নাগরিকত্ব আইনের পাশাপাশি বিদেশি চিহ্নিত করার আইনও দেখা দরকার। ১৯৪৬-এর ব্রিটিশ শাসকদের হাত ধরে আসা আইন অনুসারে একজন যে বিদেশি নয় সেইটা প্রমাণ করার দায়িত্ব সেই ব্যক্তির ছিল। এই আইনের ফলে, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে (বিশেষতঃ আসামে), ১৯৮৩ সালে ইল্লিগাল মাইগ্রেশন (ডিটারমিনেশন বা ট্রাইবুনাল) বা IMDT আইন প্রচলন হয়। এই আইনে একজনকে বিদেশি হিসেবে অভিযুক্ত করলে তা অপ্রমাণের দায় আর সেই ব্যক্তির থাকল না বরং পুলিশ এবং অভিযোগকারীকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রমাণ দিতে হতো। বিদেশি আইনের ফলে সাধারণ গরিব মানুষের নির্যাতন অনেকটাই কমাতে সক্ষম হয়েছিল এই IMDT আইনটি। এই আইনের ফলে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোখা যাচ্ছেনা বলে সর্বানন্দ সোনোয়ালের করা একটি মামলার ভিত্তিতে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা আইনটি বাতিল করা হয়। ফলে, একজন যে বিদেশি নন, সেই প্রমাণের দায়িত্ব তাঁর ঘাড়েই পড়ে। অর্থাৎ দেশের যেকোনও মানুষকে নাগরিকত্ব আইনের ধারা অনুযায়ী তথ্য পেশ করতে হতে পারে, বিদেশি হওয়ার অভিযোগ এলে। ... ...
মুম্বাইয়ের বিশিষ্ট পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ নির্বাসন ভেঙে টুইটারে ফিরে এসে বিবৃতি দিয়েছেন নতুন আইনের বিরুদ্ধে। বললে বিশ্বাস করা মুশকিল, চেতন ভগতও ছাত্রদের উপর রাষ্ট্রীয় হামলার নিন্দা করেছেন। সারা ভারতের নারী-পুরুষরা যাঁদের কথা ভেবে শয়নে-স্বপনে নালেঝোলে হন, যাঁরা মাঝেমাঝে টিভিতে 'সামাজিক' বিষয়ে অনুভূতিপ্রবণ অনুষ্ঠান করেন, সোশাল মিডিয়ায় বাণী দেন, মুম্বইয়ের সেই বৃহৎ তারকারা অবশ্য এই সংকটকালে নিশ্চুপ। বাংলাও ব্যতিক্রম নয়। বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে কেউ কেউ এর বিরুদ্ধে পক্ষ নিলেও সিনেমার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, যাঁরা আজকাল সিনেমার সুবাদে টিভি থেকে সংসদ সর্বত্রই সহজে ঢুকে পড়েন, তাঁদের মধ্যে তেমন নড়াচড়া দেখা যাচ্ছেনা। খুব সম্ভবত কোন পক্ষ নিলে সুবিধে হবে, তাঁরা এখনও এই জল মাপতেই ব্যস্ত। ... ...
এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, বাঙালি হিন্দু হল বোঝা, এবং বাঙালি 'আধিপত্য'কে সরকারিভাবেই বিপদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আসামে 'অবৈধ বাংলাদেশী' হিন্দুর একটা মনগড়া সংখ্যাও দিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। কারা এই 'বাংলাদেশী হিন্দু?' আসামে বা গোটা দেশে? কেউ জানেনা। জানা সম্ভবও না। তাই খুব সম্ভব গোটা বাঙালি জাতিকেই বাংলাদেশী না হবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। ভারতের অন্য কোনো জাতির এই সমস্যা হবেনা, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব বাঙালিই সন্দেহের পাত্র। দীর্ঘদিন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যাঁরা এই বাংলায় বসবাস করে এসেছেন, প্রত্যেককে সম্ভবত আরও একবার নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। কীভাবে প্রমাণ হবে? কেউ জানেনা। না করতে পারলে কী হবে? কেউ জানেনা। ... ...
ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ অগণিত। প্রতি মুহূর্তে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের খবর আসছে। আলাদা করে দেওয়া অসম্ভব। তবে বস্তুত ভারতবর্ষের প্রতিটি কোণে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। এরই মধ্যে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায়, শোনা যাচ্ছে, এক আর-এস-এস কর্মী বিক্ষোভকারীদের হাতে ধরা পড়েছেন। তিনি মুসলমান সেজে ধ্বংসাত্মক কাজকর্মে উসকানি দিচ্ছিলেন। আর বহু জায়গায়ই এরকম চেষ্টা চলছে বলে আশঙ্কা। তবে এইটুকুর বাইরে বাংলায় বিজেপির আর তেমন অস্তিত্ব চোখে পড়ছেনা। তাদের বিখ্যাত আইটি সেলও ক্রমশ অকার্যকর হয়ে যাবার সম্ভানায় অবশ্য তীব্র প্রচার চালাচ্ছে। ছড়ানো হচ্ছে ভুয়ো খবর, ভিডিও, উত্তেজক বাণী। তা নিয়ে প্রতিবাদও হচ্ছে। প্রবল জনবিক্ষোভে মেঘালয়ের রাজ্যপালকে ছুটিতে যেতে হয়েছে। তিনি উত্তর কোরিয়ায় ছুটি কাটাতে গেছেন কিনা অবশ্য জানা যায়নি। ... ...
গভীর রাত থেকেই ছাত্ররা রাজপথে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অবস্থান। ছাত্রছাত্রীরা গভীর রাতে যাদবপুর থেকে উপস্থিত হয়েছেন সেখানে। সারা রাত অবস্থান বিক্ষোভ চলেছে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত। বিক্ষোভ চলছে এন-আর-সির বিরুদ্ধে, এন-পি-আর এর বিরুদ্ধে। নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে। স্লোগান চলছে কেন্দ্রীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় সরকারের একনায়কত্ব না যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঞ্চলিকতাকে রক্ষা করা? সংখ্যাগুরুর একচেটা একনায়কতন্ত্র, নাকি ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুর সমানাধিকার? বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মূল প্রশ্নটি এইই। প্রথাগত বাম, শাসক তৃণমূল ছাড়াও বাংলা জাতিয়তাবাদী শক্তিগুলিও এবারের আন্দোলনে ভীষণভাবে সক্রিয়। সব মিলিয়ে কলকাতা হয়তো শাহবাগ ধাঁচের একটি গণ-আন্দোলন দেখতে চলেছে আজ থেকে। অন্যান্য মিডিয়া প্রকাশ করুক না করুন, এই আন্দোলনের খবর আমরা প্রকাশ করে চলব। নজর রাখুন এই পাতায়। ... ...
আমরা এক পা এগোলে হিন্দুত্ববাদীরা পাঁচ পা এগিয়ে যায়। ফলে আমরা যারা এতদিন সিএবি এর পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে তার বিরোধিতা করেছি, শীতকালীন অধিবেশনে যে ভার্সনটি বিজেপির নিয়ে আসবার কথা তাতে সেই বিরোধিতার প্রসঙ্গগুলি হিসেব করেই আনা হবে বলে আমার ধারণা। ২০১৬ সালের বিলটি অবিকৃতভাবে আবারও রাজ্যসভায় এবং লোকসভায় পেশ করা হবে, এই অনুমান ভুল প্রমাণিত হতেই পারে। গতবারের বিলটিতে লেখা ছিল যে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত এবং পাকিস্তান বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান এর নাগরিক মানুষদের এদেশ থেকে পাসপোর্ট আইন অনুযায়ী বহিষ্কার করা হবে না এটুকু মাত্র। এই বিলে খুব সম্ভাবনা যে কোনও ভাবে নাগরিকত্ব প্রদানের সম্ভাবনার বিষয়টি যুক্ত করা হবে, আইনের ফাঁকফোঁকর রেখে। তাহলে বিরোধীদের মুখ অনেকটা বন্ধ করে দেওয়া যাবে। আমরা প্রথম থেকে প্রশ্ন তুলে আসছি যে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় একজন মানুষ এবং তার পরিবার কি প্রমানপত্র সঙ্গে নিয়ে আসতে পারে যাতে সে প্রমাণ করতে পারে যে তারা এই তিনটি দেশের নাগরিক ছিলেন, ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়েছিলেন এবং তারা এই অমুসলিম? হতেই পারে যে এতদিন যা গ্রাহ্য করা হয়নি সেই সেল্ফ ডিক্লারেশন বা এফিডেভিট কে গ্রাহ্য নথি হিসেবে মেনে নিয়ে এদেরকে আপাততঃ এ দেশে থাকার অনুমতি দেওয়া হলো। তাহলেই তো অনেকগুলি বিরোধিতার জায়গা দূর হয়ে যাবে। ... ...
প্রথম থেকে এই তালিকা বিয়োজনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। বর্তমানে এনার্সি শুধু আসাম নয়, ভারত নয়, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রক্ষাপটেও একটি উল্লেখযোগ্য আলোচ্য বিষয়। প্রতিটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী, তাদের গণসংগঠন, প্রতিটি ভাষিক গোষ্ঠী, তাদের প্রতিনিধিত্বকারী দল উপদল, প্রতিটি ধর্মীয় গোষ্ঠী যাদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভূগোল-ইতিহাস, তারা নিজের সুবিধামতো, নিজের রাজনৈতিক লাভ, সামাজিক লাভ ক্ষতি বিবেচনায়, একটি করে আনুমানিক সংখ্যা ঠিক করেছেন, এবং প্রত্যাশা করেছেন সেই সংখ্যাই প্রতিফলিত হবে এনার্সির চূড়ান্ত তালিকায়। অসমীয়া চেয়েছেন বাঙালির নামকর্তন হোক প্রভূত পরিমাণে, বাঙালিরা উল্টোটা চেয়েছেন। হিন্দুরা চেয়েছেন মুসলমান বিতাড়িত হোক এই ভূখণ্ড থেকে, মুসলমানরা চেয়েছেন মুসলমানের সংখ্যা কম হোক, হিন্দুরা চিহ্নিত হোক বেশি পরিমাণে। এবং এই ভাবেই সম্পূর্ণ নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে নাম বিয়োজনের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে এনার্সির চূড়ান্ত তালিকা। ... ...