এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  গান

  • জর্জ বিশ্বাস: একশো বছর

    Shibanshu
    গান | ২২ আগস্ট ২০১১ | ৬০৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Shibanshu | 59.90.221.5 | ২২ আগস্ট ২০১১ ১৭:০২491953
  • জর্জদা বেঁচে থাকলে আজ একশো বছর হতো। ওপাড়ায় বন্ধুদের জন্য লেখা কিছু এলোমেলো চিন্তা এপাড়াতেও ছেপে দিচ্ছি, জানি এখানেও জর্জদার নামে পাগল হন এরকম অনেকে আছেন। এই সব লেখা পড়লে হয়তো তিনি একটু বঙ্কিম হেসে বলতেন, 'য়্যারা সব পাগল হইয়া গেসে..'

    হয়তো সে তুমি শোনো নাই,
    সহজে বিদায় দিলে তাই.....

    (১)
    দু হাজার এগারো সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতে কী বোঝায়, বাঙালির কাছে তার হয়তো একটা সহজ পরিভাষা আছে। একশো বছর আগে ব্যাপারটা এতো সহজ ছিলোনা।

    রবীন্দ্ররচিত কাব্যসঙ্গীতের অর্থ, মর্ম, পরিকল্প, সৃষ্টিকল্প, পরিবেশন, অনুশীলন, অনুপ্রেরণ, আত্মীকরণ, অর্থাৎ সৃষ্টিশীলতার এই সব স্তর কোন মানদন্ডে ব্যাখ্যা করা যাবে, তার সর্বসম্মত রূপরেখা ছিলোনা। সৃষ্টির এই শাখাটির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা সবাই নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী এর মূল্যায়ণ করতেন। ধূর্জটীপ্রসাদ, দিলীপকুমার, ইন্দিরা দেবী, প্রমথ চৌধুরী, অনাদিকুমার বা শৈলজারঞ্জন, এঁদের বর্গীকরণ বা মূল্যায়ণ যদি দেখি তবে বিষয়টি হয়তো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

    ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীতঘরানায় বহু ধরনের সুরস্রোতের স্বীকৃতি ছিলো। নিছক ভারতীয় ধ্রুপদী মার্গসঙ্গীতের প্রতি আনুগত্যের সঙ্গে য়ুরোপীয় মার্গ ও কাব্যসঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ অথবা শুদ্ধ বঙ্গীয় সঙ্গীত ঘরানার নানা ধারা, যার মধ্যে কীর্তন, নিধুবাবুর টপ্পা, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার লোকসঙ্গীতের নানা শৈলীও সামিল ছিলো। ব্রাহ্মসমাজের সূত্রে তার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলো ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ভক্তিসঙ্গীতের বহু উপাদান। অর্থাৎ এতো বহুব্যাপী সঙ্গীত সাম্রাজ্যের চাবিকাঠি ছিলো দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলির অধিবাসীদের কাছে, যে সারা দেশে এর তুল্য অপর কোনও উদাহরণ ছিলোনা।

    এই জন্য 'রবিবাবুর গান' সেই সময় অধিকাংশ মানুষের কাছেই খুব সহজবোধ্য, সহজলভ্য বা সহজস্বীকৃত ছিলোনা। আমার পিতামহের কাছে শুনেছি তিনি ও তাঁর পিতৃদেব আদি ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনায় নিয়মিত যেতেন শুধু 'রবিবাবুর গান' শোনার জন্য, যদিও তাঁরা দীক্ষিত ব্রাহ্ম ছিলেন না। এটা মোটামুটি একশো বছর আগের কথা। তখন 'রবিবাবুর গান' শোনার সুযোগ যাঁরা পেতেন, তাঁরা আলোকপ্রাপ্ত, অভিজাত কতিপয় বঙ্গভাষী ভদ্রসন্তান, যাঁদের 'রবিবাবুর গান' শোনা ও উপভোগ করার উচিৎ প্রস্তুতি ছিলো। সাধারণ শহুরে বাঙ্গালি ভদ্রলোকের কাছে প্রিয়তর ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। রবিবাবুর ভক্ত ও দ্বিজুবাবুর ভক্তদের মধ্যে নানাস্তরে কাজিয়া ছিলো খুব প্রচলিত ঘটনা।

    এরকম একটা সময়ে, ১৯১১ সালে ময়মনসিঙের কিশোরগঞ্জে দেবেন্দ্র মোহন বিশ্বাসের পুত্র দেবব্রত জন্ম নেন বাইশে অগস্ট তারিখে। সাহেবরাজা জর্জের ভারত আসার সঙ্গে সময় মিলিয়ে শিশুর ডাকনাম হয় জর্জ। রবীন্দ্রনাথের তখন পঞ্চাশ বছর বয়েস।

    ঠাকুরদা কালীকিশোর ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার অপরাধে নিজের গ্রাম ইট্‌না থেকে বিতাড়িত হন। কিশোর জর্জকেও স্কুল জীবনে সহপাঠিদের থেকে তাড়না সহ্য করতে হয়েছিলো 'ম্লেচ্ছ' অপবাদে। ১৯২৭ সালে কলকাতায় কলেজে পড়তে এসে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সংযোগের সূত্রে ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশাধিকার পান জর্জ। তখনকার রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত প্রধান ব্যক্তিদের গান শোনানোর সুযোগও এসে যায় এইভাবে। তবে এই 'ম্লেচ্ছ' কিশোরটি সৃষ্টিচেতনার প্রথম থেকেই ইতরযানী চেতনার পতাকা বহন করেছেন আজীবন। অস্বস্তিকর আভিজাত্যের দাসত্ব করেননি কখনও, না ব্যক্তিজীবনে , না শিল্পীজীবনে।

    পারিবারিকসূত্রে যদিও তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে আবাল্য পরিচয়, কিন্তু এই সঙ্গীতধারাটির নিয়মমাফিক শিক্ষা তাঁর ইন্দিরা দেবীর কাছে। কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে যেসব দিগগজ রবীন্দ্রসঙ্গীত গুরুরা সেই সময় শিক্ষণ প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের কারুর কাছেই জর্জ পরম্পরাগত শিক্ষা লাভ করেননি। সত্যি কথা বলতে কি তাঁর দিগ্‌দর্শক ছিলো স্বরবিতান, নিজের কান ও নিয়মভাঙা অফুরন্ত সৃজনশীলতা। একে যদি তাঁর সীমাবদ্ধতা বলি, তবে তাই। আর যদি বলি এখান থেকেই তিনি সূত্রপাত করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে সম্পূর্ণ নতুন এক ঘরানা, জনপ্রিয়তায় যা ছিলো শীর্ষস্থানে, কিন্তু কোনও দ্বিতীয় ঘরানাদার তৈরি হতে পারেনি। অর্থাৎ জর্জদা রবীন্দ্রসঙ্গীতে একাই একটা বাতিঘর হয়ে রয়ে গেলেন।

    অভিজাত শ্রোতৃমন্ডলীর ঘেরাটোপ আর জরিন বন্ধন থেকে যে শিল্পী প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা অন্যরকম পরিবেশনা প্রবর্তন করেছিলেন, তিনি হলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। তিনি জানতেন বাংলাদেশের মাটিতে শিল্পচর্চা গাঙ্গেয় ভারতের অববাহিকার প্রবণতার থেকে অনেক আলাদা। মার্গসঙ্গীতের প্রচুর চর্চা ও প্রচলন থাকলেও বাঙালির গান শোনার প্রবণতা কাব্য ও লোকসঙ্গীতের প্রতিই অধিক নিবেদিত। শাস্ত্রীয় গায়নের প্রতি যথার্থ মননশীল হয়েও স্বতস্ফূর্ত গায়ন, অর্থাৎ ন্যাচরল গায়নের প্রতি বাঙালির পক্ষপাত প্রশ্নহীন। অথচ রবীন্দ্রসঙ্গীতের তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত শিক্ষকদের ধারণা ছিলো, যেহেতু ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীত শিক্ষার মূলধারাটি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় গায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং রবীন্দ্রনাথ নিজে সচেতনভাবে ধ্রুপদ অনুসারী চারতুক গঠনটিকে আত্মস্থ করেছিলেন, তাই ন্যাচরল গায়নের মুক্ত বিস্তার রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে ঠিক সচল নয়।

    এই ধারণাটিকে প্রবল আঘাত করেন পঙ্কজকুমার নিজের গায়নশৈলী দিয়ে এবং আরও একটি দু:সাহসিক কাজ করেন কুন্দনলাল সহগলকে দিয়ে ক্রমাগত রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে এই ঘরানাটি ধরে রাখেন হেমন্ত ও কিশোরকুমার। দেবব্রত ন্যাচরাল গায়নে বিশ্বাসী হলেও সর্বতোভাবে এই ধারাটির অনুগমন করেননি। তাঁর ছিলো সম্পূর্ণ নিজস্ব শৈলী।

    ১৯৩৮ সালে কনক দাসের ( পরবর্তীকালে তাঁর বৌদি) সঙ্গে তাঁর প্রথম রেকর্ড, দ্বৈতকণ্ঠে। জীবৎকালে শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করেছিলেন ১৯৭১ সালে। তেত্রিশ বছরের দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবন। যদিও ১৯৭১ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বহু গান ব্যক্তিগত সংগ্রহে ফিতেবদ্ধ করে গিয়েছিলেন, যা আমরা পরবর্তীকালে শুনতে পেয়েছি।

    গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন, দুবার চিনদেশে, একবার বার্মায় ও একবার স্বাধীন বাংলাদেশে গান গাইতে গিয়ে ছিলেন। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শিক্ষা নিয়েছিলেন এবং ভারতীয় জীবনবীমা নিগমে ১৯৭১ পর্যন্ত চাকরি করেছেন। এসব নিতান্ত অনুল্লেখ্য বিষয়, কিন্তু এগুলির ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে তাই লিখলুম। অনেক মজলিশি বন্ধুরা আছেন, যাঁরা ১৯৭১য়ে জন্মই নেননি হয়তো। এই সব তথ্যের মূল্যও তো অপরিসীম, যখন তা জর্জদার মতো একজন শিল্পী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বিজড়িত।
  • Shibanshu | 59.90.221.5 | ২২ আগস্ট ২০১১ ১৭:০৪491964
  • (২)

    ' বাইরে থেকে যারা দেখে তারা কে জানবে ভিতরে একটা সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে। এ সৃষ্টির কি আমারই মনের মধ্যে আরম্ভ আমারই মনের মধ্যে অবসান। বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে এর কি কোনো চিরন্তন যোগসূত্র নেই। নিশ্চয় আছে।' ( পথে ও পথের প্রান্তে : ১৯২৬)

    জর্জদার গান প্রথম শুনি ১৯৭১ সালে, আমি তখন নেহাৎ ইশ্‌কুলের ছাত্র। বিশ্বভারতী সঙ্গীত বোর্ড ও আনন্দবাজারের বার্তাসম্পাদক সন্তোষকুমার ঘোষের নেতৃত্বে জর্জদার গানের নানা 'অসমীচীন' লক্ষণ নিয়ে তখন ঘোরতর প্রচার চলেছে। প্রথমে যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে মতভেদ, তার পর সুরসঙ্গতি নিয়ে আপত্তি এবং অবশেষে গীতবিতানের শেষ গ্রথিত গান, 'আমার হারিয়ে যাওয়া দিন'এর সুরযোজনা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তখনও তিনি আর রেকর্ড না করার ঘোষণাটি প্রকাশ্যে করেননি।

    বেঙ্গল ক্লাবের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে মঞ্চের একপাশে একটি অনুচ্চ চেয়ারে তিনি বসে, সামনে একটি টুলে হারমোনিয়াম। কোনো ভূমিকা না করেই শুরু করলেন 'প্রভু আমার, প্রিয় আমার'... মূহুর্তে স্তব্ধ বিশাল শ্রোতৃসঙ্ঘ। গানটি শেষ হতেই বললেন, সব আলো জ্বেলে দাও।তারপর ধরলেন, 'আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে'...। এই রেকর্ডটি তখন আমাদের বাড়িতে নতুন এসেছে, প্রায় নিত্য শুনি। কিন্তু সামনে বসে... সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

    তার পর সাক্ষাৎ ঠিক এক বছর পরে, সেই রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলনেই। তখন লক্ষণরেখা টানা হয়ে গেছে। জর্জদা বনাম অন্যরা, অন্তত প্রকাশ্যে সম্পর্কের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়।

    সেটা ছিলো একটা রোববার। সেবার রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে রীতিমতো নক্ষত্র সমাবেশ। সকালবেলায় আলোচনা সভা। বিষয়টি মোটামুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের স্বাধীনতার সীমারেখা কতো দূর পর্যন্ত টানা যেতে পারে। যদিও আমার তখন নেহাৎ কৈশোর, কিন্তু পারিবারিক সংযোগের সূত্রে এ জাতীয় অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে জায়গা দখল করে বসে থাকি। মঞ্চের নীচে শ্রোতাদের মুখোমুখি বসে আছেন, শান্তিদেব ঘোষ, সুচিত্রা মিত্র, সন্তোষ সেনগুপ্ত, সুমিত্রা সেন, মায়া সেন, সুবিনয় রায়, সম্ভবত সুভাষ চৌধুরীও ছিলেন সেখানে। কয়েকজনকে উদ্যোক্তারা অনুরোধ করা সত্বেও সবিনয়ে বক্তার ভূমিকা পালন করতে অস্বীকার করলেন, যেমন, ঋতু গুহ, অর্ঘ্য সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যয় প্রমুখ। পৌঁছোননি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তাঁর সেদিন বিকেলে গান ছিলো আর দেবব্রত বিশ্বাস, যাঁর গান ছিলো পরদিন সন্ধে বেলায়।

    যদিও রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুই বহুল অভিযুক্ত অথচ বহুজন শ্রোতার প্রিয়তম শিল্পী হেমন্ত ও দেবব্রত শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু সেদিনের আলোচনায় ছিলো শুধু তাঁদেরই উপস্থিতি। প্রত্যেকেই এই দুই শিল্পীর গুণমুগ্‌ধ, কিন্তু পূর্ণ সমর্থন দিতে দ্বিধাগ্রস্ত। সুচিত্রা, যিনি পরবর্তীকালে আশা ভোঁসলেকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের গানকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের অধিকার ক্ষেত্র থেকে বের করে আনার জন্য সতত সক্রিয়, ব্যক্তিজীবনে এই দুই শিল্পীর ঘনিষ্টতম সুহৃদদের মধ্যে পড়েন, তিনিও যেন স্বচ্ছন্দ হতে পারছিলেন না শ্রোতাদের স্পষ্ট প্রশ্নের উত্তরে। সবচেয়ে দ্বিধান্বিত সন্তোষ সেনগুপ্ত মশাই। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের ক্ষেত্রে এই মানুষটির একক অবদান আমরা আজ হয়তো ভুলেই গেছি। তিনি দীর্ঘকাল ধরে রেকর্ড কোম্পানিতে বিশ্বভারতী সঙ্গীত বোর্ডের মনোনীত সদস্য ছিলেন। তাঁর সিলমোহর ব্যতিরেকে কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করা যেতোনা। যদিও জর্জদা গান রেকর্ড করতেন চন্ডী সাহা মশাইয়ের হিন্দুস্থান লেবেলে, কিন্তু সন্তোষ সেনগুপ্ত অনুমতি না দিলে জর্জদার গান মানুষের কাছে পৌঁছোতোনা। সন্তোষ সেনগুপ্ত ছিলেন মনে মনে পঙ্কজকুমারের ভক্ত। তাঁর কাছে 'গুরুদেবে'র গানকে যতো অধিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই তাগিদই মুখ্য ছিলো। তিনি জর্জদার যন্ত্রানুষঙ্গ, ভঙ্গি, মুদ্রাদোষ, সব কিছুই অগ্রাহ্য করতে প্রস্তুত, কারণ তিনি জানেন জর্জদার শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার অসম্ভব সিদ্ধির কথা। হেমন্তের একটি সাক্ষাৎকার শুনেছিলুম, রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বিক্রির ক্ষেত্রে জর্জদা হেমন্তের থেকেও অনেক এগিয়ে ছিলেন।

    যাই হোক সেই আলোচনা সভায় অনুপস্থিত জর্জদাই যেন অলখ নিরঞ্জন, কথা কয়রে, দেখা যায়না।

    পরেরদিন তাঁর অনুষ্ঠান শোনার আগ্রহ শ্রোতাদের অনেকগুণ বেড়ে গেলো। কী গাইবেন জর্জদা কাল, কীভাবে গাইবেন ....?

  • Shibanshu | 59.90.221.5 | ২২ আগস্ট ২০১১ ১৭:০৬491975
  • (৩)

    ... অবোধ আমি ছিলেম বলে
    যেমন খুশি এলেম চলে
    ভয় করিনি তোমায় আমি
    অন্ধকারে....

    সেদিন সন্ধ্যার প্রথম শিল্পী ছিলেন জর্জদা। জানুয়ারি মাসে জামশেদপুরে বেশ ঠান্ডা পড়ে। শীতের জন্য তাঁর হাঁপানি একটু বেড়েছে। উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করেছেন প্রথমেই তাঁর গান রাখতে। যেই ঘোষণা হলো , আজকের প্রথম শিল্পী শ্রী দেবব্রত বিশ্বাস, আমাদের জর্জদা .... । শ্রোতাদের মধ্যে প্রত্যাশী স্তব্ধতার গুনগুন ছড়িয়ে পড়লো। পর্দা সরতেই দেখি তিনি মঞ্চের একপাশে সেভাবেই বসে আছেন একটি চেয়ারে, সামনে হারমোনিয়াম। তবলা সঙ্গতে তখনকার তরুণ শিল্পী বিপ্লব মন্ডল। মধ্যমে সুর ধরে আছেন। হঠাৎ তাঁর গভীর, গভীরতম স্বরে প্রেক্ষাগৃহ গমগম করে উঠলো, তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি, গানের সুরে....
    অসুস্থতার কোনও রেশ নেই সেই স্বরপ্রক্ষেপনে, সতেজ, সজীব । দুটো গান করার পরই স্প্রে নিচ্ছেন। কিন্তু কণ্ঠস্বরে কোনো ক্লান্তি নেই। প্রায় এক ঘন্টা গাইলেন, চোদ্দো-পনেরোটি গান। শেষ হলো, আমি চঞ্চল হে। শ্রোতাদের সরব বিনম্র অনুরোধ, জর্জদা, আরো শুনবো। ম্লান হেসে তিনি বললেন, আর পারিনা, হাঁফাইয়া গেসি।

    আমি উঠে কিছুক্ষণের জন্য প্রেক্ষাগৃহের বাইরে চলে গেলাম। মাথায় এইমাত্র শোনা গানগুলো সব ভরে আছে। এর পর বেশ কিছুক্ষণ সেখানে অন্য গানের জন্য জায়গা করে দেওয়া যাবেনা। সারদামণি ইশ্‌কুলের পাশ দিয়ে, আমবাগানের মাঠ পেরিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম এই রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ঠিক কী ভাবে মূল্যায়ণ করা যায়। আমার তখনকার সঙ্গীতবোধ নেহাৎ অসম্পূর্ণ ছিলো ( অবশ্য, এখনও সে রকমই আছে)। বহু শ্রোতার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন একটা প্যানপ্যানানি, করুণ শোকসঙ্গীত। (কিছুদিন আগে মলয় রায়চৌধুরির লেখায় সে রকমই পড়লাম। তিনি লিখেছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর কাছে এখন mourning song য়ের মতো শুনতে লাগে)। অনেক মানুষ বলেন, বিকল্প থাকলে তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীতের থেকে নজরুল গীতি শুনতে বেশি পছন্দ করবেন। অথবা, এই ধরনের সংলাপ আমরা নিয়মিত শুনি, ' এখন ঠিক রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার মুড নেই, অন্য কিছু হোক'। রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই প্রত্যাখ্যানের জন্য আমরা তো কোনও মতেই কবিকে দায়ী করতে পারবো না। তবে সঠিক প্রকৌশল ও আবেগসহ রবীন্দ্রসঙ্গীতকে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কার? এই প্রশ্নের এক কার্যকরী উত্তর পাওয়া যাবে, যদি আমরা জর্জদার সঙ্গীত পরিবেশনের জাদুটিকে সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারি। একজন 'প্রস্তুত' শ্রোতা এবং একজন 'অপ্রস্তুত' শ্রোতা, এই দুজনকেই তিনি মুগ্‌ধ করতে পারেন একই গানের মধ্যে দিয়ে। এই দুই বর্গের শ্রোতার কিন্তু গান ভালো লাগার মানদন্ড পৃথক। কিন্তু জর্জদার গানে তাঁরা উভয়েই রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করতে পাচ্ছেন একভাবে, কিন্তু ভিন্ন কারণে। অর্থাৎ একজন প্রকৃত শিল্পী সচেতনে-অবচেতনে যদি নিজস্ব বোধ, অনুভব থেকে রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করার সিদ্ধি অর্জন করতে পারে, তবেই সে সেই আলোর শিখা দিয়ে শ্রোতার মনের প্রদীপকেও জ্বালিয়ে দিতে পারে। অবশ্য সেতো অনেকেই পারে। আমার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে অন্তত পাঁচটি নাম আমি এক নি:শ্বাসে নিতে পারি, যাঁদের সেই সিদ্ধি লাভ হয়ে গেছে। তবে জর্জদা কেন অনন্য?

    এর পর প্রায় পাঁচ বছর সামনে বসে তাঁর গান শোনার সুযোগ হয়নি। যা শুনেছি তা রেকর্ড থেকে। একটা বিষয় নিয়ে এই কয়েকদিন আগে এক গানপাগল বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। তিনি সলিল চৌধুরির সঙ্গীত আয়োজন পরিচালনার কৌশল নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন, সলিল চৌধুরির বহু গানের প্রিলিউড, ইন্টারলিউডের সঙ্গে মূল গানের স্থায়ী বা অস্থায়ীর সুর কাঠামো মেলেনা। তা আমি বললুম এই ব্যাপারটি তো আমরা ছোটোকত্তার অনেক গানেই পাই। দুজনে বসে অনেকক্ষণ এই দুই স্রষ্টার নানা গান শুনতে শুনতে ভাবছিলুম ভারতীয় সঙ্গীতের প্রকৃতি আর পশ্চিমী সঙ্গীতের পয়েন্ট/ কাউন্টার পয়েন্টের চলন বিষয়ে সম্যক ধারণা না থাকলে এই ধরনের সুরসৃষ্টি করা যায়না। সেই কথাটাই মনে পড়ে যখন আমরা জর্জদার ষাট/সত্তর দশকে করা রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডগুলি শুনতে যাই। প্রথমবার প্রিলিউড শুনে কোন গানটি গাওয়া হবে বোঝাই যায়না। স্থায়ী বা সঞ্চারীর সুরের বিন্যাস যন্ত্রে বাজিয়ে দেওয়ার চিরদিনের চেনা ছক, জর্জদা বহু ক্ষেত্রেই মানতেন না। এটা ছিলো তাঁর প্রতি 'মহাশয়'দের অনীহার একটা মূল কারণ।

    তা রেকর্ডে তাঁর গান শুনে সেই সময় কান ও মন তৈরি করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু জর্জদা আর পাঁচজন ন্যাচরল গায়কের মতই। তাঁরা শ্রোতার মুখোমুখি ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে যে জাদুবিস্তার করতে পারেন, রেকর্ডের গানে যেন সেই স্ফূর্তি থাকেনা। তবু সিদ্ধ শিল্পীর সবই শ্রবণযোগ্য। তাঁরাই তো ভালো মন্দের ব্যাকরণ তৈরি করেন। বৈয়াকরণের কাজ শুধু সেটিকে নথিবদ্ধ করা। আমার এক প্রিয়তম সিদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুবিনয় রায় মশাইয়ের রেকর্ডের গান আর মুখোমুখি শোনা গানের মধ্যে পার্থক্য প্রায় নেইই। জর্জদার সেটি বেশ আছে। হয়তো গান ধরে ধরেই কিছু বলা যেতো, কিন্তু এই পাতা তার মঞ্চ নয়।

    সাতাত্তর সালে রবীন্দ্রভবনের মুক্ত মঞ্চে এক শীতের সন্ধ্যায় শেষ শুনেছিলুম তাঁর গান। মনে হয়েছিলো জর্জদা যেন রূপনারায়ণের কূলে পৌঁছে যাচ্ছেন, নীরব, দৃঢ় পদচারণায়। এই গান যেন মোহানায় তাঁর থেকে শেষ পারানির কড়ি নিতে যে সুরের রসিক নেয়ে অপেক্ষা করে আছেন, শুধু তাঁর জন্য। তখন মুখে বলতুম, 'সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনও করেনা বঞ্চনা'। কিন্তু বুঝতাম কি? বোধ হয় না।
  • mita | 64.191.211.55 | ২২ আগস্ট ২০১১ ২০:১৮491986
  • শিবাংশু,
    আজ এই লেখাটা দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। খুব ভালো লাগলো।
  • kallol | 115.241.65.120 | ২২ আগস্ট ২০১১ ২০:২৪491997
  • আহা শিবাংশু। আর একটু হোক। ওনার কটা গান ধরে ধরে, ওনার গায়কীর বৈশিষ্টগুলো যদি একটু আলোচনা করো।
    ধরো - যতো বার আলো জ্বালাতে চাই, আছে দু:খ আছে মৃত্যু, নয়ন ছেড়ে গেলে চলে এই রকম কটা গান ধরে যদি একটু বিশদ হতে।
  • Nina | 12.149.39.84 | ২২ আগস্ট ২০১১ ২০:৩৯492008
  • শিবাজি, জর্জদার গানের মতনই তোমার লেখাটিও রোমাঞ্চকর---ওনার গানের মতনই--শেষ হয়ে গেল ----মন বলে আরও চাই!
    সামনে বসে ওনার গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে আর সেই অনুভুতি প্রকাশের , আমার অক্ষমতা আমাকে বড় দীন করে দেয় নিজের চোখে :-((
    হঠাৎ এক মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল--শেয়ার করার ইচ্ছেটা রোধ করতে পারলাম না---
    এক বঙ্গসন্মেলনে, সমরেশ মজুমদারের কাছে শোনা--
    সমরেশ তখন সবে লেখা শুরু করেছেন, বয়স কম---সাহিত্য জগৎ এর রাঘব বোয়ালদের পিছু পিছু ঘোরেন, তাঁরাও স্নেহ করেন, সঙ্গে হেথা সেথা নিয়ে যান।
    একদিন তাঁদের সঙ্গে সমরেশ গেছেন রেসের মাঠে। পকেট তখনও সদাই হাল্কা, তাই দাদা-স্থানীয় সাহিত্যিকেরা তাঁকে একজায়গায় বসিয়ে --নিজেরা ঘোড়ার খবর নিতে গেছেন। কিছু দূরে একজন প্রবীন মানুষও তাঁরই মতন বসে আছেন, গুনগুন করে গান করছেন ও কি একটা বইতে দাগ দিচ্ছেন।
    তা দাদারা সমরেশের কাছে যখন ফিরে এলেন---সমরেশের তো তখনও ঘোড়ার খবরের জ্ঞান ও নেই--নেশাও নেই---তিনি সাহিত্যিক্‌দাদাদের বল্লেন
    ঐ ভদ্রলোক সমানে গান গাইছেন--অপূর্ব্ব গাইছেন। উনি যদি গানের লাইনে (ঘোড়ায় না গিয়ে) যেতেন খুব নাম করতেন।
    শক্তি কিম্বা সুনীল (ভুলে গেছি ) সেই ভদ্রলোক টিকে বল্লেন--ও দাদা শুনুন , এই ছোকরাটি বলছে আপনি গানের লাইনে গেলে নাম করবেন--
    ভদ্রলোক হেসে বল্লেন
    হ'? কইতাসেন যখন তখন দেখুম না হয় চেষ্টা কইর‌্যা :-))
    সবাই হাসতে লাগলেন--এবং সমরেশের সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের আলাপ করিয়ে দিলেন।

  • pi | 72.83.74.17 | ২২ আগস্ট ২০১১ ২০:৪৩492019
  • শিবাংশুদা, বড় ভালো লাগছে।
  • siki | 122.162.75.98 | ২২ আগস্ট ২০১১ ২১:০০492030
  • শিবাংশুদা,

    প্রাণ ভরে গেল। আশ মিটল না।
  • pharida | 182.64.242.6 | ২২ আগস্ট ২০১১ ২২:০০492036
  • বাহ। দারুণ।
  • Shibanshu | 117.195.144.59 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ০০:১৫491954
  • (৪)

    সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই
    কেবল কাজে
    বুকে বাজে
    তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে....

    সেই সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে আমার পাশে বসেছিলো এক বন্ধু। হয়তো বাংলায় তাকে 'বান্ধবী' বলে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনেক সূক্ষ্ম কারিগরি নিয়ে তার সঙ্গে সমমনস্কতায় কথা বলা যেতো। রোববার সকালের আলোচনা শুনে আমরা ভাবছিলুম রবীন্দ্রসঙ্গীত কে শোনায়, কার জন্য শোনায়, কেন শুনি, কী পাই বা না'ই পাই? এ কি বাঙালির একটা অভ্যেস মাত্র? বাড়িতে তাঁর একটা ছবি ঝোলানো থাকবে, বাচ্চাদের জন্য সম্ভব হলে 'ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায়', যদি বইয়ের তাক থাকে তবে একটা সঞ্চয়িতা, পঁচিশে বৈশাখে শাদা পাজামা পাঞ্জাবি... আগে কহো আর...

    আমাদের মতো যাদের আজন্ম পারিবারিক অভ্যেসবশে রবীন্দ্রবিজড়িত হয়ে থাকার নসিব হয়, তারা কি আলাদা করে বুঝতে পারে এই অভ্যেসের বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে কী প্রত্যাশা করেন? তাঁদের ভালো লাগা, না লাগার সূত্রগুলি কী? বন্ধুটি বলছিলেন হয়তো কিছুটা চিন্তার পূর্বাগ্রহ, কিছুটা সংস্কারের বন্ধন.... । আমি বলি তবে তো আবার কবির কাছেই যাই, ' রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে ওঠে, গানে গানে সব বন্ধন যাক টুটে... গান না শুনলে কী করে বোঝা যাবে গানের কাছে কী চাই। যেমন আমার আরেক বন্ধু, স্বঘোষিত 'রবীন্দ্রসঙ্গীত বুঝিনা'র দল, আমার আরেক পাশে বসেছিলো। ধরে এনেছিলুম তাকে, প্রায় জোর করে। সন্ধ্যার প্রথম নিবেদন নিয়ে এসেছিলেন অশোক তরু বন্দোপাধ্যায়। তাঁর প্রথম দুয়েকটি গান শুনে এই 'অবোধ' বন্ধুটি প্রশ্ন করলো, ভদ্রলোক নেশাটেশা করেন নাকি?
    অশোকতরুর এলায়িত মন্দ্র উচ্চারণ তার কাছে বিড়ম্বনা মনে হচ্ছিলো। একটু পরেই তিনি ধরলেন, না বাঁচাবে আমায় যদি, মারবে কেন তবে.....। অস্থায়ীতে এসে যেই তিনি পৌঁছোলেন, অগ্নিবাণে তূণ যে ভরা, চরণভরে কাঁপে ধরা... অবোধ বন্ধু আমার হাত চেপে ধরে বললো, দ্যাখ আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! রবীন্দ্রসঙ্গীত এমন হয়?

    আমার প্রথম বন্ধুর সঙ্গে অনুমান করছিলুম, আজ জর্জদা কী কী গান গাইবেন? দুজনেই নিজের নিজের লিস্টি নিয়ে তৈরি। কয়েকটি গান তো মিলছে, কয়েকটি মিলছে না। কতো বড়ো বড়ো স্বীকৃত শিল্পীর গান তো শুনছি তিন দিন ধরে, কিন্তু জর্জদা তো একটা আইকন হয়ে গেছেন। গান টান ছাপিয়ে মনে হয় মানুষটা কীভাবে হাত ধরে কবির কাছে নিয়ে যান, অজান্তেই, অনায়াসে, অনলস প্রয়াসে।

    আবার তাঁর সামনে। যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো তাঁকে। গেরুয়া ফতুয়া, গেরুয়া লুঙ্গি, কালো ফ্রেমের চশমা, তিন খন্ড গীতবিতান। সঙ্গে থাকে চিরকাল, কিন্তু তাকিয়ে দেখেন না সেদিকে। একজন সহকারী বসে থাকেন পাতা খুলে, তাঁর চোখ তো বোজাই থাকে। হারমোনিয়ামের বেলো খুলে তাকালেন আমাদের দিকে, বললেন, নমস্কার...., আর কথা নয়...

    সোজা মধ্যম টিপে গেয়ে উঠলেন, সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই
    কেবল কাজে
    বুকে বাজে
    তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে....

    সেই চোখ তাঁকে কেমন করে তাড়না করছে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যেন... উধাও আকাশ, উদার ধরা, সুনীল শ্যামল সুধায় ভরা.. উধাও আকাশ কীভাবে মানুষের বোধে, কণ্ঠে জেগে ওঠে, উদার ধরার সুনীল শ্যামল রূপ ধরা পড়ে যায়, সুনীল, শ্যামলের হসন্ত 'ল' প্রপাতের মতো ঝরে পড়ছে আমাদের কানে, অবচেতনায়,... একেই কি বলে প্রাণ দিয়ে গাওয়া? শিল্পীর থেকে শ্রোতা নতুন প্রাণের স্পন্দন আত্মস্থ করছে...
    'তোমায় বসাই, এ-হেন ঠাঁই, ভুবনে মোর আর- কোথা নাই, মিলন হবার আসন হারাই আপন মাঝে- বুকে বাজে তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে.....' জর্জদা যেন কথা বলছেন সেই মানুষটির সঙ্গে, যাঁর সঙ্গে আমরা কারণে অকারণে রোজই তো কথা বলি, তাঁর কণ্ঠ শুনতে পাইনা, কিন্তু তাঁর ভালোবাসা আমাদের মতো নগণ্য কীটপতঙ্গকেও ভরিয়ে রাখে। আমাদের জন্যই যদি তাঁর এতো ভালোবাসা, তবে জর্জদাকে তিনি কী দিয়ে অভিষিক্ত করছেন এই গান শুনে, কোন মন্ত্রে দীক্ষা দিচ্ছেন ? আমাদের ধরাছোঁয়ার দূরের জগৎ সেটা, কিন্তু 'বুঝেছি কি, বুঝি নাই বা, সে তর্কে কাজ নাই'। ভালো আমার লেগেছে যে রইলো সেই কথাই।

    চুলোয় যাক সঙ্গীত বোর্ড....

    ঐ একটা গানেই যেন বাঁধা হয়ে গেলো সেই সন্ধ্যার সুর। তার পর একের পর এক, যায় নিয়ে যায়, আমায় নিয়ে যায়, নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, আমি যখন তাঁর দুয়ারে, জানি নাই গো সাধন তোমার, শুধু যাওয়া আসা, গোধূলি গগনে মেঘে....এই গানটির সময় প্রথম বন্ধু আমার হাতটি লুকিয়ে ধরে ছিলেন। 'আর কি কখনো কবে , এমন সন্ধ্যা হবে, জনমের মতো হায় হয়ে গেলো হারা'। তাঁর হাতটি কাঁপছিলো, ভুলে গেছি আমার হাতটি স্থির থাকতে পেরেছিলো কি না।

    সব গান তো আর মনে নেই, তবে শেষে 'আকাশ ভরা' গাইলেন, শ্রোতারাও গাইলেন তাঁর সঙ্গে, এই টুকু মনে আছে। অসীম কালের হিল্লোলে ভেসে ফিরে গিয়েছিলুম বাড়ি সে রাতে। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাকে কী দিতে পারে, সব রকম মূঢ় আলোচনা, নিন্দা-প্রশস্তি, আরূঢ় ভনিতাকে ছুঁড়ে ফেলে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে, নতুন করে জেনেছিলুম তা। জর্জদা হাত ধরে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

    তারও বেশ কিছুদিন পরে হেমন্তের উদ্যোগে তাঁকে সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিলো কলকাতায়। ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারিনি। তবে এক বন্ধুর কাছে সেই অনুষ্ঠানের বিবরণ শুনেছিলুম। সশশ্ম্রূ জর্জদা হেমন্তকে যে যে গান করতে অনুরোধ করছেন , সেই সব গান হেমন্ত তাঁর প্রিয় বন্ধুকে শোনাচ্ছেন। শেষে হেমন্তের অনুরোধে ব্যধিজীর্ণ জর্জদা শ্রদ্ধাশিহরিত শ্রোতাদের গান শোনালেন। দৃশ্যত আবেগমগ্ন শিল্পী শুরু করলেন, 'যেদিন সকল মুকুল গেলো ঝরে আমার, ডাকলে কেন গো, অমন করে আমায়....'

    কে কাকে ডাকে, কার মুকুল ঝরে, কোন ফুল ফুটে ওঠে, কোন তারা ঝরে পড়ে, শুধু আকাশেরই মনে থেকে যায়।

    তখন হয়তো সবটা বুঝতুম না। এখন সামান্য বুঝি। জর্জদা ঠিক রবীন্দ্রসঙ্গীত 'গাইতেন' না। নিজেই 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' হয়ে উঠতে পারতেন। অনেকেই বুঝতো সে কথা সেই সময়, অনেকে বুঝেও বুঝতে চাইতো না। জর্জদার বয়েই গেছে তাদের বোঝাতে। শুধু চোখ বুজে হারমোনিয়ামটি টেনে তিনি তাদেরকে শুনিয়ে দিতেন,

    হয়তো সে তুমি শোনো নাই
    সহজে বিদায় দিলে তাই
    আকাশ মুখর ছিলো যে সেদিন
    ঝরোঝরো বারিধারা....

    তাঁর দেহাবসানের খবর শুনে একটা পদ্য লিখে ফেলেছিলুম। ১৯৮০ সালে প্রথম বয়েসের লেখা, এখন হয়তো অন্য রকম লিখতুম। তবে অনেক বন্ধুর ভালো লেগেছিলো। কেউ কেউ হয়তো আগে দেখেও থাকবেন, তবু তাঁর একশো বছরে আমি এখনও তাঁকে এই পদ্যটা দিয়েই তর্পণ জানাই,

    জর্জ বিশ্বাসের মৃত্যু

    পুড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিলো
    শুধু এই লেখা আছে
    আগুনভক্ষিত তাঁবু, তুলসিমঞ্চ
    দংশিত পাঁউরুটি, সবই ঋণ নয়
    তাকে ভালোবেসে দেওয়া হয়েছিলো

    সোনাদানা হারিয়ে ফেলেছে তবু
    বিপ্লবী এখনও

    তাকে প্রধান অতিথি রাখা যেতো
    ভরতনাট্যম নাচ উত্তাল যেখানে
    অমসৃণ, অচুম্বিত নারীরা নিভৃতে ব্যস্ত
    লেলিহান গোধূলির আক্রমণ থেকে
    শোকসভা তুলে নিয়ে যাওয়া যেতো
    শিরোপাহীন গাছের ছায়ায়
    উপযুক্ত আজানু ভালোবাসা
    একে একে সমীপেষু করা যেতো

    সময় হলোনা, তাড়া ছিলো

    অতিভোরে প্রকাশ্য শহরের শেষ মুদ্রণ
    কোনো মৃত্যুসংবাদ ছাড়া লাইনোটাইপে
    মত্ত স্বর ও ব্যঞ্জন ও কমা ও রেফ ও দাঁড়ি
    সব গোলমাল হয়ে যেতো

    মরে গিয়ে ভালো ই হয়েছে
    তাঁবুর আগুনে পুড়ে, কেরোসিনভেজা
    রবীন্দ্রসঙ্গীতসহ পুড়ে গিয়ে
    ভালো ই হয়েছে

    সোনাদানা কবে হারিয়ে ফেলেছে
    তবু এতো অধিকার....?
  • nyara | 122.172.4.31 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ০১:০০491955
  • দেবব্রত বিশ্বাস খুব সম্ভবত: সর্বোচ্চ আলোচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। দিস্তে দিস্তে লেখা হয়েছে ওনার গান গাওয়া সম্পর্কে, তাঁর জনাদর সম্পর্কে, বিরুদ্ধতা ও তৎসহ তাঁর অভিমান সম্পর্কে। কিছু আমি পড়েছি।

    ওনার গানের যে দুটো দিক নিয়ে আমি বিশেষ উৎসাহী, সে নিয়ে খুব লেখাপত্তর চোখে পড়েনি। এক, ওনার গানের যন্ত্রানুষঙ্গ ও বিন্যাস (arrangement) আর দুই, গানকে নিজের strength-এর জায়গা থেকে গড়ে নেওয়া। ওপরের লেখায় শিবাংশুবাবু এক নম্বর পয়েন্টটা ছুঁয়েছেন। আরও বেশি হলে ভাল লাগত।

    প্রথমেই ধরুন যন্ত্রের ব্যবহার। শান্তিনিকেতনী ঐতিহ্যে রবীন্দ্র গানের সঙ্গে সঙ্গতে বেজেছে এসরাজ, তালে কখনও পাখোয়াজ, কখনও তবলা, কখনও কিছু না। শান্তিনিকেতনের বাইরে আগে বাজত অর্গ্যান, পরে হারমোনিয়াম। তালবাদ্য ঐ একই। এটা আমি traditionally বলছি।

    দেবব্রতর প্রথম দিকের রেকর্ডও তাই। এটা আমার ধারণা যে ওনার হাঁপের কষ্ট শুরু হবার পর উনি যখন দেখলেন যে দম আর ধরে রাখা যাচ্ছে না, একটা বিরাম দরকার - তখন সেই বিরামের ফাঁকগুলোয় আর এই ট্র্যাডিশনাল যন্ত্র মিউজিকাল ইন্টারেস্ট ধরে রাখতে পারবে না। উনি তখন পশ্চিমি কায়দায় যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবস্থা করলেন।

    এর পাশাপাশি আর একটা ঘটনা ঘটছিল। মোটামুটি একষট্টি সালের আগে অব্দি, মানে রবীন্দ্র-শতবর্ষের হুজুগের আগে অব্দি, রেকর্ডিং-এ যন্ত্রানুষঙ্গ পুরোন যাত্রা ঘরানার ইন্টারলিউড-প্রিলিউডের ছকে বাজান হত। সেটা কী? সেটা হল গানের প্রথম লাইনটা একবার বাজিয়ে যে নোটে পরের লাইন শুরু হবে সে নোটে এসে অর্কেস্ট্রা বা হার্মোনিয়াম দাঁড়াবে, গায়ক গান শুরু করবে। ব্যতিক্রম কি ছিল না? ছিল। পঙ্কজ মল্লিক। মনে রাখতে হবে পঙ্কজ মল্লিক শুধু ডাকসাইটে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়কই ছিলেন না, তিনি নিউ থিয়েটার্সের অগ্রগণ্য সঙ্গীত পরিচালক ও অর্কেস্ট্রার কন্ডাকটরও ছিলেন। তার ফলে ওনার গানে যন্ত্রানুষঙ্গের বৈচিত্র্য দেখা যায়। কিন্তু পঙ্কজ মল্লিক ব্যতিক্রম। তাই নিউ থিয়েটার্সের রবীন্দ্রসঙ্গীতও ব্যতিক্রম। বিনতা রায় কি সাইগলের গানের যন্ত্রানুষঙ্গ শুনুন, বুঝতে পারবেন আমি কি বলতে চাইছি। সাইগলের 'তোমার বীণায় গান ছিল'র ইন্টারলিউড আজকে শুনলেও আধুনিক লাগে।

    তো এই একষট্টি সাল নাগাদ থেকে যন্ত্রানুষঙ্গ আমাদের ট্র্যাডিশনাল ইন্টারলিউড-প্রিলিউড বাজানোর ছক থেকে বেরিয়ে এসে অন্য সুর বাজাতে আরম্ভ করল। আর সে করতে গিয়ে এল অন্য যন্ত্রের ব্যবহার - বিশেষত: বেহালা।

    এই দুইয়ের মিশেলে দেবব্রত যেটা করলেন সেটা হল নিজের প্রতিটা গানকে একটি অখন্ড সৃষ্টি হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা। রবীন্দ্রনাথ, যিনি একদিকে গান রচনা করেছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদের আঙ্গিকে, অন্য দিকে পশ্চিমি সঙ্গীত ঘরানা থেকে composed music-এর আদর্শ ধার নিয়ে নিজের গানের সংরক্ষণকে রেজিমেন্টেড করতে চেয়েছিলেন - আশ্চর্য লাগে তিনি কেন গানের যন্ত্রানুষঙ্গ ও বিন্যাসকেও সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত করলেন না। এক দিক থেকে এইটা ওনার গানের একটা খামতি, আবার অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে এখানে গানের মুক্তিও বটে।

    দেবব্রত সেই খামতিকে পূরণ করার চেষ্টা করলেন নিজের মতন করে। কিরকম? তবলা ও অন্যান্য মজলিশি তালবাদ্যর ব্যবহার সীমিত করে দিলেন। তার বদলে কোথাও পিয়ানো, কোথাও রিদম গিটার দিয়ে ছন্দ ধরে রাখলেন। এবং আমার যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে, কোথাও আবার ডাবল বেস প্লাক করে তাল ধরে রাখার অনুষঙ্গে গান সাজালেন, ঠিক যেমনটা করা হয় জ্যাজে (জ্যাজে অবশ্য ডব্ল বেস কখনও রিফও বাজায় আবার কখনও হাই-হ্যাট তাল ধরে রাখে)। সুরের জন্যে ব্যবহার করলেন পিয়ানো, বেহালা, ভিয়োলা, চেলো, অ্যাকর্ডিয়ান, লীড গীটার ইত্যাদি। সঙ্গে এফেক্টসের জন্যে রইল ভাইব্রাফোন।

    অ্যাকর্ডিয়ানের ব্যবহার খুবই নন-ইন্টুইটিভ এবং আকর্ষনীয়। শোনা কথা যে দেবব্রতর যন্ত্রানুষঙ্গ করেছেন ওয়াই এস মুলকি। তাই যদি হয় তাহলে অ্যাকর্ডিয়ান ব্যবহারের একটা যুক্তিগ্রাহ্য কারণও খুঁজে পাওয়া যায়। ওয়াই এস মুলকির প্রধান যন্ত্র অ্যাকর্ডিয়ান।

    (আবার পরে)
  • nyara | 122.172.4.31 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ০১:০৯491956
  • শিবাংশুবাবুর চতুর্থ ভাগটি যে এই পাতায় পড়েছে, সেটা না দেখেই পোস্ট করে ফেলেছি। কিরকম সুর এটে ফেলেছি, সুর কেটে ফেলেছি মনে হচ্ছে। ক্ষমপ্রার্থী।
  • siki | 123.242.248.130 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ০৯:৩৪491957
  • সুর কাটা কোথায়? সুরে সুরে আজ ভরে গেল এ-পাতা। এত ভালো লেখা বহুদিন পড়ি নি।

    সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা,
    মোরা সুরের কাঙাল, এই আমাদের ভিক্ষা।
    মন্দাকিনীর ধারা, ঊষার শুকতারা,
    কনকচাঁপা কানে কানে যে সুর পেল শিক্ষা।
    তোমার সুরে ভরিয়ে নিয়ে চিত্ত
    যাব যেথায় বেসুর বাজে নিত্য;
    কোলাহলের বেগে ঘূর্ণি উঠে জেগে,
    নিও তুমি আমার বীণার সেইখানেই পরীক্ষা।
  • dd | 122.165.70.5 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ১১:১৫491958
  • ন্যাড়া

    সুর মোটেই কাটো নি। তোমার আর শিবাংশুর - দু জনের লেখাই দুর্দান্তো হছে। আরো লেখো না?
  • kallol | 220.226.209.2 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ১১:৫২491959
  • তুলনাটা ঠিক হবে কি না জানি না, তবে এতো বন্ধুদের ব্যাপার তাই সাহস করে বলেই ফেলি। এই টইটাতে রবিশঙ্কর-আলি আকবর শুনছি। ঠিক জানি না জিনি সুরের ঝর্ণাতলায় লিখছেন তিনি মনে হচ্ছে জামশেদপুর বাসী, মনে হচ্ছে চেনা চেনা। যদি তা না হয়, তবে দীপঙ্করও আসুন এই টইটাতে। ও: সেটা রবিশঙ্কর-আলি আকবর-মেইনুহিন হয়ে যাবে, যেটা আজ অবধি হয় নি।
    ন্যাড়া সুর কাটে নি কোত্থাও। তোর মতো সুরের মানুষ সুর কাটতেই পারে না।
    শিবাংশু-ন্যাড়া আরও চাই, দীপঙ্কর আসুন। চাতক হয়ে চেয়ে আছি ফকির সন্ধ্যা বেলায়। তৃষ্ণার্ত অভাজনেরা বাদলা আকাশে চোখ রেখে আছে। আরও চাই যে!

  • Sumit Roy | 68.192.169.219 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ১৮:০৪491960
  • শিবাঙ্‌শু সাবাস! মর্মস্পর্শী আর ন্যারর টিকা য়েন চূঋহার ওপর মযূরপাখা! আরো চলুক, তৃইত চাতকের হাট বসে য়াচ্ছে এদিকে গুচ পার্স করছেনা
  • sumit | 68.192.169.219 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ১৮:০৮491961
  • *শিবাংশু চুড়োর তৃষিত যচ্ছে
  • Nina | 12.149.39.84 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ১৮:২৫491962
  • ভোরবেলা এসে এ টই খুলিনু
    দিন যাবে আজি ভাল :-))
    কল্লোলদাকে ক্ক! কি অপূর্ব্ব যুগলবন্দী --চলুক চলুক
    আর সুমিতদা তোমার ঠেকাই বা এত কম কেন----আমরা গুছিয়ে বসলুম আরও শুনব বলে
    শিবাজি , ন্যাড়া
    স্যালুট !!

  • pi | 72.83.74.17 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ১৯:১৫491963
  • ন্যাড়াদা, ভালো লাগলো।

    একটা প্রশ্ন ছিল। রবীন্দ্রনাথ গান লিখলেন হিন্দুস্থানী ধ্রুপদের আঙ্গিকে বলতে কী বোঝালেন ? ধ্রুপদ বলতে তো অতি বিস্তরিত আলাপ, জোর , ঝালার লয়কারী, নোমতোম এগুলো মনে হয়। স্ট্রাকচারড ব্যাপারটার কথা বলছেন ?
  • kiki | 59.93.205.154 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ১৯:২৫491965
  • শিবাংশুদা,
    যদি রেগে না যান, তো, মানে সেই বন্ধুর কাহানী যদি সেভ করা থাকে তো হহপাপ্রে বা নতুন কোনো টই খুলে দিয়ে দিন না পিলিজ। দারুন ছিলো সে লেখাটাও।আর না থাকলে নতুন ভাবে লিখে...........pls....pls........pls
  • Nina | 12.149.39.84 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ১৯:৫৪491966
  • কিকিয়া, হহপাপে
    ;-)
    আমার যে মনে হয় সেভডপে
    কিন্তু সেই গল্প শোনার জন্য আম্মো তোর পাশটিতে বসলুম--শিবাজি সেটিও হয়ে যাক :-))

    টই হাইজ্যাকিত করছিনা---আর একটি টই-শাখার আশায় এই কটি কথা বলে গেলুম
  • nyara | 122.172.173.83 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ২২:০০491967
  • পাইকে -

    রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদের চারতুকের স্ট্রাকচার বাংলা গানে প্রথম নিয়ে এলেন। আগে ছিল ফোকের ব্যালাড-ভিত্তিক স্ট্রাকচার অথবা নিধুর টপ্পা অ্যামরফাস স্ট্রকচার, যেটা তখনকার যাত্রার গানেও ব্যবহার করেছেন গোপাল উড়েরা। শুধু গানের কথার স্ট্রাকচারের কথা বলছি না, সুরের দিকেও স্পষ্ট চারটে বিভাজন।

    রবীন্দ্রনাথের এই স্ট্রাকচারটা বাংলা গানে গেঁড়ে বসে গেল।
  • ranjan roy | 122.168.141.64 | ২৩ আগস্ট ২০১১ ২৩:৪৩491968
  • শিবাংশু-ন্যাড়াবাবু,
    একি লাবণ্য, লাবণ্য, লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ!
    আনন্দ বসন্ত সমাগমে।
    অসাধারণ!
    আর দীপংকর বসু, ওপাড়ার সর্বজনপ্রিয় বাসুদা। আপনি আসুন। সুর লাগান।

    আর আমার প্রিয় গানটি নিয়ে যদি কেউ দু'লাইন আলোচনা করেন! বাচ্চার মত আবদার করছি।
    "" আমি যে গান গাই
    জানিনে সে কার উদ্দেশে।''
    এর সঞ্চারীতে দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় যখন শুনি:

    ওই মুখপানে চেয়ে দেখি তুমি সে কি
    অতীত কালের স্বপ্ন এলে
    নুতন কালের বেশে।

    তারপরের স্তবকের দ্বিতীয় লাইনে যখন আর্তি ঝরে পড়ে:
    আজো কি আসনি মোর এ জীবনে?

    আমার শোনা শেষ হয়ে যায়।
  • nyara | 203.110.238.17 | ২৪ আগস্ট ২০১১ ১৬:০৩491969
  • কয়েকটা গানের উদাহরণ দিয়ে আমি কি বলতে চাইছি সেটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি।

    প্রথম দিককার কটা বিখ্যাত গান নিই -

    এই তো ভাল লেগেছিল: এখানে দেখুন ট্র্যাডিশনাল অ্যারেঞ্জমেন্ট। খোল আর মন্দিরা বাজছে তাল ধরে রাখতে। গানের সুরের সঙ্গে বাঁশি বাজছে, হয়তো একটা ছড়টানা কোন যন্ত্রও আছে আর ড্রোন রাখছে হারমোনিয়াম বা অর্গ্যান। প্রিলিউড আর ইন্টারলিউড বলছে গানের শুরুর 'এইতো' অংশ।
    (পাবলিকলি অ্যাভেলেবল কোন কপি পেলাম না।)

    এমনি করেই যায় যদি দিন : এখানেও পরিষ্কার তবলা শুনবেন। বাঁশি গানের সঙ্গে সুর ফলো করে চেলেছে। প্রিলিউড আর ইন্টারলিউড গানের প্রথম লাইনের সুর বাজিয়েছে। তবলা বাজছে ট্র্যাডিশনাল স্টাইলে। অন্যরকম বলতে আছে শুধু শুধু স্লাইড (হাওয়াইয়ান) গিটারের ব্যবহার।
    (
    - এটা বেশ বাজে ডিজিটাইজেশন হয়েছে। তাও আমি যেগুলো বলছি, বোঝা যাবে।)

    তুমি রবে নীরবে : এখনেও তবলা শুনবেন। শুনবেন এসরাজ গানকে ফলো করছে। শুনবেন ইন্টারলিউড-প্রিলিউড 'তুমি রবে নীরবে' অংশের সুর বাজাচ্ছে।
    (
    - এরও ডিজিটাইজেশন খারাপ। মনে হবে পাখোয়াজ বাজছে, আসলে তবলাই বেজেছে মনে হচ্ছে।)

    এবার পরের দিকের কটা বিখ্যাত গান নিন -

    প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে - গান শুরু লীড গিটার, বেহালা আর অ্যাকর্ডিয়ানের প্রিলিউডে, গানের মেলডি থেকে আলাদা। সঙ্গে স্ট্রিংস গানের পেছনে একটা কাউন্টার পয়েন্ট যোগ করছে। গান শুরুর পরে রিদম গীটার ওয়াল্‌জ্‌ বাজাচ্ছে - বুম চাক চাক, বুম চাক চাক। ফলে পুরো গানটা একটা অসম্ভব প্রাণবন্ত পশ্চিমি নাচের ছন্দ পেয়ে যাচ্ছে। বাজছে প্লাকড ডাবল-বেস। তার সঙ্গে কী শুনছেন? ম্যারাকাস। ভাবা যায়, ম্যারাকাস! রবীন্দ্রনাথের গানে ম্যারাকাস! অথচ এই ম্যারাকাস গানের কাঙ্খিত ছন্দকে অ্যাক্সেনচুয়েট করে দিচ্ছে। নো উচ্চকিত তবলা বিজনেস। ব্রিলিয়ান্ট।
    (
    )

    মেঘ বলেছে যাব যাব : শুরু হচ্ছে মূলত: পিয়ানো আর ভাইব্রাফোনের প্রিলিউডে। সারা গানেই পিয়ানো আর বিশেষত: ভাইব্রাফোন বেজে গানের অ্যাম্বিয়েন্স তৈরি করেছে। একটা স্লাইড গীটারও আছে। প্রিলিউড-ইন্টারলিউডে মূল গানের মেলডি কিন্তু কোথাও বাজছে না। তবলা-টবলাও নেই। তাল রাখতে চুনি্‌ছ একটি প্লাকড ডাবল-বেসকে। আরেকটা লক্ষ্য করার মতন জিনিস হচ্ছে গানের অ্যামবিয়েন্স তৈরি করতে দেবব্রতর গলায় রিভার্ব সাধারণের থেকে অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
    (
    )

    আমি চঞ্চল হে : প্রিলিউডে স্ট্রিংস, পিয়ানো আর স্লাইড গীটার (তাতে ভাইব্রাফোন এফেক্ট এনে) বাজছে। গানের মেলডি নয়, অন্য মেলডি। ইন্টারলিউডেও। সারা গানে বেহালা আর ভাইব্রাফোন বাজছে, কিন্তু গানের সুর ফলো করছে না। তাল রাখছে শুধু প্রতিটা মেজারে একটি করে ঘা দিয়ে।
    (
    )
  • ranjan roy | 122.168.141.64 | ২৫ আগস্ট ২০১১ ০১:২৩491970
  • ন্যাড়াবাবু,
    চমৎকার! থামবেন না, প্লীজ!
  • Tim | 198.82.22.79 | ২৫ আগস্ট ২০১১ ০১:৫৮491971
  • ন্যাড়াদার বিশ্লেষণ ভাল্লাগছে। একটা প্রশ্ন মনে এলো। করেই ফেলি। প্রথম দিকের গানের সাথে শেষের দিকের গানের উচ্চারণে পার্থক্য পেলাম। সেটা কি শোনার ভুল না বিবর্তন? উচ্চারণে শুরুর দিকের গানে খানিকটা ""রাবিন্দ্রিক"" টানের ( যাকে ব্যঙ্গ করে চিবিয়ে চিবিয়ে গাওয়া বলা হয়) কথা বলছি, পরের দিকের গানগুলোতে সেটা নেই, অনেক খোলামেলা।
    এইরকম পাশাপাশি দুই সময়ের গান ধরে ধরে কখনও শুনিনি। এখন শুনে চমৎকৃত হলাম।
  • kallol | 115.242.224.137 | ২৫ আগস্ট ২০১১ ০৬:৪২491972
  • সত্যজিত রায় মশয় দেবব্রত বিশ্বাসের মস্তো গুণগ্রাহী ছিলেন। উনিও বলতেন/লিখেছেন জর্জদার খোলা গলা নিয়ে। কিন্তু উচ্চারণের বেলায় একটু খুঁতখুঁতে ছিলেন। জর্জদার গলায় প্রবাদ হয়ে যাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত, আকাশ ভরা সূর্য তারা-য় উনি মনে করতেন আকাশ ভরাতে গিয়ে গায়ক ""ভওরা" কর ফলেছেন।

    এটা কিছু না। ছোট্ট একটা বিরতি। এর পরেই ফিরে আসছেন, শিবাংশু-ন্যাড়া জুটি। আমরা দীপঙ্করকেও চাই। ক্রিকেট হতেই হবে এমন মাথার দিব্যি তো নাই। বেসবল হলেই বা ক্ষতি কি? আমার তো মনেই হবে রবিশংকর-আলি আকবর-মেইনুহিন।

  • pi | 128.231.22.133 | ২৫ আগস্ট ২০১১ ০৬:৫০491973
  • কল্লোলদার কথায় এটার কথা আবার মনে হল:



    ক'দিন আগে ভাটে জিগেশ করেছিলাম, রায়মশায় যখন ওঁর এতই গুণগ্রাহী, তো নিজের কোনো ফিল্মে ওঁকে দিয়ে গান গাওয়ালেন না কেন ? সেরকম কোন সিচুয়েশন আসেনি বলে ?
  • pi | 128.231.22.133 | ২৫ আগস্ট ২০১১ ০৬:৫৩491974
  • বিরতির ফাঁকে একটা দুটো ছোটো প্রশ্ন রেখে যাই। না: থাক, এই টইটা বেলাইন করবো না।
  • Nina | 68.45.76.170 | ২৫ আগস্ট ২০১১ ০৭:১২491976
  • ন্যাড়া, আমি অবাক হয়ে শুনি----
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন