মঙ্গলবার সকালে গাড়িতে পেট্রোল ভরলাম ১১৪ টাকা ২২ পয়সা দরে। আজ সকালে দেখলাম কলকাতায় পেট্রোলের লিটার আরও বেড়ে ১১৫ টাকা ১২ পয়সা। খবরের কাগজ বলছে, "এখনও পর্যন্ত এটাই তার সর্বোচ্চ দর"। এই পর্যবেক্ষণ বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নেহাতই অসার। সংসদে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনার গলা টিপে দেওয়া হচ্ছে। তবু এই পরিস্থিতেও জনজীবনে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ টের পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মরীয়া তাগিদে বিনা প্রশ্নে, বিনা প্রতিবাদে, পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করে সব কিছু মেনে নেওয়াই বোধ হয় ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে বা যাঁরা এই পরিস্থিতির জাঁতাকলে পড়ে সহ্যের শেষ সীমায় চলে যাচ্ছেন, তাঁরা মর্মান্তিক ভাবে চরম পদক্ষেপ বেছে নিচ্ছেন। সস্তা-গন্ডার দিনকালের কথা পাওয়া যায় সুরসিক যম দত্তের রম্যরচনাতে -- "আশু মুখুজ্জে মহাশয় যখন ভীমনাগের দোকান হইতে রোজ রোজ করিয়া সন্দেশ খাইতে আরম্ভ করেন, তখন সন্দেশের সের চোদ্দ আনা দাঁড়ায় আর এখন?... " সন্দেশের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তিনি বাঙালির মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির চূড়ান্ত চাঞ্চল্যকর তুলনা করেছেন। তাঁর ভাষাতেই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যাক -- "যখন সন্দেশের সের দুই আনা তিন আনা তখন দেশে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মাইয়াছেন, যখন সন্দেশের দর চার আনা ছয় আনা তখন দেশে বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ জন্মাইলেন, যখন সন্দেশের সের এক টাকা, দেড় টাকা তখন দেশে সুনীতি চাটুজ্জে, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা জন্মাইয়াছেন; যখন সন্দেশের সের দুই টাকা, আড়াই টাকা তখন শ্যামাপ্রসাদ, সুভাষ বসু জন্মাইয়াছেন। আর এখন ছয়, সাত টাকা সের সন্দেশ কয়জনেই খাইবে?...বাঙালি মরিয়া গেল।" ... ...
তিনি মধুপ্রিয়। তাঁর পছন্দ নীল। তাই রুপোলি বুটিদার নীল রেশমের কাপড়ের পশ্চাৎপটে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত গৌরবর্ণ সুস্মিত দারুবিগ্রহের বুকের কাছে ধরা বাম হাতটিতে মধুর বাটি। হাতের ফাঁকে গোঁজা রয়েছে একটি হল। মাথার উপরে অনন্তনাগের প্রসারিত ফনার নিচে ডান হাতের মুঠিতে ধরা মুষল। তিনি বিষ্ণুর বাহন সর্পরাজ শেষাবতার। তিনি শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলদেব। তিনিই তো হলধর কিংবা হলায়ুধ, বলরাম বা সঙ্কর্ষণ অথবা পুরীর মন্দিরে জগন্নাথদেবের পাশে বসা বলভদ্র। তিনি এক তবু অনন্য। বর্ধমানের রায়না থানার বোড়ো গ্রামে দশ হাত উঁচু, চোদ্দটি হাতের অনার্য-পূজিত প্রাচীন বলরাম মন্দির রয়েছে। যার উল্লেখ পাওয়া যায় ধর্মমঙ্গল কাব্যে -- "বোড়ো গ্রামের বলরামে নত কৈনু শির।" উত্তর কলকাতার রাজবল্লভ পাড়ার কাছে 'হারানো বলাই' মন্দিরও আছে। কিন্তু বেলেঘাটার শুঁড়া অঞ্চলে ইতিহাস-প্রসিদ্ধ রাজাবাহাদুরের গৃহদেবতা বলদেব ও শেষজায়া অর্থাৎ রেবতীরানির এই বিশেষ মূর্তি ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই। বিভিন্ন মন্দিরে বা পারিবারিক দেবালয়ে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ সুপরিচিত ও জনপ্রিয় হলেও বলদেব ও রেবতীরানির ঠাকুরবাড়ি একেবারেই ব্যতিক্রমী। শ্রীকৃষ্ণের দাদা, তাই পরিবারের ভক্তহৃদয়ে এই কুলবিগ্রহের মৌখিক পরিচিতি একান্ত আপনার 'দাদা-বৌদি' হিসেবেই। আর এই দারুবিগ্রহের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম ভারতীয় প্রধান, বাংলার রেনেসাঁসের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের নাম। রবীন্দ্রনাথ 'জীবনস্মৃতি'তে লিখেছিলেন, "রাজেন্দ্রলাল মিত্র সব্যসাচী ছিলেন। তাঁহার সঙ্গে পরিচিত হইয়া আমি ধন্য হইয়াছিলাম। রাজেন্দ্রলালের স্মৃতি আমার মনে যেমন উজ্জ্বল হইয়া বিরাজ করিতেছে, এমন আর কাহারো নহে।" তাঁর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী উদযাপন হচ্ছে চলতি বছরেই। ... ...
তিনি ছিলেন আমার রাঙামা। আসলে রাঙা ঠাকুমা। বাবার মেজ কাকিমা। কিন্তু সকলের কাছেই তিনি একডাকে পরিচিত ছিলেন এই রাঙামা নামেই। একেবারে টুকটুকে গায়ের রঙের সঙ্গে আদরের ডাকের কী মিল! মাথায় কালো চুলের বড়ি খোঁপা। ছোটখাটো চেহারা। সংসারের হাজারো কাজ সামলে ওই বয়সেও মসৃন ত্বক। আদতে দ্বারভাঙার কন্যা। কবি যদিও বলেছেন, "যব-ছাতু খেয়ে বাঁচে পশ্চিমের দীনে," পশ্চিমে কিন্তু লোকপ্রিয় ছোলার ছাতু। উত্তরবঙ্গে বলতে শুনেছি, বুটের ছাতু। তা রাঙামা ছিলেন এই ছোলার ছাতু মাখার স্পেশালিস্ট। তাঁর হাতের তারে সেই ছাতু মাখা গোল বলের মতো দলার যে কী সুস্বাদ ছিল তা এখনও ভুলতে পারি না। আজকের আধুনিক প্রজন্ম এমন সব আটপৌরে জলখাবারের মর্মই হয়ত বোঝে না। তবে আজও এই সব সাধারণ ঘরোয়া খাবার নিয়ে বসলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পৃথিবী থেকে একে একে চলে যাওয়া প্রিয় মুখগুলি যাঁদের স্নেহ, আর ভালোবাসা আমাদের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকে এমন উজ্জ্বল করে রেখেছে। ... ...
আমাদের দেশে এখনকার ভোগবাদ-তাড়িত মূল্যবোধহীন সমাজের সঙ্গে তখনকার ইউরোপীয় সমাজের বেজায় মিল। আজ এই করোনা অতিমারীর সময় জাল কোভিড ভ্যাকসিন, জাল স্যানিটাইজার, ইমিউনিটি বাড়ানোর বুজরুকি -- এসব যত দেখছি তত মনে পড়ে যাচ্ছে বেন জনসনের কথা। ১৬১০ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হওয়া যাঁর 'দ্য অ্যালকেমিস্ট' নাটকটির প্রাসঙ্গিকতা আজ চারশ বছর পরেও বড় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় কলকাতার রঙ্গমঞ্চে সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিচ্যুতিকে কষাঘাত করে মঞ্চস্থ হয়েছে কত বলিষ্ঠ নাটক। সামাজিক ও রাজনৈতিক ভণ্ডামি, ধর্মীয় প্রহসন, মানুষের লোভ, লালসা, দুর্নীতি, প্রতারণা, সমাজের অসঙ্গতিগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার জন্যে আমাদের এই বঙ্গেও তো ছিলেন হুতোম, টেকচাঁদ ঠাকুর, রূপচাঁদপক্ষী, পরে সজনীকান্ত দাস, 'অচলপত্রে'র দীপ্তেন সান্যাল, রূপদর্শী/গৌড়ানন্দ কবি। আর এই করোনার আবহে চিকিৎসা, অক্সিজেন সঙ্কট, জীবনদায়ী ওষুধ নিয়ে কালোবাজারি, কোটরগত মানুষের অসামাজিকতা, অসহায়তা আর টিকা নিয়ে ঠগবাজি, জীবিকা-খোয়ানোর মতো বিষয়গুলি নিয়ে কালজয়ী সাহিত্য বা চলচ্চিত্র কি সৃষ্টি হবে না? ... ...
আজকাল চারপাশে বেকড রসগোল্লা, বেকড সন্দেশ, চকোলেট মিষ্টি ইত্যাদি চোদ্দরকম হাবিজাবি দেখতে দেখতে মাঝে-মাঝে যখন বড় অবসন্ন লাগে তখন মনে পড়ে যায় লীলা মজুমদারের কথা। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির রান্নাবান্না নিয়ে তাঁর মন্তব্য: "মন্দ জিনিস যে উপভোগ করে, তার চাইতেও শতগুনে অভাগা হল সেই মানুষ যে ভালো জিনিস উপভোগ করতে পারে না।" প্রাক-করোনাকালের অফিস-ফেরতা কোনও বিষণ্ণ বিকেলে হঠাতই তাই মনে পড়ে যায় আমার ঠাকুমার কথা। যাঁকে আমরা আদর করে ডাকতাম 'বাবুমা' বলে। অসাধারণ ছিল তাঁর নিরামিষ রান্নার হাত। আর দুধ, ছানা, ক্ষীর, সুজি, ময়দা, নারকেলের উপকরণে এমন সব খাবার-দাবার বানাতেন যার স্বাদ ছিল অমৃতসম। সে সবের নামও ছিল বাহারি। বাবুমা খোয়া ক্ষীর এবং ছানা দিয়ে এক স্বর্গীয় মিষ্টি বানাতেন যার নাম ছিল, 'ভাজা বরফি'। ... ...