কথায় আছে, “অষ্টমীর পূজায় ফলে বিদায়ের আশ/ নবমী দশমী বাঁধে আর বারো মাস”। অষ্টমীর পুজোয় নাকি বিদায়ের আশা ফলে গেরস্থের বুকে – সে কেমন? অষ্টমীর পুজো-শেষে নবমীর দিকে পা দিলেই বিদায় বাদ্য বাজতে থাকে কোথাও, আর মাত্র দু’ দিন। এই ‘মাত্র দু’ দিন’-এর প্রহেলিকায় গেরস্থ-কন্যা গৌরীর আগের তিনটে আলো-ঝলমল দিন কোথায় যেন পালায়! তারা এসেছিল যেন এটুকু বোঝাতেই যে তারা থাকবে না। ... ...
পুজোবাড়িতে সপ্তমীসন্ধে এলেই এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে শুরু করেন, "এই তো সপ্তমীও কেটে গেল, অষ্টমী-নবমী দুটো দিন কেটে গেলেই ভাসান! ব্যাস! এত আনন্দ-আয়োজন সব শেষ!" এটুকু শেষ করে তারপর অপেক্ষাকৃত ছোটদের দিকে তাকিয়ে জগতের এই প্রবহমানতার রহস্য ভেদ করার আনন্দে হ্যা হ্যা করেন। ... ...
ছোট পাড়ার এই রাস্তাটা আজ সন্ধেয় আলোয় সাজলো সম্পূর্ণ। দুটো গলি পেরিয়ে পাড়ার পুজো। আবছা সুরে সে পুজোর সূচনা ভেসে আসছে এত পথ। নিঝুম, হৈমন্তী রাস্তার উপর আলোর ঝালর, তারও উপরে কিছু বাড়ির বারান্দায় শৌখিন জ্বলা-নেভা আলো, আমাদের এই নিয়োগী বাড়ির গায়ে আলোর মালা, আর তারও অনেক, অনেক উপরে, হাল্কা হিমধরা আকাশে ইতস্তত তারাদের সংলাপ। বোধনের সময় হল। ... ...
নিয়োগীদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। পুজো বহুদিনের; খাতায় কলমে হিসেব পাওয়া যায় দুই শতকের, তবে তার আগেও যে হতো – সে কথা প্রায় সবাইই বলেন এ বাড়ির। কলকাতার এই বাড়ি রাধানাথ তৈরি করে থাকতে শুরু করেন বছর ষাটেক আগে, অর্থাৎ এই বসতে পুজোর বয়স সেরকমই। বাড়ির পুজোয় বাড়ির গাছের ফুল থাকুক অঞ্জলির পাত্রে – সেই ইচ্ছায় রাধানাথ তখনই লাগিয়েছিলেন দোলনচাঁপা আর শিউলি। ... ...
এপ্রিল-মে মাস তখন। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সৌজন্যে প্রতিদিন খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ছবি ভেসে উঠছে। আমরা অনেকেই সেই সময়টাকে ছবি দিয়েই মনে রেখেছি -- দিল্লির অস্থায়ী শ্মশানে একসঙ্গে চল্লিশটি দাহকুন্ডের উদ্বাহু নৃত্য; সাদা চাদরের উপর দিয়েই শবের কপালে এক বৃদ্ধ, শীর্ণ হাত টিপ পরিয়ে দিচ্ছে। স্বাধীন দেশের পঁচাত্তরে পা দেওয়ার কালে ভেঙে, মুখ থুবড়ে পড়লো স্বাস্থ্যব্যবস্থা। মানুষ, ডাক্তার হাহাকার করে গেল অক্সিজেনের জন্য, বেডের জন্য। অথচ নেতা-নেত্রীরা মেতে রইলেন ভোটক্রীড়ায়। রাজ্যের পর রাজ্য স্রেফ ছারখার হয়ে গেল জনসভা আর পথসভায় সমাগমের দাক্ষিণ্যে। অচেনা অতিমারীর ভয়ের চেয়েও ভয়াবহ, অবিশ্বাস্য এক সময়! ... ...
'ফাল্গুনী'তে চন্দ্রহাস আর তার দল হইহই করে বেরিয়ে পড়েছিল; 'ছেলেধরা' বুড়োকে ধরে আনবে বসন্তোৎসবে। কিন্তু বুড়োর টিকিটি কেউ কোনোদিন দৈবাৎ দেখে থাকলেও, তাকে পাওয়া কী আর অত সহজ! ... ...
মানুষটির গানের কোনও ঠিকঠিকানা নেই -- কখনও শিবের স্তোত্র, কখনও মীরার ভজন, গঙ্গাকে নিয়ে একটা ছোট্ট গান, কখনও আচার্য শঙ্করের 'ভজ গোবিন্দম', এমনকি রামপ্রসাদী সুরে একটা হিন্দি গানও শুনলাম তাঁর কণ্ঠে। তিনি সম্ভবত বিশেষ কোথাও ডাক না পাওয়া গায়ক; কিন্তু ডাক পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে তিনি খুব বিচলিত, এমনও মনে হলো না। নিজের গান নিজেকে শুনিয়েই মানুষটি কী খুশি! ... ...
এই সমস্ত, সবই আসলে পাঠ্য। বাতাস তাদের সবার মলাট সরিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন, শনশন শব্দে আমাদের কানে এসে বলছে, “পড়ো, পড়ো”। ... ...
সুবীর কুমার বসুকে কেউই চিনবেন না। সুবীর বসু কখনো কখনো আমার সঙ্গে বিকেলে হাঁটতে বেরোতেন। শেষ বয়সের কুঁচকে যাওয়া, চকচকে চামড়া, টলোমলো পা। হাত ধরে ধরে কিছুটা নিয়ে গিয়ে ফিরিয়ে আনতাম আবার। যাওয়াতেও যে তাঁর খুব আপত্তি ছিল, এমন নয়; আবার ফিরেও আসতেন লক্ষ্মী হয়ে, কিচ্ছুটি না বলে। ... ...
একদিন বিবিসিতে দেখলাম, দুটো প্লেন মিলে ১১০ তলার দুটো বাড়িকে মাটিতে মিশিয়ে দিল। লো-অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা রাখা। তাতে বারবার ধরা পড়ছে, কালো আর ছাই-ছাই ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে আমেরিকা, বিল্ডিংদুটো রংমশালের ফুরিয়ে আসার মতো নেমে আসছে। ... ...