এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা

    Suki
    অন্যান্য | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ | ৫৬৯৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Suki | 178.85.170.49 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ০০:১৭530386
  • এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা – ৮ (ট্রেন পর্ব)

    ভারত থকে বিদেশে এসে যখন প্রথমদিকে কেউ কেউ ট্রেনে চাপেন তা হলে বিশাল একটা ঝটকা লাগে – টাইমে ট্রেন আসছে , বসার জায়গাও পাওয়া যাচ্ছে,পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ইত্যাদি । তা এই সবে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে এলে একটা অভাব অনুভূত হতে শুরু করে – কিছু যেন একটা মিস করছি । অনেক ভেবে আমি বার করলাম সেটা আর কিছুই নয় ট্রেনে হকার দের অনুপস্থিতি ! ট্রেন অনুমোদিত কয়েকটা কফি ভেন্ডর ছাড়া বিদেশের ট্রেনে হকার কোথায় !

    আমাদের দেশে ট্রেনে হকার দের উপস্থিতি যাত্রাকে একটা আলাদা মাত্রা দিয়ে থাকে, নাহলে ঐ নরক যন্ত্রণা সহ্য করা দায় ! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমি এখানে ট্রেনে হকারদের আলোচনা মূলত সীমিত রাখব হাওড়া- বর্ধমান লাইনের মধ্যে কারণ এই লাইনের মধ্যেই আমার ফার্স্ট- হ্যান্ড অভিজ্ঞতা রয়েছে । তবে সমস্ত ট্রেন হকার প্রজাতির মধ্যে জীনগত পার্থক্য তাতটাই যতটা আমাদের আর শিম্পাঞ্জীর মধ্যে ! যাই হোক হাওড়া- বর্ধমান মেইন লাইন লোকালের হকারদের চার ভাগে ভাগ করতে হবে:

    এক) শুধু হাওড়া স্টেশন - এদের এক্তিয়ার ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত
    দুই) হাওড়া থেকে ট্রেন ছেড়ে ব্যান্ডেল দাঁড়ানো পর্যন্ত
    তিন) ব্যান্ডেল ছাড়ার পর ও বর্ধমানে থামার ঠিক আগে
    চার) বর্ধমান স্টেশন শুধু

    এদের মধ্যে তৃতীয় প্রজাতির সাথে আমার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ছিল বহুদিন । অনেকে আবার বন্ধুস্থানীয় বলা যেতে পারে । এরা অনেকেই চমকপ্রদ খাবার বিক্রী করত ।অমানুষের মত খাবারেরও যে বিবর্তন হয় তা এই ট্রেন লাইনের হকারদের খাবার অনুসরণ করলেই বোঝা যায় ।অপার্থক্য একটাই খাবারের বিবর্তনের টাইম স্কেল ডারইন স্কেলের থেকে তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত ।অযখন ট্রেনের ভেন্ডর কম্পার্টমেন্টে ভাত বিক্রি শুরু হল তখন বেশ একটা চমক লেগেছিল । এই ভাত বিক্রি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল সকাল ১০টা থেকে ১২ টার মধ্যে ট্রেন গুলিতে । এই সময়ের ট্রেনে বর্ধমানের দিক থেকে কলকাতায় ছানা আসত ।অএই ছানাওয়ালারা সকালে আশে পাশে গ্রামে গোরুর দুধ দুইয়ে, সেই দুধে ছানা কেটে কলকাতা নিয়ে আসত । ফলত এরা সত্যিকারের টাইম প্রেসারে থাকত , কর্পোরেট জগতের মত ফলস টাইম প্রেসার নয়। তা ট্রেনে ভাতের ব্যাবস্থা শুরু হওয়ায় অনেকের সুবিধাই হল । একজন বৌদি প্রথম এটা শুরু করে এক হাঁড়ি ভাত ,ডাল ,সব্জি ,মাছ ও খোপ কাটা থালা বা কলাপাতা বিছানো থালা দিয়ে ব্যাবসা শুরু । সঙ্গে বালতিতে জল- দাম মনে হয় ১০ টাকার মত ছিল । অনেক খানবালার মতে রীতিমত হোমলি খাবার ।
    ভাত ছাড়া পেট ভরানোর নিকটতম খাবার ট্রেনে যা পাওয়া যেত তা হল মশলামুড়ি । মশলা মুড়ি যারা বিক্রি করত তাদের অনেকেরই আমাদের আশে পাশের গ্রামে বাড়ি ।অআর এই লাইনে কম্পিটিশন একটু বেশি ছিল ।অএখনও দেখা যায় এক কামরায় চারজন মশলামুড়ি নিয়ে উঠে পড়ল ! কোনও নির্দিষ্ট টাইম না থাকলে যা হয় আর কি? মুল সারবস্তু সবারই প্রায় সমান ছিল- মেশিনে ভাজা মুরি,চানাচুর, পেঁয়াজকুচি, আলুর টুকরো, ছোলা ভেজানো, তাতে খাঁটি সরষের তেল খানিকটা –আর তাছাড়া ছিল একটা স্পেশাল মশলা । সেই স্পেশাল মশলা প্রায় সব হকারই একজায়গা থেকে কিনত ।অএবং সেই মিশ্রণে যে কি আছে সেটা কেউ জানত না । আমি শুনেছিলাম ঐ মশলায় নাকি কুলের বিচ গুঁড়ানো থাকে ! এত্য ফল থাকতে কুলের বিচ কেন সেই বিষয়ে আমি ধন্ধে ছিলাম ! সব মিশিয়ে স্টিলের কৌটোয় চামচ দিয়ে নাড়ানোর যে শব্দ তাতেই জিভে জল চলে আসার মত ব্যাপার । মাল ঠোঙায় ঢেলে সর্বোপরি একটা লম্বা নারকেলের টুকরো ।অএই খাবার বহু ক্ষুধার্ত স্কুল ফেরত ছোকরা , অফিস ফেরত বাবু ,সিনেমা ফেরত গৃহবধূ ,সন্ধ্যেয় রেলাক্স করতে বেরানো যুবক যুবতী দের প্রাণে জোর সঞ্চার করেছে দিনের পর দিন । তবে কম্পিটিশন মার্কেট থাকায় কোনও কোনও হকার স্ট্যান্ডার্ড রেসিপি থেকে ডিভিয়েট করত একটু আধটু – যেমন একজন আমদানী করল আমতেল দিয়ে মুড়ি। আর কিছু নয় মুড়ি , আমতেল আর নারকেল ।অবললে বিশ্বাস করবেন না এই ভাবে সে নিজের একটা মার্কেট গড়ে তুলেছিল নিজের চারদিকে ।অবর্ধমানে মেইন লাইন যে ট্রেন তা ৫।৪০ সে দাঁড়াত সেই ট্রেনের পিছন দিক থেকে তৃতীয় কামড়ায় সে উঠত। দিনে ঐ একটাই ট্রেন ও কভার করত –বর্ধমান থেকে ব্যান্ডেল ও ফেরত । প্রায় ১০০ ঠোঙা মত মাল সে বিক্রী করত । দুটাকা ঠোঙার যুগে আমতেল মুড়ি ছিল তিন টাকা ।অআর বর্ধমান স্টেশনে দেখেছি সস দিয়ে মশলা মুড়ি বিক্রী করতে । স্পেশাল বলতে হত এবং তার দাম তখনি ছিল পাঁচ টাকা মত ।অতবে সেই সস মেশানো মুড়িতে মুচমুচে ভাবটা থাকত না বরং মাখা মাখা কাদা কাদা একটা ভাব । কাগজের প্লেটে সেই জিনিস ঢেলে দিত এবং আইসক্রীম খাওয়ার চামচ দিয়ে তা খেতে হত ।

    আমার চেনা সমস্ত মুড়ি মশলা বিক্রেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার নি:সন্দেহে ছিল হারা । দিনের বেলা ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে রাতের বেলা সে তন্ত্র প্‌র্‌যাকটিস করত । বিছানার তলায় একটা খাঁড়া রাখা থাকত এবং কোথা থেকে সে একটা মাথার খুলি ও একজোড়া টিবিয়া-ফেবুলা জোগাড় করেছিল ।অশোনা যায় সেই খুলির ভেতর ঢেলে হারা নাকি মাল খেত । তবে সে গল্প অন্য জায়গায় ।

    ট্রেনের খাবার বিষয়ে আলোচনা করতে হলে একটা তুলনা মূলক প্যারালাল না চাইলেও আনতে হবে যেটা হল ঘটি বনাম বাঙাল । আমাদের দিকে এই ব্যাপারটা মাঝে মাঝে কলকাতা সুলভ ড্রয়িংরুম জাত টিক্কা-টিপ্পনীর মত সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজজীবনে প্রভাব ফেলত !দেখা গেছে যে ট্রেনের হকারদের মধ্যে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ বা তার বেশী বাঙাল !এর সমাজতত্ব গত ব্যাখ্যা আমি জানি না তবে আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হত তা হল বাঙাল ছেলে পুলেরা ঘটি কাউন্টার পার্ট গুলোর থেকে বেশি কর্মঠ ।অঘটি যুবক গন যখন আগের দিনের ক্রিকেট ম্যাচের আলোচনা করতে ও গ্রামের বাঁশের মাচায় বসে বিড়ি ফুঁকতে ব্যাস্ত , তাখন বাঙাল ছেলেদের দেখেছি বাড়ির গাছে হওয়া এক ঝুড়ি পেয়েয়ারা নিয়ে ট্রেনে বেচতে যেতে ।অআর তাছাড়া আমাদের ওদিকের বাঙালদের ব্যাবসা বুদ্ধি প্রখর ছিল । ট্রেনে ইনিভেটিভ যা কিছু হকাররা বিক্রী করে সবই বাঙাল মস্তিষ্ক প্রসূত। ভাবুন – বিটনুন দিয়ে কাঁচা আমলকী , চালের পাঁপড় ,টম্যাটো দিয়ে ছিলা মটর সিদ্ধ (তেঁতুল গলা জল সমেত), ঘটি গরম ,গরম দিলখুশ, ঘুগনি ইত্যাদি । এখানে শুধু তাও আমি খাবার নিয়ে আলচনা করছি বাকি ট্রেনে বিক্রীত ষ্টেশনারী দ্রব্যের ইনভেশনের ম্যাগ্নিটিউড এডিসন ও স্টিভ জোবসের মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিল প্রায় । সেই প্রসঙ্গ অন্যসময় আসা যাবে ।

    ইদানিং শুনলাম বিটনুন আমলকির এক নতুন ভারসান বের হয়েছে- সেটা হল বিটনুন – আমলকী ও তার সাথে ধনে পাতা । এই মালের চাহিদা আগের চেয়ে বেশি ছিল। এই মুহূর্তে আরও যা যা মনে পরছে তার মধ্যে ছিল আমসত্ব , গুড়বাদাম ।অতবে এই দুই প্রোডাক্টের মধ্যে কিঞ্চিত মার্কেটিং স্‌ট্‌র্‌যাটেজী মিশে আছে এবং এই দুই প্রডাক্টের কোয়ালিটি ক®¾ট্রাল খুবই নিম্নমানের । কস্মেটিক্স ইন্ডাস্ট্রির মত ইহাও শুধু মাত্র বিজ্ঞাপন ও প্রচারের ওপর ভর করে অনেকদূর এগিয়ে গেছে । আগে ১০০ বা ২০০ গ্রাম ওজনের আমসত্বের টুকরো বিক্রী হত । তারপর কোনও ধুরন্ধর (বাঙাল হাওয়ার চান্সই বেশি) মস্তিষ্ক প্রসূত হল এই আইডিয়া যে চকোলেটের মত করে পুরিয়ায় আমসত্ব বিক্রী হবে, ১ টাকা পিস । সেই যুগান্তকারী ভিউ চেঞ্চের পর এখন হই হই করে আমসত্ব পুরিয়া বিক্রী হচ্ছে ট্রেনে । আফসোস এই যে দেশটি ভারত হাওয়ায় আইডিয়াটি পেটেন্ট করা যায় নি ! না হলে ভদ্রলোক আমেরিকান গৃহবধুর মত যিনি স্লাইস পাউরুটির পেটেন্ট নিয়ে কোটিপতি হয়েছিলেন টার মত হতেই পারতেন । ভাবলে অবাক হতে হয় যে পাউরুটি স্লাইস করে বিক্রীর আইডিয়ার জন্যে আমাদের বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে । তাতে যদি ঐ ভদ্রমহিলার পাঁচ ছটা ছেলে মেয়ে না থাকত, তাহলে হয়ত আমাদের অপেক্ষা আরও বাড়ত !

    যাই হোক ঐ আমসত্বের মধ্যে আমের ভাগ কিন্তু খুবই কম ছিল।অআপনি নিশ্চিন্তে ঐ আমসত্ব খেতে পারেন এই জেনে যে ওর সিংহ ভাগটাই কুমড়ো থেকে তৈরী – তার সাথে মিশেছে আম সেন্টেড কিছু কেমিক্যাল ।অআর ঐ গুড় বাদামের মধ্যে খারাপ কেমিক্যাল কিছু থাকত না, কেবল ভাল বাদাম-ভুয়ো বাদামের অনুপাত প্রায় ২০-৮০ হয়ে যেত ।

    ট্রেনে ডাব বিক্রীও এক যুগান্তকারী প্রচলন ।অপ্রথমদিকে সেই ডাব খাওয়ার পর ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলাই নিয়ম ছিল-কারন তাতে ট্রেন নোংরা কম হবে । চলন্ত ট্রেন থেকে ছোঁড়া ডাব হতে বেশ কিছু পাবলিক শহীদ বা হাসপাতাল জাত হওয়ার পর ডাব খেয়ে চেয়ারের নীচে রাখাটাই নিয়ম বলে চালু হল । ফলত ট্রেন বেশি নোংরা হতে শুরু করল । কোন পদ্ধতিটি সঠিক সেই বিষয়ে প্রথম দিকে ডেলি প্যাসেঞ্জার মহল আলোচনায় সরগরম থাকত । ট্রেনে আরও যে সব ফল পাওয়া যেত তার মধ্যে কমলালেবু ও পানিফলের খোসা পাবারই সম্ভাবনা বেশি ছিল ট্রেনের কামড়ায় । তবে সবচেয়ে বেশী ব্যাবহৃত ফল শসার খোসা কিন্তু ছড়ানো অবস্থায় খুব কম পাওয়া যেত। কারন বহুবিধ শসা মূলত হকারটি ছাড়িয়ে বিটনুন মাখিয়ে,কাগজে মুড়িয়ে প্যাসেঞ্জারের হাতে চালান করত । তাই খোসা থাকত হকারটির ঝুড়িতেই এবং সেই খোসার কুলিং এফেক্টটা হকার ব্যাবহার করত তার বাকী শসাকে ঠাণ্ডা রাখতে ।অআর দিনের শেষে জমা হওয়া খোসা সযত্নে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হত পোষা গরুর জন্যে ।অএকেবারে ইকো ফ্রেন্ডলি –গ্রীন অবস্থা যাকে বলে ।

    ট্রেনের ডাবের চলনের পেছনে কিন্তু খবরের কাগজের রূপচর্চা বা স্বাস্থ্য কলামগুলির অবদান অনেকখানি । কাগজ খুললেই দেখবেন কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়া অস্বাস্থ্যকর। তার বদলে ডাবের জল খান এই সব । আর তা ছাড়া সকালে ঘুম থেকে উঠে ডাবের জল দিয়ে মুখ ধুন, চোখের পাতায় শসার টুকরো রাখুন – এই সব তো ছিলই ।অতবে আমি আজ পর্যন্ত কাউকে ট্রেনের ভিতর ডাবের জল দিয়ে মুখ ধুতে দেখি নি । যদিও অনেককে ট্রেন থকে শসা কিনে বাড়ি নিয়ে যেতে দেখেছি , মনে হয় সে যতটা চোখের পাতায় দেবার জন্যে, তার ছেয়েও বেশী মুড়ি দিয়ে খাওয়ার জন্যে। এখন ডাবের পিস কত করে হয়েছে আমি জানি না-আমি এক কালে আমাদের গাছের ডাব পাইকারী দরে বিক্রী করতাম ১১০ টাকা ১০০ ডাবের জন্যে । সেই ডাব ৫ টাকা করে ট্রেনের কামড়ায় বিক্রী হত।অতাহলেই বুঝতে পারছেন লাভের মার্জিনটা কেমন ছিল ! আর আগে যেমন উল্লেখ করলাম, ডাবের প্রচলন হঠ করে যেন বেড়ে গেল ট্রেনে কোল্ড ড্রিঙ্কস বিক্রী কমে যাওয়ার পর । আগে গরম কালে ট্রেনে আকছার বরফ ত্রিপলের ব্যাগের মধ্যে নিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস বিক্রেতাদের দেখা যেত ।অএইসব কোল্ড ড্রিঙ্কস বর্ধমানের মেহেদীবাগানের দিকে তৈরী হত বলে আমার কাছে খবর ছিল । মানুষ যে ব্‌র্‌যান্ড দেখেই খাদ্য কেনে এবং মুল স্বাদ কেমন হাওয়া উচিৎ সে বিষয়ে প্রায়শই প্রত্যক্ষ কোনও জ্ঞান রাখে না , তা এই কোল্ড ড্রিঙ্কসের বিক্রী দেখেই বোঝা যেত। ঐ সব প্রোডাক্টই যে নাকল তা বোধগম্য হতে হতে বহু লোক মাটির বাড়ি থেকে দোতলা পাকা বাড়ি হাঁকিয়ে নিয়ে ছিল ।

    ডাব বিষয়ে আমার বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে –অন্যত্র বলা যাবে ডিটেইলসে তবে এখানে একটা ছোট্ট ব্যাপার বলে রাখি ।অআমাদের সময়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দুই হাফে হত, দিনে দুটো পেপার ।অতা মাঝের ব্রেকটায় গার্জেনরা টিফিন আনতেন – এবং এপ্রিল মাস নাগাদ পরীক্ষা হবার জন্যে পরীক্ষার্থীর মাথা ঠাণ্ডা করার জন্যে ডাব । বাবা মা ডাব ধরে আছে আর ছেলে স্ট্র দিয়ে ডাবের জল টানছে ,চোখ হাতের নোট বইয়ের দিকে ।অএমন দৃশ্য তখন অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল । সবার দেখাদেখি আমার বাপও দ্বিতীয় দিন গাছের একটা ডাব নিয়ে টিফিনের সময় হাজির । তা দেখে আমি যা শক পেয়েছিলাম তাতে ইংরাজী দ্বিতীয় পত্রে আমার ১০ নম্বর মত কমে গিয়েছিল প্রায় ।

    এখন গরমকালে ট্রেনে যেটা সহজলভ্য তা হল বিমলের দই লস্যি (সলিড দণ্ডাকৃতি), তরল দইলস্যি (বাড়িতে বানানো),ও কাঁচা আমের সরবত(বাড়িতে বানানো),অনেকে আবাব কায়দা করে আম পোড়ার শরবতও বিক্রী করতেন । এই সব মালে প্রফিট মার্জিন খুবই বেশী- রঙ বা কেমিক্যাল প্রয়োগের কথা বলতে পারব না ,তবে স্বাদে সেই- তিনটাকার প্ল্যাস্টিক প্যাকেটের শরবত , OHCALCUTTA রেস্টুরেন্টের ১৩০ টাকা গ্লাসের শরবতের কাছা কাছি ছিল । দণ্ডাকৃতি দই-লস্যি একটি বিবর্তিত প্রডাক্ট- এবং যথারীতি বাঙাল মস্তিষ্ক প্রসূত । বিমলের বাড়ি বৈঁচির কাছাকাছি- সকাল ৮ টার ডাউন লোকালে মাল এসে ষ্টেশনে ষ্টেশনে নেমে যায় একটা বড় বাক্স করে । সেখানে তাব্‌ৎ হকার জড়ো হয় মাল কেনার জন্যে-সাদা শোলার পেটিতে । ১০০ পিস মাল বিক্রী করতে পারলে ৩০ টাকা কমিশন । দিনের শেষে গলে যাওয়া অবিকৃত মাল কারখানায় পুনরগমন সলিড হাওয়ার জন্যে । এই ভাবেই চক্রাকারে ঘুরতে থাকে দই-লস্যি ।অআপনি যে দই-লস্যিটি কিনলেন সেটা কতদিনের পুরনো আপনি জানতে পারবেন না। লাকি হলে আপনি একটা পুরনো মাল পেতেও পারেন কারন দই-লস্যি যত পুরনো হবে , তত গেঁজবে ও তার স্বাদ খুলবে ।অদই-লস্যির ব্যাবসা রম রম করে চলে গরম কালে – আমরা লোকাল ছেলে হবার জন্যে মাঝে মাঝে দু একটা গ্যাঁজানো দই- লস্যি ফ্রী পেতাম , যদিও এই বস্তুটি আমাদের তেমন আকর্ষণ করত না তার উৎপত্তি ও গমন পথ সম্পর্কে সম্যক ধারনা থাকা হেতু ।

    আরও দুটি খাদ্য বস্তু যা আমাদের জীবনে খুব ভালো ভাবে জড়িয়ে ছিল এবং ট্রেনের কামরায় দাপটের সাথে বিচরন করত তা হল খেঁজুর ও শনপাপড়ি । ‘খেজুরে আলাপ’ কথাটার সারমর্ম আমরা খুব গভীর ভাবেই ছোটবেলায় অনুভব করে ফেলেছিলাম । নিমো ষ্টেশন মাস্টার আমার নিজের জ্যাঠা তাই সেই সুত্রে রেল টিকিট কাউন্টারে অবাধ বিচরণ । আমাদের গ্রামে তখন বিদ্যুত ছিল না এবং ঐ টিকিটঘরই ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে টিউব লাইট জ্বলত। ঘরের আয়তন বেশ বড় – অ্যাসবেসটস চাল, এক কোণে টিকিট রাখা দেওয়াল খাপ ও তার পাশে পাঞ্চ মেশিন। বাকি পুরো ঘর ফাঁকা – সেই ফাঁকা জায়গা ব্যবহৃত হত ট্রেনের হকারদের ঝাঁকা রাখার কাজে। আমার জ্যাঠা সেই জায়গা ভাড়া দিয়ে টু-পাইস কামাত কিনা বলেতে পারব না, তবে জ্যাঠার ছেলেদের দেদার ফলমূল খেতে দেখেছি। সেই সব ফলই ঝাঁকা থেকে আসত – লেবু, আপেল, বেদানা সহ প্রচলিত সব ফলই প্রায়। তা সেই ঘরে খেজুরের প্রসেসিংঅও চলত। যাঁরা দোকান থেকে বা ট্রেন থেকে কোয়া কোয়া ইণ্ডিভিজুয়াল খেজুর খান তাঁদের সম্ভবত কোন ধারণা নেই যে ঐ খেজুর বাংলায় কিভাবে আবির্ভূত হত! খেজুরের স্ল্যাব বস্তায় (আমরা বলতাম ‘চিকচিকি’ বস্তা, পরে জানলাম উহার নাম ‘নাইলন’) করে – ইনফিনিট নাম্বার অফ খেজুর চাপসৃষ্ট অবস্থায় জড়াজড়ি করে এক আয়তকার স্ল্যাব তৈরী করত। সেই বস্তা হাজির হত টিকিটরুমে আমরা ছোটরা ভলেয়েন্টারী সার্ভিস দিয়ে খেজুর সেপারেট করতাম। আমাদের মজুরী ছিল পেটভর্তি খেজুর খেতে পারা। এটা চাইল্ড লেবার এর আওতায় পড়ে কিনা বলতে পারব না, তবে সেই কাজ আমরা আনন্দের সাথেই করতাম। খেজুরের চাঙরগুলিকে বালতির জলে ডোবাও ও আলাদা কর – প্লেন এয়ণ্ড সিম্পিল! সেই আলাদা করা খেজুর খোলা বিক্রি বা প্যাকেট করে বিক্রী হত মধ্যপ্রাচ্য বা মরুদেশীয় বিভিন্ন দেশের নামাঙ্কিত হয়ে। এটা খুবই স্ববাভিক ছিল যে একই বস্তার খেজুর চারটে আলাদা দেশের নামে চিহ্নিত করা হল – সেই ক্ষেত্রে আমাদের ভোগলিক জ্ঞান কাজে লাগানো হত। তবে মানুষের জেনারেল নলেজ সীমিত বলে অনেক সময় নামকরণের হ্যাপার মধ্যে না গিয়ে, ‘আরব’ দেশের খেজুর বলেও চালানো হত।

    তাহলে বাকী রইল শোনপাপড়ীর গল্প – এই এমন এক ব্যাবসা যা বিগত ৩০ বছর ধরে স্থিতাবস্থায় রয়েছে – যাকে বলে onlychangeisconstant টাইপ আর কি! শোনপাপড়ী তৈরী এক খুবই আকর্ষনীয় ব্যাপার। ইন ফ্যাক্ট তৈরী দেখতে খুবই ভালো লাগে – যে জিনিসটা সব খাবারের ক্ষেত্রে বলা যায় না। ধরুণ মাখা সন্দশ তৈরী – এটা খুবই ক্লান্তিকর একটা ব্যাপার। আমাদের নিমো স্টেশন সংলগ্ন ক্লাবের একটা বড় ঘর তেমনই এক শোনপাপড়ী কারিগরকে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। ‘দিলীপের’ শোনপাপড়ী নাকি কি যেন একটা নাম ছিল। ভাই বলব কি, সে ব্যাবসা বিশাল ফুলে উঠেছিল। আমি খুবই সিওর যে যাঁরা এই লেখা পড়বেন তাঁদের কারো কারো পেটে ঐ শোনপাপড়ী চালান গেছে। প্যাকেটস্থ হবার পর সেই শোনপাপড়ী দেখতে খুবই ভালো, সোনালী রঙের। কিন্তু যে পাত্রে বা পরিবেশে মাল তৈরী হত তা প্রায় কহতব্য নয়। ঐ শোনপাপড়ী খেয়ে যাদের পেটে কিছু হয় নি, তাঁরা নির্দ্ধিধায় অন্য যে কোন খাবার না ধুয়েই মুখে চালান করতে পারেন। আমাদের ক্লাবে পিকনিক হলে আমরা ঐ শোনপাপড়ী তৈরীর পাত্রগুলো অনেক সময় ব্যবহার করতাম। পাঁচ টাকা প্যাকেট ছিল তখন শোনপাপড়ীর । উত্থান ও পতন যেহেতু জাগতিক নিয়ম, তাই প্রাকৃতিক নিয়মেই একদিন সেই শোনপাপড়ী কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। মালিকের ছিল জুয়া দোষ – একদিন প্রায় সব খুইয়ে সে উধাও। তার কর্মচারীরাও কিছুদিন অপেক্ষা করে বিদায় নিল – আমাদের গ্রামের কিছু মেয়ে প্রেমিক হারা হল। সে এক জটিল সমাজতাঙ্কিÄক গল্প – ডেটেলসে অনত্র। আমাদের লাভ বলতে হয়েছিল সেই ফেলে যাওয়া বাসনপত্র ও মাল বইবার একটা তিনচাকা রিস্কা ভ্যান, সেই ঘটনা পরের পর্বে।

  • siki | 122.177.217.207 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ০০:৪৬530397
  • এর আগের সাতটা পর্ব কোথায়?
  • siki | 122.177.217.207 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ০০:৪৮530408
  • শোনপাপড়ি আজও পাঁচ টাকা প্যাকেট। ব্যান্ডেল লোকালে দেখে এলাম।
  • Suki | 80.254.147.204 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১৩:৫০530419
  • সিকিদি,
    লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। এর আগের এবং পরের পার্টগুলি আছে, কিন্তু কোথায় দেব, কেউ আদৌ পড়বে কিনা এই সব ভাবে আর পোষ্ট করি নি।
    যাই হোক, এখনও শনপাপড়ী পাঁচ টাকা প্যাকেট আছে জেনে খুবই ভালো লাগল - কি ভাবে যে এরা এতোদিন ধরে দাম কনস্ট্যান্ট রেখেছে কে জানে!
  • phutki | 121.241.218.132 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১৪:০১530430
  • সিকি "দি"!!!!!!!
    হোয়াই দিস.............. দি! :-)
  • Suki | 80.254.147.204 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১৫:৫৯530441
  • ইয়ে খুবই ভুল হয়ে গেছে - তাহলে কি ওটা "দি - সিকি" করে দেব? মানে যেমন 'দি সান' , 'দি-মুন' চিরন্তন সত্য টাইপের ব্যাপার। কিন্তু এখানে তো এডিট করার কোন উপায় নেই মনে হচ্ছে!
  • Lama | 117.194.240.99 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১৬:০৪530444
  • হাঁউ মাঁউ খাঁউ।
    সু** ঘো*র গন্ধ পাঁউ
  • Manish | 59.90.135.107 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১৮:৩৪530445
  • সুকি, আপনি এই টইতেই লিখুন। এখানে প্রচুর আমার মতো নীরব পাঠক আছে।
  • kiki | 59.93.203.14 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১৯:০১530446
  • আহা! দিলখুশের জন্য প্রানটা কেমন হু হু করে উঠলো।:(
  • Suki | 80.254.147.196 | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ২১:৩৮530387
  • এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা – ৯ (বনভোজন পর্ব)

    অনেক বয়স হবার পর কোন এক কবির লেখায় যেন এমন কয়েকলাইন পড়েছিলাম –“ডাক্তার জানে না, আমার অসুখের নাম পিকনিক”। যে রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে শতকরা ৬০ ভাগ লোক পেটের রোগের চিকিৎসা করাতে আসেন সে রাজ্যেরই এক কবি যে এমন কথা লিখবেন সে আর আশ্চর্য কি! তবে ডাক্তারের না জানার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, অন্তত: আমাদের দিকের ডাক্তাররা আমাদের অসুখের উৎপত্তি ও নিরাময় দুইই জানত বেশ ভালো করে।

    আর পাঁচটা বালকের মত আমাদের ছোটবেলাটাও পিকনিকের সাথে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে ছিল। পিকনিকের বাঙলা প্রতিশব্দ কি? কাছাকাছি রয়েছে চড়ুইভাতি ও বনভোজন। চড়ুইভাতি শব্দটির মধ্যে কেমন যেন একটা সখি সখি ভাব লেগে আছে। ম্যাচো ভাবটা কম, তাই একটা বয়সের পর আর চড়ুইভাতি করা যায় না যতক্ষন না আর একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছানো যাচ্ছে। আমাদের দিকে রেঞ্জটা ১০-৬০ বছরের মধ্যে ছিল। আর বনভোজন বাঙালী আতেঁল ও কলকাতাবাসী লোকেরা করে বলে আমাদের ধারণা ছিল। আমরা করতাম Feast– শব্দ ভেঙে ভেঙে ‘ফিষ্টি’ তে পৌঁছেছিল। আমাদের গ্রাম্য বাল্য জীবন যখন নিস্তরঙ্গ ও বর্ণহীন হয়ে আসত মাঝে মাঝে (আলু ও ধানের ফলন বা দাম ভালো না থাকলে) তখন এই ফিষ্টি নামক মোচ্ছবটি আমাদের এক্সট্রা প্রাণবায়ু ইনজেক্ট করত। ফিষ্টি বিবর্তন নিয়ে রীতিমত এক থিসিস ফেঁদে ফেলা যায় সোস্যাল সাইন্সে।

    যে কোন উপলক্ষেই ফিষ্টি হতে পারত – তবে বয়সের উপর নির্ভর করে স্থান ও কাল বদলেছে, পাত্র প্রায় একই থেকে গেছে। খুব ছোটবেলায় ফিষ্টির হাতেখড়ি হয়েছিল ঝুলন খেলার মধ্যে দিয়ে। আমরা ছোটরা নিজেদের খেলনা জড়ো করে ঝুলন পাততাম ও বড়দের কাছ থেকে পয়সা আদায় করতাম। ঝুলনের শেষে সেই টাকা দিয়ে ফিষ্টি হত। মেনু খুবই সিম্পল থাকত – কোন বছর লুচি-ঘুঘনি ও ত্‌ৎসহ মিষ্টি। আবার কোন বছর ভাত-মাংস। বাড়ির পিসি ও মায়েদের দল সব কিছুর ভার নিত, আমরা শুধু খেয়েই খালাস। মনে আসে তখন বাড়ীতে মুরগীর মাংস রান্না হত না, ফলত: পাঁঠা বা খাসি খেয়েই আমরা বড় হয়েছি (দূর্জনেরা বলেন অনুরূপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট লাভ করেছি)। ছোটবেলার ফিষ্টি সব অর্থেই নিরামিষ ছিল। পিকনিক তার প্রকৃত রূপ খুলতে শুরু করল ক্লাস নাইন-টেন উঠার পর থেকে। স্থান পরিবর্তিত হল – বাড়ি থেকে ফিষ্টির স্থান সরে গিয়ে গ্রামের ইস্কুলবাড়িতে।

    আমাদের গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের স্থানমাহাত্ম আমাদের কাছে কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, তিরুপতি বা ইডেন গার্ডেনসের মতই ছিল। গ্রামের একপ্রান্তে এই স্কুলের চত্তরেই আমাদের বেশীর ভাগ ফিষ্টি সম্পন্ন হত। সামনেই ছিল এক প্রকাণ্ড পুকুর ও খালি মাঠ, আর স্কুলের ভিতর ছিল এক বকুল গাছ। তাই প্রাক বৈদ্যুতিক যুগে সন্ধ্যের পর সেই স্থান এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করত। আবার গ্রামের একধারে হবার জন্য জলীয় দ্রব্য পানেরও অসুবিধা হত না আমাদের। প্রত্যেক বড় পূজা সম্পন্ন হবার পর একটা ফিষ্টি বাঁধা ছিল – ভাবটা এই ছিল যে, পূজার আয়োজন (বাজনা ও মাইক ভারা করা এবং বিজর দিন নাচা) সম্পন্ন করে পাবলিক খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে এবং রিল্যাক্সের জন্য একটু খাওয়া-দাওয়া দরকার।

    প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে এ সবই হত ব্যাচ সিষ্টেমে। যেমন আমাদের বাবা/কাকাদের একটা গ্রুপ ছিল, তার পরের জেনারেশনের একটা গ্রুপ, তার পরে আরো একটা এবং তার পরে আমরা। ঐ ইস্কুল বাড়িতে সব গ্রুপই ফিষ্টি করত। খাদ্য বস্তু বা মেনু মূলত: এক থাকলেও, পার্থক্য থাকত পানীয় ও ধূমপান লিমিটে। আমাদের আগের গ্রুপটি ধেনো (দেশী মদ) ও গাঁজা প্রেফার করত। আমাদের ব্যাচে প্রথমে শুরুর দিকে (হাতেখড়ির সময়) চালু ছিল থ্রি-এক্স রাম ও অফিসার চয়েস। হুইস্কি তখন বুঝতাম না, তা সেই নিয়ে মাথাব্যাথাও তত ছিল না। অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে পছন্দের এনভেলপ প্রসারিত হতে শুরু করে – রয়েল স্ট্যাগ দুরদার করে জীবনে অনুপ্রবেশ করে। আমাদের ব্যাচ আবার গাঁজা খুব একটা পচ্ছন্দ করত না – কোন এক বিশেষ কারণ বশত: পক্ষপাতিত্ব ছিল খৈনীর দিকে। আর তা ছাড়া রাতের দিকে ফিষ্টি শুরু হবার আগে অনেককেই দেখতাম ‘তাড়ি’ খেয়ে চূড় হয়ে আছে। আমরা যখন ক্লাশ ১০-১২ তে পড়ি তখন তাড়ির চল নিদারুণ বেড়ে গিয়েছিল। সুজনেরা বলে এর পিছনে আমাদের দুক বন্ধু আলম ও মনসার অবদান সবিশেষ। যাদের জানা নেই (অর্থাৎ দূর্ভাগার দল) তাদের অবগতির জন্য জানাই তাড়ি তৈরী হত তালরস গেঁজিয়ে। গরমের দিনে ভোরের দিকে তালরস সত্যই সুস্বাদু। তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে গরমে মাল গেঁজে উঠত। আর সেট জিনিস তূরীয় হত বেলা দুটো-তিনটের দিকে। গরম কালে ঘরের ভিতর দুপুরে আমরা এমনিই কেউ ঘুমুতে পারতাম না – আশ্রয় হত মূলত: বাগানগুলিতে। সেই সব আম বা গাব গাছের ছায়ায় বসে তালরস পানের মজাই আলাদা। কলকাতার আতেঁলরা বছরে একবার সেই তালরস শান্তিনিকেতনের দিকে খায়ে সারা বছর তার ঢেকুর তোলে আর সাহিত্য পয়দা করে। যাঁরা পার্কস্ট্রীটের পাবগুলিতে গিয়ে পরের দিন অফিসে ফাট্টাই মারেন তাঁদের জেনে রাখা ভালো যে নেশার জগতে খুব অল্পটাই তাঁরা ছুঁতে পেরেছেন – অন্তত: আবহের দিক থেকে। গোমড়া মুখো বারটেণ্ডারের বীয়ারের গ্লাস এগিয়ে দেওয়া আর শ্যামা বা বুধোর মায়ের মাটির ভাঁড়ে (বা গ্লাস) করে তাড়ি এগিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেকটাই পার্থক্য। এর সাথে যোগ করুন ফুরফুরে প্রাকৃতিক হাওয়ার অ্যাডভাণ্টেজ!

    তাড়ি ছিল গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে সহজলভ্য ও সস্তা নেশার পানীয়। তাড়ি পান ঠিক আছে – কিন্তু তৈরী হত সেই সেবনের পর মাঠে ফুটবল খেলতে নামলে। তাড়ি খাবার পর যে ঘাম হয় তার দূর্গন্ধ অস্বাবাভিক। ড্রাগটেষ্টের ব্যাপার না থাকায় অনেক ফুটবল ম্যাচ আমরা তাড়ির জোরে জিতেছিলাম। তার যতটা না নেশাগ্রস্ত হয়ে অকুতভয় খেলার জন্য, তার থেকেও বেশী ঘামের দূর্গন্ধের জন্য। বিপক্ষ প্লেয়ার কাছে আসার সাহসই পেত না!

    আমাদের গ্রামের সব ব্যাচেরই ফিষ্টির মেনু ছিল প্রায় ওয়ান ডাইমেনশনাল। ভাত, একটা তরকারী, মাংস ও শেষ পাতে চাটনী-মিষ্টি। ফাণ্ডের অবস্থার উপর নির্ভর করে মাংসের রকমফের হত, খাসী নয়ত মুরগী। মুরগী আবার দুই প্রকার, দেশী ও পোলট্রী। ফাণ্ডের অবস্থা শোচনীয় হলে তবেই পোলট্রী মুরগী কেনা হত। আর সিজিন অনুযায়ী রকমফের ঘটত তরকারীর। শীতকালে জনপ্রিয় ছিল বাঁধাকপি। তবে তরকারী কেন যে করা হত আমি সেটা আজও বুঝতে পারি নি। ফিষ্টি সময় তরকারীর ভূমিকা কোন প্রতিযোগীতার তৃতীয় স্থান নির্ধারক ম্যাচের মত – কোনই গুরুত্ব নেই, শুধু করতে হয় বলে করা। পোলট্রী মুরগীর দাম ৩৫ টাকা কেজি দিয়ে বহুযুগ আগে ফিষ্টি শুরু করার পর এখন তা ১২০ টাকায় পৌঁছেছে। পোলট্রী মুরগী পাওয়া বা কেনা সহজ – ওরা প্রায় শহীদ হয়েই আছে মাংসের ভারে। সমস্যা হত দেশী মুরগী সংগ্রহ করা নিয়ে। ফিষ্টির দলে কতকগুলি সদস্য ছিল যারা বাড়িতে মুরগী পুষত, আর স্বাবাভিক ভাবেই তারাই প্রাইম টার্গেট থাকত মুরগী সাপ্লাই দেবার জন্য। মুরগী সংগ্রহ ব্যাপারটাই ছিল বেশ রোমাঞ্চকর, অনেক সময় খাওয়ার থেকেও বেশী। এমন সময় গেছে যখন সন্ধ্যাবেলা মুরগী খুঁজতে বেরিয়েছি রাতে ফিষ্টির জন্য। বাড়ি বাড়ি ঘুরছি – এয়াই মুরগী বিক্রী করবে তোমারা? হয়ত কেউ বলল হ্যাঁ করব – তখন শুরু হল মুরগী ধরার পালা। সেই মুরগী আম গাছের ডগায় ঝিম মেরে বসে আছে। নিকষ অন্ধকারে আমগাছের ডাল বেয়ে চুপিসারে মুরগী ধরতে উঠছি এ দৃশ্য খুবই স্বাবাভিক ছিল এককালে। আর আমরা যেহেতু গ্রামের ছেলে ছোকরার দল ছিলাম এবং সবাই নিজেদের গাছের/বাগানের ফল-মূল ইনট্যাক্ট রাখতে চাইত – তাই প্রায়শ:ই জিনিস কিনতে গিয়ে আমাদের একটা কথা শুনতে হত, “যা, তোদের কেনা দামে দিয়ে দিলাম”। কেনা দামটা যে কি আর যে বাড়িতে পোষা মুরগী বিক্রী করছে তার কাছে কেনা দাম কি ভাবে প্রযোজ্য হয়, সেটা আন্দাজ লাগাবার বৃথাই একটা চেষ্টা দিতাম। মুরগী ধরার পর ছাড়ানাও এক হ্যাপার কাজ। সৌভাগ্য বশত: বেশ কিছু সুদক্ষ সার্জনও ছিল আমাদের দলে।

    মুরগী ছাড়ানোর মধ্যে কোন পৈশাচিক আনন্দ আছে কিনা বলতে পারব না, তবে আমাদের সার্জেনদের দেখতাম বেশ তারিয়ে তারিয়ে অথচ ক্ষিপ্রহস্তে মুরগী নিধন করছে। দলের ফিষ্টিতে বেশির ভাগ সময় রান্না আমিই করতাম। যৌথ পরিবারে মানুষ (!) হবার জন্য খাবার-দাবার ভাগ-বাটোয়ারা বিষয়ে আমার ধারণা বেশ স্বচ্ছ ছিল। ফলত: ছেলেরা সানন্দেই আমার হাতে রান্না ও মাংস ভাগের দায়িত্ব ছেড়ে দিত। মুরগী রান্না আদপেই সোজা কাজ, কারন মাংস প্রায় স্বয়ংসিদ্ধই বলা যেতে পারে – তাও আবার যদি মাতালদের উপযোগী রান্না করতে হয়। সবচেয়ে বেশী বিতর্ক অবশ্য মাংস ভাগ নিয়ে বা রান্না পদ্ধতি নিয়ে নয়, মাংস ধোয়া হবে কিনে সেই নিয়ে হত। অনেকের মতে মাংস ধুলে তার স্বাদ নাকি চলে যায় – এটা আবশ্য পরিক্ষীত সত্য নাকি মাতাল জিহ্বার ইলিউশন তা বলতে পারব না। গড়পড়তা হিসাবে জন প্রতি ২৫০ গ্রাম মুরগীর মাংস ধরা হত, খাসী হলে সেটা কমে দাঁড়াত ২০০ গ্রাম। মাংস মেখে নেওয়া হত তেল, নুন, মশলা, টক দই, আদা-রসুন বাটা ইত্যাদি দিয়ে। তারপর গরম তেলে পেঁয়াজ ছেঁকে আলাদা করার পর, সেই ছাঁকা তেলেই মাংস কষে নেওয়া হত। আলুর রকমফের অনুসারে তা আগে ছাঁকা হত বা ডাইরেক্ট ঝোলে দেওয়া হত। মাংস কষা হলে জল দিয়ে ফোটানো এবং প্রায় সিদ্ধ হয়ে এলে তাতে গরম মশালা দিয়ে ঘেঁটে দেওয়া।

    মাংস রান্না বা ফিষ্টি করতে গেলে উনুন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এখন আমাদের দিকে এই সব কাগের জন্য গ্যাস সিলিণ্ডার সহ ওভান ভাড়া পাওয়া যায়। তবে আগে আমরা উনুন নিজেরাই বানিয়ে ফিষ্টি করতাম। উনুন তৈরী ও তা ধরানোর দায়িত্বে থাকত ‘হাবা’– সে একাজে অভূতপূর্ব পারদর্শিতা অর্জন করেছিল। জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হত মূলত কাঠ ও ঘুঁটে, শুরুতে কেরোশিনের সাহায্য। পরে যখন সমাজ এগোয়, তখন আমরা কাঠের উনুন থেকে কেরোসিনের স্টোভে সিফট করে গিয়েছিলাম। হাবা এতে হালকা দু:খ পেয়েছিল, তবে এর পরেও কেরোসিনের স্টোভটি সেই নিয়ে আসত ও ধরাত।

    কাঠের অভাব খুব একটা আমরা অনুভব করি নি। আমাদের নিমো স্টেশনে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলি রেল কাটতে শুরু করে কোন এক সময়। আমার মেজো জ্যাঠা তখন সদ্য চাকুরী থেকে রিটায়ার করে সারাদিন কি করবে ঠাওর করতে না পেরে পাগলের মত কাজ (বা অকাজ!) খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাই জ্যেঠু গ্রামের বালক সম্প্রদায় কে নিয়ে গাছ বাঁচাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পরে। যে কয়টা গাছ কাটা হয়েছিল সেগুলি পড়ে রইল – রেল বাকি গাছ কাটা বন্ধ করল। এখন ঘটনা হচ্ছে ঐ কাটা গাছগুলির কি হবে? আমাদেরই গ্রুপের রবি কাঠমিস্ত্রীকে ধরা হল সেগুলি কেনার জন্য। রবি বিজনেসের সময় বিজনেস বলে শুধু মোটা গুঁড়িগুলো কিনল – বাকি থাকল গুচ্ছের ডাল পালা। সেট কাঠ বিক্রির টাকায় ফিষ্টি হল এবং তার পরের অনেক ফিষ্টিরই জ্বালানি ঐ পড়ে থাকা ডাল পালা সাপ্লাই করেছিল। অপ্রাসঙ্গিক, তবু জানিয়ে রাখা ভালো রবি সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের খাট বানিয়ে কাঠাঁল কাঠের খাট বলে এক স্বদেশীয় বিহারীকে বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছিল। গ্রামে রেলের প্রতিনিধি ছিল স্টেশন মাষ্টার আমার সেজ জ্যাঠা যাকে বলা হইয়েছিল যে গাছ বিক্রির টাকা “নিমো ভারত সেবক সমাজ” (আমাদের গ্রামের ক্লাবের নাম) এর উন্নতিকল্পে লাগানো হবে। জ্যাঠা আমাদের ভাবগতিক সম্পর্কে অবহিত থাকার জন্য পরে আর উন্নতি বিষয়ক কোন খোঁজ নেয় নি।

    আগের পর্বে আমাদের ক্লাবে শোনপাপড়ী কারখানা খোলা ও তা উঠে যাবার কথা লিখেছিলাম। তা সেই কারখানা উঠে যাবার পর পড়ে থেকে একটা বাঁশের আটচালা যেখানে মাটির উনুনে রস জ্বাল দেওয়া হত। আর পড়ে ছিল একটা মাল বইবার তিন চাকার ভ্যান রিক্সা। একবার বর্ষাকালে ফিষ্টির স্থান পরিবর্তন করে স্কুল বাড়ি থেকে ক্লাবে নিয়ে আসা হয় ঐ উনুনের সুবিধা নেবার জন্য। দ্বিতীয়বার সেই জায়গায় ফিষ্টি করতে গিয়ে রাত দশটা নাগাদ জ্বালানীতে টান পড়ল – পাবলিক তখন প্রায় মাতাল। তাই তারা আর কাঠের সন্ধানে অন্য কোথাও না গিয়ে সেই বাঁশের চালাটাই ভেঙে জ্বালানি করতে শুরু করে। সেই দিন মাংস পাঁঠার হবার জন্য পুরো চালাটাই লেগে যায় মাংস সিদ্ধ করতে। তাও সেই শোনপাপড়ী কারখানার স্মৃতি আরও কিছুদিন ছিল যখন আমরা সেই ভ্যান রিকশা নিয়ে ফিষ্টির বাজার করতে বেরোতাম। পরের একবার ফিষ্টিতে সেই রিস্কার কাঠের ফ্রেমও জ্বালানি হইয়ে যায়, ততসহ কারখানার শেষ স্মৃতি।

    একবার ঠিক হল মেনুতে বৈচিত্র আনতে হবে মাছের কোন একটা আইটেম করে। কেউ বিয়ে বাড়িতে তখন সদ্য বাটার ফ্রাই খেয়ে এসেছিল, সেই প্রস্তাব দিল যে বাটার ফ্রাই হোক তাহলে। আমাদের মধ্যে ম্‌ৎস-সম্রাট শুভর কাছে অর্ডার হল টাটকা তোপসে জোগাড়ের জন্য। শুভ করিতকর্মা ছেলে, ১০০-১৫০ গ্রাম সাইজের মাছ সে জোগাড় করে ফেলে – তারপর সেই মাছ বেসনে (সোডা মেশানো) ডুবিয়ে ভাজা। সে এক দেখার মতন দৃশ্য – সবাই (ইনক্লুডিং মাতালেরা) উনুনের চারিদিকে গোল হয়ে বসে মাছ ভাজা দেখছে, আর আমি মাছ ভাজছি। টেষ্ট করতে করতেই মাছ প্রায় শেষ হয়ে যাবার জন্য খাবার পাত পর্যন্ত আর সেই বাটারফ্রাই পৌঁছয় নি।

    রান্নার সময় আর একটা প্রধান ঝামেলার সৃষ্টি হত ঝালের পরিমাণ নিয়ে। চারপাশে দাঁডিয়ে পড়ল সব – এ বলে আর একটু গুঁড়ো লঙ্কা দাও মাংসে, তো ও বলে একদম বেশী দিও না! প্রায়শই ব্যাপারটা ফ্রেণ্ডলি মারামারির পর্যায়ে চলে যেত। যে বেশী ঝাল খেতে পারত না তাকে বলা হত রসগোল্লার পড়ে থাকা রসটা তুই পাবি!

    গ্রামের বাইরে আমরা ফিষ্টি করতে যেতাম মূলত শীতকালে, মানে যখন আর সবাই যায় আর কি। আমাদের যাবার জায়গা একটাই ছিল – দামোদরের ধার। আমাদের গ্রামের থেকে দামোদর ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যে ছিল। হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে পাল্লা রোড বলে একটা স্টেশন আছে যেটা ফিষ্টির জায়গা বলে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছিল। এর কারণ মূলত আশির দশকে সেখানে হওয়া একাধিক বাংলা সিনেমার শুটিং – পাল্লা রোডের ডাকবাংলোকে তাপস-শতাব্দী বিখ্যাত করে দিয়েছিল। তবে সত্যি কথা বলতে কি, জায়গাটা শীতকালে প্রকৃতই মনোরম হত। দামোদরের জল প্রায় শুকিয়ে আসা – ফুরফুরে বাতাস, মিঠে রোদ, আর নদীর চড়াতে ফিষ্টি। আমরা গ্রাম থেকে যেতাম ট্রাক্টরে করে, ক্লাবের সদস্য প্রায় জনা ৫০ ছিল। মাল পত্র তুলে নিয়ে সকাল সকাল রওনা – মাঝে মাংস এবং মদ কেনার জন্য স্টপ। তবে আমি এত্যো পাবলিকের রান্না করার সাহস পেতাম না, তাই গ্রামের গোপাল ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হত।

    গোপাল ঠাকুর বা তার সহকারী বুধো কলুর সাথে আমাদের একটা দুষ্ট মিষ্টি সম্পর্ক ছিল। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে এরা আমাদের ফিষ্টিতে রান্না করতে আসত কোন রকম ফিনান্সিয়াল লাভের আশা ছাড়াই। শীতাকাল হলেই ওরা জিজ্ঞাসা করতে শুরু করত, কি রে তোদের ফিষ্টি কবে? সেই বুঝে অন্যদের ডেট দেব। পাবার মধ্যে ভাগ্য ভালো হলে গোপাল ঠাকুর বেঁচে থাকা তেল, গরম মশলা, বা জিরে-ধনে গুঁড়ো একটু বাড়ি আনতে পারত। বুধো কলু কেবল একটু মাংসের ঝোল ছেলের জন্য নিয়ে যেত – মাতালরা বিশ্বভাতৃত্ববোধের ইউনেস্কো দূত হতে পারে সেটা আমাদের পিকনিক থেকে ভালো বোঝা যেত – পাবলিক যতই মাতাল হোক, বুধো তার ছেলের জন্য মাংস নিয়ে যেতে পারে নি কোনবার সেটা হয় নি। তবে একবার ফেরার পথে ওদের রান্নার হাতা-খুন্তি নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল – সবাই এটা জানে যে হালুইকরেরা নিজেদের বড় বড় হাতা ও খুন্তি নিয়ে রান্না করতে আসে। আর আমাদের পিকনিকের থেকে ফেরার সময় একটা রুটিন ছিলে যে বাকি রান্নার জিনিসপত্র একেবারে ডেকরেটারের ঘরে নামিয়ে বিল মিটিয়ে ঘরে ফেরা। তা সেইবার ফেরার সময় কারো কাছে আর বিল মেটাবার টাকা ছিল না – ফলে গোপাল ঠাকুরের রান্নার ফেমাস খুন্তি-হাতা গুলি বন্ধক রাখার তোড়জোর করা হয় – এর ফলে গোপাল ঠাকুর খুবই রেগে গিয়েছিল – কিন্তু তা সঙ্কেÄও পরের বছর পিকনিকে যথারীতি হাজির হয়।

    সারাদিন পিকনিকে গেলে একটা জলখাবারের ব্যবস্থাও করতে হয় সকালের দিকে – আমাদের সময় সেটার প্রায় ফিক্সড মেনু ছিল মুড়ি, ছোলা ছাঁকা, বেগুনী, ঘুঘনী। কেউ একবার লুচি চালু করতে চায়, তাকে যথারীতি আতেঁল বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে রুটি-ঘুঘনী হয়েছিল কোন কোন বার জলখাবার হিসাবে – কিন্তু শীতকালে ক্রীকেট টুর্ণামেণ্টগুলিতে ওটা পেটেণ্টেড মেনু থাকার জন্য আর কেউ রিপিট করতে চাইত না সেই একই খাবার। ক্রীকেট টুর্ণামেণ্ট ও ততসহ খাবার দাবার বিষয়ে একটা আলাদা পর্ব লিখব, না হলে আমাদের যৌবনের সাথে অন্যায় করা হবে। সেই ফিষ্টির মেনুও কিন্তু একই ছিল প্রায় – মাঝে মাঝে ফ্রায়েড রাইক মাংস মেনুতে উচ্ছাস বয়ে আনত। রান্না ছাড়াও আরো একটা বড় কাজ ছিল ঐ ফিষ্টির সময় মাতাল সামলানো – জলে ডুবে মারা যাবার ঘটনাও আছে – তাই সর্তক থাকতে হত যে পাবলিক যাতে ক®¾ট্রালে থাকে। যারা মাল না খেয়ে ফিষ্টিতে স্যাক্রিফাইস দিত, তারাই মাতাল সামলাবার দায়িত্বটাও নিত। গোপাল ঠাকুর কিন্তু খুব কম সময়ে রান্না করতে পারত – সেই রান্না দেখার পর আজকাল টিভিতে একটা ডিস তৈরী করতে ৩ ঘন্টা সময় নেওয়া হয় দেখে রিলেটিভিটি জিনিসটা আরও হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পারি।

    একবার তেমনই এক ফিষ্টিতে আমি সদ্য বিদেশ থেকে শেখা ‘সাংগ্রিয়া’ পানীয় প্রস্তুত করে সবাইকে খাওয়াই। সেই গল্প পরেরবার।
  • Manish | 59.90.135.107 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১৮:০৮530388
  • এর আগের ও পরের পর্বগুলো চাই
  • siki | 122.177.217.207 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ২০:৪৩530389
  • এ তো পুউরো আমার ছোটবেলার গল্প শুনছি মনে হচ্ছে!
  • Suki | 178.85.170.49 | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ০০:০০530390
  • এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা – ১০ (রিচমন্ড হিল রোড)

    রিচমন্ড হিল রোড আমার জীবনে ততটাই স্থান জুড়ে আছে যতটা আছে বি টি রোড বাংলা সাহিত্যে। আমি ৪ বছর যে বাড়িটায় বসবাস করেছিলাম সেখানে সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্যবশত: ২২ টা আলাদা দেশের পাবলিক থেকেছে আমার সাথে – সব সময় সেই দেশের সংখ্যাটা স্থির ছিল এমন নয়, তবে বেশির ভাগ সময়ের মিলে জুলে, তালে গোলে ছিলাম আমরা সবাই। আর সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য ব্যাপারটা আপনি যেমন ভাবে দেখবেন – কালচারাল এক্সপোজার পেতেন পারেন, আবার দূর্বল চিত্ত হলে কালচারাল শক ও। তবে আমি আগের পর্ব গুলোতে যেমন বলেছি, এখানেও সেটা বলে রাখি, সেই সব জটিল সমাজ বা মনস্তত্বাবিক গল্প ফাঁদার জায়গা এটা নয়, এখানে আমি শুধু খাবার দাবার নিয়েই নাড়াঘাঁটা করব।

    বৃটিশ স্টুডেন্ট হলে বেশী কোন প্রবলেম নেই, কারণ ওদের কোন নিজস্ব খাদ্য নেই, তাই রান্না জানার হ্যাপাও নেই – সামনে কোন ইন্ডিয়ান রেষ্টুরাণ্ট থাকলে না পিৎজার দোকান থাকলেই ওরা খুশী। ওদের অবজার্ব করে আপনি খাদ্য বিষয়ে বেশি কিছু শিখতে পারবেন না – যা পারবেন তা ঐ পানীয় বিষয়ে। তাই এই মুহুর্তে মালগুলোকে আলোচনার বাইরে রাখছি। আমার বিশেষ উৎসাহ ছিল ইতালিয়ান বা ফ্রেঞ্চ ছাত্র-ছাত্রীদের রান্না-বান্না সর্ম্পকে। তবে সব কিছুর উর্দ্ধে ছিল এক তাইওয়ানিজ মাল – জেসন যার নাম ইংলিশ নাম। যাঁরা জানেন না তাদেঁর এই ফাঁকে বলে রাখি, চাইনীজ বা তাইওয়ানীজ বা জাপানী মালগুলোর একটা করে ইংলীশ নাম থাকত, কারণ মূল ভাষায় ওদের নাম উচ্চারণ প্রায় অসম্ভব। প্রায় বললাম এই কারণেই যে আজকাল দেখি ভারতীয় পাবলিক ডাচ ভাষায় কথা বলছে – এই দু:সাধ্য কাজ যাঁরা করতে পেরেছে, তারা হয়ত চেষ্টা করলে চাইনীজ ও বলতে পারে, দুনিয়া আফটার অল এক আজব জায়গা। জেসনের আসল নাম মনে হয় ছিল চুয়াং মিং ডট ডট.টি.সি.। জেট লি, ব্রুস লি, স্ট্যান লি এদের সিনেমা গুলো দেখে নিয়ে একটা পারমুটেশন – কম্বিনেশন করে নিয়ে নাম বানিয়ে নিলেই হল। তা ছাড়া শেক্ষপীর তো বলেই গেছেন - নামে কি এসে যায়, তাই জেসন কে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ও সেই চীজই থাকবে। বাই দি ওয়ে, আমি একবার জার্নাল পেপার সার্চ করতে গিয়ে শুধু সারনেম এর জায়গায় ‘লি’ লিখেছিলাম, সার্চ ইঞ্জিন হ্যাং করে গিয়েছিল – আপনারাও তাই একটু খেয়াল রাখবেন।

    আমাদের রিচমন্ড হিল বাড়িতে ঢোকার শর্ট – কার্ট রাস্তা ছিল রান্না ঘরের মধ্যে দিয়ে – দু টো বড় বড় রান্না ঘর ছিল আমাদের – ৩০ টা মত পাবলিক থাকত সেই জন্য। জেসনের সাথে আমি ঐ বাড়িতে ছিলাম প্রায় ২ বছর – কথা হয়েছিল সাকুল্যে তিনবার। তার মধ্যে একবার ছিল ইন্টারন্যাশানাল মিল পার্টিতে যেখানে আমি ওকে চাইনীজ ফ্রায়েড রাইসটা এগিয়ে দিতে বলেছিলাম, তাতে করে জেসন আমাকে ওর পেয়ারের দোস্তো ভেবে নিয়েছিল অন্তত ন্যানো সেকেন্ডের জন্য হলেও! আমি জেসন কে রান্নাঘর ছাড়া কোথাও দেখি নি – আমি সকালে ৭ টায় ল্যাবে যাচ্ছি, জেসন তখন প্রাতরাশ সারছে। আমি বিকেলে ফিরছি, জেসন তখন রাতের খাবার বানাচ্ছে। শনিবার বা রবিবার দুপুরে দেখা হলে জেসন তখনো রান্না করছে দেখা যেত। আমি প্রথম দিকে ভেবেছিলাম যে ও মনে হয় ইংল্যান্ডে রান্না বিষয়ক কোর্স করতে এসেছে। কিন্তু পরে জানা গেল মালটা নাকি ‘এডুকেশন’ নামক কোন একটা বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছে। দেশে ফিরে ও এখন কি শেখাচ্ছে জানি না, তবে ভারতের মত মিড ডে মিল ওখানে চালু থাকলে ওর বেশীর ভাগ সময়টাই যে সেখানে কাটবে সেটা বলে দিতে কোন অমৃতলাল হবার দরকার নেই। এডুকেশন কে এডুকেশন – সাথে ভ্যারাইটি মিড ডে মিল!

    তবে জেসনের রান্না একটা দেখার বিষয় ছিল – অন্তত ৮-১০ টা নানা সাইজের বাটি মশলা এবং আরো নানাবিধ সব্জি কুঁচানো রাখার জন্য চারপাশে সুন্দর করে সাজানো। এ ছাড়া রয়েছে রান্না মূল পাত্রগুলি – চাইনীজরা মূলত যেটা ব্যবহার করে – ওক নামক এক পাত্র। খাবার স্বাস্থ্যকর কিংবা হলেও কতটা তা বলতে পারব না, তবে সুগন্ধ (মাঝে মাঝে দূর্গন্ধও) বেরোত। আর হত ছ্যাঁক-ছোঁক শব্দ। এটা দিচ্ছে, ওটা দিচ্ছে – খুবই কনফিউসিং ব্যাপার। শেষেমেশে অবশ্য সেই নুডুলস বা রাইসই দাঁড়াত বেশীর ভাগ দিন। আর যে দিন অন্য রকম দেখতাম, সেদিন খাবার ইতিহাস বা প্রকৃতি জিজ্ঞেস করার সাহস হত না – যদি পাছে টেষ্ট করতে বলে! মেন চাইনীজদের খাবারে একটা জিনিস দেখতাম সেটা হল যে ওরা ফ্রেস সব্জী নিয়ে বেশী নাড়াঘাঁটা করে না বা তেলে বেশি ভাজে না – মাঝে মাঝে ১০ সেকেণ্ড মত গরম জলে ডুবিয়েই তুলে নিত। ফলে ওরা প্রকৃতই সব্জীর স্বাদ পেত – আমাদের ভারতীয় রান্নার মত কেবল মশালার স্বাদ নয়। কনট্রাস্টটা একবার ভাবুন – বাড়িতে আমাদের মা-মাসি-পিসি-কাকিমাদের দেখেছি তরাকারী চাপিয়ে অন্য কাজ করতে চলল, ঐ দিকে মাল ফুটছে তো ফুটছেই! কুমড়ো ফুটে ফুটে তার অনু পরমাণু আলাদা হয়ে যেত প্রায়।

    আমাদের ঘটিদের ঘরে একটা কথা খুব চালু ছিল – যে বাঙালরা নাকি সব কিছু খায়, অর্থাৎ নঞর্থক বাচ্যে বললে বাঙালরা কিছুই ফেলে না! আমি এতে প্রবলেম টা কি সেটা ঠিক বুঝতে পারতাম না – অবশ্য আমার মনে হত গড়পড়তা ঘটির থেকে গড়পড়তা বাঙাল ভালো রান্না করার জন্য ঘটিরা ইনফিরিওটী কমপ্লেক্স থেকেই সেই গুঞ্জন ছড়িয়ে ছিল মার্কেটে। ফেলে দেওয়া জিনিস বলতে কি বোঝানো হত? যেমন ধরুণ কুমড়োর খোসা, চালকুমড়োর পাতা, কুমড়ো ফুল, ঝিঙের খোসা ইত্যাদি – এছাড়া কচুর লতি তো ছিলই। তো চাইনীজ খাবার সেই আমাদের ভাষায় বাঙাল খাবারের মতই ছিল - প্রায় কিছুই ফেলা যেত না, সি-উইড পর্যন্ত। দুনিয়ার মাশরুম থেকে শুরু করে যত আজব দেখতে সব্জী ঐ মাল গুলো যোগাড় করত চাইনীজ সুপারমার্কেট থেকে। দুটো জিনিস আপনি আন্টার্কটিকা গেলেও পাবেন গ্যারান্টি সহকারে – এক ম্যাকডোনাল্ডস ও দুই চাইনীজ সুপারমার্কেট। এই ফাঁকে বলে রাখি জাপানীরা ম্যাকডোনাল্ডসকে বলত ‘ম্যাকাডুনারুদু’– যেটা আমার কানের ফ্রীকোয়েন্সির সাথে খুব ম্যাচ করত। ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং ও কে.এফ.সি কে নিয়ে তুলনা মূলক আলোচনা অন্য কোন পর্বে।

    সব চাইনীজদের রান্না পদ্ধতি প্রায় একই রকম – আমাদের আর এক বন্ধুকে দেখেছি প্রায়ই সুইট পট্যাটো রান্না করতে – স্যুপ, তরকারী ইত্যাদি। কে নাকি ওকে বলে দিয়েছিল চীন থেকে আসার সময় যে সুইট পট্যাটোর মত সব্জী আর পাওয়া যায় না বিদেশে – মানে সবচেয়ে জম্পেশ জিনিস। তা সেই ঐ মেয়ে খেয়ে গেল প্রায় ৪ বছর – তবে আর যাই হোক, সুইট পট্যাটো আর যাই করুক ওকে ফিগার মেনটেন করতে সাহায্য করেছিল এটা আমরা সবাই মেনে নিয়েছিলাম। কুমড়ো বিষয়ে বেশ একটা রসাল ব্যাপার তৈরী হয়েছিল থাইল্যাণ্ডের মেয়েদের সাথে রান্না নিয়ে কথা বার্তা বলে। ইংল্যাণ্ডের ছেলেদের কোন এক বিশেষ কারণে থাই মেয়েদের প্রতি এক দূর্নিবার আকর্ষণ আছে, ফলে আমাদের ইউনির্ভাসিটির কোন থাই মেয়ে একলা থাকত না প্রথম দু-তিন মাস ছাড়া। তা আমরা জানলাম যে থাই ভাষায় কুমড়োকে বলা হয় –‘ফাক’। সেবাষ্টিয়ানের (সংক্ষেপে সেব) লজিক অনুসারে তা হলে বড় কুমড়োকে অবশ্যই ‘গ্রাণ্ড ফাক’ বলা উচিত। সেব তখনও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে থাই গার্লফ্রেণ্ড যোগাড় করার, তাই প্রায় সব পার্টিতেই গিয়ে থাই মেয়েদের সাথে সরাসরি কুমড়ো বিষয়ক আলোচনা চালু করত। সেব-ই প্রথাম ল্যাবে শুনতে পায় যে এক থাই মেয়ে অন্য একটা চাইনীজ মেয়ের সাথে আলোচনা করছে যে “দে ডু নট গেট গুড ফাক ইন ইংল্যাণ্ড”। সেব ভেবেছিল যে থাই মেয়েরা তা হলে খুবই ওপেন কালচারে মানুষ এবং সেটার পর আরো বেশী করে ও থাই মেয়েদের প্রেমে পড়ে যায়। এমনকি ‘ফাক’ রহস্য উন্মোচনের পরের এর অন্যথা হয় নি – প্রেম সব দেশেই অন্ধ সেটা আর একবার সেব চার বছর বান্ধবীহীন থেকে প্রমাণ করেছিল।

    আর ছিল দুই তাইওয়ানীজ মেয়ে যাদের বাপের পয়সার ঐ গই নেই, পড়তে নয়, ওদের মূল লক্ষ্য ছিল কালচারাল এক্সপিরিয়েন্স লাভ করা। তা ওরা সেই জিনিস অর্জন করেছিল, আমরা পেয়েছিলাম নানা এক্সপেরিমেন্ট জাত খাবার। এদের মধ্যে সব চেয়ে বেশী এয়াকটিভ ছিল আইভি ও রিয়া। যত উদ্ভট খাবার যোগাড়ে আইভি প্রায় আনপ্যারালাল দক্ষতা অর্জন করেছিল। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল তাইওয়ান থেকে আনার ওর ফ্লেভারড বিস্কুট টাইপের জিনিস গুলো। সে জিনিস যে কি বেসিক মালমশলা দিয়ে তৈরী সেটা জানার সাহস করি নি – ইনফ্যাক্ট যে বানিয়েছে সেও মনে হয় ঠিক করে বলতে পারবে বা। এর মধ্যে কিছু ছিল মাছের ফ্লেভার দেওয়া – আমাদের শুঁটকি মাছের গন্ধও তার কাছেই শিশু। পার্থক্য একটাই যে, শুঁটকি মাছ মহাসিন্ধুর ওপার থেকেও জানা দেয় যে সে আছে, আর এই তাইওয়ানীজ বিস্কুট মুখে দেবার পর। এ জিনিস কেবল আপনি জানবেন কি খাচ্ছেন, পাশের জন টেরটিও পাবে না যে আপনার মুখের মধ্যে কি বিল্পব ঘটছে। এই সব ক্ষেত্রে আপনি কি করবেন? ভারতীয় সভ্যতা মেনে খুব সুন্দর বলে ঘাড় নাড়বেন নাকি ডাচ ঐতিহ্য মত ডাইরেক্ট বলে দেবেন যে আপনার মুখে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছে! আমি দ্বিতীয় পথ অবলম্বন করেছিলাম আর যোসেফ ভারতীয় সংস্কৃতি।

    সেই জিনিস খাবার এফেক্ট যোসেফের লাইফে হিরোসিমা-নাগাসাকির রেডিয়েশন এফেক্টের মতই দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপার হল যোসেফের রুম আর আমার রুম পাশাপাশি, কিছু এক্সপেরিমেন্টও আমরা ল্যাবে একসাথে করতাম। ফলে ঐ ম্‌ৎস ফ্লেভারড জিনিস পুরো না খেয়েও আমি তার সাইড এফেক্ট সর্ম্পকে প্রয়োজনের থেকেও বেশী জ্ঞান লাভ করেছিলাম। পুরো পূজা সংখ্যার ভ্রমণ কাহিনী বা পাণ্ডব গোয়েন্দার সর্বভারতীয় অভিযানের কেস – না দেখেও যে লেখা যায় সেই সত্যিটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলুম।

    সেই আইভি তার সঙ্গীসাথী সহ আমার নিমো গ্রামে পদার্পণ করেছিল গত বছর – আমাকে আসার আগে জিজ্ঞাসা করেছিল কিছু আনতে হবে কিনা – আমি বলেছিলাম আর যাই হোক ঐ বিস্কুট টাইপের জিনিসগুলো যেন না আনে। ঐ জিনিস আমাদের গ্রামের লোকজন খেলে হলে আমাকে পঞ্চায়েতে ডাকা হতে পারে বিচারের জন্য – চাই কি ফাইনও করা হতে পারে। আইভী আমার কথা রেখেছিল, তবে সঙ্গে এনেছিল আরো অদ্ভূত কিছু মাল – আমার ভাগ্য ভালো যে গ্রামে এখন কেবল টিভি চলে এসেছে আর তাই পাবলিকও নানা ধরণের চকোলেটের ছবির সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেই তাইওয়ানীজ চীজগুলি চকোলেটের মত দেখতে হওয়াতে আমি চকোলেট বলেই চালিয়েছিলাম। কিন্তু আরো একবার দেখলাম যে আইভী করিতকর্মা মেয়ে – দেখতে দেখতে গ্রামের এক বিশাল অংশের ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে ভাব করে ফেলেছিল এবং দেদার সেই ‘চকোলেট’ বিলিয়েছিল। জানিনা না কি ভাষায় কথা বলেছিল, তবে ও ফিরে যাবার অনেক দিন পর পর্যন্ত গ্রামের পাবলিক আর ‘চকোলেট’ লেফট ওভার আছে কিনা এবং আইভী কেমন আছে জানতে চাইত।

    আমি, যোসেফ, আইভী ও রিয়া প্রায় নিয়ম করে প্রতি বিষ্যুতবার ‘বিগ জোন্স’ খেতে বেরোতুম। বিগ জোন্স হ ল জাঙ্ক ফুডের এক চেন জাতীয় দোকান – যার গালভরা নাম হল ‘কেবাপ শপ’। যত তৈলাক্ত খাবার এইখানে পাওয়া যেত – যাঁরা আমাদের দেশে তেলেভাজা খেয়ে তারপর ঐ জিনিস খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ রায় দিতেন, তাঁদের জানাই যে এই জাতীয় লোক বিশ্বের সব দেশেই বর্তমান। তবে মূল পার্থক্য হল খাবার পর তার বাহ্যিক এফেক্টে – আমাদের দেশে তেলজাত খাবার খেয়ে পাবলিক কেমন যেন শুঁটকে মেরে যায়, বা ভাইস ভার্সা, অর্থাৎ শুঁটকে লোকেরাই যেন তেলেভাজার দিকে প্রকৃত আকৃষ্ট হয়। কিন্তু বিলেতে ঐ তেলমাল খেয়ে পাবলিক ফুলত। আমেরিকার অবস্থা তো আরো খারাপ – প্লেনে আগে না উঠলে আপনার সীটের আধখানা হাতছাড়া হয়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা। যাত্রার সারাক্ষণ আপনাকে অপরের পাছার আধখানা কোলে করে বইতে হবে। যাইহোক কেবাপ মূলত হয় চিকেন বা ল্যাম্ব। একটা লোহার দণ্ডের চারদিকে মাংস চাপে চাপে জড়ানো। এই মাংস আমাদের কাবাবের মতন নয়, মানে এই মাংসে কোন মশলা দেওয়া থাকে না, থাকে কেবল প্রবল পরিমাণে নুন। এই জিনিস খাবার প্রাথমিক শর্তই হল, এর উৎস সম্পর্কে কোন টেনশন মনে রাখলে হবে না। কারণ আপনি এর উৎস জানতেই পারবেন না – লোকে বলে যে দুনিয়ার যত ফ্যাট থেকে শুরু করে আবর্জনা জাতীয় মাংস সব চটকে ঐ মোক্ষম জিনিস তৈরী হয়। তা ঐ মাংস একটা দন্ডে ঘুরতে থাকে, দণ্ডের পিছনে আগুন (ইলেকট্রিক হিটিং) মৃদু জ্বলে। আপনি চাইবেন আর সেই মাংস কেটে কেটে দেওয়া হবে। যতদিন না সব মাংস বিক্রী হবে ততদিন ঐ দণ্ড ঘুরতেই থাকবে এবং সেই দই-লস্যি খাবার মত ভাগ্য ভালো হলে আপনি শেষের দিকের মাংসটা পেতে পারেন। সেই জিনিসের টেষ্ট লিখে বোঝানো অসম্ভব।

    আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কেবাপ বিক্রী বাড়ত রাতের বেলায় – যত রাত হত পাবলিকের মাতলামোর ম্যাগনিচিউড তত বাড়ত। কেবাপ শপ গুলির স্‌ট্‌র্‌যাটেজিক পজিশন প্রায়শ:ই থাকত পাব বা বারগুলির ঠিক পাশে। রাত ২-৩টের দিকে ঐ সব দোকানে ঢোকা যেত না ভিড়ের ঠেলায় – হঠ করে কোন মাতালের মনে পড়ল যে তার খিদে পেয়েছে। সেই সন্ধ্যের ৭ টা থেকে মাল খেয়ে আর নেচে পেটে টান পড়েছে। এই জাতীয় মাতালেরা সাধারণত গ্রুপে থাকে আর গ্রুপ লিডারকে অনুসরণ করে। তো সবার তখন একসাথে খিদে পেয়ে যায় প্রতিবর্ত ক্রিয়ার নিয়ম অনুসারে। কেবাপ শপ গুলি সেই ক্ষুধার্ত মাতালদের খাদ্য দিত, আর দিত ক্লান্ত ঠ্যাংদের বিশ্রামের জায়গা।

    দিনের বেলায় কিছু কিছু কেবাপ শপ গুলির মতন দোকানগুলিতে ফিস অ্যাণ্ড চিপস বিক্রী হত।অফিস অ্যাণ্ড চিপস ছাড়া ইংল্যাণ্ডের খাদ্যাভাস আলোচনা করা আর শেক্ষপীরকে বাদ দিয়ে ইংরাজী সাহিত্য আলোচানা করা প্রায় একই ব্যাপার। অবশ্য আজকাল ফিস অ্যাণ্ড চিপস এর ইমর্পটেন্স ইংরাজ সমাজ জীবনে শেক্ষপীরের থেকে অনেক বেশী। তা এই ফিস অ্যাণ্ড চিপস ও আমরা মাঝে মাঝে খেতুম কেবাপ কে সরিয়ে রেখে।

    কেবাপের উপরে ছড়ানো থাকত সস - সেটা মেয়োনীজ বা কেচ আপ, বা অন্য কোন নাম না জানা সস ও হতে পারত। আমি, যোসেফ, আইভী ও রিয়া সেই জিনিস বাড়িতে বয়ে নিয়ে এসে ডাইনিং রুমে বসে বসে খেতাম। যোসেফ ল্যাম্ব কেবাপ পছন্দ করত, আমি সেটা গন্ধের জন্য বেশী খেতে পারতাম না। কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ বেরোত সেই মাল থেকে। যাই হোক খেতে খুবই মুখরোচক যাকে বলে, তবে রাতের দিকে ঘুমের হালকা একটু প্রবলেম হত, মাংসে প্রচুর পরিমাণে নুন থাকার জন্য রাতের দিকে জলটান পড়ত পাকস্থলীতে, ফলে ঘন ঘন জলপান। পরের দিকে মাথার কাছে জল রেখে শুতুম কেবাপ খাবার পর। কিন্তু আমার কোনদিন পেট খারাপ করে নি ঐ কু-খাদ্য খেয়ে যেটা আমার প্রায়ই হত দেশে অজানা জায়গার চপ-সিঙাড়া খেয়ে। তবে আমার যা মনে হয় এর মূল কারণ ছিল কোকাকোলা – কেবাপ খেয়ে একপেট কোক পান করে ফেল। বিষে বিষে বিষক্ষয়, আদি অকৃত্রিম হোমিওপ্যাথিক স্‌ট্‌র্‌যাটিজি।

    আমাদের কোকাকোলা স্টকে থাকত যোসেফের ঘরে। বাইরে ঠাণ্ডা কিনলে প্রায় চারগুণ দাম দিতে হত, স্টুডেন্ট লাইফে হিসেব করে লাইফ চালানোর জন্য আমি ও যোসেফ ঠিক করেছিলাম কোক ঘরেতে স্টক করাই ভালো। প্রথমদিকে রান্নাঘরের ক্যান্টিনে বড় রেফ্রিজেটারেই আমরা কোক ক্যান গুলি রাখতাম। পরে একটা দুই ফুট বাই দুই ফুট টেবিল টপ ফ্রিজ আমরা জোগাড় করে ফেলেছিলুম, মানে কেউ রাস্তার ধারে ফেলে দেবার জন্য রেখেছিল, আমরা সেটা ল্যাব থেকে ফেরার সময় আপন করে তুলে এনেছিলাম। সেই ফ্রিজে আমরা ক্যান স্টক করে রাখতাম সুপারমার্কেট থেকে পাইকারীদরে কিনে এনে। একবার শীতের দুপুরে আমরা যোসেফের গাড়িতে করে সুপারমার্কেট যাচ্ছি এমন সময় পিছনে সাইরেন দিতে দিতে এসে পুলিস আমাদের থামাল।

    এই ফাঁকে যোসেফের গাড়ীটা বিষয়ে একটু বলে নেওয়া ভালো কারণ সেটাই ছিল চার বছর আমাদের বাজার বয়ে আনার বাহন। গাড়ীটা যোসেফের বাবা ওকে গিফট করেছিল জন্মদিনে – একটা কোল্ড-ওয়ার সময় কালের ভক্সওয়াগন, ২০০ পাউণ্ড দিয়ে কেনা। কিন্তু ঘটনা হল গাড়ী যত পুরানো হয়, তার ইনসিওরেন্স ততই বেশী, ফলে চার বছরে যোসেফ গাড়ির দামের থেকে বেশী ইনসিওরেন্স প্রিমিয়াম দিয়েছিল। একবার বিরক্ত হয়ে যোসেফ আমাকে নিয়ে গাড়িটাকে ডিসকার্ড করার জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল – আমাদের জানানো হল যে ঐ গাড়ী ফেলতে মিনিমাম ৩০০ পাউন্ড খরচা আছে, ফলে আমরা বিফল মনোরথে গাড়ি নিয়ে ফিরে এলাম। পরে আমি আমার ভারতীয় বুদ্ধি লাগিয়ে এই ডেইলিমা থেকে যোসেফকে উদ্ধার করি। আমাদের লাষ্ট ইয়ারে যোসেফের কাকার ছেলে এল পড়তে, আমি যোসেফকে বললাম যে সবচেয়ে সস্তায় গাড়ি থেকে মুক্তি পাবার উপায় হচ্ছে ঐ গাড়ী আবার কাউকে গিফট করা। ক্রিসকে সেই গাড়ী তার জন্মদিনে গিফট করা হয়েছিল – পরের দিকে শুনি যোসেফের সম্পর্কে তার একটু ক্ষুণ্নতার সৃষ্টি হয়েছে, যেটা আমার মতে খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তবে ক্রিস যে পরামর্শটা কার দেওয়া সেটা জানত না তা বুঝতে পারলাম যখন ও আমার কবিতার বইয়ের একটা কভার করতে রাজী হয়ে যায়।

    সেই গাড়ি নিয়ে আমরা বাজার করতে বেরুব, দেখলাম যে গাড়ীর কাঁচ পুরো বরফ পরে ঢেকে গেছে, ঝাড়লে যাচ্ছে না, পুরো স্ক্রাব করতে হবে। যোসেফ বলল যে এই তো কাছেই দোকান, এত কষ্ট করে বরফ সরিয়ে আর কি হবে, আর তা ছাড়া এই শীতের দিনে রাস্তায় আছেটাই বা কে – তাই সে ড্রাইভারের পাশের দরজাটা খুলে রেখে গাড়ির বাইরে মুখ বাড়িয়ে ড্রাইভ করার পরামর্শ দিল। আমাদের কাছে সেটা খুবই যুক্তিপূর্ণ কথা বলেই মনে হল। যোসেফ জানাল যে সে এমনটা অনেক বারই করেছে ওর দেশে। প্রসঙ্গ উল্লেখ্য যোসেফের বাড়ি মালটা নাম দেশ, যেখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি। তাই ওর দেশে যোসেফ গাড়ির বাইরে মুখ বাড়িয়ে ড্রাইভ করত বরফ এড়াতে নয়, বরং গরমের হাত থেকে বাঁচতে। এমন ভাবে আমরা ৫০০ মিটার গেছি কি, পুলিস এসে হাজির – প্রথমে যোসেফের দরজা খুলে চালানোর যুক্তিটা ওরা বুঝতে পারে নি। পরে বুঝতে পেরে হকচকিয়ে গিয়ে শুধুমাত্র সর্তক করে আমাদের ছেড়ে দেয়।

    যোসেফ টুকটাক খাবার বানাতে পারত নিজে – তার মধ্যে ওর ফেভারিট ছিল ওয়াইন দিয়ে মাংস রান্না যতদিন না সে আমার ভারতীয় স্টাইলে রান্না করা ঘোড়ার মাংসটা খেয়েছিল। সেই ঘোড়ার মাংস রান্না আমি আগেই লিখেছি যা খেয়ে যোসেফ মালটা দেশটার খাদ্যাভ্যাসই বদলে দেবার কথা ভেবেছিল। একদিন যোসেফ ঠিক করল যে সে আমাদের তার দেশের ঐতিহ্যময় রান্না ‘লাসানিয়া’ বানিয়ে খাওয়াবে। সেই গল্প পরের পর্বে ..

  • pi | 72.83.76.34 | ২২ মার্চ ২০১২ ২০:৩২530391
  • পরের পর্ব কই ?
  • Suki | 62.194.83.26 | ২৩ মার্চ ২০১২ ০২:০৪530392
  • এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা – ১১ (পর্ব - মেমারী স্টেশনবাজার)

    আমাদের দিকে একটা কথা চালু ছিল যে সুতো আর জুতোর দামের কোন মা-বাপ নেই, অর্থাত আপনি জানতেও পারছেন না যে আপনি কেমন ভাবে বলির পাঁঠা হচ্ছেন। অনেকে পরিবারের সাথে পূজোর বাজার করতে গিয়ে গম্ভীর ভাবে জামা-কাপড় চয়েস করে মতামত চালান করেন, তাঁদের একটাই পরামর্শ যে প্লীজ আর করবেন না। কাপড়ের ব্যবসার সাথে সম্যক পরিচয় থাকলে আপনি হয়ত বুঝতে পারতেন যে আপনার ভ্রান্তির স্ট্যান্ডার্ড ডিভিয়েশন স্ট্যাটিকটিক্স-এর এখনও পর্যন্ত জানা তঙ্কÄ দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। আমার পিসির ছেলে কাপড়ের দোকান দিলে ব্যাপারটা আমার কাছে ক্রমশ: পরিষ্কার হতে শুরু করে। জুতোর ব্যাপারেও তাই –বন্ধু বাচ্চু আমাদের আলোর জগতে নিয়ে আস্তে শুরু করে। আমি এই দুই জিনিসের সাথে আরো একটা যোগ করতে চাইছি, সেটা হল ফল। আপনারা ট্রেনে বা ফলের দোকানে যা ফল কেনেন তার বিবর্তন বা দামের ইতিহাস জানা থাকলে এই বাজারেও একটু চমকে উঠতেন।

    যে কোন রেল স্টেশনে নামলেই প্রথম যা চোখে পড়বে তা হল ঝুপড়ি ঝুপড়ি ফলের দোকান, আমাদের ‘মেমারী’ রেল স্টেশনও তার ব্যতিক্রম নয়। আর এই সব দোকেনের মালিক বা তার ছেলেরা প্রায় সবাই আমার বাবার ছাত্র। অন্য শিক্ষকরা যখন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে মনে মনে, তখন আমার বাবা দেদার ফল বিক্রেতা প্রডিউস করে ডাইরেক্ট ফল লাভ করেছে প্‌র্‌যাক্টিক্যাল লাইফে । আমার বাপ গুরুদক্ষিণা পেত কেনা দামে ফলের দোকান হতে ফল পেয়ে। তবে এই ক্ষেত্রেও ‘কেনা দাম’ ছিল একটা বিশ্বাস মাত্র! এতো আর বিদেশী সুপার মার্কেট নয় যে ফলের গায়ে বা ফলের ঝুড়ির গায়ে বারকোড লেপ্টে থাকবে! ফলত: দামের স্ট্যাণ্ডার্ড ডিভিয়েশন কোন সিগমা গুণিতকে ধরা দু:সাধ্য ছিল। ছোটবেলায় ফলের দামের থেকেও যে জিনিসটা আমাকে বেশী আকৃষ্ট করত তা ছিল কিছু দোকানদারের ফল নিয়ে নাড়াচাড়া করা। কোন কোন সময় দেখতাম খালি দোকানে দোকানদার পরম যত্নে ফলের গায়ে হাত বুলাচ্ছে – যেমন রবিশংকর সেতারের উপর হাত চালায়। আর তা ছাড়া অনেক ফল বিক্রেতা আবার ফলেদের স্থানান্তর একটা অবশ্য কর্ম বলেই মনে করত।

    তা সে যাক – সব চেয়ে বড় নাটক মঞ্চস্থ হত তরমুজ কেনার সময়। ছোট ফল কেনার ঝামেলা কম – ধরুণ আঙুর, মিষ্টি হবে কিনা একটা মাল টপ করে মুখে পুরে দিলেই মালুম হত। শীতকালীন লেবু, গ্রীষ্মের আমও একই ভাবে যাচাই হত। কিন্তু তরমুজ – লাল হবে কি? জলসা হবে না তো! কি ভাবে বুঝবেন – আপনাকে নয়ত নিজের বিচক্ষণতার অথবা দোকানদারের রেকমেণ্ডশনের উপর নির্ভর করতে হবে। আমার জানামতে তরমুজের আকার ও বাইরের রঙের সাথে ভিতরের মালের রঙ বা মিষ্টতার কোন পরীক্ষিত ও প্রস্তাবিত সম্পর্ক ছিল না। অগত্যা সেই দোকানীর জ্যোতিষবিদ্যার মত ঘোলাটে মতামত শুনতে হত। সে পরম যত্নে তরমুজের গায়ে হাত বুলিয়ে বা যেমন ভাবে বাচ্ছা ছেলের পেট গরম হলে ডাক্তারেরা পেটে টোকা মারে (অন্তত আমাদের সময়ে মারত), তেমনি তরমুজটাকে টোকা মেরে আপনাকে বলবে কোন তরমুজটা ভালো লাল ও মিষ্ট হবে। তারপর আপনি জোরাজুরি করলে সে ছুরি দিয়ে একটা ত্রিভুজ কেটে আপনাকে দেখাবে। কিন্তু এখানেও আপনার জিত নেই – যদি সেই ত্রিভুজ লাল হয় তাহলে আপনি কনভিন্সড, কিন্তু একদিক লাল বলে অন্যদিক লাল হবে তরমুজের এমন কোন বাধ্যকতা নেই – এবং সেটাই আপনাকে ফল বিক্রেতা জানাত যদি সেই ত্রিভুজ লাল না হত। আর তা ছাড়া লাল রঙের গাঢ়তা চোখ দিয়ে পুরোপুরি পরিমাপযোগ্য নয়। কতটা লাল আসলে লাল? ফলে প্লাসিবো এফেক্ট কাজ করতে শুরু করে। আপনি নিশ্চিত মনে লাল তরমুজ কিনেই বাড়ি যান! তবে আমার বাপ শিক্ষক বলে একটু সম্মান পেত কারণ বিহারীদের মধ্যে গুরুভক্তি প্রবল। ফলে বেশীরভাগ সময়েই বাপ উইনিং সাইডে থাকত।

    আমরা ছোটবেলায় আমকেই ফলের রাজা বলে মানতাম ও জানতাম। আমাদিগের পূর্বপুরুষেরা তেনাদের নানাবিধ কার্যকলাপ দ্বারা এই ধারণা আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আমাদের মজ্জাতে। তবে সেই আম কেনারও কিন্তু একধরণের বিশেষ টেকনিক ছিল। আমের নানা প্রকারভেদ – দেশী আম, কলমের আম, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি, বোম্বাই। বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী লোকাল বাঙ্গালী আরও চালাক হতে শুরু করলে ‘কলমের’ আমের নানাবিধ প্রকারভেদ বের হল যথা – চ্যাটার্জী, ব্যানার্জী, গোলাপখাস, গোপালভোগ, কিষণভোগ, লক্ষণভোগ, মোহনভোগ ইত্যাদি। ‘আলফানসো’ নিয়ে আমরা বেশী নাড়া ঘাঁটা করি নি। দোকানের ঐ সব ফলের কদর বাঙালী মধ্যবিত্ত করতে পারত না। গলদা চিংড়ি এবং ‘আলফানসো’ ক্রেতারা প্রায়শই অভিন্ন হত।

    পরবর্তিকালে আমার নিজের ভৌগলিক বিস্তার আরও একটু বাড়ার পর এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে শ্রেষ্টর শিরোপার লড়াইটা তিন প্রজাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো – হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আলফানসো। যতদূর মনে পড়ে মুজতবা আলী সাহেবের ভোটটা ল্যাংড়ার দিকেই ছিল। আমার বাপেরও তাই, আর আমি নিজে ল্যাংড়া ও হিমসাগরের মধ্যেই দোদ্যুল্যমান ছিলাম। ‘আলফানসো’ আম দেখলেই আমার কেমন যেন পুতুপুতু তুলোয় জড়ানো শৌখিন ব্যাপার বলে মনে হত। যে খেলায় বডি কনক্যাক্ট নেই, তা আমার ঘোর না পসন্দ – তা সে তুলোয় জড়ানো আমই হোক বা ক্রিকেট!

    ফজলি আম আসত টুকরী বা বেতের চুপরী করে। মাঝে মাঝে দেখতাম যে বিশাল বিশাল সাইজের ফজলি আমদানি হয়েছে – মালদার মাল বলে চলানো হত। অভিজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করতেন যে ঐ আম আদৌ ফজলি নাকি বুনো আম! ক্ল্যাসিক্যাল টেকনিকে আম কাটা হয় তিন টুকরোয় – আঁটি ও তার সাথে দুই ‘চাকা’। যে কোন কারণেই হোক এই আজও অন্যভাবে আম কাটা দেখলে বুকটা হু হু করে ওঠে। ভাবুন একবার – আপনার জামাই বাড়িতে এসেছে – তেল ঝোল খাসি/পাঁঠার মাংসাটা শেষ করে জামাই তেলতেলে হাত বাড়াচ্ছে প্লেটে রাখা খোসা ছাড়ানো টুকরো আমের দিকে – এ ঠিক যায় না। দৃশ্য পলুউশন টাইপের। জামাই খাবে মেঝেতে বসে এবং খাবার শেষে চুষবে আমের আঁটি ও চাকা – এটাই ক্লাসিক, এটাই ঐতিহ্য – সেটাই মৃণাল, ঋত্বিক, সত্যজিত, রামকিঙ্কর, নন্দলাল।

    আরো ভাবার বিষয় হল আম কেমন ভাবে সাজানো থাকবে ফলের দোকানে – তার মধ্যেও ক্যাথলিক – প্রোটেষ্টান্ট জাতীয় টুইষ্ট আছে। আমের বোঁটা আপনার দিকে থাকে নাকি আমের সরু দিকটা? সুজনেরা বলে থাকেন আমের বোঁটার চারপাশ দেখে আমের ক্যারেক্টার বোঝা যায় – যেটা করা যায় না আমের সরু দিকটা দেখে। ফলত: আমের বোঁটা ক্রেতার দিকে করে সাজানৈ দোকানের রীতি হওয়া উচিত।

    তুলনামূলকভাবে কলা কেনা সহজ ছিল। আমাদের সময়ে মেমারীর ফলের দোকানগুলিতে তিন প্রজাতির কলারই সমাহার থাকত – চাঁপা, কাঁঠালি ও সিঙ্গাপুরি। মর্তমান কলা নৈব নৈব চ - মার্কেটে এলেও তা গলদা চিঙড়ি, আলফানসো আমের সাথে একই সোশ্যাল ক্যাটাগরিতে ঠাঁই পেত। একমাত্র এই কলা নিয়ে ভাবতে গেলেই আমার মনে হয় ডারউইন সাহেব কোথাও একটা ছোট ভুল করে গেছেন। অভিযোজন ও বিবর্তন যে কেবল হাজার বা মিলিয়ন বছরের স্কেলে হয় তাই নয় – কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিবর্তন ১০-১৫ বছরেও চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করা যায়! এই যেমন ১৯৯২ থেকে ২০১১ এর মধ্যে কলার বিবর্তন। আগে চাঁপা কলার কি সুন্দর গড়ন ছিল – আহা – ঐ জন্যই কবিরা তুলনা দিতেন চাঁপা কলার মতন [যাকে সংস্কৃতে চম্পক কলি বলে] আঙুল বিবৃত করে। যাই হোক সেই চাঁপা কলা এখন ছোট ছোট হতে হতে প্রায় হাতের কড়ে আঙুলের মতন হয়ে গেছে। বুদ্ধিমানেরা বলে এটা হয় একেবারে কাঁচা অবস্থাতেই গাছ থেকে মাল সরিয়ে নেবার জন্য, সময় দিলে তারা নাকি আরো বাড়ত! আমার সিনিক্যাল মন বলে চাঁপা কলা গাছে রেখে দিলেও আর বাড়বে না। গ্লোবাল ডিপ্রেশনের যুগে তাদের মাথাতেও এটাই ঘুরবে যে আর বেড়ে কি হবে! বরং সারভাইভ্যাল অব দ্যা ফিটেষ্ট তঙ্কÄ অনুসারে তারা আরও ছোট হতে সুরু করবে মনুষ্য দৃষ্টিকে ফাঁকি দেবার জন্য।

    অন্যদিকে কাঁঠালি কলা ছেলেকে চেনানোর জন্য আপনাকে কোন বিশেষ ছবি বা জুয়োলজির ক্লাসের সাহায্য নিতে হবে না – সিম্পলি বলবেন যে দোকানের সামনে সবচেয়ে কুৎসিত যে কলার ছড়াগুলি ঝুলছে তাহাই কাঁঠালি কলা! কাঁঠালি কলা ছাড়া পূজো হয় না কেন এবং সিঙ্গাপুরী কলার নামকরণের ইতিহাস এই দুই বিষয়ে আমি নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ও বারিদবরণ ঘোষের সাথে চিঠি চালাচালি করব ঠিক করেছি শীঘ্রই। কাঁঠালি কলা আমার এমনিতে ঠিক লাগলেও সামান্য প্রবলেম আছে ওর বীচি নিয়ে। সিঙ্গাপুরী কলার পতনের ইতিহাসও প্রায় চাঁপা কলার মতনই। আগে সিঙ্গাপুরী কলা ছিল মোটা ও ঈষ্‌ৎ বাঁকানো - এখন তাদের অবস্থা অপুষ্টি ও দূর্ভিক্ষ ছাপ মার্কা। খোসা মোটা হয়েছে ক্রমশ: এবং শাঁস হয়েছে সীমিত। ফলে একটা কলা, টুকরো পাঁউরুটি ও একটি ডিম দিয়ে স্কুলের স্পোর্টসের টিফিন করা যায় না। মিনিমাম তিনটি কলা লাগে, নাহলে ঐ স্ট্রং পাঁউরুটি গলা দিয়ে নামানোর জন্য যে পরিমাণ লুব্রিকেশন দরকার তা একটা কলা থেকে পাওয়া ক্রমশ: দু:সাধ্য হয়ে উঠছিল।

    ইনফ্যাক্ট এখনকার প্রাণী ও উদ্ভিদ সকলেই অকালপক্ক। উদ্ভিদ জগতের অকালপক্কতার পিছনে প্রধান অবদান ছিল কার্বাইডের। আজকাল কিলিয়ে কিছুই পাকাতে হয় না – এমনকি কাঁঠালও! যা পাকাতে চান চটের বস্তার ভিতর কার্বাইডের টুকরো সহ রেখে দিন – ব্যাস খেল খতম। ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলির থেকেও কার্বাইডের জোড় বেশী - ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলি রঙ ফেরায় সাতদিনে, আর কার্বাইড এফেক্ট ওভারনাইটে!

    কলা কেনা সহজ ছিল আরও একটা কারণে – তা হল টক মিষ্টির কোন ব্যাপার ছিল না তার মধ্যে। কলার মিষ্টতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে বা তর্ক ফাঁদতে আমি চরম স্কেপটিকদেরও দেখি নি! মেমারী স্টেশন বাজারে কোচনদার রেডিও সারাইয়ের দোকান ছিল সাথে সাইকেল স্ট্যান্ড। রেডিও বাজার থেকে ক্রমশ: উঠে যাবার জন্য কোচনদা তাদের অন্য একটা ঘরে এক বিহারীকে (যাকে বাঙালী বললে রেগে যেত) কলার গোডাউন করার পারমিশন দেয়। ফলে আমরা কলার কাঁদিগুলোর কৈশোর না দেখলেও যৌবন ও বার্ধক্য দেখেছি দেদার। তবে কলার কৈশোর আমার কাছে নতুন কিছু ছিল না। আমার গ্রামে অন্য যে কোন গড়পড়তা বাংলা গ্রামের মতই কলা গাছের ছড়াছড়ি ছিল। তবে অনেকেও হিসেব করে দেখেছিল খাবার কলার থেকে কাঁচাকলার চাষ বেশী লাভজনক। বাঙালী প্রি-হিষ্টরিক যুগ থেকে পেট-পাতলা বলে কাঁচাকলা ও ডুমুরের চাহিদা বাজারে কনস্ট্যান্ট রাখতে পেরেছে। আলু, ধান চাষ করে চাষী আত্মঘাতী হয়েছে নিয়মিতই – কিন্তু কাঁচাকলার চাষ করে ক্যালামিটির খবর আমার কাছে বিশেষ নেই। যে কাঁচাকলাকে আমি কৈশোরে দুরছাই করেছি, সেই কাঁচাকলাকেই যৌবনে বিদেশের সুপারমার্কেটে ‘প্ল্যানটেন’ নামে শোভিত হতে দেখেছি। লিটারেলি ‘কলাপোড়া’ খাওয়াকে ডেলিকেসি বলে চালানো হয় যেখানে।

    আমি যখন প্রথম চাকুরী করতে ঢুকি ব্যাঙ্গালোরে তখন কোম্পানীর নিয়মানুসারে গেষ্টহাউসে প্রথমে থাকা যেত। সেই সময় আমার সাথে গেষ্টহাউসে এক ডাচ ছোকরা ছিল যাকে দেখতাম রোজ সকালে ব্রেকফাষ্ট করার সময় এক থালা করে পেঁপে খাচ্ছে। বেশী পেঁপে খাওয়া আমার কাছে তখনও গরুর খাবার কথা মনে করাত। আমার গ্রামের বাড়িতে হাইব্রীড পেঁপে আমদানী হবার আগে পর্যন্ত গরুরা বেশ আয়েশ করেই পেঁপে খেত। গাছে যত পেঁপে ফলত খাবার লোক তত ছিল না, পেঁপে কেনার লোক তো আরৈ না। ফলে উদবৃত্ত পেঁপে যেত গরুর পেটে। সেই ব্যাকগ্রাউণ্ড থেকে এসে আমি ডাচ ছোকরার অতো পেঁপে খাবার কারণ বুঝতে না পেরে একদিন জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম। যা উত্তর পেলাম তার সারমর্ম হল হল্যাণ্ডে পেঁপে জিনিসটা ডেলিকেসি এবং সব সময় কেনার সাধ্য করা যায় না – তাই সে যত পারে খেয়ে পুষিয়ে নিচ্ছে! যুগ বদলেছে – গত বছর আমি মেমারী স্টেশন বাজার থেকে হাইব্রীড পেঁপে কিনেছি ৫০ টাকা কিলো দরে (মাষ্টারের ছেলে বলে ছাড় সহ) – এবং আমষ্টারডাম সুপারমার্কেটে পেঁপে দেখছি অস্বাবাভিক দামে, অদ্ভূত সাইজ ও শেপে।

    তা যা বলছিলাম, আমাদের ছোটবেলায় পেঁপে বিক্রী ফলের দোকানে অতো প্রচলিত ছিল না – পেঁপে বিক্রী হত অকেশন অনুসারে – পূজা, নবান্ন ইত্যাদি সময়ে। পেঁপের আকার ক্রমশ: বড় হতে শুরু করল – আর বীচি ক্রমশ: কমতে। একসময়ে বুদ্ধিমানেরা (আমাদের দিকে বুদ্ধিমান বলতে বাঙালদেরই বোঝাত জেনারেলি, ঘটিরা খুব একটা চালাকচতুর ছিল না এই সব ব্যাপারে) আবিষ্কার করল যে পেঁপের স্বাদ পেঁপের বীচির সংখ্যার সাথে ব্যাস্তানুপাতে পরিবর্তিত হয়। ফলে সবাই পেঁপে কিনতে গিয়ে বীচি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। বীচি আছে কি নেই এই দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে দোকানদারেরা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দেশী পেঁপে ফলের দোকানে দড়ি দিয়ে ঝোলানো যেত তখন – এখন হাইব্রীড পেঁপে কেবল তরমুজের মত জমিতে গড়িয়েই বিক্রী করতে হয়। আর তা ছাড়া ডাক্তারেরা কোন ফলের পুষ্টিগুণ বেশী সেই ধাঁধার সমাধান এখনও না করতে পারায় আপেল, পানিফল, ন্যাশপাতির সাথে পেঁপেও স্বাস্থ্য সচেতনতার উপকথায় সামিল ছিল।

    কাঁঠাল ছিল সিজেন্যাল ফ্রুট – মানে গরম ছাড়া পাকত না। কাঁঠাল খাবার কদর অসভ্য বাঙালীদের মধ্যে ক্রমশ: কমে আসছে। সভ্য বাঙালীরাই এখনও কাঁঠাল নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। কাঁঠাল বিক্রীর দোকান ছিল গড়পড়তা ফলের দোকানের থেকে আলাদা। মূল কাঁঠাল বিক্রী হত গোডাউন থেকে – মাল লাট করা থাকত অবহেলায়, অযত্নে ও অসহযোগীতায়। কাঁঠালের ফেস ভ্যালু কোনদিনই আম বা আপেলের মত ছিল না। আম-আপেল নায়ক হলে কাঁঠাল বড়জোর সহ চরিত্রাভিনেতা। তেমন কাঁঠাল হলে ১২ রিলের বছরে ২ রিল উপস্থিত থেকেই ময়দান কাঁপিয়ে দেবে। কাঁঠালের জনপ্রিয়তা হারানোর আরো একটা মূল কারণ হল কাঁঠাল ভাঙার জটিলতা ও বাঙালীর অকারণ স্বাস্থ্য সচেতনতা। বাঙালী জামাই স্লিম হচ্ছে, জিম করছে এবং শ্বশুরবাড়ি গিয়ে খাসীকে চিকেন এবং কাঁঠালকে রিপ্লেস করছে অন্য ফল দিয়ে। আর তা ছাড়া সর্ষের তেলটাও একটা ফ্যক্টর। বাঙালী হেঁসেল থেকে খাঁটি সর্ষের তেল উধাও (কিনা কোলষ্টেরল বাড়বে!) ফলে কাঁঠাল ভাঙার অসুবিধা। আনারস ছাড়াবার কল আবিষ্কৃত হলেও এখনো পর্যন্ত কাঁঠালকে অন্যভাবে খালাস করার যান্ত্রিক পদ্ধতি আমার চোখে পড়ে নি। দুই হাতে কনুই পর্যন্ত ভালো করে সর্ষের তেল মেখে কাঁঠালের ভিতর অনুপ্রবেশ করতে হয়। দুই প্রকার কাঁঠাল জনপ্রিয় – খাজা কাঁঠাল ও রস কাঁঠাল। খাজা কাঁঠাল ড্রাই টাইপের, রস কম। আর রস কাঁঠাল গলায় দেওয়ামাত্র সুরুত করে পেটে, রসে টইটম্বুর। আমাদের কৈশোরকালে রথের মেলায় গিয়ে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া একপ্রকার প্রথার মধ্যেই ছিল।

    বাঙালীর খাদ্যরসিকতার সাথে পেয়ারার সম্পর্কটা আমি আজও ঠিক ঠাক ঠাওর করতে পারি নি। পেয়ারার গল্প শর্ৎ, বিভূতিতেই সীমাবদ্ধ – কমলকুমার বা সন্দীপন পর্যন্ত আর সে পৌঁছতে পারে নি। আজকাল ট্রেন্ডী বাঙালীরা ডাইনিং টেবিলে ফলের ঝুড়ি রাখাছে – তাতে আপেল, আঙ্গুর থাকলেও পেয়ারা নৈব নৈব চ। কিন্তু পেয়ারার সাথে আমার বেশ কিছু শৈশবকাল ও রোমাণ্টিসিজম জড়িয়ে আছে। আমার কৈশোর জীবনের বেশ কয়েক পার্সেণ্ট সময় পেয়ারা গাছের ডালে কেটেছে! অন্য অনেক ফলের মতই পেয়ারারও দুই ভাগ – দেশী ও বিদেশী। পেয়ারা অবশ্যই বিদেশ থেকে এনে বিক্রী করা হত না আমাদের দিকে – দেশী পেয়ারার ভিতরটা লাল এবং বীচি শাঁসের তুলনায় বেশী। অন্যদিকে বিদেশী পেয়ারাকে কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমরা ‘কাশ্মীরি’ পেয়ারা বলতাম, তাতে সাদা শাঁস বেশী কিন্তু বীচি কম থাকত। মেমারী স্টেশন বাজারের ফলের দোকান গুলিতে দেশী পেয়ারা বিক্রী প্রায় হতই না। তারও অনেক পর শুরু হয়েছিল বারুইপুরের পেয়ারার আগমণ। আমার সাথে বারুইপুরের পেয়ারার পরিচয় প্রথম হয়েছিল বর্ধমান রেল স্টেশনের ঠিক বাইরে। সেই প্রথম আমি পেয়ারাকে কিলো দরে বিক্রী হতে দেখি, তার আগে ছিল পিস। পেয়ারার বিবর্তন রসগোল্লার বিপরীত – রসগোল্লা আমাদের দিকে কিলো থেকে পিসে নেমে এসেছিল। তাছাড়া পলিথিন ব্যাগের সাথে এক অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ছিল এই দুইয়ের সাথেই – রসগোল্লা মাটির হাঁড়ি থেকে স্থানান্তরিত হল পলিথিনে আর বারুইপুরের পেয়ারা গাছেই আশ্রয় পেল পলি গহ্বরে। আমরা ছেলেবেলায় গাছের পেয়ারা ন্যাকড়া জড়িয়ে রাখতাম পাখির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য – সে দৃশ্য সুখের ছিল না। কিন্তু গাছ থেকে পলিথিনের ভিতর পেয়ারা ঝুলছে – এ দৃশ্য শুধু অসুখের নয়, ভীতিকরও বটে!

    শসা নিয়ে আমি বিশেষ নাড়াচাড়া করতে চাইছি না। কারণ ইহা ফলের দোকানে বিক্রী হলেও কোনদিনই ফলের মর্যাদা লাভ করে নি। তা ছাড়া আজকাল হাইব্রীড শসায় দেশ ছেয়ে গেছে। ফলত: বয়স্করা মনকষ্টে ভুগছেন দেশী শসা দিয়ে মুড়ি খাবার পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করে। ছোকরারা মুড়ি ছেড়ে এখন টিফিন করা শিখেছে (যদিও এখনো কিছু রিটায়ার্ডমুখী সরকারী কর্মচারী মুড়ি দিয়ে টিফিন সারার কথা বলেন) যেখানে শসার পরিচয় কেবল স্যালাডের অঙ্গ হিসাবেই। শসার অবস্থা আগের দিনের জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বিধবা পিসিদের মতন – সুখে আছে, দু:খে আছে, কিন্তু কোন মর্যাদা নেই!

    আরো বেশ কিছু ফল দেখা যেত মেমারী স্টেশন বাজারে – সেই গুলি নিয়ে পরের বার ...

  • i | 137.157.8.253 | ২৩ মার্চ ২০১২ ০৭:০৮530393
  • এর আগের সাতটা পর্বও এখানেই পোস্ট করে দিন, সু কি। অন্যস্বাদ। মুখবদল।ভালো লাগছে।
  • dd | 110.234.159.216 | ২৩ মার্চ ২০১২ ১০:০২530394
  • বা: বা:। খাসা লাগছে পড়তে।
    চলুক চলুক
  • Suki | 80.254.147.204 | ২৩ মার্চ ২০১২ ১৩:৫৭530395
  • এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা - ১

    মুজতবা আলী সাহেব খাবার-দাবার বিষয়ে বেশ কিছু রচনা লিখে গেছেন যেগুলো পড়ে বিমলানন্দ লাভ করেছি বা এখনও নির্ভেজাল আনন্দ পাই । সেই সব লেখায় রাঁধুনি থেকে উপকরণ মায় খাদকের পরিপূর্ণ বিবরণ থাকলেও একটা জিনিসের উল্লেখ কিন্তু তিনি বেমালুম উহ্য রেখেছেন যেটা ছাড়া নবযুগের কোন খাবার বিষয়ক লেখাই পরিপূর্ণ হয় না - সেই মহার্ঘ্য বস্তুটি হল , ক্যালোরি । আমি তো এই সেদিন পর্যন্ত যানতাম না যে একটা সিঙ্গারা খেয়ে আমি নাকি ১৪০ ক্যালোরি সঞ্চয় করলাম। বলে কি ব্যাটারা ! আসলে আমার সাথে খাবারের সম্পর্ক ঐ জিহ্বা পর্যন্তই - মাল গলা দিয়ে একবার নেমে গেলে সেটা নিয়ে আর ভাবার তাগিদ অনুভব করি না, অবশ্য যদিনা সেটা পাকস্থলী জনিত হয়। একবার পার্কস্ট্রীটে মার্কোপোলো নামক রেষ্টুরেন্টে খেয়ে আমাকে তেমনই এক তাগিদ অনুভব করতে হয়েছিল পরের পুরো দিনটাতেই। বাড়িতে ট্যিসু পেপারের চল না থাকায় আমি সারাদিনে যা জল ঘেঁটেছিলাম মার্কো পোলূ মনে হয় খোদ জাহাজে বসে এত জলকেলি করেননি।

    তো যাক - খাবার ব্যাপারে কথা বলার তেমন এক্তিয়ার আমার নেই - ইদানিং শংকর তো রিসার্চ-টিসার্চ করে মোটা মোটা কেতাব ফেঁদে বসেছেন। তার থেকে আর কিছু মনে না থাকলেও এটা মনে আছে যে স্বামীজী জিলিপি খেতে ভালোবাসতেন ! এটা জেনে ফেলার পর আজকাল প্রায়ই রামকৃষ্ণ-দক্ষিণেশ্বর-স্বামীজী সংক্রান্ত আলোচনায় আমি সক্রিয় যোগদান করি। একবার যদি কোন আলোচনাকে আপনি খাবার বিষয়ক খুঁটিনাটিতে ঢুকিয়ে ফেলেন তাহলে আপনি কি করবেন বলতে পারব না, তবে আমাকে থামানো দুষ্কর হবে। নানা অদ্ভূত তথ্য, সত্য-মিথ্যা নির্বিশেষে, বিষয়ে ঢুকিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে আমার আজকাল এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ হয়। সেদিন কোথায় যেন পড়লাম ৩৫০০ ক্যালোরি শক্তি শরীরে বাড়তি সঞ্চয় হল গিয়ে ৪৫০ গ্রাম ওজন বাড়তি যোগ করা। অর্থাৎ প্রতিদিন ১০০ ক্যালোরি বাড়তি সষ্ণয় করলে একমাসে ওজন বাড়বে ৪৫০ গ্রাম, বছরে বাড়বে ৬ কিলোর কাছাকাছি। খুবই সুন্দর থিওরী, হয়তবা সত্যিও - কিন্তু মানতে কষ্ট লাগে। ঐ কোয়ান্টাম থিওরীর মতই আর কি !

    বাড়িতে কাকাতো, জ্যেঠতুতো ভাইদের দেখে ক্যালোরি বিষয়ক সকল সমীক্ষাই ভাঁওতা মনে হয়। ভাই আমার সকালে নানাবিধ জিনিস দিয়ে প্রাতরাশ সারল - যার পরিমাণ দেখে টেক্সাসের লোক পর্যন্ত ঘাবরে যাবে ! ভাত খেয়ে ৯.৫০ এর ট্রেন ধরে বর্ধমান কম্পিউটার শিখতে গেল - কার্জন গেটের কাছে হাজি নাকি ভালো বিরিয়ানী বানায়, তাই ওখানে টিফিন নিয়মিত। ২.৪০ এর ট্রেনে ফিরে আবার ভাত। সন্ধ্যাবেলা পাশের গ্রামে ছেঁড়াপরোটা-ঘুঘনি সহ জলযোগ - রাতে আবার পরিমাণ মত আহার। ভাই আমার সেই চাইনিজ অভ্যাস - বারবার খাও, কম কম খাও - এটাকে নিজের মত করে নিয়েছে। যুক্তি খুবই সিম্পিল - কাল যদি কিছু হয়ে যায়, এটা যেন তখন মনে না আসে যে - ইস দুটো লুচি খাওয়া হল না ! তা দিনে কত ক্যালোরি ভাই অর্জন করে ঠিক বলতে পারব না দাদা, তবে অনেক। তো কয় - কিছুই তো দেখি হয় না তার - দিব্যি ক্রিকেট, ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছে ! ভারতীয় কৃষ্টি সভ্যতার মূল ভিত্তিই হল আনন্দম, আর ভাই আমার আনন্দে আছে, সুতরাং এর মাঝে ক্যালোরি আসে কোথা হতে ??

    আমাদের গ্রামের টিমের গোলকিপার ছিল ডাবা। স্কুল থেকে একবার বর্ধমানের গোলাপবাগের দিকে কি একটা ছোট প্রদর্শনীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল - ওখানে পড়ন্ত দুপুরে পেট-ফুরোনে গেটের সামনের একটা দোকানে খেতে ঢোকা হয়েছিল, ১০.৫০ টাকায় মাছ ভাত। ৬ বার ভাত নেবার পর যথারীতি ডাবা দোকানদারকে অপ্রস্তুতে ফেলে দিয়েছিল - হাঁড়ি ভাত শূন্য করে। ওদিকের হোটেলে পেটফুরোন উঠে যাবার পিছনে ডাবার অবদান সাংঘাতিক। যেটা বলছিলাম - এই ডাবাও প্রতিদিন অনেক ক্যালোরি পাকস্থলীস্থ করে - কিন্তু তারও কিছু হয় না ! ধাঁধা - এমনই এক ধাঁধা হল -

    কোন ফলের পুষ্টি গুণ বেশী - আপেল, আঙুর, বেদানা ?

    হাওড়া বর্ধমান মেনলাইনে যাতায়াত করে আমি পুরো কনফিউজড। একদিন শুনলাম কোন ডাক্তার নাকি বলেছেন ওটা ন্যাশপাতি হবে। পরে শুনলাম সমীক্ষায় কিছু গলদ আছে। আসল ফল হল গিয়ে পানফল - যা দরকার ওর মধ্যেই আছে। ট্রেনে পানিফল খাবার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কামড়ায় চলার সময় লোহার মেঝেতে পানিফলের খোসার আবরণ তৈরী হয়ে কেমন একটা কার্পেটের এফেক্ট আসতে লাগল!

    তবে এইসব ব্যাপার ডিটেলসে অন্য কোনখানে ডিসকাস করা যাবেখন। এখন আমরা ক্যালোরি ভুলে স্রেফ জিহ্বা জড়িত বিষয়ে না হয় মনোনিবেশ করি। একটা খুবই জুতসই এবং অবাস্তব কথা বাজারে চালু আছে। দুই প্রকারের নাকি মানুষ হয় - একদল যারা বাঁচার জন্য খায় এবং অন্যদল যারা খাবার জন্য বাঁচে ! আমি অন্য অনেক বিষয়ের মত এই ব্যাপারেও মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছি। আমার জিমে যাওয়া, দৌড়ঝাঁপ সবই এই দুই থিওরীর সাথেই অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে। আমি খাবার খাবার ভালোবাসলেও ‘ফাইন ডাইনিং’ নৈব নৈব চ। মনে হয় এর থেকে বড় ভাঁওতাবাজি খাদ্য-ভুবনে আর আবিষ্কার হয় নি। ভাই, এ কেমন খাওয়া যেখানে ট্যাঁকখালি করে খেয়ে বেরিয়ে এসে অন্য জায়গায় আবার খেতে হয়! ইয়াব্বর প্লেট, সুদৃশ্য-দেখনদারি আর তার মাঝে ভগ্নাংশ পরিমাণ খাবার। সেই খাবার নাকি বর্ণে গন্ধে স্বাদে অতুলনীয়! এই ধরণের রেষ্টুরেন্টওয়ালারা মনে হয় এই লাইনটা সম্পর্কে সম্যক অবহিত নয় -‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। ঐ অল্প পরিমাণ খাবার খেয়ে ক্ষুধায় মাথা ঝিমঝিম করলে - পরের পদ যাই হোক না কেন, সে তো অমৃতের মত লাগবেই !

    খাবার হবে পরিমাণ মত - তবে হ্যাঁ পরিমাণ কেমন হবে সেটাকে সরলীকরণেরও বিপদ আছে। যারা আমেরিকান খাদ্য সংস্কৃতির সাথে পরিচিত তাঁরা কথাটির অর্থ আশা করি বুঝতে পারবেন। আমেরিকান রেষ্টুরান্টে ৩-কোর্স ডিনার আমার মত খানেবালার কাছে প্রহসনের মত। স্টার্টার শেষ করেই আমার পেট ভরে যায়, বাকি দুই পদ তো দূর অস্ত। এই প্রসঙ্গে আমার আর এক জ্যেঠতুতো ভাই পিকুলের লাইফের ট্রাজেডির কথাটা বলে নিই। ও তরকারী খেতে এত ভালোবাসে যে আজ পর্যন্ত কোন নিমন্ত্রন বাড়িতে মাছ-মাংসের পদ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলনা। শাক, ডাল, চচ্চড়ি দিয়েই তার খাবার শেষ। রান্নাঘরে তরকারী হাতরাতে গিয়ে ও বহুবার ধরা পড়েছে। ঐ জন্যই বলে আপ রুচি খানা।

    আমি আসলে যেটা সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাইছি সেটা হল কিছু ঘটনাপ্রবাহ - এই খাদ্য বিষয়েই। পাকচক্রে আমি চার বছর এমন একটা বাড়িতে বাস করেছি যেখানে ২১টা বিভিন্ন দেশের ছাত্র বসবাস করত - কেমন খিচুরি সিচুয়েশন ছিল আশা করি বুঝতে পারছেন। এর মাঝেই কিছু ফার্ষ্ট হ্যান্ড জ্ঞান সংগ্রহ করে ফেলেছি অনেক সময় অজান্তেই বা না চাইলেও। এর মধ্যে কোন জল নেই - একেবারে র ।

    কোথায় শুরু করি বুঝতে পারছি না - ঘোড়ার মাংস রান্না দিয়ে ?

    কয়েক দশক আগে ইংল্যাণ্ডে ঘোড়ার মাংস নাকি বিয়েবাড়ির ডেলিকেসি ছিল। এখন আর তেমন নেই - চোরাবাজারের কথা বলতে পারব না, কিন্তু খোলা বাজারে ঘোড়ার মাংস পাওয়া যেত না (যদিও উঠের খুড় সমেত পা পাওয়া যেত)। তাতে অবশ্য কি হয়েছে ! ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয় বলে একটা কথা আছে না ! যোসেফের বাবা মালটা (‘মালটা’ একটা দেশ, ইতালির ঠিক নীচেই যার অবস্থান; রকের ভাষায় ‘মালে’ ভর্তি) থেকে আসছিল - তা কাকু একটু ঘোড়ার মাংস। তা মাংস নিয়ে উনি যে কি করে কষ্টমস পেরিয়ে এলেন সেটা একটা রহস্য, কারণ সাধারণত কাঁচা মাংস নিয়ে দেশ পারাপার নিষিদ্ধ বেশীর ভাগ জায়গাতেই (এ জন্যই মনে হয় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে জীবন্ত গরু পাচার প্রের্ফাড ধরা হয়)। যাইহোক ঠিক হল যোসেফ ট্রাডিশনাল মল্টীজ স্টাইলে ঘোড়ার মাংস রাঁধবে প্রথম দিন। সন্ধ্যাবেলা ল্যাব থেকে ফিরে প্লাষ্টিকের বাক্স খুলে ঘোড়ার মাংস বেরুল। দেখলাম মাংস টকটকে লাল - মাংস ছোটছোট পিস করে একটা পাত্রে দিয়ে গুচ্ছ রেড ওয়াইন ডালা হল, তাতে কিছু গাজর সহ অন্য সব্জী, পরিমাণ মত লবণ। সব্জী কেন দেওয়া বুঝলাম না, কারণ আমি বা যোসেফ পরাতপক্ষে সবুজ জিনিস ছুঁই না। তারপরে অল্প আঁচে রান্না চলল ঘন্টা দুই। সেই ফাঁকে আমাদের একটা সিনেমা দেখা হয়ে গেল। খেতে বসে সেই মাংসের স্বাদ যোসেফের নিজেরই ভালো লাগল না - আমার মোটামুটি লাগল। ততদিনে যোসেফ ভারতীয় কারির স্বাদ পেয়ে গেছে - তাই ঠিক হল ঘোড়ার বাকি মাংসটা দিয়ে পরের দিন কারি রান্না করব আমি। গরু পর্যন্ত ঠিক আছে, তাবলে ঘোড়া ! হিন্দু ধর্ম এই প্রসঙ্গে কি বলে কে জানে !
  • d | 14.99.63.176 | ২৩ মার্চ ২০১২ ১৪:৪১530396
  • ট্রেনে আমসঙ্কÄ নামে বিক্রি হওয়া কুমড়োসঙ্কÄ নিয়েও এক আধপ্যারা লিখবেন কিন্তু। :-)
  • Nina | 12.149.39.84 | ২৩ মার্চ ২০১২ ১৯:৪৯530398
  • এই লেখার স্বাদটা বড় ভাল---নিঁখুত করে ছবি আঁকা প্রতিটি জিনিষের--ডিটেলিং অনবদ্য !
  • pi | 72.83.76.34 | ২৩ মার্চ ২০১২ ১৯:৫০530399
  • সুকি, তোমার ট্রেনের খাওয়ার লেখা প্রসঙ্গে এসবুক গ্রুপে প্রচুর মন্তব্য আর আলোচহা চলছে। তুমি নোটিফিকেশন পাও কিনা জানিনা, তাই এখানে জানিয়ে দিলাম।
  • pi | 138.231.237.8 | ০১ মে ২০১২ ০৪:৫০530400
  • সুকি কি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলে নাকি ?
  • Sudipta | 79.132.108.212 | ০১ মে ২০১২ ০৮:৫০530401
  • বাহ বাহ বেশ বেশ! সুকি কাজের কাজ করেছে এক পিস, দারুণ হচ্ছে!
    তা দিলখুশ নিয়ে কথা হচ্চিল? রামরাজাতলার দিলখুশ, বেলঘরিয়ার চিঁড়ে বাদামের চাক আর মছলন্দপুরের এ কে অধিকারীর চানাচুরের কতা কেউ বল্লে না তো? খড়্গপুরের দিকে পদ্মপাতায় ঝালমুড়ি বেচতেন এক ভদ্রলোক, রীতিমত আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে আর সেইরকম চমকদার স্বাদ, আহা!
  • Suki | 127.194.6.89 | ০১ মে ২০১২ ০৯:২৪530402
  • এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা - ২

    যাদের ভারতীয় পুরাণের সাথে কিছুমাত্র সংযোগ আছে তারা সবাই জানেন যে ঘোড়ার মাংসের সাথে হিন্দুত্বের যোগাযোগ নিবিড়। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় ঘোড়াটিকে বলি দেওয়া হত এবং ততসহ ভোজন। আমি অনেক চেষ্টা করেও সেই মাংস রান্নার রেসিপিটা জোগাড় করতে পারি নি ! নিজে সংস্কৃত না জানার জন্য অন্যের অনুবাদের উপর নির্ভরশীল ছিলাম - তাবড় তাবড় পণ্ডিতরা সমাজব্যবস্থা, নৈতিকতা, অর্থনীতি বা প্রাচীন ভারতে কারিগরীবিদ্যা (যেমন পুষ্পকরথ আসলে উড়োজাহাজেরই পূর্বসুরী ইত্যাদি) নিয়ে আলোচনা করলেও এই মাংস রান্নার রেসিপিটার উল্লখ করতে বেমালুম ভুলে গেছেন ! দ্রৌপদী নাকি বিশাল রন্ধনশিল্পী - আরে ভাই তা নিয়ে পাতার পর পাতা না ফেনিয়ে দু-একটা স্যাম্পেল ঝাড়, নিজেরা ট্রাই করে দেখে রায় দিই কে বড় কুক - দ্রৌপদী নাকি জিমি অলিভার !

    তো ঘোড়ার কারির রেসিপি না জানার জন্য - আমি সেই আদি - অকৃত্রিম মাংস রান্নার পদ্ধতি অবলম্বন করলাম। এই পদ্ধতিতে আমার বিশ্বাস সমস্ত দু পেয়ে, চার পেয়ে বা পা-বিহীন জীবের মাংস সহজে ও মুখরোচক ভাবে রান্না করা যাবে। রেসিপি বাতলাবার জায়গা এটা নয় - মাংস ছোট করে কেটে টক দই, আদা, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি বাটা, পাতিলেবুর রস, একটু তেল, লবণ, লংকা, হলুদ, জিরে গুঁড়া (এবং হাতের কাছে যা যা পাউডার টাইপের আছে) সব দিয়ে মাখিয়ে রেখে দিন ঘন্টা চার-পাঁচ। এরপর মাংসটাকে আচ্ছা করে কষে - ট্যমেটো ইত্যাদি দিয়ে অল্প আঁচে সেদ্ধ হতে দিন। যদি এর পর কোন কিছুর স্বাদ না পান তা হলে একটু ট্যমেটো-চিলি সস্ ঢেলে দিন। ব্যাস চাইনীজ্ স্টাইলে (যেমন সবেতেই সয়াসস্ ও ভিনিগার) খাবার তৈরী।

    ঘোড়ার কারি আমরা নিয়ে বসলাম বাসমতী চালের ভাতের সাথে। দাদা, নিজের মুখে নিজের প্রশংসা করব না - তবুও বলে রাখি মাংসের পাত্র নিমেষে খালি হয়ে গেল। যোসেফ একাই প্রায় অর্ধেক খেয়ে ঘোষণা করল - এর থেকে ভালো ঘোড়ার মাংস নাকি ও জীবনে খায় নি ! রেড-ওয়াইন ইত্যাদি নয় - ঘোড়া রাঁধতে হলে সেটা নাকি কারিই হওয়া উচিত। যোসেফের পিতাশ্রীও সহমত পোষণ করলেন। আসলে মালটার লোকেরা মসলার ব্যবহার জানে না - ওদের কাছে কারি মানে একধরণের পাওডার - তার নামও খুব অদ্ভূত ‘কারি পাওডার’। তাই মালটীজ কারি হল - সেদ্ধ রান্নার উপরে একটু ওই পাওডার ছড়ানো ! কেউ জেনে ধোঁকা খায়, কেউবা অজান্তে। তা এই মালটীজরা না জেনে কারি বিষয়ক ধোঁকা খেয়ে আসছে কয়েক দশক ধরে !

    অনেকে আবার খাদ্য শিল্পের সাথে অতিরিক্ত খাদ্য প্রীতি ঘুলিয়ে ফেলেন, অনেকে ভাবেন খাবার গল্প করা মানেই যে খাচ্ছে তার মুখ আর যা খাচ্ছে তার বিবরণ। আসলে কিন্তু তা নয়, খাবার গল্প এর থেকেও অনেক বেশী কিছু - আচ্ছা, তবে একটু দেখেই নেওয়া যাক গপগপ করে খাওয়া বলতে আমরা কি বুঝি !

    গপগপ ব্যাপারটা ডিফাইন করা খুবই শক্ত। আমার খাওয়া পুতুপুতু জিরো সাইজের কাছে গপগপ - আমেরিকানদের খাওয়া ইউরোপিয়ানদের কাছে গপগপ - মুখের কাছে ছোট্ট বাটিটা ধরে চপস্টিক দিয়ে মুখে ভাত পাচার করা আবার অন্য গপগপের রকমফের। আসলে সবটাই আপেক্ষিক। তবুও সৌন্দর্য্য ব্যখ্যা করার মত গপগপ ব্যখ্যারও একটা চেষ্টা দেওয়া যেতে পারে - ওই ধরণের খাওয়া মোটামুটি চোখে লাগে। মিথ্যা বলব না, ছোটবেলায় বিয়েবাড়িতে খেতে গিয়ে মাঝেমাঝেই আমি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়তাম। মিষ্টির প্রতি আমার বরাবরই একটু ঝোঁক বেশী। তাই পেটপুরে মাংস পর্যন্ত শেষ করে, চাটনি - দইএ একটু বিশ্রাম নিয়ে, মিষ্টি হাজির হলেই আমার পাকস্থলীর আয়তন কোন আভ্যন্তরীন হর্মোন ক্ষয়ের দরুণ স্ফীত হত। ফলতঃ রসগোল্লার সাথে আমার একটা মাখোমাখো গপগপের সম্পর্ক ছিল - গড় ছিল ১৮-২০টার মত। তবে যারা টিভিতে হট্ডগ ভোজন প্রতিযোগীতা দেখেছেন তাদের আশা করি গপগপ শব্দটার প্রতিশব্দ খুঁজে দিতে হবে না। আমি যবে শেষবার ওটা দেখি - ৫ মিনিটে ৫১টা হটডগ খেয়ে এক জাপানী বিজয়ী হয়েছিল। ওটা খাওয়া ছিল না - গেলা বা আঙুল দিয়ে ঠেলে পাকস্থলীতে পাঠানো বললেই হয় আর কি ! ইহা মোটেই ভালো নয়।

    তবে অন্যদিকে সৌগতর ফিলসফি ফলো করাও আমি মোটেই সমর্থন করি না। একবার আমি সৌগতর সাথে কলেজ থেকে গেছি বিয়েবাড়িতে খেতে - দুপুরের খাওয়া মিস দিয়েছি যথারীতি ভালো করে সাঁটাবো বলে। গেলুম বিয়েবাড়িতে - সবাই হাই-হ্যালো বলে আর খেতে যায়। সৌগত দেখি নড়েই না। ওর আবার হাত তুলে নমস্কার করার একটা ব্যাপার আছে - যেখানে জোড়া হাতটা ঘাড় আর বাম কাঁধের মধ্যের সমকোণটার মাঝামাঝি (অর্থাৎ ৪৫ ডিগ্রী কোণে) উঠবে। সেটা নাকি আদি/অকৃত্রিম কংগ্রেসী স্টাইল ! তো যাই হোক আমি খোঁচামারি সৌগতকে খেতে যাবারঁ জন্য। যতই হোক বিয়েবাড়িতে আসা ওর চেনাশোনার সূত্র ধরেই। তো ঘন্টা দুই পর আমার মাথায় বাজ ফেলে সৌগত ঘোষণা করল - হ্যাংলার মত খেতে যাব মানে ? আমরা নাকি জাষ্ট জলযোগ করব ! মিষ্টির প্লেট এলে ও একটা মিষ্টি ডাইরেক্ট টাকরায় (ঠোঁটে লিপষ্টিক না থাকা সত্ত্বেও) চালান করে ঘোষণা করল - বাকিগুলো ফেরত নিয়ে যান মাসিমা। বাইরে বেরিয়ে এসে সৌগত আমাকে নিয়ে রেষ্টুরান্টের দিকে রওনা দিল -সেখানে খেয়েই পেট শান্ত করলাম - কারণ বিয়েবাড়িতে খাওয়া সৌগত মতে নাকি প্রায়শঃই ভালগার।
    গপগপ খাবার শেষ উদাহরণ আমার বন্ধু কারকের বাদাম খাওয়া। ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল ট্যুরে যাচ্ছিলাম ট্রেনে করে - বাদাম কিনে সবার মাঝে রাখা হল - গল্প করতে করতে সবাই এক জায়গা থেকে নিয়েই ছাড়িয়ে খাচ্ছিলাম। খানিক পরে কারক অনুধাবন করল বাদামের ঠোঙয়ার আয়তন সসীম। তাই ও খোসা না ছাড়িয়েই বাদাম মুখে ফেলে চিবুতে শুরু করল। একের পর এক খোসাশুদ্ধ গোটা বাদাম কারকের পাকস্থলীতে চালান হতে লাগল। যতই হোক, মেদনীপুরের ছেলে বলে কথা - হজম শক্তি অনন্যসাধারণ।

    গপগপের বিপরীত ধীরেসুস্থে খাওয়ার উদাহরন কিন্তু আমাদের সকলের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে - কারও কারও তো খাবার দুইবার গরম করতে হয় মাঝে! তেমনই এক উদাহরণ ছিল আমার অন্য রুমমেট সাধন - যার সম্পর্কে সৌগত বলত “ছোটবেলায় ভালো দেখতে ছিল, আরো বড় হলে বুদ্ধি হবে”। সাধন খেতে ভালোবাসত, বিশেষ করে মাংস-রুটি। হোষ্টেলে যেদিন মাংস হত সেদিন সাধনকে দেখতাম কোণের দিকে টেবিলে খাচ্ছে চেয়ারের উপর পা গুটিয়ে আয়েশ করে। এখন কলকাতা বাজারে রুমালি রুটির সাইজ কেমন হয়েছে বলতে পারব না - কিন্তু বছ্র দশেক আগে দুটো বা তিনটে খেলেই স্বাভাবিক পেট ভরে যেত। সাধন সময় নিয়ে খেত ১২ থেকে ১৪টা। একদিন ওর খেয়াল চাপল আমাদের রুমে মাংস রান্না করা হবে। কিছু করিতকর্মা পাবলিকের দৌলতে আমাদের রুমে ইলেকট্রিক হিটার, কাঁচের নানা সাইজের পাত্র ছিল - যেগুলি সবই কেমেষ্ট্রি ল্যাব থেকে না বলে আপন করে নেওয়া। মাখনদার কাছ থেকে মশালা ইত্যাদি জোগাড় করে সাধন মাংস রান্নায় বসল। আমরা হেলপ অফার করলেও মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটবে বলে আমাদের অংশগ্রহন কেবল খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ঠিক হল। এক সময় নির্দেশ এল স্নান করতে যাবার জন্য কারণ মাংস নাকি সমাপ্ত হবার পথে। এদিকে হাল্কা পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম - সাধনের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করাতে আমি মাংস রান্নার কিছুই বুঝি না প্রতিপন্ন হল! সবার স্নান হয়ে ফিরে এলে ঢাকা দেওয়া মাংস খোলা হল। সে কি রঙ, সে কি গন্ধ - কাঠকয়লা আর বিটুমিন মেশালে যেমন রঙ হয় - আর বারুদ পোড়ার মত গন্ধ। সাধন কাঠের হাতা দিয়ে মাংসটা ঘাঁটতে গেলে হাতা ছিটকে গেল। রান্না যে একধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়া মাত্র তা সেদিন প্রথম অনুভব ও প্রত্যক্ষ করলাম। কোন এক অস্বাভাবিক প্রৌকশলে সাধন সমস্ত মাংসটাকে একটা জমাটবদ্ধ লাভায় পরিণত করে ফেলেছিল! বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, সেই মাংসেই অল্প অংশ খেয়ে সাধন ও কারক ঘোষণা করল খুব একটা মন্দ হয় নি - একটু জমাট বেঁধে গেছে এই যা !

    এর পরে তাই সাপ রাঁধার সময় বয়-দার পদ্ধতি আমাদের সাধনীয় পদ্ধতির থেকে অনেক এফেক্টিভ মনে হয়েছিল। তবে সাপ রান্নার বিবরণ দেবার আগে বয়-দার পরিচয়টা একটু দিয়ে নিতে হবে।।।।।।।।।

    (ক্রমশঃ)
  • ঝিকি | 229.83.85.197 | ০১ মে ২০১২ ০৯:৪৬530403
  • কেয়াবাত!
  • Sibu | 118.23.41.126 | ০১ মে ২০১২ ০৯:৪৯530404
  • সুকির ঘোড়া ঘোড়া কান্ড শুনে স্বামীজির মাংস রান্নার গপ্পো মনে পরে গেল।এক গুরুভাইকে লেখা চিঠিতে উনি নিজেই বর্ণনা দিয়েছে। জিরে ধনে লবংগ দারুচিনি মেথি কলোজিরে জাফ্রান, মানে প্যান্ট্রিতে যা যা ছিল তার সবই কাজে লেগেছিল। তবে একটু দুঃখু থেকে গেচল হিংঅটা পাওয়া যায়নি বলে। যারা খেয়েছিল তাদের একজনের মতামত রেকর্ডেড আছে। এক সাহেব শিষ্য লিখেছিলেন যে একজন বিবেকানন্দ যদি রান্না করতে পারেন তো উনি তা অবশ্যই খেতে পারেন, প্রাণ গেলেও পারেন। শেষে ছোট করে যোগ করা, প্রাণ অবশ্য প্রায় গিয়েছিল।
  • সোসেন | 125.241.48.23 | ১২ মে ২০১২ ০৭:১৩530405
  • পুরনো খাবার, পুরনো জিভ



    বয়েস বাড়লে কি মুখের তার পাল্টে যায়, না কি কলকেতার খাবার দাবার পাল্টে গেল গিয়া? কিসুই বুঝে পাচ্ছিনে। বেস্পতিবার মাতৃদেবীর লক্ষ্মীপূজার দিন। আর আমার ছিল গুঁজিয়া খাওয়ার দিন। আহা, দুধ-সাদা খুদে খুদে ওই মিষ্টি কে যে পেরথম বানিয়েছিল! জিভের চাপে আলতো গলে গিয়ে হালকা হালকা দুধ-গন্ধ মিষ্টি রস মুখে ছড়িয়ে পড়লেই স্বর্গের স্বাদ পেতাম। তার সঙ্গে যদি থাকে প্রচ্ছদে কৃষ্ণেন্দু চাকী কিংবা বিকাশ বাবুর সেই অত্যাশ্চর্য ছবিওয়ালা আনন্দমেলা, তা হলে আমাকে খুঁজে পেতেন তমালকাকাদের ভাড়াবাড়ির পেঁচানো লোহার সিঁড়ির ষোলো কিংবা সতেরো নম্বর ধাপে। স্বর্গের স্বাদে মশ্গুল ক্ষুদ্র বালিকা, রোগা কাঁধ থেকে খসে পড়া জামার পুট আর পাশেই ইস্টিলের ক্ষুদ্রতর প্লেটে গুঁজিয়া। এখন মা পুজোতে আর গুঁজিয়া দেয় না। সেদিন বলাতে, বাবা নিয়ে এসেছিল বোধ করি। মুখে দিয়ে স্বর্গ থেকে ঝপাং করে পাতালে পন্নু। এ কেমন হল? শক্ত, জমাট কন্ডেন্স্ড মিল্ক আর চিনি। এ কি আমার সামনে পড়ে থাকা জার্নাল আর পেপার গুলোর দোষ, না কি, বয়সে বাড়া জিভের দোষ, না কি ময়রার দোষ ? ভেবে ভেবে আর থৈ পাচ্ছিনে। দুপুরবেলায় ছোট কড়াই বা ঝুড়ি নিয়ে হেঁকে আসতো "শোন্পাপড়িইইই !" চৌকো করে কাটা বাটার পেপারে চৌকো ফুলো ফুলো সোনারং শোন্পাপড়ি, দাম ছিল তার তিরিশ পয়সা। সপ্তাহে একটিদিন তো রুটিন মাফিক পাওয়া যেত সেই স্বাদ, মিষ্টির দোকানের নয়, অন্য রকম, খানিকটা বুড়ির চুল টাইপ, কিন্তু অত মিষ্টি ও নয়। ধীরে ধীরে সে স্বাদ ভুলেই গেছি, শুধু জিভের কোন কোষে লেগে ছিল তার স্মৃতি। কাঁকুরগাছির মোড়ে পেলাম সেই রকম এক শোন্পাপড়িওলাকে খুঁজে, আর ভয়ানক খুশি হয়ে কিনে ফেল্লাম। তাপ্পর" পতন তো চিরকাল অধঃলোকেই হয়" ইত্যাদি। ফুলকপির সিঙ্গারা মর্ত্যলোক থেকে বুঝি ঘনাদার সাথে সাথেই হারিয়ে গেল। সেদিন আট টাকা দিয়ে মারোয়াড়ি ফুলকপির সিঙ্গারা খেয়েছি, দুঃখের কথা আর কি বলবো। সিঙ্গারার ভিতরে আস্ত তরকারির টুকরো আর দেখতেই পাচ্ছিনে। ছোটকালে দেখতে পেতাম মনে হচ্ছে, সে কি আমার স্মৃতির ভুল? সব দোকানেই চট্কানো ঘ্যাঁট। এই বস্তুটিতে আবার সব ভেস্তানোর জন্য কাজুবাদাম দেওয়া ছিল। লাগে রাহো ভিখারাম ভুজিয়াওয়ালা।

    আরো সব লিস্টি আছে। বল্ছি ধীরে ধীরে। তবে এহেন জিনিস(আকা খাদ্য) আছে যা বদ্লায় নি- যেমন ধরুন গিয়ে ঘটিগরম। এখনো আমের সময় কাঁচা আম, না হলে আমড়া কুচি দিয়ে -- আহহহ, বিকেলে খেলে ঘর্মাক্ত শরীরে ঘটিগরম খেয়ে, সন্ধ্যের ঝোঁকে পুকুরে স্নান করে ভিজে গায়ে বাড়ি ফিরতাম- বকুনির মধ্যেও জিভে ওই স্বাদ মুখে বুদ্ধমার্কা হাসি ঝুলিয়ে রাখার অনুপ্রেরণা যোগাত। এখনো একই রকম, আমি বদলে গেলেও।

    আর বাড়ির আলুভাতে মাখা, পেঁয়াজকুচি কাঁচালঙ্কা সৈরষার তেল দিয়া। সুকুমার রায়ের লেখার আমি ই কি একমাত্র এক্সেপশন?- কহ ভাই কহ রে, আঁকাচোরা নগরে/ বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না? আলুভাতে খেলে পরে/ ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে/ মগজেতে এক্দম বুদ্ধি গজায় না( ইট্টু ইদিক ওদিক হৈতে পারে)। তবে এইটেই বোধহয় কারণ, বদ্যি হয়েও এইসান আলুভাতে খেয়েছি, যে ইহজনমে বুদ্ধি গজানোর আর কোনো স্কোপ রৈল না কো।



    পচা আলুর বড়া-বাঙাল উত্তরাধিকার

    আমি হলাম বাঙাল। কেন? আমার মা বাবা দু'জনেই বাঙাল তাই। জন্মে অবধি বাংলাদেশের মুখ দেখিনি বিশ্বাস করুন। মা'র জন্ম ও এই দেশে, বাবা ছানা অবস্থায় ইমপোর্ট হয়েছিল। সেই সঙ্গে বাঙাল রান্না ও ভোকাবুলরিও কিছু এদেশে এসে পড়েছিল, যা কিনা আমার উত্তরাধিকার। সাথে বাংলাদেশী জমি বিক্রি করা টাকা পয়সা কিছু এলে খুসি হতাম , তা ত এল না, তাই খাদ্যের গপ্পই হউক।

    আলুর কথা যখন হচ্ছে তখন "পচা আলুর বড়া" র গল্প না বলে শান্তি পাবো না।

    আর কোনও বাড়িতে পচা আলুর আইটেম হয়? আমাদের সেনগুপ্ত ফ্যামিলির ডেলিকেসি এইটে।

    কিন্তু মা করতে পারে না, বাবা পারে। কারণ এটা এসেছে বাবার বাড়ি থেকে। রেসিপি খুব সোজা। যে সব আলু একটু দাগ ধরে যায় না? তরকারি তে দিলে গন্ধ লাগে? সেই আলু গুলো নিন। দাগ লাগা জায়গা টা কুরিয়ে ফেলে দিন। শিলে থেঁতো করুন, অনাবাসীরা গ্রাইনডার এ দিন। নুন, একটু লঙ্কাগুঁড়ো, একটু চিনি, আর অনেকটা ধনেপাতা দিয়ে মেখে নিন, এট্টুসখানি আটা দিয়ে মাখবেন। ছোট ছোট বড়া গড়ে অল্প আঁচে অল্প তেলে ভেজে ফেলুন। হেব্বি খেতে, আলু-টিকির মত নয় মোটে। আর ভাল আলু দিয়ে কললে হয়, কিন্তু স্বাদে খিঁচ থাকবে।

    তা আজকাল আলু পচা পাই না। মা বলে আলু বেশি পচে না।

    এই আলুর বড়া নিয়ে একটা গল্প আছে, বাবার কাছে শোনা, সেইটে না বললে, ব্যাপারটা শেষ হবে না। তখন বাবা ছোট, বাংলাদেশ থেকে সদ্য এসে ঠাকুর্দারা ঘাঁটি গেড়েছেন মেদিনীপুরে। মেদিনীপুরের লোকজন ত এই রেফুজি পরিবারের খাদ্যাভাস দেখে বিস্মিত, কচু, জংলি শাক যা পায় খায়- এইরকম একটা ব্যাপার। ত পাশেই ছিল এক আলুর আড়ত। আলুর আড়ত এ আলু পচে যায়, আর আড়তওয়ালা তা ফেলে দেয় রোজ রোজ। দেখে দেখে আর না পেরে আমার বাবার ঠাকুমা গিয়ে আড়তওয়ালা কে বললেন " দাদা, আলুগুলা রোজ ফ্যালাইয়া না দিয়া আমাকে দ্যান, রান্না করুম অনে। " সে ভদ্রলোক ত অবাক, "সে কি, পচা আলু দিয়ে রান্না করবেন কি?" বড়মা স্মিত হেসে বল্লেন "দ্যাখেন না, আপনারে খাওয়ামু"। খেয়ে ত ভদ্রলোক আপ্লুত। তার পরের দিন ও আবার চলে এসেছেন" মাসিমা, এই দেখুন কি এনেছি! " বড়মা বেরিয়ে এসে দেখলেন ভদ্রলোক একটা বড় পচা কুমড়ো নিয়ে এসেছেন; লাজুক লাজুক হেসে বলছেন, "আচ্ছা, পচা কুমড়ো দিয়ে কিছু রান্না হয় না? "বড়মা বোল্ড।



    ইস্কুলের বাইরের আচারের কথা মীনাক্ষী লিখতে বলেছে । এই ব্যাপারে ভাবতে গিয়ে একটু মুস্কিল হল, আমার কিছুতেই আচার বলতে স্কুলের বাইরের আচারের কথা মনে পড়ছে না। আচার বলতেই আমার জিভ সোজা দক্ষিণেশ্বর এর মন্দির প্রাঙ্গণে গিয়ে লাইন দেওয়া আচারের দোকান গুলোর সামনে নিজেকে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। অনেকটা কালী মাযের মতই।

    দক্ষিণেশ্বর যে কতবার গিয়েছি ছোট ও বড় বেলায় তার ঠিক নেই। একটু ছুটি পড়লেই বাবা চালাও পানসি দক্ষিণেশ্বর বলে আমায়, মা ও ভাইকে বগলদাবা করে দক্ষিণেশ্বর চলে যেত। বাদাম, বানর, শিব মন্দির আর কচুরী ছোলার ডাল এই ছিল আমাদের দক্ষিণেশ্বর উইকেন্ড, সস্তায় পুষ্টিকরও। বড় হয়ে একা ও দোকা ও গিয়েছি, বারে বারে।

    জানিনা, আর কে কে ওই সব অত্যদ্ভূত আচার খেতে ভালবাসেন, তবে আমার কাছে ওই আচারের কোন তুলনাই নেই। যেমন ধরুন, ডাবের শাসের আচার। ঈষত্‍ মিষ্টি, দুনিয়ার তাবত মশলা ও তেঁতুলএর র মধ্যে থেকে ভেসে আসা ডাবের ঠান্ডা ঠান্ডা স্বাদ, আর উপরে লেবু পাতার কুচি ছড়ানো। না এইটি আর পাওয়া যায় না। না পেয়েছি কোনও রেসিপি, না কোনও আচারের দোকানে আর দেখতে পাই, আমার স্মৃতি ছাড়া এই আচার চাখবার আর কোনও উপায় কেউ এট্টু বলে দিলে ধন্য হই। কিংবা, বাঁশের কোঁড় এর আচার। পিঁয়াজের আচার। কাঁচা মরিচ ও গোলঞ্চের আচার। শেষেরটা ও আর মেলে না। একেবারে সবুজরঙের আচার ছিল, ঝাল/ মিষ্টি, টক প্রায় নেই। ধনেপাতার গন্ধ বেরত, আর বেশিদিন রাখা যেত না। মরিচ দেখতে পেতাম, গোলঞ্চ কেন? কেউ যদি স্বপনে আসিয়া কহিয়া যায়-----

    আর আচার হল গে বড়বাজারি আচার। ইয়া বড় বড় লঙ্কায ঠাসা হজমিমাখা , কী বা তার স্বাদ। রসুনের হালকা হালকা সাদাটে আচার। পুদিনাপাতা ছড়ানো। এক এক জন মারোয়াড়ি মহিলা কে, এক এক কেজি আচার ও কিনতে দেখেছি। সুখের বিষয়, এই সব আচার এখনো উপলব্ধ, একই স্বাদে । ঠিকানা চাইলে বাবার কাছ থেকে জেনে ভাল করে বলে দেব। তার পর, ইয়ে, রুটি ডাল আর এক থাবা আচার- ডায়েট কন্ট্রোলের বাবা হবে, কিন্তুক জিভের তারটি থাকবে ঠিক।

    তা বলে কী আর গাড়ি ঠুনঠুন আচারকাকু কে উপেক্ষা করতে পারি? আমের সময় মিষ্টি আমের আচার আর আমতেল, আমসি ও। কুলের সময় কুলের আচার , ঝালকুল, আর লাল লাল মসলা জড়ানো সেকুল। বারোমেসে তেঁতুলের আচার। করমচার হাড় টক আচার। আর তার সাথে লম্বা লম্বা করে কাটা কামরাঙ্গা তো আছেই। কাঁচামিঠে আম, তেল নুন এ জারিয়ে, আহা, আহা, একটু মেলে কম, তবে এখন তো আর ও খেয়ে বকুনি খাই নে। করম্চার আচার কিঞ্চিত দুস্প্রাপ্য হয়ে গেছে, কিন্তু বাকিগুলো খেয়ে দেখুন। তবে,খেয়াল করে দেখবেন, চাঙ্কী চাট মসলা যেন ছড়িয়ে না দেয়। বাঙালীর আচারে পান্ডে-প্রবেশ মানবতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। হেভি সিরিয়াস মুডে বললাম-

    অথ সোনালীকৃত আচারায়ণ! কাল আবার অন্য খাবার আসবে। সংগের ছবিটি কাঁচা মরিচের আচার।



    ঘটি পোস্ত, বাঙাল পোস্ত

    পোস্ত ও ফরমায়েশি। ঘনাদা ফরমাশ করেছেন। কিন্তু আনন্দের কথা হল এই যে পোস্তর স্বাদ আমার মুখে বদলায় নি। তাই পোস্তর একটা নথি বানাব মনস্থ করলাম। প্রচুর ইন্টারভিউ ও করলাম। এখন তার ফলাফল লিখছি। সবাই কিছু কিছু যোগ করবেন এরকম ও আশা রাখছি আপাতত।

    পোস্ত প্রধানত দুই প্রকার, ঘটি পোস্ত ও বাঙাল পোস্ত। ঘটিরা কেউ কেউ দাবি করলো, গঙ্গার এপার ও ওপারের পোস্ত রান্না আলাদা। একে একে পাতে দিচ্চি, সবুর সয়েন।

    প্রথমেই আলুপোস্ত, কালজয়ী। বেশ কয়েকরকম আলুপোস্ত কে চেনা যাচ্ছে আলাদা আলাদা করে। প্রথমেই দ্যাখেন, আপনার পাতের পাশে ডুমো ডুমো গাঢ় হলুদ ভাজা আলু, সারা গায়ে লোধ্ররেণুর মত ভাজা পোস্ত, কাইটি ও দিব্য ঝুরো ঝুরো, জল নামেমাত্র, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন,বেশ ঝাল ঝাল। খাবেন আমের টক ডালের সাথে। বরিশালি পোস্ত এই রকম। পুরুলিয়ায় ও এই রকমই পোস্ত দেখেছি, মিষ্টি একটু কম পড়বে। আর ওই যে পাতের পাশে ইস্টিলের বাটিতে সাদা পোস্ত রয়েছে, ওইটি হল গঙ্গার ওপারের আলু পোস্ত। সাদা ঝোল, কাঁচা লঙ্কা, একটু কোর্স করে বাটা পোস্ত। এটি খাওয়ার জন্য চাই বিউলি ডাল ও গন্ধরাজ লেবু। কলকাতার খাস আলুপোস্ত খেতে চাইলে বরিশালি পোস্তকে একটু কম ভাজুন, জল দিন, সিদ্ধ সিদ্ধ রাখুন। বাটা হবে মিহিন। মেখে খেতে পারেন গন্ধহীন সরু চালের ভাত। আর ওই গঙ্গার ওপারের পোস্ত তে দিন বাটা শুকনো লঙ্কা। পেলেন মেদিনীপুরিয়া পোস্ত। দম থাকলে তবেই খাবেন। আমি একবার খেয়ে গোটা ঝাড়গ্রাম টুর হাপুস নয়নে কেঁদেছিলাম। তবে বাড়িতে নিশ্চয় লোকে কম ঝালেও করে।

    আলু বাদে অন্য সব্জি ঘটিরা কি কি খান পোস্ততে ? ঝিঙে, আলু + ঝিঙে এবং পিঁয়াজ। আর কিছু কেউ বলেন নি । আমরা বাঙালরা খাই- বুক ভরে দম নিন, পটল পোস্ত, ঢ্যঁাড়স পোস্ত, চিচিংগে পোস্ত, পোস্ত দিয়ে লাউশাকের ঝোল, পোস্ত-চড়চড়ি, ফুলকপি পোস্ত, শিম-বরবটি-পোস্ত-সৈরষা।

    তা ছাড়া পোস্ত- সরষের কম্বিনেশন আমরা প্রায়ই চচ্চড়িতে ব্যবহার করি। আহাহাহা- কিভাবে যে জিভের জল সামলে আমি এসব লিখ্ছি, আল্লাতালাই জানেন।

    আমিষে যাওয়ার আগে বলে নি কাঁচা পোস্ত বাটার কথা। এটা বাঙাল না ঘটি জানিনে, জান্তেও চাইনে। আমার যদ্দুর ধারণা এ রেসিপি কৈলেস থেকে ডাইরেক্ট ডেলিভারি হয়েছে। কুন ভ্যাজাল নাই। পোস্ত বাটেন, সৈরষার ত্যাল, নুন চিনি কাঁচালঙ্কা মাখেন, এক থাল ভাত খান, এক দুপুর ঘুমান। বুকের উপর একটি পুরোন দেশ পত্রিকা নিয়ে। আআআহ !

    আমিষে পোস্ত বাঙাল বাড়ি আকছার দিয়ে থাকে। মাছ-পোস্ত, মুরগি-পোস্ত, সবই হয়। তবে আমার যদ্দূর ধারণা, এগুলো খুব অথেন্টিক নয়। আমিষ পোস্ততে অথেন্টিক হল চিংড়ি-পোস্ত। ঘটি বাড়ির চিংড়ি- পিঁয়াজ পোস্ত, বাঙাল বাড়ির চিংড়ি পোস্ত ভাপা, বা চিংড়ি পোস্ত সরষে। কুমড়ো পাতায় মাছ জড়িয়ে সাদা সরষে পোস্ত বাটা দিয়ে হাল্কা ভাপা করা হয়। মনোমুগ্ধকর।মুরগি-পোস্ত ও হয় তবে তেমন দরের খেতে নয়। ঘটিরা বোধ হয় আমিষ পোস্ত তত ভালবাসেন না। একবার দৈ-ইলিশ-পোস্ত খেয়ে দেখেন কেনে?

    বড়ি পোস্ত, আর পোস্তর ঝাল। দুটোই একটু হট্কে খাদ্য, তবে আমার মত চাখুনি পার্টি হলে চেখে দেখুন। বড়ি পোস্ত তারকেশ্বর লাইনে পাবেন। আর পোস্তর ঝাল ভজহরি মান্নায়।

    সর্বশেষে আসি পোস্তর বড়ার কথায়। ঘটি -বাঙাল সব সমান পোস্ত-বড়ার কড়ায়ে। মিহিন করে পোস্ত বাটুন, নুন -চিনি মেশান, সেঁকা সেঁকা করে বড়া ভেজে ফেলুন। নো আটা, নো চালের গুঁড়ো। এই ভাজা কঠিন কাজ, লাগলে ছক্কা, না লাগলে অক্কা। কিন্তু চেষ্টা করে যান আটা ছাড়া নামাতে। যেদিন পারবেন, সেদিন আপনি রসুইঘরের রাজা!
  • সোসেন | 125.241.48.23 | ১২ মে ২০১২ ০৭:১৪530406
  • পাই এর নির্বন্ধে দিয়ে গেলুম। ঃ)
  • সুদীপ্ত | 79.132.108.212 | ১২ মে ২০১২ ০৭:২২530407
  • ঘটি পোস্ত-য় একটা জিনিস বাদ গেল, কড়াইশুঁটি দিয়ে দেখুন, দুর্দান্ত লাগে। ঝিঙের বদলে চিচিঙ্গে পোস্ত-ও বেশ উপাদেয়। আর বিউলির ডাল, সামান্য সর্ষের তেল, নুন, কাঁচালঙ্কা দিয়ে আলু ভাতে, এই আলু পোস্ত আর পাঁপড় ভাজা (মশলা নয়, আমাদের প্লেন মাধুরী পাঁপড়), ও পেলে, মুর্গী মাটন ফেলে খাই ঃ)

    খাসা লিখেছেন, আর-ও হোক
  • i | 134.168.138.7 | ১২ মে ২০১২ ১৭:২৮530409
  • সু কি,
    সাপ রাঁধার গল্প কই? বয়দার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন বলে কোথায় যে গেলেন! একদম অন্য স্বাদের লেখা। জলদি আসুন।অপেক্ষা করছি।

    সোসেন,
    আপনে তো জুলি পাওয়েলের সেই ৩৬৫ দিনে ৫২৪ রেসিপির কথা মনে করালেন মহায়।

    নিয়ামত খান সাহেবকে মিস করছি খুব। আর বাঘু বেকারকে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন