁয়া উগড়ে দেয়, আরো আরো আরো, গরম হয়ে ওঠে পৃথিবীর বাতাবরণ, গরমে আইস ক্যাপ গলে যেতে থাকে পৃথিবীর মেরুতে, অনেক সাদা ভালুকের শব উঠে আসে ধীবরের জালে, অপুষ্ট ক্লান্ত মৃতদেহ সব...

    প্রকৃতিবন্ধু সংগঠন থেকে আসা কার্ডটির উপর থেকে একটি সাদা মেরুভল্লুক আমার দিকে করুণ চোখে চেয়ে থাকে শুধু...আরেকটি কার্ডে মায়ের কোলের ওমে চুপ করে ঘুমিয়ে থাকা একটি সাদা শিশুভল্লুক। ওদের কোনওদিন দেখিনি আমি, কোনোদিন হয়তো দেখবও না...
    ""তবু আশা জেগে থাকে অয়ি অবন্ধনে/তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে...''
    হাট্টিমা পাখিরা দৌড়ে বেড়ায় মাঠ জুড়ে, তীক্ষ্ম চড়াসুরে টিঁ-ই-ই-ই-ই করে ডাকে, এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, আমি ঘরে ফিরে আসছি। কোথা থেকে একঝলক হাল্কা ফুলের গন্ধ ভেসে আসে, বেলফুলের গন্ধের মতন মনোরম...

    কে যেন বলেছিল, বাঁচো ও বাঁচতে দাও? কে যেন বলেছিল প্রাণের চারণভূমিটি কেড়ে নিও না? কে যেন বলেছিল রক্ষা করতে, যত্ন করতে, ভালোবাসতে? কে সে, কবে বলেছিল? কিছুই মনে পড়ে না, আমি আনমনে পথ হাঁটি। তীক্ষ্ম টিঁ-ই-ই-ই আছড়ে পড়ে কানের পর্দায়, মনের পর্দায় যায় কি?

    প্রজাপতিডানার রেণুধূলি
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ০২.০৮.২০০৭
    একদিন ভাবছিলাম আর চিঠি লিখব না প্রবাস থেকে। প্রবাস বা স্বদেশবাস--কোনও কিছুতেই আর কিছু তফাত দেখতে পাই না। সর্বত্রই সেই একই ভালোমন্দ আলো-অন্ধকার আসে যায় আসে যায় আসে যায় একইরকম। সেই মেঘ-রোদ্দুর-বৃষ্টি সেই মনখারাপ মনভালো---একই সব। কী হবে লিখে? চোখ মেলে দিয়ে কান খুলে দিয়ে মনের দরজা খুলে চুপ করে বসে দেখাই ভালো। মানুষের হৃদয়ের আলোছায়ার খেলাও তো এই আকাশ বাতাস মেঘরোদবননদীর উপরের আলোছায়ার খেলার মতনই। যারা সত্যিকারের অনুভবী লেখক, যারা সত্যিকারের সূক্ষ্ম স্পন্দনশীল হৃদয় নিয়ে পৃথিবী দেখেন-তারা হয়তো পারেন এই আলোছায়ার খেলা তুলে ধরতে। আমার পক্ষে চেষ্টা করাই মূঢ়তা। তবু মাঝে মাঝে কি যে আকুলিবিকুলি করে ওঠে মনের ভিতরে, না-ফোটা ডানার কুঁড়ি চঞ্চল হয়ে ওঠে, তখন কে যেন কলম তুলে দেয় হাতে, কারা যেন কানের কাছে ফিসফিস করে ওঠে, অনেক অনেক স্বর--- হাল্কা কচি স্বর,গম্ভীর জোরালো স্বর, মেয়েলি কোমল স্বর-সে প্রায় গানের মতন সুরেলা,দানা-দানা পুরুষালী স্বর, তীক্ষ্ম চড়া স্বর, তরুপত্রে বাতাসের মর্মরের মতন নরম স্বর--- ওরা বলে, "বলবে না আমাদের কথা?" কাগজের উপরে কলম সরে সরে যেতে থাকে, অক্ষরের পর অক্ষর--শব্দের পর শব্দেরা উঠে আসতে থাকে, এসব ওই স্বরগুলির গল্প--একসময় দেখি তাদের গল্পের একেকটা অংশ কখন পুরো বা আধা ফুটে উঠেছে কাগজের উপরে। তখন ওই কুঁড়ির মতন ক্ষুদে ক্ষুদে শব্দগুলি কথা বলতে থাকে, অন্ধকার থেকে আলোর ফুলের মতন ফুটে উঠতে চায় তারা, তাই...

    প্রতিটা লেখা পাঠানোর পরেই এমনি একটা মনখারাপি রঙ লেগে যায় মনের আকাশ জুড়ে, কিন্তু সব রঙ মুছে গিয়ে যখন তারারা ফুটে ওঠে মধ্যরাত্রিনীল জুড়ে তখন মনে হয়-এই যে চেনা-অচেনা জীবনগুলি বয়ে চলেছে সুখে দু:খে আনন্দে বেদনায়, এই যে আলোছায়ার খেলা চলছে নিরন্তর--এরা কোথাও না কোথাও থেকে যেতে চায়, তাই অজস্রের স্বর হয়ে কোলাহল করে, কোথাও না কোথাও পূর্ণের পদপরশ পেতে চায় সব ঘটনাই। এই চিঠিগুলির মতন অতি তুচ্ছ ক্ষুদ্রও। মনভালোর নীলসবুজগোলাপি কারুকাজ অমনি আবার ফুটতে থাকে। উড়ে যাওয়া প্রজাপতির পক্ষ্মধূলির মতন নরম সেইসব চঞ্চল পলাতক গল্পমালার দিকে চেয়ে হাসিমুখে ফিরে বলতে পারি সেই চার দশক আগের তরুণ কবির মতন,"শুভেচ্ছা নাও। হারিয়ে যেও না।"

    এখানে দেখতে দেখতে গ্রীষ্ম চড়ে ওঠে রোদ্দুরে, ল্যাকপ্যাকে ব্যাকপ্যাক পিঠে নিয়ে হেঁটে আসে ইস্কুলের ছেলেপুলেরা। স্কুলে ওদের এসময় ছুটি বলে নানারকম প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওরা আসে এসময় ইউনিভার্সিটি দেখতে। প্রায়ই দেখা যায় একঝাঁক অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে তাদের বিশেষ ধরনের পোশাক পরে বড় বড় লম্বাটে গাড়ি থেকে নামছে রেসিডেন্স হলগুলোর সামনে। সামনের শরতে যারা কলেজে উঠবে তারা গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রচুর ভিজিট করে উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্রগুলো। আর দেখি লম্বা সাদা পোশাক আর মাথায় কালো ভেল পরা পাঁচছজন তরুণী সন্ন্যাসিনীকে, সবসময় ওরা কজন একসঙ্গে চলে, অংকের ক্লাস নিতে যাওয়াই হোক, ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে যাওয়াই হোক বা জিমনাশিয়ামে যাওয়াই হোক। ওরা শুধু সামারেই ক্লাস করে, তারপরে ফিরে যায় ওদের চার্চে, রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী এনারা।

    গাছপালার সবুজ এখন খুব ঘন, ঝড়বৃষ্টি না থাকলে আকাশ এত নীলকান্তমণির মতন পরিষ্কার নীল যে দূর্গাপুজোর কথা মনে পড়ে যায় বারে বারে। চত্বরের চারধার ঘিরে অজস্র কাশফুল,এগুলো আমাদের পরিচিত কাশফুলের মতন হাল্কা নরম না, বেশ স্থূল, ঝাপালো। কাশঝোপও শনঝোপের মতন বেশ গোছাধরা। এই ফুল শীতের কটা মাস বাদ দিলে পায় সারাবছরই হয় এখানে। মনে পড়ে কীর্তিকে, মনে পড়ে শ্রুতিকে, ওরা দুই বোন, কীর্তি ছোট, শ্রুতি বড়। কীর্তি ছমাস ছিল এখানে, কদিন আগে চলে গেল অনেক উত্তরে ওর দিদির কাছে। সেখানে মাস দুই কাটিয়ে যাবে মধ্যপশ্চিমের এক রাজ্যে পড়াশোনা করতে। এখানে ওকে অমল বন্ধুত্ব ও সান্নিধ্য দিয়েছিল যে পরিবারটি, সেই পরিবারের কর্ত্রী ক্যাথিকে মনে পড়ে, হাল্কা চেহারার মধ্যবয়সি ভদ্রমহিলা, গত শীতে ক্রিসমাসের কিছু আগে ওঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় এই কীর্তি আর আরেক বন্ধু থাজিং এর সূত্রে। আমাদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন তখন। ওদের মেয়ে ভ্যালেরিকে মনে পড়ে, ভ্যালেরির সদ্য বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে, সে এখন নাচের গ্রুপ খুলেছে শহরে। কিশোরীর মতন নরম চেহারার মিষ্টি মেয়ে ভ্যালেরি। আমারই এত মনে পড়ে ওদের অত অল্প দেখাসাক্ষাতেই, কীর্তির নিশ্চয় অনেকদিন ধরে ওদের মনে পড়বে অনেক অনেক প্রহরে। ওকে ওনারা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নিয়ে যেতেন কোথাও না কোথাও।

    এখান থেকে চলে যাবার আগে ক্যাথিদের কমুনিটি চার্চে ব্যাপ্টিজ হলো কীর্তির, সেদিন ও ক্যাথিদের বাড়িতে ওর জন্য পার্টি ছিল। কীর্তি ওর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছিল সকলের সঙ্গে, ধার্মিক হিন্দু গুজরাতি পরিবারের মেয়ে হিসাবে মুম্বাই শহরে বড় হবার সময় ওর ধর্ম নিয়ে কি অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেইসব। কনভেন্টে পড়াশোনা করত ওরা দুই বোন, ষোলো বছর বয়সে ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে প্রথম ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে ও, দিদি শ্রুতি এই ব্যাপারে সাহায্য করেছিল ওকে। কীর্তি বলছিল কেমন করে বাড়িতে ও বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখত বাইবেল, কেমন করে প্রার্থনা করত স্নানঘরে জলের কল খুলে দিয়ে যাতে কেউ শুনতে না পায়, কেমন করে ও ওর মায়ের সঙ্গে মন্দিরে গিয়ে বাইরে অপেক্ষা করত, এখানে আসার পরে প্রথম কিভাবে ও স্বাধীনতা পেল ধর্মাচরণের----সেসব।

    সুখ ও দু:খের কুসুমেরতনে গাঁথা মালা, এর মধ্য দিয়ে গড়িয়ে যায় জীবন, জীবনের মতন। মানুষ মানুষকে খোঁজে, কথা বলতে চায়, সঙ্গ চায় মানুষের। কখনও আবার চায় না সঙ্গ, একাকিত্ব চায় ভীষণভাবে। মানুষের মন অতি বিচিত্র। কেউ কি আজও এর রহস্যের কোনও তল পেয়েছে? কোনওদিন কি পাওয়া সম্ভব? কি জানি, না পাওয়াই হয়তো ভালো। বিস্ময় থাক জীবনের কোণায় কোণায়---প্রতিদিন সকালে শিশুর উৎসুক উজ্জ্বল চোখের সামনে দুহাত মুঠো করে নতুন দিনটি যেমন বলে,"বলো তো, কি আছে এই মুঠোতে?'

    মনে পড়ে জেনিনের বাড়ি, বেশ কবছর ছিলাম সেখানে। জেনিনের অনেক পোষা কুকুর ছিল, বেড়াল ছিল। আর ছিল বাগান। সেখানে জেনিন নানা ফুলগাছ লাগাতেন, টোমাটোগাছ আর জুকিনিস্কোয়াশের গাছ লাগাতেন। একবার লাগিয়েছিলেন লালজবার গাছ, কিন্তু শীতের সময় ফ্রস্ট পড়ে পড়ে সে গাছ মরে গেল। একবার এক সাদা হাঁস এসে আশ্রয় নিয়েছিল কাঠের ঘরের তলায়-দুখানা ছানা হয়েছিল কদিন বাদে। একটা সাদা, একটা রঙিন। রোজ ভোরে মা আর দুই ছানা খাবার খুঁজত। সাদা ছানাটা হারিয়ে গেছিল একদিন, ওদের মা বড় বড় পা ফেলে প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকে ডেকে খুঁজছিল। খানিক পরে খুঁজে পেল। ছানারা বড় হলে তিনজনে উড়ে চলে গেল নিজবাসে। কে জানে কোথায় ওদের ঘর! হয়তো অনেক দক্ষিণে সমুদ্রের তীরের নারিকেলবনে। জেনিন এত পোষ্য ভালোবাসত বলেই কি এভাবে অতিথি পাখিরা আশ্রয় নিত এখনে? ওরা কি বুঝতে পারে কে ওদের চায়? ওদের ডানায় কি লাগে ভালোবাসার অদৃশ্য তরঙ্গ? কে জানে!

    আজ খুব বৃষ্টি পড়ছে, ঝরঝরমুখর বাদল দিন যাকে বলে, কিন্তু কয়েকঘন্টা পরেই বৃষ্টি থেমে দারুণ রোদ উঠবে, এখানে রোদবৃষ্টির বুঝি এমনই চুক্তি করা। জেনিনের কথা শুনেছিলাম ওঁর নিজের মুখেই। জেনিন নিজেও ছিল পোষ্যপুত্রী। জেনিন আর ওর যমজ ভাই--এই দুজনকে পালক পিতামাতা গ্রহণ করেন আপন সন্তান হিসাবে--একদম ছোট ওরা তখন, জেনিনের নিজের নাকি জন্মের পর কয়েকদিন বাঁচার আশাই ছিল না কি একটা অসুখে। তারপরে ভালো হয়ে গেল, পালক পিতামাতার ঘরে বড় হতে লাগল। এদেশের নিয়ম অনুযায়ী ছোটোবেলাতেই আস্তে আস্তে জানতে পারে যে ওরা দত্তক ছেলেমেয়ে। তারপরে জেনিনের পড়াশোনা, পড়া করতে করতেই বিবাহ ও সন্তান, তারপরে একসঙ্গে চাকরি ও সন্তানপালন, বিবাহবিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ,দশক অতিক্রান্ত হলে আবার বিচ্ছেদ, এখন একা একাই, মাঝে মাঝে বিবাহবিচ্ছিন্ন স্বামী দেখা করতে আসেন, এখন ওঁরা ভালো বন্ধু---সব অবলীলায় বলে গেলেন স্বাভাবিকভাবে। অবশ্য এখানকার নিরিখে খুব অস্বাভাবিক বা অন্যরকম জীবন নয়, হয়তো জেনিনের নিজের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও অনেকের জীবন এরকমই ছিল। কুকুর পোষার নেশা নাকি জেনিনের খুব অল্পবয়স থেকেই, ওঁর যখন নিজের দুই শিশুকন্যা আর সংসার চাকরি সব ছিল, তখনও নাকি পুষতেন। ভ্রুণ অবস্থাতেই ঝরে যাওয়া শিশুপুত্রটির কথাও বললেন, ছেলেটি জন্মালে একটু বড় হলে তাকে নিয়ে ওর বাবা নৌকা করে ফিশিং এ যাবার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু সে তো হল না! কিজানি স্থায়ী সংসার আর প্রেমিক-স্বামী/প্রেমিকা স্ত্রী আর উজ্জ্বল সন্তানেরা---এইসব হয়তো সব মানুষই চায়, কিন্তু যা চাওয়া যায়, সবসময় তা মেলে না, তাই স্বপ্নকল্পনা অবসরমুহূর্তের ভাবনায় থেকে যায় এইসব---আহা যদি অমন হত! জেনিন রেজিস্টার্ড নার্স ছিলেন, ওর বড় মেয়েও নার্স, ছোট মেয়ে স্কুলে পড়ায়। তারা কাছেপিঠেই থাকে, মাঝে মাঝে দেখতে আসে। অদ্ভুতভাবে ওনার বড় মেয়ের জীবন খানিকটা জেনিনের মতন--বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে দুটি সন্তান নিয়ে সে পুনর্বিবাহিত হয় আরেক লোকের সঙ্গে।

    ও বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি বহুদিন হল, তাও মনে পড়ে যায়। কত মানুষ, কত ভিন্ন ভিন্ন রকম জীবনের গাথা। মনে পড়ে সেই নাম-না-জানা বন্ধুটাকে, কোথায় সে আজ? পথের এক বাঁকে দেখা দিয়ে হাসিমুখে মিলিয়ে গেছে অন্য বাঁকে। আমাদের পুরোনো শিক্ষকেরা আজ কোথায়? কেউ কেউ আছেন, মাঝে মাঝে দেখা হয় কালেভদ্রে, কেউ কেউ ধরাধামেই নেই, তাঁরা শুধু স্মৃতির সরণী বেয়ে দেখা দিয়ে যান। সেই সব পুরোনো বন্ধুরা, স্কুলের বন্ধুরা, উড়ে গেছে পৃথিবীর কোণে কোণে, হয়তো মানুষের জীবনে এই চলাই কাম্য। চরৈবেতি চরৈবেতি।

    স্মৃতিতে ভিড় করে আসে সোনালি গোলাপি পালকের মতন কিশোরবেলা তরুণবেলার বন্ধুরা, ওদের উৎসুক তরুণ মুখগুলো, আশাদীপ্ত, আলোয় উজ্জ্বল-সময় তখনও নখচিহ্ন আঁকেনি ওসব মুখে---প্রজাপতির পাখার রেণুর মতন উড়ে এসে লাগে ওদের গল্পগুলো আমার মনের পাতায়--- মধ্যগ্রীষ্মরাত্রির বাতাসের সঙ্গে ফিসফিস করে বলি, "ভালোবাসা নাও, হারিয়ে যেও না।'
  • 11 | 185.220.101.4 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:০৪741420
  • একেই বলে শুটিং
    পারিজাত, সুইটজারল্যান্ড
    ৮.২.২০০৭
    হলিউড-বলিউডের সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না। সোলোথুর্ন পুঁচকে শহর, সুইটজারল্যান্ডের ফিল্মসিটি। কজন লোক নাম শুনেছে সোলোথুর্নের? আর কটা সুইস ফিল্মের নাম আমরা জানি? খুব ভেবে চিন্তে বললে বলব "হাইডি', "শোয়াইৎসারমাখার' (এষং ঢ়ষ থনদষলন ত জংভড়ড়?), "এস্‌কেপ্‌ টু প্যারাডাইস্‌', আর আর আর মনে পড়ছে না, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, গতবছর বেরোলো, "গ্রাউন্ডিং'। এরা সিনেমা কম বানায়, কিন্তু ভালো করে বানায়। সেরকম হাই বাজেট সিনেমা বানায় না, এগুলো সবই লো বাজেট ফিল্ম, কিন্তু যত্ন করে বানানো।

    তো আমাদের মনে খুব ইচ্ছে হয়েছিল আমরাও সব সিনেমা বানাব। ষোলো বছর বয়েসে এরকম ইচ্ছে হলে কেউ পাগল বলে না, বলে ওটা পিউবার্টির দোষ। অতএব আমরা ইস্কুলে আবদার করলাম, আমরাও ফিল্মমেকার হব। সেপ্টেম্বরে শরৎকালের ছুটি থাকে এক সপ্তাহ, সোম থেকে শুক্রের মধ্যে এত কিছু করে ফেলতে পারি আর একটা সামান্য সিনেমা বানাতে পারব না? কী এমন হাইফাই ফান্ডা লাগে সিনেমা বানাতে? স্টোরি? আছে। মানে নেই, কিন্তু এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি। বানালাম গল্প। গল্পের একটা স্টাইলিশ নাম দিলাম হেভি কায়দা মেরে - "দেজাভু'। ফ্রেঞ্চ নাম। শুধু নাম দেখিয়ে হাউসফুল করে দেব। আর কী লাগে? ভিডিও ক্যামেরা। সে হয়ে যাবে, কোনও বড়লোক ক্লাসমেটের কাছ থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ম্যানেজ করে নেব, ঘুষ হিসেবে তাকে সিনেমায় একটা রোল পাইয়ে দেব। অ্যাকটর অ্যাক্ট্রেস অনেক আছে, কত চাই? ডিরেক্টর কাম ক্যামেরাম্যান আমি নিজে। ওটাই মোস্ট দায়িত্বফুল কাজ। আর চাই, আর চাই, মুভিমেকার সফ্‌টওয়্যার আর বেশ ভালো হার্ড ডিস্কওয়ালা একটা ল্যাপটপ। ব্যাস, আমরা রেডি। অ্যাক্‌শান!

    আমাদের ক্লাস টিচার ফ্রাউ স্টুকি, যাঁকে আমাদের ইংলিশের টিচার হের ফিশার আড়ালে "মিসেস্‌ স্টাকি" বলে থাকেন, সেই স্টুকি আমার বানানো গল্পটা শুনলেন। এবং যা ভয় পেয়েছিলাম, তাইই হল, স্টুকি এই গল্পে নিজস্ব মতামত দিতে গিয়ে গল্পটার সাড়ে বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন। আমার গল্পটা ছিল এইরকম :- একটা লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন একটা হকার তার হাতে একটা ফ্রি নিউজপেপার ধরিয়ে দিল। লোকটা কাগজটায় অল্প চোখ বুলিয়ে একদম তাজ্জব। সে তখন হকারটাকে খুঁজতে গিয়ে আর তাকে দেখতে পেল না। এমন সময়ে একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে এই লোকটার হাত থেকে ওই খবরের কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়। লোকটার হঠাৎ খেয়াল হল যে, ওই হকারই খবরের কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। তখন লোকটাও ওই হকারের পেছনে দৌড় লাগাল, অনেকক্ষণ দৌড়নোর পরে এক সময়ে সে দেখল হকারটা আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেছে। তারপরে আবার কোনও একটা দেয়ালের পেছন থেকে হকারটা বেরিয়ে এসে লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলেই লোকটাকে গুলি করে মেরে ফেলল। এই কথা বলার সময়ে বোঝা গেছিল যে ওই হকারটা লোকটাকে চেনে। খুন টুন করে, হকার শান্ত ভাবে খবরের কাগজটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল, আর বিড়বিড় করে বলল, "উ: যত রাজ্যের রাবিশ খবর এরা কাগজে ছাপে'। এবার ক্যামেরা জুম করল ডাস্টবিনে, আর সেখানে দেখা যাবে যে লোকটা এইমাত্র খুন হল, তার খুনের খবর উইথ ফোটো অলরেডি ফার্স্ট পেজের হেডলাইন, আর কাগজের নাম "দেজাভু'।

    তিনমিনিটের সিনেমার জন্যে এর থেকে বড় আর ইন্টারেস্টিং গল্প আমার মাথায় খেলেনি। স্টুকির গাইডেন্সে, হকার বনে গেল "শয়তান'। সেই শয়তানের সঙ্গে ওই লোকটা একটা কন্‌ট্র্যাক্ট সই করল, আল্টিমেটলি সেই খুন ই হল। কিন্তু আমার গল্পের সব চার্ম মরে গেল। কী করব? স্টুকি আমার জার্মানের টিচার, তার হাতেই ক্ষমতা, সোলোথুর্নে গিয়ে শুটিং করার অনুমতি তিনিই দেবেন। কাজেই কম্প্রোমাইজ করলাম। এবার আরও অনেক কিছুর সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা শুরু হল। আসল নায়ক যে হবে, তেমন কোনও ছেলে পাওয়া গেল না, কেউ লড়াই না করে খুন হতে রাজি নয়। কিন্তু এ সিনেমায় ফাইটিং সিকোয়েন্সের স্কোপ নেই। তাই লোকের জায়গায় মেয়ে এল। নাম সারা। সে বেশ নায়িকা নায়িকা দেখতে, অনেক দামি দামি জামাকাপড় আছে তার, ফিগার ভালো, শুধু অ্যাকটিংটা সে পারে না। দেড় লাইন ডায়ালগ সারা ফিল্মে, সেটা বলতে সে পনেরোবার হাসে, তার মধ্যে বারোবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যায়। তাকে বেশি বকে ধমকে দিলে সে কেঁদে ফেলতে পারে, তখন তাকে তোয়াজ করে আবার শান্ত করতে হয়। ডিরেক্টরদের অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হয়। বলতে এক্কেবারে ভুলে গেছি। আমরা কিন্তু সেই ছুটির সপ্তাহের সোমবারে ট্রেনে চেপে সোলোথুর্ন পৌঁছে গেছি। স্টুকি আমাদের সঙ্গ নিয়েছেন, আর আছেন ভুগোলের টিচার হের্‌ স্টাউফার। (হের্‌ মানে মিস্টার, ফ্রাউ মানে মিসেস্‌ - যারা জার্মান জানেন না তাঁদের জন্যে।) হের্‌ স্টাউফার ভালো লোক, যাকে বলে "কুল' লোক। আগবাড়িয়ে কোনও ঝামেলা করেন না। আমরা রইলাম ইউথ হস্টেলে।

    এদিকে মার্টিন, আমাদের ক্লাসমেট, সেও রোল চায়। সিনেমায়। তখন আমি একবার ভেবেছিলাম, ওকে "এগ্‌রোল' দিলে কেমন হয়। কিন্তু "এগ্‌রোল' কী জিনিস, কেমন খেতে সেসব সুইস্‌রা জানে না, তাই এসব আর বলিনি। অনেক ভেবে চিন্তে মার্টিনের জন্যে একটা মাতালের রোল ঠিক করা হল, সে পথের ধারে মদের বোতল নিয়ে হা`ফ বেহুঁশ হয়ে বসে আছে। মার্টিন তাতেই খুশি। ওকে দশ সেকেন্ডের মতো স্ক্রিনে দেখা যাবে। তিন মিনিটের সিনেমায় দশ সেকেন্ড মানে প্রচুর। ইয়ার্কি নাকি! আমরা সিনেমাটা রিয়্যালিস্টিক করব, জালি জিনিস চলবে না, মার্টিনের মদের বোতলে আসল খাঁটি ভোদ্‌কা-ত্রো`ইকা থাকবে, লাল রঙের। শুটিং শেষ হলে, সিনেমা রিলিজ করবে কি করবে না, কিন্তু বোতলটা খালি করবার কোনও অসুবিধা হবে না। আমাদের গ্রুপের ছেলে এডি, দুবার ফেল করে তার বয়েস আঠারো, তাই সে গিয়ে বীরের মতো ভোদ্‌কা কিনে নিয়ে এল। আমরা বাচ্চা বলে আমাদের কেউ মদ বেচবে না।

    মোটকথা আমরা রেডি। অ্যাকশন বললেই শুটিং এ ঝাঁপিয়ে পড়ব। সোমবার এসব গোছাতে গোছাতেই কখন সূর্য ডুবে গেল। মঙ্গলবার আমাদের ক্লাস নিতে এলেন, নিনো জাকুসো। বিখ্যাত সুইস্‌ ডিরেক্টর। সোলোথুর্নের একটা বিশেষ সিনেমা হলে বসে দেখলাম তাঁর বানানো ফিল্ম "এস্‌কেপ্‌ টু প্যারাডাইস্‌'। যা তা অসহ্য ভালো সিনেমা। একটা টার্কিশ রিফিউজি পরিবারের গল্প, কীভাবে তারা এই দেশে অ্যাসাইলাম পেল তার ডিটেল। গল্পটাও নিনো-র নিজের লেখা। সিনেমাটা চলেনি। এত ভালো ফিল্ম চলল না? নিনো বললেন, চলেনি কারণ খুব ভুল একটা দিনে এই সিনেমা রিলিজ করেছিল। ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১, ঠিক সেই দিনে দুনিয়ায় আরেকটা ব্লক বাস্টার রিলিজ করে, জলজ্যান্ত। সবাই সেসময়ে শুধু টিভি দেখত, কেউ সিনেমা হলে ঢুকত না। নিনোর কাছে ফিল্ম বানানোর কিছু টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি নিয়ে হাতে খড়ি হল আমাদের। কিন্তু তর সইছে না, কখন শুটিং শুরু করব? কখন?

    সোলোথুর্নের রাস্তায় রাস্তায় শুরু হল শুটিং, পুরোটাই আউটডোর। কখনও ক্যামেরা নিয়ে দৌড়চ্ছি, ট্রলি নেই, আমরা গরীব স্টুডেন্ট। একটাই ক্যামেরা, কাজেই এক অ্যাঙ্গেল থেকেই একেকটা সিন নিতে হচ্ছে, শুটিং চলছে, সামনে দিয়ে লোকজন হেঁটে গেল। কাট! সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এডিটিং, ল্যাপটপে মেমরি কম, ল্যাপ্‌টপ হ্যাং করে যাচ্ছে, তবু দমছি না আমরা। বাকিরা সন্ধেবেলা "আরে' নদীর ধারে আনন্দ করছে, আর আমরা কয়েকজন তখন বুঝতে পারছি সাউন্ড ডাবিং না করলে এ সিনেমার দেড়খানা ডায়ালগের আধখানাও কেউ বুঝতে পারবে না। এই করতে করতে বুধ শেষ হল, বেস্পতিবারও প্রায় শেষ। শুটিং শেষ। এডিটিং শেষ। ডাবিং এর কোনও চান্স নেই, তাই আমরা ওটাকে সায়লেন্ট মুভি বানিয়ে ফেললাম। উইথ সাবটাইটেল। সাবটাইটেলের ভাষা নির্ভেজাল সুইস্‌ জার্মান। ভাষা নয় ডায়ালেক্ট। আরেকটু আর্টিস্টিক টাচ দেবার জন্যে সিনেমাটাকে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট করে দেওয়া হল। রং নেবো ও না, রং দেবো ও না। শুধু নামটাই একটু ঘেঁটে গেল। সেটা স্টুকির দোষ। দেজাভু-র বদলে "শয়তানের দেজাভু'। এত খারাপ নাম লোকের মাথায় কীকরে আসে? সিনেমাকে ডিভিডিতে বার্ণ করে নেওয়া হল।

    শুক্রবার আমরা ফিরছি দুপুরের ট্রেন জুরিখের দিকে। অতএব বেষ্পতিবার রাতে একটু বেশিক্ষণ বাইরে থাকার অনুমতি পাওয়া গেল। খুব বেশি নয়, জাস্ট রাত বারোটা অবধি। আর আমাদের পায় কে? আমরা হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছি সোলোথুর্ন শহরে। রেস্টুরেন্টে যাবার পয়সা যাদের কাছে নেই, যেমন আমি, তারা নদী টদি দেখে , গান গল্প করে বেজায় ক্লান্ত হয়ে গেলাম, এমন সময়ে খবর এল, আমাদের নায়িকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সারা। যিনি খুন হলেন সিনেমায়। সেই বোতল, যেটা সিনেমায় দেখা গেছিল সেটা তো শেষ হয়েইছে, এডি-র সাহায্যে এরকম আরও কিছু পানীয় এসেছে এবং শেষ হয়েছে। মোট পাঁচজন এইসব কীর্তি করেছে, কিন্তু সারা নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রায় অজ্ঞান। অ্যাম্বুলেন্স এল। সারাকে নিয়ে ফ্রাউ স্টুকি হাসপাতালে গেলেন। গোটা ইউথ হস্টেলে থম্‌থমে ভাব। সারা বাঁচবে তো? বিষক্রিয়া? সেই পাঁচজনের মধ্যে চারজনকে (কারণ সারা বাদ, সে হাসপাতালে) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, কিন্তু তারা সব চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুম। কিন্তু শুক্রবার সকাল হতেই পাঁচজনকে ভোরের ট্রেনে জুরিখ পাঠিয়ে দেওয়া হল। সারাও তাদের সঙ্গে। ও তখনও অসুস্থ, স্টুকি ওকে ভোরবেলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। ওদের বলে দেওয়া হল, সোজা ইস্কুলে যাবে আর রেক্টরের সঙ্গে দেখা করবে! এদিকে ওদের প্রত্যেকের বাড়িতে ফোন করে করে বাবা-মাকে জানানো হয়েছে, আপনার ছেলে বা মেয়ে এই কীর্তি করেছে। সবচেয়ে বেশি ভয় হয়েছিলো আমার। আমিই তো ডিরেক্টর, ওই রিয়্যালিস্টিক কান্ডকারখানর জন্যে রিয়েল অ্যাল্‌কোহলের পার্মিশান তো আমি দিয়েছিলাম। ওরা আমাকে এক ফোঁটাও দেয়নি, আমি চাইওনি, তবুও আমারও যদি শাস্তি হয়? যদি ওরা বলে, মদ কে এনেছিল, কেন এনেছিল, এসব বুদ্ধি কে দিয়েছিল?

    খুব ভয়ে ভয়ে সোমবার ইস্কুল গেলাম। কিচ্ছু হয়নি। আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন ভুগোলের টিচার। উ:, কী ভালো লোক। সারা যেহেতু হাসপাতাল অবধি যাবার মতো অবস্থায় নিজেকে নিয়ে গেছল, তাই ওকে একটা ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে, আর ওদের পাঁচজনকে ইস্কুল বাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। শাস্তি। এই সব ঝামেলায় সিনেমার ব্যাপারটাই সবাই ভুলে গেল। সেদিন দেখছিলাম ডিভিডিটা। আমার নিজের বানানো প্রথম সিনেমা। দ্বিতীয়টা এখনো বানানো হয়নি যদিও। আর লিখেই ফেললাম এই প্রবাসীর পত্র যতক্ষণ প্রবাসী আছি।

    ইস্কুলের গপ্পো - মঁসিও ব্লঁশে, এম'রাদ আর মাদাম গোলা
    পারিজাত, সুইটজারল্যান্ড
    ১৫.০৩.২০০৭
    এই পুঁচকে সুইটজারল্যান্ডের ২৬টা ক্যান্টনের মধ্যে সবসময় রেষারেষি চলছে। প্রতিটা ক্যান্টনের নিজস্ব কিছু কিছু আইনকানুন তো বটেই, এমনকি ইস্কুলের সিলেবাসগুলো পর্যন্ত আলাদা। আর সবাই বলে চলেছে "আমি ভালো, আমি ভালো'। কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রুতা হচ্ছে ফ্রেঞ্চ পার্টের সঙ্গে জার্মান পার্টের। একদিকে ভাষা জার্মান তো অন্যদিকে ফ্রেঞ্চ। কোনো জার্মান ক্যান্টন থেকে ফ্রেঞ্চ ক্যান্টনে ঢুকলে মনে হবে, যেন অন্য কোনো দেশে এলাম। ভাষা চালচলন কালচার একদম আলাদা। আর সুযোগ পেলেই একে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে আর অন্যকে নীচু দেখাবার চেষ্টা করে। এইরকম অবস্থায় আমাকে একবার জার্মান পার্ট থেকে গিয়ে ফ্রেঞ্চ পার্টে থাকতে হয়েছিলো কয়েক বছর। শুধু থাকলেই তো হবে না, ইস্কুলে ভর্তি হতে হবে। আমি তখন জার্মান পার্টে সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছি, মানে প্রাইমারি ইস্কুল শেষ, সেকেন্ডারি ইস্কুল শুরু। চলে আসার আগে জুরিখের ইস্কুল থেকে বলে দিল, "এখানেও যেমন সেকেন্ডারি ইস্কুল আছে, ফ্রেঞ্চ পার্টেও সেরকম থাকা উচিত, কিন্তু ওদের ইস্কুলের সিস্টেম বা সিলেবাস আমরা জানি না, ওখানে গেলেই জানতে পারবে।'

    এসব শুনে প্রথমেই আমার কীরকম একটা যেন খটকা লেগেছিল, কিন্তু কেউ আমাকে আমল দিল না। যাইহোক, ফ্রেঞ্চ পার্টের সেই শহরটার নাম ল্যোজান, সেই ল্যোজানে পৌঁছেই আমি একটা জিনিস খুব ভালো করে বুঝে গেলাম, যে এরা ফ্রেঞ্চ জানে আর আমি ফ্রেঞ্চ জানি না। আমি যখন প্রথম ল্যোজানে আসি, তখন ওখানে নতুন সেশন শুরুর আগে গরমের ছুটি চলছিল ইস্কুলগুলোতে। সুইটজারল্যান্ডের আইন হচ্ছে যে যাদের বয়েস ষোলোর নীচে, তাদের ইচ্ছে থাক বা না থাক ইস্কুলে যেতে হবেই, বাড়িতে বসে থাকা চলবে না। কোন ক্লাসে ভর্তি হব সেটা ওরা পরীক্ষা নিয়ে ঠিক করবে। যথাসময়ে একটা বিরাট থামওয়ালা থমথমে বাড়িতে "পরীক্ষা' দিতে গেলাম। সঙ্গে গার্জেন, মানে মা। তখন বেশ বিকেল হয়ে গেছে, আর গরমের ছুটি বলে সেই থমথমে স্কুলবাড়িটায় প্রায় কোনো লোকই নেই। কোন বিষয়ের ওপর পরীক্ষা দিতে হবে সেটাও জানি না। তখন অগাস্ট মাস, প্রচন্ড গরম। ল্যোজানের সামনে যে বিরাট লেকটা আছে, যার নাম লাক-লেমাঁ তার উল্টোদিকে ফ্রান্সে বেশ কিছু লোক গরমে মারা গেছে। ইস্কুলটা একটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে, আর ইস্কুলে ঢুকতে হলে ষাট-সত্তর ধাপ সিঁড়ি উঠতে হবে। এমনি সময় হলে আমি লাফিয়ে লাফিয়ে ষাট সত্তর কেন একশো দুশো তিনশো ধাপ সিঁড়ি উঠে যেতাম, কিন্তু "পরীক্ষা' ছিল বলে, মনে হচ্ছিল যেন অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই এভারেস্টে উঠছি আর ওই রকম গরমেও আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

    তারপরে ওখানে একটা ঘরে মাকে আর আমাকে নিয়ে গেল। ঘরটার ছাদ বিরাট উঁচু আর সবকটা দেয়াল সিলিং অবধি লম্বা বুকশেল্ফ দিয়ে ঢাকা। বুকশেল্ফ ভর্তি বই। কিন্তু কী আর বলব, কাছ থেকে ওগুলো দেখে আমার মুখ বেজার হয়ে গেল; অত ভালো ভালো বুকশেল্ফে ফেলুদা হ্যারিপটারের মতো রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস না রেখে একগাদা টেকস্ট বুক আর ফাইল রেখে সমস্ত জায়গা নষ্ট করেছে। তবুও আমি হাসি হাসি মুখ করে মায়ের পাশে বসে রইলাম, আর টেবিলের উল্টোদিকে এসে বসলেন দুজন। একজন হচ্ছেন স্কুল অথরিটির ডিরেক্টর, মঁসিও ব্লঁশে ( ফরাসিতে মঁসিও মানে মিস্টার) আর অন্যজন এক মহিলা - নাম ভুলে গেছি। মহিলা হচ্ছেন ব্লঁশে ও আমাদের মধ্যে ইন্টারপ্রেটার, কারণ ব্লঁশে একটিই ভাষা জানেন, ফরাসি। আর ইন্টারপ্রেটার জানেন দেড়খানা ভাষা, ফরাসি ও অল্প ইংরিজি। কথাবার্তা যা হচ্ছে সব ওই মহিলার সঙ্গেই হচ্ছে। পৃথিবীর যে কোনো ইস্কুলে ভর্তি হতে গেলে যা করতে হয়, করা হলো, মানে মা ফর্ম ফিলাপ করল। পনেরো মিনিট ধরে মা আমার জীবনের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিল, যথা, আমার নাম, আমার মা-বাবার নাম, আমি কবে জন্মেছি, আমি ছেলে না মেয়ে, ইত্যাদি। এরপর আসল পরীক্ষা।

    প্রথম প্রশ্ন, আমি কোন ভাষা জানি।
    আগ বাড়িয়ে এই প্রথম আমি উত্তর দিলাম - "বাংলা, ইংরিজি, হিন্দি, জার্মান..."
    অমনি টেবিলের ওপারে ব্লঁশের মুখে হাসি খেলে গেল। ব্লঁশে ও সেই মহিলার মধ্যে অল্প ফিশফিশ হল, মহিলা সেই শেল্ফগুলোর কাছে গিয়ে সেখান থেকে ইয়াব্বড় একটা ফাইল নিয়ে এলেন। ঘোষণা করা হল, এখন আমার বাংলা পরীক্ষা নেওয়া হবে।
    সেই ফাইল থেকে বেরোলো একতাড়া কাগজ আগাগোড়া বাংলায়। সেখান থেকে একটা কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মহিলা বললেন, "রিড'। আমি "রিড' করলাম, মানে রঙ্গাভঙ্গার গল্প, সেই মন্ত্যেস্যরীর আমলের গল্প, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়লাম। বুঝছি শুধু মা আর আমি। এবার মাকে দিয়ে ওই লেখাটার ডিক্টেশান দেওয়ালো ওরা, আর আমি লিখলাম। খাতা কারেক্ট করল মা! সব ঠিক। কোনো বানান ভুল টুল নেই। সেই মহিলার মুখে হাসি ফুটল, কারণ আমি কলকাতা থেকে কত হাজার মাইল দূরে জানি না, ল্যোজান বলে একটা শহরে, যেখানকার অধিকাংশ লোকই জানে না যে বাংলা বলে কোনো ভাষা আছে, সেখানে আমি আমার বাংলা পরীক্ষা পাশ করেছি! এই ব্যাপারগুলো যখন ঘটছিল, তখন আমি ঠিক "থ' হয়ে গিয়েছিলাম না কি, সত্যিই এখন বলতে পারব না। এরপরে শেল্ফের ওপরের তাক থেকে গাবদা সাইজের ইংরিজি বই এল, ইংরিজি পরীক্ষা হল। এখন অবশ্য ওই মহিলাই পরীক্ষক। এই পরীক্ষাতেও রীডিং, ডিক্টেশান। ইংরিজিতেও বিনা অসুবিধায় পাশ। এরপরে কেন জানি হিন্দি পরীক্ষা নিল না। জার্মান পরীক্ষা নেবার জন্যে ওই দুজন এবার রেডি হচ্ছে দেখলাম। আমার মাথায় প্রশ্ন ঘুরছে, এই ঘরে মোট চারজন, তারমধ্যে মাত্র একজন জার্মান জানে, সেইজন হচ্ছি আমি, তাহলে পরীক্ষাটা কে নেবে? কীকরে নেবে? এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখি, আরেকটা গোবদা জার্মান বই আসছে। আমি তৎক্ষণাৎ বলে ফেললাম, আরে: এই বইটাতো আমার পড়া! এই শুনে মহিলা হাসিমুখে বই সরিয়ে রাখলেন। জার্মানেও পাশ? ইশ্‌ আমার হিন্দিটা কেন কেউ ধরলো না?

    এবার অঙ্ক। অঙ্ক দেবেন স্বয়ং ব্লঁশে। মুখে মিটমিট করছে হাসি। প্রথমে সহজ সহজ অঙ্ক আসছিল, যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ..., তারপরে ব্লঁশে (ওই মহিলাকে দিয়ে) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পিথাগোরাস জানি কিনা।
    পিঠে-গরাস? এরকম কোনো শব্দ আমি আগে শুনিনি। কী সেটা?
    -পিথাগোরাসের থিয়োরেম।
    না: আমি পিথাগোরাস ও শুনিনি আগে, থিয়োরেম ও শুনিনি আগে।
    এই শুনে ব্লঁশের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।
    তিনি ঠিক করলেন, ছুটির শেষে আমাকেও ইস্কুল যেতে হবে, কিন্তু অন্য সবার মতো নয়, স্পেশাল ক্লাসে। হয়তো আমার দোষ এই, যে আমি থিয়োরেম ও জানি না, পিথাগোরাস ও জানি না। সেই স্পেশাল ক্লাসে আমাকে দেড় বছর ধরে ফরাসি শিখে আগে উপযুক্ত হতে হবে, তারপরে সমবয়সিদের সঙ্গে ঠিকমতো ইস্কুলে যেতে পারব। দেড়বছর বলতে মনে পড়ল, এই ঘটনার দেড় বছর পরে, তখন অবশ্য আমি আমার সমবয়সি সুইসদের সঙ্গেই ফরাসি ভাষায় পড়াশোনা করতাম। সেসময়ে অঙ্ক ক্লাসে এই পিথাগোরাসের নাম শুনেছিলাম সবাই, তফাতটা হলো, আমি শুনেছিলাম নামটা দ্বিতীয়বার আর আমার ক্লাসের বন্ধুরা সেদিনই প্রথম এই গ্রিক নামটা শোনে।

    গরমের ছুটি টিভি দেখে আর সোফার ওপর ঘুমিয়ে কেটে গেল। ছুটির পরে নতুন ইস্কুল, বাড়ি থেকে পনেরো মিনিট। পাঁচমিনিট বাসে, আর দশমিনিট খাড়া পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা। পাহাড়ে চড়তে চড়তে যখন জিভটা পুরো বেরিয়ে যায়, তখন ইস্কুলে এসে পৌঁছই। ক্লাসের বাকি সবাই আমার মতো ফরাসি শিখতে এসেছে। বাকিরা সবাই পোর্তুগিজ বা স্প্যানিশে কথা বলে, আমি একমাত্র বাঙালি, তাই টিচার আমার হাতে একটা তামিল ডিকশানারি দিলেন। উনি বললেন, আমাকে দেখেই নাকি উনি বুঝে ফেলেছেন, যে আমিও নির্ঘাৎ কোনো তামিল রিফিউজি। এই টিচারের নাম, মাদাম এম'রাদ। অরিজিন বোধহয় মরক্কো বা তুনিসিয়ার, তফাত আমি জানি না, ঠিক যেরকম উনি বাঙালি তামিলে তফাত বোঝেন না। উনি পড়াতেন ফরাসি আর জার্মান। আমাদের আরো শিখতে হত সেলাই আর অঙ্ক। সব ক্লাস ফরাসিতে হয়, এম'রাদ ঘন্টার পর ঘন্টা কী যে বলে যান, আমি কিছুই বুঝতে পারি না। কখনো কখনো হাত তুলি, কিছু বুঝতে পারছিনা, অমনি এম'রাদ ক্যাঁ ক্যাঁ ক্যাঁ ক্যাঁ করে কীসব বলেন আমাকে, মোটকথা খেদিয়ে দেন। খেলার ক্লাসটায় মোটামুটি বুঝি। আর অঙ্ক নেন অন্য একজন। এই ক্লাসে কোনো ভাষা লাগে না, আমি একটার পর একটা অঙ্ক করে ফেলি, প্রথমে দশটা, তারপর কুড়িটা, তারপর পঞ্চাশ, একশো, দুশো, সব কারেক্ট। অঙ্ক বইয়ে কোনো প্রশ্নের অঙ্ক নেই।

    আমার প্রায় কোনো বন্ধুই নেই, কারণ আমি পোর্তুগিজও জানি না, স্প্যানিশও না, চুপচাপ থাকি। অন্যরা মোবাইলফোনে একে অন্যকে এস.এম.এস পাঠায়, টেবিলের নীচে নোখে নেলপালিশ লাগায়, ক্যালকুলেটার দিয়ে অঙ্ক করে। তবু একটা বন্ধু প্রায় হতে যাচ্ছিল, আড়াই সপ্তাহ ওই ইস্কুলে পড়তে না পড়তেই আমাকে আবার ইস্কুল বদলাতে হল। বাড়ি বদলানো হয়েছিল বলে নতুন বাড়ির কাছে আরেকটা ইস্কুলে আমাকে যেতে হল। ল্যোজানের পাশে একটা ছোট শহরে। বাসে করে এক স্টপেজ গিয়েই আট দশ মিনিট হেঁটে এই ইস্কুল, কোনো পাহাড়ে চড়তে হয় না। নতুন ইস্কুলে প্রথম দিন এসে পৌঁছলাম খুব ভোরে। মা আমাকে আমার নতুন টিচারের কাছে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। এই নতুন টিচারের বয়েস পঞ্চাশের ওপরে। দেখলে এম'রাদের মতো ভয় করে না, বরঞ্চ ভয় থাকলে ভয় চলে যায়। ঠিকমতো বর্ণনা দিতে গেলে বলব, উনি একসঙ্গে দিদিমা, ঠাকুমা আর মা। ওঁর নাম মাদাম গোলা। মারি-ক্লদ্‌ গোলা। উনি খুব অল্প ইংরিজি বলতে পারেন। খুব অল্প। নতুন ইস্কুলটা আমার তখন ভালো লাগছে, ক্লাসে তখনো কেউ আসেনি। মাদাম গোলা হঠাৎ আমার কাছে এসে বললেন "ক্যান ইউ স্ক্রাইব'? আমার এই প্রশ্নটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিল। "স্ক্রাইব"? এটা কোন দিশি শব্দ? ইংরিজি? হতেও পারে। আমি কি ইংরিজির সব জানি? জার্মানে এর কাছাকাছি একটা শব্দ আছে যেটা আমার জানা, "শ্রাইবেন', লিখতে পারা। আমি মাদাম গোলার মুখের দিকে তাকালাম, ওঁর স্নেহশীল মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, হয়তো প্রশ্নটা ভুল বুঝেছি, কিন্তু উত্তর তো দিতে হবে; আরো কিছুক্ষণ ভেবে আমি ইংরিজিতে উত্তর দিলাম, "হ্যাঁ আমি লিখতে এবং পড়তে পারি'।

    প্রবাসে হ্যারিপটার
    পারিজাত, সুইটজারল্যান্ড
    ২৬.০৭.২০০৭
    চার বছরের মধ্যে তিনটে হ্যারিপটার এর বই বেরোলো - পাঁচ, ছয় আর সাত। সুইটজার্ল্যান্ডের একটিমাত্র দোকানে এই বই সে¾ট্রাল ইউরোপিয়ান টাইম একটা মানে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড টাইম রাত বারোটায় প্রথম বিক্রি করতে থাকে। দোকানটার নাম, ওরেল ফুয়েস্‌লি ইংলিশ বুক শপ। জুরিখ শহরে। কাজেই, বইটা একদম প্রথম প্রথম কিনতে হলে ঐ সময়ে জুরিখে কিংবা জুরিখের আশেপাশে থাকতেই হবে। পাঁচ নম্বর বই, দ্য অর্ডার অফ্‌ দ্য ফিনিক্সের সময়ে আমার প্রথম রাত একটায় বই কিনতে যাওয়া। তখন আমার বয়েস ছিল বারো, ইস্কুলে আমার চেয়ে এক বছরের বড় বন্ধু দারিয়া আমাকে বলেছিল, ও যাবে গভীর রাতে বই কিনতে। আমি অবশ্য তখনও জানতাম না যে চার নম্বর বইটা থেকেই যে এই বইটা বেরোনোর মুহূর্তে এত টেনশন হয়। সেবার ওই ইংলিশ বুকশপ কোথায় আমার জানা ছিল না, আর বইটার দামও প্রচন্ড, আর সবচেয়ে ঝামেলার ব্যাপার হচ্ছে ওই সময় - রাত একটায় শুধু একটা বই কিনবার জন্যে কোনও বাঙালি মা কি তার বাচ্চাকে একা একা ছেড়ে দেবে? দেবে না, জানি। দারিয়াকে তাই আর কিছু বললাম না। কিন্তু সত্যি সেই রাতে আমরা বই কিনতে বেরিয়েছিলাম।

    ইংলিশ বুকশপ টা একেবারে জুরিখের মধ্যিখানে, বান্‌হফ্‌ষ্ট্রাস্‌সে তে। ওই রাস্তায় গাড়ি চলে না, বাস চলে না, শুধু ট্রাম চলে আর লোকে হাঁটে। জুরিখের মেইন রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে জুরিখ লেকের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। লম্বা রাস্তা, আর তার দুদিকে শুধু দোকান আর দোকান, দামি দামি দোকান। উইন্ডো শপিং এর সবচেয়ে ভালো জায়গা। সেবার আমরা পৌঁছেছিলাম, রাত বারোটা নাগাদ। দোকানপাট সব বন্ধ। শুধু কিছু বার আর নাইটক্লাব তখনও খোলা। দিনের বেলায় যে রাস্তায় লোক গম্‌গম্‌ করে, সেখানে লোক তখনও আছে, কিন্তু অনেক অনেক কম। ওয়েরেল ফুসলির দোকানটা এই রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি। তার সামনে দেখলাম জড়ো হয়ে রয়েছে গোটা কুড়ি পঁচিশ লোক আর সেই সঙ্গে সুইস টেলিভিশনের ক্যামেরাটিম। দোকানের দরজা খোলা, ভেতরে একটা খাঁচার মতো জায়গায় স্তুপ করে রাখা আছে অর্ডার অফ দ্য ফিনিক্সের বইগুলো। আমি লোভী লোভী চোখে বইগুলো দেখে এলাম, হাত বাড়ালেও ধরতে পারবো না জেনেও।

    একটু পরেই এসে গেল দারিয়া, সঙ্গে তার মা। আস্তে আস্তে লোক বাড়তে লাগল দোকানের সামনে। কেউ সেজে এসেছে হারমৈনি, কেউ সেজেছে হ্যারির মতো, আর কেউ কেউ শুধু কালো পোশাক আর মাথায় ছুঁচোলো কালো টুপি। দোকানের সামনে জ্বলছে দুটো মশাল। মাশালগুলোর মাঝখানে রাখা হয়েছে একটা দেয়াল ঘড়ি। ঘড়িটার কাঁটা টিক্‌টিক্‌ করে এগিয়ে চলেছে একটার দিকে। টোটাল থমথমে অবস্থা। একটা বাজতে কিছু দেরি, আমরা দোকানের ভেতরে ঘোরাঘুরি করছি, আর বাইরে এক রাশিয়ান মা (দারিয়ার মা) আর এক বাঙালি মা (আমার) প্রচন্ড গল্পে ব্যস্ত। তাদের গল্পের মূল টপিক হচ্ছে, উফ্‌ আজকালকার বাচ্চাদের নিয়ে আর পারি না, কি মুশকিল দেখুন তো? এতো রাতে বই কিনবার হুজুগ, অথচ ক্লাসের টেক্স্‌ট্‌ বুকগুলো যদি একটু পড়ত,... অর্থাৎ মায়েরা সাধারণত যা যা বলে থাকে।

    ঘড়ির কাঁটা একটাকে ছোঁবার আগেই কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছিল, টেন, নাইন, এইট, সেভেন, ... থ্রি, টু, ওয়ান! হু উ উ উ উ উ উ উ উ উ উ উ ...... বিক্রি শুরু হয়ে গেল। আমার পরে কিনল বইটা দারিয়া। দোকানের বাইরে এসে আমরা ঠিক করলাম, বাড়ি পৌঁছেই বইটা পড়া শুরু করব, যে প্রথম শেষ করতে পারবে, সে জিতে গেল। অর্ডার অফ্‌ দ্য ফিনিক্স ছিল সবচেয়ে মোটা বই। প্রায় না ঘুমিয়ে টানা পড়ে, পুরো শনিবার আর রবিবাবের দুপুর কাটিয়ে বিকেল বেলা আমার বইটা পড়া শেষ হল। আমি দারিয়াকে এস্‌এম্‌এস্‌ করলাম, উত্তর এলো দারিয়ার এস্‌এম্‌এস্‌এ- ও তখনো পড়ছে। ছ নম্বর বইটা, মানে হাফব্লাড প্রিন্সের সময়ে অবশ্য আমরা জুরিখে ছিলাম না, ছিলাম বহুদূরে লোজান শহরে, সেখান থেকে চেষ্টা করলে একরাতের জন্যে জুরিখে এসে বইটা কি কিনে নেওয়া যেত না? যেত। তবু সেবার জুরিখ আসা হয়নি, শনিবার সকালে লোজানের একটা দোকান থেকে কিনেছিলাম বইটা। আমার সব বন্ধুদের থেকে আগে। কারণ বন্ধুরা ইংরিজি পড়তে পারত না কেউ। ওদের দেরি হত আরও তিন চার মাস, বইটা ফরাসি তে অনুবাদ হয়ে কবে বেরোবে, সেই অপেক্ষায়।

    সাত নম্বর বইয়ের সময়ে আমি আবার জুরিখে। এবার আমার বয়েস ষোলোর বেশি, কাজেই অত রাতে রাস্তায় একা একা বেরোলে কারও কিছু বলবার নেই (তা সত্ত্বেও, একা কি আর যেতে দেয় বাড়ি থেকে)। বইটার দাম আগেই দিয়ে রেখেছিলাম দোকানে। যাতে রাত একটায় ক্যাশ কাউন্টারে হুড়োহুড়ি না পড়ে যায়, বই কিনবার প্রমাণের স্লিপ জমা দাও আর বই নাও, এইরকম ব্যবস্থা ছিল। সোয়া বারোটায় দোকানের কাছাকাছিও যেতে হল না, দূর থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি কী ভিড় কী ভিড়! জুরিখে ইংরিজি জানা লোকের সংখ্যা এই চারবছরে এত বেড়ে গেল নাকি? নাকি ইংরিজিতে হ্যারিপটার পড়িয়েদের সংখ্যা বেড়েছে? নাকি রাত একটায় বই কিনবার লোকেরা বেড়েছে সংখ্যায়? কে জানে! ভিড় উপ্‌চে পড়ছে বান্‌হফ্‌ষ্ট্রাস্‌সে-তে। দুটো লাইন, এক- যারা আগে থেকেই কিনে রেখেছে, আর দুই- যারা সঙ্গে সঙ্গে কিনবে। দুটোই সমান লম্বা। এবারও দাউ দাউ করে জ্বলছে মশাল, সেই ঘড়িটাও চলছে টিক টিক করে। পাশে সেই প্যাঁচাটাকেও রাখা আছে। দোকানের ভেতরে টেলিভিশন টিম, বাইরে আমাদের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু ম্যাজিশিয়ান, সবাই কালো পোশাকে, হাতে বিরাট বিরাট থলে, কেউ কেউ বিরাট উঁচু উঁচু রণপা পরে। এরা সবাই কথা বলছে ইংরিজিতে। আমরা যাতে বোর হয়ে না যাই, দোকান থেকেই বিলি করছে হ্যারিপটার কুইজ-এর কাগজ। এবার হাজারের অনেক বেশি লোক। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল প্রায়। না, স্ট্যামপিড হবার কোনও সম্ভবনা নেই। সিকিউরিটাস-এর প্রাইভেট গার্ডরা হাসিমুখে সামলাচ্ছে লাইন। আবার শুরু হল কাউন্ট ডাউন, খুলল দোকান, পাশাপাশি দুটো লাইন ঢুকতে শুরু করল দোকানে। স্লিপ জমা দিয়ে বইটা হাতে নিয়ে প্রায় উড়তে উড়তে সবাই বেরোচ্ছে দোকান থেকে। বেরিয়ে দেখি বান্‌হফ্‌ষ্ট্রাস্‌সে দিয়ে চলছে বাস। বাস? এই রাস্তায় তো ট্রাম ছাড়া কিছু চলে না? তাহলে? ওহ্‌হো! রাত অনেক গভীর হয়ে গেছে তো, লাস্ট ট্রাম ও চলে গেছে, তাই তখন চলতে শুরু করেছে নাইট বাস; এই বাসগুলোর নম্বরের আগে এন্‌ থাকে, ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে পরপর চলে গেল দু দুটো নাইট বাস। হ্যারিপটারের সেই যশভফবঢ় থয়ড় নয় কিন্তু!

    দ্য ডেথলি হ্যালোস্‌ পড়তে আমার লাগল পনেরো ঘন্টা। বইটা পড়বার আগে যত গুজব, যত খবর, যত জল্পনা কল্পনা, তার একটাতেও কান দিইনি আমি; দিলে আমারই ক্ষতি, আমারই গল্পটা এক নি:শ্বাসে পড়বার আকর্ষণ কমে যেত। এত ঠিক ডিটেকটিভ গল্পের শেষ চ্যাপ্টার বলে দেবার মতো ব্যাপার নয়। কারণ হ্যারিপটার কোনও ডিটেকটিভ গল্প নয়। শুধু মন খারাপ লাগছে, যে শেষ বইটাও বেরিয়ে গেল। আর সেই পরের বইটার জন্যে প্রতীক্ষা করতে হবে না, গভীররাতের বান্‌হফ্‌ষ্ট্রাস্‌সে, নাইটবাস, কম্পিটিশান দিয়ে কে সবার আগে বইটা পড়ে ফেলবে, নতুন বইটা হাতে নিয়ে প্রায় উড়ে যাওয়া, এই সব আনন্দ শেষ। এর পরেও হয়ত আসবে রেকর্ড ভাঙা বিশ্বের আরো কোনো বেস্ট সেলার, আসুক, আসতেই পারে, কিন্তু হ্যারিপটার নিয়ে যে জগৎ সেটা থেকে যাবে বেশ কিছু সময়। হ্যারিপটার একটা ক্ল্যাসিক।
  • 12 | 185.220.101.4 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:০৮741421
  • জল-জঙ্গল-মানুষ
    রঞ্জন রায়
      
    না:, ভাগ্য বলে যে একটা কিছু আছে তা মানতেই হবে। নইলে এই আক্রাগন্ডার বাজারে এত সহজে একটা চাকরি পেয়ে যাই! পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর "বেরোজগার' ছিলাম মাত্র চারমাস। পোস্টগ্র্যাজুয়েট! তা ছত্তিশগড়ের রাজধানী এই রায়পুর শহরের অলিগলিতে গন্ডায় গন্ডায় পাওয়া যাবে। আর এদের দৈনন্দিন দিনচর্যার একটাই বাঁধা ছক।

    বাবা, দাদা বা বাড়ির কর্তাব্যক্তিটি ঘর থেকে বের হওয়া অবধি মটকা মেরে শুয়ে থাকা। তারপর এককাপ চা ও শুকনো রুটি চিবিয়ে পাড়ার সেলুন বা পানঠেলার সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ গালগল্প। কেউ কেউ আবার পাড়ার গার্লস স্কুল ছুটির সময় আমাদের আড্ডা বা "ঠিহা'র থেকে ছটকে যায়, খানিকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের ভাষায় "আই টনিক' নিয়ে আসে।

    এরপর আছে খবরের কাগজে কর্মখালির বিজ্ঞাপনে চোখ বোলানো, পাড়ার পলিটিক্স -- আর যারা ইতিমধ্যে চাকরি পেয়ে দলের বাইরে হয়েছে তাদের নিয়ে অম্লমধুর মন্তব্য। আরও আছে -- শহরের নবীনতম কেচ্ছা, দুপুরে খিদে পেলে বন্ধুদের কাউকে মুর্গি বানানোর চেষ্টা, এবং শহরের "বিধায়ক' ভাইয়াজি বা নগরনিগমের নতুন "পার্ষদ' চাচিজির কাছে চাকরির জন্যে বন্ধুদের চোখ এড়িয়ে গোপন উমেদারি। আর তারপর আছে অনেক রাতে পা টিপে টিপে ঘরে ঢোকা এবং ঢেকে রাখা ঠান্ডা ভাত খেয়ে মশারি গুঁজে শুয়ে পড়া।

    আমি, অর্থাৎ আপনাদের রামসাগরপাড়ার মনবোধ কৌশিকও এই নিয়মের বাইরে ছিলাম না। তবে চারমাসের নতুন বেকার তো, কাজেই ইলেকট্রিক বিল সময়মতো জমা দেওয়া বা র‌্যাশন দোকানে লাইন দিয়ে চিনি-কেরোসিন তেল জোগাড় করা এগুলো নিয়ে বেশি ধানাইপানাই করতাম না।

    এমন সময় বেড়ালের ভাগ্যে কখনও সখনও শিকে ছেঁড়ার মতো হঠাৎ একটা চাকরি জুটে গেল।

    চাকরি হল এক আধাসরকারি সংস্থায় যাদের কাজ পাহাড়ে-জঙ্গলে, মাটির নীচে খনিজ সম্পদের সার্ভে করা, নকশা বানানো ইত্যাদি। আমার কাজ হল এই সংস্থার একটি ক্যাম্পে গিয়ে সাইট অফিস সামলানো। একাধারে টাইপিস্ট কাম ক্যাশিয়ার কাম স্টোরকিপার -- থ্রি ইন ওয়ান।

    বদলির চাকরি, জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরার চাকরি। তা হোক গে, আপাতত ঘরের আবহাওয়াই গেছে বদলে।

    বাবার রিটায়ার হতে মাসসাতেক বাকি, কপালের ভাঁজ অনেকটা মসৃণ হয়েছে। বোন খুশি -- এবার ভাতখণ্ডে সঙ্গীত বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ঠেকায় কে! আর মা এখন পুত্র গরবে গরবিণী। ছেলে তার ফ্যালনা নয়। পাড়ার অন্য বেকার ছোঁড়াগুলোর সঙ্গে কোনও তুলনা হয় না।

    বলি, দেবাংগনগিন্নির ছেলেও তো শুনি রাজকুমার কলেজের পাশ। কই, করুক তো জোগাড় এমন একটা চাকরি! পাশের বাড়ির দীপকের জ্যাঠামণি বা তাউজি হলেন তহশীলা অফিসের "বড়েবাবু'। কিন্তু, বছর ঘুরতে চলল, আজও কোনও হিল্লে হয়নি। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া! মাঝেমধ্যেই দীপকের বাবা পান্ডেচাচাকে ছেলের জন্য উঠতি বয়সের মেয়েদের পেছনে লাগার বা "ছেড়ছাড়' করার অভিযোগ শুনতে হয়।

    তবে বাইরে যাই দেখাক, ভেতরে ভেতরে মার বুক মুচড়ে মুচড়ে উঠছে।

    একমাত্র ছেলে, খাওয়াদাওয়ার বড় বাছবিচার। ঘরে তো একগ্লাস জলও গড়িয়ে খায় না। বাইরে দেহাতি এলাকায়, জলে-জঙ্গলে ওর হাজারো বায়নাক্কা কে সামলাবে? কেমন করে কাটবে দিন?

    কেমন করে কাটবে সে তো আমিও জানিনে। ছোটবেলা থেকেই এই রায়পুর শহরে বড় হয়েছি। এর প্রতিটি অলিগলি নাড়িনক্ষত্র আমার চেনা, আমার জানা। একে ছেড়ে যেতে হবে। জয়স্তম্ভ চৌকের সামনের গন্নারসের দোকান, ভেলপুরি চাটের ঠেলা, শাস্ত্রীচৌক আর কফি হাউস আর গান্ধিপার্কের আড্ডা -- এগুলো ছিল আমার দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

    এসবই ছাড়তে হবে। একটু একটু করে নয় -- একসঙ্গে। এ যেন আমার আত্মার সার্জারি করা হচ্ছে। আর আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধুর দল? যাদের সঙ্গে দু'বেলা মিঠেপাত্তি পান এবং সিগ্রেট সহযোগে দুনিয়ার খবর, পাড়ার কেচ্ছা এবং নতুন সিনেমা নিয়ে না কপচালে পেটের ভাত হজম হত না, তারা সবাই ধীরে ধীরে "আঁখোসে দূর, দিলসে ভি দূর' হয়ে যাবে!

    তবু ভেতরে ভেতরে একটু রোমাঞ্চ, একটু কৌতূহল ঠিকই ছিল।

    প্রথম চাকরি, প্রথম মাইনে। মনের ভেতর ভয়, আশা-উৎকণ্ঠা সব মিলে তালগোল পাকিয়ে একটা বোদা-বোদা ভাব। আচ্ছা, বিয়ের পর প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যেতে মেয়েদেরও কি ঠিক এমনই লাগে?

    যা হোক, একদিন রেলগাড়ি ছাড়ল। ধুতির খুঁট দিয়ে বারবার চশমার কাচ মুছতে থাকা বাবার চেহারাটি ঝাপসা হয়ে এল। মালপত্তর গুছিয়ে নিয়ে একটি "জাসুসি' উপন্যাস বা গোয়েন্দাকাহিনীতে চোখ বোলাই। মন লাগাতে পারি না। নতুন চাকরি -- কেমন হবেন আমার জীবনের প্রথম বস? কেমন হবে থাকার জায়গা, পরিবেশ? কোথাও কোনও পাহাড়ের খাঁজে, নদীর বাঁকে আমার জন্যে কি কোনও আদিবাসি মেয়ে দু-বাহু বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে, -- "আজ মেরা বলমা, তেরা ইন্তেজার হ্যায়'।

    কখন যে ঘুম এসে গেল বুঝতে পারিনি। কোন স্টেশনে লোকজন ওঠানামার শোরগোলে চটকা ভাঙতেই দেখি গাড়ির গতি বেড়েছে, চারপাশের দৃশ্য বদলেছে, আর তার সঙ্গে তাল রেখে বদলে গেছে যাত্রীদের চেহারা, বেশভূষা। পুরুষদের গোঁফ ও গালপাট্টা অনেক কমেছে, মেয়েদের কানে-নাকে পেতলের চ্যাপ্টা গয়না, মাথার চুল চূড়ো করে বাঁধা। ব্যাটাছেলেরা ঘোলাটে চোখে নির্বিকার মুখে তামাক চিবোয় আর ট্রেনের কামরার মধ্যেই পিচ করে থুতু ফেলে। মেয়েরা আমার শহুরে কানের তুলনায় বড় বেশি উচ্চগ্রামে গল্প চালিয়ে যায় -- যেন ঝগড়া করছে। তবু সবেরই একটা শেষ আছে। ভর বিকেলে পৌঁছলাম আমার গন্তব্যস্থল -- একটি ছোট্ট স্টেশন।

    স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে কথা বলে মনে হল আমার টেলিগ্রাম বোধহয় পৌঁছয়নি। এটা জানা গেল যে তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে তবে আমাদের ক্যাম্পে পৌঁছনো যাবে। উনি সঙ্গে একজন লোক দিলেন। সে তার কাঁধের বাঁকে, স্থানীয় ভাষায় "কাঁওড়'-এ, ঝুলিয়ে নিল আমার বিছানা আর সুটকেস।

    হেমন্তের শেষ। মাত্র ধানকাটা শেষ হয়েছে। শুকনো ক্ষেতে খোঁচা খোঁচা ধানের গোড়া আর আল ভেঙে গরুর গাড়ির চলার পথ (স্থানীয় ভাষায় "গাড়া' রাবণ)। অনভ্যস্ত পায়ে সাবধানে চলতে গিয়ে খালি পিছিয়ে পড়ছি।

    ধানের ক্ষেতে পেরিয়ে একটা ছোট্ট মহল্লা, তারপর জঙ্গল, শেষে একটু ফাঁকা পাথুরে মাঠ বা "ভাটা'। সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া আঙিনায় লোহার ফ্রেম, কাঠের বিম আর করোগেটেড টিনের শিট দিয়ে তৈরি গোটা দুই ব্যারাকবাড়ি। -- এই আমার অফিস, এই আমার কোয়ার্টার। আঙিনায় রয়েছে গোটা দুই ড্রিলিং মেশিন, কাঁটাতারের বান্ডিল আর কিছু লোহালক্কড়।

    প্রথম দর্শনে মনটা বেশ দমে গেল। আমাদের সাড়া পেয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক বছর তিরিশের যুবক, মুখে রজনীগন্ধা দাড়ি, পরনে জিনস। প্রায় এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজার মতো কুর্নিশ করে বলল -- "আসুন, আসুন! এই গরিবখানায় তশরিফ রাখুন। বন কেটে বসত গড়ার এই কর্মশালার হে নবীন অতিথি। স্বাগতম! অধীনের নাম চ্যাটার্জি। আমি এখানকার সার্ভেয়ার কাম ড্রাফটম্যান। আপনি হবেন আমার রুম পার্টনার।' তারপর হ্যাজাকবাতির আলোয় আমাকে ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, "--আরে, আপনাকে দেখে তো নাবালক মনে হচ্ছে। কেশোদাদা! নয়ে সাথীকি অনার মেঁ এক রাউন্ড গরমাগরম চায় পিলাও। হ্যাঁ, কেশোদাদা হবে আপনার লোকাল গার্জিয়ান। রাগ করবেন না যেন। আসলে আমাদের ফিলডের অভিধানে যারা সোমরস পানে দীক্ষিত নয় তারা সবাই দুগ্ধপোষ্য নাবালক। কাজেই, গার্জিয়ান তো চাই।' আমি বললাম, "তা' আপনাকে কি সাবালকদের মধ্যে গণ্য করব?

    -- "রাইট য়ু আর!' অট্টহাস্য করে ওঠে চ্যাটার্জি। আর তৎক্ষণাৎ আমরা বন্ধু হয়ে পড়ি।

    প্রথম ক'মাস কেটে গেল কাজটা শিখতে। তেমন কঠিন নয়। ধরাবাঁধা দশটা-পাঁচটার কড়াকড়িও নেই, কিন্তু কাজের চাপ আছে। শীতও বেশ জাঁকিয়ে পড়ছে। দিনটা কাটে কাজে। আর রাত্তিরে জ্বলে অগ্নিকুণ্ড, জঙ্গলের কাঠ। খাটের পাশে আগুনের মালসা বা "গোরসি'। চ্যাটার্জির চটকদার গল্প, ট্রাঞ্জিস্টারে খবর আর "বিবিধ ভারতী', "রেডিও সিলোন'। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হই কেশোদাদার ঝলঝাল রান্নায়। খেতে শিখি কুঁদরু, গাঁওয়ারফল্লি এবং গিলকির তরকারি। আর আছে ব্যাঙের ছাতা, বাঁশের কোঁড়।

    সয়ে গেল সকালবেলায় লোটা নিয়ে প্রকৃতির ডাকে জঙ্গলে যাওয়া। সইতে হল আরও অনেক কিছু। কিন্তু এই ক'মাসেও ঠিক হজম হল না একটা জিনিস। ব্যাপারটা ঘটছে আমার এখানে আসার প্রথম দিন থেকেই।

    একেই আমার ঘুম একটু বেশি। বেলা আটটার আগে বিছানা ছাড়িনে। ভোরবেলা আধো অন্ধকারে স্বপ্ন দেখছিলাম যে একটা খালি ইঞ্জিন ফোঁস ফোঁস করতে করতে "শান্টিং' করছে। হঠাৎ ইঞ্জিনটা শাঁখের মতো এক সিটি মারল -- কু-উ-উ-উক। একেবারে কানের কাছে। ধড়মড়িয়ে উঠে চ্যাটার্জিকে ঠেলে তুলি। চ্যাটার্জি কিন্তু অবিচলিত। ঘুম চোখে বলল, "সো' যা ইয়ার! কুছ নহি, রওতাইন কাম করণে আয়ি হ্যায়। উসিকি সিগন্যাল।'

    মেজাজ চটে গেল। ঝি কাজ করতে এসেছে বলে এমনি বেয়াড়া ভাবে জানান দেবে। একি বেয়াদপি! জঙ্গলের মেয়ে বলে স্বভাবটাও কি জংলী হতে হবে?

    খানিকক্ষণ ঘুমিয়েছি, -- হঠাৎ সেই তীব্র আওয়াজ! আর পারিনে, সব কিছুরই একটা সীমা আছে। ততক্ষণে রোদ উঠেছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চ্যাটার্জি মিটিমিটি হাসে। যা বলে তার নিগলিতার্থ হচ্ছে -- এ অঞ্চলের পাহাড়ি আদিবাসি মেয়েদের একটা বড় কাজ হল জঙ্গলে জঙ্গলে শুকনো কাঠ কুড়োতে যাওয়া। কুড়োতে কুড়োতে বনের মধ্যে যখন এরা দলছাড়া হয়ে পড়ে, তখন সঙ্গীদেরও এমনি করে "কুক' নিয়ে ডাকে। আমাদের ঝি উমেদ কুঁয়রও সেই অভ্যেসে "কুক' দিয়ে তার আসা যাওয়ার সঙ্কেত দেয়। -- হাজিরি রেজিস্টারে সই মারা আর কি। অরণ্যকন্যা, কাঠকুড়নো, দলছুট মেয়ের বনের সঙ্কেতে দলকে খোঁজা -- সব বুঝলাম। তবু আমার নাগরিক মন, ঘরের মধ্যেই জঙ্গল বসাতে চায় না যে! অন্তরাত্মা "না, না' করে ওঠে।

    একদিন মেয়েটির সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় হল। কেশোকাকার শরীরটা ক'দিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না। আর চ্যাটার্জি কোনও কাজে সাতসকালেই গাঁয়ের দিকে বেরিয়ে গেয়েছিল। ফলে সকালের চা-টা পেতে একটু দেরি হল। নিয়ে এল ওই মেয়েটি -- উমেদ কুঁয়র। কোনও কথা না বলে চায়ের কাপটা নড়বড়ে টেবিলের ওপর ঠক করে নামিয়ে রাখল। আমার মেজাজটা চটেই ছিল, ডাক শুনে ফিরে এল।

    -- শোন, সাতসকালে অমন বিতিকিচ্ছিরি আওয়াজ করে ঘুম ভাঙাবে না, মাথা ধরে। কোনও কিছু বলার থাকলে কেশোদাদাকে মুখে বলবে, বুঝলে?'

    কোনও উত্তর না দিয়ে বড়বড় ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকল, তারপর চলে গেল।

    চেহারাটা খুঁটিয়ে দেখলাম। আবলুস কাঠ কেটে বসানো আঁটোসাঁটো শরীরে টানটান করে পরা লাল "লুগরা'। চোখে পড়ে চওড়া কাঁধদুটো আর ভারী বুক। তেলতেলে মুখে চাপা নাক, গোটাকয় ব্রণ, আর চোখ দুটো? আদৌ কালো হরিণ চোখ নয়, বরং খানিকটা যেন গরুর মতো।  

    জঙ্গল সাফ হচ্ছে। কাজের চাপ বাড়ছে। শীত কমছে। মার চিঠি প্রতি মাসে আসে। আমার উত্তর মাসে তিনটের থেকে কমতে কমতে একটায় দাঁড়িয়েছে। অজুহাত দেখাই কাজের চাপ। ছুটি নিয়ে রায়পুর যাওয়ার প্রস্তাবে একই দোহাই দিই। বাবাকে লিখি -- একেবারে হোলির সময় মার্চ মাসে সাতদিনের ছুটি নিয়ে যাব। সূর্যের উত্তরায়এ জঙ্গলের মধ্যেও বেশ বোঝা যায়। দুপুরে টিনের শেড তেতে ওঠে। বড় বড় সরাই আর শাল-সেগুনের পাতা ঝরছে। মাঝে মাঝে হাওয়ার ঘূর্ণি ওঠে-উড়িয়ে নিয়ে যায় ঝরাপাতার রাশি। সন্ধের মুখে শোনা যায় কোকিলের ডাক।

    আমের বৌল আর মহুয়ার ফুলের গন্ধে ম ম করে রাত। হাওয়ায় হালকা হিমেল আওয়াজ। স্থানীয় ভাষায় বলে "গুলাবি জাড়া', অর্থাৎ গোলাপি শীত।

    টের পাই -- একটু একটু করে এই আকারহীন অবয়বহীন জঙ্গল আমার মধ্যে ঢুকছে -- "আহিস্তা জনাব, আহিস্তা।'

    সার্ভের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এল। বন কেটে বসত। আগে চাই "ইনফ্রাস্ট্রাকচার'। তৈরি হচ্ছে রাস্তা। প্রায়ই জিপ আসছে ধুলো উড়িয়ে, জেলা সদর থেকে। আসছেন বড় সায়েবরা। নকশার ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখছেন কোথায় হবে "খাদান', এক নম্বর পিট, দু'নম্বর --। এছাড়া তৈরি হয়ে স্টাফ কোয়ার্টার্স, স্কুল, ডাক্তারখানা, সুপারবাজার, হাসপাতাল, সিনেমাহল। স্ট্যানলি-লিভিংস্টোনরা জিতছেন। জঙ্গলের মধ্যে তৈরি হবে নগরসভ্যতার "মুক্তাঞ্চল'। বিশাল বাজেট। ক¾ট্রাক্টরদের সাইট অফিস, গোডাউন। দরদাম চলছে -- কৃষকদের ক্ষতিপূরণের রেট নিয়ে।

    গাঁয়ের মুখিয়া রূপসায় বড় ব্যস্ত। পরিবারপিছু একজনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন সরকার। তবে চাষের জমির দর? না বলাই ভাল। "বহেরা' জামিন অর্থাৎ যাতে ধান হয়, প্রতি একর দশ হাজার টাকা। আর "টিকরা' জমিন অর্থাৎ মেঠো জমিন যাতে হয় ডাল, তিল আর সরষে, তার দর মাত্র চার হাজার। এত কম? কি আর করা যাবে, সরকার তো ম্যাজিক জানেন না। এসব দর নেওয়া হয়েছে গত পাঁচ বছরের জমিন বিক্রির গড়পড়তা বাজার দরের রেকর্ড দেখে। সে রেকর্ড মানে রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ড।

    -- রেজিস্ট্রি? হা হতোস্মি! ও তো কখনও সখনও বাইরে থেকে আসা বড়লোকেরা জমিন কেনার সময় করেন, তাও খরচা কম করার জন্যে আর ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্যে রেট কম করে লেখান। আর গরিব আদমি? আদিবাসী? ওরা কে কবে বাপের জন্মে কোর্ট-কাছারি যায়! ওদের মুখের কথায় জমির স্বত্ত্ব বা মালিকানা হাতবদল হয়। খুব বেশি হলে পাঁচ টাকার স্টাম্প কাগজে লিখাপড়ি। তাহলে বাপদাদার ভিটেজমি হারানোর বদলে সরকারি ভর্তুকি যা পাওয়া যাবে তাতে তো অতটা জমিন কেনা যাবে না। তখন ওই নতুন উদ্বাস্তু লোকগুলো যাবে কোথায়?

    চ্যাটার্জি হেসে ফেলে -- "কোথায় যাবে? কেন, সব উদ্বাস্তু যেখানে যায়।'

    --"অর্থাৎ?'

    -- "অর্থাৎ আরও গভীর জঙ্গলে। পাড়াকে পাড়া উঠে গিয়ে বনভূমি বা পড়তি জমিন আবাদ করে নতুন গ্রাম বসাবে। রুক্ষ পাথুরে অহল্যাভূমি দু-চার বছরের সাধনায় আবার প্রাণ পাবে, ফসল ফলবে। পেছনে ফেলে আসা পূর্বপুরুষদের ভিটের স্বপ্ন বেঁচে থাকবে নতুন বসতির নামের মধ্যে।

    যেমন বরপালি গাঁ থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসা লোকেরা ওদের নতুন বসতির নাম দেবে "নয়া বরপালী' -- এই আর কি।'

    -- "তারপর?'

    -- "তারপর আবার কি? তার আর পর নেই। তারপর একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে। আবার আমরা যাব। এই চ্যাটার্জি আর এই মনবোধি। তাঁবু খাটাব, ব্যারাক বানাব। আবার চলবে সেই খেলা, বন কেটে বসত। উজাড় করব কটা গাঁ, কিছু লোককে উদ্বাস্তু করব।'

    হা হা করে হেসে উঠল চ্যাটার্জি। "ব্রাদার! আমরা হলাম সভ্যতার জল্লাদ। এই আমাদের নিয়তি।'

    কদিন ধরে ঘুমোট বাড়ছে, গরম বাড়ছে। রোদের তাপ চড়ছে, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চড়ছে লোকের মেজাজ।

    গাঁয়ের মুখিয়ার ছেলে টাঙ্গির এক কোপে তার একমাত্র ভগ্নিপতির হাতের দুটো আঙুল নামিয়ে দিয়েছে। মুখিয়া গেছে সদরে -- ছেলের জামিনের ব্যবস্থা করতে। কাল গাঁয়ের লোক পাটোয়ারিকে গাঁয়ের "সরহদ' বা সীমানা অব্দি তাড়া করে গেছে।

    কি কারণে যেন আমার আর চ্যাটার্জির মধ্যেও একচোট কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। রাত্রে চ্যাটার্জি রাগ করে বাইরে খাটিয়া লাগিয়ে শুল। আমি সাপের ভয়ে টিনের শেডের মধ্যেই শুলাম।

    সকালে উঠে চ্যাটার্জি একগাল হেসে বলল, -- "চল, আজ নদীতে চান করে আসি।'

    ভাবখানা যেন কাল কিছুই হয়নি। এই বাঙালি বাবুদের বোঝা দায়।

    ক্রোশ দুই হাঁটলে পড়ে নদী। শাল-সেগুন-আমড়া-বহেড়ার বন। সকালটা বড় শান্ত। পথ চলতে চলতে চোখে পড়ে মহুয়ার ঝাড়। সাদা সাদা ফুল টুপটাপ ঝরছে। রাতে আসে হরিণ আর ভাল্লুক -- আমলকি আর মহুয়া খেতে। মাঝে মাঝে এবড়ো-খেবড়ো জমির পর বড় বড় টিলা, কালো পাথরের চট্টান আর গুফা। কোথাও কোথাও আছে ভাল্লুক পরিবারের বাসা। আমরা চলছি চোখ কান খোলা রেখে আর মাঝে মাঝে মধ্যে কুড়োচ্ছি মহুয়ার ফুল। কাঁটাটা ছাড়িয়ে সোজা চালান করছি মুখের মধ্যে আর উগ্র গন্ধওয়ালা রসে ভরে যাচ্ছে ভেতরটা।

    জঙ্গলের এদিকটা একটু যেন বেশি নির্জন, চুপচাপ। বনের ভেতর চরতে থাকা গরুর পালের টুং-টাং আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না। সামনের "কোসম' গাছের ঝাড়টা পেরোতেই চ্যাটার্জি আমাকে এক হ্যাঁচকা টানে পেছনে নিয়ে এল।

    প্রথমে একনজরে কিছুই ঠাহর হচ্ছিল না। আস্তে আস্তে চোখকে সইয়ে নিচ্ছিলাম। সামনে কাঁকুরে মাটির ঢল নেমেছে নদী পর্যন্ত। জলের ধারে একটা মস্ত কালো পাথর। তার ওপর ছড়িয়ে পড়ে আছে একটি লাল "লুগরা'। আর তারপরেই চোখে পড়ল এক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য।

    পাথর পেরিয়ে নদী বাঁক নিয়েছে পাহাড়ের দিকে। হারিয়ে গেছে গাঢ় নীল কালো জঙ্গলের মাঝে। তিনদিকে হাতির পালের মতো আকাশছোঁয়া কালো পাথরের পাহাড়। আর বাঁকের কাছে লুগরা রাখা পাথরটি থেকে একটু এগিয়ে কোমরজলে নিমগ্ন এক নারীমূর্তি -- নিরাবরন, কালো পাথরের ভাস্কর্য, নি:স্পন্দ। অপলক তাকিয়ে আছে জঙ্গলের দিকে। সকালের সূর্জ এখনও পাহাড় ডিঙোয়নি। গোলাপি আভা পড়েছে মেয়েটির ভিজে চুলে, কাঁধে আর বাঁদিকের সুডৌল বুকে। একটি পাখিও ডাকছে না। সমস্ত প্রকৃতি যেন নীরবে বন্দনা করছে এই বনদেবীকে।

    হঠাৎ আমাদের মাথার ওপরের গাছটা থেকে কোনও নাম না জানা পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল। জমাটবাঁধা নীরবতায় ঢেউ উঠল। মেয়েটি চমকে উঠে ফিরে তাকাল ঠিক যে দিকে আমরা তাকিয়ে আছি -- সেই দিকে। তারপর দু'হতে জলে ঢেউ তুলে ডুব মারল আরও গভীরে। আমরা সরে এলাম। স্নানের জন্যে খুঁজে নিলাম আর একটি ঘাট। স্নান সেরে গামছা গায়ে ফেরার পথে দুজনেই চুপচাপ। চোখে তখনও স্বপ্নের ঘোর।

    হাসির আওয়াজ। একটি গাছের নীচে একদল মেয়ে। ঢিল ছুঁড়ে কোনও অজানা ফল পাড়ছে। চ্যাটার্জি বলল যে ওগুলোকে বলে "তেন্দু'। বেশ খেতে। তারপর একছুটে পৌঁছে গেল মেয়েদের দঙ্গলের মাঝে। কি জে বলল কে জানে। জবাবে শরীর কাঁপিয়ে চোখ নাচিয়ে হেসে উঠল ওরা।

    আর একটি গাছকোমর করে পরা লাল উগরা কোঁচড় থেকে হাত ডুবিয়ে চ্যাটার্জিকে দিল কিছু ফল।

    দেখি -- খানিকটা ডুমুরের মতো, একরকম টক-মিষ্টি স্বাদ।

    দিনটা কাটল নেহাত গড়িমসি করে, রেডিওর গান আর কেশোদাদার উদ্ভটরসের গল্প শুনে। বিকেল নাগাদ ভাবলাম গাঁয়ের দিক থেকে একটু বেরিয়ে আসি।

    কেশোদাদা বলল বেশি দেরি না করতে। ঈশানকোণে এক টুকরো কালো মেঘ দেখা দিয়েছে, ঝড়বাদলের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে গাঁয়ের ভেতর বসতি অব্দি গেলে যেন মনে করে খানিকটা "মিট্টি তেল' নিয়ে আসি।

    গাঁয়ে ঢুকেই টের পেলাম যে হাওয়া খারাপ। পিপল গাছের নীচের চায়ের দোকানে আমাদের চা দিল না। বলল -- দুধ নেই।

    কিন্তু উনুনে যে কড়াইভর্তি দুধ ওথলাচ্ছে! ওটা নাকি বাচ্চারা খাবে।

    আর কেরোসিন! তাও নাকি ফুরিয়ে গেছে।

    গাঁয়ের ভেতরে ঢুকলাম। মুখিয়ার বাড়ি যাব। একটাও জোয়ান ছোকরা চোখে পড়ছে না। কিছু বুড়োবুড়ি আর কচিকাঁচা। গ্রাম্যদেবতা ঠাকুরদেব আর বাড়রানির থানের পাশে কুয়োর পাড়ে মেয়েরা জল তুলছে। আমাদের দেখে অন্যদিনের মতো চোখের চাউনি দিয়ে হাসি ছুঁড়ে মারার বদলে দড়ি-বালতি ফেলে দুদ্দাড় করে পালাল।

    শেষমেষ পৌঁছুলাম মুখিয়ার ঘরের দোরগোড়ায়। আওয়াজ দেওয়ার পর নাক দিয়ে সিকনিঝরা ইজেরপরা একটি বাচ্চা এসে একনজর উঁকি মেরে আবার ভেতরে চলে গেল। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে ফিরে যাব ভাবছি এমন সময় মুখিয়া রূপসায় আবির্ভূত হলেন।

    আমাদের প্রচলিত "রাম রাম গৌটিয়া' সম্বোধনের জবাবে শুকনো গলায় শোনা গেল -- "কি চাই'! আমরা অবাক। এই কি সেই রূপসায় যে আমাদের দেখলেই সবসময় "আওগা সাহাবমন, বৈঠো! চাহাপানি পিও' বলে হাসিমুখে ঘরের আঙিনায় খাটিয়া পেতে বসাত?

    ধাক্কাটা সামলে নিয়ে চ্যাটার্জি বলল -- "কেইসে গৌটিয়া? আজ হামলা কুছু চুঙ্গি-উঙ্গি নহি পিলাবে কা'?

    রূপসায় একটু লজ্জা পেল। যেন চটকা ভেঙে উঠে বলল -- "হবে গো সাহেবরা। বিড়িটিড়ি সবই হবে। এস, খাটিয়ায় বস। আসলে কারু মনমেজাজ ভাল নেই। সদর থেকে ফিরছি। হাকিম ছুটিতে, ছেলেটার জামিন হবে আগামী সোমবার। উকিলকে দিতে হবে আরও দুটো নম্বরী নোট।'

    আমরা বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে আমতা আমতা করে বললাম যে এতে আমাদের কি কসুর? আমরা তো বাইরের লোক, পরদেশী।

    গৌটিয়া খাটিয়া ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। -- "কসুর তোমাদের নয়! তবে কার? তোমরাই তো এনেছ যত নতুন নতুন শহুরে শব্দ, নয়ী নয়ী শহরী কানুন। আমরা জানতাম ক্ষেতী। তোমরা শেখালে -- নোকরি। আমরা জানতাম ভাব-ভালবাসা, কৌম-বিরাদরি, পরিবার-সমাজ। তোমরা শেখালে -- আপনি বাঁচলে বাপের নাম।'

    "আমরা জানতাম -- মেয়ে হল পরায়া ধন। পরের আমানত। খাইয়ে-দাইয়ে বড় করব, ধুমধাম করে বিয়ে দেব। শ্বশুরবাড়ি যাবে, ঘর আলো করবে। তোমরা নাকি নতুন নিয়ম করেছ যে বাপের বাড়ির জমিজমা-সম্পত্তিতে মেয়েরাও ভাগ পাবে।'

    "আমার ছেলে ফাঁদ পেতে শিকার করতে জানে, চাষ করতে জানে। এখন তোমাদের পাল্লায় পড়ে মাথায় নতুন পোকা ঢুকেছে যে নোকরি করবে, মাসকাবারে কটা নম্বরি নোট গুনে নেবে। তোমরা নিচ্ছ আমার দশ বিঘে জমিন, কিন্তু দেবে মাত্র একটি নোকরি। ব্যাস? এদিকে আমার জামাইও বলছে যে হয় নোকরিটা ওকে দাও, নয় দশ হাজার গুনে দাও -- নইলে আমার মেয়ে ভাগ ছাড়বে না। এখন আমি বুড়ো কি করি, কাকে বোঝাই?'

    "শালায়-ভগ্নিপতিতে এত গলায় গলায় ভাব ছিল, সব গেছে উপে। আমার বেটা আপন ভগ্নিপতির ওপর মারল টাঙ্গির কোপ। মেয়েটা একটুর জন্য বেওয়া হতে হতে বেঁচে গেল। দুটো আঙুলের ওপর দিয়েই গেছে এ যাত্রা। একজন জেলে, দুসরা হাসপাতালে।'

    "এই তো গাঁয়ের হাল। এখন গা' তোল বাবুরা। নিজেদের ডেরায় ফিরে যাও। দিন ভাল নয়। দ্যাখ, তুফান আসছে। ওঠ, ওঠ। জলদি রেঙ্গ। পা চালাও।'

    সত্যিই তো! ঈশানকোণের সেই ছোট্ট একটুকরো মেঘ কখন যেন সারা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। মেঘ আর মেঘ! নানা রঙের। -- ধূসর, পাটকিলে আর ঘরে তোলা মাখনের মতো সাদা, থকথকে, ড্যালা ড্যালা। আমরা পা চালাই, প্রাণপণে।

    গরুবাছুরের পাল ডাকতে ডাকতে দৌড়ে ঘরে ফিরছে। বনের দিক থেকে একটা আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। জঙ্গল যৌবনে পা দিয়েছে। জঙ্গল আকাশকে ডাকছে। আর প্রায় আধ-কিলোমিটার বাকি। কিন্তু জঙ্গলের মাথার পর একটা লালচে ধুলোর মুকুট -- এগিয়ে আসছে, একটু একটু করে এগিয়ে আসছে।

    চ্যাটার্জি চেঁচিয়ে ওঠে -- "আবে দৌড়, জলদি! ইয়ে আঁধি আ রহি হ্যায়। অউর ওলে গিরনেওয়ালে।' বাপরে! খোলা আকাশের নীচে শিলাবৃষ্টি? মাথা পেতে দেয়া নেহাত বোকামি হবে। লাগালাম টেনে ছুট। কোনওরকমে হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের আস্তানায় পৌঁছেছি কি ঝড় ভেঙে পড়ল। মনে হচ্ছে ব্যারাকের চালটাই যাবে উড়ে। তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করেও দেখি ঘরের মধ্যে একটা ধুলোর আস্তর। আর টিনের চালের ওপর নড়বড়ে করে শুরু হল শিলাবৃষ্টি।

    একটু পরে বৃষ্টি শুরু হল। তেতে থাকা টিনগুলো দেখতে দেখতে ঠান্ডা হল। বৃষ্টি ঝরতে লাগল। মুষলধারায়। মাঠময় বইছে জলের স্রোত। আকাশ যেন তার ঘাম আর লালায় ভাসিয়ে দিচ্ছে জঙ্গলমাটিকে। মাঝে-মধ্যে ঝুঁটি ধরে নুইয়ে দিচ্ছে জঙ্গলকে। আবার দিচ্ছে ছেড়ে। হঠাৎ হঠাৎ লকলকে জিভে চেটে দিচ্ছে জঙ্গলের গা। বৃষ্টি ঝরছে অঝোরধারায়। অবিরাম, অন্তহীন।

    কতক্ষণ কেটেছে জানিনে। কেশোদাদার রান্না করা খিচুড়ি খেয়ে টিনের চালে বৃষ্টির মাদল শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। স্বপ্ন দেখলাম -- বাররানির থান। দেবীমূর্তির সামনে আগুন জ্বলছে। আদিবাসী বৈগা -- পুরোহিত মন্ত্র পড়ছে। গাছে গাছে মশাল বাঁধা। আর একপাশে দুটো খুঁটির গায়ে পিছমোড়া করে বাঁধা রয়েছি চ্যাটার্জি আর আমি।

    গাঁ-সুদ্ধু মেয়েমরদ মশালের আলোয় ছোট ছোট টোলিতে ঘুরে ঘুরে নাচছে। নাচছে আর গাইছে একঘেয়ে সুরে -- "তোলা দয়া লাগে না, তোলা মায়া লাগে না। তোলা দয়া লাগে-এ-এ'। -- তোর দয়া হয় না গো, তোর মায়া হয় না গো।

    বৈগার মন্ত্রপড়া এবার শেষ হয়ে এল। হঠাৎ মুখিয়ার ছেলে একটা চিৎকার করে আমাদের দিকে টাঙ্গি তুলতেই বাররানি খিলখিল করে হেসে উঠলেন।

    গলাটা শুকিয়ে কাঠ। বালিশ ঘামে ভিজে জবজব। কিন্তু বাররানির মুখটি যেন সকালে নদীতে চান করতে দেখা সেই লাল লুগরা পরা সেই মেয়েটির মতো।

    বৃষ্টি চলল সারা রাত, পায় পরদিন সকাল পর্যন্ত। এখন গাছগুলো সদ্যস্নাত। সারা শীতকাল ধরে পাতার ওপর জমে ওঠা ধুলোর পরতের চিহ্নমাত্র নেই।

    দুপুর নাগাদ রোদ উঠল। আমি পনেরো দিনের ছুটির দরখাস্ত লিখে চ্যাটার্জির হাতে দিলাম। ঢের হয়েছে। বনে-জঙ্গলে অনেকদিন হল। এবার রায়পুর যাব। মার হাতের রান্না খাব। আনন্দ টকিজে সিনেমা দেখব। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেব।

    চ্যাটার্জি হাসল। --"কাল একটা জিপ রায়পুর যাচ্ছে। যদি সকাল সকাল বেরিয়ে পড়, তাহলে বিকেল নাগাদ রায়পুর পৌঁছে যাব। কেশোদাদা, তোমার দুগ্ধপোষ্য বালকটি কাল বাড়ি যাবে। আজ রাতে রান্নাটা একটু স্পেশাল হওয়া চাই।'

    আমি বললাম -- "চলো, বিকেল নাগাদ আজ একটু নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি।'

    জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার পর সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে না। খালি একটু আলোর আভাস আছে।

    আমরা কথা বলছি আর চোখ চেয়ে চলছি। নতুন বৃষ্টির পর পড়ন্তবেলায় বেরোয় সাপের দল। ডিম ফুটে তিড়িং তিড়িং করে লাফায় কেউটের বাচ্চা, স্থানীয় ভাষায় "ডোমহি'।

    আমরা পা ফেলছি সাবধানে। প্রবল বৃষ্টিতে গাছের গোড়ায় মাটি ধুয়ে নেমেছে পায়ে-চলা পথের ধারে। মাটিগুলো আবার জাতে কালো "কনহার', বড্ড চিখলা, পায়ে এঁটে ধরে।

    সারা রাত উদ্দাম নাছের পর জঙ্গল এখনও শান্ত, একটু অবসন্ন। হাওয়া নেই, একটি পাতাও নড়ছে না। নেই কোনও "পরিন্দা'রও কিচিরমিচির বা ডানা ঝাপটানো।

    শুধু আমরা কথা বলছি -- ঘরের কথা, মা-বাবার কথা, ভাইবোন-বন্ধুবান্ধবদের কথা। কিছু বেঁচে থাকা স্বপ্নের কথা। সূর্য ডুবছে। এবার ফিরতে হবে।

    এমন সময় পাশের বন ইমলির ঝাড়ে সরসর শব্দ। তাকাতেই আমাদের চোখ যেন পাথর, পা বসে গেছে মাটিতে। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রায় নেংটি পরা হিলহিলে চেহারার কালো এক কিশোর। হাতে টাঙ্গি, মাথায় ধুলোভরা কোংকড়ানো চুল, বিস্ফারিত চোখের মণি। উত্তেজনায় বড় বড় শ্বাস টানছে, সপাট বুক কামারের হাপরের মতো উঠছে আর পড়ছে।

    আমাদে দেখে ছেলেটি হাঁফাতে হাঁফাতে বলল -- "এ সাহাব, মোর দাইলা দেখেহস কা?'

    জবাব কি দেব, আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখের ভেতর থুতু শুকিয়ে গেছে। কোনওরকমে দুদিকে মাথা নাড়ি। হতাশ কালো ছেলেটি।

    -- "দেখিসনি? সেই সক্কালে মা যে কাঠ কুড়োতে বেরিয়েছে, এখনও ঘরে ফেরেনি।'

    তারপর ঘটল এক আশ্চর্জ ঘটনা। পশ্চিম আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ছেলেটি। আর দু'হাত মুখের কাছে শঙ্খের মতো তুলে ধরে সিংহনাদের মতো এক কুক দিয়ে ওঠে।

    -- "দাই! মোলা সুনথস কা ও দাই, -- কু-উ-উক।'

    -- মাগো! আমার ডাক শুনতে পাচ্ছিস কি মা?

    কেঁপে ওঠে জঙ্গল, কাঁপে অন্ধকার। বড় গাছগুলোর মাথায় ঘরে ফেরা পাখিরা ডানা ঝাপটায় আর সেই ডাক ছড়িয়ে যায় দুরে, অনেক দূরে -- দূর আকাশে। তারপর সে ডাক মেঘের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসে মাটিতে। ফিরে তাকাই ছেলেইর দিকে। মুখখানা যেন চেনা চেনা লাগে।

    আরে! এই তো ছত্তিশগড়। স্ট্যানলি-লিভিংস্টোনদের দাপটউ ঘরছাড়া। অসহায় কিশোর আজ জোরকদমে ঢুকে পড়া যন্ত্রসভ্যতার সামনে দিশেহারা হয়ে তার মাকে খুঁজছে।

    -- সাঁঝ হোয়থে দাই। ঘর যাব। ভাত খাব। মোলা লে চল। ঘরে ফেরার রাস্তা ভুলেছি মাগো। আমার হাত ধর।
  • 13 | 192.42.116.203 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:১১741422
  • ভালোবাসা একটি মোহ বৃক্ষ
    আনোয়ার সাদাত শিমুল
      
    এক

    আত্মীয়-পরিজনহীন ঢাকা শহরে মেস জীবনের বাইরে আমার বৈচিত্র্য বলতে মাঝে মাঝে মহল্লার মোড়ের মনির মিয়ার চা স্টলে গিয়ে সন্ধ্যা কাটানো। কোণার টেবিলে একাকী বসে ঘন্টা দুয়েক একটানা চা সিগারেট খাওয়া আর নিত্যনতুন মানুষদের রাজনৈতিক আলোচনা শোনা। আওয়ামী লিগ-বিএনপি ঝগড়ায় কেউ কেউ আমাকে টানতে চায়, কিন্তু আমার নির্লিপ্ত হাসি দেখে তারা আগ্রহ পায় না। ব্যাপারটি আমি মনির মিয়াকে দেখেই শিখেছি। সবসময় সে নির্দলীয় নিরপেক্ষ শ্রোতা, নি:সন্দেহে ভাল বিজনেস স্ট্র্যাটেজি।

    যেহেতু মনির মিয়ার দোকানের বাইরে ভাল বিনোদন মানেই আমার জন্য অন্যরকম ব্যাপার তাই সকালে টিকিটটি পাওয়ার পর থেকে আমার মন উড়ুউড়ু করছিল কখন অফিস ছুটি হবে। কখন সুরেলা চৌধুরীর গান শুনতে যাব! আমার অফিসের কলিগ আলতাফ ভাই কিভাবে কিভাবে যেন সুরেলা চৌধুরীর একক সঙ্গীত সন্ধ্যার দুটো টিকিটি ফ্রি পেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তার বৌ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের আর যাওয়া হল না। ভাগ্যক্রমে একটি টিকিট পেয়ে গেলাম আমি।

    বাংলাদেশ বেতার ঢাকার "ক' চ্যানেলে মাঝে মাঝে সুরেলা চৌধুরীর গান শুনেছি, তাও মনির মিয়ার দোকানে বসে। কিন্তু কখনও সামনাসামনি তার গান শুনব অমনটা ভাবিনি। পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে টানা দুই ঘন্টা তার গানে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি বসেছিলাম তৃতীয় সারিতে। সামনের দিকে বেশ কিছু নামী-দামী চেহারা চোখে পড়ল। দেশের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকেও দেখলাম। অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন হুড়োহুড়ি করে বেরোচ্ছিল তখন আমি ভাবছিলাম -- আস্তে ধীরে বাসায় যাই। ভাল লাগা সন্ধ্যাটা আরেকটু দীর্ঘ হোক। অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে দেখি হালকা বাতাস বইছে। খুব চায়ের তেষ্টা পেল তখন। পাশের দোকানে খুব আয়েশ করে চা খাচ্ছিলাম, ইচ্ছে করেই আস্তে ধীরে খাচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য একটাই -- ভাললাগাটুকু আরও কিছুক্ষণ থাক। রাত তখন আটটার মতো। সবাই চলে গিয়েছে। বলা নেই, কওয়া নেই আচমকা ঝমঝম বৃষ্টি নামল। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস। সিঁড়ির ওপাশে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টির ছটা এসে গায়ে লাগছে। মাথার ভেতর তখনও সুরেলা চৌধুরীর গানের লাইনগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। গুনগুন করে গাইছিও কয়েক লাইন। হঠাৎ আমার পাশে এসে দাঁড়ায় সুরেলা চৌধুরী। আমাকে চমকে দিয়ে অনেকদিনের চেনা মানুষের মতো বলে -- আপনি দেখি বৃষ্টিতে আটকা পড়ে গেছেন!

    আমি আড়ষ্ঠ হয়ে হাসি দিই।

    -- বাসা কোথায় আপনার?

    -- নাখালপাড়া। কিছুটা সংশয় নিয়ে জবাব দিই।

    -- আমি ও পথেই যাব, আপনি ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন। আপনাকে পথে নামিয়ে দেব। একটি বায়িং হাউজে সামান্য বেতনে চাকরি করা আমার এই ছা-পোষা সাতাশ বছরের জীবনে এমন আহ্বান কেউ করেনি।

    সুরেলা চৌধুরীর মতো জনপ্রিয় শিল্পীর সঙ্গে কথা বলাই আমার কাছে মহা আনন্দের ব্যাপার। তাই আর কথা বাড়ালাম না। বিনয়ী হয়ে সুরেলা চৌধুরীর পিছু পিছু গাড়িতে উঠলাম। আমি বসলাম ড্রাইভারের পাশে। সুরেলা চৌধুরীর সঙ্গে এক মধ্যবয়সী লোক পেছনের সিটে। বাংলা মোটরের ট্রাফিক সিগন্যালের জ্যামে বসে বসে নানান কথা হয় আমাদের মাঝে। জানতে পারি -- স্টেজে গান গাওয়ার সময় নাকি সুরেলা চৌধুরী আমাকে লক্ষ করেছেন। আমার মনোযোগী ভাব নাকি তার ভাল লেগেছে। এটুকুই শুনে জানি না কী কারণে আমি আরও বিনয়ী হয়ে পড়ি। নিজ থেকে বলা শুরু করি -- আমি সুরেলা চৌধুরীর গানের ভীষণ ভক্ত, রেডিওতে প্রায়ই তার গান শুনি, একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের অগ্রিম টিকিটও কিনেছিলাম। এ সবই বানোয়াট কথা। অতি উৎসাহ ও বিনয়ের বহি:প্রকাশ। তবে আর একটু হলেই ধরা পড়ে যেতাম যখন সুরেলা চৌধুরী আমাকে জিজ্ঞেস করল -- তার কোন কোন অ্যালবাম আমি শুনেছি ...। শত জনমের ভাগ্য -- তখন গাড়ি ড্রাম ফ্যাক্টরি পার হয়ে গিয়েছে। আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম -- আমাকে এখানেই নামতে হবে, ড্রাইভার সাহেব, এখানেই থামান!

    গাড়ি থেকে নেমে সুরেলা চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি আমার একটি ভিজিটিং কার্ডও দিলাম। সুরেলা চৌধুরী হাসি দিয়ে কার্ডটি নিলেন। চলে যাওয়া গাড়ির দিকে না তাকিয়ে আমি দৌড়ে বৈশাখী কুলিং কর্ণারের সামনে দাঁড়ালাম। তখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।

    দুই

    সুরেলা চৌধুরীর সঙ্গে ওটাই আমার শেষ দেখা হতে পারত। আমার এ আপাত সাদামাটা জীবনে সুরেলা চৌধুরীর সঙ্গীত সন্ধ্যা এবং পরবর্তী সময়টুকু এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকতে পারত। একইভাবে আগামী দিনের একান্ত নিজস্ব সময়গুলোর স্মৃতিচারণের চমৎকার উপাদান হতে পারত। অথবা মনির মিয়ার দোকানে রেডিওতে সুরেলা চৌধুরীর গান শুনতে শুনতে চায়ের কাপে আরেকটু আয়েশ করে চুমুক দেওয়া যেত। সঙ্গে যোগ হতে পারত দু-তিনটি বেনসন সিগারেট। ... এরকম অনেকগুলো ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা হারিয়ে যায় এক বিকেলে সুরেলা চৌধুরীর ফোন পেয়ে -- আমি কি মুহিব আলমের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

    -- জী বলছি।

    -- আমি সুরেলা চৌধুরী।

    হিন্দি সিনেমার "তুম বিন'-এ নায়িকার হাত থেকে গ্লাস মেঝেতে পড়ে যেরকম শব্দ হয়েছিল, আমার মনে হল, সেরকম অনেকগুলো গ্লাস ঝুনঝুন করে ভেঙে পড়ে ফোনের অপর প্রান্তে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলি -- হ্যাঁ, মুহিব বলছি। কেমন আছেন?

    -- যাক্‌, আপনাকে পাওয়া গেল। ফ্রি থাকলে আজ সন্ধ্যায় রুশ কালচারাল সেন্টারে চলে আসুন। আমার একটা প্রোগ্রাম আছে -- সন্ধ্যা সাতটায় ...।

    খানিকটা আমতা আমতা করে বলি -- আমি তো টিকিট কিনিনি ...

    আরে না, টিকিটের কথা ভাবতে হবে না। আমার নিজস্ব গেস্টদের জন্য কিছু ফ্রি এϾট্র আছে। ভাবলাম -- আপনাকে একটা দিই। আফটার অল আমার গানের একান্ত ভক্ত হিসেবে তো আপনাকে মনে রাখতেই হয়। কি বলেন?

    -- থ্যাংকস।

    -- তাহলে আসছেন সন্ধ্যা সাতটায়। আমি আসব সাড়ে সাতটার দিকে। আপনি সাতটার আগে চলে যাবেন, গেটম্যানকে আপনার নাম বলা থাকবে।

    -- জী আচ্ছা।

    -- আরেকটা কথা, আপনি বসবেন ডান পাশের সারিতে। ঠিক আছে?

    -- ওকে।

    -- বাই।

    -- বাই।

    সুরেলা চৌধুরীর নিজস্ব গেস্টের তালিকায় নিজেকে পেয়ে কেমন যেন অন্যরকম অনুভূতি জাগে নিজের ভেতরে। অফিসের কাজগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে যাই রুশ কালচারাল সেন্টারে। ঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা।

    আয়োজকরা আমাকে বেশ খাতির করে সামনের সারিতে বসায়। সুরেলা চৌধুরীর কথামতো ডান পাশের একটি চেয়ার বেছে নিলাম। স্টেজের ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা আছে -- "সেকাল-একালের বৃষ্টির গান' -- সুরেলা চৌধুরী। পাশে তিনটি তবলা, একটি দোতারা এবং আরও একটি বাদ্যযন্ত্র। আরেকটু ডান পাশে একটি খয়েরি প্রজাপতি। স্টেজের লাইটিং বেশ চমৎকার। আলো-আঁধারির মাঝে পুরোনো দিনের ঘ্রাণ ভেসে আসে। দর্শক জমতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। বেশ কিছু নাগরিক চেনা মুখ দেখতে পেলাম। আমার ডান পাশে বসেছেন -- একটি মাল্টিন্যাশনালের মার্কেটিং ম্যানেজার। বাণিজ্যের মানুষ হলেও সঙ্গীতে তার বিশেষ আগ্রহ। এরকম প্রোগ্রামে তার কোম্পানি যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করে। খবরের কাগজে পড়েছিলাম -- তিনি নিজেও টুকটাক গান লেখেন। পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে তিনি হাত মেলালেন হাসি মুখে। আমি অপেক্ষা করছি কখন গান শুরু হবে। অনুষ্ঠান শুরু হল প্রায় আটটার দিকে। পুরোনো দিনের চমৎকার চমৎকার সব গানের ফাঁকে টুকটাক স্মৃতিচারণ করছিল সুরেলা চৌধুরী। মেট্রিক পরীক্ষার সালের সূত্র ধরে অনুমান করে নিলাম -- সুরেলা চৌধুরী আমার চেয়ে অন্তত বছর দশেকের সিনিয়র। এ ভাবনাটি অবশ্য খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি তখন। কারণ, সুরেলা চৌধুরী তার চমৎকার গলায় হারানো দিনের মনকাড়া কিছু গান দিয়ে শ্রোতাদের অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুয়েকবার মনে হল আমার দিকে তাকালেনও আড়চোখে। রাত দশটায় অনুষ্ঠান শেষ হলে আমি বেশ কিছুক্ষণ গ্রিনরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম সুরেলা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করব ভেবে। গাড়ি করে লিফট নয় বরং ফ্রি টিকিটের জন্য ধন্যবাদটুকু জানাতে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও সুরেলা চৌধুরীর দেখা পেলাম না। পরে শুনলাম -- কোনও এক টিভি চ্যানেলে গানের রেকর্ডিং আছে তাই সরাসরি ওখানে চলে গেছেন তিনি। ভাবলাম, ফোনে ধন্যবাদ জানাই। দুপুরে যে নম্বর থেকে ফোন করেছিলেন -- ওই নম্বরে রিং করলাম। মোবাইল অফ। খানিকটা মন খারাপ হলেও একটু আগে শোনা বর্ষার গানগুলো এক ধরনের স্নিগ্ধতা এনে দিল পরের মুহূর্তগুলোয়। বাসায় ফেরার পথে ফার্মগেট মিউজিক পয়েন্ট থেকে সুরেলা চৌধুরীর একক অ্যালবাম "ভালোবাসার চিঠি' কিনলাম। রাতে শুয়ে শুয়ে যখন গান শুনছিলাম তখন বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে। বিজলী চমকাচ্ছে। বারবার মনে হল -- সুরেলা চৌধুরী আমাকে আবার ফোন করবে, এবং খুব শীঘ্রই ...।

    তিন

    আবার দেখা হল। এবং পরের ঘটনাগুলো নাটকীয়ভাবে। সুরেলা চৌধুরীর বাসায় যেতে হল আমাকে অফিস ছুটির পর সন্ধ্যায় কিংবা ছুটির দিনে বিকালে। কয়েকবার একসঙ্গে ডিনারও করলাম বাসায়। পরিচিত হলাম তার হাজব্যান্ড সিরাজী চৌধুরীর সঙ্গে। তাদের মেয়ে কুহেলী চৌধুরীর সঙ্গেও দেখা হল কয়েক দিন পর। সিরাজী একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন গত চার বছর পর। তবে বসে নেই একদম -- সারাক্ষণ অফিসের কাজকর্ম দেখছেন, কাগজে সই করছেন, এখানে ওখানে ফোন করছেন। কয়েকজনকে ধমকও দিচ্ছেন। দারুণ ব্যস্ত মানুষ। এভাবেই দেখা হল আরও বেশ কয়েকবার। দিনগুলো কাটল খুব দ্রুত। বুঝি নিয়মটাই এমন -- আনন্দের মুহূর্তগুলো কেটে যায় চোখের পলকে। আনন্দ কেমন ছিল তা অবশ্যই আপেক্ষিক ব্যাপার, তবে খুব অল্প সময়ের মাঝে তিনটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত জানতে পারি সিরাজী চৌধুরী আমার অফিসের বসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনেকগুলো কারণে আমার বসকে সিরাজী চৌধুরীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হয়; যার মধ্যে ব্যবসায়িক স্বার্থই প্রথান। তাই সময়ে অসময়ে অফিসের কাজ বাদ দিয়ে সিরাজী চৌধুরীর ডাকে তার বাসায় গিয়ে সময় কাটানোয় আমার বসের কোনও আপত্তি থাকত না। বলা যায়, আমার কাজের ধরন গেল পাল্টে। সিরাজী চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবার খেয়াল করেছি, ভদ্রলোক অতীতচারী। ঘুরে ফিরে একই বিষয়ে তার কথা ফিরে আসে -- তার অতীত; ছোটবেলা বেড়ে ওঠা, দারিদ্র্যের আঘাতে নিপীড়িত জীবন, গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা, সংগ্রামী নাগরিক জীবনে না পাওয়ার যাতনা এবং ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার গল্প। পরের অংশটুকু বলতে গিয়ে সিরাজী চৌধুরীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি দেখতে পাই, একজন সফল মানুষের প্রত্যয়ী মুখ। কিন্তু এর পেছনেও কোথায় যেন একটা চাপা কষ্ট - অভিমান লুকিয়ে থাকে সবসময়। প্রায়ই দেখি তিনি দু-হাতে চেপে ধরেছেন হুইল চেয়ারের হাতল। মনে হয় নিজের সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে জমা পড়ছে ওই হুইল চেয়ারের মাঝে। মাঝে মাঝে সিরাজী চৌধুরীর আচরণে আমি নিজেও ইমোশনাল হয়ে পড়ি। শ্রোতা হিসেবে তখন নিজেকে ভীষণ দুর্বল একজন মানুষ মনে হয়। তবে আমার আগেই সিরাজী চৌধুরী নিজেকে সামলেন নেন দ্রুত। এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে মন দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা তার। আমার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে অফিসের ফোন কল রিসিভ করছে। অদ্ভুত এক মানুষ! আমাদের এ আড্ডায় মাঝে মাঝে কুহেলী এসেও যোগ দেয়। কুহেলী তখন মাত্র ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নিয়েছে। ক্লাস শুরু হতে আরও সপ্তাহ কয়েক বাকি। কুহেলীর মাঝে কৈশোর পেরনো চাঞ্চল্য আছে, তবে উচ্ছ্বলতা ছাড়িয়ে এক ধরনের অবসন্নতা ধরা পড়ে বেশি -- অন্তত আমার চোখে।

    আরও একটি ব্যাপার আমি খেয়াল করেছিলাম মাসখানেক পর। সিরাজী চৌধুরীকে কুহেলী "আংকেল' বলে সম্বোধন করে। নিজের মাঝে অনেক সংশয় রেখে, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ভদ্রতাজ্ঞান রেখে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি প্রথমে। আমার কৌতূহলী মুখে দেখে একদিন কুহেলীর অনুপস্থিতিতে সিরাজী চৌধুরী নিজেই আমাকে বলেছিলেন -- পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার পর বৌ চলে যায় আমেরিকায় ছেলের কাছে। বছর পার হলেও ফিরে আসেনি। লোকমুখে খবর এসেছিল -- কোনো এক হোয়াইট ছেলের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে ওখানেই। আপন ছেলে তো অনেক আগেই বিদেশীনি বিয়ে করে চিরতরে প্রবাসী। নিজের শারীরিক অক্ষমতার মাঝে বিজনেসের কাজ, বৌয়ের বিদেশ চলে যাওয়া, নি:সঙ্গতার অসহায় জীবন। নিজের প্রতি তীব ঘৃণা। খুব বাজে সময় তখন -- বলতে বলতে, আমি আড়চোখে দেখি, সিরাজী চৌধুরীর হাতের মুঠি দুটি শক্ত হয়ে এসেছে। তখন পরিচয় হয় -- সুরেলা চৌধুরীর সঙ্গে। পরিচয়ের ডিটেইল অবশ্য জানা হয়নি আমার। শুধু জেনেছি -- সাগরে ডুবে যাওয়া মানুষ যেমন শেষ পর্যন্ত খড়-কুটো ধরে বেঁচে থাকতে চায় তেমনই সুরেলা চৌধুরীকে আশ্রয় করে আরেকবার প্রবল স্রোতের বিপরীতে ভাসার চেষ্টা করেছিল সিরাজী চৌধুরী। সে চেষ্টা বৃথা যায়নি। তিরিশ পেরনো বয়সে ডিভোর্সি, এ কারণটাও আমার জানা হয়নি, সুরেলা চৌধুরী শেষ পর্যন্ত সিরাজী চৌধুরীর জীবনে নুহের কিস্তিসম রূপ নিয়েছিল। সারাদিন গান নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সুরেলা চৌধুরী যথেষ্ট কেয়ার দিয়েছেন নতুন স্বামীর প্রতি। কিশোরী কুহেলীও মেনে নিয়েছে স্বাভাবিকভাবে। জীবন কখনও হঠাৎ ফুরিয়ে যায় না -- বিশ্বাস করে, সিরাজী চৌধুরী আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন।

    চার

    এরকম গল্পে গল্পে সময় কেটে যেত। কালেভদ্রে সুরেলা চৌধুরীও এসে যোগ দিতেন আমাদের আড্ডায়। অফিসে কাজ করতে ভাল না লাগলে আমি সোজা সুরেলা চৌধুরীর বাসায় চলে যেতাম। আমার বস তেমন কিছু বলতেন না, যতটুকু জেনেছি সিরাজী চৌধুরীর বদান্যতায় এবং আমার মধ্যস্থতায় বেশ কিছু বিজনেস ডিল এর মাঝে আমার অফিস হাতিয়ে নিয়েছে। যেমনটি বলছিলাম -- তিনটি ঘটনা, যার দ্বিতীয়টি খুব আহামরি কিছু নয়; সরকারি সংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হয়ে সুরেলা চৌধুরী বিদেশে গেলেন দুই সপ্তাহের জন্য। কিন্তু এ দ্বিতীয় ঘটনাটি সুযোগ করে দেয় তৃতীয় ঘটনার। আমি নিশ্চিত -- এ ঘটনার জন্য কোনও প্রস্তুতি ছিল না, অন্তত আমার পক্ষ থেকে তো নয়ই। বরং আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি কুহেলীও এ ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ছুটির দিনের বিকেল বেলায় মনির মিয়ার টি স্টলে সময় না কাটিয়ে চলে গেলাম সুরেলা চৌধুরীর বাসায়। তেমন কোনও প্রয়োজন ছিল না, যেমনটি ছিল না কখনওই। প্রায়ই যেতাম সিরাজী চৌধুরীর একাকী সময়ে গল্পগুজবের জন্য, সে বিকেলে গিয়েছিলাম নিজের একাকিত্ব কাটানোর জন্য। গুলশান দুই নম্বর মোড় পার হওয়ার পরই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নামল। অনেক কষ্টে মাথা বাঁচিয়ে সুরেলা চৌধুরীর বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন বৃষ্টি বাড়ছে ক্রমাগত। জানলাম, পড়ন্ত বিকেলে সিরাজী চৌধুরী ঘুমোচ্ছিলেন নিজের ঘরে। কুহেলী এগিয়ে এসে নিজের রুমে নিয়ে গেল। খুব পরিপাটি গুছানো ঘর। কম্পিউটারে গান চলছে -- সব বৃষ্টির গান। আকাশ মেঘে ঢাকা, শাওন ধারা ঝরে, এমন বরষা ছিল সেদিন শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন, একখানা মেঘ ভেসে এল আকাশে, এরকম চমৎকার চমৎকার সব গান। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে রুমে গানের সুর, এর মাঝে আমার আর কুহেলীর টুকটাক কথা। আবারও বলি -- আমি নিশ্চিত, কোনও কিছুই পরিকল্পিত ছিল না। আমাদের কোনও হাত ছিল না ওই সন্ধ্যার ঘটনা প্রবাহে। জানি না -- কেন জানি আমার বারবার মনে হচ্ছিল কোথায় যেন একটি গড়বড় হতে যাচ্ছে আজ! কোথায় যেন আজ উল্টো বাতাস বইছে! এতসব ভাবনার মাঝে খেয়াল করি -- আমরা দুজনেই নীরব হয়ে আছি। কোনও কথা নেই। বৃষ্টি বাড়ল কি কমল জানি না, তবে কম্পিউটারে গান চলছিল তখনও। বাতাসে জানলার পর্দা উড়ছিল কিনা জানি না, ওদিকে চোখ দেওয়ার সময়টুকুও ছিল না। কারণ, আমি এবং কুহেলী তখন একে অন্যের চোখে তাকিয়ে। আমি জানি না -- কেন হঠাৎ এ নীরবতা নেমে এল, কেনই বা আমরা একে অন্যের চোখে হারানোর নেশায় মাতলাম। কুহেলীর চোখ দুটো ওই মুহূর্তে কেনই বা এমন মোহ জাগানিয়া হয়ে উঠেছিল। আমি কিছুই জানি না। তবে টের পাই -- আমার নৈতিক ও আদর্শগত অবস্থানের ছোটখাটো পাহাড়টা তখন ভাঙছে। ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে কুহেলীর মাঝে। কুহেলীও ভাঙছে নদীর মতো। শরীরের সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়েও আমি ফিরে আসার চেষ্টা করি, নিজের মনকে বারবার বলি -- আমি মুহিব আলম, আমি মুহিব আলম, সাধারণ চাকরি করা মানুষ, এ মোহ আমার জন্য নয়, এ অন্যায়, অন্যায় ভাবনা। তবুও আমি নিজের মাঝে ফিরতে পারি না। ততক্ষণে ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে বিরামহীন। আরও পরে, একসময় আমি মুহিব আলম এ স্বাভাবিক জগতে ফিরে এলে জানলার পর্দা তুলে দেখি -- বাইরের ঝড়ও থেমে গেছে। সন্ধ্যা নেমেছে আরও আগে। সোডিয়াম আলোয় শহরের রাস্তাগুলো খুব অচেনা মনে হয় তখন। বাতি নেভানো ঘরে কুহেলীর মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। আমি জানি না কুহেলী কী ভাবছে, তবে নিজের মনে নিজেকে নিশ্চিত বলে রাখি -- এ ঘটনার জন্য আমরা কেইউ প্রস্তুত ছিলাম না।

    পাঁচ

    ঘটনা পরবর্তী মানসিক প্রস্তুতি সুদৃঢ় করার চেষ্টা করি -- আমি মুহিব আলম নিজের সমস্ত সত্ত্বার উপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখার সংকল্প করি। কুহেলীর মোহ নিতান্তই কোনও এক সন্ধ্যর অপ্রত্যাশিত আচরণ বলে মেনে নিই। দিন যাপনের রুটিন আগের মতোই বাসা-অফিস আর মিনির মিয়ার টি স্টলের গন্ডিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। সুরেলা চৌধুরীর বাসায় যাওয়ার কথা ভাবি না, তবে মাঝে মাঝে ওই সন্ধ্যাটি মনের মধ্যে হানা দেয় না অমন কথা বলব না। মাঝে কয়েকবার সিরাজী চৌধুরী ফোন করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছি। কুহেলীর ফোন কল পাইনি, আমি নিজেও ফোন করিনি। ... এভাবেই চলছিল, ভালোই। হঠাৎ একদিন সুরেলা চৌধুরীর ফোন পেলাম, তার বাসায় যেতে হবে। আমি আবার নিজের সঙ্গে সংগ্রাম করি। অনাকাঙ্ক্ষিত সন্ধ্যাটা আমাকে কুঁকড়ে দেয়। নিজের প্রতি থুতু দিই -- অতটুকু আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই আমার! এরকম অনেক ভেবেচিন্তে গেলাম সুরেলা চৌধুরীর বাসায়। এবার খুব বিক্ষিপ্ত আলাপ হয় আমাদের মাঝে; গান, নাটক, রাজনীতি, ট্রাফিক জ্যাম, চড়া বাজার ... আমি জানি না কেন, নিজের কাছে কোনও ব্যাখ্যা নেই এর, আমাদের মাঝে হঠাৎ নীরবতা নামে। আমি স্পষ্ট টের পাই -- ওই সন্ধ্যার অনুভূতিগুলো আবার ফিরে আসছে। জানি না বাইরে বৃষ্টি ছিল কিনা, তবে সুরেলা চৌধুরীর আহ্বান ছিল প্রকট। আমি মুহিব আলম, টের পাই -- এ ঘটনা পরিকল্পিত! আমি মুহিব আলম, ছা পোষা চাকরিজীবি মানুষ -- আমাকে এ মোহ থেকে বেরোতেই হবে। এসব ভাবনায় যখন আমি অস্থির হয়ে উঠছি তখন আচমকা দরজার সামনে কুহেলী চিৎকার করে ওঠে -- "ইটস এনাফ, মাম! ইটস এনাফ অ্যাট য়ুর এজ!'
    শুনে সুরেলা চৌধুরী আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। আমি দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। গলি পেরিয়ে মূল রাস্তায় চলে যাই। খুব দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করি।

    ... আরেকটু জোরে হাঁটলেই গুলিস্তান-পীরজঙ্গী রুটের ছয় নম্বর বাসটা ধরতে পারব।
  • 14 | 192.42.116.203 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:১৫741423
  • লাস্ট ট্রেনে
    অরণ্য
     
    লাস্ট ট্রেনে ফিরছে দেহটি --

    বাড়িতে হয়তো দুটো হাত
    ভাত খেয়ে চাপাটাপা দিয়ে
    শুয়েছে কোলের কাছে তার
    পায়ে পায়ে বুড়ো বাপ মায়ে
    জেগে থাকে আলো জ্বেলে রেখে
    মাথা বাঁধা মেয়েমানুষের মতো
    হেসে কেঁদে গুণেছিল টাকা

    অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল
    লাস্ট ট্রেনে ফিরছে দেহটি।
  • 15 | 192.42.116.203 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:১৮741424
  • দায় নেই
    অরণ্য
        
    দায় নেই বদলানো পথ   
    কার্ণিশে লাট খাওয়া এক
    পেটকাটি ঘুমের বড়ি
    মোমবাতি এবার জ্বালাক।
    রিক্সার ঠুনঠুনিরাও
    সওয়ারি সস্তা খোঁজে
    এক শুধু বৃষ্টি ছাঁটে
    মেঘে তার মুণ্ডু গোঁজে।
    পাহাড়ে পাড় বসানো
    ফিতে, টিপ, খোলার ঘরে
    ইস্কুলে পড়তে আসে
    শব্দেরা নুপুর পরে।
    দায় নেই পাথরকুঁচি
    বাপ তার পাহাড় ছিল
    মেঘে যার ছোট্টোবেলা
    তারও আজ তেষ্টা পেল?
    রাতে থাক অল্প শিশির
    দায় নেই ঝুপ  কুয়াশা
    বাঁধানো জলাশয়ে
    আগাছার দলের ভাসা।
  • 16 | 45.141.215.235 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:২২741425
  • পরীকথা
    ইন্দ্রাণী, সিডনি
    ১৯.১০.২০০৫
    পরীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট গল্পে। নিত্যদিনের অনলৌকিকতার মাঝে হঠাৎই এসেছিল একটি রাত-পরী দেখা রাত; চিরচেনাজন পরী হয়ে যায় যে ফিনিক ফোটা রাতে।

    তারপর আর কোনও পরীর কাছাকাছি আসা হয়নি।

    মাস দুয়েক আগে, হঠাৎই পরীস্থানের খোঁজ পাই। সিডনি শহরের কাছেপিঠেই পরীরা আছেন। চাইলেই হাজির হবেন তাঁরা। জন্মদিনের আসরে। সকালে, দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায়।

    ফুরফুরে টিংকার বেল, পিনোক্কিওর ব্লু ফেয়ারি, সিন্ডারেলার ফেয়ারি গডমাদার, অথবা সাতরঙা রেনবো ফেয়ারি, ছটফটে বাটারফ্লাই ফেয়ারি, দুষ্টু-মিষ্টি টুথ ফেয়ারি।

    বেশ কয়েকটি অর্গানাইজেশনের সঙ্গে পরীদের দিব্যি জানাশোনা, প্রতিযোগিতাও বেজায় তাদের। এখানকার পরীটি আপনার শিশুটিকে দেবেন ফেয়ারি কৃস্টাল তো ওখানকার পরীটি আনবেন ম্যাজিক নেকলেস। এই পরীটি যদি শিশু অতিথিদের জন্য আনেন পরী আঁকা থালা বাটি, ওই পরীটি আনবেন পরীস্থান স্পেশাল খেলনা পুতুল। আপনি চাইলে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও পরীরাই করবেন। আপনি শুধু মেনু পছন্দ করুন। বেছে নিন পছন্দের প্যাকেজটি। তারপর ফোন কিংবা ই-মেইল। আপনার আসর কখন শুরু, কজন নিমন্ত্রিত, তাদের বয়স, কোন পরীটি চাই আপনার, কতক্ষণের জন্য -- সব জানিয়ে দিন। আসরে বাচ্চাদের সংখ্যা পনেরোর বেশি হলে অবশ্য দুজন পরীকে আসতেই হবে -- সেরকমই নিয়ম -- আসলে, গলা তুলে ধমক দেওয়া পরীকে মানায় না। পছন্দের প্যাকেজ অনুযায়ী অ্যাডভান্স টাকা পাঠিয়ে দিন চেকে বা ক্রেডিট কার্ডে আর অপেক্ষায় থাকুন পরীর আবির্ভাবের। শুধু শিশুরা যেন না জানে প্যাকেজের কথা। ওরা জানুক, পরী আসবে।

    এমনভাবেই গতমাসে এক জন্মদিনের আসরে আমার সঙ্গে পরীটির দেখা।

    বসন্তের মনোরম সকাল। রঙিন কাগজের শিকলি আর অজস্র বেলুনে সাজানো ঘরখানা। জনা পরেরোর শিশু পরীর অপেক্ষায়।

    পরীটি আসে। একহাতে তার বেতের টুকরি, অন্য হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড। হাতে গলায় ফুলের গয়না, রঙিন ডানা দুটি, গোলাপি সুদৃশ্য পোশাক, একমুখ হাসি। টুকরি থেকে একে একে বের হয় জাদু শতরঞ্চি, হৃদয় আকৃতির বেলুনসমূহ রং তুলি, গল্পের বই, রঙচঙে সব মোড়ক, একটি ছোট মিউজিক সিস্টেম। বাচ্চারা পরীকে ঘিরে বসে। পরী গল্প বলেন, গান শোনান, খেলাচ্ছলে সবাইকে উপহার দেন। পরীকে ঘিরে শিশুরা নাচে। ছবি আঁকে। পরী রং তুলিতে তাদের রাজকন্যে সাজান কিংবা প্রজাপতি, খরগোশ, জলদস্যু কিংবা স্পাইডারম্যান -- যে যেমনটি চায়। মুঠো মুঠো ফেয়ারি ডাস্ট উড়িয়ে দেন ঘরময়। টুকরি থেকে আরও বেরোয় ললিপপ আর জলছবি। শিশুরা পরীতে মজে যায়।

    সকাল গড়িয়ে দুপুর। প্যাকেজ অনুযায়ী পরীর যাওয়ার সময়। ম্লানমুখ শিশুদের কেউ কেউ পরীর উড়ান দেখতে ব্যালকনিতে এসে আকাশ খোঁজে। পরী বলেন, সামান্য দূরের পার্কটি থেকে উড়ান শুরু তাঁর। সেখানে আকাশ ঢাকেনি উঁচু বাড়ি-ডানা মেলতে সুবিধে।

    সিঁড়ি বেয়ে সদর দরজা অবধি পরীর সঙ্গে আসি। শিশুদের কৌতূহলী চোখ এড়িয়ে তার হাতে প্রাপ্য টাকা তুলে দিতে হবে। সে ক্লান্ত হাসে। পরীর মুখে খিদের গন্ধ পাই। খেয়ে যেতে বলি। ফুলের মধু ছাড়া অন্য কিছু খায় না সে-মিষ্টি হেসে একটু গলা তুলে বলে। শিশুরা যেন শুনতে পায়।

    তারপর হেঁটে যায়। ওর এক হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, অন্য হাতে ভারি টুকরি। ফিরে তাকায়। ব্যালকনিতে হাত নাড়ে শিশুরা। পরী রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যায়।

    তখন একটি শিশু বলে ওঠে, আচমকাই -- "আমি জানি, ও সত্যি পরী নয়। আমি জানি ও উড়তে পারে না। ও হেঁটে গেছে।'

    কার্পেট থেকে ফেয়ারি ডাস্টের শেষ কুচিটুকু তুলে নিল ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। দুপুরের রোদে পরীর ডানাদুটি গলে গেল।
  • 17 | 185.243.218.204 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:৪২741426
  • আরশোলা
    অরণ্য
     
    আজ তিনদিন একটা আলোহীন ঘরে আছি। কিছুক্ষণ আগে আলো জ্বেলেছি, এবং জ্বালাবার পর মনে হল, আমি অন্ধ হয়ে গেছি। ভয় পেয়েছিলাম কিনা মনে পড়ছে না, তবে ঘরের কোণার দিকে তিনদিন ধরে নির্ভয়ে ঘুরে-বেড়ানো কয়েকটা আরশোলাকে দ্রুত পালিয়ে যেতে দেখে ওদের জন্য মায়া হল। অন্যের ঘরে আজীবন যাদের বসবাস, তারা হয়ত সবসময়ই একটা সংকীর্ণতাবোধ নিয়ে বাঁচে, এবং যখন সেই বোধটা থাকে না, তখন নিশ্চয় রোজকার সেই একই সংকীর্ণতাবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার গ্লানি ও কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার আনন্দ তাদের মধ্যে কাজ করে যায়। আমি জানি না, তুমি আমার এই কথাগুলো পড়ে কী ভাবছ, তবে তোমাকে জানিয়ে রাখি, একতা আরশোলার চেয়ে খুব বেশি তাৎপর্যময় জীবন আমার কখনই ছিল না, এবং অন্ধকারের মধ্যে একটানা বসে থেকে থেকে, যখন নিজের অস্তিত্ব নিজের কাছেই অদৃশ্য মনে হয়, তখন বুঝতে পারি, আলোর জন্য কোনও আক্ষেপ আমার ভেতরে আর অবশিষ্ট নেই।

    তোমার মনে আছে, বলেছিলাম, জীবনে মাত্র একবার আমি পাহাড়ে উঠেছি। অনেকদিন আগে। বছর বারো তো হবেই। বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন, নাম মনে নেই। শহর ছেড়ে দূরে, প্রায় ঘন্টা দুয়েক লেগেছিল যেতে। সেই শেষবার, কিন্তু এখনও মনে আছে, যখন আমরা পাহাড়ে পৌঁছুলাম, তখন প্রায় দুপুর। আমি গাড়ি থেকে নেমে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে, মাথাটা চারিদিকে ঘুরিয়ে যতদূর দেখা যায়, তার সবটুকুই দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, হঠাৎ যখন উপরের দিকে তাকালাম, তখন আমি কিছুই দেখতে পেলাম না, বরং আলোর তীব্র ছটায় আমার বোধ হয়েছিল, অন্ধ হয়ে গেছি। ঘন্টা দেড়েক ছিলাম পাহাড়ে, এবং আচমকা উপরের দিকে তাকিয়ে আলোর ছটায় অন্ধত্বের যে বোধ সেদিন জন্মেছিল মনে, তা থেকে বেরুতে পারিনি আজও। তারপর থেকে প্রায় সময় আমি আলোহীন জায়গা খুঁজে খুঁজে সেখানে বসে থাকতাম আর সেখান থেকে বেরিয়ে আচমকা আলোতে এসে যে বোধ হত, তাতে মনে হত, আমি এখনও সেই পাহাড়টায় দাঁড়িয়ে।

    আমি চেয়েছিলাম, তোমাকে আমার সব কথা জানাই। জানাই, কীভাবে আমি চারটা বছর একটা বড় কাঁচের বয়ামে মরা আরশোলা জমিয়ে রাখতাম। প্রায় প্রতিদিনই পুরো বাড়ি বা বাড়ির আশেপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজতাম, পেয়েও যেতাম, কিন্তু যেদিন যেদিন পেতাম না, সেদিন রাতে ঘুম আসতো না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে, চোখ বুজে কত আজগুবি ভাবনাই না ভাবতাম। এভাবে হয়ত একদিন, বড়জোর দু'দিন পারতাম, কিন্তু তৃতীয় দিনে মরা আরশোলার জন্য আমার ক্রিকেট খেলার ব্যাটটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম, এবং যেখানেই কোন একটাকে দেখতেপেতাম, তাকে তাড়া করে ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে থেতলে দিতাম। তুমি জানো না, সেই সময়ে আমার মুখের ভঙ্গি কীরকম হতো? একদিন মা দেখতে পেয়ে ভীষণ চমকে উঠেছিলেন। আমার গালে চড় মেরে বলেছিলেন, "হারামজাদা, অমন করে কি কেউ আরশোলা মারে?' আমি মায়ের "অমন' শব্দটার মানে সেদিনও যেমন বুঝতে পারিনি, তেমনি এখনও, কারণ আরশোলা মারার সময়কার মুখোভঙ্গি আমি ককহনৈ পাইনি দেখতে। তবে আমার মনে আছে, মারার পর মরা আরশোলাকে একটা কাগজে তুলে ছাদের উপর রোদে শুকোতে দিতাম, আর দূরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। আমার সেই কান্না সারাদিন, সারারাত চলত, এবং যখন কান্না থেমে যেতো, তখন একটা ফ্যাকাসে রং-এর ছোট্ট খাতায়, যেটা বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম, সেটাতে ওদের নাম লিখে রাখতাম। জানো, আমার হত্যা করা প্রতিটি আরশোলার একটি করে নাম আমি দিতাম আর তাদের হত্যা করার দিন, তারিখ, সময় সব লিখে রাখতাম। এভাবে ছয়শ' একান্নটা নাম আমি লিখেছিলাম, যার প্রথমটি ছিল নিজের, দ্বিতীয়টা বাবার, এবং তৃতীয়টি মায়ের।

    তৃতীয় নামটি লেখার সময় অবশ্যই আমার হাত কেঁপেছিল আর লেখার পর নিজের বিছানা ছেড়ে মায়ের বিছানায় গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে, বুকে মুখ লুকিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। মা কয়েকবার অবশ্য আদর করে জানতে চেয়েছিল, আমি উত্তর দিইনি, এবং যখন উনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তখন সারারাত উনাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে থাকতে মনে হয়েছিল, আমি সত্যিকারের একটা লাশকে জড়িয়ে ধরে আছি। সেদিনের সেই রাত ছিল আমার জীবনের সবচে' দীর্ঘতম ও অন্ধকার রাত। তোমাকে এতসব কথা আমি আগেও বলতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি, কারণ আমার সেই ছোট্ট ফ্যাকাসে খাতাটা এখনও আমি মাথার পাশে রেখেই ঘুমৈ।

    আমি জানি, এরপর তুমি আমার কাছে এলে খাতাটা দেখতে চাইবে, কিন্তু আমি দেখাবো না, কারণ সেখানে তোমার পরিচিত অনেকেরও নাম আছে। বছর চারেক আগে, যখন তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, সেদিন মনে হয়েছিল খাতাটা পুড়িয়ে ফেলি, কিন্তু পরের দিন স্টেশনে বাবাকে নতুন মা-সহ বিদায় জানাতে গিয়ে, প্লাটফর্মে পাটিতে মোড়া, পা ও মাথা বেরিয়ে থাকা একটা রক্তাক্ত লাশ দেখে হাসি পাওয়ায়, পারিনি। জানো, লাশটির হাত ও পায়ের মধ্যে দিয়ে একটা লম্বা বাঁশ আড়াআড়ি রাখা ছিল। দৃশ্যটা দেখে আমার ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়েছিল। আমরা ক'বন্ধু মিলে একটা বেড়ালকে বস্তায় ভরে পিটিয়ে মেরেছিলাম। বেড়ালটির অপরাধ ছিল এই, ও দুটো বাচ্চা প্রসব করেছিল, এবং যতবারই তাকে বাচ্চাসহ দূরে রেখে আসা হত, ততবারই সে তাদের নিয়ে ফিরে আসত। ওর এই অপরাধের শাস্তি স্বরূপ আমরা ক'বন্ধু মিলে তাকে বস্তায় পুরে ইচ্ছেমতো পিটিয়ে মেরেছিলাম, আর মারার পর তার হাত-পা বেঁধে, একটা বাঁশ আড়াআড়ি ঢুকিয়ে, কাঁধে করে গ্রাম ছেড়ে দূরে বিলের মধ্যে কবর দিয়েছিলাম। তারপর আর কখনই বেড়ালটি ফিরে আসেনি, ফিরে আসেনি তার বাচ্চাদুটূ, কারণ, পরে আমরা বাচ্চা দুটোকেও ওদের মায়ের কবরের পাশে রেখে এসেছিলাম।

    আমার খাতায় সেই বেড়াল ও বাচ্চা দুটোরও নাম আছে। জানি, তুমি কী ভাবছো? হয়তো আমাকে ভয় পেতে শুরু করেছো। কিন্তু, তুমি তো জানো না, আমি নিজেই সবসময় ভীত থাকি। রাতে কখনই আমার ঘুম আসে না, যদিওবা আসে, মনে হয় মারা গেছি, আর আমার শরীরের উপ্রে গিজগিজ করছে শত শত আরশোলা, যাদের প্রত্যেকের নাম আমি জানি। আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠি, বিছানায় বসে কাঁপতে থাকি, কিন্তু আলো জ্বালতে সাহস পাই না। মনে হয়, আলো জ্বাললেই দেখতে পাবো, সেই সব আরশোলা, পালিয়ে যাচ্ছে। তুমি প্রথম যেবার আমার ঘরে এলে, সেদিন ছোট্ট এই ঘরটা দেখে খুশি হয়েচিলে। বলেছিলে, "বাহ্‌! এই ঘরটা আমাদের দু'জনের জন্য চমৎকার।' কিন্তু, কিছুক্ষণ পরে এও বলেছিলে, "নাহ! এখানে তুমি থাকো কী করে? একটা জানালাও নেই!' তোমার সেদিনের এই কথাটা এখনও মনে পড়ে, এবং একটা বড়সড়, ঠিকঠাক জানালার আক্ষেপ গোপন রেখে, উত্তরে বলেছিলাম দীঘির কথা। জানো, আজকাল প্রায় মনে হয়, একটা জানালা আমার খুবই দরকার, জেটা দিয়ে আকাশ নয়, বরং বড় দীঘি দেখা যায়। ঠিক আমার গ্রামের বাড়ির মতো, অতবড় বাড়ির যে কোন যানালায় দাঁড়ালেও, বড় একটা দীঘির সবটা দেখা যায়।

    ছোটবেলায় আমি রোজ বিছানায় পেচ্ছাব করতাম, আর আমার মা প্রতিদিন সকালে সেই দীঘিটায় আমার বিছানার চাদর, কাঁথা সব ধুয়ে রোদে শুকোতে দিতেন। জানো, গতকাল রাতে এতবছর পর আবার আমি বিছানায় পেচ্ছাব করেছি। পেচ্ছাব করার পর যখন উঠে বসলাম, তখন দেখি একটা শান্ত-শিষ্ট আরশোলা চুপচাপ আমার খাটার পাশে বসে আছে। আলো জ্বললাম, তবুও পালিয়ে গেল না। আমার কেন জানি মনে হল, ওই আরশোলাটা আমার মা। আমার ভীষণ কান্না পেল, দু'হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদলাম অনেকক্ষণ, এবং কান্না থামার পর যখন দেখলাম আরশোলাটা তখনও সেখানে বসে আছে, তখন খাতাটা তুলে সেটা দিয়ে তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে থেতলে দিলাম। তারপর একভাবে তাকিয়ে থাকলাম ওর থেতলে যাওয়া শরীরের দিকে। জানো, ওভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কি মনে হলো?

    আজ আমার মায়ের মৃত্যুদিন।

    অরণ্য
    চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
  • 18 | 192.42.116.182 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:১৭741427
  • সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি
    মল্লিকা, ইউ এস এ
    ২৬.১০.২০০৬

    প্রথমবার বাড়ি আসার পরে গল্প শুনে সবাই অবাক হয়ে গালে হাত দেয়। বরফ পড়ে না, পাহাড় নেই, আকাশে লন্ডনের মতন বিষন্ন মেঘ নেই, টিপি টিপি ঝাপসা বৃষ্টি নেই, মস্ত উঁচু উঁচু বাড়ি নেই ন্যু ইয়র্কের মত,এ আবার কেমন বিদেশ! সত্যি তো! ঠিক বলছিস? তারপরে রাস্তার গল্প শোনে, ঝাঁ চকচকে সব বিশাল বিশাল রাস্তা চলে গেছে, তাতে একটা লোক নেই, সব লোক গাড়িতে, একেকটা গাড়িতে একজন বা দুজন করে, হাজারে হাজারে গাড়ি আর গাড়ি, পথের রিফ্লেকটরগুলো থেকে আলো ছিটকায়,গাড়িতে জগঝম্প বাজনা চলে।

    ছোট্ট সবুজ শহরটি, ঢেউ খেলানো ভূমির উপর দিয়ে ছড়িয়ে গেছে পুবে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে। বড় বড় মিউজিয়াম বা ইন্ডাস্ট্রি কিছু নেই, মাঝারি আকারের বিশ্ববিদ্যালয়টি কেন্দ্র করে ছড়িয়ে গেছে বাড়িঘর চেনস্টোরের মালা আর হাইওয়ে। আর অজস্র পাইন গাছ, দীর্ঘ সরল দেহ আকাশে তুলে শহরের স্কাইলাইন সবুজ করে রেখেছে। চিরশরতের দেশ, আকাশ নীল আর সেই নীলের উপরে সাদা তুলো মেঘ প্রায় সবসময়। প্রায়ই উপসমুদ্রের কালো মেঘ ছুটে আসে আর যখন তখন বৃষ্টি, বৃষ্টি। তবে দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কমে যায়। ঢেউখেলানো জমিতে জল দাঁড়াতে পারে না, গড়িয়ে চলে যায়।

    শহর থেকে তিনঘন্টার ড্রাইভে দক্ষিণে গেলে দেখা মেলে সেই বিরাট নদীর, ভূগোল বইয়ের সেই নদীটি, মিসিসিপি। যাযাবরের গান যে নদীকে বুকে রেখেছে। নদীর তীরে বাঁকা চাঁদের মতন ভূমিখণ্ডে অদ্ভুত প্রাণোচ্ছল একটি শহর নিউ অর্লিয়েন্স, আমার চেনা ঘরোয়া শহরটির থেকে একদম আলাদা। এক তো নিউ অর্লিয়েন্স সমুদ্র সমতলের চেয়ে নীচে, তার উপরে সেখানে ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার বলে একটা জায়গা সুরাসক্ত লোকেদের স্বর্গরাজ্য, সারাদিন সারারাত শহরটি জেগে থাকে আর হুল্লোড় করে। সেখানে প্রায় মাঝরাত অবধি থেকে একটা হন্টেড হাউস টুর সেরে আমরা ফিরতি পথে রওনা দিই, তিনঘন্টার ড্রাইভের পরে শেষরাতে বাড়ি ফিরে মরার মতো ঘুম। পরদিন ছুটি। একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে দেখি চেনা শহরটি আলোয় ছলছল করছে। দরজা খুলে লনে আসি, বুক ভরে বাতাস টেনে নিই, ওই পুবের পাইনগাছগুলোর ফাঁক দিয়ে নতুন ওঠা সোনার সূর্য আমায় দেখছে। কবে এমন ঘর হয়ে গেল এখানে আমার? কে ভেবেছিল এইভাবে এতদূরে এসে বছরের পর বছর থাকব? এত প্রিয় হয়ে যাবে এর পথঘাটগাছগাছালি পাখপাখালি?

    ওয়াটার ওকগুলোর সুন্দর পত্রগুচ্ছে সকালে আলো পড়ে কি মিহি সুন্দর রূপ হয়েছে, কাঠবেড়ালিগুলো গাছে গাছে ছোটাছুটি করছে, খুব ডাকে ওরা জোরে জোরে। স্নান সেরে রেডি হয়ে চলি আমার প্রিয় কফি শপে। হেঁটেই চলে যাই। ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের এইটা খুব প্রিয় কফি শপ। প্রফেসররাও মাঝে মাঝে কেউ কেউ আসেন। এখানকার কর্মীরা অনেকেই পার্ট টাইম কর্মী, এমনিতে স্টুডেন্ট, খুব ফ্রেন্ডলি। বাড়ির জন্য মন কেমন করে, আবার বন্ধুবান্ধব শুভানুধ্যায়ীদের সাহচর্যে সেসব মেঘ উড়ে যায়। অথবা রাতের রজনীগন্ধায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায়, পরদিন আবার এখানের নীল আকাশের মতন। আকাশে তাকিয়ে আধা চাঁদটি দেখে চমকে উঠি, একি মহাষ্টমী নাকি আজ? বাড়িতে চণ্ডীপাঠ নিশ্চয় ওদের সকালেই হয়ে গেছে! মহালয়ার স্মৃতি আসে, শিশিরে ভেজা ধানগাছ, শিউলিঝরা সকাল, প্রিয় সখী অনিলিখা। অনি,কোথায় তুই? কোথায় তুই, কোথায় তুই?

    কি বোকা! একা একা স্ক্রিনের দিকে চেয়ে চোখ দিয়ে কেন জল পড়ে? মুছলেও কেন আরও আরও জল? এরকম বোকামির কোনও মানে হয়?
  • 19 | 185.220.102.6 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:০৯741428
  • পাত্রী চাই
    যোষিতা

    আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবার ঠিক পরেই, তখনও ঠিক হয় নাই, আরও পড়ব - নাকি পড়া এখানেই শেষ, আমাদের কল্যানীর বাড়িতে, সন্ধ্যেবেলা রান্নাঘরে মাকে কাজে সাহায্য করছি, মা লুচি ভাজছে, আমি বেলছি, বাবা আমাদের ছোটো ভাইটাকে নিয়ে গেছে বন্ধুর বাড়ি হরিণঘাটায়, বাবা ফিরলেই সবাই খেতে বসব, লুচি গোল হচ্ছে না, মা রেগে অস্থির। মা রাগ করে বেলনটা ছুঁড়ে মারল আমার দিকে, "এত বড় হয়েছিস, আজ বাদে কাল বিয়া দিলে শ্বশুরবাড়ি কাজ করতে হবে না?" আমি রাগ করে রান্নাঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলাম,  আমি আর আমার সেজবোন তপতী দুজনেই এবার একসঙ্গে ভালোভাবে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছি, মাত্র দুইদিন আগে রেজাল্ট বেরিয়েছে, মার্কশিট এখনো আসেনি।

    হঠাৎ পেছন ফিরে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি ভীষণ আলো, অত আলো কেন? আলো নয়, আগুন, মা-র শাড়িতে আগুন, সারাগায়ে আগুন ধরে গেছে, কী করে আগুন লাগল? আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে ধরব , না কী করব? চেঁচাতেও পারছি না, আমি বোবা হয়ে গেছি। মা, ঐ অবস্থায় বাইরে ছুটে আসল, মাথার চুলগুলো সব পুড়ে গেছে,  উঠানের দিকে দৌড়ে গেল, জল-জল করে চেঁচাচ্ছে, জলের বালতি রান্নাঘরে, আমি পাতকুয়ার দিকে দৌড়ে যাবার আগেই মা পাতকুয়ার মধ্যে ঝাঁপ দিল। এতক্ষণে লোকজন এসে পড়ছে, আমার ছোট্টো বোন জয়ন্তী, ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। সমস্ত ব্যাপারটা আমার চোখের সামনে ঘটল, পাতকুয়া থেকে মাকে তুলল, আশেপাশের বাড়ির লোকজন, তখনও একটু একটু জ্ঞান আছে, শুধু বলছে, জ্বলে গেলাম, জ্বালা ভীষণ জ্বালা। মা আমাদের চোখের সামনে মারা গেল, হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু চব্বিশ ঘন্টাও কাটেনি। হাসপাতাল, পুলিশ, এসবের মধ্যে আমরা মায়ের জন্যে কাঁদতে পারিনি কেউ।

    মা-র মৃত্যুর পরে, বাবা একমাসের মধ্যে কী বুড়া হয়ে গেল যে কী বলব, মাথার আদ্ধেক চুল পাকা, ঠিকমত দাড়ি কামায় না, চোখের দৃষ্টি একেবারে ফাঁকা। বাবাকে আর চেনা যেত না। এই সময়ে বাবার মাথার মধ্যে ঢুকল, আমাদের বিয়া দেবার চিন্তা, আমার দিদির আগেই বিয়া হয়ে গেছে, বাকি আছি আমরা আরো তিনবোন, আমি মেজ, আমার পরে, তপতী আর জয়ন্তী। বাবার ধারণা এখন যদি তার নিজেরও কিৎছু একটা হয়ে যায়, তবে আমরা তিনবোন, ছোটভাই সব ভেসে যাব। আমার আর সেজবোন তপতীর জন্যে বাবা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে পাত্র খুঁজতে লাগল। আমরাও নিজেরা সেখান থেকে বেছে বেছে পাত্র পছন্দ করতে লাগলাম। একটা সম্বন্ধ আমার নিজের পছন্দ হয়েছিল, বাবারও পছন্দ ছিল, সেখানেই যোগাযোগ করা হোল, পাত্রের বয়েস একটু বেশি, কিন্তু থাকে সুইটজারল্যান্ডে, বউ মারা গেছে, সেখানেই বিয়া ঠিক হোল। তপতীর বিয়াও ঠিক হল এক ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে, আমার বিয়া ঠিক হওয়া থেকে বৌভাত, পুরো ব্যাপারটা হয়েছিলো মাত্র আট দিনে। পাত্র বাইরে থেকে আসল, আশীর্বাদ হোল, বিয়ার পুরো অনুষ্ঠান, বৌভাত, সব শেষে, বৌভাতের পরের দিন বিয়া রেজিস্ট্রি করতে গেলাম, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে। বাবা সঙ্গে যেতে চাইছিল, আমার স্বামী বলল, আপনার কষ্ট করে আসার দরকার নাই, আমার বন্ধু বান্ধব আছে, বেশিক্ষণ লাগবে না, আপনি বাড়িতে থাকুন। সেইখানেই জানলাম, বরের বয়স আমার থেকে পনের বছর বেশি নয়, তিরিশ বছর বেশি, আমার বাবার প্রায় সমবয়সি সে, আরো জানলাম, বউ তার মারা যায় নি, ডিভোর্স হয়েছে, আরো কীকী লেখা ছিলো সেই কাগজে দেখতে পাইনি, আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, কিন্তু ফুলশয্যাই হয়ে গেছে, এখন আর ঐ কাগজে সই দেওয়া আর না দেওয়ার মধ্যে কী পার্থক্য! বাড়ি ফিরে বাবাকে আমি কিছু বলিনি, বাবার এমনিতেই মন ভার, তাকে আর কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে নেই। বর আগেই চলে গেল বিদেশে, আমি গেলাম আরো তিন মাস পরে, পাসপোর্ট ভিসা টিকিট এইসবে সময় লেগেছিল, আর ততক্ষণে এটাও টের পেয়েছি, আমার শরীরে আরেকটা প্রাণ বড় হচ্ছে।

    সুইটজারল্যান্ডের এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে এসেছিলো আমার স্বামী, সঙ্গে আরেকটি ছেলে, দেখে মনে হল আমার ভাই কৌশিকের চেয়ে অনেকটাই বড়, স্বামী আলাপ করিয়ে দিলো, এ তোমার বড় ছেলে। বাহরে, আর কত মজার জিনিস দেখব? চোদ্দ পনের বছরের একটা ছেলেও আছে আমার, এই আঠার বছর বয়েসেই? কই জানতাম না তো?
    মুখে বললাম, আমার ছেলে?
    স্বামীটি উত্তর দিলো, শুধু এই ছেলে নয়, একটা মেয়েও আছে, তার বয়েস তেরো, তবে তোমার চিন্তা নাই, এরা এদের মায়ের কাছেই থাকে, মাঝেমাঝে আসে, তখন এদের ঠিকমতো যত্ন হওয়া চাই। এদের মায়ের সঙ্গে আমার ডিভোর্স।
    জানা রইল। আমি এরপরে চুপ ছিলাম বহুক্ষণ, সেই এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত।
    বাড়ি পৌঁছবার পর স্বামী আবার প্রশ্ন করে, "এত ব্যাজার মুখ কেন? এত সুন্দর একটা দেশে এসেছে, এত ভালো জায়গা, তবু এত মুখ ভার?"
    বললাম, "বিয়া হতে না হতেই আমাকে সৎমা বানিয়ে দিলে?"
    যেই না একথা বলা দুই গালে ঠাসঠাস করে দুই চড়, "মুখে মুখে কথা বলবি, তো লাথি মেরে বার করে দেব!"
    হ্যাঁ, এই আমার প্রথম স্বামীর বাড়িতে আসার অভিজ্ঞতা।

    সৎ ছেলেমেয়ে দুটো, মাঝেমাঝে আসে, আমাকে মানুষ বলেই গন্য করে না, ওদের মা সুইস, না অস্ট্রিয়ান, কী একটা যেন, বাপ ওদের বাংলা শিখিয়েছে কিছু, আর কিছুতো না, কিছু বাংলা গালি শিখিয়েছে। মুখে আনা যায় না সেসব অশ্রাব্য শব্দ; ছেলেটা ঐ সব গালি দিয়ে আমাকে ডাকে, দেশে রাস্তার কুকুরের সঙ্গেও আমরা এমন ব্যবহার করতে দেখিনি কাউকে! বাবাকে প্রথম ছয়মাস কোনো চিঠি লিখিনি। বাবা চিন্তায় অস্থির, ছোটো ভাইবোন দুটো ভাবছে, দিদি বিদেশে গিয়ে ওদের ভুলে গেছে, বাড়িতেতো মা-ও নাই, শুধু বাবা আর ছোটো দুই ভাইবোন, কী লিখব ওদের? লিখতে গেলে কান্না আসে, কতবার চিঠি লিখতে গিয়ে আর লিখতে পারিনি, লেখা যায়, বাবা তুমি জানো, আমি কীভাবে আছি? সুন্দর রাস্তাঘাট, সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি, ভালোভালো সিনারি, এসব দেখা হয়ে গেছে, শুধু লাথি ঝ্যাঁটা আর অত্যাচারই বরাদ্দ ছিলো আমার এই আঠারো বছর বয়েস থেকে? এর নাম স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক? আমার বাবাও তো আমার স্বামীর প্রায় সমবয়সি, তাকে তো কোনোদিন আমার মায়ের সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করতে দেখি নাই? ঝগড়াঝাঁটি কি হত না বাবা মা-র? হত, কিন্তু, এই বিদেশে, এই শিক্ষিত স্বামীর এ কী ব্যবহার? সব সহ্য করেই ছিলাম, প্রথমে ছেলে জন্মাল, তার পরে মেয়ে। ছেলে স্কুলে যেতে শুরু করল, আমিও তার সঙ্গে জার্মান ভাষা শিখতে লাগলাম, ভাষা না জানলে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারব না, কোনো বন্ধু থাকবে না, বিপদে আপদে কে বাঁচাবে আমাকে?

    আমার প্রথম বান্ধবী ছিলো আমাদের নীচের ফ্ল্যাটের মেয়ে, নাম সারা। ও বলল, "তোর স্বামী তোকে এত মারধোর করে, তুই পুলিশ ডাকবি!" খুব বুদ্ধি! পুলিশ তো ডাকব, তারপর? টাকা পয়সা তো কিছুই নাই আমার, দুটো বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব? ইন্ডিয়া? ডিভোর্সি বাচ্চাসহ মেয়ের কী ভবিষ্যৎ বাঙ্গালি সমাজে? তবু সারা সহ্য করতে পারে না আমার অপমান, ও বিশ্বাসই করতে পারে না, আমার স্বামী কোনোদিন একটা চুমুও খায়নি আমাকে, অথচ তার দু-দুটো সন্তানের জন্ম দিয়েছি আমি। ওরে বোকা মেয়ে, সন্তানের জন্ম দেবার জন্যে চুমু খাবার দরকার পড়ে না!

    সারা তখন বুদ্ধি দেয়, তুই চাকরি কর ব্রততী। সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ, কে চাকরি দেবে আমাকে? কিন্তু সত্যি চাকরী পেলাম, আটবছর কষ্ট সহ্য করে, ধীরে ধীরে গোপনে ভাষা শেখার ফল পেলাম, পোস্টঅফিসের কাজ, মেল সর্টিং, এর জন্যে পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নাই। ঘন্টায় তিনহাজার চিঠি সর্ট করতে হবে, আমি পারব, ঠিক পারব। কিন্তু এই বাড়িতে থেকে তো চাকরি করা যাবে না, আলাদা ফ্ল্যাট খোঁজা হোল, খাট আলমারি, টেবিল,  মানে যা যা লাগে সব কেনা হল, সারা হেল্প না করলে আমার একার পক্ষে অসম্ভব ছিল এসব।

    চাকরিতে জয়েন করার আগের রাত্রে স্বামীকে বললাম, "একটা চাকরি নিয়েছি, কাল জয়েন করব"।
    - তাহলে বাচ্চাদের দেখবে কে? সারাদিন বাইরে টইটই?
    - দিনে নয়, রাতে; বাড়ির কাজ সব গুছিয়ে দিয়ে, নাইট ডিউটি।
    - বা:, তলে তলে এত কাজ? কীসের চাকরি? প্রফেসর হবে নাকি?
    - না, প্রফেসর না, তবে একেবারে অশিক্ষিত মেয়েরেও বিয়া কর নাই, ভদ্র কাজই করব।
    আগে থেকেই জানতাম রাজি হবে না সে, তাই তো আলাদা হবার জন্যেই ফ্ল্যাট ঠিক করাই ছিলো, তবুও, বলে যেতে হয়, তাই বলেছিলাম।
    ব্যস, শুরু হয়ে গেল মারধোর, এসব আমার নতুন কিছু না, আট বছরের মার খাওয়া অভ্যাস, কখনো কখনো উল্টে দিয়েওছি দুঘা, কিন্তু সেদিন আমি চুপচাপ মার খেলাম, কালশিটে আর রক্ত দুটোই কাজে লাগবে।
    পরদিন সকালে, স্বামী কাজে বেরোলেই, ব্যাগ গুছিয়ে, বাচ্চা দুটোকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লাম, নিজের কাপড় জামা ছাড়া কিছু নিইনি, একটা চামচ ও আনিনি ঐ বাড়ি থেকে; পুলিশকে খবর দিলাম, মারধোরের দাগ দেখালাম, সব জানিয়ে, আমি স্বামীর ঘর ত্যাগ করলাম।

    অসুবিধা কি আর হয়নি? হয়েছে। দুটো ছোটো ছোটো বাচ্চা মানুষ করা, সারারাত চিঠি বাছাইয়ের কাজ, দিনের বেলা, রান্নাবান্না সব কাজ, তবু শান্তি।
    এদিকে এর মধ্যে স্বামী ঠিক খোঁজ নিয়ে এসে উপস্থিত; " চলো চলো অনেক ঢঙ হয়েছে"।
    - আমি আর ফিরব না, আমি ডিভোর্স চাই।
    - ডিভোর্স? কেন? ও বয়ফ্রেন্ড হয়েছে? তারে বিয়া করবে?
    - কী করব না করব আমার নিজের সিদ্ধান্ত, তুমি এখন যাও।

    ডিভোর্সের কেস চলছে, এমন সময়ে এক অদ্ভুত মজা হল। যা আমি কখনও কল্পনাও করিনি, আমার হাত দিয়েই শয়ে শয়ে চিঠি বাছাই হচ্ছে, সব আমার স্বামীর নামে, সে পাত্রী খুঁজতে আবার বিজ্ঞাপন দিয়েছে কলকাতার খবরের কাগজে। আটান্ন ঊনষাট বছরের ডিভোর্সি পাত্রের জন্যে রোজ শয়ে শয়ে পাত্রীর দরখাস্ত আসছে, সুইস পাসপোর্টের এমনই মধু! এসব চিঠি আমার হাত দিয়েই বাছাই হয়, খামের ওপরেই তো লেখা থাকে বিষয়বস্তু, ভাগ্যের কী পরিহাস! ডিভোর্সও হল, আর তার তৃতীয় বিয়াও হল, একমাসের মধ্যে, খবর ঠিক পেলাম আমি। এবার বউ, আমার মত আঠারো বছরের ইস্কুল পাশ মেয়ে নয়, সুশিক্ষিতা, শুনেছি লেখিকা নাকি, বাব্বা:!

    এরপরে অনেক বছর কেটে গেছে, আমার ছোট্ট ভাইটা, কৌশিক, দেশে বি.এস.সি. পাশ করে বসে ছিল, আমিই ওকে নিয়ে এলাম, তারপর এদেশে থেকে যাবার জন্যে, বাধ্য হয়ে লোকে যা করে, একটা সুইস মহিলার সঙ্গে বিয়ে। মহিলা নয়, বুড়ি, কিন্তু বাঁচতে তো হবে। পাঁচ বছর সেই বুড়ি বউকে আমার ভাই, না পারে ফেলতে, না পারে রাখতে; বুড়িটাও শয়তান, খালি ভয় দেখায় ডিভোর্স করে দেবে! আরে:, পাঁচ বছরের মধ্যে ডিভোর্স করলে, কৌশিককে তো দেশে ফিরে যেতে হবে! এখন অবশ্য সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।  খুব কষ্ট করে পাঁচটা বছর কাটিয়েছে ভাইটা। গতমাসে ডিভোর্স ও হয়ে গেছে, এবার ও পাকাপাকি থাকতে পারবে এদেশে, একটা ভালো চাকরি খুঁজছে। বাবাকে আজকাল প্রত্যেক মাসেই ফোন করি আমি। অনেক কথা হয়। আমার ডিভোর্সের কথা বাবা চেপে রেখেছিলো অনেকদিন, ছোটো বোনটার বিয়ে হওয়া অবধি। ইদানীং নাকি অনেকেই বাবার কাছে আমার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে, ডিভোর্সি, দুটো বড় বড় ছেলেমেয়ে আমার, তবুও আগ্রহ।

    বাবা বলে, " জানিস, আজকাল সমাজ অনেক পাল্টে গেছে, আজকাল বাচ্চাসহ ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়া করতে কতলোকের আগ্রহ"।
    -  রাখো তো, ওসব! সমাজ ওরকম পাল্টায় নাকি? তোমারও যা বুদ্ধি! চিন্তা করে দেখো, ওরা কি আমাকে বিয়া করতে চায়, না আমার পাসপোর্টটাকে? ইন্ডিয়ায় কুমারী মেয়ের অভাব কবে থেকে? তার চেয়ে এক কাজ কর, কাগজে বিজ্ঞাপন দাও, আমার জন্যে নয়, আমার এখানে বয়ফ্রেন্ড  আছে।  বিজ্ঞাপন দাও কৌশিকের জন্যে।
    এইভাবে লিখো, অনূর্ধ ত্রিশ, পূর্ববঙ্গ কায়স্থ, ইউরোপ নিবাসী, সুচাকুরে পাত্রের জন্যে অনূর্ধ পঁচিশ, ফর্সা, সুশিক্ষিতা, প্রকৃতসুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা পাত্রী চাই। অস্ববর্ণ চলিবে। কোনো দাবি নাই।
  • 20 | 46.182.21.250 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৪741431
  • ঘুমবাহী বিমান
    অরণ্য
        
    যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে, যেন বা আমরা সেরকমি ভাবছি আর
    আমাদের খুচরো খাতায় হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ছে লাশ
    অভ্যস্ত চোখে জেগে উঠছে স্বপ্ন আরও নতুন
    সত্যিকারের লাল রং
    প্রতিদিন পেপারের পাতায় খুঁজে মরছি সুখ অথচ বিভ্রান্তিরা বসত শুরু করেছে
    আমাদেরি প্রিয় স্ত্রীদের মত, যাদের আমরা কামনা করি, আবার ঘৃণাও
    ঘৃণা; শব্দটা এখান থেকে সরিয়ে দিলাম
    যেভাবে চোখ থেকে সাবলীল সরিয়ে রেখেছি হাস্যরত শিশুদের মুখ
    আমাদের ভবিষ্যৎ আকাঙ্খা আর দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ
    চারিদিকেই হলুদ রঙের আকাশ
    সেখানে উড়তে থাকা ক্ষুধার্ত শকুনের দিকে আঙুল তুলে ব্যঙ্গ সহকারে
    একে অপরকে বলতে থাকি, উন্নয়ন
    খবরের পাতা, যা সকালের চায়ের মতো আরামপ্রদ ও কাম্য
    সেখান থেকে খুড়ে খুঁড়ে বের আনি সমূহ নিদর্শন
    আর যেসব লাশ অজস্র মৃত শিশু কিংবা নির্যাতিত নারীদের
    আবর্জনার মত আমাদের পরিচ্ছন্ন ঘর, রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, শিক্ষালয়
    কিংবা বই-পুস্তক দুর্গন্ধময় করে তোলে
    তাদের হজম করে ফেলি রাতে ঘুমোতে যাবার আগেই
    এবং ঘুম, কত সহস্রাব্দের ঘুম
    প্রতিদিন আগেরদিন থেকে আরও বেশি রোপণ করে যাচ্ছে তার গাঢ়তা
    আমরা আরাম বোধ করি আরও, নিশ্চিন্তে বন্ধ করি চোখ
    যেনবা সত্যিই দেখব স্বপ্ন
    অথচ কত অনায়াস নেমে আসে সেইসব বিমান
    যারা রাতভর বিছানায় নিত্য-নতুন ঘুম ছিটিয়ে ছিটিয়ে
    ভোর হতে না হতেই ঢুকে যায় আমাদের নারীদের পেটে
     
     
    ৪মে , ২০০৯
  • kk | 2607:fb91:89d:9cdb:d93d:3ff2:1a91:6db5 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ২১:০৯741432
  • আরিব্বাস! এইটা পুরো সোনার খনি হয়েছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ২১:২৬741433
  • খুব সাবধান! একবার এখানে ঢুকে পড়লে আর বের হয়ে যেতে মন চাইবেনা। smiley
  • X | 49.207.217.240 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ২১:৫৬741434
  • ঈ :, এ তো  ম্যজিক!!
  • এটা সেটা এখানে সেখানে - বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী | 103.76.82.214 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ২২:২০741435
  • ২৬, ২৭, ২৮, ৩১, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ বাদে ১ থেকে ৪০ এর বাকি সব কিস্তি রইল। না পাওয়া ৯টি কিস্তি পাওয়া গেলে, বন্ধুরা, পোস্টিয়ে দেবেন এখানেই। তালিকা ,
    ১ (May 18 2005)
    বিনসর বিনসর

    তিন বন্ধু- রঙ্গন, রঙ্গনা ও রঙ্গাই। তিনজনেই হোস্টেলবাসী। ফেব্রুয়ারির দিল্লি শহরে হালকা ঠান্ডা হাওয়া, ঝক্‌ঝকে নীল আকাশ আর রাস্তাঘাটে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে লাল গোলাপি ফুলের ঝাঁক। এই মরশুমে পায়ের তলায় প্রবল সর্ষে- হোস্টেলের পাতি বাওয়ালে সহে না, সহে না। স্যান্ডির নেতৃত্বে একদল ছেলে বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য বিনসর। সেই সময় বিনসর অখ্যাত জায়গা, ক্লাব মাহিন্দ্রার বিলাসী রিসর্টের দৌলতে বা ভ্রমণ আর আউটলুক ট্র্যাভেলারের দাক্ষিণ্যে চেনাজানা ছুটি কাটানোর জায়গা হয়ে ওঠেনি। স্যান্ডি কোনোসূত্রে খোঁজখবর করে জেনেছে আলমোড়া থেকে কয়েক পা এগোলেই বিনসর- বাঁদুরেটুপিপরিহিত বাঙালী মেসো-মাসিদের ভিড়ভাট্টারহিত অতি মনোরম ভ্রমণস্থল। রঙ্গন "চলি গো চলি গো" করেও পা আর উঠাতে পারছে না। স্যান্ডিকে জিজ্ঞেস করায় জানা গেল বিনসরে নাকি মোটামুটি হোটেলটোটেল দোকানটোকান লোকটোক আছে। অভিজ্ঞ পাঠকপাঠিকামাত্রেই জানিবেন- "ট"কারান্ত শব্দপ্রয়োগের অর্থ বিষমমাত্রার কোনো ঘোর অনিশ্চিতি আপনার জন্য অপেক্ষমান। এই ঘটনার পাত্রপাত্রীগণ তখনও তদনুরূপ অভিজ্ঞতালাভ করেন নাই- অতএব। পরের দিন, বিভিন্ন দোটানা, টানাটানি এবং মাথাচালাচালির পর ঠিক করা গেল কুমায়ুনের দিকে বেরিয়ে পড়া যাক। হয় তো বিনসর, হয় তো বিনসর নয়। যার ট্যাঁকে যা ছিল তা নিয়ে এবং যার আলমারিতে যা ছিল তা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। কিন্তু বহুবিধ দোলাচলের পর বেরিয়ে পড়তে পড়তে প্রায় রাত নটা। দক্ষিণ দিল্লির থেকে উত্তর দিল্লির আন্ত:রাজ্য বাস টার্মিনাল ওরফে আই এস বি টি- অনেকটা পথ। মহানুভব অটোয়ালা এবং আই টি ও আর দরিয়াগঞ্জের জ্যামের জন্য সেই দূরত্বও দুর্বিষহ ঠেকে। কিন্তু তিন স্যাঙাৎ তখন বাহাদুর শাহ জাফর মার্গেও পাহাড় জঙ্গল দেখে ফেলছে। দিল্লির তোয়াক্কা কে করে? চলো আই এস বি টি।

    উত্তর ভারতের ছোটোখাটো শহরের ধুলোমাখা, গ্যাঞ্জামে ঠাসা বাস ডিপোগুলোর এক বিশালবপু সংস্করণ হল এই আই এস বি টি। সরকার হল বাঙালির মাই বাপ। কিন্তু দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ- দুই সরকারি পরিবহণ সংস্থাই হতাশ করলেন। আলমোড়া এবং হলদোয়ানির বাস ছেড়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। এক প্রায়ান্ধকার সিঁড়ির তলায় এক ক্ষুদ্রকায় মূর্তি "আলমোড়া হলদোয়ানি রুদ্দরপুর" বলে চিলচীৎকার করছিল। তিনমূর্তি তার থেকেই টিকিট কাটল। কিন্তু বাস কই? কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে পদব্রজে যাত্রা শুরু। এ গলি সে গলি ঘুরে গোটা চারেক তিনমাথা চৌমাথা টপকে যেখানে পৌঁছনো গেলো, সেখানে অন্ধকার গলিতে সারে সারে বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখন ঝির্‌ঝিরে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। বাসে উঠে দেখা গেল বাস বেশ ভরপুর। আস্তে আস্তে পুরো গপ্পো খোলসা হল। এই বাস হলদোয়ানি যাবে না রুদ্রপুর যাবে তা নির্ভর করছে কোথাকার কতজন যাত্রী টিকিট কেটেছে তার উপর। এবং যথারীতি আমাদের তিনমূর্তি
    হলদোয়ানির একমাত্র যাত্রীদল। আরও সরেস ব্যাপার হল, প্রতি সিট ভর্তি না হলে বাস ছাড়বেও না। এক মুরুব্বির দেখা পাওয়া গেল যিনি সকাল দশটায় টিকিট কেটেছিলেন বেলা এগারোটায় বাস ছাড়বে বলে। তিনি এখনও কাশ্মীরি গেটের বাতাস খাচ্ছেন, মুখে চরম নির্বেদের হাসি।

    এমন সময় ডেরাইভার এলেন- রাজকাহিনী থেকে জেরক্স জিনিস, টক্‌টকে রং, গালে ইয়াব্বড়ো গালপাট্টা, সাড়ে ছ ফুটিয়া বডি। রঙ্গাই তার ঠেঁট বিহারি হিন্দিতে পুছল বাস ঠিকঠাক চললে হলদোয়ানি পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে। গোঁফ চুমড়িয়ে উত্তর এল মেরেকেটে চার ঘন্টা। এতক্ষণে তিনমূর্তির ঘেঁটে যাওয়া সম্পূর্ণ। এর পর বাস এগারোটা নাগাদ যখন চলতে শুরু করল, ঘাঁটা পাবলিকের ফুত্তি দেখে কে! এপাশ ওপাশ ঘুরে দশ মিনিট বাদে বাস এসে দাঁড়াল বিরাট এক বিল্ডিং কম্পাউন্ডের সামনে- প্রচুর আলো, অনেক লোক, ব্যস্ত চলাচল। দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। অহো:! এ তো আই এস বি টি- চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবারে প্রশ্ন আরও মৌলিক স্তরে- বাস যাবে কি? একবার তিনজনের মনে হইল- আর গিয়া কাম নাই। কিন্তু জাড্য অতিক্রম অতীব কঠিন। অতএব বসে বসে দেখা গেল শতরকম জালজোচ্চুরির অন্য নাম আন্ত:রাজ্য বেসরকারী পরিবহণ। শেষে রাত একটা নাগাদ বাস ছাড়ল। ততক্ষণে রঙ্গনা বিদ্রোহী নারীমূর্তি, এই হেনস্থার কঠিন পিতিবাদ দরকার। ঠিক এই সময়ে একটি ছোট্টো ঘটনা- প্রচুর বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ওঠা দুই দেহাতী বুড়োকে ডেরাইভারের দুই কেঁদো স্যাঙাৎ ঘাড়ধাক্কা দিয়ে নির্জন ন্যাশনাল হাইওয়েতে নামিয়ে দিলো। অপরাধ ভাড়া নিয়ে সামান্য বচসা। এর পর "আমার পিতিবাদের ভাষা" সটান পেটের মধ্যে। পাঠকপাঠিকা যদি বাসের এই গপ্পে ক্লান্তি বোধ করেন তাহলে বলে রাখি মালমশলা আরও ছিল- গাজিয়াবাদের অন্ধকার মাঠে জলবিয়োগরত মালিকের সঙ্গে টাকার লেনদেন, মাঝরাস্তায় পুলিশ কর্তৃক ডেরাইভার আটক কারণ কোনোরকম বৈধ কাগজপত্তর নেই। এইসব ক্যাঁচাল শেষ করে বাস যখন একটু জোরে দৌড়েছে, ভোরের নরম আলোতে চোখ বুঁজে এসেছে, এমন সময় বাস জগদ্দল নট নড়ন চড়ন। এবার বাসের সত্যি সত্যি গঙ্গাযাত্রা হয়েছে। কাজেই গাঁয়ের লোকাল বাসে চেপে প্রথমে কাশীপুর, সেখান থেকে আর এক লোকাল বাসে হলদোয়ানি।

    হলদোয়ানি কুমায়ুন হিমালয়ে ঢোকার দরজা, সমতলের শেষ গঞ্জ শহর। কিন্তু আমাদের তিনমূর্তি বাসস্ট্যান্ডে প্রাত:কৃত্য সম্পন্ন করে হালকা দেহে ও হালকা মনেও ঠিক করতে পারেননি যে কোথায় যাবেন- বিনসর না কি নৈনিতাল, কৌশানি ইত্যাদি। বেলা বারোটা নাগাদ আলমোড়ার বাস এলে সেই বাসে ওঠাই স্থির হল কারণ আলমোড়া থেকে অন্যান্য জায়গার বাসের সংযোগ রয়েছে। এতো রকম খুচরো ঝামেলার হবার পর এই গপ্পের সব থেকে নিদারুণ সত্য আবিষ্কৃত হল- টাকাপয়সার অবস্থা বড়ই সঙ্গীন। তবে ততক্ষণে বাস গোঁ গোঁ করে চড়াইয়ে উঠতে শুরু করেছে, পাহাড়ি নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় মেজাজ তর্‌। কে আর টাকাপয়সার কথা ভাবে। তার উপর বিনসরে বসে রয়েছে স্যান্ডি আর তার দলবল। পাঠকপাঠিকা নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, পুরো গপ্পের কোথাও একবারও খাওয়াদাওয়ার কোনো প্রসঙ্গই ওঠেনি। ওঠার কথাও নয়, কারণ বিকেলের পড়ন্ত আলোতে আলমোড়া পৌঁছনো পর্যন্ত পেটে পড়েছে গুটিকয়েক কমলালেবু আর এক প্যাকেট বিস্কিট। কাজেই! আলমোড়া থেকে বিনসর যেতে হয় জিপ ভাড়া করে। নইলে বাগেশ্বরের বাসে চেপে মাঝরাস্তায় নেমে আরও দশ এগারো কিলোমিটার হন্টন। পেটে দানাপানি না থাকলে কি আর এগারো নম্বর বাস স্টার্ট দেয়? অগত্যা একপিঠের জীপ ভাড়া করে চলো বিনসর।  

    কাপড়াখান পেরোতে না পেরোতেই রাস্তা হাঁই হাঁই করে সটান উপরে উঠতে শুরু করেছে। নিশ্চুপ সন্ধ্যায় শুধু অন্ধকার পাতা বওয়া পাইনের সারি। বিনসর অভয়ারণ্যের গেট পেরোতে জঙ্গল আরও ঘন, ঠান্ডা আরও বেশি। রাস্তার দুধারে গলে যেতে যেতেও থেকে যাওয়া সাদা বরফের চাঁই পড়ে আছে। ঘনিয়ে আসা অন্ধকার আর টুকরো টুকরো বরফের মধ্যে ছোটো ছোটো বুনো লালফুলের গোছা আর নিবিড় পাইনের গন্ধ অদ্ভুতভাবে প্রাগৈতিহাসিক। গাঁ গাঁ করে উঠতে উঠতে জিপের ডেরাইভার জিগায়- থাকা হবে কোন ঠেঁয়ে? কুমায়ুন মন্ডল বিকাশ নিগম না কি বনবাংলো? তিনমূর্তি খুবই আশ্বস্ত রেলায়- অন্যান্য হোটেলটোটেলও দেখা যাবে। টোটেলও নাই, হোটেলও নাই। অভয়ারণ্যের শেষ চূড়োতে দুটি বাড়ি- একটি কে এম ভি এন, অন্যটি বনবাংলো। আর কিছু নেই- দোকানটোকান, ঘরটর, বাড়িটাড়ি- কিচ্ছু না। জিপ যখন বনবাংলোর সামনে থামলো আকাশ তখন ঘোর বেগুনি। বাংলোর সব দরজা বন্ধ। চৌকিদারের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। এই বাংলোর ভূতের গপ্পো আবার বেশ নামজাদা। কোথায় স্যান্ডি আর তার দলবল? এতক্ষণে মোটামুটি হিসেব করা গেছে- জিপের ভাড়া মিটিয়ে দেবার পর বাকি পয়সা দিয়ে দিল্লি ফেরা সম্ভব নয়। একটু পিছনে ফিরে এসে কে এম ভি এনের বাংলো। রঙ্গাই স্যান্ডিদের তালাশে গেলো। পাঁচ মিনিট বাদেই ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ফিরলেন ভগ্নদূত। একটি তথ্য ও একটি ভীষণ খারাপ খবর নিয়ে। তথ্য- স্যান্ডির দলবল এই বাংলোতেই ডেরা বেঁধেছিলো। ভীষণ খারাপ খবর- আজ দুপুরবেলা তেনারা চেক আউট করে চলে গেছেন। মনে রাখবেন, তখনও "তোমার দেখা নাই" বাজারে আসেনি। অত:পর মার্ক্স-মা কালী-রবি ঠাকুর সহায় বলে একরাতের জন্য বাংলো বুক করা হল। বুক করতে তো আর পয়সা লাগে না! বিনসরে তখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। আধো আলো ঘরে কাঠের মেঝের পুরোনো গন্ধ আর মোমবাতির কাঁপা আলোতে তিনমূর্তি সময় এবং ভাগ্যের হাতে আপাতত: সঁপিল পরান। বাংলোর পিছনের খোলা জায়গায় গিয়ে দেখা হল উত্তর দিগন্তে ভার করে থাকা লাল আর বেগুনী মেঘের দল, তার উপরে অচল রাজপ্রাসাদের একটু চূড়া তখনও উঁকি মারছে- ত্রিশূল শীর্ষ।

    এতক্ষণে হুঁশ ফিরেছে। ত্রিশূলের সেই আখাম্বা চেহারা দেখার পরে পেট ভয়ে গুড়গুড় করছে। জনপ্রাণী বলতে বাংলোর গোটা দুই তিন কর্মচারী। ঠিক এমন সময়ে লেংচে লেংচে রঙ্গাইয়ের প্রবেশ, দু গাল এঁটো করা হাসি আর থামছে না। পিছনের বাগানে এক ট্যুরিস্ট দম্পতি দেখা গেছে। কিমাশ্চর্যম, তারা বাঙালীও বটে! অন্ধকার সুড়ঙ্গের অন্যধারে কি কেউ হ্যারিকেনের পলতেতে দেশলাই ছোঁয়ালো? তিনমাথা এক করে ঠিক হল খাওয়ার আগে টুক করে গিয়ে দাদাবৌদিদের আমাদের বিপদের কথা খোলসা করে বলতে হবে। ভার পড়ল রঙ্গনের উপর। রাত আটটা নাগাদ দাবৌদির ঘরের দরজায় খুট্‌খুট্‌। মিনিট দশেক হেঁহেঁ হুঁহুঁ খেজুর ভূতের গপ্পো পাহাড়ের গপ্পো হওয়ার পর টেনশনে রঙ্গন দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারপর ছোট্টো সেই কামরায় হন্‌হনিয়ে পায়চারি। মুখের কাছে এসেও আর বেরোচ্ছে না। শেষে "বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা" ইস্টাইলে নিবেদিত হল তিন উজবুকের গপ্পো। দাদাও দুর্ভাবনায়- কারণ তিনমূর্তির ঠিক কত টাকা ধার চাই তার হিসেব এখনও মেলে নি। তারপর দু:স্থে দান করতে গিয়ে নিজের পকেটে না টান পড়ে! বাসভাড়ার পয়সা যোগাড় না হয় হল- কিন্তু তারপর বিনসর থেকে আলমোড়া যাওয়া কিভাবে? দাদাবৌদির জন্য কাল দুপুরে জীপ আসবে বটে, কিন্তু তারা কি বিনে পয়সার এই তিন উট্‌কো লোককে তুলতে রাজি হবে? এগারো নম্বর সিলেবাসের বাইরে। কিন্তু সামান্য ভরসা পেয়েই তিন হতভাগার দিলখুশ, এবং পেটে রাবণের চিতে। কিন্তু চিতে যতই জ্বলুক, পাটীগণিতের আঁক কষে কষে খাওয়া। একটি রুটি মানে পাঁচ টাকার নোট। ঠিক হল সকালের প্রাত:রাশ জলের আর চায়ের উপরেই সারা হবে। খাওয়ার পর রাত্রে বাইরে বেরোতেই কোটি কোটি তারার চাদর ঢেকে অন্ধকার পাহাড় শুয়ে আছে, উল্টোদিকের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে রাতচরা পাখির ডাক।

    পরের দিন ভোরে রক্তজমানো ঠান্ডা। কিন্তু চোখের সামনে? বান্দর্পুঞ্ছ থেকে নন্দাদেবী, ত্রিশূল হয়ে নীলকন্ঠ, কেদারনাথ পর্যন্ত সার বেঁধে একশ আশি ডিগ্রি জুড়ে এক অনৈসর্গিক থিয়েটার। খালিপেটে, টাকাপয়সা ছাড়া, ঘুমচোখে, রক্ত জমানো ঠান্ডায়, মাদক্‌হূন্য অবথায় এই ecstasy-তে পৌঁছনো হিমালয়েই সম্ভব। শুধু সাদা, শুধু বিশালতা, শুধু অনন্ত নৈ:শব্দ্য। এই বোবা করে দেওয়া বিরাটত্বের সামনে দাঁড়িয়েও দাদা কিঞ্চিৎ হাস্যরসের যোগান দিলেন বিনসর থেকে এভারেস্ট দেখিয়ে। সেদিন আকাশও "ও আকাশ, সোনা সোনা" টাইপের। হেঁটে হেঁটে জিরো পয়েন্টে গিয়ে একশ আশি ডিগ্রি প্যানোরমা আরও স্বচ্ছ, আরও মোহময়। বিনসরে দেখার বলতে এইটুকু এবং এইটুকুই যা জীবনভর দেখা যায়। কাজেই বিস্তৃত বর্ণনার পন্ডশ্রম বৃথা। এই হেসেওঠা সকালে দাদাবৌদির থেকে পয়সা নিয়ে তিনমূর্তি তাদের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। দুপুরে আলমোড়ায় ফেরৎ যাবার জীপ এলে তিনজনের ঠাঁইও মিলল। আলমোড়ায় দাদাবৌদির বাস বেরিয়ে যেতেই প্রথম কাজ খ্যাঁটনের জোগাড়- তেরি মেরি বাঙালী, পেটপূজনের কাঙালী। আর দাদাবৌদিকে- ওগো পথের সাথী, নমি বারম্বার।

    গল্পের এখানেই শেষ নয়। দিল্লি ফেরৎ যাওয়ার বাসে মুখ অনবরত চলছে। হলদোয়ানিতে নেমে তার হৃদয়বিদারক সমাপ্তি। রঙ্গন ও রঙ্গাই ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে ঢুকেছিল এক ফলের রসের দোকানে। রঙ্গাই কাঁচুমাচু মুখে শস্তার গাজর বিটের রস অর্ডার দিতেই রঙ্গনের পেল্লাই ধমক- ও সব কি শাকপাতা খাবি র‌্যা? ভাইসাব, আনার কা রস পিলা দিজিয়ে। তারপর পয়সা দিতে গিয়ে সেই রসের দাম শুনে দুজনেই বুঝল আজ রঙ্গনার হাতে মার খেয়ে হাড্ডিও পিল্‌পিলিয়ে যাবে। সব পয়সা শেষ। আই এস বি টি পৌঁছে হোস্টেলে ফেরার অটোর পয়সা নেই। দিল্লি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় আড়াইটা। ঠিক হল হোস্টেলের লোকজনকে জাগিয়ে দিয়ে পয়সা মিটিয়ে দেওয়া হবে। অটো যখন হোস্টেলের দরজায় রঙ্গনা প্রায় ম্যাজিকের মতো টাকার নোট বের করল ব্যাগ থেকে। দুই হাভাতের চোখের আড়ালে সে এই নোট বাঁচিয়ে রেখেছিল শেষ আশ্রয় হিসেবে। রঙ্গন আর রঙ্গাই রঙ্গনাকে কাঁধে চাপিয়ে পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে গাইতে গাইতে হোস্টেলে সেঁধুলো।

    ২ (Jun 2 2005)
    অন্য হিমালয়

    হিমালয় মোটের উপর দুই রকম। অন্তত: জনপ্রিয়তার নিরিখে। একধরনের হিমালয়ে নন্দাঘুন্টি-পাঞ্চৌলি-নীলকন্ঠের বেসক্যাম্পে, কুচো বরফ উড়ে আসা হিমেল হাওয়ায় উড়ে যেতে যেতে আটকে থাকা তাঁবুর সামনে কালো চশমাচোখে দামাল পর্বতারোহী, শেরপা ও কুলিদের দল। অন্য হিমালয়ে বাস ও ট্রেনের পেট উগ্‌রে বেরোনো, ভূঁড়িতে রংচঙে গোলাপ আঁকা সোয়েটার পরনে, গোলাপী-সবুজ বাঁদুরে টুপি মাথায়, ওয়াকম্যান কানে, মলের আইসক্রীম পার্লারে ভিড় করে, ঘোড়ার পিঠে চেপে ডিজিক্যামে ফোটোক তুলে ট্যুরিস্টের দল- সিমলা-কুলু-নৈনিতাল-মুসৌরীতে। এর সাথেই মিশে থাকে, সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক অন্য হিমালয়। সেখানেও ট্যুরিস্টের দল জোটে। সেখানেও কিছু উট্‌কো হোটেলের সাথে সাথে পর্যটন নিগমের ট্যুরিস্ট বাংলো গজিয়ে ওঠে। কিন্তু সেই সব জায়গায় এখনও হয় তো ছোটোখাটো জীবন নিজেদের ছন্দে কেটে যায়। ট্যুরিস্টপ্রবাহের বিপুল তরঙ্গের দোলাচলের ঝাপটা লাগলেও দিনের শেষে কোনো ঘুমপাড়ানি হাওয়া নিজের লয়ে বয়। হরেককিসিমের বিকাশ যোজনার নৈর্ব্যক্তিক উন্নয়নের আড়ালে অবিচল থাকে লোকাচার-সংস্কার-আদিম প্রাণধর্ম নিয়ে গড়ে ওঠা হিমালয়ের ছোটো ছোটো অঞ্চল ও তার জনগোষ্ঠী। নৃতত্ত্ব-সমাজতত্ত্বের গূঢ় এষণা শিকেতে তুলে, শুধু অচেনা রং মাখার আনন্দেই কখনও কখনও দাঁড়িয়ে পড়তে পারেন এই রকম অন্য হিমালয়ে। সকালের সোনা আলোতে নির্জন পাহাড়ী হাইওয়ের ধারে কোনো গুলাব সিঙের পলিথিনে ঢাকা ছোট্টো দোকানে সেরে ফেলতে পারেন নাশতা। আপনার চারদিক ঘিরে দাঁড়ানো গাছগুলো, পিচের কালো রাস্তাটা, মিলিটারিতে কাজ করা গুলাব সিঙের বড়ো ছেলে, বহু নীচে পড়ে থাকা ছোট্টো গ্রামখানা, আপনি নিজে- মিশে যাবে একান্ত অগোচরে।

    ধরুন না জৌনসর-ভাবর অঞ্চলের কথা। দেরাদুন থেকে যমুনা আর টনসের খাত ধরে যে রাস্তা হর কি দুনের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তার মাঝামাঝি এই অঞ্চল। এ হল কৌরবদের দেশ, যেখানে পান্ডবশত্রুরা দেবতার আসন নিয়েছেন। এখানে একনও চালু আছে মেয়েদের বহুপতিগ্রহণপ্রথা, হয়তো বা দ্রৌপদীর পদাঙ্কে। রাস্তায় যেতে যেতে পড়বে লাখমন্ডল। প্রবাদ, এখানেই কৌরবেরা জতুগৃহ নির্মাণ করেন। পান্ডবকৌরবদের গপ্পোগাছায় ভরপুর এ অঞ্চলের পথঘাট। এমনকি, টনস নদীর উৎপত্তি যে স্বর্গারোহিণী পর্বতশৃঙ্গ থেকে, প্রবাদানুসারে পঞ্চপান্ডবের স্বর্গদ্বারে আরোহণ সেই শ্রেণী ধরেই। সেই পথের মাঝে পড়ে ছোট্টো জনপদ চক্রাতা। মিলিটারি অনুশাসনে রীতিমতো আঁটোসাঁটো প্রশাসন। শ্রীলঙ্কায় তামিল ইলমের জঙ্গীপনার সূচনাপর্বে পিরভাকরন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর থেকে এইখানেই তালিম পেয়েছিল। সব থেকে ভালো হবে যদি বনবাংলো পেয়ে যান। নতুবা গোটা দুয়েক হোটেল সম্বল। মল নেই।বাজার বলতে এক চিলতে রাস্তার দুই পাশ ধরে ছোটোখাটো দোকান। এখানে পাহাড় এখনও ঘোর সবুজ। পিচ বাঁধানো পাকদন্ডী ধরে অনবরত মিলিটারি ট্রাকের আনাগোনা। পাহাড়ের গা দিয়ে তর্‌তরিয়ে দু আড়াই কিলোমিটার নেমে পৌঁছে যান টাইগার ফল্‌সে। কোনো পাহাড়ী রাখালকে সাথে নিন গাইড হিসেবে। আপনার শৌখিন অ্যাডভেঞ্চারের শহুরে প্রকরণ ছুঁয়ে যাবে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা চাষীবাড়ির বালিকা-যুবতীদের অবাক তাকিয়ে থাকা চোখ। ঘোর গ্রীষ্মে, তুঙ্গ সীজনেও, টাইগার ফলসে দু এক দল ট্যুরিস্টের দেখা পাওয়া সৌভাগ্য। গভীর জঙ্গলের মাথা ফুঁড়ে নামা জলপ্রপাতের পায়ের তলায় ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি ওড়ে। দুপুরেও গভীর জলজ অন্ধকারে চামড়া কেমন শির্‌শিরিয়ে ওঠে। ফেরার সময় অন্য রাস্তা ধরুন না কেন। যে রাস্তা চক্রাতার পাকা রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। ঠিক যখন সন্ধে সন্ধে ভাব, পাকদন্ডী বেয়ে উঠতে শুরু করুন। লোকসঙ্গ দুর্লভ। হঠাৎ হারিয়ে যাবেন। চারদিকে দৈত্যপাহাড়দের অর্ধেক শরীর যখন অন্ধকার হয়ে এসেছে, দেখবেন আপনার অনেক নীচে জঙ্গল, আর উপরে পাশে চারদিকে অসংখ্য কালো সবুজ পাহাড়ের মাথা। এরপর পাকা রাস্তায় উঠে এলে একলা পিচঢালা রাস্তা- সারাদিনেরাতে বাস তো দূরের কথা, এমনি কোনো গাড়িরও দেখা পাওয়া যায় না। এখান থেকে চক্রাতা প্রায় দশ কিলোমিটার। পথের দুধারের জঙ্গলে হিমালয়ের ভালুকদের ঘনবসতি। হিমালয়ের উপর ভরসা রাখুন। কোনো এক তারাভরা রাতে নিজের আস্তানার কম্বলের ওমে ঠিক পৌঁছে যাবেন।

    সিমলা তো হল বেশ কয়েকবার। কালকার থেকে কুঝিক্‌ঝিক্‌ খেলনাগাড়ি চেপে দুপাশের গাছপালার সাথে কথা বলতে বলতে। সেই রেলরাস্তার মাঝে সব থেকে লম্বা সুড়ঙ্গ যেই শেষ হয়, সেখানেই পুরানো ইংরিজি গল্পের মতো ছোট্টো ইস্টিশন বারোগ। স্থানীয় উচ্চারণে ব্রোগ। কেউ কি কার্টুনশিরোমণি নডিবাহাদুরের কীর্তিকলাপ দেখেন? নডির টয়ল্যান্ডের খেলনা ইস্টিশনের মতো এও এক খেলনা ইস্টিশন। সিমলায় যাওয়ার পথে নির্ঘাৎ এখানে ব্রেড পকোড়া কি আলুর চপ মেরেছেন। দিনে গোটা চারবার ট্রেন এলে উৎসুক ট্যুরিস্টমুখ, খাবার দোকানে হাঁকাহাঁকি, স্টেশন মাস্টার আর গার্ডের ব্যস্ততা। নইলে নি:ঝুম ইস্টিশনে ইংরেজ আমলের আলোকস্তম্ভ, খাস বিলেতে তৈরি জলের কল, লোহার বেঞ্চি, জাফরিকাটা কাঠের দেওয়ালে দুলতে থাকা বেগুনী অর্কিড চুপিচুপি যাত্রীদের জন্য প্রহর গোনে। দুখানা বেশ সাজানো গোছনো রিটায়ারিং রুমও আছে। কবি এবং পাগল ছাড়া এই ইস্টিশনে থাকতে আসবে না কেউ। তবে ব্রিটিশ সরকারের গোনাগুনতিতে কবি ও পাগলেরাও ছিল বোধ হয়। কোনো কারণ ছাড়া, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই রেললাইন ধরে হেঁটে আসুন। দুধারে সবুজ পাহাড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। দুপুর কাটান সিমলাগামী ট্যুরিস্টদের পাঁচ মিনিটের দেখনদারি দেখে। নইলে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলে কালকা-সিমলা বড়ো রাস্তা- ঘন ঘন বাস, লরি, গাড়িদের যাতায়াত। এখান থেকে নীচে বারোগ ইস্টিশনকে সত্যি সত্যি খেলনা ইস্টিশন মনে হবে। এই রাস্তার এক বাঁকে জড়ো হয়েছে ছোটো ছোটো খাবারের দোকান। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দোকানের বেঞ্চিতে বসে দিকদিগন্তে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়দের সুখদু:খরাগের পালা দেখুন। বরাৎ ভালো থাকলে উঁকি মারবে দু এক ফোঁটা রুপোলী ঝিকিমিকি। হঠাৎ পাহাড় ঢেকে কুয়াশা নামবে। পায়ের তলায় ঢেকে যাবে ধীর  সাদা ধোঁয়াতে। কুয়াশার পেট ছিঁড়ে মাঝে মাঝেই প্রচন্ড শব্দে ধেয়ে যাবে প্রাগৈতিহাসিক আর্তনাদে বাসেদের দল। মাথাকান ভালো করে ঢেকে গরম চায়ের গেলাস হাতে জড়িয়ে বসুন। কুয়াশাঢাকা বেবাক শূন্যতার মাঝে আবার স্পষ্ট করে শুনতে পাবেন হৃদ্‌পিন্ডের একটানা ধক্‌ধক্‌ শব্দ।

    কুয়াশা দেখতে পারেন কসৌলিতে। কালকার থেকে ধরমপুর হয়ে একটু পা বাড়ালেই কসৌলি। খুশবন্ত সিঙের বাংলোর মহিমায় বেশ একটু নামডাক হওয়া কসৌলি। কসৌলিতে মল আছে, ব্রিটিশ আমলের ফুট্‌ফুটে বাংলো আছে, মিলিটারি প্রতাপ আছে আর সেই প্রতাপের সুফলস্বরূপ নেই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বেজম্মা কংক্রীটের লেনদেন কারবার। আরও আছে আলুর পরোটা। কসৌলির অভিজাত এলাকা ছড়িয়ে যেখানে ঘিঞ্জি বাজার, সেই বাজারের কিছু চড়াই উৎরাই পেরোলে এক বুড়োদাদুর ছোট্টো একচিলতে দোকান, বুড়োবুড়ির বাসার লাগোয়া। কসৌলির পাহাড়জঙ্গল ঢেকে যখন ঝম্‌ঝম বৃষ্টি হবে, তখন সেই পাহাড়ী দাদুভাইয়ের দোকানে ঢুকে খাবেন আলুর পরোটা আর টক দই। দিল্লিতে তন্ন তন্ন করেও এই জিনিষ পাবেন না। আসার আগে বহু বছরের পুরোনো জরাজীর্ণ এক্সারসাইজ বুকে আপনার মন্তব্য লিখতে যেন ভুলবেন না। যাদের মনের খিদে আরও বেশি, তারা কসৌলির আপার মল ধরে চলে যান ভালোবাসা সরণিতে। এখানে ঝুপসি গাছের ছায়ায় আলো আঁধারির খেলা, ভিজে ভিজে হাওয়া, হঠাৎ জোনাকির মতো উঁকি মারে বুনো ফুলের উচ্ছসিত রং। অসমাপ্ত চিঠিখানা এখানেই লিখুন।

    আড্ডা শেষ করি উত্তরাঞ্চল দিয়ে। গাড়োয়াল হিমালয়ের অনাদৃত গঞ্জ শহর পাউরি। মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে লেপার্ড বেরিয়ে গৃহস্থের আঙিনায় ঢুকে পড়ে বলে কাগজে নাম বেরোয়। দিল্লির থেকে নাজিবাবাদ-কোটদ্বার হয়ে পাউরি গাড়োয়ালের কোলে চলে গেছে রাস্তা। পাউরির আধাশহুরে ভাব পছন্দ না হলে একটু দূরেই নিরবিচ্ছিন্ন নির্জন খিরসু, যদি না দুর্ভাগ্যক্রমে একশো ডেসিবেলে গানশোনা দিল্লিবাসী ট্যুরিস্টের খপ্পরে পড়েন। গ্রীষ্ম যখন তুঙ্গে, তখন তাপধুলোর অস্বচ্ছ পর্দায় ঢেকে থাকে বহুদূরের বরফের পাহাড়। তারপর একদিন পাহাড়ে বৃষ্টি নামে। বহুদিনের উপোসী পুরুষশরীরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে শুয়ে থাকা ক্লান্ত পৃথিবীতে। জলের তোড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ভেসে যেতে থাকে গিরিখাত, নালা, গুহার ভিতর। বৃষ্টি একটু ধরে আসার পরে আপনি গাড়ি নিয়ে নেমে আসছেন সমতলে। কোটদ্বারের পরেই উত্তরপ্রদেশের গাঙ্গেয় সমতল। নাজিবাবাদ চিরাচরিত ম্লান ধুলিধূসরিত গঞ্জশহর, মুসলমান সংখ্যাধিক্য। নাজিবাবাদ পেরিয়ে বিজনোর- উত্তরপ্রদেশের ট্র্যাডিশনাল মহকুমা সদরের আর্কিটাইপ। কিন্তু বৃষ্টির পরে চারদিক ঠান্ডা, ধুলোবালি ধুয়ে মুছে গেছে। একবার পিছন ফিরে তাকাবেন। ততক্ষণে হয় তো আপনি পৌঁছে গেছেন বিজনোর আর মীরাট জেলার সীমানায়। এখানে বিস্তীর্ণ গঙ্গা তার দু বুক মেলে শুয়ে আছে। নদীর ওপারে বিকেলের ধানক্ষেতে নির্ভার সবুজ। হয় তো সেই অমোঘ মূহুর্তে দেখবেন ধানক্ষেতের শেষে দিগন্তে আগুন জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারে সারে চৌখাম্বা কেদারনাথ নীলকন্ঠের দল। শেষ সূর্যের আগুনে নিশান উড়িয়ে সন্ধের আকাশকে কুর্নিশ জানাচ্ছে হিমালয়ের স্পর্ধিত পৌরুষ। আপনি সমতলের মানুষ- গঙ্গাতীরে, ভরন্ত ফসলের পাশে একবার নতজানু হোন। হয় তো এই মূহুর্তের জন্যই আমাদের ক্রমাগত জন্ম হতে থাকে।

    ৩ (Jun 16 2005)
    ছেঁড়াখোঁড়া সংলাপ

    "যাও বন্ধুগণ, মন্দার মালিকায় ভূষিত হয়ে স্বর্গের অক্ষয় অমরতা লাভ করো! আমরা রইলাম এই ভাঙাচোরা পৃথিবীতে....বলিষ্ঠ সমাজ....মানব সমাজ গড়তে....তোমাদের স্বপ্ন সার্থক করতে....যাও বন্ধুগণ...." - অশ্বত্থামা, মনোজ মিত্র

    ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের গোড়া অবধি একদল মানুষের বাচ্চা জন্মেছিল।

    সেই সময়ে, একদিকে এশিয়ার মুক্তিসূর্যের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ উদ্ধার হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের আঠেরো থেকে পয়ঁত্রিশের গুষ্টির তুষ্টি- কেউ মারে, কেউ মরে। দমাদ্দম লাশ পড়ছে। রাস্তায় বাজারে মোড়ে চৌমাথায় শকুনির ভিড়- পুলিশ, দালাল, খোচর, কিংবা নীরক্ত লুম্পেন। তখনও মধ্যবিত্ত বাবা মায়েদের বাচ্চারা আর জি করে, নীলরতনে, মেডিকেল কলেজে জন্ম নিত। জানলা ঢাকা কালো কাগজে। বাইরে চেনা জানা পেটোর উল্লাস। নি:শব্দ চাকুর ছোবোল। এই বাচ্চাদের জন্মানোর সময় শান্তিনগর বা পূর্বাচল নামের ছোটো ছোটো কলোনিতে মায়ের চোখের সামনে ফার্স্ট ইয়ারে পড়া ছেলেকে কুচিয়ে কুচিয়ে কাটা হচ্ছিল। কিংবা কোনো নিরীহ কনস্টেবলের হাত থেকে বাচ্চার জন্য কেনা দুধের টিন গড়িয়ে গিয়েছিল পাশের খোলা হাইড্র্যান্টে।

    "সে বড়ো সুখের সময় নয়".....

    শত ঘোষের দলবল বরানগর-কাশীপুর সাফ করে ময়লা ফেলার গাড়িতে অবলা গঙ্গায় হাজার হাজার টাটকা লাশ ফেলে এসেছিল।

    "সে বড়ো আনন্দের সময় নয়"....

    মানুষের বাচ্চারা তখন ল্যাক্টোজেন খায়। অ্যা করার জন্য তখনও পাওয়া যায় "দৈনিক বসুমতী" কি "যুগান্তর"। কিন্তু আস্তে আস্তে সুতো গুটানোর পালাও আসে। যারা মরতে মরতে বেঁচেছেন, আপাতত শান্তিকল্যাণের খোয়াইশে মাঝবয়েসের সংস্কৃতিতে থিতু হলেন। সন্তানের মুখ ধরে যদি চুমো খাওয়া যায়! যারা বাঁচতে বাঁচতে মরেই থাকেন, তারা লক্ষতম হাঁপটি ছাড়লেন। শুধু ট্রেনগুলো আর সময়ে চলবে না বলে মনে কিঞ্চিৎ খেদ রয়ে গেল। যৌবনের নিদারুণ ব্রনোদম এবং অবশ্যম্ভাবী হস্তমৈথুনের শেষে বাপদাদাদের প্রজন্ম আবার তেলেজলেঅম্বলে বেশ মাখোমাখো বাবুটি হলেন। এশিয়ার মুক্তিসূজ্জ তখন প্রায় অস্ত যাবেন যাবেন। ভারতের ভাগ্যাকাশে উদিত হচ্ছেন শত শত নষ্টচন্দ্র। নতুন আসা কালার টি ভির মতই হাতে রংবেরঙের পতাকা।

    কদ্দিন বেশ দেঁড়েমুষে চাড্ডি ভাত খাই নি মা, বেশ পাতলা মুসুর ডালে নেবু কচলে।

    ভারতের ট্রেনের প্রবল হৈহল্লার মধ্যে এক কোণে ভালো করে শতরঞ্চি পেতে বাঙালী একটু ভাতঘুম দিল। জন্ম হল মধ্যবিত্ত ভন্ডামির খাপেখোপে মিলে যাওয়া নব্যবামপন্থা।

    "Life is nothing more than the happiness that you get out of it"-Antigone, Jean Anouilh

    নব্বই আসতে না আসতে সেই মানুষের বাচ্চারা বেশ লায়েক হয়েছে। হর্মোনের খেলা যখন বেশ তুঙ্গে, যখন "বিশ্ব উদ্ধার কল্লেই হল" ভাবটা গেঁড়ে বসার তাল করছে, তখন পৃথিবীর মাটিতে কি ভীষণ ঝড়! বামপন্থী রাজপ্রাসাদগুলো দুম্‌দাম্‌ ভাঙছে। পাড়ার রকে নতুন শব্দ শোনা যাচ্ছে- "গ্লাস্তনস্ত", "পেরেস্ত্রৈকা"। বানতলায় "হয়েই থাকে" গোছের দুর্ঘটনা। তিয়েনানমেন স্কোয়ারে কিছু একটা হচ্ছে এবং হচ্ছে না। জাত ধর্ম ব্যাপারগুলো বেশ মন দিয়ে আবার ভাবতে হচ্ছে। বেশ সাদা-কালো খেলা সমস্ত- মন্ডল কমিশন নাকি মন্ডল কমিশন নয়? রথযাত্রা নাকি রথযাত্রা নয়? ঠিক এই ধুলোর ঝড়ে চোখ ঢাকতে যাবার সময়ে গুটি গুটি পায়ে বাইরের বাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। হরমোননির্গত শক্তির অধিকাংশই খরচ হয়ে গেলো নিজেরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা বুঝতে। হাত-পা-চোখ-মুখ নিজেদের জায়গায় ঠিকঠাক করে রাখতে। সময় পালটাতে যাওয়ার আগে সময়ই বাচ্চাগুলোকে পালটে দিলো।

    অতএব এখন বাবু-বিবি সক্কাল থেকে রাত অবধি আপিস এবং সংসারের উন্নতিসাধন করেন। এ ছাড়া মাঝে মাঝেই চ্যারিটিতে পয়সা দেন- ট্যাক্সো বাঁচে। যতটা নির্বিঘ্নে শেষপর্যন্ত এই মলমূত্রমাংসসমেত দেহটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তারই ধান্দা চলছে অহোরাত্র।

    দু হাজার পাঁচ।

    তিরিশ পেরিয়ে কোমরের আশে পাশের ঘের বাড়ছে। মাইনে বাড়ছে, যদিও আরও বাড়লে আরও ভালো হত। দুশ্চিন্তায় থাকি- পরের দিনের সংসার এবং পরের দিনের আপিস। নিশ্চিন্ত আছি- মোটামুটি দূরদর্শী ফাইনান্‌শিয়াল প্ল্যানিং, ছেলেমেয়ের মোটামুটি ভালো ইশ্‌কুল, মোটামুটি ভালোভাবে থাকা। বড়োরা এই এক্স-বাচ্চাদের নাম দিয়েছেন- স্বার্থপর প্রজন্ম। না আছে প্যাশন, না আছে স্বপ্ন। পচনের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে এক অসীম উদাসিপন। ঘুষ দিতে হাত কাঁপে না, ন্যাংটো মেয়েমানুষের সিনেমা দেখতে চোখ কাঁপে না, খিস্তি করতে মুখ কাঁপে না। এ তুমি কোথায় লইয়া আইলা ঈশম?

    কনে আর যাইবা কত্তা? যেখানে ছিলা সেইখানেই আইয়া পড়স।

    পথটা ছিল বৃত্তাকার। ছুটতে ছুটতে খেয়াল হয়নি। ঘুরে ঘুরে ভাঙতে ভাঙতে দম ফুরোলেই আব্বুলিশ। তাই আমরা একটু থমকে দাঁড়াই। আজকাল থমকে দাঁড়ানোটাও মুশকিল। তাও একটু ঠাহর করি এই ভুলভুলাইয়ার মধ্যে কোন ফাঁকে এক চিলতে আলো আসে। শেষ দৌড় দৌড়াবার আগে অনেকটা দম নিই।

    শেষ দৌড় দৌড়ায় কারা? সেই পুরোনো আশি আর কুড়ির গপ্পো। আশি শতাংশ বনের মোষ তাড়িয়ে কুড়ির শতাংশের ঘরের বেড়ায় মাধবীলতা বেঁধে দেয়। তা সত্তরে যা, নব্বইতেও তাই। শুধু এই কুড়িজনের কোনো তাড়া নেই। বদল ব্যাপারটা তো বিষ্ঠাত্যাগ নয়, যে পেলেই ছুটতে হবে। নব্বই না করলে পরের নব্বই করবে। তারা প্রতীক্ষাতে প্রস্তুত। তার আগে ছোটো ছোটো চারাগাছ পুঁতে যেতে থাকে। শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে। রাশিয়া, চীন চেনার আগে প্রতিদিনের লড়াই চিনে নিতে থাকে। একটা টিউবওয়েলের জন্য লড়াই। একটা পাকা রাস্তার জন্য লড়াই। একটা ছাদ্‌হুদ্ধু ইশ্‌কুলবাড়ির জন্য লড়াই। লড়াই উঠে আসে আমাদেরই জমি থেকে, আমাদের জলহাওয়ায় বড়ো হতে থাকে। তথাকথিত দেশব্যাপী বড়ো কিছু একটার অভাবে আশি শতাংশকে দেখে এই এক্স-বাচ্চাদের নাম হয় "স্বার্থপর প্রজন্ম"। সঞ্জয় ঘোষদের তাতে কিছু এসে যায় না। এই আমাদের ইতিহাসের নতুন পাঠ।

    প্রতিবাদের স্পেসের অনেকটা হাতবদল হয়। রাজনীতির প্রতিষ্ঠান ও দালালেরা কাঠি দেওয়ার মওকা খোঁজে। কিছু এসে যায় না।

    "ভূত চলে যায় ভবিষ্যতে প্রেত চলে যায় ডিমে
    ডিম ফেটে যেই বেরোই আমি, আগ লাগে পিদ্দিমে।"- ভুতুমভগবান, জয় গোস্বামী

    আমরা স্বাধীনতা দেখি নি। আমরা পরাধ্‌হীনতা জানি না।
    আমরা শূন্য সময়ে শূন্যের মোকাবিলা করি।
    আমরা অসৎ সময়ের জাতক।
    আমরা আগুনে না জ্বলে গভীর জলজ গুল্মে তা দিয়ে চলি।
    আমরা বৈপরীত্যের সন্তান।
    আমরা এক হাতে নীট রাম নিয়ে অন্য হাতে সন্তানের মুখে দুধ তুলে দিই।
    আমারা অন্যের ঘর গড়ে নির্বিকার কৌতুকে নিজের ঘর ভাঙি।
    আমাদের এক আঁখিতে তাম্বুলরাঙা বয়ানে মানদসুন্দরী, তো অন্য চোখে ছম্মকছল্লু বিপ্‌স।
    আমারা বালিশের তলায় কথামৃত লুকিয়ে প্রকাশ্যে পর্নো পড়ি।
    আমাদের হাতপায়ের শিকলের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারে চূড়ান্ত রক্তকরবী।
    আমরা অমাবস্যার হাত-পা-মুখ বেঁধে পূর্ণিমার চাঁদকে ধর্ষণ করি।

    স্বপ্ন নয়, ভালোবাসা নয়, বোধও নয়, কি যে কাজ করে, মাথার ভিতরে!

    চল্লিশ থেকে সত্তরের প্যাখনা তো অনেক হল। নব্বইয়ের ম্যানিফেস্টো কি কেউ লিখবেন? ভুলভুলাইয়াতে বুড়ো হতে থাকা স্বার্থপর প্রজন্মের ইশ্‌তেহার?

    ৪ (Jul 1 2005)
    পুনশ্চ রক্তকরবী

    "ফাগুলাল। আর, ঐ দেখো, ধুলায় লুটেছে তার রক্তকরবীর কঙ্কন। ডান হাত থেকে কখন খসে পড়েছে। তার হাতখানি আজ সে রিক্ত করে দিয়ে চলে গেল।
    বিশু। তাকে বলেছিলুম, তার হাত থেকে কিছু নেব না। এই নিতে হল, তার শেষ দান।"

    একটা স্পষ্ট আভাস ছিল- নন্দিনী "শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড" বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে শেষের দিকে, শেষ লড়াই লড়তে। অবশেষে ফাগুলাল আর তার দলবলের পূর্ণ এবং সক্রিয় সমর্থন নন্দিনীর পিছনে। বিশুর গলায় "তাদেরই দলের পিছনে আমিও আছি"। কিন্তু অবাক কান্ড ছিল এই যে রাজামশাইও কাছকোঁচা খুলে নিজের মূর্তি ভাঙার দড়িতে টান মারতে দৌড়োলেন। নন্দিনী কি অমোঘ মস্তিষ্কপ্রক্ষালন যন্ত্র! অন্যদিকে বিপক্ষনেতা সর্দারের বর্শার আগাতে ঝুলছে নন্দিনীরই দেওয়া সাদা কুন্দফুলের মালা। এই অদ্ভুত লড়াইটা কী রকম হয়েছিল?

    ***

    নন্দিনীদের জিত ছিল স্বাভাবিক। একে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকদের লোকবল। তার উপর রাজতন্ত্রের যে মোটিফ দেখিয়ে ভয় পাওয়ানো যেত, রাজা, তার জাল, তার রহস্য- সব আজ ভেঙে চুরমার, ফেটে ফর্দাফাঁই। শাসনের ভয় দেখানো অযৌক্তিক চিহ্নগুলো হঠে গেলে কি আর শাসন বেঁচে থাকে? কিন্তু ঐ কুন্দকুসুমমাল্য কি সম্ভাবনা বহন করেছিল? হয় তো সেই মালা ছিল সন্ধির শ্বেতপত্র। অর্থাৎ, আইস, আমরা রফায় বসি। মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার খাতিরে এইটুকু রফা না হয় করাই গেল। শেষাবধি সবই তো বৃহত্তর স্বার্থের জন্য বলিপ্রদত্ত। কাজেই শাসনক্ষমতা হস্তান্তরিত হল। মুক্তিসূর্যের মশাল হাতে এগিয়ে চলা নন্দিনীদেবী স্বাভাবিকভাবেই নব্য শাসনতন্ত্রের শীর্ষবিন্দুতে। তবে "উন্নততর যক্ষপুরী' নয়, পুরোনো ধাঁচার খোলনলচে পালটে জনগণের রাষ্ট্র, জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। শ্রমিকেরা নাম বদলে জনগণ হল। নন্দিনীর পরিচয় "মাটির কন্যা' হিসেবে। যক্ষপুরীর অন্ধকার মরচে ধরা সুড়ঙ্গের মাঝেও স্বপ্নকল্পনাতে শুনতে পেত "পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে'। অতএব, কৃষকদের কৌমভিত্তিক সমর্থন আরও জোরদার করার তাগিদে শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের স্লোগান বহাল হল। আরও ছিলেন অধ্যাপক, যিনি সময়ে অসময়ে দু:সময়ে নন্দিনীকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে এসেছেন, কোনও কাজের কাজ না করা সত্ত্বেও। এই বিবিধ শ্রেণীর সমর্থনে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রের সংবিধানে "জনগণ" নামে এক নতুন পাঁচমিশেলি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তি ছিল অনিবার্য। প্রাক্তন রাজার জায়গা কোথায় হবে, এ নিয়ে নন্দিনীর সঙ্গে ফাগুলালের মনোমালিন্য হয়। ফাগুলালেরা চেয়েছিল রাজার বিচার হোক জনতার দরবারে। কিন্তু ফাগুলাল ভুলে গিয়েছিল যে নন্দিনী রাজার মধ্যে "ঝড়ের আগেকার মেঘ" দেখতে পেত। সেই মেঘ যখন জল ঝরিয়ে সাদা পেঁজা তুলো, তখন তাঁকে বরিষ্ঠ উপদেষ্টার পদে বসাতে অসুবিধা কোথায়? ফাগুলাল হোলটাইমার, অর্থাৎ জনগণের সেবায় দিনরাত, বিশেষ করে রাতে, নিয়োযিত। প্রথমদিকে সর্দারদের হতোদ্যম চেহারা ছিল। ওনাদের বন্দী করা হয়নি কারণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকামী রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বন্দীর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। অন্য কোন ফোঁপরদালালির অবকাশ না থাকায় সর্দারদের ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছিল। কিছুদিন যেতে না যেতে বোঝা গেল, জনগণের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ শৃঙ্খলাও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা থাকার সুবাদে সর্দারেরা পুনর্বহাল হলেন। তবে অবশ্য স্মর্তব্য, পুনর্বহালের আগে তাদের জনসংযোগের তালিম দেওয়া হয়েছিল, অর্থাৎ অবরে সবরে পাড়ার ফুটবল ম্যাচ, দুর্গাপুজো কালীপুজোয় জোগাড়যন্তর, মাঝে মাঝে গণবিবাহ, গণভাইফোঁটা, কাঙালিদের কম্বলদান ইত্যাদি ইত্যাদি। কিশোরকে নিশ্চয় মনে আছে। যে কিশোর প্রতিদিন নন্দিনীকে ফুল দিয়ে যেত। কিশোরদের ক্লোনিং করা হয়েছে। এখন পাড়ায় পাড়ায় কিশোরেরা নন্দিনীদের রক্তকরবী দিচ্ছে। নিতে না চাইলেও "পবিত্র প্রতীক, লিবি না মানে!' বলে জোর করে দিচ্ছে। এ ছাড়াও তাদের অনেক কাজ। মহান জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের অতিপুণ্যস্মৃতি জনগণের মনে চারিয়ে দেবার জন্য কিশোরবাহিনী ঘরে ঘরে ডেরা বেঁধেছে। আর রঞ্জন? যে রঞ্জনের জোর "শঙ্খিনীনদীর মতো", যে রঞ্জন "হাসতেও পারে', "ভাঙতেও পারে'? তারে কি ভুলিতে পারি? তার চিতাভস্মের সামনে দাঁড়িয়েই তো নতুন রাষ্ট্রগঠনের শপথগ্রহণ হল। পাড়ায় পাড়ায় তার জন্য শহীদবেদী, তার ছবি সরকারী ভবনের ঘরে ঘরে। এমন কি কারাগারও তারই নামে। নন্দিনী কেমন আছে জানা বেশ শক্ত। সমস্ত কাজ "এখনই' করতে করতে আজকাল আর নিজের সামনে বসার সময় হয়ে ওঠে না। তার উপর প্রায়শ: ফাগুলালের আর বরিষ্ঠ উপদেষ্টার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দিতে হয়। সামান্য সমস্যা বিশু পাগল। এমনিতে লোকটা এখন চুপচাপ থাকে। শুধু কিশোর যখন বড়ো দাঁও মেরে চুল্লুর নেশায় বুঁদ হয়ে অঝোরে কাঁদে আর হাতের কব্জি ব্লেডের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে, তখন বিশু পাগল তাকে কি সব উৎকট গান শোনায়। গানগুলোর কথা সুর শুনলে মনে হয় কিছু পাগলা নেকড়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে। ফাগুর বউ চন্দ্রা বিশুর দেখাশুনা না করলে পাগলার বেঁচে থাকাই মুশকিল হত। কিন্তু পুরোনো কমরেডকে ভুলে থাকা কি সম্ভব? সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশুকে খুব শীঘ্র কোনো আকাদেমির চেয়ারম্যান বানিয়ে দেওয়া হবে। মোটের উপর, স্বাভাবিক সব লোকজনেরা বেশ স্বাভাবিকভাবেই ভালো আছেন।

    অথবা,

    লড়াইটা হয়েছিল। বেদম লড়াই। যদিও শেষে সর্দারেরাই জেতে, কিন্তু এ কথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল পাতি চাবুক আর শেকলের জোরে শাসনশৃঙ্খলার দিন শেষ। প্রথম মরেছিল গোকুল। বড়ো সর্দারকে দেখে "হালা ইবলিশের পো" বলে ছুটে যেতেই কুন্দফুল জড়ানো মালা বুড়ো গোকুলের দেহ এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দেয়। দু পক্ষেই মরেছিল বেশ কিছু। শেষে সর্দারেরা বাধ্য হয় শ্রমিককল্যাণে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে। এখন অন্ধকার সুড়ঙ্গের জায়গায় ঝক্‌ঝকে রাস্তাঘাট, মোড়ে মোড়ে স্ট্রিটলাইট। খনিশ্রমিকদের জন্য জীবনবীমা প্রকল্প চালু হওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। রাজা মূহূর্তের ভুলে বিপক্ষে যোগ দিলেও সিংহাসনে আবার পুন:প্রতিষ্ঠিত। রাজবংশের রক্ত বলে কথা! তবে রাজা এখন বৃদ্ধ, জরাগ্রস্ত। জানলার পিছনে রক্তকরবীর মালা গেঁথে গেঁথেই বেশির ভাগ সময় কাটে। ফাগুলালেরা ইউনিয়ন করার অধিকার পেয়েছে। তবে খনি বন্ধ হবে বলে গুজব হাওয়ায় ছড়াচ্ছে। ফাগুলালেরা শংকিত। আগেই আঁচ করে চন্দ্রা একটা বিউটি পার্লার খুলেছে। সেখানে সর্দারনীদের ভিড় লেগেই থাকে। কিশোর আগুনের আঁচ নিভতে না নিভতেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। যক্ষপুরীর মেধা তহবিল থেকে তাকে মোটা টাকার জলপানি পাঠানো হয়। যদিও তার বেশির ভাগটাই ফেরত আসে ফাগুলালদের শ্রমিক ত্রাণ তহবিলে। বিশুর এখন খুব বোলবোলাও। বছরের পর বছর তার গানের গোল্ডেন ডিস্ক বেরোচ্ছে। শুধু ফাংশনে গাইতে ওঠার আগে সেই পুরোনো পাগলের ধড়াচুড়ো পরে নেয়। আগে এই ধড়াচুড়োতে একটা সংখ্যা লাগানো থাকত। সর্দারদের আপত্তি থাকাতে সেই সংখ্যা খুলেই ধড়াচুড়ো পরতে হয়। অধ্যাপক বরাত পেয়েছেন "যক্ষপুরীর ইতিহাস" লেখার। মেজ সর্দারের সভাপতিত্বে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি বইটির নিরপেক্ষতা বিচার করবে। ফাগুলালদের প্রতিবাদের পর সেই কমিটিতে একজন শ্রমিক প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। মেটেবুরুজের এক এঁদো গলিতে এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা বাচ্চাদের ইশ্‌কুল চালান। বেশ রোগা, মুখে মেচেতার দাগ, চুকের একপাশ সাদা হয়ে গেছে। সক্কলবেলা সেই ইশ্‌কুলের বারান্দাতে এক অকালবৃদ্ধ লোক বসে রোদ পোহায়। লোকটার পাগুলো অকেজো, মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, চোখেও ভালো দেখে না বোধ হয়। রাতের মরা চাঁদ যখন মেটেবুরুজের ভাঙা বস্তির মাদুরে এসে বসে, তখন সেই প্রৌড়া মূক লোকটির মাথার চুলে বিলি কেটে দেয়। রেশন কার্ডে এই দম্পতির নাম নন্দিনী-রঞ্জন। কখনও কখনও বিলি কাটতে কাটতে গান গাইতে থাকেন-

    "আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন তাহার গেল খুলে,
    তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন্‌ অচেনার ধারে।"

    ***

    আখ্যাননির্মাণ তো রাজা-মন্ত্রী-গজ-বোড়েদের পারমিউটেশন কম্বিনেশনের গাণিতিক রোজনামচা। শেষে জনগণ যাহা চায় তাহাই পড়িয়া থাকে।

    ৫ (Jul 18 2005)
    গানের শরীর, শরীরের গান

    স্টেজের উপর রাজার রাজা জিম মরিসন। ভূতগ্রস্তের মতো পাগলা নাচ নেচে চলেছেন। মাইক্রোফোন শরীরের সাথে মিশে কখনও তীব্র যৌনাঙ্গতুল্য, কখনও আদিম রাজার ক্ষিপ্ত তলোয়ার। ছিপছিপে বেতসশরীরের প্রতি কোষ থেকে হঠাৎ হঠাৎ জান্তব আর্তনাদ। মৃত্যু ও অচেতনার কোনো গূঢ়মন্ত্র শ্রোতা ও দর্শকশরীর চারিয়ে যায়। কোনো বোধ কাজ করে। প্রবৃত্তি মথিত হয়। ঘোর কালো আকাশের নীচে সহস্র শরীর কথা বলে- "Come'n baby, light my fire"। জিম মরিসন সেই শারীরিক সঙ্গীতযজ্ঞের মহাপুরোহিত- কবিতা আর সুরের ভারে আচ্ছন্ন দেহে। অথবা জ্যানিস জপলিনের চুলের কালো চিতায় জ্বলে ওঠা উদ্দাম ছবি। জিমি হেনড্রিক্স স্টেজের উপর গীটার ভাঙেন। গীটার জ্বলে, আগুন জ্বলে, সময় জ্বলে। শিরায় শিরায় উন্মাদ রক্ত বয়ে যাওয়া শরীরে গান তৈরী হয়। গানের শরীর তৈরী হয়।

    "আমি সূর্যের আগুন খেয়ে ফেলেছি,
    আমি চাঁদের অন্ধকার খেয়ে ফেলেছি,
    আমি দুই বিশাল ব্যারেজ খেয়ে ফেলেছি
    আমি দেড়শো কবিতা খেয়ে ফেলেছি আমি ধুলোর মধ্যে বসে আছি
    আমি স্রোতের কাছে গিয়েছিলাম,
    স্রোত আমাকে ম্‌ত্যুর কথা বলল
    বৃক্ষ আমাকে মৃত্যুর কথা বলল
    চাঁদ, মেঘের পাহাড়, নীলিমা এবং নদী, প্রজাপতি
    আমাকে মৃত্যুর কথা বলল
    আ:"

    অথবা ধ্রুপদে কিবা লোকায়তে.......

    গম্ভীর সিম্ফনি নিক্তিতে মাপা। ছকেফেলা ধ্রুপদী অনড়তা। সেই অনড়তার মধ্যেই একদল ব্যালেরিনা আঙুলের পিয়ানোতে চকিত নাচের পরেই সারি সারি বেহালার তারে একঝাঁক পাখি উড়ে গেল। পরবর্তী নৈ:শব্দ্যের ক্যানভাসে একাকী নীল নদের মতো বয়ে যায় গম্ভীর চেলোতে ধীর কোনো বাহু। নির্বাক শরীর নিশ্চুপ বিভঙ্গে আঁকা হয় শব্দের ছবি, গড়ে ওঠে শরীরের সমান্তরাল সিম্ফনি।

    পিটার ব্রুক টস্কানিনির শেষ কনসার্ট শুনতে গেছেন। ভেবেছিলেন দেখবেন চূড়ান্ত নাটকীয় দৈহিক উচ্চারণ, দ্রুতলয় শারীরিক ব্যাকরণ। অথচ সেই শীর্ণ প্রাজ্ঞদেহ প্রায় চিরস্থির। হাতের প্রায় অধরা সামান্য নড়াচড়া। "And he listened. He listened through the whole of his vibrant stillness and drew from the instruments an incredibly detailed, completely transparent texture of sound in which each thread was clear and present, each player being transformed way beyond his best." পিটার ব্রুক বিস্ময়াভিভূত। সারা দেহ কিভাবে শোনে? নাটকে এই নিশ্চল শ্রবণের ধারাপ্রয়োগে ব্যর্থ হলেন। এই নিশ্চলতা দীর্ঘ জীবনের গতিজাড্য থেকে আহরিত একান্ত রসদ। "For a body to be able to listen motionless, it must first be developed is movement. It is no coincidence that conductors live so long, as they spend their life constantly exercising and bringing in harmony body, emotion and thought."

    দিল্লিতে নেহরু পার্কে, মে মাসে। নগরপালিকার সৌজন্যে প্রতি রবিবারে প্রভাতী রাগের জলসা। খোলা পার্কে ঢাকা মঞ্চ। সামনে বিস্তীর্ণ সাদা গদিতে দর্শক ও শ্রোতা। অশক্ত শরীরে পুত্রের হাতে ভর দিয়ে কোনোক্রমে ভীমসেন যোশী মঞ্চে উঠলেন। ললিত দিয়ে আসরের শুরু। অবসন্ন শরীরের ছাপ পড়েছে দাপুটে কন্ঠে। বাবু হয়ে বসতে পারেন না। স্টেজের সামনে পা ঝুলিয়ে বসে গাইতে হচ্ছে। মে মাসের ভোরে বেশ গুমোট গরম। ললিতের পর আশাবরী টোড়ি। আকাশের দূর কোণে  এক চিলতে মেঘ জমেছে। দ্রুতের বন্দিশ "ম্যায় তো তুমারো দাস"। বৃদ্ধের আর্তি ফিরে ফিরে ভরে দিচ্ছে নেহরু পার্কের সবুজ কোণা। সুরের রঙ্গোলিতে আঁকা হচ্ছে আকুতিধ্বনি "ম্যায় তো তুমারো দাস"। বুড়ো শরীরটার কোষ্ঠেপ্রকোষ্ঠে জন্মাতে থাকা স্বরের বিদ্যুৎ সবার রোমকূপ স্পর্শ করছে। "ম্যায় তো তুমারো দাস"। একটা সপাট তানের পরেই চোখ বিস্ফারিত, মুখ বিকৃত, হাত আকাশের দিকে উড়ে গেছে বসেরা খোঁজা নির্জন কবুতর। আকাশ ঘোর কালো। "ম্যায় তো তুমারো দাস।" আমি তো তোমারি দাসানুদাস হে প্রভু। মরশুমের প্রথম বৃষ্টি নামল দুরন্ত নাবালকের মতো। শেষের পাতে যখন চিরাচরিত "যো ভজে হরি কো সদা" শুরু হচ্ছে, দর্শক তখন তুরীয়ানন্দে প্রায় নৃত্যাকুল। এইভাবেও ঈশ্বরের শরীর সৃষ্টি হয়।

    নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সুফীগানের আসরেও এই চূড়ান্ত সময় উপস্থিত হয়, যখন দরবেশের শরীর সুরের উলট্‌পালট্‌ ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খেতে থাকে। বেপরোয়া শরীরভোলা শরীরের নাচে দরদালান, মিনারগম্বুজ মহাপ্রলয়ের স্রোতে কেঁপে কেঁপে ওঠে। আবিদা পরভীন যখন প্রায় ঈশ্বরী, গলার সাথে সাথে সঙ্গত করে তার হাত, চোখ, ভুরুর ভঙ্গিমা। নিপাট শান্ত সবুজ ধানক্ষেতের আলে, খেজুরগাছের তলাতেও বাউলশরীর ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে গান গায়। পায়ের আলতো ঘুঙুরের তালে তালে আর্শিনগরের নক্‌শিকাঁথা বোনা হতে থাকে। অথবা যেদিন অবাধ কীর্তনে পাগলা নাচ নাচতেন মহাপ্রভু, স্বেদস্রোতে ভিজে যেত আপাদলিঙ্গপা। নবদ্বীপের রাস্তা একদল বেনিয়মী খ্যাপার পদভারে থরথর কাঁপত, অন্ত:পুরবাসিনীদের পা কেঁপে উঠত ধুলোমাটিমাখা কীর্তনিয়া সুরে। পাশাপাশি ভেঙে গেল স্থবির ব্রাহ্মণ্য সংস্কার এবং সুলতানী অপশাসনের দ্বৈত দরোজা। জিম মরিসন নিজের জন্য, শ্রীচৈতন্যদের জন্য বলেন-

    "A hero is someone who rebels, or seems to rebel, against the facts of existence and seems to conquer them, but obviously that can work at moments. It can't be  a lasting thing....but that's not arguing that paeople shouldn't keep trying to rebel against the facts of existence.....who knows, someday we might conquer death....and disease and war...."

    এবং অন্দরমহলে

    সুচিত্রা মিত্রের গান যতটা শোনার, ততটাই দেখার। ঘাড়ের দৃপ্ত ওঠানামা, হাতের বলিষ্ঠ চলনের মায়ায় সেই গান চোখ দিয়েও শুনতে হত। অথবা দূরদর্শনের পর্দায় বুড়ো জর্জ বিশ্বাস। বন্ধুবর পরীক্ষা করলেন। টি ভির শব্দ বন্ধ করে শুধু দেখে গানের সুর ছন্দ অনুভব করতে হবে। এবং অনুভূত হল। গানের ভাব ফুটে উঠেছিল বুড়ো মুখের ক্লান্ত পেশীগুলির প্রত্যেক কুঞ্চনে সংকোচনে। কিংবা একমাথা সাদা চুলে ছোট্টোখাট্টো প্রতুল মুখোপাধ্যায় যার পুরো শরীরটাই কখনও কখনও গান হয়ে ওঠে। কিংবা দু পা সোজা করে দাঁড়ানো ক্রুদ্ধ চোয়ালে কবীর সুমনের নসরীন জাহান বা গ্রাহাম স্টেইন্‌স। সুর ভাষা ছন্দের বাইরে গানের শারীরিকতায় শ্রোতা ও দর্শক আলোড়িত হন, গায়ক গায়িকার শরীরের ভাষাতেও আমরা উন্মোচিত হই। কখনও কি ইচ্ছে করে না "আঁধার রাতে একলা পাগল" গাইতে গাইতে দুমড়ে মুচড়ে নুয়ে পড়ি, ছোটোবেলায় হারানো বটবৃক্ষের জন্য গোঙাতে থাকি "বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে", চোখের অন্য পাতায় ভাসে বিহারের অনাম্নী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা একলা অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়!

    অত:পর দুইশ চৌতিরিশে ঘেমো শরীরে শিয়ালদহ থেকে

    বাঙালির বৃহত্তম কনসার্টে কাঠপুতুলের চাবিটেপা গান। মহাপঞ্চকদের কড়া নির্দেশ- "চলো নিয়মমতে"। অতএব "গোধুলিগগনে মেঘে" এবং "হারে রে রে"- উভয়ক্ষেত্রেই শরীর একই ব্যাকরণের ভাষায় কথা বলে, অন্তত: দর্শকচোখে। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক মধ্যবিত্ত মহলে মন নামক একটি বায়বীয় পদার্থের একচেটিয়া রাজত্ব। পাঁচফোড়ন দেওয়া ভাত-ডাল-মাছের ঝোলের মতই আমাদের সুরবিহার অতীব ভদ্র এবং স্তিমিত সাবেকী গন্ডীর কঠোর বিন্যাসে। এই অভ্যস্ত ছকের থেকে বেরিয়ে দুনিয়ার সাথে তাল মিলাতে আমরা বানাই মিউজিক ভিডিও। যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় আমাদের শরীরশূন্যতা কি অসহনীয় প্রবৃত্তিতে রূপান্তরিত। কাঠপুতুলদের আরও বেশি বেশি করে পুতুল সাজানোর নক্‌হা চলে সাজানো নলবনে। সঙ্গীত পরিবেশনের দৃশ্যময়তার প্রতি আমরা উদাসীন। তাই চিরাচরিত নীল বনাতের সামনে স্থির বসে বা দাঁড়িয়ে, এক টুকরো মালা আর দু টুকরো ধূপের সমাহারে আমরা গান গাইতে থাকি। মধ্যবিত্ত শ্রোতারাও এই শারীরিক নৈ:শব্দ্য আত্মস্থ করেছেন। বিশেষত: উচ্চবর্গের জলসা হলে তো কোনো কথাই নেই। চারিদিক নি:শব্দ, বেহালা কাঁদিয়া যায় পাতে। পন্ডিত রবিশঙ্কর কলকাতায় বাজানোর পর বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন- শ্রোতারা হাততালি না দিলে বুঝব কি করে ভালো লাগছে কি লাগছে না?  তবে এই অকালেও সেই নীল বনাতের সামনে কোনো স্থির অনামা দেহ থেকে যখন হঠাৎ সিন্ধুবারোঁয়ায় লাগে তান, মুহুর্তে বেজে ওঠে অনাদিকালের বিরহবেদনা,  প্রণত হই। প্রণত হই শিল্পীর সামনে, প্রণত হই সুরের সামনে। তবুও ভাবি, কুসুমের কি শরীরও নাই?

    (লেখাটির পদ্যাংশ স্বর্গত ফাল্গুনী রায়ের লেখা, পিটার ব্রুকের উদ্ধৃতি তাঁর আত্মজীবনী "Threads of Time" থেকে।)

    ৬ (Aug 16 2005)
    কাসারগোড-বেকাল-নীলেশ্বরম

    দুর্গের কঠিন প্রাকারের চারধারে বৃষ্টিভেজা সবুজ। পিছনে আবছায়া সমুদ্রে নেমে আসছে মেঘবৃষ্টি। সেই ভিজে যাওয়া কালো দুর্গের মাথায় বসে একটি যুবক- "তেরে বিনা ম্যায় ক্যায়সে জিউঁ"। মনে পড়ে? মণিরত্নমের "বোম্বে" সিনেমার সেই জনপ্রিয় গান আর তার চিত্ররূপায়ণ? এই গানের শুটিং হয়েছিল বেকাল দুর্গে। আরব সাগরের থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তিনশ বছরের পুরোনো দুর্গ- বিজয়নগর রাজবংশ, তারপর টিপু সুলতান আর শেষে ইংরেজের হাত ঘুরে এবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে। অবস্থান কেরলের উত্তর সীমান্তে কাসারগোদ জেলায়। পর্যটনের মানচিত্রে কেরালা মানে আলেপ্পেই-কোচিন-কুমারকোম ছুঁয়ে আরও দক্ষিণে নারকেল গাছে ছাওয়া ব্যাকওয়াটার্সের শিরায় শিরায় অলস কেত্তুভাল্লাম। বিদেশী পর্যটকের হিসেবে সারা দেশে কেরল দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও উত্তরতম কেরল পর্যটকদাক্ষিণ্যের হিসেবে অকিঞ্চিৎ। কর্ণাটকের দডইণ-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে টুক্‌ করে নেমে পড়লেই কাসারগোড জেলার শুরু। সতেরো নম্বর জাতীয় সড়ক ম্যাঙ্গালোরে থেকে আরব সাগরের কোল ঘেঁষে ভারতের দক্ষিণতম বিন্দুর দিকে চলেছে। এই জাতীয় সড়কের উপরেই ছোটো সদর শহর কাসারগোড।

    ব্যাঙ্গালোরে থেকে কর্ণাটক সরকারী পরিবহণের বাসে এক রাত্রির রাস্তা। দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর কুর্গ অঞ্চল ছুঁয়ে পৌঁছয় কাসারগোডে। একত্রিশে ডিসেম্বরের রাত্রি। ব্যাঙ্গালোরে ডিসেম্বরের রাত্রিও নাতিশীতোষ্ণ। পরিচ্ছন্ন আন্ত:রাজ্য বাস টার্মিনাস- উত্তর বা পূর্ব ভারতের অসহনীয় নৈরাজ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। বছরের শেষদিনে রাস্তাঘাট ফাঁকা। শুধু রেস্টুরেন্ট, বার আর ধাবাগুলোতে অবিরত টুনিমালার দপ্‌দপানি। রাত বারোটার সময় পথের ধারের এক গ্রামের গির্জা হঠাৎ আতসবাজির রোশনাইতে জ্বল্‌জ্বল্‌ করে উঠল। কর্ণাটক পরিবহণের পক্ষ থেকে সবাইকে দেওয়া হল একটি গোলাপ। মহীশূরে স্বল্প যাত্রাবিরতির পরে বাস ধীরে ধীরে কুর্গের পথে। রাতের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে কুর্গের বুক চিরে বয়ে চলা কাবেরী, বিস্তৃত কফির বাগান, উঁচু নিচু পাহাড়ের ঢাল। বাস যখন ভোররাতে কুর্গের সদর শহর মাদিকেরিতে পৌঁছেছে, তখন বাতাসে রীতিমতো হাড়কাঁপানো ঠান্ডার কামড়। সূর্য ওঠার পর পশ্চিমঘাটের উপর দিয়ে চলা লাল মাটির রাস্তা। অসংখ্য নারকেলগাছ। হাওয়ার শীত-শীত ভাব কমে গিয়ে সমুদ্রের নোনা গন্ধ ভেসে আসছে। যাত্রীরা টুক্‌টাক্‌ করে প্রায় সবাই নেমে পড়েছে। কাসারগোড বাস`আড্ডায় বাস যখন পৌঁছল তখন বাস প্রায় পুরো ফাঁকা।

    ছোটো গঞ্জশহর কাসারগোড, কেরলীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘনবসতি। সড়কের দুধারের আলিশান ঘরবাড়িতে মধ্যপ্রাচ্যের পয়সার ছাপ স্পষ্ট। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে "দুবাই শপ" কি "শারজা স্টোর্স"। বাসঅড্ডায় বেশ কলকাতা-কলকাতা ভাব। দেওয়ালে দেওয়ালে সিটু, সি পি এম, আর এস পির রক্তিম বিজ্ঞাপন। কর্মচারীদের বেশ পোড়খাওয়া সরকারী সংগ্রামী চেহারা। এই ভোরে বাস`আড্ডায় কর্মচারীরা আর কিছু বেওয়ারিশ কুকুর। দোকানপাটের ঝাঁপ খুলতে বেশ দেরী আছে। থাকার জন্য যেতে হবে নীলেশ্বরম- কাসার্গোড থেকে আরও প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা। ভাষার অসুবিধা বড়ৈ তীব্র। তবে আকারেইঙ্গিতে নীলেশ্বরম যাওয়ার অভিপ্রায় বোঝালে একটু আধটু হিন্দি ও ইংরিজিভাষে এক গাড়িচালকের খোঁজ মিলল। বেকাল দুর্গ কাসারগোড আর নীলেশ্বরমের মাঝামাঝি জায়গায়। নীলেশ্বরম একটি নদীর নামও বটে। সেই গাছে ছাওয়া নদীর কোল ঘেঁষে টালিতে ছাওয়া লাল পাথরের দেওয়ালে ঘেরা ছোটো ছোটো কটেজ- নালন্দা রিসর্ট। কেরলের রিসর্টকুলের ঊর্ধ্বগামী মূল্যতালিকার সর্বনিম্ন শ্রেণীতে, অথচ স্বাভাবিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কমতি নেই। রিসর্টের অন্যপাশে সতেরো নম্বর জাতীয় সড়কে দিনরাত গোঁগোঁ লরিবাস। তবে নিজের ছাউনিতে ঢুকে গেলে সেই সব শব্দ আর শোনা যায় না। খাওয়ার ব্যবস্থা নদীর ঠিক ধারেই লাল টালি ছাওয়া খোলামেলা এক বিশাল মন্ডপে। খাওয়াদাওয়ার মধ্যে সনাতনী কেরলীয় ভাব সুস্পষ্ট- গোল গোল সিদ্ধ চালের ভাত থেকে মশলাদার মীন মইলী পর্যন্ত। শুধু নারিকেল তৈলে ভাজা পমফ্রেট কেমন কেমন ঠেকে। শুধু মার্ক্সবাদ আর মাছবাতই নয়- সিদ্ধচালের ভাত খাওয়াতেও কেরল-বাংলা ভাই-ভাই। ভারতের বাকি অংশে আতপচালেরই বেশি চল। তবে সুধীজনে চাইলে অন্য ব্যবস্থাও মজুত।

    দুপুর গড়াতে না গড়াতে যাত্রা বেকাল দুর্গের দিকে। সমুদ্রের থেকে থাকা এই দুর্গে শৌখীন স্থাপত্যের ঝিকিমিকি নেই। এক করুণ কাঠিন্যে ঢাকা কালো পাথরের বিরাট দেওয়ালগুলো নিষ্পলক সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঝোড়ো বাতাস, বৃষ্টি, রোদ দুর্গের গাঁঅথনিতে সহজে মিশে গিয়েছে। এখানেই বেশ কিছু ট্যুরিস্টের গতায়াত দেখা গেল। দুর্গের প্রাচীরে উঠে চোখ মেলতেই সামনে বিশাল আরব সাগর। নীচে একফালি চাঁদের মতো বেকাল সৈকত ছড়িয়ে রয়েছে। প্রাছের থেকে চোখ পড়ে সৈকতের অনতিদূরে ভাসতে ত্‌হাকা অসংখ্য ছোটো ছোটো জেলেনৌকায়। পাঁচিলের মধ্যে একফালি সুড়ঙ্গের মতো জায়গা। সেই সুড়ঙ্গ পেরিয়ে এবড়োখেবড়ো পাথর বেয়ে নীচে নামলেই সমুদ্রসৈকত। স্থানীয়ে কলেজের ছেলেরা সমুদ্রস্নানে মত্ত। সূর্যের ডোববার সময় হয়েছে। বহু রক্তের সাডঈ এই দুর্গের এক কোণায় ঝুঁকে পড়েছে এক বিশাল অশ্বথ্‌থগাছ। সেই গাছের এলোমেলো ডালপালার পিছনে গোধূলির সূর্য অস্ত গেল।

    পরের দিনের গাড়িচালক কিছু বলবার আগেই নিয়ে হাজির এক নারকেলবাগানে।নারকেলবাগান থেকেই শুকনো মাছের তীব্র গন্ধ। ছোটো আর এক সমুদ্রসৈকত। নির্জন। সামনে অকূওল সমুদ্র। অন্যপাশে বিশাল খাঁড়ি। খাঁড়ির ওপারে ঘন সবুজের ভিড়। তিন্দিক ঘিরে আছে জল। মাঝে মাঝে মাছধরার ছোটোখাটো মোটোরবোট খাঁড়ির উজান বেয়ে চলেছে। নরম বালির উপর ভুর করে রাখা শুকনো মাছ আর জেলেদের জাল। পিছনের নারকেলবাগানে এক জেলেদম্পতি খোশমেজাজে বৈকালিক বিশ্রম্ভালাপরত।  এ ছাড়া ত্রিসীমানায় লোকজন নেই। গাড়িতে বসার পর বোঝা গেল গাড়িচালক কিছু বলার আগেই কেন এখানে হুট করে নিয়ে এসেছিল। মালয়ালম ব্যতীত অন্য কোনো ভাষাবোধ শূন্য। কাজেই কোনোরকম কথাবার্তার ঝামেলাতেই যেতে চায় না। পরিকল্পনা ছিল হোসদুর্গ সৈকতে যাবার। এতদিন ধরে ডাম্ব শারাড খেলার সমস্ত কলাকৌশলও ব্যর্থ হল। নৃত্যমুদ্রা দিয়ে, ছবি এঁকে, চালক্ককে সমুদ্রসৈকত বুঝাতে ব্যর্থ। অতএব তিনি আমাদের নিয়ে ফেললেন হোসদুর্গে স্বামী নিত্যানন্দ প্রতিষ্ঠিত নিত্যানন্দাশ্রমে। এই আশ্রমে নাকি পঁয়তাল্লিশটা গুউহা আছে। খুঁজে পেতে কুড়িটার বেশি বেরোলো না। স্থাপত্যও বেশ কঠোর। মোটা মোটা দেওয়ালের রং কালো হয়ে এসেছে। দাঁড়িগোঁফওয়ালা এক বাবাজী আমাদের দেখেই এক লম্ফে টক্‌ করে এক গুহায় ঢুকে ধ্যান করতে লেগে গেলেন। আশ্রমের মূওল মন্দিরে তখন বেসুরো কীর্তনগান শুরু হয়েছে। পুনরায় চালককে আমাদের উদ্দেশ্য বোঝানোর পালা এবং ব্যর্থতা। অতএব হাল ছেড়ে দিয়ে চালকের হাতেই নিজেদের সমর্পণ করা গেল। তার ফলে তিনি আমাদের নিয়ে চললেন জাতীয় সড়কের যে দিকে সমুদ্র তার ঠিক উল্টো দিকে। পৌঁছে বুঝলাম চালক আমাদের বড়ৈ অধ্যাত্মভাবাপন্ন ঠাউরেছেন। এ আর এক অন্তুন আশ্রম- আনন্দ আশ্রম। বিশাল চত্বর ঢাকা গাছগাছালিতে। আশ্রমের আঙিনায় বাবাজীরা নেই। তার বদলে বহু অবস্থাপন্ন বৃধ্বৃদ্ধার ভিড়। এখানেও কীর্তনের আসর বসেছে। তবে কীর্তনের সুর অনেক পাকা, বনিয়াদ অনেক পোক্ত। অধার্মিক অধমও সুরেরে চলনের জোরে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। কাজেই থমকে দাঁড়ানো গেল। পাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল সন্ধ্যার হাস্নুহানার সুবাতাস। আশ্রমবিলাস সাঙ্গ হলে দুদিনের বাসায় ফেরার পালা।

    মদ্যপ বলে কেরলীয়দের খ্যাতি আছে- লোকবিশেষে সু বা কু। এক কেরলীয় বন্ধুর মতে কেরলে যে কোনো আনন্দমূহুর্ত উদ্‌যাপনের ছূড়ান্ত উপায় অন্ধকার পানশালার আরও অন্ধকার কোণে বসে নিভৃত মদ্যপান। সামাজিক দু:খবিলাসের এই বর্ণন শুনে সদাভেজা বাঙালী মনে কেমন এক কমরেডীয় অনুভূতির উদ্রেক হয়। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য, কেরলে শিক্ষার হারও বেশি, আবার আত্মহত্যার হারও বেশি। কাঠখোটারা বলেন এ নাকি শিক্ষিত বেকারত্বের ফল। আমি বলি- শিক্ষার দরুণ অনুভূতির উচ্চমার্গে না পৌঁছাতে পারলে দু:খ, মৃত্যু জাতীয় বিষন্ন ব্যাপারের নাগালে এসে পৌঁছয় না। অতএব পানশালায়। সত্যিই অন্ধকার, সত্যিই কোণে কোণে একাকী আত্মাদের নিশ্চুপ অথচ মনোযোগী মদ্যপান। গোঁ গোঁ করে চলা এ সির দাপটে হু হু ঠান্ডা। ব্যাঙ্গালোরের আদেখলা শিশুদের উচ্চৈ:স্বরে তান্ডবনিনাদে মুখরিত পাবের তুলনায় এই পানশালা স্বর্গীয় এবং শস্তা। পানীয়ের অর্ডার দিতেই পানীয় এল, আর তার সাথে এল নেবুর আচার। নেবুর আচারের চাট দিয়ে মদ্‌পান ভারতের অন্যান্য অংশের লোকজনের কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হবে। আমার পাশে বসা এক মক্কেলকে দেখলাম। তর্জনী দিয়ে লেবুর আচার তুলে জিভে মাখিয়েই অন্য হাতের দুই আঙুল দিয়ে নাক চেপে সট্‌ করে এক গেলাস নামিয়ে দিলেন। তারপর পাঁচ মিনিট বিশ্রাম। অন্ধকারেও স্পষ্ট মুখে চেশায়ার বিল্লির হাসি দেখা গেল। এই নির্ঝঞ্ঝাট নেশার স্টাইল পরম শান্তিময়। অত:পর নীলেশ্বরম নদীর তীরে ঘাসের গালিচায় শুয়ে শুয়ে ভারতের দক্ষিণ আকাশের তারা গোনা।

    ফেরার দিন চালক হিন্দিতে সুপটু। নিয়ে গেলেন কাপ্পিল সমুদ্রসৈকতে। বেকাল দুর্গ থেকে মিনিট দশেকের রাস্তা। সৈকতের অর্ধেক ছাপিয়ে গেছে তীব্র বেগুনী ফুলের গুল্মে। জল থৈ থৈ এক খাল প্রায় সমুদ্রকে ছুঁয়েছে। মধ্যে শুধু এক ছোটো বালির চড়া। দিগন্তবিস্তৃত বালির গালিচা। তার উপরে হুম্‌ড়ি খেয়ে পড়েছে বিশাল প্রাগৈতিহাসিক পাথরের দল। এখানে সমুদ্র আরও গম্ভীর, গর্জন আরও কান ঝালাপালা করা। বোবা হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো সমুদ্র। অথচ পিছনে ফিরলেই খালের টল্‌টলে নীল জল বহু দূরে চলে গেছে। দুইপারে অতিঘন নারকেলের সবুজ বনে সামুদ্রিক হাওয়ার অহেতুক মাতলামি। এবং কোথাও কেউ নেই। নিরবিচ্ছিন্ন প্রকৃতির অক্লান্ত অস্তিত্ব। মানুষের উপস্থিতিতি নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। সমুদ্রের নোনা জল গায়ে মেখে এবার ফেরার পালা। আবার কাসারগোড বাস`আড্ডায়। কেরল পরিবহণের মুরুব্বিরা খুব করে বোঝালেন যে কর্ণাটক পরিবহণের বাসে আরাম বেশি হলেও কেরল পরিবহণের বাস আরও ভালো কারণ ইহা অতীব শস্তা। বাস যায়ও অন্য রাস্তা ধরে। উত্তরে ম্যাঙ্গালোর পৌঁছে আবার পূর্বদিকে ঘুরে ব্যাঙ্গালোরে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পরে ভিড়ে ঠাসা বাস চলার শুরু। তথ্যপ্রযুক্তির জঙ্গলের দিকে।

    বিদায় কাসারগোড। আবার অন্য কোনোদিন এইখানেই।

    ৭ (Sep 1 2005)
    দেসের কতা

    আরেট্টা পোনেরোই অগাস্ট এসে পুঁই কোরে চোলে গ্যালো। বোঁচাবুঁচিরা "ধনোধান্যে পুস্পে ভরা' গেইয়ে গেইয়ে পোড়াচোকে আঁসু বৈয়ে দেলো। বাবুবিবিরা নাড্ডু আর বানরুটি বিলিয়ে দেসের জন্যো চিন্তা কোত্তে নেগে গেলেন। সে কত্তো চিন্তা! কেউ বলেন- ওরা তোমার জমিন লেবে, তোমরা ওদের অক্তো দেবে। কেউ বলেন- আমলাশোলে অক্ত নাই, আমরা কোতায় অক্ত পাই! আবার কেউ কেউ আরও কোটিন কোটিন ব্যাপার ভাবতে নেগেচেন। এই ধরেন- এক কেলাস থিকে বাংলা না পোল্লে কেন্দের রাজোস্‌সো ঘাটতির উপোর তার কি পভাব? কিম্বা ধরেন- হ্যারী পটার পোল্লে কি কেন্দো-রাজ্যো সম্পোক্কের উন্নোতি হবে? কে আবার সিদিন বোল্লো- জয়বাবু যোদি কোবিতা ছেড়ে পবন্ধ লেকেন, তাইলে ভারোত-বাংলাদেশ বডারে পবলেম সল্‌ভ হইয়ে যাবে। উ সব দেকেশুনে ভুতুমের মোনেও দেসোপ্পেমিক হবার শখ চাউড়ে চাউড়ে উটচে। ভুতুমের গুরুদেবও বোল্লেন- "বাবুবিবিরা দেসের কতা ভেবে ভেবে দু চোকের পাতা অ্যাক কোত্তে পাচ্চেন না, আর গুয়োর ব্যাটা ছাতিমগাছে চোড়ে ন্যাজ ঝোলাচ্চে! যা। গিয়া পাচ পয়েন লিকে আন- দেসের কি কোরে উন্নোতি হোতে পরে।' গুরুর আদেশ শুনে ভুতুম অনেক  ভেবেচিন্তে পাচটা পয়েন লিকে আনলো।

    এক লম্বর: সেজেগুজে বেরিয়েচো তো পাড়ার মোড়ে বঙ্কা দাঁইড়ে আচে। মুকখানা ছুঁচোর মতো গোল কোরে রেকেচে। ঠোঁটের ডগায় একদলা থুতু। ভাবতেচে সামনের পোশ্‌টারে পোসেনজিতের গলার লকেটে টিপ কোরবে নাকি রিতুপন্নার বেলাউজে টিপ কোরবে। তুমি আর এগুতে পারো না। যেই এগুতে গেলে, ওমনি থপাস। কিম্বা অটোর কিনারে একটেরে হোয়ে কোনো রকোমে পেছুন ঠেকিয়ে রেকেচো। সামনের বাসের জানলা দিয়ে পচাবাবু গোলা ছুঁড়লেন- থপাস। খানিকটে ছিটকে লাগলো তোমার জামার আস্তিনে। দেসের নোকেদের মুকে অ্যাতো অ্যাতো থুতু কোথ্‌থেকে আসে ভেবে ভেবে ভুতুম থ হইয়ে যায়। আপিসে আপিসে ঠাকুদ্দেবতার ছবি নাগিয়ে রেকেচে। আযা কোরিস, থুতু ফেলিস নে বাপু। কে কার কতা শোনে! দেসের বেওয়ারিশ রাস্তা ঘাট রোয়েচে কি কোত্তে! আপনা মাল রাস্তে মে ঢাল। পানু সোন্দেবেলার ফাংশানে ঞ্ছও আমার দেসের মাটি' গেইয়েই প্যাচাৎ কোরে মোক্ষম একদলা ফেললো দেসের মাটির বুকে। মুয়ে পান থাক কি না থাক, পাচ মিনিটে একবার থুতু না ফেললে নোকের শরীলে ক্যামোন আইঢাই কোত্তে থাকে। সায়েবরা ক্যানো আর এ দেসের নমে কুচ্ছো গাইবে নে, যকোন দেসের সবাই মিলে দিনরাত থু: থু: কোত্তে নেগেচে।

    দু লম্বর: কারু বাড়ি সোন্দেব্যালা দজ্জা ঠক্‌ঠকিয়েচো তো আশি ডেসিবেলে- "ক্যা? কি চাই?' রোবীন্দ সদনে ক্যালান্তবাবু যেই গুচিয়ে গান ধোরেচেন ওমনি পেছুনে সোত্তোর ডেসিবেলে মোবলিতে "ধুম মচা লে'। সে আবার পোতি সেকেন্ডে পাচ ডেসিবেলে বাত্তে থাকে! তাপ্পর ফোন ধোরে আবার সোত্তোর ডেসিবেলে- "কি গো? তাই নাকি? আমি কদুপিসিকে আগেই বোলেছিনু তোমার ছোটোপিসির বড়ো খুত্তুতো ননদকে অতো পাত্তা দিও নি। কিন্তুক সদুপিসির সেজোমামার কতা শুনেচো তো...' হোয়ে গ্যালো! রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স মোবাইল:! রাত্তিরে ঘুমুতে যাবে তো তলার গ্যারেজে মিস্টার তলাপাত্তোরের গাড়ি পেছুনে "সারে জাঁহা সে আচ্ছা' বাজাতে বাজাতে ঢুকচে। যে কোনো ডেরাইভার সামনে হরন পেলেই মোনের সুকে টিপতে থাকবে। আর মিটিন মিচিলের কতা তো আর বোললেম নে। পাড়ার হারানদার গলা শুনলি মোনে হয় হাঁড়িচাচার গলায় টনসিল হোয়েচে। কিন্তুক ভোট এলে তাই নিয়েই মাইকে সি কি চিল্লানি! এর পরেও রোয়েচে শোনিপুজোতে "এ আমার গুরুদোক্‌খিনা', পাশের বাসার বৌদির রোজ সোন্দেব্যালা সন্ধ্যার মার সাথে ঝগড়া, রাত হোলেই বোস্‌বাবুদের ঘরে ক্যাঁ ক্যাঁ কোরে "কিউঁ কি...', "... একদিন পোতিদিন', পাসের হোরিসবার বাহাত্তোর ঘন্টা ননিস্টপ সংকেত্তন, ববির মারুতি গাড়িতে গাঁক গাঁক কোরে "মা-কা-রে-না'। ভুতুম যে এট্টু শান্তিতে দেসাত্তোবোধোক গান শুনবে, তার উপায় কি কেউ রেকেচে? অ্যাত্তো অ্যাত্তো শব্দো শুনে ভুতুমের কানে একন তাই কোনো কতাই ঢোকে না। আমাদের চুমু ও বাতকম্মো থেকে কান্না- সবই পয়ঁষট্টি ডেসিবেলের উপর। তাই ভুতুম ছাতিমগাচে ন্যাজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুকনো মুলো চিবোয়।

    তিন লম্বর: ল্যাম্পোস্টেরও দরকার লাই। একখান খোলা জমি কি নদ্দমা পেলেই হোলো। ছ্যড়ছেড়িয়ে শব্দো, চারিদিক লি:শব্দো! বাইরের দেশ থেকি ঘুরে এসে যেই এয়ারপোট্টে পা রাখবে, ওম্নি একখান গন্দো নাকে এসে বদাম্‌ কোরে ঘুঁষি মারবে। চোতুদ্দিক আমরা ভিজিয়ে রেকেচি। এই ভিজিয়ে রাকেন যারা, তারা নিজেরাও কিন্তুক ভিজে বেড়াল। এরম অ্যাক ভিজে বিড়েলকে দেকেচিলুম আপিসের টাইমে শিয়ালদা ইস্টিশনের দু নম্বর পেলাটফর্মে দুই কামরার মাজে দাঁড়িয়ে ডিউটি দিচ্চেন। আর একজোনকে দেকেচিলুম যিনি এই কম্মে মহাপ্পোভু। হোরিদ্দারের গঙ্গাতেই এক্কেরে .. দোকানদারেরা ঘেঁটি ধোরে না নিয়ে গেলি কি যে হোতো! ভুতুমের গুরু বলেন- আমরা সব মাটির মানুষ।  ভুতুম বলে- আমরা সব জলের মানুস। বিলেতে গিয়ে ওয়েলথ্যামস্টো ইস্টিশনের বাইরে বেরিয়ে ভুতুম দেখে এক স্যাঙাৎ বিলিতি ল্যাম্পোস্টের পাশে দাঁইড়ে আপিসের কোটপ্যান্ট পোরেই এক্কেরে ছ্যাড়্‌ছ্যাড়্‌। ভুতুম ভাবে এ লিচ্চয় আমার দেসের নোক গো! মুখ ফিরুতেই- আ মোলো যা! এ তো জ্যান্তো একখান লালমুখো সাহেব গো! সিদিনকে ভুতুমের মোনে যে কি আনোন্দোটাই না হোলো! গিয়াছে রাজ, দুক্‌হু নাই, আবার তোরা মানুষ হ।

    চার লম্বর: আপিসে খেটেখুটে, বাড়িতে ভাজাভাজা হোয়ে দুখীবাবুর লরম শরীলে  বড়ো বেদ্‌না। ডাগ্‌দার বোলেচে এক্সাসাইজ কোত্তে। তাই দুখীবাবু রাস্তাতেই যতোটা পারেন সেরে ন্যান। রাস্তা পেরুবার জন্য মাটির তলা দিয়ে একখান রাস্তা কোরে দেওয়া হোয়েছে। কিন্তুক দুখীবাবু ও সবে লাই। উনি দুইখান ট্যাস্কিকে ডজ কোরে, একখান মিনিবাসরে ছোট্টো ড্রিব্‌ল কোরে, দোতলা বাসের পেছুনে কান্নিক মেরে রাস্তা পেরুন। তাপ্পর কলিগের ছেলে বাসচাপা পোড়ে মোরে গেলে ক:পু:রে শুয়োরের বাচ্ছা বলে খিস্তি মারেন। সামন্তস্যারের এরম কোনো পবলেম নাই। ওনার নিজের গাড়ি আছে। বাড়িতে কম্পুটার আছে। তাতে সামন্তস্যারের পোঁয়াপাকা ছেলে দিনরাত বাঁই বাঁই কোরে গাড়ি চালায়। সামন্তস্যারকে ধোত্তেও দেয় নে। তাই সামন্তস্যার নিজের গাড়ি নিয়েই রাস্তায় খেলু খেলু করেন। লাল লাইট পেরিয়েও যোদি পুলুশ না ধরে তাইলে পাঁচ পয়েন। বাঁ দিকে দিয়ে টেরাককে ওভাট্টেক কোল্লেই দশ। গাড়ির লেনকে কলা দেকিয়ে যদি গলির মোড়ে জ্যামের কেচ্ছা বাঁদিয়ে দেওয়া যায়, তাইলে তো পোনেরো পয়েন বাঁধা। এ ছাড়া আরও খেলা আচে- ধোঁয়া ধোঁয়া খেলা, হরন হরন খেলা, খিস্তি খিস্তি খেলা। দশ্‌শোকের আবার খেলার মাঠে লামতে লাই। তাই ভুতুম ছাতিমগাচে বোসে দেখে আর সিটি মারে।

    পাচ লম্বর: টেরেনের লাইনে দাঁড়িয়েচো- নম্বা লাইন। উশ্‌কোখুশ্‌কো কাকু সাম্নে ঘুর্‌ঘুর্‌ কোচ্চে। যেই মোনে হোলো কেউ দেকচে না, ওমনি পাত্‌লি গোলিতে সাইড মেরে- "দাদা, একটা শিমুরালি...'। কিম্বা মুদীর দোকানে ভিড়ের মোদ্যে দাঁড়িয়ে আচো। হটাৎ বিষ্টুদাদু পাজ্জনের পা মাড়িয়ে, কারুর বগলে খিমচি কেটে হাঁক পাড়বেন- "রামু, দুইখান লালসুতো দে তো দেখি।' তোমার মিন্‌মিনে গলা আর রামু ওবদি পৌঁছোয়ই না- "আমি, কিন্তু আগে, মানে, ...।' তবে এ নিয়ে ভুতুম বেসি কমপ্লেন করে না। জোর যার লাইন তার। চাগরি বাগরি, হাঁসপাতাল, ইশ্‌কুল কালেজ- সব জায়গাতেই ভুতুম এ দেকে আসচে- সালা আমার ভোগ্নীপোত এল সিতে আচে, সেই কানেক্সনে আমার হোয়ে গ্যাচে। বেসি পিতিবাদ দ্যাখাতে এলে হড়কে যাবে মামু! তাই টিরেনের লাইনে, কি দোকানের লাইনে, কি পাসপোটের লাইনে যখোন কেউ কনুই মেরে এগুয়ে যায়, ভুতুম রা কাড়ে না। ঠিকঠাক লইন মাত্তে না পাল্লে সুনাগোরিক হবি কি কোরে রে পাঁচু?

    এ সব আলফাল লিকে ভুতুম যেই গুরুদেবের কাচে গ্যাচে, গুরুদেব তো খোচে দিদি- "শুয়ার, তোমারে কী লিখতে কইলাম আর কী লিখ্যা লইয়া আইলা? না আসে কুনো সাম্রাজ্যবাদী সক্রান্ত, না আসে বিরোধীদের উপর অইত্যাসার কি আইন-শিরিঙ্খলার অবোনতি, না আসে পাশ্চাইত্যের অন্ধো অনুকরোণের বিরুদ্ধে পতিবাদ। এমন কি ইলিশমাসের আমদানি লইয়াও কিসু কস নাই। যা হালায়, এই ল তর মুলো আর গামসা। সাতিমগাসে বইয়া সাবা আর পিড়িক পিড়িক কইর‌্যা সিটি মার। আর একবার দ্যাশের কথা কইসস নি কি তুমার একদিন কি আমার একদিন!'

    ৮ (Sep 19 2005)
    স্বগত

    কাঁদতেও ভয় হয় রে সোনা! আমরা সবাই পুরোপুরি সভ্য হয়েছি। লোকজনের সামনে পুরুষের চোখের জল সভ্য সমাজের প্রায় নিয়মভঙ্গের মতো। তাই রাত্রিবেলা শহরের হিজিবিজি আলো যখন আকাশকে দব্‌দবে লাল করে রাখে, বাবারা ঘাড় গুঁজে চোখের জল পকেটে করে গাড়ি চালিয়ে কি বাসে করে বাড়িতে ফেরে। অনেকের চোখের জল কবেই শুকিয়ে গেছে! সোমত্ত আপিসবাড়িগুলো ন্যাংটো কাঁচ-স্টিল-কংক্রিটের গতর দেখায়। ঘোর রাতের ফ্লাইওভারের উপর কদাকার কাকেরা জড়ো হয়ে শিয়ালের ডাক ডাকে। কাল দুপুরবেলা পরিত্যক্ত ফাঁকা রানওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে একটা বছর তিনেকের বাচ্চা "মা মা' বলে হাপুস কেঁদেই যাচ্ছিল। সুব্বু প্রোজেক্ট মিটিঙে বসে নিজের হাতের রেখা দেখতে থাকে- পয়ঁত্রিশে কালযোগ নাকি অবধারিত। অরভিন্দ ছ মাস হল ঘরছাড়া। কাজ শেষ হলে বিকেলে একা একা চিল্ড্রেন্স পার্কে গিয়ে সময় কাটায়। রাত্রে শুদ্ধবস্ত্রে পূজাশেষে আরও বিশুদ্ধ নীলছবি দেখে রাত কাটায়। সুতনুর নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মহত্যার বীভৎস গল্প পড়া। এইভাবেই তোরা বড়ো হয়ে উঠিস আর তোদের বাবারা আরও বড়ো মানুষ, আরও কাজের মানুষ হয়ে ওঠে। শেষে মদনদার মতো কোনো কোনো বাবা মেলে আর ফোনে মেয়েদের উত্যক্ত করে আর তার ছোটো মেয়ে দুটোর সেরা ছাত্রী হিসেবে কাগজে নাম ওঠে। এই মহাজটেও এতো সমান্তরাল রেখা! কেউ কাউকে না ছুঁয়ে হেঁটে চলে যেতে থাকে। একে বুঝি হেঁটে যাওয়া বলে!

    অথচ কথা ছিল সক্কাল সক্কাল তোকে নিয়ে কুয়াশা ঘেরা বড়ো রাস্তায় ভারত সুইট্‌সের কাঠের বেঞ্চিতে বসে বাসের নাম্বার দেখিয়ে সংখ্যা পরিচয় করাব। অথচ কথা ছিল তুই যাত্রা দেখতে যাওয়ার বায়না করলে "ঐ ভূত বাপ রে' লিখতে বলে নিজের পাশে বসিয়ে রাখব। অথচ কথা ছিল লোড্‌শেডিঙের রাতে তারা তারা আকাশের নীচে বসে তিনজনে গান গাইব। মায়ের গন্ধ নিয়ে যখন বড়ো হয়ে উঠলি, বাবাদের গায়ের সেই অদ্ভুত গন্ধই মিলিয়ে গেল। এ সি ঘর, মিটিং আর রিপোর্টের মধ্যে মাথা ঘষতে ঘষতে মাথা নিচু ঘোলা চোখ একদল মানুষ হয়ে গেল বাবা। তারা টাকা রোজগার করল, তোদের ইশ্‌কুলে পড়াল, দামী দামী  খেলনা কিনে দিল, গাড়ি কিনল, বাড়ি কিনল, ধুমধাম করে বিয়ে দিল। কর্পোরেট কি সরকারি ছেনালির পয়সায় ঘরদোর উথলে উঠল। আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক?

    শুধু পারল না জোর গলায় শক্ত পায় নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছাতে চালাতে। যার গলায় নামত বর্ষার মেঘ, তার মগজে মগজে ঘোরে পলিসি সার্কুলার, ফাইল নাম্বার আর বড়ো আমলাদের তদ্বির। যে ছেলেটার হাতে ঝরত রঙের চোদ্দোপার্বণ, সে চাবির পর চাবি টিপে ঝক্‌ঝকে ভারত বানাচ্ছে। বিপ্লবী বাবাদের বিপ্লব ব্ল্যাকবোর্ডে আর পে কমিশনের রিপোর্টে। আর যে সমস্ত অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল? দস্তুরমতো হোমরা চোমরা সি ই ও। সফল বাবাগণ এইভাবেই শ্মশানের দিকে দৌড় মারছে অথবা বস হুড়কো দিলে বাথরুমে ঢুকে লুকিয়ে গালাগালি দিচ্ছে। প্রকাশ্যে খিস্তি মারলে জর্জ বুশ, ভারত সরকার, রাজনীতিবিদ বা রাহুল দ্রাভিড়। আর মাঝে মাঝে ছোবল মারে নিজের ঘরগেরস্থিতে বা সহকর্মীদের। নেটওয়ার্ক বজায় রাখা চাই, নিজের মার্কেটিং করা চাই- কম দায়িত্ব! আর এই সব না করলে বাবারা মূল দায়িত্ব পালন করেই বা কী করে- ইশ্‌কুল, খেলনা, টিউটর, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিয়ে, এবং অনন্ত ইলিউশন।

    এইভাবেই সোনা, সরীসৃপ যুগ কেটে যাবে। কেই বা ধ্বংস হতে চায়? সরীসৃপ মাটির তলায় তলায় দুর্গ বানাতে থাকে। সেই দুর্গের কোটরে কোটরে সুতনু, সুব্বু, অরভিন্দ, মদনদা। ডিস্‌ফাংশনাল মগজে দু ছটাকের বেশি স্বপ্নও ঢুকতে চায় না। তার উপরে আবার প্রার্থনার নামে রোয়াব- আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক? এর পরেও তোরা কাঁদবি, বাবাদের ছবি টাঙিয়ে রাখবি আর সফল বাবাদের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হবি। মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা শীতল আত্মারা তখনও মুচকি হাসবেন, আর হিস্‌হিস্‌ করে জিভ বাড়াবেন পরের শিকারের দিকে। এই পাগল শিকারী দুনিয়ায় যদি পারি বর্ম দিয়ে যাব। তবে তারই পাশাপাশি শিকারও চলবে। লেবাননে, প্যালেস্টাইলে, শ্রী লঙ্কায় হাতে হাতে খেলনা তুলে দেব।

    শুধু স্বাধীনতা শেখাতে পারব না।

    অন্ধকার ঘর সোনার ঝলকে আলো করে দেবো। কিন্তু সূর্যসন্ধানে নিয়ে যেতে পারব না।

    কে যেন কানের কাছে নব্বইয়ের ইশ্‌তেহারের কথা বলে? সন্তানের নরম গায়ের গন্ধের ভালোবাসা, প্লেন ল্যান্ডিং করার সময় গলায় দলা পাকানো যে সব ভালোবাসা এখনও উঁকি মেরে যায়, তাদের দেখা পেতেই এত সময় লাগে, তারপর নতুন ইশ্‌তেহারের সময় কোথায়?

    "মানুষ অনেক অন্ধ, অনেকের অন্ধতা গিয়েছে।
    বুঝেছি যাবার নয় আমার চোখের ভিক্ষা, চাপ...
    যদি কৃপা করো, যাই, সন্তানের মুখ দেখে আসি।"

    ৯ (Nov 16 2005)
    জেড্ডা: ইতস্তত বাক্যমালা

    .

    এই স্থানে সূর্য বড়ো প্রখর।
    সূর্যমুখীর হতাশায় বিমর্ষ যৌবনের নখ আঁকড়ে ধরে স্টিয়ারিং।
    স্থবির আবায়ার কালো পর্দা পেট্রোলের খ্যাপা হাওয়ায় দুলে ওঠে।
    একশ কুড়িতে ছোটা কালো মোষ কেবল থামে শপিং মলের সামনে।
    শপিং মলেও সূর্য বড়ো প্রখর।
    সব কিছু চক্‌চক্‌ করে,
    চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, পা ব্যথা করে, চোখে জং ধরে, গলা শুকিয়ে যায়।
    শিশুরা ছাড়া চেঁচিয়ে ওঠা বারণ।
    নি:শব্দ শপিং মলে পরিযায়ী পাখিদল রিয়াল গোনে।
    মকবুলও রিয়াল গোনে ট্যাক্সিতে বসে।
    নেত্রকোণায় পাঁচ বছর যাওয়া হয় নাই।
    এখন শুধু আজিজিয়া থেকে শরাফিয়া থেকে আল-বালাদ।
    দশ রিয়াল, পাঁচ রিয়াল, পনেরো...
    মক্কা যেতে পারলে বড়ো দাঁও জোটে।
    একশ কুড়িতে ছোটা মকবুল কি ভাবে আর থামে?
    সন্ধের জুম্‌জুম বুফিয়াতে চায়ের গেলাস হাতে
    নেত্রকোণা, বরিশাল, পেশাওয়ার, করাচি, কোচিন, হায়দ্রাবাদ....
    একই হাতে আল-আমিনে রুটি আর হালিম
    ঘরে ফিরে চার খাটিয়া একের উপর এক
    চার ঘেমো পুরুষ দেহ
    ফজরের নামাজের ডাকে পুন: জেগে ওঠে
    প্রখর সূর্য পিঠে অবিশ্রাম ট্যাক্সি নিয়ে আমি
    যে ট্যাক্সিওয়ালা
    ট্যাক্সির খোঁজে চার মুখঢাকা আরব রমণী নিয়ে বিপুল বৃদ্ধ
    লোহিত সমুদ্রের ধারে উটের মলগন্ধভরা কর্নিশে সান্ধ্যভ্রমণে
    দুশো ফুট উঁচু ফোয়ারার ধারে চাঁদ লটকে থাকে
    সন্ধ্যাবেলা
    বিষন্ন  সূর্যমুখী।
    বিষন্ন সূর্যমুখী শুক্রবার দুপুরে শহরের মধ্যের চাতালে
    যুবকেরা বধ হবে।
    উপোসী দেহের স্রোত মিশেছিল মনিবগৃহিণীর আবায়ার নীচে
    বধ হবে তপ্ত রক্তে, তপ্ত বালি, তপ্ত রাস্তা, তপ্ত বোমা
    রাজা তরবারিহাতে সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে নাচেন টি ভির পর্দায়
    ঐতিহ্য রক্ষা করা দায়।
    দপ্‌দপ্‌ নিয়নের আলো ম্যাক, পিৎজা হাটের শিখরে
    আফ্রিকার পকেটমার, ভিখারি ও পাগল
    ঐতিহ্যের কোলে বসা নিশ্চিন্ত বালক
    অযৌনতার নিশ্চিন্তি
    অরাজনীতির নিশ্চিন্তি
    অশরীরের নিশ্চিন্তি
    শয়তানি গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
    অষ্টমীর সন্ধ্যায় নুয়ে পড়া চাকর শরীর
    নিশ্চিন্ত নিদ্রায় হাতের কব্জি কাটে
    পাশে পড়ে থাকে প্রখর তৈলাক্ত শহর জেড্ডা
    এ ছাড়াও থাকে হোটেলের দুশো সাত নম্বর ঘর।

    ১০ (Dec 16 2005)
    তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে

    .

    "লুটা লুটা কিসনে উস্কো অ্যায়সে লুটা কে ফির উড় না পায়া"

    বাঙালি জেগেচে। বোদ্দিতলার পাঁচু শেখ থেকে মেফেয়ার গাডেনের মিশ্‌টার ডাট পজ্জন্ত জেগেচে। এক্কেরে চেগিয়ে চেগিয়ে জেগেচে। লবোজাগোরোন শুরু হোলো বোলে- ডু ইট লাও। সবেধন লীলমণি একখান পিস বেরুয়েচিলো। তারেও সুমুন্দির পোরা চক্কান্তো কোরে গুপি কোরে দিলে গা! মুয়ে ঝ্যাঁটা মারি অলপ্পেয়েদের! বিদ্যেসাগর থেকে লিবারণ চক্কোত্তি- সব মোরে হেজে ভূত হোয়ে গ্যাছে। পোড়ে আচে শিবরাত্তিরের সোলতের পোদীপ খুঞ্চুমুনু পুঞ্চুমুনু মোদের গরোব, মোদের আসা। তাই নিয়ে ধ্যাষ্টামি! চল বে, দেকিয়ে দি পিতিবাদ কারে কয়।

    আপিসে পানপরাগখেকো বস এভরিডে হুড়কো দিচ্চে- পিতিবাদ পিতিবাদ!
    বোনের হাজবেন্ডটার বহুত পয়সার রোয়াব হোয়েচে- পিতিবাদ পিতিবাদ!
    ছেলেটা ইশকুলে পানু নিয়ে গিয়েচিলো বোলে হেডমাস্টার ডেকে ধাতিয়েচে- পিতিবাদ পিতিবাদ!
    ও পাসের বাড়িতে মিসেসের ময়লার জল পোড়েচিলো বোলে মিত্তিরবাবুর সাথে হাতাহাতি হোয়ে গ্যালো- পিতিবাদ পিতিবাদ!

    সব লাঞ্ছোনা-গঞ্জোনা-বঞ্চোনা-অন্যায়-অবিচার-যাতোনা-বেদ্‌নার পিতিবাদ ইডেন গাডেনেই হবে। জাগো বাঙালি, কচুসাকের কাঙালী! বঙ্গোভঙ্গের সতোবস্‌সে দেখে লেবো বাঙালিকে কে রুখতে পারে। গিয়াছে জগু, দু:খু লাই, আবার তুই লায়ক হ। লিন্দুকেরা বোলচে যে মোদের বাংলাপেরেম সুদুই কিরিকেটের মাঠে। ইদিকে খাস কোলকেতায় বাঙালির বাস কোমতে কোমতে তলানিতে ঠেকেচে, বাংলা মিডিয়াম ইশকুল সব পগার পার- সিদিকে কোন হুঁশ লাই, খালি কিরিকেট আর কিরিকেট। কিন্তুক এনারা এটা বোঝছেন না যে এর মানে হল গিয়া আমারাও সেই ভারতীয়ই বটি। ভারতের দেসোপেরেমের জায়গা যেম্নি কিরিকেটের মাঠ, আমাদেরও বাংলাপেরেমের জায়গা সেই কিরিকেটের মাঠ। এ নিয়ে ছ্যা ছ্যা করার কি হোলো বাপু?

    ভুতুমের এই ভাঙা গলার কাতরানি সুনে গুরুদেব বেম্মোতালুতে হাত রেকে কইলেন- ঞ্ছঅতো চিন্তে কোরিস ক্যানো রে খোকোন! কিরিকেট ছেড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দ্যাখ না পাগোল- বাঙালিতে বাঙালিতে এক্কেরে ছেয়ে ফেলেচি। এই তো সিদিন মুম্বাই থেকে ঘুরে এলুম। রাণীর কতা তো ছেড়েই দে, অবিষেক, রিতিক লোশন- সবই তো আমাদের ঘরের ছেলে রে! ঐদিকে মানিক রায়ের পরেও কতো রায় দিলুম বল দিকি- রিনা রয়, পোনয় রয়, অরুন-ধুতি রয়। কোনো কতা হবে নে! ঠিক তেম্নি বাবলু সেন আর রীণা সেনের পরেই ক্যামোন বের কল্লুম সুস্মিতা সেন। সিদিকটাও অ্যাকবার দ্যাখ! খালি গাঙ্গুলী নিয়ে ডাঙ্গুলী খেল্লে কি হব্যা?ঞ্জ

    এই সুনে ভুতুমের পুরো পেত্যয় গ্যাচে যে লবোজাগোরোন দোরে এয়ে দেঁড়িয়েচে। জাস সিলি পয়েন্টে লোপ্পা এলেই খপাৎ।

    "মিলাবে মানবজাত'

    এর আগে য্যাকোন লবোজাগরণ এয়েচিলো ত্যাকোন ভুতুম খুব ছোটো- ভালো কোরে সব কতা মোনেও লাই। সেই উন্নিশে্‌শা সাত্তাত্তর সালে। য্যাকোন বাঙালি বেস রসেবশে পরিপুন্নু সাম্মোবাদী হোলো। তার আগে আগে কিরম অ্যাকটা আধাখ্যাঁচড়া ব্যাপার ছেলো। সাতাত্তরে বিরিগেডে মশাল জ্বালিয়ে বেশ লায়েকমাকা সাম্মোবাদী হোয়ে ওঠা গ্যালো। সেই তবেথ্‌থেকে অ্যাকোনো অব্দি সব্বাই সাম্মোবাদী- সি পি এম, কংগেস, তিনোমুল, বিজিপি- সব্বাই। কে আবার বোলেচে- আসোলে সব্বাই সি পি এম- সি পি এম, কংগেস, তিনোমুল, বি জি পি- সব্বাই। তবে বাঙালি যে হেব্বি সাম্মোবাদী এ নিয়ে জাস কোনো কতা হবে না। সাম্মোবাদী, অসাম্পোদায়িক, সামোস্কিতিক।

    এই ধরো ভুতুমদের পাড়ার মোহিলা সমিতির খনা বৌদি- সা, অ, সা মনে সাম্মোবাদী, অসাম্পোদায়িক, সামোস্কিতিক। বর পাট্টির হোলটাইমার মনে সাম্মোবাদী তো বটেই। ছয় ডিসেম্বার খনা বৌদির মেয়ে টুম্পা মিচিলে বেলো টিপে গান গায়- ঞ্ছমাটি কতো মেহেরবান/ আনন্দে আজ গাইচি গান/ আমরা আচি পাসাপাসি হিন্দু মুসলমান।ঞ্জ অসাম্পোদায়িক বোলে অসাম্পোদায়িক! আর সামোস্কিতিক? সে তো লেগেই রোয়েচে। ওলাইচোন্ডী থেকে রোবিন্দোজয়েন্তী- গনোসমোস্কিতি নিয়ে কিতকিত খেলচে। তো সেই খনা বৌদির বাড়িতে কাজ করে সরোস্‌সোতি আর তার আট বছোরের মেয়ে পুন্নিমা। দুক্কুরবেলা নয় বছুরে টুম্পা বাড়ি ফিল্লে তারে  চোকে চোকে রাখে আট বছরের পুন্নিমা। তবে খনা বৌদির বাড়ি ঝি-চাকরের খুব সন্মান। টুম্পা সরোস্‌সোতিকে ঝি বোলেচিলো বোলে খনা বৌদির কি ধমক রে বাওয়া- ক্যানো, কাজের লোক বোলতে পারো না? কিন্তু সাম্মোবাদের সাথে সাথে সাস্থোটাস্থোর ব্যাপারগুলো তো আচে। তাই খনা বৌদির দুটো বাত্তুনের কোনো বাত্তুনে সরোস্‌সোতি কি পুন্নিমার ঠাঁই লাই। যেদিন পুন্নিমা পোচোন্ডো পেট খারাপ নিয়েও টুম্পার দেখভাল কোত্তে এয়েছেলো, সেদিনও খনা বৌদির কড়া শাসোনে বড়ো হওয়া টুম্পা পুন্নিমাকে বাত্তুনে ঢুকতে দেয় নে। ছোটো মেয়েটা পেছুনের ন্যাড়া পার্কের ঝোপের আড়ালে বার বার দৌড়ে যাচ্চিলো। দিনের শেষে সরোস্‌সোতি য্যাকূন নিতে এলো, মেয়েটা নেতিয়ে পোড়েচে। এই দেকেই কিন্তু খনা বৌদি সাতে সাতে ওষুদের পয়সা বের কোরে দিয়েচিলো। সরোস্‌সোতির মাইনে বাড়াতেও খনা বৌদির খুব আপোত্তি। সরোস্‌সোতির বরটা মাল খেইয়ে পয়সা উড়িয়ে দেবে যে। তাই পাঁচ বচ্ছর হোয়ে গ্যালো সরোস্‌সোতি সেই একই মাইনা পায়। আর এ নিয়ে কতা কওয়ারই বা কি আচে- ঘরের নোক কি না! তবে খনা বৌদির বরের ইউনিয়ন যেদিন ধম্মোঘট শেষ কোরে দশ পার্সেন বোনাস বাড়িয়ে নিলো, সেদিন মোনের অনোন্দে খনা বৌদি সরোস্‌সোতিকে এক বাক্সো সন্দেশ কিনে দিয়েচিলো। ঘরের নোক বোলে কতা!

    একন টুম্পা বড়ো হোয়েচে। মঝে পাড়ার বিহারী কেবলওয়ালা লবকাত্তিকের সাতে খুব লটরপটর শুরু কোরেচিলো। তাই শুনে তো খনা বৌদির মাতায় হাত। মা সন্তোষী মার উপোস রাকতে হোলো। মেয়ের ভোবিসৎ নিয়ে খ্যালা কোল্লে তো চোলবে নি! শেষে জোনাল কমিটির সিক্রেটারির ভাইপো- ফরিদপুরের পাক্কা  বারেন্দ্র বাউন আই আই টি পাশ করা উইপ্রোতে চাগরি করা ছোকরার সাথে বিয়ে দিয়ে সান্তি! পুন্নিমারও বিয়ে হোয়েচে এক উড়ে জলের কলের মিস্তিরির সাতে। লোকটা ভালো, বালেশ্বরে একটা বৌ থাকলেও পুন্নিমের গায়ে হাতও তোলে না, লিসা-ভাংও করে না। পুন্নিমার বিয়েতে খনা বৌদি সুদু একছড়া হার দিয়েচিলো যে তাই লয়, তাসাথে টুম্পার বিয়েতে পাওয়া আসাপুন্না দেবীর পথম পোতিসুতি।

    ভুতুমের নাক চোক এ সব দেকে ভোক্তিতে ভোরে আসে। অ্যামোন দেসটি কোতাও খুঁজে পাবে নে কো তুমি- য্যামোন সাম্মোবাদী, তেম্নি অসাম্পোদায়িক, তেম্নি সামোস্কিতিক। এই লবোজাগোরোন এলো বোলে।

    জয়ম্মা বাঙালি, জয়ম্মা সাম্মোবাদী, জয়ম্মা লবোজাগোরোন!

    ১১ (Jan 3 2006)
    জেড্ডা

    শহরটার পশ্চিমে সমুদ্র। সমুদ্রের ধার দিয়ে কর্নিশ, এক লম্বা রাস্তা শহরটার একদিক ঘিরে রয়েছে। কর্নিশে সন্ধ্যাবেলা অজস্র ঢাউস গাড়ি, সৌদি পরিবার ও শিশুদের কলরব, উটের গুয়ের গন্ধ, বালির মধ্যে খেলনাগাড়ি চালায় সৌদি কিংবা ইয়েমেনি তরুণ। পুরোনো শহর, যেখানে সুড়ঙ্গমাফিক গলির মধ্যে আতর, খেজুর, মক্কার শস্তা ছবি আর চিন থেকে আমদানি খেলনার পসরা- নাম আল বালাদ। আল বালাদের এক প্রান্তে বন্দর। এইখানে সমুদ্র ধূসর, স্রোতহীন, কলকব্জা আর লোহার জাহাজেরা ভিড় করে একে অন্যের মুখে দেখে। দূরে দেখা যায় নীল সবুজ সমুদ্র, ধারে গাছপালা ঘেরা কোনো উদাস জমিন। অইখানে বিত্তবান যুবকযুবতীরা শরিয়তের বেড়া পেরিয়ে ঘেরাটোপের আড়ালে আমোদে মত্ত। আল বালাদের দোকানপাট, শপিং মল, রেস্তোরাঁ দুপুরে ঝাঁপ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। এই শহরের রাস্তায় কোনো কুকুরের দেখা নেই। শুধু রোগাভোগা এঁটো বিড়ালেরা চোখ সরু করে ঘুরে বেড়ায়। সমুদ্রের উড়ো হাওয়ায় শপিং মলের হা হা করা চত্বরে বেদুইন রোদ ওলট পালট খেতে থাকে। রাস্তার ধারের মালয়ালি কফির দোকান বা বুফিয়াতে কিছু খুচরো লোক তামিয়া, মানে লম্বা পাঁউরুটির মধ্যে পোরা মাংসভাজা দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারে। একটু দূরে ছোট মসজিদের সামনে পড়ে আছে একলা চত্বর। শুক্রবার এখানেই কারো শিরশ্ছেদ হবে।

    বিদেশিরা এই চত্বরকে বলে চপ চপ স্কোয়ার। বিদেশি অর্থাৎ এক্সপ্যাট্রিয়েট বা এক্সপ্যাট। বহু সংখ্যায় শ্বেতবর্ণ, তারপরেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়রা। এই বিত্তবান পেশাদারদের জীবন কাটে শহরেরই দূর প্রান্তে মিলিটারি পাহারা দেওয়া কম্পাউন্ডে। গোটা পাঁচেক দুর্গদেওয়ালের সিকিউরিটি চেক পেরিয়ে তবে ঢোকা যায় শহরের মধ্যে থাকা অন্য এক শহরে। কম্পাউন্ডের মধ্যে শরিয়তের ঢুকতে মানা। তাই পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবনযাত্রায় অশরিয়তী হালচাল। বেশির ভাগ পরিবার পরিজন ছেড়ে দীর্ঘদিন বাদশা আবদুল্লার রাজ্যে।  বিশাল বাড়ি, সুইমিং পুল, ক্লাব নিয়ে দিন কাটে, রাত কাটে। মদ্যপান নিষিদ্ধ। নৈতিক পুলিশের চোখ এড়িয়ে বাড়িতেই মদ বানানোর প্রচেষ্টা। বাড়ির কাজকর্ম করে দেয় ফিলিপিনো ঝি। দেহের তেষ্টা বেড়ে গেলে ফিলিপিনো মহিলার মধ্যস্থতায় দুই হাজার তিন হাজার রিয়ালে মহিলা দেহও জোটে। আরও গহীন ফুর্তি চাইলে বাহরাইন।

    আরও একদল বিদেশি আছে যাদের এক্সপ্যাট বলা হয় না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইন্স, ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা শ্রমিক, নার্স, ট্যাক্সি ড্রাইভারেরা। শহরের মধ্যে আল শরাফিয়া অঞ্চলে মালয়ালি প্রাধান্য, আল আজিজিয়ায় পাকিস্তানি। এদেরও মাসের পর মাস কাটে পরিবার পরিজন ছাড়া টাকা রোজগারের তাগিদে। কিন্তু না আছে কম্পাউন্ডের বিলাসব্যসন, না আছে নিয়মিত বাহরাইন দুবাই যাবার ট্যাঁকের রসদ। ধনী সৌদির বাড়িতে কাজ করতে করতে অনেক সময়ই কেউ কেউ কোনো এক গৃহিণীর শয্যাগত, এবং তারপর চপ চপ স্কোয়ার। বাজার চত্বরে কালোতে ঢাকা বাংলাদেশী রমণীদের টুকরো টুকরো সংলাপ ভেসে আসে- "কাল রাতে তোরে ডাকসিল? আমারে দুই রাতেই ডাকসে। দুই রাতই ঘুম হয় নাই।"

    সর্বত্র সর্বাঙ্গ ঢাকা নারী। তা সত্ত্বেও কাগজে খবর বেরোয়- ইভটিজিং, যৌন হয়রানি থেকে ধর্ষণ। সমাজ যেখানেই যাক, প্রযুক্তি অতি তৎপর। অতএব পার্কে যুবকেরা মহিলাদের হয়রানি করে এবং মোবাইলে তার ছবিও তোলা হয়। সেই ছবি এস এম এসে ঘুরে বেড়ায় দেশের সর্বপ্রান্তে। কে যেন বলে নারীদের পোশাকই শুধু পুরুষকে ধর্ষণে প্রোভোকিত করে? তবে দিনকালের প্রকোপে মুখের পর্দা আস্তে আস্তে খুলছে। গত বছর থেকে মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশুনা অনুমোদিত হয়েছে। চাকুরিরতা মহিলা দেখাও খুব দুর্লভ নয়। জেড্ডা চেম্বার অফ কমার্সে প্রথমবার দুই মহিলা ব্যবসায়ী প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন। কিন্তু রাস্তাঘাটে স্বামী কিংবা পিতা কিংবা ভ্রাতা ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সাথে চলাফেরা ভীষণ অপরাধ। আরও অপরাধ মেয়েদের গাড়ি চালানো। অভূতপূর্ব মিছিল বেরোয় গত বছর- মেয়েদের গাড়ি চালাতে দেওয়ার দাবিতে। বহুবিবাহের প্রচলন। শপিং মলে প্রৌঢ় শেখের পিছন পিছন হেঁটে চলে বিভিন্ন বয়সের গোটা চারেক পরী। তবে গোটা চারেক পরী ম্যানেজ করা কি মুখের কথা? কাগজে খবর বেরোয়- শপিং মলে দুই সতীনের উদ্দাম ঝগড়া এবং হাতাহাতি। কানে কানে কলমে জনৈক তিন চার পরীহুরি সামলানোর সুলভ উপায় জানতে চেয়ে চিঠি লেখেন। শহর চলে কঠোর নৈতিক শৃঙ্খলায়। শৃঙ্খলা রক্ষা করেন মুতোয়ার দল- ধর্মীয় এবং নৈতিক পুলিশ।

    অথচ এই রকম কথা ছিল না। জেড্ডা শব্দের অর্থ "ঠাকুমা"। প্রবাদ প্রথম মানবী ইভের মৃত্যু ও সমাধি এই শহরে। লোহিত সমুদ্রের ধারে গড়ে ওঠা বাণিজ্যবন্দর, অন্যদিকে মক্কায় যাবার প্রবেশদ্বার। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে বণিক ও তীর্থযাত্রীর দল ভিড় করেছে শহরের ইতিহাস জুড়ে। ১৯২৫ সাল নাগাদ ওয়াহাবীরা সৌদ রাজবংশের নেতৃত্বে জেড্ডার দখল নিল। মোহম্মদ বিন অব্দ আল ওয়াহাবের নেতৃত্বে এই ওয়াহাবী ধর্মতের জন্ম। ওয়াহাবী ধর্মমত অনুযায়ী কোন সাধুসন্তের স্মৃতিসৌধ, মাজার ইত্যাদি অ-ইসলামীয়। তাই মক্কায় হজরত মহম্মদের স্মৃতিধন্য সমস্ত বাড়িঘর বুলডোজারের ধাক্কয় গুঁড়িয়ে যায়। তার জায়ায় তৈরী হয় অসংখ্য পাঁচতারা হোটেল মক্কার তীর্থযাত্রীদের জন্য। একইভাবে অন্যান্য শহরেও ইতিহাসের স্বাক্ষর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। একমাত্র আল বালাদে বেঁচে থাকে গায়ে গায়ে ভিড় করা পুরোনো বাড়ি, বারান্দা আর জানলায় কাঠের জাফরি, ছোট ছোট সৌক বা বাজারে পুরোনো আতরের গন্ধ। সৌদ রাজবংশ এতদিন ওয়াহাবী ধর্মমতের একক ধারক ও বাহক ছিল। ইদানীং ওয়াহাবী উত্তরাধিকারের এক কঠিন প্রতিদ্বন্দীর জন্ম হয়েছে- আল কাইদা।

    জেড্ডার অন্যতম সম্ভ্রান্ত পরিবার বিন লাদেন পরিবার। ২০০৪ সালের ৬ই ডিসেম্বর জেড্ডার আমেরিকান দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলায় পাঁচজন মারা যায়। বুশ সাহেবের প্রিয় রাজা রাজ্যশাসন করেন। ইরাকে গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ হয়। ইউ এস মেরিনেরা কম্পাউন্ডে কম্পাউন্ডে ঘাঁটি গেড়ে থাকে। মাঝে মাঝেই আল কাইদার সন্ত্রাসবাদীদের ধরপাকড় চলে। অস্থির যৌবনের একভাগ আমেরিকান ভোগের জন্য উৎসুক, আর এক ভাগ উলেমাদের সৌজন্যে জিহাদ লড়ার জন্য তৈরি হয়। জনৈক শিক্ষক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে স্কুলে পোস্টার লাগান। তার জন্য শিক্ষক ও ছাত্রদের এক অংশের কাছে তাকে একঘরে হতে হয়। একদল ছাত্র তার বিরুদ্ধে ইসলামের বিরোধিতার অভিযোগ আনে। শরিয়তী বিচারে শাস্তি হয় কারাদন্ড আর চাবুক। মানুষ কী ভাবে? প্রতিবাদ হয় কাগজে টি ভি তে। সম্প্রতি রাজার হস্তক্ষেপে শাস্তি মকুব হবার কথা। আরব দুনিয়ার সব থেকে বড় দেশ ঘিরে রয়েছে প্যালেস্টাইন, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, বাহরাইন, ওমান, কাতার। রক্তের অনেক রং, অনেক গন্ধ। আমরা একই তুলিতে সাদা কালোয় ছবি এঁকে যাই। কেউ কেউ ভাবি - "ওরা ওই রকম।' কেউ কেউ- "সবের গোড়া হতচ্ছাড়া আমেরিকা।' কিন্তু গল্পের ধরতাই পাই না। কাগজে জনৈক ধর্মপ্রাণ সৌদি চিঠি লেখেন- "পৃথিবী যেন মনে রাখে মুসলিমদের সবাই সন্ত্রাসবাদী নয়। ঠিক তারই সাথে সাথে আমাদেরও ভেবে দেখা দরকার দুর্ভাগ্যবশত আপাতত সন্ত্রাসবাদীদের অধিকাংশই মুসলিম'। মন্তব্য নিÖপ্রয়োজন।

    ১২ (Jan 17 2006)
    এ রকম হয়েই থাকে

    লোকটা বহুৎ ভয় খায়। পুরো শহরটাকেই কেমন বেজম্মা মনে হয়। গাঁয়ে সব কিছু কি সুন্দর সেট করা ছিল। সকালে মাঠে হাগতে যাওয়া থেকে রাতে মাল টানা পর্যন্ত। মুখিয়া আর পঞ্চায়েতের বুড়োরা জাত-জমি-মেয়েছেলের ছক ফিট করে রেখেছিল। দারোগারও ধক ছিল না যে সেই ছকের বাইরে যায়। যদিও লোকটা ছিল নীচুজাতের। যদিও লোকটাকে বহুৎ লাথিজুতো খেতে হত। কিন্তু কার সাথে পেয়ার মহব্বৎ হবে আর কোন গিদ্ধড় দেখলে ভাগাড় থেকে কাট মারতে হবে, সেই হিসেবটা ছিল পরিষ্কার। আর ছিল খাপরার চালাঘর, ঘরের পাশের শুকিয়ে যাওয়া তেঁতুলগাছ, বাপের হাতে ক্ষয়ে আসা কোদালের বাঁট, মুখিয়ার বাড়ির ক্ষেতে শ্যালোর ঘড়ঘড়ে শব্দ, সন্ধেবেলা এম্লেবাবুর ছেলের ভট্‌ভটি, কোথাও আখের রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে, চার ব্যাটারীর জওয়ানী দীওয়ানী টর্চ। শুধু ছিল না পয়সা। ইজ্জৎও ছিল না। আনশান কিছু করলেই গান্ডুর বাচ্ছারা পিছনে কাঠি করত।

    এই বেজম্মা শহরেও অনেকদিন হয়ে গেল। শহরের হালচাল অনেকদিন হল সমঝে নেওয়া গেছে। গলায় মাদুলি মোবাইল ফোন, টি ভির পর্দার মতো একটা জিনিষের পাশের গর্তে কার্ড ঢুকালে পয়সা বেরোয়, জুতোর মতো সান্ত্রো আর পোঁদমোটা সুইফ্‌ট্‌- সব চেনা হয়ে গেছে। ওয়াশিং মেশিন, কেব্‌ল্‌ টিভি, শপিং মল, ব্লাডার ভর্তি চন্‌মনে মাল, কুত্তার নাদি, ছুছুন্দর কে সর পে চামেলি কা তেল- সব কিছু।

    তবু বহুৎ ভয় লাগে।

    গিজ্‌গিজ্‌ করছে লোক। তাও শালা লোক দেখা যায় না। শুধু মনে হয় গোঁ গোঁ করে ধোঁয়াভর্তি বাস আর ট্রাক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কলের মিস্তিরির কাজ শেখার পর লোকটাকে কেউ আর চামার বলে না। কিন্তু কেউ তো কিছু বলেই না। এদিকে সারাদিন সবাই জোরে জোরে কথা বলছে। কাকে বলছে কেউ জানে না। কে শুনছে তাও কিন্তু কেউ জানে না। সকালে মোবাইল পায়খানায় হাগার জন্য মেয়েমরদে লড়ালড়ি। রাত্তিরে মেয়েমরদের গতরের জন্য চীৎকার, ছেঁড়াছেঁড়ি। পাশের কুঠুরির লোকটা তিনদিন মরে পড়েছিল। চোখগুলো পিঁপড়েতে খুবলে খেয়েছিল। রোজ সন্ধেবেলা লোকটা হনুমানচালিশা পড়ত। কে জানে গাঁয়ে কেউ খবর পেল কিনা।

    লোকটার বহুৎ ভয় করে।

    শালা বোঝাই যায় না আছি কি নেই। শুধু বই দেখতে গেলে আন্ধেরা হলের কিৎকিতে ভিড়ে, কাঠের সিটে, বিড়ির ধোঁয়ায় একটু "আছি আছি" মনে হয়। ঐখানেই যা একটু গান, যা একটু হাওয়া।

    কাল রাতে লোকটা হাওয়া খেতে ঘোড়ায় চড়েছিল। এক তুড়িতে রাস্তাঘাট থেকে গাড়িঘোড়া সরিয়ে দিল। তারপর রেন্ডিখানার ফুলকির খোলা পিঠের মত কালো চক্‌চকে রাস্তা। চারদিকে রংমশালের মতো বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং জ্বলছে। একা একা রাস্তার সাদা ঘোড়ার পিঠে ঐ কি চামার? লোকজন পুরো হাওয়া। শুধু মোড়ে মোড়ে সাদা সাদা ল্যাম্পপোস্ট ঠক্‌ঠক করে পায়চারি করছে। এক একটা ট্র্যাফিক সিগনাল পেরোচ্ছে আর পুজোর ঢাক বেজে উঠছে। রাস্তাটা যেখানে কালো আকাশে মিশে গিয়েছে, তার উপরের আকাশে শুকতারার মতো দব্‌দব্‌ করছে লাল আলো। ঐ লাল আলোর পিছনে ভগবান লুকিয়ে লুকিয়ে চামারের ঘোড়সওয়ারী দেখছেন। চামারের ঘোড়ার দুই নাক দিয়ে বেরুচ্ছে লাল আগুনের হল্‌কা। বিজ্ঞাপনের প্রায় ন্যাংটো মানুষীরা পসরা ফেলে চামারকে দেখতে ঝুঁকে পড়েছে। রাস্তার শেষপ্রান্তে কিন্তু জেগে উঠছে এক নিকষ কালো দেওয়াল। চামার যতই এগোয়, দেওয়াল ততই বাড়ে। শেষে উপরে তাকিয়ে আর
    ঠাহর হয় না দেওয়ালের শেষ কোথায়। সেই দেওয়ালের এক ছোট্টো ঘুলঘুলি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক চিলতে আলো। চামারের সাদা ঘোড়া ছুটতে থাকে সেই আলোর চিলতের দিকে। কিন্তু পাঁচিলের ধারেকাছে পৌঁছোবার আগেই পাঁচিলের অন্ধকার এগিয়ে আসে চামার আর তার ঘোড়ার দিকে। তারপর সব অন্ধকার।

    এরপর চামার, বা লোকটাকে দেখা যাবে শক্তি মহামন্ডলে। সে এখন শক্তি মহামন্ডলে বেশ মাতব্বর। মন্ডলের রাজ্জুভাইয়া মাঝে মাঝেই বস্তিতে আসত। নির্লোম মুখ, কপালে লাল তিলক, গেরুয়া পাঞ্জাবি, সারাক্ষণ হাতে নড়াচড়া করছে কালো মোবাইল। বস্তির লোকেদের অসুখেবিসুখে, শাদিতে তেওহারে সবসময় হাজির। একটা বাল বিদ্যাভবনও খোলা হয়েছে। সেইখানে প্রায়ই গুরুমহারাজ আসেন। মাঝে মাঝে অখন্ড মহাযজ্ঞে হালুয়া পুরী চড়ানো হয়। রাজ্জুভাইয়ার কথাবার্তায় লোকটা বুঝেছে ভয়টা ওর নাদান নয়। খতরনাক জানোয়ারেরা এখানে সেখানে ওঁত পেতে আঅছে। তাই ছায়ার মতো রাজ্জুভাইয়ার পিছনে ঘুরে বেড়ায়। শরীরটাও ভালো যায় না। প্রতি রাত্তিরে ঘুমের মধ্যেই হড়্‌হড় বমি। বিছানাচাদর, কাপড়চোপড় ভিজে যায়। বমির পর শরীরটা বেশ হালকা লাগে। এটাও নেশার মতো হয়ে যাচ্ছে। রাত্তিরবেলা এই গা মোচড়ানো পেট গুলিয়ে গলায় ঠেলা মারা ব্যাপরটা না হলে মনতা কেমন ছট্‌ফট্‌ করতে থাকে। লাল তিলক, রাজ্জুভাইয়া, বস্তির পিলেভরা ছেলেদের বালবিদ্যাভবন, রাত্তিরে বমি- এই সব নিয়ে লোকটার ভিতরে একটা আবছা ধরনের "আছি আছি" ভাব আসছে।

    অত:পর যাহা হইয়াছিল তাহা অতীব সুষম এবং স্বাভাবিক। একটি কুখ্যাত রাজপথে ধর্মীয় শোভাযাত্রা এবং তজ্জনিত আইনী গোলযোগের দরুন দুইটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘোরতর কোন্দল এবং প্রায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। মহাশক্তিশালী সর্বগুণসম্পন্ন পূর্বপুরুষাদিগণের উত্তরাধিকাররক্ষার নিমিত্ত দুই পক্ষের সেনাপতিগণ ভল্লতরবারিবন্দুকসহিত মহল্লার প্রতিকোণে আপনাপন সৈন্যদল লইয়া উপস্থিত হন। আমাদিগের আলোচ্য ব্যক্তি অর্থাৎ তিনিও একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর নেতা নির্বাচিত হইয়াছেন। সেই করালবদনা রাত্রিতে অদূরস্থিত মহাহত্যার আশঙ্কায় চন্দ্রও নির্বাপিতপ্রায়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুড়ঙ্গসদৃশ গলিপথে পথচারী সারমেয়ধ্বনিও সুদুর্লভ। অবোধ শিশুগণও আপনাপন শয্যাপরে শঙ্কিতচিত্তে অনিদ্র রাত্রি যাপন করিতেছে। হেনকালে সুড়ঙ্গের একপ্রান্তে একটি মনুষ্যমূর্তির কিঞ্চিৎ চলনের আভাস মিলিয়াছিল। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই ছায়ামূর্তির পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। ইহা ছিল তাঁহার অনুল্লেখ্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মূহুর্তের সন্ধান। অতএব কোনো মনুষ্য বা মনুষ্যেতর জীবেরও উহাকে অতিক্রম করিবার সাধ্য ছিল না। বৃদ্ধা হইলে তো কথাই নাই। অতি সুনিপুণভাবে তিনি তাঁহার রামপুরিয়া মনুষ্যটির উদরে বিদ্ধ করিলেন। কাহারও উদর বিদ্ধ করিবার পর অস্ত্রের ফলাখানি ঘুরাইয়া দিতে হয়। তাহা হইলে উদরস্থ অন্ত্রাদিসমূহ পাক খাইয়া যায়। এতদ্বিধ কার্যাদি সম্পন্ন করিবার সময় তাঁহার মুখমন্ডলে অনেকখানি রক্ত ছিটকাইয়া আসিল। রক্তের উষ্ণ বনজ গন্ধে তাঁহার অস্তিত্ব পুনরায় সুসম্পূর্ণ অস্তিত্বরূপ ধারণ করিল। আশীর্ষ মূলাধারাবধি স্পন্দনের অবকাশে অবিরাম নি:সৃত প্রাণশক্তি অখন্ড সচ্চিদানন্দভাবে মিলিত হইল। মেঘাবৃত ঘোর রাত্রিতে দিকেদিগন্তরে মহাশক্তির আরধনায় ডমরুধ্বনি নিনাদিত হইল। শিবাগণের উল্লাসধ্বনিতে প্রকম্পিত মেদিনীতলে একটি তুচ্ছ বিধর্মী মনুষ্যদেহ পড়িয়া রহিল যাহাকে মনুষ্যাভিধানুসারে বৃদ্ধা বলা হইয়া থাকে। তিনি অতীব কোমল মাংসের নেশাতুর স্বাদ পাইয়া উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে ব্যস্ত হইলেন। এবং দীর্ঘ অবকাশের পর আপনার হৃৎকমলের দূরাগত ধ্বনি শুনিতে পাইলেন।

    ১৩ (Jan 31 2006)
    মানে?

    নান্দীমুখ

    "মানে?' এই প্রশ্নটা আমাকে আপনাকে হরবখত শুনতে হয়। প্রশ্নটার নিজের "মানে'ও দুইরকম। এক, আপনি যা বলছেন তার বিবিধ ব্যাখ্যা সম্ভব। কাজেই আপনি যা বলছেন তার হুবহু ব্যাখ্যা কি? দুই, আপনি যা বলছেন তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়। অতএব আপনার শব্দমালা নিরর্থক। কোনো প্রোজেক্ট মিটিঙে বা কোনো ক্লাস লেকচারে আপনাকে যদি কেউ এই প্রশ্ন করে তাহলে আপনি হয়তো খুশিই হবেন। কারণ আপনার এবং আপনার শ্রোতাদের মধ্যে ভাব ও তথ্য দেওয়া নেওয়ার একটা সাঁকো তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ শ্রোতারা আপনার বক্তব্য এবং তার অন্তর্নিহিত যুক্তির সম্পূর্ণ কাঠামো ঠিকঠাক বুঝে নিতে চাইছেন। প্রোজেক্ট মিটিং বা ক্লাস লেকচারে এই বোঝাপড়া, এই লেনদেনের সরাসরি ব্যাপারটা খুব জরুরি। ধোঁয়াশা বা হেঁয়ালি একেবারেই কাম্য নয়। কিন্তু এই "মানে'র জেরে যখন সাহিত্যকে জেরবার হতে হয়, যখন লেখকের পাঞ্জাবির খুঁট ধরে পাঠক অবোধ শিশুর মতো "মানে?' বলে ঝুলে পড়ে, তখন মনে হয় পাঠকের এইবার ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে।

    ভণিতা

    অথচ "মানে?' অর্থাৎ অর্থ খুঁজে নেবার প্রয়াস বা জিজ্ঞাসার ইতিহাস প্রবলভাবে গৌরবান্বিত। মানুষের ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র এবং ধর্ম জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। তার কিয়দংশ সাধারণের নাগালে এলেও তার সত্যাসত্য যাচাইয়ের অধিকার ছিল না। কারণ রাজা এবং পুরোহিতই ছিলেন শেষ সত্য। এই কাঠামো ভেঙে পড়তে লাগল যখন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করতে শিখল, যখন মানুষ প্রতিটি উপপাদ্যের প্রমাণ দাবি করল, প্রত্যেক বাক্যের "মানে" জানতে চাইল। স্বত:সিদ্ধ বলে আর কিছুই রইল না। যুক্তি-তক্কো-গপ্পের একটা সুনির্দিষ্ট কাঠামোয় "মানে' বুঝে নেওয়ার এই আন্দোলন ছিল নবজাগরিত ইউরোপীয় সভ্যতার শিরদাঁড়া।

    এই শিরদাঁড়ার জোরেই ইংরেজদের শিক্ষার ভিত তৈরি হয়েছিল। যার উপযুক্ত পরিণতি ছিল শিল্পবিপ্লব এবং শিল্পবিপ্লবের অনুবর্তী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাপট। তাঁরা নিজেদের গরজে আমাদেরও তার ছিঁটেফোঁটা দিয়েছিলেন, কিন্তু নিতান্ত চোলাই করা অবস্থায়। তারই মধ্যে কিছু ক্ষণজন্মা সেই চোলাইয়েরই রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে মননের বনিয়াদ পাকা করলেন। কিন্তু গড়পড়তা মানুষের কাছে শিক্ষিত হবার মূল পাথেয় হয়ে উঠল মুখস্থবিদ্যা। শিক্ষার প্রসার হল, চাহিদা বাড়ল। কিন্তু গুণগত মানের কোনো আকাশপাতাল তফাত হল না। যদিও পরীক্ষা পাশের জন্য শুধু মুখস্থ নয়, "অর্থ বিশ্লেষণও' শিখতে হয়। তার জন্য তৈরি হল "মানে' শেখাবার পরিকাঠামো। অর্থাৎ "মানে' বুঝতে ভাবতে শেখার দরকার নেই। "মানে'ও মুখস্থ করিয়ে দেওয়া যায়। প্রাথমিক স্তর থেকে গবেষণা স্তর পর্যন্ত মানেবইয়ের রম্‌রম্‌ করে চলা কুটিরশিল্প। শ্রদ্ধেয় হীরেন মুখুজ্যে মশাইয়ের আত্মজীবনী "তরী থেকে তীরের' কথা মনে পড়ে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের কোনও একটি বিশেষ অধ্যায়ের উপর রচনা লিখে আনতে হবে। সম্পূর্ণ নিজের চিন্তাভাবনা যা`রা লিখলেন তাঁরা পেলেন সর্বোচ্চ নম্বর। যাঁদের লেখা অজস্র রেফারেন্স, অজস্র কোটেশনে কণ্টকিত, তারা পেলেন সব থেকে কম, লাইব্রেরিতে যতই মাথার ঘাম পায় ফেলুন না কেন! প্রতিপাদ্য হল, ভুল হোক বা ঠিক হোক, ভাবতে শেখা দরকার। আমাদের ব্যাপারস্যাপার একটু উলটোগোছের। সাধে কি সেই পরিচালকমশায় ভাবা প্র্যাকটিস করতে বলেন!

    পাঠাগার

    এতসব ধানাই পানাই করা হল কারণ, আমরা যখন সাহিত্যের পাঠক, আমাদের শিক্ষার ঐতিহ্য অনুসারে আমরা তখনও চিন্তায় অলস, আমাদের মস্তিষ্ক মেদবহুল ও স্থবির। আমাদের আশা, প্রত্যেক গল্প-কবিতা-উপন্যাসের একটি সুনির্দিষ্ট "মানে' থাকবে। সাহিত্যের ভাষা এতটাই সহজ হবে যে গড়গড় করে পড়ে গেলে একবারেই লেখার "মানে' বুঝে নেওয়া যাবে। লেখাপত্তর পড়ে রান্নাঘরের আলমারির তাকে আলাদা আলাদা প্লাস্টিকের কৌটোতে সাজিয়ে রাখা যাবে- এটা গল্প, এটা কবিতা, এটা উপন্যাস, এটা ইয়ে, এটা ইসে। আর যখনই বুঝতে পারব না "এটা কি' বা "এটা কেন', সঙ্গে সঙ্গে লেখকের পাঞ্জাবির খুঁট ধরে ঝুলে পড়ব- "মানে'টা কি দাদা?

    যদিও প্রায় ক্লিশে, তবুও আবার বলি যে লেখা ছেপে যখন পাঠকের কাছে পৌঁছায়, তখন সেই লেখা পাঠকেরই সন্তান। কোনও লেখা বোঝা বা না বোঝা পাঠকেরই দায়িত্ব। কিংবা কোনও লেখার অর্থ নির্ণয়ের দায়ভারও পাঠকের। আপনি পাঠক হিসেবে কোনও লেখা বুঝলেন কি বুঝলেন না বা সেই লেখার কি পাঠোদ্ধার করলেন- তাতে যিনি লিখছেন তাঁর কিছু এসে যায় না। এসে গেলেও করার কিছু থাকে না। যদিও লেখা ছাপার পরে লেখক পুরস্কার পান, বক্তৃতা দেন, নিজের লেখার মানে নিয়ে মিডিয়াকে ইন্টারভিউ দেন বা প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু একক পাঠক হিসেবে আপনি লেখাটা যেভাবে বুঝেছেন সেটাই আপনার কাছে ঠিক। তা পরে লেখক যাই বলুন না কেন। কাজেই একক পাঠক হিসেবে আপনার দায়িত্বও অন্যরকম। যদি বুঝতেই না পারলেন, লেখকের দরবারে আর্জি না জানিয়ে নিজেই আর একটু আন্তরিক শ্রম ঢালুন না কেন। একটু ভাবুন। একটু দেখুন। একটু শিখুন। তার পরেও নাই বুঝতে পারেন। হয়তো অন্য কোনও অলীক সময়ে হঠাৎ করে কোনও একটা "মানে' আপনার সামনে দেখা দেবে। কিংবা এও হতে পারে যে লেখক আপনাকে পাঠক হিসেবেই চান না। আপনি লেখকের প্রার্থিত পাঠকশ্রেণীর মধ্যেই পড়েন না।

    উম্বার্তো ইকো একজন ব্যাপক হারে না-বোঝা লেখক। না-বোঝা ভাষার বোঝার জন্য নয়। না-বোঝা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে উল্লম্ফনের জন্য। প্রতি উপন্যাসে অন্তত শ খানেক গুরুগম্ভীর বিষয়ের রেফারেন্স, যা অনেক ক্ষেত্রে আপাতভবে সম্পর্করহিত, পাঠককে হতচকিত করে। "ফুকোর পেন্ডুলাম" বইটিতে এই ভার চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছেছে। কিন্তু আপনি যদি কষ্ট করে প্রথম বিশ পাতা পড়ে ফেলতে পারেন, তাহলে দেখবেন যে লেখক আস্তে আস্তে আপনার মাথার উপর থেকে ভার সরিয়ে নিচ্ছেন। ইকো সাক্ষাৎকারে বলছেন যে বইটির প্রারম্ভিক জটিলতা সুচিন্তিত এবং পরিকল্পিত। কারণ তিনি অলস পাঠক চান না। যে পাঠক সচেষ্ট হয়ে প্রথম পাঁচিলগুলো ডিঙোবে, তাকেই তিনি নিজের অন্দরমহলে বসতে দেবেন। কাজেই পাঠক হিসেবে আপনি যদি ভাবেন "মানে' শুদ্ধু সবকিছু ফ্রিতে পাওয়া যাবে, তাহলে ভুল করছেন।

    আপনাকেও শিখতে হবে। "পড়তে' শিখতে হবে। ভাবা শিখতে হবে। শোনা শিখতে হবে। শিখতে হবে যে প্রতিটি শব্দ বহুমাত্রিক। প্রত্যেক শব্দ সাদামাটা অর্থ ছাড়াও পৃথক পৃথক ধ্বনি বহন করে। তাদের আলাদা আলাদা সামাজিক মাত্রা আছে। শিখতে হবে "ফুল' কখন "কুসুম' হয়ে ফোটে, কখন "ঘোড়া' "অশ্ব' হয়ে ওঠে। কেন সাধু থেকে চলিত থেকে রক-খিস্তি ঘুরে আবার সাধুতে ফিরতে হয়? রেফারেন্স যদি নাই বুঝতে পারেন, একটু গুগলি করুন না কেন? হাতের কাছেই তো রয়েছে! যাদি না শিখতে চান, তাহলে আপনি অন্তত সারা জীবন তিলমাত্র আক্ষেপ বহন করে বেড়াবেন যে কিছু কথা আপনার বোঝার গণ্ডির বাইরে থেকে গেল, কিছু কথা আপনাকে বাজাতে পারল না। তাতে যদিও দিনের শেষে আপনারও বয়ে গেল, আর লেখকেরও বয়েই গেল। লেখক আবার নিজের মতো করে লিখবেন। আর আপনিও পড়বেন আপনার মনের মতো মানেবদ্ধ ঘর ঘর কি কহানি।

    শয়নকক্ষ

    তাহলে কি লেখক স্বয়ম্ভূ ভোলেবাবা? যার কোনও দায়দায়িত্ব নেই? মনে করিয়ে দিই, এখানে সামাজিক বা রাজনৈতিক দায়দায়িত্বের কথা বলছি না। বলছি লেখক এবং পাঠকের মধ্যের সংযোগের দায়দায়িত্বের কথা। এই ব্যাপারে একটা কথা খুব চালু আছে, লেখককে নিজের লেখার প্রতি সৎ থাকতে হবে। এই সততা-টততা খুব গালভরা শব্দ, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেকি বিশেষণ। কাজেই এই বুঝভুম্বুল শব্দ ছেড়ে সরলভাবে বলতে গেলে, লেখক শেষ পর্যন্ত কাউকে কিছু বলতে চান। একটা সংযোগের সেতু বাঁধতে চান। অ্যাড এজেন্সির কপিরাইটার থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গায়ক- সবারই এই একই মাথাব্যথা। এই সেতুর কাজ শুরু করার আগে সবারই একটা টার্গেট অডিয়েন্স থাকে। লেখকেরও ঠিক সেইরকম একজন প্রার্থিত ভার্চুয়াল পাঠক থাকেন- সচেতনে বা অচেতনে।  সেই পাঠক তিনি নিজেও হতে পারেন। বা সমমনস্ক পাঠকমণ্ডলীও হতে পারে। অথবা যাঁরা বাজারের ঘাঁতঘোঁত বুঝে ঝানু হয়ে গেছেন, তারা অনায়াসে একটা গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক বেছে নেনে। এবার তাদের কাছে পৌঁছোবার পালা। কিছু একটা বলবার পালা। লেখক যখন লিখছেন, তখন তিনি মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে সেই সেতু বাঁধবার কাজ করবেন। যদি সেইটুকু না করতে পারেন, যদি নিজের পুরোনো লেখাই বদলে বা না বদলে বারংবার চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। যদি চিন্তারহিতভাবে নিজের জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে থোড় বড়ি খারা চালিয়ে যান, তিনি দায়িত্বজ্ঞানহীন। যদি নিজের গড়া আদল ভেঙেচুরে পাঠককে নতুন করে পাবেন বলে ক্ষণে ক্ষণে হারানোর স্পর্ধা না দেখান, তিনি মৃতপ্রায়। লেখা লেখকের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রক্রিয়া। কাজেই লেখকের দায়িত্ব এই প্রক্রিয়ার সশ্রম এবং সযত্ন নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু লেখা যেই ছেপে বেরোল, এবং পড়ার প্রক্রিয়া শুরু হল, তখন সেই প্রক্রিয়ার ভার পাঠকের এবং শুধুমাত্র পাঠকের। যদি লেখক আপনাকে "মানে' বলে দেন, তা আপনার উপরি পাওনা। কিন্তু লেখক বলছেন মানেই যে সেই "মানে'টাই একমাত্র সত্যি তা মোটেও নয়। আপনার যদি মনে হয় লেখক ফাঁকিবাজি করছেন, আপনাকে ধাপ্পা দিচ্ছেন, আপনার সঙ্গে তঞ্চকতা করছেন, জোরসে লাথি মারুন। লেখকের সঙ্গে কথা বলুন। সেতু বাঁধার চেষ্টা আপনিও শুরু করুন। কিন্তু আপনাকেও খাটতে হবে। বিনিপয়সায় দুপুরের ভোজ মেলে না।

    উপসংহার

    একটা সহজ কিছু লেখার চেষ্টা করা গেল, যদিও তা ক্লিশে। কিন্তু ছেপে বেরোবার পর আপনি "মানে' বুঝবেন কিনা, বা কি "মানে' করবেন, তা আপনিই জানেন। আপনার হল শুরু। আমার হল সারা।

    পুনশ্চ

    এই লেখায় লেখক অর্থে লেখক-লেখিকা, পাঠক অর্থে পাঠক-পাঠিকা, গায়ক অর্থে গায়ক-গায়িকা ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশির ভাগ সময়ে পোলিটিকাল কারেক্টনেসের উপরে কুঁড়েমিই জয়ী হয় কিনা!

    ১৪ (Mar 3 2006)
    ইস্তানবুলের ডায়েরি - ১

    হোটেলের পাশের উঁচু বাড়িটার ছাদে রাত হলেই শুরু হয় একঝাঁক শঙ্খচিলের চিৎকার। শঙ্খচিলেরা যে প্রায় হাঁসের মতো ক্যাঁ ক্যাঁ করে কেই বা জানত? হেমাঙ্গ বিশ্বাস জানতেন? পাশের ঘরে উঁচু আওয়াজে তুর্কিভাষার টি ভি চ্যানেল চলছে। ছাদের উপরের বারে দৈনন্দিন হৈহল্লা। তুর্কিদের জাতীয় পানীয় রাকে ("এ'-র উচ্চারণ অর্ধেক)। তীব্র মৌরিগন্ধী আরক। জলের মতো। তার মধ্যে জল ঢাললে ফেনিয়ে উঠে সব সাদা হয়ে যায়। মেটিন ওর্নেক বলেছে গালাটা ব্রিজের তলায় বসফরাসের ধারে বসে মাছের স্যান্ডুইচের সঙ্গে রাকে খেতে হয়।

    মেটিন ওর্নেক। পুরো নাম হামিত মেটিন ওর্নেক। ছ ফুটিয়া ঢ্যাঙা তুর্কি যুবক। সফল পেশাদার। ধর্মে মুসলমান। কথা হচ্ছিল মহম্মদের ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে। মেটিনের মতে একটা ফালতু ছবি নিয়ে এত হইচই করার কোনও মানে হয় না। যার আঁকার কথা সে এঁকেছে। তুমি যদি দেখেই থাকো ভুলে যাও। মেটিনকে সৌদি আরবের গল্প শোনাই। মেটিন আঁতকে ওঠে। ওর প্রিয় শহর ফ্লোরেন্স আর প্যারিস।  ওর একমাত্র আলোচ্য বিষয় বিভিন্ন দেশের নারী। ফ্রান্সের মেয়েরা নাকি আসলে "মা'। "নারী' দেখতে হলে যাও ইটালি। তুরস্কের মেয়েরা বিয়ের আগে "নারী' আর বিয়ের পরে "মা'। মেটিন প্রায় প্রতিজ্ঞা করে ফেলল যে কখনই সৌদি আরবে যাবে নয়।

    মেটিন, কুর্দদের ব্যাপারটা কী? আমাদের "কাশ্মীর" ব্যাপারটার মতই মেটিনের কুর্দদের ব্যাপার। রাষ্ট্রের কাছে তো সবাই সমান। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ঐ ব্যাটারাই খালি আলাদা হওয়ার নাম করছে।  এইসব নিয়ে চ্যাঁচামেচি করে বেশ নাম করেছেন ওরহান পামুক। শোনা যাচ্ছে তিনিই হবেন তুরস্কের প্রথম নোবেলজয়ী লেখক। ইন্দ্রাণীর কথায় জানলাম সুনীলবাবুও দেশে ওরহান পামুক নিয়ে লেখালেখি করেছেন। পুরোনো বইয়ের বাজারে ওরহান পামুকের বিখ্যাত বই "কারা কিতাপের" ইংরিজি সংস্করণ পাওয়া গেল। দাম ইউরোতে, খুব চড়া। বাজারে দোকানে বই মানেই তুর্কি ভাষার বই। হোমার থেকে ব্রেখ্‌ট্‌- সবই তুর্কি। ইংরিজি বই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইংরিজিতে দীর্ঘ বাক্যালাপ করার লোক পাওয়াও কঠিন। তবে বসফরাস থাকতে আলাপের অভাব কীসের?

    বসফরাসের তিন কূলে সন্ধে আসব আসব করছে। নদীটা তিনভাগে শহরটাকে ভাগ করেছে। একদিকে এশিয়ার ইস্তানবুল। অন্যদিকে ইউরোপের নতুন ইস্তানবুল। উলটোদিকে ইউরোপেরই পুরোনো ইস্তানবুল। বাইজেন্টিয়াম, পরে কনস্টান্টিনোপলের উৎপত্তি এইদিক থেকেই। তারও আগে গ্রিসের লোকজন এশিয়ার দিকে ঘর বেঁধেছিল। গালাটা ব্রিজের পাশে একের পর এক ব্যস্ত জেটি- উসুকুদার, কর্টিকয়, কাডিকয়- এই সব জায়গায় যাবে। ফেরির লঞ্চগুলো প্রায় জাহাজী আয়তনের। ঝাঁকে ঝাঁকে শঙ্খচিল দিনের শেষ উড়ান উড়ছে। নদীর ধারের ছোট ছোট দোকান। নদীর পাড়ে নৌকোর মধ্যেও একটা দোকান। বসফরাস থেকে মাছ তুলে ভাজা হচ্ছে। মাছভাজা, টোম্যাটো আর পিঁয়াজ রুটির মধ্যে পুরে। নদীর পাশের চত্বরে ছোট ছোট বসার টুল। সামনের ছোট টেবিলে লেবুর রসের শিশি আর নুনদানি। এই সন্ধেতে খদ্দের জমেছে ভালই। গালাটা ব্রিজের মুখেই ইয়েনি চামি। চামি মানে মসজিদ। ইয়েনি চামি মানে নতুন মসজিদ। নতুন মসজিদ তৈরি হয়েছিল যদিও ষোড়শ শতাব্দীতে। বাঁপাশে টোপকাপি প্রাসাদের আলো জ্বলে উঠছে। ডানপাশে উঁচু পাহাড়ের মাথায় সুলেমানিয়ে চামি। ইস্তানবুলের বৃহত্তম মসজিদ। উলটোদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গালাটা টাওয়ার। ইয়েনির চামির পিছনেই ইস্তানবুলের বিখ্যাত মশলার বাজার। রাখা আছে শতরকমের মশলা। একটারও নাম জানি না। একটা মশলাও চিনি না। আরও দেখছি পোষা জন্তুজানোয়ারের দোকানের ভিড়। দুটো ময়ূর খাঁচায় বন্দী। ইস্তানবুলের শিরশিরে ঠান্ডা বৃষ্টিতে পাখা মেলবে কী করে?

    গালাটা ব্রিজের উপর দিয়ে ঢংঢঙিয়ে ট্রাম চলেছে। ট্রামের রাস্তার পাশে রেলওয়ে স্টেশন। এই স্টেশন থেকেই সেই ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ছাড়ত। এখনও কি ছাড়ে? মেটিনকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। সাত পাহাড়ের শহর ইস্তানবুল। পাহাড়ের মাথায় মাথায় অটোমান আমলের চামি। সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হতে না হতেই পাহাড়ে পাহাড়ে আলো জ্বলে উঠেছে। অনেক দূরে হাজার আলো জ্বালানো একটা ক্রুইজার মর্মর সাগরের দিকে ভেসে চলছে। নদীর পাশের কাঁচা মাছের বাজারে হই হই, ট্যাক্সিওয়ালাদের ঠেক। উঁচু রাস্তা চলে গেছে গালাটা টাওয়ারের দিকে। ওই রাস্তার ডানকোণে ইস্তানবুলের সরকারি বেশ্যাখানা। তুরস্কে বেশ্যাবৃত্তি বৈধ এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত পাবলিক সেক্টর। গলির মুখে পুলিশ পাহারাদার দাঁড়িয়ে থাকে। সেই গলিতে শিশু এবং নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সন্ধে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘোর ট্রাফিক জ্যাম। ইস্তানবুলের ট্র্যাফিক জ্যাম অতুলনীয়। যে কোনও পাঁচ মিনিটের রাস্তা পেরোতে আধ ঘন্টা লাগে। হোটেলে ফিরব।

    ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজে থেকেই পৌঁছে দিতে চায়। অতি অমায়িক ড্রাইভার। ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বাক্যালাপের চেষ্টা করে। সিগারেট ধরায়। তুর্কিরা ঘোর ধূম্রপায়ী জাত। কোথাও তোমার ধূম্রপানের নেই মানা! সাধে কি এদের ই ইউতে নিতে চাইছে না। ট্যাক্সি চলে ঢিকির ঢিকির। পাশে বয় বসফরাস। মিমার সিনান বিশ্ববিদ্যালয়, নুসরাতিয়ে চামি, কেমাল পাশা চামি। হঠাৎ ঘোর ভাঙে ট্যাক্সিওয়ালার ডাকে। হোটেল থেকে বেশ একটু দূরে ট্যাক্সি থামিয়েছে। মিটারে দেখি স্বাভাবিকের ডবল ভাড়া। জিজ্ঞাসা করতেই ট্যাক্সিওয়ালার রুদ্ররূপ। কথা না  বাড়িয়ে দুটো নোট দিই হাতে। নিমেষে একটা নোট ভোজবাজির মতো উবে যায়। মাথা চাপড়ে চাপড়ে এতক্ষণের বন্ধু বোঝায় আমি একটা নোট দিয়ে কম পয়সা দিয়ে ফাঁকি মারার চেষ্টা করছি। আরও কিছু টাকা গচ্চা যায়। গজ্‌গজ্‌ করতে করতে ট্যাক্সিওয়ালা চলে যায়। কিছুদূর গিয়ে নিশ্চয় হো হো করে হাসবে।

    হাসুক গে। আমি ঘরে গিয়ে এখন এন রাজমের বেহালায় "ঠুমক চলত রামচন্দ্র" শুনব। ইস্তানবুলের সন্ধের ঠান্ডায় কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। হোটেলের ঘরের জানলা খুলে দিই। পাশের ছাদে আবার রাতের শঙ্খচিলগুলো এসে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। তবে বেহালা বাজলেই কেন জানি উড়ে চলে যায়। ওরা হয় তো সুলতান ইব্রাহিমের পোষা। সুলতান ইব্রাহিম তোপকাপি প্রাসাদের খাঁচায় টানা চার বছর বন্ধ থেকে থেকে পাগল হয়ে গেছে। এবার এন রাজম চালিয়ে দিই।

    ১৫ (Mar 16 2006)
    ইস্তানবুলের ডায়েরি- ২

    টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। পনেরো তলার বন্ধ জানলায় সাঁই সাঁই হাওয়ার প্রবল ধাক্কা।

    ইস্তানবুল এক বিশালতা। সচল বিশালতা। মুখের সামনে যেন কেউ  এক তলা উঁচু কেক রেখে দিয়েছে। কেকের প্রতি অংশের স্বাদ-রং-গন্ধ-স্পর্শ আলাদা। তাও পালটাচ্ছে। ক্রমাগত। অথচ এক ঘন্টার মধ্যে খাওয়া শেষ করতে হবে। সম্ভব? কাজেই ইচ্ছের খোলা হাওয়ায় খাবলে খুবলে খাই। শুধু কেকের উপর লাল টুক্‌টুকে চেরিগুলোকে একটু সময় দিতেই হয়। এইরকমই এক অগ্রগণ্য চেরি আয়া সোফিয়া। ল্যাটিনে Sancta Sophia  আর গ্রিকে Haghia Sofia ।

    ৩৬০ খ্রিস্টাব্দ। সম্রাট কনস্টান্টিনিয়াস এক কাঠের ব্যাসিলিকা তৈরি করলেন। রায়টের আগুনে ধ্বংস হল। আবার ৪১৫ খৃস্টাব্দে সম্রাট দ্বিতীয় থিয়োডোসিয়াস তৈরি করলেন। নিকা রায়টের সময় তাও পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এখনকার কাঠামো তৈরি হল সম্রাট জাস্টিনিয়ানের হাতে। কনস্টাটিনোপলের পতনের আগে অবধি আয়া সোফিয়া ছিল খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যের মহত্তম সৌধ। ১৪৫৩ সালে সম্রাট মেহমেত দখল করলেন কনস্টান্টিনোপল। সঙ্গে সঙ্গে গির্জা হল মসজিদ। দুই ধর্মসম্প্রদায়ের কাছেই আয়া সোফিয়ার মাহাত্ম্য অসীম। ১৯৩৪ সালে কামাল আতাতুর্কের আদেশে আয়া সোফিয়া  রূপান্তরিত হল মিউজিয়ামে।

    দেশের কথা কেন যে মনে পড়ে?

    ইস্তানবুল সাত পাহাড়ের দেশ। পাহাড়ের মাথায় মাথায় অটোমান স্থাপত্যের মসজিদ। উপরের গম্বুজ নিখুঁত অর্ধগোলক। চারপাশ থেকে সরু পেনসিলের মতো খোঁচা খোঁচা মিনার আকাশের গায়ে লেপ্টে আছে। সেই তুলনায় আয়া সোফিয়ার বাইরের গড়ন একটু খাপছাড়া। বোঝা যায় হাতের পর হাত পড়েছে। ঠিক এর উল্টোদিকেই প্রকান্ড সুলতান আহমেত চামি বা নীল মসজিদ। অনেক সুঠাম। আয়া সোফিয়ার আসল খেল দরজা পেরোবার পর।

    এখনও বৃষ্টি পড়ছে। টিকিট কাউন্টারের সামনে গাঁও থেকে আসা তুর্কিদের ভিড়। উঁচু গলার কথাবার্তা। দশ লিরার টিকিট।

    আস্তে আস্তে এগোই। বিরাট অলিন্দের অন্ধকার মেঝেতে রঙিন কাচের জানলার ঝিলিমিলি। এর পরের বারান্দায় ঢুকতেই আস্তে আস্তে একের পর এক গম্বুজ খুলে যেতে থাকে। চোখের সামনে দূরে আবছায়া অনন্ত সেই মাতৃমূর্তি। মূল রাজকীয় দরজায় দাঁড়ালে বিশাল মূল গম্বুজ ছেয়ে ফেলে। নির্ভার বিশালতা। কোনো থাম ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ। নি:শব্দ টুরিস্টদের ভিড়। একপাশে কান্নার স্তম্ভ। প্রবাদ স্তম্ভের গায়ের ফুটোতে আঙুল ঢুকিয়ে প্রার্থনা করলে ইচ্ছেপূরণ হয়। তার পাশে এক মানুষ সমান শ্বেতপাথরের জালা। সোজা এগিয়ে এলে পরবর্তী ইসলামীয় সংযোজন প্রার্থনার মিহরাব, আড়ালে ঢাকা রাজকীয় প্যাভিলিয়ন। উপর থেকে ঝুলে আছে গোলাকৃতি চামড়ায় আঁকা তুর্কি ক্যলিগ্রাফিতে আল্লা আর খলিফার নাম- মুস্তাফা ইজ্জেত এফেন্দির আঁকা। আলাদাভাবে অসাধারণ, কিন্তু আয়া সোফিয়ার অলৌকিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে। সোনারঙের মোজেইকে করা ফ্রেস্কোতে একসময় আয়া সোফিয়ার দেওয়াল ভরা ছিল। এখন তার কিছু অবশিষ্ট। পাথুরে ঢালু রাস্তা বেয়ে উপরের গ্যালারিতে গেলে ছবিরা একদম চোখের সামনে। ক্লাস সেভেনের ইতিহাস বইয়ের পাতাগুলো মনে পড়ে? একসময় খ্রিস্টীয় জগতে প্রবল তর্কাতর্কি হয়। এইসব ছবি থাকা উচিত কি উচিত নয়। তার ফলে যে আভ্যন্তরীণ ধর্মযুদ্ধ তাতে বহু ফ্রেস্কো নষ্ট হয়। এর পরে ইসলাম আধিপত্য এলে আর এক প্রস্থ ধ্বংসের পালা। কিন্তু আমাদের  তুমুল সৌভাগ্য যে অটোমান সম্রাটেরা ফ্রেস্কোগুলো খুঁচিয়ে নষ্ট না করে চুনামাটি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। ফ্ল্যাশের আলো ব্যবহার বারণ। তাও অত্যুৎসাহীরা। কেন যে করে? উত্তরপুরুষের জন্য কিছু থাকবে না। সেই ভাবনাচিন্তা নেই বোধ হয়। এই সুপ্রাচীন নৈ:শব্দ্যে নাস্তিকেরও ক্ষণস্থায়ী ঈশ্বরবোধ হয়। অথচ বেশির ভাগ মন্দিরে কেন যে?

    আয়া সোফিয়া থেকে যখন বেরিয়ে আসি ইস্তানবুলের আকাশে রোদ ঝল্‌মল্‌ করছে। উল্টোদিকে ইস্তানবুলের বৃহত্তম মসজিদ- নীল মসজিদ। লন্ডনের যেমন রেনসাহেব ছিলেন স্থপতিদের রাজা, ইস্তানবুলের তেমনি মিমার সিনান। তো প্রথম থেকেই সিনানের চেষ্টা কী করে আয়া সোফিয়ার মতো থামহীন বিশাল গম্বুজ বানানো যায়। বহু মসজিদ বানানোর পরে অবশেষে সুলতানিয়ে চামিতে প্রথম সাফল্য। নীল মসজিদ বৃহত্তম হলেও এর বিরাট গম্বুজ চার থামের উপর দাঁড়িয়ে।

    কত ইতিহাস! বাতাসে তুড়ি মারলে ঝরে পড়ে। আর সে ইতিহাসও ছোটখাটো কিছু নয়। মনেই ছিল না ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সময় এই ইস্তানবুলেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গ্‌লের আত্মপ্রকাশ এবং মহত্তম সেবাকীর্তি।

    যাচ্ছি গেব্‌জেতে। ইস্তানবুল থেকে প্রায় আশি মাইল দূরে ইজ্‌মির প্রদেশে। খুবই ছোট জনপদ। মূল কেন্দ্র এক টেক্‌নোলজি পার্ক। তাকে ঘিরে মাইলখনেক জোড়া শহর। মর্মর সাগর এখানে স্থলভূমির মধ্যে গোঁৎ খেয়ে ঢুকে এসে এক উপসাগর তৈরি করেছে। উলটোদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়ের তলায় বুর্সা- অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী। আশি মাইল হাইওয়েতে। সেই এক যাত্রা। নিরুত্তাপ গতি। এটা এশিয়া। টেক্‌নোলজি পার্কে ঢোকার অনেক কড়াকড়ি। একের পর এক সিকিউরিটি চেক। গেট পেরোবার মুখে দিক্‌নির্দেশক বিভিন্ন সাইনবোর্ড। তার একটাতে লেখা হানিবলের কবর। কোনও ছোটখাটো পাহাড় হবে! মেটিনকে জিজ্ঞাসা করি। মেটিনের উত্তর- হানিবলের নাম শোনো নি/ অ্যান্টনি তো চেনো/ হানিবল সে অ্যান্টনিরই পূর্বপুরুষ জেনো। সেই হানিবল? সেই কার্থেজ, রোম, হাতির দল, আল্‌স অতিক্রম? এই অজ্ঞাতকুলশীল জনপদে শত শত প্রযুক্তিবিদের কান্ডকারখানার পাশে ভদ্রলোক শুয়ে আছেন? ঘুরে আসা যাক। পায়ে হাঁটা রাস্তা টিলার উপরে উঠে গেছে। টিলার উপরে উঠতেই আতাতুর্কের আদেশে তৈরি ছোট পার্কের মধ্যে হানিবলের সমাধি। আমাদের তুর্কি ড্রাইভারও বিস্ময়ে হতবাক। দূরে পাহাড়ের কোলে কুয়াশা ঢাকা মর্মর সাগর। অন্যদিকে বিস্তীর্ণ এশিয়ান ভূখণ্ড। এইখানেই হানিবল আত্মহত্যা করেন। রোমান সাম্রাজ্যের প্রবলতম চ্যালেঞ্জারের উপযুক্ত সমাধিস্থলই বটে।

    তুরস্কের আকাশে এখন অনেক রোদ। ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলেমেয়ে গেব্‌জের জঙ্গুলে পাহাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে।

    ১৬ (Mar 31 2006)
    একটি দুর্বোধ্য ভোটনাট্য বা গিট্টু গিট্টিয়ে গিট্টালো

    (তল্পিস্বীকার: শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

    (স্টেজের উপর পেন্ডুমিতভাবে চার গিট্টু বসে আছে। প্রথমজন বয়োবৃদ্ধ। আদুল গা, পরনে টক্‌টকে লাল শায়া, মাথায় জরির টুপি, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, মুখে একটা হেলুভাসীন ভাব। নাম চক্রবৎ চক্রবর্ত্তী। বাকি তিনজনেরই মাথায় বেসবল ক্যাপ, পরনে সাদা ব্লাউজ আর কালো শর্টস। ক্যাপের রং থেকে বোঝা যায় কার গিট্টুমি কতটা ইরম্মিভ। নাম ইল্লিয়ার্কি পাল, ধর্মাধর্ম ধাড়া এবং জয়মাদয়া কর।)

    চক্রবৎ।। ছ্যা ছ্যা ছ্যা! আবিত্ত বলে আর কিছুই রইল না। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে যত ফুসকিত বিরোধী ছ্যানাপোনা! এইটুকুও বোঝে না যে এই উদ্‌লাইয় রাজ্যে বামফ্রন্টের একমাত্র আলপত্য হল উন্নততর বামফ্রন্ট। (বাকিদের দিকে ফিরে) ও তোমরা যতই আবলুশ গাবলুশ কর, শেষে পাইবা একখান তেলুষ্টি রম্ভা।

    ইল্লিয়ার্কি।। অলপ্পেয়ের কতা সোনো অ্যাকবার! তিরিস বচোর ধোরে লাইপেঁচুটি কোরেও মুগপোড়ার গ্যাঁড়ামি গ্যালো না। কয়েক বচোর ভোটে জিতেচে বোলে ছ্যাকারি কোরেই চোলেচে, কোরেই চোলেচে! সালা ময়ামিচিলের অ্যাকটা পেন্সিনেসন কত্ত, দেখতাম কে জেতে!

    চক্রবৎ।। হায় রে কপাল! কাকে আর কী বলব? আমাদের কাছে শিখলি আর এখন আমাদেরই শেখাস! বাই দ্য ওয়ে, ওটা পেন্সিনেসন নয়, কম্পিটিশন। এই উদ্‌লায়িত রাজ্যের সর্বঘৃত স্বার্থে অন্তত ভাষাটা শুদ্ধ কর।

    ইল্লিয়ার্কি।। য্যাতো বড়ো মু নয় ত্যাতো বড়ো কতা! জ্ঞান দিবি নে, জ্ঞান দিবি নে বোলচি। দুম্‌ করে ধম্মোঘট ডেকে দেবো। সেক্টর ফাইব ইলটুবিলটু হোয়ে যাবে। সিল্পোন্নয়নের গাড়ুয়া বাজিয়ে দেবো। সালা ওয়ান থেকে ইংলিস তুলে দিয়ে অ্যাকন আবার ধিনিচাঁদ ভাসা সেকাচ্চো!

    চক্রবৎ।। (মুচকি হেসে) যার শেখার সে অমনি শেখে। তিরিশ বছরেও যখন কিছু শিখলি না, তখন ইংরিজিই বা কি, আর ধাঁইকিরিই বা কি! (হাই তুলে) জয় বাবা ধান্দানাথ, ভোট দে নয় বিরোধী দে।

    ইল্লিয়ার্কি।। পেটোন্টিফিক রিগিং সেকাতে এসেচে! বলি হ্যাঁ গা, বয়েস তো কম হল নে। অ্যাকটা মেয়েমানসের সামনে এসব কইতে পোড়ামুয়ে অ্যাকবার বাঁদলো না?

    চক্রবৎ।। নির্বোধের আবার ছেলেমানুষ মেয়েমানুষ! যাঁহা মুলো তাঁহাই বাতকর্ম।

    ইল্লিয়ার্কি।। (প্রচণ্ড চেঁচিয়ে) মাজার তলায় কাটি কল্লে সজ্জ কোরবো না বোলে দিলুম। তোমার সাদের বাগান ছালবাল কোরে দিয়ে যাবো। (দর্শকদের) এর পরেও আমার জোন্নো আপনাদের আদ ফোঁটা দুক্কু হয় নে কো! এ কোতায় আনিলে তুমি জগদীশ্বর সাজাহান? (জিভ কেটে) য্যা:, গুলিয়ে গ্যাচে। (চক্রবৎকে নীচু গলায়) অ্যাকটা সিগ্রেট ছাড়ো না জেঠু। চিল্লিয়ে মিল্লিয়ে গলাটা ঢিম্মি হোয়ে গ্যাচে।

    চক্রবৎ।। (কমল মিত্রের হাসি) হা: হা: হা: হা:। চিকলু এখন সিগ্রেটও খেতে চায়! হা: হা: হা: হা:। (হাসি থামিয়ে) এই নে তোর বরাদ্দ চুঁইবিড়ি।

    ইল্লিয়ার্কি।। (বিড়ি ধরিয়ে) বিরোদীদের মুচে ফ্যালার চক্কান্তো মানচি না, মানবো না। মানচি না, মানবো না (ঘুরে ঘুরে)।

    চক্রবৎ।। (দাপুটে গলায়) অ্যাই চোপ্‌। এনারা সব শুধু আমাদের খিল্লাখিল্লি দেখতে আসেন নি। প্রদ্যুম্ন আর অয়স্কান্তকেও কিছু বলতে দাও।

    (ইল্লিয়ার্কি বসে পড়ে। ধর্মাধর্ম একটু তোতলা। তার উপর চারশো সাতচল্লিশ বছর আগে লুপ্ত হওয়া এক ভাষায় কথা বলেন। কাজেই কেউ বোঝেও না, শোনেও না।)

    ধর্মাধর্ম।। মম পরিচিতি সম ক্ষম হে ক্ষম ধর্মাধর্ম।

    ইল্লিয়ার্কি।। মানে ওঁয়ার নাম ধম্মাধম্ম। ওঁয়াকে পোঁদ্দুম্নো বলায় দুষ্ক পেয়েচেন।

    ধর্মাধর্ম।। অপিনিহিতি অনুপ্রবেশ অপদ্রব্য আকুল আবেশ।

    ইল্লিয়ার্কি।। সালার সরকার ওনুপ্পোবেস নিয়ে কিচ্চু কোরচে না।

    ধর্মাধর্ম।। হিন্দুরাজ্য বহুব্রীহি সদয় তনয় সাগরদীঘি।

    ইল্লিয়ার্কি।। অসাম্পোদায়িক হিন্দুরাজ্জো লা হোলে কিচ্চু হবে লা।

    চক্রবৎ।। হ্যাঁ, আরও বল। ডট কম দমাদম, পা পিছলে আলুদ্দম।

    ধর্মাধর্ম।। অন্‌ অন্‌ অন্‌ .....

    ইল্লিয়ার্কি।। অন্যায়।

    জয়মাদয়া।। হ: আমার নাম লইয়াও আফনে অন্যায় করসেন। জয়মাদয়ারে অয়স্কান্‌ত বানাইয়া দিলেন। কাল গান্দিমূর্তির কুলে বইয়া ইয়ে করতে অইব। মানে ইসে। আর আউট অফ টার্ন কতা কইতে কন ক্যান? কাল আফনের ইয়েতে গিয়া কইলাম না যখনতখন ইসে কত্তে কইবেন না। ম্যাডামের লগে দুইখান কতা কইয়া লই। তারপরে ইয়ে হইব খনে।

    ইল্লিয়ার্কি।। তোর তরমুজটা ইয়ে না ইসে?

    জয়মাদয়া।। অবজেকশন ইয়োর অনার। এইসব অসাংবিধানিক ইয়ে পাইন্য করুম না। অ্যাভোকাডো কইতে পার, ব্যাদনা কইতে পার, অ্যামন কি পেডন্ড কইতে পার। কিন্তু তাই বইল্যা ইসে? মহাজোট হয় নাই বইল্যা যা খুশি তাই কইবা?

    ইল্লিয়ার্কি।। (হঠাৎ প্রচন্ড তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে শুরু করে) চুলকুচ্চে, চুলকুচ্চে। উরিব্বাপ, কি ভয়ানক চুলকুচ্চে। ওরে মারে, মোরে গেলুম রে।

    জয়মাদয়া।। এই আর অ্যাক ঢং হইসে। মহাজোট শুনলেই খাউজাইতে লাগে। (সেলফোনে কিড়িং কিড়িং এবং জয়মাদয়ার তুমুল নৃত্য) ইয়ে আইসে, ইয়ে আইসে। (নাচতে নাচতে) কইব কতা আমার লগে, কইব কতা আমার লগে।

    (এইসব চিল্লামিল্লির মাঝে ঢোকে তিনটি উলঙ্গ রোবট। এদের নাম ং, : এবং ঁ। কথা বলে চিংক্রিত সুরে।)

    রোবটেরা।। আমাদের ছাড়া মিটিন হয় কেন? মিটিন হয় কেন? মিটিন হয় কেন?

    চক্রবৎ।। এই সেরেছে। এরা আবার এখানে কেন? এদের তো তালা মেরে রেখে এসেছিলাম।

    ইল্লিয়ার্কি।। আর কদ্দিন সবাইকে টেঁউটি করে রাখবি? বাংলার ভাগ্যাকাসে আজ য্যাকোন দুজ্জোগের ঘনঘটা (জিভ কেটে) আবার গুলিয়েচি।

    রোবটেরা।। আমাদের বক্তব্য শোনা হোক। শোনা হোক। শোনা হোক।

    চক্রবৎ।। (স্বগত) পাবে পাঁচটা সিট আবার বক্তব্য! (রোবটদে) তুনবো বাবু, তুনবো। বাইলে গিয়ে এত্তু বোচো। পেতকাতা ন্যাপিকাকু বোচে আচে। ও তোমাদের মিত্তি দেবে, খ্যান্না দেবে। বয়োদের কতার মাদে দুত্তুমি কয়ে না। দাও বাবু, মিত্তি খাও। আমি এক্‌হুনি তোলে আচবো।

    রোবটেরা।। মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি। খাঁটি মিষ্টি। খাঁটি মিষ্টি। খাঁটি মিষ্টি।

    (রোবটেরা বেরিয়ে যায়।)

    ধর্মাধর্ম।। অনস্বীকার্য ব্রহ্মচর্য আলুলাইয় মূল্য ধার্য।

    জয়মাদয়া।। এইডায় আবার কি কয়?

    ইল্লিয়ার্কি।। উনিও মিস্টি খেতে চাইচেন।

    চক্রবৎ।। উফ্‌! চার গন্ডা করে প্লট দিয়েছি, বাড়ি দিয়েছি, তাও তোদের পিঙ্কিবাজি আর থামল না। বসতে দিলে শুতে চায়, খেতে দিলে হাগতে চায়! মাথাটা কেমন বন্‌বন্‌ করে। আজ সভা ভংগ। পেটকাটা ন্যাপির সাথে দুটো কথা বলা দরকার। সভা ভংগ!

    জয়মাদয়া।। সবা বঙ্গ করলে হইব? আমার তো ইসেখান কওয়াই হইল না। ফুনে ম্যাডামের লগে ইয়ে কইর‌্যা আইলাম। ম্যাডাম কইয়া দিলেন কি কইর‌্যা ইসে করতে হইব।

    ইল্লিয়ার্কি।। আমাকে পেটোন্টিফিক রিগিং না সিকিয়ে কোতায় পালাবে চাঁদু? মাগনা মাগনা মিটিন হবে? খচ্চা নেই?

    ধর্মাধর্ম।। অনস্বীকার্য ব্রহ্মচর্য আলুলাইয় মূল্য ধার্য।

    (এমন সময় এক বালকের প্রবেশ। বেশভূষা শাহেনশা বইয়ের অমিতাব্বচ্চনের মতো। নাম ম্যাঁও।)

    ম্যাঁও।। ঢিচকাও, ঢিচকাও। বুম বুম বুম।

    জয়মাদয়া।। লাও। হইয়া গ্যালো গিয়া। অখন ম্যাও সামলাও।

    চক্রবৎ।। আইস বৎস ম্যাও। ল্যাবেঞ্চুষ খাইবা?

    ম্যাঁও।। ঢিচকাও ঢিচকাও।

    ইল্লিয়ার্কি।। ল্যাবেঞ্চুস দ্যাকাচ্চো? বোলি বাজেতে পাস কোরিয়েচিলে?

    ম্যাঁও।। বুম বুম বুম।

    চক্রবৎ।। শোন রে হতচ্ছাড়া চিকলু। ম্যাঁও সামলাতে আমি কোথা থেকে কি পয়সা আনি তা নিয়ে তোদের কাছে কৈফিয়ৎ দেবো না। শালা ক্যাগের বাসায় বগের ডিম দেখাচ্ছে। (ম্যাঁওকে) আইস বৎস, ল্যাবেঞ্চুস লহ।

    ম্যাঁও।। (লজেন্স নিয়ে) ঢিচকাও ঢিচকাও বুম বুম বুম। কপাৎ কপাৎ।

    জয়মাদয়া।। রামদাও লইয়া আইসে।

    (একটি সাধারণ মানুষ ঢোকে। হতচকিত এবং অম্প্রলিত।)

    মানুষ।। (ইতস্তত: স্বরে) দাদা, রাইটার্স কোন দিকে একটু বলবেন?

    (ভীতসন্ত্রস্ত সবাই তড়াক করে লাফ দিয়ে চেয়ারের উপর।)

    চক্রবৎ।। কমরেড, সাবধান। নির্বাচন কমিশন এসেছে।

    ইল্লিয়ার্কি।। বিষ, বিষ। বাঁচাও, বাঁচাও।

    জয়মাদয়া।। আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। অ ম্যাডাম, আফনে কই গ্যালেন? ম্যাডাম, ম্যাডাম!

    ধর্মাধর্ম।। (কেঁদে ফেলেছে) হায় আল্লা, হায় আল্লা!

    ম্যাঁও।। পুলিশ পুলিশ! ঢিচকাও ঢিচকাও। পুলিশ পুলিশ!

    মানুষ।। (সন্ত্রস্ত) ও দাদা, কী হল আপনাদের? প্লিজ বলুন না রাইটার্স কোন দিকে? কয়েকটা জরুরি কাজ ছিল।

    (একটি প্রশ্ন এবং পাঁচ ভীত গিট্টুর চিল্লামিল্লির মধ্যে পর্দা পড়ে।)

    ১৭ (May 2 2006)
    আস্তিকের ভোট

    এখন পুরোনো সি পি এম মানে জ্যোতিবাবুর সি পি এম আর নতুন সি পি এম মানে বুদ্ধবাবুর সি পি এম। কিন্তু সাতাত্তরের আগেও সি পি এম ছিল। প্রমোদবাবুর সি পি এম ছিল, মুজফ্‌ফর আহমেদের সি পি এম ছিল, এমন কি এক সময় চারু মজুমদারের সি পি এমও ছিল। তবে আমাদের জন্ম সত্তরের শুরুতে। অর্থাৎ স্মৃতির খেয়া যখন ঘাটে এসে দাঁড়াল, তখন বামফ্রন্টের রাজ্যপাট শুরু হয়ে গিয়েছে। তার আগের সি পি এম গল্পকথার সি পি এম, বহুজনের স্মৃতির ভাষ্যে গড়ে ওঠা সি পি এম। আশি, এমন কি নব্বইয়ের দশকেও এই স্মৃতির ভাষ্য জীবন্ত ছিল। এখন আস্তে আস্তে জলছবির রং পালটেছে, ইতিহাসের কোণায় কোণায় মাকড়সার বাসা। এটাই স্বাভাবিক। স্মৃতিহীনতা যেমন অপক্ব সভ্যতার লক্ষণ, ঠিক সেই ভাবেই অবিরত স্মৃতিভার স্থবিরত্বের। দিন পালটায়, আমি পালটাই, তুমি পালটাও, স্মৃতিও উলটে পালটে যায়।

    ছোটবেলায় ঘরের দেওয়ালে লেনিনের ছবি টাঙানো ছিল। লেনিন হিসেবে যতটা, তারও বেশি বাবাকে দেওয়া এক ছাত্রের উপহার হিসাবে। আশির দশকে বাবা যখন শিক্ষকতা ছেড়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন, এবং যখন হঠাৎ অসুখে প্রবল বিকারগ্রস্ত, লেনিনের ছবিটা নামিয়ে ফেলেছিলেন। তারপর আরও কিছু বাসাবদলের পরে নতুন সহস্রাব্দে ছবিটা উধাও। মামাবাড়িতে লেনিন-স্তালিন-মাও কেউ ছিলেন না। একটু সব্‌জেটে প্রিন্টে হাস্যমুখ মুজফ্‌ফর আহমেদ এবং ছোটখাটো হো চি মিন। এক সময়ে বামপন্থীরা রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলে যতই গাল পাড়ুন না কেন, গোঁড়া বামপন্থী পরিবারগুলোতে রবি ঠাকুরের মহিমা ছিল অবিসংবাদিত। ব্রাহ্ম এবং বামপন্থী রক্ষণশীলতার যৌথ প্রভাবে "মহাবিশ্বে মহাকাশে' থেকে "এসো মুক্ত করো'- এর মধ্যেই যাওয়া আসা ছিল। সিনেমার তুখোড় গান শুনতে আরও অনেকটা লায়েক হতে হবে। ঠাকুমার ঝুলির পাশে খাদ্য আন্দোলনের গল্প ছিল, মিতুল নামে পুতুলটির পাশে ছিল সত্তরের কলকাতার শহরতলির গল্প, ঠাকুরদা এবং ঠাকুমার ব্রিটিশ আমলের শ্রীহট্ট জেলের গল্পের পাশাপাশি ছোটমামার কবরখানায় লুকিয়ে থাকার গল্প। এই কবরখানায় লুকিয়ে থাকার সময়ই নাকি আমার জন্ম।

    ছিল ভয়। চেনাজানা লোকেদের কাছে সত্তরের গল্প শুনতে শুনতে অনেক বড় না হওয়ার আগে ভাবতেই পারতাম না ভালো লোকেরা কংগ্রেসী হতে পারে। খালের একপাড়ে শান্তিনগর, আর এক পাড়ে পূর্বাচল। সেই পূর্বাচলের কলেজে পড়া ছেলে। পাড়ায় গোলমাল শুরু হতেই বাবা মা বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। পরে পাড়ার কংগ্রেসী ছেলেরাই বলল কোনও চিন্তা নেই, ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। কয়েকদিন বাদে সেই ছেলের লাশ খালে ভাসে। কিংবা কল্যাণনগরে তখন অবাধ দৌরাত্ম্য। কংগ্রেসের ছেলেরা রাতে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে উঠে মনের সুখে আড্ডা মারে এবং নিদ্রা যায়। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তার সঙ্গে চলে বিপুলভাবে ইলেকট্রিকের তারচুরি। একদিন পাড়ার লোক আর সহ্য না করতে পেরে বঁটি-খুন্তি হাতে বেরিয়ে এসেছিল। সেই অভাগাদের স্মরণে এক অনাদৃত স্মৃতিসৌধ কল্যাণনগর বটতলার মোড়ে পড়ে আছে। অথবা মামা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল বেলেঘাটার ছেলে রঞ্জিত। দিদার পাঁচ ছেলের সঙ্গে আরও একজন। খড়দহ স্টেশন থেকে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে ফেলা হল। থিয়েটার ওয়ার্কশপের পুরোনো নাট্যকর্মী সত্যেন মিত্র। বাড়ি ফেরার পথে সিঁথির মোড়ে কংগ্রেসী গুন্ডারা মেরে ফেলেছিল। এখনও থিয়েটার ওয়ার্কশপ মনে হয় সত্যেন মিত্রের স্মরণে পুরস্কার দেয় বা নাট্যোৎসব করে। তো এইসব গল্প শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠার ফলে ভোটের সময় কংগ্রেসের কিছু নিরীহ ছেলে বাড়িতে ভোটার স্লিপ দিতে এলেও ভয়ে দম আটকে যেত।

    এন বি এর বরুণকাকুর হাত দিয়ে পাওয়া প্রথম উপহার "ছোটদের কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহার"। অন্তত এখন যা স্মৃতির পর্দায় ধরা পড়ে। প্রথম পাতায় ছিল সাদা কালো স্টেনসিলে আঁকা দুটো উত্তোলিত হাত, আর একটা মোটা গোছের ছেঁড়া শিকল। তলায় বড় বড় হরফে লেখা- সর্বহারার শৃঙ্খল ছাড়া কিছুই হারাবার নেই। তখন রাশিয়ান আর চিনে বইয়ের রম্‌রমা খুব। তারই মধ্যে একটা বই ছিল "সোসো'। রাশিয়ার একটি বাচ্চার ছেলেবেলার গল্প। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বারবার পড়তাম। কমলা মলাটের উপর সেই কিশোরের ছবি। তার জনপ্রিয় নাম স্তালিন। কোনও এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে পেলাম মোটাগোঁফ মিলিটারি পোষাকে স্তালিনের পোস্টার। লেনিনের ছবির থেকেও তাড়াতাড়ি সেই পোস্টার হারিয়ে গিয়েছিল। তখন দেওয়ালে প্রায়ই গরু বলদের। আর এক হিংস্র ডাইনির হাত, বড় বড় নোখ, নোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। জেনে গিয়েছিলাম ওটা হল ইন্দিরা গান্ধির হাত। সেই সময় বি জে পি ছিল না। জনতা পার্টি হবে হবে করছে। লালকৃষ্ণ আদবানী, অটলবিহারী বাজপেয়ী- সবাই সেই জনতা পার্টির অংশ। ছোটদের সহজ সরল দুনিয়ায় একদিকে ভালো সি পি এম, আর একদিকে বাজে কংগ্রেস। বাকিরা অজানা।

    দম্‌দমে তখন পার্টি আফিস একতলা, উপরে টিনের চাল। প্রতি সন্ধ্যাবেলা মায়ের হাত ধরে গুটি গুটি হাজির হতাম। সবাই আমাকে চিনত পার্টি অফিসে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা হাজির হওয়া খুদে কমরেড হিসাবে। আমিও সবাইকে চিনছিলাম। নীরেন ঘোষ, শান্তি ঘটক বসে থাকতেন। নাগেরবাজার দিয়ে হেঁটে যেতে দেখতাম ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবিতে সুভাষ চক্রবর্তী। সেন্ট জেভিয়ার্সে পদার্থবিদ্যার মেধাবী ছাত্র পুকুলদা পড়াশুনো ছেড়ে সারাদিন রাজনীতি। আমার বাবা মা সারাক্ষণ পুকুলদাকে পড়াশুনা শেষ করার জন্য ব্রেন ওয়াশ করতেন। আর এক যাওয়ার জায়গা ছিল আর এন গুহ রোডের অতিবিস্তৃত বস্তি। মায়ের সঙ্গে মহিলা সমিতির মেম্বারশিপের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো। ছোট ছোট দরমার ঘরে বসে মহিলাদের সুখ দু:খের গল্প। কনফারেন্সগুলোতেও আমার ঠাঁই হত মহিলা সমিতির দেওয়া আলুর দম ঘুগনির স্টলে। কনফারেন্সের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সেই আদি আই পি টি এ বা কলকাতা কয়ার। তখনও সারা টালিগঞ্জ-নন্দন-অ্যাকাডেমি আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান বলে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। তো এই অনুষ্ঠানে আমাদের কাছে হিট ছিল রানার আর জন হেনরি। রানারে এক জায়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৌড়ানো আর জন হেনরিতে সারা গায়ে কালিমাখা লোকটার গোল্লা গোল্লা মাংসপেশী কাঁপানো। দম্‌দমের বিপুল জনপ্রিয় এম এল এ ছিলেন তরুণ সেনগুপ্ত। দীর্ঘকায়, অতি সুরসিক মানুষ। যেদিন মারা গেলেন, সেদিন ভিড়ের ঠেলায় পার্টি অফিস অবধি পৌঁছনো দায় ছিল। দম্‌দম ছুটি ছিল। বাবা প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে পার্টির তাত্ত্বিক ক্লাস নিতেন। মিটিং-এর আগে বাড়ি বাড়ি ঘুরে হইহই ছেলেরা হাতে গড়া রুটি সংগ্রহ করে নিয়ে যেত। বাড়ির দুই তাক ভর্তি ছিল লেনিনের সম্পূর্ণ রচনাবলী, আর মার্ক্সের দুই খণ্ড  গাবদা গোবদা দাস কাপিতাল। বইয়ের ওই তাকটা দেখতে বেশ সুন্দর লাগত। এক রং-এর মোটা মোটা বই সারি দিয়ে সাজানো। বেশ একটা গম্ভীর বই বই ভাব। কিন্তু এত সবের পরেও ছুটির দুপুরের নিয়মিত সঙ্গী বল্লালী বালাই আর অক্রুর সংবাদ। বছরের পর বছর।

    তারপর আমারও বয়স বাড়ে, সি পি এমেরও। দুজনেই আরও হিসেবি, আরও বুঝদার হয়ে উঠি। আমি বড় হই, সি পি এমও বড় হয়। বড়ত্বের সুনিপুণ চালে ভবিষ্যৎ ইমারতের এক একটা ইঁট জড়ো হতে থাকে। সাদা-কালো মুছে গিয়ে আস্তে আস্তে ধূসরবর্ণের চশমা লাগে চোখে। খবরের কাগজ এবং টি ভির কিছু নৈর্ব্যক্তিক খোলসের খস্‌খসে ছোঁয়া লাগে বড় হয়ে ওঠার ব্যস্ত মুহূর্তে। কোনও খোলসে নীরক্ত হাত, কোনও খোলসে শুকতারার তলায় পড়ে থাকা ছোট ছোট খেলনা কাস্তে হাতুড়ি, কোনোটায় তীব্রগন্ধ পাঁকে পচতে থাকা পদ্মফুল। এর মধ্যেও নব্বইয়ের দশকের ছবিও আলগাভাবে গুছিয়ে তুলি। তিয়েনানমেন স্কোয়ার এবং বানতলা প্রায় পিঠোপিঠি আসে। মণ্ডল কমিশনের ঝড় কলকাতায় আছড়ে পড়লে কলেজে ক্লাস বয়কট হয়। আমি নির্বান্ধব গোঁয়ার ষাঁড় একা একা প্রতি ক্লাসে হাজিরা দিয়ে আসি। হাতে হাতে লোকদেখানো লি শাও কি, হ্যালডেন, গ্রামশি। আশ্রয় দেন স্বেচ্ছাচারী শক্তি চাটুজ্জে, নাইভ বিভূতিভূষণ, প্রতিক্রিয়াশীল সমরেশ বসু। আমরা আরও ছোট হতে হতে বড় হতে থাকি। অরুণ মিত্রের কবিতার লাইন লেখা পোস্টারে দেওয়াল ছাইতে থাকি, বিজয় গঁদের আঠা দিয়ে পোস্টার লাগানোয় বিশেষ পারদর্শী হয় ওঠায় নাম হয় গঁদার, সৌমেন কল্যাণী লোকালের ভিড়ে দাঁড়িয়ে গাঁজা টানে এবং ভোটে জিততে থাকে, কলেজের সিঁড়িতে বসে আড্ডা মারা নিষিদ্ধ হয়।

    এই হল যজমানিসূত্রে পাওয়া আমাদের বামপন্থা ওরফে সি পি এম ওরফে বামফ্রন্ট। আমি কেন করি? ছোট বেলায় বাবা মাকেও করতে দেখেছি। যতদিনে যুক্তি অভ্যাস করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, ততদিনে আমরা অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। তার আগে অবধি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রাচীন যুথবদ্ধতার নস্টালজিয়া, মুছে যাওয়া দিনগুলির এক পরিবারতান্ত্রিক ইতিহাস, এক নিরালম্ব অথচ গূঢ়চারী প্রত্যয়। এখনও হয় তো অনেককেই করে। আর এটাই অনেকে বোঝেন না। আজ বহু প্রাক্তন সি পি এম সমর্থক রয়েছেন যারা চূড়ান্ত সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেন। ভাবেন একবার গদি থেকে হটলে বেনোজল বেরিয়ে যাবে। এরা সি পি এম বিরোধিতায় সাংবিধানিক বিরোধীদের থেকেও অনেক কঠোর, অনেক ক্ষুরধার। কিন্তু যখন ভোট আসে, যখন মনে হয় এবার হয় তো গণেশ উলটোলেও উলটোতে পারে, এরাই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে কয়েক সপ্তাহের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কমরেড। আসলে অনর্গল ধনতন্ত্রের পাশাপাশি আমাদের সত্তায় এখনও প্রাচীন অরণ্যের প্রবাদ, বংশপরিচয়ের গৌরব, মর্চে ধরা ইতিহাসের ঘ্রাণ। কাজেই সি পি এমেরও ভোট ঘোরা ফেরা করে একটি নির্দিষ্ট শতাংশে, বিরোধীদেরও তাই। যতই নাস্তিক্যে বিশ্বাস থাক, পৈতৃক ভিটের শালগ্রামশিলা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ধক কজনেরই বা থাকে?

    ১৮ (Jun 1 2006)
    একটি পারফোর্মেন্স টেক্সটের খসড়া

    ইহা একটি প্রেক্ষাগৃহ। বাধ্যতামূলকভাবে যাহা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। এই স্থলে পাবলিক নাট্যক্রিয়া দেখিতে গাঁটের কড়ি খসাইয়া উপস্থিত হইয়া থাকেন ("গাঁটের কড়ি' আন্ডারলাইন করিয়া লওয়া যাউক)। আমাদিগের এই ক্রিয়া  বা নাট্য, যাহাই হউক, তাহা শুরু হইবার প্রারম্ভে এইরূপ দর্শকগণ সাড়ম্বরে মধুমক্ষীগণের ন্যায় গুঞ্জনকরত: আপনাপন আসন পরিগ্রহণ করিবেন। তাঁহাদিগের জন্য চর্মবেষ্টিত আসন রহিয়াছে। তাঁহাদিগের জন্য দৃষ্টিসম্মুখে রহিয়াছে অন্ধকার একটি মঞ্চ। রহিয়াছে আশতাব্দী বঙ্গীয় নাট্যসংস্কৃতির সম্মিলিত জনস্মৃতি, জনপ্রবাদ এবং জন জানি জনার্দন তা রা রম পম রাম পম পম।

    অথচ মঞ্চ এবং প্রথম দর্শকসারির মধ্যস্তিত স্থানে টেবিল পাতিয়া তিন সামরিক উর্দি পরা মুশকো জওয়ান বসিয়া রহিয়াছেন। তাহাদের টেবিলের উপরে কৃষ্ণকায় ওয়াকি টকি, স্লিক ল্যাপি এবং কতিপয় জাবদা খাতা। দর্শকগণের প্রবেশের মুহূর্ত হইতে তাহারা অতীব সতর্কতার সহিত জাবদা খাতা ও ল্যাপিতে দর্শক আগমন ও বহির্গমনের পাকা হিসাব রাখিতেছেন। মূহুর্মূহু গাম্বাট ওয়াকি টকি বাজিয়া উঠিতেছে। আমরা এই বাক্যালাপ লিপিবদ্ধ করিতেছি না কারণ ইহা হিন্দিভাষায় করা হইতে থাকে। দর্শকাসন যখন পরিপূর্ণপ্রায় (কোনো সুচতুর ঢপ ব্যতীত যাহার সম্ভাবনা প্রায় এক দশমিক চার সাত শতাংশ) তখন বেমক্কা ট্যাঁও ট্যাঁও শব্দে তৃতীয় ঘন্টি বাজিয়া উঠে। (প্রথম এবং দ্বিতীয় ব্যতীত তৃতীয় ঘন্টি কী রূপে বাজিতে পারে সেই বিষয়ে খসড়া নীরব অথবা ইহা একটি ইচ্ছাকৃত প্রমাদ)।

    তৎক্ষণাৎ প্রেক্ষাগৃহের প্রতি দ্বারে সামরিক মদ্দাগণ পোজিশন লইয়া দাঁড়াইয়া পড়েন। সুধী দর্শকবৃন্দকে অধিক ত্যাঁদড়ামি না করিয়া আপনাপন আসনগ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করা হইয়া থাকে। ওয়াকি টকিতে কর্কশ বাক্যালাপ উচ্চগ্রামে উঠে। মাজায় সজ্জিত সামরিক অস্ত্রাদি আশংকিতভাবে খাড়া হইয়া উঠে। সামরিক পাহারাদারগণের মুখমণ্ডলে এক কঠোর উদ্বেগের ছায়া ঘনীভূত হইয়া উঠিতে থাকে। অন্ধকার মঞ্চের দিকে বোধ করি আমরা বিশেষ লক্ষপাত করি নাই। লক্ষপাত করিবার বিশেষ কারণও নাই কারণ উহা এখনও অন্ধকার। কেবল দর্শকগুঞ্জন অবিরাম হইলে একটি সুবৃহৎ ব্যানার মঞ্চ জুড়িয়া নামিয়া আসে যাহাতে "দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর'।

    প্রেক্ষাগৃহের দ্বারগুলি, যাহাদের মস্তকে রক্তিম "এক্সিট' চিহ্ন ঝুলিয়া রহিয়াছে, সেইগুলি সম্পূর্ণরূপে সিল করিয়া দেওয়া হয়। প্রেক্ষাগৃহের বিভিন্ন কোণ জোরালো সার্চলাইটে আলোকিত করা হয়। কোনোরূপ মেটাফোরিকাল আন্দারলাইন না করিয়াই বলিতেছি, মঞ্চ এখনও অন্ধকার। সার্চলাইটের উদ্বিন্নযৌবনা আলোকে প্রেক্ষাগৃহের মগডাল হইতে দড়ি বাহিয়া নামিয়া আসেন একদল কৃষ্ণবেশী জওয়ান, যাহাদের ইদানীংকার ফেশনানুসারে কদাপি ফ্যাতাড়ু বলিয়া ভ্রম করিবেন না। ইহারা ভারতমাতার অতন্দ্র সেনানী অথবা কৃষ্ণকায় মার্জার। প্রতিটি দর্শকাসন শ্যেনদৃষ্টি দিয়া পরীক্ষা করা হইতে থাকে।

    বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে এই সুবর্ণসন্ধ্যায় সত্য সত্যই একটি নাট্যক্রিয়ার উদ্‌যোগ করা হইয়াছিল। সেই নাট্যের কুশীলবগণ সমেক্‌আপ ও সসাজ মঞ্চপার্শ্বের সিঁড়ি দিয়া নামিয়া প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে আসিয়া দাঁড়ান। তাঁহাদের মুখমণ্ডলেও সন্ত্রস্ত ভাব। কতিপয় কৃষ্ণ মার্জার তাঁহাদের বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন। এবং দর্শকদের সহিত তাঁহাদেরও তল্লাশি লওয়া হইতে থাকে। এইরূপ তল্লাশিপূর্ণ সময়ে প্রথমবার মঞ্চের উপরে টিম্‌টিম্‌ করিয়া ষাট ওয়াটের একটি ডুম আলো জ্বলিয়া উঠে। মঞ্চের সম্মুখে পরিচালক মহাশয় আসিয়া দাঁড়ান এবং অতিক্ষীণ স্বরে তাঁহার বিনীত বক্তব্য পেশ করিয়া থাকেন।

    বক্তব্যের সারমর্ম অতীব সরল। তাঁহারা নাটক অভিনয়ের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কতিপয় নাশকতাবাদীর উপস্থিতি সন্দেহ করিয়া এইরূপ ব্যবস্থা লইতে তাঁহারা বাধ্য হইয়াছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁহারা দর্শকগণের এই অপরিমেয় হয়রানির জন্য যৎপরোনাস্তি দু:খিত ইত্যাদি ইত্যাদি। তল্লাশিকার্য সমাধা হইলেই প্রেক্ষাগৃহের যাবতীয় দ্বার বন্ধ করিয়া অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে এবং সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সহিত এই নাটকের অভিনয় সম্পন্ন হইবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যেহেতু আপাতত নাটক শুরু করা অসম্ভব এবং যেহেতু দর্শকগণ গাঁটের কড়ি খরচা করিয়াছেন, অতএব স্টপগ্যাপ রূপে মা-বোনেদের জন্য একটি ক্ষুদ্র অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করা হইবে যাহার নাম "রমাদির হেঁশেলে'।

    মঞ্চ আলোয় আলোয় ভাসিয়া গেল। সেতারে সরোদে বেহাগে বাহারে এক অপূর্ব সুরলহরী ধ্বনিত হইতে লাগিল। মঞ্চে এক বিশালাকার ট্রলি লইয়া আসা হইল। এই ট্রলির উপরিভাগ হইতে ঝুলিয়া আছে সদ্যোজাত মানবশিশুর ন্যায় ছলছ্‌ড়ানো গোলাপীবর্ণের অজস্র "সম্পূর্ণাকার মুর্গী"। তলে সপ্তবর্ণে বিভূষিত শাকসব্জি এবং মশল্লাদের তুরীয় কার্নিভাল। তীব্র হরিৎ পালংশাকের সহিত রক্তিম বিলাইতি বেগুন, গৈরিক আধফালি কুমড়ার সহিত গাঢ় বার্তাকুবর্ণ, ধূসর আলুর সহিত অলাবুর ফিকা শ্যামলিমা, গোলাপী রাঙা আলুর বক্ষে কতিপয় ব্রহ্মচারী রসুনের শ্বেত আভা। দর্শকগণ, মনুষ্যনাট্যের অভাবে সত্যকারের ভূমিজ এই জীবনসমূহের রংতামাশা অবলোকনের জন্য প্রস্তুত হউন। অনুভব করুন করুণাময় জগদীশ্বরের মহান সুমতি এবং আমোদগেঁড়ে অ্যাটিট্যুড। এই সব্জিযাত্রায় আপনাদের সহিত থাকিবেন আমাদের পরমশ্রদ্ধেয়া রমাদি যাঁহার পরনে আফ্রিকার আদিম জনজাতির যোদ্ধৃবেশ, যাঁহার মুখমণ্ডল অদ্ভুত ও গভীর এক মুখোশে আবৃত।

    তল্লাশি এবং রন্ধনশিক্ষা যখন পুরোদমে চলিতেছে, তখন দর্শকাসনের মধ্য হইতে একটি সুমধুর স্বর গান গাহিয়ী উঠিল "ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়"। সচকিত রক্ষীদল, নাট্যের খুশীলব এবং দর্শকবৃন্দ হতভম্ব। দর্শকের মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিলেন একটি লোক, একটি অভিনতা, একটি জীবন বা একটি সাব-অল্টার্ন। (সজোরে হাসি)। লোকটি চেহারা বর্ণনা অনাবশ্যক কারণ তিনি তিনিও হইতে পারেন, অথবা আমি, বা আপনি, কিংবা বুদ্ধদেব ভটাচার্য্য, বাইচুং ভুটিয়া, আজিম প্রেমজি এমন কি বিরিঞ্চি দাসও হইতে পারেন। মল্লিকা শেরাওয়াত, মেধা পাটকার বা অঞ্জু ববি জর্জ হইলেও আশ্চর্যা হইব না। কিন্তু সেই লোকটির উদরের চতুর্পার্শ পোয়াতী নারীর ন্যায় ফুলিয়া আছে। অত্যধিক হর্মোনবাহী সৈনিকগণের পলক পড়িবার পূর্বেই সে এক দৌড়ে মঞ্চের উপর গিয়া উঠিল। তাহার এক হস্তে রিমোট ক®¾ট্রাল, এক হস্তে অত্যাধুনিক মোবাইল, আর যে হস্তগুলি পড়িয়া আছে তাহার একটিতে একবাক্স সন্দেশ এবং অপরটিতে এক হাঁড়ি রসগোল্লা।

    বলিয়া দিবার বোধ হয় প্রয়োজন নাই যে ইনি একজন সক্ষাৎ আত্মঘাতী বোমারু ইয়ানে সুইসাইড বোম্বার। এতক্ষণে হুঁশ ফিরিয়া পাওয়া জওয়ানেরা এক পা আগাইতেই লোকটি কোলকুঁজো হইবার উপক্রম করে অর্থাৎ সাড়ে সর্বনাশ। জওয়ানেরা পিছাইয়া যায়। পুনারায় আগাইতেই পুনরায় কোলকুঁজো। এইরূপ টু স্টেপ্স ফরওয়ার্ড ওয়ান স্টেপ ব্যাকওয়ার্ড করিতে করিতে বুঝা যায় যে বোমারুকে সম্মুখযুদ্ধে বাগ মানানো প্রায় অসম্ভব। অতএব নবতর কম্ব্যাটপ্রণালী লইয়া ভাবনাচিন্তা করা হইতে থাকে। এতদ্বিধ ঘটনাসমূহ সংঘটিত হইবার কালেও রমাদি মুহূর্তের জন্য তাঁহার রন্ধনশিক্ষার ক্লাস বন্ধ করেন নাই। অতএব অপাতত উদ্বিগ্ন দর্শকগণ, হতভম্ব সৈনিকবাহিনী, যুগপৎ ভীত ও বিরক্ত অভিনেতৃগণ, হাস্যময়ী রমাদি এবং বিমুগ্ধ এক বোমারু।

    কিন্তু জয় জওয়ানরে পরাস্ত করা বিষম কঠিন কার্য। মঞ্চের পিছনদিক দিয়া গুঁড়ি মারিয়া উঠিয়া আসে একদল অতিতৎপর কৃষ্ণমার্জার। প্রেক্ষাগৃহের দিকে মুখ করিয়া সটান গুলি মারে বোমারুর পিঠে। রক্ত ছলকিয়া সম্মুখসারির এলিট দর্শকের মুখ ভিজাইয়া দেয়। তাহার সহিত ছলকিয়া যায় ভগ্ন হাঁড়ির রসগোল্লার রস। বোমারুদেহ মঞ্চে পতনের পূর্বেই কৃষ্ণমার্জারগণ ক্ষিপ্রভাবে তাহার দেহ ধরিয়া ফেলে। মঞ্চের ভুবনভোলানো আলো নিভিয়া জ্বলিয়া উঠে ষাট ওয়াটের প্রায় নিভন্ত আলো। নিভন্ত আলোয় দোদুল্যমান গোলাপীবর্ণ ছালছাড়ানো "পূর্ণাঙ্গ মুর্গী"।

    এইরূপ ক্লাইম্যাক্সের কালে সিলিত দরোজাগুলি হাট করিয়া খুলিয়া যায়। বিদেশী পোষাকে সজ্জিত তীক্ষ্মধী পুরুষের দল প্রেক্ষাগৃহে প্রবিষ্ট হন। "সোনার কেল্লা"র সে ক্ষুদ্র বালকের ন্যায় বলিতে থাকেন "মিশটেক মিশটেক"। তাহাদের মুখে খেদ এবং আশাভঙ্গের স্বাক্ষর অঙ্কিত। মঞ্চে উঠিয়া তাঁহারা বোমারুরু দেহটিকে শোয়াইয়া তাহার ঊ`র্ধাঙ্গের পোষাক অনাবৃত করেন। অনাবৃত উদরে মানিকচাঁড গুটকা, শ্রীনিকেতন, পাঞ্জাবী নিকেতন, স্বপন বাউলের মুখশুদ্ধি, বাপি চানাচুর ইত্যাদি ইত্যাদির অসংখ্য গিফ্‌ট ভাউচার বাঁধা রহিয়াছে। বিদেশী পোষাকপরিহিত অগ্রণী পুরুষ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। এই নাটকের প্রতি দৃশ্যের পরে দর্শকগণের জন্য একটি চমকপ্রদ অন-হল প্রতিযোগিতা স্পনসর করা হইয়াছিল। ঘটনার বিরূপ গতিতে সেই উপহারবাহী জীবটিকে বোমারু বলিয়া ভুল করিয়া হত্যা করা হয়। প্রযোকক সংস্থা এবং স্পন্সর কোম্পানিগণ ক্রেতা বা দর্শকগণের এইরূপ হেনস্থার জন্য আন্তরিকভাবে দু:খিত। খেসারতস্বরূপ দর্শকগণের মধ্যে গুটকা, চানাচুর, শাড়ি, রুমাল ইত্যাদির প্যাকেট বিলি করা হইতে থাকে। জওয়ানদিগের অসমসাহসী ভূমিকার জন্য তাহাদিগকেও সন্দেশের বাক্সে পুরষ্কৃত করা হয়।

    দর্শকগণ ধীরে ধীরে প্রেক্ষাগৃহ ছাড়িয়া যাইতে থাকেন। মঞ্চে পড়িয়া থাকে নিহত বোমারুর শব, মৃত মুর্গীর দল, সব্জির বর্ণালী এবং একটি ষাট ওয়াটের প্রায় নিভন্ত আলো। মঞ্চের সম্মুখে একটি বিশালাকার ব্যানার পুনরায় নামিয়া আসে- "সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারকে পুনর্নির্বাচন করার জন্য জনগণকে সংগ্রামী অভিনন্দন'।

    ১৯ (Jun 30 2006)
    হেঁটে দেখতে শিখুন

    "বারান্দায় রাতের শিশির টুপ্‌টুপ্‌। ছোট মোড়াটা ভেজাভেজা। কম্পিউটারের স্পিকারের গোঁ গোঁ শব্দ ভিতরের ঘরে। এয়ারপোর্টের টারম্যাকে এক একলা প্লেনের অবিরাম চক্কর। কম্পিউটারের নীল স্ক্রিন ড্যাবড্যাবে চোখ খুলে রাত জাগছে। ব্যাঙ্গালোর শহরে রাত দেড়টা। রাত দেড়টায় কত কি যে হয়! সম্মুগম মরে যাওয়া ছোট ছেলেটার সঙ্গে একলা একলা দাবা খেলে। অবিনাশ প্রোজেক্ট প্ল্যান বানাতে বানাতে একের পর এক পর্নোগ্রাফিক ছবি ডাউনলোড করে। সেন্থিল ব্রিগেড রোডের অটোওয়ালাদের সঙ্গে দরদস্তুর করে কোনো রাতপরীর ঠেকে ওঠার জন্য। সুরেশ অটোক্যাডে নতুন পিরামিডের নক্‌শা বানায়। ওরা কাজের মানুষ। দিনের অকাজের ঢিপির খোঁদল থেকে বেরিয়ে রাতে কাজে বসে। আবার কারো কাজও নেই, অকাজও নেই। চাকরিও নেই, নেশাও নেই।'

    এইরকমভাবে একটা লেখা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ব্যাঙ্গালোর নিয়ে এর থেকে বেশি  আর কিছু লেখার কথা ছিল না। লেখাটা স্বাভাবিকভাবেই এই এক প্যারার পরে থম্‌কে গিয়েছিল।  শুধু বাঁচার জন্য থাকা চলছিল।  এবং থাকার জন্য বাঁচা- তাও চলছিল জোরদমে।  অনেকেরই হয় তো তাই। এর মধ্যেই বারো মাস মিহিন জলবায়ু, ইতস্তত আড্ডা এবং বাঙালি সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা, মাল এবং মলময় জীবন- এই সবের ঘেরাটোপে বসে  বেশ একটা "চলছে চলবে' ভাব। পর্দার উল্টোদিকে দ্বিমাত্রিক ছবির মতো দর্শিনীর কাগজে মোড়া শস্তা ইডলি, মুকাম্বিকা বারের কাউন্টারে গেলাস হাতে শূন্যদৃষ্টি মাতাল, মল্লিকা মালিগে মাথায় গুঁজে রুগ্না পরিচারিকাদের দঙ্গল, প্রায় সংকোচে পথ চলা ইংরিজি-না জানা নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারী, ক্রসিঙে ক্রসিঙে ভিখারি বালকবালিকা।

    "ব্যাঙ্গালোরে এত ভিখারি?'

    বহিরাগতদের এইরকম সবিস্ময় উচ্চারণের কথাও শুনেছি। যেন ব্যাঙ্গালোর একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্রবিশেষ যার পথে পথে মাউস ছড়ানো, বিবর্ণ পলেস্তরা খসা বিল্ডিঙের জায়গায় গড়ে উঠেছে বৃহদাকার সি পি ইউরাশি; যেন এইস্থলে রাস্তায় পেচ্ছাপ নেই, দেওয়ালে পানের পিক নেই, ভিড় বাসে ঘাম শোঁকাশুঁকি নেই, যেন আছে শুধু নিয়নের সমান ভরের আলোয় ভরা কোটি কোটি কিউবিক্‌ল্‌; যেন বেশ্যা নেই, দালাল নেই, পকেটমার নেই, বেআইনী হকার নেই, ভিখিরি নেই, শুধু মোবাইল হাতে এবং ল্যাপটপ কাঁধে ইঞ্জিনিয়ারদের এক দানবীয় ম্যাট্রিক্স; যেন ব্যাঙ্গালোরের মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শুধু ঈষৎ বক্রচক্ষু নারায়ণমূর্তি, পক্বকেশ প্রেমজি সাহেব। যেন গিরিশ কারনাড, অনন্তমূর্তি, এম এস সথ্যু সবে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক আইকন। যেন কন্নড় ভাষা  সর্বাধিকবার জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অর্জন করেনি।

    কিন্তু খোয়াব তৈরি হয় ভেঙে যাওয়ার জন্যই। যেদিন বিকেল চারটের সময় আপিসের কাজের মধ্যে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। যখন বাড়ি ফিরছি তখনও ব্যাঙ্গালোরের রাস্তাঘাট কর্মব্যস্ত, নিরাপদ। কোনোরকম গোলমালের বিন্দুমাত্র আঁচ নেই, এফ এমে প্রচারিত কিছু ছোটখাটো ঢিল ছোঁড়ার ঘটনা ছাড়া। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা খুব দ্রুত বদলায়। অলিতেগলিতে প্রতিটি দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ। এমনকি পুরোনো কাগজ জড়ো করে রাখার ছোট টিনের গুমটির দরজাতেও তালা। মোড়ে কাউন্টার পেতে বসে থাকা পান সিগারেটের দোকানিরা উধাও। শুধু মদের দোকানের সামনে ছায়ামূর্তিদের ইতস্তত জটলা। দ্বিগুণ দামে লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু বোতল বিকায়। কেব্‌ল টি ভিতে খবর আর কন্নড় ভাষার চ্যানেল ছাড়া সব বন্ধ। পরের দিন সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টি ভির পর্দায় এক জ্বলন্ত শহরের লম্বা গল্প। চলতে থাকে সারাদিন। অবিরাম বাস পোড়ে। রাজকুমারের ছবি না লাগালে সাধারণ গাড়িও অনেক সময় রেহাই পায় না। জ্বলতে থাকা বাসের মধ্যে থেকে সন্ত্রস্ত পুলিশ কনস্টেবলকে টেনে বার করে পিটিয়ে মারা হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে, টিয়ারগ্যাস ছোঁড় এবং অবশেষে বন্দুক চালায়। বাকি দেশ গা ঝাড়া দিয়ে সবিস্ময়ে লক্ষ করে হরেক ফুটানি এবং গলাবাজি সত্ত্বেও ব্যাঙ্গালোর একটি আদি, অকৃত্রিম ভারতীয় শহর যেখানে খেমটার উপর ঘোমটার মাপটা শুধু অপেক্ষাকৃত বড়। এবং আমাদের মহান ঐতিহ্য অনুসারে যার নিতম্বে কাপড় না থাকলেও মস্তকে জরির টুপি।

    অনেকেই বেশ অবাক হয়েছিলেন। অবাক হওয়ার কিছুই ছিল না। ঠিক এইরকমটাই হওয়ার ছিল।

    ব্যাঙ্গালোরে আমাদের জীবনে অনায়াস যাত্রা ভার্চুয়াল খোপের ভিতরে। যে সংখ্যাগরিষ্ঠ কন্নড়ভাষী অনুচ্চবিত্তদের নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের ইতিহাস, তারা আমাদের বেঁচে থাকার ফেরেব্বাজির মধ্যে কিছু ছায়ার বিন্দু। অ্যাপার্টমেন্ট, অফিস, শপিং মল, পাব, রেস্টুরেন্ট এবং এয়ারপোর্ট- এই ছয়কোণা জীবন সাজাতে আমি এবং আমার মতো কিছু উদ্বৃত্তজীবী পরগাছাই যথেষ্ট। বাকিরা- মুকাম্বিকা বারের সেই মাতাল, বাড়িতে কাজ করতে আসা সেই দক্ষিণী মহিলা, অটোড্রাইভার, রঙের মিস্তিরি, ছোটখাটো দোকানদার, নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারী- একই শহরে থাকে, কিন্তু ব্যাস, ঐটুকুই। আমাদের খোপগুলো শুধু আকাশের দিকে উড়ে যেতে থাকে। বাকিদের সঙ্গে ন্যুনতম আত্মিক লেনদেনের গরজও নেই। অথচ ব্যাঙ্গালোর আমাদের কথাই শোনে। কোথায় রাস্তা হবে, কোথায় শপিং মল, কোথায় এয়ারপোর্ট- সব আমাদের পছন্দ অনুসারে। আমাদের পছন্দের দৈত্য। সেই দৈত্যের হাতের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া ছিঁটেফোঁটা ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করে বাকিদের দল। ভিক্ষান্ন ফুরিয়ে যায়, ক্রোধ জমতে থাকে। এক পাহাড় বিবমিষার চূড়োয় দাঁড়িয়ে আমরা আয়নায় নিজেদের দেখি আর হাততালি বাজাই। সাথসঙ্গত করে সগোত্র মিডিয়াবান্ধবেরা।

    তাই আবারও হবে।

    কোনও রাজনীতির কথা নয়। মানুষের কিছু মৌলিক প্রবৃত্তির কথা। ধরা যাক আমি বহু দশক ধরে পৈতৃক বাড়িতে বাস করছি। এখানেই আমার প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। হঠাৎ আমার বাড়ির পাশে গজিয়ে উঠল বিশালবপু অট্টালিকার দল। নব্যধনীদের বাড়ির দ্যাখানেপনায় ঢাকা পড়ে গেল আমার বহুযুগের আস্তানা। এখন ঘরে রোদ ঢোকে না, বাতাস খেলে না। ওরা আমার এবং আমার আস্তানার অস্তিত্বকে গণ্যও করে না। আমার নিরুচ্চার অস্তিত্ব ওদের কাছে ঠিক যেন পাড়ার ল্যাম্পপোস্ট, পোস্ট আপিসের বাক্স বা এ টি এম কাউন্টার। কর্পোরেশনের চেনাজানা বাবুরা ওদের দরজায় দরজায় জিভ বের করে ঘুরে বেড়ায়। আমার আস্তানা ঢেকে যেতে থাকে। তখন কি আমার মনে হবে না শালাদের দরজায় এক বালতি গু ছুঁড়ে দিই, গাড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে হিসি করি ছ্যাড়ছেড়িয়ে? আর এক দুর্মর আশা পুষে রাখি, একসঙ্গে হলে সারা শহরের কাচ-কাঠ-ইঁট-লোহা ভেঙে চুরমার করব। প্রাথমিক টার্গেট পুলিশ এবং সরকার। তারপর?

    এই অদ্ভুত দোতলা শহরের স্মৃতি নিয়ে কলকাতায় ফেরার পরই একটা খবর পড়লাম। একটি আবাসনের হাই ইনকাম অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা দাবি করেছেন যে তাদের বিল্ডিঙের সামনের গেট শুধু তাদেরই ব্যবহারের জন্য। অপেক্ষাকৃত নিম্নমূল্যের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা এই গেট ব্যবহার করতে পারবেন না। যদিও নির্মাণকারী সংস্থা জানিয়েছেন যে চুক্তিতে এই রকম কোনো কথাই ছিল না। মামলা উচ্চ ন্যায়ালয় অবধি গড়িয়েছে। আদালত ১৪৪ ধারা জারি করেছে।

    খোপ বাড়ছে। নিশ্চিন্ত থাকবেন না। এইবেলা গাড়ি বাড়ি টাকাপয়সা গয়নাগাঁটিগুলো একটু সামলে।

    ২০ (Jul 14 2006)
    অপেক্ষা

    সেই সময়ে মৃত্যু ছিল ভয়াবহ, শোক ছিল উৎসব।

    অন্ধকার মধ্যরাতে বিডন স্ট্রিটের এঁদো গলি কাঁপিয়ে দিত নিমতলাগামী শবযাত্রীদের হরিধ্বনি। হৃদপিণ্ড কুঁকড়ে দম আটকে আসত। কানে দু আঙুল চেপেও জোর করে ঢুকে পড়ত বলহরি হরিবোলের উৎকট রেশ। রাস্তার মোড়ে খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে লাশের পর লাশ শ্মশানে যাচ্ছে। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে চারপাশে গুঁজে রাখা পিল্‌পিলে রজনীগন্ধার রোগা ডাঁটিগুলো মুচড়ে যাচ্ছে। সাদা চাদর আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা নারকেল দড়িতে যাতে ঝাঁকুনির চোটে লাশটা পিচরাস্তায় হুমড়ি খেয়ে না পড়ে। অসহ্য ধূপের ধোঁয়ায় অঝোরে ঝরে সাদা খই আর ধূসর খুচরো পয়সা।তখন লাশ মানে একটা লাশ। জীবন নামের আসল জিনিষটা হারিয়ে আমাদের মজার দুনিয়াটায় একটা বিচ্ছিরি বেঢপ ব্যপার। তাই বৃদ্ধ আত্মীয়রা মারা গেলে ভয় হয় শুধু। এই বুঝি আবার সেই শুয়ে থাকা লাশদর্শনে যেতে হয়। সেই মরা লাশের চারপাশে ফুল আর ধূপের গন্ধ যেন তাকে আরও বীভৎস করে তোলে। তখনও শোক অধরা, অছোঁয়া। তখনও মৃত্যু মানে আগুনে লাশ পুড়ে যাওয়া ধোঁয়া, আদিগঙ্গায় ছড়িয়ে থাকা পাঁকের মধ্যে ন্যাকড়া, শিশিবোতল, জবাফুল, ছেঁড়া রজনীগন্ধার মালা।

    অথচ শ্রাদ্ধ মানেই তুমুল হৈহল্লা। কতদিন বাদে সব ভাইবোনেরা এক হওয়া। কত খেলা-গল্প-গান! বোম্বে-দিল্লি থেকে প্রবাসী আত্মীয়রা কলকাতায় ফেরেন। গন্ধওয়ালা ইরেজার, পুতুলের মধ্যে পেনসিল শার্পেনার, ছবির বই, কোকোকোলা খাওয়ার পয়সা! শ্রাদ্ধবাসরের দিকে পাও মাড়াই না। সেইখানে ছবির সামনে গম্ভীর মুখে বড়দের ভিড়। শামিয়ানার তলার টুকরো টুকরো সকালের রোদ্দুরে ভরা লুচি ভাজার গন্ধ। হঠাৎ কোনো বড়ো এসে আমাদের চেঁচামেচির জন্য ধমক লাগান। এক মিনিটের জন্য মনে হয় এটা ঠিক বিয়েবাড়ি নয়। কিন্তু তার পরে পরেই শুরু হয়ে যায় নতুন নতুন খেলার প্ল্যান। তবে শুধু ছোটোদের কথাই বা হবে কেন? সন্ধ্যাবেলা বড়োরা যথোচিত শুভ্রতা বজায় রেখে সাজুগুজু করে এসে গেটের সামনে আত্মীয়-বন্ধুদের আপ্যায়ন করেন। সদ্য কেনা পারফিউমের গন্ধ ভোজের মিশ্র গন্ধের সঙ্গে ছড়িয়ে যেতে থাকে। মগ্ন হই শোকের আনন্দপালনে।

    আসলে তখন মনে হয়নি আমিও কোনও একদিন মারা যেতে পারি। অসুখ-বিসুখে খুব ব্যথা-বেদনা না থাকলে সে ছিল বড় আনন্দের সময়। স্কুলে যাওয়া নেই, দিনরাত বিছানায় বসে গল্পের বই পড়া। বাবা-মায়ের চিন্তিত মুখ, আত্মীয়-স্বজনের দেখতে আসা, ঠাকুমার সেই পুরোনোকালের নিপুণ সেবা। অসুখের মুখে গন্ধরাজ লেবু দিয়ে শিঙি-মাগুরের পাতলা ঝোলও খারাপ লাগত না। একবার বাবার খুব অসুখে আমাকে রেখে দেওয়া হল এক বন্ধুর বাড়ি যার বাবা খুব ছোটবেলায় মারা গেছেন। সে খুব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করেছিল- তোর বাবার সঙ্গে তোর কখন শেষ কথা হয়েছে? আমার প্রায় সমবয়সি বন্ধুর গম্ভীর মুখ দেখে এবং ততোধিক গম্ভীর প্রশ্ন শুনে একপলকের জন্য হলেও একফোঁটা ভয় ছুঁয়ে গিয়েছিল বটে। কিন্তু তাই বলে আমি? এই তো আমার হাতের কাছে বাবা-মা-কাকু-জেঠু-মামা, এই তো আমার স্কুল, এই তো আমার পাড়ার মাঠ, ছাদে লুকোবার জায়গা, পুরোনো অমর চিত্রকথার ডাঁই, লুকিয়ে পড়া "দেশ' আর রবীনদার রিকশায় যশোর রোড ধরে স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে জানলায় দাঁড়িয়ে গল্প, বান্ধবীর বড় হয়ে যাওয়ার বিস্ময়- এর মধ্যে মৃত্যু কোথায়? আমার পৃথিবীতে তো কোনও মৃত্যু নেই!

    কিন্তু তাও কৈশোর হারাই। বাসাবদল হতে থাকে। শরীরেও অদ্ভুত বদল। নারীদেহ শরীর মাথা তোলপাড় করে। নিরালা দুপুরের হস্তমৈথুন, নিষিদ্ধ ম্যাগাজিন। বাংলা চটি বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেঁড়াখোঁড়া ডেবোনেয়ার আর ফ্যান্টাসি। তখনই হয়তো প্রথম দুনিয়া হারানোর স্বাদ জেগেছিল মনে। ছেলেবেলায় যা চাই তাই পাই বাবা মায়ের হাত ধরে। এখন চাওয়া পাওয়ার হিসেবের মধ্যে পয়সা-সংসার-রুটিরুজির আবছা আদল দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে অনেক কিছু আছে যা হারিয়ে গেলে ফিরে পাওয়া অসম্ভব। বা ফিরে পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়। বুকের মধ্যে কী ভাবে কান্না চাপ বেঁধে ওঠে টের পাওয়া যায়। লুকিয়ে কাঁদার অভ্যাস রপ্ত করতে হয়। যদিও হারানোর লিস্টিতে এখনও মানুষ যোগ হয়নি। শুধু আস্তে আস্তে গোলোকধাঁধায় ঢুকে পড়তে থাকি। আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাই। মাগো, বড় নষ্ট হয়ে যাই!

    এখন অ্যাড্রিনালিনের উদগ্র রোয়াব স্তিমিত। ক্যাওড়াতলার মেঝেতে নিকটজন শুয়ে থাকেন। শুধু একটি স্বেতবস্ত্র শরীরে। কি শান্ত মুখচ্ছবি! কি নিষ্পাপ শ্মশানের এই মাটি! অথচ মৃত্যুর অনতিপূর্বে তারই মুখ দানবের মতো বিকৃত, বুকমুখ ঠেলে উঠে আসে শ্লেষ্মার পাহাড়। সেই মুখ আজ নিমগ্ন কোনও মায়ের গভীর গর্ভে। মাটি ঝরে গায়ে মুখে আগুনে ওঠার আগে। শুধু দুটি পা শেষ পর্যন্ত মাটির দিকে চেয়ে থাকে। কান্না চলে। ইতস্তত কথাবার্তা, সুখস্মৃতির গুঞ্জনের হাসি। মরে যাওয়ার পরেও অনেক কাজ থাকে। তলার স্যাঁৎসেঁতে বেসমেন্টে চুল্লীর নীচে জমা হয় কালো ছাই। কোনও এক বালক অগ্রবর্তী হয়ে নিয়ে যায় সেই গহ্বরের দিকে। হাত দিয়ে তুলে আনে নাভিমূল আর মাটি। শেষ হরিধ্বনিতে আদিগঙ্গায় বিকেল ভেঙে আসে। লাশেদের মুখ থেকে পর্দা সরে যায়।

    হঠাৎ ব্যাঙ্গালোরের সন্ধ্যায় কর্মব্যস্ত সি এম এইচ রোডে আর্যসমাজের মন্দিরে ঢুকে পড়ি। কোনও অচেনা শ্রাদ্ধবাসর। অতিবিনম্রকণ্ঠে এক বালিকা গায় "প্রভু চাকর রাখো জী'। নৈ:শব্দ্যে ঘুরে বেড়ায় ধূপ আর রজনীগন্ধার অতৃপ্ত গন্ধ। কে মারা গেলেন তাঁর মুখচ্ছবি না দেখেই বেরিয়ে আসি। সন্ধ্যার সি এম এইচ রোড ভার হয়ে আসে। নিয়নের তীব্র আলোয় পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। লাল লাল মেঘেরা আকাশ ছেয়ে। আমি বড়ো বড় হয়ে গেছি। মাথার উপরে ছাওয়া ডালপালাদের একে একে ঝরে পড়ার সময় এগিয়ে আসছে। টেলিফোন অপেক্ষায় আছে।

    কত মানুষ মারা যাবে! কত মানুষ মারা গেল! বান্দ্রায়, জুহুতে, মাতুঙ্গা, ভিওয়ান্ডি, গুলমার্গ- ছেয়ে গেল মাটি আর আগুনের মুখ। মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু দাও; আমি মৃত্যু পেতে ভালোবাসি।

    ২১ (Aug 1 2006)
    ইদানীং শোনা রবীন্দ্রনাথের গান

    সুধীর চক্কোত্তি মশাই রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে একটি অসাধারণ বই লিখেছিলেন- নির্জন এককের গান। এখন আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ গান এককের গানই বটে। তব একটু অন্য অর্থে। এখনও কান আর মনে একচেটিয়া বনিয়াদ বানিয়ে রেখেছেন সেই প্রাচীন জ্যোতিষ্কমণ্ডলী। অথচ বছর পঁয়ত্রিশের বিবেচনা এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সায় দেয় না। বয়সধর্মের কারণে অবিশ্রান্তভাবে সেই নতুনকে খুঁজে ফিরি। কিন্তু এই কথা বলার স্পর্ধা রাখি না যে সাম্প্রতিক প্রজন্মের শিল্পীরা পুরোনোদের থেকে গুণমানে কোনও অংশে কম। নিশ্চয় তাঁরা অনলস চর্চায় চর্চিত এবং আন্তরিক বোধে এবং জ্ঞানে দীক্ষিত। কিন্তু আজন্ম রবীন্দ্রনাথের গান শুনে আসা কানে এখন আর কেউই এসে সেই বসত গড়েন না। সকালের বারান্দার চড়ুইপাখির মতো গানগুলো এসে এসে ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। সারাদিনের ব্যস্ততার নির্জনে কেউ হঠাৎ করে বেজে ওঠেন না। অনেক পেয়েও  না পাওয়ার যে শূন্যতা তাড়িয়ে বেড়ায়, তাকে ভরাট করার জন্য কেউ সেতু বাঁধেন না। কাজেই পড়ে থাকি আমি এবং আমার রবীন্দ্রনাথের গান। চ্যানেলে ক্যাসেটে সি ডিতে এমন কি ডি ভি ডিতেও এখন রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচুর ভাঁড়ার। তথাকথিত অন্য ধারার ফিল্মেও ন্যূনতম একটি রবীন্দ্রনাথের গান প্রায় ফর্মুলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ফর্মুলা ফর্মুলাই থেকে গেল, আমার মতো সামান্য এক শ্রোতার গান হয়ে উঠল না। হয় তো আমারই কানের দুর্বলতা।

    তাই নতুনের খোঁজে পুরোনো গানের ধূসর কুলুঙ্গি হাতড়ে বেড়াই। খুঁজতে খুঁজতে পরশপাথর না পেলেও চকিৎ অভাবনীয়ের ক্কচিৎ কিরণ এসে পড়ে মাঝে সাঝে। এই সেদিনই হাতে পেলাম বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া একগুচ্ছ রবীন্দ্রনাথের গান যাদের সবগুলিরই গায়নকাল চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ দশকের মধ্যে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি। যাঁদের গান খুঁজে পেলাম তাঁদের মধ্যে অনেকের নামই হয় তো রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুরাগীরা শোনেননি - বীণা চৌধুরী, সুনীল রায়, তপতী দাম, সমর গুপ্ত, ইলা ঘোষ, সুধা মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী নাহা, সমরেশ রায়। আবার কিছু খুব চেনা গানও রয়েছে যথা রাজেশ্বরী দত্তের "বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "হে ক্ষণিকের অতিথি' বা সুচিত্রা মিত্রের "সকল জনম ভরে' প্রভৃতি। এমন কিছু শিল্পীর গান রয়েছে যারা অন্যরকম গানের জন্যই বেশি প্রসিদ্ধ। বাংলা চলচ্চিত্রজগতের প্রখ্যাত অভিনেতা অসিতবরণের গাওয়া "আমরা দুজনা স্বর্গখেলনা'ও রয়েছে এই সংকলনে। সব গানেরই যে খুব উঁচু মান তা মোটেই নয়। শ্রীলা সেন "বিরহ মধুর হল' গানটিতে এতই বলিষ্ঠ, মনে হয়েছে গানটি বোধ হয় আরও একটু নম্রতা দাবি করে। জগন্ময় মিত্র মহাশয়ের "স্বপ্নে আমার মনে হল' ঠিক যেন "চিঠি" এবং "সাতটি বছর আগে"র একটি সিকোয়েল। ধীরেন বসুর "আজি যত তারা তব আকাশে' দেবব্রত বিশ্বাসের দুর্মর স্মৃতির কাছে দু:খজনকভাবে ম্লান।

    কিন্তু গানগুলো শুনতে শুনতে একটা কথা মনে হচ্ছিল। দিলীপকুমার রায়কে তাঁর গানের সরলতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছিলেন-

    "একজন রূপরসিকের কাছে গেছে এক সুন্দরী। তার পায়ে চিত্র-বিচিত্র করা একজোড়া রঙিন মোজা। রূপদক্ষকে পায়ের দিকে তাকাতে দেখে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলে মোজার কোন অংশে তাঁর নজর পড়েছে। গুণী দেখিয়ে দিলেন মোজার যে অংশ ছেঁড়া। রূপসীর পা-দুটি ওই যে মোজার ফুলকাটা কারুকাজে তানের পর তান লাগিয়েছে নিশ্চয়ই আমাদের হিন্দুস্থানী মহারাজ তার প্রতি লক্ষ করেই বলতেন "বাহবা', বলতেন "সাবাস'। কিন্তু গুণী বলেন বিধাতার কিংবা মানুষের রসরচনায় বাণী যথেষ্টের চেয়ে একটুমাত্র বেশি হলেই তাকে মর্মে মারা হয়। সুন্দরীর পা-দুখানিই যথেষ্ট, যার দেখবার শক্তি আছে দেখে তার তৃপ্তির শেষ হয় না। যার দেখবার শক্তি অসাড়, ফুলকাটা মোজার প্রগল্‌ভতায় মুগ্ধ হয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে।'

    এই পুরোনো গানগুলিতে রবীন্দ্রনাথের গানের এই স্বত:স্ফূর্ত সারল্য আবার খুঁজে পেলাম। বিশেষ যন্ত্রায়োজন, অজস্র তানকর্তব, উচ্চারণের চেষ্টাকৃত নাটকীয়তা- কোনও কিছুতেই গানগুলো ভর করছে না। নিজের পায়ে যেন গানগুলো আবার দাঁড়িয়ে উঠল। কথা ও সুরের মিলেই তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারা রবীন্দ্রনাথেরই গান। যদিও এই সারল্যকে অতিসরল করে রবীন্দ্রনাথের গানকে ভুষিমালে পর্যবসিত করার উদাহরণেরও অভাব নেই। যার চলা ফিরতা উদাহরণ বাৎসরিক রবীন্দ্রজন্মোৎসব বা রবীন্দ্রনাথের বাৎসরিক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহু রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষ রবীন্দ্রজন্মোৎসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে গুলিয়ে ফেলেন এবং পান থেকে চুন না খসলেও অযথাই কুপিত হয়ে ওঠেন। এই সঙ্গীতগুচ্ছের শুধু একটি গানের কথাই বিশেষভাবে উল্লেখ করব। নীলিমা গুপ্তের (ইনিই কি আমাদের চেনা নীলিমা সেন?) গাওয়া "শ্যামল ছায়া নাই বা গেলে।' মুখড়ায় গানটি গাওয়া হয় "শ্যামল ছায়া নাই বা গেলে/ না/ না/ নাই বা গেলে'। এই তিনটে নায়ের মধ্যে আর্তির যে প্রচ্ছন্ন স্বর তা তৈরি করতে গায়িকাকে একবিন্দু অতিরিক্ত নাটকের পর্দা টাঙাতে হয় না। স্বরলিপিবদ্ধ সুরের মধ্যেই কি অনায়াসে বর্ষাবিদায়ের চূড়ান্ততা ফুটে ওঠে। এইখানেই রবীন্দ্রনাথের গানের জিৎ আর এই কথা ভুলতেই আমাদের বেশি সময় লাগে না।

    কিন্তু এই মৃত মানুষদের গান তো আর সামনাসামনি শুনতে পাব না। কাজেই খ্যাপাকে পরশপাথর খুঁজে ফিরতেই হয়। এই রকম কোনও কেনার ঘোরে যা থাকে কপালে বলে কিনে ফেললাম বিক্রম সিং-এর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানের ক্যাসেট। সত্যি কথা বলতে আগে বিক্রমের কোনও গানের কথাও শুনিনি বা পড়িনি। সাম্প্রতিক শিল্পীদের চেনা চক্রে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে নতুন নাম দেখেই এই ক্যাসেট কিনে ফেলা। কিনে ফেলার পর ক্যাসেট খুলে জানতে পারলাম বিক্রম রবীন্দ্রনাথের গানের জনপ্রিয় শিল্পী মোহন সিঙের পুত্র। মোহন সিং তাঁর গানে মুগ্ধ করেছিলেন। যদিও বলে রাখা ভাল তাঁর বাংলা উচ্চারণ  কিছুটা হলেও আমার কানে লাগে। কিন্তু বিক্রম আমাকে আচ্ছন্ন করলেন। অন্তত এই একটি ক্যাসেটে সত্যি সত্যি আচ্ছন্ন করলেন।

    বিক্রম সিং সম্পর্কে দু একটা কথা বলে রাখা ভালো। বিক্রম প্রথাবদ্ধ শিক্ষায় শিক্ষিত শাস্ত্রীয়সঙ্গীতশিল্পী। বিক্রমের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটি ক্যাসেট চোখেও পড়েছে এবং শুনেছি বিক্রম অধিকাংশ সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতই গেয়ে থাকেন। বিক্রমের বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথের দিক্‌পালদের নিকট সান্নিধ্যে। কণিকা বন্দোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, নীলিমা সেনেদের সান্নিধ্যের স্মৃতিতে উজ্জ্বল বিক্রমের শৈশব এবং কৈশোর। ক্যাসেটের কভার থেকে বিক্রমের আরও এক সৌভাগ্যসংবাদ পাই। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবনের শেষ বছরে যখন বিশ্বভারতীতে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে বাংলা পড়াতে যান, বিক্রম ছিলেন তাঁর ছাত্র। শক্তি নাকি বিক্রমের গাওয়া গানের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। অর্থাৎ বোধ, সুর এবং ঘরানা- তিনের তালিমের কোনও অভাব নেই বিক্রমের গানের গঠনপর্বে। বিক্রম গান গানও গড়পড়তা শিল্পীদের থেকে অনেকটা উঁচু পর্দায়। শান্তিদেব ঘোষের পরে এবং দুই একটি গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া এত উঁচু পর্দায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে কাউকে শুনিনি। এই ক্যাসেটে গ্রথিত গানগুলির নির্বাচন থেকেই মেপে নেওয়া যায় শিল্পীর আত্মবিশ্বাসের মাত্রা- "আজ যেমন করে', "চোখের জলের লাগল জোয়ার', "আরো আঘাত সইবে আমার', "তবু মনে রেখো', "বিরহ মধুর হল আজি', "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই', "এরা পরকে আপন করে', "ও যে মানে না মানা', "আজ জ্যোৎস্নারাতে', "কিছুই তো হল না'। এর বেশির ভাগ গানই কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের গলায় সুপার ডুপার হিট। কিন্তু বলতে একবিন্দু দ্বিধা নেই, বিক্রম চেনার মাঝে অচেনার আনন্দের ভাগ দিয়েছেন। দেবব্রত-হেমন্তদের গান শুনে শুনে রবীন্দ্রনাথের গানের শ্রোতারা ব্যারিটোন প্রত্যাশী হয়ে পড়েছেন। সন্তোষ সেনগুপ্ত মশাই দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠস্বরকে মহাবলীপুরমের সমুদ্রধ্বনির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সেই তুলনায় বিক্রমের কণ্ঠ একটু অন্যরকম। মনে হয় যে হাওয়ায় দুপুরবেলা এক ঝাঁক শালপাতা মাঠের ওপারে উড়ে যায়, সেই হাওয়া রাতের কোপাইতে চাঁদের সঙ্গে খেলা করে।

    দুটি গান একটু অপ্রচলিত সুর ও ছন্দে গাওয়া। "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই" গানটির এই পাঠভেদ এবং সম্পূর্ণ কীর্তনাঙ্গ রূপ আগে কোথাও শুনিনি। চলতি গায়নের সঙ্গে এই সংস্করণটির একটু তুলনা করলে পার্থক্য পরিষ্কার হবে। সাধারণভাবে গানটির শেষ চরণটি গাওয়া হয়- "তুমি যদি বল এখনি করিব বিষয়বাসনা  বিসর্জন'। বিক্রম গেয়েছেন- "তুমি যদি বল এখনি করিব বিষয়বাসনা বিসর্জন/দিব শ্রীচরণে বিষয়/দিব অকাতরে বিষয়/ দিব তোমার লাগি বিষয়বাসনা বিসর্জন'। সাধারণভাবে "ওরা পরকে আপন করে' গানটি ঢালা গান হিসেবে গাওয়া হয়। শ্রদ্ধেয় সুভাষ চৌধুরি মশাই এই ঢালা গান গাওয়ার প্রবণতার একটি অনভিপ্রেত দিক সম্পর্কে বলেছিলেন যখন অকারণেই রবীন্দ্রনাথ প্রযুক্ত ছন্দ অস্বীকার করে গানগুলিকে ছন্দহীনভাবে গাওয়া হয়। সৌভাগ্যবশত বিক্রম এই গানটিকে ছন্দোবদ্ধ রূপে গেয়ে অন্যতর মাত্রা দিলেন। আরও দু একটি গানের কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। অনেক সময় "আজ জোৎস্নারাতে' গানটি এমন করে গাওয়া হয়ে থাকে, মনে হয় "ঠান্ডি হাওয়া ইয়ে চাঁদনি সুহানি।' অথচ গানটি রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত যন্ত্রণার গান যখন তিনি প্রিয় পুত্রের মৃত্যুর শোকে স্তব্ধ- "আমারে যে জাগতে হবে, কি জানি সে আসবে কবে/ যদি আমায় পড়ে তাহার মনে/ বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।' পিতার এই অপার্থিব সংলাপ গানের জগতে বিরল। বিক্রম চড়ায় প্রথম পর্দা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতার সাকিনে নাড়ীছেঁড়ার হাহাকার গুমরে ফেরে। আজকের দিনে এ এক দুর্লভ সৌভাগ্য। শুনেছি শক্তিরও বড় প্রিয় ছিল এই গানটি। বিক্রম চমকিত করেছেন "তবু মনে রেখো' গানটিতে। রবীন্দ্রনাথের নিজের গলায় ধরে রাখা গান যা পরে সুচিত্রা মিত্র গেয়েছেন। সুচিত্রা মিত্রের গলায় গানটি একটি লিজেন্ড। এই গানের নতুন অভিঘাত প্রায় স্বপ্নসম্ভব যা বিক্রমের গানে পেয়েছি। প্রসঙ্গত:, ক্যাসেটটির নামও "তবু মনে রেখো'। ন্যূনতম যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার হয়েছে। ঢালা গানগুলিতে তানপুরার সঙ্গতই মুখ্য যন্ত্রশব্দ।

    রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অনতিপূর্বে ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ বলছেন-

    "আমার গান যাতে আমার গান বলে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরো হাজারো গান হয়তো আছে- তাদের মাটি করে দাও-না, আমার দু:খ নেই। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি- তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের গান কি না বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য। মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব-কিছু সইতে হয়, এও যেন আমার পক্ষে সেই রকম।"

    বিক্রমের গান শুনে আচ্ছন্ন হলাম এবং আশ্বস্ত হলাম। বৃদ্ধের কথা এখনও কেউ কেউ মনে রেখেছেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পটুতা সত্ত্বেও।

    ২২ (Aug 16 2006)
    একটি বিদ্রোহের গল্প

    এ এক পুরাতন কাহিনী বটে। জ্ঞানীজন এরে ইতিহাস কন। ধর্মের ইতিহাসও বটে। অধুনা কে বা শুনে ধর্মকথা, কে বা শুনে প্রাচীন কাহিনী? ইত্তিহাদের পথ জুড়ি বসে রয় অবিরত রক্তমাংসস্রোত। প্রতিযুগ জাহিলিয়াসম। কে বা ভ্রাতা, কে বা পিতা, কে বা আত্মপর, এ জগৎ মহাহত্যাশালা। ফজরের নামাজ শেষে মুণ্ড রাখি অব্বু ঘ্রাইব ক্রোড়ে। নিরীহের রক্তস্রোতে ক্ষনদষশহয়ভড়ঢ়ত-র তোড়জোড় শুরু। বিশ্বাস ওদের গণতন্ত্রে বা বিশ্বাস ওদের জিহাদে। বিশ্বাসে মিলায় প্রাণ গল্প বহুদূর। তাও গল্প গল্প হয় সময়ের ফেরে। শোনার জন্য গল্প শুনি, বলার জন্য গল্প বলি। নীতিকথা গুণীজন করহ সন্ধান। কথকের নীতিকথা নাই।

    পারস্যদেশে সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়। পুবের দিকে ইংরাজ আর উত্তরশিয়রে রুশিগণ আছে ওঁত পেতে। তাঁরা রাজদণ্ড হাতে তোলে নাই। কেবল বণিকের মানদণ্ড কাজার রাজবংশের শাহদের রাজদণ্ডরে শিথিলতর করে। রাণীর মুকুটমণি ভারতবর্ষ যেনতেন প্রকারেণ রক্ষা করা চাই। তাই পারস্য সাগর জুড়ে ইংরাজ শ্যেনদৃষ্টি পাতে। উত্তরে রুশীদের রোয়াব। অক্ষম শাহেদের হাত থেকে সবই যায় বিদেশীদের অতল তহবিলে। অন্য দিকে ছকে পাতে ঘোর শক্তিশালী উলেমার দল। নজফ আর কারবালা জুড়ে তাঁহাদের বিপুল ওয়াকফ দৌলত। শিক্ষা, আইনব্যবস্থা চলে উলেমার অঙ্গুলিহেলনে। উলেমারাই বিদেশীদের বিরুদ্ধে অসন্তোষের রসদ জোগান। তাই শ্রেষ্ঠীগণ তাঁদেরই পদানত। শ্বেতচর্মের বর্ধমান প্রভাবে শাহের উপর তারা ভরসা হারায়।

    সাধারণ শিয়াগণ প্রচ্ছন্ন ইমামেরে খুঁজে ফিরে। যে ইমাম পয়গম্বরের স্নেহস্পর্শ বিতরণ করে, পৃথিবীরে শুদ্ধ ন্যায়ের আলোক দেখায়, সাম্যের ধ্বনিতে মন্দ্রিত করে ইসলাম হৃদয়। অথচ কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদের হাতে হুসেনের হত্যার পর থেকে ইসলামের খলিফারা শিয়াদের ইমামেরে সহিতে না পারে। একাদশ ইমাম হাসান আল আসকারিরে খলিফা গৃহবন্দী করে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে। অত:পর শিয়াগণ প্রচ্ছন্ন ইমামেরে খুঁজিয়া বেড়ায়। সেই রক্তকান্নাস্বেদ প্রতি বৎসর মহরম পরবে মথিত করে পারস্যের ভূমি।  নিরুপায় অদৃষ্টবাদী গণহৃদয় তাদের প্রচন্ড আকুতিরে উন্মোচিত করে এই পুণ্যদিনে। শাহের স্পনসরশিপে দু:খের পবিত্র উৎসব উৎসবযাপন। অথচ শূন্য শূন্যই থেকে যায়। বিগত এবং আগামীর খোয়াবে বিভোল পারসিক জনগণ। বর্তমান শুধু অন্যায়ের লীলাক্ষেত্র। কি ঘর বানাইলাম আমি শূন্যের মাঝার? এই গভীর আকুতি উলেমাদের না-পসন্দ। তাদের কেতাবে আছে ফিখ আর শরিয়ার কঠোর নিয়ম। শূন্য শুধু শূন্যে থেকে যায়।

    সময়ের এইরূপ অবস্থা যখন, হেনকালে আইলেন সৈয়দ আলি মহম্মদ। ১৮৪৪ সালে জানালেন তিনিই স্বর্গের দ্বার, তিনিই প্রচ্ছন্ন ইমাম। সেই স্বর্গের দ্বার, আরবি ভাষায় যারে বাব কহা হয়। ইশফাহান, তেহরান, খুরাসান বাবের প্রবল আহ্বানে উদ্বেল হয়ে উঠে। উলেমা, শ্রেষ্ঠী এবং মান্যগণ্যদের খরস্রোত বয় এই নববাণীর উৎসপানে। আজানে ধনিত হয় বাবের পুণ্যনাম। নামাজিদের প্রার্থনার মুখ ফিরে শিরাজে বাবের জন্মভূমিদিকে। মক্কয় হজযাত্রায় গিয়ে পবিত্র কাবার পাশে দাঁড়িয়ে বাব সজোরে উচ্চারিলা তিনিই প্রচ্ছন্ন ইমাম। তাঁর শিষ্যশিষ্যাগণ- কুরাত আল আইন, মুল্লা সাদিক, মির্জা মহম্মদ আলি বরফুরুশি এক  নবধর্মের কথা কহেন। বাব প্রকাশ করেন শিয়াদের এক নূতন ম্যানিফেস্টো- এক নূতন "বয়ান'। কী সেই নবধর্ম? কী বা সেই অদ্ভুত "বয়ান'?

    পুরাতন ধর্মের কাল গিয়াছে। মানবজাতি এক নবযুগের সদরদরজায় দাঁড়িয়ে। অতএব পুরাতন ধর্মগ্রন্থসমূহ বাতিল হউক। কর্মযোগে ভর দিয়া উঠিয়া দাঁড়াও। স্থাপন কর সামাজিক সাম্য। বাণিজ্য উন্মুক্ত হউক। সাধারণের উপর করভার লঘু করা হোক। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সুনিশ্চিত হউক। নারীগণ পূর্ণাঙ্গ মর্যাদায় উদ্বোধিত হন। এই এক মানবজীবন। বেহেশ্‌তের খোয়াব নাই, পরজন্ম নাই, আল্লার দরবারের শেষ বিচার নাই। যা হয় তা এইখানেই হয়, যা কর তা এই ক্ষণেই কর। এই পৃতিবীতে, এই একটি মাত্র জীবনে। এই পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতেই তোমাদের পুণ্য, এই পৃথিবীর সুস্থ সমাজই তোমাদের স্বর্গ।

    নগরে নগরে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। বাব যাথানিয়মে কারারুদ্ধ হলেন। এক কারাগৃহ থেকে অন্য কারাগৃহে স্থানান্তরের সময় মানুষের স্রোত উতরোল। কারাগৃহে অন্তরীণ বাব অত্যাচারী শাহকে তীব্র বিক্ষোভের চিঠি লেখেন। অনুগামীভিড়ে পরিপূর্ন কারা অভ্যন্তর। কারাগৃহ তীর্থস্থান হয়। বাব আরও দূরে নির্বাসিত হন। সুদূর চিহরিঘ দুর্গে বাব নির্বাসিত হলে তীর্থগামীদের ঠাঁই নাই কারাগৃহপ্রাচীরবেষ্টনে। ভিড় ছড়াইয়া পড়ে রাস্তায় রাস্তায়। ১৮৪৮ সালে তাব্রিজে বাবের চূড়ান্ত বিচার। অনুগামীগণ প্রত্যাশায় থরথর। ন্যায়, সাম্য, শান্তির নবযুগ আগত ঐ। তার পর? প্রমাণ করা হল বাব একটি নির্দন্ত ত্রাতা। প্রমাণিত হল বাবের আরবী ভাষাজ্ঞান সীমিত, ধর্ম ও দর্শনে তাঁর নৈপুণ্য সন্দেহজনক, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাথে তাঁর কোনো চেনাজানা নাই। তিনি পুঅনরায় কারারুদ্ধ হলেন। কিন্তু ততদিনে বাব আর ব্যক্তি বাব নন, তিনি এক পুরাকালীন অর্কপ্রভ বিপ্লবসম্ভব। ততদিনে ধর্ম আর নীতির আঙন ছেড়ে বাবপন্থীরা আর্থ-সামাজিক ন্যায়ের খোলা রাস্তায় তুমুল বেগবান। সে আগুন ছড়িয়ে গেছে সব প্রাণে।

    ধার্মিকেরা জড়ো হল নবধর্মের প্রাণোচ্ছাসে, ধর্ম-উদাসীরা জড়ো হন সামাজিক ন্যায়বিপ্লবের প্রবল উল্লাসে। ১৮৪৮ সালে খুরাসানের বুদাশ্‌ত শহরে বাবপন্থীদের বিশাল সভার আয়োজন। কী হয় সেই সভায়? প্রকাশ্যে কোরান বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। শরিয়তী আইন ইসলামের একমাত্র আইন- এইরূপ নিয়মাদি অমান্য করা হয়। বিশ্বাসীগণ আপনাপন বিবেকের স্বর মানিয়া চলুন। উলেমার কোনোরূপ সহায়তা বিনা ন্যায়বিচারের পথ খুঁজিয়া লউন। আপনাপন বিচারে শরিয়তী আইন মান্য হইলে মান্য, নতুবা নয়। অদ্য হইতে যাবতীয় "অপবিত্র' বস্তুসমূহ "পবিত্র' বলিয়া ঘোষিত। বাবের অগ্নিসমা শিষ্যা কারাত আল আইন প্রকাশ্য সভাস্থলে মুখের হিজাব ছিঁড়িয়া ফেলেন। বাবেদের কাছে নারীদমনের প্রতীক হিজাব ছিন্নভিন্ন, ভূলুন্ঠিত। সত্য এক নয়। সত্য অনির্বচনীয় নয়। কালক্রমে ধীরে ধীরে ঈশ্বরের নির্মোক উন্মোচিত হয়। এই সত্যবিচারের ভার মানুষের উপর।

    বহু ভক্ত এই প্রবল আদেশে ভীত, পলায়নপর। বহু ভক্ত নেতাদের আক্রমণোদ্যত। সভাস্থলে বিশৃঙ্খলা, নবজন্মের যন্ত্রণায় বিপন্ন সময়। কিন্তু এইবার নেতারা অস্ত্র হাতে তুলে নেন। কৃষকেরা দলে দলে যোগ দেয় যুদ্ধে। সরকারী বাহিনীর সাথে ঘনঘোর সংঘর্ষ। লড়াই এবার মগজ ছেড়ে পেটের মধ্যে বেঁধে। নারীগণ পুরুষের সাজে যুদ্ধে নামেন। এইবারে অবস্থা সঙ্গীন। এই প্রথম দরিদ্র কৃষকেরা বোঝে তাঁরাও এই অসম যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সহযোদ্ধা। তাঁদের কন্ঠও শোনবার সময় এসেছে। ১৮৫০ সালেও ইয়াদ, নাইরিজ, তেহরান, জানজানে বিদ্রোহের ফুটন্ত কুসুম। এইবার দমনের সময় এসেছে। ১৮৫০ সালের ৯ই জুলাই বাবকে ফাঁসিতে চড়ানো হয়। অন্য সব নেতাদেরও হত্যা করা হয়। অনুগামীদের উপর নামে নৃশংস অত্যাচার। এক অংশ অটোমান ইরাকে পালান। ১৮৬৩ সাল নাগাদ আন্দোলন স্তিমিত, দ্বিধাবিভক্ত।

    এই হল গল্প। ইহা ইসলামেরই গল্প বটে।

    আমার কথাটি ফুরোলো।
    নটে গাছটি মুড়োলো
    কেন রে নটে মুড়োলি
    কোন প্রাণটা জুড়োলি।
    প্রাণের গল্পে  ধৈর্য নাই
    আইস এবার  যুদ্ধে যাই।

    ২৩ (Sep 1 2006)
    বুলাদির সঙ্গে কিছুক্ষণ

    প্রবাস থেকে দীর্ঘকাল বাদে ফিরে দেখি বঙ্গভূমিতে বুলাদির জয়জয়কার। যেখানে তাকাই বুলাদি, যেদিকে শুনি বুলাদি। এমন কি শারদীয়া আনন্দমেলার বিজ্ঞাপনের পাতাতেও দেখি জ্বল্‌জ্বল্‌ করছেন মিচকে হাসি বুলাদি। আবার শুনতে পেলুম কলকাতার বড়ো বড়ো আটখানা পুজোর মণ্ডপের দোরে পেল্লায় পেল্লায় মিচকে হাসি বুলাদি দাঁড়িয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা করবেন। অনেকেই নাকি বুলাদির এই এক্সপোনেনশিয়াল বাড়বাড়ন্তে বেজায় ক্ষুব্ধ। কিন্তু বুলাদিকে দেখলেই আমার বেজায় হাসি পায়। কুল্‌কুলিয়ে পেটের ভিতর থেকে হাসি বেরিয়ে আসে। বিশেষত যখন বেচারা লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে লুডো খেলার প্রস্তাব করে। ইদানীং আমাদের সমাজে কমেডি বলতে শুধু রাজনীতি আর খবরের কাগজ। সেই অবস্থায় বুলাদি খুব জরুরি সংযোজন। তবে পড়লুম যে বুলাদির বাড়বাড়ন্তে কিছু কিছু লাভও দেখা যাচ্ছে। যেমন সোনাগাছি এলাকায় এড্‌স্‌ সংক্রামিত যৌনকর্মীর সংখ্যা পাঁচ শতাংশে নেমে এসেছে। ভারতের অন্যান্য লালবাতি এলাকায় এই সংখ্যা নাকি তিরিশ শতাংশেরও বেশি। তবে বিভিন্ন এন জি ওর অক্লান্ত পরিশ্রমও নিশ্চয় এই কাজে সহায়তা করেছে। সব থেকে বড়ো কথা, বুলাদির কল্যাণে যদি আমাদের পরভিন, বৈশাখী, মসলিনা, তপনের পুজোর গল্প একটু কম পড়তে হয় তাতে ক্ষতি কি? যাক্‌ গে। কিবোর্ড চাপড়ে সমাজ পালটানোর বকওয়াসে কোনও বিশ্বাস নেই। কাজেই আমরা আমাদের গপ্পোগাছাই করি। আমাদের যৌনতার গপ্পোগাছা। আশা করি লেখার শিরোনাম পড়ে এর মধ্যে অনেকেই ঠিক করে ফেলেছেন যে এই লেখা না পড়াই ভাল।

    ব্রাহ্মরা আসার আগে অবধি আমাদের বাঙালি সমাজে যৌনতা বেশ প্রবল আকারেই ছিল। সেই সময় কলকাতার বুকে লালবাতি এলাকার সংখ্যা দেখলে ব্যাপারটা বেশ ঠাহর হয়। তবে ব্রাহ্মরা আসার পরে এই যৌনতার ব্যাপারটা লুকিয়ে পড়ল। চলে গেল তা একেবারেই নয়। মজার ব্যাপার হল যে ব্রাহ্ম মনীষীদের মধ্যে অনেকেই নিজের জ্ঞাতি ভাই বা বোনেদের বিয়ে করেছিলেন। হুতোম প্যাঁচার কালে বাবু তার ইয়ারদোস্ত নিয়ে মাহেশে যাওয়ার সময় "মেয়েছেলে' না পেয়ে নিজের পিসিকে নিয়েই রঙ্গ করতে গেলেন। এই জাতীয় গপ্পো ব্রাহ্ম সংস্কৃতি কায়েম হবার পরে একটু থিতিয়ে এল, অন্তত প্রকাশ্যে। অন্যদিকে এই স্রোতকে আরও বলবতী করলেন মিশনারি হিন্দুরা। প্রথমে রামকৃষ্ণ, এবং পরে তাঁর পরে তাঁর শিষ্যরা। স্বামীজি নাকি ছোটোবেলাতেই রাধা-কৃষ্ণ পূজার বিরোধী ছিলেন। তাঁর উপাস্য ছিলেন শিব। তবে বৈদান্তিক সন্ন্যাসী চিরকাল সন্ন্যাসী মহাদেবকেই দেখে এলেন, দুর্গা আর চার কৃতী ছেলেমেয়ে নিয়ে ভরা সংসারের কর্তা শিবঠাকুরকে তাঁর চোখে পড়ল না। এখন আবার শুনি যৌনতার ভরা কোটাল এসেছে। কেউ কেউ কপাল চাপড়াচ্ছেন, আবার কেউ কেউ "এ যৌবনজলতরঙ্গ রুধিবে কে' বলে মস্তি করতে বেরিয়ে পড়েছেন। যদিও আশেপাশের ছেলেমেয়েদের দেখে এখনও মনে হয়নি যে তারা ফাঁক পেলেই একে অন্যের সঙ্গে শুয়ে পড়ছে। শুধু টি ভি, খবরের কাগজ, সিনেমা দেখে দেখে মনে হয়েছে যৌনতা যত সুলভ হয়েছে, ততই স্ট্যান্ডার্ডাইজ্‌ড্‌ হয়ে পড়েছে। শপিং মলে সাজিয়ে রাখা ব্র্যান্ডেড মালের মতো। উপযোগিতা আছে, আনন্দ নেই। অবিরত সুখ আছে, আকস্মিক স্বর্গীয় বিস্ফোরণ নেই।

    আমাদের ছোটোবেলার যৌনতা নিয়ে কেউ খুব একটা খোলসা করে কিছু লেখেন না। "মহাস্থবির জাতক' মনে হয় একমাত্র আত্মজৈবনিক বই, যাতে কৈশোরের যৌনতার উজ্জ্বল উল্লেখ পাওয়া যায়। তখনও কিন্তু ছেলেপুলেরা বেশ অল্প বয়সেই পাকত। অনেকেই ভুলে যান যে ইয়ং বেঙ্গলের বিদ্রোহীরা যখন মাল খেয়ে বাওয়াল শুরু করলেন, তখন তাঁরা চোদ্দো পনেরো বছর বয়সের কিশোর মাত্র। তবে আমাদের ছোটোবেলায় ঘরেদোরে সহাস্য বুলাদি ছিলেন না। ইমরান হাশমি, মল্লিকা শেরাওয়াত, শেফালী জরিওয়ালা, রাখি সাওয়ান্ত- কেউই ছিলেন না। আমাদের ভরসা বলতে রাজ কাপুর। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাড়িতে বাবা মায়ের কড়া শাসন। আনন্দমেলা-সন্দেশের বাইরে লক্ষ্মণরেখা। অন্যদিকে সিনেমা বলতে সবুজ দ্বীপের রাজা, হীরক রাজার দেশে। মানিকবাবু তো শিশুদের সিনেমায় প্রতিজ্ঞা করে কোনও নারী চরিত্র রাখলেনই না। তবে অরুণ-বরুণ-কিরণমালা দেখার সময় কিরণমালাকেই বেশি বেশি করে দেখতাম। আর ছিল আনন্দবাজারের দ্বিতীয় পাতায় বাঁদিকের নীচের কোণে অরণ্যদেব আর রিপ কার্বি। ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ার সময় যৌন তীব্রতা নেই, কিন্তু অচেনার আনন্দ তো রয়েছে। অনেকে দেশে কাপড়ের বিজ্ঞাপন দেখে সেই অচেনার আনন্দের স্বাদ নিত। সব কিছুই যে বালকদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি তা মোটেও নয়। সেই বয়সে আমার বন্ধুবান্ধবীদের মধ্যে একটা প্রিয় খেলা ছিল দেশে কোনও বিজ্ঞাপন দেখে সেই মডেলদের মতো পোজ করা। সেই পোজ যে সর্বদা ক্লাস ফোর ফাইভের বালক বালিকাদের পক্ষে নির্দোষ ছিল তাও নয়। বালক এবং বালিকা- উভয়েই অত্যুৎসাহে এই খেলা খেলত। তবে এই অচেনার আনন্দ অন্যরকম রোপ পেত ছেলেদের স্কুলে। একটু পেকে যাওয়া ছেলেরা ফরমান জারি করত যে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলাই বারণ। যার সঙ্গে ক্লাস থ্রি অবধি খেলে এসেছি, এখন রাস্তায় তাদের দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া। বাজারে যখন সবাই এই ফর্মান মেনে চলছে, তখন পলটু একদিন মাথাটা পিছনের বেঞ্চে হেলিয়ে দিয়ে বসেছিল। আর পিছনের বেঞ্চের বিলটু একটু মুখ ঝুঁকিয়ে পলটুর মুখের সামনে মুখ রেখে কথা বলছিল। ব্যাস! ক্লাসের মধ্যে উদ্দাম হুল্লোড়! শেষে এক দাড়িওয়ালা টিচার, যাঁকে দাদা বলে ডাকতুম, এসে শান্তি স্থাপন করলেন। শান্তি স্থাপনের প্রথম পর্বে উদ্দাম মার, দ্বিতীয় পর্বে গম্ভীর স্বরে জ্ঞানদান। শেষে দাদারও চোখ ছল্‌ছল্‌, আমাদেরও চোখ ছল্‌ছল্‌। এখনকার ছেলেপিলে হলে কেলাসেই নির্ঘাৎ ফ্যাঁচ্‌ফ্যাঁচ্‌ করে হেসে ফেলত। পরে যখন ঈশ্বরানুগামীদের ইস্কুলে গেলাম, সেইখানে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর ফ্রিকোয়েন্সি আরও বেশি। তার উপর পাশেই মেয়েদের ইস্কুল। কিন্তু মফ:স্বলের মধ্যবিত্ত সমাজে মেয়েদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মেশা তখনও ট্যাবু। কাজেই, যখন হর্মোন শিরায় শিরায় বন্যার মতো বইছে, তখন এই যৌনতার বহি:প্রকাশ হল একটু অদ্ভুতভাবে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় ছেলেদের মধ্যে একটা খেলা হয়ে দাঁড়াল, কাউকে একটু অসাবধান পেলেই তার যৌনাঙ্গ টিপে দেওয়া। অথচ ক্লাস নাইন টেনে কোচিং-এ যাওয়ার সুবাদে যখন আবার ছেলেরা আর মেয়েরা কাছাকাছি, এই খেলাও আর রইল না। তখনও সমকামিতার সম্পূর্ণ অর্থ জানতাম না। যাঁরা এই খেলা খেলতেন তাঁদের কেউ সমকামীও নন, কারণ পরবর্তী জীবনে সবাই বিয়েথা করে সুখী সংসারী। তবে ঈশ্বরানুগামী ইস্কুলের ছাত্র হওয়ায় হোমোসেক্সুয়ালিটির গপ্পোগাছা আমাদের কানে যত সহজে পৌঁছাত, লেসবিয়ানিজ্‌ম্‌ সম্পর্কে ততটা ধারণা ছিল না। সমকামিত্বের রাজনীতি বুঝতে আরও অনেক বড় হতে হল।

    নিউ ইয়র্কে ফিফ্‌থ এভিনিউতে সেইদিন উপচে পড়া ভিড়। দুইধারে মানুষের ঢল নেমেছে। মেট্রো স্টেশনে বহু মানুষের হাতে হালকা বেগুনি বেলুন, মাথায় রামধনু রং ফেট্টি। এক থেকে আশি বছর বয়সের লোকজন হুল্লোড় করতে করতে চলেছে। রাস্তার পাশে প্রেসবিটারিয়ান চার্চের যাজক যাজিকারা হাসিমুখে মানুষজনকে পানীয় জল সরবরাহ করছেন। আমি ম্যানহাটনের অনেকটা দক্ষিণ দিকে। তখনও প্যারেড এইদিকে এসে পৌঁছয়নি। সমকামী এবং বিকল্প যৌনতায় বিশ্বাসীদের বাৎসরিক প্যারেড যা গে প্রাইড বলে বিখ্যাত। আমি একলাফেকলা বাঙালি দর্শক, রাস্তার বেড়ার পাশে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে তাক করে দাঁড়িয়ে পড়লুম। প্রচন্ড ভিড় চারদিকে। হঠাৎ মেঘের গর্জনের গুরুগুরু রব আর জনতার তুমুল উচ্ছ্বাস। একঝাঁক তেজী আরবি ঘোড়ার মতো হার্লে ডেভিডসনের দল সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের ইঞ্জিন চলছে, তাতে মাদলের দ্রিম দ্রিম ধ্বনি। এটাই প্যারেডের শুরু। এই বিশাল প্যারেডের বিশদ বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে যদি কেউ ভাবেন এ বোধ হয় কেবল যৌনতা এবং ছ্যাবলামির কার্নিভাল, তাহলে বোধ হয় ভুল ভাববেন। যদিও প্যারেডের সিংহভাগ অধিকার করে থাকেন বিচিত্র সাজপোষাকে বা প্রায় বিনা সাজপোষাকে সজ্জিত নরনারী। আপনার যদি কৌতুকবোধের ক্ষমতা বজায় থাকে, তাহলে মাঝে মাঝে পেট ফাটিয়ে হাসি পাবে। এখনও মনে পড়ে সেই বেঁটে মোটা লোকটিকে। ডেভিড বুনের মতো চেহারা, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। মাথার চুলে পিছনের দিকে দুইটি লম্বা বিনুনি, আমার মা-মাসিরা ছোটবেলায় যেমন বাঁধতেন। পরনে সাদার উপর নীল ফুল ফুল আঁকা বাচ্চাদের ফ্রক। হাতে পুতুলের বাক্স, তার মধ্যে থেকে উঁকি মারছে ছোট্ট খুকি পুতুল। পায়ে বাচ্চাদের ইস্কুলে পরে যাওয়ার কালো জুতো।

    কিন্তু, এই প্যারেড যতটা মজা ততটাই রাজনৈতিক। হেঁটে আসেন নিউ ইয়র্ক পুলিশ এবং দমকলবাহিনীর কর্মীরা, নিজেদের ইউনিফর্ম পরনে, সমকামীদের সমানাধিকারের দাবীতে কণ্ঠ মিলিয়ে। যোগ দেন নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ রাজনীতিকেরা। প্যারেডের এক বিশাল অংশ জুড়ে কেবল বুশ-বিরোধী পোস্টার। বহু যুদ্ধবিরোধী, বামপন্থী, সমাজতান্ত্রিক, নারীবাদী গ্রুপের সদস্যরা এই মহামিছিলে সামিল। বহু ডেমোক্র্যাট পার্টির সদস্য তাদের পতাকা হাতে যোগ দিয়েছেন। আশ্চর্য ব্যাপার হল, এদের মাঝে রিপাবলিকান একটি গ্রুপও আছে। তাঁদের পদক্ষেপ একটু সংকুচিত কারণ তাঁদের দেখতে পেলেই চতুর্দিকে যথেচ্ছ বিড়াল কুকুরের আওয়াজ। এই আন্দোলন বহুত্ববাদের আন্দোলন, মানুষর বৈচিত্র্য স্বীকার করে নেওয়ার আন্দোলন। রাষ্ট্র যেমন এক ভাষা, এক ধর্ম চাপিয়ে দিতে পারে না, ঠিক তেমনি এক যৌনতাও চাপিয়ে দিতে পারে না। স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক যৌনতার নির্মাণ কৃত্রিম। যতক্ষণ দুটি মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করছে, রাষ্ট্র সেইখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এই প্যারেডে যাওয়ার আগে আমার নিজেরও সমকামিতার কথা শুনলে অস্বাভাবিক লাগত। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক আমার পিছনেই দাঁড়িয়েছিল একদল ছেলে। তারা হাবেভাবে, পোষাকে পরিচ্ছদে একদম "আমাদেরই' মতো। কিছুক্ষণ বাদে আরও একদল ছেলে এল যারা এদের বন্ধু। দেখা হতেই প্রত্যেকে প্রত্যেকের ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে চুমু খেল। সেই মুহূর্তে অস্বাভাবিক লেগেছিল। তবে এই জমায়েতে দুই তিন ঘন্টা কাটানোর পরে, সমকামী প্রেমের বহি:প্রকাশ নিয়ে সমস্ত জড়তা কেমন আপনা আপনি কেটে গেল। স্বাভাবিকতার বোধটাই অনেকটা পালটে গেল। বেশির ভাগ লোক যা করে সেইটাই স্বাভাবিক- এটা সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছামতো সাজিয়ে নেওয়া এবং শিখিয়ে দেওয়া কথা। এইটাই জরুরি শিক্ষা ছিল।

    যেদিন এই কার্নিভাল শেষ হয়, সেইদিন রাত্রে হাড্‌সনের রাতের আকাশে বাজির ফুলঝুরি। আমার নিউ জার্সির অ্যাপার্টমেন্টের জানলা দিয়ে নানা রঙের আলোর বন্যা দেখতে দেখতে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেল। কত রঙের আলোর ফুলকি নিজেদের ইচ্ছামতো আকাশে খেলা করছে! কেউ বলছেন না- তুই কেন লাল না? তুই কেন নীল? অন্ধকার হাডসন জুড়ে শুধু আনন্দের রঙিন বিস্ফোরণ। আয় রে রসের সুধায় হৃদয় ভর না।

    ২৪ (Sep 19 2006)
    পুজোর ডায়েরি

    ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসে শিউলি পড়ে থাকে না। নিউ টাউন থেকে গড়িয়ার সাদা বেঁটে বাসটা যখন অন্ধকার মাঠ চিরে ভূতগ্রস্তের মতো কালো পিচের রাস্তায় এসে দাঁড়ায় তখন কোনও দূরবর্তী ভেড়ির কালো জলের থেকে চাঁদ উঠেছে। বিধ্বস্ত শব আপিসফিরতি লোকজনের ঘামের মধ্যে মাঝে মাঝে মাথা তোলে রুগ্ন কন্ডাকটরের কণ্ঠস্বর বিহ্বল কুকুরের মতো। পার্ক সার্কাসের জ্যামে বাস যখন আটকে পড়ে হাই তোলে আর ঘাম মোছে, পাশে অন্ধকার ঘন জঙ্গলের ভিতরে কে জানে কোন কীট ক্ষুদ্র পশু রমনে আনন্দিত হয়! অথবা অন্য পাশে আই টি সি হোটেলের আলোকিত নীড়ে কার দেহে মোবাইল চুম্বন এঁকে দেন মডেলীয় বনলতা সেন। আহা এ কি আনন্দ! পুজো এসে গেল প্রায়।

    শিউলি পড়ে থাকে হাউসিং কমপ্লেক্সে ঢোকার মুখে গেটের পাশে। যেখানে কোনও বিহারী যুবা দিনরাত ইস্তিরি করে যায়, সিকিউরিটি গার্ড সন্ধে হলেই ঢুলে পড়ে আর গেটের গোল গোল আলোর উপরে অসংখ্য পোকারা আসর জমায়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কারা যেন শঙ্খ বাজায়! প্রতিদিন সন্ধ্যায় কে বা জানি ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে একা একা ঘুমোতে যায়- রাতের দিকেই ওদের ফোন আসে। যদিও বেশির ভাগ ভীষণ জোরে টি ভি চালিয়ে "একদিন প্রতিদিন' দেখে। যেন এখনি ভীষণ আওয়াজের প্রয়োজন। এত শব্দের পরেও গড়ে ওঠা প্যান্ডেলের পাশে কুকুরটি শুঁকে যায় অশ্রান্ত মনোযোগে বিগতদিনের আয়োজন। কর্তা কাল মারা গেছেন। রাতের দিকে ফোন আসেনি। এবারে মানুষজনেরাই আসবে। মানুষজন, আপনজন। পুজো আসছে।

    ওর ছেলেটার কাল থেকে খুব অসুখ। জ্বরে হাত পা পুড়ছে, ঠোঁট ফুলে লাল রক্ত পড়ে, চোখ লাল আগুনের মতো। ডাক্তার বলেছে এ এক বিরল অসুখ যা কেন হয় জানি না, কার হবে জানি না। হাসপাতালে ছোট হাতে ছুঁচ ঢোকে, স্যালাইন চলে। অন্য হাত ছুঁড়বে বলে তাও বেঁধে রাখা হয়। কত অসুখ হয়ে যাচ্ছে মানুষের। ঐতিহাসিক উপন্যাসে পড়া অসুখেও লোকে ভোগে আজকাল। অথবা একদম না- পড়া অসুখ যথা চিকুনগুনিয়া। ঠিক যেন ধলভূমের ছোট কোনও গ্রাম যাকে নিয়ে কলকাতার কোনও কবি ঠিক কবিতা লিখবেন। যেমন রিখিয়া। অসুখের নামও কেমন মিষ্টি হয়ে যাচ্ছে! তাই বোধ হয় ওর ছেলেটা একদম ঠিক হয়ে যাবে বলে ডাক্তার বলেছেন। অসুখ চলে যাবে, আবার নতুন নতুন অসুখ আসবে। অসুখের মতো পুজোও এসে যায়।

    কেউ কেউ আবার আসে না, শেষবারের মতো চুমু খেয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। এই ঘরে পড়ে থাকে সরল টিউবলাইটের সাদা আলো, গড়িয়াহাটের ফুটপাথ থেকে কেনা ফুলছাপ চাদর, জেলুসিলের ছেঁড়া পাতা, ড্রয়ারের উপরের তাকে প্রায় লুকিয়ে লোকনাথ বাবা, কাচের শোকেসে সাজানো খেলনা গাড়ি, শারদীয় নবকল্লোল, কভি আলবিদা না কহেনা। অন্যঘরে ল্যাম্পশেডের আড়ালে উদাসী হলুদ আলো, ফ্যাব ইন্ডিয়ার পর্দাগুলো জানলায়, ঢোকরার গণেশ খুব রোগা ও ঘুমন্ত, সোনি কোম্পানির সপ্রতিভ টি ভি ও হোম থিয়েটার, জমে ওঠা বার্বির সারি, টেডি বিয়ার এবং অরুন্ধতী রায়। তবে সব ঘরেই অন্তত একটা করে পুতুল থাকে। পুতুল পুতুল লক্ষ্মী পুতুল, বলো তুমি কার? মার না বাবার? এই পুতুলটা কথা বলা পুতুল না। কিছুই বলে না। বেশির ভাগ পুতুলই কিছু বলে না।  শুধু দশ হাত নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। দশ হাত নিয়ে, তলায় সিংহ নিয়ে, সামনে ধাক্কাপাড়, বমকাই, টাঙাইল, চুড়িদার নিয়ে, সকালে ছোটদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা নিয়ে, দুপুরে ভোগের ব্যাচে হুড়োহুড়ি নিয়ে, বিকেলে পাড়ার জলসা নিয়ে, রাতে পুজো কমিটির সদস্যদের ছোট ছোট হুইস্কির গ্লাস নিয়ে, দুই মাস মোটা মোটা পুজোসংখ্যা নিয়ে।

    গরুরা কাশফুল দেখে, নীল আকাশ দেখে বেশি বেশি দুধ দেয়। উৎসবে কলমসকল সাধ্যমত বীর্যবান ও ঋতুমতী হয়ে ওঠে। সাদা সাদা বাঁজা পাতা বিপুল উল্লাসে পোয়াতী হয়ে ওঠে। সবাই আমাদের নিয়ে গল্প লেখে যেন আমরাই জগতের প্রমাণিত কেন্দ্রে বাস করি। কবিতাগুলো কি আমাদের নিয়ে লেখা হয়? জীবজন্তু, গ্রহতারকা, বাসনৌকো, সর্ষে ইলিশ, বেলুড় হালেবিদ, রিনা ঢাকা, রাণী মুখার্জী এবং গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-অর্থতন্ত্র-উত্তরাধুনিকতন্ত্র নিয়ে শুধু রচনা লেখা হয়। তিরিশ থেকে পঁচাত্তরের মধ্যে সবকিছু পাওয়া যায়। তিরিশ হলে সবাই একটা দশ আর একটা কুড়ি টাকার নোট দেয়। পঁচাত্তর হলে দরাদরি করে। মায়ের বালিশের তলায় পড়ে থাকতে থাকতে মলাটগুলো খুলে আসে। মেয়েটাকে সেই মলাট দিয়ে নৌকো বানিয়ে দিতে হয়। নৌকোয় চড়ে পুজো আসে, নৌকোয় চড়ে পুজো যায়।

    আর একটা বৈজয়ন্ত গড়িয়াহাটের দোকানে দোকানে আত্মীয়স্বজনের জন্য জামাকাপড় কেনে, বউয়ের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোল খায়, রোল খাওয়ার পর কোল্ড ড্রিঙ্ক্‌সের জীবাণু নিয়ে বউয়ের সঙ্গে তর্ক করে, বাসের ভিড় দেখে বিরক্ত হয়, ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করে, মন দিয়ে হলদিরাম থেকে মিষ্টি কিনে বাড়ি যায়। ওর কপালে পিঠে বুকে কত যুগের ঘাম জমে আছে! এখনও কি গ্রীষ্ম যায়নি? আর একটা বৈজয়ন্ত সাগ্রহে পুজোসংখ্যা পড়ে, স্নান করার পরে বগলে ডিও লাগায়, টি ভিতে রাতের সংবাদ শোনে, পাশের বাড়ির ঝগড়া কানে এলে জানলা বন্ধ করে দেয়, মেয়ে ঘুমোলে মাথায় হাত বুলায়। এইভাবে ক্রমে ক্রমে শিউলির রাত নেমে আসে। ক্ষয়াটে অন্ধকারে শিউলিরা বিপুলভাবে জন্মে যায়। জন্ম জন্ম জন্মে যায়।

    সেই রাতে আমি যখন ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের এক নিরালা অংশে ঠিক রাস্তার মাঝখানে ছ্যাতলানো ঘিলু ও রক্ত মেখে পড়ে থাকি, সে আমার পাশে এসে বসে। আমি তার কপালের পিঠের বুকের ঘাম মুছিয়ে দিই। সে আমারে কোলে তুলে নিলে, শরতের চাঁদ ভেড়ির জলের পাশে বসে। সে আমাকে কোলে তুলে হেঁটে যেতে থাকে। চারদিকে কালো মাঠের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আলোর সারি আকাশে থেমেছে। আমরা সেই আলোর সারির মধ্যে দিয়ে আকাশের দিকে হেঁটে যাই। চাঁদ বসে দেখে। আমাকে আর বৈজয়ন্তকে।

    ২৫ (Oct 17 2006)
    পঁচিশ নম্বর লেখা

    ঠিক দুই বছর পরে আবার ভুতুমের সঙ্গে দেখা। সেই লন্ডন শহরে। একসময় যে শহরের নাম বড়দিনের রঙিন ঘন্টার মতো ডংডং করে বেজে উঠত। লন্ডন অনেকটা একই রকম আছে।

    অক্টোবরের রাস্তায় ঝরে যাওয়া লাল পাতার গাদার উপরে ইস্পাত যে আকাশ ঝুঁকে থাকার কথা, তার বদলে প্রায়ই হলদে রোদ আর ফিকে নীল হাওয়া। তবুও টেম্‌সের পাশে "গহন কাফেতে দোঁহে যুবকযুবতী', "সাঁঝে ওড়ে বিষনীল অনন্ত বেলুন'। মাদাম ত্যুসোর সামনে, লন্ডন আইয়ের লাইনে, টাওয়ারব্রিজের উপরে আমুদে ট্যুরিস্টদের টুক্‌রো হল্লায় টেম্‌সের জলে বুজকুড়ি ওঠে। বইয়ের দোকানে দোকানে এখনও বেশ ভিড় হয়, এবং যথারীতি মদের দোকানে আরও বেশি। সোহোর বেশ্যারা ছোটো স্কার্টে, রক্তহীন মুখে, কালিমাখা চোখে, উঁচু উঁচু চামড়াজুতোয় খদ্দের ডেকেই চলেছে। টিউবস্টেশনের এস্ক্যালেটরের পাশে সাঁটা "মামা মিয়া', "লায়ন কিং', "এভিটা'র পোস্টার। এখনও "মাউজট্র্যাপ' অভিনীত হয়! এক থেকে চার নম্বর জোনের উইকলি টিকিট সাড়ে তিরিশ পাউন্ড। নর্দার্ন লাইনের ট্রেনে প্রায় প্রতিদিনই গন্ডগোল। সকালবেলার বিনেপয়সার কাগজে সোমত্ত যুবতীদের ছবি। ক্যনারি হোয়ার্ফের অভ্রংলিহ ইমারতের তলায় সারিবদ্ধ চিন্তিত চাকুরের মুখ হাত পা  চোখ কোট। ব্রিক লেনে ইফ্‌তারের সময় দোকানের ঝাঁপ দশ মিনিটের জন্য বন্ধ। খুললে "বাইগন পসিন্দা কাবাব' আর "চিংড়ি বালতি ঝোলের' মতো উদ্ভটনামা খাবার পাওয়া যাবে। এখনও।

    কিন্তু ভুতুম আর সে ভুতুমে নাই। পঁচিশ নম্বর লেখার কথা শুনে একপাক নেচে দিল বটে প্রথম প্রথম। কিন্তু যে ভুতুম ট্র্যাফালগার স্কোয়ারের শেষ বিকেলের আলোর মিছিলে লাল গামছা মাথায় একমুখ দাড়ি নিয়ে তুর্কী নাচন নেচেছিল, সেই ভুতুমের দেখা পেলাম না। এখন ভুতুমের দাড়ি রাখতে ভয় করে। এখন হুতুমের পরনে রংচটা জিন্‌স্‌, বেখাপ্পা টি শার্টের উপর জবুথুবু জ্যাকেট, সাফসুতরো মুখ। শুধু চোখের পিছনে রাত ঘনিয়ে এসেছে। এখন সন্ত্রস্ত হয়ে থাকার সময়। বাসে যেতে যেতে  বাস ফেটে যেতে পারে। বা ট্রেনে উঠতে গিয়ে পুলিশ পিছন থেকে যদি গুলি করে! দাড়ি দেখে কেউ মুখখিস্তি দিল হয় তো বা! যে লোকগুলো বোম মারে বা মারার চক্রান্ত করে, তাদের সঙ্গে আমার মুখের মিল নেই তো? সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলেছে জোরকদমে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চলেছে জোরকদমে। তাই বড় সন্ত্রস্ত হয়ে আছি গো স্যাঙাৎ!

    এই বিদেশে সবই মানায়-
    রাতবিরেতের নিঝুম শান্তি,
    তোমার আমার অমোঘ ভ্রান্তি,
    সবই মানায়;
    সবাই মানায়
    গোপন সময়, অসুখবিসুখ,
    এক ফোঁটা জল, চার ফোঁটা দুধ,
    গড়িয়ে যাচ্ছে শেষ আলোতে
    একলা আরাম, একলা শান্তি।

    এই তো মিলিয়ে যাওয়ার সময়! এই তো মিশে যাওয়ার সময়!  যাতে সবাইকে মোটামুটি একরকম দেখতে হয়। যাতে সবার কথাবার্তায় একটা একরকম ভাব থাকে। যাতে বেশভূষায় কেউ হঠাৎ দলছুট না হয়ে যায়! আইস, আমরা খামারে গিয়া মৌন বৃন্দগান অভ্যাস করি। আপাতত মাতৃগণ দুগ্ধপান করিয়া প্রমাণ করুন যে ইহা সন্তানের নিমিত্ত। আপাতত শিশুগণ মেটাল ডিটেক্টরের মধ্য দিয়া একাকী পদচারণা করিয়া প্রমাণ করুন যে তাহারা নিরাপদ বস্তুবটেক। আপাতত মনুষ্যকুল বাঁচিয়া থাকিয়া প্রমাণ করুন যে তাঁহারা বাঁচিয়া আছেন। আপাতত এ বড় বেঁচে থাকার সময়!

    এইরকম প্রলাপকথনের মধ্যে দিয়েই ভুতুম আর আমার সময় কাটে। শেষে ভুতুমকে তার নিজের কথা বলতে বলি। ভুতুম সাদার্কের  এক নিরালা গলিতে শস্তা বীয়ারের টিন হাতে উদাস হেলান দেয়।

    "আজও বৃষ্টি পড়ে নি কোনো আকাশে। আমার চাতকের মতো তেষ্টা পায়। বীয়ারে আর মানায় না। অনেক জল। দেখো চেয়ে টেম্‌সের বুকে  অনেক জল। অনেক জল বয় গঙ্গায় নীলনদে টাইগ্রিসে। ইরাকে নাকি সাড়ে ছয় লক্ষ লোক মারা গেছে। লন্ডনে সাড়ে ছয় লক্ষ পাউন্ডে মাথা গোঁজার জায়গা কিনতে পাওয়া যায়? ঘরদোরের দাম খুব বাড়ছে। তোমাদের সেইদিকে নাকি অনেক ঘরদোরে অনেক মানুষ থাকে? তবে শুনলাম যে মশার কামড়ে অনেক মানুষ মরে যাচ্ছে? আমাদের এখানে মশা নেই। শুধু লোকে খুব ছুরি চালায়। আমার চেনাজানা বাচ্চারাও। স্কুলের গেটে মেটাল ডিটেক্টর বসানো হচ্ছে যাতে বাচ্চারা ছুরি নিয়ে স্কুলে না ঢুকে পড়ে। যে ছেলেটা আমাকে বিনি পয়সায় বীয়ার খাওয়াত সেও নাকি মারবে শুনছি। বড়ো দাড়ি রেখেছে।  পনেরো বছরের একটা ছেলে সেইদিন সারা জীবনের জন্য জেলে চলে গেল একটা এগারো বছরের মেয়েকে খুন করে। পনেরো তরিখ ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে দিওয়ালি ছিল। আমি যাই নি। রাতের বেলাতেও  ভীষণ আলো । চোখে কি জানি একটা হয়েছে। আলোতে চোখে খুব ব্যথা হয়, জল পড়ে। যত আলো বাড়ে আমি আর কিছু দেখতে পাই না। প্রতিদিন  বীয়ার খাওয়ার পরে গলা মুচড়ে পেটের থেকে গরম জল বেরিয়ে আসে। সবসময় খুব জলতেষ্টা পায়। আর ছয় বছর পরে এইখানে অলিম্পিক্‌স হবে। কত মানুষ আসবে বল দেখি! কত লোকে দৌড়াবে, লাফাবে, আনন্দ করবে! অনেকেই হেরে যাবে যদিও। খুব আলো হবে, রোশনাই হবে। আলোতে আমার চোখ ব্যথা করে। আমার জল তেষ্টা পায়।'

    বুঝলাম এই অসংবদ্ধ প্রলাপের পরে আর বিশেষ এগোবার জায়গা নেই। ভুতুমের জন্য নিয়ে আসা গুটিকয়েক জিনিষ ওর হাতে তুলে দিলাম। ভীষণ হেলায় ভুতুম জিনিষগুলো পাশে সরিয়ে রাখে। টাওয়ারব্রিজের মাথায় জটিল কুয়াশা নেমে এসেছে। ক্যানারি হোয়ার্ফের বাড়িগুলো করুণ দৈত্যের মত আবছায়ায় ঢেকে যেতে থাকে। রাস্তায় রাস্তায় বাতি জ্বলার সময় ঘনিয়ে এল। ভুতুম এইবার গর্তে ঢুকে যাবে। এইবার ভুতুমের হাতে হাত রাখি। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তার ধুমসো কোটের পরতে পরতে এক অপার শান্ত নরম কাঁথার গন্ধ। তার রাত্রিনামা চোখের কোণে আমার দুরন্ত সময় ভ্রূণ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

    "ভুতুম ভুতুম করে মায়,
    ভুতুম গেছে কাদের গাঁয়,
    কোন কাকেতে দাঁড় বায়,
    ভুতুম রে তুই ঘরে আয়।'

    এটা সেটা এখানে সেখানে - ২৬         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         নভেম্বর ১ ২০০৬

    এটা সেটা এখানে সেখানে - ২৭         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         নভেম্বর ১৭ ২০০৬

    এটা সেটা এখানে সেখানে - ২৮         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         ডিসেম্বর ৪ ২০০৬

    ২৯ (Dec 18 2006)
    প্রেসিডেন্সি-২

    "In short, to remember is to reconstruct, in part on the basis of what we have learned or said since. That's normal, that's how we remember."- The Mysterious Flame of Queen Loana, Umberto Eco

    দীপকবাবু সবসময় একটা কথা বলতেন- পড়ো, কিন্তু পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাবো। এই ভাবার প্র্যাকটিস আমাদের মগজের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছিল। আর  ভাবার একটা কাঠামো তৈরি হচ্ছিল মিহিরবাবুর ক্লাসে। খুব সম্ভবত ক্লাস হত পঞ্চাশ মিনিটের। সেই পঞ্চাশ মিনিট শুধু এক একটা ইঁট গেঁথে অর্থনৈতিক যুক্তির ইমারত তৈরি করে যাওয়া। সেই ক্লাসে একফোঁটা বাহুল্য নেই, এক মুহূর্ত বিষয়ান্তরে ভেসে চলা নেই, একটিও অদরকারি কথা নেই। যুক্তির ঘনত্বে ক্লাসের শেষে মাথা ভোঁ ভোঁ করত। তখন বুঝতাম না এই ক্রমাগত যুক্তির সঙ্গে তাল রাখতে রাখতে কিভাবে ভাবতে শিখছিলাম। যে ভাবা শুধু পঠনপাঠন বা পেশাতেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রের পাথেয় হয়ে রইল। দীপকবাবুর ক্লাস ছিল অপেক্ষাকৃত খোলামেলা। একদিন বোর্ডে হঠাৎই বড় বড় অক্ষরে লিখলেন "RIMBOUD"। এখন আর মনে নেই কি প্রসঙ্গে। তবে ক্লাসের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল টিউটোরিয়াল। এক এক টিউটোরিয়াল গ্রুপে আট দশজন করে ছিলাম। এখন ভাবলে হাসি পেলেও মিহিরবাবুর টিউটোরিয়ালে কেউ প্রথম বেঞ্চে বসতে চাইত না। আট দশজন অত বড় ক্লাসে দুটি বেঞ্চ ভরাতে পারত। কিন্তু সেই দুটি বেঞ্চ সবসময় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বেঞ্চ, যাতে মিহিরবাবুর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া যায়। অথচ মিহিরবাবু কোনোদিন উঁচুগলায় কাউকে কিছু বলেছেন শুনিনি। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে ভয়-সমীহ-শ্রদ্ধার এই যে ধ্রুপদী সংমিশ্রণ, তার বিরুদ্ধযুক্তি আরও বড় হয়ে শুনলাম  এবং কখনও কখনও মেনেও নিলাম।  শুধু মিহিরবাবু-দীপকবাবুর মতো শিক্ষকদের নতজানু হয়ে প্রণাম করা এড়াতে পারলাম না। আজও। তাই আমাদের কলেজজীবনের শেষের দিকে যখন নবীন এবং প্রবীণ শিক্ষণপ্রতিভা একে একে কলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, আমাদের দু:খ ছিল নিখাদ, যে রাজনৈতিক গ্রুপেই থাকি না কেন। প্রতিভার এই বিপুল অপচয় ছাত্রদেরও বিদ্ধ করেছিল। তখন নব্বই দশক মাঝপথে।

    বরষা কখন ঘন মরীচিকা সাজে

    তবে আগেও বলেছি, জীবনযাপনের একটা স্বাভাবিক কিন্তু ছোট অংশ ছিল পড়াশুনা। বাকিটার পুরোটাই অধিকার করে থাকত প্রেম-রাজনীতি-সংস্কৃতিচর্চার হুল্লোড় বা বেশির ভাগ সময় স্রেফ নিখাদ হুল্লোড়। যে কারণে কলেজে ঢোকার পরেই প্রথম গন্তব্য ছিল প্রমোদদার ক্যান্টিন। তখনও ক্যান্টিনে নরম পানীয়ের ভেন্ডিং মেশিন বসেনি। মলিন হলুদ দেওয়াল ছেয়ে থাকত পোস্টারের পর পোস্টার। এস এফ আইয়ের পোস্টারিং ছিল খাসা। সুভাষ মুখুজ্জে, অরুণ মিত্র থেকে শুরু করে শক্তি চাটুজ্জে- কেউই বাদ যেতেন না। কিন্তু যারা সেই পোস্টার লিখত এবং সাঁটত তাদের কলেজে দেখা যেত কম। কারণ তাদের বেশির ভাগেরই নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল প্রমোদদার দেওয়ালে লাগানো টেবিলে এবং বেঞ্চ। অন্যদিকে আই সির নেতৃবৃন্দের জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। তাঁদেরই একজন এখনকার "ধুম'খ্যাত প্রীতম। এখনও মনে পড়ে ভোটের দিন সকালে কালীপুজোর টিপ লাগিয়ে প্রীতম সবাইকে পুজোর সন্দেশ বিলাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল সেই সন্দেশের ভাগ থেকে বিরোধীরাও বাদ যেত না। ফিক্স্‌ড্‌ পয়েন্টের অধিকাংশ আসত নকশাল শিবির থেকে। একবার এই রকমই একজন ক্যান্টিনে আমার কাছে সিগারেট জ্বালবার জন্য আগুন চাইলেন। আমার কাছে দেশলাই নেই আর সিগারেটের টুকরোটা সবে মাটিতে ফেলে দিয়েছি। তিনি সেই মাটিতে ফেলা সিগারেটের টুকরো তুলে নিয়ে সিগারেট জ্বালালেন এবং আমার দিকে খাঁটি উত্তমকুমার স্টাইলে ঘাড় ঘুরিয়ে কইলেন- আমরা এখনও নেভা আঁচ থেকে আগুন জ্বালাতে পারি। কিন্তু আগুন সত্যি সত্যি নিভে আসছিল। অরাজনৈতিকেরা ক্রমাগত রাজনৈতিক স্পেসের দখল নিচ্ছিল। গ্লাস্তনস্ত পেরেস্ত্রৈকা শুরু হয়ে গেছে। সাবেকি রাশিয়ান বামপন্থা টুকরো টুকরো হচ্ছে। চিনে তখন তিয়েনানমেন স্কোয়ার। আস্তে আস্তে পতনোন্মুখ বামপন্থী সাম্রাজ্যের সান্ধ্য ছায়া লম্বা হয়ে আসছে। সেই সময় বামপন্থী গ্রুপেরা দিশেহারা। রাজনৈতিক যুক্তি দিয়ে সমর্থন জোটানোর ভরসা হারিয়ে যাচ্ছে। তার জায়গা নিচ্ছে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা। এই দিশেহারা ভাব প্রখর হল মণ্ডল কমিশনের সময়।

    কলেজ পোর্টিকোতে ভয়ানক উত্তেজনা। কলকাতাতে মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে বিশাল ছাত্র মিছিল বেরোচ্ছে। নকশালরা মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে না পক্ষে খুব একটা খোলসা নয়। এস এফ আইয়ের ঘোর বিপদ কারণ কেন্দ্রে তখন ভি পি সিং-এর বন্ধু সরকার। এমনকি ইন্ডিপেন্ডেন্টরাও ঘোর বিপদে কারণ ইউনিয়নের কোনও ডাক ছাড়াই ক্লাস বয়কট হতে যাচ্ছে স্বত:স্ফূর্ত ভাবে। প্রেসিডেন্সির মতো এলিটিস্ট প্রতিষ্ঠানে মণ্ডল কমিশনের পক্ষে কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অরাজনৈতিকেরা রাজনৈতিক স্ট্যান্স খোলসা করে উঠতে পারেনি। আমি কোনও ছাত্র সংগঠনের নির্দেশ ছাড়াই ক্লাস বয়কটের বিপক্ষে ছিলাম কারণ আমার মনে হয়েছিল আপাতত: রাজনৈতিক যুক্তিকে ছাপিয়ে উঠেছে এক সর্বগ্রাসী আবেগ। আমাদের ক্লাসের সমস্ত ছেলেমেয়ে ক্লাস বয়কট করল। আমি একা প্রতি ক্লাসের আগে প্রফেসরদের কাছে গিয়ে গিয়ে হাজিরা দিয়ে এলাম। এর পরে আরও দুই দিন যেতে না যেতেই রাজনৈতিক সমীকরণগুলো পরিষ্কার হয়ে এল। এস এফ আইকে মণ্ডল কমিশনের পক্ষে যেতেই হল কারণ গোপালন ভবন বন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে লেজুড়ের মতো জুড়ে দেওয়া হল অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার যুক্তি যে রেকর্ড এখনও বাজছে। কিন্তু বন্ধু সরকার ছাড়া হাতে আর কোনও জোরালো যুক্তি ছিল না। ইন্ডিপেন্ডেন্টস কনসোলিডেশন মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিল। নকশালদের স্ট্যান্ড বুঝে ওঠা সাধ্যাতীত ছিল। যখন মণ্ডল কমিশনের সম্পর্কে ফিজিক্স লেকচার হলে ছাত্র-শিক্ষক কনভেনশন আয়োজিত হল, তখন নকশাল ছাত্র সংগঠনের মুখপাত্রী বললেন- যারা মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তারা স্রেফ তাদের শ্রেণীস্বার্থ চরিতার্থ করছে কিন্তু....কিন্তু মণ্ডল কমিশন অত্যাচারিতদের অধিকার অর্জনের কোনও পথ নয় কারণ এ হল ভিখিরির দিকে ভিক্ষে ছুঁড়ে দেওয়ার মতো অপমানজনক। ছাত্রছাত্রীদের সম্মিলিত বেপরোয়া মুডের সামনে অন্য কিছু বলা বোধ হয় সম্ভব ছিল না। কাজেই "কিন্তু"র উদ্ভব।

    এই "কিন্তু" বানতলার ঘটনার পরে আর সম্ভব ছিল না। আমরা কেউ কেউ দাবি করলাম এস এফ আইকে বানতলার ঘটনার প্রতিবাদে পোস্টারিং করতে হবে। যা রাইটার্স বিল্ডিঙের তল্পিবাহক ছাত্র সংগঠনের পক্ষে অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজ বলেই হয় তো সম্ভবপর হয়েছিল। কিছুদিন তীব্র বাক্‌বিতন্ডার পরে এস এফ আই সত্যি সত্যি বানতলার দুর্ঘটনা নিয়ে ক্যান্টিনের দেওয়ালে পোস্টার মারল। তবে এই ত্রিমুখী লড়ালড়ির চত্বরে একত্র কণ্ঠস্বরের জায়গাও ছিল। যখন রামমন্দির আন্দোলন এবং তজ্জনিত রায়টের পরে কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে  বিশাল মিছিলে সে¾ট্রাল অ্যাভিনিউ মুখরিত হল। এই লিবারেল ধাঁচের কচি এবং হালকা বামপন্থা সেই সময়ের প্রেসিডেন্সি কলেজের রাজনৈতিক ইডিয়ম। বিরাট কোনো আদর্শগত ভেদাভেদ বা রাজনৈতিক যুক্তির লড়াই মুছে যাচ্ছিল।  নব্বই একানব্বইতেই আজকের ভারতের ধারক বাহক অর্থনৈতিক নীতির পথ চলা শুরু যেখানে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনই শেষ কথা।

    মঙ্গলগ্রহে বেড়াল থাকে না

    এই অরাজনীতি প্রত্যাশিত ছিল। কারণ প্রেসিডেন্সি কলেজে একদল ভালো ছাত্রছাত্রী পড়লেও পড়াশুনার বাইরে আঁতেলীয় বীক্ষণের যে বাজারচলতি গপ্পো চালু আছে তা অনেকাংশেই মিথ। কেউ কেউ অবশ্যই এক বগলে হকিং, আর এক বগলে গ্রামশি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তখনও দেরিদা-ফুকোরা আসি আসি করছেন। কলেজ স্ট্রিটের ক্ষুদ্র ভাবজগতে তাঁদের হেজিমনির ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। কাউকে কাউকে দেখতাম মুখে আধপোড়া চারমিনার নিয়ে গম্ভীরভাবে জ্যামিতিক কবিতার চর্চা করতেন। কলেজ ম্যাগাজিনে পেখম মেলে দেখনদারির স্বভাবজ প্রয়াস ছিল, বিশেষত ইংরাজি বিভাগে। কেউ কেউ অঙ্ক কষে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রমাণ করতেন, কেউ কেউ নতুন মার্ক্স এবং পুরোনো মার্ক্সের দ্বন্দ্ব নিয়ে বুলি কপচাতেন, কেউ কেউ ভূমিসংস্কারের অর্থনীতি নিয়ে গম্ভীর গম্ভীর কথা লিখতেন। বেশির ভাগই ছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে দুষ্পাঠ্য। সত্যিকারের সৎ এবং ভালো লেখা দেখা যেত বাংলা বিভাগে। তবে এই বৌদ্ধিক দেখনদারি ছিল সীমাবদ্ধ। তার বাইরে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ছিল একদম আর পাঁচটা কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মতই।

    কলেজের ফাংশনে সব থেকে জনপ্রিয় ছিল হিন্দি সিনেমার গান, কারণ তখনও সুমন পূর্ণ মহিমায় এসে পৌঁছাননি এবং বাংলা ব্যান্ড ভবিষ্যতের গর্ভে। নকশাল ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানে অন্যধরনের বাংলা গান শোনা গেলেও তার চলন ছিল এক সীমিত গোষ্ঠীর মধ্যে। রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হত এবং হলের বেশির ভাগ অংশই ফাঁকা থাকত। সব থেকে বেশি হাততালি পাওয়া যেত হুল্লোড়ের গান গেয়ে। কোনও এক অনুষ্ঠানে এখনকার প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী, তখন আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ছাত্রী  রাজশ্রী ভট্টাচার্য্যের গানের সময় বীভৎস হুল্লোড়বাজি হয়। নকশাল ছাত্র সংগঠন তার প্রতিবাদে সাইক্লোস্টাইল করা এক প্রতিবাদপত্র প্রকাশ করেছিল কিন্তু ওই পর্যন্তই। ফেস্টের সময় সব থেকে ভিড় হত রকফেস্টের দিন, অন্যান্য যে কোনও কলেজের মতই। তবে একটু আলাদা হওয়ার বদভ্যাস মাঝে মাঝেই চিমটি কাটত। যে জন্য আমি সম্পূর্ণ বাবুবেশে ধুতি-পাঞ্জাবিপরিহিত হয়ে রকফেস্টে হাজির হয়েছিলাম। পরিপূর্ণ হুল্লোড়বাজির আগেই চলে আসতে হয়, কারণ ধুতি খুব একটা নির্ভরশীল পরিধেয় ছিল না। বেশ উঁচু মানের নাটক-বিতর্ক-আলোচনা হত। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজ সাংস্কৃতিক জগতে অন্যান্য কলেজের থেকে আলাদা ছাপ মারা, এ কথা কখনও মনে হয়নি।

    আবার বছর কুড়ি পরে

    এর পরে জগৎ ও জীবনের নিয়মানুসারে আমরা প্রত্যেকেই নিজের ঘর-দুয়ার-সার্টিফিকেট গুছানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠলাম। সাম্রাজ্য ধুলিসাৎ, অশীতিপর উদাসীন মুখ্যমন্ত্রী নিয়মিত শ্রাগ করছেন, চারদিকে দেখছি গেরুয়া ফেট্টিমাথায় কপিবাহিনীরা উঠে আসছে, জাত এবং ধর্ম নিয়ে তীব্র প্রাণঘাতী লড়াই, আর অর্থনীতির বাঁধ খুলে গিয়ে আখের গুছিয়ে নেবার দিন আগত ওই। অতএব প্রত্যেকে নিজের ভেলায় নিজের স্রোতে উজান ডিঙিয়ে চলি। আমাদের আগের প্রজন্মও মনে হয় না এর থেকে খুব বেশি কিছু করেছিলেন। ঠিক সেই সময় বিভিন্ন বিভাগ থেকে নক্ষত্র শিক্ষকেরা অন্যকূলে পাড়ি দিচ্ছেন। এর পরে কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্মিলিত নস্টালজিয়া ভাগ করে নেওয়ার সূত্রে। শিক্ষণ ও পঠনপাঠনের মান নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ছাত্রছাত্রীদের মান নিয়ে কোনোদিনই সন্দেহ রাখিনি। আমাদের মধ্যে পড়াশুনায় ভালো করা নিয়ে কোনও রেষারেষি ছিল না। কিন্তু এক আজব রসায়নের খাতিরে পরীক্ষায় ভালো করার তাগিদটা আপনা থেকেই চারিয়ে যেত। দেড় দশকে হয় তো ছবিটা পালটে গেছে। আমাদের স্বভাবজ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মান রাখতে গিয়ে স্বাধীনতার পরে প্রতিষ্ঠান ভেঙেছি অনেক। গড়েছি অতীব সামান্য। আশা করি আর একটা প্রেসিডেন্সি কলেজ না গড়তে পারলেও, বাংলার সারস্বতসমাজ অন্তত একটা প্রেসিডেন্সি কলেজ টিঁকিয়ে রাখতে পারবেন।

    ৩০ (Jan 2 2007)
    আসছে বছর আবার হবে

    "Routine being the source of all happiness, its guarantee, and its death!"- Orhan Pamuk

    ২০০৬ বিগতপ্রায়। ২০০৬ সালের শেষের কয়দিন মানে ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, বিলিতি খরিদ্দারেরা ছুটিতে, প্রবাসী বন্ধুরা কয়দিনের জন্য এসেছেন, চেনাজানাদের নিমন্ত্রণ, বাধ্যতামূলক উৎসবপালন, ডেডলাইন, ডেডলাইন, অসহ্য চাপ। এবং পার্ক স্ট্রিট জমকালো কাগজে হেডিং ডিং বেজে ওঠে ঘন্টার রবে, ২০০৭ সালে পুনরায় হবে।

    যত দিন যাচ্ছে তত ধুলো বাড়ছে। আমাদের অফিসের চারদিকে ধুলোর মধ্যে লোকে খায়, মোতে এবং প্রোগ্রাম লেখে। ধুলোয় মোড়া পার্ক স্ট্রিটে ধুলো ধুলো মানুষের ভিড়ে রেস্তোরাঁ আর নাইটক্লাবগুলো খন্ডহর। ধুলোদের গায়ে গায়ে ধাক্কা, পায়ে পায়ে লেগে যাওয়া, হাতে হাতে মিঠে খুনসুটি। নিয়নের আলো থেকে ধুলো ঝরে পড়ছে। আমরা তাকে গোধূলি বলি।

    এ এক মজার ভাগ হয়েছে। প্রতি তিনশ পয়ঁষট্টি দিনে এক এক বছর। একটা সোজা লাইন টেনে রাখো। তিনশ পয়ঁষট্টিটা ঢ্যাঁড়া কাটার পরেই নিশ্চিত জেনে রাখো যে নতুন বছর এসে গেল। অতএব ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, বিলিতি খরিদ্দারেরা ছুটিতে, প্রবাসী বন্ধুরা কয়দিনের জন্য এসেছেন, চেনাজানাদের নিমন্ত্রণ, বাধ্যতামূলক উৎসবপালন, ডেডলাইন, ডেডলাইন, অসহ্য চাপ। এবং পার্ক স্ট্রিট জমকালো কাগজে হেডিং ডিং বেজে ওঠে ঘন্টার রবে, yyyy পুনরায় হবে।

    একসময় যদিও সময়ের এইরকম চলন ছিল না। তখন সময় ছিল অখন্ড, চক্রবৎ। মানুষের জন্ম-শিক্ষা-বিবাহ-প্রজনন-মৃত্যুর চক্র ছিল এক জীবনকাল। এর মধ্যেই রাজ্যপাট, যুদ্ধবিগ্রহ, এক রাজা আসে, এক রাজা যায়, লাল জামা গায়ে নীল জামা গায়ে। দিন বদলায় না। সময়ের বৃত্তাকার গতিতে দিনবদলের সম্ভাবনা কোথায়? বর্ষাকালে বীজবপন, হেমন্তে সুপক্ব ফসল, শীতের নবান্ন শেষে আবার বর্ষার প্রতীক্ষা। খেলা তখন ছিল তোমার সনে। আমাদের ঠাকুর্দা ঠাকুরমাদের জন্মদিনের খোঁজ কে রাখত? পশ্চিমী ধাঁচের পরিবারে হয় তো বা জন্মদিন। নইলে কোনো এক কাল্পনিক এবং সুবিধাজনক জন্মতারিখ নিয়ে ইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হওয়া। জন্মেছি যে দেখাই যায়, জন্মের দিনে কিসের দায়?

    অথচ কারখানা কি আর এই গোল গোল নিরুপদ্রবে চলে? কারখানার ভিত্তি হল একটি লাইন। অ্যাসেম্বলি লাইন। সময়ের একটা সাদাসিধে নাগাল পাওয়া দরকার। এই লাইনের পরে আমার কাজ শেষ, তোমার কাজ শুরু। সোজা সোজা বার গ্রাফ, ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮, ডট ডট ডট। জন্মেছি যখন তখন শূন্য। তারপর স্কুলে যাওয়ার মধ্যে একটা চার পাঁচ ইঞ্চির লাইন। তারপর স্কুল পাশ। সেই লাইনেরও একটা নিখুঁত দৈর্ঘ্য আছে। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি একটানা একটি লাইন। মাঝে মাঝে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর লাল লাল ঢ্যাঁড়া। সেই লাইনের কোনো অংশের নাম ২০০৫, কোনোটা ২০০৬, কোনোটা....। সবার দৈর্ঘ্য সমান। চলো নিয়মমতে।

    কিন্তু দূরে তাকিয়ো নাকো বললেই কি না তাকিয়ে পারা যায়? বড়ো বড়ো কলকারখানা হবে, কোটি কোটি মানুষ কাজ করবে, বড়ো বড়ো রাস্তা, বাজারহাট দোকানপাট। কাজেই যদিও দৈর্ঘ্যে সমান, তাও ভেবে যাওয়া ২০০৭ হয় তো ২০০৬-এর থেকে একটু বেশি ভালো, ২০০৮ হয় তো আরো একটু। কলকারখানা বাড়ে, লোকের হাতে দুটো পয়সা আসে, বাজার বাড়ে, সেই বাজারের চাহিদা মেটাতে আরো কলকারখানা, আরো কাজ, আরো লোক, আরো চাহিদা। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। এই বছরে নয় তো পরের বছরে।

    তাহলে প্রতি বছরের শেষে কেন ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, বিলিতি খরিদ্দারেরা ছুটিতে, প্রবাসী বন্ধুরা কয়দিনের জন্য এসেছেন, চেনাজানাদের নিমন্ত্রণ, বাধ্যতামূলক উৎসবপালন, ডেডলাইন, ডেডলাইন, অসহ্য চাপ? এবং কেন পার্ক স্ট্রিট জমকালো কাগজে হেডিং ডিং বেজে ওঠে ঘন্টার রবে, yyyy পুনরায় হবে?

    সময় কুঁকড়ে যাচ্ছে। শ্রদ্ধেয় নীরেন চক্রবর্তী মহাশয়ের একটা কথা মনে ধরেছিল। কোনো এক বিরল দিনে যখন তাঁর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, উনি বলেছিলেন মানুষের জীবনযাত্রার প্রতি পরিবর্তনের মধ্যের সময়কাল ক্রমে ছোটো হয়ে আসছে। মানুষের আগুন জ্বালানো থেকে চাষবাষ শিখতে যা সময় লেগেছিল, তার তুলনায় চাঁদে যাওয়া আর ইন্টারনেটের মধ্যবর্তী সময়কাল প্রায় শূন্য। এটাই প্রগতি, এটাই সময়ের কুঁকড়ে যাওয়া। শেষে লাইনটা কুঁকড়ে কুঁকড়ে একটা বিন্দু হয়ে যায়। আমরা এক একটা বিন্দুতে বেঁচে আছি।

    এই বিন্দুকে আমরা বলি বর্তমান। ভগবানকে ভয় পেয়ে বা না পেয়ে, বর্তমানেই বেঁচে থাকি। যাঁরা নব্যধর্মপালন করেন, যাকে বইয়ের দোকানে নিউ এজ রিলিজিয়ন বলা হয়, তাঁরা হয় তো জানেন অত্যাধুনিক এই ধর্মমতে বলা হয় বর্তমানে বেঁচে থাকাটাই শ্রেয় কারণ ভবিষ্যতের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, আর অতীত তো যা গেছে তা যাক যাক। বৌদ্ধধর্মের আলগা ছোঁয়া এই ভাবধারা কর্পোরেট জগতেও অধুনা প্রবল জনপ্রিয়। কাজেও লাগে। কারণ কোটি কোটি কর্মী দরকার যারা বর্তমানে বাঁচে, এবং খাটে। ভবিষ্যতের দিকে তাকাবার ফুরসৎ নেই, অতীতের দিকে তাকাবার প্রয়োজন নেই।

    সবাই বর্তমানে বাঁচি। বুশ সাহেবও বাঁচেন। ভিয়েতনাম ভুলে যান, ২০০১ সালে দাঁড়িয়ে ২০০৬ দেখতে পান না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বর্তমানেই বাঁচেন এবং বেঁচে আছেন সে কথা বলা তো বাহুল্যমাত্র। আমার পাশের বাড়ির কল সেন্টারে কাজ করা ছেলেটা ১৯৫১ জানে না, ১৯৭১ জানে না, ১৯৯২ জানে না। আর ২০০৭? একেবারেই না। আমি? ২০০৬ বলতেই ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, বিলিতি খরিদ্দরেরা ছুটিতে, প্রবাসী বন্ধুরা কয়দিনের জন্য এসেছেন, চেনাজানাদের নিমন্ত্রণ, বাধ্যতামূলক উৎসবপালন, ডেডলাইন, ডেডলাইন, অসহ্য চাপ। স্রেফ ডিসেম্বরের শেষের কয়টা দিন। এই হল আপাতত: ২০০৬।

    ছোটোবেলায় পড়া জ্যামিতি ভুলে গেছি। বিন্দুর কোনো দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, উচ্চতা নেই। স্রেফ একটা মাত্রাহীন ধারণা। যাদের মাত্রা নেই, তাদের কি করে আলাদা করি? অতএব যদিও বেশ বুঝতে পারছি মানুষজনের চোখ কাঁচের গুলি হয়ে যাচ্ছে, শব্দগুলো সংখ্যার মত হয়ে যাচ্ছে, গানগুলো সাইরেনের মত আর হৃদ্‌পিন্ড নোকিয়ার লেটেস্ট মডেলের মত, তাও ২০০৬ শেষ হচ্ছে ভাবলেই ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, .......।

    ২০০৭ আসুক। বেশির ভাগ লোকই আশা নিয়ে ঘর করেন এবং আশায় পকেট ভরেন। সেই নাছোড় আশাবাদীরা নিউ ইয়ার্স ইভের পরের দিন মাথায় ঘোরতর হ্যাং ওভার নিয়ে উজ্জ্বলতর ২০০৭-এর খোয়াইশ দেখুন। ২০০৬-এর এই শেষ কয়দিন আমার স্রেফ এইটুকু আশা যে ২০০৭ ঠিক যেন ২০০৭-ই হয়।

    এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩১         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         জানুয়ারি ১৬ ২০০৭

    ৩২ (Feb 1 2007)
    সুন্দরবনের ডায়েরি

    ২৬শে জানুয়ারি ২০০৭ কাটল বালি দ্বীপের ৯নং ব্লকে। গ্রামের প্রান্তে গুমড়ি নদীর বিস্তার প্রায় আকাশ ছোঁয় ছোঁয়। প্রায় না দেখতে পাওয়া অন্যপারে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। আগে বাঘ নদী পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ত। এখন গ্রামের কাছাকাছি থাকা জঙ্গলের সীমানা বেড়ায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বাঘের আচম্বিতে হামলাও অনেক কমেছে। নদীর ধারে বাঁধের উপরের রাস্তা জেটি থেকে ট্যুরিস্ট ক্যাম্প পর্যন্ত সুঠাম, ইঁটে ছাওয়া। তারপরেই এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা। তার উপর দিয়েই সাইকেল চলেছে কিড়িং কিড়িং। প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে ছোট ছোট মেয়েরা কেউ কেউ রাস্তার পাশের জমে থাকা জলে ছোট জালে মাছ ধরছে, কেউ আবার নদীর কাদাপাড়ে জাল ফেলেছে। এক বাড়ির উঠোনে ঘড়ঘড়িয়ে ধান কোটার মেশিন চলছে। ঢেঁকি বলে কিছু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। গ্রামের অনেকটা ভিতরে মুদির দোকানের দাওয়ায় গুটিপাঁচেক কন্যাশিশু স্লেট হাতে দুলে দুলে "চারে শূন্য চল্লিশ, পাঁচে দুই বাহান্ন'। গুরুমশায় দাঁতন করতে করতে একবার মুদির দোকানে, আর একবার পাঠশালে। অতীতে এই গুরুমশাই ছিলেন চোরাশিকারী। বনের হরিণ শিকার করতেন। মিন্টুও চোরাশিকারী ছিল। ওর তিন বছরের ছেলে অন্য আর এক পাঠশালে যাওয়া শুরু করেছে। সেই পাঠশালের মাস্টারমশাই সকালে কচিকাঁচাদের নিয়ে আমাদের উঠোনে এসে হাজির। সকাল কাটে তিন-চার বছুরেদের "জয় হিন্দ', "বন্দে মাতরম' শুনে। তাদের এই ধ্বনি শেখালেন দুই নেপালি প্রৌঢ়া, যারা সুদূর দার্জিলিঙের গ্রাম থেকে সুন্দরবনের জলহাওয়া মাখতে এসেছেন। তাঁরাই বাচ্চাদের হাতে হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা করে বিস্কিটের প্যাকেট। বাকি গ্রাম সাতসকালেই ভারী কর্মব্যস্ত। হই হই করে হাত পা চলছে। একটু বেলা হতেই জেটির পাশের খোলা জমিতে বাচ্চা ছেলেগুলো ব্যাট বল হাতে নেমে পড়বে। কারুর হিরো শচীন, কারও সৌরভ। গ্রামের জোয়ানদের মধ্যেও শচীন-সৌরভ-রাহুল নিয়ে জোর আড্ডা শুনতে পাই। দু একটা বাড়ির খড়ের ছাউনির উপরে মাথা উঁচিয়ে আছে ডিশ টিভির অ্যান্টেনা। তবে যেহেতু বিদ্যুৎ মানে সৌরবিদ্যুৎ, আর সৌরবিদ্যুৎ রঙিন টি ভির খাঁই মেটাতে পারে না, আপাতত সাদা কালো টিভি ভরসা। বেশির ভাগ মানুষের আয় বাগদার মীনচাষে। মাটি বেজায় নোনা। আগে একফসলি ছিল। এখন কিছু মিষ্টি জলের পুকুর তৈরি হওয়াতে শীতে ধান উঠে যাওয়ার পরেও শাকসব্জি, ডালের চাষ হয়। খেঁসারির ডালের চাষ বেশি কারণ অল্প আয়াসে অধিক ফলন। পঞ্চায়েতে আগে সি পি এম ছিল, এখন আর এস পি। বাঁশের বেড়ার গায়ে ইতস্তত আর এস পির পোস্টার লটকানো।

    এখানে বেড়াতে আসতেই পারেন। শহুরে চোখ-মন-কান শান্তি পাবে। মনে হবে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ইত্যাকার মধ্যবিত্ত ফ্যান্টাসির একটা বাস্তব আদল খুঁজে পেলেন বুঝি। সমস্যাগুলো খুব একটা ফ্যাশনেবল নয়। কাজেই শহুরে বাবুরা বিশেষ প্রতিবাদ বা বাওয়াল- কোনওটাই করেন না। সব থেকে কাছের হাইস্কুল হেঁটে যেতে এক ঘন্টা। তাও মাটি শুকনো থাকলে। হাসপাতাল রাঙাবেলিয়াতে। সেও প্রায় ঘন্টা খানেক মাটির রাস্তা ভেঙে যাওয়া। লঞ্চ চলে দিনে এক দুইবার। ক্যানিং-গোসাবা-বাসন্তী-সোনাখালির মত গঞ্জ শহরের দক্ষিণে আর কোনও কলেজ নেই। রাঙাবেলিয়াতেও নদীর পাড় ভাঙছে, জল ঢুকছে নিশ্চিত ভঙ্গীতে। এই সব দ্বীপে কৃষিজমি অধিগ্রহণ বা শিল্পায়ন নিয়ে শহরের বুদ্ধিজীবীদের ব্যস্ত মাথা ঘামাতে হবে না। বিদ্যুৎ বলতে টিম্‌টিম করে জ্বলা সৌরপ্রদীপ। মূল যোগাযোগ সমুদ্রপ্রমাণ নদীনালা পেরিয়ে। চাষের জমি নোনা। তার উপর নদীদের খামখেয়ালিপনায় আজকের চাষের জমি কালকের নদী, অথবা উলটোটাও। একসময় হরিণশিকার ছিল সব থেকে লাভজনক উপজীবিকা। গড়পড়তায় জনপ্রতি চার কেজি মাংস পাওয়া যেত একটা হরিণ মারতে পারলে। মানে চারশ টাকা। এই সব অঞ্চল থেকে নারী পাচার হয় খুব। অনেকে ওঠে বেশ্যাপাড়ার কোঠায়, আর অনেকে প্রবাসী উচ্চবিত্তের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে। কে বেশি ভালো থাকে বলা ভারী শক্ত। সোনাখালির দক্ষিণে মসজিদ নেই। গ্রামে গ্রামে বনবিবির থান। বনবিবির চেহারা লক্ষ্মী-সরস্বতী-জগদ্ধাত্রীর মতো। পাশেই বসেন বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গুলী। পায়ে গামবুট, মুখভর্তি গোঁফহীন চাপদাড়ি, মাথার পিছনে সবুজ পটে একটি তারা, এক ফালি চাঁদ। বনবিবির পালা শেষ হলে আল্লানাম নিতে হয়, হরিধ্বনিও দিতে হয়। কলকাতার পায়ের তলায় এ বড় আজব পড়শীনগর বটে।

    এত সব আবোল তাবোল বকতে বকতে আসল ব্যাপারটাই বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সুন্দরবনে বাঘ থাকে। সেই বাঘ দেখতে ঝেঁটিয়ে মানুষ যান। সাধারণত তাঁরা লঞ্চের পিছনে ম্যারাপ বেঁধে প্রচুর রান্না করেন, ডেকের উপর বোতল খুলে বসে পড়েন, বাজনা চালিয়ে নাচেন, পাশের আর একটা ম্যারাপ বাঁধা লঞ্চ দেখলে সবাই মিলে হাত নাড়েন, সজনেখালি-সুধন্যখালির ওয়াচ টাওয়ারে উঠে প্রবল চেঁচামেচি ও ঠেলাঠেলি করেন, বাঁদর এবং হরিণ দেখে বেজায় এক্সাইটেড হন এবং শেষে "ধুর শালা, এর থেকে চিড়িয়াখানা ভালো' বলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান। এনাদের খিদমত খেটেও দু পয়সা ঘরে আসে। প্রাইভেট গাইডের কাজ করেন অনেকে। দিনের শেষে পকেটে আসে শ দেড়েক। আমাদের ম্যারাপ-না-বাঁধা লঞ্চে গাইড ছিলেন মন্ডলবাবু। লঞ্চ যাচ্ছিল কুমীরমারির পাশ দিয়ে। কুমীরমারি রাজনৈতিক খুনোখুনির জন্য কুখ্যাত। এই অঞ্চলে প্রধান দল মানে বামফ্রন্টের দুই শরিক সি পি এম এবং আর এস পি। তাদের মধ্যেই প্রবল ক্যালাকেলি। জেটির পাশে সাপ্তাহিক হাটের জমিতেই খুনোখুনি হয়। এখনও গ্রামে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। গ্রামের এক বাসিন্দা আড়ালে জানান ঘরে ঘরে বেআইনী দোনলা রয়েছে। মন্ডলবাবুই কুমীরমারি চেনালেন। ঠিক তার উল্টোদিকে আর এক জঙ্গুলে দ্বীপ সন্ধ্যানদীর ছায়ায় ভূতুড়ে হয়ে উঠছিল। মনে হয় না সেই দ্বীপে কোনও জনবসতি আছে। মন্ডলবাবু বলেন দ্বীপের নাম মরিচঝাঁপি। তেভাগা-তেলেঙ্গানা-নকশালবাড়ির কুমীরছানা মাঝেই মাঝেই দেখানও হয়। এখন তো আরও বেশি বেশি করে। অথচ মরিচঝাঁপির কণ্ঠস্বর বাঙালি স্মৃতি থেকে বিলুপ্তপ্রায়। অমিতাভ ঘোষ মশাই তাঁর ইংরিজি উপন্যাসে মরিচঝাঁপির গল্প বলেছেন বটে। কানাইয়ের মেসোমশাই মরিচঝাঁপির ডায়েরি লিখে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত মরিচঝাঁপি মনে রাখেনি। সামাজিক স্মৃতির খেলা বড়ই আজব বটে! ভাবছি নিজের বেড়ানোর আগড়ম বাগড়ম না বকে মরিচঝাঁপির গল্পটা ছোট করে বলে নেওয়া যাক। অনেকের হয় তো মনে আছে। অনেকে জানেন, কিন্তু মনে নেই। আবার অনেকে হয় তো জানেনই না। এই গল্পটা লিখতে আমি প্রায় সব মালমশলা ধার করব Annu Jalais-এর লেখা "Dwelling on Marichjhanpi: When Tigers Became 'Citizens', Refugees 'Tiger-Food'" প্রবন্ধের, যা ইকোনমিক এন্ড পোলিটিকাল উইকলির এপ্রিল, ২০০৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

    ষাট সত্তরের দশকে যখন বাংলাদেশ উত্তাল, নিম্নবর্ণের মানুষ রিফিউজি হয়ে সীমান্তের এইপারে চলে আসতে লাগলেন। দেশভাগের পরেও এই সব নিম্নবর্ণের মানুষেরা দেশের মাটি ছাড়েন নি। মিহির সেনগুপ্ত মশাইয়ের "বিষাদবৃক্ষে" তার বিবরণ পাবেন। বাবুদের শহরের নাজুক গায়ে যাতে এই হাড়হাভাতেদের আঁচড় না পড়ে, তাই তাদের পাঠানো হল মধ্যভারতের দণ্ডকারণ্যে। এই সব উদ্বাস্তুদের অধিকাংশ এসেছিলেন খুলনা থেকে। তাঁদের আগেই-চলে-আসা আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন সুন্দরবনের দ্বীপে দ্বীপে। দণ্ডকারণ্যে যাবার কোনও ইচ্ছা ছিল না। তখন বামপন্থীরা বিরোধীপক্ষ। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জ্যোতিবাবু বহুবার বিধানসভায় দণ্ডকারণ্যে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের বিপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। ১৯৭৪ সালে প্রকাশ্য জনসভায় জ্যোতিবাবু দাবী করেন দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া উদ্বাস্তুদের সুন্দরবনে পুনর্বাসিত করতে হবে। ১৯৭৫ সালে দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুদের এক বৃহদংশ সুন্দরবনের দিকে পাড়ি দিলেন। তখন থেকেই স্টেশন থেকে টেনে হিঁচড়ে তাদের দণ্ডকারণ্যে ফেরত পাঠাবার পালা শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলেন। ততদিনে প্রায় দেড় লাখ উদ্বাস্তু দণ্ডকারণ্য থেকে এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা হাঁ করে তাকিয়ে আছেন এই নতুন সরকারের দিকে। আশায় বাঁচে চাষা। সরকার প্রমাদ গুনলেন। জোর করে ফেরত পাঠানো অব্যাহত। অনেকেই সেই বজ্র আঁটুনি পেরিয়ে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেন। মে মাসে প্রায় তিরিশ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির নেতা সতীশ মন্ডলের নেতৃত্বে মরিচঝাঁপিতে বসতি স্থাপন করলেন। ক্রমে ক্রমে টিউবোয়েল বসল, রাস্তা তৈরি হল, মাছের ব্যবসা, ডিস্পেন্সারি, ইস্কুল- সব। আশেপাশের সাতজেলিয়া, কুমীরমারি, ঝড়খালি ইত্যাদি গ্রামের বাসিন্দারদের কেউ কেউ এসে মরিচঝাঁপিতে থাকতে লাগলেন। গরীবগুর্বোদের নিজেদের হাতে গড়া এক নতুন উপনিবেশ। সরকার এই সব দেখে রেগে আগুন তেলে বেগুন। শহরের খোকাখুকুরা বাঘ দেখবে কি করে? তাই সরকার বাহাদুর লিখলেন- এই উদ্বাস্তুরা এসেছে with the intention of settling there permanently thereby disturbing the existing and potential forest wealth and also creating ecological imbalance". টেনে হিঁচড়েও দ্বীপ খালি করা গেল না। ১৯৭৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি পুলিশ গুলি চালাল। ৩৬জন মারা গেলেন। পত্রপত্রিকা এবং বিরোধীরা চেঁচামেচি করায় জ্যোতিবাবু ঘোষণা করলেন মরিচঝাঁপিতে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। প্রজাতন্ত্র দিবস ১৯৭৯। অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষিত হল। তাতেও কাজ হয় না দেখে মে মাসে মরিচঝাঁপি ব্যারিকেডে ঘিরে দেওয়া হল যাতে সেখানকার লোকজনের কাছে জল এবং খাদ্য না পৌঁছায়। তিরিশটা পুলিশের লঞ্চ দাঁতালো কুমীরের মতো তখন দ্বীপটাকে ঘিরে আছে। বাড়িঘর গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, কাঁদানে গ্যাস চলছে, নৌকাগুলো ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাকে গুলি করা হচ্ছে। জানা যায় না কত শত মানুশ মারা গিয়েছিলেন। জানাও যাবে না আর। স্রেফ অনেক মানুষ মরেছিল- এইটুকুই। কোনও দল তাদের নেতৃত্ব দেয়নি। তাহলে জানা যাবেই বা কি করে? কারা জানি বলেছিল "এ লড়াই বাঁচার লড়াই'? নদীর নোনা হাওয়াতে মিলিয়ে গেছে সব, মিশে গেছে শব।

    তবে আর কিছু হোক না হোক, পরিবেশ কিন্তু বাঁচল মশাই। এখন সুন্দরবনে প্রায় আড়াই শ বাঘ আছে। তাও তেনাদের দেখতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। না দেখতে পেলেই বা হয়েছে কি, অনেক অনেক "প্রকৃতি', অনেক অনেক "পরিবেশ' রয়েছে। বেশ ভালো লাগবে। জল আর আকাশের প্রায় মিশে যাওয়া মোনোক্রোম ক্যানভাসে একটা দুটো গাঢ় সমান্তরালতা। সেই সব ভালো লাগা গল্পেই ফেরা যাক। এবার জাস্ট "দাও ফিরে সে অরণ্য, লও হে নগর'। প্রমিস।

    (ক্রমশ)

    ৩৩ (Feb 16 2007)
    সুন্দরবনের ডায়েরি

    (গত সংখ্যার পর)

    এই নিয়ে আট কি নয়বার সুন্দরবনে। কয়েকবার পশ্চিমের দিকে মানে নামখানা কাকদ্বীপ বকখালি সাগর। কয়েকবার পূর্বে বনবিবির দক্ষিণরায়ের রাজত্বে। এই দুইদিকের মাঝামাঝি মাতলার জল। মাতলার পশ্চিমে জলজঙ্গল কম, মূলত লোকালয়। এইদিকে বাঘের আনাগোনা নেই। তবে যার উপদ্রব আছে তিনি বাঘের থেকে কম কোনোমাত্রায় কম না। এইদিকে বনবিবি দক্ষিণরায় নেই, কিন্তু ঘরে ঘরে মনসার পূজা। পূর্বদিক মানেই জল, ম্যানগ্রোভ জঙ্গল আর চারদিকে বাঁধ দেওয়া দ্বীপের মাঝে গ্রাম যেন কানাতোলা বাটির মধ্যে বসে। নব্বইয়ের দশকে সুন্দরবন ভ্রমণার্থীর আশাভরসা বলতে ছিল সরকারি পর্যটন কিংবা ক্যানিং থেকে প্রাইভেট লঞ্চ ভাড়া করে পিকনিক। সজনেখালি আর নেতিধোপানি ছাড়া ওয়াচটাওয়ার ছিল না। সুধন্যখালির ওয়াচ টাওয়ার একানব্বই বিরানব্বইতে ছিল কিনা মনে করতে পারছি না। এখন সুন্দরবনে পর্যটনের চেহারা অনেকটাই পালটেছে। দোবাঁকি, বুড়ির ডাবরির মতো নতুন নতুন সুপরিকল্পিত ওয়াচ টাওয়ার তৈরি হয়েছে। বুড়ির ডাবরির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ এটি মনে হয় একমাত্র ট্যুরিস্ট ওয়াচ টাওয়ার যা উত্তর চব্বিশ পরগণায় বসিরহাট ফরেস্ট রেঞ্জের ভিতরে। উত্তর চব্বিশ পরগণার মধ্যেও যে সুন্দরবনের একটা বিস্তৃত অংশ রয়েছে তা অনেকেই জানেন না। বুড়ির ডাবরির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিশাল নদী রায়মঙ্গল। রায়মঙ্গলের অন্যপারে আবছা দেখা যায় খুলনা জেলার গাছপালামাটি। একবার রওনা হয়েছিলাম হাসনাবাদ থেকে। হাসনাবাদ থেকে শুরু করে সারা সুন্দরবন চষে যাত্রা শেষ হয়েছিল ক্যানিঙে। ক্যানিঙের আশেপাশে ট্যুরিস্ট লঞ্চের যত আনাগোনা, উত্তর চব্বিশ পরগণার দিকে তা অত দেখা যায় না। তার আরও একটা কারণ সুন্দরবনের সীমান্ত এলাকায় জলদস্যুর প্রকোপ। বিশেষত রায়মঙ্গল এবং আশপাশের নদীগুলো দস্যুবৃত্তির পক্ষে সহায়ক, কারণ জলের মধ্যে অদৃশ্য ভারত-বাংলাদেশের সীমানা। একসময় খবরের কাগজে জেলেদের অপহরণ এবং মুক্তিপণ দাবী নিয়মিত খবর ছিল। এখন শুনলাম এই উৎপাত আগের থেকে অনেকটাই কমেছে।

    জলদস্যুর উৎপাত যেমন কমেছে, পাখিও অনেক কমে গেছে। নব্বইয়ের দশকে গাছে গাছে পাখির ঝাঁক দেখেছি। এখন পাখি দেখতে পাওয়া গেলেই লাফ দিয়ে উঠে চোখে দূরবীন লাগাতে হয়। কাদাখোঁচা, পানকৌড়ি, কোঁচবকই পাখিদের আসর সরগরম করে রাখে। জলে ডুবে থাকা ডালের উপর সাধারণ মাছরাঙাও খুব একটা দুর্লভ নয়।  গ্রামের আশেপাশে ফিঙের ঝাঁক ঘুরে বেড়ায়। সুধন্যখালির উলটোদিকের জঙ্গলে দেখলাম প্রায় দুর্লভদর্শন কমলামাথা মাছরাঙা। ম্যানগ্রোভের ডালে ঠিক এক বড়োসড়ো কমলালেবুর মতো। আর হঠাৎ দুপুরে ঘন নীল আকাশ জুড়ে একঝাঁক হলুদপেট টিয়ার ঝাঁক উড়ে গিয়েছিল এ বন থেকে সে বনে। শুনলাম গত দশকের কয়েকটি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের ফলে পাখিদের এই হাল। সেই তুলনায় কুমীরেরা মনে হল বহাল তবিয়তেই আছে। বিশেষত শীতের দুপুরে যখন ভাঁটা লাগে, নদীর জল কাদার চর থেকে নেমে আসে, তখন কাদার চরে নটনড়নচড়ন কুমীরমশায়দের ল্যাদ করতে দেখা খুব একটা দুর্লভ নয়। একদম মিনি থেকে দশাসই কুড়িফুটিয়া কুমীরও দেখা যায়। যথেষ্ট হরিণ চরে বেড়ায়। তবে ভারতের যে কোনো জঙ্গলেই বেশির ভাগ পর্যটককে যেহেতু শুধু হরিণ দেখে বাড়ি ফিরতে হয়, জঙ্গলভ্রমণের ব্র্যান্ড ইকুইটির দিক থেকে হরিণেরা নিতান্তই সাব-অল্টার্ন। হরেদরে সবাই হরিণ দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে ধুস্‌ বলে বাড়ি ফেরেন। তবে জরা হাটকে দেখলে বোঝা যাবে ম্যানগ্রোভের জটিল জালের আড়ালে লুকিয়ে সতেজ ত্বক, বিশাল শরীর আর বিস্তৃত শিং নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই সব হরিণের সঙ্গে ঘাসজমিতে চরতে আসা শকুন্তলার পোষ্য কাটিং মৃদু এবং খুদে হরিণের দলের একটু তফাত আছে। তবে বাঁদরের সংখ্যা বেড়েছে মনে হল। আমার একান্ত ব্যক্তিগত ধারণায় ট্যুরিস্ট বাড়লেই বাঁদর বাড়ে। ব্যাখ্যা নিÖপ্রয়োজন।

    এইবার বাঘ নিয়ে দুই এক কথা। সুন্দরবন চষে ফেলে কোনোদিন বাঘের লেজের ডগাও দেখতে পাইনি। প্রথমবার সুন্দরবন থেকে ফিরে ক্যানিং লোকালে বসে হতাশ ট্যুরিস্টদল যখন নিষ্ফলা ভ্রমণের আলোচনা করছিলাম তখন আমাদের পাশেই বসে থাকা এক ফলওয়ালা প্রায় তিরষ্কারই করেছিলেন। বলেছিলেন সুন্দরবনের বাঘ দেখা সুখকর অভিজ্ঞতা তো নয়ই, প্রাণঘাতীও হতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য বাঘের তুলনায় সুন্দরবনের বাঘ অনেকটাই আলাদা। এরা অনায়াসে দশ কুড়ি কিলোমিটার সাঁতরাতে পারে, নোনা জল খায় আর নিয়মিত খাদ্যের মধ্যে আছে মাছ আর কাঁকড়া। আরও বড়ো কথা প্রায় বিনা প্ররোচনায় মানুষকে আক্রমণ করে যা অন্যান্য কোনো অঞ্চলের বাঘ করে না। তবে বার বার গিয়ে বুঝেছি বাঘ দেখলেই জানের খতরা অনেকটা মিথই বটে। লঞ্চ থেকে পর্যটকেরা বাঘকে নদী এপার ওপার করতে দেখেছেন বা পঁচিশে ডিসেম্বর সুধন্যখালির ট্যুরিস্টমুখরিত ওয়াচ টাওয়ারের পাশে বাঘ এসেছে- এই রকম ঘটনা ঘটেই থাকে। একবার সুন্দরবনের গভীরে যেতে যেতে চামটা অবধি চলে গিয়েছিলাম। চামটার বাঘেরা আবার সুন্দরবনের বাঘের মধ্যে ইস্পেশাল ব্র্যান্ড। তাও তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই। ইচ্ছে ছিল আরও দক্ষিণে গিয়ে সুন্দরবনের প্রায় শেষ ঘাঁটি হলদিবাড়ি অবধি যাওয়ার, যা প্রায় মোহনার কাছাকাছি। কিন্তু সেইখানে তখন বাঘের থেকেও ডাকাতের ভয় আরও বেশি। কাজেই আর গিয়ে ওঠা হয়নি। এখন নেতিধোপানির দক্ষিণে সুন্দরবনের কোর এরিয়াতে ঢোকা নিষিদ্ধ। চামটা, হলদিবাড়ির জঙ্গল আওতার বাইরে। তবে স্থানীয় লোকেরা বলেন, কোথায় কখন বাঘ দেখা যাবে তা স্রেফ কপালের খেলা। কেউ সজনেখালির পর্যটকাক্রান্ত মহলেও বাঘ দেখতে পারেন, আবার কেউ চামটার বুক ধুক্‌পুক গভীর জঙ্গলে রাত কাটিয়েও শূন্যচোখে ফিরে আসতে পারেন। ঠাট্টা করে অনেকেই বলেন সুন্দরবনের বাঘ আসলে একটা ধারণামাত্র। সরকারি হিসেবে আড়াইশোর বেশি বাঘ রয়েছে। যদিও টাইগার সেন্সাসের এই পরিসংখ্যান নিয়ে অনেকের মধ্যেই তীব্র সন্দেহ রয়েছে। তো এই জীবন্ত মিথকে দেখতে পেলে কেমন আনন্দ হয় পরখ করিনি, তবে বসে আছি পথ চেয়ে-র আকুলতাও কম রোমাঞ্চের নয়। হেঁতালের পাতা নড়লেই যখন শরীর টানটান, সাজাগ হয়ে ওঠে কান। যদিও তারপরেই ধুস্‌। এবং একটা ভয় যেটা লঞ্চে দুপুরবেলা মাছভাত খেতে খেতে অনুভব করা অনেকসময় দু:সাধ্য। যে সব বাউলেরা মধু আর কাঠের খোঁজে জঙ্গলপাড়ি দেয়, ভয়ই তাদের বাঁচার রসদ। এ এক তীক্ষ্ম যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে ভয়ের জোরে মানুষ বাঘের সঙ্গে খালি হাতে লড়াই করে।

    সেইবার নেতিধোপানির জঙ্গলে। একটু আগেই পিকনিক পার্টির অশ্লীল চেঁচামেচিতে জঙ্গলের পাখিরাও উড়ে চলে গেছে। আমরা অপেক্ষা করে আছি। নেতিধোপানিতে ওয়াচটাওয়ারের রাস্তার চারদিক জালে ঘেরা। ওয়াচটাওয়ারের সামনে মিষ্টি জলের ডোবা। ওয়াচটাওয়ার আর ডোবার মাঝেও স্টিলের তারের উঁচু বেড়া। সবাই ফিরে যেতেই দুপুরের জঙ্গল যখন নিঝুম, আমাদের দুজনের সেই বেড়ার গেট খুলে ডোবার পাশে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। ডোবার পাশেই বাঘের তাজা পায়ের ছাপ। আমাদের সঙ্গে লাঠিধারী বনরক্ষী। হঠাৎ মনে হল, জালের এইপাশে এসে এখন আমরা দর্শক থেকে দ্রষ্টব্য। আমরা তাকে দেখছি না, কিন্তু সে হয় তো আমাদের দেখছে, চারদিকের ঘন জঙ্গলের কোনো দুর্গম আড়াল থেকে। ঘাড়ের রোয়াঁগুলো দুপুরবেলাতেও খাড়া হয়ে উঠল। এই সেই  ভয়। আর একবার আমাদের লঞ্চ ঝড়খালির জেটিতে নোঙর ফেলেছে। যে সময়ের কথা বলছি তখন ঝড়খালিতে সরকারি ফিশারি রম্‌রমিয়ে চলছে। এখন সরকারি অবহেলায় সেই ফিশারি অবলুপ্ত। সন্ধেবেলা চাঁদের স্তিমিত আলোয় জলজঙ্গল গম্ভীর, থমকে রয়েছে। লঞ্চের ডেকে কালীপদ জমিয়ে গল্প ধরেছে। দু হপ্তা আগে নদীর উলটোপারে বাঘ ধরে নিয়ে গেছে গ্রামের এক মহিলাকে। কালীপদ প্রায় জি পি এস মনিটরের মতো নির্ভুলভাবে স্থানটি দেখায়। চার পাঁচদিন আগে ঝড়খালির কাঠের বাংলোর নীচে দুটি বাঘের ছানা খেলা করছিল। বাঘের গল্পে যখন সবাই মশগুল, তখন রাতের খাবারের ডাক পড়ে। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে দেখা যায় ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো এ তরী। ঠিক হয় মহিলা এবং শিশুরা লঞ্চেই রাত্রিযাপন করবেন আর আমরা দুই জোয়ান ছেলে দ্বীপের মধ্যে পাকা বাংলোতে রাত কাটাব। পাকা বাংলো কাঠের বাংলো থেকেও আরও অনেকটা পথ গিয়ে। জেটি থেকে বাংলো অবধি উঁচু রাস্তা সটান চলে গিয়েছে। আমাদের গাইডের হাতে গদা সাইজের একখানা টর্চ। নিশ্চয় রাস্তার মধ্যে সাপখোপ থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা যে শুধু সাপখোপ নয় বুঝতে পারলাম যখন তিনি সেই টর্চটা খুব দ্রুতগতিতে প্রায় একশ আশি ডিগ্রি ঘোরাতে ঘোরাতে চললেন। আগেই বলেছি চাঁদ একেবারেই স্তিমিত। তখনও ঝড়খালিতে সৌরবিদ্যুৎ আসেনি। সেই তুমুল অন্ধকারের মধ্যে শুধু একফলা তীব্র আলোর দ্রুত থেকে দ্রুততর আন্দোলন। কোনো দূর থেকে আবছা হৈহল্লা ভেসে আসছে মনে হয়। কানের ভুল কিনা জানি না। রক্ত থমকে গেছে। এই সেই ভয় যা প্রাণের গভীর থেকে স্বতোৎসারিত, যার কোনো সমাজ-সংস্কৃতি-জাতিভেদ নেই। শুধু শরীরকে টান টান ছিলা করে তোলে। এই সেই ভয়।

    (ক্রমশ)

    এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৪         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         মার্চ ১ ২০০৭

    ৩৫ (Mar 17 2007)
    শেষ বসন্তের ডায়েরি

    (যে লেখাটা জমা পড়ার কথা ছিল সেটা জমা পড়ল না। ২০০৭ সালের ১৫ই মার্চ মনে হয় একটু অন্যরকম দিন যেদিন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষেরা শুধু একটা ব্যাপার নিয়েই ভাবতে পারেন, বলতে পারেন বা লিখতে পারেন। রাগে-বিক্ষোভে-ঘৃণায়-যন্ত্রণায় অনেকেই কাঁদছেন, বাজপড়া গাছের মতো শুকিয়ে যাওয়া চোখে।  আবার "গুলি করেচে বেস করেচে' প্রতিক্রিয়াও দুর্লভ নয়। জানি না বাংলালাইভের বিদেশবাসী পাঠক-পাঠিকারা এই কান্নাঝরা অন্ধকার বসন্তের অভিজ্ঞান কীভাবে পাবেন, কিংবা আদৌ পাবেন কিনা। নিশ্চয়ই তর্কের ঝড় উঠবে নেটে নেটান্তরে, এবং তারপর "তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে',  ঠিক আগের মতই। তবুও...., তবুও কেন জানি মনে হয় এই স্থবির হতবুদ্ধি সময়ে যেটুকু হৃদয়ের তাগিদ বেঁচে রয়েছে, তা দিয়ে এখনও আমারই স্বজন-সুজনের কান্নাকে ছুঁতে পারি। তাঁদের চোখের সেই পবিত্র জলকে সালাম জানিয়ে আমার শেষ বসন্তের ডায়েরি।)

    "ওখানে রয়েছে শুয়ে গুলিবিদ্ধ একটা মানুষ
    বুকে তার রক্তপদ্ম মুখে তার চৈত্রের পলাশ
    অঙ্গ জুড়ে শান্ত নদী যন্ত্রণার গোলাপ বাগানে
    তাকে ঘিরে গাছ পাখি বসন্তের প্রকৃতি আকাশ।" - রাম বসু

    আজ থেকে একমাস আগে যখন ছোট করে মরিচঝাঁপির ইতিহাস লিখেছিলাম, তখন বুঝিনি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কতটা সম্ভব, কতটা অমোঘ। মরিচঝাঁপিতে সরকারি হিসাবে পুলিশের গুলিতে ৩৬জন মারা গিয়েছিলেন। প্রথমে ভাতে এবং শেষে হাতে তিলতিল করে যাদের মারা হয়েছিল তাদের সঠিক হিসেব আজ গভীর নদীগর্ভে। নন্দীগ্রামের হিসেবও উলটেপালটে যাবে। অথবা গেছে। জলমাটির দেশ রক্তকে খুব তাড়াতাড়ি মুছে ফেলে। শুধু দেখেছি গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়া এক মহিলাকে আর এক মহিলা তুলে নিতে গেলে এক পুরুষ পুলিশ তাদের ক্রমাগত লাঠি মেরেই চলেছে। মেরেই চলেছে, মেরেই চলেছে যাতে মানুষ নামের শক্ত পাথরটাকে থেঁতলে গুঁড়িয়ে নরম তুলতুলে মাংসের বল বানিয়ে দেওয়া যায়। তারপর সেই নরম দলাটা দিয়ে ইচ্ছে হলে ভূমিসংস্কার কিংবা শিল্পায়ন। দেশের সংহতি কিংবা শান্তিশৃঙ্খলারক্ষাও হতে পারে। যখন যেটা দরকার আর কি! দেখেছি এক মহিলার মাথা ফুঁড়ে গুলি চলে গেছে, আর এক মহিলার পেট ফুঁড়ে। "সোনার বাংলায়' কি ঘরের, ক্ষেতের কাজ কম পড়িয়াছে যে গ্রামের মহিলারা সবাই দুম্‌দাম্‌ সমাজবিরোধী হয়ে যাচ্ছেন? নাকি সকালবেলায় ঘরের কাজ সেরে "বহিরাগত' তাঁরা অন্য গ্রামে পুলিশের বসন্ত উৎসব দেখতে গিয়েছিলেন?

    সময়টাই বড় অদ্ভুত। এখন রাস্তা সারাতে গেলে পুলিশ দিয়ে মানুষকে খুন করতে হয়। এখন বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই লড়তে গেলে পুলিশ অফিসারদের সহায়তা লাগে। এখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে বেয়াদপ গ্রামকে শিক্ষা দেওয়া প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এখন দিল্লির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের রাজনৈতিক সংগ্রামের হালহকিকৎ বুঝে ফেলা যায়। এখন এমবেডেড সাংবাদিক না হলে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ নিষেধ। কিংবা সময়টা হয় তো আদৌ সে রকম অদ্ভুত নয়। পশ্চিমবঙ্গে ইতিহাসের চাকা শম্বুকগতিতে ঘোরে বলে হঠাৎ চোখের সামনে সূচীভেদ্য অন্ধকার আমার অদ্ভুত লেগেছে। হয় তো আলো কমেই আসছিল। অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে বুঝতেই পারি নি। ইতিহাস বুঝতে পারি নি। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ভুলে গিয়েছিলাম।

    ২০০৭ সাল, ১৪ই মার্চ, সি পি এম পলিটব্যুরোর বিবৃতি:

    "For two and a half months five gram panchayats in Block I of Nandigram have been out of bounds for the administration. Certain elements had resorted to violence and cut off roads and bridges in the area on the pretext of land acquisition.
    CPI(M) members and supporters were driven out of the area. Two thousand and five hundred people were driven out of the area. More than a thousand people are sheltering in relief camps outside the area. Even after the government categorically declared that no land is being acquired in Nandigram, the Trinamul, naxalite and other elements refused to allow the administration or police into the area. Those who did not go along with their disruptive activities were targeted. Only a few days ago a woman, Sumita Mandal, was raped and killed. The repeated efforts to have meetings so that peace can be resorted were rebuffed with these parties and elements refusing to attend the meetings. Finally, after an all-Party meeting, which was boycotted by the Trinamul Congress, a decision was taken that the administration must reestablish its authority and peace be resorted in the area. The police entered Nandigram to see that the roads, culverts and bridges are repaired and the administration restored. They were attacked by brickbatting, bombs and use of pipe guns. It is regrettable that lives have been lost in police firing. But the organised elements who utilised bombs and pipe guns on the police have to take the blame. The Polit Bureau appeals to the people of West Bengal and in particular Nandigram and East Midnapur district to stand  unitedly against such disruptive forces."

    ১৯৪৮ সালের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসের সাতদিনের অধিবেশন শেষ হয় ৬ই মার্চ। তার ঠিক কুড়িদিন পরে পশ্চিমবাংলায় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

    ১৯৪৮ সাল, ৩০শে মার্চ, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরণশঙ্কর রায়ের বিবৃতি:

    "....গত কয়েক মাসের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচী এবং ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে সম্ভবত পরিষদের অনেক সদস্যই ওয়াকিবহাল নহেন।....সম্প্রতি খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়প্রার্থীর পুনর্বসতি, বেকারি ইত্যাদি আশু সমাধান সাপেক্ষ সমস্যাগুলির উপর গভর্নমেন্টের দৃষ্টি নিবদ্ধ হইয়া আছে। কম্যুনিস্ট পার্টি সরকারের এই তন্ময়তার সুযোগ গ্রহণ করিতে দ্বিধাবোধ করে নাই। তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল একটা অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করা এবং শেষাশেষি ঐ সুযোগে হিংসাত্মক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। গ্রামাঞ্চলে ঐ পার্টি খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে কি রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করিতেছে গভর্নমেন্ট তাহার অসংখ্য সংবাদ পাইয়াছেন। এই পার্টি যে সব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করিতে পারিয়াছে সেইসব অঞ্চলে তাহারা গ্রামবাসীদের আইন ও শৃঙ্খলা অমান্যের জন্য উস্কানি দিয়াছে। হুগলী জেলার কমলপুর গ্রামের সাম্প্রতিক ঘটনা পরিষদের স্মরণ থাকিতে পারে। কম্যুনিস্ট পার্টির প্রভাবে গ্রামবাসীগণ বেশ কিছুকাল যাবৎ কর্তৃপক্ষ স্থানীয়দের সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করিয়া আসিয়াছে। একটি ক্ষেত্রে তাহারা এক পুলিশদলের উপর চড়াও হয়; ঐ পুলিশদল ফৌজদারি মামলা সম্পর্কে কয়েকজন পলাতককে গ্রেপ্তার করিতে গিয়াছিল। পরিশেষে পুলিশদল আত্মরক্ষার প্রয়োজনে গুলি চালাইতে বাধ্য হইয়াছিল।......গভর্নমেন্টের পক্ষ হইতে আমি জানাইতে চাই যে অত্যন্ত দু:খ ও অনিচ্ছার সঙ্গে আমরা এই ব্যবস্থা লইয়াছি। কোন জনপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক গভর্নমেন্টের পক্ষে এই সব অসাধারণ ক্ষমতার প্রয়োগ রীতিবিরুদ্ধ। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে একটা আসন্ন বিপদ নিবারণের জন্যই, এই বিপদ অত্যন্ত দ্রুত প্রসারলাভ করিয়া শান্তি ও শৃঙ্খলার বিঘ্নস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।...."

    জানি না গুণীজনেরা একেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলেন কিনা। জানি না বসন্তকাল হত্যার উপযুক্ত সময় কিনা। যে সময়ে কিরণশঙ্কর রায় এই বিবৃতি দিচ্ছেন, সেই সময়েরই এই গল্প:

    ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮- বড়া কমলাপুরে পুলিশি সন্ত্রাস। ১৫০জন কৃষক গ্রেপ্তার। সান্ধ্য আইন জারি। পুলিশের গুলিতে গুইরাম মন্ডল ও কার্তিক ধাড়া নিহত ও ৪জন মহিলা আহত।
    ২৭শে ফেব্রুয়ারি,১৯৪৯- হাওড়ার মাসিলা গ্রামে কৃষকদের উপর গুলি। ৩জন কৃষক-বধূ নিহত।
    ৯ই মার্চ, ১৯৪৯- তমলুকের চকদুর্গাপুরে কৃষকদের উপর গুলি। নিহত ২জন।
    ২২শে মার্চ, ১৯৪৯- মালদহে খেতমজুর সম্মেলনের উপর গুলি।
    ২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০- মেদিনীপুরের কেয়াপাড়া গ্রামে কৃষকদের উপর গুলি। ১জন নিহত ও ১জন আহত।

    এই ইতিহাসের প্রায় ষাট বছর পেরোবার সময় আমি জানি না আদৌ কাউকে ভরসা করা যায় কিনা। একদম ছোটবেলায় পুলিশের ভয় দেখিয়ে দুধ খাওয়াবার সময় থেকে পুলিশের উপর ভরসা হারিয়েছি। আমি ভরসা করি না একটিও রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে, ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাহীন, কারণ তাদের প্রত্যেকের হাত নিরীহ মানুষের রক্তে লাল। আমি ভরসা করি না সেই সব বুদ্ধিজীবীদের যাঁরা হাওয়ামোরগের মতো উলটেপালটে যান। আমার ভরসা থাকে না সেই সব নামী দামি গায়ক-শিল্পীদের উপর যাঁরা মানুষের রক্তে শৌখিন বিপ্লবের মধ্যবিত্ত আঁচ পোহান। আমি সেই বৈজয়ন্ত চক্রবর্তীকে একফোঁটা ভরসা করি না যে উদ্বৃত্তভোগী বাবুটি গোলমাল দেখলেই একদিকে তত্ত্ব এবং অন্যদিকে রক্তে থেকে যাওয়া ছিঁটেফোঁটা "আস্তিকতার' আড়ালে মুখ ঢাকার রাস্তা খোঁজেন। বন্ধের দিন একফোঁটা রোজগার না হওয়া আমার বাড়ির সামনের চাওয়ালাটি যখন ধরে আসা গলায় প্রশ্ন করেন "এই লোকগুলোর বাচ্চাদের কী হবে দাদা?' ভরসা রাখি তাঁর ওই প্রশ্নের উপর। ভরসা রাখি তাঁর মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, বৈশিষ্ট্যহীন, ভিড়ে মিশে যাওয়া লাখ লাখ মানুষের এইসব প্রশ্নের উপর। এই সব ভরসা নিয়েই আমরা সবাই বেঁচে থাকি। আর সেই ভরসা হারিয়ে গেলে তৈরি হয় একের পর এক নন্দীগ্রাম। জানি তাঁরা কেউ কোনোদিন আমার এই ডায়েরি পড়বেন না। আবার যাঁরা পড়বেন বিশ্বকাপের উত্তেজক মরশুমে অথবা বিদেশের ব্যস্ত জীবনের গতিতে এই অসহায় কণ্ঠস্বর ভুলে যেতে তাঁদের বেশিক্ষণ লাগবে না। তবুও সেই সব অপাঠক এবং অপাঠিকাদের জন্যই লিখলাম আমার শেষ বসন্তের ডায়েরি।

    এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৬         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         এপ্রিল ৩ ২০০৭
    এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৭         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         মে ৩ ২০০৭
    এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৮         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         মে ১৮ ২০০৭
    এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৯         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         জুন ১৮ ২০০৭

    ৪০ (Jul 6 2007)
    শেষ কিস্তি

    আবার এসেছে আষাঢ় বারোটা বাজিয়ে। শরীর আর বৃষ্টির জল মিলেমিশে হাওয়ায় ঘামের টোকো গন্ধ। অল্প বৃষ্টিতে রাস্তার কাদাই সার, বেশি বৃষ্টিতে রাস্তায় গাছ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, রাস্তাঘাটে গাড়ি নেই, অফিসে আসা ধুন্ধুমার। যেদিন তিনি প্রথম আসেন, সেদিন নতুন ভেজা মাটির যোনিগন্ধে এক বিপুল উত্তেজনা মিশে থাকে। কলকাতার উথালপাথাল হয়ে যাওয়া রাস্তাঘাটে চুপচুপে ভিজতে ইচ্ছে করে। দিন যত এগোয় রিয়েল বা আনরিয়েল- কোনও এস্টেটই আর মেঘমল্লার শোনে না। শিউলি ঝরে পড়ার অপেক্ষায় শুধু হাপিত্যেশ বসে থাকা। তবে আমার পাশের গাছটায় দেখি সম্বৎসর শিউলি ফোটে। কে জানে আজকাল হয় তো ফুলও কার্বাইডে ফোটে! ইদানীং জাতে ওঠা পল্লীসমাজের এথনিক বর্ষাতেও বিশেষ সুখ মনে হয় না, যদি না উত্তরায়ণের বারান্দায় আরামকেদারা পেতে বসা যায়। সরকারি অযত্নের কাঁচা রাস্তা, পাড় ভাঙতে থাকা গঙ্গা এবং বন্যার উপদ্রবের মধ্যে স্বার্থপর প্রফেটটির একটি গানই সত্য- ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। ভেবে দেখলাম এই হিসেবী বয়সে বর্ষা উপভোগের ভ্যান্টেজ পয়েন্ট হল কোনও চোদ্দোতলা বাড়ির টঙে কাচঘেরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘর। তার সাথে খেয়ালি বয়সের নস্টালজিক অনুপানরূপে এক বোতল রাম আর একথাল খিচুড়ি, বোসের মিউজিক সিস্টেমে নিখিলবাবুর মেঘ কিংবা মোহরদির নীলাঞ্জনছায়া। বাইরে বেরোলেই শহরে বৃষ্টি জলকাদামাখা নোংরা দেদার, বগলে বেঁটে ছাতা, চোখের চশমা ঝাপসা, অফিস থেকে বাড়ি ফেরা পুরো হাতা। ঝাপসা হয়ে আসে মগজও, এক অদ্ভুত স্যাঁৎসেঁতে ক্লান্তিতে।

    বর্ষা প্রকৃত প্রস্তাবে যৌনতার সময়। রাজবংশীদের বৃষ্টির দেবতা হলেন হুদুমা। কোনও অমাবস্যার রাতে অনাবাদী জমিতে লাঙল আর বীজ নিয়ে রাজবংশী মেয়েরা এলোচুলে নগ্নদেহে নাচে আর গায়-

    হিল হিলাসে কোমরটা মোর
    শির শিরাসে মোর গাও
    কোন্ঠে কেনা গেলে এলা
    হুদুমা দেখা পাও?
    পাটনিখানি পরেসে খসিয়া
    আওলা হয়েছে খোঁপাটা মোর
    হুদুম দেখা দাও গো আসিয়া
    আইসেক রে হুদুমা দেওয়া
    রসিয়া রসিয়া
    তোর পদে মই আসে রে বসিয়া
    দিংশালি দিংশালি কোমরটা
    তাতেও নাই মোর ভাতারটা।
    কারো কি মই কইবা কয়
    কোন্ঠে গেলা দেখা হয়
    দেখা হলে দেহটা জুড়ায়।

    সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে- "আমার কোমরটা দুলছে, শরীরটা কাঁপছে হুদুমার জন্য, কোথায় তাকে পাব? আমার কাপড়খানি খসে গেছে শরীর থেকে, চুল এলো হয়ে গেছে। হুদুমা, এবার দেখা দাও, আর এসে আমাকে তোমার রসে সিক্ত কর। আমার ভাতার এখানে নেই। কাকে বলব আমার কথা? কোথায় গেলে তোমার সঙ্গে দেখা হয়, ও দেখা হলে শরীরটা জুড়ায়?' প্রথম বৃষ্টির যৌনতার এই প্রবল আর্তি আমাদের রুটিনশরীরে সয় না। এই শরীরগুলোতে আপাতত কোনও আর্তি নেই, তাই কোনও প্রাপ্তি নেই। কোনও প্রাপ্তি নেই, তাই কোন বিস্ময়বোধ নেই। কোনও বিস্ময়বোধ নেই, তাই ক্লান্তিতে নুয়ে আসে বর্ষার ভিজেথাকা দিনরাতগুলো। স্থবিরের জন্য বর্ষা কিছু রেখে যায় না।

    আকাশে ভর দিয়ে কোনওরকম দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর হাক্লান্ত মেঘ দেখে মনে পড়ে বর্ষা মৃত্যুরও সময়। শ্মশানে সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল বুলেটের মতো। শ্মশানযাত্রীরা পড়িমড়ি দৌড়ে ঢুকে গেল অ্যাসবেস্টসের ছাউনির তলায়। পাগল হয়ে যাওয়া বৃষ্টিতে নিথর শুয়ে থাকা মানুষটির হাড়মাস অবিরত ভিজে যাচ্ছিল। পাশে বসে ঠায় ভিজছিল তাঁর নিথর সন্তান, শ্মশানের গাছদের মতো। প্রফেটের এই সৌভাগ্য হয়নি। বাইশে শ্রাবণ অসম্ভব ভিড় আর হুড়োহুড়ির মধ্যে শরীরটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেদিনও কলকাতার রাস্তা অঝোর বৃষ্টিতে ভিজেছিল। কিন্তু সেই বৃষ্টির গল্প বিশেষ শুনিনি। বরং অনেক বেশি করে শুনেছি কাদাতে পিছল নিমতলার মাটির কথা। নিজের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য বেশ গুছিয়েগাছিয়ে শান্তিপারাবারের একটা ভাবগম্ভীর গান লিখে গিয়েছিলেন। অথচ বাইশে শ্রাবণ ভাবলেই মনে পড়ে শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, অঝোর বৃষ্টির তলায় শুইয়ে রাখা একটি মৃতদেহ, পাশে বসে ভিজে যাওয়া একাকী সন্তান। সেই ছবিতে আমি মায়া দেখি। কি ঘোর মায়ায় সন্তানেরা পিতামাতাদের শরীরে হাত রেখে ভিজে যেতে থাকে। এই মায়া, এই বৃষ্টির জন্যই আমাদের চূড়ান্ত অপেক্ষা। ক্লান্তির জলে যদি বা ভাসে মায়ামাখা শবদেহগুলি!

    মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধব:।
    মাধ্বী ন: সন্তু ওষধী:।।
    মধু নক্তম্‌ উত ঊষস: মধুমৎ পার্থিবং রজ:।
    মধু দ্যৌ: অস্তু: ন: পিতা।।
    মধুমান্‌ ন: বনস্পতি: মধুমান অস্তু: সূর্য:।
    মাধ্বী গাব: ভবন্তুন:।।

    এতদিনের জমিয়ে তোলা অক্ষরগুলো পিঁপড়ের মতো গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। নিজের লিখে যাওয়া অবিরল শব্দের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় এত কথা হয় তো আদৌ বলার ছিল না। নিজেকে ভয়ানক বাচাল মনে হয়। আপাতত ভীষণ ক্লান্ত লাগে। বাইপাসে আমাদের বলে যাওয়া লিখে যাওয়া শব্দের মতো গাড়িগুলো হুস্‌হাস্‌ বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতেও তাদের হুঁশ নেই। এই অবিরাম চলনে খুব ক্লান্ত লাগে। আবার নিজের মধ্যে মায়ার রসদগুলো জড়ো করে তুলতে হবে। তার আগে থামতে হবে, নিজের সাথে কথা বলে যেতে হবে, নি:শব্দ হতে হবে। নৈ:শব্দ্যের অন্যপিঠে শব্দের নির্মাণ। লেখালেখিতেও কত মায়া! পাঠিকা পাঠকদের নিয়ে শব্দের মায়ার সংসার। এই মায়ার সংসার বারে বারে বহু যতন করে ধুয়েমুছে রেখে দিতে হয়। সেই পদ্মের জন্য সারারাত কোজাগর পূর্ণিমায় জেগে থাক বুড়োটে মগজ। নৈ:শব্দ্য প্র্যাকটিস করুক।

    Hello darkness, my old friend,
    I've come to talk with you again,
    Because a vision softly creeping,
    Left its seeds while I was sleeping,
    And the vision that was planted in my brain
    Still remains
    Within the sound of silence.
  • বিলেত ফেরত : বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী | 103.76.82.214 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:০৩741436
  • তালিকা (ছবিগুলো উদ্ধার করা গেল না, তা বাদে ডায়েরি : বিলেত ফেরত পুরোটাই উদ্ধার হল)
     
    বিলেত ফেরত -- পর্ব ১         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         ডিসেম্বর ১৬ ২০০৪
     
    ইদানীং লন্ডন

    ভূতুম সক্কাল সক্কাল রাসেল স্কোয়ারে পৌঁছে তাজ্জব। রাসেল স্কোয়ারের এক আলিশান বাড়িতে বাবু রামমোহন রায় থাকতেন বলে শোনা। সেই বাড়ি দেখতে গিয়ে ভূতুম দেখে রাসেল স্কোয়ার লালে লাল লালিম। ভূতুমকে এক বোতল ধেনোর পয়হা দিলেই সিধু কানু ডহরে ঝান্ডা নেড়ে চিল্লিয়ে আসে। কিন্তু এখানে সাদা কালো লাল হলুদ- সব মক্কেল হাতে লাল সাদা নীল পতাকা হাতে মিছিলে খাড়া। ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া বাজছে। ভূতুমের যা স্বভাব- মাথায় লাল গামছা বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়া! সবার হাতের প্ল্যাকার্ড দেখে ব্যাপারটা বুইল- ইউরোপিয়ান সোশাল ফোরামের ডাকে "ইরাক ছাড়" আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী মিছিল- রাসেল স্কোয়ার থেকে ট্রফালগার স্কোয়ার। আবছা বৃষ্টির মধ্যেও হাজার হাজার মেয়েমদ্দবুড়োবাচ্চাদের ভিড়। ইউরোপের যাবতীয় সমাজতন্ত্রী, উদারনৈতিক আর সাম্যবাদীদের দঙ্গল জুটেছে। ভূতুম দেশের একমাত্র প্রতিনিধি। (বাওয়া ভূতুমের কি ধক মাইরি!) ভূতুমের হাতে প্ল্যাকার্ড- "বুশ-ব্লেয়ার ইরাক ছড়", মুখে গান- "লাল নীল সবুজেরি মেলা বসেছে"। (কোনো গণসঙ্গীত মনে এল নি কো!) পাশেই হাঁটছিল উইলিয়াম ব্রাউন, হাতে একগোছা সাপ্তাহিক কাগজ "শ্রেণী সংগ্রাম"। লাল গামছা মাথায়, হেটো ধুতি পরা ভূতুমকে দেখে বিলুদা তো পুরো ট্যান। ভূতুম হাত কচলে সাকিন কবুল করতেই বিলুদা প্রায় উচ্ছে খাওয়া গলায়- "ও: হো! তা আউটসোর্সিং কেমন চলছে?" ভূতুম পুরো কেস খেয়ে- " আইজ্ঞা কত্তা, সোর্স নেই বলেই তো আউট হয়ে গেনু গো! এ সবের আম্মো কিছু জানে নে"। এইটুকু বলেই মুখ ফিরিয়ে ভূতুমের চিল চিৎকার- " ইন্তি-ফাদা! ইন্তি-ফাদা!" কলকেতায় ভূতুম মিছিলে বেজার মুখ, তেতো মুখ, হবিষ্যি খাওয়া মুখ, বদরাগী মুখ দেখে এলিয়ে গেছে। এখানে কি জোশ, কি ফূর্তি, কি শক্তি রে বাপ! দমাদম ঢাকের তালে তালে নাচছে পা, নাচছে প্ল্যাকার্ড, নাচছে পুরো সময়। ভূতুম আর না পেরে একটু তাসা পাট্টির নাচ নেচে দিল।

    ট্রাফালগার স্কোয়ারে নেলসনের কলামের তলায় ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। ভিজে ঠান্ডা বিকেলে উত্তুরে হাওয়ার বেদম দাপট। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন চে বাবার মেয়ে আলেইদা গেভারা, প্রবীণ ব্রিটিশ নেতা টোনি বেইন। টোনি বেইন- "বুশবাবা বলেছে ভগবানের সাক্ষাৎ দূত হিসেবে উনি আমেরিকা শাসন করছেন। নাস্তিক হওয়ার জন্য এর থেকে ভালো যুক্তি আর হয় না"। ভূতুম ব্রিটিশরাজের সিংহের তলায় বসে দেখল মার্কিনরাজ বিরোধের হালককিকৎ। পরে ভূতুম শুনেছে- পুলিশের মতে দশ হাজার লোক হয়েছিল আর উদ্যোক্তাদের মতে এক লাখ। ভূতুম হেসে আর বাঁচে না- সল্ট লেকের দাদা আর কালীঘাটের দিদি থাকলে কি মজাই না হত মাইরি! আমুদে ভূতুম পতাকা দুলিয়ে, দৌড়ে, নেচে, চিল্লিয়ে বেড়ে ফুত্তি করল। তার পরেও ঘুমোতে গিয়ে সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ছে- ট্রফালগার স্কোয়ারের এক কোণে দাঁড়িয়ে একা চিঠি পড়ছিল, হাতের পতাকা হিমেল হাওয়াতে লৎপৎ করছে, লাল পতাকার মাঝে জ্বল্‌জ্বল্‌ করছে একটা শব্দ- "বিপ্লব"। ভূতুম কেমনে ঘুমায় বটে?
     

    এইসব করে আহূতুম বার খেয়ে ভাবল মার্ক্সবাবার বাড়ি দেখে আসবে। প্রখ্যত বা কুখ্যাত সোহো অঞ্চলে ডিন স্ট্রিটে এক বাড়িতে বালবাচ্চা নিয়ে কার্ল আর জেনির দিন গুজরান হত। এইখানে থাকার সময়ই "ডাস কাপিটাল" লেখা হয়। ভূতুম গিয়ে দেখে যে বাড়িতে মার্ক্সবাবা না খেয়ে প্রায় অক্কা পাচ্ছিলেন, সেখানে এখন ঘ্যামচিক রেস্তোরাঁ "কুও ভাদিস"। তো ভূতুমের সবেতেই সুখ- "Das Kapital" বা "Thus Capital"। ধনতন্ত্র দীর্ঘজীবি হউক! তবে মার্ক্সবাবার বাড়ি বলে কতা! ভূতুম ভাবুক মনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কানের পাশে শোনে- "আজ দুজনে মন্দ হলে মন্দ কি"। খাইসে গো কত্তা! রাস্তার নাম বারউইক স্ট্রিট। সন্ধের সোহোতে "জ্বলছে নিভছে নিয়নের বিজ্ঞাপন"। আবার ডাক- "আহা এমন রাতে এসো না আজ ভাব করি"। মদালসাদের মদির আহ্বান শুনে ভূতুম কেঁদে ফেলে আর কি! হাত জোড় করে- "পেন্নাম মা ঠাউরাইনেরা! এই পাগলা হতচ্ছাড়াকে ছড়ি দে মা!" এই বলে দু পা এগোতে না এগোতেই নিরীহ চেহারার ঘোর কালো এক মাসী- "এশিয়ান মেয়ে চাই নাকি গো মক্কেল?" ভূতুম ঢুকে পড়েছে লন্ডনের ড্রাগ আর যৌনতার সাম্রাজ্যে। আহূতুম দেখে এখানেও এঁদো অলিতে গলিতে দাঁড়িয়ে সোনাগাছি, হার্হাটা, কালীঘাট। কিন্তু এ ছাড়াও কফে, রেস্তোরাঁ আর প্রাপ্তবয়স্ক দোকানের ভিড়ে তূলকালাম কান্ড। অসংখ্য লবেজান বাবুবিবির গালগপ্পোগজল্লার মৌতাতে সোহো ম ম করছে। সোনাগাছি, ধর্মতলা আর কলেজ স্ট্রিট মিলেমিশে একাকার।

    আমুদে ভূতুম উলুক ঝুলুক দেখতে দেখতে এগোয় - এইখানে ১৮৫৪ সালে পাঁচ হাজার লোক কলেরায় মারা যায় আর এইখানেই স্নোসাহেব আবিষ্কার করলেন ময়লা জল আর কলেরার সম্পর্ক। এ ছাড়া ম্যাডাম জোজোর মোহিনী রাত আড্ডা, অস্কার ওয়াইল্ডের প্রিয় রেস্তোরাঁ কেট্‌নার্স, পিটার ওটুলের নিয়মিত ঠেক কোচ এন্ড হর্সেস পাব। এরই ফাঁকে এত এত নামী দামি মক্কেলদের উচ্ছুগ্গু করে দু গণ্ডুষ চন্নামেত্তো সেবন। এত সব খাটাখাটনির পরে ভূতুম ভাবে- এখানে দুর্বার সমন্বয় সমিতি আছে বুঝি? কালীঘাট ব্রিজের তলার সেই হতশ্রী মুখগুলো কোথায়? সেদিন বিবিসিতে রাত্রের ছবি "সেক্স ট্রাফিক"- মেয়ে পাচার নিয়ে কাঁপুনি ধরানো ডকুফিচার। পূর্ব ইউরোপ থেকে প্রতিদিন শয়ে শয়ে মেয়ে পাচার হয়ে পৌঁছচ্ছে ভূতুমের আমুদে লন্ডনে। ভূতুম কি আর এ সব চেনে না? লিথুয়ানিয়া বা নেপাল, লন্ডন বা কলকাতা, সেক্স ট্রাফিক বা সালাম বম্বে - নেশাড়ু ভূতুমের জমে যাওয়া মগজে ছবিগুলো কেটেছিঁড়েজুড়েমুচড়েজ্বলেপুড়ে এক পাগলাটে নেত্য করতে লেগেছে। ভূতুম কোনোরকমে লেপের তলায় ঢুকতেই আবার সেই মেয়ে - ট্রফলগার স্কোয়ারের কোণে হাসিমুখ এক একলা মেয়ে চিঠি পড়েই চলেছে, মাথার উপরে টেম্‌সের দিক থেকে উড়ে আসা বিষণ্ন হাওয়াতে লত্‌পত্‌  করে উড়ে চলেছে একলা নিশান।

    ভূতুম কেমনে ঘুমায় বটে?

    ছবি: লেখক

    বিলেত ফেরত -- পর্ব ২         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         ডিসেম্বর ৩১ ২০০৪

    তুমি আমাদের পিতা

    লন্ডনে এখন ব্যাপক মোচ্ছব- আনন্দের ক্রিসমাস, ফূর্তির ক্রিসমাস, হুল্লোড়ের ক্রিসমাস। অক্সফোর্ড সার্কাস থেকে লেস্টার স্কোয়ার হয়ে পিকাডিলি সার্কাস, রিজেন্ট স্ট্রিটে আর অক্সফোর্ড স্ট্রিটে, সোহোর লাগোয়া অলিতে গলিতে এক্কেরে চন্নননগরের আলো আর গড়িয়াহাটের পূজোর সেলের ভিড়। বাপ মায়ের কোলে কাঁখে হাত ধরে খোকাখুকির দল লন্ডনের ময়লা ঠান্ডা আকাশে সাত রঙের হাউই উড়িয়ে দিলে। রিজেন্ট স্ট্রিটে সব থেকে বড়ো খেলনার দোকান হ্যামলিজের সামনে পেরচন্ড গুঁতোগুঁতি। এই মরশুমে, অন্তত এক ফুট দূরে দাঁড়ানোর ব্রিটিশ কেতার দফারফা। ভূতুমের মনে লাগে হাজরার মোড়ে দাঁড়িয়ে বসিরহাট-ক্যানিং-মধ্যমগ্রাম-কল্যাণীর উপচেপড়া ভিড় দেখতেছে।তবে শীতের কামড় বড় জব্বর। তাই হেটো ধুতির উপর ভূতুম এক ধুমসো ভাল্লুকে কম্বল চাপিয়ে নেয়েছে। দোকানে পার্কে আইস স্কেটিং রিঙ্কে থোকা থোকা গোলাপের মতো কত কত বাচ্চাদের খুশিমুখ। এদিকে ভূতুমের না আছে নকল দাড়ি আর পরচুলা, না আছে লাল টুপি আর চোগা চাপকান। মোজাই বা পায় কোথায়? নিজের মোজা পরার আগে নাকের ডগায় একটু আতর মেখে না নিলে মগজ পুরো তর্‌ হয়ে যায়। সেই মোজায় বাচ্চাদের খেলনা রাখলে হাজতবাস কপালে নাচ্ছে। এ শিবঠাকুরের আপন দেশ নয় বটে, কিন্তু আইনকানুনের কতা- কিচ্ছু বলা যায় না।

    আইনের কতায় মনে পড়ল। ইদানীং কাগজপত্তরে খুব হইচই করে ব্রিটিশ সরকারের ফরমান জারি হয়েছে যে বাবা-মারা ছেলেপুলের গায় হাত তুলতে পারবে নে। এক দল বলতেছে- বাপ মা ছেলেপুলেদের কিভাবে মানুষ করবে না করবে তাও সরকার ঠিক করে দেবে নাকি? আর এক দল বলছে, বাচ্চা বলে মানুষ নয় নাকি? বুড়ো হোক কি বাচ্চা হোক- গায়ে হাত দেবে কেনে? সরকার বেদম ফ্যাসাদে। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছেন অল্পবিস্তর শাসন চলতে পারে, কিন্তু গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেওয়া চলবে নে কো। বডিতে দাগ থাকতে পারবে নে। ভূতুম দেখেশুনে পুরো থ। এট্টু লেখাপড়া করে জানা গেল, ইউরোপের বেশ কিছু দেশে শিশুদের মারধোর করলেই শাস্তি। সুইডেন সবার আগে এই কান্ড বাঁধিয়েছিল। এখন মহজনের পথে চলেছে নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সাইপ্রাস, ক্রোয়েশিয়া, লাটভিয়া আর জার্মানি। কাজেই বাচ্ছধিকার এখন বেশ বড়োসড়ো ব্যাপার। কিছু বড়ো-হলে-নেতা-হতে--পারে বাচ্চার ছবি দেখা গেল যারা ডাউনিং স্ট্রিটে খোদ ব্লেয়ারকাকুকে আর্জি জানিয়ে এসেছে। ভূতুমের পাশের বাড়ির বিষ্টুকাকু, আ কা শ্রী বিষ্‌ণু গড়াই, সন্ধেবেলা ফিরেই দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে দু ঘা বসিয়ে ঠেক মারতে যান। জিগালে বলে- হাতের মুঠো আলগা করেছ তো গেছ। ভূতুম ভাবে বিষ্টুকাকুরে কি করে বিলেতের ভিসা আর টিকিট ধরানো যায়। আর শুধু বিষ্টুকাকু? স্থবিরের বাপ শ্রীযুত মহেশ আতর্থী! ওনার যা গপ্পো আছে এখানে এলে আর হাজত থেকে বেরোতে হত নি। কলিকালের কত নীলে রে মা!

    এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভূতুম হাঁটতে লেগেছে। হঠাৎ সামনে দেখে পেল্লায় ঘড়ি, আর কী সব আলিশান ঘরবাড়ি! এই বড় ঘড়ি বড় বেনের তলায় ব্লেয়ারকাকুর ঘরসংসার। ব্লেয়ারকাকুর ঘরসংসারে ঘরগেরস্থির যিনি দেখভাল করেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাকে নিয়ে এখন নিদারুণ সমিস্যে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ব্লাঙ্কেট কিছুদিন এক বিবাহিতা মহিলার সাথে প্রেম করে ফেলেছিলেন। সেই মহিলার দুই শিশু। এখন ব্লাঙ্কেটসাহেব মামলা ঠুকেছেন যে এক শিশুর বাবা আসলে তিনিই। এখন আদালতে জোর সওয়াল জবাব- "বাবা কে"। সেই একটা বই ছিলো না- "ছেলে কার"। এখানে তার উল্টো পুরাণ- বিকাস রায় টোম্যাটোর পিছনে ধাওয়া করেছেন। লোকে বলাবলি করছে ব্লাঙ্কেতসাহেব আরও গভীর কেলো করে বসে আছেন। মন্তিরি হওয়ার সুবাদে কলকাঠি নেড়ে সেই প্রেমিকার বাচ্চাদের ফিলিপিনো দাইমাকে চট্‌জলদি ভিসা পাইয়ে দিয়েছেন। অতএব লাগাও তদন্ত কমিশন। সেই ট্র্যাডিশন এখানেও চলছে, ওখানেও চলছে। এদিকে ব্লাঙ্কেট সাহেবের এই মামলায় "ন্যায়ের জন্য বাবারা" বলে এক সংগঠন খুব উৎসাহ পেয়েছে। এদের লড়াই হল ডিভোর্সের পর সব বাপ যেন ছেলেমেয়েদের উপর নিজেদের অধিকারের দেনাপাওনা বুঝে নিতে পারে। কয়েকদিন আগে এদেরই এক মুরুব্বি রাণীমার খাসমহলের বারান্দায় বাদুড়মানুষ সেজে দাঁড়িয়েছিল। এদের প্রতিবাদের ধরনই এই রকম উদ্ভুট্টে গোছের। (তবে এই কিস্‌সা শুনতে শুনতে ভূতুম দুটো কথা নোট করে নিয়েছে। দেশে গিয়ে বলবে। এক, ব্লাঙ্কেটসাহেব পুরোপুরি অন্ধ। দুই, ব্লাঙ্কেটসাহেব নিজের রেলের পাস সেই প্রেমিকাকে দিয়েছিলেন। কাগজপত্র এই নিয়ে চেল্লাচিল্লি শুরু করতেই সেই টিকিটের পয়সা নিজের পকেট থেকে মিটিয়ে দিয়েছেন।) কিন্তু এখন কতা হল, বাবা-মা-বাচ্চা নিয়ে এতো গোলমাল সান্তাবুড়ো সামলাতে পারবে তো?

    তবে এই বাচ্চাদরদী সরকারের অন্য এক খুড়োর কল আছে- লাদেনবাবা গোছের কিছু জুজুবুড়ো। এই জুজুবুড়োর ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের সব হিসেবনিকেশ জড়ো করা হচ্ছে- কে কবে অঙ্কতে গোল্লা পাচ্ছে, কার কবে একশ দুই জ্বর ছিল, কার বাপের বিয়ারের লিশা একটু বেশির দিকে ইত্যাদি ইত্যাদি। সরকারের সব দপ্তর এই রেকর্ডের নাগাল পাবে, কিন্তু বাচ্চার বাবা মা পাবে নে। তোমার বাচ্চা তো কী হয়েছে, সরকারি নথিপত্র কি সবাইকে দেখাতে আছে গা? কাজেই বাচ্চারা জানে না বাপ-মায়ের মারের হাত থেকে  বাঁচলেও এখন থেকে তার সরকারবাহাদুরের আঙুলের ডগায়, মহারাণীর সম্পত্তি। এক মার্কিনি যুদ্ধ কোম্পানি ভেরিকুল বলে এক যন্তর বানিয়েছে- সেই যন্তর দিয়ে এই দেশের কিছু স্কুলে বাচ্চাদের আঙুলের ছাপ তুলে নজরদারি চলছে। সরকারবাহাদুরের পোয়াবারো- জন্মাবার পর থেকেই প্রজারা সব হাতের মুঠোয়। শ্রী শ্রী ১০৮ সরকার সব জানবেন, কিন্তু তুমি জানবে না প্রভু কী জানেন। কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ! লাদেনবাবার দয়ায় এদ্দিনে এক ভগমান পেনু গো- যিনি সত্যি সত্যি সব জানেন। ১৯৮৪ সাল থেকেই ভূতুম এ রকম স্বপ্ন দেখত।

    তবে ভূতুমের খ্যাঁচাকল মাথায় এ সব ছাতার পোড়া বেশি ঢুকতে চায় না। ভূতুম গিয়ে কভেন্ট গার্ডেনে পোলকসাহেবের খেলনার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে দমদেওয়া আর ইলেকটিরির খেলনা নয়, আদ্যিকালের কাঠ, কাপড় আর কাগজে তৈরি পরী, রাক্ষস, জানোয়ার পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায় কার্ডবোর্ডে তৈরি ছোটো ছোটো খেলনা থিয়েটার, সুতোয় নাচা বুড়ো, ভাল্লুক, ভাঁড়, ডাইনী আরও কত কি! ভূতুম ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। শয়ে শয়ে ভূতুম- ঢুকছে, বেরোচ্ছে। সুতোটা কার হাতে খোদতাল্লাই জানেন।

    পু: এই লেখা শেষ করার দিন সন্ধেবেলা জানা গেল, ব্লাঙ্কেট সাহেব ভিসা তাড়াতাড়ি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ মেনে নিয়ে ইস্তফা দিয়েছেন।

    বিলেত ফেরত -- পর্ব ৩         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         জানুয়ারি ১৭ ২০০৫

    আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে

    ভূতুম ভূতুম করে মায়
    ভূতুম গেছে কাদের গাঁয়
    কোন কাকেতে দাঁড় বায়
    ভূতুম রে তুই ঘরে আয়।

    ভূতুম এই বিদেশবিভুঁইয়ে না পায় বুদ্ধুর দেখা, না পায় লালকমল নীলকমল। স্যান্ডুইচ, পাস্তা আর পাইয়ের গুঁতোয় জিভ পুরো হ য ব র ল। কোথায় নলেন, ফুলকপির খাস্তা সিঙাড়া আর কোথায়ই বা জয়নগরের মোয়া। হররোজ পাতালের টিরেনে গ্রাম্ভারী সাহেব মেমে, কালো ছাই মেটে চোগা চাপকান পড়ে কচর কচর পাঁউউটি চিবুচ্ছে আর মোটকা মোটকা কিতাব পড়ছে। ভূতুম ভাবে, পাঁউউটি সাবড়ে আর বান্ধাকপি চিবুয়ে বিশ্ব জয় করে নিলে গা! কিন্তু ভূতুমের সহে না, সহে না, কাঁদে পরাণ। দেশোয়ালি ভাইয়াদের সাথে দু দন্ড সুখদু:খের কতা কইতে পারলে এই দিওয়ানা দিল বর্তে যেত। রাস্তার ইদিকে উদিকে বাদামি বাদামি লোকজন প্রায়ই চোখে পড়ে। কিন্তু মুখচোরা ভূতুম আগ বাড়িয়ে কথা কইতে সাহস পায় নে।
     

    ভূতুমের দেশোয়ালি ভাইয়াদের বড়ো ঠেক সাউথঅল যারে লোকে লন্ডনের লুধিয়ানা কয়। পেরায় রাস্তার উপ্‌রে এক মদ্দ কড়াইতে গরমাগরম সামোসা আর জেলেবি ভাজা হচ্ছে। নাকের দশা ভালো হলে বাতাসে সর্ষে শাকের গন্ধ পাবে। "বীর-জারা" চলছে রম্‌রম্‌। এ হল লন্ডনের দক্ষিণ-পশ্চিমে। অন্যদিকে যাও, এক্কেবারে পূবে। সেখানে ইস্ট্‌হ্যামে পাবে "শকথি স্টোর্স" আর "রেবথি জুয়েলার্স"- দোকানে ঢুকেই চন্নন ধূপের গন্ধ, টি ভিতে উদয়া বা সানে ব্যাপক নাচন, ভুর করে সারি সারি মুরুক্কুর প্যাকেট, এক কোণে ডাঁই তামিল ম্যাগাজিন। পাশাপাশি একের পর এক ধোসা ইডলি বিসি বেলে বাথের ছোটো ছোটো দোকান। গ্যাঁট হয়ে অম্বরীশ কি বিষ্ণুবর্ধন কি কামাল হাসানের নতুন বই দেখতে দেখতে আরামসে সম্বর, আভিয়াল আর রসম দিয়ে একথাল ভাত সাবড়ে ফেলবে। ভূতুম এক কোণে খেল মুর্গ মাখানি, আর এক কোণে ধোসা। তবু ভরিল না চিত্ত।   

    অতএব মন চল ব্রিক লেনে। মনিকাবিবি আর বুকারের দৌলতে এই ছোট্টো এঁদো গলি এখন দুনিয়ায় ধামাকা ফেলে দিয়েছে। পুব অল্ডগেট স্টেশনে নেমে বাঁহাতি এগোলেই সরু গলি ব্রিক লেন। মরচে লাল ইঁটের দেয়ালে ছোটো ছোটো বাংলা হরফে লেখা অলিগলির নাম। ঢুকতেই ডান হাতে মডার্ন শাড়ি সেন্টার- "সর্ব প্রকার শাড়ী কাপড় ও ছেলেমেয়েদের পোষাকের একমাত্র নির্ভরযোগ্য বাংগালী প্রতিষ্ঠান"। অন্যপাশে সোনালি ব্যাঙ্কের আপিস। গলিতে আর একটু ঢুকলেই দুপাশে গন্ডা গন্ডা খাবারের দোকান হামলে পড়েছে। হাওয়াতে কষা পেঁয়াজ রসুন আদা মশলার পেট হু হু করিয়ে দেওয়া খোশবাই। বিলেতি সাহেব মেমেদের সোয়াদ বদলের ঠাঁই আর ভূতুমের তো কথাই নাই- ভুনা শুঁটকি থেকে চিতলের পেটি, বড়ো বড়ো ফুলকপি দিয়ে রাঁধা পাকা রুইমাছের কালিয়া, রসে ভেজা চম্‌চম্‌ আর পান্তুয়া। তয় তেলঝালে অ্যালার্জি থাকলে নৈব নৈব চ। সাহেব মেমেদের লিঙ্গোতে এই রান্নার নাম হয়েছে বালতী রান্না। ভূতুমের জিভ ভরলে আর পেট পুরলেই হরি ওঁ তৎসৎ।

    পুব লন্ডনে ছড়িয়ে আছে এই রকম অগুন্তি ব্রিক লেন। তবে মুখ বিজ্ঞাপনে আর কতই বা ঢাকে? ব্রিক লেনেদের ইঁটে চিকেন টিক্কা মসালার খুশবু চিরে বেরিয়ে আসে ড্রাগ আর খুনখারাপির চোরা বদবু। ছোটো ছোটো দমচাপা হতচ্ছিরি কাউন্সিল হাউসে বড়ো হয়ে উঠেছে ও উঠছে ছিঁড়েখুঁড়েফেলা একদল উচ্চন্ড রাগ- না আছে সাকিন, না আছে শেকড়, না আছে দু বেলা নোকরির আশা। সুর্মাপাড়ের কমলার ফুলে শুকিয়ে আসছে আর উঁচু হচ্ছে পাউন্ডপোয়াতী আলিশান বিশদুয়ারী। শ্যাডওয়েলের মতো ছোটোখাটো জায়গায় সুয্যিঠাকুর অস্তে যেতেই ড্রাগনারায়ণের হিংস্র বাওয়ালি। ভূতুম ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে রাস্তা পেরোতে গিয়ে দেখে একদঙ্গল জেদি তিত্‌কুটে মুখ। সরাসরি নেশাবাজারের লেনদেন, একটু খেরে গেলেই থোবড়ায় রামপুরীয়ার ধারালো চুমু। লন্ডনের নীচু বাড়ির রাজত্বে অশ্লীল মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আখাম্বা ফ্ল্যাটবাড়ি। রাতে তার সিঁড়ির কোণায় পড়ে থাকে মদভরপুর বমির বাসি গন্ধ, ভাঙা ইঞ্জেকশনের কাঁচ, সিগারেটের পুড়ে যাওয়া রাংতা। ভূতুমের এক দোস্ত "হোমো" হবার অপরাধে ঢিল খায়, ল্যাজ গুটিয়ে পালাতে হয় এই অন্ধকার রাগের ফোঁসফোঁসানিতে। এই সময়ে, এই তল্লাটে বেড়ে ওঠে আবু হামজার মতো বিষক্ত মৌলবী যার জিহাদের চিৎকারে পবিত্র আজান সুর ভুলে যেতে থাকে। সমান বিষাক্ত একুশে আইন চালু হয়- বিদেশিদের সরকার সন্দ করলেই বিনা বিচারে যতদিন খুশি জেলের লপসি খাও গা। ব্রিক লেন, হোয়াইটচ্যাপেল, শ্যাডওয়েল, লাইমহাউস ইত্যাদি নিয়ে গড়া টাওয়ার হ্যামলেট ছড়িয়ে পড়ে আফগানিস্থান, তুর্কি, ইজরায়েল, ইন্দোনেশিয়ায়। ভূতুম মুখে মাথায় ন্যাকড়া জড়িয়ে ভিতু নেড়ি কুত্তার মতো দৌড়ে পালায়।   

    এই মুলুকে যথারীতি রয়েছে কেতাবি পলিটিক্সের প্যাঁচালো কিস্‌সা। তিন পাট্টির কাজিয়া- লেবার, তোরি আর লিবারেল ডেমোক্র্যাট বা "লিব ডেম"। এতদিন ছিল ব্লেয়ারকাকুর পার্টির শাসন। লিব ডেম এখন বেশ জোরালো জায়গায় কারণ উনারা একমাত্র পার্টি যারা জোরগলায় ইরাকে বদমাইশির বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়েছে। এই অঞ্চলে ইরাকের যুদ্ধ খুব বড়ো ইস্যু। এর মধ্যে ঢুকেছেন জর্জ গ্যালওয়ের "রেস্পেক্ট কোয়ালিশন"- লেবার থেকে দলছুট এক অতিবাম পার্টি। ব্লেয়ারকাকুকে আদর করে "নেকড়েসোনা" বলায় পার্টি থেকে জর্জ সাহেবকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তার উপর টেলিগেরাফ কাগজে বলা হয়েছিল জর্জসাহেব সাদ্দামবাবার থেকে টাকা খেয়েছিলেন। জর্জসাহেব মামলা ঠুকে জিতে গিয়ে বেশ মোটা পয়া পেয়েছেন। এই প্রায়বাম মুলুকের খেয়োখেয়ি চলছেই। একদা ব্লেয়ারকাকুর যম, এখন জিগ্‌রি দোস্ত, লন্ডনের বাম মেয়র কেন লিভিংস্টোন জর্জসাহেবেঅকে দু হাত নিয়েছেন। এখন এম পি উনা কিং এক কালো মহিলা। কেনসাহেবের মতে জর্জসাহেব লেবারের ভোট কেটে হাতে গোণা কালো মহিলা রাজনীতিকদের একজনকে হারানোর তাল করছেন। লিব ডেমের সমিস্যে একটু অন্য রকম। পেরথম পেরথম ফিয়াজ মুঘল বলে এক পাকিস্তানি ভদ্রলোক টিকিট পেয়েছিলেন। কিন্তু এই তল্লাটের বাসিন্দেরা সব বাংলাদেশি হওয়ায় টিকিট বাতিল। এখন নতুন বাংলাদেশির খোঁজ চলছে। অথচ দেখুন কিং মেমসাহেব জিতে চলেছেন যাঁর মা ইহুদী। বাবা আমেরিকার মানুষাধিকার মোর্চার নেতা। নাকি ভারত এবার ব্রিটেনবিজয় করিবে? গাঁই-জ্ঞাতি-গুষ্টি-গোত্রের চুলচেরা হিসাব করিয়া টিকেটবন্টন হইবেক! এমন কেন সত্যি হয় না আহা! পাট্টি আপিসের সামনে বেদম ভিড়, সাহেবদের কালো কোট ছিঁড়ে ফর্দাভাই, চলছে স্লোগান, মারপিট, ধস্তাধস্তি, সামনে বেকার বাংলাদেশি ছেলেগুলো চিকেন টিক্কা রোলের দোকান বসিয়ে দিয়েছে।  

    ভূতুমের স্বপ্নেরও শেষ নাই, দু:স্বপ্নেরও শেষ নাই।

    ছবি: লেখক

    বিলেত ফেরত -- পর্ব ৪         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         ফেব্রুয়ারি ১৫ ২০০৫

    বিপিনবাবুর কারণসুধা

    অদ্য অদ্য মদ্যপান
    জল খাবি তো মালসা আন
    মালসা ধরে দিলাম টান
    ধ্যাত্তেরিকা চিৎপটাং।

    এই গপ্পো বলার সময়, বাবুরা বিবিরা, ভূতুমকে এট্টু মাপ করে দিয়েন। লেখার গতিক কখনো ট্যারা, খানিক হেলেপড়া, অনেকটা টাল্লি খাওয়া, হয়তো কালী সিঙ্গি নয়তো চন্দ্রবিন্দু- এ সবই হতে পারে। কারণবারি সেবার গপ্পো করতে গেলে এটুকু বেসামাল বোলচাল ধর্তব্যেই ফেলবেন না। ফার্স্টেই বলে নেওয়া ভালো, বিলেতিরা ওয়াইন গোছের শৌখিন মদিরা ঠিকঠাক বানাতে শিখেছে অনেক পরে, চিরকালই এল (Ale) আর বিয়ার হল পাবলিকের আসলি পেয়ার। মানে ওয়াইনাদি হল বিলেতিদের বিলিতি। কাজেই মদিরাসেবন নয়, পাতি মাল প্যাঁদাবার গরজে লন্ডন পুরোপুরি "পাবিত" শহর। শুক্কুরবার হলেই পাবে পাবে পাবকপানের হুল্লোড়ে পুলিশ বাবাজীবনেরাও নাস্তানাবুদ। আমাদের লোকজন ব্যাঙ্গালোর নামে ওঁচা শহরের ততোধিক ওঁচা পাবে নকলনবীশ ইয়াপ্পিকুলের ভিড় দেখেই ভাবেন "কি হনু"। আসলি ঠেকের সুলুকসন্ধান কিন্তু এই শহরে, যেখানে শুঁড়িখানাভ্রমণ "ইঙ্গজীবনের অঙ্গ"। লন্ডনের পাবের নামেও পাবেন সেই ট্র্যাডিশনের বহমানতা- আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে লন্ডনে সত্তরটা পাবের নাম "King's Heads", নব্বইটা "King's Arms", পঞ্চাশটা "Queen's Heads", সত্তর "Crowns", পঞ্চাশ "Roses" আর গোটা পঁচিশ "Royal Oaks"। সেই সময়ে ঠিকানা জানতে চাইলে উত্তর হত এই রকম- "সিধে গিয়ে "Three Turks", তার থেকে ডানদিকে বেঁকে "Dog and Duck" পেরিয়ে যাও, যেতে যেতে "Jolly Old Cocks" এলে মোড় ঘুরে পরপর পাবে "Veteran", "Guy Fawkes", "Iron Duke"। তারপরের প্রথম ডানদিকের রাস্তা ধরলেই বাঁ হাতে পাবে সুমুন্দির বাসা"। এ হেন মুল্লুকে ভূতুমের কোনো ছাড়াছাড়ি নাই- চল পানসী বেলঘরিয়া।

    শহরের এক্কেরে মাঝখানে- যেখানে দিনেরাতে ট্যুরিস্টের ঢল নামে- প্রথম পাব। কেতাদুরস্ত ব্রিটিশ নাম। শুক্কুরবারের সন্ধে। যে পাবেই যাও, ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। অষ্টমীর সন্ধেতে গড়িয়াহাটের বেদুইনে রোল খাবার ভিড়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই গজল্লা, চীৎকার আর হাসির দাপটে চোখ কান ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ। একদিকে বিড়িখোরদের জায়গা, অন্যদিকে নির্বিড়িরা। সেই নির্বিড়ি বা non-smoking কোণায় ভিড় একটু পাতলা। বিড়িবাজদের ঠেকে কোহলগন্ধে আর তামাকুহেলীতে ঘরদোর পুরো গুলজার। একধারে বিশাল টি ভিতে গাঁক গাঁক করে প্রিমিয়ার লিগের খেলা চলছে। ফুটবাল আর মদ- দুই নেশায় জগৎ মাৎ। ভূতুম আর তার সাথে আরও কেউ- জায়গা মেলা কঠিন। তাই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছোটো বালতির মতো বড়ো গেলাসে ঘোর কালো, কষা, ঘন থক্‌থকে গিনেসে চুমুক। আধঘন্টা বাদে পেছন ঠেকাবার ঠাঁই মিলল। চোখে ধোঁয়ার ঘোর থিতিয়ে এসেছে। মগজে গিনেসের ফেরেব্বাজিতে ভূতুম চোখে আরও পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। পাশের টেবিলে বিলিতি জুড়ি একে অন্যতে বিভোর। টুকরো টুকরো কথা আর হাসির মধ্যে চুমুর ঝড়- কী সর্বগ্রাসী চুমু রে বাপ! ঠোঁটগুলো পেটে না পুরলে যেন তৃপ্তি নাই। অন্যপাশে টাই আলগা করে, কালো কোট পিছনে ঝুলিয়ে একদঙ্গল আপিসফেরতা চাকুরে। বসেদের লালচোখ, ব্যালান্স শিটের বাঁদরামি আর আড়ষ্ট মিটিঙের খোঁয়ারি ভাঙে্‌ত তারা ডেসিবেলের সব মাত্রা ছাড়ায় বলে। রুনির পায়ে বল এলেই হৈ হৈ রৈ রৈ, বেচারা গেলাসেরাও থর্‌থর্‌ করে কাঁপছে। তারই মধ্যে কাউন্টারের এক কোণে এই ছোট্টো বুড়ো বিড়্‌বিড়্‌ করছে আর তরল আগুন মূহূর্তে মূহূর্তে পেটের মধ্যে। পাশে বাসি গার্ডিয়ান কুঁকড়ে মুকড়ে পড়ে, তার উপরে রাখা সদ্য সদ্য বেরোনো বব ডিলানের আত্মজীবনী। এখান থেকে আর একটু দূরে আর এক পাব- একটু অন্যরকম। কাউন্টারের পেছনে ঝক্‌মক্‌ করছে স্টেনসিলে আঁকা চে গেভারার মানুষসমান পোস্টার। হাসিঠাট্টা ঝগড়াঝাঁটি আরও উচ্চগ্রামে। ভূতুমের ততক্ষণে "ধায় রাত্রি ধায় রাত্রি আয় ধাত্রী ভান্ড খুলি তোর"। কোমলকরে জড়িয়ে ধরে অতুলন কৃষ্ণাঙ্গী অষ্টাদশীর কোমর- Cuba Libre- গ্রীক দেবতার মতো দেখতে কাউন্টারের ছেলেটি বানিয়ে দিয়েছে সব্বো অঙ্গে রামনাম মাখা এই পানীয়। কুসুমের আর মন কি করে থাকে গো বাবু? "ধায় রাত্রি ধায় রাত্রি মাতৃধারা যায় রে গঙ্গায়"।

    নেশা নিয়ে এই বেলেল্লাপনা শহরের রক্তে রক্তে। অষ্টাদশ শতকে এই শহরে উঠেছিল জিনের হুজুগ। আমাদের এম সি শূকরেরা জিনকে যতই নারীপানীয় বলে হতচ্ছেদ্দা করুন না কেন, সেই যুগের লন্ডনে, ১৭৪০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে গোটা ১৭০০০ জিনঠেকের হদিশ পাওয়া যায়। এই মালের আরও বোলবোলাও ছিল গরীবদের মধ্যে, নারীপুরুষশিশুনির্বিশেষে। অগত্যা মাতলামি, দৈন্যদুর্দশার ছকমাফিক সালতামামি। জনৈকা জুডিথ ডেফোর নিজের দু বছরের মেয়ের গলা টিপে মেরে ফেলে, তার গায়ের নতুন জামাকাপড় খুলে বিক্রি করে, সেই পয়সায় জিনসেবন করেন। ১৭৫১ সালে হেনরি ফিল্ডিং লিখছেন- "A new kind of drunkenness, unknown to our ancestors, is lately sprung up among us, and which if not put a stop to, will infallibly destroy a great part of the inferior people." যথারীতি সরকার বাহাদুর মাঠে নেমেছিলেন। ১৭৩৬ সালে পাশ করেছিলেন জিন আইন। কিন্তু এই যৌবনজিনতরঙ্গ রুধিবে কে? আইনকে কলা দেখিয়ে সবই চলল বহালতবিয়তে। গুজরাটে নিষেধ হল, মহারাষ্ট্রে বিক্কিরি বেড়ে গেল। সেইরম আর কি। তবে হুজুগের যেরম হঠাৎ শুরু, তেমনি হঠাৎ শেষ। নতুন শতক আসতে না আসতে মিলিয়ে গেল জিনের উপদ্রব।

    আর এখন? কিছু কিছু জায়গায় সপ্তাহান্তে রাস্তায় রাস্তায় শুকনো বমির দাগ, ঠান্ডা গুমোট হাওয়া ফুঁড়ে উঠে আসে বাসি বমির গন্ধ। ক্রিসমাসের আগের দিন এতই সঙ্গীন অবস্থা হয় যে প্রায় রায়টকালীন অবস্থায় পুলিশ লাগাতে হয়। বিলেতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ আর প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন মহিলা বিপজ্জনকভাবে মদখোর। এইটুকু যদি কমল গুহ মহাশয় পড়ে ফেলেন, ভূতুমকে আর দেশে ফিরতে হচ্ছে নি। তবে পাব মানে কিন্তু নিছক শুঁড়িখানা নয়। পাব হল সপ্তাহান্তের আড্ডাখানা, নেশা হল আড্ডার নেশা। কে বলে আড্ডা হল বঙ্গজ কেরামতি? নেশা করতে মদেরও দরকার নাই, এক গেলাস হরলিক্স হলেও চলবে। শুধু চাই স্যাঙাৎ। যুদ্ধের সময় লন্ডন যখন খন্ডহর, তখন মহিলারা পাবে গিয়ে গিয়ে পাব বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সেইকালের ভূতুমেরা খাস কলকাত্তাই ঠেকে গামলায় মদ ঢালতেন, সবার হাতে থাকত একটা প্যাঁকাটি, গামলার মধ্যে ভাসত একটি গোলাপ। প্যাঁকাটির নল দিয়ে টেনে গোলাপটাকে কে নলের আগায় ফার্স্টে আনতে পারবে, তার কম্পিটিশন চলত। লন্ডনের হৃৎকমলে আজও সেই ধুমের বাহার। বিলাতের এই ঠেক কালচারের জয় হউক।

    বিলেত ফেরত -- পর্ব ৫         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         মার্চ ১ ২০০৫

    ল্যাদাড়ুর বোম্বাচাক

    ল্যাদম্‌ ল্যাদৌ ল্যাদা:
    রা নাহি দেয় রাধা
    পায়ের উপর পা
    ঘুমটা ভাঙাস না।

    (উপরিউক্ত বিষয় সম্পর্কে লিখিতে হইলে, অর্থাৎ ল্যাদাড়ুর সঠিক ভূমিকাপালন করিতে হইলে শূন্য পৃষ্ঠা লিখিতে হয়। অধুনা একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এমত ইয়ার্কি দন্ডনীয় বলিয়া কতিপয় অক্ষরপ্রকাশে বাধ্য হইলাম।)

    হাইড পার্কের এলিয়ে পড়া ঘাসজমিতে, গাছের তলে গামছা চোখে পড়ে ছিল বুদ্ধু আর ভূতুম। হঠাৎ সুমুখে দেখে "বঙ্গে বর্গী" পালার পিদ্রু সাহেব- সেই অবিকল সাদা তুলো মাথায়। সাহেব হেঁকে বলল- "টোমাডিগের মঢ্যে যে সব ঠেকে ল্যাড, টাকে আমি এক জালা বিয়ার ডিবে। হাট টুলো- কোন lad খুব ল্যাড?" বলতে না বলতেই বুদ্ধুর  চোখ পিট্‌পিট্‌, দুই হাত তুলে নদের নিমাই। ভূতুম যথারীতি কেলিয়ে। সাহেব চিল্লিয়ে উঠল- "ব্রাভো ভূটুম, সট্যিকারের ল্যাড পাইলাম"। বুদ্ধুর মতো ক্যালানে বিগ বেনের তলাতেও পাওয়া যায় না! খাঁটি ল্যাদাড়ু বিয়ারের মাগ কেন, জ্যান্ত মাগ কোলে তুলে দেওয়ার কথাতেও খেটেখুটে হাত তুলবে না। (ল্যাদ খেলে গুল্প চোথা কত্তে হয়!)।

    এই হপ্তার ইস্পেশাল ল্যাদ ও ল্যাদাড়ুদের ইয়ে। (মগজেও শালার ল্যাদ!) গত এক মাস ল্যাদের চোটে ভূতুম কলমখান হাতেই তুলতে পারেনি। ভূতুমের প্রিয় ল্যাদাড়ু পাঠকপাঠিকারা ভাবতেছেন- যে জাত পাঁউরুটি চিবুয়ে চিবুয়ে আর সেদ্ধ বাঁধাকপির বিতিকিচ্ছিরি বাতকম্মো সত্ত্বেও আধা দুনিয়ার পেছনে সের্ফ গতর খাটিয়ে চুলবুলি করে গেল, তাদের মুলুকে গিয়ে ল্যাদের খেউড়! নরেন মোদি হজযাত্রা করলেন না মমতা বাঁড়ুজ্জে ভাবনাচিন্তা কত্তে শিখলেন? তাইলে একটা গপ্পো বলি শুনুন।

    বিলেতের বড়ো বড়ো বেওসায়িদের যে কেলাব, মানে আমাদের সি আই আই বা ফিকির জাতভাই, তারা পয়সা খর্চা করে, পড়াশুনা করে দেখেছেন যে বেশিরভাগ লোকে আজকাল আলফাল ব্যামোর বাহানা করে আপিস থেকে গরহাজির। তার উপ্‌রে এদের মাজায় ব্যথা, পেট কন্‌কন্‌, দাঁত কট্‌কট্‌ - সবই হয় শুক্কুরবারের বারবেলায় বা সোমবারের নতুন যুগের ভোরে। এইরম একাদশীর উপোসের মতো পাঁজি মেনে চলা শরীর দেখে তো সাহেবদের কপালের ভাঁজের পর ভাঁজ। গরহাজির সাহেবদের এক সাহেব ল্যাদসাহেব। ল্যাদসাহেবের মাজায় সত্যি সত্যি খুব বেদ্‌না- হাড়মড়মড়ি ব্যারাম, নড়াচড়া বন্ধ। আপিসের কাজে যেতে পারে না। কাজেই আপিস যাওয়া ছেড়ে দিল। দয়ালু সরকার হাড়মড়মড়ি ব্যারামের খাতিরে মাসে মাসে মাসোহারা দেন। এইরমভাবে কেটে গেল বছর তিনেক। হঠাৎ কোনো এক গল্ফ ক্লাবের লুকোনো ক্যামেরায় ধরা পড়ল- ল্যাদসাহেব ভর দুক্কুরবেলা হাঁই হাঁই করে গল্ফ খেলতেছে। লাঠিখান মাথার উপর তুলে সোঁ করে এসে ছোট্টো বলের পাছায় ঠাকাস্‌ বাড়ি- বল হাঁকপাঁক কত্তে কত্তে মাঠের অন্যধারে। কোথায় রে ভাই তোর হাড়মড়্‌মড়ি ব্যারাম? আদালত, সরকার- সবার চক্ষু চড়কগাছ। আদালতবাহাদুর হুকুম জারি করেছেন- এই তিন বছরের মাসোহারা গুনেগেঁথে, পাইপয়সার হিসেব মিটিয়ে ফেরত দিতে হবে। কাজেই প্রোটেস্টন্ট কর্মবীর উন্নতশির সাহেবমুলুকে সারাদিন পা নাচানো ল্যাদাড়ুর সংখ্যা বাড়ছে।   

    এ সব খচরামি বাড়বেই না বা কেন? উন্নিশশ বত্তিরিশ সালে রাসেল সাহেব উঁচুগলা করে লিখলেন "In Praise of Idleness"। তাঁর মোদ্দা কথা হল- কর্মযোগ হইতে কর্মবিয়োগে উপনীত হইতে না পারিলে যুদ্ধ, মন্বন্তর, অজীর্ণ, পায়োরিয়া, ভগন্দর- এতদ্বিধ করাল হস্ত হইতে মুক্তি নাই। কি সাংঘাতিক ফুসলানোর মন্তর ভাবুন- "Modern methods of production have given us the  possibility of ease and security for all; we have chosen, instead, to have overwork for some and starvation for  others. Hitherto we have continued to be as energetic as we were before there were machines;in this we have been foolish, but there is no reason to go on being foolish for ever." মহাজনের পথ ধরে বিলেতের কিছু ছেলে ছোকরা এক পত্রিকাও খুলে ফেলেছে- The Idler। এদের কথাবাত্তা শুনবেন? "It is our conviction that laziness has been unjustly criticised by modern society, and that it deserves to have its good conscience returned to it and defended as an essential component of a happy life." গোদের উপর বিষফোঁড়া সমুদ্দুরের অন্য পারে। Corrine Maier  নামে Electricite de France-এর এক চাকুরে এক মারকাটারি বই লিখেছেন- Bonjour Paresse (Helllo Laziness): The Art and Importance of Doing the Least Possible in the Workplace। একশ তেরো পাতার বই, ঢপের বোনাস পাওয়ার পর বসের কোলে ফেলে দেবেন- নিজেকে মনে হবে দু:শাসন বধের পর দ্রৌপদী।

    এইসব দেখে ল্যাদপিয়াসী ভূতুমের মনে বেদম ধন্দ। শেষে না থাকতে পেরে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের এক রাগী স্যাঙাৎরে জিগায়- "এই যে কিছু ভুলভাল লোক ওয়ার্ক কলচরকে রসাতলে পেঠিয়ে নিরালম্ব আলস্যসাধনা কচ্চে- বলি এ সব হচ্চেটা কি? আমরা কইচি do it now  আর তোমরা বসে বসে ক্যালাচ্ছ?" স্যাঙাৎ বলে - "ওরে আমার গন্ধগোকুল হোঁৎকাপেটুক! চিকিচ্ছের খরচ পাচ্ছিস, গাড়ির তেলের মাসোহারা পাচ্ছিস, এমনকি বালবাচ্চার জন্য খেলাঘরও পাচ্ছিস- তাই বলে গোড়ার হিসেবটা ভুলে গেলি বাওয়া? কামাই বাড়াও আর খর্চা কামাও- যত কত্তে পারবে ততো বেশি লাভ। একশ পয়সার মাল বেচে তোকে দেওয়া হচ্ছে পাঁচ পয়সা। এই একশ পয়সা যদি একশ দশ হয় আর পাঁচ পয়সা হয় তিন পয়সা, তাইলে পোয়াবারো। আমাদের কেসটাও একই নিয়মে চলবে তো না কি? আমাদের কামাই হল মাসমাইনে আর খর্চা হল খাটুনি। মুনাফা তো আমাদেরও চাই কত্তা। কাজেই হয় কামাই বাড়াও নয় খর্চা কমাও। বাজারের যা ধিনিকেষ্ট অবস্থা তাতে রোজগার বাড়ানো আর বে-রাণী বিলেত- একইরকম অসম্ভব, কাজেই খর্চা কমাই। এ সব লেনিন কাস্ত্রো মাও ম্যাও কিচ্ছু নয়, বাজারের পাতি হিসেব- ফাঁদ পেতেছেন গোষ্ঠমামা, নিজের আখের গুছোই রে মা। তবে কিছু পোঁয়াপাকা এর মধ্যে সাবভার্শনের চোঁয়া গন্ধও পাচ্ছেন বটেক।"

    ভূতুম নিপাট ঘাড় নেড়ে চলে এল। কিন্তুক হিসেবটা কি এতোই সিধে? চেতনা আর নীরজ ভাটিয়া- পাঞ্জাব থেকে এয়েছিল। হাতে এক পয়সা ছিল না, ছিল না চাকরি। দোরে দোরে ঘুরে চাকরির খোঁজ, তারপর নিজের ছোটো ব্যবসা, রাতদিন খেটে নিজেদের ছোটো সংসার, ঘর দুয়ার। ভূতুমকে বলল- "আমরা খাটছি, ট্যাক্সো দিচ্ছি। সরকার সেই পয়সা খর্চা করছে বেকারদের মাসোহারা দিতে। এই বেকারগুলোর বেশির ভাগ হল পাতি ছ্যাঁচড়া- ল্যাদ করে পয়সা কামাচ্ছে। তাইলে আমরা খাটি কেন?" কেস আরও কেলো- এই সব বেকারদের একটা বড়ো ভাগ গরীব বাংলাদেশি, পাকিস্তানি অথবা "ওরা" আর কালোরা। কে মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়েও বেকার আর কে যে পাতি ল্যাদ করব বলে বেকার- সে হিসেবটা করে কে? কাজেই বাড়ছে বিরক্তি, বাড়ছে রাগ- ল্যাদের হস্ত করে সমস্ত খাটুনির ধন চুরি। দিব্যচোখে দেখা যাচ্চে স্বয়ম্ভূ সেই দেজা ভু- আর এক থ্যাচার মেম সাহেব, গরীবের পেছনে লাগা, কথা কম, কাজ বেশি।

    উ: বাব্বা! এতো ভাবা যায় না লেখা যায়! এখন নি:শ্বাস ফেলতেও ভূতুমের ল্যাদ!

    বিলেত ফেরত -- পর্ব ৬         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         মার্চ ১৭ ২০০৫

    তিন নম্বর ঘন্টি

    "If music be the food of love, play on,
    Give me excess of it that, surfeiting,
    The appetite may sicken and so die.
    That strain again, it had a dying fall.
    O, it came o’er my ear like the sweet sound
    That breathes upon a bank of violets,
    Stealing and giving odour. Enough, no more,
    ’Tis not so sweet now as it was before"

    লেখার নামে ভুতুমের এইরম আধপাকা ঢ্যামনামি দেখে এক মুরুব্বি কয়েছেন- "বিলাত হইতে ফিরিলে, না লিখিলে শেক্ষপীয়র বাণী, না লিখিলে রাজ্ঞী বারতা"। এখন এমনিতেই হাটেবাজারে মাঠেঘাটে "ছুঁচো শীল" থেকে "টেপী পিসি" পজ্জন্ত আধবুড়ো রাজপুত্তুর আর আধবুড়ি ঘুঁটেকুড়ুনি বালিকার পীরিতের কেচ্ছায় মশগুল। কাজেই সেই প্যাঁচালে আর কাম নাই। শেক্ষপীয়রকে চীয়র্স জানিয়ে এই বেত্তান্তের শুরু। তবে এই শেখুবাবার সাথে আমাগো রবিবাবার এট্টু তফাত আছে। শেখুবাবার নামে কেউ সিন্নিও চড়ায় না, তসবীরে মালাও পরায় না। তাও উনি আছেন। বেশ আছেন- ঝালে ঝোলে অম্বলে, দিনে রাতে কম্বলে। এডিনবরার নামজাদা নাটকমেলাতে বাঁয়ে ঘুরবি- হ্যামলেট, ডাইনে- ম্যাকবেথ, পিছনে- ওথেলো, সামনে- জুলিয়াস সীজার। এখনও! এক্কেরে শেক্ষে শেক্ষে শেক্ষলাপ। তবে  ভুলেও ভাববেন নি কো সেই টেপজামা পরে, মাজায় কাড্‌বোডের তরোয়াল গুঁজে সীজাররাজা পদ্য আউড়াচ্ছে। এখন নিয়ম হল- যে যেভাবে দেখেন, তিনি সেইভাবেই দেখবেন। ব্রুকসাহেব বসন্তরাতের খোয়াবে ট্র্যাপিজ দুলিয়েছিলেন মনে নাই? আজকাল তো শুনচি গিরিশ-শিশির-মধুসূদনেও দোলে দোদুল দোলে। তাই বলছিলুম আর কি- উনি এখন রসেবশে "আমি তোমাদেরি লোক" স্টেটাস পেয়েছেন।

    তো লন্ডনে শেক্ষপীয়রের কেরামতি দেখতে হলে আছে থেটারপাড়া- শহরের পশ্চিম দিকে- "West End" বা "Waste End"। দোস্তেরা বলেচে- "ঢিপঢাপ পাড়ার নাম ড্রপ করছ, এবার এট্টু ডিরেকশন ফিরেকশন ছাড়ো।" তাই যেখানেই থাকেন, দুইখান লাইনের কথা মনে রাইখেন- পিকাডিলি আর নর্দার্ন। নামেন লেস্টার স্কোয়ারে। বাইরইলেই দেখবেন রংতামাশা, নাচনকোঁদন, আড্ডামৌতাতে মেহফিল জমজমাট। এরই আশেপাশে অলিতেগলিতে সব নাট্যশালা। পকেট ভারী না থাকলে একটু সমিস্যে। হলে বই দেখতে গেলে যা দেন, তার তিনগুণ গচ্চা যাবে। দাঁড়িয়ে যাবেন আধাদামের টিকিটের লাইনে। তাপ্পর দেখেন লাইন দিয়া- অ্যাডেলফি থেকে শ্যাফটসবেরি, "Lion King"এর হৈহল্লা থেকে "Who Flew Over Cukoo's Nest"এর চেনা আলো চেনা অন্ধকার। ভূতুম এই মহল্লায় ঘুরতে ঘুরতে টুক করে ছুঁয়ে এলো এতদিনের শোনা "Mousetrap"। এখনও উনি চলছেন, তবে কেমন একটু ঢিমিয়ে, এককোণে লুকিয়ে কেমন ম্যাড়মেড়ে। এমনধারা ঘুরতে ঘুরতে ইতিউতি চাইতে চাইতে চোখ ঠেকল  এক আজবধারার বিজ্ঞাপনে- চিকচিকে শিফন শাড়ি জড়িয়ে লচকদার বিবিসাহেবা, পেছুনে মহেন্দ্র দত্তের কালো ছাতা মাথায় ধরে পাজামা আর আর্দালির উর্দি পরে এক মুন্সিজি, পাশে জাফরিকাটা কাঠের জানলায় উঁকি দিচ্ছে ঝম্‌ঝমানো দেশোয়ালী বিষ্টি। হিন্দিতে লেখা- "বারয়িঁ রাত"। হঠাৎ এখানে মিস ভাটিয়া আর মুঙ্গেরিলাল? "Twelfth Night"- শেখুবাবার লেখা, চলছে অ্যালবেরি থিয়েটারে। ট্রাফালগার স্কোয়ার থেকে বাঁয়ে নাকবরাবর গেলে এই নাট্যশালা, পাশেই দাঁড়িয়ে বিলিতি জাতীয় অপেরার নাচঘর- কলিসিয়াম।

    তিন নম্বর ঘন্টি পড়তেই স্টেজের উপর আলোয়ার-আমরোহা-বাগপতে দেখা সরাইয়ের দেউড়ি, দেওয়ালে ছোটো খুপরি, কোথাও মুচি জুতো সারাচ্ছে, দেওয়ালে ঠেস দেওয়া পুরোনো হারকিউলিস, ভিড় করে ঝুলে আছে ইলেকটিরির তার, পেছন জুড়ে ঝরো ঝরো বরিষে, সেতারে মল্লারতান। তাপ্পর কি দেখলুম বলব কি মশাই! ঘক্ষড়ভশষ কুর্তা পাজামা পরে জমিদারের পো, হাতে ডিপ্লোম্যাট বাগিয়ে জভক্ষ ঝষথঁ আনরদব করোলবাগের খিস্তিবাজ বেওসাদার, ঘরভৎভত লাজপত নগরের ঝিনচ্যাক শাড়িটাড়ি নামিয়ে ক্‌ক্‌ক্‌ সিরিজ থেকে উঠে এলো বুঝি! "দ্বাদশ রাত্রির" কথা মনে আছে তো? একদিকে পীরিতে দীওয়ানাদের মায়ার খেলা, অন্যদিকে আমোদগেঁড়ে ফক্কড়দের ইতরামি ফাজলামি- রঙে বেরঙে গানে নাচে চীৎকারে খেউড়ে দিল গুলজার। তবে মাইরি বলছি- উনি কোনো বক্তব্য রাখেন নি। এই খাঁটি বিলিতি নাটক হঠাৎ দুপাট্টা  শাড়ি শেমিজ গায়ে চাপিয়ে হারমোনি বাজাচ্ছে? তবে শুনুন অধিকারীর কথায়- "Everything we discovered in India seemed to make sense of the play: its vibrancy, its passion, its cruelty, the irreverent humour that informs every interaction, the public nature of people's emotional lives. Shakespeare might have recognised a great deal, not least the unsentimental way people approach what's thrown at them. Ingenuity is all, in India and in Illyria." ভাগ্যিস শেখুবাবা মা ভিক্টোরিয়ার আগের আমলে! তাপ্পার ইঞ্জিরি উশ্চারণের কথা কি আর বলব? শেক্ষপীয়র বলতে তো শুনিচি দত্তমশায়ের ভারী গলায় পাবলিক ইশ্‌কুলের গম্‌গমে ইঞ্জিরিতে ওথেলোবিলাপ। এইখানে কিন্তু হাটুরে পাঞ্জাবে উশ্চারণে দুনিয়া কাঁপানো লাইন গড়গড়িয়ে, কখনও আবার বলিউডের দু এক কলি। সাহেবমেমেরা এই বাওয়াল দেখে তো আনন্দে অস্থির। Feste ফকির একলা স্টেজে নোংরা ধুতিতে মালকোঁচা মেরে, গলায় গোটা দশেক পুঁতির মালা ঝুলিয়ে, কপালে ধ্যাবড়া চন্দন সিঁদুর লেপে যেই ধরেছে- হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হো- মাক্কালীর দিব্বি, কল্‌জেটা খল্‌বল্‌ করে উঠল। Feste করেছেন যে লাটকবাবু, কুলভিন্দর ঘির-  হাঁটায় চলায়, নাচে গানে, পাতি আর অ-পাতি ভাঁড়ামিতে হল পুরো তোলপাড় করে দিলে গা! এই মুল্লুকে ল্যান্ড করলে রঘুবীর যাদব বা বিজয় রাজদের কপালে নির্ঘাৎ ভাঁজ ফেলে দিতো। বিজয় রাজ বলতেই মনে পড়ল- "Monsoon Wedding"-এর নেহা দুবেকে মনে আছে? তিনিও আছেন- Olivia। তাই বলে কি আর খামতি নেই? চারজনের বেশি পাঁচজন এলেই কেমন "কই দাঁড়াই কই দাঁড়াই" ভাব, অ্যাক্টো কত্তে কত্তে মাঝেমধ্যে একটু ঢিলে পড়া- এ সবও আছে। কিন্তু তাও আছে একট তরতাজা হাতেগরম নাটক, নোটবই কনসাল্ট না করেই ভালো লাগা একটা নাটক।

    দেখে দেখে ভূতুমের মনটা বড়ো উদাস হয়ে গেলো গো! পোড়ামুখোর দেশে নাটুকে স্যাঙাৎরা কপনি পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে- কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে। নাটক হিট হলেও বানাবার খচ্চা ওঠে না। আর কারই বা এতো ধক যে একবারটি বলবে- দেখলে হবে? খচ্চা আছে। অথচ  এই মুল্লুকে বিকেল গড়াতেই থেটারে থেটারে পাবলিকের ঢল নেমেছে। বচ্ছর বচ্ছর অধিকারীর দল হৈ হৈ করে পালা নামাচ্ছে। রেলগাড়িতে কতো কতো পড়ুয়াদের হাতে দেখি থেটারের হোমটাস্কের খাতা। আর মোদের? থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার একতা কাপুর। দেশোয়ালী পাবলিকের উপর অচ্ছেদ্দা ধরে গেলো মাইরি! তবে দুখীমুখী ভূতুমকে দেখে রাডার (হাবিবভাই পাশ করার পর নান্দীকারের হুজুগে বংরা টাডার মতো রাডাও চেনে) এক স্যাঙাৎ কইল- "অত ভাইঙ্যা পড়িস না রে। আমাগো দশাও খুব একটা পদের নয়। ধান্দামান্দা কইর‌্যা একপিস এডিনবরায় নামাইতে পাল্লে খানিকটা কল্কে মেলে। তাপ্পর বইস্যা থাকো- ওয়েস্ট এন্ডের কোনো গৌরী স্যান যদি ট্যাহার থলি লইয়া আসেন। তয় ওয়েস্ট এন্ডেও দশখানের মধ্যে একখান হিট। বাকিগুলান সব ব্যাকস্টেজের পিছন গুদামে। সং সাজছি বটে। কিন্তু জেবনের ওঠাপড়া বড়ই গায়ে লাগে রে ভাইটু।" এই কি খুব সুখের কথা শুনাইলে স্যাঙাৎ? অলীক কুনাট্যরঙ্গে অপচিত সময়ের সোনা।

    ভূতুম, আর কতা কইস নে। এবার একটু পা চালিয়ে।  দুনিয়ার রংঢং দেখবি নে? থার্ড বেল যে পড়ে গেলো!

    বিলেত ফেরত -- পর্ব ৭         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী         এপ্রিল ১ ২০০৫

    ১লা এপ্রিল, ২০০৫

    "বহুদিন বেদনায়, বহুদিন অন্ধকারে হয় হৃদয়ের উদঘাটন
    সে-সময়ে পর্দা সরে যায় প্রাচী দিগন্তের দিকে....."

    সেদিন লন্ডনের আপাদমস্তক  ছাইরঙা কম্বল। উত্তুরে হাওয়ার প্রবল ঝড়ে বাড়িঘর কুঁকড়েমুকড়ে একসা। রাস্তাঘাট ফাঁকা ধু ধু। ভূতুম অভ্যেসের দাস। হাজির হোয়াইটচ্যাপেলের কাছে নিতান্ত অখ্যাত এক পাবে। শীতের অন্ধকারে পাবে খদ্দের প্রায় নেই বললেই চলে। ভূতুম হাতে গেলাস নিয়ে বসে পড়ে এক কোণের টেবিলে। গলায় গুমরে মরছে ধোঁয়ার তেষ্টা। কিন্তু আগুন কই স্যাঙাৎ? পাশের অন্ধকার টেবিলে মুখ গুঁজে এক মেয়ে। ভূতুম ইতস্তত: করে মুখ ফেরাতেই মেয়েটি সিধে হিন্দিতে লাইটার অফার করে। মেয়েটির মুখে আলোছায়া ছিল, চোখের তলায় ছিল ঘনকালি, মুখের আশেপাশে শুকিয়ে যাওয়া আঘাতের দাগ। ভূতুম ফেরে নিজের টেবিলে, বিড়ি ধরায়। কিছুক্ষণ পরে সময়ের পর্দায় বেজেছিল পাগলা সানাই। এই সময়ের হালহকিকৎ ঠাহর করা বড়ই মুশকিল। ভূতুম, কেন কে জানে, গিয়ে বসে মেয়েটার টেবিলে। মেয়েটা কেঁদে ফেলে- কতজন্মের কান্না গড়ায় পাবের চটাওঠা টেবিলে! বিড়ির আগুন দব্‌দব্‌ করে জ্বলে যায়।
     

    তারপর দুজনের কথা হয়। অনেক সময় ধরে কথা হয়। অনেক কথা হয়। কি কথা?

    গুজরাট থেকে এসেছিল এই মেয়ে। পড়াশুনা-চাকরি-বিয়ের বাঁধা গতে অবিরাম জীবনযাপন। প্রোজেক্টের কাজে হঠাৎ বিলেতে। মেয়েটির কাজ খদ্দেরদের খুব পছন্দ। কাজেই প্রায় পাকাপাকিভাবে বিলেতে বাসা বাঁধার চেষ্টা চলে। স্বামীও দেশের চাকরি ছেড়েছুড়ে বউয়ের সাথে জোটে লন্ডনে। বছরের পর বছর যায়। ছেলের চাকরিলাভের গরজ নেই। শুধু পাবে পাবে ঘুরে মোক্ষলাভের স্বার্থপর গরজ। তারপর থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়! মারপিট, বোতল ছোঁড়াদ্‌হুঁড়ি, খিস্তিখেউড়ের দমবন্ধ অভ্যেস। তাও দিনের শেষে পাখি খাঁচায় না ফিরলে মোবাইলে অবিরত ডাক পড়ে। নাকি ঝগড়াঝাঁটির নেশাও চেপে বসে এই জাঁকিয়েবসা ঠান্ডা জীবনাভ্যাসে? যাই হোক। সেদিন ছিল সেই একাকী অদ্ভুত সন্ধ্যা, যেদিন মোবাইলে ঝগড়ার ডাক পড়ে নি। তাই হয় তো মেয়েটার মনে ভয়ের ঝড় উঠেছিল, তাই হয় তো ফাটাফুটো নৌকার জন্য কান্না আছড়ে পড়েছিল পাবের টেবিলে। ভূতুম তখন কি ভাবে হে কুটুম? পোড়া ঠোঁটের ব্যাঁকা হাসি কই গেল রে ভূতুম? ভূতুমের গলার কাছে কি পাকায় কিছু? ঠিক এমন সময়, মোবাইল বেজেছিল।

    "সবার বয়স হয়   আমার বালক-বয়স বাড়ে না কেন
    চতুর্দিক সহজ শান্ত  হৃদয় কেন স্রোতসফেন
    মুখচ্ছবি সুশ্রী অমন, কপাল জুড়ে কী পরেছো
    অচেনা, কিছু চেনাও চিরতরে।"

    পরের দেখাও ট্রেনের কামরায়। ডিস্ট্রিক্ট লাইনে অফিসের দমবন্ধকরা ভিড়ে। সেদিনও আকাশ বড়ো উদাস, বড়ই বিষণ্ন। দুজনেই টাওয়ার হিল স্টেশনে নেমে পড়ে। ওরা চুপ করে বসে টাওয়ার অফ লন্ডনের সবুজ চত্বরে। যে চত্বরে অষ্টম হেনরীর আদেশে অ্যান বোলীনের শিরশ্ছেদ হয়েছিলো। টাওয়ার অফ লন্ডন থেকে বেরিয়ে বোধহয় টাওয়ার ব্রিজ পেরিয়ে ওরা পৌঁছেছিল টেম্‌সের দক্ষিণ পাড়ে। হঠাৎই দুজনে ঢুকে পড়ে London Dungeon-এ, যেখানে ভয় দেখানোর হরেকরকম ছেলেমানুষী খেলা। অন্ধকারে গিলোটিনের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটা ঝরঝরিয়ে আলোর মতো হেসে ওঠে। আর কখনও তুমি হেসেছিলে কি? হাঁটতে হাঁটতে দুজনে এসে দাঁড়ায় মিলেনিয়াম ব্রিজের সামনে। ব্রিজের একদিকে টেট মডার্ন আর অন্যদিকে সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল টেম্‌সকে আঁকড়ে ধরে আছে। টেম্‌সের রেলিঙে ভর করে অনেকক্ষণ দাঁড়ায় দুজনে। মনে হয় না কেউই কোনো কথা বলেছিল। তারপরের কিছু সময়ের হিসাবকিতাব নাই। ওদের আবার দেখা যায় ন্যাশনাল  ফিল্ম থিয়েটারের সামনে ফিল্ম কাফেতে দু কাপ কফি হাতে বসে থাকতে। তখনের টেম্‌স বুঝি বা নিপুণা জননী। এই মলিন বারবেলাতেও শীতল চন্দন  আঁকে পুড়ে যাওয়া মুখের উপর। একদিকে মাথা উঁচিয়ে ঘুরে যায় লন্ডন আই। ছেলেবুড়ো ভিড় করে দেখছিল চরকাবুড়ির মতো জবুথুবু পড়ে থাকা লন্ডন শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। হাঙ্গারফোর্ড ফুটব্রিজের উপর এক পাগলাটে বুড়ো বাঁশি বাজিয়েই যেতে থাকে। চাইকোভস্কি? নাকি দেশ? কে জানে! দুজনে উঠে আরও খানিক পথ একসাথে হেঁটেছিল। হঠাৎই কি মনে পড়ায় মেয়েটি হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে যায় ওয়েস্টমিনস্টার টিউব স্টেশনের দিকে। একলাফেকলা বালক ভূতুম টেম্‌সের এককোণে। সন্ধ্যার ক্লান্তিতে টেম্‌সের জল তখন বিষনীল। বিগ বেনের আওয়াজ ছড়ায় যেন প্রত্নসারসের গম্ভীর পাখা।

    "পৃথিবীতে ঘটনার ভুল
    চিরদিন হবে
    এবার সন্ধ্যায় তাকে শুদ্ধ করে নেওয়া কি সম্ভবে?"

    শেষ দেখা ব্রিক লেনের এক বাংলাদেশি সুপারমার্কেটে। মেয়েটির মুখ তখনও বিধুর। শুধু চোখের কালোতে এক অবিচ্ছেদ উজ্জ্বলতা। মেয়েটি এবার একটু অন্যরকম কাজের  হদিশ  পেয়েছে। ভূতুমকে তার সেই কাজের গল্প শোনায়। কাজের গল্প, অসীম সুখে গদগদ শহর লন্ডনের কোণে পড়ে থাকা গল্প।

    বাংলাদেশের মেয়ে রাবেয়া। আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি, বয়েস পনেরোয় শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ি লন্ডনে। বর ছোটোখাটো ট্রাভেল এজেন্ট। অল্পবয়সে বিয়ের জন্য রাবেয়া ডিপ্রেশনে ভোগে। একবার কব্জির শিরাও কেটে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তারপর কোল আলো করে আসে নতুন জীবন। জন্মের কিছুদিন বাদেই সন্তানের সারা শরীর নীল, গায়ে ধুম জ্বর, নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারেরা বাঁচিয়ে তোলেন কিন্তু বহু শলাপরামর্শের পরেও রোগ নিয়ে ধন্দ কাটে না। দিন যায়- বেরঙীন লন্ডনে রাবেয়ার আরও বেরঙীন বারোমাস্যা। কিছুদিন বাদে বাচ্চার আবার সেই একই অসুখ। আবার ডাক্তার, আবার চিকিৎসা, আবার রোগ অধরা। এইরকম চারবার হবার পর ডাক্তারেরা সন্দেহ করেন রাবেয়া Manchusen's Syndrome বলে এক মানসিক অসুখে ভুগছে- যে অসুখে মা তার নিজের সন্তানের ক্ষতি করে স্ব-ইচ্ছায়। কোথা আইলি মা আমার? জঠরযন্ত্রণা মা গো, জননীযন্ত্রণা। পুলিশ আসে। রাবেয়ার সন্তানকে তুলে দেওয়া হয় তার দাদীর কোলে। রাবেয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হয় সন্তানহত্যা প্রচেষ্টার মামলা। মা গিয়ে ওঠেন জেলের কুঠুরিতে, "মা" ডাকের দখল হারিয়ে। আশমানে তখনও বুঝি কোনো দয়ালু নক্ষত্র জেগে ছিলো। কিছু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সাংবাদিকের চোখে পড়ে এই ঘটনা। তাঁরা বাংলাদেশের গ্রামে ছুটে যায় রাবেয়ার বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়িতে খোঁজ নিতে। জানা যায় যে দুই বংশেই আগেও বহু সন্তানের ঠিক এইরকম রোগে অকালমৃত্যু হয়েছে- সেই নীল হয়ে আসা শরীর, সেই দম আটকে যাওয়া, গায়ে ধুম জ্বর। অন্য ডাক্তারবাবুরা বলেন এই রোগ মনে হয় বংশগত। সঠিক রোগনির্ণয়ের চেষ্টা না করেই রাবেয়ার উপর অহেতুক হত্যার মামলা চালানো হচ্ছে। আবার নতুন করে ফাইল খোলা হয়। কিন্তু ভূতুমের মনে বড়ো ডর। বাংলাদেশের অজ পাড়াগাঁয়ে কেই বা রাখে রোগের ফাইল, কেই বা রাখে শিশুমৃত্যুর ঠিকুজিকুলুজি! "সভ্য" দেশে  ঠাকুমা দিদিমাদের মুখের কথায় কিই বা এসে যায়? প্রমাণ চাই, প্রমাণ। ডাক্তারের সই করা কিছু চোথা না হাতে পেলে দাঁড়িপাল্লা নড়েও না, চড়েও না। সময়ই হয় তো  বলবে কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।

    "লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা?"

    আমাদের গল্পের গুজরাটি মেয়ে, কিসের তাড়নায় কে জানে, স্বেচ্ছায় তদন্তকারী সাংবাদিকদলের সাথে চলেছে বাংলাদেশে। এর পর মেয়েটা আর কিছু না বলেই হঠাৎ চলে গিয়েছিল। ভূতুম দোয়া করে একটা মেয়ে যেন বাংলাদেশে জীবনের ন্যূনতম স্বাদ খুঁজে পায় আবার। ভূতুম দোয়া করে একটা মেয়ে যেন লন্ডনে সন্তানের গায়ের গন্ধ খুঁজে পায় আবার। দোয়া করে আর জলে ভাসে। জলে ভাসে আশমান, জমিন, জীবন, দেবতা। জলে মোদে্‌হ পাতার পর পাতা, লেখার পর লেখা, নক্‌হাদারির দেখনহাসি কিস্‌সা। মাঝটেম্‌সে বুঝি বা ভাসে আয়ত নক্ষত্রসরণির দিকে চেয়ে থাকা ত্রিনয়ন।  জলে ভাসাই ঘরে ফেরার মান্দাস। এবার ফিরে যাই "ফেরার কুতূহলে", এবার ঘরে ফিরি "ফেরার কামনায়"।   

    (শেষ)
     
  • 21 | 104.244.77.80 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:২৭741437
  • আন্টিমাসি
    পারিজাত

    আমি কলকাতার যে ইস্কুলে দেড় বছর পড়েছি সেখানে এমন এমন সব জিনিস হত যে মনে হত এটা হয় সার্কাস কিংবা ম্যাজিক শো, নয়তো স্বপ্ন দেখছি। এই ইস্কুলটা ছিল একজন, সেই একজনের নাম আন্টিমাসি। কেন তার এরকম নাম আমাকে জিজ্ঞেস কোর না, কারণ আমি জানি না। আন্টিমাসি যদি হাসে তবে সবাইকে হাসতে হবে যেন খুব মজার কিছু একটা হয়েছে। আন্টিমাসি গম্ভীর হয়ে গেলে সবাইকে সেকেন্ডের মধ্যে গম্ভীর হয়ে যেতে হবে তা মনে মনে যতই হাসি পাক না কেন। সবাই তার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। যেমন একদিন বৃষ্টি হচ্ছিল আর কোনও ক্লাসের কোন ছেলে যেন চারতলার জানলা দিয়ে গীতবিতানটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল রাস্তার ওপর। গীতবিতানটা ভিজে গিয়েছিল কিংবা আরও ভয়ঙ্কর কিছু মানে রবীন্দ্রনাথই হয়তো ভিজে গিয়েছিলেন এরকম ভয় পেয়েছিল সারা ইস্কুল। এ খবর আন্টিমাসির কানে গিয়েছিল কিনা আমি জানি না, তবে ইস্কুলে সবাই জানত যে ধরা পড়লে ওই ছেলেটার কপালে দু:খ আছে। রোজ সকালে প্রেয়ারে একই রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে গাইতে গাইতে গাইতে, নাচের ক্লাসে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুলে দুলে ঢলে ঢলে নাচতে নাচতে ওই ছেলেটাও নিশ্চয়ই আমার মতোই বোর হয়ে গিয়েছিল আর সেই জন্যই ওর সব রাগ গিয়ে পড়েছিল ওই গীতবিতানটার ওপরে। আর সেই জন্যেই ও ভেবেছিল বইটা বিদায় হলে যদি ওই দুলে দুলে নাচ-গান অন্তত কিছুদিনের জন্যে বন্ধ হয়। কেউ ধরা পড়েনি শুধু কয়েকজন প্রাইম সাসপেক্ট ছিল। তাও প্রমাণের অভাবে তাদের বাইজ্জৎ বরি করে দেওয়া হয়, বলি হতে হতে বেঁচে যায় তারা। এমনকি ওটা কোনও ছেলে করেছিল না কোনও মেয়ে সেটাও কেউ জানে না, তবু আমার ধারণা ওটা ছেলে ছিল।

    মেয়েরা প্রায় সবাই আন্টিমাসির কাটলারি। তারা ওকাজ করতে পারে না। অনেক টিচারেরই কাটলারি থাকে তা তারা চাক বা না চাক, কিন্তু আন্টিমাসির পুরো কাটলারি সেট ছিল। তারা সবসময় ক্লাসের সামনের দিকটা আলো করে বসত পদধূলি বেশি করে নেওয়ার জন্য। মাঝখানে কিছু এলেবেলে মিডলক্লাস আর পেছনের দিকটায় পড়া ফাঁকি দেওয়া ছেলেরা, এছাড়া আমার মতো একজন দুজন না ঘরকা না ঘাটকা। ওহো সেই গল্পটা বলি এবার। আমাদের পুজোর ছুটিতে অনেকগুলো কবিতা মুখস্থ করতে দেওয়া হয়েছিল "কথা ও কাহিনী' থেকে। আমরা কেউ সবগুলো মুখস্থ করিনি। আমি একটা করেছিলাম তাও হাফ। এদিকে আন্টিমাসির ক্লাস। ওটা অন্য একটা ঘরে হত। মিউজিক রুমে। সেখানে আমাদের মেঝের ওপর বসতে হত। সবাই বসে পড়লে একজন লোক এসে আন্টিমাসির চেয়ারের সামনে একটা ছোট টুল এনে রাখত, ওটা ফুটরেস্ট। আর ওটা এনে রাখা মানেই উনি এবার আসছেন। ঠিক সেই মহারাজ রাজসভায় আসছেন অতএব সবাই সাবধান, টাইপের লাগত। সবাই চুপ। এবার কবিতা ধরা হবে। উনি রোল নাম্বার ধরে ধরে লিস্ট থেকে নাম পড়ে পড়ে কবিতা ধরছেন। আমি সেই বহে মাঘমাসে শীতের বাতাসটা আদ্দেকের কম বলতে না বলতেই উনি বসতে বলে অন্য একজনকে ধরতে লাগলেন। পাঁচ ছ'জনকে ধরতে না ধরতেই ঘন্টা পড়ে গেল। পরের দিন আবার ক্লাস আবার ফুটরেস্ট এল। যারা আগেরদিন বলেনি তাদের পড়া ধরা শুরু হল। কাটলারি-মিডলক্লাস-ফা`কিবাজের মধ্যে তিন-চার জন কবিতা পারল, বাকিদের মুখস্থ হয়নি। ঠিক পিসি সরকারের ম্যাজিক। আন্টিমাসি যার দিকে আঙুল তুলছেন সে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। কেউ হয়তো বলল, -- বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস স্বচ্ছ সলিলা যমুনা -- না না যমুনা নয় বরুণা। স্বচ্ছ সলিলা বরুণা -- ব্যাস, ভ্যানিশ। ক্লাসের বাইরে কেউ বাথরুমের সামনে, কেউ তিনতলার বারান্দার কোণে, কেউ একতলার ক্রেশের সামনে, আন্টিমাসি প্রত্যেককে কো-অর্ডিনেট বলে বলে সেখানে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। মিনিট কুড়ির মধ্যে ক্লাস ফাঁকা হয়ে গেল পড়ে রইলাম আমরা চার-পাঁচজন। আন্টিমাসি এবার আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলেন। সেই লোকটা এসে ফুটরেস্টটা তুলে নিয়ে গেল। আর বলে গেল যারা যারা শাস্তি পেয়েছে তাদের জোগাড় করে পুরো ক্লাসকে একতলায় যেতে হবে আন্টিমাসি ঘরের সামনে। উনি ডেকেছেন।

    সবাই গেলাম। লাইন করে দাঁড়াতে হল আমাদের। আমরা পাঁচজন যারা কবিতা পেরেছিলাম তাদের আন্টিমাসি বললেন -- যারা কবিতা পারেনি তাদের প্রত্যেকের গালে চড় মেরে এসো। এরকম সুবর্ণ সুযোগ কেউ ছাড়ে না। কিছু মিডল ক্লাস আর কিছু ছেলেকে কষে চড় মারলাম। আন্টিমাসি এগুলো লক্ষ রাখছিলেন, যারা আলতো করে হাত বুলোবার মতো চড় মেরেছিল তাদের বললেন আবার গিয়ে মেরে আসতে। আমাকে বলেননি। চড় মারা হয়ে গেলে বলা হল ওদের এখন কবিতা মুখস্থ করতে হবে আর আমরা ওদের কবিতা ধরব। এই বলে আন্টিমাসি নিজের ঘরে চলে গেলেন। এদিকে অনেকক্ষণ টিফিনের ঘন্টা পড়ে গিয়েছে। পাশেই নার্সারির বাচ্চাদের ক্রেশ থেকে মাছের ঝোলের গন্ধ ভেসে আসছে আর আমাদের টিফিন বক্সগুলো পড়ে আছে ক্লাসে। আমরা দশজন ওদের কবিতা ধরছি। নীচু ক্লাসের ছুটি হয়ে গিয়েছে, তারা বাড়ি যাওয়ার পথে দেখছে আমরা সব শাস্তি পেয়েছি আর কবিতা মুখস্থ করছে অনেকে। এমন সময়ে ক্রেশের এক বদরাগী মহিলা এসে জানালেন আমরা ক্লাসে গিয়ে টিফিন বাক্স নিয়ে আসতে পারি। আমরা টিফিন বাক্স নিয়ে এলাম। এবার একজন টিচার এসে বললেন, "আজ বোর্নভিটা কুইজ কনটেস্ট থেকে লোক এসেছে' এটা শুনেই সব ছেলেদের মুখ চক্‌হক করে উঠল, "কিন্তু এই লিস্টে যাদের নাম তারাই জেতে পারবে', এই বলে তিনি লিস্ট থেকে আমাদের দশজনের নাম পড়লেন। আমরা যারা একটু আগে চড় মারার অধিকার পেয়েছিলাম, তাদের নাম। ছেলেদের মুখগুলো তখন দেখার মতো। ঠিক যেন ওদের চোখের সামনে হ্যারি পটার খুন হয়ে যাচ্ছে।

    যাই হোক, ওই কুইজ কনটেস্টের লোকগুলো চলে যাওয়ার পরে খবর পেলাম, আমরা দশজন বাদে বাকি ক্লাস সাতদিনের জন্যে সাসপেন্ড। ওই সাতদিনে ওদের সবগুলো কবিতা ঝাড়া মুখস্থ করে ফেলতে হবে। এই কথা শুনবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই চেন রি-অ্যাকশনে হুহু করে কাঁদতে লাগল। এর মধ্যে একজন কাটলারি আবার দোষীদের হয়ে আন্টিমাসির কাছে কেঁদে কেঁদে ক্ষমাও চাইল। সে নাকি এসব দোষ বুঝতে পেরেছে, সেইজন্যে তার খুব দু:খ হয়েছে, অতএব সে ক্ষমা চায়, আন্টিমাসি যেন ক্ষমা করে দেন, না হলে তার আরও দু:খ হবে, এইসব। এর একটু পরে ছুটি হওয়ার কথা। আমরা জানি না আমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, না আরও কতক্ষণ একতলার উঠোনে সিঁড়িতে কবিতা মুখস্থ করতে হবে। আবার সেই ফুটরেস্ট বাহক এসে বলল, আন্টিমাসি আমাদের তিনতলার হলঘরে ডেকেছেন। গিয়ে দেখি উনি বসে আছেন হাতে মাইক। শুধু উনি নন, আরও অনেক টিচারও সেখানে ঘোরাফেরা করছে। সবার মুখ গম্ভীর। শুধু আমরা নই বাকি সব ক্লাসও সেখানে উপস্থিত। এবার আন্টিমাসি স্পিচ দিতে শুরু করলেন। আমি পেছনের দিকে বসে ছিলাম। উনি প্রথম দিকে অনেক কিছু বলে গেলেন যা সত্যিই ঠিক বোঝা যাচ্চিল না। তারপর বুঝলাম আমাদের শাস্তি দিয়ে ওনার খুব দু:খ হয়েছে। স্পেশালি ওই একজন ক্ষমা চেয়েছে, সেটা শুনে ওনার নাকি ভীষণ কষ্ট হয়েছে। এই অবধি বলার পরে সব চুপ। তারপরে মাইকটা খারাপ হয়ে গেল। আমি পেছনে ছিলাম দেখতে পাইনি কিন্তু পরে শুনেছিলাম আন্টিমাসি কেঁদে ফেলেছিলাম আর সেই চোখের জল মাইকের ভেতরে ঢুকে গিয়ে মাইক খারাপ করে দিয়েছে। ঘ্যাশঘ্যাশ আওয়াজ হতে লাগল মাইক থেকে।

    এবার আরেকটা মজার জিনিস হল। সামনের রো-এর কাটলারিরা ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগল। সেই কান্না দেখে সেকেন্ডে রো ও কান্না শুরু করল। সেকেন্ড রো থেকে থার্ড রো। এইভাবে ঠিক যখন আমার সামনের রো-এর মেয়েরা ফোঁফাচ্ছে আমি ভাবছি আমারও কাঁদা উচিত সবাই যখন কাঁদছে না হলে আমাকে হয়তো সাসপেন্ড করেও দিতে পারে, তাই আমিও মাথা নীচু করে ফোঁফানোর অ্যাকটিং করতে লাগলাম। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও চোখ কচলেও চোখে জল আনতে পারলাম না। কিন্তু কান্নাটা ছিল এপিডেমিক। এদিকে ইস্কুল ঘন্টাখানেক আগে ছুটি হয়ে গিয়েছে কিন্তু আমরা তখনও কান্নার অ্যাকটিং করে যাচ্ছি আর আন্টিমাসি স্পীচ দিয়ে যাচ্ছেন। বাকি টিচাররা তটস্থ আর আমাদের দিকে রাগী রাগী মুখ করে তাকিয়ে। সেগুলোও অ্যাকটিং ছিল মনে হয়। মোট কথা ইস্কুল ছুটি হওয়ার ঘন্টা দেড়েক পরে আমাদের ছুটি হয়েছিল। এই ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই ওই ইস্কুল ছেড়ে দিই। কে বলতে পারে ওখানে আরও বেশিদিন থাকলে আমিও হয়তো এতদিনে ছিঁচকাঁদুনে কাটলারি বনে যেতাম।
  • sankhaonline একটি এক্সপেরিমেন্টাল গল্প | 104.244.77.80 | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:২৯741438
  • একটি এক্সপেরিমেন্টাল গল্প
    sankhaonline
    9/20/2011

    https://web.archive.org/web/20111009062733/http://banglalive.com/Blog/Other/56

    ... শুধু নায়ক দৌড়োলো না, অস্ফুটে বললো, চিঠি দিও ...
    নায়িকা শুনতে পেলো কি না ঠিক বোঝা গেলোনা
    ...

    এই এতো ভোরে পুবের দরজা খোলেনি, আবছা অন্ধকার আর কুয়াসায় মাখামাখি হয়ে আছে এই ছোট্ট হল্ট। ঠিক স্টেশনও বলা যায় না একে, কয়েকটি ট্রেন, অল্প কিছু সময়ের জন্য এখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। এই ট্রেন, যাতে করে নায়িকা চলে যাচ্ছে তার দেশের বাড়ির দিকে, সেটি এই কিছুদিন হল এখানে স্টপেজ দিচ্ছে। ভোরবেলাতে। আর ফিরতি ট্রেন সেই রাঙা বিকেলবেলায়।

    ট্রেনের দিকেই তাকিয়েছিলো সে, একদৃষ্টিতে, পলক ফেললে যদি হারিয়ে যায়। কেউ কি তার মতই পাল্টা তাকিয়ে আছে এদিকপানেই, এই হল্টটির দিকে? তার দিকে?
    যখন আস্তে আস্তে নির্দিষ্ট বাঁক, কুয়াসা আর গাছপালায় মিলিয়ে গেল ট্রেন, ততক্ষণে তার চোখ কর কর করতে শুরু করেছে, একদৃষ্টিতে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকার জন্যে।

    কংক্রিটে বাঁধাই ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম, ইতিউতি মাথা চাড়া দিয়েছে ঘাস আর চারাগাছ। পাখির আবর্জনায় ভরা কয়েকটা কাঠ আর লোহার বেঞ্চি। অনেকটা উঁচু জমির ওপরে বানানো এই রেলপথ। লোকে বলে রেলপাড়। দুপাশে নেমে গেছে ঢাল, মিশেছে নিচের ধানজমিতে। সেই ঢালটুকু নানা রকম ঝোপঝাড়ে আর ছোটবড় গাছে ভর্তি। গাছের পাতায় পাতায় সারারাতের শিশির জমে টলটল করছে। কিটকিট করে কি একটা পোকা একঘেয়ে ডেকে চলেছে।

    দু'পা হেঁটেই একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লো সে। এতক্ষণের জমে থাকা অস্বস্তিটাকে মুছে দিতেই যেন চোখের পাতা বুজলো, বুকের মধ্যে কোথাও একটা ভারি কপাট বন্ধ হতে অনুভব করলো সে। চোখের কোল বেয়ে একটা শীর্ণ ধারা নেমে এসে গালের ওপর জমল।

    পরে অনেকক্ষণ সেই শুকিয়ে যাওয়া জলের চড়চড়ে অনুভূতিটাকে নিয়ে, পুষে রেখে দিয়েছিলো সে। না, সে চোখ মোছেনি।

    (১) পূর্বরাগ
    -----------

    ক্লাস ইলেভেনের সায়েন্সের রুমটা একেবারে তেতলায়। ইস্কুল বাড়ির মগডালে। বাঁদিকে টুয়েলভ কমার্স, ডানদিকে টুয়েলভ সায়েন্স। বেশ বড়-সড় রুম। ভেতরে বিশাল বড় ব্ল্যাকবোর্ড। ক্লাসের একদিকে ঢোকার দরজা। উল্টোপিঠের দেয়ালে রুজু রুজু জানালা। সেই জানালা দিয়ে নিচে তাকালে দেখা যায় রাস্তা। স্কুলের দেয়াল আর বাউন্ডারীর পাঁচিলের মধ্যে ফাঁক সামান্যই। মাঝে মধ্যে এই সব উঁচু ক্লাস গুলো থেকে চক, কমলালেবুর খোসা এইসব হাবিজাবি ছোঁড়া হয় নিচের পথচলতি মানুষদের মাথায়। বদলে ফ্রিতে কাঁচা কাঁচা খিস্তি মেলে, পূর্বপুরুষ বা প্রজনন সংক্রান্ত জটিল বিষয় নিয়ে, কখনো সখনো কমপ্লেন। কেউ একবার বায়োলজির কাটা ব্যাঙ ছুঁড়েছিলো, সেই নিয়ে একবার সুরাসুরে সমুদ্র মন্থন হয়ে গেছে।

    স্যার বললেন, আজকে তোদের সরণ আর গতির অঙ্ক করাবো। আগে ফর্মুলা গুলো লিখে নে। ভি ইকোয়ালটু ইউ প্লাস এটি। যেখানে এ হল ত্বরণ। ভি হল
    ...

    কিছুই ভালো লাগছে না। তার মাধ্যমিকে মেকানিক্স অ্যাডিশনাল ছিলো। এই সব তার জানা সিলেবাস। ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে বোর্ডে চকের পিন্ডি চটকানো চলছে। তার চোখ বারে বারে চলে যাচ্ছে বাঁ দিকে মেয়েদের বেঞ্চিগুলোর দিকে।

    এই অ্যাক মফস্বলি কায়দা হয়েছে। ক্লাসের বাঁদিকের বেঞ্চিগুলোয় মেয়েরা বসে। ডানদিকের বেঞ্চিগুলোয় ছেলেরা। এই অলিখিত আইন বোধহয় স্কুলের সেই জন্মকাল থেকে চলে আসছে।

    এই স্কুল খুব পুরোনো আর এই তল্লাটের সবচেয়ে নামকরা। এমনিতে কোএড না। কিন্তু ইলেভেন টুয়েলভ কোএড। ইলেভেনে এতো রাশি রাশি ভর্তির ফর্ম কি পড়ে এমনি এমনি। তবে হ্যাঁ, বহু সফল কৃতী ছাত্রের জন্ম দিয়েছে এই স্কুল। সেদিকে বললে হবে না। টিচাররাও যথেষ্ট নামিদামি।

    আর সেই রকমের রক্ষণশীল। পড়ানোর থেকেও যেন কে কার সঙ্গে একটু কথা বলে নিলো, নোট আদানপ্রদানের ফ্রিকোয়েন্সি মাত্রাতিরিক্ত কিনা, চোখে চোখে (হাহ) কথা বলো, মুখে কিছু বলো না (হায়রে), এই সব পাকড়াও করতে বেশি আগ্রহী।

    সে এখন যাকে দেখার চেষ্টা করছে, সেই মেয়েটি এই তল্লাটেরই। খুব ফর্সা, বড় বড় চোখ, সেই চোখে লুকিয়ে আছে যেন অতল জলের আহ্বান। তার রোগা কণ্ঠার হাড় একদুবার ওঠানামা করলো। মুখ ঘুরিয়ে তাকানো সম্ভব না, ভরসা হল বিশাল ব্ল্যাকবোর্ডের বাঁদিকে মুখটা রেখে চোখটাকে যতখানি বাঁয়ে ফোকাস করা যায়। বেশিক্ষণ এই ভাবে রাখলে চোখ-কপাল টনটন করে, ধরা পড়ে যাবারও সম্ভাবনা। দুদিন আগেই তারা এই নিয়ে ফিজিক্সের স্যারের কাছে প্যাঁক খেয়েছে, ওরে এইভাবে চললে তো চোখের পাওয়ার বেড়ে যাবেরে। ক্লাসসুদ্ধু সবাই ট্যারা হয়ে গেলি কি করে?

    স্যারের কথা শেষ হতে না হতেই বামফ্রন্ট থেকে ভেসে এসেছিলো হুহুহিহি হাসির রোল। যেন সবাই এতক্ষণ চেপে রেখেছিলো, এই কথাতে ড্যাম রিলিজ হয়ে গেলো। অগত্যা তারাও হাসলো, বোকার মত খ্যাক খ্যাক করে। স্যারের হাতেই ল্যাব। দু একজন খুব লাজুক ভাবে মাথা নিচু করে ফেললো। এই গুলো শালা ক্যালানে আতা।

    সে একটু আহত হয়েছিলো, কেননা সে মুহূর্তে সেও তাকিয়েছিলো সেই চোখদুটির দিকে, সেই কালো দিঘির নিথর জলে ছায়া, মুখে কি একটুকরো রোদের আভাস? কে জানে
    ... চোখের ভুল। প্রেমের খেলা কে বুঝিতে পারে, ও বাতাসীরে ...

    স্যারকি বনলতা সেন পড়েননি? ঐযে লাইনটা, পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে
    ...

    নিচের তলা থেকে ঢ্যাং ঢ্যাং উত্তাল বেল বাজার শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে নিচু ক্লাসের ছেলেপিলে দের হট্টগোলে জানান দিলোঃ টিফিন।

    (২) লাভ ইন দা টাইম অফ ...
    ----------------------------------

    সিনেমা মোড়কে লোকজন ঐ নামে ডাকে কেন সে ঠিক বোঝে না। মানে এখনও কেন ডাকে।

    বহু আগে এই মোড়ে ঠিক না, মোড়ের খানিকটা দূরে একটা সিনেমা হল ছিলো। ছিলো মানে যাকে বলে একেবারে পাস্ট পারফেক্ট টেন্স। তবু এই চৌমাথার মোড়ের সেই ত্রেতাযুগের নামটাই চলে আসছে।

    বিকেলের দিকে মোড়ের মাথায় ভিড় যেন উপছে পড়ে। একের পর এক লোকাল বা দূরপাল্লার বা স্টেট বাস গাদাগুচ্ছের লেন্ডি পেন্ডিকে উগরে দিয়ে চলে যায়। বদলে তুলে নেয় আরেক লট। বাদুড়ঝোলা ভিড়ের মধ্যে থেকে কন্ডাক্টার তারস্বরে চেল্লাতে থাকে, 'খালি বাস, খালি বাস,সিট আছে'। হেল্পার গন্তব্য আর মেন মেন স্টপেজের নাম ধরে ধরে রোলকল করে।

    ঘাড়ের ওপরেই নিশ্বাস ফেলছে ভ্যান আর রিকশার লাইন। গলার গালের হাড় বেরোনো শীর্ণ চালকেরা সিটের ওপরে বসে গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খায়। চাকার পেছনে কালো রঙের রবারের মাডগার্ডে দোল খায় বোম্বাইয়ের নায়িকার ছবি। ধুলো কাদাতে মুখ না চেনা গেলেও শরীরী বিভঙ্গের আবেদন প্রাণে পুলক জাগায়।

    রাস্তার পাশেই লম্ফ বা কুপি জ্বালিয়ে বসে খুচরো আনাজ বিক্রেতা, ইটালিয়ান সেলুন, সস্তার মনিহারি দোকান, লে লে বাবু ছ আনা। এক পাশে একটা যাত্রী প্রতীক্ষালয় আছে, সেটা এক রোল চাউমিনের দোকান ব্যক্তিগত ডাইন ইন করে নিয়েছে। সন্ধ্যের পর বুভুক্ষু জনতা সিমেন্টের বেঞ্চিতে যাহোক করে পেছন ঠেকিয়ে লাল রঙে ভরা কুমড়ো দিয়ে বানানো 'টমাটো সস' আর হলদেটে কাসুন্দি মাখিয়ে তেলতেলে হড়হড়ে চাউমিন গোগ্রাসে খায়। গনেশ দালদার হলুদ প্লাস্টিকের কৌটো খোলা থাকে ক্লান্তিহীন রোল ভাজার জন্যে। একটা কম বয়েসী বাচ্চা সারা সন্ধ্যে ময়দা ঠেসে ঠেসে লেচি বানায় রোলের। গা বেয়ে নামা গঙ্গা যমুনার ধারা জুড়োতেই হয়ত মাঝে মধ্যে তাকে বিরতি দিয়ে প্লেট, চামচ এই সব ধুতে পাঠায় দোকানি। দোকান খালি গেলে বাচ্চাটা ঐ সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে পা দোলায়। তখন বাচ্চাটাকে জগতের অন্যতম খুশি মানুষের একজন মনে হয় তার। প্রতীক্ষালয়ের ভেতরে ঝুল কালি পানের পিকে ভর্তি দেয়ালে সাঁটা থাকে পাতলা কাগজে লাল নীল সবুজ গেরুয়া কালিতে ছাপা ব্রিগেডে চলার তামাদি আহ্বান আর তার পাশেই ইউনানি চিকিৎসার হলুদ ছোট্ট বিজ্ঞপ্তি। পাশের শহরের ব্যস্ত সিনেমাহলে সগৌরবে ২য় সপ্তাহে চলা অনিল কাপুরের কোন সিনেমার নাম লেখা পোস্টার। এসবের মাঝখানে বাচ্চা ছেলেটার পা দোলানি দেখতে দেখতে তার কেন জানি সিলেবাসের দোরোখা একাদশী কবিতাটার কথা মনে পড়ে।
    সে এই দোকানের রেগুলার খদ্দের। ছিলো। কদিন আগেও।

    বহুবার ভেবেও সে মাথার মধ্যে মোটা নীল মাছির মত ভোঁ ভোঁ করে ঘোরা এই সব দৃশ্য চিন্তাকে গোবরচাপা দিতে পারে না। শুয়ে শুয়ে এই সবই সে খালি ভাবে। এখন তার হাতে অফুরন্ত সময়।

    তার জন্ডিস হয়েছে। এতদিন কায়দা মেরে 'কেস জন্ডিস' বলার সময় সে জানতো না, কেস আসলে কি। এবারে সে টের পাচ্ছে। একটু দেরিতে ধরা পড়েছে। এক প্রস্থ বমি, জ্বর, তলপেটে ব্যথা নিয়ে সে পাড়ার ডাক্তার বাবুকে দেখাতে আসে। তিনি বিশেষ দেরি না করে তাকে অষ্টপ্রহর নজরে নজরে রাখার জন্য নিজের খালি নার্সিং হোমে ঢুকিয়ে নিয়েছেন। তার রিকভারি প্রগ্রেস নাকি খুব স্লো।

    বাড়ি থেকে এই নার্সিং হোম পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। ডাক্তার বাবুর বাড়িও পাশেই। তবু কেন এখানেই তাকে থাকতে হবে এই উত্তর ডাক্তারবাবু ছাড়া কেউ জানে না। কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ হচ্ছে না, তাকে নার্সিং হোমের খাবারও খেতে হচ্ছে, যেটাতে তার তুমুল আপত্তি। তার বাড়িতে ভালো রান্না হয়। সে সুখাদ্য খেয়ে অভ্যস্ত, সেখানে এই নার্সিং হোমে তাকে প্রায় জেলের খাবারে রাখা হয়েছে। দুপুরে খাবারের পর সে শুয়ে শুয়ে তেতো জিভ নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে। সেইসব চিন্তার মধ্যে সিংহভাগ জুড়ে থাকে চেনা কোনো কালো হরিণ চোখের চাউনি, মুখের ডৌল, থ্রি কোয়ার্টার কামিজের মধ্যে থেকে বেরিয়ে থাকা সরু গোল কবজি, রেনল্ডসের ডটপেন দ্রুত ছোটে খাতায়, শান্তি আর বিদ্যার জন্য আঙ্গুলে বড় মুক্তোর আংটি তিরতির করে কাঁপে। তারও আছে আংটি ঐ রকম একটা।

    আর থাকে খাবারের চিন্তা। মুখরোচক, বাইরের খাবার। আগে রবিবারে সকালে তার বাবা বাজারের নামী দোকান থেকে আনতেন রাধাবল্লভী। এই মোটা মোটা তেল বা দালদা চপচপে রাধাবল্লভীতে কামড় মারলেই হিং আর ডালের সুবাস মাখা ভাপ ওঠে, জিভের মধ্যে একশো আহ্লাদে উথলে ওঠে নোলার জল। প্যাকেটের তলায় একটা ছোট্ট প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে আলুর দম। গায়ে মাখা মাখা। কোন কোন দিন এর সঙ্গে থাকে টাটকা ভাজা জিলিপি। সেই সব দিনগুলো তার যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি বলে মনে হয়।

    কোন কোন দিন বিকেলে সে নিজেই টিউশনি সেরে ফেরার পথে সিনেমামোড়ের চপ-ঘুঘনির গলিতে ঢুকত। কয়েকটা দোকান সেরেফ এই সব বেচেই লাখপতি। সব যেন একেকটি আদর্শ হিন্দু হোটেলের হাজারি ঠাকুর।

    চপের দোকানে গনগনে উনুনে বিশাল কড়া আর সেই কড়াতে প্রায় জাতীয় কংগ্রেসের সমসাময়িক সরষের তেল টগবগ করে ফুটছে। এদের একটা নিবেদন প্রথা আছে, সে জানে। দোকানে এসে দোকানি সবার আগে উনুন ধরায়। আঁচ বুঝে তারপর চাপায় তেলের কড়া। সেটা দোকানেই বসানো থাকে মস্ত অ্যালুমিনিয়ামের ঢাকনা দিয়ে। দোকানি বাড়ি থেকে নিয়ে আসে আলুর পুর, মোচার পুর, সেদ্ধ ডিম। তেল গরম হতে হতে সে বেসন গুলতে শুরু করে মস্ত গামলায়। এই ধাপে এসে বড্ড সময় লাগে। কিন্তু কেন জানি তার এই প্রতীক্ষার সময় বিরক্তি আসে না। সে একমনে দেখতে থাকে চপ দোকানির নিষ্ঠা, তার নির্দিষ্ট সময় ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেসন ফেটিয়ে যাওয়া।

    তারপর সব রেডি হলে প্রথম চপটি বানিয়ে দোকানি আঁচের মধ্যে গুঁজে অগ্নিকে নিবেদন করে।

    এই নিবেদনের ফান্ডাটা সে কাজে লাগিয়েছিল।

    সে যে কেমিস্ট্রির টিচারের কাছে টিউশনি পড়ে, মেয়েটিও সেখানে ঢুকেছে। স্যারের নির্দেশে মেয়েটি তারই খাতা থেকে পুরোনো নোটস টুকে নেয় এবং কেমিস্ট্রি টিচারের ঐ তোতাপাখির মত হোটেলের মেনু আউড়ে যাবার স্পীডে নোটস দেবার সময়েও হাতের লেখা এতটা নীট দেখে অস্ফুটে বিস্ময় প্রকাশ করে। জনান্তিকে।

    সেটাই সে একটা মস্ত কমপ্লিমেন্ট হিসেবে নিয়েছে। এবং তারপর থেকে টিউশনি পড়তে গেলে মনে মনে নোটগুলি মেয়েটিকে নিবেদন করে, স্বপ্ন দেখে সে একে একে বাকি টিউশনির জায়গাতেও আসবে। আর সে তার হাতে তুলে দেবে সযত্নে লিখে রাখা এই সব নোটস। সে হয়ত অবাক চোখে এই সব দেখে বলবে
    ....

    মাঝে মাঝে নিজেকে অপু আর গান্ডুর মধ্যে বেছে নিতে বড় দ্বিধা হয় তার।

    টিউশনি গুলো এগিয়ে যাচ্ছে, সে পিছিয়ে পড়ছে, ক্লাস যেখানে ছিলো সেখানেই আছে। অন্তর্জলী যাত্রা করা বুড়োর মাথার পাশে বসে থাকা শকুনের মত জয়েন্ট নামের একটা কালো ছায়া সে মাঝে মধ্যে অনুভব করে নিজের মাথার মধ্যে। কয়েকটা বই সে এনেছে, কিন্তু মোটা মোটা বইতে কিলবিলে থিওরি আর গুপ্তধনের ম্যাপের মত সাংকেতিক অঙ্ক করতে একদম উৎসাহ পাচ্ছে না।
    তার মনটা একটু খারাপ।

    কিছুদিন হল তার বন্ধু ফিরে এসেছে। না, মেলায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধু না। সেই নার্সারিতে শুরু, হাফ আর ফুলপ্যান্টের আমলে জোর থেকে জোরদার হওয়া বন্ধুত্ব। তারই সহপাঠী। মাধ্যমিকের পর বাইরে পড়তে গেছলো, মন টেঁকাতে আর ধুতি পরতে পারে নি (বন্ধু উবাচঃ 'লোজ্জা করে'। টাইপো না)। ফিরে এসেছে। সেও ভালো স্টুডেন্ট, এই স্কুলেরই ছাত্র। স্কুল মিড সেশনে লুফে নিয়েছে।

    সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু এই অসুস্থ হবার কিছুদিন আগে বন্ধুর হাবভাব দেখে আর কথাবার্তা শুনে তার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেছলো।

    গতিক সুবিধের না। হেই মা কালী দেখিস মা
    ...

    দেবদেবীদের নজরানা, শুকরানা ইত্যাদি নানারকম ঘুষ দেবার ফন্দিফিকির করে সে। একবার সুস্থ হয়ে বেরোলে হয়। ঐ রবিবারের দুপুরের মূক ও বধিরদের সংবাদ পাঠের মত হাবে ভাবে না, একেবারে ব্রিফ অ্যান্ড টু দি পয়েন্টে বলে দেবে
    ...

    একটা অস্থির উত্তেজনা যেন চ্যাটচেটে মাকড়শার জালের মত তাকে আটকে ফেলছে
    ...

    সামনের দেওয়ালে মর্চে ধরা পেরেকে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে রামকৃষ্ণ তাঁর উদাত্ত হাসি নিয়ে চেয়ে থাকেন আবেগের চুড়োতে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বসে থাকা এই তরুণটির দিকে।

    (৩) PG-13 অথবা  U/A এপিসোড
    -----------------------------------

    Rated PG-13 for language, sexuality and drug content

    - তুই আর নিস না।
    -
    ... (সে কাঁধ ঝাঁকায়)
    - এটাই লাস্‌স্‌ট কিন্তু!
    - শুয়োরের বাচ্চা! আর আনিসনি?
    - না বে ***। খিস্তি দিলি যে **!! তোর বাপের খাই না পরি? কাল থেকে নতুন *** খুঁজে নিবি! ইয়েতে
    ...

    তাদের এই অপ্রত্যাশিত গলাবাজিতে, একটু দূরে, সামনে ঝোপের পাশে বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে বসে থাকা কাপল একটু নড়ে চড়ে বসলো। অল্প বয়েসী মেয়েটি নিপুণ হাতে তার স্খলিত ওড়না ঠিক করে পরে নেয়। ঝামেলা খুব সংক্রামক জিনিস। সঙ্গী ছেলেটি এতক্ষণ অন্য এক জগতে ছিলো যেন। ধড়াম করে এই স্বেদ ও চেল্লানিতে ভরা প্রেমহীন কর্কশ পৃথিবীতে অবতরণ করে সে যেন একটু হতভম্ব ও শংকিত হয়ে পড়ে। যে প্রয়োজনে এসেছে তা মোটামুটি মিটে যাওয়াতে আর বেশিক্ষণ সঙ্গিনীর নেকু মৌখিক আবদারের ঘামাচিতে তার স্পর্শজনিত আদরের নাইসিল বোলাতে রাজি না সে। মেয়েটি ছাড়বে কেন?

    কিছু কথা কাটাকাটি হল বোধহয় নিজেদের মধ্যে। তারপর আগে ছেলেটি এবং পিছু পিছু মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। ছেলেটি দৃশ্যতঃই যঃ পলায়তি স জীবতি মোডে স্যুইচ করে গেছে। ঠিক তখনই তার বন্ধু একটা কুৎসিত হাসি হেসে অত্যন্ত আপত্তিজনক কিছু একটা মন্তব্য করে বসলো।

    চলে যাবার আগে মেয়েটি হঠাৎ তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে কিছু একটা বলে থুঃ করে একদলা থুতু ফেলেছিলো সামনের ঘাসে।

    সন্ধ্যেবেলার ঝুঁঝকো আঁধার ব্লটিং পেপারের মত সেই ঘৃণার উষ্ণ ক্লেদটুকু চেটেপুটে নিঃশেষ করে নিয়েছিলো নিজের মধ্যে, লেশটুকুও রাখেনি দৃষ্টিগোচরে; কিন্তু ইথারের মত অশরীরী ভাবে ছোঁড়া অবজ্ঞাটুকু সপাটে তাকে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে যায়।

    তার সঙ্গের ছেলেটিকে হাত ধরে টেনে না থামালে একটা নোংরা বাওয়ালি শুরু হয়ে যেত সে জানে। গাঁজার ধুমকিতে আরক্ত ঘোলাটে নজরে মেয়েটির চলে যাওয়া দেখতে দেখতে সে প্রথমে নিজেকে নিয়ে হাসতে শুরু করে, হাসির দমকে ফুলে ফুলে উঠেছিলো সে, তারপরে সেটা কাশিতে পরিণত হয়। শুকিয়ে কাঠ বুকে গলায় কাশির দমকের প্রতিধ্বনি নিজের প্রতিটা রক্তকণিকায় শুনতে পাচ্ছিলো সে।

    স্থানঃ গড়। কালঃ সন্ধ্যের চৌকাঠ ডিঙিয়ে রাত্তিরের দিকে। পাত্রঃ সে আর একজন। একা এবং কয়েকজন।

    সিনেমা মোড় থেকে যে পিচের রাস্তাটা একটু দক্ষিণমুখী হয়ে বেরিয়ে গেছে তার দুপাশে ঘড়ি সারাই ও বিক্রির দোকান, আলু-মুলোর মেক-শিফট সবজি মান্ডি, অষ্টপ্রহর রেডিও বাজানো একটা সেলুন, আলকাতরায় স্নান করা একটা পানগুমটি, পেপার-ম্যাগাজিনের দোকান যারা সিজন মাফিক রাখি ও রাখে, গ্রীটিংস কার্ড ও রাখে আবার বিশেষ সুরে 'আছে না-কি?' বলতে পারলে হলুদ রঙের মলাটে চটি বই ও যোগান দেয়। তার কাছে কোথায় লাগে সচিত্র সহস্র এক আরব্য রজনীর গল্প!
    সেই রাস্তা গিয়ে মিশেছে ওদিকে গার্লস হাইস্কুলের দিক থেকে আসা মোরাম বিছানো রাস্তার সঙ্গে।

    ধৌলিগঙ্গা আর অলকানন্দার প্রয়াগের মত দুটি রাস্তার সংযোগস্থল পুণ্যভূমি হয়ে আছে একটি জুতোর দোকানে। না, রসিকতা না। স্থানীয় দু একটি কলেজের অধ্যাপকরা, (দুর্জনে বলে, যাঁদের সেরকম টিউশনি জোটেনি) সন্ধ্যের ঝোঁকে এই জুতো দোকানে মিলিত হয়ে রাজা-উজির, অভাবে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস মারেন। লোকে আদর করে এই আঁতেল ঠেকটিকে 'শু-ইউনিভারসিটি' বলে ডাকে। তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলে রাস্তাটা একটা 'হ' এর মতো বাঁক নিয়ে এগিয়ে গেছে আঞ্চলিক কলেজ ও তাদের স্কুলের দিকে। এই রাস্তার বাঁ দিকে একটা মস্ত পরিখা কাটা আছে। সেটা পেরোলেই 'গড়' এর মস্তবড় স্বতন্ত্র ভূখন্ড।

    গড় অর্থে পূর্বেকার সামন্ত রাজাদের রাজবাড়ি ও তৎসংলগ্ন এলাকা। সেই রাজাদের রবরবা আর কিছুই এখন নেই, ক্ষত্রিয় যুগ পেরিয়ে বৈশ্যদের এখন বোলবোলাও। তবুও মরা হাতি লাখটাকা।
    তাদের স্কুলের ঠিক সামনে দিয়ে একটা ছোট ব্রিজ পেরিয়ে এই গড়ে ঢোকার মস্ত বড় ফটক। কাঠ আর লোহার সুপ্রাচীন ঔরসজাত এই ফটকের নিচে একটা ছোট দরজাও আছে। কখনো ফটক বন্ধ থাকলেও ঐ দরজা খুলে রাখা হয়। গরু, ছাগল, সাইকেল-সওয়ারি সবই গলে যায়।

    দুপাশে মস্ত মস্ত পাম গাছের সারি নিয়ে ভেতরের রাস্তাটা এগিয়ে গেছে বাহিরমহলের দিকে। বাহিরমহল অর্থাৎ কিনা সার্ভেন্টস কোয়ার্টার।

    বাহির মহল আগে থেকেই ম্যাড়ম্যাড়ে ছিলো, এখন তার জেল্লা আরো উবে গেছে, বাজারের একটা চালু মিষ্টির দোকান একটা বড় রুম নিয়ে তাদের রসুইঘর বানিয়েছে। অনেক বিকেলে সে আর তার বন্ধুরা এই রসুইঘরে এসে ঠাকুরের সঙ্গে সাঁট করে সদ্য ভাজা সিঙ্গাড়া কিনেছে ভেতরে রাজাদের দীঘির পাশে ভাঙ্গা পাড়ে আয়েশ করে বসে মারা আড্ডার রসদ হিসেবে। এই জায়গাটা পেরোনোর সময় রসুইঘর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসে ছানার টোকো গন্ধ বা চিনির রসে পাক দেবার মিষ্টি গা গোলানো সুবাস।

    ভেতরে দুপাশে দুই সিংহের পাথুরে মূর্তি থাপুস আরামে বসে আছে অনন্তকাল। ছোটবেলায় সে এদের পিঠে চেপে হেই হ্যাট হ্যাট করতো। দুই সিংহের মাঝখানে প্রায় কুড়িফুটের বিস্তার নিয়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে পুরনো রাজবাড়ির মহার্ঘ্য শ্বেতপাথরে মোড়া সিঁড়ি। মূল দালানও মোড়া ঠান্ডা নিস্পৃহ এই ধবল অহংকারে। দালানের দুই ধারে অনেকগুলো গম্ভীর থাম বহু উঁচুতে উঠে গিয়ে মিশেছে খিলান আর কড়িবরগার জ্যামিতিতে। সিংহের পিঠ থেকে নেমে এক দৌড়ে এই দালানে উঠে এসে সে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতো এই সব থামগুলো। ছোট্ট দুই হাতে সে যেন অনুভব করতে চাইতো এই সব খাঁজকাটা থামগুলোর বিস্তার, ঘাড় উঁচু করে ওপরের কড়ি বরগা দেখতে দেখতে সে একপা একপা করে হেঁটে যেত দালানের হিমশীতল স্পর্শ পায়ে মাখতে মাখতে।

    কদিন আগেও সিগারেটের ছাই ফেলে তাতে গাঁজা পাতা ঠাসতে ঠাসতে এই সব আগেকার কথা গুলো তার মনে কোলাজের মত ভিড় করে আসছিলো।

    জীবনের রিওয়াইন্ড বাটনটা যদি কেউ টিপতো পারতো!

    যো জিতা ওহি সিকন্দর।

    পরের দিনে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, ডাক্তার বাবু সেই আশ্বাস দিয়েছিলেন, পরের কদিনের ওষুধ আর পথ্য নিয়ে একপ্রস্থ কচকচানির পর। সেই ঝলমলে রোদের বিকেলে কখন একটুকরো মেঘ এসে ভাসছে সে টেরও পায়নি।

    বন্ধু দরজায় পা দিয়ে মুঠো করা হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে যখন প্রথম কথা বলেছিলো, 'ইয়েস্‌স্‌স', সে একটা হার্টবিট স্কিপ করে।

    'লাভ' দিয়ে শুরু এই খেলায় সে আগে স্কোর করতে শুরু করলেও তার বন্ধু ফিরে আসার পর তারা মোটামুটি 'ডিউস' অবস্থানেই ছিলো বেশ কিছু দিন। তারপরেই তার 'কেস জন্ডিস' হয়ে যায়।

    এই অনুপস্থিতির কদিনের ক্রমাগত তোতাই-পাতাই, একসঙ্গে টিউশনি থেকে ফেরা, ভালো ছাত্র হিসেবে মেয়েটির বাড়িতে খাতির ইত্যাদি মিলিয়ে তার বন্ধু 'অ্যাডভ্যান্টেজ' ডিক্লেয়ার্ড ছিলো। বন্ধুর বাবা টিচার, মেয়েটি তাঁর কাছে টিউশনি পড়তে আসে। ঐদিনের দুপুরে ঘটনা মোড় নেয়। মেয়েটি কোনকারণে বাড়ি থেকে খোঁটা খেয়ে বা ঐ রকম কোন কারণে ছলছলে চোখে নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই পড়তে চলে আসে। বন্ধুর বাবা সেদিন একটু বাইরে ছিলেন। বন্ধু এই সব দিনে নাওয়া খাওয়া ভুলে রোদ পোহানো কুমীরের মত আপাত নির্লিপ্ত ভাবে আড়চোখে জানালা দিয়ে চেয়ে বসে থাকত। সেদিনের ড্যামজেল ইন ডিসট্রেসকে দেখে তার ধ্যানভঙ্গ হয়, সে তাকে নিজের ঘরে এনে সবকথা মন দিয়ে শোনে, নানাবিধ লোকসভা এবং বিধানসভা সুলভ আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দেয়, নিজের ভবিষ্যতের উজ্জ্বল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শোনায়, এবং উপছে পড়া চোখের জল আঙ্গুল দিয়ে মুছিয়ে দেবার সময় মূলাধার চক্রের তীব্র তাড়নায় চকাম করে মেয়েটিকে একটা চুমু খেয়ে বসে।

    তার বন্ধুর একটু তোতলামি আছে। উত্তেজিত হলে সেটা বেড়ে যায়। দুহাতেই বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মধ্যমা, অনামিকা আর কনিষ্ঠার বিভাজিকা ঘষতে ঘষতে সে হড়বড় করে বলতে থাকে তার কথা। স্বাভাবিক সংস্কারের বশবর্তী হয়ে একটু ছিটকে গেলেও মেয়েটি নাকি তার গাল থেকে পিপারমিন্টের স্বাদ হাতের চেটো দিয়ে মুছে নেয় এবং নিজের জন্য একটা লজেন্সের ভাগ দাবি করে।

    বিরিঞ্চিবাবা পড়ে থাকার কারণে 'যাঃ' বললে তার ইন্টারপ্রিটেশন কি করতে হয় বন্ধু জানত, কিন্তু এই 'আউট-অফ-বক্স' লজেন্সের ভাগ চাওয়াতে সে এক লাফে সপ্তম স্বর্গে আরোহণ করে, তার পিঠ থেকে উদ্ভূত কাল্পনিক ডানার তলায় সে বাতাস পায়।
    তার বাবা ফিরে আসার কারণে মেয়েটির টিউশনি শুরু হয় আর সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সবার আগে জিগরি দোস্তকে এই খবর জানিয়ে একটু হালকা হতে আসে।

    গেম 'বন্ধু'।

    তার সুস্থ হয়ে ওঠা কয়েকদিন পিছিয়ে যায়। সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আসার পর সে নিজেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিতে থাকে সবকিছু থেকে, নিজের মধ্যে গুম হয়ে যেতে থাকে, কোন এক বিকেলে রেলপাড়ের পাশে খুঁজে পায় গাঁজার এক ঠেক এবং সবকিছু, বিশেষকরে নিজেকে হারিয়ে দেবার দুর্দম ইচ্ছেতে আস্তে আস্তে গড়, রেলপাড়ের ঠেকের নিয়মিত হাজিরা ছাড়া আর কোনরকম ব্যাপারে আগ্রহ হারাতে থাকে।

    পরবর্তী জীবনে এই অন্ধকার দিনগুলোর শিক্ষা তার অনেক কাজে লেগেছিলো। সেটা সে পরে অনুভব করে। কিন্তু ততদূর যাবার অনেক আগেই, মাত্র একবছর পরে সে টের পায়,
    ১ এই গানটা স্রেফ তার জন্যই লেখা হয়েছিলোঃ

    'যে আমার নতুন খেলার জন/ তারি এই খেলার সিংহাসন
    ভাঙারে জোড়া দেবে সে/ কিসের মন্তরে
    ...
    খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি
    আমার মনের ভিতরে
    ..'

    এবং
    ...
    ২ রোলার কোস্টার রাইডের সবেমাত্র প্রথম লুপটা সে নেমেছে
    ...

    (৪) স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার ... অ্যান্ড স্প্রিং
    --------------------------------------------

    স্প্রিং
    ****

    সিনেমা মোড়ের সেই 'ছাত্রবন্ধু' বইএর দোকানটা থেকে তারা একটা হলুদ চটি তুলে এনেছে। দোকানি তাদেরকে প্রথমটা খুব একটা পাত্তা দিতে ন চাইলেও পরে যখন কনভিন্স হয় যে এরা লাইনেরই লোক, নতুন খদ্দের, একটু কিন্তু কিন্তু করে তাদেরকে একটা চটি দিয়েছে। 'ভালো?' এই প্রশ্নের জবাবে সে (দোকানি) একটু হাসে।

    কদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি নুন-গোলমরিচের মত ছড়ানো আছে তার মুখময়। কালচে খয়েরী ঠোঁটের ফাঁকে ময়লাটে দাঁত উঁকি মেরে যায়, কেমন রহস্যময় ঠেকে তার হাসি। সে বলে, 'বাবু, ময়রা মিষ্টি খায় না। তোমরা চাও, তাই আমি রাখি। এসব সখ আমাদের জন্য না গো।'

    পরে একটা কুচো বাচ্চা নটরাজের পেন্সিল রাবার কিনতে এলে তাকে নিয়ে দোকানি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের দাম মেটানো হয়ে গেছলো, তারা সাইকেলে স্পীড তোলে।

    গড়ের ভেতরে নতুন আর পুরনো দুটো রাজবাড়ি আছে। সামনে সিংহ নিয়ে পুরোনো রাজবাড়ি। সেটা থেকে রাস্তাটা ডানদিকে বেঁকে গেছে। সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে পুরনো রাজবাড়ির বিস্তার বোঝা যায়।

    একটু এগোলে রাস্তাটা দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে। ডানপাশে রাজাদের গোপাল-রাধার মন্দির। লোকে বলে গোপালজীর মন্দির। তার পাশ দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে নতুন রাজবাড়ির দিকে।

    বাঁ দিকে গেলে রাজদীঘি আর মস্ত বড় মাঠ। ওদিকটা বড় নির্জন আর খোলামেলা। তারা নতুন রাজবাড়ির দিকেই এগিয়ে গেলো।

    সে পথে ডানদিকে একটা মস্ত বড় ঢিবি। কেউ বলে ওর ওপরে কামান রেখে দাগা হত, কেউ বলে ওর তলায় অনেক মানুষ পোঁতা আছে। মানুষ রহস্য বড় ভালোবাসে। নিজে নিজে তৈরি করে নেয় মিথ, গল্প, উপকথা। নতুন প্রজন্ম সেই সব গল্প খুব মন দিয়ে, গালে হাত রেখে শোনে, অবচেতনে তাতে মেশায় নিজের পছন্দের রঙ। এই ভাবেই চলে নির্মাণখেলা।

    ঢিবির উল্টোদিকে সারি সারি গাছ বেশ প্যাটার্ন মনে লাগানো আছে। তাদের নিচু নিচু ডাল, বাঁকানো গুঁড়ি, এই সব অল্পবয়েসী স্থানীয় ভাটুরেদের রোয়াকের কাজ করে। এর মধ্যে আছে এঁচড়ে পাকা স্কুলের ছাত্র থেকে কলেজের রাজনৈতিক দাদা, বেকার হতাশ যুবক থেকে মধ্যবয়েসী ধান্দাবাজ উটকো লোক।

    এই জায়গাটা তাদের বেশ পছন্দের, কোন দিন এখানটা বেদখল দেখলে তাদের মটকা গরম হয়ে যায়। আজকে মাঠ ফাঁকা, তারা এমনিতেই উত্তেজিত, এবারে একটু খুশিয়াল হয়ে ওঠে।

    সবাই মিলে চাঁদা করে বই কেনা হয়েছে, কিন্তু কেউ একা পড়বে তা তো হয় না। ঠিক হয়েছে কেউ একজন পাঠ করে শোনাবে, বাকিরা জায়গা মতো ফুট কাটবে। পাঠের দায়িত্ব সে নিজে থেকেই নেয়।

    একেবারেই বিশেষত্ব হীন সেই বই। এবিটিএ-র টেস্ট পেপারের মত বাজে রদ্দি কাগজে ছাপা। মলাটে কোন নাম নেই। খুলতে প্রথম পাতাতে নাম লেখা 'মধুর মিলন'। নিচে লেখক রসিকলাল বা ঐ রকম কিছু, আর কি একটা আলফাল প্রেসের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি।

    বেশি ভনিতা না করে পরের পাতা থেকেই গল্প। প্রচুর চেনা অচেনা টার্ম, স্ল্যাং, মাখো মাখো বিবরণ। একেকটা লাইন পড়ে আর জনগণ খোরাক শুরু করে।

    প্রথম গল্পটি বেশ দ্রুত শেষ হয়ে যায়। সবাই বেশ জমিয়ে বসে, কাছ্‌ক্‌ক্‌কাছি এগিয়ে আসে। কার্টেন রেইজারেই চমকে দিয়েছো মামা, পরে তাহলে কি আছে!

    পরের গল্পটিও সে পড়তে শুরু করে।

    শুরু করেই তার কেমন একটা খটকা লাগে। তবুও সে পড়ে যায়। পড়তে পড়তে সে সঙ্গীদের দিকে তাকায়। তারা উশখুশ করে। একজন আর অসোয়াস্তি চাপতে না পেরে বলেই দেয়, 'আগের গল্পটাই পড়ছিস নাকি **? ছেলে *** জানে, পাতা উল্টোতে জানে না।'

    বাকিরা খুকখুক হাসে। সে বক্তার বিশেষ অঙ্গে লাথি মারার একটা ভঙ্গি করে। বইটা খুলে তাদের সামনে ধরে, '**-র ভাই, এটা কোন পাতা? শেখাতে এসেছেন *** ঠাকুর!'

    সেই আগের গল্পটাই ছাপা হয়েছে। যাহ্‌ শালা!! সে পাতা উল্টোয়। আবারও উল্টোয়। তারপর উল্টেই যায়।

    বিস্মিত সবার সামনে সে নিজেও একটা অবিশ্বাস আর উত্তেজনা নিয়ে দেখে কোন ছাপাখানার ভূত না, কোন প্রিন্টিং মিসটেক না, ঐ একটা গল্পই মোট ছবার ছাপা হয়েছে।

    তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এ ওর দিকে তাকায়। একটা দমবন্ধ করা সাসপেন্স তাদের মধ্যে।

    তারপর প্রচন্ড জোরে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ে তারা। এ ওর গায়ে পড়ে যায়, সবাই সবাইকে জাপটে ধরে হাসে। তাদের হাসিতে একটু দূরে একটা চড়াই আর তার গিন্নি আরো দূরে লাফিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যায়।
    মাঝে মাঝে 'মুর্গি বনে গিয়েও' মানুষের ছানার এই সব অর্থহীন হাহা হিহি তাদের প্রতিদিনের খুঁটে খুঁটে খেয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নিয়োজিত, নিমজ্জিত বোধগম্যতার বাইরে।

    সামার
    ****

    বালির ওপর দিয়ে হাঁটছে ওরা চারজন। চুপচাপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। পায়ে স্যান্ডালের মধ্যে বালি ঢুকে কিচকিচ করছে। নরম অনভ্যস্ত পায়ে, আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে সব জায়গায় বালি ঘষা খাচ্ছে নির্মম জুতোর দেওয়ালে, নুনছাল উঠে গিয়ে সবারই পায়ের পাতা অল্পবিস্তর জ্বলছে। তবুও যেন এক ঘোরের মধ্যে দিয়ে ওরা হাঁটছিলো।

    বাঁদিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে ডেকে আগুপিছু করছে কুমিরডাঙ্গা খেলতে চাওয়া সমুদ্র। ডানদিকে বেশ অনেকটা দূরে এগোলে বালিজমি আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে টিলার আকার নিয়েছে, তারও ওপাশে সবুজের আভাস। কোন বন টন হবে। সমুদ্রের তীরবর্তী মোটামুটি নামকরা এই ছোট অঞ্চলটিতে বেড়াতে এসেছে ওরা।

    যেখানটায় সবাই জলে নেবে হুটোপুটি করছে সে জায়গাটা বড্ড নোংরা। রাস্তা বালিয়াড়ির টিলার ওপরে, বেশ একটু দূর আছে, সেখান থেকে সাগরের সফেন শীতল সীমানাটুকু পেতে গেলে বোল্ডার, মানুষ বা অন্য প্রানীর বিষ্ঠা, জঞ্জাল, পচা কাঠ, মরা মাছ, সামুদ্রিক প্রাণীর খোলা, শাঁখের টুকরো, স্নানে নামা আমোদগেঁড়ে পাবলিকের চটি, ডাবদোকানি, নুলিয়া, 'রামতেরি গঙ্গা মৈলি' স্টাইলে সিক্তবসন/বসনা টুরিস্টের ছবি তুলে দেবার ফোটোগ্রাফার এই সব হাজার একটা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আসতে হয়। তারা এই সব থেকে দূরে যেতে চায়।

    তাই তারা সাগরের সীমানা ধরে ক্রমাগত হেঁটে চলেছে। প্রথমটা একটু একা-বোকা লাগছিলো, তাই নিজেদের মধ্যে হুটোপাটি করে তারা ভরিয়ে রাখছিলো তাদের শহুরে কানে তালা লেগে যাওয়া এই নীরবতা।
    প্রথমটায় সবাই নানান আকৃতির শামুক-ঝিনুক বা আরো নির্দিষ্ট করে বললে সেসবের ভাঙা-আধভাঙা খোলা কুড়োচ্ছিলো। কে হঠাৎ করে একটা হলুদ ছিটছিটে ফুটকি ওয়ালা আস্ত ঝিনুক পেয়ে গেলো, বাকিরা একটু হতাশ, সবাই ইউনিক কিছু পেতে চায়, সে একটু খোঁজাখুজি করে পেয়ে গেলো একটা বেশ বড়ো প্যাঁচলাগানো শাঁখ। বেশ হালকা কমলা তার রঙ। সবাই একবার করে কানে নিয়ে শুনতে চায় তার গর্ভে চিরদিনের মত প্রতিধ্বনিত হয়ে যাওয়া সমুদ্রের গর্জনের শব্দ। এক বন্ধু বললো, 'অ্যাই এটা কিন্তু দক্ষিণমুখী না।'
    - 'তাই নাকি, সেটা আবার কি জিনিস'?
    - 'আরে সেই যে গল্প ছিলো না, লীলা মজুমদারের, গুপির মেশোমশায়ের দক্ষিণমুখী শাঁখ, ডাকাতি আটকে দিয়েছিলো'।

    এই ভাবে কথার পিঠে কথা এসে বসে। চলতে থাকে আড্ডা। মাঝে মধ্যে দু এককলি গান। তার গলায়। সে গান ভালো গায়।

    আকাশে মেঘে রোদে ঠেলাঠেলি চলেছে। সেই ছায়া পড়ে ঘোলাটে নীল গম্ভীর সমুদ্রের ওপর। তখন কেমন একটা বিষণ্নতা ভেসে আসে। বহুদূরে জলের ওপরে একটা বয়া ভাসছে। তার কালো শরীর যেন হাবুডুবু খাওয়া কোন সামুদ্রিক দানবের মাথা বলে মনে হয়।

    তৃতীয়জন বললো, 'চল একটু বসে যাই'।

    একটু দূরে একটা মস্ত বড় কাঠের গুঁড়ি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বালির মধ্যে। সেইটেতে তিনজন বসলো। ভাঁটার টান শুরু হয়েছে, জলের সীমানা যেন একটু পিছিয়ে গেছে। সে নিজের জুতোটা খুলে ভেজা বালির ওপরে রেখে তার ওপরে বসলো।

    সামনে বেশ অনেকটা ছড়ানো যায়গায় একটা অদ্ভুত দৃশ্য। জমি এখানে অজস্র ছোটবড় গর্তে ভর্তি। সেই সব গর্তের চারিদিকে একচিলতে করে বালি আর মাটির বেড়। সমস্ত জমিটাকে যেন ব্রেইলে লেখা একটা মস্তবড় বইয়ের পাতা মনে হবে অনেক ওপর থেকে দেখলে।

    আর সেই সব গর্ত দিয়ে পিলপিল করে আনাগোনা করছে অজস্র লাল রঙের ছোট ছোট কাঁকড়া। তারা একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সেই দিকে।

    অনেক পরে সে আস্তে আস্তে গান ধরেছিলো, 'আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে/ তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণ গগন তলে'।

    তার বন্ধুরা চেয়ে থাকে দূরে সমুদ্রের অতল জলের দিকে। সে তাদের চোখ এড়িয়ে আনমনে হাতের শাঁখের কোণা দিয়ে ভেজা বালিতে একটা খুব চেনা নাম লিখতে থাকে আস্তে আস্তে। একবার লেখা হয়ে গেলে সে খুব মমতা ভরে প্রতিটি অক্ষরে, প্রতিটি টানে, প্রতিটি সরল বা বক্র রেখায় বুলিয়ে দেয় তার আঙ্গুল। নখের ফাঁক থেকে ঝরে ঝরে পড়ে আধভেজা বালির রেণু।

    গান শেষ হবার পরেও তার রেশ ফুরোয় না। শুধু একটু দূরে ঝাউ বা অন্য কোন গাছের বনে শনশনে বাতাস বয়। সমুদ্রের ঢেউ মাথায় করে বয়ে আনা ফেনা রেখে যায় পাড়ে। একসময় একটা ঢেউ একটু বেশিই এগিয়ে এসে ধুয়ে নিয়ে যায় তার লেখা নাম। বাকিটুকু সে হাত দিয়ে মুছে দেয়।

    অনেকক্ষণ বসা হয়েছে, উঠে দাঁড়িয়ে সে প্রস্তাব দিলো, সবাই মিলে আগ্রাসী ঢেউ এর ওপর দিয়ে দৌড়ানোর। বেশ মজা! সবাই রাজি। জল ছপছপিয়ে তারা তারা ছুটছে, পায়ের তলা থেকে সরে সরে যাচ্ছে বালি, পায়ের লোমে জড়িয়ে যাচ্ছে সাদা ফেনা, কেমন একটা কিরকিরে ভালোলাগার অনুভূতি।

    একটুও না হাঁপিয়ে তারা অনেকটা দৌড়ে গেলো। তারপর একজন বুদ্ধি দিলো ব্যাপারটাকে আরো মজার করে তোলার জন্য।

    এখন চারটে ছেলে জলের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে, পরনের অন্তর্বাসটুকু ছাড়া তারা বাকি সব জামা কাপড় খুলে রেখে দিয়েছে পাড়ের কাছে। উদোম খালি গায়ে চুমু খেয়ে যাচ্ছে সতেজ নোনা হাওয়া আর তাতে মিশে থাকা আর্দ্রতা। কাপড় ভিজে যাবার পিছুটানটুকু না থাকায় তারা অনেকবেশি সাবলীল, ঘোড়ার মতই ক্ষিপ্র, পরোয়াহীন। এইভাবেই ছুটতে ছুটতে তারা হয়তো পার হয়ে যাবে তাদের সব ভুলতে চাওয়া ক্ষতমুখ, বিষণ্নতা, জমে থাকা সব তুচ্ছতা।

    আপাতত তারা দৌড়েই চলেছে, সব কিছু ভুলে। আর ভাঁটার টানে ভেতরের দিকে সরে যাওয়া সমুদ্র তাদের জন্য যেন একটু একটু করে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে।

    ফল
    ***

    মশারির বাইরে থেকেই মার হাঁকডাকে আর হাতের ঠেলা খেয়ে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

    বাইরে এখনো অন্ধকার। পাখিটাখি কেউই খুব একটা হল্লাগুল্লা জুড়ে দেয়নি এখনো। এতো সকালে ঘুম থেকে ওঠা তার কস্মিন কালের অভ্যেস নয়। তবু আজকে উঠতে হবে, বা বলা ভালো সে উঠবে।

    আজকে মহালয়া। প্রতি বছর রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী শুনে তাদের পরিবারের এই দিনটি শুরু হয়। কোনো ব্যতিক্রম নেই।

    চোখে এখনো গঁদের আঠার মত ঘুম লেপটে আছে, বাঁ হাত দিয়ে পিচুটি ছাড়াতে ছাড়াতে সে পাশের ঘর থেকে সন্তোষের মাঝারি সাইজের রেডিওটা নিয়ে এলো। লাল কাঁটা কততে আছে দেখতে গেলে আবার টিউবলাইট জ্বালাতে হয়, তার চেয়ে অন্ধের মত চাকা ঘুরিয়ে গেলেই হয়, একসময় না এক সময় স্টেশন আসবেই।

    মায়ের আর তর সয় না, তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিয়েই রেডিও সেট করেন, একটু পরে ঘর গমগমিয়ে ওঠে, ইয়া চণ্ডী, মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনি
    ... র গায়ে কাঁটা দেওয়া স্তোত্রপাঠে।

    ঈষৎ বুড়োটে সেই চেনা গলাটা যখন অমোঘভাবে 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির' ঘোষণা করে, সে বাতাসে কাল্পনিক শিউলির গন্ধ পায়। পুজো শুরু হয়ে গেল।

    মহিষাসুরমর্দিনী শোনার সময় আবার ঘুমিয়ে বা শুয়ে পড়া তাদের বাড়িতে নিষেধ, তবুও বেশ আয়েশ করে শোনার অছিলায় সে পিঠের বালিশে হেলান দিয়ে আবার নিমীলিত নয়ন হয়ে পড়ে। এই ভোরের আধো ঘুম, আধো জাগরণ বড় মিষ্টি লাগে তার।

    গলাবুক জ্বালিয়ে দেওয়া একটা চোঁয়া ঢেকুরের ঠেলায় তাকে অবশ্য একটু বাদেই ধড়মড়িয়ে উঠতে হল। মুখভর্তি তেতোভাবটা চেপে রেখে পুরো অনুষ্ঠানটা শুনলো সে। ইতোমধ্যে পাশের কয়েকটা বাড়িতেও গাঁক গাঁক করে রেডিও চালিয়ে দিয়েছে, তারা নিজেরা শুনেই ক্ষান্ত না, পাড়াতুতো যাদের রেডিও নেই, বা কানে কালা, সব্বাইকে শুনিয়ে ছাড়ার মহৎ পণ করে ফিল্ডে নেমেছে।

    লুচি আলুভাজা হালুয়া সাঁটিয়ে যখন গেট থেকে সাইকেলটা বের করছে নিজেকে একটু সুস্থ মনে হল তার। সেই হাকুচ তেতো ভাবটা আর নেই মুখের মধ্যে। তবুও মায়ের বানানো, বিটনুন আর লেবু দিয়ে জারানো, একচিমটে যোয়ান মুখে রেখেছে সে।

    মিনিট পনেরো বাদে যখন সে তার টিউশনের স্যারের বাড়ির গেট দিয়ে সাইকেল ঢোকাচ্ছে, অবাক হয়ে দেখলো তার ব্যাচের সবাই ইনক্লুডিং স্যার, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি মুখ থেকে যোয়ানের চেবানো দলা ফেলে দিলো সে। তার গলার কাছটা আবার একটা পাক মেরেছে।

    ***********
    আকাশ আজকে ঝকমকে নীল একটা শাড়িতে খুব সেজেছে। সেই শাড়ির আঁচলে ছোপকা ছোপকা অনেক সাদা সাদা মেঘের কারুকাজ। রোদের আলো সারাদিন অনেক প্রশংসা করে এখন ফুরিয়ে এসেছে, তবুও আকাশের গালে রাঙা লাজুক ছোপ এখনো পড়ে নি।

    নীলরঙা ম্যাটাডোরের পেছনে পেট সমান উঁচু পাটাতন থেকে তাদের লাইব্রেরি টিচারের সাদা কাপড়ে মোড়া নিথর দেহটা নামাতে নামাতে তার দৃষ্টি কেন জানি ঐ ওপরে আকাশের দিকেই চুম্বকের মত কেউ টেনে নিচ্ছিলো। অথবা এও হতে পারে, এর আগে এতো কাছ থেকে মৃত্যুমাখানো মুখের জ্যামিতি সে আগে কখনো দেখেনি বলে তার নার্ভাস সিস্টেম বারবার বিদ্রোহ করছিলো। মাথার দিকটাই সে ধরে আছে। মাত্র ফুটকয়েকের ব্যবধানে জীবিত আর মৃত দুটো সত্ত্বা একে অন্যকে দাবাবোর্ডের ঘুঁটির মত নিবিষ্ট ভাবে জরিপ করে নিচ্ছে অদ্ভুত এক টেলিপ্যাথি দিয়ে।

    ম্যাটাডোরের চালক যখন তার হেল্পারটাকে খেঁকিয়ে উঠলো, 'বডি নামানো হয়ে গেছে। যা পেছনটা একবার দেখে নে, বাবু গোডাউন হয়ে আসতে বলেছে', সে একবার শিউরে উঠলো। 'বডি' কথাটা তার অনভ্যস্ত কানে পেন্সিলের খোঁচার মতে লাগলো। তাহলে এই মানুষটা আর কারো স্যার নয়, আর কারো কোন কাজে আসবেনা, সবার সব হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে মানুষটা কি নিদারুণ খরচা হয়ে গেলো!! এই শরীরটা যখন কোন এক অজানা শক্তির দেওয়া দমে চলছিলো, কতবার তাকে এ র‌্যাক সে র‌্যাক থেকে ঝেড়ে ঝুড়ে খুঁজে এনে দিয়েছে পুরনো দুÖপ্রাপ্য বই, সে কতবার এই মানুষটাকে তার সাইকেলের রডে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে গেছে, স্যারের হাঁটতে বড্ড কষ্ট হত নাকি, সে মাঝে মধ্যে চালাকি করে ভিড়ের অছিলায়, অন্যমনস্কতার ভান করে, সোঁ করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেছে, পাছে এই মানুষটাকে ক্যারি করতে হয়।

    সেই লোক আজকে 'বডি' হয়ে শুয়ে আছে তাদের স্কুলের সামনে। অনেক লোক জমা হয়ে গেছে। সবার মুখে মুখে ঘুরছে মৃত্যুর কবর, জল্পনা-কল্পনা।

    সকালে এই খবরটা শুনে তার শরীর খারাপ লাগা বেড়ে যায়। একটা সময়ে সে আর থাকতে না পেরে ঝরঝর করে বমি করে ফেলে। আগের সপ্তাহেই স্যারকে নিয়ে সে সাইকেল চালিয়ে গেছে।

    স্যারের শরীর ভালো ছিলো না এটা স্যার মুখে না বললেও কাছে পিঠের সবাই মোটামুটি বুঝতো, মহালয়ার আগের রাতে সেই খারাপ লাগা চরমে ওঠে। আভ্যন্তরীন কোন এক খিঁচুনিতে নাকি শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। তাঁর স্ত্রী পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের হাতে পায়ে ধরে মাঝরাত্তিরে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে সব নিয়মকানুন চুকিয়ে ভালোমত চিকিৎসা শুরু হবার আগেই তিনি সব কিছুর অনেক দূরে চলে যান। যাবার আগে বড্ড কষ্ট পেয়ে গেলেন কয়েক ঘন্টা ধরে।

    সেই মানুষটা এখন শুয়ে আছে তাদের স্কুলের সামনে। অনেক ছাত্র জড়ো হয়েছে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। এরপর এখান থেকেই তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে।

    ভিড়ের একপাশে স্যারের রোগা, ছোটখাটো স্ত্রী মাটিতে থেবড়ে বসে আছেন, এই পৃথিবীর কোন কিছুই তাঁকে যেন ছুঁতে পারছে না। তাঁর আঁচলের খুঁট ধরে মুখ লুকিয়ে আছে তাঁর ছোট্ট ছেলে। এত সব হট্টগোল, মায়ের কান্না সে কিছুই ভালো করে বুঝছে না। তার ভীরু চোখ একটা খুব চেনা নিজের মানুষকে খুঁজছে, যে মানুষটা হয়ত বিকেলে ফিরে তাকে কোলে তুলে নেয়, হয়ত তাকে রাত্তিরে হালকা চাপড় দিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে একটা কোনদিন শেষ না হওয়া গল্প বলে, সে ঘুমিয়ে পড়লে আস্তে করে তার মুখ থেকে তার বুড়ো আঙ্গুল বের করে মুছিয়ে দেয় গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া লালা।

    একটা অদ্ভুত তীব্র অনুভূতিতে ধুয়ে গেল তার মন মাথা, গলার কাছটা দলা পাকিয়ে উঠলো। কয়েক পা হেঁটে এসে সে তার মায়ের পাশ থেকে বাচ্চাটাকে টেনে নিয়ে বসলো। কোলের ওপর বাচ্চাটাকে বসিয়ে তার মাথার ওপরে সে নিজের থুতনি ঠেকিয়ে বসে থাকলো, তার খুদে খুদে ঠান্ডা হাতগুলো নিজের মুঠোতে ধরে।

    আজ মহালয়া, পিতৃপক্ষের শেষ, দেবীপক্ষের শুরু। তার কোলের মধ্যে ধুকপুক করছে যে শিশু সে যে জানেই না, তার পিতৃপক্ষ ইহজন্মের মত শেষ।

    উইন্টার
    *****

    আজ আকাশে গোটাগুটি একটা চাঁদ উঠে পড়ছে। সব হোমওয়ার্ক সেরে ফেলা বাচ্চার মত একগাল হাসি নিয়ে উঁকি মেরে দেখছে পৃথিবীর
    ২৪ঃ৭ চলতে থাকা কার্টুন নেটওয়ার্ক। ধপধপে সাদা জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে এই অলীক প্রান্তর। আর সেই চাঁদের আলো বেয়ে নেমে আসছে ঝুরঝুরে হিমকণার মত ঠান্ডা কুয়াসা।

    তারা তিনজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। টিউশনি পড়তে এসেছিলো ওরা। টিউশনি শেষ, এবারে ঘরে ফেরার পালা। পড়ে ফেরার পথে একটু দাঁড়িয়ে গিয়ে খানিকক্ষণ আড্ডা মেরে নেয় ওরা। আজও তার কোন ব্যত্যয় হয়নি।

    তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা একটা তিনমাথার মোড়ের মত, ঐ জমিগুলোর মাঝে আলের ওপর। তার একদিকে আল গিয়ে মিশেছে মোরাম বিছানো একটা মাঝারি মাপের রাস্তায় যেটাতে যা হোক করে দুটো ভ্যান রিকশা একে অন্যকে মুখোমুখি পেরোতে পারবে। এই রাস্তাটা সেই দূরে পিচরাস্তার ওপাশে ইলেকট্রিক অফিসের সামনে থেকে উদ্ভূত হয়ে সোজাসুজি এগিয়ে গেছে রেলপাড়ের দিকে। এই রাস্তার দুপাশে এককালে কেউ শখ করে কিছু লম্বা লম্বা গাছ লাগিয়েছিলো, সেই সব গাছের ঝুঁকে পড়া ছায়া জমাট বেঁধে আছে রাস্তার ওপর। আলোয়-ছায়ায় কাটাকুটি খেলে জেব্রা ক্রসিং এর মত লাগছে ঐ সব গাছের তলাগুলো।

    তার চোখ বারবার চলে যায় দূরে রেলপাড়ের দিকে, কার্তিক মাস নয় ঠিকই কিন্তু এমন জোৎস্নার রাতেই তো মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খেতে আসে এমনই কোন নির্জন প্রান্তরে। একরাশ খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ির মত লাগছে রেলপাড়ের ঢালু জমিটাকে। তার ওপরে শুনশান রেললাইনে কুয়াশা জমে দেওয়ালের মত হয়ে আছে। গলার মাফলারটাকে আরেকটু টাইট করে পরে সে।

    সব কিছু নিয়ে গাবজালি হচ্ছে তাদের, ক্লাসের মেয়ে (ভুলেও 'সেই তার' নাম নয়), তাদের অন্য অন্য টিউশনির জায়গাতে কোথায় কি সিলেবাস কভার হল, খবরের কাগজের হেডলাইন, পরের বছর তাদের স্কুলের একটা খুব বড় জুবিলি আছে, সেই জন্যে প্রোগ্রাম, এগজিবিশন এই সব অর্গানাইজ করতে হবে, তার গাঁজা খাবার সুলুক সন্ধান এই সব।

    আড্ডাটা বড়িয়া জমে গেছে, একটু আদিরসের আধিক্য, সবারই মুখের হাইড্রেন্ট খুলে তোড়ে খিল্লি বেরোচ্ছে, এমন সময়
    ....

    হঠাৎই তার মনে হল কিছু একটা ঘটছে। তার চোখের সামনেই, কিন্তু সে ধরতে পারছে না। কিছু একটা যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়, এক অজানা তাড়নায় সে কথা থামিয়ে এদিক ওদিকে তাকালো। তারপরেই তার নজর সিধে হয়ে গেলো।

    বহুদূরে রেলপাড়ের ওপর থেকে কুয়াসার আস্তরণ ভেদ করে যেন অন্য জগত থেকে আবির্ভূত হয়েছে একটা আকৃতি, আর দ্যাখ-না-দ্যাখ সেটা খুব দ্রুতগতিতে ঢালু পাড় বেয়ে নেমে এলো। তার ঋজু গড়ন, এত দূর থেকে আর বেশি কিছু বোঝা না গেলেও একরঙা সাদাটে কাপড়ে মোড়া অবয়ব তীব্রগতিতে নামছে, সেটা টের পাওয়া যায়।
    রেলপাড় আর নিচের রাস্তার যোগসূত্র আছে, সে একটা পায়ে চলা পথ, খুব খাড়াই, দিনের বেলাতেও দেখে শুনে উঠতে বা নামতে হয় এবং সেটাও একেবারে সোজাসুজি না। মাঝখানে অনেক ছোটখাট ঝোপ, কাঁটা বন আছে, গরু বাছুরও এমন হুড়মুড়িয়ে নামে না।

    নিচে চত্বরমত জায়গাতে নেমে আকৃতিটার সুমুখে এই মোরাম রাস্তাটাই পড়েছে। তার মনে হল যেন মূর্তিটা ঐ পথ ধরেই এগিয়ে আসছে, তাদের দিকেই, এদিকপানেই
    ... আরে আরে ও কি?

    রাস্তার পাশে গাছগুলোর ফাঁকে এক দুবার যেন তাকে নড়তে দেখা গেল, তারপর সেই জমে থাকা ছায়া ছায়া আঁকিবুকির মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল সেই অবয়ব। একটা শূন্যতা যে নিমেষে গিলে খেলো সেই অবয়বের চিহ্নটুকু।

    আর এই সমস্ত ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেলো, সে কথা থামিয়ে একটা ছোট শিস দিয়ে উঠলো। তার চোখের মণি বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে, তার সমগ্র স্নায়ু দিয়ে সে অনুভব করতে চাইছে সেই অবয়বকে, এতটুকু কোন নড়াচড়া, শব্দ, কোন কিছুই।

    তার বন্ধুরাও তার মুখচোখের এই আকস্মিক পরিবর্তন খেয়াল করেছে। সাইকেলের সিটে বসা বন্ধু জিজ্ঞেস করলো, 'কিরে কি হল? এমন থম মেরে গেলি?'
    - 'সেকি! তোরা দেখলি না?'
    - 'কি দেখবো বলতো? তুই ই তো ওদিকে হাঁ করে তাকিয়েছিলি!'
    - 'তুই কিছু দেখলি নাকি'? অপর বন্ধু জিজ্ঞেস করে। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই যেন তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমে গেছে বলে তার মনে হয়। ঘাড় বেয়ে সিরসিরে একটা কেন্নো যেন পিঠের দিকে নামতে থাকে।

    বেশিক্ষণ লাগে না, তারপরেই দলটাকে তারা দেখতে পায়।

    রেলপাড়ের ওপরে কয়েকটা জোরালো টর্চের আলো দেখা দিয়েছে, সেই আলোর ফোকাস এদিক ওদিক ঘোরে, তাদের দিকেও কেউ যেন একবার ফোকাস মারলো, সেই কৃত্রিম আলো ক্ষীণ হলেও চোখে ধাঁধা লাগায়। লোকগুলো পায়ে চলা পথটা খুঁজে পেয়েছে বোঝা গেল, আলোগুলো বাঁকা পথে দেখে শুনে হিসেব করে নিচে নামে।

    তার দুই বন্ধুর কাছে সাইকেল আছে, স্রেফ তার কাছেই নেই। তার বাড়ি কাছেই, পাড়ার পাশেই। হাতের চারসেলের টর্চটাকে শক্ত করে চেপে ধরে সে। লোকগুলো এই দিকেই আসছে।

    অনেকটা এগিয়ে এসে দলটা দূর থেকে তাদের দেখতে পায় আর সঙ্গে সঙ্গে থমকে পড়ে।

    তার বুকের মধ্যে ধুপধাপ ঢেঁকির পাড় পড়ছে। আড়চোখে বন্ধুদের মুখের দিকে তাকায় সে, দেখে উৎকণ্ঠায় তাদেরও চোয়াল শক্ত, সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে থাকা আঙ্গুলের গাঁট গুলো এই ফটফটে আলোয় যেন চকচকে, রক্তশূন্য লাগে। সে ফুটিফাটা ঠোঁট ভিজিয়ে নেবার জন্যে জিভ বোলাতে গিয়ে সবিস্ময়ে খেয়াল করলো জিভও শুকিয়ে খড়খড়ে।

    লোকগুলো ফিসফাস কি একটা সাঁট করে নিলো, নেতা টাইপের একজন এগিয়ে এসে বেশ সাবধান ভাবেই জিজ্ঞেস করলো, 'কারা ওখানে?'

    'পাড়ার ছেলে। তোমরা কারা?' সে অনুভব করে এই কটা কথা বলতে তার গলা চিরে চিরে যাচ্ছে, আঃ এই সময় একটু জল যদি পাওয়া যেতো
    ...

    পাশ থেকে তার বন্ধু একটু চেঁচিয়ে ওঠে, 'এতো রাতে কি চাই?' তার এই খাপছাড়া চিৎকারে একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক যেন চমকে থেমে যায়। নৈঃশব্দে মোড়া, কুকুরের চোখের মত জ্বলজ্বলে চাঁদের আলোতে ছায়াতে, সেই থমথমে মুহূর্তকটি যেন লাফ দেবার আগে টান টান শ্বাপদের মত ভয়ংকর লাগে।

    *********

    রাত প্রায় নটা সাড়ে নটা বজে। এইদিকের রাস্তাঘাট সব যেন নিশুতি হয়ে গেছে। দূরে দূরে লোকের বাড়ির ফাঁকফোঁকর, ভেন্টিলেটর দিয়ে আলো দেখা যায়। এছাড়া বাকি পৃথিবী শুনশান, শীত তার কুটকুটে কম্বলে মুড়ে নিয়েছে চরাচর। একটা ঝুপসি গাছ পেরিয়ে নিজের বাড়িটা দেখতে পেয়ে সে একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেললো। এতক্ষণ হনহন করে হেঁটে এই শীতের রাত্রেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আবার সে মনে মনে ভেবে নেয়।

    লোকগুলো আসার আগে বন্ধুদের প্রশ্নে সে হতভম্ব হয়ে যায়, কেননা গোটা ঘটনাটার সাক্ষী তার মানে শুধু সে?

    ভুল দেখেছে এই কথা বলে আর উড়িয়ে দেওয়া যাবে না ব্যাপারটা, কেননা লোকগুলো নাকি পালিয়ে আসা একজন পাগল আত্মীয়কে খুঁজছিলো। একজন মেয়ে কে।

    ঠিক এই জায়গাটাতেই তাদের সন্দেহ হয়। লোকগুলোর হাবভাবে, বারবার ফিসফাস করে নিজের মধ্যে আলোচনা করে প্রতিটি কথার জবাব দিচ্ছিলো তারা। কিছু একটা চেপে যাবার আর মেয়েটাকে খোঁজার একটা উৎকট তাড়া দেখে তারা এ ওর হাত টেপে। আর কোন কিছুই দেখার পুরো ব্যাপারটা চেপে যায়। সেই সময় সে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। কথা যা বলার তার দুই বন্ধুই বলে।

    লোকগুলো ফিরে যাবার সময় আলজমির দুপাশে তাদের টর্চের আলো আঁকুপাঁকু করে কাউকে খোঁজে। স্পষ্টতঃই বিশ্বাস করে নি তাদের কথা।

    লোকগুলো চলে যেতে তাদের টনক নড়ে। তারাও একটু এগিয়ে এগিয়ে এদিকে সেদিকে টর্চ মেরে দেখতে থাকে বিস্তীর্ণ ধানজমি, সরু আল, দূরের ছোট্ট ডোবার পাড়। একটা চোরা বাতাস বয়, আসে পাশে গাছের মাথা দুলতে থাকে, দূরে ফোকাস মারায় তাদের টর্চের আলো ডুবে যায়, তারা কিছুই দেখতে পায়না। একটানা জ্বালিয়ে রাখায় দপদপ করে ক্ষীণ আর লাল হয়ে আসে টর্চের আলো।

    অথচ কেউ যদি রাস্তা থেকে এই জমিতে নেমেও পড়তো, সেটা অনেক দূর থেকেও বুঝতে পারার কথা। যে এসেছিলো এই দিকে, সে কোথায় উবে গেলো? কিকরেই বা কেউ খুঁজে পেলো না? লোকগুলোর একবর্ণ কথা তারা বিশ্বাস করে নি, তারা কারা?

    যদি লোকগুলো খারাপ কেউ হয়, আর কোন ভাবে মেয়েটাকে খুঁজে পেয়ে যায়! এই নিশুতি রাতে?

    ভাবতেই তার মাথা দপদপ করে।

    ফেরার পথে শীতের রাতে ফিনকি দেওয়া আলোয় মোড়া চাঁদ একধরণের গা ছমছমে বিভ্রম তৈরি করে, অন্ধকার তবু মেনে নেওয়া যায়, রাতের বেলা কয়েক হাজার মাইল ওপর থেকে নেমে আসা এত আলোতে তার মনে হয় অসংখ্য দৃষ্টি তার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে। আনাচ-কানাচ থেকে।

    সে বাঁক পেরিয়ে নিজের উষ্ণ নিশ্চিন্ত আস্তানায় ঢুকে পড়ার আগে একবার মুখ তুলে ওপরে চাইলো।

    মানুষের মত প্রকৃতিও রহস্য পছন্দ করে হয়ত, সব কিছু সে জানায় না। তার আঁচলের খুঁট থেকে মাঝে মধ্যে এক আধটা আধুলি বের করে দিলেও লুকিয়ে রাখে আরও কতকগুলো।

    ... অ্যান্ড স্প্রিং
    *********

    টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা গোটাগুটি বছর শেষ হয়ে গেলো।

    পেছন ফিরে তাকালে স্রেফ একবার চোখের পলক ফেলার মত লহমা সময়।

    সময় পাল্টাচ্ছে। কিছুই থেমে নেই। কেউ কারুর জন্যে বসে নেই।

    এবারের নবীনবরণের কমিটিতে সে আছে।

    নিচু ক্লাসে যারা ভর্তি হয়, তাদের বাদ দিলে ক্লাস ইলেভেনে অনেক নতুন নতুন বাইরের ভালো ভালো ছাত্রছাত্রী তাদের স্কুলে ভর্তি হয়। প্রতিবছর। এই বহিরাগতদের প্রতি স্কুল কতটা যত্নবান সেটা দেখানোর একটা মাধ্যম হিসেবে স্কুল এই নবীনবরণের আয়োজন করে। ক্লাস টুয়েলভের ছেলেমেয়েরাই ম্যানুয়াল লেবার দেয়, তা নইলে এই অনুষ্ঠানের সব ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই ওয়েল ডিফাইনড।

    ফুলটুল দিয়ে একটা বড় হলঘর সাজানো হয়, অনেক টিচার স্কুল, রেজাল্ট, কেরিয়ার, তাদের অঞ্চল এই সব ভারি ভারি টপিক নিয়ে লম্বা লম্বা লেকচার দেন। নিচু ক্লাসে জীবন বিজ্ঞান ও ইতিহাস পড়ান এমন একজন শিক্ষক কিছু গান জানা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দুএকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, নতুন ভর্তিদের পুষ্পস্তবক আর পেন দেওয়া হয়, কিঞ্চিৎ মিষ্টি মুখের ব্যবস্থাও থাকে, পায়রার ডিমের সাইজের ক্ষীরকদম্ব, কড়াপাকের সন্দেশ আর নিমকি। স্থানীয়রা বা যারা জানে, নিমকিটা ছোঁয়না, বাকিরা খায় এবং বাকি দিনটা অম্বলে আইঢাই করে কাটায়।

    সে যেহেতু গান গাইতে পারে, এবং বেশ ভালোই গায়, এই কমিটিতে সেও আছে। তাছাড়া এই বছর তাদের স্কুলে বড় মাপের একটা প্রোগ্রাম আছে, সেই দিকে তাকিয়ে এটা একটা ড্রেস রিঃআর্শাল ও বলা যায়।

    সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়তে হয়েছে ফুল আনতে। ওটা তার দায়িত্বে। আর্টস, কমার্স আর সায়েন্স মিলিয়ে বেশ ভালোই লোকজন। দোকানি ভোর ভোর নাকি সব রেডি করে রাখবে, টাটকা ফুল দিয়ে স্তবক বানিয়ে। তার কাজ দোকানির বিল নেওয়া, ফুলের ডেলিভারি স্কুল অবধি করে দেওয়া। পরে দোকানি স্কুলের থেকে টাকা নিয়ে নেবে।

    ঘটনাটা ঘটল তার তৃতীয় ট্রিপটা মারার আগে।

    অন্য সবার মত ফুলদোকানিও 'ইন্ডিয়ান স্টান্ডার্ড টাইমে' চলে। ব্যাপারটা সে নির্দিষ্ট সময়ে দোকানে গিয়ে টের পেয়েছিলো। সেটা প্রথমবার। দোকানি তখন সবে মাত্র দোকান খুলে বসে বুকপেট চুলকোতে চুলকোতে হাই তুলছে। তাকে একেবারে টাইমের টাইম পৌঁছে যেতে দেখে দোকানি ফুলের চিন্তায় তার রাতের ঘুম ঠিক হয়েছিলো কিনা এই সব জিজ্ঞেস করে। দোকানি নেহাত তার বাবাকে চেনে বলে সে অতিকষ্টে জিভের ডগায় এসে যাওয়া দোকানি আর দোকানির পূর্বসূরী সংক্রান্ত বাক্যগুলো গিলে ফের কখন এলে ডেলিভারি পাওয়া যাবে জানতে চায়।

    পরের চুক্তির সময়ের আধঘন্টা পরে এসে সে ডেলিভারি পায় ঠিকই, কিন্তু পুরোটা একসাথে না। অগত্যা সে যতগুলো স্তবক রেডি ছিলো সেগুলো নিয়েই স্কুলে ফেরে। মনটা সেই নিয়ে খিঁচড়ে ছিলো।

    নবীনবরণের দায়িত্বে থাকা টিচারের অনেক বয়স, মুখের লাগাম বয়সের ব্যস্তানুপাতিক এবং তিনি পুরুষকারে তীব্র বিশ্বাসী। তার এতো দেরিতে এতো কম সাপ্লাই নিয়ে আসা দেখে তিনি তার মর্দাঙ্গিতে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং প্যান্ট শার্ট পাল্টে বারো হাত কাপড়ে আঁচল ও ঘোমটা টানতে বলেন। তার সঙ্গে আর যারা গান গাইবে, সেই সব মেয়েদের সামনেই। নেহাত সিনিয়র মোস্ট ক্লাসের স্টুডেন্ট না হলে হয়ত দুঘা জমিয়েও দিতেন।

    জিনিসপত্র আরেকজনের জিম্মায় রেখে সে নিচে সাইকেল রুমে ফেরে। জলদি জলদি বাকি মাল নিয়ে আসতে হবে, নতুন ব্যাচের লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। চোখে না দেখলেও পেছনে ঘনিয়ে ওঠা হাসিগুলো তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছিলো। পারলে সে খালি হাতেই কয়েকটা ঘাড় মটকে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, ইনক্লুডিং টিচার।

    পেছনের চাকার লকটা খুলতে গিয়েই ব্যাপারটা চোখে পড়লো তার। টায়ার বসে গেছে। একফোঁটা হাওয়া নেই। সামনের টায়ারেও একই হাল। ভালভের দিকে চোখ পড়তেই সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হলো। ভালভের প্যাঁচটাকে কেউ একেবারে ওপরে তুলে দিয়েছে। কোন **** **, *** ****
    নঢ়দ নঢ়দ র প্র্যাকটিক্যাল জোক।

    এতক্ষণের ফিক্সড ডিপোজিটে রাখা রাগটা ফেটে বেরিয়ে এলো। উত্তাল খিস্তি মারতে মারতে সে প্রথমে ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকের ঝকঝকে নতুন ছোট খাট দেখতে মেরুন কালারের সাইকেলের চেনগার্ডে প্রথম লাথিটি মারে। তারপর আবারও। ধারেপাশের আরো দু একটা সাইকেলেও। যথাসাধ্য জোরে। অন্ধের মত। রাগের প্রথম সিটি তার মাথার প্রেসার কুকার থেকে বেরোতে সে আরো প্র্যাকটিক্যাল ড্যামেজে মন দেয়। শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ। আশেপাশের বেশ কয়েকটা সাইকেলের পাম্প খুলে দিলো সে।

    ***********

    অনুষ্ঠান ভালো হয়েছে। তার গানের পর তুলনামূলক ভাবে বেশি হাততালি পড়েছে। স্বয়ং স্যার তার প্রশংসা করেছেন আলাদা করে। অবশ্যই সবার সামনে।

    আরো একটা ব্যাপার আছে। স্টেজ ফ্রাইটের প্রাথমিক চটকাটা কেটে যাবার পর সে সাহস করে সামনের নতুন মুখগুলোর দিকে তাকায়। বিশেষ করে হাততালি পাবার সময়। একটা খুব উজ্জ্বল মুখ আর মানানসই হাসিতে তার চোখ চুম্বকের মত আটকে যায়।

    মেয়েটি নতুন। এই তল্লাটে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। মাঝারি মাপের মফঃস্বলে যা হয় আর কি। একে সে আগে দেখে নি। বাটালির মত ধারালো চিবুকের পাশে একটা ছোট তিল, তার বুকের মধ্যে পানা জমা হেজে মজে যাওয়া পুকুরে কোন অতল থেকে একটা মস্ত বড় মাছ যেন ঘাই মারলো। সেও তারই দিকে তাকিয়ে আছে, সরাসরি, নজর সরাচ্ছে না।

    পরের গান শুরু হবার পরেও দুটো দৃষ্টি এক অন্যকে অনেকক্ষণ অনুসরণ করেছিলো।

    বাকি স্কুলের ক্লাস চললেও এই নবীনবরণ উপলক্ষ্যে আজকের দিনে ইলেভেন টুয়েলভের তাড়াতাড়ি ছুটি। অনুষ্ঠান শেষ হলেই। যেহেতু সে সকাল থেকে উদভ্রান্ত খেটেছে, তাই তাকে অনুষ্ঠান পরবর্তী গোছগাছ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সকাল থেকে যা যা ঘটেছে, সে গড়ের বাগানে গিয়ে মৌজ করে ব্যোমভোলায় দুটো টান দিয়ে এগুলো নিয়ে একটু ভাবতে চায়। তার আগে সাইকেলে পাম্প দিয়ে নিতে হবে। সে সাইকেল রুমের দিকে এগিয়ে যায়।

    ফাঁকা রুম, সারি সারি হিরো, বিএসএ ইত্যদি নানা রঙের, ধরনের, গড়নের সাইকেলের দঙ্গল, এই সব কিছুর মধ্যে সেই মেয়েটি ছলোছলো চোখে নিচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার নবীনবরণে পাওয়া ফুলের তোড়াটা ধুলোভরা মেঝেতে অবহেলায় লুটোচ্ছে।

    সে দরজার সামনে আসতে মেঝেতে তার লম্বা ছায়া সেই ফুলের তোড়ার ওপর এসে পড়ে। মেয়েটি মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলায়, একটু মুখ টিপে কষ্ট করে হাসেও যেন।

    - 'কি হয়েছে, কোন সমস্যা?' আপনা থেকেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে কথা।

    - 'তোমাদের স্কুল বুঝি এরকম?' একটা সুরেলা তেজি গলা শোনা গেল।

    এতক্ষণ খেয়াল হয় নি, এবারে সামনে চোখ পড়তেই তার পিলে চমকে গেল। মেয়েটির সামনে স্ট্যান্ড করানো আছে তার সকালের তান্ডবের শিকার সেই ঝকঝকে নতুন মেরুন রঙের সাইকেলটি। সেটা যে লেডিস সাইকেল, এই হুঁশ তার তখন ছিলো না। চেন গার্ডের তলাটা দুমড়ে ভেতরের দিকে বেঁকে আছে, ধুলোবালি মেশানো জুতোর ছাপ দেখা যাচ্ছে এবং তার সাইকেলের মত এটারও পেছনের চাকায় কোন পাম্প নেই, তফাৎ শুধু এইটুকুই, এটার এই দুরবস্থা সে নিজের হাতে করেছে।

    এই রাঙা বসন্তের দুপুরে কোথাও কোন কোকিল ডাকছে না, কোন উদাসী হাওয়াও দেয় নি, স্কুলের দিক থেকে নিচু ক্লাসে বাচ্চাদের চেল্লামেল্লি কানে আসছে, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের সামনে যে পরিস্থিতি, তা মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক না, তবুও
    ....

    পরের কথা শুরু হবার আগে দুটো দৃষ্টি এক অন্যকে অনেকক্ষণ অনুসরণ করেছিলো।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন