এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আঠের বছর - মনে হয় এই তো সেদিন

    shrabani
    অন্যান্য | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ | ১০৮৫২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shrabani | 117.239.15.28 | ৩০ মার্চ ২০১২ ১৬:১৬514901
  • হু হু করে কেটে গেল সাতটা দিন, কোথা দিয়ে কখন আবার ফেরার শনিবার এসে গেল টেরই পেলাম না। হাওড়া স্টেশনের যেখানে পার্কিং লট, সেই ন নম্বর (?)প্ল্যাটফর্ম থেকেই ছাড়বে ট্রেন। শেষ মুহূর্ত অবধি গাড়িতে বসে রইলাম, ট্রেনে উঠতে আর পা সরেনা, এদিকে যারা ছাড়তে এসেছে তাদের উৎসাহ দেখার মত। দুমাস আগের যাত্রার ছবিটা কিন্তু ঠিক উল্টো ছিল, তখন আমি মহা আনন্দে লাফাচ্ছিলাম আর অন্যরা গম্ভীর, জল ছলছল চোখ!

    আমার ব্যাপারটা তো বোঝা যায় কিন্তু বাড়ির লোকেদের এহেন পরিবর্তনের কারণ বুঝে সেই বিদায় মুহূর্তে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারার ব্যাথা, অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারিনা। বীরাঙ্গনা ট্যাগ একবার লেগে গেলে সে যে কী আপদ তা যার লেগেছে সেই জানে, ফেলাও যায়না, নিয়ে চলাও দায় হয়! এই কদিনে আত্মীয় পরিজন, পাড়াপড়শী সব দলে দলে এসে রায় দিয়ে গেছে, আমি নাকি ভীষন শোধেরবোধের হয়ে গেছি, দুমাসেই এই তো আগে না জানি এ মেয়ে দিনে কালে কী হয়ে দাঁড়াবে, পরিবারের মুখ উঙ্কÄল হয়ে একেবারে ফ্ল্যাশলাইটের মত জ্বলবে!
    বাড়ির লোকেরাও তো দেখছে, সোনামুখ করে হাবিজাবি যা দিচ্ছে চেয়ে চেয়ে খাচ্ছি। মাছ আর সবজি না খাওয়ার যে লম্বা লিস্ট ছিল তা পুরো নাল এবং ভয়েড সাব্যস্ত করে দিয়ে ইলিশমাছের লেজা খাচ্ছি ভালোবেসে! এতবছরে মায়ের বকুনি, চোখ রাঙানি যা করতে পারেনি দুমাস ট্রেনিংয়ে সেইসব অসম্ভব সম্ভব হয়ে গেছে। তারওপর রান্নাঘরে গিয়ে সহজ রান্না শিখছি শখ করে, সময় মত ঘুম থেকে উঠে পড়ছি। না জানি সে কেমন ট্রেনিং আর কেমনই বা সে জায়গা যেখানে এত অল্পদিনেই এরকম উন্নতি সম্ভব হয়! ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আর কি কারো কোনো দ্বিধা থাকে? সবাই নিজেদের মধ্যে মাথা নেড়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে এমেয়েকে আগে পড়ার জন্যে দুরে হস্টেলে না পাঠিয়ে যে ভুল হয়েছিল তা শুধরে নেওয়ার মহা সুযোগ এই এসেছে।
    মুখ চুন দেখে কেউ পাত্তাই দিলনা, বারোয়ারী মেজাজ অনুকূল নয় দেখেও মিনমিন করে দু একটা অসুবিধের কথা বলতে চেষ্টা করে বিফল হলাম। সবাই বেশ কঠিন কঠোর জবাব দিতে লাগল, এমনকি মাও।
    "নিজের ইচ্ছেয় গেছ, কেউ জোর করে পাঠায়নি। সব ব্যাপারে এত অস্থিরচিত্ত হলে চলে, দুমাস যেতে না যেতেই আর ভালো লাগছে না?"" চাকরি ওরকমই হয়, কখোনৈ ভালো লাগেনা, মানিয়ে নিতে হয়। আরও ছেলেমেয়ে আছে কীকরে!" "সব ব্যাপারে এত মুডি হলে চলেনা, এটা বোঝার সময় এসেছে। যা শুনছি তাতে খারাপ কিছু তো মনে হচ্ছেনা। মা, তুমি যদি এভাবে সব মেনে নাও, কাল বিয়ে দিলে, দুমাস পরে এসে বলল ভালো লাগছে না, তখন কি সেটাও মেনে নিতে হবে!"

    নানানিধি তরিবতের খাবার ভরা অতিরিক্ত ব্যাগ, শেষ মুহূর্তে হাতে গুঁজে দেওয়া পাকানো কিছু নোট, বুকভর্তি আরো অনেক কিছু নিয়ে জানালায় বসে দেখলাম ছবির মত আস্তে আস্তে দুরে সরে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো প্রিয় মুখগুলো। জানালা থেকে মুখ সরাতে পারলাম না সে অনেকখন, দু চোখের অভিমানের বরষায় তখন ঝাপসা চারধার। সারা রাস্তা কেমন করে যেন কেটে গেল, কোনোদিকে না তাকিয়ে। কৃষ্ণপক্ষের বাহানায় ফিরতিপথে সুখের জোছনাও উধাও ,আসলে দু:খের সাথে বোধহয় তার সত্যিই চিরকালের আড়াআড়ি।
    কিচ্ছু ভালো লাগছিলনা, কেঁদেকেটে হাক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাড়াতাড়ি। সকালে পৌঁছবার কথা, ভোরে তড়িঘড়ি উঠে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে, মানে রাতে যেখানে ছিল সেখান থেকে নাকি একচুলও নড়েনি। কোথায় কী হয়ে লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ। এবার আর জল বা খাবারের কষ্ট নেই, সঙ্গে প্রচুর ছিল সবই, কিন্তু কামরায় টেকা দায় হচ্ছিল গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে। মাঝরাস্তায় যেখানে গাড়ী দাঁড়িয়ে, চারিদিকে ধূ ধূ প্রান্তর, গাছপালা যা কটি আছে সব ন্যাড়া, রুক্ষ শুস্ক প্রকৃতি। জায়গাটা ঠিক মনে নেই, খনি এলাকা বোধহয়!

    ট্রেন ছাড়ল, গরমে এত কাহিল যে তখন শুধু মনে হচ্ছে কখন পৌঁছে সারা গায়ে ঠান্ডা জল ঢালব। রেনুকূট পৌঁছে মালপত্র (যাওয়ার সময় খালি ব্যাগ ছিল, এখন ভরা, এছাড়া যোগও হয়েছে আরো) বয়ে নিয়ে ওপরে উঠে বাসের জন্যে দাঁড়ানো। রবিবারের বাজার বলে কিনা কে জানে, বাস খালি পেলাম, বসতে জায়গাও। গরমে, ক্লান্তিতে এতটাই দিশেহারা যে কোনোরকমে ব্যাগগুলোকে নামিয়ে রেখে বসে পড়লাম কোনোদিকে না তাকিয়ে। কন্ডাকটরই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে যত্ন করে রেখে দিল। পথে বাস থামলে নেমে পানের দোকান থেকে ঠান্ডা ফ্রুটি কিনে আনলাম দু তিনবার। ব্যাগ ট্যাগ দেখতে হয়না এখানে, সরল দেহাতের বিশ্বাসী মানুষজনের সাথে পথ চলায় শহুরে সন্ধিগ্‌ধ মনের কোনো ঠাঁই নেই!
    শক্তিনগর এলে সেই কন্ডাকটর ও আরো দু একজন মালপত্র রিকশাতে তুলে দিল। আমি শুধু একহাতে পার্স আর অন্যহাতে ফ্রুটি নিয়ে বাস থেকে নেমে পথের দাদা ভাইদের টাটা করে কৃতাত্থ করলাম। আবার সেই পথ, উঁচু নীচু,রেলব্রিজের আগের সেই পরিচিত বাঁক,রিকশাওয়ালার হাঁপটান, শুধু প্রথম দিনের মুগ্‌ধতার জায়গায় মনে কেমন পাগলা দাশু পাগলা দাশু ভাব, "আবার সে আসিছে ফিরিয়া"!

    হস্টেল ফাঁকা, সবাই বেড়াতে বেরিয়েছে। সন্ধ্যের ঠিক আগে হবে, গোধূলির পর বোধহয়, সমুদ্রতল থেকে উঁচুতে, গাছপালা ঘেরা ক্যাম্পাসে তখন মন্দ মধুর হাওয়া বইছে, প্রাণ জুড়ানো, দুপুরের গরমের লেশমাত্র নেই সে হাওয়ায়। কোনোদিকে না তাকিয়ে চাবি খুলে ঘরে ঢুকে সাতদিনের ধূলো ঝাড়াঝাড়ি অন্তে প্রাণভরে চান করলাম। চানটান করে পোশাক বদলে বেরোলাম ডাইনিং হলের দিকে। রবিবার, চায়ের পাট মিটিয়ে রান্নার লোক আর ছোটুর ছুটি হয়ে যায় সেদিনের মত। মিষ্টির বাক্সগুলো ফ্রিজে রেখে, কনটেনারে পড়ে থাকা প্রায় ঠান্ডা চা নিয়ে বাইরে বাগানের দিকের বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলাম, ট্রেনিংসেন্টারের দিকে মুখ করে।
    শান্ত চারধার, পাখিদের নীড়ে ফেরার কিচিকিচি, বাতাসে একটা মাতাল গন্ধ, কোন ফলের কে জানে! চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনে হল, না: খুব খারাপ লাগছেনা ফিরে এসে, জায়গাটার একটা আকর্ষণ আছে বটে, কেমন যেন ভালোলাগার প্রলেপ লাগিয়ে দেয় অজান্তেই।
    বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে বসে থাকার পরে দেখি ভেতরের দিক থেকে অনিল আসছে। বিদিশা থেকে আসা তিনজনের একজন হল অনিল। বয়স যাই হোক দেখতে একদম স্কুলের ছেলের মত লাগে। দিল্লীর দিনগুলোতে ওকে সবসময় দেখা যেত নানা ধরণের গোলাপী অথবা নীল জামা পরে আর হলের আলো জ্বললে অন্যেরা জেগে উঠলেও ও ঘুমোতেই থাকত। আমরা মেয়ের দল ওর কথা উঠলে বলতাম "উহ ব্লু পিঙ্ক শার্ট"। এখানে আসার পর ওর নাম জেনেছিলাম। এখনও দিনের বেশী সময়ই ও ঘুমিয়ে থাকে। ঘুম থেকে উঠে চান টান করে এসেছে, আমাকে দেখে মহা খুশী, "এসে গেছ? মিঠাই আনো নি?"
    খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সব্বাইকার যে একই অবস্থা সে আর বলার অপেক্ষা রাখেনা নিশ্‌চয়ই। আমি মায়ের দেওয়া ছাড়াও নিজে অনেক মিষ্টি কিনে এনেছি এদের কথা ভেবে। "ফ্রিজে আছে", শুনে দৌড়ে ফ্রিজের দিকে যেতে যাবে, আমি আটকাই। "আগে যাও, রেখাকে খুঁজে নিয়ে এস তারপরে মিষ্টি দেব।" অনিল দৌড়য় স্যাট কম সেন্টারের দিকে। ওখানকার ফুলের বাগান খুব সুন্দর, রবিবারে ছুটির দিন হলেও খোলা থাকে, দু তিনজন থাকে শিফ্‌ট ডিউটিতে। আমরা মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে বসি। অনিলের হয়ত জানা ছিল সবাই ওখানে গেছে।
    কিছুক্ষণ পরে দেখি অনিল ফিরে আসছে একইভাবে ছুটতে ছুটতে, সোজা ফ্রিজের কাছে গিয়ে থামে। ততক্ষনে প্রনব ইত্যাদিরা পৌঁছে গেছে, মিষ্টির খবর চাউর হয়ে গেছে। রেখা এল সবার শেষে কারন সে হেঁটে এসেছে, বাকীরা দৌড়ে। ফ্রিজের সামনে মৌমাছির চাকের মত ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আমরা দুজন ঘরে যাই, সাতদিনে অনেক কথা জমেছে, অনেক কিছু দেখানোর আছে, আমাদের দুজনের জন্যে আলাদা করে রাখা মিষ্টি ইত্যাদি তো আছেই!

    আমাদের দলের মধ্যে এমপ্লয়ী নাম্বার হিসেবে প্রথম তিনজন হলাম অশোক আমি আর রেখা। এই নম্বরগুলো হেড অফিস থেকে দেওয়া হয় যোগদান পর্বের সময়। কী হিসেবে দেওয়া হয় জানিনা তবে গুজব আছে পরীক্ষা, ইন্টারভিউ, গ্রুপ ডিসকাশন মানে বাছাইয়ের নানা পর্বের নম্বর যোগ করে সেই নম্বর অনুযায়ী লিস্ট বানানো হয়। সে যাই হোক আজ অবধি ঐ "কয়েদী নম্বর ২০৩" দিয়েই চাকরি ক্ষেত্রে আমাদের পরিচয়, সবকিছুতেই ঐ নম্বর দিয়ে যায় চেনা!
    তাই স্কীম ট্রেসিংয়ের জন্য যখন তিন তিন জনের মোট ছয়টি দল বানানো হল ঐ নম্বর ধরে ধরে, আমি অশোক আর রেখা এক গ্রুপে পড়লাম।
    পিপিএফের একটি মূল অঙ্গ হল স্কীম ট্রেসিং। পাওয়ার প্ল্যান্টের বিভিন্ন স্কীম, ড্রয়িং ধরে ধরে আমাদের খুঁজে চিহ্নিত করতে হবে। ক্লাসরুম ট্রেনিংয়ের থেকে বাইরে খোদ সাইটে গিয়ে ঘোরাফেরা করার ব্যাপারে সবারই প্রভূত উৎসাহ দেখা গেল।
    শুধু অশোকের মুখ ভার, তার দলে দুটি মেয়ে। সবাই এসে তাকে সহানুভূতি জানাতে থাকল, অবশ্য আমাদের আড়ালে। ধরে নেওয়া হল যে আসলে সে একলাই, গ্রুপে দুজন মেয়ে থাকার মানে তো তাই দাঁড়ায়!
    শুনেছিলাম অশোক সিংসাবকে এ নিয়ে আর্জিও জানিয়েছিল, দুজন মেয়েকে একসাথে না দিয়ে আলাদা আলাদা গ্রুপে দেওয়া হোক। সিংসাবও নিমরাজী মত ছিল কিন্তু সুপারবস জৈন নাকি শুনে তেড়ে এসেছিল, এবং এরকম কথা আবার শুনলে, যে বলবে তার নামে জি এমের কাছে কমপ্লেন করবেন এ ধমকিও দেন। অতএব মডিউল শুরু হওয়ার আগে কদিন দেখা গেল অশোক আমাদের দেখলেই মুখটাকে গম্ভীর করছে আর অন্যদের দেখলে বেচারা ভাব করছে!
    ততদিনে আমরা দুজন, গুজরাটের দুজন ও রেখার সিনিয়র রঘু, এই পাঁচজনের একটা ভালো দল হয়েছে। গুজরাটের প্রনব আর অনিল হিন্দি আর গুজরাটী (নিজেদের মধ্যে) ছাড়া কিছু বলেনা, রেখা আর রঘু ইংরেজী আর নিজেদের মধ্যে মালয়ালাম। আমরাও চেয়েছিলাম স্কীম ট্রেসিংয়ের টীমে আমরা একসাথে থাকি, তবে সেরকমটা হয়নি বলে অশোকের মত মুষড়ে পড়ে মুখখানা বাংলার পাঁচ করে ঘুরছিলাম না কেউ।
  • kumu | 122.160.159.184 | ৩০ মার্চ ২০১২ ১৬:৩৯514902
  • জগমে রহ যায়েঙ্গে প্যারে তেরে বোল।
  • shrabani | 117.239.15.28 | ৩০ মার্চ ২০১২ ১৬:৪৫514903
  • নিয়মিত প্ল্যান্টে যাওয়া শুরু হওয়ার আগে আমাদের ড্রেস জুতো হেলমেট ইত্যাদি ইস্যু করা হল। আগেই দিয়ে দেওয়া হত কিন্তু স্টক ছিল না,সেবছর ট্রেনিং শুরু হয়েছিল দেরীতে,তাই সময়ের হিসেব একটু গরমিল হয়ে গিয়েছিল। এর আগে প্ল্যান্টে গেছি যে তা ক্লাসরুমে যারা পড়াতে আসতে তারা দায়িত্ব নিয়ে কোনো জিনিস হাতে কলমে দেখাতে গেছে বলে। সেইসব স্বল্প ভিজিটে, জুতো হেলমেট ইত্যাদির দিকে কেউ খেয়াল করেনি। আমাদের অবশ্য ঐ সেফটি হেলমেট মাথায় দেওয়া ব্যাপারটা বেশ পছন্দের ছিল, ওটা মাথায় থাকলে বেশ একখানা কাজের কাজী ভাব আসে। তাই অবাক হয়ে দেখতাম ভারিক্কী লোকজন সব বেশীরভাগই ওটা মাথা থেকে খুলে হাতে নিয়ে ঘুরত, যেন সেটাই দস্তুর, কেন কে জানে!

    স্কীম ট্রেসিং মানে প্রতিদিন প্ল্যান্টের ভেতরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ানো, ট্রেনিং সেন্টার থেকে উদ্যোগ নিয়ে কর্পোরেট অফিস থেকে সব সুরক্ষা সম্পর্কিত জিনিসপত্র আনালো আমাদের জন্যে। তখন আমাদের কম্পানিতে ছেলেদের ড্রেস ছিল একটু গাঢ় পীচ কালারের শার্ট ও নস্যি রঙের ট্রাউজার। ছেলেরা খুব চাইছিল ঐ ড্রেস মেটিরিয়াল, কারণ ওগুলো খুব টেকসই ছিল, রোজকার ছাই ও কয়লার ধুলোয় জামাকাপড় নোংরা হবে, ধুতে হবে ঘন ঘন, তার জন্যে ঐ কম্পানির কাপড়ই ভালো। এক দুপুরে লাঞ্চের আগে আমাদের বলা হল জামাজুতো সব নিয়ে যেতে, দত্ত বাবু বিলি করছেন।
    গিয়ে দেখি আমাদের জন্যে ড্রেসের জায়গায় এসেছে শাড়ি (পুরুষদের জামার রঙের বেসের ওপর সুন্দর প্রিন্টেড শিফন, অনেকটা এয়ার হস্টেসদের মতন, ম্যাচিং ব্লাউজ পীস) আর জুতোর জায়গায় খটখটে হিলতোলা স্যান্ডাল। আমাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দত্ত বাবু হাসেন, "আরে মেয়েদের সালওয়ার কুর্তার মেটিরিয়াল স্টকে নেই, তাই শাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। নিয়ে নাও, কী আর করবে? পরের বছর যেখানে থাকবে সেখানে একটু আগে থেকে বলে রেখো সালওয়ার কামিজ দেওয়ার জন্যে। কর্পোরেটে সবাই তো শাড়িই নেয়।" তা নাহয় হল, কিন্তু জুতো? জানা গেল সেও নেই, কর্পোরেট অফিস থেকে আসে এসব, তারা খুব একটা বুদ্ধি খাটায়না, লিস্টে মেয়েদের নাম দেখে স্যান্ডাল পাঠিয়ে দিয়েছে, এরা কী করবে!

    খটখট হিলযুক্ত চপ্পল (তাকে চপ্পল হিসেবেও পায়ে দেওয়া যায়নি কোনোদিন), শাড়ি ও হেলমেট নিয়ে ঘরে এলাম। সে চপ্পল শেষমেশ ঐ হস্টেলের ঘরেই ফেলে এসেছিলাম, শাড়িগুলো একেতাকে উপহার দিয়েছিলাম। দুবছর বাদে এই ড্রেস ব্যাপারটা উঠে যাওয়ায় পুরুষ কর্মচারীরা দু:খ পেলেও আমি বা আমাদের মত মেয়েরা খুশীই হয়েছিলাম!
    ছেলেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাজারের একমাত্র দরজিকে নিয়ে, দুদিনের মধ্যে জামাপ্যান্ট বানাতে। আমরা ধরনা দিলাম সবেধন জুতোর দোকানটিতে, যদি একটি ঢাকাঢুকি দেওয়া সাইজের জুতো আনিয়ে দিতে পারে বেনারস থেকে। দরজি এবং জুতোর দোকানী দুজনেই সাধ্যমত আমাদের আবদার রেখেছিল কোনো অতিরিক্ত মূল্য ছাড়াই।
    প্ল্যান্টে সুরক্ষার হেলমেট জুতো ইত্যাদি ঠিকঠাক পরা হচ্ছে কিনা প্রাথমিক ভাবে সিকিউরিটি অর্থাৎ সি আই এস এফের লোক দেখে ঢোকার মুখে, কিছু গোলমাল পেলে তারা আমাদের সুরক্ষা বিভাগকে জানায়। তাই জুতো ঠিক না হলে গেটেই আটকে যেতে পারি এই ভয় ছিল। এমনিতে ট্রেনিংয়ের বাসে গেলেও গেটে সবসময় বাস দাঁড় করিয়ে দুজন সি আই এস এফের লোক উঠে আসত বাসে চেক করতে। দলে আমরা মেয়েরা ছিলাম বলে একটি মহিলা কর্মীও আসত। এই মহিলাটিকে দেখলে আবার আমাদের ছেলেরা প্রচুর উৎসাহিত হয়ে সে নেমে গিয়ে বাস ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে কোরাসে চেঁচাত "গঙ্গা, গঙ্গা" (খাকী ড্রেস দেখে ওদের খলনায়কের মাধুরীকে মনে পড়ত)। সেই গঙ্গা অবশ্য বোঁচা নাক আর খুদে খর চোখে এদিক ওদিক দেখতে ব্যস্ত থাকত,রসিক নাগরদের ডাকে তার চিত্ত বিক্ষিপ্ত হওয়ার কোনো লক্ষন কখনো দেখিনি!

    স্কীম ট্রেসিং যবে শুরু হল তখন বোধহয় বাইরের তাপমাত্রা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। প্ল্যান্টের ভেতরে এলাকা বিশেষে দশ পনের যোগ করা যায়। ট্রেনিং সেন্টারের পাহাড়ী জঙ্গলে কিছু সবুজ তখনও অবশিষ্ট রয়ে গেছে, বাকী যেখানেই চোখ যায়, তামাটে হলুদে শুস্ক রুক্ষ চারিধার।
    প্রথমদিনই আমরা মানে আমি অশোক আর রেখা গেলাম টারবাইনের নীচেতলায়। আমরা দুই দুর্বল নারী লাফিয়ে লাফিয়ে (এদিকে ওদিকে নানা আকারের পাইপলাইন, ভালভ, যন্ত্র জড়াজড়ি করে চারধারে, সেসব পেরোতে লাফাতেই হচ্ছে) এদিক ওদিক করছি আর ভাপে প্রায় সেদ্ধ হচ্ছি তবে কাহিল হইনি। এদিকে সঙ্গী পুরুষটি প্যাংলা রোগাভোগা, কিছু পরেই দাঁড়িয়ে পড়ল, সে আর পারছেনা। তখন তাকে নিয়ে ওপরে উঠি, কনট্রোল রুমের এসিতে নিয়ে যাই। সেখানে ঢুকে জলের খোঁজ করব কী, জোড়ায় জোড়ায় চোখ হাঁ করে এই অদ্ভুত দলকে দেখতে ব্যস্ত। দুজন মেয়ে একটি ছেলেকে প্রায় ধরে নিয়ে এসে বসাচ্ছে আবার জল চাইছে, এমন দৃশ্য তারা কোনোদিন দেখেনি এর আগে।
    যাইহোক সেসব দৃষ্টি উপেক্ষা করে জল খাইয়ে অশোককে ওখানে বসিয়ে আমরা চলে যাই আবার নিজেদের কাজে। একটু এসিতে বসে জিরিয়ে নেওয়ার লোভ হলেও পরিবেশ দেখে সে মায়া ত্যাগ করি। সেই প্রথমদিনের অস্বস্তিকর অবস্থার দরুন পরে আর কোনোদিন আমরা ছেলেদের মত শুধু জল খেতে বা এসিতে বসতে কনট্রোল রুমে ঢুকতাম না, কাজ পড়লে যেতাম। তবে ইহা মেন কনট্রোল রুমের গল্প, এছাড়া চারধারে ছড়িয়ে ছিল অজস্র ছোট ছোট অপারেটর রুম বা ডি এম প্ল্যান্ট, সি এইচ পির কনট্রোল রুম, সেখানে সাধারনত নন একজিকিউটিভ অপারেটররা বসত, একজন দুজন।
    দুরে একা একা বসত বলেই কি না কে জানে এরা খুব অতিথিবৎসল হত। আমাদের ডেকে ভেতরে নিয়ে যেত, চা জল খাওয়াত, "বসুন স্যর, ম্যাডাম, দুদন্ড জিরিয়ে নিন।"
    এমনিতেও শক্তিনগরের সাধারণ নগরিকেরা খুব সরল ও সাহায্যকারী ছিল। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলে গাড়ি থামাবে, উল্টোপথে হলেও তোমাকে পৌঁছে দেবে তোমার জায়গায়। প্ল্যান্টের ভেতরেও মজদুর ওয়ার্কমেন এরা সবসময় সব কাজে সাহায্য করার জন্যে মুখিয়ে থাকত। মাত্র কয়েক কিলোমিটারের ব্যবধানে মধ্যপ্রদেশের বিন্ধ্যনগরে কিন্তু ছবিটা একদম অন্যরকম ছিল, ভেতরে আর বাইরে দুইই।

    অশোক সেদিন লাঞ্চের পরে আর ফিরলনা, বিশ্রাম নিল। আমাদের প্ল্যান্টের ভেতরে আবার সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিল বিকেলের সময়টা। চারটে বাজলেই মোটামুটি তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা দিতাম ক্যান্টিনের দিকে। তখন গরমা গরম ভাজা হচ্ছে সমোসা, বড়া, জিলিপি, চা কফি তো আছেই। সেইসব মুখরোচক জলপান সহযোগে আড্ডা চলত পাঁচটা অবধি,বাবা ততখনে বাস নিয়ে হাজির হয়েছে ক্যান্টিনে, নাস্তা করবে তারাও। গুনেগেঁথে সবাইকে নিয়ে বাসে ওঠা হত। যতক্ষণ ঘোরাঘুরি করতাম ক্লান্তি বুঝতাম না, হস্টেলে ফিরে স্নানটান করে কিন্তু কেমন একটা এলানো লাগত, আর বেরোতে ইচ্ছে করতনা মোটেও। যেদিন ফোন করার থাকত খাওয়াদাওয়ার পর রাতে যেতাম শক্তিতে।
    পরদিন সকালে অশোক গেল আমাদের সঙ্গে যথারীতি, একটু ঘোরার পরেই দেখি পকেট থেকে কী সাদা একটা গুঁড়ো বার করে মুখে ঢালছে। আমরা তাকিয়ে আছি দেখে হেসে বলে, "গ্লুকোজ, মাঝে মাঝে মুখে ঢালব, তাহলেই শক্তি এসে যাবে। তোরাও নিয়ে আসিস কাল থেকে।" আমরা অবশ্য বিনা গ্লুকোজেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম সেই স্কীম ট্রেসিংয়ের বেলা, এমনকি অত গরমে জলও প্রায় না খাওয়াই। এক তো জল খেতে হলে কনট্রোল রুমে বা কোনো অফিস ঘরে কারুর কাছে যেতে হবে, এমনি পানীয় জল যত্রতত্র উপলব্ধ ছিল না সেযুগে। অফিস ঘরটর সব দুরে দুরে হত। জলের বোতল বা ব্যাগ নিয়ে ঘুরছি এতো ভাবতেই পারতাম না। হাতে খাতা পেন থাকত, ঘরের চাবি থাকত প্যান্টের পকেটে (হয় নিজেদের নয় বন্ধুদের)। এখন মেয়েদের দেখি সুন্দর লেদার পাউচ আড়াআড়ি ভাবে নিয়ে ঘোরে। এছাড়া জল খেলেই আবার বিয়োগের প্রসঙ্গ আসতে পারে, যে প্ল্যান্টের ভেতরে সেসময় মেয়েদের দেখলে লোকে সব ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, সেখানে লেডিজ টয়লেট যে থাকবেনা তা কি আর বলে দিতে হয়!

    প্রথম প্রথম প্ল্যান্টে চাকরীজীবনের সেই শৈশবস্থায়, নব্য চাকুরে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ মনে হত বয়লারে চড়া, মানে একেবারে ওপর অবধি যাওয়া পুরোটাই, একটুও লিফটে না উঠে। যেদিন যে বয়লারে চড়ত সারাদিন সে র‌্যালা নিত। এবার এমনি এমনি তো আর ওপরে চড়ে বসা যায়না, কাজে অর্থাৎ তেমন তেমন বয়লার সম্বন্ধীয় স্কীম ট্রেস করতে হয়েছে যখন তখনই চড়েছি। এটা বোধহয় আমাদের মধ্যে এসেছিল কারণ সবকিছু ঠিকঠাক চললে পুরনো পাপীরা কেউই চট করে বয়লারের দিকে যেতে চাইতনা। আমাদের তখন কী শখ একেবারে, ওপরে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে বসে বিন্ধ্য পর্বত দেখতাম, চারদিকের দিশ্যি দেখে মুগ্‌ধ হতাম, মনে হত কুতুব মিনারে চড়ে বসে আছি!
    একবার আবার ওরকমই এক নিরালা ফ্লোরে কালিঝুলি মাখা নীল জামা আর হলুদ হেলমেটের আড়ালের এক ওয়ার্কার, আমাদের রঘু, থমাস এদের কথা শুনতে পেয়ে মালয়ালামে কথা বলে ওঠে। শক্তিনগরে মালয়ালী বেকারী ছাড়া এমনি কেরালার লোকের পপুলেশন গোনাগাঁথা এক বা দুই ছিল। সেই বিকেলে বয়লারের ওপরে দেশোয়ালী ভাই আবিস্কারের যে উত্তেজনা পরস্পরের, সে বলে বোঝানো যাবেনা। আমি আর রেখা সেখানে ছিলাম না। রেখাকে ওরা এসে ডেকে নিয়ে গেল মালয়ালামে কথা বলতে।
    আমাদের বাঙালীদের অবশ্য ব্যাপারটা অন্য রকম, একজিকিউটিভ ছাড়াও এমনি প্রচুর বাঙালী দেখা যেত পথে ঘাটে। ষষ্ঠীর রোলের দোকানে তো রীতিমত বাঙালীদের রকাড্ডা টাইপের আসর বসত প্রতি বিকেলে। কোল ইন্ডিয়া, বিন্ধ্যনগর মিলে বাংলা সংস্কৃতি এক্কেরে জমজমাট ঐ অঞ্চলে। কলকাতার অনেক লেখক কবিরা নাকি নানা অনুষ্ঠানে আসে ওখানে, এমনিও এসে ঘুরে যান কেউ কেউ, এমন মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে খুশী হয়ে এসে এদের আতিথ্য গ্রহণ করে তারা। অনেকেই বিশেষ করে মহিলারা প্রথম সুযোগেই জানিয়ে দিত লেখক কবিদের সাথে তাদের ব্যক্তিগত আলাপ, চিঠি চালাচালির কথা। আমি আবার মাঝেসাঝে বাঙালীদের আধিক্যেই বরং একটু বিরক্তমতন হতাম!
    তা সেই গ্লুকন ডি হাতে অশোককে দেখে মনে হয়েছিল ওকে নিয়ে গ্লুকন ডি একটা বিজ্ঞাপন করতে পারে, খাওয়ার আগে ধুঁকতে ধুঁকতে হাঁটন্তি অশোক, ব্যাকগ্রাউন্ডে চিমনির ধোঁয়া ইত্যাদি এদিক ওদিক টারবাইন জেনারেটর সব বড় বড় যন্ত্রদানব......., সবুজ প্যাকেট থেকে সাদা গুঁড়ো মুখে ঢালতেই তরতর করে অশোক একেবারে বয়লারের ওপরে,ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে টারবাইন জেনারেটর ইত্যাদির দিকে করুণার হাসি দিচ্ছে, চিমনিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে।
    গ্লুকন ডি ম্যান, গ্লুকন ডি ম্যান..........
  • Nina | 12.149.39.84 | ৩০ মার্চ ২০১২ ১৮:৫২514904
  • একই সঙ্গে ঝরে মেয়েটা---
    কখনও চোখ ভর্তী জল--
    কখনও চল চল রে চল--
    একই অঙ্গে কত রূপ ধরে
    শ্রাবণী---ও তার কলম
    আমি শুধু শুনি
    অবাক হয়ে--শুনি----
  • sayan | 115.184.75.67 | ৩১ মার্চ ২০১২ ০১:১১514905
  • স্থাণু চিত্রগীতে রোদ ভরে দাও তুমি
    বেহালার ছড়, আড়বাঁশী
    স্তবকের নাম জপমালা রেখে যারা
    সব খুইয়েছিল, সেদিনের
    নিম্নলিখিত সাধারণ বাঁচার মাধ্যম বেয়ে
    আশিক শ্রুতিলিখন গাঁথে মিথ্যা
    নিথর প্রাণ এসো, গগনে ও গহীনে -
    রোদ নামুক গালিচার মত
    তামাটে জ্বলে যাওয়া রঙ নিভে
    কাঁচা সোনা জয় খুব ধীরে,
    সালতামামির বেয়াদপি বরদাস্ত করে
    শেষবারের মত চোখ রাখতে চাই
    লৌহপ্রতিমায়
  • sayan | 115.242.148.250 | ৩১ মার্চ ২০১২ ০১:১৩514906
  • ধুৎ, জয় না, হয়
  • Tim | 198.82.18.48 | ৩১ মার্চ ২০১২ ০২:০৭514907
  • কি লেখে মাইরি! ছবির মত এক্কেরে।

    কুডোস!
  • Tim | 198.82.18.48 | ৩১ মার্চ ২০১২ ০২:১২514908
  • একদিন আম্মো কলার তুলে বলবো, শ্রাবণীদির সাথে আলাপ হয়েছিলো গুরুতেই। মুখবইতেও আছে, বন্দুক। লোকে বলবে, ঐ উনি? যিনি এবছর অমুক পেরাইজ পেলেন?!!

    সান্দাকেও সাবাশ। বহৎ খুব!
  • Tirthang | 140.247.29.73 | ৩১ মার্চ ২০১২ ০২:৩৪514909
  • পড়ছি আর উত্তরোত্তর মুগ্‌ধ হচ্ছি। অনবদ্য।
  • rimi | 75.76.118.96 | ৩১ মার্চ ২০১২ ০২:৪৮514780
  • সত্যি, আমিও যত পড়ছি মুগ্‌ধ হচ্ছি। শ্রাবনির পাখা হয়ে গেছি অলরেডি।
  • i | 124.149.115.136 | ৩১ মার্চ ২০১২ ০২:৫৬514781
  • এত বিশদে সব মনে রাখা-বর্ণ গন্ধ স্বাদ-এই তো সেদিন শিরোণাম সার্থক।
  • shrabani | 117.239.15.27 | ০৯ এপ্রিল ২০১২ ১৭:২০514782
  • দৈনন্দিন থোড়বড়িখাড়ার মধ্যে একটু স্বাদবদল বলতে বাসুবাবু ও জৈন সাহেবের বদলি। বাসুবাবু গেল লেকের ওপারে রিহান্দনগর আর জৈন গেল দিল্লীর অনতিদুরে, ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি। শক্তিনগর ও বিন্ধ্যনগর ছাড়াও এ অঞ্চলে কম্পানির একটি তৃতীয় প্রজেক্ট আছে রিহান্দনগরে।
    শক্তিনগর ও বিন্ধ্যনগরকে রিহান্দনগর থেকে আলাদা করেছে বিশাল রিহান্দ জলাধার বা রিহান্দ লেক। তখন রিহান্দনগর থেকে এদিকে আসতে গেলে ঘুরপথে আসতে হত, সে রাস্তাও খুব খারাপ ছিল,সরাসরি রাস্তা হয়েছে অনেক পরে। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে তাই লোকে জলপথে আসাযাওয়া করত, বোটে। সকাল দুপুর ও বিকেল তিন বার বোট ছাড়ত শক্তিনগর ও রিহান্দনগর উভয় পারের ঘাট থেকে। বোটে ঘন্টাখানেক লাগত, রিহান্দের লোকজন শক্তিনগরে এসে বাস বা ট্রেন ধরত, কিম্বা এমনিই আসত কাজে, বাজারে দোকানে। এই তিনটি জায়গার মধ্যে শক্তিনগর ছিল সবচেয়ে বেশী উন্নত সুযোগসুবিধার অধিকারী।
    লোকে এই তিন প্রজেক্টকে কম্পানির বারমুডা ট্র্যাঙ্গল বলে অভিহিত করে থাকত বা থাকে এখনও। এই প্রদেশে ঢুকলে নাকি আর সহজে বাইরে বেরোনো যায়না, তিনটির মধ্যেই ঘুরপাক খেতে হয় যদি না জৈনের মতো বিশেষ ভাগ্যশালী কেউ হয়!
    তিনটির মধ্যে আবার তখনকার দিনে হয়ত দুর্গমতার কারণেই, কারুর বদলি রিহান্দনগরে হলে তার বাড়িতে প্রায় শোকের আবহাওয়া তৈরী হয়ে যেত, বন্ধুবান্ধব পাড়াপড়শী এসে সমবেদনা জানিয়ে যেত! বাসুবাবুর ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি, অর্ডার আসা থেকে মুখ চুন করে ঘুরছিল, আগের হাঁকডাক হম্বিতম্বি সব উধাও। শুধু তাই নয়, সেই থেকে আমাদের সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার করতে লাগলে যে কিছুদিন পরে ওর রিহান্দ বাসের প্রথম মাসেই আমরা ওর বাড়িতে অতিথি হলাম।

    পান্ডে কান্ডের পরে একদিন জৈন আমাদের দুজন মেয়েকে ডেকে পাঠিয়ে ঘটা করে খোঁজখবর নিল। এর আগে দলে ছাড়া কোনোদিন আলাদা করে জৈনের সঙ্গে কথাবার্তা হয়নি। আমাদের ঘরবাড়ি পরিবার ইত্যাদি সম্বন্ধে বিশদ খোঁজখবর নেওয়া অন্তে উনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে শক্তিনগরে আমরা খুব বোর হচ্ছি এবং পরিবার পরিজনের থেকে দুরে খুবই দু:খে আছি।
    "আমার স্ত্রীও খুব বোর হয় এখানে, শহরের মহিলাদের এখানে ভালো লাগতেই পারেনা।" দু চারবার বলার চেষ্টা করলাম যে আমরা এমন কিছু বোর হচ্ছিনা বা বোর হওয়ার সময় পাচ্ছিনা, তা সে আমাদের বলতে দিলে তো। সমস্ত তুখোড় এইচ আর ব্যক্তিত্বের মত জৈনও অন্যের কথা শোনার থেকে নিজেই বলে যাওয়া বা নিজের মতামতকে অন্যের মস্তিস্কে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল। ওর রুম থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষনের জন্যে আমাদের দুজনেরও নিজেদের খুব বেচারা বেচারা আর চারিপাশকে কেমন বোরিং লেগেছিল।
    এরপরে উনি আমাদের নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেন। লাঞ্চ ডিনার ইত্যাদি বিশেষ কোনো কিছুর আমন্ত্রন নয়, শুধুই শনিবার বিকেলে ওর বাড়ি গিয়ে স্ত্রী ও বাচ্চাদের সঙ্গে আলাপ করা। আমাদের খুব একটা ইচ্ছে ছিলনা কিন্তু ট্রেনিংয়ের বড় কর্তার কথা ফেলতেও পারলাম না। বাকীরা যারা নেমন্তন্ন পেল না তারা শুনে খুব হাহুতাশ করতে লাগল। সেসব দিনে কারু বাড়ি যেতে বলেছে মানে অন্ততপক্ষে ভালো জলখাবারের ব্যবস্থা থাকবে সেখানে, তাই সবার এত দীর্ঘশ্বাস ফেলা!
    ট্রেনিং সেন্টার ছিল টাউনশিপের লোকালয় থেকে একটু দুরে, একটেরে, সেখানে থাকতে থাকতে এই কদিনে আমরা কিঞ্চিত অসামাজিক হয়ে উঠেছিলাম। ট্রেনিং, প্ল্যান্ট ইত্যাদির বাইরে, বাজারে বা ক্লাবে মাঝেসাঝে কোথাও কোনো পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত বা আলাপটালাপ যা হয়েছে তাতে তদানীন্তন শক্তিনগর টাউনশিপের সমাজের ঝলক দেখা গেছে। দেখেশুনে সেই সমাজের প্রতি কোনো বিশেষ আকর্ষণ গড়ে ওঠেনি। বরং বিরক্ত হতাম যখন দেখতাম, আমাদের নিয়ে এক অপার কৌতূহল সবার মধ্যে,বিশেষ করে মহিলাদের। দুজন মেয়ে এতগুলো অনাত্মীয় ছেলের সাথে এক ছাতের তলায় বাস করছে এটা কিছুদের কাছে বেশ অ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপার মনে হত আবার কিছু লোকে খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। প্রথম দলের মধ্যে একটু কমবয়সী মহিলারা পড়ত, দ্বিতীয় দলে সাধারণত মাঝবয়সীরা ছিল যারা আলাপ হলে আমাদের সঙ্গে হয় সেরকম কথাই বলতনা, নয় প্রথমেই সরাসরি জিজ্ঞেস করত বিয়ে হয়েছে কিনা বা কবে বিয়ে করব। তবে সেই কদিনে আমাদের আলাপ পরিচয় খুব বেশী বাসিন্দাদের সাথে হয়নি তাই স্যাম্পল সাইজ পর্যাপ্ত ছিল এ দাবী করতে পারিনা।
    যারা পড়াতে আসত তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়িতেও যেতে বলেছে ক্লাসের সবাইকে, কিন্তু আমরা সেভাবে কখনো নিজেদের গন্ডীর বাইরে কারোর সাথে মিশতে যাইনি, বাই চয়েস! তবে অশোক আর দেবাশিস কিন্তু খুব ঘুরে বেড়াত বাঙালীদের বাড়িতে এবং অনেক পরিবারের সঙ্গেই বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল মাত্র কদিনেই। ওদের দৌলতে দু তিনটি বাঙালী পরিবারের সঙ্গে পাকেচক্রে কিছুটা পরিচিতি আমারও হয়েছিল, তারা অবশ্য সবাই বেশ ভালো, আমুদে হৈচৈয়ে ছিল।

    যাইহোক নির্দিষ্ট শনিবারে আমরা রওনা দিলাম জৈনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। একটাই ভালো ব্যাপার, জৈন নিজে সেদিনই বাইরে গেছে, ট্যুরে। ভাবলাম গিয়ে কোনোরকমে মিসেস জৈনের সাথে একটু দেখা করেই চলে আসব। নম্বর আর টাইপ খুঁজে দুধারে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচুড়ার লাল হলুদ বিছানো সরু পিচঢালা পথ ধরে পৌঁছে গেলাম সারি সারি একতলা কোয়ার্টারের সামনে। রাস্তার পরে একফালি লন, মেহেন্দীর বেড়া ঘেরা, কিছু টবে, কিছু মাটিতে, ফুল পাতাবাহারের গাছ।
    ছোট্ট গেট ঠেলে ঢুকতেই লনে পাতা চেয়ার ছেড়ে উঠে এল এক সুবেশা সুন্দরী মহিলা সঙ্গে দুটি বাচ্চা মেয়ে। বাচ্চাদের মধ্যে একটি একটু বড়, বছর দশেকের হবে, অন্যটি নিতান্তই পুচকি, চার পাঁচের বেশী হবেনা। শ্রীমতী জৈন বোধহয় দিল্লীর ওদিককারই মেয়ে, স্বামীর মতই স্মার্ট, খুব ভালো করে কথা বলেন। শক্তিনগরে কী পাওয়া যায় কী যায়না, গরমে কিভাবে থাকতে হয়, কী খেতে হয় এসব নিয়ে নানা পরামর্শ দিলেন, এছাড়া গান সিনেমা ইত্যাদি নিয়েও কথা হল। মেয়েদুটির সঙ্গে অল্প কথা বললাম, বড়টির সঙ্গে তার স্কুল নিয়ে, ছোটটির খেলনার ভান্ডার দেখা হল, একটু খেলাতেও অংশ নিতে হল। ঘন্টা দুয়েক পরে চা দইবড়া চানাচুর খেয়ে উঠলাম যখন তখন বেশ ভালৈ লাগছিল, খারাপ কাটলনা বিকেলটা।
    গেটে দাঁড়িয়ে শেষ মুহূর্তের বিদায় সম্ভাষন "ফির মিলেঙ্গে" ইত্যাদি চলছে, আমরা আসায় ওরা কত খুশী, আমরাও আসতে পেরে কত আহ্লাদিত, দুপক্ষই বারংবার নানা ভাষায় নানা অলঙ্কারে পরস্পরকে শোনাতে থাকি। ছোট মেয়েটি এতক্ষণ এর ওর হাত ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিল, বার বার বড়দের মুখে একই কথা শুনে বোর হয়ে না এক জায়গায় অতক্ষণ দাঁড়িয়ে অধৈর্য্য হয়ে কিম্বা ছোট্ট মনের খেয়ালে বলে ওঠে,"মাম্মি, দেখলে এই দিদিরা কত ভালো। তুমি পাপার ওপর মিথ্যেই অত রাগ করছিলে কাদের না কাদের ডেকেছে বলে। তখন যে খুব বলছিলে একটু কথা বলেই চা দিয়ে দেব যাতে চা খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। এখন তো তুমি খালি গল্প করেই যাচ্ছ, ওদের যেতেই দিচ্ছ না"।

    ভদ্রমহিলা হতবাক, মানে মুখের দিকে সাহস করে সেরকম ভালোভাবে তাকাতে পারিনি কিন্তু জানি মুখের ভাব সেই যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমুঢ় গোছের কিছু একটা হবে!
    অমন স্মার্ট মহিলা, তার কী অবস্থা,কী বলবে কী বলে সামলাবে, কিছুই ঠিক করতে পারেনা। আমাদের সামনে মেয়েকে ধরমারও করতে পারছেনা, শেষে বোকা বোকা লাজুক লাজুক হেসে আমতা আমতা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। আমাদের অবস্থাও কিছু এমন সুবিধের নয়, প্রথমে চুপ, পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে অপ্রস্তুতের হাসি হেসে "ওকে বাই, গুডনাইট" করে তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি।
    সারা রাস্তা মিসেস জৈনের ছাইপানা মুখ আর বেকুবের মত হাসির কথা মনে করে কুলকুল হেসেছিলাম দুজনে। বেচারী দিল্লিওয়ালী স্মার্ট মিসেস জৈন!
  • shrabani | 117.239.15.27 | ০৯ এপ্রিল ২০১২ ১৭:৩৮514783
  • এর পরে আর কোনোদিন জৈন আমাদের তার বাড়িতে ডাকেনি, অবশ্য এর অল্প কয়েকদিন পরেই ওনার বদলি হয়ে গেল। জৈন পরিবারের সবার সঙ্গে আবার দেখা হল ফেয়ারওয়েল ডিনারে। তখন নতুন কর্তা রাও সাহেব এসেছে জৈনসাহেবের জায়গায় । জৈনের শেষদিনে এসে যোগ দিলেন ইনি অন্য কোন এক ডিপার্টমেন্ট থেকে। স্বভাবে প্রথমজনের সম্পূর্ণ বিপরীত, টেকনিক্যাল লোক, আমাদেরই মত ট্রেনী হয়ে ঢুকেছিল এককালে। স্বভাবে এদিককার ভাষায় যাকে বলে মস্ত আর বিনদাস, রাওসাহেব হল তাই। তেলুগু শুধু নামে, বাকী সবকিছুতে আদ্যোপান্ত বিহারী, রাঁচীর ঐদিককার লোক। মুখে সবসময় পান, হুল্লোড়ে আর হুজুগে সবার আগে থাকে।

    ওনারই উৎসাহে জৈনকে পরিবারসুদ্ধু ডিনারে ডাকা হল ট্রেনিং সেন্টারের একজিকিউটিভদের তরফে। ট্রেনিং সেন্টারে সিং, দত্ত আর রাও নিজে, এই কটি গোনাগুনতি একজিকিউটিভ, তাই ট্রেনীদের নেওয়া হল দলে। রাও সাব আমাদের ডেকে দায়িত্ব দিল পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজন করার, সেই রাতেই। ইতিমধ্যে বাসুবাবুরও বদলির আদেশ এসে গেছে। সে অবশ্য যাচ্ছে কাছেই, কিছুদিন দেরী আছে যেতে। তবু একযাত্রায় তাকেও সপরিবারে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হবে ঠিক হল।
    দায়িত্ব পেয়ে আমরা খুব মেতে উঠলাম। ট্রেনিং সেন্টারের যে ঘরটায় চা খাওয়া হত সেখানে টেবিল জুড়ে জুড়ে, তার ওপর সাদা চাদর পেতে খাবার রাখার ব্যবস্থা হল। আমাদের দুজনের ওপর ভার পড়েছিল সাজানোর। টেবিলের মাঝখানে ফুলদানিতে বাগান থেকে ফুল নিয়ে এসে সাজানো হল। এদিক ওদিক থেকে ফুলের টব নিয়ে এসে হল ঘরের নানা জায়গায় রাখলাম। রঙিন কাগজ কিনে ফুলপাতা বানিয়ে দরজা জানালায় লাগালাম।
    খাবার অর্ডার দেওয়া হল উপবনকে। শক্তি রেস্তোরাঁ ছাড়া আরেকটি রেস্তোরাঁ ছিল শক্তিনগর বাজারে, উপবন। যে সে নয়, এসি রেস্তোরাঁ,সুন্দর সাজানো চেয়ার টেবল, ভারী পর্দা লাগানো। কিন্তু কেন জানি সেই জঙ্গলের মধ্যে সাজানো প্রাসাদ অথচ একটিও জনপ্রাণী নেই টাইপের, উপবনে কোনোদিনও খদ্দেরের ভিড় কেউ দেখেছে বলে শুনিনি।
    শক্তিনগরে এমনিতে মিষ্টির দোকানও ছিলনা তখন, টাউনশিপের বাইরে গেলে দেহাতী গ্রামের দোকানে চিনি বোঝাই দানাদার গজা জাতীয় কিছু পাওয়া যেত কিন্তু সে কেউ মুখে দিতে পারবেনা।
    বিন্ধ্যনগরে ছিল ইন্ডিয়ান কফি হাউস , টাউনশিপের ভেতরে। ওদিককার হিসাবে তার খাবারদাবার বেশ ভালো ছিল কিন্তু শক্তিনগরে সে সুবিধা ছিলনা। বড় কাজে লোকে দুর থেকে মিষ্টি আনাত, রান্নার লোকজন ডেকে বাজার দোকান করে খাবার তৈরী করাতে হত, হাঙ্গামা ছিল প্রচুর। ছোটখাটো ব্যাপারে আগে থেকে বিন্ধ্যনগর কফি হাউসকে অর্ডার দিলে এক হত, মোটকথা বাছবিচারের খুব বেশী সুযোগ ছিলনা।

    আমাদের দলের আবার উপবনের সঙ্গে প্রথম আলাপটা একটু অম্লমধুর গোছের হয়েছিল।
    বৈচিত্রের অছিলায় (অবশ্যই খাওয়াদাওয়া সংক্রান্ত) হস্টেলে শুরু হয়েছিল দলের সদস্যদের জন্মদিন পালন করা। কারুর জন্মদিন থাকলে তার ঘাড় ভেঙে মালয়ালী বেকারীর কেক আসত, মেসের খাওয়াতেও বিশেষ দিনের জন্যে ছোলে পনীর জাতীয় স্পেশ্যাল মেনু। তা এরকমই এক জন্মদিনে উপবন থেকে কিনে আনা হয়েছিল রসগোল্লা। রাতে খাওয়ার পর প্রথম মিষ্টিটি মুখে দিয়ে বোঝা গেছিল মেনুতে চাটনির অভাব পূরণ হয়ে গেল, এমনই টোকো স্বাদ সেই মিষ্টান্নের। এটা কিছু এমন ব্যাপার নয়, হতেই পারে কখনোসখনো এরকম দুর্ঘটনা কিন্তু পরবর্তীতে যা হল তা সত্যিই অভাবনীয় ছিল। ছেলেরা মিষ্টির প্যাকেটটি ফেরত নিয়ে যাওয়া মাত্র উপবনের কাউন্টারে বসেথাকা মালিক কাম ম্যানেজার ভদ্রলোক বিনাবাক্যব্যয়ে এদের হাতে পুরো টাকা ধরিয়ে দেন। সেইসব বীরেরা যারা প্রচুর ঝগড়া বাদানুবাদ করে টাকা আদায় করার নিমিত্ত দল পাকিয়ে গেছিল, তারা সুযোগ ফসকানোর হতাশায় এমনটাও বলল যে টাকা নাকি গোনাগুনতি করে রেডিই রাখা ছিল!

    এরপরে আবার সেই উপবনে ফেয়ারওয়েল ডিনারের অর্ডার দেওয়ার সাহস আমাদের হচ্ছিলনা কিন্তু কাছেপিঠে আর কোনো উপায়ও ছিলনা। সময়ের অভাব ছিল,আয়োজনটা করতে হয়েছিল মাত্র কয়েক ঘন্টার নোটিসে, পরদিনই জৈন চলে যাবে শক্তিনগর ছেড়ে। যাইহোক দত্তবাবু ও সিং সাব ভরসা দিল, উপবনকে ভালো করে বুঝিয়ে বললে নাকি ঠিকঠাক খাবার দেবে, যেরকমই হোক ওদের ব্যবসা তো এই টাউনশিপের মধ্যেই!
    একটা ভালো ব্যাপার ছিল যে আখ্যা উত্তর মধ্য ভারতে ভেজ পার্টি মেনু নিয়ে সচরাচর কোনো জটিলতা থাকেনা, সেই রামের অযোধ্যাবাসের সময় থেকে বোধহয় উৎসবে আনন্দে মোটামুটি খাদ্যতালিকাটা একইরকম,রকমফেরে ছোলে পনীর, দালমাখানী, পুরী পোলাও, গুলাবজামুন!
    তফাত বলতে জৈনের জন্য সবকিছু পেঁয়াজ ছাড়া করতে হল। সে যাত্রায় উপবন তবে মুখ রেখেছিল (আমাদের ও তার নিজেরও), বলতে গেলে আশাতিরিক্ত ভালো স্বাদের খাবার ছিল।

    খাওয়ার আগে প্রনবের গান, রাজেশ ও পান্ডে মজার জোক শোনালো, সব মিলিয়ে উৎরে গেল ডিনার পার্টি, আমাদের প্রথম দলগত সাফল্য। বিদায় নেবার আগে শ্রীমতী জৈন সত্যিকারের আন্তরিক ভাবে আমাদের দুজনের হাত ধরলে, ভালো করে জানা চেনার আগেই চলে যেতে হচ্ছে বলে দু:খ করলে, পরে যদি কোনোদিন ওদের ঐদিকে আসা হয়, যেন ওর সঙ্গে অবশ্যই দেখা করি, কথা নিলে। আমরা বাচ্চাদুটোকে আদর করলাম, ওদের দুজন আর বাসুবাবুর ছেলের জন্য রাখা উপহার সবাইকে দিতে বাচ্চারা খুব খুশী। বাসু বৌদির সঙ্গে আলাপ হল, খুব ভালো ভদ্রমহিলা। পরদিনই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছিল কলকাতায়, তাই শক্তিনগরের বাড়িতে ডাকতে পারলনা। বার বার রিহান্দনগরে ওদের বাড়ি যাবার জন্যে নেমন্তন্ন করে গেল।

    অশোক আর দেবাশিস, কয়েকজন বাঙালীর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করত, তার মধ্যে দাস পরিবারের সঙ্গে তো ওরা রীতিমত ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। আমার সঙ্গেও এদের অল্পবিস্তর আলাপ ছিল, দু একবার আমি ও রেখা গেছি এদের বাড়ি চা খেতে। বৌদি স্কুলে পড়াত আর যেখানে যত প্রোগ্রাম হত, বাঙালীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেখানে আবৃত্তি, গান ইত্যাদির দায়িত্বে থাকত। এদের বাড়িতে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় জমাটি আড্ডা গানের আসর বসত। জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি কী শেষ দিকে, মোটামুটি বর্ষা শুরুর আগে এই পরিবারটির উদ্যোগে স্থির হল এক রবিবারে বোটে চড়ে রিহান্দ যাওয়া হবে সদলবলে। এক সন্ধ্যায় অশোকদের হস্টেলে ছাড়তে এসে দাদা বৌদি আমার ঘরে এসে আমাকে অনুরোধ করল ওদের সঙ্গী হতে। বাসুবৌদির নেমন্তন্ন তো ছিলই, বোটে যাওয়া হচ্ছে শুনেই আমি এককথায় রাজী হয়ে গেলাম।

    রেখাকে একবার বলতে সে খুব একটা উৎসাহ দেখায় না, বুঝি বাঙালীদের দলে সারাদিন কাটাতে ও রাজী নয়, আমিও সেটা একটা শাস্তির মতই হবে ভেবে জোর করিনা। ততদিনে আমাদের পরিচিতি বেড়েছে, বন্ধুও হয়েছে যার মধ্যে তিনজনের কথা বলেছি। তাই আমারও রেখাকে ছেড়ে যেতে চিন্তা হবেনা প্রথম দিনগুলোর মত। তাছাড়া আমার অনুপস্থিতিতে পরেশও খুব খেয়াল রাখে রেখার, আমার দায়িত্ব হিসেবে।
    পরেশ হল দুই ওড়িয়ার দ্বিতীয় জন ও দলের সর্বকনিষ্ঠ। কটকে ওদের বড় পরিবার, সবাইকে ছেড়ে এসে খুব মনমরা হয়ে থাকত প্রথম কদিন। সন্দীপের সঙ্গে ওর দিল্লীতে পরিচয়। প্রথম থেকেই হিন্দি ছাড়া অন্য ভাষাভাষীর সবাই নিজের নিজের রাজ্যের সদস্যদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল ভাষার কারণেই এবং সেইমত সবাই যে যে দল পাকিয়ে ঘুরত। সেই হিসেবে পরেশও সর্বদা সন্দীপের সঙ্গে থাকত এবং এইভাবে ওদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যে যাই বলুক, পরেশ সন্দীপভাই বলতে অজ্ঞান, তার কোনো দোষ সে দেখেনা।

    এদিকে শক্তিনগরের প্রথমদিকে ওর এক মনখারাপের বেলায় কালভার্টের ওপরে যখন একা একা বসেছিল, আমি গিয়ে ওর সঙ্গে অনেক গল্প করেছিলাম, ওর মন ভালো করতে। ওর বাড়ির কথা, পাঁচ ভাইয়ের এক বোন, ওর দিদির কথা এসব নানা আলোচনা হয়েছিল আমাদের মধ্যে। তারপর থেকে কী ভেবে ও আমাকে দিদি বলে ডাকতে শুরু করেছিল। আমার আবার বাড়িতে পরিবারে সবার ছোট হওয়ার দরুন, কেউ দিদি ডাকবার ছিল না। প্রথম কলেজে যেতে গিয়ে বাসের কন্ডাকটর যখন দিদি বলে ডাকল কী খুশী! তবে ঐ পর্যন্তই, চেহারার জন্যে নাকি কে জানে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়ররাও কেউ দিদি বলে ডাকতে চাইতনা। দিদি ডাকার লোকের অভাব ছিল বলে দিদি ডাকের ওপর তখন একটা বেশ মায়া ছিল।
    এর ফলে পরেশ আমার ভাই হয়ে গেল। শক্তিনগরের দিনগুলোতে পরেশ আমার একটা বড় ভরসা ছিল, সবকিছুতে আমার পাশে পাশে থেকেছে আপনার চেয়েও আপন হয়ে। পরে ভেবে দেখেছি পরেশ ছোট হয়েও কতটা বুদ্ধিমান তাই একাধারে সন্দীপের বিশ্বাসযোগ্য চেলা ও আমার অনুগত ভাই, এই দুই দায়িত্ব এত সফলভাবে পালন করেছে। কারণ সন্দীপের তো সব ব্যাপারে মনে হত বাঙালীদের সাথে আর বিশেষ করে আমার সাথে যেন জন্ম থেকেই আড়ি।

    একবার অশোক দেবাশিসরা অনেক তুতিয়ে পাতিয়ে সবাইকে রাজী করালো যে আমরা কজন নিজেরা মাছ কিনে এনে রান্না করে খাব। তেল মশলা ইত্যাদি মেসের ভাঁড়ার থেকে, মাছের দাম আমরা দেব। শক্তিনগর বাজারে তখন মাছ ভীষণ সস্তা, সেই ড্যামচি ব্যাপারস্যাপার। ঐ সস্তার মাছ দেখে আর রোজরোজ লাউ কুঁদরু খেয়ে খেয়ে এরা মরিয়া হয়ে গিয়েছিল। একদিন ডিনারের সময় সবার অনুমতি নেওয়ার উদ্দেশ্যে যখন কথাটা তোলা হল তখন মছলি খাওয়ার আরো লোক পাওয়া গেল, দুই ওড়িয়া ও ইন্দোরের রাজেশ। রাজেশ নাকি সব নেশা যেমন করেছে বা করে থাকে তেমন খাওয়ার ব্যাপারেও সর্বভূক। অশোক আর দেবাশিস এসে আমাকে ধরল, "তুই মাছ রান্না করতে জানিস? বাহাদুর বলছে ও মাছ শুধু ভাজতে পারবে। ভেজে দিলে তুই তরকারী করে দিবি?"
    আমি কোনোদিন মাছ রাঁধিনি, কিন্তু থিওরিটিক্যালি প্রায় সব রান্নাই আমার জানা (অন্তত আমি তাই মনে করতাম)। আমাদের পরিবারে রান্না আর খাওয়ার শৌখীন লোকজন সব, বাজার চর্চা সকালে একটা বিরাট পর্ব, কার সাথে কী রাঁধতে হয়, কিসে কী দিতে হয়, কোন রান্নার তরকারী কিভাবে কাটতে হয় এসব আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে পড়ে, সারাজীবন দেখেদেখে আর শুনেশুনে।

    বন্ধুদের করুণ মুখ দেখে অভয় দিই, ওদের কথামত আলু দিয়ে মাছের ঝোল বানিয়ে দেব। জানি রান্নাঘরে বাহাদুর আর ছোটু থাকবে সাহায্যকারী, অতএব ভয় কিসের। মাছের চাঁদা তোলা হল, শনিবার বাজারে গিয়ে টাটকা কাতলা মাছ কিনে ছজনের জন্যে পিস কাটিয়ে নিয়ে এল অশোকেরা।
    বাহাদুর আর ছোটুর সাহায্যে, দেবাশিসের তত্বাবধানে শেষমেশ সফলভাবে নামিয়ে দিলাম জীবনের প্রথম আলু দিয়ে মাছের ঝোল। চেয়েচেখে দেবাশিস রায় দিল যে প্রথম রান্নায় যা দেখা যাচ্ছে যে দিনে কালে আমি আর কিছু না হই কেউকেটা রাঁধুনী হবই (দীর্ঘদিন পরে প্রথম মাছ খেলে যেমন তেমন রান্নাও অমৃত লাগবে, সে আমি বুঝে জেনে নিয়েছিলাম, তাই বাড় খাইনি তেমন!)।
    সে সন্ধ্যেয় সব তাড়াতাড়ি খিদে পেয়ে গেল মেছো বাঙালীদের, খেতে বসে গেলাম সকাল সকাল। ভালোই খেলাম, রেখাকেও আলু আর ঝোল টেস্ট করাতে সেও খুব ভালো বলল। সন্দীপ ও পরেশ খেতে এল রাতে, সময় মত। সেই মাছের তরকারী খেয়ে সন্দীপ বাঙালীদের এত গালাগালি দিল যে তারপরে আর একদিনও মেসে মাছ নিয়ে এসে খাওয়ার কথা তুলিনি কেউ।
    পরেশ অবশ্য পরে হেসে আমাকে বলে গেছিল মাছটা ভালোই ছিল, সন্দীপভাই তো এমনিই গুসা করে, ওতে কিছু মনে না করতে। সন্দীপের প্রথম কথা ছিল, বাঙালীরা কঞ্জুসের মত মাছ কিনেছে, মাত্র দু পিস করে মাছ প্রত্যেকের ভাগে, এ আবার কী মাছ খাওয়া! যত ইচ্ছে তত না খেলে সে আবার কী মাছ খাওয়া হল। দ্বিতীয় আপত্তি হল মাছ নাকি কড়া করে ভাজা না হলে খাওয়াই যায় না।
    "ইয়ে ক্যা কাচ্চা মছলি বনা দিয়া, খানা বনানা ভি নহী আতা, বঙ্গালী লড়কী সব খালি ফ্যাশন, কোই কাম কা নহী"।
    তা বলে কেউ যেন না ভাবে যে সে সেদিন মাছ ছোঁয়নি, পুরোটাই খেয়েছিল কিন্তু ক্রমাগত গালি দিতে দিতে আমাকে রান্নার জন্যে, অশোকদের কম মাছ আনার জন্যে। এখন ভেবে মজা লাগলেও তখন আমরা সবাই খুব বিরক্ত হয়েছিলাম এবং নিজেদের মধ্যে ঠিক করেছিলাম মাছ না খেয়েই কাটিয়ে দেব বাকী ক মাস!

    আঠের বছর আগে প্রথম বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলার পথে, সম্পর্কের যে সব মণিমুক্তো কুড়োনো শুরু হয়েছিল আজ তা জীবনের বহুমূল্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। পরেশ আমার ভাই, তখনও সবকিছুতে দিদির পাশে থাকত, আজ দুরে থেকেও জানি সে আমার পাশে আছে সবসময়। সে যেমন আমার বাড়ির ছেলে, আমিও তেমনি আজ কটকের মহান্তি পরিবারের মেয়ে, তার বিয়েতে বোনের পাওনা আমিও পাই, আমার বিয়েতে আমার দাদারা হাসিমুখে ছোটভাইয়ের করণীয় তাকে করতে দেয়। অনেকসময় আজও প্রথম দেখায় অনেকে যারা ওর ওখান থেকে, ওর কথায় দেখা করতে এসেছে, সব না জেনে তারা আমার সঙ্গে ওড়িয়ায় কথা বলতে শুরু করে দেয়! রেখা আজ একাধারে প্রিয় বন্ধু ও বোন, অথচ দুজনে একসাথে থেকেছি শুধু ঐ প্রথম ছয়টি মাস।
  • shrabani | 117.239.15.27 | ০৯ এপ্রিল ২০১২ ১৭:৫০514784
  • রবিবার সকাল সকাল উঠে তৈরী হয়ে নিই, সকাল সাতটা নাগাদ দাসদা বৌদি ও মেয়েকে নিয়ে একটা গাড়িতে ও চৌধুরীদা একা আরেকটা গাড়ি নিয়ে এসে পড়ে। আমরা চারজন ভাগাভাগি করে দুটো গাড়িতে উঠে পড়ি, কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই ঘাটে। সেখানে অপেক্ষায় মন পবনের নাও, চেহারায় সাবেক ছইওয়ালা নৌকো, যেমনটি ছবিতে দেখা যায়, কার্যে মোটর বোট, ইঞ্জিন সুদ্ধু।
    আমার নৌকো চড়ার অভিজ্ঞতা একেবারে শূণ্যের ঘরে বললেই হয়, গ্রাম আমার নদীর ধারে নয়। অথচ শখ ছিল খুব একটা "নদী কিনারে গাঁও" তে বাড়ি হবে। সেই সকালে, পাহাড় বনের অপরূপ প্রকৃতির সাথে রিহান্দ লেকের ওপর নৌকাভাসি আরও একটা কারণ হয়ে রইল শক্তিনগর বাস আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে ওঠার।

    রিহান্দ জলাধার, চওড়ায় সে প্রায় বড় নদীর মতই বিশাল, পার হতে এক ঘন্টার একটু বেশীই লেগে গেল। আকাশে মেঘ রোদের খেলা, বৌদি গান গেয়ে যাচ্ছে একের পর এক, যে যেমন পারছে তাতে গলা মেলাচ্ছে। কনিষ্ঠতমা সদস্য মুনিয়া শুরু থেকেই আমার হাত ধরে থাকে, তার সাথে নানা গল্পে হাসি গানে ভেসে চলি, রিহান্দনগরের ঘাটে যখন নৌকো ভিড়ছে, মনে হয় পথ বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল! উঁচুনীচু খোয়া বিছানো পারে তখন আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে বাসুবাবু সঙ্গে ওনার প্রতিবেশী তীর্থদা গাড়ি নিয়ে। গাড়ি একটিই তবে ঘাট থেকে বাড়ির পথ সামান্যই, দুই ট্রিপে সবাই পৌঁছে গেল।
    সেখানে তখন হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড, রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাশাপাশি বাড়ির সদস্যরা আমাদের অভ্যর্থনায়। বৌদি একবার রান্নাঘরে ছুটছে আর একবার বাইরে আসছে। সবাই একসঙ্গে কথা বলছে, আলাপ করছে। প্রথমটা দেখে অবাক লাগলেও পরে আস্তে আস্তে বুঝি ব্যাপারটা। সেই আমলে যখন রাস্তাঘাট সেভাবে হয়নি তখন জায়গাটি এতই একটেরে নির্জন দ্বীপের মত ছিল যে সেখানে লোকজন বড় একটা কেউ আসতনা। বাঙালী পরিবারের সংখ্যাও বেশ কম, তাই কোনো বাঙালী বাড়িতে কেউ অতিথি এলে সে সবার অতিথি হয়ে উঠত।
    বাজারের ভরা বা খালি থলি স্কুটারে ঝুলিয়ে একের পর এক লোকে এসে বাসুবাবুর বাড়িতে দুদন্ড দাঁড়িয়ে আমাদের খোঁজখবর নিতে ও সময় করে একবার তাদের বাড়িতে যেতে বলে গেল। ব্রেকফাস্টের পরে আমরা বেরোলাম টাউনশিপ ঘুরতে। বেলা দশটাতেই কেমন দুপুর দুপুর ভাব, আশেপাশে লোক তেমন দেখিনা, হুশ হাস করে দু চারটে ট্যু হুইলার ছুটে যায়। সুন্দর পরিস্কার ফাঁকা রাস্তা, পরিচ্ছন্ন চারধার, ঠিক মাঝ বরাবর খাড়াই উঠে গেছে একখানা পাহাড়, লেক, প্ল্যান্টের চিমনি থেকে অল্প ধোঁয়া,সব মিলিয়ে ছবির মত। আমরা চারজন বেরিয়েছিলাম সঙ্গে পথ দেখাতে বাসুবাবুর ছেলে সৌম্য চলল, আসা ইস্তক সে আমাদের সঙ্গে সেঁটে গেছে। বেচারা শক্তিনগরে সব বন্ধুদের ছেড়ে এসে ওর একটুও মন বসছেনা এখানে, পুরনো জায়গার সবাইকে পেয়ে আজ তার মহা আনন্দ।

    রিহান্দনগরের কোয়ার্টার গুলোও, যে বিদেশী কম্পানি প্ল্যান্ট বানিয়েছে, তাদের হাতে বানানো। তার ফলে বাড়িগুলোর ভেতর বাইরের ডিজাইন বেশ সাহেবী ধরণের, খুব ভালো লাগে, শক্তিনগরের থেকে একেবারে অন্যরকম, সুন্দর।
    দু তিনজনের বাড়ি গেলাম, গেলাম মানে স্কুটারে গৃহস্বামী যাচ্ছে, রাস্তায় আমাদের দেখে পাকড়াও করে নিয়ে চলল। কেউ আবার পাশের বাড়িতে আমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে এসে ধরে নিয়ে গেল। আদর আপ্যায়নের ঠেলায় প্রাণান্তকর অবস্থা, এ পায়েস খাওয়ায় তো ও কেক মিষ্টি, আরও কত কী। সেইমাত্র পেটভরে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি বলেও পার পাইনা। সবাই খাওয়াতে চায়, রবিবারে বাজার বসে, আজ তাই সবার ঘরে প্রচুর রসদ। বাসুবাবুর ওখানে খাব শুনে প্রথমে হতাশ তারপরেই দাবী তাহলে সেদিন থেকে গিয়ে রাত্রে খাও।
    শহুরে অনভ্যস্ত চোখে এসব অদ্ভুত বা বাড়াবাড়ি ঠেকলেও পরে ভেবে দেখেছি এরকমটা তো আগেকারদিনে গাঁয়ে গঞ্জে হয়েই থাকত। আমাদেরই সব গ্রামের বাড়িতে দেখেছি অসময়ে অতিথি এলে এর ওর বাড়ি থেকে তরকারির বাটি এসে অতিথির থালার পাশে রকমারি পঞ্চব্যঞ্জনের সম্ভার। এর গাছ থেকে ফল তরকারী ওর পুকুর থেকে মাছ, অতিথি বিদায়ের কোনো ত্রুটি থাকতে দেওয়া হতনা। রিহান্দনগরের বাঙালীদের যদি সেরকমই এক গ্রামের পরিবারের লোক ভেবেনি, তাহলে এই অচেনা অতিথিদের আদর সমাদর তো খুব কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার হয়না!

    আর অচেনা চেনা হতে কতক্ষণ লাগে বিশেষ করে হৃদয় যখন অনুকূল, তীর্থদার স্ত্রী বেহালার, সে অত মাইল দুরত্বে, আমার পাশের বাড়ির দিদিই বলা যায়, তার মেয়ের আমি মাসি হলাম কিনা!
    দুবছরের গোলগাল গোলাপী মেয়েটা তাই বোনঝির অধিকারে আমাকে বুড়ি করে ঘুরতে থাকে "দঙ্গল দঙ্গল পতা তলা হ্যায়, তাদ্দি পহনকে ফুল কিলা হ্যায়", মুনিয়ার হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় তাদের বাড়ির ওপরে,
    "দ্যাতো, আমাল দতটা ছেঁলা দামা আতে,আলমালিতে। দিদা এতটা দিয়েছে, মাথি এতটা"। আমি কিঞ্চিত ধন্দে, দিদা মাসি এরা ছেঁড়া জামা কেন দিয়েছে, সেসব আলমারিতে কেন, তা আবার দেখাবারই কী আছে, এরকম বহু প্রশ্ন মনে!
    রহস্যটা মেয়ের মা পরিস্কার করে, মেয়ে সবসময় আলমারি থেকে নতুন জামা বার করে পরার বায়না করে বলে, তাই যাই জামার কথা বলে,মা বলে দেয় "ওটা ছেঁড়া, এখন পরতে নেই, ঠিক করে পরে পরবে"!

    আরেকজন মহিলা দেখা গেল আমাদের কলেজে একজন ক্লাসমেট ছিল তার পাড়ার মেয়ে। এরকম ভাবে দিনের শেষে কোন না কোনো সম্পর্ক বেরিয়ে গিয়ে কেউ আর দুরের অচেনা রইল না। দুপুরে মাছ মাংস ইত্যাদি নানা নিধি দিয়ে ভরপেট লাঞঅ হল, গল্পে আড্ডায় বিকেল গড়িয়ে ফেরার পালা। বাসুবৌদি, তীর্থ বৌদি সবারই চোখ ছলছল, একটু বেশী বসে যাওয়ারও উপায় নেই, নৌকো ছাড়ার সময় বাঁধা। তাড়াতাড়ি চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, দুপুরে রোদ ছিল, তখন আবার আকাশকোণে একটু যেন মেঘের আভাস, হাওয়া দিচ্ছে। এসময় ঝড় নামে, তাই সবাই ভয় পাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে যেতে চাইছিল। ঘাটে পৌঁছে অবাক, যতগুলি বাঙালী পরিবার ছিল প্রায় সবাই এসেছে বা আসছে, কেউ আর বাকী নেই।

    মহিলাদের চোখ ছলছল, হাত ধরে আবার আসার প্রতিশ্রুতি নিল সবাই, আমরাও দিলাম কিছু না ভেবেই, এমনই একটা ভারী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল সেই বিকেলে রিহান্দনগরের ঘাটে, না দিয়ে উপায়ও ছিলনা। দু তিনজনের হাতে ক্যামেরা, গ্রুপ ফোটো তোলা হল, বাচ্চাদের আদর করে, সবাইয়ের কাছে বারংবার বিদায় নিয়ে চড়ে বসলাম ফিরতি বোটে। কিছুদুর গিয়ে দেখি তখনও ঘাটে সেই গ্রুপ ফোটোর পোজে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই, হাত নাড়ছে,যতদুর বোট দেখা যায় বোধহয় অমনিই থাকবে।

    মন ভার হয়ে গেল। আমার তিনজন ট্রেনী সঙ্গী দেখি আলোচনা জুড়েছে, যেখানেই যাক এই জায়গায় কোনোদিন যাতে না আসতে হয় তা দেখতে হবে। "কী অবস্থা দেখলি লোকগুলোর, কিভাবে আছে। যেন দ্বীপান্তরের বাসিন্দা, বাইরের লোকের সঙ্গ পেয়ে পাগলের মত করছে।"

    হয়ত ওরাই ঠিক তবু কেমন যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। সত্যিই তো আর এমন কিছু নির্জন দ্বীপে পড়ে নেই সব, রাস্তা আছে, একটু ঘুরপথ, জলপথে যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা আছে। এটা কেন ভাবতে অসুবিধে হচ্ছে সবার যে এখানকার লোকেরা সত্যিই ভালো, লোকজন ভালোবাসে, ঠিক সেই আমাদের গ্রামের মত। এখন সেখানে সুন্দর রাস্তা হয়েছে, রিহান্দ লেকে আর নৌকো চলেনা, সেইসব লোকেরাও আর নেই সেখানে। আর কোনোদিন যাওয়া হয়নি, জানিনা অতিথিদের অভ্যর্থনা এখন কী ভাবে হয়, সেই সমবেত ভাবে না যার যার তার! যেমনই হোক, তাতে সমালোচনার কিছু নেই, আঠের বছরে তো সর্বত্রই সব কিছু বদলে গেছে,সে জায়গাই বা এক থাকে কী করে। তবু এখনো সেই বিদায়বেলার রিহান্দনগরের ঘাটের ছবি চোখ বুজলেই দেখতে পাই। কারণ বিশ্লেষণ করার দায় তখনো অনুভব করিনি, এখনো করিনা, সেই একবেলায় এতগুলো লোকের সঙ্গে জানাশোনা, তাদের ভালোবাসা, আতিথেয়তা সব মিলিয়ে সেই সুখস্মৃতি মনের মণিকোঠায় অমলিন হয়ে থাক চিরকাল।

    ফেরার পথে গুরু গুরু গরজে, বোটের দুলুনি, আমাদের গান কথা সব বন্ধ, লেকের জলও কেমন সকালের নীলচে সবুজের জায়গায় ঘোলা ঘোলা। তখন সেই বিকেলে বড়দের ভয় উদ্বেগটা অনুভব করেও মনে হচ্ছিল, এই মাঝ দরিয়ায় ঝড় নামলে বেশ হয়, আহা ঝড় নেমে আয়!
    কিছুই হল না, আমরা ভালাভালিই পৌঁছে গেলাম শক্তিনগরের ঘাটে, তখন নেমেছে আঁধার, তখনও আসেনি আষাঢ়। মুনিয়ার মাথা আমার কাঁধে, অঘোরে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। তাকে কোলে করে ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে, আমরা ফিরি চৌধুরীদার গাড়িতে, হস্টেলে।
    এর একবছর পরেই শুনেছিলাম কী একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে বোট সার্ভিস চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং সরকারের ভরসা না করে কম্পানির খরচায় ব্রিজ বানিয়ে সুন্দর রাস্তা তৈরী হয়েছিল।
  • a | 122.179.30.15 | ০৯ এপ্রিল ২০১২ ২৩:১৮514785
  • অসাধারণ। শ্রাবণীদি, তোমার লেখায় একটা অন্যরকম মায়া আছে। খুব সুন্দর।
  • sch | 14.97.175.43 | ১০ এপ্রিল ২০১২ ০২:০৫514786
  • শ্রাবণী,

    টুপি-ছাতা-রোদ চশমা সব খুললাম। এমন পাতা জুড়ে ছবি এঁকে যাওয়াকে সেলাম। স্লিপার-যাত্রার দিনের সে সব গরমে হা-ক্লান্ত দুপুর - শীতে হাড়ে-বাজনা-বাজন্ত মধ্য রাত্রি আর সব পেরিয়ে রাশিকৃত বন-জঙ্গল-আবছায়া আর নানান বর্ণ-গন্ধ-আশ্লেষময় মানুষের মাঝে হারিয়ে গিয়েও একলা নিজেকে নতুন করে আবিস্কার - সব সব ফিরে এলো।

    ট্রেনিং এর সময়ের বালখিল্য সব মুহুর্ত্ত গুলো যে কত্ত শত অদ্ভুত সময়ের সাক্ষী - যে দূর-দুরান্ত আধো-শহর-আধো গঞ্জ প্রজেক্ট সাইট প্রথম হেলমেট পরিয়ে তেল-কালিতে সাজিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করায় তাকে যেন চাইলেও ভোলা যায় না। মেস, অদিকিচ্ছিরি (নীনাদি র মেয়ের এই শব্দটা বেজায় পছন্দ হয়েছে!)খাবার, অদ্ভুতুড়ে দৃষ্টি র সাথে সাথে ক্ষণেকের চেনায় তৈরী সেই সব সম্পর্ক যা আজও ছুঁয়ে থাকে, বা মন-খারাপ-মন-ভালো মেশানো ছোটো-ছোটো ঘটনা - যেগুলো আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিলো হয়ত সে সময় - সবাই ভিড় জমায়। এই সুতোটা পড়তে-পড়তে তাই শ্রাবণীকে এক ইয়াব্বড় থ্যান্‌ক্‌স।
  • shrabani | 117.239.15.102 | ১০ এপ্রিল ২০১২ ১৭:০৭514787
  • পি পি এফের একদম শেষের মুখে এক দুপুরে আমরা চড়ে বসলাম এম জি আরের ট্রেনে। তার আগে ক্লাসে পড়া হয়ে গেছে কয়লা আনা নেওয়া, লোড আনলোড করার খুঁটিনাটি, ওয়াগন টিপলার কী করে কাজ করে। প্রায় রোজ কয়লা ভর্তি বা খালি ট্রেনকে যাতায়াত করতে দেখি আমাদের আঙিনা দিয়ে। প্রথম দিকের সেই ট্রেনের আওয়াজে থমকে যাওয়া, অপু দূর্গা ভাব আর নেই যদিও তবু মাঝে মাঝে ছুটির দিনের ফাঁকা অলস দুপুরে ট্রেন লাইনের পাশের ঘাসে বসি, বই হাতে বা এমনিই গল্প করতে। যেমন গাছপালা,বন ঘিরে থাকে, পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের উঠোনে, তেমনি ট্রেনও চলে যায় নিত্যই পাশ কাটিয়ে, আলাদা করে কেউ কারু চোখে পড়িনা।

    শুধু সেই দ্বিপ্রহরে থেমে গেল ফাঁকা ট্রেন, ট্রেনিং সেন্টারের একটু আগে, শুধু আমাদেরই জন্যে, শুধুই আমাদের জন্যে। কথা বলে সব ব্যবস্থা করা ছিল, দলবল নিয়ে মাস্টারমশাই উঠল ড্রাইভারের কেবিনে। বেশ খুশী মনেই ড্রাইভার ও তার সঙ্গী বোঝাতে লাগল ট্রেন চালানোর খুঁটিনাটি। কোনো মডিউলে ছিলনা এ বিষয়, এমনিই সবার উৎসাহে আবদারে ট্রেনিং বিভাগ থেকে ব্যবস্থা করেছিল। বাচ্চাদের খেলনা পার্ক বা ওয়ান্ডারল্যান্ডে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার মত, আমরা সেই মালগাড়ীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরে বেড়াই ইচ্ছেখুশীতে। হলই বা কয়লার গাড়ি, একটা আস্ত ট্রেন আমাদের দখলে, আমাদের কথামত চলবে থামবে। অবশ্য কয়লার গাড়ি হলেও রক্ষনাবেক্ষনে ঝকঝক করছে আপাদমস্তক। সব দেখাশোনা মিটলে ড্রাইভার তার জায়গা নিতে আহ্বান করে আমাদের। দু একজন এগিয়ে যায়, একটু একটু চালায় অনেকেই। আমরা পেছনে ছিলাম, খুব ইচ্ছে করছিল ট্রেন চালাই, এ সুযোগ কী আর আসবে! শেষমেশ থাকতে না পেরে এগিয়ে যাই, ড্রাইভার খুশী হয়ে বুঝিয়ে দেয় কী করতে হবে। খুবই সামান্য ব্যাপার তবু আমার চাকা ঘোরানোয় যখন ট্রেন এগোয় তখন কাঁচ দিয়ে সামনের চলমান লাইনের দিকে তাকিয়ে অনাবিল আনন্দে ভরে আসে মন, সেই ছোট্টবেলায় প্রিয় কোনো খেলা খেলতে পেয়ে যেমন লাগত তেমনি!
    সারা বিকেল আমরা শুধু ঐ কথাই বলতে থাকি, ট্রেনের নানা ব্যাপার, যারা চালিয়েছি তারা কলার টলার তুলে ঘুরতে থাকি, হুঁ হুঁ বাবা, ট্রেন চালিয়ে এলাম, যা তা ব্যাপার। মজা গল্প হৈ চৈ সব মিলিয়ে সেদিনটা একটা অন্যরকম দিন হয়ে থাকে আমাদের ট্রেনিং ক্যালেন্ডারে।

    জুলাই মাস থেকেই বোধহয় শুরু হয়েছিল আমাদের বিষয়ভিত্তিক ট্রেনি,ং তার আগে অবশ্য হয়েছিল স্কীম ট্রেসিং ও পিপিএফ সংক্রান্ত নানা পরীক্ষা, এতকিছু এই কদিনের ক্যাপসুল কোর্সে, খেই পেতে বেশ অসুবিধেয় পড়েছিলাম প্রত্যেকেই, ফলত সে সব পরীক্ষায় বেশীরভাগেরাই ভালোরকম ধেড়িয়েছিল। তাই নতুন মডিউল শুরু হতে বেশ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম গোছের বোধ হতে লাগল। ক্লাস, ল্যাব সব হয় সেই ওয়ার্কশপে, ট্রেনিং সেন্টারের বাড়িতে খুব একটা যাওয়া আসা নেই। তখন সময়টাও বেশ ভালো, বর্ষা আসি আসি করছে, বৃষ্টি সেভাবে না হলেও আকাশে নিত্যই মেঘের আনাগোণা, সহনীয় গরম। ওয়ার্কশপটা তো পুরো গাছপালা নালায় ঘেরা, ক্লাসরুমটাও ছোট,একধারে, ঘরোয়া ব্যাপারস্যাপার। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে ছোট পাখি ঢুকে পড়ে, ধারে বসলে কানের কাছে কত পোকা প্রজাপতি এসে গুনগুন করে।
    যারা পড়াতে আসত বেশীরভাগই বঙ্গজ, যাদবপুর বা কলকাতার, কিছু শক্তিনগরের লোক, কিছু আবার আসত বিন্ধ্যনগর থেকে। বিন্ধ্যনগরের ওরাই ট্রেনিং সেন্টারে কথা বলে ব্যবস্থা করল আমাদের কিছুদিন বিন্ধ্যনগর প্ল্যান্টে গিয়ে ওখানকার সিস্টেম দেখার। আমাদেরও ব্যাপারটা বেশ যুক্তিযুক্ত মনে হল, এত কাছে থেকে ভালো করে প্ল্যান্টটা না দেখে না শিখে চলে যাওয়ার মানেই হয়না। দুটো প্ল্যান্টের সময় কাল ও অনেক কিছুই আলাদা। প্রথমদিন গেলাম বিন্ধ্যনগরে ব্যানার্জীদার দায়িত্বে, তিনি কোঅর্ডিনেটর। সব ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব তার, সঙ্গে নিলে তার আন্ডারে কাজ করে এমন এক সিনিয়র টেকনিশিয়ানকে। ব্যানার্জীদা কনট্রোল রুমে ঢুকেছে কী কাজে, টেকনিশিয়ানটি আমাদের দলের সাথে টারবাইন ফ্লোরে, তখনই এল সেই প্রশ্ন আমাদের দুজনের উদ্দেশ্যে, "ক্যা, কম্পানি আপনাদের মেয়েদেরও ছেলেদের সমান মাইনে দেয়, ক্যা?"
    হ্যাঁ বলতে গিয়েও লোকটির চাপা কৌতুকে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি দেখে থেমে যাই, এড়িয়ে সরে যাই, তবু মুখের মধ্যে রয়ে যায় তিক্ত এক স্বাদ, এতদিনে এই প্রথম এরকমটা লাগল। কয়েকদিন ওখানে গিয়ে পদে পদে বুঝতে পারি শক্তিনগর ও বিন্ধ্যনগরের তফাতটা। পাশাপাশি দুটি জায়গার সাধারণ লোকের ব্যবহার, চিন্তা ভাবনায় এত অমিল হয় কী করে, তার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনা। অবশ্যই লোক বলতে এখানে একজিকিউটিভদের কথা বলছিনা, ওয়ার্কমেন, সুপারভাইজার অর্থাৎ সেইসব কর্মচারী যাদের নিয়োগ করা হয় স্থানীয় লোকেদের মধ্যে থেকে, তাদের মধ্যেই এই ফারাক দেখেছি। শক্তিনগরে সবাই কী ভালো, মুখে বলার আগেই কাজ করে দিচ্ছে আর বিন্ধ্যনগরে বলে বলে কাজ পাওয়া যায়না, একটা কথায় দুটো আইন শুনিয়ে দেবে। অফিসারদের মতে সেই সময়ে এই লোকজন দিয়ে কাজ করানোর ব্যাপারে যে দুটি প্রজেক্ট সবচেয়ে অসুবিধেজনক ছিল তার একটি হচ্ছে বাংলায় স্থিত একটি প্রজেক্ট আর অন্যটি এই বিন্ধ্যনগর!

    সঙ্গীদের ভাবভঙ্গী খুব একটা সুবিধের লাগেনি সেই অস্বস্তির মুহূর্তে তাই তাদের সঙ্গে আলোচনায় না গেলেও শেষে থাকতে না পেরে ব্যানার্জীদাকেই একান্তে বলি অপমানের কথা (হ্যাঁ, সে সময় মানেই লেগেছিল কারণ মনে হয়েছিল প্রশ্নটা ইচ্ছাকৃত)। বলে ভালই করেছিলাম,ব্যানার্জীদা শুনে দু:খ পেল, তবে সেইসঙ্গে আমার ধারণাটা যে সঠিক সেটাও প্রমাণ হয়ে গেল।
    "ও জানেনা, মেয়ে একজিকিউটিভ ছেলেদের সমান মাইনে পায় কিনা! অ্যাসোসিয়েশনের পান্ডা, কথায় কথায় এইচ আর রুলবুক আর কম্পানি কানুন কপচায়, দিল্লী গিয়ে মিটিং করে আর ও জানেনা। বদমায়েশীর চুড়ান্ত, কাজে নেই শুধু অকাজে আছে। কোনো কাজ দিলে করেনা বলে ভেবেছিলাম, তোদের ঘুরিয়ে দেখানোর কাজটা দিই, সারাদিনে একটা কিছু করুক। একদম এসব লোককে পাত্তা দিবিনা, আবার এরকম কিছু বলতে এলে শুনিয়ে দিবি দুকথা"।
    আমাকে শোনাতে হয়নি দুকথা, সে সুযোগ আসেনি, ব্যানার্জীদা ব্যবস্থা নিক বা যাই হোক, লোকটিকে আর আমাদের রাস্তায় দেখিনি এর পরে, তবে তেতোভাবটা অনেকদিন রয়ে গেছিল। শুধু লোকটির কথায় নয়, কেমন মনে হয়েছিল আশপাশের আরো কেউ কেউ আমাদের উদ্দেশ্যে করা ঐ ব্যঙ্গভরা উক্তি বেশ উপভোগ করেছিল তাই এতদিন যা একটু করে গড়ে উঠছিল সবার সঙ্গে, সেই সম্পর্কে, টোল মতন দেখে কোথায় যেন চিনচিন বেজেছিল, এইটুকুই আর কিছু না !

    রেখারা চারজন এরমধ্যে বাড়ি ঘুরে এল। ওদের বাড়ি যাওয়া মানে দুটি হপ্তার ধাক্কা, যেতে আসতেই তো কমকরে পাঁচদিন লেগে যায়। রাও সাহেব ছিল বলেই সম্ভব হল এত ছুটি পাওয়া। উনিই রায় দিলেন যে ওরা এই দু সপ্তাহে যে পরীক্ষা মিস করবে তা ওরা ফিরে এলে শুধু ওদের চারজনের জন্যে আবার নেওয়া হবে। রেখা অবশ্য আমায় বলে গেল সম্ভবত ওর মা বাবা ওকে ফিরে আসতে দেবেনা। আমার খারাপ লাগছিল কিন্তু কী করার আছে, ওর বাড়ির লোকে এতদুরে এসে চাকরি করতে নাই দিতে পারে। সত্যিতো, দুরত্বের হিসেবে ওদের তুলনায় আমার তো পাশের বাড়ি।
    বেশ মন খারাপ নিয়েই একা একা ঘুরছিলাম কটা দিন। একটাই ভালো ব্যাপার ছিল যে যবে থেকে বিষয়ের মডিউল শুরু হয়েছিল পরীক্ষা আর পড়ার চাপটা কমে গিয়েছিল। যা সব পড়ানো হচ্ছিল তা আমরা বি টেকে বেশ ভালোমতন পড়েশুনে এসেছি, সেরকম এফর্ট না দিয়েও পরীক্ষা ইত্যাদি বেশ তরতরিয়ে পার হয়ে যাচ্ছিলাম। পরস্পরের সঙ্গ ততদিনে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে দুজনেরই, প্রথম যেন বিচ্ছেদের ভাবনা এল মনে। আর কয়েক মাস পরেই তো দলের সবাইকে এদিক ওদিক করে দেওয়া হবে, আর দুজন মেয়েকে কোনোমতেই একসঙ্গে একজায়গায় পোস্টিং দেবেনা।

    তবে রুটিনে বাঁধা জীবন, সময়ে ক্লাস, সময়ে ল্যাব, খাওয়া শোয়া, কেটে যাচ্ছিল। বাজারে যেতে হলে পরেশ সঙ্গী হত। "যা তোর দিদির কাছে যা, অকেলী দ্যাখ, বসে বসে কাঁদছে হয়ত।" এইসব নানা মজার মন্তব্য করলেও সন্দীপ নিজেই খেয়াল করে পরেশকে পাঠাত আমার খোঁজ করতে।
    প্রথম বাড়ির বাইরে বেরিয়ে শিখলাম যে বই খাতার বাইরেও কত কিছু অজানা থাকে, শেখার থাকে এবং সার হচ্ছে বই খাতায় জীবনের কিছুই থাকেনা, তার বাইরে এসেই সব শিখতে হয়। সন্দীপ মহান্তি, রাজেশ, পান্ডে, এমনি আরো কত জনকে চেনা রঙে চিহ্নিত করা যায়না, সব কিছুরই শুধু সাদা কালো হয়না, এরকম আরো কত শিক্ষার শুরু আমার সেইদিন গুলো থেকেই,সেই আঠের বছর আগে।
  • shrabani | 117.239.15.102 | ১০ এপ্রিল ২০১২ ১৭:১৩514788
  • রেখাদের ট্রেন বেশী না মোটে একদিন লেট করেছিল!
    বেনারস থেকে বাসে গরমে হাক্লান্ত চারমূর্তি যখন হস্টেলে পৌঁছলে, মুখ দেখে সত্যি মায়া হয়েছিল আমাদের সক্কলের। তাড়াতাড়ি ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। রেখার ঘরের চাবি আমার কাছে ছিল তাই ঘর পরিস্কারই ছিল। চানটান করে সেদিন টা ওরা ঘুমিয়েই কাটালো। আমি তো এতখুশী রেখা ফিরে আসায় যে ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছি, ঘর ঠিক করছি,পারলে প্রায় ওকে খাইয়েও দি।
    এদিকে পরদিন এদের আসার খবর পেয়ে সিংসাব ছুটে আসে ওয়ার্কশপে। আমরা তখন দরকার না পড়লে ট্রেনিং সেন্টারের দিকে যেতাম না, তাই আমাদের ধরতে উনি বনজঙ্গল ব্রিজ পেরিয়ে ল্যাবে এসেছেন, পারলে সেইদিনই এদের দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ায়। আমার বাঙালী সঙ্গীদের একেবারে বিপরীত চরিত্রের ছিল রেখার তিন সঙ্গী, এমনিতে খুব ভদ্র, আজ্ঞাকারী কিন্তু কোনো কিছুতেই সেই গেল গেল ভাব নেই, ক্লাস করে,পড়াশুনা করে, পরীক্ষা দেয়, কিন্তু রেজাল্ট যাই হোক তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সবমিলিয়ে যাকে বলে প্রচন্ড কুল। ওদের সেরকমভাবে ধরলে সিংসাবের চিন্তা মুক্ত করতে ওরা বোধহয় তখনি পরীক্ষা দিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে কিছু স্বঘোষিত নেতালোগ ছিল তারাই এদের হয়ে কথা টথা বলে ঠিক হয় দুদিন পরে শুক্রবারের বিকেলে আমরা যখন ল্যাব করব, এরা পরীক্ষা দেবে।
    সিংসাবের দেখা গেল রেখার জন্যেই চিন্তা বেশী। আমাকে বার বার বলে গেল রেখাকে ভালো করে পড়িয়ে দিতে, মোটামুটি ভাবে যা আমাদের প্রশ্নপত্রে ছিল তারই কাছাকাছি প্রশ্ন আসবে, সেরকম হিন্টও দিয়ে গেল। আমি দু রাত্তির রেখাকে পড়াতে বসি, কিন্তু তার তখন এত কথা জমে আছে, বাবা মা তার বিয়ের চেষ্টা করছে। একটু পড়া হতে না হতেই আমরা এদিক ওদিকের কথা বলতে শুরু করে দিই। শেষমেশ যাকে হিন্দিতে বলে রট্টা মারা তা ছাড়া উপায় রইল না। শেষদিন কিছু প্রশ্ন উত্তর যা মনে ছিল একটা কাগজে লিখে দিয়ে ওকে রট্টা মারতে (মুখস্ত করা, কিন্তু রট্টা আমার বড় প্রিয় শব্দ) দিলাম। পরীক্ষা দিচ্ছে রেখা আর বাইরে টেনশনে আমি আঙুল কামড়াচ্ছি। পরীক্ষা চুকতেই দুজনে লাফাতে লাফাতে শক্তিতে গিয়ে দোসা খেতে বসে গেলাম, অনেকদিনের পরে!
    রেজাল্ট বেরোলো, আমি এ, রেখা বি, এই প্রথম দুজনের গ্রেড আলাদা। নিজেকে একটু অপরাধী লাগছিল, মনে তো হচ্ছে সবই ঠিক ঠিক বলে দিয়েছিলাম ওকে, কিছু কী তাহলে ঠিক বলিনি, ভুল করেছি! রেজাল্ট নিয়ে এই প্রথমবার মন খারাপ হল তাও বি না পেয়ে এ পেয়েছি বলে!
    খাতা দেখে বুঝলাম রেখা শেষদিকের প্রশ্ন গুলোর উত্তরই করেনি, করলে ঊ এ পেত। বেশ মাস্টারনী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ওর নাকি একা একা পরীক্ষা দিতে খুব বোর লাগছিল তাই শেষ না করেই খাতা দিয়েছিল, বোঝো! তবে দত্তবাবুর যে মনোবাসনা ছিল আমাদের দুজনের খাতা আলাদা ভাবে দেখে, আলাদা নম্বর দেবার তা একবার হলেও মিটল!

    বর্ষা জানান দিচ্ছিল বেশ কিছুকাল ধরেই, যে সে আছে, আশেপাশে, হয়ত বেতলার জঙ্গলে নয়ত বিন্ধ্যর ওপারে। তবে ঐ টুকুই, আষাঢ়স্য প্রথম দিবস বৃথা চলে গেল শুধু বাঁশি শুনেই, চোখে চোখে দেখা হল বেশ কিছুদিন পরে যখন দেশের নানা প্রান্তে তার জেঁকে বসার খবর পুরনো হয়ে গেছে। লাঞ্চের পরে তখন ল্যাবে ব্যস্ত সব, টিনের (নাকি অ্যাসবেসটসের?) ছাউনি তে প্রথমে টিপটিপ টুংটাং তারপরে ঝমঝম ঝমাঝম অবিরল। আলো কম হয়ে এসেছে টের পাইনি, নীচু জানালা দিয়ে সেভাবে বাইরের হালচালও বোঝা যায়নি। বিকেলে যখন বাইরে বেরিয়েছি দেখি সামনের শুকনো নালা দিয়ে কলকল বয়ে যায় জলস্রোত, চারিদিক ভিজে ভিজে, বৃষ্টি থেমেছে তবে এদিকে সেদিকে নানা গাছের পাতা থেকে তখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে টুপটাপ। পাতার আড়ালে কোথাও কোথাও ভেজা ডানার ঝাপটানি শোনা গেল।
    আমরা প্রথমে আনন্দে দিশাহারা, এত বৃষ্টি হয়েছে, নালা ভরে গেছে। কাঠের ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ঘুরপাক খেয়ে চারিদিক দেখছি, লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ভেজা মাটির গন্ধ নিই বুক ভরে। তারপরেই মনখারাপ, ইস, বৃষ্টি থেমে গেছে, ভেজা হল না! দুজনে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করি, রাস্তার পাশে মাটিতে কোথাও গর্তমত হয়ে একটু জল জমেছে দেখলেই সেই জল কাদাতে খানিক লাফিয়ে নিই ছপ ছপ করে পা ভিজিয়ে, প্রথম বর্ষার জলে।

    তবু শুধু পায়ের পাতা ভিজিয়ে কী সাধ মেটে! বাজার থেকে ফিরে এসে চিঠির ঝাঁপি খুলে বসেছি, সবাইকে বর্ষার আগমনের খবরটা তো দিতে হবে। দরজায় জোরে ঠকঠক, রেখার ডাক, "ইট্‌স রেনিং আগেন, শ্রাবণী, বৃষ্টি হচ্ছে"। দুজনে খোলা উঠোনে এসে দাঁড়ালাম, দুই হাতে দুই হাত শক্ত করে ধরা লম্বা করে আড়াআড়ি, তারপরে ঘুরতে শুরু করলাম বৃষ্টির মাঝে, বয়সের হিসেবে মাস বছর যাই হোক না কেন সেই সন্ধ্যায়,সেই মুহূর্ত ছিল আমাদের কিশোরীবেলা, পাহাড়, বন নালা, পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝোরা, পাখি পোকা মাকড় সবাইকে নিয়ে মেতেছিলাম আমরা দুজনও,বর্ষাবরণে

    "আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে........"
  • Reshmi | 119.226.173.2 | ১০ এপ্রিল ২০১২ ১৭:৪৯514789
  • শ্রাবণী-র লেখার গুণে এখানেও ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে গেল :)
  • titir | 128.210.80.42 | ১০ এপ্রিল ২০১২ ২০:০৭514791
  • মহাভারতের সঞ্জয় ও হার মেনে যাবে তোমার দিব্যদৃষ্টির কাছে। এত বছর আগের ঘটনা, এত প্রানবন্ত যেন চোখের সামনে সব কিছু দেখতে পাচ্ছি। ধন্য তোমার চোখ ধন্য তোমার লেখনী।
  • Lama | 117.194.225.140 | ১০ এপ্রিল ২০১২ ২০:৪৫514792
  • কি যে বলি!

    আমিও একটা টই খুলব ভেবেছিলাম, প্রথম চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। যা পড়ছি, আর পড়লাম, এর পর আর হয় না। বাংলায় লিখে হয় না অন্তত:।
  • siki | 122.177.24.139 | ১০ এপ্রিল ২০১২ ২২:০৯514793
  • ক্ষী আর বলব। দিল্লির জলহাওয়া ... হে হে ... :-)
  • Nina | 68.34.167.250 | ১১ এপ্রিল ২০১২ ০৬:৫৩514794
  • শত কাজের মধ্যে--ঘেমে-নেয়ে ---শ্রাবণীর কলমের বৃষ্টিতে ভিজে কি আরাম কি আরাম ! আহ!
  • shrabani | 117.239.15.102 | ১৭ এপ্রিল ২০১২ ১৬:৪৯514795
  • এতদিন শক্তিনগরের বসন্ত ছিল ঘোষিত ফেভারিট, প্রথম প্রেম, দেখা গেল বর্ষার আগমনে বসন্তের সে আসন টলমল প্রায়। বৃষ্টি ধারায় পুরনো যা কিছু অনুভূতি সব ভেসে গিয়ে, হদৃয় তখন ময়ুরের মত নাচে রে।
    সবচেয়ে যেটা পছন্দের ছিল তা হল ওখানে বৃষ্টি কেমন চারধার ধুয়ে মুছে পরিস্কার উঙ্কÄল করে দিত, থামলেই সব শুকনো,বোধহয় উঁচুতে হওয়ার জন্যেই কাদা প্যাচপেচে বা জল জমার ব্যাপারটা তেমন ছিলনা। কিছুদিন যেতেই মনে হল পাহাড়, ঝোরা, বনজঙ্গল, মানে সারা শক্তিনগর যেন সেজে উঠেছে। বনে নতুন সবুজ পাতা সজল হাওয়ায় সলাজে দোলদোল, কেয়াফুলের গন্ধে ম ম চারিধার, ফল বিছানো সাদা ধবধবে কদম তলা!
    ভরা বর্ষায় দিনের পর দিন রোদের দেখা তেমন পাওয়া যেতনা কিন্তু তার জন্য অভিযোগ করতে কে যাচ্ছে! ক্লাসের বাইরে আমরা, বিশেষ করে আমরা দুজন যখনই সুযোগ পেতাম টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় করে বেরিয়ে পড়তাম। ফাঁকা রাস্তায় খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতাম, বনের ভেতর দিয়ে ভিজে ঝরা পাতার স্তুপ মাড়িয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম অনেকদুর।

    এরকম একটা পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা দেশে প্রথম বর্ষা, আমাদের রোম্যান্টিকতার আর শেষ নেই তবে পুরনো বাসিন্দারা খুব বিরক্ত দেখতাম। হবে নাই বা কেন, এক তো জামাকাপড় শুকোচ্ছেনা, ঘরদোর ভেজা স্যাঁতসেতে, তায় পোকামাকড় চ্যাঙব্যাঙ সাপখোপের কার্নিভ্যাল টাইম, সর্বত্রই নানা র ঙের নানা ধরণের পোকামাকড়ের ভিড়, রাস্তা চলতে যখনতখন আড়াআড়ি পেরিয়ে যেতে দেখা যায় সরসরে সরীসৃপ, ঘোঁঘর ঘোঁঘর ব্যাঙের ডাক সকাল দুপুর রাত্তির।
    তবে আমাদের সেসবের পরোয়া নেই খুব একটা, ঐ যে আগে বলেছি, দিন কাল বয়সের দৌলতে মেজাজ তখন রুমানি,এসব বাস্তব সমস্যার সেখানে কোনো স্থান নেই!
    বর্ষার শুরুতে সবাইকে দেওয়া হল রেনকোট, এক রঙের,একঢালা, বেশ দামী, ভালো জিনিস। ভালোই হল, কারণ সেই উতল হাওয়া জড়ানো বৃষ্টি যে ছাতায় আঁটার নয়, সে প্রথম দু এক দিনেই সকলে বুঝে গিয়েছিল। আমরাও পেলাম মানে আমরা দুজন মেয়েট্রেনী, তবে ঐ আর কী, ছেলেদের বড় সাইজের ঢাউস রেনকোট। যথারীতি মেয়েদের ছোট সাইজের রেনকোট এদের কাছে ছিলনা। শুধুমাত্র দুখানা রেনকোটের জন্যে কর্পোরেট অফিসে রিক্যুইজিশন দেওয়া যায় না। দিলেও তাদের কাছে থাকবে বা তারা ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দেবে তার কোনো গ্যারান্টী নেই। সাধারণত এসব কেনাকাটা হিসেব করে বছরে একবারই হয়। আমরা সেই জুতোর মত এটাও নিয়ে নিলাম আপত্তি না করে,আর বাইরে দুরে ঘুরে ঘুরে নিজেদের ছোট লেডিজ ছাতাকে হাওয়ায় উড়ে লুটোপুটি খেতে দেখার আনন্দ নিতে থাকলাম ভিজে ভিজে। তবে বৃষ্টিতে ভিজে একদিনের তরেও ভুগেছি বলে মনে পড়েনা।

    দেবাশিস মাঝে মাঝেই খুব বকাবকি করত, "এরকম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঘুরে বেড়াস না, শরীর খারাপ হলে বিপদে পড়বি। এখানকার ডাক্তাররা সব যা, জ্বরের নামে পেটখারাপের চিকিৎসা করে"!
    সত্যি, টাউনশিপের হসপিটাল সে শুধু নামে, নাহলে গ্রামের হেলথ সেন্টার ছাড়া কিছুই নয়। কাছেপিঠে এছাড়া চিকিৎসার অন্য সুবিধেও ছিলনা। দেবাশিসের অভিজ্ঞতা এ ব্যাপারে আমাদের সবার চেয়ে বেশী এবং তিক্ত, তাই তার আশংকাও ঘন।
    সে এখানে এসেই ম্যালেরিয়ায় পড়েছিল। বন্ধুরা নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার ম্যালেরিয়া না বুঝে এবং রক্ত পরীক্ষা না করিয়েই একগাদা কড়া অ্যান্টিবায়োটিক ঠুসে দেয়। জ্বরও ছাড়েনা, অথচ রুগী দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। বেশ কিছুদিন এভাবে ভোগে বেচারা,তারপর কী করে কী হয় ঠিক মনে নেই, তবে যতদুর সম্ভব শেষে বাড়িতে ফোন করে সব জানিয়ে কোনো চেনা ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ম্যালেরিয়ার ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়।
    অথচ কম্পানির বদান্যতায় হসপিটালে সমস্ত আধুনিক মেশিনপত্তর ছিল, ওষুধ মজুত থাকত প্রচুর, ডাক্তারও ছিল বেশ কয়েকজন। আসলে অভাব ছিল ভালো অভিজ্ঞ ডাক্তারের। ভালো ডাক্তার কেউ ঐরকম দুরে, বাঁধা মাইনের চাকরি করতে যেতে চাইতনা। শহর থেকে দুরে কম্পানির সমস্ত প্রজেক্টে ছবিটা একরকম। কখনো কোনো সদ্য পাস করা ছোকরা ডাক্তার বা লোক্যাল ছেলেপিলে কেউ দলছুট এসে পড়ত, তাদের মধ্যে কেউ ভালো হলেও হত তবে এরকম ডাক্তাররা বেশীদিন থাকত না, একটু হাত পাকিয়ে চলে যেত, পড়ে থাকত সেই ঝরতিপড়তির দল!

    একবার রেখার মাইগ্রেনের জন্যে গেছিলাম হাসপাতালে, সেই একবারই। ও যে ওষুধ খেত সে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছিলনা শক্তিনগরে, তাই অন্য কোনো ওষুধ লিখিয়ে আনতে। কার্ড টার্ড বানিয়ে সোজা পৌঁছে গেলাম সি এম ও অর্থাৎ চিফ মেডিক্যাল অফিসারের ঘরে। বেলা চারটে টারটে হবে, খালি ছিল, তিনি বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। সব শুনে রেখার মাথা টিপে, চোখের পাতা টেনে বলল সমস্যাটা নাকি চোখের, চোখের ডাক্তারের কাছে যেতে, চশমার পাওয়ার ঠিক হলেই মাথা ব্যথা সেরে যাবে। আমরা যত বলি, ওর মাইগ্রেন আছে, আপনি একটা মাইগ্রেনের মাথা ব্যথার ওষুধ দিন, সে শুনবেনা। ঘ্যাঁসঘ্যাঁস করে প্রেসক্রিপশনে লিখল, "টু সি আই স্পেশ্যালিস্ট"!
    অগত্যা, বেরিয়ে এসে চোখের ডাক্তারের খোঁজ করে জানা যায়, সে ছুটিতে (সি এম ও কী আর জানত না!)।
    কী করি, আর একজন ডাক্তার খালি বসে আছে দেখে তার কাছে গিয়ে সমস্যাটা বলি। সে অন্য কিসের একটা ডাক্তার ছিল, একটু ছোকরামত। দুজন মেয়ে সমস্যায় পড়েছি দেখে করুনাপরবশ হয়ে আমাদের কাছে ওষুধের নামটা জেনে লিখে দিল (তার মাইগ্রেনের অন্য ওষুধের নাম জানা নেই)আর বলে দিল হাসপাতালের স্টোরে নেই লিখিয়ে নিয়ে বাইরে দোকানে গিয়ে বললে ওরা বেনারস বা দিল্লী থেকে আনিয়ে দেবে ওষুধ। সেইমত করে দু তিনদিন পরে ওষুধ পাওয়া গেল। এরপরে আমরা ভুলেও আর কোনোদিন হাসপাতালের রাস্তায় হাঁটিনি।

    প্রায়ই সাপ বেরোতো, ট্রেনিং সেন্টার ও হস্টেলের আশেপাশে। দেখেশুনে পথ চলতে হত। রাতে ঘর থেকে বেরোবার সময় আলো নেভানো হত না। বাইরে থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতে হত সাবধানে দেখেশুনে। এতদিন শপিং কমপ্লেক্স বা বাজারে যাওয়ার জন্য আমাদের একটা সোজাপথ ছিল এম জি আরের লাইন পেরিয়ে বনের মধ্যে দিয়ে, চড়াই ওঠাটা অত বোঝা যেতনা সে পথে, ঘুরপথে অত হাঁটার দরকার পড়ত না। বর্ষার শুরু থেকে সে পথে যাতায়াত বন্ধ করতে হল, সবাইয়ের বারণে। সিকিউরিটী চাচার তেল চুকচুকে লাঠিটা আমার প্রথম থেকেই খুব পছন্দ, অনেকদিন থেকে বলছিলাম ওরম একটা লাঠি আমাকে এনে দিতে। এইসময়ই এনে দিল চাচা, আমিও চাচার দেখাদেখি অন্ধকারে বেরোলে লাঠিটা হাতে রাখতাম, ঠকঠক আওয়াজ করতাম সাপ তাড়াতে। লাঠি দেখে ছেলেরা খুব হাসাহাসি করত, ছদ্ম ভয়ের মুখভঙ্গী করত দুর থেকে আমাকে লাঠি হাতে দেখলেই। আমি অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে মজাসে লাঠি হাতে ঘুরে বেড়াতাম।
    পদস্থ অফিসাররা মেয়েদের যেভাবেই যেচোখেই দেখুক, ঝামেলা মনে করুক,থাকতে থাকতে ট্রেনিং সেন্টারের সাধারণ কর্মচারী যেমন,সিকিউরিটী চাচা, ড্রাইভার বাবা, ধোপা, রান্নার বাহাদুর, সবজিওয়ালা, মুদির দোকানের লালা, এরকম লোকজনের সঙ্গে আমাদের খুব দহরমমহরম হয়ে গেছিল।
    কালু ধোপা তো আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধোপা, এত সুন্দর কাপড় কাচত এত সামান্য পয়সায়। রেখা নিজেই কাচত নিজের জামাকাপড়, কথায় কথায় ইস্ত্রি নিয়ে বসে যেত, আমি কিন্তু আমার ওয়ার্ডরোব কালুর জিম্মায় করে দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্তে ছিলাম। দুদিন ছাড়া এসে ময়লা কাপড় নিয়ে যেত আর সুন্দর কেচে ইস্ত্রি করে দিয়ে যেত, আমার কাজ শুধু সেসব নিয়ে কাবার্ডে তুলে রাখা। কয়লা ছাই তেল কালির কল্যানে ও নিজেদের অসাবধানতায় জামাকাপড়ের দুর্দশা যা হত সে আর বলার নয়, তবে কালুর হাতে পড়লেই সেসব একেবারে টাইড চমক। সেরকম সেরকম দাগ না উঠলে পেট্রল ওয়াশ করত, ভালো ভালো জামাকাপড়ও তাই। কালু ধোপাই আমার দেখা শেষ ধোপা যে ঘরে এসে নোংরা কাপড় নিয়ে গিয়ে কেচে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করে দিয়ে যায়। এরপরে যেখানে গেছি সেখানে শুধু ইস্ত্রি করার লোক, কাচেনা কেউ।
  • shrabani | 117.239.15.102 | ১৭ এপ্রিল ২০১২ ১৭:০৬514796
  • টিভিতে কেবল আসতনা, দুরদর্শনও ঝিরিঝিরি, বৃষ্টির দিনে বেশী রাত অবধি ঘোরাফেরা করা যেতনা। প্রায়ই সন্ধ্যের দিকে ঝেঁপে আসত, তাই ক্লাবে গিয়ে খেলাও বন্ধ। বেশ বোর হচ্ছিল সবাই, ছেলেরা ব্যবস্থা করে একদিন ক্লাব থেকে ভি সি পি নিয়ে এল, খাওয়াদাওয়ার পর সিনেমা দেখা হবে। কাছাকাছি সিনেমা হল বলে কিছু ছিলনা, আগে অ্যাম্ফিথিয়েটারে মাঝে মাঝে পর্দা খাটিয়ে সিনেমা দেখানো হত বলে শুনেছি তবে কেবল চলে আসার পর তা বোধহয় কমে গিয়েছিল। সিনিয়রদের সঙ্গে পরে যখন শক্তিনগর নিয়ে গল্প হয়েছে তখন শুনেছি, তারা দেখেছে বলে, আমরা থাকাকালীন একদিনও এরকম কিছু হয়েছে বলে মনে পড়েনা।
    যাইহোক, ভিসিপি আনা হবে সেই এক শনিবারের রাতে। তার আগের দিন থেকেই ভোটাভুটি হচ্ছে, বিদিশাত্রয়ীর মত একটু ছটপটে ছেলেরা এর ওর রুমে দৌড়ে দৌড়ে সিনেমার নামের লিস্ট বানাচ্ছে।
    আমার বা রেখার হিন্দি সিনেমা নিয়ে তেমন কোনো উৎসাহ নেই, সেই কমাস কাগজ ম্যাগাজিন ইত্যাদির সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। বাড়িতে দিয়ে গেলে পড়া একরকম আর কাগজ ম্যাগাজিন পড়ার জন্যে অত রাস্তা হেঁটে রোজ ক্লাবে যাওয়া অন্যরকম (গেলেও সেখানে পুরনো কাগজ বা পুরনো জ্ঞানগম্ভীর পত্রপত্রিকার ভিড় শুধু), অভ্যেস আর ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল। হপ্তায় দু একদিন ক্লাবে যেতাম, লাইব্রেরী থেকে গল্পের বই আনতে, রবিবার অবশ্য খেতে যাওয়া হত বেশীরভাগ দিনই, অন্য কিছু প্রোগ্রাম বা নেমন্তন্ন না থাকলে।
    দু একটি চেনাশোনা ইংরাজী সিনেমার নাম দিলাম। শেষমেশ বিকেলবেলায় জানা গেল ক্লাবে যা ক্যাসেট ছিল তার মধ্যেই বেছে নিতে হয়েছে, সেখানে এমন কিছু বিশাল ভান্ডার নেই পছন্দ করার মত। তিনটি ক্যাসেট এসেছে, একটি মাধুরীর "বেটা", দ্বিতীয় হিন্দিটির নাম মনে নেই তবে শিল্পা শিরোদকর অভিনীত আর তৃতীয়টি ইংরাজী "ডাই হার্ড"। অবশ্যই আমাদের পছন্দের তালিকায় এটি ছিলনা এবং যেগুলি ছিল তা ক্লাবে উপলব্ধ নয়। অতএব ছেলেরা নিজেরাই ভেবেচিন্তে মেয়েদের জন্যে খুঁজেপেতে যা পেয়েছে তার মধ্যে আস্ত দেখে একখানা ইংরেজী মুভি নিয়ে এসেছে, তবে মেয়েরা তো কীরকম নখরেওয়ালী হয় সবার জানাই আছে, ক্যাসেটের কভার দেখে দুজনের মুখই ভেটকি মুখো ভ, নো কৃতজ্ঞ হাসি!

    সন্ধ্যেবেলায় টিভিকে ডাইনিং হলে আনা হল, ঘর অন্ধকার করে চেয়ার সারি সারি পেতে পুরো সিনেমা হল, বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। প্রথমে "ডাই হার্ড" দেখানো হল, সোনামুখ করে বসে দেখলাম, ভদ্রতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!
    মাধুরীকে ওরা শেষের জন্যে রেখে দিয়ে এরপর শিল্পা চালু করল। ডাই হার্ডের সময় অনেকেই উঠে চলে গিয়েছিল দরকারী কাজ সারতে। শিল্পার দোলায় ফিরে এল তারা এক এক করে। আমার একটু পরেই অসহ্য লাগতে শুরু করল, রেখার দিকে তাকিয়ে দেখি সেও চোখ গোল করে দু:খী মুখে বসে আছে। অনেকেরই বোধহয় ভালো লাগছিলনা, ডিনার ব্রেক হল। আমাদের মুখ দেখে চতুর্থ যাদবপুরীয় বঙ্গজ মুখে বেশ সহানুভূতি সূচক শব্দ করে বলল, " শিল্পা শিরোদকারটা ভালো নয়, ওর বোনটা কিন্তু দিব্যি, দেখনি? নম্রতা শিরোদকার, মিস ইন্ডিয়া হয়েছিল।"
    কয়েকমাসের শক্তিনগর বাসে আমি তখন পুরোপুরি বন্য হয়ে গেছি, কে নম্রতা, কার বোন কিছুই মাথায় নেই, উৎসাহও নেই। রকম দেখে ছেলেটি রীতিমত আহত হল, মিস ইন্ডিয়ার খবর রাখেনা, এ কেমন পাবলিক সব!

    খেয়েদেয়ে আমরা ঘরে চলে গেলাম, শো শুরু হল, রক্ষে যে আমাদের কেউ আর ডাকতে এল না, কিছু জিজ্ঞেসও করলনা। রোজকার রুটিন মত এক ঘরে কিছুক্ষণ গল্পটল্প করে যে যার ঘরে শুতে গেলাম। ঘুমোবার আগের মুহূর্তেও শুনলাম মাঝে মাঝেই একটা বিকট হল্লা ভেসে আসছে ডাইনিং হলের দিক থেকে। পরের দিন পরেশের কাছে শুনলাম, সিনেমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও নাকি পাবলিক ডিম্যান্ডে "ধকধক করনে লগা" পঁচিশবার রিপিট হয়েছে। সে খুব বিরক্ত, "বকোয়াস লড়কে সব, ভালো হয়েছে তোমরা ছিলেনা"। আমরা থাকলে কি আর দেখতে পারত ওরা, আমরা নেই বলেই দেখেছে। সে কথা পরেশকে আর বোঝাতে যাইনা, কী হিতে বিপরীত বোঝে পাগল! এক খতড়ী এপিসোডের পরে ট্রেনিং হস্টেলে বসে অন্য দু:সাহসী কিছু দেখার হিম্মত বেচারাদের নেই, তাই বারবার মাধুরীর ধকধক দেখেই দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়েছে!

    আকাশে মেঘ ছায়ে সজল বায়ে, সবুজ মন সব মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে চলে, তাই বোধহয় এদিক সেদিক একোণ ওকোণ থেকে নানা সুর নানা কথা ভাসতে থাকে হাওয়ায় হাওয়ায়। ততদিনে টেপরেকর্ডার প্রায় হস্টেলের প্রতি ঘরে, কোথাও চলে "রিমঝিম গিরে" তো কোথাও "কঁহা সে আয়ী বদরা", "অব কে সাওন"। এমনকী পান্ডের ঘরেরও দরজা খুলে যায়, "প্যার হুয়া ইকরার হুয়া" র সুরে তবে এবার আর আমরা রেগে যাইনা, আষাঢ় শ্রাবণের এমনই মহিমা!
  • sayan | 101.63.213.68 | ১৮ এপ্রিল ২০১২ ০০:০০514797
  • প্রতিটা পোস্ট একবার ক'রে প'ড়ে থোড়াই আশ মেটে! শুধু লক্ষ্য করছি কী অবলীলায় প্রতিটা পোস্টের শেষ প্যারাগুলোর মোহময়তা বাকি অংশের এক্সট্রীম ক¾ট্রাস্টের সাথে পাল্লা দিয়ে রেসে নেমেছে। দিজ ওয়ান, আ মাস্টারপীস!
  • shrabani | 124.124.86.86 | ২০ এপ্রিল ২০১২ ১২:১২514798
  • তেরটি যুবক ও দুটি মেয়ে,পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা মেঘমেদুর বরষা, বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা। প্রকৃতির নিজহস্তে সাজানো এহেন সুন্দর রঙ্গমঞ্চে মদনদেবের কোনো ভূমিকা থাকবেনা তা কেমন করে হয়! বিশেষ করে ওনার গার্জিয়ান শক্তি তার শিবকে নিয়ে জ্বালাদেবী রূপে যখন কাছেপিঠেই থাকেন, উনিই বা দুরে থাকেন কী করে!
    গুজরাটের প্রণব গান গাইত অপূর্ব, এবং একদম আনকোরা নিভাঁজ গলায় নিখুঁত গায়কী, কোনো শিক্ষা বা রেওয়াজের ছাপ ছিলনা বলেই বোধহয় আরো ভালো লাগত, অবশ্য তার কিছুটা যে সময় ও পরিবেশের গুণ নয় তা হলফ করে বলা যায় না । প্রতিটা অনুষ্ঠানে, এছাড়া দৈনন্দিন নানা বাহানায় আমরা আর্জি জানাতাম আর সেও গাইত হাসিমুখে।
    কেরালার রঘু ততদিনে প্রণবের দ্বিতীয় নাম্বার ওয়ান ফ্রেন্ড। গান তো দুরের কথা, কথা বলতেও তার গলা দিয়ে সেভাবে আওয়াজ বেরোতো না। কোনো এক বর্ষাদিনে ঘরে বন্দী আমরা, পাসিং দ্য পার্সেল খেলতে খেলতে রঘু আউট হলে, মজা করেই তাকে বলা হয়েছিল দুলাইন গাইতে। অপ্রস্তুত লাজুক মুখ দেখার আশায় তাকিয়ে দেখি সে উঠে দাঁড়িয়েছে, হাতদুটো এক করে পেছনে মোড়া, নির্ভীক দৃষ্টিতে একটু দুরে জানালার বাইরে তাকিয়ে শুরু করল "তুমসে মিলকে, অ্যায়সা লগা তুমসে মিলকে"। আমরা অবাক, হিন্দিতে কথা বলতে কোনোদিন শুনেছি বলে মনে পড়েনা যে মুখে, সেই মুখে হিন্দি গান, নির্ভুল কথায় সুরে, অল্প উচ্চারণে ছাড়া কোনোকিছুতে খামতি নেই!

    কলেজের এক ছেলে বন্ধুর চিঠি পেলাম, "হ্যাঁরে তোদের ওখানে একটা মেয়ে আছে একদম নাকি কাঁচের শোকেসে রাখার মত?" ঠিক কিরকম হলে কাঁচের শোকেসে রাখার মত মেয়ে হয় জানা ছিলনা।
    বুঝলাম বারতা ছুটেছে দিকে দিকে,সংবাদের উৎস আন্দাজ করতে অসুবিধে হয়না, বর্ষার কলরোল বোধকরি মেডেল তপস্যারত মুনিদের মনও উচাটন করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
    হয়ত এ অবস্থা অনেকেরই হয়েছিল,তবে তার খবর ছিলনা আমার কাছে। এমন কী এও অনেকদিন জানতে পারিনি যে দুই প্রাণের বন্ধুর স্বপনচারিনী এক ও অভিন্ন। তবু শেষ অবধি আমি তো জেনেছিলাম কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের যা তা হল সারাদিন পাশাপাশি ঘুরেও সে দুজন এমনই ঘোরে থাকত যে নিজেরাও পরস্পরের মনের খবর আঁচ করতে পারেনি।
    হালে ক বছর আগে ওদের একজনের সঙ্গে দেখা হওয়ায় পুরনো কথা উঠল, সেইসব স্মৃতিচারণের মাঝে মাঝে যখন আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাটা তখন তাকে সত্যিকারের বিস্ময় প্রকাশ করতে দেখলাম। তবে দেখা গেল যেমনটা কবিরা বলে থাকেন এই শতাব্দীতে শোকের আয়ু বেশীদিনের না, সে ভাঙা প্রেমের শোক হোক আর যাই হোক, তেমনটাই হল। অবশ্য এক্ষেত্রে এটা আরো স্বাভাবিক, কারণ বরমাল্য শেষ পর্যন্ত কারো ভাগ্যেই জোটেনি!

    ট্রেনিং, পরীক্ষা এসবে তখন বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে সবাই, প্রথম দিকের চাপ ভাবটা কেটে গিয়ে নতুন নতুন জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা উপভোগই করছি। নিজেদের বিষয়ের নানা লোকজনের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে, অনেক কিছু জানা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে এদের মত লোকেদের সঙ্গে, এদের মত করে কাজ করতে হবে, তাই আগ্রহ প্রচুর। বেশীরভাগ যারা পড়াতে আসত তাদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল, ঘরোয়া,নানা আলোচনা গল্প হত। তারাও সাগ্রহে আমাদের বাল্যখিল্য প্রশ্নের সব উত্তর সাধ্যমত দিতে চেষ্টা করত। দেবাশিস ও অশোকের উপস্থিতি সত্বেও মোটামুটি আমরা বাকীরাও ক্লাসে সক্রিয় ভাগ নিতে শুরু করেছিলাম, ক্লাস ও পড়াশোনা বেশ সহজ হয়ে আসছিল এভাবে।
    পড়ুয়াদের মধ্যে পান্ডে রাজেশের মত দু চারজন ব্যতিক্রম ফাঁকিবাজ যেমন ছিল, শিক্ষকদের মধ্যেও এক আধজন অনুরূপ নমুনা যে ছিল না তা নয়। এই দলের প্রথম সারিতে আসবে মিশ্রজী, ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল যাকে বাংলায় বলে কদম ছাঁট, লম্বা দোহারা সুন্দর কসরত করা চেহারা। শুধু চোখের দৃষ্টি ছিল অদ্ভুত, ছোট ছোট চোখে শিশুর মত বিস্ময় ভরা। ক্লাসে যে যাই জিজ্ঞেস করুক, উত্তরে প্রথমে থেমে যাবে, ভালো করে মন দিয়ে প্রশ্ন শুনবে,শুনে ঐ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকবে চুপ করে, যেন খুব ভাবনা চিন্তা করছে, দারুন কিছু উত্তরের আশায় ক্লাসের দমবন্ধ, উত্তেজনা চরমে। এরপর খানিক বিরতি এবং ক্লাইম্যাক্সের সেখানেই ইতি।
    মিশ্রাজী ফিরে গেছে বোর্ডে, যে জায়গায় পড়ানো থামিয়েছিল প্রশ্নের আগে,আবার সেখান থেকে চালু করে দিয়েছে। কার প্রশ্ন, কিসের উত্তর, সব মায়া!
    পরদিন আবার প্রশ্ন করলে সেই এক পুনরাবৃত্তি। প্রথম দুদিনের পরে আর সবাই হাল ছেড়ে দিয়ে এর ক্লাসে চুপ করে থাকত শুধু দেবাশিস কিছুদিন চেষ্টা চালিয়ে গেসল, পরে সেও নাজেহাল হয়ে ক্ষান্ত দেয়। আমরা খুব খুশী হয়েছিলাম, এতদিনে দেবাশিসকে টক্কর দিয়ে বোর করার মত লোক এসেছে! শুধু এইজন্যেই মিশ্রজীকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম শেষ পর্যন্ত, কারণ মিশ্রর সিলেবাস শেষ হওয়ার পরে দেখা গেল অন্যান্য ক্লাসেও দেবাশিসের প্রশ্ন করার ঝোঁকটা অনেক কমে গেছে!
  • shrabani | 124.124.86.86 | ২০ এপ্রিল ২০১২ ১২:৩১514799
  • মেয়ে দুজন দলের অনেকেরই তেমন পসন্দিদা ছিল না, তার কারণও ছিল নানা। কানাঘুষোয় একটা অন্যতম কারণ যা শোনা গিয়েছিল তা হল দেবদ্বিজে একেবারে ভক্তি নেই এদের!
    অন্য সব দোষ নাকি মেনে নেওয়া যায় কিন্তু মীরাবাঈয়ের দেশে ভক্তিহীনাদের কোনো ঠাঁই হতে পারেনা। আমরা সোম মঙ্গল, শিব বজরঙ্গবলী, কারুকে স্মরণ করেই কোনো উপবাস রাখতাম না, অথচ ছেলেরা রাখত। অনেকেই মাসে এক বা একাধিক শনি/মঙ্গলবারে সারাদিন না খেয়ে মন্দিরে যেত, তারপরে ক্ষুধাজনিত তিরিক্ষি মেজাজে অসময়ে ডাইনিং হলে বসে গপগপ করে কলা খেত ও ছোটুকে বকাঝকা করে চায়ের হুকুম দিত।
    ঐ সব দিনে আমাদের দেখলে এরাই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে জানতে চাইত "ফাস্ট নহী রখতে আপলোগ, ক্যায়সী লড়কী হ্যায়"!
    টাউনশিপের কোথাও তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর একটি মন্দির ছিল বলে শুনেছিলাম কিন্তু তা সাধারণ যাতায়াতের রাস্তা থেকে অনেক দুর হওয়ায় কোনোদিন চোখে দেখিনি। চলে আসার অনেক পরে জানলাম জ্বালাগাঁওর মন্দির নাকি ও তল্লাটের প্রধান দর্শনীয় স্থান ও তার তীর্থমাহাত্ম্য প্রবল, জ্বালাগাঁওয়ের রাস্তায় প্রায়ই হেঁটেছি পথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ভালোবেসে, মন্দির অবধি যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
    পরবর্তীকালে দলের অন্য মেয়েদের দেখেছি অন্য প্রজেক্টে, তারা সবাই বিভিন্ন দিনে উপবাস রাখত, মাথায় ওড়নার ঘোমটা দিয়ে মন্দির থেকে ফিরে দলের সবাইকে "পরসাদ লিজিয়ে না" বলে নকুলদানা অফার করত। তাই এ আর আশ্চর্যের কী যে শক্তিনগর দলের ছেলেরা আমাদের আদর্শ ভারতীয় নারী নামের কলঙ্ক মনে করবে!

    এছাড়া ছিল ভাষার সমস্যা। কেন কে জানে ইংরেজীতে কথা বলা দলের বেশীরভাগ সদস্যই পছন্দ করত না, হিন্দি ছিল স্বীকৃত ভাষা সব কাজে। এদিকে হিন্দিতে সাউথের ছেলেমেয়েদের অসুবিধে হত সবচেয়ে বেশী কিন্তু তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিলনা। মেজরিটির দাবীতে পড়াতে যারা আসত ( বা তাদের নিজেদেরও হয়ত এতেই সুবিধে হত!), এক দুজন ছাড়া সবাই হিন্দিতে ক্লাস নিত। বাঙালীরা ম্যানেজ করে নিত কিন্তু কেরালার চারজন পারতনা, ওরা তাই আরো বেশী করে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকত।
    আমরা যারা ওদের সাথে বা ওরা থাকলে ইংরেজী বলতাম, তাদের খুব ট্যারাবাঁকা কথা শুনতে হত অন্যদের কাছে। আড়ালে যাই বলুক, নিন্দে করুক এনিয়ে, সামনে মেয়েদের দুজনকে বেশী না ঘাঁটানোর কারণের মধ্যে অন্যতম ঐ ইংরেজী ভুতের ভয়ও ছিল!
    তবু কিছু কিছু লোকজন ছিল যাদের কাছে এই দোষগুলি তেমন দোষ হয়ে দেখা দেয় নি, কিছু জন যাদের মেয়েদের সম্বন্ধে ধারণাটা ঠিক সাবেক উত্তর মধ্য ভারতীয় বা রক্ষনশীল নয়। ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল এরকম কিছুর সঙ্গে, বাকী সবার সাথে মেলামেশা ছিল ওপর ওপরে, কিন্তু ভেতরে কোথাও শেষ পর্যন্ত এমন একটা গভীর গহন ফাঁক রয়ে গিয়েছিল যা কোনোদিন কোনো কিছুতেই ভরানো যায়নি। এমনিতে দলে একটা হালকা টীম স্পিরিট ভালোই কাজ করত, তবে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ছিল মূলত: প্রান্তিক। ভাষাভাষীর গন্ডীর বাইরে কেউই বেরোতে পারেনি অন্তত ওই ছমাসে এমনটি দেখিনি।
    একমাত্র আমাদের পাঁচজনের দলটা ছিল আলাদা, গুজরাট কেরালা বঙ্গের মিলনক্ষেত্র, তবে তার ভিত্তিও যে নিছক বন্ধুত্ব ছিল তা আজ আর বলি কেমন করে!

    ঘোর বর্ষায় শক্তিনগরের বনে বনে পাতায় পাতায় রঙ লেগেছে, টুপটুপ বৃষ্টির ধারায় নুপুরের রিনিঝিনির সুর। নীল ঘন মেঘে কখনো বা আড়ালে লুকোনো সূর্যের হালকা হলুদ আভা, কখনো আবার বৃষ্টিশেষের আকাশজুড়ে রামধনু রঙ। যা দেখি সবই নতুন, সবই ভালো লাগে, দেখে দেখে আশ মেটেনা, মনে হয় এমনটি আগে কখনো দেখিনি। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একাত্মতা তো চিরকালীন, তাই বুঝি কোথায় অলক্ষ্যে নতুন মেঘে পুরনো মনের হারিয়ে যাওয়া টের পাইনা কেউ। হঠাৎ যখন দেখি কমাসের চেনা দেখাশোনা অন্যরকম অচেনা হয়ে গেছে, তখন চমক লাগে।
    ঋতুরঙ্গের সেই আসরে কোনো মুগ্‌ধ চোখের দৃষ্টি মনে রেখাপাত করবেনা, সেরকমটা সচরাচর হয় না, হওয়া স্বাভাবিকও নয়, মেঘদূতে এমনটা বলেনা। এক্ষেত্রে তবে সেই চিরকালীন নিয়ম খাটেনি, যা অস্বাভাবিক, সেটাই ঘটেছিল। এতকাল পরে সেই ঘটনার বিশ্লেষণে শুধু এটুকুই বলা যায় যে মানুষের স্বভাবই বোধহয় সেই "যাহা পাই তাহা চাই না"।
    যা চেয়েছিলাম তা তখন ফেলে এসেছি, ঠিক ফেলে নয়, মহান হবার লোভ সামলাতে না পেরে সত্ব ছেড়ে এসেছি অন্য একজনের কাছে। চিঠিপত্রে পরের ডিসেম্বরে হস্তান্তরের দলিল পাকা হবার খবর পেতাম। অতএব মুগ্‌ধ সে দৃষ্টিতে ভেসে যাবার অবসর সেটা ছিলনা। উল্টে জমাট মন আরো কঠিন হয়ে ওঠে, আরো যান্ত্রিক।

    তবু যখন সারাদিনের বৃষ্টির পরে সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে যাই চিলকা লেকের পানে, পার্কের মধ্যের হরিণের খাঁচার সামনে গিয়ে হাতে করে চীনেবাদাম খাওয়াই হরিণশিশুকে, তখন নরম হয়ে আসত ভাবনাগুলো। যখন লেকের ধারে ভেজা ঘাসে গোল হয়ে বসি সকলে, হাসি গল্পের ফাঁকে চোখ না তুলেও বুঝতে পারি এদিকপানে কার চোখ, তখন তখন সেই বৃষ্টিভেজা দিনে, ভেজা মনে, এক অদ্ভুত মন খারাপের বেলা ঘিরে ধরে অবশ করে দিত মনপ্রাণ!
  • shrabani | 124.124.86.86 | ২০ এপ্রিল ২০১২ ১২:৩৯514800
  • বর্ষা শেষে বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠল। চড়া ভাদুরে রোদের মতই খুশীর ছটা প্রত্যেকের চোখেমুখে। যতই ভালো লাগুক জায়গাটা, পরে যা হয় হবে, তখন শহরে ফেরার জন্যে ব্যাকুল আমরা সবাই। তাই যেদিন মডিউলের শেষ পরীক্ষা দিলাম সেদিন তো প্রায় উৎসবের দিন। এরপরে শুধু প্রজেক্ট বাকী রইল। প্রথম ছমাসের ট্রেনিংয়ের এই অংশটা মোটামুটি দেখা গেল আমাদের সবারই খুব পছন্দের।
    কলেজে প্রজেক্ট বানানো আর এখানে বানানোর মধ্যে যে তফাতটা ছিল তা হচ্ছে রিসোর্সের। ল্যাবে স্টোরে মজুত অঢেল জিনিসপত্র, যেরকমটি চাই যা জিনিসপত্র, সব মুখের কথায় পেয়ে যাচ্ছি। ওয়ার্কশপে টেকনিশিয়ানরা যেরকম বলছি দরকারী কাঠামো ইত্যাদি বানিয়ে দিচ্ছে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এক বা একাধিক প্রজেক্টের কাজ শুরু করলাম সবাই মহা উৎসাহে। এবার রেখা আর আমি এক দলে, আমাদের সাথে আর কেউ নেই। একদিন ট্রেনিং কর্তা রাও সাহেব এসে ঘুরে দেখে গেল আমাদের প্রজেক্টের কাজকর্ম। দেখেশুনে রীতিমত ইমপ্রেসড, এরকম ভালো ভালো প্রজেক্ট নাকি আগে কোনো ট্রেনীর দল হাতে নেয়নি। এর আগে জৈনের ফেয়ারওয়েল ওনার মাথায় ছিল, তাই এবার আমাদের ডেকে ভার দিলে ট্রেনিং সেন্টারের বিশ্বকর্মা পুজোর আয়োজন করার। প্রতিবছরই হয় এই পুজো, ঐ ওয়ার্কশপে। সেবারে ঠিক হল, পুজোর সাথে সাথে আমাদের প্রজেক্টগুলোর প্রদর্শনীও হবে।

    আমরা তো যাকে বলে মহা চার্জড হয়ে পুজো ও প্রজেক্ট দুইয়েরই তোড়জোর শুরু করে দিলাম। ঠিক হল জি এম ও মিসেস জি এম কে ডাকা হবে উদ্বোধন করতে। বিশ্বকর্মা পুজো শক্তিনগরের এক বড় উৎসব, কলকব্জার ছড়াছড়ি চারদিকে,তাই বছরের এই দিনে প্রত্যেকটি আনাচকানাচে যন্ত্রের দেবতাকে স্মরণ করা হয় ধুমধাম করে। প্ল্যান্টে প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট ও আরো নানা জায়গায় গুচ্ছের পুজো। তখন অবশ্য সিকিউরিটীর কড়াকড়ির জন্য সাধারণ মানুষের প্ল্যান্টে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে,তবে আগে নাকি ঐদিন গেট খুলে দেওয়া হত সর্বসাধারণের জন্যে। বাইরেও ট্রেনিং সেন্টার, পাম্প হাউস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, টাউনশিপ ইলেক্টিক সাপ্লাই, হাসপাতাল, কেবল টিভি, এরকম অজস্র জায়গায় পুজো হয়ে থাকে। শক্তিনগরবাসীরা সকলেই বিকেলবেলা থেকে সেজেগুজে ঠাকুর দেখতে বেরোয় পরিবারসহিত, এছাড়া বিন্ধ্যনগরের বাসিন্দারাও আসে, এদিককার লোকও ওদিকে যায়।
    ঠাকুর আনতে গিয়ে আমার তো চক্ষু ছানাবড়া। এতদিন বিশ্বকর্মাকে দেখেছি কার্তিকের মতই, তরুন, ঠোঁটের ওপর সরু কালো বাহারী গোঁফের রেখা, মাথায় কুচকুচে কালো বাবরী চুল। এখানে দেখি সাদা দাড়িগোঁফে মুখভর্তি, বুড়ো বিশ্বকর্মা। শুনলাম বাংলার বাইরে কিছুদুর এলেই নাকি বিশ্বকর্মা বুড়ো হয়ে যান। আমার তো খুব মনখারাপ, তাকাতেই ইচ্ছে করছেনা ঠাকুরের মুখের দিকে, এত কষ্ট করে মন্ডপ সাজালাম আর এখন এই ঠাকুর!
    অশোক আর দেবাশিস খুব হাসতে থাকল আমার বেজার মুখ দেখে, "দাঁড়া তোর একটা পাকা দাড়িগোঁফওয়ালা বর খুঁজব, নেহাত বর না পাওয়া গেলে নিদেন একখানা ওরকম শ্বশুর।"

    পুজোর আগের কদিন থেকে আমরা দিন রাত পড়ে আছি ল্যাবে। প্রজেক্ট শেষ করার সাথে সাথে চলছে ল্যাবের সাজসজ্জা। আগেরদিন খুব বৃষ্টি হল, দুপুর নাগাদ প্রজেক্টকে ফাইন্যাল টাচ দিয়ে আমি আর রেখা যখন খেতে এলাম তখন ডাইনিং হলে খালি আমরা দুজন। বাকিরা তখনও ল্যাবে, খিদেতৃষ্ণা ভুলে সব কাজ করছে। থমাস আর বাবু একটা গেট বানাচ্ছে, জিএমের জন্য, উনি গেটের নীচে দাঁড়ালেই ওপরের ফ্ল্যাপার গেট সরে গিয়ে গোলাপের পাপড়িবৃষ্টি হবে। আমরা সবাই সেই গেটের নীচ দিয়ে বারবার গিয়ে মহড়া দিতে থাকলাম, ফ্ল্যাপার ঠিকমত খুলছে কিনা,ওদের ভালোর জন্যেই যাতে শেষমুহূর্তে ফ্ল্যাপার ফ্লপ না করে। কিন্তু ওরা তা বুঝলনা, শেষে থমাস রেগেমেগে সাপ্লাই অফ করে বসে রইল।

    এইসব ব্যস্ততার মাঝে এগিয়ে আসছিল আমাদের যাত্রার দিন। খেয়াল ছিল, মন খারাপও, তাই একটু সময় পেলেই দুজনে ছুটে যেতাম রেল লাইনের ধারে, পাহাড়ের নীচে, বনের মধ্যে ঢুকে জাম কুড়োতাম। ট্রেনিংয়ের এই পর্ব শেষ হওয়া মানে শুধু এই জায়গা থেকে চলে যাওয়াই নয়, এর পরে আমরা আলাদা হয়ে সবাই যাব ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অন জব ট্রেনিং করতে, তাই আমাদের একসাথে চলাও এখেনেই শেষ। এতকিছুতে জুড়ে ছিলাম সেই দিনগুলোতে, সে একরকম ভালোই, নাহলে কষ্টটা আরো বেশী করে বাজত। তবু তারই মাঝে যখনই কিছু ভালো লাগত বা আমাদের পছন্দসই জায়গাগুলোতে যেতাম কিম্বা সেরকম কোনো বিশেষ মুহূর্তে রেখা আমার হাতটা শক্ত করে ধরত আর চুপ করে দুজনে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে থাকতেম।

    পুজো ও প্রদর্শনী দুইই দারুন সফল, দিকে দিকে খবর গেল আমাদের প্রদর্শনীর আর সন্ধ্যে নাগাদ এত জন সমাগম হল তা ট্রেনিং সেন্টারের ইতিহাসে প্রথম। সারা রাস্তা জুড়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিন্ধ্যনগর, শক্তিনগর এই দুই জায়গার কেউ বোধহয় বাকী ছিলনা আসতে। আমরা নি:শ্বাস নেবার ফুরসত পাচ্ছিলাম না সবাইকে বোঝাতে ও ডেমো দেখাতে গিয়ে। বাচ্চাদের ও স্কুলের ছেলেমেয়েদের বিস্ময় ও নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়ে কাহিল অবস্থা।
    সবাই এক বাক্যে প্রশংসা করে গেল ট্রেনী দল ও ট্রেনিং কর্তা রাও সাহেবের এমনকি খোদ জি এম ও মিসেস জি এম ও। তবে সকালে উদ্বোধনের সময় গেটে ফুলবর্ষণের ব্যাপারটায় কিঞ্চিত গড়বড় হয়ে গিয়েছিল। জি এম ঢুকতে যাবেন, পিছনে হাজার বুটি সাদা তাঁতের শাড়ীতে সুন্দরী স্মিতহাসি মিসেস জি এম, এমন সময় থমাস প্রচন্ড উত্তেজনায় এক দিক থেকে আরেক দিকে দৌড়তে গিয়ে তারে পা আটকে ফ্ল্যাপার গেট খুলে গিয়ে জি এমের ঢোকার পূর্বমুহূর্তেই পুস্পবৃষ্টি সারা হয়ে গেল। আমরা দু:খে লজ্জায় চোখ প্রায় বন্ধ করে ফেলেছি, হঠাৎ কানে এল চারদিক থেকে জোর করতালির আওয়াজ, জিএম গেট দিয়ে ঢুকলেন গোলাপের পাপড়ি বিছানো পথে!
    আসলে সবাই তো আর আদত পরিকল্পনা টা জানত না, ভাবল বোধহয় ঢোকার আগে আগেই ফুল পড়ার কথা, জি এম নিজেও হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করল আমাদের।
    আমরাও এনিয়ে আর কাউকে কিছু বললাম না, বরং সবাই এমন একটা মুখ করে ঘুরে বেড়াতে থাকলাম যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল!
  • shrabani | 124.124.86.86 | ২০ এপ্রিল ২০১২ ১২:৫৩514802
  • এর দু তিনদিন পরেই আমাদের বিদায়ের পালা এসে গেল। দিনগুলো কিভাবে যে কাটছিল, গোছানো, গোটানোর চরম ব্যস্ততায়। ট্রেনিং সেন্টারেও সবাই ব্যস্ত, পরীক্ষা প্রজেক্টের নম্বর, রেজাল্ট ইত্যাদির ফাইল তৈরী করে দিল্লী পাঠাতে হবে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কোটা, সেখানে দু সপ্তাহের ট্রেনিং,তারপরে দিল্লীতে মিড টার্ম অ্যাপ্রেজাল।
    হস্টেলের ছমাসের সংসার গোছানো শুরু হয়ে গেল। দুদিন আগে থেকে মেস বন্ধ করে ছোটু, বাহাদুর, মুদী, সবজিওয়ালা সবার হিসেব বুঝিয়ে দেওয়া হল। এ দুদিন শক্তি, ক্লাব ও মোতির ধাবাতে খাওয়াদাওয়া চলল। আমরা চার বাঙালী আর রেখার অবশ্য ঢালাও নেমন্তন্ন ছিল দাসবৌদির ঘরে। দু একবার সেখানে গিয়েও খেলাম। তবে সেখানে খাওয়া মানে পিকনিক, নিজেদেরই গুছিয়ে গাছিয়ে খুঁজে পেতে সরঞ্জাম যোগাড় করে রান্না করে নিতে হবে। বৌদির সংসার তখন এমনই ছিল, কোথায় কী রাখা আছে, আদৌ আছে কী নেই কেউ জানতনা। রান্না কমই হত সে বাড়িতে, যে খেতে চায় নিজে গিয়ে করে নাও ধরণের ব্যবস্থা।
    তবে গেলে খাওয়াদাওয়ার যা ব্যবস্থাই হোক বসার ঘরে হারমোনিয়াম পাতা থাকত সবসময়, কবিতার বইও খোলা।
    অবশ্য ইদানীংকালে শুধু "বিদায়, অশ্রুজল, মনে রেখো" টাইপের গান কবিতায় ওদের ঘরের আবহাওয়া বেশ ভারী হয়ে থাকত। এসব নানা কারণে আর ব্যস্ততার দরুন সেখানেও যাওয়া হতনা সবসময়।

    আমরা জানতে পারিনি এতদিন, এই যাবার বেলায় ট্রেনিং সেন্টারের নানাজনে এসে বলে যেতে থাকল আমরা কত ভালো ছিলাম, এরকম দল নাকি আগে আসেনি। এমনকি সিংসাব ও দত্তবাবুও সবার সামনে আমাদের দুই মেয়ের এমন উচ্ছসিত প্রশংসা করলে যে আমরা লজ্জাটজ্জা পেয়ে গেলাম প্রায়। আমাদের নাকি এতটুকু নখরা ছিলনা, লক্ষ্মী মেয়ে সব (বেশীরভাগ বি পাওয়া সত্বেও?)। এর আগে নাকি যেসব মেয়েরা এসেছে কম দিনের শুধু ল্যাব ট্রেনিং করতে তারা কেউ ট্রেনিং হস্টেলে থাকেনি, তাদের জন্যে দুরে গেস্ট হাউসে আলাদা ব্যবস্থা করতে হয়েছে, আনা নেওয়ার গাড়ি ইত্যাদি, নানা ঝামেলা। পান থেকে চুন খসলে তারা নালিশের বোঝা নিয়ে বড় সাহেবদের কাছে চলে যেত।
    আর এবারে বোঝাই যায়নি ছমাস ধরে দুটো মেয়ে এসে ট্রেনিং হস্টেলে আছে। কোনোদিন কোনো অভিযোগ করতে আসেনি, কিছু দাবী করেনি, অসুবিধের কথা ফলাও করে বলতে আসেনি, চুপচাপ হাসিখুশীতে নিজেদের মত করে থেকেছে। প্ল্যান্টের লোকেদেরও নাকি একমত, মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সব জায়গায় গেছে, সমস্ত দুর্গম এলাকায়, কখনো টুঁ শব্দ করেনি, পারবনা বলেনি।
    এতদিনে কখনো যা দেখিনি, সিংয়ের চোখে সেই বাৎসল্য ভাবের ঝলক, "বহুত বড়িয়া বচ্চী হ্যায় দোনো"।
    মন ভিজে আসে, আমরা আলাদা করে হয়ত ওকে বিরক্ত করিনি কিন্তু পুরো দলের যা জোর জুলুম সব ওর ওপরেই ছিল। এখন বছরখানেকের জন্যে নিশ্চিন্ত যতদিন না আবার পরের ব্যাচ আসছে।

    যাওয়ার দিন বাবার বাস এল আমাদের স্টেশনে নিয়ে যাবার জন্য। কালু ধোপা, সিকিউরিটী চাচা, ছোটু,বাহাদুর, ট্রেনিং সেন্টারের কর্মচারীরা সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। সেই ছমাস আগে বাড়ি ছেড়ে বেরোবার মত মনে হচ্ছে, প্রিয়জনদের ছেড়ে যাচ্ছি। সবাই বলছে "ফির আইয়েগা, পোস্টিং নিয়ে এখানেই এসে যান।" আমরাও মুখে "হ্যাঁ,হ্যাঁ" করছি, যদিও জানি সে কিছুতেই সম্ভব নয়, এলেও হয়ত একজন আসবে।
    বারবার ঘুরে যাই ঘরটা দেখতে, কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা। এককোণে পড়ে আছে চাচার দেওয়া লাঠি। জানি ফেলে অনেককিছু যাচ্ছি, আবার এও জানি, তা নিয়ে যাওয়া যায়না তাই ফেলে যাচ্ছি। শুধু তখন এটা বুঝিনি যে নিয়েও অনেককিছুই এসেছিলাম।

    বাসের পিছু পিছু স্কুটারে দত্তবাবু আর সিংসাব আসে স্টেশন অবধি। ত্রিবেণী এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে সকাল থেকে শক্তিনগর স্টেশনে, সেই ফার্স্ট ক্লাসে চড়া হচ্ছে শেষপর্যন্ত। ছোট স্টেশন, চেনাজানা, টাউনশিপের নিজস্বই বলতে গেলে। হাঁকডাক করে গুছিয়ে মালপত্র তোলা হতে থাকল দত্তবাবুর তদারকিতে। ওদিকে দু তিনটে গাড়ি এসে গেছে, বাঙালী সব, মূলত দেবাশিস অশোকদের পরিচিত। সাদা মারুতির গায়ে হেলান দিয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে দাসবৌদি আর তারপাশে দাঁড়িয়ে অশোক আর দেবাশিস। আমি তিনজনকেই সান্ত্বনা দিতে যাই। মুনিয়া এসে "পিসী, আবার কবে আসবে" বলতে এবার আমার চোখও ঝাপসা।

    ট্রেনে উঠে গেছি, সিংসাব প্ল্যাটফর্মের ওপর দৌড়ে দৌড়ে এ জানালা ও জানালায় গিয়ে ছেলেদের ধরে ধরে বলছে, "এদের খেয়াল রেখো, লখনৌ থেকে আবার ট্রেন পাল্টানো, এতটা রাস্তা,কতরকমের সব লোকজন, মেয়েদের খেয়াল রেখো।" জনে জনে তাকে আশ্বাস দেয়, তারা আমাদের খেয়াল রাখবে। ঐ বয়স্ক ট্রেনিংকো অর্ডিনেটরটিকে ওভাবে আমাদের কথা ভেবে উৎকন্ঠায় এ দিক ওদিক করতে দেখে ভেতরে কী একটা হয়ে যায়। ট্রেন থেকে নেমে যা আমি সচরাচর করিনা, তাই করে বসি, ওনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। উনিও কিরকম হয়ে যান, আমার মাথায় হাত রেখে বলেন, "জিতে রহ, জিতে রহ, খুব আগে বঢ়, খুব তরক্কী করো।"
    ওনাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি হত, কাজের নয়, বছরের পর বছর প্রমোশন হয় না, রাও সাহেব ওর কলেজের জুনিয়র, সে আজ ওর বস ইত্যাদি। সেই মানুষ সেদিন আমায় উন্নতি করার আশীর্বাদ দিয়েছিল।

    ট্রেন ছেড়ে দিল, এবার অন্য পথ, তবু দুদিকে তাকালে সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য, বর্ষার জলে সাজা শরৎ প্রকৃতি, আমার সাধের পুরু চওড়া গদি আঁটা আরামের ফার্স্ট ক্লাস কামরা, কামরায় যাত্রী শুধু আমরা। তবু চেঁচামেচি হট্টগোল কিছুই নেই, কেউ কথা বলেনা, সবাই চুপচাপ যে যার জায়গায় বসে থাকে।
    অশোক ওপরের বার্থে উঠে মুখ ঘুরিয়ে শুয়েছিল। হঠাৎ নেমে এল, এসে জানালার ধারে বসা দেবাশিসের কাঁধে হাত রেখে বলল, "আমি এখানেই ফিরে আসব, পোস্টিং নিয়ে।" দেবাশিস মুখ ফেরায়, "আমিও"। দুজনে এবার উল্টোদিকে হাত ধরে বসে থাকা আমার আর রেখার দিকে তাকায়, সেই মুহূর্তে "আমিও" ছাড়া আর কিছু বলতে চাইনি, কেউ শুনতেও চায়না। কিন্তু কী আশ্চর্য অন্য সময়ের মত আমি রেখাকে কথাটা বুঝিয়ে বলে দেওয়ার আগেই রেখা আমার হাতটা ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে। "মি ট্যু, শ্রাবণী, মি ট্যু"।
    ..........
    (শক্তিনগর পর্ব শেষ)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন