এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • দূর্গাপুর আর ই কলেজের জীবন ও সংগ্রামঃ ১৯৬৬-৭০এর দিনগুলি

    দিলীপ
    অন্যান্য | ২৬ আগস্ট ২০১৩ | ১৯৮০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দিলীপ | 116.199.70.57 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ১৫:৫৬619663
  • ১৯৬৬ সালে ১৯ বছর বয়সে দূর্গাপুর আর ই কলেজের ছাত্র হিসাবে আমি বাংলায় আসি। কলেজটিতে তখন আই আই টি এন্ট্রান্সে পাস করা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৫০% আসন সংরক্ষিত ছিল এবং সে কারনে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বেশ ভাল সংখ্যক অবাঙ্গালী ছাত্রের উপস্থিতি ছিল।
    আমার বাবা ছিলেন প্রতিরক্ষা বিভাগে কর্মরত একজন কেরানী। কানপুরের এক শ্রমিক বস্তিতে থাকতাম। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার, ভূ-সম্পত্তির সাথে কোনরকম সম্পর্ক ছিলনা। কম বয়সে যুক্তিবাদী নাস্তিক অবস্থান থেকে শুরু করে '৬০ দশকের প্রথম ভাগে সর্বোদয় আন্দোলনের প্রতি স্বল্পস্থায়ী ঝোঁক এবং তারপর '৬০ দশকের মাঝামাঝি শ্রমিক আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে তাঁদের সাথে জীবন্ত যোগাযোগের কারনে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কম্যুনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হই। কানপুরের সাংসদ তখন একজন কম্যুনিষ্ট, এস এম ব্যানার্জী। আমাদের এলাকার এমএলএ-ও কম্যুনিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ান লীডার সন্ত সিং ইউসুফ।

    কলেজের আবহাওয়া ছিল দম আটকানো। সেনা ছাউনির মত রেজিমেন্টেড জীবন কাটাতে হত। যে কোন রকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ বা স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একবার কর্তৃপক্ষ জানতে পারল যে একজন ছাত্র হস্টেলের রুমে মার্ক্স-এর বই পড়ছে। হস্টেল তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হয় এবং ছাত্রটিকে রাস্টিকেট করার হুমকি দেওয়া হয়। মাত্র একবারই, ১৯৬৫ সাল নাগাদ, কিছু স্টুডেন্ট একটা স্ট্রাইক সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিল যা চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এই ঘটনা কর্তৃপক্ষের মনোভাবকে আরও কঠোর করে তুলেছিল।
    প্রতি বছর 'জিমখানা' কমিটির নির্বাচন হত। কর্তৃপক্ষের দ্বারা অনুমোদিত রুটিন মত সাংস্কৃতিক কর্মসূচী গ্রহন করাই ছিল জিমখানা সংস্থার কাজ। ছাত্র-ছাত্রীর ব্যাপক অংশেরই রাজনীতি সম্পর্কে কোন আগ্রহ ছিলনা। পেটি-বুর্জোয়া জীবন যাপন ও কেরিয়ার নিয়ে আচ্ছন্ন ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, মূলত কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্রদের একাংশের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য স্থানীয় শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ আর ই কলেজের ছাত্রদের ভীষণ অপছন্দ করত।

    সেই সময়কার পশ্চিমবাংলার বুকে একটা কলেজের এই ছিল অবস্থা, অথচ চারপাশে এক বাম অভ্যুত্থান ফেটে পড়ছিল।

    হিউম্যানিটিজ-এর ক্লাসে টাকার তৎকালীন অবমূল্যায়ন বিষয়ে শর্ট নোট লিখতে দিলে আমাদের সেকশানে কেবল রবিচন্দ্রন ও আমি আমেরিকার চাপকে ধিক্কার জানিয়ে লিখেছিলাম এবং শিক্ষকের দ্বারা 'বামপন্থী' হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিলাম।
    তামিলনাড়ুর উজ্জ্বল ছাত্র রবিচন্দ্রন পরবর্তিতে পার্টির হোলটাইমার হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের জেলে ছিল কয়েক বছর। পরবর্তিতে আবার পড়াশুনা শুরু করে। কানপুরে এম টেক পড়ার সময় সি আর সি-র প্রভাবে আসে। বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরের কোন এক গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করে। ওঁর এখনকার রাজনৈতিক অবস্থান কি জানিনা। যাই হোক, কলেজের দিনগুলোতে রবিচন্দ্রন ছিল আমার ঘনিষ্ঠ কমরেড।
    কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি সত্ত্বেও আমরা সাত-আটজন মিলিত হয়ে প্ল্যান করেছিলাম লোকাল সিপিআই(এম)-এর সাথে যোগাযোগ করব, অবশ্যই গোপনে।

    বাঙালী ও অবাঙালী ছাত্রদের মধ্যে এক বিশাল ব্যবধান ছিল, বলা চলে, একটা টেনশন সবসময় কাজ করত এবং অবাঙালী হিসাবে শুরুতে আমি বেশ অসুবিধায় পড়েছিলাম। খুব দ্রুত আমি ভাষাটা শিখে ফেলি এবং অল্প সময়ের মধ্যেই আমার বন্ধু মহল হয়ে যায় মূলত বাঙালী। অবাঙালীদের প্রতি মনে মনে ঘৃণা পোষণ করত এরকম কিছু বাঙালীও আমার জীগরি দোস্তে পরিণত হয়েছিল।
    অবাঙালী কমরেডদের কথা বলতে গেলে কমরেড ওমস্বরূপের কথা বলতেই হয়। কলেজের রীসার্চ ফেলো, আন্দোলনে যোগ দিয়ে পার্টির হোলটাইমার হয়ে যায়। কাপুরূষের মত সিপিআই(এম) গুন্ডারা ঠান্ডা মাথায় ওমস্বরূপকে হত্যা করেছিল, ১৯৭১ সালে দূর্গাপুরে। মেধাবী ইন্টেলেকচুয়াল এই ছেলেটি কম্যুনিস্ট গুণাবলীর দিক থেকে ছিল আমাদের সবার সেরা।
    আর ছিল ব্রীজ বিহারী পাণ্ডে, আমার ছেলেবেলার বন্ধু। একই সাথে আমরা কলেজে এসেছিলাম, একই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে পার্টিতে আসি। বর্তমানে ও আমাদের পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা।
  • দিলীপ | 116.199.70.57 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ১৬:০২619674
  • যে কথা হচ্ছিল, সিপিআই(এম)-এর সাথে আমাদের প্রাথমিক যগাযোগ হতে না হতেই ঘটে গেল নক্সালবাড়ি আর আমরা সবাই রাতারাতি বনে গেলাম 'নক্সালপিন্থী'। এই পর্যায়ে আমরা গোপনে বিপ্লবী প্রচারকার্য চালাতাম। সামান্য কয়েকজনই আমাদের প্রভাবে এসেছিল। পাশাপাশি, সিপিআই(এম) থেকে বেরিয়ে আসা শ্রমিক ক্যাডারদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং টাউনশীপে শ্রমিকদের জিবি মিটিং-এ বক্তব্য রাখতাম, সিপিআই(এম) লীডার ও ক্যাডারদের সাথে তীব্র বিতর্ক চালাতাম।

    আরও এগনোর আগে পুরনো ব্যাচগুলোর কিছু কমরেডদের কথা তোমাদের জানাই। এরা পার্টিতে যোগ দিয়েছিল এবং 'নক্সাল' আন্দোলনে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শান্তি চ্যাটার্জী ছিলেন এমনই একজন। ১৯৭১-৭২ নাগাদ ত্রিপুরার দায়িত্বে ছিলেন। আমার সাথে কখনও দেখা হয়নি, বর্তমানে কোথায় থাকেন তাও জানিনা। প্রবল রায়, খুব সোবার ও আন্তরিক কমরেড যার বাড়ি থেকে সিএম গ্রেপ্তার হন, আমাদের কলেজেরই ছাত্র ছিল। আমি তার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নাই। আশীষ দাশগুপ্ত ছিল আমার এক বছরের সিনিয়র। কলেজের বিষয়-আসয়ে তার খুব একটা আগ্রহ ছিলনা। সে ছিল জ্ঞানী ছেলে এবং প্রতিশ্রুতিবান মার্ক্সবাদী স্কলার। বহুদিন তার সাথে দেখা হয়নি, যতদূর জানি সিপিআই(এম-এল) শান্তি পাল গ্রুপের সাথে যুক্ত আছে।
  • দিলীপ | 116.199.70.57 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ১৬:৪৯619685
  • ১৯৬৮ সাল। জিমখানা নির্বাচন সামনে এসে গেল। আমরা ঠিক করলাম নির্বাচনে লড়ব এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে এই মঞ্চটাকে ব্যবহার করব। যদিও ক্যাম্পাসে আমাদের তেমন রাজনৈতিক সমর্থন ছিলনা, তথাপি ব্যক্তিগত স্তরে আমরা খুব পপুলার ছিলাম। আমরা প্রায় সবকটি অফিস বিয়ারার পদেই জিতে গেলাম। আমিও একজন মেম্বার হিসাবে নির্বাচিত হলাম, একমাত্র অবাঙালী মেম্বার।

    আমরা কালচারাল প্রগ্রামের চেহারা চরিত্র বদলে দিতে শুরু করলাম। কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা ধরতে পারল না। কলেজ ম্যাগাজিনের নাম পাল্টে রাখা হল 'ভ্যানগার্ড' এবং প্রথম ইস্যুতে (টিচার ইন চার্জকে অন্ধকারে রেখে) চেয়ারম্যান মাও ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে সম্পাদকীয় লেখা হল। পত্রিকা বিলি হতেই মৌচাকে ঢিল পড়ল। আমরাই প্রথম কামান দেগেছি, পরিণাম সামনা করার জন্য প্রস্তুত রইলাম।

    প্রিন্সিপাল জিমখানা মেম্বারদের ডাকলেন। সবাইকে রাস্টিকেট করার হুমকি দেওয়া হল। কয়েকজন মেম্বার, যারা আমাদের ছেলে নয়, পিছু হটল; কিন্তু দেবাশীষ, অসিত, আমি ও অন্য কয়েকজন দায় স্বীকার করলাম। দেবাশীষ ভালো গান গাইত, ভালো সাংস্কৃতিক কর্মীও ছিল, পরবর্তিতে পার্টির হোলটাইমার হয়ে কয়েক বছর গ্রামাঞ্চলে কাজ করেছিল। অসিত ছিল গুরুত্বপূর্ণ পার্টি সংগঠক, বহু বছর গ্রামাঞ্চলে কাজ করে।

    ছাত্র ফ্রন্টে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনীতিকরণের এই আকস্মিক হেভী ডোজ হজম করতে ব্যর্থ হয় এবং তাদের এই অসূয়া ও অসহমত্যকে হাতিয়ার করে ছাত্রদের মধ্যেকার কম্যুনিষ্ট বিরোধী অংশ প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করে। 'ভ্যানগার্ড' পত্রিকা পোড়ানো হয়। আমরা ছিলাম মাত্র চার-পাঁচজন। প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিলনা। কিন্তু, মিছিল পাস করার সময় আমরা মাও ও চীনের সমর্থনে শ্লোগান দিই। ফেরার পথে মিছিলকারীরা আমাদের ঘরে চড়াও হয়। আমাদের ধোলাই দেওয়া হয়।

    যাই হোকনা কেন, এই ছিল প্রথম প্রকাশ্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও কর্তৃপক্ষকে প্রকাশ্যে অমান্য করা। আমরা আমাদের বহিষ্কারের আদেশ ঘোষিত হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। এরকম সময়ে একটা ঘটনা অবস্থাটা বদলে দিল।
  • | 24.97.108.143 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ১৬:৫৩619696
  • পড়ছি .........
  • সে | 203.108.233.65 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ১৬:৫৭619707
  • তারপর?
  • Blank | 180.153.65.102 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ১৭:০৮619718
  • দিলীপ বাবু কি নিজে লিখছেন এটা। আপনার লেখা পড়ে অন্তত অবাঙালী বলে মনে হচ্ছে না। লিখতে থাকুন, পড়ছি।
  • দিলীপ | 116.199.70.57 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ১৭:২৬619726
  • প্রয়োজনীয় এটেন্ডেন্স না থাকা স্টুডেন্টদের একটা ব্ল্যাকলিস্ট বানিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবেনা তাদের। এই লিস্টে ছাত্রদের দুই শিবির থেকেই অনেকের নাম ছিল। ফলত বিষয়টা কমন ইস্যুতে পরিণত হয়। অনেকদিন ধরেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষোভ জমছিল এবং এই ইস্যুতে তা বিষ্ফোরক মাত্রা নেয়। ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হল। চূড়ান্ত সফল। কর্তৃপক্ষ ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে কোন ভাবেই ধর্মঘট ভাঙতে পারলনা। আন্দোলন স্টেলমেট অবস্থায় পৌঁছল। শেষে একদিন, সমস্ত টিচারদের মিটিং চলাকালীন আমরা ঘেরাও সংগঠিত করি। সকাল ১০টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঘেরাও চলে। ভোর তিনটে নাগাদ, যখন কয়েকজন ছাত্রই মাত্র উপস্থিত ছিল, টিচাররা ব্যারিকেড ভেঙ্গে বেড়িয়ে যান। এই পয়েন্টে এসে আন্দোলন হিংসাত্মক মোড় নেয়। মুহুর্তের মধ্যে শয়ে শয়ে ছাত্র লাঠি ও রড হাতে হস্টেল থেকে বের হয়ে আসে, স্টাফ কয়ার্টারের দিকে ধেয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের লোকেদের ফ্ল্যাটগুলি আক্রান্ত হয়। পুলিশ ডাকা হয়েছিল, কিন্তু আতঙ্কিত কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের দাবীর কাছে মাথা নত করে। ব্ল্যাকলিস্ট প্রত্যাহার করা ছাড়াও কলেজ পরিচালনায় ছাত্রদের অংশীদার করার দাবী মেনে নেয়। কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।

    তখনকার দিনগুলিতে আমরা সেই সময়কার ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম। কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রসাধারণের দ্বন্দ্বকে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের দ্বন্দ্বের মত করে ভাবা, ক্যাম্পাস কন্ট্রোল করা ও সমান্তরাল প্রশাসন চালান ইত্যাদি ধারণা আমাদের সার্কেলে বেশ প্রবল ছিল। আন্দোলনে আমাদের কমরেডরা মতাদর্শগত অভিমুখ আরোপ করার প্রচুর চেষ্টা চালায়। কিন্তু আন্দোলনটা ছিল মূলত স্বতস্ফূর্ত চরিত্রের এবং কোন একসারি পরিচিত নেতৃত্ব বা মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত এমন দাবী করার উপায় ছিলনা।

    আমাদের কলেজের ছাত্র আন্দোলনের প্রথম পর্ব এভাবেই শেষ হয় এবং এর পর থেকে কর্তৃপক্ষ রক্ষণাত্মক অবস্থান নিতে শুরু করে। এইভাবে আমাদের কলেজ তৎকালীন পশ্চিমবাংলার ছাত্র-আন্দোলন ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের মূলস্রোতে স্থাপিত হয়।

    আমাদের রাস্টিকেটের ইস্যু আন্দোলনের গভীরে চাপা পড়ে যায়। তবে, ঘনিষ্ঠ কিছু ছাত্রের জোরাজুরিতে 'ভ্যানগার্ড'-এর পরবর্তি সংখ্যার সুর অনেকখানি মৃদু করে দেওয়া হল।
  • দিলীপ | 116.199.70.57 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ১৮:০০619727
  • কলেজের ভেতর পূর্ণমাত্রায় রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হয়ে গেল। ১৯৬৯-এর শুরুর দিকে কাশীপুর ও ইছাপুরে শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে টাউনশীপের রাস্তায় মিছিল সংগঠিত করলাম আমরা। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মসূচীও নেওয়া হল। টাউনশীপের শ্রমিকদের সংগ্রামের সংহতিতে ছাত্রদের মোবিলাইজ করা হল। অগ্রণী কমরেডরা শ্রমিকদের জিবি মিটিং-এ বক্তব্য রাখার কাজ চালিয়ে গেল। এর সাথে, একটা বস্তিতে নাইট স্কুল চালু করা হল যেখানে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা গরীব বাচ্চাগুলোকে পড়াতে যেত। জনগণের সাথে আন্তক্রিয়ার উপায় হিসাবেই এটা করা হয়েছিল।

    বাইরে সিপিআই(এম)-এর সাথে আমাদের সংঘাত লীডার ও ক্যাডারদের সাথে বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ওদের মুখ বন্ধ করতে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় হাতিয়ার ছিল লেনিনের 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব' বইখানি। কলেজে আমাদের কার্যকলাপ নিয়ে অবশ্য সিপিএম খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। কারণ কলেজে ওদের কোন প্রভাব ছিলনা।

    কলেজের ভেতর এন্টি-কম্যুনিস্ট লুম্পেন টাইপের ছাত্রদের সাথে আমাদের সংঘাত বেশ তীব্র আকার নিতে থাকল। ওরা আমাদের এক্টিভিটি সহ্য করতে পারত না। প্রগতিশীল নাট্য অনুষ্ঠানের সময় ওরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। পরীক্ষাটা হয়ে যাওয়ার পরই আমরা ওদের উচিত শিক্ষা দেব সিদ্ধান্ত নিলাম। ইতিমধ্যে আমাদের ভেতর বেশ কয়েকজন পড়াশুনা ছেড়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে কাজ করব বলে ঠিক করে ফেলেছিলাম।

    যাই হোক, আবার একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল।
  • siki | 127.192.13.45 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ২৩:০৪619664
  • বাপ্পো! রোকেয়া এত তাড়াতাড়ি খুঁজে ফেলল?

    দিলীপবাবু কি এটা অনুবাদ করছেন?
  • cm | 233.185.147.14 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ২৩:১০619665
  • এদের একটু তর সয় না।
  • তাতিন | 127.197.66.150 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ২৩:১২619666
  • অনুবাদটা চলুক না
  • দিলীপ | 120.227.166.185 | ২৬ আগস্ট ২০১৩ ২৩:৫০619667
  • ১লা জুন, পাশের চক থেকে পুলিশ দু'জন কলেজ স্টুডেন্টকে গ্রেপ্তার করে। ট্রাফিক পুলিশ এক বেকসুর ট্রাক ড্রাইভারকে মারধর করায় ওই দুই ছাত্র তার প্রতিবাদ করেছিল। কলেজে খবর পৌঁছন মাত্র শয়ে শয়ে ছাত্র লাঠি নিয়ে স্থানীয় পুলিশ পোস্ট রেইড করে, যে ক'জন পুলিশকে সামনে পায় পেটায় এবং দুই ছাত্রের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে জিটি রোড অবরোধ শুরু করে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী আসতে শুরু করে। গুলি চালানর হুমকি দেয়। কিন্তু ছাত্ররা রাস্তা ছাড়তে অস্বীকার করে। পুলিশ ইন্সপেক্টর কথা বলতে আসতেই তাকে ঘিরে ফেলা হয় এবং কার্যত ঠেলতে ঠেলতে কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়া হয়। আমরা তার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করি ও তাকে মাও চিন্তাধারার ওপর লেকচার দিই। পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে সংবাদ পাঠান হয় যে আমাদের ছাত্রদের ছেড়ে দিলেই অফিসারকে ছেড়ে দেওয়া হবে। সন্ধ্যা নাগাদ প্রশাসন দুই ছাত্রকে ছেড়ে দিল। আমরাও অক্ষত অবস্থায় ইন্সপেক্টরকে ছেড়ে দিলাম। জয়ের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল ছাত্রদের মধ্যে। কিন্তু গল্প যে সবে শুরু তা হৃদয়ঙ্গম হল পরদিন।
  • দিলীপ | 120.227.166.185 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০০:০৬619668
  • পরদিন সকালে শত শত সশস্ত্র পুলিশ চারিদিক থেকে ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলল। মিনিট খানেকের মধ্যে আমরাও শখানেক ছাত্র বেরিয়ে গিয়ে ঢিল ছোঁড়া শুরু করলাম। বিনা বাক্য ব্যয়ে পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করল। প্রকাশ পোদ্দার মারা গেল। তারপর ওরা মার্চ করে কলেজের ভেতর ঢুকে পড়ল, কলেজে তখন পরীক্ষা চলছিল। সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত তারা যাকে সামনে পেল পেটাল, লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের দরজা ভেঙ্গে বের করল; ১০০র বেশী ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীকে আহত আবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। জেলা প্রশাসন ও হোম মিনিস্টারকে কর্তৃপক্ষ পাগলের মত ফোন করতে থাকল কিন্তু কোন লাভ হলনা। ওদের একটাই বক্তব্য যে পুলিশ বিদ্রোহ করেছে এবং তার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরাই দায়ী। বিকেল চারটায় ইএফআর আসার পর পুলিশ ফিরে গেল।

    পুলিশের এই আকারের গুলি চালনা ও নির্মমতা সামনা করার এটাই ছিল আমাদের প্রথম অভিজ্ঞতা। মনে আছে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে, প্রতিশোধ নেবার শপথ করেছিলাম। আর, পেশাদার বিপ্লবী হিসাবে বিপ্লবের কাজে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব চিরতরে অবসান হয়ে গেছিল।

    হ্যাঁ, শ্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারে ছিল তখন। প্রেসিডেন্সী কলেজ ও যাদবপুর বিস্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পুলিশের গুলি চালনাকে ধিক্কার জানিয়ে বিক্ষোভ সংগঠিত করে। জ্যোতি বসুর সামনে আমাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনেও আবার পুলিশের লাঠি চলে।
  • দিলীপ | 120.227.166.185 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০০:২৬619669
  • "রেড স্টার ওভার দূর্গাপুর" নামে স্টেটসম্যান পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হল। ১লা জুনের ঘটনাবলী দেখে সিপিআই(এম) ভাবল 'নক্সালরা' বুঝি কলেজে খুব শক্তি অর্জন করে ফেলেছে এবং সেজন্য সবক শেখাতে সিপিএম তথাকথিত পুলিশ বিদ্রোহকে এলাউ করেছিল। বাস্তবে অবশ্য এসবই ছিল পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে দেখা। সমগ্র আন্দোলনটাই ছিল সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের লড়াই, পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার স্বাভাবিক স্পৃহার বহিঃপ্রকাশ। আন্দোলনের পুরোভাগে আমরা ছাড়াও সেই সমস্ত ছাত্রেরা ছিল যাদের সাথে আমাদের বৈরীতার সম্পর্ক। গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্র দু'জন ছিল সাধারণ ছাত্র। প্রকাশও তাই। এটা ছিল ছাত্রসমাজের বিক্ষোভের স্বতস্ফূর্ত বিস্ফোরণ। আমাদের সবক শেখানোর বদলে এই ঘটনা ছাত্র সমাজকেই সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়, কলেজ সত্যি সত্যিই আমাদের লাল ঘাঁটিতে পরিণত হয়। আমাদের কর্মী সমর্থক ব্যাপক প্রসারিত হয় এবং আমরা সমগ্র ছাত্র-ছাত্রীদের নেতা হিসাবে উঠে আসি।

    এই অবস্থায় কিছু লুম্পেন এলিমেণ্ট, যাদের নিজেদের আর কিছু করার ছিলনা, বাইরের সিপিআই(এম)-এর সাথে যোগাযোগ করে এবং সিপিআই(এম)ও কলেজে পা রাখার লোভে তাদের প্রশ্রয় দিতে শুরু করে। কলেজে কোনঠাসা হলেও বাইরের বিশাল সিপিএম বাহিনীর মদতে এরা কলেজের মধ্যে বিভিন্ন ঝামেলা পাকাতে শুরু করে। অবশেষে, সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে, একদিন তাদের আচ্ছা করে ধোলাই দেওয়া হয়। সিপিআই(এম) বেশ ভালো সংখ্যক শ্রমিক সহ কয়েকশ জনের বাহিনী নিয়ে পালটা আক্রমণ সংগঠিত করে। রক্তপাত এড়াতে আমরা পিছিয়ে আসি। আমাদের মধ্যে পনের জনকে অবশ্য ওরা ধরে ফেলে, মারধর করে এবং শ্রমিক কোয়ার্টারে দু'দিন আটকে রাখে। আমরা সিপিআই(এম) নেতাদের সাথে তীব্র বিতর্কে লিপ্ত হই এবং আমাদের মুক্তির দাবীতে হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, শ্রমিকেরা এবং সিপিআই(এম) নেতাদের একাংশ আমাদের আটকে রাখাটাকে মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা খুব সহানুভূতি সহকারে আমাদের শুশ্রূষা করে, ছলছল চোখে আমাদের অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নেতারা আমাদের নিরাপদে মুক্ত করে।

    ইত্যবসরে কলেজের মধ্যে লুম্পেন অংশটা স্বেত সন্ত্রাস শুরু করে। আমাদের সমর্থকদেরও নির্দয় ভাবে মারে। আমরা গোপনে প্রস্তুতি নিতে থাকি। দু'মাসের মাথায় আকস্মিক ও ক্ষিপ্র হামলা চালিয়ে বদমাসগুলোকে উত্তম মধ্যম দেওয়া হয় ও স্বেত সন্ত্রাসের অবসান ঘটান হয়। শ'য়ে শ'য়ে ছাত্র উল্লাস করতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সিপিএম বাইরে থেকে আক্রমণ চালায়, কিন্তু কয়েক ঘন্টার বোমাবাজীর পর পিছু হটতে বাধ্য হয়। পুলিশ ছাত্রনেতাদের ধরবার জন্য প্রায় শ'পাঁচেক ছাত্রকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু ততক্ষণে বেশীরভাগ কমরেডই নিরাপদ যায়গায় চলে এসেছে। এরপর থেকে কলেজে আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন আমরা যাকে বলতাম 'লাল সন্ত্রাস' , সেই লাল সন্ত্রাস প্রতিষ্ঠা করেছিলাম আমরা। সিপিআই(এম) নাক গলানো বন্ধ করে আর সেই রীং লীডাররাও হাওয়া হয়ে যায়।

    এভাবে শুরু হয় আমাদের আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়।
  • দিলীপ | 120.227.166.185 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০০:৫৮619670
  • কম্বোডিয়ায় মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ধর্মঘট সংগঠিত করি আমরা। ধর্মঘট সম্পূর্ণ সফল হয়। নিম্নরুচীর অশ্লীল পুস্তিকার বিরুদ্ধে অভিযান সংগঠিত হয়। প্রত্যেক রুম থেকে বের করে প্রকাশ্য জায়গায় ওইসব পত্রিকা পোড়ানো হয়। ছাত্রদের স্থানীয় জনসাধারণের সাথে ঠিকঠাক ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অনেকগুলো ব্যাচ স্থানীয় শ্রমিক কলোনীতে রাজনৈতিক প্রচার কাজে অংশ নিত।

    প্রায় ২০০০ ছাত্রের রাজনৈতিক সমাবেশ সংগঠিত করে কলেজ বিল্ডিং-এর চূড়ায় লাল পতাকা ওড়ানো হয়। শ্রমিকদের সংগ্রামের খবর এলেই শ'য়ে শ'য়ে ছাত্র গিয়ে তাতে যোগ দিতাম।

    সম্ভবত ১৯৭০-এর মে মাস। সে সময়ে আমাদের অনেক ক্যাডারই গ্রামাঞ্চলে অথবা শ্রমিক মহল্লায় কাজ করতে চলে গেছে। আমি তখন পার্টি নেতার দায়িত্ব নিয়েছি, কলেজের কাজ দেখভাল করা ছাড়াও দূর্গাপুর পার্টি সংগঠনের সাধারণ কাজকর্মও দেখতে হয়।

    কমরেড ধূর্জটি বক্সী ছিলেন একজন সিনিয়র কমরেড যিনি কলেজ ছেড়ে পার্টি হোলটাইমার হন। বর্তমানে তিনি আমাদের পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা।

    কলেজে আরেকজন নেতা ছিলেন গৌতম সেন, সুবক্তা এবং কম্যুনিস্ট গুণাবলীতে আমাদের সবার সেরা। আমাদের কিছু মতবিরোধ ছিল কিন্তু আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই সেগুলোর মীমাংসা করতাম। পরবর্তিতে তিনি পার্টি হোলটাইমার হন। বর্তমানে, যদ্দুর জানি, তিনি মজদুর মুক্তি নামে একটি গ্রুপ ও কলকাতা থেকে একই নামে একটি পত্রিকা পরিচালনা করেন।

    সেই 'লাল সন্ত্রাস'-এর জমানায় আমরা প্রতিক্রীয়াশীল ও লুম্পেন বিশেষ করে স্বেত সন্ত্রাসের সময়কার মস্তান সর্দারদের জন্য কিছু কিছু শাস্তির বন্দোবস্ত করেছিলাম। ব্যাপারটা চূড়ান্ত জাগায় পৌঁছল যখন রিংলীডার মধুসূদন ক্ষমা চেয়ে কলেজে ফিরে এল। ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে প্রবল ঘৃণা করত এবং একদঙ্গল ছাত্র তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এই ছিল আমাদের 'লাল সন্ত্রাস'-এর পরিসমাপ্তি, কারণ পুলিশ কলেজের দখল নিল ও অনর্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। আমারও ছাত্রনেতা হিসাবে কাজকর্ম শেষের পথেই ছিল এবং আর একবার কলেজে ফেরার মত অবস্থায় ছিলামনা।
  • দিলীপ | 120.227.166.185 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০১:২০619671
  • পেছন ফিরে তাকিয়ে এখন মনে হয় যে সেই 'লাল সন্ত্রাস'-এর দিনগুলিতে আমরা অনেক বাড়াবাড়ি করেছিলাম এবং এর প্রাথমিক দায় মূলত আমার ওপরই বর্তায়। আর যাই হোক, মধু ছিল একজন ছাত্র এবং সে পড়াশোনা চালাতেই ফিরে এসেছিল। আমি ভাবতেই পারিনি মারধরের পর ও মারা যাবে। ওর মৃত্যুতে মাঝে মাঝেই আমার আক্ষেপ হয়েছে, চেষ্টা করলে আমি আমার জঙ্গী কমরেডদের নিরস্ত করে ওকে বাঁচাতে পারতাম।

    চার বছর আগে, ট্রেনে যেতে যেতে, ঘটনাক্রমে এক ক্লাসমেটের সাথে দেখা হয়। ও এখন জেশপ ফ্যাক্টরিতে ইঞ্জনীয়ার। কলেজের দিনগুলিতে ও ছিল আমার বিরুদ্ধ শিবিরে। আমাদের হিটলিস্টে মধুর পরই ওর নাম ছিল। পুরন দিনের স্মৃতিচারণ করতে করতে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপচারিতায় সেই সময়কার বাড়াবাড়ি নিয়ে আমি অনুতাপ প্রকাশ করি। প্রত্যুত্তরে সে আমায় সান্ত্বনা দেয়। বলে যে তোমরা সেদিন অনেক ভালো কাজ করেছিলে, আমরাই বরং অনেক খারাপ কাজ করেছি যার শাস্তি আমাদের প্রাপ্য ছিল। গভীর আবেগের সাথে সে আমাকে বলে, "মিশ্র, আমি তোমার জন্য গর্ব বোধ করি"।

    তার কথা কি সেই প্রজন্মের ছাত্রদের বর্তমান অনুভবেরই অভিব্যক্তি? জানি না। দিনে দিনে ঘন কালো মেঘে সেই 'লাল তারা' ঢাকা পড়ে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, শক্তিশালী গণমাধ্যম, এক্স-নক্সাল প্রজাতি ও আমাদের নিজস্ব ভূল-ভ্রান্তির হাতে পড়ে পশ্চিমবাংলায় আমাদের আন্দোলনকে এমন সার্বিক লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে যে নির্দিষ্ট কোন পরিঘটনায় অর্জিত সাফল্য বা বিশেষ কোন প্র্যাক্টিসকে আলাদা করে চিহ্নিত করাই আজ দুষ্কর।

    আমাদের দিক থেকে শুধু এটুকু বলতে পারি যে আমরা একটা প্রফেশনাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রেজিমেন্টেড জীবনধারাকে ভাঙতে চেয়েছিলাম; ছাত্র সমাজের মাঝে বিপ্লবী প্রগতিশীল সংস্কৃতির সঞ্চার ঘটানর সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলাম; ব্যক্তিগত কেরিয়ার ছাড়া জীবনে যাদের আর কোন লক্ষ্য ছিলনা তাদেরকে বিপ্লবী রাজনীতি ও কম্যুনিস্ট মতাদর্শে শিক্ষিত করে তোলার জন্য প্রাণপাত করেছিলাম; শ্রমিক ও শ্রমজীবি মানুষের জীবন ও সংগ্রামের সাথে ছাত্র সমাজকে একাত্ম করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছিলাম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ও পুলিশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের উত্থিত করেছিলাম।

    প্রকাশ ও ওমস্বরূপ ছাড়াও তপন ঘোষ ও আনন্দ, দু'জন কলেজ ছাত্র, যাদের ১৯৭২ সালে আসানসোল জেলে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল, এই প্রক্রিয়ায় জীবন দিয়েছিল।

    আমি নিজে, ধূর্জটি বক্সী, ব্রীজ বিহারী পাণ্ডে, আশীষ দাস ও গৌতম সেন সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের সংগ্রামে নিযুক্ত, যিনি যে পথকে সঠিক মনে করেন সেই পথে।

    আমরা অনেক ভূল, অনেক বাড়াবাড়ি করেছি কিন্তু সর্বদাই ব্যাপক ছাত্রসাধারণের সমর্থনের ওপর ভর করে চলেছি। আমাদের স্বাধীন পরিচিতিকে বহন করে চলেও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবেই থেকেছি, তাদের সমস্যা ও দাবীকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরে লড়ায়ের সামনের সারিতে থেকেছি। আসলে এটাই ছিল আমাদের সমস্ত শক্তির উৎস এবং এই কারণেই কর্তৃপক্ষই হোক বা সিপিএম বা পুলিশ কেউই আমাদের ধ্বংস করতে পারেনি, বারবার আমরা ফিরে এসেছি।

    চে'র 'শহরে গেরিলা একশন'-এর তত্ত্ব আমরা কখনও ফেরি করিনি প্র্যাক্টিসও করিনি। 'কাকা' স্টাইল কোন সুপার হিরোও আমাদের মধ্যে থেকে জন্মায়নি। আমরা সর্বদাই পার্টির মূলধারার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম এবিং যদিও আমরা তীব্র বিতর্ক চালাতাম তবু দলাদলি ছিলনা আমাদের মধ্যে। বিস্তৃত পরিধিতে মার্ক্সবাদী সাহিত্য অধ্যয়ন ও রাজনৈতিক প্রচারে আমরা গভীর মনযোগ আরোপ করেছিলাম। একটা পর্যায়ে প্রায় ১০০জন ছাত্র পার্টি-হোলটাইমার হয়ে যায় যাদের একটা বড়ো অংশই গ্রামাঞ্চলে কাজ করতে যায়। আমাদের সম্পর্কে এসে যে চারজন শ্রমিক কমরেড হোলটাইমার হয়ে গেছিলেন তারা এখন আমাদের পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। বহু শ্রমিক ও তাদের পরিবার এখনও দূর্গাপুর আর ই কলেজের স্মৃতি বুকে বয়ে চলেন। বাকীটা ইতিহাস।

    যা যা মনে এল লিখে ফেললাম। স্মৃতির পথ বেয়ে তোমাদের আর ভারাক্রান্ত করতে চাইনা।
  • Ekak | 132.172.230.40 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০২:০৮619672
  • এতেন্দেনস না থাকলে পরীক্ষায় বসতে দেবেনা এর বিরুদ্ধে ছাত্র জমায়েত করে যে "আন্দোলনের" বীজ পোঁতা হয় সেখান থেকে কী বেরোবে জানা কথা । এখানে দেখছি সকলি মহান কারণ সকলি কমি । উহা বিজ্ঞান বলে ?
    গোটা রাজ্যটা কিভাবে হাঁসের পেছনে গেছে তার দলিল দেখতে পেলুম । স্বীকারোক্তির জন্যে ধন্যবাদ দিলীপ । কিছু তো স্খালন হোক ।
  • Ekak | 132.172.230.40 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০২:১৮619673
  • হয়ত একটু হার্শ্লি বোল্লুম কিন্তু এগুলো শুনলেই সেই প্রশ্নটা বারবার মনে আসে ।চুপ থাকা যায়না ।
    ওইদিপাউস যেদিন নিজের ভুল বুঝেছিল সেদিন চোখ অন্ধ করে ফেলেছিল । যারা প্রাহা র রাস্তায় সাঁজোয়া গাড়ি চালিয়েছিল তারা তাহলে কী করবে ভবিষ্যতে ? কিভাবে হাত ধোবে !
  • ছাত্র | 132.164.38.100 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৬:৫৮619675
  • বিনোদ মিশ্র লোকটার লেখা পড়ে একজায়্গায় বড্ডো দুঃখু পেলাম - A campaign was organised against obscene and cheap literature.

    এমনিতে তো একেতাকে পিটিয়ে, 'রেড টেরর' হ্যানত্যান করে দিন কাটাতো, আবার ছাত্রদের পানুও পড়তে দিত না! কি খোরাক লোক ছিল মাইরি! :d :d
  • h | 127.194.250.11 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৭:৩২619676
  • ভালো লাগলো। এই প্রথম একজন নকশাল আন্দোলনের নেতা স্ল্যাশ কর্মী কে বলতে শুনলাম, আমি ক্যালানোয় ছিলাম, আমি বিশুদ্ধ মরালিটির পক্ষে ছিলাম ইত্যাদি।

    এটা বেশ ফ্রেশ।
  • dd | 132.167.3.57 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৭:৫৩619677
  • সমস্ত রকমের অশ্লীলতা খারাব ছিলো। পানু, সিনেমাতে উত্তেজক দৃশ্য,মুক্তমেলার নাম করে তরুন তরুনীদের অবাধ মেলামেশা ও বেলেল্লাপনা এই সবই আমেরিকার ষড়যন্ত্র ছিলো। সিয়ার কারসাজি ছিলো।

    বিপ্লবের থেকে মুখ ফেরানোর জন্য তরুন সমাজকে এইসব প্রলোভোন দেওয়া হোতো।

    হোমসেক্স এক অবিশ্বাস্য খারাপ বুর্জোয়া রোগ। সব রকমের পরিবেশ চেতনা আসলে সমাজতান্ত্রিক দেশকে পিছিয়ে রাখার এক কনস্পিরেসি। এই সবই আমাদের জানা ছিলো।
  • dd | 132.167.3.57 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৭:৫৫619678
  • ও হো। এটা নকুদের একচেটিয়া ছিলো না। ওহ, নো নো। মার্কসবাদে উদ্বুদ্ধ সব তরুনেরাই এই সব জানতো।
  • s | 182.0.249.87 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৮:১৭619679
  • একটা জিনিস আমার ব্যপক লাগলো। নিজেরা স্টাফ কোয়ার্টরে গিয়ে ক্যালালে কিংবা পুলিশকে ক্যালালে সেটা ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব, বিপ্লব, আর অন্য অবাম গোষ্ঠী ওনাদের ক্যালালে তারা লুম্পেন। মাইরি। ঃ-)
  • cm | 71.95.189.220 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৮:৫৬619680
  • আমি এখেনে কোন কতা কব না। খালি লিখে যাই কিছু কিছু জায়গায় ভারি মজা পেইচি।
  • sch | 126.203.174.138 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৮:৫৯619681
  • লেখাটার অবজেক্টিভ কি বুঝলাম না -
  • siki | 131.243.33.212 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৯:০০619682
  • "নিজেরা স্টাফ কোয়ার্টরে গিয়ে ক্যালালে কিংবা পুলিশকে ক্যালালে সেটা ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব, বিপ্লব, আর অন্য অবাম গোষ্ঠী ওনাদের ক্যালালে তারা লুম্পেন। মাইরি।"

    এই সব তুলনাগুলো তখনকার সময়ের ইন্টেলিজেন্ট ছেলে মেয়ের দল কীভাবে বিশ্বাস করত? মাথায় সামান্য ঘিলু থাকলেই তো ব্যাপারটাকে এইভাবে বোঝা যায়।
  • শ্রী সদা | 127.194.197.122 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৯:১১619683
  • নির্মল ঃ)
  • | 24.97.112.15 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৯:৩৭619684
  • লেখাটার উদ্দেশ্য স্মৃতিচারণ।
    আমার ভালই লাগছে পড়তে।
  • kc | 204.126.37.78 | ২৭ আগস্ট ২০১৩ ০৯:৪৫619686
  • অনুবাদ একদম ঝরঝরে। তড়তড় করে পড়া হয়ে গেল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন