এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ফ্রিকিক

    Tim
    অন্যান্য | ০৬ ডিসেম্বর ২০০৯ | ২৫৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Tim | 71.62.121.158 | ০৬ ডিসেম্বর ২০০৯ ০৮:৩৯426598


  • রেডিওতে সাতটা দশের খবরটা শুরু হতেই ধড়মড় করে উঠে পড়লো শঙ্কর। এখন সে প্লাস্টিকের প্যাকেটে বুটজোড়া ভরে নিয়েই একছুটে কলতলায় গিয়ে চোখেমুখে জল দেবে। তারপর উঠোনের তারে ঝোলানো জার্সিটা গলিয়ে নিয়ে উর্দ্ধ্বশ্বাসে ছুটবে মাঠের দিকে। শঙ্করদের বাড়িটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। বেড়াটা পেরোলেই একফালি সরু রাস্তা, তারপর আরেকসারি বাড়ি। প্রতি দুটো বাড়ির মাঝে এক চিলতে ফাঁক। সেখান দিয়ে অনায়াসে গলে যাওয়া যায় পরের রাস্তায়। সেই রাস্তার পরে আবার একসারি বাড়ি, তারপরেই রংকলের মাঠ। শঙ্করদের প্র্যাক্টিস শুরু হয় সাতটায়। আজ রবিবার। প্রত্যেক রবিবার সমস্ত শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হাজির থাকেন চিফ কোচ সুবলস্যার। সমস্ত অভিযোগ শোনেন, দরকার হলে শাস্তি দেন।

    আজ অবশ্য শুরুটাই একটু অন্যরকম হলো শঙ্করের। প্রথমেই জার্সিটা পরতে গিয়ে দেখলো সেটা আধভেজা। তারপর মায়ের কাছে দৈনন্দিন বকুনিটা খেলো না খেয়ে বেরোবার জন্য। খাবার বলতে দুটো শক্তমতন বিস্কুট আর চা। সেইটুকুও না খেয়ে দশটা অবধি খেলে ফিরলে মালতী খুবই রাগ করে। শঙ্করের বাবার নাম মৃন্ময়।

    শঙ্করের সাথে আরো তিনজন আজ দেরি করে এসেছে। অন্যদিন হলে হয়ত রেহাই পাওয়া যেত, কিন্তু আজকে কোনো চান্সই নেই, বুঝলো শঙ্কর। বাকি তিনজনের সাথেই মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো সে। বাকিরা তখন সার বেঁধে ওয়ার্ম আপ শুরু করে দিয়েছে। তিনজন অ্যাসিস্টেন্ট কোচের একজন, বিল্টুদা এখন দেখছে সবাই ঠিকঠাক জগ করছে কিনা। দ্বিতীয় জন , অমিয়দা গোলকিপারদের ট্রেনিং শুরু করে দেবে আলাদা করে গা ঘামানো শেষ হলেই। তৃতীয়জন, ঝোটনদার দায়িত্ব উইথ দ্য বল প্র্যাক্টিস দেখাশোনা করা। এখন যেহেতু ঝোটনদার কিছু করনীয় নেই, তাই তাকে দেখা যাচ্ছে অ্যাটেনডেন্সের খাতা বগলে সুবলস্যারের সাথে। সবাই বেশ ব্যস্ত, ওদের চারজনের দিকে কেউ তাকিয়েও দেখছেনা। নাহ্‌, একেবারে তাকাচ্ছে না বললে ভুল হবে। ওয়ার্ম আপ করতে করতে তপন, অসিত, বাপ্পারা সব দেখছে। আর একটু পরেই শঙ্করদের বিচার হবে, ওরা তারিয়ে তারিয়ে দেখবে সেসব।

    শঙ্করের বয়স বারো। ওদের সব সময় সিনিয়রদের কথা শুনে চলতে হয়। সিনিয়র মানে যাদের বয়স পনেরোর বেশি। এরকম জনা পনেরো আছে এই ক্যাম্পে। ওরা আর কদিন বাদেই ট্রায়াল দিতে শুরু করবে ময়দানের বিভিন্ন মাঠে। ট্রায়াল দেখতে একবার গেছিলো শঙ্কর। খুব একটা কিছু বোঝেনি। কিন্তু একটা জিনিস দেখে ভারি মজা হয়েছিলো তার। এই কৌশিকদা, রজতদারা এখানে বাঘের মত থাকে। সুবলস্যার বাদে বাকিদের তেমন পাত্তা দেয়না। কিন্তু ওখানে ওরাই কেমন কুঁকড়ে যায়, সবসময় নিচুস্বরে কথা বলে।

    কৌশিক-রজতরাও মাঠে এসে গেছে ততক্ষণে। অল্পস্বল্প দৌড়োদৌড়ি করছে। ওদিকে ওয়ার্ম আপ শেষ হয়ে ফিজিকাল ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। আজ হয়ত বেশিক্ষণ হবেনা এই ট্রেনিং। হাল্কা স্প্রিন্ট আর লং স্ট্রাইডের পরেই ছেড়ে দেওয়া হবে। কোন কোন রবিবার খেলার শেষে চৌধুরি স্যার আসেন স্পেশাল ফিজিকাল ট্রেনিং করাতে। সেইসব দিন বাড়ি ফিরে অন্তত ঘন্টা চারেক নড়তে পারেনা শঙ্কর।

    এইসব ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ কেটে গেছে জানেনা শঙ্কর। সম্বিৎ ফিরলো ঝোটনদার গলা শুনে।

    - শঙ্কর, এদিকে আয়। রাকেশ, চিনু আর জামালকেও আসতে বল।

    দুরু দুরু বুকে এগিয়ে গেল ওরা। বেশিদূর যেতে হলো না অবশ্য। সুবলস্যার অ্যাটেনডেন্সের খাতার পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন :

    - ফিফটি ল্যাপ্‌স। পঞ্চাশ পাক দৌড়ে তারপর আমার সাথে দেখা কোরো।
  • Tim | 71.62.121.158 | ০৬ ডিসেম্বর ২০০৯ ১১:৫৮426609


  • রংকলের মাঠটা খুব একটা ছোট নয়। সম্বৎসরের ক্রিকেট-ফুটবলের টুর্নামেন্ট, আসেপাশের স্কুলগুলোর বার্ষিক খেলাধুলো এখানেই হয়ে থাকে। বছর দুয়েক আগে নতুন গোলপোস্ট হয়েছে। মাঝখানে খানিকটা জায়গা ন্যাড়া করে অস্থায়ী পিচ বানানো হয়েছে, সেও প্রায় কয়েক মাস হয়ে গেল। যদিও সে পিচের হাল খুব একটা ভালো রাখার জো নেই। বুটের স্টাডে চাকলা চাকলা মাটি তুলে এখান দিয়েই ওভারল্যাপে যায় সাইডব্যাক, উইঙ্গার কাট করে ভেতরে এসে আচমকা শ্যুট করে। অবশ্য সামান্য কয়েকজন বাদে ক্রিকেট নিয়ে খুব একটা আপশোষ করেনা কেউ। ক্রিকেট এ অঞ্চলে এখনও বেশ বড়লোকের খেলা বলে পরিচিত। শঙ্করের জানাশোনা যারা ক্রিকেট করে তাদের সবারই অবস্থা বেশ ভালো।

    পঞ্চাশ পাক এই মাঠে এর আগে কেউ দৌড়েছে বলে শোনেনি শঙ্কর। চিনু আর রাকেশ এর আগেও একবার দেরি করে আসায় পনেরো পাক দৌড়েছিলো, কিন্তু আজ একেবারে সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। শঙ্কর বুঝলো সুবলস্যার শাস্তিটা বেশি দিলেন আজ শঙ্কর ওদের সাথে আছে বলে। শঙ্কর ওদের মধ্যে সবথেকে সাধারণ মানের। কিন্তু তাও সুবলস্যার ওকে পছন্দ করেন। কেন তা শঙ্কর জানেনা। আজ ওর দেরি হওয়াতেই স্যার বিলক্ষণ চটেছেন।

    - শঙ্কু, তোর আজ দেরি হলো যে?
    - ঘুম ভাঙলো না।
    - তুই এত বেলা অবধি ঘুমোস?
    - বেলা অবধি কই? এমনি দিনে সাড়ে সাতটায় উঠি। সাড়ে সাতটার আগে উঠে কি হবে? উঠলেই তো পড়তে বসতে হয়।
    - আমি তো উঠেই বাজারের দিকে হাওয়া হয়ে যাই। দাদা দোকানে আসে ছটায়, আমি পৌনে ছটায় ঢুকে যাই।
    এইসব মামুলি কথাবার্তা বলে ওরা। আর দৌড়ে চলে। ততক্ষণে ওদের নি:শ্বাস ভারি হয়ে আসছে। গলার কাছে একটা ব্যথা চিনচিন করছে। গভীর করে কাটা সাইডলাইনের ধারে দাঁড়িয়ে রজত ওদের দেখতে থাকে। একটু পরে তার পাশে বাকিরাও এসে দাঁড়ায়। আড়চোখে একবার দেখে নেয় শঙ্কর। মনে মনে বেশ একটা গর্ব হতে থাকে তার। সিনিয়ররা ওদের ডেকে কথা বললে বা হেসে দুয়েকটা মজার কথা বললে ওরা বর্তে যায়। সুবলস্যারের ওপর একটুও রাগ হয়নি ওদের। বরং এখন একটু একটু করে ভালোই লাগতে থাকে। হঠাৎ করে যাবতীয় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গিয়ে ওরা অবাক হয়েছে খুব, খুশি হয়েছে আরো বেশি।

    কুড়ি- পঁচিশ-তিরিশ..... অল্প অল্প করে লক্ষ্যস্থির করে এগোতে থাকে শঙ্কর। তাহলে হাঁফ ধরবে না, এদিকে আবার দূরত্বটাও বেশি বলে মনে হবেনা। ততক্ষণে মাঠের মধ্যে বাকিরা জড়ো হয়ে স্প্রিন্ট টানছে। ছিপছিপে চেহারার অসিত তীরের মত ছুটে সবাইকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে--- দেখলো শঙ্কর। ওদের সবারই কিছু না কিছু আছে। বরুণের স্কিল, শক্তপোক্ত চেহারা। সুমনের হেডিং। শঙ্করের কোনোকিছুই তেমন একটা আহামরি নয়। স্যার তো ওকে প্রথমে নিতেই চাননি। পরে নিমরাজি হয়ে বলেছিলেন, "" ঠিক আছে। এসো। কদিন দৌড়োদৌড়ি করো। তারপর দেখা যাবে। আপাতত তোমার নাম খাতায় লেখা হচ্ছে না, যদি টিঁকে যাও তো মাস ছয়েক পরে লিখে নেবো।""

    মাস ছয়েক শঙ্করকে এই যন্ত্রণাটা সইতে হয়েছে। প্রায় সত্তরজনের একটা ক্যাম্পে একমাত্র ওরই নাম ডাকা হত না। তারপর একদিন ঝোটনদা এসে যখন খবরটা দিলো তখন ওর বিশ্বাস হয়নি। আর কিছু না, বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে থাকতে একেবারেই ভালো লাগতো না ওর।

    গল্প করতে করতে দৌড়োচ্ছিলো ওরা চারজন। এখন আর তেমন কষ্ট হচ্ছে না। আর মাত্র দশপাক। বেশ বোঝা যাচ্ছে সেটুকু ওরা ঠিকই চালিয়ে নেবে। প্রতিবার স্যারের কাছে দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা নিচু করে নিচ্ছিলো ওরা। সুবল ভট্টাচার্য ময়দানের একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।

    সাতচল্লিশ পাকের মাথায় ওরা দেখতে পেলো দুটো দল তৈরী করে খেলা শুরু হচ্ছে। সিনিয়র জুনিয়র মিলিয়েই দল হয় এইরকম খেলার সময়। কয়েকজন করে সাবস্টিটিউট প্লেয়ারও থাকে, সাধারণত তারা সবচেয়ে জুনিয়র।

    -আজ সারাদিনটা দৌড়ে দৌড়ে কেটে গেল। ম্লানমুখে বললো জামাল।
    - হ্যাঁ বল ছুঁতেই দেবেনা আজকে, দেখে নিস।
    চিনু কি একটা বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই সুবলস্যারের গলা শোনা গেল। সাইডলাইনে নিজের বেঞ্চে বসেই কি একটা চেঁচিয়ে বলছেন বিল্টুদাকে। কথার শেষ অংশটা সুনতে পেলো শঙ্কর ,

    -......... দশ মিনিটের মাথায় ফার্স্ট চেঞ্জ। অসিতের জায়গায় শঙ্কর আর সুবীরের জায়গায় জামাল আসবে। আরো দশ মিনিট পরে চিনু আর রাকেশকেও নামিয়ে দেবে।

    নিজেদের কানকে ওরা বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এরপর তো ওরা মাঠে দাঁড়াতেই পারবে না। স্যার কি দৌড় করিয়ে মেরে ফেলতে চান? মাঠের মধ্যে তাকিয়ে দেখলো শঙ্কর। রজতদাও চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে আছে।
  • d | 117.195.37.103 | ০৬ ডিসেম্বর ২০০৯ ২২:২৬426620
  • পড়ছি। একেবারে অন্য থিম বলে সাগ্রহে নজর রাখবোও। :) থেমো না। আবার লোকের পুড়কিতে তাড়াহুড়োও কোরো না। মতিবাবুকে মাথা থেকে বের করে দিয়ে নিজের পেসে লিখতে থাকো। (এই শেষ লাইনটা লিখলাম কারণ কেউ না কেউ ঠিক উল্লেখ করবে।)

  • tkn | 122.162.42.61 | ০৬ ডিসেম্বর ২০০৯ ২২:২৮426625
  • হুঁ - ঐ -
  • aranya | 173.54.108.10 | ০৭ ডিসেম্বর ২০০৯ ০৪:৫২426626
  • আজ সত্যিই মনটা ভরে গেল, আমাদের মধ্যে থেকে কেউ খেলা নিয়ে গল্প লিখছে আর টিমের মত শক্তিশালী একজন লিখছে - দারূণ ব্যাপার। গপ্পোর শুরূটা খুব ভাল হয়েছে = ছোটবেলার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মতি নন্দী ছাড়া বাংলায় খেলা নিয়ে আর কেউ তেমন লিখেছেন কি - অরুণ আইনের 'হলুদে সবুজে' মনে পড়ছে আর একটা একজন লং ডিস্টেন্স রানারকে নিয়ে - সেটাও কিশোর ভারতীতেই, নামটা মনে আসছে না।

  • Blank | 203.99.212.53 | ০৭ ডিসেম্বর ২০০৯ ১৫:৫৫426627
  • নেক্‌স্‌ট এডিশানে শঙ্কর নামটা বদলে দিস। বাকি টা ব্যাপক এগোচ্ছে
  • SB | 114.31.249.105 | ০৭ ডিসেম্বর ২০০৯ ১৬:১৬426628
  • দারুন!! ছোটবেলাটা মনে পড়ে গেল!
  • Bratin | 125.18.17.16 | ০৭ ডিসেম্বর ২০০৯ ১৭:০৬426629
  • কোন সালের নেহেরু কাপ ভুলে গেছি। প্রায় মাঝ মাঠ থেকে নেওয়া পন্সে র বাঁকানো ফ্রি কিক গোল-কীপারের হাত এড়িয়ে গোলে ঢুকে গেল। আজ ও চোখে ভাসে সে গোল
  • aranya | 144.160.226.53 | ০৭ ডিসেম্বর ২০০৯ ২১:৩৭426630
  • ৮২-র নেহেরু কাপটা মনে আছে ? উরুগুয়ে যেবার বেশ কটা বিশ্বকাপার নিয়ে এল -সেই ফ্রান্সিসকলি ইত্যাদি, আহা।
    ব্ল্যাঙ্কি, শঙ্কর কি দোষ করল ?
    এই গল্পের টই-টার কিন্তু ফুটবল স্মৃতিচারণের টই হয়ে ওঠার একটা ভাল সম্ভাবনা আছে :-)

  • d | 117.195.39.167 | ০৭ ডিসেম্বর ২০০৯ ২১:৪০426599
  • না তা কেন হবে? ফুটবল স্মৃতিচারণার জন্য টই আছে তো। এটা থাকুক না গল্পের জন্য।
  • aranya | 144.160.226.53 | ০৭ ডিসেম্বর ২০০৯ ২২:০০426600
  • d, নিশ্চয়ই। এটা গল্পেরই টই। আমি জাস্ট ঠাট্টা করছিলাম। আসলে আমরা ফুটবল ফ্যানরা যে কোন ছুতোয় স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসি তো, ফুটবল সংক্রান্ত লেখা পড়তে গেলেই মনে পড়ে সেই গোলটার কথা, কোন একটা সেন্টার, একটা ডজ, একটা দৌড় বা তেমন অনেক কিছু - সেই ব্যাপারটাই বলছিলাম।
  • Tim | 71.62.121.158 | ১০ ডিসেম্বর ২০০৯ ১০:০১426601
  • ** নাম আর পাল্টাচ্ছি না। এইটা শঙ্করেরই গল্প। :)
  • Tim | 71.62.121.158 | ১০ ডিসেম্বর ২০০৯ ১১:০৫426602


  • প্র্যাক্টিসের পর অল্প খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটছিলো চিনু। এখনও মিনিট কুড়ি হাঁটতে হবে তাকে। মাজারের কাছে চিনুর বাবা, সুমিত দাসের রেডিমেড জামাকাপড়ের দোকান। ব্যবসার অবস্থা খুব একটা ভালো না। সামান্য কয়েকজন বাঁধা খদ্দেরের বাইরে প্রায় কেউ আসেনই না সুমিতের দোকানে।

    কুড়ি মিনিটের রাস্তাটা আধঘন্টায় পার করে অবশেষে যখন চিনুর দোকানের সামনে এলো, তখন সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। রোদে চারদিক তেতেপুড়ে যাচ্ছে। দোকানে কেউ নেই। চিনু অবশ্য এতে একটুও অবাক হলো না। বেলা পড়ে এলে সামনের বাজারে তাসের আড্ডা বসে ফি রবিবার। দোকান খালি থাকলে মাঝে মাঝেই সুমিত সেখানে উঁকি দিয়ে আসেন। উল্টো ফুটপাথেই নিতাই টেলার্স। সুমিতের অনুপস্থিতিতে নিতাই চোখ রাখে দোকানের দিকে। কেউ এলে ছোকরা চাকরটাকে পাঠিয়ে সুমিতকে খবর দেয়।

    - ও নিতাইকাকু, বাবা বাজারে গেছে?
    নিতাই সেলাইমেশিনে পা চালাতে চালাতে হেসে ঘাড় নাড়ে।
    - ল্যাং খেয়েছিস নাকি?
    - গোড়ালিটা মচকেছে। জানো , আজ পঞ্চাশ পাক দৌড়োলাম। রংকলের মাঠে।
    - যা যা, গুল দিস না। পঞ্চাশ পাক!
    - আরে হ্যাঁ গো! শাস্তি খেলাম। বলেই জিভ কাটে চিনু। এবার নিতাইকাকু বাবাকে নির্ঘাৎ গল্প করবে।
    নিতাই চশমার ফাঁক দিয়ে তাকায়।
    - শাস্তি কেন?
    - দেরি হয়ে গেল। বাবাকে রোজ বলি সাইকেলে মাঠ অবধি পৌঁছে দিতে। কিছুতেই দেবে না।
    - এখান থেকে দৌড়ে গেলেই পারিস।
    - বাবাও তো তাই বলে। অত সকালে ভাল্লগে না রাস্তা দিয়ে দৌড়োতে। তাছাড়া মা ও বারণ করেছে।
    - হ্যা: কত ময়ের কথা শুনিস জানা আছে!
    চিনু চুপ করে যায়। কথা কম বলাই ভালো। নিতাইকাকুর সাথে গল্পের ছলে কি বলে ফেলবে, তারপর আবার তার ল্যাঠা সামলাও। চুপ করে কাঠের বেঞ্চিটায় বসে পড়ে। সুমিত দোকান বন্ধ করবে একটায়। তারপর সাইকেলে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দেড়টা বাজবে। এদিকে চিনুর পেটে এখনই ছুঁচো দৌড়োচ্ছে।

    *******************************

    জামাল আর রাকেশ একসাথে বাড়ি ফেরে রোজ। গল্প করতে করতে চৌমাথার মোড় অবধি হেঁটে যায় দুজনে। তারপর জামাল ডানদিকের রাস্তা ধরে পুলিশ কোয়ার্টারের দিকে হাঁটতে থাকে। রাকেশ যায় সোজা, বাস গুমটির পাশ দিয়ে খানিকটা গিয়ে হার্ডওয়ারের দোকান পেরিয়ে ডানদিকের সরু গলিটার শেষ মাথায় ওর বাড়ি। রাকেশের বাবা এখানে থাকেন না। শোনা যায় শিলিগুড়ি এলাকায় ব্যবসা আছে ওঁর।

    একতলা পাকা বাড়ি রাকেশদের, খুব একটা আহামরি নয়। যদিও সে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। টিফিনে কেক বা সন্দেশ নিয়ে যায়। জন্মদিনে ক্লাসে লজেন্স বিলি করে।

    বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই রাকেশ চেঁচিয়ে প্র্যাক্টিসের গল্প শুরু করে দিলো। আজ ও লেফ্‌ট আউটে খেলেছে, স্যার একবার ওর একটা সেন্টারে গুড বলে চেঁচিয়েছেন, এসব বলতে বলতেই ওর খেয়াল হলো আসল ব্যাপারটাই বলা হয়নি।

    জামালও তখন পঞ্চাশ পাক দৌড়োনোর গল্পটা বলছিলো। দুপুরের খাবারের জোগাড় করতে করতে ইয়াসমিন শুনছিলো সব। ততক্ষণে বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। আড়াইটে বাজে প্রায়।

    ওদিকে আড়াইটে বেজে যাচ্ছে বলে অসিত ক্রমশই অধৈর্য্য হয়ে উঠছিলো। চারটের সময় ওকে কাজে দৌড়োতে হবে। সারা সকাল হাড়ভাঙা খাটুনি গেছে। এখন খেয়ে একটু গড়িয়ে না নিলে রাত অবধি টানতে পারবে না। অসিত একটা ছোটোখাটো গ্যারেজে কাজ করে। সপ্তাহে সাতদিন কাজ করে। রোজগার মাসে বারোশো টাকা।

    চারজন ভুক্তভোগী বাদে আরো একজনের মাথায় প্র্যাক্টিসের ঘটনাগুলো ঘুরছিলো। সুবল ভট্টাচার্য দ্বিপ্রাহরিক আহারের পরে ইজিচেয়ারের শুয়ে আসন্ন অনূর্দ্ধ পনেরো আই এফ এ টুর্নামেন্টের দলগঠন নিয়ে ভাবছিলেন। তাছাড়া, সামনের মাসেই শুরু হচ্ছে স্যার দুখিরামের নামাঙ্কিত নক আউট টুর্নামেন্ট।
    কুড়িজনের দল, পনেরোদিনের স্পেশাল ট্রেনিং ---- এই দুটো সিদ্ধান্ত খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে ফেলেই পলিতকেশ বৃদ্ধ অগুন্তি ফর্মেশনের চিন্তায় হারিয়ে গেলেন।
  • dukhe | 122.160.114.84 | ১৭ ডিসেম্বর ২০০৯ ১১:২১426603
  • হাফটাইম আর কতক্ষণ ?
  • dukhe | 122.160.114.84 | ০৪ জানুয়ারি ২০১০ ১১:২৩426604
  • মতি নন্দীর স্মৃতিতে এটার পুনরুজ্জীবন হোক ।
  • lcm | 69.236.172.178 | ০৪ জানুয়ারি ২০১০ ১১:৪১426605
  • ওহ! মতি নন্দী - "স্ট্রাইকার' -- প্রসূন, যুগের যাত্রী, শোভাবাজার ইউনিয়ন, হর্ষ-দা, নীলিমা...
  • Manish | 117.241.228.154 | ২৭ মার্চ ২০১০ ১৬:৪৯426606
  • @ Tim
    কথা দিয়েছিলেন যে এই টইয়ের গল্পটা শেষ করবেন। বড্ড দেরী করছেন লিখতে।
  • Tim | 71.62.121.158 | ২৮ মার্চ ২০১০ ১০:২৩426607


  • স্কুলের মাঠটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালো শঙ্কর। বিবর্ণ, ছিঁড়ে আসা জালদুটো খুলে নেওয়া হচ্ছে। খগেনদা দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করছে। ব্যাপারটা কি জানার জন্য এগিয়ে গেল সে। ওকে কাছিয়ে আসতে দেখেই মুচকি হাসলো খগেন।
    - এইযে বড়ো প্লেয়ার এসে গেছে।
    - নতুন জাল লাগান হচ্ছে নাকি?
    - সামনের মাসে ইন্টার স্কুল শুরু , খেয়াল আছে?
    - জানি তো। পরশুদিন থেকে ট্রায়াল, সুশান্তস্যার বলে গেছেন ক্লাসে।
    - দ্যাখো চান্স পাও কিনা! এবার ভালো টিম হচ্ছে। ইন্সপেক্টর নিজে থাকবেন।

    মনটা দমে যায় শঙ্করের। ওদের স্কুলের খেলাধূলোয় বেশ নাম আছে। ফুটবলের টিমে চান্স পাওয়ার জন্য এক হপ্তা ধরে ট্রায়াল চলে। প্রচুর ঝাড়াইবাছাই করে তারপর একেকজনকে নেন সুশান্তস্যার। সুশান্ত সরখেল একসময় জেলা টিমে খেলেছেন। এখন বি কে মেমোরিয়াল স্কুলের ফুটবল কোচ। ওঁকে ছেলেরা প্রধানত ভয় পায় অঙ্কের ক্লাসের জন্য। সেভেন অবধি পাটিগণিত পড়ান সুশান্তবাবু। পান থেকে চুন খসলেই ঠ্যাঙানোর জন্য বিশেষ খ্যাতি আছে ওঁর।
    *****************************
    দুটো দিন নিমেষেই কেটে যায়। শঙ্করদের স্কুলে আজ ট্রায়াল। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে সকালের দিকে। এখন মেঘছেঁড়া ভাঙা ভাঙা রোদ এসে পড়ায় বি কে মেমোরিয়ালের ফুটবল মাঠটাকে অদ্ভুৎ লাগছে। বুটের ফিতে শক্ত করে পাক বাঁধতে বাঁধতে চারদিক দেখছিলো শঙ্কর। জুতোর মধ্যে পায়ের নড়াচড়াটাই আসল। বলটা যেন পায়ের সাথে কথা বলে, দূর থেকে যেন মনে হয় অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা আছে পায়ের সাথে, খেয়াল রাখিস। স্যার বলেছেন।
    এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বাঁশির শব্দ পেলো শঙ্কর। অমনি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল সবাই। শঙ্করও পড়িমরি করে জুতো বাঁধা শেষ করে দৌড়োলো।

    প্রথমদিনের ট্রায়ালে তিরিশজন এসেছে। তিনটে টিম হলো। একজন গোলকিপার শর্ট পড়ায় শুভাশিসকে দেখা গেল নেমে পড়তে। সে সিনিয়র প্লেয়ার, কাস ইলেভেনে পড়ে। স্কুল টিমের প্রথম গোলরক্ষক। শঙ্কর মনে মনে চাইছিলো শুভাশিসের টিমে খেলতে। অন্তত হারতে হবেনা। কিন্তু বিধি বাম।
    তিনটে টিমের নাম হয়েছে রেড , ব্লু আর গ্রীন। শঙ্করদের রেড বনাম জয়ন্তদের গ্রীন টিমের খেলা প্রথমে। জয়ন্ত মাঝমাঠে খেলে। একটা পাড়া টুর্নামেন্টে ওকে খেলতে দেখেছে শঙ্কর। পায়ে বল বেশি রাখে বলে বদনাম আছে ওর।

    খেলা শুরু হলো। ১০-২-১০ ফরম্যাটে খেলা। রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে তিনটে টিম খেলবে। সুশান্তবাবু জানেন কি দেখতে হবে এই খেলাগুলোয়। ফুটবলের বেসিক স্কিল আর সেন্স। স্ট্যামিনা এই ছেলেগুলোর সবারই ঊনিশবিশ। সাতদিনের ট্রায়াল শেষে হয়ত পাঁচ-ছয়জনকে নেওয়া হবে। কোন কোন জায়গার প্লেয়ার চাই তাও ছকে রাখা আছে।

    ট্রায়াল ম্যাচের খেলা যেমন হয়, সেরকমই হচ্ছিলো। অসংখ্য মিসপাস, বোঝাপড়ার অভাব প্রকট এদের খেলায়। এরা কেউ কারুর সাথে আগে খেলেনি, এমনটাই হওয়ার কথা।

    প্রথমার্ধটা একরকম একঘেয়ে কাটলো শঙ্করের। একবার বল ঠিকমত রিসিভ করতে পারেনি, আর একবার একটা ডায়গোনাল বল একটু বেশি জোরে বাড়িয়ে ফেলায় সেটা পার্শ্বরেখা পেরিয়ে গেছে --- এইদুটো ভুলের জন্য সে মরমে মরে ছিলো। মাঝের দুমিনিটের বিশ্রামে সে মনমরা হয়ে মাঠের একপাশে বসে রইলো।

    দ্বিতীয় অর্ধেরও অনেকটাই একইরকম সাদামাঠা ফুটবল দেখা গেল। উদ্দেশ্যহীন লম্বা পাস, যা হয় গোললাইন পেরিয়ে যাচ্ছে, নয়ত বিপক্ষ স্টপারের পায়ে জমা পড়ছে। সুশান্তবাবু ভ্রু ধনুকের মত কুঁচকে গেছে, ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন।

    এমন সময় একটা ঘটনা ঘটলো। মাঝমাঠের থেকে একটা আলগা বল নিয়ে আড়াআড়ি দৌড়োচ্ছিলো জয়ন্ত। কিন্তু বেশিদূর এগোবার আগেই রশিদ সেটা কেড়ে নিয়ে বাঁদিকে খেলে দিলো। ভালো পাস। বাঁ প্রান্ত দিয়ে খানিকটা দৌড়েই অভি দেখলো পুরো ডিফেন্সটা এক লাইনে দাঁড়িয়ে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে কে যেন তাকে দিয়ে একটা অসাধারণ থ্রু বের করিয়ে নিলো। অত ভালো একটা পাসের জন্য তৈরী ছিলোনা শঙ্কর। স্টার্ট নিতে তার একটু দেরিই হলো। তারপর তীরের মত দৌড়ে যখন বলটার কাছে পৌঁছালো সে, ততক্ষণে গোলকিপার প্রায় পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কোনমতে বুটের ডগা দিয়ে একটা হালকা লব করামাত্রই প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলো শঙ্কর। মাটিতে ছিটকে পড়ার ঠিক আগেই সে অবশ্য দেখে নিতে পারলো বলটা একটা ড্রপ খেয়ে গোলে ঢুকে যাচ্ছে।

    সুশান্তস্যার খুশিটা চেপে রেখে বোতল থেকে এক ঢোঁক জল খেলেন। খেলা আবার শুরু হওআর প্রায় সাথে সাথেই শেষের বাঁশি বাজিয়ে দিলো শুভাশিস। এবার ওকে গোলকিপিং করতে হবে।
  • Tim | 71.62.121.158 | ২৯ মার্চ ২০১০ ০৫:৩৯426608


  • দেখতে দেখতে সাতদিনের ট্রায়াল শেষ হয়ে এলো। শেষদিনের খেলাগুলো নমো নমো করে হবে। সিলেকশান একরকম হয়েই গেছে। সুশান্তবাবু এক এক করে রুলটানা খাতা থেকে নামগুলো পড়তে থাকেন, ভিড় থেকে বেরিয়ে নির্বাচিত ছেলেগুলো খুশি খুশি মুখে সার বেঁধে দাঁড়ায়। অল্পস্বল্প কানাকানি বাদে আওয়াজ শোনা যায়না।

    মোট পনেরোজন নির্বাচিত হয়েছে। প্রথম দিনের তিনটে দল থেকে যে পাঁচজন নির্বাচিত হলো তাদের নামগুলোই আগে পড়লেন সুশান্তবাবু। জয়ন্ত, রুবেল, শিবেনরা উচ্ছ্বসিত হয়ে বেরিয়ে এলো ভিড় ঠেলে। শঙ্করকে কোথাও দেখা যায়না। অবশ্য খুব একটা দরকারও পড়েনা তার। তার নাম নির্বাচিতদের তালিকায় নেই।
    **************
    বাড়ি থেকে বেরোতেই রাকেশের সাথে দেখা হয়ে গেল শঙ্করের। স্কুলে যাচ্ছে। দুজনে খানিকটা পথ একসাথে হেঁটে যায়। সেইটুকু পথ শঙ্কর মনে মনে ইষ্টনাম জপ করে। ভাবার চেষ্টা করে স্কুল টিমের কথা রাকেশকে গল্প করেছিলো কিনা। ট্রায়ালের কথা রাকেশ কি জেনে গেছে অন্য কারুর থেকে?

    ওদের রাস্তাদুটো একসময় আলাদা হয়ে যায়। শঙ্কর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু বেশিদূর যেতে হয়না.... উল্টোমুখেই ঝোটনদা আসছে, হাতে বাজারের থলে। ......
    এইভাবে চোরের মত কয়েকদিন কাটে শঙ্করের। স্কুল-বাড়ি-প্র্যাক্টিসের বৃত্তে ডুবে যেতে যেতেও যে কথাটা পিনের মত ফোটে, সেটা লুকিয়ে স্বাভাবিক সেজে থাকতে হয়। মালতি টের পান। মৃন্ময় আফিস থেকে বাড়ি ফিরে হালকা সান্ত্বনাবাক্য বলে ক্লান্ত চোখটা খবরের কাগজে মেলে দেন।
    সবথেকে মর্মান্তিক লাগে সুশান্তস্যারের কথাগুলো। ক্লাসে সবার সামনেই শঙ্করকে জানিয়ে যান তিনি, সে একটুও দাগ কাটতে পারেনি।
    শঙ্করের মনে বহু কথা, বহু তর্ক গজগজ করে। একেক সময় প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে ঠেকিয়ে রাখে সে। কেন তাকে অনভ্যস্ত জায়গায় খেলানো হলো, এই কথাটা জিগ্যেস করার জন্য ওর মনটা হাঁকপাঁক করে। স্ট্রাইকার থেকে রাইট ব্যাক! জীবনে প্রথমবার ঐ পজিশনে খেললো সে। মাত্র একটা ম্যাচেই স্যার বুঝে গেলেন ওকে দিয়ে হবেনা।

    কিন্তু এসব কিছুই জানা হয়না তার। সুশান্তবাবু পানটা গালে ঠুসে কথা শেষ করে অন্য ক্লাসে চলে যান। একের পর এক ঘন্টা পড়ে, ক্লাস শুরু ও শেষ হয়, শঙ্করের দিনগুলো হাঁফাতে হাঁফাতে কাটে, কোনক্রমে।

    একটা কথা ভেবে অবশ্য শঙ্কর অবাক হয়। প্র্যাক্টিসে কেউ ওকে এই নিয়ে কিছু বলেনা। ফুটবল নিয়ে গল্পগাছা ও রোজই হয়। সিনিয়ররা কোন কোন ক্লাবে ট্রায়াল দিয়ে এলো, কোন তাঁবুতে আচমকা কোন স্টারকে দেখে ফেলেছে সেইসব নিয়ে মুখর থাকে ওরা। বিদেশের খেলোয়ার আর দল নিয়ে জোট পাকিয়ে ঝগড়া করে ওরা। বিভিন্ন মিসপাস আর গোল নষ্টের হিসেব দেয়ানেয়া চলে। তখন ওদের দেখলে কে বিশ্বাস করবে ওরা ভারতবাসী, যে দেশের ফুটবল বিশ্বে কোন পরিচিতিই নেই।
    *********

    অন্যদের জীবনও চলে একই বাঁধা গতে। ভালোমন্দের দোলাচলে আস্তে আস্তে এগোয় ওরা বয়:সন্ধির দিকে। অসিতের গ্যারেজের চাকরিটা চলে যায় একদিন। রাকেশের বাবা আর ওদের কাছে ফিরে আসবেনা, জানা যায় একদিন। এইরকম করেই অনূর্দ্ধ পনেরোর দল ঘোষনা করেন সুবলস্যার। যথারীতি এক রবিবার ভাঁজ করা কাগজ থেকে নামগুলো পড়ে যান তিনি। কুড়িজনের দলে চারজন ফরোয়ার্ড। শঙ্কর চতুর্থ ফরোয়ার্ড হিসেবে চান্স পেয়েছে।
  • Manish | 117.241.229.42 | ২৯ মার্চ ২০১০ ০৯:৪৮426610
  • সাধু: সাধু:

  • Tim | 173.163.204.9 | ০৯ জুলাই ২০১০ ০৯:১৯426611

  • অনূর্দ্ধ পনেরোর ছেলেদের নিয়ে টুর্নামেন্ট। স্যার দুখিরামের নামে এই প্রতিযোগিতা চালায় আই এফ এ। বন্দোবস্ত খুব যে ভালো তা নয়, তবে স্থানীয় ফুটবলপ্রেমীরা মাঠের চারপাশে জড়ো হন। খেলাগুলো ফেলা হয় বিকেলের দিকে, প্রায়শই শনিবার করে, যাতে দর্শক হয়। ওদের প্রথম খেলা লেকের একটা দলের সাথে, হাকিমপাড়ার মাঠে। জায়গাটা খুবই কাছে, রংকল থেকে মিনিট পনেরোর হাঁটাপথ। একরকম ঘরের মাঠেই খেলা পড়েছে জেনে সবাই বেশ খুশি হলো।

    খেলার দিন ক্রমেই এগিয়ে আসছে, আর হয়ত সপ্তাহ তিনেক বাকি, এমন সময় জানা গেল আই এফ এর লোক বয়সের সার্টিফিকেট দেখে ক্লিয়ারেন্স দিলে তবেই মাঠে নামতে দেওয়া হবে। খেলার দিন ঐ অফিসার মাঠেই থাকবেন। কথাটা চাউর হওয়া অবধি শঙ্কর দেখলো, চারদিকে কানাকানি হচ্ছে। বয়সের কারচুপি, নকল সার্টিফিকেট আর ক্লাব রাজনীতি --- এইসব নতুন শেখা শব্দগুলো ওদের আচ্ছন্ন করে ফেললো কয়েকদিন। সম্বিৎ ফিরলো সুবলস্যারের বকুনির চোটে, তখন আর মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টা বাকি খেলার।

    শঙ্করদের টিমে বয়স ভাঁড়ানোর সমস্যা নেই। সবার আসল সার্টিফিকেটই জোগাড় হয়েছে। সুবলস্যার এই বিষয়ে খুবই কড়া। দীর্ঘ ক্রীড়া ও কোচিং জীবনে কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। খেলতেন ইস্টার্ন রেলে, প্রধানত মাঝমাঠে।

    সে যাই হোক, দেখতে দেখতে খেলার দিন এসে গেল। শনিবার, এমনিতেই সেদিন শঙ্করদের হাফছুটি থাকে। তাও খেলা আছে বলে এক পিরিয়ডের পর বাড়ি চলে এলো সে। বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা করছে, পায়ের তলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে, এমনকি ঘোর গরমকালেও টনসিলের কাছটা ব্যথা ব্যথা করছিলো ওর।

    সুবলস্যারের নির্দেশ, ক্যাম্পের সকলকে মাঠে হাজির থাকতে হবে। তাই একসাথেই মাঠের দিকে হাঁটছিলো চারমূর্তী।

    - কিরে, মুখটা এমন কেন? ভয় লাগছে?
    -নাহ্‌।
    - চিন্তা নেই আজ কৌশিক জিতিয়ে দেবে। ঐ মাঠ তো আমরা চিনি।
    বলতে বলতেই মাঠটা দেখা গেল দূর থেকে। এর মধ্যেই বেশ লোক হয়েছে। খেলা শুরুর সময় ভালোই ভিড় হবে, বোঝাই যাচ্ছে।
    শঙ্কর তখন মনে মনে ভাবছিলো আজ না নামতে হলেই ভালো হয়। এর আগে সে কখনও ভিড়ঠাসা মাঠে খেলেনি।

    ওরা মাঠের ধারে পৌঁছনেই ঝোটনদা দৌড়ে এলো।
    - শঙ্কু সার্টিফিকেট এনেছিস?
    -হ্যাঁ
    -যা শিগ্গির ড্রেস কর।
    বাকি তিনজন অন্যদিকে চলে গেল। শঙ্কর ছুটলো একটা বিশেষ দিকে। সেখানে সুবলস্যার সবাইকে জড়ো করে পকেটে হাত দিয়ে কিসব বোঝাচ্ছেন। শঙ্কর গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই একপাশে রাখা স্তূপীকৃত গাঢ় সবুজ জার্সিগুলো দেখতে পেল।

    কিছুক্ষণ পরেই স্যার কথা শেষ করে একটা পান মুখে দিলেন। আর অমিয়দা এসে ওদের জার্সি বাছাই করতে বললো। হলোই বা অনূর্দ্ধ পনেরোর টিম, জার্সির ভার সর্বত্রই সমান। দেখা গেল কেউ দশ নম্বর জার্সিটা পরতে চাইছেনা। শঙ্করও সযত্নে সেটা এড়িয়ে গিয়ে আট নম্বরটা তুলে নিলো। দশ নম্বরটা অবশ্য বেশিক্ষণ পড়ে থাকলোনা। কিছুক্ষণ পরেই বান্টি এসে পৌঁছলো, যেমন প্রায়ই সে দেরি করে আসে। এসেই দশ নম্বরটার তুলে আলতো করে কাঁধে ফেলে ওয়ার্ম আপ করতে নেমে গেল। শঙ্কর আড়চোখে দেখলো বান্টিকে। দুহাতে সাদা ব্যান্ড পড়েছে, জার্সিটা দৌড়োতে দৌড়োতেই পরে হাতাদুটো সামান্য গুটিয়ে নিলো বান্টি। সে ভালো করেই জানে সুবলস্যার এইসব পছন্দ করেননা। কিন্তু বান্টি ওরকমই।
    আজেবাজে কথা না ভেবে একটু মনসংযোগ করার চেষ্টা করছিলো শঙ্কর। খেলার টুকটাক বইতে সে পড়েছে মনসংযোগই আসল। এমন সময় সুবলস্যার ওকে ডেকে নিলেন। আরো তিনজনের সাথে শঙ্করও আপাতত মাঠের বাইরে থাকবে। পরে দরকার হলে নামানো হবে। মানুষের মন বড়ো জটিল। এতক্ষণ যদিও মনে মনে এইটাই চাইছিলো শঙ্কর, তবু এখন মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। ওরা মাঠের বাইরে আসতেই রেফারি দুদিকে তাকিয়ে খেলা শুরুর বাঁশি বাজিয়ে দিলেন।
  • Arya | 125.16.82.195 | ০৯ জুলাই ২০১০ ১০:১১426612
  • আমি অনেকদিন আগে, ফ্রিকিক বলে একটা গল্প পুজোবার্ষিকি শুকতারা বা আনন্দমেলায় পড়েছিলাম, লেখকের নামটা মনে আসছে না।
  • Shibanshu | 59.93.94.85 | ০৯ জুলাই ২০১০ ১৫:৫৩426613
  • ভালো এগোচ্ছে.....
  • de | 203.197.30.2 | ০৯ জুলাই ২০১০ ১৬:১২426614
  • খুব ভালো হচ্ছে টিম!
  • Arya | 80.221.18.28 | ০৯ জুলাই ২০১০ ২১:২৭426615
  • @Arya: একটা বাচ্চা ছেলে মোহনবাগানের এগেনস্টে ব্যাকভলিতে গোল করেছিল? ছেলেটার একটা ছোট্টো বোন ছিল, যে খেলার শেষে "আমার দাদা গোল করেছে, আমার দাদা গোল করেছে" বলে হাততালি দিয়ে লাফাচ্ছিল?
  • Abhyu | 80.221.18.28 | ০৯ জুলাই ২০১০ ২১:২৮426616
  • উপ্‌প্‌স: আগের পোস্টটা আমার :(
  • Tim | 108.228.61.183 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১২:৫৮426617


  • সাইডলাইনে বসে খেলা দেখতে বেশ লাগে শঙ্করের। পায়ের জঙ্গলে বলটা মাঝে মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে, কখনো এমাথা ওমাথা দ্রুততালে, কখনও ঢিমে গতিতে খেলা হচ্ছে, রেফারির বাঁশি, আসেপাশের লোকেদের উত্তেজনা, সব মিলিয়ে সময় কোথা দিয়ে যেন উড়ে চলে। তার মধ্যে যদি নিজেদের দল খেলে তো কথাই নেই। আজ অবশ্য খানিকটা নার্ভাসও লাগছে। বাইরে থেকে দেখলে এটা হয়, শঙ্কর জানে। যারা খেলছে তাদের অত ভাবার সময় নেই।

    দেখতে দেখতে হাফটাইম হয়ে গেল। স্কোরলাইন গোলশূন্য। ঘামে জ্যাবজ্যাবে জার্সিগুলো একে একে জড়ো হচ্ছে মাঠের ধারে, এমন সময় একটা কান্ড হলো। বান্টি এতক্ষণ শঙ্করের সাথেই বসেছিলো। দশ নম্বর জার্সি পরেও প্রথম এগারোয় জায়গা হয়নি তার, সেরকম কথাও ছিলোনা। সে হঠাৎ উঠে গিয়ে সুবলস্যারকে কিছু বললো। পাশেই ঝোটনদা বসে, শঙ্কর স্পষ্ট দেখলো তার ভ্রু কুঁচকে গেল। সুবলস্যার সম্ভবত "ঠিকাছে, দেখছি" বলে অন্যদিকে চলে গেলেন। বান্টি এসে গজগজ করতে করতে আবার বসলো।

    - তুই স্যারের সাথে যেচে কথা বললি?
    -হুঁ, বললাম সেকেন হাফে আমাকে নামাবেন? নইলে এক জায়গায় যাওয়ার ছিলো
    -এরকম বললি?!!

    বান্টি উত্তর দিলোনা। ইতিমধ্যে আবার খেলা শুরু হয় হয়। ঘামে ভেজা জার্সি নিঙড়ে নিয়ে পরেছে কেউ কেউ। শঙ্করদের দলে কোন পরিবর্তন হয়নি, লেকের দলটি রাইট হাফে নতুন মুখ এনেছে। আবার এমাথা ওমাথা দৌড়, জটলা, বাঁশির আওয়াজ....

    -এই শঙ্কর, তোকে ডাকছে না?
    - ক্কই! কে ...

    ঝোটনদা ডাকছে। শঙ্কর উঠে যেতেই ধমক দিয়ে বললো, কতক্ষণ ধরে ডাকছি, মন কোনদিকে থাকে? ওয়ার্ম আপ করে নে। অলকের জায়গায় নামবি। অলক রাইট আউট, শঙ্করের হাত পা হিম হয়ে গেল। তার তো তেমন স্পিডই নেই।

    শঙ্কর নেমেই বুঝলো সে অসম্ভব জড়োসড়ো হয়ে আছে ভেতরে ভেতরে। কেমন যেন মনে হচ্ছে বাকি দশজন এক সুতোয় গাঁথা আর সে খাপছাড়া। শুরু থেকে না খেললে কি এরকম হয়?

    অবশ্য অত ভাবার সময় নেই। বিপক্ষের স্টপার একটা বল হাওয়ায় ভাসালো, সেটা ধরে খানিক এদিক ওদিক করে লেফট হাফ বলটা জমা দিলো অসিতকে। সে বাঁদিকে খানিক দৌড়ে চকিতে টার্ন নিয়ে ফাঁকায় পুশ করার আগেই শঙ্কর দৌড় শুরু করেছিলো, অতি সহজেই সে বলটা পেল। বলতা পেয়েই ডানদিক ধরে একটু এগিয়ে সেন্টার। সুমিতের হেড লেকের গোলকীপার ফিস্ট করে দিলো। কর্নার!

    কর্নারের সময় বেশিরভাগ খেলোয়াড় পেনাল্টি বক্সেই ধাক্কাধাক্কি করে, শঙ্করের সেটা পছন্দ না। সে বক্সের গা ঘেঁষে বাইরেই দাঁড়ালো। অসিত কর্নার নিতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে বলটা শঙ্করকে ঠেলে দিলো। শঙ্কর দেখলো এখান থেকে চমৎকার শট নেওয়া যায়, কিন্তু সেসব করার আগেই কে একজন একছুটে এসে একটা ঝটকা মেরে বলটা কেড়ে নিয়ে দৌড়োলো। শঙ্কর দেখলো, সেই নতুন মুখ বলটা নিয়ে লম্বা স্ট্রাইডে ছুটছে, শঙ্করদের ডিফেন্সে শুধু রঞ্জিৎ আর বাদল। নতুন মুখ রঞ্জিৎকে স্রেফ স্পিডেই পেরিয়ে গেল, আর বাদলকে আউটসাইট ডজে। তারপর টপ বক্সের কাছ থেকে কোনাকুনি জোরালো শট নিলো, সুপ্রিয় নড়ার আগেই বল জালে জড়িয়ে গেছে।

    বাকি সময়টা কি হলো শঙ্করের ভালো মনে নেই। শেষের দিকে আরেকটা কর্নার থেকে সে একটা ভলি মেরেছিলো, যা ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে। দিন খারাপ হলে এরকমই হয়। খেলাশেষে একা একাই বাড়ির পথ ধরলো শঙ্কর। ততক্ষণে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। স্কুলবাড়ির ভেতর দিয়ে শর্টকাট নিয়ে বাড়ি যখন এলো তখন অন্ধকার এখানে ওখানে দলা পাকিয়েছে। নারকেল গাছ থেকে গলা বের করে তক্ষকটা ডেকে উঠলো, শঙ্করের মনে হলো ওকে টিটকিরি দিচ্ছে। রুটির গন্ধ, আর ঝিঁঝির ডাকে ঘুম আসছে। লজ্জার, ক্লান্তির, গভীর ঘুম।
  • T | 165.69.199.16 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৩:২৪426618
  • পড়ছি।
  • T | 165.69.199.16 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৩:৩৭426619
  • বাপ্রে...ছ বছর পরে।
  • Tim | 108.228.61.183 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৩:৫৮426621


  • হাকিমপাড়াতেই সুপ্রিয়র বাড়ি। এমনিতে সে বেশ চৌকশ খেলোয়াড়, হাসিটিও মিষ্টি, কিন্তু হারলেই বড়ো মুখ খারাপ করে। এন টি স্পোর্টস কাউন্সিল, অর্থাৎ শঙ্করদের ক্যাম্প প্রথম রাউন্ডেই হেরে বিদায় নিয়েছে, আর গোলের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ দায় শঙ্করের, এইটা পরিষ্কার হয়ে যেতেই বেশ গোলমাল হলো। সুপ্রিয় মাঝেমধ্যেই নানা অছিলায় শঙ্করকে খিস্তিখাস্তা করে। সেদিন একটা নির্বিষ থ্রু রিসিভ করতে না পারা নিয়ে খেলার পরে রসিয়ে ফুট কাটছিলো। শঙ্করের মাঝে মাঝে মনে হয় এইসব খেলাধুলো ওর জন্যে নয়, ওর হবেনা। কিন্তু ছেড়ে দিতেও মন চায়না। খেলার পাতার প্রতিবেদন বা ছবি দেখে সে প্রায়ই স্বপ্নাবিষ্ট হয়। দেখে, কানফাটানো চিৎকার, আর তার মাঝে সে একটা ইনস্টেপে শট নিলো, গোলকীপার ঝাঁপিয়েছে, আর বলটা সোয়ার্ভ করে.....

    দেখতে দেখতে শীতকাল আসে। রংকলের মাঠে এখন সকালের দিকে ভারি কুয়াশার চাদরে কিচ্ছু দেখা যায়না বলে প্র্যাক্টিসের সময় পিছিয়ে গেছে। সময়ও কম পাওয়া যায় এখন। মাঠ শক্ত হয় এই সময়, তাই বর্ষামাঠের লম্বা স্টাড পরা যায়না। এই মাঠে খেলার জন্য খাটো স্টাডের বুট চাই, সিন্থেটিক হলেই ভালো। ওদের বেশিরভাগেরই সেসব নেই, কোনমতে একজোড়া জুতোই জোগাড় হয়েছে। তাই প্রায় সবাই কেডস পরে আসে প্র্যাক্টিসে। শঙ্কর অবশ্য এসব জানেনা, তবে তারও একজোড়াই জুতো। এই সময় প্র্যাক্টিসও পাল্টে যায়। বেশিরভাগই ফিজিকাল ট্রেনিং আর শেষে নমো নমো করে আধঘন্টার ম্যাচ। ময়দানেও এটা সবথেকে ঝিমিয়ে চলা সময়। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান আর মহমেডান স্পোর্টিং নিয়ে উত্তেজিত তর্কবিতর্ক এখন মাঝে সাঝে হয়, রোজ না। বরং বিদেশের লীগের কিছু কিছু খবর আসে।

    অসিত এখন আর খেলতে আসেনা। নেপালগঞ্জ পেরিয়ে কোথায় যেন জন খাটতে যায় কাকভোরে। পুরোনোরা অনেকেই কোথায় যেন সরে যায়। লাল্টু, তপন, কৌশিকদা, রজতদা, অনেক নাম। অবশ্য নতুন মুখও আসে। সেই যে লেকের দলের হয়ে গোল করেছিলো, সেই ফর্সা ছিপছিপে ছেলেটা এসে ভর্তি হয় শঙ্করদের ক্যাম্পে। ওর নাম নঈম, বাড়ি আনোয়ার শা রোডের কাছে। শঙ্কর ভাবে, এতবড়ো প্লেয়ারের নামে নাম, এ ভালো কিছু হবেই হবে। নঈম স্কুলে যায়না বললেই চলে, ওর বাবা মা নেই, এক কাকার কাছে থাকে। প্রথমদিনের প্র্যাক্টিসেই নঈম হ্যাট্রিক করে, তার দুপায়েই চমৎকার পাঞ্চ। শঙ্কর মুগ্ধ ও নবলব্ধ বন্ধুর ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিত হয়। প্রায়দিনই খেলাশেষে কয়েকজন জটলা পাকায়। চিনু, জামাল, শঙ্কর আর নঈম।

    হাফ ইয়ার্লিতে শঙ্করের অন্যবারের তুলনায় ভদ্রস্থ রেজাল্ট হয়। অঙ্কে চুয়ান্ন তার কাছে ভালো নম্বরই বলা চলে। বাকি গুলোতেও পঞ্চাশ-ষাটের ঘরেই থাকে। অবশ্য মালতি খুবই চেঁচামেচি করেন। বাবাকে তেমন ভয় নেই, শঙ্কর জানে। তাই কোনক্রমে মায়ের নিন্দেমন্দ হজম করে সে রেডিওটা চালিয়ে দেয়। শীতকাল, তাই ক্রিকেট রিলে হচ্ছে। ইডেনে টেস্টম্যাচ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এসেছে শহরে। কদিন আগেই সে প্র্যাক্টিসের পর ক্লাবের পাঁচিলে অনেক লোক দেখেছিলো। ঐ ক্লাবে গল্ফ খেলা হয়, সেখানে নাকি ক্রিকেটাররা এসেছে। ঐ পাঁচিলে কাচের ফালি লাগানো, বা পেরেক কোথাও কোথাও, তাই মালতি জানতে পারলে সমূহ বিপদ। শঙ্করের তাই গ্রিনিজ, হেন্স, রিচার্ডস কাউকে দেখা হয় নি। এখন তাদের নাম শোনা যাচ্ছে রেডিওতে। শঙ্কর ডাল ভাত আলুসেদ্ধ আর রিলে গোগ্রাসে গেলে। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারত হেরে যায়। ইডেনের পাটাপিচেও, মাত্র কয়েক ঘন্টায়। পাশের বাড়ি থেকে বিনোদবাবু হতাশায় "ছাগোল, যত ছাগোল জুটেছে" বলে টিউশনে আসা ছাত্রদের না ভারতীয় ব্যাটসম্যান কাদের গালাগাল দেন, বোঝা যায়না।

    ক্রিকেট টীমের সাথে সাথে একসময় শীতেরও শেষ ঘনায়। এই সময়টাই শঙ্করের জন্য সবথেকে খারাপ। একদিকে নতুন সিজন শুরু বলে তার ভেতরটা ছটফট করতে থাকে। অন্যদিকে অ্যানুয়াল পরীক্ষাও ক্রমশই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে জানান দেয়। পূর্নেন্দুবাবুর ক্লাসটেস্টে চল্লিশে সাত পায় সে। খাতাটা মুড়েটুড়েব্যাগের গহীন কোনে জমিয়ে রেখে খেলতে যেতে হয়। ইদানীং মাঠে আবার ভালো লাগছে খুব। আজকাল পায়ে বল রাখতে পারছে বেশিক্ষণ। নঈমের সাথে স্প্রিন্ট টেনে খুব আরাম, চিনুর সাথে ওয়াল খেলে। সেদিন চারজনে ননস্টপ আধঘন্টা জাগলিং করেছে। এইসব , আরো ছোট ছোট আনন্দ ওদের কিছুক্ষণ ভুলিয়ে রাখে। ক্লাসটেস্ট, বড়োদের চোখরাঙানি, চাকরির আকাল আর নিভে আসা কলজের দেশে ওরা বড়ো হতে থাকে।

    মার্চের মাঝামাঝি অনেকগুলো নতুন খবর আসে। এক রবিবার সুবলস্যারের কাছে আসে শক্ত গড়নের দুটি মেয়ে। ওরা আসতেই গুজগুজ করে কেউ কেউ। কিছুক্ষণ থেকে, স্যারকে প্রণাম করে ওরা চলে যায়। সেদিনের শেষে সুবলস্যার সবাইকে ডেকে জানান, পরেরদিন থেকে আরো দুজন তাদের সাথে প্র্যাক্টিসে আসবে।

    - বর্ণাকে তোমরা আশাকরি চেনো। আর অন্যজনও চেনা অনেকের, ওর নাম কৃষ্ণা। তোমরা আশাকরি কোনরকম অসভ্যতা করবেনা।

    এই বলে স্যার চলে যান। শঙ্কর এদিক ওদিক দেখে। তারপর ক্রমশ সব স্পষ্ট হয়। বর্ণা অর্থাৎ বর্ণালী ঘোষ ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের সদস্যা, খুবই নামকরা প্লেয়ার। আর অন্যজন এখনও ইন্ডিয়া খেলেনি তবে বাংলার হয়ে রেগুলার। দুজনেই সুবলস্যারের ছাত্রী।
    অন্য খবরগুলো হলো, এক, এই গ্রীষ্মের ছুটিতে গোল্ড কাপ হবে এই রংকলের মাঠেই। সেখানে ফার্স্ট ডিভিশন প্লেয়ারদের অনেকে খেলবে। দুই, স্পোর্টস কাউন্সিলের কোচিং স্টাফ পাল্টে যাচ্ছে। তিন, আর এটাই সথেকে মর্মান্তিক, আগামী একমাস প্র্যাক্টিস বন্ধ, ঐ সময় একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আছে।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন