ডঃ অনিরুদ্ব বসু কলকাতা ছেড়েছেন কুড়ি বছর আগে। বর্তমানে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য দর্শনের খ্যাতনামা গবেষক। প্রায়ই তার ইউ-পেন, ব্রাউন, হার্ভার্ড ইত্যাদি আইভি লিগ ইউনি থেকে বক্তৃতার ডাক পড়ে। স্ত্রী শ্রাবণী ও বছর এগারোর একমাত্র কন্যা রুমাকে নিয়ে তিনি নিউ হেভেন, কনেকটিকাটে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসেই থাকেন।
অনিরুদ্ধ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বছর তিনেক আগে মা মারা যেতে বাবা প্রবীর বসু একা হয়ে পড়লেন। পরের বছর কলকাতায় এসে অনিরুদ্ধ নিঃসঙ্গ, বিপত্নীক পিতাকে চিকিৎসা, সাহচর্য, নিরাপত্তার কথা ভেবেই কলকাতার নিউ টাউনে একটি বিলাসবহুল, প্রফেশন্যালি ম্যানেজড্ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলেন। প্রবীরবাবু খুব লজিক্যাল মনের মানুষ। তাই ছেলের প্রস্তাবে ভুল কিছু দেখেন নি।
যে সংস্থাটি ঐ বৃদ্ধাশ্রম চালাচ্ছে তারা অবশ্য তাদের ‘ফেসিলিটি’ কে Old Age Home গোছের ওল্ড ফ্যাশনড্ ধারণায় সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। তাই তার নাম দিয়েছেন বাংলায় - “
স্নেহলতা” - অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে হলেও, সেখানে দুর প্রবাসে বসবাসকারী কৃতি সন্তানের পিতামাতাকে স্বদেশে প্রফেশনাল কেয়ারগিভাররা লতার মতো স্নেহ মমতায় জড়িয়ে রাখবে। সংস্থার মিশন স্টেটমেন্ট ইংরেজিতে। সেটা বেশ সমীহ উদ্রেককারী -
A luxurious Assisted Senior Citizen Living Facility.
বাবার বয়স সবে সত্তর পেরিয়েছে কিন্তু এখন থেকেই একটু ভুলো মনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। হয়তো মা চলে গিয়ে একাকী হয়ে যাওয়ার ফলে। সময় অসময় নেই অনিরুদ্ধ বা পূত্রবধু শ্রাবণীকে ফোন করে ফেলেন। তখন হয়তো অনিরুদ্ধ ইউনিতে লেকচার দিচ্ছে - ফোন সাইলেন্ট থাকে, তাই শোনা যায় না। শ্রাবণী একটা ল ফার্মে কাজ করে, সেও সপ্তাহের দিনে ব্যস্ততায় থাকে। বাবার ফোন মিস হয়ে যায়। প্রবীরবাবু ছেলেমানুষের মতো অভিমান করেন।
এই মানবিক সমস্যা এড়াতে এবার ক্রিশমাসের ছুটিতে দেশে আসার সময় অনিরূদ্ধ বাবার জন্য একটা Dual Time Zone Timex ঘড়ি কিনে এনেছে। ওটা Made in USA. দোকানে গিয়ে উদ্দেশ্যটা বলতেই দেখালো। অনেক ছেলেমেয়ে যারা আমেরিকায় এসে অন্য টাইম জোনে সেটলড্ হয়ে গেছে, তাদের দেশের প্রিয়জনের কথা ভেবেই হয়তো তৈরী এ ঘড়ি।
অনিরুদ্ধ কলকাতার ফাইভস্টার ফেসিলিটি স্নেহলতায় এসে বাবাকে ঘড়িটা হাতে পরিয়ে দিতে প্রবীরবাবু বলেন, “এ আবার কী ঘড়ি আনলি রে অনি, দু দুটো ডায়াল?”
অনিরুদ্ধ বলেন, “বাবা, ডান দিকে বড় ডায়ালটা কলকাতার সময় মানে IST তে সেট করে দিয়েছি। বাঁদিকেরটা কনেকটিকটের সময়ে সেট করা আছে। ওখানকার সময় কলকাতা থেকে সাড়ে ন ঘন্টা পিছিয়ে। আন্দাজ দশই ধরে নাও। আমাদেরকে সপ্তাহের দিনে ওখানকার হিসেবে সকাল সাতটার আগে বা সন্ধ্যা আটটার পরে ফোন করলে ভালো হয়। তার মানে ধরো এখানকার হিসেবে বিকেল পাঁচটার আগে বা সকাল ছটার পরে।”
প্রবীরবাবু বিড়বিড় করে বলেন, “এখন আমার মাথা ভালো কাজ করে না রে অনি। এখানকার সময়ের সাথে এসব যোগ বিয়োগের হিসেব মনে থাকলে হয়। এতোই যখন ভাবলো ওরা, তাহলে ওদেশের ডায়ালের নীচে একটা AM/PM ডিসপ্লে রেখে দিলেও তো পারতো। সরাসরি ওটা দেখেই বুঝতে পারতাম কখন ফোন করলে তোদের কথা বলার সুবিধা হয়।”
বিখ্যাত গবেষক ডক্টর অনিরুদ্ধ বাসু উপলব্ধি করেন, ভুলো মনের হয়ে গেলেও বাবার স্বাভাবিক বুদ্ধি এখনো বেশ প্রখর।।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।