এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বনারস চালিসা

    shibaa`mshu
    অন্যান্য | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ | ৪৩১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • শিবাংশু | 127.197.239.80 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ০১:০১582441
  • বনারস চালিসা

    'হিন্দু' ধর্ম কতো প্রাচীন তা কেউ জানেনা। অথবা সবাই নিজের মতো করে জানে। দশ থেকে এক, যে কোনও সংখ্যার পর তিনটে শূন্য বসিয়ে বক্তব্য রাখার লোকজন চারদিকে গিজগিজ করে। ফরাসি ডাক্তার বের্নিয়েরসাহেব একবার বনারসে এসে পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন কতোদিন ধরে 'হিন্দু'ধর্ম পৃথিবীতে রাজত্ব করছে। কাশীর পন্ডিতরা তাঁকে এতো রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে এর প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে সাহেব কিছু বুঝে, বেশিটাই না বুঝে 'হিন্দুধর্ম বড়ো প্রাচীন' বলতে বলতে বিদায় হয়েছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে নানা পন্ডিতেরা এখানকার অসংখ্য পুরাতাত্বিক নিদর্শন পরীক্ষা করে প্রয়াস করেছেন এই শহরের বয়স নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত আসার। কিন্তু কোনও ঐক্যমত্য এখনও হতে পারেনি। কবে হবে কেউ জানেনা।

    কিম্বদন্তী বলে, যখন কিস্যু সৃষ্টি হয়নি, তখন ভগবান শংকর তাঁর বাসস্থান কাশীকে নিজের ত্রিশূলের উপর স্থাপন করে ঘুরে বেড়াতেন। তার পর যখন চরাচর সৃষ্টি হলো তখন পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে একটা ভালো জায়গা দেখে তিনি সেই ত্রিশূলটি পুঁতে দিলেন।বনারস শহর তখন থেকে সেই জায়গাতেই বিরাজমান। তা এখন এই বিশ্বচরাচর কবে সৃষ্টি হয়েছে সেটা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হলেই বনারসের বয়সের ধাঁধাটা সমাধান হয়ে যাবে।

    যেহেতু এই স্থানটি সৃষ্টির আগে থেকেই রয়েছে, তাই একে 'অপুনর্ভবভূমি' বলা হয়ে থাকে। এই জমিতে শিবের মৌরসিপট্টা থাকার সুবাদে একে 'রুদ্রাবাস'ও বলা হয়ে থাকে। পুরাকালে গাঙ্গেয় অববাহিকায় অত্যন্ত উর্বর ভূমি হওয়ার জন্য এই স্থান হরিৎময় ছিলো। তাই 'আনন্দবন' বা 'আনন্দকানন' নামও পাওয়া যায়। সেই সব অরণ্যে প্রচুর মুনিঋষিরা বসবাস করতেন, তাই এ ছিলো 'তপঃস্থলী' । ধীরে ধীরে জনসমাগম বাড়তে থাকায় তাদের অন্তিমসংস্কার যখন বেশ বড়ো মাত্রা নিলো তখন এই স্থানকে 'মহাশ্মশান'ও বলা হতে লাগলো।

    তখনও পর্যন্ত 'কাশী' নামটি পাওয়া যায়না। কারণ এই স্থানে আর্য বসতি ছিলোনা। ছিলো শুধু অনার্য দেবতা শিবের পুজো আর শিবের চ্যালাচামুন্ডা যতো অরণ্যবাসী ভূত-গণ-যক্ষ-রক্ষ জাতির অনার্য মানবগোষ্ঠীর বসতি। আর্যদের চোখে তারা ছিলো 'অ'মানুষ। শিবের শ্মশানরাজ হবার গপ্পো-ও এখান থেকেই তৈরি হয়।

    আর্যযুগে কাশ্য নামে রাজপুত্র এখানে এসে বসবাস করতে শুরু করেন এবং তাঁর নামেই এই নগরীর 'কাশী' নাম নসিব হয়েছিলো। এই কাশ্য উত্তরপশ্চিম থেকে আসা কোনও আর্য নৃপতির সন্তান ছিলেন।কোনও কারণে পিতৃসম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য পূর্বদিকে এই অরণ্যপ্রদেশে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলেন। এই সময় কাশীতে কোনও কেন্দ্রীয় রাজার শাসন ছিলোনা। অনার্যদের নিজস্ব রীতি অনুযায়ী আদিম গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রশাসনই এখানে প্রচলিত ছিলো। কাশ্য এখানে আর্যধারার রাজতন্ত্র প্রবর্তন করেন। এভাবেই বহুদিন পরে কাশ্যের প্রপৌত্র কাশী নগরীকে রাজধানী করে একটি রাজ্যের পত্তন করেন।

    কাশ্যের বংশধরই ছিলেন দিবোদাস।তিনি নিজেকে মহারাজ বলতেন।একবার হৈহয় বংশের রাজা কাশী আক্রমণ করলে 'মহারাজ' দিবোদাস কাশী থেকে পলায়ন করে পশ্চিমে গঙ্গা-গোমতীর সঙ্গমদেশে বসতি স্থাপন করেন।বেশ কিছুদিন পরে শক্তিসঞ্চয় করে তিনি কাশী ফিরে আসেন এবং হৈহয়দের যুদ্ধে পরাজিত করে কাশী পুনর্দখল করেন। দিবোদাসের ধারণা হয় হৈহয় অধিকারে থাকার জন্য কাশী নগরী অপবিত্র হয়ে পড়েছে। তার থেকে মুক্ত হবার জন্য তিনি দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। যে স্থানে এই যজ্ঞ করা হয়েছিলো, সেখানেই আজকের দশাশ্বমেধ ঘাট। দিবোদাস বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে কাশীকে সুরক্ষিত করার জন্য নগরীর চারদিকে পরিখা খনন করেন। তাঁর বংশ প্রায় পাঁচশো বছর এখানে রাজত্ব করে। এতোদূর পর্যন্ত লোককথার এলাকা, ইতিহাস এখনও এসে পৌঁছোয়নি কাশীতে।

    ঋগবেদ, স্কন্দপুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত সহ বহু ভারতীয় পুরাণকথায় কাশীর বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। সাতশো খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৌদ্ধসাহিত্যে এখানে ব্রহ্মদত্ত বংশের রাজাদের ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়। সেই সময় থেকেই 'কাশী' রাজ্যের নাম 'বারাণসী' লেখা হতে থাকে। একটি মত অনুযায়ী বরুণা ও অসী নদীর সঙ্গমক্ষেত্র হবার জন্য এই নাম হয়। কিন্তু অন্য মতও রয়েছে। তবে কাশী প্রথম শিরোনামে উঠে আসে যখন শাক্যমুনি বুদ্ধ এখানকার ঋষিপত্তনের মৃগদাবে বসতি করেছিলেন।
    বুদ্ধের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাশীর প্রসিদ্ধিও বাড়তে থাকে। যার ফলে প্রতিবেশী নাগ, সুঙ্গ ও কন্ব বংশের রাজারা ক্রমাগতভাবে কাশী আক্রমণ করতে তৎপর হয়। সেই সময়ের অন্ধকার ইতিহাস সারনাথের প্রত্নসামগ্রীতে মুদ্রিত রয়েছে।

    ২.
    সিকন্দর শাহের ফৌজ কাশীতে এসেছিলো কিনা, ঠিক জানা নেই। কাশীর প্রথম উল্লেখযোগ্য বিদেশী অভ্যাগত কুষান সম্রাট কণিষ্ক। কুষাণরা ছিলো পামির আর আমু দরিয়ার দক্ষিণে ব্যাক্ট্রিয়া দেশের লোক। সিকন্দর শাহ যেমন ভারত ইতিহাসে একটা মোড় দিয়ে গিয়েছিলেন, কুষাণ সম্রাট কণিষ্কও ছিলেন সেরকম এলেমদার লোক। কণিষ্কই প্রথম বিদেশী প্রভাবশালী রাজা, যিনি বুদ্ধ ও তাঁর দর্শনকে ভারতবর্ষের সীমার বাইরে বিস্তারিত ভাবে প্রচার করেছিলেন। এখানে আমি শ্রীলংকাকে বৃহত্তর ভারতবর্ষের অংশই মনে করছি। প্রথম খ্রিস্টিয় শতকে এদেশে এসে কণিষ্ক ঋষিপত্তনে সারনাথকে বৌদ্ধধর্মের একটি মুখ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। আসলে আর্যাবর্তের মূলরাজপথ যেটা পাটলিপুত্ত হয়ে তক্ষশিলা পর্যন্ত যেতো, বারাণসি ছিলো তার একটা প্রধান কেন্দ্র। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্তযুগে কাশীর গৌরব শিখর স্পর্শ করে। তারপর সপ্তম শতকে মৌখরি ও বর্ধন রাজত্বেও কাশীর গৌরব অক্ষুণ্ণ থাকে। হর্ষবর্ধন কাশীতে এসেই বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। অষ্টম শতকে প্রথমে পাল রাজারা ও তার পর প্রতিহার রাজারা এসে কাশীতে রাজত্ব করেন। প্রতিহারবংশীয়দের থেকে ক্ষমতা যায় কলচুরি রাজাদের হাতে। নবম শতকে আদি শংকরাচার্য কাশী বিশ্বনাথকে উপলক্ষ্য করে শৈবউপাসকদের একত্র করেন ও তখন থেকে বারাণসি এদেশে শৈবসমষ্টির মূলকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই সময় কাশীতে সহস্রাধিক মন্দিরগড়ে উঠেছিলো। কিন্তু দ্বাদশ শতকের শেষ থেকে মুসলিম শাসকদের দৌলতে কাশীর দুঃসময় শুরু হয়। প্রথমে মুহম্মদঘুরি, তার পর অলাউদ্দিন খিলজি, বারবাক শাহ কালাপাহাড়, কুতুবুদ্দিন আইবক, ফিরোজ শাহ, সিকন্দর লোদি বারাণসিকে ধূলিসাৎ করে দেন। যেহেতু সেই সময় বারাণসি ছিলো সারাদেশে সনাতনধর্মীয়দের প্রধানতম কেন্দ্র, মুসলিম রাজাদের ধারণা ছিলো কাশীকে ধংস করতে পারলে সারাদেশে পৌত্তলিকদের ধর্মকে চূড়ান্ত আঘাত করা যাবে। কাশী অতীতের মতো আবার 'মহাশ্মশান' য়ে পরিণত হয়।

    ৩.

    এই 'মহাশ্মশান' থেকেই আবার ফিনিক্সের মতো জেগে ওঠে ভারতবর্ষের চিরকালীন সমন্বয়ের সাধনা। চতুর্দশ শতকে একজন মানুষ জন্মান বারাণসিতে। তাঁর নাম কবির। তার পরে আসেন রবিদাস এবং সুদূর তালওয়ান্ডি গ্রাম থেকে ভারতাত্মার খোঁজে পরিব্রাজক নানক। ভারতবর্ষের 'সবার উপর মানুষ সত্য' এই বিশ্বাস এই সব মানুষেরা আবার সপ্রমাণ করেন এবং তার কেন্দ্রও ছিলো বারাণসি। একদা সহস্র মন্দিরের শহর কাশীতে কলচুরি রাজা নির্মিত কর্দমেশ্বর শিবের মন্দিরটিই আজ প্রাচীনতম। এটি দশম-একাদশ শতকের নির্মান। আর যত কিছু মন্দির/দেবস্থান আজ কাশীতে দেখা যায়, সবই পরবর্তীকালের। ১৩০০ সালে অলাউদ্দিন খলজি থেকে সপ্তদশ শতকে ঔরঙ্গজীব পর্যন্ত সমস্ত সম্রাট কাশীতে বিনাশযজ্ঞ ব্যতীত আর কিছু করেননি। মুঘল আমলেই এই শহরের নাম বনারস হয়ে ওঠে। ঔরঙ্গজীব সর্বদাই নতুন কিছু করতেন। বনারসের সরকারি নাম তাঁর আমলে হয়ে গিয়েছিলো 'মুহম্মদাবাদ'। বারাণসি ব্যতীত দেশের আর একটি প্রাচীনতম শহর পাটনাও তাঁর নাতির নামে বদলে 'আজিমাবাদ' করে দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের বারাণসি এবং পাটনা আর মিশরের কাহিরা (কায়রো) এবং ফিলিস্তিনের জেরুজালেম, এই চারটি শহরের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এদের মধ্যে কোন জনপদটি প্রাচীনতম জীবিত শহরের দাবি করতে পারে। ইংরেজ আমলে 'বনারস' , 'বেনারস' হয়ে যায়। স্বাধীন ভারতে ডঃ সম্পূর্ণানন্দের উদ্যোগে গৌতম বুদ্ধের ২৫০০তম জন্মদিনে ( যদিও এখনও স্থির হয়নি বুদ্ধের সর্বসম্মত জন্মসাল কী) এই শহরের নামে আবার সরকারিভাবে 'বারাণসি' ফিরে আসে।

    তবে নামে আর কীই বা আসে যায় ? একজন ভারতীয়, সে দেশের যেকোন প্রান্তেই শিকড় রাখুক না কেন, বনারসের টান উপেক্ষা করতে পারেনা।

    'খাক ভি জিস জমীঁ কা পারস হ্যাঁয়,
    শহর মশহুর য়হি বনারস হ্যাঁয় ।'

    এই শরতে বনারস আবার টানলো আমাকে। এই শহরের পুরোনো লক্ষণগুলির বয়স কখনও বাড়েনা। সেই সব চিরনতুন আকর্ষণগুলি নিয়ে কিছু কথাবাত্তা আপনাদের সঙ্গে বিনিময় করার ইচ্ছে রইলো।

    (ক্রমশঃ)
  • শিবাংশু | 127.197.239.80 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ০১:০৬582452
  • বনারস চালিসা -২

    ভোর ভই.....

    ' ত আলল্লা বনারস চশমে বদ দূর
    বহিশ্তে খুর্রমো ফিরদৌসে মামুর
    ইবাতত খানএ নাকুসিয়াঁ অস্ত
    হমানা কাবয়ে হিন্দোস্তাঁ অস্ত"

    ( হে ঈশ্বর, বনারস কে অশুভ দৃষ্টি থেকে দূরে রেখো। কারণ এ এক আনন্দময় স্বর্গের মতো স্থান। এইখানে ঘন্টাবাদক জাতির( অর্থাৎ হিন্দুদের) পূজাস্থল। এ তো আসলে হিন্দুস্তানের কাবা।)

    এইভাবেই বলেছিলেন নজমুদ্দৌলা, দবির-উল-মুল্ক, নিজাম জং মির্জা অসদুল্লা বেগ খাঁ ওরফে মির্জা ঘালিব, বনারসের মহিমা প্রসঙ্গে।

    ভোরটি ছিলো দুর্গাদশমীর তিথি। আগের দিন রাতে শুতে শুতে বেশ দেরি হয়েছিলো। সিগরার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের পুজোয় নবমীর আরতি খুব জমকালো। বনারসের উৎসবের তালিকায় এই অনুষ্ঠানটি জনতার কাছে অতীব প্রেয়। প্রবল জনসমাগম এবং বর্ণাঢ্য আরতি চলেছিলো অনেক রাত পর্যন্ত। সংযোগবশতঃ আমার অতিথিশালাটি ভারত সেবাশ্রম সংঘের ঠিক উল্টোদিকে। যাঁদের উত্তরাপথের সমস্ত শহরে মহানবমীর রাতে উপচে পড়া জনস্রোত দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁরা জানেন জনগণেশের সেই রুদ্ধশ্বাস উদ্যাপনের মাত্রা কতোটা বৃহৎ। বনারসও তার কোনও ব্যতিক্রম নয় । সারা রাত সারা শহর রাস্তায় ভ্রাম্যমান। সেই উন্মুখর আবেগ থেকে নিজেদের সরিয়ে এনে গৃহবন্দি হলুম। পরদিন ভোরবেলা যে গঙ্গা থেকে দিন উঠে আসার দৃশ্যকাব্য দেখতে যেতে হবে।

    ২.

    তখনও আলো ফোটেনি ঠিক। বেশ শিরশিরে হিমেল স্নিগ্ধতা ভোর হাওয়ায়। সরাইখানা থেকে বেরিয়ে আসি দুজনে।একটু এগিয়ে সিগরার তিমুহানির মোড়। এতো সক্কালে কি কিছু সওয়ারি পাওয়া যাবে। যাকগে না পাওয়া গেলে চরণদাস ভরসা। সারা শহর তখন যেন উৎসব শেষের শ্রান্তি গায়ে জড়িয়ে নিঝুম হয়ে শুয়ে আছে। হঠাৎ একটি অটো এসে দাঁড়ায়। কঁহা জানা হ্যাঁয় সাব? গোদৌলিয়া জাই? জাই, পর মোড় পর উতরনা পড়ি। কো-ই বাত নইখে হো, চলি।

    অটোতে হাওয়া বেশ শীতল লাগতে থাকে। রথযাত্রা মোড় পেরিয়ে বাঁদিকে গুরুবাগের রাস্তা ধরে। সেখান থেকে লাক্সা রোড। গড়াতে গড়াতে গোদৌলিয়ার মোড় এসে যায়। ডানদিকে সন্ত থমাস গির্জা। সামনে রাস্তায় পুলিস ব্যারিকেড। এই পথেই গোদৌলিয়া হয়ে বিকেল থেকে প্রতিমার শোভাযাত্রা যাবে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। আলো ক্রমে আসিতেছে। আমরা হাঁটতে থাকি নদীর দিকে।

    সেই বহুশ্রুত গোদৌলিয়ার পূর্বমুখী পথ। বনারসের স্নায়ুকেন্দ্র। দুধারে উঁচু সৌধগুলি, ভরা আছে বিপনীসারিতে। তাদের কপাট তখনও খোলেনি, কিন্তু সবজিওয়ালারা বসতে শুরু করেছে রাস্তার ধারে। চায়ের দোকান, পানের দোকান সব নড়ে চড়ে বসছে। স্নানশেষে ফেরা লোকজন, আবার স্নানযাত্রায় এগিয়ে যাওয়া মানুষের সারি, মন্থর ষাঁড়, অনাবিল আবর্জনা, আশেপাশের ছোটখাটো মন্দির থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি, স্পিকারে মারুতিনন্দনের ভজন....

    আর একটু এগিয়ে যেতেই বনারসের চিরপরিচিত ঘাটের সিঁড়ি। দশাশ্বমেধ ঘাট, গঙ্গানদীর সব চেয়ে বিখ্যাত তীরভূমি, রঘু রাইয়ের ছবি থেকে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

    ভোর ভই বনারস মা ।

    ৩.

    একজন বনেদি বনারসিবাবুর কাছে একটি গপ্পো শুনেছিলুম।

    তিনি গঙ্গার ওপার থেকে নৌকোতে একটি কবি সম্মেলন সেরে ফিরছিলেন। পৌষ মাস, রাত বারোটা বেজে গেছে। ঘাটে নৌকো লাগতে তিনি দেখেন একটি লোক দাঁতন করছে। তিনি একটু আশ্চর্য হয়ে জিগালেন, এখন দাঁতন করছো কেন? উত্তরে সেই বনারসি একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, 'সুকওয়া তো উগল ভয়ে, অব ভিনসার মেঁ কিতনা দের ভই?' অর্থাৎ, শুকতারা তো উঠে গেছে, ভোর হতে আর কতো দেরি? এমত ঘোষণার পর সে কুলকুচোসহ 'বম শংকর' আওয়াজ করে নদীতে ডুব দিলো। বনারসে কখন যে 'ভোর' হয়, সে কথা কেউ বলতে পারেনা।

    শুধু ঐ টানা চার-পাঁচ কিমি টানা সিঁড়ির সারি হয়তো বলতে পারবে, কখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ নসিব হয়, যখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, 'ভোর ভই'।

    ৪.

    রাঁড়, সাঁড়, সীঢ়ী, সন্ন্যাসী।
    ইনসে বচে তো সেবে কাশী ।।

    কে যে এই প্রবাদটির জন্ম দিয়েছিলো তা আর কারো মনে নেই। কাশীর চারটি লক্ষণের মধ্যে সিঁড়িটিই আপাতভাবে একমাত্র নিষ্প্রাণ পদার্থ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কাশীর সিঁড়ি অনেকগুলি জলজ্যান্ত চরিত্র। প্রতিটি ঘাটের সিঁড়ির রূপ আলাদা। প্রত্যেকের বলার মতো অনেক কথা আছে। ঘাটের কথা। তাদের সর্বদা চোখে চোখে রাখতে হয়, নয়তো সশরীরে শিবলোকলাভ অনিবার্য। সিঁড়ির ধাপগুলি উঁচু নিচু। সতর্ক না থাকলে বেশ বিপজ্জনক। আসলে যতোটা জায়গা নিয়ে এই সিঁড়িগুলি নির্মান করার কথা ছিলো, স্থানাভাবে তা আর করে ওঠা সম্ভব হয়নি। তাই এই বিড়ম্বনা।

    কাশীর ষাঁড় সম্বন্ধে যতো-ই বলা যায়, যথেষ্ট হয়না। রাস্তাঘাটে তো নাহয় দুচার ফুট জায়গা থাকে এই পৃথুল, রইস, শৃঙ্গী, প্রাগৈতিহাসিক জন্তুগুলির সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবার। কিন্তু যখন সাকুল্যে তিন-চার ফুট চওড়া বাবা বিশ্বনাথের গলিতে সবেগে এই পশুগুলি ধেয়ে বেড়ায় তখন একটু অসতর্ক থাকলেই পর্যটকের আক্ষরিক অর্থে প্রাণান্ত হতে পারে। দুধারের দোকানদারেরা কিন্তু পরম প্রশান্তিতে আপনাকে স্বস্তিবাচন দেবে, ' ডরিয়ে মত, ই এয়সেহি নিকল জাই....'। আশ্বস্ত হতে পারা আপনার বিশ্বাসের গভীরতার পরিচয়।

    সন্ন্যাসী জাতির লোকজন প্রথম দেখা যায় তথাগতবুদ্ধের অনুগামীদের মধ্যে। তার আগে সন্ন্যাসকে বৃত্তি হিসেবে নেওয়া মানুষ এদেশে ছিলোনা। এঁরা 'সংসার' করেননা, কিন্তু নানা রকম ঐহিক মোহজালে বদ্ধ থাকেন। আসলে ভারতবর্ষে সব রকম আর্যধর্মেই কাশীর সিলমোহর না লাগলে তা জাতে ওঠেনা। সনাতনধর্মের অসংখ্য শাখাপ্রশাখা ছাড়াও বৌদ্ধ, জৈন, শিখ সব ধর্মবিশ্বাসেই যেহেতু কাশীর অন্যতর মহত্ব রয়েছে, তাই নানা ধরন, নানা মডেল, বিবিধ রূপের সন্ন্যাসীদল এখানে ভরে আছেন। তাঁদের মহিমা বা গরিমা নিয়ে এখানে প্রশ্ন তোলা নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু এঁদের মধ্যে খতরনাক প্রজাতির লোকজনও বিশেষ কম নেই। ভোরবেলা কাশীর বিভিন্ন ঘাটে এঁদের জমায়ত বেশ চোখে পড়ে। এঁদের সম্পর্কে প্রবাদটি বেশ লাগসই,

    ' নারি মুই সম্পত্তি ভই নাসী
    মুড় মুড়ায়ে ভয়ে সন্ন্যাসী ....'

    বাকি রইলো প্রথম যাঁদের নাম নেওয়া হয়েছিলো তাঁদের গপ্পো।

    তা কাশীর অবিদ্যাদের গপ্পো তো কিম্বদন্তী স্বরূপ। ভোরবেলা তাদের কথা তো লোকে বিশেষ বলেনা। নগরবধূদের যতো রকম প্রকারভেদ আছে, তার সব নিদর্শনই বনারসে সগৌরবে বিরাজমান। অগণিত গান্ধর্বী থেকে রূপোপজীবীর মোহন টান উপেক্ষা করে 'ভালো' মানুষ হয়ে থাকার প্রেরণা সত্যিই বনারসিদের জন্য এক চ্যালেঞ্জ। দালমন্ডি, ছত্তাতলে কি মডুয়াডি রসিক নগরবাসীদের জন্য সাঁঝবেলা থেকে সেজেগুজে রেডি।

    এঁদের কথা বলার মতো রসিক মির্জা ঘালিবের থেকে অধিক কে আছে?

    ' কয়ামত কামতা, মিজগা দরাজাঁ
    জ মিজগা বর সফে-দিল তীরঃ বাজাঁ
    ব মস্তী মৌজ রা ফরমুদঃ আরাম
    জ নগজে আব রা বখশিন্দা অন্দাম'

    এই সব রূপসী দীর্ঘ অক্ষিপলকধারিনী সুন্দরীদের দিকে তাকালে কয়ামত কি না এসে পারে? এঁরা বড়ো নিষ্ঠুর দক্ষতায় হৃদয়ে শরবৃষ্টি করতে পারঙ্গম। এঁদের মস্তির চমক দেখে গঙ্গার ঢেউও শান্ত হয়ে যায়। এঁদের রূপ বহমান স্রোতধারাকেও স্থির করে দিতে সক্ষম।

    (ক্রমশঃ)
  • শঙ্কু | 127.223.192.37 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ০৯:৩৪582463
  • শিবাংশুদা এক কালজয়ী রচনায় ব্যপৃত হয়েছেন। ইঁট পেতে বসে গেলাম।
  • dd | 133.237.15.232 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ১১:৫৭582467
  • এটা ফাটাফাটি হচ্ছে তো।
  • কৃশানু | 226.113.128.239 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ১৫:৪০582468
  • কোনো কথাই যথেষ্ট নয়। না বারানসী সম্বন্ধে, না এই লেখা সম্বন্ধে। চলতে থাকুক।
  • | 233.237.113.18 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ১৫:৪৬582469
  • শিবাংশু দা দারুন। আমি এক সময় খানিক পড়াশুনা করেছিলাম বারণসী/কাশী নিয়ে । কয়েক ট প্র্শ্ন নিয়ে আসবো।

    গল্প চলতে থাকুক।
  • dd | 133.237.15.232 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ১৬:৪৯582470
  • আমার এক বন্ধু, ভলান্টারী রিটায়ার নিয়ে রা কৃ মিশনের কোলাবরাশনে কাশীর ইতিহাস লিখছে। কলকাতার বাসিন্দা কিন্তু এখন অনেকটা সময় বেনারসেই কাটায়।

    এই লেখা পড়তে পড়তে মনে পরলো। দারুন ইন্টেরেস্টিং কাজ না?
  • | 116.197.134.158 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ২১:০৩582471
  • কাশী নিয়ে কথা হচ্ছে বলে লিখলুম। আমাদের প্রিয় মহারাজ স্বামী মেধসানন্দ ( আগে আমাদের প্রিন্সিপাল, এখন জাপান র সেন্টার টা দেখেন) উনি একটা বিশাল মোটা বই লিখেছেন। Varanasi , the crossroad এটাই ওনার Phd থিসিস।

    আমার বাবা এটার বাংলা অনুবাদ করছেন লাস্ট দেড় ব্চর ধরে, প্রায় হয়ে গেছে। শিগ্গির উদ্বোধন থেকে বেরোবো। এই বাপী র অনুবাদ করা অংশ গুলো ই আমি পড়েছি।
  • Sibu | 84.125.59.177 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ২২:৫৭582472
  • শিবাংশু তো লা জওয়াব, যেমনটা হয়ে থাকে আর কি।

    একটু নিটপিক। একদম প্রথম লেখাটায় একটা লাইন একটু কনফিউসিং। "সাতশো খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৌদ্ধসাহিত্যে এখানে ব্রহ্মদত্ত বংশের রাজাদের ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়।" সাতশো খ্রিস্টপূর্বে কি বৌদ্ধসাহিত্য ছিল? যতদূর মনে পড়ছে বুদ্ধের জন্ম তো সাতশো খ্রিঃপূঃ র পরে। ভুল জানলে এট্টু শুধরে দিও প্লীজ।
  • siki | 24.97.191.206 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ২৩:১৮582442
  • পড়ছি।

    বারাণসীর হিন্দি কি আমাদের পরিচিত হিন্দি নয়?
  • শিবাংশু | 127.197.241.217 | ১২ ডিসেম্বর ২০১২ ২৩:৩৩582443
  • বনারস চালিসা-৩

    অনন্ত সোপানবীথি স্পর্শ করে থাকে
    জলের আশ্লেষ

    পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। একের পর এক সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে জলের কাছে। সিঁড়ি, নদী ও মানুষ এবং দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বিবিধ প্রণালী, নানা অভ্যেস, যার অন্য নাম ভারতবর্ষ। উদ্যত সূর্য, কল্লোলিত জলরাশি আর শব্দের ঐক্যতান সাক্ষী রেখে আরেকটি দিন উঠে আসে অনন্ত মূহুর্তময় কালস্রোত থেকে।

    চোখের সামনে কোন সব দৃশ্যের জন্ম হয়?

    গোল ছাতার নীচে চাতালে বসে থাকা মুন্ডিত মস্তক তিন ভাই, পুরোহিতের সঙ্গে পিতৃতর্পণ করছে। সারি সারি সিঁড়ির উপর নানা তলে অসংখ্য মানুষ। কেউ তিলক কাটছে, কেউ বা তৈলমর্দনে ব্যস্ত ( অবশ্যই নিজেকে), কেউ দিচ্ছে ডনবৈঠক, কোন তরুণী স্নানশেষে সিক্ত সিঁথিতে পরে নিচ্ছে মঙ্গলচিন্হ। সকল লোকের মাঝে বসে নিজস্ব মুদ্রাদোষে অসংখ্য স্বল্পবসন পুরুষ আর স্খলিতবেশ নারীদের নৈমিত্তিক প্রভাতীস্নান, গরদপরা ভক্তজনের পূজাশেষে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া ফুলমালা। নৌকো আসছে, নৌকো যাচ্ছে, পর্যটকের ক্যামেরা খুঁজে নিচ্ছে সঠিক দৃষ্টিকোণ। তার মধ্যেই গেরুয়াবসনের আড়ালে কখনও ঘুরে বেড়ানো, কখনও ধ্যানমগ্ন ত্রিশূল-দন্ডধারী সন্ন্যাসীর দল। কেউ সম্পূর্ণ কেশ মুন্ডিত, কেউ বা শ্মশ্রূসংকুল।

    মাঝিরা এসে ধরে, নৌকোবিহারের প্রস্তাব নিয়ে। নিশ্চয় হবে খেয়ায় ভাসা, তার আগে একটু দাঁড়িয়ে দেখি । আমরা যাইনি মরে আজও, তবুও কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়। লোকে মরতে আসে বারাণসিতে, বাঁচতেও আসে সমান মাত্রার আবেগ নিয়ে। আর কোথাও কি এমন চক্রধর তেহাই বাজে মহাকালের হাতে? জানিনা....

    সঙ্গিনীকে বলি , যাবে নাকি?
    যাবো বলেই তো এসেছি...
    সত্যিই আমাদের সব আসাই তো শেষ পর্যন্ত যাওয়ার জন্যই...

    নেমে আসি তীর থেকে তরী। গায়ে গায়ে মাঝি নৌকো, দড়ি দিয়ে বাঁধা। জলের ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলছে। ভারসাম্য রেখে নৌকোতে গিয়ে বসি। মাঝিকে বলি, কোথায় যাবে? সে নামতা মুখস্ত বলার মতো অমুক ঘাট তুসুক ঘাটের অনিঃশেষ লিস্ট শোনাতে থাকে। আমরা শুনি, আবার শুনিও না। নদীর যেমন কোনও নাম হয়না, ঘাটেরও হয়না। তবু নাম দেওয়া হয়, কলৌ নামৈব কেবলম। নৌকা দাঁড় বায় দক্ষিণবাহিনী।

    ২.

    বারাণসিতে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠে অসংখ্য প্রাসাদ, হাবেলি, মন্দির, চাতাল। যতো হিন্দু রাজা-বাদশা-জমিদার ইংরেজতোষনে সক্ষম হয়ে নিজেদের ধনসম্পদ বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলো, তাদের মধ্যে অনেকে এইসব নির্মাণকাজে নিযুক্ত হয়। নদীর গায়ে গায়ে গড়ে ওঠে এই সব ধনগর্বী রাজন্যের প্রতাপী নিদর্শন। সঠিক পরিমাণ স্থান সংকুলান না করে এই সব বসতি গড়ে ওঠায় ঘাটের সিঁড়ির জায়গা কমে যায়। ফলত অব্যবস্থিত মাপ ও মাত্রার সিঁড়ির ধাপই শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এইখানে নদীতে জোয়ারভাঁটায় জলের ওঠানামা অনেকটা উচ্চতা গ্রাস করে। ফলে উঁচু ঘাট না হলে সমূহ বিপদ।

    প্রতিটি ঘাটেরই একটি করে নিজস্ব গৃহপোষ্য লিঙ্গমন্দির রয়েছে। প্রাচীনতম লিঙ্গমন্দিরের মধ্যে একটি অসীসঙ্গমেশ্বর শিব রয়েছেন দক্ষিণতম এবং বিখ্যাত অসীঘাটে। এইখানেই গোস্বামী তুলসীদাস বাস করতেন। এখানেই তিনি লিখেছিলেন রামচরিতমানস, উত্তরভারতের সব চেয়ে জ্যান্ত কবিকৃতি। হ্যাঁ, আজও সমান গরিমায় উজ্জ্বল। এখান থেকেই একটু উত্তরে গেলে লোলার্ককুন্ড। সনাতনধর্মের সৃষ্টির আদিতম কালের সূর্যপীঠ। বস্তুত সনাতনধর্মের অনেক আগেই এর উৎপত্তি। এখান থেকে উত্তরবাহিনী হলে পর পর শিবালা ঘাট, হনুমানঘাট এবং কেদার ঘাট। কিম্বদন্তী বলছে হনুমানঘাট পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত বৈষ্ণব সন্ত বল্লভাচার্যের জন্মস্থান। বারাণসির দক্ষিণভারতীয়দের প্রধান উপনিবেশ এখানেই। এই ঘাটেই রয়েছে শৈবধর্মের একটি আদিতম উপাস্য দেবতা রুরু'র বিগ্রহ, সঙ্গে বাহন সারমেয়, নাম ভৈরব।

    যে সব পুরাণকথার মধ্যে ভারতধর্মের মূল ছাঁদটি ধরা আছে তার একটি হচ্ছে রাজা হরিশ্চন্দ্রের কিম্বদন্তী। মূল্যবোধের যে স্তরে যাযাবর আর্য উপজাতিরা এদেশে নিজেদের উন্নীত করেছিলো, তার একটি নিখুঁত নমুনা এই লোককথা। গপ্পোটা সবার জানা, তাই পুনরুক্তি নয়। কিন্তু পটভূমি হিসেবে বারাণসিকেই কেন নির্বাচন করা হয়েছিলো সেখানে? ভারতধর্মের শ্রেষ্ঠ পরীক্ষাগার বলে কি? সেই রূপকথার রাজার নামে একটা ঘাট আছে এখানে। হরিশ্চন্দ্র ঘাট। অনেক অন্ত্যেষ্টি হয় এই ঘাটে আর হয় মণিকর্ণিকা ঘাটের শ্মশানরক্ষক অর্থাৎ ডোমসম্প্রদায়ের সদস্যদের শেষ কৃত্য। তাঁরা নাকি মণিকর্ণিকায় নিজেদের শবদাহ করেন না। বারাণসির এটাই প্রাচীনতম শ্মশানঘাট, তাই আদি মণিকর্ণিকাও বলা হয় একে। ১৭৪০ সালে পেশোয়াদের গুরু নারায়ণ দীক্ষিত এই ঘাটটি সংস্কার করে পাকা করে দিয়েছিলেন।

    এর পরের বড়ো ঘাট কেদারঘাট। এখানে ষোড়শ শতকে স্বামী দত্তাত্রেয়র শিষ্য কুমারস্বামী একটি মঠ নির্মান করেছিলেন। এর লাগোয়া চৌকি ঘাটে বৌদ্ধ ও পৌরাণিক যুগের নাগবংশীয়দের নানা পুরাতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। বারাণসির বৃহত্তম নাগপঞ্চমীর উৎসব এখানেই যাপিত হয়। লাগোয়া মানসরোবর ঘাট স্থাপনা করেছিলেন জয়পুরের রাজা মানসিংহ ১৫৮৫ সালে। এই ঘাট পেরিয়ে এলেই রাজা ঘাট, বিশাল আর জমকালো। পেশোয়া বালাজি বাজিরাওয়ের তৈরি। পরে সংস্কার করেন পেশোয়া অমৃত রাও। পর পর খোরি ঘাট, পান্ডেয় ঘাট আর তার পর একজন বাঙালি জমিদার নির্মিত বিশাল প্রাসাদ ও ঘাট চোখে পড়ে, দিঘাপাতিয়া ঘাট। দিঘাপাতিয়ার রাজবংশকে মুর্শিদকুলি খান রায়রায়ান উপাধি দিয়েছিলেন। রাজশাহী জেলার এই রাজারা বরেন্দ্রভূমের একছত্র অধিপতি ছিলেন বহুকাল। ঘাট সংলগ্ন প্রাসাদটিতে এখন সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ স্বামীর আশ্রম রয়েছে।

    বারাণসির পুরোনো শক্তিসাধনার একটি নিদর্শন রয়েছে চৌষট্টি ঘাটে। এখানে চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির ছিলো প্রাচীনকাল থেকে। ষোড়শ শতকে বিশ্রুত সংস্কৃত পন্ডিত মধুসূদন সরস্বতী মন্দিরের পাশে এই ঘাটটি স্থাপনা করেন। সপ্তদশ শতকে উদয়পুরের রানার পোষকতায় এই ঘাটটির সংস্কার হয়। এই মূহুর্তে চৌষট্টি দেবীর যে মন্দির রয়েছে, সেখানে ষাটটি দেবীবিগ্রহ বর্তমান। চারটি বিগ্রহ অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। তার পর পর দ্বারভাঙার রাজা ও তাঁর মুন্সি শ্রীধর নারায়ণ নির্মিত দ্বারভাঙা ও মুন্সি ঘাট, রানী অহিল্যাবাইয়ের নামাঙ্কিত ঘাটটিও রয়েছে সেখানে।

    আবার ফিরে আসা দশাশ্বমেধে। প্রশ্ন উঠতে পারে এতো ঘাটের কথা জেনে কী হবে? উত্তরটি খুব সহজ, কিছুই হবেনা। কিন্তু ভারত ইতিহাসের একটা ধারা, যা সনাতনধর্মকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে উঠেছিলো তার হালহকিকতে যাঁদের রুচি আছে তাঁরা নিশ্চয় আগ্রহবোধ করবেন। ঘাটের কাছে নদীর জল কোন কথা শুধিয়ে যায় অনন্ত প্রহর।

    ৩.

    আমার একটা তেমন সুলভ নয় ব্যসন রয়েছে। সেটা শ্মশানঘাটে 'বেড়াতে' যাওয়ার নেশা। না সেখানে গিয়ে কোনও ঐহিক নেশায় রুচি নেই, শুধু দেখতে যাওয়ার নেশা বলা যায়। আমাদের গ্রামে সুবর্ণরেখার ধারে যে সুন্দর সাজানো ঘাট রয়েছে, ছুটির দিনে সেখানে মাঝে মাঝে খেপ মেরে আসার অভ্যেস আমার বেশ পুরোনো। এ যাওয়া কিন্তু কোনও চেনা মানুষকে এগিয়ে দিয়ে আসার জন্য যাওয়া নয়, সেতো শতবার হয়ে গেছে, একে বলা যায় জীবনের শেষ স্টেশনের পথে ড্রাই রান। ভারতবর্ষে প্রাচীনতম যে দুটি শ্মশানঘাট রয়েছে, তার একটি পাটনার বিখ্যাত বাঁশঘাট। সেই বৌদ্ধযুগ থেকে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু জায়গা বদলেছে, কিন্তু ঘাটটি সগৌরবে রয়ে গেছে। তা পাটনা থাকাকালীন আমার দফতর আর বাড়ির মাঝামাঝি জায়গায় ছিলো এই স্থানটি। আমার এক অগ্রজ সহকর্মী, তিনিও জামশেদপুরের লোক এবং এরকম একটি উদ্ভট নেশায় আমার সঙ্গী। প্রতি শনিবার বেলা থাকতে থাকতে যখন বাড়ি ফিরতুম, তখন বাঁশঘাটের পাশে গাড়িটি লাগিয়ে দুজন মিলে ও তল্লাটে একবার ঢুঁ মেরে আসার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো। অনেকেই জানতো এই বিচিত্র নেশার কথা। কেউ অবাক হতো, কেউ পাগল ভাবতো, কেউ বা অন্যকিছু।

    তো বাঁশঘাট ছাড়া দেশের অন্য প্রাচীনতম আর ব্যস্ততম শ্মশানটি রয়েছে বারাণসিতে, সেটা একবার না দেখে তো ফেরা যায়না। কিন্তু যাবো রাতের দিকে, অন্ধকারে। সন্ধে হতেই দশাশ্বমেধে এসে আবার নৌকোয় চড়ে বসি। তরী এবার উত্তরবাহিনী। বাঁদিকে শ্মশানরাজ কালুডোমের বিশাল রাজপাট। ঘাট ছেড়ে নদীর দিকে উজানে বয় নৌকো। নদীর ঢেউয়ে দুলে যায় তীরের আলোকমালা। আসে মানমন্দির ঘাট, জয়পুরের রাজা নির্মিত অষ্টাদশ শতকের একটি মানমন্দির রয়েছে এখনও। তারপর ললিতা ঘাট বা নেপালি মন্দির ঘাট। নেপালি স্থাপত্যের একটি ভারি সুন্দর কাঠের মন্দির আছে সেখানে। মাঝির সঙ্গে গপ্পো জুড়ি, তার নাম দীপক মন্ডল। বলি দীপক নাম তো বাঙালিদের মধ্যে বেশি পাওয়া যায়। সে বলে আমি তো কোলকাতার লোক। বাবুঘাটে নৌকো বাইতাম। বাবার তাড়নায় বনারস পালিয়ে আসি। ভোজপুরিতে সুখদুঃখের কথা হয়। প্রশ্ন করি, সব মাঝিই কেন শাড়ি মন্ডিতে নিয়ে যাবার জন্য পীড়াপিড়ি করে? সে জানায়, বনারসের সব ঘাটে যতো নৌকো আছে সবের মালিক মারওয়াড়ি শাড়ির ব্যবসায়ীরা। মাঝিরা ভাড়া খাটে দিনমজুরিতে। যা রোজগার হয় সব তুলে দিতে হয় মালিকের যে সব এজেন্টরা ঘাটে ঘুরে বেড়ায় তাদের হাতে। ভিড়ের মরশুমে বেশি কামাই হলেও মাঝির জন্য আলাদা কিছু নেই। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সংখ্যক কিছু গ্রাহককে রোজ মালিকের শাড়ির গদিতে নিয়ে যাবারও চাপ আছে। ব্যাংকারের মাথা কাজ করে। জিগাই, নিজে একটা নৌকো কেনোনা কেন? সে বলে এ রকম একটা নৌকোর দাম অন্তত নব্বই হাজার। কোথায় পাবো? আমাদের তো থাকারও একটা ঢঙের জায়গা নেই। বলি, ব্যাংক যদি দেয়? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে নৌকো এখানে আমাকে কেউ বাইতে দেবেনা।

    নিরুত্তর, শূন্যপানে চাই। তখনই দূরে ভেসে ওঠে সারি সারি প্রজ্জ্বলিত চিতার আলো, সেই সব ভাগ্যবানের পঞ্চভূতে মিশে যাবার জাদু প্রতিবিম্ব, যারা অনেক পুণ্যে ঐ ঘাটে ঠাঁই পেয়েছে। এসে গেছে মণিকর্ণিকা। নৌকো একটু একটু করে ঘাটের কাছাকাছি যায়। একসঙ্গে ছ-সাতটি চিতা জ্বলছে পাশাপাশি। আবছা আলোয় দেখা যায় ঘিরে থাকা মানুষদের মুখ। প্রিয়তম স্বজনদের অগ্নিআহূতি দিতে জড়ো হয়েছে তারা। ডোমরা এসে চিতাকাঠ উল্টে দিয়ে যায়। সোনালি নীহারিকার মতো আগুনের ফুলকি সন্ধে হাওয়ায় উড়ে যায় কোন অজানার দেশে। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে প্রিয় কবির শব্দের সারি। আমার পিতৃদেব চলে যাবার কিছু দিন আগে এই কবিতাটি স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করে ফিতেবন্দি করে গেছেন আমাদের জন্য।

    চতুর্দশীর অন্ধকারে বয়ে যায় গঙ্গা
    তার ওপরে আমাদের পলকা নৌকোর নিঃশ্বাস
    মুখে এসে লাগে মণিকর্ণিকার আভা

    আমরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকাই না
    হাতে শুধু ছুঁয়ে থাকি পাটাতন
    আর দু'এক ফোঁটা জলের তিলক লাগে কপালে

    দিনের বেলা যাকে দেখেছি চন্ডাল
    আর রাত্রিবেলা এই আমাদের মাঝি
    কোনো ভেদ নেই এদের চোখের তারায়

    জলের ওপর উড়ে পড়ছে স্ফুলিঙ্গ
    বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে ভস্ম
    পাঁজরের মধ্যে ডুব দিচ্ছে শুশুক

    এবার আমরা ঘুরিয়ে নেবো নৌকো
    দক্ষিণে ঔ হরিশ্চন্দ্রের ঘাট
    দুদিকেই দেখা যায় কালু ডোমের ঘর

    চতুর্দশীর অন্ধকারে বয়ে যায় গঙ্গা
    এক শ্মশান থেকে আরেক শ্মশানের মাঝখানে
    আমরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকাই না ।

    ( মণিকর্ণিকাঃ শঙ্খ ঘোষ)

    অনেকে দাবি করেন, কবিতা বুঝিনা। সত্যিই কি বোঝেন না?

    জানিনা.....

    (ক্রমশ)
  • শিবাংশু | 127.197.241.217 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:০২582444
  • শিবু,

    ষোড়শ মহাজনপদের সময়কাল ৭০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সেই সময় এদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজত্ব ছিলো কাশী ও কোসল। তৎকালীন ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজার নাম পাওয়া অশ্মক মহাজনপদে। কিন্তু অশ্মক হলো আজকের বিদর্ভদেশ। অতএব কাশীর সঙ্গে মিলছে না। অশোক পিয়দস্সির সময় কলিঙ্গের রাজা ছিলেন আরেক ব্রহ্মদত্ত। তবে এক্ষেত্রে তিনিও সেই রাজা নন। কিন্তু ক্ষান্তি-বন্নন-জাতকে ব্রহ্মদত্ত রাজার নাম পাওয়া যায় কাশীর রাজা হিসেবে। এই ব্রহ্মদত্ত বুদ্ধের পূর্ব এক জন্মের নাম। তবে জাতক ইতিহাস নয়, নেহাৎ গল্পকথা। কিন্তু বুদ্ধের জন্মের দুশো বছর আগে যে কাশীতে কোনও ব্রহ্মদত্ত রাজা ছিলেন না, তাও লেখা নেই কোথাও। ব্রহ্মদত্ত থাকুন বা না থাকুন, বুদ্ধের জন্মের দেড়-দুশো বছর আগে কাশী মহাজনপদ বহাল তবিয়তে ছিলো এটা গ্রহণ করা যায়।

    সিকি,

    বনারসের প্রচলিত ভাষা হলো ভোজপুরি। খড়ি বোলির থেকে আলাদা।
  • সিকি | 24.97.191.206 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:১১582445
  • কাশী অঙ্গ মগধ কোশল
    বৃজি মল্ল চেদী পাঞ্চাল
    অস্মক সুরসেনা XXXX মৎস্য
    অবন্তী গান্ধার কম্বোজ বৎস্য

    স্মৃতি থেকে আওড়াতে গিয়ে দেখি একটা মহাজনপদের নাম মনে পড়ছে না কিছুতেই। কোনটা বাদ গেল, কেউ বলতে পারবে?
  • Sibu | 84.125.59.177 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:১৯582446
  • কুরু?

    ধন্যবাদ শিবাংশু। আমি লাইনটার ভুল অর্থ করেছিলাম। বৌদ্ধসাহিত্যের সময় সাতশো খ্রিঃপূঃ নয়, ওটা ব্রহ্মদত্তের সময় হবে।
  • সিকি | 24.97.191.206 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:২৫582447
  • ইয়েস, কুরু। মনে পড়েছে। থ্যাঙ্কু শিবুদা।
  • dd | 120.234.159.216 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১২ ০৯:১৩582448
  • দশ অবতারের মতন ষোড়োশ মহাজনও কিন্তু ফিক্ষড কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন লিস্টি হয়েছে।
  • শিবাংশু | 127.197.236.230 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১২ ২২:৩৩582449
  • বনারস চালিসা-৪

    কবিরকথা

    জাতি ন পুছো সাধু কা

    ১.

    সে একটা সময় ছিলো।

    দিল্লির সুলতান, বিখ্যাত বা কুখ্যাত তুর্কি মুহম্মদ বিন তুঘলক আর নেই। নিহত হয়েছেন ভাই ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে। সেই ফিরোজ শাহ তুঘলকও মারা গেলেন ১৩৮৮ সালে। দিল্লির মসনদে প্রায় রোজ রাজাবদল। সীমান্তের ওপারে বহুদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলেন তুর্কো-মোঙ্গল যুদ্ধব্যবসায়ী তইমুর লংগ। ১৩৯৮ সালের শীতকালে তিনি আক্রমণ করলেন দিল্লি। তৎকালীন সুলতান মাহমুদ শাহ পালিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু আট দিনের দিল্লি অবরোধে এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হলো এবং লুণ্ঠিত হলো সব সম্পদ। একজন মুসলিম শাসকের হাতে এতো মুসলিমের রক্তচিণ্হ বোধ হয় এদেশ প্রথম দেখেছিলো তখন। হিন্দু, হিন্দুর সঙ্গে নেই, মুসলিম, মুসলমানের সঙ্গে নেই। মানুষ মানুষের সঙ্গে নেই। ইতিহাসের ঘোর অন্ধকার পর্ব শুরু হয়েছিলো সেদিন।

    ঠিক সেই সময় বনারসের উপান্তে একটি সরোবর, লহরতারার ধারে মুসলিম তন্তুবায় নিরু আর তাঁর পত্নী নিমা কুড়িয়ে পেলেন একটি সদ্যোজাত শিশুকে। তার গর্ভধারিনীর কোনও খোঁজ নেই, দেখে মনে হয় উত্তমকূলে জন্ম। কোনও উপায়ান্তর না দেখে সেই দরিদ্রতম শ্রমজীবী পরিবারটি শিশুটিকে আশ্রয় দিলেন। এতোদূর পর্যন্ত ইতিকথা লোকগাথায় পাওয়া যায়।

    কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাস যখন থেকে নিয়মানুগভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে, অর্থাৎ সপ্তম-অষ্টম শতকে, তার পরের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই শিশুটির আবির্ভাবের তথ্য সতত কুয়াশায় অন্তরালে। শুধু আবির্ভাবেই নয়, তাঁর তিরোভাবের তথ্যও রূপকথার রাজ্যের কথকতা। ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এতো পরস্পরবিরোধী যে এই মানুষটির সর্বসম্মত কোনও জীবনকথা এখনও পাওয়া যায়না। তাঁর জন্মসাল হিসেবে একবার বলা হয় ১৩৯৮, আবার কখনও ১৪৪০ বা ১৪৫৫ সন। তবে তিনি গুরু নানকের ( জন্ম ১৪৬৯) অনেক আগেই এসেছিলেন সেটা নিশ্চিত। গুরু নানকের 'জন্মসাক্ষি' পঞ্জী বেশ নিষ্ঠা সহকারে গ্রন্থিত আছে। সেখানে দেখছি তাঁর প্রথম দেশযাত্রা, যাকে শিখরা 'উদাসি' বলে থাকেন, সেটি ছিলো ১৫০০ থেকে ১৫০৭ সালের মধ্যে। এই সময়ই গুরু নানক বারাণসিতে সন্ত কবিরের সঙ্গ করেছিলেন। গুরু নানকের সঙ্গী ছিলেন ভাই মর্দানা, একজন মুসলিম। এর ঠিক আগেই ১৪৯৯ সালে গুরু নানকের ইষ্টদর্শন হয় এবং তিনি প্রচার করতে থাকেন, ঈশ্বর তাঁকে বলেছেন জগতে হিন্দুও নেই, মুসলমানও নেই, শুধু 'আমি' আছি। তাই নানক সমস্ত প্রচলিত ধর্মমতকে অস্বীকার করে 'ঈশ্বরের' শিষ্য হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন। শুধুমাত্র ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমেই যে মানুষের উত্তরণ ঘটে সেই আদর্শই তিনি সন ১৫০০ থেকে ১৫২৪ পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষ, তিব্বত, মধ্য এসিয়া, আরবদেশ ও শ্রীলংকায় প্রচার করেন। গুরু নানক যখন বারাণসিতে এসেছিলেন, তখন সন্ত কবিরের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা মধ্যগগনে। কারণ গুরু নানকের ধর্মমত যেসব সাধকের চিন্তন ও বোধিপুষ্ট, সন্ত কবির তার মধ্যে প্রধান। গুরু গ্রন্থসাহিবে সর্বাধিক গ্রন্থিত রচনা সন্ত কবিরের বাণী থেকেই সংগৃহীত। তাই ধরে নেওয়া যায় মোটামুটি ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে পরে হতে পারে। কিন্তু তিনি যে একদিন এদেশের মাটিতে বেঁচে ছিলেন, হেঁটে বেড়িয়েছেন, আর এদেশেই একদিন ঐহিক অস্তিত্ত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সামূহিক মানববিশ্বে লীন হয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ রয়ে গেছে তাঁর রচনাবলীতে, লোকবিশ্বাসে আর মুকাম বনারসে।

    ২.

    জাতি জুলাহা নাম কবিরা , বনি বনি ফিরো উদাসী.....

    জুলাহা, বাংলায় যার নাম জোলা, অর্থাৎ তন্তুবায় নামের শ্রমজীবী শ্রেণী ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিলো। কিন্তু সেই সময় এইদেশের যেসব প্রান্তে বয়নশিল্পের চূড়ান্ত উন্নতি ঘটেছিলো, সেখানে স্বাভাবিকভাবে তন্তুবায়বর্গের মানুষদের বৃহৎ বসতিও প্রতিষ্ঠিত হয়। বারাণসি ছিলো উত্তর ভারতে সে রকম একটি কেন্দ্র। সেখানেই জন্ম সন্ত কবিরের এবং তিনি স্বীকার করেছিলেন পালক পিতার বৃত্তিগত পরিচয়। সেই সূত্রে মুসলিম হলেও অধ্যাত্মদর্শনের প্রথম গুরুমুখী পাঠ তিনি নিয়ে ছিলেন সন্ত রামানন্দের ( আনুমানিক ১২৯৯- ১৪১০) কাছে। ভারতবর্ষে মধ্যযুগের ভক্তিবাদী অধ্যাত্ম আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান পুরুষ। তাঁর দর্শনের সঙ্গে পারস্য থেকে আসা ইসলামি সুফি দর্শন মিলেমিশে তৈরি হয় এ দেশের প্রথম সমন্বয়বাদী অধ্যাত্মসাধনা। পরবর্তীকালের ভারতবর্ষে বৃহত্তর জনমানসে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন বলতে যে বোধটি বিকশিত হয়েছে তার অংকুর এই সময়েই স্ফুরিত হয়। এই আন্দোলনের সমস্ত নায়করা, যেমন, সন্ত কবির, সন্ত রবিদাস, সন্ত নানক, পরবর্তীকালে সন্ত তুকারাম সবাই সন্ত রামানন্দের ভাবশিষ্য। সন্ত রামানন্দ ও কবিরের সম্পর্কটি ভারতবর্ষে পরবর্তীকালের অধ্যাত্ম ও রাজনৈতিক জগতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিম্বদন্তী বলে সন্ত কবির নিজের জন্মপরিচয় লুকিয়ে সন্ত রামানন্দের থেকে শিক্ষা নেন। কারণ তখনও পর্যন্ত প্রয়াগের ব্রাহ্মণ রামানন্দ কোনও 'বিধর্মী'কে তাঁর উপদেশ দিতে স্বীকৃত ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস বলে সন্ত রামানন্দ ও সন্ত কবিরের মধ্যে দীর্ঘ বোধবিনিময়ের ধারা দুজনকেই একসঙ্গে সমৃদ্ধ করে তোলে। এমন রটনাও রয়েছে যে কবিরের প্রকৃত পিতা রামানন্দের একজন ব্রাহ্মণ শিষ্য এবং কবিরের গর্ভধারিণী একজন ব্রাহ্মণ অকালবিধবা রমণী। লোকলজ্জায় তাঁরা সদ্যোজাত সন্তানকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন লহরতারার জলে। সেখান থেকেই 'ম্লেচ্ছ' জোলা নিরু আর নিমা তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।

    তবে সন্ত কবিরের নিজস্ব ব্যাখ্যায় সন্ত রামানন্দ অনুসৃত শ্রীরামানুজ কথিত নির্গুণ ব্রহ্ম, একেশ্বরবাদ ও প্রেমভক্তির পথে ঈশ্বর, আল্লাহ, হরি, রাম বা অলখ নিরঞ্জনলাভ দর্শনতত্ত্ব সেই সময় থেকেই আপামর ভারতবাসীর মধ্যে অত্যন্ত কার্যকরীভাবে গৃহীত হয়েছিলো। অনেকদিন পরের মানুষ আমাদের লালন সাঁই বলছেন,

    ' শুদ্ধভক্তি মাতোয়ালা, ভক্ত কবির জেতে জোলা
    সে ধরেছে ব্রজের কালা, দিয়ে সর্বস্বধন তাই...

    'ভক্তের দোরে বাঁধা আছেন সাঁই...'

    ৩.

    জব ম্যঁয় থা, তব হরি নহি
    অব হরি হ্যাঁয়, ম্যঁয় নহি
    সব অঁধিয়ারা মিট গয়া
    জব দীপক দেখা ম্যঁয়নে....

    সেই অন্ধকারযুগে সহায়হীন নিপীড়িত শ্রমজীবী শ্রেণীর ইতরমানুষদের আত্মার শূশ্রূষায় জন্য প্রদীপের আলো হাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন সন্ত কবির। তিনি সন্ন্যাসী ছিলেন না। সংসার করেছিলেন, পত্নীর নাম ছিলো লো'ই । এক পুত্র কমাল আর কন্যা কমালি। পুত্র কমাল পিতার সাধনার মর্ম বুঝতেন না। তিনি ছিলেন বিষয়বিষে বিজড়িত। আক্ষেপ করে কবির বলেছিলেন,

    ' বুরা বংস কবির কা, উপজা পুত কমাল
    হরি কে সুমিরন ছোড়কে, ঘর লে আয়া মাল...'

    গুরু রামানন্দ ও শিষ্য কবিরের মূল কর্মক্ষেত্র ছিলো শহর বনারস। গুরু ছিলেন সে সময়ের ভারতবর্ষে একজন শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত, দার্শনিক ও প্রসিদ্ধ চিন্তানায়ক আর চেলা ছিলেন 'নিরক্ষর' সামাজিক মর্যাদাহীন জোলা। নিজের সম্বন্ধে কবির বলেছিলেন,

    'মসি কাগদ ছুয়ো নহি
    কলম গহি নহি হাথ....'

    আর গুরু সম্বন্ধে বলেছিলেন,

    ' গুরু গোবিন্দ দোনো খড়েঁ
    কাকে লাগু পাঁয়
    বলিহারি গুরু আপনো
    গোবিন্দ দিয়ো মিলায়...'

    সন্ত কবির ছিলেন ভারতবর্ষের শাশ্বত ইতরযানী বোধিবিশ্বের ভান্ডারী ও নায়ক। ব্রাহ্মণ্য বোধ ও উপলব্ধির চেনা কক্ষপথের বাইরে আবহমানকাল ধরে এদেশে গরিষ্ঠ মানুষের মননজগতের শ্রেষ্ঠ ফসল উদ্গত হয় সন্ত কবিরের এই সব অমৃতবাণীর মাধ্যমে। তাঁর বাণীর প্রথম প্রামাণ্য সংকলন পাওয়া গুরু অর্জনদেব সংগৃহীত শিখদের 'আদিগ্রন্থ' আর গোবিন্দওয়াল পোথির মধ্যে। তার পর রাজস্থান থেকে সংগৃহীত 'বীজক' আর বুন্দেলখন্ড থেকে নথিবদ্ধ করা 'অনুরাগসাগর'। এসবের প্রণেতা ছিলেন নিরক্ষর, তাই এর প্রামাণ্যতা শুধু বাচনিক ঐতিহ্যের মধ্যে বিচরণ করেছে।

    তিনি ছিলেন এক গর্বিত 'জুলাহা'। যেখানেই নিজের সম্পর্কে কিছু বলার, তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে নিজের শ্রমজীবী জাতিপরিচয় নিয়ে সরব হয়েছেন। ঈশ্বর তাঁর কাছে একজন শ্রেষ্ঠ তন্তুবায়। ঠিক যেভাবে একজন জোলা সুতোর সঙ্গে সুতোর খেলায় মত্ত হয়ে অনুপুঙ্খ কৌশলে শিল্পসৃষ্টি করে, সেভাবেই ঈশ্বর মাতৃগর্ভ নামক তাঁত থেকে সমস্ত প্রাণ, সারা জগতসংসারকে উৎপন্ন করছেন। এই ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদনের সময় তাঁর আবেগ কোনও বাঁধ মানেনা।

    ' সাত সমন্দর কী মসি করৌঁ
    লেখনি সব বনরাই ।
    ধরতি সব কাগদ করৌঁ
    হরিগুণ লিখা ন জাই ।।'

    ৪.

    কবিরকে নিয়ে আমার অনেকদিনের কৌতূহল। পশ্চিমের সংস্পর্শে আসা ভারতীয়দের মধ্যে বিদেশে কবিরবাণী প্রচারের প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯১৫ সালে 'Songs of Kabir' নামে তাঁর অনুদিত কবিরের দোহাবলী লন্ডনে প্রকাশিত হয়। ইভলিন আন্ডারহিল এই সংকলনটির ভূমিকা লিখে দেন। এই বইটি পড়েই ডব্লিউ বি ইয়েটস পশ্চিমে কবিরকে বিস্তৃত পরিচিতি দান করেন। যদিও কবিরের তিরোভাব হয়েছিলো বারাণসি থেকে প্রায় দুশো কিমি দূরে গোরখপুরের কাছে মগহরে। আর তাঁর জন্মের কাহিনী এতো-ই অস্পষ্ট যে তাঁর প্রকৃত জন্মস্থানও বারাণসি কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কিন্তু বনারস তাঁর কর্মভূমি এবং চিরকালীন ভারতবোধে এই স্থান ও কবির অচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাঁধা। তাই এবারের বনারসযাত্রায় কবিরের কর্মভূমি কবিরচৌরা ছিলো আমার দর্শনীয় ঠিকানাগুলির অংশ। একসময়ের গণিকা, কসাই ও অন্যান্য 'অসামাজিক' পেশায় নিয়োজিত মানুষ অধ্যুষিত এই স্থানে বসবাস করে মহাত্মা কবির কোন প্রেরণায় নিখিল মানবাত্মার কাছে তাঁর শাশ্বত সন্দেশ পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন তা হৃদয়ঙ্গম করার একটা বাসনা থেকেই গিয়েছিলো। মুকাম বনারসের কি কোনও ভূমিকা ছিলো এই বিবর্তনের পথে?

    (ক্রমশঃ)
  • শিবাংশু | 127.197.254.108 | ১৪ ডিসেম্বর ২০১২ ২২:২৯582450
  • বনরস চালিসা-৫

    কবিরকথা-২

    ১.

    কবিরা খড়া বজার মেঁ
    মাঁগে সবকা খ্যয়ের ।
    না কাহুসে দোস্তি
    না কাহুসে ব্যয়ের ।।

    ('বজার' মানে মানে এই সমাজবিশ্ব। কবির সেখানে দাঁড়িয়ে সবার মঙ্গল কামনা করছে। তার সঙ্গে কারও বন্ধুতা নেই, শত্রুতাও নেই।)

    ছোটবেলায় পড়া কবিরের অনেক দোহার থেকে এই দোহাটি আলাদা করে মনে থেকে গিয়েছিলো। নির্গুণ ভূমাদর্শনের সব কথা এই কটা শব্দের মধ্যে ধরে ফেলা কবিরের পক্ষেই সম্ভব। বয়সের বিভিন্ন স্তরে এই শব্দনির্মাণটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।

    সকালবেলা সিগরা মোড়ে এসে একটা অটোকে জিগালুম, কবির চৌরা চলি? সে আপাদমস্তক দেখে বললো, 'হোনে সে কিধর জাইকেঁ পড়ি?' আমি বলি, 'বস, হোনে হি জীব'। সে আবার শুধায়, ' মঠ চলি?' কেমন অবিশ্বাসের সুর গলায়। হাঁ, রৌয়া, মঠে মেঁ চলিকে পড়ি।' উত্তর আসে, 'বইঠিয়ে'। আমরা দুজন বসে আবার জিগাই, ' কা ভইয়া, হোনে কোনও রৌয়া ন জাই কা?' 'না না এয়সা নইখে, পর...' তাকে বলি তনি লহরতারা হইকে জাঁই।' সে অটোর মুখটি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে মডুয়াডিহ-র পথ ধরে।

    ২.

    বারাণসি শহরের দক্ষিণে একটি প্রাচীন জলাশয় আছে। এই বিশাল সরোবরটির সঙ্গে কোনকালে গঙ্গার যোগসূত্র ছিলো। নদীর মতো-ই এর জলে তরঙ্গ উঠতো এবং মানুষজনের কাছে এর পবিত্রতার খ্যাতিও শোনা যেতো। তরঙ্গকে হিন্দিতে বলে লহর, আর ফার্সিতে জলাশয়কে বলে তাল, হিন্দিতে তা হয়ে যায় তালাও। এই সরোবরটিকে লোকে বলতো লহরতাল, অপভ্রংশে লহরতারা। তার জলে ছিলো পদ্মবন আর শীতল শান্তি। আজকের বারাণসি রেল স্টেশন থেকে তিন কিমি মতো দক্ষিণে হবে। নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় আজ গঙ্গার জল আর সেখানে পৌঁছোয়না । সরোবরের ব্যপ্তি আর নেই।

    একজন মুসলিম তন্তুবায়, নাম আলি, ডাকনাম নীরু বিয়ে করতে গিয়েছিলেন শহরের উপান্তে মান্দুর গাঁয়ে। এই মান্দুর আজকের মডুয়াডিহ। নতুন বৌ নীমাকে নিয়ে দ্বিরাগমন করতে যাবার সময় লহরতালের ধারে একটি সদ্যোজাত শিশুকে তাঁরা কুড়িয়ে পান। খোঁজাখুঁজি করেও যখন কোনও দাবিদার মেলেনা তখন এই দম্পতি তাকে আল্লাহর আশীর্বাদ ভেবে বাড়িতে নিয়ে আসেন। নীরুর তাঁতবাড়ি ছিলো লহরতারার থেকে পাঁচ-ছ কিমি উত্তরে বরুণানদীর চৌকাঘাটের কাছে। সেখানে ছিলো একটা টিলার মতো উঁচু জমি, মুহল্লা নরহরপুরা, সেখানেই দরিদ্র নীরুজোলার দরিদ্রতর গেরস্থালী। আজ তার নাম নীরুটিলা। মৌলভি সাহেব সেই কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর নাম দেন ঈশ্বরের নামে, কবির। কবির বড়ো হয়ে ওঠেন এই আবহে। বড়ো হবার পর তাঁর কাছে কেউ যখন বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইতো, তিনি বলতেন,

    কবিরা তেরি ঝোপড়ি
    গলকট্টো কে পাস ।
    জো করেগা সো ভরেগা
    তুম ক্যিঁউ হোত উদাস ।।

    সেটা ছিলো গলকট্টো অর্থাৎ কসাইদের টোলা। তারা ছাড়া থাকতো কিছু জুলাহা আর সস্তা গণিকা। শৈশব থেকেই এই দরিদ্র মানুষগুলি ও তাদের কাদামাটির জীবনধারার সংস্পর্শে থেকে কবির বুঝতে পেরেছিলেন পোষাকি ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মিকতার বহ্বাড়ম্বর এই সব দরিদ্র সংখ্যাগুরু মানুষদের কাছে কতোটা মূল্যহীন।

    নরহরপুরায় নীরুজোলার টিলার উপর ভাঙ্গাচোরা পর্ণকুটির আর পাশের একটা চবুতরা ছিলো কবিরের খাস দুনিয়া । একটু বড়ো হবার পর তিনি পিতার সঙ্গে জাতব্যবসায় যোগ দেন। দিনের শেষে এই চবুতরাটিই ছিলো সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে গল্পগুজবের ঠিকানা। এখানে বসেই কবির আশপাশের নিরক্ষর, হতদরিদ্র, মানহীন শ্রমজীবীর দলকে আশ্বাস দিতেন তাদের মানুষজন্ম বৃথা নয়। তাদেরও ঈশ্বরলাভ হতে পারে। ঈশ্বর শুধু ব্রাহ্মণ আর শেখসৈয়দের মৌরসিপট্টা নয়। দিনে দিনে কবিরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে মানুষের ভিড় নরহরপুরার পুরোনো চবুতরা ছাপিয়ে যায়। পাশে আর একটা নতুন চবুতরা তৈরি করতে হয়। কবিরের নামে তার নাম হয় কবির চবুতরা। লোকমুখে সেই নাম কবিরচৌরা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

    এখানে বসেই ধনীর আরও ধনলালসা দেখে কবির বললেন,

    সাঁই ইতনা দিজিয়ে
    জা ম্যঁয় কুটুম সমায় ।
    ম্যঁয় ভি ভুখা না রহুঁ
    সাধো ন ভুখা জায় ।।

    ব্রাহ্মণ্য পন্ডিতদের আত্মগর্ব দেখে প্রচার করলেন সেই অমোঘ বাণী,

    পোথি পড়ে পড়ে জগ মুয়া
    পন্ডিত বনেঁ ন কোয় ।
    ঢাই আখর প্রেম কা
    পড়ে সো পন্ডিত হোয় ।।

    জাগতিক সাফল্যের আশায় অতৃপ্ত অসহিষ্ণু মূঢ়দের শোনালেন,

    ধীরে ধীরে রে মনা
    ধীরে সব কুছ হোয় ।
    মালি সিঁচে সও ঘড়া
    রিত আওয়ে ফল হোয় ।।

    সেই অন্ধকার মধ্যযুগে ভারতদর্শনের সারসংক্ষেপ একজন 'অশিক্ষিত', হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো আর্যাবর্তের সংখ্যাগুরু নিপীড়িত, দরিদ্র, হতমান ইতর মানবজাতির কাছে আত্মার শূশ্রূষা হয়ে।

    ৩.

    লহরতারার সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ায়। যদিও এই স্থানের মাহাত্ম্য কিম্বদন্তী ভিত্তিক, কিন্তু সারা পৃথিবীর কবিরপন্থীদের জন্য এ এক পুণ্যতীর্থ। এখানেই ছিলো গুরু রামানন্দের শিষ্য সন্ত অষ্টানন্দের টিলা ও ভিটে। অনেকে বলে এই অষ্টানন্দই কবিরের প্রকৃত পিতা ছিলেন। এই স্থানে কবির একা এবং তাঁর পিতামাতার সঙ্গে প্রায়ই আসতেন। তাঁর পালিকা মাতা নীমার প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এই রমণীই সেই পরিত্যক্ত শিশুকে এই জনহীন প্রায় বনভূমির বিপন্নতা থেকে মুক্ত করে প্রাণ ও জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কবির কখনও তা ভোলেননি। তিনি এই মায়ের সঙ্গে প্রকৃতিমাতার তুলনা করতেন। লহরতারা ছিলো কবিরের জন্য এক অনিঃশেষ আশ্রয়। পরবর্তীকালে এইখানে অনেক কবিরপন্থীদের অখাড়া স্থাপিত হয়েছিলো। পরে গঙ্গা সরে যাওয়ায় এখানে সরোবরের পরিসর সংকুচিত হয়ে যায়। সংলগ্ন জমিতে বড়ো বসতি গড়ে ওঠে। উত্তর প্রদেশ সরকার ও পুরাতত্ত্ব বিভাগ এখানে বেশ কিছুটা জমি অধিগ্রহন করে একটি ছোটো স্মৃতিস্তম্ভ ও তৃণভূমিসহ উদ্যান স্থাপন করেছে।

    ফিরে আসি সেই সরোবরকে প্রত্যক্ষ করে। পরের গন্তব্য কবিরচৌরা। বারাণসি রেলস্টেশনের সামনে দিয়ে উত্তরের পথে। একটি অপরিসর গলির মুখে দাঁড়িয়ে চালক বলেন, 'হেনে সে পয়দল জানেকে পড়ি।' দেখি শাদা ধুতি উত্তরীয় শোভিত কবিরপন্থীদের জত্থা চলেছে সেই পথে। গলিটি যেখানে শেষ হচ্ছে সেখানেই বাঁদিকে ঘুরেই মূল দরজা। উপরে লেখা আছে, সদগুরু কবির মন্দির, কবির চৌরা মঠ, , আদি মূল গাদী। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। পাদুকামুক্ত হয়ে দেখি মঠের নিয়মকানুন ও কবিরচৌরার ইতিহাস লেখা ফলক। সেখান থেকে এগিয়ে গেলেই বাঁদিকে সমাধি মন্দির ও সামনে বীজক মন্দির। বীজক তত্ত্ব হলো কবিরের অধ্যাত্ম দর্শনের মূল দর্শন। যেখানে এখন বীজক মন্দির হয়েছে, সেখানেই ছিলো মূল কবিরচৌরার ভূমি। কবির এখানে বসেই তাঁর অধ্যাত্মদর্শন আলোচনা করতেন অনুগামী, অতিথি ও অন্য সাধকদের সঙ্গে। বীজক মন্দিরের ডানদিকে অতিথি ও ভোজন শালা। মাঝখানটিতে একটি মন্ডপ। এর চারদিকে কবিরের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ভাস্কর্যকর্ম রাখা হয়েছে। ভাস্কর্যের মান অতি উত্তম। বীজক মন্দিরের বাঁদিকে রয়েছে একটি কবিরের সময়কালের কূপ, যার জল কবির সেবন করতেন।

    এসে বসি শাদাকালো মর্মরের ছক কাটা সমাধি মন্দিরের দাওয়ায়। সেই সমাহিত শান্তিকল্যাণের আঙিনায় দৈবী, ঐশী কোনও মোহকে আমল না দিয়েও জীবনের গভীরতর সত্যসন্ধানে মন কিছু চায়। সঙ্গিনীর সঙ্গে সেই সব কথা হয়। মন্দিরের নিরাভরন গর্ভগৃহে উঁকি দিয়ে দেখি কবিরের একটি প্রতিকৃতি ও শ্বেতপাথরের সমাধিবেদী।

    কবির গত হয়েছিলেন বারাণসি থেকে প্রায় দুশো কিমি দূরে বস্তিজেলার মগহরে। তাঁর শবদেহ কিন্তু কেউ খুঁজে পায়নি, কলহরত অধিকারপ্রবণ হিন্দু ও মুসলিম অনুগামীরা। শবশয্যায় নাকি পাওয়া গিয়েছিলো শুধু কিছু পদ্মফুল। তৎকালীন বারাণসির রাজা বীরসিং বাঘেল সেই ফুল ভাগ করে দিয়েছিলেন সবার মধ্যে। মগহরে কবিরের দুটি সমাধিস্মারক রয়েছে, হিন্দু ও মুসলিম অনুগামীদের জন্য পৃথক সেই আয়োজন। মগহর ও বারাণসি ছাড়াও দেশে আরও চার জায়গায় কবিরের সমাধিস্থল দেখা যায়। মাঝে মাঝে ভাবি, যে বিগ্রহপূজকদের ভ্রান্তি ঘোচাতে বুদ্ধ বা কবিরের মতো মানুষেরা আসেন, সেই মূঢ় অন্ধের দল তাঁদেরও শেষ পর্যন্ত 'বিগ্রহে' পর্যবসিত করে। হা হতোস্মি।

    ৪.

    আবার গলিপথ বেয়ে ফিরে আসতে থাকি অত্যন্ত জনসংকুল বারাণসির রাজপথে। মাথার ভিতর কবির গুনগুন করতে থাকেন,

    মায়া মরি না মন মরা
    মর মর গয়া শরীর ।
    আশা তৃষ্ণা না মরি
    কহ গয়ে দাস কবির ।।

    (ক্রমশঃ)
  • nina | 233.29.203.84 | ১৫ ডিসেম্বর ২০১২ ০৮:৫১582451
  • বনারস কা বনা রস!
  • Pramit | 161.191.175.204 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১২ ২১:৩১582453
  • শিবাংশু দা

    আপনার প্রতিটি লেখার মতো এটাও অনবদ্য লাগছে। এক অসাধারণ মুগ্ধতায় পড়ে চলেছি। কিছু প্রশ্ন জেগে উঠেছে মনে। অপ্রাসঙ্গিক মনে হলে নিজ গুণে মার্জনা করে দেবেন।

    ১। বরুণা আর অসী নদীর আজ আর কি কোনো অস্তিত্ব আছে?
    ২। আজকের বিশ্ব্নাথের মন্দিরের কবে নাগাদ প্রতিষ্টা হয়েছে?
    ৩। আজকের বিশ্ব্নাথের মন্দির যদি নতুন হয়, তাহলে শঙ্করাচা`্র্যের সময় কোন মন্দির ছিলো?
  • শিবাংশু | 127.201.163.43 | ২২ ডিসেম্বর ২০১২ ১৩:১৬582454
  • প্রমিত,

    ১. বরুণা নদী আদি বারাণসির উত্তর সীমা ছিলো এককালে, এখন তার উত্তর পাড়ে শহর বহুদূর এগিয়ে গেছে। দক্ষিণে আদি কেশবঘাটের কাছে এসে বরুণা গঙ্গায় মিশেছে। অসী নদী এখন স্রোতহারা, প্রায় পুরোটাই মজে গিয়েছে। আগে যেখানে তা গঙ্গায় মিশতো, অর্থাৎ পুরোনো বারাণসির দক্ষিণতম সীমা, সেখানে গঙ্গায় অস্সি ঘাট রয়েছে, কিন্তু অসী নদী নেই।

    ২. বর্তমান বিশ্বনাথ মন্দির ১৭৭৬ সালে রাণী অহিল্যাবাই নির্মাণ করেন। পঞ্জাবকেশরী রণজিৎ সিং এর শিখরটি সোনায় মুড়ে দেন।

    ৩. বিশ্বনাথরূপী দেবতা ও মন্দিরের স্থান ও রূপ বদল বহুবার হয়েছে। হিউয়েন সাং (পুরোনো বানান) ৬৪০ সাল নাগাদ কাশীতে শতাধিক বিশাল মন্দির দেখেছিলেন। তাঁর কথামতো এগুলি শৈব মন্দির ছিলো। তবে সেগুলি ছিলো প্রধানতঃ দারুনির্মিত, শুধু ভিত্তিটি পাথরের থাকতো। তাই স্থায়িত্বের দিক থেকে তা ছিলো ভঙ্গুর। গুপ্তযুগে পঞ্চম শতকে প্রধান শৈব মন্দিরের দেবতা ছিলেন অভিমুক্তেশ্বর লিঙ্গ। এই দেবতাকে চলিত ভাষায় 'দেবাদেব' বা দেবাদিদেবও বলা হতো। এই শৈব ঐতিহ্য প্রাক আর্যকালের। স্কন্দপুরাণে কাশীবিশ্বনাথের উল্লেখ পাওয়া যায়, তবে তা পরবর্তী কালের ধারণা। মনে করা হয় কাশীর শিবের ' বিশ্বেশ্বর' রূপটি 'বিশ্বনাথ' রূপের থেকে প্রাচীন। শক্তিরূপা দেবী অন্নপূর্ণার ( পরবর্তীকালের নাম) ভৈরব কিন্তু বিশ্বেশ্বর, বিশ্বনাথ ন'ন। নবম শতকে আদি শংকর কোনও বিশেষ শৈব বিগ্রহের প্রতি কেন্দ্রিত ছিলেন না বলেই মনে হয়। তাঁর আনুগত্য ছিলো 'শিব' নামক দৈবী ধারণার প্রতি। আদি শংকর শুধু একজন অধ্যাত্ম দার্শনিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বিশাল মাপের সংগঠক ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন পুরুষ। আর্যদের বিষ্ণুকেন্দ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে অনার্যদের শৈব আনুগত্যকে মেলাবার যে কৌশল তিনি প্রয়োগ করেছিলেন তারই ফলশ্রুতি আধুনিক সনাতন ধর্ম, যাকে লোকে 'হিন্দু' ধর্ম বলে জানে। আর্যধর্মের আদিকাল থেকে ভারতবাসীদের সম্মিলিত করার যতো প্রয়াস করা হয়েছে, তার মধ্যে আদি শংকরের এই প্রয়াসটুকুই সফল হয়েছিলো এবং তারই পুণ্যে ক্রমাগত অন্যধর্মীয়দের বিপুল আক্রমণ, অত্যাচার সামলে এখনও 'হিন্দু' ধর্ম বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। তাঁর এই যুগান্তকারী প্রয়োগের ভিত্তিভূমি হিসেবে তিনি বারাণসিকেই নির্বাচন করেছিলেন।

    পাথরের দেবতা ও তাঁর বাসগৃহের ইতিহাস বেশ আকর্ষণীয়। পঞ্চম শতক থেকে নবম শতকের মধ্যে দেবতা ও তাঁর বাসগৃহ কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে। একাদশ শতকে কাশীনরেশ একটি স্থায়ী পাথরের মন্দির নির্মাণ করেন। ১১৯৪ সালে মুহম্মদ ঘুরি কাশীর আরও সব মন্দিরের ( আনুমানিক পাঁচশো) মতো কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরকেও ধূলিসাৎ করে দেন। অনতিবিলম্বে আবার মন্দির নির্মিত হয়, কিন্তু কুতুবুদ্দিন আইবক তাকে ধংস করেন। কুতুবুদ্দিনের মৃত্যুর পর কয়েকজন হিন্দু রাজা মিলে একটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করেন। কিন্তু ১৩৫১ সালে ফিরুজশাহ তুঘলকের হাতে সেই মন্দিরটিও কালগতি প্রাপ্ত হয়। আকবর বাদশার রাজস্বমন্ত্রী টোডরমল ১৫৮৫ সালে আবার কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরটি বানিয়ে দেন। এই মন্দিরটি কিছুকাল টিকে ছিলো। কিন্তু ১৬৬৯ সালে 'মহামতি' ঔরংজীব মন্দিরটি ধংস করে সেখানে একটি মসজিদ তৈরি করেন। শুধু তাই নয় মন্দিরের শিবলিঙ্গটি, যেটি বহু আক্রমণ সামলে টিকে ছিলো, তাকে জ্ঞানভাপীর কূপে নিক্ষেপ করেন। একেবারে ঢাকীশুদ্ধু বিসর্জন। তখন থেকেই জ্ঞানভাপীর কূপ হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র বিগ্রহ হয়ে পড়ে। কারণ কাশী বিশ্বনাথের আদি লিঙ্গটি সম্ভবতঃ ঐ কূপেই সলিলসমাধিস্থ হয়ে রয়েছে।

    এর প্রায় একশো বছর পরে ১৭৭৬ সালে অহিল্যাবাই হোলকারের অর্থানুকূল্যে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে এবং এখনও টিকে আছে। 'হিন্দু' ধর্মের 'সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়' দর্শন এই মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে মিলিত আছে।
  • secular | 71.16.194.150 | ২২ ডিসেম্বর ২০১২ ১৪:০০582455
  • মন্দিরের গায়ে মস্জিদ গজালো কিভাবে এব্ণ কবে
  • ranjan roy | 24.96.155.59 | ২২ ডিসেম্বর ২০১২ ১৬:৪৪582456
  • শিবাংশু,
    এই তো সেই জ্ঞানবাপী মসজিদ? আর একটি ইতিহাস-বিতর্কের সূতিকাগার?
  • শিবাংশু | 127.197.248.203 | ২৭ ডিসেম্বর ২০১২ ০৯:১১582457
  • বনারস চালিসা

    বুদ্ধকথা

    বারাণসি গমিষ্যামি গত্বা বৈ কাশিকা পুরীম।
    ধর্মচ্ক্রং প্রবর্তিষ্যে লোকে স্বপ্রতিবর্তিতম ।।

    কাশীপুরী গমন করে বারাণসিতে লোকের মুক্তির জন্য ধর্মচক্র প্রবর্তন করলাম ( আজীবকের প্রতি শাক্যমুনি বুদ্ধ)

    মহাভিনিষ্ক্রমণের পর সিদ্ধার্থ প্রথমে গিয়েছিলেন কোসল রাজ্যে আলার কালামের কাছে। অরিয়পরিয়সেন সূত্তে বুদ্ধের জবানিতে লেখা হয়েছে, ' মঙ্গলকর পথ ও শ্রেষ্ঠ, লোকোত্তর, শান্তিময় তত্ত্বের সন্ধানে আমি আলার কালামের কাছে গেলাম। নিদানকথা, বুদ্ধচরিত ও ললিতবিস্তরে এ বিষয়ে নানা বিপরীত কথা বলা হয়েছে। প্রথম দুটি গ্রন্থে বলা হয়েছে সিদ্ধার্থ প্রথমে রাজগৃহে রাজা বিম্বিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ও তার পর মগধে আলার কালামের কাছে দর্শনশিক্ষা করতে যান। তৃতীয় গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে তিনি প্রথমে বৈশালী গিয়ে আলার কালামের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। পরে রাজগৃহে এসে রাজা বিম্বিসারের নির্দেশে উদ্দক রামপুত্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে এই তিনটি গ্রন্থই বুদ্ধের দেহাবসানের অনেক পরে, পঞ্চম শতকে, সংকলিত হয়েছিলো। তাই স্বয়ং বুদ্ধের উক্তিটিকেই প্রামাণ্য ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু আলার কালাম বা উদ্দক রামপুত্তের কাছে সিদ্ধার্থকে দেবার মতো কিছুই ছিলোনা। তাঁরা ছিলেন সংসারত্যাগী উপাসক, নিজস্ব ধরনে সাধনা করতেন। তাঁদের থেকে সিদ্ধার্থের প্রাপ্তি বলতে চারটি ধ্যান ও চারটি স্তব। তাতে তাঁর আর কী হবে? কোসল ত্যাগ করে এলেন রাজগৃহের নানা প্রসিদ্ধ শ্রমণদের থেকে দর্শনতত্ত্ব শিখতে। এই শ্রমণরা নানারকম তপস্যা করতেন। তাই দেখে সিদ্ধার্থ তপস্যা করতে শুরু করলেন। প্রথমে হটযোগ, তার পর কৃচ্ছ্বসাধন, উপবাস, খাদ্যগ্রহণ করে আবার উপবাস, এরকম চললো ছ'বছর। কিন্তু ধ্যানমার্গ, তার স্তরভেদ, কঠোর কৃচ্ছসাধন ও তপস্যা , অর্থাৎ সেসময় যা যা কিছু প্রচলিত সাধনবিধি ছিলো সব কিছু নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন। এটা প্রমাণ করে তিনি আদ্যন্ত একজন মানুষ ছিলেন, কোনও স্বর্গচ্যুত দেবতা নয়। পরবর্তীকালে তাঁকে দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে নানা প্রচেষ্টা হয়েছে।

    সেই সময় বৈদিক ধর্মের অন্যমেরুতে একটি সামাজিক মন্থন চলছিলো। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জাতির অত্যাচারে সংখ্যাগুরু মানুষ কোনও নতুন 'ধর্মীয়' উত্থানের অপেক্ষায় মুহ্যমান। এ বিষয়ে চর্চা আরণ্যক ও উপনিষদেও আছে। ব্রাহ্মণ্যধর্ম ব্যতিরেকে যেসব মুনিঋষি তখন সমাজে ছিলেন তাঁরা ব্যক্তিগত দর্শনের গন্ডিতে আবদ্ধ, নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা তাঁদের ছিলোনা। এঁদের মধ্যে ছিলেন, অজিত কেশকম্বলি, পুরাণ কাশ্যপ, পাখুদা কাত্যায়ন, সঞ্জয় বেলটঠিপুত্ত, মোক্ষলি গোপাল, চার্বাক প্রমুখ। তাঁরা হয়তো প্রচলিত ব্যব্স্থার প্রতি বীতরাগ ছিলেন, কিন্তু নিপীড়িত মানুষকে শূশ্রূষা দেওয়া ছিলো সাধ্যের অতীত। তাঁদের পঞ্চভূতবাদ, বিক্ষেপবাদ, অক্রিয়বাদ, নিয়তিবাদ ইত্যাদি ছিলো মস্তিষ্কের ব্যায়াম, প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিতান্ত তাত্ত্বিক। এই সব জড়নীতির প্রেক্ষাপটে তীর্থংকর মহাবীর প্রচার করছেন পঞ্চমহাব্রত ও ব্রহ্মচর্য। জাগতিক প্রয়োজনকে অস্বীকার করে কঠোর উপবাস ও নিবেদিত সন্ন্যাস জীবনের ব্রত।

    সিদ্ধার্থকে এসব কিছুই প্রভাবিত করতে পারলো না। কঠোর, কঠোরতর তপস্যা ও কৃচ্ছসাধনের পীড়ন প্রত্যাখ্যান করে তিনি অবলম্বন করলেন 'মধ্যপথ'। প্রচার করলেন সংক্ষিপ্ত স্মৃতিনির্দেশ, পঞ্চশীল। তাঁর তপস্যাপর্বের পাঁচ সঙ্গী, কোন্ডিণ্য, বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম ও অস্মজি মনে করলেন বুদ্ধ কঠোর তপস্যার চাপ নিতে অক্ষম এবং 'মধ্যপন্থা' আসলে আরামের কাছে আত্মসমর্পণ। তাঁরা ত্যাগ করলেন বুদ্ধকে। মগধ ছেড়ে তাঁরা যাত্রা করলেন বারাণসির দিকে।

    ২.
    'অনেক জাতি সংসারং সন্ধাবিস্সং অনিব্বিসং
    গৃহকারকং গবেসন্তো দুঃখ জাতি পুনপ্পুনং ।
    গহকারক ! দিটঠোহসি, পুন গেহং ন কাহসি
    সব্বা তে ফাসুকা ভগ্গা গহকূটং বিসংখিতং।
    বিসঙ্খারগতং চিত্তং তণ হানং খয়মজঝগা ।
    (ধম্মপদ)

    'জন্ম জন্মান্তর পথে পথে ফিরেছি কিন্তু সন্ধান পাইনি। এ গৃহ যে নির্মাণ করেছে কোথায় সে গোপনচারী। বার বার দুঃখ পেয়ে এবার তোমার দেখা পেলাম, হে গৃহকারক! আর তুমি এ গৃহ রচনা করতে পারবে না। তোমার স্তম্ভ, গৃহভিত্তি সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার চিত্ত আজ সংস্কারবিগত, তৃষ্ণার থেকে মুক্ত আমি আজ।'

    নৈরঞ্জনা নদীর ধারে এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে প্রথম প্রহরে তাঁর মনে পড়লো পূর্বজীবনের কথা। দ্বিতীয় প্রহরে লাভ করলেন দিব্যচক্ষু, তৃতীয় যামে দর্শন করলেন ভবচক্র ( প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ) এবং চতুর্থ প্রহরে সর্বজ্ঞান অধিগত করে অরহত্ত্ব প্রাপ্ত হলেন সিদ্ধার্থ। উল্লিখিত উপলব্ধি উচ্চারণ করার পর শাক্যমুনি পরমকারুণিক গৌতম বুদ্ধের জন্ম হলো।

    বুদ্ধত্ব লাভের পর আট-দশ দিন গৌতম বুদ্ধ বোধিবৃক্ষের চারদিকে তপস্যাযাপন করলেন। মহাবগ্গ অনুযায়ী এই সময়ই প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু সংযুক্তনিকায় বলে এই উপলব্ধি বুদ্ধের অনেক আগেই হয়েছিলো। এই তত্ত্ব জটিল। তবে মূল কথা হলো তৃষ্ণা ও তার ফলরূপ দুঃখের আকর মানুষের অবিদ্যা। কীভাবে অবিদ্যাকে বিনাশ করে স্তরে স্তরে তৃষ্ণা ও দুঃখ জয়ের শেষে মোক্ষলাভ হয় তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা আছে এই তত্ত্বে। কিন্তু কার কাছে প্রচার করবেন তাঁর অর্জিত দর্শন? প্রথমে প্রয়াস করলেন তাঁর প্রথম 'গুরু' উদ্দক রামপুত্তের সঙ্গে এই তত্ত্ব নিয়ে বিনিময় করেন। কিন্তু সংবাদ পেলেন উদ্দক প্রয়াত হয়েছেন। তার পর খোঁজ নিলেন আলার কালামের কুশল। দুর্ভাগ্য আলারও তখন আর ধরাধামে নেই। এই নবদর্শনকে সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে এমন কাউকে আর মগধে পেলেন না। বুদ্ধ কাশীর পথে অগ্রসর হলেন। কারণ কাশীই ধারণ করতে পারে এই নবদর্শনের গরিমা।

    দীর্ঘ, দুর্গম বনপথ অতিক্রম করে তিনি পৌঁছোলেন বারাণসির উপান্তে ঋষিপত্তনে ( ইস্সিপত্তন)। পথে গঙ্গানদী পেরোলেন সাঁতার দিয়ে। তাঁর কাছে নৌকোযাত্রার পাথেয় ছিলোনা। তাঁর পঞ্চশিষ্য শুনলেন বুদ্ধ এসেছেন, কিন্তু কৌন্ডিণ্য ব্যতিরেকে বাকিরা স্থির করলেন কঠিন তপোশ্চর্যা যে মানুষের কাছে ত্যজ্য, তিনি গুরু হতে পারেন না। কিন্তু যেহেতু তিনি রাজসন্তান তাই ন্যূনতম সম্মান তাঁর প্রাপ্য। তাই পাঁচ জনেই অপরাণ্হে এলেন ঋষিপত্তনের দক্ষিণে সেই প্রান্তরে যেখানে বুদ্ধ ধ্যানমগ্ন ছিলেন। বুদ্ধকে দর্শনমাত্র তাঁরা বুঝতে পারলেন যে এই বুদ্ধ একজন অন্য ব্যক্তিত্ব। ধর্মদর্শন আলোচনা করতে করতে তাঁরা আরো উত্তরের দিকে মৃগদাবের পথে যাত্রা করলেন। রাত্রির প্রথম যামে বুদ্ধ উপবেশন করলেন একস্থানে,
    । তার পর মৌনতা অবলম্বন করে ধ্যানমগ্ন হলেন। দ্বিতীয় প্রহরে তিনি ধ্যান সম্বরন করে পঞ্চশিষ্যের কাছে আত্মউন্মোচন করলেন। সেই নিশীথ আকাশের নীচে সুপ্ত চরাচরে তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর উপলব্ধির মূলতত্ত্ব।

    " হে ভিক্ষুগণ, একদিকে সংসারী মানুষের উপভোগ্য ইন্দ্রিয়সুখ, অপরদিকে ফলহীন দুঃখকর ব্রহ্মচর্য্য, এই উভয়ই ধর্মার্থীগণ পরিত্যাগ করিবে। আমি এক মধ্যপথ আবিষ্কার করিয়াছি, যে পথ অবলম্বন করিলে চক্ষু উন্মীলিত হয়, দিব্যজ্ঞান জন্মে, শান্তিলাভ হয়, মানব নির্বানপ্রাপ্ত হয়। সৎদৃষ্টি, সদবাক্য, সৎসঙ্কল্প, সদ্ব্যবহার, সদুপায়ে জীবিকা আহরণ, সৎচেষ্টা, সৎস্মৃতি, সম্যক সমাধি, আমার আবিষ্কৃত এই অষ্ট পথ। দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখনিরোধ, দুঃখনিরোধের পথ, আমার প্রচারিত এই চারিটি মহাসত্য। " তার পর সারা রাত্রি ধরে তিনি আলোচনা, ব্যাখ্যা, বিনিময় করলেন তাঁর হৃদয়ের উপলব্ধি। এই পঞ্চশিষ্য তাঁকে রাজগৃহ-উরুবেলায় ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন। বিশদ আত্মমন্থন করে তাঁরা অনুভব করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ বিনা তাঁদের গতি নেই। তাঁরা তো গুরুর অপেক্ষাতেই দিনযাপন করছিলেন বারাণসিতে।

    পরদিন ব্রাহ্মমূহুর্তে কৌন্ডিণ্য বুদ্ধের প্রথম শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। তার পর একে একে বপ্প, ভদ্দীয়, মহানাম ও অস্মজি বুদ্ধের শরণ নিলেন।

    ৩.

    গাড়িটি এসে দাঁড়ালো সুরম্য তৃণভূমিঘেরা একটি পুরা অবশেষের পাশে। নামফলকে লেখা আছে 'চৌখন্ডী স্তূপ। চতুর্থ-পঞ্চম শতকে গুপ্তযুগে নির্মিত বর্গাকার স্তূপটি সেই স্থানকে নির্দিষ্ট করছে যেখানে বুদ্ধ প্রথম তাঁর পাঁচ অনুগামীর সঙ্গে পুনঃ সাক্ষাৎ করেছিলেন। সপ্তম শতকে হিউয়েন সাঙের বিবরণীতে এই স্তূপটির উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমে ১৮৩৫ ও পরে ১৯০৪-০৫ সালে উৎখননের পর এই ৯৩ ফুট উঁচু পিরামিড আকারের স্তূপটি পুনরাবিষ্কৃত হয়। খননের ফলে এখান থেকে গুপ্তযুগের বুদ্ধমূর্তি ছাড়াও নানা উৎকৃষ্ট ভাস্কর্য উদ্ধার হয়েছে। এই স্তূপের চূড়ায় ১৫৮৮ সালে হুমাউঁর বারাণসি আগমন উপলক্ষে রাজা টোডরমলের পুত্র গোবর্ধন একটি বুরুজ নির্মাণ করেন।

    এইখান থেকেই ঋষিপত্তন বা সারনাথের পুরা অবশেষের সীমানা শুরু হলো।

    (ক্রমশঃ)
  • শিবাংশু | 127.201.160.166 | ৩১ ডিসেম্বর ২০১২ ২৩:৪২582458
  • বনারস চালিসা

    বুদ্ধকথা-২

    'নত্থি রাগসম অগ্গি, নত্থি দসসমো কলি,
    নত্থি খন্দাদিসা দুক্খা, নত্থি সন্তিপরং সুখং।
    জিঘচ্ছা পরমা রোগা, সঙ্খারা পরমা দুখা,
    এতং ঞত্বা যথাভূতং নিব্বানং পরমং সুখম ।।'

    চৌখন্ডিস্তূপ থেকে দু-আড়াই কিমি উত্তরে এগিয়ে গেলে সারনাথের মূল পুরাতত্ত্ব অবশেষের অবস্থান। বুদ্ধ পদার্পণ করার সময় এখানে ছিলো বিস্তীর্ণ বনভূমি । স্থানটি হরিণ অধ্যুষিত হবার জন্য সেটি মৃগদাব নামেও কথিত হতো। এই মৃগদাবের সন্দর্ভ ধরেই পরবর্তীকালে জাতককথার সূত্রপাত হয়। আসলে সারনাথ নামটিই এসেছে মৃগরাজ সারঙ্গনাথের নাম থেকে। এখনও সেখানে একটি সরকার স্থাপিত হরিণ অভয়ারণ্য রয়েছে। সেখানে মূলতঃ বিদেশী বুদ্ধভক্তদের ভিড় দেখতে পেলুম। মূল চত্বরটির প্রবেশপথের পাশ থেকে শুরু হয়ে যায় বৌদ্ধ মঠের ভগ্নাবশেষ। চক্রপথের ডানপাশে শ্রমণ ও ভিক্ষুদের সারবাঁধা বাসস্থানের ভগ্নাবশেষ রয়েছে। সেগুলি পেরিয়ে গেলেই ধর্মরাজিকাস্তূপ। এই স্তূপটির মাহাত্ম্য বিষয়ে পরে আলোচনা করছি। ধর্মরাজিকা স্তূপ থেকে ঈষৎ উত্তরমুখী হলেই প্রাচীন মূলগন্ধকুটিবিহার মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ।

    ২.
    ' বারাণসির উত্তর-পূর্বদিকে বরণা ( বরুণা) নদী পেরিয়ে ১০ লি মতো গেলে 'লু ঈ' বা মৃগদাব সঙ্ঘারামের দেখা পাওয়া যায়। এর সীমানা আট ভাগে বিভক্ত, একটি ঘেরা দেওয়াল দিয়ে সব গুলি সংযুক্ত রয়েছে। কয়েকতল উঁচু বুরুজগুলি সংলগ্ন ঝুলবারান্দা ও সেগুলির কারুকাজ খুব নিপুণ হাতের কাজ। এই সঙ্ঘারামটিতে ১৫০০ মতো ভিক্ষু রয়েছেন। তাঁরা হীনযান মতের সম্মতীয় শাখার উপাসক। বিরাট সীমানার মধ্যে প্রায় দুশো ফুট উঁচু একটি বিহার দেখলাম। তার শীর্ষদেশে একটি সোনায় মোড়া আমের প্রতিকৃতি রয়েছে। দালানগুলির ভিত্তি পাথরের। সিঁড়িও পাথরের, কিন্তু বুরুজ ও কুলুঙ্গিগুলো ইঁটের তৈরি। কুলুঙ্গিগুলো চারদিকে একশোটি সারিতে সাজানো ও তার প্রত্যেকটিতে একটি করে সোনার বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। বিহারের মধ্যে দেশি তামা দিয়ে তৈরি একটি বুদ্ধমূর্তি। ধর্মব্যাখ্যানের রত এই মূর্তিটির আকার স্বাভাবিক মানুষের সমান।'

    মূলগন্ধকুটিবিহারের এই বর্ণনা করেছিলেন হিউ এন সাং আনুমানিক ৬৪০ সালে। তাঁর বিবরন পড়ে মনে হয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে গুপ্তযুগে নির্মিত এই বিহারটি সেই সময় পূর্ণ গৌরবে বিরাজ করতো। বুদ্ধ নিজে তাঁর অনুগামীদের যে চারটি স্থানকে 'অভিজাহিতাত্থানানি' অর্থাৎ অপরিবর্তনীয় তীর্থভূমি বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন ঋষিপত্তনের মৃগদাব, যেখানে মূলগন্ধকুটিবিহার নির্মিত হয়েছিলো, তার অন্যতম। বাকি তিনটি উরুবেলা (বোধগয়া), সংকস্সা ও শ্রাবস্তীর জেতবন। বৌদ্ধদর্শনের পবিত্রতম কেন্দ্র হিসেবে ঋষিপত্তনের বিহারটি সমগ্রবিশ্বে স্বীকৃত ছিলো। একটি রটনা আছে যে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক নাকি ঋষিপত্তনের বিহারটি বিধ্বস্ত করেছিলেন। এই রটনাটির সূত্র কিন্তু আবার হিউ এন সাং নিজেই। তিনি ৬৪৪ সালে ভারত ত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর ঋষিপত্তন আগমন তার দুচার বছর আগেই। তাই তাঁর পূর্বোক্ত বিবরনের সঙ্গে এই স্থানে শশাঙ্কের ধ্বংসলীলার আখ্যান ঠিক মেলেনা। একথা ঠিক অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধদেশে শশাঙ্ক 'বেদবিরোধী' শ্রমণদের বহু প্রতিষ্ঠান বিনষ্ট করেছিলেন এবং সেইকালে তীব্র বৌদ্ধবিরোধিতার কারণে বেশ বিখ্যাত বা কুখ্যাতও ছিলেন। শ্রীহর্ষের সঙ্গে তাঁর বহুবিদিত শত্রুতা এবং সেই কারণে শ্রীহর্ষানুগত হিউ এন সাঙের রচিত ইতিহাসে তাঁর সম্বন্ধে সমদর্শী বিশ্লেষণ থাকার সম্ভাবনা নিতান্ত কম মনে হয়।

    হিউ এন সাং 'ধর্ম-ব্যাখ্যানে রত' যে বুদ্ধমূর্তিটির কথা উল্লেখ করেছেন সেটি বুদ্ধের উপবিষ্ট 'ধর্মচক্রপ্রবর্তনমুদ্রা'র প্রতিচ্ছবি। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী সেটি ধাতুনির্মিত ছিলো। কিন্তু ঊনবিংশ শতকে মূলবিহারের খননসূত্রে লব্ধ এই মুদ্রায় বুদ্ধের প্রস্তরমূর্তিটির ( যেটি এই সময় সারনাথ জাদুঘরে রয়েছে) মতো উচ্চকোটির ভাস্কর্য আমি দেশে আর একটিই দেখেছি। সেটি পাটনা জাদুঘরে আরো চারশো বছর আগে মৌর্যযুগের শেষ পর্যায়ে নির্মিত বিখ্যাত দিদারগঞ্জের যক্ষী মূর্তি।

    ৩.
    এই বিহারটির বাইরে হিউ এন সাং দশটি স্তূপ, তিনটি সরোবর ও 'হেঁটে যাবার ভঙ্গিমায়' তথাগতের একটি 'মহান করুণা ও ভাবব্যঞ্জক' মূর্তি দেখেছিলেন। এছাড়া তিনি একটি প্রায় তিনশো ফুট স্তূপ দেখেছিলেন এখানে। ' এই স্তূপটির নীচের ভিত্তি বেশ চওড়া ও নির্মানটি অনেকটা উঁচু। এটি বিভিন্ন ধারার কারু ও শিল্পকাজ শোভিত এবং মহার্ঘ বস্তু দিয়ে সুন্দর করে সাজানো'। এই স্তূপটিই আদিরূপে সম্রাট অশোক নির্মিত 'ধর্মচক্র স্তূপ' ছিলো, পরবর্তীকালে পালিভাষায় ধম্মখ বা বর্তমানকালে ধামেখ স্তূপ নামে পরিচিত। এটিকে পঞ্চম শতকে গুপ্তযুগে বিশাল আকার দেওয়া হয়। এর নীচের অংশে আটদিকে আটটি কুলুঙ্গি করা আছে এবং পাথরে উৎকীর্ণ নানা জ্যামিতিক বিন্যাস , স্বস্তিক, পুষ্প-পত্র, পক্ষী ও মানুষিক নক্শা দেখতে পাওয়া যায়। কারুকৃতি হিসেবে এর তুলনা সাঁচীর স্তূপের সঙ্গে করা যেতে পারে। এর দক্ষিনে রয়েছে ধর্মরাজিকা স্তূপ। এখন শুধু এর চক্রাকার ভিত্তিভূমিটিই অবশিষ্ট রয়েছে। সারনাথের উপর বারাণসির অন্যান্য মন্দিরের মতো বারম্বার তুর্কি ও অন্যান্য বিধর্মী আক্রমণ হয়েছে। ফলতঃ এর গরিমাময় প্রাচীন স্থাপত্যের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই শুধু ধামেখ স্তূপটি ছাড়া। কিন্তু ধর্মরাজিকা স্তূপটির যতোটা অবশেষ বাকি ছিলো, অষ্টাদশ শতকে কাশীনরেশ চেত সিংএর দিওয়ান জগত সিং একটি বাজারের দোকানপাট নির্মাণের জন্য তার ইঁটগুলি ভেঙে নিয়ে যায়। এই স্তূপে একটি সবুজ পাথরের আধারের মধ্যে বুদ্ধের দেহাবশেষ ছিলো। এই লোকটি বুদ্ধের আত্মার শান্তি কামনায় তা গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। শূন্য আধারটি এই মূহুর্তে ভারতীয় জাদুঘর, কলকাতায় রক্ষিত আছে। এই নিদর্শনটি ব্যতিরেকে এই স্তূপটির অভ্যন্তরে বেশ কিছু অমূল্য পুরা সামগ্রী পাওয়া গিয়েছিলো, কিন্তু তার কোনও হদিশ এখন আর পাওয়া যায়না। ধর্মরাজিকা স্তূপটি প্রাক অশোকপর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিলো। কারণ প্রাপ্ত লোককথা বা ইতিহাস অনুযায়ী এই বিশেষ স্থানটিতেই বুদ্ধ তাঁর প্রথম পাঁচ শিষ্যকে ধর্মচক্রপ্রবর্তন বিষয়ক উপদেশ দিয়েছিলেন। অশোক পিয়দস্সি ইতোপূর্বে স্থাপিত স্তূপটিকে বিবর্ধিত করেছিলেন। তার পর গুপ্তযুগে দুবার এবং পরবর্তীকালে আরো দুবার এই স্তূপটির আকার বৃদ্ধি করা হয়েছিলো। কিন্তু জগত সিংয়ের কল্যাণহস্তের আশীর্বাদে এখন শুধু এর ভিত্তিভূমিটিই অবশিষ্ট আছে।

    সিংহলে প্রাপ্ত মহাবংশে বলা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে যখন অনুরাধাপুরায় মহাস্তূপের উদ্বোধন হয়েছিলো তখন ঋষিপত্তন থেকে প্রায় দ্বাদশ সহস্র ভিক্ষু ও শ্রমণ সেখানে সমাগত হয়েছিলেন। পঞ্চশিষ্যকে দীক্ষা দেওয়ার পর যশ নামে কাশীর এক প্রতিপত্তিশালী ব্রাহ্মণ বুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তিনি সপরিবারে ঋষিপত্তনে এসে তাঁর শরণ গ্রহণ করেন। এই ঘটনার পর বারাণসিতে বুদ্ধের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এক বছরের মধ্যে ষাট জন অনুগামী তাঁর ধর্মে দীক্ষা নেন। এই সব শিষ্যকে বুদ্ধ নবধর্ম প্রচার করতে বিভিন্নদিকে প্রেরণ করেন ও নিজে ফিরে যান উরুবেলায়।

    ৪.

    এই পরিসরে এখনও বেশ কিছু স্তূপ ও চৈত্যের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। দেখা যায় অশোক পিয়দস্সির স্থাপিত ধর্মচক্র সিংহস্তম্ভের ভগ্ন মূল ভিত্তিটি। এই স্তম্ভটি তুর্কি আক্রমণে ভূলুন্ঠিত হয়। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ এই স্তম্ভের শীর্ষদেশে স্থাপিত চতুর্দিকে সিংহচিণ্হিত মূর্তিটি ভূলুণ্ঠিত হলেও তার ক্ষতি সামান্যই হয়েছিলো। এই সিংহমূর্তিটিই স্বাধীন ভারতের সরকারি প্রতীক। সিংহমূর্তিগুলির নীচে চারটি পশুমূর্তি, হস্তী, বৃষ, অশ্ব ও সিংহ এবং চব্বিশ শলাকার চক্র উৎকীর্ণ রয়েছে। এই চক্রটি ভারতীয় জাতীয় পতাকার মধ্যমণি। এই চতুর্সিংহ ও অন্য চারটি পশু ভারতবর্ষের চতুর্দিকে সার্বভৌম সম্রাট অশোকের অধিকার প্রচার করছে। একদিকে প্রায় ভূমিগত অবস্থায় রয়েছে এককালের জমকালো পঞ্চায়তন মন্দির।

    সারনাথ শুধু বৌদ্ধধর্মের শ্রেষ্ঠ তীর্থ নয়। সার্বভৌম ভারতধর্মের যে সংহত রূপ বারাণসি নামক ধারণার মধ্যে দেখি, সারনাথ তার সার সংক্ষেপ বলা যায়। যখন ঐ অঙ্গনপরিসরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম তখন এই ভাবনাটিই মনের ভিতর ক্রমশঃ অনুরণিত হয়ে যাচ্ছিলো। ইতিহাসের নানাপর্যায়ে বিভিন্ন চিন্তানায়কের থেকে ভারতদর্শন বা ভারতধর্ম বিষয়ে যেসব বোধের মণিমুক্তো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে, ঋষিপত্তন বা সারনাথের ঐ নাতিবিশাল ভূখন্ডটি তার মূর্ত নিদর্শন।

    ৫.

    যেসব উৎসাহী মানুষ সারনাথ দর্শনে আগ্রহী, তাঁদের অবশ্যকর্তব্য এর সন্নিহিত জাদুঘরটি মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করা। স্থানিক জাদুঘর সারাদেশে অসংখ্য দেখেছি, কিন্তু এই ছোট্টো সংগ্রহশালাটি এককথায় অনুপম এবং শিহরণ জাগায়। মৌর্য, কুষাণ, গুপ্ত ও পালযুগের বিভিন্ন পুরানিদর্শন ও ভাস্কর্যের যে নমুনা এখানে আমি দেখেছি তার সত্যিই কোনও তুলনা নেই। পূর্বোক্ত ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রায় বুদ্ধের মূর্তিটি ও অশোকের সিংহস্তম্ভ ছাড়াও বহু বোধিসত্ত্ব ও সনাতনধর্মের দেবদেবীর ঈর্ষণীয় সংগ্রহ এই জাদুঘরটিতে দেখা যায়।

    ঋষিপত্তনের বৌদ্ধ এলাকার সঙ্গে লাগোয়া রয়েছে জৈন তীর্থংকর শ্রেয়সনাথের মন্দির। একটি মহাবৃক্ষকে কেন্দ্রে রেখে এই মন্দিরের সন্নিহিত উদ্যানটি মনে হয় শান্তিকল্যাণ। বারাণসি শ্রেয়সনাথের জন্মস্থান। এই মন্দিরটির বিপরীতদিকে রয়েছে বিখ্যাত বৌদ্ধ সাধক, পন্ডিত ও চিন্তানায়ক সিংহলের অনাগারিক ধর্মপাল কর্তৃক ১৯৩১ সালে স্থাপিত মূলগন্ধকুটিবিহারের নবমন্দিরটি। মনে করা হয় ঋষিপত্তনে গৌতমবুদ্ধ এই মন্দিরটির ভূমিতে অবস্থিত একটি মঠে বসবাস করতেন। এই মন্দিরটিতে তক্ষশিলা থেকে সংগৃহীত কিছু বৌদ্ধ পুরানিদর্শন রয়েছে। অনাগারিক ধর্মপাল ছিলেন আধুনিককালে ভারতভূমির বৌদ্ধ নবমূল্যায়ণের পথিকৃৎ । ১৮৯১ সালের বুদ্ধপূর্ণিমায় তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহাবোধি সমাজ। আজকের সারনাথের সংস্কার ও বিকাশের ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন মূল প্রেরণা। তাঁর সমাধিমন্দিরও রয়েছে এই পরিসরেই।

    ৬.

    সূর্যাস্তের সময় এগিয়ে এলো। ফিরে যাচ্ছিলুম আবার বারাণসির মূল শহরের আস্তানার দিকে। 'বেদবিরোধী' বুদ্ধকে একসময় ব্রাহ্মণ্য শক্তিকেন্দ্র চরম আক্রমণ চালিয়েছিলো বিধর্মী অভিযোগে। আদি শংকরের পূর্বসূরি কুমারিলভট্টের নেতৃত্বে যে সংখ্যায় বুদ্ধভক্তদের হত্যা করা হয়েছিলো, চারশো বছর তুর্কি অত্যাচারেও ততো বৌদ্ধনিধন হয়নি। ব্যক্তিক নীতিবোধ যখন গোষ্ঠীগত 'ধর্ম'বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়, মানবিকচর্যা ও মূল্যবোধের তুমুল বিপর্যয় তখনই সম্ভবামি এবং যুগে যুগে তার অন্ধ অনুকরন ইতিহাসকে কলংকিত করে রাখে। কিন্তু এই ঋষিপত্তনে শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ তাঁর এক প্রিয়তম শিষ্য সারিপুত্তকে যা বলেছিলেন, তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কালের উপনিষদেরও মর্মবাণীর মধ্যে সেই একই আকূল পথনির্দেশ পাওয়া যায়।

    ' অপারূতা তেসং অমতস্স দ্বারা
    যে সোতবন্তো পমুঞ্চন্তু সদ্ধং,
    বিহিংস সঞঞী পগুণং ন ভাসিং,
    ধম্মং পণীতং মনুজেসু ব্রহ্মে ।' ( মহাবগ্গ)

    অমৃতের দুয়ার আজ উন্মুক্ত। যাহারা শ্রবণে সক্ষম, তাহারা শোন। শ্রদ্ধাদ্বারাই এই অমৃতের সাক্ষাৎকার লাভ হইবে। হিংসা অপগুণ হইতে মুক্ত হও। ধর্ম এইরূপে মানুষের সার্থকতা প্রণয়ন করে।

    (ক্রমশঃ)
  • এই | 79.210.251.164 | ০১ জানুয়ারি ২০১৩ ০৯:৩২582459
  • শেষ পদের শেষ ছত্রানুযায়ী ব্রহ্ম মানে সার্থকতা?
  • dd | 132.167.13.51 | ০১ জানুয়ারি ২০১৩ ১০:৩২582460
  • "আদি শংকরের পূর্বসূরি কুমারিলভট্টের নেতৃত্বে যে সংখ্যায় বুদ্ধভক্তদের হত্যা করা হয়েছিলো, চারশো বছর তুর্কি অত্যাচারেও ততো বৌদ্ধনিধন হয়নি।"...... শিবাংশু উবাচ। আমিও এই রকমই জেনে এসেছি। প্লাস দু একটা উপকথা বা পদ্য "স্তুপে যে করিবে অর্ঘরচনা"..... ইঃ।

    ভারতীয় ইতিহাস রচনায় একটা বিশাল উপাদান বৌদ্ধ ও জৈন পুঁথিগুলি। সমকালীন ইতিহাস রচনা আকর হিসেবে খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। নমুনাও প্রচুর।

    এই যে বৌদ্ধদের গনহত্যা - এই থিওরীর কি কোনো প্রমান আছে? অ্যাট লিস্ট কোনো বৌদ্ধ/জৈন পুঁথি বা আখ্যানে? কেউ জানেন? কোনো রেফারেন্স? বা কোনো প্রামান্য ইতিহাসের বইতে কোনো রেফারেন্স? নাকি পুরোটাই গনস্মৃতি/আর্বান লিজেন্ড ?
  • শিবাংশু | 127.201.164.66 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১২:৩৬582461
  • এই,

    মহাবগ্গ সংকলনের সময় 'ব্রহ্ম' শব্দের অর্থ অন্যরকম ছিলো। এই শব্দটি ভারত ইতিহাসে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তাৎপর্যে ব্যবহার হয়েছে। প্রাক বুদ্ধ উপনিষদগুলিতে ব্রহ্মের উল্লেখ আছে, কিন্তু তার পরিভাষা বেদান্ত কথিত ব্রহ্মের থেকে পৃথক। এই মূহুর্তে বাংলাভাষায় 'ব্রহ্ম' নামক ধারণার স্বীকৃতরূপ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে স্থির করা হয়েছে। তার সঙ্গে এই শব্দের আদি রূপটির অর্থ অনেকটাই মেলেনা। এমনকি বৌদ্ধ জাতক বা অবদানেও একরাশ ব্রহ্মের প্রাদুর্ভাব রয়েছে।

    dd,
    লোককথাই ভিত্তি বলে মনে হয়, তবে ঘটনা কিছু রয়েছে।

    রোমিলা থাপর, ব্যাশাম সাহেব, রাখালদাস, পার্সিভ্যাল স্পিয়র বা ধর্মানন্দ কোশাম্বি, এঁদের বইয়ে দেখলুম কুমারিলভট্টের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু মূলতঃ বাত্তিকা, মীমাংসা বা জৈমিনি প্রসঙ্গে। তবে নীহাররঞ্জনের বইয়ে পেলুম একটি অন্যতর দৃষ্টিকোণ। তিনি পালবংশের পরবর্তী বর্মণ বংশের রাজত্বকালে প্রভাবশালী রাজগুরু ও প্রথিতযশা পন্ডিত ভবদেবভট্টের প্রসঙ্গ এনেছেন। এই ভবদেবভট্ট কুমারিলভট্টের ভক্ত ও শিষ্য। তিনি কুমারিলের করা মীমাংসা, জৈমিনি ও বাত্তিকার টীকাকার ও শৈবধর্মের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন। বলা হয়েছে তাঁরই প্ররোচনায় বর্মণ রাজারা সোমপুরা বিহার বিনষ্ট করেছিলেন এবং বহু বুদ্ধ ভক্তকে বিনাশ করেছিলেন। মিনহাজউদ্দিনের লেখায় দেখা যাচ্ছে, তুর্কো আফঘান খিলজি রাজারা নালন্দায় দুহাজার মুন্ডিত মস্তক 'ব্রাহ্মণ'কে হত্যা করেছিলো। ব্যাপার হচ্ছে এই 'মুন্ডিত মস্তক' লোকেরা ছিলেন বৌদ্ধ, 'ব্রাহ্মণ' নয়। যেহেতু তুর্কিদের কাছে মুন্ডিত মস্তক ভারতবাসী মানেই 'ব্রাহ্মণ' তাই, তাই এই ভ্রান্তি। খিলজিদের এই নরমেধযজ্ঞে বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণের বিভেদ ছিলোনা, কিন্তু শৈবজনতার ছিলো। তাই বেছে বেছে বৌদ্ধবিনাশ ব্রাহ্মণদের বিলাস হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

    মজা হলো কুমারিলভট্ট যে আদতে কোথাকার মানুষ, তাই নিয়েও প্রচুর মতভেদ। একটা মত অনুযায়ী তিনি কামরূপের মানুষ, অন্যএকটা ঘরানা বলে তিনি পশ্চিম পঞ্জাব বা কাশ্মীরের ব্রাহ্মণ। আবার তিনি যে কেরালার লোক এ সূত্রটিও অনেকে বিশ্বাস করেন। থ্রিসুরের কাছে তাঁর একটা স্মৃতিচিণ্হগোছের ব্যাপার দেখেছিলুম। একটা রটনা তিনি কালাদির শংকরের সঙ্গে তর্কে পরাজিত হয়ে অগ্নিসমাধি নিয়েছিলেন। তার পর কুমারিলের শিষ্য মন্ডন মিশ্র প্রতিশোধ নিতে শংকরের সঙ্গে তর্কযুদ্ধ করেছিলেন। যখন তিনিও শংকরের কাছে পরাভূত হয়ে অগ্নিসমাধি নেবার সিদ্ধান্ত নেন, তখন মন্ডন মিশ্রের পত্নী উভয়ভারতী আসরে এসে শংকরকে তর্কে পরাজিত করেন। একটি সূত্রে বলা হচ্ছে মন্ডন মিশ্র বিদর্ভের মানুষ, কিন্তু মিথিলায় মন্ডন মিশ্র কাল্ট নায়ক। কোশি নদীর পশ্চিম পাড়ে সহর্ষের কাছে ময়না গ্রামে মন্ডন মিশ্রের ভিটে ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত শক্তি পীঠ রয়েছে। আমি নিজে সেখানে গিয়েছি এবং সন্দেহ করার কোনও কারণ পাইনি। আবার একটা মতও পাই যে কুমারিলভট্ট প্রয়াগ বা বারাণসিতে পরিণত বয়সে প্রয়াত হয়েছিলেন। তবে ঘটনা হচ্ছে কুমারিল দীর্ঘদিন ছদ্মপরিচয়ে বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে বসবাস করে বৌদ্ধদর্শনের গভীরতম অধ্যয়ন করেছিলেন। ধরা পড়ে যেতে বুদ্ধভক্তরা তাঁকে বিশেষ অপমান করে বিতাড়ন করে। এই ব্যাপারটি তিনি কখনও ভোলেননি। পন্ডিতেরা বলেন, সমসময়ে কুমারিলের তুল্য বৌদ্ধদর্শনে ধীমান ব্যক্তি বৌদ্ধদের মধ্যেও কেউ ছিলেন না।

    বোধিচর্চা ছাড়া কুমারিল যে কাজটি করেছিলেন তা হলো শৈবপন্থীদের নৈতিক স্তম্ভ হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি 'নিজে' বৌদ্ধ হত্যা করেছিলেন এমন কোনও উল্লেখ কোথাও পাইনি, তবে তাঁর বৌদ্ধবিরোধী প্রচারে 'উদ্বুদ্ধ' হয়ে বহু মানুষ বৌদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন এই কাজটি করেছিলো মূলতঃ শৈব যোগীরা। শৈব যোগীরা, তখন কেন, আজকের দিনেও শিবের চেলাচামুন্ডা ভূত-গণ-প্রেতেদের মতো অসামাজিক, অনিয়ন্ত্রিত ও হিংসাপর গোষ্ঠী। এদের মূল অংশটিকে আমরা আজকের দিনে নাগা সন্ন্যাসী হিসেবে দেখে থাকি।

    এতো কিছুর পর যে কজন বৌদ্ধ টিকে গিয়েছিলেন তাঁরা পাহাড় পেরিয়ে নেপাল, তিব্বত বা চিনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের সব খতিয়ান স্বাভাবিকভাবেই শৈবদের প্রতি ক্রোধ ও ঘৃণায় ভরা। তার প্রামাণ্যতা সন্দেহের ঊর্ধে নয়।
  • dd | 132.167.0.23 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১৪:৫২582462
  • রোমিলা থাপার, বাশাম সাহেব, স্পীয়র সাহেব ইত্যকার কোনো ইতিহাসকারের লেখাতেই ঐ বুদ্ধিস্টদের উপরে গনহত্যা হয়েছিলো এরকম আদৌ কিছু পড়ি নি। এই ব্যাপারে আমারে খটকা লাগতো সব সময়েই। আদৌ এরকম কিছু ঘটেছিলো কি? সর্ব ভারতীয় ভাবে? হলে এইসব ইতিহাসকারগন একবার উল্লেখও করবেন না এটা মানা যায় না।

    বিশেষতঃ বুদ্ধিস্ট ও জৈন পুঁথির অভাব তো কোনো যুগেই হয় নি। তাঁদের কলেকটিভ স্মৃতিতেও কিছু লেখা নেই ? এরকম হতে পারে?

    অর আঞ্চলিক ভাবে গোষ্ঠী সংঘর্ষ ইজ নট ইকুয়াল টু গনহত্যা। পুরো দক্ষিন ভারতেই শৈব ও বৈষ্ণব দের মধ্যে লড়াই চলতো ,এমনাকি এখনো কর্নাটকে এই বিভাজন এখনো রয়েছে। সেরকম ভাবে কোথাও কোনো সময়ে নিশ্চয়ই কিছু সংঘর্ষ হয়েছিলো,স্তুপ ভাঙা হয়েছিলো,ইঃ। ঐ পর্যন্ত্যই।
  • কৃশানু | 226.113.128.239 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১৫:৪৬582464
  • শিবাংশু দা, বেনারসে তো জোয়ার-ভাঁটা হয় না, ঘাট গুলো উঁচু করা হয় বর্ষাকালের জন্য।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন