হঠাৎ একটা ফড়ফড়ানি হাওয়া, আর আবারো তাদের গায়ে গায়ে ঠোকাঠুকি। অথচ শেষবার যখন সংঘর্ষ বেঁধেছিল, সবকিছু দ্রুত মিটিয়ে দিয়ে লম্বা সফরে বেরিয়ে পড়েছিল হাওয়া, আর সেই অবসরে রোদটা স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করেছিল, তার একচ্ছত্র দাপটে আর একটানা ধোঁয়ায় কাৎরাতে কাৎরাতে প্রায় ঝিমুনি ধরে গিয়েছিল তাদের!
অনেকটা তেড়ে আসা কণ্ঠে বলল পালোয়ান দেখতে আকৃতিটাঃ ‘আবার যদি গায়ে পড়তে আসিস, চেপে ধরব একেবারে বলে দিলাম… আর ঢ্যাঙ্গামো করার শখ মিটে যাবে চিরতরে, বুঝলি।‘
‘আচ্ছা, চেপে ধরিস, দেখব তোর মধ্যে সত্যিই চাপ কিছু আছে, না কি পুরোটাই চাপা!’ খিলখিল করে হাসির দমক ছড়িয়ে দিতে দিতে বলে পাতলা শরীরের অবয়বটা!
পাশাপাশি একই তারে বাঁধা ছিল তারা। মেলে দেয়া পুরো শরীরের কোথাও কোথাও হুক থাকলেও, তা পর্যাপ্ত ছিল না তাদের অনড় রাখতে। আর হাওয়া-রোদে মাখামাখি হয়ে তাদের কোন অংশ কখন ফুলে উঠবে, বা কোন জায়গাটা জাবে চিমসে, সে বোধ করি তাদেরও জানা ছিল না! তাদের সামনে বিরাট একটা মাঠ, তারপর পাকা সড়ক, পেছনে নারকেল, আর সুপুরির বেড়ায় আটকানো ঘরবাড়ি, দক্ষিণে পুকুর, আর উত্তরে আদিগন্ত ক্ষেত।
পাতলা অবয়বটা থেকে নেমে আসা হাসির শেষ স্বরটি ঝংকার তুলতে তুলতে হাওয়ায় বিলিন হওয়ার পর তাদের মাঝখানে বেশ কিছুক্ষণ আর কথা হয় না। তারপর কী এক অজানা কারণে সড়সড় করে উঠে পাতলা! কীসের যেন এক অধীরতা! সেই সাত সকালে মেলে দিয়ে গেছে গিন্নি-মা; পাশাপাশি এতটা সময় থাকা, কথা না কয়ে পারা যায়! তার হয়েছে জ্বালা, অন্যদিন তো কত ছোটখাট শাড়ি, লুঙ্গি, সায়া, ব্লাউজ, পাঞ্জাবি থাকে; আজ আর কেউ নেই - সঙ্গী বলতে এই বিশালদেহি হাতি-মার্কা দামড়াটা!
হাওয়ার তোড় আবার থেমে গিয়েছে, আর মরার ঘুমটা আবার নেমে আসতে চাইছে হাত-পা সব অবশ করে দিয়ে! এক সময় আর পেরে না উঠে পালোয়ান অবয়বটির দিকে পাতলা নিজের বিস্তৃত আর বিছানো শরীরটা টেনে নেয়। তবে হাওয়ার ভারে যেভাবে লুটিয়ে পড়েছিল ওর গায়ের উপর, তেমনি না ঘেঁষে থেকে বরং নিরাপদ একটা দূরত্ব রেখেই ফিসফিস স্বরে বলতে থাকে সে, ‘জানিস, বাবু সোনা কাল আমাকে নিয়ে হাচোর পাচোর করছিল, সেই আগের দিনের মত।‘
প্রথমটায় মনে হয়, পুরু চামড়ার পর্দা ভেদ করে পালোয়ানের কাছে পৌঁছোয়নি কথাটা; আগের মতই নির্বিকার চিত্তে রোদ পোহাতে থাকে সে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা গমগমে আওয়াজ বের হয় তার মধ্য থেকে, যা প্রকম্পিত করে তোলে নিজেকেসহ তার বাঁধা খুঁটিটাকেওঃ”সেই দিনকার বাল-বাচ্চা, অথচ কী তার পাকা পাকা কথা! নেহায়েৎ গিন্নি-মা পেতে দিয়ে গেছে, না হলে….! চোখের সামনে আছিস, ভাল হয়ে থাক, উলটাপালটা বলে আমার মাথাটা গরম করিস না!‘’ এক নাগাড়ে কথাগুলি শেষ করার পর ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকে পালোয়ান, আগুন আগুন রোঁয়া বেরুতে থাকে তার ভারী শরীরটার মধ্য থেকে!
কিন্তু রাগে না হালকা। ও যেন এক চরিত্রহীন, মুখচেনা ছেনাল! সেরকমই এক হাসিতে পতপত খেতে খেতে বলতে থাকে, ‘আমায় এ বাড়ির মানুষ এক সময় পরে থাকতো দিন রাত … জানিস? আর তোকে তো এনেছে সেইদিন বাজার থেকে!‘ এরপর বাচ্চা মেয়েদের ফ্রকের লেস যেভাবে হাওয়ায় দুলতে থাকে, সেরকম এক তালে হাওয়ার বাহু গলে গলে নাচতে থাকে পাতলা! রোদের আগুন ওর শরীরের সূক্ষ্ম ফাঁক গলে পথ করে নেয়, সেলাইয়ের বাঁকগুলি খুঁজে নিয়ে একের পর এক গলি পেরুতে থাকে!
পালোয়ানের ভারি মুখটা আগে থেকেই ভার করে ছিল, পাতলার জবাবের পর তা আরো টানটান হয়ে যায়; লাল বর্ণের শরীরটা সেই টানের চোটে ফুলে উঠে জায়গায় জায়গায়, আর ফুসকুড়িতে ছেয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যেই। এদিকে যৎসামান্য বাতাস যা ও বইছিল ফাঁকে-ফোকরে, তাও থেমে যায় যেন ঘোর অঘটনের কোন ইঙ্গিত রেখে। মনে হতে থাকে, খুব বেশী দেরি নেই আর; হয়ত মুহূর্তেই বেঁধে যাবে বড় ধরণের দাঙ্গা-হাঙ্গামা!
কিন্তু ঘাবড়ায় না পাতলা। ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ এই প্রবাদটার জ্যান্ত রূপটা কিছুক্ষণের মধ্যেই আবিষ্কার করতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত সে! সেজন্যই হয়ত খানিকটা ঘেঁষে আসে সে গোঁয়ার গোবিন্দ ভুটকো শরীরটার কাছে। আর কী আশ্চর্য, ঠিক তখুনি বজ্র ডেকে উঠে আকাশের বুক চিতিয়ে, ‘হ্যাঁ, প্রয়োজনীয় আর মূল্যবান জিনিস তো বাজার থেকেই আনে সবাই। তুইই বল, বছরের ক’টা দিন তুই ইচ্ছেমত লেপ্টে থাকতে পেরেছিস মনিবের গায়ে? সুযোগ পেলেই লাথিগুতো মেরে বের করে দেয়নি? অথচ এই আমাকে দেখ, একবার আমার মধ্যে ঢুকতে পেলে আর বেরুনোর কথা মনেই থাকতো না মনিবের। এমন করে ঠেসে ধরত আমায় যে, যদি আমি বেরুতে ইচ্ছে করতামও, পারতাম না কিছুতেই।‘
‘তা অবশ্য মিথ্যে বলিসনি! নিজের চোখেই তো দেখতেই পেতাম…সেই দিনগুলিতে বাবু সোনা তখন পড়াশুনোর পাঠ চুকোয়নি… আহা…কী সেই আন্না তান্না, কী সেই আবেগ, আর কাঁপুনি ! মোবাইলের পর্দা থেকে চোখ সরাত না অনেক রাত অবধি! তারপর সারা রাত এপাশ ওপাশ করত!’ পালোয়ানের কথায় যে সূক্ষ্ম চড়টা ছিল, তা যেন মাথাতেই ঢুকলো না পাতলার, হঠাৎ কোন একটা চিন্তা যেন তাকে আনমনা করে দিয়েছে!
‘হ্যাঁ, তুই দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখতিস। আর আমার উপর তো বয়ে যেত টর্নেডো।‘ বলার পরপরই একটি খিক্খিক্ শব্দের ধারাপাত হল যেন, আর পালোয়ানের শরীরটাও সাথে উড়ে-ফুড়ে উঠতে চাইল!
‘কী করবে বেচারা! বয়সটাও দেখতে হবে! আর যেই লাজুক! ভালবাসার মস্ত পাহাড়টা বুকেই চেপে রাখত, আর রাত হলে পর সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে ফেটে বেরিয়ে পড়তে চাইত।‘ পাতলার কণ্ঠটা ভারী শোনাল, যেন গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলে ফেলেছে আর সে নিজেও তা বুঝতে পেরেছে।
‘বুঝলাম, চাপা স্বভাব। কিন্তু যখন বাড়ির সবাই মিলে বিয়ের জন্য চাপ দিল, তখনো চেপেই রইল। কেন?’ পালোয়ানের কণ্ঠে হঠাৎ কেমন একটা চাপল্য ভর করেছে, যেন উৎসুক্য ঝরে ঝরে পড়ছে দুকুল ছাপিয়ে, আর সাথে নড়ে উঠছে তাদেরকে ধারণ করা দড়িটা! অথচ পাশের বাঁশ দুটি কিন্তু নির্বিকার দর্শকের মতই চলচ্ছক্তিহীন; মনে হচ্ছে, বাতাসের মত তারাও জমে গিয়েছে যদিও হিম ঋতুর আসতে তখনো কিছুটা দেরী!
‘তা কী করবে, আরো আগেই যখন ঠোট ফাঁক করেনি, তাহলে পরে আর ফাঁক করেই বা কী হবে! মেয়েটা মনে হয় ততদিনে চলে গেছে অন্য সংসারে! তবে এ আমার ধারণাই কেবল! মনে করো না যে, কেউ আমায় বলে দিয়ে গেছে!’’ পাতলাকে হঠাৎ সতর্ক দেখায়; মনে হচ্ছে, কেউ যেন নোট নিচ্ছে তার কথাগুলোর, যেমনি করে এজলাসে দাড়ানো সাক্ষীর কথাকে কলমের খোঁচায় বন্দী করা হয়!
‘কিন্তু এক সময় তো ঠিকই হাসতে হাসতে বউ নিয়ে ঢুকলো ঘরে। পরিবারের মতে হলেও ঐ যে হাসির ছলাৎ ছলাৎ, জলতরঙ্গে যেভাবে বৈঠা চলে… আমার একেবারেই ভাল লাগেনি, বুঝলি!’ বেশ একটা চ্যারচ্যারে আর অভিমানী সুর পালোয়ানের, যেন একটা বড় ধরণের অন্যায় হয়েছে তার নিজেরই উপর, আর চোখ-কান-নাক-মুখ বুঁজে মেনে নিতে হচ্ছে!
‘সে তুই আবার দেখলি কী করে?’’ পাতলা আচমকা ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় পালোয়ানের দিকে! এতক্ষণ আনমনে তাকিয়ে ছিলে ডানের ক্ষেতটার দিকে!
‘শীতের দিনের আনন্দ উৎসবের মানে … তুই কী বুঝবি? এসব জেনে তোর কাজ নেই!’ পালোয়ান আবার ফুঁসতে থাকে, তুলো উঠে গিয়ে ক্ষোভের ঢেউ ধুলো ছড়িয়ে দিতে থাকে আশেপাশে!
‘আমাকে বছরে যতদিন জড়িয়ে রাখে, তার সিকিভাগও কি তোর কাছে থাকে? আর আমার থেকে ভালবাসার গল্পের বড় সাক্ষী আর কে আছে? চুপটি করে ধারে বসে থাকি যে! আমাকে তো আর তোর মত করে আলমারির অন্দর ঘরে রেখে আসে না! গায়ে না থাকলেও বিছানাতেই থাকি আমি!‘ পাতলা দেহখানি নিয়ে ঝপঝপ করতে থাকে পাতলা, রসিকা বেণী দুলিয়ে!
‘আমায় লন্ড্রিতে ড্রাইওয়াশ করিয়ে…তারপর যত্ন করে পলিথিনে মুড়ে… তার উপর আবার আলাদা আরেকটি ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে দেয়া হয়; তাহলে বুঝতেই পারছিস আমার দাম কতখানি?’ একটানে তড়বড় করে বলে যাওয়ার পর দ্রুত নিঃশ্বাস ছাড়তে হয় তাকে। তবু অনেকক্ষণ পর একখানা মোক্ষম জবাব দিতে পেরে পালোয়ানের মুখে স্বস্তির সরু আভা চমকাতে থাকে।
‘হ্যাঁ, দামি বটে! না হলে, অমন দামি জিনিসটা আর রাখার জায়গা খুঁজে পায়নি! আর তাতে নতুন বউটার হাত লেগে যাওয়াতেই তো আগুন জ্বলে উঠল! পুড়ে ছারখার হয়ে গেল সব!’ একটা টিপ্পনির সুর ছিল ঠিকই, কিন্তু তাও পাতলার দাগ-মাখা মুখে যেন হঠাৎ করেই ভর করে কালো মেঘের থমথমে ছায়া!
‘সে অবশ্য আমিও বুঝতে পারি না! কেন যে আমার ভাঁজেই রাখতে হয়েছিল হতভাগাকে জিনিসটা, কে জানে! আর যদি রাখলিই, বউ ঘরে আনার পর মনে করে সরিয়ে ফেলবি না! মেয়েমানুষের হাতে ঐ জিনিস পড়লে কী হতে পারে পরিণাম, একবারও ভাবলি না! ম্যালা দিন ধরেই তো দেখে আসছি, এমন উজবুক আর উড়চণ্ডী ছেলেটা! ‘পাতলার মেঘ যেন এই মুহূর্তে ভর করে পালোয়ানকেও, আর পাতলার কথায় লুকিয়ে থাকা খোঁচাটা তার ভারী শরীরটাকে বিঁধতে না পেরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে!
‘’ভারি মেয়ে মানুষ চিনতে শিখে গেছিস, দেখছি! মেয়েটা ফটোটা যেখানে ছিল, সেখানেই তো রেখে দিয়েছিল, আর তারপর তো পুরোই চেপে গিয়েছিল, কাকপক্ষীকেও টের পেতে দেয়নি ব্যাপারটি। হ্যাঁ, একটুখানি মন খারাপ করেছিল, আর তা কি স্বাভাবিক না?’ বেশ টেনে টেনে কথাটা বলে পাতলা, দাদী-নানীদের মত মুখখানাকে কখনো থামিয়ে, কখনো হেঁটে, কখনো দৌড়ে! যেন এ জীবনে দেখেছে অনেক, আর বাকীও আছে খুব সামান্য! জানা হয়ে গেছে ন্যায়-অন্যায়ের সব ধ্যান-ধারণা, সন্ধি-অভিসন্ধির যত অভিধান - তাও হয়ে গেছে পাঠ!
‘ভুল বললি। একটুখানি না, খুব বেশীই মন খারাপ করেছিল; আর না বললেও বর ঠিকই বুঝতে পেরেছিল হয়েছে কিছু একটা। দিন শেষে পুরুষ মানুষ ঘরে এসে কী চায় বলতো? একটুখানি হাসি-মুখ বউয়ের, তাই না? হ্যাঁ, মেয়েটা হাসতো তারপরো, কিন্তু সে হাসি যে জোর করে, এটুকু বুঝবে না একটা মানুষ, যার হৃদয়ে বইতে থাকে অহর্নিশি তাজা রক্তের উষ্ণ স্রোত?’ দার্শনিকের মত উত্তেজিত স্বরে বলতে থাকে পালোয়ান, যেন সে এইমাত্রই একটা ঘটনার সাক্ষী হয়েছে, আর তার উপর ভার পড়েছে সত্যটা প্রকাশ করার।
‘আর সেখানেই মনে হয় সমস্যাটা আরো বেড়ে গেল! ছেলেটা বুঝত, কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কী যে সেই ‘কিছু একটা’, তা জানতে জানতে রাত ভোর করে যেত তার। একটা আশ্চর্য জিনিস খেয়াল করেছিস, ছেলেটাও কিন্তু মেয়েটার মতই নীরব রইল। একটা দিনও মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করল না বউটিকে, কেন সে অমন করছে! এ করে করে সেও বউয়ের মত বদলে গেল! দেখা হত তাদের প্রতিদিনই, তবু মনে হত, বুঝি দেখা হয় না বহু বছর! এক সময় ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়াল যে, তাদের সংসার যাপন যেন শুধুই এক নিয়ম রক্ষা! মনে আছে তোর যে, ঐ সময়টাতে ওরা কেউই আমাদের গায়ে চড়াত না? কী শীত, কী গরম, কী বর্ষা - কোনকিছুই মনে হয় ওদের আর স্পর্শ করতো না!‘ বলতে বলতে একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ে পাতলা। ঠিক সেই সময় হিমের বার্তাবাহী এক টুকরো বাতাস এক পলক বয়েই আবার দপ করে নিভে যায়!
‘হ্যাঁ, সেরকম ছিল বটে কিছুদিন। এরপর তো একদিন যখন দাপিয়ে জ্বর এল মেয়েটির, ছেলেটি কিন্তু সব ভুলে শিয়রেই থাকল বউটির। সুতরাং, সিনেমার শেষ দৃশ্যের মত একটা মিলের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল কিন্তু!… বলতে কী, ছেলেটি কী আবেগভরেই না সেদিন বউটির গায়ের উপর বিছিয়ে দিতে গিয়েছিল তোকে, আর কী করল সে? ছুঁড়ে ফেলে দিল তোকে!!’ হঠাৎ যেন এক পশলা দরদ ঝরে পড়ে পালোয়ানের কণ্ঠে, কিন্তু তা পাতলা না কি ছেলেটার জন্য, তা বোঝা যায় না!
‘ঘটনাটা সেদিন সবার চাক্ষুষ হলেও আরও আগে থেকেই তার বীজেরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল একটুখানি মাথা তোলার জন্য! আসলে মাথা খারাপ অসুখটার চুড়ান্ত পরিণতিটাই শুধু দেখতে পেয়েছিলি তোরা। ওদিকে আমি কিন্তু আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম সব। আর সে কারণেই দায়টাও এড়াতে পারব না, আর নিজেকে ক্ষমাও করতে পারবো না কখনো!’ হঠাৎ খুব বিমর্ষ দেখায় পাতলাকে, যেন অনেকক্ষণ ধরে ওয়ার্ম আপ করতে থাকা আশ্বিনে ঝড়টা এখুনি বইতে শুরু করে দেবে!
‘তোর আবার দায় কী রে! তুই তো নেহায়েতই একটা জড় পদার্থ! এভাবে নিজের ঘাড়ে দোষ ধরে গুরুত্ব বাড়াতে যাস না নিজের, বুঝলি!‘ যখন আকষ্মিক ক্ষেপে উঠতে দেখা গেল পালোয়ানকে, তখন আগের মতই বোঝা গেল না,তা আসলে কার উপর – পাতলা, না কি মেয়েটার উপর!
‘মেয়েটি যেদিন ফটোটা দেখেছিল, সেদিন জায়গামত গুঁজে রেখেছিল সত্যি। কিন্তু তার পরদিন কী করেছিল, জানিস? আবার বের করেছিল ফটোটা। এরপর বালিশের নীচ থেকে আমাকে বের করে নিয়ে একবার আমায়, আরেকবার ফটোটা দেখছিল! যদিও ছবি আর আমি দুজনেই বয়সের কারণে ফিকে হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তাও ওর চোখ এড়াল না, ও কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল যে ফটোর মেয়েটি যা পরে রয়েছে, তার সাথে আমার চেহারার রয়েছে অবিকল মিল। আর তখন কী করল, জানিস, …ওহ্, জানবি কী করে! তুই তো তখন তোর বাক্সে! আমায় …আমায় … হাত থেকে ফেলে দিল ফটোটার মতই! কতক্ষণ পড়েছিলাম মার্বেল পাথরে খোদাই করা মেঝেটিতে, মনে নেই; কিন্তু একটা সময় যে উঠেছিলাম আমরা ওর হাত ধরেই, তা বেশ মনে আছে। আর উঠানোর সময় সে কী তাড়াহুড়ো তার! আমাদের নিজ নিজ আসনে বসিয়ে মেয়েটির এরপর ঘরকন্যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে! কিন্তু সেই শেষ না! এরপর মাঝে মাঝেই এ কাজটা সে করত!’ যেন লম্বা একটা বক্তৃতা দেয়া হয়ে গেছে, আর দর্শক শ্রোতার শোরগোলের ফাঁকে একটুখানি অবসর মিলেছে, সেইমত করে জিরোতে থাকে পাতলা!
‘এরপর কিছুদিনের মধ্যে তো তার মানসিক বিকৃতির প্রকাশ আরো ব্যাপক, পৌনঃপুনিক ও দুঃসহ হয়ে উঠল। যাই দেয়া হত, সবই ফেলে দিত, এমনকি ঔষুধটুকু পর্যন্ত! দেখা যেত, এই হাড় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে, তো আমাকে চাপিয়ে দেয়া হলে এক মিনিটও রাখতে দিত না। আবার জ্বর একটু নামতেই যখন তোকে চাপানো হত গায়ে, তাও তো সে ফেলে দিত। একবার তো তোকে গলায় বেঁধে কী এক কান্ডও করতে গিয়েছিল! ছেলেটা পাশে না থাকলে সেদিনই ঘটনাটা ঘটে যেত!‘ পালোয়ান যখন থামে, একটা চলন্ত ট্রাকের ব্রেক কষার মত সাউন্ড হয়, আর আবারো ধুলোর ঝড় উঠতে থাকে চারপাশে!
‘’কিন্তু সেই দিনটিতে …সেই ভয়ংকর দিনটিতে … সেদিন …সেদিন তো আমাকে, তোকে … দুজনকেই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল ওর উপর! কিন্তু ও তো সেদিন …সেদিন …পুরো নিথর….আহারে! আর নড়ার শক্তি ছিল না বাছার আমার! আর কোন শক্তিই অবশিষ্ট ছিল না দেহে ..সব শেষ হয়ে গিয়েছিল…সব …’’ কথা শেষ করতে পারে না পাতলা; হঠাৎ চতুর্দিকে ঘন ধুলোর পর্দা পড়ে যায়, বাতাসের দাপটে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়, তারের উপর বেঁধে রাখা অবয়ব দুটো আর কেউ কাউকে দেখতে পায় না! কিছুক্ষণের মধ্যেই অঝোর ধারায় পড়তে শুরু করবে ভারী অথচ হালকা সব মেঘের দল, যারা লম্বা সময় ধরে ধৈর্য ধারণ করে বসেছিলেন আ-কাশ বিস্তৃত নীলিমার গায়ে হেলান দিয়ে!
‘বিদায়, হে বন্ধু! ভাল থাকিস!’ জলের ফোঁটার হাড় কাঁপানো বিলাপের শব্দে কান পাতা দায়, তবু তারই মাঝে শোনা যায় পালোয়ানের গমগমে আওয়াজ!
‘বিদায় কেন? ঘরে নিলে পরেই তো দেখা হচ্ছে আমাদের! শীতের আগের এই সময়টাতে আমাদের দুজনের দেখা তো নিয়মিতই হতে থাকবে। আর কিছুদিন পরেই তো বাবু সোনার শিয়রে আমরা দুজনেই থাকবো, এক সাথে! ‘ পাতলা একটু উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করে পালোয়ানকে; কিন্তু আকাশ কিছুটা ফর্সা হয়ে এলেও জলের ফোঁটার প্রতাপ অক্ষুণ্ণই ছিল, আর তার চোখজোড়াকে ক্রমাগত ধাঁদিয়ে যেতে লাগল তারা!
‘সম্ভবত আর দেখা হচ্ছে না আমাদের, বন্ধু! কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য গিন্নি-মা লোক পাঠিয়ে দেবে আমাদের জন্য! … কিন্তু এখানে আসার আগে দেখে এসেছি, একজন বসে রয়েছে মুড়ো পেতে তার হাঁটুর কাছে। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিল লোকটি আমাদের দিকে! তখনই যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। ‘’ প্রায় দুর্বোধ্য এক স্বরে বলতে থাকে পালোয়ান, মনে হয়, বৃষ্টির ফোঁটায় ফুলে উঠে নেতিয়ে গেছে তার চড়া স্বাভাবিক কন্ঠটা!
‘তাই না কি! তবে কি পুরনো জিনিসপত্র আর রাখতে চাইছেন না ঘরে গিন্নি-মা? হয়ত ছেলের জন্য নতুন করে ঘর সাজাতে…’ আবারো কথাটা শেষ করতে পারে না পাতলা, তার আগেই একটা শক্ত ও রোমশ হাতের টান দুমড়ে মুচড়ে দিতে থাকে তার হাড়গোড়, আর ওদিকে একটা ঘোত ঘোত শব্দের জোরালো কিন্তু নম্র স্বর ভেসে আসে পালোয়ানের দরবার থেকেও!
এরপর যেন অনেকটা ভোজবাজির মত, মুহূর্তেই শূন্য হয়ে যায় দড়িটা; ভারমুক্ত হয়ে অনেকটা উপরে উঠে আবার নীচে পড়ে যায় সে। আর ওদিকে বাঁশের খুঁটি দুটো দু’পাশে ঝুঁকে যেয়ে ফের দাঁড়িয়ে যায়; তাদের নগ্ন শরীরের উপর অঝোর ধারায় পড়তে থাকে ক্রমেই তেজ বাড়াতে থাকা জলের চাবুক; পাতলা ও পালোয়ানের অনুপস্থিতে শেলের মত বিঁধে যেতে থাকে তাদের অনভ্যস্ত শরীরে। তবে এই অবর্ননীয় কষ্টের মাঝেও সেই উত্তাপটা মুছে যায় না পুরো, যা এতটা সময় জড়িয়ে রাখার সময় তাদের মোলায়েম আর মিহি স্পর্শে আপনাআপনিই তৈরী হয়েছিল!
(সমাপ্ত)
……………………………………………………………………………………………………………..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।