এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • সর্ষে-সাদামাটা পথচলা-বিয়াসকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে

    শ্রাবণী
    অন্যান্য | ০৩ মে ২০১৩ | ২০৭৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১১:২০600349
  • ***********************************
    বেরোনোটা সকালে মোটামুটি পরিকল্পনামাফিকই হয়েছিল, এক আধ ঘন্টার এদিক ওদিকে, ভারতীয় স্ট্যান্ডার্ড সময়সূচী মেনে। এবার শুধু অনেকদিন পরে গাড়ী নিয়ে অনেকদুর অনেকসময় ধরে পাহাড়ে বেড়ানো নয়, অনেক আগের অতীতের এক ভ্রমণের সুখস্মৃতি ঝালানো, মন তাই মস্ত। আর কে না জানে খুশী ছোঁয়াচে, তাই যার এযাত্রায় কোনো পুরাতন স্মৃতিপট মাজা ঘসার ব্যাপার নেই, যার চলা শুধুই নতুনের সন্ধানে, সেই সঙ্গীরও শাহী মেজাজ। সোনেপতের আগে মুরথালে শর্মাজীর ধাবায় আলু পরাঠার ওপরের সাদা মাখনের তাল সরিয়ে না রেখে, তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া, মালাইদার লস্যির গেলাসে আহা চুমুক, সেসবই ঐ দরিয়া দিলের পরিচায়ক!

    বড় সুন্দর ছিল সকালের রোদের মায়াবী আলো, দুপাশে সোনালী গমের খেত, রামনবমীর ছুটির কারণে অন্যান্য দিনের তুলনায় ফাঁকা রাস্তা, সব মিলিয়ে একটি নিটোল যাত্রাপথ। কিন্তু গুণীজনে বলে গেছে, ভালো ভালো, তবে বেশী ভালো কি বেশী ভালো?
    মায়েরা যেমন সাজিয়ে গুছিয়ে বাছাদের বাইরে বের করার আগে কড়ে আঙুলটি কামড়ায়, নিজের ও বিশ্বসুদ্ধু সব্বার নজর থেকে বাঁচাতে, ঠিক তেমনিই প্রকৃতি ঠাকরুন এমন নিখুঁত সুন্দর এক দৃশ্যপটকে জালিম দুনিয়ার বুরী নজর থেকে বাঁচাতেই বোধহয় কিঞ্চিত আঘাতে খুঁতো করে দিলেন।
    ট্রাকের পিছনে বিভিন্ন বানানে "বুরে নজরওয়ালে তেরা মুহ কালা" লেখা মানে শুধু অন্যের নজরের হিসেব রাখা,তাদের নিজেদের নজর কালোধলো যা খুশী হোক, তা টের পেল বেচারা নির্দোষ বাহন, কিছুদুর চলার পরে। কীভাবে কী হয়ে গেল ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই, ড্রাইভারের পাশে আসীন যাত্রীর মুখে "ব্রেক ব্রেক", হাত মোবাইলে। কিন্তু সারথি সেদিকে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে স্টিয়ারিং পুরো বাঁয়ে জোরে ঘুরিয়ে পিচ রাস্তা ছেড়ে ধারের মাটির পথে।
    পরে বোঝা গেল যে ওরকমটা না করে অন্যজনের পরামর্শমত ব্রেক করলে গাড়িটি চ্যাপ্টা হবার সম্ভাবনা দেখা দিলেও দিতে পারত।
    এদিকে আততায়ী হাতছাড়া, দুর্বার গতিতে চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়, ওদিকে পুলিশের একশ নম্বরে রিং হয়েই চলেছে। যতক্ষণে নাগরিক শান্তিরক্ষকদের সময় হল ফোন তোলার ততখনে শুধু সেই ট্রাকটি নয়, আরো গোটা পনের গাড়ী তাকে অনুসরন করে বেরিয়ে গেছে এই পথ ধরে,তার মধ্যে অন্ততপক্ষে পাঁচটি একইধরন গড়নের ট্রাক ছিল।
    অবশ্য ট্রাকটি না পালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই যে পুলিশ দৌড়ে আসত তাদের ধরতে এমনটা ভাবা এ মহান দেশের বাসিন্দাদের পক্ষে সুস্থমস্তিস্কের লক্ষণ মোটেই নয়। তারা ধীরে সুস্থে সব শুনলেন, পলাতকের পরিচিতি সংখ্যা নিয়ে একটু দোনোমনা ছিল, আয়তন নিয়েও। সব শুনেটুনে ওদের খালি দুটি প্রশ্ন, এক, যাত্রীদের কতটা চোট লেগেছে, দুই, তারা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অবস্থায় কিনা! এবং দুটিরই জবাব নাতে শুনে হাইটাই তুলে, তুড়ি মেরে, ফোন নাম্বার নিয়ে পরে খবর দেবে বলে ফোন রেখে দিল, স্থির জানি ফোন নাম্বারটা কোথাও লিখে রাখলনা!

    মন আকাশের নীলে কালো মেঘের ছায়া। একটু দুরে গিয়ে গাড়ীর একটি প্রাথমিক চিকিৎসালয়ে তাকে ফার্স্ট এড দেওয়ানো হল, পরীক্ষায় দেখা গেল যা চোট লেগেছে তা বাইরে, ভেতরে সব ঠিকই আছে। মোটামুটি কাটা ছেঁড়ার দাগ ভরতে সময় ও অল্প প্লাস্টিক সার্জারীর কারিকুরির দরকার পড়বে ভবিষ্যতে। মেঘ হাল্কা হলেও একেবারে কাটলনা যদিও সারাপথ চালক গাড়ী চালানোর সাথে সাথে অতিরিক্ত দায়িত্বে "আধুনিক ডেন্টিং পেন্টিংয়ের ম্যাজিক" পুরো প্রথম পাতা থেকে মুখস্ত আওড়ে যেতে লাগল সঙ্গীর ডেন্টেড মন চাঙ্গা করতে!
    তালেগোলে দুপুরের খাওয়াটা আর হলনা, ঐ সাদা মাখনের অভিশাপেই বোধহয়।

    পঞ্চকুলা চন্ডীগড়ের লাগোয়া শহর, সাজানো সুন্দর, হোটেলটিও মনোরম পরিবেশে, সবই ভালো শুধু গাড়ি পার্ক করে হোটেলের লোক যখন জিনিসপত্র নামাচ্ছে কেমন মনে হচ্ছিল ওদের নজর গাড়ির ঐ চোট লাগা অংশের দিকেই এবং সে চোখে গাড়ির যাত্রীদের প্রতি অবজ্ঞার মত কিছু আছে। এদিকে শোকসন্তপ্ত মনোভাবের আঁচ করে তিনি আগেই পাখিপড়া করেছিলেন যে গাড়ি যখন সচল আছে তখন যেন মুড অফ বলে বেড়ানোর প্ল্যানের সওয়া বারোটা না বাজানো হয়। বুকে পাথর চেপে লোক্যাল রেন্ট আ কার কে ফোন, শহর ঘুরে দেখাবার জন্যে (ধাক্কাধুক্কির পালার কারণে নয়, এরকমটা আগেই ঠিক ছিল, শহরের রাস্তা খুঁজে বেড়ানোর সময় বাঁচাতে)।

    কেন জানিনা, কোনোদিন চন্ডীগড় আসা হয়নি এর আগে, অথচ সেই কবে থেকে কত বিষয়ে চন্ডীগড়ের নাম উঠে আসে, এর বাড়ি ওর বাড়ি, ও ছিল এ ছিল। স্কুলে বন্ধুরা ছুটিতে আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরে এসে রক গার্ডেনসের গল্প শোনাত, স্কুল থেকে একবার ট্রিপও নিয়ে গেছিল, তবে বড় ক্লাসকে।
    শুনে শুনে ছবি দেখে দেখে শহরটার মত নেকচাঁদের আশ্চর্য সৃষ্টি,পাথুরে বাগিচাও যেন চিরচেনা। এমন অনেক একদা শোনা বহুলপ্রশংসিত ও প্রচারিত জিনিস বহু বছর পরে সামনে গিয়ে যখন প্রথম দেখেছি তেমন আহামরি কিছু বোধ হয়নি কিন্তু এক্ষেত্রে তার অন্যথা হল। খুব সুন্দর লাগল, যদিও পর্যটকদের তরফে চেষ্টার কসুর নেই একে কলুষিত করে তোলার, যেখানে সেখানে নোংরা ফেলা, পাথরে নিজেদের ভালোবাসার নাম খোদাই, জলে প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট। তবে চোখে পড়েনা সেসব, সেখানে রোদছায়ায় উজ্জ্বল একজন সৃষ্টিশীল মানুষের কল্পনা ও বাস্তবের এক অপরূপ মেল, এক অনবদ্য সৃষ্টির রূপে, প্রথম দেখায় আর অন্যকিছুর দিকে নজর সরেনা।

    শহরটাকেও কী ভালোই না লাগে, সাজানো গোছানো, প্রশস্ত পথ, দুধারে নিবিড় গাছের সারি, নীল আকাশের গায়ে দুর পাহাড়ের আভাস। হাওয়ায় ছড়িয়ে এক চেনা গন্ধ, মনে পড়ে অন্য কোথাও, খুব প্রিয় কোনো দেশে বিকেলের বাতাসের গন্ধটা ঠিক এমনি ছিল। চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে কিছুটা যেন সমাধান মেলে এই ধাঁধার, গাছ ফুল সবই যে বড় চেনা, সেখানেও এদের দেখা যেত। গোলাপ বাগানে ঢুকে তাই ঘাস মাড়িয়ে গিয়ে বসি লাল ঝুমঝুম ফুলে ভরা বটলব্রাশের তলায়, তার পাতা কগাছা তুলে নিয়ে হাতে ঘসি, তারপরে নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ শুঁকি, চোখ বোজা। আঃ, কোন অতীত মনছোঁয়া বিকেল যেন তার রূপরসগন্ধ সব নিয়ে উঠে আসে ঐ এক ঘ্রাণে।
    শহরের এই আর এক দ্রষ্টব্য সাজানো গোলাপ বাগান অবশ্য শুকোনোর তোড়জোরে ব্যস্ত, যদিও গরম এখনো তেমন ভাবে আসেনি তবু সময় থাকতে বাঁধাছাঁদা করাই ভালো, ফুলেদের সেরকমই ভাব দেখলাম।
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১১:৩১600360
  • মান্ডি যাওয়ার সাধারণ পথে না গিয়ে ঘুরপথে যাওয়ার কথা, কারণটা আর কিছু নয়, খারাপ রাস্তা আর ট্র্যাফিক এড়ানো। সময়ের হিসেবে একঘন্টা বেশী লাগবে, দুরত্বে অতিরিক্ত প্রায় একশ কিমি। আর লাভের ঘরে? কিছুদুর গিয়ে নদীর সঙ্গ, চারিধারের সুন্দর দৃশ্যাবলী আর পাহাড়ের উঁচুনীচুতে চীনেদের বানানো মসৃণ রাস্তা।
    হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে পেট্রোল ভরা হল, শনিবারের বাজারে লোকজন তখনো আড়মোড়া ভাঙছে তাই চন্ডীগড়ের রাস্তার বিখ্যাত ট্র্যাফিক থেকে কিছুটা বাঁচোয়া।

    হাতে দুটি গুগল ম্যাপের প্রিন্ট আউট, একটি চন্ডীগড়ের আভ্যন্তরীন পথের, অন্যটি শহর থেকে বেরোনোর পরে যে রাস্তায় মান্ডি যাওয়া হবে তার। এক হাতে ম্যাপ, অন্য হাতে জিপিএস,শ্যেনদৃষ্টি কখনো রাস্তার বোর্ডের তরে তো পরক্ষণেই মোবাইলে, লেফট রাইট রাইট লেফট করে যাত্রা হল শুরু।
    শুরুতে চালক অবশ্য শুধু গাইডের ভরসায় পুরোপুরি না থেকে নিজের অভিজ্ঞতা, শোনাকথা,ধারণা ইত্যাদি নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখার ফলে সাদামাটা বেরঙ পথচলাও মাঝে মাঝে ঘুরেফিরে বেশ রঙীন ডিজাইনার যাত্রা হয়ে উঠছিল।

    সেসব পেরিয়ে অবশেষে শহর ছেড়ে অনেকদুরে এসে পড়লাম রূপনগর বা রোপারের রাস্তায়। এক এক করে পেরিয়ে যাই রোপার, আনন্দপুর সাহেব, সাথী হয় ভাকরা, পৌঁছই নাঙ্গালে।
    উনার পর থেকেই বোধহয় সেভাবে ঘাট শুরু হয়, তখনো হিমাচল হিমালয়ের সবুজের সমারোহ নেই, একটু যেন রুক্ষ প্রকৃতি তবু তাতেই মুগ্ধ সমতলের প্রাণ।
    সময়টা যদিও বৈশাখ তবুও পাহাড়ে ফাগুনমাস, পলাশের আগুনে রাঙানো চারিধার, হঠাৎ পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনায় অভিভূত হৃদয়, গাড়ি থামে, ফুল কুড়নো হয়। এই পাগলপনা দেখে কিছু দুরের হিমালয় বোধহয় মুচকি হাসে, এখনো তো পাইনের সার আসেনি, ওক বার্চ দেওদার, রডোডেনড্রনের লাল ছিটে ছড়ানো রৌদ্রজ্জ্বল নীল আকাশ দেখনি, এখনই এমনি উতল, শুধু এইটুকুতেই?

    সব ভালো এই রাস্তার তবে যেহেতু দুরের যাত্রীরা হয় এর খোঁজ এখনো তেমনভাবে পায়নি অথবা অতিরিক্ত ঘন্টা ও কিলোমিটার হিসেবের খাতার অন্য ঘরে ভারী পড়ে বলে, তাদের আনাগোণা এ তল্লাটে কম। ফলত রাস্তার ধারে তেমন ভদ্রস্থ খাবার জায়গা, প্রায় অনুপস্থিত। যারা রাস্তার খবর দিয়েছে তারা এই সমস্যাটির উল্লেখ করতে ভুলে যাওয়ায় প্রায় সারা পথ ভাবতে ভাবতে চলা যে আর একটু এগোলেই হয়ত ঠিকঠাক কোনো জায়গা পাওয়া যাবে। এভাবেই উনা থেকে বাঙ্গানা, বাঙ্গানা থেকে ভোটা, ভোটা থেকে ঘুমরউইন, একের পর এক ম্যাপে দাগানো গুরুত্বপূর্ণ সব দেশ পেরিয়ে যাই, পরিচ্ছন্ন একটি ধাবার দেখা আর নাই।

    পাহাড়ী জঙ্গল কোথাও, তার ফাঁকে ছোট বসতি, একটু ঘন বসতি, ঘিঞ্জি বাসস্ট্যান্ডের ধার মানে অপেক্ষাকৃত বড় কসবা। তবে কোথাও কোনো ব্যস্ততা নেই, অলস দুপুর, শান্ত পাহাড়ী জনপদ, নিরুদ্বিগ্ন পাহাড়ের বাসিন্দা। সোনালী ফসল ভরা ক্ষেত, তার গায়ে লাগানো গ্রামের বাড়ী, লাল ইঁটের দেওয়াল আর স্লেট পাথরের টালির চাল, পুরো ছবির মত লাগে।
    স্লেট পাথর এখানের প্রাকৃতিক সম্পদ, পাহাড়ে পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে, তাই স্বভাবতই ঘর তৈরীতে এর ব্যবহারও খুব হয়ে আসছে বহু কাল থেকে। রাজাদের বাড়িতে, পুরনো মন্দিরেও জায়গায় জায়গায় এই পাথর দেখা যায়, দেওয়ালে, চালে। তবে গত ভুমিকম্পে দেখা গেছে পাথরের চালের জন্যে ঘর চাপা পড়ে লোক মরে অনেক বেশী, তাই আজকাল যাদের সংগতি আছে তারা পাহাড়ের গ্রামেও শহুরে ধাঁচের ছাদওয়ালা বাড়ি করে। পাথর ছাড়া কাঠও প্রচুর ব্যবহার হয় এখানকার বাড়িঘরে।

    ভোটা থেকে ঘুমরউইনের পথে যখন, তখন পেটে ইঁদুররাও ম্যারাথনের পরে ক্লান্ত,মানে কিছু মুখে না দিলে আর চলছে নাআআ। পাহাড়ের বাঁকে জঙ্গলের মধ্যের এক ধুলোয় ধুসর টিমটিমে ধাবা,সেখানেও তখন সবজি অর্থাৎ তরকারী শেষ। রাজমা কিছুটা পড়ে আছে, তাই সই। গরম রুটি, রাজমা আর আন্ডা ভুর্জি দিয়ে পিত্তিরক্ষা হয় শেষমেশ। মান্ডি থেকে ফোন আসে, কোথায় পৌঁছলি, কতদুরে, ঘাঘস পেরিয়েছিস?
    ঘাঘস, সে আবার কোন দেশ রে ভাই, ম্যাপে নাই যে এ নাম? ওখানেই তো চন্ডীগড় থেকে বিলাসপুর হয়ে আসা সোজা পথ এসে মিশেছে এই অন্য পথের সাথে, মিলেমিশে যাবে মান্ডির উদ্দেশ্যে বিয়াসের পাড় ধরে। প্রিন্টেড ম্যাপে না থাকলেও একটু এগোলে জিপিএসে দেখা যায় ঘাঘস, আশপাশ আর দেখব কী, ঘাঘসের দিকে চোখ রেখে বসে থাকি, সেই লেফট লেফট রাইট রাইট, এরকম রাস্তায় না আছে বোর্ড, না পড়া যায় মাইলস্টোনের লেখা ঠিকঠাক!
    বেশীদুর যেতে হয়না, একটু পরেই আসে ঘাঘস, পথের বাঁকে বড় সবুজ বোর্ডে একদিকে চন্ডীগড় বিলাসপুর, দুরত্বসহ সব জায়গার উল্লেখ,অন্যদিক মানে যেদিক থেকে আমরা এলাম, সেদিকে লেখা হামীরপুরের নাম। সামনে সোজা পথ গিয়েছে, সুন্দরনগর, মান্ডির দিকে।

    সুন্দরনগরের পথে ডানদিকে দেখি মোদের কম্পানির হাইড্রো প্রজেক্টের মহাপ্রবন্ধক অফিস অর্থাৎ জেনারেল ম্যানেজারের অফিস। জানতাম এ প্রজেক্ট বিলাসপুরের কাছে কোথাও তবে সে যে এই রাস্তায় জানা ছিলনা। কিছুদুর গিয়ে দেখি চারধারে ও নামের ছড়াছড়ি, পথনির্দেশিকা বোর্ড থেকে শুরু করে এ অফিস ও অফিস পাহাড়ের নানা ধাপে। আসল সাইট অবশ্য মেন রোড থেকে ছয় কিলোমিটার দুরত্বে। সে পথে আর গেলাম না, ছুটির মাঝে এতদুর এসেও সেই কমলি দর্শনে বিশেষ আহ্লাদ কারোরই যে হয়না সে কি আর বলার অপেক্ষা রাখে!

    মান্ডি সীমা শুরু হয়েছিল অনেক আগে, শহর এলো অনেক পরে। মান্ডি পুলিশের ফেসবুকে উপস্থিতি জানিয়ে বিজ্ঞাপন পাথরে, দেখে বেশ ইমপ্রেসড আমরা। ফোন এল আবার দিক নির্দেশ দিতে, যাব আই আই টিতে, ব্রিজ পেরিয়ে, নদীর ওপারে বাস স্ট্যান্ড আর পয়দল ময়দানের পেছন দিকে পাহাড়ের ওপরে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের গেস্ট হাউসে। মান্ডি ঢুকে প্রথম ব্রিজ পেয়ে তড়িঘড়ি নদী পেরৈ আমরা, পরে দেখি আরো দুটি ব্রিজ আছে আগে। পয়দল ময়দানের নাম নিয়ে ঈষৎ ধন্দের সৃষ্টির অন্তে আসে বাস স্ট্যান্ড, কিন্তু পাহাড়ে ওঠার ছোট রাস্তা যায় চোখ এড়িয়ে, সোজা পেরিয়ে চলে যাই। রাস্তার মুখে আমাদের নিতে হাজির যিনি তিনি উৎকন্ঠায় বার বার ফোন করতে থাকেন। ভুল বুঝতে পেরে গাড়ি ঘোরানোর আগে চোখে পড়ে মান্ডির বড় গুরুদ্বার যা মান্ডির রাজা বানিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দসিংয়ের জন্যে।
    গুরু নাকি মান্ডির রাজাকে কথা দিয়েছিলেন যে পাঞ্জাব কখনো মান্ডি আক্রমণ করবেনা, অনেকদিন একথা রেখেছিল পাঞ্জাবের শাসকরা, পরে রঞ্জিত সিংয়ের সময়ে বোধহয় এ কথার খেলাপ হয় ও পাঞ্জাবের দখলে আসে ও থাকে মান্ডি, যতদিন না ব্রিটিশরা মান্ডিকে পাঞ্জাবের অধীন থেকে ছাড়ায়।

    এবার আর পথ ভুল হয়না, কারণ পথের ওপরে দাঁড়িয়ে প্রিয়জন অপেক্ষায়, হাতে কাগজের প্যাকেটে দুধ ফল জাতীয় নানাবিধি শুধু আমাদের জন্যে। কয়েক মাসের ব্যবধানে দেখা,খুব খুশী দুপক্ষই,রোদ ঝলমল পাহাড়ে ঘেরা মান্ডি, চড়াই উঠতে গিয়ে তাকিয়ে দেখি রোদ পড়ে নদীর জল চিকচিক করছে। অনেক দিনের পরে দেখা, কিছুটা শান্ত বিয়াস, স্মৃতিতে যে পাহাড়ী পাথরের বুক ভেদ করে বয়ে যাওয়া খরধারা বিয়াস আছে তার থেকে আলাদা, তবু বিয়াস তো। আগামী কদিনের পথ চলার সঙ্গী হবে সে আমাদের, তার কলধ্বনিতে সকাল হবে, হবে রাত। অপেক্ষায় কাটবে এই দুদিন, বিয়াসের সেই পরিচিত দস্যি রূপ দেখার অপেক্ষায়!
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১১:৩৯600371
  • রাতে খাওয়াদাওয়ার পর হাঁটতে বেরোই, নদীর ধার ধরে। অন্ধকারে পাহাড়ের ধাপে ধাপে শহরের আলোর জোনাকী দেখে কেমন দেওয়ালীর কথা মনে হয়, কোথাও বা মনে পড়ে গুরুবায়ুর মন্দিরগাত্রের প্রদীপের আলোকসজ্জার কথা। পয়দল ময়দানের মধ্যে দিয়ে চলি স্থানীয় কলেজের ক্যাম্পাসে, যেখানের একদিকের বিল্ডিং এখন আইআইটির অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ব্লক।

    ময়দানে ছড়িয়ে আছে ভাঙা মেলার চিহ্ন। শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে এখানে একমাসব্যপী বিরাট মেলা বসে। আশেপাশের যত মন্দিরের বিগ্রহ আছে সবাই সুসজ্জিত দোলায় চড়ে, বাজনাবাদ্যির সাথে শোভাযাত্রা করে ময়দানে আসে, তাদের প্রত্যেকের জন্যে নির্দিষ্ট আলাদা তাঁবু থাকে, সেখানে তাদের রাখা হয়। অনেকটা কুলুর বিখ্যাত দশেরা উৎসবের মত নিয়ম। মান্ডি আসার পথেই দু তিন জায়গায় এই ধরণের বর্ণময় শোভাযাত্রা চোখে পড়েছিল।

    পরদিন সকাল সকাল বেরনো, যাওয়া হবে পাশ কিলোমিটার দুরের পরাশর লেকে, মান্ডি শহর থেকে অনেকটা ওপরে, পথে পড়বে কমান্দ, আই আই টির স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরীর বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে সেখানে। ভোরে বেশ কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, আকাশের মুখ তখনো ভার তবে এ নতুন কিছু নয়, এমনটাই হয়ে থাকে পাহাড়ের এদেশে। রোদের পরে বৃষ্টি আসে, বৃষ্টির পরে রোদ, তাপমাত্রার প্রচন্ড কিছু হেরফেরের কারণ যাতে না ঘটে সেদিকে সদাই সচেষ্ট প্রকৃতি এখানে।
    সরু ভিজে রাস্তা,চুলের কাঁটা বাঁক,দুদিক থেকে গাড়ি আসছে,তার মাঝে বিপত্তি,হর্ন কাজ করছেনা,দুটোর একটিও না। চালকের মুখে অবশ্য স্বভাবসিদ্ধ নিরুদ্বেগ হাসি, যাত্রীদ্বয়ের মধ্যে একজন পোড়খাওয়া, বৃষ্টিবাদলায়, নানা প্রতিকুল পরিস্থিতিতে এই গাড়িতে পাহাড়ে ঘোরার অনেক অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে, তাই সে ঘাবড়ায়না। নবাগত অপর যাত্রীর আতঙ্ক দুর করতে অতীত ভ্রমণের নানা সাহসিক গল্প ফাঁদে সে, তবে তাতে কেমন উল্টো ফল হতে দেখে শেষে আর কথা না বাড়িয়ে রাস্তার দুধারের দৃশ্যের দিকে মনোনিবেশ করে!

    আশা অনুযায়ী সাবধানী চালক বিনা আওয়াজেই পথ পেরিয়ে কমান্দ ক্যাম্পাসে ঢুকিয়ে দেয় গাড়ি। তারপরে শুরু হয় হাঁকডাক, রবিবারে ছুটির দিনে তেমন কাজের কাউকে পাওয়া না গেলেও, আসে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যান অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারগণ যে যেখানে ছিল, আসে ইলেকট্রিশিয়ান। যে যেমনভাবে পারে হাতে যা যন্ত্রপাতি আছে তাই দিয়ে ঠুকঠাক করতে থাকে অচল হর্নকে সচল করার প্রচেষ্টায়। এদিকে একাধারে গাড়ির মালিক ও চালক যিনি তিনি দুরে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে। সাধারণত এমনটা হয়না, নিজের গাড়ির ব্যাপারে তাকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলেই জানি তাই অবাক হই। পরে জানতে পারি যে সে নাকি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিল হর্নদুটির নিরাময়ের আশা নেই তাই তার গাড়ির খরচের খাতায় ধরা যন্ত্রাংশ নিয়ে অন্যদের লাফঝাঁপে বিচলিত হবার কোনো কারণ সে দেখেনি।

    এর মাঝে ঘুরে বেড়াই ক্যাম্পাসে, দু চারটি বিল্ডিং ও ডাইরেক্টরের বাংলো ছাড়া বাকী সবের কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। বিশাল এলাকা জুড়ে নির্মাণের কাজ চলছে, এ পাহাড় ও পাহাড়, নদীর এধার ওধার জুড়ে অনেকদুর অবধি জমি আই আই টির জন্যে বরাদ্দ।তবে সমতল ভূমির অংশ কম, পাহাড় কেটে সমান করে নির্মাণ করা অনেক ঝামেলার কাজ, সময় এবং খরচসাপেক্ষও। তাই প্রথমে তাড়াতাড়িতে কাজ হচ্ছে যেখানে যতটা প্লেন ল্যান্ড আছে সেখানে। এ পাহাড়ে নর্থ ক্যাম্পাস, তার উল্টোদিকের পাহাড়ে প্রস্তাবিত সাউথ ক্যাম্পাস, দুটির মাঝখানে সবার আগে ব্রিজ তৈরী করতে হবে, সে জায়গাও দেখা হল। এখানে বিয়াস নেই, আছে তার শাখানদী উল। উলের একদম কিনারে যেখান থেকে আকাশছোঁয়া পাহাড়শ্রেণী ঘিরে ধরেছে জঙ্গলকে, সেখানে বাংলোর বাইরের উঠোনে বসে চা খাই আমরা। আমাদের টুকরো কথা ছাপিয়ে যায় নদীর আওয়াজ, বিভিন্ন পাখির ডাক,বৃষ্টির পরের টাটকা তাজা হাওয়ায় ভাসে নানা ফুল পাতার সুগন্ধ। এখনো নাকি ফুলের সময় হয়নি তবু তাতেই যা দেখা যায় চারপাশে, অনবদ্য!

    যতদুর চোখ যায় পাহাড় আর জঙ্গল, এখানে অন্যান্য ক্যাম্পাসের মতো ল্যান্ডস্কেপিংয়ের আর দরকার পড়বে বলে মনে হয়না, পাথরে মাটিতে গাছপালায় ফুলে ফলে প্রকৃতি আসর সাজিয়ে রেখেছে শুধু একটু গুছিয়ে গাছিয়ে নিলেই হয়!
    হর্ন ঠিক হলনা, রবিবারে এদিককার বাজার দোকান সব বন্ধ থাকে, রাস্তায় মেকানিক পাওয়া যাবে সে আশাও কম, তবে সেইসঙ্গে পরাশরের রাস্তায় ভিড় নেই, সেরকম বিজ্ঞাপিত ট্যুরিস্ট স্পট কিছু নয়, লেক আছে আর আছে পরাশর মুনির মন্দির, স্থানীয় ভক্ত সমাগমই বেশী হয় বারের দিনে। এতটা এসে শুধু হর্নের কারণে ফিরে যাওয়া, সে কি হয়! আতঙ্কের চরম অবস্থা কেটে গিয়ে তখন অন্য যাত্রীরও সাহস ফিরে এসেছে, বুঝিবা চালকের ওপর ভরসাও। পথ চলি, অনেক দুর অবধি আই আই টির এলাকা, একদম শেষে এক টিলা, নদীতট থেকে অনেকটা ওপরে। ঐ টিলায় যার বাড়ি বা যে বাড়ি হবে তার বাসিন্দাদের কথা ভেবে চিনচিনে হিংসে। এত জায়গা যদি ওদের না লাগে,এই সীমাশেষের টিলাটা চাইলে যদি দিয়ে দেয় অথবা ওখানে যদি একটা গেস্টহাউস হয়, তাহলে এসে কাটাতে পারি তো কদিন,এরকম নানা জল্পনায় মশগুল হয়ে এগিয়ে চলা পরাশরের দিকে।

    যত ওপরে উঠি, দুধারের জঙ্গল আরো ঘন হয়ে ওঠে পাইনের, সিলভার ওক, বার্চের, আর দেখা যায় রডোডেনড্রনের সমারোহ, থোকা থোকা লাল সবুজে আঁকা ছবি। আছে নাম না জানা আরো অনেক বুনো ফুল,কুরাল ফুলে ভরা পাতাহীন গাছ, ফুলের ভারে নুইয়ে পড়া লতানে গোলাপ।
    মাঝে মাঝে ছোট পাহাড়ী গ্রাম এ পথে, কোথাও লেখা নাম, কেউ বা আবার অজানাই থেকে গেল।

    এক জায়গায় এসে কয়েকটি দোকানপাট, সেখান থেকে বেঁকে গেছে খাড়াই রাস্তা পরাশরের দিকে, বোর্ডে লেখা। সেই দোকানপাটের মধ্যে একটি আবার সাইনবোর্ড অনুযায়ী মোটোর মেরামতির। তবে খরিদ্দার কাউকে দেখা গেলনা, যে দুজন কারিগর ছিল তারা দুটি সাইকেল ঠিক করতে ব্যস্ত ছিল। তাদের ধরেটরে বনেট খোলানো হল, মনে হয় সচরাচর এমন কেস তারা পায়না তাই মহা উৎসাহে তারা খুলে ফেলল একটি হর্ন, অন্যটিও খুলতে যাচ্ছিল, গাড়ির মালিকের হস্তক্ষেপে তা আর সম্ভব হয়নি। আসলে, খুলে অল্পস্বল্প ঠোকা দিলে হর্ন বাজছিল তাই আমাদের অভিপ্রায় ছিল যে যদি কোনোরকমে কিছু উত্তর ভারতীয় জুগাড় করে কাজচালানোর মত ব্যবস্থায় পরাশর ও মান্ডি ব্যাক যাওয়া যায়। যে হর্নটি ছেলেগুলো খুলেছিল, মেরামতির চেষ্টায় সেটি পুরোপুরি দেহ রাখল। অপরটিতে টায়ারের টুকরো না কী যেন গোঁজামিলে লাজুক স্তিমিত স্বরে ডাকার অবস্থায় নিয়ে এল মালিক স্বয়ং।
    এরপর ছেলেদুটিকে মহা জোরাজুরি করে অল্প পারিশ্রমিক দেওয়া হল, তারা নিতে একদমই রাজী ছিলনা, আমরাও ছাড়বনা, সময়ের দাম নেই নাকি!
  • hu | 188.91.253.11 | ০৩ মে ২০১৩ ১১:৪৪600382
  • আহ! কি আরাম! বড় ভালো হচ্ছে।
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১১:৫৩600384
  • পরাশরের রাস্তা ঠিক যতটা খারাপ, চারিদিকের দৃশ্যরাজি ঠিক ততটাই সুন্দর। মেঘ সরে গিয়ে দুরে অল্প অল্প বরফে মোড়া পাহাড়চুড়ূ দেখা গেল। চারিদিকে কিছুই নেই, শুধু কিছুটা নীচে গিয়ে পি ডাব্লিউ ডির বিশ্রাম গৃহ দেখা যাচ্ছে। দু তিনটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ট্যুরিস্ট একদল, স্থানীয় দর্শনার্থী আছে কিছু। রাস্তা থেকে লেক বা মন্দির কিছু দেখা যায় না।
    অনেকটা ওপরে পাহাড়ে উঠে সেখান থেকে আবার নামলে পাহাড়ঘেরা লেক ও মন্দির। ছোট ডিম্বাকৃতি লেক, চারিদিক তারের জাল দিয়ে ঘেরা, ভেতরে যাওয়া শখত মানা। লেকের এক কোণের দিকে একটি ছোট টিপের মত গোল সবুজ দ্বীপ। এই দ্বীপটির বিশেষত্ব হল এটি ফ্লোটিং বা ভাসমান। এখানেই নাকি পরাশর সাধনা করত। দ্বীপটি ভেসে ভেসে বেড়ায়, বিভিন্ন ছবিতে এর বিভিন্ন অবস্থান দেখলাম মান্ডির নানা জায়গায়। একবার এক বিদেশী বিজ্ঞানীর দল সম্ভবত ইটালিয়ান,এসেছিল লেকটির গভীরতা মাপতে তাদের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে, কিন্তু সফল হয়নি।

    মন্দিরটি হিমাচলে যেমন হয়, কাঠের কারুকাজ করা দরজা, বীম, খুঁটি, পাথর আর কাঠের ও পাথরের দেওয়াল, স্লেট পাথরের চাল। ভেতরে পরাশর মুনির মূর্তি। আশেপাশে কিছু নেই বলে আমরা সঙ্গে শুকনো খাবার নিয়ে এসেছিলাম, পরাশরে পৌঁছে আগে গাড়িতে বসে খাওয়াদাওয়া করে নিয়েছিলাম। এখন নীচে মন্দিরে এসে তার সামনের দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে রোদে বেঞ্চিতে বসি। এত উঁচুতে বলে ঠান্ডা এখানে জম্পেশ, রোদ বড় মিঠে লাগে।

    মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষনের তেমন চিহ্ন নেই, উল্টোদিকে দোতলা স্কুলবাড়ির মত বাড়ি, ভাঙা, খালি, তারই দাওয়ায় দোকান। হিমাচলে দেখি মুনিদের পুজোর রেওয়াজ, মানালিতে বশিষ্ঠ মন্দির, মান্ডিতে পরাশর মুনির মন্দির। পাহাড়ে তবে পুজো আচ্চা খুব চলে, এখানে সেখানে যেদিকে দেখি ছোটবড় হাজারটা পুজোর স্থান, গাছের তলায় ঠাকুর, এক পা যেতে না যেতে এক চিলতে মন্দির। হয়ত বা প্রকৃতির খামখেয়াল থেকে বাঁচতেই এরা এত বেশী বেশী করে দেবদেবীকে আঁকড়ে ধরে এসেছে।

    মন্দির থেকে ফিরছি, দেখি কয়েকটা বাচ্চা ছেলে দুহাত ভরে বুকের কাছে গুচ্ছ রডোডেনড্রন নিয়ে আসছে। আমি তো নিশ্চিত আমাদের বেচতে আসছে এবং নেব সেটাও ঠিক করে ফেলেছি। হতাশ হয়ে দেখলাম তারা আমাদের এড়িয়ে পেরিয়ে চলে গেল ।
    পরে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ফুলের ফটো নেওয়া হচ্ছে যখন তখন দুজন স্থানীয় লোকের সঙ্গে আলাপে জানলাম রডোডেনড্রনের চাটনি ও আচার এদের প্রিয় খাদ্য। ছেলেগুলি সম্ভবত ফুল গ্রামে তাদের বাড়ির জন্যে নিয়ে যাচ্ছিল। অমন সুন্দর কাব্যিক ফুলের চাটনি?
    শুধু এই নয় আরো আছে। জঙ্গল আলো করে গাছ ভরিয়ে থাকা বেগুনি সাদা কুরাল ফুলের বেসন দিয়ে বড়াও নাকি পাহাড়ের ডেলিকেসির মধ্যে পড়ে। আমার হায় হায় শুনে সঙ্গীরা মনে করায় যে ভিনদেশী পুস্পপ্রেমীরা আমাদের কুমড়োফুল ও বকফুল সম্পর্কেও হয়ত একই মনোভাব পোষণ করতে পারে!

    পরাশর থেকে নেমে মান্ডি শহর পেরিয়ে হাইওয়ে, হন্যে হয়ে হর্ন খোঁজা শুরু। গাড়ির শোরুমগুলি দেখা গেল যথার্থ শো রুম মানে গাড়ি শো করা ছাড়া সেখানে আর কিছু হয়না। মোটোর মেরামতির দোকানগুলি চেহারায় পরাশরের ওখানের দোকান থেকে উন্নততর হলেও সার্ভিসে প্রায় একই গোত্রের, টায়ার বদলানো ছাড়া খুব বেশী কিছু করেনা। শেষমেশ আশা যখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছি সবাই তখন একটি দোকান দেখা গেল, নাম কার ক্লিনিক। নাম শুনে তেমন ভরসা না হলেও, সেই হয়ে দাঁড়ালো আমাদের মুশকিল আসান। লোক্যাল ব্র্যান্ডের একটি হর্ন পাওয়া গেল এবং একেবারে অকেজো হর্নখানি বদলে নতুনটি লাগিয়ে শান্তি।
    আপাতত এই ব্যবস্থায় বাকী পথ যে নির্বিঘ্নে কেটে যাবে এ নিয়ে কারো কোনো সন্দেহের অবকাশ যখন আর রইল না তখন মুহূর্তটিকে সেলিব্রেট করতে ও দুপুরের লাঞ্চের ভরপাই করতে আবার শহরে ঢোকা হল, হোটেল রাজমহলের উদ্দেশ্যে। অবশ্য শুধু খাওয়ার জন্যে নয়, রাজমহল এমনিতেও শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্যস্থান, কারণ এই হোটেলটি একদা মান্ডি রাজার প্যালেস ছিল এবং এখনো এটি একটি প্রাইভেট হোটেল যার পরিচালনার ভার বর্তমান রাজার নিজের হাতে।
    এ অঞ্চলের এটি সর্বোত্তম হোটেল,শহরের যাবতীয় বড় বড় পার্টি ইত্যাদি এখানেই হয়ে থাকে।

    মান্ডির রাজারা বাংলার লক্ষণসেনের বংশধর। ইতিহাস কী কয় জানিনা, একজনের কাছে ছাড়া ছাড়া গল্প শুনলাম সেদিন রাতে খাবার টেবিলে। লক্ষণসেনের নাতি রূপসেন কোনো এক গহৃত কাজ করায় তাকে দেশবার করে দেওয়া হয়। কিভাবে সে রাজপুত বনজারাদের সংস্পর্শে আসে এবং ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে রূপনগরে (এখনের রোপার বা রূপনগর) নতুন এক রাজ্যের পত্তন করে। রাজত্ব নাকি ভালোই চলছিল, রূপসেনের নাতি বা ছেলের সময় দিল্লীর মুঘল বাদশার নজর এই রাজ্যের ওপর পড়ে এবং বাদশা রাজাকে বশ্যতা স্বীকার করতে বলে, রাজা তাতে রাজী না হয়ে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। রাজারা তিন ভাই ছিল, একজন যুদ্ধে মারা যায়, অপর দুজন পালিয়ে একজন মান্ডিতে আসে, অন্যজন কুলুর কাছে কোথাও আসে।
    পরবর্তীতে নানা ঘটনাবলীর মাধ্যমে এই সেনেদেরই বংশধর মান্ডির রাজা হয়। কিছু কিছু শব্দে যেমন ঝোল ইত্যাদি, মাছ খাওয়ার চলে, খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে পরিবারের নিয়মে আচারে সেই সুদুর বং কানেকশন নাকি টের পান পন্ডিতেরা!
    রাজমহলের প্রতিটি হল, করিডর, পেন্টিং, প্রোট্রেট, দেওয়ালে সাজানো অস্ত্রে, কাঁচের কেসে সাজানো নানা অ্যান্টিকে, ইতিহাস কথা বলে, তবে এযাত্রায় কান করে তা শোনবার মত অবকাশ হয়নি, ফির কভি।
    সেই মুহূর্তে সুস্বাদু পকোড়া, কফি, গ্রিলড চিকেন স্যান্ডউইচের ডাক বড় বেশী মনকাড়া মনে হয়েছিল, সারাদিনের ঘোরাঘুরির ধকলের পরে।
    বাড়ি ফিরে আবার গোছগাছ, পরদিন সকালে মানালি যাত্রা কুলু হয়ে, পথ বেশী নয় তবে উত্তেজনা চরমে। কতবছর পরে আবার মানালি! সেবার এসেছিলাম শিমলা হয়ে, এবারে মান্ডি দিয়ে যাওয়া। কিছুদুর গেলে শিমলার রাস্তা এসে মেশে মান্ডির রাস্তায়, তার মানে কিছুটা চলার পরে আসবে সেই পথ যে পথে গেছি বারে বারে না হলেও অন্তত দুবার তো বটেই এবং সে এমন চলা যার স্মৃতি আজ এতবছর পরেও ধুলোহীন অমলিন!
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১২:০৪600385
  • ********************************
    -"এই মেয়েটা হয়েছে বড্ড ঘরকুণো, কোথাও নড়তে চায়না। কলেজটা যায় ঐ কোনোরকমে, ব্যস। বলে বলে এদিক ওদিক কারো বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়না, কাজবাড়িতে একবার গিয়ে ধন্য করবে, তার জন্যেও কত বায়নাক্কা!
    বেশী বললে সাজবেনা গুজবেনা, গিয়ে ফ্যাকাশেমুখে এমন গোঁজ হয়ে থাকবে যে লোকের কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে প্রাণ বেরোয়। শুধু বাড়িতে বই মুখে বসে থাকতে দাও, নাহলে টিভি অথবা গান, খুব খুশী। আগে ছোটবেলায় কত আনন্দ করে বেড়াতে যেত, এখন যেতেই চায়না। গতবারেও তো ওর দিদিরা দার্জিলিঙের টিকিট কেটে কত সাধল, না। তবু তখন নাহয় কলেজ ছিল, এখন তো ছুটি সেই ভাইফোঁটা অবধি, সবাই বলছে, আমিও বলছি ঘুরে আসতে, যাবেনা।"

    না, ঘুরে বেড়াতে মেয়েটি ভালোবাসতনা, বড় হওয়া ইস্তক। তবু যেতে হত, সংসারে বিশেষ করে তাদের পরিবারে হুজুগে লোকের অভাব নেই, তারা গরমের ছুটি, পুজোর ছুটিতে পাহাড়ে যায়, বর্ষায় দঙ্গল বেঁধে দীঘা পুরী যায়, শীতে নানা অদ্ভুত জায়গায় পিকনিক করতে যায়। তা যাকনা, কে বারণ করছে, কিন্তু একলা বা ইচ্ছুক দু চারজন মিলে যাওয়া তাদের কুষ্ঠিতে লেখেনি। বড় একটা দল জুটিয়ে হই হট্টগোল করে, সবাইকে দলে টেনে, ব্যতিব্যস্ত করে, ব্যবস্থাদিতে নানা গোলমাল পাকিয়ে বেড়াতে না গেলে তাদের শান্তি নেই!

    সেবার এরকমই এক দল পুজোর পরে চলেছে শিমলা কুলু মানালি, মামারা দাদা দিদি তাদের বন্ধুবান্ধব পরিবার, সব মিলে জনা কুড়ি তো হবেই। কলেজে তখন পুজোর হাওয়া, বিকেলে ছুটির পর বাড়ি না ফিরে গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়ানো দিদি বা মামীর সাথে মিট করে পুজোর বাজার। হাত ভর্তি কেনাকাটি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে পুবালীতে উঠে কবিরাজী কাটলেট অথবা ফিশফ্রাই খেয়ে ট্রাম ধরে বাড়ি ফেরা। টিফিন টাইমে দৌড়ে কলেজের কাছের মোড়ে টেলর ভাইয়ার কাছে পুজোর জামাগুলো তাড়াতাড়ি করে দেবার জন্যে তাড়া দেওয়া।
    বেশ চলছিল দিনগুলো ফুরফুরে, আসন্ন ছুটির অপেক্ষায়, এমন সময় এহেন উৎপাতে মেজাজ খিঁচড়ে খ একেবারে। ঐ শিমলা ভ্রমণের দলে কিভাবে যেন তার নামও ঢুকে গেছে আর নাছোড়বান্দার দল কিছুতেই না শুনছেনা।
    -"চল না, খুব ভালো লাগবে, বোনেরা সবাই মিলে যাব, মজা হবে।"
    -"তুই না গেলে অত ভালো জায়গায় গিয়েও আমাদের মন খুঁতখুঁত করবে, মন খারাপ করবে তোর জন্যে।"
    -"ভালো কেন?'
    -"ওমা, জানিস না। মানালিতে গেলেই বরফ দেখা যায়। ওখান থেকে বরফে ভরা রোটাং পাস, চারদিকে বরফ, সে এক দারুন ব্যাপার। কত সিনেমার শ্যুটি ংহয় ওখানে।"
    -"হোক, আমি কেন যাব? আমি কি সিনেমা করি? আমি একটুও যেতে চাইনা। বেশী ঠান্ডা জায়গা আমার ভালো লাগেনা, কাশ্মীরে তখন ছোট বলে চলে গিয়েছিলাম, এখন হলে যেতাম না। আমি বাড়িতে থেকে ছুটির দিনগুলোয় পুজোসংখ্যা শেষ করতে চাই।"
    এই বলে মুখ গোমড়া করে বসে। এত কড়া কথার পরেও উৎসাহী লোকজন তাকে পাত্তা না দিয়ে হাইকোর্ট অর্থাৎ মায়ের শরণাপন্ন হয় এবং মা তার ফেভারিট টপিক "ঘরকুণো মেয়ে" নিয়ে আক্ষেপ শুরু করে।
    কলেজে বন্ধুরা কেউ রাজস্থান যাচ্ছে কেউ নৈনিতাল। শিমলা মানালি সুযোগ পেয়েও যাচ্ছে না শুনে নানা টিপ্পনী। "কেন রে, এভাবে বাড়ির সাথে যেতে ভালো লাগছেনা? একেবারে বরের সাথে যাবি বলে? ও জায়গা তো শুনি হানিমুনার্সদের স্বর্গ।'
    শুনে শুনে পিত্তিপরাণ জ্বলিয়া যায় এক্কেবারে!

    এতদিক থেকে এত চাপ, ফল, পুজোয় গ্রামের বাড়ি থাকার কোটা কাঁটছাঁট করে সাততাড়াতাড়ি ফিরে এক সন্ধ্যেয় না রাতে কালকা মেলে চড়ে বসা। একবার যাত্রা শুরু হওয়ার পর খারাপ লাগছিল বললে মিথ্যাভাষণ হবে, ট্রেনে দলবেঁধে যাওয়ার একটা মজা তো আছেই তারওপর এমন হুড়দাঙ্গা দল। বাড়ি থেকে প্যাক করে আনা নানানিধি খাওয়াদাওয়া, এতগুলো সিট ঘিরে একই দলের এতলোকে কামরাটাকে প্রায় ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিল।

    একটু খিঁচ যা ছিল তা হল দিল্লী থেকে কালকা সবার ওয়েটিং লিস্ট বা আর এ সি টিকিট, তবে এজেন্ট বলে দিয়েছিল কনফার্ম হয়েই গেছে ধরে নিন! তখন তো আর নেট নেই, কম্পিউটারাইজড রিজার্ভেশনেরও দিন নয় সেটা। দিল্লী স্টেশনে রাতেরবেলা নেমে খুঁজে পেতে দলের লীডাররা এক জায়গায় রেলের কাগজে কার্বন ছাপের আবছা অস্পষ্ট নীলচে হরফে মোটামুটি এখান ওখানে করে সবার নাম লিস্টে পেয়ে গেল। একটি কামরায় মালপত্র, একজন মহিলা ও তিনটি কমবয়সী মেয়েকে রেখে বাকীরা স্টেশনে টহল দিতে গেল, ট্রেন অনেকটা সময় দাঁড়ায় সেখানে।
    কিছুক্ষন পরে সেখানে একদল বাঙালী ট্যুরিস্ট এল হৈ হৈ রবে রেলের এক কর্মচারীর সাথে, হাতে তার গোলাপী সবুজ কাগজের রেল কোম্পানির জাবদা রসিদ বই, এসে বলে সিট খালি করতে। এ দলে ভালো হিন্দি জানা হিসেবে লোকটিকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল। বাইরে কামরার গায়ে সাঁটানো কাগজে আমাদের নাম আছে শুনে তারা বাইরে দেখতে বলে, গিয়ে দেখি সে কাগজ ছেঁড়া হয়ে গেছে। কর্মচারীটির হাতে এক টাইপ করা লিস্ট, তাতে কোথাও আমাদের নাম নেই। সে আমাদের উঠিয়ে দিয়ে সেখানে জম্পেশ করে বসে অন্য দলের লোকেদের নামে রসিদ কাটে, রিজার্ভেশনের টাকা নিয়ে। আমরা অসহায় দাঁড়িয়ে দেখি, বড়রা কেউ নেই আশেপাশে, অত পয়সাও কাছে নেই যে বার্থ নীলামীর প্রস্তাব রাখব!

    গাড়ি ছাড়তে দেরী আছে, বাথরুমের কাছে ডাঁই করে রাখা আমাদের কুড়িজনের বাক্সপ্যাঁটরা। চারজন আমরা ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার, ওদলে দু তিনজন দেখে মনে হয় বয়সে বড় তরুন, চেহারাও আমাদের তুলনায় ভালোই, যারে কয় খাতাপীতা টাইপের। সঙ্গে এছাড়া আর একটি পরিবার,মহিলা, বয়স্ক, সব মিলে জনা দশ, হাঁকডাক করে মালটাল গুছিয়ে বসে আমাদের উদ্দেশ্যে অনেক আহা আহা করল। কথায় বোঝা গেল ওরা কলকাতা থেকে রিজার্ভেশন করেনি, এখানে এসে "ব্যবস্থা" করেছে।
    -"আসলে ওসব এজেন্ট টেজেন্ট সব দুনম্বরী, মিথ্যে বলে আপনাদের কত ওয়েটিং লিস্ট ধরিয়েছে কে জানে! তাই আমরা নিজেরাই সব টিকিট করেছি।"
    ছেলেগুলিই সব আয়োজন করেছে, তাদের মুখে গর্বের হাসি, অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলে,
    "কেমন, দেখলে তো, আমাদের উপস্থিতবুদ্ধি। নাহলে এজেন্ট দিয়ে টিকিট কাটলে হয় সারারাত দাঁড়িয়ে যেতে হত নয় হয়ত টিটি এসে নামিয়েই দিত ট্রেন থেকে।" দলের বাকীদের মুগ্ধ সপ্রশংস দৃষ্টি আর আমাদের প্যাঁচামুখ।

    ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে আমাদের দলপতি হাজির, অভিজ্ঞ টো টোকারী, সংক্ষেপে ব্যাপারটা বোঝাতে কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। এর কিছু পরে এক পাহাড়ী টিটির সঙ্গে তার পুনরাগমন। পাহাড়ের লোক বলে বোধহয় দেখতে একেবারে লম্বাচওড়া ফরসা লাল, সাহেবদের মত, তার হুঙ্কারে সব বীর বাঙালীদের কুঁইকুঁই করে গর্তে সেঁধানো হাল। সে নিজের হাতের একতাড়া কাগজের মধ্যে থেকে সেই আবছা কার্বনের আদি লিস্টটি বার করলেন ও তাতে লেখা নম্বরটম্বর কী সব খুঁজে একটি টাইপকরা লিস্ট বার করলেন যাতে আমাদের সবার নাম জ্বলজ্বল করছে। এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত, নিজের ডিপার্টমেন্টের লোকের বদমায়েশীর প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে টিটি শেষে উপস্থিতবুদ্ধিদের ট্রেন থেকে নামালে না, তবে মালপত্রসহ তাদের ঠাঁই হল বাথরুমের কাছের মেঝেতে।

    সকালে কালকা, সেখান থেকে টয় ট্রেনে চড়লাম, সারাদিনের সফর শেষে বিকেলে পৌঁছলাম শিমলা। এর আগে কখনো টয়ট্রেনে চড়িনি যদিও দলের অনেকে চড়েছে, দার্জিলিঙে। ভালো যে লেগেছিল সে তো মনে আছে, তখনো তো ছোটোবেলার অভ্যেস অনেক রয়ে গেছে যদিও প্রাণপণে বড় হওয়া মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে, তাই তখনো ট্রেনে উঠতাম খাতা নিয়ে, লিখতাম পথে আসা স্টেশনের নাম আর সময়। ছোটোবেলায় মা এই অভ্যেস করিয়েছিল, দুরের যাত্রায় বোর হয়ে বিরক্ত করতাম বলে। টয়ট্রেনের স্টেশনগুলোর নাম লেখা খাতা এখন ধুলোচাপা কোথায় আছে কে জানে, টানেলগুলোর জন্যে আলাদা মার্ক করা ছিল খাতার পাতায়!
    ছবির মত স্টেশন সব, মাঝে কোথাও কোথাও খাবার পাওয়া যাচ্ছিল, চাও, নেমে গিয়ে কিনে এনে খাওয়া হচ্ছিল। এখন যদি যাই কেমন লাগবে জানিনা তবে সে যাত্রায় ফিরে এসে অনেকদিন অবধি আমরা টয়ট্রেনের কথা বলতাম, শিমলা কোনোদিন গেলে ওতে ছাড়া অন্য কিছুতে যাবনা সেরকম একটা সংকল্পও প্রায় নিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন, যদিও এখন ভেবে দেখলে মনে হয় সেদিনের সে দলের কেউ সে কথা রাখেনি!

    অক্টোবরের শেষের মেঘলা বিকেল, হিমেল হাওয়া বইছে, স্টেশনে নেমে আগে মালপত্র খুলে সবাই কোট শাল চাপায় গায়ে, তারপর হোটেলের দিকে চলা, পায়ে হাঁটা পথে। ম্যলে যেতে হলে সিঁড়ি ভাঙতে হয় বেশ কিছুটা, ওপরে গিয়ে ঘুরে ফিরে রাত হলে আস্তানায় ফেরা। সবাই ছোট ছোট দলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দু একজন ক্লান্তির কারণে রয়ে গেছে হোটেলে, বিশ্রাম নিতে। কচিদের দলে এক বড় দিদি, ঘুরে ফিরতে গিয়ে বিপত্তি, রাস্তা চিনতে পারেনা, একাধিক জায়গা থেকে একইরকম সিঁড়ি নেমে গেছে, কোন পথে গেলে আমাদের গন্তব্য তা বুঝে পায়না দলের কেউ। একজন খুব আস্থার সাথে জানায় সে মার্ক করে রেখেছে আমাদের রাস্তা। "কোথায়, কোন দিকে?"
    "সেই সিঁড়ির মুখে ডিমওয়ালা ডিম সেদ্ধ বিক্রি করছিল।" ব্যস, জলের মত সোজাপথ, ডিমওয়ালাকে পেলেই ঠিক রাস্তা পাওয়া যাবে। রাত নটার সময় উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুব থেকে পশ্চিমে চারজনে ডিমওয়ালা খুঁজে ফিরি শিমলার ম্যলে। শেষমেশ উদ্ধার করে গুরুজন একজন, খুঁজতে এসে প্রচুর বকুনি, এত রাতে এখনো ডিমওয়ালা বসে আছে তোদের রাস্তা চেনাবার জন্যে!
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১২:২০600386
  • পরদিন এদিক ওদিক ঘুরে কুফরি যাওয়ার পথে নামল সেই গুঁড়ি গুঁড়ি বরফের বৃষ্টি বা স্নো ফল। "বরফ পড়ছে, বরফ পড়ছে", এই মরশুমের প্রথম, সঙ্গের হিমাচলী ড্রাইভারদের মুখে খুশীর হাসি, যেমনটা আমাদের হয়, আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে, প্রথম বর্ষায়।
    কুফরিতে সেই আমলে তেমন কিছু ছিলনা, বেশ ফাঁকা জায়গা, তবু বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে সেখানে লোক আসে শীতের সময় স্কিইং করতে, তাই তার খ্যাতি। পাহাড়ের ধারে পাইনঘেরা নতুন হোটেল, সেখানে যাই কফি খেতে। একটি ছেলে এগিয়ে আসে আমাদের কথা শুনে, সেখানের কর্মচারী, বাঙালী, বর্ধমানে বাড়ি। আমরা যারা কাঁচার দল তাদের ইতিমধ্যে জায়গাটা দারুন ভালো লেগে গেছে। ঐ ঢালু পাহাড় নাকি কিছুদিন পরে বরফের চাদরে ঢেকে যাবে, তখন সে কেমন দৃশ্য হবে ভেবে ভেবে রোমাঞ্চিত।
    "ইস, এমন জায়গায় একটা চাকরী পেলে সারাজীবনের জন্যে রয়ে যেতাম।"
    তারপরেই বুদ্ধি, "চল ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে দেখি, এই হোটেলে কোনো চাকরি হয় কিনা!"
    ওভাবে জিজ্ঞেস করব মনে হওয়াটা সহজ হলেও কথাটা আদতে বলা যায়না, বয়সে একটু বড়, সংকোচ হয় কী ভাববে। তাও শেষমেশ বড়দের সঙ্গে যখন তার কথা হচ্ছে, তখন একবার নাক গলিয়ে,
    "এখানে কর্মখালি আছে?"
    লাজুক হাসে সে,
    "না, সেরকম কিছু জানা নেই।"
    হতাশ উৎসাহীর দল, এর মানে এমন স্বর্গ থেকে ফিরে চলে যেতে হবে, আবার সেই পরীক্ষা, বাসে গুঁতোগুঁতি করে কলেজ, বিচ্ছিরি গরমে বর্ষায়, দৈনন্দিনের যুদ্ধ। বেজার মুখে,
    "আপনার এখানে কী কাজ?" ছেলেটি হঠাৎ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে তড়িঘড়ি চলে যেতে যেতে বলে,
    "আমি মিষ্টি তৈরী করি।"

    সবার মাছিগেলা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে এবার বকুনি বড় এক দাদার,
    "অ্যাঁ, চাকরি খোঁজা হচ্ছে, পড়াশোনার নাম নেই, কে দেবে তোমাদের চাকরি এমনি এমনি? চল এখন, কলকাতায় গিয়ে মিষ্টির দোকানে মিষ্টি বানানো শিখে ফিরে আসিস আবার।"

    শিমলা থেকে মানালি যাওয়ার বাসের টিকিট কাটা হল। সে যাত্রায় মানালি ছিল আমাদের প্রধান গন্তব্য, ট্যুরিজমের হোটেল বুক করা আছে কদিনের জন্যে। অনেকটা পথ, সকালে শুরু করে প্রায় বিকেল হয়ে যায় পৌঁছতে। বড় বাস, সবাই নির্বিঘ্নেই সিট টিট খুঁজে বসা হল। বাসটির অধিকাংশ যাত্রী বাঙালী। দুটি দল পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করছে সিট নিয়ে, মাঝে মাঝে কন্ডাক্টরকে বকছে দুদলই। কন্ডাক্টর উদাস হয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাই তুলছে, ড্রাইভার নিজের সিটে বসে রাস্তার কার সঙ্গে গল্প করছে, ইঙ্গিত পেলেই চালু করবে বাস।
    বাস আর ছাড়েনা, আমাদের একজন বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করে,
    "এই বাঙালীরা যেখানে যাবে ঝগড়া করবে, কিছুতেই শান্তিতে ঘুরে বেড়াতে পারেনা।"
    ব্যস, আর যাবে কোথায়!
    "এই যে, আপনি এটা কী বললেন? নিজে বাঙালী হয়ে নিজের দেশের লোক সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করতে লজ্জা করল না?
    দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ মিলেমিশে একাকার, যে যা সিট সামনে পেল তাতেই বসে পড়ে বাছা বাছা শব্দে যার দিকে আক্রমণ শানাচ্ছে সে তখন মুখে চাদর চাপা দিয়ে হেলান দিয়েছে সিটের গদিতে।
    কন্ডাক্টর এই সুযোগে দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারকে হাঁক দেয়, বাস চালু হল।

    সেই পথ, যে পথে কিছুদুরে গিয়ে সাথী হবে বিপাশা বা বিয়াস। যেখানে মাঝে মাঝে নদীর ওপর দেখা যাবে ঝুলন্ত দড়ির সেতু, পায়েচলা পথ। সেতু পেরিয়ে ওপারে কোথাও পাহাড়ের উঁচুনীচু আর জঙ্গল, জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে বসতি,বাড়িঘর। আমরা জানালা থেকে মুখ সরাবো না, সারাক্ষণের কলকলিয়ে বলে যাওয়া মনের কথার ঝাঁপি থাকবে বন্ধ, পাথরের নুড়ির ওপর আছড়ে আছড়ে পড়ে চলা বিয়াসের কলধ্বনিতে!
    ******************************
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৫:২২600387
  • *******************************
    মান্ডি থেকে এ রাস্তায় জিপিএসের তেমন দরকার পড়লনা, সোজা সাপ্টা রাস্তা তারওপর বহুল ব্যবহৃত ট্যুরিস্ট রুট, তাই সব মোড়ে সবুজ পথনির্দেশক বোর্ড, রাস্তার অবস্থাও ভালোই। এর আগে এত লম্বা রাস্তা পেরিয়ে আসার পর, এখন সামনের একশ কিলোমিটার মত পথ মনে হচ্ছে এইটুকু, ও তো এখুনি পৌঁছে যাব।
    কিছুদুর অবধি সেই শান্ত বিয়াস, আসলে তার গতি এখানে নিয়ন্ত্রিত, পথে পড়বে হাইড্রো প্রজেক্ট ও ড্যাম। খানিকটা গিয়ে এল এক লম্বা সুড়ঙ্গপথ। যেন শেষই হয় না, এতবড় টানেল এর আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়েনা।
    রাস্তার একদিকে খাড়াই পাহাড় আর অন্যদিকে খাতে বইছে বিয়াস। ভুনটার হাওয়াই আড্ডা বা এয়ারপোর্টের বোর্ড দেখে বুঝলাম কুলুর কাছাকাছি এসে গেছি। বাতাসে পাইনের গন্ধ, স্রোতের গতি তীব্র হয়ে উঁকি মারে পরিচিত বিয়াস, রাস্তার ধারে কুলু শাল দোকানের আহ্বান।
    দশেরার সময় না এলে কুলুতে তেমন কিছু দেখবার থাকেনা। তবু আমাকে দেখতেই হবে, সে শুধু শহরের দ্রষ্টব্য হলে অন্য কথা, আমাকে যে খুঁজতে হবে অন্য কিছু। কুলুতে থামার বাহানা হল তাই লাঞ্চ আর কেনাকাটির। চালকের আপত্তি সত্বেও শহরের ভেতরের ঘিঞ্জি রাস্তার মধ্যে দিয়ে গাড়িকে নিয়ে গেলাম দশেরা মেলা গ্রাউন্ডে, জানতাম সেখানে কিছুই থাকবেনা, তবুও।

    সেবারেও তেমন কিছু ছিলনা, ভাঙা মেলা, তবু শীতের বেলায় রোদের ওম মেখে কুলুর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হেঁটে বেড়াতে গিয়ে কোথাও বিগ্রহদের ফেরার মিছিল চোখে পড়লে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ভাঙা হাটেরও জৌলুস কম ছিলনা, রঙীন টুপি চাদর পোষাকে স্থানীয়রা ব্যস্তসমস্ত ঘুরে বেড়াচ্ছিল, অনেক বিদেশী ছিল ছড়িয়ে চারধারে।
    শাল কেনায় আমাদের তেমন উৎসাহ ছিলনা তবু সঙ্গী হয়েছিলাম দিদির মামীদের, এ দোকান ও দোকানে দরদস্তুরের কথোপকথনে তাদের সাহায্য করছিলাম। এখানেই এক দোকানে মামীর সেই বিখ্যাত উক্তি, "ইয়ে রঙ কেমন ক্যাটক্যাট করতা হ্যায়, দুসরা দো"। তখন বড়দের মুখে ভুল হিন্দি শুনলে খুব লজ্জা পাই, শুধরে দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করি প্রাণপন। বেরিয়ে এসে মামীকে বলি, "তুমি তো পাটনায় থেকেছ, হিন্দি জান, ক্যাটক্যাটে বললে কোন আক্কেলে? ও বুঝল?" মামী অনড় অটল, "ক্যাটকেটে রঙের কোনো হিন্দি হয়না তো আমি কী করব"!

    শাল গায়ে দিতামনা তাই কেনার কথা মনেও হয়নি। যদিও সাধা হয়েছিল অনেক, কিছু একটা নে, কিছু তো কেন। নিয়েছিলাম হিমাচলী টুপি, মাথায় দিয়েওছিলাম এক আধদিন সেই যাত্রায়। তারপরে সেই টুপির কী গতি হয়েছিল জানিনা। আজ এতকাল পরে দোকানে থরে থরে সাজানো টুপি দেখে মনে পড়ল আমার টুপির কথা। জানতে ইচ্ছে হল, কোথায় আছে সেই কুলুর টুপি! হয়ত কোনো বাতিল জিনিসের বাক্সের একেবারে নীচে পড়ে আছে, অথবা নেই, কেউ ফেলে দিয়েছে পুরনো জিনিসের সাথে। কোথায় খুঁজব, কাকে জিজ্ঞেস করব। সেসময়ে আমার ভুবনের ভার যার ওপরে ছিল সে আজ এ ভুবনছাড়া।

    কার জন্যে টুপি কিনব ভেবে পেলাম না, যার কথাই মনে হল ভেবে দেখলাম দেওয়াই সার হবে, অথবা কী মনে করবে, এতদুর থেকে এরকম একটা অকাজের উপহার এনে দিল। সঙ্গীকে সাধলাম, নাওনা একটা টুপি। সে শুনে আঁতকে উঠল, ঐ টুপি মাথায় দেবে, পাগল নাকি! শেষে নিজের জন্যেই কিনব এরকম একটা সিদ্ধান্তে আসতে সে আরো ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি অন্যান্য কেনাকাটার সাথে র‌্যাক থেকে একটা টুপি তুলে নিল এবং পরে পাছে টুপি মাথায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি তাই তাকে এমন গোছালো যে যখন মনে পড়ছিল তখন কোন ব্যাগের কোন স্তরে তা আছে কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিলনা।

    হিমাচল ট্যুরিজমের রেস্তঁরাতে খেয়ে কুলু শহর থেকে বেরিয়ে মানালির রাস্তা ধরলাম। দুর বেশী নয় তবে পাহাড়ী রাস্তা, আর আমরা চলেছিলাম ধীরে ধীরে সব দেখতে দেখতে। বিয়াসের ধারে ধারে অগণিত অ্যাডভেন্চার স্পোর্টসের কেন্দ্র, র‌্যাফটিংয়ের টুপি জ্যাকেট এসব পরিয়ে কাকতাড়ুয়ার মত রাস্তায় সাজিয়ে রাখা। কোথাও স্থানীয় ছেলেরা ট্যুরিস্ট ধরার জন্যে প্রায় রাস্তায় চেয়ার পেতে বসে, গাড়ি পেরোলেই হই হই করে হাত দেখাচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে অ্যাঙ্গোরা র‌্যাবিট ফার্ম।
    আশপাশে দেখতে দেখতে এসময় ওসময়ের হুঁশ থাকেনা। কখন যেন পথচলা শেষ হয় প্রায়, সঙ্গীর ডাকে তাকাই, সামনে বরফ শুভ্র হিমালয়ের চূড়া, মানালি এসে গেছে!
    ****************************
  • hu | 188.91.253.11 | ০৩ মে ২০১৩ ১৫:২৬600388
  • ছবির মত লেখা।
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৫:২৭600350
  • ********************************************************
    মানালিতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল হিমাচল ট্যুরিজমের সাথে, এতগুলি লোকের জায়গা হয়নি তাদের হোটেল বিয়াসে, তাই পাশের ট্যুরিস্ট লজে ভাগাভাগি করে ব্যবস্থা। মেয়েরা সবাই বিয়াসে, ছেলেরা কয়েকজন মিলিয়েমিশিয়ে। সেইসময় বিয়াসের একেবারে ধারে শুধু এই দুই ঠাঁই, দুটি বাড়ির মাঝখানে শুধু একফালি রাস্তা, সেই রাস্তাতেই ওপারে যাওয়ার ঝুলন্ত ব্রিজের শুরু। রাস্তা থেকে একটু উঁচুতে উঠে পাইনের বনের মাঝে এক কাঠের বিশাল হলঘর, চারিদিকে তার কাঁচেঘেরা। সেটি হল ট্যুরিজমের রেস্তঁরা, সেখানেই এই কদিন আমাদের খাওয়াদাওয়া। নীচু হাইটের সোফা টেবিলে সাজানো বসার ব্যবস্থা, কড়া কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে জানালার বাইরে বিয়াস, রাস্তা, ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়ি ও লোকের চলাচল, ওপারের পাহাড় এসব দেখতে দেখতে বোধহয় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় এমন পরিবেশ।

    ট্যুরিস্ট লজটা আমার বেশী পছন্দের ছিল কারণ তার ঘরেও সব ইয়া বড় দেওয়াল কাঁচের, পর্দা সরালে একেবারে সামনে বিয়াস। তবে সেখানে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়নি, ওরকম কাঁচঘেরা, প্রাইভেসী নেই, মেয়েরা কেমনে থাকে। তখন মানালির রাস্তাঘাটে ভিড় অনেক কম ছিল, গাড়ি ব্রিজ পেরিয়ে এদিকে আসার নিয়ম নেই, হেঁটে হেঁটে ঘোরা। দুদিনেই অর্ধেক শহর চেনা হয়ে গেল, ড্রাইভাররা, ডিমওয়ালারা, শাল সোয়েটার বিক্রেতারা দেখে চেনা হাসি হাসত। বাঙালী ট্যুরিস্ট খুব বেশী যেত বলে বিক্রেতারা কথার ফাঁকে নানা বাংলা শব্দ ঢুকিয়ে দিত, মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজী।

    এদিকে দলের লোকেরা কেউ আর বাংলায় কথা বলছেনা, মুখ দিয়ে সর্বক্ষণই হিন্দি বেরোচ্ছে আর তা শুনে আশেপাশের লোকজন হাঁ হয়ে যাচ্ছে তবে তাতে নির্ভীক বঙ্গবাসীদের হেলদোল নেই। আমি ইচ্ছে করেই একটু দুরে দুরে থাকি, একটু আলাদা, নাহলে ছোঁয়াচ লেগে আমার বুলিও না ঘেঁটে যায়!
    প্রথম রাতে কাঁচের ঘরে খেতে গিয়ে চোখে পড়েছিল অনেকের, হাসিমুখে সুদর্শন স্মার্ট তরুন ম্যানেজার সকলের সঙ্গে কী সুন্দর করে কথা বলছে। শিমলা পৌঁছে এ কদিন আমরা কজন আলু পরাঠা ছাড়া কিছুই প্রায় খেতাম না, সকালে রাতে যে কোনো সময়, অপশন দিলেই আলু পরাঠা। রাতে হোটেলের থেকে কোনো লোক্যাল ধাবা টাইপের দোকানে খেতে যাওয়ার তাল খুঁজতাম বড়দের কাউকে রাজী করিয়ে। মানালি এসে প্রথম দিনের পর দেখা গেল অনেকের পছন্দটা ঘুরে গেছে, মেনু কার্ডের অন্যান্য খাবারেও লোকে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ব্রেকফাস্টে ছাড়া আর কোনো সময় কাঁচঘরে পরোটা পাওয়া যেতনা, আর এত ঠান্ডায় দুরে রাস্তার ওপরে ধাবা খুঁজতে যাওয়া, সামান্য আলু পরোটার জন্যে, নাআআ!
    *********************************************
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৫:৩৭600351
  • ***************************************************
    "গুগল ম্যাপ দ্যাখো, জিপিএস দ্যাখো, হোটেলটার লোকেশনটা দেওয়া আছে, হিড়িম্বা টেম্পল রোডে। আমরা মানালিতে ঢুকছি, কিন্তু অত দেখবার সময় কই, আমি সতৃষ্ণ নয়নে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি বিয়াসের দিকে, কখন আসবে হোটেল বিয়াস, ট্যুরিস্ট লজ আর সেই কাঁচঘর। এত ভিড় দোকান গাড়ি আর অটো কোত্থেকে এসে কেমন ঘিঞ্জি হয়ে গেছে জায়গাটা, তবু চেনা যায়। চারপাশের ঝাঁ চকচকে হোটেল রিসর্টের ভিড়ে বিয়াস হোটেলকে নেহাতই সাদামাটা দেখায় তবে জায়গাটা একই রকম রয়ে গেছে, ঐ এলাকায় অমন বিয়াসের ধারে এখনো হোটেল নেই একটাও।
    মানালিতে কোনো ম্যল ছিল বলে মনে পড়েনা, তবে এখন আছে ও সেখানে এক চিলতে জায়গায় গাড়ী ঢোকা বারণ, তৈরী হচ্ছে পায়ে চলার নতুন পথ, তাই বিশৃঙ্খল অবস্থা। তার মাঝে জিজ্ঞেস করে গোলচক্কর পেরিয়ে হিড়িম্বা মন্দিরের রাস্তা ধরি। আগে এই রাস্তায়ও এত দোকানপাট ছিলনা।
    অনেকটা ওপরে উঠে ক্লাবহাউস পেরিয়ে আমাদের কটেজ, কাঠের বাড়ি, কাঁচের জানালা দিয়ে সামনে বর্ফীলা পাহাড়ের চুড়া, চারিদিক ঘেরা পাইনে। একটু নীচে নদী, তবে সে বিয়াস নয়, মনালসু, মানালির ছোট নদী, যতদুর সম্ভব এ গিয়ে বিয়াসে মেশে, মান্ডির উল নদীর মত।
    এখন প্রতি হোটেলে আসন্ন ট্যুরিস্ট সীজনের জন্যে তৈয়ারী চলছে, এদেরও রেস্তঁরা তাই বন্ধ, সেখানে কাজ চলছে। কটেজে কিচেন আছে আধুনিক সমস্ত ব্যবস্থাই আছে, মাইক্রো ওয়েভ ফ্রিজ গ্যাস ইত্যাদি।
    -"ম্যাডাম চাইলে রান্না করে নিতে পারেন, নাহলে খাবার পাশের হোটেল থেকে এনে দেবে"।
    বেড়াতে এসে কুটো নাড়ার কাজও করিনা, অন প্রিন্সিপল, আর এরা আমাকে রান্না করতে বলে!
    যাইহোক, কফি পকোড়া ব্রেকফাস্টের পরোটা ব্রেড অমলেট ইত্যাদির যোগান ইন হাউস পাওয়া যাবে শুনেই শান্তি।

    এদিন রোদ ঝলমল হলেও পরদিন সকালে মেঘ দেখা গেল। রাতে বৃষ্টিও হয়েছিল, শুয়ে শুয়ে মেঘের গর্জন আর কটেজের চালে জল পড়ার আওয়াজ শুনেছিলাম।
    এদিন প্রথমে আমরা গেলাম নাগর। রোয়েরিকের গ্যালারী, তার বাড়ি দেখে ফিদা হয়েছিলাম আগের বার। এবারে তাই যেন আর তর সইছে না সেখানে আবার যাওয়ার জন্যে। ঘোরাফেরা করার জন্যে গাড়ি নেওয়া হয়েছে, ড্রাইভার পথে আমাদের এ মন্দির ও মন্দির দেখাবে আর আমরা কিছুতেই দেখব না।
    অবশ্য রোয়েরিক গ্যালারী, ওপরে উরুস্বতী আর নাগরের ক্যাসলে সারাদিন কাটিয়ে ফেরার পথে সে আর মন্দির দেখানোর বায়না করেনি!

    ভালো লেগেছিল মনে আছে, ঘোর লেগেছিল তাও মনে পড়ে তবু সে দেখা আর এ দেখা এক কিনা কীভাবে বলি? দরজায় দাঁড়াই অনেকক্ষণ, তার আগে পাহারায় যিনি, সেই মহিলার সঙ্গে গল্প করি খানিক, ফুল কেন এখনো ফোটেনি রোয়েরিক বাগানে।
    আসলে সময় কিনি, আমার চারিদিকে এত বছরে কত তোলপাড় হয়ে গেছে তার হিসেবও নেই, আমাতে এখন কোন আমি তাই জানিনা। ঢুকতে ভয় হয়, সোনা যাচানোর মুহূর্ত, কত খাদ বেরোবে কে জানে, দামই বা কত পাব!
    চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ঢুকে পড়ি, সামনে নীল সাদায় উজ্জ্বল কাঞ্চনজঙ্ঘা।
    তিনটে ছোট ছোট কুঠরির দেওয়ালের সামনে ঘুরপাক খাই কত বার, সঙ্গী ছেড়ে চলে যায়, ঘরে উপস্থিত লোক বদলে যায়, খেয়াল থাকেনা। এ শুধু ছবি দেখা নয়, এ সেই কোন সুদুরের ভালোলাগা আবার ফিরে পাওয়া। সুখ জড়িয়ে মড়িয়ে উপচিয়ে পড়ে চারদিক থেকে, এত আগুনে পুড়েও যে এক টুকরো আদত মন কোথাও কোন চোরাকুঠরিতে রয়ে গেছিল, কে জানত!
    ***********************************************
  • siki | 132.177.195.193 | ০৩ মে ২০১৩ ১৫:৪১600352
  • তাপ্পর?
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৫:৫২600353
  • *****************************************************
    এত জন একসঙ্গে তৈরী হয়ে সকালে সময়ে বেরোনোটা শুধু মুশকিলই নয় নামুমকিন!
    গাড়ি এদিকে দাঁড়াতোনা (আসা বারণ ছিল কিনা, নিয়ম ছিল কিনা ঠিক মনে পড়েনা), মনে আছে হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে ওদিকে গিয়ে গাড়িতে ওঠা হত, তবে বাসস্ট্যান্ড সম্ভবত এপারেই ছিল। যাওয়া হবে কুলু, নাগর। সকালে ব্রেকফাস্টও রাস্তায় সারা হবে। নতুন জায়গায় তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে তৈরী হয়ে নিয়েছি, একটু বিয়াসের ধার থেকেও ঘুরে এসেছি। তবে একা একা আর কোথায় যাই, রোদে দাঁড়িয়ে আছি লজ আর হোটেলের মাঝামাঝি রাস্তায়। সকালের ব্যস্ততা শুরু হয়নি, বড় শান্ত চারধার। রাতে বরফ পড়েছে, কিন্তু এখন এই সকালের রোদে এমনিতে তার কোনো চিহ্ন নেই শুধু হাওয়াটা আরো ঠান্ডা লাগছে আর পাহাড়ের গায়ে গায়ে এদিক ওদিক সাদা ছোপ, বেলা পড়লে সেও আর হয়ত থাকবেনা, দুরের চুড়ায় যদিও জমাট শুভ্রতা।
    -"ব্রেকফাস্ট করবেন না?"
    বেশ তো দেখায় কোট স্যুটে, মাথায় ঐ টুপিটা কি এদের না পরলেই নয়। কথা হচ্ছে ইংরেজীতে আর তা শুনে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসা এক সঙ্গী পশ্চাদপসারণ করে।
    -"না, দেরী হয়ে যাবে। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, এমনিতেই সবাই তৈরী হয়নি, এতজনের সময় লাগছে।"
    -"সবাই রেডি নয় তো কী হয়েছে, আপনি আসুন, মানে আপনারা যারা রেডি তারা আসুন।"
    আশ্চর্য, এভাবে রাস্তা থেকে খদ্দের ধরতে হয় নাকি একে, তায় আবার সরকারী রেস্তঁরার জন্যে!
    -"না, সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করব। সেরকম বেলা কিছু হয়নি।"
    কাঁচঘর থেকে টুং টাং আওয়াজ আসছে, সকালের প্রস্তুতি, কেউ একজন ডাকও দিল বোধায়।
    -"এখানে এই ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসে একটু কফি খেয়ে যান না, আমাদের স্পেশ্যাল কফি, খুব ভালো কফি।"
    সে আর জানিনা, খুব ভালো কফি শুধু নয় তার দামও খুব ভালো, কালই যারা খেয়েছে তাদের মুখে শুনেছি। এত কিছু কফিপ্রেমী নই যে সকাল সকাল পকেটের পয়সা খরচ করে ঐ কফি খেতে যাব, অত শখও নেই।
    বিরক্ত হোটেলের দিকে তাকাই, কেন কেউ আসছেনা। তখন কী জানি ইচ্ছে করেই আসছেনা, কাছেই আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা গিলছে তারা।
    -"না, মানে আমি আপনাকে ইনভাইট করছি কফি খেতে। এসময় দোকান খুলে আমি এককাপ কফি খাই, চলুননা আমার সাথে এক কাপ কফি খাবেন।"
    কী বলব বুঝে ওঠার আগেই হইহই করে ওদিকে ট্যুরিস্ট লজ থেকে সবাই এসে পড়ল, হাঁকডাকের চোটে হোটেলের লোকেরাও বেরোলো, দু একজন আবার ম্যানেজার সাহেবকে দেখে "গুড মর্নিং" ইত্যাদি সম্বোধন করার ফাঁকে আমরা ছুটে ব্রিজ পেরোই যেখানে সারি সারি ট্যাক্সি আমাদের দলের অপেক্ষায়।

    রোয়েরিকের নাম আমি জেনেছিলাম প্রথম কোনো এক সিনেমা পত্রিকায় দেবিকারানী সম্বন্ধে লেখা থেকে। দেশের বাড়িতে একটা জানালার কুঠরিতে ডাঁই করা থাকত নানা পুরনো দিনের ম্যাগাজিন, তার মধ্যে অনেক সিনেমা পত্রিকাও ছিল। সম্ভবত সেখানেই পড়েছিলাম। তারপরে এদিক ওদিক লেখা পড়েছি, খুব খুঁটিয়ে না। তখন তো আর বেড়ানোর আগে নেট ঘেঁটে সে জায়গার কুষ্ঠি ঠিকুজি পড়ার রেওয়াজ ছিলনা, দলের অনেকেই অবশ্য ভ্রমণ সঙ্গী নিয়ে ঘুরত। ওনার আর্ট গ্যালারীতে ঢুকে বুঝেছিলাম কিছুই জানতাম না। কয়েকটা রেখার টানে, কিছু রঙ ছড়িয়ে, পাহাড়ের বিশালতা, ব্যপ্তি, তার সৌন্দর্য্য, দিনের নানা আলোয় তার নানা রূপ, এমন ভাবে কাগজে ফুটিয়ে তোলা যায়, না দেখলে বুঝতাম না। রঙের ব্যবহার জানতাম কিন্তু সমঝদার এখনো নই, তখন তো আরো কিছু জানতাম না। শুধু ভালোলাগাটা টের পেয়েছিলাম, গ্যালারী থেকে বেরিয়ে আশেপাশের পাহাড় যেন এক নতুনরূপে ধরা দিয়েছিল আমার চোখে।
    ফুলে ভরা ছিল শিল্পীর বাগান। সেই গোলাপবনে তিন বোনের ছবি তোলা হয়েছিল, এখনো পুরনো অ্যালবামে সে ছবি দেখলে মন ভালো হয়ে যায়, হাসিখুশী তিন উজ্জ্বল মুখ আর নানা রঙের গোলাপ।

    নাগর ক্যাসল সেরকম দেখার মত মনে হয়নি, কাঠ পাথর দিয়ে তৈরী বাড়ি, স্লেটের চাল, এ নাকি আবার রাজাদের ঘর! তবে মনে আছে খুব অবাক লেগেছিল একের পর এক পাথর আর মাঝে মাঝে কাঠ দিয়ে গড়া দেওয়াল দেখে যখন শুনেছিলাম কোনো ভুমিকম্পে নাকি এই ইমারতের কোনো ক্ষতি হবেনা কখনো, এ এমনভাবে গড়া।
    নাগরের পরে যাওয়া হল কুলুতে, দশেরা তখন শেষ। তবু তার রেশ ছড়িয়ে আছে গ্রাউন্ডে। সেখানে খানিক ঘোরাঘুরি হল লাল ধুলো উড়িয়ে, উৎসবের অবশিষ্ট র ঙীন যেখানে যা ছিল মেখে নেওয়া। কেনাকাটির কথা তো আগেই বললাম।

    মানালিতে ফিরলাম যখন তখনো কিছুটা বেলা আছে। মহিলারা সবাই হাজির বাজারে সেখানে তখন বড় এক প্যান্ডেল খাটিয়ে সেখানে উলের জিনিসপত্রের সওদা নিয়ে বসেছে নানাজনে। মামীরা দিদিরা তাতে মেতে গেল, দরদস্তুর কেনাকাটায় তাদের আর কোনো দিকে হুঁশ রইল না। কর্তারাও টাকার থলি নিয়ে গিন্নীদের পেছনে, এদিকওদিক যাবার উপায় নেই। তিনচারজন বড় দাদা মামা যাদের গিন্নীর পেছনে ঘোরার বালাই নেই, তারা বিরক্ত হয়ে কেটে পড়ার উপক্রম করে। "দুর এই এত তাড়াতাড়ি কে হোটেলে গিয়ে বসবে, চল বশিষ্ঠ ঘুরে আসি।" আমাদের কান খাড়া, প্ল্যান শুনে ফেলেছি, আমাদেরও সঙ্গে নিতে হবে।
    -"যেতে পারবি, হেঁটে যেতে হবে কিন্তু, গাড়ি নেই"। খুব পারব, কেন পারবনা। উৎসাহে ছুটি, হোটেল থেকে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে যাব, দাদারাও যায় টর্চ আনতে, ফিরতে অন্ধকার হয়ে যেতে পারে। বাজারের ওখান থেকে হোটেলের দিকে যেতে সিঁড়ি ভাঙি তরতর করে সঙ্গীরা পেছনে। মাঝ সিঁড়িতে কাঁচঘরে ঢোকার কাঁচের দরজা। দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখ, বেশী কিছু না বলে কায়দায় দরজাটা একটু খুলে আমন্ত্রন জানায়,
    -"কফি?"
    তাকিয়ে ভেতরে দেখি ফাঁকা, দুপুর শেষ হয়ে বিকেল হতে একটু বাকী, এখনো লোকে চা কফির ভিড় জমায়নি। মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়,
    -"না, থ্যাঙ্কস।" আর পেছনে হইহই, "হ্যাঁ,কফি, হ্যাঁ, কফি",
    কিন্তু আমি ততখনে শেষ ধাপে। হোটেলে ঢুকতে যাব, পেছনের লোকেরাও এসে পড়েছে। জিজ্ঞেস করতে বলল,
    -"দুর, কফি খাবার জন্যে অত ইংরেজী বলা পোষাবে না আর আমাদের হিন্দি তো "কোই বাত নহী, কুছ ফারাক নহী" র আগে যায় না। কাল বরং একটু খুঁজেপেতে দেখব সেইসব উপস্থিতবুদ্ধিদের দেখা যায় কিনা, আমাদের ঐ বাংলাই ভালো।"
    হেসে মজা করতে করতে ব্রিজ পেরিয়ে হাঁটা দিই বশিষ্ঠের দিকে। পিচের রাস্তা দিয়ে মাঝেসাঝে দু একটা গাড়ী পেরিয়ে যায়, কিছুদুর গিয়ে পা টনটন করে তবু চলি। পাহাড়ে দুরত্ব সম্বন্ধে সঠিক ধারণা হওয়া খুব মুশকিল, একদিন যে পথ দীর্ঘ মনে হয়, দু চার দিন চলার পর সেই পথই "এই তো এখানে" মনে হয়। তাই পথে দেখা হওয়া কাজ সেরে ঘরের পানে ফেরা স্থানীয়দের জনে জনে যখন জানতে চাই "আর কতদুর?" তারা সবাই, যে দুরত্বেই হোক না কেন, বলে , "ব্যস, পঁহুচ গয়ে আপ, পাস হী তো হ্যায়"।
    *******************************************
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:০৬600354
  • ******************************************************
    -"জান, আমরা বশিষ্ঠ এসেছিলাম মানালি থেকে হেঁটে হেঁটে।"
    -"ধেত, এতটা রাস্তা, হাঁটা যায় নাকি? গোলি দিচ্ছ।"
    -"আরে না, তখন বয়সটা ভাবো। ঐ তো দ্যাখো ঐ ছেলেগুলো হাঁটছে।"
    -"হুঁ,সে অবশ্য ঠিক। তবে শর্টকাট আছে নিশ্চয় কোনো।"
    ছিল তো, আমরা জানতাম না। ফেরার পথে জেনে ফিরেছিলাম, আপেল বনের মধ্যে দিয়ে, অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে। পরে শুনেছিলাম সেখানে লেপার্ড বেরোয় মাঝে মাঝে।

    রোহতাং থেকে ফেরার পথে গেলাম বশিষ্ঠে। অবশ্য রোহতাং অবধি যাওয়া যায়নি, তার প্রায় কুড়ি কিলোমিটার এদিক থেকেই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া আছে। বরফ গললে খোলা হবে, সেই জুনে। কাল রাতেও বৃষ্টি হয়ে গেছে, হয়ত বরফও পড়েছে ওপরে। আজ তবে সকাল থেকেই ঝকঝকে সোনা রোদ ছড়িয়ে গেছে সারা ভ্যালিতে। পাইনের গান আর বিয়াসের সঙ্গত, মিলেমিশে এক অপার্থিব সুরে ভরে আছে আকাশবাতাস।
    বরফে যাওয়ার পোষাক ও তার সঙ্গে স্কিইংয়ের প্যাকেজ অফার নিয়ে দুধারে সারি সারি দোকান বসে আছে। আমার বড়ই আপত্তি ঐ পোশাক পরায়, সব দেখলেই কেমন নোংরা মনে হয়। এদিকে ড্রাইভার থেকে শুরু করে দোকানদাররা সবাই কানের কাছে গুনগুন করছে, বরফে নামলে কাদা ইত্যাদিতে জ্যাকেট প্যান্ট সব খারাপ হয়ে যাবে। অনেক দোকান দেখে নাকচ করে দেওয়ার পর ড্রাইভার মরীয়া হয়ে একটা দোকানে এনে ফেলে খুব রেগে বলল,
    -"এখানেও যদি পছন্দ না হয় কিছু করার নেই, এখানে সেলিব্রিটিরা আসে"।
    কে সেলিব্রিটি, তারা কোথাকার, ইত্যাদি না জানলেও এখানে পোষাক দেখে পরিস্কার মনে হল, দক্ষিনা বেশী কী কম জানিনা। কিছুদুরে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে একটি জলধারা, কুণ্ড, নাম নেহরু কুণ্ড। সত্যি মিথ্যে জানিনা, নেহরু নাকি এখানকার জল ছাড়া খেতেন না, হেলিকপ্টারে ক্যান ভরে রোজ জল নিয়ে যাওয়া হত এখান থেকে। এদিকে কোনসময় থাকাকালীন এই কুণ্ডের জল খেয়ে তার শরীর ভালো হয়ে যায়, তিনি তরতাজা অনুভব করেন, তার পর থেকেই এই ব্যবস্থা। এসবই ড্রাইভারের গপ্প, এর সত্যতা যাচাই করে দেখার চেষ্টায় যাইনি।

    এখানে যত ওপরে উঠি তত দেখি আপেল গাছ সব ফুলে ফুলে ভরে গেছে, আবার গোলাপে শুধু কুঁড়ি এসেছে যেখানে নীচে গোলাপ ফুল ফুটেছে আর আপেল গাছ খালি এখনো।
    মাড়ি গ্রামের কিছু আগে গাড়ি থেমে গেল। এই প্রথম একটা জায়গায় যাকে বলে লোকে লোকারণ্য তাই দেখলাম। আগের বারে পুজোর পরে এসে শুধু বাঙালী ট্যুরিস্ট দেখেছি, এবার মহাবীর জয়ন্তী উপলক্ষ্যে যেদিকে তাকাই শুধু গুজরাতী ভৌদের দল।
    তবে তাই বলে বঙ্গ কিছু কম পড়েনি। আগেরদিন নাগর ক্যাসলে লাঞ্চ করতে গিয়ে আশেপাশে কয়েকটি আমার দেশের দল ও একটি শ্বশুরবাড়ীর দেশের দল পেয়েছিলাম। বাঙালী দলে একজন লোক সবাই কে কী কতটা খেয়েছে দেখে বিলের অ্যামাউন্টে কত টাকা কার ভাগে যাবে তার হিসেব করছিল খুব সিরিয়াস হয়ে আর মালয়ালীরা একটুও মালয়ালাম না বলে ভুল হিন্দি ও ইংরেজীতে কথা বল্‌ছিল নিজেদের মধ্যে। দলের বাচ্চাটা মুখ না খুললে ওরা দক্ষিণের ঠিক কোন রাজ্যের আমরা জানতে পারতাম না!

    তার আগে রাস্তা এত ভালো লাগছিল, পাহাড়ে ঘেরা, পাক দিয়ে দিয়ে যত উঁচুতে উঠছিলাম তত বরফ কাছে আসছিল। এই জায়গায় পৌঁছে সমস্ত ভালো লাগা অন্তহৃত হয়ে গেল। ঘোড়া, গাড়ি, লোকজন সব মিলে একেবারে নরক গুলজার!
    যেদিকে লোকে যাচ্ছে হেঁটে বা ঘোড়ায় সেই রাস্তা এত নোংরা যে চলার ইচ্ছেই হলনা। ফিরে যে যাব, ড্রাইভার আমাদের ওখানে ছেড়ে গাড়ি পার্ক করে উধাও, এদিকে কোনো মোবাইলের নেটওয়ার্ক কাজ করছেনা।
    শেষমেশ ও পথে না গিয়ে গাড়ির রাস্তা ধরে একটু একটু করে এগৈ, যতটা যাওয়া যায়। কিছুদুরে গিয়ে এল মাউন্টেন বাইকের দল, তারা নিয়ে যাবে একেবারে শেষ পর্যন্ত, যেখানে ঘোড়ার দল বা হাঁটাপথে লোক যাচ্ছে তারও আগে।
    এতদুর এসে যখন ফেরার পথও বন্ধ আপাতত, তখন অগত্যা তাতেই চড়ে বসি।
    ভালোই হয়, ওরা অনেকটা এগিয়ে দেয়, সেখানে লোকের ভিড় অনেক কম। এরপরে কিছুটা হাঁটলে সব পাওয়া যায়, বরফ, পাহাড় আর নির্জনতা। মনের সুখে আমরা বরফে ঘুরে বেড়াই, পা পিছলাই, পোশাকগুলো সত্যি খুব কাজে লাগে।

    রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে ডিম ম্যাগি কফি চা নিয়ে টেবিলে অস্থায়ী দোকান খুলে বসে আছে স্থানীয় ছেলেরা। যে ছেলেটি সব শেষে আছে তার কাছে গিয়ে বসি। আঠের উনিশের হবে, বাচ্চাই। নীচে হাত দিয়ে দেখাল, যেখানে আমাদের গাড়ি থেমেছে, সন্ধ্যে হলে সেখানে নেমে গিয়ে বনে তাঁবুতে থাকে, আবার সকালে হলে পশরা নিয়ে ওপরে ওঠে। খিদে ছিলনা, তবু ওকে ম্যাগি করতে বলি। মান্ডিতে কথা হচ্ছিল একজনের সাথে, বাইরের লোক, খুব জোর দিয়ে বললেন, আমাদের দেশে পাহাড় এত গ্রসলি নেগলেকটেড। এত বছর হয়ে গেছে কোনো সরকার কিচ্ছু করেনি এদের জন্যে। প্রতিটি বেসিক জিনিসের জন্যে এদের এত সংগ্রাম করতে হয় প্রতিনিয়ত।
    সেই কথা মনে পড়ল, এই বয়সের ছেলের কী এরকম একটা জীবন হওয়া উচিত, জঙ্গলে দিনের পর দিন পরিবার থেকে দুরে, কতটুকু রোজগার হয়! শীতকালে যখন এদিকে ট্যুরিস্ট আসেনা তখন এরা কী করে কে জানে!

    গাড়িতে ফিরে ড্রাইভারকে উধাও হওয়ার জন্যে বকা দেওয়া হলনা। ভালোই হয়েছিল, নাহলে হয়ত অতদুর যাওয়া হতনা, ফিরে যেতাম। এছাড়া এদের এই পাহাড়ের সাধারন লোকেদের সঙ্গে আলাপ হওয়া থেকে আমাদের দুজনেরই যাকে বলে খুব ফীল হচ্ছে, কিছুই করতে পারিনা শুধু খারাপ লাগা ছাড়া। ফেরার পথে কোঠিতে ( এদিকের শেষ গ্রাম) গাড়ি দাঁড় করায়, একটি খাওয়ার জায়গায়। ম্যাগি খেয়ে আমাদের খিদে নেই, সঙ্গী ড্রাইভারকে খেতে বলে তার সঙ্গে যায় বিল মেটাতে ও কফি খেতে। ফিরে এসে জানায় যে সার্ভ করছিল সে কমান্দের ছেলে। আমরা মান্ডি আই আই টি থেকে আসছি শুনে নাকি খুব ধরেছে সেখানে একটা কাজ করে দিন, এখানে একদম লোক আসেনা, দোকানের লাভ থাকেনা বলে ওরা মাইনেও পায়না ঠিকমত। বাড়ি থেকে এতদুরে এসেছে, কিন্তু নিজেরই খাওয়ার পয়সা নেই, বাড়ি পাঠানো তো দুরের কথা।

    রোহতাং থেকে আমাদের নিয়ে গেল সোলাং ভ্যালি, সেখানে নাকি সব অ্যাডভেনচার স্পোর্টসের বন্দোবস্ত আছে ট্যুরিস্টদের জন্যে। এর আগে এ জিনিস ছিল বলে মনে পড়েনা। তাড়াতাড়ি মানালি ফিরে কী হবে, তাই গেলাম। সোলাংয়ের পথে দেখলাম টানেল তৈরীর কাজ চলছে, পুরো হলে রোহতাং পাসের ওপর ভরসা না করে সারা বছরই ওদিক যাওয়া যাবে।
    প্যারা গ্লাইডিংয়ের নামে ধুলোর ওপর গড়াগড়ি দেওয়া দেখেই ভক্তি চলে গেল। একটি প্রাইভেট সংস্থা রোপওয়ে চালাচ্ছে, একটু উঁচুতে পাহাড়ের ওপর নিয়ে যায়। দেখে ভালৈ লাগল, গেলাম।
    আমার জীবনের একমাত্র রোপওয়ে চড়ার অভিজ্ঞতা রাজগীরে, খোলা চেয়ারে, মায়ের কোলে। এমন নাকি নীচে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছিলাম যে মা সারাক্ষণ ভয়ে কাঠ হয়ে ছিল এবং ফেরার পথে আমাকে শক্তপোক্ত বড়মামার হাওয়ালে করে দিয়েছিল। যদিও সেটা যে বয়সে তা আমার মনে থাকার কথা নয়, বললে কেউ বিশ্বাস করেনা কিন্তু আমার কেমন যেন মনে আছে। এর পরে রোপওয়ে আছে এমন অনেক জায়গায় গেছি কিন্তু আমি চড়িনি।

    এখানে কী মনে হল চড়লাম। ওপর থেকে নীচে সোলাং ভ্যালি দেখতে ভালো লাগে, এখানে ওখানে ধুলোমাখা বরফও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক সেদিকে তবে লোকে যারা যাচ্ছে তারা গিয়েই ওপরে একটা ছোট চায়ের জায়গায় চা চিপস খেতে বসে যাচ্ছে, তার আগে অবশ্য নোংরা বরফে শুয়ে বসে ছবি সেশন হচ্ছে খানিক।

    বশিষ্ঠ না গেলেও হত, মন্দির বা কুণ্ড এসবে আমাদের কারো কোনো উৎসাহ নেই তবু গেলাম সেই অনেকদিন আগেকার হেঁটে হেঁটে বশিষ্ঠ যাওয়ার স্মৃতিটা একটু তাজা করতে। মন্দির বন্ধ ছিল, ভুল করে কুণ্ডে মেয়েদের দিকে ঢুকে পড়ে চোখ ফিরিয়ে পালিয়ে আসি, আগেরবারে এমনটা দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে না। তবে এক স্থানীয় বিগ্রহের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার দর্শন হয়ে যায়, বশিষ্ঠে এসেছে ঠাকুর চান করতে। সুন্দর সাজানো দোলা, বিরাট বিরাট শি ঙা ঢোল করতাল আর নৃত্যরত ব্রাহ্মণ, বিদেশীরা দেখি মহা আনন্দে ফোটো তুলছে।
    *****************************************************
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:১৭600355
  • **************************************************************
    দলবেঁধে বশিষ্ঠে পৌঁছলাম যখন তখনই বিকেল ধূসর। বড়দের হঠাৎই খেয়াল হয়েছে মেয়েগুলোকে নিয়ে এভাবে নির্জন রাস্তায় আসা ঠিক হয়নি, ফিরতে যেখানে অন্ধকার হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি দর্শনের পাট চুকিয়ে নীচের দিকে রওনা দিই। এক হাস্যমুখ ব্রাহ্মণ পথ চলছিলেন, চলছিলেন বললে ভুল হবে দৌড়চ্ছিলেন, কারন ঢালুতে নামার সময় চলার গতিটা স্বাভাবিকভাবেই একটু দ্রুত করতে হয়। তিনি হাসতে হাসতেই আমাদের দিক নির্দেশ দিলেন, আপেল বনের মধ্যে কাচা পাথুরে রাস্তা দিয়ে নেমে গেলে বিয়াস, সেখান থেকে একটু হেঁটে উঠলেই আলোকোজ্জ্বল মানালি শহর, সময় লাগবে যে পথে এসেছি তার অর্ধেক।
    আপেলবনে তখন আপেলদের বিদায় নেবার পালা, মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আছে তোলার লোকও নেই। ঐ ম্লান হয়ে আসা দিনের আলোয় দেখে যা চোখে পড়ে দুহাত ভরে তুলে নিই, এক আধজন পাহারাদার সাড়া পেয়ে এসে দেখে আরো নিতে উৎসাহ দেয়। কিছুক্ষণ এরকম মজায় আপেল কুড়ানোর পরে দাদাদের তাড়ায় বাগান ছাড়ি।
    বিয়াসের কুল ধরে চলতে চলতে দেখি ওপেন টেরাস কাফে, দেখে সবারই খুব শ্রান্ত লাগে, মনে হয় অনেক দৌড়ঝাঁপ হয়েছে, এবার এক কাপ কফি না হলে চলা যাবেনা। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মেয়েদের আহা উহুতে উপস্থিত জন জেনে যায় কেমন করে উমদা কফির আমন্ত্রণ এক কথায় নাকচ করে এসেছি।
    সবার নালিশে বিচার করতে বসে দাদা।
    -"এ আবার কী অসভ্যতা, একজন ভদ্রলোক এক কাপ কফি খেতে বলেছেন, তুমি তাতে একেবারে দুদ্দাড় করে পালিয়ে এলে। আমার বোন এত আনস্মার্ট হতে পারে আমি ভাবতেই পারিনা। সেরকম হলে তুমি সবার কফির দাম অফার করতে পারতে।"
    সত্যিই তো, এক কাপ কফি সকালে বিকেলে, তাতে এমন করার কী ছিল! হয়ত আমাকে অফার করেছে কারন খেতে গেলে কথাবার্তা আমি বেশী বলি, ভাষা সড়গড় হওয়ার দরুন। মাঝে বোধহয় কে একবার বলেওছিল যে আমার হিন্দি খুব ভালো, সেটাই শুনে থাকবে। আমি দাঁড়িয়েছিলাম একা তাই আমাকে বলেছে, অন্য কেউ দাঁড়ালে তাকে বলত। আমার কেন যে অন্যরকম মনে হল!

    রাতে খেতে গিয়ে কিন্তু মনেই হলনা বিকেলের ঘটনার কিছু প্রভাব আছে। বড় রেস্তঁরা নয়, ওয়েটাররাও সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করে, ম্যানেজারও, এটা ওদের কাজ। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে সবাই, সারাদিনের ক্লান্তি তো আছেই, তারওপর আবার পরদিন ভোরে ওঠা রোহতাং যাওয়া। বেশী দেরী হলে নাকি রোহতাংয়ের রাস্তায় জ্যাম হয়ে যায়, গাড়ির লাইন পড়ে যায়। অবশ্য রোহতাং পাস এখন বন্ধ, আমরা যেতে পারব মাড়ি অবধি।

    ড্রাইভাররা আগের দিনের, আমাদের ভাগ হয়ে গেছিল কে কোন গাড়িতে যাবে কোন ড্রাইভার ভাইয়ার সাথে। রাস্তায় পোষাকের দোকানে বরফের পোষাক পরা। প্যান্ট জ্যাকেট জুতো আছে, তা না চাইলে ওভারকোট আর জুতো। আমার আবার একটু সর্দিমতন হয়েছে, বরফে যাবনা ডিক্লেয়ার করে দিয়েছি। প্যান্ট আর জ্যাকেট পরে সবাইকে দেখতে কিম্ভুত লাগছে, একটুও ইচ্ছে নেই ও জিনিস গায়ে দেওয়ার। তবু জোর করে ওভারকোট চাপিয়ে দেয় গায়ে, বরফে না নামলেও ঠান্ডাটা তো বিকট, আরো শরীর খারাপ হয়ে যাবে।
    এ কদিন যেখানেই যাই গাড়িতে শুধু গান বাজে, "হুসন পহাড়োঁ কা, য়ঁহা বারা মহীনা, মৌসম জাড়োঁ কা, ও সাহিবা"। এ গান যেন পাহাড়ের ন্যাশনাল অ্যানথেম। তবে এই পরিবেশে কেমন যেন এ গানকে যত মানিয়েছিল তেমন আর কোনো গানকে বোধহয় মানাতো না। প্রথম প্রথম "এমা একই গান। ইস ঐ মন্দাকিনীর মুখটা মনে পড়লেই কেমন লাগে", এসব আপত্তি পেরিয়ে কেমন একটা মায়া জড়িয়ে গিয়েছিল গানটার প্রতি। এর পরে এ গান আর আলাদাভাবে খেয়াল করে শুনিনি।

    মাড়ির একটু আগে গাড়ি থামিয়ে দেয়, সামনে দেখা যায় বরফ। সবাই হাঁটা দেয় সেদিকে শুধু আমি গাড়ির কাঁচ তুলে বসে থাকি। একটু পরে দিদি ছুটতে ছুটতে আসে, ড্রাইভার ভাইয়া দাঁড়িয়েছিল বাইরে, গল্প করছিল বন্ধুর সাথে, তাকে দিদি বলে,
    -'ভাইয়া একটু গাড়িটাকে নিয়ে চল ঐ পর্যন্ত, তাহলে আমার বোনটা বরফে যেতে পারে। কী সুন্দর বরফ চারিদিকে, সবাই খুব মজা করছে, দেখবি চল।"
    ভাইয়া চলে গাড়িটাকে নিয়ে, আস্তে আস্তে বরফের মধ্যে দিয়ে। আমি নামি, প্রথমটায় একটু অনিচ্ছায়, তারপরে মেতে যাই বোনেদের সঙ্গে। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ, যেন মনে হয় বিদেশী সিনেমা দেখছি। তার মাঝে মাড়ির একমাত্র ধাবা, তার চালও বরফে ঢাকা। লোকজন সেখানে ভিড় করছে খাবার জন্যে। বরফে জমে গিয়ে আমরা ঢুকি ধাবায়, রোগা পাতলা বলে এখান ওখান দিয়ে গলে সোজা পৌঁছে যাই উনুনের ধারে, সেখানে এক একটা রুটি গরম সেঁকা হচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছে থালায়।
    এত ঠান্ডায়, কারা দোকানের লোক আর কারা খদ্দের কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছেনা। ডাল তরকারী উনুনে বসানো, নামালেই ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমরা রুটি হাতে নিয়ে আমাদের দলের লোকেদের থালায় পাঠিয়ে দিই আগুন সেঁকতে সেঁকতে। উনুনের কাছে শুধু ধাবার দুজন রুটি মাখছে বেলছে আর কিছু ড্রাইভার ও আমরা। ভদ্রজনেরা সব অপেক্ষা করে আছে লোকে তাদেরকে খাবার সার্ভ করতে আসবে আর এদিকে সেল্ফ হেল্প পন্থায় আমাদের খাওয়া শেষ। আমাদের দল যখন সবার আগে খেয়েদেয়ে বেরোচ্ছে তখন চারিদিকে অনেক অসন্তুষ্ট মুখ আমাদের দিকে বেশ সহিংস নজরে তাকায়!

    তাড়াতাড়ি ফিরলেও সেদিন সবাই ক্লান্ত, বরফে ঠান্ডায় অনেকটা শক্তিক্ষয় হয়েছে সবারই। আমাদের অবশ্য ওসবের বালাই নেই, এমনকী বরফে খেলে টেলে হাঁচিটুকুও গায়েব।
    যদিও এই দুদিনে ধারণাটা পাকা হয়েছে যে মানালি বেশ শান্ত নিরূপদ্রব জায়গা এবং দাদারা বলছে আমরা কজন নাকি সারা মানালির সাথে ভাই পাতিয়ে ফেলেছি, রাস্তায় দুপা হাঁটলেই কোনো একটা ভাইয়ার দেখা পাওয়া যাবেই যাবে, তবুও তিনজনে একা একা বাজারে বা নদীর ওপারে ঘুরে বেড়ানো মানা।
    হোটেলের মধ্যেই নীচে নদীর ধারে বসি আমরা, শেষে যখন ঘরে গিয়ে টিভিতে সিনেমা দেখার প্রস্তাব হয় তখন সবার সঙ্গে গিয়েও ঘরে না ঢুকে পায়ে পায়ে বাইরে রাস্তার দিকে আসি। একটু পায়চারি করে ব্রিজ অবধি যাই, রাস্তায় লোক চলাচল দেখি, না ভেতর না বাহির, কোনোদিক থেকেই কেউ খোঁজেনা আমায়!
    ট্যুরিস্ট লজের দিকে যেতে গিয়ে দেখি ব্রিজ পেরিয়ে চার পাঁচজনের দল, কেমন চেনা চেনা লাগে। কাছে আসতে দেখি, সেই "উপস্থিতবুদ্ধিরা"। তারাও চিনতে পেরেছে, হয়ত সে রাতে ট্রেনে আমিই রেলকম্পানির সাথে কথাবার্তা বলছিলাম বলে, মনে আছে।
    -"কোথায় উঠেছেন?" ওদিকে বারান্দায় দলপতি এসে দাঁড়িয়েছে, আমাকে অচেনা লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে দেখে সেখান থেকেই চেঁচিয়ে ডাকছে। সেভাবেই চড়া ডেসিবেলে আলাপ পরিচয়ের পাট সারা হলে এদের আমন্ত্রণ এল লজ থেকে, ওপরে উঠে ঘরে আসার জন্য, আমিও গেলাম সাথে সাথে। ওরা শহরের ভেতরের দিকে কোন হোটেলে উঠেছে, ট্যুরিজমে বুকিং পায়নি, লোকেশনটার খুব তারিফ করতে লাগল, বিয়াসের এত কাছে।
    তাদের ওঠার বেলায় হোস্ট ভদ্রতা দেখিয়ে তাদের কাঁচঘরে চা খেতে নিয়ে যেতে চাইল, মানা না মানার পালা শেষে সবাই যাচ্ছে যখন, আমার দিকে খেয়াল হল তাদের, "তুই তো চা খাসনা, যা সন্ধ্যে হচ্ছে, ঘরে যা। ওরা সব কোথায়, একা একা ঘুরিস না।"
    আমি আর বলতে পারিনা, চা না খেলেও কফি তো খাই, হায়!
    *******************************************************************
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:২৫600356
  • *******************************************************
    "হিড়িম্বা টেম্পল আপনারা দেখে নিয়েছেন না যাবেন?" ড্রাইভারের সঙ্গত প্রশ্ন, আমরা মন্দিরের কাছেই থাকি, একটু ওপরে উঠলেই মন্দির। তখন আর হাঁটতে ইচ্ছে করছেনা, তাই গাড়িতেই যাওয়া স্থির করলাম। মন্দিরটা মনে আছে খুব শান্ত ঘনঘোর পরিবেশে ছিল, মানে ঘন পাইনবন ঘেরা। গিয়ে দেখি মন্দির চত্বরে মোদী বাবুর দেশের লোকেরা হুড়দুম মচিয়ে রেখেছে। দুপুর থেকে মাঝে মাঝে অল্প বৃষ্টি হচ্ছে তাই রোদের তেজ তেমন নেই, তার ওপরে এত বড় বড় গাছ যে আকাশ প্রায় দেখাই যায়না। সবাই পাথরে দাঁড়িয়ে, সিঁড়িতে বসে দৌড়ঝাঁপ করে নানা পোজে ফটো তুলতে ব্যস্ত। মন্দিরেও পুজো করার জন্যে লম্বা লাইন।
    ব্যাপার দেখেশুনে আমরা সেখান থেকে পালাই, বনবিহারে। পাইন বনের কিছুটা ঘিরে সেখানে ঢুকতে পাঁচ টাকার টিকেট নিচ্ছে। তবে ঐ টিকেট নেওয়ার কারণে হোক বা যে জন্যেই হোক, সেখানে ভিড় নেই। মনের সুখে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াই, পাইনের গন্ধ মেখে মাটিতে বসে থাকি।

    অদ্যই পালা শেষের পালা, পরদিন ফিরতি যাত্রা শুরু। কিছু কেনা উচিত, কিন্তু কী কিনব মনে পড়েনা। মনে আছে সেবার খুব আপেল জুস খেতাম। কলকাতায় তেমন জুস আর পাইনি বলে সে শখের ইতি হয়। এবারে খাওয়া হয়নি এখনো, চল তবে এইচ পি এম সির স্টলে। তার আগে ড্রাইভারের ইচ্ছায় গেলাম ক্লাব হাউসে,
    এটি এবারের নতুন। মনালসু নদীর ধারে, ওরা বলে এ জায়গা নাকি ওল্ড মানালি। এনট্রি টিকিট নিয়ে ভেতরে ঢুকে, এক চত্বরে কিছু দোকানপাট, সরকারী বেসরকারী, বাচ্চাদের নানা খেলার জায়গা, একটি বিল্ডিংয়ে অডিটোরিয়াম, ট্যুরিজমের রেস্তঁরা আর ডিসকো থেক।
    কুলু থেকে নাগর, প্রত্যেক জায়গায় এইচ টি ডি সি র হোটেলগুলোর খাবার খুব ভালো দেখেছি। খেলাম গ্রিলড স্যান্ডউইচ,গ্রিলড ট্রাউট আর কফি। মানালিতে চারিদিকে ছড়িয়ে ট্রাউট ফার্ম, সেখানে এসে ট্রাউট না খেয়ে গেলে অপরাধ মানা হবে শুনলাম, খুবই সুস্বাদু ছিল।

    ক্লাবহাউস থেকে বেরিয়ে গাড়ি আমাদের ম্যলে ছেড়ে দিল। একটু এদিক ওদিক ঘুরছি, এইচ পি এম সির একমাত্র স্টল বাসস্ট্যান্ডে, সেখানেও তেমন কিছু প্রডাক্ট নেই, তাই হতাশ। হঠাৎ একটা বোর্ড দেখিয়ে সঙ্গী বলে, এটাও দেখছি সরকারী, কিসব ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ারের দোকান, ওখানে যাবে, কিছু পাওয়া যেতে পারে।
    কিন্তু সে বোর্ড শুধুই বোর্ড, দোকান অন্য কোথায়, অন্য কোনোখানে। জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছই সিঁড়ির কাছে। যে অটো ওয়ালা দেখিয়ে দেয় তার দিকে অবিশ্বাসে তাকাই। "ওটা তো ট্যুরিজমের রেস্তঁরা, ঐ কাঁচঘর।"
    -'নহী ম্যাডাম, ওটাই দোকান, আপনারা যা খুঁজছেন।"
    দুধাপ নেমে থমকে দাঁড়াই, সেই কাঁচের দরজা, দেওয়ালে ডিসপ্লেতে নানা জিনিস ঝুলছে। আমি এই কদিনে আসিনি কেন এইদিকে? আজই বা এলাম কেন?

    সঙ্গী নেমে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়। একটি ছেলে বেরিয়ে এল, আস্তে আস্তে নামি, তাকেই জিজ্ঞেস করি, "এখানে রেস্তঁরা ছিল না?"
    - "না, ম্যাডাম।"
    ছেলেটা বাইরে একটা টুলে বসে গুনগুন করে, "হুসন পহাড়োঁকা, ও সাহিবা"।
    আমার গায়ে কাঁটা দেয়, একদিন ঘুরে বেড়ানোর সময় কী যেন নেই, কী একটা বাদ যাচ্ছে মনে হচ্ছিল বারে বারে। এখন মনে হল, এই তো এই গানটা। এই অল্পবয়সী তরুনের কাঁচঘরে আগে কী ছিল জানা নেই অথচ সেই কবেকার গান মনে আছে!
    ভেতরে ঢুকি, সেই কাঠের মেঝে, কাঁচঘেরা। সামনের রান্নাঘরের এলাকাটায় মজুত জিনিসপত্র ডাঁই করে রাখা আছে। সোফা, নীচু টেবিল নেই, তার জায়গায় সারা হল জুড়ে সাজানো নানা পোষাক শোপিস, অন্যান্য অনেক দ্রব্য, সারা দেশের আদিবাসীদের তৈরী জিনিসপত্রের সম্ভার।

    আমি ঘুরে বেড়াই দিশেহারা, খুঁজে বেড়াই। এতদিন হয়ে গেছে, এতটা সময় পেরিয়ে গেছে?
    মেয়েটি আমার সাথে ঘোরে, "এটা দেখুন ম্যাডাম। ঠিক কী খুঁজছেন আপনি?"
    -"এখানে আগে এসেছিলাম আমি, তখন এটা একটা রেস্তঁরা ছিল।"
    এটা আশা করেনি, একটু অবাক হয়ে বলে,
    -"সে তো মনে হয় অনেকদিনের আগের কথা। আপনি কবে এসেছিলেন? বচপনে?"
    আমি হেসে ফেলি।
    -"না, বচপন নয় তাহলে তো দায় ছিলনা। বালপন বলতে পারো, বালি উমর..........!
    কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকাই, গাছগুলো বোধহয় সেদিনও ছিল, আর বিয়াস। সেদিনের সেই বিয়াস আজও একইরকম আছে, অপরিবর্তিত। এ যাত্রায় শুধু বিয়াসকেই মনে ধরে নিয়ে যাই, আবার কোনো হাজার বছর পরে এলেও সে থাকবে আমার জন্যে!
    ************************************************************************
  • Blank | 180.153.65.102 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:২৮600357
  • বাহ ....
  • শ্রাবণী | 134.124.244.107 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৩৩600358
  • *********************************************************
    "আজ আর কোনো গাড়িটাড়ি নয়, এত সুন্দর জায়গা, পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াব সবাই"। সকালে ধীরেসুস্থে বেরৈ আমরা, ব্রেকফাস্ট আজ বাজারের দোকানে, আলু পরোটা। সেখান থেকে আবার লোকে একপ্রস্থ কেনাকাটা করতে ঢুকে পড়ে। কোনোরকমে তাদের সেখান থেকে বার করে নিয়ে যাওয়া হয় মনাস্ট্রিতে।
    আমি এর আগে কোনোদিন কোনো বুদ্ধিস্ট মনাস্ট্রিতে যাইনি, কর্পুর আর মোমবাতি পোড়ার গন্ধে কেমন আমেজ আসে। "যত কান্ড কাঠমান্ডুতে"র জপযন্ত্র চাক্ষুষ দেখেও মহাখুশী, ঘুরিয়ে যাই বারবার। এদিকে একদল তখন মনাস্ট্রির রাস্তায় বাঙালী খাবারের হোটেলের সন্ধান পেয়ে পুলকিত, সেখানে আবার বাইরে বোর্ডে নাকি আলুপোস্ত লেখা আছে। শেষদিনে দেখি সব খাবারই বাইরে বাইরে খাওয়া হচ্ছে। সবার সঙ্গে মুখ বেজার করে খেতে ঢুকে মজা লাগে। আলুসেদ্ধর ওপর পোস্ত ছড়ানো দেখে সন্ধানীরা যাকে বলে খেপচুরিয়াস, এই নাকি আলুপোস্ত, খাবারও বিচ্ছিরি। যাক, অন্তত ডিনারটা কাঁচঘরেই হবে সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, শেষ দিনে আস্ত মুরগীর রোস্টের অর্ডার দেওয়ার কথা হয়ে গেল।

    খেয়েদেয়ে একটু এদিক ওদিক ঘুরে শুরু হল হিড়িম্বা যাত্রা। সেসময় তো এ একটা মজার ব্যাপার, হিড়িম্বার মন্দিরই শুধু নয়, পাশে আছে তার ছেলে ঘটোৎকচেরও মন্দির। পাহাড়ের সব হিসেবই কেমন আলাদা, আমাদের সমতলের সঙ্গে মেলেনা।
    ওঠার মুখে একটা দোকানে আপেল জুস খেয়ে শক্তিস্ঞ্চয় করা হল। সেদিনের শহরের মত হিড়িম্বা মন্দিরের ওখানেও লোকের ভিড় ছিল নগণ্য, গা ছমছমে শান্ত চারধার। বসলাম গিয়ে মন্দির চত্বরে সবাই মিলে। এমন একটা জায়গায়, পরিবেশে কেউ বেশী কথাও বলছিল না। খুব খুব অন্যরকম একটা জায়গা, শান্তির, আরামের।

    নামতে নামতে দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেল আর নেমেই কেমন দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। সবারই কিছু না কিছু বাকী রাখা কাজ মনে পড়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডে পরের দিনের বাসের ঠিকঠাক সময় জানতে গেল কজন। কেনা সোয়েটার ছোট বা বড় হওয়ায় পাল্টাতে গেল এক মেয়েকে নিয়ে তার মা, শেষ মুহূর্তের কেনাকাটিতে গেল আরেকদল। এমনিভাবে আমি কখন যেন কার পেছনে হোটেলের দিকে চলি। সিঁড়ির মাঝামাঝি ধাপ পর্যন্ত নেমেছি কোনোদিকে না তাকিয়ে, কাঁচের দরজা খুলল, হ্যান্ডেলে হাত রেখে প্রায় সেদিনের মত হেসে,
    -"কফি?"
    হেসে ফেলি,
    -"আমি খাওয়াব।"
    -"সে দেখাযাবেখন।"
    -
    -
    -"যখন বরফে ভরে যায় মানালি, তখন কী করেন"?
    -"ঘর থেকে বেরোনো যায়না, মোটামুটি ঘরেই থাকি। কাজকম্মও থাকেনা বললেই চলে, সব বন্ধ থাকে।"
    -"বোর লাগেনা?"
    -"না মনে হয়। বরফ না পড়লে বরং খারাপ লাগে। সাহিবা, পাহাড় এরকমই, এখানে বারা মহীনা, মৌসম জাড়োঁ কা। "
    -"খুব সুন্দর এই পাহাড়ের দেশ।"
    -"পাহাড়ী মানুষেরাও ভালো, তাদের সঙ্গে কফি খেলে দোষের হয়না।"
    -
    -
    -
    -
    ********************************************************
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৪০600359
  • ****************
    সকালে ব্রেকফাস্টের পর মালপত্র গাড়িতে তোলা হয়। হোটেলের ম্যানেজার গিরি এসে দেখা করে, প্রথমদিন থেকেই অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার ছিল। বারবার আফশোষ করতে লাগল, ওদের কিচেনের বিখ্যাত পিৎজা খাওয়াতেপারল না বলে।
    -"মান্ডিতে তো তোমাদের আত্মীয় আছে, তাহলে আবার চলে এস। এলে এখানেই থেকো, তোমাদের জন্যে ডিসকাউন্টেড রেট আমার হোটেলের!" এরকম উদার আমন্ত্রণ পাহাড়ের পাহাড়ীরাই বোধহয় পারে জানাতে।
    টেম্পল রোড থেকে নামি, ক্লাবহাউসকে পাশে রেখে, নদীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে গিয়ে ঘুরে দেখে নিই একবার, আবার কত বছর পরে আসার কথা কে জানে!
    হয়ত আর হবেনা, এই শেষ, বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়ে গেল। কিংবা হয়ত আসব আবার এক শীতের শুরুতে, বরফে ভরা মানালির রূপ দেখতে, হুসন পহাড়োঁ কা!

    বিয়াসের সাথে এসেছিলাম, ফিরে চললাম তারই সাথে, ঠিক ফিরে নয় উড়ে চললাম। কখন কিভাবে মান্ডি পৌঁছলাম টেরও পেলাম না, মনে হল এমা এতটুকু সময়!
    উজানে যে টান ছিল, ফিরতিতে তাতে ভাটা। তবু একেবারে বাড়ি না ফিরে মান্ডিতে আর একদিনের মেয়াদ, ফেরাটা সহজ করে দেয়।

    সারাদিন অনেক গল্প হয়, চেনা দু একজনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়ে ভালো লাগে।
    আরো ভালো লাগে যখন শুনি ক্যাম্পাসের ফার্স্ট লেডি, তার বাংলো আমার খুব খুব পছন্দ হয়েছে শুনে খুশী হয়ে এমন মতও প্রকাশ করেছেন যে ঐ টিলাটায় যে বাড়ি বানানো হবে সেখানে আমি এলে আমাকে থাকতে দেবেন!
    আমি শুনে ভাবি এতকাল কী করে ভুলে ছিলাম আমি এই পাহাড়কে, পাহাড়ী টিলার নীচে বয়ে যাওয়া নদীকে, পাইন আর রডোডেনড্রনকে। সেবারে কে কত পাইন ফল কুড়োতে পারে তার প্রতিযোগীতা ছিল, সেসব বয়ে নিয়ে গিয়ে অনেকদিন সাজানো ছিল ঘরে। তারপরে যেখানে পাহাড়ে গেছি পাইনফল খুঁজেছি, পেলে কুড়িয়েছি কিন্তু মন ভরেনি, সেই প্রথম বারের মত সুন্দর ফল পরে আর কোথাও পেলাম না।
    আজ এতদিন বাদে আবার সেই পাহাড়ে তবু আমি একটাও পাইন ফল কুড়ৈ না। এত ভার বইবার মত জোর আর নেই যে!

    সকালে তাড়াতাড়ি বেরোই, অনেকটা পথ যেতে হবে। যদিও জানি কয়েক হপ্তা পরেই দেখা হবে তবু এ ছিল বিদায় বিষাদের নিমেষ। ব্রেকফাস্ট করে সব নিজে হাতে গুছিয়ে দিই যতটা পারি, একদিনের কাজ হলেও। ঘর থেকে কার পার্কের দিকে যেতে গিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি উঠলে ছোট একফালি বাগান। এই কদিনে অনেকবার এপথ দিয়ে যাতায়াত হয়েছে। কখনো বটলব্রাশ দেখে দাঁড়িয়েছি, কখনো বা ডেকে দেখিয়েছে বড় বড় ধুতরো ফুল। মানুষটাকে জানি খুব শক্ত, কড়া, যার ছাত্ররা আমাদের সঙ্গে কথা হলে কখনো বিস্ময়ে বলেই ফেলত আগে, "ওনার সঙ্গে একই বাড়িতে থাক তোমরা ? ভয় করেনা?"
    তৈরী হয়ে ক্লাস নিতে যাবার আগে আমাদের বিদায় দিতে এসেছে। পাশে পাশে গাড়ির দিকে চলতে চলতে একথা ওকথা, হঠাৎ নীচু হয়ে মাটিতে বিছানো হলুদ ফুলের থেকে একটা ডাল তুলে নেয়, "এই দ্যাখ, সিলভার ওকের ফুল, নে নিয়ে যা, আগে দেখিসনি তো?"
    আমি আর বলিনা, এ কদিন রোজ দেখছি, আগেও দেখেছি। দু হাত পেতে নিই যা সে শুধু সিলভার ওকের ফুল কেন হবে, সে আমার অনেক কিছু। গাড়ি চলতে থাকে, সিলভার ওকের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে ব্যাকুল বিষাদজড়ানো সময়। সে দিকে তাকিয়ে মনে হয় ফিরে আসতেই হবে এখানে, আবার।
    গাড়ির পেছনের সিটে এ কদিনে জড়ো হয়েছে নানা রকমের ফুল, রডোডেনড্রন, কুরাল, পলাশ, গোলাপ, তাদের পাশে আজকের সিলভার ওক।
    দুদিনেই শুকিয়ে যাবে, এই ঠান্ডার পরিবেশ থেকে বেরোলে, তবু যতদিন থাকে গন্ধ, থাক গাড়ির অন্দরে বা আমার হৃৎবাগানে। কতদিন? বছর কুড়ি,........ একুশ....... বাইশ -----------যতদিন না বিয়াস ডাকে, ততদিন!
  • | 126.203.138.89 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৪১600361
  • শ্রাবনী দির লেখা । তাই একটু একটু করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে পড়ছি। তারপরে মিনিময় করবো।

    এখন অবধি যা বুঝেছি

    ১। লেখিকা এই সফরে ডায়েটিং কে তুড়ি মেরে ওড়িয়ে দিয়েছিল।

    মান্ডি টা কমন ছিল না। গাঁথিয়ে নিলুম।
  • নেতাই | 131.241.98.225 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৪২600362
  • আমিও তাড়িয়ে তাড়িয়ে পড়ছি।
  • siki | 132.177.195.193 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৪৮600363
  • সবকটাকে ধরে ক্যালানো উচিত। মার্সিলেসলি। :X
  • de | 190.149.51.66 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৫১600364
  • কি তাড়িয়ে তাড়িয়ে পড়ছে সবাই? শ্যামাপোকা?

    চলুক শ্রাবণী -- খুব ভালো হচ্ছে --
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৫২600365
  • (শেষ) :))
  • siki | 132.177.195.193 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৫৪600366
  • সেই দুহাজার চারে গেছিলাম মানালি। আজও চোখে লেগে আছে। তখন লোকের ভিড় ছিল আরও কম। শুধু বিয়াসের ধারে বসেই সারাটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।

    হিড়িম্বার লোকাল নাম হল হাড়িম্বা। ওখানে বলে হাড়িম্বা টেম্পল। নব্বই দশকের সেই বিখ্যাত সিনেমা, রোজা, যেখানে অরভিন্দ স্বামীকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে টেররিস্টরা রোজার চোখের সামনে থেকে, সেটা এই হাড়িম্বা টেম্পলেই শুট করা।

    মানালির মল্‌এর খুব পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে অ্যালেও নামে এক নদী। আমরা ছিলাম সেই অ্যালেও নদীর ধারে এনএইচপিসির গেস্টহাউসে।

    অ্যাপার্ট ফ্রম দ্যাট, শ্রাবণীর লেখা, আবার আবার খুব ভালো লাগল। লেখাটা কি এইখানেই শেষ করে দিলে?

    যদি সম্ভব হয়, টোটাল ড্রাইভিং রুটটা একটা ম্যাপ করে দিয়ে দেবে এখানে? মান্ডি, মানালি, শিমলা, কোনটা কার থেকে কত দূরে, কীভাবে যাওয়া যায়, কতক্ষণ লাগে ... এইসব?
  • de | 190.149.51.66 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৫৫600367
  • যাঃ!! আমি এই খুলে সবে দুটো এপিসোড পড়লাম -- ঠিক হ্যায় -- বাকীগুলো পড়ে নিচ্ছি--
  • siki | 132.177.195.193 | ০৩ মে ২০১৩ ১৬:৫৭600368
  • পড়ো পড়ো, তুমি যেন আবার "তাড়িয়ে তাড়িয়ে" পোড়ো না। :)
  • শ্রাবণী | 127.239.15.28 | ০৩ মে ২০১৩ ১৭:০৫600369
  • শমীক, সতীশকে বলব রুট ম্যাপের জন্যে। লিখেইছি আমরা ঘুরপথে গেছি, মান্ডিতে ইউজুয়ালি কেউ থাকেনা গিয়ে।

    লেখা শেষ তো বটেই, বেড়ানোর মধ্যেই শুরু হয়েছিল, এখানে দেব কিনা সেটা ডিসাইড করতে পারছিলাম, আজ হাতে সময় ছিল দিয়ে দিলাম।
  • a | 132.172.179.22 | ০৩ মে ২০১৩ ১৭:২৬600370
  • সাধে কি আর পাখা হইসি!!! দারুন দারুন
  • san | 69.144.58.2 | ০৩ মে ২০১৩ ১৮:১৩600372
  • চমৎকার !
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন