এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দেবেশ রায়ের শেষ উপন্যাস 

    পাপাঙ্গুল লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ মে ২০২৪ | ১২০ বার পঠিত


  • "গল্প লেখা বা বলার দেবতা বলল - তা হলে তুমি একটা চির -অতীতের গল্প লেখো বা বলো না কেন?"

    এই বাক্য দিয়ে, পৃথিবীর একটি প্রাচীনতম আখ্যান ভিত্তি করে এই বই শুরু হয়। ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পগুলো তৈরি হয়েছিল ১২০০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথকের জিভে ও উচ্চারণে, প্রাচীন হিব্রু বা আরমাইক এ। ৭০ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম ধ্বংসের পর ওল্ড টেস্টামেন্টের সব পাণ্ডুলিপিই প্রায় লুপ্ত, ইহুদি ধর্মজ্ঞরা স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে [ বেদ / শ্রুতির মত, একটা তফাৎ আছে - রামায়ণ মহাভারতের ভাষা কখনো ধ্বংস হয়নি] মাসোরেটিক কপি তৈরী করেন। পরে একাদশ খ্রিস্টাব্দে তৈরী ও লেনিনগ্রাদে রক্ষিত এক পাণ্ডুলিপি থেকে মাসোরেটিক পাণ্ডুলিপির প্রামাণিক সংস্করণ তৈরী হয়। শুধু অংকের হিসেবে দশ হাজার বছরের পুরোনো এই আখ্যান পাঁচশো খ্রিষ্টাব্দে ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে কোরান শরীফে এসেছে।

    এই আখ্যানের চির অতীতে সব ঘটেই আছে। বাইবেলের পৃথিবী - গ্যালিলির সমুদ্র, জর্ডান নদী, তেতোজলের হ্রদ, সুয়েজের উপসাগর, আকোয়াবার উপসাগর, লাল জলের সমুদ্র। এই সবের ওপর দিয়ে বয়ে যায় লেভিয়াথান (পূব বায়ু)। বাআআল নামে সমুদ্রিক দেবের সঙ্গে লেভিয়াথানের কয়েক ঋতু ধরে প্রবল যুদ্ধে কয়েক বছরের হাওয়া মেঘ ও জল তছনছ হয়ে যায়। লেভান্ট ভূমি হয়ে দাঁড়ায় সৈকত আর মরুভূমির মাঝের সাঁকো।

    ইয়ুসুফ অন্যের স্বপ্নের ভেতর ঢুকতে পারে। স্বপ্নে কি ঘটছে আর কি ইশারা আছে সব সে দেখতে ও বুঝতে পারে। তার প্রপিতামহ আব্রাহামের সঙ্গে ঈশ্বরের কথাবার্তা হয়েছিল যিনি আব্রাহামকে আদেশ করেছিলেন তার প্রতি বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে নিজের পুত্রকে হত্যা করতে। ঈশ্বর যে ঈশ্বর, তা প্রমাণের জন্য তারপর ঈশ্বরকে সেই শিশুর পুনর্জীবন ঘটাতে হয়েছিল।

    জন্মানোরও আগে ইয়ুসুফ তৈমুসের রাজকন্যা জুলেখার, এক কিশোরী থেকে নারী হয়ে ওঠার সময়ের তিনখানা স্বপ্নে প্রবেশ করে ক্রমান্বয়ে বলেছিল -
    ১। আমি এখনো জন্মাইনি, জন্মাব
    ২। আমিই তোমার স্বপ্নপুরুষ
    ৩। আমি আজিজ মিশির

    সেই স্বপ্ন দেখে জুলেখা কানান থেকে খুঁজতে খুঁজতে মিশরে এসে সম্রাট আজিজ মিশিরকে দেখতে পায়, কিন্তু তার সঙ্গে তার স্বপ্নপুরুষের মুখ মেলে না। জুলেখার সঙ্গে আজিজ মিশিরের বিয়ে হয়ে যায়।

    নৃপতি আদেশ কৈল বাজিতে বাজন।
    সৈন্য সেনাপতি মোর করউ সাজন।।
    দুন্দুভির শব্দে পুরিল দিগন্তর।
    ঢাক ঢোল দন্ডি কাঁসি বাজয়ে সুস্বর।।
    [ সম্ভবত মধ্যযুগের বাংলার শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা 'ইউসুফ-জুলেখা' থেকে এরকম অনেকগুলো পয়ার লেখার মাঝে মাঝে দেবেশ রায় উদ্ধৃত করেছেন ]

    মিশরের রাজা দুটো জিনিসকেই একমাত্র জিনিস বলে ভাবে - বিড়াল আর ফুল। দেবতাদের চাইতেও মন্দিরে প্রধান হচ্ছে বিড়াল। পৃথিবীতে যত রং আছে ও দুটি রঙের মধ্যে যতরকম তফাৎ থাকতে পারে সবরকম রঙের বিড়াল মিশরের শহরের মানুষদের পায়ে পায়ে ঘোরে। ঘন লাল রঙের বিড়াল পাওয়া যায়না বলে রাজা সেই খামতি ঘন লাল রঙের ফুলে মিটিয়ে দিয়েছেন।

    ওদিকে জন্মানোর পর বালক ইয়ুসুফকে কারা এক কুয়োর ভেতর ঠেলে ফেলে দেয়। কুয়োর ওপরে আঁধার পাখিদের পাক খেতে দেখে যাযাবর বণিক তাকে উদ্ধার করে, বাঁচিয়ে তোলে ও নিজের কাফেলার সঙ্গী করে নেয়। সেসময় মিশরের আর এক নাম মিজরেইম। যাযাবর বণিকদের মুলুককে মিদিয়ানও বলে। সারা বছরই এরা পূব দিক থেকে দুই নদীর দেশ [মেসোপটেমিয়া]র মধ্যে যাতায়াত করত। তারা নানা মেলায় তারা মিশরের কাপড়, কুশদেশের ধূপকাঠি, জর্ডনের কাঁচের বাসন, লোহিত সমুদ্রের দ্বীপ থেকে আনা শুকনো মাছ, সমুদ্রের ভেতরের শাকসবজির পসরা সাজিয়ে বসে। কাফেলার ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইয়ুসুফের লোফা ভাজার গরম গন্ধ। 'এলে সেমথ' বা এক্সডাসের বিপরীত পথে সিনাই থেকে কানান হয়ে মিশরে এসে বণিক পুরো রাজকোষের বিনিময়ে ইয়ুসুফকে বিক্রি করে দেয় আজিজ মিশিরের কাছে।

    "পশুর মত শুধু বেঁচে থাকা আর মানুষের শারীরিক লজ্জাবোধের সমপরিমাণ আত্মচেতনা দিয়ে তৈরী হয় দাস। ইয়ুসুফের মনে হয় সে এই পরিধির কেন্দ্র। ইউসুফের মনে হতে থাকে কেন্দ্রই তাকে পরিধি করে তুলেছে। একমাত্র দাসই পারে একই সঙ্গে কেন্দ্র ও পরিধি হতে। ইয়ুসুফ সেই দাস। সেইই দুনিয়ার মালিক, সেইই পারে দুনিয়াকে বদলে নিতে। "

    উদ্ধার করার পর থেকে এতদিন স্বঘোষিত ক্রীতদাস ইয়ুসুফ হয়ে যায় আজিজ মিশিরের দাস। জুলেখা তাকে চিনতে পারলেও ইয়ুসুফ পারে না ও সে জুলেখার থেকে পালায়। মাঝখানে বালির দেশে সে ভাবে অনন্তকাল আগে প্রোথিত নরসিংহ তাকে চিরবিখ্যাত তিনটি প্রশ্ন করতে পারেন নাও পারেন। প্রশ্নগুলো একই থাকে, উত্তরগুলো বারবার ভুল হয়ে যায়। বণিক তাকে বলেছিল মিশর ছাড়াও সিরিয়া, ফিনিসিয়া, মাইসিনিয়াতেও স্ফিঙ্কস আছে।

    একসময় ঠিকই বালিতে সমগ্র দেহ নিয়ে ডুবে থাকা স্ফিঙ্কস উঠে আসে। স্ফিঙ্কস তাকে থিবসের জেলে পাঠায় - যতদিন না ইউসুফ তার দেওয়া যে 'আমি তোমার স্বপ্নপুরুষ' বলে স্বপ্ন জুলেখাকে দেখিয়েছিল - তা মনে না করতে পারছে। অন্য কাউকে স্বপ্ন দিয়ে নিজে সে স্বপ্ন ভুলে যাওয়া অপরাধ।

    জেলে গিয়ে ইয়ুসুফ আবার নিজের জন্য এক কুয়ো বানায়। সে বুঝতে পারে "আমি স্বপ্নস্রষ্টা নই, স্বপ্নবাহক মাত্র"। স্বপ্ন ঈশ্বরের সংকেত। ইয়ুসুফ নিজে থেকে কাউকে স্বপ্ন দেখাতে পারে না। ঈশ্বর চাইলে তাঁর প্রয়োজনে কাউকে ইয়ুসুফকে দেখাতে পারেন। কুয়োর মধ্যে একসময় জুলেখা তাকে খুঁজে পায় এবং তারা বাইরে বেরিয়ে দেখে প্রলয় চলছে। স্ফিঙ্কস আবার তাদের রাস্তা আটকায় এবং পরামর্শ দেয় "ফ্যারাও এক স্বপ্ন দেখেছেন এবং তার মানে ইয়ুসুফ করতে পারলে এই প্রলয় থেমে যাবে। " ইয়ুসুফ ও জুলেখা ফ্যারাওয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এখানেই সাড়ে তিনশো পাতার উপন্যাসটি অতর্কিত শেষ, দেবেশ রায় পুরোটা লিখে যেতে পারেননি।

    এই প্রাচীন আখ্যানের পুনর্নির্মাণের মাঝে মাঝে গল্পের দেবতার সঙ্গে 'ডিসকোর্সে', ইতিহাস ভূগোল নিয়ে বইতে নানারকম তত্ত্ব আছে যা দেবেশ রায়ের লেখায় খুঁজে পাওয়া স্বাভাবিক। উপন্যাসের দুটি স্বতন্ত্র অংশ সম্ভবত আগে কোনো কোনো পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়েছিল -'স্বপ্নপুরুষ' ও 'দাসপুরুষ' নামে। এরকম সমসাময়িক বিষয় /ভৌগলিক অঞ্চল নিয়ে আর একটিই উপন্যাস বাংলায় পড়েছি - আবুল বাশারের 'মরুস্বর্গ'।

    স্বপ্নপুরুষের খোঁজে জুলেখা
    দেবেশ রায় / আজকাল

    https://en.wikipedia.org/wiki/Canaan
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • &/ | 151.141.85.8 | ১০ মে ২০২৪ ০৪:২৯531541
  • 'রাজাবলি' ও। আবুল বাশারেরই । বাথশেবা সলোমন আনাথ ..আরও অনেকে 
  • পাপাঙ্গুল | ১০ মে ২০২৪ ১৮:৪৫531569
  • &/ ,হ্যাঁ ঠিক। 'রাজাবলি' র কথাটা মনে পড়েনি। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন