এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গঙ্গা-সাগরে আমরা দু'জন

    Santosh Kumar Pal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৪৯২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • গঙ্গা-সাগরে আমরা দু'জন

    সেই মাধ্যমিকে 'সাগর সঙ্গমে নবকুমার'  (বঙ্কিমচন্দ্রের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ মাত্র) পড়েছিলাম। তাতে দুটি বাক‍্য মনে বেশ দাগ কেটেছিল: প্রথমটি কপাল কুণ্ডলার বয়ানে 'পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো?' দ্বিতীয়টি "তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইবো কেন?" আর তার সঙ্গে চালু কথা, "সব তীর্থ বার বার, গঙ্গাসাগর একবার"। এসব মাথায় এমনভাবে ঢুকে খাপটি মেরে বসে ছিল যে কখনো সাহস হয়নি ওখানে সশরীর যাওয়ার কথা ভাবার। কিন্তু বর্তমান সরকারের উৎসাহ, টিভি ও খবরের কাগজের দৌলতে ভিতরের ভয় কাটতে শুরু করে। সেই সুদূর থর মরুভূমি থেকে এত কষ্ট, ত‍্যাগ স্বীকার করে এখানে কেন কীসের লোভে আসে কথিত পুণ্যার্থীরা! উল্টে মাথায় ঢোকে এত মানুষের পদচারণা যেখানে সেখানে একবার যাওয়া খুবই দরকার। বছর খানেক আগে কল‍্যাণদার সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হওয়ার মনস্থির করে ফেলি একবার গঙ্গা-সাগর সন্দর্শনে যাবই যাবো। আড়াই শো কিলোমিটারের কাছাকাছি দূরত্ব আমি অতিক্রম করতে পারবো না? আর সাগরসঙ্গমে যাবে গৃহকর্তা, কর্ত্রীর কি আর মন বোঝে! পতির পুণ‍্যে সতীর পুণ্য--আজ আর মানতে চায় কই!

    কল‍্যাণদা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বছর চারেকের সিনিয়র কল‍্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়, কাকদ্বীপ কলেজের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক, যদিও অবসর নেওয়ার সময় কড়া নাড়ছে দাদার দরজায়। (সেটাও একটি কারণ আমাদের তাড়াহুড়োর।) তবে বিশেষ সামাজিক এক অনুষ্ঠানে দাদার উপস্থিতির অনিবার্যতার কারণে আমাদের সুবিধামতো উইকএণ্ডে দাদা সঙ্গ দিতে অপারগতার কথা জানিয়ে  দুঃখপ্রকাশ করলেন। তবে আমাদের যেন কোনরূপ অসুবিধা না হয় তার জন্য  তাঁদের এক প্রাক্তন ছাত্র,  সাগরেই বাড়ি, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। 

    ইতোমধ্যে আমার ওদিককার এক ডাইরেক্ট স্টুডেন্ট আমাদের অভিসন্ধি কোনক্রমে জানতে পারে। আর যায় কোথা!  সে একবারে নাছোড়বান্দা: "আমার বাড়িতে একদিন থাকুন। আমি ও আমার বন্ধু (কপিলমুনির আশ্রমের আড়াই-তিন কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে যার বাড়ি) আপনাদের তীর্থ-পর্যটনের সব ব‍্যবস্থা করবো।"  মথুরাপুর রোড সন্নিকট বাজারবেড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা এই ছাত্রের এই অকৃত্রিম আহ্বান ষাটোর্ধ্ব পণ্ডিতমশায় কি পায়ে মারিয়ে যেতে পারেন! বেটার সিকিউরিটির আশ্বাস পেয়ে কল‍্যাণদা ও তার ছাত্রকে জানালাম আমাদের বিকল্প প্রযোজনার কথা।

    ১ লা ডিসেম্বর, ২০২৩ শুক্রবার সকাল সকাল ছেলের হাতে সংসারের ভার তুলে দিয়ে আমরা দু'জন বেরিয়ে পড়লাম। সাতটার মধ্যে বর্ধমান স্টেশন পৌঁছে টিকেট কাউন্টার থেকে বর্ধমান-মথুরাপুর রোড জেনারেল টিকেট কেটে নিলাম।সাতটা বাইশের সিউড়ি-শিয়ালদহ মেমু ধরবো বলে অর্ধাঙ্গিনীকে এক নম্বর প্লাটফর্মে বসিয়ে স্টেশনের পূর্ব-পশ্চিম প্রাত:ভ্রমণ শুরু করে দিলাম। পশ্চিম প্রান্তের বুড়ি ছুঁয়ে ঘুরে তিন চার মিনিট হেঁটেছি, ব‍্যস! ম‍্যাডামের ফোন :"তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। লোক‍্যাল টিকেটে হবে না! এক্সপ্রেসের টিকেট কাটতে হবে!" নেটে/ অ্যাপে স্পষ্ট করে বলা নেই। স্টেশনে টিটিদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানায় অধিকাংশ লিমিটেড স্টপ মেমু বা ফাস্ট প‍্যাসেঞ্জারে এখন এক্সপ্রেসের ভাড়া গুনতে হবে! আজাদি কি অমৃত মহোৎসবে- এসবই আমদের প্রাপ‍্য! কী আর করা! আগের লোক‍্যাল টিকেট যথারীতি পকেটে রেখে শিয়ালদহ পর্যন্ত এক্সপ্রেস টিকেট কাটতেই হল। চালে ভুল করায় ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। পাঁচ নম্বরে প্রায় ঠিক টাইমেই গাড়ি ঢুকছে। এখন আবার উঠা-নামার এস্কেলেটর। তবে হাঁ, দুটো একসাথে চলবে না। আড়ি! যখন যেটা দরকার পড়ছে ঠিক তার পাশেরটাই সচল থাকছে তখন! এই হুড়োহুড়ির মধ্যেই বন্ধ হয়ে থাকা এসকেলেটরের সিড়ি ভেঙে ৫ নং এ নেমে মেমু-এক্সপ্রেসে উঠে দাঁড়ালাম।বাণ্ডেলের পর আমি বসার একটি সিট পাই। যদিও এক্সপ্রেস-টিকেট কেটেও সকলেই বসার সিট পায়নি, তথাপি সেরকম ভিড়ভাট্টা ছিল না। ভদ্র সভ‍্য কিশোরের মতো ঠিক সময়ে শিয়ালদহ পৌঁছলেন 'মামু'। নেমে এবার সেই বিখ্যাত লক্ষ্মীকান্তপুর লোক‍্যাল ধরা। আত্মবিশ্বাসে এবার চিড় ধরতে শুরু করেছে: শেষ পর্যন্ত উঠতে পারবো তো! আমরা নর্থের মানুষ, সাউথে প্রায় ব্রাত‍্য। যাকেই জিজ্ঞেস করি, ১০ টা ২০-র লক্ষ্মী কত নম্বরে দেবে সবাই উত্তর এড়িয়ে যায়। শেষে ২০ নং প্লাটফর্মের এক ভেণ্ডার একটি উদার অভিমত ব‍্যক্ত করলেন, ১৬ থেকে ২১ এর মধ্যে যে কোনো প্লাটফর্মে দিতে পারে! এর মধ্যে হঠাৎ ঘোষণা, ডাউন লক্ষ্মীকান্তপুর ২০ নম্বর থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়বে! ছোটাছুটি শুরু। আমাদেরও। ঠিক কোথায় দাঁড়ালে তিনি আমাদের গ্রহণ করবেন ভাবতে ভাবতে প্রায় প্লাটফর্মের মাঝখানে  এসে পড়েছি। অন‍্যান‍্য ভাবী সহযাত্রীদের অভিজ্ঞতার অনুসারী হয়ে স্থিতিজাড‍্যে থিতু হতেই রাজকীয় গতিতে লক্ষ্মীদিদি এসে গেলেন। উঠার সময় একটু ধৈর্য‍্যের ঘাটতি দেখা দিলেও ভালোই বসার আসন পাওয়া গেল।  সহযাত্রীর একজন আমাদের সেল্ফ-ইনকারড অজ্ঞতা কাটিয়ে দিলেন: এই সময় ডাউনে সেরকম ভিড় হয় না! 

    যদিও আমার বিশ্বস্ত সফর-সঙ্গী মুড়ির একটি প‍্যাকেট মেমুতেই গলাধঃকরণ করেছি, তথাপি হরেক জিনিস নিয়ে ভেণ্ডার উঠছে-- দু'চারটে আইটেম আবার সাউথ স্পেশাল-- আমার ফেলে আসা কিশোরমন ভাবছে, এই নতুন আইটেমটা একটু চেখে দেখলে হয় না! কিন্তু আমার অন্তরঙ্গ সহযাত্রীর কাছে থেকে সেরকম সাড়া না পেয়ে ড্রাগন ফল থেকে শুরু সবকিছু আসে, আবার চলে যায়। বারুইপুরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মনে একটু বল পেলাম। অর্ধাঙ্গিনীর সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করেই দশ টাকায় চারটি পেয়ারা! ছোট কিন্তু আলাদা স্বাদ। আমার পরিবার অনেক আগে থেকেই, বিশেষ করে পাঁজাবাগানের বাড়িতে ওঠার পর থেকেই, বারুইপুরের পেয়ারার গুণগ্রাহী। কিন্তু সেই করোণা-কাল থেকে বারুইপুর বে-লাইন: "তোমার দেখা নাই গো, তোমার দেখা নাই!" এই সুযোগে নদীয়া-মুর্শিদাবাদের বিচিত্রবপু পেয়ারাগুলি বর্ধমানের বাজার দখল করে নিলো! কি আর করার। 'নিয়তি কেন বাধ‍্যতে!' যাই হোক, ড্রাগনের স্বাদ-গ্রহণ সম্ভব না হলেও বারুইপুরের পেয়ারা দু'জনে বেশ মৌজ করেই খেলাম। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নতুন নতুন স্টেশন, নতুন নতুন শহর শহরতলি চটি দেখতে দেখতে হঠাৎ হাজির জয়নগর! মোয়ার জন্য বিখ্যাত সেই জয়নগর! ভেণ্ডার ছেলেটির হাতের মোয়া দু' এক পিস খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি যে তা নয়, কিন্তু আমার ছাত্র এসব ডুপ্লিকেট জয়নগর খেতে নিষেধ করেই রেখেছিল, অরিজিনাল খাওয়াবে বলে!

    যাই হোক, 'মোয়া' স্টেশনের পরেরটাই মথুরাপুর রোড। নেমেই ফোন লাগাই ছাত্রকে। ও স্টেশনেই অপেক্ষা করছিল সম‍্যাম স‍্যারকে স্বাগত জানানোর জন‍্য। স্টেশনের মেইন প্রস্থানপথ দিয়েই বেরিয়ে  ওদের গ্রামের দিকে রাস্তায় তুললো ছাত্র। টোটোয় আমারা তিন সওয়ারি। কারবালা মোড় পেরিয়ে ডায়মণ্ড হারবার মেইন রোডে উঠেই ইন্দ্রিয়গুলি সজাগ উঠলো। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এদিকে কখনও আসা হয় নি। তাই চতুর্দিক দেখার চেষ্টা করছি, এ দিকের ধরিত্রী-মাকে বোঝার প্রয়াস করছি: কতটা মিলছে আমাদের সঙ্গে, আর কতটাই বা নতুন! না, আমাদের মতো সমতল ঝোপঝাড়হীন দিগন্ত-বিস্তৃত ধানখেত নয় এই এলাকা। ধানচাষ অবশ্যই আছে। তবে তা 'একমেব অদ্বিতীয়ম' নয়। নারকেল, পেয়ারা, সবেদা ইত্যাদি হরেক রকম ফলের সঙ্গে আরও কিসের চাষ হয় জানেন? আপনার কল্পনায় কুলোবে না: শোলার চাষ! শোলা ও শোলাশিল্পের পাইকারি বাজার এখানেই! বাজারবেড়িয়া যাওয়ার সময় দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল, তাই এসবের পাইকারি বিকিকিনি দেখা হয় নি। পরের দিন সকালে ফেরার সময় শোলার বিরাট বড় বড় বোঝা আঁটোসাঁটো করে বাঁধা পড়ে রয়েছে রাস্তার দু'পাশে, বার্গেনিং চলেছে। আর সান্ধ্যকালীন গ্রাম-দর্শনের সময় আমাদের তেত্রিশ কোটি দেব/দেবীর সাজের শোলার কাজ সুনিপুনভাবে বাড়ির দাওয়ায় বসে করে চলেছে গৃহবধূরা, বাড়ির বাকি সব কাজ সামলে। স্কুলে গার্ডিয়ান মীটে এঁদের সম্পর্কে তাঁদের ছেলে-মেয়েরাও কি বলবে "আমার মা কিছু করে না!" সকল কাজ সমাপনান্তে এত দেবদেবীর অলংকার যাঁরা যুগিয়ে দেন তাঁরা কতটুকু রেকগনিশন পান, বা আদৌ পান কি না জানতে ইচ্ছে করে।

    প্রান্তিক কৃষক পরিবারের ছেলে আমার ছাত্র। (আমিও অবশ্য চাষার ব‍্যাটা!) দু'চার বিঘা জমির উপর সবকিছু। জমিটুকু নিজেরা যে চাষ করবে তারও উপায় নেই। বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাক, কোনো রকমে টিকে আছেন মাত্র।  অন‍্যেরা চাষ করে যা দেয় তা দিয়েই দিনানিপাত! গোদের উপর বিষফোঁড়া, বেশ পুরনো শরিকী বাড়িটা রিপেয়ার না করলেই চলছিল না। সংস্কার্যমান এই বাড়িতে  আমাকে সস্ত্রীক আপ্পায়ন করতে গিয়ে আরো বেসামাল ছাত্র, যদিও ওদের ব‍্যবহারে আমরা একেবারে আপ্লুত। সেট/গেট/টেট ও বিএড করা, সঙ্গে বিধিবদ্ধ জাতের শংসাপত্র, আমার ছাত্রের মেধার কোন কদর নেই এ রাজ‍্যে। বড় হতাশ লাগে এদের কথা ভেবে! আর যাদের ভরসায় চৌত্রিশের জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে নতুন সরকারের জন্য এরা গলা ফাটালো তাদের অফিস-বাগানবাড়ি- ঘরে-টয়লেটে থরে থরে সাজানো 'লক্ষ্মী'! না এদিকের কোন সিভিক মাস্টার বা ও দিকের স্টার্টআপ--কোন লক্ষ্মীই আমার এই ছাত্রকে স্পর্শ করে নি এখনো। (বিগত বারো বছরের আমার হিসেবে প্রায় দু'হাজারের মতো ছাত্র পাশ করিয়েছি। তার মধ্যে সর্বসাকুল্যে চল্লিশ জনের মতো 'তাঁর' করুণা লাভ করেছে। বাকি ঊনিশ শো ষাট জনের অবস্থা কমবেশি এই ছাত্রের মতোই!) এখন বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম  সদস্য, অথচ বর্তমান বা অদূর ভবিষ্যতে কিছু নজরে আসছে না তার জন্য আমার। বহু কষ্টে একটুখানি বাঁচার মতো বাঁচতে চাওয়া কী অন‍্যায় এই উত্তর-আধুনিক যুগে! 

    যাক সে কথা। পরের দিন মথুরাপুর রোড থেকে কাকদ্বীপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সাড়ে আটটার ট্রেন ধরলাম। লক্ষ্মীকান্তপুরে অভ‍্যাসমতো আধঘণ্টার মতো বিশ্রাম নিয়ে নামখানাগামী এই লোকালটি আবার চলতে শুরু করলো। গতি এদিকের তুলনায় শ্লথ। সিঙ্গেল লাইন কী না। দশটায় কাকদ্বীপ স্টেশন। সেই লড়াই-খ‍্যাত কাকদ্বীপ:  স্টেশনে নেমেই দু'চারটি ছবি/সেলফি নিয়ে কয়েকটি মিনিট নষ্ট করার শাস্তি টোটো স্টাণ্ডে গিয়ে পেলাম।  অনেক টোটো ছেড়ে গিয়েছে লট নং ৮ জেটি ঘাটের উদ্দেশ্যে। দু-একটি রয়ে গেছে। তবে তাদের মেজাজ বেশ চড়া! ২০ টাকার টোটোকে প্রায় ডবল দিয়ে ঘাটে পৌঁছনো। রাস্তা বেশ সংকীর্ণ বেশ কিছুটা। তার সঙ্গে সিমেন্ট-নির্মিত রাস্তায় হাজারো ক্ষত, কতক কাঁটা-ছেঁড়া। বেপরোয়া গতি কখনও বা। শ্লিপডিস্ক হয়ে যেতেও পারতো! মিনিট সতেরোর মধ্যে আমরা অবশ্য জেটিতে পৌঁছে দেখি মা ষষ্টীর প্রায় হাজার খানেক পোলাপান গঙ্গা মায়ের কৃপাপ্রার্থী হতে জেটির সামনে  দণ্ডায়মান! এখানে দুইটা কথা কহনেরে লাগবো। এক, সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার সঙ্গে পারাপার গভীরভাবে সম্পর্কিত, আর এখানে কর্মরত সরকারী বাবুদের মর্জির সঙ্গেও কিছুটা। আগের দিন সন্ধেয় এই দুয়ের হিসেব-নিকেশোত্তর পরদিনের পারাপার-ক‍্যালেণ্ডার এখন স‍্যোসাল মিডিয়ায় ছাড়া হয়।  তার সঙ্গে আছে যাত্রী-সংখ্যার ধারাপাত ও ভেসেলের সংখ্যা। হাঁ, এখানে যাত্রী-পরিবাহক যন্ত্র-চালিত বড় লঞ্চকে 'ভেসেল' বলা হয়। দুই, এসব দৈনন্দিন যাতায়াতের ব্রতকথা। পৌষ-সংক্রান্তির সময় কী যে হয় সে আমি জানি না। জোয়ার-ভাটাকে ট‍্যাকেল করা যায় কিনা তাও জানি না। তবে বিকল্প ঢালাও ব‍্যবস্থা থাকে শুনেছি, লক্ষ লক্ষ টাকার ড্রেজিং হয়। (তবে সবটাই যে মা গঙ্গার নাড়িভুঁড়ি সরাতেই খরচ হয়, এমন কথা জোর দিয়ে কেউই বলতে পারছে না এখন!)। রুটও বাড়ানো হয় তখন। তবে সে যাই হোক, কল‍্যাণদার বয়ানে, 'স্টেশনে প্রাণটা নিয়ে নামতে পারলেই হলো। বাকিটা নিউটনের গতিসূত্র বুঝবে। শুধু সঙ্গের ব‍্যাগ-বটুয়া আর লোটাকম্বলকে মাথায় রেখে দুই হাতে ধরতে হবে! (ফ্রোজেন সোল্ডালের সমস্যা আপনার থাকলে সেরেও যেতে পারে!) সঙ্গে প্রশ্নাতীত বিশ্বাস, ভক্তি ও পুণ্য লাভের আকুতি থাকলে সব কিছুই সহজ হয়ে যায়। 

    এবার আমাদের 'আদার ব‍্যাপার'-এ আসি। প্রথম ভেসেলে তো নয়ই, তৃতীয় ভেসেলে কোনোক্রমে একটু পা রাখতেই লঞ্চ ছেড়ে দিলো ঠিক সাড়ে এগারোটায়। দু'এক মিনিট লাগল ব্রিদিং রিদম ঠিক করতে। তারপর ধাতস্থ হতেই খেয়াল হল, আমার সহ-ধর্মিনী কোথায়? ছাত্রটি আমার? এদিক ওদিকে তাকিয়ে ঠাহর হলো, ওরা আছে, যদিও একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে। লঞ্চে উঠে এক অবাঙালি মা-ও এমনি করেই তার দশ বছরের 'বাচ্চা'কে খুঁজে পায়! ঐ মা বলে, 'বেটা মেরি পাশ আ যাও।' লঞ্চের নির্দিষ্ট যাত্রী সংখ্যা যেখানে লেখা রয়েছে ২৫০, সেখানে উঠেছে প্রায় শ'চারেক। এবার ভাবুন, ঐ দশ বছর কা বাচ্চা ক‍্যায়সা মাকে পাশ যা সকতা? অবস্থা এমন যে একটি মাছি-কিশোরকে স্থানান্তরিত হতে হলে আমাদের মাথার উপর দিয়ে যেতে হবে! এদিকে মা ডেকেই চলেছে, বাচ্চাভি চেষ্টা করে যাচ্ছে গলতে। আমরা বাংলার 'ঘরে যত ভাই-বোন' ('প্রাক্তনী' ছবিতে সাবিত্রীদিদির মতো হিন্দিতে) বলছি, "এভাবে যেতে পারবে না ও। আর দরকার কী, আমরা তো রয়েছি। কোন চিন্তা নেই। আপনার 'বাচ্ছা'কে আপনি অক্ষত অবস্থায় পাবেন।" কিন্তু মায়ের মন কি আর মানে! বাচ্চাটি গোঁতাগুঁতি করে, এর ওর পা মারিয়ে, বাগের উপর পা দিয়ে মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রাণপন চেষ্টা ব‍্যর্থ হওয়ায় ঐ মা থাকতে না পেরে হিন্দিতে আমাদের গালাগালি শুরু করে দেয়। এরকম এক উত্তেজনার মুহুর্তে হিন্দিভাষী মা  বাপ-মা তুলে ইংরেজিতে একটি গালি দেয়, যেটি ভেতো বাঙালি সকল বুঝে ফেলে। ব‍্যস, আর যায় কোথায়! 'এই মারে, এই কাটে' অবস্থা! কিন্তু কেউই কোনরূপ স্থানান্তর করতে পারছে না বলে যাকে বলে 'গায়ের হাত দেওয়া' সম্ভব হচ্ছে না। ব‍্যপারটি তাই মৌখিকভাবেই চলতে থাকে। এর মধ্যেই প্রায় আধঘণ্টা কেটে যায়। আমাদের চিড়ে-চ‍্যাপটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কষ্টেরও লাঘব হয়!

    প্রসঙ্গ-ক্রমে, এই 'হি-হি-হি'-র এক তরফ বিজ্ঞাপন অ-হিন্দিভাষীদের কীভাবে ভ‍্যাবাচ‍্যাকা খাইয়ে দিচ্ছে তার একটা নমুনা: কয়েক দিন আমি একটি জাতীয় স্তরের বক্তৃতায় যথারীতি ইংরেজিতে শুরু করি, যেখানে দু'জন বাদে বাকি সকলে আমাদের মতো 'মাছে-ভাতে' বাঙালি। মাঝে আমার কথায় 'প্রাণের পরশ' আনতে 'পৃথিবীর মধুরতম ভাষা'-য় দু'চারটে বাক‍্য তথা বাকবিধি উচ্চারণ করি। দেড়-দু'মিনিট হয়েছে আমার মায়ের ভাষায় কথা বলা। ব‍্যস, অংশগ্রহণকারী অন‍্যতর আমার পাশের রাজ‍্যের বাসিন্দা: "হিন্দি মে বলিয়ে, রাষ্ট্রভাষা মে বলিয়ে!" আমি প্রত‍্যুত্তরে "হোয়াট ডু ইউ মিন? আই অ্যাম হিয়ার টু স্পিক ইন ইংলিশ। হোহাই ইনসিস্ট অন হিন্দি?" ব‍্যাজার মুখে থামে ঐ ছাত্র। আমি ইংলিশেই বলি বাকি সোওয়া একঘন্টা। পরে যখন প্রশ্ন করি ইংরেজিতে তখন ও নিজে ভাঙা ভাঙা  বাংলা ও হিন্দিতে  উত্তর করার চেষ্টা করে! ভাবুন। হিন্দি বা ইংলিশ কোনটিই রাষ্ট্রভাষা নয়।‌ দুটিই সমমর্যাদার 'লাঙ্গুয়েজ ফর কমিউনিকেশন'! কিন্তু কি গা-জোয়ারি দেখুন।

    প্রসঙ্গে আসি। 'কাক'-কুল ছেড়ে ভেসেল 'কচু'-কুলে জেটিতে থামে। সামনে বড় করে লেখা "আই লাভ সাগর," যেমন যত্রতত্র এখন দেখেন আর কি! "ওয়েলকাম টু গঙ্গা-সাগর" দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতেই কচুবেড়িয়া টাক্সিস্ট‍্যাণ্ড, একটু দূরে বাসস্ট্যাণ্ড। সকলেই ডাকাডাকি করছে: নানা মানের ট‍্যাক্সি, অটো, বাস।  সাড়ে বারোটা বেজে যায় উপযুক্ত যানের সন্ধান পেতে। আমরা বাসই ধরলাম। কচুবেড়িয়া বাসস্ট্যাণ্ড টু কপিলমুনি বাসস্ট্যাণ্ড। চল্লিশ টাকা ভাড়া মাথা পিছু। বেশ ভালো সিট। সাগরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, ৪০ কিলোমিটারের মতো। বাসে যাওয়ার এক সুবিধা হলো, এই রাস্তার আশেপাশের জনবসতি দেখা যায়, স্থানীয় লোকজন উঠে নামে। দু'একটি কথা ও হয়। সোয়া ঘণ্টায় কপিলমুনি বাসস্টাণ্ডে পৌঁছলাম। আমার ছাত্রের বন্ধু ভাড়ায় টোটো নিয়ে তার বন্ধুর বাড়িতে তুলে দিল। হোমস্টে-র জন্য বাড়ির দু'তলা সাজিয়েছে। আমরাই উদ্বোধক আর কি!  একজন বাচ্ছা সহ স্বামী-স্ত্রী থাকার জন্য রুমগুলি বেশ ভালো। অফ-সিজনে এক একটি ওয়েল ফার্নিশড প্রয়োজনীয় ব‍্যবস্থাসহ রুমের জন্য হাজার টাকা।  বাড়িতেই রান্না করা খাবার দেওয়ার ব‍্যবস্থা হবে শীঘ্রই। 

    আমি ঘরে ঢুকেই ভাবলাম, সূর্যাস্তের আগেই এই এরিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা করে ফেলা দরকার। আর সঙ্গমে একটি স্নানও। আমার সহ-ধর্মীনি আমার এত দ্রুত অগ্রগমন নিতে পারল না। ও ঘরেই রেস্ট নিতে থাকল। ছাত্র ও তার বন্ধু কুন্তলের সঙ্গে আমি পদব্রজে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে থেকে মন্দির দর্শন করে মেলার মাঠ ও সঙ্গমের আশপাশ জরিপ করতে লাগলাম সোৎসাহে। মেলাতে চেষ্টা করতে লাগলাম গত পৌষ-সংক্রান্তির দিনগুলিতে টিভি স্ক্রিনে যা যা দেখেছিলাম তার সঙ্গে। যাই হোক, এক সমুদ্র, তার উপর গঙ্গার মোহানা। এই সঙ্গম স্থলে ঘুরতে পুরাণের সেই সব গল্প-গাথা মনে আসতে লাগলো।   আমি খুব একটা পুণ্য-লোভী নয়, এ বৈতরণী আমার পেরুতেই ইচ্ছে করে না! তথাপি এত মানুষ এখানে আসে বিশেষ মুহুর্তে স্নানের জন্য। ভেবে কুল-কিনারা করতে না পেরে আমিও একটি ডুব দিয়ে ফেললুম। ড্রেস চেঞ্জ করে এত বড় মাঠ ও সঙ্গমে কেমন অবস্থা হয় ঐ দিনগুলিকে জানার চেষ্টা করলাম কুন্তলের কাছে। আগেই বলেছি কুন্তলের আমার ছাত্রের বন্ধু, একবারে এখানে 'সান অফ সয়েল'। ও জানালো, মেলার কয়েক দিন স্থানীয়দেরও স্বাভাবিক গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়ে। যান চলাচলও প্রায় বন্ধ থাকে মন্দিরের দশ কিলোমিটারের মধ্যে। তবে এই মেলাই কিন্তু সাগরের সারা বছরের মানুষজনের জীবিকার অর্ধেকের বেশি। অবশ্য চাষাবাদ হয় এখানে। মূলত ধান ও সবজি। আর মৎস‍্য। হাঁ, মাছের এত বড় বাজার খুব কম জায়গায় দেখা যায়।  স্বাদু জলের মাছ ও সামুদ্রিক মাছ--দুই-ই পর্যাপ্ত! তবে উচ্চ-ফলনশীল ধানের চাষের ব‍্যবস্থা নেই বলেই মনে হল। সেই পুরোনো পদ্ধতিতে চাষ, উৎপাদন কম। 

    ঐ দিন বিকেলে আমরা আশ্রম এলাকার বাইরে বেশ কিছু দ‍র্শনীয় স্থানে যাই। আশ্রমের কাছেই আমাদের হোম-স্টে। ঘর থেকে বেরিয়ে যেদিকেই সেখানেই কোনো না ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভক্ত/শিষ্যদের থাকার ব‍্যবস্থা, কোনো কোনটি একবারেই ধর্মশালা! উত্তর ও পূর্ব ভারতের প্রায় ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপস্থিতি উজ্জ্বল এখানে। কপিল মুনির মন্দির থেকে শুরু করে সর্বত্র উত্তর ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির দাপট যেন একটু বেশিই। দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব ভারত (আমরাও) একটু নিষ্প্রভ মনে হলো।

    বিকেলে একটি টোটো করে আশপাশে ঘুরতে বের হই। বেশ কিছুটা বিপরীত দিকে গিয়ে আমরা লাইট হাউসের মেরিন লাইটিং দেখতে পেলাম। (কচুবেড়িয়া থেকে ধরলে এই মেরিন লাইট এলাকার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটারের মতো।) সঙ্গে বিস্তীর্ণ বালুকা বেলা। ঝাউ গাছের বন তৈরির চেষ্টা চলছে এখানে। শান্ত মনোরম পরিবেশ। একটি গোটা দিন এখানে কাটিয়ে দেওয়া যায়। গোধূলির দৃশ্যপট আরো সুন্দর, নয়নাভিরাম। "দূরাদয়শ্চক্রনিভস‍্য.." -এর যেন সান্ধ‍্য  ভার্শন বলা যায়। দূরে খিদিরপুর, হলদিয়া থেকে জাহাজগুলি ভেসে চলেছে। তাদের মাস্তুলের আলো দেখা তাদের আলাদা করে চেনা যায়। আর এদিক থেকে প্রায় সাতশো মিটার লাইন দিয়ে আলোর রেখা। শুনলাম জাহাজকে আলো দেখানো বহু পুরানো, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে, হিসেব মোতাবেক ১৮২১ খৃষ্টাব্দ থেকে। শুকুই মাছের গন্ধ যদি আপনার খারাপ না লাগে, তাহলে দেখতে পারেন কীভাবে সমুদ্রতটের বেলাভূমিতে রশিতে ঝুলিয়ে সারি দিয়ে সামুদ্রিক মাছ শুকাতে দেওয়া হয়েছে। এও এক শিল্পকর্ম বলেই মনে হবে।

    প্রায় ২৪০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবনের এই ব-দ্বীপ। কাছাকাছি মাঠে বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ দেখলাম। আমরা ডিসেম্বরে প্রথম দিকে এসেছি বলে ধানখেতই বেশি দেখছি। পরে রবি-চাষ হবে। 

    নূতন দু'একটি পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। মা মনসাকে পুষ্ককরণীর মধ‍্যিখানে রেখে মনসা পার্ক। একটা বেলা অনায়াসে এখানে কাটানো যায়। ঐ সন্ধ্যায় আবার মন্দির ও সঙ্গমস্থলের ঘোরাঘুরি করলাম। সান্ধ্যকালীন সমুদ্রসৈকত ও নির্মীয়মান মেলার মাঠ চাক্ষুষ করলাম। শেষে মন্দিরের সন্ধ্যা-আরতি দর্শনেচ্ছায় ভিতরে প্রবেশ করলাম। জয় বজরংবলী থেকে শুরু করে আমাদের রাধে-কেষ্ট সকলেই এক সারিতে ছোট ছোট আলয়ের মধ্যে। কাঁচ দিয়ে ঘেরা সামনের অংশ। তার উপর সাদা কাপড়ের পর্দা। এই পর্দা সরিয়ে এক ধার থেকে উপস্থিত সকল দেব-দেবীর আরতি। আমাদের সকলকে ধমক দিয়ে সামনে বসিয়ে রাখলেন এক নিরাপত্তা কর্মী পুরোহিতদের চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ফাঁক রেখে। বাঁ হাতে ঘন্টা ও ডানহাতে অগ্নিবলয় নিয়ে আরতি হলো প্রায় আধঘন্টার মতো। আরতি সমাপনান্তে (প্রায় সবটাই হিন্দিতে) "জয় মাতা পার্বতী কি!" "জয় বজরংবলী কি!" "জয় কপিল মুনি কি!"  ইত‍্যাদি। আমরা বলে গেলাম "জয়!" "জয়!"...
    ফেরার সময় মন্দির সংলগ্ন রেস্টুরেন্ট থেকে রুটি তরকা নিয়ে হোম-স্টে তে ফিরে এলাম। আমার ছাত্রকে তার বন্ধু কুন্তল নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। কথা হয়ে থাকলো কাল সকাল সকাল আবার সঙ্গমে প্রাতভ্রমণ, সমুদ্র-দর্শন ও স্নান। আগেই বলেছি, আমারাই সৌরভের লজিং ব‍্যবসার প্রথম অতিথি। হোমস্টে-র ব‍্যবস্থা প্রায় শেষের দিকে। শুধু বেসিনের উপরে আয়নাটা লাগানো হয় নি আজ দুপুর পর্যন্ত। (বিকেলে আয়না ফিটিংসের মিস্ত্রি এসে বাকি চারটি ঘরে লাগিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা চাবি রেখে যাই নি, ভুলে গেছি। তাই...) বিকেলে বের হবার সময় হোমের (সদ‍্য গ্রাজুয়েট) পরিচালক সৌরভকে বলেছিলাম একটা মশারির কথা। ও সব ঘরেই অল-আউট সদৃশ ব‍্যবস্থা করেছে। তাই আর মশারির কথা ভাবে নি হয়তো। 

    ফিরে এসে ঘরে কয়েক মিনিট বসেছি। দরজায় খটাখট। খুলে দেখি সৌরভের মা, সঙ্গে নতুন আনকোরা মশারি। দু-এক বলতে না বলতেই ম‍্যামকে নীচে নিয়ে গিয়ে কত কথা। হাঁ, আমরা তো এদের কথাও এসেছি। ঘন্টা খানেকর আলাপে পরিবারের কথা, এখানকার অবস্থা, ছেলের জীবিকার এই হোম-স্টে.... ।

    পরের দিন সকালে উঠে রেডি হয়ে ছাত্রকে ফোন লাগাই। আধ ঘন্টা র মধ্যে এসে জানায় ওরা রাতে স্থানীয় একটি পাড়ায় যাত্রা শুনতে গিয়েছিল। তাই উঠতে দেরি! মনে পড়ে গেল ছোট বেলায় গ্রামান্তরে যাত্রা শুনতে যাওয়ার কথা। সন্ধ্যায় বেরিয়ে পাঁচ-সাত কিলোমিটার হেঁটে যাত্রা দেখে বাড়ি ফিরতে সকাল!  বিলীয়মান এই শিল্প- মাধ্যমটি এই জেনারেশন আর দেখতে পাবে না।

    সমুদ্রকুল, গঙ্গা-সাগর, সাগর-সঙ্গম, যাই বলি না কেন, এর আকর্ষণে সকালে আবার উপস্থিত আমরা চার-মূর্তি। মেলার আগে এসেছি বলে পরিবেশ রৌদ্র-উজ্জ্বল ও দূষণ-মূক্ত। (মেলার এক দু'দিন পরে এলে বুঝতে পারবেন কি ভয়ংকর বায়ূ, মৃত্তিকা ও জল দূষণ! বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের সার্ভে জানিয়েছে, অন্তত মেলার দিনগুলোতে বিকল্প ব‍্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে সাসটেনিবিলিটি রক্ষা করা সম্ভব নয়। ) এখন বেশ কিছু ব‍্যবস্থা যে নেওয়া হয় তার কিছু চালচিত্র আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান। তবে নিজের বাড়িতে যেমন আমরা যত্ন নিই, সেই রকম আন্তরিক প্রয়াস ছাড়া প্রকৃতি-মাকে যথার্থ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আর্ণে নেসের ডীপ ইকোলজি বা জেমস লাভলকের গাইয়া-তত্ত্ব মনে করিয়ে দিয়েছে যে প্রকৃতি শুধু মানুষের ভোগ-বিলাসের জন্য নয়। আমরা তার কাছে আমাদের প্রয়োজনের দাবী রাখবো। তেমনি মার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ভুলে যেতে পারি না। এখানে প্রয়োজন ও ভোগবাদী লোভের মধ্যে পার্থক্যের কথা তো আমাদের গান্ধীজিই বলে গেছেন!

    'ছোট' আমি-তে ফিরে আসি। সকালে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে দিকচক্রবালের সঙ্গে মিশে যাওয়া লবলাম্বুরেখা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মন্দিরমুখী হতেই ডাব-বিক্রেতাদের মুখোমুখি। সবাই একটি করে খেতে খেতেই  সামনে নজরে এলো খেজুর রস। যদিও ছোট বেলায় গ্রামে একটু আধটু পান করেছি, এখন তো আমাদের কাছে দুষ্প্রাপ্য স্বর্গীয়  সোমরস-তুল‍্য। চার জনে চার গ্লাস, দশ টাকা প্রতি গ্লাস। (অবশ্য ডা. চক্রবর্তীর বিচারে এটা গলাধঃকরণ ঠিক হয় নি এই বয়সে! এর হাইজিন নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাড়ি ফিরে অ্যান্টি বায়োটিক নিয়ে সামাল দিতে হয়।) ঘন্টা দেড়েক মন্দির- সঙ্গমে ঘোরাঘুরির পর কয়েকটি স্মারক কিনে ফেরার সময় ছাত্রের বন্ধু কুন্তল বললেন, চলুন একবার নাগা সন্ন‍্যাসীদের বসতিগুলি দেখে যাই। দেখলাম মন্দিরের বিপরীতে বেশ কয়েকটি বাঁধানো কুঠিরে ওনিরা থাকেন, ছাই-ভস্ম মেখে। কেউ কেউ পাশাপাশি মানুষজনের মিলেমিশে থাকেন, স্বল্পবাসও পরেন। কথাবার্তাও বলেন প্রয়োজনে। কিন্তু গম্ভীরভাবে একাকী সাধন-মগ্ন অনেকেই। আমারা একজন ভস্মের আস্তরণে ঢাকা বাবাকে দেখলাম, যিনি শাস্ত্রপাঠে মগ্ন। তবে আড় চোখে আমাদের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করেন। আমরা অবশ্য কোন আশীর্বাদ চাই নি, তাই উনিও বাক‍্যব‍্যয় করেন নি!

    এদিকে আজই ফিরতে হবে বর্ধমানে। কাল থেকে যথারীতি ক্লাস। এটা-সেটা দিয়ে একটু প্রাতরাশ সেরে মন্দির বাসস্ট্যাণ্ডে চলে আসি। সৌরভ, তার পরিবার ও কুন্তলকে সকৃতজ্ঞ বিদায় জানিয়েছি আগেই। মিনিট চল্লিশের মধ্যে কচুবেড়িয়া লঞ্চঘাটে। লঞ্চের জন্য টিকিট কেটে সামনে তাকিয়ে দেখি, জেটিতে বাঁধা লঞ্চ, নামান্তরে ভেসেলটি ছেড়ে গেল। সময় পেয়ে ছোট টয়লেট সেরে পরের ভেসেলে উঠলাম। এখানে একটি ফুট না কাটলেই নয়: লঞ্চের টিকিট মূল্য ছাপা রয়েছে ৯ টাকা ৩৬ পয়সা। বেশিরভাগই ১০ টাকা দিচ্ছেন,  কিন্তু কাউকে ৬৪ পয়সা ফেরৎ দিচ্ছেন না!  অবশ‍্য জানি না কেউ  ৯ টাকা ৩৬ পয়সাই দিলে ওনারা নিচ্ছেন কি না।

    ফেরার ভেসেলে সামুদ্রিক পাখিদের বিশেষ ধরনের দানা, যা জলে ডুবে যায় না, লঞ্চেই কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে কিনে সী-গালদের খাওয়াতে খাওয়াতে মা গঙ্গা পার হলেন। আমরাও এক প্রস্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতি পথেই কাকদ্বীপ স্টেশন, লক্ষ্মীকান্তপুর বিরতি, বারুইপুর হয়ে শিয়ালদহ। কিছুক্ষণ স্টেশন-দর্শন। পুরনো প‍্যাটিস গরম করে দেওয়া হল, অনলাইনে পে করে খেলাম। অনেক খুঁজে  লিকার চা খেয়ে নতুন শিয়ালদহকে দেখতে ঘোরাঘুরি শুরু করে দিলাম। প্লাটফর্মের প্রায় এক চতুর্থাংশ বড় বড় কর্পোরেটদের দখলে চলে গেছে। ছোট-খাটো ভেণ্ডারদের দৌরাত্ম্য (নাকি স্বল্প পুঁজির জীবন-সংগ্রাম!) আর নেই। সন্ধ্যের সিউড়ি মেমুকে এক্সপ্রেসের টিকেট নিয়ে চেপে বসলাম। সাড়ে আটটার মধ্যে গঙ্গা-মা আমাদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিল।

    শেষে, সব তীর্থ বারবার কিন্তু গঙ্গা সাগর কেন একবার বলা হয় সে সম্পর্কে দু'একটি কথা। জানি না, বঙ্কিমচন্দ্রের আগে কেউ এমনটি ছাপার অক্ষরে বলেছেন কিনা। ওনাকে কেন্দ্রে রেখে আমার কয়েকটি কথা। ১৮৬৩ সালে বঙ্কিমচন্দ্র "কপাল কুণ্ডলা" লেখেন। শুরু করছেন এভাবে:    "প্রায় দুই শত পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে একদিন মাঘ মাসের রাত্রি শেষে একখানি যাত্রী নৌকা গঙ্গা সাগর হইতে প্রত‍্যাগমন করিতেছিল।" সেই সময় দেশি-বিদেশি নাবিকদস‍্যুর ভয় যেমন ছিল ঠিক তেমনি  দুই তীর বরাবর দুর্ভেদ্য অরণ্য, তার উপর শ্বাপদ-সঙ্কুল। কেবল নদী পথে সবটুকু যাওয়া-আসা, জোয়ার-ভাটার  উপর নির্ভরতা-- ভাবতে পারেন কীরূপ অবস্থা ছিল তখন! বৈতরণী পার হওয়ার তীব্র মনোবাঞ্ছা, পরজন্মের জন্য পুণ‍্যার্জনের শাস্ত্রীয় উপদেশকে একান্ত সত্য মেনে সেই সুদূর উত্তর ভারত থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তীর্থ-পর্যটন, গঙ্গা-সাগরে সন্তান-বিসর্জন --সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুর  এদতিরিক্ত গতি কি বলুন! তাই বার বার রয়‍্যাল বেঙ্গল টাইগারের মুখে পড়তে হয়েছে তাদের অনেকেই। তাই বেঁচে ফিরলে একবারই! আজকের মতো কাকদ্বীপ লোক‍্যাল বা গঙ্গা সাগর স্পেশাল থাকলে, লট নং ৮ থেকে কচুবেড়িয়া ভেসেল থাকলে সপ্তাহে একদিন করেও যাওয়া-আসা করা যেতে পারে। এখন যেটুকু করা প্রয়োজন:

    ১. কাকদ্বীপ পর্যন্ত ট্রেন পরিষেবা বাড়ানো, 
    ২. জেটি ও লঞ্চের সংখ্যা বাড়ানো এবং 
    ৩. সত‍্যিকারের পরিবেশ-অনকুল ব‍্যবস্থা গড়ে তোলা।

    আমার এই ভ্রমণ-কাহিনি বেশ কিছুটা 'ফেনোমেনোলজি অফ রিলিজিওসিটি'র পদ্ধতির আদলে লেখা। আপনাদের মনন ও হৃদয়কে যদি বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারে তাহলেই আমি কৃতার্থ।

    ।। সন্তোষ কুমার পাল, বর্ধমান ।। ০৪.১২.২৩ -- ২৫.১২.২৩
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Aditi Dasgupta | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:২৭527172
  • অন্যরকম এক লেখা। বাস্তব, দরদী, ও সুরসিক। শিয়ালদা দক্ষিণ শাখা নানা কারণেই বিতৃষ্ণার উদ্রেক ঘটায়, অপরিচ্ছন্নতা, সাধারণ পরিষেবা , অতিরিক্ত ভীড় সব কিছু নিয়ে ভদ্দর লোকের আতঙ্কের কারণ! সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়াটাও সাধারণ জনতার পথ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। আপনি সেই পথ পরিক্রমা করে এলেন। গঙ্গাসাগর শুধু ধর্মীয় তীর্থ নয়, এই অঞ্চলের একটা পরিচিতি। ম্যানগ্রোভ অতিরিক্ত। কিন্তু চটকদার উচ্ছাস ছাড়া তেমন কিছু তো দেখতে পাচ্ছিনা।
  • মনামী মুখার্জী | 103.155.234.168 | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৫০527209
  • লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো স্যার । সমৃদ্ধ হলাম । 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন