এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • পায়ের তলায় সর্ষে - ২

    pather pothik
    অন্যান্য | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ | ৫৫০৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • damayantee | 61.246.73.249 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০১:০০499820
  • চক্রাতা
    =========

    আসলে ঠিক ছিল "লা কোয়েন্টা" প্রোজেক্টের অমিতাভদের সাথে জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে যাব ২৬শে জানুয়ারীর ছুটিটায়। তাই ২৭শে শুক্রবার, ছুটিও নিয়ে রেখেছিলাম। ২৩ তারিখ অমিতাভ বলল ওদের গ্রুপের একজনের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই ওরা কেউই যাচ্ছে না। যা: তাহলে কি হবে? আমার তো মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তৈরী হয়ে আছে যাবে বলে। কি করা যায়? শুরু করলাম খোঁজখবর। কিন্তু খুব বেশী সুবিধা হল না। অত কম নোটিশে জিম করবেট ব্যবস্থা করা, তাও একলা একলা, প্রায় অসম্ভব।

    ধুত্তোর নিকুচি করেছে। "যদি তোর ডাক শুনে ------ " ইত্যাদি প্রভৃতি --- যে কোন একটা বাসে উঠে দেরাদুন কিম্বা উখীমঠ চলে যাব, তারপর দেখা যাবে। জানা গেল NCR এ বাসেরা সব "বাস-আড্ডা"য় জমা হয় এবং গুরগাঁওতে এরুপ একটি আড্ডা আছে। সেখান হইতে ভোর 6.45 এ দেরাদুনের বাস ছাড়ে। সকাল ৬ টায় যখন বেরোলাম বাড়ী থেকে, তখনও চারিদিকে গভীর অন্ধকার। পূবদিক নাকি একটু একটু আলো হয়ে থাকে এইসময়? লোকে যে বলে। কিন্তু কোনটা যে পূবদিক সেটাই ঠিক করে উঠতে পারা গেল না। সবদিকই সমান অন্ধকার, কোনদিকেই আলোর কোন আভাস নাই। রাস্তায়ও নাই কোন যানবাহন। বাস অবশ্য সকাল সাতটার মধ্যেই ছেড়ে দিল। তখন আকাশে দিব্বি চালধোয়া জলের রঙ। মোদিনগর অবধি গিয়েই বাস কেৎরে পড়ল। প্রচুর যাত্রী, যারা হরিদ্বার এর আগে কোথায়ও যাবেন, নেমে হরিয়ানা রোডওয়েজের অন্য বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলে গেলেন। আমার বাপু অত কৃচ্ছ্রসাধনের অভ্যেস নেই, অতএব বসেই রইলাম, যতক্ষণ না বাসটা ঠিক হয়। আরে বাবা বাসকে তো দেরাদুন পৌঁছতেই হবে, নাহলে ফিরবে কি করে? তা সে গেল--- বেলা ৩ টে নাগাদ দেরাদুন ISBT তে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    সেখানে জানা গেল 'চক্রাতা' যাবার সরাসরি কোন বাস নেই। ওখান থেকে যেতে হবে বিকাশনগর, সেখান থেকে ট্রেকারে চেপে চক্রাতা। ট্রেকার!! ওরে বাবা! তাতে তো ছাদখোলা যানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়! ঐ পাহাড়ী পথ দিয়ে! তার থেকে ট্যাক্সি অধিকতর নিরাপদ অপশান। তা এই ঠান্ডার সময়ে তাতে কোন অসুবিধা হল না। কালসী অবধি গিয়ে এক ঘন্টার বাধ্যতামূলক স্টপ। কালসীতে ওপরে যাবার পরের ঘাট ছাড়বে সাড়ে পাঁচটায়। ততক্ষণ অপেক্ষা। ঘাট ছাড়ল যথাসময়েই, শুরু হল সমতল ছেড়ে পাহাড়ী রাস্তা। সরু রাস্তা, চুলের কাঁটা বাঁক, হঠাৎ রাস্তায় ৩০-৪০ টা ছাগল, কানফাটানো বাইক .... আর মাঝে মাঝে সেই ভীতিকর ট্রেকার। তার খোলা চাতালে হাসিখুশী নারীপুরুষ ... কাজ শেষে ফিরছে কোন পাহাড়ী গাঁওতে। একটু করে উঠছে গাড়ী আর হিমালয় দেখাচ্ছে তার একটু করে পাহাড়ের সারি। তখনও পর্যন্ত কোন 'আদিম মহাদ্রুম'এর দেখা নেই, নিতান্তই কচি দ্রুম সব। পাহাড়ের খাতে নদীগুলির অবস্থা করুণ। জল প্রায় নেই বললেই চলে, রুক্ষ পাথরে ভর্তি। 'সেউনি'তে আবার থামতে হল ঘাটের জন্য। যোয়ান দেওয়া আলু পরোটা খেতে খেতেই গাড় অন্ধকার ঝাঁপিয়ে নামল পৃথিবীতে, আর ঘাটও ছাড়ল। রাস্তায় বাড়ল বাঁকের সংখ্যা, আর সাথে সাথে বাড়ল গাড়ীর গতি। কারণস্বরুপ চালক বললেন ওপরের দিকে ছোটখাট জন্তুজানোয়ার পা চুলকোলে পাথরের টুকরো গড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গা দিয়ে, পড়ার সম্ভাবনা থাকে গাড়ীর ছাদে। জোরে চালালে নাকি এই সম্ভাবনা এড়ানো যায়। শুনে যে খুব একটা স্বস্তি পেলাম, তা নয়, তবে আমার হাতে নাই স্টিয়ারিং।কাজে কাজেই ..... কেউই জানে না আমি চক্রাতা আসছি, মা জানে আমি জিম করবেটে গেছি অমিতাভদের সাথে, বন্ধুবান্ধবেরা জানে কোথায়ও একটা যাব---ডানদিকে এবড়ো খেবড়ো খাড়া পাহাড়, জায়গায় দেওয়া চুনের দাগ গাড়ীর হেডলাইটের আলোয় দাঁত খিঁচিয়ে যাচ্ছে। বাঁ দিকে নি:সীম গভীর কালো অন্ধকার, সামনে শুধু গাড়ীর হেডলাইটের আলো--- আগেপিছে কিচ্ছু নেই----- অনেকটা চলার পরে অনেক দূরে কোন পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মতই মিটমিটে এককুচি আলো দেখা দিয়েই ভোঁ---- গাড়ীর আওয়াজ ছাড়া এই পৃথিবীতে নাই আর কোন শব্দরাজি---এই চালক বোধহয় মহাকালের রথেরই সারথী।
  • Arijit | 128.240.229.67 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০২:০০499831
  • ইয়ে, ফল্‌সটাকি আগেই ছিলো, নাকি ক্যানসাসের লেকের মতন?
  • sayan | 59.160.140.1 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০৩:০০499835
  • শেষ করে দিলে নাকি?!!

    পরের পার্ট কবে আসছে? কাঠগোদাম হয়ে হাঁটা পথে মুসৌরী কেউ কি গেছ?
  • Samik | 221.134.226.64 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২১:৩৮499815
  • আগের কলাম অনেক লম্বা হয়ে গেল বলে আরেকটা থ্রেড চালু করলাম।

    তখন থার্ড ইয়ার। শীতের ক্ষুদ্রতম ছুটিকে দীর্ঘতম এক্সটেনশন দিয়ে জনতা সব চলে গেছে বাড়ি। হপ্তা দুয়েক হল কাঞ্চনও আর চোখের সামনে দেখা দেয় না। ঘন কুয়াশায় মুড়ে যাচ্ছে তরাই। অলস দিন ফুটে ওঠবার আগেই চা বাগানের গা বেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সন্ধ্যে।

    পয়লা জানুয়ারি। প্রচন্ড ঠান্ডা। প্রায় ২ ডিগ্রির কাছাকাছি। হস্টেলের মেটালের খাটে শোওয়া এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। চারশো জনে ভরে থাকা জে সি বোস হলে তখন আমরা মাত্র সাতজন। আরও দশজন আঠাশে ডিসেম্বর চলে গেছে সান্দাকফু ট্রেকিং করতে। আড়াই হাজার টাকা খরচা করার মত ক্ষমতা ছিল না বলে যাই নি। বাকি ছজনের বেড়ানোটা বিড়ম্বনা সম বলে যায় নি।

    কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে ছড়িয়ে দিলে সে বিড়ম্বনা উড়ে যেতে কতক্ষন? বার খেয়ে গেল ছজনের পাঁচজন। সান্দাকফু যাওয়া না হোক, জলুর মধ্যেই কোথাও যাওয়া যাক না! জলদাপাড়া?

    রাখাল চন্দ্র মাতাল ওরফে দেবদাস দে, ইনফো দিল, ওখানে টুরিস্ট লজ বুক করতে গেলে শিলিগুড়ি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে বুকিং করে আসতে হয়। ফান্ডা নিতে যাওয়া হল খনির বাড়িতে। খনির বউ রক্তিমা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ক্লার্ক।

    বাই দ্য ওয়ে, খনি হল আমাদের ক্যাম্পাসের ডাক্তার। তা, রক্তিমা আমাদের তেমন কোনও তথ্য দিতে পারল না। অতএব আমরা ছজন, জাস্ট অনুমানে ভর করে চেপে বসলাম একটা হাসিমারা-গামী বাসে।

    জলপাইগুড়ির কোনও লোকাল বাসে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছেলে পুরো ভাড়া দেয় না। ফিফটি পার্সেন্ট। সেটা জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ি রুটের কন্ডাক্টররা জানে। তাই পাঁচ টাকার বেশি ভাড়া নিত না, এমনকি ভাড়া বেড়ে যখন দশ থেকে এগারো হয়ে গেল, তখনও। কিন্তু হাসিমারা রুটের কন্ডাক্টর সে সব মানবে কেন?

    অতএব বাওয়ালি। ভাড়া দেবই না। কী করবি কর।

    জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের এলাকাটার নাম মাদারিহাট। মাদারিহাট পৌঁছে খুব ল্যাদ লাগল। এই তো সবে বাসে উঠলাম, এখনই নামব? থাক। পেদো বলল হাসিমারা থেকে সামান্য দূরেই জয়গাঁও, ভূটান বর্ডার। একটুর জন্য বিদেশযাত্রা মিস করব? স্রেফ গন্ডার দেখার আশায়?

    হাসিমারা থেকে সামান্য দূরত্বে জয়গাঁও। দু টাকা বাসভাড়া। একটাকা দিলাম। দুপুর বারোটায় জয়গাঁও।

    সামনেই অপূর্ব কারুকাজ করা ভূটান গেট। ঠিক সেখান থেকেই সমতল থেকে, বলা নেই, কওয়া নেই, আচমকা রাস্তা চড়াই হয়ে উঠে গেছে। ভূটান পাহাড়ের ওখান থেকেই শুরু, একেবারে আচমকা।

    এলাকাটা বাঙালি ভুটিয়াতে ছড়াছড়ি, ঐ ঠান্ডাতেও ছোটো স্কার্টের মত ভুটানি পোষাক পরে ক্ষুদে চোখের গম্ভীর এবং হাসিখুশি ভুটিয়ার দল সাইকেলে স্কুটারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    ভূটানের দিকে জায়গাটার নাম ফুয়েন্টশেলিং। টুকটুক করে পাহাড়ের ওপর উঠে গেলাম। অনেকটা। আস্তে আস্তে লোকালয় কমে এল। চারদিকে কেবল লম্বা লম্বা পাইন গাছ, আর তীব্র ঠান্ডা হাওয়ায় পত্‌পত্‌ করে উড়ে বেড়ানো লম্বা লম্বা বৌদ্ধ পতাকা। রংবেরংয়ের।
  • Samik | 221.134.226.64 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২২:১৩499826
  • কে কে যেন ছিলাম? সবার নাম মনে পড়ছে না, আমি, মাতাল, পেদো, ও হ্যাঁ, রংবাজ ছিল। রংবাজ, সুমন দুয়ারি।

    সুমনই প্রথম দেখাল, পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, একটা মনাস্ট্রি।

    হনহনিয়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম মনাস্ট্রি। বড় সুন্দর। ফুলেফুলে ঢাকা বুদ্ধমূর্তি। সামনে একটা বিশাল ধম্মচক্র।

    বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। ভেতরে কথা বলা নিষেধ। একজন লামা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জানিয়ে দিলেন।

    তারপর আবার বেরোলাম। পেদোর ইচ্ছে হল একজন লামাকে নিয়ে ফটো তুলবে, রামপুরহাটে ফিরে গিয়ে দেখাবে সবাইকে।

    সামনেই এক বয়স্ক লামা ঘুরছিলেন, তাঁকে ইশারায় আর ভাঙা ইংরেজিতে অনুরোধ করতেই এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। পোজ দিয়ে বেশ কটা ছবি তুললেন। আলাপ করলেন। খুব গর্বের সঙ্গে জানালেন, তিনি লেখাপড়া জানা। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছেন।

    প্রথমে মনে হল, ভুল শুনছি। কিন্তু লামার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনও মিথ্যে কথা বলার লক্ষণ দেখলাম না। অপার্থিব সরল মুখ। কে জানে, কোন প্রত্যন্ত ভূটানি গ্রামের ছেলে কোন ছোটবেলা থেকে এই মনাস্ট্রিতে সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।

    আবার নেমে এলাম ফুয়েন্টশেলিংয়ের সমতলে। ড্রুক জ্যম জেলি তৈরির কারখানা দেখলাম বাইরে থেকে, একটা কুমীর প্রকল্প আছে, দেখলাম তাও, পাশেই একটা সিনেমাহল, ভূটানেই পড়ে, সেখানে চলছে গোবিন্দার ছোটে সরকার।

    ফিরে এলাম জয়গাঁও। বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। সারাদিন খাওয়া হয় নি। একটা পাইস হোটেলে ঢুকে গোগ্রাসে খেলাম। হিসেব করে দেখলাম, সকালে হস্টেল থেকে বেরনোর পর এখনও পর্যন্ত খরচা হয়েছে সাঁইত্রিশ টাকা মাত্র। মাত্র সাঁইত্রিশ টাকায় ফরেন ট্যুর।

    লোকাল বাসে ফেরত হাসিমারা। এবার মাদারিহাটে নামতেই হবে। নইলে জলদাপাড়া আর দেখাই হবে না।

    (ক্রমশ)
  • tareq | 211.28.40.185 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২২:৪৫499837
  • শমীকদা,
    দারুন হচ্ছে!
    লিখতে থাকো।
  • Samik | 221.134.226.64 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২৩:২৭499845
  • মাদারিহাটে দুটো ট্যুরিস্ট লজ আছে। অভয়ারণ্যের বাইরেরটার নাম মাদারিহাট ট্যুরিস্ট লজ, ওটা সাধারণের নাগালে। অভয়ারণ্যের ভেতরের এলাকাটার নাম হলং, সেখানে আছে হলং ট্যুরিস্ট লজ, বড়লোক ট্যুরিস্ট আর সর্বহারাদের জন্যে। সর্বহারা বলতে, জ্যোতি বসু অ্যান্ড কোং। সেই সব জাতীয় পশু এলে লাখ টাকা দিয়ে বুকিং করা থাকলেও বুকিং ক্যানসেল হয়ে যাবে।

    আমরা নামলাম মাদারিহাটের মোড়ে। প্রথমে মাদারিহাট লজে অ্যাপ্রোচ। বিশাল এলাকা জুড়ে লজ, উঁচু কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। আর কাঠের তৈরি উঁচু লগের ওপর বানানো লজ একেকটা। কাঠের সিঁড়ি।

    অফিসঘরে বলল, এক রাত্তির থাকা খাওয়া দুশো পঁচাত্তর টাকা। পারহেড।

    ইল্লি আর কি! ভূটান ঘুরে এসে, অন্তত আমার পকেটে তখন একশো তেষট্টি টাকা মাত্র। বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ। বললাম, খাব না। বললাম, স্টুডেন্ট।

    কোনও কিছুতেই ভবি ভুলল না। শুধু লজিং হয় না, থাকতে গেলে খেতেই হবে, আর স্টুডেন্ট কনসেশন কিছু নেই।

    নিরুপায়। পেদো বলল, শালা, মেয়ে তো নই, এখানেই কোনও না কোনও দোকানে রাত কাটিয়ে নেব। কী আর হবে? চল দেখি, জায়গা জুটে যাবে।

    বলা খুব সোজা। কিন্তু ও সব এক্সপিরিয়েন্স গল্পের বইতেই দেখা যায়। দুটো মিষ্টির দোকান মিষ্টি কথায় হাঁকিয়ে দিল, তারপর আর এগোতে না এগোতেই লোকালয় শেষ, সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজে, মনে হচ্ছে যেন গভীর রাত, কোনও দোকান খোলা নেই, রাস্তায় আলো নেই।

    মাতাল বলল, চ' দেখি আবার লজে যাই। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি। না হলে আমার কাছে ক্যাশ আছে, হয়ে যাবে ছজনের। পরে মিটিয়ে দিস।

    আবার গেলাম লজে। এবং আশ্চর্য ব্যাপার, এবার অভাবনীয় ভাবে 'মাল নেমে' গেল। ডর্মিটরি পাওয়া যাবে। চারজনের বেড আছে, ওরা দুটো এক্সট্রা ম্যাট্রেস লাগিয়ে দেবে, কেবল পারহেড একশো পঁচিশ করে নেবে। খাওয়া দেবে না। খাওয়া নিজের দায়িত্ব।

    পাগ্‌লা ক্ষীর খা! গুড় দিয়ে রুটি, চিনি দিয়ে চা! জল না চাইতেই মেঘ। হইহই করে ঢুকে পড়লাম ডর্মিতে। কাঠের ঘরে সেই প্রথম থাকা। লাগেজ রাখতে না রাখতেই একজন এসে বলল, চা খাবেন? চা খেলাম। রাত তখন সওয়া আটটা। ম্যানেজার বললেন, গেট কিন্তু রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যায়, খেয়ে দেয়ে ফিরতে হলে দশটার আগে, নইলে সারারাত বাইরে।

    তথাস্তু বলে তো বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কোথায় খাবো?

    (এরপর কাল)
  • tanu2 | 171.72.5.133 | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০০:০০499846
  • খুব ভালো লাগছে পড়তে। পরের কিস্তি তাড়াতাড়ি চাই :-)
  • tareq | 211.28.40.185 | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ১০:০২499847
  • শমীকদা , দেরি কোরো না! কুইক লেখো, একেবারে অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস লাগছে!
  • vikram | 147.210.156.39 | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ১৫:৪৭499848
  • ভালো হচ্ছে

    বিক্রম
  • Samik | 221.134.225.38 | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২২:২৩499849
  • অ্যাডভেঞ্চারই বটে। পয়সা বাঁচানোর লক্ষ্যে খেয়াল ছিল না যে এটা জলপাইগুড়ির একটা ইন্টিরিয়র গ্রাম, সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে সমস্ত দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যেতে আমরা নিজের চোখে দেখে এসেছি।

    তবু যদি কিছু পাওয়া যায়। উদ্দেশ্যহীন ভাবে খানিক ঘুরলাম মাদারিহাটের রাস্তায়। এবং হ্যাঁ, আশাতীত ভাবে পেয়ে গেলাম একটা গুমটির দোকান। সাধারণ অবস্থায় হয় তো সে দোকানের দিকে এগোতামই না, কিন্তু ক্ষিদের জ্বালায় লক্ষ্যও করলাম না, দোকানে দুটো পাঁড় মাতাল ছাড়া অর কেউ নেই, তাদের মধ্যে একজন দোকানদার।

    কী আছে? রুটি আর মাংস। যে সে মাংস নয়, শুওরের মাংস। তখন বয়েস কুড়ি, কোনওদিন পর্ক খাই নি, অতএব বেশ একটা নিষিদ্ধ উত্তেজনা আছে চিকেন মাটন বাদে যে কোনও রকমের মাংসের প্রতি। চল্‌ পাগলা।

    চার পাঁচটা করে রুটি খাবার পরে যখন ক্ষিদেটা একটু মরল, টের পেলাম মাংসটা মোটেই ভাল খেতে নয়, এবং ভাল করে সেদ্ধও নয়। বই পড়া বিদ্যে অনুযায়ী আমাদের পেটে এতক্ষণে ফিতেকৃমি চলে গেলেও যেতে পারে। কিন্তু কে আর ওসবের কেয়ার করে? পেট ভরে আধসেদ্ধ শুওরের মাংস আর আধপোড়া রুটি খেলাম। পেদোর এইবার প্রেম পেয়ে গেছে। সে চৈতালিকে ফোন করবেই। রাত তখন নটা চল্লিশ। পেদো বলল, তোরা লজে ফিরে যা, আমি ফোন বুথ খুঁজে ফোন করে দশটার ভেতরেই ফিরব।

    অগত্যা, আমরা ফিরে এলাম। রাত দশটা বেজে গেল, পেদোর দেখা নেই। শেষমেশ, গার্ডকে বলে কয়ে গেট খুলে আমরা বেরোলাম আবার। জলদাপাড়ায় রাত দশটা মানে, গভীর রাত। চারদিক শুনশান, কেবল লজের জেনারেটরের শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

    বেশিদূর যাওয়ার দরকার হল না, দু পা এগোতেই দেখি হন্‌হন্‌ করে পেদো আসছে, আমাদের দেখেই হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, শালা, খুব জোর বেঁচে গিয়েছি, দুটো লোক আমার পিছু নিয়েছিল।

    মানে? বলে কী? পেদোর কাছ থেকে শুনলাম ঘটনা। ফোন করে ফেরার পথে দুটো পথচারীকে ওভারটেক করার সময়ে পেদো ওভারহিয়ার করে, তারা বলাবলি করছে, 'এই জানিস, ইঞ্জিন কলেজের কয়েকটা ছেলে এখেনে এসেছে, থাকার জন্য দোকানঘরের চাতাল খুঁজছিল।' অন্যজন তখন বলে নাকি, 'তবে তো ভালো মওকা, নিশ্চয়ই ওদের কাছে ভালো টাকাপয়সা থাকবে, কলকাতার ছেলে' ...

    তখনি পেদোকে দেখে ওদের একজন ফিসফিস করে নাকি বলে, 'এই দ্যাখ দ্যাখ, ওদের একখান ছেলে এইটা' । পেদো তখন অর্ধেক হেঁটে অর্ধেক দৌড়ে এগোতে থাকে, লজের কাছাকাছি আসার পরে সেই লোকদুটো বুঝতে পারে আমরা বাইরে রাত কাটাবো না, তখন সরে যায়।

    কী যে বিপদ হতে পারত, কে জানে, তবে বেঁচে গেছিলাম।

    ক্লান্ত, বিধ্বস্ত আমরা বিছানায় জাস্ট ধপ্‌ধপ্‌ করে উপুড় হয়ে পড়েছি, এমন সময়ে দরজায় টোকা। লজের ম্যানেজার।

    পুরো জামাই আদর যাকে বলে। ঢুকেই বলেন, তোমরা কি কাল হাতির পিঠে চেপে জঙ্গল ঘুরতে যাবে? পারহেড চল্লিশ টাকা লাগবে।

    জাস্ট ভদ্রতা করে ম্যানেজারকে ফেলে চুমু দিলাম না। বলে কী? থাকার জায়গা জুটছিল না, আবার হাতির পিঠে চড়ে জলদাপাড়া দেখা? দেখব না মানে?

    ম্যানেজার বললেন, সাড়ে পাঁচটায় হাতি হলং ট্যুরিস্ট লজ থেকে স্টার্ট করবে, এখান থেকে পাঁচটায় জিপ ছাড়বে, তোমাদের বাহাদুর পৌনে পাঁচটায় ডেকে দেবে, রেডি হয়ে নিও। এটা মিস করলে কিন্তু পরের হাতি বিকেল তিনটের আগে খালি নেই। পয়সা দাও।

    ম্যানেজার চলে যেতে আমরা পুরো হুলা হুলা নৃত্য শুরু করলাম, কোথায় গেল তখন সমস্ত ক্লান্তি।

    কাঠের ঘর, কাঠের মেঝে, জানতাম না, পাশের ঘরেই এক সায়েব আছেন, হঠাৎ শুনি, দরজার বাইরে কেউ ইংরেজিতে কিছু বলছে, অনেকটা গায়ত্রী মন্ত্র পড়ার মতন শোনাচ্ছে ঘরের ভেতর থেকে।

    মাতাল দরজা খুলে দেখে এক লালমুখো খুব বিরক্ত ভাবে বাইরে দাঁড়িয়েই বলে চলেছে, কাল ওর শিলিগুড়ি থেকে ফ্লাইট আছে, ওর ঘুম দরকার, আমরা যদি দয়া করে হইহুল্লোড় কম করি তো ও ঘুমোতে পারে।

    তখন আমরা কেউ ইংরেজিতে কথা বলতে পারতাম না। মাতাল কোনওমতে ওকে ওকে, সরি সরি, গুডনাইট বলে সায়েবকে কাটালো। অ্যালার্ম লাগিয়ে আমরা ঘুমোতে গেলাম।
  • samik | 221.134.239.238 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২২:২৭499850
  • বাহাদুরকে ডাকতে হয় নি। আমরা নিজেরাই উঠে পড়েছিলাম সাড়ে চারটেয়। জানুয়ারির তিন তারিখ, তাপমাত্রা তখন শূন্যের কাছাকাছি।

    বাহাদুর চা দিয়ে গেল। অমৃত লাগছিল তখন। ধরাচূড়ো পরে পাঁচটার আগেই আমরা রেডি।

    আ হা:। সিনিমায় যেমুন দেখা যায়, হুডখোলা জিপ। হইহই করেচেপে বসলাম। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

    বেশি দূর না, মাত্র চার কিলোমিটার। গাড়ি এসে দাঁড়াল হলং ট্যুরিস্ট লজের সামনে। তিনতলা বাংলো, কাঠের তৈরি, নীল সাদা রং করা, দেখলেই বোঝা যায় বড়লোকেদের জন্য তৈরি। এবং, অবশ্যই সর্বহারাদের জন্য। লজের সামনে একটা উঁচু খাম্বা, খানিকটা ওয়াচ টাওয়ারের মত, লোহার সিঁড়ি লাগানো, ওপরে রেলিং দেওয়া। অন্ধকার তখনও ঘন, চারপাশে শুধু গাছগাছালি, তাতে করে অন্ধকার আরও মিশমিশে লাগছে।

    খানিক বাদেই হাতি এসে হাজির। হাতি নয়, হাতিনী। মা-হাতি, সাথে একটা পুচকি হাতির ছানা। কী যে মিষ্টি দেখতে, এর পিঠেও লোক চাপাবে নাকি? সারা গায়ে বড় বড় লোম ভর্তি, ফোক্‌লা মুখ, এসেই কচি খোকা শুঁড় দিয়ে মায়ের পা জড়িয়ে ধরল। মা-ও শুঁড় দিয়ে ছানাকে একটু আদর করে নিল।

    এবার আমরা সেই ওয়াচ টাওয়ারের ওপর উঠলাম। হাতি এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল তার পাশে। মাহুতের সাহায্যে আমরা দিব্যি চড়ে গেলাম হাতির পিঠে। নোংরা কম্বলের ওপর লাল কাপড় বিছিয়ে তৈরি হাওদা। সামনে হাতির টাকে বসে মাহুত, হাতে অঙ্কুশ। সেই অঙ্কুশের সাইজ দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমার মাথায় ওটা আলতো করে ছোঁওয়ালেই আমার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে।

    যাত্রা হল শুরু। পাথরের বোল্ডারের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পাতলা ঝোরার ওপর দিয়ে ছপছপিয়ে চলল হাতি, পাশে পাশে ছানা। একটু এগোতেই দেখি আকাশের একটা দিক ফরসা হয়ে এল, আর ... হ্যাঁ, সূর্যোদয়। ঘন জঙ্গলের ভেতরে সূর্যোদয় দেখারও একটা আলাদা ব্যাপার আছে, তাও হাতির পিঠে। চারপাশের গাছের পাতাপত্তর চোখে মুখে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে, ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে হিমশীতল শিশিরের ফোঁটা। মাঝে মাঝে হাতি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, ছানা শুঁড় তুলে চুকচুক করে একটুখানি করে মায়ের দুধ খেয়ে নিচ্ছে। আবার মাহুতের অঙ্কুশের বাড়ি খেয়ে মাতৃস্নেহ ভুলে ডিউটি পালন। এতটুকু বিরক্তি নেই।

    এক ঘন্টারও বেশি ঘুরলাম জঙ্গলে। বাঁদর দেখলাম, ময়ূর দেখলাম, বুনো শুওরও দেখলাম, কিন্তু গন্ডার দেখা হয় নি। ওটা লাকের ব্যাপার। কপালে না থাকলে গন্ডার মেলে না। অত সকালে বোধ হয় গন্ডাররা ঘুম থেকে ওঠে নি। লেট রাইজার সব!

    তারপরে আবার হলংয়ে ফেরৎ। সকাল সাতটায়।
  • Tirthankar | 130.207.94.244 | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০১:০০499816
  • বেড়ে লিখেছ গুরু!
  • santanu | 59.37.32.122 | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০৫:২২499817
  • শমীক, অসাধারন, খুব ভালো, সকাল বেলা প্রান ভরে গেল।
    কিন্তু last এ কি তোমার খুব তাড়া ছিল, last লাইন টা যে ধপাস করে এসে গেল।
  • Samik | 221.134.238.94 | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ১৫:০৬499818
  • তাড়া একটু ছিল বটে, ভুতোকে সেরেল্যাক খাওয়ানোর ছিল, তবে শেষ এখনও হয় নি। আরও লিখব।
  • tareq | 211.28.40.185 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ১১:৪৫499819
  • দারুন লিখেছো।
    অপেক্ষায় আছি বাকিটার জন্যে।
  • r | 85.100.122.49 | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ১৬:৩৮499821
  • চক্রাতা যাবার বাস পাইলা না? ধুর্‌। দিল্লির বাস গিয়ে যে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ায়, সেখান থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তায় দেরাদুনের অন্য বাসস্ট্যান্ড। সেইখান থেকে চক্রাতার বাস ছাড়ে।
  • damayantee | 61.246.73.249 | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ১৯:২৮499822
  • চক্রাতা
    ===========

    সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার ঘোর অন্ধকারে যা বোঝা গেল, চক্রাতা আসলে খুবই ছোট্ট একটা জায়গা। সাত হাজার ফুট উচ্চতায় ট্যুরিস্ট বিশেষ আসে না - এই শীতে তো আরোই নয়। চালক জিগ্যেস করে কোথায় থাকব? আরে তার আমি কি জানি? নিয়ে চল কোন একটা হোটেলে। সূর্য্যের সাথে জেগে ওঠা জনপদ তখন লেপের আদরের খোঁজে। 'হিমগিরি ট্যুরিস্ট লজ' ---- সামনের ঘরটিতে চ্যেআর টেবিলের পাশে একটি সিঙ্গল বেড। তাতে বসে এক গাড়োয়ালী যুবক মাটিতে রাখা তামার পাত্রে রাখা জ্বলন্ত আগুনের তাতে হাত সেঁকছে। জালের ঢাকনির নীচে লালচে আগুনও শীতের প্রকোপে একটু যেন ম্রিয়মান। জানা গেল ঘর পাওয়া যাবে। ৩ তলার ঘরটাই মোটামুতি পছন্দ হল। না হলেও কোন উপায় ছিল না অবশ্য। ঘরে রুম হীটার না থাকলেও বাথরুমে গীজার আছে দেখা গেল, আর বিছানায় দুটো লেপ।

    গাড়ীর চালক আসার পথেই জানিয়েছিল, যেহেতু আমাকে আবার গাড়ী ভাড়া করে ফিরতে হবে, সে ওখানে থেকে যেতে প্রস্তুত, আশেপাশের ৮-১০ কিলোমিটার যা আমি ঘোরাঘুরি করব, সে তার জন্য কিছুই নেবে না। আমিও তাতে আপত্তির কিছুই দেখি নি, যদিও "মা" পরে এই কথা শুনে এত ভয় পাবে যে--- সে যাকগে-- সে তো আরো দিন তিনেক পরের কথা। তা সে-ও সেখানেই কোথায়ও থাকবে। গাড়োয়ালী যুবক জানায় তার রিস্তেদার সকলেই কারো শাদী উপলক্ষ্যে উ-ই পাহাড়ের গাঁওতে গেছে। হাত জোড় করে জিগ্যেস করে আমি 'সম্পুর্ণ শাকাহারী' কিনা? আরে না না পাগল নাকি, চিকেন এনে দাও তো বাপু। না: চিকেন এখানে সহজলভ্য নয়, মাটন নাকি খুব ভাল, সে আমাকে মাটন কোর্মা আর খান আষ্টেক রোটি অফার করে। হায় আমাকে দেখে অনেকেই ভীমটিম গোছের কিছু একটা ভেবে নেয়! ভাতের সন্ধান করতে জানা গেল, এখানে তো বাসমতী চাল বিশেষ পাওয়া যায় না, এখন তো যাবেই না - ভাত কিন্তু একটু মোটা চালের হবে। তা তাই সই, নিয়ে এসো। ভাত আর মাটন কোর্মা এলে দেখলাম অমন স্বাস্থ্যবান ভাতের দানা আমি কস্মিন কালেও দেখি নাই। তবে সারাদিনের পাঁউরুটি, বিস্কুট, চিপস খাওয়া মুখ ও জিবের অবশ্য তার স্বাদগ্রহনে কোন অসুবিধা হয় নি।

    ঠান্ডার বহর দেখে দুটো লেপই গায়ে চাপানোই বুদ্ধির কাজ হবে মনে হল। কিন্তু সে লেপেদের টেনে খুলতে বা পাততে আরেকটা সাহায্যকারী বড়ই দরকার। অন্যথায় হাতে ব্যথা অনিবার্য। তো হাতের ব্যথা নিয়েই ঘুমিয়ে তো দিব্বি পড়লাম। হঠাৎই ঘুম ভাঙ্গে দেওয়াল আলমারীর পাল্লার আওয়াজে। খুটখুট, টকটক, খসখস ---- কিসের আওয়াজ রে? আমি তো আলমারী বেশ চেপে বন্ধ করেছিলাম। আবছাভাবে মনে পড়ে স্বপনকুমারের গল্পে দেওয়াল আলমারীর মধ্যে থাকে গুপ্তপথ, খুনী আসে সেই পথ ধরে ভেতর থেকে পাল্লা খুলে --- নাকি সেটা দস্যু মোহনের গল্প? এদিকে অত ওজনদার লেপের নীচে নড়াচড়াও করা যাচ্ছে না --- বহুকষ্টে ছেঁচড়ে মেচড়ে অর্ধেকটা বেরিয়ে লাইট জ্বালানো গেল। ডানদিকে জানালার পরদা উড়ছে হইহই করে, বাঁদিকে পাল্লা মাঝেমধ্যেই দুলে উঠছে। ভুমিকম্প? কিন্তু খাট, চ্যার টেবিল তো অনড় অচল। বিশেষ অনুসন্ধানের পর বোঝা গেল জানালার ভেতর থেকে জালের পাল্লা বন্ধ থাকলেও বাইরের কাঁচের পাল্লা খোলা, আর বাইরে প্রবল হাওয়া ও অল্পস্বল্প বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এরপরে তো all set. একঘুমে ভোর সাড়ে সাত।
  • santanu | 59.37.32.122 | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০৫:০৪499823
  • ৭০০০ ফুট উচুতে চড়ে, এক থালা ভাত, ৮ টা রুটি আর মাটন কোর্মা খেয়ে দমদিদি ঘুমিয়ে পরল।

    চক্রাতার বাকি গল্পটা?
  • r | 85.100.122.49 | ০৪ মার্চ ২০০৬ ০১:৫১499824
  • ওরে দমু, ওঠ্‌ রে! ভোর হয়ে গেল। বাকিটা?
  • damayantee | 61.246.76.128 | ০৫ মার্চ ২০০৬ ১৭:২৮499825
  • চক্রাতা
    =======

    জায়গাটা এমনিতে চীন সীমান্ত। বিদেশীদের নাকি সেথায় যেতে "পারমিট" লাগে। ওয়েবসাইটে দেখেছিলাম বটে, তবে নয়ন থেকে মরমে তা পশে নাই। চক্রাতা-বাজার আর পাঁচটা ছোট পাহাড়ী বাজারের মতই। মোটেও সুন্দর কিছু নয়, তাই অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রাস্তা ধরে হাঁটতেই মন চাইল। রাস্তা আস্তে আস্তে ঘুরে ঘুরে উঁচু হচ্ছে। কিছু নেহাৎ বালকগোছের লোককে দেখি মিলিটারী পোষাক পরে কাঠের বোঝা নিয়ে আসছে। কেউবা আবার মস্ত বস্তা কাঁধে , খোদায় মালুম তাতে কি আছে। মস্ত মস্ত দেওদার গাছ আর সদ্য ঘুম থেকে ওঠা সুয্যিঠাকুর রাস্তাটিকে ভারী সুন্দর একটা চিকরিমিকরি জালিকাটা ছায়ায় ঢেকে রেখেছে। রাস্তার পাশের বেঁটে কার্নিস থেকে অনেকটা ঝুঁকে দেখলে তবে দেখা যায় দেওদার গাছেদের গোড়া, আর ঘাড় বেঁকিয়ে প্রায় আধশোয়া হয়ে গেলে তবে দেখা যায় গাছের ডগা। এঁরাই হলেন সব আদিম মহাদ্রুম। চালক মশাই জানিয়েছিলেন যেখানেই দেখিবে দেওদার, জানিবে সেখানেই তুষারপাত হইয়া থাকে। কেন যে অন্তত একটা ক্যামেরাও সঙ্গে আনলাম না, ভাবতে ভাবতেই "ম্যাডামজী, ম্যাডামজী-ঈ" এই আকস্মিক চিৎকারে চমকে উঠি।

    অপেক্ষাকৃত বয়স্ক গাড়োয়ালী মিলিটারী, কিছু বোঝানো বা মনোযোগ আকর্ষনের আপ্রাণ চেষ্টায় লালচে গাল টুকটুকে লাল হয়ে গেছে। তিনি হিন্দী বলেন গাড়োয়ালী মেশা, আমি বাংলা মেশা। তবে কিনা 'ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়' আর জগতে কমিউনিকেশানের কোন বিকল্প নাই - এই আপ্তবাক্যদের সত্যি প্রমান করে আমরা একসময় একে অপরের কথা বুঝেও ফেললাম। জানা গেল এটি মিলিটারী সংরক্ষিত এলাকা, অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হয়। গেটের কাছেই নাকি আমাকে আটকানোর কথা চিল (আমি কিন্তু কোন গেট দেখি নি আসার সময়ে)। আমি কোথায় থাকি, কেন এসেছি জেনে তিনি ভারী অবাক হলেন। আমার কোন আত্মীয় বা বন্ধু মিলিটারীতে নেই, তাও আমি বেড়াতে এসেছি --- কি আশ্চর্য্য! কতরকমের "আজীব ইনসান"ই যে উপরওয়ালা পয়দা করেন , এই ভাবনায় তিনি বড়ই ভাবিত। সামনেই মিলিটারী ক্যান্টিন। ইতিমধ্যে কচিকাঁচা আরো খান পাঁচেক "মিলিটারী" জমা হয়ে গেছেন। তাঁরা কে? না 'মিলিটারী' --- ঐ তাঁদের পরিচয়। সবাই মিলে প্রচুর পীড়াপিড়ি ক্যান্টিনে আমি যেন এক কাপ চা আর অন্তত দুটো আলু কিম্বা গোবির পরাঠা খেয়ে যাই। আমিও খাব না, তাঁরাও ছাড়বেন না, এদিকে যত বলি চীন বর্ডারটা একবারটি দেখিয়ে দাও, তার বেলা আর ভবি ভুলল না।

    ফেরার সময়ে গেটটা দিব্বি দেখতে পেলাম, কারণ রাগী গেটম্যান আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কোথায় থাকি, কেন এসেছি জিগ্যেস করেই তাঁর ক্রুদ্ধ প্রশ্ন তাঁকে জিগ্যেস না করে ভেতরে গেছি কেন? আমি এবারে দেখলাম "ভোলি সি লড়কি'টা প্লে করাই যাক। ভারী নিরীহ মুখে জানালাম গেটটা তো খোলাই ছিল, আর তিনিও ছিলেন না, আর অনুমতি জে নিতে হয় তা-ও জানা ছিল না, অগত্যা -----। আসলে তো অপেক্ষাকৃত ভাল একটা হোটেল খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, তাও পেলাম না, আর চীন সীমান্তও কেমন সামনে এসেও ফস্কে গেল! হোটেলে ফিরে দু:খ করতেই তারা তাড়াতাড়ি হোটেলের ছাদে নিয়ে গেল, সেখান থেকেই ভিউফাইন্ডারে দেখা চীন সীমান্ত আর চারিদিকে অজস্র স্নো-পীকের সারি। "ওয়াগা বর্ডার" এর মত জমকালো নয়, ভারী নির্জন ছোট্ট একমেটেগোছের সীমান্ত। আশেপাশের পাহাড়গুলো পেরোবার ক্ষমতা থাকলে, "সীমান্ত"র গেটের ধারেকাছেও না গিয়েই দিব্বি এদেশ-ওদেশ করা যায়।
  • damayantee | 61.246.76.128 | ০৫ মার্চ ২০০৬ ২৩:২১499827
  • চক্রাতা
    =======

    টাইগার ফলস হেঁটে গেলে নাকি ৬-৭ কিমি, আর গাড়ীতে গেলে ১২-১৪। তা গাড়ীতেই তো যাব। গাড়ী নামতে থাকে ঘুরে ঘুরে। অনেকটা নামতে হবে। পথে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায় সেইসব ট্রেকারদের। ঠাসবোঝাই হয়ে চলেছে। ক্রমশ: উপস্থিত হওয়া গেল এক জনশূন্য পাহাড়ঘেরা জায়গায়। গাড়ী আর যাবে না। নেমে হন্টন। কিছুদুর তো দিব্বি গেলাম। তারপর দেখি আর কোনরকম রাস্তার বালাই নেই। একটা মাটির পায়েচলা পথ। দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করব, এমন সময়ে এলেন এক বয়স্ক পাহাড়ী। জিগ্যেস করে জানা গেল ঐ খাড়া নেমে যাওয়া রাস্তাটাই টাইগার ফলসের রাস্তা। দেখেশুনে বেশ ভয় লাগল ---- পড়লে আর দেখতে হবে না, অথচ পড়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল। তিনি জানালেন, তিনি ঐদিকেই যাচ্ছেন, আমি আসতেই পারি। তাও আমাকে নড়তে না দেখে, তাঁর জিজ্ঞাসার উত্তরে যেই না বলেছি পড়ে যাবার ভয় --- সে কি রাগ তাঁর! ওটা নাকি পড়ে যাবার মত রাস্তাই নয়। তাতেও আমাকে সাহস করতে না দেখে, সামনের একটা বেঁটে মত গাছ থেকে একটা ডাল ভেঙ্গে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন তাঁর পেছনে পেছনে আসতে। আর যা তাচ্ছিল্যের একটা দৃষ্টি ছুঁড়লেন, তার পরে আর দাঁড়িয়ে থাকাযায় না।

    ওফ্‌ সে কী রাস্তা রে বাবা!! ঠিক একজন লোক যেতে পারে, আর প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছে গড়িয়ে পড়ে যাব। ঐ টালমাটাল পায়ে টলতে টলতে কাঁপতে কাঁপতে ফলসের কাছে পৌঁছে ---- আহাহা ---- বেশ মাঝারী গোছের মোটাসোটা ফলস, অনেক জল নিয়ে ৫০ মিটার মত ঝাঁপিয়ে নামছে। ফলসের গা বেয়েও নামার রাস্তা আছে, জলের ছাঁটে ভেজা। নীচে তৈরী হওয়া সরোবরটায় পৌঁছানো যায়। কটি মেয়ে এসেছে সেই সরোবর থেকে জল নিয়ে যেতে। ওরা উঠে এলে জানলাম ওরা নাকি খায় না এই জল। এ শুধু অন্য প্রয়োজনে ব্যবহার করে। খাবার জ্জল আনতে যায় আরো দুরে --- "হোগা করিব বিস পঁচ্চিস মাইল" নির্বিকার উত্তর। আশেপাশে বেশ ঘন গাছের সারি। দেওদার বা চীর বলে মনে হল না, এই দুটো ছাড়া অন্য কিছু হবে।

    ফিরতি পথে একাই। কি অদ্ভুত নিস্তব্ধ চারিদিক। নিজেরই জ্যাকেটের খসখস শব্দ আমায় সঙ্গ দেয়, আর মাথার ওপরে সুয্যিমামা। আচমকাঅই দেখা হয় এক বৃদ্ধের সাথে। তাঁর মুখের অজস্র ভাঁজ, যেন অনেক ওপর থেকে দেখা পর্বতশ্রেনীরই রূপ। কি যে বলেন, কিছুই বুঝি না ----আমার কথাও তিনি বোঝেন না ---- কিন্তু বলেই চলেন, কথার ভঙ্গী দেখে বেশ প্রীত মনে হয়। ইতিমধ্যে এসে গেছে এক যুবক গাড়োয়ালী। সে মোটামুটি ভাঙ্গা হিন্দী বলতে পারে। তাকে বৃদ্ধ খুব দ্রুত কিসব বলে যান। যুবক নিশ্চিত হয়ে নেয় আমি ভারতীয়। অন্য কোন দেশের লোক নই, তারপর সেও মহাখুশী হয়ে যায়। কিরে বাবা! ব্যপারটা কি? না ওঁরা অনেক বিদেশিনী মহিলাকে একলা একলা এখানে আসতে দেখেছেন, কখনও কোন স্বদেশিনীকে দেখেন নি। তাই আমি নিশ্চয় কোন দেবীর অংশ হব, এই তাঁদের বিশ্বাস। ক্কি সব্বনাশ!! ওরে বাবারে দেবী টেবীরা শুনলে ভয়ংকর ক্ষেপে যাবেন যে! এমনকি তাঁদের ভক্তকূলও প্রবল ক্ষেপবেন।

    প্রায় গাড়ীর কাছাকাছি এসে পাওয়া গেল একদল বাচ্চাকে। মানে সাকুল্যে ৬টি। কোথায় থাকে? না "আপনা গাঁওমে"। কি নাম সেই গাঁওয়ের? হেসেই কুটিপাটি। যেন কি একটা অসম্ভব প্রশ্ন করেছি। স্কুলে যায় কিন? না: যায় না। গাঁয়ের কেউ যায়? হ্যাঁ যারা অনেকটা করে হাঁটতে পারে, তারাই তো যায়। উল্টে জিগ্যেস করে ওরা অতদূর হাঁটবে কি করে? ওরা ছোট না? সত্যিই তো অনেকটা হাঁটতে না পারলে যে স্কুলে যাওয়া যায় না --- এই বোধই তো শখ করে বেড়াতে আসা আমার ছিল না।
  • rimi | 71.109.208.136 | ০৬ মার্চ ২০০৬ ১৩:১২499828
  • বা: বা:, দারুণ লাগছে। তারপর??????
  • Sayan | 59.160.140.1 | ০৬ মার্চ ২০০৬ ১৮:১১499829
  • দমুদি, এভাবে প্রতি পদে ঠেলা না খেয়ে চটপট পুরোটা নামিয়ে দাও ... ওফ্‌ কী প্রবল চাপ :))
  • r | 202.144.91.204 | ০৬ মার্চ ২০০৬ ১৮:১৬499830
  • আহা রে! দমুটা পায়ে হাঁটা রাস্তাটায় গেলে কি বেড়ে মজাটাই না হত। গাড়িতে গিয়েই যা বর্ণনা শুনছি! আমরা হেঁটে গিয়ে ফিরতি পথে বেমালুম হারিয়ে গিয়েছিলাম।
  • Arijit | 128.240.229.67 | ০৬ মার্চ ২০০৬ ১৯:৪৯499832
  • আমরা একবার বাঘমুণ্ডি থেকে অযোধ্যা পাহাড় অবধি হেঁটে যেতে গিয়ে কায়দা করে জঙ্গলে ঢুকেছিলুম, শর্ট কাট মারবো বলে। সে কি কেলো রে ভাই - রাস্তা হারিয়ে কেলেংকারী, আর পাহাড় চড়ে চড়ে রীতিমতন জিভ বেরিয়ে গেছিলো...প্রায় ঘন্টা দুয়েক দিশেহারার মতন চক্কর মেরে বড় রাস্তা পাওয়া গেসলো।
  • damayantee | 59.144.176.226 | ০৭ মার্চ ২০০৬ ১১:১৫499833
  • চক্রাতা
    =========

    দেওবন যেতে বড় গাড়ী লাগবে, যা পাওয়া গেল না। কানসর যেতে তেমন কোন সমস্যা নেই। অতএব সেদিকপানেই যাওয়া যাক। ৮৫৯৬ ফুট উচ্চতা আর চক্রাতা থেকে ২৬ কিমি মত দূর। দেরাদুন থেকে তিউনি যাবার রাস্তায় পড়ে কানসর। তিউনি থেকে সারা দেশে উচ্চমানের মার্বেলপাথর চালান যায়, তাই ট্রাক বা বাসের চলাচল ভালই, ফলে রাস্তাও বেশ পাকাপোক্ত।

    কানসরের বেশ কিছু অগে একটা বাঁক ঘুরেই --- সামনে ধু ধু সাদা বরফ। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা কোন জলধারা শীতবুড়োর অভিশাপে জমে গেছে। রাস্তার বেশ কিছু অংশ, পাহাড়ের ঢাল, যেখানে সূর্য্যের আলো পৌঁছায় না এপ্রিল মাসের আগে, সেখানেই পুরু বরফ। গাড়ী চলে টলে টলে হেলেদুলে। নারীপুরুষ নীচ থেকে পিঠে করে নিয়ে আসেন শুকনো কাঠ বা ঘাসের বোঝা।

    প্রধান রাস্তা থেকে অল্প একটু নেমে গিয়ে কানসরের ফরেস্ট বাংলো। দাজা জানালা সব বন্ধ। চারিদিকে প্রচুর গাছ, কেমন কালচে সবুজ ছায়ায় ঢাকা এক মন্দির -- 'বাসিক দেব' এর মন্দির। বাসিক কি বাসুকী? কে জানে? মন্দির তালাবন্ধ। পুজারী আসবেন ঘন্টা ৩ বাদে। অতক্ষণ থাকব না। ঐ বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করা গেলে মন্দ হত না! কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না কোত্থায়ও। চালক ভয় দেখায় এই জঙ্গলে নাকি অনেক চিতা আছে। বলে কিরে! আমি যে হো হো করে হেসে ফেলি নি, সে তো নিতান্ত ভদ্রমহিলা বলেই----- কিন্তু চালকমশাই মহা দায়িত্ববান। কিছুতেই আমাকে বেশীদূর যেতে দিলেন না। নাকি গাছ থেকে লাফ দিয়ে চিতা নেমে আসে! আমি কিন্তু গাদাখানেক হনুমান ছাড়া কিছুই দেখলাম না।

    চক্রাতা থেকে ফেরার পথে সেউনির ঘাট এড়াতে স্থানীয় লোকেদের পরামর্শে নেওয়া হল অন্য একটা রাস্তা, যা সরাসরি কালসীতে এসে মেশে। চলার পথকেই যদি রাস্তা বলা যায়, তাহলে এটাও রাস্তা। তবে আসলে অধিকাংশ জায়গায়ই মাটির, কোথায়ও কোথায়ও রাস্তা তৈরী হচ্ছে --- ব্যাস। ফলে ৩ ঘন্টার যাত্রাপথে আর দ্বিতীয় কোন গাড়ীর দেখা পাওয়া গেল না। মানুষজনও বড়ই কম। শুধুই আলো ছায়া, রুক্ষ পর্বতশ্রেনী, সবুজ পর্বতশ্রেনী, দলছুট হনুমান, ঝাঁকড়া লেজ আর লাল চোখের পাহাড়ী কুকুর, ঝুম চাষের ছোট ছোট ক্ষেত, কোথায়ও বা শুধুই ছোট ছোট ধাপ কাটা, এখনও বোনা হয় নি তাতে কোন বীজ, শীর্ণকায়া নালা, যাকে বর্ষাকালে 'ঝর্ণা' বলা যাবে। আর তখনই হিমালয় দেখা দেয় এক প্রেমিক পুরুষের বেশে। তাম্রবর্ণ এক আদিম পুরুষ, যার পেশীবহুল কঠোর পৌরুষ তীব্র আকর্ষণে টানে, রুক্ষ প্রকৃতি দূরে ঠেলে, দেওদারের ছায়ায় মেঘের মায়ায় কোমল হয়ে আসে সেই প্রেমিক, কাছে টানে------।

    এই যাত্রায় এমন কিছু দেখলাম কি যা আগে কখনও দেখি নি? না: তেমন কিছুই নয়। সবই কখনও না কখনও, কোথায়ও না কোথায়ও দেখেছি। তবে? বালিকা থেকে কিশোরীবেলায় যেতেই যে বাঁধন আস্তে আস্তে জড়িয়ে গেছে হাতে পায়ে, তার পাকগুলো খুলে যাবার সুখ, যেমন ইচ্ছে ঘোরার সুখ, পরিচিত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার আনন্দ, চাইলেও কেউ খোঁজ পাবে না ---- কোথায় আছি, কি করছি ---- তেমনই আমিও জানাতে পারব না কাউকেই, আহা ----
    "এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
    আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে"।
  • r | 202.144.91.204 | ০৭ মার্চ ২০০৬ ১২:১৪499834
  • তিনটে তথ্য:

    ১) এই অঞ্চল ভারতের একমাত্র অঞ্চল যেখানে পূজ্য দেবতা কৌরবেরা।
    ২) বহুপতি প্রথা এখনও প্রচলিত। যৌন অভ্যাসও খোলামেলা। বিল আইটকেনের লেখা পড়ে জানতে পারি, এই একমাত্র ভারতীয় গ্রাম যেখানে তিনি খোলা ক্ষেতে প্রকাশ্যে চুমু খেতে দেখেছেন।
    ৩) এই অঞ্চলেই লাখমন্ডল যেখানে প্রবাদানুযায়ী বারাণাবতের জতুগৃহ।
  • dri | 199.106.103.254 | ১৯ অক্টোবর ২০০৬ ০৫:৩৮499836
  • বুধবার অফিস থেকে তাড়াতাড়ি কাটলাম। রেন্টাল কারের জানলায় স্টিকারে স্টারস অ্যান্ড স্ট্রাইপস। লোড করতে করতে সাড়ে চারটে বাজল। আজ বেড়ানোর প্রিলুড। কাজ একটাই। বাবা আর বোনকে লাস ভেগাসের এয়ারপোর্ট থেকে তুলে হোটেলে বডি ফেলা। মিনি ভ্যানে আছি মা, বউ, মেয়ে ও আমি। মা কটা দিন আগে এসেছে। বাবা এই এল। দু সপ্তাহ বোনের কাছে কাটিয়ে আমার কাছে আসছে। তারই ফাঁকে এই ফ্যামিলি আউটিং। স্যান ডিয়েগো, এসকন্ডিডো, রিভারসাইডের ভীড় ঠেলে বেরোতে বেরোতে সূর্য্য ডুবল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গাড়ী চালানোর মধ্যে গল্প খুঁজে বার করা খুব মুস্কিল। মেয়ে একটু ঘ্যানঘ্যান করেছিল, তবে সেটা বলার মত কিছু নয়। গাড়ী যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছল, মেয়ে তখন ঘুমে অচৈতন্য। তারপর সবাই যখন হোটেলে ঢুকলাম তিনি আড়মোড়া দিয়ে উঠলেন।

    পরদিন গাড়ী লাস ভেগাস ছাড়িয়ে চলল আই-ফিফটিন ধরে উত্তরে। তীরের মত সোজা রাস্তা ধূ ধূ মরুভূমির ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে দূর পাহাড়গুলোর দিকে। পাশে মোটরবাইকে চলেছেন প্রৌঢ় প্রৌঢ়া। প্রৌঢ় চলেছেন তাঁর পিঠ পর্য্যন্ত খোলা চুল উড়িয়ে। একমুখ দাড়ি, পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি, হাতে উল্কি। তাঁকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন কালো জ্যাকেট পরিহিতা প্রৌড়া। মা বলে, 'এরা হাজবেন্ড ওয়াইফ, না রে? বয়েস হয়েছে কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে বেশ মস্তিতে আছে।' শুনে আমার বউ হাসি চাপে, বোন হেসে ফেলে।

    (ক্রমশ)
  • dri | 199.106.103.254 | ১৯ অক্টোবর ২০০৬ ০৫:৫৮499838
  • জায়নে পৌঁছলাম বেলাবেলি। কিন্তু হোটেলে চেক ইন করে সময় নষ্ট করে যে কি মুর্খামি করলাম সেটা পরে বুঝব। পার্কে ঢোকার মুখে জুতো, মোজা আর লাঠি ভাড়া করে নিলাম। জায়ন ন্যারোজ ঠ্যাঙ্গানোর সময় এগুলো কাজে লাগবে। গেট দিয়ে ঢোকার মুখে বউকে বললাম, মনে আছে আগের বার এইখানে রামধনু দেখেছিলাম? ওর মনে আছে। সেবার ও গাড়ী চালাচ্ছিল। আমি রামধনু, রামধনু করে চ্যাঁচাতে হ্যাঁচকা ব্রেক মেরে রাস্তার পাশে গাড়ী দাঁড় করিয়েছিল।

    ন্যাশানাল পার্ক হিসেবে জায়নের সাইজ তেমন বড় নয়। বেশ কয়েকটা উঁচু পাহাড়ের টিলা, অধিকাংশই কালচে লাল, কয়েকটা লালচে কালো, আর একটা সাদা। এই পাহাড়গুলোর ফাঁকে রয়েছে একটা সরু ক্যানিয়ন। পন্ডিতেরা বলেন গিরিখাত। সেখান দিয়ে বয়ে গেছে ফিতের মত সরু ভার্জিন নদী। পাথুরে পাহাড় এমনিতে ঊষর হলেও নদীর পাড়দুটো একদম সবু-উ-জ। পার্কের বাসে চড়ে নদীর ধার ধরে গাড়ীরাস্তার শেষ ভিউপয়েন্টে পৌঁছলাম। টেম্পল অব শিনাওয়াভা। শিনাওয়াভা রেড ইন্ডিয়ানদের দেবতা। এক সময়ে এই ক্যানিয়নে ইন্ডিয়ানরা থাকত। এখন তাদের হটিয়ে দিয়ে এই অঞ্চলটা শ্বেতপ্রধান। পার্কের নামে রাখা হয়েছে নিজেদের জায়নগডের নামে। ঢং করে এই পয়েন্টের নাম শিনাওয়াভার নামে রাখার কি দরকার ছিল কে জানে? পলিটিকালি কারেক্ট থাকার জন্য হয়ত।

    এই পয়েন্ট থেকে পায়ে হাঁটা পথ চলে যায় ক্যানিয়নের আরো সরু অংশে। কিন্তু ঢোকার মুখেই হরিণ! দুটি হরিণ পরিবার জোড়ায় জোড়ায় ঘাস খাচ্ছে। নি:সঙ্গ হরিণছানাও খাচ্ছে। দেখে বউ বলল, বা হরিণরা এত প্রোগ্রেসিভ হয়ে গেল এই ক বছরে। আগের বার তো মেয়ে হরিণদের দল বেঁধে চরতে দেখেছিলাম। পটাপ্পট ছবি উঠল। মা নদীতে নামল পা ভেজাতে। জায়নে এখন আর্লি ফল। সবুজ পাতায় হলুদের ছোঁয়া লেগেছে মাত্র। দু একটা শুকনো পাতা জলে ভেসে যাচ্ছে স্রোতের টানে। জায়ন ন্যারোজ মা বাবা এই বয়েসে হ্যান্ডল করতে পারবে না। তাই মেয়েকে ওদের হাতে গছিয়ে দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম ন্যারোজের দিকে।

    (ক্রমশ)
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন