এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  গান

  • বসন্তের ভিসা-পাসপোর্ট ঃ ঘর ছাড়া এই পাগলটাকে

    শিবাংশু
    গান | ১৯ এপ্রিল ২০১৩ | ১৭৭৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • শিবাংশু | 127.197.253.75 | ১৯ এপ্রিল ২০১৩ ২৩:৪০601409
  • 'সবিতা, মানবজন্ম আমরা পেয়েছি
    মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে...' (জীবনানন্দ)

    দিনের বেলা বেশ গরম। সন্ধে হলেই উত্তাল হাওয়া দেয়। সান্ধ্য ভ্রমণে যখন নতুন ক্যানাল রোড দিয়ে হেঁটে বেড়াই ঐ হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিয়ে দিয়ে যায়। সমুদ্রের শীতল হাওয়া, কিন্তু এখনও বাষ্পাকুল হয়ে ওঠেনি। এই হাওয়াটাই মনে করিয়ে দেয় বসন্ত এখনও তার মায়া ছড়িয়ে চলেছে। একেই কি কোমল মলয়সমীর বলে, ললিতলবঙ্গলতাকে স্পর্শ করা তার পরিশীলিত প্রেম ?

    ২.

    ললিতলবঙ্গলতা পরিশীলন কোমলমলয় সমীরে।
    মধুকরনিকর করম্বিতকোকিল কূজিতকুঞ্জকুটীরে ।।
    বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে।
    নৃত্যতি যুবজনেন সমং সখি বিরহিজনস্য দুরন্তে ।।
    ( বসন্তরাগ যতিতালাভ্যাং গীয়তে) (গীতগোবিন্দমঃ জয়দেব)

    বহুদিন আগে সামনে বসে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের থেকে জয়দেবের এই শ্লোকটি গলায় তুলেছিলুম। জয়দেব গোস্বামী বলেছিলেন শ্লোকটি গাইতে হবে রাগ বসন্ত, তাল যতি, যাকে সংক্ষেপে যৎও বলা হয়, সেই ভাবে। রামকুমার বলেছিলেন, তাঁর তরুণ বয়সে বনারসে বড়ি মোতিবাইয়ের কাছে শেখা এই গান, এক হোলির পূর্বসন্ধ্যায়। সুরের এবং সংরচনার জাদু এমন, এই গানটি শ্রোতাকে, এমনকি গায়ককেও যেকোনও ঋতুতে বসন্তের কাছে নিয়ে যেতে পারে। তিনি যৎ তালে গাইতেন না। প্রথম চরণদুটি মুক্তবিস্তারে আর তার পর রাধাকান্ত নন্দীর ( আহা, রাধাকান্ত, দু'টি রোমাঞ্চকর হাত ও সিম্পলি ডুবিয়ে দেওয়া দশটি আঙুল ছিলো তাঁর) সঙ্গতে তিনতালে 'বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে।
    নৃত্যতি যুবজনেন সমং সখি বিরহিজনস্য দুরন্তে ।।'
    ঢিমে থেকে লয় বাড়তে থাকে, রাধাকান্ত চলে যান তাঁর প্রবাদপ্রতিম উল্টো ঠেকায় আর রামকুমার নক্শা কাটতে থাকেন সুরে। চিলের ডানার মতো স্থির নৈঃশব্দ্যে বসন্ত নেমে আসে বুকের ভিতরে।

    ৩.
    'প্রদ্যোতস্য সুতা বসন্তসময়স্তংচেতি নাম্রা ধৃতি
    কামঃ কামমুপৈত্বয়ং মম পুনর্মনৈ মহানুৎসবঃ ।।'
    ( শ্রীহর্ষের রত্নাবলী নাটকে কামউৎসবে রাজার উক্তিঃ সপ্তম শতক)

    'প্রদ্যোতের কন্যা ( রতি দেবী), বসন্তসময় এবং তুমি বিদ্যমান। অতএব নাম দ্বারাই কাম পর্যাপ্ত সন্তোষ লাভ করুন। এই মহান উৎসবকে ( বসন্তকালীন কামমহোৎসবকে) নিজস্ব উৎসব মনে করছি। '

    জীমূতবাহন লিখেছিলেন দায়ভাগ গ্রন্থ দ্বাদশ শতকে। তা'তে রয়েছে হোলাক বা হোলক উৎসবের কথা। সারা উত্তর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেও এই উৎসবটির সম্যক প্রচলন ছিলো। সময়ের সঙ্গে এই পার্বণটির ক্রমবিবর্তন বেশ আকর্ষণীয় বিষয়। আদিযুগে এই উৎসবটি ছিলো কৃষিসমাজের পূজা অনুষ্ঠান। শস্যপূর্ণা চ বসুন্ধরার কামনায় নরবলি ও যৌনলীলাসম্পৃক্ত নৃত্যগীত উদযাপন ছিলো এর মুখ্য অঙ্গ। এই অনার্য ঐতিহ্যের সঙ্গে পরবর্তীকালের বৈদিক উপচার হোমযজ্ঞ মিলে যায়, নরবলির বদলে পশুবলি প্রচলিত হয়। সুশস্যকামনায় পূজা অর্চনার ক্ষেত্রে যেমন বলি ও যজ্ঞ গৃহীত হয়, একইভাবে হোলির শৃঙ্গাররসমুখর দিকটি কেন্দ্র করে বসন্ত, মদন ও কাম উৎসবের এবং রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলার উৎপত্তি হলো। এর সঙ্গে কোন এক মূর্খ রাজাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার জন-ইচ্ছাটিও প্রথা হিসেবে সামগ্রিকভাবে হোলি উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলো।

    যেরকম নথিভুক্ত ইতিহাসে দেখা যায়, তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, অর্থাৎ গুপ্তযুগের প্রাথমিক সময়কাল থেকেই ষোড়শ শতক পর্যন্ত সম্পূর্ণ পুরাণযুগে বসন্ত বা মদন বা কামমহোৎসব নামে একটি উৎসব উত্তরভারতের সর্বত্র অতিসমারোহে পালিত হতো। এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায় তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাৎসায়নের কামসূত্রে, সপ্তম শতকে শ্রীহর্ষের রত্নাবলীতে, অষ্টম শতকের মালতী-মাধব নাটকে, একাদশ শতকে অল-বিরুনির লেখায়, দ্বাদশ শতকে জীমূতবাহনের কালবিবেক গ্রন্থে এবং ষোড়শ শতকে রঘুনন্দনের বিবরণে। এই উৎসবে প্রচুর নৃত্যগীতবাদ্য, শৃঙ্গারসূচক সংলাপ ও যৌনতাব্যঞ্জক অঙ্গভঙ্গি মুখ্য স্থান নিয়ে থাকতো। পূজা অনুষ্ঠানের অভীষ্ট দেবতা ছিলেন মদন ও রতি দেবী এবং পুষ্পময় চৈত্রের অশোকবৃক্ষের ছায়ায় তার আয়োজন করা হতো। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীহর্ষের রত্নাবলী নাটকে মদন মহোৎসবে ভিজ্যুয়ালটি এইভাবের বর্ণনা করা হচ্ছে,
    'অহো, পৌরগণের আহ্লাদ অত্যন্ত উৎকর্ষ প্রাপ্ত হইতেছে, যেহেতু দিবস প্রারম্ভতুল্যকারী কুন্কুমচূর্ণবদ গৌর , বিক্ষিপ্ত পীত চূর্ণরাশি ও স্বর্ণালংকরণ দীপ্তি এবং কিণ্কিরাত পুষ্পশোভিত ভার অবনত পীত পরিচ্ছদশোভিত কৌশাম্বী নগর যেন স্বর্ণদ্রব মন্ডিত লোকযুক্ত হইয়া শোভা পাইতেছে'। (অর্থ, পীত বস্ত্রশোভিত পুরবাসীরা পীতচূর্ণরাশি ( আবির) প্রক্ষেপ করে অশোকবৃক্ষের ছায়ায় স্বর্ণমন্ডিত হয়ে কামউৎসব উদযাপন করছে।)
    যেরকম অনুমান করা হয়, ষোড়শ শতকের পরবর্তীকালে চৈত্রীয় কামমহোৎসব, ফাল্গুনী দোলপূর্ণিমায় প্রচলিত হোলি উৎসবের সঙ্গে মিলে যায় এবং মদন উৎসব উদযাপনের দিন শেষ হয়ে যায়। আসলে মুসলিম রাজাদের আমলে হোলি উৎসব রাজ অনুগ্রহে প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং মদন উৎসবকে গ্রাস করে নেয়। তবে এর ধর্মীয় দিকটি বেঁচে থাকে যখন একাদশ শতক নাগাদ রাধাকৃষ্ণের ঝুলন উৎসব এই চৈত্রীয় পার্বনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। অল-বিরুনির বিবরণ ছাড়াও গরুড় ও পদ্মপুরাণে এমত পড়া যায়। তারও পরবর্তীকালে এই অনুষ্ঠান চৈত্র পূর্ণিমা থেকে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় এগিয়ে আসে। এই উৎসবের প্রধান পালনীয় কৃত্য ছিলো ঝুলন আরোহী রাধা ও কৃষ্ণের প্রতি সখিসহচরীরা আবীর, কুমকুম ও পুষ্পবৃষ্টি করবে। বাংলায় এই জন্যই উৎসবটিকে 'দোলযাত্রা' বলা হয়, ঝুলনে দোলায়িত পুরুষ-প্রকৃতির যুগ্মসম্মিলনের দৈবী মাহাত্ম্য মুখর এর গরিমা। প্রাক বৈদিক আদিম কৃষিজীবী সমাজের ব্যাকানালিয়ার উদযাপন ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে হোলির বর্তমান রূপে বিবর্তিত হয়েছে। এখনও এই উৎসব মূলত 'শূদ্রে'র উৎসব। হোলিকাদহন বা বাংলায় যার নাম চাঁচর, তার আগুন অস্পৃশ্য শূদ্রদের থেকে গ্রহণ করার বিধি রয়েছে।

    ৪.
    সে'ও ছিলো এক বসন্তের মোহিনী রাত। বহুদিন হলো। বেঙ্গল ক্লাবে সারা রাতের অনুষ্ঠান। বুধাদিত্য তখন যুবক এবং অদ্ভুত চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী নবীন প্রতিভা। মধ্যরাতে আড়াইটা তিনটে নাগাদ তিনি বসলেন। সেনী ঘরানাদার উঁচু সপ্তকে বাঁধা যন্ত্র তাঁর । জোয়ারির শব্দ ঝর্ণার মতো, ভাসিয়ে দিয়ে যায়। রাগের নাম বললেন না। বন্দীশ শুনে কখনও মনে হলো আহির ভৈরব, না না এতো জোগিয়ার মতো লাগছে। উদ্গ্রীব হয়ে কান পেতে থাকা, ধরতে চাওয়া লক্ষণগুলিকে। ভৈরব না বসন্ত, কার ছোঁয়া বেশি লাগছে, বন্ধুরা চর্চায় মত্ত হই। অওচার আলাপ শেষ করে বুধাদিত্য ঘোষণা করলেন তিনি রাগ বসন্ত মুখারি বাজাচ্ছেন। বসন্ত মুখারি, সেই কর্নাটকী রাগ বকুলভরণম, পারস্যের রাগ হিজাজের ছাঁচে এই অনুপম রাগটিকে নিজের শরীর দিয়েছিলেন পন্ডিত রতনজনকার। । ততোদিন শুধু শোনা ছিলো উস্তাদ আমির খানের গায়নে বসন্ত মুখারি। কিন্তু বুধাদিত্য বাজালেন এক সম্মোহক নেশাগ্রস্ততায় মত্ত সুরের বৃষ্টি। যেন আকাশ ভেঙে ঝরে পড়লো বসন্তের ঝোঁকে। আমরা আজানুসমর্পণে দুহাত বাড়িয়ে ভিজে গেলুম সেই শেষ রাতের অন্ধকারে।
    সুরের মধ্যে অমন করে ঋতু বসন্তকে বেঁধে ফেলার জাদু খুব একটা শুনিনি আর। পারস্যের ঢঙে নজরুল এই সুরটিকে রাগ বসন্তের সঙ্গে মিলিয়ে হিজাজবসন্ত নামে একটা সুর তৈরি করেন। এই সুরেই তিনি কম্পোজ করেন অতিখ্যাত একটি গান, 'নীরব কেন কবি, ফুলের জলসায়'। সারঙ্গিতে এই রাগটির স্বরগুলি অন্যমাত্রার মগ্নরূপে ধরা দেয়। কেউ যদি উস্তাদ সুলতান খান বা উস্তাদ আবদুল লতিফ খানের সারঙ্গি যন্ত্রে রাগ বসন্তমুখারি শোনেন, নিশ্চয় একমত হবেন। তবে শেষ পর্যন্ত এই রাগের সেন্টিমেন্ট ধরার ক্ষেত্রে রাজা হয়ে থাকছেন আবার পন্ডিত রবিশংকর। তাঁর ছাব্বিশ মিনিটের রেকর্ডটিতে শুরু থেকেই মধ্য লয়ে গৎ বাজছে। সেভাবে আলাপ বা অওচার নেই। কারণ এই রাগটির চরিত্র অনুযায়ী ঢিমে আলাপ এর অন্তস্থঃ বিলোলতাকে ধরতে পারবে না। লয় ক্রমে বাড়িতেছে, কিন্তু কোনও ঝাঁকুনি নেই। এই সুরটির রাগদারি খুব ডেলিকেট ( বাংলা জানিনা, পেলব, কোমল, স্পর্শকাতর, কোনও বিশেষণই ঠিক মুডটি ধরতে পারবে না) পাল্টা তানে তেহাই পড়ছে নির্ভুল দক্ষতায় এবং রাগের বঢ়ত রেশমের মতো এগিয়ে দ্রুত তানকারি ও তোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে । শেষ স্ট্রোকটি পড়ছে তার সপ্তকে, সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে। লয় ও তানবিস্তারে তাঁর সিদ্ধি পন্ডিতজি আবার প্রমাণ করলেন অবলীলায়। রোবু ভাইয়ের আলুভাই, উস্তাদ আলি আকবরও বড়ো করে এই রাগটি বাজিয়েছিলেন। অওচার গতে মিড় সুতের কাজ অনবদ্য আর জোড় অঙ্গে লপেট আর তানকারি, জওয়াব নইখে। মাইহার ঘরে এই রাগটির খুব আদর রয়েছে। অন্য ঘরে যাঁরা এই রাগটি গেয়েছেন, তার মধ্যে পন্ডিত যশরাজের মধ্যদ্রুতে একটি ছোটো বন্দিশ রয়েছে, 'জল যমুনা...', ঠিক পূর্ণাঙ্গ খেয়াল নয়, তবে তিনি সিদ্ধ শিল্পী, বিন্দুতে সিন্ধু ধরতে জানেন। আমি সামনে বসেও তাঁর কণ্ঠে এই গানটি শুনেছি। পাতিয়ালা ঘরে কৌশিকিও খুব যত্ন করে গেয়েছেন রাগ বসন্তমুখারি। আর পন্ডিত রামকুমার শর্মা, যথারীতি লাজওয়াব তাঁর বাইশ মিনিটের এক পশলা বসন্ত বর্ষায়। আর পন্ডিত পান্নালাল ঘোষের বাজানো ছোট্টো একটুকরো রাগ বসন্তমুখারি, গায়ে কাঁটা দেয়।

    হিন্দি ছবিতেও এই রাগটি নিয়ে কিছু সফল প্রয়াস চোখে পড়ে। রাগ কিরওয়ানি নিয়ে আমার লেখাটি পড়ার পর কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, ছায়াচিত্রে ব্যবহৃত গানের সুর কি অবিকল রাগের অনুশাসন মেনে চলে? এর উত্তর হলো, কোনও রকম লঘু সঙ্গীতেই অবিকল রাগের অনুশাসন মেনে চলা হয়না। তাহলে তা 'লঘু' না থেকে শাস্ত্রীয় হয়ে যেতো। যে'টা ঘটে, তা রাগভিত্তিক সুরের একটা চলন তৈরি করা। অর্থাৎ বিভিন্ন রাগের আরোহ-অবরোহে উভয়পক্ষে পাঁচ-ছয় বা সাতটি স্বরের কম্বিনেশন থাকে। একটি স্বরের পরিবর্তনেও অনেক সময় গোটা রাগটি পাল্টে যায়। লঘু সঙ্গীতকে রাগাশ্রয়ী করার সময় রাগের সম্পূর্ণ সুরের গঠনটি অধিকাংশ সময়ই অনুসরন করা যায়না, যা করা হয় তা অধিকতর সংখ্যায় স্বরগুলিকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা। যেমন ধরা যাক, ও. পি. নৈয়রের একটি গান, 'ফির ওহি দিল লায়া হুঁ' ছবিতে লতা ও ঊষার দ্বৈত কণ্ঠে 'দেখো বিজুলি ডোলে বিন বাদল কি', এটিতে রাগ ভৈরবের অঙ্গ বেশ প্রকট, কিন্তু যদি স্বর গুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার হয়, তবে বসন্তমুখারির পাল্লা ভারি হয়ে যাবে। আগেই বলেছি, রাগ বসন্তমুখারি সৃষ্টি হয়েছে রাগ ভৈরব ও রাগ জোগিয়ার মিশ্রণে। কিন্তু লঘুসঙ্গীতে, বিশেষতঃ চিত্রগীতিতে পরিস্থিতিনির্ভর প্রয়োগ হয়। সেখানে গানের প্রসাদগুণটিই উপজীব্য, শাস্ত্রীয় লক্ষণ নয়। অতএব লঘুসঙ্গীতে সুর রাগাশ্রয়ী হয়, বিশুদ্ধ রাগ অনুসারী হয়না। বসন্তমুখারি রাগাশ্রয়ী কয়েকটি অন্য গান, যেমন শংকর জয়কিশনের ' ও বসন্তী পবন পাগল', লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের ' চলো সাজনা, জঁহা তক ঘটা চলে' বা কল্যানজী আনন্দজীর 'ওয়াদা কর লো সাজনা' ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এই প্রথাই প্রযোজ্য ।
    (ক্রমশঃ)
  • sosen | 125.242.234.99 | ১৯ এপ্রিল ২০১৩ ২৩:৪১601420
  • আহাহা
  • শিবাংশু | 127.197.253.75 | ১৯ এপ্রিল ২০১৩ ২৩:৫০601431
  • ৫.

    'গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো ওড়ে তোমার উত্তরী
    কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী...'

    বসন্ত নামের রাগটি বেশ প্রাচীন এবং পারস্য থেকে আসা বহার রাগটির সঙ্গে তার মেজাজের সাদৃশ্য অতি প্রকট। যদিও শরীরে একেবারে পৃথক। ঠিক যেভাবে মেলে প্রাচীন ভারতীয় রাগ কল্যাণ আর পারস্যের রাগ য়মন। এভাবেই যুগ্মরাগ য়মনকল্যাণ এবং বসন্তবহার মূল উৎস রাগের থেকে অধিক প্রেয় হয়ে যায়। 'ধমার' শব্দটি এসেছে 'ধমাল' শব্দ থেকে। ধমাল মানে হোলি উপলক্ষ্যে যাপিত ইতরজনের বন্ধহীন ব্যাকানালিয়া। 'ধমার' নামক সঙ্গীতের শাখাটির সৃষ্টিই হয়েছিলো হোলি বা বসন্তউৎসবকে কেন্দ্র করে গাওয়া গানের সমাহার থেকে। ধমারের বয়স ধ্রুপদের মতো-ই প্রাচীন। কিরানা ঘরের মহাগুরু আবদুল করিম খানের প্রিয় রাগ ছিলো বসন্ত। তাঁর শিষ্য ও সুরের দেবতা ভীমসেনের কণ্ঠে রাগ বসন্তে সেই বিখ্যাত বন্দিশ ' ফগওয়া ব্রজ দেখন কো চলেরি/ ফগওয়া মেঁ মিলেঙ্গে কুঁওর কানহা...'

    রাগ বসন্ত, কোমল প্রকৃতির রাগ বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু পন্ডিত রাজন-সাজনের নেতৃত্বে ২৭৫০ জন গায়কগায়িকার সম্মেলক কণ্ঠে যাঁরা বড়ে রামদাসজি রচিত বন্দিশ ' মা বসন্ত আয়োরে...' শুনেছেন, তাঁরা কিছুটা অনুমান করতে পারবেন এই প্রাচীন রাগটিতে যখন পুরাকালে সমস্বর ধ্রুপদ গাওয়া হতো, তার অভিঘাত ঠিক কেমন হতো। কণ্ঠসঙ্গীতে নামী-অনামী, সিদ্ধ-শিক্ষার্থী সব স্তরের গায়কবাদক শিল্পীর দল কখনও না কখনও বসন্ত বা বসন্তবহার গেয়েছেন বা বাজিয়েছেন। সবার কথা লিখতে গেলে একটা গ্রন্থের আয়তন নেবে। তবে একটা উল্লেখ থাকা দরকার, শিখদের শবদকীর্তনে রাগ বসন্তের বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। যাঁরা শবদকীর্তনের রসিক, তাঁরা এ কথা নিশ্চয় জানেন।

    আমাদের মতো ইতর শ্রোতাদের মনে রাগ বসন্তবহারের নাম উঠলেই যে গানটি স্বতঃ ঝলসে ওঠে, সেটি শংকর জয়কিশনের নির্দেশনায় পন্ডিত ভীমসেন আর আমাদের ঘরের মান্না দে'র আক্ষরিক অর্থে অবিস্মরণীয় যুগলবন্দি, 'কেতকী গুলাবজুহি চম্পক বনফুলে/ ঋতু বসন্ত অপনে তন্ত্র গোরি ডরওয়া লগায়...'। আমার জন্মের আগের গান, এখনও কী তার আবেদন মানুষের কাছে। মান্না দে'র স্মৃতিচারণে পড়েছিলুম, শংকর জয়কিশন যখন তাঁকে এই কম্পোজিশনটি শুনিয়েছিলেন, তখন তিনি রীতিমতো পুলকিত হয়ে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু যেই মাত্র জানা গেলো তাঁকে পন্ডিতজির সঙ্গে গাইতে হবে এবং নাটুকে প্রতিযোগিতায় তাঁর গান'কে জয়ী হতে হবে, তখন তিনি দৃঢ়ভাবে জানালেন তিনি এর মধ্যে নেই। সামনে বসে আড্ডার সময় একবার বলেছিলেন, 'ইয়ার্কি নাকি? পন্ডিতজির সঙ্গে গাওয়া, আবার লড়াই? আমি নেই ।' শেষে জয়কিশন অনেক বুঝিয়ে তাঁকে রাজি করেন এবং পন্ডিতজিও মান্নাদা'কে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। ফলতঃ যে সৃষ্টিটি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠতে পেরেছিলো, তার জুড়ি আজও বোধ হয় আর নেই। প্রয়াত জগজিৎ সিং একবার এই গান'টি স্মরণ করে মান্না দে'র উদ্দেশ্যে নিজের প্রণাম জানিয়েছিলেন। অনিল বিশ্বাসের একটা রচনায় সমবেত স্বরে বসন্ত বহারের একটা দারুণ কাজ আছে। হিন্দি তথা বাংলা ছবিতে হোলি উপলক্ষ্যে বহু গান রচিত হয়েছে। তবে সেসব ক্ষেত্রে রাগ বসন্তের থেকে কাফি, পিলু, খমাজের প্রচলনই অধিক। এছাড়া হোরি, ফাগুয়া বা চৈতীও তো রয়েছে, চোখ বুজে শুনলেই মনে হয় অন্তরীক্ষ থেকে ফাগ-গুলালের ধারা ঝিরঝির নৈঃশব্দ্যে মাথায় ঝরে পড়ছে। এই সমস্ত রাগরাগিণীই কিন্তু শৃঙ্গার ও দেহজ প্রেমের নানা স্তরকে ধরার প্রয়াস করে। তাই তারাও এই বসন্ত আলাপে ব্রাত্য নয়।

    ৬.

    'কথা বলতে বলতে এক নদীর ধারে পৌঁছোলুম
    যেখান থেকে বিনি-মাগনার খেয়া
    এপারের হাতছানি
    ওপার থেকে আমায় টেনে এনেছে ।' ( শক্তি)

    উত্তর ভারতে প্রচলিত হোলি উৎসবের যে সাধিত অমার্জিত উদযাপন রয়েছে তার থেকে ঊনবিংশ শতকের বাবুকালচারভিত্তিক নাগরিক বাঙালির 'দোলযাত্রা'র চোরাস্রোত আর অবক্ষয়ের ডাইনামিক্সের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিলোনা। এই পর্যায় থেকে দোলউৎসব উদযাপনে ব্রাহ্ম রুচিবোধ ও য়ুরোপীয় সফিস্টিকেশন নিয়ে আসার কৃত্যটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেকালের বাঙালির থেকে একালের বাঙালির রুচি ও মননবোধে আরো অসংখ্য পরিমার্জন সাধনের পথে কবির এই প্রয়াসটিও অল্পবিস্তর সফল হয়েছিলো। মঙ্গলকাব্য থেকে নিধুবাবু, বাংলায় বসন্তঋতু ও উৎসব নিয়ে অনেক কিছুই লেখাটেখা হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে এসে সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতটি পাল্টে যায়। আমাদের সমৃদ্ধতম ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দি ও উর্দু'র সাহিত্য ও মননসৃজনের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় থাকার সুবাদে বলতে পারি বসন্ত বা বর্ষা নিয়ে বাঙালির মননবিশ্বে যে গহন আততি রয়েছে, তার জুড়ি এই ভাষাগুলিতে দেখিনি। এর শ্রেয়ফল রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্য।

    বাঙালির পক্ষে বসন্ত নিয়ে কোনও কথা বলতে গেলে বা বসন্তের হৃদমাঝারে যাত্রা করার কোনও ইচ্ছে থাকলে পাসপোর্ট নিতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। কারণ কোত্থাও ছিলোনা, বসন্তের এমন একটা চিত্র চলন তাঁর ধারণা থেকে আমাদের মধ্যে এসেছে। এতো প্রগাঢ় তার আবেষ্টন আর অন্তঃসলিল অভিঘাত, যে আমাদের চেতনায় বসন্ত শুধু একটা ঋতু হয়ে নেই, একটা অন্তর্জলী সমর্পণ হয়ে গেছে। শান্তিনিকেতনী দোলের পৌত্তলিকতার থেকে ভিন্ন, কালিদাসের কুমারসম্ভব থেকে পৃথক বা বিহার অওধের শারীরমাংসে তপ্ত রং বর্ষে জুনুন থেকে আলাদা এক নিগূঢ় রণিত সন্ধান।

    অনেকদিন আগে আমাদের গ্রামে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এক আলোচনা সভায় তৎকালীন অত্যন্ত জরুরি এক প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট বিলোপ নিয়ে বেশ বিচলিত বিতর্ক চলছিলো। আমরা, যারা কপিরাইটের ধার ধারিনা বলে উচ্চকিত ছিলুম, তাঁদের প্রতি প্রবীণদের সশংক সাবধানবাণী ঘোষিত হচ্ছিলো। সেখানে আমি বলি, এটা কীভাবে ভাবা যাবে যে ' এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে' কেউ ব্যান্ডপার্টির সঙ্গে নেচে নেচে গাইছে আর মানুষ তা শুনছেও? বাঙালির গান শোনার যে অভ্যেস রবীন্দ্রনাথ তৈরি করে দিয়েছেন, তার থেকে কতোটা বিচ্যুতি মানুষ গ্রহণ করতে পারে, তার একটা পরীক্ষা হওয়া দরকার। কতোদিন আর বাবার হাত ধরে বড়ো রাস্তা পার হবার বিলাস আমরা করে যেতে পারি? একজন অগ্রণী প্রবীণ সুধীজন, উত্তেজিত আশংকায় বিনিময় করছিলেন তাঁর চিন্তা, হঠাৎ নীরব হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ পরে তিনি বললেন তিনি কিন্তু এভাবে আগে ভাবেননি। সত্যিই তো 'উদাসী হাওয়া'কে কতোটা বিকৃত করা যাবে আর। যদি করাও হয়, তবে কে শুনবে সেই উন্মাদের কোলাহল? মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো.....

    চান্স নিয়েছিলুম, সফলতা এলো। আমার একান্ত প্রিয়তম এই গান'টি নিয়ে ফাটকা খেলেছিলুম যেন। এই গান, যে তিলমাত্র অতিকথন, নিমিত্তমাত্র রূঢ়তা সহ্য করতে পারবে না, যে অবলীলায় স্পর্শ করবে আমার অন্দরমহলের অন্তরতম হিরণ্যপাত্র, পলকের মধ্যে, তা'কে বিকৃত কে করতে পারে? অসংখ্য অতীন্দ্রিয় আশ্লেষময় রবিবসন্তের সুরশব্দকে মনে রেখেও এই গানটি যেন বসন্তের শেষ পাসপোর্ট। অনন্ত মেয়াদের ভিসা আছে তার। কোনও অর্থকরী পাথেয়র ব্যয় নিষ্প্রয়োজন।

    আপাতভাবে খুব সহজ বাউলাঙ্গসুরের গানটি। ' বসন্তে কি শুধু ফোটা ফুলের মেলা রে...'। তার আগে কি কেউ দেখেছে, শুকনো-পাতা আর ঝরা ফুল কী খেলা খেলে? অরূপরতন নাটকের এই গান যেন বসন্তকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করছে, রূপসাগরের মোহ পেরিয়ে রূপসমগ্রতায় যাত্রা আসলে কোন অনুভব।
    '.. যে ঢেউ উঠে তারি সুরে
    বাজে কি গান সাগর জুড়ে
    যে ঢেউ পড়ে তাহারও সুর
    জাগছে সারা বেলা রে
    বসন্তে আজ দেখরে তোরা
    ঝরা ফুলের খেলা রে...।"

    এই উদাস আর্ষ সমগ্রতা নিয়ে যায় সেই অনেকদিনের মনের মানুষের দিকে, যে ভুলে যাওয়া বসন্ত থেকে ফিরে এলো। যা কিছু ফেলে গিয়েছিলো, তাই খুঁজতে এসেছে চেনা ফুলের চিণ্হ দেখে পথ চিনে। এই মানুষটি তো বাইরের কেউ নয়, আমার ভিতরেই বাসা বেঁধে থাকে নিয়ত। 'আমার কিছু কথা আছে, ভোরের বেলার তারার কাছে, সেই কথাটি তোমার কানে...। এই তুমিটি দখিন হাওয়া, যে দূরের গাথা আর বনের বাণী আমাদের ঘরের কোণে এনে দেয় বসন্তযামিনী জুড়ে।

    একদিকে রয়েছে, ' বাঁধন যতো ছিন্ন করো আনন্দে, আজ নবীন প্রাণের বসন্তে' বা ' তার কলধ্বনি দখিন-হাওয়ায় ছড়ায় গগনময়, মর্মরিয়া আসে ছুটে নবীন কিশলয়' অথবা 'সেইখানে মোর পরানখানি যখন পারি বহে আনি, নিলাজ- রাঙা পাগল রঙে রঙিয়ে নিতে থরে থরে', আবার অন্যদিকে ' নীল দিগন্তে মোর বেদনখানি লাগল, অনেককালের মনের কথা জাগল' কিম্বা 'বুঝি মনে তোমার আছে আশা, আমার ব্যথায় তোমার মিলবে বাসা' এবং 'তুমি কিছু নিয়ে যাও বেদনা হতে বেদনে-যে মোর অশ্রু হাসিতে লীন, যে বাণী নীরব নয়নে'।

    বসন্তকে কেন্দ্র করে এতো ব্যাপক স্পেকট্রামের মননদিগন্ত আমাদের সংস্কৃতিতে আগে আমরা পাইনি। মানুষের সংবেদনবিশ্বকে আপাতভাবে একটি ঋতুর আধারে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মেধার গহন অভিমুখে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার কাজটি আমাদের ভাষায় তিনিই প্রথম করেছিলেন এবং হয়তো এখনও পর্যন্ত সফলতম প্রয়াসের কৃতিত্বও তাঁরই।

    শব্দ দিয়ে বসন্তের মেজাজকে এক অনিবার্য মোহন ক্যাথার্সিসের মধ্যে ধরে ফেলে ছিলেন তিনি,

    ' .....বসন্তের শেষ রাতে এসেছি যে শূন্য হাতে- এবার গাঁথিনি মালা, কী তোমারে করি দান। কাঁদিছে নীরব বাঁশি, অধরে মিলায় হাসি- তোমার নয়নে ভাসে ছলোছলো অভিমান।।'

    (ক্রমশঃ)
  • ranjan roy | 24.96.57.81 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ০১:৪০601442
  • আমি ধন্য! আমি তৃপ্ত।
  • nina | 79.141.168.137 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ০৩:৩৪601453
  • শিবাজি
    প্লিজ এইসঙ্গে একটু তোমার গুনগুন ও টেপ করে রাখ----এত সুরের মাঝে চোখ ও মন ধন্য শুধু কান একটু অভিযোগ করছে--বলছে আমাকেও দাও আমাকেও দাও।
  • সুকি | 212.160.16.215 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ০৫:৫৫601454
  • অদ্ভূত - আপনার লেখা পড়ে মনে হয় জীবনে কত কিছুই যে শেখার আছে! আর আমাদের মত পাবলিক কত অল্প জ্ঞান নিয়েই বারফাট্টাই মারি!

    আরো লিখতে থাকুন - আর আমরা কিছু শিখতে থাকি। কোন এক কারন বশতঃ গানের বিশেষ কিছু না বুঝলেও আমার ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের কিংবদন্তীদের নিয়ে লেখা জিনিসপত্র পড়তে ভালোলাগে। কিছু বইপত্র জোগাড় করেছিলাম এককালে - তবে আপনাদের মত ফার্ষ্ট হ্যান্ড-দের কাছ থেকে রস নেবার মজাই আলাদা।
  • pi | 78.48.231.217 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ০৭:১৩601455
  • শিবাংশুদা, লেখা নিয়ে আর নতুন ক'রে কী বলবো ঃ)

    একটা প্রশ্ন অনেকদিনের। এই লেখা পড়ে আবার মনে হল। এই যে বসন্তের, যৌবনের রাগের কথা লিখেছেন, শৃঙ্গার রসের রাগ, সেই প্রসঙ্গে মনে পড়লো।
    কামোদের কথা। বসন্তের রাগ নয়, কিন্তু শৃঙ্গার রসে ভরপুর। পুরো নেশা ধরানো রাগ। কিন্তু হিন্দী সিনেমার গানে তো এই এতো সুন্দর রাগটা সেভাবে তো এলোইনা। এলো কি ?
  • শিবাংশু | 127.201.166.104 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ১১:২২601456
  • ৭.

    'অমিল পয়ার ছন্দে রচিত বসন্তকাল শেষ হয়ে এলো।
    পথের উপর আজ দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখলাম চারিপাশে মাঠ
    কালো কালো ধান গাছে ঢাকা আছে, এই সব সুমুদ্রিত ধানগাছগুলি
    আমার এ জীবনের বসন্তের অভিজ্ঞতা।
    .... আমার ভরসা এই প্রাকৃতিক নিয়ম রয়েছে
    স্বভাবত কিছু রস ঝরে যাবে মাঝে মাঝে বসন্তসন্ধ্যায়।' (বিনয়)

    #
    এবার হাওয়ায় শীতল আমেজটা চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত রয়েছে।

    চাইবাসা রেল স্টেশনটা শহরের একটু একদিকে। পুরোনো স্টেশন। জায়গাটাও তো পুরোনো। সেই কতোদিন আগে সাহেবরা এসেছিলো এই অনন্ত প্রসারিত জঙ্গলমহল আর আকরিকখনির মালিকানা হাসিল করতে এই সুদূর গ্রামে। সিংভূমের জেলার সদর দফ্তর ছিলো মানচিত্রের বাইরের এই আরণ্যক ভূমি। টানা প্ল্যাটফর্ম চলে গেছে একদিকে, অন্যদিকে নিচু বাঁধানো সোপান। লাইন পেরোলেই সারি সারি পলাশ, কেঁদ, শিরিষ আর ঝোপঝোপালির সবুজ ঘাগরা। আকাশ চিরে উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটে যাচ্ছে রেলের ট্র্যাকশন তার। প্যাসেঞ্জার ট্রেন থেকে এখানে লাফিয়ে নামে মানুষ জন। আর সওয়ারি ট্রেন কটাই বা? সকালে বিকেলে দু-তিনটে। ট্রেনের জানালার বাইরে বাঁধা ঝুলন্ত শুকনো গাছের ডালের বোঝা, লম্বা রোগা শালগাছের চোরাই লগ,সাইকেল, কেঁদপাতার বস্তা।
    কামরাগুলো মনে হয় গত শতকের। ভিতরের মানুষজন বিভূতিভূষণের লবটুলিয়া-বইহার থেকে থেকে নেমে এসেছে যেন। তবে মাঝে মাঝেই দুচারজন শহুরে সজ্জিত লোকজন চোখে পড়ে। তারা সব এই পথের শেষে সাজানো সব খনিবসতি নোয়ামুন্ডি, বোলানি, মহিষানি, জোডা, গুয়া, বড়বিল, কিরিবুরু, মেঘাতুবুরুর যাত্রী। মেঘাতুবুরু .... হ্যাঁ, সিংভূমের বসন্ত, শুকনো পাতা আর ঝরা ফুলের মেলা দেখার জন্য আর কোথায় বা যাওয়া যায়।
    #

    '..... কেবলি রিকির নাম লিখি আজ ফাল্গুনের মসৃণ বাতাসে।
    ঐখানে লিচুগাছে অগণিত মুকুল ধরেছে....
    ... ওসব মুকুল ঘিরে তাদের গোত্র বা পরিচয়
    জানা নেই ওরা ওড়ে ঈষৎ গুঞ্জন করে করে...' (বিনয়)

    চাইবাসায় হয়ে গেলো বছর দুয়েক। থাকি টুংরি মহল্লায়, দফতর সদর বাজারে। দিনের বেলা চাকরি, সন্ধে হলে আমাদের গাঁইয়া ছোটো কাগজের সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে হইহল্লা। মাঝে মধ্যে পয়সা জুটলে সুরাপান। নাহ, আমাদের কারুরই মহুয়ার নেশা নেই, অথচ কলকাতা থেকে লোকজন এখানে মহুয়া খেতে আসে। আমার টুংরির ভাড়া বাড়িটার গায়েই সাহেবদের পুরোনো কবরখানা। ভিতরে গেলেই দেখা যাবে আসল সাহেবমেমসব শুয়ে আছে মাটির নিচে। উইলিয়ম হ্যামিলটন, আর আই পি ১৮৬০, সিন্থিয়া জোন্স, লেইড ইন পীসঃ ১৮৬২। মানে সেই সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার লোকজন এই শালবন আর পাহাড়ি লালমাটির দেশ থেকে রোজ এ কয়ামতে যাত্রা করেছিলো। কয়েকটা কবরে বেশ খরচা করা পাথরের সাজগোজ, কয়েকটা দীন মলিন চিণ্হ শুধু। চারদিকের শালগাছের ঝরে পড়া পাতার নরম তোষক, অযত্নে বেড়ে বুগেনভিলিয়ার উজ্জ্বল ঝাড় আর সর সর করে পাতার বিছানায় মসৃণ ছুটে যাওয়া সতেজ সরীসৃপ। গায়ে গায়ে পাতা জোড়া রেল লাইন । মাঝরাতে আমার অ্যাসবেস্টস ছাত কুঁড়ে ঘরের ভিত কাঁপিয়ে ঝমঝম ছুটে যাওয়া মালগাড়ি, লোহাপাথর বয়ে নিয়ে চলেছে দেশে বিদেশে। ভালো ছিলুম, খুব ভালো ছিলুম।

    কয়েকদিন আগে একটা পোস্টকার্ড। সারান্ডার বসন্ত দেখতে হোলির ছুটিতে পর্ণা আসবে কাকার বাড়ি নোয়ামুন্ডি। সেখান থেকে দুয়েকদিনের জন্য মেঘাতুবুরু। থাকা মেঘা অতিথশালায়। সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক এক লাইন, অসুবিধে না থাকলে দেখা হতে পারে। আমি আগেই ভেবেছিলুম এবার হোলিতে আমার বন্ধু সমু'র ওখানে একবার যাবো। বেচারা কলকাতার ছেলে, কিরিবুরু ব্রাঞ্চে পোস্টেড। একদিনের ছুটিতে বাড়ি যেতে পারেনা। যাওয়াই যায়। শীতল বনজ্যোৎস্নায় শীতলতর বীয়রের সঙ্গে শালবনের মাথায় দোলপূর্ণিমার চাঁদ আর মদির নীল আভায় ঝলসানো অধরা চরাচর। কোন গান হবে আধো আঁধারের ঘুমন্ত পাহাড় জুড়ে? রাগ পিলুতে, 'কাটে না বিরহা কে রাত', অথবা স্রেফ, 'কাঁদিছে নীরব বাঁশি অধরে মিলায় হাসি, তোমার নয়নে ভাসে ছলোছলো অভিমান...' । রাগ পিলু এখন আমাকে পাগল করে রেখেছে .....

    প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে ঢুকতে দেখি ট্রেন আসছে, বড়বিল প্যাসেঞ্জার। বহুদিন পর একা যাচ্ছি কিরিবুরু।

    #
    '... আকাশে বশিষ্ঠ ঋষি নামক নক্ষত্র আর তার বৌ তারা
    সর্বদাই ভালো ছিলো, এখনও আনন্দে আছে, চিরদিন নিরাপদে আনন্দেই রবে।
    একথা অগ্নিরা জানে, এ বিশ্বের সব অগ্নি এই কথা জানে.....' (বিনয়)

    হোলির আগের দিন, ট্রেনে বিশেষ ভিড়ভাড় নেই। এইসময় লোকে পাহাড় থেকে নেমে সমতলে শহরবাজারে গিয়ে মস্তি করে। পাগল ছাড়া কে আর উল্টো যাবে ম্যাপের বাইরে থাকা বনপাহাড়ের সাংগ্রিলা। সামনে যে কামরাটা এলো চড়তেই দেখি পিছন পিছন সমাদ্দারবাবু। বোলানি মাইন্সে অ্যাকাউন্টসে বড়বাবু, চাইবাসায় বাড়ি। আমি একটু অবাক হই, বৌবাচ্চা ছেড়ে হোলির সময় উল্টো বাগে চলেছে কোথায়? প্রশ্নটা মুখ থেকে খসেনি, ব্যাস আর যায় কোথায়? অফিসের বস থেকে অন্তরীক্ষের দেবতা, সব্বাইকে একযোগে গালমন্দ করতে লাগলেন ভদ্রলোক। গতকাল দুপুরদিকে একটু তাড়াতাড়ি অফিস ছেড়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ অডিটওয়ালারা এসে গেছে, মার্চ শেষ হবার আগে কম্মোটি সারা করতে হবে। তাই আজ থেকে তাঁর ছুটি নাকচ। বাড়িতে পা দেবার আগেই ফেরত মার্চিং অর্ডার অপেক্ষা করছিলো, সঙ্গে গৃহিণীর গোমড়া মুখ ফাউ। 'কেন যে লোকে বিয়ে করে .....?' ( আমার নয়, এটা ওঁর সুভাষিত)।

    তবে একটা ভালো হলো, সমাদ্দারবাবু মনোদুঃখে বিশেষ কাতর। অকারণ বকবক করে সারা চাইবাসার হেঁসেলের খবর নিয়ে এই মূহুর্তে আমার মাথা খারাপ করবেন না। জানালা দিয়ে রোদভাসা নীল আকাশ, লাল প্রান্তর, সবুজের ছিট মহল আর চার দিকে ঘিরে থাকা কালো পাহাড় দেখতে দেখতে ভাবনাহীন ঘিরে ফেললো , ' আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার ওগো প্রিয়....'

    আবার রাগ পিলু ?

    #

    '... চারিদিকে চিরকাল আকাশ থাকার কথা, আছে কিনা আমি দেখে নিই।
    অনেক শালিক পাখি আসে রোজ এই গাছে, বটফলগুলি
    তারা খুঁটে খুঁটে খায় বসন্তের হাওয়া বয়, শালিকের ডাক
    এবং পাতার শব্দ মিশে একাকার হয়ে চারিদিকে ভাসে।...' (বিনয়)

    হাটগামারিয়া আসতে আসতে গাড়ি বেশ ফাঁকা। সামনের সিটে পা তুলে চুলের ভিতর হাওয়ার খেলা উপভোগ করা। একটু ঝিমও ধরে মাঝে মাঝে। এইভাবে পৌঁছে গেলুম নোয়ামুন্ডি। এই ছোট্টো শহরটি একেবারে একটি হিল স্টেশন, দুয়ার হতে অদূরে। হয়তো সাবেক শৈল শহরগুলির চেয়ে গরম একটু বেশি, কিন্তু শীত আর বর্ষা যথেষ্ট হলেও বেশ মনোরম। টাটা'র লোহাখনি আছে এখানে, তাই সাজানো ছবির মতো সব কিছু। আপাততঃ পর্ণা এখানেই আছে ওর বাবার এক সহকর্মীর বাংলাবাড়িতে। বন, পাহাড় আর নানা রঙের সবুজঘেরা নির্জন পাড়ার ঐ বাংলাবাড়িগুলি সিম্পলি ইরেজিস্টিবল। বেশিদিন হয়ে গেলে ভালো লাগেনা হয়তো, কিন্তু মাঝে মাঝে পৃথিবীর নাড়িতে হাত রাখতে গেলে এই সব ঠেকের কোনও তুলনা নেই। কবি যখন মনে করিয়ে দেন, চারিদিকে আকাশ থাকার কথা, তখনই আমি খুঁজতে শুরু করি আকাশটা রয়েছে তো। বসন্তের হাওয়ায় শালিকের ডাক আর পাতার শব্দ একাকার হয়ে গিয়েছে কি এই উৎসবে। নয়তো মনেই থাকে না কিছু। না থাকিলো, তবুও আমার গান সকলই তোমারে লক্ষ্য করে।

    আমি কোনও খবর দিইনি, নয়তো স্টেশনে পৌঁছে যেতো ঠিক। চমকটা থাকুক একটু। পর্ণাকে দেখলে সচকিত সমাদ্দারবাবু সপ্তাহান্তেই চাইবাসার প্রতি গলিতে হিতৈষী লোকজনকে খবর করে দিতেন । সন্দিগ্ধ পিতামাতাদের সতর্ক করে দিতেন, ব্যাংকের ঐ ছেলেটা সুবিধের নয়, ওর সঙ্গে মেয়েদের গান-টান গাইতে পাঠাবেন না। মজা হতো খুব, কিন্তু এখন তো আর সম্ভব নয়।

    রেল লাইনের পাশ দিয়েই যে কাঁচা রাস্তাটা প্ল্যাটফর্মের দিকে ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে , সেখানে একলা দাঁড়িয়ে একটা শিরিষ গাছ আর তার ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা ।

    বসন্তের শেষ রাতে এসেছি যে শূন্য হাতে
    এবার গাঁথিনি মালা , কী তোমারে করি দান......

    (ক্রমশঃ)
  • pi | 78.48.231.217 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ১৭:২৪601410
  • কামোদ আর তিলকামোদ আলাদা। জল আর জলপাই এর মতন।
  • pi | 78.48.231.217 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ১৭:৩২601411
  • কামোদ দিয়ে অনেক গান কোথায় ? তিলককামোদ দিয়ে অনেক গান আছে তো।

    এখানেও এইগুলোর কথাই আছে ঃ
    http://chandrakantha.com/raga_raag/film_song_raga/kamod.shtml

    তুমকো দেখা তো এখানে বলেছে বটে, কিন্তু আমার কিন্তু কিন্তু লাগছে। আর রাগের ঐ রসটাই অনুপস্থিত। শিবাংশুদা বা অন্যেরা বলুন।

    আর শিবাংশুদা আগে লিখুন। এই এত সুন্দর লেখার মাঝে এই কচকচানি এনে ফেলার জন্য দুঃখিত।
  • sosen | 125.242.205.136 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ১৭:৩৩601412
  • হুম, সে তো জানি,
    এইগুলো তো কামোদ -ই?
  • sosen | 125.242.205.136 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ১৭:৩৪601413
  • আমি অবিশ্যি জানতে চাইছিলুম। বুঝিনে বেশি তো -:)
  • Abhyu | 34.158.244.193 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ২০:৫১601414
  • খুব ভালো লেখা।
  • শিবাংশু | 127.197.249.171 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ২২:২১601415
  • ৮..

    #

    '.... বসন্ত এসেছে দেশে, আমাদের গ্রামে ক্ষেতময়
    ছোট ছোট ধানগাছ গজিয়েছে ;
    ... শস্য খেয়ে বাঁচে মানুষের মনপ্রাণ
    মানুষও শষ্য খায় ছন্দে ছন্দে চিবিয়ে চিবিয়ে...' (বিনয়)

    বড়াজামদার কাছে এসে মনে হলো ড্রাইভারের জোশ বেড়ে গেছে, দাঁড়াবেই না এখানে। সোজা চলে যাবে বড়বিল । কিন্তু আউটার পেরিয়েই পেশল ব্রেক লাগতে শুরু করলো। লোহায় লোহায় ঘষা লেগে একটা আগুনের মতো তপ্ত গন্ধ বেরোয় চাকা থেকে, গায়ে একটু শিহর লাগে। কিন্তু দাঁড়াতে তো হবেই, ইচ্ছায় অনিচ্ছায়, ক্রোধে, প্রেমে, ঘৃণায়। সব পথ শেষে থমকে থেমে যায় চারপাশে সজনেবাগান ঘেরা কোঠাবাড়ি আর টিম টিম লন্ঠন ছায়া নিকোনো উঠোনে। না থামলে আশ্রয় নেই, পরিত্রাণ নেই কোনোভাবে।

    ট্রেন দাঁড়াতেই সমাদ্দারবাবু বলে উঠলেন, আরে আপনি টাটা গেলেন না হোলিতে? আমি নামতে নামতে বললুম, টা টা... এবার টাটা আসছে এখানেই, তাই...
    মানে..?
    মানে অডিটরকে ভালো করে তোয়াজ টোয়াজ করুন.. দিনকাল ভালোনা...

    নেমে দেখি সমু দাঁড়িয়ে আছে বেরোনোর গেটের কাছে, টিটি'র সঙ্গে খোশ গপ্পো করছে। আমি যেতেই বললো, নিন, আমার বন্ধু এসে গেছে, আপনি এবার শিকারটিকার ধরুন। বাইরে বেরোতেই বললো, শোন তোর জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। আমি সারি সারি পিনে কা পানি কল দেখিয়ে বললুম, যা ওখানে খেয়ে আয়। তা বলে কি, নাহ ওসব খেলে শরীর খারাপ করবে। আমি বলবীরের ধাবায় তিনটে গোল্ডেন ঈগল বরফে ঢুকিয়ে এসেছি, এতোক্ষণে সলিড হয়ে গেছে।

    -ভালো করেছিস, পয়সাটা দিয়ে দিয়েছিস তো?
    -আরে না, তোকে কি কখনও অপমান করতে পারি ? তুইই দিবি চিন্তা নেই..
    - শালা, ব... চ...
    - আবে চল চল ... এখুনি মেজাজ ঠান্ডা হয়ে যাবে...

    স্টেশন থেকে বেরিয়েই বাঁদিকে একটা মোটর গ্যারেজ, তেজু সিং সর্দারের। পাশ কাটিয়ে গেলে পিছনদিকে মস্তো একটা শ্যাওড়া গাছ। তারই নিচে বলবীর ওরফে বীরের অন্ধকার আর ঠান্ডা ঠেক। পৌঁছোতেই বীরে হাত বাড়িয়ে , বস, বহুতদিন বাদ, মজা আ গয়া। বীরে মাঝে চাইবাসায় ব্যাংকে যায় শুঁড়িখানার চালানটালান জমা করতে । ওভাবেই ওর সঙ্গে পরিচয়। একটা কোনায় গিয়ে বসতে না বসতেই টেনিয়া ছোকরা চিকেন চিলি আর বীয়র নিয়ে হাজির। বলবীরকে ডাকি, আসেনা। বস অভি নহি, রাত কো বন্দ করতে ওয়ক্ত হোগা। পয়্সা চুকাতে গিয়ে আরেক ঝামেলা, সর্দারজি নেবেনা। বস, চাইবাসা মেঁ বরাবর কর দেনা। কী আর করা। প্রায় অন্ধকার ঠেক থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেই রোদ ঝন ঝন করে উঠলো। ট্রেকার স্ট্যান্ডের ধারে দুটো পলাশ আর একটা রাধাচূড়া। কমলা আর হলুদের আগুন লাগিয়ে রেখেছে। ট্রেকারওয়ালা জমাল সমু'র কাস্টমার, ব্যাংক থেকে গাড়ি নিয়েছে। সমু বললো, জমাল, সামনে সিট রিজর্ভ।
    -জরুর বস।
    সামনের সিটে যারা বসেছিলো, তাদের নামিয়ে পিছনে চালান করলো জমাল। ঘটনাটা হলো নিয়ম মতো পাহাড়ি রাস্তায় সামনে সিটে ড্রাইভারের পাশে শুধু দুজন বসবে। কিন্তু অন্ততঃ চারজন বসে আর একজন সাইডে দাঁড়ায়।
    আমাদের জন্য ইস্পেসল খাতির, শুধু দুজন আরাম করে বসবে। জমালের আবার খুব সঙ্গীত প্রেম , পুরোনো হিন্দি গান শোনে শুধু। সাহবলোগোঁকে মনোরঞ্জন কে লিয়ে গাড়ির ডেকটা চালিয়ে দিলো। কী আশ্চর্য, নৌশাদ সাহেবের হাত ধরে লতা গাইতে লাগলেন 'ঢুঁডো ঢুঁডো রে সাজনা , মোরে কান কা বালা...' পিলু কি আজ পণ করেছে , আমাকে সারাদিন রেহাই দেবেনা।

    পাহাড়ের পদতলে সমভূমি , বড়াজামদা, একটু এগোলেই পাহাড়ে চড়াই শুরু হয়ে যায়। ফাল্গুনের অপরাণ্হে ভাসাভাসি উষ্ণ হাওয়া, রাধাচূড়ার হলুদফুল উড়ে পড়ছে এদিক ওদিক, অহংকারী পলাশসুন্দর ইকেবানার মতো দু'টি গাছ শুধু মাথা নেড়ে যাচ্ছে দাদরা'র তালে তালে।
    'জামেঁ লালে লালে হাঁ হাঁ ,
    জামেঁ লালে লালে মোতিয়ন কি লটকে মালা,
    হো ঢুঁডো , ঢুঁডো...

    নৌশাদ সাহেবের অর্কেস্ট্রেশনে সেতারের বড়ো ভূমিকা থাকতো। তিনি নিজেও খুব ভালো সেতার বাজাতেন। উত্তরপ্রদেশ-বিহারের বিভিন্ন প্রচলিত লোকসুর আর উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যেসব সুর তিনি নিজের কম্পোজিশনে ব্যবহার করেছেন, তার ছকটি তিনি সৃষ্টি করতেন সেতারের সুরে। আর কে না জানে রাগ পিলু সেতারেই সব চেয়ে ভালোভাবে উদ্ভাসিত হয়। তাই এই গানটিতেও সেতারের সুর আর দাদরার মদির পূর্বী ঠেকা মেলোডির শেষ কথাকে ধরে রাখছে। এই কম্বি আরেকটা রয়েছে, মারাত্মক তার ঘূর্ণি। বৈজু বাওরাতে 'ঝুলে মেঁ পবন কে আই বহার'। সব কিছুই এক ধরনের, কিন্তু এখানে পিলু ধরে রেখেছে প্রথম বর্ষার আমেজ। ভৈরবীকে সদাসুহাগন বলা হয়, পিলু-ই বা কম কী?

    ইতোমধ্যে জমাল গাড়ি ছেড়েছে। আমি নওয়াব ওয়াজিদ আলি শাহের মতো বললুম, ফির বজাও। উৎসাহিত জমাল গাড়ি থামিয়ে ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করে আবার খুঁজতে লাগলো কান কা বালা। শরীরে তখন বোতল দেড়েক ঠান্ডা গোল্ডেন ঈগল। গাড়ি একটু এগিয়েই বাঁহাতি মোড় নিয়ে পেরিয়ে গেলো কোয়েলের ব্রিজ, পাহাড়ের এলাকা শুরু হয়ে গেলো। একদিকে উঁচু জমি , অন্যদিকে খাই... ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সারান্ডার অন্দরমহল। আমিও চোখ বুজে পৌঁছে যাই লখনউ কইসরবাগে চৌলাখি কোঠিতে, যেখানে নওয়াব ওয়াজিদ আলি পিলুতে ঠুমরি গাইছেন আর শরীরের ভিতরের ম্লেচ্ছ শীতল ভল্লুক ক্রমে বদলে যাচ্ছে ইরানি সিরাজির মৌতাতে।

    দুপাশে সবুজ অরণ্যানী, ঢালু নেমে যাওয়া খাদের দিকে কমলা, লাল, ইয়েলো অকার মাটির উপর ঝরে পড়ে আছে শাল, কেঁদ, করম পাতার কার্পেট, গাড়ি ধীরে এগোচ্ছে চড়াইতে, গান বাজছে ওমকার প্রসাদ নৈয়ারের পিলু, প্রফেটিক অনিবার্যতা নিয়ে, ' যাইয়ে আপ কহাঁ যায়েঙ্গে, ইয়েহ নজর লৌটকে ফির আয়েগি,
    দূর তক আপকে পিছে পিছে
    মেরি আওয়াজ চলে আয়েগি... '

    দূর তক.... দূর দূর তক ওহি আওয়াজ....আখির চলি আতি হ্যাঁয়...

    #
    ' গাছের নিজের ছায়া, পাহাড়ের বড়ো ছায়া দীর্ঘ হয়ে দূরে চলে যায়
    মনে হয় কিছু খোঁজে, আগের রাতের কথা আগামী রাতের কথাগুলি
    খুঁজে খুঁজে দীর্ঘ হয়ে চ'লে যায় সুখ মনে আনবার সুখে;
    ফলে অস্পষ্টতা থাকে, অনিশ্চিতভাবে থাকে সকালে ও বিকালবেলায়। .... ' (বিনয়)

    ঝিমুনি এসে গিয়েছিলো। গাড়িটা দাঁড়িয়ে যেতে তাকিয়ে দেখি বরাইবুরু চেক পোস্ট এসে গেছে। রাস্তার বাঁদিকে অতলখাদ, লতা-গুল্ম-বৃক্ষে জড়িয়ে ভরিয়ে পাহাড়ের পায়ের কাছে নেমে গেছে অদৃষ্টের মতো। শেষবেলার রোদে গাছের ছায়া দীর্ঘ হয়ে এসেছে। এতো উপর থেকে দেখলে বোলানির খাদান আর ঘরবাড়ি লাল ধুলোর মেঘে কেমন আবছা । ডানদিকে কাঁচা মোরমের রাস্তা ঢুকে গেছে জঙ্গলের মধ্যে। কাঠের গেট, কোনও দিন শাদা ছিলো, এখন লাল ধুলোয় রঙিন। পাশে বোর্ডে লেখা বরাইবুরু চেক পোস্ট। পাহাড়ের এই পাশ থেকে সারান্ডার অন্দরমহলে ঢোকার একমাত্র সরকারি রাস্তা।ব্যাস, কিরিবুরু আর মাত্র দু-তিনটে চড়াই। পৌঁছেই গেলুম শেষ পর্যন্ত।

    #

    ' সন্ধ্যাযূথীর গন্ধভারে পান্থ যখন আসবে ঘরে
    আমার আপনি হবে নিদ্রাভগন
    সাঁঝের রঙে....

    এবার রঙিয়ে গেলো হৃদয়গগন সাঁঝের রঙে...'

    সমুর কোয়ার্টারের সামনের আঙিনা থেকে দূরে পাহাড়ের পিছনে সূর্যাস্তের একটা খোলা ভিউ বাধাহীন ভাবে চোখে পড়ে। স্নানটান সেরে এসে দুজনে দাঁড়িয়ে দেখছিলুম আকাশের লাল। ঐ লাল রোজ দেখেও কি মনে হয় আজকের শেডটা যেন একটু আলাদা? এই রঙের মেজাজটাই কি রাগদারির আত্মা? কবি কি এটাকেই হৃদয়গগনের রঙিয়ে দেওয়া সাঁঝ বলতে চেয়েছিলেন। পাশের বাড়ির পালবাবুর বাগান থেকে ফুলের গন্ধ আসতে শুরু করেছে। কী ফুল, উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে চোখে পড়লো পালবাবু একটি গামছাসম্বল রাজবেশে পাইপ হাতে গাছে জল দিচ্ছেন। সমু'কে দেখে বললেন, অ, বন্ধু আইস্যা গেসে? বৈকালে আইসেন তবে..। সমু বলে, আইস্যা।
    আমি জিগাই, কেসটা কী?
    সে বলে , নাথিং সিরিয়াস, পালবাবু প্রিয় পাত্রদের মুফতে দারু খাওয়ায়...
    -সে কী রে, এই মাইনসে তো তবে পুলিশ দিয়ে ক্রাউড কন্ট্রোল করতে হবে ...!!
    - আরে না, বহুত খ্যাঁচা পাবলিক.. জনতা একটু দূরে থাকে.. তবে আমাকে না জানি কেন বিশেষ প্রেম করে...
    - মেয়ে-টেয়ে আছে না কি .. ?
    - ধ্যুৎ, একটাই ছেলে, বাইরে পড়ে..

    ভদ্রলোক খ্যাঁচা হোন বা অন্য কিছু, বাগানটা দারুন করেছেন। মাঝখানে একটু গোল ঘাসজমি, চারদিকে বেলি জুঁইয়ের হেজ আর তার পর গোলাপ, নানা ক্রোটন আর পাম দিয়ে সাজানো।

    সমুর বারান্দায় দুটো ভাঙা বেতের চেয়ারে বসে আমরা আকাশ দেখি আর গুনগুন করি..
    ' মনে লাগে দিনের পরে পথিক এবার আসবে ঘরে
    আমার পূর্ণ হবে সাঁঝের লগন সাঁঝের রঙে...'
    সমু জিগায় , এই গানটা কি বাউলাঙ্গ?
    - নাহ, দাদরায় আছে, তাই ওরকম লাগছে.. তবে সুরটা পিলুর ছাঁদে... বুঝলি আজ আমাকে রাগ পিলুতে পেয়েছে...
    - হুমম, বুঝলুম, এক 'প' থেকে আরেক 'প' ..
    কী বলছে বোঝা গেলো। বলি, মেঘাতে একটা ফোন মারতো, পৌঁছোলো কি না খোঁজ নে..
    -দাঁড়া দেখছি...

    ঘরের ভিতর থেকে ফোন করে ফিরে এলো সমু। আমি সপ্রশ্ন চোখে তাকাতেই বললো, ল্যান্ডেড সেফলি..
    - কজন এসেছে?
    -দুজন বললো তো, দুজন ম্যাডাম...
    - আরেকটি কে বাওয়া?
    -সে শালা তুই জানিস...
    -জানলে তো ভালো-ই হতো, কিন্তু জানিনা...
    -কখন যাবি?
    - দাঁড়া সন্ধে হোক...

    - 'এলো আঁধার ঘিরে পাখি এলো নীড়ে
    তরী এলো ফিরে
    শুধু আমার হিয়া বিরাম পায়না কো
    ওগো দুখ জাগানিয়া
    তোমায় গান শোনাবো...'

    -এটাও কি পিলু নাকিরে?
    -হুমম...
    -তোর দুখজাগানিয়ার কপালে দুঃখ আছে...
    -বলছিস?
    -বলছি...

    #
    ' পৃথিবীতে তারকার আলোক আসার পথপাশে
    চাঁদ থাকলেই সেই তারকার আলো যায় বেঁকে
    চাঁদের আকর্ষণেই; তারকাদিগের খোপা, ভুরু, দুই হাত
    মনোযোগ দিয়ে দেখি, তারকাদিগের সঙ্গে কথাবার্তা বলি।' (বিনয়)

    সন্ধ্যার ঝুঁঝকো আঁধারে দোলচতুর্দশীর আগুনে চাঁদ চোখে রেখে আমরা মেঘা অতিথশালার দিকে হাঁটি। এতো আলো, তারা'রা কোথায় লুকিয়ে গিয়েছে। বসতির মাঝে মাঝে একলাদোকলা শালবীথির মাথাগুলো রূপোলি গুঁড়োর রঙে ঝলমল। এরকম একটা সন্ধ্যাতেই তো পর্ণার সঙ্গে দেখা করা যায়। এর থেকে কম উদযাপন ওকে মানায় না। বেশ কিছুদিন দেখা হয়নি।

    'আমার নদীর যে ঢেউ ওগো জানে কি কেউ
    যায় বহে যায় কাহার পানে
    কে জানে...

    তখন কে আসে যায় সেই বনছায়ায়
    কে সাজি তার বহে আনে
    কে জানে...'

    (ক্রমশঃ)
  • ranjan roy | 24.96.83.37 | ২০ এপ্রিল ২০১৩ ২৩:২৪601416
  • বহোৎ খুব! শিবাংশু,
    বিনয়ের এই কবিতাগুলি একসংগে কী নামে পাওয়া যাবে?
  • pi | 78.48.231.217 | ২১ এপ্রিল ২০১৩ ১৭:২৭601417
  • পিলুটা আবার ঘুরেফিরে পড়ছি।
    -' রাগ পিলু এখন আমাকে পাগল করে রেখেছে .....'
    বরাবরই রাখে।
  • nina | 79.141.168.137 | ২১ এপ্রিল ২০১৩ ২০:৪৪601418
  • পাই একখান নমুনা পাঠিয়ে দে প্লিজ--শুনব মনভরে---
    শিবাজিকেও বলছি কয়েক টুকড়ো কানেও শোনাতে---
  • শিবাংশু | 127.197.234.27 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ০০:০৩601419
  • ৯.

    '... এবার হয়েছে সন্ধ্যা, দিনের ব্যস্ততা গেছে চুকে
    নির্বাক মাথাটি পাতি, এলায়ে পড়িব তব বুকে
    কিশলয়, সবুজ পারুল
    পৃথিবীতে ঘটনার ভুল
    চিরদিন হবে
    এবার সন্ধ্যায় তাকে শুদ্ধ করে নেওয়া কি সম্ভবে?' (শক্তি)

    মেঘা গেস্ট হাউসের গেট থেকে ভিতরের রাস্তাটা হঠাৎ উঠে গেছে পোর্টিকোতে। পাহাড়ি জায়গায় যেমন হয় আর কি। আমি ভিতরে গেলুম না। সমু'কে গেস্ট হাউসের লোকজন চেনে। ওকেই বললুম খোঁজ নিয়ে আসতে, কী করছেন তেনারা। গেটের বাইরে বড়ো রাস্তা একটা চুলকাঁটা মোড় নিয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে। সেই উৎরাইয়ের ঢাল বেয়ে বিশাল শাল বৃক্ষ সব। আমি উপর থেকে দেখছি তাই তাদের মাথায় মুকুটের মতো ঝলসিত চাঁদ মেধাবী সমর্পণে নিশ্চুপ সুভাষিণী। তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কি না জানিনা, তবু ভাবতে ভালো লাগে.... আছে।

    নিঃশব্দে কেউ এসে কাঁধে হাত রাখলো। চেনা পারফিউমের আত্মীয়তা। না তাকিয়েই হাতটা ছুঁলাম, সেই উষ্ণ পেলব করতল, যে হাত কখনও কোনও পাপ করতে পারেনা। নিশ্চুপ প্লব মেদুর ভেলভেটের শান্তি। দুয়েক মূহুর্ত জুড়ে শব্দহীন সমুদ্রঢেউয়ের রাতবেলা। স্বর্গদ্বারের ব্রেকার যেন বুকের উপর আছড়ে পড়ছে, কিন্তু কোনও শব্দ নেই। কালো পাথরের মতো পিচ রাস্তা যেন পায়ের তলায় পিছলে যাওয়া বালি। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ।

    ফিরে তাকাই, বলো...
    -জানতাম তুমি আসবে..
    -হুমম...
    -তুমি জানালে না কেন?
    -দরকার ছিলোনা, তুমি তো জানো'ই, আসবো
    -না, আমি জানতাম না..
    -এইই চলবে নাকি সারা সন্ধে?

    প্রগলভ হাসিতে চুরমার,
    - কক্ষণো না...
    -সঙ্গে কে এসেছে?
    -গেটের দিকে তাকিয়ে দেখো..
    ঘুরে তাকিয়ে দেখি সমু আর আর একটা দারুণ সুন্দর মেয়ে বিস্ফারিত চোখে ফোকটে উত্তম-সুচিত্রার অজয় কর মার্কা শেষ দৃশ্য দেখছে।
    আমি বলি, এ কী? এতো দর্শকের সামনে শ্যুটিং হচ্ছে বলোনি তো...
    -দরকার ছিলোনা, তুমি তো ভালো-ই জানো সিনটা কেমন করে করতে হবে, পারফেক্ট টেক...

    ওরা দু'জনে এগিয়ে আসে। সমু বলে, ওরে এটা বিহারের গ্রাম, প্যারিসের গলি নয়। হোলির দিন পুলিশের গাড়ি খুব টহল দিচ্ছে। দেখতে পেলে সোজা পাবলিক ন্যুইসান্সের দু'চারটে ধারা লাগিয়ে দেবে। তোর ঐ সব পিলু ঠুমরি টুমরি পাঁড়েবাবাদের সঙ্গে চলবে না।
    -ঠিক বলেছিস, তো এর পর কী?
    -চল ভিতরে লাউঞ্জে গিয়ে বসি...
    -চল..

    পর্ণার সঙ্গে এসেছে শ্রীরাধা, নোয়ামুন্ডির পাতানো কাকার মেয়ে। বছর দুয়েকের ছোটো। কলকাতায় পড়ে। একটু অন্তর্মুখী, কিন্তু বেশ ধারালো। আমায় বলে, আমি আপনার সব কথা জানি। চমকে যাই,
    -তুমি আমার অন্তঃস্তলের খবর জানো ? ভাবতেই আমি লাজে মরি...
    পর্ণা বলে, 'তোমার সব কায়দা আজকেই দেখিয়ে দিওনা ওকে, কিছু বাঁচিয়ে রাখো..ও এসব কিছু বলেনি, শান্তিনিকেতনের গল্পটা ও জানে...
    -ওহ, ওটা তো নিরাপদ বিপ্লব... সেফ অ্যান্ড এডুকেশনাল...চিন্তা নেই..
    -যতোক্ষণ আমি আছি বিপ্লব সব নিরাপদেই কোরো, মাত্রা ছাড়িওনা।
    - যথা আজ্ঞা কবি কামিনী রায়...

    #
    '... রক্তে রেখে গেছে ভাষা,
    স্বপ্নে ছিলো যাওয়া আসা-
    কোন যুগে কোন হাওয়ার পথে,
    কোন বনে কোন সিন্ধুতীরে,

    মন যে বলে চিনি চিনি...'

    কাল দোলপূর্ণিমা। যখন দেখা হয়েই গেলো, কেমন করে উদযাপন হতে পারে রঙ দে চুনরিয়ার পর্ব। অবশ্য তিনি যখন বকায়দা হাজির, তখন আমাদের বিহারিমতে উদ্দাম কিছু আশা না করাই ভালো। হোলিই বছরের একমাত্র তিথি, যেদিন রোদমাথায় রাম খাবার প্রবৃত্তি হয় অথবা নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী ভঙ্গ কা রঙ্গ জমা হো চকাচক... ওসব হবেনা। তবে এক্কেরে 'খোল দ্বার খোল' হয়ে গেলে আখরি পরেশানি। যাকগে ঠিক হলো, দিনের বেলা বেরোনোর মানে হয়না, বড্ডো গরম। যো ভি হই, সো সাঁঝ ঢলনে কে পার। সকাল সকাল দুই মূর্তি চলে আসবে সমুর বাড়িতে, কিছুমিছু রান্নাখাওয়া আর গান থেকে আড্ডা , আড্ডা থেকে গান। তবে শীতল ভল্লুকের থেকে অধিক কোনও পানীয় নিষিদ্ধ।

    রাতের বেলা যখন ফিরে আসছিলুম আমরা সারা রাস্তা খালি। দূর থেকে হাওয়ায় ভেসে আসছে খনিমজুরদের বসতি থেকে উদ্দাম ফাগুয়া-চইতা হোলির গান,ঢোলক আর ঝাঁঝের সিম্ফনি। পাহাড়ি রাস্তায় ওঠানামার যাত্রা। চাঁদ কখনো পাতার আড়ালে কখনো ঈষৎ মেঘে। ঐ অলীক, অথচ মারাত্মকভাবে বাস্তব আলোকতরণী দিদার করতে করতে আমরা সশব্দে ডুবে যাই,

    'কেবল তোমার চোখের চাওয়ায় দোলা দিলে হাওয়ায় হাওয়ায়
    বনে বনে দোল লাগালো ঐ চাহনি তুফান তোলা
    তোমায় দোলা দেবে কে..... '

    সমু বলে এই সুরটার মধ্যে একটা বসন্তের কন্ডিশনিং রয়েছে, বেশ টের পাওয়া যায়। বলি, এই সুরটা বসন্তবহার আর খমাজের কম্বিনেশন। এক কথায় ডেডলি... যতোক্ষণ ইচ্ছে গেয়ে যেতে পারিস, ক্লান্তি লাগবে না... ইনটক্সিকেটিং....

    বাড়ি পৌঁছে শুয়ে পড়ি ব্রহ্মচারীর শয্যায়, জানালা দিয়ে কাঁটার মতো জ্যোৎস্না এসে গায়ে বাজে... এমন যামিনী কাটিল বিরহশয়নে...

    '...ডুবিয়াছিলো নদীর ধার আকাশে অধোলীন
    সুষমাময়ী চন্দ্রমার নয়ান ক্ষমাহীন
    কী কাজ তারে করিয়া পার যাহার ভ্রকূটিতে
    সতর্কিত বন্ধদ্বার প্রহরা চারিভিতে
    কী কাজ তারে ডাকিয়া আর এখনো, এই বেলা ....' (শক্তি)

    কখন ঘুমিয়ে পড়েছি , টের পাইনি।

    #
    '... নিঃশব্দচরণে প্রেম এসেছিলো দুয়ার মাড়িয়ে-
    ঘরে ও ঘরের বাইরে তখন ছিলোনা অন্ধকার
    আলো ছিলো, ভালো ছিলো-ছিলো তা, যা থাকে না কখনো
    একটি মানুষ ছিলো সুন্দরের অপেক্ষায় বসে-....' (শক্তি)

    ভোরের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায়। আলসেমি চলবে না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে থাকতে হবে। স্নান করতে গিয়ে বেশ শিরশিরে ঠান্ডা। কিরিবুরুতে অগস্ট থেকে মার্চের শেষ, শীতলতার ঋতু। সমু রান্নাঘর গুছোচ্ছে। ব্যাচেলরের রান্নাঘর যেমন হয় আর কি। এই কাজে আমি অতি গবেট, তবে চেষ্টা করি ওকে একটু সাহায্য করতে। বিছানার চাদরটাদর গুলো পাল্টানো, বসার জায়গা রেডি করা এই সব। ঠিক আটটার মধ্যে সুন্দরীযুগলের আবির্ভাব। শ্রীরাধার বাবা ওঁর কালো অ্যামবাসাডরটি চালকসহ ওদের সেবায় পাঠিয়ে দিয়েছেন, দারুণ ব্যাপার। নয়তো এসব জায়গায় কোনও পাব্লিক গাড়িঘোড়া পাওয়া যায়না বিশেষ। শুধু মাইনসের জীপ, সারাক্ষণ লাল অগ্নিবর্ণ ধুলো উড়িয়ে এদিক থেকে ওদিক ছুটে চলেছে।

    - এ কী, দুজনেই উঠে পড়েছো... ভাবলাম গিয়ে ঘুম ভাঙাতে হবে... সকাল কেমন হয় দেখোনি তো কখনও...

    - প্রিয়ে,
    'আজ সাধ্যাতীত ভালোবাসবো ব'লে সকাল আমার
    এতো ভালো লাগে, এতো সুন্দর, আলস্যভরা বায়ু
    ঘর না বাহির, নাকি ঊর্ণাময় স্বপ্নের ফোয়ারা-
    আমি বসে আছি....
    আমি ভালোবাসবো, আমি হৈ হৈ করবো সারাদিন....'

    - কী ব্যাপার? সকাল সকাল পদ্য নামিয়েছো নাকি...?
    - মূর্খ নারী, ইহা শক্তি এবং শক্তি... আর শুনবে?

    -কী?

    - '... দুঃখ হলে সংক্ষিপ্ত শহরে
    কাকে বলবো, কথা দাও-দেড় হাজার চুম্বনের কম
    এ দুঃখ যাবার নয়, কাকে বলবো গান ধরো জোরে?'

    - এতো পুরো ক্ষিপ্ত, সংক্ষিপ্ত কোথায়?

    - ক্ষিপ্ত তাই, পদপল্লবে তব যাচ্ঞাহীন টিকে আছি
    দয়াময়ি, সভয়ে অনাসৃষ্টি বরণ করেছি বেদনায়...

    -এটাও শক্তি?

    -আজ্ঞে না , ভবিষ্যতের শক্তি...

    - সে আবার কে?

    -এই তোমার সামনেই সে নতমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে...

    হঠাৎ দেখি শ্রীরাধা বেশ অবাক মুখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। হয়তো মনে মনে আগের সন্ধেতে ' আমি আপনার সব কথা জানি' বলার প্রায়শ্চিত্ত করছে। অথবা ভাবছে এই পুরো উন্মাদ লোকটার সঙ্গে পর্ণাদির সম্পর্কটা কী হতে পারে?

    পর্ণাও লক্ষ্য করেছিলো ব্যাপারটা। ওর দিকে তাকিয়ে বললো, কী রে , কী ভাবছিস? পাগল, না..? শ্রীরাধা একটু লজ্জা পায়, না, না, তা নয়...ঐ ইয়ে আর কি... বলে হেসে ফেলে,

    ' যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে
    চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে....'

    (ক্রমশঃ)
  • শিবাংশু | 127.197.234.27 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ০১:১৮601421
  • @ রঞ্জন,

    শ্রেষ্ঠ কবিতাঃ বিনয় মজুমদারঃ দে'জ

    @নিনা,

    সেই উপমাটিই মনে পড়ে। 'পাঁজিতে লেখে বিশ আড়া জল, কিন্তু নিংড়ালে এক ফোঁটাও পড়ে না।' সুরের জাদু কি আর শব্দে ধরা যায়? পরের বার দেখা ও সুযোগ হলে পিলু'র মায়া নিয়ে কিছুক্ষণ বসা যাবে। ঃ-)
  • sosen | 125.241.75.25 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ০১:২৪601422
  • সুন্দর, শিবাংশুদা। অনধিকারীর ভালোলাগা জানিয়ে গেলাম।
  • শিবাংশু | 127.201.165.105 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ১০:৫৭601423
  • সোসেন, রঞ্জন, নিনা, পাইদিদি, সুকি,

    না-চিজ কা শুক্রিয়া... ঃ-)
  • aalbaal | 24.98.143.166 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ১৪:৫৩601424
  • আলবাল লেখা
  • অজানা | 125.187.32.34 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ১৫:১২601425
  • শিবাংশু বাবুর লেখাটা চেটে পুটে খেলাম । কি তৃপ্তি !
  • aalbaal | 24.98.143.166 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ১৫:৪৪601426
  • কাল না পেট ছাড়ে
  • কৃশানু | 177.124.70.1 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ১৬:৩৩601427
  • অসাধারণ। ভেবেছিলাম এ লেখা শেষ হওয়ার আগে মন্তব্য করব না, কিন্তু পারলাম না।
  • de | 190.149.51.69 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ১৮:৩৫601428
  • আঃ!! অপূর্ব, শিবাংশুদা! চলতে থাকুক!
  • শিবাংশু | 127.197.255.234 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ২৩:০৬601429
  • ১০.

    'মনে এক রমণীর বসবাস সকল সময়।
    তাকে ভালোবাসতেই হয়।
    বাইরের সব ভালোবাসা
    তাই ভাসা ভাসা।
    তুমিও যখন এসো ঘরে
    দেয়ালেই শুধু ছায়া পড়ে
    ঘরের ভিতরে তুমি নেই।
    যা বলি তোমাকে,
    বলি সে-রমণীকেই। ' ( সঞ্জয় ভট্টাচার্য)

    প্রতিটি রাগের অন্দরমহলেই হয়তো এক রমণীর বসবাস সকল সময়। হয়তো আমার মনে শুধু তার ছায়া পড়ে, ঘরের ভিতর সে আসেনা। তবুও আমার সকল গান.....

    এখন যেমন পিলু'কে নিয়ে পড়েছি। প্রশ্ন উঠতে পারে এতো এতো কুলীন রাগ থাকতে কেন পিলু? কারণটা হয়তো এই যে এই রাগটির ব্যঞ্জনা আমার মতো লঘুচরিত্র মানুষের মানসিকতার সঙ্গে বেশ মেলে। এর একটা শাস্ত্রবিরোধী চপলতা আছে, যে জন্য এই রাগে কখনও খেয়াল গাওয়া হয়না। সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ রাগ হওয়া সত্ত্বেও এ এক ইতরজনের প্রেয় সুর। এর শরীরী আবেদন প্রচ্ছন্ন থাকেনা। সেরিব্রাল স্থিরতার চাইতে চঞ্চল শৃঙ্গারমুখর আবেগ একে অধিক সার্থক করে তোলে। অওধের নওয়াবরা ঠুমরি নামক শৈলীটিকে বিকশিত করার আগে শাস্ত্রদেবতার দরবারে পিলু ছিলো একেবারে অন্ত্যজ অস্তিত্ব। মজার ব্যাপার হলো অন্য পরে কা কথা, টপ্পাও সম্ভবত পিলু'তে গাওয়া হতোনা। কারণ দেখছি বাংলা নাগরিক গানের যিনি ভগীরথ, সেই নিধুবাবু বহু জনপ্রিয় রাগে টপ্পাসহ নানা ধরনের গান বাঁধা সত্ত্বেও পিলুতে কোনও গান বাঁধেননি।

    পিলু কাফি ঠাটের অংশ। এই ঠাটের ভীমপলশ্রীর সঙ্গে তার মিল আছে। কিন্তু বেশি মিল আছে আর এক ম্যাজিক রাগ ভৈরবীর সঙ্গে। কোমল গান্ধার, কোমল ধৈবত আর কোমল নিষাদের বিভিন্ন ধরনের মিশ্রণ কীভাবে এক অন্যধরনের মায়া মানুষের কানে সৃষ্টি করে তা নিয়ে বহুকাল ধরেই ভাবছি। এই স্বরগুলির মধ্যে কী কানের ভিতর দিয়া মরমে পশে যাওয়ার কোনও অজানা ফর্মুলা রয়েছে? পন্ডিতরা হয়তো বলতে পারবেন। কিন্তু যাঁরা শাস্ত্রীয় মার্গের সুরচর্চা থেকে অনেক দূরে, অর্থাৎ ইতরযানী শ্রমজীবী মানুষজন, তাঁদের সঙ্গীতচর্চার মধ্যে পিলুর সুর খুব সহজে জায়গা করে নিয়েছে। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের লোকসুর ও লোকগানের জঁরগুলি, যেমন হোরি, ফাগুয়া, চৈতা বা ভক্তিগীতি ও শৃঙ্গারগীতি, সবারই পিলুভিত্তিক সুরের প্রতি স্পষ্ট আনুগত্য দেখা যায়। পিলু'র সে অর্থে কোনও 'শুদ্ধ' রূপ নেই। তীব্র স্বর বা কোমল স্বর কীভাবে প্রয়োগ করা হবে সে নিয়ে পন্ডিতেরা বিশেষ লাঠি ঘোরান না। প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো যাই গাওয়া বা বাজানো হোক না কেন, তা'কে শ্রুতিমধুর হতে হবে। আমার মতো ইতরশ্রোতারা তো প্রাথমিকভাবে সঙ্গীতের কাছে তাই চেয়ে থাকেন। তাই বোধ হয় প্রাজ্ঞ শ্রোতার কাছে এই সব রাগের বিশেষ কদর নেই, যেমন পিলু বা ভৈরবী। আমরা আম আদমিরা এই দুটি রাগের সঙ্গে মিলে মিশে জীবন কাটিয়ে দিই। কবি বলছেন, আমাদের জন্ম হয়েছিলো কোনও এক বসন্তের রাতে। সেই বসন্ত, যে ধুলোখেলার নেশায় ধরে রাখে ইতরযানী রুচি, যার বিপুল শারীরবৃত্ত যাপন ঘিরে থাকে সংখ্যালঘু মননবৃত্তের সেরিব্রাল জগৎ। এই দুই স্রোতের মিলনবিন্দুর অভিঘাত চিরকাল মানুষের মনে ভালোবাসার বীজপত্র অঙ্কুরিত করে যায়।

    #

    'বঁধুর কাছে আসার বেলায় গানটি শুধু নিলেম গলায়
    তারি গলার মাল্য করে করবো মূল্যবান....'

    বাঙালিরা যখন গান কম্পোজ করেন, কয়েকটি বিশেষ রাগের প্রতি তাঁদের অধিক পক্ষপাত থাকে। বাংলা নাগরিক গান যাঁর হাতে জন্ম নেয়, সেই নিধুবাবু গানের সুর করার সময় যে রাগগুলির প্রতি অধিক নির্ভরশীল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও দেখি মোটামুটি সেই সব রাগের ছায়া সুর করার সময় এসে পড়ে। এর মধ্যে প্রথম তালিকায় থাকে, ভৈরবী, খমাজ, বেহাগ, পুরিয়া, য়মন, কানড়া, কাফি। পরের তালিকায় ধরা যেতে পারে পরজ, ললিত, মালকোষ, তোড়ি, হামির, কেদার ইত্যাদি। এই লিস্টিটা রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী প্রায় সব বাংলা সুরকারদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, ভক্তিসঙ্গীত বা রঙিন গান, উভয়তঃ। পিলু এসে যুক্ত হয় প্রথম রবীন্দ্রনাথের রচনাতেই। পরবর্তীকালেও এই পক্ষপাতের ধারার ইতরবিশেষ হয়নি। কারণ এই সব রাগাশ্রয়ী সুরগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং যেহেতু মানুষ গানের কাছে প্রথমতঃ আশ্রয় খোঁজার জন্যই আসে, তাই চেনা গাছের ছায়াই অধিক কাম্য।

    শুধু যে বাঙালি শ্রোতারাই এই সব সুরে স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজে, তা নয়। এটা প্রায় সর্ব ভারতীয় ব্যাপার। শচীনকত্তা ছিলেন ভৈরবীর রাজা, পুত্রের ঝোঁক ছিলো খমাজে। পিলু'কে মাথায় করে রাখতেন ও পি নৈয়র। নৌশাদসাহেবেরও পিলুর প্রতি বেশ পক্ষপাত ছিলো। ও পি নৈয়র ১৯৫৪ সালে ' আরপার' ছবিতে শমশাদ বেগমকে দিয়ে গাইয়ে 'কভি আর কভি পার' গানটি সুপারডুপার হিট করেছিলেন। তার পর থেকে পিলুর উপর তাঁর হয়তো একটা দুর্বলতা জন্মায়। অবশ্য তিনি যে দেশের লোক, অর্থাৎ পঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের লোকগানে পিলুর বিশেষ প্রভাব রয়েছে, যা হয়তো তাঁর কান'কে শৈশব থেকেই মজিয়েছিলো। তাই পিলুনির্ভর সুর তাঁর গানে ফিরে আসতো। এই নিয়ে কেউ একজন কটাক্ষ করায় তিনি বলেন পিলুর সুরের মধ্যে এতো রকম সম্ভাবনা আছে যে মানুষের সব রকম আবেগ, আকর্ষণ, আশ্লেষকে তা অবলীলায় ধরে রাখতে পারে। সে সময়ই প্রায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে ১৯৫৮ সালে বিভূতি মিত্র পরিচালিত 'ফাগুন' ছবিতে আট-ন'টি গানের সব গুলিই পিলু-আশ্রিত সুরে কম্পোজ করেছিলেন। সঙ্গে রাগ বসন্তের কিছু অনুষঙ্গ ছিলো। প্রায় সব গানই হিট হয়েছিলো, কয়েকটি সুপার হিট। সিনেমাটি অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু গান গুলি আজও বেঁচে আছে। ' এক পরদেশি মেরা দিল লে গয়া', 'সুন জা পুকার', 'পিয়া পিয়া ন লাগে মোরা জিয়া', ইত্যাদি। সেই থেকে যে ট্র্যাডিশন শুরু হয়েছে আল্লা রাখা রহমান পর্যন্ত তার জয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ।

    #

    আমাদের চিরকালীন শাস্ত্রীয় ও উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে প্রাচীনতম রেকর্ড পাচ্ছি ১৯০৮ সালে গাওয়া অচ্ছনবাইয়ের পিলু। তার পর কে নেই সেই তালিকায়? সুরের ঈশ্বরকোটী আবদুল করিম, বড়ে গুলাম, ভীমসেন ছাড়া ইন্দুবালা, সিদ্ধেশ্বরী দেবী, রসুলন বাই, বেগম আখতার, রোশনারা বেগম, প্রভা আত্রে, গিরিজা দেবী, শিপ্রা বসু এবং অজয় চক্রবর্তী সব্বাই আছেন। এতো গেলো কণ্ঠসঙ্গীতে। বাল্যকালে আমার প্রথম শোনা রাগ পিলু পন্ডিত রবিশংকরের সেতারে, মিশ্র পিলু, সঙ্গে আল্লারাখা, চব্বিশ মিনিটের বাজনা, এই রাগটির সঙ্গে আমাকে চিরকালের জন্য বেঁধে ফেলে। পরে শুনি তাঁর আগে বাজানো দশ মিনিটের পিলু ঠুমরির রেকর্ডটি, সঙ্গতে চতুরলাল। আরো পরে অনুষ্কার সঙ্গে রঙ্গিলা পিলু। কিন্তু একটি স্মৃতিচারণে তিনি বলেছিলেন ইয়েহুদি মেনুহিনকে সম্মত করে তাঁর সঙ্গে যুগলবন্দির রেকর্ডটিই তাঁর বিশ্বজয়ের প্রথম সোপান। এখানেও রাগটি ছিলো পিলু। তাঁর গুরুভাই নিখিল বন্দোপাধ্যায় এবং অপরজন অফতাব-এ-সিতার বিলায়ত খান সাহেব বড়ো করে বাজিয়ে রাগ পিলু রেকর্ড করেছিলেন। এই বাজনাগুলি শুনলে বোঝা যায় এই সব গুরুরা তথাকথিত অল্পপ্রাণ পিলু রাগের মধ্যে কী সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছিলেন। এছাড়া আমার চিরকালের প্রিয় পিলুর উপস্থাপনার লিস্টিতে আছেন পন্ডিত বুধাদিত্য, পন্ডিত শিবকুমার, পন্ডিত হরিপ্রসাদ, উস্তাদ শাহিদ পরভেজ, উস্তাদ রইস খান, উস্তাদ আসিফ আলি খান, পন্ডিত ব্রিজ ভূষন কাবড়া এবং সরোদের দুই দেবতা উস্তাদ আলি আকবর ও উস্তাদ আমজাদ আলি।

    চিরকালের জন্য কোনও নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত হলে উস্তাদ বড়ে গুলামের 'সঁইয়া বোলো তনিক মোহে রহিও ন জায়' অবশ্য সঙ্গে যাবে, তৎসহ তাঁর ঘরের আরেক দুর্লভ সঙ্গীত প্রতিভা গুলাম আলি সাহেবের গাওয়া সেই একই গান অন্য মেজাজে, তাকেও যেতে হবে।

    #

    বসন্ত নিয়ে আড্ডায় এই সব কথাই তো হয়। জীবনের কাছে আর অতিরিক্ত কীই বা চাওয়ার থাকে ইদম অগ্নয়ে অমৃতরসের স্বাদ পাওয়ার পর। আমাদের চারজনের বসন্ত উৎসবে সারাদিনের কথোপকথন বাকি জীবনের জন্য কিছু সঞ্চয় তো নিশ্চয় রেখে গিয়েছিলো সেদিন। বাকিদের চোখে ছিলো নতুন কিছু জানতে পাওয়ার তৃপ্তি আর পর্ণার চোখে এক অন্য বিশ্ব আবিষ্কার করার রোমাঞ্চ। সেদিন সন্ধেবেলা জনান্তিকে বলেছিলো, একটা রাগই যদি এতো পরিপূর্ণতার স্পর্শ এনে দেয়, তবে এতো বিস্তৃত সুরের জগতের স্বাদ কোন স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। আমি বলি, সেই জন্যই তো গড দ্য অলমাইটি বৈকুণ্ঠলোকেরও উপরে আমার জন্য একটা স্বর্গ বানিয়ে দিয়েছেন।
    - তাইইই, তা সে স্বর্গটির নাম কী জানতে পারি ?
    -এখনো দেওয়া হয়নি...ভেবেছি তোমার নামে দেবো, আপত্তি করবে কি?
    সে হাসেও না, কথাও বলেনা, শুধু চোখ্দুটো তাকিয়ে বলে, সত্যি বলছো....?

    '... ভালোবাসি সেই কথা তোমাকে তো বলি বার বার
    আকাশ যেমন বলে, মাটি শোনে রৌদ্রে মেঘে আর
    অন্ধকারে বার বার। তুমিই শিউরে ওঠো
    বর্ষে বর্ষে মাটির মতন....' (বিষ্ণু দে)

    (ক্রমশঃ)
  • শিবাংশু | 127.197.255.234 | ২২ এপ্রিল ২০১৩ ২৩:০৬601430
  • ১০.

    'মনে এক রমণীর বসবাস সকল সময়।
    তাকে ভালোবাসতেই হয়।
    বাইরের সব ভালোবাসা
    তাই ভাসা ভাসা।
    তুমিও যখন এসো ঘরে
    দেয়ালেই শুধু ছায়া পড়ে
    ঘরের ভিতরে তুমি নেই।
    যা বলি তোমাকে,
    বলি সে-রমণীকেই। ' ( সঞ্জয় ভট্টাচার্য)

    প্রতিটি রাগের অন্দরমহলেই হয়তো এক রমণীর বসবাস সকল সময়। হয়তো আমার মনে শুধু তার ছায়া পড়ে, ঘরের ভিতর সে আসেনা। তবুও আমার সকল গান.....

    এখন যেমন পিলু'কে নিয়ে পড়েছি। প্রশ্ন উঠতে পারে এতো এতো কুলীন রাগ থাকতে কেন পিলু? কারণটা হয়তো এই যে এই রাগটির ব্যঞ্জনা আমার মতো লঘুচরিত্র মানুষের মানসিকতার সঙ্গে বেশ মেলে। এর একটা শাস্ত্রবিরোধী চপলতা আছে, যে জন্য এই রাগে কখনও খেয়াল গাওয়া হয়না। সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ রাগ হওয়া সত্ত্বেও এ এক ইতরজনের প্রেয় সুর। এর শরীরী আবেদন প্রচ্ছন্ন থাকেনা। সেরিব্রাল স্থিরতার চাইতে চঞ্চল শৃঙ্গারমুখর আবেগ একে অধিক সার্থক করে তোলে। অওধের নওয়াবরা ঠুমরি নামক শৈলীটিকে বিকশিত করার আগে শাস্ত্রদেবতার দরবারে পিলু ছিলো একেবারে অন্ত্যজ অস্তিত্ব। মজার ব্যাপার হলো অন্য পরে কা কথা, টপ্পাও সম্ভবত পিলু'তে গাওয়া হতোনা। কারণ দেখছি বাংলা নাগরিক গানের যিনি ভগীরথ, সেই নিধুবাবু বহু জনপ্রিয় রাগে টপ্পাসহ নানা ধরনের গান বাঁধা সত্ত্বেও পিলুতে কোনও গান বাঁধেননি।

    পিলু কাফি ঠাটের অংশ। এই ঠাটের ভীমপলশ্রীর সঙ্গে তার মিল আছে। কিন্তু বেশি মিল আছে আর এক ম্যাজিক রাগ ভৈরবীর সঙ্গে। কোমল গান্ধার, কোমল ধৈবত আর কোমল নিষাদের বিভিন্ন ধরনের মিশ্রণ কীভাবে এক অন্যধরনের মায়া মানুষের কানে সৃষ্টি করে তা নিয়ে বহুকাল ধরেই ভাবছি। এই স্বরগুলির মধ্যে কী কানের ভিতর দিয়া মরমে পশে যাওয়ার কোনও অজানা ফর্মুলা রয়েছে? পন্ডিতরা হয়তো বলতে পারবেন। কিন্তু যাঁরা শাস্ত্রীয় মার্গের সুরচর্চা থেকে অনেক দূরে, অর্থাৎ ইতরযানী শ্রমজীবী মানুষজন, তাঁদের সঙ্গীতচর্চার মধ্যে পিলুর সুর খুব সহজে জায়গা করে নিয়েছে। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের লোকসুর ও লোকগানের জঁরগুলি, যেমন হোরি, ফাগুয়া, চৈতা বা ভক্তিগীতি ও শৃঙ্গারগীতি, সবারই পিলুভিত্তিক সুরের প্রতি স্পষ্ট আনুগত্য দেখা যায়। পিলু'র সে অর্থে কোনও 'শুদ্ধ' রূপ নেই। তীব্র স্বর বা কোমল স্বর কীভাবে প্রয়োগ করা হবে সে নিয়ে পন্ডিতেরা বিশেষ লাঠি ঘোরান না। প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো যাই গাওয়া বা বাজানো হোক না কেন, তা'কে শ্রুতিমধুর হতে হবে। আমার মতো ইতরশ্রোতারা তো প্রাথমিকভাবে সঙ্গীতের কাছে তাই চেয়ে থাকেন। তাই বোধ হয় প্রাজ্ঞ শ্রোতার কাছে এই সব রাগের বিশেষ কদর নেই, যেমন পিলু বা ভৈরবী। আমরা আম আদমিরা এই দুটি রাগের সঙ্গে মিলে মিশে জীবন কাটিয়ে দিই। কবি বলছেন, আমাদের জন্ম হয়েছিলো কোনও এক বসন্তের রাতে। সেই বসন্ত, যে ধুলোখেলার নেশায় ধরে রাখে ইতরযানী রুচি, যার বিপুল শারীরবৃত্ত যাপন ঘিরে থাকে সংখ্যালঘু মননবৃত্তের সেরিব্রাল জগৎ। এই দুই স্রোতের মিলনবিন্দুর অভিঘাত চিরকাল মানুষের মনে ভালোবাসার বীজপত্র অঙ্কুরিত করে যায়।

    #

    'বঁধুর কাছে আসার বেলায় গানটি শুধু নিলেম গলায়
    তারি গলার মাল্য করে করবো মূল্যবান....'

    বাঙালিরা যখন গান কম্পোজ করেন, কয়েকটি বিশেষ রাগের প্রতি তাঁদের অধিক পক্ষপাত থাকে। বাংলা নাগরিক গান যাঁর হাতে জন্ম নেয়, সেই নিধুবাবু গানের সুর করার সময় যে রাগগুলির প্রতি অধিক নির্ভরশীল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও দেখি মোটামুটি সেই সব রাগের ছায়া সুর করার সময় এসে পড়ে। এর মধ্যে প্রথম তালিকায় থাকে, ভৈরবী, খমাজ, বেহাগ, পুরিয়া, য়মন, কানড়া, কাফি। পরের তালিকায় ধরা যেতে পারে পরজ, ললিত, মালকোষ, তোড়ি, হামির, কেদার ইত্যাদি। এই লিস্টিটা রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী প্রায় সব বাংলা সুরকারদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, ভক্তিসঙ্গীত বা রঙিন গান, উভয়তঃ। পিলু এসে যুক্ত হয় প্রথম রবীন্দ্রনাথের রচনাতেই। পরবর্তীকালেও এই পক্ষপাতের ধারার ইতরবিশেষ হয়নি। কারণ এই সব রাগাশ্রয়ী সুরগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং যেহেতু মানুষ গানের কাছে প্রথমতঃ আশ্রয় খোঁজার জন্যই আসে, তাই চেনা গাছের ছায়াই অধিক কাম্য।

    শুধু যে বাঙালি শ্রোতারাই এই সব সুরে স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজে, তা নয়। এটা প্রায় সর্ব ভারতীয় ব্যাপার। শচীনকত্তা ছিলেন ভৈরবীর রাজা, পুত্রের ঝোঁক ছিলো খমাজে। পিলু'কে মাথায় করে রাখতেন ও পি নৈয়র। নৌশাদসাহেবেরও পিলুর প্রতি বেশ পক্ষপাত ছিলো। ও পি নৈয়র ১৯৫৪ সালে ' আরপার' ছবিতে শমশাদ বেগমকে দিয়ে গাইয়ে 'কভি আর কভি পার' গানটি সুপারডুপার হিট করেছিলেন। তার পর থেকে পিলুর উপর তাঁর হয়তো একটা দুর্বলতা জন্মায়। অবশ্য তিনি যে দেশের লোক, অর্থাৎ পঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের লোকগানে পিলুর বিশেষ প্রভাব রয়েছে, যা হয়তো তাঁর কান'কে শৈশব থেকেই মজিয়েছিলো। তাই পিলুনির্ভর সুর তাঁর গানে ফিরে আসতো। এই নিয়ে কেউ একজন কটাক্ষ করায় তিনি বলেন পিলুর সুরের মধ্যে এতো রকম সম্ভাবনা আছে যে মানুষের সব রকম আবেগ, আকর্ষণ, আশ্লেষকে তা অবলীলায় ধরে রাখতে পারে। সে সময়ই প্রায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে ১৯৫৮ সালে বিভূতি মিত্র পরিচালিত 'ফাগুন' ছবিতে আট-ন'টি গানের সব গুলিই পিলু-আশ্রিত সুরে কম্পোজ করেছিলেন। সঙ্গে রাগ বসন্তের কিছু অনুষঙ্গ ছিলো। প্রায় সব গানই হিট হয়েছিলো, কয়েকটি সুপার হিট। সিনেমাটি অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু গান গুলি আজও বেঁচে আছে। ' এক পরদেশি মেরা দিল লে গয়া', 'সুন জা পুকার', 'পিয়া পিয়া ন লাগে মোরা জিয়া', ইত্যাদি। সেই থেকে যে ট্র্যাডিশন শুরু হয়েছে আল্লা রাখা রহমান পর্যন্ত তার জয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ।

    #

    আমাদের চিরকালীন শাস্ত্রীয় ও উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে প্রাচীনতম রেকর্ড পাচ্ছি ১৯০৮ সালে গাওয়া অচ্ছনবাইয়ের পিলু। তার পর কে নেই সেই তালিকায়? সুরের ঈশ্বরকোটী আবদুল করিম, বড়ে গুলাম, ভীমসেন ছাড়া ইন্দুবালা, সিদ্ধেশ্বরী দেবী, রসুলন বাই, বেগম আখতার, রোশনারা বেগম, প্রভা আত্রে, গিরিজা দেবী, শিপ্রা বসু এবং অজয় চক্রবর্তী সব্বাই আছেন। এতো গেলো কণ্ঠসঙ্গীতে। বাল্যকালে আমার প্রথম শোনা রাগ পিলু পন্ডিত রবিশংকরের সেতারে, মিশ্র পিলু, সঙ্গে আল্লারাখা, চব্বিশ মিনিটের বাজনা, এই রাগটির সঙ্গে আমাকে চিরকালের জন্য বেঁধে ফেলে। পরে শুনি তাঁর আগে বাজানো দশ মিনিটের পিলু ঠুমরির রেকর্ডটি, সঙ্গতে চতুরলাল। আরো পরে অনুষ্কার সঙ্গে রঙ্গিলা পিলু। কিন্তু একটি স্মৃতিচারণে তিনি বলেছিলেন ইয়েহুদি মেনুহিনকে সম্মত করে তাঁর সঙ্গে যুগলবন্দির রেকর্ডটিই তাঁর বিশ্বজয়ের প্রথম সোপান। এখানেও রাগটি ছিলো পিলু। তাঁর গুরুভাই নিখিল বন্দোপাধ্যায় এবং অপরজন অফতাব-এ-সিতার বিলায়ত খান সাহেব বড়ো করে বাজিয়ে রাগ পিলু রেকর্ড করেছিলেন। এই বাজনাগুলি শুনলে বোঝা যায় এই সব গুরুরা তথাকথিত অল্পপ্রাণ পিলু রাগের মধ্যে কী সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছিলেন। এছাড়া আমার চিরকালের প্রিয় পিলুর উপস্থাপনার লিস্টিতে আছেন পন্ডিত বুধাদিত্য, পন্ডিত শিবকুমার, পন্ডিত হরিপ্রসাদ, উস্তাদ শাহিদ পরভেজ, উস্তাদ রইস খান, উস্তাদ আসিফ আলি খান, পন্ডিত ব্রিজ ভূষন কাবড়া এবং সরোদের দুই দেবতা উস্তাদ আলি আকবর ও উস্তাদ আমজাদ আলি।

    চিরকালের জন্য কোনও নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত হলে উস্তাদ বড়ে গুলামের 'সঁইয়া বোলো তনিক মোহে রহিও ন জায়' অবশ্য সঙ্গে যাবে, তৎসহ তাঁর ঘরের আরেক দুর্লভ সঙ্গীত প্রতিভা গুলাম আলি সাহেবের গাওয়া সেই একই গান অন্য মেজাজে, তাকেও যেতে হবে।

    #

    বসন্ত নিয়ে আড্ডায় এই সব কথাই তো হয়। জীবনের কাছে আর অতিরিক্ত কীই বা চাওয়ার থাকে ইদম অগ্নয়ে অমৃতরসের স্বাদ পাওয়ার পর। আমাদের চারজনের বসন্ত উৎসবে সারাদিনের কথোপকথন বাকি জীবনের জন্য কিছু সঞ্চয় তো নিশ্চয় রেখে গিয়েছিলো সেদিন। বাকিদের চোখে ছিলো নতুন কিছু জানতে পাওয়ার তৃপ্তি আর পর্ণার চোখে এক অন্য বিশ্ব আবিষ্কার করার রোমাঞ্চ। সেদিন সন্ধেবেলা জনান্তিকে বলেছিলো, একটা রাগই যদি এতো পরিপূর্ণতার স্পর্শ এনে দেয়, তবে এতো বিস্তৃত সুরের জগতের স্বাদ কোন স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। আমি বলি, সেই জন্যই তো গড দ্য অলমাইটি বৈকুণ্ঠলোকেরও উপরে আমার জন্য একটা স্বর্গ বানিয়ে দিয়েছেন।
    - তাইইই, তা সে স্বর্গটির নাম কী জানতে পারি ?
    -এখনো দেওয়া হয়নি...ভেবেছি তোমার নামে দেবো, আপত্তি করবে কি?
    সে হাসেও না, কথাও বলেনা, শুধু চোখ্দুটো তাকিয়ে বলে, সত্যি বলছো....?

    '... ভালোবাসি সেই কথা তোমাকে তো বলি বার বার
    আকাশ যেমন বলে, মাটি শোনে রৌদ্রে মেঘে আর
    অন্ধকারে বার বার। তুমিই শিউরে ওঠো
    বর্ষে বর্ষে মাটির মতন....' (বিষ্ণু দে)

    (ক্রমশঃ)
  • nina | 79.141.168.137 | ২৩ এপ্রিল ২০১৩ ০৫:০২601432
  • সঙ্গে আছি---
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন