বড়দিনের মধ্যে আমরা এক শিশি নেসক্যাফে কেনার মত জিনিস জমিয়ে ফেললাম! নেসক্যাফের শিশি, সে বিরাট শৌখিন জিনিস! এছাড়াও আমরা বেশ কয়েক সপ্তাহ আমরা খুবই কৃচ্ছ্রসাধন করে কাটালাম - বড়দিনের দিন সেসব জমানো জিনিস দিয়ে, আটা ময়দা গুড়ের তৈরি খুব আনাড়ি কিছু মিষ্টি তৈরি করে সবাই মিলে ভাগ করে খেলাম! আর বড়দিনের ভোরে আমাদের জন্যে দারুন এক চমক অপেক্ষা করে ছিল - কে বা কারা আমাদের জন্যে দরজার সামনে একটা কেক আর এক ডজন কলা উপহার দিয়ে গেল! আর স্টোরের লোকজন আমাদের রেশনের সঙ্গে সেদিন বেশ কয়েক টুকরো পাঁঠার মেটে পাঠিয়ে দিল! জেনানা ফাটকের বাইরেও যে লোকজন আমাদের চেনে বা আমাদের খোঁজ খবর ভালোই রাখে সেটা সেদিন বুঝতে পারলাম! ... ...
হাজারিবাগ জেল আসলে ছিল মূলত বিচারাধীন বন্দীদের স্বল্পকালীন আটকখানা। তাই এখানে অন্য বড় জেলের মত অত কাজকর্ম থাকতো না। সকালে, পুরুষ বিভাগের দর্জিখানায় তৈরি সরকারি উর্দিতে মেয়েরা বোতামের ঘর সেলাই করতো। তারপর উঠোন, আশপাশ পরিস্কার করা, বাগান করা, রান্না, আর গল্পগাছা। এখানে একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল - রোজ সকালে ডাল আর সব্জি রান্না করা দেওয়া হত, কিন্তু ময়দা আর চাল দেওয়া হত এমনি। এবার যে যারটা যেমন করে পারো ফুটিয়ে, বানিয়ে খাও। কোন জ্বালানী বা বাসন কিন্তু দেওয়া হত না! হয়তো একদিনের খাবারের বিনিময়ে একটু কয়লা পাওয়া যেত, কিন্তু রান্নার জন্যে, যে অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রান্না খাবার আসতো, ভাত রুটি তার মধ্যেই বানাতে হতো। ... ...
অনেক রাতে, দেওয়ালের ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে কল্পনার সঙ্গে কথা বলে ক্লান্ত হয়ে, সেলের গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে দেখতাম - জেলের দেওয়ালের বাইরের অশ্বত্থ গাছের মাথার ওপর ঝকঝকে পরিস্কার আকাশে চাঁদ উঠেছে, একটা সাদা প্যাঁচা স্থির হয়ে বসে পুরুষ ফাটকের ছাতে, উঠোনের অন্য প্রান্তে হাজার হাজার ঘুমন্ত পাখিকে বুকে নিয়ে শান্ত নিমগাছের নিচে নর্দমা থেকে বেরিয়ে ব্যাং গুলো লাফঝাঁপ করছে। ... ...
জঙ্গলের মধ্যে দুঃসাহসিক বন্দুক যুদ্ধে আমার ধরা পড়া, ইউরেনিয়াম প্ল্যান্ট উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত, বিস্ফোরক দিয়ে পুলিশ থানা উড়িয়ে দেওয়া - এইসব খবর বেরুচ্ছে হৈহৈ করে। অবশেষে তদন্তকারীরা সব ফিরে গেল - দিল্লি, পাটনা, কলকাতা, পাঞ্জাবে, আমার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লেখা মোটা মোটা সব ফাইল নিয়ে - আমাকে আমার খুপরি সলিটারি সেলে ফেলে রেখে। বাইরের পৃথিবী, এমনকি জেলখানারও অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন আমার সেলে। তখনই মনে হয় আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম - গত কদিন, কয়েক সপ্তাহ ঠিক কী হচ্ছিল। এর আগে পর্যন্ত আমি বোধহয় ঠিক বুঝতেই পারিনি, কী চলছে, কী হতে পারে, কী হবে। আমার মস্তিষ্ক বোধয় এই ভয়ানক চাপ থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার চিন্তা পদ্ধতিকেই কিছুটা অকেজো করে দিয়েছিল - অন্তত শুরুর কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে আমাকে মানিয়ে নেওয়ানোর জন্য। ... ...
শেষবারের মত অমলেন্দুর সঙ্গে কথা বললাম - বিদায় জানাতে। অমলেন্দুর মাথায় হাত ছুঁইয়ে, ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে কল্পনার সঙ্গে ফাটকের রক্ষীর পেছন পেছন বিশাল উঁচু কাঠের গেটের ছোট্ট নীচু দরজা পেরিয়ে জেলের অন্দরমহলে ঢুকলাম। পাথর বিছনো অন্ধকার সুড়ঙ্গের মত পথ, খালি পায়ে, রক্ষীর লন্ঠনের আলোয়, আরেকটা লোহার তারকাঁটা বসানো বড় গেট। আমরা ভেতরে ঢুকলাম, পেছনে সশব্দে গেট বন্ধ হল। ... ...
মনে হলো সবারই মত যে সংগ্রামের লক্ষ্য হবে যেসব জায়গায় অন্তত ৭০% মানুষ আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে সেসব জায়গায় ভূমি সংস্কার করা, আর শিক্ষিত যুবকরা আস্তে আস্তে গ্রামের দিকে যেতে থাকবে, কৃষিভিত্তিক সংগ্রামী রাজনীতির প্রচার করতে আর কৃষকদের সংগ্রামের সঙ্গী হতে। অমলেন্দুর এক তুতো ভাই আমাকে নিয়ে গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেন বড় বড় জনবিরল ভুতুড়ে দালানগুলি আগাপাস্তলা স্লোগানে মোড়া। যেসব ছেলেমেয়েরা জীবন কাটিয়েছে এই শহরে, তারা তাদের আরাম, ভবিষ্যৎ, কেরিয়ার উৎসর্গ করে দিতে উদগ্রীব, কৃষকদের সংগ্রামে তাদের সঙ্গী হয়ে, একটা নতুন, সহমর্মী দেশ গড়ে তোলার জন্যে। আমার সঙ্গে যাদেরই দেখা হয়েছিল, আমি দেখছিলাম নকশালপন্থীদের প্রতি প্রকাশ্য অথবা প্রচ্ছন্ন সমর্থন, যেন সংসদীয় গণতন্ত্রে কারোরই আর আস্থা নেই, একটা বড় রকম বদলের জন্য সবাই উদগ্রীব। ... ...
মুগ্ধ বিস্ময় আর আগ্রহ তখন আমার, বাইরের পৃথিবী, নানান দেশ, বিদেশের মানুষজন নিয়ে। আমার কিশোরীবেলা থেকে পকেটমানি জমিয়ে রাখি, অন্য দেশে বেড়াতে যাবো বলে। বড় হয়ে, লন্ডনে আর জার্মানীতে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অন্য পাঁচ মহাদেশের ছত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশে বুঝতে শুরু করলাম - অন্য দেশের মানুষ আমাদের কী চোখে দেখে। আমাদের, মানে বৃটিশদের। আমি বুঝতে শুরু করলাম স্কুলে পড়ানো আমাদের 'গৌরবময়' রাজকীয় ইতিহাস আসলে ঠিক তত গৌরবময় না, আর ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির দারিদ্র আর দুর্দশার পেছনে বৃটেন বা তার মত অন্যান্য কলোনীপ্রভুদের প্রভুত্বের অতীত ও নীতি টীতিগুলির কতটা অবদান। ... ...