এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ফেলানি :আধুনিক অসমিয়া উপন্যাস

    Sushanta
    অন্যান্য | ১২ অক্টোবর ২০১১ | ৬৩৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Sushanta | 117.198.56.83 | ১২ অক্টোবর ২০১১ ২১:৫৯495473
  • ফেলানি
    মূল উপন্যাস: অরূপা পটঙ্গীয়া কলিতা

    { ইংরাজি সাহিত্যের ডক্টরেট অরূপা পটঙ্গীয়া কলিতা আধুনিক অসমিয়া সাহিত্যের এক উঙ্কÄল নাম। পাঠক-সমালোচক মহলে বিপুলভাবে সমাদৃত এই লেখক ইতিমধ্যে বেশ কিছু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। সেগুলো মধ্যে আছে ১৯৯৩তে পশ্চিম বাংলার ‘সাহিত্য সেতু’ নামের লিটিল ম্যাগাজিনের থেকে শৈলেশ চন্দ্র দাসগুপ্ত সাহিত্য সেতু পুরস্কার, ১৯৯৫তে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮তে দিল্লীর ‘কথা’ নামের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির দেয়া ‘কথা পুরস্কার’। ১৯৯৫তে অসম সাহিত্য সভার দেয়া ‘বাসন্তী বরদলৈ স্মৃতি পুরস্কার’ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি এই বলে প্রত্যাখ্যান করেন যে সাহিত্য কর্মে তিনি লেখকের লিঙ্গভেদ মানেন না।
    ১৯৯৪তে প্রকাশিত তাঁর ‘অয়নান্ত’ নামের উপন্যাসটি অসমিয়া উপন্যাসের প্রথম শ্রেণির গুটি কয় উপন্যাসের মধ্যে একটি বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। অয়নান্তের ন’ বছর পর তিনি লেখেন এই বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফেলানি’। ২০০৩এ প্রকাশিত এই উপন্যাসের পটভূমি গেল কয়েক দশকের জাতিদাঙ্গাতে অভিশপ্ত ও অশান্ত অসম। জাতিদাঙ্গা ও উগ্রপন্থার শিকার দরিদ্র মানুষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের এক মর্মস্পর্শী উপন্যাস এটি। ‘ফেলানি’র চরিত্রগুলোর অবস্থান সমাজের প্রান্তে , কেন্দ্রে নয়। সমাজ যে মানুষগুলোকে দূরে নিক্ষেপ করছে তাদের প্রতীক। আবার সমাজের কেন্দ্রকে উপেক্ষা করে প্রান্তীয়তাতেই নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করবার যে প্রক্রিয়া তার ব্যঞ্জনাঋদ্ধ এক সত্তার নামও ফেলানি। মৃত্যু যেমন সহজ তেমনি জীবনের প্রতি সুতীব্র ভালোবাসাও মৃত্যুর বিপরীতে উপস্থাপিত। জাতি-ধর্ম নয়, সুবিশাল মানবতার পরিচয়েই ফেলানির পরিচয়। ‘ফেলানি’র পৃথিবীতে অজস্র চরিত্র আর বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে নিষ্করুণ সমাজ সত্য এবং বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে পাঠক যাত্রা করবেন সামাজিক উপলব্ধির অন্য এক সীমান্তের দিকে।
    টংলা মহাবিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক অরূপা ‘দামল’ নামের সাহিত্য-সংস্কৃতি মূলক অব্যবসায়িক সাময়িকীর সম্পাদনা সহযোগী। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলো হল:
    মৃগনাভি ( ১৯৮৭), মেপল হাবির রং ( ১৯৮৯), মরুযাত্রা আরু অন্যান্য ( ১৯৯২), অয়নান্ত ( ১৯৯৪), মরুভুমিত মেনকা আরূ অন্যান্য (১৯৯৫), কাঁইটত কেতেকী (১৯৯৯), পাছ চোতালর কথকতা (২০০০) , অরুণিমার স্বদ্বেশ (২০০০), মিলিনিয়ামর সপোন (২০০২) }
    ‘যে গাছে ফল ধরে না
    তাকে বলে নিস্ফলা
    কিন্তু কেউ কি পরীক্ষা করে দেখেছেন মাটি?
    যে ডাল সহজে ভেঙ্গে যায়
    তাকে বলে ঠুনকো।
    কিন্তু তার উপর কি জমেনি অজস্র বরফ?’
    ---- বার্টল ব্রেখট

    অধ্যায় এক (১)
    ফেরিখানা ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে এসে আমিনগাঁয়ে দাঁড়াল। পাড়হীন একখানা শাদা শাড়িতে শরীর প্যাঁচানো যুবতীটির ম্লান চোখজোড়া উঙ্কÄল হয়ে পড়েছে। কালো ভোমরার মতো ওর চোখ দুটো এক জোড়া খঞ্জনা১ পাখির উপর পড়ে স্থির হয়ে আছে। খঞ্জনা দুটো টুপ টুপ করে লেজখানা ওঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে। ছোট্ট ফড়িঙের মতো খঞ্জনাদের লেজের ছন্দে ওর চোখের ভোমরা দুটূ ফেরি ঘাটের বালির উপর দিয়ে গুণ গুণ করে পাখা মেলে দিল। যে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো রূপালী বালিকণা চিকমিক করছিল সেগুলোর একএক টুকরোতে এই পড়ল তো, এই উঠল। ভোমরাদের পায়ে রূপোর গুঁড়ো লেগে গেল ।
    কেঁদে কেঁদে ফুলে উঠা ওর চোখজোড়াতেও হাসির বালিকণা চিকমিক করে উঠেছে। সে বাবার সঙ্গে এসে রেলে চড়ল। এই রেল রঙিয়াতে যাবে। তারপর রঙিয়াতে রাতটা থেকে সকালে ব্রাঞ্চলাইনের ছোট রেলটাতে চড়বে। ব্রাঞ্চলাইনের রেলে চড়ে বাপে মেয়েতে যাবে ভুটান পাহাড়ের নিচের সেই রাধিকা আর কৃষ্ণাইকে বুকে ধরে রাখা সেই জায়গাটিতে।
    যতই রেলখানা বন জঙ্গলে ভরা জায়গাটিতে গিয়ে ঢুকছে, ততই মেয়েটির চোখের ভোমরা দু’টো চঞ্চল হয়ে উঠছে। এখানে পড়ছে , ওখানে পড়ছে। যেখানে পড়ছে সেখানেই ঝিরঝির করে ঝরছে পায়ের বালিকণা। ওর বয়সটাই হলো রূপালী বালিকণা কুড়িয়ে বেড়ানোর। কেঁদে কেঁদে ফুলে ওঠা চোখের পাতাও উড়ন্ত ভোমরা ক’টিকে বেঁধে রাখতে পারে না। রত্নমালার মনটি এ ক’দিন গুয়াহাটির সেই একদল মানুষের ঘরে বালিতে উল্টো পড়ে থাকা এক ভাঙ্গা শামুকের খোলার মতো পড়ে ছিল। দেখলেই যে লোকটিকে ভয় করে, লোকটি যাতে কিছুতেই রাতে ওর কাছে না আসে তার জন্যে ঈশ্বরের কাছে কত প্রার্থনা । সেই মানুষটি হঠাৎ চলে গেল। আসলে লোকটি আজ প্রায় মাসখানেক ছিলই না। বায়ু পাল্টাবার জন্যে টিবি রোগী মানুষটিকে কোথাও নিয়ে গেছিল। নিশ্চিন্ত রাতগুলোতে সে প্রাণভরে শুয়েছিল, গুনগুণ করে গান গেয়েছিল। যেদিন রাতে বাড়িটিতে কান্নার রোল উঠল, সেদিন সে ভাশুরের মেয়েটির জন্যে ছেঁড়া কাপড়ে তৈরি বর-কনেকে ঘরে তৈরি পাটের খুদে খুদে জামা পরিয়ে শেষ করেছিল মাত্র। ওর ঘরে একদল মানুষ ঢুকে পড়েছিল। ওর শরীর থেকে জামা কাপড়, গয়না গাটি সব খুলে ফেলেছিল। সাদা কাপড় পরতে দিয়েছিল। তাকে মাটিতে শুতে দিয়েছিল। এতো আগ্রহে তৈরি করা বর-কনেকে কেউ আবর্জনার সঙ্গে ঝেড়ে নিয়ে গেছে। বর কনের জোড়টিকে এনে গুটিয়ে রাখতে গিয়েও সে আর তা করে নি।
    আজ মানুষটি চলে যাবার মাসখানিক পরে এই রত্নমালা নামের এক আধোফোটা সাদা পদ্মটির মতো মেয়েটি শাদা একখানা কাপড় পেঁচিয়ে বাবা চন্দ্রধর মৌজাদারের সঙ্গে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যি দিয়ে বৃটিশ সাহেবের বসানো ব্রাঞ্চলাইনের রেলটিতে উঠে বাড়ি আসছে।
    রেলটি দাঁড়িয়েছে। এই জনশূন্য স্টেশনে রত্নমালা ও তার বাবা নামবে। অরণ্য ঘেরা এই স্টেশনে সময়ের থেকে আগে সন্ধ্যা নামে। খুব কম মানুষের সমাগম হয় এখানে। শুধু সোমবারে সোমবারে উজানমুখো রেলখানা যাবার বেলা স্টেশনটিতে কিছু মানূষের আনাগোনা দেখা যায়। বেশ কিছু গরুর গাড়ি এসে দাঁড়ায়। গরুগাড়ির থেকে চা পাতার বাক্স নামে। বাক্সগুলো রেলে উঠে। ব্রাঞ্চলাইনের রেলটি আমিনগাঁয়ে দাঁড়াবে। সেখানে বাক্সগুলো নামবে। ব্রহ্মপুত্র নদী ফেরিতে পার করে বাক্সগুলো পাণ্ডুতে নামাবে। তারপর বাক্সগুলোর সাত সাগর তের নদী পার করবার যাত্রা শুরু হবে। আজ একখানা ছই দেয়া গরুগাড়ি এসে স্টেশনের কাছের শিমূলতলাতে দাঁড়িয়ে আছে । রত্নমালা দৌড়ে গিয়ে গাড়িটার কাছ চাপল। ঝাঁপ দিয়ে ছইর ভেতরে ঢুকল।
    ছইতে ছাওয়া গাড়িটা এসে গাছ গাছালিতে ঢাকা বাড়িটার মুখে দাঁড়াল। বড় সড় ঘর। শীতে রোদ পোহাবার মতো করে প্রশস্ত পূবের বারান্দা, গরমে গায়ে বাতাস লাগাবার মতো দক্ষিণের বারান্দা। দু’হাত শক্ত ডাঁট করে বওয়া খড়ের চালের উপর জালের মতো কাটা বাঁশের সিলিং। উঠোনে ঢোকার আগে একটা ছোট্ট জলের ধারা তথা খাল পেরোতে হয়। খালটি লোকে ব্যবহার করে তাতে একটা জলের শব্দ সারাক্ষণ শোনা যেতেই থাকে। মৌজাদারের সঙ্গে যারা দেখা করতে আসে তারা সবাই সেখানে হাত পা ধুয়ে আসে । জলের ধারা পার করে একটি তোরণ । বিষ্ণুর দশাবতার খোদাই করা পাকা তোরণখানা রত্নমালার পার হবার পক্ষে যথেষ্ট উঁচু। সবাই তোরণটির নিচে একটু থেমে গিয়ে প্রণাম করে তবে বাড়িতে প্রবেশ করে। এমন কি রত্নমালাও শুঁড় তুলে একটা নমস্কার করে। মৌজাদারের মেয়ে রত্নমালা নিজের নামটা হাতিকেও দিয়েছিল। রত্নমালা বলে ডাকলে হাতিটাও মাথা তোলে আর মেয়ে রত্নমালাও দৌড়ে আসে।
    বাপে মেয়েতে বাড়িটে ঢুকতেই কান্নার রোল উঠল। রত্নমালা খানিক ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। মায়ের কান্না দেখে সেও খানিকটা কাঁদল। চোখে নাচতে থাকা ভোমরাগুলো নিয়ে সে আর কতক্ষণই বা চোখের জল ফেলতে পারে? পারে নি। সে ঠাকুমার পুরোনো ফাটা পাটের চাদর একটা নিয়ে খুড়তুতো বোনের জন্যে বর কনে তৈরি করতে শুরু করল। তাকে বর কনে তৈরি করতে দেখে মা ঠাকুমা পিসিরা আবারো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
    বর কনে তৈরি করতে করতে সে একটা লক্ষ্য করল তার বহু চেনা ঘরখানা একেবারে বদলে গেছে, কোথাও কিছু একটা হয়েছে। যেই আসে সেই তাকে ধরে কেবলই কান্না জুড়ে বসে। চোখের জলগুলো তার চোখের ভোমরা দু’টোকেও ভিজিয়ে ফেলল। উড়তে না পেরে পাখা দুটো মিইয়ে গেল। চেয়ে থাকতে থাকতে পাখাগুলো ভেসে গেল। ওর ঝলমলে চোখদুটো যেন দুটো কালো অঙ্গার হয়ে গেল। আলো নেই, প্রাণ নেই, রং নেই। কেবল নিথর দু’টুকরো জ্বলে পুড়ে শেষ হওয়া কালো অঙ্গার। যেখানে সেখানে চুপটি করে বসে থাকা রত্নমালার চোখের অঙ্গার দুটো দেখে এবারে বাড়িটিতে নতুন করে অশ্রুধারা বইতে শুরু করল। গোপনে , সে টের না পায় এমন করে, বাড়ির যেখানে সেখানে অশ্রুধারা বইতে থাকল। তার চোখের ভোমরাগুলোকেই নয় শুধু, সে মানুষটাকেও এই চোখের জল ডুবিয়ে ফেলল। সব্বাই দেখল সে শুধু চুপ করে বসেই থাকে না, যেখানে বসে সেখানে সে ফিসফিসিয়ে কাঁদতেও থাকে।
    রত্নমালাকে একদিন ওর খুড়ো এসে নিয়ে গেল। বাড়ির সবাই চাইছিল সে অল্প বেড়িয়ে টেরিয়ে আসুক, মনটা ভালো হবে। মৌজাদারের ভাই কুলধর বরুয়া পলাশতলি বাগানের বড়বাবু। পলাশতলি বাগানটই ভূটান পাহাড়ের নিচে। দূরের থেকে দেখলে বাগানখানাকে একটি ঢেউ খেলানো সবুজ সাগর বলে মনে হয়। বৃটিশ সরকার বুঝতে পেরেছিল পাহাড়ের নিচে এ অঞ্চলে সোনা গজাতে পারবে। নামটাই বা কে পলাশতলি রাখল। ফাল্গুন মাসে এ অঞ্চলে মাঘ বিহুর ‘মেজি’২ আগুনের মতো পলাশ ফোটে। সে জন্যেই বোধ হয় বাগানটির নাম পলাশতলি হয়েছে। পলাশতলি পর্যন্ত যোগাযোগের মাধ্যম হল হাতি আর গরুর গাড়ি। বাগানের বড় সাহেব অলিভার স্মিথ সাহেব বাগানের স্টাফের মানুষজনকে কোথাও যেতে হলে কাগজে লিখে দেন। তাদের নিয়ে আসতে বা রেখে আসতে যাবার বেলা ‘BullockcartwithSoi’ ব্যবহার করতে হয়। চা পাতার বাক্স বা অন্যান্য জিনিসের জন্যে হাতি আছে। মৌজাদারের হাতি রত্নমালাকে বাগানে মাস কয়েকের জন্যে দেয়া হয়েছে। চতুর বড়বাবুটি এই জন্যে প্রয়োজনীয় যোগাযোগটুকু করে দিয়েছেন।
    রত্নমালা হাতির উপরে চড়ে খুড়োর সঙ্গে মৌজাদার তন রত্নমালা এসে সেই নদীটার কাছে পৌঁছুলো। শুকনো নদী। শুধুই ভেজা পাথর। রত্নমালা দাঁড়ালো। মাহুত ওকে দাঁড় করায় নি। নিজেই দাঁড়িয়েছে। হাতিটি জানে নদীটি পার করার আগে অল্প দাঁড়াতে হয়। সবাই দাঁড়ায়। কখন বা শুকনো নদীতে পাগলা জোয়ার আসে কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দেখা গেল, ঢেউ তুলতে তুলতে শুকনো নদীতে নুড়ি-পাথর ভেঙ্গে জোয়ার আসছে। বেশি সময় নয়। খুবই কম সময়ে নদী আবার আগের মতো হয়ে যায়। আজও হলো। মানুষ রত্নমালাকে পিঠে নিয়ে হাতি রত্নমালা নদীখানা পার করে গেল। এবারো, তাকে কেউ কিছু বলে নি। জেনে বুঝে সে নিজেই নিজের কাজ করেছে।
    এর আগেও রত্নমালা খুড়োর সঙ্গে বাগানে এসছে। মা কাকীমাদের সঙ্গে আসে আর চলে যায়। এবারে সে একা অনেকদিন থাকবে বলে এসছে। সঙ্গে এসছে রম্ভা দিদি। বাগানে এসে তার সবসময়েই ভালো লাগে। সবচে’ ভালো লাগে উড়ন্ত ময়ূরগুলোকে দেখতে । দিনটিতে এক না হয় একবার সে ময়ূরের পেখম তোলা দেখবেই। ছোট ছোট ছাগলের মতো হরিণগুলোকে দেখেও ওর ভালো লাগে। আর এত্তোগুলো সারি সারি চা গাছ! সবুজ ঢেউ খেলানো একটা চাদর মেলে গিয়ে নীল পাহাড়টিতে গিয়ে মিশে গেছে। সন্ধ্যেবেলা বাঘের গর্জন শুনতে পেলে ও ভয়ও পায়। আর ভয় পায় সময়ে অসময়ে এসে পড়া বন্য হাতির দলকে। মাঝে মাঝে বাগানের মজুরেরা মেরে কাঁধে ঝুলিয়ে আনা প্রকাণ্ড সাপগুলোকে দেখলেও তার ভয় করে। সবচে’ ভয় করে গা কাঁপানো জ্বরটিকে। বাবা তাকে বাগানে আসতে দিত না কেবল ঐ জ্বরটির জন্যে । বাগানে আসবার কথা উঠলেই জ্বরের কথা উঠে। খুড়োর প্রথম ছেলের মরবার কারণও ছিল ঐ গা কাঁপুনি জ্বর। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎই এই কাঁপুনি জ্বর একটা পুরো মানুষকে কাবু করে ফেলে।অবাতাসে যেমন করে কলাপাতা কাঁপে তেমনি কাঁপতে শুরু করে তার পর গা পোড়া জ্বর। কুইনাইন খেলেও লাভ কিছু নেই। জ্বর কমলেও লিভার বেড়ে যায়। পেট ঢোল হয়ে পড়ে। মানুষটা যে চা গাছের গুড়ির মতো হয়ে পড়ে। কোনো কাজেই আর লাগে না। গুড়ি পচার মতো পচতে শুরু করে। উঁচু জমির এই পলাশতলি বাগানের জল একেবারে বিশুদ্ধ। এই বিশুদ্ধ জলে ম্যালেরিয়ার মশা প্রবল প্রতাপে বংশ বিস্তার করে। ম্যালেরিয়ার বীজানু শরীরে নিয়ে মশাগুলো গোটা অঞ্চল জুড়ে বনবন করতে থাকে। লেবারদের পাতা মাপতে আসবার সময়েই দু’দুটো কুইনাইন পিল খেতে দিতে হবে। ম্যানেজার স্মিথ সাহেবের কড়া হুকুম। খুড়ো তাকেও তেতো বড়ি গুটি কয় দিয়ে সবসময় খেতে বলেছে। সব সময় ঐ তেতো বড়িগুলো খেতে তার ভীষণ বাজে লাগে। বাবাইবা তাকে কেন বাগানে পাঠালো? ম্যালেরিয়া হয় বলেই, একটা সময় ছিল, বাবা তাকে এদিকটাতে আসতেই দিত না। সে বুঝতে পেরেছে। খুড়ূ তাকে আদর করে এখানে আনে নি। তাকে বাড়ি থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছে। তেতো বড়ি ক’টা গিলবার বেলা তার চোখের জল নেমে আসে।
    কিছু দিন থেকে ওর মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। ওর যেন কেঊ নেই। বাবারাও ওর কোনো খবর টবর নেন নি। নীরব এই বাড়িটাতে সে আর রম্ভা দিদি। রম্ভা দিদি কাজের ভেতর ঐ ভাত ক’টা রান্না করে, গাল ভরে খায় আর পাটি একটা পেতে শুয়ে থাকে। ডাকলেও রাগ করে। খুড়ো বাড়িতে নেই। যুদ্ধের জন্যে বাগান থেকে শ’খানিক মজুর নিয়ে মিছামারি গেছে। সেখানে নিজের নিজের বাগান থেকে মজদুর নিয়ে গিয়ে আলাদা আলাদা বাগান থেকে মানুষগুলো গিয়ে জড়ো হবে।অমিছামারিতে এয়ার ফিল্ড আছে। সেখান থেকে ইংরাজ সরকার যুদ্ধের কাজে খাটাবার জন্যে বাগান থেকে মজদুর চেয়ে পাঠিয়েছে। আর খুড়োরই বা কি, ঘরে থাকা আর না থাকা। বন্ধ পেলেই বাড়ি চলে যায়।
    বাকি রইল রত্নমালা আর মাহুত কিনারাম। রত্নমালা আর কিনারাম সাধারণত বাগানের কাজে লেগে থাকে। পাহাড়ের নিচের দিকে বাগানে নতুন চারা গাছ রোয়া হচ্ছে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাছ কেটে ফেলা গড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। রত্নমালা নইলে কারবা সাধ্য সেই গাছ নাড়াবার? দিন দুই কাজ বন্ধ। রত্নমালাকে নিয়ে কিনারাম ঘরেই আছে।
    মেয়ে রত্নমালাকে দীর্ঘ নির্জন দিনটি যেন একেবারে চেপে ধরেছে। কিনারাম জাল দিয়ে মাছ মেরে এনে দিয়েছিল। তাই দিয়ে রান্না করা ঝোলে ভাত খেয়ে রম্ভা দিদি পাটি পেতে নাক ডাকছে। সে ধীরে ধীরে এসে কিনারামে কাছে দাঁড়ালো। সে রত্নমালাকে কলাগাছ খাওয়াচ্ছিল। কিনারামের শরীরের রং পাকা পেয়ারার মতো। চোখ জোড়া ছোট ছোট। হাসলে চোখের জায়গাতে রেখা একটাই দেখা যায়। মণিগুলো যেন পাগলা নদীটির বুকের কালো পাথরের দু’টো টুকরো। অল্প একটু হাসলেই পাথরের টুকরোগুলো ঘোলা জলে ঢেকে যাবার মতো যায়।
    সে তরুণী রত্নমালার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল । চোখের কালো পাথরের টুকরো ক’টার উপর রয়েছে মাছে ঘোলা করা খানিক জল। সে হাতিটিকে আদর করছে, “খা রত্নমালা খা।’’ নিজের নামটি তার মুখে শুনে মানুষ রত্নমালার হাসি পেয়ে গেল। সে হাতিকে বসিয়ে তার উপরে চড়তে যেতেই রত্নমালা আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলে “কোথাও যাবে বুঝি ?’’ আসলে তার কারো সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলবার ইচ্ছে হচ্ছিল।
    “শিকার দেখতে ।” সে হাতিকে দাঁড় করিয়েই দিল ।
    “কার শিকার?” তরুণী রত্নমালার স্বর কাঁদো কাঁদো।
    “ লেবারদের হরিণ শিকার।”
    “ আমাকে নেবে?” সে চট করে জিজ্ঞেস করে ফেলল।
    কিনারাম আবারো হাতিকে বসালো। মেয়ে তাতে উঠে গেল। অনেকদিন পরে সে রত্নমালার পিঠে চড়েছে। কিনারামের সঙ্গে চড়েছে। চেনা ছন্দে হাতি যেতে শুরু করল। কিনারাম একখানা সাঁকোর কাছে গিয়ে হাতিকে দাঁড় করালো। সাঁকোখানা বৃটিশ সরকারের তৈরি। মজবুত লোহার সাঁকো। সাঁকোর নিচে শুধুই ভেজা বালি আর পাথর। এই সেই পাগলা নদী। সাঁকোর নিচে তির ধনুক নিয়ে একদল মজদুর দাঁড়িয়ে আছে।অসামনের থেকে আরো এক দল হুর হুর করে হরিণ তাড়িয়ে আনছে। রত্নমালা চোখে স্পষ্ট দেখতে পেল দুটো ছাগলের মতো হরিণ। মুগার মতো রং , তাতে সাদা গোল গোল ফোটার মতো দাগ । সারা বাগান জুড়ে এই ছোট ছোট হরিণগুলো সে বহুবার দেখেছে। তিরবিদ্ধ হরিণগুলো কাঁধে ঝুলিয়ে মজদুরের দল চলে গেল। এই হরিণের মাংসও সে অনেকদিন খেয়েছে। বাড়ির পেছনের উঠোনে মাটিতে পোঁতা একটা গোল কাঠের টুকরো মাংস কাটতে কাটতে একদিকে বাঁকা হয়ে গেছে।
    হরিণ শিকার দেখেই রত্নমালার দিনটা কেটে গেল।
    পর দিন, তার পরদিনও, খুড়ো ফিরে আসার পরেও তার দিনগুলো কিনারামের সঙ্গে রত্নমালার পিঠে পিঠে পাগলা নদীর পারে পারে, সবুজ সাগরের ঢেউগুলোর মাঝে ছড়িয়ে পড়ল।
    একদিন রাত ভোর না হতেই কিনারাম রত্নমালাকে নিয়ে এসে হাজির হলো। রম্ভা দিদি শুয়ে আছে, খুড়া বাড়িতে গেছে। সে রত্নমালার পিঠে চড়ে সবুজ সাগরের মাঝে মিলিয়ে গেল। আজ কিনারাম পাগলা নদীতে জাউরিয়া৩ মাছের ঝাঁক দেখাবে। মাছগুলোর চামড়া কালো আর রূপালী মেশা। মুখটা কর্কশ । মনে হয়ে যেন কেউ সুচ দিয়ে খুঁচিয়ে কিছু ফুটো করে রেখেছে। চামড়া আর পাতিগুলো বড্ড আঠা আঠা। এ মাছের খোসা ছাড়াতে রম্ভাদিদির বেশ কষ্ট হয়। ছাইতে ভালো করে মাখিয়ে না নিলে তাতে বটি দা লাগাতেই পারে না। স্বাদের জন্যেই মাছগুলো কষ্ট করে কাটে সে। কিনারামের মুখে সে শুনেছে এই মাছ ধরতে পাহাড়ের উপরের দিকে যেতে হয়। সেখানে পাগলা নদীতে কিছু গর্ত আছে, যেখানে জল জমে থাকে। আকাশ গোলাপী হতেই সে ডোবাগুলোতে জাউরিয়া মাছের ঝাঁকগুলো আসে। উপরের দিকে নদীতে মাঝে মাঝেই হাঁটু সমান গর্তে স্পটিকের মতো জল দেখা যায়। বাকি সবটাই ভেজা ভেজা পাথর আর বালি। ভেজা পাথর আর বালির মাঝে মাঝে এক একেকটা গর্ত। আকাশ রাঙা হতেই সেই গর্তগুলোতে কালো রূপালী মাছগুলো এসে খেলতে শুরু করে । চুপ চাপে জাল ফেলে দিলেই মাছগুলো ধরা যায়। খিরিক করে একটা শব্দ হলেই মাছগুলো ত্‌ৎক্ষণাৎপালিয়ে যায়। আকাশে গোলাপী রং থাকা অব্দিই মাছগুলো থাকে, আলো খানিকটা উঙ্কÄল হতেই ওরা চলে যায়। কিনারাম কদম গাছ একটার নিচে হাতিকে বসালো। রত্নমালা বড় শান্ত হাতি। ওকে বাঁধতে হয় না। মাহুত কিনারামের আদেশ না পেলে সে এক পাও এদিক ওদিক করে না। শীত আসতে এখনো দেরি। কিন্তু এই পাহাড়ের নিচে সবুজ সাগরটিতে শীত অল্প আগেই চলে আসে। বিন্দু বিন্দু কুঁয়াশা পড়তে শুরু করেছেই। বাতাসেও একটা মৃদু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। মেয়ে রত্নমালা কিনারামের পেছনে পেছনে একটা সরু পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল। এ জায়গাটাতে অল্প চড়াই উঠতে হয়। তার পরেই নদীর উঁচু পার শুরু হয়েছে। বালি মাটি। পা পড়লেই মাটি অল্প ঝর ঝর করে তলাতে ঝরে পড়ে। সে বারে বারে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। কিনারাম অল্প দাঁড়িয়ে গিয়ে ওর হাতখানা ধরল। আকাশ অল্প অল্প ফর্সা হয়ে এসছে। তাকে সে মুখে রা করতে মানা করে রেখেছে। শব্দ হলেই মাছ একটাও থাকবে না। নদীর পার শুরু হয়েছে। খাড়া বালি মাটির পার। রত্নমালা দাঁড়িয়ে পড়ল। কিনারামও। রত্নমালা নামবে কী করে? কিনারাম হাত দু’খানা বাড়িয়ে তাকে ধরে নিল। দু’জনে ধরাধরি করে নেমে গেল। কোথাও একটা পাখি দীর্ঘ সুর ধরে ডাকছে। বালিতে নেমেই রত্নমালা আকাশের দিকে তাকালো। শাদা মেঘগুলো গোলাপী হয়ে গেছে । নদীর হাঁটু জলে কেউ যেন গোলাপি রঙের পাটের চাদর একখানা মেলে দিয়েছে। কিনারাম তাকে আঙুলে দেখিয়ে দিল। সত্যিই জায়গায় জায়াগায় ছোট ছোট গর্তে জাউরিয়া মাছের ঝাঁক ঝিলমিল করছে। কিনারাম নদীতে নেমে গিয়ে জাল মেলে ধরল। রত্নমালাও অল্প দাঁড়িয়ে থেকে শেষে নদীতে নেমে গেল। পায়ের পাতা সমান জলে ওর ঘি রঙের পা দু’টো দুটো ফোটা চাঁপা ফুলের মতো ঝলমল করে উঠল। সামনের গোলাপী রঙে রাঙ্গা গর্তে সাঁতরাচ্ছে এক ঝাঁক কালো রূপালী জাউরিয়া মাছ আর কাছেই ঝলমল করছে খোলা চুলের আরো এক কালো আর ঘি রঙ মেশানো জাউরিয়া মাছ। কিনারাম জাল ধরে অল্প দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎই একটা শব্দ শুনতে পেল। পাগলা নদীতে জোয়ার এসছে। গড়িয়ে দেয়া বিশাল এক পাথরের মত জোয়ার আসছে। সাদা সাদা ফেনাগুলোতে গোলাপী রঙ ছড়ানো। কিনারাম ঘপ করে রত্নমালাকে তুলে ধরল। নিল , জলে এই ওদের ভাসিয়ে নিল বলে। নিমেষে রত্নমালাকে বুকে নিয়ে সে গিয়ে পার পেল। দু’জনের গায়েই রূপালী বালিকণা লাগল। পাগলা নদীর জোয়ারের ছিটেয় দু’জনের শরীর ভিজে গেল। ওদের চোখে আর কিছুই ছিল না। ছিল শুধু গোলাপী জলের ডোবাতে খেলায় ব্যস্ত এক ঝাঁক কালো রূপালী মাছ। একটাও শব্দ উচ্চারণ করা যাবে না। মাছগুলো যে খিরিক করে শব্দ একতা হলেই হারিয়ে যায়।
    বাগানের সীমা পার হলেই পাহাড়ের নিচে সারি সারি চন্দনের গাছ। এ জমিতে গাছের গুটি খেয়ে পাখিতেই নিশ্চয় এই চন্দন গাছের চারা গজিয়েছিল। এখন পাহাড়ের নিচে আঁকা বাঁকা করে চন্দন কাঠের একখানা সম্পূর্ণ সুরভিত অরণ্য। মিঠে, লাল লাল চন্দন গুটি খাবার জন্যে গাছে গাছে, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। কিনারাম ওকে জাউরিয়া মাছের ঝাঁকই নয়, চন্দন কাঠের সুরভিত অরণ্যও দেখালো। সেদিন রত্নমালা মুখে কথা বলতে পারছিল না। কথা কিছু শুনলেই যে নির্জন অরণ্যে চন্দনের বীজ খেতে ব্যস্ত পাখির ঝাঁকগুলো নিমেষে উড়ে চলে যায়।
    কী করেই বা কথা বলে রত্নমালা ? ওর যে গোলাপী নদীর জলে নাচতে থাকা কালো-রূপালী মাছের ঝাঁক , চন্দন গাছে বসে গান গাওয়া পাখিগুলো, পেখম তোলা ময়ূরের পালকের রঙ বড় ভালো লাগে। নীল রঙে হাজার হাজার তাঁতে বোনা ফুলের কাজ। রঙ আর ফুলগুলো নাচছিল। সে মেয়ে একটাও কথা বলতে পারছিল না।
    রত্নমালাকে নিয়ে যেতে মা, বাবা আর কাকিমা এলেন। তাকে দেখে মানুষগুলো অবাক হয়ে গেল। বাগানের জল-হাওয়া গায়ে লাগানো ভালো। তাই বলে মেয়েটা কি অমন পদ্ম ফুলের ফুলের মতো ফোটে উঠবে ? মায়েরা আসার পরদিন সবাই দেখল রত্নমালাকে বেঁধে রাখা জায়গাটিতে একটি বিরাট বড় হাতি দাড়িয়ে আছে। অন্ধকারেও তার পাকানো দাঁত জোড়া সবাই দেখতে পেল। এক দু’দিন নয়, অন্ধকার হবার সঙ্গে সঙ্গে রোজ দাঁতাল হাতিটা এসে রত্নমালার কাছে দাঁড়ায়, রাত ভোরে আবার চলেও যায়। প্রত্যেক দিন লোকে ভাবে আজ আর রত্নমালাকে দেখতে পাবে না, হাতিটা নিয়ে যাবে। কিন্তু তাকে দেখা যায়, সে একই রকম শান্ত হয়ে গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে । রাতে বাড়ির ভেতর থেকে সবাই টের পেল দাঁতাল এসছে। সবাই স্থির হয়ে যায়। কখনো বা কেউ একজন কৌতুহলে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকায়, দেখে একজোড়া হাতি। নি:শব্দে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে।
    এ ক’দিন মা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে শুয়েছেন। একদিন রাতে মা মেয়েকে কাছে না দেখে চমকে উঠলেন। দোয়ারখানা আজানো ছিল। ঠেলা দিয়ে খুলে সেখানেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। এক জোড়া হাতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে অল্প দূরেই এক জোড়া ছেলে মেয়ে। ছেলেটার শরীরের পাকা পেয়ারার রং দাঁতালের ঘি রঙের দাঁতজোড়ার মতো অন্ধকারেও ঝলমল করছে। তিনি কথাতা কাউকে বললেন না। শুধু আর একরাত এখানে থেকে বাড়ি যাবার কথা তোললেন। দু’জন মেয়ে মানুষ বেরিয়ে এসছে, বাড়িখানা এমনিতেই ছাড়া বাড়ি হয়ে আছে নিশ্চয়। মা রত্নমালাকে পুরোটা দিন চোখে চোখে রাখলেন। এদের সব কথাই স্পষ্ট হইয়ে গেল। একবার সে এসে মেয়েকে কলাপাতায় মোড়া কিছু বকুল ফুল দিয়ে গেল , একবার অল্প পাকা জেতুলি৪ । মেয়ে মাথা নুয়ে এখানে ওখানে বসে থাকে আর চোখের জল ফেলে। বাড়ির লোকে ভাবে সেতো কাঁদবেই, এ এমন কী নতুন কথা? মা বুঝতে পেরেছেন মেয়ের এ অন্য চোখের জল । সে রাতেই হাতি রত্নমালা আর মানুষ রত্নমালা হারিয়ে গেল। হাতি রত্নমালা ঘুরে এলো, মানুষ রত্নমালা আর এলো না।
    তার পরের কথাগুলো বড় সংক্ষিপ্ত। মেয়ে একটা জন্ম দিতে গিয়ে রত্নমালা মারা গেল। মৌজাদারের ভয়ে পাহাড়ে গিয়ে লুকোনো রত্নমালা আর বেঁচে থাকতে পারল না। বাচ্চাটাকে নিয়ে কিনারাম বাগানের কাছে নিজের গাঁয়ে ঘুরে আসার ক’দিন পর তার গুলিবিদ্ধ দেহ নদীতে দেখা গেছিল। জাউরিয়া মাছের ঝাঁক যখন নদীতে খেলতে আসে তখন লোকে সে দেহ নদীতে ভাসতে দেখেছিল। সেই দাঁতাল হাতিটা এসে যে তারা গাছে ভরা ডোবাতে৫ লুকোয় সেখানে কিনারামের রক্ত বয়ে গেছিল। কেউ টু শব্দটিও করে নি।
    রত্নামালা আর কিনারামের মেয়েটিকে বহুদিন ধানের ডুলিতে ঢেকে রেখেছিল। পাহাড়ের তলায় গ্রামখানাতে সে বড় হয়েছিল। কিনারাম মায়ের কর্দৈমণি৬ হারখানাও মেয়ের সঙ্গে নিজের বাড়িতে সমঝে দিয়েছিল । কর্দৈমণিটি বুঝি কিনারামের বাড়ির লোকেরা মাটিতে পুঁতে রেখেছিল। কেউ বুঝি সেখান থেকে মাঝরাতে কেমন এক আলো বেরোতে দেখেছিল । ওঝা ডেকে এনে ঝাড় ফুঁক করে মণিটা চুলোর উপরে সরিষার ডুলিতে ভরিয়ে রেখেছিল।
    তার পরের কথাগুলো আর ছোট। যুতিমালাকে গোটা গ্রাম যেন ধানের ডুলিতে ঢেকে রাখার মতো রেখেছিল। তেমনি করে থেকেই সেও একদিন যৌবনে পা দেয়। যুতিমালা নিজেই জানত সে অন্য মেয়েদের মতো যেখানে সেখানে বেরোতে বেড়াতে পারে না। সে এক সময় একে ওকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করে দাঁতাল হাতিটা এসে যে তারা গাছে ভরা ডোবাতে লুকিয়ে থাকত সে জায়গাটা কোথায়? বাগানের কোন কোয়ার্টারে ঢোকার পথে হাতিটা এসে মাদি হাতির কাছে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকত। সে রকম সমইয়েই যুতিমালা একদিন ক্ষিতিশ ঘোষ নামের জোয়ান ছেলেটির সঙ্গে পরিচিত হয়। ক্ষিতিশ নামী মিঠাইর কারিগর। অসুরের মতো খাটতে পারে। ছেলেটি বড় কম বয়সে ভালো পশার জমিয়েছিল। পাহাড়ের নিচের বাগানটির থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ কি: মি: দূরের শহরমুখো যে গ্রামটিকে রেললাইন ছুঁয়ে গেছে সেখানে তার এক মিষ্টির দোকান বেশ বড় হয়ে উঠেছিল। মৌজাদের পরিবারটি যে শহরে থাকে সেখানে বিয়ে-শ্রাদ্ধেতে সেই মিষ্টি যোগান দেবার দায়িত্ব নেয়। পয়সা কড়িও হাতে এসছে।
    ভুটান পাহাড়ের নিচে এই গ্রামে বছরে এক বড় মেলা বসে। ক্ষিতিশ এই মেলাগুলোতে জনাতিনেক কর্মচারী নিয়ে প্রতিবছরেই একটা দোকান দিয়ে এসছে। শুরুর দিনগুলোতে শিলিগুড়ি থেকে এসে এই মেলাগুলোতে দোকান দিয়েই সে পায়ের নিচের জমি পাকা করেছিল। সাইকেলে মালপত্র বেঁধে সাঁকো ছাড়া ভাঙ্গা ছেঁড়া রাস্তাগুলো দিয়ে সে মেলায় মেলায়, বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াতো। যেখানে রাত সেখানেই কাত। আজকাল মেলাগুলোতে সে আর নিজে যায় না, কর্মচারী পাঠিয়ে দেয়। এই মেলাতে সে এসছে অন্য এক কারণে। এই মেলাতে ভুটিয়া লোকেরা কুকুরের বাচ্চা বিক্রি করবার জন্যে নিয়ে আসে। এরা যে বাচ্চাগুলো আনে সেগুলো ছাগলের বাচ্চা থেকেও ছোট পুতুলের মতো দেখতে হয়। কিন্তু বড় হলে হয় ঘোড়ার সমান। সেগুলো ওরা অন্য জিনিসের সঙ্গে বিক্রী করতে নিয়ে আসে। সে এসছে ঐ পুতুলের মতো ছোট্ট কুকুরের খোঁজে। নতুন সাজানো ঘরে রাতে গিয়ে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে তার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কুকুর একটা থাকলে তার সঙ্গী হবে। সাত জায়গাতে থেকে সাত ধাক্কা খেয়ে বড় হয়েছে সে, তার এ জগতে কেউ নেই। টাকা পয়সা হতে দেখে শিলিগুড়ির কোনো কোনো নিজের মানুষ বেরিয়েছে। মাঝে মধ্যে খবর আত্তি করতে , টাকা পয়সা চাইতে আসে। সেও দেয়। এলে ঘরে রাখে, খাইয়ে বসিয়ে পাঠায়। কিন্তু এইটুকুন মানুষে তার ঘরের নির্জনতা ঘোচে না।
    এই মেলাতে সে যুতিমালাকে দেখতে পেল। দখনা৭ পরলেও ওর চেহারা কারো সঙ্গে মেলে না। রাজহাসের মতো ঝিল মিল করে যে মেয়ে তার খবর বের করা এমন কী কঠিন কাজ? সে ঐ কোয়ার্টারও দেখে এলো। ঘরটা ভেঙ্গে চুরে গেছে। কেউ থাকে না সেখানে। ঘরটার সামনে আগের সেই তারা গাছে ভরা ডোবাও আছে। তার পর সে সোজা যুতিমালার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছুলো। ভয় ডর নেই ছেলের, এমন জোয়ান মানুষ। শরীরের জোড় আছে, পয়সার জোর আছে।অযুতিমালার বাবা কিনারামের সমাজের সমস্ত নিয়ম মেনেই সে তাকে নিয়ে গেল। সে অবশ্য কুকুরের বাচ্চা একটাও নিয়ে গেল। এক ভুটিয়া ছেলে হলৌচোলার৮ জেবে ভরে দুটো কুকুরেরে বাচ্চা এনেছিল। হাতের তালুতে নেয়া যায় এমন ছোট্ট কুকুর বাচ্চা দুটোকে তার হাতে দেবার সময় সেই ভুটিয়া দুটো চুমো খেয়ে দিয়েছিল।
    তার পরের কথাগুলো যেন তারা গাছে ঢাকা ডোবাতে গুলি খেয়ে পড়ে রয়েছিল ছিল যে সেই পেয়ারা রঙের জোয়ান ছেলেটির জীবনটির মতো, চোরাই ব্যাপারীতে উজাড় করা পাহাড়ের নিচের সুরভিত চন্দন কাঠের অরণ্যের মতো, মেরে মেরে মাংস খেয়ে শেষ করে ফেলা সেই ময়ূর পাখিদের মতো, ফুটফুটে হরিণগুলোর মত ---সবই আরম্ভ হয়েছিল, সবই ছিল, কিন্তু এখন কিছু নেই। আছে শুধু হাহাকার, শূন্যতা, অপূর্ণতা। জোয়ান ছেলের বুকের থেকে বেরুনো ছলাৎ ছলাৎ রক্তের মতো, কেটে গড়িয়ে ফেলা চন্দন গাছের অরণ্যে বাসা বাঁধা আকাশ বাতাস কাঁপানো চিৎকারের মতো, পালক টেনে টেনে মেরে লাল মাংস বের করে ফেলা ময়ূর পাখিগুলোর মসৃণ উলঙ্গ শরীরের মতো, কেটে কেটে বাজারে ভাগ করে রাখা ফুট ফুটে হরিণগুলোর রক্ত লেগে থাকা মাংসের মতো—কেবল শূণ্যতা,ধ্বংস এবং হাহাকার।
    ভয়ডর নেই ছেলেটার, ভেবেছিল পৃথিবীর সমস্ত বিপদের সঙ্গে লড়াই করা যায়। জেতা যায় যুদ্ধ করে। কোঁকাচ্ছিল যুতিমালা ঘরে। ওকে তেমনি রেখে ক্ষিতিশ বেরিয়ে গেছিল। চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল, বন্দুক ছুটছিল। বহু মানুষ মরাপাটের ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। সেই যে গেল সে আর ঘুরে এলো না। যুতিমালা মেয়ে একটির জন্ম দিয়ে উঠোনেই পড়েছিল। প্রাণ বাঁচিয়ে ক্ষিতিশের দূর সম্পর্কের ভাতিজা রতন এসে এ বাড়িতে পৌঁছেছিল। সে তাকাচ্ছিল। আগুন ধরিয়ে দেয়া ঘরের চালখানা এসে অচেতন যুতিমালার গায়ে পড়ছিল বলে। সে পুকুরে ঝপাং করে একটা শব্দ শুনেছিল। কেউ কচি শিশুটিকে
    জলে ফেলে দিয়েছিল। লোকগুলো চলে গেছিল। রতন বেরিয়ে এসে পুকুরে এসছিল। দল ঘাসের মাঝে শিশুটি পড়ে রয়েছিল। রতন ঘোষ তাকে দলবনের মধ্যি থেকে এনে কোলে তুলে নিল।
    এই মেয়েটি ফেলানি । ওর নামটির সঙ্গে থেকে গেল জলে ঝপাং করে হওয়া সেই শব্দ। জলে ফেলে দেয়া মেয়ে ফেলানি হলো।
    লম্বোদর ওকে বাড়ি নিয়ে আসার পরেও নামের সঙ্গে শব্দটি জড়িয়ে রইল। লম্বোদরের ঘর উঠোন করেই সে এখন ছেলের মা, সাত মাসের পোয়াতি। এক হাতে চুলে তেল মেখে মেখে আর হাতে ঝলমলে ফোটা লাল গোলাপ ছুয়ে আছে যে সেই ফেলানি, রত্নমালার নাতনি, যুতিমালার মেয়ে। আশ্বিনের ধানের মাঠের মতো সাত মাসের পোয়াতি তরুণী, বঁধুটিই ফেলানি। লম্বোদরের ঘরনি, মণির মা।

    টিকা:
    ১) খঞ্জনা: অসমিয়াতে পাখিটির নাম বালিমাহী। এর প্রতিশব্দ আছে খঞ্জনা। খঞ্জনা বাংলাতে পরিচিত নাম। যদিও
    স্থানীয় নাম পেলে শোধরানো হবে।
    ২) মেজি: ছই দিয়ে তৈরি একরাতের অস্থায়ী ঘর। যা পৌষ সংক্রান্তির পরদিন মাঘের প্রথম ভোরে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অসমের বরাক উপত্যকার
    বাংলাতে একে বলে ভেড়াভেড়ি বা মেড়ামেড়ির ঘর। যদ্দূর জানি, শব্দটি ব্রহ্মপুত্রের বাঙালিদের মধ্যে পরিচিত নয় । তাই মূল নাম রেখে দিলাম।

    ৩) জাউরিয়া: দল বেঁধে পাহাড়ের উপরের ডোবাতে ভেসে বেড়ায় বলে অসমিয়াতে এমন নাম। কেঊ বাংলা নাম বলে
    দিলে উপকৃত হব।
    ৪) জেতুলি: এক ধরণের লতানে গাছের ফল, যে গাছে কাঁটা থাকে। Rosaceae পরিবারের গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Rubushexagynous
    ৫) তারা গাছে ভরা ডোবাতে: অসমিয়াতে শব্দটি ‘তরাণিডরা’। অসমের বরাক উপত্যকাতেও ডোবা জমি বোঝাতে ‘ডর’ বা ডহর ব্যবহৃত হয়। যেমন, নারায়ণডর, মালিনীডর। ‘হ্রদ’ থেকে ‘ডর’ এসছে। কিন্তু ‘তরাণিডরা’র মতো নামাকরণের নজির বাংলাতে নেই। বেতের মতো সবুজ এক ধরণের আধা জলজ উদ্ভিদকে ‘তারা’ গাছ বলে যার থেকে সাদা ফুল হয়। বাংলাতে কেঊ এর বিকল্প নাম, যা অসমে চলে , জানালে শোধরানো হবে। Zingiberaceae পরিবারের গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Alpiniaalughas
    ৬) কর্দৈমণি: ‘কর্দৈ’ শব্দের অর্থ কামরাঙা। কর্দৈমণি হার মানে কামরাঙার মতো মণি যুক্ত হার। বাংলাতে চন্দ্রমণি হার রয়েছে । কিন্তু এর অলঙ্করণে বাঙালিদের হারের সঙ্গে তফাৎ আছে। তাই মূল শব্দ রেখে দিলাম।
    ৭) দখনা: বডো মেয়েদের ঐতিহ্যগত পোষাক। মেখলা চাদরের মতো।
    ৮) হলৌ চোলা: পশুচামড়াতে (সম্ভবত হলৌ বাঁদরের) তৈরি এক ধরণের পুরো শরীর ঢাকা আলখাল্লা।
  • Sushanta Kar | 117.198.53.200 | ২২ অক্টোবর ২০১১ ২১:৫২495484
  • অধ্যায় দুই (২)

    লম্বোদর ওকে আজ সকালে বলে গেছে যেন সে যেটুকু পারে, অল্প অল্প জিনিস পত্র বেঁধে গুটিয়ে রাখে। কী গুটোয় সে? বর্ষাতে চালের ফুটো দিয়ে ফোটা ফোটা জলে যেমন পুরো বাটি ভরে যায় তেমনি গেল ন বছরে একটা দুটো করে কত কি জিনিস করেছে ওরা। কোনটা রেখে কোনটা নিয়ে যায়? কী বেঁধে নিয়ে যায়? ঐ দু’বছরেই ফল ধরেছে যে কামরাঙা গাছটায়? কলিতেই কী মিষ্টি খেতে ! জাহাজী কলার গাছটা, যার থোর ঝুলে পড়ে মাটি ছুঁই ছুঁই করছে? ঐ যে গাছে লাল গোলাপ ফুটে চিমমিক করছে, ওটা? মাছে ভরা পুকুরটা ? আঁচলে, বাক্সে, পোতলাতে –কিসে করে বাঁধে সে? সাত মাসের পোয়াতি সে ভারি দেহটা নিয়ে এদিক ওদিক দেখছে কেবল।
    রাতে হৈ হল্লা হতেই থাকে, কেউ শুতে পারে না। ছোট হলেও মণি বয়সের থেকে বেশি সমঝদার হয়েছে। এই আট বছরেই সে কত কী বুঝে! সারা রাত সে শোয় না। চোখ বুজে আসে , তবু সে সজাগ থাকে। বাবা যখন গাঁয়ের আর লোকের সঙ্গে রাতে পাহারা দিতে যায়, তখন রোজ বলে যায় কিনা, মাকে দেখবি। সে ঘুমোয় কী করে? গেল রাতে পুরো ছ’বার হাল্লা হয়েছে। গাঁয়ের যারা পাহারা দিচ্ছিল তারা আগুনের আলো দেখেছে, মরা পাটের খেতের মাঝখানে মানুষের আনাগোনা দেখেছে, পেট্রোলের গন্ধ পেয়েছে, তিরে লেগে এসে পড়া নাহরের বীজ১ দেখেছে। সে বারে বারে বিছানাতে ওঠে আর নামে। থেমে থেমে গোটা রাত সে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে গেছে।
    সে ছেলের গিয়ে দাঁড়াল । শুয়ে থাকা ছেলেকে তার আলতো করে একটা চুমো খেতে ইচ্ছে হলো, পারল না। কিছু দিন থেকে সে ভালো করে নোয়াতে পারে না। হঠাৎই ওর মনে হোল শ্বাসটা যেন বন্ধ হয়ে যাবে। পেটেরটি পাশ ফিরছে। পেটের একদিকটা যেন শক্ত হয়ে ফুলে উঠল, আবার যেমন ছিল তেমনি আগের মত হয়ে গেল। সে টেনে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিল। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন , হবে বটে একটা ...। ওর ঠোঁটে খানিকটা হাসি দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে গেল।অছেলেটি ঘুমের মধ্যে কিছু বিড় বিড় করে বলছে। মায়ের বুকে যেন কিছুতে চেপে ধরেছে। এ বয়সে ছেলেটির উচিত ছিল খেলেধুলে গোগ্রাসে কতকগুলো খেয়ে সন্ধ্যে হতেই পড়ে ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়া । কিন্তু এই ছোট্ট ছেলেটিকে দেখতে হচ্ছে সারা দেশের যত বাজে জিনিসগুলো। সে ছেলের মাথার নিচের বালিশটা ঠিক করে দিল। বালিশটা বাঁকা হয়ে গিয়ে ওর গলা থেকে একটা ঘড়ঘড় করে শব্দ বেরুচ্ছিল।
    মানুষটা তেমাথাতে যাবে বলে বেরিয়ে গেছে। গাঁয়ের সমস্ত ছেলে বুড়ো জীবনের দোকানে জড়ো হবে। জীবনের দোকানের কাঁচে ঘেরা আলমারিগুলো খালি। এতোদিন সে বন, কাটা বিস্কিট আর লাল চা বিক্রি করছিল। এখন সেগুলূ বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু লোকগুলৈ সেখানে জড়ো হয়। আগেও মানুষগুলো ওখানে বসত। জীবন একটা খবরের কাগজ রাখে, কাগজটাও ওদের একটা মুখ্য আকর্ষণ। কেউবা রেডিও একটাও নিয়ে যায়। এই মানুষগুলো আগে আর কই এতো রেডিও,খবরের কাগজের প্রতি আগ্রহ দেখাতো? এই গোলমাল শুরু হবার পর থেকেই ওরা এতো সচেতন হয়েছে। কোথাও খিটিং করে শব্দ একটা হলেই ঝাঁপ দিয়ে উঠে।
    ফেলানি জীবনের দোকানে যায় না। সেখানে কী আলোচনা হয় তাও টের পায় না। টের পেলে যে জানতে পেত কী ভাবে নির্বাচন বর্জন করবার জন্যে আন্দোলনকারী ছেলেগুলো উঠে পড়ে লেগেছে। খবরের কাগজ রেডিওর সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও টের পেত। মনোনয়ন পত্র জমা দিতে যাবার বেলা সেই মেয়ে মানুষটিকে ছেলে মেয়ে বাচ্চা বুড়োতে কী করে বাধা দিয়েছিল। কী করে পুলিশে গুলি করে তাদের দু’জনকে মেরেছিল। মেরে কত লোককে পঙ্গু করেছিল। সেই গোলগাল মুখের ছেলেটির শবদেহ নিয়ে শহরে কেমন শোভাযাত্রা হয়েছে। সে শুধু একা নয়, জীবনের দোকানে যারা বসত সেই লোকগুলূ সেই গোপন ইস্তাহারের কথা জানত না , যেটিতে লেখা হয়েছিল: “ভোট গ্রহণ কেন্দ্র, গাড়ি, দেশদ্রোহীর ঘর দোয়ার ইত্যাদিতে অগ্নি সংযোগ করবেন। রেলের সিড়ি, ফিসপ্লেট উঠিয়ে দিতে হবে। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে ফেলবেন। সরকারি যানবাহনকে বাধা দেবেন , অপহরণ করবেন। অসম বিরোধী ব্যক্তিকে পঙ্গু করবেন। চোত্রা পাতার গুঁড়ো, লংকাগুঁড়ো, বলা –মৌমাছি গুটিয়ে রাখবেন। বাড়ি ঘর জ্বালাবার জন্যে তির ধনুক, নাহরের বিচি১ , মরা পাট ইত্যাদি জোগাড় করে রাখবেন...” লোকগুলো শুধু জানতে পেয়েছে যে সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেছে। ঝড় আসবার আগের নিস্তব্ধতার মতো সময় অজগরের মতো সবাইকে পেঁচিয়ে ধরেছে। চারদিকে শুধু ভয় আর আতঙ্ক। পাতা একটা ঝরলেও সবাই আঁতকে উঠে।
    জীবনের দোকানে গতকালই সবাই আলোচনা করেছে, বাচ্চা আর মেয়ে মানুষগুলোকে একটু দূরে কোথাও পাঠিয়ে সরিয়ে ফেলাই ভালো হবে। কোথায়, কবে, কোনদিকে কী হয় তার ঠিকানা নেই। সে জন্যেই তাঁকে ওর স্বামী বলে গেছে, যা পারবি গুছিয়ে টুছিয়ে রাখবি। সে থপ থপ করে ঘরের ভেতরটাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী গোছায় সে? এবারে সে তালা দিয়ে রাখা বাক্সটা খুলেছে। কাপড়ের ভেতর থেকে মুখে দেবার ক্রীমের একটা কৌটো একটা বের করে আনল। কৌটোটি খুলতে বেরিয়ে এল কয়েক পদ অলংকার। মা বাবা নেই মেয়েটাকে কেই বা সাজিয়ে গুজিয়ে বের করে দেবে? লম্বোদর কোচের ঘরের ছেলে। খাওয়া পরার ব্যবস্থা আছে। খেত খামারও রয়েছে। হাইস্কুলে কয়েক ক্লাস পড়েছিল। বংশ পরিচয়ও মন্দ নয়। মঙ্গলদৈ থেকে পনের কিলোমিটার ভেতরে ওর মূল বাড়িও নেহাৎ ফেলনা নয়। সে কাকার সঙ্গে ভাগের জমি চাষ করতে এসে এ গ্রামে থেকে গেল। তার মন বেঁধে ফেলল মিষ্টির কারিগর রতনের ঘরের পালিতা কন্যা ফেলানির লম্বা চুল ক’গাছা। সে যেদিন প্রথম পুজোর মেলাতে ফেলানিকে দেখেছিল, অবাক হয়ে ভেবেছিল-- এই নজর কাড়া মেয়েটির নাম কে ফেলানি রেখেছে! যখন জানতে পেল তার মন জিলিপি তৈরির জন্যে মেলাতে গুলে রাখা ময়দার মতো নরম হয়ে গলে গেল। বাড়ির আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে সে মিঠাইর কারিগরের উঠোন থেকে সাজিয়ে গুছিয়ে না দেয়া সত্বেও মেয়েটিকে সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে এল। বাড়ির লোকেরা বেজাতের মেয়ে আনবার জন্যে তাকে প্রায় ত্যাগ করল। পনের বছরের মেয়ে এখন লম্বোদরের ঘর উঠোন করতে করতে তেইশ বছর বয়সের গৃহিনী, একটি ছেলের মা হয়ে গেছে।
    সে অলংকারে কৌটাটা খুলল। হাতের তালুতে তার কর্দৈমণি। হারটিতে একগাছা ভারি মিনা করা ঝোলানো অর্ধচন্দ্রের মতো লকেট। হারের কামরাঙার মতো মণি ক'টিতে বেশ ভালো রকম সোনা রয়েছে। লকেটটা খাটি মুক্তোর। অলংকারটা হতে নিয়ে ওর বুকটা ধুঁকপুক করে উঠল। এই গয়নাটি পরিয়ে ওকে বিদেয় দিলেও লোকে রতনকে ধন্য ধন্য করত। কিন্তু কার এতো সাহস আছে এই ভারি কর্দৈমণি রোদের আলোতে নিয়ে আসবার? ওর মাকেও যখন এটা দেয়া হয়েছিল, তখন কাপড়ের মাঝখানে ছেঁড়া কাপড়ের পোটলার ভেতরে ওটা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল যাতে অন্যে না দেখতে পায়। মিঠাইর কারিগর ক্ষিতিশ ঘোষের দূর সম্পর্কের ভাই রতন ঘোষের ঘরের অন্ধকার কোণাতে এই হারখানা যেভাবে ছেঁড়া কাপড়ের পোটলাতে পেঁচিয়ে আনা হয়েছিল সেভাবেই পড়েছিল। ষাট সনের সেই রক্তে ধোয়া দিনগুলোতে হারখানা বাইরে বেরিয়ে এসছিল।
    যেদিন এই হার টিনের বাক্সের থেকে বেরিয়েছিল সেদিন বাতাস আগুনের ফুলকীতে ভরে গেছিল। দাউদাউ করে বাড়ি ঘর জ্বলছিল। তার মতো তার মায়েরও সেদিন গা ভারি ছিল। ছ্যাঁছড়ে ছ্যাঁছড়ে স্বামীর সম্পর্কিত ভাই রতনের বাড়িতে গিয়ে ঢুকে গেছিল। মা শরীরের থেকে বেরুনো থোকা থোকা রক্তে আধপোড়া ঘরের স্তুপাকার ছাই ভিজিয়ে ফেলেছিল। মা শিশুটিকে আর ছেঁড়া কাপড়ে বাঁধা ‘কর্দৈমণি’ হার, নিজের সোনাতে বাঁধানো, স্বামীর দেয়া আংটিটা একটা বস্তাতে রেখে চোখ বুজেছিল। রতন যেখানে লুকিয়ে ছিল সেখান থেকে বাচ্চার কান্না শুনতে পেয়েছিল। আর শুনতে পেয়েছিল ঝপাং করে জলে একটা শব্দ। সেই দাঙ্গাবাজগুলো চলে যাবার পর রতন তাকে তুলে এনে ঝোপের দিকে দৌড় দিয়েছিল। ফেলে দেয়া মেয়েটি ফেলানি হয়েছিল। কেঊ ডাকে ফিলানি, কেঊবা ফেলাইনি, পেলানি, ফলানি....ফালানি...। মোটের উপর ওর নামটা থেকে গেল ঝপাং করে জলের একটা শব্দ।
    ‘ফেলাইনি...ফেলাইনি...’, সুর করে কেউ ডাকতে সে গলার স্বর থেকে বুঝতে পারল জানকিদের ঠাকুরমা। কেঁদে কেঁদে মানুষটির স্বরটা ভেঙ্গে গেছে। বুড়ী ভোক ভোক করে কাঁদছে। সে বেরিয়ে গেল। জানকিদের পরিবারটি তল্পিতল্পা বেঁধে কোথাও যাবার জন্যে বেরিয়েছে। ওরা পাটখেতের মধ্যে দিয়ে মিলিয়ে গেল। ফেলানি আবারো ঘরে এলো। ওকে যে স্বামী তৈরি থাকতে বলে গেছে। সে হাঁটু ভেঙ্গে বসে চুলো জ্বালিয়ে ডেকচিতে চাল-ডাল আর আলু একসঙ্গে বসিয়ে দিল। গুটিয়ে রাখা শুকনো আমের ডাল দপদপ করে জ্বলে গেল, ভাতও হয়ে গেল।অ। চুলোর কাছের খড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর বুক কেমন করে উঠল। মানুষটা ওর জন্যে সবই ছাড়ল, আজ অব্দি মানুষটা ওকে শুধু সুখই দিল। চারদিকে এতো গোলমাল, এর মধ্যেও লোকটা ওর কথা ভুলে নি। চুলোর কাছে এনে দেয় লাকড়ি। পুকুর থেকে জল তুলে এনে বালতি চড়াই২ ভরিয়ে রাখে...। পেটেরটই আবারও পাশ বদল করছে...। কিছু একটা খাওয়া উচিত ছিল, না খেয়ে থাকলে পেটেরটিকেই কষ্ট দেয়া হবে।
    বেড়াতে আলোর রেখা চিকমিক করে উঠেছে। বিছানাতে বের করে রাখা গয়নাগুলোতে খিড়কি২ দিয়ে রোদের আলো পড়ছে। কর্দৈমণিতে রোদের আলো পড়ে চিকমিক করে উঠতেই সে প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওটা বালিশে ঢেকে দিল।অএমন মণিটাকে সে কোন সাহসে আলো হাওয়াতে বের করল?ওর সারা গা কেঁপে উঠল। এই মণির ইতিহাস মনে ফেলানির দিদিমা রত্নমালার ইতিহাস, মৌজাদারের পরিবারের আলো বাতাস পড়তে দেয়া হয় নি যার গায়ে, যে কলঙ্ক মুছে দিতে চাওয়া হয়েছিল তার ইতিহাস। তাকে অনেকেই দেখলে বলে দিদিমার মতো দেখতে। রতনের বাড়িতে সে ছিল সন্দেশ বানহাবার জন্যে রাখা ছানার মতো। ঢেকে টেকে রাখতে হবে,ঢাকবার কাপড়খানাও পরিস্কার হতে হবে, মাছি পড়তে পাবে না। তা না হলে সন্দেশে পাক ধরবে না, টক হয়ে যাবে। কেউ তাকে পারতে বাড়ির বাইরে বেরুতে দিত না। শুধু রতনই জানে তার দোকানে মিষ্টি কিনবার ছলে তিনদিনে তিনবার মৌজাদারের পরিবারের গাড়ি এসছিল।
    সে ধীরে ধীরে চন্দ্রমণি হার পরে নিল। ওর ভরা শরীরে মণি বসানো কামরাঙাগুলো তারার মতো ঝলমল করে উঠল।
    ‘মণি! মণি!’ বরের ডাক শুনে সে সাত তাড়াতাড়ি মণিহারখানা খুলে বাক্সে ভরিয়ে রাখল। চাদরের মাথাটা ভিজিয়ে সে গলাতা মুছে নিল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তারা গাছের হালকা ঝাড়ের মাঝে পড়ে থাকা একটি সুঠাম দেহের জোয়ান ছেলের মৃতদেহ। রতনের কাকা ভয়ে ভয়ে কাকীমাকে বলতে সে শুনেছিল সে বাড়ির গাড়ি এসে দোকানের সামনে দাঁড়াবার কাহিনি। ওর শরীরের রোমগুলো শিউরে উঠল। মণি উঠে বাবাকে দোয়ার খুলে দিল।
    বর এসে ওর কাছ ঘেঁষল, “ গোছানো টোছানো কিছু হলো? কাল ভোরে...’’ সে কথা শেষ করতে পারল না। মা ছেলেকে ধরে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে শুরু করল।
    “মালতী ! মালতী! এমনটি করিস না। তোর একতা বাড়ি আছে না? শ্বশুর শাশুড়ি সবাই আছে, ওরা খবর করে পাঠিয়েছেন।আল্প সামলে টামলে নিয়ে আমিও যাব। তার উপর তোর এই শরীর...” ওর কান্নার বেগ এবারে কমে গিয়ে ফিসফিসানিতে নেমে এসছে।
    “মালতী, মালতী! আমি মানুষটা এখনো মরি নি, না!”
    স্বামী ওকে এই প্রথমবারের মতো দিনের আলোয় মালতী বলে ডাকল। সে লজ্জাও পেল না , রাগও উঠল না। সে ভয়ে শিউরে উঠল। মালতী নামটি যেন ভর দুপুর বেলার চারপাশের রোদে ছড়িয়ে মিলেয়ে গেল। কাল যখন এক অচেনা বাড়িতে সে যাবে তখন কি পারবে আদরের এই ডাকটাকেও তল্পিতল্পার সঙ্গে করে বেঁধে নিয়ে যেতে?
    সে পলক না ফেলে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
    ~~~০০০~~~~
    টীকা:
    ১) নাহর: বাংলা অসমিয়া দুটো ভাষাতেই এর ত্‌ৎসম প্রতিশব্দ ‘নাগেশ্বর’। নাহর অসমিয়া তদ্ভব শব্দ। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক ভাবে জনপ্রিয় শব্দ। আদর্শ বাংলাতে তেমন কোনো স্বতন্ত্র জনপ্রিয় তদ্ভব শব্দ নেই এবং অসমের বাংলাতে শব্দটি প্রচলিত বলে আমরা মূল শব্দটিকে রেখে দেয়াই সমীচীন বোধ করলাম।
    ২) চড়াই, খিড়কি: শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ গামলা, জানালা। কিন্তু অসম তথা পূব বাংলার বাংলাতে শব্দগুলো বহুল প্রচলিত বলে আমরা এভাবেই রেখে দেয়াতে কোনো অসুবিধে দেখছি না। এমন পরে আরো যত শব্দ আসবে আমরা রেখে দেব এবং অ.বা.( অসমের বাংলা) বলে চিহ্নিত করব।
  • i | 124.171.42.168 | ২৩ অক্টোবর ২০১১ ১১:৩১495495
  • প্রথমে ভেবেছিলাম, উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা। এখন মনে হচ্ছে, সম্পূর্ণ উপন্যাসটির অনুবাদ করছেন সুশান্তবাবু। সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার তবে তো।
  • | 124.168.27.96 | ২১ নভেম্বর ২০১১ ১৭:১০495506
  • I | 14.99.127.73 | ২৬ নভেম্বর ২০১১ ২২:৪১495512
  • থেমে গেল কেন?
  • | 124.171.5.236 | ০৩ মার্চ ২০১২ ০৫:৪০495513
  • পাই | 82.83.79.41 | ১৯ জুলাই ২০১২ ১৯:০৮495514
  • সুশান্তদা, বাকিটা ?
  • সুশান্ত কর | 127.198.48.148 | ১৯ জুলাই ২০১২ ২১:১৪495515
  • আমি সুতোটা খোঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই দিতে পারছিলাম না। দিচ্ছি এখন।
  • সুশান্ত কর | 127.198.48.148 | ১৯ জুলাই ২০১২ ২১:১৫495516
  • অধ্যায় তিন (৩)

    মানুষটা অল্প বিছানাতে পড়েছে, গায়ে গা লাগিয়ে ছেলে মণি বাবার মাথার চুলগুলো বিলিয়ে দিচ্ছিল। মালতী হাতে একটা চিরুনি নিয়ে বাইরের উঠোনে গিয়ে মুড়ো একটা নিয়ে বসল। ঝলমল করে ফোটা লাল গোলাপ গাছে পড়ন্ত বেলার আলো এসে পড়াতে ফুলগুলোকে আরো বেশি লাল করে তুলেছে। সে চুল মেলে সেদিকে অল্প তাকিয়ে রইল। খুলে দেয়া চুলের গাছা মাটি ছুঁয়েছে। সে নারকেলের তেল অল্প হাতে ঢেলে নিল। চুলের গাছা সামনে টেনে নিয়ে এসে হাতের তালুতে অল্প অল্প করে মাখতে শুরু করল। মায়ের সোনাতে বাঁধানো শাঁখা ক’গাছার থেকে কিটিং কিটিং করে শব্দ একটা হচ্ছে। সে শাঁখাগুলো ছুঁয়ে দেখল। তার আজ মাকে ভীষণ মনে পড়ল। সব সময় যেমন ভাবে , আজো ভাবতে শুরু করল, তার মা না জানি কেমন ছিল ! কোনো যুক্তি নেই, শাঁখা ক’গাছার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই সে মনে মনে মায়ের একখানা ছবি আঁকবার চেষ্টা করল। মা ফরসা ছিল। চোখজোড়া ছোট ছোট । হাসলে প্রায় বুজে আসে। হাতপাগুলো ভরাট। কী পরিয়ে সে মায়ের ছবিখানা দেখে? শাঁখা ক’গাছাতে সে হাত বুলিয়ে দেখতে থাকে। একখানা লাল রঙের সোনালি পাড় দেয়া শাড়ি পরে হাসলে চোখ বুজে আসা এক মেয়েমানুষ তার সামনে এসে দাঁড়ান বটে। লাল শাড়িতে যেন তাঁকে কোথাও মানায় না। রোজকার মতো সে শেষ অব্দি লাল দখনা পরা এক মেয়ে মানুষকে দেখতে পায়। মানুষটির সারা গা লাল । তাতে হলদে সবুজে ফুলের কাজ করা এক হাত পাড়ের দখনাটিতেই যেন সবচে’ বেশি মানাবে। শাঁখার জোড়াগুলো সে সামান্য সময়ের জন্যে ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসে, মিহি নারকেল তেলের গন্ধ। এ যেন সে যে তেল মাখছে তার গন্ধ নয় । এ তার মায়ের গায়ের গন্ধ। কোনো যুক্তি নেই, কোনো কারণ নেই, সে শাঁখাগুলোতে মায়ের গন্ধ পায়। মশলা হলদি তেল, কাপড় ভেজাবার জন্যে করে রাখা সাবানের জল, উঠোন লেপার জন্যে নেয়া গোবরের জল, ধুয়ে থুয়ে রাখা মাছ, কাটা লাইশাক, বাটা সরিষা---হাতের শাঁখা ক’গাছাতে যা কিছুর গন্ধই লাগুক সে তাতেই মায়ের গন্ধটি খুঁজে পায় যেন। অযৌক্তিক , অকারণ। মায়ের কথা ভাবলেই তার বুকটা ভারি হয়ে আসে।
    গায়ে মৌজাদারের বংশের রক্ত থাকাটাই পাপ ছিল , সে কি আর নিজের অর্জিত পাপ? বাপ তারা গাছে ভরা ডোবাতে পড়ে থাকবার পর বাচ্চা মেয়েকে ঘরে রাখতে ভয় করত। বাপ মরার পর বাচ্চাটিকে বুঝি ধানের ডুলিতে পুরো সাতদিন সাতরাত ঢেকে রেখেছিল। রত্নমালাকে দেখে যেমন কিনারাম মাহুতের ডরভয় মিলিয়ে গেছিল, তার মাকে দেখেও ক্ষিতিশ কারিগরের তেমনি হয়েছিল। শিলিগুড়ি শহরের সাত জায়গাতে গুঁতো খেয়ে বড় হওয়া ছেলে, এমনিতেও ডর ভয় কম। । হাতের বিদ্যে আছে, যেখানে সেখানে ভাত একমুঠো জোগাড় করতে পারবে। এই ছোট্ট গাঁয়ে কম দিনে ওঁর ব্যবসা বেড়েছিল। হাতে সোনাতে বাঁধানো শাঁখা পরিয়ে , শিলিগুড়ির লাল বেনারসিতে সাজিয়ে, চিনির রসে রসগোল্লা দেয়ার মতো বড় আলতো করে মিঠাইর কারিগর যুতিমালাকে হাফ ওয়ালের ঘরটাতে এনে ঢুকিয়েছিল। গাঁয়ের লোকে প্রাণ জুড়িয়ে খেয়েছিল আমির্তি, মুখে দিলেই গলে যায় এমনটি ছানায় তৈরি আমির্তি । কিনারামেদের সমাজের সব নিয়মই সে মেনেছিল। মেয়ের বাড়ির নেমন্তন্ন খাওয়াবার সমস্ত খরচই সে দিয়েছিল। শিলিগুড়ির থেকে ক্ষিতিশের আত্মীয় পরিজন যারা এসেছিল তারা সবাই তার ব্যবসাপাতি, বাড়িঘর দেখে কপাল চাপড়েছিল। দেশবাড়ির মেয়ে বিয়ে করলে সে ঘড়ি সাইকেল, রেডিও ছেড়েও সোনা আর নগদ টাকাও পেত। এখন আর ঘরে কিসের দুটো পয়সা আসবে ? উলটে বরং গেল। বৌভাতের দিন শিলিগুড়ির থেকে মিঠাই কারিগরের ভাগ্নী ভাতিজী যারা এসছিল তারা যখন ময়ূরপঙ্খী রঙের বেনারসি পরিয়ে কনেকে বাহারী খোঁপা বেঁধে দিল, তাতে খৈয়ের মালা পরিয়ে কপালে লাল চন্দনের তিলকে সাজিয়ে দিল তখন তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল মিঠাই কারিগরের মনটি ঠিক কোথায় এক মুঠো মচমচে ভুজিয়ার মতো হয়ে পড়েছিল। হাতে নিয়ে একটু চেপে দিলেই বেশ সহজে ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়।
    সে মাটিতে নারকেল তেলের কৌটাটা রাখতে চাইল , পারল না। পেটটা অল্প নিচের দিকে নেমে গেছে। সামান্য একটু ব্যথা যেন এই এল, এই গেল। কোলের উপর তেলের বোতলটা রেখে সে পরম মমতায় শাঁখা ক’গাছা গালে লাগিয়ে বসে রইল। চারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। বাতাসে এমন কি চড় চড় করে কলাপাতাগুলোর নড়বার শব্দও শোনা যাচ্ছে । এ যেন কলাপাতার শব্দ নয়, কালবৈশাখীর বাপের বাড়ি যাবার পথে প্রমত্ত বাঁশঝাড়ের বুক কাঁপানো শব্দ এ। বাড়িগুলোতে তালা, প্রায় মানুষই চলে গেছে। অসমিয়া, বাঙ্গালি, বিহারি, বড়ো প্রায় সব বাড়িরই পুরুষ মানুষগুলো কোথাও থাকলেও পরিবারগুলো নেই। বাঙালিদের পুরুষমানুষেরাও নেই। মালতী পাশের শিবানীদের বাড়ির দিকে তাকালো। পথের মোড়ে ওদের ফার্মাসী রয়েছে, শিবানীর বাবা আর বড় দাদা আছে । বাকি পরিবারটি চলে গেছে। কোচ বিহারের মাসির বাড়ি গেছে। বাঁ পাশের সুভাষ মাস্টারের বাড়ির উঠোন এ সময়ে সাইকেলে ভরে থাকে। মাস্টার , “কী করছ হে লম্বোদর?” বলে ডাক একটা দিয়ে যায়। মণির বাবাও চেঁচিয়ে কখনো জিজ্ঞেস করে, “ ট্যুশন চলছে কি না?” আজ থমথমে নীরবতা। মাস্টারও নিজের পরিবারকে আলিপুরদোয়ারে পিসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামনের রতি সাহার বাড়িতে বুড়োবুড়ি দু’জন আছেন। ছেলে বৌরাও আছে। সমস্যা হয়েছে এই বুড়ো বুড়িকে নিয়ে। দু’জনেরই বাতের ব্যথা। দু’জনেই হাড় মাস এক করে , রক্ত জল করে বানানো ভিটে বাড়ি ছেড়ে যাবেন না । এমনিতেও মরবার বয়স হয়েছে। কেঊ মারলেও মরা, এমনিতেও মরা। পেছনটায় বীরেন বৈশ্যের বাড়ি, পাট মুগার কাপড়ের ব্যবসা করে। অবস্থা বেশি ভালো নয়, ছেলে মেয়েও পাঁচটা। প্রায়ই মানুষটি মণির বাবার কাছে এসে হাত পাতে। বহু বছরের পুরোনো মানুষ এরা। যদিও রতি সাহাদের মতো নয়। সাহারা ধান পাটের খেত খামারে, গুয়া তাম্বুলের গাছে, গরু গোয়ালে ভরা গৃহস্থ।
    কারো কাশির শব্দ শুনে সে মাথা তুলে তাকাল। মামণির বাবা ,মানে বীরেন বৈশ্য এসছেন। মানুষটা এসেই ওর শাঁখাগুলোর দিকে কটমট করে তাকালেন ।
    “তুই এখনো এগুলো খুলিস নি?”
    সে মাথা নত করে। কেউ বলল বলেই কি সে এগুলো খুলতে পারে? কেউ কি বুঝবে তার মায়ের গন্ধটার কথা?
    “মরবি! এই ক’টির জন্যেই মরবি! যখন আসবে হাতিতে গুঁড়িয়ে নিয়ে যাবার মতো নিয়ে যাবে।”
    “কী হলো?” মণির বাবা উঠে এসছে। মালতী চা করবার জন্যে উঠে গেল। ভেতর থেকে সে কান পেতে মণির আর মামণির বাবার কথা শুনে গেল। ওরা সেই একই কথা গুণগুণাচ্ছে। মামণির বাবা আবারো সেই একটা করে গামছা দুই ঘরে পতাকার মতো উড়িয়ে রাখার কথা বলছে। মণির বাবা মানা করছে, “ এতো দিন এক সঙ্গে থাকলাম । আজ খারাপ দিন এলো বলেই...।” মণির বাবার স্বর কান্নার মতো শোনাচ্ছে। সে মামণির বাবার হাতটা চেপে ধরেছে, “ওকে কী করে বাড়িতে নিয়ে যাই? পুল নেই, রাস্তার হাল এমনটা। ঠেলা ধাক্কার চোটে বেটা মানুষের শরীরেরই হাড়ে মাংসে এক হয়ে যায় আর ওকে এই শরীরে...।” মালতী চায়ের কাপগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কিছু পরোয়া করে না যে মানুষটা সেই সমর্থ মানুষটা আজ কেমন কেঁদে গলে যাচ্ছে। রতি সাহা এসছে , সঙ্গে সাহার মা। বুড়ি হাতে করে এক কাঁদি কলা নিয়ে এসছে। বুড়িকে দেখেই মালতী ‘দিদা’ বলে এগিয়ে গেল। বুড়ি ওকে ভীষণ আদর করে। বুড়ি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। তাঁর হাতে শুধু ছাল আর হাড়। ছাল ঝুলে পড়েছে। শাদা আঁকি বুঁকিতে ভরা ছালে কালো কালো ফুট ফুট দাগ পড়েছে। পাটি একটাতে বসে সে বুড়ির সঙ্গে কলকলিয়ে বাংলাতে কথা বলতে শুরু করেছে। সে বুড়ির সঙ্গে এমন করে বাংলাতে কথা বললে লম্বোদর বেশ আমোদ পেয়ে তাকিয়ে থাকে। সেও তার দরঙ্গীয় ধাঁচে দু’একটা বাঙলা বাক্য বলবার চেষ্টা করে। মেয়ে মানুষদুটিতে হেসে অস্থির হয়ে পড়ে। মালতী আজ বুড়িকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করছে। ষাট ইংরাজির গোলমালের সময় মা কেমন করে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে রতন ঘোষের আধপোড়া ভিটেতে মরে গেছিল। সে কথা আজ সে খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করল। বহুবার শুনেছে। কখনো বা বুড়ি তুলেছে, কখনো বা সে নিজে তুলেছে কথাটা লম্বোদর অল্প চুন নিতে এসে ওদের দু’জনএর দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না। আবারো মাথা নুইয়ে চলে গেল। মালতী বুড়ির কোঁচকানো মুখখানার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বলিরেখাতে ভরা একটি মুখ, মাথার চুল পুরো শাদা, ভুরু দু’টোও শাদা হয়ে গেছে। শাদা চুলের সিঁথিতে উজ্জ্বল লাল সিঁদুর, কপালে বিশাল বড় সিঁদুরের ফোঁটা। সমগ্র কান জুড়ে মিনা করা এক ময়ূর পাখি। লতিতে ঝুটির সঙ্গে মাথা আর কাণ জুড়ে পেখম তোলা লেজখানা। নাকে একটা ছোট্ট নাকফুল। বুড়ি কথা বলবার বেলা হাত নাড়িয়ে অংগী ভংগী করে কথা বলে। হাত নাড়ালে হাতের পলা আর শাঁখা ক’গাছার থেকে একটা শব্দ হয়। মালতী যেন এই রোদ পড়ে মাঝে মাঝে ঝিলমিলিয়ে ওঠা বুড়ির কানের পেখম তোলা ময়ূরটা, নড়ে ওঠা লালে শাদায় পলা আর শাঁখা ক’গাছা, কপালের সিঁদুরের ফোটার যাদুতে বাঁধা পড়েছে। সে সব ভুলে গেছে। গোলমাল , মণির বাবা, মণি এমন কি মাঝে মাঝেই ব্যাথায় রাইজাই করা নিজের শরীরটিকেও। ময়ূরটি, শাঁখার জোড়া , ফোঁটাটা নাড়া চাড়া করছে। তেরই মাঝে মাঝে তার মা তার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে।
    বুড়ির শাঁখাজোড়াগুলো একবার নিচে নামছে আরেকবার উপরে উঠছে, মাঝে মাঝে ডানে বাঁয়ে দুলছে।... গ্রামখানার থকে শহরে ফুটবল খেলবে বলে বাসে করে দলটিকে নিয়ে যাচ্ছিল সুভাষ মাষ্টার। বাসে রোজ যেমন উঠে তেমনি মানুষ উঠেছিল। সেই ছেলেগুলোও কোনো একটাতে উঠেছিল। হঠাৎই মাষ্টার দেখল কোথাও যেন শব্দ একটা হয়েছে। না হবার মতো কিছু একটা হয়েছে। তাঁর কানে এসে পড়ল গোটা কয় শব্দ, ‘ এক পিস করেও ভাগে পড়বে না।” শব্দ নয় , যেন গলানো সিসে। মাষ্টার তৎক্ষণাৎ বাসটা থামিয়ে নিজের ছাত্রদের থেকে চারটাকে নামিয়ে দিলে। “ভাগে এক পিস করেও” না পড়ার কথা যারা সরবে বলছিল তারা হায়ার করা প্লেয়ার। মাষ্টার নিজের গাঁয়ের থেকে নিয়ে আসা নিজের ছাত্র ক’টিকে নামিয়ে দিয়ে ভাবল তাঁর নিজের শরীরটা বা ভাগে ক’ পিস করে পড়বে? ছেলেগুলো গ্রামে ফিরে গেল। ভাষা আন্দোলনের গরম বাতাসের সামনে ফুলকী পড়ল, চারদিকে ধোঁয়া দেখা দিতে শুরু করল। বাসের থেকে নামিয়ে দেয়া গাঁয়ের ছেলেরা বেশ করে পাথর লাঠি নিয়ে টাউনে যাবে বলে বেরুল। ‘ভাগে এক পিস করেও পড়বে না’ বলে আশংকা করেছিল যারা সেই ‘হায়ার করা প্লেয়ার’ , অচেনা ছেলেদের দলও এগিয়ে গেল। বেলা চারটার থেকে হাতাহাতি, মারামারি, পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি। চারদিকে ঢিল ছুটে আসবার মতো গুজব রটল। হায়ার করা প্লেয়ারের দলটি রাতে ট্রাকে উঠে আসা বন্দুকধারীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এক ধার থেকে গাঁয়ের পর গাঁ জ্বলল।
    বুড়ির চোখের জল কপালের ফোঁটার আকৃতি পাল্টে দিয়েছে...মালতীর মায়ের মালতীর মতো অবস্থা তখন। পেট নামছে। জলও ভাঙছে। গ্রামের লোক গাঁওবুড়া হরেন দাসের বিশাল মরাপাটের খেতের মাঝে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে বসেছে। গাঁওবুড়া থেকে শুরু করে গাঁয়ের মাতব্বর লোকেরা ট্রাকে উঠে আসা মানুষের দলটিকে পাটখেতের মাঝে লুকোনো মানুষগুলো নামগন্ধ পেতে দেন নি। ওঁরা চিঁড়া মুড়ি, নারকেল যা পারেন লুকিয়ে লুকিয়ে এই লুকোনো মানুষগুলোকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। এমন কি পুকুরে বাসন কোশন ফেলে রাখতে, পাট খেতে ট্রাঙ্ক লুকোতে সাহায্য করেছেন। ‘হায়ার করা প্লেয়ার’গুলো বাড়তে বাড়তে তিন চার ট্রাক হয়ে গেছে, হাতে হাতে লাঠি, বল্লম, পেট্রল , কেরোসিন। গাঁওবুড়া, শইকিয়া, বরা, হাজরিকারা কাঁপতে কাঁপতে দেখছেন চতুর্দিকে আগুন। এ আগুন পাটখেতের ভেতর থেকেও মানুষগুলো দেখছে। সেখানে এই বুড়িও ছিল। আগুনে লাল করে ফেলা আকাশের দিকে বুড়ি তাকিয়ে ছিল।
    এবারে নাকের জলে নাকফুলটাও ভিজে গেছে...মালতীর মায়ের থেকে থেকে ব্যথা উঠছিল।তাকে বিছানার নীচে রেখে ক্ষিতিশ কারিগর একটু বাইরে গেছিল পরিস্থিতি দেখবে বলে। সঙ্গে সম্পর্কিত ভাই রতন। দু’জনেই দেখেছিল এক লরী বন্দুকধারী মুখ বাঁধা মানুষ, হাতে হাতে অস্ত্র। রতন ঝোপ জঙ্গলের মধ্যি দিয়ে পাট ক্ষেতের মাঝের জায়গা করে বসা মানুষগুলোর কাছে গিয়ে পৌঁছুলো। লরী আসবার খবর পেয়ে পাট খেতে না আসতে পেরে কেউ বা উপরে আগাছা আবর্জনা দিয়ে গর্তের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে, কেউ বা জঙ্গলে লুকিয়েছে। শুধু লুকোবার চেষ্টা করেনি ক্ষিতিশ। সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। বাড়িতে যে মেয়ে মানুষটি কোঁকাচ্ছে তার কী করে সে? এক বালতি জল তুলতে না দিয়ে , ভালোর থেকে ভালোটা এনে খেতে দিয়ে রেখেছে যাকে সেই ঘরের মেয়ে মানুষটি কোঁকাচ্ছে। দরকারের সময় লাগবে বলে টাকা পয়সা কিছু গুটিয়ে রেখেছিল। এখন সে পয়সাতে কী করে? সে হনহন করে রাস্তা দিয়ে হাঁটা দিল। কিছু একটা করতেই হবে। সেই তাকে শেষ দেখা গেছে। কেঊ জানতে পেল না তার কী হলো। ঘরে যে মেয়ে মানুষটি কোঁকাচ্ছিল সে ছ্যাঁছড়ে ছ্যাঁছড়ে রতনের বাড়ি অব্দি এসছিল।
    বুড়ির মুখের ভাঁজ আরো আঁকা বাঁকা হয়েছে। মালতী প্রায়ই যেমন শুনতে পায়, তেমনি জলে একটা ঝপাং করে শব্দ শুনতে পেল।মায়ের কথা উঠলেই সে শেষে ওই শব্দটি শুনতে পায়। হাতের শাঁখা ক’গাছা গালে লাগিয়ে সে বসে রইল। ওর শরীরটা যেন কেমন করেছে। কেঊ ওকে ডাক একটা দিয়ে গেল। গাঁ ছেড়ে যাওয়ার পথে কেউ হবে বুঝি বা। মাকে ডেকে নিয়ে যেতে বুড়ির ছেলে এলো। বুড়ির ছেলের থেকেই জানতে পেল পাটখেতের মাঝে জায়গা করা হয়েছে। নারকেল চিঁড়া মুড়ি গোটানো হয়েছে। জায়গায় জায়গায় গর্ত করে আগাছা আবর্জনাতে ঢেকে রাখা হয়েছে। গেলবারের গণ্ডগোলের সময় বহু মানুষ এই গর্তে ঢুকেই প্রাণ বাঁচিয়েছিল। মানুষগুলো বারে বারে গেলবারের গণ্ডগোলের কথা পাড়ছে।
    আগুন দেয়া দলটি রাতে আগুন দিয়ে সকাল থেকে আর আসে নি। হাতে বন্দুক এক দু’টোই ছিল পুকুরের বাসনপত্র, ঝোপঝাড়ে রাখা বাক্সপত্রে হাত দেয় নি। পাটখেতের ভেতরের মানুষগুলো কিছু রাত থাকতেই বেরিয়ে বাড়ি ঘরে ফিরে এসছিল। আগুন নিভিয়েছিল। পুকুর থেকে বাসনপত্র তুলেছিল। ঘুরে ঘুরে মিঠাই কারিগরের কথা উঠছিল। কেউ একজন ক্ষিতিশ নিখোঁজ হবার পরদিন কুকুরে টানাটানি করে শতচ্ছিন্ন করা রক্তমাখা সার্ট একখানার কথা বলছে।
    বড় চাপা গলাতে বলাবলি হচ্ছিল এ গাঁয়ে ওরা আসবেই । এখানেই বিয়ে হয়েছিল রত্নমালার মেয়ে যুতিমালার। যুতিমালা এখানেই মিঠাইর কারিগরের গৃহিণী হয়েছিল। এখানেই আছে যুতিমালার মেয়ে। মৌজাদারের বাড়ির একটি ছেলে আন্দোলনের বড় লীডার। গুয়াহাটির থেকে সমস্ত নেতাগুলো এলে ওখানে থাকে। বহু কথা উঠছে। গেলবারের গন্ডগোলের বেলা লোকগুলোর হাতে যে বন্দুক ছিল সে বুঝি ঐ মৌজাদারেরই বাড়ির বন্দুক। প্রথম রাতে এ গাঁয়ে এ জন্যেই আক্রমণ হয়নি যে বন্দুকটি অন্য গাঁয়ে গেছিল। মিঠাই কারিগরকে বুঝি পেছন থেকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে গুলি করেছিল। অনেক কথা উঠছে, আগা নেই গোড়া নেই, জাতে জাতে কথা। ঘুরে ঘুরে কথাগুলো এসে ঐ এক জায়গাতেই জড়ো হয়। এবারে আর বন্দুক একটা নয়, হাতে হাতে বন্দুক। মৌজাদারের বাড়ির নেতাটি বুঝি এবারে এই গ্রামখানা উপড়ে ফেলে তবে ছাড়বে। গুয়াহাটির দু’জন বড় লীডার এসে শহরের হাইস্কুলের ফিল্ডে সভা করে গেছে বুঝি। সভাতে অসমিয়া মানুষকে ওরা দয়া মায়া, আদর স্নেহ ইত্যাদি ভুলে যেতে বলে গেছে। বলে গেছে মানবতা, মানুষ এই শব্দগুলো ভুলে নিজেদের কঠিন করে তুলতে। কেউ একজন গুয়াহাটির নেতা বুঝি মৌজাদারের বাড়িতেই আছে। ওর হাতে বুঝি এমন বন্দুক রয়েছে যেটি ঘুরালেই পাখি মারবার মতো মানুষ মারে। একই ধরণের কথাগুলোকে ফেনানো হচ্ছে । শোনা কথাটাকে বলছে নিজের চোখে দেখা, চোখে দেখা কথাটাকে বলছে নিজেরই কথা। মাথা মুণ্ডু নেই, দাড়ি কমা নেই, লম্বা লম্বা ভাষণ।
    সবাই লম্বোদরের উঠোনের থেকে দেখতে পেল গাঁওবুড়া পরিবার নিয়ে, জিনিসপত্র সহ যাবার জন্যে বেরিয়েছেন। সবাই উঠে রাস্তা অব্দি গেল। সবারই গলা শুকিয়ে গেছে। নিজের পাটখেতে যিনি সবাইকে জায়গা করে দিয়ে আশ্রয় দেন, যিনি লরীতে আসা লোকগুলোর একা একা মুখোমুখি হন , ঘর বাড়ি পোড়া মানুষগুলোকে নিজের বাঁশঝাড়ের থেকে বাঁশ দিয়ে যিনি অভয় দেন সেই মানুষটি আজ পরিবার নিয়ে যাবার জন্যে বেরিয়েছেন! লম্বোদরদের মুখে রা নেই। তাঁর মুখখানা ভয় আর আতংকে শাদা হয়ে গেছে। লম্বোদরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ আগুনে যখন পোড়ায় লাকড়ি , বাঁশ, খের কিচ্ছু মানে না। হাভাতে মানুষ হয়ে আগুনের সঙ্গে কী যুদ্ধ করবি?” বৃদ্ধ মানুষটির স্বরটা বসে গেছে , “ এ আগুন কারো ভালোর জন্যে জ্বলে নি । কোনো সাধারণ মানুষের সাধ্য নেই একে বাধা দেয়, সব্বাইকে পুড়িয়ে ছাই করবে।” এবারে বৃদ্ধ লাঠিটা ধরে বসে পড়লেন, “ আমার কুকুরটা কোনো কাজের নয়, শুধু পড়ে পড়ে খায়। ওর উপরেই পিতৃপুরুষের ভিটেমাটির ভার দিয়ে যাবার জন্যে বেরিয়েছি। বুড়ো বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছেন,“ যমে মানুষে টানাটানির দিনে আর পাপ বাড়াব না।”
    দৃঢ়চেতা মানুষটার পা ফেলতে গিয়ে কাঁপতে দেখে সব্বাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। নিমেষে সিদ্ধান্ত হলো কাল ভোরেই সবাই এই গ্রাম ছাড়বে। নেবে, মালতীকে পাঁজাকোলা করে হলেও নিয়ে যাবে। আজ রাত্রিটা শুধু পার হোক।
  • সুশান্ত কর | 127.198.48.148 | ১৯ জুলাই ২০১২ ২১:১৫495474
  • অধ্যায় চার (৪)
    মশারিটা ভালো করে চারদিকে গুঁজে মালতী মণিকে শুইয়ে দিল। বাবা এসে তার কপালে হাত বুলিয়ে দিল। হাতে লাঠি আর টর্চটা নিয়ে সে যাবার বেরুলো। কিছু একটা ভেবে সে আবারো দোয়ারমুখে ফিরে এলো। সে হাতের লাঠিখানা দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে রাখল। বৌএর ভারি দেহটা আলতো করে জড়িয়ে ধরে । স্বর কোমল করে বলল, “ মালতী, মালতী আমার, তুই এমন মন খারাপ করে থাকবি না। আমি মানুষটা আছি না, বুঝি? আর মাত্র একটা রাত, কাল আমরা বাড়ি যাব,...।” সে বাড়ির কথা কিছু বলতে চাইছিল, পারে নি। সে খানিকখন মালতীর মুখখানাতে হাত বুলিয়ে গেল। বাইরে কেউ ডাকছে। পাহারাতে এসছে, এমন কেউ হবে। সে মালতীকে ছেড়ে দিল, “ যা শুয়ে থাক গিয়ে। আমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাব। তোকে কাঁচা ঘুম থেকে উঠতে হবে না।সে একবার মালতীর হাতের শাঁখাজোড়া ছুঁয়ে কিছু বলতে চাইল, বলল না। মালতী মণির কাছে শুয়ে পড়ল। মুখখানাতে লেগে রইল এক পুরুষ হাতের স্পর্শ। মানুষটি তাকে শুধু কিছু সাহস দিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। এক গভীর প্রশান্তিতে তার উত্তেজিত স্নায়ু ক্রমে ক্রমে শীতল হয়ে এলো। সে ঘুমিয়ে গেল।
    সে একটা স্বপ্ন দেখছিল, তার কোনো আগাগোড়া নেই। দমবাঁধা ছাইয়ের উপর একটা কুকুর গোল হয়ে শুয়ে আছে...কুকুরটার কাছে একটা শিশু, ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে । তার পরেই সে ঝপাং করে একটা শব্দ শুনল। জলে পাথর ছুঁড়ে মারলে যেমন শব্দ করে তেমনি। শব্দটি বেড়েই যাচ্ছিল। বেড়ে বেড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল, এক সময় যেন কানে তালা দেবার মতো অবস্থা হলো। তার ঘুম ভেঙ্গে গেল, মণিও জেগে গেছে। চারদিকে আশ্চর্য সব শব্দ।মণি তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল, সেও তাকে জড়িয়ে ধরল। শব্দটা সে এবারে চিনতে পেল। নাগরা আর শঙ্খ। মণি তাকে জিজ্ঞেস করল, মা কার ঘরে কীর্তন হচ্ছে ? সে কিছু একটা জবাব দিতে গেছিল, কিন্তু পারল না। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চেপে আসা গলাতে সে সামান্য থুথুও গিলতে পারছে না এমন অবস্থা হলো। নাগরা আর শঙ্খের আওয়াজ বন্ধ হয়েছে। এবারে মরণ কান্না। কিছু আতশবাজি , আতশবাজি ঠিক নয়, তার থেকেও জোর শব্দ শোনা গেল। নাকে খারের মতো একটা গন্ধ এসে লাগল। সে উঠে মণিকে ধরে ধরে দরজার কাছে গেল। বাইরে থেকে বন্ধ। মণির বাবা বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছে। মানুষটা চাইছিল না তাকে মাঝরাতে কাঁচাঘুম থেকে ওঠাতে। সে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল বাইরে চারদিকে লাল আলো। এবারে সে পেছনের দরজাটা খুলল। বেরিয়ে যাবে না, ভেতরে থাকবে? একটার পর একটা ঘর আগুনে ছেয়ে ফেলছে। হুইশেলের মতো তীক্ষ্ণ একটা শব্দ তার কানে এলো। সে মণির মুখখানা চেপে ধরল।তারপর তাকে নিয়ে বাড়ির কোনের পুকুরটাতে নেমে গেল। পুকুর মানে একটা বেশ গভীর বড়সড় গর্ত। মানুষটার বড় শখ ছিল বাড়ির কোণাতে একটা পুকুর খুঁড়ে তাতে মাছ পোষবার। মালতী যে বাড়িতে গিয়ে এখনো পা দেয় নি সেখানে বুঝি দু’দুটো পুকুর। ওদের গ্রামটিতে বুঝি সব বাড়িতে একটা পুকুর রয়েইছে। কিন্তু পুকুরে সে মাছ ফেলতে পারল না। এখানকার নদীটার জন্যেই বুঝি লোকে পুকুর খুঁড়তে পারেনা, নদী সব জল টেনে নিয়ে যায়। কেউ শখ করে খুঁড়লেও ভরা বর্ষার ভারি বৃষ্টির পরেও জল ধরে রাখতে পারে না। জল জমাতো হয়। কিন্তু অল্প রোদেই শুকিয়ে যায়। পুকুরের জন্যে খোঁড়া গর্তগুলো আবর্জনা ফেলবার জায়গা হয়ে পড়ে। লম্বোদরের খুঁড়া পুকুরও আবর্জনা ফেলবার গর্ত হয়ে রইল।আবর্জনা ফেলবার গর্তটিতে রি রি করা মশা আর আবর্জনার দুর্গন্ধের মধ্যে সে মণিকে নিয়ে বসে রইল। দিন দু’এক আগে বাড়ির কলাগাছ কতকগুলো পরিষ্কার করেছিল । সমস্ত শুকনো কলাপাতা এনে এই গর্তটিতে ফেলেছিল। দশ বারো কলা গাছ মাছেলেকে ঢেকে ফেলবার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
    একদল মানুষের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, সঙ্গে একটা জীপগাড়ির চেনা শব্দ। অল্প দিন থেকে এধরণের জীপ গাড়ি ওদের গাঁয়ে ঘন ঘন আসা যাওয়া করতে শুরু করেছিল। কেটে ফেলা মালভোগ কলাগাছগুলোতে কেঁচো জন্মাতে শুরু করেছে। সেই গাছগুলোতে পা দিয়েই পাতার ফাঁকে সে মাথাটা অল্প তুলে বাইরে তাকাল।আগুনের আলোয় পুরো জায়গাটা আলোময় হয়ে পড়েছে। সে দেখতে পেল দু’টো মানুষ দৌড়ে দৌড়ে এসে ঘরটিটে ঢুকেছে। বুঝতে পেল শিবানীর দাদু আর...। সে ভালো করে তাকালো শিবানীর বাবা। মানুষটা খোঁড়াচ্ছে। এবারে মানুষটা পেছনের দরজাটা খুলছেন। মানুষদু’টোর পেছনে আরো বেশকিছু মানুষ। সম্পূর্ণ অচেনা পোষাক, চেহেরা এমনকি হাঁটার ধরণ। লোকগুলো ঘরটাকে ঘিরে ফেলেছে। ঐ ঐ ওরা ঘরের দরজাগুলো বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। করছে কী ডাকাতগুলো? মালতীর নাকে পেট্রল আর কেরোসিনের গন্ধ এসে লাগল। চোখের সামনে ওর ঘর দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করল। ভেতর থেকে দুটো মানুষের চীৎকার। সে মণিকে কলাপাতার ভেতরে আরো বেশি করে ঢুকিয়ে দিল। সে খামচে ধরে রেখেছে ভাঙ্গা দা খানা। কোনো এক মহিলা রাস্তা দিয়ে দৌড়ে গেছে ... ঐ ধুম করে শব্দ একটা হয়েছে...ওই মানুষটি গড়িয়ে পড়েছে...লোকগুলো ওকে ঘিরে ফেলেছে... আধমরা মেয়েমানুষটিকে টুকরো টুকরো করে কাটছে...কোলের শিশুটিকে ঐ পোড়া ঘরটাতে ছুঁড়ে ফেলেছে। নাগরা বাজছে, শঙ্খ বাজছে। ওর পেটেরটি কাত ফিরছে। একহাতে মণিকে ধরে সে নুয়ে নুয়ে কলাপাতার মাঝে আরো ঢুকে গেল। তার পায়ে লাগছে পঁচা আবর্জনার ঠাণ্ডা ছোঁয়া। হুঁইসেল বাজছে, লোকগুলো ওদিকে গেছে। একদল লোক পুকুরগুলোর থেকে বাসন বর্তনগুলো বের করে এক জায়গায় জমা করছে। অন্যেরা টেনেটুনে বাক্সটাক্সগুলো লরীতে তুলছে। সে আগুনের আলোতে স্পষ্ট দেখল ক’জন হাতে বর্শা বল্লম, চোখা চোখা ত্রিশূল নিয়ে আবর্জনাতে ভরা গর্তগুলো খুঁচিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন মালতী যে পুকুরে লুকিয়ে ছিল, তার পাড়ে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে আদেশ দিয়ে বলল, “ গেলবারে এই রক্তচোষাগুলো গর্তে লুকিয়ে বেঁচে গেছিল। একটা গর্তও ছেড়ে দিবি না।যেখানেই বেশি গর্ত দেখবি খুঁচিয়ে যাবি।” বড় করে হৈ...ঐ...ঐ...আওয়াজ তুলে ছেলেটি চলে গেল। বর্শা বল্লম ত্রিশূল হাতে ছেলেগুলো শুকনো পুকুরেরে কাছে কাছে চলে এসছে। ওদের বর্শা বল্লম ত্রিশূল শুকনো কলাপাতাতে লেগে খসখস করে যাচ্ছে। কলাপাতার ডাটার স্তুপ পুরো একটা মানুষের সমান হয়ে পড়াতে মালতী আর মণির মাথার উপর উঠে গেছে। তাতেই ওরা বর্শা বল্লম আর ত্রিশূলগুলোর খোঁচার থেকে আত্মরক্ষা করতে পারছে। যদি কেউ একজন চেঁচিয়ে বলে, “দে জ্বালিয়ে এই পুকুরেরে শুকনো কলাপাতাগুলো!” যদি কেউ পোড়া ঘরেরে থেকে নিয়ে আসে একটুকরো জ্বলা কাঠ, একটুকরো অঙ্গার ! মালতী মণিকে আরো জড়িয়ে ধরে। মণির গায়ে কুঞ্জলিকা২ লেগে লেপটে আছে। কলার খোসাগুলো অল্প খচমচ করে উঠেছে। দলটির থেকে একটা ছেলে ফিরে এসে হাতের ত্রিশূলটা দিয়ে কলার পাতাগুলোকে খুঁচিয়ে দেয়াতে আরো একবার কিছুক্ষণ খসখসে শব্দ একটা হলো।মালতী শ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। একটা আগুনের ফুলকীও যদি ওরা এনে এখানে ফেলে দেয়! সে মণির মুখটা বুকে চেপে ধরল। ফাল্গুন মাসের বাতাস সোঁ সোঁ করে বইছে, সঙ্গে করে বেড়ে যাচ্ছে আগুন। দলটি চলে গেছে। ওর কানে আর কোনো শব্দ আসছে না।হঠাৎ সে অনুভব করল এক উত্তাপ, কানে পড়ল ফট ফট করে একটা শব্দ। আগুন লেগেছে। শুকনো কলাপাতাগুলোতে আগুন লেগেছে। সে মণির হাতে ধরে পুকুরটা থেকে উঠে এলো। পাড় ভেঙ্গে উঠতে ওর বেশ কষ্ট হলো। মণির হাতে ধরে সে পাড়ে উঠল । মণির দিকে তাকালো সে। ওর মুখে, গায়ে পঁচা আবর্জনা। সে একবার হেলেদুলে জ্বলন্ত ঘরটার দিকে যেতে চাইল। মণি ওর হাত ধরে টান দিল। আবার নাগরার শব্দ, হৈ হোল্লোড়ের শব্দ। দুজনেই বাড়ির পাশের ছোট খালে নেমে গেল। কেউ মাথা নুইয়ে যেতে থাকলে দেখা যায় না, লুকোনো যায়। বর্ষাতে এই খালে জল থাকে, শীতে শুকিয়ে যায়। শুকোলেও জায়গায় জায়গায় বালি পাথরগুলো ভিজে থাকে। মায়ে ছেলেতে নুইয়ে নুইয়ে এই খাল দিয়ে এগুতে থাকল। মালতী যেতে পারছিল না। নোয়ালেই ওর শরীরটা যেন ভেঙ্গে ছিঁড়ে যায়। এবারে সে হামাগুড়ি দিতে শুরু করল। মণি ফিসফিসিয়ে বলল, “ মা,কলাপাতাগুলোতে আগুন...!” খালের পারে পাড়ে মানুষের পায়ের শব্দ, বর্শা বল্লমের ঝনঝনাঝন শব্দ। মায়ে ছেলেতে দু’জনেই বসে পড়ল। লোকগুলো চলে গেল। এই খালটা দিয়ে যেতে থাকলে মরা পাটের খেত পাওয়া যাবে। সেখানে পাটখেত ভেঙ্গে গাঁয়ের লোকে আড়াল তৈরি করে লুকিয়ে আছে। নারকেল, চিঁড়ামুড়ি গুটিয়ে রেখেছে। আর গুটিয়ে রাখা আছে তির ধনুক, টর্চ লাইট। গেলবারের গোলমালে ওখানে লুকিয়েই মানুষগুলো রক্ষা পেয়েছিল। বিঘার পর বিঘা ছড়িয়ে আছে ঘন সবুজ পাটখেতের মাঝে লুকিয়ে আছে একদল ভয়ার্ত মানুষ। সে আরেকটু জোরে হামাগুড়ি দিতে আরম্ভ করল। খালটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে প্রচুর জমা পঁচা জল। উপরে কচুরি পানাতে একটা ঘন স্তর পড়েছে। এই খালটা পার হতেই আরম্ভ হয়েছে বিশাল মরাপাটের খেত। এখানে খালটিটে বেশ জল রয়েছে। কাদাতে হামাগুড়ি দিয়ে মালতীর কাপড়চোপড় জবজবে হয়ে গেছে। ঠিক যেন সারা গায়ে কাদা মাখা মহিষ একটি, এমন দেখাচ্ছিল ওকে। সে মণির হাতে ধরে খাল থেকে উঠতে যেয়েও আবারো নেমে এলো। ট্রাক একটিতে একদল মানুষ। পেছনে আরো অনেক দল। তারই দু’একটা এসে এই খালের থেকে অল্প দূরে দাঁড়ালো। শঙ্খ বাজল, বাজল নাগরা । শেষটাতে বাজল এক তীক্ষ্ণ হুইশেলের শব্দ। মায়ছেলেতে আবারো ওই পঁচা খালটিতে নেমে কচুরিপানার নিচে গা ঢাকা দিল। চতুর্দিকে শোনা গেল হৈ হৈ হোল্লোড়। তারপর সৈনিকের মতো নানা দলে ভাগ হয়ে গিয়ে লোকগুলো পাটখেতের ভেতরে ঢুকে গেল। অল্প পরেই শোনা গেল বন্দুকের শব্দ, মানুষের আর্ত চীৎকার। কচুরিপানাতে ঢাকা পঁচা খালটার উপর দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে আগুনের হলকা। পাট খেতের ভেতর থেকে উড়ে আসছে তির। সামান্য পরে শোনা গেল বন্দুকের, কিন্তু আলাদা ধরণের, শব্দ। এক একতা করে নয়, একাধারে অনেকগুলো গুলি চলবার মতো এক সমগ্র শব্দ। শব্দটি পাটখেতের ভেতরে চলে গেছে। ভেতরের মানুষের চীৎকার চেঁচামেচিও কমে গেছে। একাধারে হওয়া বুকে কাঁপন তোলা শব্দটিও মিলিয়ে গেছে। সে দেখতে পেল আকাশে অল্প অল্প আলো দেখা দিতে শুরু করেছে।
    সে আকাশের অল্প আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেল মোটা লম্বাটে মানুষ পাটখেতের ভেতর থেকে দৌড়ে আসছে। পেছনে পেছনে পাটখেতের আড়ালে লুকোনো মানুষগুলোর আরো জনা দুই। কেউ একজন একতা জাল ফেলে দিল মানুষটার উপর। মানুষটা তার ছাই রঙের বন্দুকটা সহ গড়িয়ে ঐ জালে বাঁধা পড়ে গেল । লোকগুলো তির,লাঠি, বাঁশের বল্লম যাতে পারে প্রবল আক্রোশে মানুষটাকে খোঁচাতে শুরু করল। চতুর্দিকে ফিনকী দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়ল। তারপর আবারো সব নিঃশব্দ।
    সে মণিকে ধরে কচুরিপানার থেকে বেরিয়ে এল। আকাশে আলো ফুটেছে। আলোতে সে দেখল এক ঝাঁক হাতীতে যেন সবুজ পাটের খেতখানাকে পিষে চলে গেছে। চতুর্দিকে মরা মানুষ আর রক্তের দাগ। সে মণির দিকে তাকালো। জলে ভিজে ভিজে গায়ের চামড়াগুলো কুঁচকে গেছে। গায়ে মুখে অনেকগুলো জোঁক। একটা ছাড়াতে গিয়ে রক্তের এক ছোট দলা ওর হাতে লাগল। মণির বাবা? লোকটা কোথায় গেল? কৈ গেল মানুষটা! “তোকে কাঁচা ঘুম থেকে উঠতে হবে না...” বলে মানুষটা গেল কোথায় ? পাটখেতের মাঝে মাঝে যে মানুষগুলো পড়ে আছে তাদের মধ্যে...। সে হঠাৎ যেন চোখে ধোঁয়াসা দেখতে পেল, পড়ে গেল। পড়ে যাবার আগে সে দেখতে পেল কতকগুলো লোক ওর দিকে দৌড়ে আসছে। ধীরে ধীরে ওর চোখে নেমে এলো একখানা কালো চাদর। চাদরখানা কাঁপতে কাপতে একসময় থেমে স্থির হয়ে গেল।

    টীকাঃ
    ১)কল-ঠরুয়া ( কলঠৰুৱা) রয়েছে মূল শব্দটি। এতে কলাগাছের খোসা না কলার পাতা বোঝায় নি:সন্দেহ নই। খোঁজছি। ‘শব্দে’ও জিজ্ঞেস করেছি। পেলে পালটে দেব বা রেখে দেব।
    ২) প্রকৃত বাংলা শব্দটি খুঁজছি। কাছাড়ে আমরা বাংলাতে ‘কুমজেলেকুৱা’কে তাই বলি। অথবা ‘কেঞ্জেলুকা’।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৩৯495475
  • অধ্যায় পাঁচ (৫)

    সে চোখ খুলে মণির উদ্বেগ ভরা মুখখানা দেখতে পেল। দেখাচ্ছিল বসন্ত রোগীর মতো। পুরো মুখে ঘা। সে তাকে ডাকতে চাইল , ‘মণি’। পারল না। আসলে সে তাকে ওর বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল। পারল না। স্বরটা যেন কেমন গলাতে লেগে ধরেছে। এবারে কাত হয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকালো। গাঁয়ের মুখ, চেনা লোক। বাঁচবে বলে পাটের খেতে জায়গা করে যারা বসেছিল, তাদের থেকে সত্যি সত্যি দু’একজন বেঁচে গেছিল। তারাও রয়েছে। সে বসবার চেষ্টা করল। কোথায় আছে সে? চারদিকে হালকা ঝোপঝাড়। ধরতে পারল চা বাগানের কাছে এসে পড়েছে সে। কিন্তু ওকে এতো দূরে কে নিয়ে এলো? তার চোখের সামনে একখানা কালো চাদরকে কেঁপে কেঁপে স্থির হয়ে যেতে দেখেছিল। দেখেছিল জালে বাঁধা পড়া মানুষটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবার দৃশ্য। ফিনকি দিয়ে বেরিয়েছিল রক্ত। সে জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কোথায়, কী ভাবে , কেন ? দুপুরের গা পোড়া রোদ। মণি একখানা কচু পাতাতে করে অল্প জল নিয়ে এলো। সেই জলে সে অল্প তেষ্টা মেটালো, অল্প চোখে মুখে দিয়ে ঝরঝরে হয়ে উঠল। একটা লোক দৌড়ে দৌড়ে সেখানে এসে পৌঁছুলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, কেঁদে কেঁদে, থেমে থেমে, আটকে আটকে যতদূর সে উচ্চারণ করতে পারল তার থেকে মালতী বুঝতে পারল তাদের গাঁয়ে একটাও বাড়ি টিকে নেই, একটা মানুষ বেঁচে নেই। জালে বাঁধা পড়ে পাটখেতের মধ্যে যে লাশটা পড়ে রয়েছিল সেটি নিয়ে যেতে শহর থেকে একদল মানুষ এসেছে। সঙ্গে বন্দুক, নানা রকমের অস্ত্র। লোকগুলো তৈরি হয়ে এসেছে। গ্রামে সেই সকাল দশটা থেকে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেছে। সে আর বেশি কথা বলতে পারল না, হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল।
    একজন কেউ বেশ কষ্ট করে জিজ্ঞেস করল, “ পুলিশ মিলিটারি?”
    কান্না বন্ধ করে মানুষটা জোরে জোরে মাথা নাড়ালো। তোতলাতে তোতলাতে বলবার চেষ্টা করল, শহর থেকে বড় নেতা এসেছে। রাগে সব ক’টা জ্বলছে। ছাগলও একটাও বেঁচে নেই।
    লোকগুলো উঠে দাঁড়ালো। মালতী জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাব? কেউ একজন মুখে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলতে মানা করল। যে লোকটা গাঁয়ের খবর এনেছিল সে তার দিকে তাকিয়ে শুধু একটাই শব্দ উচ্চারণ করল , ‘ইস্টেশন’ ।
    বাগান হয়ে স্টেশনে যাবার ছোট রাস্তাটা মালতী চেনে। সে মানুষগুলোর পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করল। পেটের বাড়ন্ত অংশটিতে হাত দিল। হঠাৎই ওর খেয়াল হলো পেটেরটি অনেক ক্ষণ নাড়াচাড়া করেনি। মণির মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বুকখানা ধড়ফড় করে উঠল। দুটো প্রাণীকে উপোস রাখতে হচ্ছে । একটা সরকারী টিউব কলের কাছে গিয়ে সবাই দাঁড়ালো। দু’হাতের আঁজলা ভরে জল খেল। এখানেই সরু রাস্তাটা এসে পাথুরে মূল রাস্তাটিতে উঠেছে। এরকম বিকেলে রাস্তাটা লোকজনের ভিড়ে গমগম করতে থাকে, আজ জনশূন্য। দোকান টোকান সব বন্ধ। পাথুরে রাস্তাটার থেকে নেমে গেলে সামান্য ঢালু জায়গা । ওখানে নাগাগাছ১, ঢেঁকী , ফুটুকলার ২ গাছে হালকা একখানা জঙ্গলই হয়ে গেছে। জায়গাটিতে শুকনো পায়খানার গন্ধ। নাকে হাত দিল সে। ঢালু জায়গাটা গিয়ে একটা মাঠে পড়েছে । এতোদিন মাঠে সবুজ বিন্নি ধানের গাছ বাতাসে হেলত দুলত। এবারে অন্য আরো বহু মাঠের মতো এই মাঠেও কেবলি খের । মাঠখানা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একখানা গ্রাম শুরু হয়েছে। হালকা জনবসতির গ্রামটিতে এখন একটাও জনমানব নেই, দু’একটা ঘর এখনো জ্বলছে। গ্রামে পা দিয়েই মানুষগুলোর রা করা বন্ধ হয়ে গেল। এখনি বুঝি শুনতে পাবে শঙ্খ আর নাগরার শব্দ। ভেসে আসবে একটা তীক্ষ্ণ হুইসেলের শব্দ। পোড়া ঘরগুলোর ধোঁয়াতে ভারি বাতাস এখনি ভরে উঠবে রক্তের গন্ধে। কানে ধরা সেই আতশবাজির থেকেও জোরালো শব্দগুলো চারদিক থেকে বাতাস চিরে ফালাফালা করে ফেলবে। ওরা একটা বাড়ির উঠোন পেরোচ্ছিল। গোবরে লেপা উঠোনে গৃহস্থ বাড়ির ধান শুকোনো হচ্ছিল । ঘরের বেড়াতে হেলিয়ে রাখা রয়েছে একখানা ভিমকলার আটি । এদের ধানের ভাঁড়ারটা তখনো জ্বলছে। কেউ টু শব্দটি না করে হাতে যতটা পারে কলা ছিঁড়ে নিয়ে নিলো। মালতীর কিছুই মুখে দিতে ইচ্ছে হলো না। যে মানুষটি ওকে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে কষ্ট দিতে চায় নি তাকে বারেবারেই মনে পড়ছিল। কই বা গেল, কী বা হলো! বাড়িটার উঠোন পেরোতেই বেলা ডুবে এলো। এবারে লোকগুলোর পায়ের জোর বেড়ে গেল। একজন মণিকে কাঁধে তুলে নিলো। মণির হাতটি ছেড়ে ওর কেমন খালি খালি লাগছিল। কানা মানুষ একটার হাত থেকে যেন কেউ লাঠিটা নিয়ে গেছে। ওরা এক আখের খেত পার হচ্ছিল। আখের খেতও সেই পাট খেতের মতো মাড়িয়ে গেছে। অল্প আঁধারে একটা শরীর দেখতে পেল সবাই, যার মাথাটা নেই। চারদিকে দলা দলা রক্ত। সে কাছে গেল। গায়ের ছাল কুঁচকে যাওয়া এক বৃদ্ধের শরীর, কোমরে একটা ছেঁড়া ধুতি প্যাঁচানো রয়েছে। “ মা, তাড়াতাড়ি আয়।“ ছেলের ডাক অনুসরণ করে সে দেখল লোকগুলো বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। হনহন করে ওদের যাওয়া দেখলে মনে হয় যেন কেউ ওদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। হঠাৎই ওর পায়ে লেগে একটা কিছু ছিটকে পড়ে গেল। আখের খেতের ভেতরটা বাইরের থেকে একটু অন্ধকার যদিও সে স্পষ্ট দেখল ওর পায়ে লেগে একটা বাচ্চার শরীর ছিটকে পড়েছে । একটা সম্পূর্ণ মানব শিশু নয়। উপর থেকে নিচে সমানে কেটে দু’টুকরো করা হয়েছে। নাক মুখ , পেট , পা সব সমানে সমানে কাটা । সে চীৎকার দিয়ে উঠল। লোকগুলো ঘুরে তাকালো। দু’টুকরো শিশুটিকে দেখে সবারই মুখের থেকে কিছু চাপা শব্দ বেরুলো। কোথাও একটা শব্দ হলো। ধস্ত আখের খেতের মধ্যি দিয়ে যেন কিছু একটা দৌড়ে গেল। সবারই চোখে পড়ল দুটো শেয়াল। মণি, মালতী আর সঙ্গের মানুষগুলোও দেখল দুটো শেয়ালে শিশুটির এক টুকরোকে টেনে খেতের যে দিকটা ধসে যায়নি সেখানে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মালতী দৌড়তে শুরু করল। মণি আর সঙ্গের লোকগুলোও ওর পিছু নিলো।
    সে যখন আখের খেত থেকে বেরুলো তখন বাতাসে কলাপাতার মতো কাঁপছিল। ওর চারপাশের সবকিছু যেন চাকার মতো ঘুরছিল। মণির গায়ে কাঁধে হাত রেখে সে যখন এসে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছুলো তখন ওর গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। মানুষের ভিড়ে প্ল্যাটফর্ম ভরে গেছে। বিচিত্র বাক্স বোচকা তল্পিতল্পার জন্যে কোথাও পা ফেলবার জো নেই। ওকে কেউ একজন একটু জায়গা বের করে দিল। প্ল্যাটফর্মের ঠাণ্ডা পাকা মেঝেতে সে অচেতন মানুষের মতো পড়ে রইল। ঠাণ্ডা মেঝের মতোই ওর শরীর আর মগজখানাও ঠাণ্ডা আর অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছিল।
    মাঝরাতে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে এক হৈ হল্লা শুরু হলো। হাল্লা মানে একেবারে মারণ চীৎকার ! ‘ এসেছেরে! , এসে পড়েছে!’ বলে স্টেশনের এ মাথা থেকে ও মাথা অব্দি আকাশ বাতাস কাঁপানো চীৎকারে সে ঠাণ্ডা পৃথিবীটার থেকে ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো। এবারে আকাশ কাঁপানো শব্দগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অদ্ভুত ধরণের কিছু শব্দ। কেউবা হাতের কাছে পাওয়া বাঁশের লাঠিতে স্টেশনের লোহার খুটাতে ঘা মারছে, কেউবা টিনের বাক্সে ঘা দিয়ে আওয়াজ করছে। কেউ একজন ফেলে রাখা ড্রাম একটা পেয়ে তাতেই কাছে বসা এক বুড়োর হাতের লাঠি নিয়ে ঘা বসাচ্ছে। নানারকম শব্দ বাক্যে গলাগুলো একেবারে ছিঁড়ে ফেলে সবাই মিলে আর্ত চীৎকারে শুধু একটাই কথা বারে বারে বলে যাচ্ছে, “ এসে গেছে ওরা! এবারে আর কেউ বাঁচবে না! সব শেষ হয়ে যাবে!” সারা রাত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ভোরের দিকে মানুষগুলো একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আবারো একবার চীৎকার চেঁচামেচি শুরু হলে সবাই আঁতকে উঠল। একটা মুগা রঙের কেউটে এসে প্ল্যাটফর্মের আবর্জনা ফেলবার বাক্সটাকে প্যাঁচিয়ে বসে আছে। মানুষের হৈ হট্টগোলে সাপটা ফণা তুলে দিয়েছে। ফণাতে মধ্যিখানে সবাই এক অদ্ভুত সুন্দর আর ভয়ঙ্কর চক্র দেখতে পেল। ভয়ার্ত মানুষগুলোর দুর্বল মনে সাপের চক্রটি ক্রমেই অলৌকিক হয়ে পড়ল। মা মনসা, শিব কিম্বা নিজের নিজের দীক্ষাদাতা গুরুর নাম কীর্তন ,জপ আরাধনাতে প্ল্যাটফর্ম দেখতে দেখতে এক মন্দির হয়ে পড়ল। পুজো অর্চনার মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছিল সেই মৃত্যু ভয়ের আর্তনাদ। ‘এটাক হবেই’ । মানুষের মুখে মুখে শব্দগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। শুধু মানুষ ভেদে শব্দটা একটু অন্যরকম হচ্ছে। এটেক, অটেক,আটেক, উটেক...। শব্দটি ভিন্ন রূপ নিতে পারে। কিন্তু অর্থ সেই একই। এক ভয়ঙ্কর আতংক মিশে আছে শব্দটিতে। সমস্ত আশংকা, ভয় গিয়ে জড়ো হলো গিয়ে ঐ চক্রটিতেই।
    মালতীর অর্ধ-চেতন মনটিতেও চক্রটি ঢুকে পড়েছে, একবার মণিকে , একবার ওর বাবাকে চক্রটি এসে গ্রাস করে । তারপর আবারো সব হালকা আঁধারে ডুবে যায়।
    পরদিন, ঠিক রাত নয় সন্ধ্যার খানিকটা পরেই প্ল্যাটফর্মের লোকেরা পুবদিকে দাউদাউ করে ঘরবাড়ি জ্বলতে দেখতে পেল । আগুন থেকে বেরুচ্ছে একটা শব্দ , এটেক, এইটেক, এটাক, আটেক, উটেক...। মানুষগুলোর মাঝখানে শব্দটি এক আগুনের শিখা হয়ে দাউদাউ করে জ্বলছে। সাপটা আবর্জনার বাক্সটি থেকে অল্প অল্প করে বেরুচ্ছিল।ভয়, খিদে আর তেষ্টাতে উন্মাদ মানুষগুলোর থেকে দু-একজন কাঁদতে শুরু করল। মা মনসা থাকবার জন্যেই ওরা আসতে পারেনি। গেলেই এসে পড়বে। আবারো আরম্ভ হলো জপ আরাধনা। ক্ষুধা, ভয় আর কান্নার মাঝ থেকে উঠে আসা এই প্রার্থনা সঙ্গীতের হুলস্থূলতে সাপটি আবারো একবার ফণা তুলে দাঁড়ালো। গোল গোল করে চক্কর দিতে দিতে ঘুরতে থাকল। সারা রাত এই মানুষগুলো তাদের চারদিকে দেখতে পেল আগুন জ্বলছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল শঙ্খ আর নাগরার শব্দ। এই শব্দগুলো এসে প্ল্যাটফর্মের মানুষগুলোর কাছে পেলেই একটাই মাত্র শব্দে এসে জড়ো হয়। অর্থ সেই একই। মুখ ভেদে তার ধ্বনিগুলো আলাদা আলাদা চেহারা নেয়। সাপটি আবর্জনার বাক্স থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের মাঝে এসে পড়েছে। একটা খুঁটি প্যাঁচিয়ে ধরেছে। লোকগুলো এবারে ভালো করে দেখল সাপটার গায়ে ঘা। পোড়ার দাগ। সাপটি যেন পোড়া কোনও কিছু উপর দিয়ে চলে এসেছে। ওদের লাগানো আগুনে মা মনসাও পুড়েছেন! অভিশাপ লাগবে। ওরা সবংশে মারা পড়বে। লোহার ঘর তৈরি করে ঢুকে থাকলেও বাঁচবে না। চাঁদ সওদাগর কি পেরেছিল লক্ষীন্দরকে রক্ষা করতে? পারে নি, কখনোই পারবে না। মা মনসার শাপে ওরা শেষ হয়ে যাবে। আবারো শুরু হলো সেই নাকি সুরের মা মনসার বন্দনা। সাপটা খুঁটির প্যাঁচটাকে অল্প ঢিলে করেছে। আকাশে ফরসা হয়ে আসছে। এবারে যেন মানুষগুলো শঙ্খ আর নাগরার শব্দ খুব কাছে থেকে শুনতে পেল। চারদিকে খা খা নীরবতা। এই ছোট্ট স্টেশনটিতে এমনিতেও রেল কম আসে।এখন সেগুলোও নেই। স্টেশন মাস্টার, গার্ড সবারই কোয়ার্টার সেই কবে থেকেই খালি। যেন নয়, সত্যি সত্যি ওরা পুবদিকে শঙ্খ আর নাগরার আওয়াজ শুনতে পেল। আবারো আরম্ভ হলো সেই মৃত্যু কাতর চীৎকার চেঁচামেচি । এখানে ওখানে ঘা বসাবার বিচিত্র অদ্ভুত সব শব্দ। সাপটা আবারো একবার ফণা তুলে দাঁড়ালো। ওর গলার দোলন্ত চক্র দুটো ঝিলিক দিয়ে উঠল। এক মহিলা, যার হাতে পায়ে দায়ের কোপের চিহ্ন ফুলে ঘা হয়ে গেছে , সে গিয়ে সাপটার সামনে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। চক্র দুটো অল্প দুলে নিচে নেমে এলো। তার পরেই সাপটি ফোঁস ফোঁস করে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে গেল। মহিলাটির ইতিমধ্যে কোনও সাড়াশব্দ নেই । মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে গেছে। ভিড়ের লোকেরা কাছে সরে এলো। এবারে কী করা যায়? একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলো। দাঁত-শূন্য মুখে এক অদ্ভুত শব্দ করে একটা ছুরি বা ব্লেড আর মুরগীর বাচ্চা চাইল। একটা ব্লেড পাওয়া গেল। কেউ একজন বেঁধে সঙ্গে করে আনা দুটো মুরগীর বাচ্চাও বের করে দিল। বৃদ্ধ মেয়েমানুষটির পায়ের হাঁটুর নিচে, হাঁটুর ঠিক উপরটাতে এবং উরুতে তিন জায়গাতে বাঁধল। তারপর যেখানে সাপের দাঁত বসেছিল ওখানে কেটে দিল। খানিকটা কালো রক্ত বেরিয়ে এলো। বৃদ্ধ এবারে মুরগীর বাচ্চার মলদ্বার কাটল। সবাই ঝুঁকে গিয়ে লক্ষ্য করছে বৃদ্ধের হাতটা যতই কাঁপুক না কেন ঠিক সময়ে ঠিক থেমে যায়। বৃদ্ধ এবারে মুরগীর বাচ্চার কাটা মলদ্বার মহিলাটির ক্ষততে লাগিয়ে দিল। খানিক পরেই মুরগীর বাচ্চাটি ধড়ফড় করে মরে গেল। অন্য যেটি ছিল সেটিকেও একই রকম মলদ্বার কেটে ক্ষততে লাগিয়ে দিল। খানিক পরে সেটিও মরে গেল। এবারে বুড়ো একটা শব্দ উচ্চারণ করল, কী করল কেউ বোঝেনি। ওর ছেলে-বৌ বুঝিয়ে দিল আরো যদি ত্রিশ পঁয়ত্রিশটা মুরগীর বাচ্চা পাওয়া যায় তবে গিয়ে মেয়ে মানুষটি বাঁচবে। মুহূর্তে সবার চোখে ভেসে উঠল এক একেকটা ঝাঁট দিয়ে লেপে মুছে রাখা উঠোন। উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছে মায়ের সঙ্গে একদল মুরগীর বাচ্চা। খুবই সাধারণ দৃশ্য । এই প্ল্যাটফর্মে জটলা বেঁধে থাকতে গিয়ে মানুষগুলো হঠাৎই আবিষ্কার করল এইটেই পৃথিবীর সবচে’ বড় স্বপ্ন যেটিকে আর হাতে ধরা যাবে না। মুরগীর বাচ্চা নিয়ে একেকটা উঠোনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতে থাকতেই মুরগীর বাচ্চাগুলোরই মতো সামান্য ধড়ফড় করতে করতে মেয়েমানুষটি নিথর হয়ে গেল। মা মনসা বলি নিয়েছেন বলে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করতেই সবাই শুনতে পেল হুঁইসেলের শব্দ । মাঝখানে নীল হয়ে পড়ে থাকা একটি মহিলা আর মরা মুরগীর বাচ্চাগুলো নিয়ে মানষগুলো নীরব হয়ে গেল। সব্বাই একে অন্যের আরো কাছে চেপে এলো। বৃদ্ধ তার দু হাত উপরে তুলে দাঁতঝরা মুখে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। ভিড়ের মানুষগুলো বৃদ্ধের আরো কাছে চেপে এলো। কেউ একজন মণির মাকেও কাছে টেনে কাছে নিয়ে এলো। ওর অর্ধ-চেতন শরীরে সাপের বিষে বিষাক্ত কালো রক্তের কয়েক ফোটা লেগে গেল। এইবারে বন্দুকের আওয়াজ স্পষ্ট শোনা গেল। হুঁইসেলের তীক্ষ্ণ শব্দটি আর হৈ ..ঐ... ঐ ধ্বনির শব্দ ক্রমেই মিলিয়ে গেল। খানিক সময় থমথমে নীরবতা। নীরবতা ভেঙ্গে মণির মা কিছু একটা বলে বিড়বিড়িয়ে উঠেছিল, তারপরে আবার শুয়ে পড়ল।পাকা মেঝেতে পড়ে থাকা মণির মা আর নীল হয়ে যাওয়া মহিলাটির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। শুধু একজনের পেটটা ঢিলা হয়ে নিচে নেমে গেছে আর অন্যজনের পেটটা ছোট।
    ওরা ঘরঘর করে গাড়ির শব্দ শুনতে পেল। এবারে যেমন পিঁপড়েতে জমাট বাঁধে তেমনি মানুষগুলো জড়ো হয়ে গেল। নিশ্চুপ মানুষগুলো থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। অল্প পরেই বুট জুতোর গপ গপ শব্দে প্ল্যাটফর্ম ভরে গেল।
    দলবাঁধা লোকগুলোকে আর্মি কর্ডন করে ফেলল। মাঝখানে দুটি মেয়েমানুষ। একজন অচেতন , অন্যজন মৃতা । আর দুটো মুরগীর বাচ্চা, রক্তে মাখামাখি যেন তুলোতে তৈরি তেমনি সাদা । এর চারদিকে বানের জলে ভেসে যাবার জন্যে তৈরি একদল পিঁপড়ের মতো মানুষ। মানুষগুলোকে ঘিরে ফেলেছে বন্দুকধারী মিলিটারি। তাদের গায়ে জলপাই রঙের পোশাক তাতে আবার পাতার ছবি আঁকা। কারো মুখে কোনও কথা নেই।

    টীকা:
    ১)নাগাগছঃ অসমিয়াতে শব্দটি নগাবন। আগাছা জাতীয় গুল্ম। মূল বাংলা না পাওয়া অব্দি একে ‘নাগাগাছ’ বলতে অসুবিধে দেখছি না। এমন কাছাকাছি নাম দুটি ভাষাতে বিরল নয়। যেমন ঢেঁকীয়া। ব্রহ্মপুত্রের বাংলাতে এটি ‘ঢেঁকি’ ।
    ২) ফুটুকলাঃ আগাছা জাতীয় গুল্ম।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪০495476
  • অধ্যায় ছয় (৬)
    যখন চোখ মেলে তাকালো পাতলা প্লাস্টিকের মধ্যি দিয়ে এসে এক অদ্ভুত নীল রঙের আলো ওর চোখে ছ্যাঁত করে পড়ল । ঔষধের গন্ধ লাগল নাকে। কান ভরে উঠল কোঁকানো আর কান্নার শব্দে। নীল আলোটা সহ্য হয়ে আসার পরে দেখতে পেল ও এক ক্যাম্প-খাটে শুয়ে আছে। চারদিকে মাটিতে বালিতে, বস্তাতে বিছানাতে পড়ে আছে মানুষই মানুষ। প্রায় সবারই মাথায় হাতে পায়ে আঘাতের চিহ্ন। সে উঠে বসল। তারপরেই চীৎকার দিয়ে উঠল, ‘মণি! মণি!’ সাদা কাপড়ে এক মহিলা এসে কাছে এলো।
    “কী হলো? চেঁচাচ্ছ কেন?”
    “ছেলেটা, আমার ছেলেটা, মণি...।”
    মহিলাটি চলে গেল। সে এবারে দাঁড়ালো। মণি এসে ঢুকল।
    “ মা আমি ভাত খেয়ে এলাম।”
    “কই?” সে ছেলের মুখের দিকে তাকালো।
    “ঐ ওখানে।” ছেলে যেদিকটাতে আঙুল দিয়ে দেখালো, সে দেখল ওদিকেও নীল প্লাস্টিকের ছাদে তৈরি আরো বেশ কিছু ঘর। ঘরগুলোতে প্রচুর মানুষ। ঔষধের গন্ধ ভেদ করে ওর নাকে এসে লাগল পায়খানা আর পেচ্ছাবের গন্ধ। পেটটা যেন গুলিয়ে উঠল। পেটে হাত দিয়ে ওর খেয়াল হলো পেটেরটি একেবারেই নড়াচড়া করে নি। কাছে দাঁড়ানো মণির হাতে ধরে সে জিজ্ঞেস করল , “মণি, বাবার কিছু...।” ভাত খেয়ে হাসি খুশি ওর মুখখানা মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল। খানিক পরে ওর মুখের দুটো ধার বেয়ে জল নেমে এলো। সে ছেলেকে কাছে টেনে নিলো।
    সামান্য দূরে একটা হুলস্থূলু শুনে সে মাথা তুলে তাকালো। ক’জন মেয়েমানুষে ক’জন জোয়ান ছেলেকে গলা চড়িয়ে গালিগালাজ করছে। বেগুনি রঙের ব্লাউজ, বেগুনি পাড়ের চাদর আর মুগার মেখলা পরা এক শ্যাম বর্ণের মহিলা বেশি করে কথা কাটাকাটি করছে। ছেলেগুলোও সমানে তর্ক করছে। মেয়েমানুষটি কিছু বলতে বলতে মালতীর দিকেই আসছিল। মানুষটির ওর দিকে আসার ভঙ্গিমাটা দেখলে মনে হয় যেন উলু খাগড়ার বন পোড়ানোর জন্যে লাগানো একটুকরো আগুন পাক খেতে খেতে ওর দিকে ধেয়ে আসছে। সে হেসে ফেলল। মেয়েমানুষটি এসে ওর হাত ধরে ছেলেগুলোকে ধমকে দিয়ে বলছে, “ ওর কেন কোনও চিকিৎসা করানো হয় নি? ওকে কেন এভাবে ফেলে রেখে দেয়া হয়েছে?”
    মণি মায়ের গেয়ে লেপ্টে ধরে রেখেছে। মহিলাটি ওর হাত ছেড়ে পাশে আর যারা কোঁকাচ্ছিল গোঙাচ্ছিল তাদের দেখিয়ে বলল, “কী দোষ এই মানুষগুলোর?”
    সাদা কোট পরা একটি ছেলে রাগে গজ গজ করতে করতে ওর দিকে ধেয়ে এলো। আরো ক’জন সাদা কোট পরা ছেলে এসে মেয়েমানুষটিকে ঘিরে ফেলল। মেয়েমানুষটি মালতীর শাঁখা পরা হাতখানা তুলে ধরল, “ এই এরই জন্যে ওকে ফেলে রাখা হয়েছে।” সাদা কোট পরা ছেলেদের একজন চড়া গলায় মহিলাটিকে গালি দিয়ে বলল, “ এদের প্রতি আপনার এতো দরদ কিসের শুনি, দেখি?”
    মেয়েমানুষটিও গলা চড়ালো, “ মানুষ বলেই এদের প্রতি আমার দরদ। ”
    “এই ঘাস ফড়িঙের দলগুলোকে, যারা আমাদের খেতের ধান খেয়ে শেষ করে ফেলল, এদের আপনি মানুষ বলছেন?”
    আরেকজন বলল, “আপনার মতো মানুষের জন্যেই আজ অসমিয়া মানুষের এই দুর্দশা।”
    “ তোমাদের বিপ্লবের নেতাগুলো সিংহাসনে বসবে। সারা দেশটাকে লুটেপুটে খাবে। তোমরা না বিপ্লবের জন্যে ব্লেকআউট করো। অসমে চিরদিনের জন্যে ব্লেকআউট হবে, বুঝেছ? চিরদিনের জন্যে ব্লেকআউট !” মেয়েমানুষটি কেঁপে কেঁপে উঠছিল আর কথাগুলো বলছিল।
    একজন হাত তুলে মহিলাটিকে তেড়ে এলো। মহিলাটিও তেড়ে গেল, “ কী করবে? মেরে ফেলবে? আমার মত মেয়ে মানুষ একটাকে মারা আর পিঁপড়ে একটাকে মারা একই কথা। ঐ মানুষটার মাথা কেটে রাস্তাতে ফেলে দিতে চাইছিলে। যারা অসমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় তোমাদের নাজিবাহিনী তাদেরই মাথা কেটে রাজপথে ফেলে দিতে চাইছে!” মেয়ে মানুষটি আঙুল ঝেড়ে বলছিল, “ তোমাদের নেতা নিজে রাজা হয়ে রাজভোগ করবার খেলা খেলছে।”
    মেয়েমানুষটি আর সাদা কাপড় গায়ে ছেলেগুলোর আশেপাশে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। মানুষের ভিড় ঠেলে একটি লোক প্রায় দৌড় দিয়ে মালতীর কাছে এসে দাঁড়াল।
    “মণির মা, তুই এখানে কী করে? মণি , লম্বোদর, এই মানুষগুলো...।” এক শ্বাসে মানুষটি ওর থেকে পুরো মহাভারতখানা জেনে নিতে চাইল। মালতীরা পা কাঁপছিল, দাঁড়াতে পারছিল না। এ যে বীরেন বৈশ্য। পাট মুগার ব্যবসা করে। মণির বাবার কাছে প্রায়ই মুখে একরাশ লজ্জা নিয়ে এসে ও এটা ওটা চেয়ে হাত পাতে। বাড়ির পাশের সেই মানুষটিকে পেয়ে মালতীর শোক যেন উথলে উঠল। “ মণির বাবা, মামণির মা, দিদাদাদু...।” এক এক শ্বাসে ঐ মহাভারতই জানতে চাইল। মণি মামণির বাবার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ালো , “ জেঠামশাই, পাপুরা কোথায়?”
    মুগার মেখলা পরা শ্যাম বর্ণের মহিলাটির সঙ্গে যে সাদা কোটের ছেলেগুলো কথা কাটাকাটি করছিল তাদের একজন এসে মণির মা আর মামণির বাবার কাছে দাঁড়ালো। “ইনি...।” ছেলেগুলো ওর হাতের শাখাগুলো দেখছিল। মামণির বাবা মালতীকে ধমক দিয়ে বলল, “ বলছিলাম কিনা আমি, এগুলোই তোকে মারবে ! কোচের বাড়ি বৌ হয়ে তুই এই বাঙালিদের সঙ্গে পড়ে আছিস ! খোল এই শনিগুলো!”
    সে শাখাগুলো নাকের কাছে নিয়ে গেল। একটা দূর স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয়া নারকেল তেলের গন্ধ এখনো রয়েছে এতে।পরম মমতায় সে শাখাগুলো গাল লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
    মামণির বাবা সাদা কোট পরা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, “ এ কোচের বাড়ির বৌ। এর স্বামী সাত পুরুষের নির্ভেজাল অসমিয়া। হায় ! হায়! নিজের জন্মভূমিতে আজ আমাদেরই মেয়ে বৌদের এ কী অবস্থা হলো!”
    সাদা কোট পরা আরো একটি ছেলে এসে ওর কাছে দাঁড়ালো। একজন ওর পেটটা পরীক্ষা করল, “ বেবির অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। আপনি কী জাত?”
    মালতীর চোখের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেল রত্নমালা হাতির উপরে বসে বডো কিনারাম, গলায় কামরাঙা হার পরে মৌজাদারের মেয়ে রত্নমালা। পেরিয়ে গেল ডর-ভয়শূন্য শিলিগুড়ির জোয়ান ক্ষিতীশ, যেখানেই যায় সেখানেই এক রাজহাঁসের মতো ঝিলমিল করতে করতে মা যুতিমালা। তাকে খাইয়ে পরিয়ে করে বড় করলেন যিনি সেই রতন কাকা আর বিন্দু কাকিমাও পেরিয়ে গেলেন একে একে---কার কথা বলে সে? না কি তাকে সিঁদুর পরিয়ে যে নিয়ে এলো সেই লম্বোদরের কথাই বলে।
    সে অপলক চোখে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটিও ওর মুখের দিকে তাকালো। ছেলেটি একটু অবাকই হলো। পৃথিবীর সবচাইতে সহজ প্রশ্নটির জবাব দিতে গিয়ে মেয়েমানুষটি কেমনটি যেন করছে । মালতী চুপ রইল। শুধুমাত্র মুখের ভেতরে একবার ছেলেটির প্রশ্নটিকেই বিড়বিড়িয়ে গেল, “ কী জাত?” মামণির বাবা আর ছেলেটি একটাই শব্দ শুনতে পেল , “ জাত।“ বৈশ্য ধড়ফড়িয়ে উঠল , “স্ত্রীর কিছু একটা হয়েছে শুনলে মানুষটা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ত, কোথাকার মানুষ কই বা আছে। এখানে ওর ভালোবাসার স্ত্রীর এই দশা।”
    সেই মহিলাটি এবারে সাদা কোটের ছেলেদের বললেন , “আপনারা ‘ওথ অব হিপক্রেটিক’ ছুঁড়ে ফেলুন।” মালতীর হাতের শাখা ক’গাছা দেখিয়ে বলল, “ আপনাদের কাছে এই মানুষটির থেকে ঐ ধাতুর জিনিসগুলো বেশি বড়।”
    একটি ছেলে মহিলাটিকে ধাক্কা দিয়ে দিল, “আপনি এখান থেকে চলে যান, যান! নইলে আরো অপমানিত হবেন।” মহিলাটির সঙ্গের লোকেরা তাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে চলে গেল।
    হুলস্থুলুতে যে ছেলেটি ওকে পরীক্ষা করছিল তার গায়েই ঢলে পড়ল ফেলানি।
    “পেসেন্ট বড় উইক।” একজন ওকে একটা ইঞ্জেকশন দিল। তারপরে বৈশ্য আর ছেলে দুটোতে মিলে ওকে একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে অন্য এক শিবিরে নিয়ে গেল। সেখানেই বৈশ্যও রয়েছে সপরিবারে। চোখ মেলে ও মামণির মাকে দেখে জড়িয়ে ধরল। মামণির মাও ওকে জড়িয়ে ধরল , “ আমার কপালে আগুন লেগেছে গো! পাঁচটা পোলাপানের দুটো আছে। বাকিরা যে কৈ গেল কিচ্ছু বলতে পারি না।” মণি আস্তে জিজ্ঞেস করল , “পাপু কৈ?” জবাবে মামণির মায়ের আরেক প্রস্থ কান্না। মালতী ধীরে ধীরে বলল, “ মণির বাবা...।” ওর স্বর ভেঙ্গে পড়েছে। মামণির বাবা এসে অবশ্যি ওকে একটা খবর দিল। যাদের যাদের পরিবারের লোক হারিয়েছে কাল মিলিটারি তাদের নিয়ে গ্রামে যাবে। মামণির বাবা যাবে হারানো ছেলে মেয়ের খোঁজে; আরো অনেকেই যারা পরিজনকে হারিয়েছে তারা সব্বাই যাবে। ফেলানিও যাবে কি না জানতে চেয়ে মানুষটি দাঁড়ালো।
    “এই শরীরে তুই পারবি বুঝি...?”
    “মানুষটার জন্যে...?”
    পথে যদি কিছু একটা...।”
    “কিছু হবে না দাদা। পেটেরটি নড়াচড়া বন্ধ করেছে। ভগবান যদি রাখেন থাকবে। না রাখলে নেই। আমার শুধু মানুষটা...।”
    “ তুই আবার গিয়ে কী করবি? বাদ দে! আমিই খবর করে আসি গে।” আসলে সে ওকে বলতে চাইছিল মিলিটারি শুধু মরা মানুষকে শনাক্ত করতেই ওদের গাঁয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। গ্রামে পচতে শুরু করা শবদেহগুলো স্তূপের মতো জড়ো করে রেখেছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারল না। শুধু মাত্র অস্পষ্ট স্বরে বলল, “ যাবি না হয় । মনটা শান্তি পাবে।” কথাটা বলেই পর মুহূর্তে আবারো বলল , “ দাঁড়া তো দেখি! রাতটা পোহাক তো আগে।“
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪০495477
  • অধ্যায় সাত (৭)
    ভোরেই আর্মি এসে সব ক’টি শিবির থেকে মানুষ তুলে নিলো। প্রায় সবারই কেউ না কেউ নিখোঁজ হয়েছে। বৈশ্য বাবুর সঙ্গে ফেলানিও বেরুলো। ওকে আরো দু’জন মহিলার সঙ্গে সামনে বসতে দিল।
    গাড়ি চলতে শুরু করলে কিছু পরেই সে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঠিক ঘুম নয়, এক ধরণের তন্দ্রা । যখন তখন কোথাও একটু হেলান দিলেই, শুয়ে পড়লে তো কোনও কথাই নেই, চোখে কালো ছাই রঙের এক চাদর নেমে আসে। হালকা সেই অন্ধকারের মধ্যি দিয়ে সে খুব ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে। আজও গাড়ির সিটে হেলান দেবার সঙ্গে ওর চোখে নেমে এলো পাতলা চাদরখানা। ক্রমেই সেই পাতলা কুয়াশা রঙের চাদরখানা একটা ডাঁট কালো পর্দা হয়ে এলো। পর্দাটি মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি খেয়ে আবারও স্থির হয়ে পড়ে। এবারে ঐ কালো পর্দাটি এক গর্ত ভরা শুকনো কলাপাতার ডাঁটার সমান হয়ে ওকে পোঁতে ফেলল। ওর গালে মুখে সর্বত্র খসখসে কলার শুকনো পাতা। মাছ আটকাবার পর জাল টেনে আনলে তার ভেতরে যেমন মাছগুলো ধড়ফড় করতে থাকে সেও ঐ কলাপাতার ডাঁটার মধ্যে ধড়ফড় করতে শুরু করেছিল। যতই সে হাত পা ছুঁড়ছে কলার পাতাগুলো ওকে যেন আরো চেপে ধরছে. সে শ্বাস নিতে পারছিল না। চারদিকে অন্ধকার দেখছিল। শুধু যে ঐ কলার পাতাগুলো--- তাই নয়, এই অন্ধকারও যেন ওকে পোঁতে ফেলতে চাইছে। আঁধারের মধ্যে সে ওর হাতে একটা চেনা হাতের ছোঁয়া অনুভব করল। স্পর্শটি কোমল বা মিহি নয়, শক্ত আর খসখসে। খসখসে হাতটি ওকে কলাপাতার ডাঁটাগুলোর মধ্যি থেকে তুলে ধরল। আলোতে সে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দেখে ঐ মানুষটির হাতখানা ওকে জোর করে ধরে রেখেছে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল মানুষটির শক্ত হাতের টান টান আঙুলগুলো। সে খিলখিলেয়ে উঠেছে, “এ মা! এটাই কি হাত, না সেগুনের পাত! কী যে বড়!” শক্ত হাতের মানুষটির সেগুন পাতার মতো হাতে ওর হাতটি লুকিয়ে পড়ল, “ হবে হয়তো। ভগবান তোকে টগর ফুলের মতো হাত দিয়েছে, আমার না হলে সেগুন পাতার মতোই হলো!” কেবলই আলো আর আলো। আলোতে সে মানুষটিকে ভালো করে ঠাহর করতে পারেনি। চারদিকের রোদে যেন ওর মানুষটিকে ঢেকে রেখেছে। সে চোখ কচলে তাকাবার চেষ্টা করল। কিচ্ছু দেখা যায় না। এক অদ্ভুত ধারালো রোদ ছ্যাঁত করে গিয়ে ওর চোখে পড়েছে।
    মিলিটারি ট্রাকটি দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে কালো পর্দাটির তলার থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে চোখ ধাঁধানো রোদ। আগে আগে মিলিটারি পেছনে মানুষ, মানুষের পেছনেও মিলিটারি। গ্রামটিতে ঢুকতেই পড়ে নামঘর। অনেকদিনের পুরোনো। নামঘরের উঠোন জুড়ে ডালপালা মেলে ছায়া ফেলে রেখেছে অজস্র গাছ গাছালি। গাছগুলোতে পায়রার ঝাঁক। ঠিক বন্যও নয়, ঘরে পোষাও নয়। পায়রারা রাতে নামঘরের সিলিঙে থাকে, দিনে গাছের ডালগুলোতে পড়ে থাকে। নামঘরের কাছে গিয়ে পায়রাগুলোর বহু চেনা বাক-বাকুম, বাক-বাকুম শব্দটি না শুনতে পেয়ে ও একটু অবাক হলো। কোথায় গেল এই পায়রাগুলো ? সত্যি সত্যি একটাও পায়রা নেই। আর নামঘরটি? সেখানে যেন একটা যুদ্ধই হয়ে গেছে। গাঁয়ের লোকে লেপে মুছে যেখানে একে পরিপাটি করে রাখে সেখানে পুরো নামঘরটার এক তৃতীয়াংশ শুয়ে পড়েছে। দু’একজন লোকের সঙ্গে সেও নামঘরের দোয়ারের সামনে অল্প দাঁড়ালো। ঠিক গেটের মুখটাতে কিছু একটা ভেঙ্গে টুকরো টাকরা হয়ে আছে। সে ভাঙা টুকরোগুলো কিসের তা চিনতে পেল। বিয়ের আগে গা ধুয়ে গাঁয়ের অন্য মেয়েদের সঙ্গে সেও নামঘর মোছার জন্যে আসত। মণিকুটের১ ভেতরে ঢোকা নিষেধ ছিল। নামঘরের প্রতিটি জিনিসের প্রতি ওদের ছিল অপার কৌতূহল । নামঘরের লোকেরা অন্য কোনও জিনিসে হাত দিতে না দিলেও আসতে যেতে দবাটিতে২ দু’এক ঘা বসাতে দিয়েছিল। ভেঙে টুকরো টুকরো সেই দবাটি সে ঠিক চিনতে পারল। ওর কানে ভেসে এলো দবার গুম গুম শব্দ। এই শব্দটিই একদিন গাঁয়ে বিপদের আগাম সংকেত হবে বলে কি কেউ ভেবেছিল? সে যখন ছোটো ছিল, কতদিন যে সন্ধ্যে হলেই নামঘরের এই দবার শব্দে সেও বড়দের সঙ্গে হাতজোড় করেছিল। গালিও খেয়েছিল। নামঘরে দবা বেজে উঠার আগেই ছোটদের হাত পা ধুয়ে নিতে হতো। তখন কেউ ভাবেনি যে নামঘরে নামঘরে মানুষ জড়ো হবে, দবা বাজবে আর দবার শব্দে মানুষ প্রণাম করবে না। এ হবে রণভেরী। কেউ ভাবেনি। দবার শব্দে জুড়ে যাবে রক্ত , মৃতদেহ, আগুন আর হত্যা।
    সে বাকি মানুষগুলোর সঙ্গে বড় নামঘর পেরিয়ে এগুতে থাকল। চতুর্দিকে আধপোড়া ঘর। বাগিচার ফল ধরা গাছগুলো মাটিতে শুয়ে আছে। ধানের ভাঁড়ারগুলোর জায়গাতে ছাইয়ের দম। ছাইয়ের মধ্যে কয়েকটি কুকুর শুয়ে আছে। ওরা তেমাথার মোড়ে এসে পৌঁছুলো। তেমাথার এই মোড়ে রয়েছে এক বিশাল বটগাছ। বটগাছটিতে নানা রকমের পাখির বাসা। এ গাছটির কাছে এলেই ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির কিচির মিচির শোনা যায়। আজ নামঘরের গাছগুলোর মতো এই বটগাছটিও যেন নিস্তব্ধ। সে এমনিই মাথা তুলে তাকালো। তাকিয়েই সে চেঁচিয়ে উঠল। দুর্গন্ধে নাক চাপা দিয়ে অন্যেরাও সেদিকে মাথা তুলে তাকালো। গাছটির ডালে ঝুলিয়ে রাখা আছে কাটা হাত পা, দুটো মুণ্ডহীন শিশু আর...। ওর মতোই অনেকেই আর ওদিকে তাকাতে পারল না।
    ওদের সেই মরাপাটের খেতের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। মরাপাটের খেতের প্রায় চিহ্নই নেই আর। চিঁড়া। মুড়ি , নারকেল গুটিয়ে নিয়ে গিয়ে যেখানে লুকোনোর জায়গা করা হয়েছিল সেখানে এখন সার দিয়ে পড়ে আছে অজস্র মৃতদেহ। শিশু আর মেয়ে মানুষই বেশি। মৃতদেহগুলোতে কাদা লেগে আছে। কাদা আর রক্ত মাখা এই দেহগুলো থেকে মানুষগুলোর শরীর থেকে একটা দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। ঢেকে রাখা মৃতদেহগুলোর আবরণ সরিয়ে দেয়া হলো। বেশ কিছু মানুষ। তিনজন মহিলা গিয়ে ঐ মৃত দেহগুলোর উপর আছড়ে পড়ল। মামণির বাবাও বুকে জড়িয়ে ধরেছে মাথা কাটা যাওয়া একটি ছেলের শরীর। মানুষটি হাউমাউ করে কাঁদছে। মালতীর বুকে যেন কেউ একটা পাথর বেঁধে দিয়েছে। সে শ্বাস নিতে পারছিল না। কাঁদতে পারছিল না। ওর চোখ দুটো যেন পুড়ছিল। সে মৃতদেহগুলো দেখার চেষ্টা করছে। পোড়া চোখে সে কিছুই দেখছিল না। চতুর্দিকে চাকা চাকা রক্ত আর কাদাতে লেপ্টানো কতকগুলো মৃতদেহ। সে ওই পড়ে থাকা পাটগাছগুলোর উপর হাঁটু মোড়ে তাতে মাথা গুঁজে বসে পড়ল। আবারো ওর চোখে নেমে এলো পাতলা কুয়াশা রঙের চাদরখানা। চাদরটি কালো হতে যাবে কি তখনই ওকে কেউ ট্রাকে উঠতে আদেশে দিল। ট্রাকটি এবারে গাঁয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। স্কুলের কাছেই মিলিটারি মানুষগুলোকে ছেড়ে দিল। সবাই যার যার বাড়ি ঘরের খোঁজে এগুলো। সেও বৈশ্যবাবুর সঙ্গে হাঁটা দিল।
    মাত্র দুটা রাত। মানুষজনে ভরা একটা পুরো গমগমে গ্রাম শ্মশানপুরী হয়ে পড়ল। বেশির ভাগ বাড়িই আগুনে ছাই হয়ে গেছে। ধানের ভাঁড়ারগুলোর জায়গাতে ছাইয়ের দম। তিন চার বছর চালানো যায় এমন ধানের কিছু ভাঁড়ার থেকে এখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সাদা সাদা পাকিয়ে পাকিয়ে উপরের দিকে উঠা ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ওর চোখে ভেসে উঠল ওদের নিজেদের ধানের গোলাটি। একটা পুরো বছর চলে এমন ধানের ভাঁড়ারটিকে সে আর মণি ওই কলাপাতার ডোবা থেকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখছিল। গোলাটির থেকে কি এখনো তেমনি আগুন বেরুচ্ছে না, কবেই জ্বলে ছাইয়ের দম হয়ে গেছে। বৈশ্যবাবুর পেছনে পেছনে সে চেনা পথটিতে পা দিল। আধপোড়া বাড়িগুলোর মধ্যি দিয়ে এগুতে থাকল।
    ওদের পাড়াটার শুরুতেই প্রশস্ত উঠোনের সাহাদের বাড়ি। পান সুপারির ভরা বাগানের ছায়াতে ঢাকা বাড়িটির একাংশ পুড়ে গেছে। বাগানের ফল ধরতে শুরু করা গাছগুলোকে যেন এক তুমুল ঘূর্ণি বাতাসে দুমড়ে মোচড়ে ফেলে দিয়েছে। মাটিতে শুয়ে পড়া গাছগুলোর মধ্যি দিয়ে ঘরটাকে দেখে সে অল্প দাঁড়ালো, দাঁড়ালো বৈশ্যবাবুও। হাতে একটা পোটলা নিয়ে একটি আধবয়সী লোক ঘরটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। বুড়া বুড়ির ছেলে, মেজোটি। ওর গায়ের একটা ধুতি প্যাঁচানো, হাতে কুশের ধাড়া দেখে মালতীর মুখের থেকে একটাই কথা বেরুলো,’দাদু-দিদা।‘ ওর মুখের উপরেই বৈশ্যবাবু জিজ্ঞেস করে ফেলল, ‘বুড়া বুড়ির...।’ জবাবে মানুষটি মাটিতে বসে পড়ে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে শুরু করল। মালতীর আবারো সেই তন্দ্রা এসেছে। চারদিকের রোদ যেন নিস্তেজ হয়ে এসেছে। ওর চোখের সামনে একটা হাত ভেসে উঠেছে যার সর্বত্র কালো কালো ফুট ফুট দাগ, কুঁচকে যাওয়া ঢিলে ছাল দিয়ে যেন প্যাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। হাতটি ওর মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পুরো সাদা চুলের মাঝখানে লাল সিঁদুর। কান জুড়ে বসে পেখম তুলে বসে আছে এক ময়ূর পাখি। সে যেন বহু দূর থেকে দুটো মানুষকে কথা বলতে শুনতে পাচ্ছে। সেই শব্দগুলোর সঙ্গে সঙ্গে সে দিনে দুপুরে, এই অসময়ে নামঘরে নামঘরে দবা বাজানোর শব্দ শুনতে পেল। মানুষের হুড়োহুড়ি লেগেছে। অলক্ষুণে ছেলেটি বাতের বেমারি বুড়ো বুড়ি দুজনকে হাতে ধরে ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।মানুষগুলো পালাচ্ছে যেন হরিণের পেছনে শিকারি পড়েছে । বাতের বেমারি বুড়ো বুড়ি দৌড়োনো তো দূরের কথা , ভালো করে হাঁটতেই পারছে না। তিন টুকরো করে কেটে ফেলল বুড়ো বুড়িকে। মানুষটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, “ ঐখানটায়...।” ফল আসা যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে সেগুলোর মাঝখানে শিমুল গাছটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি আজই চলে যাবে। এখানে আর থাকবে না।সে পোটলাখানা খুলে মেলে দিল, “ মা-বাবার চিহ্ন বলে এগুলো নিয়ে যেতে এলাম।” মালতী পোটলাটার দিকে এক লহমার জন্যে তাকিয়ে বুঝতে পারল দিদা-দাদু রোজ যাকে পুজো করতেন সেই কৃষ্ণের মূর্তিটা। সে একটা প্রণাম করল।
    লোকটি উঠে বাড়ির গেটে যেতেই আরেকটা লোক পেছন দিক থেকে দৌড়ে এলো। চেনা মুখ। রঘু। মালতী ওকে লম্বোদরের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই চেনে। রঘুর কেউ কোথাও নেই। সে যদিও একটু ভেদার মতো কিন্তু বুদ্ধিহীন নয় মোটেও। লেলিয়ে লেলিয়ে কথা বলা, একটু ছড়ানো বাঁকানো পা দুটোতে হেলে দুলে হাঁটা -- –এসব নিয়ে প্রথম দৃষ্টিতে রঘুকে দেখলে পুরো একটা ভেদা মানুষ বলেই মনে হবে। কিন্তু ওকে যেই একবার কোনও কাজে লাগায় সেই বুঝতে পায় এই ভেদাই চেহারাটার আড়ালে এক ধরণের বিশেষ বুদ্ধি রয়েছে। মণির বাবা ওকে প্রায়ই দিন হাজিরা করতে ডাকত। একবার দুটো কাঠ দিয়ে ইট ভরে ভরে একটা সিমেন্টের ফিল্টার সে একাই এমন করে বসিয়ে দিলে যে মণির বাবা বহুদিন ধরে কথাটা কাউকে বা কাউকে সুযোগ পেলেই বলত। রঘু যেখানেই ইচ্ছে সেখানেই পড়ে থাকে। কুকুর একটার যতটুকু ঠাঁই চাই, ওরও সেটুকুই চাই। জনশূন্য গ্রামটিতে রঘু এখন একচ্ছত্র সম্রাট। এই ক’দিন ধরে সে সাহাদের আধপোড়া ঠাকুর ঘরটাতেই থাকতে শুরু করেছে।
    সে এসে সাহার পায়ে পড়ে কোঁকাতে শুরু করল। তার পর হাতে একটা ছোট্ট পোটলা তুলে দিল। পোটলাটা ভালো করে বাঁধা ছিল না, সব জিনিস মাটিতে পড়ে গেল। হাতি দাঁতের মূর্তি,তামার কোষা-অর্ঘ, রূপোর বাসন। সে লেলিয়ে লেলিয়ে বুঝিয়ে দিলে, এসব জিনিস বাঁচাবার জন্যেই সে এ ক’দিন ঠাকুর ঘরে শুয়ে আছে। জিনিসগুলো হাত পেতে নিয়ে মানুষটি কোনও দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
    মালতী ঘাসের উপর বসে পড়ল। রঘু একটা কলাপাতাতে চার পাঁচটা পাকা মালভোগ কলা এনে দিল। বাটি একটাতে সামান্য জল। কলার কাঁদিটা ওর চেনা । মণির বাবা বীজ এনেছিল। দিদা ওর থেকে চারা একটা এনেছিল। খাব না, খাব না বলতে বলতে সে দুটো কলা খেয়ে ফেলল। রঘু ওদের কাছে বসে কেঁদে ফেলল। সব সময় যে মুখে একটা বোকা বোকা হাসি নিয়ে কাজ করতে থাকে সেই রঘুর মুখের কান্নাটা ওর কেমন কিজানি লাগল। রঘুর ঐ লেলিয়ে লেলিয়ে বলা কথাগুলো শুনতে ওর তখন অসহ্য লাগছিল। তবুও সে বলেই যাচ্ছে।, মাঝ মাঝে অদ্ভুত এক কান্নাতে ওর মুখখানা বাঁকা হয়ে যায় । রঘু ‘র’ উচ্চারণ করতে পারে না, ‘ল’ হয়ে যায়। কখনো বা ‘র’ গিয়ে ‘ন’ হয়ে যায় আর তুই- তুমি- আপনির কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। এখন সেটি আরো বেশি হচ্ছে। ওর চিন্তা, শব্দ সব এলোমেলো হয়ে গেছে। সে মণির মায়ের শরীরে শরীর লাগিয়ে বসতে চাইছে। বহুদিন পর বাড়ির মালিককে দেখতে পাওয়া কুকুর একটার মতো করছে সে।
    “ মলি মা! মলি বাবা!...আমি ইশকুলে ছিলাম। লাতে এতো এতো মানুষ, মুখ নেই...।”
    “ মুখ ছাড়া মানুষ দেখেছিলি তুই?” বৈশ্যবাবু কোমরের তাবিজটা ধরে টানাটানি করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন।
    “নেই , চোখ নেই, মাথা নেই, কালো কালো কাপল...নামঘলে দবা, লাতে দবা, দুম দুম দুম , নামঘলেও মানুষ...মাথা নেই, চোখ নেই, আমি পুকুলে, বল নামঘলেল পুকুলে। মাথাল উপল কচুলি পানা। আগুন দিল , মলি মা, কিবানি আর কিবানিল বাবা, তোদেল ঘলে আগুন। সকালে কুকুল আর শিয়াল। পুলো গলৈ মাছ, কালা।” সে হাঁউ মাউ করে কাঁদছে। ঠিক কান্না নয়, এক ধরণের গোঙানো, “ দাদু...দিদাল শিমুল গাছের তলায়, বুলো বুলিল মাথা...ছাগলের মাথা, বীনেন কছাইল দোকান...লাল লাল লক্ত।” ভোঁৎকা একটা গন্ধ বেরুচ্ছে ওর গা থেকে। সেই ওকেই জলে ডুবতে যাওয়া মানুষ যেমন বাঁচতে গেলে খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে তেমনি জড়িয়ে ধরতে চাইছিল মালতী। এ সব দেখেছে। “ রঘু তুই মণির বাবাকে দেখেছিলি কি, দেখেছিলি কি ?”
    রঘু চুপ করে গেল। সে মাথা নিচু করে কিছু একটা মনে করবার চেষ্টা করল।
    “মলিল বাবা...।”
    “ হ্যাঁ রঘু , মণির বাবা। অ্যাঁ মলিল বাবা।” সে টেরই পেল না কখন রঘুর স্বরেই বলে ফেলল।
    “ মলি বাবা সুভাষ মাচতল পাহলা পাটিতে...।”
    “হ্যাঁ রঘু, মণির বাবা, সুভাষ মাষ্টার সেদিন পাহারাতে ছিল।”
    “পাহলা পাটি পুলের কাছে, পুলের উপল দিয়ে মানুষ, মাথা নেই, চোখ নেই।”
    “ তার পর রঘু, তারপর কী হলো?”
    “মাষ্টলকে টিশনের ছেলেলা নামঘলে নিয়ে গেল। সাল! সাল! আমলা আপনাকে মলতে দেব না, টিশনেল ছেলেলা মলিল বাবাকেও নিয়ে গেল। মাষ্টলকে নামঘলে কেলাশিন,আগুন। টিশন ছেলেকে মলি বাবা গালি, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গালি। পুলে মানুষ...মাথা নেই...চোখ নেই...মলি বাবাকে আগুন...।” রঘু এবারে মাটিতে গড়িয়ে মুখ ঢেকে গোঙাতে শুরু করল, “ মলি বাবা, মাষ্টল...নামঘলে আগুন...পুলে মানুষ...মাথা নেই...চোখ নেই...।” এমনিতেই অস্বাভাবিক রঘুর মুখখানা আরো বাঁকা হয়ে গেছে। সে মণির মাকে নিজে দেখা সব কথা বলতে চাইছিল। একই কথাগুলো বারে বারে বলে মণির মাকে সে অনেক কথাই বলবার চেষ্টা করছিল।“তোদেল বাড়িতে আগুন...দাদু দিদাল মাথা...ছাগলেল মাথা...লাল লাল লক্ত।” ওর চোখ দুটো এক অদ্ভুত ভয়ে বিস্ফোরিত, “ মানুষ , বহু মানুষ...মাথা নেই, চোখ নেই, মুখ নেই...কালো কাপল।”
    বৈশ্যবাবু এসে মালতীর কাছে দাঁড়ালো, “ চল, জোরে চল। এটি এক প্রেতের গ্রাম হয়ে গেছে গো মণির মা। এখানে কেউ থাকে না। শুনলি না রঘু কী বলছে, মুণ্ডহীন মানুষ। বেরুবে বুঝলি, রাত হলেই বেরুবে। ওকে এতো করে বললাম গামছা একটা রাখ । শুনল না। বাঙালিদের বাঁচাতে যায়। গামছা রেখেই বা আমার কী হলো? আগুনে কী চেনে। পুড়ে ফেলল, সব পুড়ে ফেলল। দুটো ছেলে মেয়েকে এই শ্মশান পুরিতে রেখে গেলাম। বাকি ক’টাকে...।” মালতী বৈশ্যবাবুর সঙ্গে পা মেলাতে পারেনি। এবারে মানুষটা দাঁড়িয়েছে। ওদের বাড়িটা । লম্বোদরের হাতের কাজে ফুলটাতে ফলটাতে সেজে গ্রামের ভেতরে চোখে পড়বার মতো সেই বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সে আধপোড়া সদর দরজাতে হাত দিতে চাইল। মামণির বাবা ওর হাত ধরল, “ ঢুকবি না, ঢুকবি না বলেছি না। তার উপর দু-দুটো মানুষ। বাড়ির ভিটে ছেড়ে যায় না ওরা। ঢুকবি না বলেছি, গায়ে লেগে এসে পড়বে।” ওকে মানুষটি ছ্যাঁচড়ে নেবার মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। “ চল না , বলছি জোরে চল। আর্মির গাড়ি এখন ফিরে যাবে। ওদিকে তাকাবি না।গায়ে করে লেগে আসবে।
    মালতীর এমনটি মন হলো যেন এই রঘু আর মানণির বাবার কথাগুলো একই। কেবল রঘু ‘র’ বলতে পারেনা,মণির বাবা পারে।

    টীকা:
    ১)মণিকূটঃ নামঘরের পূর্ব বা উত্তর দিকে বিগ্রহ ভাগবত ইত্যাদি স্থাপন করবার জন্যে ছোট ঘর।
    ২) দবাঃ নাগরার আকারে গড়া একধরণের বাদ্য , যাকে ছোট লাঠির ঘায়ে বাজাতে হয়।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪১495478
  • অধ্যায় আট (৮)
    শিবিরে মুখ্যমন্ত্রী আসবেন। পায়খানা, পেচ্ছাব পরিষ্কার করা হচ্ছে। এখানে ওখানে চুন দেয়া হচ্ছে। ফেনাইল ছেটানো হচ্ছে। ভাতের সঙ্গে এসেছে মাছ! চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার , ঔষধ। মোটের উপর শিবিরে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। মণি মাথা আঁচড়ে কাপড় চোপড় পরে এদিক ওদিক দৌড়ো দৌড়ি করছে। মানুষে এখানে ওখানে জটলা পাকিয়ে এ কথাই বলাবলি করছে। মুখ্যমন্ত্রী হাত খুলে দেবে। প্রত্যেক পরিবারকে এক বান্ডিল করে টিন আর পাঁচ হাজার করে টাকা দেবে। আজই দেবে । মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে হাতে হাতে দেবে। সত্যি সত্যি ট্রাকে করে চিকচিকে সাদা টিন এসে গেল। লোকগুলো যে যার ঘরে ফিরে যাবার কথা ভাবছিল। টিনই যখন এলো পাঁচ হাজার টাকা কি আর না এসে থাকবে? শিবিরগুলোর থেকে অল্প দূরে খোলা মাঠে লোকগুলো জড়ো হয়েছে। অল্প পরে হেলিকপ্টার আসবে। প্লাস্টিকের কাপড়ের ঘরগুলোর সবক’টাই খালি হয়ে গেল।
    ফেলানি হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। শরীরটা অস্বস্তি করছে। থেকে থেকেই একটা ব্যথা চাগিয়ে উঠছে। সে পেটে হাত দিয়ে দেখল, বেশ ক’দিন ধরে একই আছে। সাড়া শব্দ নেই। বাঁশের একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে সে বসে রইল। খানিক বসে থাকার পর কোঁকাতে শুরু করল। ওর চারদিকে আবারো এক কুয়াশা রঙের কাপড়। অনেক দূর থেকে সে শুনতে পেল, “ মালতী , তুই এমনটি করবি না তো...।” একটা রোগা হাত ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিল। কান জুড়ে পেখম তোলা ময়ূর । শাখা ক’গাছাতে লেগে আছে নারকেল তেলের গন্ধ। একটা মানুষের অদ্ভুত গোঙানো শোনা যাচ্ছে। কাছে চলে আসছে দবার শব্দ ...। কেউ যেন ফেলানিকে তুলে ধরেছে।
    যখন সে চোখ খুলল, ওর নাকে লাগল তীব্র ঔষধের গন্ধ। শিবিরের অস্থায়ী চিকিৎসালয়ে ওর এক মরা মেয়ে হলো। সে উঠে বসল। শরীরটা হালকা হালকা লাগছে। একটি মেয়ে ওকে জিজ্ঞেস করল, “ মরা বাচ্চাটা দেখবেন কি ? জমাদার নিয়ে যাবে যে।” সে বড় আস্তে আস্তে বলল, “ছেলে না মেয়ে ছিল?”
    “মেয়ে । বেবিটা বেশ মেচিওরই হয়েছিল।”
    “একবার দেখব ওকে।” নার্স একটা গামলাতে করে বাচ্চা একটা নিয়ে এলো। পুরোটা শরীর ভেজা,এক মাথা কালো চুল। এই টুকুন হাত পা নিয়ে এইটুকুন ছোট্ট একটি মেয়ে। গায়ে কিছু নেই। গায়ের রঙটা নীল হয়ে গেছে। অবশ হাত পায়ের ছাল চামড়াগুলো কুঁচকে গেছে। সে হাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে একবার ছুঁয়ে দেখল, ঠাণ্ডা। ঠিক যেন একটা পাথরের মতো। একটা লোক এসে মেয়েটি শুদ্ধ গামলাটাকে বাইরে নিয়ে গেল। সে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে রইল। ওর চোখদুটো শুকনো। লাল। বালি পড়লে যেমন করে তেমনি খচমচ করছিল।
    তিনদিন থেকে অস্থায়ী হাসপাতাল থেকে ও বেরিয়ে এলো। এসে মাথা ভিজিয়ে স্নান করল । অনেক দিন সে অমন করে স্নান করে নি। স্নান করে ওর নিজেকে বেশ হাল্কা বোধ হলো। চুল আঁচড়ে সিঁথিতে দেবার জন্যে একটু সিঁদুর আনবে বলে মামণির মায়ের কাছে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর কানে বেজে উঠল রঘু ভোঁদাইর ‘র’ বাদ পড়া শব্দগুলো...। “ মলি বাবা পুকুলেল থেকে নামঘল...মাথা নেই, চোখ নেই, মলি বাবাকে...” ওর শরীরের ভেতরেই যেন ওই ভোদা মানুষটার অদ্ভুত গোঙানো পাক দিয়ে উঠছে। মাথার থেকে পা অব্দি গোঙানিটা নেমে যায় , আবারো পায়ের থেকে উঠে আসে। সে সিঁথি ঢেকে চুলগুলো পেছনে খোপা করে বেঁধে ফেলল । ঘন কালো চুলের ভেতরে খালি সিঁথিটা ঢেকে গেল। কাপড় ধোঁয়া সাবানের জল চোখে ঢুকেছে বলেই বোধ হয় ওর চোখ জোড়া জ্বলছিল। চাদরের পাড়ে মুখের থেকে নিয়ে অল্প গরম ভাপ লাগিয়ে তবে যেন সে অল্প আরাম পেল।
    বাইরে হুলস্থূল লেগে গেছে। এ রকম হুলস্থূল লেগেই থাকে। কালও লেগেছিল ঐ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে নিঃস্ব বুড়ি দিদিমা আর ওর নাতনি রুণুকে নিয়ে। রুণু সতেরো বছরের উঠতি মেয়ে। সে বিকেলে লম্বা চুল খুলে সামনে নিয়ে শিবিরের গেটে দাঁড়িয়ে থাকে । ওর বয়সই এমন। এই মুহূর্তে কাঁদলে পর মুহূর্তে আবার হাসতে পারে। সে শিবিরের পচা চালের ভাত খেয়েও ফুলের মতো ফুটতে পারে। কারো থেকে একটু মিঠা তেল চেয়ে নিয়ে কৌটা একটার ঢাকনিতে প্রদীপ বানাতে পারে। তাতে আবার ছেঁড়া ন্যাকড়ার সলতে জ্বালিয়ে কাজল বানাতে পারে। সেই কাজলে নিজের চোখও সাজাতে পারে। এই রুণুকে নিয়েই হুল্লোড়টা বেঁড়ে চলেছে। গতকাল ও শিবিরে দিদিমাকে নিয়ে শুয়েছিল। প্লাস্টিকের ফাটা বেড়া দিয়ে মাঝ রাতে দুটো ছেলে ঢুকে পড়ে ওকে বাইরে তুলে নিয়ে গেছিল। ছেলে দুটো কারা ও চিনতে পারে নি। চীৎকার চেঁচামেচিতে ওকে ওরা ফেলে রেখে চলে যায়। আজো তারই জের চলছে।
    ক্রমেই শিবিরে সার্বজনীন রান্নাঘরগুলো উঠে গেল। সে জায়গাতে এখন এক থপথপে উন্মুক্ত পায়খানা। রোদ দিলে উপরে এক কালো প্রলেপ পড়ে। বৃষ্টি দিলে কাদার মতো আবার বিষ্ঠাগুলো বেরিয়ে পড়ে। চারদিকে সেই বিষ্ঠার গন্ধ ছড়িয়ে থাকে । সেখানে সাদা সাদা একধরণের পোকা হয়েছে। একটু বৃষ্টি দিলেই দলে দলে পোকাগুলো ছড়িয়ে পড়ে কিলবিল করতে থাকে। ঝুপড়িগুলোর প্লাস্টিকগুলো ফুটো হয়ে গেছে। রোদ বৃষ্টি কোনোটা থেকেই বাঁচাতে পারে না। শিবিরের অর্ধেক মানুষ চলে গেছে। যারা আছে ওদের অসুখে ধরেছে। একবার যদি রক্ত পায়খানা হয় তো অন্যবারে বমি পায়খানা তো পরের বারে জ্বর।
    মামণির বাবারা পুরোনো ভিটেতে গিয়ে উঠেছে। একেবারে শুয়ালকুচির পিতৃ-ভিটা। দাদু-দিদা মারা যাবার পর সাহা পরিবার বাংলাতে চলে গেছে। সুভাষ মাষ্টারের পরিবার গেছে কোচ বিহারে। মাস্টারণীর বাপের বাড়ি ওখানে। সে শুনতে পেয়েছে , এমন কি গাঁওবুড়াও সেই গ্রাম ছেড়ে গেছে, শহরে বাড়ি ঘর করেছে। শিবানীদের পরিবার শিলিগুড়িতে, ওখানে নতুন করে ব্যবসা ধরেছে। পুরো গ্রামটিতে যে ক’জন থেকে গেছে ওদের আঙুলে গোনা যায়। এখন ওই আধপোড়া গ্রামটিতে শুধু ‘র’ বলতে পারে না যে লোকটা সেই গোঙাতে গোঙাতে ঘুরে বেড়ায়। সে সব খবর পাচ্ছে, বাতাসে খবর ঘুরে বেড়ায়। ভাবছিল সে যায় কই। ওর বরের যে বাড়িটি কোনোদিন দেখেনি ওখানে সে কী দাবিতে যায়? বেজাতের মেয়ে, তায় বিধবা। ওকে রাখবে কে? মামণির মা বাবা শুয়ালকুচিতে যাবার কথা বলছে। মানুষটার নিজেরই মাথার উপর কিছু নেই। তবু যে বলছে ! সেকি যাবে একবার মণির হাতে ধরে মৌজাদারের বাড়িতে? পড়ে থাকবার জন্যে একটা কোণ আর থাকবার জন্যে উচ্ছিষ্টের ভাগটুকুও কি সে পাবে না? কী বলে পরিচয় দেবে?
    ক্যাম্পের চাল মুঠো সেদ্ধ করে মণিকে খেতে দিয়ে বাকি সময় সে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকে। শব্দ একটা শুনবে বলে খানিক ক্ষণ এমনি বসে থেকে রোজ সে ঘুমে ঢুলতে থাকে। তার পরেই শুরু হয় চোখের সামনে সেই ছবিগুলোর যাওয়া আসা। হাতির পিঠে উঠে যাচ্ছে এক ভর যৌবনের তরুণী। তারা গাছের ডোবাতে পড়ে থাকা একটি তরুণ। সারা গায়ে দখনা পরে সারাক্ষণ হাসে একটি মেয়ে। আর একটি পুরুষ যে জানে না ভয় কাকে বলে । বিছানাতে পড়ে কোঁকাচ্ছে ওর বৌ আর সে যায় ওকে একা রেখে ধাইয়ের খোঁজে। যতই ওর চোখ দুটো বুজে আসে ততই স্পষ্ট সেই ছবিগুলো সে দেখতে শুরু করে। কুশিয়ার খেতের হাল্কা আঁধারে পায়ে লেগে ছিটকে পড়া শিশুর এক ফালি কোমল দেহ । দুটো অদ্ভুত সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর কেউটে। রক্তমাখা দুটো মুরগীর বাচ্চা। গামলা একটাতে একটি অবশ নীল মেয়ে সন্তান । প্রায়ই সে মহিলাটির থেকে গামলাটি কেড়ে নেয় । দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে শক্ত বাহুর পুরুষ একজনের গায়ে । স্পষ্ট শুনতে পায় সে শুকনো গলার স্বর , “ এমনটি করবি না তো মালতী, এমনটি করবি না তুই!” গামলার থেকে মেয়েটি উঠে আসে , বাতাসে কেঁপে উঠে এক মাথা কালো চুল। প্রায়ই এমন হয়, মণি ওর মাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে উঠিয়ে দেয়—“ মা! ও মা! তুমি হাসছ কেন?” “ ও মা অমন করে কাঁদছ কেন?” “ ও মা! চেঁচাচ্ছ কেন?” সে কিছু বলতে পারে না। মণি টের পায়, মাকে সবাই আধ পাগলী বলে বলতে শুরু করেছে। সে আজকাল খেলাধুলো করে বেড়ায় না, মায়ের কাছে কাছে থাকে।
    সেদিন মণির ভীষণ খিদে পেয়েছিল। ঠেলা ধাক্কার মধ্যে মা চাল তুলে আনতে পারে নি। সে কিছু লাকড়ি আর পায় যদি, তবে কিছু বন্য কচুর খোঁজে গেছিল। কখনো কখনোবা কাজের খোঁজেও বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে। সে দোকান দাকানে গিয়ে কাজের কথা বললেই , ‘ভাগ ব্যাটা বাচ্চা , কোথাকার ! কী কাজ করবিরে তুই!’ বলে লোকে তাড়িয়ে আসে। তবুও সে একদিন এক হোটেলে গ্লাস বাটি ধুয়ে এক বেলার ভাত আরেক দিন এক দোকানে পচা পেঁয়াজ বেছে পাঁচ টাকা রোজগার করেছিল। খিদেতে থাকতে না পেরে শিবিরের একেবারে শেষের দিকে থাকে যে মেয়েগুলো, ওদের ওখানে গিয়েছিল। ওদিকে ওকে যেতে মানা করা হয়েছিল। একদিন কৌতূহলের বশে ওদিকে যাবার দায়ে সে আর রন্টু মামণিদি’র বাবার হাতে মার খেয়েছিল। মণি জানে এই মেয়েদের কাজ করে দিয়ে বিজয়, কুলু, যোগেনরা পয়সা রোজগার করছে। ওদের গায়ের জামা ছেঁড়া নয়, ওরা খালি পেটেও থাকে না। মণি এক পা দু’পা করে ওখানে চলে গেছিল। তখন সন্ধ্যে হয় হয়ে। সে দাঁড়িয়ে ছিল। একটি লোক নীল প্লাস্টিকের চাল আর চাটাইতে তৈরি বেড়ার একটি ঘরের থেকে বেরিয়ে এসে ওর হাতে তিনটা দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে সোজা সামনে আঙুলে কিছু দেখিয়ে দিল। মণি কিছুই না বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে রইল । বিজয় এসে ওর কাছে দাঁড়ালো, “ কী হলো বে ? বাবুর মাল এনে দে জলদি!”
    “মাল ? কী মাল?” মণি একটু অবাকই হলো। ইতিমধ্যে কুলু আর যোগেনও এখানে এসে গেছে।
    “ বুদ্ধু।“ কুলু ওকে গালি দেবার মতো করে বলল।
    “ নতুন লাইনে এসেছে, আস্তে আস্তে শিখে যাবে।” বিজয় বড় মানুষের মতো গাম্ভীর্য নিয়ে কথাটা বলল।
    “ যা মণি ভায়া! ঐ দোকানের থেকে এক পেকেট পেপেসি এনে লতাদি’র ঘরে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিবি।”
    “ খবরদার বাচ্চা ছেলে! বেড়া দিয়ে ভেতরে তাকাবি না। বাবুদের মৌজ করবার সময় এটা।“ যোগেন স্বর আরো বেশি বড় মানুষের মতো ।
    “ পেপসি?” মণির কথাতে বিজয়ের রাগ উঠে গেল।
    “ তুই লতাদি’র হাতে মার খাবি, বুঝলি?” বিজয় মণির হাতে ধরে শিবিরের মাঠটা পার করে রাস্তাতে নিয়ে গেল। রাস্তার কাছে একটা পান সুপারির দোকান।
    “ দেখ, ঔ দিকে দেখ।” বিজয় মণিকে দোকানের পেছনের দিকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিল। বিজয়ের নির্দেশ মেনে পান সুপারির দোকানের পেছনে তাকিয়ে দেখল একটি গর্ত ভরে ফেলেও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে সাদা কালো নীল সবুজ এক গাদা প্লাস্টিকের বেগ ।
    “ এগুলো পেপসির পেকেট , বুঝলি?”
    বিজয় মণিকে দুটো তরল পদার্থে ভরা পলিথিনের পেকেট কিনে দিল। সে যেমনটি শিখিয়ে দিয়েছিল মণি সেই রকমই প্লাস্টিকের নীল কাপড়ে তৈরি দরজার নিচে ছিঁড়ে যাওয়া টুকরোর ফাঁক দিয়ে পেকেটগুলো রেখে এলো। ওর হাতে রইল পুরো একটি দশ টাকার নোট। বিজয় তাকে ছোট ছোট চালাগুলো একটা একটা করে চিনিয়ে দিল। এক নম্বর লতাদি, দুই নম্বর মেনকা, তিন রুমি, চার রানি, পাঁচ জবা, ছয় সীতা, সাত গীতা। বিজয় ওর শিক্ষার প্রমাণ নেবার জন্যে জিজ্ঞেস করল, “ তুই এখন কাকে পেপসির প্যাকেট দিয়ে এলি, বল দেখি?”
    মণি ঘরগুলো গুনে গেল, এক দুই তিন...। পাঁচ নম্বর চালাটির দরজার তলাটা ছেঁড়া। তার পরেই হেসে ফেলে বলল,
    “লতাদি।”
    “ ঠিক। এ লাইনে তুই আমাদের থেকেও ওস্তাদ হবি।”
    মণি আর বিজয় দেখতে পেল ছোট চুলের একটা মোটা লম্বা লোক এসে দাঁড়িয়েছে । বিজয় মণির কানে ফুসফুসিয়ে বলল, “এ ফৌজের লোক। এ লাইনের সবচে’ ভালো কাস্টমার।” লোকটিকে সে তিন নম্বর চালাটিতে নিয়ে গেল। ঢোকার আগে লোকটি ওকে টাকা দশটা দিল। আরেকটি কালো মোটা পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোক এসে দাঁড়ালো । বিজয় মণিকে ঠেলে দিল, “ যা মণি, এক নম্বরে নিয়ে যা।” মণি মুখে কিছু না বলে লোকটিকে ডাক দিল। এক নম্বরের লতাদি বেরিয়ে এসে মণিকে আদর করে টাকা দুটো ধরিয়ে দিল। লোকটিও টাকা পাঁচটা দিল। সতেরো টাকা হাতে নিয়ে মণির মনে পড়ল চাল বেছে সে পেয়েছিল মাত্র পাঁচ টাকা। মণি দেখল যতই রাত বাড়ছিল বিজয়দের কাজ আর দৌড়া দৌড়িও বেড়ে যাচ্ছিল। সেও ওদের সঙ্গে দৌড় ঝাঁপ শুরু করে দিল। শীঘ্রই ওর সতেরো টাকা বেড়ে বাইশ টাকা হলো।
    বিজয় মণিকে জিজ্ঞেস করল, “ তুই এই বাইশ টাকাতে কী কিনবি?”
    “চাল।“ মণির সোজা উত্তর।
    “ ক্যাম্পে চাল দেয়া প্রায় বন্ধই হলো। চাল যখন দিচ্ছিল এ লাইনে তখন কোনও বিজনেসই ছিল না।। চাল যতই কমিয়ে দিয়েছে, এ লাইনে ততই বিজনেস বেড়ে গেছে।”
    “ তোদের কি রোজই এমন রোজগার হয়?”
    “ নসিব থাকলে হয় বে।”
    “ তুই কি স্কুলে গেছিলি?” বিজয় , যোগেনদের দেখে মণির নিজের স্কুলটাকে মনে পড়েছে।
    “ গেছিলাম। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত উঠেছি। তারপরেই তো গোলমালটা হলো”
    “ তোর বাবা আছে?”
    “ আছে। বরং আমার মাই নেই। গোলমালে মা আর দিদি মারা গেল। বাবার পায়ে গুলি লেগেছিল। এখানকার ডাক্তার গুলিটা বের করে দিয়েছে। কিন্তু পা-টা পচতে শুরু করেছে। কিছুই করতে পারে না। বোন একটি আছে।” বিজয় অল্প আগে পেপসি কিনে আনতে গিয়ে দুটো মর্টন কিনে এনেছিল। তারই একটা মণিকে দিল।
    “ গোলমালে তোর কে মারা গেল?”
    “ বাবাকে হারিয়েছি।” মণির চোখে জল এসে পড়েছিল।
    “ মা আছে?” বিজয় মণির কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
    “ সবাই বলছে, মা বুঝি আধা পাগল হয়ে গেছে।”
    “ কী করবি? গোলমালের পর সব মানুষেই আধ পাগলা হয়ে গেছে। আমার ছোট্ট বোনেরও তোর মায়ের মতো অবস্থা।
    সেও এটা ওটা দেখিয়ে অনবরত কী সব বকতে থাকে। সে মা আর দিদিকে...।” বিজয়ে গলার স্বর বসে গেল।
    মণি দেখল মা ওর দিকে আসছে। মা এসে ওর হাতে ধরল , “ চল।” সে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা দিল।

    * * *

    সেদিন রাতে মণির রোজাগারের টাকাতে ভাত খেতে খেতে সে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। ছেলেটিকে নিয়ে এই নর্দমার থেকে সে বেরিয়ে যাবে। ভাত খেয়ে মুখ ধোবার পরেই বৃষ্টি দিয়েছিল। বৃষ্টিতে ছোট ছোট লেজের সাদা সাদা পোকাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।মামণির বাবার ফেলে যাওয়া ক্যাম্প-খাটটিতে মণি বেঘোরে ঘুমচ্ছিল। কিচ্ছুটি বলতে পারে না। ফেলানি সারা রাত, মণি কোত্থেকে জোগাড় করে নিয়ে এসেছে একটা সাবানের বাক্স , তাতে বসে জেগে কাটিয়ে দিল। ওর মনে হঠাৎই একটা ভয় ঢুকল, এই কিলিবিলিয়ে আছে যে পোকাগুলো ওদের একটাও যদি ওর ছেলের শরীরে ঢুকে পড়ে ! বেয়ে বেয়ে নাকে, কানে, শ্বাস নেবার জন্যে সামান্য মেলানো মুখ দিয়ে যদি পোকাগুলোর একটাও ওর শরীরে ঢুকে যায়! কী হবে তখন? একটা মোম জ্বালিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল পোকাগুলোকে। পলিথিনের একটা থলে হাতে পরে নিয়ে পিষে পিষে মেরেছিল সারাটা রাত। মাছের পেটির মতো পোকাগুলোর শরীর থেকে দলা দলা যে জিনিসগুলো বেরুচ্ছিল তাতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছিল ওর হাতের পলিথিনের থলেটা। একটি বারের জন্যেও চোখের পাতা ফেলেনি। একটিবারের জন্যেও সেই ছবিগুলো ওর চোখের সামনে আসে নি।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪১495479
  • অধ্যায় নয় (৯)
    চাল প্রায় পাওয়াই যায় না । অল্প যেটুকে আসে মানুষে কাড়াকাড়ি লাগিয়ে দেয়। সে আর মণি প্রায়ই ওই কাড়াকাড়ির মধ্যে গিয়ে ঢুকতে পারে না। ওদের ভাগের চাল প্রায়ই বুলেন গিয়ে এনে দেয়। বুলেন শরণীয়া১ মানুষ। ফেলানিকে নিজের বলে ভাবে। কিনারামের লতায় পাতায় ও কিছু একটা হয়ও। সেই সূত্রেই সে ফেলানি আর মণিকে নিজের বলে ভাবে। বুলেন ওর মা না দিদিমার থেকে যেন কিনারাম রত্নমালার গল্প শুনেছে। বুলেনই আগে ভাগে গিয়ে ওদের ভাগের টিন ক’খানাও গুটিয়ে দিয়েছিল। পয়সাপাতি সেও পায়নি, মণিরাও পায়নি।
    বুলেন ছেলে ভালো , স্বাস্থ্যও ভালো। শরীরের রঙ লালচে সাদা। চোখদুটো অল্প ছোট, নাক তীক্ষ্ণ। মাথাতে চুল আর মুখের দাড়িও ঘন। বুলেনদের গাঁয়ের মানুষের চেহারা পাতি সাধারণ বডো মানুষের থেকে অল্প আলাদা। ওদের গ্রাম সম্পন্ন গ্রাম। বুলেনের অবস্থাও ভালো। খেত খামার রয়েছে। বছরের খোরাকি বাদেও কিছু ধান বিক্রি করতে পারে। বাড়িতে কর্মী মানুষ বুলেন মাছ দুধ ডিমের ব্যবসা করেও দু’পয়সা রোজগার করে। ও বিয়ে করেছে মাধব দাসের বোন সুমলাকে। মাধব দাস সে অঞ্চলের একজন সুপরিচিত বামপন্থী কর্মী। একদল মানুষ মাধব দাসকে যেভাবে মনে প্রাণে ভালোবাসে আর দলের কাছে তিনি তেমনি কালশত্রু। বিশেষ করে সেই যেবারে তাঁর পার্টির কর্মীরা জমি দখলের আন্দোলনে জয়ী হয়ে কয়েকজন কৃষকের জমির দখলী স্বত্ব ঘুরিয়ে দিল সেবার থেকে তাঁর আরো অনেক শত্রু বেড়ে গেল।
    সেদিন বোনকে দেখতে মাধব দাস এসেছিলেন। এসেছিলেন মানে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। সুমলা-বুলেনের প্রথম সন্তানের অন্নপ্রাশন ছিল। বুলেনের ইচ্ছে ছিল লোক ডেকে এনে পুকুরের রঙিন রৌ মাছ দিয়ে ভাত দুমুঠো খাওয়াবে। দেশের অবস্থা দেখে মনের কথা মনে চেপে মামাকে ডেকে কাজটি সংক্ষেপে সারাই ঠিক করলো। ও বেছে বেছে জাল ফেলে লাল হয়ে ওঠা একটা রুই মাছ তুলেছিল। এক জোড়া পায়রাও মেরেছিল। সুমলা সেই সকাল বেলা স্নান করে গিয়ে রান্না ঘরে ঢুকেছিল। ঘর উঠোন সেই তাজা মাছের ভাজার গন্ধে মোঁ মোঁ করছিল। গোবর মাটিতে লেপা উঠোনে খিলখিল করে খেলছিল দাসের ছোট্ট ভাগ্নেটি। মামা ওর জন্যে একটা জামা ছাড়াও এনেছিল একটা স্লেট, ‘কুঁহিপাত’ ২ এবং পেন্সিল। মাধব দাসের সঙ্গে এসেছিল পার্টির কর্মী রত্নেশ্বর বৈশ্য। ভাত বাড়া হয়েছিল। মামা ভাগ্নের মুখে প্রথম অন্ন বলে পায়েস এক চিমটে দিতে গেছিলেন। ঠিক সেই সময় ‘জয় আই অসম’৩ বলে ধ্বনি দিয়ে এক দল ছেলে বুলেনদের বাড়িটাকে ঘিরে ফেলল। বুলেনের সে ভয় ছিল। সম্বন্ধীর জন্যে তাকেও বহু দিন বহু কথা এই আন্দোলনকারীদের থেকে শুনে সহ্য করে যেতে হয়েছে। পাড়া প্রতিবেশীদের বলে রেখেছিল অল্প চোখ কান খোলা রাখতে। কে কোন দিকে চোখ রাখবে ? ছেলেগুলো হাতা হাতে দা, সাইকেলের চেন, লাঠি বল্লম নিয়ে এসে পুরো বাড়িটা ঘিরেই ফেলল।
    “বদনকে৪ বের করে দে!”
    “ ঘরের শত্রু বিভীষণকে শেষ করে ফেল!”
    “ বেরিয়ে আয় কুকুর !”
    “দুটো বদনকে আজ বলি দেয়া হবে!”
    চিৎকার চেঁচামেচিতে সুমলার লেপা মোছা উঠোনখানা ভরিয়ে তুলল। সুমলা আর বুলেন বাচ্চা মেয়েকে কোলে করে নিয়ে বেরিয়ে এলো। নমস্কার জানিয়ে গলবস্ত্রে এই চ্যাংড়া ছেলেগুলোকে সরাইতে৫ করে পান তাম্বুল৬ এগিয়ে দিল । দু’জনেই ওদের বলতে যাচ্ছিল যে এই শিশুকে মুখে ভাত দেবে বলে ওর মামা এসেছে। কিচ্ছুটি বলতে পেল না। ভেতর থেকে রত্নেশ্বর আর মাধব দাস বেরিয়ে এলেন। জংলি৭ কুকুরের পাল যেমন শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি সেই ছেলেগুলো মাঝবয়সী এই মানুষ দুটোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাঁড়ার ঘর থকে দা একটা নিয়ে চিৎকার করে বুলেন ওদের তাড়িয়ে গেল। জনা দুয়েকে মিলে বড় লাঠিতে ঘা দিয়ে ওকে ভাঁড়ারের সামনেই ফেলে দিল। কাছে রাখা এক মকৈর বাঁধা আটির উপর বুলেন পড়ে গেল। ওর মুখের রক্তে লাল হয়ে গেল ওরই হাতে চাষ করে গুটিয়ে রাখা মকৈর সোনালি রঙ। এমন ঘটনা দেখে যারা জড়ো হয়েছিল সেই পাড়া প্রতিবেশিরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদেরই দু’একজন বুলেনকে তুলে নিয়ে গিয়ে নাগা ঘাস কিছুটা থ্যাঁতলে ক্ষততে লাগিয়ে দিল।ভাগ্য ভালো যে উপরে উপরে কিছুটা আঘাত পেয়েছে। খানিক পরেই রক্ত পড়া থেমে গেল। একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ওকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল। মানুষটি সেখানে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইল।
    মাধব দাস আর রত্নেশ্বর বৈশ্যকে ওরা হাতে পায়ে গলাতে রশি বেঁধে টানতে শুরু করল। দেড় কিলোমিটারের মতো পাথরে ভরা পথে ওরা ওদের টেনে ছ্যাঁচড়ে নিয়ে গেল। নিজেদের পার্টি অফিস পাবার আগে ঐ জংলি কুকুরেরা মানুষ দুটোর হাতের আঙুল কেটে টুকরো টুকরো করে পথের কুকুরকে খেতে দিল। ওদের শরীরের রক্তে পথের পাথর লাল হয়ে গেল। পাগল কুকুরগুলোর পেছনে পেছনে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়োচ্ছে সুমলা, “দাদা! ও দাদাগো! আমি তোমাকে ডেকে আনলাম গো...ছেড়ে দে ছেড়ে দেরে আমার দাদাকে...!” মাধব দাসের আঙুলই ওরা প্রথম কাটল। আঙুলটা দেশি কুকুর একটার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে একজন বলল, “ নে খা রে! বদনের মাংস, টেস্ট আছে।” ডান হাতের মধ্যমাটি অল্প শুঁকে কুকুরটি লেজ তুলে দৌড়ে পালালো। সুমলা সেই কুকুরটির দিকে তাকিয়ে সেখানেই গড়িয়ে পড়ল। একজন বডো চাষি ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে বাড়ি নিয়ে গেল। চোখে মুখে জল ছিটিয়ে ওর জ্ঞান ফেরবার চেষ্টা করল।
    পার্টির কার্যালয়ে মাধব দাস আর রত্নেশ্বর বৈশ্যের শরীরের ছাল তুলে তুলে নুন আর খার মাখে দেয়া হলো। চোখ দুটো খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলল। এক সময় বদন নীরব হয়ে গেল।
    বুলেনদের গাঁয়ে সেদিন কারোরই ঘরে চুলো জ্বলে নি। বুলেন, সুমলা আর ওদের বাচ্চা ছেলেটিকে ঘিরে গ্রামের মানুষ সারা রাত জেগে কাটিয়ে দিল। গ্রামের থমথমে নীরবতাকে যেন সুমলা নিজের বুকে বেঁধে ফেলেছে। সেই যে নীরব হলো, আজ অব্দি ওর গলাতে কোনও স্বর বেরোয় নি। হাসি খুশি মানুষটি পাথরের মতো জড় হয়ে গেল। তার কিছু দিন পরেই বুলেনদের ঘরে আগুন দিল। পাথর প্রায় স্ত্রী আর শিশু পুত্রকে বুকে তুলে নিয়ে বুলেন এই শিবিরে এসে উঠল।
    মণির মা প্রায়ই তাকিয়ে দেখে , বুলেন হাজিরা করে এসে বৌয়ের মুখ হাত ধুইয়ে দেয়। ছেলেটিকেও হাত পা ধুইয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। ভাত রাঁধে। নিজেও খায়। বৌ ছেলেকেও খাইয়ে দেয়। কখনো বা বৌ ভাত খেতে চায় না, মুখ চেপে রাখে। অসীম ধৈর্যে বুলেন এক গ্রাস দু গ্রাস করে ওকে ভাত খাওয়ায়। সে লক্ষ্য করেছিল বুলেন হাজিরার কাজ করতে গেলে সঙ্গে করে ছেলেটিকেও নিয়ে যায়। মা যে থাকা না থাকা একই। যখন ফিরে আসে ছেলেটির তখন খিদে তেষ্টাতে একেবারেই কাহিল অবস্থা। কিছুদিন থেকে ফেলানিই ওকে রাখছে। কোনও অসুবিধে নেই। এক মুঠো খাইয়ে দিলে মণির সঙ্গে খেলতে থাকে। সে জন্যে এইটুকুন করতে পেয়ে ওর ভালোই লাগে। বুলেনও ফেলানিকে বৌদি বলে ডেকে ওর জন্যে কম করেনি কিছু।
    হাজিরা কাজ করে এসে রোজ যেমন করে , বুলেন ভাত রাঁধল। বৌয়ের হাত মুখ ধুয়ালো। ভাতও খাওয়ালো। ছেলেটির জন্যে ওর আজকাল আর বেশি ভাবনা নেই। মণির মাই দেখাশোনা করে। আজ ভাত খাওয়াবার বেলা স্ত্রী ওর বাহুতে আঁচড়ে লাল করে ফেললে। বোবা মহিলাটি মাঝে মাঝেই এমন রেগে উঠে। এমনটি হলেই সে ওকে ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে দেয়। চাল জোগাড় করতে না পারলেও সে ঔষধটা ঠিক জোগাড় করে রাখে।
    সেদিন সুমলার উন্মাদনাতে পেয়েছিল। হাতে ছুরি একটা নিয়ে লোক জনকে তাড়াতে শুরু করেছিল। কেউ কাছে আসতে পারছিল না। কেউ ওর চোখে মরিচের গুড়ো অল্প ছিটিয়ে দিল । জ্বালাতে চিৎকার করে সে বসে পড়ল। সেই সুযোগে কেউ একজন একটা রশি এনে বেঁধে ফেলল। বুলেনের তৈরি চালাটার একটা খুঁটিতে ওকে বেঁধে রেখে সবাই চলে গেল। মুখে ফেনা বের করে সুমলা ওখানেই পড়ে রইল।
    ফেলানি দূর থেকে একবার সুমলাকে দেখে সরে এলো। হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে করতে প্লাস্টিকের রশি রক্তে লাল হয়ে গেছে। চোখ জোড়াও রক্তের মতো লাল হয়ে পড়েছে। ছেলেটি পাশে কাঁদছে। ওকেই কোলে তুলে ফেলানি চলে এলো। নিজের চালাতে ঢোকার মুখে ও দেখল পাগলিকে ছেলে ক’জন পাথর ছুঁড়ে মারছে। সে ওদের তাড়িয়ে যেতে ছেলেগুলো পালালো। ছেলেটাকে হাত পা ধুইয়ে এক মুঠো খাইয়ে দিতে দিতে বুলেন এসে পড়ল। এসেই সে বৌয়ের বাঁধন খুলল। ফেলানি তাকিয়ে রইল। এতোক্ষণ যে চেঁচাচ্ছিল সে একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল। শিশু ছেলেটিকে স্নান করিয়ে এক বালতি জল নিয়ে বুলেন সুমলাকেও স্নান করিয়ে দিল । তারপরে ওকে চাঙে৮ তুলে শুইয়ে দিলে । ইকড়ার বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল বুলেন চুলোতে আগুন দিয়েছে। আগুনের আলোতে যে মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল তাতে দুনিয়ার যত ক্লান্তি। কিন্তু চোখজোড়াতে রয়েছে একটা শান্ত ভাব। সে একটা থালাতে ভাত বেড়ে বিছানাতে রাখল। তারপর বৌয়ের মুখখানা কোলে নিয়ে এক গ্রাস এক গ্রাস করে খাওয়াতে শুরু করল। পাগলি কোনও গোঁ গা করল না। খেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ল। বুলেন খানিকক্ষণ ওর চুলে হাত বুলিয়ে গেল। ফেলানি যেন এক অস্পষ্ট গানের গুণ গুণ শুনতে পেল।
    বুলেন বেরিয়ে এলো। এক মগ জল নিয়ে চোখে মুখে দিয়ে সে এবারে ফেলানির চালার মুখে দাঁড়িয়ে ডাক দিল, “ বৌদি, ও বৌদি ! ছেলেটা কি শুয়ে পড়েছে?” সে বেরিয়ে এলো। ক্লান্ত বুলেনকে একটা মোড়া এগিয়ে দিল। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বুলেন ওকে বলল, “ বুঝলে বৌদি ! ভাবছি আমরা এখান থেকে চলে যাব।“
    “ কোথায় যাবি?”
    “শহরের সামনেই একটা জঙ্গল আছে। সেখানে অনেকেই গিয়ে বসেছে। আগে থেকেই একটা বস্তি ছিল। এখন সেটিই বাড়ছে।”
    “যা ভালো বুঝিস কর।” ওর বুকখানা কাঁপছিল। একজন একজন করে শিবির থেকে মানুষজন চলে যাচ্ছে। বেছে বেছে, ঐ পরের হাড়ি ভেঙ্গে খায় যে ক’টা বদমাশ, ওরাই থেকে যাবে এই নর্দমাতে। বুলেন চলে গেলে ও কার ভরসাতে থাকবে এখানে? পাগলি হলেও সুমলা ওকে সঙ্গ দিত। আর দিত এই বাচ্চাটি। সে নিজের কোলে ঘুমোনো বুলেনের ছেলেটির দিকে তাকালো। একে ছেড়ে ও...। ফেলানির চোখের থেকে একফোটা জল শুয়ে থাকা ছেলেটির গায়ে পড়ল গিয়ে।
    “কী হলো বৌদি ? তুই দেখছি চুপ করে রইলি? চিরদিন এখানে থেকে যাবি বলে ভাবছিস বুঝি?”
    “যাব কোথায়?” ওর চাপা গলাতে বলল।
    “কেন, আমরা যে বস্তিতে যাব সেখানে যাবি। টিন ক’টাতো আছেই। ঘর একটা নয় আমিই তুলে দেব।”
    “ আর মাটি?”
    “ ওখানেই বের করতে হবে।”
    “ না পারলে?”
    “ হবে কিছু একটা। শুরু শুরুতে গিয়ে ভাড়া ঘর একটা নিবি।”
    “ ভাড়া দেব কী করে? এখানে তবু মাঝে মধ্যে চাল এক দু মুঠো পাই। আশে পাশের দু’একটা লোকের ঘরেও কাজ পাই।”
    “ বৌদি ! মনটা শক্ত করে বেরো। কিছু একটা হবে।” বুলেন একটু থেমে আবারো বলল,” মনটা শক্ত করে আছি বলেই টিকে আছি, বুঝলি? সুমলাকে তুই ভালো থাকতে দেখলি না। মেয়েটি এমনিতেই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেল , বুঝলি।”
    ফেলানি দেখল জোয়ান মদ্দ মানুষটা কাঁদতে শুরু করেছে। বেটা মানুষের চোখে জল দেখে ওরও খারাপ লেগে গেল। বুলেন আর সে এক সঙ্গে দেখতে পেল পাগলিকে যে রশিটা দিয়ে বেঁধে রেখেছিল সেটি কয়েকটি কুকুর মিলে টানাটানি করছে। বুলেন চট করে উঠে গিয়ে কুকুর ক’টাকে তাড়িয়ে রশিটা তুলে বুকে নিয়ে নিলো। ফেলানির এমনটি মনে হলো যেন বুলেন রশি নয়, নিজের বৌকেই কুকুরগুলোর থেকে বাঁচিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। সে যেন একটা শুকনো গলার গুঞ্জন শুনতে পেল।
    বুলেনের ছেলেটিকে মণির কাছে শুইয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে এলো।হাতে একটি ভেজা কাপড়। সেই ভেজা কাপড়ে পাগলিকে যে খুঁটিতে বেঁধে রেখেছিল সেখানে লেগে থাকা রক্ত মুছে ফেলল।
    বুলেন শুতে যাচ্ছিল, ফেলানি জিজ্ঞেস করল, “কবে যাবি?”
    “ কালই যাই চল। আমি ঘর একটা দেখে রেখে এসেছি। পঞ্চাশ টাকা করে ভাড়া । কালী বুড়ির ঘর। টিন ক’টি লাগিয়ে নিতে হবে।”
    “ কোন বুড়ি?”
    “ গেলেই তো দেখবি।”
    ভেতরে সুমলার কোঁকানো শোনা গেল। বুলেন দৌড় দিল। ফেলানির হাসি পেয়ে গেল। এ যেন বিছানাতে শোয়ানো বাচ্চাকে কাঁদতে শুনে ওর মা দৌড়ে গেল। ঘুম না আসা অব্দি হাসিটা ওর মুখে লেগে রইল।।

    টীকা:
    ১) শরণীয়াঃ দীক্ষিত । যে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। বডোদের মধ্যে যারা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন তাদের সংক্ষেপে ঐ নামে বা ‘শরণীয়া কছাড়ি’ চিহ্নিত করা হয়।
    ২) কুঁহিপাতঃ নতুন বেরুনো কোমল পাতা। জনপ্রিয় অসমিয়া বর্ণপরিচয়ের বই।
    ৩) জয় আই অসমঃ জয় মা অসম। অসম আন্দোলনের সময় জনপ্রিয় হওয়া জাতীয়তাবাদী স্লোগান।
    ৪) বদনঃ বদন বরফুকন আহোম রাজপুরুষ ছিলেন। অষ্টাদশ শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরুতে (১৭৯৬-১৮২৬) অসমে মানের আক্রমণের জন্যে বদন বরফুকনকে দায়ী করা হয়। আহোম রাজসভার অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে ক্ষমতা নিজের কুক্ষিগত করবার আশাতে তিনি ব্রহ্মদেশে গিয়ে মানেদের ডেকে আনেন। পরের দশকগুলোতে মানের আক্রমণে অসম বিপর্যস্ত হয়। বহু ধন ও প্রাণ বিপন্ন হয়। সেই স্মৃতি অসমের মানুষ আজো ভুলেন নি। বদনকে তাই অসমে বাংলার মীরজাফরের মতো বিশ্বাসঘাতক রূপেই মানুষ মনে রেখেছে।
    ৫) সরাইঃ বিশেষ ধরণের একটি মাত্র পায়া সহ অসমিয়া পানের বাটা ।
    ৬) তাম্বুলঃ সুপারি । কাঁচা সুপারিকে বিশেষ উপায়ে পচিয়ে তৈরি। যা কেবল অসম নয় গোটা পূর্বোত্তরে এক জনপ্রিয় নেশা জাতীয় ফল।
    ৭) জংলি কুকুরঃ মূলে আছে ‘রাং কুকুর’। এর অর্থ 'বনরীয়া' বা জংলি কুকুর ।
    ৮) চাঙঃ বাঁশে বা কাঠে তৈরি খাট। শব্দটি স্থানীয় বাংলাতেও রয়েছে বলে রেখে দিলাম।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪২495480
  • অধ্যায় দশ (১০)

    আগে এই ছোট্ট শহরের সীমা ছিল ছেলে-মিশনটি। ছেলে-মিশন মানে হোস্টেলের সঙ্গে ডনবস্কো স্কুলখানা। স্বাধীনতার বছর বিশেক আগেই এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বেশ ক’বিঘা জমিতে বিশাল এলাকা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। খৃষ্টান মিশনারিরা মূলত এই শহরের লাগোয়া কয়েকটি বাগানের শ্রমিকের ছেলেমেয়েদের দিকে চোখ রেখেই এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। অন্য ডনবস্কো স্কুলের সঙ্গে সুদৃশ্য এই স্কুলের বিল্ডিঙের মিল থাকলেও এর চরিত্রের সঙ্গে অন্যগুলোর কোনও মিল নেই। হাইস্কুলটি অসমিয়া মাধ্যমের,ছাত্রেরা প্রায় সবাই বাগানের আদিবাসী ছেলেমেয়ে । ছেলে-মিশনের সঙ্গে সঙ্গে শহরের মানুষের খুব একটা সম্পর্ক নেই । শুধু ওই শনিবার বিকেলে যখন ফাদার লাইন ধরিয়ে ছেলেগুলোকে শহরের রাস্তা দিয়ে বেড়াতে নিয়ে যান তখন সে দৃশ্য লোকে বেশ একটা আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে। দৃশ্যটি অনেক বছরের পুরোনো, কিন্তু মনে হয় যেন চির নতুন। ‘ছেলে-মিশন’ শব্দটিও শহরের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত নাম।
    ছেলে-মিশনের আশে পাশে লোক জনের বসতি খুব নেই। আসলে এটি রিজার্ভের মাটি। কেউ ঘর তুলতে চায় না। কেননা, কখন এসে উচ্ছেদ করে তার কোনও ঠিক নেই। দু’এক জন কোনও উপায় না পেয়ে ঝুপড়ি ক’খানা তৈরি করে বসতে হবে বলে বসেছে। যাকে বলে সংসার পাতা , তেমন কিছু করেনি। ছেলে-মিশনের থেকেই শুরু হয়েছে রিজার্ভের জঙ্গল। এই জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট পাহাড়ি নদী রাধিকা। জঙ্গলের একেবারে শেষ প্রান্ত, যেখানে গ্রামের মানুষের ধানের খেতে গিয়ে জঙ্গলটি শেষ হয়েছে সেখানেই রয়েছে কৃষ্ণাই নদী। রাধিকার মতো এক হাঁটু জলের ক্ষীণকায়া নদী নয়। শীত বরষাতে জল থাকে এরকম গভীর নদী। নদী দুটো নেমেছে ভুটান পাহাড় থেকে। সেখান থেকেই নেমেছে তিনটে নদী।কৃষ্ণাই আর রাধিকা কিছু দূর পাশাপাশি বইতে বইতে একসময় আলাদা হয়ে গেছে । আরেকটি নদী সোনজিরি কিছু দূর রাধিকা কৃষ্ণাইর কাছে কাছে বইতে বইতে একসময় পুরো অন্যদিকে বয়ে চলে গেছে। নদী তিনটির উৎসে একটি বাঁধ আছে। লোহার জাল আর পাথরে বাঁধানো মজবুত বাঁধ। নদী তিনটির জল যাতে একটা শৃঙ্খলা মেনে বয়, বাঁধটি তাতে সাহায্য করে এসেছে। নদী মুখে ঐ জালে তৈরি বাঁধের জন্যেই বোধ হয় জায়গাটির নাম জালিমুখ।
    রিজার্ভ ফরেস্ট যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই রাধিকা নদীর পাড়ে পাড়ে শুরু হয়েছে একটা বস্তি। রিজার্ভেরই সরকারি জমি ছিল। গাছ লাগানো হয়নি। এমনি পড়ে ছিল। খালি জমিটার একদিকে একখানা গ্রাম। ধান, নারকেল, সুপারি গাছে সাজানো বডো আর রাভা মানুষের গ্রাম। নেপালি, বাঙালি আর ক’ঘর অসমিয়া মানুষও রয়েছে।
    সরকারি জমিতে অসংখ্য ছোট ছোট ঝুপড়ি। ঝুপড়িগুলোর সংখ্যা কিছুদিন থেকে হঠাৎই অকল্পনীয়ভাবে বেড়ে গেছে। একই রকম একচালার ঘর সব। টিনগুলো চিকচিক করতে থাকে। প্রায় সব ক’টা ঘরে টিনের সংখ্যা একই। সরকারে দেয়া টিনের বাণ্ডিল গুলোতেই সাহস করে লোক গুলো ঘর তুলেছে। একই রকম টিনের চালের উপর বাঁশ আর ইটের টুকরো। ভেতরের মানুষগুলোর অবস্থাও একই । তুফানে বাসা ভেঙ্গে ফেলার পর পিঁপড়েগুলো আবারও বাসা বাঁধবার আয়োজন করছে।
    ক্যাম্পের মানুষজনের অনেকেই সরকারি টিনগুলো নিয়ে এখানে এসে উঠেছে। কোনও দিক থেকে বাধা আসে নি। বস্তি তো ছিলই। সবাই এখানে তাড়া খাওয়া মানুষ। কাউকে জলে তাড়িয়েছে, কাউকে হাতিতে , কাউকে আবার খিদে। জায়গাটি সুবিধের, হাত বাড়ালেই নদীটি রয়েইছে। রিজার্ভের জঙ্গলটাও আছে। ঢেঁকি শাক, লাকড়ি এসব এমনি মিলে যায়। গামারি, সেগুন, শিশু, লালি১ গাছের অজস্র ডাল পালা না কাটতেই এমনিতে এখানে ওখানে পড়ে থাকে। গাছগুলোতে কেউ হাত দেয় না। রিজার্ভ পেরুলেই ছেলে-মিশন পেরিয়ে শহর। দু’মুঠো ভাত জোগাড় করবার জন্যে এই বাড়ন্ত শহরে সুযোগের কোনও অভাব নেই।
    বুলেন একটা ঠেলা ভাড়া করে এনে তাতে সামান্য যেটুকু মালপত্র আছে তাই তুলে দিয়ে মালতী আর মণিকেও সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পের থেকে বেরিয়ে রাস্তাতে পা বাড়াল। ফেলানি বুলেনের ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলো। মণি এর আগেও বুলেনের সঙ্গে সে বস্তিতে বেশ ক’বার গেছে। মণির পেছনে পেছনে ফেলানি এগুতে থাকল। কাল এক পশলা বৃষ্টি দিয়েছিল। আজ গরম অনেকটাই কমে গেছে। হাসির শব্দ শুনে সে পেছনে ফিরে তাকালো। ঠেলাতে বসে সুমলা হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাসছিল। ঠেলাতে সে হাত পা মেলে বসেছে। বারে বারে গায়ের থেকে কাপড় চোপড় ফেলে দেয়, বুলেন তুলে তুলে দেয়। হঠাৎই মণির মায়ের চোখে পড়ল সুমলার চাদরটির এই বারে বারে পড়ে যাওয়ার দিকে পথের কিছু মানুষ তাকিয়ে আছে। সে নিজের ব্লাউজের থেকে সেফটিপিন একটা খুলে সুমলার চাদরে ব্লাউজে আটকে দিল। কিছুক্ষণ টানাটানি করে সে চাদর টানা বাদ দিয়ে খোঁপা খুলে চুলগুলোকেই এলোমেলো করতে শুরু করল। বুলেন ঠেলাটাকে অল্প দাঁড় করিয়ে ওর লম্বা চুলে আবারো খোঁপা বেঁধে দিল। আশে পাশের দু’একটা মানুষ তাই দেখে হেসে ফেলল। বুলেন সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার ঠেলা চালাতে থাকল। সুমলা এবারে শান্ত হয়ে গেল।
    বুলেন সরকারি টিনে একটা ঘর তুলে নিয়েছে। মণিদের জন্যে কালীবুড়ির বাড়িতে এক কোঠার ঘর একটার ব্যবস্থা করেছে।বুড়িকে মাসে পঞ্চাশ টাকা দিলেই হবে। বুড়ি মাসে নব্বুই টাকা করে চেয়েছিল। কিন্তু মণিদের দেয়া ঘরটার শুধু বেড়া ক’টিই আছে, চাল নেই বললেই চলে। বুলেন ফেলানির ভাগের টিন ক’খানা লাগিয়ে দেবার পরেই শুধু ঘরটি ঘর হয়ে উঠে। বুড়িও মাসে পঞ্চাশ টাকাতে রাজি হয়ে গেল।
    কালী বুড়ির গলার স্বরটি বেশ রুক্ষ । খানিকটা ভাঙা ভাঙা আর চড়া। দূর থেকে শুনলে এমন মনে হয় যেন এই স্বরের অধিকারিণী এক মোটা গাট্টা মেদবহুল,শক্ত সমর্থ মহিলা। কাছে চাপলে দেখা যায় ধারণাটি একেবারেই ভুল। বরং ইনি এক হালকা পাতলা মহিলা, গায়ের চামড়াও হালকা , শিরা ধমনিগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। রঙটি একসময় হলদেটে সাদা ছিল। এখন এমন মনে হয় যেন ভদ্রমহিলা নিজের শরীর ধুয়ে ধুয়ে পুরোনো হয়ে ছিঁড়তে বসা একটি এড়ি চাদর প্যাঁচিয়ে রেখেছেন। মহিলার মুখোমুখি হলেই প্রথম যে প্রশ্নটি মনে দেখা দেয় তা এই যে এমন স্বর কী করে এসে এমন এক মহিলার মুখে জুড়ে বসল? একটু অবাক লাগলেও উঁচু আওয়াজের এই ভাঙা ভাঙা গলা নিয়ে দুর্বল মহিলাটি নিজের স্থিতি ঘোষণা করে চলেছেন।
    এই বস্তিতে যারা প্রথম এসেছে কালীবুড়ি তাদেরই একজন, তাড়া খাওয়া মানুষ। জলে নয়, রায়টে নয়, খিদেতেও নয়, তার তাড়া খাবার গল্প অন্য। যৌবনে বুঝি কালীবুড়ি বেশ রূপসী ছিলেন। গরীব ঘরের রূপসী তরুণীদের সাধারণত যা হয় তাঁরও তাই হয়েছিল। সতেরো বা আঠারো বছর বয়সে মোটামোটি ভালো অবস্থার একটি মানুষ ওকে বিয়ের সমস্ত খা-খরচ দিয়ে নিয়ে গেছিল। লোকটি আগের বিয়ের বৌ চলে গেছে। চার পাঁচটি ছেলে মেয়ে দেখার জন্যে মেয়ে মানুষ চাই। তাই তাকে নিয়ে যাওয়া। ব্যবসায়ী আর ধার্মিক মানুষ ছিলেন তাঁর স্বামী। বাড়িতে নিত্য পুজো পার্বণ কীর্তনাদি লেগেই থাকত। কেউ টের না পেতেই কালী এক নধর কান্তি জোয়ান গোঁসাইর সঙ্গে চলে গেল। সে গোঁসাইর স্বভাব ছিল ফুলে ফুলে মধু খুঁজে ফেরা । একটি ফুলে ওর নৈবেদ্যের থালা ভরে না। রোজ নতুন নতুন মহিলা ভক্তরা ওর দেহে চন্দন লেপে দেয়, স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে দেয়। ভোর রাত অব্দি কীর্তনের সুরে ভক্তদের ভক্তিমার্গ দর্শন করিয়ে ক্লান্ত হলে তার সেবা আত্তি করে। তার নৈবেদ্যের থালা ভরে থাকে। নতুন বস্ত্র, অলংকার, চন্দনে সেজে থাকে তার দুধের আলতার মতো নধরকান্তি শরীর । পেটে সন্তান দিয়ে সেই গোঁসাই তাকে বাসি ফুলের মত ফেলে দিয়ে চলে গেল। এক মাসের পেটে খসিয়ে কালী এক চেনা পরিবারের সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে এখানে এসে পৌঁছুল । ধার্মিক ব্যবসায়ী আবারো বিয়ে করল, নইলে তার ঘর দেখবে কে ? বাপের বাড়ির লোকেরা মেয়ে মরে গেছে ভেবে ভুলেই বসল। ব্যবসায়ী জামাইর থেকে ওরা কম সুবিধে আদায় করেন নি। মেয়ের এই কাণ্ড সবাইকে অসহায় করে ফেলল। বাকি আর কিছু বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে কেউ খুঁজতে বেরুলো না, খবরা খবর করাতো দূরেই থাক।
    সেই মেয়ে এই বস্তিতে এসে ধীরে ধীরে কালী বুড়ি হয়ে গেল। মা বাবার দেয়া এক নাম ছিল তাঁর। আরতি। সে নাম অন্যে তো বাদই থাক, কালীবুড়ির নিজেরও হয়তো মনে নেই। আরতি নাম নিয়ে যখন তিনি এ বস্তিতে আসেন আলাদা আলাদা চেহারাতে এখানেও গোঁসাই আর ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার দেখা হয়। ঠিক সেরকম সময়ে তাঁকে একদিন কালী ঠাকুর ভর করেন। যারা তার কাছে প্রায় রোজ আসত কালী পাবার পর তারা এখানে আসা ছেড়ে দেয়। দিনে সে মুড়ি ভাজত, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করত। রাতে তার গায়ে রোজ কালী ভর করত। একবছর এভাবে চলার পর মুড়ি বেচার পয়সা দিয়ে সে বড় করে কালী পুজো দিয়েছিল। বছর না ঘুরতেই লোকে দেখল রাতে যখন ঠাকুর ভর করেন তখন তার মাথাতে এক লম্বা জটা বেরিয়ে আসে। সকাল হতেই আবার মিলিয়ে যায়। আরতি ধীরে ধীরে কালী বুড়ি হয়ে যায়। প্রতি বছরের কালীবুড়ির দেয়া পুজো এখন বস্তির সমস্ত মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই কালি বুড়ির দু’টো ঘরের বাড়ির একটাতে ফেলানি এসে উঠল । সকাল দশটা নাগাদ এসে পৌঁছেছিল। ঠিক ঠাক করে রাখবার মতো আর কীই বা এমন জিনিসপত্র রয়েছে? ঘরটির এক কোনে চুলো একটা ছিলই । সে একটু লেপে টেপে নিলো। কেঁচোর মাটিতে সারা ঘর ভরা ছিল । মণির সঙ্গে সেগুলো পরিষ্কার করে ফেলল। কোদালে শেওলাগুলো চেঁচে নিয়ে লাল মাটিতে মুছে ফেলার পর ঘরে শ্রী ফিরে গেল। মণি ইতিমধ্যে নদীতে স্নান করতে গেছে। বুলেন এসে ডাক দিল।
    “ও বৌদি, কী করছ?’ হাতে দা কোদাল নিয়ে এসেছে ও।"
    “এখন এই ভর দুপুরে তোকে কে কাজে রাখবে রে?”
    “ এই শহরের এক মাষ্টার বাবুর ঘরে বেড়া একটার কাজ আদ্ধেক করে রেখে এসেছিলাম। ভাবছি, সেটাই পুরো করে দিয়ে আসি গে’ । আগাম টাকা নিয়ে এসেছি যে।“
    “ তোর জন্যে কি আর বেড়া পড়ে রয়েছে? দেখগে’ অন্য কামলা লাগিয়ে কাজটা করিয়ে ফেলেছে।”
    “ আমার হাতে কাজ না হলে মাষ্টার মাস্টারণী কারোরই মন ভরে না , বুঝলে!” বুলেন হাসছিল। ওর ভুরুর উপর কোঁচকানো রেখাগুলো আজ নেই। ওই নর্দমার থেকে বেরিয়ে হয়ত ফেলানির মতোই ওরও মনটা আজ খোলামেলা লাগছে।
    হঠাৎই আবার ওর কপালের গাঁট কুঁচকে গেল। খানিকের হাসিমুখখানা আবারও আঁধার হয়ে এলো।
    “ বৌদি , ওকে একটু দেখবি। নতুন জায়গা বলেই বোধহয় ওর আজ আবার সেই পাগলামোতে পেয়েছে।” সে ওর পরনের গামছাখানা অল্প তুলে দেখালো। উরুতে জন্তুতে আঁচড়ানোর মতো লাল লাল ফোলা দাগ।
    “ ওষুধ দিলি ওকে?”
    “হ্যাঁ, দিয়ে শুইয়ে রেখেছি। আমি আসা অব্দি উঠবে না। বৌদি, তুই বরং এটা কাজ কর। ভাত রান্নাটা তুই আমাদের ওখানে কর গে’ যা। ছেলেটাকেও খাওয়াবি। আর ও যদি উঠে যায় তবে ওকেও...।” মানুষটির রা বন্ধ হয়ে গেল। ফেলানির এমন মনে হলো যেন উরুতে আঁচড়ানোর দাগ বুলেনের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
    বুলেনের গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছিল যেন কফে বসে গেছে, “ ওকে কিচ্ছু খাওয়াতে পারি নি।” হঠাৎই সে কোনও দিকে না তাকিয়ে চলে গেল।
    ফেলানি ভেতরে এসে দেখে কালী বুড়ি বসে আছে। বুড়ি ওকে ডাকল, “আয়।” বুড়ির ডাকটা কেমন যেন লাগল ওর। আস্তে কথা বললে মনে হয় বুড়ি ফিসফিসিয়ে বলছে, শব্দগুলো একের গায় আরেকটা জুড়ে বসে। যখন জোরে বলে শব্দগুলোর যেন তেজ বেড়ে যায়, কানে এলে বেশ ভয় করে। ফেলানিও বুড়িকে এক ধরণের ভয় পায়। কিন্তু আস্তে আস্তে ফিসফিসিয়ে কথা বললে দুর্বল এই মহিলাকে ভয় পাওয়া তো দূর, কেমন যেন মায়াই হয়। মণির মা বুড়ির ঘরে গিয়ে ঢুকে গেল। ধূপ আর ধূনার গন্ধ একটা নাকে লাগল। ঘরটির চারদিকে নানা রকম কালী মায়ের মুখোশ। জিহ্বা মেলে কালো মুখগুলো বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। ও চাদরের আঁচল খুটতে খুটতে মাথা নুয়ে বসে রইল। বুড়ি মুড়ি আর চা নিয়ে এলো। মুড়িগুলোর থেকে তেল পেঁয়াজের গন্ধ একটা বেরুচ্ছে।
    “আপনি খাবেন না?” ফেলানি বাংলাতে বলে বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। বুড়ির অবাক হবার পালা।
    “ তুই বাংলা বলছিস!”
    “আমার বাবা ছিলেন ক্ষিতীশ ঘোষ, দাদু ছিলেন কিনারাম বডো, আমাকে বড় করেছেন রতন ঘোষ।”
    বুড়ি মুখে কিছু না বলে বাটি একটাতে অল্প মুড়ি আর এক কাপ লাল চা নিয়ে এসে ওর কাছে বসল
    “তোর আর কে কে আছে?”
    তাইতো, ওর আর কে কে আছে? ওকে লম্বোদরের কাছে সমঝে দিয়ে রতন আর বিন্দু একেবারে চলে গেল। রতনের ছেলেমেয়ে নেই। নিজের কাছের মানুষ রয়েছে। ওদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবে বলে আলিপুর দুয়ারের কাছের এক গ্রামে চলে গেল। পাহাড়ের তলার গ্রামটির কিনারামের বাড়িতে? লম্বোদরের বাড়িতে? সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াশার মতো।
    সে মনে মনে হাতের তালুতে মুড়ি দু’একটা নিয়ে এমনি নাড়াচাড়া করতে থাকল।
    “তুই এখন কী করবি?”
    সে এ প্রশ্নের জবাবেও চুপ করে বসে রইল।
    বুড়ি কাপ আর বাটিগুলো সরিয়ে রাখল।
    “ কালী মাকে প্রণাম কর। মা সব ঠিক করে দেবে।” বুড়ি কালীর মুখোশের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করলে, অও তাই করল।
    “আপনি কী করে...” সে কালী বুড়ি কী করে ঘর চালায় জানতে চেয়েছিল, কিন্তু কেমন এক সংকোচে কথাটা স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করতে পারল না। একা এক মহিলা। বাড়ি ঘর করেছে। নিজেও চলছে। ওকেও কিছু একটা মুখে দিতে উপরোধ করছে।
    বুড়ি আবারও কালীর মুখোশগুলোকে প্রণাম করছে। সে উঠতে গেলে বুড়ি ওকে দরজা অব্দি এগিয়ে দিল। দরজা পেরোতেই বুড়ি ওর হাত ধরল। এবার বুড়ি জিজ্ঞেস করল, “তুই মুড়ি ভাজতে জানিস?” সে অবাক হয়ে মাথা নাড়ল, “জানি।”
    “জানবিই তো! বাঙালি মেয়ে।“
    “আমি বাঙালি নই। আমার ছেলের বাবা...” বুড়ি ওর কথাতে কান দিল না।
    “মুড়ি ভাজলে চাল অল্প বেশি করে নিই। কাল একসঙ্গে শহরে যাব।“
    সম্মতি দিয়ে সে বুলেনের ঘরের দিকে রওয়ানা দিল।
    একচালা ঘরটা বুলেন বেশ গুছিয়ে সাজিয়েছে। আধ কাঠার মতো মাটি বের করে নিয়েছে। নদীর পারের জমি। তার উপর বুলেনের খেটে খাওয়া হাত। দুদিনেই এই মাটি ফুলে ফলে ভরে উঠবে। সে ভেতরে ঢুকে গেল। সুমলা বাঁশের চাঙে ঘুমিয়ে আছে। লম্বা চুলগুলো বেণি বাঁধা, সিঁথিটা বাঁকা। দেখলেই বোঝা যায় ছেলে মানুষের হাত পড়েছে। এভাবে এক ঘুমিয়ে থাকা মেয়ে মানুষকে দেখে কে বলবে সে খানিক আগেই ওর বরের উরুতে খামচে রক্ত বের করে দিয়েছে। ছেলেটি নেই।নিশ্চয়ই মণি কোলে নিয়ে কোথাও গেছে। ঘুমন্ত সুমলাকে একটা মৌমাছি বিরক্ত করছিল। সে আস্তে করে পায়ের কাছে রাখা পাতলা কাপড়খানা তুলে ওর গায়ে দিয়ে দিল। মৌমাছিটা চলে গেল। সুমলাও শান্তিতে শুয়ে রইল।
    বুলেনের ছেলেকে নিয়ে মণি এসে ঘরে ঢুকল।
    “মা তোকে ঘরে খুঁজে পেলাম না।”
    “খিদে পেয়েছে?”
    “ পেয়েছিল। কিন্তু কালীবুড়ি চা মুড়ি খাইয়ে দিল।”
    “ কালী বুড়ি বলবি না। আইতা ২...।” খানিক থেমে গিয়ে বলল, “ ‘দিদা’ বলে ডাকবি।... তুই স্নান করলি?”
    “হ্যাঁ।” সে হাতের পলিথিনের থলে একটা মাটিতে উলটে দিল। একটি সাদা চকচিকে পুটা মাছ। ছেলে উচ্ছ্বসিত আনন্দে জানান দিল, “ মা! আমি যখন স্নান করছিলাম, এ আমার পিঠে এসে ঠেকেছিল। আমি গামছা দিয়ে ধরে ফেলেছি!”
    “তোকে ভেজে দেব, যা।” বাবুকে পিঠে তুলে মণি দৌড় দিল, সে মুখ ফুটিয়ে বলেই ফেলল, ‘ঐ হাগা মুতার নর্দমার থেকে বেরুতে পেরে সবারই দেখি মনটা ভালো হয়ে গেছে!”
    বুলেন চুলোর কাছে এক আঁটি লাকড়ি রেখে গেছে। রিজার্ভ থেকে গুটিয়ে নিয়ে আসা শুকিয়ে কনকনে হয়ে আছে ডালগুলো। চুলোতে তুষের আগুন একটু জ্বলছে। কাঁচা চুলো বলে তুষ জ্বালিয়ে রেখেছে। তাতে খড়ি কটা দিতেই খানিক চেষ্টাতে আগুন জ্বলে উঠল। চুলোর উপরে চাল , ডাল, মিষ্টি লাউ একটা, আলু দু’একটা তেল নুন গুটিয়ে রাখা আছে। কী করে যে মানুষটা মেয়ে মানুষের মতো সব করে রেখেছে! সে ডালের মধ্যেই দুটো আলু আর মিষ্টি লাউ টুকরো দুটো দিয়ে দিল, ভাতও ওদিকে হয়ে গেল। মণির আনা মাছটা আঙটাতে পুড়ে অল্প তেল নুন দিয়ে ভর্তা বানিয়ে দিল। ছেলে দুটোকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলো। মিষ্টি লাউ যেমন লাল তেমনি মিষ্টি। গরম মসুর ডাল দিয়ে অনেক দিন পর সে পরম তৃপ্তিতে ভাত ক’টা খেল। বুলেন আর সুমলার জন্যে আলাদা করে রেখে সুমলাকে জাগাতে পারে কিনা তার চেষ্টা করে দেখল। ওঁ ওঁ শব্দ করে ও আবার এক কাতে ঘুমিয়ে পড়ল। ওষুধ খাওয়া ঘুম, কই আর এতো তাড়াতাড়ি ভাঙবে? মণি আর বাবু ভাত খেয়েই বেরিয়ে গেল। গাছের থেকে শালিকের বাচ্চা একটা পড়ে গেছে। সেটিকে নিয়েই দুজনে ব্যস্ত হয়ে গেছে। বাকি দুনিয়ার খবর ভুলেই গেছে। ফেলানি সুমলার কাছেই একটু গড়িয়ে নেবে বলে শুয়ে পড়ল। সুমলা জেগে উঠলেই দুমুঠো খাইয়ে দেবে। ঘরের গায়ে লেগে আছে একটি লিচু গাছ । পাখির এনে ফেলা বীজ থেকে গজানো গাছ হবে। খয়েরি রঙের কিন্তু বড়ইর মতো ফল ধরে বলে বুলেনের মায়া পড়ে গেল । সে ওটি আর কাটে নি। ঘড়টিকেও ঢেকে রাখে গাছটি। সে দেখল সুমলা গা থেকে চাদরটা ফেলে দিয়েছে। বোতাম খোলা শরীরটার দিকে সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। কী মানুষের কী হয়েছে। ওর চোখদুটো ভিজে এলো।
    বুলেনের ডাকে ফেলানি জেগে গেল। কখন যে ঘুম পেয়ে গেছে সে টেরই পায়নি। উঠে দেখে সুমলা বিছানাতে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। বুলেনকে সে ভাতগুলো দেখিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হলো। বুলেন একটি থালাতে দু’জনের মাপে ভাত নিয়ে বাচ্চাকে কোলে তুলে আনার মতো করে স্ত্রীকে কোলে তুলে নিলো। কোলে করে ওকে এক গ্রাস দু’গ্রাস করে ভাত খাওয়াতে শুরু করল। ওর নগ্ন শরীর বুলেনের বুক ছুঁয়ে আছে। সুমলা এক হাতে বুলেনকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। শান্ত কচি খুকীর মতো ভাতগুলো খেয়ে নিচ্ছে। দু’জনকে এভাবে এক লহমার জন্যে দেখে নিয়ে ফেলানি বেরিয়ে গেল। যাবার আগে দরজাটা আঁজিয়ে গেল। তার চোখে পড়ল--তাই দেখে পাশের কিছু লোক জটলা পাকিয়ে ফিশিং ফিশাং শুরু করেছে।
    ফেলানি ঘরে গিয়ে ঢুকল। দরজা আঁজিয়ে সে ভেতর থেকে কাঠ দিয়ে দিল। তার পরেই খানিক আগেই লেপে মোছে রেখে যাওয়া ভেজা মেঝেতে বসে পড়ল। ওর বুকখানা যেন ভেঙে পড়বে। কেউ যেন ওর কাঁধে খসখসে শুকনো হাত একখানা রেখেছে,” কাঁদছ কেন? মালতী...ও মালতী...এমন করবি নাতো... আমি মানুষটা মরিনি, না!” হাত খানা সে ছুঁয়ে দেখতে চাইল। একবার বলতে চাইল, “এ্যা মা! এ কি সেগুনের পাত না মানুষের হাত, কী বড়রে বাবা!” সেগুন পাতার মতো হাতে টগর ফুলের মত হাতখানা লুকিয়ে গেল। “ তাই হোক, ভগবান তোকে তো টগর ফুলের মতো হাত দিয়েছে! তাতেই হবে...।” কথাটা পুরো হতে পারল না, গা থেকে ভোঁৎকা একটা গন্ধ বেরুচ্ছে যে লোকটার সে এসে লেলিয়ে লেলিয়ে বলে কিনা , “ মলি বাবা পুকুলেল থেকে নামঘল... মাথা নেই ...চোখ নেই...।” কান্নাটা শব্দ হারিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। শব্দহীন কান্নাটি মেয়ে মানুষটিকে একেবারে ঝাঁজরা করে দিয়ে গেল।
    “ মা, মা ও মা! কিছু একটা দে তো। পাখির বাচ্চাটা দেখ, কেমন করে মুখ মেলে চিঁ চিঁ করে যাচ্ছে!”
    সে চোখ মুখ মোছে দরজাটা খুলে দিল। বাইরে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার।
    “বৌদি!” কচু পাতা একটাতে মাছ কতকগুলো নিয়ে বুলেন এসে হাজির।
    “ মণির মা...” হাতে সন্ধ্যা পূজার প্রসাদ নিয়ে কালীবুড়ি।
    সে বাইরে গিয়ে হাত দুটো অঞ্জলির মতো মেলে দিল। মণির পাখিটির জন্যে। বুলেনের মাছগুলোর জন্যে। কালীবুড়ির প্রসাদের জন্যে। মণির পাখিকে কিছু খেতে দিতে হবে। বুলেনের মাছগুলো কাটতে হবে। কালীবুড়ির প্রসাদের থালা ঘুরিয়ে দিতে হবে। ভেতরে ঢুকে পড়া কান্না এবারে চোখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইল। পারে নি। সে হাতদিয়ে মুছে ফেলল।

    টীকা:
    ১) লালিঃ এক রকম আরণ্যক গাছ।
    ২) আইতাঃ দিদিমা।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪২495481
  • অধ্যায় এগার (১১)
    মণিকে দু’গ্রাস ভাত খাইয়ে বস্তাটির উপর শুইয়ে দিল । এখন গরমের দিন যেমন তেমন, শীত আসতে আসতে কিছু একটা করতে হবে । সে ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। ঘুমের মধ্যে সে বিড়বিড়িয়ে উঠল, পাখিটা নিশ্চয় ওর বাচ্চাকে নিয়ে খেলছে । ছেলেকে স্কুলে দিতে হবে । বুলেনের তৈরি করে দেয়া চুলোর কাছে প্লাস্টিকের প্যাকেটের তলায় সামান্য কয়েকটি চাল পড়ে আছে, গেল রাতে সেই দিয়ে গেছে । হাতল ভাঙ্গা কড়াই একটা কাল কালীবুড়ি দিয়ে গেছিল । তাতেই ভাত রেঁধেছিল, তাতেই খেয়েছিল।খালি খালি ঘরটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত সিটকে উঠল । মণির প্যান্টের পাছার দিকটাতে ফেটে গেছে । ফেলানি চাদরের আঁচলটা খুলে দেখল , টাকা পাঁচটা রয়েছে । ক্যাম্পে থাকতে এক বাড়িতে কাজ করে টাকা ত্রিশটা পেয়েছিল, তার থেকেই এই পাঁচ টাকা থেকে গেছে। ক্যাম্প থেকে চলে এসে কি সে ভুল করল ! তাতে অন্তত এক পয়সা না দিয়ে মাথা গুঁজবার ঠাই একটা পেয়েছিল । সপ্তাহে একবার হলেও ধানে,তুষে, পোকে মেশানো চাল একমুঠো পেয়েছিল । এখন সে কী করবে? ক্যাম্পের আশে পাশে কয়েক ঘর মানুষের সঙ্গে চেনা পরিচয় হয়েছিল, দু’একটা কাজ কম্মও পেয়েছিল । শহর থেকে গাড়ি করে একদল মহিলা ওদের দেখতে এসেছিল । ওরা একটা শাড়ি দিয়ে গেছিল । সেটি অবশ্যি , পা মেলে বসতে গিয়ে ওখানে থাকতেই ফেটে গেছিল । সেটিই সম্বল ছিল । কিন্তু ক্যাম্পে থাকতেই সেরকম আরেকটা পেয়েছিল । কীর্তন গাইতে গাইতে সাধুর দল একটা এসে সেটি দিয়ে গেছিল । সাদাতে নীল আঁকি বুকি শাড়িটা সে যত্ন করে তুলে রেখেছে । শাড়িটার মতো তার বুকখানাও যেন কোথাও ছ্যাঁত করে ফেটে গেছে । ওর বুকখানাও আজকাল ফাটতে শুরু চাদরের মতো হয়ে গেছে. কোথাও অল্প টান পড়লেই হলো আর কি, এখানে ওখানে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে ছিঁড়তে শুরু করে । সে মণির দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল । বুকের ভেতরে ফাটা চাদরখানা নিয়ে সে কালীবুড়ির বারান্দাতে গিয়ে বসল । চোখ থেকে জল ঝরছিল । নেই , সেই পুরুষালি হাতের ছোঁয়া নেই, একটা গমগমে গলার সোহাগে নরম শব্দগুলো নেই, “তুই এমন করবিনা তো, আমি মানুষটা.... ।’ সে ব্যাকুল হয়ে পড়ল । কী করে সে ? কী করে ?
    সে আঁচ করল, কেউ একজন ওর পিঠে হাত রেখেছে. গা শিউরে উঠল । ভীষণ হাল্কা একটি হাত, যেন শরীরের উপর অশ্বত্থ বটের পাতা একখানা এসে পড়ল । সে মুখ তুলে তাকালো । কালীবুড়ি ।
    “মণির মা, কী করছিস?
    কোন উত্তর দিল না। কালীবুড়ি ওকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল ।
    “মাকে প্রণাম কর ।” বুড়ির গলাতে কঠিন আদেশ , “রোজ আমার ঘরে ঢুকবার বেলা প্রণাম করবি।”
    সে কালীর মুখোশগুলোর দিকে মুখ করে হাত জোড় করল । বুড়ি দু’টো কাঁসার থালাতে ভাত বাড়ল । ভাত , আর সঙ্গে লংকা সর্ষে দিয়ে মাছের ঝোল. চুলোর থেকে বুড়ি দু’টো কাঁঠাল বিচি বের করল। সে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে তাকিয়ে রইল । হালকা শিরা বেরিলে পড়া আঙুল ক’টি দিয়ে টিপে বুড়ি ভর্তা বানাচ্ছে । গরম ভাত, মাছের ঝোল আর কাঁঠাল বিচির ভর্তার গন্ধে গোটা ঘর ভরে গেল । ওর মুখখানা বারে বারে ভিজে আসছিল ।
    “ আয় ।” বুড়ি দুটো পিঁড়ি পেতে ওকে ডাকল ।
    সে কিছু একটা বলতে চাইছিল । ভেজা জিভে শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারল না । আসলে বলতে চাইছিল,সে ভাত খেয়েছে, ভাতের কোনও দরকার নেই ।
    “আয়!” বুড়ির গমগমে ডাকে একটা পুরুষালি ভাব । ডাকটির মাঝে আদেশের একটা সুর ছিল বলে , না কি, ভেজা জিহ্বার জন্যে—সে পিঁড়িটিতে গিয়ে বসে গেল । নীরবে চেটে পোঁছে সব ক’টা ভাত খেয়ে ফেলল । খেয়ে কালীবুড়ির মুখের দিকে তাকালো । বুড়ির মাথার জটাটি নেই । অথচ বেলা পড়লেই বুড়ির মাথাতে মেটে রঙের ফণাধর সাপের মতো একটা গুচ্ছ জটা বেরিয়ে আসে । জটা বেরুলে কালীবুড়ির চোখ লাল হয়ে আসে । পুজো দিতে দিতে কখনো বা বুড়ি উদোম নাচে । কপালের সিঁদুরের ফোঁটাতে লাল হয় কপাল । বস্তির লোকের ভিড়ে ভরে পড়ে কালীবুড়ির উঠোন । কালীমায়ের সামনে রাখা ধূপ ধুনোর আশে পাশে খুচরো পয়সা পড়ে জমতে থাকে । বাতাসা, ফলমূল, নকুলদানাতে মায়ের কালো রং ঢেকে যায় । লোকে নিজের নিজের মানত করে, কালীবুড়ি আশীর্বাদ দেয় । ফেলানি এগুলো দেখেনি, শুনেছে শুধু ।
    বুড়ি এঁটো বাসন গুছিয়ে এসে ওর কাছটিতে বসল । সে বুড়ির সাদা চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইশল । সাদা চুলগুলো কপালের সামনে নেমে এসেছে । কপালের উপরের কোঁকড়ানো চুলগুলো ভুরু ছুঁই ছুঁই করছে । এই চুলগুলোতে জটা বাঁধবার কোনও চিহ্ন মাত্র নেই । অবাক হয়ে বুড়ির চুলগুলো দেখছে দেখে বুড়িই বলল, “ মা যখন ভর করেন আমার মাথাতে শুধু তখনইএ জটা গজায় । মা আমার শরীর থেকে গেলে সঙ্গে করে তাঁর চিহ্নও নিয়ে যান ।” বুড়ি অল্প ফোঁপাচ্ছে । এক দুর্বল বৄদ্ধা । ফেলানির ইচ্ছে হলো তাঁকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দেয় । ঘরের বেড়াতে হেলান দিয়ে রোগা পাতলা মানুষটি যখন বসে থাকেন তখন এই ঘরে বহুবার বহু মানুষ তাঁকে থালা ভরে নাড়ু পিঠা, ধুয়ে মুছে খোসা ছড়িয়ে আনা বাড়ির গাছের পেয়ারাটা, পেঁপেটা এগিয়ে দিয়ে গেছে । ফেলানিরও ইচ্ছে হলো এমনটি এগিয়ে দেয় । বুড়ি ধীরে ধীরে বেড়াতে হেলিয়ে রাখা মাথাটা তুলে ধরল । ফেলানিকে ভাত ক’টি বেড়ে দিতেই যেন বুড়ির বড্ড কষ্ট হচ্ছিল । ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসগুলো নিয়মিত হতেই বুড়ি জিজ্ঞেস করল,
    “ তোর বড় খিদে পেয়েছিল, না রে?”
    সে মাথা নিচু করে আছে । সত্যি সে ভাতের থালাতে হাত দিয়েই আর সব ভুলে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করেছিল । হ্যাঁ, মাছ ভাতের গন্ধে খানিকক্ষণের জন্যে হলেও সে আর সব ভুলে গিয়েছিল । এমনকি সে নিজেকেও ভুলে গিয়েছিল । আজ সে কত দিন হলো এমন স্বাদ করে একবেলাটিও খেতে পায়নি । তার অল্প লজ্জাও করছিল ।
    “পেটের জ্বালা বড় জ্বালারে !”
    ওর পিঠে যেন আবারো আরেকটি বটের পাতা এসে পড়ল । রোগা পাতলা হাতটিতে একধরণের আশ্বাস । অশ্বত্থ পাতার মতো হালকা ছোঁয়া কেন জানি হঠাৎই মনে পড়িয়ে দিল সেগুণ পাতার মতো ছড়ানো হাতটি কথা । সে হাঁটুতে মাথা গুঁজে দিল । পাকা অশ্বত্থ পাতাটি তখন ওর চুলের উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে ।
    “তোর সঙ্গে ছেলে একটি রয়েছে । আমি একেবারে একা ছিলাম । আমি তোর থেকেও দেখতে সুন্দর ছিলাম । মা কালী আমাকে বাঁচিয়ে দিলে । তোকেও উনিই দেখবেন, দেখবি । মাকে প্রণাম কর । ” সে মুখ তুলে তাকালো । গোটা ঘর জুড়ে জিহ্বা মেলে রাখা একটি কালো মেয়েমানুষের রক্তরাঙা চোখের চাউনি । এই কালী ঠাকুর কি সত্যি একজন কম বয়সের মেয়েমানুষকে ভাত জোগাতে পারেন, দিতে পারেন দু’বেলা পাল্টাবার মতো দুটো কাপড় ? এই বৃদ্ধা মহিলাটি তো বেঁচে আছেন । খেয়ে পরেই আছেন । নিজের ঘর একটাও রয়েছে। নিজেও আছে, অন্যকেও রেখেছে । ওকে আজ মাছে ভাতে একবেলা খাইয়েছে। বুড়ির পিঠে তো কখনো সেগুণ পাতার মতো কোনও ছড়ানো ছিটানো হাতের ছোঁয়া ছিল না। তবুও বুড়ি ওর রোগা হাতটি ওর পিঠে রাখতে পেরেছে । কেবল কি ঐ কালী ঠাকুরের জন্যেই ? বুড়ির আদেশ মানতে নয়, নিজের থেকেই সে কালীর কালো জিহ্বা মেলা মুখখানার দিকে তাকিয়ে প্রণাম করল । ওর কিচ্ছু চাইনে, দুবেলা খেতে পারার মতো দুমুঠো ভাত, মণিকে পরতে দিতে পারবার মতো একটা কাপড়। ওর গালের দুই পাশ দিয়ে জলের ধারা নেমে এলো ।
    “ এর জন্যেই, মানুষের এই ব্যাপারটাই আমার এক্কেবারে পোষায় না| কান্না আর কান্না !আর কিছু করতে পারিস কি? না ব্যস , ভেঁ ভেঁ করে কাঁদতে পারিস ! কোন মরদকে দেখাতে চাইছিস ? মেয়ে মানুষের এই কান্না মরদদের দেখাবার জন্যে । তবে সে, একটা ভাতার আসবে। শরীর দলাই মলাই করে বলবে, আহা ! হা , বেচারি! মেয়ে মানুষ আহ্লাদে আটখানা । দলাই মলাই পর আসল সুখ । তার পর পেট।”
    বুড়ি তেতে উঠেছে । “ পেট লাগে যদি আরো কান্না জোড় । হাউ মাউ করে কান্না জোড় । বস্তির সবক’টা ভাতার এক্ষুনি এসে পড়বে। তোর শরীরের বাঁধুনি ভালো । দলাই মলাই ভালোই হবে ।”
    ফেলানির রাগ চড়ে গেল । কী বলে বুড়ি? ওর বাড়িতে আছে বলেই এতো কথা ! এক বেলা এক মুঠো ভাত খাওয়ালো বলেই এতো কথা ! সে রেগে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে গেল । চোখ শুকনো । ক্ৰোধের তাপে ওর চোখের জল শুকিয়ে গেছে । চোখের থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে ।
    “ আপনি আমার মায়ের চে’ও বয়সে বড় । আমি আপনার বাড়িতে আছি । এমনি এমনি থাকছি না । দস্তুর মতো ভাড়া দেব । কিছু একটা রোজগার করে ভাত জোগাড় করব । মানুষটা নেই বলেই... আমার ছেলেটা আছে... হাত দুটো আছে... এক বেলা দুটো ভাত খাওয়ালেন বলে... ।” রাগে ওর কথাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছিল । কী বলতে চেয়ে কী বলছে ।
    ওর পিঠে আবারও সেই পাকা বটের পাতার ছোঁয়া । যেন বিছে পড়েছে তেমনি ঝ্যাঁটিয়ে সে হাতটি সরিয়ে দিল এবারে । বুড়ি আলু প্যাঁজের ছোট্ট বাঁশের ঝুড়ি থেকে একটি লংকা তুলে নিলো । সাদা ছোট্ট লংকা । সে চিনতে পারল মেম লংকা, কেউ কেউ সূর্যমুখী মরিচও বলে থাকে, কেউ বলে বিষ মরিচ, কেউ বা নাগা মরিচ, কেউ বা ধেনো । উপর মুখো হয়ে গাছ ভরে থাকে এগুলো । সাদা সাদা । ছোট ছোট । প্রচণ্ড ঝাল। মুখে দিলেই মনে হয় যেন মুখ পুড়ে যাবে ! কী করছে বুড়ি? মরিচটা ওর চোখে ভেঙ্গে দেবে না তো ? মরিচটা হাতের তালুতে নিয়ে বুড়ি ওর কাছে চেপে এসেছে । সে কুঁচকে সামান্য সরে দাঁড়ালো ।
    “ মেয়ে মানুষকে এই লংকার মতো হতে হয় । দেখতে ছোট কিন্তু মুখে দিলে জ্বালিয়ে দিতে পারে ।” বুড়ি মেম মরিচটা ওর হাতে দিল । ওর রাগ কমে নি । বুড়ি এবারে মহাদেবের শরীরের উপরে পা রেখে দাঁড়ানো কালী মায়ের একটা ছবি দেখালো তাকে, “ মায়ের শক্তি দেখ, পুরুষকে কেমন করে পদাঘাত করছে । মায়ের ভক্ত হ’ । শক্তি পাবি ।”
    ছবিটা সে ভালো করে দেখে নি । আসলে ভরপেট ভাত খেয়ে ওর ঘুম পেয়েছে। বারে বারে মা কালী, বুড়ি, মেম মরিচ---সবকিছু চোখের সামনে আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে । হঠাৎ যেন ও নিজের নাকের শব্দ নিজেই শুনতে পেল ।
    “ ওঠ, এদিকে আয় ।” বুড়ি ওকে মূল ঘরের পাশের বেড়া দিয়ে ঢাকা চালা একটার নিচে নিয়ে গেল । ছোট চালাটিতে ধানের গন্ধ একটা ছড়িয়ে আছে । একদিকে একটা চুলোর উপর লোহার কড়াই একটা, কয়েকটা চালনি, দু বস্তা ধান, মাটির কলসি, বালি, লবণের বয়াম একটা । মুড়ি ভাজার এক সম্পূর্ণ আয়োজনে ভরা চালাটিতে দাড়িয়ে ওর চোখের তন্দ্রা ছুটে পালিয়ে গেল । বুড়ি একটি বস্তার থেকে একমুঠো ধান বের করে হাতের তালুতে নিলো, “ দেখ কি সুন্দর মালভোগ ধান ।” আরেকটা বস্তার থেকে আরেক মুঠো বের করে মালতীর হাতে দিয়ে বলল , এই শালি ধানের মুড়িও ভালো হয় ।” এবারে বড় ধান সেদ্ধ করবার কড়াইটা দেখালে,” পুরো আটশ পঁচিশ টাকা নিয়েছিল ।” মাটির কলসিটি ছুঁয়ে বুড়ি হেসেই ফেলল,” বালি গরম করে করে কলসিগুলো লোহার কড়াইর মতোই হয়ে গেছে ।” কলসিগুলো বাজিয়ে দেখালো । মুড়ি ঘাঁটাবার ভোঁতা হাতাখানা ওর হাতে তুলে দিল । “ নে, মুড়ি ভাজ।” কথাটি বলে বুড়ি আগুন জ্বালিয়ে বালি, মাটির কলসিতে বালি গরম করেই ফেলল । কাজে নেমে পড়লে বুড়ির হালকা, সাদা আঙুলগুলো দেখলে মনে হয় যেন বাতাসের ছোঁয়াতে গোটা এক নলবন কাঁপছে । ফেলানি এক দৃষ্টিতে বুড়ির আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইকল ।
    “ধান সেদ্ধ করে চাল বের করে রাখা আছে ।” বুড়ি চালাটার এক কোনায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ।
    সে কিচ্ছুটি বলল না । যেমনি দাঁড়িয়ে ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইকল । কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। বুড়িই বা কী বলতে চাইছে! ওর আবারও ঘুম পাচ্ছিল ।
    বুড়ি খ্যাঁট খ্যাঁটিয়ে উঠল , “দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মুড়িগুলো ভেজে উঠতে না পারলে কাল কী খাবি । রোজ রোজ আমি তোকে খাওয়াতে পারব না । তোর ছেলেকে স্কুলে দিবি না? কোন ভাতার আসবে তোর খরচ চালাতে, শুনি?”
    সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলল ।
    “আসছিস না যে বড়? এই বুড়ো শরীরে একা আর আমি পারি নে বাপু।”
    সে ঐ একইস রকম দাঁড়িয়ে রইএল । ওখান থেকেই শুধু আস্তে আস্তে বলল, “ আমার হাতে টাকা পয়সা নেই, কোথাও যদি কাজ কর্ম কিছু.... ।” সে আসলে বলতে চাইছিল, মুড়ি ভেজে বিক্রি করতে তাকে প্রথমে ধান কিনতে হবে, অন্যান্য আসবাব পত্র কিনতে হবে । একটা ব্যবসা করতে গেলে মূলধনের দরকার পড়ে । আরো জিজ্ঞেস করতে চাইছিল মুড়ি ভেজে দিলে বুড়ি ওকে কী দেবে? মানে, মজুরি কী দেবে? পারলে সেই মজুরি থেকেই সে অল্প অল্প করে পয়সা বাঁচাবে আর কড়াই, কলসি, মালভোগ ধান কিনে নেবে ।
    বুড়ি এবারে তেতে একেবারে খিঁচিয়ে উঠল, “তোকে টাকার কথা কে বলেছে? আমি তোকে মুড়ি ভাজার কথা বলছি ।”
    সে ভয়ে ভয়ে বুড়ির এগিয়ে দেয়া পিঁড়িতে গিয়ে বসল ।
    বুড়ির চুলোর তুষ লাল হয়ে এসেছে। সেদ্ধ করে তৈরি করে রাখা মালভোগ ধানের চালের গন্ধে চারদিক মোঁ মোঁ করছে । বুড়ি চালগুলোতে এক বাটি লবণ জল ঢেলে দিল । ফেলানি বুড়ির বাঁদিকে বসে চুলোর উপরে রাখা মাটির কলসিতে গরম বালিতে অল্প অল্প করে চালগুলো দিতে শুরু করল । ফটফট করে ভাজা চাল ফুটে সাদা সাদা মালভোগ ধানের মুড়িতে ভরে পড়ল । সে হেসে ফেলল । বুড়ি ওর দক্ষ হাতে তুষের আগুন থেকে গোবরের ঘুঁটে একবার বের করছে, আরেকবার ঢুকিয়ে দিচ্ছে । সমান তাপে ভাজা চালের থেকে মুড়িগুলো ঠিকঠাক ফুটে বেরুচ্ছে । দেখতে দেখতে একটা মাঝারি আকারের বস্তা মুড়িতে ভরে পড়ল । বুড়ি দুটো বড় বড় কালচে পড়া বিস্কুটের টিনে ঠেসে ঠেসে মুড়িগুলো ভরালো । বস্তাতে থেকে যাওয়া মুড়ির থেকে অল্প ছোট টিন একটিতে ভরিয়ে মালতীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “ নে তোর পোলাকে দিবি ।” সে হাত পেতে মুড়ির টিনটা নিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই বুড়ি ডাক দিল, “ ভালো করে ঘুমোবি । সকালে মুড়ি বেচতে টাউনে যেতে হবে । আমার বাঁধা গ্রাহক আছে । ” বুড়ি উঠে দাঁড়িয়েছে, “তোরও ভাত-মুঠোর জোগাড় হবে, আমার বুড়ো শরীরও আরাম পাবে।” সে বুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একবার ফিরে তাকালো । বুড়ি মুড়ির ঘরের জিনিসগুলো গোছগাছ করছে । কেরোসিনের বাতি আর তুষের আগুনের আগুনের আলোতে বুড়িকে দেখতে এক্কেবারে মেম মরিচটি যেন লাগছিল । রোগা, পাতলা, সাদা । চুলগুলোও সাদা । শুকনো বুড়ির মধ্যে সে কি ঝাল ! একটা হাসি এসে মালতীর মুখখানাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল যেন ।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৩495482
  • অধ্যায় বারো (১২)
    সে হাতে মুড়ির টিনটা নিয়ে যখন বেরুলো তখন কালী বুড়ি সাদা কাপড়ের শাড়ি, সাদা ব্লাউজ পরে, কাশ ফুলের মতো চুলে খোঁপা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুড়ির ঢেউ খেলানো চিকমিকে চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল খানিকটা। কালীমেমকে, লংকার মতো ঝাল বুড়িকে দেখে আজ তার সাদা বেলি ফুলের কথা মনে পড়ল, কোমল কিন্তু মজবুত। ঝরে ঝরে পড়তে থাকলেও অনেকক্ষণ সতেজ থাকবে। বুড়ি ইতিমধ্যে ঘরে তালা মেরেইছে, ওকে দেখে বেরিয়ে এলো।
    “ পোলাকে কী খেতে দিলি?”
    “মুড়ি।”
    “আর বুলেনের বৌকে?”
    “মুড়ি।”
    “আজ চাল নিয়ে আসবি।”
    বুড়ি সাদা শাড়ির আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলল আবার। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ওকে ডাক দিল, “ চুলোর কাছে কালকের কিছু ভাত তরকারি আছে, যা ছেলেকে দিয়ে রেখে আয়। মুড়ি খেয়ে ও বুঝি থাকতে পারবে?”
    সে অল্প সংকোচ করছিল।
    “জলদি কর! বস্তির সব মানুষ বেরিয়ে গেছে, যা!” সে যাবে কি যাবেনা করতে করতে বুড়ির ঘরে ঢুকে চুলোর কাছে গিয়ে সাদা চাড়ি একটিতে ভাত তরকারি নিয়ে মণির কাছে গেল। মণি ইতিমধ্যে মুড়িগুলো খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। সে একটা খবরের কাগজ নিয়ে বানান করে করে পড়বার চেষ্টা করছিল। প্রায়ই মুখে কিছু একটা দিয়েই বিছানাতে বই মেলে ধরে সে। আজ বহু দিন পর সেই চেনা ভঙ্গিতে বিছানাতে গা ছেড়ে বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়বার চেষ্টা করছে।
    “বাবা, তোর জন্যে আমি একটা বই নিয়ে আসব। কী বই লাগবে, বল।” মা ওর মাথাতে হাত বুলিয়ে দিল। ছেলের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
    “ সত্যি বলছ , মা?”
    “সত্যিই তো।”
    “ পয়সা কই পাবে?” ওর গলা দিয়ে কান্না বেরিয়ে আসছিল ।”
    “ আজ আমি মুড়ি বেচতে যাচ্ছি যে !” সে আঙুল দিয়ে ছেলেকে বাইরে রাখা কালচে পড়া বিস্কিটের টিনটা দেখালো।”
    “ তুই দুষ্টুমি করবি না, কেমন? ঘরে থাকবি...।”
    “ নদীতে গিয়ে সাঁতরাতে থাকবি না। ভাতগুলো খেয়ে দৌড়বি না।” ছেলে মাকে হুবহু নকল করে কথাগুলো বলতেই মায়ে ছেলেতে একসঙ্গে হেসে উঠল।
    “ মায়ে ছেলেতে কী এতো কথা হচ্ছে?”
    ফেলানি তাকিয়ে দেখে এক রোগা লম্বা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মাথাতে একটি বস্তা। তার দাঁড়াবার ভঙ্গি থেকেই বুঝা যায়, বস্তাটি বেশ বড় যদিও, পাতলা। বস্তার মুখে লেগে আছে কতকগুলো মুড়ি, সেগুলোও দেখে বোঝা যায় বস্তাটা মুড়ির। মেয়ে মানুষটি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “ চল, মনির মা।” ফেলানি বুড়ির দিকে নজর ফেলল। বুড়ি ইতিমধ্যে রাস্তাতে পা ফেলেইছে। হালকা শরীরে বুড়ি পাখির মতো পা ফেলে। সে অনভ্যস্ত হাতে মুড়ির টিন দুটো সামলাতে পারছিল না। বুড়ি একবার তার দিকে ফিরে তাকিয়ে হাত তার হাত থেকে মুড়ির টিনটা নিয়ে মাথাতে তুলে নিলো। সে শুধু ঐ বুড়ির রাজ হাঁসের মতো ছোট, ক্ষীণ, সাদা গলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই গলা নিয়ে সত্যি সত্যি টিনটা নিয়ে যেতে পারবে বুড়ি? পারছেই তো, অনায়াসে বুড়ি টিনটা মাথাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
    “জোনের মা, তোর ঘরের বরটি কেমন আছে?”
    “ওর কথা আর জিজ্ঞেস করে লাভ আছে কী?”
    “ কেন? ওর শ্বাসের টান বেড়েছে বুঝি?”
    “কোন দিনই বা কম ছিল, বল?”
    “বাজার হাট করতে পারছে?”
    “আজ দু’সপ্তাহ ধরে বসে আছে।”
    “সংসার তুই একা টানছিস?”
    “ সব সময়েইতো একা টানছি।। কী আর এমন নতুন কথা হলো?”
    ফেলানি মনে মনে মহিলাটি আর বুড়ির কথা শুনে যাচ্ছিল। আবহাওয়া পরিষ্কার। ঝাঁ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। জোনের মা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, “ মণির মা, চুপচাপ কেন? শরীর খারাপ লাগছে, না মন খারাপ?” উত্তরে সেও মানুষটির দিকে তাকিয়ে হাসল খানিকটা। জোনের মায়ের গায়ের রং পাকা কালো জামের মতো। মিহি, কালো, চিকমিক করে।” রোদে ঝরে যাওয়া কালো জাম যেন পাতার ঝুটির মাঝখানে তিড়বিড় করছে। কালো মুখে সাদা আর সমান দাঁতের পাটি ফেলানির চোখের সামনে খানিকক্ষণ ভেসে রইল।
    “ তোমাদের কথা শুনেছি। তোমার উনার কোনও অসুখ করেছে?”
    “ আমার বুড়োটার অসুখ হয় না কবে সেটি জিজ্ঞেস কর।” ওর কপালে আধুলির সমান সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথিতেও উজ্জ্বল সিঁদুরের টান।ফেলানি লক্ষ্য করল হেসে হেসে কথা বললেও মেয়ে মানুষটির গলাতে সারা রাজ্যের সমস্ত বিরক্তি মিশে রয়েছে।বস্তিটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা দোকানের সামনে গিয়ে জোনের মা দাঁড়ালো। রাস্তার এক পাড়ে বুড়ি আর মালতী , অন্য পাড়ে জোনের মা। জোনের মা বস্তার থেকে মুড়ি বের করছে, দাড়ি-পাল্লাতে মাপছে। কেন জানি মালতীর মনে হলো সে এই কাজগুলো করতে ইচ্ছে করেই দেরি করছে। এতো হাসাহাসির কী এমন কথা হচ্ছে ওখানে?
    মেয়ে মানুষটি আবার যখন মুড়ির বস্তা মাথাতে তুলে ওদের দিকে আসছিল মালতীর তখন ওর দিকে তাকাবার ইচ্ছে হচ্ছিল না। শাখা-সিঁদুর পরা মেয়ে মানুষ, মান ইজ্জত নেই? সে মুখ গুমড়ো করে কালি বুড়ির কাছে দাঁড়িয়ে রইল। বুড়ির মুখের দিকেও সে একবার তাকালো, কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।
    “ চলো, তাড়াতাড়ি চলো। নাহলে বাজারে বসবার জায়গা পাওয়া যাবে না।” এবারে জোনের মা তাড়াহুড়ো শুরু করেছে।
    “আরে জোনের মা কী বলে?” মেয়ে কি বৌ ধরা মুস্কিল, চাঁদপানা মুখের বাচ্চা কোলে এক ফরসা দেখতে মহিলা এসে ওদের সঙ্গ নিলো।
    বস্তির গলিটি ছেড়ে এই ক’জন মহিলা মূল রাস্তাতে পা দিল। ফরসা মহিলাটি কোলের বাচ্চাটিকে টপাট্টপ কয়েকটা চুমু খেয়ে নিলো। একবছরের বাচ্চাটিকে দেখলে দেখতেই ইচ্ছে করে। নাক চোখা, দুধে আলতা রং, হাসলে গালে একটা টোল পড়ে। ফরসা হলে কি হবে, মায়ের নাক চোখ চ্যাপটা, শরীরের রং ছেলের মতো এতো মিহি নয়। মা ছেলেকে এক সঙ্গে দেখলে মনে হয় যেন বাড়ির ঝি বড়লোক মনিবের ছেলেকে নিয়ে এসেছে । বাচ্চাটির মা ছেলের কোল পালটে বলল, “জোনের মা যদি বাজারে জায়গা না পায় তবে আর পাবেটা কে?”
    “ কেন? আমার পেয়ারের লোক আছে না বাজারে?” কালো মানুষটি কালো কেউটের মতো ফোঁস করে উঠল। বাচ্চা কোলে মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
    “ হাসছিস যে বড়ো? সবই তো দেখি তোরই পেয়ারের লোক। যেখানে যাবি সেখানেই ঠাই পাবি, খেতে পাবি শোবার জন্যে বিছানা তো দেখি পাতাই থাকে...।”
    “ আমার তো আর বাজারে ডম্বরু বাজিয়ে, ইঁদুর মারার ওষুধ বিক্রি করা শক্ত সমর্থ পুরুষ নেই। এইসব পুরুষেরাই আমাকে খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে।”
    “ জারজ সন্তান নিয়ে বেড়াস । লাজ লজ্জা নেই।”
    “ঐ কালি বেটি! লাজ শরমের কথা তুই বলবি না বলে দিলাম। বস্তিতে তোর কথা সব ফাঁস করে দেব।
    “ কোন কথাটা ফাঁস করবি শুনি?” কালো বৌটির মাথার উপরের মুড়ির বস্তাটিও কথার তালে তালে কাঠঠোকরা পাখির জটার মতো নাচছিল ।
    “তোকে কোন ব্যাপারী কম দামে সিঁদুরের কৌটো দেয়, কে আলতা দেয় আমি জানি না বলে ভেবেছিস বুঝি?
    “আমাকে না হয় আলতা সিঁদুর দিয়েইছে। তোর মতো তো আর কোলে জারজ সন্তান দেয় নি।”
    “আমার ছেলেকে জারজ বলে বলবি নে , বলে দিলাম! আমি খাওয়াচ্ছি, আমি পরাচ্ছি। আসলে তো হিংসে। তোদের নোংরা চালার সামনে আমার চালা যেন কাকের পালে ময়ূর।“ সে বাচ্চাটিকে আবারো চুমো খেলো।
    ফেলানি একবার কালো মহিলাটি, একবার নাক চ্যাপ্টা ফরসাটি আরেকবার কালী বুড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ওদের দুজনের কথা শুনে ও ভেবে পাচ্ছিল না কী করে সে। বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেও দাঁড়িয়ে রইল।
    “আমরা তো এদিক দিয়েই যাব।” বুড়ি মূল রাস্তার থেকে বেরিয়ে যাওয়া গলি পথ একটা দেখালো।
    সে কালো আর ফরসা মেয়েমানুষ দুটির দিকে তাকালো।
    “ওরা দুজন বাজারের দিকে যাবে।”
    “বুড়ি মা, তুই কি এদিকে যাবি?”
    “আমি এই মণির মাকে অল্প কয়েকটা বাড়ি ঘর দেখিয়ে আসি।” ওরা দু’জন মণির মায়ের দিকে তাকালো। সে ঠোঁট কামড়ে মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওর চোখে মুখে স্পষ্ট ঘৃণা, বিরক্তি আর রাগ।
    “ মণির মা , তুই দেখি আমাদের সঙ্গে কথাই বলিস না।” ফরসাটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। মাকে হাসতে দেখে বাচ্চাটিও খিলখিল করে হাসছে। ফেলানির দিকে দুই হাত মেলে বাড়িয়ে দিয়েছে। সে বাচ্চাটির দিকে তাকায় নি।
    “মণির মা, খারাপ পাবি না। অল্প ঠাট্টা ইয়ার্কি না করলে কী করে থাকবি বল? বাড়ি গিয়ে তো সেই দেখবি বুড়ো উঠোনে বসে শ্বাস টানছে আর বক বক করছে। ফরসাটি ফেলানির মুখে ধরে বুড়োর মতো লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে টেনে, মাঝে মাঝে কেশে কেশে বলতে শুরু করল, “ শালি... মাগি...কই মরতে গেছিলি ...। কোন মরদ ধরেছিলি...বাড়িতে যে পুরুষ মানুষটা...। বজ্জাত মেয়ে মানুষ...। তোকে...।”
    দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। সে শুধু অবাক হয়ে এই দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল। কোলে কচি শিশু , মাথাতে মুড়ির বস্তা নিয়ে এই দুটি মেয়ে মানুষের দিকে সে তাকিয়েই রইল।
    “ কী হলো মণির মা? চল , এদিক দিয়ে চল। ওরা বাজারের দিকে যাবে।”
    সে কালি বুড়ির নামিয়ে রাখা মুড়ির টিনটা কলসির মতো কাঁখে নিয়ে নিলো। এক হাঁতে কাঁখের টিন ধরে অন্য হাতে আরেকটা ঝুলিয়ে নিয়ে সে দিব্যি পথ হাঁটতে শুরু করল।
    “একটা আমাকে দে, তোর অভ্যেস নেই। গৃহস্থ ঘরের বৌ, মুড়ির টিন এমনি করে বয়েছিলি কখনো?”
    “কেন, জল টানিনি বুঝি? একটা কলসিতে কাঁখে আরেকটা বালতি হাতে।” কথাগুলো বলে সে এমনিই হেসে ফেলল। কেন জানি ওর মনটা বড় হালকা বোধ হলো।
    “ সংসারের কি জ্বালাতে যে জ্বলছে রে মেয়েগুলো...।” সে ঠিক ধরতে পারেনি বুড়ি কার কথাই বা বলল।
    যখন ফিরে এলো ওর হাতে তখন এক কেজি চাল, চারটা ডিম, আধা কেজি আলু, এক পোয়া মিঠা-তেল আর একটি সাহিত্যের বই। মুল রাস্তার থেকে যে গলি ছোট পথটি বস্তিতে ঢুকে গেছে তার মোড়ে তেঁতুল গাছের নিচে মণির মায়ের জন্যে দাঁড়িয়েছিল। মাকে দেখেই দৌড়ে কাছে ছুটে গেল। মায়ের হাতের থেকে বাজারের থলেটা নিজের হাতে নিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলে, “মা, চাল এনেছ?” মা ওর মুখের দিকে তাকালো। এক্কেবারে শুকিয়ে আছে। সেই সকালে বুড়ির দেয়া ঠাণ্ডা ভাত কতকগুলো খেয়েছিল। ফেলানির বুক টনটন করে উঠল।
    ঘরে ঢুকে দেখে টিন একটাতে পরিষ্কার এক টিন জল ভরে রাখা। চুলোর কাছে এক আঁটি লাকড়ি।
    “ মা, বুলেন কাকা টিনটা রেখে গিয়েছিলেন। আমি নদীতে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে এনেছি। লাকড়িগুলোও কাকার সঙ্গে গিয়ে রিজার্ভ থেকে নিয়ে এসেছি।”
    “জল কিসে করে আনলি? এই টিনে?”
    “ধ্যৎ ! না না। কালী বুড়ির বালতিতে করে নিয়ে এলাম। বালতিটাও বালি দিয়ে মেজে রেখেছি।”
    “ কৈ রাখলি বালতিটা?”
    “ঐ যে ওখানে” সে বুড়ির বারান্দার দিকে দেখিয়ে দিল।
    মণি থলের থেকে বাজার বের করতে লেগে গেল। একেকটা জিনিস বের করে মাটিতে রাখে আর আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে।
    “চাল”
    “আলু”
    “ডিম”
    “মিঠা-তেল”
    “এটি আমার সাহিত্যের বই।”
    বইটি হাতে নিয়ে আনন্দে ছেলের মুখের রা বন্ধ হয়ে গেল। অল্পক্ষণ বইখানা নেড়ে চেড়ে দেখে হাসিতে ভরা তার মুখখানা আবার ম্লান হয়ে পড়ল।
    “ অংক তো ভুলেই গেছি।”
    “কেন ভুলবি, স্কুলে গেলে মাস্টার আবার শিখিয়ে দেবে না বুঝি?”
    “আবার আমি স্কুলে যাব? সত্যি মা?”
    “যাবিই তো” আগামী সপ্তাহের থেকেই যাবি। আমি তোকে স্কুলে যাবার জামাও তো এনে দেব।”
    “মুড়ি ভেজে দিলে কালীদিদা কি রোজ তোকে পয়সা দেবে?”
    “রোজ কি আর আমি অন্যের মুড়ি ভাজব রে? আমি নিজেই ধান কিনব, মুড়ি ভাজব।”
    “পয়সা কোথায় পাবে?”
    “জোগাড় করব।”
    ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে ডাল বসালো, ভাত বসালো। ডিম দুটো সেদ্ধ করবে বলে ভেবেও চারটা দিয়ে দিল। আলু একটা আগুনে পুড়ে বের করে রাখল। মণি মায়ের গায়ে গা দিয়ে বসে আছে।
    “ এই ক’টা বুলেন কাকাকে দিয়ে আসতে পারবি রে?” দুটো সেদ্ধ ডিম কাগজ একটাতে বেঁধে ছেলেকে এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখে সে ঘুমে ঢলে পড়েছে। তার পেটের থেকে করকর করে শব্দ একটা বেরুচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি করে ভাত বাড়ল। ছেলে নিজেই কলাপাতা কেটে রেখেছিল।
    “ওঠ বাবা, ভাত ক’টা খেয়ে নে।”
    সে চোখ মেলে তাকালো, “ মা তুই না খেলে আমি একা একা ভাত খাব না।”
    “ তাই হবে।” নিজের পেটের থেকেও একটা করকর শব্দ শুনতে পেল। তারও ছেলের সঙ্গে বসে এবেলার ভাত খাবার ইচ্ছে হলো। কলাপাতে নেয়া গরম ভাতের গন্ধে ওর উপোসি পেটটাই যেন বেরিয়ে আসতে চাইছিল।
    ভাত ক’টা খেয়ে ফেলানির শরীরটাতে যেন জোর ফিরে এলো। যে একটা অস্থির ভাব ছিল সেটি এখন চলে গেছে। ছেলেকে বস্তাটিতেই শুইয়ে দিয়ে ওর গায়ে কালো পাড়ের অল্প ছেঁড়া শাড়িটা দু'ভাঁজ করে দিয়ে দিল। ক্যাম্পে গেরুয়া পোষাকে যে সাধুর দল এসেছিল ওরা এটি দিয়ে গেছে। খানিকক্ষণ ওঁ ওঁ করে ছেলে আবার ঘুমিয়ে গেল। সে ছেলের কাছ থেকে সরে এসে ডিম সেদ্ধ দুটো কলাপাতাতে বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে ফুরফুরে জ্যোৎস্না। ফিনফিনে বাতাস বইছে। গরমও নেই ঠাণ্ডাও নেই। অল্প আগেও বস্তির বাঁশের বেড়ার ঘরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ভেতরে আগুন জ্বলতে দেখা গিয়েছিল। এখন আগুনগুলো নিভে গেছে। আগুনের সঙ্গে করে মানুষের হৈ-হল্লাগুলোও থেমে গেছে। কাকভোরে যে বস্তি জেগে উঠে রাত আটটা ন’টা বাজতেই সেটি শুয়ে পড়ে। সে কলাপাতাতে বাঁধা ডিম দুটো হাতে নিয়ে বুলেনের ঘরের দিকে পা চালাল। আজ এতোটা দিন ধরে মানুষটা ওদের এতো কিছু খাইয়েছে, সেতো উল্টে কিছু দিতে পারেনি। বাড়ির চারদিকে বুলেন গাছের ডালে বেড়া দিয়ে সাজিয়ে ঘিরে ফেলেছে। আধা মাটি চাষ করাও হয়ে গেছে, কয়েকদিনের মধ্যেও ওর মাটি থেকে হাসি বেরুবে। সে কাঠে তৈরি ফাটকটা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। দরজা খোলাই ছিল। বাঁশের চাঙে ছেলে শুয়ে আছে।।মাটিতে একটা বস্তা পেড়ে গামছা পরে খালি গায়ে বুলেন বৌকে ভাত খাওয়াবার চেষ্টা করছে। বৌ বড় জ্বালাতন করছে। সে গিয়ে ওদের দু’জনের পাশে বসল। নিঃশব্দে ডিম দুটো থালাতে রেখে দিল। ডিম দুটো দেখেই ওর বৌ হাত দুটো মেলে ভাতের থালাতে ছোঁ মারতে গেল। বুলেন তৎক্ষণাৎ ডিম ভেঙ্গে এক এক টুকরো এক এক গ্রাস ভাতের সঙ্গে দিতে শুরু করল। বৌ তখন শান্ত শিশুর মতো ভাতগুলো খেয়ে গেল। বুলেনের মুখটাও শান্ত হয়ে এসেছে , “আজ গোটা দিন ওর মুখে কিছু দিতে পারি নি।” আস্তে আস্তে কথাগুলো বলে মানুষটি ফেলানির দিকে তাকালো। ইতিমধ্যে বৌয়ের মুখ খালি হয়ে গেছে। রাগে সে নিজের গায়ের চাদর খুলে ফেলানির গায়ে ছুঁড়ে ফেলল। বুলেন বৌয়ের মাথাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বৌ ওর কোলে উঠে বসল। গায়ে গা লাগিয়ে বসে চোখ জোড়া আধা বুজে বৌ ভাত খেতে থাকল। বাতিটা নিভে গেল, তেল ফুরিয়ে গেছে। চুলোর আগুনও ছাই হয়ে গেছে। শুধু আধা খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের ফুটফুটে জ্যোৎস্নার আলো এসে ওদের গায়ে পড়ছে। ভাত খাওয়া শেষ হলে বুলেন অল্প জলে বৌয়ের মুখ মুছিয়ে দিল। কুঁ কুঁ একটা শব্দ করে পাগলি গিয়ে ওর স্বামীর বুকে লেপটে গিয়ে বসল। ওর শরীরে ঢিলেঢালা পেটিকোট একটা। পুরুষ মানুষের বেঁধে দেয়া টান টান বেণি মেঝেতে পড়ে আছে। বুলেন ওর উদোম পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাত অল্প সরালেই মানুষটি জেগে উঠে। বাঁকা জ্যোৎস্নার আলোতে এই নারী পুরুষের জোড়াকে দেখতে পাথরে কাটা মূর্তির মতো লাগছিল। এক লহমা ওদের দেখে সে যাবার জন্যে উঠল। বুলেন চোখের ইশারাতে ওকে একেবারেই শব্দ না করে যেতে বলল। খিরিক করে শব্দ একটা হলেই পাগলি উঠে যাবে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে বড় জ্বালাতন করে। বুলেনের ক্লান্ত চোখে মিনতি। সারা দিন জুড়ে বাইরে কাজ করে এসে আবার তাকে ঘরে এতোটা করতে হয়। তার মুখখানা দেখলেই বোঝা যায় তার পেটও ভাতের গন্ধে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভাতক’টা খেয়ে তারও একটু গড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। ফেলানি যতটা আস্তে পারে শব্দ না করে বেরিয়ে এলো। দরজার কাছে এসে অল্প দাঁড়ালো । দরজাটা ভেজিয়ে দেবে কি? থাকুক, আবার যদি শব্দ হয়। সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো।
    বস্তিটা প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। দ্রুত পায়ে বুলেনদের ঘর থেকে নিজের বাসাতে আসছিল। আসার পথে হঠাৎই শুনতে পেল। কেউ একজন ওর স্ত্রীকে গালি দিচ্ছে। লোকটার গলা যেন ওর চেনা চেনা মনে হলো। কোথাও যেন এই শব্দগুলো সে শুনেছে। ওর পা মন্থর হয়ে এলো। একচালা নয়, দু’চালা কেঁচি বাটা দেয়া একটি ঘরের বারান্দাতে সে দেখল একজন বুড়ো মানুষ হাঁটু গুঁজে বসে আছে। মানুষটির পিঠ ওঠানামা করছে। শ্বাস নেবার ঘর-ঘর শব্দ একটা শুনতে পেল সে। ঘরটির সামনে সে অল্প দাঁড়ালো।
    “শালি! বজ্জাত মেয়ে মানুষ...। ঘরে বেমারি মানুষটা পড়ে আছে... আর মেয়ে মানুষটা মরতে যায় কই...।” শব্দগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। শুনা যাচ্ছে শুধু শ্বাস টানার একটা ঘর ঘর শব্দ। সে ওখানে অল্প সময় দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে গিয়ে পৌঁছলো। তাকেও ঘুমে ফেলে দিচ্ছে। সেও ছেলের কাছে হাত পা গুটিয়ে শুয়ে পড়তে গিয়েও থেমে গেল। এই শাড়ি পড়েই কি সে শুবে? শুধু এই শাড়িটাই আছে। সে শাড়িটা খুলে ভাঁজ করে গুটিয়ে রাখল। বুলেনের জোগাড় করে দেয়া বস্তাটা টেনে এনে ঘুমোবার জন্যে শরীরটা এলিয়ে দিল। সারা দিনের ক্লান্ত দেহ, সে ভেবেছিল শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে যাবে। কিন্তু বস্তাতে গা এলিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে তার ক্লান্তি মিলিয়ে গেল। তার চোখের সামনে আসা যাওয়া করতে শুরু করল এর পেছনে ওই ছবিগুলো। একটা বারান্দাতে লম্বা শ্বাস টানতে টানতে শাপ শাপান্ত দিতে ব্যস্ত বুড়ো মানুষটা...বেলি ফুলের মতো এক বুড়ি…পাকা জামের মতো কালো মেয়ে মানুষ একটি...চাঁদের মতো বাচ্চার মতো নাক চাঁপা ফরসা একটি মেয়ে মানুষ...কালো একটি পাল্লাতে উপচে পড়া সাদা সাদা মুড়ি। সমস্ত ছবিগুলো এসে ভিড় করল বাঁকা চাঁদের আলোর নিচে পড়ে থাকা এক জোড়া মানুষের গায়ের উপর। এক উদোম বুকে, দুই বাহুর মাঝে এক যুবতি মেয়ে ...ছেলে মানুষের হাতে বাঁধা একটি বেণি। ওর চোখের সামনে অনেকক্ষণ ছবিটা রইল। ছবিটা ক্রমেই সেগুন পাতার মতো কাজের লোকের হাত হয়ে গেল, মালতীর গায়ের উপর সেগুন পাতা ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশস্ত হাতখানা যেখানেই পড়ে সেখানেই যেন পড়ে চাঁদের এক টুকরো বাঁকা জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্নার আলো যে তুষের আগুন হয়ে মালতীকে ঘিরে ফেলেছে। সে ঘোপ করে উঠে বসল। তারপর সে দরজা খুলে ঘুরের বাইরে গিয়ে বসল। হাঁটুর মাঝে মাথা রেখে সে চুপচাপ বসে রইল। সে অনুভব করল ওর পিঠে এক কর্কশ হাতের স্পর্শ। ক্রমেই ওর চোখ জোড়া ভিজে এলো। বাইরে সোঁ সোঁ করে বাতাস বইছে। শরীরটা শিরশিরিয়ে উঠল। পাহাড়ের পাশের শহরটিতে বৃষ্টি আসার হলেই বাতাস ভারী হয়ে পড়ে। বৈশাখ মাসেও শরীরে গরম একখানা কাপড় নিতেই হয়। সে আবারও ভেতরে চলে গেল। মণির ঠাণ্ডা লাগছে, ঠাণ্ডাতে বেচারা কুঁকড়ে শুয়েছে। ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখা ক্যাম্পে পাওয়া শাড়িখানা , যেটি এখনো ছেঁড়েনি, ওর গায়ে বিছিয়ে দিতে গিয়ে কিছু ভাবছিল। ঠাণ্ডাতে ছেলেটি কেঁকিয়ে উঠল। দু'ভাঁজ করে সে কাপড়টি দিয়ে ওর শরীরে চাপিয়ে দিল। ওম পেয়ে ও আবার ঘুমিয়ে গেল। সে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিল। তার জন্যে একটা গেঞ্জি, একটা পেন স্কুলের পোশাক, শরীরে দেবার একখানা কাপড়, শুবার জন্যে একটা বিছানা, ভাত খাবার জন্যে একটা থালা। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হবে। বাতাস একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ফেলানি বস্তাটিই গায়ে দেবে ভেবে আবার খানিক অপেক্ষা করল। কিছু একটার গন্ধ বেরুচ্ছে। গন্ধটা কিসের সে ধরতে পেল। মানুষটা প্রত্যেকবারই যখন কপি খেত করতে শুরু করবে তখন এক সারের বস্তা নিয়ে আসে , তাতে অমন গন্ধ করত। কপির চারা উঠাতে উঠাতে রোদে পোড়া মানুষটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “ মালতী চুলগুলো টেনে টেনে কী সব ভাবছিস বসে?” নেই আর কেউ নেই, গায়ে বস্তা একটাও দেবার সামর্থ্য হারানো মালতীকে দেখবার এখন আর কেউ নেই। চোখের জল যেন ওর বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। মণি স্বপ্ন দেখে কিছু বিড়বিড় করছিল। সে যদি এখন জেগে উঠে। তার শরীরের থেকে শাড়িটা টেনে আনতে গিয়ে সে হাত গুটিয়ে নিলো। থাকুক, মাথা ঢেকে শুয়ে আছে এখন শাড়িটা টেনে আনলে সে কাঁচা ঘুম থেকে উঠে যাবে। গামছা গায়ে দিয়েই সে আবার বাইরে বেরিয়ে এলো। এবারে ওর বুক ফেটে হুড় হুড় করে চোখের জলের ধারা নেমে এলো। চোখের জল মুছে মুছে সে একটা চেনা পথ ধরে এগিয়ে গেল। একটা কামরাঙা গাছ রয়েছে দুবছরেই ফল ধরে যায়, কলিতেই মিষ্টি তার ফল—সেই গাছ পেরিয়ে, ফল ধরলে মাটি ছুঁই ছুঁই করে যে জাহাজি কলার গাছ --সেটি পেরিয়ে, লাল গোলাপের গাছ পেরিয়ে, মাছে ভরা পুকুরটা পার করে সে সেই ঘরটার দরজায় গিয়ে হাত দিল। ভেতরে একটা বিছানা, রোদে গরম করা লেপ, শিমুল তুলোর বালিশ, রোদে গরম করা তোষক, ধবধবে সাদা বিছানা চাদর , সাদা মশারি। সে হামাগুড়ি দিয়ে বিছানাতে গিয়ে ঢুকছে। রোদে দেয়া লেপ তোষকের সঙ্গে মিশে আছে আরেকটা উত্তাপ। সেই উত্তাপে তাকে ছেয়ে ফেলেছে। সে ঐ তাপে খানিকক্ষণ ডুবে রইল কি রইল না দাউদাউ আগুনে সব জ্বলে উঠল, কামরাঙা গাছ, জাহাজি কলার গাছ, লাল গোলাপের গাছ মিইয়ে গেল। ঘরের জিনিসগুলো ছাই হয়ে গেল। পুকুরের মাছগুলো সাদা হয়ে ফুলে ফুলে ছাই কালিতে মেখে জলে ভেসে উঠল। থোকা থোকা ছাইয়ের থেকে উঠে এলো এক হাদাভোঁদা মানুষ। কথাগুলো লেগে লেগে যায়। র বলতে পারেনা। হেলে দুলে হাঁটে... সে মালতীর পায়ের কাছে পড়ে গোঙাতে শুরু করল, “মলি বাবা... পুখুলেল থেকে ...নামঘলে আগুন।” অনেকগুলো কলাপাতার শুকনো ডাঁটাতে ওকে ঢেকে ফেলেছে, গালে মুখে পিছল পিছল ভেজা কিছু লেগে ধরেছে। ওর নাকে এসে লাগল এক অদ্ভুত গন্ধ। ওর পুরো শরীর পুড়েছে, মাথাতে কি যেন করছে। সে মাথাটা বেড়াতে হেলিয়ে দিল।
    “মণির মা, কী করছিস?” সে চমকে উঠল।
    ‘কে?”
    “আমি-ই, মণির মা।”
    সে ধীরে ধীরে মাথাটা সোজা করে তার সামনে দাঁড়ানো মেয়ে মানুষটির দিকে তাকালো। জোনের মা। জ্যোৎস্নাতে মানুষটির শরীরকে দেখতে কেমন যেন লাগছে। সে চোখ দুটো মুছল।
    “কে?”
    “আমি জোনের মা।” মহিলাটি ওর কাছে বসল। এবারে মহিলা ওর কাঁধে হাত রাখল। “আরে দেখো, সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গায়ে একটাও কাপড় নেই।” ফেলানি কোনও কথা বলল না।
    “ কী হয়েছে মণির মা?”
    উত্তরে ওর চোখের জল জোনের মায়ের হাতে পড়ল।
    “তুই ভালো করে কাপড় একটা গায়ে চাপাসনি কেন?”
    ঐ একই রকম হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে রইল। জোনের মা ধীরে ধীরে সেখান থেকে উঠে গেল। মেঘ গিরিং গিরিং করে ডাকছে। ওর কোনও নড়ন চড়ন নেই। সে অনুভব করল ওর গায়ে একটা আধা পুরোনো কাপড়ের ওম।
    “কাপড়টা পরে নে। ভালো কাপড় নয়। বেশ ক’ জায়গায় ফেটেছে।”
    সে নড়ে চড়েনি।
    “ এই একখানা কাঁথা নে। ছেলেটার গায়ে চাপিয়ে দে।” পুরোনো কাপড় জোড়া দিয়ে দিয়ে কাঁথাটা সেলাই করা হয়েছে।
    “ কাঁথাটাও ভালো নয়, বুঝলি। উপরে দেবার জন্যে ভালো কাপড় একটুকরোও নেই। ছেঁড়া-ফাটা জুড়ে বানিয়েছি।”
    হঠাৎ ডাকতে ডাকতে মেঘ যেন ভেঙ্গে পড়ে গেল। একচালা ঘরটা থেকে হুড়হুড় করে জল পড়ছে। দু’জনে নিঃশব্দে ভেতরে উঠে গেল। জোনের মা-ই কাঁথাটা মণির গায়ে চাপিয়ে দিল।
    ফেলানির ইচ্ছে হলো মহিলাকে কিছু খেতে দেয়। এতো দিন বাড়িতে আসা মানুষকে যেমন খাইয়ে এসেছে। সকালে বুড়ির দেয়া মুড়ি অল্প ছিল। নরম হয়ে গেছে। সেগুলোই একটা কলাপাতাতে এগিয়ে দিল। মানুষটি বড় আগ্রহে সেগুলোই খেয়ে নিলো। মুড়িব’টি খেয়ে এক গ্লাস জল ঢকঢক করে পান করে যেন তার শরীরে প্রাণ ফিরে এলো।
    “উস! বড় খিদে পেয়েছিলরে মণির মা।”
    “কেন ভাত খাওনি কেন?”
    “খাইনি।”
    “আসবার সময় দেখি পুটি মাছ কিনে এনেছিলে।”
    “এনেছিলাম, ভাতও রেঁধেছিলাম, মাছও রেঁধেছি।”
    “তবে খেলেনা কেন?”
    “ মণির মা, আমাকে শহরের বাবুনির মতো ডাকছিস কেন?” সে অল্প হাসল।
    “ ভাত খেলি না কেন?”
    “ কী আর পেটের খিদে থাকবে রে, এসেই বুড়োর গালি।”
    “রাতের বেলা এখানে এসে বসে আছিস। জোনের বাবা কিছু বলবে না?”
    “ সে কিছু টের পেলে তবে না বলবে। ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে এসেছি। শ্বাসের টান উঠে দিন দুই পর যখন একটু ভালো হয়, কাটা কাঠের মতো পড়ে থাকে। বুড়ো শরীরে এতো কড়া ঔষধ সইবে কেন?”
    “তুই ঘরটার জন্যে এতো করিস। বুড়ো এতো গালি পাড়ে কেন?”
    হঠাৎ জোনের মা ব্লাউজখানা খুলে ফেলল।ফেলে দিল গায়ের চাদর। পাকা জামের মতো রসে টইটম্বুর তুলতুলে দেহ নগ্ন হয়ে পড়ল।
    “এই শরীরটার জন্যে বুঝলি, এই শরীরটার জন্যে।”
    মহিলার রাগ চড়েছে।
    “ওর গায়ে রসকষ কিছু নেই, রাতের কাজ করতে না পেরে সে আমাকে কী করে দেখ।” ছ্যাঁত করে সামান্য বিজলি চমকালো। সেই আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল কালো জামের থ্যাতলানো চামড়ার মাঝেমধ্যে লালা মাংস উঠে গেছে, ভরে গেছে ঘায়ে।
    “ছুঁয়ে দেখ মণির মা, ছুঁয়ে দেখ।” মেয়েমানুষটি ওর ক্ষতবিক্ষত বুকে ওর হাতখানা লাগিয়ে দিলে। এবারে মানুষটি কেঁদে উঠলে, “ বল মণির মা , আমি কী করে ভাত খাই?”
    এবারে সে জোনের মার পিঠে হাত রাখল। কিছু একটা বলতে গিয়েও তেমনি থেমে গেল।
    “মণির মা, আমার শরীরটা ওর মতো শুকিয়ে গেলেই আমার শান্তি হবে। কিন্তু এই বেড়ালের শরীর, এর কিচ্ছুটি হয় না। কফ কাশি নিয়ে ঐ বুড়োর পাশে আমার এই শরীর...।” পাকা জাম যেমন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে সে তেমনি ফেলানির গায়ে গড়িয়ে পড়ল।
    অল্প সময় দু’জনে এমনি করে বসে রইল। বৃষ্টি থেমেছে। বাইরে আবার আলো দেখা দিয়েছে। জোনের মা উঠে দাঁড়ালো । সে শরীরের আঁচল থেকে কয়েকটা নোট বের করল। এবারে টাকাগুলো ফেলানির হাতে গুঁজে দিল।
    “একটা কাপড় কিনে নিবি।”
    সে না না করছিল। জোনের মা বাইরে বেরিয়ে গেছে।
    “পারবি যখন দিয়ে দিবি।” পেছনে না তাকিয়ে সে বেরিয়ে চলে গেল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৪495483
  • অধ্যায় তেরো (১৩)

    রাতে শুতে যেতে দেরি হয়েছিল। মণি মায়ের আগে ঘুম থেকে উঠে গেছে। ফেলানি চোখ মেলে দেখল ছেলেটি বস্তাতে বসে সাহিত্য বইটি পড়ছে। সে আজ আর বানান করে পড়ছে না, ঝরঝর করে পড়ে যাচ্ছে। ওর মুখ থেকে যেন আলো ঠিকরে পড়ছে। চেহারার দিকে তাকিয়ে ওর মুখেও হাসি ফুটে বেরুলো। বাবার চোখের মণি ছিল ছেলে। পারলে বাবা যেন ওকে আকাশের চাঁদও এনে দেয় আর কি। ছেলেকে পড়বার জন্যে ওরই মাপের এক জোড়া টেবিল চেয়ারও তৈরি করে দিয়েছিল। শহর থেকে কলম এনে দিয়েছিল। তার স্কুলের জামা গ্রামের আর সমস্ত ছেলের থেকে ভালো ছিল।
    “মা, আমি স্কুলে কবে যাব?”
    “আগামী সোমবার থেকে।” কথাটা বলে সে চুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। একমুঠো ভাত দুটো আলু দিয়ে বসিয়ে দিল। কালীবুড়ি এখনই আসবে। গতকাল যে মুড়িগুলো ভেজে রেখেছিল, এসেই সেগুলো সে বুড়ির কথামতো টিনে ভরিয়ে রেখেছিল।
    “মণি, যা তো। কলাপাতা একটা কেটে নিয়ে আয়গে'।” গায়ে ভালো করে কাঁথা মুড়ে ছেলে একমনে বইয়ের ছবিগুলো দেখছিল। মায়ের কথাগুলো শুনতে মাথা তুলেও সে আবারও ছবি দেখাতে মন দিল।
    “ভাত খাবি না বুঝি?”
    “ হ্যাঁ।” ছেলে মায়ের দিকে তাকালোই না।
    “ মাটিতে খাবি বুঝি?” মা ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল।
    “পাতা আনতে কী করে যাব? রিজার্ভে জল জমে গেছে।” যেন সে জলে ডোবাতে নামেই না আরকি। জলের জন্যে নয়, ওর মন আসলে বইটি ছেড়ে যেতে চাইছে না।
    মালতীর নিজের উপরে খানিকটা রাগ চড়ল। এতো কি শুতে হয়? বস্তির বেশির ভাগ মানুষ কাজে কর্মে বেরিয়েইছে। সে আর আজ কই নদীতে গিয়ে স্নান করতে পারবে? কালীবুড়ির ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল বুড়ি শাদা শাড়ি পরে আঁচলে চাবি বেঁধে তৈরি।
    “ কী করছিস তুই, মণির মা?” সে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকালো। পেছনে কোলে বাচ্চা নিয়ে ফর্সা মেয়ে মানুষটি আর তারও সামান্য পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জোনের মা। দুজনে ভেতরে ঢুকে এলো।
    “ ভাত খেলি?”
    “ স্নান করলি?”
    জবাবে সে মাথা নাড়ল। কালীবুড়িও এসে ঢুকে পড়ল।
    “জলদি কর।”
    “ মরদ নেই মেয়ে মানুষ এতো বেলা অব্দি শোয় !” ফর্সা মহিলাটি খিলখিলিয়ে হাসছে। মালতী দাঁড়িয়ে আছে। কী করে সে? স্নান করতে হবে, ভাত খেতে হবে।
    “ যা কল তলাতে গিয়ে স্নান করে আয়গে'।” কালীবুড়ি কলতলাটা দেখিয়ে বলল। বস্তির ক'টা বাড়িতেই বা কল আছে। সবাই রাস্তার সরকারি কলের জলই খায়। তবে কালীবুড়ির কলের জল অন্যগুলোর চে' ভালো। সে দাঁড়িয়ে আছে।
    “কী হলো ?” বুড়ি বিরক্ত হয়ে পড়ছে।
    মালতী বুলেনের দিয়ে যাওয়া টিনটার দিকে তাকাচ্ছিল। কী করে সে । টিনটা তুলে নিয়ে যাবে কি? খাবার জলগুলো কী করে? ছেলেকে যে বলবে জল নিয়ে আসতে, ওর ইচ্ছে নেই।
    “ যা কলের পারে বালতি আছে।” জোনের মা হেসে উঠল। সে কলের পারে স্নান করতে গিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে রইল। পেটিকোটটা ভিজিয়ে ফেলে যদি কী পরে যাবে সে? এই একটাই তো ভালো পেটিকোট রয়েছে ওর। ক্যাম্পে থাকার সময় যে বাড়িগুলোতে গিয়ে কাজ করত তারই এক বাড়ির দিদি একজন ওকে দিয়েছিল। সে প্রথমে শাড়িটা খুলল। দাঁতে কামড় দিয়ে কাপড়টা ধরে পেটিকোট খুলে কলের উপরে রাখল। জোনের মায়ের দেয়া শাড়িটা শরীরে রেখে চট করে এক বালতি জল সে ঢেলে দিল। ফাটা শাড়িটা ওর শরীরে লেপ্টে গেল। ফাটা, ভেজা শাড়িতে শরীর ঢাকতে না পেরে ভীষণ অস্বস্তি হলো। জোনের মায়ের মতো গলা করে সমস্ত তিক্তটা ঝেড়ে ফেলতে সে বিড়বিড় করে উঠল , ”এই বেড়ালের শরীর...” দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে পেটিকোটটা নিতে গিয়েই সে থেমে গেল। একটা তীক্ষ্ণ মিহি শিষ। চমকে উঠে সামনের দিকে তাকালো সে। সামনের বাড়ি একটার উঠোনে দাঁড়িয়ে একজন পুরুষ মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখে পড়তে স্পষ্ট একটা নোংরা আর কুৎসিত হাসি দেখতে পেল । শিউরে উঠল সে। মাথা নুয়ে ঘরের দিকে আসবার পথে ওর কানে পড়ল টানা ঢিল পড়বার মতো কিছু নারী কণ্ঠের গালি। শাড়িটা কোমরে প্যাঁচিয়ে নিয়ে কোলের বাচ্চাকে জোনের মায়ের কাছে তুলে দিয়েছে গৌরাঙ্গিনী মেয়েমানুষটি। বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানো এম্বেসেডার গাড়িতে হেলান দিয়ে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে । ওকে অনবরত গালি বর্ষণ করছে সে। বেঁটে, ফর্সা এই মেয়েমানুষের মধ্যে কোথায় যে এতো গালি লুকিয়ে ছিল।
    “ কুকুর! শালা! মাইয়া দেখলে চুলকানি উঠে। এই বুড়িমায়ের দিকে তাকিয়ে একটা শিষ দে, দেখি তো। মার খেয়ে বেটা হেগে দিবি...।”
    লোকটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। বেরিয়ে এলো এক রোগা লম্বাটে দেখতে মহিলা। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিকের উগ্র রং, হাতে একটা খাড়ু। পরনে লাল পেড়ে একটা সবুজ শাড়ি। মহিলাটি কালীবুড়ির বাড়ির দিকে তেড়ে আসছিল। ঠিক যেন একটা ফড়িং ঝাঁপ দিয়ে বেড়াচ্ছে। জোরে একটা ঝাঁপ দেয় আর গোরাটিকে গালি দেয়, “ ঐ কুত্তি ! আমার বাড়ির অতিথিকে তুই গালি পাড়িস কেন?”
    গৌরাঙ্গিনীও পিছিয়ে যায় নি, “ তোর অতিথি? চেনা আছে। তোর বিছানায় আসা অতিথি তোরই শরীর চাটতে থাকুক। অন্য বাড়ির ভদ্র মেয়ে মানুষের দিকে চোখ দেয় কেন?”
    “ দেখ রেণ্ডী, জিহ্বা বের করে আনব কিন্তু!”
    “পুলিশ লাগিয়ে তোকে একদিনেই জিন্দা লাশ বানিয়ে দেব।”
    “ ডেকে আন তোর পেয়ারের লোকেদের।”
    “ বিয়ে করা বৌ আমি। মাথার উপর পুরুষ মানুষ আছে। ঘরে ছেলে মেয়ে আছে। তোর মতো...।”
    “বিয়ে করা বৌ । মাথার উপর পুরুষ মানুষ আছে। তোর মাথার উপরের লোকটাকে ডেকে আন। ওর মুখখানা দেখি একবার...।”
    “ ঐ! আমার মানুষটার নামে তুই কেন কথা বলতে যাবি, শালি রেণ্ডী!” রোগা পাতলা মহিলাটি এবারে সত্যি ফড়িঙের মতো লাফিয়ে কালীবুড়ির বেড়া পার করে চলে এলো। এসেই গোরা মেয়েটির চুল টেনে ধরল।
    ইতিমধ্যে মণির মা মাথা আঁচড়ে , কাপড় পরে, খাবার নামে ভাত দুটো ছুঁয়ে মুড়ির টিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে। বাইরে ঐ চকচকে লালপেড়ে শাড়ি পরা মেয়ে মানুষটির কীর্তি দেখে ওর গা কেঁপে উঠল। কি কুটিল আর হিংস্র চাউনি এই মহিলাটির। মেয়ে মানুষের যে এমন দৃষ্টি থাকতে পারে সে কল্পনাও করতে পারে নি। সেই দৃষ্টি এবারে ওকেই ঘিরে ধরল। “ ভদ্দর ঘরের মেয়ে যদি এই রেণ্ডী মেয়েগুলোর সঙ্গে কেন?”
    “কাকে তুই রেণ্ডী রেণ্ডী বলছিসরে! চুপ করবি কি না বল?” এবারে জোনের মাও যোগ দিল। মাথার থেকে মুড়ির বস্তা নামিয়ে সে ঐ ফড়িং মেয়েটিকে চেপে ধরল। ফড়িং তখনো গোরির চুল টেনে ধরে আছে। জোনের মায়ের উঁচু লম্বাটে মজবুত শরীর। ধাক্কাটা ঐ রোগা পাতলা মেয়ে মানুষ সহ্য করতে পারে নি। সে এবারে গলা ফাটিয়ে চেঁচালো, “ এই রেণ্ডীগুলো আমাকে মেরে ফেলল রে! ঐ ড্রাইভার, ড্রাইভার! শালা বৌয়ের পয়সাতে মদ খেয়ে পড়ে থাকবি। বৌ বাঁচল কি মরে গেল, বেটার কোনও খবরই নেই। ঐ ড্রাইভার!” ওর খিনখিনে স্বর ভেঙে গিয়ে এক অদ্ভুত সুর বেরুচ্ছে।
    ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন পায়ে পা লেগে চিঁ চিঁ করতে করতে শালিক তিনটা ধুলোয় মাটিতে একসা হয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কালীবুড়ির ঘরের সামনে ইতিমধ্যে একটা ভালো জটলা বেঁধেছে। এরই মধ্যে কালীবুড়ি এক কালীভক্তকে কিছু একটা বিধান দিচ্ছিল। বিধানের কাজ শেষ করে সে বেরিয়ে এলো। বুড়িকে দেখে মালতী আর মণি দুজনেই চমকে গেল। বুড়ির মাথাতে একটা দীর্ঘ জটা, কপালে লাল সিঁদুর।
    বুড়ি আঙুল তুলে ড্রাইভারণীকে শাসিয়ে দিয়ে বলল, “ আমার বাড়িতে এই ভদ্র ঘরের বউ মায়ের পায়ে শরণ নিয়েছে। ওকে কেউ কিছু করলে মায়ের কোপ দৃষ্টিতে পুরো ভস্ম হয়ে যাবি বলে দিলাম।” বুড়ির রোগা শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। চর্বিতে ঠাসা থলথলে শরীরের একটা লোক এসে কালীবুড়ির বাড়ির গেটে দাঁড়ালো। লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায় এই মাত্র শুয়ে উঠে এসেছে, চোখ লাল হয়ে আছে। সে মুখের লালা মুছে ফেলে বৌয়ের কাছে চেপে দাঁড়ালো। “ চল, ঘরে চল।” সে একবার কালীবুড়ির দিকে তাকালো আর কিচ্ছুটি না বলে স্বামীর পিছু নিলো। স্বামী তার আগে আগে গামছাতে গিঁঠ দিতে দিতে যাচ্ছে। খানিক পরেই আবার সেই খিনখিনে গলার জোর গালি গালাজের সবটাই এসে কানে পড়ল। কান না দিলেও শব্দগুলো ঢিল পড়বার মতো ছুটে কানে আসছিল। বৌয়ের পয়সাতে খায় বলে খিনখিনে গলাটি চাবুক চালিয়ে যাচ্ছে। আর আড়ষ্ট জিহ্বে লোকটি নিজেকে বাঁচাবার জন্যে প্রাণপাত করছে। সে বারেবারেই বলতে চাইছে, নিজের রোজগারেই খাচ্ছে সে। গাড়ি চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করছে, বৌয়ের রোজগারে নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
    বই বন্ধ করে মণি বসে ছিল। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এক নর্দমার থেকে ছেলেকে সে আরেক নর্দমাতে নিয়ে এলো বুঝি? যেখানটায় সে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই বসে ওর প্রাণ খুলে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরল। কালীবুড়ি ভেতরে এলো না। বাইরে থেকেই একটা থালাতে করে কিছু এগিয়ে দিয়ে বলল, “ দে, পোলারে দে ।” বুড়ির গলাটা যেন কেমন কেমন লাগছে ,”আর তুই বেরোসনি যে? মুড়িতে যদি বাতাস লেগে যায়, কেউ নেবে না বলে দিলাম।” সে বুড়ির হাত থেকে থালাটা নিলো। মিষ্টি আর কয়েক পদ ফল। থালাটা দেখে ছেলে হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে মালতীরও মনের ভার নেমে গেল।
    “ আয়,মণির মা।” জোনের মা মুড়ির বস্তা মাথাতে উঠিয়ে নিয়েছে। মালতী একটা টিন মাথাতে, আরেকটা কোমরে তুলে বেরিয়ে এলো। বাইরে বেরিয়ে দেখে গোরাটি উঠোনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া ক'মুঠো ঢেঁকি, ক'মুঠো কলমি, কলার থোড় দুটো গুটিয়ে থলেতে ভরছে আবার। কাঁখ আর মাথার থেকে টিন দুটো নামিয়ে মালতী ওকে জিনিসগুলো থলেতে ভরাতে সাহায্য করল। সে লক্ষ্য করল মেয়েটির গালে আঁচড়ের দাগ। তিনজনেই কালীবুড়ির গেটে গিয়ে পৌঁছুলো। মালতী দাঁড়িয়ে গেল। কালীবুড়ি আসে নি।
    “কার জন্যে দাঁড়িয়ে আছিস? কালীবুড়ির জন্যে? ” মাথার চুলগুলো ঠিক করতে করতে গোরা ওকে জিজ্ঞেস করল।
    “ হ্যাঁ।”
    “ বুড়ির শরীরে মা ভর করেছেন ।” জোনের মা অল্প সময় চোখ মুদে দাঁড়িয়ে রইল। সঙ্গে সেই গৌরাঙ্গিনীও।
    তিনজনেই রাস্তার দিকে বেরিয়ে গেল।
    “তুমি...মানে তুই এই জিনিসগুলো বাজারে বিক্রি করবি?” গৌরাঙ্গিনীকে তুমি বলে সম্বোধন করতে গিয়ে ওর জোনের মায়ের কথাগুলো মনে পড়ল, “ আমাকে শহরের বাবুণীর মতো কেন ডাকছিস?”
    “ হ্যাঁ গো! তা না করে করবটা কী? কাল রিজার্ভের থেকে জোগাড় করে রেখেছি।”
    “সংসার চলে অমন করে?”
    “ কই আর চলে মণির মা? ছেলেটার খরচ আছে, আমার পেট আছে, আছে ঘর ভাড়া। খরচাপাতি অনেক।”
    “তোর মানুষটা?”
    “ বলতে পারব না, ও পেটে থাকতেই নেই।”
    “ নেই মানে?”
    “ মিনতির মা -বাবা নেই। দিদির ঘরে বড় হয়েছে। দিদিই ওকে গুয়াহাটির এক বড়লোকের ঘরে কাজ করতে ঢুকিয়েছিল। সেখানেই সর্বনাশ হলো ওর।”
    “ কী হলো ওখানে?”
    “ মেয়ে মানুষের সবচে' বড় বিপদটা হলো, আমার পেট করে ও চলে গেল।”
    “ কে সে?”
    “মালিকণীর ভাই।”
    “ তুই তাকে ছেড়ে দিলি? গুণ্ডা কোথাকার।”
    “ আর বলিসনে মণির মা, ওকে খারাপ মানুষ বলে বলিসনে, গুণ্ডাও না। সে আমাকে বড্ড ভালোবেসেছিল।” এতো আদর কোনও ছেলে মানুষ মেয়েমানুষকে দিতে পারে না। কী আর করে । বেচারা ওর বাড়ি ছাড়ে কী করে?” মেয়ে মানুষটির মুখের থেকে কেউ যেন রাগ উষ্মা সব মুছে নিয়ে গেল। ওর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে এলো। কোমল মুখখানাতে একটা লাজুক লাজুক হাসি ফুটে বেরুলো।
    “ এতো সুন্দর ছেলেমানুষ আমি আর দেখিনি। ওর চুলগুলো, চোখ দুটো, শরীরের রং...। ফিল্মের হিরোর থেকেও সুন্দর ছিল সে। কী রকম করে যে কথা বলত সে...।” বলতে বলতে ওর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ছেলেটি বাবার চেহারা পেয়েছে। সে ওকে একটা চুমো খেল।
    ওরা এসে বড় রাস্তাতে পা দিল। হঠাৎই মালতীর খেয়াল হলো, সেদিন তো সে কালীবুড়ির সঙ্গে এসেছিল। বাড়িগুলোর পথগুলোর কিছুই তো ওর মনে নেই। ড্রাইভারণীর কাজিয়া, তীক্ষ্ণ শিষটা, কালীবুড়ির জটা---সব মিলিয়ে ওর মাথাটা চেপে ধরেছিল যেন। কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না সে। তা না হলে অমন করে কালীবুড়িকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস না করে আর কি সে বেরিয়ে আসে? বুড়ির সঙ্গে করে আসার দিন যে পথে নেমে গেছিল সেটির মোড়ে এসে সে দাঁড়িয়ে গেল।
    “ এদিক দিয়েই গেছিলাম। বাড়িগুলো বের করে নিতে পারবো তো?”
    “আজ নাহয় বাজারেই চল। এই ক'বাড়িতে কালকেই তো মুড়ি দিলি। আজ কি আবার নেবে ওরা?”
    হ্যাঁ, সে কথা তো সে ভাবেই নি। লোকে কি আর ভাত খাবার মতো করে মুড়ি খাবে ? বাজারে যাবার কথাতে ও একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। বাজারে গিয়ে ও কীভাবে কী করবে?
    “ কী হলো দাঁড়িয়ে রইলি যে, চল। আজ বেরুতেই কত দেরি হলো।”
    দ্রুত পায়ে তিনজন গিয়ে বাজারে পৌঁছুলো। বাজারে ভিড় শুরু হয়ে গেছে। বসার আগে তিনজনেই ঠিক করল আজ মুড়ি পাইকারকেই দিয়ে চলে যাবে।মিনতিও জিনিসগুলো ব্যাপারীকেই দিয়ে দেয়া ঠিক করল। দুটো পয়সা কম পেলেও কিছু হবে না।আজ সবারই বাজারে কাজ আছে। মিনতি ছেলেকে ডাক্তার দেখাবে, ক'দিন থেকেই ওর পেট খারাপ যাচ্ছে।ছেলের জন্যে একটা জামাও নেবে।জোনের মা একটা কড়াই কিনবে। নিজের জন্যে পারলে একটা ব্লাউজ, বুড়োর ধুতি, জোনের জন্যে স্লেট।অনেক দিন ধরেই নেবে নেবে করছিল কিন্তু এতো দিন ধরে বাজার বসেছিল যদিও ভিড় ছিল না বললেই চলে। আজ ক'দিন ধরেহে বাজার জমতে শুরু করেছে। তিনজনেই গিয়ে দোকানীকে জিনিসগুলো সমঝে দিয়ে পয়সা নিয়ে বাজার করতে বেরুলো। প্রথমে ওরা নবীনের ওখানে গেল। নবীন স্লেট-পেন্সিল, বই খাতার ব্যবসা করে। ওদের বস্তিতেই থাকে। হাটে হাটে 'কুঁহিপাত'১ , বই , স্লেট, পেন্সিল, কালি , পেন, পেনের নিব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
    নবীনও তাড়া খাওয়া লোক। এই বস্তিতে ওর আজ তিন বছর হলো। মা বাবা কেউ নেই। কেবল এক ভাই পুতুকণ। মা বাবা দুজনেই আগে পরে মারা গেছেন। বাধ্য হয়েই তাকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তার পরেই এই স্লেট পেন্সিলের ব্যবসাতে নেমে পড়েছিল। বড় মামার বইয়ের দোকান ছিল। মামা প্রথম প্রথম সাহায্য করেছিলেন। মামার দোকান থেকেই বই খাতা নিয়ে গিয়ে হাটে হাটে বিক্রি করে ফিরত। দাদা আর ভাইয়ের ছোট সংসারটা চলে যায়। মাথা গুঁজবার বাড়ি একটা ছিল। ধান ছিল, দুধ ছিল। শাক, কলাগাছের ঝাড় বাড়ির কোনেই ছিল। চলে যাচ্ছিল। নবীন ভেবেছিল মেট্রিক পাশ করলে পরে কলেজে পড়িয়ে ভাই পুতুকণকে মানুষ করবে। দুটোই স্বপ্ন ছিল তার। পুতুকণ বড় মানুষ হবে আর তার নিজের স্লেট পেন্সিলের দোকান হবে।স্বপ্ন দুটোকে এহাত ওহাত করে তালুতে নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে খেলবার মতো করে একটা চেহারা করে ফেলেছিল সে। ছুঁয়ে উত্তাপের আঁচ নেবার মতো অবস্থাও হয়েছিল। ঠিক সেই সময়েই সব ওলট পালট হয়ে গেল।
    বাজারে বাজারে বই , খাতা, স্লেট পেন্সিলের বোঝাটা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আগে কোনোদিনই না শোনা শব্দ কয়েকটা ঘন ঘন শুনতে শুরু করল। 'বিদেশি, 'আন্দোলন', 'আসু','সংবিধান', 'ইয়াণ্ডাবু সন্ধি', 'ছাত্র সংস্থা', 'গণ সত্যাগ্রহ',। কয়েকটি নাম বাজারে আলু পেঁয়াজের মতো গড়িয়ে বেড়াতো, 'প্রফুল্ল মহন্ত', 'ভৃগু ফুকন'। লোকে বেশি বেশি করে খবরের কাগজ পড়তে শুরু করেছিল। ওই যে সব শব্দ সর্বত্র শোনা যায় খবরের কাগজগুলোও সেগুলোতেই ভরে উঠছিল। সে ভেবেছিল ওই শব্দগুলো খবরের কাগজে আর মানুষের গুঞ্জনের মধ্যেই রয়ে যাবে। কিন্তু রইল না। শব্দগুলো পথে নেমে এলো। ঘরে ঘরে, হাটে বাজারে ঢুকে পড়ল। প্রায়ই তার বাজারের দিনগুলো মার যেতে শুরু হলো। বাজারের ক্ষতি হলেও বন্ধগুলোতে থেকে যে যখন বাড়িতে থেকে বাগিচা সাফাই করত দেখত পুতুকণ প্রায় রোজই ঘরে থাকে না। সে বেরিয়ে না গেলেও ওর বয়সের কিছু ছেলে এসে ডেকে নিয়ে যায়। অবিরত যে ছেলেটি বইয়ের পাতায় মাথা গুঁজে পড়ে থাকত সে এখন বই ছোঁয়েও দেখে না । পড়ার মধ্যে খবরের কাগজই বেশি করে পড়তে শুরু করেছে।
    সেদিন নবীন ঘরে ছিল। ভীষণ শীত করেছে, ঘন কুয়াসা ছিল। সে গরুটার জন্যে বস্তা দিয়ে গায়ে দেবার জামা একটা তৈরি করেছিল। পুরো ছত্রিশ ঘণ্টার বন্ধ ছিল। গোটা শহর থমথমে হয়ে গেছিল। ভোটের অফিসের মুখে মুখে পুলিশ মিলিটারি। ছাত্র সংস্থার ছেলেরা দলে দলে মানুষকে বাড়ি বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেছে। পুতুকণ ওদের পাড়ার লোকগুলোকে জড়ো করে পরের দিন ভোর রাতে সার্কিট হাউসে যাবার কথা বলে রেখেছিল। এতো গুলো ছেলে-বুড়োতে মাথা নত করে শুনে গেছে। ভোর রাতে দলে দলে মানুষগুলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের মধ্যিখানে সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলল গিয়ে। সেই রাতে পুতুকণ বাড়ি ছিল না। নবীন রাস্তার এপার থেকে বড় বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। চারপাশের মানুষের মধ্যে 'নমিনেশন পেপার', 'ইলেকশন', 'কার্ফিউ', 'আর্মি', 'পুলিশ' এই শব্দগুলো উড়ে বেড়াচ্ছিল। সার্কিট হাউসের থেকে একখানা পুলিশের গাড়ি বেরিয়ে এসেছিল, গাড়িতে একজন মহিলা বসে। রাস্তার এপাশ থেকে দেখতে পেয়েছে নবীন। মুহূর্তে মানুষগুলো গাড়িটি ঘিরে ফেলেছিল, এগুতে দিচ্ছিল না। পুলিশের মারে ওরা ছিটকে পড়েছিল। তারই মধ্যে শুনেছিল গুলির শব্দ। লোকগুলো মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। শুধু পথের মধ্যিখানে এক কিশোরের মৃতদেহ পড়ে ছিল। নবীন দৌড়ে গেছিল। দেহটি ছিল পুতুকণের। সে তাকিয়ে রইল, পুতুকণের মৃত্যু যেন সমগ্র শহরের জন্যে একটা উৎসবে পরিণত হলো। ফুলের মালা, গান বাজনা, ধুমধাম শ্রাদ্ধ, সর্বধর্ম প্রার্থনা, গাড়ি মটরে আসা মানুষ, সার সার বাতি। নবীনের কেমন যেন লাগল সব কিছু। এক রাত দুপুরে সে সেই শহর থেকে, পুতুকণকে হারানো শূন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার মতো চলে এলো। সে সময় সে আর কিছু চায় নি। কেবল ফুল, প্রদীপ, ভজন , কীর্তন, ফটো, মানুষের ভিড়ের চাপ থেকে বেরিয়ে এসে বুক ভেঙে কাঁদতে চাইছিল।
    মাঝ রাতে ট্রেনে চেপে সত্যি নবীন এক কোনে বসে বুক ভেঙে কেঁদেছিল। রেলখানা কোথায় যাবার জন্যে স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। তখন অব্দি ট্রেনে কেউ উঠেই নি। গোটা রাত সে সেই শূন্য রেলে উঠে হো হো করে কেঁদেছিল। ভোর রাতে ট্রেন ছেড়েছিল। মেঝেতে হাঁটু গুঁজে বসা নবীনকে এক কাপ চা এনে দিয়েছিল মিনতি। ওকে কাঁদতে দেখে ওর মায়া হচ্ছিল। সেদিন মিনতিও মাঝরাতে সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে যে বাড়িতে এতো দিন ধরে কাজ করেছে । সেখানেই ওরা জগুর দেখা পেয়েছিল। জগু রেলে ঘুরে চানা বিক্রি করে বেড়ায়। সেদিন কোথাও এক বড় গোলমাল হয়েছিল। রেল যাবার পথে কোনও চা বাগানে সে রাতেই সাতজন মানুষ মারা গেছিল। সে এলাকাতে কার্ফিউ ছিল। নবীন যে কামরাতে চড়েছিল তাতে মাত্র ওরা তিনজনই ছিল---নবীন, মিনতি আর জগু। তিন জনেই চানার সঙ্গে দুঃখগুলোকেও নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। জগুই ওদের বস্তিতে নিয়ে এসেছিল। বস্তিতে এসে নবীন আবার আগের ব্যবসাই শুরু করেছিল। চার মাস পর মিনতির রাজপুত্তুরের মতো একটা ছেলে হয়েছিল।
    সেই নবীনের ওখানে স্লেট বই কিনতে এসেছে জোনের মা, মিনতি আর মালতী।
    ওদের দেখে হেসে নবীন ওর গ্রাহককে বিদেয় করে নিলো।
    “ চা খাবি?” বলেই পাশের দোকানে বলতে চলে গেল। জগুর দোকান । ওই গোলমালগুলোর জন্যেই জগু রেলে চানা বিক্রি বন্ধ করে বাজারে চায়ের দোকান খুলে বসেছে। পাঁচটা ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার। ওর স্ত্রী ঘরে চিঁড়ার নাড়ু, মুড়ির নাড়ু, ভুজিয়া তৈরি করে বেঁধে দেয়। সে এখানে চা তৈরি করে বেচে। বাজারগুলো ঠিক মতো বসলে উপোস করতে হয় না। খাবার খরচ উঠেই যায়। বাকি খরচের জন্যে টাকা জমানোটা বড় কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। জগুর স্ত্রী দেখতে রোগা হলে হবে কি, হাত দুটোতে যেন মা লক্ষ্মীর বাস। ওর হাতে নারকেলের সন্দেশ, মচমচে ভুজিয়া, মুড়ির নাড়ু,চিঁড়ার নাড়ুর জন্যেই জগুর দোকানে একবার চা খেলেই লোকে পরের বার আর একবার আসে। মুড়ির নাড়ুগুলো মুখে দিলেই গলে যায়। শহরের কিছু বাড়িতেও ওর বৌ এই সব জিনিস বানিয়ে , বিশেষ করে নারকেলের সন্দেশ, নিয়মিত দিয়ে আসে। বিহু , পুজোর দিনগুলোতে ওর টগর ফুলের মতো শাদা নারকেলের নাড়ু আর সন্দেশের চাহিদা বেড়ে যায়।
    নবীন জগুর দোকানের লাল চা আর সন্দেশ এনে তিনজনকে খেতে দিল। নবীন মালতীর সঙ্গে বড় ভদ্রভাবে ব্যবহার করছে। নারকেলের সন্দেশটা খেয়ে সে বলেই ফেলল , “ বড় ভালো হয়েছে তো!” জোনের মা স্লেট দেখছে। হাতে সন্দেশ নিয়ে মালতীর চোখের সামনে ভেসে উঠল ছড়ানো হাতে বড় আদরে তুলে আনা পুকুর পারের নারকেলগুলো। দুটো গাছে ধরেছিল। দিদা ঠিক এরকমই এক থালা সন্দেশ বানিয়েছিল। দুজনের সন্দেশ এতোটাই এক! কামড়টা দিয়েই ওর বুকখানা খা খা করে উঠল।
    “খা মণির মা, কী ভাবছিস?” সঙ্গে আসা ছেলেমেয়েদের যেমন মায়েরা দেখে দেখে নিয়ে যায় মিনতি ওকেও তেমনি করে দেখছে।
    জোনের মা স্লেট কিনল, মিনতিও একখানা ছোট মণি বসানো স্লেট কিনে ছেলেটির হাতে দিল। সে হেসে স্লেটের মণিগুলো ছোঁবার কাজে নেমে পড়ল।
    “ তোর ছেলে দেখি পড়তে শুরুই করেছে।” নবীন ছেলেটির গালে হাত বুলিয়ে দিল।
    “ দেখবি, ও কত মেধাবী ছেলে হবে। ওকে আমি যে করেই হোক পড়াব।” মিনতির মুখ আবারো কোমল হয়ে এলো।
    মালতীও একখানা খাতা নিতে চায় বলে জোনের মাকে জানাল। প্রায় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ খাতা একটা আর কলম কত পড়বে?” সে ব্লাউজের ভেতর থেকে টাকাটা বের করল, “ তোর দেয়া টাকাটা আছে।”
    “ এই পয়সাগুলো তো তোকে একখানা কাপড়ের জন্যেই দিয়েছিলাম।” কথাগুলো বড় করে বলাতে ও লজ্জা পেয়ে গেল।
    “ হোক গে। একটা কাঁপড় তো তুই দিলিই দেখি।” সে পেন একটা আর খাতা দুখানা নিলো।
    নবীন হিসেব করে করে ওদের থেকে যতটা পারে কম করে পয়সা নিলো। নবীনের ওখান থেকে ওরা একটা কাপড়ের দোকানে গেল। বাজারে যাবার এই রাস্তার দোকানগুলো হাটবারে মুল দোকান থেকে অল্প অল্প এগিয়ে আসে। বাসনের দোকানের বাসনে, কাপড়ের দোকানের কাপড়ে আর বাক্স পেটরার দোকানের বাক্সতে ওদের সামনের জায়গাটা ভরে যায়। মাড়োয়াড়ি বুড়োর দোকানে ভালো একখানা ভিড় হয়েছে। লাল, হলদে দখনা পরা একদল মেয়ে রঙিন সুতোগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিল। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন ফুলের উপর প্রজাপতির মেলা বসেছে। দেখলেই বোঝা যায় চুলপাকা ঐ মাড়োয়াড়ি বুড়োর সঙ্গে এই মেয়েদের ভালোই জানাশোনা রয়েছে। মিনতিরা ভেতরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের ভিড়ের ভেতর থেকে বুড়ো ডাক দিল,
    “ কী নিবি রে?”
    “ অনেক কিছুই নেব রে!” জোনের মা খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল।
    হাসিতে উজ্জ্বল মুখখানার দিকে মালতী খানিক তাকিয়ে রইল। চুলপাকা মাড়োয়াড়ি বুড়োর সঙ্গে দর কষাকষি করে জোনের মা একখানা সাদা ধুতি, একটা সাইজের হাত কাটা গেঞ্জি আর একটা ব্লাউজ কিনল। মিনতি ছেলের জন্যে একটা পেন্ট কিনল। দুজনে হাতের বাকি পয়সাগুলো গুনল, মেলাল। সেই পয়সাতে দু'জনে মিলে একটা পেটিকোট কিনে মালতীকে দেবার জন্যে এগিয়ে দিল। সে না না করছিল।
    “ ধার শোধ করে দিবি, পরে।” মিনতি বলল।
    “ ধার আমি কোত্থেকে শুধব?” ওর কাঁদো কাঁদো অবস্থা। বুক কেমন করছিল। ওদের দু'জনেরই নেই আবার অন্যকে দিচ্ছে। পেটিকোটের পোটলাটা সে বুকে জড়িয়ে ধরল। তিনজনে বেরিয়ে এলো। বস্তিতে যাবার পথে পড়ে কল্যাণ ডাক্তারের হোমিওপ্যাথিক ফার্মাসি । মিনতি ওখানে ঢুকে ছেলেটার জন্যে ঔষধ নিয়ে যাবে। খানিক দূর হেঁটে মালতী কাপড়ের পোটলাটা মিনতিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
    “ আমাকে কালই জোনের মা টাকা দুটো দিয়েছে। তার ধারই কী করে শোধ করি?”
    “ তোকে কে ধরেছে ধার নে বলে?”
    “ তোরা আমাকে রোজ খাওয়াবি পরাবি বুঝি?” ওর চোখে জল নেমে এসেছে।
    “ কী করে পারব মণির মা?” জোনের মায়ের গলা ধরে এলো।
    “ তুই কি একটা বাসন নিবি বলেছিলি না?” মিনতি বাসন বর্তনের একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালো।
    “ ওর ঘরে কড়াই একটাই নেই, থাল বাটি এক জোড়াও নেই।” জোনের মাও বাসনের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল।
    তিনজনে একটা কড়াই , থালা দুখানা, বাটি একটা, গ্লাস একটা আর একটা বালতি কিনল। ওর হাত খালি হবার জোগাড় হলো।
    “ থালা দুখানা লাগবে না, একটাতেই হবে। গ্লাসও লাগবে না তো।” দুইজনেই কিছু বলল না। সে নিজেই একটা থালা আর একটা গ্লাস রেখে দিল।
    “ টাকা কী রইল?” জোনের মা জিজ্ঞেস করল।
    উত্তরে সে হাত দুটো মেলে ধরল। কথাটা মিনতিই প্রথমে তুলল। ও পরের বাজারে আসার সময় ডালের বড়া বানিয়ে আনতে পারে দেখি। মিনতি লবণ তেলের খরচটা ঐ ডালের বড়াতেই বের করে থাকে। ওরা এবারে কলাই ডাল আধা কেজি, মসুর ডাল আধা কেজি, পান-মশলা আর কালিজিরা কিনল। মালতী মসুর ডাল দেখে জিজ্ঞেস করল, “ দুরকম ডাল নিলি যে?”
    “ দু'রকম বড়া বানাবি।”
    “আমি এসব করিনি কখনো, গ্রামে দিদাকে বানাতে দেখেছি।”
    “ কাল তো বাজার নেই, আসবি সকাল বেলা, আমি শিখিয়ে দেব।”
    “ বড়া কিনবে কে?”
    দুজনেই হেসে উঠল, “ এতো মানুষ বাজারে এসে এতো এতো জিনিস কিনছে।” সে মানুষের দিকে তাকালো, সব্বারই বেগগুলো শাক সবজিতে উপচে পড়ছে। প্রায় সব মানুষের বেগে সজনে আর মিষ্টি কুমোড়ের ডোগা বেরিয়ে আছে। সে নরম নরম সজনে বিচির স্বাদ জিহ্বে অনুভব করল। কিনবে কি একমুঠো সজনে? বাজার ভরে চতুর্দিকে সজনের দম। পর মুহূর্তেই পিছিয়ে এলো। ওর চোখ যেন পুড়ে যাচ্ছে। দু'ফোঁটা জল এসে চোখ ঝাপসা করে দিল। মানুষের ভিড়ে গমগমে বাজারটি, এমন কি ওর সঙ্গে করে এসেছে যে এই মেয়েমানুষ দুটি--তাদেরকেও যেন ধোঁয়া রঙের একটা পর্দা ঢেকে ফেলল। দৌড়ে সে গিয়ে লালমাটিতে লেপে রাখা রান্নাঘরে ঢুকল। চুলোর কাছে কয়েকটা সজনে, ভেতরে নরম নরম বিচি হয়েছে। তেলে মেথি ফোটার গন্ধ, আদা সরষের বাটা, বুক চেরা কাঁচা লংকার গন্ধের সঙ্গে আরেকটা গন্ধ বারে বারে ওর নাকে এসে লাগছে। এইমাত্র পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান সেরে এসে ওর কাছে ভাত খেতে বসেছে মানুষটি। এ তারই গায়ের গন্ধ। মানুষটি মুখের দিকে না তাকিয়ে ওরই থালাতে সরষে মাখানো সজনে ডাঁটা দিয়ে দিয়েছে। সে তারই একটা হাতে নিয়ে চুপি চুপি বলছে, “আমাকে দিয়ে দিচ্ছ কেন? আমি কি নিইনি না কি?” এবারে মানুষটি ভাতের পাতের থেকে মুখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে, “ ডাঁটাগুলো চিবুতে কোন ছাগলী ভালোবাসে?” সরষে, আদা, লংকা, মেথির গন্ধের সঙ্গে দুটো হাসির গন্ধ মিশে গেছে...। ওর চোখে আটকে থাকা জলের ফোটা গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। আবার পরিষ্কার হয়ে এসেছে বাজারটি। কাছের বৌমানুষ দু'জন। দু'জনে মিলে আধা কেজি মসুর আর আধা কেজি কলাই ডালে বড়া তৈরি করে বেচলে কতটা লাভ হবে তারই হিসেব করছিল। মিনতি ওকে বলতে চাইছিল, সপ্তাহের বাজারে কয়েকটা বড়া বানিয়ে আনতে পারলে অন্তত ওর লবণ তেলের খরচটা বেরিয়ে যাবে। সে তৎক্ষণাৎ মালতীর গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলের ফোটা দেখতে পেল।
    “ কী হলো রে!”
    “ শরীর খারাপ লাগছে বুঝি?”
    দু'জনেই উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সে এবারে দুটি মহিলার উদগ্রীব মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যি কথাটিই বলে ফেলল।
    “ আমার সজনে খেতে ভালো লাগত, মণির বাবা...”, ওর গলা ধরে এলো।
    “ ছাড় হে মণির মা, বরের টান বড় টান। আমার দিকেই তাকা না। শ্বাস টেনে টেনে আমাকে গালি পাড়তে থাকে মানুষটা, ওর কিল ঘুসি। সেই যদি একবার বলে উঠে ' জোনের মা, শুনে যা তো...' আমি আর সব ভুলে যাই। মাছি তাড়ানো, ইঁদুর তাড়ানোর ঔষধ ফেরি করে করে মানুষটি এখনো সংসারটাকে টানছে। বুড়োটা চলে গেলে...” এবারে জোনের মায়ের গলা ধরে এলো।
    “মেয়ে মানুষের মরদের টানটা বড় টানরে মণির মা, তা সে না হয় মরেই যাক...।” মিনতির একই দশা।
    হনহনিয়ে হেঁটে তিনজনে বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মালতী ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে কালীবুড়ির ঘরে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে । কালীমূর্তির সামনে জটাধারী সিঁদুরের ফোটাতে কালীবুড়িকে প্রথমে সে চিনতেই পারেনি। মাকালীর সামনে নৈবেদ্য আর পয়সা জমা হচ্ছে। মানুষ আসছেই। ওর চোখের সামনে ড্রাইভার এলো। সে গামছা পরে আসে নি, এক জোড়া প্যান্ট সার্ট পরে এসেছে। ড্রাইভার এসে কালীবুড়ির পায়ে প্রণাম করল। তারপর সিঁদুর মাখানো থালাতে টাকা বিশটা রাখল। ভাবগম্ভীর হয়ে লোকটার কালীবুড়িকে প্রণাম করা দেখে মালতীর হাসি পেয়ে গেল। কী মানস করছে লোকটি? বৌয়ের সুমতি? মণি ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘর এসেছে। বই, খাতা আর পেন্সিল পেয়ে সে হেসে ফেলল। কড়াই, থাল, গ্লাস ক'টা বের করে মা মণিকে বলল, “ এগুলো তোর জন্যে।” সে জিনিসগুলো গুছিয়ে চুলোর কাছে রাখল। চুলোর কাছে এক আঁটি ঢেঁকি শাক, চালতা দুটো, এক আঁটি কারিপাতার ডোগা , শুকনো লাকড়ি এক আঁটি।
    “রিজার্ভে কার সঙ্গে গেছিলি?”
    “জোনের সঙ্গে ।” মালতী চুলোর কাছে রাখা জিনিসগুলো দেখছিল আর দেখছিল ছেলের শুকনো মুখ। বাবা নেই বলেই ছেলেটাকে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। মা ওর মাথাতে হাত বুলিয়ে দিল,” বাবা খিদে পেয়েছে?” সে রা করল না। শুধু ডালের পোটলাটা খুলেছে।
    “ আজ কি ডাল রাঁধবি মা?”
    সে বলতে চাইছিল, “ এ ডাল খাবার জন্যে নয়।” বলল না। ছেলে ছেপ গিলছে।
    “রাঁধব বাবা।” ডাল কতকগুলো ধুয়ে ফেলল।
    বাইরে ঢাকের শব্দ হচ্ছে। মণি দৌড় দিল। কালীমায়ের সামনে বসে ঢাক বাজাচ্ছে বড় রাস্তার পাশের দোকানের মালিক যদু। বস্তি বহু মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। কেউ একজন বেসুরো গলায় কীর্তন আরম্ভ করেছে।
    মালতী ডালে ঢেঁকি শাক কতক গুলো আর চালতা দু টুকরো ফেলে দিল। গন্ধতে সে টের পেল চালতাটা মিষ্টি। তেল দিতে গিয়ে দেখে বোতলে এক ফোটাও তেল নেই। হবে, গন্ধটা তো হবে। ভাত নামিয়ে ছেলেকে ডাকতে গেল। কালীমায়ের সামনে প্রণাম করছে বুলেন। বুড়ি ওকে আশীর্বাদ করছে। সিঁদুর মাখানো থালাতে টাকা দশটা দিল। বুড়ি মানুষকে বিধান দিচ্ছে---মালতী অল্পসময় দাঁড়িয়ে তাই দেখল। ঢাকের শব্দ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। বুড়ি এবারে কালীমায়ের সামনে নাচতে শুরু করল। বুড়ি নেচে নেচে দাঁতে কোনও এক ভক্তের দেয়া পায়রা একটার গলা ছিঁড়ে রক্তগুলো পান করে ফেলল। সমবেত সবাই সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ করল। চারদিকে ধ্বনি উঠল –জয় মা কালী! মালতীর শরীর কেমন ঘুলিয়ে এলো। অবাক হয়ে দেখছিল ছেলে, ওকে হাত ধরে টান দিল। কিছুতেই আসবে না। সে ভেতরে গিয়ে বস্তাতে শরীর এলিয়ে দিল। গোটা দিন ধরে পরিশ্রম গেছে। ক্লান্তিতে ওর শরীর ঢলে পড়েছে। ঘুমে চেপে ধরা অবস্থাতেই সে একসময় টের পেল মণি ওর কাছে এসে শুয়েছে।
    সকালে সে বস্তির অন্যদের সঙ্গেই জেগে গেল। উঠেই নাকে একটা গন্ধ পেল। ধূপধুনো, ফুল, মিঠাতেলের বাতি। উঠে বাইরে এলো। উঠোন নোংরা হয়ে আছে। কলার খোসা, প্লাস্টিকের থলে, কলাপাতা--এমন নানা জিনিসে উঠোনটা ভরে আছে। অথচ বুড়ি রোজ উঠোনটাকে ঝেরে লেপে পরিষ্কার করে রাখে। বুড়ির ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে দোয়ার বন্ধ। সকাল সকাল উঠে বুড়ি কাজ শুরু করে, আজই বা কী হলো? সে দোয়ারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতরে একটা অস্পষ্ট গোঙানোর আওয়াজ। কীই বা হলো বুড়ির? আস্তে আস্তে দরজাতে কয়েকটা টোকা দিল। দরজাটা খোলাই আছে। ভেতরে যাবে কি যাবে না ভেবে সে দাঁড়িয়ে রইল। এবারে দুর্বল গলার ডাক শুনতে পেল, “মণির মা।” সে ঢুকে গেল। বুড়ি বিছানাতেই পড়ে আছে। বুড়ির চোখজোড়া দুর্বল।, মুখখানা ম্লান। সে বুড়ির কাছে চাপল। বুড়ি ওকে একগোছা দিল। বিছানার নিচের কাঠের ছোট একটা বাক্স দেখালো। বুড়ির নির্দেশে বাক্সটার থেকে একটা প্লাস্টিকের বেগ তুলে আনল।বেগে কয়েকটা নোট আর খুচরো পয়সা। বুড়ি ওকে বিছানার তলার বাক্স একটাতে পয়সাগুলো রাখতে বলল। বুড়ি উঠে বসেছে।
    “ চা খেয়েছিস?”
    “ না।” সে কী করেই বা বলে যে তার ঘরে চায়ের কোনও জোগাড় যন্ত্রই নেই।
    “ছেলেকে কী দিলি?”
    সে চুপ করে রইল। এখন চাল আনতে যাবে মাত্র।
    বুড়ি আবারো বিছানাতে শরীর এলিয়ে দিল। ঠিক শোয় নি। যেন বড় ক্লান্ত। মালতী গামছা একটা ভিজিয়ে বুড়ির মুখখানা মুছে দিল। মরাপাটের মতো শাদা চুলগুলো আঁচড়ে ঠিক করে দিলে। বুড়ির কপালের সিঁদুরগুলো দেখে ওর ভাল্লাগেনি। গামছাটা আর একবার মুছে ওই সিঁদুরগুলো মুছে দিল। বুড়ি ঠোঁট দুখানা জিহ্বে ভেজাবার চেষ্টা করছে। সে বুড়ির স্টোভ জ্বালাল। সসপেনে জল দিয়ে এককাপ লাল চা করে বুড়িকে দিল । সঙ্গে কিছু মুড়ি। বুড়ি উঠে বসতে পারে নি। রোগাপটকা মহিলাটি বড় দুর্বল হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে ধরে সে বুড়িকে বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। চাগুলো খেয়ে নিয়ে বুড়ি যেন অল্প বল পেল। ওর শরীর ভালো লাগতে শুরু করেছে। বুড়ির মুখ দেখে মালতীর মনে হলো দুটো ভাত পেটে গেলে যেন মানুষটি খানিক স্বস্তি পাবে। তাইতো, সেই কাল সকাল থেকে কালীমা ভর করেছে বলে বুড়ি কিচ্ছুটি মুখে দেয়নি।
    “ ভাত ক'টা...।” ওর কথা না ফুরোতেই বুড়ি ওকে ভাত বসাতে বলল। বুড়ির কাঠের তক্তাতে সব জিনিস সাজানো গোছানো থাকে। সে শুধু দেখল, লাকড়ি কম আছে। মণিকে হাঁক দিয়ে ঘর থেকে লাকড়ি কয়েকটা আনতে বলে চুলোতে আগুন দিল।
    “ তোর আর পোলার জন্যেও রাঁধবি।” কথাটা বলেই বুড়ি বেড়ার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল। সে শুধু অস্পষ্ট এক বিড়বিড়ে আওয়াজ শুনতে পেল। বুড়ি কী যেন কী উপবাসে থাকার কথা বলছে। বিছানাতেই বুড়িকে ভাত ক'টা খাইয়ে সে বেরিয়ে যেতে চাইল। যাবার আগে আগের দিনের মুড়ি বিক্রির টাকাগুলো বুড়ির সামনে হাতের তালুতে মেলে ধরল। বুড়ি টাকাগুলো নিয়ে আধা নিজে রেখে আধা ওকে দিয়ে দিল। ভাত ক'টি খেয়ে বুড়ি তরতাজা হয়ে পড়েছে। গলাও স্পষ্ট হয়ে গেছে, “মণির মা, মুড়ির ব্যবসাটা তুইই চালা। কোনও ঝামেলা নেই। বাঁধা গ্রাহক আছে। এক বাজারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিবি, আরেক বাজারে জোনের মায়ের সঙ্গে বাজারে বসবি। ধানের টাকা আমি খাটাব।” বুড়ি ওর হাতখানা ধরেছে, “ মণির মা! এতো ধকল আর আমার শরীরে সয়না রে!” সে বুড়ির গায়ে একটা কাঁথা চাপিয়ে দিল।
    কোন বুড়ি আসল বুড়ি? কাঁচা লংকার মতো বুড়ি? কালী ভর করা দেবী বুড়ি? না এই শিশুর মতো বুড়ি? যেই হোক, দিনে দিনে বুড়ি ওর আপন হয়ে এসেছে। সে নীরবে বুড়ির চুলে হাত বুলিয়ে দিল, বুড়ি ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।
    “মণির মা! মণির মা!” বলে হাঁক পাড়তে পাড়তে জোনের মা ঢুকে এলো। এসেই আগের দিন ভিজিয়ে রাখা ডাল চেয়ে বসল।
    “ ভালো রোদ দিয়েছে, বড়া দিবি না?”
    “আমি যাচ্ছি, স্নান করে নি।”
    “ কই স্নান করবি? কলের পাড়ে?”
    “ না, নদীতে যাব। এসে ডাল বাটব।”
    ওর সঙ্গে জোনের মাও নদীতে স্নান করতে চলল। শহর আর এই বস্তিকে ভাগ করেছে রিজার্ভটি। তার অল্প ভেতরেই নদীর একটা বাঁকা ভাঁজ আছে। ভাঁজে তিনটা বড় বড় পাথর। এই পাথর তিনটাতেই সাধারণত বস্তির মেয়েরা স্নান করে। ওরা গিয়ে পাবার আগেই ওখানে আরো ক'জন স্নান করছে। প্রায় সবাই কাপড় ধুচ্ছে। মেয়ে-বৌদের গায়ে সুতো সামান্যই আছে। সেও বিনা দ্বিধাতে শাড়ি ব্লাউজ খুলে পেটিকোটটা বুকে টেনে নিয়ে জলে নামল। বনের আড়ালে সেও বাকি মেয়েদের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেল।
    স্নান সেরে এসে দেখে মণি ইতিমধ্যে বুড়ির ওখানে ভাত খেয়ে ফেলেছে। একটা ভাত ঘুম দিয়ে বুড়িও টনটনে হয়ে পড়েছে। বুড়ির ঘরের দাওয়াতে মিনতি বসে আছে। ওর ছেলেটি মণির সঙ্গে। সুপুরি পাতার খোল দিয়ে মণি ওকে টেনে নেবার রথ বানিয়েছে, তাতে বসে বাচ্চাটি দুহাতে জোরে সেটি ধরে রেখেছে। সুন্দর ছেলেটি তারও চেয়ে সুন্দর করে খিলখিলিয়ে হাসছে। ওদের দু'জনকে ভেতরে আসতে দেখে মিনতি দাঁড়িয়ে গেল, “মণির মা, আজ বড় ভালো রোদ দিয়েছে। আয়, বড়াগুলো দিয়ে দি।” সে কালীবুড়ির পাটা বাইরে এনে এমন কি ডালগুলোও ধুয়ে আলাদা করে রেখেছে। চুল আঁচড়ে মিনতি আর জোনের মায়ের সঙ্গে কাজগুলো শুরু করতে গিয়েই দেখে বুলেন কাঁধে একটা বাঁশ নিয়ে এসেছে। “বৌদি, বাঁশটা রেখে যাই। মাচাটা রাতে এসে বেঁধে দিয়ে যাব।” ওর নিজের বোঝাটি সাইকেলে বেঁধে নিয়ে বুলেন রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে গেল। যাবার পথে ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেখিয়ে গেল। জগু আর রোগা মহিলা একজনও গেল। মেয়ে মানুষটির হাড় বের করা শরীর। মেয়েটি কালীবুড়ির গেট পার করে আবার ফিরে এলো। বুড়ির পায়ে ধরে প্রণাম করল। মালতীর দিকে তাকিয়ে রোগা মেয়েটি একটা হাসি দিল, “তুই ঠিকই বলছিলি , মিনতি! ” ওর শুকনো মুখখানা দেখতে বড় ভালো লাগল। হঠাৎই ওর মনে হলো এখানকার সমস্ত মানুষেরই হাসিগুলো বড় সুন্দর। কালীবুড়ির ভাঁজ পড়া মুখের হাসিটা, মিনতির চোখে মুখে হাসিটা, জোনের মায়ের কালো মুখের শাদা সমান পাটির দাঁতের হাসিটা, বুলেনের ক্লান্ত মুখে জেনে না জেনে বেরুনো হাসিটা, নবীনের লাজুক লাজুক হাসিটা, জগুর বোকা বোকা হাসিটা, জগুর বৌয়ের শুকনো মুখের পাতলা ঠোঁট দুখানার মধ্যি দিয়ে বেরোনো হাসিটা। সব ক'টা হাসিমুখ ওর বড় ভালো লেগে গেল। ওর মুখেও ফুটে বেরুলো এক ছড়ানো ছিটোনো হা...হা...সি।

    টীকাঃ
    ১) কুঁহিপাতঃ অসমিয়া বর্ণপরিচয়ের বই।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৪495485
  • অধ্যায় চৌদ্দ (১৪)

    সে কার্তিক শাইল আর সুহাগমণি ১ দু'ধরণের ধানই আলাদা আলাদা করে রোদে শুকোলো। ধানগুলো দুটো ধারাতে ছড়িয়ে দিয়ে হাত পা মেলে উঠোনে বসল। ধানগুলো যখন সেদ্ধ করা হয়েই গেছে আসল কাজটাই সারা হয়ে গেছে, রাতে মুড়িগুলো ভেজে ফেলতে হবে। কাল আবার বাজারবার। মণি স্কুলে গেছে। তিনটেতে ফিরবে। রান্নাবান্নাও শেষ। স্কুলে যাবার আগে মণির জন্যে যে ভাত বসিয়েছিল তাতেই হয়ে যাবে। বস্তির বাকি মানুষগুলোর মতো তারও এখন সন্ধ্যে সাতটা হতেই ভাত খেয়ে নিতে কোনও অসুবিধে হয় না। আটটা বাজলেই শুয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়া , কাকভোরে ওঠা, বাজারে যাওয়া, নদীতে স্নান করা, মুড়ি ভাজা, বড়া তৈরি করা--সব কিছুই ওর জন্যে সহজ হয়ে পড়েছে।
    সে ধারার ধানগুলো একটু নেড়ে চেড়ে দিল। হাতের তালুতে নিয়ে ধানগুলো একটু ভালোকরে দেখল। ধানগুলো সেদ্ধ করবার বেলা আজকাল আর কালীবুড়িকে দেখে দিতে হয় না। ঠিক চুলের মতো ফাটা দিলেই ধানগুলো যে নামিয়ে নিতে হয়, সে কথা ও এখন জেনে গেছে। ওর হাতের মুড়ি এখন গুণেমানে কালীবুড়ির মতোই হয়। আরেকটা নতুন কাজ শিখেছে সে। মোড়া তৈরি করা। বাজার থেকে এসে ভাত চারটা বসিয়ে মণি যতক্ষণে ওর পড়াশোনা শেষ করে ফেলানি একটা মোড়া তৈরি করে ফেলে। বাজারে যেতে মুড়ির সঙ্গে করে মোড়াগুলোও নিয়ে যেতে ওর আজকাল কোনও অসুবিধে হয় না।
    মোড়া বানাতে সে শিখেছে রত্নার মায়ের থেকে। রোগাপটকা মেয়েমানুষটি যেভাবে দুইহাতে কাজ সেরে ফেলে দেখে সে অবাক হয়ে গেছিল। রত্নার মায়ের তিন মেয়ে। বড়টিকে বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ে দেবার বেলা জানত না, ছেলেটি মদ খায়। বুকের একটা দিক খেয়েই ফেলেছিল। মেয়ে একটা জন্মাবার পরেই স্বামী হারালো।শ্বশুরের ঘরে এখন বিধবার জীবন যাপন করছে। মেজো মেয়েটি গুয়াহাটির একটি বাসাতে থাকে। ছোটটি বাড়িতে থাকে। চার নম্বর মেয়েটি মারা গেছে। রত্নার বাবা পান চাষ করত । পানচাষিদের সবাই ওকে চেনে। এখন মানুষটি কিছুই করে না। গরম কালে কাঁঠাল তলায় আর শীতের দিনে উঠোনের মাঝখানটিতে বসে থাকে। মেজো-মেয়ের টাকা ক'টিতেই এখন সংসারের এটা ওটা ঝামেলা কাটিয়ে উঠতে হয়। খাবার খরচ ঐ মোড়াগুলোতেই উঠে যায়। একটা ছেলে সন্তান না থাকার যাতনা বাড়িটাকে চেপে ধরে রেখেছে। হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে বসে কাঁঠাল তলা থেকে, উঠোনের মধ্যি থেকে বুড়ো মানুষটা অনবরত বকতে থাকে, “ আমার যদি একটা ছেলে থাকত...আমার যদি একটা জোয়ান ছেলে থাকত...একটা ছেলে সন্তান...।” মানুষটার এই একটা কথাতেই গোটা বাড়ি নীরব করে রাখে। রত্না দিদির দিয়ে যাওয়া, নিজে পরে আধা পুরনো হওয়া, মালিকনীর মেয়ের পুরোনো কাপড়গুলো পরেই বারান্দার বেড়াতে হেলান দিয়ে বসে থাকে। একটা খড়কুটোও এদিক ওদিক করে না। সেও আজকাল বাবার মতোই কথা বলতে শিখেছে, “ আমাদের একটা যদি বড় ভাই থাকত,” “ যদি একটা ছেলে থাকত...।” রত্নার মা এই দুটো চুপ করে বসে থাকা মানুষের মাঝে নীরবে নড়া চড়া করে থাকে। ভাত রাঁধে, রিজার্ভ থেকে খড়ি জোটায়, মোড়া তৈরি করে, বাজারে মোড়া নিয়ে যায়, চালডাল কিনে।

    মালতী শলা তৈরি করে রেখেছে, সাইকেলের ট্যুব, প্লাস্টিকের রশি...সবই জোগাড় করে রেখেছে। দুটো মোড়া আদ্ধেক আদ্ধেক বানিয়েও ফেলল—গাঁটগুলো দেবার বেলাতেই সমস্যা দাঁড়ালো। ঐ আধা তৈরি মোড়া একটা নিয়েই সে রত্নার মায়ের বাড়ি যাবে বলে বেরিয়ে গেল, যাবার বেলা ধানগুলো দেখবার জন্যে কালীবুড়িকে বলে গেল । জোনের মায়ের বাড়ি পেরিয়ে তবে রত্নার মায়ের বাড়ি যেতে হয়। আজ সকাল থেকে মানুষটি একবারও আসে নি। বরের শরীর বেশি খারাপ হলো কি? না সে মুড়ি ভাজতে বসেছে? না কি জোনেরই কিছু একটা হয়েছে?

    জোনের মা উঠোনে এদিক ওদিক করছে। মালতীকে দেখে ওর চিৎকার আরো বেড়ে গেল। কাকেই বা অমন প্রাণ ঢেলে গালিগালাজ করছে? জোনের মায়ের বাড়িটা প্রায় নদীর পারেই। জোনের বাবার এই বস্তিতে আসার হয়েছে অনেক বছর। এই জায়গাটা সুবিধের দেখে বসত গড়েছিল। নদীটা এতো কাছে ছিল না। বাঁক একটা বাড়তে বাড়তে নদীকে এ অব্দি নিয়ে এসেছে। জোনদের বাড়ির গায়েই লেগে আছে রত্নাদের বাড়ি। রত্নার বাবাও জোনের বাবার কাছাকাছি সময়েই এখানে এসে ভিটে-বাসা করে বসেছিল। ওদের আসার বহু আগে থেকেই নদীর পারের বিশাল বটের তলার বাড়িটায় হরি ভাঙুয়া ছিল। হরির দাদা ঠাকুরদারাও এ অঞ্চলেরই বাসিন্দা ছিলেন।এই বস্তির বেশ একটা বড় অংশ হরি ভাঙুয়া তার বাবার থেকে পেয়েছিল। রত্নার বাবা, জোনের বাবাদের দিয়ে শুরু করে ও আজ অব্দি ঐ মাটি বিক্রি করেই মদ ভাঙের খরচ বের করছে। এই নদী, এই রিজার্ভের মতোই হরি ভাঙুয়া এখানে এমনই এক দৃশ্য যা কারোরই আর আলাদা করে চোখে পড়ে না। ওর বাবার আমলের ঘরখানা মেরামতির অভাবে সেই কবেই খসে পড়েছে। একটা একটা করে সেই ঘরের বাঁশ-কাঠ নিয়ে হরি ভাঙুয়ার বৌ ভাত রেঁধে শেষ করল। এখন প্লাস্টিক আর খের দিয়ে তৈরি কাকের বাসার মতো একটা চালার তলায় পরিবারটি থাকে। বটগাছের গায়ে হেলান দিয়ে আছে বলে ঘরটি ভেঙে পড়ে নি। বট গাছটার ঝালরের মতো বেরুনো অজস্র শেকড়ের তলাতে একটি কালো পাথর তেল সিঁদুর দিয়ে রাখা আছে। তার কাছেই কোনোক্রমে গামছা একটাকে নেংটির মতো পরে ওর নগ্নতাকে ঢেকে সে সিলিম টানতে থাকে। তার চোখজোড়া রক্তজবার মতো রাঙা। ছোট ছোট চোখদুটোতে সবসময়েই একটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। থুতনিতে কয়েকটি লকলকে আধা কাঁচা আধা পাকা দাড়ি। ওর বৌ সবুজ একটা মেখেলা পরে দিনভর এটা ওটা কাজ সারতে থাকে। সকালে ভাঙুয়া আর ছেলের জন্যে ভাত চারটা বসিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। ওর কাজ আবহাওয়া আর সময় অনুসারে বদলাতে থাকে। কখনো বা সুপারি বেপারীর কাছে গিয়ে সুপারির খোসা ছাড়ায়, মিলে চাল বাছে, রাস্তাতে বুরুস মারে, কখনো বা সুবিধে পেলে মিস্ত্রির সঙ্গেও কাজ করে। কাজের থেকে এসে রিজার্ভে লাকড়ি খোঁজে বেড়ায়, ঢেঁকিয়া তোলে, নদীতে মাছ মারে। রাতে এসে ছেলের বকাঝকা শুনে, বরের শাপ-শাপান্ত শুনে বা প্রায়শ:ই ধুমধাম কিল খেয়ে ভাত রাঁধে। আঠারো -উনিশ বছরের ছেলেটি কখনো বা আধ কেজির মতো শুয়োরের মাংস নিয়ে আসে। মাংসে তেল মশলা কম হলে মায়ের গায়ে থাল ছুঁড়ে ফেলে ঘরের থেকে বেরিয়ে পড়ে। ছেলেটির হাত নড়ে বলে এই বস্তির সবাই জানে। হাঁস-মুরগির থেকে আরম্ভ করে জলের কল অব্দি সে অনায়াসে সাফ করে দেয়। কেউ ধরতেই পারে না। হাতে নাতে কেউ ধরতে পারেনি বটে, কিন্তু কিছু একটা হারালে সবাই জানে হরি ভাঙুয়ার ছেলেই সে কাজটা করেছে।
    আজ জোনের মায়ের গালি বর্ষণ হচ্ছে ঐ নদীর বাঁকের কাছের বট গাছের ঝুরিতে হেলান দেয়া চালাটার দিকেই। জোনের মায়ের গাভিন ছাগলটি বাঁধের উপর থেকেই হারিয়ে গেছে। মুড়ার সঙ্গে মালতীকে দেখে জোনের মায়ের মুখ বন্ধ হলো।
    “ কী হলো জোনের মা?” জোনের মায়ের রাগ দেখে সে হাসল।
    “ কী আর হবে, ভাঙুয়ার ছেলে ছাগলটি নিয়ে গিয়ে বেচে দিল।” মালতী অল্প দূরের নদীর পারের বাড়িটার দিকে তাকালো। উঠোনে একটা আধ ন্যাংটো ছেলে গামছা পরে হাতে দা নিয়ে মাটিতে অনবরত কুপিয়ে যাচ্ছে। সে যেন মাটিতে নয়, জোনের মায়ের গাভীন ছাগলটাকেই কোপাচ্ছে। কেন যেন ছেলেটির এই কুপানো দেখে ওর পুরো শরীর শিরশিরিয়ে উঠল। জোনের মায়ের হাত দুটো গিয়ে ধরল সে, “ এই সব ছেলেদের সঙ্গে তুই লাগালাগি করবি না।” জোনের মায়ের স্বর দ্বিগুণ বেড়ে গেল , “ কেন, লাগালাগি করব না কেন? কী করবে আমাকে? দায়ের কোপ বসাবে? দেখি, আসুক দেখি ক'টা ঘা মারে!” ওর গলা শুকিয়ে গেছে। দা'টা নিয়ে যদি সে এখনই এদিকে তেড়ে আসে? কী হবে? মালতীর ভয়ে ঠাণ্ডা হবার জোগাড় হলো। কোনও রকমে মাথা তুলে বটগাছটার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল দা'টা হাতে নিয়েই একটা অদ্ভুত গর্জন করে ছেলেটি কোথাও চলে গেল।
    “ ওর হম্বিতম্বি দেখিস নি? কেন ওদের সঙ্গে গায়ে পড়ে মরতে যাস?” সে ওই এক কথাতেই লেগে রইল।
    “ আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে মণির মা। ছাগলটাকে রত্নার ময়ের থেকে আধি নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হাতে দুটো পয়সা আসবে। জোনের বাবার শ্বাস কষ্টটা বেড়ে গেছে, টাউনের একজন ডাক্তারকে দেখাব।” জোনের মা বসে পড়েছে। মালতীও জোনের মায়ের মুখে দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বসে পড়ল। রত্নার মা হাতে এক বোঝা শলা আর ছুরি একটা নিয়ে ওদের দুজনের কাছে এসে বসল। মাটিতে শলার বোঝা রেখে ছুরিতে একটা একটা করে শলা নিয়ে চাঁচতে শুরু করল। রত্নার মায়ের হাত দুখানা অশ্বত্থ পাতার মতো ফেটে ফেটে পচে গেছে। মালতী সেই হাতগুলোর দিকেই তাকিয়ে রইল। আঙুলের গাঁটগুলো বড় হয়ে যাওয়াতে হাত দুটো বাঁকা বাঁকা দেখাচ্ছিল। ঐ বাঁকা আঙুলেই এতো মিহি করে শলা চেঁছে বের করছে মেয়ে মানুষটি। সে নিজের হাতের মুড়াটার দিকে তাকালো। কেমন যেন কর্কশ দেখাচ্ছে। সে বলেই ফেলল, “ আপনার হাতের শলাগুলো এতো মিহি হচ্ছে, আমারগুলো দেখুনতো।” রত্নার মা মালতী মুড়াটা হাতে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ঠিক ঠাক করে ফেলল। জোনের মা নুন দেয়া লাল চা আর কিছু মুড়ি উঠোনের মধ্যেই নিয়ে এলো।
    “ খা, রত্নার মা।” রত্নার মা বেশ আমোদে চায়ের কাপে চুমুক দিল। অনেকক্ষণ পর ওকে বলতে শোনা গেল, “ অনেক দিন পর চা খেলাম।” স্বরটা বড় ছোট। এমন মনে হচ্ছিল যেন সে ঐ কথাগুলো বলতে যেতেই কেউ ওর গলা চেপে চেপে ধরছিল। মালতীও বেশ আগ্রহে চায়ের কাপে মুখ দিল। কালীবুড়ি না দিলে সেও যে এককাপ চা খেতে পায় না। চাল ডালের সঙ্গে চা, চিনির ব্যয়টা সে কোন সাহসেই বা বাড়িয়ে নেয়? জোনের মাও শাড়ির আঁচলে চায়ের গ্লাসটা ঠোঁটে ছুঁইয়েছে। “ চিনি দেয়া চা এক কাপ বহুদিন খায় নি, চিনি কিনবার পয়সা থাকেই বা কৈ?” হরতকি গাছের ছায়াতে বসে তিনজনেই অল্প অল্প করে চা মুড়ি খেতে রইল । কাশির শব্দ শুনে মালতী ঘুরে তাকালো। জোনের বাবা এসেছে। মানুষটাকে সে আজ এই প্রথমবারের জন্যে কাছের থেকে দেখল। মাথাতে চুল প্রায় নেইই। গাল দুটো ঢুকে পড়েছে। মেরুদণ্ড পিঠের কাছে বাঁকা হয়ে পড়েছে। বড় ক্লান্ত লাগছিল মানুষটাকে। জোনের মায়ের চায়ের গ্লাসে আরো খানিকটা চা বাকি ছিল। সে ঘোপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রায় দৌড়ে গিয়ে বরের হাত থেকে বাজারের থলেটা আর কাঁধের পোটলাটি নিয়ে নিলো। যে ক'টা পোটলার ভারে মানুষটি বাঁকা হয়ে পড়েছিল, লম্বাটে মহিলাটির হাতে সেই একই ভার ছোট আর হালকা হয়ে পড়ল। জোনের বাবা ওদের দু'জনকে কিছু একটা বলতে চাইছিল, পারেনি। শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হলো। মানুষটি উঠোনে বসে পড়ল। উঠোনে এক ঘরঘরে শব্দ যেন গড়িয়ে পড়ল। চায়ের গ্লাস একটা সামনে এগিয়ে দিয়ে জোনের মা বুক চাপড়া কাঁদতে শুরু করল , “ মণির মা, ছাগলটা আমি বেচে...।” ওর কথা বেরুচ্ছিল না। ওর কান্না আর কুঁজো মানুষটির বুকের ঘরঘরে শব্দ যেন কোনও এক জায়গাতে এসে মিশে গেল। মাথাটা তুলে জোনের বাবা দাঁত কটমট করে ক্রন্দনরতা জোনের মাকে গাল পাড়তে চাইছিল, পারে নি। গালির বদলে বেরিয়ে এলো আরেকটা ঘরঘরে শব্দ। রত্নার মা যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালো। মালতী একটু দাঁড়াল, জোনের মায়ের ফিসফিসিয়ে কান্নার সঙ্গে পিঠটা ওঠা নামা করছিল। সেই পিঠে হাত রেখে ওর কিছু একটা বলবার ইচ্ছে হচ্ছিল। হঠাৎই জোনের বাবার চোখে চোখ পড়ল। পারলে যেন এই জোড়া চোখেই মানুষটি কালো মেয়েমানুষটিকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল কালো জামের মতো দুটো চকমকে পুষ্ট স্তন। কালো মাংসের মাঝে মাঝে মাটিতে পড়ে থ্যাঁতলানো জামের মতো লালচিটে ঘা। ওর শরীর শিউরে উঠল। মোড়াটা হাতে নিয়ে সে জোরে হাঁটা দিল।
    কালীবুড়ি একটা পিড়িতে বসে ধানগুলোর থেকে পাখি তাড়াচ্ছিল। জট ছাড়া এই মানুষটিকেই কত শান্ত লাগে। যখন জট গজায়, কপালে অঙ্গারের মতো ফোটা পরা থাকে, মুখে রক্তের দাগ নিয়ে এই একই মহিলা যেন কেমন ভয়ানক হয়ে পড়ে। বুড়ি পাই পাই করে পয়সা গোটাচ্ছে। আগামী মাসে কালী পূজা করবে। মাথাতে যেদিন থেকে জটা গজিয়েছে সেদিন থেকেই বুঝি বুড়ি প্রতি বছর কালী পূজা করে আসছে। কত না কষ্ট করে বুড়ি পয়সা জোগাড় করছে। আলুর খোসাটাও ফেলে দেয় না বুড়ি। আলুটা যদি ভাতে সেদ্ধ দেয়, বাকলগুলো মিহি করে কেটে পেঁয়াজ লংকা দিয়ে ভাজে। হাতে সুই সুতো থাকেই। কাঁথা সেলাই করেও পয়সা জোগাড় করে বুড়ি। একটা ডাঁটা খুলে পড়া চশমা পরেই বুড়ি দিনে রাতে মাথা নুইয়ে নুইয়ে মানুষের দেয়া ছেঁড়া কাপড় জুড়ে জুড়ে কাঁথা সেলাই করে। আজও বুড়ি ধানের ধারাগুলোর কাছে আরেকটা ধারাতে কাঁথার কাপড়গুলো মেলে ধরেছে। সে গিয়ে বুড়ির কাছে দাঁড়ালো। কাঁথা সিলাই করবার সময় বুড়ি ঐ ডাঁটা ছাড়ানো চশমাটা পরে। বাজারবার বাজারবারে বড় বটগাছের নিচে চশমা নিয়ে বসে এক দোকানী। ওর থেকে বুড়ি এটা কিনে এনেছিল। বুড়ির সেলাই করার ধরণ দেখলেই বোঝা যায় চশমাটা পরা আর না পরা একই কথা। একেকবার বুড়ি এতোটাই ঝুঁকে পড়ে যে কাঁথার সঙ্গে প্রায় লাগো লাগো হয়। সূচে সুতা ভরাবার বেলা সূচটা একবার নাকের কাছে নিয়ে আসে আরেকবার দূরে নিয়ে যায়। সূচে সুতা ভরানো হয়ে গেলে পরে কাঁথা সহজেই সিলাই করে নিতে পারে। আগে বুড়ি বাঁহাতের আঙুলগুলো বুলিয়ে নেয়, তারপরে ডানহাত চালায়। সে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, এক সারি সেলাই শেষ হলেই পরে বুড়ি পুরো কাপড়েই উপুড় হয়ে পড়ে। বুড়ির জমানো টাকা আছে। সে জানে বুড়ি কালীপূজার জন্যেই পাই পাই করে টাকা জমাচ্ছে। পূজা করবার জন্যেই বুঝি চশমার ডাঁটাও পাল্টাবে না? সে জিজ্ঞেসই করে ফেলল, “ এই বাজারবারে একজোড়া চশমা নিয়ে আসব কি?” বুড়ি ওর দিকে চোখ বাঁকা করে তাকালো , “ ধানগুলো গুটিয়ে ফেল, মুড়ির চাল বের করতে হবে।” সে বুঝতে পেল প্রশ্নটা বুড়ির ভালো লাগে নি। সে ধান গুছানো সারতেই মণি এসে পড়ল। তার সঙ্গেই ভাত দুটো খেয়ে সে রত্নার মায়ের কাছে যাবার জন্যে বেরুলো। এখনো সে মুড়ার উপরের দিকে প্লাস্টিকের রশি দিয়ে বোনা শেখে নি।
    রত্নার মায়ের বাড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ওর বড় অস্বস্তি হলো। কী বলে বা সে ঢুকে গিয়ে? মানুষটি আছে বা নেই ? রত্নার মায়েরাও এই বস্তিতে প্রথম আসা পরিবারগুলোর একটি। ভাঙুয়া বুড়োর থেকেই আধ কাঠা মাটি নিয়ে ঘরটা তুলেছিল। ভাঙুয়াকে টাকা দেয় নি , রত্নার মায়ের একটা আঙটি দিয়েছিল। আঙটিটা পেয়ে ভাঙুয়া বেশ খুশি হয়েছিল। সে আস্তে করে ডাক দিল, “রত্নার মা!” একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। মেয়েটি মোটাসোটা, গায়ের রঙ অনেকটাই ফর্সা। সে লালের মধ্যে সাদা ফুল আঁকা চুড়িদার কামিজ পরে আছে, ঠোঁটেও লাল রঙ। সে এসে বললে , মা নেই । দোকানে গেছে, এখনই আসবে। মেয়েটি বসবার জন্যে একটা ভাঙা মোড়া দিয়ে গেল।লাল চুড়িদার কামিজ পরা এই মেয়েটিকে ঢিগে দিয়ে রাখা এই ঘরে কেমন বেমানান দেখাচ্ছে। রত্নার মা এসে ঢুকল, হাতে পলিথিনের পেকেটে কিসের পোটলা একটা।
    “মণির মা, আজ বড় মেয়েটি আসবে। সে ভালো খাওয়া দাওয়া করে। বাড়ি এসে কষ্ট পাবে। তাই এই আলু ক'টা নিয়ে এলাম। রত্না, আলুগুলো রাখ নিয়ে!” রত্নার মা রোদে পুড়ে লাল হয়ে ফিরেছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। মালতী ভেতরের দিকে তাকালো। মেয়েটি কি জল একগ্লাস নিয়ে আসবে, মায়ের হাত থেকে পোটলাটা কি নিয়ে যাবে? না, আসে নি। রত্নার মা ভেতরে গিয়ে কাপড় পালটে এলো। পাল্টানো কাপড়টা বাড়ন্ত। বেশ ক'জায়গাতে ফাটা। ঠিক বুকের কাছে এক টুকরো ভালো রকমই ছিঁড়ে গেছে। ছেঁড়া কাপড়, পাতলা ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে কোঁচকানো একটা স্তন বেরিয়ে পড়েছে। ছেঁড়া জায়গাটা লুকোবার চেষ্টা করে রত্নার মা খানিক হেসে ফেলল। , “ কী করব মণির মা, বড় মেয়ের দেয়া শাড়িটাই পরছি। আমার রোজগারেতো শুধু ওই ভাত-দুমুঠোই জোগাড় হয়। ইতিমধ্যে সে মোড়ার উপরটা বুনে ফেলল। মালতী মন দিয়ে দেখে নিয়েছে, আর ভুল হবে না। বসবার জায়গাটাতে লাল হলুদ প্লাস্টিকের রশিতে বরফির মতো তোলা ডিজাইন দেখে সে তাকিয়ে রইল, “ রত্নার মা, কী সুন্দর হয়েছে!” রত্নার মা হাসছে। বাড়ির মুখে একটা রিক্সা এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে কালো এয়ারবেগ নিয়ে একটি রোগা শুকনো মেয়ে নেমে এলো। মেয়েটির পরনের কাপড় বেশ ভালোই। রোগা শরীরে পোশাক দেখে মনে হচ্ছে যেন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মেয়েটিকে দেখে গামছা পরা একটি মানুষ বাড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে এলো। আধো পাকা, আধো কাঁচা দাড়িতে শুকনো মুখ তার । মানুষটি বাড়ির মুখ অব্দি এগিয়ে গেল। মেয়েটিকে রিক্সার থেকে নামতে দেখে ভেতর থেকে ফর্সা মেয়েটি দৌড়ে এসে হাত থেকে ছোঁ মেরে বেগটা নিয়ে চলে এলো। পুরুষ মানুষটি ওর মাথাতে হাত রেখেছে ,
    “আমার ঔষধ এনেছিস? এরা তো আমি যদি পেটের অসুখে মরে পড়েও থাকি, খবরটাই করে না।” “ এনেছি “, বলে মেয়েটি হাসিতে ক্লান্তি ঝরিয়ে দিল। রত্নার মা হাঁটুতে মাথা গুঁজে দিয়েছে। মেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসে মালতীর দিকে তাকিয়ে হাসল। মেয়েটির শুকনো মুখের হাসিটা কেন জানি মালতীর বড় ভালো লেগে গেল।
    “ বস্তিতে নতুন এসেছেন?” ওর কথাতে শহুরে সুর।
    “ এই অল্প দিন হয়েছে। তোমার নাম কী? গুয়াহাটিতে থাকো?
    “ আমার মায়েদের দেয়া নাম অম্বিকা, দিদিরা গুয়াহাটিতে কুকু বলে ডাকে।”
    “ মা তোমার শরীর ভালো? এতো শুকিয়েছো না।”
    রত্নার মা মেয়ের হাত পায়ের জল লেগে হওয়া ঘাগুলো হাতে ছুঁয়ে দেখছিল , “ সেখানে বুঝি বাড়ির ভেতরে জল, জল কাদা ঘাটতে হয় না। তবে এতো জলে খেল কী করে?”
    রত্না এসে দিদির কাছে দাঁড়ালো, “ আমার নতুন কাপড় কই? প্রত্যেকবার ঐ পুরোনো কাপড় আনতে হয় বুঝি?”
    বাবা এসে ওর থেকে টাকা দশটা চাইল।
    রত্নার মা খিটখিটিয়ে উঠল , “মেয়েটি এসেছে মাত্র, সব্বার এখন এটা লাগে , ওটা লাগে।”
    বাবা একবার গেটের বাইরে গিয়ে আবার ফিরে এসে কাঁঠালতলাতে বসে পড়ল। মানুষটি মাথায় কপালে হাত দিয়ে বসেছে। , “ আমার যদি জোয়ান ছেলে একটা থাকত তবে আমি পায়ের উপর পা তুলে মাছে ভাতে খেতাম। পোড়া কপাল। পেটের ব্যথার একটা ওষুধও জোটে না।”
    পচতে শুরু করেছে ঘরের একটা খুঁটি। তাতে ধরে দাঁড়িয়ে ফর্সা মেয়েটি বলল , “ রোজগেরে দাদা একটা থাকলে কি আর আমাকে লোকের ফেলে দেয়া কাপড় পরে থাকতে হতো?”
    গুয়াহাটির থেকে এসে ক্লান্ত মেয়েটি নীরবে ঢিগে দিয়ে রাখা ঘরটিতে ঢুকে গেল। রত্নার মা মালতীর দিকে তাকালো, “ একটি ছেলে জন্ম দিতে পারিনি। অম্বিকা আর রত্নার মাঝের দুটো নষ্ট হলো, রত্নার পরে আরো দুটো। শেষেরটা ছেলে ছিল মণির মা। ছ'মাসে খসে গেছিল। আমি নিজেই গিয়ে ছেলেটিকে পোঁতে এসেছিলাম মণির মা। সেই সন্তান খসানোর রোগেই আমাকে শেষ করল।”
    “ মা ঘরে চিনি চা পাতা নেই?” ভেতর থেকে বোধহয় অম্বিকা জিজ্ঞেস করছে।
    রত্না রশিতে মেলে দেয়া কাপড় গোটাতে এসে মুখ ঝাঁকিয়ে বলল, “ চা পাতা , চিনি! এই বাড়িতে থাকবে?”
    মালতী বাসাতে ফেরার জন্যে উঠে দাঁড়ালো। হাতে মোড়টা নিয়ে সে শেষবারের জন্যে ডিজাইনটা দেখে নিলো। অম্বিকা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো, সে এবারে একটা ফ্রক পরেছে। বয়সের ছাপ পড়েছে ওর মুখে, তার উপর রোগা পাতলা শরীরে এই ফ্রক পরা মেয়েটিকে অদ্ভুত লাগছিল দেখতে। মেয়েটির শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ওর কেমন যেন বোধ হলো। সে শুধু বলল, “ আসবে কিন্তু অম্বিকা, আমি কালীবুড়ির বাড়িতে ভাড়া থাকি।”
    একবার কি জোনের মায়ের ওখানে যাবে? ছাগল হারিয়ে মানুষটি একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। না কি বুলেনের বাসাতে যাবে? বুলেন ফেরে নি। সে টাউনের রাস্তাতে পাথর ঢালার কাজে লেগেছে। আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। পাগলির উপদ্রব আজকাল কমেছে। সে প্রায়ই কাঠ-লিচুর গাছের নিচে বসে থাকে , নইলে বিছানাতে পড়ে শুয়ে থাকে। সে বাসাতে ফেরাই ঠিক করল।
    বহুদিন পর ওর সেই ভুলটা আবার হলো।সে যাচ্ছিল, নারকেল সুপুরি গাছের মাঝের রাস্তাটি দিয়ে। গিয়ে গিয়ে সে বাড়ির মুখের দরজাটিতে হাত দেবে। লাল গোলাপের গাছ, মাছে ভরা পুকুর, কামরাঙা গাছের চারা, বেড়ার জন্যে বাঁশ চিরতে ব্যস্ত একটি মানুষ উঠে আসবে। ওর চোখে চোখ রাখবে। কিছু কি জিজ্ঞেস করবে মানুষটি? মানুষটি চোখ দিয়ে একবার তাকালেই কত কথা বলে বলে যায়। মালতী ভেতরের দিকে এগুবে, মানুষটি কি যাবে ওর পেছন পেছন? ডাক দেবে কি একটি বার?
    “মণির মা, মোড়া নিয়ে বাজারে যাবি বুঝি?” জোনের মা সাদা মিহি দাঁত দুপাটি বের করে হাসছে।
    “ রত্নার মায়ের থেকে মোড়ার বুনন শিখে এলাম একটু। তুই কই যাচ্ছিলি?”
    “ এই যাবার জন্যে বেরিয়েছি, চিনি নিয়ে আসি, জোনের বাবা চিনি দিয়ে চা এক কাপ খেতে চাইছিল। চা এক কাপ পেলে মানুষটি বড় আরাম পায়।”
    “ চল, আমিও দোকানের থেকে আসিগে' । লবণ নেই।”
    “এখন কি তুই মোড়া নিজে বুনতে পারিস?”
    “ পারি। রত্নার মায়ের মতো এত তাড়াতাড়ি পারি না।”
    “ রত্নার মা বেশ কাজের মানুষ। কিন্তু হবেটা কি, সুখ নেই মানুষটির।”
    “ আজ বড় মেয়ে এসেছে।”
    “ওই সংসারটা চালাচ্ছে।”
    মিনতির বাড়ির সামনে এসে দুজনে দাঁড়ালো, ঘর দোয়ার বন্ধ। সে ভালো করে তাকালো। বাইরে কোথাও গেলে চারকোনা যে তালাটা রোজ লাগিয়ে যায়, আজ সেটি নেই। তার মানে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। সে বাড়ির ভেতরে গিয়ে মিনতিকে ডাক দেবে ভাবল। জোনের মা ওর হাত ধরে টানল, “ ডাকিস নে।”
    “কেন?” সে অবাক হলো। ছেলেটার অসুখের খবর নিত সে, জোনের মা এমন করল কেন? জোরে পা চালাচ্ছে, কেন?
    “ দাঁড়া না, জোনের মা! এতো দৌড়োচ্ছিস কেন?”
    পাকা রাস্তাতে উঠে রামুর দোকানের কাছে আসতেই সে দেখল সমস্ত দোকানগুলো ধুপধাপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রামুও তার দোকান বন্ধ করছে।
    “ কী হলো রামুদাদা ?” সে জিজ্ঞেস করল। ওর শরীর শিরশিরিয়ে উঠল। এভাবেই ধুপধাপ দোকান বন্ধ হয়। মানুষগুলো এখানে জটলা বাঁধে, ওখানে জটলা বাঁধে। তারপরেই সব ওলট পালট হয়ে যায়।
    “প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করে মেরেছে ।"
    “নিজের রক্ষীই গুলি করেছে।”
    “ ভদ্রমহিলা পাখির মতো ছটফট করছিল।”
    “ বেশ ক'টা গুলি লেগেছে।”
    বাজারের দোকান একটাতে টানিয়ে রাখা একটা বড় ছবি ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। ছোট চুল, হাসি মুখে এক সুন্দরী রমণী। কেই বা মারল, কীইবা করেছিল? কেই বা শত্রু ছিল? ছেলেমেয়েরাই বা কী করছে? স্বামী আছে বা নেই! মা বাবা?
    জোনের মা বিশেষ কথাবার্তা বলেনি। অমন হাসিমুখে মিশুকে মহিলাটি অমন চুপ করে থাকলে ওর বাজে লাগে। ওরা ফিরে আবার মিনতির বাড়ির সামনে এসে গেছে। দরজা এখনো খুলে নি। সে জোনের মায়ের মুখের দিকে তাকালো। বারির সামনে দিয়ে ওরা যাচ্ছে, কিন্তু অসুখে ছেলেটার খবর একটা নেয়া হলো না।
    “ জোনের মা!” মালতী মিনিতির বাড়ির সামনে দাঁড়ালো।
    “চল, এখন ওর বাড়িতে ঢুকতে হবে না। নীরবে সে জোনের মায়ের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকল। নিজের বাসাতে ঢোকার রাস্তার কাছটাতে এসে চুপটি করে জোনের মায়ের মুখের দিকে তাকালো। মানুষটি ছাগলের শোক ভুলতে পারে নি।
    “মিনতি আজ ঘরে মরদ তুলেছে।” কথাটা বলেই জোনের মা নিজের পথ ধরল।
    সে এসে ঘরের তালা খুলল। খেলাধুলা সেরে নদীতে স্নান করে এসেছে মণি। ওকে সামান্য খাবার কিছু দিয়ে ও দরজার সামনে বসে রইল। মুড়ি ভাজবার ছিল, মোড়া একটাও বুনতে হবে। কালকে বাজারে যাবে। ওর কিছুই করবার ইচ্ছে হলো না। কানে গুমগুম করছে একটি হাবাগোবা মানুষের অস্পষ্ট বিড়বিড়ানি “ মাথা নেই, চোখ নেই।” মাথা নেই, চোখ নেই—অমন একদল মানুষ একটি সুন্দরী মেয়ে মানুষকে গুলি করে মারছে, পাখির মতো ছটফট করছে মহিলাটি। লোকগুলো মিনতিকে চেপে ধরেছে। বন্ধ ঘরে মিনতি চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে। লোকটি বিড়বিড়িয়ে যাচ্ছে --মাথা নেই চোখ নেই।
    ওর চোখজোড়া ভার হয়ে এসেছে।
    “মা, কী করছ?” মণি ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
    “না, কিছু না। যা তো দিদাকে ডাক দে, মুড়ি ভাজতে হবে।”
    মণি চলে যেতেই ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে নামল।

    টীকাঃ
    ১) সুহাগমণিঃ মূল অসমিয়া নাম সুৱাগমণি। তাই রাখলাম কেবল বাংলা উচ্চারণ অনুযায়ী লিখে দিলাম। নামটির বাংলা হতে অসুবিধে নেই। সুহাগমণি একধরণের শাইল ধান।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৫495486
  • অধ্যায় পনের (১৫)

    মিনতি , জোনের মা আর সে বাজার সেরে ঘরে ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হলো। আজ তিনজনেই মুড়ির সঙ্গে মোড়াও নিয়ে এসেছিল। দুজোড়া দুজোড়া করে মোড়া সহজেই বিক্রি হয়ে গেল। তিনজনেই মোড়াতে আলাদা আলাদা ডিজাইন তুলেছিল। তিনজনেই ওরা চা খাবার জন্যে জগুর দোকানে বসলগে'। লাল চায়ের সঙ্গে নারকেলের সন্দেশ দুটো দুটো নিয়ে তিনজনে হাত পা মেলে বসল। মালতী মণির জন্যে সন্দেশ একটা নিতে গিয়ে দেখে বৈয়াম খালি ।
    “কি রে দোকানি, সব সন্দেশ বিক্রি করে ফেললি?”
    “আজকাল ও বেশি করে তৈরি করে দেয় , তবু ফুরিয়ে যায়।”
    “ওর শরীর ভালো আছে?” জোনের মা-ই পয়সা ক'টা দিল। মানুষটি পয়সাগুলো দিতে বড় ভালোবাসে । পয়সা দিয়ে ও রোজ বলে, “ মাথার উপর মরদ থাকা মেয়ে মানুষ আমি...।” ঠিকই তো ।জোনের মায়েরই মাথার উপর মরদ আছে, নিজের একটি চালা আছে।
    জোনের মায়ের প্রশ্নে জগু চুপ করে রইল।
    “ বৌয়ের কথা জিজ্ঞেস করছে, বল না কেন?” মিনতির প্রশ্নটিও জগু এড়িয়ে যেতে চাইছে।
    “তোর নিজের চেহারাটা দিনে দিনে ভালো হয়ে আসছে।”
    “ সে আর করেটা কী? বৌ সারাটা দিন ,সারাটা রাত খেটে ঐ জিনিসগুলো বানায়। সে ওগুলো নিয়ে বাজারে আসে, আর বসে বসে চা বিলোয়।”
    “পয়সা ক'টা গুনে, চাল ডালটা বাড়ি নিয়ে যায় আর রামুর দোকানে বসে তাস খেলে।”
    “বাড়ি গিয়ে বৌ পেটায়।”
    জোনের মা আর মিনতির ওকে চেপে ধরা মালতী বহুবার দেখেছে। মুচকি হেসে সে ওদের ঠাট্টা ইয়ার্কি দেখছিল।
    হঠাৎ জগু ফোঁসে উঠল, “ওর কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবি না। নোংরা বেমারি মেয়েমানুষটাকে আমি বলেই ঘরে রেখেছি । অন্যে হলে সেই কবে লাঠিয়ে বাড়ির বাইরে বের করে দিত।”
    “নোংরা বেমারি?” মালতীর মুখের থেকে শব্দগুলো আপনাতেই বেরিয়ে এলো।
    হঠাৎ বাজারে হুলস্থূল লেগে গেল। একদল ছেলে হুড়মুড় করে তেড়ে এলো । জগুর চায়ের দোকানের গায়ে লেগে আছে মাছ মাংসের বাজারটা । ছেলেগুলো এসে বাজারের বাকি যে ক'টা হাঁস মুরগি পায়রা আছে, এখানে ওখানে আধা ঝুলানো ছাগলগুলোর উপর এমনভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ল যেন পচা আমের গায়ে মাছি পড়েছে। ওদের ভাবগতিক দেখলেই বোঝা যায় ওরা পয়সা দেবে না, হাঁস মুরগি ছাগলগুলোর উপর যেন ওদের মালিকানা রয়েছে। দে --বললে , দিতেই হবে। সবক'টা দোকানদার মনে মনে এদিনের লোকসানের হিসেব করলেও ওদেরকে হাসিমুখেই মাংসগুলো এগিয়ে দিল। 'জয় আই১ অসম', 'প্রফুল্ল মহন্ত জিন্দাবাদ', 'অসম চুক্তি জিন্দাবাদ', রাজীব গান্ধী জিন্দাবাদ' 'ভৃগু ফুকন জিন্দাবাদ' 'প্রফুল্ল মহন্ত, ভৃগু ফুকন অমর রহে' ধ্বনি দিতে দিতে ওরা আলু পেঁয়াজ ডাল লেবু যা পারে তুলে নিতে থাকল। জগুর চায়ের দোকানের কাছে চলে এলো ছেলেগুলো । বৈয়াম খুলে যে ক'টা মুড়ির নাড়ু , চিঁড়ার নাড়ু বাকি ছিল তুলে নিয়ে চলে গেল। ওদের হাতে হাতে একজন গোল টেকো, দাড়িমুখের আর একজন অল্প লম্বাটে মুখের চশমা পরা মানুষের ছবি। মুহূর্তে বাজার খালি করে ছেলেগুলো বেরিয়ে গেল। ওদের দেখে মেয়ে মানুষ তিনটি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। ধীরে ধীরে উঠল। জগুও দোকান গোটালো । মুহূর্তের মধ্যে লোকে জমজমাট বাজারখানা জনহীন হয়ে পড়ল। গোটা বাজার মাঝরাত্তিরের মতো তৎক্ষণাৎ খালি হয়ে গেল। মিনতিরাও বাজার থেকে বেরিয়ে পড়ল।
    পুরো শহর যেন দেওয়ালিতে মেতেছে। সাধারণত মিনতি বা জোনের মায়েরা সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি চলে আসে । প্রায়ই বিকেল থাকতে এসে পৌঁছে যায়। কিছু কেনাকাটার থাকলেই দেরি হয়। আজই ঐ পোড়ামুখোগুলোর জন্যে ভয়ে সিঁটকে থাকতেই অন্ধকার হয়ে এলো । শহরে চারদিকে বাজি ফুটছে, বাড়ি বাড়ি প্রদীপ জ্বলছে, বহু জায়গাতে ভোজের আয়োজন। মাঘের বিহু, দেওয়ালি, পুজো সব উৎসব যেন একসঙ্গে পালন করে ফেলছে এই শহর। বাজারে শোনা শব্দগুলো বাজি, মাংস, ভাত, মদের সঙ্গে চারদিকে ছিটকে বেড়াচ্ছে 'অসম চুক্তি জিন্দাবাদ', 'প্রফুল্ল মহন্ত অমর হোন', 'ভৃগু ফুকন অমর রহে,' 'রাজীব গান্ধী জিন্দাবাদ, 'জয় আই অসম'। এরই মাঝে ওরা ক'জন বাড়ি ফিরছে। হঠাৎই মিনতি একটি কাগজে পা ফেলল, মড়মড় করে উঠল বড় কাজগটি। চারদিকের আলোর রোশনাইতে বড়মাপের কাগজের ছবিটি দেখতে সামান্যও অসুবিধে হলো না । সেই গোল,দাড়িমুখো, টেকো মানুষটির ছবি। মিনতি 'আহ!' বলে লাফ দিয়ে উঠল। সে যেন নিজের ছেলেটির গায়েই পা দিয়ে ফেলেছে । হাঁটু ভেঙে কাগজখানা তুলতে গিয়ে সে পরম ভক্তিতে চোখ মুদে প্রণাম একটাও করে ফেলল। তারপর হাত দিয়ে কাগজখানা সমান করে আলতো করে হাতে তুলে নিলো। মুখে ওর একটা লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়েছে । চোখজোড়া কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়েছে, অথচ ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়েছে একটা চাপা হাসি। সে এখন ওর কথা বলবে । বাকি দুজন বুঝে ফেলল।
    “ এই মানুষটি ওর ভগবান ছিল। সে আমাকে বলেছিল, এই মানুষটিই অসম থেকে সব বিদেশি তাড়াবে। এখানে রামরাজ্য হবে । আর সে আমাকে প্রায়ই বলত সেই নতুন দেশে ওর আমার একখানা সংসার হবে ।”
    দুজনে চুপচাপ ওর কথা শুনছিল। কলেজে পড়া আন্দোলনের লিডার সেই ফিল্মের হিরোর মতো দেখতে ছেলেটির থেকে সে বহু কথা শিখেছিল।
    “ সে তোকে বলেছিল গোলমাল হবে বলে?”
    “বলেছিল। দিদি জামাইবাবু অফিসে বেরিয়ে যাবার পর প্রায়ই সে এসে আমার বাক্সে বন্ধুক লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিল।”
    “ তুই জিজ্ঞেস করিসনি ওগুলো দিয়ে কী করবে?”
    “ করেছিলাম। সে বলেছিল অসমের সব শত্রু খতম করবে ।”
    কথা বলতে বলতে একটা হুলস্থূলুর শব্দে ওরা তিনজন চমকে উঠল। পথের এককোনে একদল ছেলের সঙ্গে একটি মানুষের তর্ক বেঁধেছে । মানুষটিকে সে চিনতে পেল। কালীবুড়ি মুড়ির যে কয়টি বাঁধা গ্রাহকের বাড়িতে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল তাদেরই একটি বাড়ির লোক। ছোট পরিবার, ছোট মেয়ে আর বৌ নিয়ে । তিনি শিক্ষক। মানুষটি রোজ বারান্দাতে বসে পত্র পত্রিকা বই পত্রে চোখ বুলাতে থাকেন। সে মুড়ির বস্তা নিয়ে ঢুকলে হাসি একটা দিয়ে রোজ একটাই কথা বলেন, “যা, দিদি ভেতরে আছেন।” মানুষটি একদিনই ওর সঙ্গে একটু বাড়িয়ে আলাপ করেছিলেন। কালীবুড়ি গোলমালে তার বাড়ি আর স্বামী হারানোর গল্প করেছিলেন। শুনে মানুষটি চটে লাল হয়ে গেছিল। সেই মানুষটির সঙ্গেই চ্যাংড়া ছেলে কয়েকটার তর্ক বেঁধেছে । লোকটিকে ওরা ঘিরে ফেলেছে ।
    “উঠিয়ে নিন আপনার ভবিষ্যৎ বাণী।”
    “ না উঠাব না, একশ বার উঠাব না। এই চুক্তিতে কোনও সোনা ফলবে না।”
    “ কেন ফলবে না? আপনার মতো দেশদ্রোহী এরকম বলবেনই।”
    “ তোমাদের লিডার টাকার পাহাড় জমাবে আর অসমকে শ্মশানপুরী করে তুলবে।”
    “ ও মুরগি একটা না দেবে না দিক, তাই বলে আমদের নেতার নামে কথা শোনাবে কেন?”
    “ মার একে।”
    “ দে দুই চড় কষে।”
    “ প্রফেসর হয়েছে।”
    “ প্রফুল্ল মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী হয়ে টাকা খাবে! এমন পোড়া মুখ! দে ভেঙ্গে দাঁতগুলো। অমন কথা বলে যে ওর মুখ চেপ্টা করে দে।”
    ছেলেগুলো মানুষটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজন মহিলা আর একটি মেয়ে আর্তনাদ করে উঠল। জটলার মধ্যি থেকে ভেসে আসছে কোঁকানোর শব্দ । কোঁকানোর শব্দটি একবার বড় হয় , একবার খাটো।
    মালতী পা চালাতে না পেরে দাঁড়িয়ে গেছিল। চোখে ধোঁয়াশা দেখতে শুরু করেছে । পাগুলো কাঁপছে । সে যেন কলাপাতাতে ঠাসা একটা পুকুরে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে । দু দুটো জোক ওর দুই চোখকে যেন সেলাই করে জুড়ে ফেলছে । সামান্য নড়াচড়া করলেই একদল ছেলে কলাগাছগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেবে ।চতুর্দিকে মাংস পোড়ার গন্ধ । সে একটুও নড়াচড়া না করে রাস্তার কাছেই বসে পড়ল।
    “ কী হলো হে ওর?” বলে জোনের মা তার শক্তি সমর্থ শরীরে মালতীর নড়বড়ে শরীরটাকে তুলে ধরল, “ ধর , একে ধর। গৃহস্থ ঘরের বৌ, সোয়ামীর আদরে দিন কাটিয়েছে। কপাল পুড়ে আজ বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে ।”
    “ জল একটু যদি ছিটিয়ে দিতে পারা যেত।”
    “ জলের কথা বাদ দে, আগে রিজার্ভ পাই গে'। চারদিকে কেমন হাল্লা চীৎকার হচ্ছে দেখছিস না, কখন বা কী বা হয় !”
    ওকে মাঝে ধরে ওরা বস্তির দিকে এগুলো। ওর দেহের ভারের বেশিটাই নিয়েছে জোনের মা । শহর থেকে যতই দূরে চলে এসেছে ততই হুলস্থূলগুলো কমে আসছে । রিজার্ভের এলাকা পেয়ে যেন ওদের বুক থেকে পাথর নামল। এই এলাকা শান্ত । কোথাও বা দু একটা পাখির ডাক। জঙ্গলের মধ্যি দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ঝির ঝির শব্দ। চেনা শব্দ চারদিকে ।
    “ শরীরটা ভাল লাগছে মণির মা?” মিনতি ওর মুখে খানিক জল ছিটিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল।”
    “ আজ ঐ বদমাশগুলোর জন্যে অনেক দেরি হয়ে গেল। তোর হয়তো খিদে পেয়েছে ।”
    জোনের মা বাড়ির জন্যে কেনা ব্রেডের আদ্ধেকটা ওর দিকে এগিয়ে দিল। ব্রেডের টুকরো ও হাতে নিয়েছে । কিন্তু মুখে দেয় নি । খানিকক্ষণ জোনের মা আর মিনতির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সামান্য হাসবার চেষ্টা করে বলল, “কিচ্ছু হয় নি। মাথাটা অল্প খারাপ লাগছিল।” এবারে সে কাউকে না ধরে হাঁটা দিল।
    বস্তিতে ঢুকেই দেখল শহরের সমান নাহলেও এখানেও ধূমধাম হয়ে গেছে। সবারই বাড়ির সামনে ছোট হলেও একটা করে মোম জ্বলেছে । খাবারের আয়োজন হচ্ছে । ভাঙুয়ার ছেলে সবার আগে । সবার ঘরে ঘরে মোম জ্বলাতে বলে বেড়াচ্ছে । তার পেছনে পেছনে একই বয়সের আর কতকগুলো ছেলে । ছেলেগুলো কালীবুড়ির উঠোনে এসে পড়েছে, মুরগি লাগে। ভেতরে মণি কাঁপছে । সে বাজারবারে মাকে বলে কয়ে টাকায় একটা করে মুরগি বাচ্চা আনিয়েছিল। তুলো দিয়ে সাজানো যেন বাচ্চাগুলো । তারই দুটো মরে গেছে, তিনটা সামান্য বড় হয়েছে। ভাঙুয়ার ছেলে আর তার দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুরগি , ছাগল খুঁজছে দেখে সেই বিকেলে এসেই সে বাচ্চাগুলোকে ঘরে ঢুকিয়ে রেখেছে। পরের শুক্রবারের কালী পুজোর জন্যে ভোগের জন্যে কেউ এক জোড়া কালো পায়রা দিয়ে গেছিল। ওদের দেখে কালীবুড়ি সেগুলোই ওদের দিয়ে দিল। পায়রা পেয়ে নিজেদের ভাষাতে কথা বলতে বলতে ছেলেগুলো চলে গেল। কালীবুড়ির উঠোন থেকেই ড্রাইভারণী হাতের ইশারাতে ওদের ডেকে নিয়ে গেল। ছেলেগুলোর সঙ্গে ড্রাইভারণীর হাসি তামাসা ভালোই শোনা গেল। ড্রাইভারণী ওদের চা মিষ্টি খাওয়াচ্ছে । আধঘণ্টাখানিক পরে যখন ওরা ওখান থেকে বেরিয়ে গেল ওদের পা তখন আর সোজা চলছে না । জন্মের থেকে চেনে বলেই বোধহয় নেশা বেশি চড়তে দেয়নি । কালীবুড়ি আর মালতী বাতি নিভিয়ে ড্রাইভারণী আর ছেলেদের কীর্তি দেখতে থাকল। ছেলেগুলো চলে গেলে বুড়ি ওকে ফিসফিসিয়ে বলল, “ এই মহিলার থেকে সাবধানে থাকবি। এ বড়ো সাংঘাতিক মেয়েমানুষ!”
    “কেন ?” ওর স্বরও বসে গেছে।
    “ ও, যে পার্টির শক্তি বেশি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করে রাখে। সব বাজে কাজের সিদ্ধান্ত ওর ঘরে বসে ঠিক হয়। ওর নিজের বলতে আছেটা কী? তুই মোট কথা সাবধানে থাকবি।”
    রোগা পটকা এক মহিলা বাড়িতে ঢুকল। কাছে এলে সে চিনতে পারল জগুর বৌ । মানুষটি আরো শুকিয়ে গেছে ।
    “ আয় বস।” কালীবুড়ি পিড়ি পেতে দিল। সে লক্ষ্য করল মহিলা বসবার আগে কাপড়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কী যেন ঠেলে দিল।
    “ বসব না বেশিক্ষণ, ঘরে ছেলে চেঁচাচ্ছে। ভাত লাগে । ওদের ভাত খাইয়ে নারকেল কোরাতে হবে । চিঁড়ার নাড়ু, মুড়ির নাড়ু বানিয়েছি।” এইটুকুন বলতেই ও হাঁপিয়ে উঠছিল। খানিক শ্বাস নিলো। এতো দুর্বল মহিলাটি । বসতে যেন ওর বেশ অসুবিধে হচ্ছে । একবার পা মেলে বসে, একবার কুঁচকে। একবার সোজা হয় তো আরেকবার ঝুঁকে ।
    “ তোমার হাতের সন্দেশ খাই , কী যে ভালো। আমাকে শিখিয়ে দেবে?”
    “ তুই আর কোন কাজটা না শিখবি , শুনি?” কালীবুড়ি হেসে ফেলল।
    “ হবে, শিখিয়ে দেব। কীইবা আর কঠিন কাজ, সামান্য খাটা খাটুনি। মহিলাটি এবারে পা মেলে বসেছে । বড় করে শ্বাস একটা নিয়ে ও জিজ্ঞেস করল, “ মণির মা, ওদের বাবাকে বাজারে দেখেছিলি আজ? এতো হুলস্থূল হচ্ছে। এখনো ঘরে আসে নি।”
    “ দেখেছিলাম। আমাদের সঙ্গেইতো দোকান বন্ধ করল। ফেরেনি এখনো?”
    মহিলাটি ঘোপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কাউকে কিছু না বলে সে চলে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
    “ তোমার কী অসুখ হয়েছিল , বলছিল জোনের মা। এখন কেমন?” জগুর বৌ দাঁড়িয়ে পড়ল।
    “ কই আর ভালো হবে এসব অসুখ?” সে বুঝতে পারল মানুষটির বুক ভার হয়ে এসেছে। শুকনো এই দেহে রয়েছে অনেক কথা । “ ঔষধ খেলে কি আর অসুখ ভালো হয় ?”
    যেতে গিয়ে সে গেল না, দাঁড়িয়ে রইল। কী যেন একটা বলতে চাইছে । ওর স্বর খাটো হয়ে এসেছে। “ দোকান বন্ধ করে মানুষটাকে কোনদিকে যেতে দেখলি?” চাপা স্বরটিতে যেন অনেক রাগ, শোক আর অভিমান জমা হয়ে আছে। রোগা পটকা মানুষটি অল্প অল্প কাঁপছিল দাঁড়িয়ে । এক গ্লাস জল খেতে পেলে যেন রক্ষে পায়।
    “ চলো , আমার ঘরে বসবে।” সে এমনি করে বলে দেখল। মহিলা এমন ভাবে ঘুরে এলো যেন এই কথাটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। সে পেতে দেয়া বস্তাতে বসতে গিয়ে আবারো মানুষটি কাপড়ের উপর দিয়ে যেন কী একটা ভেতরে ঠেলে দিল।
    “ কি করলে?” হঠাৎ ওর মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়েই এলো।
    “এটাই তো আমার অসুখ, আমার ভাগ্য।”
    কিছুই বুঝতে না পেরে সে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পরেই শৌচ করবার মতো বসে কাপড় অল্প তুলে দিল। সে স্পষ্ট দেখতে পেল একটু মাংসের মতো কী যেন ঝুলে পড়েছে । আবার কাপড়টা নামিয়ে পা মেলে সে বস্তাতে বসে পড়ল।
    “ দেখলি মণির মা, মেয়েমানুষের জ্বালা।”
    “ ডাক্তারকে দেখিয়েছিস।” নিজের অজান্তেই সে মহিলাটিকে তুই বলে বলতে শুরু করে দিল।
    “ প্রথমদিকে অসুবিধে দেখে সেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল।”
    “কোথাকার ডাক্তার?”
    “ কোথাকার আবার, সরকারি হাসপাতালের ।”
    “ কী বলল, ডাক্তার?”
    “ এই অসুখের কোনও ঔষধ নেই।”
    “ ঔষধ নেই? কেন হয় এই অসুখ?”
    “ ডাক্তার আমাকে খুব করে গালি দিল।”
    “ কিসের জন্যে?”
    “তিনবার শরীর খসাবার জন্যে। এমনিতেই পেটে পাঁচটা ছেলে ধরেছি । তার উপর আবার তিনবার গা খসিয়েছি । সে জন্যেই এই অসুখে পেল।”
    “কোনও চিকিৎসা নেই বুঝি?” সে মহিলাটিকে দুই টুকরো ব্রেড আর এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল। বিনা আপত্তিতেই ব্রেড টুকরো মুখে দিল সে । মালতী দুটো মুড়িও এগিয়ে দিল।
    “ যন্তর দিয়ে জরায়ুটা ভেতরে ঠেলে দিয়েছিল। আবার বেরিয়ে এলো । ডাক্তার বলেছিল, মশলা বাটবে না, জলের কল মারবে না, ভারী জিনিস তুলবে না, নারকেল কোরাবে না। বল মণির মা, এইগুলো না করলে আমাদের চলবে? দিনে আমি বিশ ত্রিশটা নারকেল কোরাই, কোরানো নারকেল পাটাতে বাটি। এ নইলে ভাত দুমুঠো আসবে কী করে?
    সে জগুর বৌয়ের শুকনো পিঠে হাত রাখল। তার নিজের কথা বলবার ইচ্ছে হলো । সেই মানুষটির কথা , সেগুন পাতার মতো ছড়ানো হাত যার, সেই ভোৎকা গন্ধের মানুষটার কথা, মুণ্ডহীন ধড়গুলোর কথা, চোখ খসে পরা পিশাচগুলোর কথা ।
    “বড় জ্বালা, বেঁচে থাকার বড় জ্বালা।” সে কালীবুড়ির কথাগুলোই আওড়ালো ।
    “দেহের জ্বালা সইতে পারি, কিন্তু মনের জ্বালা সইতে পারা বড় কঠিন রে মণির মা।”
    “তোর মাথার উপর ছেলে মানুষ আছে, ছেলে মেয়ে আছে। দুবেলা দুমুঠো খেতে পাচ্ছিস। কিসের জ্বালা তোর? আমার মতো তো আর সব পুড়ে শেষ হয় নি।”
    “তোর মানুষটা তোর মনে আছে। তাকে মনে নিয়ে সব করতে পারিস। আমার মতো জ্যান্ত স্বামী...।” কী একটা বলতে গিয়ে রোগা মানুষটি কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো।
    “ কী করে জগু তোকে?”
    “ কী করবে? নিজের বিছানাতে সুখ না পেলে পুরুষ মানুষ কী করে?”
    “ জগুর জন্যে তুই এতো করিস আর সে অন্য মেয়ে মানুষ...”
    “ সে বাজার থেকে বাইরে বাইরে মাঠ দিয়ে এসে কই ঢুকে জানিস? ঐ ড্রাইভারণীর ওখানে। রুগ্ন মেয়েমানুষটির হাতের হাড়মাস বেরিয়ে গেছে, শিরা ধমনির রেখাগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ে। সেই হাতে মাটিতে আঘাত করতে করতে বলে যায়, “ আমি যখন নারকেল কোরাই, পরদিনের বাজারের জন্যে পাতাতে সেগুলো বেটে সন্দেশ নাড়ু বানাতে থাকি আমার মানুষটি তখন রেণ্ডীর ওখানে গিয়ে মৌজ করে। গোটা দিনের রোজগার ওর হাতে দিয়ে আমার ঘরে এসে লাঠি হাঁকায় । ভাত ভাত করে বাচ্চাগুলো কাঁদতে থাকে আর ও ওদের ধরে ধরে পেটায়।” মহিলাটি আবারো শৌচ করবার মতো বসে এবারে কাপড়টা একটু বেশিই তুলে দিল। গোটা একটুকরা মাংস ঝুলে দুলতে থাকল, এই অবস্থাতে কি আমার শরীরে আর কোনও কষ্ট সইতে পারে? বল্ আমি এখন কী করি?” শুকনো মহিলাটি থরথর করে কাঁপছে।
    সে আস্তে করে ওর পিঠে হাত রাখল। জগুর বৌর চোখজোড়াতে এক ফোটাও জল নেই। জ্যেষ্ঠ মাসের ফেটে চৌচির ধান খেতের থেকে তুলে আনা দু টুকরো শুকনো মাটির দলার মতো ওর চোখজোড়া তাকিয়ে আছে।
    বাইরে তখন ভাঙুয়া বুড়োর ছেলে আর ওর সঙ্গীদের চুক্তি সম্পন্ন হবার খানাপিনা পুর দমে চলছে। গান বাজছে। ওদের হাসির শব্দে গাছের কাকগুলোও ভয়ে ওদের বাসা থেকে বেরিয়ে কা কা করতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে বিকট সম্মিলিত কণ্ঠে বেজে উঠছে জয়ের নিনাদ। জয় জয় আর জয়।
    জগুর বৌ যাবার জন্যে উঠতে উঠতে এক হাতে জরায়ুটা ভেতর দিকে ঠেলে দিল। মালতীর মুখে কোনও কথা নেই। বহুদিন বৃষ্টি না পড়া মাঠের দু দলা মাটির মতো চোখজোড়া যেন শুকনো খড়ের আবর্জনার মতো সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল।
    ওর সামনে সামনেও দাঁড়িয়ে রইল আরো একজন বৃষ্টি না পড়া মাটির মতো শুকনো মানুষ।

    টীকাঃ
    ১) আই—মা; জয় আই অসম অর্থ জয় মা অসম।
    ২) অসম চুক্তি- ১৯৮৫র ১৫ আগস্ট রাজীব গান্ধী নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার এবং প্রফুল্ল মহন্ত , ভৃগু ফুকন নেতৃত্বাধীন সারা অসম ছাত্র সংস্থার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৫495487
  • অধ্যায় ষোল (১৬)
    সমস্ত বস্তিতে হুলস্থুলু লেগে গেছে। দুপুরে বারটা নাগাদ ভোট চাইতে বেশ ক'জন আন্দোলনের নেতা বস্তিতে আসবে। ভোট ইতিমধ্যে গোটা বস্তিকে উথাল পাথাল ফেলেছে । ভাঙুয়ার ছেলে রতন এই সবে আগ ভাগ নিয়েছে । ওর সঙ্গের ছেলেরা রোজই বস্তি আসছে । কখনো বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে, কখনো বা মিটিং করে আন্দোলন পার্টিকে ভোট দিতে বলছে। বস্তিতে ঢোকার পথে একটা গেট তৈরি করেছে । পুরোটাতে মাথাতে অল্প চুল কম, দাড়ি থাকা আর চশমা পরা লোক দুজনের ছবিতে ভরিয়ে ফেলেছে। আজ ভাঙুয়ার ছেলে আর ওর সঙ্গীরা কাউকে কাজে কর্মে , বাজারে যেতে দেয় নি। আজ ছিল বাজারবার। সবাই বাজারে যাবার জন্যে নিজের নিজের মাল আগের দিনই ঠিকঠাক করে রেখেছিল। বস্তির থেকে মুল রাস্তাতে উঠার জায়গা থেকে ছেলেগুলো সবাইকে ফেরত পাঠাল। সেই জায়গাটা লোকে ভরে পড়েছে । গেট তৈরি হয়েছে, কলাচারা পোঁতা হয়েছে। জগু ওখানে লাল চা আর নারকেল সন্দেশের দোকান বসিয়ে দিয়েছে । রমাকান্ত সবুজ রঙ দিয়ে সেদ্ধ করে রাখা মটর , তাতে কুচি কুচি করে পেঁয়াজ কেটে ছড়িয়ে বাক্সটা গলাতে ঝুলিয়ে জগুর তোলা চুল্লির কাছে দাঁড়ালো গিয়ে। ভাঙুয়ার বৌ আর ময়নার মা কলাপাতা বিছিয়ে সেদ্ধ পিঠা সার করে সাজিয়ে ফেলেছে।
    মণি মাঝে মাঝে এসেই মাকে শেষ খবর জানিয়ে যাচ্ছে। ভাত খাবার নামে মুখে দুটো গুঁজে সে আবার দৌড় দিল। দেখতে দেখতে ছেলেটা বড় হয়ে গেছে । মুঠোভর নুন ভাত খেয়ে সে বড় হয়ে যাচ্ছে । ওকে যেমন করে হোক যদি মেট্রিকটা পাশ করাতে পারে । পারবে কি সে কলেজে পড়তে? পড়াবে, সে যতটা ইচ্ছে করে ততটা পড়াবে। মোড়া বানাবে, মুড়ি ভাজবে। সে ঠিক করে ফেলল, মিনতির থেকে ঠোঙা বানাতে শিখে নেবে। অবসর সময়ে ঠোঙা বানাবে । কী আর এমন বড় কাজ? মিনতি , রত্নার মা, জোনের মা, এমন কি জগুর বৌও বানায়। মণিও হাত লাগিয়ে দিতে পারবে । মোড়াগুলোতো আজকাল ওই বানায় অনেকটা । ওর থেকে ভালো করে শলা চাঁচে । কত ভালো করে গাঁঠ দিতে শিখেছে । ওকে কলেজে পড়াবে । একবার ওর মণির মুখখানা দেখবার বড় ইচ্ছে হলো । কোথায় বা কী করে বেড়াচ্ছে । বেলা পড়তে শুরু করেছে । দুপুরে আসবার কথা নেতাদের , আসেনি বোধহয়। এলে মণি খবর দেবেই। ঐ তো মণি দৌড়ে আসছে । নেতাকে দেখতে যাবার একেবারেই ইচ্ছে নেই মালতীর। কলাপাতায় ভরা ডোবার ভেতর থেকে একেবারে কাছ থেকে সে অনেক নেতাদের দেখেছে । ওর বারবার মনে পড়ছে নিজের চোখে দেখা জালে বন্দি জঙ্গলের রাজার মতো ছটফট করছে সেই লম্বাটে শক্তসমর্থ ছেলেটি । ফিনফিনিয়ে রক্ত বেরিয়েছিল। জনা দুয়েক লোক প্রচণ্ড আক্রোশে পাট খেতে মধ্যে বেঁচে যাওয়া ছেলেটাকে লাঠি বর্শাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলেছিল। তারপর ওদের গ্রামখানা উজাড় করে ফেলেছিল। মালতীর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা গাছে ঝুলন্ত পচতে শুরু করা বাচ্চা, ওর হাত পা, মাথা ছিল না। আজ যে নেতারা আসছে তাদের মধ্যে কেউ একজনও যদি জানতে পায় সেই গ্রামের এক মহিলা এই গ্রামে বেঁচে আছে, যদি এই নেতাদের মধ্যে কেউ একজনও জানে এই বস্তিতে এমন এক মহিলা আছে যার ফাটা কাঁথার মধ্যে এক কামরাঙাহার রয়েছে। সেতো জানে সেই মৌজাদারের বাড়িতে এসে আন্দোলনের নেতারা রাত কাটিয়েছিল। ওর গলা শুকিয়ে এলো । হাতের মোরাতে ও মন বসাতে পারেনি । আধা তৈরি মোড়াটা রেখে সে ভাত রাঁধার জোগাড় যন্ত্র শুরু করল। সন্ধ্যা প্রায় হয়েই এলো । কালীবুড়ি এখন বেরোবে না, পুজোতে বসেছে। মাথাতে জটা দেখা দিলে বুড়ি কারো সঙ্গে কথা বলে না । সেই বেরিয়ে গেল। সেই ছেলেদের দুটো এসেছে,
    “টাকা চাই, প্রদীপ কিনতে হবে।”
    সে ভেতরে গিয়ে টাকা দুটো এনে দিল।
    “ দু টাকা দিতে এসেছে!” একটা ছেলে দাঁত খিচিয়ে উঠল।
    “হবে চল, পরে দেখা যাবে।”
    ওর বুকের কাঁপন বেড়ে গেল।
    জোকার, শঙ্খ, ঘণ্টার ধ্বনিতে বস্তিটা ভরে গেল। বস্তির সবাই সেখানে । ঐ কে দৌড়ে দৌড়ে আসছে? মেয়ে মানুষটি ওর দিকেই আসছে। খানিক কাছে এলে দেখল মিনতি । ও কথাই বলতে পারছে না , হাঁপাচ্ছে।
    “আহ! জল খা, হলো কী তোর?”
    মিনতি এক ঢোকে গ্লাসের জলে খেয়ে ফেলল। ভেতরের বাতির আলোয় দেখল মিনতি মেখলা চাদর পরেছে। গোলাপি রঙের উপর লাল কালো ফুল রয়েছে । একটা খোঁপা বেঁধেছে । কানে দুল। কপালে একটা বড়সড় ফোঁটা। কী সুন্দর যে লাগছে ওকে! গাল দুখানা লাল হয়ে গেছে। কন্ট্রোলের শাড়ি পরে বেড়ানো এই মেয়েটাইতো ?
    “কী হলো তোর? বিয়ের কনে সেজেছিস দেখছি।”
    মিনতি ওকে জড়িয়ে ধরল। ওর গায়ের উপর মেয়েটি কোমল আর নড়বড়ে হয়ে পড়েছে ।
    “ ও এসেছে মণির মা, ও এসেছে। ভোট চাইতে আসা লোকগুলোর সঙ্গে অও এসেছে ।
    আনন্দে উথলে উঠা মিনতিকে দেখে ওর রাগ চড়ে গেল, “ তোকে যে ঠকে গেল সেই বজ্জাতটা এসেছে, আর তুই তার জন্যে কনে সাজা দিয়েছিস!”
    “ তেমন করে বলবিনে মণির মা, তেমন করে বলবিনে। ও আমাকে ঠকায় নি । তুইই বল ছাত্র অবস্থাতে একটা ছেলে বা একটা মেয়ে বাড়ির অমতে করবেই বা টা কী?”
    “শরীরে বাচ্চা দিয়ে সে তোকে মরবার জন্যে ছেড়ে দেয় নি?”
    “ না, দেয়নি মণির মা। আমি তার সম্মান রাখবার জন্যে নিজেই পালিয়ে এসেছি । কী সম্মান তার কাগজে, টিভিতে তার ফটো।”
    “একবারও খবর করেছে তোর ও? একবার দেখেছে ও তার ছেলেকে? ওর ছেলেকে বাঁচাবার জন্যে তুই ঘরে পুরুষমানুষ তুলিসনি? ঘোপ করে কথাগুলো বলে ও থমকে গেল।
    “তুলেছি পুরুষ, একশবার তুলেছি। তার ছেলে তার ছেলে করবি না বলে দিলাম। সে আমারও ছেলে ।”
    মিনতি ওর হাতে ধরল,” যাবি মণির মা, একবার তাকে দেখে আসব, মাত্র একবার।”
    “তোর সঙ্গে ওর দেখা হয় নি? আমি আরো ভেবেছিলাম...।” এক অদ্ভুত আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে পড়া মেয়ে মানুষটার উপর রাগ চড়লেও সে রাগ করতে পারল না।
    “কী যে বলিস মণির মা।” লজ্জায় মিনতি লাল হয়ে পড়েছে ।
    কী করেই বা মানা করে এই মেয়েটিকে? সে তালা দিয়ে কালীবুড়ির দিকে উঁকি দিয়ে তাকালো। মাথাতে এক বিশাল জটা নিয়ে বুড়ি মায়ের সামনে বসে আছে । সে আর মিনতি নিঃশব্দে প্রণাম করে সেখান থেকে চলে গেল।
    “মিনতি , সত্যি করে বল। সে তোর এখানে এসেছিল কি না ।”
    “আসেনি মণির মা। আমি কোথায় আছি ও জানেই না ।”
    “মরেছে বলে ভেবেছিল।”
    “ আমি মরলেও সে আমাকে ভুলবে না।”
    “বজ্জাতটা তোকে...।”
    ওর কথা শেষ হতে দেয় নি মিনতি, “ সে আমাকে কী বলে ডাকত জানিস, মণির মা?”
    এতো ছোট্ট করে কথাটা বলল যে শব্দগুলো ওর নিজের ভেতরে উঠে আবার নিজের ভেতরেই ডুবে গেল।
    বস্তির মুখে বিশাল জটলা। চারদিকে বাতি জ্বলছে, ধূনার গন্ধ, ধূপ আর ফুলের গন্ধ। কয়েকজন নেতা ভাঙুয়ার ছেলের দলে বাঁধা মঞ্চে উঠে বসে আছে । একজন কথা বলছে । বিদেশি তাড়িয়ে সোনার আসাম তৈরির কথা বলছে, বলছে রামরাজ্য নিয়ে আসবার কথা।
    “ মণির মা , দেখ দেখ!”
    “কোনটা?”
    “দেখিস নি?”
    “ওর মাথাতেই কাজ করছে না, আমি কী করে চিনে পাব?”
    এক ফর্সা, লম্বা ছেলে কথা বলবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে যেন দাঁড়ালো না, মাইক হাতে নিয়ে কথা বলে নি। মানুষের ভিড় ঠেলে এসে মিনতির কাছে পৌঁছুলো । সে মিনতির আনন্দে লাল মুখখানা তুলে ধরে যেন বলছে, “তুই মরলেও আমি তোর কথা ভুলব না।” মিনতি কোনোদিকে তাকাতে পারেনি । লজ্জা আর আনন্দে সে মাথা নুইয়ে বসে আছে।
    “এটা বুঝি?” মালতী চাপা গলাতে জিজ্ঞেস করল। উত্তরে মিনতি ওর হাতখানা খামচে ধরল। মিনতির হাত ঘামে ভিজে গেছে । ওর শরীরে টুপ করে কিছু পড়ল যেন। কালীবুড়ির বাগান থেকে বেলি ফুল পেড়ে মিনতি খোঁপায় গুঁজেছিল, সেই ফুল। ফুলটি দেখে , না মিনতির আনন্দে, না ছেলেটার একগুচ্ছ বকবকানি শুনে মালতী বড্ড বিরক্ত হয়ে পড়ল। সে মিনতির কাছ থেকে সরে এলো । বাড়ি এসে দেখল কালীবুড়ির জটা নেই। সেই একই রকম শুকনো চুল, থান কাপড়ের শাড়ি। এই কালীবুড়িকে সব বলা যায়, সব জিজ্ঞেস করা যায়।
    “আজ মুড়ি ভাজতে হবে না?” সে ভাবল আজকের বাজারবারতো গেলই। মাঝের তিনদিন আর তাকে মুড়ি ভাজতে হবে না । বুড়ির ভাগেরটা ভেজে দেবে । পারলে কাল বুড়ির বাঁধা গ্রাহকদের দিয়েও আসবে । বুড়ির এইটুকুন কাজ করে দিয়ে ওর ভালোই লাগে । বুড়ি একটা কাঁথা পেড়ে ফেলেছে । সে বুড়ির হাতের থেকে সূচটা নিয়ে সুতো ভরিয়ে দিল। বুড়ির কান ভার হয়েছে । ভালো শুনতে পায় না । দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়েছে মানুষটি । বুড়ির যা উপার্জন হয় তাতে একজন মানুষের দিব্বি চলে যায়। অথচ বুড়ি একবেলা খেয়ে আর বেলা না খেয়ে কেমন করে যে টাকা জমাচ্ছে । চশমার নালটাও পাল্টায় নি । কী করবে পয়সা জমিয়ে?
    কানের কাছে চেঁচানোর মতো করে সে বুড়িকে বলল, “ মুড়ি ভাজতে হবে না?” বুড়ি কোনও উত্তর দিল না। মাত্র নাল ছাড়ানো চশমার মধ্যি দিয়ে ওর দিকে তাকালো একবার। তারপর আবার কাঁথাতে হাত দিল। একই রকম আগে বাঁ হাতখানা পরে ডান হাতখানা... এক সারি সেলাই শেষ হলে কাঁথাটার উপর উপুড় হয়ে পড়ে। এভাবেই বুড়ি সপ্তাহে একখানা কাঁথা সেলাই শেষ করে । কিসের জন্যে এতো কষ্ট করে বুড়ি? হঠাৎ বুড়ি ওর দিকে তাকিয়ে বলল,” তুই আর আমার ঘরভাড়া দিতে হবে না।” বুড়ির চুলোতে আগুন ধরিয়ে সে কড়াইতে মুড়ি ফোটাতে শুরু করেছিল। এক হাতা লবণ জল ঢেলে দিয়ে সে অবাক হয়ে বুড়ির দিকে তাকালো । বুড়ি বলেটা কী? ওকে বাড়ি থেকে তুলে দেবে না তো?
    “ আমাকে কি কোনও কারণে খারাপ পেলি?” জোনের মায়েদের মতো সেও যে কখন বুড়িকে তুই বলতে শুরু করেছে বলতেই পারে না।
    “তোকে খারাপ পেতে যাব কেন?”
    “ তবে আমার ঘর...” ওর গলা যেন কেউ চেপে ধরেছে।
    “তোকে কে যেতে বলছে মণির মা? তুই আছিস বলেই না...” বুড়ি কাঁথাতে মন দিল , সেও মুড়িতে।
    “মণি কই?” বুড়ি কাঁথা গোটাচ্ছে।
    “ ভোটের মিটিঙে।”
    সে বুড়ির কাছ চেপে এলো। কেন জানি বুড়ির থেকে সে কোনও কথা লুকোতে পারে না ।যেকোনো কথা বুড়িকে বলতে না পারা অব্দি সে শান্তি পায় না ।
    “আজ ভোটের মিটিঙে মিনতির ছেলের বাপ এসেছে।”
    “কী রকম বাপ সে?” বুড়ি চটে গেল। “ মিনতি ওকে ঘরে তুলেছে ?”
    মালতীর স্বর চাপা হয়ে এলো, “ সে বড় লিডার।”
    “আন্দোলন পার্টির লিডার?” বুড়ির স্বরও খাটো হয়ে এলো। আবারও মুড়ি আর কাঁথা । অনেকক্ষণ ওরা দুজন চুপ করে বসে রইল।
    “মণিকে কেন এতো দেরি বাইরে থাকতে দিচ্ছিস?” বুড়ির কথাটা শেষ না হতেই মণি এসে পৌঁছুলো।
    “ যা পড়গে' খিদে পেলে মুড়ি খেয়ে নিবি।”
    “ খাব না মুড়ি আজ, বুট দিয়েছে, কলা দিয়েছে, নারকেল দিয়েছে।” সে পকেটের থেকে পোটলা একটা বের করল। লাফিয়ে লাফিয়ে সে বুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
    বিছানাতে পড়ে সে মিনতি আর সেই বড় লিডারটার কথাই ভাবতে থাকল। আজ অনেক দিন পর সে বিছানাতে পড়ে কাঠের মতো জেগে রইল না । চোখের পাতায় পাতায় লাগে, সে চিলমিল তন্দ্রাতে আচ্ছন্ন হয়, আবার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
    চোখের পাতা লাগল কি লাগল না চোখের সামনে নাচতে থাকে জালের ভেতরে ফর্সা, লম্বা, কপালের সামনে পড়ে থাকা এক চিলতে চুল। ছেলেটাকে বল্লম, বর্শা হাতে একদল মানুষ ঘিরে ধরেছে, মিনতি গোলাপি কাপড় একটা পরে সেদিকে দৌড় দিয়েছে, চুল থেকে ঝিরঝির করে সাদা বেলি ১ ফুল একগুচ্ছ ঝরে পড়েছে । ফুলগুলো ওকে পুঁতে ফেলেছে । মিনতিকে ডাকতে চেয়েও সে পারেনি । গলাটিকে চেপে ধরেছে একগুচ্ছ সাদা ফুল । সাদা ফুলে সে হোঁচট খেয়ে পড়েছে । তাকে ধরে ফেলেছে সেগুন পাতার মতো ছড়ানো এক হাত। হাতখানা ওর শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । মেয়ে একটি এক অদ্ভুত সুখ আর আনন্দে উছলে উঠেছে । কোন মেয়ে ? সে নিজে না মিনতি? সে ঘোপ করে জেগে উঠে গেল। তার শরীরের অদ্ভুত সুখের কাঁপন এখনো আছে । চোখ মেলে সে টের পেল সেই কাঁপনটি ওকে বারে বারে নাড়িয়ে যাচ্ছে । ওর থেকে ওর শরীর সরে গিয়ে যেন বারে বারে কাঁপছে । ভয় পেয়ে গেল, নিজের শরীরটাকে সেই ভয় পেয়ে গেল।
    “মণি, মণি , মণি!” উঠবে না, মণি উঠবে না। সে মণির বাহুতে ধরে ঝাঁকার দিল। এবারে সে উঠল। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে উঠা ওর চোখজোড়া লাল।
    “ জল একগ্লাস দে তো।” মণি জল একগ্লাস কলসটির থেকে ঢেলে মাকে দিল। মা তার চুলে হাত বুলিয়ে দিল।
    “শুয়ে থাক বাবা।” সে তৎক্ষণাৎ ঘুমে ঢলে পড়ল।
    “ বাবা, তুই কখনো বাবাকে স্বপনে দেখিস?” নেই , কোনও উত্তর নেই। সে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ।
    “আমি দেখি, বুঝলি? কখনো বা দেখি।” কথাগুলো সে নিজেকে বলবার মতো করে বলল।
    “এইমাত্র দেখেছিলাম, বুঝলি মণি? আমি কি করতে চাইছিলাম...।” তারও কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে এলো । ক্লান্ত দেহটাকে চেপে ধরল ঘুম, গভীর ঘুম।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৬495488
  • অধ্যায় সতেরো (১৭)

    ঠিক যে সময়টিতে মালতী নিজের শরীরকে নিয়ে ভয়ে মণিকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে জাগাচ্ছিল ওদিকে তখন ঠিক সেই সময়টিতেই মিনতির চাটাই দিয়ে বাঁধা দরজাতে টোকা পড়েছিল। মিনতি দরজাটা খোলেনই। কেই বা এসময় এসেছে! বেশ কয়েকজনেরে টোকা পড়েছিল। উঠে বসেছিল সে।
    “কে বাইরে?”
    “আমি।”
    “ কে?” এবারে সে ভয় পেয়ে গেছিল।
    “ আমি হরি ভাঙুয়ার ছেলে।”
    “এতো রাতে তোর কী চাই?”
    “স্যার খবর পাঠিয়েছেন, দরজা খোল বলছি না।”
    “কোন স্যার?” সে কি ঠিক ভাবছে? দরজা খুলবার জন্যে উঠতে গিয়ে মিনতির শরীর কেঁপে উঠল। তার মানে সে মিনতিকে দেখেছে। মিনতির ভুল হয়নি তবে। একবার সে খানিকক্ষণ মিনতির দিকে তাকিয়েছিল। চোখে চোখ পড়েছিল। সে দরজাটা খুলে দিল। ছেলেটি ওকে বলল,
    “চল, আমার সঙ্গে চল। স্যার ডাকছেন।”
    “কই যাব?”
    “ডাক বাংলোতে।”
    “কী করে?”
    “আমি গাড়ি এনেছি, স্যার পাঠিয়েছেন।”
    “ওকে জাগিয়ে দিই , দাঁড়া।”
    “ছেলেকে নিতে হবে না।”
    “কেন?”
    ছোট্ট করে চোখ মুদে সে এক নোংরা হাসি দিল, “লাগবে না।”
    “ওকে তবে জোনের মার ওখানে রেখে যাই।”
    “খবরদার তুই কোথাও যেতে পারবিনে, ছেলেকে আমার মায়ের কাছে রেখে যাবি।” কিছু একটা ভেবে খানিক থামল সে, “দাঁড়া, মা-ই আসবে এখানে।”
    সে দিনের বেলা পরা কাপড়টাই আবার পরেছিল। লম্বা চুলে খোঁপা বাঁধেনি শুধু, একবেণী বেঁধে সামনের দিকে ফেলে রেখেছিল। ডাক বাংলোর একটা ঘরে ছেলেটি একটি বিছানাতে বসে ছিল।
    “বস মিনতি।”
    মিনতি বসবার জন্যে মোড়া বা টুল কিছু একটার খোঁজে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছিল। সবসময়েই সে উপরে বসত মিনতি নিচে। স্যার-দিদিদের বাড়িতেও সে এভাবে ওঠ বস করবার শিক্ষাই পেয়েছিল সবার থেকে।
    “বস, এখানেই বস”, সে বিছানাটা দেখিয়ে দিল।
    “ভালো আছিস?”
    “হ্যাঁ।”
    “তুই ওভাবে আমাকে কিছু না বলে চলে এলি কেন?”
    মিনতি কিচ্ছু বলল না।
    “ছেলেটা কবে হলো?”
    “আসার তিন মাস পর।”
    “চলছিস কী করে?”
    “মুড়ি ভাজি আর...”, ওর স্বর কাঁপছিল, “মোড়া বানাই।”
    “থাকিস কই?”
    “ভাড়া নিয়েছি।”
    সে বালিশের নিচে থেকে একটা টাকার তোড়া মিনতির দিকে ছুঁড়ে দিল, “এটা রাখ।” বোতলের থেকে মদ ঢালতে শুরু করল তারপর।
    “আপনি এগুলো কবে থেকে খেতে শুরু করেছেন?” সে শক্ত সমর্থ, লাল চোখের কঠিন মুখের মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। সেই কোমল মুখের ছেলেটি, বাড়িতে যখন কেউ থাকত না তখন এসে ‘আমার সোনামণি’ বলে মিনতিকে জড়িয়ে চুমো খেতে যে ছেলেটি, হঠাৎ একদিন বিহ্বল হয়ে ভুল করে ফেলা ছেলেটি, ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল যে ছেলেটি... সেই ছেলেটি আর এই মানুষটি।
    “ কী! এতো দূরে দূরে বসে আছিস? এদিকে আয়, কতদিন পর দেখা পেলাম!” লোকটার কথাগুলো জড়িয়ে এসেছে, ঠোঁটগুলো শুকিয়ে গেছে, মিনতিকে ধরেছে যে হাতে সেটি বেশ গরম। মিনতি হাত গুটিয়ে নিলো।
    “ছেলেটিকে ঘরে একা রেখে এসেছি?”
    “ওর নামে জমা রাখবার জন্যে কিছু টাকা দেব।”
    সে আবারো আধা গ্লাস মদ খেল।
    “ওগুলো এভাবে খাচ্ছ কেন?”
    “আমার অনেক দুঃখ, অনেক চিন্তা মিনতি!”
    সে মিনতিকে কাছে টেনে নিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল।
    বাইরের জ্বলন্ত টিউবের আলো ভেতরে চলে এসেছে। আলোতে মানুষটার মুখখানা ও দেখতে পাচ্ছিল। সামান্য মাত্র আবেগ নেই। যে মানুষটি গায়ে হাত দিলেই মিনতি কেঁপে উঠত এই অভিজ্ঞ মানুষটির মধ্যে সেই ছেলেটিকে খোঁজে বেড়ালো। মিনতি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে নিজেকে সুরক্ষিত করে ফেলল। এই রাতে এগুলো কোথায় পেলে? সঙ্গে রাখো? মিনতি ভয় পেয়ে গেল। রোদে বর্ষাতে পিটে গড়া মিনতির সুঠাম শরীর থেকে চরম তৃপ্তিটুকু হাসিল করবার আগের মুহূর্তটিতে মানুষটি ঠিকই ধরতে পারল ওর পায়ের তলায় কুকুরের মতো নেতিয়ে পড়া মেয়েমানুষটি সন্দেহ আর অবিশ্বাসে নিথর হয়ে পড়েছে। “আর তোকে বিপদে ফেলব না, মিনতি।” কথাটিতে যেন যাদু ছিল। মুহূর্তে সে আবার ফিরে পেল কুকুরের মতো নেতানো মেয়ে মানুষটিকে। দামি মদের নেশা থেকেও বেশি উত্তেজনায় সে মাতাল হয়ে উঠল। সে ভাবতেই পারেনি, এই বাজে রাস্তাঘাট, ভাঙ্গা সাঁকোর ছোট শহরে এই নেশা মেটাতে পারবে বলে। আশা না করেই হাতে আসা মিঠাইর মত যে মিনতিকে পরম তৃপ্তিতে গিলতে শুরু করল।
    বাকি নেতারা চলে যাবার পরেও লোকটা আরো দিন পাঁচেক এই ছোট শহরে রইল। পুরো পাঁচ দিন পর মিনতিকে আজ বস্তির মানুষ দেখতে পেল। সে বাজারে যাবার জন্যে বেরিয়েছে। শুধু জোনের মা আর গোপাল জানে সেই পাঁচ রাতে ও ছিল কোথায়, করেছিল কী।
    মণির মায়ের হাতে মোড়া, মাথায় মুড়ি।জোনের মায়ের হাতেও মোড়া আর মুড়ি। মিনতির খালি হাত। মণির মা একটু অবাক হলো। কিছু না থাকলে মিনতি ঠোঙার বোঝা হলেও একটা আনে।
    “আজ তুই খালি হাতে যে?”
    “ আজ ওই এক আধটু কিছু কেনা কাটা করব।”
    “কী কিনবি?”
    “ একটা খাট, বিছানার কাপড় আর...।”
    “এতো জিনিস!”
    জোনের মা আর মণির মায়ের বিস্ময়বিমূঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে সে অল্প হাসল, “ সে অল্প টাকা দিয়ে গেছে।”
    “ কী বলল সে তোকে?”
    “ছেলেটার খবর নিয়েছে।”
    উতলে উঠা স্তন নিয়ে গাভি যেমন করে, মিনতি তাই করল। বাছুরে আস্তে করে খোঁচা একটা দিতেই দুধ বেরিয়ে এলো। ওর ভালোবাসা...ওর দুঃখ...মিনতির জন্যে ওর চিন্তা...ওকে নিজের বাড়ি ঘর করে দেবার প্রতিশ্রুতি... এমনকি মিনতিকে বিপদে না ফেলে দেয় তার জন্যে তার যত প্রয়াস। দুধে যেন সে একেবারে গলে গেল।
    মিনতির কথাতেই ওরা দু’জনে দুটো কম পয়সাতে মোড়া আর মুড়িগুলো ব্যাপারীকে দিয়ে দিল। সত্যি সত্যি মিনতির হাতে একশ টাকার নোট। একটা নয়, বেশ ক’টি।
    আজ ওরা দুটো রিক্সা নিলো। একটিতে খাট নিয়ে মিনতি আরটিতে ডেকচি, কড়াই, একটা কেরোসিনের স্টোভ, আরো নানা জিনিস নিয়ে ওরা বাকি দু’জন। মিনতি আজ দু’জনকেই একটা করে ব্লাউজও দিয়েছে। ঘরে ফিরতে ওদের বিকেল হয়ে গেল। মিনতির চালাতে ছোটখাটো একখানা উৎসবই হয়ে গেল। জগুর বৌ, রত্নার মা, কালী বুড়ি, জোনের মা, মালতী ধরাধরি করে মিনতির জিনিসগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে দিল। ছোট্ট ঘরটা ভরে গেল। এমনকি ড্রাইভারণী এসেও একবার দেখে গেল। ও একটা টিভি এনেছে। সবাইকে ফিল্ম দেখবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেল। মিনতির আনা বিস্কিটে সবাই নতুন কাপে করে চা খেয়ে গেল।
    মিনতির সুখী মুখখানা মনে করে করেই মালতী মুড়ি ভাজছিল। যাই হোক, মেয়েটি খানিক সুখ পেয়েছে। এতো করেছে! কী জানি যদি, মানুষটা ওকে আর ছেলেটাকে নিয়েই যায়! মালতীর চোখের সামনে ভেসে উঠল দিন দুপুরে বন্ধ চাটাইর বেড়া। এ যেন আর না হয়। ছেলেটার অসুখের জন্যে মেয়েটিকে কীই না করতে হয়েছিল! হোক, ওর জীবন সুখের হোক!
    “মণির মা! মণির মা! এদিকে আয় না!”
    মিনতির আকুল ডাক ভেসে আসা শুনে সে ঝাঁপ দিয়ে উঠল। মিনতি ঢুকেই গেছে ঘরে। ছেলেটার কপাল থেকে রক্ত ঝরছে। মিনতি কালীবুড়ির কাছে এসেছে। কালী বুড়ি ছোটখাটো কাটাছেঁড়ার ওষুধ দেয়। যেখানকার মুড়ি সেখানে রেখে মালতী ছেলেটার কপাল জলে ধুয়ে দিল। ইতিমধ্যে কালীবুড়ি কালীমন্দিরের কাছের ঝোপঝাড় থেকে জংলি ওষুধের গাছগাছালি থেকে একটার পাতা ছিঁড়ে ছেলেটার কপালে রসটুকু লাগিয়ে দিল। রক্ত থেকে গেল। মিনতি স্বস্তির শ্বাস ফেলল। ওর চেঁচামেচিতে বস্তির বেশিরভাগ লোক জড়ো হয়ে গেছে। জগুর বৌ মিনতির ছেলেটিকে কোলে নিতে চাইছিল। “ ছেলে ফেলে কই ট ট করে বেড়াস? ছেলে মা হলে...।” পাঁচটা ছেলেমেয়েকে বড় করবার অভিজ্ঞতা নিয়ে জগুর বৌ এক ছেলের মা মিনতিকে কিছু একটা উপদেশ দিতে চাইছিল। মিনতি বাঘিনির মতো গর্জে উঠল। রুগ্ন মানুষটিকে যেন ঠেলে ফেলে দেবে।
    “তোর পোলার বাপকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর, কী করেছে সে আমার ছেলেকে!”
    “কী করেছে তোর হারামজাদাকে?” জগুর বৌ এক্কেবারে কাজিয়াতে লেগে গেল। হালকা পাতলা মানুষটি একেবারে নলখাগের মতো কাঁপতে শুরু করল।
    মিনতির শরীরে যেন কেউ ঝাল লংকা মেখে দিয়েছে। দৈবে ভর করা কালী বুড়ির মতো সে ভয়ঙ্কর হয়ে পড়ল, “কাকে বলছিস হারামজাদা? মুখ সামলে কথা বলবি। তোর জামাই মেয়েমানুষের পা চাটবার জন্যে সারা দুনিয়া চষে বেরায়, সে আসবে কেন আমার বাড়ি? আমার হাতে ধরবে কেন? শুনে রাখ তোর পা চাটাটাকে তাড়াতে গিয়েই আমার ছেলে পড়ে গেল। নিজে না পারিস তবে, কেউ একজনকে ধরে ওই কুকুরটাকে দিয়ে দিবি।”
    লাউমাচা বেয়ে উঠে সবুজ সাপ লাঠির ঘায়ে আধমরা হয়ে পড়ে থাকলে যেমন লিকলিকে লাউডগাতে মিশে একাকার দেখায় জগুর বৌ তেমনি মিইয়ে গেল। শুধু বাতাসে লাউ পাতা কাঁপে যেমন তেমনি মাথা তুলে কাঁপছিল। । গৃহস্থ বাড়ির কেউ যখন মাচার থেকে লাউ পাড়তে যায় তার হাতের লাঠির থেকে গা বাঁচাতে গিয়ে এই লাউ থেকে ওই লাউর ডগাতে ঝাঁপিয়ে উড়ছিল সেই সাপ। এক ঘায়ে ছিঁড়ে ফেলা লাউডগার মতো সাপটাও নিথর হয়ে গেল। সবুজ নরম থ্যাতলানো লাউডগা পড়ে রইল।
    জগুর বৌ মাথা নুয়ে ভিড়ের মধ্যি থেকে চলে গেল। মালতী জগুর বৌয়ের মুখখানা দেখতে চাইছিল। দেখা যায় না। হালকা আঁধারে লুকিয়ে পড়েছে। ভেতরে যেতে গিয়ে সে যেন একবার দেখতে পেল রোগা বৌটি ছেঁড়া কাপড়ের আঁচলে বারে বারে চোখ মুছছিল। কালীবুড়ির বাড়ির থেকে মিনতি বেরিয়ে যেতে চাইছিল। মালতীর চোখে জল এসে গেল। মিনতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার মুখে সে ভেজা গলাতে গিয়েওর হাতে ধরল। মালতীর সত্যি রাগ চড়েছে।
    “মিনতি শুন!”
    “ কী হলো মণির মা?”
    “কেন বললি , ওভাবে ওকে?”
    “কেন বলব না? আমার ছেলেকে ও হারামজাদা বলবে কেন? ওর খায় না পরে? এই দেখ, আমার ছেলে ওর বাবার দেয়া জামা পরে রয়েছে।”
    “দেমাক দেখাচ্ছিস? সে এসে দু’রাত তোকে মাংস খেয়ে হাড় ফেলে দেবার মতো ফেলে দিয়ে গেছে, দুটো টাকা দিয়ে গেছে আর তুই ঐ অসুখী মেয়েমানুষটির কাছে বরের দেমাক দেখাবার যুগ্যি হয়ে গেলি!” ছেলের কাপড় দেখাতে এসেছিস? ওর অসুখের ওষুধ কিনবার জন্যে যখন ঘরে পুরুষ তুলেছিলি তখন কই ছিল তোর স্বামী?” ওর গলার স্বর জোনের মায়ের মতো বড় হয়ে গেছিল আর দূর অব্দি শোনা যাচ্ছিল।
    মিনতির মুখখানাও ঘা খেয়ে থ্যাতলানো সবুজ লাউডগার সাপের মতো নেতিয়ে পড়ল। সে মাথা নুইয়ে দিল।
    “তুইও মেয়ে মানুষ, তোরও ওর মতো অসুখ হতে পারে। ওর বর তো ওকে দুমুঠো ভাত দিচ্ছে। ওর অসুখে পেলে তোকে পোকায় কেটে খাবে।”
    “ জগু কই বৌকে ভাত দিচ্ছে? বৌ ঐ হারামজাদাকে ভাত দিচ্ছে। তুই দেখবি জগুর বৌকে ঐ পচা পোকে খাবে। সে আরেকটা বৌ নিয়ে আসবে। পুরুষমানুষে আর কী করতে পারে, মাংস খেয়ে হাড় ফেলে দিতে পারে!” মিনতি থু ছিটিয়ে ফেলল।
    “আর তুই মেয়ে হয়ে কী করলি?”
    মিনতি জায়গাতে বসে পড়ল।“ জগুতো দেখাই যায় ওর বৌকে ঘেন্না করে, ও আমাকে বলেছে ওর অসুখের কথা। কিন্তু বৌ ভালো হলে সেও আর অন্য জায়গাতে যায় না।”
    “ সে ওদের স্বামী স্ত্রীর কথা । কিন্তু তুই আমাকে বল, তুই কেন ওর বৌকেই বললি একটা মেয়েমানুষ নিয়ে আসতে?”
    মিনতি এবারে ফিসফিসিয়ে কাঁদতে শুরু করল, “ আমি জানি ও আমার বিপদের কথা ভাবেনি, সে আমাকে ঘেন্না করে। আমি জানিরে মণির মা!”
    মালতীর রাগটাও ঘায়ে আহত সাপের মতো নেতিয়ে এলো। এই মানুষটির উপর রাগ করেই কী করে? নাকে মুখে জল ঝরছে যে মেয়েটির ওর উপর কি আর রাগ করা যায়?”
    “তোর মাথা গরম হয়েছে, যা ভাত খেয়ে শুয়ে পড়গে' যা।” মালতী মুড়ির চুলোতে এলো। কড়াইর মুড়িগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।” সে বালিগুলো বদলে দিল। ভেতর থেকেই দেখতে পেল মিনতি চলে গেছে।
    মিনতি মালতীর ওখান থেকে জগুর বাড়িতে গেল। ঢুকবে কি ঢুকবে না করতে করতে দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেটা সেই কখন খিদেয় উপোসে আর ভয়ে মিইয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে কাঁধ বদল করে নিয়ে মিনতি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে জগু পাটাতে নারকেল বাটছিল, বৌ কড়াইতে চিনি গলাচ্ছিল। পাঁচ ছেলে মেয়েতে বসে বসে মায়ের তৈরি করে দেয়া নারকেলের মণ্ডগুলো থালাতে নিয়ে চেপে চেপে বরফির আকারে কেটে একটা ডালাতে মেলে সাজিয়ে রাখছিল। দেখাই যাচ্ছিল, জগু নারকেলগুলো পাটাতে বেটে মিহি করতে পারছে না। সে যতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে ততক্ষণে এক থালা সন্দেশ হয়ে যাবার কথা ছিল, হয়নি। জগুর বৌ এবারে নারকেল কুরোনো বাদ দিয়ে বাটাতে হাত লাগালো। পাটাতে বসবার আগে ও কী একটা যেন কাপড়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ঠেলে দিল।
    মিনতি একটা হাঁচি দিল। কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে কাজ করতে করতে এ বাড়ির মানুষগুলোর সবাই হঠাৎ ওর দিকে ফিরে তাকালো। সে নীরব রইল।
    জগুই প্রথম ডাক দিল, “আয় মিনতি, বস।” সে একটা মোড়া এগিয়ে দিল।
    মিনতি যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। জগুর বৌ বলে উঠল, “মিনতি আয়, ছেলেটা এখন একটু ভালো?”
    “কী হলো ? আবার গালি দিবি বুঝি?” কথাগুলো বলেই রোগা মেয়েমানুষটি ওর কালো দাঁতের মাড়ি দেখিয়ে হাসল। ধীর ধীরে জগুর এগিয়ে দেয়া মোড়াতে গিয়ে বসল মিনতি। জগু তার কাছ চেপে বসেছে, “তুই আমার বোনের মতো, খারাপ পাবি না। আসলে আমি অল্প নেশা করে ফেলেছিলাম। আজকাল এমনিতেও মাথার ঠিক থাকে না। আমি তোকে জিজ্ঞেস করতে গেছিলাম কোনও সরকারি টাকা পয়সা পেলি কিনা তুই।”
    “সবাই বলে তোর বড় বড় মানুষের সঙ্গে ওঠা বসা। তোর ছেলের বাবা...।” কথাগুলো বলে জগুর বৌ ভয়ে ভয়ে থেমে গেল।
    মিনতি চুপ করে রইল।
    “বৌটাকে ভালো করবার জন্যে টাকা পয়সার কথা বলতে আমি তোর কাছে গেছিলাম, তোর হাতে ধরে আমি তোকে তাই বলতে চাইছিলাম। কিন্তু তুই ক্ষেপে গেলি।”
    “আমাকেও কত কথা বললি , এতো মানুষজন ছিল।”
    “আমারও মাথার ঠিক নেই। ছেলেটাকে নিয়ে একা...” মিনতি কথাগুলো শেষ করতে পারেনি।
    “কেন ওর বাবা...।” মিনতির ছেলেটাকে কোলে নিয়ে জগুর বৌ কী একটা বলতে গিয়ে আবারো চুপ করে রইল।
    মিনতি কিচ্ছু বলল না। সবাই চুপ করে রইল। সন্দেশ বানানো শেষ করে ছেলেমেয়েগুলো বড়সড় বাঁশের চাঙে আথালে-পাথালি শুয়ে পড়ল। মিনতির ছেলেটি জগুর বৌর কোলে জেগে গিয়ে কেঁদে উঠল।
    “ও কি ভাত খেয়েছে?”
    মিনতি চুপ করে রইল।
    “পোলা রেখে ট ট করে বেড়াস বললে রেগে যাবি। এতো রাত অব্দি ওকে ভাত দিস নি! দেখ তো ছেলেটা কেমন দুর্বল হয়ে গেছে!”
    “খেয়ে যা এখানেই দুমুঠো”, জগু বলল। সে সন্দেশগুলো সাবধানে বাজারে নিয়ে যাবার বাক্সে ভরাচ্ছিল। কাজটা বেশ ভালো করেই করছে! একটাও সন্দেশ ভাঙেনি।
    জগুর বৌ মিনতির ছেলেটার সঙ্গে নিজেরগুলোকেও ভাত খাইয়ে দিল। ভাত আর শসা- আলুভাজা। ডেকচিতে ভাত কম হয়েছিল। মিনতি চাল বেছে দিল। জগুর বৌ ভাতগুলো বসিয়ে দিল। রেশনের চাল, গুড়ো পাথর, পোকা, ধান ---সব আছে। তবুও চালগুলো খারাপ নয়, পরিষ্কার করতে সামান্য কষ্ট করতে হয় শুধু। জগুর বৌ ঘরের পেছনে গিয়ে কী একটা পাতা ছিঁড়ে আনল গিয়ে। গন্ধটা ও চিনতে পারল। ভাদালি লতার পাতা। পাতাগুলো কালোজিরা, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পাটাতে বেটে কড়াইতে সামান্য তেল দিয়ে খানিক নেড়ে টেরে দিল। ভাত বেড়ে থালার কিনারে সেগুলো দিয়ে জগুর বৌ মিনতিকে খেতে দিল।
    “খা মিনতি, কী আর খাবি। চায়ের দোকান দিয়ে কোনোমতে রেশনের চাল ক’টা কিনে আনি। বাকি আর কিছুর জন্যেই পয়সা থাকে না। কখনো বা থাকলেও অসুখ বিসুখে সব নিয়ে যায়। ধারে টিকে আছি , বুঝলি।” জগুর গলা শুনে বুড়ো মানুষের মতো লাগছিল।
    মিনতি ওই ভাদালি পাতার বাটা দিয়েই তৃপ্তিতে ভাতগুলো খেতে শুরু করল।
    “ডাক্তারের কাছে গেছিলি কি না?” মিনতি রোগে ক্লান্ত মানুষটির চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারেনি।
    “কী হবে আর গিয়ে? সেই একই কথা—ভারি কাজ করবে না, পাটার কাজ করবে না, কল মারবে না। যন্ত্র দিয়ে ঠেলে দেবে , দু’দিন পরেই বেরিয়ে আসবে। বলে কিনা অপারেশন করতে হবে।”বলে বলে সে বেশ মন দিয়ে আঙুলে থালাখানা চেঁছে পরিষ্কার করে খেয়ে নিলো।
    জগুও ঐ একইরকম থাল পরিষ্কার করতে শুরু করেছে,” পাঁচটা বড়ি একবারে কিনতে পারি নাম আবার হাজার হাজার টাকা খরচ করে অপারেশন!”
    মিনতিও আন্মনে কখন আঙুলে থালা চাঁচতে শুরু করল নিজেই বলতে পারে না।
    এই মুহূর্তে দেখলে মনে হবে যেন এই মহিলা দুজন আর মানুষটির জীবনে একটাই কাজ বাকি আছে, আঙুলে ভাতের থালা চাঁছা, আঙুলগুলো মুখে নিয়ে যাওয়া, আবার থালা চাঁছা, আবার আঙুল মুখে, আবার থালা...।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৬495489
  • অধ্যায় আঠারো (১৮)
    রত্না আজকাল ড্রাইভারণীর বাড়িতে রোজ বিকেলে যাতায়াত করে। ওর আকর্ষণ হলো লাল রঙের ছোট টিভিটা। বিকেল হলেই ওর মনটা আনচান করতে শুরু করে! গুচ্ছ গুচ্ছ ছবিতে ওকে চেপে ধরে একেবারে! চারকোনা কাঁচে যে ঝাঁকে ঝাঁকে যে মানুষগুলো বেরোয় ওরা তাকে হাত দিয়ে ডাকে। সে উতলা হয় । আজও বেরিয়ে এলো। দিদির মালিকনীর মেয়ের শোকার্ত আর টপ একটা বের করে পরে নিলো। আজ সে চুলগুলো অন্যরকম করে বেঁধেছে। আজ শুক্রবার, রাত আটটায় সেই সিরিয়েলটা দেবে। একটা ছেলে ফরসা, লম্বা, চুলগুলো অল্প বাদামি। আর চোখগুলো বাদামি রঙের চোখগুলো, কী করে যেন তাকায় সেই চোখে, কিচ্ছুটি বলতে হয় না। বাদামি রঙের চোখের ছেলেটি একটা বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা ফুল। আর সেই মেয়েটি? শরীরে লেপ্টে ধরা লাল টপ, একটা নীল স্কার্ট । শরীরে চামড়ার সঙ্গে মিশে যাওয়া টপটা যেন এখনি ফেটে যাবে। সেখানে ঢুকিয়ে রাখা যেন দুটো পাকা গোল গোল বেল। ও হাঁটলে মনে হয় যেন ফল দুটো এখন বেরিয়ে এসে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে। গোলাপ ফুল নিয়ে দাঁড়ানো ছেলেটার কাছ দিয়ে মেয়েটি পেরিয়ে গেছে। বেড়ার আড়াল থেকেই ছেলেটি খপ করে মেয়েটির হাত ধরল। সে আছাড় খেয়ে গিয়ে পড়ল ছেলেটির গায়ে। গোলাপ ফুলও ছিটকে পড়ল। ছেলেটির মুখ এগিয়ে যাচ্ছে কম্পমান দুটো পাকা বেলের দিকে। ব্যস, সেখানেই ফুরিয়ে গিয়ে চেনা গানটা শুরু হলো। আজ কী করবে ছেলেটি? মেয়েটিকে ছুঁয়ে দেখবে কি ছেলেটি? কী সুন্দরী মেয়েটি! ফরসা, ঠিক যেন পূর্ণিমার চাঁদ। বাদামি চোখের ছেলেটি আর পূর্ণিমার চাঁদের মতো মেয়েটি। রত্না পাউডারের কৌটোটি হাতে নিয়ে নাড়িয়ে দেখল, কিচ্ছু নেই। খালি হাতই মুখে বুলালো।
    “সব মেয়েদেরই এতো কিছু আছে, আমারই কিচ্ছু নেই।” মা রত্নাকে কিছু একটা বলতে চাইছিল। ওর বাঁকা ঠোঁট দেখে কিছুই বলতে পারল না। বাবা ওর বেরিয়ে যাওয়া দেখে কপাল চাপড়ে উঠল, “ আমার একটা ছেলে থাকত আজ, বাড়িতে বসে মেয়ে টিভি দেখত।” রত্নার মাও মেয়ের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল। বাবা বকেই যাচ্ছে, “আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে জোয়ান হয়ে রোজগার করে আনত। কতদিন সামান্য মাছের গন্ধ পাইনি। আমার কপালেই এমন অলক্ষ্মী বেটি, পেটে ছেলে ধরেও মেরে ফেলে।”
    রত্নার মা মাথা নুয়ে একমনে মোড়া বুনবার চেষ্টা করছে। ওর ভেতরে মোড়া বোনার জন্যে চেঁছে রাখা শলাগুলো যেন কথা কিছু কিছু বের করে আনবার জন্যে খোঁচাখুঁচি করে যাচ্ছে। বারে বারে আঘাতে, যন্ত্রণাতে মানুষটি মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ছে, রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। কথাগুলো রক্তে ডুবিয়ে তুলে ছুঁড়ে দিতে যাচ্ছিল, “কেন, তোর মেয়ে তোকে রোজগার করে খাওয়ায় না? নিজের হাত দুটো নেই? কাজ করিসনে কেন? ফুটানিটা কিসের! তোর মতো পানের বরজে কাজের লোক এই বস্তিতে আর একটাও নেই। মেয়ের পয়সাতে বিড়ি খায় আবার অলক্ষ্মী বেটির কথা বলে!” কিন্তু শব্দগুলো বেরোয়নি? বেরুচ্ছে...। অসুখে দুর্বল শরীরে এমন খাড়া কোপ আর সহ্য হয় না। শব্দগুলো সে খুঁজছিল, “ এতো কোপ মারতে পারে যে মানুষটা তার গায়ে কাজ করবার দম নেই? হারামজাদা, মেয়েমানুষের ঘাড়ে বসে খাবি আর সেই মেয়েমানুষকেই পিটবি, শালা কুত্তা!” সে পিক করে থু একদলা ফেলে দিল।
    ড্রাইভারণীর বাড়িতে টিভি দেখতে যাবার পথে মেয়েকে একবার মাথা তুলে দেখল মা। দিদির দেয়া কাপড়টা কেটেকুটে সে একেবারে কী একটা যেন করে ফেলেছে। গলাটা কেটে ফেলেছে। ঢিলে কাপড়টা গলা কেটে ফেলাতে কেমন যেন দেখাচ্ছে। কিছু একটা তুলতে গিয়ে সে যখন উবুড় হয় পুরো বুকটা বেরিয়ে পড়ে। কী খেয়ে ওর এই শরীর হয়েছে! মা শিউরে উঠল। ঘরের কাজের নামে কুটা একটা তুলে যে দু' টুকরো করতে চায় না সেই মেয়ে ফেল করে স্কুল ছাড়বার পর থেকে কেবলি নিজের ঐ শরীরটার পেছনেই লেগে থাকে। ড্রাইভারণীর বাড়িতে টিভি দেখতে যাওয়া শুরু করার থেকেই ওর এই এক ঢং হয়েছে । মায়ের একটা কথাও যদি সে শুনত। আজ সে ভাত খাবেই না, ড্রাইভারণী খাওয়াবে। ড্রাইভারণীর গাড়ি চালাবার পয়সা আছে। লোকে বলে সেই পয়সাতেই ড্রাইভারের মদের পয়সাও বেরোয় না। আসল টাকা হলো ড্রাইভারণীর। এই বস্তিতে শুধু ড্রাইভারণীর ঘরেই রঙিন টিভি আছে। মেয়ে পুরোনো কাপড় কেটে, টান করে পরে রোজ সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় সেই মহিলার বাড়িতে যায়, রাত নটায় ঘুরে আসে। মা হাতের শলা , প্লাস্টিকের রশি হাতে নিয়ে বসে রইল। এমন সময়ে গুয়াহাটির বড় মেয়েটিকে মনে পড়ে। ও থাকলে বোনকে কিছু একটা বলতে পারত। ড্রাইভারণীর বাড়ি যাবার কথা উঠলেই মেয়েটা চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, “ দে একটা টিভি কিনে , যাব না। টিভি না দেখলে হয় বুঝি!” কী করে জিজ্ঞেস করে মা এসব কথা, কী করেই বা? উত্তর কী আসবে জানা আছে, “ অলক্ষ্মী বেটি! ছেলে জন্ম দিয়ে মেরে ফেলবে। থাকত আমার দাদা , গাড়ি চালিয়ে হলেও একটা টিভি ঘরে নিয়ে আসত।” চেঁছে রাখা শলাগুলোতে হাত রেখে মানুষটি মাথা নুয়ে বসে রইল। জলে খেয়ে শেষ করা হাত দুটো যদি পিঠে এসে হাত বুলিয়ে দিত, ভয়ে ক্ষীণ, চাপা স্বরে একবার যদি ডেকে বলত, “ মা , তোর গা খারাপ?”
    বিড়ির গন্ধ একটা নাকে এসে লাগাতে মেয়েমানুষটি খপ করে উঠল। খরকরে শব্দগুলো যাতে কানে না পড়ে তার জন্যে ভেতরে উঠে গেল যদিও শব্দগুলো ওকে ভেতর অব্দি তাড়া করে গেল, “ কাকেই বা বলব এক কাপ চা করে দিতে? মেয়ের বাবা আমি, কেই বা চিনি চাপাতার যোগান দেবে?”
    রত্নার মা টাকা পাঁচটা হাতে নিয়ে চা-পাতা, চিনি আনতে যেতে ড্রাইভারণীর বাড়ির সামনে নিয়ে একটু ঘুরে গেল। ঢুকবে কি ওখানে? হাত ধরে টেনে আনবে কি মেয়েকে? গলা ফুলিয়ে ফুলিয়ে কি বলবে, “টি ভি দেখতে হবেনা, আয় আমার সঙ্গে মোড়া তৈরি করবি। জলে খাওয়া হাত দুটোতে তো সংসারটা টানছেই, তাতে আরো দুটো হাত যোগ হোক। আয় দেখি বাপকে দেখাই, পেটের মেয়ে চা-পাতা চিনির যোগাড় করতে করতে পারে কি পারেনা।” ...? ড্রাইভারণীর ঘর থেকে টিভির আওয়াজ বেরুচ্ছে। মা বাড়ি ঢুকবার মুখে দাঁড়াল। বুক ধড়ফড়িয়ে উঠল। আজকাল প্রায়ই অমন হয়। অল্প চিন্তা করলে, দুটো কাজ বেশি করলে, রাগে ভেতর জ্বলতে থাকলে বুক ধড়ফড়িয়ে উঠে, মাথা ঘুরতে শুরু করে। এরকম হলেই তার সেই জলে খাওয়া দুটো হাতের ছোঁয়ার জন্যে আনচান করতে থাকে। সে মেয়েকে বাপে আর বোনে নিংড়ে নিঃশেষ করে ফেলবে। কেউ জানেনা, রত্নার মা যে বিছানাতে শোয় সেটির ফাটা তোষকের ভেতরে ফাটা গামছাতে বাঁধা পোটলাতে এক জোড়া সোনার দুল আছে। সে দিনেরাতে স্বপ্ন দেখে সেই দুলজোড়া পরে শান্ত মেয়েটি একটা হাতের কাজ জানা ছেলের সঙ্গে ঘর করতে চলে গেছে। মেয়ের মাইনের টাকা থেকেই জমিয়ে জমিয়ে এই দুলজোড়া বানিয়ে রেখেছে। শুধু এই ইচ্ছেটা পূরণ হলেই ওর মা হাসি মুখে বুক ধড়ফড়িয়ে বুক ধড়ফড়িয়ে পড়ে মরে থাকবে।
    মা যখন বাড়ির ড্রাইভারণীর বাড়ির গেটের থেকে চলে আসছিল রত্না তখন ডুবে গিয়েছিল বাদামি চোখের ছেলেটি আর ঘোড়ার শাবকের মতো ছটফটে মেয়েটির মধ্যে। ছেলেমেয়ে দুটো এখন এক নদীর পাড়ে। নদীর পাড় এতো দারুণ থাকে বুঝি! নদী পাড়ের গাছগুলোর মাঝে মাঝে কিছু সাদা চামড়ার, সোনালি চুলের মানুষ। এখন ছেলেমেয়ে দুটিতে একটি রাস্তার উপর। ছটা গাড়ি একসঙ্গে যেতে পারে এমন মিহি রাস্তাটি সে শ্বাস বন্ধ করে দেখছে। পথের মাঝে মাঝেই ফুল। ফুলগুলোর মাঝে মাঝে ওরা দুজনায়। রত্নার বাহ্যিক জ্ঞান কমে এসেছে। ছেলেটা প্রেমাচ্ছন্ন বাদামি দুটি চোখে মেয়েটিকে দেখছে। একটা ঢালু ঝোপের ভেতরে ছেলেটি শুয়ে আছে। তার একহাত মেয়েটির কোমরে, আর হাত চুলে। মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটার হাত মেয়েটির পিঠে চরে বেড়াচ্ছে। হাতটা মেয়েটার শরীরে ঠিক কোন জায়গাতে আছে? রত্নার কান গরম হয়ে আসছে। হঠাৎই সবুজ বাগিচাটি ছড়িয়ে বড় হয়ে গেল। সবুজ বাগিচাতে ছেলেমেয়েদুটি যেন প্রজাপতি হয়ে গেল, মিষ্টি নরম সুরের একটি গান। আবারো ছেলেমেয়ে দুটি স্পষ্ট হয়ে এলো। শিশু যেমন মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে ছেলেটির মুখ তেমনি মেয়েটির বুকে লুকিয়ে যেতে চাইছে। খিলখিলিয়ে হেসে মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। রত্না অবাক হয়ে গেল। বাদামি চোখের ছেলেটির বাহুতে শুয়ে ঐ মেয়েটি কে? খালি পাউডারের কৌটোর থেকে পাউডারের সামান্য কিছু গুড়ো মুখে মেখে চলে আসা এই মেয়েটি কে? ওর বুক ঠেলে বারে বারে ঢুকে যাচ্ছে এক জোড়া বাদামি চোখ। সে চোখ বোজে হেলে পড়ল। পুরো শরীর থেকে থেকে কাঁপছে। এক অচেনা তীব্র অনুভূতি গায়ে নিয়ে রত্না চেয়ারে চোখ বোজে পড়ে রইল। চেনা গানের সুরটা বাজছিল।
    “কী রে রত্না , শুয়ে পড়লি বুঝি?”
    ড্রাইভারণীর ডাকে সে চোখ মেলে তাকালো। মহিলাটি এক জোড়া লাল, তাতে হলদে কাজ করা চুড়িদার কামিজ পরেছে। ঠোঁট গাল লাল, হাতে একটা লাল খাড়ু।
    “কোথাও যাবে বৌদি?”
    “কোথাও যাব না। আমার অতিথি আসবে এখন।”
    “দাদার সঙ্গে আসবে?”
    “তোর দাদা আজ এক বিয়ের ভাড়া নিয়ে গেছে।”
    “ অতিথি থাকবেন?”
    “কি জানি, থাকলে থাকবে।”
    একটা পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোক ভেতরে এলো। লোকটা একটা কাপড়ের প্যাকেট হাতে নিয়ে এসেছে। তার থেকে বের করে হলদে রঙের একটা শাড়ি ড্রাইভারণীর হাতে দিল।
    “এগুলো আর কেন নিয়ে আসো মামা?” লোকটা যে চেয়ারে বসেছে তারই হাতলে বসে ড্রাইভারণী ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। লাল চুন্নি পিছলে যাচ্ছে। লোকটা ড্রাইভারণীর কোমরটা একহাতে জড়িয়ে ধরল।
    “রত্না , তোর জন্যে আমি সাদা বাটিটাতে মাংস রেখেছি, নিয়ে যা।”
    “এহ! লাগবে না বৌদি!” ওর আরেকটা সিরিয়েল দেখে যাবার ইচ্ছে। ওটিতেও বাদামি চোখের ছেলেটি আছে।
    “ কেটে বেছে দিলি, মশলা করে দিলি। অল্প নিয়ে যাবিনে? এখানে ভাত খেয়ে যেতে বলতাম। কিন্তু এখন যে মামাকে ভাত দেব।” কথাগুলো বলে ড্রাইভারণী অমন করে হাসল যেন লোকটার গায়েই পড়ে যাবে ঢলে। লোকটাও এবারে প্রায় ওর শরীরে হেলে পরা ড্রাইভারণীর কোমরে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে।
    রত্না অবাক হয়ে মানুষ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল।
    “টিভিটা অফ করে রেখে যা রত্না।”
    সে অনিচ্ছেতে টিভিটা বন্ধ করে মাংসের বাটিটা নিয়ে রওয়ানা দিল।
    “রত্না!” সে ফিরে তাকালো। ড্রাইভারণী চুন্নিতে গা ঢাকবার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার হাত দুখানাও ঢেকে ফেলেছে। রত্না দেখতে পেল লা চুন্নির নিচে হাত দু’খানা নড়চড় করছে। ড্রাইভারণী ওর দিকে তালা-চাবি ছুঁড়ে দিল, “বাইরে থেকে তালা দিয়ে রেখে যাবি।”
    “চাবি?”
    “দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে রেখে যাবি।”
    চাবিটা দরজার নিচে দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে গিয়ে রত্না হেসে হেসে ড্রাইভারণীকে বলতে শুনল একটাই শব্দ, “বদমাইশ!”
    বাড়ি পৌঁছে দেখল মা বাবা বসে আছে। মা গলা শক্ত করে বলল, “কী করছিলি ওখানে?”
    সে টু শব্দটি করল না। দড়ি থেকে ছেঁড়া ফ্রক একখানা এনে পরনের কাটে কুটে অদ্ভুত করে ফেলা মাপের থেকে বড় কাপড়টি খুলে বড় যত্নে তুলে রাখল। এটা ছিঁড়লে ওর আর কাপড় নেই। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল মুখে ঘষবার ক্রিম। এক অপ্সরা মেয়ে সাগরের নিচে গিয়ে মুক্তো হয়ে পড়া শামুকের একটা খোলার ভেতরে ক্রিমটা পেয়েছিল। ক্রিমটা মাখার সঙ্গে সঙ্গে কালো কুচকুচে মেয়েও সেই অপ্সরা মেয়েটির মতো হয়ে গেছিল। কালোর থেকে ফরসা হয়ে পড়া মেয়েটিকে একটি ছেলে ফুল দিচ্ছে, বড় চাকরি করা ছেলে। রত্নার চোখে ঝিলমিলিয়ে উঠল একটা ছেলের মুগ্ধ একজোড়া বাদামি চোখ। চোখজোড়া ক্রিম মেখে অপ্সরা হয়ে পড়া সেই মেয়েটি, যে খালি পাউডারের কৌটা থেকে যা কিছু পেত তাই মাখত , ওর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। রত্নার ভাগ্য পালটে গেছে। বদলে গেছে ভাঙা ঘর, ছেঁড়া কাপড়। সে হয়ে গেছে নীল জলে ভেসে থাকা পূর্ণিমার চাঁদ। রত্নার সেরকম একটা ক্রিম কেনার ইচ্ছে হলো।
    সে রান্নাঘরে গেছে, পেছনে পেছনে ওর মা।
    “ভাত রাঁধা হয়নি, দিনের বেলার ঠাণ্ডা ভাত আছে। আলু একটাও যে ভাজব...।”
    “লাগবে না।” সে চালের টিনটা দেখছে, একবেলার মাপে চাল আছে। সে বিড়বিড়িয়ে উঠল, “ এই বাড়িতে দুবেলার মাপে চাল থাকবে বুঝি?” ঘটং করে টিনটা তুলে সে চালগুলো ধুচুনিতে নিয়ে ধুয়ে ফেলল।
    “ভাত রাঁধবি?”
    মায়ের কথার কোনও জবাব দিল না সে।
    “ভাতের সঙ্গে কী খাবি? ঘরে তেল নেই, ডাল নেই।”
    চরম বিরক্তিতে মুখ বিটকে মেয়ে মাকে ধমকে দিল,
    “ যা তো , এক পোয়া আলু নিয়ে আয়, জবান চালাতে এসেছে!”
    মা মেয়ের এই মুখ ভেংচানি সহ্য করতে পারেনি।
    “মাংসের তরকারি এনেছি , দেখ! ঘি , গরম মশলা দিয়ে রান্না করা মাংস। পারবি খাওয়াতে?” সে সাদা বাটির মুখ তুলে দিলে। সত্য, ঘি, গরম মশলার গন্ধে ঘর ভরে উঠল।
    ভাত বেড়ে সে বাবাকে ডাকল, মাকেও ডাকল। বাবা পরম তৃপ্তিতে ভাত খাচ্ছে। গরম ভাত আর ঘি গরম মশলাতে রাঁধা মাংস। রত্নার মাও সামান্য ভাত মাংসের আলু একটা ভেঙে মেখে নিয়েছে। মুখে ভরাতে গিয়ে নিজের মনে মনে বলল, “ ঠাণ্ডা ভাত ছিল, গরমের দিন, সেই দুপুরের ভাত, নষ্ট হবে, কাল কী রাঁধব? বাজারবারও নয়, মোড়া...।”
    “মেয়ে ভালো মানুষের সঙ্গে ওঠ বস করছে, আদর করে কিছু একটা দিয়েছে। তুই মা হয়ে সহ্য করতে পারিসনি। আমার একটা ছেলে থাকত তবে রোজ এরকম খাওয়াতো।”
    রত্নার মা জানে এর পর কী বলবে। ভাত ফেলে উঠে যাবার ইচ্ছে হলো। কিন্তু জিহ্বে মাংসের স্বাদ লেগেছে, নাকে ঘি, গরম মশলার গন্ধ। কখনো বা এই ইন্দ্রিয়গুলোতে মন কাবু করে ফেলে। রত্নার মাও বলতেই পারে না কখন ভাতগুলো খেয়ে ফেলল, গরম ভাত আর ঘি , মশলা দিয়ে রাঁধা মাংস। মেয়ের দিকে তাকালো মা, ছেঁড়া ফ্রকে শরীরটা ঢাকতে পারেনি। ছোট্ট মেয়ের মতো সরল মুখ। উঠতি বয়স। এ সময়ে ওরা ভালো কিছু খেতে চায়, ভালো কিছু পরতে চায়। ড্রাইভারণী আজ ওকে মাংস খাওয়াচ্ছে , কাল খাবে ওর মাংস। লোকে কত কি বলে ওর সম্পর্কে। মা মন থেকে সমস্ত শঙ্কা ঝেড়ে ফেলতে চাইল। লোকে কত কি বলে, শাখা সিঁদুর পরা মেয়ে মানুষ। ড্রাইভার দস্তুরমতে গাড়ি চালিয়ে ইনকাম করে। শুনেছে পুরোনো হলেও এম্বেসেডার গাড়িটা ওর নিজের। মালিককে দিতে হয় না। হাতের টাকা হাতেই থাকে। লোকে বলে ড্রাইভারণী কিনে দিয়েছে গাড়িটা। ভাঙা এম্বেসেডারে ড্রাইভারের সংসার চলে না। অনেক গাড়ি হলো শহরে। ছাল বাকল নেই গাড়িটার, কেইবা নেবে ভাড়াতে। যেটুকু পায় সে ওর মতো মাতালের কাছে হাতের ময়লা মাত্র। দু’কাঠা মাটিতে বাঁশ কাঠের হলেও নিজের ঘর, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে ছেলে, গ্যাসের চুলা—এই পয়সাগুলো কোত্থেকে আসে? লোকে বলাবলি করে। রত্নার মায়ের চোখের সামনে ভেসে উঠল সকালে ফুলের কাজ করা ম্যাক্সি পরে টিফিনের বাক্স, জলের বোতল দিয়ে ছেলেকে যখন স্কুলে পাঠায় মহিলাটি, তার তখনকার মুখখানা। ছেলেকে রিক্সাতে তুলে দিয়ে কখনো বা রত্নাকে দেখলে ডেকে পাঠায়, “আসবি তো রত্না, আজ পিঙ্কুর জন্মদিন। ওর বন্ধুবান্ধবদের ডেকেছি।”, “আচার অল্প করব ভাবছি, আসবি তো একটু সাহায্য করবি।”, “আজ সিনেমা আছে, আসবি।” কখনোবা রত্নার কাছে ওর মাকে দেখলে বলে, “আজ রত্না আমার ঘরে ভাত খাবে।” রত্না বলেছে ছেলেটা লেখায় পড়ায় ভালো। ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় হয়। দারুণ ছবিও আঁকে, প্রাইজও বুঝি পেয়েছে। এই সেই মহিলা। কিন্তু লোকে যে কিসব বলাবলি করে! সেদিন দু’একজন বলেইছিল, “কী রে , মেয়েকে বুঝি ড্রাইভারণীর লাইনেই দিলি? মানুষের বাড়ি চাকরের কাজ করার থেকে এই লাইনটাই ভালো। খাবে , পরবে মৌজ করবে।”
    রত্নার মায়ের বুকখানা আবার ধড়ফড়াতে শুরু করে। শ্বাসটা যেন বন্ধ হয়ে আসবে। বুকটা হাতে দিয়ে দলাই মলাই করতে করতে মানুষটি যন্ত্রণাতে কুঁকড়ে পড়ে রইল। ধড়ফড় করতে করতে বুকখানা যেন ভেতর থেকে অনুনয় বিনয় করছে ফেটে চৌচির দু’খানা হাতের জন্যে, আদরের দুটো কথার জন্যে, “মা, তোর শরীর ভালো? এতো শুকিয়ে গেছিস কেন?” বাইরের চেঁচামেচিতে সে চমকে উঠল। কেউ একজন ভোটে জিতেছে। জীপ গাড়ি, মটর সাইকেল বস্তির ভেতরেও ঘোরাঘুরি করছে। কান দুটো বন্ধ করে সে ঘুমোবার চেষ্টা করল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৭495490
  • অধ্যায় উনিশ (১৯)
    আজ মণির গরমের বন্ধ খুলেছে। বন্ধ দিতেই স্কুলের জামাকাপড় ধুয়ে ভাঁজ করে রেখে দিয়েছিল। আজ পরাতে গিয়ে হাসবে কি কাঁদবে অমন অবস্থা হলো। গায়ে আঁটে না আর। এমনিতেও ছোট হয়ে এসেছিল, এ ক’দিনে এক্কেবারেই ছোট হয়ে গেল। মা ছেলের দিকে তাকালো, সত্যি ছেলে বড় হয়ে এসেছে। বাপের গড়ন স্পষ্ট হয়ে এসেছে। ফেলানির চোখ ভিজে এলো।
    “ হবে তো মা! দিন দুই পরতে পারব। তুই জামার দামটা দিতে পারবি? প্যান্টের দাম আমার ডিম বেচা টাকাতে বেরিয়ে যাবে।”
    কী বোঝদার হয়েছে ছেলেটা। ও যদি কষ্ট করতে না পারত তবে ওরা দু’ই প্রাণীতে দুমুঠো ভাত খেয়ে টিকে থাকতে পারত না।” আজকাল মালতীর দেরি হলে মণি ভাত বসিয়ে দেয়। লাকড়ি, শাক দু’একটা, কখনো বা মাছও দুই একটা যোগাড় করে রাখে। বন্ধের ভেতরে সে কত সুন্দর করে মোড়া বানানো শিখে ফেলেছে। ওর গরমের বন্ধে এতোদিন পর মালতী দুটো পয়সা জমাতে পেরেছে।
    “ ডিম বেচার পয়সাতে বই খাতা নিবি, জামাপ্যান্টের কথা তোকে ভাবতে হবে না।”
    আঁটোসাটো জামাপ্যান্ট পরে ছেলে যখন বেরিয়ে গেল যতক্ষণ দেখা যায় সে তাকিয়ে রইল। আজই ওর পোশাক কিনে আনতে হবে। আসলে সে ভাবতেই পারেনি কাপড় গুলো এতোটা ছোট হয়ে যাবে। টাকা কটা সে রেখেছিল একটা বালতি আনবে বলে। পারলে কালীবুড়িকে একটা চশমা এনে দেবে বলে সে প্রায় ঠিক করেই রেখেছিল। কীইবা ভর করেছে বুড়িটার গায়? কড়ি একটা খরচ করতে হাজারবার ভাবে। এ বয়সেও বুড়ি উপার্জন কম করে না। মালতীকে মুড়ি ভাজার যোগাড়যন্ত্রও ঠিকই করে দিচ্ছে। চাল, লাকড়ি, এমনকি সেদিন একটা নতুন কড়াইও কিনে দিল। সেও বিক্রির আধা পয়সা ঠিকঠাকই দিয়ে যাচ্ছে। কাঁথাও সেলাই করে যাচ্ছে বুড়ি ঝোঁকে ঝোঁকে। আজকাল একশ টাকার নিচে বুড়ি কাঁথা সেলাই করে দেয় না। মুড়ির বাঁধা গ্রাহক থেকেই কাঁথা সেলাই করে বুড়ি শ কয়েক টাকা পেয়ে গেছে। আজকাল সপ্তাহে একবার মাথাতে জটা গজাবেই, সেদিনও কালীভক্তরা টাকা পয়সা না দিয়ে থাকে না। জটা গজিয়ে ভর করবার পর বুড়ির যে কী এক অবস্থা হয়। মালতীর বুক ভেদ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ঠোঁট নীল হয়ে যায়, হালকা পাতলা শরীরটা ছেঁড়া কাপড়ের মতো এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকে, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। পুরো একটা দিন আর রাত মুখে এক ফোঁটাও জল না দিয়ে কাটিয়ে দেয় বুড়ি। মালতী প্রায়ই ভাবে আর বাঁচবে না বুড়ি। কিন্তু বুড়ি ঠিক আবার উঠে বসে। ভালো হয়ে রোজ একটা কথাই বলে বারেবার, মায়ের আমাকে নেবার সময় হয়নি। কী করে বুড়ি পয়সা দিয়ে? চশমার নালটাই ঠিক করে না। সে মন বেঁধে ফেলল, বুড়িকে নতুন চশমার ফ্রেমই একটা কিনে দেবে।
    অন্যদিনের থেকে বেশি তাড়াতাড়ি করে সব কাজ সেরে ফেলল সে। মিনতির ঘরে ঢুকে যেতে হবে। ও আজ বাজারে যাবে কি যাবে না। না গেলেও নিয়ে যেতে হবে। জামাপ্যান্ট কিনতে ওকে না হলে হবে না। দোকানীর ওখানে ওই পারে দরদাম করতে। বুড়ো দোকানীর ওখানেই কিনতে হবে।বুড়ো হরেক কিসিমের কাপড় রাখে। দামও অন্য দোকান থেকে অনেক কম। রোজ দেখে দেখেই বোধহয় বুড়োকে নিজের নিজের বলে মনে হয় । বেশ হাসিঠাট্টা করে, কথাবার্তাতে জড়তাও কেটে গেছে। ওকে বৌ বলে ডাকে । মাড়োয়াড়ি বুড়োর মুখে বৌ শব্দটি বেশ ভালো লাগে। বেজাতের মেয়ে বিয়ে করার ফলে বাড়ির লোকেরা ছেলেকে ত্যাজ্য করে দিল। সে শ্বশুরবাড়িটা পেলে ওখানে নিশ্চয় বৌ বলে ডাকবার জন্যে অনেককেই পাওয়া যেত। কিছুদিন থেকে বুড়োর মুখখানা শুকিয়ে গেছে, হাসিঠাট্টা তো দূর, ভালো করে দামদরও করতে চায় না। দোকানখানাও কেমন যেন শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। বেশ ক’টি থাক শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। নতুন মাল নেই বললেই চলে।
    দরজাটা তালা দিয়ে সে মোড়াগুলো হাতে নিয়ে নিলো। মোড়াগুলো হয়েছে দেখবার মতো, বেশ মজবুতও হয়েছে।ছেলের হাতের মোড়াগুলো পথেই বিক্রি হয়ে যায়, বাবার হাত পেয়েছে। মুড়ির টিনটা মাথাতে তুলে নিলো। বুলেনদের বাড়িতেও একবার দেখা দিয়ে যেতে হবে। সুমলাকে আজকাল ঔষধ খাইয়ে দিতে হয় না। দু’একটা কাজও করে। গাও ধোয়। মাথাও আঁচড়ায়। কাজের থেকে ফিরে বুলেন আজকাল পরিষ্কার ঘর, বাড়া ভাতও পেয়ে যায়। ছেলেটাও স্কুলে যাবার মতো হয়েছে।
    মণির মা প্রথমে জোনের মায়ের ওখানে গেল, মোড়াগুলো আর মুড়ির টিন নামিয়ে রাখল।
    “ কিরে মণির মা , এলিই বুঝি! আমার হয়ই নি!”
    “ হ্যাঁ, একটু তাড়াতাড়িই এলাম, মিনতি যায় কি না যায়।”
    “ যাবে বোধহয়, কাল মাঝরাত অব্দিতো আমার এখানেই বসে বসে মোড়া আর ঠোঙা বানাচ্ছিল।”
    “ কেন , তোর এখানে ছিল কেন?”
    “তোকে বলেনি?” জোনের মা চোখ বড় হয়ে এলো, স্বর নেমে এসেছে।
    “ দু'রাত ধরে ও এসেছিল যে!”
    “ ও আসতে দিয়েছে বলেই এসেছে, তাতে তোর এখানে রাত কাটাবার কী হলো?” মিনতির রাজকুমারটার কথা উঠলেই ওর রাগ চড়ে।
    “ও আলফা হয়ে গেছে , না!”
    “আলফা?” জোনের মায়ের ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলোতে সে একটু অবাক হলো।
    “ চুপ কর বোকা!”
    “নতুন আন্দোলন করা পার্টি বুঝি?” ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা থপথপে হাগা-মুতার নর্দমা; গাছ একটাতে ঝুলিয়ে রাখা মানুষের হাত ,পা , মাথা; শিশুর কাটা কোমল দেহ। ওর পুরো শরীর শিউরে উঠছে।
    “কী করছিস মণির মা?” হাতে একটা ঠোঙার থলে আর তিন জোড়া মোড়া নিয়ে মিনতি জোনের মায়ের ঘরে এসে ঢুকল।
    “এলি?” জোনের মাও মুড়ির টিন নিয়ে বেরিয়ে এলো। ওর হাতের একটা থলেতে সামান্য এলাচ লেবু। জোনের বাবা আগে গাছের কলম, চারা, বীজের ব্যবসা করত। এখন ঘুরে বেড়াতে পারে না বলে, মাছি মারা, ইঁদুর মারার ঔষধের ব্যবসা ধরেছে। তখনই আরো কিছু ফলের গাছের সঙ্গে এই লেবুর গাছও লাগিয়েছিল। এক ফোঁটা রস পড়লেই পুরো ঘরটা ম ম করে। এই সময়ে ডাল ভরে ভরে ধরে, জোনের মাও পয়সা দুটো পায়। লেবুগুলো বের করলেই বাজারে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। চারটা লেবু বের করে ও মণির মাকে দিল।
    “এগুলো রেখে দে, বাজারে বের করবার পর আর থাকবে না।”
    “এই, লাগবে না এতোগুলো” দুই হাতে নিতে নিতে বলল।
    “আর হবে, তোকে এই লেবু চারটা দিতে পারবখন। ভাঙা হলেও মাথার উপর চাল একটা আছে, বেমারি হলেও মাথার উপর মানুষ একটা আছে।”
    “দে, তবে।” লেবু এগিয়ে দেয়া মেয়েলোকটির পাকা জামের মতো মুখে আধলির মতো জিলকোচ্ছে সিঁদুরের ফোঁটা, তারই তৃপ্তি দেখে ওর একটু ঈর্ষাই হলো।
    “ঐ মোড়াওয়ালি, এই দিকে আয়তো!” একটা মেয়ের ডাকে সে মাথার থেকে মুড়ির টিনটা নামিয়ে দাঁড়ালো। পথের পাশের বাড়ি একটার থেকে ডেকেছে। তিনজনেই গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মণির মায়ের দুজোড়া মোড়া তৎক্ষণাৎ বিক্রি হয়ে গেল। পথে হাঁটতে গিয়ে ওর ইচ্ছে হলো বলে উঠে, “ বাবা নেই তো কী হলো, মাথার উপর লাউর ডগার মতো বাড়ন্ত ছেলেটা রয়েছে যে।” মিনতির কালো মুখখানার দিকে তাকিয়ে বলল না।
    “ কী হলো , মিনতি? খাঁচায় বাঁধা হাঁসটির মতো হয়ে আছিস কেন?”
    “আমার বড় ভয় করছে গো মণির মা।”
    “কিসের ভয়?”
    “ওর জন্যে।”
    “তোকে নিংড়ে নিংড়ে খেয়েছে, আবার ওকে বিছানাতে তুললি !”
    “কে বললে , ওকে বিছানাতে তুলেছি?”
    “ তোর ওখানে আসেনি ও?”
    “মিনতি আমার ঘরে ছিল তো।” জোনের মায়ের মুখ ভার হয়ে এসেছে, “ ও এলে তোকে আর আমি রাখতে পারব না, আমারও একখানা সংসার আছে।”
    “ও এলে তুই ওকে বের করে দিবি, কী দিয়েছে ও তোকে? জ্বালার পর জ্বালা। ওর টাকাতে যা কিছু কিনেছিস, ফেলে দিবি ছুঁড়ে।”
    “মণির মা, এবারে যখন ও এলো গায়ে প্রচুর জ্বর ছিল, হুঁশ ছিল না। পুরো শরীরে জোঁকে খেয়ে ঘা।”
    “কোত্থেকে এসেছিল সে?”
    “পাহাড়ে ট্রেনিং নিয়ে এসেছিল।”
    “ কিসের ট্রেনিং?”
    “মানুষ মারবার। মানুষ মারবার হাজারটা উপায় ও শিখে এসেছে। ও বোমা বানিয়ে মানুষ মারবে, বন্ধুক চালিয়ে মারবে। মানুষ মারবার একশটা বুদ্ধি শিখে এসেছে যে তাকে আমার ভয় করবে না?”
    মিনতির কথা শুনে মনে হচ্ছিল ওই ছেলেটি নয়, ওরই জ্বর উঠেছে।
    “মানুষ মেরে ও করবেটা কী? আন্দোলন করে, ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মেরে ওরা রাজপাটে তো উঠল, এরা আবার মানুষ মেরে কী করবে?
    “আমি জানি না , মণির মা! আমি শুধু এই জেনেছি ওর পার্টির লোকের লাগে রক্ত আর টাকা। আমার বড় ভয় করছে।”
    “তুই কি এবারেও ওকে বিছানাতে তুলেছিলি?” জোনের মা জিজ্ঞেস করল।
    “আমি দেখি তোর বাড়িতেই ছিলাম। ও মানুষ মেরে এসেছিল। ওর বেগে রাখা কাপড়ে আমি রক্তের দাগ দেখেছি। মানুষ মারা হাতে...” ও যেন এখনো রক্তের ছিটে লেগে থাকা কাপড় ধরে আছে হাতে, রক্তের ছিটে পড়া কাপড় পরে একটা লোক ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মিনতির মুখ ম্লান হয়ে পড়েছিল।
    “ও কি তোর গায়ে হাত দিতে চেয়েছিল?” সেবারে ভোটের সময় যখন এসেছিল ও তোকে বেশ কয়েকরাতের জন্যে নিয়ে যায় নি?”
    “ নিয়ে গেছিল, আমিও গেছিলাম। আমি ভুল করেছিলাম জোনের মা।”
    “ আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দিচ্ছিস না যে?”
    “না চায়নি। ওরা বাকি যা কিছু বিছানার তলায় ভরিয়ে হাতে বন্ধুক নিয়ে মদ খেয়ে পুরো রাত ঢল হয়ে পড়েছিল। বমি করে করে পুরো ঘর ভরিয়ে দিয়েছিল।”
    “দিনে কই গেছিল ও?”
    “ জানি না, বলতে পারি না।”
    “ মানুষ মারতে যে জিনিষগুলো নিয়ে এসেছিল, সেগুলো কই রেখেছিল?”
    “বিছানার তলার বেগে।”
    “দিনে ও...।“ মণির মায়ের মনেও মিনতির ভয় সেঁধিয়ে গেছিল।
    “বলতে পারি না, মণির মা। রাতে কয়েকটা ছেলে এসে ওকে নিয়ে গেছিল। আমি একটা কথাই বুঝেছিলাম ওরা টাকা আর মানুষ মারবার কথা বলাবলি করছিল।”
    বাজারের কাছে চলে আসতেই ওদের তিনজনের মুখেই যেন খানিক প্রাণ ফিরে এলো। চেনা পরিবেশ, শুক্রবারের বাজার লোকে গমগম করছে। তার উপর আগের মঙ্গলবারের বাজারের দিন সকাল আটটা সাড়ে আটটাতেই আকাশ কালো করে যে ভাবে বৃষ্টি নেমেছিল, বাজার বসতেই পারেনি সেদিন।
    তিনজনেই নিজের নিজের জায়গাতে গিয়ে বসল। দরদাম, বিক্রিবাটা, লোকজনের ভিড়ে সামান্য আগে ওদের যে ভয়ে পেয়েছিল ক্রমেই তা গলে গেল।
    বিক্রিবাটা সেরে তিনজনেই বুড়োর দোকানের দিকে এলো। মণির মায়ের বুক ধপধপ করছে। আজ সে প্রথম এতো বেশি টাকার জিনিস একসঙ্গে কিনতে যাচ্ছে। বুড়োর দোকানটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে। গদির এক কোনে বসে আছে বুড়ো। ওরা তিনজনে বুড়োর কাছে বসল গিয়ে। কেমন যেন কোনও সাড়া শব্দ নেই দোকানে। অথচ আজ অন্যদিনের থেকে দোকানে বিক্রিবাটা একটু বেশিই হচ্ছে। রোজ যাদের দেখা যায় ওরা ছাড়াও আর কিছু অচেনা মুখও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কাপড় দেখাবার আগ্রহ কারোরই নেই। ওরা তিনজন কিছু সময় বসে রইল। কেউ একজন সেই চেনা প্রশ্নটা করল না যে ,” কী চাই?”
    “একজোড়া সার্ট-পেন্ট দেখি তো।” জোনের মা বলল। তবু কেউ এগিয়ে এলো না। আগে ব্লাউজ একটা কিনতে গেলেও কত প্রশ্ন—-“কী রঙ নেবে, কেমন কাপড়? সাইজ কী? কী ধরণের হাত হলে ভালো?” আজ কী হলো এদের?
    “আজ বিক্রিবাটা নেই।” ভারি গলাতে এক কোনের থেকে কেউ বলল।
    “কেন? দোকান খোলা রেখেছেন কেন? না, ভেবেছো পয়সা না দিয়ে নিয়ে যাব?” জোনের মা যেন দরকার থেকে একটু বেশিই বলল।
    “কী চাই, তাড়াতাড়ি দিয়ে দে।” গদির কোনায় বসে বুড়ো বলল। বুড়োটাকেও যেন কেমন অন্যরকম মনে হচ্ছে। অন্যদিনের মতো ওদের বৌ, ভাতিজি বলে ডেকে হাসি ঠাট্টা করছে না। বিক্রির জন্যে বের করবার আগেই জোনের মা বুড়োকে দেবে বলে তিনটা লেবু আলাদা করে রেখেছিল। ওর বিপদে আপদে বুড়ো অনেক সহায় সাহায্য করেছে, টাকা দিতে না পারলে বাকিতেও কাপড় দিয়েছে। বুড়োর গুমড়া মুখ দেখে ওর লেবুগুলো বের করবার সাহস হলো না, আর ইচ্ছেও হলো না। থমথমে দোকানটা ওদের কারোরই ভালো লাগল না। তবুও দেখেশুনে জামাপ্যান্ট একজোড়া বেঁধে নিয়ে ওরা যাবার জন্যে উঠল।
    উঠতেই ওরা দেখল দুটো মটর সাইকেলে চারটা ছেলে এসে দোকানের সামনে দাঁড়ালো ওরা তিনজনের চোখের সামনে দা, লাঠি, লোহার রড নিয়ে বুড়োর দোকান থেকে প্রায় দশ পনেরটা লোক বেরিয়ে এসে ছেলে চারটাকে তাড়া করে গেল। মণির মায়েরা কাপড়ের একটা আলমিরার কাছের দরজা দিয়ে গিয়ে গুদাম একটাতে গিয়ে ঢুকল, খোলা দরজাটা যে বন্ধ করে নেবে সেই সাহস কারো হলো না।
    বুড়োর লোকেরা দা-কুঠার নিয়ে তাড়া করে যেতে দেখে ছেলেগুলো বন্দুক বের করল। দুটো ইতিমধ্যে মটর সাইকেলে উঠে সেখান থেকে চলে গেল।বাকি দুটোর বন্দুকের গুলিতে বুড়োর দুটো ছেলে আর তিনজন কর্মচারী পড়ে গেল। সামান্য আগে যেখানে ওরা তিনজনে বসেছিল সেখানে রক্তের নালা বইতে শুরু করল।
    ‘ডাকাত ! ডাকাত!’ বলে ক’জন লোক গুদামের ভেতর দিয়ে দৌড়ে গেল। ব্লাউজ আর পেটিকোটের একটা স্তুপ গড়িয়ে পড়ল ওদের উপর। কাপড়গুলোও গেল ছিঁড়ে টিরে। তিনজনে থরথর করে কাঁপছিল। কারো মুখে রা নেই। হাতে কাপড়গুলো সরাতে গেলে আরো খসে খসে পড়ছে। আজ অনেক দিন পর মনির মাকে সেই আলো আঁধারে ঘিরে ধরেছে। একবার সামান্য আলো দেখে , আবার অন্ধকার। মানুষটি একটা কলাগাছের পুকুরে ডুবে যাচ্ছে। এই পুকুরে কেউ আগুন লাগিয়ে দেবে। ঐ লোকগুলো পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেল। কেউ কেউ শুকনো কলা গাছের খোসা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, একটা বন্ধ ঘরে দুটো মানুষের মরণ কান্না। আঁধার একবার গাঢ় হচ্ছে, একবার হালকা । মণি, মণি কোথায় আছে? হাতের জামাপ্যান্টই সে খামচে ধরল জোরে।
    বুড়োর দোকানের লোকগুলোকে গুলি করে ছেলেগুলো মটর সাইকেলে উঠছে। বাকি লোকগুলো পেছনে তাড়া করে করে যাচ্ছে। ওরা ভাঙা গলাতে যত পারে জোরে চেঁচাচ্ছে।
    ‘ডাকাত! ডাকাত!’ বাইরের সব দোকান টোকান থেকেও মানুষজন বেরিয়ে আসছে। কাকের বাসাতে সাপ বা বেড়াল উঠলে কাক যেমন করে, মানুষগুলো তেমনি চেঁচামেচি করছে। একটা পানের দোকানের সামনে দিয়ে মটর সাইকেলগুলো চলে যাচ্ছে। পান-দোকানি পান ভেজাবার জলের বালতিটাই ছুঁড়ে মারল, যে ছেলেটা চালাচ্ছে তাকে তাক করে। এই হঠাৎ আক্রমণে মটর সাইকেলের ছেলেটা পড়ে গেল। পড়ন্ত মটর সাইকেল থেকেই পেছনেরটা ঝাঁপ দিয়ে নেমে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। চালকের আসনে যে ছেলেটি ছিল সে কিছু বলতেই পেছনেরটি চলে গেল। পাগল হাতিকে যেমন করে তেমনি লোকে ওই বন্দুকধারী ছেলেটিকে রাস্তা ছেড়ে দিল। মাটিতে যেটি পড়েছিল ও উঠতে যেতেই একজন কেউ ওই পানের বালতি দিয়ে জোরে গিয়ে ওর মাথাতে মারল । ইতিমধ্যে বুড়োর এক ছেলে আর কর্মচারী মারা যাবার কথা এবং বাকিদের ঘায়েল হবার কথা লোক জানাজানি হয়ে গেছে। লোকের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ঐ পড়ে থাকা ছেলেটির উপর। বিচিত্র সব আঘাতে পাঁচ মিনিট হলো কি হলো না , ছেলেটি মরে গেল।
    আধ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ এসে পৌঁছুলো। তিনটা লাশ পুলিশ ভেনে তুলে নিলো, লোকজনে বোবার মতো দেখে গেল। ছেলেটার হাতে গ্রেনেড ছিল। ব্যবহার করতে সুবিধে পায়নি। এদিকে ওদিকে জড়ো হয়ে আতংকিত মানুষজনে বলাবলি করতে শুরু করল। মুহূর্তে জানাজানি হয়ে গেল যে এটি এক নতুন সংগঠন। বুড়োর কাছে টাকা দাবি করেছিল। কোনোদিন এমন অন্যায় দাবি ধমকের কাছে বুড়ো মাথা নত করেনি, তাই ডাকাতগুলোকে মারতে দোকানে লোক জড়ো করে রেখেছিল। সবাই বুঝতে পারল এই কাজ বুড়ো ভালোর জন্যে করেনি। দূরে দুটো মটর সাইকেল দেখে লোকজন যে যেদিকে পারল ছিটকে গেল। ‘আবার এসেছে!’, ‘এসেই গেল!’ এমন আরো কিছু চিৎকারে চেঁচামেচির পর রাস্তাটা একেবারে শূন্য হয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে পুলিশে মিলিটারিতে জায়গাটা একেবারে ঘিরে ফেলল।
    বুড়োর আনন্দ-মহলে কান্নার রোল উঠল। ওরা তিনজনের শরীরের উপর গড়িয়ে পড়া কাপড়গুলো কেউ সরিয়ে দিয়েছে, ওরা নিজেরাও সরিয়েছে কিছু। জোনের মাকে মাঝে নিয়ে রক্তনদী ডিঙিয়ে বুড়োর দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। শাড়ির তলাগুলো ভিজে জবজবে হয়ে গেল। রাস্তার কলে সরকারি জল এসেছে। জোনের মা, মণির মা, আর মিনতির মুখে মাথায় জল ছিটিয়ে দিল, নাকে চোখে জল দিল। মণির মা চোখ মেলেছে। জামাপ্যান্ট জোড়া খামচে ধরে আছে । শাড়ির তলাটাও ওরা ধুয়ে নিলো। তারপর যেমন তেমন ওখান থেকে চলে আসতে শুরু করতেই পুলিশ একটা এসে ওদের মুড়ির টিন থেকে শুরু করে হাতের টাকা কড়ি সব তন্ন তন্ন করে দেখে ছেড়ে দিল।
    দ্রুত পা চালাল ওরা। আজ রাস্তাগুলো শূন্য। প্রায় মানুষই বাড়িতে চলে গেছে। এক নতুন আতঙ্কে মানুষ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলছে। সবাই বুঝতে পারছে এ মাত্র শুরু। কিছু লোক বুড়োকে দোষারোপ করছে। যে টাকা চেয়েছিল দিয়ে দিলেই হতো, এখন কী হলো? কিছু লোক বলছে ভালোই হয়েছে, ভবিষ্যতে আর কারো কাছে গিয়ে চাইবে না। লাখের উপর টাকা চায় , উপার্জন করুক দেখি টাকা একশ। রিজার্ভের কাছে গিয়ে গাছের ছায়াতে দাঁড়ালো খানিক ওরা। প্রায় দৌড়ে আসার মতোই আসছিল। বুক ধুকপুক করছে, ঘামে গা ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।
    “এটা ওর সঙ্গের লোকেদের কাজ।” মিনতি যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। দেখবি তোরা ওরা আরো কত কী করে, মানুষ মারার নানান ফন্দিফিকির শিখেছে ওরা। এক ঘায়ে মানুষ মেরে ফেলে! মানুষ মারবার কী বুদ্ধি!”
    “বুড়োর থেকে টাকা চাইছিল কেন? কী করবে এতো টাকা দিয়ে?” জোনের মায়ের মুখখানা কালি দেখাচ্ছিল।
    “কী করবে? লোক মারবার জন্যেই ওদের টাকা চাই। চল চল , যাই।” মিনতিকে যেন কিসে কামড়ছে , এমনি ঝাঁপ দিয়ে বলল, “ চল না, যাই।” মিনতি দৌড়তে শুরু করল। বাকি দুজনে ওর সঙ্গে পেরে উঠা মুস্কিল হলো। সামান্য দূরে গিয়ে দেখে বস্তির দিক থেকে অনেক মানুষ এদিকে আসছে। বুলেন, জোনের বাবা, মণি, নবীন, জগু, কালীবুড়ি। সব্বার মুখ কালো। ওদের দেখে কালীবুড়ি হাতজোড় করে প্রণাম করলে, “ মা, ওদের তুই রক্ষা করলি, মা!” জোনের মা আর মিনতিও হাত জোড় করল। মালতীর হাত আপনি জোড়া হয়ে গেল। মণি এসে মায়ের কাছে দাঁড়ালো। সে আজকাল মাকে আহ্লাদে জড়িয়ে ধরে না। মা জানে ওকে আজকাল লোকের সামনে গালে মুখে হাত বুলিয়ে দেয়া সে পছন্দ করে না। সে নীরবে ছেলের হাতে জামাপ্যান্ট তুলে দিল। সমস্ত মানুষজন কালীবুড়ির উঠোনে গিয়ে বসল। জোনের মা কালীর সামনের প্রদীপ কটা জ্বালিয়ে দিল। কিছু পরেই সবাই দেখল মাথাতে মস্ত এক জটা নিয়ে কালীবুড়ি বেরিয়ে এসেছে। বুড়ি এসে কালী মায়ের মূর্তির সামনে দণ্ডবৎ করল।
    দণ্ডবৎ করে লোকগুলো উঠে বসতে পারল কি পারল না চারদিকে এক হৈ হল্লা শুরু হয়ে গেল। আর্মি আসছে। সত্যি সবাই দেখল নদীর পাড়ের বটগাছে হেলানো ঘরখানা ঘিরে ফেলেছে মিলিটারিতে। হরি ভাঙুয়ার অসৎ ছেলেটাকে ওরা গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। ভালো মন্দ কিচ্ছু বলেনি। শুধু জোনের মা সামান্য জোর গলাতে ওকে বলল, “মণির মা, ভগবান আছে বুঝলি! ভগবান আছে!”
    “ যা! তোরাই যে বেঁচে এলি , এই ঢের!”
    “ পাপ করলে শাস্তি আছেই রে জোনের মা” সে কথাগুলো বড় আস্তে করে বলল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৭495491
  • অধ্যায় বিশ (২০)
    বুড়োর দোকানের দিকে চোখ পড়তেই ওর শরীরটা কেমন কেমন করতে শুরু করল। কী করে যে ধ্বসে গেল পুরো একটা পরিবার।সেবারে টাকা নিতে এলে মেজো ছেলেটা মারা পড়ল। যারা জড়ো হয়েছিল, তাদের আর বুড়োর নিজের মানুষের সঙ্গে ওদের একটাও মরল। তার এক সপ্তাহ গেল কি গেল না বুড়োর ছোট ছেলেটাকেও মেরে রেখে গেল। তারপর পুরো চারবার আক্রমণ করে বুড়োর পরিবারের জনা ছয় মানুষ মেরে ফেলল। বুড়ো দোকান গুটিয়ে দেশে চলে গেল। এখন ওদের সংগঠনের নাম শুনলেই লোকে বাঁশপাতার মতো কাঁপতে থাকে। একটা ছোট্ট চিঠি হাতে পড়লেই মোটা অংকের টাকা ওদের পায়ে দিয়ে আসে গিয়ে।
    আজ মণির মায়ের বাজারে আসতে সামান্য দেরি হলো। মোড়া পাঁচটা এনেছিল। একজোড়া বাকি ছিল। সেই দুটোর আশাতে সে অনেক বেলা পর্যন্ত বসে রইল। মোড়াগুলো অবশ্য শেষে বিক্রি হলো। মিনতি আর জোনের মা চলে গেছে, ঘরে বাচ্চা ছেলে রেখে এসেছে। ওদের ছেলেমেয়ের পেনপেনানি শেষ হয় নি। ওর ছেলেটাই আজকাল বোঝদার হয়ে উঠেছে। সবাই মণির প্রশংসা করে। এমন ছেলে বুঝি বহু সাধনা করেই পায় লোকে। মায়ের কত দুঃখ বোঝে! সে সংসারটাকে ধরেছে বলেই প্রাণী দুটো টিকে আছে। কটা ছোট ছেলেই বা সেদিকে তাকায় যে মায়ের থালাতে কি আছে কি নেই? নিজে খেতে পেলেই হলো, পারলে মায়ের থেকেও নিয়ে যায়। মা গিয়ে না পৌঁছুনো অব্দি রাস্তার পাশে কেমন দাঁড়িয়ে থাকে। লেখাপড়াতেও ভালো এতো কষ্টের মধ্যেও ছেলেটা মন দিয়ে পড়ছে। যে কাজই করবে মন দিয়ে করে। তার নতুন ক্লাস শুরু হয়েছে, বইপত্র চাই। মোড়া ক’জোড়া বিক্রি করে ওর বুকখানা একটু শক্ত হলো। টাকা কিছু বেরুলো যদি ছেলের খরচাপাতির জন্যে কোনও ভাবনা নেই। আবার বা কবে বাজার বসে! কোথায় কী ঘটনা ঘটে বলা তো যায় না। বুড়োর দোকানের ঘটনাগুলোর জন্যেই বেশ ক’তা বাজার গেল। ছেলের ডিমগুলো বেচা গেল বলেই ভাতের জোগাড় হতে পেরেছে। এ পর্যন্ত সে নিশ্চয়ই হাঁসমুরগিগুলো তুলে নিয়েছে। পড়তে বসছে কী? না কি চুলোতে আগুন দিয়ে ভাত বসাবারই চেষ্টা করছে। কীই আর আছে ঘরে! চালের পাত্রটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল, আধার থেকেও কম আছে। থাক, আজ চাল না হলেও চলবে। আসছে বাজারে নেয়া যাবে। সে নিশ্চয় ভাত বসিয়েছে, তাতে ডিম আলু সেদ্ধ দিয়েছে হয়তো। ডাল , মিঠা তেল কিছুই নেই। সে ভাতের সঙ্গে ডিম আলু সেদ্ধ করতে ভালোবাসে, সহজ হয়। ফেলানির মনটা ছেলের জন্যে আনচান করতে শুরু করে। এই বয়সে এতো চিন্তা ওর মাথায় ঢুকেছে! কীই বা পেয়েছে সে। কিছুতেই কোনও আপত্তি করেনা, কোনও রকম দাবিও নেই তার। ছেলের জন্যে কিছু একটা কেনার ইচ্ছে হলো ওর। তার কলমটা খারাপ হয়েছে, একটা কলম হলে পরীক্ষাতে লিখতেও ওর সুবিধে হবে। সে জোরে নবীনের দোকানের দিকে পা চালাল।
    নবীন ওর বইপত্র প্রায় গুটিয়ে ফেলেছিল। ফেলানি কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
    “মামী , আজ দেখি একা?” নবীন আজকাল ওকে মামী বলে ডাকে। একদিন কথাপ্রসঙ্গে মণির বাবার শহরের বাড়িটার কথা উঠেছিল। সেই বাড়িতে নবীনের পরিবারের কোনও মহিলার বিয়ে হয়েছে। সেই সূত্রেই নবীনের মামী হবার উপাধিটা পেয়েছে।
    “আর বলো কেন, বাকিদের ছেলেমেয়ের ঝামেলা আছে, তাড়াতাড়ি চলে গেছ। আমিই একজোড়া মোড়ার জন্যে বসে রইলাম।”
    “মোড়া বিক্রি হলো কি না?”
    “হ্যাঁ, হয়ে গেছে! আমার ছেলের হাতের জিনিস পড়ে থাকবে বুঝি?” ওর মুখে একটা গর্বের হাসি।
    “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। মণির মতো ছেলে ক’জনের ভাগ্যেই বা জোটে?” নবীনের মুখ কালো হয়ে এলো, “মামী , আমার ভাইটাও মণির মতো ছিল, কিন্তু ওকে যে পাহাড়ের আগুনে ডেকে নিয়ে গেল।”
    কী বলবে কী বলবে না ভেবে মালতী দাঁড়িয়ে রইল। নবীন জোরে হাত চালিয়ে ওর দোকান গোটাচ্ছে, “ কিছু নেবেন মামী?”
    “মণির জন্যে একটা কলম লাগছিল।”
    কলমটা সে নিজেই হাত লাগিয়ে বাছতে বাছতে নবীনের বড় বড় বেগগুলোতে দোকান সামলানো হয়ে গেছে। সাইকেলে বেগ তোলাও হয়ে গেছে।
    “মামী হলো?” কলমের বাক্সটাই শুধু ভরাবার বাকি। সে একটা কালো আর একটা নীল কলম নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলে। শেষে কালোটাই নিলো।
    “পয়সা...?”
    “মামী, কই আর পালিয়ে যাবেন? বাড়িতে নেব গিয়ে।” নবীন হাসছে।
    “সাইকেল ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে নবীন, কাছে কাছে সে।
    “মামী, মুড়ির টিনটা সাইকেলে তুলে দিন।”
    “না লাগবে না, তোমার বোঝাটাই তো বেশ ভারি দেখি।তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?”
    “চলছে , বাজার ঠিকমতো চললে চিন্তা থাকে না।”
    “হ্যাঁ, বাজারটা নাহলেই মাথায় বাড়ি পড়ে।”
    “কই আর বাজার ঠিকমতো বসে? কিছু না কিছু একটা লেগেই থাকে।”
    “ব্যাংকে যে ডাকাতিটা হয়েছিল, তারপর চারটা বাজার মারা গেল।”
    “সে কি আর কম কিছু হলো সেবার?”
    “তুমি ছিলে না ব্যাংকে?
    “ আমি যে দোকান থেকে বইপত্র আনি তার মালিকের ছেলে একটা পাসবুক খুলে দিয়েছিল, তারই মাসিক কিস্তি জমা দিতে গেছিলাম।”
    “ডাকাতগুলো মুখে কাপড় বেঁধে এসেছিল?”
    “না না, তা আসেনি। আপনি তো বুড়োকে যখন সংগঠনের ছেলেরা এসে এট্যাক করে তখন সেখানে ছিলেন?”
    মালতীর কানে শব্দটা যেন ঝনঝনিয়ে উঠল, ‘এট্যাক!’ সন্ধ্যে গড়িয়ে রাতের শুরু হয়েছে। পুব দিকে জ্বলে উঠেছে একটুকরো দাউ দাউ আগুন। ভেসে আসছে নাগারা আর শঙ্খের শব্দ। দাউ দাউ আগুনে গ্রাস করে ফেলছে ঘরের পর ঘরের সারি। আগুন থেকে একটাই শব্দ বেরুচ্ছে, “এট্যাক, এটাক, এইটেক, আটেক, উটেক...” শব্দগুলো স্ফুলিঙ্গের মতো মানুষের ভিড়ে গিয়ে পড়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে। পোড়া দাগ গায়ে নিয়ে একটা খুটাতে প্যাঁচিয়ে আছে সাপ একটা, দুটো চাকার মতো দুলছে ওর বাকি শরীর...।” মালতীর শরীর শিউরে শিউরে উঠল।
    সন্ধ্যা নেমে আসছে, আগুনের তাপ নিয়ে একটা শব্দ ভেঙ্গে ভেঙ্গে ওর কানে গিয়ে ঝনঝনিয়ে উঠছে।
    “মামী, কীসব যে আমাদের দেখতে হচ্ছে। আমি একটা জোয়ান ছেলের মরা লাশ ডিঙ্গিয়ে পেরিয়ে এসেছিলাম। মরা লাশ ছিল না মামী! জ্যান্ত মানুষ ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছিল। ওর চোখদুটো...ওর বুক থেকে ছলকে ছলকে রক্ত বেরুচ্ছিল। ওর চোখদুটো ছিল আমার ভাইয়ের মতো। ওর ঠোঁটের থেকে বেরুনো শব্দগুলো শুনবার জন্যে আমি ঝুঁকেছিলাম, কেউ আমাকে লাথি মেরে দিয়েছিল , বুট জুতো পরা পায়ের লাথি, মামী...” মানুষটা কাঁপছিল।
    “ব্যাঙ্ক ডাকাতি করা ছেলেগুলো আর বুড়োকে...” ‘এটাক’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে মালতী থেমে গেল, ঠিক যেমন সন্ধ্যে হলে সাপের নাম নিতে গিয়ে, অমাবস্যার দিনে যেমন মরা মানুষের নাম নিতে গিয়ে থেমে যেতে হয়—তেমনি।
    “একই পার্টি, একই সংগঠন।”
    সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। আর তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। মণি নিশ্চয় পথের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের দেরি হলে মণির রাগ উঠে। মালতী বুঝে তার বেচারার মায়ের জন্যে ভাবনা হয়। নিয়ে আসতে না বলেও যখন কলমটা হাতে পাবে তখন ওর মুখটা দেখতে কেমন হবে? ওকে টাউনের দিকে আসতে হবে না। কোথায় কী হয়ে যাবে। সে তার উপর এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াবার ছেলেও নয়। স্কুলেও যায় আর বাড়ি আসে। শুধু ঐ রিজার্ভে পারলে রোজ যায়। জঙ্গলের মধ্যের খালবিলের মাছ, গাছের শুকনো ডাল--- ওসবের খোঁজে সে অস্থির হয়ে থাকে। লাগবে না ওকে রিজার্ভে যেতে, লাগলে লাকড়ি কিনেই নেবে। জঙ্গলে আজকাল অচেনা ছেলেদের দেখা মেলে।
    ওরা সেই জঙ্গলটা পেরিয়ে যাচ্ছে। শালগাছগুলো হৃষ্টপুষ্ট হয়ে এসেছে। সেগুন, তিতা-চাঁপা, চামগাছগুলোও এতো বড় হয়ে গেছে যে একটা মানুষ লাফ দিয়েও নাগাল পাবে না। জায়গাটা থমথমে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। কালো জঙ্গলে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকা জ্বলছে নিবছে।
    “মামী জানেন তো? ব্যাঙ্ক ডাকাতির আগের দিন ওরা বুঝি এখানে এসেছিল। কেউ কেউ বলে সবগুলো ছিল, কেউবা বলে দুটো ছেলে ছিল। আমার চোখের সামনে ছেলেগুলো যেন শূন্যে পাক খেয়ে খেয়ে গাড়িতে চড়ছিল। ওদের কি কম ট্রেনিং আছে বলে ভেবেছো?”
    “টাকাগুলো তো সব নিয়ে গেছে।”
    “অনেক টাকা নিয়েছে! শুধু কি আমাদের এখানেই ব্যাঙ্ক লুঠ করেছে? কত জায়গাতে যে লুটছে। আমাদের এখানে নাহয় কেউ মরেনি। কত জায়গাতে যে মানুষ মেরেছে!”
    “সেই ছেলেটা...” নবীনের ভাইকে মনে পড়িয়ে দেয়া ছেলেটির কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল মালতী।
    “সে সংগঠনের ছেলে ছিল।”
    “এই ছেলেরা চায়টা কী?”
    আন্দোলন করে সেই পার্টিটা তো রাজপাটে বসল। ওদের আর কী চাই! নিয়ম করে রোজ কাগজ পড়ে নবীন, তার দিকে বড় আগ্রহে তাকিয়ে রইল মালতী।মিনতি বলেছিল এরা দেশ স্বাধীন করতে চায়। দেশটা দেখি এমনিতেই স্বাধীন। নবীনকে এসব জিজ্ঞেস করতে ওর লজ্জা হলো।
    “আগেরগুলো তো বিদেশি তাড়িয়ে সোনার অসম গড়বে বলে মানুষকে বোকা বানালো। এরা বলছে অসমকে ভারত থেকে আলাদা করে এনে স্বাধীন করবে। সব্বাই এক, সবারই লুটেপুটে খাওয়া চাই, রাজা হওয়া চাই। মাঝে পড়ে এই আমাদের হয়েছে মরণ।”
    ওরা এসে বস্তির কাছ চেপেছে। নবীন দাঁড়ালো। মালতী এই জায়গাতে ঢুকে যাবে, সে সামনের গলি দিয়ে। নবীন লজ্জা মাখানো হাসি একটা হেসে তাকালো। কিছু একটা বলতে চাইছে।
    “মামী! আমার বিয়ে।”
    “তাই বুঝি? কোথাকার মেয়ে?”
    “আমি যে দোকান থেকে বইপত্র আনি, সে দোকানের ছেলেটিই ঠিক করে দিয়েছে। আমি যে বলেছিলাম ব্যাংকে পাসবই খুলে দিয়েছে বলে, ওকে আমার মাঝে মধ্যে নিজের ভাইয়ের মতো মনে হয়।”
    নবীনের মুখ থেকে লজ্জার হাসিটা চলে গেল। ভাইটির কথা উঠলেই ওর চোখের দিকে আর তাকানো যায় না। পোড়া কয়লার মতো কালো হয়ে আসে, চোখের পাতা পড়ে না।
    মণি দৌড়ে আসছে। কলমটা পেয়ে সে হেসে ফেলল। ওকে দেখে নবীনের মুখ থেকে পোরা কয়লা খসে পড়ল। পাগলাটে চোখের জায়গা নিয়েছে এক টুকরো হাসির ঝিলিক। ভরা সাইকেলটার জন্যে নবীন মণিকে গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে পারে নি। কিন্তু ওর পুরো শরীরে মণির জন্যে আদর উপচে পড়ছিল। মা মরা ভাইটাকে সে কত ভালোবেসেছিল। নিজে অনাথ হয়েও জন্ম দিতে গিয়ে মা মরা ভাইটাকে নিজের হাতে বড় করেছিল সে। মালতীর বুকটা কেমন করে উঠল। ওর গায়ে আঁচ একটা পড়তে না দিয়ে রেখেছিল যে মানুষটি। কত মানুষ যে হারিয়ে গেল। সে ঘোপ করে মণিকে ধরে ফেলল, “মণি, তোকে আর রিজার্ভে যেতে হবে না।”
    “কেন মা?”
    “যেতে হবে না, ব্যস!” মালতীর স্বর ভয়ে কাঁপছে।
    “ ওখানে যেতে হবে না, ওখানে বাজে লোকেরা আসে।” নবীন মণিকে কাঠ পেন্সিল একটা দিল। নবীন চলে যাবার পথে ওরা দু’জনে খানিক তাকিয়ে রইল।
    “কোন বাজে লোক রিজার্ভে আসে মা?” মায়ের হাত থেকে মণি মুড়ির টিনটা নিলো।
    “এই দু’হাতে দেশ লুটেপুটে খেতে চায় এমন মানুষ কিছু।”
    বোঝে না বোঝে মণি মায়ের কথাতে মাথা নাড়ল।
    “লুটেপুটে কীকরে খায় মা?” ছেলেটা ভাবছে, “ সেই যে কাপড়ের দোকানিকে মারল, সেরকম? তাই না মা?”
    ছেলের মুখে অমন কথা ওর ভালো লাগেনি।
    “তুই কিছু খেলি মণি?”
    “খাইনি মা, একসঙ্গে খাবো বলে অপেক্ষা করছি।”
    মায়ে-ছেলেতে দু’জনে দু’জনার গায়ে গা লাগিয়ে ভেতরে চলে গেল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৮495492
  • অধ্যায় একুশ (২১)

    রিজার্ভের দিকে বস্তিটা বাড়বার আর জায়গা নেই। বাড়ছে এদিকটাতে । মাঠগুলো এক কাঠা, আধা কাঠা মাটি নিয়ে তৈরি ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে ভরে গেছে। সেইখানেই এক কাঠা একসালা মাটিতে বুড়া দর্জির ঘর। লোকটার জোয়ান বয়সেও ঐ একই নাম ছিল। বুড়ো নামটা পেল কেন, জানি না । দুটো কারণ হতে পারে । সে বুড়ো মানুষের কাপড়ই সেলাই করে । শহরের চারআলিতে যখন দোকান ছিল তখন বয়স্ক মানুষের পাঞ্জাবি, ফতোয়া বা পেছনে লম্বা লম্বা ভাঁজ দেয়া ধুতির সঙ্গে পরবার সার্ট, বয়স্কা মহিলাদের লম্বা রশি বা বোতাম লাগানো ব্লাউজের দেদার অর্ডার পেত। সেই সময়েই বুড়োর বিয়েও হয়েছিল। মেয়েটি দর্জির থেকে বারো তেরো বছরের ছোট,দেখতেও বেশ সুন্দরী রসেটসে ভরা মেয়ে। কাপড় সেলাই করে করেই বোধহয় গলার খানিকটা নিচে দর্জির মেরুদণ্ডে একটা ভাঁজ পড়ে গেছে। সেজন্যে বয়সের থেকে একটু বুড়োই দেখায় তাকে । বুড়ো দর্জির হাতে তৈরি কাপড় নয়, বাজারের ফুল পাতা আঁকা, চুমকি বসানো, বড় গলার, ছোট হাতা ব্লাউজের থেকে লাল শাড়ির আঁচল পিছলে পিছলে ওর বৌ যখন বেটাছেলেদের সঙ্গে আলাপ জমায় তখন যেন বুড়ো দর্জির বয়সটা আরেকটু বেড়ে যায়। সে সময় বুড়ো দর্জির আয় উপার্জন ভালো ছিল। বৌকে তিনবেলা ভালো খাইয়েছিল। প্রতি বাজারবারে বৌ ব্লাউজ, শাড়ি, পাউডার , স্নো কিনেছিল। নিজে পিছলে ফেলে না দিলেও ওর ভরপুর শরীর থেকে শাড়ির আঁচল এমনিতেই পিছলে যেত।রূপোর পায়েল পরে ওকে হেঁটে যেতে দেখলে মেয়েলোকেরা বলত, “বাঁজা মেয়েমানুষ না? শরীর অমনটি হবেই।” পুরুষমানুষেরা চোখ দিয়ে প্রায় চেটে ফেলতে চাইত বাচ্চার মুখের ছোঁয়া না লাগা, গায়ে কাপড় রাখতে অনিচ্ছুক এই শরীর।
    সে বাজারে যাবার বেলা দর্জির দোকানে বসে যেত। আসবার সময় সঙ্গের সবাইকে নিয়ে পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে বসে চা-জিলিপি খেত, কিন্তু পয়সা নিত এই বুড়ো দর্জির থেকে। বাজারে থেকে নিয়ে আসা মাছগুলো দেখিয়ে স্বামীটিকে তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে ভাত খাবার কথা বলে আসত। সবাই দেখত পুরো দিনটা সেজে গুঁজে এবাড়ি ওবাড়ি করে ঘুরে বেড়ালেও সন্ধ্যে হতেই মেয়েলোকটি বাড়ি চলে আসত। গরম ভাত রেঁধে, জল গরম করে সে আস্তে আস্তে পথ চলতে অভ্যস্ত একজন বাঁকা মানুষের ঘরে ফেরার পথে তাকিয়ে থাকত। লোকটা বেরিয়ে না যাওয়া অব্দি হাজার ডাকলেও সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসত না । কেউ কেউ বলে ও কখনো দর্জিকে স্নান করিয়ে দেয়, ভাত খাইয়ে দেয়। কখনো কখনো কেউবা দেখেওছে শীতকালে সে রোদে বসিয়ে বুড়ো দর্জিকে তেল মালিশ করে দিচ্ছে, নখ কেটে দিচ্ছে; গরমের দিনে বাড়ি ফিরে আসা মানুষটাকে পাখাতে বাতাস করে দিচ্ছে। হাসি-চাপা এই মেয়েটি শুধু একটা কথাতেই রেগে কালভৈরবীর রূপ ধরে । যদি কেউ বলে যে, পেটে বাচ্চা দিতে পারেনা যে লোকটা তার সঙ্গে ও ঘর করছে কেন? কত আছে, ওকে কাছে পেলে ধন্য হয়ে যাবে, তারও কোল ভরবে। এইসব কথা শুনলেই ও ক্ষেপে যায়, চুল মেলে একেবারে পাগল হয়ে যায়। কথাটা শুনলেই ও যেখানে আছে সেখানেই বসে পড়ে, যে বলে তার চুল টেনে টেনে আক্রমণ করতে শুরু করে। কথার কোনও ঠিক থাকে না, চোখ লাল হয়ে আসে। চুল এলো মেলো হয়ে যায়।
    “আমার জামাই জোয়ান নয়! ও যেমন করে রেখেছে, তোদের ক’টা জামাই তোদের রাখতে পেরেছে...! তোদের ঘরে তো দেখি একবেলা ভাত জুটে না, আমার ঘরে তিনবেলা মাছ-ভাত...! দেখগে’ আমার বাক্সে ক’টা নতুন কাপড়...আমার বুড়ো জামাই আমাকে বাচ্চা দিতে পারে না, তোদের জোয়ান জামাইদের বিছানায় তুলে তুলে যত ইচ্ছে বাচ্চা বিইয়ে থাক না, আমাকে দেখে জ্বলে মরিস কেন?”
    সেই দর্জির বৌ ফুল আজকাল ঘরেই মদ তৈরি করে বিক্রি বেচে। মদ খেতে যাবার থেকে বেশিরভাগ লোকই ওর ঘরে তামাশা করতেই যায়। ফুলকে কেন দর্জি মদ বেচার কাজে লাগাতে গেল সেও এক কাহিনি । তখন ফেলানি, বুলেনরা নিজের নিজের বাড়িতে ছিল। শুরু হয়েছিল অসম আন্দোলন। লোকে বুঝে না বুঝে ছেলেছোকরাদের হাবভাব দেখে যাচ্ছিল। সে সময়ে যারা আন্দোলনে নেমেছিল তারা স্বাবলম্বিতার শপথ নিয়েছিল। বুড়ো দর্জির দোকানের সামনে একটা দর্জির দোকান বসল। দোকান মানে দুটো মেশিন আর একদল ছেলেছোকরা । মেশিন নিয়ে যে ছেলেটি বসেছিল সেই ছেলেটিকে ফুলেরা চিনত। বস্তিতে থাকে, স্কুল ছেড়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। কিছু দিন থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গ নিয়েছে । ওর মা ওকে বুড়ো দর্জির দোকানে দিয়েছিল। একমাসের মতো থাকল। কাজ শেখার কোনও আগ্রহ নেই। শেষে দর্জি তাকে অর্ডার আনা, কাপড় দিয়ে আসা ইত্যাদি কাজে লাগালো। সেখানেও সে গোল পাকালো । সেটুকুন অভিজ্ঞতা নিয়ে সে মেশিনে বসেছে । বুড়ো দর্জি ওদের কীর্তি কলাপ দেখতে থাকল। ছেলেগুলো কাপড় সেলাই করবার অর্ডার পেল ঢের। বিচিত্র কাপড়ে ওদের আলমিরা ভরে গেল। একদিন ছেলেগুলো এক দলা রঙিন কাপড় দর্জির দোকানে দিয়ে গেল। সেলাই করবার সময়ও দিল। কাপড়গুলো নিয়ে মানুষটি আরো বেশি বাঁকা হয়ে গেল। কী করে কী করে? যে মানুষ কিনা বুড়ো মানুষের জন্যে কাপড় সেলাই করে, সে এইসব রংচঙে ভরা পিচ্ছিল কাপড়গুলো নিয়ে কী করে? এই ভারি বোঝাটা নিয়ে কী করে? কীই বা করে? সময় পেরিয়ে গেল। গাল-ধমক খেয়েও মানুষটি কাজে হাত দিল না। একদিন সবক’টা ছেলে এসে, দোকান পাট ভেঙে, মেশিনগুলো লণ্ডভণ্ড করে দিল। বুড়োর গায়েও হাত দিল। মানুষটাকে মূর্ছা যেতে দেখে ভাবল বুঝি মরেই গেছে, ওরা চলে গেল। পুরো দুটো দিন একটা রাত পর বুড়োর জ্ঞান ফিরল। জ্ঞানই ফিরল, মেরুদণ্ডের ব্যথাতে নড়াচড়া করা মুস্কিল হয়ে পড়ল। জল এক গ্লাসও তুলে খাবার মতো অবস্থা রইল না । হাত থরথর করে কাঁপে । তারপর থেকেই ফুল বাড়িতে মদ বানিয়ে বেচে । ওর মদ বেচার সময় হলো সন্ধ্যে বেলা । বুড়ো দর্জির বাড়িতে রাত অব্দি লোকে ভর্তি থাকে । শেষ লোকটা না যাওয়া অব্দি দর্জি বসে থাকে । কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলকে সাহায্য করে । একটা কাজই মূলত দর্জি বেশি করে, টাকা পয়সা নেই আর খুচরো পয়সা ঘুরিয়ে দেয়।
    আজ ফুল ফেলানিদের সঙ্গে বাজারে এসেছে। দর্জির জন্যে ওষুধ নেবে আর নিজের জন্যেও টুকটাক কিছু কিনবে । মণির মা, ফুল, কালীবুড়ি, মিনতি, জোনের মা সবাই হাতের পোঁটলাপুটলি সামলে সামলে জোরে পা চালিয়ে এসে বড় রাস্তাতে উঠল। মণির মায়ের হাতে মোড়া, মাথাতে মুড়ির টিন, কালীবুড়ির হাতেও কাঁখে বাচ্চা নেবার মতো করে নেয়া মুড়ির টিন, মিনতির মাথাতে ছোট টুকরিতে ভাদালি পাতা, থানকুনি পাতা, ভাতুয়া শাক, আমরুলের শাকের মুঠো ,জোনের মায়ের হাতের পোটলাতে গরম মশলার প্যাকেট। এই কাজ জোনের মা নতুন নিয়েছে।বেশি করে এলাচ, দারচিনি কিনে ছোট ছোট প্যাকেট করে বেচে। জোনের বাবার হাঁপানির টানটাও বেড়েছে আজকাল। বাজারে যেতেই পারে না । জোনের মা চারদিক সামলেও পেরে উঠছে না ।
    সবাই নিজের নিজের ভাবনায় বিভোর। গেল বাজারে টানা বৃষ্টি দিয়েছিল। এদের সব্বার লোকসান হয়ে গেল। মিনতিকে এক টুকরো শাক ফেলে দিতে হয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি বাড়ি নিয়ে গিয়েও বিক্রি করতেও নিয়ে যেতে পারে নি। কাকে গিয়ে দেবে? বস্তির বাড়ি বাড়িতে এই সব শাক তোলা থাকে। এক বোতল তেলে সাত দিনের কাজ চালায় যারা তারা কি আর সাধ করে এই শাক ওই শাক ভেজে খাবে? ওর চোখে ভেসে উঠল টুকরির শাকগুলো। রিজার্ভে কত কষ্ট করে তুলে আনা শাক ওভাবে ফেলে দিতে হওয়াতে তার মনটাই কেমন হয়ে গেছিল। আজকাল আগের মতো রিজার্ভে যেতেও ভয় করে । কখনো বা এক দল ছেলে পাহাড় থেকে নেমে এসে এক দু রাত এখানে থেকে যায়। ওরা সাধারণত রিজার্ভের ভেতরে থাকে, নদীর পাড়ে এক দু রাত থেকে চলে যায়। সে গেল বাজারবারের আগের দিন ঢেঁকি শাকের খোঁজ করতে করতে নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছেছিল। সেখানে থেকে সাধারণত আর আগে যায় না কেউ। পাহাড় অব্দি ছড়িয়ে পড়া এই অরণ্য এখান থেকেই নিঝুম হতে শুরু করেছে । পাহাড় থেকে নেমে এসে ওরা ওপারেই থাকে । রিজার্ভে ঢুকলেই ওর যেন কী হয়ে যায়, নদীর পাড় ওকে সুর সুর করে টেনে নিয়ে যায়। একবার নদীখানা দেখে না গেলে ও শান্তি পায় না । সেদিনও গেছিল। দুটো লোকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না এত্তো বড় কয়েকটা শিমূল গাছের তলায় প্রচুর ঢেঁকি শাক। ভয়ে ভয়ে ও এগিয়ে গেছিল।
    লোকে বলে শিমূল গাছগুলোর তলায় একটা জায়গা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কেউ কেউ ওখান থেকে রাজহাঁসের মতো ডাক শুনতে পায়। কালীবুড়ি প্রায়ই বলে বস্তিরই বুঝি রাউতা বলে একটা লোক ছিল, তাকে সেই জায়গাতে নীল করে ফেলেছিল। কাউকে কাউকে বুঝি ওখানে প্রকাণ্ড সাপে তাড়া করেছিল। রাজহাঁসের মতো ডাকে, বাসার চারপাশটা পরিষ্কার করে রাখে –এটি বুঝি বিশাল কালনাগ । ঢেঁকি শাকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মিনতির মনে পড়ছিল, মানুষের সাড়াশব্দ পেলেই ঐ কালনাগ তেড়ে আসে। ওর হাত খালি । ছেলেটা ডিম খাবার বায়না ধরেছে । সে ঘোপ করে ঢেঁকি শাকের ঝোপে ঢুকে গেল। একটা না দুটো বড়ই গাছকে স্বর্ণলতাতে ঘিরে ফেলে বেড়ার মতো করে ফেলেছে । বেড়ার পাশটা পরিষ্কার। সে দৌড়ে ওখান থেকে সরে এসেছিল। কেউটে টেউটে নয়, ছেলে একটা হাতে বন্দুক নিয়ে তেড়ে এসেছিল। সে চেঁচিয়ে নয়, কিন্তু স্পষ্ট করে গলা চড়া করে আস্তে আস্তে বলেছিল, “আমরা কাল চলে যাব। সাবধান! যদি কাউকে কিছু বলো।” মিনতি দৌড়োচ্ছিল। লোকে যেখানে নতুন বসতি গড়ছে, জঙ্গল যেখানে পাতলা হয়ে এসেছে সেই খানে এসে ও থেমেছিল। পরের দিন বস্তিতে রটে গেল মিনতি কালনাগটাকে দেখেছে । কালীবুড়ি ওর হয়ে বাতি দিয়েছিল।
    “মিনতি , তোকে কাল কালনাগে তাড়া করেছিল?”
    “না, তাড়া করেনি তো।”
    “ বেরিয়ে এসেছিল?”
    “কত লম্বা?”
    “কালো না হলদে ?”
    “তুই ভয় পেয়েছিলি?
    “ একটা না এক জোড়া?”
    “ফণা তুলেছিল?”
    “রাতে তুই স্বপ্নে দেখেছিলি?”
    সবাই মিলে মিনতিকে প্রশ্নের উপর প্রশ্নে জেরা করতে শুরু করল। মিনতি চুপ করে রইল। ভয়ে ওর চোখের মণি দুটো গোলগাল হয়ে গেছে ।
    “ও ভয় পেয়েছে।”
    “কাল নাগ যদি, তবে জোড়ায় দেখেছে, হবে।”
    “ওর মুখটা দেখ।”
    “হ্যাঁ,কেউ যেন এই ফরসা সুন্দর মেয়েটির মুখখানার উপর ছাই মেখে দিয়েছে।”
    “ ও যদি স্নান না করা শরীরে...”
    “ জোড়াতে দেখলে মেয়েদের শরীরের...”
    মিনতিকে প্রশ্ন করা ছেড়ে কথা বলতে বলতে ওরা একজন অন্যজনের গায়ে গা লাগিয়ে কাছে চেপে এলো। মিনতির মতো ওদের মুখেও যেন কেউ ছাই মেখে দিয়েছে ।
    প্রথমে শুনেছিল মণির মা। মাথার থেকে মুড়ির টিনটা নামিয়ে খানিক দাঁড়ালো । ওকে দেখে অন্যরাও দাঁড়ালো । তারপর কালীবুড়ি শুনতে পেল। তারপরে বাকি সবাই শুনতে পেল শহর থেকে লাগাতার বোম ফোটার মতো শব্দ । গিঁট না খুলেই যেন কেউ একপাতা মরিচ বোমের সলতেতে আগুন দিয়ে দিয়েছে । শব্দটা শুধু তার থেকেও অনেক বেশি । কিসের শব্দ কিছু বুঝবার আগেই ওরা দেখে শহরের দিক থেকে এক দল লোক হুড়োহুড়ি করে দৌড়ে এদিকটাতে আসছে । কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না, লোকগুলো হাত তুলে তুলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আসছে।
    “একেবারে শেষ।”
    “মরার পরেও গুলি করে যাচ্ছিল।”
    “আমেরিকার স্টেনগান।”
    “পুলিশ বাড়িটা ঘিরেই রেখেছিল।”
    “ডিমান্ড ছিল যে।”
    “ টাউনের ব্যাপারীদের মুখিয়াল ছিল।”
    “ সভাপতি ছিল।”
    “ এখন সব ব্যাপারী হয় ব্যাপার করা ছাড়বে, নইলে গিয়ে ওদের পায়ে ধরবে।”
    “গাড়ি গাড়ি আর্মি নেমেছে।”
    “কার্ফিউ দেবে।”
    নবীন এলো ওর বইপত্রের ওপচানো সাইকেল নিয়ে, পোটলাগুলো থেকে টপ টপ করে একটা একটা করে জিনিস পড়ে পড়ে যাচ্ছে। সে গিয়ে মাত্র জিনিসগুলো বাজারে নামিয়েছিল।
    জগু এলো লাল চা, আর নারকেলের নাড়ুর ঘুমটি গুটিয়ে। রমাকান্ত এলো সবুজ মটরের টুকরিটা নিয়ে । টুকরিটা ভেঙে রাস্তাতে মটর পড়ে পড়ে যাচ্ছে আর সেই সঙ্গে যেন ওর চলার পথের চিহ্ন রেখে রেখে যাচ্ছে ।
    বাজারে যারাই গেছিল সব্বাই একে একে ফিরে এলো। বাসা ভাঙলে কাক যেমন করে তেমনি হৈ হট্টগোল করছিল ওরা ।
    মালতীরা রাস্তার উপরের দল বেঁধে দাঁড়িয়ে । হঠাৎ মিনতির কী হলো । এতোক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ যেন ওর বাই উঠল। যেখানকার টুকরি সেখানে ফেলে কাপড় কুঁচকে বস্তির দিকে দৌড় দিল। দুহাত তুলে কাকের ভিড়ের মতো ছুটোছুটি ভিড়ে ও হারিয়ে গেল।
    “আমি সব জানতাম, দেখতে থাক। আরো হবে , সবাই মরবি। কেউ বেঁচে থাকবি না ।”
    সবাই মিলে মিনতির পিছু নিলো। এতোক্ষণ বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েলোকটির মুখে এই ক’টা ভয়ঙ্কর শব্দ শুনে সবার মনে পাক খেয়ে ফণা মেলে দুলে উঠল এক একটা কালনাগ। সবাই যেন পাগল হয়ে গেল নিজের নিজের সন্তান , স্বামী আর বাড়িঘরের ভাবনায়।
    বাসা ভেঙ্গে দিশে হারা কাকের ভিড়ে ছটফট করতে করতে ওরাও এক একজন কাক হয়ে ভিড়ে গেল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৮495493
  • অধ্যায় বাইশ (২২)
    মণির মা ক'দিন ধরেই বুলেনের ওখানে একবার গিয়ে আসবার কথা ভাবছিল। হরি ভাঙুয়ার ছেলেটা আজকাল সবসময় ওর ওখানে বসে থাকে। সে জন্যেই বুলেনের ওখানে যেতে ওর ভালো লাগে না। বুলেনের সঙ্গে ওর কীইবা এতো কথা। গেল বাজারটা মার খেলো, মুড়ি যেমন ছিল টিনে তেমনি আছে। আজ বিশেষ কাজ নেই। অনেক পর আজ ও খানিক অবসর সময় পেয়েছে। মাথাটা আঁচড়ে খালি হাতখানাই মুখের উপর বুলিয়ে ও বেরিয়ে গেল। মণি হবে হয়তো আছে কোথাও। সে আজকাল সময় পেলেই মোড়ের সিং গ্যারেজে গিয়ে বসে থাকে। সে বুঝি কর্তার সিং ছেলেটার থেকে গাড়ি চালানো শিখছে। মাথাতে পাগড়ি পরা ছেলেটা বেশ ক’দিন মণির খোঁজে এসেছে। উঁচা লম্বা ছেলেটার হাসিটা ওর বড় ভালো লাগে। এতো অল্প বয়সে এতো বেশি দায়িত্ব সামাল দিতে পারছে, বাপের হাতের বিদ্যা সবটাই শিখেছে। মালতী দেখেনি মণিকে গাড়ি চালাতে, শুনেছে সে চালায় বলে। শুনলে ওর বড় ভয় করে। গাড়ি একটা চালানো কী চাট্টিখানি কথা? রাস্তা ভর্তি গরু-ছাগল, মানুষজন, রিক্সা-ঠেলা, গাড়ির লাইন। এতো সবের ভিড়ে একটু বেটা ছেলে হয়ে উঠেছে বলেই কি মণি গাড়ি চালাতে শুরু করবে? পাগড়ি পরা ছেলেটা বুঝি মণিকে গাড়ির কাজও শেখাচ্ছে।প্রায় রোজই বিকেলে সে জামাতে তেল মবিল লাগিয়ে ঘরে ফেরে। মালতী কিছু বলে না। শিখুক হাতের কাজ একটা , মণি ওর কীইবা আর বাজে কাজে হাত দেয়? সব্বাই বলে মণি হলো এক সোনার টুকরো ছেলে। ছেলের গম্ভীর মুখখানা মনে পড়াতে মালতীর মুখেও রং পালটে গেল, দেখে মনে হয় এক পশলা বৃষ্টির পর সূর্যকে দেখায় যেমন ঠিক তেমনি। আগামীবার ও মেট্রিক দেবে। ওকে কলেজে পড়াতে হবে। যা করেই হোক পড়াবে, সে মোড়া বানাবে,মুড়ি ভাজবে, কাঁথা সেলাই করবে। আজকাল ও জানে না কোন কাজটাই বা। দরজাটা বন্ধ করে ও এমনিই মুখে হাতদুটো বুলিয়ে নিলো। কী যে ওর অভ্যেস এই একটা। হাতের খসখসে ছোঁয়া অনুভব করল গালে। যে লোকটা লাজুক হাসি হেসে ‘মনে হয় যেন টগর ফুল!’ বলে হাত দুখানা ঠোঁটের কাছে নিয়ে ধরে রাখতে ভালোবাসতো সে যদি আজ এই পচা অশ্বত্থ পাতার মতো হাত দু’খানা দেখত তবে কী ভাবত? কাজকম্ম মালতীর থাকত না বিশেষ, থাকলেও কাজ সেরে অবসর হাত দুখানা নিজের সেগুন পাতার মতো ছড়ানো হাত দুটোতে আলতো করে তুলে ধরত মানুষটা, দিত দু’খানা ঠোঁটের তপ্ত ছোঁয়া। ছোঁয়াটা যেন ওর শরীর দিয়ে গড়িয়ে গেল, পুরোটা শরীর নাড়িয়ে দিল। বন্ধ দরজাতেই সে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তরঙ্গের পর তরঙ্গ। দরজাতে হেলান দিয়ে সে কেঁপে উঠল।
    “কী করছ, মামী?” সাইকেল থেকে না নেমেই ও একটা চীৎকার দিয়ে গেল। নবীনের ডাক, ওর হাসি কিছুই চোখে পড়ে নি ফেলানির। পড়ল শুধু সাইকেলের প্যাডেল মারতে মারতে ওর প্যান্টের ভেতর থেকে প্রকট গোপনাঙ্গগুলো। প্যাডেল মারতে মারতেই সেগুলো অদৃশ্যও হয়ে গেল। এবারে সে প্রায় দৌড়ে কালীবুড়ির উঠোনে কালীমূর্তির সামনে গিয়ে লম্বা হয়ে পড়ল। কালীবুড়ি লেপে রেখেছিল সে জায়গাটা, মালতীর চোখের জলে ভিজে গেল সে মাটি। ধীরে ধীরে ওর শরীরের তরঙ্গগুলো মুছে গেল। খানিকক্ষণ ও হাঁটু মোড়ে কালীমূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল।
    কালীবুড়ি বেরিয়ে এসে প্রথমে ধরতে পারে নি যে এ মণির মা। বুড়ি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আবছা একটা সাদা কিছু চোখে পড়ল বুড়ির। একটু পরে গলা শুনে ধরতে পারল যে এ মণির মা। বুড়ি কাছে চাপল। কাছে গিয়ে মণির মাকে অমন দণ্ডবতের ভঙ্গীতে দেখে একটু অবাকই হলো। কোনদিনই ওকে দেবীর সামনে প্রণাম করতে দেখেনি। বুড়ি গিয়ে মণির মাকে আশীর্বাদের ফুল এনে দিল। দেবার সময় হাতখানা কাঁপছিল। বুড়ির যেটুকু উপার্জন হয় তাতেই একজন মানুষের চলে যায়। কিন্তু ও পাই পয়সাটাও জমায়। বছরের কালীপুজোটা গেলবার বুড়ি করতে পারে নি। এবারে করবেই করবে। কত কষ্টে বুড়ি টাকা জমাচ্ছে মণির মা জানে। জীবনে যা কিছু রোজগার করল সবই কালিমার নামে দিয়ে দিল। ওর মাথাতে নির্মাল্য দিতে গেলে মণির মা বুড়ির হাতখানা কিছু সময় ধরে রইল। এই মহিলাকে কে বাঁচিয়ে রেখেছে? এই মাটির মূর্তি? বুড়ি কি কখনো সাইকেল চালানো জোয়ান ছেলের অণ্ডাশয় দেখেছিল? বুড়িরতো একটা মণিও ছিল না। সে খানিকক্ষণ ঘি রঙের কোঁচকানো ছাল একটাতে প্যাঁচিয়ে রাখা বুড়ির কতকগুলো হাড় পরম মমতাতে বুকের কাছে ধরে রইল। এই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে এই হাতখানা থেকে শক্তিশালী আর কিছুই নেই। ওর মনটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো।
    “মা তোর মঙ্গল করবেন।” কালীবুড়ি হাতটা ওর মাথার উপর রাখল। তারপর গিয়ে যে খাট থেকে নেমে এসেছিল, সেটিতে বসল গিয়ে। আজ বুড়ি চিঁড়ার নাড়ু বানিয়েছে। কিছু দিন থেকে সে কাঁথা সেলাই করতে পারছে না, আন্দাজে আন্দাজেও না। সেই থেকে বুড়ি চিঁড়া মুড়ির নাড়ুই বানাচ্ছে। জগুর বৌ আজকাল বেশি কাজ করতে পারে না। ওর বেমারটা বেড়েছে। জগু ওকে আঠারো বছর বয়সে বিয়ে করে এনেছিল। সেই তখন থেকেই নারকেলের কত কত নাড়ু সে বানিয়ে এলো, জগু লাল চায়ের সঙ্গে বাজারে দোকান দিয়ে এসেছে। এখন মানুষটা করেই বা কী? ওর বৌয়ের এখন নারকেল কুরোবার ক্ষমতা নেই। শরীরে দেয় না। কালীবুড়ি এই সুবিধেটা নিয়েছে। জগু নারকেল কিনে খোসা ছাড়িয়ে , ফাটিয়ে বুড়িকে এনে দিয়ে যায়। বুড়ি নাড়ুগুলো বানিয়ে রাখে। আজকাল মণির মা দেখে আরো অবাক হয়। বুড়ি কালীপুজোর জন্যে পয়সা জমাচ্ছে। সেটুকু পয়সা জমেছে তাতে প্রতিমার খরচও হবে না। তার চোখে ভেসে উঠল মাঝে রাতে সেই যে বুড়ি কালী প্রতিমার সামনে পড়ে কাঁদছিল তার ছবি। কঠিন এই মহিলাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে ওরও মন কেমন করে উঠেছিল। পুজো করতে না পেরে বুড়ির যেন মাথারই ঠিক নেই। বাড়ি ভাড়ার জন্যে যেমন করে তাগাদা দেয়, জগু সেদিন পয়সা দিতে একদিন দেরি করেছিল বলে একেবারে খ্যাঁকখ্যাকিয়ে উঠল। কুষ্ঠ আক্রান্তদের মতো অনবরত পয়সা গুনতে থাকে। ফেলানি জানে বুড়ি একবার রেঁধে তিনবারে খায়। এমনিতেই কম খায়, এখন পাখির মতো খুটোখুটি করে। বুড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সে বেরিয়ে গেল। বুলেন আর সুমলাকে একবার দেখে আসবে। বুলেনের ছেলেটার জন্যে একটা প্যাকেটে মুড়ি কতকগুলো নিয়ে নিলো।
    দেখতে দেখতে বস্তিটা ভরে পড়ল। সে যখন এসেছিল তখন এতো ঘিজিঘিজি বাড়িঘর ছিল না। এখনে একটার গায়ে ঘেঁষে অন্যটা গড়ে উঠেছে। কাল রাতে বৃষ্টি দিয়েছিল। সাত সকালেই আকাশ পরিষ্কার করে রোদ উঠেছে। সে আস্তে আস্তে হাঁটছিল। কোথাও একটা কোকিল ডাকছিল। বহুদিন পরে আজ কোকিল ডাকছে। কথাটা মনে পড়তেই ওর হাসি পেয়ে গেল। কোকিলে কেন ডাকবে না? নিশ্চয়ই ডাকে। তারই কি আর সে ডাক শোনার সময় আছে? বিহু এসেই পড়ছে। মণিকে একটা গামছা দিতে হবে। হঠাৎই ওর ইচ্ছে হলো, সব কাজ বাদ দিয়ে ও একটা তাঁতশাল দিয়ে বসবে । বাড়ির সামনাতে আমগাছের ছায়াতে বসে ও গামছা বুনবে। কাকে কাকে দেবে সে গামছা? অবাক কথা। আমগাছের ছায়াতে তাঁতশাল আছে যেখানে সেই সবুজ শ্যামল গাঁয়ের একটা মানুষও ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল না। এমনকি সেগুন পাতের মতো ছড়ানো ছিটোনো হাতের সেই মানুষটা, অল্প আগে যে ফেলানির ফেটে যাওয়া হাতখানা ঠোঁটে নিয়ে বিব্রত করছিল সেই মানুষটাও ওর চোখের সামনে এগিয়ে এলো না। এলো একদল সহায় সম্বলহীন মানুষ, জাতপাতের চিহ্ন ছাড়া ম্লান একদল মানুষ এসে হাত পেতে একটা একটা করে গামছা নিয়ে গেল। জোনের মা, মিনতি, কালীবুড়ি, ফুল, জগুই, জগুর অসুস্থ স্ত্রী, বুলেন, সুমলা, নবীন, রত্নার মা, এমনকি কাঁপা কাঁপা হাতে পায়ে বাঁকা হয়ে ঝুঁকে পড়া সেই বুড়ো দর্জিও এলো। ওর ইচ্ছে হলো, লেপে পুছে লাল করে রাখা রান্নাঘরে সব্বাইকে বসিয়ে ছাই আর তেঁতুলে মেজে ঘসে সোনার মতো চকচকে করে তোলা কাঁসার বাটিতে পিঠে নাড়ু খেতে দেয়। কী তৃপ্তি করে সেই দৈ চিঁড়ে খাবে মানুষগুলো। মণি ছোট থাকতে যেমন ভরা দুধে ওর বুক দুটো ব্যথায় টনটন করত আজও তেমনি টনটন করে উঠল। কোকিলটা তখনও ডাকছে।
    “ কই যাও মণির মা?” জোনের মা ওর সাদা দাঁতগুলো বের করে হাসছে। স্নান করে আধুলির সমান ফোঁটা পরেছে কপালে, তাতে মেয়ে মানুষটি পাকা জামের মতো চকচক করছে। রোজ যেমন তাকায় আজো মানুষটির দিকে সে মুগ্ধ হয়ে তাকালো। কত সুন্দর শরীর ওর, মুখের গড়নও তেমনি সুডোল। স্বামীর পিঠে কিছু একটা মালিশ করছিল। অনেকদিন হলো লোকটা হাটে হাটে ইঁদুর মারা, আরশোলা মারার ঔষধ বিক্রি ছেড়ে দিয়েছে। মোড়ের রাস্তার দোকান থেকে চাল আধা কিলো নিয়ে আসতেও মানুষটির কষ্ট হয়।
    “ আয়।” জোনের মা ডাকল ওকে।
    “ না গো, আজ আসছি না, বুলেনের ওখান থেকে আসি গে।” সে ফিরে তাকিয়ে দেখল শক্ত সমর্থ স্বাস্থ্যবান যুবতী কেউ যেন শিশু একটাকে তেল মালিশ করছে। একটা গন্ধ এসে নাকে লাগল। জোনের মায়ের উঠোনে এলাচ লেবুর গাছে ফুল ফুটেছে নিশ্চয়। নতুন জল পেয়েছে, এখন তো লেবু, জাম্বুরা এসবে ফুল ফোটার সময়।
    “ কই যাস মণির মা? দাঁড়াতে বলছি যে?” গলা শুনে ও ফিরে দাঁড়াল, মিনতি। মাথাতে এক গামলা কাপড় নিয়ে নদীতে যাচ্ছে। একটু পেছনে পেছনে ওর ছেলের হাতে সাবান আর বালতি। সুন্দর নাক-মুখের থুলথুলে পরিষ্কার ছেলেটিকে দেখলেই মায়া হয়। মালতী ছেলেটার হাতে একটু মুড়ি দিল। মুড়ি পেয়ে ও হেসে ফেলল। ও তাকে আরো কিছু মুড়ি দিল। ওরা নদীর দিকে এগিয়ে গেল।
    সাইকেলে বোঝাই নারকেল নিয়ে জগু ওর পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেল। সে বোধহয় সেই সকালেই নারকেলের খোঁজে বেরিয়েছিল। অসুস্থ সেই মহিলাটি বা কেমন আছে? সেদিন মিনতি বলছিল, অসুখটা বুঝি বেড়েছে। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল দু’পায়ের মাঝে ঝুলে থাকা এক টুকরো লালচে মাংস, শুকিয়ে ফেটে চৌচির মাঠের মতো এক জোড়া চোখ। কানে গুমগুমিয়ে উঠল একটা কথা, “ মরা মরদকে মনে নিয়ে সব করতে পারি, কিন্তু আমার মতো জ্যান্ত স্বামী...।” কেমন বা আছে বৃষ্টিতে না ভেজা মাটির মতো শুকনো সেই মহিলাটি। সে বুলেনের বাড়ি যাবার গলির থেকে পথ পালটে অন্য এক গলিতে পা দিল। দু’তিনটে মানুষকে চলতে হলেও এই গলিতে সামনে পেছনে চলতে হয়। তার উপর দু’পাশে নালা। ছোট ছোট বাড়িগুলোতে ঘরটা দাঁড় করবার জায়গা ছেড়ে আর অল্পই মাটি বাকি থাকে। নোংরা জলগুলো ছোট নালা একটা খোঁড়ে আসবার যাবার রাস্তার দিকে বইয়ে দেয়। রাস্তার দু’পারে নালাগুলোতে ভেসে আছে ভাত, মাছের কাঁটা, শাক সবজির বাকল, নানা রঙের প্লাস্টিকের থলে, ব্যবহৃত নিরোধ, মালা ডি বড়ির প্যাকেট। সে নালাগুলোর দিকে ভালো করে না তাকিয়েই হাঁটবার চেষ্টা করল। অল্প দূরে গিয়ে সে টোকা দিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়ালো। লেপে পুছে পরিচ্ছন্ন থাকত যে বাড়িটা তার কী ছিরি হয়েছে। উঠোনে ঢেঁকি শাক উঠেছে। বেড়াগুলো খসে পড়েছে। ভুল হলো কি? লেপা মোছা বারান্দায় যে রোগা মহিলাটি নারকেল নাড়ু দিয়ে লাল চা খেতে দিত এ সেই মহিলার বাড়ি নয় কি? হতেই তো হয়। ঘরের উপর ঢলে পড়া বরই গাছটা তো দেখি ঠিকই আছে। এই গাছের বরইতে কত কত আচার এই রোগা মহিলা বানিয়ে দিল, আর ওর বর জগু সেগুলো বিক্রি করে গেল। সেই ঝাল-মিষ্টি-টক আচারের স্বাদ মালতীও চেখে দেখেছে , এই বাড়িতেই। সে ঢুকে গেল। বাড়িতে ঢোকার দরজা বলে কিছু নেই। বাঁশ একটাতে সুপারির খোল ঝুলিয়ে বেড়ার নামে যে একটা আড়াল তৈরি করা ছিল তারও একটা দিক বসে গেছে। খোলগুলো খসে খুলে পড়ে এক জায়গাতে জমা হয়ে আছে। উঁই ধরেছে, আদ্ধেক খোল ইতিমধ্যে মাটি হয়ে গেছে, বাকিটাও শীগগির তাই হয়ে যাবে। খোলগুলোর পাশ দিয়ে সে ভেতরে এলো। কোনও সাড়া শব্দ নেই। আজানো দরজার কাছে নারকেলের স্তূপ। ও যে জগুকে সাইকেলে করে নারকেল আনতে দেখেছিল এগুলো সেই নারকেলই হবে। পুরো ঘরটাতেই একটা পচা পচা গন্ধ।
    “কে?” দুর্বল একটা ডাক শুনে সে চমকে গেল।
    “আমি ,মণির মা। এদিকে আয়।”
    এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ঢিগা দিয়ে রাখা ঘরটার পেছনে গিয়ে ছেঁড়া কাঁথার স্তূপ একটা পড়ে থাকতে দেখতে পেল। তেল চিটকে পড়া, সেলাই করা থেকে জলের ছোঁয়া না মেলা এই কাঁথার স্তূপ থেকেই হয়তো গন্ধটা আসছে। সে দেখল দুর্বল ডাকটা এই কাঁথার ভেতর থেকেই বেরুচ্ছে। কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। পুঁজ , রক্ত লেগে আছে কাঁথাগুলোতে। তার ভেতর থেকে মেয়ে মানুষটি ডাক দিল।
    “মণির মা, কে মণির মা?” কাঁথার স্তূপের ভেতরে বসেছে জগুর বৌ। মালতীর নাকে একটা গন্ধ লাগল, কংকালসার মহিলাটির গা থেকেই বেরুচ্ছে।
    “ তোর বেমার...মিনতি বলল...।” সে কিছু একটা বলতে গিয়ে বলতে পারছিল না, গলাতে আটকে যাচ্ছিল। জগুর বৌও ওর কথাগুলো ধরতে পারেনি।
    “ তোকে দেখিনি অনেকদিন, জগু...।”
    জগুর বৌ হাত একটা তুলে জোরে নাড়ালো, যেন একটা শুকনো পেঁপের পাতা ডাল সহ বাতাসে নড়ছে। ভেঙ্গে দু’টুকরো হবেই এইমাত্র।
    “মণির মা তুই আমার বিচার করতে এসেছিস?” মণির মা ভালো করে দেখল গর্তে বসে পড়া চোখজোড়া থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।
    “ কি আর খবর নিবি এই মরা শরীরের?” মহিলার রক্তে পুঁজে ঘায়ে ভরা ঝুলন্ত জরায়ু কাপড়ের থেকে বেরিয়ে এসেছে। মালতীকে সে দিকে তাকাতে দেখে সে দাগে ভরা শাড়িতেই সেটি ঢাকার চেষ্টা নিলো।
    “ ডাক্তার , হাসপাতাল...” সে তাকে চিকিৎসার কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল।
    “ যন্ত্র দিয়ে আর ঢুকিয়ে দিতে পারে না। উঠিয়ে দিতে হবে। হাসপাতালের মহিলা ডাক্তারটি আমাকে খুব গালাগাল করেছে। করলে কী হবে? এটা উঠাতে অনেক টাকা লাগবে, এতো টাকা কোথায় পাব? বুঝলি মণির মা আমার ভেতরে সব পচে গেছে। খালি রক্ত আর পুঁজ, কি যে দুর্গন্ধ।” বলতে বলতে নিজেই নাকে হাত দিল।
    পায়ের শব্দ শুনে দু’জনে ঘুরে তাকালো। জগু। সে ভেতরে ঢুকে কাপড় পাল্টাচ্ছে। বৌ আর মালতী চুপ রইল। সে একজোড়া পরিষ্কার কাপড় পরল। তারপর বেরিয়ে গেল। পেছনটায় যে দু’জন মহিলা বসে আছে তাদের কোনও অস্তিত্বই অনুভব করল না। সে বেরিয়ে যাবার পর ওর বৌ নড়ে চড়ে বসল। পচা গন্ধটা ভোক করে নাকে লাগল।
    “আমি মরলেই ভালো ছিল। তুই কি জানিস এসব অসুখে লোক মরে কতদিনে?”
    “ডাক্তারনীকে...” সে চিকিৎসার কথাটা আবার পাড়তে চাইছিল।
    “ডাক্তারদি কী বলছিল , জানিস মণির মা?”
    “কী বলেছে?”
    “ বলেছে আমার এই অসুখটা হয়েছে কেন?”
    “কেন হয়েছে?”
    “সেই আঠারো বছর বয়স থেকে আমি প্রতি রাতে ত্রিশটা করে নারকেল কুরেছি, পাটায় পিষেছি, সন্দেশ নাড়ু বানিয়েছি। মহিলা ডাক্তার ওকে খুব বকা বকি করেছে।”
    “ঠিক করেছে।” মণির মায়ের হঠাৎ মিনতির বলা কথাগুলো। সে হাতে পয়সা পেলেই ড্রাইভারণীর ওখানে যায়। সে বুঝি একদিন ফুলের ওখানে মদ খেতে গিয়ে ওর হাতে চড় খেয়েছে। মিনতি জগুর নাম শুনলেই চটে যায়। সে বুঝি আজকাল যার তার সঙ্গে গড়াগড়ি করে বেড়ায়। মিনতির বিটকোনো ঠোঁট দু’টোর থেকে বেরিয়ে ঝরে পড়া শব্দগুলো ওর মনে পড়ল। বজ্জাতটা বৌকে খাটিয়ে খাটিয়ে বেমারি করল, এখন তার ডিম দুটোর চুলকানো বেড়েছে।” মালতী আবার বলল, “ভালো করেছে ডাক্তারণী।”
    “ অমন করে বলবি না মণির মা। সে বেটা মানুষ, তাতে জোয়ান পুরুষ। সে বলেই এখনো একজনকে নিয়ে আসেনি। ভাত রাঁধতে না পারলে সে আমার জন্যে কিছু না কিছু রেখে যায়। এই দেখ মণির মা।” কাপড়ের তলা থেকে সে ছোট একটা ব্রেড বের করে দেখালো। “ তাকে আমি কীইবা দিতে পেরেছি, না পেরেছি সংসার চালাতে, না দিতে পেরেছি বিছানার সুখ।” কংকালসার মেয়েমানুষটির কথাগুলো শুনে ওর যেন গায়ে লংকা পোড়া লাগল। ঠিক মিনতির মতো মুখ বিটকে ও হঠাৎই নিজের অজান্তে বলে উঠল, “ তোকে খাটিয়ে খাটিয়ে মারল, এখন তার...।” থেমে গেল সে।
    “কী বলতে চাস মণির মা! সে জোয়ান পুরুষ, জোয়ান পুরুষের খালি বিছানা।” মুখ বাঁকা করে কেঁদে ফেলল জগুর বৌ, সেদিকে তাকিয়ে কেমন এক বিতৃষ্ণাতে মন ভরে গেল মালতীর, ঠিক যেমন মিনতির হয় মুখখানা যখন জগুর কথা বলে, ওরও তাই হলো।
    “ ছেলেমেয়েগুলো গেছে কই?” সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইল।
    “ কী করবে আর? একটা ভাঙ্গাচোরার ব্যবসাতে নেমেছে, একটা রদ্দি জোগাড় করে ফেরে, একটা...।” মহিলাটি কথা বলতে গিয়ে হাঁপাচ্ছিল।“ কী করবে, মা হলো ওদের মরা লাশ।”
    “বাবা কী করে, সে দেখতে পারে না?”
    “ ওর কথা তুই অমন করে বলবি না, সে দু’হাতে জড়িয়ে রেখেছে বলেই দু’মুঠো খেতে পাচ্ছি।”
    হঠাৎ সে উঠল।
    “যাই , বুঝলি। বুলেনের ওখান থেকে আসিগে একটু।” মুড়ির তোড়াটা ওর হাতে দিয়ে ও বেরিয়ে এলো। পচা গন্ধের সঙ্গে কোথাও যেন মিশে গেছে এক সস্তা আতরের গন্ধ। জগু কাপড়ে মেখে বেরিয়ে গেছে। ওর ঠোঁট দুটো মিনতির মতো ভাঁজ হয়ে গেছে, ভাঁজ করা ঠোঁটে বিড় বিড় করছে সেই শব্দগুলো। নালার দিকে তাকিয়ে সে পিক করে থু এক দলা ফেলে দিল। অল্প শান্তি পেল যেন।
    রত্নার মা পিড়িতে বসে বাঁশের শলা চাঁচছিল। সে ডাক দিল।
    “ কী করছ, রত্নার মা?”
    “কী আর করবি, শলা দুটো চাঁচছি।”
    “গেল বাজারটা মার খেল।”
    আমি বাসস্ট্যাণ্ডে গিয়ে দু’জোড়া বিক্রি করে এসেছি। কোনোক্রমে চাল কতকগুলো আছে।”
    “মণি সিঙের গ্যারেজে কাজ করে চালের খরচটা তুলেছে বলেই উপোস করতে হলো না।”
    “তুই হলি বেটার মা।” রত্নাদের ঘর থেকে তখন বুড়ো মানুষটা বেরিয়ে আসছিল কিছু বলতে বলতে। হাতে একগুচ্ছ ঠোঙা। বুড়োর কথাতে দুনিয়ার তেতো মেশানো,
    “ আজ আমার একটা ছেলে থাকত তবে আমাকে কি এই বুড়ো শরীরে এসব করতে হতো?” বুড়ো ঠোঙার তোড়া উপরে তুলে দেখাচ্ছে। মালতীর পাশ দিয়েই বুড়ো বেরিয়ে গেল।
    “রত্নার মা, বুড়ো যে ঠোঙা বানায় এ চোখ দিয়ে পারে?”
    “চোখে সব পারে, খেতে পারে, শুতে পারে, কী করতে পারে না? মা-মেয়েকে গালি পাড়বার সময় বুড়োর গলা শুনবি, জোয়ান মানুষে ওর সঙ্গে পারবে না। কাজের সময় ওর বেটা নেই।”
    “ঠোঙা কে বানালো তবে?”
    “ কে আবার, আমি!”
    “রত্না” রত্নার কথা কিছু ওর কানে আসছে। বেশিরভাগ সময় ও ড্রাইভারণীর বাড়িতে থাকে। জোনের মা বলছিল চাকরের কাজ করে। ওর কানে বেজে উঠে একটা তীব্র মিহি শিষ। একটা গাড়িতে হেলান দেয়া পুরুষ আমার মেয়েমানুষের রোজগারে খায় বলে গালি পাড়তে পাড়তে মাতাল একটাকে নিয়ে যাচ্ছে আরেকজন মানুষ। সেই বাড়িতে, সেইসব মানুষের সঙ্গে...।
    রত্নার মা কিচ্ছু বলেনি, একমনে শলা চাঁচছে।
    “বুকের ব্যথাটা?” সে মেয়েমানুষটির শরীরের কথা, বুকের ব্যথার কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল। মানুষটি কোনও উত্তর করল না। সেও কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এলো।
    ড্রাইভারণীর বাড়িটা পেরিয়ে একটা পাক দিলেই বুলেনের ঘর। ড্রাইভারণী নতুন ঘর তুলছে। নতুন ঘরের টিনে টিভির এন্টেনা বাঁধা। শুনেছে রঙিন টিভি , বড় কাঁচের বড় টিভি। বুড়ো দর্জি বা নবীনের ঘরের ছোট সাদা কালো টিভি নয়। নতুন ঘরের সামনে ড্রাইভারের সাদা রঙের গাড়ি।
    বস্তির ভেতরে ড্রাইভারণীরই অবস্থা ভালো। ড্রাইভারণীর ঘর থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে। বড় কাঁচের বড় টিভির থেকেই হয়তো। সেইটুকু জায়গা ও মাথা নিচু করে পেরিয়ে গেল। কেন জানি ওর মনে হলো কেউ ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। তার মনে হলো যেন গলা শুকিয়ে আসছে।
    বুলেন জাত্রোফা গাছ দিয়ে বেড়া তৈরি করেছিল , এখন এগুলো বেড়ে এমন হয়েছে যে একটা মুরোগও এপার ওপার হতে পারবে না। বেশ সবুজ হয়ে উঠেছে বেড়াগুলো। লিচু গাছটাও দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেছে। গাছাটাতে ছোট ছোট ফুল ধরেছে।বুলেনের বাড়ির উঠোনে সে এক নতুন গাছ দেখতে পেল। ফনি মনসার গাছ একটা বাড়তে বাড়তে ডালপালা মেলে একেবারে মাঝ উঠোনে এসে পড়েছে। গাছাটার চারদিকে বেড়া । দেখলেই বোঝা যায় বুলেনের কাজ। গাছটার চারদিক লেপাপোঁছা করে রাখা, একটা প্রদীপও জ্বলছে। বুলেন হরি ভাঙুয়ার ছেলের সঙ্গে বসে আছে। মালতী ভেতরে ঢুকে এলো।
    “ আয় বৌদি।” বুলেন ওর দিকে একটা কাঠের টুল এগিয়ে দিল।
    “সুমলা কই? ভালো আছে তো?”
    “কী আর ভালো থাকবে? ভাঙা গাছ শেকড় কি মেলবে কখনো?”
    কমলা রঙের একটা দখনা আধা মাটিতে ছ্যাঁচড়ে আধা পরে সুমলা বেরিয়ে এলো। ওর মাথার লম্বা চুলগুলো নেই। কদম ছাট দিয়ে ছেটে ফেলা হয়েছে।
    “ চুলগুলো, চুলগুলো কেটে দিলি কেন?”
    “ উকুন হয়েছিল।”
    “ এই কাপড়টা ও পরবে কী করে? বাজার থেকে একটা ম্যাক্সি কিনে এনে...।”
    ওর কথা শেষ না হতেই বুলেন গিজগিজিয়ে উঠল, “পরতে হবে জাতের কথা আছে, না পরলে হবে কি?”
    “বেজাতের পোশাক পরতে নেই। এখন সমস্ত বডো মানুষকে নিজের পোশাক পরতে হবে।” ভাঙুয়ার ছেলে মালতীর গায়ের কো-অপারেটিভের সস্তা শাড়ির দিকে চোখ বাঁকা করে তাকালো।
    “বৌদি ,তুইও এসব কাপড় ছাড়। নিজেদের পোশাক পর।”
    “নিজেদের পোশাক?” কী বলে বুলেন? বুলেন এতো পালটে গেছে?
    “তোর গায়ে বডোর রক্ত। তুই কিনারাম বডোর নাতনি।”
    সে অবাক হয়ে বুলেনের দিকে তাকিয়ে রইল।
    “ বড়ো সড়ো আন্দোলন হবে। অসম আন্দোলনের থেকেও বড়ো, আমরা নিজেদের রাজ্য নিয়েই ছাড়ব।” হরি ভাঙুয়ার ছেলে যখন কথা বলে চোখগুলো লাল অঙ্গারের মতো হয়ে পড়ে।
    “আন্দোলন হবে?”
    “হবে।” বুলেনের গলার স্বর এই ফণিমনসার গাছের মতো তীব্রগন্ধী।
    “তারমানে আবার গোলমাল হবে?” ওর কানে বেজে উঠল এক হাবাগোবা মানুষের স্বর , “ মাথা নেই, চোখ নেই।”
    কী করে সে ভুলে লোকটার সেই গোঙানোর স্বর, “ দাদু...দিদা, শিমুল গাছের তলায়, বুলাবুলির মাথা...লাল লালা লক্ত।”
    “হবে, গোলমাল, বন্ধ, সব হবে। আমরা রাজ্য আদায় করেই ছাড়ব।” হরি ভাঙুয়ার ছেলের চোখে সে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠা এক অগ্নিকুণ্ড দেখতে পেল।
    “ এগুলো যদি না হয়, এগুলো কি না করলেই নয়?”
    “হবে না, দেখলি না ওরা কী করল? বিদেশী তাড়াবে বলে গদি দখল করল। কোদাল দিয়ে ধন তুলে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। আমাদের কী হলো? আমরা পেলাম কী? আমার বাড়িঘর ধ্বংস করেছে ওরা, আমার বৌ পাগল হলো। চাইই চাই, নিজেদের রাজ্য চাই।”
    হরি ভাঙুয়ার ছেলে চলে গেল। যেতে যেতে ওর শরীরের শাড়িটার দিকে আরো একবার তাকিয়ে গেল।
    “তুই ঐ মিনতি না টিনতি ঐ হারামজাদীর সঙ্গ ছাড়।” বুলেনের স্বর ছোট হয়ে আসছে, “পাক্কা খবর পেয়েছি ওর শরীরে ওই জারজ জন্ম দেয়া লোকটার সঙ্গের অনেকে সারেণ্ডার করবে, সেও করবে। তার পর দেখবি ঐ হারামজাদী রেণ্ডীর বিছানাতে এসে মরা লাশে শকুন পড়ার মতো এসে পড়বে এই সব ক’টা। তোকে বলে রাখলাম।”
    মালতী ঢোক গিলল। সুমলা এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো। ওর শরীরের দখনাটা খুলে গেল। গায়ে শুধু পেটিকোট। পেটিকোটে লাল লাল দাগ। বুলেন দখনাটা ওর শরীরে প্যাঁচিয়ে একটা রশিতে সেটি বেঁধে দিল। পুরো পরিবেশটা—বুলেন, এই দখনা পরা সুমলা সবই যেন কেমন অচেনা ঠেকল মালতীর।
    “যাইরে, মণি আসবার সময় হল। ভাত দুটো বসিয়ে দিইগে’ ।“ ধপ করে উঠে সে বুলেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
    “বৌদি, গাছটাতে একটা প্রণাম করে যা।” বুলেনের ডাক না শোনার ভান করে সে চলে গেল।
    কেন জানি ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। চারদিকে যেন লকলক করে বেড়ে উঠেছে তীক্ষ্ণ কাঁটার ফণিমনসার গাছ। ও সেদিকেই যায় সদিকেই পাতাগুলো ওকে ঘিরে ফেলে। কী করে সে যায়, কোনদিকেই বা?
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৪৯495494
  • অধ্যায় তেইশ (২৩)
    মণি স্নান করে এসেছে। সে আজকাল খুব সকাল সকাল স্কুলে যায়। দশম মানে উঠেছে থেকেই সকালে স্কুলে কোচিং ক্লাস করে। আগামীবার মেট্রিক দেবে। কী করে যে সময়গুলো পেরিয়ে গেল। মণি স্কুল পেরিয়ে কলেজে পড়বে। হবে, তার মণি বড় মানুষ হবে। স্নানে যাবার আগেই বেগুন দুটো গাছ থেকে ছিঁড়ে চুলোর কাছে রেখে গেছিল। গাছটা ঘরের ভিটেতে এনে লাগিয়েছিল সেই। কোত্থেকে যে গুটি বিচি এনেছিল সেই জানে। সে মাটিতে গুঁজে দিলেই গাছ হয়, ফল ধরে। সাদা সাদা বেগুনগুলো ভাতে দিয়ে তেলনুনে ভর্তা করে খেতে সে ভীষণ ভালোবাসে। একদিন মণিরও একটা ঘর হবে। চারদিকে গুঁজে দিলেই ফল হয় যে হাতে সেই হাতের লাগানো গাছপালার ছায়া আর সে –মণির মা। সে গাছের তলাতে বসে নাদুসনুদুস ছেলে কোলে রূপকথার গল্প বলে যাবে। পাখির গল্প, বেড়ালের গল্প, রাজা-রানির গল্প। ভাতে দেবার জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে বেগুনগুলো ধুতে যাবে ডাঁটার চোখা কাঁটাতে বুড়ো আঙুল বিঁধে গেল। কাঁটাও যে সে নয়, একেবারে বরই গাছের কাঁটার মতো। ওর আঙুল থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ে মেখেলার চাদরে লাল দাগ ফেলে দিল। মুখে চোষে সে রক্ত বন্ধ করল। মণি আসতে আসতে তার ভাতও হলো, বেগুন ভর্তাও হয়ে গেল।
    মণি যাবার পর ও মুড়ি ভাজতে বসল। কাল বাজার বার। মোড়ার কাজ করতে করতেই সময় চলে গেল। আজকের দিনটা বসতে পারলেই হয়ে যাবে। মণি রান্না করা ভাত দু’মুঠো খেয়ে গেছে। সে এলে আবার দু’মুঠো বসিয়ে দেবে। মাগুরি ধানের মুড়িগুলো ফুলে ফুলে উঠছে।
    “বৌদি, ও বৌদি!” বুলেনের ডাক। কি যে অসময়ে এসেছে মানুষটা। মুড়িগুলো ফেলে এখন যায় কী করে?
    “ আয় ভাই, এখানে আয়। সে যে পিড়িতে বসেছিল সেটি বুলেনকে এগিয়ে দিয়ে চাদরের আঁচলে মুখখানা মুছে নিলো। খবরের কাগজে প্যাঁচিয়ে কিছু একটা এনেছে বুলেন। সে এলে খালি হাতে আসে না, মণির জন্যে কিছু না কিছু আনবেই। কথাবার্তা বলে, চা পান খেয়ে যাবার বেলা চুপটি করে তোড়াটা রেখে যায়, “এগুলো মণির জন্যে এনেছিলাম গো।” কলাপাতাতে মোড়ে লাই একমুঠো, লাউ এক টুকরো, কলা চারটা, ছোট মাছ কটা।
    কিন্তু আজ সে এসেই কাগজের তোড়াটা খুলল। একটা সবুজ দখনা, পাড়ের কাছে ছোট ছোট হলদে লতা আঁকা। বুলেনের গলার স্বরে ফণিমনসার হুল, “ বেঁচে থাকবার ইচ্ছে আছে যদি এটা পরবি।”
    “কী এটা?”
    “ দেখিস না?” সে কাপড়টা মেলে ধরল।
    “এগুলো রঙিন কাপড়। তুই কেন ভুলে গেলি ভাই? মণির বাবা...।”
    “বডোদের মধ্যে এসব নিয়ম নেই।”
    “ এসব কাপড় আমি কোনোদিন পরিনি...।”
    “ না পরলে নেই, আমি ভালোর জন্যে বলছি, এই বলে রাখলাম।”
    “তোর হয়েছে কী, বল দেখি?” ওর স্বরটা কান্নার মতো শোনাচ্ছিল।
    “কী হয়েছে আমার ঘরে দেখগে গিয়ে।”
    “সুমলার কিছু হয়েছে। বেশি ঘোর উঠেছে কি?”
    বুলেন হনহন করে বেরিয়ে গেল। কী করে না করে ভাবতে বাহতে সেও মুড়ির চুলো সামলে সুমলে বুলেনের পিছু নিলো। কীই বা হলো মেয়েটির! ঘোরের বশে ছেলেটাকেই কিছু করে বসেনি তো? বুলেন ফিরে তাকিয়ে তাকে দেখে দাঁড়ালো।
    “বৌদি তুইই বল, আমাদের এমন অত্যাচার করলে আমরা আলাদা রাজ্য দাবি না করে কী করব? আমি ভাঙুয়ার ছেলের পার্টিতে নাম লিখিয়েছি।”
    “এই পার্টি কী করবে?”
    “আমাদের জন্যে রাজ্য আনবে।”
    “ এই রাজ্যে তোরা একা থাকবি না অন্যদেরও থাকতে দিবি?”
    “কাউকে তাড়াবো না, মিলে মিশে থাকতে হবে। আমাদের রাজ্যে আমাদের কথা শুনে থাকতে হবে।”
    “ একদল তো নিজে একা খাবে বলে রাজা হলো, তোরাই বা একা খাবি বলে কী করিস!” মণির মা হাসল।
    “বৌদি এগুলো হাসি ঠাট্টার কথা নয়। অনেক সয়েছি, আর নয়।” বুলেনের রাগত মুখখানা দেখে সে চুপ করে গেল।

    বুলেনের বাড়ির উঠোনে বসে আছে সুমলা। ওর গায়ে রশি দিয়ে বেঁধে পরানো লাল দখনা ও শরীর থেকে টেনেটুনে খসিয়ে বসে আছে। সুমলাতো ঠিকই আছে। তবে আবার কার কী হলো? ছেলেটাও স্কুলে গেছে। সে প্রশ্নবোধক চিহ্নটা চোখে নিয়ে বুলেনের দিকে তাকালো। বুলেন ফণিমনসার নিচে বসে মাটিতে কিলোচ্ছে। অদ্ভুত এক রাগে মানুষটাকে কালো দেখাচ্ছে। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবার আর সাহস হলো না মালতীর। সে বারান্দাতে বসবে বলে ভেতরে যাচ্ছিল কি একটা গোঙানোর শব্দ কানে এলো। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে তের চৌদ্দ বছরের একটি মেয়ে গায়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে শুয়ে আছে। পাশে বুকে মেখলা পরে মাঝ বয়েসী এক মহিলা মেয়েটির মাথাতে বাতাস করছেন।
    “কী হয়েছে ওর?” মহিলা কিছু বললেন না।
    “কোনও অসুখ করেছে? মেলেরিয়া?”
    বুলেন ভেতরে এলো, রাগে মানুষটা কাঁপছে। ওর রাগটুকু যেন একটুকরো বিধ্বংসী আগুন। চোখের পলকে এই চাল থেকে শুকিয়ে ঠনঠনে অন্য চালে ঝাপিয়ে পড়ছে যেন। মহিলাটির মুখও রাগে লাল হয়ে পড়েছে, “ দেখ, তোদের সরকারে আমার এই কচি মেয়েটাকে কেমন কাক-শকুনের মতো খেয়েছে।” মহিলা মেয়েটির অচেতনপ্রায় শরীর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিলেন। মালতী চেঁচিয়ে উঠল প্রায়। বুকের মাংস খুবলে তুলেছে। পুরো শরীরে দাঁতের দাগ। যৌনাঙ্গে একটা কাপড় গুঁজে দেয়া রয়েছে।
    “পুলিশ, আমাদের সরকারের পুলিশ? আমাদের সরকার...” মালতী মহিলাটিকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সরকারের সঙ্গে ওর সম্পর্ক কী? ওর সরকার বলে কেন বলছে মহিলাটি? মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বুলেনও এলো। সে বেড়ার থেকে একটা দা বের করে মাটিতে কোপাচ্ছে।
    “দেখলি বৌদি, আমার এই পৃথিবীতে আপন বলতে ছিলেন এই পিসিই। ভাতিজি বলেছিল এখানে থেকেই কলেজে পড়বে, ওর পড়ার বড়ো ইচ্ছে ছিল।”
    “পুলিশ কেন?”
    “ গাঁয়ের আরো অন্য অনেকের সঙ্গে সেও মিছিলে গেছিল।”
    “কিসের মিছিল?”
    “আন্দোলনের সময় যে রকম তোদের লোকেরা গেছিল। পুলিশ আমাদের মেয়েদের ছিঁড়ে কুরে খেল। বল বৌদি,তুইই বল এই সরকারের শাসন না থাকত যদি কোন কুকুরের এতো সাহস হতো?” এতো জোরে দা’টা মাটিতে কোপালো যে মাটিতেই বসে গেল সেটি।
    “মিছিল করতে হলো কেন?”
    “নিজের রাজ্যের জন্যে। এই কুকুরদের সঙ্গে আমরা আর থাকব না। দেখবি, তুই চেয়ে থাকবি আমরা নিজেদের রাজ্য আদায় করেই ছাড়ব। একজনকে আধমরা করলি, আরো কত আছে আমাদের দেখতে থাক। হরি ভাঙুয়ার ছেলে পাহাড়ে গেছে, সে বোমা বানানো শিখে আসবে। ওরা ঘুরে এলেই দেখবি, সব ছারখার হবে।”
    “ওহ!” খুব ছোট্ট করে শব্দটা উচ্চারণ করল সে।
    “বৌদি দেখ, তোর গায়ে বডো রক্ত আছে বলেই এগুলো বলছি। তোকে আবারো বলি, নিজের পোশাক পরবি। কিছু হবে না। নাহলে দেখবি আগুনে ছাই হয়ে যাবি।”
    সুমলা ইতিমধ্যে টেনে টেনে দখনাটা খুলে ফেলেছে। ওদের দিকে সে এগিয়ে আসছে।
    “ভাই, তুই শরণীয়া , সুমলা কোচ, তোরা এই আলাদা রাজ্য দাবির পার্টিতে কেন ঢুকলি?”
    “আমার ভাতিজিটা কী ছিল? ও আমাদের রক্তের নয়? সে কী করেছিল? বন্ধুদের সঙ্গে কী হচ্ছে দেখতে গেছিল। আর আমি সুমলাকে বিয়ে করেছি, ওর পেটে আমার ছেলে দিয়েছি।”
    সুমলা দখনাটা লম্বা করে মেলে মাটিতে ছ্যাঁচড়াচ্ছিল , একটা গিঁটে এক টুকরো লেগে ছিল মাত্র। ও এখন ভাত খাবে। ভাত না দিলে খানিক পরেই মানুষটির ঘোর চড়বে।
    “ আমি যাচ্ছি হে, মুড়ির বালি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আজ মুড়িগুলো না ভাজতে পারলে পেটে গামছা। ” সে একটু হেসে বলল, “বুঝলি ভাই, আমি তোদের সব কথা বুঝি না। কিন্তু একটা কথা বুঝেছি , পেটের ভাতমুঠো জোগাড় করা বড় কঠিন কাজ। যে কাজই করিস করবি, কিন্তু আমাদের ভাতমুঠো জোগাড় করবার রাস্তাটা বন্ধ করবি না।”
    যাবার জন্যে গেট অব্দি যেতেই সে দেখে কলাপাতা মোড়া তোড়া একটা ওর হাতে দিচ্ছে বুলেন, “ সৌলফা একমুঠো আছে, মণিকে রেঁধে দিবি।” সৌলফাগুলো মুঠোতে ধরে সে বুলেনের দিকে তাকালো, “ভাই, ঘর একটা উচ্ছন্নে যেতে একরাতও লাগে না, পাততে...।” কেন জানি ওর চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে এলো। সে দ্রুত পথ ধরল।
    বস্তির মানুষগুলো দেখি দৌড়াদৌড়ি করে বিশেষ একটা গলির দিকে এগুচ্ছে। কীই বা হলো? লোকগুলো যে চেঁচামেচি করছে , তাও নয়। মুখ গুমড়া করে আছে। ভয় না পেলে হোক না হোক একটা কিছু নিয়ে কাজিয়া ঝগড়া করবে, হাসি তামাসা করবে, এভাবে থাকে না মানুষগুলো। কীই বা হলো, কোথায় বা কী হলো?
    ঐ যে লাতুর মা। একই চেহারা , জল তেল নাপড়া চুল, অপরিপাটি কাপড়, নোংরা হাত পা। আজ লাতুর মাও চুপচাপ হাঁটছে। সে হাজিরা কাজ করে। কাজ মানে কাপড় ধোয়া, উঠোন লেপা, বাসন মাজা। ওর নোংরা চেহারা দেখে কেউ ওকে কাজে লাগায় না। আবার মানুষটাই নোংরা, ওর ধোয়া কাপড়, মাজা বাসন দেখলে আবার ডাকেও কাজে। উৎসবে অনুষ্ঠানেও ওকে ডাকবার লোক রয়েছে। দাদা বৌদির সংসারের এক কোনে পড়ে থাকে। স্বামী ছিল। বিয়ের পাঁচ মাসের মাথাতে ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। দাদার সঙ্গে এক সঙ্গে কাঠমিস্ত্রির কাজ করত। বোধহয় বিহারি লোক ছিল। লাতুর মা নিজে রেঁধে বেড়ে খায়। ওর একটাই কথা, ওর ভাই বৌ ওর এই অবস্থা করেছে। ওর স্বামী ভালো মানুষ ছিল। বারে বারে সে বলতেই থাকে, তার কিনে দেয়া শাড়ির কথা, দুটো বালার কথা, সে দেখানো সিনেমার কথা, তার দেয়া খাটি সোনার আঙটিটা, সে যে জমিটা কিনবে বলেছিল তার কথা, যে ঘর তুলবে বলেছিল তার কথা। একমাত্র বৌদিটাই কান মন্ত্র দিয়ে দিয়ে ওর মন ভেঙ্গে ফেলেছিল। ওর ছেলে মামা-মামীদের ওখানে থাকে, সেখানেও খায় দায়। মামীর ছেলেমেয়ে নেই। মামার সঙ্গে যোগালির কাজ করে। পুরো দিন রান্দা মেরে , কাঠ কেটে এসে সে মায়ের বক-বকুনির থেকে মামীর হাসতে হাসতে এগিয়ে দেয়া জল এক গ্লাস খেতে ঢের বেশি ভালোবাসে। মায়ের চালা ঘরে কম তেলে, জল ছিটিয়ে ভাজা আলুভাজা, রেশন চালের ভাতের থেকে মামীর হাতের মাছের ঝোলের ভাত খেতে সে বেশি ভালোবাসে। মামার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে গৃহস্থ যদি এভাবে কর, ওভাবে কর বলে বোঝাতে শুরু করে মুখের উপর ফোঁস করে বলে দেয়, “এতো মাথা খেয়ে কাজ করতে পারব না কিন্তু।” নইলে এমনিতে সে বেশি কথা বলেই না। মামা যদি দিন দুইর জন্যে ঠিকাদারের সঙ্গে দূরে কোথাও কাজ করতে যায়, মামী তবে, “আমার ভয় করে, আমার সঙ্গে শুবি আয়। ” বলে নিয়ে চলে যায়। মায়ের চালা ঘর থেকে মামীর সঙ্গে ফেনের নিচে ঘুমোতে ও বেশি ভালোবাসে। ভালো লাগার অনুভূতি, ভরপেট ভাত এবং গোটা দিনের পরিশ্রম। লাতু নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়ে। কখনো বা মামী দাঁত খটমট করে বলে উঠে, “এই পাগলিটার জন্যে একটু শোবারও উপায় নেই!” সে জেগে ওঠে। ওদিকে চালাঘরে মা বকতে থাকে, “রাক্ষসী, সব খেলো সে আমার। আমার ছেলেকে যাদু করেছে, আমার স্বামীটাকেও তাড়িয়েছে।” লাতুর মা কখনো বা কেঁদে ফেলে, “আমাকে এই রাক্ষসী শেষ করেছে।” মামী লাতুর গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, “শুয়ে থাক। পাগলী মানুষ। সকালে আবার কাজে যেতে হবে।” ভালো লাগার অনুভূতির মধ্যে মাঝে মাঝে এই এক মেয়ে মানুষের কান্না। লাতুর ভালো লাগে না, রাগ উঠে। ‘এতো মাথা খেতে পারব না’ , বলে যে নাক ডাকতে শুরু করে।

    আজ সেই লাতুর মাও বকা বকি করছে না, মাথা নিচু করে হাঁটছে। কিসে বা ওর মুখখানা বন্ধ করেছে? আশ্চর্য হলো , ওর পাশে পাশে মামীও। সাপে নেউলে একসঙ্গে! ঐ যে লাতু আর ওর মামা, সঙ্গে ওদের মিতির পার্টিও। জগুও এসেছে। নবীনও। রত্নার বাবা, এমন কি ড্রাইভারও পা চালিয়ে বিশেষ একটা গলির দিকেই এগুচ্ছে। কিছু একটা হলে ছেলে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ড্রাইভার ড্রাইভারণীর কাজিয়া, জগুকে মিনতির মারা চড়টা, হরি ভাঙুয়ার জমি বিক্রি করে পাওয়া টাকাতে লালপানি* দিয়ে শুয়োরের মাংস খাবার আসরে বাপে ছেলেতে হুড়োহুড়ি—এসব ঘটনাই এই মানুষগুলোকে জড়ো করবার পক্ষে যথেষ্ট। কালীবুড়ির জটা উঠে ঘোর লাগা, হাঁপানির শ্বাস টেনে টেনে নীল কাঠের মতো স্বামীকে তেল মালিশ করে জোনের মায়ের হায় হায় করে কান্না , নবীনের একটা ছোট টিভি নিয়ে আসা—এরকম ঘটনা ঘটলে-তো কথাই নেই। কলবল করতে করতে মানুষগুলো ঠিক জায়গাতে এসে জড়ো হবেই। তৎক্ষণাৎ কারণটা জানাজানি হয়ে যায়।
    “কালীবুড়ির ঘোর লেগেছে, আজ জটা হাঁটু অব্দি এসে পৌঁছেছে।”
    “নবীন টিভি এনেছে। আনবেই, বই বিক্রি করে কম টাকা কি পায়?”
    “ করুণার বাবা মারা গেল। বৌটা কী করে? এতো জোয়ান বৌ।”
    “ লাতুর মা ভাইবউকে ঘা দুয়েক মেরেছে। না না, ভাই বৌটাই ননদীকে চেরা কাঠ দিয়ে মেরেছে... পাগলি মানুষ... না হে পাগলি... লাতুর মাই মেরেছে।”
    কারণগুলোর নিজের নিজের ব্যাখ্যাও আরম্ভ হয়ে যায়।
    আজ উল্টো হচ্ছে। লোকগুলো কেমন যেন গুমড়ো হয়ে গেছে। কেউ মুখ খুলতে চাইছে না। কিসের এতো ভয় পেয়েছে লোকগুলো? বুড়ো দর্জি আর ফুলের বাড়ির কাছাকাছি এসে লোকগুলো দাঁড়িয়ে পড়ছে। সেখানে জোনের মা আর মিনতি আগে থেকেই রয়েছে। মিনতির কাছে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? মিনতি মানুষের ফাঁকে ফাঁকে ওকে নিয়ে এগিয়ে গেল।
    বুড়ো দর্জি আর ফুল ওদের ওদের উঠোনের সামনে রাস্তাতে কানে ধরে, হাঁটু মোড়ে বসে আছে। উঠোনে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে ফুলের মদ বানাবার জিনিসপত্র। বুড়ো দর্জি যেন আরো বাঁকা হয়ে গেছে। মাথাটা মাটি ছোঁয় ছোঁয়। চোখা রোদে মানুষটা একটা ছিঁড়ে ফেলা আমরুতের ডগার মতো নেতিয়ে আছে। এমনিতেই বেমারি মানুষ। ফুলের চোখে জল আর ক্রোধ। সে কানে ধরে ধরেই স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে। বুড়ো দর্জির মাথাটা ঘুরছে যেন, চার দিকে ধোঁয়া ধোঁয়া দেখছে। লোকে থ হয়ে দেখছে। কেউ কিছু বলছে না। হঠাৎ মণির মা এগিয়ে গেল। সে ফুলের মাথাতে হাত দিল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ জোড়াতে জল। এবারে ফুল থাকতে পারল না। হাঁটু মোড়েই মণির মায়ের পা দুটো ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল, “মণির মা, আমি কেন মদ বানাই বল? সে কেন মেশিনে বসতে অক্ষম হয়ে গেল বল। বল , মণির মা এই অসুস্থ মানুষটার কী দোষ? যা করেছি, আমি করেছি। আমাকে শাস্তি দে, এই বেমারি মানুষটাকে কেন? কত যত্ন করে মানুষটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি।”
    বুড়ো দর্জি বাঁকা হাড়গুলো যতটা পারে তুলে ট্যাঁরা চোখে ফুলের দিকে তাকালো। চাউনিটা ট্যাঁরা মনে হয় বটে, আসলে বাঁকা ঘাড়ে ওর তাকাতে অসুবিধে হয়। চোখ জোড়া মরা মাছের মতো ম্লান হয়ে গেছে। ফুল ওর পা ছেড়ে দেয় নি, “ তুই বোঝার মানুষ, পারলে আমার মানুষটাকে বাঁচা। দেখছিস না ওর মুখখানা। ও মরলে আমি কার সঙ্গে থাকবরে মণির মা!”
    “চুপ থাক, মদ বানাবি আবার এখন কান্না জুড়েছিস!” মটর সাইকেলে করে আসা দুটো ছেলে ফুলকে ধমকে দিল। সবাই দেখল ছেলে দুটোর কোমরে অস্ত্র চিকমিক করছে।
    “শুন, কেউ যদি মদ বেচিস বা বানাস, বা জুয়ার আড্ডা বসাবি তো কী হবে জানিসই।”
    একটা ছেলে কোমর থেকে পিস্তল বের করে ব্ল্যাংক ফায়ার করল, মানুষগুলো হুড়মুড় করে সরে গেল। কোনও শব্দ নেই। মাটি ধ্বসে পড়ে যেমন তেমনি ঢেলাগুলো ধ্বসে পড়ল। দাঁড়িয়ে রইল শুধু ফেলানি-মণির মা। ফুল ওর পা দুটো ছাড়েনি। ছেলে দুটো মোটরসাইকেল থেকে নেমে ওদের দিকে আসছিল। সে আস্তে আস্তে বলল, “ মানুষটা অসুস্থ, তাঁকে ছায়াতে যেতে দেবেন?”
    “মদ বানাবার বেলা তো সে অসুস্থ ছিল না।”
    “ মদ আমি বানাই, আমাকে শাস্তি দিন। অসুস্থ মানুষটাকে নয়।”
    “চুপ কর , তুই!”
    ফুল চুপ করে গেল। মালতীর স্নিগ্ধ মুখে এক ধরণের কঠোরতা জায়গা করে নিলো, “ অসুস্থ মানুষটা যদি ছায়াতে গিয়ে হাঁটু গাড়ে কিছু হবে বুঝি!”
    “ উঠ ! ছায়াতে যা। ঐ বেটি, তুইও যা!”
    “ না, আমি যাব না! বেমারি মানুষটাকে যেতে দে!”
    বুড়ো দর্জি উঠতে পারে নি। মালতী গিয়ে দর্জির বাঁকা শরীরটা ধরে ধরে ছায়াতে বসিয়ে দিল গিয়ে। সে পিস্তল কোমরে ছেলেদের দিকে না তাকিয়েই ফুলের ঘরে ঢুকে এক গ্লাস জল এনে বুড়োকে খেতে দিল। চাদরের আঁচল ভিজিয়ে সে দর্জির মুখ মুছিয়ে দিল।
    ছেলেগুলো যাবার জন্যে বেরিয়েছে। মটর সাইকেলের শব্দ হচ্ছে। আবার বন্ধ হচ্ছে। ছেলেগুলো এবারে ওর দিকে আসছে। ওর মনে হলো শুকনো কলাপাতায় ভরা গর্ত একটাতে ও ঢুকে যাচ্ছে, এখনই আগুন দেবে, গায়ে এসে লাগবে দাউ দাউ আগুনের এক টুকরো। সে যেন মণিকে কাছে টেনে নিয়েছে। “মণি।” অস্ফুটভাবে সত্যিই সে মণির নামটা উচ্চারণ করল।
    “আপনি আমাদের মানুষ হয়ে এই বেজাতগুলোর হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন কেন?” ছেলেগুলোর কথাতে সম্ভ্রম থাকলেও স্বরটি বেশ কঠিন।
    “ দেখবেন কিন্তু, এই বেজাতদের সবাইকে এখান থেকে উঠতে হবে, আর কথায় আছে না নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না!” এই ছেলেটার স্বর আগেরটার থেকেও কঠোর।
    “লোকগুলো যাবে কোথায়?” মালতীর স্বর কান্নার মতো শোনালো। মটর সাইকেলের শব্দে ওর ক্ষীণ স্বরও মিলিয়ে গেল। ছেলেগুলোর দিকে সে তাকিয়ে রইল। ওরা কী করতে চাইছে? ওদের স্বাধীন দেশে কে থাকবে? আর বুলেনদের নিজের রাজ্যে? কী কী ভাগ করবে এরা? মাথার উপরের আকাশটা? নদীর জল? এই গাছগুলো? মাটি? না মানুষকে? ও আর কালীবুড়ি? সুমলা আর মিনতি? জোনের মা আর জগুর বৌ? কালীবুড়ি আর ফুল? কী করে ভাগ করবে? কেটে টুকরো টুকরো করে? নদীতে বাঁধ দিয়ে? জমিতে গড়খাই দিয়ে? গাছগুলো মাটিতে গড়িয়ে দিয়ে? এ রাজ্য থেকে ঐ রাজ্যে ওরা কি উড়ে যেতে দেবে ঘরমুখো পাখির দল? মায়ের সঙ্গে মাছের পোনাগুলোকে কি উজিয়ে আসতে দেবে? ভেসে যেতে দেবে ফুলের সুবাস? এক গাছের ফুলের রেণু আর গাছে নিয়ে যেতে দেবে কি ভোমরাকে?
    সে ঘরে ফিরে এলো। বেলা মাথার উপরে এসে গেছে। সমস্ত কাজগুলো পড়ে আছে। মুড়িগুলো ভাজতে হবে, কাপড় ধুতে হবে, ভাত রাঁধতে হবে। কোনটা রেখে কোনটা করে ? আকাশের কোনে কালো মেঘ জমেছে। বৃষ্টির কথা বলা যাবে না। এখনো আসতে পারে, রাতেও আসতে পারে। কাপড় ক’খানা না শুকোলে দিগদারি আছে। সেই সকালে বেগুন ছিঁড়তে গিয়ে চাদরে দাগ লাগিয়ে দিল। রক্তের দাগ তাড়াতাড়ি না ধুলে যাবে না, শুকনো তো দূরেই থাক। বাজারে পরে যাবার এই একখানাই আছে। নদীতে যাবার সময় নেই। আর নদীতে চাড়ি ভরে কাপড় নেবার ওর আছেই বা ক’টা?
    সে চাদরটা আর ছোটখাটো কাপড় কতকগুলো নিয়ে কালীবুড়ির কলের পাড়ে গেল। পাথর ফেলে কলের পাড়টা বেশ ভালো করে তুলেছে মণি। মণির কথা ভাবলেই তার গর্ব হয়। পাথরে সে চাদরের দাগ লাগা আঁচলটা মেলে ধরল। বেশ বড় করে লেগেছে দাগটা। সেখানে কাপড় ধোবার সাবান খানিক ঘসে ও বসে রইল। এ ওর রক্তের দাগ। কার কার রক্ত মিশে আছে এই দাগে?
    ওর দিদিমা মৌজাদারের মেয়ে রত্নমালার?
    ওর দাদু হাতির মাহুত কিনারাম বডোর?
    মায়ের রক্তে কার রক্ত বেশি ছিল? রত্নমালা না কিনারামের? না বাবা ক্ষিতীশ ঘোষের রক্তই একটু বেশি আছে ওর রক্তে?
    আর সেই মানুষটা? ওর কোলে বাচ্চা দিল যে! তার রক্ত কি সিঁদুর হয়ে ওর কপালে ভাস্বর হয়ে ছিল না?
    দিদিমা রত্নমালার কামরাঙাহারটা।
    দাদু কিনারামের মায়ের বওয়া দখনাটা।
    মায়ের সোনার কাজ করা শাখা ক’গাছা।
    ছেলে হলে মণির বাবার কিনে দেয়া সেই বড় ফুলের ছাপ থাকা মুগার কাপড় জোড়া।
    কী পরবে ও? কী নেবে ও? বেঁচে থাকবার ইচ্ছে হলে শাখাগুলো খুলে রাখতে বলেছিল বৈশ্য। বুলেন বলল, বেঁচে থাকবার ইচ্ছে থাকলে দখনা পরতে। বন্দুকধারী ছেলেগুলো বলল বেজাতের লোকগুলোর সঙ্গে থাকলে বেঁচে থাকতে হবে না। কী করে বেঁচে থাকবে সে?
    মেঘ অনেক উপরে উঠে এসেছে। বৃষ্টি রাত অব্দি অপেক্ষা নাও করতে পারে। অল্প পরেই যদি চলে আসে তবে আর মুড়িগুলোও ভাজা হবে না। চালটাতে বেশ ভালো করে একটা ফুটো হয়েছে। অল্প বৃষ্টি দিলেই হুড়হুড় করে জল পড়ে। আজ মুড়িগুলো ভাজা না হলে কাল আবার বাজার আছে। সে হাত চালিয়ে চাদরে সাবান মাখিয়ে কচলে দিল। রক্তের দাগ উঠে গেল। কাঁচা রক্তের দাগ, বেশিক্ষণ হয় নি , তাই সহজে দাগটা উঠে গেল।
    সে কাপড়ক’টা মেলে মুড়ির খোলাতে গিয়ে বসল।
    বেঁচে থাকবার জন্যে ওকে এখন এই ছেঁড়া শাড়িতেই শরীর ঢেকে আগে মুড়িগুলো ভাজতে হবে। পারলে মোড়াদুটোর কাজও শেষ করতে হবে। মণি আসবে অল্প পরেই, ভাতদুটোও বসাতে হবে। ওর রান্নাঘর থেকে মুড়ি ভাজার গন্ধটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫০495496
  • অধ্যায় চব্বিশ (২৪)
    রাতে হু হু করে তুফান দিয়েছিল। মাঝরাতে গিয়ে বন্ধ হয়েছিল। কালীবুড়ি পুরো রাত হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বসে ছিল। কিসে যে পেয়েছে এই বুড়িকে , একটা কড়ি পয়সাও খরচ করতে চায় না। মাথাতে সেই এক চিন্তা, দুবছর মায়ের পুজো করতে পারে নি, এবারে করতেই হবে। এমনিতেই বুড়ি কম খায়, আজকাল চড়াইর সমান খায় বোধহয়। দুমুঠো ভাত বসাবে, একটা আলুতেও যে পয়সা খরচ করবে-- কষ্ট পায়। রিজার্ভের জঙ্গলে যায় যদি তবে কচু ঢেঁকী দু'মুঠো নিয়ে আসবে, নাহলে খার শাকের পাতা, নরসিংহ বা ভাদালি পাতা সামান্য বেটে ভাত-মুঠো খাবে। তাও একবেলা রাঁধবে । ঘরে খুটা পাল্টায় না বুড়ি। পচা খুটাতে হেলে পড়া ঘরটাতে সামান্য বাতাস দিলেই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বসে থাকে বুড়ি। সেই বুড়িকে দেখে কেউ ঘুমোতে পারে? ফেলানিও পারে নি। ওদের ঘরের খুটাগুলো মণি একদিন বুলেনকে বলে ঠিক করিয়ে নিয়েছিল। বুড়িকেও বলেছিল সে। আলু একটা, ডাল এক পোয়াতে পয়সা খরচ করতে কষ্ট হয় যে বুড়ির সে বাঁশ খুটাতে পয়সা ঢালবে?
    সে সময় তুফান ধরে এসেছিল। সে আর মণি গিয়ে বুড়িকে ডেকে শোবার জন্যে চাপাচাপি করেছিল। মণি বিছানাতে পড়বামাত্রই কাঠ হয়ে যায়। কালীবুড়ির বোধহয় একটু তন্দ্রা এসেছিল। সেই শুধু বিছানাতে পড়ে ছিল মাত্র। ভাত ঘুমটা ভালো করে হলেই সে এক ঘুমে রাত পার করে দেয়। মাঝে ঘুম ভাঙলেই রাজ্যের চিন্তা এসে ওকে চেপে ধরে। সেদিনও ধরেছিল। রাত বোধহয় একটা দেড়টা বেজেছিল। মিনতি এসে দরজাতে টোকা দিল।
    “ ও মণির মা, উঠ না একটু। দরজাটা খোল তো। । ঘুমিয়ে আছিস বুঝি? উঠ তো মণির মা।”
    মিনতির ডাকে ক্রমেই ধৈর্যচ্যুতির আভাস। সে জেগেই ছিল। চাদরটাও গায়ে চাপাতে দিচ্ছেনা ।
    “মণির মা, ও মনির মা! উঠ না একটু।”
    ওর একটু রাগই চড়ল। “যাচ্ছি দাঁড়া, কি এতো হুড়োহুড়ি শুরু করেছিস!” ওর চিন্তাও হলো, কীইবা হলো এই মাঝরাতে? মিনতির ঘরের সামনে একটা কদম গাছ রয়েছে। সেইটেই বাতাসে উল্টেপাল্টে পড়েনি তো ওর ঘরে? না ছেলের অসুখ কোনও? দরজা খুলে দেখল ছেলের হাত ধরে মিনতি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ছেলেটার ধবধবে সাদা মুখখানা ঝিলিক দিচ্ছে। রোজ যেমন মনে হয়, আজো তার মনে হলো ছেলেটার মুখে যদি একটু হাসি থাকত। একেবারেই হাসে না ছেলেটা। মিনতির মুখ ম্লান হয়ে আছে। সে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। দরজা খুলে ভেতরে ডাকল, “আয়।” মিনতি ঢুকে এলো।
    “ভাত খেলি?”
    “না।”
    “ওকে কী দিলি?”
    “কিছুই দিই নি।”
    সে সকাল বেলার জন্যে ডেকচিতে সব সময় সামান্য ভাত রাখে। আজো আছে। প্যাঁজ একটা কেটে তেল নুন দিয়ে একটা থালাতে ভাত বেড়ে সে মিনতির দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা দু-গ্রাসের মতো খেয়ে ঘুমে ঢলে পড়ল। মিনতি থালা চেঁছে ভাতগুলো খেলো। শুয়ে পড়া ছেলেটাকে সে মণির পাশে শুইয়ে দিল। কাত পাল্টে মণি আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
    মিনতি বেড়াতে হেলান দিয়ে বস্তাতে বসে আছে। মালতী কাছ চেপে গেল। দু’জনেই নীরবে কিছু সময় বসে রইল। হঠাৎ হুট করে উঠে দাঁড়ালো।
    “আয়”। মুড়ি ভাজবার চালার দিকে এগুচ্ছে মিনতি। মালতীও কালির বোতলে তৈরি বাতিটা নিয়ে ওর পেছনে এগুলো। সেখানে গিয়ে আবার মিনতি বেড়াতে হেলান দিয়ে বসল। বাতিটা রেখে সেও বসল। কেমন যেন করছে মেয়েটি। কীই বা হলো! ওরও বুকে কাঁপন ধরল। বাতিটা নিভিয়ে দিল মিনতি। বাইরে তুফানের পরে জোৎস্না উঠেছে। মুড়ি ভাজবার চালার ভাঙ্গা বেড়া দিয়ে অল্প অল্প জোৎস্নার আলো ভেতরে আসছে।
    “সে এসেছে?”
    “আসেনি।”
    “ তবে আর এই রাতে ঘর ছেড়ে এসেছিস কেন? ঘরের উপরে গাছ পড়েছে?”
    “ না, পড়ে নি।”
    “ ঘরে এখন কে রয়েছে?”
    “ ওর চার বন্ধু এসেছে।”
    “ কখন এলো?”
    “ওই তুফান আসতেই।”
    “ক’টা এসেছে বললি?”
    “চারটা”
    “ কী করছে?”
    “ শুয়ে আছে।”
    “ভাত রেঁধে খাইয়েছিস?”
    “না, ভাত যে খাবে সে অবস্থাই নেই ওদের।”
    “কেন?”
    “সবক’টার বেমার। দু’টোর রক্ত আমাশা, রক্ত পায়খানা করছে। দু’টোর গায়ে জ্বর!...এই মণির মা, এরা বস্তির ছেলে নয়, গাঁয়ের কাদামাটি ছেনে বড় হয় নি। ভালো জিনিস খেয়ে সুখে আরামে বড় হয়েছে। এরা বড় চাকরি করে আরামে থাকতে পারত। কিসের সন্ধানে বেড়াচ্ছে ওরা?”
    “কখনো বা মানুষকে আগুনে ডাকে, জলে ডাকে, পাহাড় ডাকে। এদেরকেও ডেকেছে। না গিয়ে থাকতে পারে না।”
    “ছেলেগুলোকে জোঁকে খেয়েছে, পুরো শরীরে বসন্ত গুটির মতো ফুলে ফুলে উঠেছে। পা ফুলে ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে। এসেই আমার দেয়া লাল চা আর মুড়ি খেয়ে শরীর এলিয়ে সটান পড়ে আছে।”
    “এসেছে কোত্থেকে এরা?”
    “ বলতে পারব না, কিন্তু এটা ঠিক যে বহু দূর থেকে এসেছে।”
    “তোর ঘরেই আসে কেন ওরা? ওর জন্যে?”
    “শুধু ওর জন্যেই নয়। একবার এলো, ভাত এক মুঠো পেলো, শুতে পেলো, আসতে থাকে আর কি। রিজার্ভের গা-ঘেঁষা বলে এখানে এসে ঢুকতেও সুবিধে পায়। পাহাড় থেকে নেমেই রিজার্ভের ভেতর দিয়ে আমার ঘরে এসে ঢোকতে পারে।”
    “তুই কেন ওদের আসতে দিস? মিলিটারিতে পেলে চ্যাপ্টা বানিয়ে দেবে।”
    মিনতি চুপ করে রইল।
    “ কথা বলিস না কেন? তোর ঘরে ওদের ঢোকতে দিস কেন?”
    সে একই রকম ভ্যামচা মেরে বসে রইল।
    “ওর সঙ্গের বলে। ওর খবর নিয়ে আসবে বলে? কিসের এতো টানলো তোর তার জন্যে? কী পেয়েছিস ওর থেকে? মরবি তুই, তার জন্যেই একদিন মরবি।”
    মিনতির সেই পরিচিত ভঙ্গিমা, কোপ খাওয়া সাপের মতো ফোঁস করে উঠল,
    “তার কথা আনছিস কেন? সে কী করেছে আমাকে? তোদের হিংসে, সবার হিংসা, ওর মতো একটা মানুষ তোদের দিকে চোখ তুলেই তাকাবে না। সে আমাকে ভালোবাসে, তার ছেলে আমার কোলে। তোদের হিংসা।”
    মিনতির এসব কথা বহু চেনা কথা। সে কিছু উত্তর দিল না। অল্প শান্ত হলো মিনতি। মুখে তার গভীর চিন্তার ছাপ।
    “বুজলি মণির মা, ওদের বড় কিছু একটা বিপদ হয়েছে।”
    “পুলিশ-মিলিটারিতে তাড়া করেছে?”
    “ওরা পুলিশ-মিলিটারিকে ভয় করে না।”
    “তবে, কী হয়েছে?”
    “ আমি কথাগুলো ভালো করে ধরতে পারি নি।”
    “কী করে বুঝলি তবে বিপদ হয়েছে?”
    “ ওরা এসে ঢোকবার পরে আমি ওদের গরম জল করে দিলাম। ওরা মুখ হাত ধুলো।”
    “গরম জল করে দিলি কেন? বৈশাখ শেষ হয়ে আসছে।”
    “ও এসে সবসময় বলে ‘একটু গরম জল করে দে তো মিনতি।’ আগেও বলত। আমি শহরের বাড়িটাতে কাজ করবার সময়েও ও এসেই সব সময় গরম জল চাইত।”
    “তার জন্যে ওর সঙ্গীগুলোকেও দিলি।” মিনতির মুখে ওর কথা শুনলে সবসময় যেমন শরীর গা রি রি করে উঠে, আজও উঠল। বলে লাভ নেই। মিনতি ওর জন্যে আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারবে।
    “তার পর লবণ চা আর মুড়ি দিলাম। আমাশাতে ভুগছে যে দু’টো ওদের ডালিমের কলি দু’টো পুড়ে রস করে অল্প অল্প দিলাম। ওরা বলল, ‘আপনি শুয়ে থাকুন। আমরা রাত না পোহাতেই চলে যাবো।’ আমার বিছানাটা ওদের ছেড়ে দিয়ে আমি চুলোর সামনে বসে ছিলাম। ছেলেটাকে একটা বস্তাতে শুইয়ে দিয়েছিলাম। আমার ছেলেটাকে দেখে ওদের একজন কী বলেছিল, জানিস?”এখন ওর কথা বলবে। ঠিকই ওর মুখখানা লাল হয়ে এলো, “ও একেবারে জিতদার মতো হয়েছে দেখতে।” মিনতি খানিক চুপ করে রইল। ওর বুকে বুঝিবা রাতের তুফানটাই হু হু করে ছুটছে।
    “তার পরে কি হলো? তুই কিছু বিপদের কথা বলছিলি।”
    “ওদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়েছিল।”
    “কী নিয়ে হয়েছিল?”
    “ আমি সব কথা বুঝি নি।”
    “তবু...।”
    “প্রথমে ওরা কোনও এক বিদেশী পার্টিকে গালি পাড়ল। সেই বিদেশের পার্টিটা বুঝি ওদের বন্দুক-বোমা চালাতে শেখায়। পার্টিটা বুঝি অনেক টাকা চেয়েছে। সেই টাকা দিতে এরা বুঝি চা-বাগান থেকে টাকা পয়সা তুলেছে।”
    “সে আর কি এমন বিপদের কথা হলো? বন্দুক বোমা চালায় এমন সব পার্টিই টাকা পয়সা তোলে। দেখিস নি বুড়ো দোকানীকে কী করে মারল?”
    “আমি বললাম না, যে সব কথা বুঝি নি। কী যেন গণ্ডারের খড়্গের কথা বলছিল, বিদেশি পার্টিটা বুঝি গণ্ডারের খড়্গ চেয়েছিল। ওদের একজন কহঁরা বলে এক জায়গা থেকে দু’টো গণ্ডার মেরে বুঝি ওদের লিডারকে দিয়েওছিল। সেই কথা নিয়েই এখন দু’ই পার্টির ছেলেদের মধ্যে বেশ রাগারাগি। ওরা বিদেশি পার্টির জন্যে কী যেন ডেগার না কি একটা জিনিস আনা নেয়া করেছিল। সেই নিয়েও রাগারাগি। বন্দুক চালানো শেখাবে বলে কথা দিয়ে ওদের দিয়ে বুঝি ব্যাঙ্ক ডাকাতিও করিয়েছিল। এতো কিছু করবার পরেও বুঝি ঐ পার্টিটা এমন বন্দুক –বারুদ দিল যে সেগুলো ফুটেই না।”
    “বিদেশি দলটি ওদের মারবে বুঝি?”
    “ সে হয়তো নয়। কিন্তু একটা কথা ঠিক যে ওদের নিজেদের ভেতরে ভাগ হয়ে গেছে। একটা অংশ পার্টি ছেড়ে দেবে।”
    “পার্টি ছেড়ে দিলে পুলিশ –মিলিটারিতে কিছু করবে না?”
    “কী জানি, বলতে পারব না।”
    “ সে কী করবে?”
    মিনতি চুপ করে রইল।
    “তুই জিজ্ঞেস করিস নি?”
    “করেছিলাম।”
    “কী বলল?”
    “সেও পার্টি ছেড়ে আসবে।”
    “এলে কী হবে?”
    “জানি না।”
    “ সে আসবে বলে জেনে তোর ভালো লাগছে?”
    সে চুপ করে আছে।
    “সে ঘুরে এলে তোকে আর ছেলেকে নিয়ে যাবে?”
    মিনতি চুপচাপ।
    “তুই তাকে আবার বিছানাতে তুলবি?”
    সে সেই যে চুপ করেছে, চুপই রইল।
    “ও তোকে টাকা পয়সা দেবে?”
    না, ওর কোনও রা নেই।
    “তুই কী আশা করে আছিস?”
    ওর মুখে টু শব্দটি নেই।
    এবারে মণির মা ক্ষেপে গেল। “মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছিস যে! এই আমি বলে রাখলাম। তোকে কুশিয়ারের মতো আচ্ছা করে চিবুবে, ছিবড়েটা ফেলে রেখে চলে যাবে। তুই পড়ে থাকবি ঐ কুশিয়ারের চিবোনো ছিবড়ের মতো। আমি বলে রাখলাম।”
    ওর মুখ থেকে এবারেও কোনও শব্দ বেরুলো না।
    বাইরে আলো ফুটছে। পাখি ডাকছে। একটা কাক কা কা করে পাশ দিয়ে উড়ে চলে গেল।
    “যা গে যা, ওরা চলে গেছে। আমিও একটু গড়িয়ে নিই।”
    শুয়ানো ছেলেটাকে কোলে তুলে মিনতি চলে গেল, একই রকম মনে মনে, মুখে কোনও শব্দ না করে। মালতীও মণির পাশে কাত হলো, নিঃশব্দে।

    মণির মায়ের ব্যাপার আজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। মোড়া যে কয় জোড়া ছিল একটি লোকেই নিয়ে চলে গেল। মুড়িগুলোও চলে গেল। ‘কলমদানি’ ধানের গোটা গোটা মুড়ি যারই নজরে পড়ল সেই নিয়ে গেল। আজকাল মণি বাঁশ বেতের ছোটখাটো জিনিস মোড়ার সঙ্গে বানিয়ে দেয়। এই কলম পেন্সিল রাখার বাঁশের চোঙা, ছোট ছোট বাঁশের ধুচুনি, ছোট ফুল তোলা চারকোণা ফুলের সাজি। সেগুলোও গেল,
    শুধু ঐ ধুচুনি দু’টো বাদে। আজ জোনের মা, মিনতি একজনও আসেনি। ওর আর এই ধুচুনি দুটো নিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে গেল না। মিনতির সঙ্গে বসে বসে গোটা রাতে ঘুমের ক্ষতি হয়েছে। শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। সে যাবার জন্যে তৈরি হলো। মাথাটাও কামড়াচ্ছে যেন। লাল চা এক কাপ খেতে পারলে ভালো হতো। সঙ্গের ওরা ক’জন থাকলে জগুর দোকানে চাপ এক কাপ খেতে পারত। নবীন বাজারের উলটো দিকে পথের পাশে বসে। তাকে দেখে ডাক দিল---
    “মামী, বাজার আঁটালেন বুঝি?”
    “সেই মনে কর।”
    “ধুনুচিগুলো বেশ সুন্দর হয়েছে তো, দেখি তো।”
    সে নবীনের বই-খাতার দমের উপরেই ধুনুচিগুলো রাখল।
    “কে বানালো? মণি?”
    “ আর কে বানাবে?”
    “ বুনোনটা দেখো তো, কেমন ফুল তুলে তুলে বেঁধেছে। আমাকে একটা দিয়েই যাও।”
    সে বসল। আজকাল সে যেখানে সেখানে জোনের মায়েদের মতো হাত-পা মেলে বসতে পারে। চা খেতে পারে, বড় গলাতে দরদাম করতে পারে। কোনও রকমের সংকোচ নেই।
    “ নে তবে।” ওর মুখের থেকে তুমি-তামি চলে গেছে। জিভের ডগাতে শুধু তুই-তোকারিই নেচে থাকে।
    “দিন তবে মামী, দু’টাই দিন। বাড়িতে আলু-প্যাঁজ মাটিতে গড়াগড়ি করে থাকে।”
    “বড় সংসারী হয়েছিস! ব্যাপারখানা কী?”
    নবীন হাসল।
    “এক কাজ কর, ধুচুনি বাবদ পয়সা লাগবে না। মণির জন্যে খাতা দিয়ে দে, হিসেবে মিললে
    রাবারে পেন্সিলেও দিয়ে দিবি।”
    “চা এক কাপ খান, মামী।”
    নবীনের এই আপনি টাপনি, তুমি তামি গুলো ওর কানে বাজছে।
    “ এই নবীন শহরের বাবুদের মতো কথাগুলো বলিস কেন?”
    ওর কথা অনেকটাই জোনের মায়ের মতো শোনাচ্ছে।
    “ আর হবে, মামী!”
    মালতীর মুখের হাসিটা বড় খোলামেলা।
    “ চা খাওয়াবি যদি জলদি দে। ঘরে গিয়ে শুতে হবে, চোখজোড়া টান টান করছে।”
    “রাতে শোন নি? গোটা রাত বসে বসে মুড়ি ভেজেছেন কি মামী?”
    ছোট ছেলে একটা চা দিয়ে গেলো। পা মেলে সে চায়ে চুমুক দিল।
    “মিনতি এলো মরবার জন্যে। ঠিক তুফানটার পরেই।”
    “ ও কেন এসেছিল এতো রাতে? তুফানে ঘরে সুপুরি গাছ পড়েছিল কি? আমি ওকে বলেছিলাম,
    একটা না দুটো সুপারি গাছে ফাট দিয়েছে। ঝড় একটা এলেই ভাঙ্গবে।”
    “ ঘরে ওর আসল ‘তামোল’ই১ ভেঙ্গেছিল। একটা দু’টা নয় , গোটা গোটা চারটা।”
    নবীনের স্বর ছোট হয়ে এলো, “আবার এসেছে?”
    সে চুপ করে রইল।
    “ ও মরবে দেখবেন।”
    “বললে ও মা-কালীর মূর্তি ধরে।”
    “গেল কি না?”
    “ভোরবেলাই গেছে।”
    মালতীর ইচ্ছে হলো মিনতির বলা কথাগুলো একটা একটা করে নবীনকে বলে। জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছে হলো। করে কী করে? একটা ছেলে এলো, পেন একটা কিনল। ছোট ছেলেটা আর সঙ্গের মহিলাটি বসেই আছে, খাতা চাই। বুড়ো মানুষ একজন এসেছে, সার্টের পকেট থেকে কাগজ একটা বের করে কাগজ একটা বের করে চশমাটা নাকের কিছু নিচে নামিয়ে পড়ে দেখছে। নিশ্চয় বই কিনবে। মালতীকে যে খাতাগুলো দিতেই নবীনের অবসর জোটেনি। খবরের কাগজ দেবার ছেলেটা এসে একটা কাগজ বের করে ছুঁড়ে ফেলে গেলো। এই ছেলেটিকে দেখে মালতী রোজ বেশ একটা আমোদ পায়। সাইকেল থেকে নামে না ছেলেটা। উঠে উঠে সামনের বাক্স থেকে কী যে এক কায়দা করে খবরের কাগজ বের করে যেখানে দেবার ঠিক সেখানে দিয়ে যায়, দেখে ভালোই লাগে। ও রোজ ভাবে এই মোড়ানো কাগজ দোকানে এসে পড়বে না, আবর্জনার স্তূপে এসে পড়বে বা ষাঁড় কিম্বা গরুর গায়ে পড়বে। না, ঠিক দোকানের গদিতে গিয়েই পড়ে। নবীন কাগজখানা মেলে ধরেছে। মণি প্রায়ই মাকে বলে খবরের কাগজ এনে দিতে। কোন সাহসেই বা মাসের বাঁধা খরচ আরেকটা গলায় ঝুলিয়ে নেয়? বাজারটা চলতে থাকলে তাও যেমন তেমন। যা দিন কাল পড়েছে। কোনদিন কী হবে কেউ জানে না। কখনো বা পুরোনো কাগজ দুই একটা পেলে সে মণির জন্যে নিয়ে যায়। বড় আগ্রহে সে কাগজগুলো পড়ে। এবারে একটা খবরের কাগজ মণির জন্যে রাখতেই হবে।
    নবীন কাগজটা মেলে ধরল। প্রথম পৃষ্ঠাতেই বড় বড় অক্ষরে চা বাগানের কোনও একজন পাল উপাধির কাউকে হত্যার সংবাদ। চা বাগানের ক্লাবে গুলি চালনার, গুলিতে জৈন বলে কারুবার মৃত্যু। মালতীর বুকে ছ্যাঁত করে উঠল। মিনতির বলা কথাগুলো মনে পড়ল। তাহলে টাকার জন্যেই এরা মানুষ মারছে।
    নবীনের গ্রাহক ক’জন চলে গেছে। ওকে খাতা দু’খানা বেঁধে দিল। তোড়াটা নিয়ে সে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালো।
    “যাই রে!”
    “যাচ্ছো মামী?”
    “ খবরের কাগজগুলোতে দেখি মানুষ মরারই কথা শুধু।”
    “ বুজলে মামী, এবারে এরা বাজে জায়গাতে হাত দিয়েছে।” কথা বলতে বলতে আপনি টাপনি বাদ দেয়াতে নবীনকে ওর বেশ আপন আপন মনে হতে শুরু করল। এই মানুষটাকে যেন সব বলা যায়, সব জিজ্ঞেস করা যায়।
    “কিছু হবে কি?” ভেদা লোক একটা ওর আশে পাশে ভোৎকা গন্ধ নিয়ে ঘোরা ঘুরি করতে শুরু করল, মানুষটা তেড়ে এলো, “মলি মা, মাথা নেই , চোখ নেই...।”
    “হবে মামী, কিন্তু এগুলো উপরে উপরে পালটে যাবে। আমাদের বেশি দিগদারি দেবে না।
    নবীন হাসছে। “আমাদের আর কী? বাজারটা শুধু বসলেই হলো...”
    “ঠিকই, বাজারটা বসতে থাকলেই আমাদের ভালো, না বসলেই বাজে...”
    সে খাতার টোপলাটা মুড়ির টিনে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর হনহন করে পা চালালো।
    আজ আবহাওয়াটা পরিষ্কার বলে মনে হয় দূরের পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। সবচে’ উঁচু পাহাড়টার সাদা চূড়াটাই শুধু দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়টা দেখতে দেখতে সে হাঁটছিল। খুব একটা তাড়া নেই। আজ আগেভাগেই বাজার আঁটাতে পেরেছে। ওর মনটা হাল্কা লাগছিল। আশ্চর্য, এই হালকা মনটাতে আর কেউ এসে ঢোকতে পারে নি। সামান্য আগে দেখা হলো , সেই নবীন, বাজারের এতোসব মানুষ, মণি, মিনতি, জোনের মা , কালী বুড়ি—কেউ না। এমন কি সেগুন পাতার মতো চ্যাপ্টা হাতের মানুষটাও না। ওর মন জুড়ে শুধু এক সারি নীল পাহাড় উঁচু নিচু।
    পাহাড়গুলোতে মনে হয় ধানের খেত আছে, মানুষে ভরা গ্রাম শহর আছে। বন জঙ্গল আছে। সেই জঙ্গলগুলোতে থাকে কি মিনতির রাজকুমার? আর সেই ছেলেগুলো? কই থাকে এরা? এই পাহাড় থেকেই তো নেমে আসে। রিজার্ভের ভেতর দিয়ে এসে মিনতির ঘরে ঢোকে, জোঁকে খেয়ে শরীর বসন্তের গুটির মতো ফুলিয়ে দেয়, রক্ত পায়খানা হয়, জ্বরে বেহুশ পড়ে থাকে। ভালো ঘরের ভালো জিনিস খেয়ে বড় সব ছেলেরা, বড় বড় চাকরি করে থাকতে পারত যেসব ছেলেরা ওই পাহাড় পেরিয়ে ওরা অন্য পাহাড়ে যায়। সেখানে বিদেশি পার্টিটি ওদের বন্দুক-বোমা চালানো শেখায়। সেই পার্টিটির সঙ্গে সেখানে তাদের কাজিয়া ঝগড়া হয়। অনেক টাকা চেয়ে বসে, খড়্গ দাবি করে আর বেআইনি জিনিস এপার ওপার করতে দেয়। ঐ পাহাড়টার কোনদিক দিয়ে যে এরা নেমে আসে, ঐ নিচু পাহাড়টা দিয়েই কি চোখা উঁচু ঐ পাহাড়ের মাথাতে উঠে? না লম্বাটেটা দিয়ে চড়ে ঐ গোল চূড়াটা দিয়ে নেমে আসে? ওরা খবরের কাগজে যাদের কথা লেখে তাদের মারে । আবার ফিরে চলে যায়।
    বেলা পড়ে আসছে। চোখা চূড়ার পাহাড়টাতে রোদ পড়েছে। নিচেরটাতে কালো ছায়া। লম্বা সারিটিতে আলো আছে। আলোর রং বদল হচ্ছে। সাদার থেকে হলদেটে হচ্ছে। ছায়া পড়েছে যেগুলোতে সেগুলো আরো কালো হচ্ছে। ঠিক কালো নয়, এক পশলা বৃষ্টি আসার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ যেমন রং ধরে, কাজলা বললেও চলে।
    পাহাড়টা দেখতে দেখতে সে এগুতেই থাকল। খানিক দূরে গিয়ে ওর হঠাৎ খেয়াল হলো , কখন রিজার্ভ পেরোলো, কখন বস্তিতে ঢুকবার রাস্তা পেরোলো সে টেরই পায় নি। তাকে পাহাড় ডাক পাঠিয়েছিল। পাহাড় সত্যি মানুষকে ডাকে? ওদের ডেকেছে। বুলেনদেরকে ডেকেছে।
    আজ তাকেও পাহাড়ে ডেকেছে। অদ্ভুত এক ভয়ে সে শিউরে উঠল। সে চোখ ফেরালো আর যত জোরে পারে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে বাসাতে গিয়ে পৌঁছুতেই হবে।

    ~~~~~~~~~~ ~~
    টীকাঃ
    ১ তামোলঃ সুপারি। কিন্তু অসমিয়া তামোল যেহেতু বাংলাতে পরিচিত শুকনো বা নিতান্ত কাঁচা সুপারি নয়, বিশেষ করে পচিয়ে ভিজিয়ে তৈরি সুপারি শব্দটি তাই মূলেই রেখে দেয়া গেল।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন