আমি রবি ঠাকুরের কবিতাও গড়্ গড়্ করিয়া বলিয়া যাইতে পারি। যেমন, ছপ্পড় পর কৌঁয়া নাচে ও আর কত কাল একা থাকব। এরূপ ভীষণ স্মরণশক্তি আজিকালকার বাঙ্গালীদের মধ্যে দেখা যায় না। শুনিয়াছিলাম মহাপুরুষ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের এইরূপ ভীষণ স্মরণশক্তি ছিল। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয় বাঘের ন্যায় গর্জ্জন করিতে পারিতেন। এ কারণে লোকে তাঁহাকে বাঙ্গালার বাঘ বলিত। তিনি একবার অত্যাচারী বৃটিশ শাসকের বাড়িতে গিয়া এইরূপ ভয়ানক গর্জ্জন করিয়াছিলেন যে অত্যাচারী বৃটিশ শাসক ভয় পাইয়া তাঁহার নামে একটি অট্টালিকা লিখিয়া দেয়। সেই অট্টালিকাতে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয় একটি কলেজ স্থাপন করেন। সেই কলেজ অধুনা আশুতোষ কলেজ নামে খ্যাত। এইরূপ আরো বহু ঘটনার কথা আমি নানা দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থে পড়িয়াছি। এইভাবে নানা দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের পর গ্রন্থ পড়িতে পড়িতে আমি বর্ত্তমানে একজন কেও-কেটা হইয়াছি। আমার সহিত এখন আর কেহই পাল্লা টানিতে পারিবে না। ... ...
আর দেখুন, রবীন মণ্ডল তো কলকাতার লোক কেনে নি। কিনেছে দিল্লী আর মুম্বাইয়ের বায়াররা। লাস্ট ফোর-ফাইভ ইয়ার্স, দে আর বায়িং টু বিল্ড আপ দেয়ার স্টক। এরপর কী হবে? মার্কেটে যা পড়ে আছে, ওরাই কিনে নেবে - দরকার হলে, বেশী দামে হলেও। দেন, দে উইল ক্রিয়েট আ ডিমান্ড, আ ক্রাইসিস - প্রাইস চড়চড় করে বাড়বে। দিস হ্যাপেনড উইথ সুজা অ্যান্ড টেক মাই ওয়ার্ডস, দ্য সেম ইজ গোয়িং টু হ্যাপেন উইথ রবীন মণ্ডল। বেশ কথা। শাঁসালো কালেক্টর কদ্দূর সহমত হলেন, বলতে পারি না। আমার শুধু মনে পড়ে গেল, রবীন মণ্ডল চেয়েছিলেন, তাঁর ছবি দেখে দর্শক যেন দর্পণের মুখোমুখি হন। কে সেই দর্শক? দর্পণের মুখোমুখি হয়ে ডিজাইনার হেয়ার-সালোঁ থেকে ছেঁটে আসা চুলটুকু গুছিয়ে নেওয়া বাদে সেই ধনী মানুষটি আর কী করবেন? ... ...
ছুটতে ছুটতেই দারিয়ানাসু লুকোনো দরজার দূরত্ব মনে মনে মেপে নেয়, মনে মনেই একবার হাসে। নিশ্চিন্ত হবার হাসি, পেছনে ছোটা ঘোড়সওয়ারদের বোকা বানানোর হাসি। আরও পিছনে হৈ-হৈ করতে থাকা লোকগুলোকে এখন দেখা যাচ্ছে না, টিলার আড়ালে হারিয়ে গেছে। ঘোড়সওয়ারদেরও দারিয়ানাসু আগেই বোকা বানিয়ে দিতে পারত, হরিণের মতো ছুটতে পারে সে, কিন্তু পিঠের দামি বোঝাটা ফেলে দিতে চায়নি। অবশ্য তাতে কিছু ক্ষতি হয় নি তার, আর বিশবার শ্বাস নিতে-না-নিতেই সে পৌঁছে যাবে লুকোনো গোল দরজার পাশে। ব্যাস, তারপর একটা ছোট্ট লাফ, তারপর দু’পলকে দরজার ফাঁকটুকু বুজে যাবে। হাঃ হাঃ হাঃ, ঘোড়সওয়ারগুলো বুঝতেই পারবে না কোথায় ভ্যানিস হল তাদের শিকার। ছাউনিতে গিয়ে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবে অন্যদের কাছে, বলবে ভুতুড়ে মানুষের কথা, যাদের দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। ... ...
বাঙালি মাত্র বিদেশে গেলেও দেশের খাবার খোঁজে। দিল্লী স্টেশনের বাইরে বাংলা সাইনবোর্ড যারা দেখেছেন তারা জানেন। মালিক হতে পারে রাজস্থানি, দুটো বাঙালিকে কাজে রেখে দিব্বি দু পয়সা করে খাচ্ছে। আমিও এতে দোষের কিছু দেখিনা। কথাতেই বলে, আপ রুচি খানা। যা পছন্দ হবে খাও, কে কি বলবে হ্যা ! তো, ওই গাইডগিরি করার সময়, কানে কানে ফিসফিস করে সাদেক মিয়ার হোটেলের (মানে ওই, রেস্টুরেন্ট, আমরা ওটাকেই হোটেল বলি) কথা বলে দিতুম। এই সাদেক মিয়ার কথা আগেও বলেছি, এনার মাইয়ারে আমি বাংলা পড়ানোর নাম করে গল্পগুজব করতুম হফতায় দুদিন। টুরিস্টদের বলতুম, দেশের কথা মনে পড়ে যাবে, ফেরার টিকেট দু দিন এগিয়ে আনতে হবে, এতো ভালো এর খাবার। ... ...
আমরা মূলত সুখস্মৃতিটুকু নিয়েই নস্টালজিক হই। এবার দেখি সাইকোলজিস্টরা কি বলেন এই ব্যাপারে। তারা বলেন আপনার নস্টালজিয়া কেবল আপনিময়। অর্থাৎ আপনার স্মৃতি, আপনার অতীত, যা আপনি ছিলেন, যা আপনি হয়েছেন, এই সবে মিলে আপনহারা। সব মিলিয়ে নস্টালজিয়া হল আপনার ‘আমি কে?’ প্রশ্নের উত্তর। সত্যি কথা বলতে আপনি হলেন এমন একটি সময়রেখা (timeline) যে তার অতীতের কিছু স্মৃতি মনে ধরে রেখে দেয় এবং অতীত ও বর্তমানের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে একটি কন্টিন্যুয়াম তৈরি করে। খুব কঠিন হয়ে গেল? সাইকোলজিস্টরা বলেন আপনার অতীতের ঘটনার সাথে বর্তমানের যে যোগসূত্র সেটিকে শক্ত করে এই নস্টালজিয়া। সময়ের সাথে সাথে আপনি পালটান, আপনার অভ্যাস পালটায়, বন্ধুরা পালটে যায়, কাজকর্ম, পরিবেশ, চিন্তাভাবনা সবই পালটাতে থাকে। কিন্তু নস্টালজিয়া আপনাকে সাহায্য করে এই সব ঘটনার সাথে যুক্ত রাখতে। এই নস্টালজিয়াই আপনাকে সাহায্য করে বয়ঃসন্ধি কালে বা বার্ধক্যে এসে পৌছোলে, ভূতপূর্ব জীবনের সাথে ব্যালেন্স বজায় রাখতে। ... ...
ছােট্ট পরী বড় বড় চোখ করে তাকায় 'তােমার মন খারাপ?' 'আমার আর চাকরি নেই। আজ থেকে... ছুটি।' 'বাঃ । কী ভালাে হলাে। আমরা আরাে গল্প করবাে। না?' 'কোথায় থাকবে পরী। আমাকে তাে এই অফিস ছেড়ে চলে যেতে হবে।' 'ওহ' একটু চিন্তায় পড়ে পরী। যখন চিন্তা করে পরী তখন তার রং হয় বেগেনেটে আর কেমন একটা সামুদ্রিক সৌগন্ধে ভরে যায় অশােকের কামরা। থির থির করে কাঁপতে থাকে পরী -অশােকের মুঠি ভরে ওঠে মখমলী ভায়ােলেট রঙে। চোখে মুখে ছিটে লাগে আর কানের কাছে শােনে গভীর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস। কোন অলৌকিক বেলাভুমিতে আছড়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ'র ব্যার্থ ছোবল। শ্যাওলার আঁশটে গন্ধ। 'তােমার ব্যাগে থাকবাে আর রাত্রিবেলা, যেমন নিয়ে যাও আর নিশুত রাতে আমাকে বারান্দায় নিয়ে যাবে - আমরা কালাে আকাশের নীচে দাঁড়াবো আর মিটমিটে তারাদের ঝিকমিকি আলাে পান করবাে। কেমন?' ... ...
নদীতে মৎস্য শিকার, অন্ধকারে নদীজলে টর্চের আলো ফেলে মাছ ধরার সে এক অদ্ভুত কৌশল। টর্চের নীলাভ আলো মাছের চোখে পড়লে জলেও খালবিলে মাছ স্থির হয়ে যায়। নড়তে চড়তেও পারে না আর। তখন ঝোপ বুঝে কোপ মারলেই হলো। কেউ কেউ তো তলোয়ারের কোপ মেরেই মাছটাকে করে ফেলে দু'টুকরা, নদীজলে রক্তারক্তি কাণ্ড। শশাঙ্ক বেহেরা অতোটা আবার নিষ্ঠুর নয়। টর্চের ফোকাস মাছের উপর ফেলে রেখে অন্য হাতে মাছটাকে খপ করে তুলে নেয় সে। তার যে জীবন্ত ধরাতেই আনন্দ। এই কিছুদিন পূর্বেও সুবর্ণারেখা নদীতে ইলিশ উঠত। খান্দারপাড়া গ্রামের ঝড়েশ্বর পানী আর মাধব পানী দুই ভাই, নদীবুকে পাটায় দাঁড়িয়ে দিবারাত্রি অষ্টপ্রহর জাল ফেলত। দিনে তাদের গড়ে বত্রিশটা ইলিশেরও রেকর্ড আছে। এখন সে দিনকাল আর নাই। জিজ্ঞাসা করলে তারাও তেরচা করে বলে "আঘু তভু অনেক ইলশা উঠতায় সুবনরেখায়। অখন সে ইলশা কুবে আছে জানু?কলকাতায়!" ... ...
ধ্যান করার প্রথম ও প্রধান কারণ হল নিজের চারপাশে ভ্যাকুয়াম বলয় সৃষ্টি করা। নিজের সত্তাকে ট্রানসেন্ড করানো মানেই হচ্ছে তাকে শব্দের জগত থেকে বের করে আনা। এবং আত্মা যখন ট্রানসেন্ড করে তখনই তো আমরা শরীর ধরে কান্নাকাটি করি! আমরা যাকে মৃত্যু বলি সে শুধু দেহেরই ঘটে। আমাদের ভালোবাসা কেবলই বস্তুকে ঘিরে। মানুষের যদি বাদুড়ের মতো দৃষ্টি না থাকতো তাহলে দৃশ্য বা বস্তুর আবেদন অনেকখানি কমে যেত; এক্ষেত্রে সৃষ্টির সেরা জীব হত বানর গোছের কিছু একটা। ... ...
কবে থেকে মামা ফকিরের এই কেরামতি , গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক বৃদ্ধ মানুষটি জানান, যেদিন নোয়াখালিতে বাবুজি মহাত্মা গান্ধী আসেন আর মালগাড়ী কামরাভর্তি করে মরা মানুষ এনে ভৈরবের মেঘনা নদীতে ফেলে দেওয়ার খবর বাতাসে উড়তে উড়তে এই গ্রাম পর্যন্ত এসে পোঁছেছিল সেদিন কাকডাকা ভোরে মামা ফকির প্রথম আগুন আগুন! বলে চিৎকার করে। তার দৃষ্টি ছিল রায়বাড়ি বরাবর। গ্রামবাসী পরদিন ভোরে অবাক বিস্ময়ে দেখে রায়বাড়ির উত্তরাধিকার বাবু মহেন্দ্র নারায়ণ রায়, (এমএ ডিস্টিংশন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)-এর রক্তাক্ত দেহ তুলসিতলায় পড়ে আছে আর নাটমণ্ডপ সিন্দুক ভর্তি কাঁসার বাসন-কোসন, লক্ষনৌ থেকে আনা সেতার সব সুসজ্জিত রেখে তার পরিবারটি রাতের অন্ধকারে ভারত পালিয়েছে। ... ...
মতামত দিয়েছেন - যশোধরা রায়চৌধুরী, জয়া চৌধুরী, রৌহিন ব্যানার্জ্জি, অচল সিকি, সৌভিক ঘোষাল ... ...
মালতীর বাড়ীতে এক তুতো দিদির বিয়ে। বিয়ে বাড়ীর লাখো কথা, হট্টগোল, খাওয়া-দাওয়া, আত্মীয়-কুটুম সে এক এলাহি ব্যাপার! কিন্তু সব ছেড়ে মালতীর চোখ পড়ল দুটো জিনিসে। প্রথমতঃ বিয়ের সব দায়িত্ব দিদির বাবা-মা’র অথচ বিয়ের কার্ডটি বাড়ীর এক অনুপস্থিত দাদুর ( বাবার জ্যাঠামশায়ের ) নামে। আশ্চর্য এই কারণে যে যৌথ পরিবার হলেও নাহয় কথা ছিল – কিন্তু সেসবের পাট চুকেছে বহুদিন আগে। এখন সব যার যার নিজের সংসার। তাই দিদির রোজকার খাওয়া-ঘুম-পড়াশোনার দুনিয়ায় তিনি কোথায়? অথচ এটাই নাকি নিয়ম! আর সেই প্রসঙ্গে শোনা গেল, দিদিকে সম্প্রদান করবেন দিদিরই আরেক প্রবাসী জ্যেঠু। এ তো আরও বড় অনুপপত্তি! ... ...
উৎসব টুৎসব মিটল, এবার কথাটা বলা যাক। প্রতি বছর পুজো এলেই দুমদাম করে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় মহালয়া থেকে। হরেক রকম বিষয়ে। যেমন ধরুন, পিতৃপুরুষের তর্পণের দিনকে শুভ মহালয়া বলা উচিত কি উচিত না। ঐতিহ্যগতভাবে কেউ শুভ মহালয়া বলেননি কখনও, কিন্তু হতেও পারে, ধর্মীয় চিহ্নগুলিকে বাদ দিয়ে উৎসব স্রেফ ফুর্তিতে পরিণত হচ্ছে। তার পরই আসে কুমারী পুজো। বাচ্চা একটি মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে পুজো করার মধ্যে অনেকে পুতুল খেলা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাননা। উল্টোদিকে এর তীব্র বিরোধীরা ধর্মীয় কুপ্রথার পুনর্নবীকরণ দেখতে পান। পুজো গড়ায়, বিতর্কও গড়ায়, এবং দশমীতে এসে চরমে পৌঁছয়। দশমীর পেট টপিক সিঁদুর খেলা। সিঁদুর খেলা কি স্রেফ নান্দনিক ফূর্তি, নাকি নারীর বশ্যতার প্রতীক? এইসব নানা ব্যাপার... মতামত দিয়েছেন - শুচিস্মিতা, সুমন মান্না, সৃজিতা সান্যাল শূর এবং সম্রাট আমীন। ... ...
অ্যায় ফুলো কে রানি বাহারো কে মালকা। পশ্চিমে পি ডাব্লুর পেছনে মহানন্দার জলে ঝপ করে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ আলো থাকে। সেই আলোতে সব দেখা যায়, কিন্তু ছায়া পড়ে না। গান শেষ হলেও সুরটা জড়িয়ে কথাগুলো কিছুক্ষণ আধো আলো আধো অন্ধকারে ভেসে বেড়ায়। আমরা সবাই অস্পষ্ট দেখি সাধনার কপালের সামনে ঝুরো চুল বাতাসে উড়ছে। ... ...
আমি যখন অষ্টম বা নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন আমাদের গ্রামে প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয়। আমাদের কাজ মূলত: ছিল কর্মকর্তাদের ফরমাশ খাটা - বাজারের জিনিসপত্র বয়ে আন রে, মণ্ডপঘর পরিষ্কার কর রে, আঙিনা ঝাঁট দে রে ইত্যাদি । এতে ঠিক পুজোর আমেজ ছিল না । মনে এই ভাব জাগতো, "পুজো তো বড়দের ব্যাপার। আমাদের কি?" তবে ওই দূর্গাপুজোর দুটো ব্যাপার মনে আছে এখনো । এক, পদ্মফুল আনার গল্প । দুই কাকুর সাথে আমরা কমবয়েসী দুজন গিয়েছিলাম ধোয়া চাদর নিয়ে পদ্ম তুলতে । চাদরে পোটলা বেঁধে ফুল ভর্তি করে নিয়ে এসেছিলাম। আর মনে আছে আমার এক পিসতুতো বোন, নাম ছিল ডলি, প্যান্ডেলের সামনে আরতি নেচে আরতি করেছিল। দুটো পদ্ম ফুলের মধ্যেকার পদ্মচাকি ফেলে দিলে একটা ঝুমকোর মতো দেখায়। ওর সাজগোজ হয়ে যাবার পর দুটো পদ্মের ঝুমকো ও কনুই-এর ওপরে পদ্ম দিয়ে একটা গয়নার মতো বেঁধে দিয়েছিলাম। ... ...
যে লোকালয়ে তোমার বাস, গ্রামে বা নগরে, যেখানে তোমার সামাজিক পরিচিতি বিদ্যমান, সেইখানে তুমি পিঞ্জরাবদ্ধ শের। অনিশ্চয়তা বিহীন সেই কৌমজীবনে তুমি আবাল্য অভ্যস্ত। অতএব তোমার হারাইবার ভয় নাই। চিন্তা নাই। এই চিন্তার অভাব তোমার পরিধি নির্ণয় করে, তোমাকে সীমার মাঝে বাঁধিয়া ফেলে, ক্রমে তুমি অসীমকে ভুলিয়া যাও, নিজেকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করিতে করিতে জন্মসংসারের নাগপাশে আবদ্ধ হইয়া গোলকধাঁধায় ঘুরিয়া মর। মুক্তির স্বাদ যে ভুলিয়াছে, মোক্ষ তাহার রুচিবে কেমনে? ... ...
কিন্তু একমাত্র পায়ে চলার পথে বরফের প্রলেপ সুখকর নয় মোটেই। পা পিছলে যায়, পথের কাদায় জুতো ভিজে যায়। তার উপরে অসভ্য ইয়াকের যাওয়া আসার ফলে রাস্তাটা সভ্য মানুষের উপযুক্ত নেই। আমরা কাদা বাঁচিয়ে, আছাড় খাওয়া সামলে, হাঁপাতে হাঁপাতে উপর-পানে গুটি গুটি চলেছি। সেই ক্লেশের পথে মনোহরণ বিরাম হিসাবে পথের দু'ধারে লাল হয়ে যাওয়া রডোডেন্ড্রনের সারি না থাকলে হিমালয়ের অন্দরমহলে পাগল পানা লোকজন আধপেটা খেয়ে ঘুরে মরত না। ... ...
তিনদিন হাঁটবার পর, এমনস্থানে পৌঁছনোর কথা, যেখানে খচ্চরের পক্ষেও রাত্রিবাস সম্ভব নয়। অতএব, ওই প্রচন্ড শীতকে মোকাবিলা করবার মতন শীতবস্ত্র আমাদের সঙ্গে রাখতেই হবে। মোটের ওপর এইসমস্ত বিষয়, এবং, এর সাথে সাথে, কিছু হাঁটবার, বিশ্রাম নেওয়ার, ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়ার ব্যাপারে অবগত হওয়ার পওকে উনিশে অক্টোবর দশমীর সকালে, আরম্ভ হলো, আমাদের রুপিন পাস্ ট্রেক। এবং, ওই তখন থেকেই, সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ! ... ...
আমরা ঝটপট শহুরে ক্লেদাক্ত জামাকাপড় ছেড়ে ফেলে টুপি-মোজা-জ্যাকেট সম্বলিত হয়ে চল্লুম রান্নাঘরের পানে, সেখানে তখন অপেক্ষা করছে গরমাগরম মোমো আর কফি। সেই সন্ধ্যায় আমরা দু'রকম জায়গার চারজন মানুষ গল্প করতে করতে কখন একাত্ম হয়ে গেছিলাম টের পাইনি। হুঁশ ফিরলো জীবন দা, যে কিনা এই হোমস্টের মালিক তার কথায়। 'এখানে অনেক গেস্ট আসেন, কিন্তু সেরকম কোনো সাইট সিইং, বাজার-মল, সিনেমা হল এসব কিচ্ছু না থাকায় ফিরে চলে যান একদিন বাদেই।' হায়রে Mall, Hall ও কোলাহল প্রেমী বাঙালী, প্রকৃতির কাছে এসেও প্রকৃতিকে না ছুঁয়ে সেই গতানুগতিক "এখানে দেখার কী আছে"? আমাদের এখানে একদিন থেকে পরদিন মূলখারকা চলে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তাগাথাং ঢুকেই আমরা ঠিক করে ফেলেছিলাম একদিনে আমাদের মন ভরবে না। ... ...
ফোন করতে যাবে ঠিক সেই সময়ে ধড়মড় করে উঠে বসলো কাক ভিজে হওয়া চিমসে একটা লোক। সামনের লুকিং গ্লাসে ঠিক মতো মুখটাও দেখতে পেল না বল্টু। গাড়ি বুকিং হয়েছে খাল পাড় পর্যন্ত। “দাদা একদম ভিজে গেছেন। আমার কাছে একটা পরিষ্কার তোয়ালে আছে। একটু মুছে নেবেন?” বল্টুর কোন কথার উত্তর দেয় না লোকটা। বল্টু নিজেও কোন কথা বাড়ায় না। একেই অনেক রাত। চারপাশে গাড়ির সংখ্যা কম। নেশা-টেশা করে আছে কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। যাক তার চেয়ে তার নতুন গাড়ির সিট ভিজুক। কিছুক্ষণ পরে শুধু হাওয়ার মতো ফিসফিস করে লোকটা বলে “আপনার বইটা একটু দেখতে পারি?” বল্টুর মনেই ছিল না তার সিটের পাশেই রাখা বই। ‘কলকাতার গোলকধাঁধা’। কিন্তু এই অন্ধকারে বৃষ্টি আর বিদ্যুতের মাঝে লোকটা বইটা দেখতে পেল কী করে? ... ...
ছবি দেখার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? (অথবা, রাগসঙ্গীত শোনার? সাহিত্যপাঠের? কিম্বা, ভালো সিনেমা দেখার? এককথায়, শিল্পবিষয়ে সচেতন চর্চার কি আদপেই কোনো যুক্তি আছে?) ভেবেছিলাম, এই প্রশ্নের অতি স্বাভাবিক উত্তরটি অস্তিবাচক। কিন্তু, কিছু আলাপ-আলোচনার শেষে বুঝলাম, এই প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর পাওয়া মুশকিল। যেমন, আমার মনে হয়, এই অভ্যেস জরুরী। এই প্রসঙ্গেই, আগের একটি লেখায় বলেছিলাম, নান্দনিকতার বোধ গড়ে তুলতে এই অভ্যেস অবশ্যপ্রয়োজনীয়। পশ্চিমী দেশে, স্কুলের বাচ্চাদের নিয়মিত আর্ট গ্যালারী বা চিত্রপ্রদর্শনীতে নিয়ে যাওয়ার চল রয়েছে। এবং, শুধু দেখাই নয়, ছবি দেখে কেমন লাগলো, সেই অনুভব নিয়ে তাদের দস্তুরমতো লিখতেও হয়। এইভাবেই নান্দনিকতার বোধ তৈরী হয়, আর সাথে সাথে নিজের ভালো লাগাটিকে বিচার বা বিশ্লেষণ করার বোধটিও তৈরী হয়। সুকুমার হৃদয়বৃত্তির গঠনে এমন চর্চা বা পাঠ জরুরী, এমনই আমার ধারণা। ... ...