এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আমার বড়মামার কবিতা : গন্ধ বিধুর ধ

    Kulada Roy
    অন্যান্য | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ | ৪৭৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০১:২০490893
  • আমার বড়মামার কবিতা : গন্ধ বিধুর ধূপ
    ----------------------------কুলদা রায়

    আমার বড়মামা জীবনে একটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। লিখেওছিলেন। মাত্র দুটো লাইন—
    ওগো গন্ধ বিধুর ধূপ
    তুমি কেন আজি চুপ।অ।

    লিখে দেখাতে চেয়েছিলেন বাংলার রাসমোহন সাহাকে। সাহা স্যার থাকতেন সোলায়ম্যান ম্যানসনে। আমাদের ছোটো নদীটির পাড়ে।

    তখনো নদীটি বেশ বড়ই ছিল। মাঝে মাঝে নদী শ্বাস ছাড়ত। সেই শ্বাসে অনেকের বুকের ভেতরে দীর্ঘশ্বাস জমা হত। সেসব এখন গপ্প। এই গপ্পের পাড়ে ইউ প্যাটার্নের সোলাইম্যান ম্যানসন। বেশ বড়োসড়ো লালবাড়ি। দোতলা। নীচতলায় সল্লু দর্জির দোকান। তারপর রামু মুচির শো রুম। নাম নাই। জিজ্ঞেস করলে একগাল হেসে বলত—রবিদাস কারখানা। একদিন সাইনবোর্ড লেখা হবে। সেই একদিন আসিবে নিশ্চয়ই। এরপরে ধনঞ্জয়ের ধনা স্পেশাল পানের দোকান। এখানে সন্ধ্যার পরে পান বিক্রি হয়। খাইলে ভানুমতি নিশ্চিত। ভানুমতি কে একথাটা ছিল গুপ্ত। কারো কারো কাছে ছিল সুপ্ত। কিছু কিছু লোকজন সকাল থেকেই এ দোকানের আশে পাশে ঘুর ঘুর করত। করুক। তাতে ধনঞ্জনের কিছুই ঠেকা পড়ে নাই। সন্ধ্যাকালে ধনা স্পেশাল পানের ঝাঁপ তোলা হত। রামু মুচির দোকান আর ধনা পানের দোকানের মাঝখানে বেশ বড়সড়ো একটি প্রবেশ পথও ছিল। এই পথে পরীরা যাওয়া আসা করত বলে পথটির নাম ছিল পরী গেট। পরী দেখলেই লোকে ভয় পেত। আর এই আনন্দে রাসমোহন সাহা এই সোলাইম্যান ম্যানসনে একা একা থাকতেন। দিনের বেলায় ঝাঁপফেলা ধনা পান স্টোরে। আর রাতে রামুমুচির শো রুমে।

    বড়মামা দিনের বেলাই এসেছিলেন এই সোলায়ম্যান ম্যানসেন। কিন্তু সেদিন ঘটনাক্রমে ধনার ঝাঁপখোলা। ঘরের মধ্যে রাসমোহসন স্যারের থাকার কথা। তিনি নাই। তার বদলে একটা ঘোমটাবতী ফোঁস ফোঁস করছেন। মামা ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে দোনামোনা করছেন। বাইরে ঘোরাফেরা করছেন। তখন, ঘোমটাবতী আওয়াজ দিলেন, কেডা তুমি চান্দু?
    মামা চমকে গেলেন। অর্ধস্ফুট গলায় বললেন, ধূউপ..
    –ধূউপ?
    –ওগো ধূপ।
    –কি, আমি ধূউপ। তুমি হালায় আমারে ধূপধুনা ধান্ধাইতেছ? তুমি আগুন জ্বালাইতে চাও?
    –না, আমি কইতে চাইছি—ওগো ধূপ।
    --আবার ওগো ডাকতিছ? এক হালায় আগুন জ্বালাতি জ্বালাতি কম্ম ফতে করছে। আর তুমি আইছ ম্যাগো ফ্যাগো বোল ধইরা। রসো—রসো, তুই গেলি কুহানে?
    –এইতো আমি। মামা বলল।
    –তর নামও রসো নিকি?
    –হ। রসো। রসরঞ্জন বনিক।
    –অ। তুইও রসো। এত রস আছে দুন্নিয়ায়? গেছিরে বাপা। বলে ঘোমটাবতী থেমে গেল। মেঝের উপর ধপ করে বসে পড়ল। তখন তার মাথা থেকে ঘুমটা খুলে গেছে। একমাথা চুল। আর সিঁথিতে টিকলি। নাকে নথ। কানে মাকড়ী। পুরো রসোবতী । রসবতী বড়মামার দিকে বড় বড় চোখ করে বলল, তুমারে নয়গো বাছা। আমি রাসমোহনরে খুঁজছি। আমি ফুলপরী। ফুলবনে থাকি। বাংলার রাসমোহন আমার ডানা লইয়া গেছে। কী করি কওতো?

    কী আর কওয়া হয়নি। আমার বড় মামা কাঁপতে কাঁপতে ধনা স্পেশাল পান স্টোর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সেইদিন। আর ওদিকে যাওয়া হয়নি। কবিতাটি দেখানো হয়নি রাসমোহন সাহাকে। রাসমোহন সাহাকেও আর আমাদের শহরে দেখা যায়নি। অসামাপ্ত রয়ে গেছে গেছে সেই ধূপের কবিতাটি। সোলাইম্যান ম্যানশন, ধনা বা রামু মুচির দোকান সেই একই রকম রয়েছে। সেখান থেকে দিনে চামড়ার গন্ধ বের হয়। আর রাতে স্পেশাল পানের খুশবু। পরীরগেটে মাঝে মাঝে পরীরা আসে যায়। মাঝখানে বাঁকা নদী আরও বাঁকা হয়েছে। এই পর্যন্ত। কোনো কোনো কবিতা অসমাপ্ত রয়ে যায়।

    .
    অসমাপ্ত থাকার অনেক বেদনা আছে। সে বেদনায় বড় মামা কলেজে যাওয়া থেমে গেছে। বাবা তাকে নিয়ে হাঁটে গিয়েছিল। হাঁটুরেদের দেখে মামা হা করে চেয়ে থাকত। এই ফাঁকে অনেক আলুপটল উবে যেত। বাবা একদিন রাগারাগি করে বলেছিল, তুমারে কি ভুতে পাইছে?

    মামাকে কোন ভুতে পেয়েছিল বাবাকে তা কখনো বলেননি। শুধু পরদিন বড়মামা নাই হয়ে গেল। আজা মশাই লোক মারফত জানিয়েছিলেন—রসোকে কেশীর মায়ের কাছে নেওয়া হয়েছে। তিনি চালপড়া দিয়ে বলেছেন, এ ভুত যে সে ভুত নয়। কিম্ভুত। সুতরাং উপায় নাই।

    এর মধ্যে আজামশাই বুড়ো হয়ে গেছেন। তাঁর চুল দাড়ি সব পেকে গেছে। সামান্য কুজোঁ হয়ে চলেন। চোখে নীল বর্ণ। সন্ধ্যায় হাঁপাতে হাঁপাতে গান ধরেন, হরি দিনতো গেল সন্ধ্যে হল। পারের জন্য তার অপেক্ষা হচ্ছে। হরি এলেই সন্ধ্যে সন্ধ্যে রওনা করে দেবে। এভাবে ধূপের মত আর পুড়তে মন চায় না।

    আজা মশাই তাঁর সাত মেয়ে আর পাঁচ ছেলেকে কাছে ডাকেন। মেজোমামা, সোজোমামা, নমামা, ছোটোমামা এসেছেন। বড় মামা আসেন নাই। বড়মামা তখন বারখাদিয়ার বটতলায় বিড়বিড় করছেন। তার কাছে লোক গেল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে চাঁদ উঠে গেছে। কোনো এক ফুলের সুবাস আসছে। সেই সুবাসে তাড়াতাড়ি হাঁটা মুশকিল।

    বারবার বড়মামা বসে পড়েছে। এই আলো আর হাওয়ার মধ্যে আকাশ থেকে নেমে এসেছে রেশমের মতো মিহি সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়েছে এক মেয়ে। পথ হারিয়ে ফেলেছে। তার চোখে বিষাদ। চারিদিকে মাঠে নির্জনতা। দুটো কোঁড়া পাখির ডাক। হাতে দুটো পদ্মপাতার ডানা। এই ডানা মেলে উড়তে পারবে। পথটি খুঁজে পাবে। উড়ে যাওয়ার জন্য মেয়েটি পিঠে ডানা লাগাবে। চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। চোখে জল। অস্ফুট গলায় বলছে, আহ—আহ…
    এই আর্তনাদ শুনে বড়মামার ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। পারছে না। মামাকে লোক ধরে আছে। বলছে, দেরী কইরো না। সময় নাই।

    সময় কোথায় যায়? সময় নাই কেন? এটা ভাবতে ভাবতে বড়মামা দেখতে পাচ্ছেন, মেয়েটা একা দাঁড়িয়ে আছে। তার চুল উড়ছে। হু হু হাওয়া। হাওয়া বলে, সময় চলে যায়গো মেয়ে। সময় যায়।
    বড়মামা বলার চেষ্টা করছে, আমি আসছি।
    মেয়েটা বলছে, আহ-আ-হ।

    মামাকে লোকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মাঠ থেকে, রাত থেকে, আলো থেকে, হাওয়া থেকে। বলছে, দেরী কইরো না। মাস্টার মশাই অপিক্ষা করতিছেন।
    সত্যি সত্যি আজামশাই অপেক্ষা করছিলেন। বড়মামাকে দেখে ডান হাত দুটো ওঠানোর চেষ্টা করছেন। হাতটা কেঁপে কেপে উঠল। সামান্য উঠল। আবার পড়েও গেল। সাদা ভুরুর মধ্যে মাকড়সা। চোখ স্থির।
    বড়মামা আজা মশাইয়ের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলছেন, অ বাবা, ধূপ, ধূপ রাখছো কোথায়? ধূপ আছে কোথায়?

    সেদিন মামাবাড়িতে কোনো ধূপ ছিলনা সত্যি সত্যি। থাকলেও আজা মশাই কোথায় রেখেছেন কেউ জানে না। কাউকে বলে যাওয়ার সময় ছিল না। আর আদৌ কিনেছিলেন কিনা—সেটাও কঠিন প্রশ্ন বটে। এই কারণে আজামশাইকে লোকে পুকুর পাড়ে নিয়ে গেল। বাড়ির পশ্চিমের তালপুকুর। থৈ থৈ জল। জলে হৈ হৈ মাছ । দক্ষিণ পাড়ে দুটো তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে। তালপাতায় বাবুই পাখি। খড়কুটোর বাসার বাইরে উঁকি দিয়ে চেয়ে আছে। আজা মশাইয়ের মাকড়সার ভুরু মাটিকদম হয়ে যাচ্ছে। তাই দেখে বড়মামা চেঁচিয়ে বলছেন, অ বাবা, মাইয়াডারে মশায় কামড়ায়। ধূপ কোথায় রাখছো—কইয়া যাও। ধূপ ধুনো জ্বালাইলে মশা যাবে।

    মেয়েটা ডানা ছাড়া জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মাথা নিচু করে। দুরে। দুহাতে ডানাদুটো। রাসমোহন সাহা কেটে ফেলেছে। চারিদিকে ভন ভন করে মশা উড়ছে। আর মেয়েটি বলছে—আহ-আহ-।

    .
    এইভাবে পাখি সব করলে এরকম রাত্রিও পোহায়ে যায়। কাননে কুসুম কলি ফুটে ওঠে। সে কুসুম বড়মামার কপালে ছুইঁয়ে আজিমা বলছেন, যা বাবা, দুগ্গা দুগ্গা বলে রওনা কর।
    রাতে মশার কামড়ে বড়মামার মুখ ফুলে গেছে। চোখে ঘোর। মামা বলে, ধূপের কী হইবে?
    –হইবে বাবা। ধূপ হইবে। বেতন পাইলে তুই কিন্যা আনিস।

    বড়মামা আজামশাইয়ের রিফু করা ছাতিটা বগলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন। নারিকেলবাড়ি পেরিয়ে বটবাড়ি। তারপর নিজামকান্দি। পরের গ্রাম নিজড়া। নিজড়ার পরে জাঙ্গালিয়া। পাঠশালার বালকবৃন্দ বসেছিল গাছতলায়। মাস্টারমশাইকে দেখে উঠে দাঁড়াল। সালাম দিল। আজ তাদের মাস্টারমশাই আসেন নাই। তার ছেলে এসেছেন। ছেলে মাস্টারমশাই তার বাবা বুড়ো মাস্টারমশাইয়ের মত একরকমভাবে বসে আছেন। বুকের কাছে রাখা হাত। মাথাটা সামান্য কাত। এখনই সামান্য কুঁজো। চক্ষু থরোথরো। বালকবৃন্দ সুর করে বলতে শুরু করেছে—
    এক এক্কে এক।
    নয়ন মেলে দেখ।অ।
    দুই দুগুনে চার।
    জগ্‌ৎ পরাবার।
    তিন দুগুনে ছয়।
    পরান জোড়া ভয়।অ।

    এইখানে এসে বড়মামার ভয় ভয় করে। বাড়িতে আজিমা বসে আছেন। বড়মামা চাল আনবে। তেল আনবে। নুন আনবে। চল্লা থেকে বেগুন মরিচ তুলে রান্না হবে। পাঁচ ভাই—সাতবোনের পাত পড়বে। এর মধ্যে ধূপ কেনার পয়সা নাই। নিজেই ধুপের মত পুড়ছে।

    জামতলায় ধূপের ধোঁয়ার মত সন্ধ্যা নেমেছে। মাঠের মধ্যে ধেড়ে ইঁদুর আকাশ পানে চেয়ে দেখছে। মেঘের কোল থেকে গলতে গলতে চাঁদ উঠেছে। সেই মেয়েটি জলের উপর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাকে ফিরতে হবে মধুমতির পাড়ে। সোলাইমান ম্যানসনে। নীচে সল্লু দরজির সেলাইকলের খটখট শব্দ। আর রামু মুচির সট সট চামড়া কাটার গন্ধ। ধনা স্পেশাল পানের জন্য লোকজন ঘোরাফেরা করছে। তার বদলে এই পদ্মবিলার বিলে শোনা যাচ্ছে, আহ-আহ। বড় মামার পকেটে অসমাপ্ত কবিতা বলছে, নাহ—নাহ–

    বিলের জলে মশা। মশা ভন ভন করে। মশা ঘুরে ঘুরে কামড়ায়।

    .
    মামীর নাম রমা। কেষ্টপুরের মেয়ে। পদ্মবিলায় পদ্ম ফোটে। কেষ্টপুরে গাঁদা ফুল। রমা মামী এলেন হলুদ গাড়া ফুলের মালা গলায় দিয়ে। আজিমা মামীকে সকালে ধানদুব্বো দিয়ে বরণ করলেন। আর হাতে চাল ধোয়ার পাতিলটা তুলে দিয়ে বললেন, চিন্তা কইরো না গো মা। আমার রসো তুমারে সোনার বিছাহার কিন্যা দেবে।

    এই বিছাহার কেনার কথাটি পদ্মবিলার লোকে পদ্মফুল তোলার সময় জানে। কেষ্টপুরের বটতলার হাটেও দূর দূর গাঁয়ের হাঁটুরেদের মধ্যেও কথা হয়। দেবাশুরের পিঠাবুড়ির মেলাও জানে। বারখাদিয়ার আচি খালও শুনতে পায়—রমামামীর গলায় বিছাহারটি আসবে। বিছা হারটি বড়মামা কিনে আনবে।
    এই সুখে রমামামী তাজা তাজা পুটি মাছ কোটে। কচি ঢেঁড়শ দিয়ে তরকারী রাঁধে। কলমী শাক ভেজে রাখে। মামা ফিরলে এক ঘটি জল এগিয়ে দেয়। মামার পা থেকে জল গড়িয়ে গড়িয়ে নামে। মামীর পায়ে জল লাগে। জলে মামীর পা গলে যায়। জল বলে, আহা-আহা। সেই সুরে জলগলা পায়ে জোনাক পোকা জ্বলে ওঠে। এই জ্বলুনীর মধ্যেই মামী দাঁড়িয়ে আছে। আর মামীর মাথা থেকে লম্বা ঘোমটা পড়ে যায়। গলায় শিউলী ফুলের মালা।

    শিউলী ফুলে ভর দিয়ে রাত্রি নামে। চাঁদ ওঠে। ধুপের গন্ধ জাগে। সেই মেয়েটি ঠোঁট চেপে ধরে পদ্মবিলার মাঠ থেকে নিরবে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে তার পা-গলা জলের উপর চলে। হাতে ডানা দোলে। আমাদের ছোটো নদীটির পাড়ে সোলাইমান ম্যানশনের ছাঁদে গিয়ে নামে। নিচে সল্লু দর্জি খট খট করে সেলাইকল চালায়। রাম মুচি সট সট করে চামড়া কেটে কোলাপুরি চটি বানায়। ধনঞ্জয়ের ধনা স্পেশাল পানের দোকানের ঝাঁপ ওঠে। ভানুমতির যশোগান গাইতে গাইতে রাসমোহন সাহা বাঁকানো ছড়ি হাতে পরীগেট দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। মামার দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন, দেখি, কি লিখেছ হে?
    ছাঁদ থেকে পরী নামে। বলে, আহা। আহা।

    পরীটির হাতে আজ আমার বড়মামার কাঁপা কাঁপা হাত। আর হাওয়ায় ধুপের গন্ধ নয়—কবিতার গন্ধ ভাসে।
    আজ বড়মামার কবিতাটি পুড়ছে। বাইরে জ্যোৎস্না।

    ...............................
    *নিউ ইয়র্ক.
    ২ সেপ্টেম্বর ২০১১।
    ·
  • ranjan roy | 122.173.178.213 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০১:৪৮490904
  • কুলদা,
    পাগল কইর‌্যা দিলেন। এই জাতের লেখা বহুদিন পড়ি নাই। পিপাসা বাড়ছে।
  • i | 137.157.8.253 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০২:১৮490915
  • ঠিক রঞ্জনদা। একেবারে অন্যজাতের লেখা। পাগলকরা।
  • kk | 107.3.242.43 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৩:১৫490926
  • কুলদা, কি করে এত ভালো লেখেন ?!!?
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:২৮490936
  • আমি এখন আমার মামাবাড়ি নিয়ে লিখছি। পাঁচ মামাকে নিয়ে লিখব। ৬ মাসীকে নিয়ে লিখব। আমার ছোটো পিসিকে নিয়ে লিখতে হবে। এই জীবন নিয়েই তো চলছি। আপনাদের ভাল লাগছে বলে ধন্যবাদ।
  • P | 193.28.178.61 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৪:১২490937
  • কুলদাবাবু , অসম্ভব ভাল লাগল। ধন্যবাদ।
    আগামী বারোদফার(+) অপেক্ষায় রইলাম।
  • dd | 124.247.203.12 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৪:২২490938
  • চমৎকার লাগলো। আরো ভাল্লাগ্লো যে লেখাটা একেবারে নিঁখুত যায়গায় শেষ হয়েছে।

    এটা আরেকটু লম্বা হলেই রিপিটিটিভ হয়ে যেতো। কিন্তু হয়নি।

    কুলদাবাবুর আরো মামা হোক।
  • Shibanshu | 59.90.221.5 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৫:৪৭490939
  • দারুণ লাগলো। অদ্ভুত সাররিয়্যাল, শক্তি বর্মণের ছবি যেন।
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৭:১৮490940
  • ধন্যবাদ পড়ার জন্য। শক্তিবর্মনের ছবি কেমন? একটু বলুন।
  • Tim | 198.82.18.179 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ২২:৫৬490894
  • খুবই ভালো লাগলো লেখাটি। অপেক্ষায় রইলাম।
  • Shibanshu | 59.90.221.5 | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১০:৪৭490895
  • @ কুলদা, .... এইরে...কমু এহন..এইহানে নয়..
  • Nina | 12.149.39.84 | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৮:৫৩490896
  • কুলদাভাই,
    কি যে কই ---সব কথাই এহন চুপকথা----মুগ্‌ধ!!!
  • vikram | 143.239.7.4 | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০১:৪৭490897
  • জিও কুলদা রায়। জাস্ট অসা।
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ১৩ নভেম্বর ২০১১ ১১:২৪490898
  • আমার বড় মামার কবিতা : গন্ধ বিধুর ধূপ
    কুলদা রায়
    ------------------------------------------------

    আমার বড়মামা জীবনে একটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। লিখেওছিলেন। মাত্র দুটো লাইন—

    ওগো গন্ধ বিধুর ধূপ

    তুমি কেন আজি চুপ।অ।

    লিখে দেখাতে চেয়েছিলেন বাংলার রাসমোহন সাহাকে। সাহা স্যার থাততেন সোলায়ম্যান ম্যানসনে। আমাদের ছোটো নদীটির পাড়ে।

    তখনো নদীটি বেশ বড়ই ছিল। মাঝে মাঝে নদী শ্বাস ছাড়ত। সেই শ্বাসে অনেকের বুকের ভেতরে দীর্ঘশ্বাস জমা হত। সেসব এখন গপ্প। এই গপ্পের পাড়ে ইউ প্যাটার্নের সোলাইম্যান ম্যানসন। বেশ বড়োসড়ো লালবাড়ি। দোতলা। নীচতলায় সল্লু দর্জির দোকান। তারপর রামু মুচির শো রুম। নাম নাই। জিজ্ঞেস করলে একগাল হেসে বলত—রবিদাস কারখানা। একদিন সাইনবোর্ড লেখা হবে। সেই একদিন আসিবে নিশ্চয়ই। এরপরে ধনঞ্জয়ের ধনা স্পেশাল পানের দোকান। এখানে সন্ধ্যার পরে পান বিক্রি হয়। খাইলে ভানুমতি নিশ্চিত। ভানুমতি কে একথাটা ছিল গুপ্ত। কারো কারো কাছে ছিল সুপ্ত। কিছু কিছু লোকজন সকাল থেকেই এ দোকানের আশে পাশে ঘুর ঘুর করত। করুক। তাতে ধনঞ্জনের কিছুই ঠেকা পড়ে নাই। সন্ধ্যাকালে ধনা স্পেশাল পানের ঝাঁপ তোলা হত। রামু মুচির দোকান আর ধনা পানের দোকানের মাঝখানে বেশ বড়সড়ো একটি প্রবেশ পথও ছিল। এই পথে পরীরা যাওয়া আসা করত বলে পথটির নাম ছিল পরী গেট। পরী দেখলেই লোকে ভয় পেত। আর এই আনন্দে রাসমোহন সাহা এই সোলাইম্যান ম্যানসনে একা একা থাকতেন। দিনের বেলায় ঝাঁপফেলা ধনা পান স্টোরে। আর রাতে রামুমুচির শো রুমে।

    বড়মামা দিনের বেলাই এসেছিলেন এই সোলায়ম্যান ম্যানসেন। কিন্তু সেদিন ঘটনাক্রমে ধনার ঝাঁপখোলা। ঘরের মধ্যে রাসমোহসন স্যারের থাকার কথা। তিনি নাই। তার বদলে একটা ঘোমটাবতী ফোঁস ফোঁস করছেন। মামা ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে দোনামোনা করছেন। বাইরে ঘোরাফেরা করছেন। তখন, ঘোমটাবতী আওয়াজ দিলেন, কেডা তুমি চান্দু?

    মামা চমকে গেলেন। অর্ধস্ফুট গলায় বললেন, ধূউপ..

    –ধূউপ?

    –ওগো ধূপ।

    –কি, আমি ধূউপ। তুমি হালায় আমারে ধূপধুনা ধান্ধাইতেছ? তুমি আগুন জ্বালাইতে চাও?

    –না, আমি কইতে চাইছি—ওগো ধূপ।

    আবার ওগো ডাকতিছ? এক হালায় আগুন জ্বালাতি জ্বালাতি কম্ম ফতে করছে। আর তুমি আইছ ম্যাগো ফ্যাগো বোল ধইরা। রসো—রসো, তুই গেলি কুহানে?

    –এইতো আমি। মামা বলল।

    –তর নামও রসো নিকি?

    –হ। রসো। রসরঞ্জন বনিক।

    –অ। তুইও রসো। এত রস আছে দুন্নিয়ায়? গেছিরে বাপা। বলে ঘোমটাবতী থেমে গেল। মেঝের উপর ধপ করে বসে পড়ল। তখন তার মাথা থেকে ঘুমটা খুলে গেছে। একমাথা চুল। আর সিঁথিতে টিকলি। নাকে নথ। কানে মাকড়ী। পুরো রসোবতী । রসবতী বড়মামার দিকে বড় বড় চোখ করে বলল, তুমারে নয়গো বাছা। আমি রাসমোহনরে খুঁজছি। আমি ফুলপরী। ফুলবনে থাকি। বাংলার রাসমোহন আমার ডানা লইয়া গেছে। কী করি কওতো?

    কী আর কওয়া হয়নি। আমার বড় মামা কাঁপতে কাঁপতে ধনা স্পেশাল পান স্টোর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সেইদিন। আর ওদিকে যাওয়া হয়নি। কবিতাটি দেখানো হয়নি রাসমোহন সাহাকে। রাসমোহন সাহাকেও আর আমাদের শহরে দেখা যায়নি। অসামাপ্ত রয়ে গেছে গেছে সেই ধূপের কবিতাটি। সোলাইম্যান ম্যানশন, ধনা বা রামু মুচির দোকান সেই একই রকম রয়েছে। সেখান থেকে দিনে চামড়ার গন্ধ বের হয়। আর রাতে স্পেশাল পানের খুশবু। পরীরগেটে মাঝে মাঝে পরীরা আসে যায়। মাঝখানে বাঁকা নদী আরও বাঁকা হয়েছে। এই পর্যন্ত। কোনো কোনো কবিতা অসমাপ্ত রয়ে যায়।

    .

    অসমাপ্ত থাকার অনেক বেদনা আছে। সে বেদনায় বড় মামা কলেজে যাওয়া থেমে গেছে। বাবা তাকে নিয়ে হাঁটে গিয়েছিল। হাঁটুরেদের দেখে মামা হা করে চেয়ে থাকত। এই ফাঁকে অনেক আলুপটল উবে যেত। বাবা একদিন রাগারাগি করে বলেছিল, তুমারে কি ভুতে পাইছে?

    মামাকে কোন ভুতে পেয়েছিল বাবাকে তা কখনো বলেননি। শুধু পরদিন বড়মামা নাই হয়ে গেল। আজা মশাই লোক মারফত জানিয়েছিলেন—রসোকে কেশীর মায়ের কাছে নেওয়া হয়েছে। তিনি চালপড়া দিয়ে বলেছেন, এ ভুত যে সে ভুত নয়। কিম্ভুত। সুতরাং উপায় নাই।

    এর মধ্যে আজামশাই বুড়ো হয়ে গেছেন। তাঁর চুল দাড়ি সব পেকে গেছে। সামান্য কুজোঁ হয়ে চলেন। চোখে নীল বর্ণ। সন্ধ্যায় হাঁপাতে হাঁপাতে গান ধরেন, হরি দিনতো গেল সন্ধ্যে হল। পারের জন্য তার অপেক্ষা হচ্ছে। হরি এলেই সন্ধ্যে সন্ধ্যে রওনা করে দেবে। এভাবে ধূপের মত আর পুড়তে মন চায় না।

    আজা মশাই তাঁর সাত মেয়ে আর পাঁচ ছেলেকে কাছে ডাকেন। মেজোমামা, সোজোমামা, নমামা, ছোটোমামা এসেছেন। বড় মামা আসেন নাই। বড়মামা তখন বারখাদিয়ার বটতলায় বিড়বিড় করছেন। তার কাছে লোক গেল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে চাঁদ উঠে গেছে। কোনো এক ফুলের সুবাস আসছে। সেই সুবাসে তাড়াতাড়ি হাঁটা মুশকিল।

    বারবার বড়মামা বসে পড়েছে। এই আলো আর হাওয়ার মধ্যে আকাশ থেকে নেমে এসেছে রেশমের মতো মিহি সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়েছে এক মেয়ে। পথ হারিয়ে ফেলেছে। তার চোখে বিষাদ। চারিদিকে মাঠে নির্জনতা। দুটো কোঁড়া পাখির ডাক। হাতে দুটো পদ্মপাতার ডানা। এই ডানা মেলে উড়তে পারবে। পথটি খুঁজে পাবে। উড়ে যাওয়ার জন্য মেয়েটি পিঠে ডানা লাগাবে। চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। চোখে জল। অস্ফুট গলায় বলছে, আহ—আহ…

    এই আর্তনাদ শুনে বড়মামার ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। পারছে না। মামাকে লোক ধরে আছে। বলছে, দেরী কইরো না। সময় নাই।

    সময় কোথায় যায়? সময় নাই কেন? এটা ভাবতে ভাবতে বড়মামা দেখতে পাচ্ছেন, মেয়েটা একা দাঁড়িয়ে আছে। তার চুল উড়ছে। হু হু হাওয়া। হাওয়া বলে, সময় চলে যায়গো মেয়ে। সময় যায়।

    বড়মামা বলার চেষ্টা করছে, আমি আসছি।

    মেয়েটা বলছে, আহ-আ-হ।

    মামাকে লোকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মাঠ থেকে, রাত থেকে, আলো থেকে, হাওয়া থেকে। বলছে, দেরী কইরো না। মাস্টার মশাই অপিক্ষা করতিছেন।

    সত্যি সত্যি আজামশাই অপেক্ষা করছিলেন। বড়মামাকে দেখে ডান হাত দুটো ওঠানোর চেষ্টা করছেন। হাতটা কেঁপে কেপে উঠল। সামান্য উঠল। আবার পড়েও গেল। সাদা ভুরুর মধ্যে মাকড়সা। চোখ স্থির।

    বড়মামা আজা মশাইয়ের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলছেন, অ বাবা, ধূপ, ধূপ রাখছো কোথায়? ধূপ আছে কোথায়?

    সেদিন মামাবাড়িতে কোনো ধূপ ছিলনা সত্যি সত্যি। থাকলেও আজা মশাই কোথায় রেখেছেন কেউ জানে না। কাউকে বলে যাওয়ার সময় ছিল না। আর আদৌ কিনেছিলেন কিনা—সেটাও কঠিন প্রশ্ন বটে। এই কারণে আজামশাইকে লোকে পুকুর পাড়ে নিয়ে গেল। বাড়ির পশ্চিমের তালপুকুর। থৈ থৈ জল। জলে হৈ হৈ মাছ । দক্ষিণ পাড়ে দুটো তাল তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে। তালপাতায় বাবুই পাখি। খড়কুটোর বাসার বাইরে উঁকি দিয়ে চেয়ে আছে। আজা মশাইয়ের মাকড়সার ভুরু মাটিকদম হয়ে যাচ্ছে। তাই দেখে বড়মামা চেঁচিয়ে বলছেন, অ বাবা, মাইয়াডারে মশায় কামড়ায়। ধূপ কোথায় রাখছো—কইয়া যাও। ধূপ ধুনো জ্বালাইলে মশা যাবে।

    মেয়েটা ডানা ছাড়া জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মাথা নিচু করে। দুরে। দুহাতে ডানাদুটো। রাসমোহন সাহা কেটে ফেলেছে। চারিদিকে ভন ভন করে মশা উড়ছে। আর মেয়েটি বলছে—আহ-আহ-।

    .

    এইভাবে পাখি সব করলে একরকম রাত্রিও পোহায়ে যায়। কাননে কুসুম কলি ফুটে ওঠে। সে কুসুম বড়মামার কপালে ছুইঁয়ে আজিমা বলছেন, যা বাবা, দুগ্গা দুগ্গা বলে রওনা কর।

    রাতে মশার কামড়ে বড়মামার মুখ ফুলে গেছে। চোখে ঘোর। মামা বলে, ধূপের কী হইবে?

    –হইবে বাবা। ধূপ হইবে। বেতন পাইলে তুই কিন্যা আনিস।

    বড়মামা আজামশাইয়ের রিফু করা ছাতিটা বগলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন। নারিকেলবাড়ি পেরিয়ে বটবাড়ি। তারপর নিজামকান্দি। পরের গ্রাম নিজড়া। নিজড়ার পরে জাঙ্গালিয়া। পাঠশালার বালকবৃন্দ বসেছিল গাছতলায়। মাস্টারমশাইকে দেখে উঠে দাঁড়াল। সালাম দিল। আজ তাদের মাস্টারমশাই আসেন নাই। তার ছেলে এসেছেন। ছেলে মাস্টারমশাই তার বাবা বুড়ো মাস্টারমশাইয়ের মত একরকমভাবে বসে আছেন। বুকের কাছে রাখা হাত। মাথাটা সামান্য কাত। এখনই সামান্য কুঁজো। চক্ষু থরোথরো। বালকবৃন্দ সুর করে বলতে শুরু করেছে—

    এক এক্কে এক।

    নয়ন মেলে দেখ।অ।

    দুই দুগুনে চার।

    জগ্‌ৎ পরাবার।

    তিন দুগুনে ছয়।

    পরান জোড়া ভয়।অ।

    এইখানে এসে বড়মামার ভয় ভয় করে। বাড়িতে আজিমা বসে আছেন। বড়মামা চাল আনবে। তেল আনবে। নুন আনবে। চল্লা থেকে বেগুন মরিচ তুলে রান্না হবে। পাঁচ ভাই—সাতবোনের পাত পড়বে। এর মধ্যে ধূপ কেনার পয়সা নাই। নিজেই ধুপের মত পুড়ছে।

    জামতলায় ধূপের ধোঁয়ার মত সন্ধ্যা নেমেছে। মাঠের মধ্যে ধেড়ে ইঁদুর আকাশ পানে চেয়ে দেখছে। মেঘের কোল থেকে গলতে গলতে চাঁদ উঠেছে। সেই মেয়েটি জলের উপর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাকে ফিরতে হবে মধুমতির পাড়ে। সোলাইমান ম্যানসনে। নীচে সল্লু দরজির সেলাইকলের খটখট শব্দ। আর রামু মুচির সট সট চামড়া কাটার গন্ধ। ধনা স্পেশাল পানের জন্য লোকজন ঘোরাফেরা করছে। তার বদলে এই পদ্মবিলার বিলে শোনা যাচ্ছে, আহ-আহ। বড় মামার পকেটে অসমাপ্ত কবিতা বলছে, নাহ—নাহ–

    বিলের জলে মশা। মশা ভন ভন করে। মশা ঘুরে ঘুরে কামড়ায়।

    .

    মামীর নাম রমা। কেষ্টপুরের মেয়ে। পদ্মবিলায় পদ্ম ফোটে। কেষ্টপুরে গাঁদা ফুল। রমা মামী এলেন হলুদ গাড়া ফুলের মালা গলায় দিয়ে। আজিমা মামীকে সকালে ধানদুব্বো দিয়ে বরণ করলেন। আর হাতে চাল ধোয়ার পাতিলটা তুলে দিয়ে বললেন, চিন্তা কইরো না গো মা। আমার রসো তুমারে সোনার বিছাহার কিন্যা দেবে।

    এই বিছাহার কেনার কথাটি পদ্মবিলার লোকে পদ্মফুল তোলার সময় জানে। কেষ্টপুরের বটতলার হাটেও দূর দূর গাঁয়ের হাঁটুরেদের মধ্যেও কথা হয়। দেবাশুরের পিঠাবুড়ির মেলাও জানে। বারখাদিয়ার আচি খালও শুনতে পায়—রমামামীর গলায় বিছাহারটি আসবে। বিছা হারটি বড়মামা কিনে আনবে।

    এই সুখে রমামামী তাজা তাজা পুটি মাছ কোটে। কচি ঢেঁড়শ দিয়ে তরকারী রাঁধে। কলমী শাক ভেজে রাখে। মামা ফিরলে এক ঘটি জল এগিয়ে দেয়। মামার পা থেকে জল গড়িয়ে গড়িয়ে নামে। মামীর পায়ে জল লাগে। জলে মামীর পা গলে যায়। জল বলে, আহা-আহা। সেই সুরে জলগলা পায়ে জোনাক পোকা জ্বলে ওঠে। আর মামীর মাথা থেকে লম্বা ঘোমটা পড়ে যায়। গলায় শিউলী ফুলের মালা।

    শিউলী ফুলে ভর দিয়ে রাত্রি নামে। চাঁদ ওঠে। ধুপের গন্ধ জাগে। সেই মেয়েটি ঠোঁট চেপে ধরে পদ্মবিলার মাঠ থেকে নিরবে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে তার পা-গলা জলের উপর চলে। হাতে ডানা দোলে। আমাদের ছোটো নদীটির পাড়ে সোলাইমান ম্যানশনের ছাঁদে গিয়ে নামে। নিচে সল্লু দর্জি খট খট করে সেলাইকল চালায়। রাম মুচি সট সট করে চামড়া কেটে কোলাপুরি চটি বানায়। ধনঞ্জয়ের ধনা স্পেশাল পানের দোকানের ঝাঁপ ওঠে। ভানুমতির যশোগান গাইতে গাইতে রাসমোহন সাহা বাঁকানো ছড়ি হাতে পরীগেট দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। মামার দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন, দেখি, কি লিখেছ হে?

    ছাঁদ থেকে পরী নামে। বলে, আহা। আহা।

    পরীটির হাতে আজ আমার বড়মামার কাঁপা কাঁপা হাত। আর হাওয়ায় ধুপের গন্ধ নয়—কবিতার গন্ধ ভাসে।

    আজ বড়মামার কবিতাটি পুড়ছে। বাইরে জ্যোৎস্না।
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ১৩ নভেম্বর ২০১১ ১১:২৬490899
  • ছোট পিসি বড় পিসি
    কুলদা রায়

    .
    আমার দুপিসি। বড় পিসি ক্ষেপি পিসি। ছোট পিসি পচি পিসি। নামের মতই তারা নির্মল।

    ক্ষেপি পিসি বাবার বড়। দুজনের মা বাল্যকালে মারা যান। তিনি ছিলেন হীরা বাড়ির সাতভাই চম্পা পারুল। ছিলেন শ্যামলা মেয়ে। ছিলেন মুখ বুজে কাজ করা বউ। তার স্বামী গান বাজনা নিয়ে ব্যস্ত। একদিন চুনখোলা থেকে গান গেয়ে ফেরার সময় তার সাইকেলে চড়ে বসেছিল ফুটফুটে মেয়ে। তিনি ছিলেন সুন্দর। তিনি আমার গোরা ঠাকুরমা। এই সময় আমার ঠাকুরমা ছায়ার মত ফুরিয়ে গেলেন। সকলের মাঝ থেকে হাওয়া।

    আমাদের পারিবারিক একমাত্র ছবিতে এই ঠাকুরমা ঘাড় নিচু করে বসেছিলেন। মুখে ঘোমটা। মলিন মুখ। হাসি নেই। একটু দূরে ঠাকুরদা—চোখে গোল্ড রিমের চশমা, পাশে গোরা ছোট বউ। কাছাকাছি ছোট পিসি। পরনে ফ্রক। বাবার গায়ে হাফ শার্ট। চুলে বাঁদিকে সিঁথি। আর মাঝখানে ক্ষেপি পিসি জোড় হাতে বসে বসে। সামনে তাদের মৃত ঠাকুরমা। সবার হয়ে ঠাকুরমার জন্য প্রার্থনা করছে। তার চক্ষু মুঞ্জা।

    আমাদের বড় ঠাকুরমা মারা গেলে ছোট ঠাকুরমা ধীরে ধীরে পাগল হয়ে গেল। পরপর দুটি কাকা হয়েছিল। তারা জন্মকালেই সূর্য দেখেনি। এরপর থেকে পাগল ঠাকুরমা কারো সঙ্গে আর কথা বলেনি। পুকুরপাড়ে বসে থেকেছে—রাতের আঁধারে ঘুর ঘুর করেছে উঠোনে। একা একা বিড়বিড় করেছে। কোনো কোনো ছায়ার দিকে চেঁচিয়ে বলেছে, যারে যা, নিব্বুংঅইশা।

    এই দুই ঠাকুরমার নাম কোথাও লেখা নেই। জোঁকা নেই। কি নাম ছিল তাদের?

    .
    আমাদের কোনো স্মৃতিচিহ্‌ণ থাকতে নেই। শুধু একজনের আছে। তিনি মেজোঠাকুরদার তৃতীয় বউ। তিনি লীলাবতী। লীলাবতী মেঘে এলো তন্দ্রা। তিনি আমাদের মাইজারদ্দি। তার চুল ছিল রাত্রির মত কালো। আর চোখ ছিল জ্যোৎস্নার মত ধলো। এই চুল আর চোখ নিয়ে বহুদিন বেঁচে ছিলেন তার ঘর গেরস্থালীসমেত।

    আর এই মধ্যে আমার ক্ষেপি পিসি পচি পিসি—আর মাঝখানে একটিমাত্র ভাই, এই তিনজন-- তিন ভাইবোন এই বড় বাড়ির মধ্যে একা হয়ে ছন্ন হয়ে ঘুরছে। মা নেই। ছোট মা পাগল। তাদের বাবা বাইরের মানুষ। বছরে কয়েকবার বেড়াতে আসেন। হাতে বোতলেবন্দি জল। সুতরাং তারা পচি-ক্ষেপি। তারা নো স্কুল। নো সাজন গোজন। আর আমাদের মাইজারদ্দির দু মেয়ে প্রজাপতি প্রজাপতি পাখনা মেলো। তারা নাচ। তারা গান। তাদের চুলে লাল রিবন। হাতে বালা। গলায় হার। তারা ক্লাশ টেন।

    আমার পিসিদের কথা হেতা কেহ তো বলে না। তারা পচি। তারা ক্ষেপি। আর আছে শুধু মিছে কোলাহল।

    .
    ক্ষেপি পিসির বিয়ে হয়েছিল বেদগ্রামে। সেই বাড়ির চারিধারে বড়সড়ো মাঠ। বাড়িটির নাম ছিল পোড়া বাড়ি। বাড়িটিতে একটি ঘরে আগুন লেগেছিল। সে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল ক্ষেপি পিসির বড় ছেলে বড় মেয়ে। এরপরে পিসেমশাই মোল্লাকান্দি---এরপর পিসেমশাই ছোট বউ। ছোট বউ বলে, আমার যেমন বেণী তেমন রবে চুল ভেজাব না। তার চুল কখনো ভেজেনি। তার কোল আলো করা ছেলে। ছেলে গ গ করে বলে, অ মা, তোমার চুল কেন ভেজে না?

    বড় পিসির বাড়িতে কখনো বেড়াতে যাওয়া হয়নি। বছরে দুকএবার নেমতন্ন করতে গেছি। তখন পিসেমশাই বাড়িতে নেই। বাজারে গেছেন। তার ছোট ভাইটি ভাসাবাবু—বটতলায় মদ গিলছেন। আমাদের দেখে বলছেন, এ আজাদি ঝুটা হ্যায়—লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়। আমরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। তার হাতে চকচকে রূপোর বালা। বলি, ভাসাকাকু, ইনসান মানে কি? তিনি হা হা করে হেসে ওঠেন। বোতলটা মাথার উপরে একটু ছুড়ে মেরে আবার ধরেন। আবার ছুড়ে মারেন। আবার ধরে ফেলেন। ঠা ঠা করে বলেন, কদম কদম বাড়ায়ে যা। আমরা কদম কদম বাড়ায়ে যাই।

    পিসিদের বারান্দায় মোল্লাকান্দির সতীন পিসি তখন ছেলেটিকে মাই দিচ্ছেন। মুখ উঁচিয়ে বলছেন, তোমাগো পিসির কাণ্ড শুনিছো? হ্যায় শ্বশুরমশাইয়ের চশমা ভাংছে।

    আমরা ভয়ে ভয়ে গোয়ালঘরের পানে যাই। দেখতে পাই হাদা বিশ্বাস ছড় বেছড় গালি পাড়ছে। সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষেপি পিসি-- হাতে গোবর গোলা। চোখ তার ঘোলা। পায়ের কাছে সুতা দিয়ে গাঁথা চশমার ফ্রেম। আর উবু হয়ে ভাঙা কাঁচের টুকরো কুড়োচ্ছে আমাদের পিসাতো বোন তৃপ্তি। এই তৃপ্তি ক্লাশ ফাইভ। এই তৃপ্তি ভাঙা কাঁচ। এই তৃপ্তি ঝড়ে ভাঙা গাছ। এই তৃপ্তি স্রোতে যায় ভেসে, ডোবে বুঝি শেষে, করে দিবানিশি টলমল

    .
    ছোট পিসির বাড়ি কোন্দরগাতি। ইউনিয়ন মাঝিগাতি। খাল থেকে একটু দূরে। চারিদিকে ধানক্ষেত। বাকা জল করিছে খেলা। এর মধ্যে মজুমদার বাড়ি। পিসমশাই এই বাড়ির হরিদাস।

    একটি ঘরের বারান্দায় পিসিদের গেরস্থালী। দুটো ছাগলছানা। গোটা ছয়েক পাক পাক হাঁস। একটি তিলকী মিঁয়াও। বিড়াল কহে মাছ মাছ খাব না—কাশি যাব। কাশি যেয়ে মেকুর হব। মাঠে ধলি গাইটিকে আনতে গেলে ওরা সবাই পিসির আগে পাছে হাঁটে। আর মা মা করে ডাকে। এই এরা আমার পিসাতো ভাইবোন।
    হরিদাস পিসেমশাই নৌকার ঠুকঠুক মিস্ত্রি। তাঁর এক বাক্স যন্ত্রপাতি। একটা গুপি যন্ত্র। আর এক জোড়া প্রেমজুড়ি। আর গান। গান বলে, তুমি নির্মল করে মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে। মর্ম শুনে হাসে।

    ছোট পিসির বাড়ি আমরা সবাই মিলে গিয়েছিলাম একাত্তরে। পাক হানাদার বাহিনী তার পরদিন গুলি করে সব সাফা করে দিয়েছিল। আমরা মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, কয়লা হয়ে পুড়ে গেছে সেই ছাগল ছানাটি। ধলি গরুটি।

    চুয়াত্তরে যখন দুর্ভিক্ষ এসেছিল, তখন পচি পিসি আর পিসেমশাই কোন্দরগাতি ছেড়ে জন্মের মত চলে এসেছিল আমাদের শহরে। একটা ছাড়াবাড়িতে ঝুপড়ি ঘর তুলেছিল। সেই ঘরে রাতবিরেতে জোনাকি জ্বলত। আর ঝিঁঝিঁ পোকা। এই সময় আমাদের ছোট বোনটি হামাগুড়ি দিয়ে পিসির কোলে উঠে বলেছিল, পে। পচি পিসি সেই থেকে ছোট বোনটির প্রিয় পে। আর কিছু নয়।

    .
    দুপিসি যখন আমাদের বাড়ি আসত তখন ক্ষেপি পিসি পথ থেকে তুলে আনত নটে শাক। কটা সজনের ডাঁটা। অথবা ক’গোছা শাপলা। ভুর ভুর গন্ধভাদুল।
    আর পচি পিসি নিয়ে আসত এক টিন মুড়ি। কিছু খইয়া মুড়ি ধানের খই। দুহালি ডিম। পাকা কুমড়ো। কটা জালি লাউ। শুকনো মরিচ—মরিচের গুড়ো। নৌকা থেকে নেমেছে এক ধামা আলা চাল। আর কিছু কোটা চিড়ে। এক হাড়ি নলেন গুড়। জাবা চিনি। একটা হাত পাখা। পাখাটি দিয়ে বাতাস খাবে তার দাদা।
    ক্ষেপি পিসি এসেই মন্দিরে প্রণাম করত। জোড় হাতে কৃষ্ণের আষ্টোত্তর শতনাম বলে যেত।

    শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন।
    যশোদা রাখিল নাম যাদু বাছাধন।অ।

    তারপর ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীর ঝাঁপির সামনে বসে চক্ষু মুদে বলে যেত—
    উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর গোপাল।
    ব্রজবালক নাম রাখে ঠাকুর রাখাল।অ।

    আর উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে—পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে-- সুবল রাখিল নাম ঠাকুর কানাই/ শ্রীদাম রাখিল নাম রাখাল রাজা ভাই। সেই সুর আমাদের হাসনুহেনার ঝাড়ে মিশে যেত দূরে—বহুদূরে। চারিদিক তখন আশ্চর্য ঠাণ্ডা হয়ে যেত। শুধু ক্ষেপি পিসির সুর ভেসে ভেসে বেড়াত।

    এর ফাঁকে, আমরা তখন হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছি। বুড়ি দিদি অঙ্ক। দাদা দি কাউ ইজ এ ফোর ফুটেড এনিম্যাল। আর তেজো বোনটি সদা সত্য কথা কহিবে। কদাচ মিথ্যা নহে। পিসি সে বইটি নিয়ে পড়তে শুরু করেছে, প্রথম পৃষ্ঠা থেকে—আদর্শ লিপি। লেখক—সীতানাথ বসাক। প্রকাশকের নাম। ছাপাখানার ধাম। আর মুল্য। আর ভূমিকাসমেত স্বরে অ-তে-অজগর। স্বরে আ-তে আম। পিসি এইসব বই পড়ে যাচ্ছে কৃষ্ণের শতনামের সুরে। ছন্দে। আলো নিভে গেলেও এই পড়া কখনো থামতে শুনিনি। অন্ধকারের থিকিথিকির মধ্যে আমরা অনেকগুলো ভাইবোন চুপ করে শুনতে পেতাম পিসি আদি অনাদি অনন্তকাল থেকে আদর্শলিপি প্রথম পাঠ পড়ে চলেছে। থামাথামি নেই। চলছে। চলবে।

    ছোট পিসি তখন রান্নাঘরে আনাজ কুটছে। ভাতের হাড়িতে দুটো বেগুন ফেলে দিচ্ছে। আলু ছুলে রেখেছে। এরপর বারাষি বরই দিয়ে খাট্টা রানবে। চুকাই শাক ধুয়ে রেখেছে। রসুন দিয়ে একটু সুক্তো হবে। সন্ধ্যা ঘুরে গেলে ঘষে ঘষে সিয়ৈ পিঠে বানাবে। দুটো নাড়ু বের করে দিয়ে বলছে, বউদিগো, দাদার পাতে দিয়ে আসো। আর মুছি পাটালি। তার ইচ্ছে এই বাড়ির পুকুরে কটা পাক পাক হাঁস ছেড়ে দিয়ে যায়। হাঁসগুলি পুকুরে ভাসবে। হাঁস ছাড়া গেরস্ত বাড়ি হয় কি করে?

    .
    মধ্য রাত্রি এলে বারান্দায় বড়পিসি ছোট পিসি ক্ষেপি পিসি পচি পিসি চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। বাইরে তখন ঝিরঝির হাওয়া। নিমফুলের গন্ধ। আর মাঠ থেকে উড়ে আসছে বুনো জ্যোৎস্না। বড় পিসির বেঁচে মেয়ে তৃপ্তি তখন দূর দেশে পথে পথে ঘুরছে। আর ছোট পিসির তিলকি বিড়ালটি মা মা করে ছাড়া বাড়ির আনাচে কানাচে ঢুঁড়ছে। এর মধ্যে দুবোন দেখতে পাচ্ছে, পুকুর ঘাটে বড়মা মাছ ধুতে নেমেছে। সিঁড়ি ভেঙে একটু একটু জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথাসমান জল এসে গেছে। জলে চুল ভেসে গেছে। তারপর কে একজন উঠোন থেকে ছুটে যেতে যেতে বলছে, দিদিইই। দিদিইই।অ।

    এরা দুবোন হয়তো আমার পিসিদের দুটো মা। অথবা আমার বড় পিসি-ছোট পিসি। ক্ষেপি পিসি-পচি পিসি। এরা ছাড়া আর কে হবে?
  • Sumit Roy | 67.242.141.24 | ১৩ নভেম্বর ২০১১ ১৯:৫২490900
  • "আমি অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি!"
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ১৪ নভেম্বর ২০১১ ১০:০০490901
  • এর পরে মেজোমামা গল্প বলব। ধন্যবাদ।
  • dd | 124.247.203.12 | ১৪ নভেম্বর ২০১১ ১৪:২৮490902
  • উফ। কুলদা বাবু কি সাংঘাতিক ভালো লিখেছেন। একেবারে বাপ রে বাপ টাইপের ভালো।
  • pi | 72.83.76.29 | ১৪ নভেম্বর ২০১১ ১৯:৫৪490903
  • ..অন্ধকারের থিকিথিকির মধ্যে আমরা অনেকগুলো ভাইবোন চুপ করে শুনতে পেতাম পিসি আদি অনাদি অনন্তকাল থেকে আদর্শলিপি প্রথম পাঠ পড়ে চলেছে। থামাথামি নেই। চলছে। চলবে।...

    এ লেখার যেন থামাথামি না হয়। চলছে। চলুক।
  • Nina | 12.149.39.84 | ১৪ নভেম্বর ২০১১ ২০:৫৫490905
  • উফ! কুলদাভাই---যাই বলি কমই হবে----অ্যারে কয় ল্যাখা----
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ২০ নভেম্বর ২০১১ ১১:১০490906
  • আমাদের কখনো জন্ম হয় না
    কুলদা রায়
    ------------

    আমার জন্মদিন কবে সত্যি আমার জানা নেই। আমার মায়েরও নেই। বাবারও ছিল না। ঠাকুরদার তো মনে থাকার কথাই নেই। এসব বালাই তাদের ছিল না। ভাগ্যিস আমারও নেই।

    আমার ভাইবোনদের কারোরই জন্মদিন বলে কোনো ব্যাপারে কখনো আগ্রহ দেখা যায়নি। সবার একটা জন্মদিন আছে বটে--সেটা বানানো। স্কুল থেকে দেওয়া। যেদিন ভর্তি হয়েছিলাম স্কুলে ক্লাশ টুতে-- হুজুর স্যার একটা জন্মতারিখ বসিয়েছিলেন--মনে পড়ে। ক্লাশ ফাইভে বৃত্তিপরীক্ষার সময়ে হেড স্যার আরেকটা বানিয়েছিলেন। ফাইনালী ক্লাশ নাইনে রেজিস্ট্রশনের আমার ফাইনাল জন্মতারিখ কেরানী কাকু হিসেব করে ঠিক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন--আর নো চেঞ্জ।

    আমার বড় দিদির একমাত্র নাতনীর বয়স বছরখানেক। গেল মাসে হুট করে দিদি পোলার বাসা থেকে খবরাদি না দিয়েই চলে এসেছে মায়ের কাছে। আমার বুড়ি মা মহাখুশি তার বড় মেয়েকে পেয়ে। তাকে এটা খেতে দেয়--ওটা পরতে দেয়। শিয়রে বসে ঘুম পাড়ায়। গুণ গুণ করে কাঁকনমালার গল্প গায়।
    মাঝরাতে দিদি চোখ মেলে বলে, অ মা, কওতো আমার জন্মদিন কবে?
    মা অস্ফুট গলায় বলে, ক্যান রে?
    দিদি বলে, আমার নাতনীর জন্মদিন হবে। আমার পোলা জিগাইছে, মা তুমার জন্মদিন কবে?
    মা জানতে চায়, তুই কি কইলি?
    দিদি বলে, কইছি, বেটা, আমার জন্মদিন জাইনা তুই কি করবি?
    পোলা কয়--আমার মাইয়ার লগে তুমার জন্মদিনও করুম এবার থিকা।

    মা অবাক হয়ে শোনে দিদির কথা। দিদির চুলে বিলি কেটে দেয়। এ সময় দুএকটা ইঁদুর ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক দৌঁড়ে যায়। হারিকেন দপ দপ করে জ্বলে--নেভে। কারো কারো নাসিকা গর্জন হাওয়ায় ভাসে। কে একটা শিশু ঘুমের মধ্যে থেকে থেকে কেঁদে ওঠে।

    মা জানে এরপর তার বড় মেয়ে কী বলবে। জানে বলেই মা নি:শব্দে হাসে। মায়ের মনে পড়ে কোনো এক বর্ষারাতের কথা। প্রবল যন্ত্রণার কথা--প্রথম আনন্দের কথা। আশ্বিনের ব্যাথা। অঘ্রাণের যথা। চৈত্রের জ্যোৎস্নার ভেতরে কে কখন হয়েছিল আজ তার মনে নেই। মনে কোনোদিন ছিল না ভেবে মা হালকা করে হাসে। দিদিও হাসতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
    দিদির পাশে আমার বুড়া মা কাত হয়। বহুদিন পরে তার আবার ঘুম পায়। ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখতে পায় দিদির চুল পেকেছে। কপালের শিরা জেগেছে। শিরার ভেতরে রক্ত দপ দপ করে। তার নিজের মায়ের কী চুল পেকেছিল?

    আমার মায়ের চুল কবরের মতো কালো। অন্ধকারে চাঁদ হেলে পড়ে। ক্ষুৎপিপাসা বাড়ে। এইখানে এসে মনে পড়ে--আমি তো দিদির ভাই।

    সত্যি সত্যি আমার জন্ম হয়নি। হতে নেই। হবেও না। জন্ম হয়ে লাভ কী?
  • i | 124.171.34.239 | ২০ নভেম্বর ২০১১ ১১:১৮490907
  • ঘুরে ফিরে পড়ি কুলদাবাবুর লেখা। বহুদিন পরে এই ইন্টারনেট দুনিয়ায় কারো লেখার ঘোরতর ভক্ত হলাম।
    শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা প্রসঙ্গে সে সময়ের এক তরুণ গল্পকার( অধুনা প্রবীণ) লিখেছিলেন- ' সংসারে প্রবলভাবে থেকেও যেন এক গোপন অভিসার ছিল দিব্য কোনো পৃথিবীর সঙ্গে। সে আমাদের এই পৃথিবী নয়। সে হয়তো তার দ্বিতীয় ভুবন।সে পৃথিবীর পথ কখনও টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর পাশ দিয়ে হরিদেবপুর হয়ে চলে যায় সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে। ... এই সময়ের ভেতরে ভেতরে আর এক গোপন সুড়ঙ্গ পথে হাতছানি দেয় আবুল ফজলের ধূসর পান্ডুলিপি, ইবন বতুতার দিনলিপি, আবু রায়হান বিরুনির কথামালা। ... অ্যাবাকাসের মত রঙিন পুঁতির মালা মাথার ভেতর সরে যেতে থাকে'।

    আপনার লেখা পড়ে আমারও আজকাল এমন কিছু একটা মনে হয়।
    লেখার অপেক্ষায় থাকি।
  • pi | 72.83.76.29 | ২০ নভেম্বর ২০১১ ১১:৩৮490908
  • কুলদাদার লেখার জন একেবারে ঠিক শব্দ। 'দ্বিতীয় ভুবন' ।
  • shrabani | 59.94.99.51 | ২০ নভেম্বর ২০১১ ১২:০০490909
  • এত ভালো যে ভালো লাগা বোঝানোর ভাষা নেই, প্রথম থেকেই এবং সব লেখাই.....সবার থেকে আলাদা একেবারে অন্যরকম কিন্তু মনকাড়া...
  • | 124.168.27.96 | ২১ নভেম্বর ২০১১ ১৭:১২490910
  • titir | 128.210.80.42 | ২১ নভেম্বর ২০১১ ২২:৪০490911
  • মন ভরে যায়। বার বার পড়ি। অসাধারণ!
  • ranjan roy | 115.118.157.216 | ২২ নভেম্বর ২০১১ ০০:০৫490912
  • একেবারে অবাক করা লেখা। শেষ করে অনেকক্ষণ বসে থাকি। কোথায় একটা কিছু দলা পাকিয়ে ওঠে। আরেক ভুবনের নির্মাণ যেন থেমে না যায়। কি লেখা!
  • Nina | 12.149.39.84 | ২২ নভেম্বর ২০১১ ০০:৩৩490913
  • একেবারে ছোটাইকে ক্ক---দ্বিতীয় ভুবন---কুলদাভাইর লেখা এক অন্য ভাবের, অন্য জগতের লেখা , এক অপরূপ রূপকথা!!
  • siki | 123.242.248.130 | ২২ নভেম্বর ২০১১ ১০:৪৯490914
  • ২০ নভেম্বর মিস করে গেছিলাম।

    কুলদাবাবুকে এফসি।
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ২২ নভেম্বর ২০১১ ১৯:৩৮490916
  • পরীকথা
    কুলদা রায়

    আমার এক মাসি পরী হয়ে গেল। সেদিন আকাশে চাঁদ ছিল না। জ্যোৎস্নাও ছিল না। এক ফালি মেঘ শরবনের ফাঁক দিয়ে আকাশে উঠে গেল। টুক করে হালকা অন্ধকার ঘিরে এল। আর বুড়ো মানুষের মত ঝিমুতে লাগল।

    মাসি একবার জামগাছের নিচ দিয়ে, পেয়ারাতলার ধার দিয়ে পলকা একটা অরবরই গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসল। বলল, অ খোকা, আমারে দেখতি পারতিছিস?
    আমি মাসিকে সত্যি সত্যি দেখতে পাচ্ছিলাম। একটা ডুরে শাড়ি পড়েছে। চুলে বেঁধেছে হালকা লাল রঙের ফিতে। বললাম, না তো মাসি। তুমি কুথায়?
    --সত্যি তুই আমারে দেখতি পারতিছিস না!
    --দেখতি পাইলি তো কব।
    মিথ্যে বললাম। যদি বলি দেখতে পাচ্ছি, তাহলে মাসির মন খারাপ হয়ে যাবে। মাসির মন খারাপ হোক, আমি কক্‌খনো চাই না। হে ভগবান, মাসি আমার হাসি খুশি থাকুক।
    --হুম। তাইলে ক’তো, আমি কুথায়?
    -দেখতে পারতিছি না।
    -হি হি হি। আমি কিন্তু এখন অরবরই গাছে নাই। এই আমি উইড়া যাইতাছি জাম গাছে। জাম খাইবি তুই?
    মাসি কিন্তু অরবরই গাছেই আছে। জামগাছে যাবে কিভাবে! একট দূরে জামগাছটা সাধুবাবার জটা চুলের মতো ডালপালা ছড়িয়ে আছে।
    -হি হি হি। কী মজা। নে, এই জামগুলা ধর। পাইছিস? কুড়ায় পাইছিস?
    -- হ মাসি। খুব টসটসে হৈছে। আরো দুইডা দ্যাও। মাইজা মামারে দেব।
    - তোর দিতি হবে না। মাইজাদা ফিরলি আমিই দেবখন। এই দ্যাখ, আমি এখন পেয়ারা গাছের পাতার উপরে বইসা পড়ছি।
    মাসি কিন্তু অরবরই গাছেই আছে। পা দুটো আরেকটু চঞ্চল হয়েছে মাত্র। বললাম, অ মাসি। তুমি এই গাছে গাছে যাইতাছ ক্যামনে?
    --ক্যান, উইড়া উইড়া।
    --তুমার ডানা আছে?
    এইবার মাসি একটুকু চিন্তিত হয়ে পড়ল। ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, নাহ। এখনো অয় নাই। জোসছোনা উডুক। তখন গজাইবে।

    এ সময় দাদুর পদশব্দ পাওয়া গেল। খড়ম খুলে পা ধুচ্ছেন। বিড়ালটা লেজ উচিয়ে চারিদিকে ঘুরছে।
    তালগাছের নিচ থেকে একটা শিয়াল উঁকি ঝুঁকি মারল। দাদু অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আলো খুঁজতে লাগল। কোথাও কোন আলো জ্বলে ওঠেনি। দাদুর স্কুল বন্ধ। তবু স্কুলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে গান ধরল-

    আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
    চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।অ।

    কয়েকটি ছেলেমেয়ে গুটি গুটি করে ছুটে এসেছে। গোল হয়ে বসেছে উঠোনে। ওরা অমৃত মধুর গলায় গলা মেলাচ্ছে--

    ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
    মরি হায়, হায় রে-
    ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধূর হাসি।অ।

    মাসি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেঘের মধ্যে কীঁ একটা খুঁজে চলেছে। কয়েকটি তারা উঠেছ। চাঁদ ওঠেনি। মাসি ফিস ফিস করে বলল, আমারে নিয়া যা। বাবা এক্‌খুনি ডাকপে।

    দাদু ডাকল না। সন্ধ্যা সঙ্গীত শেষ হল। ঘরের কোনে একটি খোলা মাটির পিদিম জ্বেলে বড় মামা বসে আছে। মুড়ির কলসিটা খুঁজছে।
    মাসি কিন্তু আমাকে না ধরেই ঠিক ঠিক ঘরের মধ্যে হেঁটে গেল। বড়ো মামাকে মুড়ি বের করে দিল। একদলা আখের গুড়ও দিল। মামা খেতে খেতে পৌষ সংক্রান্তির পিঠার কথা ভাবতে লাগল।

    দিদিমা ভোর ভোর চাল কুটতে বসেছে। দাদু অনেক আগেই গাত্রোত্থান করে গাড়ু নিয়ে মাঠে গেছে। বড়ো মামা হা করে ঘুমোচ্ছে। দিদিমা ডাকল, রসো। অ, রসরঞ্জন।
    মামা মুখ বন্ধ করে পাশ ফিরল মাত্র। পিঠের নিচে খড় বিছানো। উপরে হোগলার পাটি। মাসি বলল, আজ তোরে হলুদ দিয়া সিনান করাব।
    এমন ঝামেলা হল-- কারো ঘরে কাঁচা হলুদই পাওয়া গেল না। আনাজখোলায় মাটি খুঁড়ে দেখা গেল-- হলুদগাছ পচে গেছে। ডালিম পাতা বেটে আমার সারা গায়ে মাখিয়ে দিল। বলল, তোর গা ডালিম ফুলের মত হৈবে। বললাম, মাসি তুমি মাকপা না?
    -পরীদের মাখতি হয় না। মানুষদেরই মাখতি অয়রে বোকা। পরীরা ডালিম কুমারী।

    সেদিন দুপুরেও মেজো মামার দেখা নাই। আজিমা ভাউতা শোলের মাথা দিয়ে ডাটা শাকের পাতা ভাজি করেছে। খুন্তি নাড়তে নাড়তে পথের দিকে বারবার তাকাচ্ছে।
    বড়ো মামার কোন ভাবনা নেই। আজ তার মন খুব ভাল। পিঠা খেতে পারবে। কয়েকটা কাঁচা মরিচ তুলে আনল গাছ থেকে। শেষে দুটো ঝাল পিঠা খাবে।

    বারখাদিয়ার মাঠের মাঝখানে বুড়ো বটগাছ। ঝুরি নেমেছে। একটা পাটখড়িতে একটা একটা করে পিঠা গেথেছে আজিমা। অনেকে খুব বড়ো বড়ো পিঠাখড়ি এনেছে। আমাদেরটা বেশ ছোট। বটগাছের নিচে হেলান দিয়ে রাখল। আর একটা ঝুরির গায়ে তেল সিঁদুর মেখে দিল।
    বড়ো মাসিও এসেছে। আজিমাকে বলল, মা-- কপিল আসে নাই?

    আজিমা কিছু বলছে না। বিড় বিড় করে পিঠা বুড়িকে বিনতি করছে। সধবারা গেয়ে উঠল--

    লক্ষ্মীদিঘা ধানের আগায় সাজাই দিলাম হুল,
    এই না পউষে পিঠা খাইও না কৈরো মা ভুল।অ।
    চইতরো মাসে আগুন জ্বলে প্যাটে বিষম জ্বালা
    এইনা জ্বালার কুসুম তুইলা গইড়া দিলাম মালা।অ।
    ওরে, রূপার মালা উইড়া যাওরে যাওরে দক্ষিণ দেশ
    গোলা ভৈরা লক্ষ্মী দিও না করিও দ্বেষ।অ।
    তোমার ধান তোমায় দিলাম গৈড়া চিতই পিঠা
    তুমি খাইয়া তুষ্ঠ হৈলে আমরা পাইব মিঠা।অ।

    মাঠের মাঝখানে একজন আধবুড়ো লোক বাক্স টকি দেখাচ্ছে। তার মাথায় খুব পুরনো একটা বাদুরে টুপি। বহুদিন ধোয়া হয়নি। জনা পাচেক ছেলে মেয়ে বাক্সের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আর আধবুড়ো লোকটা ভাঙা ভাঙা গলায় সুর ধরেছে- আইসা গেল তাজমহল।
    তাজমহলের সামনে পরিখা। জল টলমল করে। বাসন্তিবালা মাসিকে জিজ্ঞেস করল, তাজমহলটা কোন দ্যাশে রে?
    মাসি কিছু বলল না। বুড়োটা তখন সম্রাট শাহজাহানকে দেখাচ্ছে। আর মমতাজ মহলের কিসসা ধরছে। মমতাজ মহলের পিঠে দুটো ডানা। উড়ে আসছে মেঘের উপর দিয়ে। নিচে পরিখাঅলা তাজমহল। ঝিলিক দিয়ে উঠছে। তাজমহল মমতাজের মরণঘর।

    খুব ভিড় জমেছে চক্রক্রীঈড়ায়। ঘাসের উপরে পাটি বসিয়ে রাখা হয়েছে তিব্বত স্নো, মায়া পাউডার, মিস নূরজাহান লিপিস্টিক। চক্র ছুড়ে যার গায়ে গাথা যাবে সেটা তার। কে একজন স্টার সিগারেটের প্যাকেট জিতেছে। ভুর ভুর করে টানতে লাগল। খেলা জমে গেছে।

    মাসির পছন্দ কাচের চুরি। বাসন্তি বাঁহাতে ছয়টি পরেছে। ঘুরয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। মাসিকে বলল, নিবি নাকি?
    --না। চুরি আমার ভাল লাগে না।
    গোটা চার পাঁচজন লোক মাসির বাঁহাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। বলল, আমাগো ভাল লাগে।

    মেলার মধ্যে খুব হৈ চৈ লেগে গেল। যে যেভাবে পারল পালাতে লাগল। পিঠেখড়ি তছনছ হয়ে গেল। অন্ধকার নেমে এল। ওরা, বীরদর্পে মেলার মাঠ পেরিয়ে চলে গেল। যেতে বলল, বাঘ মার্কা জিন্দাবাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

    আমি বলছি, মাসি উড়াল দাও। উড়াল দ্যাও। উইড়া যাওগে।
    মাসি কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ডানা নাইরে। ডানা নাই। উড়াল দিমু ক্যামনে। আমার ডানা দুইডা আইন্যা দে।

    অন্ধকারের কাছে বিনতি করছি, হে অন্ধকার- তুমি চান্দকে ডাইকা আনো। হে চান্দ- তুমি জোৎস্নাকে আসতি কও। তুমি মাসির পিডে ডানা গজাইয়া দ্যাও। হে পিঠা বুড়ি, তুমি মাসিকে ইবার সত্যিকারের পরী কৈরা দ্যাও। মাসিকে উড়াল করতি দ্যাও।

    মেজো মামাকে পাওয়া গেল দেবাসুরের বিলে। হাঁটুজলের মধ্যে মামা একা একা ছুটাছুটি করছে। মুখে কোন কথা নেই। দাড়ি গজিয়ে গেছে। উদ্ভ্রান্ত চোখ। পথ হারিয়ে ফেলেছে।

    ততদিনে কিছু লোকজন পোটলা পুঁটলি বেঁধে ফেলেছে। চোখ থেকে নিদ্রা উধাও। দাদু ভয়ে সিটিয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরয় না। অর বরই গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে মেজো মামা। মাথাটা বুকের কাছে ঝুলে পড়েছে।
    বাসন্তিবালার বাবা মামাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে-- অ কপিল, কতো-- কি করি অখন?
    মামা নির্বাক। দুপা ছড়িয়ে দিয়েছে। হাঁটুর চামড়া উঠে গেছে। মাছি ভন ভন করছে।
    বাসন্তিবালার বাবা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলছে, অ কপিল-- কি শুইন্যা আইলি ঢাকা থেইক্যা। আমাগো আবার দ্যাশ ছাইড়ে হৈব? আর কুনো উপায় নাই? অ কপিল, কথা করে বাপ।

    তেতুলিয়ার কেশির মা খুব বড় গুণিন। কাঠ মালতি গাছের নিচে মেজো মামার মুখে হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অনেক ঝাড় ফুঁক করেছে জীবনে। কখনো ব্যর্থ হয় নাই। বড়মামাকে কেশির মা বলল, অরে লৈয়া যা।
    বড় মামা চিন্তিত হয়ে বরল, কপিলের কী অইবে?
    -- জানি না।

    মধুমতির উপর দিয়ে খোলা নৌকায় বাসন্তিবালার বাবা মেজো মামাকে ধরে আছে। বড়ো আশায় বারবার বলছে, কথা ক। কথা ক, অ কপিল।

    এই সময় একটি লঞ্চ দূর থেকে ভটভট করে আসতে দেখা গেল। দোতলার রেলিংঅএ কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। একটা শালু কাপড়ে লেখা-- জাগো বাঙালী জাগো। বড় মামা বিরক্ত হল। ঢেউ দুলিয়ে দিচ্ছে ছোট নৌকাটাকে। তাল সামলানো মুশকিল। ঢেউয়ের আড়াআড়ি নৌকাটা তুলে দিল। বলল, কাগু, কপিলরে ধইরা রাইখো ঠিক কৈরা।
    হঠাৎ করে মেজো মামা লাফিয়ে উঠল। দাঁড়াল সোজাসুজি। মাথা খাড়া করে দুহাত ছড়িয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে বলল, মুজিব ভাই...

    লঞ্চের বাইরে সাদা পাঞ্জাবী দীর্ঘদেহ চশমা পরা পাইপ হাতে কে একজন জলদ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন-- জয় বাংলা।

    সেদিন সন্ধ্যার আগেই ঝকঝকে চাঁদ উঠল। ফুল ফুটল। জোৎস্না ভরে গেল চারিদিক।

    মেজো মামা বাসন্তিবালার বাবা বড়ো মামা বুড়ো দাদু আজিমা -- আমাদের সবার পিঠে সত্যি সত্যি এবার ডানা গজিয়ে গেল। এই ডানা বেশ মজবুত। ঝড়ের মধ্যে উড়াল দেওয়া যায়। হাসতে হাসতে ঢেউয়ের সমুদ্রও পাড়ি দেওয়া যায়। আর কোন ভয় নাই।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন