এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • কুলদা রায় | 34.90.91.2 | ১৭ আগস্ট ২০১২ ২০:০২570325
  • হুজুর সন্ধ্যা
    কুলদা রায়

    বাড়িটির নাম চিলেকোঠা। চারিদিকে বাগান। মাঝখানে ছোটো বাংলো ধরনের টিনের ঘর। কোনো চিলেকোঠা নেই এই ঘরটিতে। মধ্য পাড়ার প্রবীণ মোক্তার অসিতবরণ সরকার মফস্বলের ইতিহাস নামে ইতিহাস একটি রচনায় লিখেছেন—এই এলাকায় গ্রেগরী চিলম্যান নামে এক ইংরেজ এসেছিলেন ১৮০৩ সালে। শুরু করেছিলেন নীলচাষ। এই নীলচাষের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একটি মাঠের নাম আজও জারী আছে। নাম–নীলার মাঠ। এই নীলার মাঠে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে ঘোড়-দৌঁড় হয়। অসিতবরণ বাবু আরও লিখেছেন—এই চিলম্যান সাহেব মধুমতী নদীর তীরে পাঁচ বিঘা জমির উপরে এই বাড়িটি তৈরি করেন। তিনি একাই থাকতেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। চিলম্যানের নাম-অনুসারে এই বাড়িটির নাম চিলেকোঠা। প্রবন্ধটি ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে প্রকাশিত সাহিত্য সংকলন কোরক-এ ছাপা হয়েছিল।

    এই চিলেকোঠা বাড়িটিতে হুজুর স্যার থাকতেন। তাঁর পুরো নাম সৈয়দ সালামতউল্লাহ। বাড়ি দিরাই, শালনা। জেলা সুনামগঞ্জ। এইটুকু তথ্যই মডেল স্কুলের রেজিস্ট্রারে লেখা আছে। তিনি কবে দখিন দেশের এই মফস্বল শহরে এসেছিলেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। স্কুলের কেরানি আসমত আলী বললেন—স্কুলটি ১৯৭২ সালে সরকারী হয়। এর আগের কাগজ পত্র নাই। পাক মিলিটারীরা পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে লোকে বলে, তাকে কখনও এ শহরটি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে দেখা যায়নি। ফলে শালনা দিরাই বা সুনামগঞ্জ যে তাঁর বাড়ি সে ব্যাপারটিও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।

    হুজুর স্যার অঙ্ক কষাতেন। আরবী ক্লাশ নিতেন। মসজিদে শুধু যেতেন নামাজ পড়তে। আর কোথাও যেতেন না। সবার সঙ্গে এক ধরনের দুরত্ব রেখে চলতেন।

    হুজুর স্যারই আবিস্কার করেছিলেন—আলমগীরের ছবি আঁকার সহজাত প্রতিভা আছে। ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে সে কাঠ পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকে তার খাতায়। ফুল বা পাখির ছবি। তার নিচে আবার লেখে—হলুদিয়া পাখি। তখনো এই শহরে রং পেন্সিল আসেনি। এলেও আলমগীর কিনতে পারত কিনা সন্দেহ আছে।

    হুজুর স্যার ছিলেন বাম হাতি। প্রতিদিন একটি বেত বাম হাত দিয়ে ধরে আনতেন। টেবিলের এক কোনে স্কুলের নিয়ম অনুসারেই রেখে দিতেন। কেউ কখনো স্যারকে বেত মারতে দেখেনি। এটা তার প্রয়োজন হত না। তিনি অঙ্কে বিখ্যাত ছিলেন।

    সেদিন আলমগীর ছবি আঁকছিল অঙ্ক কষা বাদ দিয়ে- – হুজুর স্যার সেটা ধরে ফেললেন। খাতাটি হাতে নিলেন। সবাই বুঝলো আজ বিপদ হতে পারে আলমগীরের। জীবনে প্রথম হুজুর স্যার বেতটি ব্যবহার করবেন। সবাই নীরবে সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটির জন্য অপেক্ষা করছিল তখন হুজুর স্যার খাতাটি নিয়ে জানালার কাছে গেছেন। গভীরভাবে দেখছেন। সবাই অবাক হয়ে দেখতে পেল হুজুর স্যারের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। তিনি বলে উঠলেন—দুধ ফুল। দুধের মত সাদা। এই এলাকায় বলে টগর ফুল। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি একটি ছড়াও বললেন– হলুদ বনে কলুদ ফুল। তারার নামে টগর ফুল।।
    তিনি আলমগীরের কাছে গিয়ে বললেন, ফুলটি টগর ফুলই হয়েছে। এর পাশে দুটো পাতা এঁকে দাও।

    আলমগীর দুটো পাতা এঁকে দিল। স্যার আরও মুগ্ধ হলেন। বললেন বাহ। কিন্তু আলমগীরের মন ভরেনি। সে মৃদু গলায় বলল, পাতায় সবুজ রঙ হলে ভাল হত। স্যার বললেন, এই টগর ফুলের গন্ধ নেই। থোকা টগরে গন্ধ আছে। তবে টগর ফুলের পাপড়িতে শিশির পড়লে আরও সৌন্দর্য্য বাড়ে। এর তুল্য তসবির নাই।
    এরপর একদিন হেড স্যার আলমগীরকে একবাক্স রং পেন্সিল দিলেন। এগুলো ইউনিসেফের। এতদিন কোনো ছাত্রকে দেওয়া হয়নি। আলমারীতে তালাবদ্ধ ছিল। আলমগীরই এ ব্যাপারে ইতিহাস গড়ল। হেড স্যার বললেন, শুধু ছবি খাড়া নিয়াই থাইকো না। তোমার তো অঙ্কের রেজাল্ট খারাপ। লেখাপড়ায় মনোযোগ দাও।
    হুজুর স্যারই আলমগীরের লেখাপড়ার দ্বায়িত্ব নিলেন। এরপর থেকে প্রতিদিন সকালে তার বাড়িতে আলমগীর সুবেহ সাদেকের পরে হাজির হয়। তিনি নামাজ শেষে বাগানে ঘুরে বেড়ান। তাঁর ইষৎ শীর্ণ শরীর। শাদা দাড়ি। আলমগীর এখানে একটি টুলে বসে পড়ালেখা করে। আর ফাঁকে ছবি আঁকে। এর আগে আর কেউ কখনই স্যারের কাছে এভাবে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পায় নি। এটাও ইতিহাসের নতুন সংযোজন।

    ছবি আঁকার ব্যাপারটি আলমগীরের বাবা পছন্দ করতেন না। তিনি পুলিশে চাকরি করতেন। তাদের পরিবার কুসুমদিয়ার পীর শের আলীর বংশধারা বহন করে। তারা ছবি আঁকাকে বেদাতি কর্ম বলে মনে করে। এই কাজে কবর আজাব হবে। তিনি দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকে ভুগে মারা গেলেন। মরার আগে আলমগীরকে ডেকে বলেছিলেন, বাবা আমার, ছবি খাড়া ছাইড়া দিয়া তুই হুজুর হইয়া যা।

    এরপর আলমগীর ছবি আঁকবে কি আঁকবে না এই ধন্দে যখন পড়ে গেল তখন হুজুর স্যারই বললেন, যে কাজটি করে তুমি মনে শান্তি পাও—সেই কাজটি করার মধ্যে কোনো কসুর নাই। যে কাজ তোমার মনে অশান্তি আনে— সেই কাজটি তুমি করো না। শান্তিই হল মুল কথা। আল্লাহ সবাইকে শান্তি দেন। তার ইশারা ছাড়া একটি গাছের পাতাও নড়ে না।

    ফলে অঙ্ক কষার পাশাপাশি আলমগীরের ছবি আঁকা চলতে লাগল। কেউ তাকে আর নিষেধ করেনি। এরপর একদিন হুজুর স্যার মারা গেলেন। তখন ছিল সন্ধ্যা। আবার পুর্ণিমা রাতও। এই সন্ধ্যারাতে হাঁটতে তিনি বেরিয়েছিলেন বাগানে। ভোরবেলায় সুবেহ সাদেকের পরে আলমগীরই তাঁকে বাগানে একটি কাঁঠাল গাছের নিচে সেজদা রত অবস্থায় দেখতে পায়। কাছে গিয়ে সে বুঝতে পারে—স্যারের ইন্তেকাল হয়েছে। তিনি একা থাকতেন। দারা-পরিবার কিছু ছিল না। তাঁর আত্মীয়-স্বজন কেউ আছে এ ধরনের খবরও কেউ জানত না। বাড়ির মালিক খোনকার সাহেব হুজুর স্যারকে সম্মান করতেন। এছাড়া এলাকার লোকজনেরও দাবী অনুসারে এই চিলেকোঠা বাড়ির পশ্চিম দিকে দেয়াল ঘেষে হুজুর স্যারের কবর হল।

    এরপর বাড়িটিতে তালা ঝুলে গেল। মাঝে মাঝে দেখা যেত–আলমগীর দেওয়ালের বাইরে আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকছে। খোনকার সাহেব শুক্রবার পবিত্র দিনে গেটটি খুলতেন। এ সময়ই আলমগীর ভেতরে ঢুকে কবর মোবারকে সালাম করত।

    চিলেকোঠার বাড়িটি বছর তিনেক এভাবে শুন্য পড়েছিল। একদিন নতুন একজন ভাড়াটে এলেন। নাম আনিস স্যার। তিনি অতি সুদর্শন। স্থানীয় কলেজের বাংলার টিচার। তিনি পড়ান শ্রীকান্ত উপন্যাস। উপন্যাসে নায়িকা রাজলক্ষ্মী তখনো ছোটো। তাঁর বৈঁচি ফল চাই। মালা বানাবে। কিন্তু কাঁটার ভয়ে যেতে পারছে না। শ্রীকান্ত তখন তাঁকে বৈঁচি ফল তুলে এনে দিয়েছে। এই বৈঁচি ফলের জায়গাটিতে এসে আনিস স্যার সুর করে গেয়ে উঠলেন—শিবঠাকুরের গলায় দোলে বৈঁচি ফুলের মালিকা। গলায় দড়ি কে পরালে বল না গৌরী বালিকা।।

    এই গানটি তখন এ শহরে জনপ্রিয় হয়ে গেল। সবার গলায় গানটি ফিরতে লাগল। তবে আনিস স্যার পুরো গানটি গেয়ে শোনাননি। সবাই স্যারকে ক্লাশে অনুরোধ করল পুরো গানটি গেয়ে শোনানোর জন্য। তিনি কিন্তু তিনি গাইলেন না। সবার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। শুধু বললেন গানটির শিল্পীর নাম হৈমন্তী শুক্লা। কোলকাতার উঠতি গায়িকা।

    জনতা রোডের মানি মিয়ার বড় মেয়ে শাহনাজ সুলতানা এনির ইচ্ছে জেগেছে সামনের কলেজ ফাংশনে এই গানটি করবে। তার গানের শিক্ষক অনাদি বাবু দু’কলি শুনে বললেন, গানটি মধুর। হর-পার্বতিকে নিয়ে লেখা। প্রেমমূলক। তবে অনাদিবাবু এর আগে গানটি শোনেননি। এনিকে বললেন, কাননবালার আমি বন ফুল গো গানটি করতে। এটা স্বরলিপি সহকারে তিনি শেখাতে পারবেন। আরও জানালেন কাননবালা তাদের সময়ে ছিলো স্বপ্নের রানী ছিলেন।

    কিন্তু এনির জেদ চেপে গেছে শিবঠাকুরের গানটিই সে করবে। এ শহরে বিষ্ণু সরকারের মাইকের দোকান আছে। তিনি প্রবীণ হয়েছেন। বললেন, এই গানটি নতুন। তাদের কাছে রেকর্ড এখনো আসেনি। তিনি গানটির লাইন দুটি ও শিল্পীর নাম লিখে রাখলেন। বললেন কলকাতা যাওয়া হলে আনিয়ে দেবেন। তবে একটুকু সময় লাগতে পারে।

    মরিয়া হয়ে একদিন এনি টিচার’স রুমেও গেল। আনিস স্যার তখন খুবই ব্যস্ত ছিলেন। কলেজ ফাংশনের দ্বায়িত্ব তার ঘাড়ে চেপেছে। এনির দিকে তাকিয়ে তিনি হাসলেন। চোখ থেকে গোল্ড রিমের চশমাটি খুলে টেবিলে রাখলেন। বললেন, শোনো—গান শিখলেই হবে না। তোমাকে গানের অংশ হয়ে উঠতে হবে। যে গ্রামের রাঙ্গা ধূলা পায়ে মাখেনি সে কী করে ঠাকুরের গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ গানটি করবে? তিনি আরেকটু ব্যাখ্যা করলেন, শিব ঠাকুর হলেন সুন্দরের দেবতা। তাকে ভালবাসে গৌরী নামের একটি মেয়ে। এই মেয়েটি রোজ বৈঁচি ফলের মালা গেঁথে শিবের গলায় পরিয়ে দেয়। দেখ, গানটিতে ফুলের কথা নেই—বলা হচ্ছে ফলের কথাটি। ফুলের পরিণতি ফল। সুন্দরের পরিণতি মঙ্গল। তোমাদের এই ফলটি সংগ্রহ করতে হবে। মালা গাঁথতে হবে। সুন্দরের গলায় পরাতে হবে। তারপর বুঝতে পারবে কেন সুন্দরের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সবাই। হৃদয় থেকে নিবেদন হিসেবে সঙ্গীত সৃষ্টি হয়। এই নিবেদনটাই আসল।

    এইটুকু বলে এই টিচার’স রুমের সবাইকে উপেক্ষা করে আনিস স্যার একটু নিচু গলায় গেয়ে উঠলেন—শিব ঠাকুরের গলায় দোলে বৈঁচি ফুলের মালিকা। গলায় দড়ি কে পরালো বল না গৌরী বালিকা। এই দুটি লাইনই। প্রথম লাইনটি গেয়ে এনিকে শুধালেন, বৈঁচি ফুল দেখেছ মেয়ে? এনি মাথা নাড়াল—না, সে দেখেনি। শুনে আনিস স্যার চোখে গোল্ড রিমের চশমাটি পরলেন। একটু গম্ভীর হয়ে কাজে ডুবে গেলেন।

    আনিস স্যারের সঙ্গে এনির এই সাক্ষাৎকার একটি বাঁক পরিবর্তন। তার ঘোর লেগে গেল। এবার শুধু গানটি নয়—তার দরকার বৈঁচি ফলও। নানাজনকে জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারল বৈঁচি ফলের সন্ধান একমাত্র আলমগীরই জানতে পারে। সে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ছবি আঁকে। তাকে পাওয়া মুশকিল। কলেজে নিয়মিত নয়। ফলে এনি তাদের বাসায় গেল। আলমগীরের মায়ের সঙ্গে দেখা করল।

    আলমগীরের বাবার মৃত্যুর পরে সংসারের অবস্থা পড়ে গেছে। বড় ভাইটি পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে আদালতের মোহরীগিরি ধরেছে। মায়ের ইচ্ছে—আলমগীর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করুক। তারপর পুলিশের চাকরিতে ঢুকে পড়বে। এসপি সাহেব বলেছেন—পাশ করে এলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু আলমগীরের মতিগতি বোঝা ভার। ছবি আঁকাই তাঁর ধ্যান জ্ঞান। এনিকে পেয়ে আলমগীরের মা বলল, মা, তোমরা তো ওর লগে পড়। ওরে একটু বুঝাইয়া পড়াশুনা করতে কও। অর দিকেই আমরা চাইয়া আছি।

    অনেক খুঁজে অবশেষে এনি একদিন আলমগীরকে ধরতে পারল। শহরের পুরনো বটতলায়। শেকড়ের ফাঁকে সে ঘুমিয়ে আছে। গায়ের উপর বটের ঝুরি নেমেছে। মাথার পাশে একটি খাতায় বটগাছটির অসম্পূর্ণ ছবি। বাকিটুকু ঘুম ভাঙ্গলে আঁকবে। আরেকটি খাতায় কিছু অঙ্ক কষা। ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস। বোঝা যায় পরীক্ষার চিন্তাটাও তার মাথায় আছে।

    এনিকে দেখে আলমগীর অবাক হল। বলল, তুমি আমাকে কেন খুঁজছো?

    এনি বলল, বৈঁচি ফল দরকার।

    আলমগীর বৈঁচি গাছটা চেনে। তার খাতা খুলে দেখাল, এই গাছটির ছবিও সে এঁকেছে। এনি বলল ছবি দিয়ে আমি কী করব। আমাকে ফলটি এনে দাও। আলমগীর এনিকে উত্তর করল, বৈঁচি ফুল শীতকালে ফোটে। এখন তার ফল পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। তবে গাছটিকে চেনানোর জন্য আলমগীর এনিকে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে গেল। এখানে মধুমতী নদীটা একটা বাঁক নিয়েছে। একটু দূরেই নীলার মাঠ। এই মাঠেই বেশ বড় সড় ঝোঁপ আছে। হাত তুলে এনিকে দেখালো, অই ঝোঁপটা আসলে বৈঁচি ঝোঁপ। কাছে গিয়ে দেখা গেল সেখানে একটি পুরনো কবর আছে। শ্যাঁওলা পড়ে কালচে সবুজ হয়ে আছে। একটু ঘষা দিতেই কবরটির পরিচয় লিপিটি বেরিয়ে এলো। ইংরেজিতে লেখা—

    Gregory Cealman.

    (1762—1828)

    A son of solitude.

    আলমগীর এনিকে বলল, বৈঁচি ফল ধরলে তোমাকে নিয়ে আসব। তবে সেখানে কয়েকটি কুঁচ ফল পাওয়া গেল। কোনোটি লাল, কোনোটি হলুদ। কোনোটির লাল ও কালো। লালের গায়ে কালো ফোঁটা। এই কুচ ফল দেখে এনি মুগ্ধ।

    আলমগীর তাকে বলল, কুঁচ নিয়ে তুমি গান করতে পার। এনি মাথা নেড়ে গুন গুন করে গেয়ে উঠল—কুঁচ বরণ কন্যা তোমার মেঘ-বরণ চুল।

    কুঁচ দিয়ে একটি মালা গাঁথল এনি। সেটা গলায় দিয়ে একদিন আনিস স্যারের চিলেকোঠা নামের বাড়িটিতে হাজির হল। সেদিন গেটে তালা নেই। হাত দিয়ে খোলা যায়। খুলবে কি খুলবে না এটা নিয়ে সংশয়ে পড়েছে। তার হৃৎকম্প হচ্ছে। ঠিক তখনি দেখতে পেল—চিলেকঠার বাড়িটির উঠোনে একটি টানানো তারে কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। তার পাশ দিয়ে এক তরুণী বউ ধীরে ধীরে হাঁটছে। কৌতুহল নিয়ে বাগানটি দেখছে। আনিস স্যারের গলাও পাওয়া গেল। তিনি ঘরের ভেতর থেকে বলছেন, হিমিকা, চায়ের মধ্যে একটু আদা দিও।

    ইনি আনিস স্যারের বউ। নাম হিমিকা। আনিস স্যার বিবাহিত এ খবরটি এ শহরের কেউ-ই জানতো না। এনিই প্রথম জানল। এনি তার গলা থেকে কুঁচ ফলের মালাটি খুলে ফেলল। গেটের পাশে মালাটি পড়ে রইল। তারপর ক্লান্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরল। রোদে ঘুরেছে বলে সে রাতে তার জ্বর এল।

    আনিস স্যারের বউয়ের নাম গুলবদন বানু। এই নামটি তার পছন্দ নয়। বিয়ের পরে তিনি নামটি পালটে রেখেছেন—হিমিকা। এতদিন বউটি বাপের বাড়ি ছিল বলে এই নামে ডাকার সুযোগ ঘটেনি। এখানে আসার পরে স্যার হিমিকা নামেই তাকে ডাকছেন, এই ডাকটি হিমিকার পছন্দ হয়েছে। তার ইচ্ছে তার স্বামী এই নামেই তাকে জীবন ভর ডাকুক। হিমিকা নামে একটি কবিতা লিখুক। তাকে নিয়ে নিয়ে গান হোক। তাকে নিয়ে বেড়াতে বের হোক। কিন্তু আনিস স্যার গীত গোবিন্দ নিয়ে একটি বড় নতুন প্রবন্ধ রচনায় ব্যস্ত। তিনি লিখতে লিখতে বউকে বলছেন, হবে, হবে। সবুর কর।

    এই চিলেকোঠা বাড়িটি হিমিকার ভালই লাগছে। একা একা বাড়ির ভিতরে ঘুরে বেড়ায়। গাছপালার নিচে কখনো বসে। ঘাসের ভিতরে পা রাখে। আবার রান্না করতে ছটে। এর মধ্যে হিমিকা ঘর গোছাতে গিয়ে একটি অতি পুরনো কষি টানা এক্সারসাইজ খাতা পেয়ে গেল। খাতাটি কাপড় দিয়ে পেঁচানো। ভিতরের পাতায় বাঁকা অক্ষরে লেখা—

    পাতা পাতা বুটা বুটা হাল হামারা জানে হ্যায়।

    জানে না জানে গুল হি না জানে—

    বাগ তো সারা জানতে হায়া।।

    ভেতরের পাতায় ঝরনা কলমে লেখা রয়েছে কিছু নোট, চিঠিপত্র, হিসাব, ডাইরী। আনিস স্যারের সামনে খাতাটি ধরে বলল, এইটা পড়।
    গীতগোবিন্দের জয়দেব তখন যমুনায় স্নানে গেছেন। এই ফাঁকে তাঁর ঘরে কৃষ্ণ এসেছেন জয়দেবের রূপ ধরে। জয়দেবের স্ত্রী তাঁকে স্বামি ভেবে ভুল করলেন। অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি স্নান না করেই ফিরে এলে?’ এইখানে এসে হিমিকার বাড়িয়ে দেয়া নোট-খাতা দেখে আনিস স্যার বিরক্ত হলেন। তাঁর এখন জয়দেব, তাঁর স্ত্রী আর ছদ্মবেশধারী কৃষ্ণকে গভীর ভাবরাজ্যে ডুব দিতে হবে। তিনি বললেন, শো কেসে রেখে দাও। গীতগোবিন্দ শেষ হলেই দেখবেন। এবং বললেন, হিমিকা, তুমি তো এখন বেশ ছোট—এই সব নোট ফোট পড়ো না। কিছু সমস্যা হতে পারে।

    তবে একদিন দুপুর বেলা আনিস স্যার কলেজে গেলে হিমিকা খাতাটি খুলে বসলো। কয়েকটি পাতা উলটে বুঝতে পারল কোনো এক মির্জা তার স্ত্রীকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছেন। স্ত্রীর নাম টগর।

    চিঠি.১

    টগর

    টগর নামেই তোমাকে ডাকি। এই ফুলটি আমাদের সুনামগঞ্জের ভাটি এলাকায় দুধ ফুল নামে পরিচিত। চরক-শুশ্রুতে ইহার আরেকটি নাম অনন্ত পুষ্প। আমি তোমাকে অদ্য হইতে টগর নামেই ডাকিব। টগর, আমার দুধফুল—আমার অনন্ত পুষ্প। তোমাকে আমার মনে পড়িতেছে। তোমাকে মনে করিয়া আমি কাঁদিতেছি। আমি হাসিতেছি।

    –ইতি—

    মীর্জা।

    চিঠি.২

    প্রিয় টগর

    আজ তিন মাস হইল তোমাকে ছাড়িয়া আসিয়াছি। ছাড়িয়া আসিতে মন চাহিতেছিল না। বড়ই পীড়ন বোধ হইতেছে। সুনামগঞ্জে যখন মাদ্রাসায় পড়িতাম তখন জানিতাম খোদা ভিন্ন আর কিছু এ জীবনে আরাধ্য নাই। খোদার পথেই আমি ছিলাম মজনুন।

    এ সময় আমার পিতা হুজুর একদিন গঞ্জে আসিয়া উপস্থিত। কহিলেন, তুমি এখন বালেগ হইয়াছ। তোমার শাদি মোবারক করাইতে চাহিতেছি। পিতা হুজুরকে কর জোড়ে কহিলাম, আব্বা, খোদা ভিন্ন এ জীবনে অন্য কছু ভাবিবার নাই। আমাকে মাফ করিয়া দিন। পিতা হুজুর শুনিয়া হাস্য করিলেন। বলিলেন, বৎস, আমি তাহা জানি। এই কারণেই তোমাকে আমি এতো স্নেহ করি। তুমি বিখ্যাত আলেম হইবে। আমাদের বংশের মুখ উজ্জ্বল হইবে। কিন্তু পুত্র, সন্তান বালেগ হইলে পিতার দ্বায়িত্ব তাহাকে শাদী মোবারক করানো। আমি তোমার মাতা সাহেবার সহিত আলাপ করিয়াছি। ইহাতে তাহার সম্মতি আছে। আশা করি তুমি অন্যথা করিবে না।

    টগর, তোমার সহিত আমার আকদ হইল। তখন তোমাকে দেখিবার কোনো সুযোগ ছিল না। দেখিবার কোনো অভিপ্রায়ও আমার ছিল না। মুন্সিজী আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার সহিত অমুকের কনিষ্ঠা কন্যার শাদি মোবারকের প্রস্তাব হইয়াছে। আপনি কি তাহাকে স্ত্রী হিসেবে কবুল করিবেন?

    পিতা হুজুরের ইঙ্গিতে কহিলাম—কবুল।

    পিতা হুজুর আমাকে গঞ্জে পাঠাইয়া দিলেন। কহিলেন, বৎস, তোমার পড়াশুনা চালাইয়া যাও। বধুঁমাতা বিষয়ে তোমাকে ভাবিবার প্রয়োজন নাই। তোমার রোজগারপাতি শুরু হইলেই আত্মীয় -পরিজন সহ তোমার স্ত্রীকে তুলিয়া আনিব। তোমরা সংসার ধর্ম পালন করিবে। জানিও– স্ত্রীর প্রতি স্বামীর হক আদায় করা ফরজ।

    টগর, তুমি জান, এইরূপে বৎসর দুই কাটিয়া গেল। আমার পাঠ শেষ হইল। কাজ কর্মের চেষ্টা করিতে গিয়া তোমাদের মোহনগঞ্জের এক মাদ্রাসায় গিয়াছি। সেখানে তোমার মামু জানের সহিত সাক্ষাত হইল। তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। তিনি আমাকে জোর করিয়া তোমাদের বাড়িতে লইয়া গেলেন। খানা-পিনা শেষ হইতে রাত্রি হইয়া গেল। তোমার পিতা হুজুর কহিলেন, আজ যাইয়া কাজ নাই—থাকিয়া যাও। আমার জন্য যে গৃহে শয়নের ব্যবস্থা হইল , তাহাতে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম—পালঙ্কের উপরে দুধ ফুলের মত অতীব সুন্দরী একটি কন্যা বসিয়া আছে। সেই কন্যা তুমি—আমার টগর। আমার ঘোর লাগিয়া গেল।

    প্রভাতকালে জাগ্রত হইয়া দেখিলাম—তুমি নাই। শয্যা শুন্য। তুমি যে রাত্রে আসিয়াছিলে ইহার কোনো নজির নাই। মনে হইতে লাগিল, রাত্রে যাহা ঘটিয়াছে তাহা অধিক ভোজন হেতু কোনো খোয়াব হইবে।

    এই খোয়াব আমার হায়াত। এইখোয়াবই এখন আমার মউৎ।

    খোদা আমি কি পতিত হইলাম?

    টগর, তুমি-ই আমার পতন। পতনেই আমি নতুন করিয়া দাঁড়াইতে শুরু করিয়াছি। ইহা ভিন্ন আমার কোনো গতি নাই।

    ইতি—

    মীর্জা।

    এরপর খাতাটির কয়েকটি পাতা শুন্য। কিছু হিসাব দেওয়া আছে—

    বাসা ভাড়া— দশ টাকা

    বাবুর্চি বখশিস—দু আনা

    চিড়া ক্রয়—ছয় আনা

    আখের গুড় ক্রয়—চার আনা

    মেসওয়াক ক্রয়—দু আনা

    নৌকা ভাড়া—এক আনা

    বাস ভাড়া—আট আনা

    ট্রেন ভাড়া—পাঁচ টাকা

    স্টিমার ভাড়া—দেড় টাকা

    নগদ—বিশ টাকা

    একুনে—তেত্রিশ টাকা চারি আনা মাত্র।

    চিঠি.৩

    টগর

    মুকিমপুর পরগনায় আসিয়া পৌঁছিয়াছি। এইখানের নদীটির নাম মধুমতী। জায়গাটির নাম রাজগঞ্জ। এইখানে একটি বিদ্যালয়ে কাজের ব্যবস্থা হইতেছে। কাজ আরবীর শিক্ষকতা। আপাতত বেতন নাই। খাওয়া দাওয়া নিখর্চায়। তবে উন্নতি করিলে বেতন হইবার সুযোগ রহিয়াছে। খোদা পরম দয়ালু। তিনি নিশ্চয়ই মুখ তুলিয়া তাকাইবেন।

    টগর, সেদিন তোমাদের বাড়ি হইতে আসিবার কালে গভীরভাবে চিন্তায় পড়িয়া গেলাম। নিজেকে গুনাহগার বলিয়া মনে হইতে লাগিল। ইহার কারণ, ১. পিতা হুজুরের আদেশ অমান্য করিয়াছি। ২. স্ত্রীর সঙ্গ করিয়াছি।

    পিতা হুজুর জানিতে পারিলে অতিশয় ক্ষুব্ধ হইবেন। আমাকে বিশ্বাস হন্তা মনে করিবেন। আমাদের বেহায়া মনে করিবেন। ইহাতে অভিসম্পাত লাগিতে পারে। তাহা আমাদের ভবিষ্যত সংসার জীবনের জন্য মঙ্গলকর হইবে না।

    সুতরাং এ ক্লেশভার আমাকে পলে পলে দগ্ধ করিতে লাগিল।

    মাদ্রাসার বড় হুজুরের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি বলিলেন, তোমাদের আকদ হইয়াছে। স্ত্রীর সহিত তোমার সাক্ষাতের অধিকার জন্মিয়াছে। এই স্ত্রী-সাক্ষাতে তোমার কোনো গুনাহ হইবে না।

    কিন্তু আরেকটি চিন্তা আমাকে পুনরায় দগ্ধ করিতে লাগিল। তাহা হইল, তোমার সহিত এই সাক্ষাতে নিশ্চয়ই তোমার গর্ভ সঞ্চার হইয়াছে। যদি তাহা হয়—তাহা হইলে তাহা অচিরেই প্রকাশ পাইবে। গোপন থাকিবে না। ফলে পিতা হুজুর নিশ্চিত হইবেন—আমি সত্যি-ই বিশ্বাস হন্তা। রোজগারপাতি ছাড়াই স্ত্রীর অধিকার দাবি করা অন্যায়। ইহাতে তাহার যে মনবেদনা উপস্থিত হইবে তাহার গ্লানি আমাদের অনাগত সন্তানের উপরও পড়িবে। তাহার অকল্যাণ হইবে। যদি এই গর্ভাবস্থা প্রকাশের আগেই আমি কোনো রোজগারপাতি করিতে আরম্ভ করি তাহা হইলে তৎপূর্বেই তাহার সম্মুখে গিয়া বলিতে পারিব, আব্বা, আমার স্ত্রীর সরা তুলিয়া আনেন। আমার আম্মা নিশ্চয়ই তাহাকে সম্মত করাইবেন।

    এইরূপ চিন্তা করিয়া এক বন্ধুর পরামর্শে দক্ষিণাঞ্চলে চলিয়া আসিয়াছি। আসিবারকালে তোমাকে জানাইতে পারি নাই। কাহাকেও জানাই নাই। সকলের অলক্ষ্যে চলিয়া আসিয়াছি। রোজগার শুরু হইলেই ফিরিব। পরম দয়াময় খোদা ভরসা। তিনি আমার টগর বানুর সহিত অতি দ্রুত সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিবেন। ইহাতে বিলম্ব নাই।

    –মীর্জা।

    চিঠি.৪

    টগর

    কাল রাত্রে খোয়াবে তুমি আসিয়াছ। তোমার চেহারা মোবারক অতি মলিন। ইহাতে আমার দিল ভাঙ্গিয়া যায়। চন্দ্র যখন রাহুতে পতিত হয় তখন তাহার চেয়ে কদাকার আর কোনো তসবীর হইতে পারে না। মনে হইল—ধিক এই জীবন। আমি তোমাকে মারিয়া ফেলিয়াছি। ভাবিলাম—পড়িয়া থাকুক এই চাকুরীর আশা। জাহান্নামে যাক এই ক্লেশকর প্রবাস জীবন। ছুটিয়া যাই আমার টগর—আমার দুধ ফুলের নিকট। খোদা, এ গরীবকে তুমি উদ্ধার কর।

    অদ্য আবার বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি শ্রীযুক্ত বাবু কৈলাশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি কহিলেন অত্র এলাকায় মুসলমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। ফলে আরবীর সহিত গণিত বিদ্যাতেও বুৎপত্তি লাভ করিতে হইবে। গণিতের প্রবীণ শিক্ষক যাদব বাবু আমার গণিতের পাঠ লইতেছেন।

    সভাপতি মহোদয় অতি সদাশয় ব্যক্তি। গত মাস হইতেই তিনি আমাকে কিছু হাত খরচও দিয়াছেন। বলিলেন—আগামী মাস হইতেই বেতন প্রদান করা হইবে। খোদা বোধ হয় অবশেষে মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন। আগামী মাসে বেতন পাইবার সঙ্গেই আমি রওনা হইয়া আসিব। আমাদের মিলন আর কোনো বাঁধা থাকিবে না। শরীরের প্রতি যত্ন লইও।
    – ইতি
    মীর্জা।

    পরের পৃষ্ঠায় একটি নোট লেখা আছে।

    পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত নং ১.
    সভাপতি শ্রীযুক্ত বাবু কৈলাশ মুখোপাধ্যায় মহাশয় অতি সম্প্রতি সপরিবারে দেশ ত্যাগ করায় তাহার স্থলে অত্র এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি মৌলানা হাতেম আলী শেখ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন।

    সিদ্ধান্ত নং ২.

    পুরনো পর্ষদের অনেক সদস্য চলিয়া যাওয়ায় বিদ্যালয়ে অর্থ সংকট দেখা গিয়াছে। ফলে অত্র বিদ্যালয়ে কর্মরত সকলের বেতন ৪০% কর্তন করা হইল। আয় বাড়িলে সকলের বেতন বর্ধিত করা হইবে।

    চিঠি.৫

    টগর

    দেখিতে দেখিতে অষ্টম মাস কাটিয়া গেল। এখন নবম মাসে পড়িয়াছি। ভাবিয়াছিলাম তোমার সহিত বহুপুর্বেই সাক্ষাৎ করিতে পারিব। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাহাতে কপর্দক শুন্য অবস্থায় পিতা হুজুরের স্মমুখে দাঁড়াইবার কোনো অবস্থা নাই। বদ-নসীব হেতু আমি অকুল সায়রে পতিত হইয়াছি। পিতা হুজুরের বিশ্বাস হন্তার গুনাহে বোধ এইরূপ শাস্তি প্রাপ্ত হইতেছি।

    টগর, বুঝিতে পারিতেছি—তোমার দুর্দশার সীমা নাই। তুমি সকলের উপহাসের পাত্র হইয়াছ। কেহ কেহ হয়ত সন্দেহ করিতেছে তোমার গর্ভস্থ সন্থানের পিতা কে? যাহার পিতা হইবার কথা তাহাকে তো কেহই দেখে নাই। এ অমর্যাদাকর অবস্থার জন্য দায়ী আমি–দায়ী আমার বদ নসীব। আমাকে ক্ষমা করিও। তোমার সম্মুখেও দাঁড়াইবার তাগদ আমার লুপ্ত হইয়াছে। মনে হইতেছে এ জীবন রাখিয়া আর কী লাভ!

    টগর, তবুও তোমার চেহারা মোবারক স্মরণ করিয়া আমি এই ক্লেশকর দিন অতিবাহিত করিতেছি। তোমার চেহারা তসবীরই আমার জীবনে বাঁচিয়া থাকিবার নিদান।

    তোমার বোধ হয় প্রসাবকাল আসন্ন। আমি খোদার কাছে দোয়া করিতেছি—তোমার একটি কন্যা সন্তান হইবে। তাহার নাম রাখিও—শবনম। শবনম অর্থ ভোরের শিশির। টগর ফুলের উপর এই শিশির পড়িলে তাহা বেহেস্তি সুরত আনে। প্রাণে শান্তি দেয়।

    আমাদের সন্তানের নাম রাখিও—শবনম। শবনম তাহার হতভাগ্য পিতাকে ভুল বুঝিবে না। তাহাকে ক্ষমা করিবে। তাহাকে ভালবাসিবে।

    ইতি

    মীর্জা।

    এরপর একটি কবিতা লেখা আছে।

    দারুন হার-বাত-এ জান-ইস্ত পিনহান।

    বা-জের-ই-কুফার ইমান-ইস পিনহান।।

    অনুবাদঃ সাধনার প্রতিটি মূর্তি সজীব হইতে পারে। অবিশ্বাসের নিচেই লুকিয়ে আছে বিশ্বাসের ফল্গু ধারা।

    চিঠি.৬

    টগর

    আমি হারাইয়া গিয়াছি। আমি নিজেকে আর খুঁজিয়া পাইতেছি না। হায়।

    এখানে কোনো নাম স্বাক্ষর নাই। লেখা আছে কলে পড়া ইদুঁর।

    চিঠিগুলো পড়ে হিমিকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। এখন রোদ পড়ে এসেছে। তার বুক ভরে কান্না পাচ্ছে। কাঁদতে গিয়ে টের পেল—তার গর্ভপ্রদেশ মৃদু ভাবে কাঁপছে। সেখানে কেউ যেন আশ্রয় খুঁজছে। হিমিকা তখন শবনমের নামে চোখের জল ফেলতে লাগল। তার মনে হল, মীর্জা নামের একজন বদ নসিবী তার দিয়ে তাকিয়ে আছেন।

    আনিস স্যার সে রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে হিমিকাকে বললেন, এ বাড়িতে যিনি থাকতেন তিনি কোনো মীর্জা নন। তার নাম সৈয়দ সালামত উল্লাহ। নারী বিষয়ক কোনো ঘটনা তার নামে প্রচলিত নেই। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। তবে বয়স অল্পতা হেতু এসব বিষয়ে হিমিকার কান দেওয়া উচিত নয়। এক্সারসাইজ খাতায় যা লেখা আছে তার লেখক সৈয়দ সালামত উল্লাহ না হওয়ারই কথা। এটা কাল্পনিক। সাহিত্য। সাহিত্য এবং কল্পনা এক নয়। যদি টগর নামে কেউ বাস্তবেই কেউ থেকে থাকত তাহলে তার চিঠিও পাওয়া যেত।।

    সেই রাত্রেই হিমিকা আকুল হয়ে তার স্বামীর নিকট সন্তান প্রার্থনা করল। বলল, এত বড় বাড়িতে তার একা থাকতে দম বন্ধ হয়ে যায়। একজন সোনামনি হলে তাকে নিয়ে তার সময়গুলো আনন্দে কেটে যাবে। তিনি যেন আজ তাকে দয়া করেন।

    আনিস স্যার এই আবদারে বড়ই বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বললেন, এখনি তার বাবা হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। শবনম শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ার আগে বিড় বিড় করে প্রার্থনা করতে লাগল, শবনম, তুমি আমার ভেতরে আসো। আমি তোমার চুলে টগর ফুল গুঁজে দেব গো মা।

    ক্রমশ হিমিকার গর্ভদশা প্রকাশিত হতে শুরু করল। আনিস স্যারের এ সময়ে আরও ব্যস্ততা বেড়েছে। তাকে নানা ধরনের প্রবন্ধ লিখতে হচ্ছে। নানা ধরনের সভা-সমিতিতেও যেতে হচ্ছে। স্থানীয় মহকুমা প্রশাসক সাহেব তাকে বিশেষ পছন্দ করেন। সরকারী স্মরণিকাদি রচনা কর্মে আনিস স্যারের বিকল্প তাদের নেই। ফলে এই সময় দিনের অধিকাংশ ক্ষণে হিমিকা চিলেকোঠা নামের এই বাড়িটিতে একা একা ঘুরে বেড়াতে লাগল। খুঁজে দেখে অবাক হল, এ বাড়িতে কোনো টগর ফুল গাছ নেই। অথচ এই সময়ে এই ফুলটাই দেখতে ইচ্ছে করছে। তার চোখের সামনে গাছটি বেড়ে উঠবে। কলি ধরবে। ফুল ফুটবে। ফুলটির উপর শিশির বিন্দু জমবে। তার নাম হবে শবনম।

    হিমিকা দুএকজন প্রতিবেশীর কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, এ শহরেই টগর ফুল নেই। থাকলেও তারা চেনে না। তবে এ শহরের একমাত্র আর্টিস্ট আলমগীর চিনলেও চিনতে পারে। তারা আরও বলল, আলমগীর চিলেকোঠার হুজুর স্যারের খুব ঘনিষ্ট ছিল। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরে এ বাড়িটায় আসে। দেওয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। হুজুর স্যারের কবর মোবারক জেয়ারত করে।

    এভাবে এক শুক্রবারে হিমিকা আলমগীরের দেখা পেল। আলমগীর একটু লম্বা প্রকৃতির। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখে ঔদাসীন্য। আলমগীর হিমিকাকে বলল, এ শহরে কবিরাজ মধুসূদন আচার্যের বাড়িতে দুটি টগর ফুল গাছ ছিল। তার বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে কিছুদিন আগে দখল হয়ে গেলে কে বা কারা ঐ বাড়ির সব গাছপালা কেটে ফেলেছে। শুনে হিমিকা ম্লান হয়ে গেল। তখন আলমগীর তাকে আশ্বাস দিয়ে জানাল, সে নিজে গাছটি দেখেছে। ফুলটিও দেখেছে। তার ছবি সে ইতিপুর্বে এঁকেছিল।

    এই টগর ফুলটির জন্য দিন দিন হিমিকার মধ্যে এক ধরনের হাহাকার আর তৃষ্ণা জেগে উঠেছে। একদিন তার ব্যাকুলতা দেখে আলমগীর চিলেকোঠার উঠোনে বসে টগর ফুলটির ছবি আঁকা শুরু করল। সেদিন আনিস স্যার জেলা শহরে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে। দুপুর বেলা যখন মাথার উপরে গণগণে সুর্য উঠল, তখন সাদা কাগজের উপর আলমগীরের পেন্সিল থেকে বেরিয়ে এলো গাছটি। সবুজ রংএর টানে মেলল সবুজ পাতাগুলো। নিচের তৃতীয় পাতাটির অর্ধেক ছেঁড়া। ছবিটি জানালার নিচে রেখে হিমিকাকে দেখাল। হিমিকা চোখ মেলে দেখতে পেল বাতাসে পাতাগুলো নড়ছে। শাখাগুলো দুলছে। একেবারে জ্যান্ত। মুগ্ধ হওয়ার মতই ছবি।

    আলমগীরের তখন পিপাসা পেয়েছে। তার জন্য একটি গ্লাস ভাল করে ধুয়ে পানি নিয়ে এসে হিমিকা দেখল আলমগীর নেই। চলে গেছে। জানালার নিচে কাগজটি নেই। বাতাসে উড়ে গেছে একটু দূরে। কুড়িয়ে নিয়ে দেখতে পেল ওটা সাদা কাগজ। কোনো ছবি নেই। কিন্তু জানালার নিচে একটি টগর ফুল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। পাতার উপরে একটি ছোট প্রজাপতি বসেছে।

    জেলা শহর থেকে ফিরে আনিস স্যার ঘটনাটি শুনে হেসে উড়িয়ে দিলেন। হিমিকাকে বললেন, এইসব আজগুবি কথার কোনো অর্থ হয় না। ডাক্তাররা বলেন গর্ভাবস্থায় মেয়েদের এ ধরনের সাময়িক মনোবৈকল্য দেখা দিতে পারে।

    তখন হিমিকা বলল, কিন্তু আলমগীর তো আমার সামনে বসেই এই টগর ফুলটা এঁকেছে। এই দেখ, নিচের তৃতীয় পাতাটি ছেঁড়া। ও এইরকম এঁকেছিল। আলমগীরের হাতে যাদু আছে। ও যা আঁকে তা সত্যি হয়ে যায়।

    আলমগীরের নাম শুনে আনিস স্যারের ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি আলমগীরকে চেনার চেষ্টা করছেন। অবশেষে চিনতে পেরে বললেন, এই ছেলেটি নেশা ভাং করে। ওকে ভেতরে আসতে দিও না। বলেই তিনি শোকেস থেকে মীর্জার এক্সারসাইজ খাতাটা বের করে বিরক্ত সহকারে জানালার বাইরে ছুড়ে দিলেন। হিমিকা ছুটে এসে তাকে থামাতে গেল। পারল না। ততক্ষণে খাতাটি টগর গাছটির উপর পড়েছে। হিমিকার খুব রাগ হল। তার চোখ লাল হয়ে গেছে। গো গো করে মাথা ঝাঁকাতে লাগল।

    পরদিন সকালে আনিস স্যার হিমিকাকে প্রস্তাব করলেন, এ সময়ে মেয়েরা বাপের বাড়িতে থাকে। চল, তোমাকেও বগুড়া রেখে আসি। হিমিকা মাথা নেড়ে জানাল, না, সে যেতে চায় না। এখানেই ভাল আছে।

    এরপর থেকে হিমিকা প্রতিদিন নিয়ম করে টগর ফুল গাছটিতে পানি দিতে লাগল সকাল বিকাল। মাঝে মাঝে গোড়ার মাটি হালকা করে খুঁড়ে দিল। দিন দিন গাছটি বেড়ে উঠতে লাগল। জানালা স্পর্শ করে ফেলল। একদিন কলিও ধরল। যেদিন ফুল ফুটল– ফোঁটার কিছুক্ষণ আগে হিমিকার প্রসব বেদনা উঠল। যখন তার চেতন হল তখন এলাকার রুক্মিনী দাই বলল, মা গো, চাইয়া দেখ, তোমার চান্দের লাহান মাইয়া হইছে।

    মেয়েটাকে কাঁথার পুটুলিতে রাখা হয়েছে। সকালের নরম আলো এসে পড়েছে তার মুখে। হিমিকা চোখ মেলে দেখতে পেল, জানালার ওপাশে টগর ফুটেছে। পাপড়ির উপর জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির। হিমিকার মুখ গভীর প্রশান্তিতে ভরে গেছে। আনিস স্যারকে বলল, আমার মেয়ের নাম শবনম। এরপর শবনম আর তার মা হিমিকা দুজনেই ঘুমালো।

    ঠিক তখনই আনিস স্যার দেখতে পেলেন শবনমের ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ। ফোলা ফোলা। গলার উপরে একটি জড়ুল চিহ্ণ। এটা হিমিকার গলায় আছে। মেয়েটা তার মায়ের থেকে পেয়েছে। কিন্তু তার কাছ থেকে কী পেয়েছে? এই প্রশ্নে এসে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

    শবনমকে নিয়ে হিমিকা খুব খুশি। কোনোদিন বলে শবনমের জন্য একটা ঝুমঝুমি এনে দাও। কোনোদিন বলে একটা চোখ পিট পিট করা পুতুল এনে দাও। আবার নুপুর কিনে দেওয়ার বায়না ধরে। ব্যস্ততার মধ্যে কোনোটি আনে—কোনোটি আনতে ভুলে যায়। একদিন কলেজ থেকে এসে আনিস স্যার ফিরে দেখতে পেলেন, জানালার কাছে খঁচার মধ্যে একটি মুনিয়া পাখি শিস দিচ্ছে। তাই দেখে ছোট্ট শবনম খিলখিল করে হাসছে। হিমিকা তাকে অবাক করে দেওয়ার জন্য বলল, এ পাখিটা আজ আলমগীর এঁকে দিয়েছে।

    তিনি ভুরু কুঁচকে বললেল, এটা তো আঁকা পাখি না। জ্যান্ত পাখি।

    তখন হিমিকা পানি ভরা একটা কাঁচের বইয়াম নিয়ে এলো। তার মধ্যে একটা লাল মাছ ঘোরাফেরা করছে। হিমিকা বলল, এই মাছটাও আলমগীর এঁকেছে। দেখ, ওকে বলেছিলাম—মাছটার চোখ কালো করে দিতে। বইয়ামটা স্যারের চোখের সামনে তুলে ধরে বলল, চেয়ে দেখ, মাছটার চোখে কী সুন্দর কাজল টেনে দিয়েছে আলমগীর।

    বলে হিমিকা আনিস স্যারের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে রইল। শবনমও হাত পা ছুড়ে মাছটিকে দেখে আ আ করছে। এই প্রথম আনিস স্যার লক্ষ করলেন শবনমের বাম পায়ের কড়ে আঙ্গুল্টা একটু ছোট। এ রকম ছোট আঙুল তার নিজের বা হিমিকার নেই। তাহলে এই আঙুল্টা শবনম কার কাছ থেকে পেল?

    সেদিন রাতে আনিস স্যার কিছু খেলেন না। তার মাথা ধরেছে। এই মাথা ধরাটা তার নিয়মিত হলে গেল। এলাকার প্রখ্যাত বিজিতেন ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, এটা কঠিন মাইগ্রেন। আপনার বাকি জীবনের সঙ্গী।

    আনিস স্যার কিছুদিনের জন্য ছুটি চাইলেন। কলেজের অধ্যক্ষ বললেন, সামনে পরীক্ষার ঝামেলা আছে। এ সময়ে আপনার মত গুরুত্বপুর্ণ শিক্ষককে ছাড়া যাবে না। সেবার পরীক্ষার হলে আনিস স্যার এবার বেশ কঠিন ভাবে গার্ড দিলেন। বেশ কজন ছাত্র সামান্য কারণে বহিষ্কৃত হল। আলমগীরের মা কপালে করাঘাত করে কান্নাকাটি করলেন। তার ছেলে আলমগীর দু বছর পরীক্ষা দিতে পারবে না। তার পুলিশে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা লুপ্ত হয়ে গেছে।

    তার কদিন পরেই হিমিকা বাবার বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরল। কয়েক পাল্লা কান্নাকাটির পরে আনিস স্যার শবনমসহ হিমিকাকে বগুড়ার পত্নীতলায় বাপের বাড়ি রেখে এলেন। যাওয়ার পথে তিনি দেখতে পেলেন শবনম তাকে দেখে হাসে। বা বা করে কথা বলার ভঙ্গী করে। তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছুক্ষ্ণ পরে ঘুমিয়ে পড়ে। নামিয়ে রাখতে গেলে ডুকরে ওঠে। পত্নীতলায় রেখে চলে আসার সময় তার কোল থেকে শবনম নামতেই চাইল না। শব্দ করে কান্না-কাটি জুড়ে দিল।

    চিলেকোঠায় ফিরে এসে তিনি কাজের মধ্যে গভীরভাবে ডুবে যেতে চাইলেন। রাধা-কৃষ্ণের বিরহ নিয়ে অসমাপ্ত প্রবন্ধটি লিখতে শুরু করলেন। নতুন কিছু বইপত্র যোগাড় করেছেন। ভুলে যেতে চাইলেন হিমিকাকে—শবনমকে। তবে ভুলে থাকার মধ্যেই বারবার তার মনের মধ্যে শবনমের গলার কাছটির জড়ুলটির কথা চলে এলো। এই চিহ্নটি সে হিমিকার কাছ থেকে পেয়েছে। তার কাছ থেকে কিছু পায়নি। তার বাম পায়ের ছোটো কড়ে আঙ্গুলটির কথা মনে আসতেই চমকে উঠলেন—এই চিহ্নটি হিমিকারও নেই—তারও নেই। এটা শবনম পেল কার কাছ থেকে? এই প্রশ্নটি তার রাধা-কৃষ্ণ বিরহকে ছিন্ন করে দিল। এ সময়ে আরেকটি প্রশ্নের উদয় হল—এই ছোটো আঙ্গুলটি কী তাহলে আলমগীরের আছে? এই প্রশ্নে তার ঘুম ছোটো হয়ে গেল। খাবার স্পৃহা কমে। দাড়ি কাটতেও ভুলে গেলেন। অধ্যক্ষ তাকে দেখে কয়েকদিনের ছুটি দিয়ে দিলেন। বললেন, কিছুদিন বগুড়া থেকে ঘুরে আসুন।

    বগুড়ার পত্নীতলায় গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন–সেখানে হিমিকা নেই। হিমিকার বাবা-মা তাকে চিনতেই পারলেন না। বললেন, হিমিকা নামে তাদের কোনো মেয়ে নেই। তাদের মেয়ের নাম গুলবদন বানু। সে এখানে নেই। দিনাজপুরে গিয়েছে। সেখান থেকে জামাইসহ বিদেশে যাওয়ার কথা। আর কিছু তাদের বলার ছিল না।

    বাড়িটির বারান্দায় খাঁচার মধ্যে মুনিয়া পাখিটি ঝিমুচ্ছিল। তাকে দেখে একবার ডেকেও উঠল। এই পাখিটা আলমগীর শবনমের জন্য এঁকেছিল। গুলবদন বানুর মা পাখিটিকে দানা-পানি দিতে এলেন। এই পাখিটা তাদের মেয়ে গারো পাহাড় থেকে কিনেছে। গুলবদন বানুর বাবা আনিস স্যারকে বললেন –তার এখন নামাজে যেতে হবে। ফলে আনিস স্যার বাড়ির বাইরে গেলে তিনি গেটটি বন্ধ করে দিলেন।

    এরপর তিনি চিলেকোঠা বাড়িটিতে ফিরে এলেন একা। বেশ কিছুটা শুকিয়ে গেলেন। কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিলেন। লোকে দেখতে পেলো—এ শহরের সদা ব্যস্ত রসিক মানুষটি গ্রেগরী চিলম্যানের বাড়িটিতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    এ খবর পেয়ে একদিন এনি চিলেকোঠার বাড়িটিতে এল। সঙ্গে তার স্বামী। জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনার একি চেহারা হয়েছে? আপনাকে তো চেনাই যাচ্ছে না! কী সমস্যা হয়েছে আপনার? আনিস স্যার তাকে বললেন, তেমন কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হল– তার কানের কাছে একটি শিশু সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে। এই শিশুটির নাম শবনম। শবনমের গায়ে তার নিজের গায়ের কোনো চিহ্ন নেই। এটা এখন বড় প্রশ্ন নয়। এই শিশুটির কান্না তিনি সহ্য করতে পারছেন না। ওকে থামানো দরকার। শিশুটি কেঁদে কেঁদে তার কোলে আসতে চাইছে। তাকে থামাতে হলে তাকে কোলে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেটা সম্ভব নয়। কারণ তিনি শিশুটিকে দেখতে পাচ্ছেন না। অথচ তাকে দেখতে হবে। এই দেখা কাজটি সম্ভব করতে পারে একমাত্র আলমগীর। কারণ হিমিকা তাকে বলেছিল—আলমগীর যা আঁকে তা সত্যি হয়ে যায়। ও শবনমের একটা ছবি এঁকে দিলেই শবনমকে পাওয়া যাবে।

    এনি আনিস স্যারকে আলমগীরদের বাড়িতে নিয়ে গেল। বাড়িটা খুঁজে পেতে এনিদের কষ্টই হল। কারণ আলমগীর অবস্থা আরও পড়ে গেছে। সংসার চলতে চায় না। বড় ভাইটি মোহরিগিরিতে তেমন কিছু করতে পারছে না। তার উকিল হেমাঙ্গ বসু বাবু আগের মত আর নিয়মিত নন। মাঝে মাঝে দেশে থাকেন না। বয়সও হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের দেখতে ঐদেশে যান। ফলে মোয়াক্কেলরা নিজাম উকিলের কাছে ছুটছে। এই অবস্থায় তারা একটু ছোট বাসা নিয়েছে। আলমগীরের মা বললেন, আলমগীর কলেজ থেকে বহিস্কৃত হওয়ার পরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। সে গহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় গিয়ে হুজুর হয়ে গিয়েছে। মাদ্রাসার বর্তমান বড় হুজুর বুজুর্গ মানুষ। তাঁর কথায় জ্বিন-পরীও ওঠা-বসা করে। সেখানে আলমগীর গেছে বলে তিনি শান্তি পাচ্ছেন। আলমগীরের আব্বার জীবনের শেষ ইচ্ছেও তাই ছিল। সেটা পূরন হয়েছে।

    আনিস স্যার পরদিন গহরডাঙ্গা রওনা করলেন। গীমাডাঙ্গা এবং টুঙ্গীপাড়ার মাঝখানে গওহরডাঙ্গা। ১৯৩৭ সালে মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী সদর সাহেব (রহ.) মাদ্রাসাটির গোড়াপত্তন করেন। মধুমতী নদী পার হওয়ার সময়ে পারাণি মাঝি বলল, একটা পরী বড় হুজুরের সঙ্গে বেয়াদবী করায় তিনি তার বাম ডানাটি কেটে দিয়েছেন। পরীটি মধুমতীর পাড়ে পড়ে ছিল। মাদ্রাসার একজন নবীন তালবেলেম সেই ডানাটি জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। বড় হুজুর তার উপরে ক্ষেপে গিয়ে তাকে মাদ্রাসার ঈশান কোণে অবস্থিত একটি তালগাছের আগায় বন্দী করে রেখেছেন। সেইখানে বসে সেই বদ-নসিবী কান্নাকাটি করছে।

    আনিস একটু হেঁটে মাদ্রাসায় হাজির হলেন। তখন বেলা পড়ে এসেছে। বড় হুজুর সেখানে ছিলেন না। তিনি সফরে আছেন। তার এক খাদেম আতাউর মাওলানা আনিস স্যারকে বললেন, আলমগীর নামে এক বেয়াদ্দব বুৎপরোস্তি বেকারার এখানে এসেছিল বটে, তার আল্লা-বিল্লা নাই—হুজুর তার জন্য অনেক তদবিরও করেছিলেন। কিন্তু শয়তানের আছর হওয়ায় সব সময়ই সে তসবীর খাড়ার বদ মতলবে থাকে। ফলে হুজুর তাকে একদিন সন্ধ্যায় তাড়িয়ে দিয়েছেন। সে এখন কোথায় থাকে এই প্রশ্নে তিনি খুব বিরক্ত হলেন। আরেকজন ছোট খাদেমকে ধরিয়ে দিলেন। ছোট খাদেমটি মশকরা করে বললেন, ওই বেল্লিকটা আবার যাবে কোথায়! সে এই মাদ্রাসায় থেকে মাঝে প্রতিদিন বিহানবেলায় মধুমটির ঘাটে যেত। ওইখানে এক নতুন কসবি পরীরানীকে দেখে তার মধ্যে লাইলীকে খুঁজে পেয়েছে। সে এখন তার মজনু হয়ে গাছে। তাকে পেতে হলে কসবী পরীরানীর কাছেই খোঁজ নেন। এরপর ছোট হুজুরটি সুর করে বলে উঠলেন—পানির স্বভাব যেমন ধারা নিম্ন দিকে ধায়।

    মধুমতীর ঘাটে চার পাঁচটি চালা ঘর আছে। এর মধ্যে একটি চালা পরীরানীর। তখনও সন্ধ্যা হয় নি। পরীরানী আনিস স্যারকে যত্ন করে বসতে দিল। তার সামনে বসে চুলে নারিকেল তেল মাখল। ঠোঁটে কড়া লিপিস্টিক দিল। বলল, তার কাছে কত খদ্দেরই তো আসে। কারও নামই সে মনে রাখতে পারে না। আর রাখারইবা দরকার কি। আলমগীরের নামটিও তাই পরীরানী মনে করতে পারল না।

    তখন আনিস স্যার তাকে আলমগীরের বর্ণনা দিলে পরীরানী মনে করতে পারল। বলল, হা, এই রকম এক খদ্দের একদিন সন্ধ্যায় এসেছিল। কদিন এখানে ছিল। এখানে বসে ছবি খাড়ত। একদিন সন্ধ্যায় সে চলেও গেছে। কোথায় গেছে পরীরাণী তা জানে না।

    এইটুকু বলে পরীরানী ম্লান আলোতে পিঠের শাড়িটা টেনে নামালো। জিজ্ঞেস করল এখনই আরো নামাবে কিনা? আনিস স্যার কিছু বললেন না। তিনি দেখতে পেলেন, পরীরানীর বাম হাতের গোড়ায় কাঁধের কাছে কাটা দাগ। আনিস স্যার সেই ঘোরলাগা সন্ধ্যায় চমকে উঠলেন। এটা সেই বড় হজুর স্যারের ডানা কেটে দেওয়ার দাগ। তিনি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পরীরানী, এইটা তোমার কিসের দাগ? পরীরানী আস্তে করে বলল, বাল্যকালে গোইয়া গাছ থাকে সে পড়ে গিয়ে কেটে গিয়েছিল। আর কিছু নয়।

    এ সময়ে আনিস স্যারের কানের ভেতরে একটি শিশু কেঁদে উঠল। শিশুটি বেশ শব্দ করেই আজ কাঁদছে। খুব কাছেই। তিনি মাথা চেপে ধরলেন। পরীরানী কাপড়টি আবার গায়ে জড়িয়ে চালা ঘরের অন্ধকার কোনায় এগিয়ে গেল। সেখানে কাঁথার মধ্যে একটি শিশু ঘুমিয়ে ছিল। শিশুটির ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পরীরানী তাকে কোলে নিয়ে আদর করে আবার ঘুম পাড়ালো। শিশুটি ঘুমিয়ে গেলে আনিস স্যার জিজ্ঞেস করলেন, শিশুটির নাম কী?

    পরীরানী একটু হেসে বলল, শবনম।
  • ডিডি | 120.234.159.216 | ২৩ আগস্ট ২০১২ ১৪:৩৭570336
  • কুলদা রায়ের সব লেখাই একেবারে রুদ্ধশ্বাসে পড়ি।
    এটা জমিয়ে রেখেছিলাম। খুব ধীরে ধীরে, প্রায় বানান করে করে, প্রত্যেকটি শব্দ আলাদা আলাদা ভাবে পড়লাম।

    কুলদা এবারেও নিরাশ করে নি।
  • b | 135.20.82.164 | ২৪ আগস্ট ২০১২ ১০:৫০570347
  • অসম্ভব ভালো। কুলদাবাবু-র কি কোনো বই আছে? লোকজনকে পড়াতাম
  • ঐশিক | 213.200.33.67 | ২৪ আগস্ট ২০১২ ১৪:০৯570358
  • অসাধারণ লেখা, আপনার সোনার কলম হোক
  • কুলদা রায় | 34.90.91.2 | ২৪ আগস্ট ২০১২ ২০:০৭570366
  • ডিডি,
    আমার লেখাটি আপনাকে নিরাশ করেনি শুনে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। হয়তো আপনার জন্যই আমি লিখছি।

    বি,
    কুলদা রায়ের কোনো বই নেই। এই বই নেই বলেই আমি এতোদিন বেশ হেসে খেলে থাকতে পারছি। এক ছেলে, নাম রাব্বানি, থাকেন নিউ ইয়র্কে, নিউ ইয়র্কের বই মেলায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক সেমিনারের জন্য ভুল করে আমার নাম প্রস্তাব করে বসেছিলেন বক্তা নির্বাচক কমিটির কাছে। কমিটির ভদ্রলোকের নাম জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। গল্পকার। অনেকগুলো গল্পের বই লিখেছেন। তাঁর সেরা ৫০ টি গল্প নামে একটি বইও আছে। তাঁর দুএকটা গল্প পড়ে মনে হয়েছে--তিনি গল্প লিখতে চাননি, কবিতা লিখতে চেয়েছেন। ফলে আমরা যারা গল্পের মধ্যে গল্পই পড়তে চাই--তাদের কাছে তিনি বিস্মৃত হবেন বলেই আমার ধারণা, এটা আমি কোথাও বলেছিলাম। রাব্বানিকে কড়া করে ধমকে দিলেন--কুলদা রায় কি কোনো বই লিখেছেন? রাব্বানি বললেন, না। তখন জ্যতিপ্রকাশ বাবু আরো রেগে বললেন, যার বই-ই নেই সে আবার কী কথা বলবে!
    দত্ত বাবু খুব খাঁটি কথা বলেছেন। আমি জীবনে কোথাও কথা বলতে যাইনি। জ্যোতিবাবু কেনো, ওনার বাবার বাবা বললেও বক্তা হিসেবে আমাকে কখনো পাওয়া যেত না। যাবেও না।
    বই মেলাটি হচ্ছিল আমার ছোট মেয়ের স্কুলে। ও গিয়েছিলো চটপটি খেতে মেলাতে। আমি গিয়েছিলাম ওকে আনতে। দত্ত বাবু কার কাছে শুনলেন আমার নাম কুলদা রায় অনেক ক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, আপনি একটা বই লিখে ফেলুন।
    বললাম, কেনো দাদা? বই লিখে কী হবে?
    দত্তবাবু বললেন, আপনি নিজে লিখতে না পারলে আমার স্ত্রীর সঙ্গে লিখুন। উনি নারীবাদী গল্প লেখেন। এবার অন্য কিছু লিখতে চান।
    আমি আমার মেয়ের খোঁজ করছি। আর দেখতে পাচ্ছি জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, বাংলাদেশের এক বয়স্ক গল্পকার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বিড় বিড় করে বলছেন, একটা বই লিখে ফেলুন। দেরী করবেন না। আমার মেয়েটা এসে আমার কাছে চটপটির জন্য ডলার চাইছে। আমি তাকে আগ্রহ ভরে দিচ্ছি।
    মেয়েটা চটপটি খেতে খেতে বলছে, বাবাগো তোমাগো দেশের লেখকরা মনে হয় পচা করে লেখে।
    বললাম, কেনো মা, তোর এরকম মনে হচ্ছে কেনো।
    মেয়েটা বলল, কেউ তাদের বই কেনে না। আমার মেয়ে আর আমি দুজনে হেঁটে বাসায় ফিরছি। মেয়েটা বলছে, বাবা, তুমি কিন্তু বই বের করবা না।
    আমি হেসে বলি, না মা, আমি কোনো বই করব না। বক্তৃতা দিতে আমার ভয় করে।

    ঐশিক,
    আপনাকে ধন্যবাদ।
  • b | 135.20.82.166 | ২৪ আগস্ট ২০১২ ২১:১৪570367
  • গল্পের বই চেয়ে আরেকটা অনু-গল্প পেয়ে গেলাম। ক্ষতিবৃদ্ধি নাই।
  • Sibu | 84.125.59.185 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ০১:২৫570368
  • এই টইটা মিস করে গেছলাম কি করে? আপনার লেখা আবার ভাল লাগল কুলদাবাবু।
  • pi | 82.83.82.13 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ০১:৪৩570369
  • Name: আনোয়ার শাহাদাত

    IP Address : 34.90.37.162 (*) Date:08 Aug 2012 -- 04:30 AM

    দুইদিনে দুটো গল্প পড়েছি। প্রথম পড়া গল্পটির লেখক কর্তৃক পত্রিকায় পাঠানোর পর সেই সময় অমনোনীত হওয়া। আর দ্বিতীয়টি মনোনয়নের জন্য এখনো পাঠানোই হয়নি বলে বুঝি। প্রথমটি লেখা ১৯৩৬ সালে। ছাপা হোলও এই বর্তমান সংখ্যা পত্রিকায় যেটা এখনো বাজারে আছে। ওই অর্থে ৭৬ বছরের মাথায় গল্পটি 'ছাপার-মুখ' দেখল! গল্পের নাম 'থ্যাঙ্ক ইউ ফর দা লাইট' ,লেখক হলেন এফ. স্কট ফিটযেরাল্ড, আর পত্রিকা- নিউ ইয়র্কার।

    ফিটযেরাল্ডের গল্পের প্রথম অনুচ্ছেদ এরকমঃ
    "সুন্দরী চল্লিশ পড়ন্ত মিসেস হ্যানসন অন্তর্বাস ও কোমরের বিছা বিক্রি করেন, শিকাগোর বাইরে তার ভ্রমণ করতে হয়। অনেক বছর পর্যন্ত যে সব এলাকায় তাকে ভ্রমণ করতে হয়, টালিডো, লিমা, স্প্রিংফিল্ড, কলাম্বাস, ইন্ডিয়ানাপলিস, এবং ফোর্ট ওয়েইনে। পদোন্নতি দিয়ে তাকে আরো পশ্চিমে স্থানান্তর করা হয় আইয়োয়া-কানসাস-মিসৌরি অঞ্চলে ওহাইওর বাইরে পশ্চিমে প্রতিষ্টানের শক্ত প্রসার বৃদ্ধি লক্ষে।"(আমার নিজের অনুবাদ)

    অন্য গল্পটির পড়বার সময় লেখকের নাম খেয়াল করলাম না। জানিওনা এটি মনোনয়নের জন্য পাঠানো হয়েছে কিনা কোথাও। নাকি ৭৬ বছর এর চক্রে? ক্ষতি কী? দরগায় এখনই গরম তবারক খেতে হবে তেমনটি না-ই বা হলো সবার জন্য! গল্পের নাম 'হুজুর সন্ধ্যা'।
    "তার প্রথম অনুচ্ছেদঃ বাড়িটির নাম চিলেকোঠা। চারিদিকে বাগান। মাঝখানে ছোটো বাংলো ধরনের টিনের ঘর। কোনো চিলেকোঠা নেই এই ঘরটিতে। মধ্য পাড়ার প্রবীণ মোক্তার অসিতবরণ সরকার মফস্বলের ইতিহাস নামে ইতিহাস একটি রচনায় লিখেছেন—এই এলাকায় গ্রেগরী চিলম্যান নামে এক ইংরেজ এসেছিলেন ১৮০৩ সালে। শুরু করেছিলেন নীলচাষ। এই নীলচাষের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একটি মাঠের নাম আজও জারী আছে। নাম–নীলার মাঠ। এই নীলার মাঠে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে ঘোড়দৌড় হয়। অসিতবরণ বাবু আরও লিখেছেন—এই চিলম্যান সাহের মধুমতী নদীর তীরে পাঁচ বিঘা জমির উপরে এই বাড়িটি তৈরি করেন। তিনি একাই থাকতেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। চিলম্যানের নাম-অনুসারে এই বাড়িটির নাম চিলেকোঠা। প্রবন্ধটি ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের উদ্যগে প্রকাশিত সাহিত্য সংকলন কোরক-এ ছাপা হয়েছিল।"
    শিল্পে'র লুকানো সৌন্দর্য ও প্রিটেন্সহীনতার সত্য, ওইটুকুর মধ্যেই যা আছে তাতে আমার আর একবেলা সিঙ্গেলমল্ট হুইস্কিতে ডুবতে কোনো অকারণ কারণের খোঁজে ছুটতে ও ঝাঁপাতে হবে না!
  • aranya | 154.160.226.53 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ০৩:৪৭570370
  • থ্যাঙ্কস, পাই - শাহাদাতের এই লেখাটার কথা আমারও মনে পড়ছিল।
    আরও মজার ব্যাপার, কাল রাতে হুজুর সন্ধ্যা পড়ছি আর খানিকটা 'বি'-র মতই আমার মনে হচ্ছে, কুলদা বাবুর বেশ কটা সত্যি কারের ভাল লেখা তো গুরু-র পাতায় পড়লাম -এমন কয়েকটা লেখা একত্র করে কি একটা চটি বের করা যায়, ওনার কি অলরেডি কোন বই বেরিয়েছে, এইসব।

    অসাধারণ ক্ষমতাধর লেখক, এই কুলদা রায়।
  • ranjan roy | 24.96.129.190 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ০৮:৫১570326
  • অরণ্যের সঙ্গে গলা মেলালাম।
    কুলদাবাবু,
    আপনাকে কোথাও সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিতে হবে না, শুধু আপনার মায়া-কলম দিয়ে লিখে যান। আর আপনার একটি গল্প-সংগ্রহ চটি বই করে আগামী বইমেলায় গুরুচন্ডালীদের প্রকাশ করতে অনুমতি দিন।
    আমাদের মত আড্ডাবাজ, স্বপ্নদেখাদের দলে আপনার বই প্রকাশ করার আনন্দ ও গর্ব নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে।
    প্লীজ, রাজি হয়ে যান।
  • b | 135.20.82.166 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ০৯:১৫570327
  • হ্যাঁ, আর আমরা কেউ বিশেষ বক্তব্য রাখি না।
  • nina | 78.34.167.250 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ০৯:২৫570328
  • কুলদাভাই
    অনেকদিন কথা হয়নি আপনার সঙ্গে----
    সত্যি আপনার এল্খা গুলো একজায়গায় করে গুরু বেশ সুন্দরপানা--চটি-বই করুক--আমাদের অনুরোধ!
    আপনার লেখাগুলো একেবারে অন্য স্বাদের----রেশ রয়ে যায়----অনেকক্ষণ।
  • r2h | 78.46.93.195 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ১০:০৫570329
  • অদ্ভুত। ভালো, অসাধারন এইসব বড় বহুব্যবহৃত শোনায়, কুলদা রায়ের লেখা আমার কেমন লাগে তা জানানোর মত ভাষা আমার জানা নেই।
  • Tim | 105.59.92.102 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ২২:১৫570330
  • শেষ কবে এত বড়ো লেখা একটুও না থেমে, একবারে পড়েছি মনে পড়েনা। কুলদাবাবুকে ধন্যবাদ গুরুচন্ডালীতে লেখার জন্য। আরো অনেক এমন লেখাপত্র পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

    পুনশ্চঃ পরে যোগ করা বক্তৃতা ও চটপটি সংক্রান্ত কথোপকথন এতটাই দুঃখজনকভাবে সত্যি ও লেখালেখির চেষ্টা করা প্রায় সবার জন্যই এতটাই প্রাসঙ্গিক যে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় একদিন তিতিবিরক্ত হয়ে শক্তিশালী লেখকেরা সব কলম তুলে রাখবেন, এবং ভবিষ্যতের প্রতিভাবানেরা আর বাংলায় লিখবেন না।
  • h | 127.194.236.105 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ২২:১৭570331
  • আমার কথাটা হুতো সুদূর আমেরিকা থেকে এসে বলে দিল।
  • Sibu | 118.23.96.4 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ২২:২৩570332
  • এই জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত নামটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। উনি কি বুদ্ধদেব বসু-র কেউ?
  • a x | 118.207.195.138 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ২২:৩১570333
  • জ্যোতির্ময় দত্ত। বুদ্ধদেব বসুর জামাই।
  • a x | 118.207.195.138 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ২২:৩৪570334
  • এই লেখাটা কেমন অদ্ভূত। যেন ধরতে ধরতেও ধরা যায়না। মায়াবী অথচ কি নিস্পৃহ। অনেকদিন পরে কোনো লেখা এত মুগ্ধ করল।
  • I | 24.99.213.150 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ২২:৪৯570335
  • আমিও বিড়বিড় করে বলছি-কুলদাবাবু আপনি লিখতে থাকুন! লিখতে থাকুন !
  • intellidiot | 131.245.38.156 | ২৫ আগস্ট ২০১২ ২৩:৫৯570337
  • অদ্ভুত সুন্দর। ফ্যাক্ট, ফ্যান্টাসি, পাশাপাশি। সুরিয়াল।
  • kk | 117.3.243.18 | ২৬ আগস্ট ২০১২ ০০:১৭570338
  • কুলদা রায় গল্প আঁকেন, ছবি লেখেন!
  • Sibu | 118.23.96.4 | ২৬ আগস্ট ২০১২ ০১:২৭570339
  • হ্যাঁ, জ্যোতির্ময় দত্ত। মাই ব্যাড।

    ধন্যবাদ অক্ষদা।
  • i | 134.168.48.209 | ২৬ আগস্ট ২০১২ ০৩:২৬570340
  • আগেও বলেছি কয়েকবার -কুলদাপাঠে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণে আসেন।
    'আত্মজা ও একটি অস্টিন ১৯২৯'এ শ্যামল লিখেছিলেন, ' ... যা ঘটে তা লিখলে লেখা হয় না। বরং যা ঘটলেও ঘটতে পারে-এমনকী কোনো দৈবী পাগলামিতে জারিয়ে নিয়ে কাগজের ওপর শব্দ বসিয়ে গেলেই তবে লেখা হয়'।
    দৈবী পাগলামিতে ভরা লেখা সীমিত সংখ্যার। কুলদাবাবুর লেখার অপেক্ষায় থাকি।
  • h | 127.194.228.33 | ২৬ আগস্ট ২০১২ ০৮:০১570341
  • অন্য লেভেল বস অন্য লেভেল।

    এই সময়ে দমু আর সৈকত(দ্বিতীয়) থাকলে খুব ভালো হত। কুলদা রায়ের লেখা আমার সলিড লাগে। কোন কথা হবে না, এই লেভেল এর লেখক এর যদি একটাও বই না থাকে, মরার আগে অব্দি আমার আর একটাও গল্প না লেখা হলেও কোন চাপ নেই।

    এই গল্পটা আর আগের একটা গল্প পড়ে, আমার তিনটে স্পেসিফিক গল্পের কথা মনে হয়েছে, তুলনামূলক সম্মান অসম্মন এর কোন গল্প নেই, জাস্ট মনে হয়েছেঃ

    ক - মিলির হাতে স্টেনগান (ইলিয়াস)
    খ - শহীদুল জহির এর এককটা গল্প, যেখানে একটা পাড়ার একটা পার্টিকুলার বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে দম্পতি/পরিবার এসে থাকেন। একটা চাঁপা গাছ তার সাক্ষী। নামটা যে ছাতা কেন মনে পড়ছে না।
    গ- পেটার বেকসেল এর গল্প, একটা লোক একটা স্টেশনের আর অন্যান্য বাড়ির সিঁড়ি গুনতো, নাম মনে নেই।
  • | 24.99.52.189 | ২৬ আগস্ট ২০১২ ১২:৫২570342
  • 'কাকমানুষের চকখড়ি' নামে কুলদা রায়ের একটি বই আছে বলে তো আমি জানতাম। ভুল জানতাম নাকি?
  • Blank | 69.93.255.107 | ২৬ আগস্ট ২০১২ ১৩:৩৯570343
  • ভাল লাগলো লেখাটা
  • শ্রাবণী | 69.94.96.129 | ২৬ আগস্ট ২০১২ ১৪:২২570344
  • কুলদা রায়ের এখানে সব লেখার মত এলেখাও মায়াময়........মামা মাসিদের লেখাগুলো বোধহয় শেষ হয়নি, না?
  • সুকি | 71.6.243.27 | ২৬ আগস্ট ২০১২ ১৬:৩৯570345
  • দারুণ লেখা - এমন লেখা প্রায় বিরল হয়ে গেছে আজকাল। আরো পড়ার আশায়।
  • ranjan roy | 24.97.205.117 | ২৭ আগস্ট ২০১২ ২১:৪৮570346
  • শিবু,
    একটু পি এন পি সি করার লোভ সামলাতে পারছি না। জ্যোতি দত্ত-মিমি দত্তের মেয়ে কংকাবতী দত্তের একটি ধারাবাহিক উপন্যাস প্রায় বছর কুড়ি আগে দেশ পত্রিকায় বেরোতে শুরু করে। এতটাই খাজা লেখা যে গোটা কয়েক সংখ্যার পর সম্পাদকমন্ডলী দেশ লেখাটা হটাৎ বন্ধ করিয়ে দেয়। কুলকুলিয়ে হাসি পেয়েছিল।
  • pipi | 139.74.191.152 | ২৭ আগস্ট ২০১২ ২২:৪৪570348
  • সিম্পলি অসা!
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন